স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই-২
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু
ক্রিকেট কি শুধু পরিসংখ্যানের খেলা? পরিসংখ্যানে কতটুকু সত্য থাকে? কোনো মহাকাব্যিক ইনিংস কি অনুভব করা যাবে পরিসংখ্যান দেখে? ১৯৬০ সালে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার টাই টেস্টের পরতে পরতে যে উত্তেজনা ও অবিশ্বাস্য নাটকীয়ত স্নায়ুকে বিকল করে দিয়েছিল, তা কি ফুটে ওঠে পরিসংখ্যানের কঙ্কালে? ক্রিকেটের বর্ণাঢ্য চরিত্র ‘বুড়ো শয়তান’ খ্যাত ডব্লিউ জি গ্রেস কিংবা সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে সম্মানিত ডন ব্রাডম্যানকে পরিসংখ্যানে কতটুকু চেনা যায়? চেনা যায় না বলেই যুগে যুগে ক্রিকেট লিখিয়েরা তাদের মিষ্টি-মধুর কলমে পরিবেশন করেছেন ক্রিকেটের রূপ-রস-সৌন্দর্য। তাদের কলমের আঁচড়ে স্মরণীয় হয়ে আছে মহান ক্রিকেটারদের অমর কীর্তি আর মহাকাব্যিক ইনিংসের লাবণ্য ও সুষমা। সাহিত্যের অধ্যাপক হীরেন চট্টোপাধ্যায় যেমনটি বলেছেন : ‘আসলে ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে লেখা মানে যে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান পেশ করা নয়, তাকে যে প্রাণবন্ত করে তোলা যায়, একটি সুন্দর ইনিংস যে মোৎজার্টের একটি সিম্ফনি বা বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের বিলম্বিত ও মধ্যলয়ের শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীর সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পারে, এই আবিষ্কারই তো ওইসব লেখার প্রতি আমাদের মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল।’ ক্রিকেট যেমন বৃটিশদের গর্ভজাত, তেমনি ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেট সাহিত্যও তাদের দান। এ বিষয়ে রাখাল ভট্টাচার্যের অভিমত হচ্ছে : ‘খেলার রাজ্যে ভাবোদ্বেল সাহিত্য সৃষ্টির অবকাশ ক্রিকেটে যত আছে, এত আর কোনো কিছুতে নেই। ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেট-সাহিত্য যারা পাঠ করেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, মহাসমৃদ্ধশালী ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পংক্তিতে স্থান পাবার যোগ্যতা তার আছে। যে রসসমৃদ্ধ, অলঙ্কারম-িত ও ছন্দময়। ক্রিকেটের বিকল্প নয় সে সাহিত্যপাঠ; ক্রিকেট দেখার থেকে সূক্ষ্ম রসানুভূতি মেলে তাতে। আমি তো বলি, ক্রিকেটের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস ব্যাট থেকে উৎসারিত হয়নি, তা হয়েছে একজনের কলম থেকে, তার নাম নেভিল কার্ডাস। কার্ডাস মূলত সঙ্গীত-সমালোচক। সঙ্গীতেরই তাল-লয়-যতি, মীড়-মূর্ছনা-গমক, সব তার কাছে ধরা পড়েছে, ক্রিকেটেও এবং এত কিছু যে ক্রিকেটে আছে, তারও খবর লোকে জেনেছে সঙ্গীত-সমালোচক কার্ডাসের ক্রিকেট-সমালোচনা পড়ে।’
বাঙালির রক্তে ক্রিকেট নেইÑ পঙ্কজ রায় অল্প কিছু পরিমাণে এবং সৌরভ গাঙ্গুলি তা পুরোপুরি খ-ন করে দিয়েছেন। এখন তো বাঙালিদের একটি দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলছে। তবে ক্রিকেট খেলায় নাম কুড়ানোর আগেই সমঝদার হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছে বাঙালিরা। যদিও কথাসাহিত্যিক শঙ্করের মত বাঙালিরা শুরুতে মনে করতেন : ‘ক্রিকেটটা কোনো খেলা নয়, কলোনিয়াল কালচারের একটি বর্বর প্রকাশ মাত্র, ফলে দু’জন লোক লাঠি হাতে সারাদিন খাটায় একাদশ নির্দোষ মানুষকে।’ অথচ একদিকে বাঙালিরা ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছে, অন্যদিকে মজেছে ক্রিকেট রসে। আস্তে-ধীরে বাঙালিরা আÍস্থ করে নিয়েছেন ‘ক্রিকেট-কালচার’কে। আর এ থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলা ক্রিকেট-সাহিত্যের। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে পূর্ণতা দিয়েছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু (জন্ম : ২১ অক্টোবর, ১৯২৮, হাওড়া, কোলকাতা)। ষাটের দশকটা ছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, চিত্রকলার উজ্জ্বল সময়। সে একটা সময় ছিল, যখন হেমন্ত-লতা-কিশোরের রোমান্টিক গান বুকে সুর হয়ে বেজেছে। উত্তম-সুচিত্রার মিষ্টি প্রেমের ছবি মনকে করেছে উতলা। সুনীল-শক্তির কাব্যরসে আপ্লুত হয়েছেন পাঠক। চিত্রকরের রঙিন ক্যানভাস রূপতৃষ্ণায় ভরিয়ে দিয়েছে দু’চোখ। সৃষ্টিশীল এমন এক সময়ে ‘গদ্যের মধ্যে পদ্য করে ক্রিকেট-সুন্দরীর গায়ে রঙ-বেরঙের নকশা’ কেটেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। বিশিষ্ট সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর ভাষায়, ‘ক্রিকেট রসিক’ এই ভদ্রলোকের হাতে জন্ম সুনিপুণ ক্রিকেট সাহিত্যের। রাজকীয় ও কেতাদুরস্ত ক্রিকেটে ইংরেজি ভাষায় যতটা লাবণ্য ধরে, বাংলা ভাষায় কি ততটা মাধুর্য পাওয়া যায়? এমন একটা দোলাচল বরাবরই ছিল। সাহিত্যের অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের মরুভূমিতে শুধু ফুলই ফোটাননি, তারই হাতে পরিস্ফুটিত ও বিকশিত হয়েছে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের সুবাসিত এক বাগানের। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের যে সোনার খনির সন্ধান দিয়েছেন, তা থেকে পাঠকরা এখনও তুলে নিচ্ছেন মুঠো মুঠো সোনা। শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং তার ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে লিখতে যেয়ে প্রতি মুহূর্তে তারই লেখার স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। ক্রিকেট নিয়ে তার কল্পনা, তার সৃষ্টি, তার অনুবাদ এমনই আবিষ্ট করে রাখে যে, এর বাইরে নতুন ভাবনা কিংবা শব্দচয়ন খুবই দুর্বল ও অপ্রতুল মনে হয়। তাকে জানার সোজাপথ হলো তার লেখা পাঠ করা। এ কারণে এ লেখায় তার লেখার উদ্ধৃতি ও বাক্য অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ তিনি শুধু ক্রীড়া লেখক ছিলেন না। তার গবেষণার আলোয় আলোকিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা দিক। সাহিত্যের অধ্যাপক অমিয় দত্তের মতে : ‘বৈদগ্ধ্যের বৈভবে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ভাবমূর্তি হিমালয়-সদৃশ। কত দিকেই না তার মানসাভিসার। বৈষ্ণব সাহিত্যের রসময় আলোচনায়, ক্রিকেট সাহিত্যের সৌরভময় দুনিয়ায়, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা-সুভাস চন্দ্রের ঐতিহাসিক আবির্ভাবের গবেষণাধর্মী মহাগ্রন্থ রচনায় তার অসামান্যতা সর্বজনবিদিত।’
বাঙালির জীবনচর্যা ও সংস্কৃতিতে বহুল উচ্চারিত শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখনী নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন কথাসাহিত্যিক হর্ষ বসু : ‘সে এক গভীর বিস্ময়, বাকরুদ্ধ স্তব্ধতা। কেবলই মনে হয়ছে, শুধু নিষ্ঠা বা মেধার জোরে এমন কালজয়ী কাজ করে ওঠা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জন্মগত বিরল প্রতিভা। শঙ্করীপ্রসাদ সেই বিরল প্রতিভাসম্পন্নদের মধ্যে একজনÑ যাঁরা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। কিন্তু যাদের সৃষ্টি প্রবহমান মানবসভ্যতাকে এক অপতিরোধ্য ঋণের জালে বেঁধে রেখেছে।’ জীবন ও সৃষ্টির নানাদিক নিয়ে মেতে উঠলেও শঙ্করীপ্রসাদ বসু স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলার ‘নেভিল কার্ডাস’ হিসেবে। ‘খেলার মাঠকে তিনি সারস্বত সাধনার ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন।’ প্রথম যৌবনে তিনি যখন ছিলেন ক্রিকেট নেশাগ্রস্ত, তখন ‘ক্রিকেটের নেশা আমাকে যখন পেয়ে বসলো তখন একদিকে জীবনের মধুর শীতের দুপুরগুলি কাটাতে শুরু করলুম ইডেনের গ্যালারীতে বসে, অন্যদিকে বাড়ি ফিরে এসে চোখ ডুবিয়ে দিলুম ইংরেজিতে লেখা ক্রিকেটের অপূর্ব সব কাহিনীতে। ক্রিকেট যারা ভালবাসে- তারা খেলা কেবল মাঠেই দেখে না, বইয়ের পাতাতেও দেখে থাকে’Ñ এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটের রসকে কাগজে-কলমে রূপায়িত করেছেন। চোখের দেখা, ইংরেজি ক্রিকেট সাহিত্য আর পরিসংখ্যানের ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে আহরণ করেছেন ক্রিকেটের মাধুর্য। মহাজীবনের গাঁথা (১৯৫৩), মধ্যযুগের কবি ও কাব্য (১৯৫৫) ও চ-ীদাস ও বিদ্যাপতির (১৯৬০) লেখক শঙ্করীপ্রসাদ বসু ১৯৬০ সালে ‘ইডেনে শীতের দুপুর’ লিখে কাঁপিয়ে দেন বাংলার ক্রিকেটানুরাগীদের। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘শঙ্করীপ্রসাদ বসুও সেই দুর্লভ বাকশক্তির অধিকারী, অন্যের মনশ্চক্ষুকে যা অতি অকেশে খুলে দেয়। ছাত্রমহল জানে, তিনি একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক; ক্রীড়ামহল জানে, তিনি একজন দক্ষ দর্শক এবং পাঠকমহল জানে, তিনি একজন শক্তিমান লেখক, বাচনভঙ্গির চাতুর্যে নেপথ্যের ঘটনাকেও যিনি দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন। আমি তার এই বই (ইডেনে শীতের দুপুর) পড়েছি এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ঘরে বসেই ক্রিকেট খেলা দেখেছি। দেখা সম্ভব হতো না, তার ভাষা যদি-না বর্ণনাময় এবং বর্ণনা যদি-না নিখুঁত হতো। আসল কথা, ক্রিকেটকে তিনি ভালবাসেন। ভালবাসার বস্তুটিকে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। দূরের থেকে কাছে টেনে এনেছেন। এ অতি শক্ত কাজ, তাতে সন্দেহ নেই।’ লেখকের বসবাস কলকাতায় হওয়ায় ইডেন গার্ডেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মধুময় স্মৃতি। ইডেন গার্ডেনে কাছ থেকে খেলতে দেখেছেন বিশ্ব-সেরা ক্রিকেটারদের। কোনো কোনো ক্রিকেটার তার মন জয় করে নেন। তাঁদের ক্রিকেটশৈলী ও ব্যক্তিত্ব তাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। মূলত এদেরকে কেন্দ্র করে ‘ইডেনে শীতের দুপুর’-এ যেন শব্দ দিয়ে বাজানো হয়েছে হৃদয়ের সুর। ক্রিকেটের আলোয় খুঁজে পাওয়া যায় জীবন-জগতের নতুন ব্যঞ্জনা। ‘এর নাম ইডেন গার্ডেন’ শিরোনামের লেখায় ফিরে ফিরে আসে শৈশব-কৈশোরের মধুমাখা দিনগুলো। লেখক তার গুণেনদার হাত ধরে সেই কবে গিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেনে, সেই থেকে যাবার পর প্রতিবারই ফিরে আসার সময় চোখের তৃষ্ণা পিছনে ফেলে এসেছেন। তারই তাড়নায় আবার গিয়েছেন। এমনি চলেছে বছরের পর বছর। ইডেন গার্ডেনের মায়া থেকে নিস্তার পাননি। পাননি বলেই ভুলতে পারেননি জীবনের সেইসব আনন্দময় দিনগুলোর কথা : ‘কিভাবে শীতের সকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখতে লাইন দিয়েছি ইডেন গার্ডেনে। খুব ভিড়ের সম্ভাবনা, সিজন টিকিটের পয়সা জোটেনি। ভোর-ভোর বেরুতে হয়েছে। যখন মাঠে পৌঁছেছি, অলস ঘুমের মতো তখনও কুয়াশা জড়িয়ে আছে পাইন-দেবদারুর পাতায় পাতায়। ওধারে হাইকোর্টের চূড়োটি কেমন মায়াময়। আবছা আলোয় গড়ের মাঠ। কালো নোঙর-করা নৌকোর মত টেন্টগুলো। ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে মাথা-নামানো ব্রোঞ্জের সৈনিক দুটোর ভঙ্গিতে সুকোমল নমস্কার। দৌড়ে-দৌড়ে আসতে হয়েছে। ইতোমধ্যে লাইন খুব কম হয়নি। আমরা আছি পাঁচজন। তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে দু’জনকে পাঠিয়ে দেয়া হলো খোঁজ-খবরে আমাদের লাইনটা ঠিক লাইন কি না, অন্য গেটে ছোট লাইন আছে কি না, চেনাশোনা কেউ আগে আছে কি না, সেখানে ঢোকার চান্স কি রকম? কাঁধের ঝোলাগুলো, একবার নেড়েচেড়ে নিই। ঠিক আছে’। ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ হয়ে যারা ছুটে যান ক্রিকেট মাঠে, এ তো তাদের জীবনের দিনলিপিÑ যা চমৎকারভাবে এঁকেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তখন সময়টা আসলেই অন্যরকম ছিল। সবকিছুতেই ছিল সুরুচির একটা প্রচ্ছন্ন ছাপ। ভাল বই, ভাল গান আর ক্রিকেট ছিল বাঙালির মন্থর নগর জীবনের প্রধান বিনোদন। তবে সবার পক্ষে ক্রিকেট মাঠে যাওয়া সম্ভব না হলেও বেতারের ধারাবিবরণী কানে মধবৃষ্টি বর্ষণ করতো। সংবাদপত্রে খেলার বিবরণী কিছুটা তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হতো। কিন্তু শঙ্করীপ্রসাদ বসু যেন বাঙালিদের ক্রিকেট রসে মজিয়ে দেন। দৈনিক পত্রিকার গতানুগতিক রিপোর্টিং- এর বাইরে নতুন এক ধারার প্রবর্তক তিনি। এ যে ক্রিকেট সাহিত্য! বাঙালির আটপৌঢ়ে জীবনে এক নতুন রসদ।
বাঙালিরা যে ক্রিকেট খেলতে পারেন, এটা প্রমাণ করেছিলেন, পঙ্কজ রায়। বর্তমানে ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ও ক্রিকেটার ‘বাঙালি-বাবু’ সৌরভ গাঙ্গুলির আগে পঙ্কজ রায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ব্যাটসম্যান। সে সময়কার ভেতো ও ভীতু বাঙালি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ‘চরিত্রশক্তিতে অনন্যভাবে সমৃদ্ধ’ ছিলেন তিনি। বলা যায়, পঙ্কজ রায়কে দিয়ে বাঙালির ক্রিকেটে নববসন্তের সূচনা। এ কারণে অন্য অনেকের মত পঙ্কজ রায় ছিলেন লেখকের প্রথম জীবনের ভালবাসা। তাকে পেয়েছিলেন ‘ক্ষ্যাপা আনন্দের জগতে নন্দন চরিত্ররূপে’। ভালবাসার মানুষটিকে বাঙময় করে তুলেছেন এভাবে: ‘কিন্তু সেদিন পঙ্কজের মধ্যে যা দেখেছিলুম, তা আর দেখবার আশা করি না। ছেলেটির সমস্ত দেহের মধ্যে থেকে একটা জিনিস বিচ্ছুরিত হচ্ছিলÑ আÍবিশ্বাস। চলা-ফেরা, ব্যাট ধরা, স্ট্রোক করাÑ সবকিছু সহজ দর্প এবং প্রফুল্লতার ভঙ্গিতে বাঁধা। কোনো বলই তার কাছে সমস্যা নয়। তাই বলে কি সেগুলিকে নিরন্তর বাউন্ডারিতে পাঠাচ্ছিলেন? মোটেই নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু থামাচ্ছিলেন, মারছিলেন মাত্র মারবার বলটি। কিন্তু যেভাবে ক্রিজের উপর ঘোরাফেরা করলেন, যে প্রত্যয়ের অনায়াস গতিতে, সে জিনিস একমাত্র তার পক্ষেই করা সম্ভব, যে জীবনের প্রসন্ন মুখ দেখেছে, সেই গৌরবর্ণ খর্বকায় বাবু চেহারার যুবকটি আমাদের মনে একটি সানন্দ মহিমার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। (ইডেনে শীতের দুপুর)। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৩টি টেস্ট খেলে ৩২ দশমিক ৫৬ গড়ে ২৪৪২ রান করেছেন পঙ্কজ রায়। এর মধ্যে ৫টি সেঞ্চুরি। ১৯৫৬ সালে মাদ্রাজে ভিনু মানকদকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম উইকেট জুটিতে যে ৪১৩ রান করেন, তা আজো রেকর্ড বইয়ের পাতায় অম্লান হয়ে আছে। উপর্যুপরি ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন। পরিসংখ্যানে কি আমরা প্রকৃত পঙ্কজ রায়কে চিনতে পারবো? পারবোনা বলেই বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়কে তিনি আমাদের মানসপটে ছবির মত এঁকে দিয়েছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তী সুঁটে ব্যানার্জি, মুস্তাক আলী, লালা অমরনাথ, বিজয় মার্চেন্ট, বিজয় হাজারে, রুসী মোদী, পল উমরিগড়, জি এস রামচাঁদ, দাত্তু ফাদকার, ভিনু মানকদকে জীবন্ত করে রেখেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। এই ক্রিকেটাররা গেয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের নবজীবনের গান। অপরিণত ভারতীয় ক্রিকেট দলকে এরাই দিয়েছিলেন নতুন পথের ঠিকানা। ১৯৩২ সালের জুনে লর্ডসে প্রথম টেস্ট খেলার প্রায় ২০ বছর পর ভারত ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাদ্রাজে ইংল্যান্ডের সঙ্গে পঞ্চম টেস্টে ইনিংস ও ৮ রানে প্রথম জয়ের মুখ দেখে। এই জয়ে ভিনু মানকদের অসাধারণ বোলিং, পল উমরিগড় ও পঙ্কজ রায়ের দায়িত্বশীল সেঞ্চুরি ছাড়াও লালা অমরনাথ, অধিনায়ক বিজয় হাজারে প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এদের অন্যতম মুস্তাক আলীর মধ্যে লেখক খুঁজে পেয়েছিলেন ‘রৌদ্রতপ্ত দূর ভারতের রহস্যময় সৌন্দর্য’। কল্পনা ও প্রতিভায় পূর্ণ এই ক্রিকেটার সহসা ঝলসে উঠে রাঙিয়ে দিতে পারতেন আকাশপ্রান্ত। তার দায়িত্বহীন সৌন্দর্য- বিলাস সবাইকে মুগ্ধ করতো। তার আউট হওয়া মানে চঞ্চল অথচ সুন্দরের মৃত্যু। মুস্তাক আলী আউট হওয়ার মুহূর্তটি লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন এখনও তা যে কাউকে আপ্লুত করবে: ‘মুস্তাক আলী নামলেন। ক্রিকেটের নবকুমারকে অভ্যর্থনা জানাতে সে কি বিপুল করতালি! সমস্ত মাঠ মেতে উঠল দিনশেষে মুস্তাকের উদয়ে। রামাধীন বল করতে শুরু করলেনÑ প্রথম বল- মুস্তাক সুন্দরভাবে আটকালেন। দ্বিতীয় বল- যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছেন মুস্তাক- রামাধীনকে আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না- বোলারের মাথার উপর দিয়ে উঁচু করে বলটি চালিয়ে দিলেন। কিন্তু হায়, যথেষ্ট উঁচু হলো না বল এবং খর্বকায় রামাধীন একটি অদ্ভুত লাফ দিয়ে বলটি ধরে নিলেন। কট আউট। সকলের হৃৎপি- যেন লাফিয়ে উঠল। কণ্ঠে কণ্ঠে সাঁড়াশির চাপ- শব্দমাত্র নেইÑ শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ- কালির বোতল গড়িয়ে পড়েছে- এমন সময় সুমধুর রবে বেজে উঠল ভারতীয় ব্যান্ডের সুবিখ্যাত আনন্দগীত; তালে-তালে লুটোপুটি করতে লাগল সুর রঙ্গভরে। দর্শকরা এমন নিস্তব্ধ যে, শোনা গেল সুরের মৃদুতম ধ্বনি পর্যন্ত। সেই থেকে বন্ধ হয়ে গেল খেলার মধ্যে ব্যান্ডবাদ্য’ (ইডেনে শীতের দুপুর)। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করার গৌরব লালা অমরনাথের। ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে মুম্বাইতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে তার অভিষেক টেস্টে এই সেঞ্চুরি করেন। লেখক লালা অমরনাথকে বলেছেন, ‘প্রাকৃতিকতার ক্রীড়ারণ্যে সচল বনস্পতি’ এবং ‘সমুদ্র আর মরুভূমির মাঝখানে বিস্তৃত অমরনাথের জীবন’। ‘আÍক্ষয়ী প্রতিভা’ লালা অমরনাথকে ‘সমুদ্র-সন্তান’ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন: ‘মহান সি কে নাইডু সর্বাঙ্গীনতায় ভারতীয় ক্রিকেটে অনতিক্রান্ত। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, ক্যাপ্টেন্সিÑ কোথায় সি কে মহীয়ান নন? তার শক্তি অনেক সময়ই প্রাকৃতিক, তার ব্যাটিং ক্রিকেটের ধর্ম-সমাজে ‘ব্রাত্য’ সকল বেড়ার বাইরে। তবু, তাকে সম্মান জানিয়েই বলব, শক্তির উদ্ধত প্রকাশে অতুলনীয় সি কে-ও এক জায়গায় অমরনাথের কাছে হেরে গেছেনÑ শক্তির প্রকাশ-লাবণ্যে। সি কে আমাদের যখন স্তম্ভিত ক’রে রাখেন, তখন অমরনাথের ব্যাটে বিপ্লবের বীণা বাজে। ঝড়ের রাতের সেই সঙ্গীত অমরনাথের বিধিদত্ত’। (ইডেনে শীতের দুুপুর)। অধিনায়ক বিজয় হাজারে ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক শূন্যকে পূর্ণ করেছেন, অনেক ভগ্নকে করেছেন উত্তোলন। প্রয়োজনের বেদীতে বারবার বলি দিয়েছেন সৌন্দর্যকে। লেখকের মতে, ‘মুস্তাক আলীর মুখরতা, সি এস নাইডুর কোলাহল, সি কে’র অট্টহাস্য, অমরনাথের রণধ্বনি কিংবা মার্চেন্টের বিদগ্ধ বচন না থাকলেও ‘ক্রিকেট পৃথিবীতে মহৈশ্বর্যে নম্র ও সম্পদে ভীত এক শান্ত মহিমার নাম বিজয় হাজারে’। তার চওড়া ব্যাটে ও চওড়া বুকে সকল আঘাত সহ্য করতে পারতেন। লেখকের বর্ণনা গুণে বিজয় হাজারের খেলা ভেসে উঠে মানসনেত্রে: ‘অথচ হাজারে কী করেছেনÑ দিনের পর দিন দেখেছি বিষাক্ততম বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তার অবিচলিত নিপুণতা। আহত সর্পের মতো বলগুলো ফণা বাড়িয়ে ছোবল দিতে চাইছে উইকেটে, আর অদ্ভুত সহজ কৌশলে পা এবং হাত বাড়িয়ে ফণার মুখে হাজারে পেতে দিচ্ছেন ব্যাটের ব্লেডটিকে। পিচের ‘লাল’ দাগ ফুটে উঠছে ব্যাটের কাষ্টদেহে, কিন্তু উইকেট অক্ষত। হাজারের খেলা দেখে কতবার মনে হয়েছে- কি আশ্চর্য, এই যোদ্ধা তরবারি ফেলে দিয়ে যেন শুধু ঢাল দিয়ে বিপক্ষের তরবারির আঘাত প্রতিহত করার কৌতুককর খেলায় মত্ত। তরবারির ফলক ঝিলিক দিয়ে এগিয়ে আসে দেহস্পর্শের জন্য, তার আগে পেয়ে যায় ঢালের নির্বিকার প্রতিরোধকে। তারপর একসময় দেখি, কখন যেন যোদ্ধা কুড়িয়ে নিয়েছেন তার তলোয়ার। তার আঘাতে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে বিপক্ষের অস্ত্র। হাজারের ড্রাইভগুলো চোখ ধাঁধিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাউন্ডারির সীমানায়’। (ইডেনে শীতের দুপুর)। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ভিনু মানকদ। রেকর্ডবুকে তার সময়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্রিকেটার। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম সময়ে ১০০ উইকেট এবং হাজার রানের কীর্তি গড়েন। ব্যাটসম্যান হিসেবে সাহসী ও কল্পনাপ্রিয় ভিনু মানকদ টেস্ট ম্যাচের উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি এবং দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করা ভারতের প্রথম ক্রিকেটার। ভিনু মানকদের মধ্যে লেখক খুঁজে পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চরিত্রকে: ‘ভিনুর দিকে একবার তাকান আর ভারতের জাতীয় স্বভাব স্মরণ করুন। এদেশের জীবনের ধীর লয়, অব্যস্ত গতি, প্রসন্ন সহিষ্ণুতা, শান্ত প্রতিরোধ, অহিংস অসহযোগিতা; এ দেশের প্রান্তর, কৃষক, গরুর গাড়ি, ধানকাটা, তাঁত বোনা; আর মনে করুন ভিনু মানকদকে। এদের মধ্যে কোথাও কি একটা ঐক্য নেই।’ (ইডেনে শীতের দুপুর)। এমন কাব্যময় বর্ণনা ক্রিকেট মাঠের একজন কবি ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে রাখাল ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘কবির দৃষ্টিতে অতি সাধারণ বস্তুও রূপময় হয়ে ওঠে। বর্তমান লেখকের কবিতা রচনার অভ্যাস আছে কিনা জানি না, কিন্তু বিভিন্ন ক্রিকেটারের খেলার ধরন অনুধাবন করে, তিনি যেভাবে তার বিশ্লেষণ করেছেন, জীবন ও প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশের সঙ্গে উপমা দিয়ে তাকে বাক্সময় সাকার রূপ দিয়েছেন, তা যে কবিকৃতি, তাতে সন্দেহ নেই’।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘রমণীয় ক্রিকেট’। ১৯৬০ সালের ৯ থেকে ১৪ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্য ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি’র পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট। মহান অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মুখোমুখি রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে গ্যারি সোবার্সের সৌন্দর্যপূর্ণ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে করা ১৩২, সলোমন ৬৫, ফ্রাঙ্ক ওরেল ৬৫, আলেকজান্ডার ৬০ ও ওয়েস হলের ৫০ রানের সুবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ ৪৫৩। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিডসন নেন ৫টি উইকেট। জবাবে অস্ট্রেলিয়া নর্মান ও’নীলের কষ্টসাধ্য ১৮১, সিম্পসনের ৯২ ও ম্যাকডোনাল্ডের ৫৭ রানে ৫০৫ রান করে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে যায়। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ওয়েস হল ৪টি উইকেট নেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্রাঙ্ক ওরেলের ৬৫, রোহান কানহাইয়ের ৫৪ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮৪ রান করলে জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়ায় ২৩৩ রান। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিডসন ৬টি উইকেট নেন। কিন্তু বুনো বোলিংয়ে ভয়ঙ্কর ওয়েস হলের তা-বে ৯২ রানে অস্ট্রেলিয়ার ৬টি উইকেটের পতন ঘটলে ক্যারিবীয়দের পুরু ঠোঁটে ক্যালিপসো সুর ভাসতে থাকে। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ডেভিডসন ও অধিনায়ক রিচি বেনো ক্যারিবীয়দের সুর থামিয়ে দেন। সলোমনের দুর্দান্ত থ্রোতে ডেভিডসনকে ৮০ রানে ফিরিয়ে দিলেও বেনো থাকায় জয়ের তরী অস্ট্রেলীয় বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় থাকে। শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৬ রান। হাতে ৩টি উইকেট। বল হাতে ‘দানবীয়’ হল। হলের বাউন্সারে বেনো ধরাশায়ী হলে যন্ত্রণার-আবেগের-উৎকণ্ঠার লাভা গড়িয়ে পড়তে থাকে মাঠে। ২৩২ রানের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার শেষ দুই ব্যাটসম্যান গ্রাউট ও মেকিফ রান আউট হলে ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত ‘টাই’ হয়। ‘মানুষের সাধনা ও বিধাতার বাসনার যৌথ সৃষ্টি ঐ ‘টাই’।এরপর ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে চেন্নাইতে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যেকার দ্বিতীয় ‘টাই’ হলেও প্রথম ‘টাই’ ম্যাচে যে আবেগ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাস ও øায়ুর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তা তুলনারহিত। লেখকের বর্ণনায় ঝরে পড়ে মুগ্ধতা : ‘১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসের ব্রিসবেন টেস্ট সম্বন্ধে লিখতে আমার সংকোচ হচ্ছে। যে খেলা সম্বন্ধে বলা হয়েছেÑ না দেখলে তাকে সত্য বলে বিশ্বাস হবে না, দেখলেও বিশ্বাস হওয়া শক্তÑ যে খেলা দেখতে দেখতে রসিক দর্শকের মনে অপূর্ব অব্যক্ততার চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে- সে খেলার সত্যরূপ ফোটাব কি ক’রে? আমি তো ছার, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে কলম দিলেও তিনি কুন্ঠাবোধ করবেন, কারণ স্রষ্টাও শেষ পর্যন্ত সৃষ্টির সব রহস্য জানেন না। তাছাড়া, সৃষ্টির ব্যাপারে তার ভূমিকা অনেকটা নাট্যকারের মতো। নাট্যকার নাটক লেখেন কিন্তু সে নাটক প্রাণ পায় অভিনয়ে। ক্রিকেট-বিধাতা অদৃশ্য থেকে ব্রিসবেনের টেস্ট নাটকটি লিখে দিয়েছিলেনÑ কিন্তু সে নাটকের মাঠ রূপের সফলতা এনেছিলেন কয়েকজন ক্রিকেটার-অভিনেতা, তাদের অভিব্যক্তির স্বাধীনতায়।’ . . . . . ‘চঞ্চলতায়, বিহ্বলতায় আন্দোলিত খেলা- বৈদ্যুতিক উত্তেজনা এবং øায়ুধ্বংসী সংকটে পূর্ণÑ বেনো ভাবছিলেন- আশা নৈরাশ্যের অবিরত ওঠাপড়ার যন্ত্রণা- এ কী ক্রিকেট। যা দেখলুম। যা খেললুম! ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা কিভাবে অনিবার্য পরাজয়কে রক্তজমা ‘টাই’-এ পরিবর্তিত করল। তাদের সাহসের শক্তি, তাদের প্রয়াসের মহত্ত্বে বেনো প্রশংসাবোধ করেন। ‘নৈরাশ্য’? হ্যাঁ, নৈরাশ্য একই সঙ্গে মনে জাগে- এত লড়াইয়ের পরেও আমরা জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় একটি মাত্র রান জোগাড় করতে পারলুম না’। (রমণীয় ক্রিকেট)। শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটকে মনে করেন ‘খেলার রাজা’, ‘ক্রিকেট মহান খেলা’। কারণ, ‘ক্রিকেটের সাহিত্য আছে। খেলার সাহিত্য যদি একমাত্র ক্রিকেটের থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ক্রিকেটই সবচেয়ে জীবনময় খেলা’। . . . . .‘জীবন বলতে কেবল উত্তেজনা বোঝায় না। জীবন অনেক ব্যাপক। উত্তেজনা, আবেগ ও ধীরতার নানারূপী বিন্যাস সেখানে। জীবনে আছে সূচনা ও সমাপ্তি। উভয়ের মধ্যে ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তনের তরঙ্গ গতি। ক্রিকেট সেই খেলা। ক্রিকেট জীবনের ক্রীড়া-সংস্করণ’। তিনি অসাধারণ যে দৃশ্যপট এঁকেছেন, তাতে ক্রিকেট রাজ্যে সবাই রাজা: ‘এসব কথাও ভুলে যান। মনে রাখুন একটি শীতের অপরাহ্নকে। সোনালী রোদের মদ। সবুজ মাঠ। আতপ্ত সুতৃপ্ত অবসর। আপনি সেই অবসরের অধীশ্বর। আপনার ইচ্ছার সম্মানে সাদা ফানেলে ঢাকা ব্যাট-বল হাতে কয়েকটি অভিনেতা। আপনি রাজা, সত্যই রাজা। রূপকথাগুলো এখনো বাজেয়াপ্ত হয়নিÑ স্বপ্নে ও কামনায় একটি নিতান্ত রাজা। রাজা হয়ে বসে আপনি খেলা দেখছেনÑ দেখছেন খেলার রাজাকে। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই খেলার রাজত্বে। (রমণীয় ক্রিকেট)। এছাড়া ‘রমণীয় ক্রিকেট’ গ্রন্থে ‘চায়ের পেয়ালায় ক্রিকেট’, ‘রমণীয় ক্রিকেট’, ‘নাতি রমণীয় ক্রিকেট’, ‘সমালোচকের সমালোচক’, ‘অস্ট্রেলিয়ানিজম’, ‘ক্রিকেটের কুরুক্ষেত্র’, ‘ক্রিকেটারের বউ’, ‘কলমে ক্রিকেট’, ‘ইডেন-গার্ডেনে’ লেখাগুলো ভিন্ন স্বাদের।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসের সব মহান ও মহৎ চরিত্ররা। ডব্লিউ জি গ্রেসের মত এতটা আকর্ষণীয়, রোমাঞ্চকর এবং অবিশ্বাস্য সব কীর্তি ও কুকীর্তি আর কোনো ক্রিকেটারের ঝুলিতে নেইÑ এ কথা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়। ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটগাঁথার এই নায়কের গোটা জীবনটাই ক্রিকেটময়। ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেললেও ৪৪ বছরের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ১২৪টি সেঞ্চুরি ও ২৫১টি হাফ-সেঞ্চুরিসমেত ৮৭০ ম্যাচে ৫৪ হাজার ২১১ রান, ২৮০৯টি উইকেট আর ৮৭৬টি ক্যাচ নিয়ে তিনি এক কিংবদন্তী হয়ে আছেন। ‘দ্য ডক্টর’ নামে খ্যাত গ্রেসকে বলা যায়, আধুনিক ব্যাটিং পদ্ধতির প্রবর্তক। বিশাল চেহারা, লম্বা দাঁড়ি ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির এই ক্রিকেটার তার মহত্ব, তার চালাকি ও তার অনবদ্য ছেলেমানুষি দিয়ে ক্রিকেটের রূপকথার নায়কে পরিণত হয়েছেন। ক্রিকেটের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য এই চরিত্র ডব্লিউ জি গ্রেসকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে: ‘ক্রিকেট, গ্রেসের কাছে ক্রীড়ামাত্র ছিল না, ছিল জীবনের অঙ্গ। ক্রিকেট এবং জীবনবোধÑ একই কথা এবং জীবন যেহেতু সাজানো ড্রইংরুম নয়, তাতে কৌতুক আছে, কৌশল আছে, ভদ্রতা এবং পরিমিত মাত্রায় ইতরতাÑ সবই আছেÑ গ্রেসের ক্রিকেটেও তাই ছিল। আনন্দোচ্ছ্বল দুর্বৃত্ততার গুণে জিতে গিয়েছিলেন গ্রেস। তার চরিত্রও ঐ রকমই ছিল। সাধারণ ইংরেজদের চরিত্রও তাই- সহানুভূতি, সহৃদয়তা, সংকীর্ণতা ও রক্ষণশীলতার বিচিত্র সমন¦য়। অন্য বিখ্যাত খেলোয়াড়রাও অনেকে খেলার মধ্যে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু তাদের সেই ব্যক্তিরূপ তাদের জাতিরূপের একাংশকে মাত্র প্রকাশ করেছে। অপরপক্ষে ডাঃ গ্রেস ছিলেন সকল সাধারণ ইংরেজের প্রতিনিধি। সুতরাং সাধারণের স্বভাব অনুযায়ী তিনি খেলা থেকে কৌতুকময় দুষ্টুমি বা ভদ্র স্বার্থপরতা বাদ দিতে পারেননি।’ (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
সুরে, সুধায় ও জীবনকে যারা মিলিয়েছেন ক্রিকেটের রাখীবন্ধনে, সেই ক্যারিবীয় দ্বীপের ক্যালিপসো সুর যেন শঙ্করীপ্রসাদ বসুর কলমে গেয়ে ওঠে গুণগুণ করে: ‘সারাক্ষণ বিদ্যুৎগতিতে খেলা চলে একসময় শেষ হলো। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। খেলোয়াড়রা মাঠের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল হাত-পা ছড়িয়ে। পরক্ষণেই আবার লাফিয়ে উঠে একটা গোটা বোতল গলায় ঢেলে দিল ঢক্-ঢক্ করে। ততক্ষণে সকলে ফিরে এসেছে। নারকেল গাছের তলায়, তেঁতুল গাছের অন্ধকারে, জ্বলে উঠেছে একে একে মশাল। খানাপিনা শুরু হয়। প্রচুর প্রচুর খায়, পানও করে তেমনি। পানে-ভোজনে-স্ফূর্তিতে মাতাল সবাই। মশালগুলো নিভে আসে, কিন্তু আকাশে ওঠে চাঁদ। তার আলো দুধের মতো গড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। দূর থেকে ভেসে আসে সমুদ্রের গর্জন। হু-হু ক’রে বাতাস বয়ে যায়। শিউরে ওঠে নারকেল বন। বাজনা বেজে ওঠে, বেজে ওঠে এক সুরে শত শত কণ্ঠ। সেই চন্দ্রধৌত রাত্রে সমুদ্রতটে, সরল উচ্ছ্বল মানবের প্রাণতটে, আছড়ে পড়তে লাগল সুরের পূর্ণ তরঙ্গ। শুরু হলো নৃত্য।’ (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
ক্রিকেট পৃথিবী রোমাঞ্চিত ও সঙ্গীতময় হয়ে ওঠেছিল পঞ্চাশের দশকে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের রাজপুত্র ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, মন্ত্রীপুত্র এভারটন উইকস ও কোটালপুত্র কাইভ ওয়ালকট। বার্বাডোসের সেন্ট মাইকেলে ত্রিশের দশকের মাত্র ১৮ মাসের ব্যবধানে জন্ম নেয়া বিশ্বখ্যাত এই তিন ক্রিকেটার ফুলে-ফলে ভরিয়ে দেন ক্রিকেটের বাগান। ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকালে অর্ভিষেক হওয়া বিখ্যাত এই তিন ‘ডাব্লিউ’র রানে ও গানে উছলে ওঠে ক্যালিপসো সুর। পৃৃথিবীর ক্রিকেট ইতিহাসে এমনভাবে তিনজনের সম্মিলন আর ঘটেনি। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে, কোনো টেস্টে তিনজনের একজনও কিছু করতে পারেননি। ‘মর্যাদার লাবণ্যে অনতিক্রান্ত ওরেল, আঘাতে আক্রমণে উন্মুক্ত উইকস, ঋজু শক্তির বহির্বিকাশে সুদৃঢ় ওয়ালকট’। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ১৫ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ৯টিতে জয়ী, ৩টি পরাজিত, ২টিতে ড্র ও একটিতে টাই করেন। ওরেলের ব্যাটের হাসি আর মুখের হাসি একাকার হয়ে গেছে। তার ভুবনভুলানো অতুলনীয় হাসিটি ক্রিকেটের সেরা সম্পদ হয়ে আছে। ওরেল ক্রিকেটে গেয়েছেন জীবনের গান। তিনি মনে করতেন” ‘সুখের সঙ্গে মানুষের মতো বেঁচে থাকো, তোমার কথা লিখে ইতিহাস মানুষের ইতিহাস হয়ে উঠুক’। ওরেলকে মনে করা হয় ‘সোজা ব্যাটের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যময় খেলোয়াড়’। ওরেলের মহানুভবতা ও রুচির আভিজাত্য ছিল তার সহজাত। মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনি মর্যাদার সঙ্গে খেলেছেন। উইজডেনের মতে, ‘মারের সৌন্দর্যে ক্রিকেটের ইতিহাসে ওরেলকে কেউ অতিক্রম করতে পারেননি’। ক্রিকেটকে যারা সুর-ছন্দ ও মাধুর্য দিয়ে কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে সেরা হলেন তিন ক্যারিবীয় শিল্পী ক্রিকেটার ওরেল-উইকস-ওয়ালকট। তারা ক্রিকেট খেলেছেন হৃদয় দিয়ে। ফ্র্যাংক ওরেলকে ‘প্রিন্স অব ডেনমার্ক’ অভিহিত করে শঙ্করীপ্রসাদ বসু যেভাবে গেঁথেছেন শব্দের মালা: ‘ফ্রাঙ্কি ওরেলের জন্য আমরা তাই প্রতীক্ষা করিÑ প্রতীক্ষা ক’রে থাকব চিরদিন। ওরেলরা আমাদের বর্ণহীন পৃথিবীতে সু-বর্ণময়। রুশো বলেছিলেন, ফিরে যাও। প্রকৃতির কাছে থাকলে তোমরা আরও বেশি ‘মানুষ’ থাকবে। জীবনের হারানো আনন্দকে খুঁজে পাবে দুয়োরানীর কুটিরে। কাউন্টি খেলার ব্যবসায়িকতা যখন ক্রিকেটকে বণিকবৃত্তিতে পর্যবসিত করেছে, কিংবা শেফিল্ড-শীল্ডের দুঃসাহসী ছোকরারা যখন ক্রিকেটে এনেছে ধারাবাহিক ভীতি-শিহরণ, তখন ওরেলরা ক্রিকেটের মুক্তিদূত। বাল্যের সহজ সুস্থ পবিত্র আনন্দকে যেন খুঁজে পাই এদের মধ্যেÑ ক্রিকেট খুঁজে পায় তার নির্মলতাকে। এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে ইডেন গার্ডেনে ওরেলের খেলা। শীতের দুপুরে একটি মিঠে প্রেমকাহিনীর মতো অলস আনন্দের ক্রীড়াবিস্তার। আক্রমণ নেই, আঘাত নেইÑ শুধু ব্যাট-বলের মধুস্পর্শ। সুখের খুশির বিহ্বল বিলাস। তার আঘাতকেও আঘাত বলে মনে হয়নি, এমনই আঘাতের ছন্দ। অতি বড় কঠিন কথাকেও সেদিন ওরেল বলেছিলেন কবির মতোই অবহেলার লাবণ্য-ভঙ্গিমায়। ক্রিকেটের একজন কবির নাম ফ্রাঙ্কি ওরেল। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)। এভারটন উইকসের ব্যাটে পাহাড়ের নদীর মতো রানের স্রোত নেমে আসে দুদ্দাড় করে। সেই ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে টেস্টে তিনি টানা পাঁচটি ইনিংসে সেঞ্চুরি করে যে রেকর্ড গড়েছেন, তা আজও অটুট আছে। টেস্টে দ্রুততম সহস্র রানের অধিকারী, ওই ক্রিকেটারের ‘তার স্বাভাবিকতা, তার অনায়াস প্রত্যয়, তার নিখুঁত সংহার, তার অচঞ্চল সমাপ্তি’ দিয়ে এমনই মাদকতা তৈরি করেছেন, যে কারণে দেশের পরাজয়ের মাঝেও প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারের প্রশস্তিতে মজে যান শঙ্করীপ্রসাদ বসু: ‘উইকসের সেঞ্চুরি মানে কলকাতার মাঠে ভারতের জেতার আশা শূন্যের দিকে সরে যাওয়া। কিংবা পরপর ইনিংসে টেস্ট-সেঞ্চুরি উইকসের গৌরব যত বাড়াচ্ছে, ভারতের গৌরব ঠিক পরিমাণে কমাচ্ছেÑ অবিশ্বাস্য বিশ্ব রেকর্ডটি করা হচ্ছে ভারতের বোলিং ও ফিল্ডিংকে ধূলায় মিশিয়ে। ওসব কোনো কথাই তখন আমাদের মনে হয়নি। কেবল দেখলুম। ব্যাটের তলোয়ার, বলের মৃত্যু, ফিল্ডারের বেড়ার দিকে পলায়ন। উইকস আমাদের সম্মোহিত করে, আমাদের সকল আঞ্চলিক, পেশাগত ও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতাকে জয় করে, একটি সুদীর্ঘ বাহবা আদায় ক’রে নিলেন। যে বাহবা গল্পের সুপরিচিত আÍঘাতী বাহবার তুল্য; তরবারির অপূর্ব কৌশলে নিজ পুত্রকে বিভক্ত অথচ অবিচ্ছিন্ন দেখে দেশের প্রবীণ শস্ত্রবীর যেমন তারিফ করেছিলেন নবাগত চ্যাম্পিয়নকে। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
ওরেল-ওয়ালকট-উইকসরা ক্রিকেট মাঠে গেয়েছেন জীবনের গান। তাদের ব্যাটে যেমন ছিল সুরের নৃত্যগীত, তেমনি ক্রিকেটকে ভরিয়ে দিয়েছেন আনন্দের ঝরণাধারায়। ‘এরা খেলায় অনেক কিছু দিয়েছেন। এঁরা খেলাকে বাঁচিয়েছেন মৃত্যুর হাত থেকে। দ্রুত রানের বদলে ধীর রানের পৃথিবীব্যাপী প্রতিযোগিতার হিসাব-খাতা এঁরা পুড়িয়ে দিয়েছেন। কয়েদীর মৃত্যুশীতল চাহনি নিয়ে ক্রিকেটাররা যেখানে চেয়ে থাকেÑ সেখানে এঁরা গেয়েছেন জীবনের গান। এই তিন ক্রিকেট-মাস্কেটিয়ার্স উৎফুল্ল শৌর্যে অনতিক্রান্ত। অপরিসীম অর্থক্ষুধায় ক্রিকেটকে মারছে একদিকে কর্তৃপক্ষ, আনন্দলক্ষ্মী শিউরে উঠছেন কুবের-সঞ্চয় দেখে, অন্যদিকে পরাজয়ভীতি আচ্ছন্ন করেছে অধিনায়ক ও খেলোয়াড়দের। বক্সিংয়ের প্রদর্শনী-যুদ্ধের মতো ড্র করার প্রাণহীন ক্রিকেটযুদ্ধ। হারবো নাÑ আগে বলত বীরপুরুষ। তারা হয় হারত, নয় জিতত। হারবো নাÑ বলছে এখনকার সাবধানী ক্রিকেটাররা। ফলে তারা প্রায়ই হারছে কাপুরুষের মতো, জিতছে আরো কম, বেশি করছে ড্র। নিশ্চিত-নিরাপদ একটি মাঝারিপনা গ্রাস করেছে ক্রিকেটকে। বিলেতি ওল্ডদের রুচিহীন পোশাক আর নি®প্রাণ নাচের আড়ম্বরে ধরা পড়েছে ক্রিকেট’। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ‘দুষ্টু বালক’ খ্যাত সিড বার্নসকে নিয়ে লিখেছেন ‘শেরউড বনের ক্রিকেটার’। ডন ব্রাডম্যানের দলের এই ক্রিকেটারের খ্যাতি ও অখ্যাতি তুমুলভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। বার্নসের ব্যক্তি জীবনের চমকপ্রদ দীর্ঘ কাহিনী তুলে ধরে লেখক লিখেছেন: ‘শেরউড বন গেল কোথায়! বার্নসের ভিতরে একটা অবুঝ দুরন্ত ক্রন্দন ও সন্ধান। সেই হাহাকারের স্বরূপ বার্নস নিজে সম্পূর্ণ বোঝেন নি। রবিন হুডের কয়েক শতাব্দী পরে তিনি জন্মেছেন। রবিনের সাম্রাজ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ভিতরের উৎকণ্ঠা যত তীব্র হয়েছে বাইরের জগতে তত উগ্র ও বেখাপ্পা হয়ে পড়েছেন। জীবনে বেড়া টপকানোর শেষ হলো না।’ (বল
