অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব-২


ড. আনিসুজ্জামান
জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে তাঁর উপস্থিতি অনিবার্য। সংগ্রামে, সংশয়ে, সংকটে, সম্ভাবনায়। তিনি আছেন। না, রাজনীতি তাঁর বিষয় নয়। সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ। কিন্তু তিনি এড়াতে পারেন না পারিপার্শ্বিকতাকে। তাঁর বোধ-বুদ্ধি, বিবেক তাঁকে নিয়ে আসে জনতার সারিতে। সময়ের সঙ্গে অগ্রসর মানুষ ড. আনিসুজ্জামান।
ড. আনিসুজ্জামানের জন্ম কলকাতায়। ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। দেশ বিভাগের পর চলে আসেন খুলনায়। শৈশব থেকেই তিনি শিল্প-সাহিত্যের অনুকূল হাওয়ায় মানুষ।
শৈশবকাল সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘কলকাতায় পারিবারিক সূত্রে অনেক লেখক, সাংবাদিককে দেখা এবং তাঁদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়। এঁদের মধ্যে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আব্দুল ওদুদ, জসিমউদ্দিন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, বেনজীর আহমদ, জয়নুল আবেদীন, সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, রোকনুজ্জামান খান, সিরাজউদ্দিন হোসেন, ফজলুল হক শেলবর্ষী, মোহাম্মদ মোদাব্বের উল্লেখযোগ্য। আমি কবি আহসান হাবীবের বিশেষ স্নেহ লাভ করি। আমরা তখন দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিলের সদস্য এবং শিল্পী কামরুল হাসানের সর্বাধিনায়কত্বে গড়ে ওঠা মুকুল ফৌজে যোগ দিয়েছিলাম। আমি পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে পড়তাম। আমার এই স্কুলজীবনের সহপাঠীদের মধ্যে মেজর জেনারেল ডা. আনিস ওয়াইজ, খোন্দকার আলী আশরাফ অন্যতম। বাল্যবন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আব্দুস সালামের জ্যেষ্ঠ পুত্র হাসান শফি। তাঁর অকাল মৃত্যুতে আমরা আমাদের পাড়ায় তাঁর নামে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তুলি। এই কাজে আমার সঙ্গে যাঁর উদযোগ জড়িত ছিল, তাঁর নাম খায়রুল বাশার। এখন কুয়ালালামপুরে এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশনে কর্মরত। খায়রুল ও আমি পরে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিই। শেষ পর্যন্ত সেটি রোকনুজ্জামান খান ও ফজলে লোহানীর সম্পাদনায় ‘নোতুন দিন’ নামে প্রকাশিত হয়। আমাদের বাড়িতে একটু সাহিত্যচর্চার পরিবেশ ছিল। আমার মা ও বড় বোন কিছু কিছু লিখতেন। আমার পিতামহ যিনি আমার জন্মের আগেই মারা যান, তিনি প্রথিতযশা সাংবাদিক ও গ্রন্থাকার ছিলেন। কাজেই সাহিত্যের প্রতি একটা আগ্রহ অল্প বয়সেই জেগে ওঠে।’
নিজের লেখালেখির জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথম গল্প লিখি যখন খুলনার জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। পরে ওই গল্পটি কিঞ্চিৎ রূপান্তরিত হয়ে গোলাম মোস্তফা পরিচালিত ‘নওবাহার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। ওটাই আমার প্রথম প্রকাশিত রচনা। ততোদিনে আমরা চলে এসেছি ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (এখন নবাবপুর হাইস্কুল নামে পরিচিত) ভর্তি হই এবং সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করি। ১৯৫১ সালে আমরা একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করেছিলাম। আমি, সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দীন আহমদ, সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদার রশীদ মিলে। আমার লেখা কিছু কিছু মাহে নও ও আজাদে প্রকাশিত হয়। পরে সংবাদ ও অন্যান্য পত্রিকায়। ইতোমধ্যে পাড়ার সূত্রে যোগাযোগ হয় মোস্তফা মনোয়ার ও শিল্পী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। আমিনুলের মাধ্যমে অনেক তরুণ লেখক ও শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। এঁদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মর্তুজা বশীরের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রিয়নাথ স্কুলে আমার সহপাঠীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেয়ামুল বশীর ও সৈয়দ আহমদ হোসেন। নেয়ামুল আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু উর্দু থেকে অনুবাদে কবিতা ও প্রবন্ধ রচনায় তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ভাষা নিরূপণেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সৈয়দ আহমদ হোসেন এখন বাংলাদেশে জাতিসংঘ সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি খুব অল্প বয়সেই বামপন্থী রাজনীতির অনুরাগী হয়ে পড়েন। তাঁর এই চিন্তা নেয়ামুল ও আমাকে প্রভাবানি¦ত করেছিল। ’
ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামানের নিজের অভিজ্ঞতাÑ ‘ভাষা আন্দোলনের সময় যখন বেশিরভাগ নেতা আত্মগোপন করেন, তখন ইমাদ উল্লাহ ও আমি মিলে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সংগঠনের সঙ্গে জেলা সংগঠনের যোগাযোগ কিছুদিন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছাই। আমাদের চোখের সামনেই গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। একটি আহত বালককে আমরা কোলে করে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। গুলি চালানোর পর মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে মাইক্রোফোন স্থাপন করে পুলিশের উদ্দেশে বক্তৃতা ও সাধারণভাবে ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রচার করা হয়। আমিও সেখান থেকে কিছু বলেছিলাম। সেখান থেকেই আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ বক্তৃতা করেছিলেন। অলি আহাদের পরামর্শে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে আমি একটি পুস্তিকা রচনা করি। এটি সংশোধন করেন অলি আহাদ ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি এবং কেন’ নামে যুবলীগ থেকে প্রচার করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এটাই ছিল প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকা। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমি অনেক রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীর সংস্পর্শে আসি এবং বামপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ি।’
তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘১৯৫৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন মোঃ আব্দুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী দীন মোহাম্মদ, মযহারুল ইসলাম, রবীন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী। আহমদ শরীফ তখন বিভাগের গবেষণা সহায়ক ছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলা বিভাগে যোগ দেন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। বিভাগে তখন সাহিত্য ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার খুব অনুকূল পরিবেশ ছিল। বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন একদিকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। অন্যদিকে জ্ঞান চর্চা ও সংস্কৃতি চর্চার বড় রকম সুযোগ সেখানে ছিল। ১৯৫৬ সালে আমি অনার্স এবং ১৯৫৭ সালে এমএ পাস করি। আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। সেটা হচ্ছে হল সংসদের বার্ষিক নাটকে ছাত্র-ছাত্রীদের সহ-অভিনয়ের সূচনা। এ ব্যাপারে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ড. মোঃ ওসমান গনি উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফরিদা বারী মালিক, কামরুন্নাহার লাইলী, মোহরা তারা খানম প্রমুখ। তাঁদের অভিভাবকরাও সম্মতি দিয়ে প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করেছিলেন। ঢাকার সঙ্গীত, নাটক জগতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশ ছিল।’
ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক। আন্দোলনের এক পর্যায়ে শিক্ষকরা প্রকাশ্যে এতে যোগ দেন। বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শামসুদ্দোহা হত্যার প্রতিবাদে দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যৌথভাবে আন্দোলনে নামেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর সেখানকার দ্বিতীয় আবাসিক হল এএফ রহমান হলের প্রভোস্ট নিযুক্ত হই। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভাইস চ্যান্সেলর ড. এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে আমরা কিছু কিছু ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করি। তবে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমাদের হলগুলো হয়ে ওঠে ইপিআরের বাঙালি সৈন্যদের ঘাঁটি। তারা কয়েকদিন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রেখেছিলো। তাদেরকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে গ্রামবাসী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবাই। যুদ্ধের অবস্থা আমাদের প্রতিকূলে চলে গেলে ১ এপ্রিলের মধ্যে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাই। কিছুকাল গ্রামাঞ্চলে কাটিয়ে আমি পরিবার নিয়ে ২৬ এপ্রিল আগরতলায় পৌঁছাই। মে মাসের মাঝামাঝি সময় কলকাতা চলে যাই এবং সেখানে আমাদের শরণার্থী শিক্ষকদের নিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গঠন করি। ড. এ আর মল্লিক সভাপতি। আমি সাধারণ সম্পাদক। আমরা দু’জনে এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে আরো দু’জন শিক্ষক উত্তর ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ব্যাখ্যা করি। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কিছুকাল পর মুজিবনগর সরকার একটি পরিকল্পনা সেল গঠন করে। পরে তা উন্নীত হয় পরিকল্পনা কমিশনে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের অভিপ্রায় অনুযায়ী পরিকল্পনা সেলের সদস্য হিসেবে যোগ দিই। এর অপর সদস্যরা ছিলেন ড. খান সারওয়ার মোর্শেদ, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. স্বদেশ রঞ্জন বসু। অল্পকাল পরে ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী পরিকল্পনা কমিশনের সভাপতি পদে যোগ দেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধকালের কিছু সমস্যা সম্পর্কে এবং দেশ স্বাধীন হলে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারেÑ তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি। তবে নানা কারণেই আমাদের তৈরি করা কাগজপত্র অস্থায়ী সরকারের কাছে পৌঁছুতে বিলম্ব হয়। তাদের বিবেচনা করতে সময় লাগে এবং কিছু কিছু বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই এমন সব ঘটনা ঘটে যায়, যাতে সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিকল্পনা কমিশনে আমার দায়িত্ব ছিল শিক্ষাবিষয়ক সমস্যা সম্পর্কিত কাগজপত্র তৈরি করা। ডিসেম্বর মাসে যখন মুক্তি আসন্ন, তখন আমি একটি প্রস্তাব রচনা করি। তাতে আমি বলি যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চে ছাত্ররা যে যে কাসে ছিল, ১৯৭২ সালের ১ মার্চ থেকে আবার সে সেই কাস থেকে পড়াশোনা শুরু করবে। এক বছর জাতীয় ক্ষতি বলে স্বীকৃত হবে। তাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এক বছর বাড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু ওই প্রস্তাব সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি জনসভায় ঘোষণা করেনÑ বিনা পরীক্ষায় সব ছাত্র পরবর্তী কাসে উন্নীত হয়ে যাবে। তাজউদ্দিন সাহেব পরে আমাকে বলেছিলেন, ওই ঘোষণায় মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছিল না; এই ঘোষণা প্রত্যাহার করা সে সময় সম্ভবও ছিল না। আমি এখনো মনে করি, ওই ঘোষণা কার্যকর করায় শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের আমি খ-কালীন সদস্য ছিলাম। আমি এখনো মনে করি, বাংলাদেশে একই মাধ্যমে একই পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের যে প্রস্তাব এসেছিলো, তা কার্যকর করতে পারলে ভালো হতো।’
