‘প্রেস বক্স’ ‍: ইতিহাসের ছেঁড়াপাতা? -দুলাল মাহমুদ

ছুটিও যে মনস্তাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেটা সেদিন আমরা যারা ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলাম, তারা পলে পলে অনুভব করছিলাম। দিনটি ছিল ১১ নভেম্বর ২০০০। আগের দিন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে রচিত হয়েছে নতুন এক ইতিহাস। স্বপ্ন আর কল্পনাকে সত্যি করে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে বাংলাদেশের। অনাবিল আনন্দের এই রেশ কাটতে না কাটতেই পরের দিন অভিষেক টেস্টকে রাঙিয়ে দিচ্ছিলেন ব্যাটসম্যান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের উদীয়মান আকাশে রঙধনু হয়ে ফুটতে থাকেন তিনি। ৭০ রান নিয়ে খেলতে নেমে তিনি একটু একটু করে পাড়ি দিচ্ছিলেন স্বপ্নের পথ। দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করার এক বিরল গৌরব হাতছানি দিচ্ছিল তাকে। মাঠে খেলছিলেন বুলবুল, অস্থিরতায় ছটফট করছিলেন সারা দেশের ক্রীড়ানুরাগীরা। বুলবুলও তো কম স্মায়ুর চাপে ভুগছিলেন না। এমনিতে ব্যাট করতে নামলে তাকে নার্ভাসনেসে পেয়ে বসে। তারপর বেশ কিছু দিন যাবৎ ফর্মও ভালো যাচ্ছিল না। দর্শকরাও বোধকরি তার ওপর খুব একটা আস্থা রাখতে পারেননি। নতুবা আগের দিন স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক পরের দিন কোথায় গেলেন? এমন অবস্থায় তিনি কি পারবেন ইতিহাসের সোনালী পাতায় নিজের নামকে খোদাই করে রাখতে? পারবেন কি অভিষেক টেস্টকে স্বপ্নের রঙে রাঙিয়ে দিতে? এমন সব প্রশ্ন ঝড় তুলছিল মনের মধ্যে। আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে গন্তব্যে পৌঁছে যান বুলবুল। ভারতের বাঁ-হাতি স্পীনার মুরালি কার্তিককে সুইপ করে স্কোয়ার লেগে ঠেলে দিয়ে এক রান নিয়ে গড়েন অবিনশ্বর কীর্তি। ক্রিকেট ইতিহাসের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি গড়েন অনন্য এই নজির। বাংলাদেশের একজন ব্যাটসম্যানের এমন একটি কৃতিত্ব সবাইকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। করে আপ্লুত। বুকের মধ্যে বয়ে যায় রোমাঞ্চ, শিহরণ আর আনন্দের ঢেউ। ন্টেডিয়ামে উপস্থিত ক্রীড়া সাংবাদিকরা তাৎক্ষণিকভাবে আবেগ-উচ্ছ্বাসে মাখামাখি হলেও পরক্ষণেই তাদের মনে ছড়িয়ে পড়ে কষ্টের অনুভূতি। চারপাশের আলোর ফোয়ারার মধ্যে নিজেকে মনে হতে থাকে নিঃসঙ্গ নাবিকের মত। সেদিন যে পবিত্র শব-ই-বরাতের ছুটি। পরের দিন পত্রিকা প্রকাশিত হবে না। ছুটি পেয়ে তো উদ্বেলিত হওয়ার কথা। কোনো টেনশন নেই। উদ্বেগ নেই। কাজের তাড়া নেই। সোনালী রোদে মুক্তমনে তারিয়ে তারিয়ে খেলা উপভোগ করা যায়। না, সেদিনের ছুটিটা কারো কাছেই কাঙ্খিত ছিল না। এটাকে তারা মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। যেন এই ছুটিটা এসেছিল জীবনের পরম একটি দিনকে আড়াল করে দিতে। গৌরবের একটি মুহুর্তকে দূরে সরিয়ে দিতে। বুলবুলের কীর্তি তাতে ম্লান না হলেও ক্রীড়া সাংবাদিক জীবনের আলোকিত একটি দিন তো মেঘে ঢাকা হয়ে রইবে। বুলবুলের গড়া ইতিহাস নিয়ে পরের দিন কোথাও কিছু লেখা হবে না, এরচেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি আছে? জীবনে এমন দিন তো আর কখনো আসবে না। হৃদয়ের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার নৈবেদ্য সাজিয়ে বুলবুলকে নিয়ে লেখার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিকরা। এমন একটি ঘটনা তাদের কলমে নন্দিত হবে না, এটা তাদের কাছে সত্যি সত্যি মর্মযাতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুরো দেশ আনন্দে, উল্লাসে উদ্বেলিত হলেও প্রেস বক্সে ছুঁয়ে যায় বিষাদের কালো রঙ।