পড়ে ব্যাট নড়ে)।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’। এই গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত। মহান ক্রিকেটার ভিক্টর ট্রাম্পার ‘বিদ্যুতের অক্ষরে ক্রিকেটে মহাকাব্যের অনেকগুলি পৃষ্ঠা লিখে গিয়েছিলেন মাঠে-মাঠে’। স্বপ্নের নায়ক ট্রাম্পারকে জীবনে প্রথম আউট করার পর স্পিনার আর্থার মেইলীর অনুভূতি হয়েছিল এমন : ‘অপসৃয়মান সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে কিন্তু কোনো জয়ের আলো ছিল না। একটি সুন্দর পাখীকে আমি মেরে ফেলেছিÑ হ্যাঁ, ঠিক তাই করেছিÑ আমি অনুভব করেছিলুম’। ট্রাম্পার মারা যাবার পর বলা হয়েছিলÑ ‘ঈগলের পাখা থেমে গেছে, এখন কাক আর চিলের কাল’। তার সম্পর্কে লিখেছেন: ‘পরমোজ্জ্বল সুপ্রখর প্রতিভা, অথচ সদানন্দ সুস্মিত মানুষ। প্রচ-তম আক্রমণের মধ্যেও সৌজন্যøিগ্ধ। সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাট করতে গিয়েছেন। মাঠ ভিজে, ভিজে মাঠের মহাপাতক জ্যাক স্যান্ডার্স বল করছেন। তার প্রথম বল ট্রাম্পারকে হারিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্যান্ডার্স ভাবলেন- পেয়েছি। সকলেই তাই ভাবল। ট্রাম্পার হাসলেন। এগিয়ে গিয়ে বললেনÑ পুরনো দোস্তের সঙ্গে একী ব্যবহার? যা হোক ভায়া, আজ তোমার দিন কি আমার দিন। সে দিনটা কারো নয়- একমাত্র ক্রিকেট-দেবতার। ট্রাম্পার ষাট মিনিটে একটি দেবভোগ্য সেঞ্চুরি করলেন’। (ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট)।
শ্রেষ্ঠতম ক্রীড়ার মহান নীতির প্রতিপালক আম্পায়ার। আম্পায়ার ছাড়া ক্রিকেট খেলার কথা ভাবা না গেলেও তাদের অবদানকে কেউ গুরুত্ব দিতে চান না। ক্রিকেট মাঠে তাদের অবহেলিত উপস্থিতি। আম্পায়ারদের প্রসঙ্গে শঙ্করীপ্রসাদ বসু চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন: ‘হিন্দু বিয়ে বাড়িতে পুরোহিতের ঐ একই অবস্থা। উৎসবের অগ্নিসাক্ষী ও মন্ত্রপাঠ যিনি করাচ্ছেন, তিনি কে, কি রকম দেখতেÑ তা কি ভালো ক’রে চেয়ে দেখা হয়? তিনি না এলে চেঁচামেচি, থাকলে খেয়াল নেই। কাজকর্ম মিটবার পরে ভক্তিমতী স্থূলাঙ্গী বাড়ির গৃহিণী গলায় কাপড় দিয়ে হাঁসফাঁস ক’রে তাকে প্রণাম করেন, তিনি যদি অধিকন্তু হৃদয়াবতী হন, তাহলে মিছরির জলের সঙ্গে পান্তুয়ার অর্ডার দিয়ে সোরগোল তোলেন, তারপরে জানিয়ে দেন বিগলিত শ্রদ্ধায়Ñ ‘ঠাকুরমশাই তো আর কিছু খাবেন না’। এদিকে যে-সব ছেলে-ছোকরা কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পরিবেশনের নামে হট্টগোল করেছে, কনেকে ঘুরিয়েছে সাতপাক, পাউডার-ঘষা ঘাড় উঁচু ক’রে বরের ফ্রেন্ডরূপে বিয়ে দেখতে গিয়ে ভালো ক’রে দেখেছে কনের ফ্রেন্ডদের- তাদের কাছে চিরকালই পুরুতব্যাটা পাজি, মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে টাকা হাতাবার যম। দয়া ক’রে যদি তারা বিবাহ-সম্পাদক আর্য ব্রাহ্মণটিকে কত ধরে দেয়া হয়েছে খোঁজ নিতেন! আম্পায়ারের ‘মাহিনা’ কত খোঁজ নিয়েছেন আপনারা?’ (ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট)।
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘নটআউট’। ১৯৬৪ সালে ইডেন গার্ডেনে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচের শীতের তীব্র হাওয়া হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও পাঁচ দিনের খেলা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। ক্রিকেট থেকে ‘অনিত্যের মধুপান’ করেছেন। তার রোমান্টিক চোখে ক্রিকেটীয় সুধা পান করার পাশাপাশি ক্রিকেট মাঠের রসিকতাটুকুও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। পঞ্চ দিনস্থায়ী বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশটি তার কাছে মনে হয়েছে বিশ্বজীবনের খ-রূপে। তাই ম্যাচ শেষে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর হৃদয়ে বয়ে যায় আরেক অনুভূতির মিশ্র অনুভূতি: ‘.........আমরা সকলে যখন পঞ্চম দিনের শেষে হাজির হলুম- যখন মাঠ ছেড়ে যাবার সময় এল- তখন সহসা অভাবিত নিঃস্বতায় ভরে গেল মন- ক্রিকেট হারালুম বলে নয়, অনেক মানুষের সঙ্গ হারালুম বলে। ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে বহু মানুষের সঙ্গ পাই আমরা- আজ ক্রিকেট আমাদের সামাজিক উৎসব।
একটা অদ্ভুত সত্য অনুভব করলুম- ফুটবল জাতীয় ক্রীড়া হলেও সামাজিক অনুষ্ঠানের চেতনা মনে জাগায় না। ক্রিকেট তেমন মনোভাবকে জাগাতে পারে এই জন্য যে, সে অনেকগুলি মানুষকে অনেকক্ষণ একত্র রাখে। নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়, নতুন সান্নিধ্যের। রেলের কামরায় বহু ঘণ্টার যাত্রা যেমন মানুষকে এনে দেয় অচেনা মানুষের কাছে, এখানেও তেমনিÑ বিদায় নেবার আগে এখানেও আবার ফিরে দেখা হওয়ার কামনা- যে ইচ্ছার জীবন যদিও পথে নামার পরেই পায়ে-পায়ে গুঁড়িয়ে যাবে।’ (নট আউট)। ক্রিকেট মাঠের উপেক্ষিত দ্বাদশ-ব্যক্তিদের মনোবেদনা লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি: ‘তাকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্রিকেটের এই বাধ্য বাহনটি অঙ্গে জিন চড়িয়ে রেডি থাকবেন- কখন ছুটতে হয়। নিজ দলের ব্যাটিং ও ফিল্ডিং কোনো সময়েই তার অব্যাহতি নেই। সারাক্ষণ জামা-জুতো পরে তটস্থ। যখন নিজ দল ফিল্ডিং করছে, তখন তো ‘ঘরের বাহিরে দ-ে শতবার’। কারণ এগারোজন খেলোয়াড় বিনা অসুস্থতায় মাঠে বিরাজ করতে পারে না, কিন্তু যখন নিজ দল ব্যাটিং করছে, তখনো অ্যাটেনশন। নিজ দলের ফিল্ডিং করার সময়ে দ্বাদশ ব্যক্তি মাঠে নামলে তবু কিছু মর্যাদা পায়। কারণ সাধারণভাবে সে ফিল্ডিং-এ পারদর্শী এবং বোলার ও উইকেটকিপার ছাড়া সকলেই এক জাতীয় ফিল্ডার। (নট আউট)।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘লাল বল লারউড’ গ্রন্থে বডিলাইন সিরিজের অন্যতম নায়ক ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউডকে কেন্দ্র করে বডিলাইন সিরিজের গোটা ইতিহাসের রোমাঞ্চকরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ট্রাজিক চরিত্র হ্যারল্ড লারউড। তার জীবনে ছিল নাটকীয়তা ও রোমাঞ্চের সমন¦য়। নটিংহ্যাম্পশায়ারের কয়লাখনির এই শ্রমিক খনির অন্ধকারের মধ্যে কাজ করার সময় ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখতেন। অদম্য মনোবল ও তীব্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তিনি ওঠে আসেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাদপ্রদীপে। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে ইংল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়া সফরটি কুখ্যাতি পায় ‘বডিলাইন’ সিরিজ হিসেবে। অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার এবং অপ্রতিদ্বন্দ¡ী ডন ব্রাডম্যানকে টার্গেট করার ক্ষেত্রে উদ্ধত, কঠিন শীতল সাহস ও উত্তেজক মেজাজের ধুরন্ধর অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের হাতের পুতুল হয়ে ওঠেন লারউড। বিরল জাতের এই ফাস্ট বোলার অস্ট্র্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের মাথা ও শরীর লক্ষ্য করে গোলার মত যে মরণঘাতি বাউন্সার ও বাম্পার ছুঁড়ে মারেন, যা লেগ-থিয়োরি হিসেবে খ্যাত, তা তীব্র বিতর্কের জন্ম নেয়। এমনকি এ নিয়ে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেকার সম্পর্ক ক্ষুণœ হওয়ার উপক্রম হয়। যাবতীয় বিতর্ক ও সমালোচনাকে মাথা পেতে নিয়ে সমস্ত শক্তি নিংড়ে বল করে সিরিজ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হ্যারল্ড লারউড। অথচ অকারণ অপবাদের কারণে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে ইংল্যান্ড দলের হয়ে তার আর ক্রিকেট খেলা হয়নি। বডিলাইনের শিকারী এবং শিকার যিনি একদেহেÑ সেই লারউডের নামে ইতিহাসনাট্যের যবনিকামোচন করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। লারউডের উঠে আসার কাহিনী বিস্ময়কর : ‘আগের গোটা রাত্রি সে কাজ করেছে কোলিয়ারীতে। তবু খেলতে নামল ম্যাচে। এত গরীব যে, ক্রিকেট-বুট জোটাতে পারেনি। সাধারণ জুতো পরেই খেলছে। কয়েক ওভার বল করার পর নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। সঙ্গী খেলোয়াড়রা বলল, যাও যাও, বিশ্রাম করো, আর খেলে কাজ নেই। ছেলেটি শুনল না। বল ক’রে চলল- কারণ, সে খনির অন্ধকারের মধ্যে কাজ করার সময়ে ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখে। অন্ধকারেই সে কল্পনার বল ছোঁড়েÑ বল গিয়ে ছিটকে দেয় স্টাম্প- তার শব্দ ছড়িয়ে পড়ে- ঘুরপাক খায় টানেলের গায়ে-গায়েÑ কল্পনার কানে সে শোনে। সেখানে এই সত্যকার খেলায়- জীবনের প্রথম এই বড় খেলায়- ঘেমে যাবে সামান্য নাকের রক্তের জন্য? কখনো না, কখনো না। রক্ত মুছে ছেলেটি ছুটতে শুরু করে আরও জোরে। আরও জোরে বল- আরও জোরে। রক্ত পড়া বেড়ে যায়। গলগলিয়ে ঝরে পড়ে- জামা রক্তে রাঙা। সবাই বলে- চলে যাও, চলে যাও। না- না- না। হঠাৎ ছিটকে পড়ে মিডলস্টাম্প- আঃ! রক্ত-মোছা হাতে আবার বল ছোঁড়ে- রক্তপাতে আর অসহ্য আনন্দে দুর্বল হয়ে পড়ে সে। তবু- তৃতীয় বল- ভেঙে গেল অফস্টাম্প। রক্তের মূল্যে ছেলেটি জীবনের প্রথম হ্যাটট্রিক পেল! সে ক্রিকেট খেলবে না? ক্রিকেট যে তার কাছে বাঁচার একমাত্র কারণ!’ (লাল বল লারউড)।
দ্রুতগামী বোলারের মনের কথাকে লেখক ভাষা দিয়েছেন এভাবে: ‘বোলিং হয়েছে তীব্র থেকে তীব্রতর। নিজের শরীর লাল ক’রে ফাস্ট-বোলারকে বল করতে হয়। তাদের বিষয়ে বলা হয়, পায়ের বুট-জুতোর মধ্যে তাদের মাথা লুকিয়ে থাকে। ঘর্ষণে-ঘর্ষণে পায়ের চামড়া উঠে যায়, শরীর জ্বলতে থাকে যন্ত্রণায়, লুটিয়ে পড়ে কান্তিতে, কিন্তু যখন ছিটকে যায় উইকেট- আঃ অপরূপ সে সঙ্গীত! যখন ব্যাটসম্যানের শরীরকে হিম ক’রে দিয়ে গা ছুঁয়ে বেরিয়ে যায় উষ্ণ বলÑ তখন কিবা উপভোগ্য সেই আতঙ্ক! -আমার বলে খেলার সময়ে ভুল করা চলবে না, কদাপি না, আমি ফাস্ট-বোলার! যদি ভুল নড়েছÑ উড়িয়ে নিয়ে গেঁথে দেব স্ক্রীনে। আমি ফাস্ট-বোলার- হ্যাঁ, আমার আক্রমণ শারীরিক আক্রমণ। আমার রক্তে পুড়ে ঐ আগুনের গোলার মতো বল ছুটেছে? ফাস্ট-বোলিংকে ভয় করে না কে?’ (লাল বল লারউড)।
শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সপ্তম গ্রন্থ ‘সারাদিনের খেলা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন তিন কৃতী ‘ভারতীয়’ ক্রিকেটার কে এস রণজিৎ সিংজী, কে এস দলীপ সিংজী ও পতৌদির নবাব ইফতিখার আলী খান। এদেরকে নিয়ে ইংরেজ ক্রিকেট লিখিয়েদের মন্তব্যগুলো খুঁজে পেয়েছে তার ক্রিকেট-পিপাসু মন। পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজদের মত করে ক্রিকেট খেলতেন রণজিৎ সিংজী। তার বিদায় ইংরেজদের ক’রে তোলে আবেগমথিত: ‘শেষ বল গড়িয়ে গেছে মাঠের উপর দিয়ে। এবারের মতো খেলা শেষ। .... লর্ডসের গ্র্যান্ড-স্ট্যান্ড নির্জন, শূন্য। ক্রিকেটকে বিদায় দিয়েছি আমরা, আর বিদায় দিয়েছি ক্রিকেটের রাজাকে। ক্রিকেট আবার আসবে যখন ফিরবে বসন্ত, নতুন তৃণ, তরু। কিন্তু রাজা ফিরবেন না। কারণ জামসাহেব এখন চল্লিশে পৌঁছে গেছেন। দেহ হয়ে পড়েছে স্থূল। সেই সঙ্গে তার রাজ্য নবনগর। সেখানকার মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, উজ্জ্বল রৌদ্র, মসলাগন্ধ, তালীবন তাকে ডাকছে রাজকর্তব্য পালনের জন্য। প্যাভিলিয়নের সিঁড়ি দিয়ে মুখভরা হাসি নিয়ে লঘুপদে নেমে আসতে আর তাকে দেখা যাবে না। সুখরৌদ্রের মধ্যে আসীন থেকে তার অতুলনীয় রূপকলা দেখতে দেখতে সারাদিন কেটে যেত। তারপর যখন সন্ধ্যার ছায়া আড়াআড়ি রেখা টেনে দিত তৃণাস্তীর্ণ মাঠের উপরে, তখন আমরা ফিরে যেতাম মাঠ থেকে তৃপ্তিভরা মন নিয়ে- না, তা আর ঘটবে না। বহু সমাদৃত ধন্য অভিনেতা শেষ রজনীর শেষে বিদায় নিয়েছেন। এখন তিনি শুধু স্মৃতি-সুখস্মৃতির রাজ্যে। নমস্কার করি, নমস্কার! জাম সাহেব। ক্ষুদ্র রাজ্যে রাজকুমার-বৃহৎ খেলার সম্রাট’। (সারাদিনের খেলা)।
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ¡ী সম্রাট শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলাদেশে খুব বেশি পরিচিত বলে মনে হয় না। যে কারণে তার কোনো গ্রন্থ খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব। তবে ক্রিকেট-পিপাসু কিছু অনুরাগী আছেন, যারা তার লেখার সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচিত। এদের একজন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ নূরুল আনোয়ার। রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ক্রিকেটের পাগলপ্রেমিক এই ভদ্রলোক শুধু তার অনুরাগীই নন, তাকে ‘সর্বদাই অত্যুক্তিতে উদ্ব্যস্ত’ করে চলেছেন। যে জন্য প্রতিটি গ্রন্থে ডঃ নূরুল আনোয়ারকে প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন লেখক। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে অধ্যাপক নূরুল আনোয়ারের মূল্যায়নটা এমন: ‘ইডেনে শীতের দুুপুর’ (১৯৬০), ‘রমণীয় ক্রিকেট’ (১৯৬১), ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ (১৯৬২), ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’ (১৯৬৩), ‘নট আউট’ (১৯৬৫), ‘লাল বল লারউড’ (১৯৬৭) এবং ‘সারাদিনের খেলা’ (১৯৭৬)Ñ এই সাতটি ক্রিকেট-কাসিকের যে কোনোটিই পড়তে থাকলে ঐন্দ্রজালিক কথোপকথন, দুর্লভ বাক্শক্তি, চাতুর্যপূর্ণ লেখার শক্তি ও মনোরমময় বর্ণনা পাঠককে নিমেষে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলবে (যেমন হয়ে থাকে উচ্চতর প্রতিভাবান গায়ক-গায়িকার উচ্চতর রীতির গান শুনে), স্বচক্ষে দেখা বা শোনা ক্রিকেট খেলা, খেলোয়াড়দের চরিত্র, ক্রিকেট-ঘটনা পাঠকের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং বিমূর্ত ভাব সৃষ্টি করবে। পাঠকের সৌভাগ্য, বৈষ্ণব সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছ থেকেÑ জীবন থেকে টেনে এনে, অন্তরঙ্গ অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টি ক্রিকেটের বহু চরিত্র ও ঘটনাকে তারা অনুপম সাহিত্য মাধ্যমে পড়তে পেরেছেন। সংস্কৃতিমান বাঙালি ক্রিকেট-অনুরাগী সন্ধান পেয়েছেন অবিশ্বাস্য আনন্দলাভের এক দুর্লভ উৎস। ক্রিকেট-অনুরাগীদের মধ্যে যারা সমাজসচেতন ও মননসমৃদ্ধ, যারা সকল ঘটনা বিশ্লেষণধর্মী মন নিয়ে দেখে থাকেন এবং সঙ্গীত, সাহিত্য ও ক্রীড়া দিয়ে অবিমিশ্ররূপে যাদের মন তৈরি, তাদের কাছে শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট গ্রন্থগুলো মূল্যবান দলিল ও অমূল্য শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হবে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির গভীরতর বিষয়কে ধারণ করতে পেরেছেন বলেই শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট-লেখা শীলিত ও আলোকিত ও বর্ণাঢ্যময় এবং বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে উত্তীর্ণ’।
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের রূপকার শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটবিষয়ক সাতটি অসাধারণ গ্রন্থ লিখে চুকিয়ে দিয়েছেন তার লেনদেন। এ কারণে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: ‘ক্রিকেট লেখার সময় সারাক্ষণ মাথায় ক্রিকেট ঘুরত। অনেকগুলো ক্রিকেট বই লেখার পর মনে হল, আমার যতদূর সাধ্য লিখে ফেলেছি। আরও ভালো কিছু লেখার ক্ষমতা নেই। এখন ইতি টানাই উচিত। তাছাড়া আমার মূল কর্মবৃত্তির সঙ্গে এই ক্রিকেট-লেখক ভূমিকার একটা সংঘাত ছিলই’।
শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেট লেখা থেকে দূরে সরে গেলেও পাঠকরা কিন্তু তাকে কখনো ভুলতে পারেনি। ক্রীড়া সাহিত্যের যে রস তিনি উপহার দিয়েছেন, তা পাঠকদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। আর কোনো লেখক এখন অব্দি তার শূন্যস্থান পূরণ করতে না পারায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু পাঠকের মনের মণিকোঠায় চির-অম্লান হয়ে আছেন। তার লেখা এখনকার পাঠকদের দারুণভাবে আপ্লুত করে। আর এ কারণে তার সাতটি গ্রন্থের সমন¦য়ে ১৯৭৬ সালে দুই খ-ে ‘ক্রিকেট অমনিবাস’ এবং ১৯৯৯ সালে বাছাইকৃত লেখা নিয়ে ‘বাছাই ক্রিকেট’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
ষাট দশকের মাঝামাঝি গগনচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাবস্থায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখির সঙ্গে তার রাখীবন্ধন ছিন্ন করেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে কোলকাতায় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসলে একটুখানি নড়ে বসেন তিনি। প্রায় তিন দশকে বদলে গেছে ক্রিকেট। ওয়ানডে ম্যাচ ক্রিকেটে রীতিমত বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ধ্রুপদী ক্রিকেটের পরিবর্তে এখন একদিনের রোমাঞ্চকর ক্রিকেট। শুধু ক্রিকেট নয়, দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও অনেক বদল ঘটেছে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুও মনে করেন: ‘যুগ বদলেছে। ক্রিকেটের পঞ্চদিবসী অবসর বিনোদনে মানুষের মন নেই। বাঙালি জাতি এখন ঘোর-ওয়ার্ক-কালচারী-অফিস-আদালতে সে দমবন্ধ ক’রে খেটে যাচ্ছে। সে জন্য টানা পাঁচদিন অফিসে কলম-ধর্মঘট না ক’রে একদিনের ধুদ্ধুমার ক্রিকেটের নাচনে মেতেছে।’ পরিবর্তনের এই হাওয়াকে শঙ্করীপ্রসাদ বসু অস্বীকার করেননি। বড় ধরনের ধাক্কা খেলেও মেনে নিয়েছেন যুগ-রুচিকে। যুগের চাহিদাকে।
‘সুপারহিট ক্রিকেটিলা’ শিরোনামে ‘দেশ’ পত্রিকায় তিনি লেখেন: ‘এখন হিসেবি উত্তেজনা। এখন ঘড়ির খেলা আর কড়ির খেলা। ওভার মেপে, ঘড়ি ধরে বলতে হবে, ওহে ব্যাটধারী, এইবার তুমি ঠ্যাঙাড়ে হও, খেপে যাও, এসে গেছে ধাতানি-পর্ব (স্লগ-ওভারস্)। এখন-মার কাটারি, ধুন্ধুমার। নবমীর পাঁঠাবলি। ড্যাংডাং, ড্যাড্যাং পাঁঠা পড়ছে আর রক্তপাগল ভক্তরা হিংস্র উল্লাসে মাঠ .......একদিনের ক্রিকেটকে ঠেকানো যাবে কী ক’রে এই মুক্ত অর্থনীতির দিনে। যখন ফাস্ট ফুডে বাজার ছেয়ে গেছে! সুতরাং পুরনো রীতিÑ দূর হঠো দূর হঠো। রক্তে আমার ঝড়ের মাতামাতি, যায় যদি যাক নিভে আমার প্রাচীন শ´েখর বাতি’। এরপর তিনি সোনায় মোড়া তার ক্রিকেট সাহিত্যের কলমখানি সম্ভবতঃ চিরদিনের মত রেখে দিয়েছেন দেরাজে। শিক্ষক অলোক দাসের ভাষায়: ‘বৈষ্ণব শাস্ত্রের গভীর পা-িত্য ও অভিজ্ঞান ক্রমে ক্রমে বিবেকানন্দ লোকমাতার গৈরিক বর্ণে আচ্ছন্ন হ’ল। হারিয়ে গেল ইডেনের সবুজ মাঠ’। কিন্তু শঙ্করীপ্রসাদ বসুর যারা অনুরাগী পাঠক, তারা তার অনুপস্থিতি অনুভব করেন পলে পলে। তাদের একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রসেনজিৎ বন্দোপাধ্যায় : ‘সকালের খবরের কাগজের জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকতাম। কাগজ পেয়ে প্রথমেই খেলার পাতাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা! চুলোয় যাক পরিষ্কার চোখ রাঙানি, বাবার ধমকানি। এই খেলার পাতাতেই প্রথম তার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং প্রথম দর্শনেই (পঠনেই) গভীর প্রেম। কে এই শঙ্করীপ্রসাদ বসু? ইনি তো কোন কাগজের সাংবাদিক নন! লেখার শৈলীটিও তো সাধারণ ক্রীড়া সাংবাদিকের মতো নয়! এ এক নতুন ধারা, নতুন রীতি। ক্রিকেট যে সাহিত্য হতে পারে, সাহিত্যের মন্দিরে এদেশে এতদিনের ব্রাত্য ক্রিকেটের যে অনায়াস গমনাগমন থাকতে পারে, আমার কিশোর চোখ আগে তা দেখেনি। খ্যাতনামা ইংরেজ ক্রিকেট-সাহিত্যিকদের কোনো লেখা তার আগে পড়িনি। ‘শঙ্করীপ্রসাদের’ হাত ধরেই প্রথম ক্রিকেট সাহিত্যের আঙিনায় উঁকি দিলাম এবং স্তব্ধ হয়ে গেলাম এর বিশাল সমারোহ এবং আভিজাত্য দেখে। তারপর থেকে তার হাত আর ছাড়িনি।’ . .........ষাটের দশকে যে অসাধারণ চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট-সাহিত্যের রস আস্বাদন করেছি, আজ এই সহস্রাব্দের মুখে দাঁড়িয়ে তার অভাবে নিদারুণ তৃষ্ণার্ত আমরা। এই ফরমাইসী, চটুল, অন্তঃসারশূন্য, ক্রীড়া-সাংবাদিকতার যুগে শঙ্করীদা’র মতো উচ্চ শ্রেণীর লেখনীর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। বিশ্বাস করি, তার লেখা পড়লে নতুন প্রজন্মের মানুষরা সৎ ক্রীড়া-সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত না হয়ে পারত না। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? এই বয়সে কি আর তিনি নতুন কলমে নতুন কালি ভরে নতুন চশমা পরে খেলার কথা লিখবেন? জানি না। বোধ হয় লিখবেন না, খেলার প্রেরণা অনুভব করবেন না। তার মন এখন অন্য গগনচুম্বী, যেখানে ঠাকুর-স্বামীজি-নেতাজির জীবন তাকে আরও গভীরভাবে আকর্ষণ করে। হয়তবা এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতির গভীরতর আকর্ষণে তিনি বস্তুজীবনের কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আর তেমন টান অনুভব করেন না। হয়তবা কাঞ্চন-কৌলীন্যের দাস, হৃদয়হীন, কম দক্ষ খেলোয়াড়ের ক্রীড়াদক্ষতা আর তাকে সেভাবে চঞ্চল করে না। হয়তবা তরলমতি পাঠকদের পড়াশুনার গভীরতা বা ব্যাপ্তির বিষয়েই তিনি সন্দেহমুক্ত নন। সে যাই হোক, আপন পথে চলেই তিনি বিজয় পতাকা ওড়ান। তাতে আমাদের মত গুণমুগ্ধদের আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু যদি কখনও, কোনোদিন কলমে আবার খেলাকে তুলে নেন, যদি আবার গদ্যের মধ্যে পদ্য করে ক্রিকেট-সুন্দরীর গায়ে
রঙ-বেরঙের নকশা কাটেন, যদি ময়দানের খেলুড়েরা রাজপুত্র, কোটালপুত্র হয়ে তার ক্রিকেট-রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়ে, যদি অলস শীতের দুপুরে গ্যালারিতে বসে থাকা মানুষেরা তার ক্রিকেট-অ্যাম্ফিথিয়েটারে ঢুকে পড়েÑ তবে? তবে আমি আবার ইডেনে আসব, তার হাত ধরে’।
এখন অনেক পাল্টে গেছে ক্রিকেট। এসেছে ওয়ানডে ক্রিকেটের জোয়ার। ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলার বোলের মত ক্রিকেটেও দ্রুততার ঝড় বইছে। ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে যেমন উত্তাল সমুদ্রের প্রলয়ঙ্করী ঢেউ, তেমনি বোলারদের বলে মহাকাশ যানের তীব্র গতি। ক্রিকেটে এখন রঙের বাহার। নানা রঙে ধাঁধিয়ে যায় চোখ। ২৪ ঘণ্টাই এখন ক্রিকেটের। দিনেও ক্রিকেট, রাতেও ক্রিকেট। ফাড লাইটের আলোয় ক্রিকেটের রূপ খোলতাই হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ড্রইংরুমে নিয়ে এসেছে ক্রিকেটকে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায় ক্রিকেটের মাধুর্য। টিভি আম্পায়াররা যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে সিদ্ধান্ত দেন, তেমনি দর্শকরা একই বল নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে পারেন। সঙ্গে নানা গ্র্যাফিক্স ও তথ্যের সমাহার। ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেটার ও ক্রিকেট প-িতদের পু´খানুপু´খ বিশ্লেষণ। সবই টাটকা। এখন সবচেয়ে সহজলভ্য পণ্য ক্রিকেট! পণ্য তো বটেই; কেননা ক্রিকেটকে ঘিরে বিশাল ব্যবসা গড়ে ওঠেছে। আর এই ব্যবসায়ীরা তাদের মর্জিমাফিক পরিচালনা করছেন ক্রিকেটকে। যে কারণে ক্রিকেটের সেই বনেদীয়ানাটা হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্রিকেটকে ঘিরে কত গল্প আর কাহিনীর ঘনঘটা। ইলেট্রনিক্স মিডিয়া আলাদীনের চেরাগের মত ক্রিকেটের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় দর্শকের দরবারে হাজির করলেও তাতে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। কল্পনাশক্তি আর রসের ভিয়েন মিশিয়ে কলমের ক্রিকেটের ঐন্দ্রজালিকতা পাঠককে যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়। অথচ ক্রিকেটের নতুন দিনের সুর, ছন্দ ও রোমাঞ্চকে শব্দে শব্দে খোদাই করার জন্য নেভিল কার্ডাস, জ্যাক ফিঙ্গলটন কিংবা পেলহ্যাম ওয়ার্নারের মত সহজাত সৃজনী ক্ষমতার অধিকারী ক্রিকেট লিখিয়েদের অভাব এখন দারুণভাবে অনুভূত হয়ে আসছে। এরা ক্রিকেট সাহিত্যকে মহাসমৃদ্ধশালী ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পংক্তিতে স্থান করে দেয়ার পাশাপাশি চিরঞ্জীব করে রেখেছেন সেই সময়ের ক্রিকেটার ও ক্রিকেটকে। বাংলা ভাষায় ক্রিকেটকে ভালবেসে এই কাজটি করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তিনি স্বপ্ন, কল্পনা ও ভালবাসা দিয়ে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে যে পথ দেখিয়ে গেছেন, তা এ কালের ক্রিকেট রসিকদের কাছে মনোবেদনার কারণ হয়ে আছে। কেননা শঙ্করীপ্রসাদ বসু সরে দাঁড়ানোর পর বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য যেন হঠাৎ থমকে গেছে। কলমের ক্রিকেটের সেই মাধুর্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালির ব্যাটে-বলে যখন নতুন দিনের সূর্য, তখন বাঙালির ক্রিকেট সাহিত্যে যেন অস্তগামী সূর্যের আভা। বাঙালিদের একটি দল যখন টেস্ট ক্রিকেট খেলছে এবং সৌরভ গাঙ্গুলি শুধু ভারতকে নেতৃত্বই দিচ্ছেন না, বিশ্ব ক্রিকেটে গড়ছেন নতুন নতুন মাইলফলক, তখন বাঙালি ক্রিকেট লিখিয়েদের কলমে কেন বেলা শেষের গান? এমন একটা সন্ধিক্ষণে বারবার মনে পড়ে যায় শঙ্করীপ্রসাদের কথা। তার মিষ্টি-মধুর কলমের কথা।
তথ্য সূত্র :
১) বাছাই ক্রিকেট Ñশঙ্করীপ্রসাদ বসু
২) শঙ্করীপ্রসাদ : ব্যক্তি ও সৃষ্টি Ñশ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থ
ক্রীড়াজগত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৫
বিষয় : ফুটবল
বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের হল্কা
সারা দুনিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তাপে টগবগিয়ে ফুটছে। স্বাভাবিক নিয়মেই এর হল্কা এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। সুদূর ইটালি থেকে বাংলাদেশÑ পথ কিংবা ভৌগোলিক দূরত্ব নিঃসন্দেহে কম নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞাপন ও প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগীর পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকরাও ঘরে বসেই বিশ্বকাপ ফুটবলের সুধারসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রত্যক্ষ করছেন স্বপ্নিল ও সৌকর্যময় ফুটবল। ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবাইকেই বিশ্বকাপ ফুটবল
মাতিয়ে রেখেছে। রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ফুটবলের সৌন্দর্য ও উত্তেজনায়
মেতে আছেন সবাই।
এমনিতেই এ দেশের মানুষ ফুটবলের নামে পাগল। নিজেদের গতিহীন ও অনুজ্জ্বল জীবনে ফুটবলের মাঝে হয়তো তারা গতি ও আনন্দের দীপ্তি খোঁজেন। তাই বিশ্বকাপ ফুটবলের সবটুকু রূপ-রস-গন্ধ ও নির্যাস তারা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়। যে কারণে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দেশের সব শহর-বন্দর-জনপদ এখন বিশ্বকাপ ফুটবলের জ্বরে আক্রান্ত।
বিশ্বকাপ ফুটবলের কারণে সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট, বিপণি-বিতান জনবিরল হয়ে পড়ে। যানবাহন চলাচলও হালকা হয়ে আসে। সে সঙ্গে গভীর রাতে কী এক মোহে জেগে ওঠে সারা দেশ। রাত জেগে খেলা দেখার রেশ চলে পরের দিন পর্যন্ত। কেননা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি হেঁশেল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও গুলতানি চলতে থাকে। যারা ফুটবলের বকলম, তারাও জাহির করেন নিজেদের পা-িত্য। এমনকি আসলাম, ওয়াসিম, কায়সার হামিদ, সাব্বির কেÑ এ কথা অনেকেই বলতে না পারলেও ম্যারাডোনা, গুলিত, ভিয়ালি, কারেকা, ম্যাথিউস, লোথারের জীবনবৃত্তান্ত এখন তাদের কণ্ঠস্থ। বিশ্ব ফুটবলের শক্তিশালী দেশ পশ্চিম জার্মানির ফুটবল কেন ভালো লাগে না, দীর্ঘ দু’দশক শিরোপা না পেয়ে তবুও ব্রাজিল কেন প্রিয় কিংবা সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন কেÑ যে কারো কাছে এর উত্তর পাওয়া যাবে।
খেলাধুলার খবর প্রকাশের ব্যাপারে বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো এমনিতেই হাড়-কিপটে। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে সাধারণত খেলার খবর প্রথম পাতায় ঠাঁই পায় না। অথচ বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে পরিস্থিতি পুরোপুরিভাবে উল্টো। নানান রঙের বাহার দিয়ে ঢাউস সাইজের পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি প্রতিদিনের ‘লিড নিউজ’ হয়ে আসছে বিশ্বকাপ ফুটবল!
সে সঙ্গে প্রথম পাতার প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে থাকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ছবি ও খুঁটিনাটি সংবাদ। বিশ্বকাপ ফুটবলের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ পাঠকদের আগ্রহ ও চাহিদা।
সারাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা। মূলত ঢাকা স্টেডিয়াম এবং এর আশপাশ এলাকাজুড়েই রাজধানীর ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকা- পরিচালিত হয়। ফলে সারা বছরজুড়েই ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকা কোনো না কোনো খেলা নিয়ে মেতে থাকে। একদম কিছু না থাকলেও খেলোয়াড়, কর্মকর্তা কিংবা খেলাপাগল কিছু লোক স্টেডিয়াম এলাকায় নিয়মিত আড্ডা মারেন। তা না হলে তাদের পেটের ভাত নাকি হজম হয় না! কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার পর ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকার নিজস্ব বনেদীয়ানা, চঞ্চলতা ও আড্ডাটুকুও কে যেন কেড়ে নিয়েছে। সন্ধ্যার পর ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকা এখন খাঁ খাঁ করে। এমনকি প্রথম বিভাগ হকি লীগ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও দর্শকদের তা টানতে পারছে না। অবস্থা সুবিধের হবে না মনে করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন মা ও মণি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট পিছাতে পিছাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের পরে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ফেডারেশনও তাদের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। দুনিয়া তোলপাড় করা বিশ্বকাপ ফুটবলের ঢেউ বাংলাদেশে যেভাবে আছড়ে পড়েছে, তার কোনো তুলনা হয় না। অনেকটা আফিমের নেশার মতো বুঁদ করে রেখেছে।
আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদীদেরও সরগরম করে রাখবে। কখনো হাসাবে। কখনো কাঁদাবে।
সাপ্তাহিক মূলধারা : ১৭ জুন ১৯৯০
তবুও ভালবাসি ফুটবল
এই পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কোনটি? কোনো রকম দ্বিধা না রেখে বলা যায়Ñ ফুটবল। ফুটবল খেলা এই ভূপৃষ্ঠের কোথায় হয় না? মানুষের পদচিহ্ন যেখানে পড়েছে, এক চাঁদ ছাড়া আর সর্বত্রই ফুটবলের জয়-জয়কার। বিশ্বের সর্বোচ্চ সংগঠন জাতিসংঘের চেয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলের নির্বাহী সংস্থা ফিফার সদস্য সংখ্যা বেশি। এই তথ্য অবাক করলেও এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ফুটবল তার গ্ল্যামার ও সর্বজনীন আবেদন দিয়ে দেশে দেশে মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ফুটবল। ফুটবলের বাঁধ ভাঙা জোয়ারের কাছে ভেসে গেছে কে পুঁজিবাদী আর কে সমাজতন্ত্রী? ফুটবল এমন একটি খেলা, যার মায়ার বাঁধনে একবার কেউ জড়ালে তার থেকে মুক্তি নেই।
১৫ আউন্স ওজন আর ২৭ ইঞ্চি পরিধির বায়ুভর্তি এক চামড়ার গোলকের কী এমন আকর্ষণ, যার মায়াবী হাতছানিতে ছুটতে বাধ্য হন মানুষ! ফুটবল কি হ্যামিলনের সেই বংশীবাদক, যার মোহন বাঁশির সুরে সুরে আমাদের হৃদয় আপ্লুত হয়! আসলে মানুষ নগদ সওদার খরিদ্দার। স্বল্প সময়ে ফুটবলে যে তরতাজা উত্তেজনায় অবগাহন করা যায়, তার সঙ্গে তুলনা হয় না অন্য কিছুর। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ফুটবল খেলার কোনো বিকল্প নেই। কেননা, এ দেশে শিক্ষার হার যেমন বেশি নয়, তেমনিভাবে বিত্তবান লোকের সংখ্যাও হাতে গোনা। যে কারণে স্বল্প ব্যয়ের জটিলতাবিহীন ফুটবলকেই তারা আপন করে নিয়েছে। এ কারণে শাসক ও শোষক হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশের পায়ে পায়ে এ দেশে ফুটবল এলেও তা খুব সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ দেশের সহজ-সরল মানুষের জীবনে বিনোদনের অন্যতম বাহন হয়ে ওঠে ফুটবল।
এ দেশের ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। ফুটবল বাঙালির জীবনে শিকড় গেড়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি ফুটবলারদের কৃতিত্ব ও অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। ফুটবলে চমৎকার ও উজ্জ্বল উত্তরাধিকার থাকা সত্ত্বেও ফুটবলে আমাদের বড় কোনো সাফল্য নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ আজও সাফ ও সার্ক ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারেনি। তা না পারলেও দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশ যে একটি শক্তিশালী দেশ, সেটা প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বারবার বাংলাদেশ শিরোপার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণে এ দেশের ফুটবল অনুরাগীরা কিছুটা হলেও হতাশ হয়ে পড়েন।
এ জন্য প্রশ্ন উঠেছেÑ ফুটবল কি বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে? এ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। আর এই বিতর্ককে উসকে দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটের রমরমা অবস্থা। আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ সপ্তম বিশ্বকাপ খেলার গৌরব অর্জন করায় সারাদেশে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বয়ে যায়। এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। দেশের যে কোনো সাফল্যই আমাদের জন্য গর্ব ও আনন্দের। কেননা, আমাদের এই দেশটিতে আনন্দিত হওয়ার মতো উপলক্ষ খুব কমই ঘটে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনাটা ঠিক নয়। ক্রিকেটের এই সাফল্যের কারণেই হঠাৎ দেশে ক্রিকেটের জোয়ার যেমন বেড়েছে, তেমনি এর প্রতি মানুষের আগ্রহ-সমর্থন ও ভালবাসা বেড়েছে। এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এদেশের মানুষ আবেগতাড়িত। যখন কোনো কিছু তাদের মন জয় করে নেয়, তখন তার জন্য হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দিতে তারা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। ক্রিকেট এখন সেই সুসময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমরাও মনে-প্রাণে কামনা করি, ক্রিকেটের সাফল্যে উদ্ভাসিত হোক আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি। বাংলাদেশের নিয়াজ মোরশেদ এই উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হলে সারাদেশে দাবার চর্চা ও জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের দু’কৃতী শুটার আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি স্বর্ণপদক পেলে শুটিং নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে থাকি। আসল কথা হলো যেসব খেলায় আমরা সাফল্য পাবো, তার প্রতি সবারই সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে। কেননা, দেশের সুনাম ও সুখ্যাতির স্বার্থে সেসব খেলাকে সর্বাÍক পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত।
কিন্তু প্রতিটি দেশেই এমন কিছু খেলা আছে, যে খেলায় সাফল্য না এলেও সেটা সে দেশের মানুষের প্রাণের খেলা। সে হিসেবে আমাদের দেশের মানুষের প্রাণের খেলা ফুটবল। নানা কারণে সাময়িক একটা ভাটার টান এলেও ফুটবল এ দেশের মানুষের কাছে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ভালবাসার অপর নাম। ফুটবল এমন একটি খেলা, যা এ দেশের ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের কাছে সমান প্রিয়। অনেকেই ফুটবলকে ভালবাসেন জীবনের মতো। তাদের কাছে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনার নাম ফুটবল। ফুটবলের স্বপ্ন দোলায় উদ্বেলিত হয় সারা দেশের মানুষ। আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ফুটবল। তাছাড়া আমাদের মতো দরিদ্র দেশে বিনোদনের সর্বজনীন কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে বিনোদন হিসেবে ফুটবলের কোনো বিকল্প নেই। এ অবস্থায় আমরা কি ফুটবলকে এড়িয়ে যেতে পারি?