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই কম-বেশি জড়িত ছিলাম। বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সঙ্গে আমার যেটুকু সংশ্রব ছিল, তাও আমার গণতান্ত্রিক চেতনার একটি ফল বলতে পারি। চতুর্থ সংশোধনী আমি কখনোই সমর্থন করতে পারিনি এবং অনেককে অসন্তুষ্ট করে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেছি এবং যে ৩১ জন নাগরিক নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব প্রথম দেয় ১৯৮৭ সালে, তার মধ্যে আমি একজন ছিলাম। আমার স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া সত্ত্বেও নব্বইয়ের আন্দোলনে কার্ফ্যু ভঙ্গ করে মিছিল করেছি এবং কাঁদানে গ্যাসের সম্মুখীন হয়েছি। স্বভাবতই ১৯৯১-এর অভূতপূর্ব নির্বাচনের পরে গভীর আশায় আমরা উজ্জীবিত হয়েছি। আমাদের প্রত্যাশা সফল হয়েছে একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী সংসদে গৃহীত হওয়ায় এবং গণভোটের ফলাফলে। তবে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ দেখতে পাচ্ছি না। জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বর্তমান পর্যায়ের ঘটনাবলী তার সাক্ষ্য। তাছাড়া সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে যে সহিংস-সংঘাত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আরো তিনটি ছাত্র সংগঠন সন্ত্রাসের সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে আমি খুবই শংকিত। গণতন্ত্রের একটা প্রধান ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি ও সহনশীলতার চর্চা। আমরা এতোদিন পর গণতন্ত্র পেলাম। অথচ এই সন্ত্রাস এবং অসহিষ্ণুতা সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমি এখনো মনে করি আমাদের উন্নতির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন হওয়া দরকার। সংক্ষেপে বলা যেতে পারেÑ প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি সম্প্রসারিত হওয়া দরকার। বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষা শুধু মেধাবীদের জন্যই উন্মুক্ত রাখা উচিত। হাতে-কলমের কাজে মানুষকে উৎসাহিত করা দরকার। সে সঙ্গে তরুণদের উৎসাহিত করতে হবে স্ব-নিয়োজিত কাজেÑ এসবই শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে আমাদের হতাশার গভীরতর কারণ এই যে, আমরা এখনো সম্পূর্ণভাবেই পরামুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছি। বিদেশের ওপর এতোটা নির্ভরশীল হলে নিজেদের পক্ষে কোনো নীতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের ভার যদি বিদেশীদের হাতে চলে যায়, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হবে।’
নিজের সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, আমি মনে করি যে, আমি যতোটুকু করেছি, তার চেয়ে বেশি আমার করা উচিত ছিল। আমি আরো কিছু করতে পারিনি, তার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত আমি শুদ্ধ অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিজেকে নিয়োগ করতে পারিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছি। এতে বেশ খানিকটা সময় দিতে হয়েছে। তাছাড়া আমি বন্ধুদের সংশ্রবও ভালোবাসি। ফলে সামাজিক-পারিবারিক দিকেও অনেকখানি সময় দিতে হয়েছে। কিছুকাল ধরে আমার স্বাস্থ্য ভালো নেই বলে কর্মক্ষমতাও কমে গেছে।’
৭ অক্টোবর ১৯৯১


সিরাজুর রহমান
ছোটখাটো মানুষ। গড়পড়তা বাঙালির হাইট। কিন্তু কাজের পরিমাপে তিনি যেন সের্গেই বুবকা। কেতাদুরস্ত। কথায়, কাজে, চলাফেরায়। পেছনে ফেলে এসেছেন স্মৃতিমাখা শৈশব, কৈশোর, যৌবন। এখন প্রৌঢ়ত্বের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু টাল খাননি কোথাও। না দেহে, না মনে। শ্রোতাদের কাছে জীবন্ত শিহরণ সিরাজুর রহমান। বিবিসির বাংলা বিভাগের অপরিহার্য নাম। দীর্ঘ তিন দশকের নিবিড় সম্পর্ক তাঁর বিবিসির সাথে।
