সোনালি অতীতের দিনগুলো-৩ / বশীর আহমেদ




১ এপ্রিল ২০১২
(পঁচানব্বই)
আউটার স্টেডিয়ামে ৯-৬-৬৭ তারিখের খেলায় পুলিশ পাইওনিয়ারের কাছে ২-০ গোলে পরাজিত হয়েছিল। বিরতির পূর্বে পুলিশ অনবরত আক্রমণ চালিয়েও গোল পায়নি, উল্টো খেলার ১২ মিনিটে পাইওনিয়ারের সেন্টার ফরোয়ার্ড আলিম পুলিশের ঢিলেঢালা ডিফেন্সে ঢুকে মালাকারকে কাটিয়ে গোল করে পুলিশ টিমকে থ বানিয়ে দেয়। গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালালেও পাইওনিয়ারের তরুণ রক্ষণভাগের ফাটল ধরাতে পারেনি। বিরতির পর পাইওনিয়ারের তরুণ খেলোয়াড়রা নিজেদেরকে সুসংহত করে আরো গোছানো ফুটবল খেলতে থাকে, যার জন্য পুলিশের ফরোয়ার্ড লাইন কিছুতেই গোলের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছিল না- পুলিশের পুরো টিম গোল শোধ করতে ওপরে উঠে আসে। পাইওনিয়ারের সেন্টার ফরোয়ার্ড আলিম একটি থ্রু পাস ধরে দ্রুত পুলিশের সীমানায় ঢুকে লেফট আউট নওয়াব বক্সে এসে যায়গা নিল, যেখানে আলিমকে বল পাস দিতে কোন চিন্তা করতে হয়নি আর নোয়াবও সঠিক জায়গায় বল পাঠাতে ভুল করেনি। ২-০ গোলের পরাজয় এড়াতে পুলিশ তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ভাগ্যের এতটুকু সহায়তা লাভ করতে পারেনি।
১০ জুন মোহামেডান শেষ মুহূর্তের গোলে উতরে গিয়েছিল আর তারই মাধ্যমে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছিল ভিক্টোরিয়া। মোহামেডানের লেফট-ইন হাফিজউদ্দিন খেলার একমাত্র গোলটি করেছিল। ভিক্টোরিয়ার ডিফেন্স অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলে চ্যাম্পিয়ন দলের ফরোয়ার্ড লাইনআপকে স্তব্ধ রেখেছিল। বিশেষ করে তাদের গোলরক্ষক ইকবাল শাহের চমৎকার গোল কিপিং সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তার এন্টিসিপেশন, সাহসিকতাপূর্ণ কিপিং ছিল দেখার মত। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার আক্রমণভাগকে সেরকম সক্রিয় দেখা যায়নি, তাদের গোল করার স্পৃহা ছিল না, বিশেষ করে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ইউনুস ছিল ভীষণভাবে ব্যর্থ। অন্যদিকে মোহামেডানের চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে মাঠে উপস্থিতি ছিল। সম্মিলিত দল হিসেবে তারা মাঠ নিয়ন্ত্রণ করে খেলছিল। খেলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা পরিকল্পিত ফুটবল খেলা উপহার দিলেও মুসা হাফিজ শামসু আব্দুল্লাহ গোল উপহার দিতে পারেনি। বরং সুযোগ নষ্ট করেছে অনেক। ভিক্টোরিয়ার টিপু ইউনুসও গোল মিস করেছে, যদিও মোহামেডানের গোলরক্ষক নুরুন্নবী ছিল কিছুটা ‘শ্যাকি’। খেলা বেশিরভাগ সময় মাঝমাঠে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রথমার্ধে গোলশূন্য ড্র, দ্বিতীয়ার্ধের অর্ধের সময় পার হয়েছিল গোলের দেখা না পেয়ে। দু’দলের স্কোরারের ব্যর্থতায় দর্শকরা গোল না দেখার হতাশা আর খেলার ফলাফল ড্র চিন্তা করে মাঠ ছাড়ার উপক্রম করছেন। খেলা শেষ হওয়ার নয়-দশ মিনিট বাকি, তখনই হাফিজউদ্দিন বাম প্রান্ত থেকে একটি বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় ভিক্টোরিয়ার সীমানা পেরিয়ে বক্সে ঢুকে দুর্দান্ত এক শটে গোলরক্ষককে পরাজিত করে দলকে দুর্লভ এক জয়  এনে দিয়েছিল। এ জয়ের সব প্রশংসা হাফিজের।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলাটি প্রেস এবং স্টেশনারি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। পরদিন প্রচুর বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ।
তার পরদিন অর্থাৎ ১৩ জুন প্রেস এবং ফায়ার সার্ভিসের খেলাতেও কোন গোল হয়নি। গত দিনের তুমুল বৃষ্টির ফলে মাঠে পানি জমেছিল, কর্দমাক্ত মাঠ এবং খেলার অনুপযুক্ত মাঠে দু’টিম খেলতে বাধ্য হয়েছিল। লিগ শেষ করতে হবেÑ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ। পানিতে বল চলছিল না, কর্দমাক্ত মাঠে বল মারা যাচ্ছিল না। পাস দেয়া যাচ্ছিল না। শুধু লম্বা লম্বা কিক করে বিপক্ষ দলের সীমানায় বল পাঠানোই ছিল মূল লক্ষ্য। বলে এলোপাতাড়ি লাথি মারা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হচ্ছিল না। বল নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি, সেটা কুস্তির আদলে ফুটবল, সব মিলিয়ে খেলাটি যা ইচ্ছে, তাই হচ্ছিল। খেলার এক পর্যায়ে খেলা রাফ হয়ে ওঠে। যাতে রেফারি কবিরউদ্দিন মৌখিক সতর্ক করেও খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। বিরতির পর দু’টিম ভাল খেলার চেষ্টা করেছিল, বিশেষ করে প্রেস ফায়ারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। তাদের নিমাই সুন্দর একটি হেডের মাধ্যমে গোল করেই ফেলেছিল কিন্তু সীতাংশু অত্যন্ত চমৎকারভাবে শেষ মুহূর্তে ডাইভ দিয়ে গোল বাঁচিয়েছিল। প্রেসের আক্রমণে আরও একটি গোল কার সুযোগ এসেছিল। রাজ্জাক বক্সের ভেতর বল পেয়ে কিক করার মুহূর্তে গোলরক্ষক সীতাংশু তার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গোল সেভ করেছিল। দু’জনই আঘাত পেলেও সীতাংশু বেশি আঘাত পেয়েছিল। পরে সে উঠেই রাজ্জাককে মারতে উদ্ধত হলে দু’দলে হাতাহাতি লেগে যায়। খেলা কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে। পুনরায় খেলা আরম্ভ হলেও সেটা শুধু দৌড়-ঝাঁপ দিয়েই শেষ হয়েছিল। ফলাফলের কোন পরিবর্তন হয়নি, গোলশূন্য ড্র।
১৩ জুন রহমতগঞ্জের শাহজাহান, নাজির, নয়া আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে গোল করার সিরিজ মিস করেও ৩-০ গোলে জয়লাভ করেছিল আর গোলের খাতা খুলেছিল শাজাহানই। তবে আজাদ শুধু গোল হজম করেছে তা বলা যাবে না বরং তারাও আক্রমণ চালিয়ে রহমতগঞ্জের ডিফেন্সকে তটস্থ করে রেখেছিল; শুধু দক্ষ স্কোরারের অভাবে তারা উপযুক্ত জবাব দিতে পারছিল না। বাম প্রান্ত থেকে গফুরের করা লব শাজাহান হেড করে গোলরক্ষক আমানকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বেলাল দলের পক্ষে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গোলটিও করেছিল। নয়ার কিক বারপোস্টে লেগে ফেরত তার কাছে এলে সে শুধু টোকা দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিয়ে তৃতীয় গোল করেছিল। 