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফুটবলকে নিয়ে আমাদের বড় কোনো প্রত্যাশা নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করাটাই আমাদের স্বপ্ন। কিছুদিন আগে আন্ডারডগ হয়েও ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ যেভাবে রানার্সআপ হয়েছে, তাতে আমরা দারুণ আশাবাদী হয়েছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ একদিন দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করবে। সেদিন নিশ্চয়ই বেশি দূরে নয়। তবে ফুটবলে আমরা যদি বড় কোনো সাফল্য নাও পাই, তাতে কিছু আসে-যায় না। ফুটবল আমাদের স্বপ্ন ও ভালবাসা। আমরা ফুটবলের নিখাদ আনন্দে মেতে উঠতে চাই। যতই প্রতিকূলতা আসুক না কেন, ফুটবলের প্রতি আমাদের যে অকৃত্রিম ভালবাসাÑ তা অটুট থাকবে। আমরা ফুটবলকে ভালবেসেই যাবো। জয়তু ফুটবল।
১৫তম ফেডারেশন কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের স্যুভেনির : মে ১৯৯৯
শান্তির ফুটবল
শান্তি-সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ফুটবল খেলার রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। আর এ কারণেই এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য
মনোনয়ন পেয়েছে ফুটবল।
গত ২২ জানুয়ারি সুইডিশ পার্লামেন্টের সদস্য লার্স গুস্তাফসন ফুটবল খেলাকে নোবেল মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তাব করেন। নরওয়েজীয়ান নোবেল কমিটিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে ফুটবল অব্যাহতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং হাজারো জাতিগত ও আঞ্চলিক সংঘাতের মধ্যেও এ খেলাটি টিকে আছে। তার মতে, বৈরী দেশগুলোর মধ্যে অন্য কোনো পর্যায়ে যোগাযোগের চিন্তা অকল্পনীয় হলেও ফুটবল মাঠে ঠিকই তারা নামছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়া এবং ১৯৯১ সালে যুব বিশ্বকাপে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যাচের কথা উল্লেখ করেন।
ফুটবলকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য লার্স গুস্তাফসন যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এ যাবৎ মানুষ ফুটবলকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখে এসেছে। এখন অব্দি আবিষ্কৃত ফুটবলের বংশ-লতিকা অনুযায়ী, ২০৬ খৃস্টাব্দে হ্যান ডাইন্যাস্টির আমলে চীনে আদি ফুটবলের উদ্ভব। অবশ্য ফুটবলের জন্ম নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কারো মতে, ফুটবলের জনক চীন, আবার কারো কারো মতে, বৃটিশরা। তবে অতি সম্প্রতি ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার চীনের পক্ষে তার রায় দিয়েছেন। গত ১৮ জানুয়ারি তেহরানে চার জাতির সিভিলাইজেশনস কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ইংরেজরা যত বড়াই করুক, আসলে ফুটবলের জন্ম হয়েছে চীনে। চীনের পর ফুটবল খেলা শুরু হয়েছে মিসরে। সেখান থেকে গেছে যথাক্রমে গ্রিস, রোম, ফ্রান্স এবং অবশেষে ইংল্যান্ডে।’ ফুটবলের জন্ম নিয়ে বিতর্ক থাকলেও খেলাটির জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ¡ নেই। ফুটবল তার
আবেগ-উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা নিয়ে অনায়াসে মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। ফুটবলের আবেদন সর্বজনীন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে ফুটবল। ফুটবল মানুষকে বেঁধেছে সম্প্রীতির বন্ধনে। যে কারণে বিশ্বের যত লোক বা দেশ ফুটবল খেলে বা ফুটবল খেলা ভালবাসে, আর কোনো খেলায় তেমনটি নেই। এমনকি জাতিসংঘের চেয়ে ফিফার সদস্য সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ ফিফা গোটা বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
আসলে ফুটবল যেভাবে সবাইকে একত্রিত করতে পেরেছে, অন্য কারো পক্ষে তেমনভাবে সম্ভব হয়নি। দেশে দেশে, মানুষে মানুষে যে সহযোগিতা-সহমর্মিতা ও ভালবাসার বন্ধন গড়েছে ফুটবল, তার কোনো তুলনা হয় না। সম্মিলিত ও শান্তিময় বিশ্বের পতাকা উত্তোলন করেছে ফুটবল। ফুটবল মানুষকে সুস্থ ও সুন্দর জীবনবোধে উজ্জীবিত করে। বিশেষ করে সস্তা ও জটিলতাহীন খেলা হিসেবে ফুটবল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষণিকের জন্য হলেও ফুটবল তাদের জীবনে যে আনন্দটকু উপহার দেয়, তা বড় এক পাওয়া। শান্তির সপক্ষে ফুটবল
নীরবে-নিভৃতে কাজ করে চলেছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট পরিসরে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলেও ফুটবলের ক্ষেত্র অনেক বড়।
খেলার মাঠে ফুটবল উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও তা সাময়িক। ফুটবলকে ঘিরে যে
শান্তি-সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে, তা সুদূরপ্রসারী। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ফুটবলকে মনোনয়ন দেয়াটা ইতিবাচক চিন্তা। ফুটবল এ পুরস্কার পেলে এর গৌরবময় অংশীদার আমরাও।
ক্রীড়াজগত ঃ ১ ফেব্রুয়ারি ২০০১
বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি এবং আমাদের স্বপ্ন
ফুুটবলের প্রতি এ দেশের মানুষের যে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও গভীর ভালবাসা, তা আরো একবার উদ্ভাসিত হলো বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে। এ ট্রফি আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে নিয়ে আসে কিছুটা বৈচিত্র্য ও আনন্দময় কোলাহল।
ফুটবল এমন একটি খেলাÑ যার সম্মোহনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন দুনিয়ার তাবৎ ফুটবল অনুরাগী। জনপ্রিয়তার নিরিখে ফুটবলের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক ফুটবল খেলা ভালবাসেন, ফুটবল খেলা দেখেন ও ফুটবল খেলেন। বিনোদনের অন্যতম বাহন হিসেবে ফুটবল যেমন আনন্দের দোলায় দোলাতে থাকে, তেমনিভাবে গেঁথে দেয় সবাইকে এক সূতোয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবাই ফুটবলের মায়াজালে মোহিত ও আপ্লুত হন। আর বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসলে তো কথাই নেই। সবারই রাত-দিন হয়ে যায় একাকার। পৃথিবীর সেরা সেরা দেশ ও সেরা সেরা ফুটবলারের ক্রীড়াশৈলীতে পাওয়ার ও শৈল্পিক ফুটবলের নান্দনিকতা ও সৌকর্যের যে বর্ণাঢ্য সমাহার ঘটে, তা চোখ ও মনের জন্য হয় মহাভোজ। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে মাত্র সাতটি দেশ চ্যাম্পিয়ন হলেও ফুটবলে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ ও প্রতিটি খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে বিশ্বকাপ জয় করা এবং বিশ্বকাপ হাতের মুঠোয় নেয়া। যদিও সবার এ স্বপ্ন পূরণ হয় না।
বিশ্বকাপ ফুটবলে বিজয়ী না হয়েও বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফির উষ্ণতা পেয়েছে। এমনিতে একটি ট্রফির কীইবা মূল্য? ইতালীয় ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগার ডিজাইনে তৈরি বর্তমান ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফির উচ্চতা ৩৬ সেন্টিমিটার আর ওজন ৫ কেজি। খাঁটি সোনার হলেও এর যা বাজারমূল্যÑ এ রকম ট্রফি অসংখ্য তৈরি করা অসম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি শুধু একটি ট্রফি নয়Ñ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফুটবলের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগীর স্বপ্ন, উন্মাদনা ও ভালবাসা। কোনো কিছুর বিনিময়ে এর মূল্য নির্ধারণ করা যাবে না। পার্থিব-অপার্থিব দোলাচালের মাঝামাঝি একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে বিশ্বকাপ ট্রফি। যারা এক বা একাধিকবার এ ট্রফি জিতেছেন, তারা আবার একে পেতে চান এবং যারা কখনো পাননি, আদৌ পাবেন কিনা জানেন না, তারাও এ অধরা স্বপ্নকে স্পর্শ করতে চান। এ যেন পরশ পাথর। যার সন্ধানে ছুটে চলেছেন ফুটবল অনুরাগীরা।
২৭ এপ্রিল বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি ঢাকায় আসলে ফুটবল অনুরাগীরা তাকে বরণ করে নেয় বিপুল উচ্ছ্বাসে আর হৃদয়ের তীব্র আবেগে। এই দুর্লভ বস্তুটি স্পর্শ কিংবা এক পলক দেখার জন্য সবার মাঝে ছিল দারুণ ব্যাকুলতা। ঐতিহাসিক একটি ঘটনার সাক্ষী হতে চেয়েছেন সবাই। আসলে ফুটবলের সঙ্গে এ দেশের মানুষের রয়েছে আÍিক বন্ধন। ফুটবলে এখন ভাটার টান চললেও এ দেশের মানুষের হৃদয় থেকে ফুটবল হারিয়ে যায়নি। বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি এ দেশের মানুষকে যেভাবে আনন্দ ও রোমাঞ্চে শিহরিত করেছে এবং খেলোয়াড় ও সংগঠকরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তাতে আশা করা যায়, ফুটবলে ফের জোয়ার সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি দারুণভাবে আলোড়িত ও রোমাঞ্চিত করেছে। ট্রফি হাতে নিয়ে তিনি বলেছেন: ‘শুধু এভাবে দেখা নয়Ñ আমরা কি পারি না এ ট্রফিটি জয় করে আনতে? সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই আমরা কি পারি না কাজ শুরু করে দিতে?’ এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন: ‘এই লক্ষ্যে আপনারা কাজ করুন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের ফুটবলের ইতিহাসও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিদেশের মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম বহন করেছিলো বাংলাদেশের ফুটবল দলের খেলোয়াড়গণ। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। ফুটবলের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবো কেনো। লক্ষ্য স্থির করে, অবিচল আস্থায়, দৃঢ় প্রত্যয়ে, অনড় মনোবল নিয়ে, নিয়মিত অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে আমরাও তো পারি এ ক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠতে। কেনো পারবো না? এ ট্রফিটি কোনো না কোনো দেশের খেলোয়াড়রাই তো পায়।’
প্রধানমন্ত্রী আমাদের সকলের মনের কথাই ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি আমাদের কাছে সুদূরের স্বপ্ন হয়ে থাকলেও তার কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টাটুকু অন্তত আমাদের থাকা দরকার। দু’শত বছর ফুটবল খেলেও যদি আমরা কিছুটা না এগুতে পারি, সেটা সবার জন্যই দুঃখজনক। বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি আমাদের নতুন স্বপ্ন ও নতুন অঙ্গীকার হোক।
ক্রীড়াজগত : ১ মে ২০০২
‘হেথায় সবারে হবে মিলিবারে’
বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন উৎসব হয়ে ওঠেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করার অভিপ্রায় নিয়ে আগামী ৩১ মে থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের সপ্তদশ আসর বসছে কোরিয়া ও জাপানে।
বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হলেও ৭২ বছরের ইতিহাসে একে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা সমস্যা ও সংকট। তবে বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে দু’টি বিশ্বকাপ ঝরে গেলেও আর কখনো ব্যাহত হয়নি চলার পথ। বরং সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বকাপ ফুটবলের মর্যাদা ও কৌলীন্য ক্রমান¦য়ে বেড়েছে। মাঝে-মধ্যে কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেলেও শেষ অব্দি জয় হয়েছে ফুটবলের। ফুটবলের সম্মিলিত শক্তি ও আলোয় দূর হয়েছে অন্ধকার। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও মনস্তাত্ত্বিক একটা সংকটকে সামনে রেখে আয়োজিত হয়েছে। এই সংকটের সূত্রপাত ১১ সেপ্টেম্বরের পর। সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব ও অহংকার টুইন টাওয়ার বালির বাঁধের মত ধসে যাওয়ায় পাল্টে গেছে বিশ্ব প্রেক্ষাপট। দেশে দেশে মানুষের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম, তবে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটে গেছে। একটা সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস আচ্ছন্ন করে রেখেছে সবার মনকে। শিথিল হয়ে পড়েছে পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর বন্ধন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি এর প্রতিফলন ঘটেছে খেলার মাঠেও। বদলে যাওয়া এমন একটা সময়ে আয়োজন করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির যে সুর কেটে গেছে, বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে সুযোগ এসেছে তার তাল-লয়-ছন্দ ফিরিয়ে আনার। ফুটবলের আবেদন চিরকালীন ও সর্বব্যাপী। ফুটবলই পারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একই সূতোর মালায় গাঁথতে। পারে হিংসা-বিদ্বেষ-রেষারেষি দূর করে অনির্বচনীয় এক স্বর্গীয় আনন্দযজ্ঞে নিয়ে যেতে। এই প্রথম এশিয়ায় এবং একই সঙ্গে দু’টি দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের নেপথ্যে রয়েছে ঐক্য ও মিলনের সেই মর্মবাণী: মিলবে আর মেলাবে। এশিয়ান ফুটবল নিয়ে ফুটবলের পরাশক্তি দেশগুলোর এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে। এশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনকে তারা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ফুটবলের শক্তিমত্তা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে এশিয়ার কোনো একক দেশের পক্ষে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করা আসলেই প্রায় অসম্ভব। তবে জনসংখ্যা ও জনপ্রিয়তা যাচাই করলে এশিয়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। আর এ কারণেই এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক ও ফুটবল পরাশক্তি কোরিয়া ও জাপানকে যৌথভাবে সুযোগ দিয়েছে বিশ্বের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা। এই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে উজ্জীবিত করেছে ফুটবলের স্বপ্ন, আবেগ ও উন্মাদনা। ফুটবলের জন্য তারা এখন পরস্পরের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলেছে। আর এখানেই হচ্ছে ফুটবলের বিজয়।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মে ২০০২
বাড়ির পাশে বিশ্বকাপ ফুটবল
বাড়ির পাশে না হলেও খুব বেশি দূরে নয় কোরিয়া এবং জাপান। এশিয়ার এই দুটি দেশে এই প্রথম যৌথভাবে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসছে। আমাদের অবশ্য বরাবরই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশ কখনোই খেলেনি এবং আগামীতে কখনো খেলতে পারবে কিনা, তা কেবল বলতে পারে ভবিতব্য। বাংলাদেশ দল কখনোই উপস্থিত না থাকলেও এ দেশের ফুটবল অনুরাগীরা কখনোই বিশ্বকাপ ফুটবলের মূলধারার স্পন্দন থেকে দূরে সরে থাকেনি। বিশ্বকাপ ফুটবলের শুরু থেকে টেলিপ্রিন্টারের তারে তারে যেটুকু উত্তাপ এসে পৌঁছায়, তা থেকেই তারা রসাস্বাদন করেছেন কম-বেশি। এতে খুব বেশি সম্পৃক্ত না হওয়া গেলেও স্যাটেলাইট দূরকে কাছে নিয়ে আসার পর বিশ্বকাপ ফুটবল এ দেশের মানুষের কাছে উৎসবের উপলক্ষ হয়ে ওঠেছে।
ফুটবল এ দেশের মানুষের প্রাণের খেলা। বাঙালীর চিরায়ত লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ফুটবলের সম্পৃক্ততা না থাকলেও ফুটবলকে ছেঁটে ফেলার কথা চিন্তা করা যায় না। যদিও হালে ফুটবলের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে, তারপরও ফুটবল এখনও বিনোদনের অন্যতম অবলম্বন। ফুটবল বৃটিশের গর্ভজাত এবং তাদের হাত ধরে এ অঞ্চলে এলেও বৃটিশদের কাছ থেকে যা কিছু পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের
সভ্যতাÑ ফুটবল তার একটি। বাঙালীর সহজিয়া ও ঢিমেতালের জীবনধারায় ফুটবল নিয়ে আসে অন্যরকম গতিবেগ। সস্তায় ও সুলভে বিনোদনের এর চেয়ে ভাল মাধ্যম বাঙালীর জীবনে আর আসেনি। ফুটবলকে পেয়ে তারা মেতে ওঠে দারুণভাবে। বঞ্চিত, শোষিত ও গ্লানিকর জীবনে ফুটবলের তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় সহজেই ভুলে থাকা যায়Ñ না পাওয়ার যন্ত্রণা।
বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে কিংবা খেলছেÑ এমন অনেক দেশের ফুটবল ইতিহাস ও ঐতিহ্য বাংলাদেশের তুলনায় উজ্জ্বল নয়। বাংলাদেশের মানুষ যখন থেকে ফুটবল খেলছে, তখন এসব দেশ ফুটবলের সংস্পর্শেও আসেনি। কিন্তু পিছিয়ে থেকেও তারা খুব দ্রুত এগিয়ে গেছে। আর আমাদের ফুটবল খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারেনি। তাতে করে যে ফুটবলের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ হ্রাস পেয়েছে, তা নয়। এ অঞ্চলের মানুষ ফুটবল খেলে আসছে মনের আনন্দে। যে কারণে ফুটবল খেলা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। তবে এ দেশের মানুষ ভাল ফুটবলের সমঝদার। উচ্চ মানসম্পন্ন ও শিল্পিত ফুটবলের ছোঁয়া পেলে তারা তাতে সবকিছু ভুলে মেতে উঠতে দ্বিধা করে না। আর চার বছর অন্তর-অন্তর বিশ্বকাপ ফুটবলের তীব্র উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস আর আবেগ সকলকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
১৯৭৮ সাল থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে এ দেশের মানুষের আÍিক ও নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে। আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত সেবারের বিশ্বকাপের একটি কিংবা একাধিক খেলা টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়ার পর বাংলাদেশের জীবনধারার অংশ হয়ে উঠেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। পরবর্তীকালে প্রতিটি বিশ্বকাপ সরাসরি সম্প্রচার হওয়ায় ফুটবলের টইটম্বুর আনন্দ-রসে অবগাহন করেন তারা। এ দেশের ফুটবল অনুরাগীরা বরাবরই ব্রাজিল ও পেলের প্রতি দারুণভাবে অনুরক্ত। ব্রাজিল ও পেলের খেলা সরাসরি দেখে এ দেশের মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। বিশ্বকাপ ফুটবলে যখন থেকে ব্রাজিল এবং পেলে খেলছে, তখন তাদের খেলা দেখার সুযোগ আমাদের দেশে ছিল না। কিছুটা জেনে, কিছুটা শুনে তাদের ঘিরে এক ধরনের কিংবদন্তী বা মিথ গড়ে ওঠেছে। তাদের প্রতি এই দুর্বলতা এখনও অটুট আছে। কেননা, স্যাটেলাইটের কল্যাণে ব্রাজিলের শিল্পিত ও সৌন্দর্যময় ফুটবল আর সাম্বা নাচ দেখে তাদের প্রতি যে ভাললাগা ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে অনুরাগে। তবে ১৯৭৮ সালের পর থেকে সমর্থনের ধারা আর একক স্রোতে বয়নি। টেলিভিশনে বিভিন্ন দেশ ও তারকা খেলোয়াড়দের চোখ ধাঁধানো ও মনমাতানো খেলা দেখে দেখে সমর্থনের পাল্লাও নানাভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে ড্যানিয়েল প্যাসারেলার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন ও মারিও কেম্পেসের দুরন্ত খেলা, ১৯৮২ সালে ছিলো দিনো জফের নেতৃত্বে ইতালি চ্যাম্পিয়ন ও পাওলো রসির ম্যাজিক ফুটবল, ১৯৮৬ সালে দিয়াগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন ও ম্যারাডোনার যাদুকরী ফুটবল, ১৯৯০ সালে লোথার ম্যাথিয়াসের নেতৃত্বে জার্মানী চ্যাম্পিয়ন ও লৌহমানব ম্যাথিয়াসের পরিশ্রমী ফুটবল, ১৯৯৪ সালে ডুঙ্গার নেতৃত্বে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন ও রোমারিওর ভেলকি, ১৯৯৮ সালে ডেসচ্যাম্পের নেতৃত্বে ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন ও জিনেদিন জিদানের অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী দর্শকদের আপ্লুত করে।
তবে লাতিন ঘরানার প্রতি এ দেশের ফুটবল অনুরাগীদের স্বভাবজাত দুর্বলতা চিরদিনের। ইউরোপের পাওয়ার ও যান্ত্রিক ফুটবল কারো কারো ভাল লাগলেও লাতিন আমেরিকার প্রতি পাল্লা বরাবরই ভারী। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দুই দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা জয় করে নিয়েছে সবার মন। তবে আর্জেন্টিনাকে আলাদা এক সম্ভ্রমের জায়গায় তুলে দিয়েছেন দিয়াগো ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার খেলা দেখার পর অনেকেই আজ আর্জেন্টিনার সমর্থক। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ফুটবলশৈলীর রোমাঞ্চকর জাদুতে মুগ্ধ হননি- এমন ফুটবল অনুরাগীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। একক দক্ষতায় খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি সবাইকে চমকে দেন।
বলা যায়, দিয়াগো ম্যারাডোনাই এ দেশের ফুটবলের সমর্থনের ক্ষেত্রে নতুন জোয়ার নিয়ে আসেন। বিশ্বকাপ ফুটবল এলে এখন অন্য রকম উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে মায় হেঁসেল অব্দি ঢুকে পড়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তেজনা। বাড়িশুদ্ধ লোক হুমড়ি খেয়ে পড়েন টিভির সামনে। প্রিয় দল, প্রিয় খেলোয়াড়কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় পক্ষ-বিপক্ষ। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকারা হয়ে পড়েন একে অপরের প্রতিপক্ষ। যুক্তি-তর্ক, রাগ-অনুরাগ, ঝগড়াঝাটি, এমনকি বিচ্ছেদের ঘটনা পর্যন্ত গড়ায়। এ সময় সারাদেশ ফুটবল জ্বরে কাঁপতে থাকে। সবকিছুই বিশ্বকাপ ফুটবলের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। অফিস-আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজে একটা ঢিলেমি ভাব চলে আসে। বাড়িতে বাড়িতে শোভা পায় প্রিয় দলের পতাকা, প্রিয় খেলোয়াড়দের পোস্টার। কেউ কেউ প্রিয় দলের জার্সী পরিধান করে কিংবা মুখে পতাকার উল্কি এঁকে অবলীলায় ঘুরে বেড়ান। সর্বত্রই আলোচনায় ওঠে আসে বিশ্বকাপ ফুটবল। কম-বেশি সবাই হয়ে ওঠেন ফুটবল-বিশেষজ্ঞ। বিশ্বখ্যাত তারকাদের ভুল-ত্রুটিগুলো তারা তীক্ষèভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেন সমালোচকের দৃষ্টিতে। মনোভাবটা এমন, তাকে মাঠে নামিয়ে দিলে তিনি এমন ভুল করতেন না! প্রিয় দলের সাফল্য কামনা করে মিলাদ-মাহফিল, দোয়া-দরুদ পাঠ ও পূজা-অর্চনা করা হয়। ব্যর্থতায় মন খারাপ হয়ে যায়। চোখ হয়ে ওঠে অশ্রুসজল। বিশেষতঃ টেলিভিশনে খেলা চলাকালে আবেগ-উচ্ছ্বাসের উত্থান-পতন ঘটে। প্রিয় দল গোল দিলে কেঁপে ওঠে পাড়া-মহল্লা। আবার গোল হজম করলে নেমে আসে শশ্মানের নীরবতা। প্রিয় ফুটবলার মাঠে প্রতিপক্ষের প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে ব্যর্থ হলে কিংবা রাফ ট্যাকলে যন্ত্রণায় লুটিয়ে পড়লে মনে হয় নিজেই যেন ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা ব্যথা পেয়েছেন। জয়ের আনন্দে মিষ্টি খাওয়া, মিছিল-সমাবেশ ও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। একটি দল তিল তিল পরিশ্রমে গড়ে তোলে প্রস্তুতি, তেমনিভাবে একজন ফুটবল অনুরাগীও মনের মাঝে লালন করেন দলের প্রতি সযতœ ভালবাসা। সঙ্গত কারণে সাফল্য যেমন দলকে উদ্বেলিত করে, তেমনিভাবে আপ্লুত করে সমর্থককেও। প্রিয় দল ও প্রিয় খেলোয়াড় যদি অবিচারের শিকার হয়, তা অনুরাগীকেও বিক্ষুব্ধ করে। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে রেফারীর রোষানলের শিকার হয় আর্জেন্টিনা। আগের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার জাদুকরী ফুটবলশৈলীতে আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনার তখন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। সঙ্গত কারণে সবার প্রত্যাশা ও ভালবাসা আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনাকে ঘিরে। ম্যারাডোনা অসাধারণ খেললেও মেক্সিকান রেফারি কোডেসালের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বলি হয় আর্জেন্টিনা। সেদিন যেন কোডেসাল আর্জেন্টিনাকে হারানোর পণ করে মাঠে নেমেছিলেন। সামান্য কারণে আর্জেন্টিনার দু’জন নির্ভরযোগ্য ফুটবলারকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পেনাল্টি দিলে তা থেকে গোল করে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানী। এভাবে পরাজিত হওয়ায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দিয়াগো ম্যারাডোনা। তার কান্না সবাইকে দারুণভাবে স্পর্শ করে। আর্জেন্টিনার এই ন্যক্কারজনক পরাজয় মেনে নিতে পারেননি বাংলাদেশের আর্জেন্টিনার ফুটবল সমর্থকরা। তারা কোডেসালের বিরুদ্ধে ধিক্কার, নিন্দা ও সমালোচনায়,
ক্ষোভে-বিক্ষোভে, মিছিল-মিটিং-এ সরব হয়ে ওঠেন। কোডেসালের বিচার ও ফাঁসি দাবি করে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। বিশ্বকাপ ফুটবল যত দূরেরই হোক না কেন, এ ঘটনায় অনুধাবন করা যায়, তা এ দেশের মানুষের হৃদয়ের খুব কাছাকাছিই অবস্থান।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে যে ১৬টি আসর এর আগে বসেছে, তা ছিল বিশ্বের অপর প্রান্তে। ফলে যখন থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়, দর্শকরা তা উপভোগ করেছেন রাত জেগে জেগে। বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে পাল্টে গেছে মানুষের জীবনধারা। খেলা দেখার জন্য নানাভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন ফুটবল অনুরাগীরা। এবার পাল্টে গেছে প্রেক্ষাপট। এই বিশ্বকাপ ফুটবল আর রাত জেগে খেলা দেখতে হবে না। ৩১ দিনে ৩২টি দল ৬৪টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশের দুপুরে কিংবা বিকেলে। রাত জাগার কান্তি না থাকলেও খেলা দেখতে হবে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়ে কিংবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে। অবশ্য দ্বিধানি¦ত মন নিয়ে ফুটবল উপভোগ করা যায় না। ফুটবল দাবি করে অখ- মনোযোগ। কেননা, চোখের পলকে এমনসব দৃশ্যপট তৈরি হয়, একটুখানি অমনোযোগী বা উদাসীন হলে চমৎকার দৃশ্যগুলো কিংবা ছবির মত দেয়া গোলের আনন্দ আড়াল হয়ে যেতে পারে। টিভির রিপ্লেতে আর যাই হোক, টাটকা স্বাদ পাওয়া যায় না। নিবিষ্ট মনে বিশ্বকাপ ফুটবল উপভোগের জন্য বাড়িতে কিংবা কাবে আড্ডার মেজাজে টিভির সামনে বসার জন্য সবরকম পিছুটানকে উপেক্ষা করতে হয়। তাতে ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি হলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বার্থে এই ক্ষতিটুকু মেনে নিতে কেউ কার্পণ্য করবেন না।
বিশ্বকাপ ফুটবল এ দেশের মানুষের দিন-রাতকে একাকার করে দেয়। এবার এশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজিত হওয়ায় এর মাদকতা আরো বেশি ছড়িয়ে পড়বে। কেননা, কাছাকাছি দেশে আয়োজিত হওয়ায় এর স্পন্দন দারুণভাবে অনুভব করা যাবে। ইতোমধ্যে বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রথম ২৭ এপ্রিল ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি ঢাকায় আসায় দেশের ফুটবল অনুরাগীদের মনে আবেগ-উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। বিশ্বকাপ জয় করে ট্রফি নিয়ে আসা বাংলাদেশের কাছে সুদূরের স্বপ্ন হয়ে থাকলেও ট্রফি দেখাটা ফুটবল অনুরাগীদের কাছে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এই ট্রফি এ দেশের ফুটবলপ্রেমীদের আরো বেশি উসকে দিয়েছে।
এশিয়ায় এবং একই সঙ্গে দু’টি দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এশিয়ান হিসেবে এই ব্যতিক্রমী ঘটনার কিছুটা হলেও আমরা অংশীদার। বিশ্বকাপ ফুটবলের নামে আমরা এমনিতেই নেচে ওঠি, এশিয়ায় এটি আয়োজিত হওয়ায় আমাদেরকে আরো বেশি আপ্লুত করবেÑ এ কথা অন্তত বলা যায়।
দৈনিক যুগান্তর : ৩১ মে ২০০২
ব্রাজিলের সেই ম্যাজিক-ফুটবল কোথায়
আমাদের বুকের মাঝে নীরবে অনুরণিত হয় মেঠো ও লোকজ সহজিয়া সুর। যেখানে তাল আছে, লয় আছে, সুর আছে, আছে ছন্দ। তা আমাদেরকে টেনে নেয় খুব সহজেই। আমাদের শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে এবং জীবনধারায় প্রচ্ছন্ন আছে এই গীতিময়তা। ঢোলের বাড়ি শুনলে চকিতে নেচে ওঠে আমাদের মন-প্রাণ। ফুটবলেও আছে গতি, শক্তি ও বৈচিত্র্যের দুরন্ত মিশেল। আর এ কারণেই ফুটবলের সঙ্গে আমাদের জীবনের অদ্ভুত মিল। ফুটবলের তীব্র উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস আর আবেগ আমাদেরকে দারুণভাবে আপ্লুত করে। প্রতিদিনের জীবনে অনেক না-পাওয়ার বেদনা থাকা সত্ত্বেও ফুটবল মাঠে আমরা খুঁজে পাই মুক্তির আনন্দ। সাময়িকভাবে হলেও ফুটবলের মোহন বাঁশির সুর আমাদের নিয়ে যায় বর্ণিল ও স্বপ্নময় জগতে। ফুটবলে আছে এক ধরনের মাদকতাÑ যা বেঁচে থাকার রসদ যোগায়।
খেলার মাঠে পিছিয়ে থাকলেও এ দেশের মানুষ প্রাণোচ্ছ্বল ও আনন্দময় ফুটবলের সমঝদার। শৈল্পিক ও ছন্দময় ফুটবল তাদেরকে আবিষ্ট করে রাখে। আর এ কারণেই লাতিন ঘরানার ফুটবলের প্রতি রয়েছে তাদের সহজাত দুর্বলতা। এমনিতেই লাতিন আমেরিকার মানুষের গান, বাজনা, নৃত্য, দারিদ্র্য, রাজনীতি ও জীবনধারার সঙ্গে কোথায় যেন আমাদের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাদের সবকিছুর প্রতি রয়েছে আমাদের আলাদা আকর্ষণ ও মুগ্ধতা। বিশেষ করে, লাতিন ফুটবল আমাদেরকে হ্যামিলনের বাঁশির মত মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। ফুটবল যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিল্প হয়ে থাকে, তার রূপকার লাতিন আমেরিকা। সমৃদ্ধ ফুটবল ঐতিহ্য, ব্যক্তিগত প্রতিভা, স্কিল ও দক্ষতা দিয়ে তারা মাতিয়ে রাখার পাশাপাশি বিশ্ব ফুটবলকে শাসন করে আসছে। একই সঙ্গে ইউরোপের পাওয়ার, যান্ত্রিক ও আধিপত্যবাদী ফুটবলের সঙ্গেও তারা লড়াই চালাচ্ছে। ইতালী, পশ্চিম জার্মানী, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী, সুইডেন, হল্যান্ডের প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে খর্ব করে তৃতীয় বিশ্বের জয়ধ্বনি গেয়েছে লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। আলট্রা ডিফেন্সিভ ও লড়াকু মানসিকতা ইউরোপীয় ফুটবলের বৈশিষ্ট্য হলেও ইতালী, ফ্রান্স ও হল্যান্ডের শিল্পিত ফুটবলও যথেষ্ট আনন্দদায়ক। কিন্তু এ দেশের ফুটবল অনুরাগীদের পক্ষপাত লাতিন আমেরিকার দিকে। ১৯৩০ ও ১৯৫০ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে লাতিন আমেরিকার মর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয় উরুগুয়ে। এরপর অর্ধ-শতাব্দীকাল পেরিয়ে গেলেও উরুগুয়ের সেই রমরমা আর নেই। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে মারিও কেম্পেসের দুরন্ত ক্রীড়াশৈলী এবং ১৯৮৬ সালে দিয়াগো ম্যারাডোনার ম্যাজিক্যাল ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আর্জেন্টিনা দর্শক-হৃদয় জয় করে নেয়। ম্যারাডোনা পরিণত হন অবিসংবাদিত নায়কে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, ম্যারাডোনা তার অবিশ্বাস্য ও অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী দিয়ে কিংবদন্তীর ফুটবলারদের সারিতে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন তো বটেই, পাশাপাশি আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তা ও গ্ল্যামার অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও ম্যারাডোনার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই আর্জেন্টিনা বিশ্ব ফুটবলের প্রতিষ্ঠিত শক্তি। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বপ্ন, আকা´খা ও ভালবাসার দল হিসেবে আর্জেন্টিনাকে গড়ে তোলার কৃতিত্ব বোধ করি ফুটবলের স্বপ্নপুরুষ ম্যারাডোনার। আমাদের দেশেও ম্যারাডোনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে আর্জেন্টিনার অসংখ্য গুণগ্রাহী।
সত্যিকার অর্থে লাতিন ফুটবল ঘরানার উজ্জ্বল প্রতিনিধি ব্রাজিল। ব্রাজিল এ দেশের মানুষের হৃদয়-মন্দিরে ঠাঁই করে নিয়েছে অনেককাল আগে থেকেই। ব্রাজিল নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্রই হাওয়ায় সৌরভ ছড়ায় ফুটবল। ফুটবল ও ব্রাজিল হয়ে উঠেছে একে অপরের সমার্থক। শিল্পিত, নান্দনিক ও রোমাঞ্চকর ফুটবলের চারণভূমি ব্রাজিল। শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মত ব্রাজিলীয় শিল্পী-ফুটবলাররা এক টুকরো সবুজ জমিতে ফুটিয়ে তোলেন ভ্যান গঁগের জীবন্ত ‘সূর্যমুখী’।
ব্রাজিল প্রতিটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার এক বিরল ও ব্যতিক্রমী রেকর্ড গড়েছে। আর কোনো দেশের পক্ষে এই রেকর্ড স্পর্শ কিংবা অতিক্রম করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বেশি চারবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছে ব্রাজিল। বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিল এবং ব্রাজিলীয় ফুটবলাররা এমনসব কীর্তিগাথা রচনা করেছেনÑ যা অমর ও অমলিন হয়ে আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের একটি ট্রফিকে ঘিরে কত উন্মাদনা, কত স্বপ্নের জন্ম ও মৃত্যু এবং কিংবদন্তীÑ যা ব্রাজিলকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না। বিশ্বকাপ ফুটবলের শুরু থেকেই ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দি¡তা ও নীরব রেষারেষি; তাতে ইউরোপের আটটি দেশÑ ইতালী, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী, পশ্চিম জার্মানী, সুইডেন, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও ফ্রান্স ৮ বার চ্যাম্পিয়ন ও ১২ বার রানার্সআপ হয়ে কিছুটা এগিয়ে আছে। পক্ষান্তরে, লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল আটবার চ্যাম্পিয়ন ও চারবার রানার্সআপ হয়েছে। তবে বিশ্বকাপ ফুটবল ইউরোপ বা লাতিনে হলে সাধারণত সে অঞ্চলের দেশ জিতেছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ব্রাজিল। তারা ১৯৫৮ সালে ইউরোপ এবং ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাপ জয় করেছে।
সাফল্যের আলো দিয়ে বিশ্ব ফুটবলকে আলোকিত করলেও ব্রাজিল বিশ্বের তাবৎ ফুটবল অনুরাগীর মন কেড়েছে তার জাদুকরী ও দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দিয়ে। ব্যালে নাচ ও জিমন্যাস্টিক্স এবং শিল্প ও গতির সমন¦য়ে টোটাল ফুটবল দিয়ে সবাইকে সম্মোহিত করে দেয় ব্রাজিল। ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ হিসেবে খ্যাত ব্রাজিলের লিওনিদাস ডা সিলভা ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপে গোল করার অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তবে ব্রাজিলীয় ফুটবলের শৈল্পিক ধারার বিকাশ ঘটে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে। নিজের মাটিতে তারা চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও তাদের ফুটবল নতুন এক শৈলীর জন্ম দেয়। হাল আমলে লাতিন সাহিত্যে ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’ অর্থাৎ যাদু বাস্তবতা নিয়ে সাড়া পড়লেও খেলার মাঠে এর অঙ্কুরোদগম হয় ব্রাজিলের হাত ধরে। ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপে ব্রাজিলীয় ফুটবল তার রূপ-রস-গন্ধ-মাধুর্য পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরে। সুপ্ত কুঁড়ি যেন ফুল হয়ে ফোটে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ধ্রুপদ সঙ্গীতে বেটোফেনের মত সুরের মূর্ছনায় মাতাল করে দেন ব্রাজিলের এক দল সৃষ্টিশীল শিল্পী-ফুটবলার। ডিডি, গ্যারিঞ্চা, জাগালো, ভাভা, রিভেলিনো, টোস্তাও, জরজিনহোর সঙ্গে ১৭ বছরের তরুণ পেলেকে নিয়ে যে অর্কেস্ট্রা দল, তা দিয়ে ছন্দময় ফুটবলের জাদু দেখান ব্রাজিলের ম্যানেজার ভিসেন্তে ফিওলা। এই বিশ্বকাপে আবিষ্কৃত ‘কালো মানিক’ পেলে সবচে’ কম বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে, সবচে’ কম বয়সে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করে এবং সবচে’ কম বয়সে বিশ্বকাপের সোনা পেয়ে নতুন সেনসেশনে পরিণত হন। সবচে’ বড় কথা, যান্ত্রিক ফুটবলের বিপরীতে শৈল্পিক ফুটবলের জন্ম দিয়ে ব্রাজিল সেই যে বিশ্ববাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেয়, সে ধারা অব্যাহত আছে। ১৯৬২ সালে ব্রাজিলীয় রোমাঞ্চকর ফুটবলের নায়ক ছিলেন গ্যারিঞ্চা। ‘ছোট্ট পাখি’ হিসেবে খ্যাত গ্যারিঞ্চা তার অসঙ্গতিপূর্ণ দু’পা দিয়েই তার প্রতিভা ও সৃজনশীলতার বিস্ফোরণ ঘটান। তার বাঁ পায়ের দুরন্ত শট, চিতা বাঘের গতি ও লাফিয়ে ওঠে হেড নেয়ার অসামান্য দক্ষতা এবং সঙ্গী ভাভাও নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে ব্রাজিলকে উপর্যুপরি দ্বিতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন করেন। পেশীতে টান ও ইনজুরির কারণে ১৯৬২ ও ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে পেলে তেমনভাবে ঝলসে উঠতে না পারলেও ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ ছিল তার নৈপুণ্যে ভাস্বর। টোস্তাও এবং জর্জিনহোকে নিয়ে সৃষ্টিশীল ফুটবল উপহার দিয়ে তৃতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন করেন ব্রাজিলকে। ফলে “জুলে রিমে ট্রফি” চিরদিনের মত ব্রাজিলের হয়ে যায়। চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ, দুটি ফাইনালে ৩টি সহ বিশ্বকাপে মোট ১৩ গোল দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ব ফুটবলের মডেল। বিধ্বংসী রিফেক্স আর অসামান্য চিন্তাশক্তির সমন¦য়ে ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে তার চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী দেখে দলের ম্যানেজার জোয়াও সালদানার অভিমত হচ্ছে: ‘ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়রের যে সম্মান, ব্রাজিলের ফুটবলে পেলেও তাই।’ এরপর থেকে পেলে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তী ফুটবলার। আগে-পরে অনেক ফুটবলার এলেও পেলের মত খ্যাতি, সম্মান ও জনপ্রিয়তা আর কারো ভাগ্যে জোটেনি। ১৯৭০ সালের পর টানা পাঁচটি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করলেও ব্রাজিলের খেলায় যে ছন্দ ও গ্ল্যামার থাকে, তা থেকে ফুটবল অনুরাগীরা বঞ্চিত হননি। জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাও, কারেকার মত শিল্পী ফুটবলাররা ব্রাজিলীয় ঘরানায় ফুটবল খেলে আনন্দ দিলেও শিরোপার নাগাল পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে ব্রাজিলের ফুটবল নিয়ে ভেতরে ভেতরে একটা অসন্তোষ গড়ে ওঠে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেরা ব্রাজিলের নিজস্ব স্টাইল বিসর্জন দিয়ে ‘ডিফেন্সিভ ফুটবল’ খেলে ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করেন। রোমারিও ও বেবেতোর খেলা কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ব্রাজিলের খেলা অনুরাগীদের মন ভরাতে পারেনি। ১৯৯৮ সালে মারিও জাগালোর দল প্রত্যাশিত নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালে ব্রাজিল যে খেলা খেলেছে, তা অনুরাগীদের মন ভেঙ্গে দিয়েছে।
মাঠের ফুটবল দিয়ে ব্রাজিল সবার মন জয় করলেও তাদের সমর্থকরাও বিশ্বকাপের অন্যতম আকর্ষণ। কত রকম সাজ, পোশাক, নাচ-গান। মুখে-চুলে হলুদ-সবুজ রঙ মেখে কিংবা পতাকা নিয়ে নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে ফুটবল উপভোগ করার পাশাপাশি অন্যদের আনন্দ দেয়াটা ব্রাজিলীয় সমর্থকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোন্ পত্রিকায় যেন মন্তব্য করা হয়েছে: ‘ব্রাজিলের ফুটবল যদি কবিতা হয়, ব্রাজিলিয়ান দর্শকরা তা হলে ঝরনাধারা।’ ফুটবল আর সাম্বা নাচ ব্রাজিলিয়ানদের জীবনবেদ। ব্রাজিল দলের খেলার সময় গ্যালারীতে আনন্দ-উৎসবের ঢেউ বয়ে যায় বিটের তালে তালে। দেহবল্লরীর উচ্ছ্বাস আর উদ্দামতায় উন্মাতাল হয়ে ওঠে পুরো স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের খেলার প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিকের অভিমত হচ্ছে এমন: ‘একটা মস্ত বড় সর্ষে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে প্রবল একটা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। গোটা স্টেডিয়াম গা মুড়ি দিয়েছে একটাই চাদরে। যার রং হলদে-সবুজ।’
মাঠে শৈল্পিক ফুটবল আর গ্যালারীতে সাম্বা নাচ দিয়ে বিশ্ব ফুটবলে যে গ্ল্যামার, জনপ্রিয়তা ও আবেদন তৈরি করেছে ব্রাজিল, তাতে বোধকরি খানিকটা ভাটার টান লেগেছে। জয়ের নেশায় যেনতেনভাবে খেলে সাফল্য পেলেও ভক্ত-অনুরাগীদের মন জয় করতে পারছে না ব্রাজিল। তদুপরি এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই-পর্বে যেভাবে তারা ঘষটাতে ঘষটাতে চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হয়েছে, তা রীতিমত হতাশাজনক পারফরম্যান্স। শৈলী এবং পারফরম্যান্সÑ দুটোই যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে ব্রাজিলীয় ফুটবলের থাকেটা কি?