বিবিসির বাংলা বিভাগের উপ-প্রধান সিরাজুর রহমানের জন্ম নোয়াখালী জেলায়। ১৯৩৪ সালে। পিতা শিক্ষকতা করতেন কলকাতায়। দেশ বিভাগের আগে। সেই সুবাদে পড়াশোনা কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রাবস্থায় হাতেখড়ি সাংবাদিকতায়। ঘটনাক্রমে দৈনিক আজাদে। তারপর ক্রমশ খবরের পেছনে ছুটে চলা। হাত পাকিয়েছেন। পরিণত হয়েছেন অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তান, দৈনিক জিন্দেগী, দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক মিল্লাত, পাকিস্তান অবজারভার ও দৈনিক ইত্তেফাকে। ঢাকায় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের প্রধান সম্পাদক ছিলেন সাত বছর। ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি যোগ দেন বিবিসির পূর্ব বাংলা বিভাগে। টমসন ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ নিয়ে গ্লাসগোতে টমসন টেলিভিশন কলেজে যোগ দেন ১৯৬৫ সালের মার্চে। একপর্যায়ে কিছুকাল কাজ করেছেন রেডিও পাকিস্তান এবং পাকিস্তান টেলিভিশনে। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ১৩ জুন আবার বিবিসির বাংলা বিভাগে ফিরে যান পাকাপাকিভাবে।
কলমে ও কণ্ঠে সমান শক্তিমান সিরাজুর রহমান সম্প্রতি বিবিসির বাংলা বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশে আসেন। ওঠেন হোটেল শেরাটনে। ব্যস্ত ছিলেন প্রতিটি মুহূর্ত। এরই ফাঁকে তাঁর সঙ্গে কথা হয় দু’দফায়। কথা বলেন গুছিয়ে এবং দ্রুত। বিবিসি শ্রোতাদের প্রিয় নাম সিরাজুর রহমানের ভিত্তি গড়ে ওঠে দূর শৈশবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার কলকাতার জীবন প্রভাব ফেলে পরবর্তী জীবনে। ছোটবেলা অল ইন্ডিয়া রেডিওর ছোটদের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিতাম। অবশ্য রেডিও যে জীবনের নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়াবেÑ তা ভাবিনি কখনো। একবার ছোটদের এক অনুষ্ঠানে আমি কি হতে চাইÑ সে সম্পর্কে বলা হয় বলতে। আমি বলেছিলাম, আমি কবি হতে চাই। তবে আমি মোটেও কবি নই। বাস্তব অথবা কাল্পনিক প্রেম নিয়ে কবিতা লিখেছি। চাকরির জন্য কবিতা অনুবাদ করেছি। যাক সে কথা। আমার সাংবাদিক জীবনেরও সূচনা হয় কলকাতায়। আমি ছিলাম মুকুল ফৌজের ৩৬০ নম্বর সদস্য। দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বের মুকুল ফৌজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ কারণে মাঝে মাঝে তাঁর কাছে যেতাম। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হাতছানি পাই সাংবাদিকতা জীবনের। এক সময় সেই সুযোগও এসে যায়। দৈনিক আজাদে তখন হিন্দুরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানদের মধ্যে ছিলেন সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজিবুর রহমান খান, সৈয়দ আব্দুল মান্নান, আহমেদ হোসেন। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় হিন্দুরা সব চলে যান। ফলে পত্রিকা বের করা হয়ে পড়ে অসম্ভব। সৈয়দ আব্দুল মান্নান ও আহমেদ হোসেনের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সাংবাদিক খুঁজে আনার। তখন তাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজের খায়রুল কবীর, ইসলামী কলেেেজর শহীদুল্লাহ ও মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে আমাকে নিয়ে আসেন। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। এরপর মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সঙ্গে সঙ্গে অর্ধ সাপ্তাহিক পাকিস্তান, দৈনিক জিন্দেগী, দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক মিল্লাতে। ইনসাফ থেকে আমি বার্তা সম্পাদক। ১৯৫২ সালের জানুয়ারির গোড়ার দিকে বের হয় দৈনিক মিল্লাত। সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বের। আমি বার্তা সম্পাদক। পত্রিকার মালিক ফরিদপুরের মোহন মিঞা। প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের সঙ্গে বিরোধ ছিল তাঁর। যে কারণে মিল্লাতের সম্পাদকীয় নীতিতে কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না। রোজ মিল্লাত কেনার জন্য মারামারি হতো। ২১ ফেব্রুয়ারির সময় মোদাব্বের সাহেব অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে ছিলেন। পত্রিকার অন্যরা খ-কালীন। ফলে আমিই ছিলাম পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। মোদাব্বের সাহেব হাসপাতালে থাকায় আমরা সব টাটকা খবর পেয়ে যেতাম। পুলিশের লাশ গুম করা থেকে যাবতীয় গোপন তথ্য। ফলে হৈচৈ পড়ে যায়। এতে টনক নড়ে নূরুল আমিনের। তিনি হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুর থেকে পত্রিকার মালিক মোহন মিঞাকে নিয়ে আসেন। রাতের বেলা সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে মিল্লাতে হাজির হন মোহন মিঞা, রেজা-ই করিম, খান বাহাদুর জসিমউদ্দীন। তাঁরা প্রথমে ছাপাখানা বন্ধের চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রেসের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি মোহন মিঞাকে বলেন, দিনের বেলা আপনি মালিক। কিন্তু রাতের বেলা সম্পাদক ছাড়া আমরা অন্য কারো কথা মানতে রাজি নই। এ ব্যাপারে আমাকেও যথেষ্ট চাপ দেয়া হয়। এ ঘটনায় হাসপাতাল থেকে এসে মোহাম্মদ মোদাব্বের চাকরি থেকে রিজাইন করেন। তাঁর অনুরোধে আমাকে মিল্লাতে থেকে যেতে হয়। তবে পরবর্তীকালে আরেক ঘটনায় আমার চাকরি চলে যায়। মোঃ নূরুদ্দীন তখন প্রেসকাবের সভাপতি। জহুর হোসেন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক ও আমি যুগ্ম সম্পাদক। তাছাড়া আমি পূর্ব পাকিস্তÍান সাংবাদিক ইউনিয়নের অস্থায়ী সভাপতি। আজকের প্রেসকাব ছিল তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী মোঃ আফজালের বাসভবন। তিনি চলে গেলে বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়। আমরা তখন ওই বাড়িটা প্রেসকাবের জন্য পেতে চাই। এজন্য এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু মোহন মিঞার সঙ্গে তখন নূরুল আমিনের বিরোধ আবার চাঙা হয়ে উঠেছে। ফলে মোহন মিঞা নির্দেশ দেন, নূরুল আমিনের অনুষ্ঠানে মিল্লাতের কেউ যেতে পারবে না। কিন্তু পদমর্যাদার কারণে আমাকে বাধ্য হয়ে যেতে হয় এবং আমি মিল্লাতে ওই অনুষ্ঠানের তিন কলাম নিউজ করি। পরদিন অফিসে গিয়ে দেখি আমার চেয়ারে বসে আছেন রহিমউদ্দিন সিদ্দিকী। দুঃখের বিষয়, আমার চাকরি চলে যাওয়া নিয়ে কোনো আন্দোলন হয়নি। অথচ আমি ছিলাম সাংবাদিক-নেতা। এ অবস্থায় তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার জর্জ ডেভিডের অনুরোধে আমি ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে যোগ দিই।’
সে সময়কার সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে সিরাজুর রহমান বলেন, ‘দৈনিক ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় লেখার জন্য আইয়ুবের সামরিক আইনে মানিক মিঞাকে আটক করা হয়। অথচ ওই সম্পাদকীয়গুলো লিখেছিলাম আমি, আব্দুল আউয়াল ও আলী আকসাদ। এজন্য আমরা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। তখন মানিক মিঞা বলেন, সবক’টা সম্পাদকীয়র জন্য উনি দায়ী। তাঁর ইচ্ছা ও নির্দেশে তা লেখা হয়েছে। সব দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিয়ে নেন অবলীলায়। এ ধরনের ঘটনা বিরল। আসলে সে সময়ে কয়েকজন সাংবাদিকের আপোষহীন ও সাহসী ভূমিকা সংবাদপত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়।’
বাংলাদেশে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এত পত্রিকা সাংবাদিকদের স্বার্থের অনুকূলে কি-না জানি না। তবে ১৯৭৫ সালে জ্যামাইকা থেকে দেশে ফেরার পথে লন্ডন বিমানবন্দরে এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব আমাকে বলেছিলেন, দেশে কতো পত্রিকা। প্রতিটি পত্রিকা কতোজন পাঠক পড়েন? আসলে এতো বেশি পত্রিকা থাকলে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া যায় না। যথেষ্ট ভালো সাংবাদিকও গড়ে উঠছে না। পত্রিকার সংখ্যা কিছু কম হলে প্রচার ভালো হয়। সাংবাদিকদের স্বার্থের অনুকূল হয়। বেশিরভাগ পত্রিকাই বের হয় কোনো একটা রাজনৈতিক দলের নীতিকে সমর্থন করার জন্য। রাজনৈতিক দলের সংখ্যা যেমন ক্ষেতের আগাছার মতো, তেমনি সংবাদপত্রও। সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে পত্রিকা বের হলে অসংখ্য পত্রিকা ঝরে যাবে।’