দেরিতে ভিক্টোরিয়া জ্বলে উঠলে ওয়ারী বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া শেষ মুহূর্তে পাওয়া পেনাল্টি কিক মিস করেও ৩-২ গোলে ওয়ারীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বৃষ্টির মৌসুম। বৃষ্টির কারণে প্রায়ই খেলা পরিত্যক্ত হচ্ছিল, যদিও ১৫ জুন বৃষ্টি ছিল না কিন্তু ফুটবল খেলার উপযুক্ত মাঠও সেটা ছিল না, সে মাঠেই ওয়ারী ভিক্টোরিয়া ভাল খেলার চেষ্টা করেছিল। দু’টিমই বিচ্ছিন্ন আক্রমণ চালাচ্ছিল, সেরকম জোরালো কিংবা বিপজ্জনক আক্রমণ কেউ করতে পারছিল না। মাঝমাঠেই বল ঘোরাফেরা করছিল। এভাবেই কেটেছিল ২৫ মিনিট। একটি বল ভিক্টোরিয়ার গোললাইন অতিক্রম করছিল। তখন তাদের রাইট-ফুল আবদুল্লাহ অনর্থক বল ধরে বিপদ ডেকে এনেছিল। সে বল ধরার সাথে ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড ছুটে আসে বল ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। সে সময় আবদুল্লাহ তাকে ফাউল করলে রেফারি পেনাল্টির নির্দেশ দেন। ওয়ারীর স্টপার নজর গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। গোল করে ওয়ারী বেশ উজ্জীবিত হয়ে খেলতে থাকে এবং তাদের লেফট-ইন জামিল আখতার সুন্দর একটি গোল করে দলের গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয় (২-০)।
বিরতির পর ভিক্টোরিয়া নতুন উদ্যম নিয়ে খেলতে নামে এবং সংঘবদ্ধভাবে তারা আক্রমণ চালিয়ে ওয়ারীর ডিফেন্সকে কোণঠাসা করে রাখে। আক্রমণের ধারাবাহিকতায় ভিক্টোরিয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ড  বাচ্চু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গোল করে ব্যবধান কমায় ২-১। দলকে সমতায় ফেরাতে অধিক সময় নিতে হয়নি। মাত্র তিন মিনিট, বাচ্চুর দেয়া একটি সুন্দর পাস ধরে ইউনুস ততোধিক সুন্দরভাবে বল জালে জড়িয়ে দেয় (২-২)। 
খেলার প্রায় ৩০ মিনিট, টিপুর এক থ্রু থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড বাচ্চু চেনাপথ দিয়েই ওয়ারীর গোলপোস্টে বল পাঠিয়ে ভিক্টোরিয়ার বুক থেকে পাষাণ ভার নামিয়ে দিয়েছিল (৩-২)। খেলার অন্তিম মুহূর্তে ওয়ারীর ব্যাক নুরুল ইসলাম বক্সের ভেতর বাচ্চুকে ফাউল করলে ভিক্টোরিয়া পেনাল্টি লাভ করেছিল। ইউনুসের পেনাল্টি কিকটি ক্রসবারে লাগলে ভিক্টোরিয়া গোলবঞ্চিত হয়েছিল। তারপরও তারা ৩-২ গোলের জয় নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ফিরে গিয়েছিল।
মোহামেডান জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল আর রহমতগঞ্জ প্রথম হারের স্বাদ গ্রহণ করেছিল। ১৬ জুন স্টেডিয়ামে উল্লেখযোগ্য দর্শক একটি কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মারু টিম রহমতগঞ্জের কাছ থেকে চ্যাম্পিয়ন দলের বিরুদ্ধে চমকপ্রদ কিছু একটা দেখার আশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু সবই ভেস্তে গিয়েছিল যখন রহমতগঞ্জ বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের প্রথম হার মেনে নিয়েছিল। রহমতগঞ্জের ডিফেন্স  অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে খেললেও তাদের গোলরক্ষক সেদিন খুবই বাজে খেলেছিল। যার জন্য তাদেরকে এত গোলের ব্যবধানে হারতে হয়েছিল। অন্যদিকে মোহামেডান তাদের পরিকল্পিত এবং সম্মিলিত আক্রমণ দ্বারা রহমতগঞ্জের শক্তিশালী ডিফেন্সের ওপর চেপে বসেছিল। কিন্তু চার গোলের বেশি করতে পারেনি।
মাঠে সিনিয়র খেলোয়াড়দের অখেলোয়াড়োচিত আচরণ ছিল দৃষ্টিকটু। খেলার মাঝে তারা প্রায়ই বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে খেলায় বেঘাত ঘটাচ্ছিল। একবার বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে শামসু এবং গাউসের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি লেগে যায়, এ নিয়ে মুসা রেফারির সাথে তর্ক জুড়ে দেয়, সেজন্য রহমতগঞ্জের খেলোয়াড়রা ছুটে এসে মুসাকে ধরে বসে, যার কারণে খেলা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে।
মাঝ মাঠ থেকে পাওয়া একটি বল শামসু মুসার উদ্দেশে দিলে গোলরক্ষক অনাথ বল ধরতে পোস্ট ছেড়ে এগিয়ে আসে। মুসা তার আগেই পৌঁছে চিপ করে বল অনাথের মাথার ওপর পোস্টে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। প্রথমার্ধের প্রায় ২৫ মিনিটের সময় রহমতগঞ্জের ডিফেন্ডার গাউস বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে বল চলে যায় মোহামেডানের রাইট আউট প্রতাপের কাছে আর সে সেটাকে গোলে রূপান্তরিত করে দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেয়। বিরতির আগ মুহূর্তে মোহামেডানের লেফট হাফ গফুর তার নিজস্ব বুলেট শট, মেরে বারপোস্ট কাঁপিয়ে জালে বল জড়িয়ে দেয় (৩-০)।