দৈনিক আজকের কাগজ : ৩১ মে ২০০২
রমণীয় বিশ্বকাপ
চারিদিকে যখন ধ্বংসের দামামা বেজে উঠেছে, ঠিক তখন আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবলে ধ্বংস নয়, আছে সৃষ্টির আনন্দ। আছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধন। আর এ কারণেই পৃথিবীর কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগী রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় প্রহর গুণছে বিশ্বকাপ ফুটবলের। ফুটবল নিছক কোনো খেলা নয়। বিশ্বকাপের সবচে সফল দল ব্রাজিলীয়দের কাছে ফুটবল দেবতার মতো। ফুটবলকে ওরা দেখে জীবনের উচ্ছ্বাসে। ফুটবলের আবেগ-উত্তেজনা ওদের রক্তে নাচন ধরায়। ফুটবলের বেদীতে নিজেকে সঁপে দিতে পারলে ওরা খুঁজে পায় জীবনের সার্থকতা। এ কারণেই রোজমেরি ডি মেলো ব্রাজিলীয়দের কাছে হয়ে আছেন রূপকথার নায়িকা। রীতি ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ করেও এই বালিকা সাহস ও ভালবাসার প্রতীক হয়ে ওঠেন। তার কু-কীর্তিতে রক্ষা পেয়েছে ব্রাজিলের সম্মান ও মর্যাদা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের খেলা চলছে দক্ষিণ আমেরিকায়। বাছাই পর্বে সেবার ব্রাজিলের অবস্থা খুবই নাজুক। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে ব্রাজিল খেলতে পারবে কিনাÑ তা নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলায় দোল খাচ্ছে ব্রাজিলের তাবৎ অনুরাগী। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে চিলিতে অনুষ্ঠিত প্রথম খেলায় স্বাগতিক দলের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে বেকায়দায় পড়ে যায় ব্রাজিল। চূড়ান্ত পর্বে খেলতে হলে নিজের মাঠে পরবর্তী খেলায় ব্রাজিলকে অবশ্যই জিততে হবে। এমন একটা অবস্থায় দু’দেশের খেলা হয় ব্রাজিলের মারকানা স্টেডিয়ামে। খেলায় ১-০ গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিক দেশ। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা গড়িয়েছে ২৪ মিনিট। এ সময় একটি ‘আগুন-বোমা’ ছুঁড়ে মারা হয় মাঠে। বোমাটি পড়ে চিলির গোলরক্ষক রবার্তো বোজাসের পেছনে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যান এবং হাত দিয়ে মুখ ঢেকে এমন ভাব করেন যেন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় চিলির খেলোয়াড়রা নিরাপত্তার দাবিতে মাঠ ছেড়ে চলে যায়। তারা আর মাঠে ফিরে না আসায় ফিফা ম্যাচটি বাতিল করে দেয় এবং ব্রাজিলকে ২-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করে। চিলির গোলরক্ষক আহত হওয়ার ভান করায় ফুটবল খেলা থেকে তাকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এ ঘটনা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্রাজিলীয় ফুটবল ফেডারেশনকে ১২ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিতে হলেও ব্রাজিল অনায়াসেই উন্নীত হয় চূড়ান্ত পর্বে। হাঁফ ছাড়েন ব্রাজিল অনুরাগীরা। ব্রাজিলবিহীন বিশ্বকাপ তাদের কাছে লবণ ছাড়া তরকারির মতো স্বাদহীন। চিলির সঙ্গে খেলায় এগিয়ে থাকলেও ব্রাজিল যে জয়ী হতে পারতো, এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বরং গোল খেয়ে আহত বাঘের মতো আক্রমণাÍক হয়ে ওঠে চিলি। যে কোনো মুহূর্তে গোল শোধ হয়ে যেতে পারতো। এমন সময় ব্রাজিলের দুর্দশার সদয় হয়ে ফুটবল দেবতা যেন ‘আগুন-বোমা’ দিয়ে পাঠান রোজমেরি ডি মেলোকে। মুমূর্র্ষু অবস্থা থেকে ব্রাজিলকে রক্ষা করায় ব্রাজিলিয়ানদের কাছে রোজমেরি হয়ে ওঠেন ঈশ্বরের প্রেরিত দূত।
বিশ্বকাপ ফুটবল ব্রাজিলিয়ানদের কাছে আসলে তীর্থ দর্শনের মতো। ব্রাজিল দলের খেলার সময় মাঠে উপস্থিত থাকতে পারলে তারা নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করেন। বিশ্বের যে প্রান্তেই খেলা হোক না কেন, তারা ছুটে যাবেনই। ব্রাজিলীয় সমর্থকরা ফুটবল অনুরাগীদের কাছে আলাদা স্থান করে নিয়েছেন। তারা স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘গ্যালারির শিল্পী’ হিসেবে। হলদে-সবুজ রঙে শরীরকে রাঙিয়ে এবং ব্যান্ডের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুরে সুরে যে উন্মাতাল সাম্বা নাচ তারা নাচেন, তা যেন গ্যালারির বৃহৎ ক্যানভাসে সম্মিলিত শিল্পচর্চা।
বিশ্বকাপ পুরুষদের হলেও গ্যালারি ও টিভির দর্শকদের মাঝে ফুটবলের তীব্র উত্তেজনা, আবেগ আর উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। সাম্বা নেচে দেহবল্লরীর ছন্দ ও উদ্দামতা নিয়ে দর্শকদের আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে নেয়ার কৃতিত্ব ব্রাজিলীয় তরুণীদের। ব্রাজিলের দেখাদেখি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশের সমর্থক এখন গ্যালারিতে ফুটিয়ে তোলেন স্ব-স্ব দেশের নৃত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতিকে। নানান সাজ, স্টাইল ও ফ্যাশনের সঙ্গে শোভা পায় জাতীয় পতাকা, পোস্টার ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। কারো কারো মাথায় বিশাল বিশাল হ্যাট। ইউরোপীয় ও লাতিন ঘরানার পাশাপাশি ফুটবল মাঠে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছে অন্ধকার থেকে উঠে আসা আফ্রিকানরা। গ্যালারিতে তাদের বিচিত্র এবং বাহারী কেশ ও বেশভূষা সবার নজর কেড়ে নেয়। বিশ্বকাপে সমর্থকরা যে কত রকম কলাকৌশল দেখিয়ে থাকেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের ‘মেক্সিকো ওয়েভ’ পৃথিবীর বিভিন্ন মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইংল্যান্ডের দাঙ্গাবাজ সমর্থকদের কুখ্যাতি ফুটবলের প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো।
বিশ্বকাপ ফুটবল এলে আবেগের বন্যায় ভাসতে থাকে সারা বিশ্ব। আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ফুটবলের উত্তেজনা। ফুটবলের উন্মাদনায় সবাই একাকার হয়ে যায়। বস্তিবাসী থেকে অভিজাতবাসীÑ সমাজের সবার স্বপ্ন ও আনন্দ, চাওয়া ও পাওয়া হয়ে ওঠে এক-একটি ফুটবল দল। ১১ জন ফুটবলার হয়ে ওঠেন গর্ব ও আবেগ। বিশ্বকাপের একটি মাস কেটে যায় আনন্দ ও উল্লাসে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে টিভি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। দেশে দেশে টিভিতে খেলা চলাকালে রাস্তাঘাটে লোক চলাচল থেমে যায়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এবং ইদানীং এশিয়ায়ও বড় বড় স্ক্রিনে খেলা দেখানো হয়। অনেকেই ঘরে বসে ফুটবল খেলা দেখতে পছন্দ করেন না। তারা ছুটে যান আনন্দময় কোলাহলে। রেস্তোঁরা, কফিশালা, পানশালা, সরাইখানা, ক্যাসিনোগুলো হয়ে ওঠে জমজমাট। তারা অনাবিল আনন্দে চুইয়ে চুইয়ে উপভোগ করেন ফুটবল। এমনকি সমুদ্রের তীরে দেখানো হয় ফুটবল খেলা। সবাই খেলা দেখেন পিকনিকের আমেজে। নাঙ্গা তরুণ ও টপলেস তরুণীরা কখনো জলে, কখনো অন্তরীক্ষে নাচে-গানে-বাজনায়, চুম্বনে-হল্লায় মেতে ওঠেন ফুটবলের উন্মাদনায়। বিশ্বকাপকে ঘিরে জুয়ার আসরগুলোও হয়ে ওঠে সরগরম।
বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে আকাশছোঁয়া যে স্বপ্ন, আনন্দ ও গ্ল্যামারÑ তাতে যতই দিন যাচ্ছে, মেয়েদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। নেপথ্যের কর্মী ও সংগঠক হিসেবে প্রতিটি বিশ্বকাপ আয়োজনে তাদের রয়েছে শ্রম, মেধা ও সহযোগিতা। এছাড়াও তারা নানাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন। এবার তাদের জন্য বাজারজাত করা হয়েছে বিশেষভাবে নির্মিত ‘হ্যাটট্রিক ব্রা’। শাদা-কালো ইমিটেশন চামড়া দিয়ে তৈরি এই ব্রা’য় তিনটি ফুটবলের আকৃতি দেয়া হয়েছে। এই ব্রা প্রস্তুতকারী কোম্পানি জানিয়েছে, জাপানি ফুটবল অনুরাগীদের ৫০ শতাংশেরও বেশি মহিলা। মহিলারা শুধু এই ব্রা পরিধান করেই খেলা দেখতে পিছু পা হবেন না।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে নতুন রূপে দেখা যাবে মেয়েদের। তারা বল-গার্লের দায়িত্ব পালন করবে। মাঠের বাইরে যাওয়া বল তারা প্রজাপতির মতো ছুটে ছুটে নিয়ে আসবে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে এটি হবে নতুন এক আকর্ষণ। বিশ্বকাপ ফুটবলকে আরো আনন্দময় ও গ্ল্যামারাস করার ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই ফুটবল অনুরাগীদের বাড়তি আনন্দ দেবে।
দৈনিক ইত্তেফাক : ৩১ মে ২০০২
নানান রঙের বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপ ফুটবলের উল্লাসে, উচ্ছ্বাসে ও উন্মাদনায় মেতেছে দুনিয়া। সঙ্গে স্বপ্নপূরণ ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বকাপ এক সূতোর মালায়
গেঁথেছে বিশ্বকে।
বিশ্বকাপ নিছক খেলার মেলা নয়, মানবজাতির মিলনমেলাও বটে। এর মাধ্যমে উদ্বোধন ও উন্মোচন হয় জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির নানা রূপ। এখন আর শুধু মাঠের খেলায় আমাদের মন কাড়ে না, খেলোয়াড় এবং গ্যালারীর দর্শকদের নানা রঙের, নানা বর্ণের সাজে ও আনন্দ-বেদনায় আমরা মুগ্ধ হই, ব্যথিত হই এবং আপ্লুত হই। সর্বোপরি আমরা জানতে পাই অজানাকে। একটা বিশ্বকাপ কতভাবেই না আমাদের কাছে মেলে ধরে। আমরা বিভিন্ন দেশের পতাকা, মানচিত্র, জনসংখ্যা, ভূগোল, জাতীয় সঙ্গীত, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, ফ্যাশন, স্টাইল এবং জীবনকে উপভোগ করার ভঙ্গিমাগুলো দেখতে পাই। আসলে বিশ্বকাপ এমন একটি স্ফটিক, যার বর্ণিল আলোয় আমরা নানাভাবে আলোকিত হই। ভাবিত হই। বিশ্বকাপ আমাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসে পরস্পরের। একে অপরকে জানা ও বোঝার মধ্যেই গ্রথিত আছে মানবজাতির যে ঐক্যসূত্র, তার চমৎকার উপলক্ষ বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রত্যেক মানুষ ও প্রতিটি দেশের একটি কেন্দ্রবিন্দু থেকে উত্থান ও বিকাশ।
সময়ের পরিক্রমায় বদলেছে ভাষা, মানচিত্র ও অবস্থান। বেড়েছে দূরত্ব। পরিচয় হয়েছে নানা গোত্র-বর্ণ-ধর্ম-জাতি হিসেবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের যুপকাষ্ঠে বলী হতে হয়ে বেড়েছে বিভেদের দেয়াল। এর মাঝেও মানুষ গাইছে মিলনের গান। কখনো আন্তঃদেশীয়, কখনো মহাদেশীয় কিংবা কখনো বিশ্ব পরিসরে। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল যেভাবে সবাইকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত করে এবং সবার আবেগ-উচ্ছ্বাস, আনন্দ-বেদনা ও জীবনের নানা অভিব্যক্তিগুলোর উদ্ভাসন ঘটায়, তেমনটি আর কোথাও আমরা দেখি না। এ ক্ষেত্রে বিশ্বকাপ ফুটবল অনন্য ও অদ্বিতীয়।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু বিভেদের দেয়ালটাই আড়াল করে না, পাশাপাশি সবাইকে নিয়ে আসে একই সারিতে। ধনে-মানে-জনে ও শক্তিতে নজরকাড়া দেশগুলো ফুটবল মাঠে দুর্বল ও বিত্তহীন দেশগুলোর কাছে হরদম ধরাশায়ী হচ্ছে। ফ্রান্সের মত শিল্পোন্নত দেশ আফ্রিকার গহীন অন্ধকার থেকে ওঠে আসা অজ্ঞাত-অখ্যাত-অপরিচিত দেশ সেনেগালের কাছে হার মানছে। দোর্দন্ডপরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চোখের পানি আর নাকের জল এক হচ্ছে পোল্যান্ডের কাছে। বিপুল জনসংখ্যার দেশ চীন পাত্তাই পাচ্ছে না ক্ষুদ্র জনসংখ্যার দেশ কোস্টারিকার কাছে। এর মাধ্যমেই সত্যিকার অর্থে প্রকাশ ঘটছে শৌর্য-বীর্য ও মানবিক সৌন্দর্যের। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা পিছিয়ে দিলেও মুছে দিতে পারছে না মানুষের সহজাত প্রতিভা, সদিচ্ছা, কল্পনাশক্তি ও মহৎ গুণাবলীকে। এর প্রমাণ আমরা পাই শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে এবং খেলার মাঠে। পেলে, ম্যারাডোনারা যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, পাপা বুয়াবা দিওপ, সালিফ দিয়াও, ফাদিগা, হেনরি কামারারা এখন তা অনুসরণ করে চলেছেন।
সেনেগাল নামক দেশটি এতদিন আমাদের কাছে আড়াল হয়ে ছিল। আফ্রিকার এই দেশটি সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি কৌতূহল ছিল না। দেশটির এমন কোনো কীর্তি কিংবা কু-কীর্তি কখনোই আমাদের কাছে সেভাবে পৌঁছায়নি। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগে আস্তে-ধীরে আমরা জানতে পারি যে চারটি দেশ প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলতে আসছে, তার মধ্যে একটি সেনেগাল। তারপরও এককালের ফরাসী ঔপনিবেশভুক্ত ছোট্ট এই দেশটি আমাদের কাছে ছিল অনুজ্জ্বল হয়ে। আমরা একরকম ধরে নিয়েছিলাম, আফ্রিকা থেকে আসা একটা দুর্বল দল কতটুকুই বা যেতে পারবে? আমাদেরকে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করে ফুটবলের আলো দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেছে সেনেগাল। পেছনের ইতিহাস যতই কষ্টের, বেদনার, অন্ধকার হোক না কেন, কিংবা ফুটবলের ঐতিহ্য নাইবা থাকলো, মানুষের ভেতরে যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, তা যে সময় ও সুযোগমত বিচ্ছুরণ ঘটায়, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো সেনেগালিজরা। আর ফুটবলের ‘বাউল’ ফরাসি কোচ ব্রুনো মেটসু সেনেগাল দলটির অনালোকিত দিকটি নিয়ে এসেছেন আলোয়। আর এটি সম্ভব হয়েছে ফুটবলকে তিনি খেলা হিসেবে না দেখে দেখেন জীবনদর্শন হিসেবে। আর এই দর্শন দিয়ে তিনি সেনেগালের ফুটবলারদের উজ্জীবিত করতে পেরেছেন।
সেনেগালের এই সাফল্য, এই গৌরব আমাদের মত দেশকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। পিছিয়ে পড়া দরিদ্র ও অনুজ্জ্বল একটি দেশ যদি পারে, আমরা কেন পারবো না?
ক্রীড়াজগত : ১৬ জুন ২০০২
সেই দিনটি কবে আসবে
বিশ্ববাসীকে ফুটবলের আনন্দযজ্ঞে মাতিয়ে শেষ হলো দুনিয়া কাঁপানো বিশ্বকাপ। তবে এর রেশ এখনো আমাদের আপ্লুত করে স্মৃতির মৌতাতে। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কত রকম অম্ল-মধুর দৃশ্যপট।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু ক্ষণিকের আনন্দ কিংবা মোহ নয়। প্রতিটি বিশ্বকাপের আবেদন চিরন্তন। একটি বিশ্বকাপ অতীত হয়ে গেলেও তা আমাদের আনন্দময় স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে যায়। যেভাবে বেঠোফনের সিম্ফনি অনির্বচনীয় অনুভূতি এনে দেয়, ভ্যান গঁগের ছবি স্বপ্নময় জগতের সন্ধান দেয়, শেক্সপীয়ারের কবিতা ও নাটক মনের জানালা খুলে দেয়, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র অনাবিল মাধুর্যে ভরিয়ে দেয়; তেমনিভাবে বিশ্বকাপ ফুটবলও দেয় ভাল লাগার অনাস্বাদিত আমেজ।
এবারের বিশ্বকাপ কতভাবেই না আমাদের বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করেছে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে শক্তি ও শৈলীর ব্যবধান হ্রাস পাওয়ায় খেলায় ঘটেছে অপ্রত্যাশিত ফলাফল। যে কারণে এবারের বিশ্বকাপকে আন্ডারডগদের বিশ্বকাপ, অভাবিত বিশ্বকাপ কিংবা অঘটনের বিশ্বকাপ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, উরুগুয়ের মত দেশ দ্বিতীয় পর্বে উঠতে পারবে না, এটা মোটেও ভাবা যায়নি। শিরোপার অন্যতম দাবিদার ফ্রান্স কোনো ম্যাচ জিততে পারবে না, এমনকি একটি গোলও করতে পারবে না এবং আর্জেন্টিনাও প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেবে, এ তো কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। তেমনিভাবে এই প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে আসা সেনেগাল, দুই স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র যে সাফল্য দেখিয়েছে, তাতে উৎসাহিত হয়েছে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার উত্থান সবাইকে শুধু চমকেই দেয়নি, একই সঙ্গে ফুটবলের বিশ্বায়নকে এগিয়ে নিয়েছে অনেকটা পথ।
জিনেদিন জিদান, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, লুই ফিগো, থিয়েরি অঁরি, হারনান ক্রেসপো, ডেভিড ত্রেজেগে, ফ্রান্সেসকো তোত্তি, হুয়ান ভেরনের মত জগতখ্যাত তারকারা অনুজ্জ্বল হয়ে যাবেন, আর জ্বলে ওঠবেন মিরোস্লাভ কোস, বুয়াবা দিওপ, হাসান সাস, ইলহান মনসিজ, ইনামতো, মরিয়েন্তেস, হেনরি কামারার মত অনুজ্জ্বল ফুটবলাররাÑ এও তো বিশ্বকাপ ফুটবলের এক রহস্য। যে রোনালদো গত বিশ্বকাপের ফাইনালে কোনো এক রহস্যময় কারণে মাঠে নেমে অন্যলোকের বাসিন্দা হয়ে ওঠেছিলেন এবং তারপর থেকে ইনজুরির আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ফুটবলের সঙ্গে একরকম সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন; সেই রোনালদো এবার গোল্ডেন বুট জয় করবেন, এটাও এক রকম বিস্ময়। ফুটবলের দুই পরাশক্তি হয়েও ব্রাজিল ও জার্মানী এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল একরাশ সংশয়। উভয় দলই বাছাই পর্বে তাদের শেষ ম্যাচে জিতে চূড়ান্ত পর্বে ওঠা নিশ্চিত করে। আর এই দল দু’টি ফাইনালে উঠে জানিয়ে দেয় ফুটবলও কম অনিশ্চয়তার খেলা নয়। ব্রাজিলীয় অধিনায়ক কাফু উপর্যুপরি তিনটি বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে খেলে এক বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। একইভাবে এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তুরস্কের হাকান সুকুর। কোরিয়ার সঙ্গে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় ১১ সেকেন্ডে গোল করে তিনি বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে সবচে’ দ্রুততম গোল করেছেন। ব্রাজিল ও জার্মানী এবারই প্রথম বিশ্বকাপে মুখোমুখি হওয়াটা যেমন বিস্ময়ের, তেমনিভাবে খেলতে না নেমেও আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার ক্যানিজিয়ার লাল কার্ড পাওয়াটা কম বিস্ময়ের নয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিলের রোনালদিনহো রঙধনুর মত ফ্রি-কিক থেকে যে গোলটি দিয়েছেন তা আমাদের বুকে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি হয়ে থাকবে।
তবে সবচে’ আশার কথা, কোরিয়া ও জাপান মাঠের খেলা দিয়েই শুধু মুগ্ধ করেনি, আয়োজক হিসেবেও তাদের পারদর্শিতা সবাইকে অবাক করেছে। কোনো রকম অঘটন ছাড়াই বৈরী এই দুই প্রতিবেশী যেভাবে পরস্পরের হাতে হাত মিলিয়ে বিশ্বকাপের সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আয়োজন করেছে, তাতে এশিয়বাসী হিসেবে আমাদেরও গৌরব বেড়েছে। তবে বিশ্বকাপের আলোকে আমরা যখন আমাদের ফুটবলের দিকে তাকাই, তখন দারুণভাবে হতাশ হতে হয়। কেননা, এবারের ‘বিশ্বকাপের বিস্ময়’ কোরিয়ার সঙ্গে আমাদের ফুটবলের বন্ধন দীর্ঘদিনের। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে কোরিয়া এ অঞ্চলে খেলতে আসে। এই আশির দশক অব্দি তাদের সঙ্গে আমাদের ফুটবলের খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। কিন্তু বর্তমানে দু’দেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে দুস্তর ব্যবধান। আমরা ক্রমান¦য়ে পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্বকাপ যায়, বিশ্বকাপ আসে। আমরা দূরের বাসিন্দা হয়ে তা উপভোগ করছি সমঝদার দর্শক হিসেবে। এটাই বুঝি আমাদের নিয়তি! আমরা কি কখনো ঘুরে দাঁড়াবো না? নিশ্চয়ই একদিন দাঁড়াবো। কিন্তু সেই দিনটি কবে আসবে?
ক্রীড়াজগত : ১ জুলাই ২০০২
বিষয় : অন্যান্য
তবুও লিখে যেতে হবে
একটা স্বপ্ন ও আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ছিলাম ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখিতে। অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে কেন জানি না, লেখালেখিতে এখন আর আগের মতো উচ্ছ্বাস খুঁজে পাই না। লিখতে গেলে কলমের ডগায় এসে ভর করে একরাশ আলস্য। একটি প্রশ্ন এসে করোটিতে ধাক্কা মারে অনবরতÑ লেখালেখি করে কি আদৌ কিছু হবে? তখন এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না। বরং বুকের মাঝে অনুভব করি ব্যর্থতার জ্বালা।
আদতে দীর্ঘদিন লেখালেখি করে কী দেশের খেলাধুলার সার্বিক অবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? নাকি আমরা ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই কম-বেশি ঘুরপাক খাচ্ছি একটি বৃত্তের মাঝে? আমার তো মনে হয়Ñ আমরা ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরা যেমন একই কথামালার পুনরাবৃত্তি করে চলেছি, তেমনি ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকরা জ্বালাতে পারছেন না আশার আলো। তাহলে কেন এই মিছে ‘ধূলো-খেলা’? যারা শত প্রতিকূলতার মাঝে আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে চান, তাদের কাছে আমার কথাগুলো চরম হতাশাব্যঞ্জক মনে হবে। কিন্তু তাতে প্রকৃত সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আসলে আমরা এমন একটা রহস্যময় বাহনের আরোহী, যেটা সারা রাত চলার পরও দাঁড়িয়ে আছে মাঝ দরিয়ায়। হয়তো নদীর জোয়ার-ভাটার অবস্থানের তারতম্য ঘটছে; কিন্তু এগিয়ে যেতে পারছে না সামনে। যেন এক গোলক ধাঁধায় আটকা পড়েছে। আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সামগ্রিক দৃশ্যপটও অনুরূপ। স্বাধীনতা-উত্তর দু’দশক ইতোমধ্যে পেরিয়ে এসেছি আমরা। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের যেদিকে দৃষ্টিপাত করি না কেন, চোখে ভেসে ওঠে মরুভূমির ধু-ধু শূন্যতা। এর মাঝে ছিটেফোঁটা সবুজ দৃশ্যমান হলেও তা মোটেও আশা জাগানিয়া নয়। দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদ যেন পথ হারিয়ে ফেলেছেন। বক্সার মোশাররফ হোসেন ১৯৮৬ সালে এশিয়ান গেমসে লাইট হেভিওয়েট বিভাগে ব্রোঞ্জপদক পেয়ে ভীতু বাঙালির বদনাম ঘুচাতে কিছুটা সক্ষম হয়েছিলেন। এটা অবশ্য তেমন কলকে পাওয়ার মতো সাফল্য নয়। এরপর বড় সাফল্য বলতে দু’শুটারের বিস্ময়কর কৃতিত্ব। ১৯৯০ সালে কমনওয়েলথ গেমসে শুটার আতিকুর রহমান ও আব্দুর সাত্তার নিনি ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের দ্বৈত ইভেন্টে স্বর্ণপদক জিতে আমাদের বুকটাকে যেভাবে আকাশের মতো করে দিয়েছিলেন, তাতে আমরা দারুণভাবে আশাবাদী হয়ে উঠি। কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই। কিছুটা বুদ্বুদ সৃষ্টি করে সব যেন মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়। দেশের খেলাধুলার মানচিত্রে এছাড়া আছেই বা কি! সুরিনামের সাঁতারু অ্যান্থনি নেস্টির মতো এমন কেউ কি আছেন, যাকে নিয়ে আমরা সারা জীবন গর্ব করতে পারি? না, তেমন কারো দেখা এখন পর্যন্ত আমরা পেলাম না। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াবার সম্ভাবনা না হয় সুদূর পরাহত, তাই বলে আঞ্চলিক পর্যায়ে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলোÑ আমাদের কাছে ‘অলিম্পিক’ হিসেবে খ্যাত সাফ গেমসেও আমাদের অবস্থান খুবই নাজুক। গর্ব এটুকু যে, মালদ্বীপ ও ভুটানকে এখনও পেছনে রাখতে পেরেছি। কিন্তু ফুটবলেও মালদ্বীপ আমাদের টেক্কা দিয়েছে। এই যদি খেলাধুলার সামগ্রিক চিত্র হয়, তাহলে আমরা যাবো কোথায়? যেখানে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি, সেখানে আমাদের ভবিষ্যতই বা কী?
এদ্দিন খেলাধুলায় আমাদের ব্যর্থতার একটা সান্ত¡না ছিলো স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় এমন হবেই। কিন্তু বছর দুয়েক হলো আমরা প্রত্যাবর্তন করেছি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়। এ সময় কি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে আশানুরূপ কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে। এরও কোনো ইতিবাচক জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এই প্রথম ক্রীড়াক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। সঙ্গত কারণে তার কাছে ক্রীড়ামোদীদের চাহিদা ও প্রত্যাশা অনেকখানি। তিনি কি পেরেছেন প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে? বরং অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছেÑ ক্রীড়াঙ্গন এখন ‘সংকটকালীন অবস্থা’ অতিক্রম করছে। সবক্ষেত্রেই বিরাজ করছে স্থবিরতা। কোথাও কোনো আশা নেই। সবাই যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এমন অবস্থা অতীতে আর কখনো সৃষ্টি হয়নি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক হলোÑ সর্বত্র গণতন্ত্রের অনুশীলন। কিন্তু গভীর ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছেÑ ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অপরিসীম কুণ্ঠা। এর কোনো বাস্তব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ ক্রীড়ামোদীদের দাবিমাফিক ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরা ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচন দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করে আসছেন। কিন্তু তাদের সব লেখাই যাচ্ছে বিফলে। তাহলে লেখালেখির আর কী মূল্য আছে? অনর্থক কাগজ-কলমের অপচয় নয় কী? নিবন্ধটির এখানে সমাপ্তি টানতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। আশা নিয়ে বেঁচে থাকে মানুষ। স্বপ্ন দেখে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। আমরাও আশাবাদী একদিন কেউ না কেউ দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদ, শুটার আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি এবং বক্সার মোশাররফ হোসেনকে অতিক্রম করে ছিনিয়ে আনবে বিজয়ের মালা। ক্রীড়াঙ্গনও বিকশিত হবে গণতন্ত্রের ছোঁয়ায়। এই বদ্ধ জলাশয় আর থাকবে না। আন্তর্জাতিক খ্যাতির আলোয় ভেসে উঠবে বাংলাদেশ। আমরা ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরা তখন আর গাইবো না হতাশার গান। আমাদের কলম মুখরিত হয়ে উঠবে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। সেই সুখের দিনের প্রত্যাশায় আমাদের অবশ্যই লিখে যেতে হবে। কিন্তু কথা হলোÑ সেদিন আসবে কবে?
পাক্ষিক ক্রীড়ালোক : ১-১৫ ডিসেম্বর ১৯৯২
চাই পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ
খেলাধুলায় বিজয়ী হওয়াটা নিঃসন্দেহে গৌরবেরÑ কিন্তু জরুরি কোনো বিষয় নয়। খেলাধুলার সার কথা হচ্ছে, কিশোর ও তরুণদের শারীরিক ও মানসিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ। কেননা, দুর্বল ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্য জাতি গঠনের অন্তরায়। যে কোনো দেশের জনগণের শারীরিক মানচিত্র দেখে সে দেশ সম্পর্কে অনেকটা আঁচ করা যায়। খেলাধুলায় অগ্রসর দেশগুলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও স্বনির্ভর ও উন্নত। উন্নত দেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিক সচ্ছল জীবনের পাশাপাশি সুস্থ ও সবল দেহের অধিকারী। রোগ-তাপ-শোক তাদেরকে সহজে স্পর্শ করতে পারে না। সে কারণে তাদের গড় আয়ুও বেশি। এসব দেশে সরকারকে চিকিৎসা খাতে তেমন অর্থ ব্যয় করতে হয় না। অথচ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে এর বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং অবস্থা অতিমাত্রায় নাজুক।
দেশ ও জাতি গঠনের স্বার্থে খেলাধুলা কিংবা শরীরচর্চার ব্যাপক বিস্তৃতির প্রয়োজন। আর এর অন্যতম বাহন হচ্ছে পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ কিংবা উন্মুক্ত চত্বর। কিন্তু সারা দেশেরই খোলা মাঠ দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে উঠছে। বিশেষত ক্রমবর্ধমান রাজধানী ঢাকা ক্রমান¦য়ে ইট-পাথর, লোহা-লক্কড়, বালু-সিমেন্টের ‘প্রাণহীন’ অরণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নগর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল বায়ু, নির্জন প্রান্তর, নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও খোলা মাঠ। অথচ দু’দশক আগেও পরিস্থিতি এমন নাজুক ছিল না। তখন খেলার মাঠ কিংবা খোলা চত্বর ছাড়া কোনো পাড়া, মহল্লা, জনপদ কল্পনা করা যেতো না। এসব মাঠ, প্রান্তর শিশু-কিশোর-তরুণদের কলকাকলিতে মেতে থাকতো। প্রতিদিন সকাল-বিকাল কোনো না কোনো খেলায় মাঠগুলো ভরপুর হয়ে উঠতো। আর আজ ভোজবাজির মতো মাঠগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় তো দূরে থাক, জাতীয় পর্যায়েও পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ নেই। বাংলাদেশে প্রায় ৩০টির মতো ক্রীড়া ফেডারেশন থাকলেও তাদের অধিকাংশেরই নিজস্ব মাঠ কিংবা জিমন্যাসিয়াম নেই। অন্যান্য খেলাধুলার কথা বাদ দিলেও মাঠের অভাবে বাঙালির প্রাণপ্রিয় খেলা ফুটবল নির্বাসনে যেতে বসেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নিজস্ব কোনো মাঠ নেই। অন্যের ওপর নির্ভর করে সারা বছর তাদের কার্যক্রম চালাতে হয়। এমনকি জাতীয় দলের অনুশীলনের জন্য অনেক সময় মাঠ পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। যখন যেখানে সুযোগ পাওয়া যায়, সেখানেই প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করা হয়। মাঠের স্বল্পতার কারণে প্রায়শঃই ঘরোয়া ফুটবল বন্ধ রেখে জাতীয় দলের অনুশীলন চালাতে হয়। সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লীগ যা হোক নিয়মিত অনুষ্ঠিত হলেও দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ ও পাইওনিয়ার লীগ যথাসময়ে আয়োজন ও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। মাঠ সমস্যাই এর প্রধান কারণ। ঢাকার সিনিয়র, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ ও পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে সব মিলিয়ে ১৪০ থেকে ১৫০টি দল। এর মধ্যে ৮/১০টি কাবের নিজস্ব মাঠ রয়েছে। সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লীগের আবাহনী, রহমতগঞ্জ, ইস্টএন্ড, ধানমন্ডি এবং দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের আদমজী, বিজি প্রেস, সিটি কাব ছাড়া আর কোনো দলের নিজস্ব মাঠ নেই। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ছোট ছোট কাবের কথা ভাবাই যায় না।
এ কারণে কাবগুলোকে বিভিন্ন সংস্থার মাঠ ভাড়া নিয়ে কিংবা দূর-দূরান্তে গিয়ে প্র্যাকটিস করতে হয়। এমনিতেই কাবগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা আশানুরূপ নয়। কাব চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মাঠ সমস্যা তাদের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া স্টেডিয়াম সংলগ্ন কাব মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ারী, ওয়ান্ডারার্স, আজাদ স্পোর্টিং, দিলকুশাকে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে ওসমানী উদ্যানে সংকুলান করা হয়। প্রথমত এতেও কাবগুলোর মাঠ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। দ্বিতীয়ত কাবগুলোর স্থান সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে। অথচ এই কাবগুলোকে পরিকল্পিত উপায়ে সংকুলান করা যেতো।
বড় কাবগুলো যেখানে মাঠ সমস্যায় জর্জরিত, সেখানে ছোট ছোট কাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চরণই ভরসাÑ ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট সে তরী’। কাবগুলো না হয় একটু দূরের ব্যাপার। খেলাধুলার সূতিকাগার স্কুল-কলেজেরও মাঠ সমস্যা প্রকট। অতীতের স্কুল-কলেজগুলোতে কিছু কিছু খেলার মাঠ থাকলেও বর্তমানে নতুন করে যেসব স্কুল-কলেজ গড়ে উঠছে, তার অধিকাংশেরই কোনো খেলার মাঠ নেই। বিশেষত আজকাল বেনিয়া মনোভাব নিয়ে যারা স্কুল-কলেজ গড়ে তুলছেন, তারা খেলার মাঠের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। কয়েকটি কাস রুম থাকলেই হলো। তাতে গাদাগাদি করে দিনের পর দিন ছাত্র-ছাত্রীদের কাস নেয়া হচ্ছে। ফলে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা বদ্ধ পরিবেশে সংকুচিত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। পরবর্তীতে এরা স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে ওঠে। কেননা, শিশু-কিশোর-তরুণদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অস্বাভাবিক পথে। তাছাড়া শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলা থেকে দূরে রাখা হলে পরে আর তারা এর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে না। যে কারণে আজ মাস্তানী, সংঘর্ষ, হত্যা, মাদকাসক্তের সংখ্যা ভয়ানক বেড়ে গেছে। তরুণ, যুবকরা খেলা দেখার চেয়ে ভিসিআরে ‘নীল ছবি’তে দংশিত হতে ভালবাসে। এমনিতেই এ দেশে বিনোদনের তেমন পথ খোলা নেই। খেলাধুলাই যেখানে প্রধান ভরসা, সেখানে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত চত্বর ক্রমান¦য়ে সংকুচিত হয়ে পড়ায় মানুষের মূল্যবোধগুলো ভেঙে পড়ছে। নিষিদ্ধ পথ হয়ে উঠছে অবারিত।
অবশ্য একদিনেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। জনসংখ্যার চাপ দিনে দিনে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। এখন আর কেউ পতিত জমি ফেলে রাখতে চায় না। না সরকার, না জনগণ। আগের দিনে বিশাল এলাকা নিয়ে বাড়িঘর বানানো হতো। এসব বাড়িঘরে থাকতো রুচি-সৌন্দর্যের প্রতিফলন। থাকতো নির্মল বায়ু, গাছ-গাছালি আর ছেলেমেয়েদের খেলার জন্য আঙিনা। কিন্তু আধুনিক জীবনের জটিলতায় মানুষের সেই রুচি ও সৌন্দর্যবোধ ঝরে যাচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা এখন ঘরে-বাইরের গুমোট পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে।
মানুষের চাহিদার কারণে বাসস্থান ও ফসলি জমির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেলেও তাতে কোনো পরিকল্পনার ছাপ থাকছে না। ফলে যেখানে-সেখানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি। যে কারণে হারিয়ে যাচ্ছে খোলা মাঠ, শূন্য প্রান্তর। তাছাড়া রুচি, সৌন্দর্য, নান্দনিক বোধ ও স্থাপত্য-রীতি অনুসরণ না করায় নগরায়নের নামে জঞ্জালের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ হয়ে পড়ছে দূষিত। বেশ কিছুদিন আগে ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকৌশল বিভাগ আয়োজিত একটি সেমিনারের অভিমত এমনÑ ‘বাংলাদেশের রাজধানীতে গগনচুম্বী অফিস ভবন, বিপণন কেন্দ্র, কল-কারখানা ও ভবনাদি দ্রুত প্রসারের ফলে নগরীর স্থানে স্থানে শ্বাসরুদ্ধকর তপ্ত অচলায়তনের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।’ সেমিনারের দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞরা প্রাকৃতিক আলো-হাওয়ায় অবারিত আনাগোনায় সুযোগ রেখে সামঞ্জস্য স্থাপত্যরীতি উদ্ভাবনের আহ্বান জানান। পারিপার্শ্বিকতার তুলনায় ঢাকা নগরীর ভবনাদির ভেতরে তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় স্থানে স্থানে এক দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে তারা সতর্ক করে দেন। সেমিনারের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, খোলা মাঠ কিংবা উন্মুক্ত চত্বর নগরায়নের অপরিহার্য অংশ। অথচ বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও তারা বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে না। ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালতের জন্য খোলা মাঠ ও উন্মুক্ত চত্বর হারিয়ে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতার কারণে কিছু কিছু মাঠের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে আউটার স্টেডিয়ামের কথা বলা যায়। আগে যেখানে হাজার হাজার ফুটবলার একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতে পারতো, সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থে স্টেডিয়াম গড়ে তুলে সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্টেডিয়ামটি হকি ফেডারেশনকে দেয়া হলেও সারা বছরই প্রায় শূন্য পড়ে থাকে। তাছাড়া অবস্থানগত ও পরিবেশগত কারণে এই স্টেডিয়ামটির নির্মাণ যথার্থ নয়। গত কয়েক যুগে রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের প্রভাবে নগর পরিকল্পনার সমস্ত ন্যায়-নীতিকে বিসর্জন দিয়ে অসংখ্য খেলার মাঠকে সুপরিকল্পিতভাবে মুছে দেয়া হয়েছে। আজকের আবাহনী মাঠ একসময় উল্লিখিত ব্যক্তিদের কোপানলে পড়েছিলো। তৎকালীন ক্রীড়ামোদী তরুণ-যুবকদের প্রতিরোধের কারণে আবাহনী মাঠকে গ্রাস করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সবক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিরোধ গড়ে না তুলতে পারায় খেলার মাঠ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
সাপ্তাহিক ছুটি : সেপ্টেম্বর ১৯৯৫
সেই সুদিনের অপেক্ষায়
প্রকৃত মানুষ হতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রচলিত ধারায় যেমন শিক্ষিত হওয়া যায় না (অবশ্য ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না), তেমনিভাবে মাঠ ছাড়া খেলাধুলার কথাও ভাবা যায় না। আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করছি, যেখানে পড়ালেখা করতে চাইলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্রতুলতার কারণে ধুঁকতে হয়, খেলতে চাইলে মাঠের অভাবে ঘরে বসে থাকতে হয়। অথচ ক্রীড়াক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ সাফল্য লাভের স্বপ্ন দেখি। এ জন্য অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা তো দূরে থাকুক, পর্যাপ্ত মাঠ না থাকায় খেলাধুলাই হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। মাঠই যদি না থাকে, তাহলে খেলাধুলায় অগ্রসর হবো কীভাবে?
দেশ ও জাতি গঠনের স্বার্থে খেলাধুলা কিংবা শরীরচর্চার ব্যাপক বিস্তৃতির প্রয়োজন। আর খেলাধুলার অন্যতম বাহন হচ্ছে পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ কিংবা উন্মুক্ত চত্বর। কিন্তু সারা দেশেই খোলা মাঠ দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে উঠছে। বিশেষত ক্রমবর্ধিষ্ণু রাজধানী ঢাকা ক্রমান¦য়ে ইট-পাথর, লোহা-লক্কড়, বালু-সিমেন্টের ‘প্রাণহীন’ অরণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নগর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল বায়ু, নির্জন প্রান্তর, নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং খোলা মাঠ। অথচ দু’দশক আগেও পরিস্থিতি এমন নাজুক ছিল না। তখন খেলার মাঠ কিংবা খোলা চত্বর ছাড়া কোনো পাড়া, মহল্লা, জনপদ কল্পনা করা যেতো না। এসব মাঠ, প্রান্তর শিশু-কিশোর-তরুণদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকতো। আর আজ ভোজবাজির মতো মাঠগুলো যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে। নগর পরিকল্পনার নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে ঘর-বাড়ি তৈরি করার কারণেই এমনটি হচ্ছে।
কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা বদ্ধ পরিবেশে সংকুচিত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। এদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অস্বাভাবিক পথে। তাছাড়া শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলার সুযোগ না পেলে পরবর্তীতে তারা এর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এমনিতেই দেশে বিনোদনের তেমন পথ খোলা নেই। খেলাধুলাই যেখানে প্রধান অবলম্বন, সেখানে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত চত্বর ক্রমান¦য়ে সীমিত হয়ে পড়ায় নিজেকে মেলে ধরতে না পারায় ভঙে পড়ছে মানুষের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ঐতিহ্য।
তবে আশার কথা, বর্তমান সরকার খেলাধুলার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। খেলাধুলাকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে খেলার মাঠ তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। তারই আলোকে ভূমি মন্ত্রণালয় জেলা, থানা ও ইউনিয়ন প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। অচিরেই হয়তো দেশজুড়ে অসংখ্য মাঠ আগামী দিনের স্বপ্ন আর সাফল্যের অভিযাত্রীদের পদচারণায় প্রাণময় হয়ে উঠবে। সারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সূচিত হবে নতুন দিগন্ত। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায়।
ক্রীড়াজগত : ১ জুন ১৯৯৭
গুডবাই ‘কিং অব চ্যানেল’
অনেকটা চুপিসারে চলে গেলেন ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী সাঁতারু ব্রজেন দাশ। আমরা হারালাম একজন কিংবদন্তীসম ব্যক্তিত্বকে। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির গর্ব। বাঙালির স্বপ্নের অন্যতম রূপকার।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল উপেক্ষিত। নিজেদের মেধা ও প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ বলতে গেলে ছিল না। শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণে বাঙালিরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বঞ্চনা আর আশা ভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়ে বঙ্গোপসাগর বিধৌত আজকের বাংলাদেশ। ব্রজেন দাশকেও স্পর্শ করে এই বঞ্চনা। ১৯৫৫ সালে সমগ্র পাকিস্তানে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ¡ী সাঁতারু। সঙ্গত কারণে পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসে তার প্রতিনিধিত্ব করার কথা। অথচ তাকে অলিম্পিকগামী পাকিস্তান দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তার একমাত্র অপরাধ, তিনি বাঙালি। এই উপেক্ষার মোক্ষম জবাব দেয়ার উপায় খুঁজতে থাকে ব্রজেন দাশের বিদ্রোহী মন। সবাইকে চমকে দেয়ার জন্য বেছে নেন অসম্ভবের পথ। প্রথম এশীয় হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে তাকে উপেক্ষা করার যুৎসই জবাব দেন তিনি। একইসঙ্গে উজ্জ্বল করেন বাঙালির মুখ। চ্যানেল বিজয় ছাড়াও ব্রজেন দাশের মুকুটে শোভা পায় তিনটি বিশ্বরেকর্ড। ১৯৬১ সালে গড়া বিশ্বরেকর্ড তিনটি হচ্ছেÑ ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী দ্রুততম ব্যক্তি, ছয়বার চ্যানেল বিজয়ী এবং একইদিনে একই সময়ে দুটি বিশ্বরেকর্ডের স্রষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্রজেন দাশকে বিশেষ ট্রফি ‘কিং অব চ্যানেল’ প্রদান করে যুক্তরাজ্য সুইমিং এসোসিয়েশন।
বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, ব্রজেন দাশ তাদের অন্যতম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘. . . . . . ব্রজেন দাশও বাঙালি জাতিকে একটি পরিচয় দিয়েছিলেন।’ এই পরিচয় হলোÑ ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।
এ কারণে ব্রজেন দাশের নাম শুধু ক্রীড়াঙ্গনে নয়, বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ‘কিং অব চ্যানেল’ ব্রজেন দাশের মৃত্যুতে একটি জীবন্ত কিংবদন্তীর অবসান হলেও তার কিংবদন্তীর কথা স্মরিত হবে চিরকাল।
ক্রীড়াজগত : ১৬ জুন ১৯৯৮
ক্রীড়াবিষয়ক প্রকাশনা
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে শোকের, গৌরবের ও মর্যাদার। পৃথিবীতে মাতৃভাষার দাবিতে আÍত্যাগের ইতিহাস একমাত্র বাঙালির। এ আমাদের বড় অহঙ্কার। মহান ভাষা শহীদদের আÍোৎসর্গের দিনটি এখন আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এবারই প্রথম আমাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে দেশে দেশে স্মরিত হবে আমাদের আÍত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস।
ভাষা আন্দোলনের মহান শহীদদের অমর একুশে উদযাপনের আরেক গৌরবময় ঐতিহ্য বাংলা একাডেমির বইমেলা। এই মেলা আমাদের মেধা, মনন ও সৃজনশীল চর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ। একে কেন্দ্র করে বয়ে যায় সৃষ্টিশীলতার জোয়ার। নানারকম প্রকাশনায় জমজমাট হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমীর বইমেলা। বাংলা ভাষায় এখন বিজ্ঞান ও কম্পিউটার চর্চা পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যিÑ উপেক্ষিত হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন। ক্রীড়াবিষয়ক প্রকাশনার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।
ক্রীড়া সাহিত্য এখন আর অনাদৃত কোনো বিষয় নয়। বরং সাহিত্যের অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলা স্বীকৃতি পেয়েছে। নেভিল কার্ডাস ক্রীড়া সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। বাংলা ভাষায়ও যে ক্রীড়া সাহিত্য চর্চা সম্ভব, তার অনুপম দৃষ্টান্ত রেখেছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোলকাতার শঙ্করী প্রসাদ বসু, মতি নন্দী, রূপক সাহা প্রমুখ। এদের পাশাপাশি খেলাধুলাকে সর্বজনগ্রাহ্য করার জন্য বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা হচ্ছে বিভিন্ন আইন-কানুনের বই।
অথচ আমাদের দেশ ক্রীড়া প্রকাশনায় যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। এ দেশের মানুষের খেলাধুলার প্রতি যে অপরিসীম আগ্রহ ও ভালবাসা, তার ন্যূনতম প্রতিফলন ক্রীড়া প্রকাশনায় ঘটে না। আমাদের দেশেও প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক আছেন। তাদের লেখা বিভিন্ন দৈনিক ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠকরা তাদের লেখা সাগ্রহে পাঠ করে থাকেন। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারা গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারছেন না। অবশ্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু কিছু বই বের হলেও তার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।
এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক পুরনো হলেও তা সংকলিত না হওয়ায় ক্রমান¦য়ে হারিয়ে যাচ্ছে। শতবর্ষী কাব ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের ইতিহাস, অতীতের খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের কীর্তি কালের মরীচিকায় আড়াল পড়ে যাচ্ছে। এমনকি এ দেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তা এবং হালের ক্রিকেটের সাফল্য ও জোয়ার বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে না। আমরা যদি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অতীতকে হারিয়ে ফেলি, তা হবে দুঃখজনক ঘটনা। কেননা, অতীতের পথ বেয়েই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এমন নয় যে, আমাদের দেশে ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থের পাঠক চাহিদা নেই। বিশেষ করে এ দেশের গরিষ্ঠ তারুণ্যের একটি প্রিয় বিষয় খেলাধুলা। কিন্তু আগ্রহের তুলনায় সরবরাহ না থাকায় তারা অতিমাত্রায় বিদেশি খেলা, খেলোয়াড় ও গ্রন্থের প্রতি ঝুঁকছে। এর ফলে আমাদের খেলা ও খেলোয়াড়রা অবহেলিত হচ্ছেন। এটা আমাদের দেশীয় ক্রীড়াঙ্গনের জন্য আশাপ্রদ ঘটনা নয়।
এ দেশের খেলাধুলার প্রসার ও মানোন্নয়নে ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থ যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে এখনই আমাদের নজর দেয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় যদি সবরকম প্রকাশনা হতে পারে, তাহলে আমরা কেন ক্রীড়াবিষয়ক প্রকাশনায় পিছিয়ে থাকবো?