দূর থেকে বাংলাদেশকে দেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দূর থেকে আমি বাংলাদেশকে তেমন একটা তীক্ষèভাবে দেখিনি। তবে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ে, লোকজন কাজ করতে চায় না। কর্মবিমুখ। কাজের সাফল্য ও কর্ম সম্পাদনের আনন্দ বাংলাদেশের মানুষ ভুলে গেছে।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গন এখন অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। নেতা, কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ সৎ ও শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। রাজনৈতিক অনুশাসন সবল হয়ে উঠলে স্বৈরশাসনের কোনো সুযোগ নেই।’
তিনি আরো বললেন, ‘বহুকাল পরে গণতন্ত্র এসেছে। সবার দায়িত্ব এটা ধরে রাখার। দীর্ঘদিন যাবৎ স্বৈরাচার গণতন্ত্রকে নষ্ট করে দিয়েছে। যে কোনো স্বৈরাচার প্রথম সুযোগেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেয়। এজন্য একদিন স্বৈরতন্ত্র থাকলে দশদিন গণতন্ত্র পিছিয়ে যায়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সুস্থির অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিমান রাজনৈতিক দলগুলোকে এ নিয়ে ভাবতে হবে।’
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সিরাজুর রহমান বলেন, ‘শেখ মুজিবকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। তাঁকে আমি মুজিব ভাই বলে ডাকতাম। তাঁর সঙ্গে আমার বড় ও ছোট ভাই সম্পর্ক ছিল। তাঁকে আমি ভালোবাসতাম। আবার গালাগালিও করতাম। কেননা, তাঁর দোষও ছিল অনেক। তবে তাঁর তিনটি গুণ ছিল। সাহস, অটল মনোভাব অর্থাৎ সর্বশক্তি দিয়ে কিছু করা এবং ক্যারিশমা বা ব্যক্তিগত আকর্ষণ। গত সংসদ নির্বাচন কভার করার সময় নির্বাচনী প্রচারাভিযানে খালেদা জিয়ার মধ্যে আমি শেখ মুজিবের এই গুণাবলী দেখতে পেয়েছি। এ কারণে নির্বাচনের আগে এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে বিএনপি জিতবে। এ কথা আমি বিবিসিতে বলেছিও।’
বিবিসিতে তিন দশকের অভিজ্ঞতায় সিরাজুর রহমান বলেন, ‘৩০ বছরে সম্প্রচারের প্রকৃতি বদলে গেছে। আগে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ছিল না কৃত্রিম উপগ্রহ। বিদ্যুৎ ছিল সীমিত পরিসরে। রেডিও ছিল ঢাউস সাইজের। কলাকুশলী সীমিত। টেপের ব্যবহার ব্যাপক হয়নি। ষাটের দশকের শেষভাগে এসে হয় ট্রানজিস্টর বিপ্লব। ছোট ছোট রেডিওর বৃদ্ধি পায় ধারণ ক্ষমতা। রেডিওর সংখ্যা বেড়ে যায়। আবির্ভাব ঘটে উন্নততর ট্রান্সমিটারের। কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অনায়াসে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়। সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা হ্রাস পায়। আগের দিনে সরকার সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো রেডিও। এখন আর বেতার-টিভি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এমনকি অনেক দেশেই ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে, সরকারের হাতে রেডিও-টিভির নিয়ন্ত্রণ রেখে লাভ নেই। নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়া ভালো। এই পরিবর্তন-পরিবর্ধন দেখেছি চোখের সামনে। কোনো কোনো ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থেকেছি নিজে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতিমান ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছি। তাদের কাছ থেকে দেখবার, জানবার সুযোগ হয়েছে। এতে সমৃদ্ধি ঘটেছে মনের।’
কথা প্রসঙ্গে সিরাজুর রহমান জানান, ‘১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য পত্রিকা ‘সংকেত’ তিনি বের করেন। ওই সংখ্যায় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা, হাসান হাফিজুর রহমানের প্রথম দেখা এবং আলাউদ্দীন আল আজাদের প্রথম গল্প ছাপা হয়। স্কলারশিপের টাকা দিয়ে ওই পত্রিকা বের করি। সংকেত-এর মোট সাড়ে ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় আমাদের মনোভাব ছিল আপসহীন। যে কোনো বিষয়ে রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা করতাম না।’
২২ অক্টোবর ১৯৯১

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

এক সময়ের দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ মোহামেডানের কামরু/ দুলাল মাহমুদ

এখন সময় মেসির, এখন সময় আর্জেন্টিনার / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