বিরতির পর রহমতগঞ্জ কিছুটা নড়েচড়ে খেলা শুরু করেছিল, যার ফলস্বরূপ লালু, নয়া নাজিরের সম্মিলিত আক্রমণে নাজির সান্ত্বনাসূচক গোলটি করেছিল (৩-১)। সে সময় খেলায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ বাঁশির মিনিটখানিক আগে অনাথ একটি বল নিজ দলের খেলোয়াড়কে থ্রো করে দিলে গফুর তার তীক্ষè এন্টিসিপেশনের গুণে ছুটে এসে বল ধরে গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয় গোলপোস্টে। অনাথ পৌঁছার আগেই বল জালে জড়িয়ে গিয়েছিল আর সেই সাথে মোহামেডান ৪-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে ইপিআইডিসি রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল।  গোলের সংখ্যা জানিয়ে দেয় খেলার চিত্র। এ খেলা নিয়ে ইপিআইডিসির কোনরকম মাথাব্যথা ছিল না তারা একেবারেই হাল্কাভাবে নিয়েছিল আর গোলগুলো যেন নিজে নিজেই হয়ে যাচ্ছিল। খেলার ১০ মিনিটে পেনাল্টি লাভ করেছিল ইপিআইডিসি আর রাইট ফুলব্যাক আমিন সেটার মাধ্যমে গোলের সূচনা করেছিল (১-০)। হাশিমের থ্রু পাস ধরে জব্বরের গোল করতে কোন বেগ পেতে হয়নি (২-০)। হাশিম নিজস্ব নৈপুণ্যে দলের তৃতীয় গোল করলে জব্বর সেটাকে হালিতে পূর্ণ করেছিল (৪-০) হাশিম আবারও গোল করে বিরতির পূর্বেই দলকে ৫-০ গোলের লিড এনে দিয়েছিল; সেই সাথে বড় স্কোর করার আভাস দিয়েছিল। বিরতির পর খেলার কোন পরিবর্তন হয়নি। একইরকম বোরিং খেলা। জব্বর দ্রুত দু’গোল করায় পাইওনিয়ার অধিকসংখ্যক গোলের হার থেকে রক্ষা পেয়েছিল; কারণ জব্বরের হ্যাটট্রিকের জন্য দলের অন্য খেলোয়াড়রা গোল করতে আগ্রহ দেখায়নি। ইপিআইডিসি ৭-০ গোলের জয় দিয়েই শেষ করেছিল তাদের খেলা। তখনও তারা অপরাজিত ছিল।

১৬ এপ্রিল ২০১২
(ছিয়ানব্বই)
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, মাঠে কোথাও  কোথাও জমেছিল পানি, কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল মাঠ। ঐ মাঠে ভাল খেলাতো দূরের কথা, খেলা হওয়াটাই উচিত ছিল না। তবুও ১৭ জুন পিডব্লিউডি এবং ফায়ার সার্ভিস এ মাঠেই খেলতে নেমে পড়েছিল। ‘কিক এন্ড রান’ পদ্ধতিতে দু’টিম খেললেও তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছে ভাল খেলার। উভয় দলের গোলরক্ষকদ্বয় তাদের দায়িত্ব  পালনে এতটুকুও গাফিলতি দেখায়নি। কিন্তু ২০ মিনিটে পিডব্লিউডি খেলার ধারার বিপরীতে গোল করেছিল, গনির এক থ্রু পাস লেফট আউট মনজুর ধরে দ্রুত ফায়ারের বক্সে ঢুকে, সজোরে কিক চালিয়ে দেয়। সীতাংশুকে কোন সুযোগ না দিয়ে বল জালে জড়িয়ে গিয়েছিল (১-০)। ৭ মিনিট পরই শরফুদ্দিন একটি নিশ্চিত গোল মিস করে। বিরতির মিনিট পাঁচ থাকতে ফায়ারের আবুল ২০ গজ দূর থেকে বাম পায়ে দুর্দান্ত শট দিয়ে পিডব্লিউডির গোলরক্ষক রেজাকে পরাস্থ করলে ফায়ারের বুক থেকে পাথর সরে গিয়েছিল। বিরতির পর খেলা দু’দিকেই ঘোরাফেরা করছিল কিন্তু সোনার হরিণ গোল ধরা দিচ্ছিল না। খেলার ধারা অনুসারে খেলা ড্র হলেই মানানসই ফলাফল হতো কিন্তু খেলার একেবারেই শেষ মুহূর্তে লেফট আউট মঞ্জুর একটি বল ধীরেনের উদ্দেশে বক্সের ভেতর পাস দিলে সে সেটাকে সুজাকে ঠেলে দেয়, সে মুহূর্তে গোলরক্ষক ছুটে গিয়েছিল বল আয়ত্তে নেয়ার জন্য। তার আগেই সুজা বলে টোকা দিয়ে জালে জড়িয়ে দিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করে দিয়েছিল (২-১)।
ভিক্টোরিয়া আরও একটি পয়েন্ট হারিয়েছিল ওয়ান্ডারার্সের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। খেলার ২৪ মিনিটের সময় ভিক্টোরিয়া এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু বিরতির ১ মিনিটেই ওয়ান্ডারার্স তা ফিরিয়ে দিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ৮ ম্যাচ খেলে ৫টি জয়, ২টি ড্র এবং ১টি পরাজয়; অন্যদিকে ওয়ান্ডারার্সও সমানসংখ্যক ম্যাচ খেলে ৩টি জয়, ৪টি ড্র এবং পরাজিত হয়েছে ১টিতে। ১৮ জনের খেলার ধারা অনুযায়ী ভিক্টোরিয়ার পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে ফেরা উচিত ছিল, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে তাদের প্রশংসনীয় খেলাটিকে সার্থক করে তুলতে পারেনি তাদের ফরোয়ার্ডরা। রাইট-আউট ইউসুফের তিনটি সহজ মিস ছিল অমার্জনীয়, সেই সাথে অন্যদের মিসও ছিল চোখে পড়ার মতো। অপর পক্ষ ওয়ান্ডারার্সও দু’একটি সুযোগ মিস করেছিল এলোমেলো পোস্টে শট করে।
ভিক্টোরিয়ার লেফট-আউট টিপু খেলার মাঝামাঝি সময় একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে ওয়ান্ডারার্সের দু’তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে প্রচন্ড কিকের মাধ্যমে গোলরক্ষক ফেরদৌসকে পরাস্ত করেছিল (১-০)।
বিরতির এক মিনিটেই ওয়ান্ডারার্স একটি থ্রু পায়Ñ যা ভিক্টোরিয়ার বক্সের মধ্যে ফেললে বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে জটলার সৃষ্টি হয়। আর সেটার সুযোগ নেয় ওয়ান্ডারার্সের ছোটখাটো গড়নের রাইট-ইন ওয়াসি। সে বলে টোকা মেরে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয় (১-১)। তারপর খেলা ভিক্টোরিয়ার পক্ষে ঝুঁকেছিল সারাক্ষণ কিন্তু গোলরক্ষক ফেরদৌসের তীক্ষè দৃষ্টি আর চমৎকার গোলকিপিং ওয়ান্ডারার্সকে এক পয়েন্ট পেতে বড় অবদান রেখেছিল।
ভিক্টোরিয়ার হয়ে সেদিন যারা খেলেছিল : ইকবাল শাহ (গোলরক্ষক), সাল্লে আলী মোহাম্মদ এবং দেবীনাশ, লতিফ এবং চুন্নু, ইউনুস, ইউসুফ, বাচ্চু, জানি এবং টিপ্
ুওয়ান্ডারার্স : ফেরদৌস (গোলরক্ষক), আফাজ, নবী বখশ এবং আসলাম, রিয়াজ এবং ইসমাইল রুশো, আনসার, ওয়াসি, সাদেক, আলাউদ্দিন এবং তসলিম।
আজাদের বিপক্ষে মোহামেডানের ২ গোলের সহজ জয় আর দুটো গোলই এসেছিল খেলার প্রথমার্ধে সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসুর বুট থেকে। একমাত্র ফায়ার সার্ভিসের সাথে ড্র করা ছাড়া মোহামেডানের জয়যাত্রা অব্যাহত রয়েছে এবং তাদের চ্যাম্পিয়নশিপটাও অক্ষুণœ থাকবে বলে ফুটবল অঙ্গনে ধরা করা হচ্ছিল। ১৯  জুন আজাদের বিপক্ষে মোহামেডান আরো অধিকসংখ্যক গোলে জয়লাভ করতে পারতো কিন্তু শামসুর হ্যাটট্রিকের জন্য সতীর্থরা গোল করতে আগ্রহ দেখায়নি। আজাদ স্পোর্টিং অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলে তাদের সাধ্যমত মোহামেডানের আক্রমণের প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। ভাগ্য সহায়তা করলে তারা খেলার ৫ মিনিটেই এগিয়ে যেতে পারতোÑ যদি তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড দেবুর হেডের বল ক্রসবারে লেগে ফেরত না এসে জালে জড়াতো। তারপর থেকে মোহামেডানের অনবরত জালে আক্রমণে আজাদ বেসামাল হয়ে পড়েছিল কিন্তু আজাদের গোলমুখ খুলতে মোহামেডানকে ২৪ মিনিট চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