ক্রীড়াজগত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০০
স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
এখন স্টেডিয়াম পাড়ায় গেলে বড্ড কষ্ট হয়। আগের মত আর প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায় না। সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে। অবশ্য সময় নামক চোরা স্রোতে ভেসে যায় প্রতিদিনের দৃশ্যপট। অমলিন থাকে না কোনো কিছুই। তারপরেও স্টেডিয়াম এলাকার একটা প্রাণোচ্ছ্বল দৃশ্যপট আছে, যা অনেকটা চিরন্তন। এর মেজাজ ও মর্যাদা সম্পূর্ণ আলাদা। হরেক রকম খেলাধুলা, হই-হুল্লোড়, তুমুল আড্ডাবাজি এ এলাকার এক অন্তরঙ্গ প্রতিচ্ছবি।
সন্ধ্যার পর স্টেডিয়াম চত্বরে পা রাখলে দেখতে পাওয়া যায় ছোট ছোট জটলা। জটলাকারীদের গুলতানি মারা ছাড়া দৃশ্যত কোনো কাজ নেই। হয়ত কারো ঘরে চুলোও ঠিকমত জ্বলে না কিংবা জীবনে তাদের নানা জটিলতা, তবুও ঘর বা পারিবারিক জীবন তাকে আটকে রাখতে পারে না। সবকিছু ভুলে স্টেডিয়ামের আড্ডায় তার শামিল হওয়া চাই। এ ব্যাপারে কোন সংশয় নেই যে, এদের সকলেই ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ। খেলা দেখা, দেশ-বিদেশের খেলাধুলার খোঁজ-খবর রাখা এবং তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে ওঠা এদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। তাদের জীবনের অধিকাংশ বেলা খেলায় খেলায় হলো সারা। এদের অনুপস্থিতিতে স্টেডিয়াম চত্বর মনে হয় নি®প্রাণ।
দিনের পর দিন স্টেডিয়াম চত্বরে আড্ডাবাজদের দেখে আসছেন সবাই। বিকেলের পর জমজমাট হয়ে ওঠাটা স্টেডিয়াম এলাকার নিত্যদিনের ছবি। অফিস ফেরতা কর্মজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, বেকার যুবকসহ নানা পেশার নানা বয়েসী মানুষ, যাদের রক্তে ঢুকে গেছে খেলাধুলার বীজ, তাদের অন্ততঃ প্রতিদিন একবার স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুঁ না মারতে পারলে পেটের ভাত হজম হয় না। স্টেডিয়ামে যদি কোনো খেলা থাকে তাহলে খেলার পর জমে ওঠে আড্ডা। খেলার হারজিত নিয়েই আড্ডা সরগরম হয়ে ওঠে। এরপর কাবগুলোর হাড়ির খবর আর খেলোয়াড়দের নাড়ি-নক্ষত্র কে কতটা জানেন, তা নিয়ে চলে মত-বিনিময়। যেসব খবরা-খবর অনেক সাংবাদিকও রাখেন না। এসব খবরে এদের কারো কোনো উপকার না হলেও তারা এক ধরনের আÍতৃপ্তি পান। নিজের জীবনে এরা ‘জিরো’ হলেও ক্রীড়াঙ্গনের হিরোদের মাঝে খুঁজে নেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি। প্রিয় কাব আর প্রিয় খেলোয়াড়ের সাফল্যে তারা হয়ে ওঠেন আনন্দে উচ্ছল। মনে করেন, এটাই তাদের নিজের সাফল্য। এসব আড্ডাবাজের অধিকাংশই কাব সমর্থক। স্টেডিয়াম চত্বরের জটলাগুলোও কাবকেন্দ্রিক। কাবই তাদের ঘর, কাবই তাদের সংসার। তারা নিজেদের এই ঘর-সংসারের জিম্মাদার মনে করেন। যে কারণে নিজের ঘরের প্রতি তারা যতটা না মনোযোগী, তার চেয়ে বেশি আপন মনে করেন কাবকে। কাবকে ঘিরেই তাদের যাবতীয় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। এসব নিয়েই তারা আড্ডায় আড্ডায় কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবনের মূল্যবান দিনগুলো। এ জন্য তাদের একটুও আফসোস নেই। কেননা তাদের নেই কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা। যেখানে কোনো
স্বার্থ থাকে না, সেখানে ভালবাসা হয় গভীর। এই ভালবাসা নিয়েই তাদের প্রতিদিনের জীবন।
এ তো গেল একদিক। আরেক ধরনের আড্ডা হয় স্টেডিয়াম এলাকার বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন আর রেস্তোরাঁগুলোকে ঘিরে। সন্ধ্যার রঙ যত গাঢ় হয়, ততই মশগুল হয় এই আড্ডাগুলো। নানা কিসিমের সংগঠক, সাবেক ও বর্তমান ক্রীড়াবিদ, হালের খেলোয়াড়, সাংবাদিক, ব্যর্থ ক্রীড়াবিদ ও গভীর ক্রীড়ানুরাগীরা এই আড্ডায় সমবেত হন। উদ্দেশ্য একটাইÑ খেলাধুলা। কখনো-সখনো অন্য বিষয় ওঠে এলেও তা খুব একটা স্থায়ী হয় না। এ আড্ডার মানুষগুলো একটু অন্য রকম। তারাও কোনো কিছু পাওয়ার আশায় স্টেডিয়ামে আসেন না। আসেন প্রাণের রসদ যোগাতে। তবে তাদের প্রতিদিনের চিন্তা-ভাবনায় খেলাধুলা। বিনোদনের আরো অনেক দুয়ার খোলা থাকলেও খেলাধুলাই তাদের অষ্ট প্রহরের স্বপ্ন। এই দলের বড় অংশ ক্রীড়া সংগঠক। কী করে দেশের খেলাধুলার মঙ্গল হয় কিংবা নিজের কাব কীভাবে সাফল্য পেতে পারে, তা নিয়ে তাদের অন্তহীন গবেষণা। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেই তারা ব্যস্ত। খেয়ে না খেয়ে তারা মুখ বুঁজে স্টেডিয়ামে বা কাবে পড়ে থাকেন। সংসার কীভাবে চলছেÑ সেটার তারা খোঁজও রাখেন না। নিবেদিতপ্রাণ এই ক্রীড়া সংগঠকরা বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাদের জীবনে কোনো উজ্জ্বলতা নেই। মঞ্চের নেপথ্যের কুশীলবের মত তাদের জীবন। তারা তারকা তৈরি করেন এবং তারকাদের পরিচালনা করেন, এটাই তাদের জীবনের আনন্দ। তাদের কেউ চিনুক কিংবা না চিনুক, তাতে কিছু আসে-যায় না। তবে স্টেডিয়াম এলাকার মূল সুতোটা তাদের হাতেই ধরা থাকে। বলা যায়, এই আড্ডাবাজরা দেশের খেলাধুলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। যে কারণে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই তারা ছুটে যান স্টেডিয়াম এলাকায়।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় গোড়াপত্তন হয় ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামের। আর তখন থেকেই স্টেডিয়ামকে ঘিরে সূত্রপাত হয় আড্ডার। ধীরে ধীরে আড্ডাগুলো জমজমাট হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে স্টেডিয়াম এলাকায় কাব গড়ে উঠার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সংখ্যা ক্রমান¦য়ে বাড়তে থাকলে আড্ডাগুলো সমৃদ্ধ হতে থাকে। পঞ্চাশ দশক থেকে এখনো স্টেডিয়াম এলাকায় আড্ডার মৌতাতে মেতে আছেনÑ এমন লোকের সংখ্যাও বিরল নয়। খেলাধুলা নিয়ে আড্ডা তাদের প্রধান বিনোদন। এ আড্ডায় পাওয়া যায় দেশের খেলাধুলার অনেক অলিখিত ইতিহাস আর টুকরো টুকরো মজার স্মৃতি। বলা যায়, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম আকর্ষণ এই আড্ডা।
আশির দশকের শেষ দিকে স্টেডিয়াম অঙ্গন থেকে কাবগুলো সরিয়ে নেয়া হয়। এ সময় কাবকেন্দ্রিক আড্ডাগুলো কিছুটা হলেও হোঁচট খায়। বিশেষত মোহামেডান স্পোর্টিং কাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, আজাদ স্পোর্টিং, ওয়ারীর মত জনপ্রিয় ও বনেদি কাবগুলো সরে যাওয়ায় স্টেডিয়াম এলাকা অনেকটা প্রাণহীন হয়ে যায়। তবে আড্ডা থেমে যায়নি। সংখ্যা হ্রাস পেলেও আড্ডার ধারা অব্যাহত থাকে। কেননা, জাতীয় স্টেডিয়ামে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সকলকে মাতিয়ে রাখে। তবে স্টেডিয়াম এলাকার যে কোন আড্ডারই প্রাণ হলো ফুটবল। ফুটবল এমন এক খেলা, যার স্বপ্ন দোলায় দোলে সারা দেশ। তাই ফুটবল নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই। প্রতিটি আড্ডাকে সরগরম করে রাখতো ফুটবল।
নব্বই দশকের শেষে এসে ম্রিয়মান হয়ে যায় আড্ডাগুলো। এখন স্টেডিয়াম এলাকায় আড্ডাবাজদের তেমনভাবে চোখে পড়ে না। প্রায় চার দশকের ঐতিহ্য যে আড্ডার, তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এর কারণ ফুটবল। বছর দু’য়েক হলো ফুটবলবিহীন হয়ে পড়েছে ঢাকা নগরী। যে কারণে ফুটবল ক্রেজ হ্রাস পেযেছে অনেকখানি। প্রথমত নিয়মিত ফুটবল আয়োজিত না হওয়া। দ্বিতীয়ত এই শূন্যতায় ক্রিকেটের আড়ালে পড়ে গেছে ফুটবল। ক্রিকেট জনপ্রিয় হলেও ফুটবলের স্থান দখল করতে পারেনি। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা একটা নির্দিষ্ট বলয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফুটবল সর্বজনপ্রিয়। ফুটবল সহজেই সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। যে কেউ ফুটবল নিয়ে সহজেই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। ক্রিকেট নিয়ে সেটি সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণে ফুটবলের অনুপস্থিতিতে স্টেডিয়াম থেকে আড্ডাগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন স্টেডিয়াম এলাকা ঝকঝক করলেও আড্ডা না থাকায় প্রাণের আমেজ পাওয়া যায় না। তবে এই আড্ডাগুলো ফের না জমে উঠলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনও অনুজ্জ্বল থেকে যাবে। আর দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে উজ্জ্বলতা দিতে পারে ফুটবল। ফুটবল ফিরে আসুক তার স্বরূপে, সেই সঙ্গে স্টেডিয়াম এলাকার চিরপরিচিত আড্ডাগুলো হয়ে উঠুক জমজমাট। আমরা সেই আড্ডার প্রতীক্ষায় থাকলাম।
ক্রীড়াজগত : ১ মার্চ ১৯৯৯
খেলাধুলায় মেয়েরা পিছিয়ে কেন
এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে আমরা যখন নারীর চোখে বিশ্ব দেখছি, ঠিক তখন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন কি নারীবিবর্জিত হতে চলেছে? এমনটি বলার কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের উপস্থিতি দারুণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েরা যেখানে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, সেখানে খেলাধুলার প্রতি তারা একদমই আগ্রহ অনুভব করছে না। খেলাধুলার প্রতি এই অনীহার কারণ কি?
ক্রীড়াক্ষেত্রে এ দেশের মেয়েদের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। দেশভাগের পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের সরব পদচারণা। তৎকালীন বিরূপ পরিবেশ, সামাজিক অনুশাসন ও ভ্রƒকুটিকে উপেক্ষা করে মেয়েরা খেলার মাঠে এসেছে। দাপটের সঙ্গে মাঠ মাতিয়েছেন জিনাত আহমেদ, লুৎফুন্নেছা হক বকুল, কাজী জাহেদা আলী, ডলি ক্যাথরিন ক্রুজ, কাজী নাসিমা হামিদ, সুলতানা কামাল, রওশন আরা ছবি, সুফিয়া খাতুন, ইশরাত প্রমুখ। এরা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে খেলার মাঠে মেয়েদের অবস্থানকে সুসংহত করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অনুকূল পরিবেশে মেয়েরা অধিক সংখ্যায় খেলাধুলায় অংশ নেয়। ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের এই রমরমা অবস্থা আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময় রাজিয়া সুলতানা অনু, শামীম আরা টলি, শামীমা সাত্তার মিমু, কামরুন্নেসা লিপি, শর্মিলা রায়ের মতো অ্যাথলেট; রুমানা আহমেদ, কামরুন্নাহার ডানা, মরিয়ম তারেকের মতো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়; মুনিরা রহমান হেলেন, কাজী দিলা, জোবেরা রহমান লিনুর মতো টেবিল টেনিস খেলোয়াড়; খুরশিদা আক্তার খুশী, পারভীন সুলতানা লুসির মতো জিমন্যাস্ট; কামরুন্নার হিরুর মতো জুডোকা; সেতারা, মাহমুদা, শরীফা, ডালিয়ার মতো সাঁতারু; রানী হামিদের মতো দাবাড়ু ক্রীড়া আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে জ্বলেছেন। এরপর থেকে মহিলা ক্রীড়াঙ্গন তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে। অবশ্য এর মাঝে শুটার কাজী শাহানা পারভীন, সাবরিনা সুলতানা; দাবাড়ু শাবানা পারভীন নিপা প্রমুখ মহিলা ক্রীড়াঙ্গনকে উজ্জ্বলতা দিলেও সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। অথচ আগের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা যেমন বেড়েছে, তেমনিভাবে প্রচারের আলোয় নিজেকে প্লাবিত করার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও মেয়েরা যেসব খেলায় সচরাচর অংশ নিয়ে থাকে, সেই অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, সাঁতার, জিমন্যাস্টিক্স, জুডো, দাবা, শুটিংয়ে বলতে গেলে নতুন কোনো মুখ নেই, যাকে নিয়ে গর্ব করা যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই ক্রীড়াঙ্গন মেয়েশূন্য হয়ে পড়বে।
অবশ্য খেলাধুলার প্রতি মেয়েদের ওই অনাগ্রহ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সামগ্রিকভাবে দেশে যে স্খলন ও সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে খেলাধুলা বিচ্ছিন্ন নয়। এখন ছেলেমেয়েরা অবাধে মেলামেশা করলেও মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। যে কারণে নিশ্চিত হয়নি মেয়েদের নিরাপত্তা। মেয়েরা খেলার মাঠে আসতে চাইলেও নোংরা পরিস্থিতির কারণে তারা সরে আসতে বাধ্য হয়। নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠকের অভাবে মেয়েরা এগিয়ে যেতে পারে না। তাছাড়া আগের মতো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খেলাধুলার প্রচলন না থাকায় এবং কাব, ফেডারেশনগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন না করায় খেলোয়াড়ও তৈরি হচ্ছে না। সাধারণত মধ্যবিত্ত, নিু-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে মেয়েরা খেলতে আসে। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অভিভাবকরা মেয়েদের খেলাধুলায় দিতে চান না। কেননা, ক্রীড়ায় সাফল্য পেতে হলে শ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। মেয়েরা এখন আর শারীরিক শ্রম বেশি দিতে রাজি নয়। ইদানীং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার জয়-জয়কার। নাচ, গান, নাটক, মডেলিং করলে খুব দ্রুত গ্ল্যামার ও পরিচিতি পাওয়া যায়। যে জন্য মেয়েরা এর প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকছে। কম-বেশি একটা ধারণা গড়ে উঠেছেÑ খেলাধুলা করলে পড়ালেখার ক্ষতি হয় এবং চেহারার কমনীয়তা নষ্ট হয়। যে কারণে খেলাধুলা আর একবিংশ শতাব্দীর নারীদের প্রলুব্ধ করতে পারছে না।
অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়েরা খেলাধুলায় অংশ নিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। আর আমাদের দেশের মেয়েরা ক্রীড়াক্ষেত্রে ক্রমান¦য়ে পিছিয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় মেয়েদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে মেয়েরা যেখানে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে, সেখানে খেলাধুলায় কেন পিছিয়ে থাকবে? এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মার্চ ২০০০
সিটিয়াস অলটিয়াস ফরটিয়াস
প্রাকৃতিক সম্পদ আর ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে শুরু হয়েছে অন্যরকম এক বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ধ্বংস নয়, সৃষ্টির। এ যুদ্ধ গতি, শক্তি ও দৈর্ঘ্যরে। সৌভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সখ্য, সংহতি ও ভালবাসার। অলিম্পিকের মূলমন্ত্র হলো ‘সিটিয়াস, অলটিয়াস, ফরটিয়াস’। অর্থাৎ আরো দ্রুত, আরো উঁচু, আরো শক্তিশালী। লাতিন এ বাগধারায় উজ্জীবিত হয়ে ক্রীড়ানৈপুণ্যের অবিশ্বাস্য সব নজির স্থাপন করে মর্ত্যলোকের মানুষেরা।
বিশ্বমানবের মহামিলন কেন্দ্র অলিম্পিক গেমস। সেই সুপ্রাচীনকালে গ্রিসের অলিম্পিয়ায় শরীর ও মননচর্চার পাশাপাশি ঐক্য ও সংহতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে অলিম্পিক গেমসের সূচনা হয়। মাঝে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলেও অলিম্পিক তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। বরং ব্যারন দ্য কুবার্তের আধুনিক অলিম্পিকের মর্যাদা, গৌরব, কৌলীন্য ও জৌলুস অনেক বেড়েছে। তাবৎ দুনিয়ার পতাকা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটায় অলিম্পিক গেমস। অবশ্য দুবার বিশ্বযুদ্ধের কারণে আধুনিক অলিম্পিকের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলেও ১৮৯৬ সাল থেকে চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’।
সিডনি অলিম্পিকে ২৮টি খেলায় অংশ নেবে ২০০ দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০,২০০ অ্যাথলেট। সেরা অ্যাথলেটরা নিজেদের নৈপুণ্য মেলে ধরার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। অবশ্য কেউ কেউ এর আগে অলিম্পিকে অংশ নিলেও অধিকাংশ অ্যাথলেট এবারই প্রথম তাদের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাচ্ছেন। পুরনোদের পাশাপাশি নতুন অ্যাথলেটদের কাছে এটা শুধু ক্রীড়া-উৎসব নয়, জীবনযুদ্ধের লড়াই। নিজেকে প্রতিষ্ঠার, নিজের দেশের মর্যাদা রক্ষার তীব্র সংগ্রাম। সিডনি অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও অলিম্পিকের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। অলিম্পিকে নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যৌবনের দূতরা চারটি বছর নিজেদের তৈরি করেন। ‘দুরন্ত যৌবন, অপ্রতিরোধ্য জীবন, অদম্য অস্তিত্ব যেন ক্রীড়াঙ্গনে প্রাণেরই পতাকা তুলে ধরে। দৌড়বাজের দু’খানা ছন্দোবদ্ধ পা যেন হয়ে যায় কবিতা। জিমন্যাস্টিক্সের ভেতর শরীরের সঙ্গীত, হাইজাম্প বা পোলভল্টে যেন পাখি হয়ে উড়ে বেড়ায় অবিশ্বাস্য মানুষেরা। আমাদের দুর্মর কল্পনা বা সীমাবদ্ধ প্রত্যাশার সীমারেখা ভাঙচুর করে আমাদেরই মতো মানুষেরা।’
বর্ণাঢ্যতায় ও ব্যাপকতায় বিশাল অলিম্পিককে ঘিরে কত না অম্ল-মধুর নাটক মঞ্চস্থ হয়। টুকরো টুকরো হাসি-কান্নার কাহিনী গড়ে উঠে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বেদ, রক্ত, পরিশ্রম, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, প্রাপ্তি ও নিরাশা। সৃষ্টি হয় নতুন তারকা। নতুন রেকর্ড। অনেকের স্বপ্ন পূরণ হয়। মুছে যায় রঙিন স্বপ্ন।
আমাদের মত দেশে অলিম্পিক স্বপ্নময় এক ক্রীড়াযজ্ঞ। এ ক্রীড়াযজ্ঞে আমাদের অংশগ্রহণ অনেকটা অতিথির মতো। ‘অলিম্পিক গেমসে বিজয়ী হওয়া নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’ অলিম্পিকের এই মতবাদ আমাদের মতো দেশগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে এবং এটা হুবহু মেনে চলে। এছাড়া কীইবা করার আছে? তবে একেবারে হাল ছেড়ে দেয়াটা যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। কমনওয়েলথ গেমসে আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি শুটিংয়ে স্বর্ণপদক পাবেন কিংবা আমরা এতো শীঘ্র টেস্ট ক্রিকেট খেলবোÑ এটা ছিল আমাদের প্রত্যাশার বাইরে। সিউল অলিম্পিকে সাঁতারের ১০০ মিটার বাটারফাইতে সোনা জিতে অ্যান্থনি নেস্টি চিনিয়ে দেন সুরিনাম নামে একটি দেশ পৃথিবীতে আছে। তাহলে অলিম্পিক গেমসে আমরা কেন হঠাৎ কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করবো না? আজ না হোক, আগামীকালের কাছে সেই প্রত্যাশাটুকু জমা থাকলো।
ক্রীড়াজগত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০০
অলিম্পিকের আনন্দ-বেদনা
বুকের মাঝে একরাশ কান্না নিয়েও ১১০ মিটার হার্ডলসে রুপার পদক জিতেছেন নাইজেরিয়ার গ্লোরি অ্যালেজি। দুর্ঘটনায় হবু বরের মৃত্যু তাকে যথেষ্ট দমিয়ে দিলেও অলিম্পিকের আহ্বানে তিনি সাড়া না দিয়ে পারেননি। এ রকম অসংখ্য আনন্দ-বেদনার ঘটনায় উদ্ভাসিত সিডনি অলিম্পিক। পদক না পেয়েও ঝলমলে একটি নাম এরিক মোসাম্বানি। তিনি শুধু তার দেশ ইকোয়েটোরিয়ান গিনিকে পরিচিত করেননি, পাশাপাশি অলিম্পিকের সুমহান আদর্শকে সমুজ্জ্বল রেখেছেন। ছোট্ট একটি দ্বীপের বাসিন্দা মোসাম্বানির দেশের বড় সুইমিংপুলটির দৈর্ঘ্য মাত্র ২০ মিটার। এ পুলেই চলতি বছরে তার সাঁতারে অভিষেক হয়। যে কারণে অ্যাকুয়াটিক সুইমিং সেন্টারটি তার কাছে অনেকটা ‘সাগরে’ রূপ নেয়। সাঁতারে অনভিজ্ঞ কৃষ্ণাঙ্গ এ যুবকটি একপর্যায়ে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে দর্শকরা তাকে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করলে তিনি অলিম্পিক ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে সাঁতার শেষ করতে সক্ষম হন। কোনো কোনো পরাজয় বিজয়ের চেয়েও মহান। তার চমৎকার দৃষ্টান্ত এরিক মোসাম্বানি। সাঁতার শেষে মোসাম্বানি দর্শকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রতিযোগিতায় পদক জয়ের আশা না থাকা সত্ত্বেও সবার পেছনে থেকেও গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তার যে সর্বাÍক প্রচেষ্টা, এটাই হলো অলিম্পিকের স্পিরিট।
স্বপ্ন পূরণ আর স্বপ্নভঙ্গের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য, ব্যাপক ও বিশাল ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিক গেমস। এবারের অলিম্পিক গেমসে রচিত হয়েছে আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। প্রজ্বলিত হাইটেক মশালের চেয়ে মারিয়ান জোনস, মরিস গ্রিন, ক্যাথি ফ্রিম্যান, মাইকেল জনসনের সাফল্য কোন অংশে অনুজ্জ্বল নয়। গ্রিন-জোনসের দ্রুততম মানব-মানবী হওয়া, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম কোনো আদিবাসী মেয়ে হিসেবে ৪০০ মিটার দৌড়ে ক্যাথি ফ্রিম্যানের স্বর্ণপদক জয়, একই ইভেন্টে মাইকেল জনসনের ইতিহাস গড়া, ম্যারাথনে জাপানের নাওকো তাকাহাসির প্রথম স্বর্ণ জয়, দুই ডাচ সাঁতারু ‘নতুন টারজান’ পিটার ফন ডেন হুগেনব্যান্ড ও ফাইং ডাচ ওয়োম্যান ইঙ্গে ডি ব্রুইনের অভাবিত সাফল্যটা আনন্দের এবং অন্যদিকে বেদনার হলোÑ ফরাসি অ্যাথলেট মেরি হোসে পেরেকের রহস্যময় প্রস্থান এবং ডাক্তারের ভুলে রুমানিয়ার তরুণী জিমন্যাস্ট আন্দ্রিয়া রাদুকানের স্বর্ণপদক হারানো। স্বদেশী কিংবদন্তী নায়িকা নাদিয়া কোমানিচির পর তিনি রুমানিয়ার হয়ে অল অ্যারাউন্ড ইভেন্টে বিজয়ী হয়ে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করলেও তার আনন্দটুকু ছিল ক্ষণস্থায়ী। রাদুকান নির্দোষী হয়েও শিকার হয়েছেন ট্র্যাজেডির। তার দুঃখে সবাই কম-বেশি সমব্যথী হলেও ড্রাগের ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি এবারের অলিম্পিক। যেটি আশঙ্কাজনক, তা হলোÑ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাথলেটদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। ড্রাগের এ আগ্রাসন থামানো না হলে অলিম্পিকের মহিমা ও মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণœ হবে।
সিডনি অলিম্পিকে বিস্ময়করভাবে হেরেছেন ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত কুস্তিগীর আলেকজান্ডার কারেলিন এবং পোলভল্টের জীবন্ত কিংবদন্তী সের্গেই বুবকা। এ দুজন ক্রীড়াবিদ তাদের স্ব-স্ব ইভেন্টে অপ্রতিদ্বন্দ¡ী হলেও সময়ের কাছে তারা হার মেনেছেন। অলিম্পিক হলো শক্তিমান, বেগবান ও ক্ষমতাবানদের। তারই আলোকে এবারে সবচেয়ে দ্রুত দৌড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্টার মরিস গ্রিন, সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছেন একজন পোলভল্টার এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মানব হয়েছেন ইরানের হোসেন রেজা জাদেহ।
সাফল্য-ব্যর্থতা ছাড়াও অলিম্পিকই মহামিলনের প্রধান উৎসব, যেখানে পৃথিবীর তাবৎ দেশের মানুষেরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে বিনিময় করেন নিজেদের ভাষা, পতাকা, সংস্কৃতি। গড়েন বন্ধুত্ব-মৈত্রী-বন্ধন। এটাই অলিম্পিকের বড় বৈশিষ্ট্য। ফের চার বছর পর অলিম্পিকে সবাই একত্রিত হবেন। এ সময় কত কি ঘটে যাবে। কিন্তু অলিম্পিক থাকবে। থাকবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ভালবাসা।
ক্রীড়াজগত : ১ অক্টোবর ২০০০
ক্রীড়াবিদদের বীরোচিত ভূমিকা
স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্রীড়াবিদদের বীরোচিত ভূমিকা ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছে। তাদের আÍত্যাগ ও গৌরবময় অবদানে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে।
পাকিস্তানের ২৪ বছরে শাসকদের বৈষম্যমূলক শাসন ও শোষণের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াজগত ছিল উপেক্ষিত। এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদরা যাতে তাদের প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছতে না পারে, সে জন্য হয় কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। তাদের তাচ্ছিল্য ও পক্ষপাতিত্বের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত বাজেট। জনসংখ্যার অনুপাতে বাজেট বরাদ্দের কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যদি এক কোটি টাকা বরাদ্দ করা হতো, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের (তৎকালীন) জন্য করা হতো এক লাখ। ফলে অবহেলা, উপেক্ষা ও বঞ্চনার মাঝেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও ক্রীড়াশৈলী দেখিয়ে কোনো কোনো ক্রীড়াবিদ সাফল্য দেখালেও তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়া হতো না।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সুযোগ দেয়া তো দূরে থাকুক, এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদরা যাতে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে না পারেন, সর্বদা সে চেষ্টাই করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটারের টেস্ট খেলার যোগ্যতা থাকলেও সর্বসাকুল্যে সুযোগ পেয়েছেন একমাত্র নিয়াজ আহমেদ সিদ্দিকী। তবে তিনিও বাঙালী ছিলেন না। অবহেলা আর উপেক্ষা পেতে পেতে এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষোভের অনলে জ্বলতে থাকে। এ কারণে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে খেলা হলে প্রাদেশিক মনোভাব ও উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়। ’৭১ সালের ১ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল পাকিস্তান এবং কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে। দর্শকরা খেলা উপভোগ করার সময় বেতারে দুপুর ১টার খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অর্ধিবেশন ডাকবেন না। এর অর্থ ছিল বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করা। স্বাধিকারের চেতনায় মুহূর্তেই দর্শকরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠেন এবং মাঠে ঢুকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ধাওয়া করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ক্রীড়াবিদরাও তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ বিশ্বের ক্রীড়া ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ফুটবলারদের অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। অনুরূপভাবে ’৭১-এর ১২ অক্টোবর কোলকাতার কলেজ স্কোয়ারে সাঁতারু অরুণ নন্দী একটানা ৯০ ঘণ্টা সাঁতরে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেন। এছাড়াও সাঁতারু কানাইলাল শর্মাসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব ক্রীড়াবিদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছেন, তাদের কথা জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্রীড়াবিদরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির পাশাপাশি মাতৃভূমির জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছেন। ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নাম ক্রিকেটার জুয়েল, ফুটবলার সারোয়ার, মজিবর, কুটু মনি, বাবুল, অ্যাথলেট সিরাজ, শাহেদ আলী, ক্রীড়া সংগঠক মুশতাক, ক্রীড়া সাংবাদিক আব্দুল মান্নান লাড়ু ভাই স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন সঁপে দিয়েছেন।
মহান এ বিজয় দিবসে স্বাধীনতা সংগ্রামে গৌরবময় ভূমিকা পালনকারী ক্রীড়াবিদদের কথা আমরা স্মরণ করছি।
ক্রীড়াজগত : ১৬ ডিসেম্বর ২০০০
নতুন শতাব্দী, নতুন সহস্রাব্দ
সময়ের পল, অনুপল নিয়ে যে মহাকাল, তার অতলে ডুব দিয়েছে আরো একটি শতাব্দী ও সহস্রাব্দ। উত্তাল কালসমুদ্রে শতাব্দী বা সহস্রাব্দ কিছুটা ঢেউ তুলে মিলিয়ে গেলেও মানব সভ্যতার ইতিহাসকে তা দারুণভাবে আন্দোলিত করে। এ কালখন্ডে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়যাত্রা মানব প্রজাতির জীবনযাত্রা ও চিন্তা-ভাবনাকে আমূল বদলে দেয়ার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনেও সাধিত হয় বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা।
বিংশ শতাব্দী আমাদের উত্তরণের কাল। এ সময় আমরা বৃটিশ ও পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হয়েছি। তবে এ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালির আÍপরিচয়ের যে নির্মিতি, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ক্রীড়াঙ্গনেও যে সাফল্যের আলো, তা আমাদেরও আলোকিত করেছে। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে খেলাধুলায় বাঙালির বলার মত তেমন সাফল্য নেই। তদুপরি ১৯১১ সালের ২৯ জুলাই গোরাদের ফুটবল দল ইস্ট ইয়র্ককে হারিয়ে মোহনবাগানের আইএফএ শীল্ড জয় আমাদেরকেও দারুণভাবে উদ্বেলিত করে। কেননা মোহনবাগান দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় ছিলেন পূর্ব বাংলার। ১৯৩৭ সালের ২১ নভেম্বর আমাদের ফুটবলের একটি যুগান্তরী দিন। বাংলার ছেলেদের নিয়ে গড়া ঢাকা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র পাখী সেনের গোলে এএফসি কোরিন্থিয়ান ক্লাবকে বিস্ময়করভাবে হারিয়ে দেয়। সে সময় ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম দল ছিল এই ইংলিশ ক্লাব।
পাকিস্তান আমলে অন্য সবকিছুর মত ক্রীড়া ক্ষেত্রেও আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের ক্রীড়াবিদদের সুযোগ ছিল সীমিত, তারপরও সম্ভাবনাটুকু কাজে লাগাতে দেয়া হয়নি। এর মাঝে ১৯৫৯ সালে বিক্রমপুরের ছেলে সাঁতারু ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে সাড়া জাগান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালির ইতিহাসে সবচে গৌরবময় ঘটনা। এ সময় বাংলাদেশের সপক্ষে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং সাঁতারু অরুণ নন্দীর রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার পর ক্রীড়াঙ্গনে উড়তে থাকে বিজয়- নিশানা।
দাবায় উপমহাদেশের প্রথম গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, বৃটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন রাণী হামিদ, ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসের দ্রুততম মানব শাহ আলম, ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসের দ্রুততম মানব বিমল চন্দ্র তরফদার, ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসে সর্বাধিক স¦র্ণ ও ১৯৮০ সালে এশিয়ান সাঁতারে রূপাজয়ী মোশাররফ হোসেন খান, ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে বক্সিং-এ ব্রোঞ্জজয়ী মোশাররফ হোসেন, হংকং পেশাদার ফুটবল লীগে প্রথম বাঙালি ফুটবলার সালাউদ্দিন, কোলকাতা লীগ মাতানো ফুটবলার মোনেম মুন্না, এএফসির দৃষ্টিতে ফুটবলার অব দ্য মান্থ আলফাজ, ১৯৯০ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের দ্বৈত ইভেন্টে স্বর্ণজয়ী আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি, কমনওয়েলথ শুটিং-এ স্বর্ণজয়ী সাবরিনা সুলতানা, অভিষেক টেস্টের অধিনায়ক ও ৬ উইকেট লাভকারী নাঈমুর রহমান দুর্জয়, অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক আকরাম খান, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ খালেদ মাহমুদ সুজন, ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মেহরাব হোসেন অপি প্রমুখ ক্রীড়াক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল নাম। ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালের এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে রৌপ্য পদক, ১৯৯৭ সালে সাফ গেমসের ফুটবলে স্বর্ণপদক জয়, ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলা এবং ২০০০ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ ও ১০ নভেম্বর অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলা এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অনন্য ঘটনা। আলাদা মানচিত্র ও লাল-সবুজ পতাকা অর্জনের পর অন্যান্য ক্ষেত্রের মত ক্রীড়াঙ্গনেও বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব সগৌরবে ঘোষণা করছে।
গেল দ্বিতীয় সহস্রাব্দ ও বিংশ শতাব্দীতে খেলাধুলায় বাঙালি নিজেদের ভিত্তি স্থাপন ও সাফল্যের সূচনা করেছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নতুন সহস্রাব্দ ও শতাব্দীতে ক্রীড়া ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা নতুন ধারার সৃষ্টি করবে।
ক্রীড়াজগত : ১ জানুয়ারি ২০০১
ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর চাই
খেলাধুলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা জাদুঘরে যে কোনো ঘটনার উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। তা থেকে ভবিষ্যত প্রজন্ম জানতে পারে অতীতের ঘটনাবলী।
ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘরের ক্ষেত্রে অন্যতম দৃষ্টান্ত অলিম্পিক জাদুঘর। আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিয়ারে দ্য কুবার্তের প্রথম অলিম্পিক জাদুঘর সম্পর্কে ধারণা দেন। ল্যুসানে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)-এর সদর দফতর স্থাপনের পর ১৯১৫ সালে তিনি এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তারই ধারণার আলোকে শুরু হয় অলিম্পিক জাদুঘরের যাত্রা। তবে ১৯৮০ সালে জুয়ান অ্যান্টোনিও সামারাঞ্চ আইওসির সভাপতি হওয়ার পর অলিম্পিক জাদুঘরকে অত্যাধুনিকভাবে ঢেলে সাজানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। নানা রকম ক্রীড়ার ছবি, ক্রীড়াবিদদের ব্যবহৃত পোশাক ও সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দৈনন্দিন সামগ্রী, বই, ডায়রি, চিঠি, স্ট্যাম্প, মুদ্রা ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ভান্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি সামারাঞ্চ ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘরকে জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন। এতে সমন¦য় ঘটানো হয় আধুনিক অডিওভিজ্যুয়াল ও কম্পিউটারের। বর্তমানে অলিম্পিক জাদুঘরে অলিম্পিক আন্দোলন সংক্রান্ত ১৭ সহস্রাধিক গ্রন্থ, ২৫০টি মূল্যবান সাময়িকী, ২০ লাখ ক্যাটালগ, আনুমানিক ১৫ হাজার ঘণ্টার ফিল্ম নিয়ে অডিওভিজ্যুয়াল আর্কাইভ, তিন লাখ ফটো নিয়ে ফটোগ্রাফিক পাঠাগার, ১২ সহস্রাধিক স্ট্যাম্প ও ডাকটিকিট সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলপত্র এবং অলিম্পিক উপলক্ষে প্রকাশিত মুদ্রা রয়েছে। অবশ্য শুধু অলিম্পিক জাদুঘর নয়, ফিফার জাদুঘরও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এছাড়াও রয়েছে নানা রকম ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর।
অথচ এ ক্ষেত্রে আমরা দারুণভাবে পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর ধারণাটি এখনও তেমন স্পষ্ট নয়। আমাদের জাতীয় জাদুঘরে ক্রীড়া সংক্রান্ত ছিটেফোঁটা নিদর্শন থাকলেও তা একদমই অপ্রতুল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের খেলাধুলার মান আশানুরূপ না হলেও এ দেশের খেলাধুলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক দিনের। সঙ্গত কারণে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গড়ে তোলা এবং তা সজ্জিত করার মত অনেক নিদর্শন ও উপকরণ আমাদের দেশে রয়েছে। বাঙালির লোকজ খেলাধুলার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। বৃটিশ আমলে প্রবর্তন ঘটে ফুটবল, ক্রিকেটসহ আধুনিক খেলাধুলার। ১৯৩৭ সালে কোরিন্থিয়ান ফুটবল ক্লাবকে হারানো, ১৯৫৯ সালে সাঁতারু ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফুটবলারদের ঐতিহাসিক ভূমিকা, দাবায় উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, ১৯৯০ সালে কমনওয়েলথ গেমসে আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনির স্বর্ণপদক জয়, বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা, অভিষেক টেস্ট খেলাসহ নানারকম ঘটনাবহুল ঘটনা আমাদের ক্রীড়া ইতিহাসে সঞ্চিত হয়েছে। এসব খেলার ঘটনাবলীর ছবি, ক্রীড়াবিদদের ব্যবহৃত পোশাক ও সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দৈনন্দিন সামগ্রী, বই, ডায়রি, চিঠি, স্ট্যাম্প, মুদ্রা, ভিডিও ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গড়ে তোলা হলে এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। এ বিষয়ে এখনই সচেতন ও সতর্ক না হলে আমরা ইতিহাসের অনেক নিদর্শন ও উপকরণ হারিয়ে ফেলবো।
আমরা আশা করবো, অচিরেই ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হবে।
ক্রীড়াজগত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০১
ক্রিকেট কি শুধু পরিসংখ্যানের খেলা? পরিসংখ্যানে কতটুকু সত্য থাকে? কোনো মহাকাব্যিক ইনিংস কি অনুভব করা যাবে পরিসংখ্যান দেখে? ১৯৬০ সালে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার টাই টেস্টের পরতে পরতে যে উত্তেজনা ও অবিশ্বাস্য নাটকীয়ত স্নায়ুকে বিকল করে দিয়েছিল, তা কি ফুটে ওঠে পরিসংখ্যানের কঙ্কালে? ক্রিকেটের বর্ণাঢ্য চরিত্র ‘বুড়ো শয়তান’ খ্যাত ডব্লিউ জি গ্রেস কিংবা সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে সম্মানিত ডন ব্রাডম্যানকে পরিসংখ্যানে কতটুকু চেনা যায়? চেনা যায় না বলেই যুগে যুগে ক্রিকেট লিখিয়েরা তাদের মিষ্টি-মধুর কলমে পরিবেশন করেছেন ক্রিকেটের রূপ-রস-সৌন্দর্য। তাদের কলমের আঁচড়ে স্মরণীয় হয়ে আছে মহান ক্রিকেটারদের অমর কীর্তি আর মহাকাব্যিক ইনিংসের লাবণ্য ও সুষমা। সাহিত্যের অধ্যাপক হীরেন চট্টোপাধ্যায় যেমনটি বলেছেন : ‘আসলে ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে লেখা মানে যে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান পেশ করা নয়, তাকে যে প্রাণবন্ত করে তোলা যায়, একটি সুন্দর ইনিংস যে মোৎজার্টের একটি সিম্ফনি বা বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের বিলম্বিত ও মধ্যলয়ের শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীর সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পারে, এই আবিষ্কারই তো ওইসব লেখার প্রতি আমাদের মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল।’ ক্রিকেট যেমন বৃটিশদের গর্ভজাত, তেমনি ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেট সাহিত্যও তাদের দান। এ বিষয়ে রাখাল ভট্টাচার্যের অভিমত হচ্ছে : ‘খেলার রাজ্যে ভাবোদ্বেল সাহিত্য সৃষ্টির অবকাশ ক্রিকেটে যত আছে, এত আর কোনো কিছুতে নেই। ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেট-সাহিত্য যারা পাঠ করেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, মহাসমৃদ্ধশালী ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পংক্তিতে স্থান পাবার যোগ্যতা তার আছে। যে রসসমৃদ্ধ, অলঙ্কারম-িত ও ছন্দময়। ক্রিকেটের বিকল্প নয় সে সাহিত্যপাঠ; ক্রিকেট দেখার থেকে সূক্ষ্ম রসানুভূতি মেলে তাতে। আমি তো বলি, ক্রিকেটের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস ব্যাট থেকে উৎসারিত হয়নি, তা হয়েছে একজনের কলম থেকে, তার নাম নেভিল কার্ডাস। কার্ডাস মূলত সঙ্গীত-সমালোচক। সঙ্গীতেরই তাল-লয়-যতি, মীড়-মূর্ছনা-গমক, সব তার কাছে ধরা পড়েছে, ক্রিকেটেও এবং এত কিছু যে ক্রিকেটে আছে, তারও খবর লোকে জেনেছে সঙ্গীত-সমালোচক কার্ডাসের ক্রিকেট-সমালোচনা পড়ে।’
বাঙালির রক্তে ক্রিকেট নেইÑ পঙ্কজ রায় অল্প কিছু পরিমাণে এবং সৌরভ গাঙ্গুলি তা পুরোপুরি খ-ন করে দিয়েছেন। এখন তো বাঙালিদের একটি দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলছে। তবে ক্রিকেট খেলায় নাম কুড়ানোর আগেই সমঝদার হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছে বাঙালিরা। যদিও কথাসাহিত্যিক শঙ্করের মত বাঙালিরা শুরুতে মনে করতেন : ‘ক্রিকেটটা কোনো খেলা নয়, কলোনিয়াল কালচারের একটি বর্বর প্রকাশ মাত্র, ফলে দু’জন লোক লাঠি হাতে সারাদিন খাটায় একাদশ নির্দোষ মানুষকে।’ অথচ একদিকে বাঙালিরা ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছে, অন্যদিকে মজেছে ক্রিকেট রসে। আস্তে-ধীরে বাঙালিরা আÍস্থ করে নিয়েছেন ‘ক্রিকেট-কালচার’কে। আর এ থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলা ক্রিকেট-সাহিত্যের। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে পূর্ণতা দিয়েছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু (জন্ম : ২১ অক্টোবর, ১৯২৮, হাওড়া, কোলকাতা)। ষাটের দশকটা ছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, চিত্রকলার উজ্জ্বল সময়। সে একটা সময় ছিল, যখন হেমন্ত-লতা-কিশোরের রোমান্টিক গান বুকে সুর হয়ে বেজেছে। উত্তম-সুচিত্রার মিষ্টি প্রেমের ছবি মনকে করেছে উতলা। সুনীল-শক্তির কাব্যরসে আপ্লুত হয়েছেন পাঠক। চিত্রকরের রঙিন ক্যানভাস রূপতৃষ্ণায় ভরিয়ে দিয়েছে দু’চোখ। সৃষ্টিশীল এমন এক সময়ে ‘গদ্যের মধ্যে পদ্য করে ক্রিকেট-সুন্দরীর গায়ে রঙ-বেরঙের নকশা’ কেটেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। বিশিষ্ট সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর ভাষায়, ‘ক্রিকেট রসিক’ এই ভদ্রলোকের হাতে জন্ম সুনিপুণ ক্রিকেট সাহিত্যের। রাজকীয় ও কেতাদুরস্ত ক্রিকেটে ইংরেজি ভাষায় যতটা লাবণ্য ধরে, বাংলা ভাষায় কি ততটা মাধুর্য পাওয়া যায়? এমন একটা দোলাচল বরাবরই ছিল। সাহিত্যের অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের মরুভূমিতে শুধু ফুলই ফোটাননি, তারই হাতে পরিস্ফুটিত ও বিকশিত হয়েছে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের সুবাসিত এক বাগানের। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের যে সোনার খনির সন্ধান দিয়েছেন, তা থেকে পাঠকরা এখনও তুলে নিচ্ছেন মুঠো মুঠো সোনা। শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং তার ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে লিখতে যেয়ে প্রতি মুহূর্তে তারই লেখার স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। ক্রিকেট নিয়ে তার কল্পনা, তার সৃষ্টি, তার অনুবাদ এমনই আবিষ্ট করে রাখে যে, এর বাইরে নতুন ভাবনা কিংবা শব্দচয়ন খুবই দুর্বল ও অপ্রতুল মনে হয়। তাকে জানার সোজাপথ হলো তার লেখা পাঠ করা। এ কারণে এ লেখায় তার লেখার উদ্ধৃতি ও বাক্য অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ তিনি শুধু ক্রীড়া লেখক ছিলেন না। তার গবেষণার আলোয় আলোকিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা দিক। সাহিত্যের অধ্যাপক অমিয় দত্তের মতে : ‘বৈদগ্ধ্যের বৈভবে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ভাবমূর্তি হিমালয়-সদৃশ। কত দিকেই না তার মানসাভিসার। বৈষ্ণব সাহিত্যের রসময় আলোচনায়, ক্রিকেট সাহিত্যের সৌরভময় দুনিয়ায়, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা-সুভাস চন্দ্রের ঐতিহাসিক আবির্ভাবের গবেষণাধর্মী মহাগ্রন্থ রচনায় তার অসামান্যতা সর্বজনবিদিত।’