হঠাৎ মনে হলো, আরে, সূর্যের আলো দিয়ে বুলবুলকে আলোকিত করা না গেলেও জ্যোছনা দিয়েও তো তাকে বরণ করে নেওয়া যেতে পারে। প্রেস বক্সে উপস্থিত সবার লেখা নিয়ে একটা বুলেটিন বের করতে পারলে দুধের স্বাদ তো অন্তত ঘোলে মেটানো যায়। ভাবতে সময় নিলেও উদ্যোগ নিতে বেশি সময় লাগেনি। এই প্রস্তাব পেশ করা মাত্রই মন খারাপ নিয়ে বসে থাকা ক্রীড়া সাংবাদিকরা উল্লসিত হয়ে ওঠেন। ফুটতে থাকেন টগবগিয়ে। প্রবীণ থেকে নবীন, কেউ এ থেকে বঞ্চিত হতে চাচ্ছিলেন না। উৎসবের মেজাজ নিয়ে সবাই লিখতে বসে যান। মনের মাধুরী আর মাধুর্য দিয়ে মেতে ওঠেন বুলবুল বন্দনায়। ১৪৫ রানের ইনিংসটি নানা রঙে বর্ণিল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ ও ভারতের ৭০ জন ক্রীড়া লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকের কলমে। লেখা তো হলো, এখন ছাপানো যায় কোথায়? সব জায়গায় তো ছুটির আমেজ। কাছাকাছি থাকা খেলার ভূবনের সারওয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কম্পোজ ও ছাপার দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। কিন্তু কাগজ-কালির খরচ দেবে কে? অগত্যা, ক্রিকেট সংগঠক পারটেক্স গ্রুপের আজিজ আল কায়সারের স্মরণাপন্ন হতে হয়। তাকে বুঝিয়ে বলতে তিনি পাঁচ হাজার টাকা বিজ্ঞাপন দিতে সম্মতি জানান। সাদা অফসেট কাগজে ট্যাবলয়েড আকারে চার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় বিশেষ বুলেটিন ‘প্রেস বক্স’। আসলে সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকলে কোনো কিছু করা অসম্ভব নয়। সেদিন তা আবারও প্রমাণিত হয়। ক্রীড়া লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভালোবাসার নিদর্শন বুলেটিনটি বুলবুলের হাতে তুলে দিলে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। এটিকে তিনি মনে করেন জীবনের এক পরম পাওয়া হিসেবে।
দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান, জিম্বাবুয়ের ডেভিড হটন এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের আমিনুল ইসলাম বুলবুল। কিন্তু এমন কীর্তির পর ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিতে আর কোনো দেশের ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরা কোনো বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন কিনা সেটা আমার অন্তত জানা নেই। ক্রিকেটের বাইবেল উইজডেন কিংবা লর্ডসের ক্রিকেট জাদুঘরে কি এমন কিছু ঠাঁই পেয়েছে? বলতে পারবো না। যদি পেয়েও থাকে, তাতেও ‘প্রেস বক্স’য়ের গুরুত্ব বা মহিমা একটুও কমে যায় না। এই বুলেটিনটি শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ নয়, এটি মাইলফলক হয়ে থাকবে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও। তবে ‘প্রেস বক্স’ কি একটু একটু করে বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে? তখন কেন জানি প্রশ্ন জাগে মনে, এই বুলেটিনটি কি ইতিহাসের ছেঁড়াপাতা হয়ে থাকবে নাকি কোনো দিন স্থান করে নেবে কোনো ক্রিকেট জাদুঘরে? জানি, এর উত্তর কেবল সময়ই দিতে পারে।

১২-১১-২০১১, দৈনিক যুগান্তর

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

কমলা রঙের উৎসবের অপেক্ষায় / দুলাল মাহমুদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