কাদেরের একটি লব ধরে শামসু প্রথম গোল করেছিল এবং এর দু’মিনিট পরই সেটাকে দ্বিগুণ করেছিল মুসার বানিয়ে দেয়া বলে। প্রথমার্ধের বাকি সময় এবং দ্বিতীয়ার্ধের পুরো সময় মোহামেডানের সবাই মিলে শামসুর হ্যাটট্রিকের পেছনে সময় ব্যয় করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হ্যাটট্রিকের দেখা মেলেনি। দুই গোল আর দুই পয়েন্ট নিয়ে মোহামেডান খুশিমনেই ফিরেছিল।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় পিডব্লিউডি সেন্ট্রাল স্টেশনারিকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল। প্রথমার্ধে জয়ী দল ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল। দু’দলের মধ্যে নিঃসন্দেহে পিডব্লিউডি ভাল টিম, তারপরও খেলা শুরু হয়েছিল আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে জমে ওঠা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এক ম্যাচের মধ্য দিয়ে। স্টেশনারি বেশিক্ষণ পিডব্লিউডিকে আটকে রাখতে পারেনি। খেলার ১০ মিনিটেই পিডব্লিউডির লেফট-ইন ওয়াহিদুজ্জামান চমৎকার একটি থ্রু পাস সেন্টার ফরোয়ার্ডের উদ্দেশে দিলে সুজা সে বল জালে জড়াতে কোন ভুল করেনি (১-০)। স্টেশনারির রাইট-হাফ সিরাজের কর্নার কিক ক্রসপিসে প্রতিহত হলে তারা সমতায় ফিরতে পারেনি। উল্টো পিডব্লিউডির রাইট আউট ধরের কাছ থেকে বল পেয়ে ওয়াহিদুজ্জামান গোল করে দলকে ২-০তে এগিয়ে নেয়। বিরতির পর সেন্টার ফরোয়ার্ড ল্টুজা তার দ্বিতীয় গোল করে লেফট আউট মঞ্জুরের পাস থেকে (৩-০)। স্টেশনারি গোল খেলেও খেলা একেবারে ছেড়ে দেয়নি, লড়ে গেছে; যার ফল তারা পেয়েছিল শেষ বাঁশির আগ মুহূর্তে একটি গোল শোধ দিয়ে (৩-১)।
২০ জুন ওয়ারী বনাম প্রেসের খেলা। খেলার পূর্বে ২ মিনিট নীরবতা পালন। কিছুক্ষণ আগে অর্থাৎ বিকেল ৪টায় ফিফা রেফারি মাসুদুর রহমান মিটফোর্ডে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে ... রাজেউন)। তিনি ২ মাস যাবৎ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। তিনি ৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন পরিপূর্ণ ক্রীড়াবিদ ছিলেন। তার সময়ে তিনি একজন কৃতী হকি খেলোয়াড় ছিলেন। খেলেছেন কলকাতা মোহনবাগান এবং কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ফিফা রেফারি হিসেবেই আমাদের কাছে অধিক পরিচিত ছিলেন। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে সর্বত্রই তার পদচারণা লক্ষ্য করা যেত। ফুটবলে যেমন তাকে দেখা যেত, তেমনি হকি মাঠে, অ্যাথলেটিক ট্র্যাক থেকে সুইমিংপুল, বাস্কটবল, কিংবা ব্যাডমিন্টন কোর্টেÑ সব যায়গাতেই তার উপস্থিতি থাকতো একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে।
মাসুদুর রহমানের অসুস্থতার সময় তাকে সাহায্য করার জন্য একটি চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের ব্যবস্থা করতে ইপিএসএফকে জোর তাগিদ দিয়েছিল ক্রীড়া লেখক সমিতি। কিন্তু ইপিএসএফ মাত্র ২০০০ টাকা তার চিকিৎসার জন্য দিয়েছিল।
আমার খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুর দিকে আমি মাসুদুর রহমান ভাইকে পেয়েছিলাম ব্রাদার্স  ইউনিয়নের ক্লাব হকির কর্মকর্তা হিসেবে। আমার হকি ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ব্রাদার্স ইউনিয়ন থেকে। ইস্ট পাকিস্তান হকি টিমের কোচ হিসেবেও তাকে পেয়েছিলাম। আমার যতদূর মনে হয়, আমি তাকে হকির গোলকিপার হিসেবে খেলতে দেখেছি। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
মাসুদুর রহমানের মৃত্যু সংবাদে স্টেডিয়ামের পরিবেশ ভাবগম্ভীর হয়ে উঠেছিল। গ্যালারিতে খেলা দেখার চেয়ে দর্শকের মাঝে মাসুদুর রহমানকে নিয়ে আলোচনাই বেশি হচ্ছিল; খেলা দেখার প্রতি কারো আগ্রহ ছিল না। খেলাও ছিল ডাল আর নিম্নমানের। ওয়ারী কিছুটা গোছানো ফুটবল খেলার চেষ্টা করেছিল, যার ফলে তারা নিশিথের মাধ্যমে একটি গোলও পেয়ে গিয়েছিল। প্রেস বাকি সময়টুকু সমতায় ফেরার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি।
ইপিআইডিসি আজাদের বিপক্ষে একমাত্র গোল করে ১টি পয়েন্ট হারানো থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ২২ জুন ইপিআইডিসির জন্য ছিল বাজে দিন; সেদিন তারা মৌসুমের সবচেয়ে জঘন্য খেলা খেলেছিল। প্রথমার্ধ গোলশূন্য ড্র। দ্বিতীয়ার্ধের ১২ মিনিটে তারা মান বাঁচানোর গোলটি করতে পেরেছিল। স্টপার গফুর বেলুচ প্রায় ৩৫ গজ দূর থেকে একটি ফ্রি-কিক রাইট-আউট বদরুলের উদ্দেশে উঁচু করে মারলে বদরুল বল না ধরে হেড করে বক্সের ভেতর আসলামকে দিলে আসলাম হেডের মাধ্যমেই বলকে জালে জড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর খেলা রাফ হয়ে ওঠে আর সে সাথে খেলা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। ইপিআইডিসি সেই এক গোলে জয় নিয়ে খেলা শেষ করলেও দর্শক-সমর্থকদের ইটপাটকেল এড়াতে পারেনি। এতে বেশকিছু দর্শক-সমর্থক আহত হয়েছিল।
ভিক্টোরিয়া আয়েশের সাথে ৫-১ গোলে রহমতগঞ্জকে উড়িয়ে দিয়েছিল। বিরতির পূর্বে তারা ২ গোল করেছিল। রহমতগঞ্জের জন্য এটা ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতা। ভিক্টোরিয়ার সীমানায় বারবার হানা দিয়েও সফল হতে পারেনি, সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও গোল করতে পারেনি। আক্রমণে শাহজাহান এবং গফুর ছাড়া সবাই ছিল ব্যর্থ। তাদের রক্ষণ এবং গোলরক্ষককে মনে হয়েছিল তারা ছুটি কাটাতে এসেছে। অন্যদিকে ভিক্টোরিয়া পরিকল্পিত আক্রমণে রহমতগঞ্জের ডিফেন্স ভিত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। কবির ভাই দ্বিতীয় ম্যাচেও (ভিক্টোরিয়ার জার্সি গায়ে) ভিক্টোরিয়ার আক্রমণে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাদের মাঝমাঠের রক্ষণ ছিল শক্তিশালী, তাদের জোরদার ট্যাকলিং এবং এন্টিসিপেশন রহমতগঞ্জের আক্রমণকে অকৃতকার্য করে রেখেছিল। তাদের গোলরক্ষক ইকবাল শাহ চমৎকার খেলা প্রদর্শন করেছে।