বাঙালির জীবনচর্যা ও সংস্কৃতিতে বহুল উচ্চারিত শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখনী নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন কথাসাহিত্যিক হর্ষ বসু : ‘সে এক গভীর বিস্ময়, বাকরুদ্ধ স্তব্ধতা। কেবলই মনে হয়ছে, শুধু নিষ্ঠা বা মেধার জোরে এমন কালজয়ী কাজ করে ওঠা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জন্মগত বিরল প্রতিভা। শঙ্করীপ্রসাদ সেই বিরল প্রতিভাসম্পন্নদের মধ্যে একজনÑ যাঁরা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। কিন্তু যাদের সৃষ্টি প্রবহমান মানবসভ্যতাকে এক অপতিরোধ্য ঋণের জালে বেঁধে রেখেছে।’ জীবন ও সৃষ্টির নানাদিক নিয়ে মেতে উঠলেও শঙ্করীপ্রসাদ বসু স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলার ‘নেভিল কার্ডাস’ হিসেবে। ‘খেলার মাঠকে তিনি সারস্বত সাধনার ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন।’ প্রথম যৌবনে তিনি যখন ছিলেন ক্রিকেট নেশাগ্রস্ত, তখন ‘ক্রিকেটের নেশা আমাকে যখন পেয়ে বসলো তখন একদিকে জীবনের মধুর শীতের দুপুরগুলি কাটাতে শুরু করলুম ইডেনের গ্যালারীতে বসে, অন্যদিকে বাড়ি ফিরে এসে চোখ ডুবিয়ে দিলুম ইংরেজিতে লেখা ক্রিকেটের অপূর্ব সব কাহিনীতে। ক্রিকেট যারা ভালবাসে- তারা খেলা কেবল মাঠেই দেখে না, বইয়ের পাতাতেও দেখে থাকে’Ñ এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটের রসকে কাগজে-কলমে রূপায়িত করেছেন। চোখের দেখা, ইংরেজি ক্রিকেট সাহিত্য আর পরিসংখ্যানের ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে আহরণ করেছেন ক্রিকেটের মাধুর্য। মহাজীবনের গাঁথা (১৯৫৩), মধ্যযুগের কবি ও কাব্য (১৯৫৫) ও চ-ীদাস ও বিদ্যাপতির (১৯৬০) লেখক শঙ্করীপ্রসাদ বসু ১৯৬০ সালে ‘ইডেনে শীতের দুপুর’ লিখে কাঁপিয়ে দেন বাংলার ক্রিকেটানুরাগীদের। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘শঙ্করীপ্রসাদ বসুও সেই দুর্লভ বাকশক্তির অধিকারী, অন্যের মনশ্চক্ষুকে যা অতি অকেশে খুলে দেয়। ছাত্রমহল জানে, তিনি একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক; ক্রীড়ামহল জানে, তিনি একজন দক্ষ দর্শক এবং পাঠকমহল জানে, তিনি একজন শক্তিমান লেখক, বাচনভঙ্গির চাতুর্যে নেপথ্যের ঘটনাকেও যিনি দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন। আমি তার এই বই (ইডেনে শীতের দুপুর) পড়েছি এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ঘরে বসেই ক্রিকেট খেলা দেখেছি। দেখা সম্ভব হতো না, তার ভাষা যদি-না বর্ণনাময় এবং বর্ণনা যদি-না নিখুঁত হতো। আসল কথা, ক্রিকেটকে তিনি ভালবাসেন। ভালবাসার বস্তুটিকে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। দূরের থেকে কাছে টেনে এনেছেন। এ অতি শক্ত কাজ, তাতে সন্দেহ নেই।’ লেখকের বসবাস কলকাতায় হওয়ায় ইডেন গার্ডেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মধুময় স্মৃতি। ইডেন গার্ডেনে কাছ থেকে খেলতে দেখেছেন বিশ্ব-সেরা ক্রিকেটারদের। কোনো কোনো ক্রিকেটার তার মন জয় করে নেন। তাঁদের ক্রিকেটশৈলী ও ব্যক্তিত্ব তাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। মূলত এদেরকে কেন্দ্র করে ‘ইডেনে শীতের দুপুর’-এ যেন শব্দ দিয়ে বাজানো হয়েছে হৃদয়ের সুর। ক্রিকেটের আলোয় খুঁজে পাওয়া যায় জীবন-জগতের নতুন ব্যঞ্জনা। ‘এর নাম ইডেন গার্ডেন’ শিরোনামের লেখায় ফিরে ফিরে আসে শৈশব-কৈশোরের মধুমাখা দিনগুলো। লেখক তার গুণেনদার হাত ধরে সেই কবে গিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেনে, সেই থেকে যাবার পর প্রতিবারই ফিরে আসার সময় চোখের তৃষ্ণা পিছনে ফেলে এসেছেন। তারই তাড়নায় আবার গিয়েছেন। এমনি চলেছে বছরের পর বছর। ইডেন গার্ডেনের মায়া থেকে নিস্তার পাননি। পাননি বলেই ভুলতে পারেননি জীবনের সেইসব আনন্দময় দিনগুলোর কথা : ‘কিভাবে শীতের সকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখতে লাইন দিয়েছি ইডেন গার্ডেনে। খুব ভিড়ের সম্ভাবনা, সিজন টিকিটের পয়সা জোটেনি। ভোর-ভোর বেরুতে হয়েছে। যখন মাঠে পৌঁছেছি, অলস ঘুমের মতো তখনও কুয়াশা জড়িয়ে আছে পাইন-দেবদারুর পাতায় পাতায়। ওধারে হাইকোর্টের চূড়োটি কেমন মায়াময়। আবছা আলোয় গড়ের মাঠ। কালো নোঙর-করা নৌকোর মত টেন্টগুলো। ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে মাথা-নামানো ব্রোঞ্জের সৈনিক দুটোর ভঙ্গিতে সুকোমল নমস্কার। দৌড়ে-দৌড়ে আসতে হয়েছে। ইতোমধ্যে লাইন খুব কম হয়নি। আমরা আছি পাঁচজন। তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে দু’জনকে পাঠিয়ে দেয়া হলো খোঁজ-খবরে আমাদের লাইনটা ঠিক লাইন কি না, অন্য গেটে ছোট লাইন আছে কি না, চেনাশোনা কেউ আগে আছে কি না, সেখানে ঢোকার চান্স কি রকম? কাঁধের ঝোলাগুলো, একবার নেড়েচেড়ে নিই। ঠিক আছে’। ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ হয়ে যারা ছুটে যান ক্রিকেট মাঠে, এ তো তাদের জীবনের দিনলিপিÑ যা চমৎকারভাবে এঁকেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তখন সময়টা আসলেই অন্যরকম ছিল। সবকিছুতেই ছিল সুরুচির একটা প্রচ্ছন্ন ছাপ। ভাল বই, ভাল গান আর ক্রিকেট ছিল বাঙালির মন্থর নগর জীবনের প্রধান বিনোদন। তবে সবার পক্ষে ক্রিকেট মাঠে যাওয়া সম্ভব না হলেও বেতারের ধারাবিবরণী কানে মধবৃষ্টি বর্ষণ করতো। সংবাদপত্রে খেলার বিবরণী কিছুটা তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হতো। কিন্তু শঙ্করীপ্রসাদ বসু যেন বাঙালিদের ক্রিকেট রসে মজিয়ে দেন। দৈনিক পত্রিকার গতানুগতিক রিপোর্টিং- এর বাইরে নতুন এক ধারার প্রবর্তক তিনি। এ যে ক্রিকেট সাহিত্য! বাঙালির আটপৌঢ়ে জীবনে এক নতুন রসদ।
বাঙালিরা যে ক্রিকেট খেলতে পারেন, এটা প্রমাণ করেছিলেন, পঙ্কজ রায়। বর্তমানে ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ও ক্রিকেটার ‘বাঙালি-বাবু’ সৌরভ গাঙ্গুলির আগে পঙ্কজ রায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ব্যাটসম্যান। সে সময়কার ভেতো ও ভীতু বাঙালি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ‘চরিত্রশক্তিতে অনন্যভাবে সমৃদ্ধ’ ছিলেন তিনি। বলা যায়, পঙ্কজ রায়কে দিয়ে বাঙালির ক্রিকেটে নববসন্তের সূচনা। এ কারণে অন্য অনেকের মত পঙ্কজ রায় ছিলেন লেখকের প্রথম জীবনের ভালবাসা। তাকে পেয়েছিলেন ‘ক্ষ্যাপা আনন্দের জগতে নন্দন চরিত্ররূপে’। ভালবাসার মানুষটিকে বাঙময় করে তুলেছেন এভাবে: ‘কিন্তু সেদিন পঙ্কজের মধ্যে যা দেখেছিলুম, তা আর দেখবার আশা করি না। ছেলেটির সমস্ত দেহের মধ্যে থেকে একটা জিনিস বিচ্ছুরিত হচ্ছিলÑ আÍবিশ্বাস। চলা-ফেরা, ব্যাট ধরা, স্ট্রোক করাÑ সবকিছু সহজ দর্প এবং প্রফুল্লতার ভঙ্গিতে বাঁধা। কোনো বলই তার কাছে সমস্যা নয়। তাই বলে কি সেগুলিকে নিরন্তর বাউন্ডারিতে পাঠাচ্ছিলেন? মোটেই নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু থামাচ্ছিলেন, মারছিলেন মাত্র মারবার বলটি। কিন্তু যেভাবে ক্রিজের উপর ঘোরাফেরা করলেন, যে প্রত্যয়ের অনায়াস গতিতে, সে জিনিস একমাত্র তার পক্ষেই করা সম্ভব, যে জীবনের প্রসন্ন মুখ দেখেছে, সেই গৌরবর্ণ খর্বকায় বাবু চেহারার যুবকটি আমাদের মনে একটি সানন্দ মহিমার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। (ইডেনে শীতের দুপুর)। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৩টি টেস্ট খেলে ৩২ দশমিক ৫৬ গড়ে ২৪৪২ রান করেছেন পঙ্কজ রায়। এর মধ্যে ৫টি সেঞ্চুরি। ১৯৫৬ সালে মাদ্রাজে ভিনু মানকদকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম উইকেট জুটিতে যে ৪১৩ রান করেন, তা আজো রেকর্ড বইয়ের পাতায় অম্লান হয়ে আছে। উপর্যুপরি ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন। পরিসংখ্যানে কি আমরা প্রকৃত পঙ্কজ রায়কে চিনতে পারবো? পারবোনা বলেই বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়কে তিনি আমাদের মানসপটে ছবির মত এঁকে দিয়েছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তী সুঁটে ব্যানার্জি, মুস্তাক আলী, লালা অমরনাথ, বিজয় মার্চেন্ট, বিজয় হাজারে, রুসী মোদী, পল উমরিগড়, জি এস রামচাঁদ, দাত্তু ফাদকার, ভিনু মানকদকে জীবন্ত করে রেখেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। এই ক্রিকেটাররা গেয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের নবজীবনের গান। অপরিণত ভারতীয় ক্রিকেট দলকে এরাই দিয়েছিলেন নতুন পথের ঠিকানা। ১৯৩২ সালের জুনে লর্ডসে প্রথম টেস্ট খেলার প্রায় ২০ বছর পর ভারত ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাদ্রাজে ইংল্যান্ডের সঙ্গে পঞ্চম টেস্টে ইনিংস ও ৮ রানে প্রথম জয়ের মুখ দেখে। এই জয়ে ভিনু মানকদের অসাধারণ বোলিং, পল উমরিগড় ও পঙ্কজ রায়ের দায়িত্বশীল সেঞ্চুরি ছাড়াও লালা অমরনাথ, অধিনায়ক বিজয় হাজারে প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এদের অন্যতম মুস্তাক আলীর মধ্যে লেখক খুঁজে পেয়েছিলেন ‘রৌদ্রতপ্ত দূর ভারতের রহস্যময় সৌন্দর্য’। কল্পনা ও প্রতিভায় পূর্ণ এই ক্রিকেটার সহসা ঝলসে উঠে রাঙিয়ে দিতে পারতেন আকাশপ্রান্ত। তার দায়িত্বহীন সৌন্দর্য- বিলাস সবাইকে মুগ্ধ করতো। তার আউট হওয়া মানে চঞ্চল অথচ সুন্দরের মৃত্যু। মুস্তাক আলী আউট হওয়ার মুহূর্তটি লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন এখনও তা যে কাউকে আপ্লুত করবে: ‘মুস্তাক আলী নামলেন। ক্রিকেটের নবকুমারকে অভ্যর্থনা জানাতে সে কি বিপুল করতালি! সমস্ত মাঠ মেতে উঠল দিনশেষে মুস্তাকের উদয়ে। রামাধীন বল করতে শুরু করলেনÑ প্রথম বল- মুস্তাক সুন্দরভাবে আটকালেন। দ্বিতীয় বল- যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছেন মুস্তাক- রামাধীনকে আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না- বোলারের মাথার উপর দিয়ে উঁচু করে বলটি চালিয়ে দিলেন। কিন্তু হায়, যথেষ্ট উঁচু হলো না বল এবং খর্বকায় রামাধীন একটি অদ্ভুত লাফ দিয়ে বলটি ধরে নিলেন। কট আউট। সকলের হৃৎপি- যেন লাফিয়ে উঠল। কণ্ঠে কণ্ঠে সাঁড়াশির চাপ- শব্দমাত্র নেইÑ শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ- কালির বোতল গড়িয়ে পড়েছে- এমন সময় সুমধুর রবে বেজে উঠল ভারতীয় ব্যান্ডের সুবিখ্যাত আনন্দগীত; তালে-তালে লুটোপুটি করতে লাগল সুর রঙ্গভরে। দর্শকরা এমন নিস্তব্ধ যে, শোনা গেল সুরের মৃদুতম ধ্বনি পর্যন্ত। সেই থেকে বন্ধ হয়ে গেল খেলার মধ্যে ব্যান্ডবাদ্য’ (ইডেনে শীতের দুপুর)। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করার গৌরব লালা অমরনাথের। ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে মুম্বাইতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে তার অভিষেক টেস্টে এই সেঞ্চুরি করেন। লেখক লালা অমরনাথকে বলেছেন, ‘প্রাকৃতিকতার ক্রীড়ারণ্যে সচল বনস্পতি’ এবং ‘সমুদ্র আর মরুভূমির মাঝখানে বিস্তৃত অমরনাথের জীবন’। ‘আÍক্ষয়ী প্রতিভা’ লালা অমরনাথকে ‘সমুদ্র-সন্তান’ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন: ‘মহান সি কে নাইডু সর্বাঙ্গীনতায় ভারতীয় ক্রিকেটে অনতিক্রান্ত। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, ক্যাপ্টেন্সিÑ কোথায় সি কে মহীয়ান নন? তার শক্তি অনেক সময়ই প্রাকৃতিক, তার ব্যাটিং ক্রিকেটের ধর্ম-সমাজে ‘ব্রাত্য’ সকল বেড়ার বাইরে। তবু, তাকে সম্মান জানিয়েই বলব, শক্তির উদ্ধত প্রকাশে অতুলনীয় সি কে-ও এক জায়গায় অমরনাথের কাছে হেরে গেছেনÑ শক্তির প্রকাশ-লাবণ্যে। সি কে আমাদের যখন স্তম্ভিত ক’রে রাখেন, তখন অমরনাথের ব্যাটে বিপ্লবের বীণা বাজে। ঝড়ের রাতের সেই সঙ্গীত অমরনাথের বিধিদত্ত’। (ইডেনে শীতের দুুপুর)। অধিনায়ক বিজয় হাজারে ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক শূন্যকে পূর্ণ করেছেন, অনেক ভগ্নকে করেছেন উত্তোলন। প্রয়োজনের বেদীতে বারবার বলি দিয়েছেন সৌন্দর্যকে। লেখকের মতে, ‘মুস্তাক আলীর মুখরতা, সি এস নাইডুর কোলাহল, সি কে’র অট্টহাস্য, অমরনাথের রণধ্বনি কিংবা মার্চেন্টের বিদগ্ধ বচন না থাকলেও ‘ক্রিকেট পৃথিবীতে মহৈশ্বর্যে নম্র ও সম্পদে ভীত এক শান্ত মহিমার নাম বিজয় হাজারে’। তার চওড়া ব্যাটে ও চওড়া বুকে সকল আঘাত সহ্য করতে পারতেন। লেখকের বর্ণনা গুণে বিজয় হাজারের খেলা ভেসে উঠে মানসনেত্রে: ‘অথচ হাজারে কী করেছেনÑ দিনের পর দিন দেখেছি বিষাক্ততম বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তার অবিচলিত নিপুণতা। আহত সর্পের মতো বলগুলো ফণা বাড়িয়ে ছোবল দিতে চাইছে উইকেটে, আর অদ্ভুত সহজ কৌশলে পা এবং হাত বাড়িয়ে ফণার মুখে হাজারে পেতে দিচ্ছেন ব্যাটের ব্লেডটিকে। পিচের ‘লাল’ দাগ ফুটে উঠছে ব্যাটের কাষ্টদেহে, কিন্তু উইকেট অক্ষত। হাজারের খেলা দেখে কতবার মনে হয়েছে- কি আশ্চর্য, এই যোদ্ধা তরবারি ফেলে দিয়ে যেন শুধু ঢাল দিয়ে বিপক্ষের তরবারির আঘাত প্রতিহত করার কৌতুককর খেলায় মত্ত। তরবারির ফলক ঝিলিক দিয়ে এগিয়ে আসে দেহস্পর্শের জন্য, তার আগে পেয়ে যায় ঢালের নির্বিকার প্রতিরোধকে। তারপর একসময় দেখি, কখন যেন যোদ্ধা কুড়িয়ে নিয়েছেন তার তলোয়ার। তার আঘাতে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে বিপক্ষের অস্ত্র। হাজারের ড্রাইভগুলো চোখ ধাঁধিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাউন্ডারির সীমানায়’। (ইডেনে শীতের দুপুর)। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ভিনু মানকদ। রেকর্ডবুকে তার সময়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্রিকেটার। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম সময়ে ১০০ উইকেট এবং হাজার রানের কীর্তি গড়েন। ব্যাটসম্যান হিসেবে সাহসী ও কল্পনাপ্রিয় ভিনু মানকদ টেস্ট ম্যাচের উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি এবং দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করা ভারতের প্রথম ক্রিকেটার। ভিনু মানকদের মধ্যে লেখক খুঁজে পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চরিত্রকে: ‘ভিনুর দিকে একবার তাকান আর ভারতের জাতীয় স্বভাব স্মরণ করুন। এদেশের জীবনের ধীর লয়, অব্যস্ত গতি, প্রসন্ন সহিষ্ণুতা, শান্ত প্রতিরোধ, অহিংস অসহযোগিতা; এ দেশের প্রান্তর, কৃষক, গরুর গাড়ি, ধানকাটা, তাঁত বোনা; আর মনে করুন ভিনু মানকদকে। এদের মধ্যে কোথাও কি একটা ঐক্য নেই।’ (ইডেনে শীতের দুপুর)। এমন কাব্যময় বর্ণনা ক্রিকেট মাঠের একজন কবি ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে রাখাল ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘কবির দৃষ্টিতে অতি সাধারণ বস্তুও রূপময় হয়ে ওঠে। বর্তমান লেখকের কবিতা রচনার অভ্যাস আছে কিনা জানি না, কিন্তু বিভিন্ন ক্রিকেটারের খেলার ধরন অনুধাবন করে, তিনি যেভাবে তার বিশ্লেষণ করেছেন, জীবন ও প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশের সঙ্গে উপমা দিয়ে তাকে বাক্সময় সাকার রূপ দিয়েছেন, তা যে কবিকৃতি, তাতে সন্দেহ নেই’।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘রমণীয় ক্রিকেট’। ১৯৬০ সালের ৯ থেকে ১৪ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্য ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি’র পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট। মহান অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মুখোমুখি রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে গ্যারি সোবার্সের সৌন্দর্যপূর্ণ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে করা ১৩২, সলোমন ৬৫, ফ্রাঙ্ক ওরেল ৬৫, আলেকজান্ডার ৬০ ও ওয়েস হলের ৫০ রানের সুবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ ৪৫৩। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিডসন নেন ৫টি উইকেট। জবাবে অস্ট্রেলিয়া নর্মান ও’নীলের কষ্টসাধ্য ১৮১, সিম্পসনের ৯২ ও ম্যাকডোনাল্ডের ৫৭ রানে ৫০৫ রান করে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে যায়। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ওয়েস হল ৪টি উইকেট নেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্রাঙ্ক ওরেলের ৬৫, রোহান কানহাইয়ের ৫৪ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮৪ রান করলে জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়ায় ২৩৩ রান। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিডসন ৬টি উইকেট নেন। কিন্তু বুনো বোলিংয়ে ভয়ঙ্কর ওয়েস হলের তা-বে ৯২ রানে অস্ট্রেলিয়ার ৬টি উইকেটের পতন ঘটলে ক্যারিবীয়দের পুরু ঠোঁটে ক্যালিপসো সুর ভাসতে থাকে। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ডেভিডসন ও অধিনায়ক রিচি বেনো ক্যারিবীয়দের সুর থামিয়ে দেন। সলোমনের দুর্দান্ত থ্রোতে ডেভিডসনকে ৮০ রানে ফিরিয়ে দিলেও বেনো থাকায় জয়ের তরী অস্ট্রেলীয় বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় থাকে। শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৬ রান। হাতে ৩টি উইকেট। বল হাতে ‘দানবীয়’ হল। হলের বাউন্সারে বেনো ধরাশায়ী হলে যন্ত্রণার-আবেগের-উৎকণ্ঠার লাভা গড়িয়ে পড়তে থাকে মাঠে। ২৩২ রানের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার শেষ দুই ব্যাটসম্যান গ্রাউট ও মেকিফ রান আউট হলে ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত ‘টাই’ হয়। ‘মানুষের সাধনা ও বিধাতার বাসনার যৌথ সৃষ্টি ঐ ‘টাই’।এরপর ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে চেন্নাইতে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যেকার দ্বিতীয় ‘টাই’ হলেও প্রথম ‘টাই’ ম্যাচে যে আবেগ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাস ও øায়ুর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তা তুলনারহিত। লেখকের বর্ণনায় ঝরে পড়ে মুগ্ধতা : ‘১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসের ব্রিসবেন টেস্ট সম্বন্ধে লিখতে আমার সংকোচ হচ্ছে। যে খেলা সম্বন্ধে বলা হয়েছেÑ না দেখলে তাকে সত্য বলে বিশ্বাস হবে না, দেখলেও বিশ্বাস হওয়া শক্তÑ যে খেলা দেখতে দেখতে রসিক দর্শকের মনে অপূর্ব অব্যক্ততার চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে- সে খেলার সত্যরূপ ফোটাব কি ক’রে? আমি তো ছার, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে কলম দিলেও তিনি কুন্ঠাবোধ করবেন, কারণ স্রষ্টাও শেষ পর্যন্ত সৃষ্টির সব রহস্য জানেন না। তাছাড়া, সৃষ্টির ব্যাপারে তার ভূমিকা অনেকটা নাট্যকারের মতো। নাট্যকার নাটক লেখেন কিন্তু সে নাটক প্রাণ পায় অভিনয়ে। ক্রিকেট-বিধাতা অদৃশ্য থেকে ব্রিসবেনের টেস্ট নাটকটি লিখে দিয়েছিলেনÑ কিন্তু সে নাটকের মাঠ রূপের সফলতা এনেছিলেন কয়েকজন ক্রিকেটার-অভিনেতা, তাদের অভিব্যক্তির স্বাধীনতায়।’ . . . . . ‘চঞ্চলতায়, বিহ্বলতায় আন্দোলিত খেলা- বৈদ্যুতিক উত্তেজনা এবং øায়ুধ্বংসী সংকটে পূর্ণÑ বেনো ভাবছিলেন- আশা নৈরাশ্যের অবিরত ওঠাপড়ার যন্ত্রণা- এ কী ক্রিকেট। যা দেখলুম। যা খেললুম! ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা কিভাবে অনিবার্য পরাজয়কে রক্তজমা ‘টাই’-এ পরিবর্তিত করল। তাদের সাহসের শক্তি, তাদের প্রয়াসের মহত্ত্বে বেনো প্রশংসাবোধ করেন। ‘নৈরাশ্য’? হ্যাঁ, নৈরাশ্য একই সঙ্গে মনে জাগে- এত লড়াইয়ের পরেও আমরা জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় একটি মাত্র রান জোগাড় করতে পারলুম না’। (রমণীয় ক্রিকেট)। শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটকে মনে করেন ‘খেলার রাজা’, ‘ক্রিকেট মহান খেলা’। কারণ, ‘ক্রিকেটের সাহিত্য আছে। খেলার সাহিত্য যদি একমাত্র ক্রিকেটের থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ক্রিকেটই সবচেয়ে জীবনময় খেলা’। . . . . .‘জীবন বলতে কেবল উত্তেজনা বোঝায় না। জীবন অনেক ব্যাপক। উত্তেজনা, আবেগ ও ধীরতার নানারূপী বিন্যাস সেখানে। জীবনে আছে সূচনা ও সমাপ্তি। উভয়ের মধ্যে ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তনের তরঙ্গ গতি। ক্রিকেট সেই খেলা। ক্রিকেট জীবনের ক্রীড়া-সংস্করণ’। তিনি অসাধারণ যে দৃশ্যপট এঁকেছেন, তাতে ক্রিকেট রাজ্যে সবাই রাজা: ‘এসব কথাও ভুলে যান। মনে রাখুন একটি শীতের অপরাহ্নকে। সোনালী রোদের মদ। সবুজ মাঠ। আতপ্ত সুতৃপ্ত অবসর। আপনি সেই অবসরের অধীশ্বর। আপনার ইচ্ছার সম্মানে সাদা ফানেলে ঢাকা ব্যাট-বল হাতে কয়েকটি অভিনেতা। আপনি রাজা, সত্যই রাজা। রূপকথাগুলো এখনো বাজেয়াপ্ত হয়নিÑ স্বপ্নে ও কামনায় একটি নিতান্ত রাজা। রাজা হয়ে বসে আপনি খেলা দেখছেনÑ দেখছেন খেলার রাজাকে। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই খেলার রাজত্বে। (রমণীয় ক্রিকেট)। এছাড়া ‘রমণীয় ক্রিকেট’ গ্রন্থে ‘চায়ের পেয়ালায় ক্রিকেট’, ‘রমণীয় ক্রিকেট’, ‘নাতি রমণীয় ক্রিকেট’, ‘সমালোচকের সমালোচক’, ‘অস্ট্রেলিয়ানিজম’, ‘ক্রিকেটের কুরুক্ষেত্র’, ‘ক্রিকেটারের বউ’, ‘কলমে ক্রিকেট’, ‘ইডেন-গার্ডেনে’ লেখাগুলো ভিন্ন স্বাদের।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসের সব মহান ও মহৎ চরিত্ররা। ডব্লিউ জি গ্রেসের মত এতটা আকর্ষণীয়, রোমাঞ্চকর এবং অবিশ্বাস্য সব কীর্তি ও কুকীর্তি আর কোনো ক্রিকেটারের ঝুলিতে নেইÑ এ কথা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়। ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটগাঁথার এই নায়কের গোটা জীবনটাই ক্রিকেটময়। ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেললেও ৪৪ বছরের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ১২৪টি সেঞ্চুরি ও ২৫১টি হাফ-সেঞ্চুরিসমেত ৮৭০ ম্যাচে ৫৪ হাজার ২১১ রান, ২৮০৯টি উইকেট আর ৮৭৬টি ক্যাচ নিয়ে তিনি এক কিংবদন্তী হয়ে আছেন। ‘দ্য ডক্টর’ নামে খ্যাত গ্রেসকে বলা যায়, আধুনিক ব্যাটিং পদ্ধতির প্রবর্তক। বিশাল চেহারা, লম্বা দাঁড়ি ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির এই ক্রিকেটার তার মহত্ব, তার চালাকি ও তার অনবদ্য ছেলেমানুষি দিয়ে ক্রিকেটের রূপকথার নায়কে পরিণত হয়েছেন। ক্রিকেটের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য এই চরিত্র ডব্লিউ জি গ্রেসকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে: ‘ক্রিকেট, গ্রেসের কাছে ক্রীড়ামাত্র ছিল না, ছিল জীবনের অঙ্গ। ক্রিকেট এবং জীবনবোধÑ একই কথা এবং জীবন যেহেতু সাজানো ড্রইংরুম নয়, তাতে কৌতুক আছে, কৌশল আছে, ভদ্রতা এবং পরিমিত মাত্রায় ইতরতাÑ সবই আছেÑ গ্রেসের ক্রিকেটেও তাই ছিল। আনন্দোচ্ছ্বল দুর্বৃত্ততার গুণে জিতে গিয়েছিলেন গ্রেস। তার চরিত্রও ঐ রকমই ছিল। সাধারণ ইংরেজদের চরিত্রও তাই- সহানুভূতি, সহৃদয়তা, সংকীর্ণতা ও রক্ষণশীলতার বিচিত্র সমন¦য়। অন্য বিখ্যাত খেলোয়াড়রাও অনেকে খেলার মধ্যে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু তাদের সেই ব্যক্তিরূপ তাদের জাতিরূপের একাংশকে মাত্র প্রকাশ করেছে। অপরপক্ষে ডাঃ গ্রেস ছিলেন সকল সাধারণ ইংরেজের প্রতিনিধি। সুতরাং সাধারণের স্বভাব অনুযায়ী তিনি খেলা থেকে কৌতুকময় দুষ্টুমি বা ভদ্র স্বার্থপরতা বাদ দিতে পারেননি।’ (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
সুরে, সুধায় ও জীবনকে যারা মিলিয়েছেন ক্রিকেটের রাখীবন্ধনে, সেই ক্যারিবীয় দ্বীপের ক্যালিপসো সুর যেন শঙ্করীপ্রসাদ বসুর কলমে গেয়ে ওঠে গুণগুণ করে: ‘সারাক্ষণ বিদ্যুৎগতিতে খেলা চলে একসময় শেষ হলো। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। খেলোয়াড়রা মাঠের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল হাত-পা ছড়িয়ে। পরক্ষণেই আবার লাফিয়ে উঠে একটা গোটা বোতল গলায় ঢেলে দিল ঢক্-ঢক্ করে। ততক্ষণে সকলে ফিরে এসেছে। নারকেল গাছের তলায়, তেঁতুল গাছের অন্ধকারে, জ্বলে উঠেছে একে একে মশাল। খানাপিনা শুরু হয়। প্রচুর প্রচুর খায়, পানও করে তেমনি। পানে-ভোজনে-স্ফূর্তিতে মাতাল সবাই। মশালগুলো নিভে আসে, কিন্তু আকাশে ওঠে চাঁদ। তার আলো দুধের মতো গড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। দূর থেকে ভেসে আসে সমুদ্রের গর্জন। হু-হু ক’রে বাতাস বয়ে যায়। শিউরে ওঠে নারকেল বন। বাজনা বেজে ওঠে, বেজে ওঠে এক সুরে শত শত কণ্ঠ। সেই চন্দ্রধৌত রাত্রে সমুদ্রতটে, সরল উচ্ছ্বল মানবের প্রাণতটে, আছড়ে পড়তে লাগল সুরের পূর্ণ তরঙ্গ। শুরু হলো নৃত্য।’ (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
ক্রিকেট পৃথিবী রোমাঞ্চিত ও সঙ্গীতময় হয়ে ওঠেছিল পঞ্চাশের দশকে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের রাজপুত্র ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, মন্ত্রীপুত্র এভারটন উইকস ও কোটালপুত্র কাইভ ওয়ালকট। বার্বাডোসের সেন্ট মাইকেলে ত্রিশের দশকের মাত্র ১৮ মাসের ব্যবধানে জন্ম নেয়া বিশ্বখ্যাত এই তিন ক্রিকেটার ফুলে-ফলে ভরিয়ে দেন ক্রিকেটের বাগান। ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকালে অর্ভিষেক হওয়া বিখ্যাত এই তিন ‘ডাব্লিউ’র রানে ও গানে উছলে ওঠে ক্যালিপসো সুর। পৃৃথিবীর ক্রিকেট ইতিহাসে এমনভাবে তিনজনের সম্মিলন আর ঘটেনি। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে, কোনো টেস্টে তিনজনের একজনও কিছু করতে পারেননি। ‘মর্যাদার লাবণ্যে অনতিক্রান্ত ওরেল, আঘাতে আক্রমণে উন্মুক্ত উইকস, ঋজু শক্তির বহির্বিকাশে সুদৃঢ় ওয়ালকট’। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ১৫ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ৯টিতে জয়ী, ৩টি পরাজিত, ২টিতে ড্র ও একটিতে টাই করেন। ওরেলের ব্যাটের হাসি আর মুখের হাসি একাকার হয়ে গেছে। তার ভুবনভুলানো অতুলনীয় হাসিটি ক্রিকেটের সেরা সম্পদ হয়ে আছে। ওরেল ক্রিকেটে গেয়েছেন জীবনের গান। তিনি মনে করতেন” ‘সুখের সঙ্গে মানুষের মতো বেঁচে থাকো, তোমার কথা লিখে ইতিহাস মানুষের ইতিহাস হয়ে উঠুক’। ওরেলকে মনে করা হয় ‘সোজা ব্যাটের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যময় খেলোয়াড়’। ওরেলের মহানুভবতা ও রুচির আভিজাত্য ছিল তার সহজাত। মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনি মর্যাদার সঙ্গে খেলেছেন। উইজডেনের মতে, ‘মারের সৌন্দর্যে ক্রিকেটের ইতিহাসে ওরেলকে কেউ অতিক্রম করতে পারেননি’। ক্রিকেটকে যারা সুর-ছন্দ ও মাধুর্য দিয়ে কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে সেরা হলেন তিন ক্যারিবীয় শিল্পী ক্রিকেটার ওরেল-উইকস-ওয়ালকট। তারা ক্রিকেট খেলেছেন হৃদয় দিয়ে। ফ্র্যাংক ওরেলকে ‘প্রিন্স অব ডেনমার্ক’ অভিহিত করে শঙ্করীপ্রসাদ বসু যেভাবে গেঁথেছেন শব্দের মালা: ‘ফ্রাঙ্কি ওরেলের জন্য আমরা তাই প্রতীক্ষা করিÑ প্রতীক্ষা ক’রে থাকব চিরদিন। ওরেলরা আমাদের বর্ণহীন পৃথিবীতে সু-বর্ণময়। রুশো বলেছিলেন, ফিরে যাও। প্রকৃতির কাছে থাকলে তোমরা আরও বেশি ‘মানুষ’ থাকবে। জীবনের হারানো আনন্দকে খুঁজে পাবে দুয়োরানীর কুটিরে। কাউন্টি খেলার ব্যবসায়িকতা যখন ক্রিকেটকে বণিকবৃত্তিতে পর্যবসিত করেছে, কিংবা শেফিল্ড-শীল্ডের দুঃসাহসী ছোকরারা যখন ক্রিকেটে এনেছে ধারাবাহিক ভীতি-শিহরণ, তখন ওরেলরা ক্রিকেটের মুক্তিদূত। বাল্যের সহজ সুস্থ পবিত্র আনন্দকে যেন খুঁজে পাই এদের মধ্যেÑ ক্রিকেট খুঁজে পায় তার নির্মলতাকে। এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে ইডেন গার্ডেনে ওরেলের খেলা। শীতের দুপুরে একটি মিঠে প্রেমকাহিনীর মতো অলস আনন্দের ক্রীড়াবিস্তার। আক্রমণ নেই, আঘাত নেইÑ শুধু ব্যাট-বলের মধুস্পর্শ। সুখের খুশির বিহ্বল বিলাস। তার আঘাতকেও আঘাত বলে মনে হয়নি, এমনই আঘাতের ছন্দ। অতি বড় কঠিন কথাকেও সেদিন ওরেল বলেছিলেন কবির মতোই অবহেলার লাবণ্য-ভঙ্গিমায়। ক্রিকেটের একজন কবির নাম ফ্রাঙ্কি ওরেল। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)। এভারটন উইকসের ব্যাটে পাহাড়ের নদীর মতো রানের স্রোত নেমে আসে দুদ্দাড় করে। সেই ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে টেস্টে তিনি টানা পাঁচটি ইনিংসে সেঞ্চুরি করে যে রেকর্ড গড়েছেন, তা আজও অটুট আছে। টেস্টে দ্রুততম সহস্র রানের অধিকারী, ওই ক্রিকেটারের ‘তার স্বাভাবিকতা, তার অনায়াস প্রত্যয়, তার নিখুঁত সংহার, তার অচঞ্চল সমাপ্তি’ দিয়ে এমনই মাদকতা তৈরি করেছেন, যে কারণে দেশের পরাজয়ের মাঝেও প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারের প্রশস্তিতে মজে যান শঙ্করীপ্রসাদ বসু: ‘উইকসের সেঞ্চুরি মানে কলকাতার মাঠে ভারতের জেতার আশা শূন্যের দিকে সরে যাওয়া। কিংবা পরপর ইনিংসে টেস্ট-সেঞ্চুরি উইকসের গৌরব যত বাড়াচ্ছে, ভারতের গৌরব ঠিক পরিমাণে কমাচ্ছেÑ অবিশ্বাস্য বিশ্ব রেকর্ডটি করা হচ্ছে ভারতের বোলিং ও ফিল্ডিংকে ধূলায় মিশিয়ে। ওসব কোনো কথাই তখন আমাদের মনে হয়নি। কেবল দেখলুম। ব্যাটের তলোয়ার, বলের মৃত্যু, ফিল্ডারের বেড়ার দিকে পলায়ন। উইকস আমাদের সম্মোহিত করে, আমাদের সকল আঞ্চলিক, পেশাগত ও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতাকে জয় করে, একটি সুদীর্ঘ বাহবা আদায় ক’রে নিলেন। যে বাহবা গল্পের সুপরিচিত আÍঘাতী বাহবার তুল্য; তরবারির অপূর্ব কৌশলে নিজ পুত্রকে বিভক্ত অথচ অবিচ্ছিন্ন দেখে দেশের প্রবীণ শস্ত্রবীর যেমন তারিফ করেছিলেন নবাগত চ্যাম্পিয়নকে। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
ওরেল-ওয়ালকট-উইকসরা ক্রিকেট মাঠে গেয়েছেন জীবনের গান। তাদের ব্যাটে যেমন ছিল সুরের নৃত্যগীত, তেমনি ক্রিকেটকে ভরিয়ে দিয়েছেন আনন্দের ঝরণাধারায়। ‘এরা খেলায় অনেক কিছু দিয়েছেন। এঁরা খেলাকে বাঁচিয়েছেন মৃত্যুর হাত থেকে। দ্রুত রানের বদলে ধীর রানের পৃথিবীব্যাপী প্রতিযোগিতার হিসাব-খাতা এঁরা পুড়িয়ে দিয়েছেন। কয়েদীর মৃত্যুশীতল চাহনি নিয়ে ক্রিকেটাররা যেখানে চেয়ে থাকেÑ সেখানে এঁরা গেয়েছেন জীবনের গান। এই তিন ক্রিকেট-মাস্কেটিয়ার্স উৎফুল্ল শৌর্যে অনতিক্রান্ত। অপরিসীম অর্থক্ষুধায় ক্রিকেটকে মারছে একদিকে কর্তৃপক্ষ, আনন্দলক্ষ্মী শিউরে উঠছেন কুবের-সঞ্চয় দেখে, অন্যদিকে পরাজয়ভীতি আচ্ছন্ন করেছে অধিনায়ক ও খেলোয়াড়দের। বক্সিংয়ের প্রদর্শনী-যুদ্ধের মতো ড্র করার প্রাণহীন ক্রিকেটযুদ্ধ। হারবো নাÑ আগে বলত বীরপুরুষ। তারা হয় হারত, নয় জিতত। হারবো নাÑ বলছে এখনকার সাবধানী ক্রিকেটাররা। ফলে তারা প্রায়ই হারছে কাপুরুষের মতো, জিতছে আরো কম, বেশি করছে ড্র। নিশ্চিত-নিরাপদ একটি মাঝারিপনা গ্রাস করেছে ক্রিকেটকে। বিলেতি ওল্ডদের রুচিহীন পোশাক আর নি®প্রাণ নাচের আড়ম্বরে ধরা পড়েছে ক্রিকেট’। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ‘দুষ্টু বালক’ খ্যাত সিড বার্নসকে নিয়ে লিখেছেন ‘শেরউড বনের ক্রিকেটার’। ডন ব্রাডম্যানের দলের এই ক্রিকেটারের খ্যাতি ও অখ্যাতি তুমুলভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। বার্নসের ব্যক্তি জীবনের চমকপ্রদ দীর্ঘ কাহিনী তুলে ধরে লেখক লিখেছেন: ‘শেরউড বন গেল কোথায়! বার্নসের ভিতরে একটা অবুঝ দুরন্ত ক্রন্দন ও সন্ধান। সেই হাহাকারের স্বরূপ বার্নস নিজে সম্পূর্ণ বোঝেন নি। রবিন হুডের কয়েক শতাব্দী পরে তিনি জন্মেছেন। রবিনের সাম্রাজ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ভিতরের উৎকণ্ঠা যত তীব্র হয়েছে বাইরের জগতে তত উগ্র ও বেখাপ্পা হয়ে পড়েছেন। জীবনে বেড়া টপকানোর শেষ হলো না।’ (বল
পড়ে ব্যাট নড়ে)।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’। এই গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত। মহান ক্রিকেটার ভিক্টর ট্রাম্পার ‘বিদ্যুতের অক্ষরে ক্রিকেটে মহাকাব্যের অনেকগুলি পৃষ্ঠা লিখে গিয়েছিলেন মাঠে-মাঠে’। স্বপ্নের নায়ক ট্রাম্পারকে জীবনে প্রথম আউট করার পর স্পিনার আর্থার মেইলীর অনুভূতি হয়েছিল এমন : ‘অপসৃয়মান সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে কিন্তু কোনো জয়ের আলো ছিল না। একটি সুন্দর পাখীকে আমি মেরে ফেলেছিÑ হ্যাঁ, ঠিক তাই করেছিÑ আমি অনুভব করেছিলুম’। ট্রাম্পার মারা যাবার পর বলা হয়েছিলÑ ‘ঈগলের পাখা থেমে গেছে, এখন কাক আর চিলের কাল’। তার সম্পর্কে লিখেছেন: ‘পরমোজ্জ্বল সুপ্রখর প্রতিভা, অথচ সদানন্দ সুস্মিত মানুষ। প্রচ-তম আক্রমণের মধ্যেও সৌজন্যøিগ্ধ। সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাট করতে গিয়েছেন। মাঠ ভিজে, ভিজে মাঠের মহাপাতক জ্যাক স্যান্ডার্স বল করছেন। তার প্রথম বল ট্রাম্পারকে হারিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্যান্ডার্স ভাবলেন- পেয়েছি। সকলেই তাই ভাবল। ট্রাম্পার হাসলেন। এগিয়ে গিয়ে বললেনÑ পুরনো দোস্তের সঙ্গে একী ব্যবহার? যা হোক ভায়া, আজ তোমার দিন কি আমার দিন। সে দিনটা কারো নয়- একমাত্র ক্রিকেট-দেবতার। ট্রাম্পার ষাট মিনিটে একটি দেবভোগ্য সেঞ্চুরি করলেন’। (ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট)।
শ্রেষ্ঠতম ক্রীড়ার মহান নীতির প্রতিপালক আম্পায়ার। আম্পায়ার ছাড়া ক্রিকেট খেলার কথা ভাবা না গেলেও তাদের অবদানকে কেউ গুরুত্ব দিতে চান না। ক্রিকেট মাঠে তাদের অবহেলিত উপস্থিতি। আম্পায়ারদের প্রসঙ্গে শঙ্করীপ্রসাদ বসু চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন: ‘হিন্দু বিয়ে বাড়িতে পুরোহিতের ঐ একই অবস্থা। উৎসবের অগ্নিসাক্ষী ও মন্ত্রপাঠ যিনি করাচ্ছেন, তিনি কে, কি রকম দেখতেÑ তা কি ভালো ক’রে চেয়ে দেখা হয়? তিনি না এলে চেঁচামেচি, থাকলে খেয়াল নেই। কাজকর্ম মিটবার পরে ভক্তিমতী স্থূলাঙ্গী বাড়ির গৃহিণী গলায় কাপড় দিয়ে হাঁসফাঁস ক’রে তাকে প্রণাম করেন, তিনি যদি অধিকন্তু হৃদয়াবতী হন, তাহলে মিছরির জলের সঙ্গে পান্তুয়ার অর্ডার দিয়ে সোরগোল তোলেন, তারপরে জানিয়ে দেন বিগলিত শ্রদ্ধায়Ñ ‘ঠাকুরমশাই তো আর কিছু খাবেন না’। এদিকে যে-সব ছেলে-ছোকরা কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পরিবেশনের নামে হট্টগোল করেছে, কনেকে ঘুরিয়েছে সাতপাক, পাউডার-ঘষা ঘাড় উঁচু ক’রে বরের ফ্রেন্ডরূপে বিয়ে দেখতে গিয়ে ভালো ক’রে দেখেছে কনের ফ্রেন্ডদের- তাদের কাছে চিরকালই পুরুতব্যাটা পাজি, মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে টাকা হাতাবার যম। দয়া ক’রে যদি তারা বিবাহ-সম্পাদক আর্য ব্রাহ্মণটিকে কত ধরে দেয়া হয়েছে খোঁজ নিতেন! আম্পায়ারের ‘মাহিনা’ কত খোঁজ নিয়েছেন আপনারা?’ (ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট)।
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘নটআউট’। ১৯৬৪ সালে ইডেন গার্ডেনে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচের শীতের তীব্র হাওয়া হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও পাঁচ দিনের খেলা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। ক্রিকেট থেকে ‘অনিত্যের মধুপান’ করেছেন। তার রোমান্টিক চোখে ক্রিকেটীয় সুধা পান করার পাশাপাশি ক্রিকেট মাঠের রসিকতাটুকুও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। পঞ্চ দিনস্থায়ী বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশটি তার কাছে মনে হয়েছে বিশ্বজীবনের খ-রূপে। তাই ম্যাচ শেষে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর হৃদয়ে বয়ে যায় আরেক অনুভূতির মিশ্র অনুভূতি: ‘.........আমরা সকলে যখন পঞ্চম দিনের শেষে হাজির হলুম- যখন মাঠ ছেড়ে যাবার সময় এল- তখন সহসা অভাবিত নিঃস্বতায় ভরে গেল মন- ক্রিকেট হারালুম বলে নয়, অনেক মানুষের সঙ্গ হারালুম বলে। ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে বহু মানুষের সঙ্গ পাই আমরা- আজ ক্রিকেট আমাদের সামাজিক উৎসব।
একটা অদ্ভুত সত্য অনুভব করলুম- ফুটবল জাতীয় ক্রীড়া হলেও সামাজিক অনুষ্ঠানের চেতনা মনে জাগায় না। ক্রিকেট তেমন মনোভাবকে জাগাতে পারে এই জন্য যে, সে অনেকগুলি মানুষকে অনেকক্ষণ একত্র রাখে। নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়, নতুন সান্নিধ্যের। রেলের কামরায় বহু ঘণ্টার যাত্রা যেমন মানুষকে এনে দেয় অচেনা মানুষের কাছে, এখানেও তেমনিÑ বিদায় নেবার আগে এখানেও আবার ফিরে দেখা হওয়ার কামনা- যে ইচ্ছার জীবন যদিও পথে নামার পরেই পায়ে-পায়ে গুঁড়িয়ে যাবে।’ (নট আউট)। ক্রিকেট মাঠের উপেক্ষিত দ্বাদশ-ব্যক্তিদের মনোবেদনা লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি: ‘তাকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্রিকেটের এই বাধ্য বাহনটি অঙ্গে জিন চড়িয়ে রেডি থাকবেন- কখন ছুটতে হয়। নিজ দলের ব্যাটিং ও ফিল্ডিং কোনো সময়েই তার অব্যাহতি নেই। সারাক্ষণ জামা-জুতো পরে তটস্থ। যখন নিজ দল ফিল্ডিং করছে, তখন তো ‘ঘরের বাহিরে দ-ে শতবার’। কারণ এগারোজন খেলোয়াড় বিনা অসুস্থতায় মাঠে বিরাজ করতে পারে না, কিন্তু যখন নিজ দল ব্যাটিং করছে, তখনো অ্যাটেনশন। নিজ দলের ফিল্ডিং করার সময়ে দ্বাদশ ব্যক্তি মাঠে নামলে তবু কিছু মর্যাদা পায়। কারণ সাধারণভাবে সে ফিল্ডিং-এ পারদর্শী এবং বোলার ও উইকেটকিপার ছাড়া সকলেই এক জাতীয় ফিল্ডার। (নট আউট)।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘লাল বল লারউড’ গ্রন্থে বডিলাইন সিরিজের অন্যতম নায়ক ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউডকে কেন্দ্র করে বডিলাইন সিরিজের গোটা ইতিহাসের রোমাঞ্চকরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ট্রাজিক চরিত্র হ্যারল্ড লারউড। তার জীবনে ছিল নাটকীয়তা ও রোমাঞ্চের সমন¦য়। নটিংহ্যাম্পশায়ারের কয়লাখনির এই শ্রমিক খনির অন্ধকারের মধ্যে কাজ করার সময় ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখতেন। অদম্য মনোবল ও তীব্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তিনি ওঠে আসেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাদপ্রদীপে। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে ইংল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়া সফরটি কুখ্যাতি পায় ‘বডিলাইন’ সিরিজ হিসেবে। অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার এবং অপ্রতিদ্বন্দ¡ী ডন ব্রাডম্যানকে টার্গেট করার ক্ষেত্রে উদ্ধত, কঠিন শীতল সাহস ও উত্তেজক মেজাজের ধুরন্ধর অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের হাতের পুতুল হয়ে ওঠেন লারউড। বিরল জাতের এই ফাস্ট বোলার অস্ট্র্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের মাথা ও শরীর লক্ষ্য করে গোলার মত যে মরণঘাতি বাউন্সার ও বাম্পার ছুঁড়ে মারেন, যা লেগ-থিয়োরি হিসেবে খ্যাত, তা তীব্র বিতর্কের জন্ম নেয়। এমনকি এ নিয়ে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেকার সম্পর্ক ক্ষুণœ হওয়ার উপক্রম হয়। যাবতীয় বিতর্ক ও সমালোচনাকে মাথা পেতে নিয়ে সমস্ত শক্তি নিংড়ে বল করে সিরিজ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হ্যারল্ড লারউড। অথচ অকারণ অপবাদের কারণে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে ইংল্যান্ড দলের হয়ে তার আর ক্রিকেট খেলা হয়নি। বডিলাইনের শিকারী এবং শিকার যিনি একদেহেÑ সেই লারউডের নামে ইতিহাসনাট্যের যবনিকামোচন করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। লারউডের উঠে আসার কাহিনী বিস্ময়কর : ‘আগের গোটা রাত্রি সে কাজ করেছে কোলিয়ারীতে। তবু খেলতে নামল ম্যাচে। এত গরীব যে, ক্রিকেট-বুট জোটাতে পারেনি। সাধারণ জুতো পরেই খেলছে। কয়েক ওভার বল করার পর নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। সঙ্গী খেলোয়াড়রা বলল, যাও যাও, বিশ্রাম করো, আর খেলে কাজ নেই। ছেলেটি শুনল না। বল ক’রে চলল- কারণ, সে খনির অন্ধকারের মধ্যে কাজ করার সময়ে ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখে। অন্ধকারেই সে কল্পনার বল ছোঁড়েÑ বল গিয়ে ছিটকে দেয় স্টাম্প- তার শব্দ ছড়িয়ে পড়ে- ঘুরপাক খায় টানেলের গায়ে-গায়েÑ কল্পনার কানে সে শোনে। সেখানে এই সত্যকার খেলায়- জীবনের প্রথম এই বড় খেলায়- ঘেমে যাবে সামান্য নাকের রক্তের জন্য? কখনো না, কখনো না। রক্ত মুছে ছেলেটি ছুটতে শুরু করে আরও জোরে। আরও জোরে বল- আরও জোরে। রক্ত পড়া বেড়ে যায়। গলগলিয়ে ঝরে পড়ে- জামা রক্তে রাঙা। সবাই বলে- চলে যাও, চলে যাও। না- না- না। হঠাৎ ছিটকে পড়ে মিডলস্টাম্প- আঃ! রক্ত-মোছা হাতে আবার বল ছোঁড়ে- রক্তপাতে আর অসহ্য আনন্দে দুর্বল হয়ে পড়ে সে। তবু- তৃতীয় বল- ভেঙে গেল অফস্টাম্প। রক্তের মূল্যে ছেলেটি জীবনের প্রথম হ্যাটট্রিক পেল! সে ক্রিকেট খেলবে না? ক্রিকেট যে তার কাছে বাঁচার একমাত্র কারণ!’ (লাল বল লারউড)।
