কখনো আনন্দ কখনো বিষাদ / দুলাল মাহমুদ




এক একটি বিশ্বকাপ মনের আকাশে কতভাবেই না রঙ ছড়ায়। কোনো রঙ আনন্দের। কোনো রঙ বিষাদের। বিশ্বকাপ ফুটবলে কলম্বিয়া নামক দেশটির কথা মনে হলে একই সঙ্গে ভেসে উঠে দু’টি মুখ। একজন কার্লোস ভালদেরামা। অপরজন আন্দ্রেস এসকোবার। ভালদেরামা নজর কেড়েছিলেন তাঁর আফ্রিকান চুলের কারণে। ঝাঁকড়া কোকড়ানো চুলগুলো কত রঙেই না রাঙানো হতো। তবে সোনালি রঙটাই বোধহয় বেশি পছন্দ করতেন তিনি। বাহারি এই লম্বা চুল যখন বাতাসে উড়তো, তখন তাতে ঢেউ খেলে যেতো অপরূপ শোভা। বৈচিত্র্যময় চুলের কারণে সবার দৃষ্টি কাড়লেও ফুটবলার হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। মধ্যমাঠের কুশলী এই খেলোয়াড় নিখুঁত পাস, বল যোগান দেওয়া আর খুব বেশি না দৌঁড়িয়ে কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিতেন। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ খেলার গৌরব তাঁর। কলম্বিয়ার ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়।  বিশ্বকাপ ফুটবলে কলম্বিয়ার বড় কোনো সাফল্য নেই। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে লাতিন ঘরানার দলটি ১৯৬২ সালে প্রথম চূড়ান্ত পর্বে খেলে। এরপর দীর্ঘ দিন কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ১৯৯০ সালের পুনরায় খেলার সুযোগ পায়। ভালদেরামার নেতৃত্বে দলটিতে ছিলেন পাগলাটে গোলরক্ষক রেনে হিগুইতা। ‘এল লোকো’ অর্থাৎ ‘দ্য ম্যাডম্যান’ নামে পরিচিত হিগুইতা তাঁর পাগলামির জন্য অনেক বেশি আলোচিত ছিলেন। নিজের গোলপোষ্ট ছেড়ে তিনি বল নিয়ে সামনে চলে যেতেন এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ড্রিবলিং করে আনন্দ পেতেন। ফুটবল ইতিহাসে তাঁর মতো পাগলামি কম গোলরক্ষকই করেছেন। অথচ সোনালি চুলের ভালদেরামা, পাগলা হিগুইতারাই দেশের পক্ষে সেরা সাফল্য বয়ে আনেন। তাঁদের দলটিই প্রথম ‘গ্রুপ অব সিক্সটিন’-এ খেলেছে। ১৯৯৪ এবং ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বেও কলম্বিয়ার অধিনায়ক ছিলেন ভালদেরামা। ব্যতিক্রমধর্মী, বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য ফুটবলার ভালদেরামা, হিগুইতারা মনের পটে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
কিন্তু কলম্বিয়ার আন্দ্রেস এসকোবারের কথা মনে হলে বিষাদে ছেয়ে যায় মন। খেলোয়াড় হিসেবে খুব বেশি আলোচিত ছিলেন না এই ডিফেন্ডার। তবে তাঁর দেশের প্রেক্ষাপটে অপরিচিতও ছিলেন না। ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে দেশের প্রতিনিধিত্ব তো আর এমনি এমনি করেননি। যোগ্যতা দিয়েই জাতীয় দলে দলভুক্ত হন। দেশের হয়ে খেলেছেন অর্ধ-শতাধিক ম্যাচ। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল নিভিয়ে দেয় তাঁর জীবনালেখ্য। ফুটবলের ইতিহাসে তাঁর মতো দুর্ভাগা খুব কমই আছে।  ১৯৯৪ সালের যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে স্বাগতিক দলের সঙ্গে খেলায় এসকোবারের আত্মঘাতি গোলে ২-১ গোলে হেরে যায় কলম্বিয়া। এই আত্মঘাতি গোল, এই হারই কাল হয়ে উঠে তাঁর জীবনে। কলম্বিয়ার জয়ের পক্ষে বাজি ধরে প্রভাবশালী ড্রাগ লর্ডরা। কিন্তু তাঁরা বাজিতে হেরে যাওয়ায় প্রাণ দিতে হয় ২৭ বছর বয়সী এসকোবারকে। বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফিরে এলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসকোবারের এভাবে চলে যাওয়াটা ভীষণভাবে দুলিয়ে দেয় ফুটবল বিশ্বকে। এ কারণে এসকোবারের নামটি খোদাই হয়ে আছে বুকের নিভৃত কোণে।            

টানা তিনটি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হওয়ার পর এবারের বিশ্বকাপে ফিরে এসেছে কলম্বিয়া। শত বছরের নির্জনতা ভাঙিয়ে দিয়েছেন যে কথাশিল্পী, সেই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং ‘দিস টাইম ফর আফ্রিকা’ আর ‘লা লা লা লা লা লা’-র নিতম্বের দুলুনি দিয়ে যিনি কাঁপিয়ে চলেছেন সারা দুনিয়া, সেই শাকিরার দেশ কলম্বিয়ার ফুটবল দল এবার বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ের সফলতম ষ্ট্রাইকার রাদামেল ফালকাওকে ছাড়াই খেলতে হয় তাদের। ইনজুরির কারণে বাছাই-পর্বের অন্যতম নায়ক ‘এল টাইগার’ আসতে না পারায় দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় কলম্বিয়া। কিন্তু প্রথম রাউন্ডের খেলায় তাঁর অনুপস্থিতি টেরই পায়নি ‘লস ক্যাফেতেরস’রা। নেদারল্যান্ডস এবং আর্জেন্টিনার মতো তিন ম্যাচেই জয়ী হয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে কলম্বিয়া। এই সাফল্যের ক্ষেত্রে তুরুপের তাস হয়ে উঠেছেন আক্রমণভাগের খেলোয়াড় জেমস রদ্রিগেজ। ‘ত্রিকলার’রা কত দূর যেতে পারবে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে জাদু বাস্তবতার লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আর নৃত্যপটিয়সী শাকিরার জন্মভূমি যদি অনেকটা পথ পাড়ি দিতে পারে, সেটা তাঁদের অনুরাগীদের নিশ্চয় আনন্দিত করবে। কিন্তু আনন্দের অপর পিঠেই তো লেখা থাকে বেদনা। কলম্বিয়া বিশ্বকাপে আরো বেশি দূর যেতে না পারলেও সেটা বড় কোনো কষ্ট হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু আন্দ্রেস এসকোবারের জীবনে যেমনটি ঘটেছে, তেমন কিছু হলে সেটাই হবে বড় বেদনাদায়ক। আমরা তেমন কিছু চাই না।


dulalmahmud@yahoo.com     

মন্তব্যসমূহ

  1. মার্কেজ,শাকিরাদের দেশে ড্রাগ নামের ড্রাগন থাবাউঁচিয়ে মুখ ব্যদন করে বসে আছে এটা ভাবাই কষ্টকর।এসকোবারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না হোক আমাদেরও তা কাম্য।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