খেলার ১০ মিনিটে ভিক্টোরিয়া প্রথম আঘাত হেনেছিল রাইট আউট ইউসুফের মাধ্যমে। লেফট আউট টিপুর লম্বা পাস ধরে কবির ভাই ইউসুফকে দিলে সে তার সাথীকে নিরাশ করেনি (১-০)। ৩ মিনিট পর কবির ভাই এবং ইউসুফ বল আদান-প্রদান করে লেফট ইন খালেদকে দিলে সে দলের দ্বিতীয় গোল করে (২-০)। বিরতির পর রহমতগঞ্জ কিছুক্ষণের জন্য জ্বলে ওঠে এবং আক্রমণ চালিয়ে দুটো গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল কিন্তু তাদের নজর দুটো গোলই মিস করে দেয়। উল্টো কবির ভাইয়ের মাপা কর্নার কিকে মাথা লাগিয়ে খালেদ গোল করে দলকে ৩-০ গোলের লিড এনে দেয়। পরের মিনিটে শাহজাহান নজরের কাছ থেকে বল পেয়ে চমৎকার একটি গোল করে দলকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইউসুফ পরপর দুটো গোল করে তাদের সব আশা ভেঙ্গে দিয়ে ভিক্টোরিয়াকে ৫-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।


১ মে ২০১২
(সাতানব্বই)
২৪ জুন দর্শক পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে মোহামেডান তাদের দ্বিতীয় পয়েন্ট হারিয়েছিল ইপিআইডিসির সাথে ১-১ গোলের ড্র করে। বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা প্রথমার্ধে ১ গোলে এগিয়ে ছিল। খেলা শুরু থেকে উভয় দল মাঠে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করার লড়াই চালিয়েছিল। এ লড়াইতে ইপিআইডিসি কিছুটা এগিয়ে থাকলেও তাদের আক্রমণে সেরকম ধার ছিল না। তাছাড়া মোহামেডানের টাফ এন্ড রাফ খেলা ইপিআইডিসির আক্রমণভাগকে গোল করার কোন সুযোগ দেয়নি। অন্যদিকে মোহামেডান দলগত গোছানো খেলা খেলছিল। তাদের আক্রমণে গতি ছিল, পরিকল্পনা ছিল; তারপরও তারা দক্ষ শুটারের অভাবে সফল হতে পারছিল না। আক্রমণের প্রাণ ছিল মুসা। ইপিআইডিসি মাঠে ছিল স্লো, ছিল দলীয় সমঝোতার অভাবÑ যার জন্য গোল করার সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। তার ওপর মোহামেডানের শক্তিশালী রক্ষণ দৃঢ়তার সাথে তাদেরকে সামাল দিচ্ছিল। আগের দিনের মুষলধারে বৃষ্টি মাঠকে কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল করে দিয়েছিল, যার জন্য মাঠে খেলোয়াড়দের স্লিপ করে পড়ে যেতে দেখা যাচ্ছিল।
খেলার মাত্র দু’মিনিটেই চ্যাম্পিয়নরা লিড নিয়ে বড় স্কোর করার হুংকার ছেড়েছিল। মুসার দুদান্ত শট গোলরক্ষক হাকিম বল পাঞ্চ করে রক্ষা করলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। পাঞ্চ করা বল পোস্টের কাছেই দাঁড়ানো শামসুর কাছে চলে গেলে সে টোকা দিয়ে বল জাল জড়িয়ে দেয় (১-০)। ১০ মিনিট পর মুসার আরও একটি শট ক্রসবারে প্রতিহত হলে মোহামেডান গোলবঞ্চিত হয়। ইপিআইডিসি ধীরে ধীরে নিজেদের সংঘবদ্ধ করে এবং আক্রমণ চালাতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বিরতির কিছু পূর্বে হাশিমের বুলেট শট নুরুন নবী চমৎকার ফ্লাই করে সেভ করলে মোহামেডান সে যাত্রায় বেঁচে যায়। বিরতির পর ইপিআইডিসি মোহামেডানের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে এবং দুটো সুযোগও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দক্ষ শুটারের অভাবে সব পন্ড হয়ে যায়। উভয় দলের খেলোয়াড়রা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ডান প্রান্ত থেকে সলিমুল্লাহর একটি লব গোল করার কেউ না থাকায় বল গড়িয়ে সাইড লাইন দিয়ে মাঠের বাইরে চলে যায়। খেলার প্রায় শেষদিকে বাম প্রান্ত থেকে গাজীর মারা একটি উড়ন্ত বল প্রতুল হেড করলে গোলরক্ষক নূরুন নবী বল ধরার আগে আসলাম মাথা ছুঁইয়ে বল জালে জড়িয়ে দেয় (১-১)। দু’দলের খেলোয়াড়রা শরীরকে আর টানতে পারছিল না। খেলা শেষ হলেই তারা বেঁচে যায়Ñ এমনি অবস্থাতে খেলা শেষ হয়েছিল।
মোহামেডান এবং ইপিআইডিসি দলের মধ্যে মাত্র ১ পয়েন্টের ব্যবধান।
মোহামেডান ১০ খেলায় ৮ জয় ও ২ ড্র দিয়ে পয়েন্ট হয় ১৮। আর ইপিআইডিসির ১০ খেলায় ৭ জয় ও ৩ ড্র দিয়ে পয়েন্ট হয় ১৭।
ওয়ান্ডারার্সের ওয়ারীর বিরুদ্ধে সহজ জয়। বিরতি পর্যন্ত তারা ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল। বেশিরভাগ সময় তারা খেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ওয়ারীও বিপক্ষ সীমানায় হানা দিচ্ছিল; তবে তাদের আক্রমণ সেরকম জোরদার বা পরিকল্পিত না হওয়ায় সফল হতে পারছিল না। উভয় দলের দৈহিক শক্তি প্রয়োগে খেলার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। রেফারির দুর্বলতার জন্য খেলাটি বিশৃংখল খেলায় পরিণত হয়েছিল। একপর্যায়ে ওয়ারীর স্টপার বেলাল এবং ওয়ান্ডারার্সের লেফট আউট তসলিমের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ থাকে। রেফারি মোহাম্মদ আলী দুজনকে মৌখিক সতর্ক করা ছাড়া আর কিছু করার সাহস দেখাতে পারেননি।
খেলার ৮ মিনিটে ওয়ান্ডারার্স এগিয়ে গিয়েছিল আনসারের লব থেকে সাদেকের হেডে করা গোলে। তারপর মিনিটেই ইসমাইল রুশো সেটাকে দ্বিগুণ (২-০) করে দেয়। গোল খেয়ে ওয়ারী কিছুটা নড়েচড়ে খেলতে থাকে এবং ফলও পেয়ে যায়। হামিদের মারা দুর্দান্ত শট ফেরদৌস গ্রিপে রাখতে পারেনি। বল চলে যায় নিশিথের কাছে আর সে সহজেই বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয় (২-১)। পরক্ষণেই ওয়ান্ডারার্স একটি পেনাল্টি লাভ করে। ইসমাইল রুশোর কিক ওয়ারীর গোলরক্ষক চমৎকারভাবে সেভ করে। খেলায় বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। দু’দলই গোল করার জন্য খেলতে থাকলে খেলাটা বেশ জমে ওঠে।
বিরতির পর আনসারের কর্নার কিকে তসলিম দলের পক্ষে তৃতীয় গোল করে দলকে ৩-১ গোলে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় আনসার এবং ওয়াসি পরপর দু’গোল করলে ওয়ারীর খেলা সেখানে শেষ হয়ে যায়।
খেলার শেষ মুহূর্তে ওয়ান্ডারার্সের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের ঢিলেমির সুযোগ পেয়ে জামিল আকতার তার নিজস্ব স্টাইলে বল পেঁচিয়ে (ডজ দিয়ে) বিপক্ষ সীমানা থেকে বক্সে লব করলে অরক্ষিত নিশিথ হেড করে বল জালে জড়িয়ে দেয় আর খেলার ফলাফল গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫-২।
ভিক্টোরিয়া এবং পিডব্লিউডি’র ২৬ জুনের খেলার মূল আকর্ষণ ছিল দু’দলের দুই গোলকিপার, ভিক্টোরিয়ার ইকবাল শাহ আর পিডব্লিউডির গোলরক্ষক রেজার চমৎকার গোলকিপিং। খেলার দু’মিনিটে ইকবাল শাহের টেস্ট নিয়েছিল পিডব্লিউডির সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজা তার প্রচন্ড শট মেরে আর সেটা সুন্দরভাবে সেভ করে উৎরে গিয়েছিল গোলরক্ষক। কিন্তু পরক্ষণেই লেফট হাফ মোহাম্মদ আলীর লব থেকে ধীরেনের হেডে সে পরাস্ত হয়েছিল। একইভাবে রেজাও পরাস্ত হয়েছিল ভিক্টোরিয়ার ইউসুফের হেডের কাছেÑ যা আলী মোহাম্মদের দেয়া উড়ন্ত বল ছিল। ১-১ গোলের সমতা। প্রায় ১০ মিনিট পাল্টাপাল্টি খেলার একপর্যায়ে কবির ভাইয়ের কাছ থেকে বল পেয়ে ভিক্টোরিয়ার লেফট আউট টিপ দুরন্ত গতিতে বিপক্ষ সীমানায় ঢুকে দুর্দান্ত শটে রেজাকে পরাভূত করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। খেলা তখন ভিক্টোরিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় আর তখনই শুরু হয় দু’দলের মধ্যে রাফ খেলা। ঐ অবস্থায় খেলা এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন পিডব্লিউডির গনি বিপক্ষ গোলমুখে উঁচু করে বল দিলে সুজা তার দৈহিক উচ্চতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাম্প করে হেড দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেয়; সে সাথে দলকে ২-২ গোলে সমতা এনে দেয়। খেলার বাকি অল্প সময়টুকু দু’দল ঝগড়া করে শেষ করে দিয়েছিল।
সেদিনের অপর খেলা আউটার স্টেডিয়ামে রেলওয়ে পাইওনিয়ার এবং স্টেশনারি নিজেদের মধ্যে পয়েন্ট ভাগ করে নিয়েছিল গোলশূন্য রেখে। পাইওনিয়ার তাদের লিগপর্ব শেষ করেছিল ১২ খেলায় ৬ পয়েন্ট নিয়ে। তারা পুলিশ এবং আজাদকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল আর ড্র করেছিল ফায়ারের সাথে ১-১ গোলে এবং গোলশূন্য ড্র করেছিল স্টেশনারির সাথে। স্টেশনারি ২ ম্যাচ বাকি থাকতে ওয়ান্ডারার্স এবং পিডব্লিউডি ৫টি ড্র এবং বাকিগুলো হারে।
আজাদের দ্বিতীয় জয়টি এসেছিল ২৭ জুন প্রেসের বিরুদ্ধে। তারা বিরতি পর্যন্ত ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল। তুলনামূলকভাবে আজাদ অবশ্যই ভাল দল। আজাদ খেলার দশ মিনিটেই আবুলের মাধ্যমে গোলের খাতা খুলেছিল এবং বিরতির পর আবুলই সেটাকে দ্বিগুণ করেছিল। ২৫ মিনিটে দেবু তৃতীয় গোল করলে সেটাকে হালিতে পরিণত করেছিল নজরুল। খেলার শেষ বাঁশির আগ মুহূর্তে নিমাই গোল করে দলকে লজ্জার হাত থেকে কিছুটা  বাঁচাতে পেরেছিল (৪-১)।
২৮ জুন ওয়ান্ডারার্সের জন্য একটা বাজে দিন যে, দিনটিতে তারা মৌসুমের সবচেয়ে বাজে খেলা খেলে দুর্বল স্টেশনারির সাথে গোলশূন্য ড্র করেছিল। অন্যদিকে স্টেশনারি এ ড্র’র ফলে ৬ ম্যাচে ৬ ড্র এবং ৬ পয়েন্ট নিয়ে ফিকশ্চার শেষ করেছিল। তারা ১২ খেলায় একটিও গোল করতে পারেনি, জিততেও পারেনি।
ওয়ান্ডারার্স ভুরি ভুরি গোল মিস করে মাথা হেঁট করে সেদিন স্টেডিয়াম ছেড়েছিল। খেলার শুরুতেই তসলিম মিসের তালিকায় নাম লেখিয়েছিল। তারপর লেফট আউট থেকে উড়ে আসা বল আনসার ধরার সাথে সাথে সমর্থকের চিৎকারে সেই বল বাইরে মেরে সে অমার্জনীয় অপরাধ করেছিল। আর গোল মিসের মহড়া দিয়ে ওয়ান্ডারার্স প্রথমার্ধ শেষ করেছিল।
বিরতির পর ওয়ান্ডারার্স চাঙ্গা হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। তাদের একের পর এক আক্রমণ কিছুতেই সফলতা পাচ্ছিল না; অ™ভুত অ™ভুত সব মিস হচ্ছিল। এদিকে স্টেশনারির আক্রমণে ইলিয়াস পরিশ্রম করে খেলে একক প্রচেষ্টায় মাঝেমধ্যে ওয়ান্ডারার্সের বিপদসীমায় হানা দিয়ে তাদের বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছিল। এমনি একটি আচমকা আক্রমণ করে ইলিয়াস যে শটটি পোস্টে মেরেছিল, সান্টু সতর্কতার সাথে সেভ না করলে তারা গোল খেয়ে যেতেও পারতো। দু’দলের নিম্নমানের এ জঘন্য ড্র হওয়া খেলা দেখে মাঠে আসা ওয়ান্ডারার্স সমর্থকরা ঢাকাইয়া ভাষায় গালাগালি দিতে দিতে মাঠ ছেড়েছিলেন।
পিডব্লিউডি খুব কষ্ট করে ২৯ জুনে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের খেলায় রহমতগঞ্জের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। সুজার চমৎকার দুটি গোল এই জয়লাভে বড় অবদান রেখেছিল। পিডব্লিউডির শক্তিশালী রক্ষণ দলীয় সমঝোতা আর সংঘবদ্ধ আক্রমণ রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে ২-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল। ৩ মিনিটেই পিডব্লিউডি এগিয়ে যেতে পারতো যদি সুজা মিস না করতো। তবে ২১ মিনিটে সুজাই গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিল আবিদের বানিয়ে দেয়া বলে। গোল খেয়ে রহমতগঞ্জ মরিয়া হয়ে ওঠে গোল শোধ দেয়ার জন্য এবং অনবরত আক্রমণ চালাতে থাকে আর এর ফলও পেয়ে যায় বিরতির ঠিক আগ মুহূর্তে যখন শাজাহানের সুন্দর একটি পাস বেল্লাল ধরে দর্শনীয় গোল করে (১-১)।
বিরতির পর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা খুবই জমে উঠেছিল। দু’দলের শক্তিশালী রক্ষণ, গোলরক্ষকদ্বয়ের তীক্ষè দৃষ্টি, কোন দলই গোল করতে পারছিল না। উপভোগ্য খেলাটি ড্র হলেই মানানসই হতো কিন্তু রহমতগঞ্জ ম্যাচ হেরে গিয়েছিল সুজার চমৎকার হেডের কাছেÑ যা গনির মাপা লবে সে করেছিল (২-১)।
পিডব্লিউডি দলের খেলোয়াড় : রেজা (গোলরক্ষক), হামিদ, ওয়াহেদ এবং মোহাম্মদ আলী, আবিদ হোসেন এবং বিমল, ধীরেন, গনি, সুজা, বাবুল এবং মনজুর।
রহমতগঞ্জ : বরকত (গোলরক্ষক), ফারুক, গাউস এবং হাসনাত, লালু এবং কায়কোবাদ, নাজির, শাজাহান, বেলার, গফুর এবং নয়া।


১৬ মে ২০১২
(আটানব্বই)
১৯৬৭ সালের ফুটবল লিগ প্রায় মাঝপথে, এমনি অবস্থায় লিগ বর্জনের হুমকি দিয়েছিল সাতটি ক্লাব। ৩০ জুনের মধ্যে লিগের অংশগ্রহণকারী সব ক্লাবের প্রতিনিধি সমন্বয়ে লিগ অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করে সেই কমিটির মাধ্যমে লিগের খেলা পরিচালনাকরার দাবি মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারী, ফায়ার সার্ভিস, পাক পিডব্লিউডি, সেন্ট্রাল স্টেশনারি এবং রেলওয়ে পাইওনিয়ার ক্লাবগুলোর। দাবি না মানলে লিগ থেকে তাদের দল প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। এই হুমকিটা সাতটি ক্লাবের ছিল না। মূলত সেটা এসেছিল একটি গ্রুপের তরফ থেকে। যারা ঢাকা সিটি কাউন্সিলর নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। ইপিএসএফ দেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতো। এতদিন সিনিয়র ক্রীড়াব্যক্তিত্ব সংগঠকরা ইপিএসএফের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন, তারা নিজেদের মতো করে ক্রীড়াঙ্গনকে পরিচালিত করতেনÑ যা অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তরুণ সংগঠকদের নিয়ে তারা ক্রীড়াঙ্গনকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করেছিলেন, যার জন্য সংগঠকদের মাঝে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ইপিএসএফের গভর্নিং বডি গঠনের লক্ষ্যে ঢাকা সিটির ২৩ জন সাধারণ কাউন্সিলর নির্বাচনের সময়। ঢাকা সিটির ১০৪টি ক্লাবের প্রতিনিধিরা দুটি প্যানেলে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 
সিনিয়র সংগঠনের প্যানেল ‘দি ইউনাইটেড স্পোর্টসম্যান কাউন্সিল’, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান, শাজাহান ভাই, মঈনুল ইসলাম, এএ সিদ্দিকী, ওয়াদুদ চৌধুরী প্রমুখ। আর জুনিয়র সংগঠকরা নির্বাচন করেছিলেন ‘স্পোর্টস প্রমোটার্স ফ্রন্ট’ প্যানেলের মাধ্যমে, যার নেতৃত্বে ছিলেন ইপিএসএফের সাধারণ সম্পাদক ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সভাপতি আজহার উদ্দিন খান এবং অন্যদের মধ্যে ছিলেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের আনিস ভাই, শান্তিনগর ক্লাবের পল্টু ভাই, গেন্ডারিয়া ক্লাবের রাইস বাই, মাহুৎটুলী ক্লাবের আলমগীর আদেল ভাই, নূর হোসেন স্যার, দাবির সিদ্দিকী প্রমুখ। স্পোর্টস প্রমোটার্স ফ্রন্টের পুরো প্যানেল বিজয়ী হলে সিনিয়ররা ইপিএসএফ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন আর এখান থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে দলাদলি-গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব। এ ব্যাপারে ক্রীড়াজগতের ২০১১ সালের ১ জুলাই ২৪ সংখ্যায় কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম।
ঢাকা সিটির ২৩ জনসহ সারাদেশের ৯৬ জন নির্বাচিত কাউন্সিলর ভোটের মাধ্যমে ইপিএসএফের গভর্নিং বডি গঠন করার দিন ধার্য করা হয়েছিল ২৬ মার্চ ১৯৬৭। ইপিএসএফের কর্মকান্ডে সিনিয়রদের কিছু করার আর সুযোগ ছিল না; অথচ তাদের অবদানের কথা স্মরণে রেখে এবং তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি এবং পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী  আব্দুস সবুর খান। তিনি বিবদমান দু’দলের কর্মকর্তাদের সাথে মধ্যস্থতা করে একটি সমঝোতা করেছিলেন যে, স্পোর্টস প্রমোটার্স ফ্রন্ট থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গভর্নিং বডিতে যে ১১টি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেখান থেকে ৪টি আসন সিনিয়রদের সম্মানে ছেড়ে দিতে হবে এবং সবাই একসাথে মিলে পূর্ব পাকিস্তানের খেলাধুলাকে এগিয়ে নিতে হবে। সমঝোতার সুবাদে সিদ্দিকুর রহমান ইপিএসএফের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ পেয়েছিলেন এবং অন্যরা বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান/সেক্রেটারি মনোনীত হয়ে খেলাধুলার কর্মকান্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এরকম পরিবেশ বেশিদিন বজায় ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই এক এক করে দশজন সিনিয়র সংগঠকগণ ইপিএসএফের বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান/সেক্রেটারির পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন; এমনকি ভাইস প্রেসিডেন্টর পদ থেকে সিদ্দিকুর রহমানও পদত্যাগ করেছিলেন। অন্যদের মধ্যে লনটেনিসের চেয়ারম্যান ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি মঈনুল ইসলাম, ভারোত্তোলন কমিটির চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম ডিএসএ’র সাধারণ সম্পাদক এসএ ইসলাম এছাড়াও শাহজাহান ভাই, এএ সিদ্দিকী, ওয়াদুদ চৌধুরী, আব্দুল জলিল প্রমুখ তাদের অর্পিত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। পদত্যাগের কারণ সম্বন্ধে তারা বলেছিলেন, ইপিএসএফ অনভিজ্ঞ এবং অদক্ষ ব্যক্তিদেরকে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেশের খেলাধুলাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শাজাহান ভাই কারণ দেখিয়েছিলেন অর্থনৈতিক গরমিলের।
এ ব্যাপারে ইপিএসএফ জেনারেল সেক্রেটারি আজহার উদ্দিন খান পত্রিকার মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, কিংবদন্তী খেলোয়াড় বা অভিজ্ঞ এবং ক্রীড়াব্যক্তিত্ব সুপরিচিত সংগঠক হলেই ক্রীড়াঙ্গন যে সুষ্ঠুভাবে চলেÑ তা নয়; প্রয়োজন সৎ ও নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী সংগঠকের।
ইপিএসএফ দ্রুত মিটিং করে পদত্যাগী কর্মকর্তাদের যায়গায় নতুন কর্মকর্তা মনোনীত করেছিল। সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের যায়গায় জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলকে নির্বাচন করেছিল। গভর্নিং বডিতে তিনজন সদস্যকে নির্বাচন করা হয়েছিল : তারা হলেনÑ যশোর ডিএসএ’র শামসুল হুদা, পার্বত্য চট্টগ্রামের এমপিএ রাজা ত্রিভিদ রায় এবং ময়মনসিংহ এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির ইলিয়াস উদ্দিন।  ইলিয়াস উদ্দিন একজন ফুটবল খেলোয়াড়, পঞ্চাশ দশকে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে আমরা একসাথে ফুটবল খেলেছি। সভায় আরও তিনজনকে কো-অপট করা হয়েছিল বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান করার উদ্দেশ্যে। তারা ছিলেন ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান এ রহিমকে অ্যাথলেটিক্স কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়েছিল মনজুর মোর্শেদ পদত্যাগ করায়। টেকনিক্যাল কমিটি থেকে এএ সিদ্দিকী পদত্যাগ করলে সেখানে রাজশাহীর আব্দুল হাইকে নির্বাচন করা হয়েছিল এবং বডিবিল্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে সৈয়দ আলী হোসেনের পদত্যাগের বিপরীতে বরিশালের এবিএম জাহিদ হোসেনকে নির্বাচন করা হয়েছিল।
ইপিএসএফের গঠনতন্ত্রে ‘লিগ অর্গানাইজিং কমিটি’ গঠন করার কোন বিধান না থাকায় দাবি অনুযায়ী কমিটি গঠন করে খেলা পরিচালনা করা সম্ভব নয় বলে ইপিএসএফের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে ইপিএসএফের ফুটবল কমিটির বাইলজ অনুযায়ী ফুটবল লিগকে সহায়তা করার জন্য একটি সাব-কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যেখানে ক্লাবগুলোর প্রতিনিধিত্বও থাকতে পারে তাছাড়াও কমিটিকে সহযোগিতা করার জন্য ফুটবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কমিটিতে নেয়া যেতে পারে। সাব-কমিটি গঠনের আশ্বাস দিলে লিগের পরবর্তী খেলাগুলো চালাতে কমিটির আর কোন সমস্যা হয়নি।
৩০ জুন ইপিআইডিসি আরও একটি পয়েন্ট খুইয়ে ছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে ড্র করে। এদিন ইপিআইডিসি ভাগ্যের বিপক্ষে মাঠে খেলতে নামে। সেদিনের খেলায় নায়কের ভূমিকায় ছিল ভিক্টোরিয়ার গোলরক্ষক ইকবাল। তার প্রশংসনীয় গোলকিপিং ইপিআইডিসিকে আটকাতে অবদান রেখেছিল। তার এন্টিসিপেশন, দ্রুতগতি ইপিআইডিসির অনেক আক্রমণকে সফল হতে দেয়নি। তাছাড়াও ভাগ্য তাদেরকে এতটুকু সাহায্য করেনি। তাদের গোলপোস্টে মারা দুটি বল সাইডবারে লেগে মাঠে ফেরত চলে এসেছিল। একটি বল গোলরক্ষক ইকবালকে বিট করলেও গোললাইনের ওপর থেকে দেবীনাশ আটকে দিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল মাঠের চিত্র কিন্তু এমনটা ছিল না। ভিক্টোরিয়াও আক্রমণ করে ইপিআইডিসিকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল কয়েকবার, বিশেষ করে প্রথমার্ধে তারাই প্রথম হানা দিয়েছিল ইপিআইডিসির সীমানায়।
খেলার ১৩ মিনিটে আলিমুল্লাহর দেয়া পাসে হাশিম গোল করতে ব্যর্থ হয়। এর দু’মিনিট পর ভিক্টোরিয়া দুটি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করেছিল। প্রথমটি আজিম ইউনুসের কাছ থেকে বল পেয়ে গোলপোস্ট খুঁজে না পেয়ে বাইরে মেরেছিল আর দ্বিতীয়টি কবির ভাই আজিমের দেয়া পাস বয়সের ভারে পোস্টে শট নিতে দেরি করায় বল খুইয়েছিলেন। খেলার ২৩ মিনিটে ভিক্টোরিয়া ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছিল, যখন হাশিমের বুলেট শটটি ইকবালকে বিট করে সাইড করে প্রতিহত হয়েছিল। তারপরই হাশিমের দেয়া পাস আসলামের দুর্দান্ত শটটিও সাইডবারে লেগে মাঠে ফেরত এসেছিল। এভাবেই গোলশূন্য অবস্থায় কেটেছিল প্রথমার্ধ।
বিরতির পর ইপিআইডিসি ভিক্টোরিয়ার ওপর চেপে বসেছিল কিন্তু গোল না খাওয়ার পণ করে ভিক্টোরিয়াও তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করে আক্রমণ ঠেকিয়ে যাচ্ছিল; তার ওপর ভাগ্যদেবীও তাদের সাথে ছিল, নইলে হাশিমের শট ইকবালকে পরাস্ত করলেও নিশ্চিত গোলটি গোললাইনের ওপর থেকে দেবীনাশ বুক দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। তারপরই আসলামের পোস্টে মারা শটটি ইকবাল চমৎকার ফ্লাই করে সেভ করতে সক্ষম হয়েছিল।
সেদিন ছিল ড্র করার দিন। আউটার স্টেডিয়ামে অপর খেলায় আজাদ-পুলিশ ১-১ গোলের ড্র করেছিল। সমমানের দুই টিম জয়ের জন্য খেলতে নেমে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে। খেলাটি বেশ জমজমাট হয়েছিল কিন্তু খেলার মূল আকর্ষণ গোলÑ সেটা ছিল অনুপস্থিত।
দ্বিতীয়ার্ধে ৩০ এবং ৩২ মিনিটে গোলের বন্ধাত্ম ঘুচলেও দু’দল মিলে ২টি গোল করায় খেলাটি ১-১ ড্র হয়েছিল। প্রথমে পুলিশের সাত্তার গোল করলে দু’মিনিটেই দেবুর পাসে নজরুল আজাদের পক্ষে গোলটি শোধ করে দিয়েছিল। #

মন্তব্যসমূহ

  1. Dear Mr. Dulal Mahmud- as an avid sports reader- i was searching throughout net for articles regarding our own domestic sports & u'r blog came up. I found it as a gold mine. Looking through u'r profile i came to know that u r on sports journalism. Its a pleasure to know that our sports writers are writing online, a practice which is very usual among sports writers abroad.

    Me too, as a sports fan often try to write down sports articles. I will found it most helpful if u keep posting such blog-posts regarding our domestic sports. Thank u.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে? দুলাল মাহমুদ