দ্রুতগামী বোলারের মনের কথাকে লেখক ভাষা দিয়েছেন এভাবে: ‘বোলিং হয়েছে তীব্র থেকে তীব্রতর। নিজের শরীর লাল ক’রে ফাস্ট-বোলারকে বল করতে হয়। তাদের বিষয়ে বলা হয়, পায়ের বুট-জুতোর মধ্যে তাদের মাথা লুকিয়ে থাকে। ঘর্ষণে-ঘর্ষণে পায়ের চামড়া উঠে যায়, শরীর জ্বলতে থাকে যন্ত্রণায়, লুটিয়ে পড়ে কান্তিতে, কিন্তু যখন ছিটকে যায় উইকেট- আঃ অপরূপ সে সঙ্গীত! যখন ব্যাটসম্যানের শরীরকে হিম ক’রে দিয়ে গা ছুঁয়ে বেরিয়ে যায় উষ্ণ বলÑ তখন কিবা উপভোগ্য সেই আতঙ্ক! -আমার বলে খেলার সময়ে ভুল করা চলবে না, কদাপি না, আমি ফাস্ট-বোলার! যদি ভুল নড়েছÑ উড়িয়ে নিয়ে গেঁথে দেব স্ক্রীনে। আমি ফাস্ট-বোলার- হ্যাঁ, আমার আক্রমণ শারীরিক আক্রমণ। আমার রক্তে পুড়ে ঐ আগুনের গোলার মতো বল ছুটেছে? ফাস্ট-বোলিংকে ভয় করে না কে?’ (লাল বল লারউড)।
শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সপ্তম গ্রন্থ ‘সারাদিনের খেলা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন তিন কৃতী ‘ভারতীয়’ ক্রিকেটার কে এস রণজিৎ সিংজী, কে এস দলীপ সিংজী ও পতৌদির নবাব ইফতিখার আলী খান। এদেরকে নিয়ে ইংরেজ ক্রিকেট লিখিয়েদের মন্তব্যগুলো খুঁজে পেয়েছে তার ক্রিকেট-পিপাসু মন। পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজদের মত করে ক্রিকেট খেলতেন রণজিৎ সিংজী। তার বিদায় ইংরেজদের ক’রে তোলে আবেগমথিত: ‘শেষ বল গড়িয়ে গেছে মাঠের উপর দিয়ে। এবারের মতো খেলা শেষ। .... লর্ডসের গ্র্যান্ড-স্ট্যান্ড নির্জন, শূন্য। ক্রিকেটকে বিদায় দিয়েছি আমরা, আর বিদায় দিয়েছি ক্রিকেটের রাজাকে। ক্রিকেট আবার আসবে যখন ফিরবে বসন্ত, নতুন তৃণ, তরু। কিন্তু রাজা ফিরবেন না। কারণ জামসাহেব এখন চল্লিশে পৌঁছে গেছেন। দেহ হয়ে পড়েছে স্থূল। সেই সঙ্গে তার রাজ্য নবনগর। সেখানকার মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, উজ্জ্বল রৌদ্র, মসলাগন্ধ, তালীবন তাকে ডাকছে রাজকর্তব্য পালনের জন্য। প্যাভিলিয়নের সিঁড়ি দিয়ে মুখভরা হাসি নিয়ে লঘুপদে নেমে আসতে আর তাকে দেখা যাবে না। সুখরৌদ্রের মধ্যে আসীন থেকে তার অতুলনীয় রূপকলা দেখতে দেখতে সারাদিন কেটে যেত। তারপর যখন সন্ধ্যার ছায়া আড়াআড়ি রেখা টেনে দিত তৃণাস্তীর্ণ মাঠের উপরে, তখন আমরা ফিরে যেতাম মাঠ থেকে তৃপ্তিভরা মন নিয়ে- না, তা আর ঘটবে না। বহু সমাদৃত ধন্য অভিনেতা শেষ রজনীর শেষে বিদায় নিয়েছেন। এখন তিনি শুধু স্মৃতি-সুখস্মৃতির রাজ্যে। নমস্কার করি, নমস্কার! জাম সাহেব। ক্ষুদ্র রাজ্যে রাজকুমার-বৃহৎ খেলার সম্রাট’। (সারাদিনের খেলা)।
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ¡ী সম্রাট শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলাদেশে খুব বেশি পরিচিত বলে মনে হয় না। যে কারণে তার কোনো গ্রন্থ খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব। তবে ক্রিকেট-পিপাসু কিছু অনুরাগী আছেন, যারা তার লেখার সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচিত। এদের একজন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ নূরুল আনোয়ার। রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ক্রিকেটের পাগলপ্রেমিক এই ভদ্রলোক শুধু তার অনুরাগীই নন, তাকে ‘সর্বদাই অত্যুক্তিতে উদ্ব্যস্ত’ করে চলেছেন। যে জন্য প্রতিটি গ্রন্থে ডঃ নূরুল আনোয়ারকে প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন লেখক। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে অধ্যাপক নূরুল আনোয়ারের মূল্যায়নটা এমন: ‘ইডেনে শীতের দুুপুর’ (১৯৬০), ‘রমণীয় ক্রিকেট’ (১৯৬১), ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ (১৯৬২), ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’ (১৯৬৩), ‘নট আউট’ (১৯৬৫), ‘লাল বল লারউড’ (১৯৬৭) এবং ‘সারাদিনের খেলা’ (১৯৭৬)Ñ এই সাতটি ক্রিকেট-কাসিকের যে কোনোটিই পড়তে থাকলে ঐন্দ্রজালিক কথোপকথন, দুর্লভ বাক্শক্তি, চাতুর্যপূর্ণ লেখার শক্তি ও মনোরমময় বর্ণনা পাঠককে নিমেষে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলবে (যেমন হয়ে থাকে উচ্চতর প্রতিভাবান গায়ক-গায়িকার উচ্চতর রীতির গান শুনে), স্বচক্ষে দেখা বা শোনা ক্রিকেট খেলা, খেলোয়াড়দের চরিত্র, ক্রিকেট-ঘটনা পাঠকের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং বিমূর্ত ভাব সৃষ্টি করবে। পাঠকের সৌভাগ্য, বৈষ্ণব সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছ থেকেÑ জীবন থেকে টেনে এনে, অন্তরঙ্গ অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টি ক্রিকেটের বহু চরিত্র ও ঘটনাকে তারা অনুপম সাহিত্য মাধ্যমে পড়তে পেরেছেন। সংস্কৃতিমান বাঙালি ক্রিকেট-অনুরাগী সন্ধান পেয়েছেন অবিশ্বাস্য আনন্দলাভের এক দুর্লভ উৎস। ক্রিকেট-অনুরাগীদের মধ্যে যারা সমাজসচেতন ও মননসমৃদ্ধ, যারা সকল ঘটনা বিশ্লেষণধর্মী মন নিয়ে দেখে থাকেন এবং সঙ্গীত, সাহিত্য ও ক্রীড়া দিয়ে অবিমিশ্ররূপে যাদের মন তৈরি, তাদের কাছে শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট গ্রন্থগুলো মূল্যবান দলিল ও অমূল্য শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হবে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির গভীরতর বিষয়কে ধারণ করতে পেরেছেন বলেই শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট-লেখা শীলিত ও আলোকিত ও বর্ণাঢ্যময় এবং বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে উত্তীর্ণ’।
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের রূপকার শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটবিষয়ক সাতটি অসাধারণ গ্রন্থ লিখে চুকিয়ে দিয়েছেন তার লেনদেন। এ কারণে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: ‘ক্রিকেট লেখার সময় সারাক্ষণ মাথায় ক্রিকেট ঘুরত। অনেকগুলো ক্রিকেট বই লেখার পর মনে হল, আমার যতদূর সাধ্য লিখে ফেলেছি। আরও ভালো কিছু লেখার ক্ষমতা নেই। এখন ইতি টানাই উচিত। তাছাড়া আমার মূল কর্মবৃত্তির সঙ্গে এই ক্রিকেট-লেখক ভূমিকার একটা সংঘাত ছিলই’।
শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেট লেখা থেকে দূরে সরে গেলেও পাঠকরা কিন্তু তাকে কখনো ভুলতে পারেনি। ক্রীড়া সাহিত্যের যে রস তিনি উপহার দিয়েছেন, তা পাঠকদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। আর কোনো লেখক এখন অব্দি তার শূন্যস্থান পূরণ করতে না পারায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু পাঠকের মনের মণিকোঠায় চির-অম্লান হয়ে আছেন। তার লেখা এখনকার পাঠকদের দারুণভাবে আপ্লুত করে। আর এ কারণে তার সাতটি গ্রন্থের সমন¦য়ে ১৯৭৬ সালে দুই খ-ে ‘ক্রিকেট অমনিবাস’ এবং ১৯৯৯ সালে বাছাইকৃত লেখা নিয়ে ‘বাছাই ক্রিকেট’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
ষাট দশকের মাঝামাঝি গগনচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাবস্থায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখির সঙ্গে তার রাখীবন্ধন ছিন্ন করেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে কোলকাতায় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসলে একটুখানি নড়ে বসেন তিনি। প্রায় তিন দশকে বদলে গেছে ক্রিকেট। ওয়ানডে ম্যাচ ক্রিকেটে রীতিমত বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ধ্রুপদী ক্রিকেটের পরিবর্তে এখন একদিনের রোমাঞ্চকর ক্রিকেট। শুধু ক্রিকেট নয়, দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও অনেক বদল ঘটেছে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুও মনে করেন: ‘যুগ বদলেছে। ক্রিকেটের পঞ্চদিবসী অবসর বিনোদনে মানুষের মন নেই। বাঙালি জাতি এখন ঘোর-ওয়ার্ক-কালচারী-অফিস-আদালতে সে দমবন্ধ ক’রে খেটে যাচ্ছে। সে জন্য টানা পাঁচদিন অফিসে কলম-ধর্মঘট না ক’রে একদিনের ধুদ্ধুমার ক্রিকেটের নাচনে মেতেছে।’ পরিবর্তনের এই হাওয়াকে শঙ্করীপ্রসাদ বসু অস্বীকার করেননি। বড় ধরনের ধাক্কা খেলেও মেনে নিয়েছেন যুগ-রুচিকে। যুগের চাহিদাকে।
‘সুপারহিট ক্রিকেটিলা’ শিরোনামে ‘দেশ’ পত্রিকায় তিনি লেখেন: ‘এখন হিসেবি উত্তেজনা। এখন ঘড়ির খেলা আর কড়ির খেলা। ওভার মেপে, ঘড়ি ধরে বলতে হবে, ওহে ব্যাটধারী, এইবার তুমি ঠ্যাঙাড়ে হও, খেপে যাও, এসে গেছে ধাতানি-পর্ব (স্লগ-ওভারস্)। এখন-মার কাটারি, ধুন্ধুমার। নবমীর পাঁঠাবলি। ড্যাংডাং, ড্যাড্যাং পাঁঠা পড়ছে আর রক্তপাগল ভক্তরা হিংস্র উল্লাসে মাঠ .......একদিনের ক্রিকেটকে ঠেকানো যাবে কী ক’রে এই মুক্ত অর্থনীতির দিনে। যখন ফাস্ট ফুডে বাজার ছেয়ে গেছে! সুতরাং পুরনো রীতিÑ দূর হঠো দূর হঠো। রক্তে আমার ঝড়ের মাতামাতি, যায় যদি যাক নিভে আমার প্রাচীন শ´েখর বাতি’। এরপর তিনি সোনায় মোড়া তার ক্রিকেট সাহিত্যের কলমখানি সম্ভবতঃ চিরদিনের মত রেখে দিয়েছেন দেরাজে। শিক্ষক অলোক দাসের ভাষায়: ‘বৈষ্ণব শাস্ত্রের গভীর পা-িত্য ও অভিজ্ঞান ক্রমে ক্রমে বিবেকানন্দ লোকমাতার গৈরিক বর্ণে আচ্ছন্ন হ’ল। হারিয়ে গেল ইডেনের সবুজ মাঠ’। কিন্তু শঙ্করীপ্রসাদ বসুর যারা অনুরাগী পাঠক, তারা তার অনুপস্থিতি অনুভব করেন পলে পলে। তাদের একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রসেনজিৎ বন্দোপাধ্যায় : ‘সকালের খবরের কাগজের জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকতাম। কাগজ পেয়ে প্রথমেই খেলার পাতাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা! চুলোয় যাক পরিষ্কার চোখ রাঙানি, বাবার ধমকানি। এই খেলার পাতাতেই প্রথম তার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং প্রথম দর্শনেই (পঠনেই) গভীর প্রেম। কে এই শঙ্করীপ্রসাদ বসু? ইনি তো কোন কাগজের সাংবাদিক নন! লেখার শৈলীটিও তো সাধারণ ক্রীড়া সাংবাদিকের মতো নয়! এ এক নতুন ধারা, নতুন রীতি। ক্রিকেট যে সাহিত্য হতে পারে, সাহিত্যের মন্দিরে এদেশে এতদিনের ব্রাত্য ক্রিকেটের যে অনায়াস গমনাগমন থাকতে পারে, আমার কিশোর চোখ আগে তা দেখেনি। খ্যাতনামা ইংরেজ ক্রিকেট-সাহিত্যিকদের কোনো লেখা তার আগে পড়িনি। ‘শঙ্করীপ্রসাদের’ হাত ধরেই প্রথম ক্রিকেট সাহিত্যের আঙিনায় উঁকি দিলাম এবং স্তব্ধ হয়ে গেলাম এর বিশাল সমারোহ এবং আভিজাত্য দেখে। তারপর থেকে তার হাত আর ছাড়িনি।’ . .........ষাটের দশকে যে অসাধারণ চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট-সাহিত্যের রস আস্বাদন করেছি, আজ এই সহস্রাব্দের মুখে দাঁড়িয়ে তার অভাবে নিদারুণ তৃষ্ণার্ত আমরা। এই ফরমাইসী, চটুল, অন্তঃসারশূন্য, ক্রীড়া-সাংবাদিকতার যুগে শঙ্করীদা’র মতো উচ্চ শ্রেণীর লেখনীর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। বিশ্বাস করি, তার লেখা পড়লে নতুন প্রজন্মের মানুষরা সৎ ক্রীড়া-সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত না হয়ে পারত না। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? এই বয়সে কি আর তিনি নতুন কলমে নতুন কালি ভরে নতুন চশমা পরে খেলার কথা লিখবেন? জানি না। বোধ হয় লিখবেন না, খেলার প্রেরণা অনুভব করবেন না। তার মন এখন অন্য গগনচুম্বী, যেখানে ঠাকুর-স্বামীজি-নেতাজির জীবন তাকে আরও গভীরভাবে আকর্ষণ করে। হয়তবা এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতির গভীরতর আকর্ষণে তিনি বস্তুজীবনের কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আর তেমন টান অনুভব করেন না। হয়তবা কাঞ্চন-কৌলীন্যের দাস, হৃদয়হীন, কম দক্ষ খেলোয়াড়ের ক্রীড়াদক্ষতা আর তাকে সেভাবে চঞ্চল করে না। হয়তবা তরলমতি পাঠকদের পড়াশুনার গভীরতা বা ব্যাপ্তির বিষয়েই তিনি সন্দেহমুক্ত নন। সে যাই হোক, আপন পথে চলেই তিনি বিজয় পতাকা ওড়ান। তাতে আমাদের মত গুণমুগ্ধদের আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু যদি কখনও, কোনোদিন কলমে আবার খেলাকে তুলে নেন, যদি আবার গদ্যের মধ্যে পদ্য করে ক্রিকেট-সুন্দরীর গায়ে
রঙ-বেরঙের নকশা কাটেন, যদি ময়দানের খেলুড়েরা রাজপুত্র, কোটালপুত্র হয়ে তার ক্রিকেট-রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়ে, যদি অলস শীতের দুপুরে গ্যালারিতে বসে থাকা মানুষেরা তার ক্রিকেট-অ্যাম্ফিথিয়েটারে ঢুকে পড়েÑ তবে? তবে আমি আবার ইডেনে আসব, তার হাত ধরে’।
এখন অনেক পাল্টে গেছে ক্রিকেট। এসেছে ওয়ানডে ক্রিকেটের জোয়ার। ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলার বোলের মত ক্রিকেটেও দ্রুততার ঝড় বইছে। ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে যেমন উত্তাল সমুদ্রের প্রলয়ঙ্করী ঢেউ, তেমনি বোলারদের বলে মহাকাশ যানের তীব্র গতি। ক্রিকেটে এখন রঙের বাহার। নানা রঙে ধাঁধিয়ে যায় চোখ। ২৪ ঘণ্টাই এখন ক্রিকেটের। দিনেও ক্রিকেট, রাতেও ক্রিকেট। ফাড লাইটের আলোয় ক্রিকেটের রূপ খোলতাই হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ড্রইংরুমে নিয়ে এসেছে ক্রিকেটকে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায় ক্রিকেটের মাধুর্য। টিভি আম্পায়াররা যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে সিদ্ধান্ত দেন, তেমনি দর্শকরা একই বল নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে পারেন। সঙ্গে নানা গ্র্যাফিক্স ও তথ্যের সমাহার। ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেটার ও ক্রিকেট প-িতদের পু´খানুপু´খ বিশ্লেষণ। সবই টাটকা। এখন সবচেয়ে সহজলভ্য পণ্য ক্রিকেট! পণ্য তো বটেই; কেননা ক্রিকেটকে ঘিরে বিশাল ব্যবসা গড়ে ওঠেছে। আর এই ব্যবসায়ীরা তাদের মর্জিমাফিক পরিচালনা করছেন ক্রিকেটকে। যে কারণে ক্রিকেটের সেই বনেদীয়ানাটা হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্রিকেটকে ঘিরে কত গল্প আর কাহিনীর ঘনঘটা। ইলেট্রনিক্স মিডিয়া আলাদীনের চেরাগের মত ক্রিকেটের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় দর্শকের দরবারে হাজির করলেও তাতে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। কল্পনাশক্তি আর রসের ভিয়েন মিশিয়ে কলমের ক্রিকেটের ঐন্দ্রজালিকতা পাঠককে যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়। অথচ ক্রিকেটের নতুন দিনের সুর, ছন্দ ও রোমাঞ্চকে শব্দে শব্দে খোদাই করার জন্য নেভিল কার্ডাস, জ্যাক ফিঙ্গলটন কিংবা পেলহ্যাম ওয়ার্নারের মত সহজাত সৃজনী ক্ষমতার অধিকারী ক্রিকেট লিখিয়েদের অভাব এখন দারুণভাবে অনুভূত হয়ে আসছে। এরা ক্রিকেট সাহিত্যকে মহাসমৃদ্ধশালী ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পংক্তিতে স্থান করে দেয়ার পাশাপাশি চিরঞ্জীব করে রেখেছেন সেই সময়ের ক্রিকেটার ও ক্রিকেটকে। বাংলা ভাষায় ক্রিকেটকে ভালবেসে এই কাজটি করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তিনি স্বপ্ন, কল্পনা ও ভালবাসা দিয়ে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে যে পথ দেখিয়ে গেছেন, তা এ কালের ক্রিকেট রসিকদের কাছে মনোবেদনার কারণ হয়ে আছে। কেননা শঙ্করীপ্রসাদ বসু সরে দাঁড়ানোর পর বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য যেন হঠাৎ থমকে গেছে। কলমের ক্রিকেটের সেই মাধুর্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালির ব্যাটে-বলে যখন নতুন দিনের সূর্য, তখন বাঙালির ক্রিকেট সাহিত্যে যেন অস্তগামী সূর্যের আভা। বাঙালিদের একটি দল যখন টেস্ট ক্রিকেট খেলছে এবং সৌরভ গাঙ্গুলি শুধু ভারতকে নেতৃত্বই দিচ্ছেন না, বিশ্ব ক্রিকেটে গড়ছেন নতুন নতুন মাইলফলক, তখন বাঙালি ক্রিকেট লিখিয়েদের কলমে কেন বেলা শেষের গান? এমন একটা সন্ধিক্ষণে বারবার মনে পড়ে যায় শঙ্করীপ্রসাদের কথা। তার মিষ্টি-মধুর কলমের কথা।
তথ্য সূত্র :
১) বাছাই ক্রিকেট Ñশঙ্করীপ্রসাদ বসু
২) শঙ্করীপ্রসাদ : ব্যক্তি ও সৃষ্টি Ñশ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থ
ক্রীড়াজগত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৫
বিষয় : ফুটবল
বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের হল্কা
সারা দুনিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তাপে টগবগিয়ে ফুটছে। স্বাভাবিক নিয়মেই এর হল্কা এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। সুদূর ইটালি থেকে বাংলাদেশÑ পথ কিংবা ভৌগোলিক দূরত্ব নিঃসন্দেহে কম নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞাপন ও প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগীর পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকরাও ঘরে বসেই বিশ্বকাপ ফুটবলের সুধারসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রত্যক্ষ করছেন স্বপ্নিল ও সৌকর্যময় ফুটবল। ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবাইকেই বিশ্বকাপ ফুটবল
মাতিয়ে রেখেছে। রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ফুটবলের সৌন্দর্য ও উত্তেজনায়
মেতে আছেন সবাই।
এমনিতেই এ দেশের মানুষ ফুটবলের নামে পাগল। নিজেদের গতিহীন ও অনুজ্জ্বল জীবনে ফুটবলের মাঝে হয়তো তারা গতি ও আনন্দের দীপ্তি খোঁজেন। তাই বিশ্বকাপ ফুটবলের সবটুকু রূপ-রস-গন্ধ ও নির্যাস তারা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়। যে কারণে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দেশের সব শহর-বন্দর-জনপদ এখন বিশ্বকাপ ফুটবলের জ্বরে আক্রান্ত।
বিশ্বকাপ ফুটবলের কারণে সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট, বিপণি-বিতান জনবিরল হয়ে পড়ে। যানবাহন চলাচলও হালকা হয়ে আসে। সে সঙ্গে গভীর রাতে কী এক মোহে জেগে ওঠে সারা দেশ। রাত জেগে খেলা দেখার রেশ চলে পরের দিন পর্যন্ত। কেননা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি হেঁশেল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও গুলতানি চলতে থাকে। যারা ফুটবলের বকলম, তারাও জাহির করেন নিজেদের পা-িত্য। এমনকি আসলাম, ওয়াসিম, কায়সার হামিদ, সাব্বির কেÑ এ কথা অনেকেই বলতে না পারলেও ম্যারাডোনা, গুলিত, ভিয়ালি, কারেকা, ম্যাথিউস, লোথারের জীবনবৃত্তান্ত এখন তাদের কণ্ঠস্থ। বিশ্ব ফুটবলের শক্তিশালী দেশ পশ্চিম জার্মানির ফুটবল কেন ভালো লাগে না, দীর্ঘ দু’দশক শিরোপা না পেয়ে তবুও ব্রাজিল কেন প্রিয় কিংবা সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন কেÑ যে কারো কাছে এর উত্তর পাওয়া যাবে।
খেলাধুলার খবর প্রকাশের ব্যাপারে বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো এমনিতেই হাড়-কিপটে। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে সাধারণত খেলার খবর প্রথম পাতায় ঠাঁই পায় না। অথচ বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে পরিস্থিতি পুরোপুরিভাবে উল্টো। নানান রঙের বাহার দিয়ে ঢাউস সাইজের পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি প্রতিদিনের ‘লিড নিউজ’ হয়ে আসছে বিশ্বকাপ ফুটবল!
সে সঙ্গে প্রথম পাতার প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে থাকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ছবি ও খুঁটিনাটি সংবাদ। বিশ্বকাপ ফুটবলের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ পাঠকদের আগ্রহ ও চাহিদা।
সারাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা। মূলত ঢাকা স্টেডিয়াম এবং এর আশপাশ এলাকাজুড়েই রাজধানীর ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকা- পরিচালিত হয়। ফলে সারা বছরজুড়েই ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকা কোনো না কোনো খেলা নিয়ে মেতে থাকে। একদম কিছু না থাকলেও খেলোয়াড়, কর্মকর্তা কিংবা খেলাপাগল কিছু লোক স্টেডিয়াম এলাকায় নিয়মিত আড্ডা মারেন। তা না হলে তাদের পেটের ভাত নাকি হজম হয় না! কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার পর ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকার নিজস্ব বনেদীয়ানা, চঞ্চলতা ও আড্ডাটুকুও কে যেন কেড়ে নিয়েছে। সন্ধ্যার পর ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকা এখন খাঁ খাঁ করে। এমনকি প্রথম বিভাগ হকি লীগ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও দর্শকদের তা টানতে পারছে না। অবস্থা সুবিধের হবে না মনে করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন মা ও মণি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট পিছাতে পিছাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের পরে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ফেডারেশনও তাদের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। দুনিয়া তোলপাড় করা বিশ্বকাপ ফুটবলের ঢেউ বাংলাদেশে যেভাবে আছড়ে পড়েছে, তার কোনো তুলনা হয় না। অনেকটা আফিমের নেশার মতো বুঁদ করে রেখেছে।
আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদীদেরও সরগরম করে রাখবে। কখনো হাসাবে। কখনো কাঁদাবে।
সাপ্তাহিক মূলধারা : ১৭ জুন ১৯৯০
তবুও ভালবাসি ফুটবল
এই পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কোনটি? কোনো রকম দ্বিধা না রেখে বলা যায়Ñ ফুটবল। ফুটবল খেলা এই ভূপৃষ্ঠের কোথায় হয় না? মানুষের পদচিহ্ন যেখানে পড়েছে, এক চাঁদ ছাড়া আর সর্বত্রই ফুটবলের জয়-জয়কার। বিশ্বের সর্বোচ্চ সংগঠন জাতিসংঘের চেয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলের নির্বাহী সংস্থা ফিফার সদস্য সংখ্যা বেশি। এই তথ্য অবাক করলেও এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ফুটবল তার গ্ল্যামার ও সর্বজনীন আবেদন দিয়ে দেশে দেশে মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ফুটবল। ফুটবলের বাঁধ ভাঙা জোয়ারের কাছে ভেসে গেছে কে পুঁজিবাদী আর কে সমাজতন্ত্রী? ফুটবল এমন একটি খেলা, যার মায়ার বাঁধনে একবার কেউ জড়ালে তার থেকে মুক্তি নেই।
১৫ আউন্স ওজন আর ২৭ ইঞ্চি পরিধির বায়ুভর্তি এক চামড়ার গোলকের কী এমন আকর্ষণ, যার মায়াবী হাতছানিতে ছুটতে বাধ্য হন মানুষ! ফুটবল কি হ্যামিলনের সেই বংশীবাদক, যার মোহন বাঁশির সুরে সুরে আমাদের হৃদয় আপ্লুত হয়! আসলে মানুষ নগদ সওদার খরিদ্দার। স্বল্প সময়ে ফুটবলে যে তরতাজা উত্তেজনায় অবগাহন করা যায়, তার সঙ্গে তুলনা হয় না অন্য কিছুর। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ফুটবল খেলার কোনো বিকল্প নেই। কেননা, এ দেশে শিক্ষার হার যেমন বেশি নয়, তেমনিভাবে বিত্তবান লোকের সংখ্যাও হাতে গোনা। যে কারণে স্বল্প ব্যয়ের জটিলতাবিহীন ফুটবলকেই তারা আপন করে নিয়েছে। এ কারণে শাসক ও শোষক হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশের পায়ে পায়ে এ দেশে ফুটবল এলেও তা খুব সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ দেশের সহজ-সরল মানুষের জীবনে বিনোদনের অন্যতম বাহন হয়ে ওঠে ফুটবল।
এ দেশের ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। ফুটবল বাঙালির জীবনে শিকড় গেড়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি ফুটবলারদের কৃতিত্ব ও অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। ফুটবলে চমৎকার ও উজ্জ্বল উত্তরাধিকার থাকা সত্ত্বেও ফুটবলে আমাদের বড় কোনো সাফল্য নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ আজও সাফ ও সার্ক ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারেনি। তা না পারলেও দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশ যে একটি শক্তিশালী দেশ, সেটা প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বারবার বাংলাদেশ শিরোপার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণে এ দেশের ফুটবল অনুরাগীরা কিছুটা হলেও হতাশ হয়ে পড়েন।
এ জন্য প্রশ্ন উঠেছেÑ ফুটবল কি বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে? এ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। আর এই বিতর্ককে উসকে দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটের রমরমা অবস্থা। আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ সপ্তম বিশ্বকাপ খেলার গৌরব অর্জন করায় সারাদেশে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বয়ে যায়। এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। দেশের যে কোনো সাফল্যই আমাদের জন্য গর্ব ও আনন্দের। কেননা, আমাদের এই দেশটিতে আনন্দিত হওয়ার মতো উপলক্ষ খুব কমই ঘটে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনাটা ঠিক নয়। ক্রিকেটের এই সাফল্যের কারণেই হঠাৎ দেশে ক্রিকেটের জোয়ার যেমন বেড়েছে, তেমনি এর প্রতি মানুষের আগ্রহ-সমর্থন ও ভালবাসা বেড়েছে। এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এদেশের মানুষ আবেগতাড়িত। যখন কোনো কিছু তাদের মন জয় করে নেয়, তখন তার জন্য হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দিতে তারা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। ক্রিকেট এখন সেই সুসময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমরাও মনে-প্রাণে কামনা করি, ক্রিকেটের সাফল্যে উদ্ভাসিত হোক আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি। বাংলাদেশের নিয়াজ মোরশেদ এই উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হলে সারাদেশে দাবার চর্চা ও জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের দু’কৃতী শুটার আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি স্বর্ণপদক পেলে শুটিং নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে থাকি। আসল কথা হলো যেসব খেলায় আমরা সাফল্য পাবো, তার প্রতি সবারই সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে। কেননা, দেশের সুনাম ও সুখ্যাতির স্বার্থে সেসব খেলাকে সর্বাÍক পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত।
কিন্তু প্রতিটি দেশেই এমন কিছু খেলা আছে, যে খেলায় সাফল্য না এলেও সেটা সে দেশের মানুষের প্রাণের খেলা। সে হিসেবে আমাদের দেশের মানুষের প্রাণের খেলা ফুটবল। নানা কারণে সাময়িক একটা ভাটার টান এলেও ফুটবল এ দেশের মানুষের কাছে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ভালবাসার অপর নাম। ফুটবল এমন একটি খেলা, যা এ দেশের ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের কাছে সমান প্রিয়। অনেকেই ফুটবলকে ভালবাসেন জীবনের মতো। তাদের কাছে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনার নাম ফুটবল। ফুটবলের স্বপ্ন দোলায় উদ্বেলিত হয় সারা দেশের মানুষ। আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ফুটবল। তাছাড়া আমাদের মতো দরিদ্র দেশে বিনোদনের সর্বজনীন কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে বিনোদন হিসেবে ফুটবলের কোনো বিকল্প নেই। এ অবস্থায় আমরা কি ফুটবলকে এড়িয়ে যেতে পারি?
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফুটবলকে নিয়ে আমাদের বড় কোনো প্রত্যাশা নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করাটাই আমাদের স্বপ্ন। কিছুদিন আগে আন্ডারডগ হয়েও ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ যেভাবে রানার্সআপ হয়েছে, তাতে আমরা দারুণ আশাবাদী হয়েছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ একদিন দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করবে। সেদিন নিশ্চয়ই বেশি দূরে নয়। তবে ফুটবলে আমরা যদি বড় কোনো সাফল্য নাও পাই, তাতে কিছু আসে-যায় না। ফুটবল আমাদের স্বপ্ন ও ভালবাসা। আমরা ফুটবলের নিখাদ আনন্দে মেতে উঠতে চাই। যতই প্রতিকূলতা আসুক না কেন, ফুটবলের প্রতি আমাদের যে অকৃত্রিম ভালবাসাÑ তা অটুট থাকবে। আমরা ফুটবলকে ভালবেসেই যাবো। জয়তু ফুটবল।
১৫তম ফেডারেশন কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের স্যুভেনির : মে ১৯৯৯
শান্তির ফুটবল
শান্তি-সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ফুটবল খেলার রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। আর এ কারণেই এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য
মনোনয়ন পেয়েছে ফুটবল।
গত ২২ জানুয়ারি সুইডিশ পার্লামেন্টের সদস্য লার্স গুস্তাফসন ফুটবল খেলাকে নোবেল মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তাব করেন। নরওয়েজীয়ান নোবেল কমিটিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে ফুটবল অব্যাহতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং হাজারো জাতিগত ও আঞ্চলিক সংঘাতের মধ্যেও এ খেলাটি টিকে আছে। তার মতে, বৈরী দেশগুলোর মধ্যে অন্য কোনো পর্যায়ে যোগাযোগের চিন্তা অকল্পনীয় হলেও ফুটবল মাঠে ঠিকই তারা নামছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়া এবং ১৯৯১ সালে যুব বিশ্বকাপে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যাচের কথা উল্লেখ করেন।
ফুটবলকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য লার্স গুস্তাফসন যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এ যাবৎ মানুষ ফুটবলকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখে এসেছে। এখন অব্দি আবিষ্কৃত ফুটবলের বংশ-লতিকা অনুযায়ী, ২০৬ খৃস্টাব্দে হ্যান ডাইন্যাস্টির আমলে চীনে আদি ফুটবলের উদ্ভব। অবশ্য ফুটবলের জন্ম নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কারো মতে, ফুটবলের জনক চীন, আবার কারো কারো মতে, বৃটিশরা। তবে অতি সম্প্রতি ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার চীনের পক্ষে তার রায় দিয়েছেন। গত ১৮ জানুয়ারি তেহরানে চার জাতির সিভিলাইজেশনস কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ইংরেজরা যত বড়াই করুক, আসলে ফুটবলের জন্ম হয়েছে চীনে। চীনের পর ফুটবল খেলা শুরু হয়েছে মিসরে। সেখান থেকে গেছে যথাক্রমে গ্রিস, রোম, ফ্রান্স এবং অবশেষে ইংল্যান্ডে।’ ফুটবলের জন্ম নিয়ে বিতর্ক থাকলেও খেলাটির জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ¡ নেই। ফুটবল তার
আবেগ-উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা নিয়ে অনায়াসে মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। ফুটবলের আবেদন সর্বজনীন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে ফুটবল। ফুটবল মানুষকে বেঁধেছে সম্প্রীতির বন্ধনে। যে কারণে বিশ্বের যত লোক বা দেশ ফুটবল খেলে বা ফুটবল খেলা ভালবাসে, আর কোনো খেলায় তেমনটি নেই। এমনকি জাতিসংঘের চেয়ে ফিফার সদস্য সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ ফিফা গোটা বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
আসলে ফুটবল যেভাবে সবাইকে একত্রিত করতে পেরেছে, অন্য কারো পক্ষে তেমনভাবে সম্ভব হয়নি। দেশে দেশে, মানুষে মানুষে যে সহযোগিতা-সহমর্মিতা ও ভালবাসার বন্ধন গড়েছে ফুটবল, তার কোনো তুলনা হয় না। সম্মিলিত ও শান্তিময় বিশ্বের পতাকা উত্তোলন করেছে ফুটবল। ফুটবল মানুষকে সুস্থ ও সুন্দর জীবনবোধে উজ্জীবিত করে। বিশেষ করে সস্তা ও জটিলতাহীন খেলা হিসেবে ফুটবল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষণিকের জন্য হলেও ফুটবল তাদের জীবনে যে আনন্দটকু উপহার দেয়, তা বড় এক পাওয়া। শান্তির সপক্ষে ফুটবল
নীরবে-নিভৃতে কাজ করে চলেছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট পরিসরে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলেও ফুটবলের ক্ষেত্র অনেক বড়।
খেলার মাঠে ফুটবল উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও তা সাময়িক। ফুটবলকে ঘিরে যে
শান্তি-সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে, তা সুদূরপ্রসারী। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ফুটবলকে মনোনয়ন দেয়াটা ইতিবাচক চিন্তা। ফুটবল এ পুরস্কার পেলে এর গৌরবময় অংশীদার আমরাও।
ক্রীড়াজগত ঃ ১ ফেব্রুয়ারি ২০০১
বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি এবং আমাদের স্বপ্ন
ফুুটবলের প্রতি এ দেশের মানুষের যে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও গভীর ভালবাসা, তা আরো একবার উদ্ভাসিত হলো বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে। এ ট্রফি আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে নিয়ে আসে কিছুটা বৈচিত্র্য ও আনন্দময় কোলাহল।
ফুটবল এমন একটি খেলাÑ যার সম্মোহনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন দুনিয়ার তাবৎ ফুটবল অনুরাগী। জনপ্রিয়তার নিরিখে ফুটবলের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক ফুটবল খেলা ভালবাসেন, ফুটবল খেলা দেখেন ও ফুটবল খেলেন। বিনোদনের অন্যতম বাহন হিসেবে ফুটবল যেমন আনন্দের দোলায় দোলাতে থাকে, তেমনিভাবে গেঁথে দেয় সবাইকে এক সূতোয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবাই ফুটবলের মায়াজালে মোহিত ও আপ্লুত হন। আর বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসলে তো কথাই নেই। সবারই রাত-দিন হয়ে যায় একাকার। পৃথিবীর সেরা সেরা দেশ ও সেরা সেরা ফুটবলারের ক্রীড়াশৈলীতে পাওয়ার ও শৈল্পিক ফুটবলের নান্দনিকতা ও সৌকর্যের যে বর্ণাঢ্য সমাহার ঘটে, তা চোখ ও মনের জন্য হয় মহাভোজ। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে মাত্র সাতটি দেশ চ্যাম্পিয়ন হলেও ফুটবলে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ ও প্রতিটি খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে বিশ্বকাপ জয় করা এবং বিশ্বকাপ হাতের মুঠোয় নেয়া। যদিও সবার এ স্বপ্ন পূরণ হয় না।
বিশ্বকাপ ফুটবলে বিজয়ী না হয়েও বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফির উষ্ণতা পেয়েছে। এমনিতে একটি ট্রফির কীইবা মূল্য? ইতালীয় ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগার ডিজাইনে তৈরি বর্তমান ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফির উচ্চতা ৩৬ সেন্টিমিটার আর ওজন ৫ কেজি। খাঁটি সোনার হলেও এর যা বাজারমূল্যÑ এ রকম ট্রফি অসংখ্য তৈরি করা অসম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি শুধু একটি ট্রফি নয়Ñ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফুটবলের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগীর স্বপ্ন, উন্মাদনা ও ভালবাসা। কোনো কিছুর বিনিময়ে এর মূল্য নির্ধারণ করা যাবে না। পার্থিব-অপার্থিব দোলাচালের মাঝামাঝি একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে বিশ্বকাপ ট্রফি। যারা এক বা একাধিকবার এ ট্রফি জিতেছেন, তারা আবার একে পেতে চান এবং যারা কখনো পাননি, আদৌ পাবেন কিনা জানেন না, তারাও এ অধরা স্বপ্নকে স্পর্শ করতে চান। এ যেন পরশ পাথর। যার সন্ধানে ছুটে চলেছেন ফুটবল অনুরাগীরা।
২৭ এপ্রিল বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি ঢাকায় আসলে ফুটবল অনুরাগীরা তাকে বরণ করে নেয় বিপুল উচ্ছ্বাসে আর হৃদয়ের তীব্র আবেগে। এই দুর্লভ বস্তুটি স্পর্শ কিংবা এক পলক দেখার জন্য সবার মাঝে ছিল দারুণ ব্যাকুলতা। ঐতিহাসিক একটি ঘটনার সাক্ষী হতে চেয়েছেন সবাই। আসলে ফুটবলের সঙ্গে এ দেশের মানুষের রয়েছে আÍিক বন্ধন। ফুটবলে এখন ভাটার টান চললেও এ দেশের মানুষের হৃদয় থেকে ফুটবল হারিয়ে যায়নি। বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি এ দেশের মানুষকে যেভাবে আনন্দ ও রোমাঞ্চে শিহরিত করেছে এবং খেলোয়াড় ও সংগঠকরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তাতে আশা করা যায়, ফুটবলে ফের জোয়ার সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি দারুণভাবে আলোড়িত ও রোমাঞ্চিত করেছে। ট্রফি হাতে নিয়ে তিনি বলেছেন: ‘শুধু এভাবে দেখা নয়Ñ আমরা কি পারি না এ ট্রফিটি জয় করে আনতে? সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই আমরা কি পারি না কাজ শুরু করে দিতে?’ এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন: ‘এই লক্ষ্যে আপনারা কাজ করুন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের ফুটবলের ইতিহাসও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিদেশের মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম বহন করেছিলো বাংলাদেশের ফুটবল দলের খেলোয়াড়গণ। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। ফুটবলের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবো কেনো। লক্ষ্য স্থির করে, অবিচল আস্থায়, দৃঢ় প্রত্যয়ে, অনড় মনোবল নিয়ে, নিয়মিত অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে আমরাও তো পারি এ ক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠতে। কেনো পারবো না? এ ট্রফিটি কোনো না কোনো দেশের খেলোয়াড়রাই তো পায়।’
প্রধানমন্ত্রী আমাদের সকলের মনের কথাই ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি আমাদের কাছে সুদূরের স্বপ্ন হয়ে থাকলেও তার কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টাটুকু অন্তত আমাদের থাকা দরকার। দু’শত বছর ফুটবল খেলেও যদি আমরা কিছুটা না এগুতে পারি, সেটা সবার জন্যই দুঃখজনক। বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি আমাদের নতুন স্বপ্ন ও নতুন অঙ্গীকার হোক।
ক্রীড়াজগত : ১ মে ২০০২
‘হেথায় সবারে হবে মিলিবারে’
বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন উৎসব হয়ে ওঠেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করার অভিপ্রায় নিয়ে আগামী ৩১ মে থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের সপ্তদশ আসর বসছে কোরিয়া ও জাপানে।
বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হলেও ৭২ বছরের ইতিহাসে একে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা সমস্যা ও সংকট। তবে বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে দু’টি বিশ্বকাপ ঝরে গেলেও আর কখনো ব্যাহত হয়নি চলার পথ। বরং সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বকাপ ফুটবলের মর্যাদা ও কৌলীন্য ক্রমান¦য়ে বেড়েছে। মাঝে-মধ্যে কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেলেও শেষ অব্দি জয় হয়েছে ফুটবলের। ফুটবলের সম্মিলিত শক্তি ও আলোয় দূর হয়েছে অন্ধকার। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও মনস্তাত্ত্বিক একটা সংকটকে সামনে রেখে আয়োজিত হয়েছে। এই সংকটের সূত্রপাত ১১ সেপ্টেম্বরের পর। সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব ও অহংকার টুইন টাওয়ার বালির বাঁধের মত ধসে যাওয়ায় পাল্টে গেছে বিশ্ব প্রেক্ষাপট। দেশে দেশে মানুষের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম, তবে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটে গেছে। একটা সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস আচ্ছন্ন করে রেখেছে সবার মনকে। শিথিল হয়ে পড়েছে পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর বন্ধন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি এর প্রতিফলন ঘটেছে খেলার মাঠেও। বদলে যাওয়া এমন একটা সময়ে আয়োজন করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির যে সুর কেটে গেছে, বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে সুযোগ এসেছে তার তাল-লয়-ছন্দ ফিরিয়ে আনার। ফুটবলের আবেদন চিরকালীন ও সর্বব্যাপী। ফুটবলই পারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একই সূতোর মালায় গাঁথতে। পারে হিংসা-বিদ্বেষ-রেষারেষি দূর করে অনির্বচনীয় এক স্বর্গীয় আনন্দযজ্ঞে নিয়ে যেতে। এই প্রথম এশিয়ায় এবং একই সঙ্গে দু’টি দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের নেপথ্যে রয়েছে ঐক্য ও মিলনের সেই মর্মবাণী: মিলবে আর মেলাবে। এশিয়ান ফুটবল নিয়ে ফুটবলের পরাশক্তি দেশগুলোর এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে। এশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনকে তারা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ফুটবলের শক্তিমত্তা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে এশিয়ার কোনো একক দেশের পক্ষে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করা আসলেই প্রায় অসম্ভব। তবে জনসংখ্যা ও জনপ্রিয়তা যাচাই করলে এশিয়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। আর এ কারণেই এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক ও ফুটবল পরাশক্তি কোরিয়া ও জাপানকে যৌথভাবে সুযোগ দিয়েছে বিশ্বের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা। এই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে উজ্জীবিত করেছে ফুটবলের স্বপ্ন, আবেগ ও উন্মাদনা। ফুটবলের জন্য তারা এখন পরস্পরের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলেছে। আর এখানেই হচ্ছে ফুটবলের বিজয়।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মে ২০০২
বাড়ির পাশে বিশ্বকাপ ফুটবল
বাড়ির পাশে না হলেও খুব বেশি দূরে নয় কোরিয়া এবং জাপান। এশিয়ার এই দুটি দেশে এই প্রথম যৌথভাবে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসছে। আমাদের অবশ্য বরাবরই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশ কখনোই খেলেনি এবং আগামীতে কখনো খেলতে পারবে কিনা, তা কেবল বলতে পারে ভবিতব্য। বাংলাদেশ দল কখনোই উপস্থিত না থাকলেও এ দেশের ফুটবল অনুরাগীরা কখনোই বিশ্বকাপ ফুটবলের মূলধারার স্পন্দন থেকে দূরে সরে থাকেনি। বিশ্বকাপ ফুটবলের শুরু থেকে টেলিপ্রিন্টারের তারে তারে যেটুকু উত্তাপ এসে পৌঁছায়, তা থেকেই তারা রসাস্বাদন করেছেন কম-বেশি। এতে খুব বেশি সম্পৃক্ত না হওয়া গেলেও স্যাটেলাইট দূরকে কাছে নিয়ে আসার পর বিশ্বকাপ ফুটবল এ দেশের মানুষের কাছে উৎসবের উপলক্ষ হয়ে ওঠেছে।
ফুটবল এ দেশের মানুষের প্রাণের খেলা। বাঙালীর চিরায়ত লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ফুটবলের সম্পৃক্ততা না থাকলেও ফুটবলকে ছেঁটে ফেলার কথা চিন্তা করা যায় না। যদিও হালে ফুটবলের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে, তারপরও ফুটবল এখনও বিনোদনের অন্যতম অবলম্বন। ফুটবল বৃটিশের গর্ভজাত এবং তাদের হাত ধরে এ অঞ্চলে এলেও বৃটিশদের কাছ থেকে যা কিছু পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের
সভ্যতাÑ ফুটবল তার একটি। বাঙালীর সহজিয়া ও ঢিমেতালের জীবনধারায় ফুটবল নিয়ে আসে অন্যরকম গতিবেগ। সস্তায় ও সুলভে বিনোদনের এর চেয়ে ভাল মাধ্যম বাঙালীর জীবনে আর আসেনি। ফুটবলকে পেয়ে তারা মেতে ওঠে দারুণভাবে। বঞ্চিত, শোষিত ও গ্লানিকর জীবনে ফুটবলের তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় সহজেই ভুলে থাকা যায়Ñ না পাওয়ার যন্ত্রণা।
বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে কিংবা খেলছেÑ এমন অনেক দেশের ফুটবল ইতিহাস ও ঐতিহ্য বাংলাদেশের তুলনায় উজ্জ্বল নয়। বাংলাদেশের মানুষ যখন থেকে ফুটবল খেলছে, তখন এসব দেশ ফুটবলের সংস্পর্শেও আসেনি। কিন্তু পিছিয়ে থেকেও তারা খুব দ্রুত এগিয়ে গেছে। আর আমাদের ফুটবল খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারেনি। তাতে করে যে ফুটবলের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ হ্রাস পেয়েছে, তা নয়। এ অঞ্চলের মানুষ ফুটবল খেলে আসছে মনের আনন্দে। যে কারণে ফুটবল খেলা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। তবে এ দেশের মানুষ ভাল ফুটবলের সমঝদার। উচ্চ মানসম্পন্ন ও শিল্পিত ফুটবলের ছোঁয়া পেলে তারা তাতে সবকিছু ভুলে মেতে উঠতে দ্বিধা করে না। আর চার বছর অন্তর-অন্তর বিশ্বকাপ ফুটবলের তীব্র উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস আর আবেগ সকলকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
১৯৭৮ সাল থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে এ দেশের মানুষের আÍিক ও নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে। আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত সেবারের বিশ্বকাপের একটি কিংবা একাধিক খেলা টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়ার পর বাংলাদেশের জীবনধারার অংশ হয়ে উঠেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। পরবর্তীকালে প্রতিটি বিশ্বকাপ সরাসরি সম্প্রচার হওয়ায় ফুটবলের টইটম্বুর আনন্দ-রসে অবগাহন করেন তারা। এ দেশের ফুটবল অনুরাগীরা বরাবরই ব্রাজিল ও পেলের প্রতি দারুণভাবে অনুরক্ত। ব্রাজিল ও পেলের খেলা সরাসরি দেখে এ দেশের মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। বিশ্বকাপ ফুটবলে যখন থেকে ব্রাজিল এবং পেলে খেলছে, তখন তাদের খেলা দেখার সুযোগ আমাদের দেশে ছিল না। কিছুটা জেনে, কিছুটা শুনে তাদের ঘিরে এক ধরনের কিংবদন্তী বা মিথ গড়ে ওঠেছে। তাদের প্রতি এই দুর্বলতা এখনও অটুট আছে। কেননা, স্যাটেলাইটের কল্যাণে ব্রাজিলের শিল্পিত ও সৌন্দর্যময় ফুটবল আর সাম্বা নাচ দেখে তাদের প্রতি যে ভাললাগা ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে অনুরাগে। তবে ১৯৭৮ সালের পর থেকে সমর্থনের ধারা আর একক স্রোতে বয়নি। টেলিভিশনে বিভিন্ন দেশ ও তারকা খেলোয়াড়দের চোখ ধাঁধানো ও মনমাতানো খেলা দেখে দেখে সমর্থনের পাল্লাও নানাভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে ড্যানিয়েল প্যাসারেলার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন ও মারিও কেম্পেসের দুরন্ত খেলা, ১৯৮২ সালে ছিলো দিনো জফের নেতৃত্বে ইতালি চ্যাম্পিয়ন ও পাওলো রসির ম্যাজিক ফুটবল, ১৯৮৬ সালে দিয়াগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন ও ম্যারাডোনার যাদুকরী ফুটবল, ১৯৯০ সালে লোথার ম্যাথিয়াসের নেতৃত্বে জার্মানী চ্যাম্পিয়ন ও লৌহমানব ম্যাথিয়াসের পরিশ্রমী ফুটবল, ১৯৯৪ সালে ডুঙ্গার নেতৃত্বে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন ও রোমারিওর ভেলকি, ১৯৯৮ সালে ডেসচ্যাম্পের নেতৃত্বে ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন ও জিনেদিন জিদানের অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী দর্শকদের আপ্লুত করে।
তবে লাতিন ঘরানার প্রতি এ দেশের ফুটবল অনুরাগীদের স্বভাবজাত দুর্বলতা চিরদিনের। ইউরোপের পাওয়ার ও যান্ত্রিক ফুটবল কারো কারো ভাল লাগলেও লাতিন আমেরিকার প্রতি পাল্লা বরাবরই ভারী। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দুই দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা জয় করে নিয়েছে সবার মন। তবে আর্জেন্টিনাকে আলাদা এক সম্ভ্রমের জায়গায় তুলে দিয়েছেন দিয়াগো ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার খেলা দেখার পর অনেকেই আজ আর্জেন্টিনার সমর্থক। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ফুটবলশৈলীর রোমাঞ্চকর জাদুতে মুগ্ধ হননি- এমন ফুটবল অনুরাগীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। একক দক্ষতায় খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি সবাইকে চমকে দেন।
বলা যায়, দিয়াগো ম্যারাডোনাই এ দেশের ফুটবলের সমর্থনের ক্ষেত্রে নতুন জোয়ার নিয়ে আসেন। বিশ্বকাপ ফুটবল এলে এখন অন্য রকম উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে মায় হেঁসেল অব্দি ঢুকে পড়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তেজনা। বাড়িশুদ্ধ লোক হুমড়ি খেয়ে পড়েন টিভির সামনে। প্রিয় দল, প্রিয় খেলোয়াড়কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় পক্ষ-বিপক্ষ। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকারা হয়ে পড়েন একে অপরের প্রতিপক্ষ। যুক্তি-তর্ক, রাগ-অনুরাগ, ঝগড়াঝাটি, এমনকি বিচ্ছেদের ঘটনা পর্যন্ত গড়ায়। এ সময় সারাদেশ ফুটবল জ্বরে কাঁপতে থাকে। সবকিছুই বিশ্বকাপ ফুটবলের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। অফিস-আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজে একটা ঢিলেমি ভাব চলে আসে। বাড়িতে বাড়িতে শোভা পায় প্রিয় দলের পতাকা, প্রিয় খেলোয়াড়দের পোস্টার। কেউ কেউ প্রিয় দলের জার্সী পরিধান করে কিংবা মুখে পতাকার উল্কি এঁকে অবলীলায় ঘুরে বেড়ান। সর্বত্রই আলোচনায় ওঠে আসে বিশ্বকাপ ফুটবল। কম-বেশি সবাই হয়ে ওঠেন ফুটবল-বিশেষজ্ঞ। বিশ্বখ্যাত তারকাদের ভুল-ত্রুটিগুলো তারা তীক্ষèভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেন সমালোচকের দৃষ্টিতে। মনোভাবটা এমন, তাকে মাঠে নামিয়ে দিলে তিনি এমন ভুল করতেন না! প্রিয় দলের সাফল্য কামনা করে মিলাদ-মাহফিল, দোয়া-দরুদ পাঠ ও পূজা-অর্চনা করা হয়। ব্যর্থতায় মন খারাপ হয়ে যায়। চোখ হয়ে ওঠে অশ্রুসজল। বিশেষতঃ টেলিভিশনে খেলা চলাকালে আবেগ-উচ্ছ্বাসের উত্থান-পতন ঘটে। প্রিয় দল গোল দিলে কেঁপে ওঠে পাড়া-মহল্লা। আবার গোল হজম করলে নেমে আসে শশ্মানের নীরবতা। প্রিয় ফুটবলার মাঠে প্রতিপক্ষের প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে ব্যর্থ হলে কিংবা রাফ ট্যাকলে যন্ত্রণায় লুটিয়ে পড়লে মনে হয় নিজেই যেন ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা ব্যথা পেয়েছেন। জয়ের আনন্দে মিষ্টি খাওয়া, মিছিল-সমাবেশ ও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। একটি দল তিল তিল পরিশ্রমে গড়ে তোলে প্রস্তুতি, তেমনিভাবে একজন ফুটবল অনুরাগীও মনের মাঝে লালন করেন দলের প্রতি সযতœ ভালবাসা। সঙ্গত কারণে সাফল্য যেমন দলকে উদ্বেলিত করে, তেমনিভাবে আপ্লুত করে সমর্থককেও। প্রিয় দল ও প্রিয় খেলোয়াড় যদি অবিচারের শিকার হয়, তা অনুরাগীকেও বিক্ষুব্ধ করে। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে রেফারীর রোষানলের শিকার হয় আর্জেন্টিনা। আগের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার জাদুকরী ফুটবলশৈলীতে আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনার তখন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। সঙ্গত কারণে সবার প্রত্যাশা ও ভালবাসা আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনাকে ঘিরে। ম্যারাডোনা অসাধারণ খেললেও মেক্সিকান রেফারি কোডেসালের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বলি হয় আর্জেন্টিনা। সেদিন যেন কোডেসাল আর্জেন্টিনাকে হারানোর পণ করে মাঠে নেমেছিলেন। সামান্য কারণে আর্জেন্টিনার দু’জন নির্ভরযোগ্য ফুটবলারকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পেনাল্টি দিলে তা থেকে গোল করে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানী। এভাবে পরাজিত হওয়ায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দিয়াগো ম্যারাডোনা। তার কান্না সবাইকে দারুণভাবে স্পর্শ করে। আর্জেন্টিনার এই ন্যক্কারজনক পরাজয় মেনে নিতে পারেননি বাংলাদেশের আর্জেন্টিনার ফুটবল সমর্থকরা। তারা কোডেসালের বিরুদ্ধে ধিক্কার, নিন্দা ও সমালোচনায়,
ক্ষোভে-বিক্ষোভে, মিছিল-মিটিং-এ সরব হয়ে ওঠেন। কোডেসালের বিচার ও ফাঁসি দাবি করে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। বিশ্বকাপ ফুটবল যত দূরেরই হোক না কেন, এ ঘটনায় অনুধাবন করা যায়, তা এ দেশের মানুষের হৃদয়ের খুব কাছাকাছিই অবস্থান।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে যে ১৬টি আসর এর আগে বসেছে, তা ছিল বিশ্বের অপর প্রান্তে। ফলে যখন থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়, দর্শকরা তা উপভোগ করেছেন রাত জেগে জেগে। বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে পাল্টে গেছে মানুষের জীবনধারা। খেলা দেখার জন্য নানাভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন ফুটবল অনুরাগীরা। এবার পাল্টে গেছে প্রেক্ষাপট। এই বিশ্বকাপ ফুটবল আর রাত জেগে খেলা দেখতে হবে না। ৩১ দিনে ৩২টি দল ৬৪টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশের দুপুরে কিংবা বিকেলে। রাত জাগার কান্তি না থাকলেও খেলা দেখতে হবে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়ে কিংবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে। অবশ্য দ্বিধানি¦ত মন নিয়ে ফুটবল উপভোগ করা যায় না। ফুটবল দাবি করে অখ- মনোযোগ। কেননা, চোখের পলকে এমনসব দৃশ্যপট তৈরি হয়, একটুখানি অমনোযোগী বা উদাসীন হলে চমৎকার দৃশ্যগুলো কিংবা ছবির মত দেয়া গোলের আনন্দ আড়াল হয়ে যেতে পারে। টিভির রিপ্লেতে আর যাই হোক, টাটকা স্বাদ পাওয়া যায় না। নিবিষ্ট মনে বিশ্বকাপ ফুটবল উপভোগের জন্য বাড়িতে কিংবা কাবে আড্ডার মেজাজে টিভির সামনে বসার জন্য সবরকম পিছুটানকে উপেক্ষা করতে হয়। তাতে ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি হলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বার্থে এই ক্ষতিটুকু মেনে নিতে কেউ কার্পণ্য করবেন না।
বিশ্বকাপ ফুটবল এ দেশের মানুষের দিন-রাতকে একাকার করে দেয়। এবার এশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজিত হওয়ায় এর মাদকতা আরো বেশি ছড়িয়ে পড়বে। কেননা, কাছাকাছি দেশে আয়োজিত হওয়ায় এর স্পন্দন দারুণভাবে অনুভব করা যাবে। ইতোমধ্যে বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রথম ২৭ এপ্রিল ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি ঢাকায় আসায় দেশের ফুটবল অনুরাগীদের মনে আবেগ-উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। বিশ্বকাপ জয় করে ট্রফি নিয়ে আসা বাংলাদেশের কাছে সুদূরের স্বপ্ন হয়ে থাকলেও ট্রফি দেখাটা ফুটবল অনুরাগীদের কাছে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এই ট্রফি এ দেশের ফুটবলপ্রেমীদের আরো বেশি উসকে দিয়েছে।
এশিয়ায় এবং একই সঙ্গে দু’টি দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এশিয়ান হিসেবে এই ব্যতিক্রমী ঘটনার কিছুটা হলেও আমরা অংশীদার। বিশ্বকাপ ফুটবলের নামে আমরা এমনিতেই নেচে ওঠি, এশিয়ায় এটি আয়োজিত হওয়ায় আমাদেরকে আরো বেশি আপ্লুত করবেÑ এ কথা অন্তত বলা যায়।
দৈনিক যুগান্তর : ৩১ মে ২০০২
ব্রাজিলের সেই ম্যাজিক-ফুটবল কোথায়
আমাদের বুকের মাঝে নীরবে অনুরণিত হয় মেঠো ও লোকজ সহজিয়া সুর। যেখানে তাল আছে, লয় আছে, সুর আছে, আছে ছন্দ। তা আমাদেরকে টেনে নেয় খুব সহজেই। আমাদের শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে এবং জীবনধারায় প্রচ্ছন্ন আছে এই গীতিময়তা। ঢোলের বাড়ি শুনলে চকিতে নেচে ওঠে আমাদের মন-প্রাণ। ফুটবলেও আছে গতি, শক্তি ও বৈচিত্র্যের দুরন্ত মিশেল। আর এ কারণেই ফুটবলের সঙ্গে আমাদের জীবনের অদ্ভুত মিল। ফুটবলের তীব্র উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস আর আবেগ আমাদেরকে দারুণভাবে আপ্লুত করে। প্রতিদিনের জীবনে অনেক না-পাওয়ার বেদনা থাকা সত্ত্বেও ফুটবল মাঠে আমরা খুঁজে পাই মুক্তির আনন্দ। সাময়িকভাবে হলেও ফুটবলের মোহন বাঁশির সুর আমাদের নিয়ে যায় বর্ণিল ও স্বপ্নময় জগতে। ফুটবলে আছে এক ধরনের মাদকতাÑ যা বেঁচে থাকার রসদ যোগায়।
খেলার মাঠে পিছিয়ে থাকলেও এ দেশের মানুষ প্রাণোচ্ছ্বল ও আনন্দময় ফুটবলের সমঝদার। শৈল্পিক ও ছন্দময় ফুটবল তাদেরকে আবিষ্ট করে রাখে। আর এ কারণেই লাতিন ঘরানার ফুটবলের প্রতি রয়েছে তাদের সহজাত দুর্বলতা। এমনিতেই লাতিন আমেরিকার মানুষের গান, বাজনা, নৃত্য, দারিদ্র্য, রাজনীতি ও জীবনধারার সঙ্গে কোথায় যেন আমাদের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাদের সবকিছুর প্রতি রয়েছে আমাদের আলাদা আকর্ষণ ও মুগ্ধতা। বিশেষ করে, লাতিন ফুটবল আমাদেরকে হ্যামিলনের বাঁশির মত মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। ফুটবল যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিল্প হয়ে থাকে, তার রূপকার লাতিন আমেরিকা। সমৃদ্ধ ফুটবল ঐতিহ্য, ব্যক্তিগত প্রতিভা, স্কিল ও দক্ষতা দিয়ে তারা মাতিয়ে রাখার পাশাপাশি বিশ্ব ফুটবলকে শাসন করে আসছে। একই সঙ্গে ইউরোপের পাওয়ার, যান্ত্রিক ও আধিপত্যবাদী ফুটবলের সঙ্গেও তারা লড়াই চালাচ্ছে। ইতালী, পশ্চিম জার্মানী, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী, সুইডেন, হল্যান্ডের প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে খর্ব করে তৃতীয় বিশ্বের জয়ধ্বনি গেয়েছে লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। আলট্রা ডিফেন্সিভ ও লড়াকু মানসিকতা ইউরোপীয় ফুটবলের বৈশিষ্ট্য হলেও ইতালী, ফ্রান্স ও হল্যান্ডের শিল্পিত ফুটবলও যথেষ্ট আনন্দদায়ক। কিন্তু এ দেশের ফুটবল অনুরাগীদের পক্ষপাত লাতিন আমেরিকার দিকে। ১৯৩০ ও ১৯৫০ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে লাতিন আমেরিকার মর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয় উরুগুয়ে। এরপর অর্ধ-শতাব্দীকাল পেরিয়ে গেলেও উরুগুয়ের সেই রমরমা আর নেই। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে মারিও কেম্পেসের দুরন্ত ক্রীড়াশৈলী এবং ১৯৮৬ সালে দিয়াগো ম্যারাডোনার ম্যাজিক্যাল ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আর্জেন্টিনা দর্শক-হৃদয় জয় করে নেয়। ম্যারাডোনা পরিণত হন অবিসংবাদিত নায়কে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, ম্যারাডোনা তার অবিশ্বাস্য ও অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী দিয়ে কিংবদন্তীর ফুটবলারদের সারিতে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন তো বটেই, পাশাপাশি আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তা ও গ্ল্যামার অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও ম্যারাডোনার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই আর্জেন্টিনা বিশ্ব ফুটবলের প্রতিষ্ঠিত শক্তি। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বপ্ন, আকা´খা ও ভালবাসার দল হিসেবে আর্জেন্টিনাকে গড়ে তোলার কৃতিত্ব বোধ করি ফুটবলের স্বপ্নপুরুষ ম্যারাডোনার। আমাদের দেশেও ম্যারাডোনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে আর্জেন্টিনার অসংখ্য গুণগ্রাহী।
সত্যিকার অর্থে লাতিন ফুটবল ঘরানার উজ্জ্বল প্রতিনিধি ব্রাজিল। ব্রাজিল এ দেশের মানুষের হৃদয়-মন্দিরে ঠাঁই করে নিয়েছে অনেককাল আগে থেকেই। ব্রাজিল নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্রই হাওয়ায় সৌরভ ছড়ায় ফুটবল। ফুটবল ও ব্রাজিল হয়ে উঠেছে একে অপরের সমার্থক। শিল্পিত, নান্দনিক ও রোমাঞ্চকর ফুটবলের চারণভূমি ব্রাজিল। শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মত ব্রাজিলীয় শিল্পী-ফুটবলাররা এক টুকরো সবুজ জমিতে ফুটিয়ে তোলেন ভ্যান গঁগের জীবন্ত ‘সূর্যমুখী’।
ব্রাজিল প্রতিটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার এক বিরল ও ব্যতিক্রমী রেকর্ড গড়েছে। আর কোনো দেশের পক্ষে এই রেকর্ড স্পর্শ কিংবা অতিক্রম করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বেশি চারবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছে ব্রাজিল। বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিল এবং ব্রাজিলীয় ফুটবলাররা এমনসব কীর্তিগাথা রচনা করেছেনÑ যা অমর ও অমলিন হয়ে আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের একটি ট্রফিকে ঘিরে কত উন্মাদনা, কত স্বপ্নের জন্ম ও মৃত্যু এবং কিংবদন্তীÑ যা ব্রাজিলকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না। বিশ্বকাপ ফুটবলের শুরু থেকেই ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দি¡তা ও নীরব রেষারেষি; তাতে ইউরোপের আটটি দেশÑ ইতালী, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী, পশ্চিম জার্মানী, সুইডেন, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও ফ্রান্স ৮ বার চ্যাম্পিয়ন ও ১২ বার রানার্সআপ হয়ে কিছুটা এগিয়ে আছে। পক্ষান্তরে, লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল আটবার চ্যাম্পিয়ন ও চারবার রানার্সআপ হয়েছে। তবে বিশ্বকাপ ফুটবল ইউরোপ বা লাতিনে হলে সাধারণত সে অঞ্চলের দেশ জিতেছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ব্রাজিল। তারা ১৯৫৮ সালে ইউরোপ এবং ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাপ জয় করেছে।
সাফল্যের আলো দিয়ে বিশ্ব ফুটবলকে আলোকিত করলেও ব্রাজিল বিশ্বের তাবৎ ফুটবল অনুরাগীর মন কেড়েছে তার জাদুকরী ও দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দিয়ে। ব্যালে নাচ ও জিমন্যাস্টিক্স এবং শিল্প ও গতির সমন¦য়ে টোটাল ফুটবল দিয়ে সবাইকে সম্মোহিত করে দেয় ব্রাজিল। ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ হিসেবে খ্যাত ব্রাজিলের লিওনিদাস ডা সিলভা ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপে গোল করার অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তবে ব্রাজিলীয় ফুটবলের শৈল্পিক ধারার বিকাশ ঘটে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে। নিজের মাটিতে তারা চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও তাদের ফুটবল নতুন এক শৈলীর জন্ম দেয়। হাল আমলে লাতিন সাহিত্যে ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’ অর্থাৎ যাদু বাস্তবতা নিয়ে সাড়া পড়লেও খেলার মাঠে এর অঙ্কুরোদগম হয় ব্রাজিলের হাত ধরে। ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপে ব্রাজিলীয় ফুটবল তার রূপ-রস-গন্ধ-মাধুর্য পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরে। সুপ্ত কুঁড়ি যেন ফুল হয়ে ফোটে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ধ্রুপদ সঙ্গীতে বেটোফেনের মত সুরের মূর্ছনায় মাতাল করে দেন ব্রাজিলের এক দল সৃষ্টিশীল শিল্পী-ফুটবলার। ডিডি, গ্যারিঞ্চা, জাগালো, ভাভা, রিভেলিনো, টোস্তাও, জরজিনহোর সঙ্গে ১৭ বছরের তরুণ পেলেকে নিয়ে যে অর্কেস্ট্রা দল, তা দিয়ে ছন্দময় ফুটবলের জাদু দেখান ব্রাজিলের ম্যানেজার ভিসেন্তে ফিওলা। এই বিশ্বকাপে আবিষ্কৃত ‘কালো মানিক’ পেলে সবচে’ কম বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে, সবচে’ কম বয়সে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করে এবং সবচে’ কম বয়সে বিশ্বকাপের সোনা পেয়ে নতুন সেনসেশনে পরিণত হন। সবচে’ বড় কথা, যান্ত্রিক ফুটবলের বিপরীতে শৈল্পিক ফুটবলের জন্ম দিয়ে ব্রাজিল সেই যে বিশ্ববাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেয়, সে ধারা অব্যাহত আছে। ১৯৬২ সালে ব্রাজিলীয় রোমাঞ্চকর ফুটবলের নায়ক ছিলেন গ্যারিঞ্চা। ‘ছোট্ট পাখি’ হিসেবে খ্যাত গ্যারিঞ্চা তার অসঙ্গতিপূর্ণ দু’পা দিয়েই তার প্রতিভা ও সৃজনশীলতার বিস্ফোরণ ঘটান। তার বাঁ পায়ের দুরন্ত শট, চিতা বাঘের গতি ও লাফিয়ে ওঠে হেড নেয়ার অসামান্য দক্ষতা এবং সঙ্গী ভাভাও নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে ব্রাজিলকে উপর্যুপরি দ্বিতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন করেন। পেশীতে টান ও ইনজুরির কারণে ১৯৬২ ও ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে পেলে তেমনভাবে ঝলসে উঠতে না পারলেও ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ ছিল তার নৈপুণ্যে ভাস্বর। টোস্তাও এবং জর্জিনহোকে নিয়ে সৃষ্টিশীল ফুটবল উপহার দিয়ে তৃতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন করেন ব্রাজিলকে। ফলে “জুলে রিমে ট্রফি” চিরদিনের মত ব্রাজিলের হয়ে যায়। চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ, দুটি ফাইনালে ৩টি সহ বিশ্বকাপে মোট ১৩ গোল দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ব ফুটবলের মডেল। বিধ্বংসী রিফেক্স আর অসামান্য চিন্তাশক্তির সমন¦য়ে ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে তার চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী দেখে দলের ম্যানেজার জোয়াও সালদানার অভিমত হচ্ছে: ‘ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়রের যে সম্মান, ব্রাজিলের ফুটবলে পেলেও তাই।’ এরপর থেকে পেলে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তী ফুটবলার। আগে-পরে অনেক ফুটবলার এলেও পেলের মত খ্যাতি, সম্মান ও জনপ্রিয়তা আর কারো ভাগ্যে জোটেনি। ১৯৭০ সালের পর টানা পাঁচটি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করলেও ব্রাজিলের খেলায় যে ছন্দ ও গ্ল্যামার থাকে, তা থেকে ফুটবল অনুরাগীরা বঞ্চিত হননি। জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাও, কারেকার মত শিল্পী ফুটবলাররা ব্রাজিলীয় ঘরানায় ফুটবল খেলে আনন্দ দিলেও শিরোপার নাগাল পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে ব্রাজিলের ফুটবল নিয়ে ভেতরে ভেতরে একটা অসন্তোষ গড়ে ওঠে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেরা ব্রাজিলের নিজস্ব স্টাইল বিসর্জন দিয়ে ‘ডিফেন্সিভ ফুটবল’ খেলে ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করেন। রোমারিও ও বেবেতোর খেলা কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ব্রাজিলের খেলা অনুরাগীদের মন ভরাতে পারেনি। ১৯৯৮ সালে মারিও জাগালোর দল প্রত্যাশিত নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালে ব্রাজিল যে খেলা খেলেছে, তা অনুরাগীদের মন ভেঙ্গে দিয়েছে।
মাঠের ফুটবল দিয়ে ব্রাজিল সবার মন জয় করলেও তাদের সমর্থকরাও বিশ্বকাপের অন্যতম আকর্ষণ। কত রকম সাজ, পোশাক, নাচ-গান। মুখে-চুলে হলুদ-সবুজ রঙ মেখে কিংবা পতাকা নিয়ে নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে ফুটবল উপভোগ করার পাশাপাশি অন্যদের আনন্দ দেয়াটা ব্রাজিলীয় সমর্থকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোন্ পত্রিকায় যেন মন্তব্য করা হয়েছে: ‘ব্রাজিলের ফুটবল যদি কবিতা হয়, ব্রাজিলিয়ান দর্শকরা তা হলে ঝরনাধারা।’ ফুটবল আর সাম্বা নাচ ব্রাজিলিয়ানদের জীবনবেদ। ব্রাজিল দলের খেলার সময় গ্যালারীতে আনন্দ-উৎসবের ঢেউ বয়ে যায় বিটের তালে তালে। দেহবল্লরীর উচ্ছ্বাস আর উদ্দামতায় উন্মাতাল হয়ে ওঠে পুরো স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের খেলার প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিকের অভিমত হচ্ছে এমন: ‘একটা মস্ত বড় সর্ষে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে প্রবল একটা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। গোটা স্টেডিয়াম গা মুড়ি দিয়েছে একটাই চাদরে। যার রং হলদে-সবুজ।’
মাঠে শৈল্পিক ফুটবল আর গ্যালারীতে সাম্বা নাচ দিয়ে বিশ্ব ফুটবলে যে গ্ল্যামার, জনপ্রিয়তা ও আবেদন তৈরি করেছে ব্রাজিল, তাতে বোধকরি খানিকটা ভাটার টান লেগেছে। জয়ের নেশায় যেনতেনভাবে খেলে সাফল্য পেলেও ভক্ত-অনুরাগীদের মন জয় করতে পারছে না ব্রাজিল। তদুপরি এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই-পর্বে যেভাবে তারা ঘষটাতে ঘষটাতে চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হয়েছে, তা রীতিমত হতাশাজনক পারফরম্যান্স। শৈলী এবং পারফরম্যান্সÑ দুটোই যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে ব্রাজিলীয় ফুটবলের থাকেটা কি?
দৈনিক আজকের কাগজ : ৩১ মে ২০০২
রমণীয় বিশ্বকাপ
চারিদিকে যখন ধ্বংসের দামামা বেজে উঠেছে, ঠিক তখন আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবলে ধ্বংস নয়, আছে সৃষ্টির আনন্দ। আছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধন। আর এ কারণেই পৃথিবীর কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগী রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় প্রহর গুণছে বিশ্বকাপ ফুটবলের। ফুটবল নিছক কোনো খেলা নয়। বিশ্বকাপের সবচে সফল দল ব্রাজিলীয়দের কাছে ফুটবল দেবতার মতো। ফুটবলকে ওরা দেখে জীবনের উচ্ছ্বাসে। ফুটবলের আবেগ-উত্তেজনা ওদের রক্তে নাচন ধরায়। ফুটবলের বেদীতে নিজেকে সঁপে দিতে পারলে ওরা খুঁজে পায় জীবনের সার্থকতা। এ কারণেই রোজমেরি ডি মেলো ব্রাজিলীয়দের কাছে হয়ে আছেন রূপকথার নায়িকা। রীতি ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ করেও এই বালিকা সাহস ও ভালবাসার প্রতীক হয়ে ওঠেন। তার কু-কীর্তিতে রক্ষা পেয়েছে ব্রাজিলের সম্মান ও মর্যাদা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের খেলা চলছে দক্ষিণ আমেরিকায়। বাছাই পর্বে সেবার ব্রাজিলের অবস্থা খুবই নাজুক। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে ব্রাজিল খেলতে পারবে কিনাÑ তা নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলায় দোল খাচ্ছে ব্রাজিলের তাবৎ অনুরাগী। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে চিলিতে অনুষ্ঠিত প্রথম খেলায় স্বাগতিক দলের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে বেকায়দায় পড়ে যায় ব্রাজিল। চূড়ান্ত পর্বে খেলতে হলে নিজের মাঠে পরবর্তী খেলায় ব্রাজিলকে অবশ্যই জিততে হবে। এমন একটা অবস্থায় দু’দেশের খেলা হয় ব্রাজিলের মারকানা স্টেডিয়ামে। খেলায় ১-০ গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিক দেশ। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা গড়িয়েছে ২৪ মিনিট। এ সময় একটি ‘আগুন-বোমা’ ছুঁড়ে মারা হয় মাঠে। বোমাটি পড়ে চিলির গোলরক্ষক রবার্তো বোজাসের পেছনে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যান এবং হাত দিয়ে মুখ ঢেকে এমন ভাব করেন যেন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় চিলির খেলোয়াড়রা নিরাপত্তার দাবিতে মাঠ ছেড়ে চলে যায়। তারা আর মাঠে ফিরে না আসায় ফিফা ম্যাচটি বাতিল করে দেয় এবং ব্রাজিলকে ২-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করে। চিলির গোলরক্ষক আহত হওয়ার ভান করায় ফুটবল খেলা থেকে তাকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এ ঘটনা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্রাজিলীয় ফুটবল ফেডারেশনকে ১২ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিতে হলেও ব্রাজিল অনায়াসেই উন্নীত হয় চূড়ান্ত পর্বে। হাঁফ ছাড়েন ব্রাজিল অনুরাগীরা। ব্রাজিলবিহীন বিশ্বকাপ তাদের কাছে লবণ ছাড়া তরকারির মতো স্বাদহীন। চিলির সঙ্গে খেলায় এগিয়ে থাকলেও ব্রাজিল যে জয়ী হতে পারতো, এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বরং গোল খেয়ে আহত বাঘের মতো আক্রমণাÍক হয়ে ওঠে চিলি। যে কোনো মুহূর্তে গোল শোধ হয়ে যেতে পারতো। এমন সময় ব্রাজিলের দুর্দশার সদয় হয়ে ফুটবল দেবতা যেন ‘আগুন-বোমা’ দিয়ে পাঠান রোজমেরি ডি মেলোকে। মুমূর্র্ষু অবস্থা থেকে ব্রাজিলকে রক্ষা করায় ব্রাজিলিয়ানদের কাছে রোজমেরি হয়ে ওঠেন ঈশ্বরের প্রেরিত দূত।
বিশ্বকাপ ফুটবল ব্রাজিলিয়ানদের কাছে আসলে তীর্থ দর্শনের মতো। ব্রাজিল দলের খেলার সময় মাঠে উপস্থিত থাকতে পারলে তারা নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করেন। বিশ্বের যে প্রান্তেই খেলা হোক না কেন, তারা ছুটে যাবেনই। ব্রাজিলীয় সমর্থকরা ফুটবল অনুরাগীদের কাছে আলাদা স্থান করে নিয়েছেন। তারা স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘গ্যালারির শিল্পী’ হিসেবে। হলদে-সবুজ রঙে শরীরকে রাঙিয়ে এবং ব্যান্ডের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুরে সুরে যে উন্মাতাল সাম্বা নাচ তারা নাচেন, তা যেন গ্যালারির বৃহৎ ক্যানভাসে সম্মিলিত শিল্পচর্চা।
বিশ্বকাপ পুরুষদের হলেও গ্যালারি ও টিভির দর্শকদের মাঝে ফুটবলের তীব্র উত্তেজনা, আবেগ আর উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। সাম্বা নেচে দেহবল্লরীর ছন্দ ও উদ্দামতা নিয়ে দর্শকদের আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে নেয়ার কৃতিত্ব ব্রাজিলীয় তরুণীদের। ব্রাজিলের দেখাদেখি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশের সমর্থক এখন গ্যালারিতে ফুটিয়ে তোলেন স্ব-স্ব দেশের নৃত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতিকে। নানান সাজ, স্টাইল ও ফ্যাশনের সঙ্গে শোভা পায় জাতীয় পতাকা, পোস্টার ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। কারো কারো মাথায় বিশাল বিশাল হ্যাট। ইউরোপীয় ও লাতিন ঘরানার পাশাপাশি ফুটবল মাঠে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছে অন্ধকার থেকে উঠে আসা আফ্রিকানরা। গ্যালারিতে তাদের বিচিত্র এবং বাহারী কেশ ও বেশভূষা সবার নজর কেড়ে নেয়। বিশ্বকাপে সমর্থকরা যে কত রকম কলাকৌশল দেখিয়ে থাকেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের ‘মেক্সিকো ওয়েভ’ পৃথিবীর বিভিন্ন মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইংল্যান্ডের দাঙ্গাবাজ সমর্থকদের কুখ্যাতি ফুটবলের প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো।
বিশ্বকাপ ফুটবল এলে আবেগের বন্যায় ভাসতে থাকে সারা বিশ্ব। আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ফুটবলের উত্তেজনা। ফুটবলের উন্মাদনায় সবাই একাকার হয়ে যায়। বস্তিবাসী থেকে অভিজাতবাসীÑ সমাজের সবার স্বপ্ন ও আনন্দ, চাওয়া ও পাওয়া হয়ে ওঠে এক-একটি ফুটবল দল। ১১ জন ফুটবলার হয়ে ওঠেন গর্ব ও আবেগ। বিশ্বকাপের একটি মাস কেটে যায় আনন্দ ও উল্লাসে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে টিভি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। দেশে দেশে টিভিতে খেলা চলাকালে রাস্তাঘাটে লোক চলাচল থেমে যায়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এবং ইদানীং এশিয়ায়ও বড় বড় স্ক্রিনে খেলা দেখানো হয়। অনেকেই ঘরে বসে ফুটবল খেলা দেখতে পছন্দ করেন না। তারা ছুটে যান আনন্দময় কোলাহলে। রেস্তোঁরা, কফিশালা, পানশালা, সরাইখানা, ক্যাসিনোগুলো হয়ে ওঠে জমজমাট। তারা অনাবিল আনন্দে চুইয়ে চুইয়ে উপভোগ করেন ফুটবল। এমনকি সমুদ্রের তীরে দেখানো হয় ফুটবল খেলা। সবাই খেলা দেখেন পিকনিকের আমেজে। নাঙ্গা তরুণ ও টপলেস তরুণীরা কখনো জলে, কখনো অন্তরীক্ষে নাচে-গানে-বাজনায়, চুম্বনে-হল্লায় মেতে ওঠেন ফুটবলের উন্মাদনায়। বিশ্বকাপকে ঘিরে জুয়ার আসরগুলোও হয়ে ওঠে সরগরম।
বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে আকাশছোঁয়া যে স্বপ্ন, আনন্দ ও গ্ল্যামারÑ তাতে যতই দিন যাচ্ছে, মেয়েদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। নেপথ্যের কর্মী ও সংগঠক হিসেবে প্রতিটি বিশ্বকাপ আয়োজনে তাদের রয়েছে শ্রম, মেধা ও সহযোগিতা। এছাড়াও তারা নানাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন। এবার তাদের জন্য বাজারজাত করা হয়েছে বিশেষভাবে নির্মিত ‘হ্যাটট্রিক ব্রা’। শাদা-কালো ইমিটেশন চামড়া দিয়ে তৈরি এই ব্রা’য় তিনটি ফুটবলের আকৃতি দেয়া হয়েছে। এই ব্রা প্রস্তুতকারী কোম্পানি জানিয়েছে, জাপানি ফুটবল অনুরাগীদের ৫০ শতাংশেরও বেশি মহিলা। মহিলারা শুধু এই ব্রা পরিধান করেই খেলা দেখতে পিছু পা হবেন না।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে নতুন রূপে দেখা যাবে মেয়েদের। তারা বল-গার্লের দায়িত্ব পালন করবে। মাঠের বাইরে যাওয়া বল তারা প্রজাপতির মতো ছুটে ছুটে নিয়ে আসবে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে এটি হবে নতুন এক আকর্ষণ। বিশ্বকাপ ফুটবলকে আরো আনন্দময় ও গ্ল্যামারাস করার ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই ফুটবল অনুরাগীদের বাড়তি আনন্দ দেবে।
দৈনিক ইত্তেফাক : ৩১ মে ২০০২
নানান রঙের বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপ ফুটবলের উল্লাসে, উচ্ছ্বাসে ও উন্মাদনায় মেতেছে দুনিয়া। সঙ্গে স্বপ্নপূরণ ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বকাপ এক সূতোর মালায়
গেঁথেছে বিশ্বকে।
বিশ্বকাপ নিছক খেলার মেলা নয়, মানবজাতির মিলনমেলাও বটে। এর মাধ্যমে উদ্বোধন ও উন্মোচন হয় জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির নানা রূপ। এখন আর শুধু মাঠের খেলায় আমাদের মন কাড়ে না, খেলোয়াড় এবং গ্যালারীর দর্শকদের নানা রঙের, নানা বর্ণের সাজে ও আনন্দ-বেদনায় আমরা মুগ্ধ হই, ব্যথিত হই এবং আপ্লুত হই। সর্বোপরি আমরা জানতে পাই অজানাকে। একটা বিশ্বকাপ কতভাবেই না আমাদের কাছে মেলে ধরে। আমরা বিভিন্ন দেশের পতাকা, মানচিত্র, জনসংখ্যা, ভূগোল, জাতীয় সঙ্গীত, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, ফ্যাশন, স্টাইল এবং জীবনকে উপভোগ করার ভঙ্গিমাগুলো দেখতে পাই। আসলে বিশ্বকাপ এমন একটি স্ফটিক, যার বর্ণিল আলোয় আমরা নানাভাবে আলোকিত হই। ভাবিত হই। বিশ্বকাপ আমাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসে পরস্পরের। একে অপরকে জানা ও বোঝার মধ্যেই গ্রথিত আছে মানবজাতির যে ঐক্যসূত্র, তার চমৎকার উপলক্ষ বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রত্যেক মানুষ ও প্রতিটি দেশের একটি কেন্দ্রবিন্দু থেকে উত্থান ও বিকাশ।
সময়ের পরিক্রমায় বদলেছে ভাষা, মানচিত্র ও অবস্থান। বেড়েছে দূরত্ব। পরিচয় হয়েছে নানা গোত্র-বর্ণ-ধর্ম-জাতি হিসেবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের যুপকাষ্ঠে বলী হতে হয়ে বেড়েছে বিভেদের দেয়াল। এর মাঝেও মানুষ গাইছে মিলনের গান। কখনো আন্তঃদেশীয়, কখনো মহাদেশীয় কিংবা কখনো বিশ্ব পরিসরে। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল যেভাবে সবাইকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত করে এবং সবার আবেগ-উচ্ছ্বাস, আনন্দ-বেদনা ও জীবনের নানা অভিব্যক্তিগুলোর উদ্ভাসন ঘটায়, তেমনটি আর কোথাও আমরা দেখি না। এ ক্ষেত্রে বিশ্বকাপ ফুটবল অনন্য ও অদ্বিতীয়।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু বিভেদের দেয়ালটাই আড়াল করে না, পাশাপাশি সবাইকে নিয়ে আসে একই সারিতে। ধনে-মানে-জনে ও শক্তিতে নজরকাড়া দেশগুলো ফুটবল মাঠে দুর্বল ও বিত্তহীন দেশগুলোর কাছে হরদম ধরাশায়ী হচ্ছে। ফ্রান্সের মত শিল্পোন্নত দেশ আফ্রিকার গহীন অন্ধকার থেকে ওঠে আসা অজ্ঞাত-অখ্যাত-অপরিচিত দেশ সেনেগালের কাছে হার মানছে। দোর্দন্ডপরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চোখের পানি আর নাকের জল এক হচ্ছে পোল্যান্ডের কাছে। বিপুল জনসংখ্যার দেশ চীন পাত্তাই পাচ্ছে না ক্ষুদ্র জনসংখ্যার দেশ কোস্টারিকার কাছে। এর মাধ্যমেই সত্যিকার অর্থে প্রকাশ ঘটছে শৌর্য-বীর্য ও মানবিক সৌন্দর্যের। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা পিছিয়ে দিলেও মুছে দিতে পারছে না মানুষের সহজাত প্রতিভা, সদিচ্ছা, কল্পনাশক্তি ও মহৎ গুণাবলীকে। এর প্রমাণ আমরা পাই শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে এবং খেলার মাঠে। পেলে, ম্যারাডোনারা যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, পাপা বুয়াবা দিওপ, সালিফ দিয়াও, ফাদিগা, হেনরি কামারারা এখন তা অনুসরণ করে চলেছেন।
সেনেগাল নামক দেশটি এতদিন আমাদের কাছে আড়াল হয়ে ছিল। আফ্রিকার এই দেশটি সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি কৌতূহল ছিল না। দেশটির এমন কোনো কীর্তি কিংবা কু-কীর্তি কখনোই আমাদের কাছে সেভাবে পৌঁছায়নি। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগে আস্তে-ধীরে আমরা জানতে পারি যে চারটি দেশ প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলতে আসছে, তার মধ্যে একটি সেনেগাল। তারপরও এককালের ফরাসী ঔপনিবেশভুক্ত ছোট্ট এই দেশটি আমাদের কাছে ছিল অনুজ্জ্বল হয়ে। আমরা একরকম ধরে নিয়েছিলাম, আফ্রিকা থেকে আসা একটা দুর্বল দল কতটুকুই বা যেতে পারবে? আমাদেরকে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করে ফুটবলের আলো দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেছে সেনেগাল। পেছনের ইতিহাস যতই কষ্টের, বেদনার, অন্ধকার হোক না কেন, কিংবা ফুটবলের ঐতিহ্য নাইবা থাকলো, মানুষের ভেতরে যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, তা যে সময় ও সুযোগমত বিচ্ছুরণ ঘটায়, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো সেনেগালিজরা। আর ফুটবলের ‘বাউল’ ফরাসি কোচ ব্রুনো মেটসু সেনেগাল দলটির অনালোকিত দিকটি নিয়ে এসেছেন আলোয়। আর এটি সম্ভব হয়েছে ফুটবলকে তিনি খেলা হিসেবে না দেখে দেখেন জীবনদর্শন হিসেবে। আর এই দর্শন দিয়ে তিনি সেনেগালের ফুটবলারদের উজ্জীবিত করতে পেরেছেন।
সেনেগালের এই সাফল্য, এই গৌরব আমাদের মত দেশকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। পিছিয়ে পড়া দরিদ্র ও অনুজ্জ্বল একটি দেশ যদি পারে, আমরা কেন পারবো না?
ক্রীড়াজগত : ১৬ জুন ২০০২
সেই দিনটি কবে আসবে
বিশ্ববাসীকে ফুটবলের আনন্দযজ্ঞে মাতিয়ে শেষ হলো দুনিয়া কাঁপানো বিশ্বকাপ। তবে এর রেশ এখনো আমাদের আপ্লুত করে স্মৃতির মৌতাতে। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কত রকম অম্ল-মধুর দৃশ্যপট।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু ক্ষণিকের আনন্দ কিংবা মোহ নয়। প্রতিটি বিশ্বকাপের আবেদন চিরন্তন। একটি বিশ্বকাপ অতীত হয়ে গেলেও তা আমাদের আনন্দময় স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে যায়। যেভাবে বেঠোফনের সিম্ফনি অনির্বচনীয় অনুভূতি এনে দেয়, ভ্যান গঁগের ছবি স্বপ্নময় জগতের সন্ধান দেয়, শেক্সপীয়ারের কবিতা ও নাটক মনের জানালা খুলে দেয়, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র অনাবিল মাধুর্যে ভরিয়ে দেয়; তেমনিভাবে বিশ্বকাপ ফুটবলও দেয় ভাল লাগার অনাস্বাদিত আমেজ।
এবারের বিশ্বকাপ কতভাবেই না আমাদের বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করেছে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে শক্তি ও শৈলীর ব্যবধান হ্রাস পাওয়ায় খেলায় ঘটেছে অপ্রত্যাশিত ফলাফল। যে কারণে এবারের বিশ্বকাপকে আন্ডারডগদের বিশ্বকাপ, অভাবিত বিশ্বকাপ কিংবা অঘটনের বিশ্বকাপ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, উরুগুয়ের মত দেশ দ্বিতীয় পর্বে উঠতে পারবে না, এটা মোটেও ভাবা যায়নি। শিরোপার অন্যতম দাবিদার ফ্রান্স কোনো ম্যাচ জিততে পারবে না, এমনকি একটি গোলও করতে পারবে না এবং আর্জেন্টিনাও প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেবে, এ তো কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। তেমনিভাবে এই প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে আসা সেনেগাল, দুই স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র যে সাফল্য দেখিয়েছে, তাতে উৎসাহিত হয়েছে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার উত্থান সবাইকে শুধু চমকেই দেয়নি, একই সঙ্গে ফুটবলের বিশ্বায়নকে এগিয়ে নিয়েছে অনেকটা পথ।
জিনেদিন জিদান, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, লুই ফিগো, থিয়েরি অঁরি, হারনান ক্রেসপো, ডেভিড ত্রেজেগে, ফ্রান্সেসকো তোত্তি, হুয়ান ভেরনের মত জগতখ্যাত তারকারা অনুজ্জ্বল হয়ে যাবেন, আর জ্বলে ওঠবেন মিরোস্লাভ কোস, বুয়াবা দিওপ, হাসান সাস, ইলহান মনসিজ, ইনামতো, মরিয়েন্তেস, হেনরি কামারার মত অনুজ্জ্বল ফুটবলাররাÑ এও তো বিশ্বকাপ ফুটবলের এক রহস্য। যে রোনালদো গত বিশ্বকাপের ফাইনালে কোনো এক রহস্যময় কারণে মাঠে নেমে অন্যলোকের বাসিন্দা হয়ে ওঠেছিলেন এবং তারপর থেকে ইনজুরির আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ফুটবলের সঙ্গে একরকম সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন; সেই রোনালদো এবার গোল্ডেন বুট জয় করবেন, এটাও এক রকম বিস্ময়। ফুটবলের দুই পরাশক্তি হয়েও ব্রাজিল ও জার্মানী এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল একরাশ সংশয়। উভয় দলই বাছাই পর্বে তাদের শেষ ম্যাচে জিতে চূড়ান্ত পর্বে ওঠা নিশ্চিত করে। আর এই দল দু’টি ফাইনালে উঠে জানিয়ে দেয় ফুটবলও কম অনিশ্চয়তার খেলা নয়। ব্রাজিলীয় অধিনায়ক কাফু উপর্যুপরি তিনটি বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে খেলে এক বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। একইভাবে এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তুরস্কের হাকান সুকুর। কোরিয়ার সঙ্গে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় ১১ সেকেন্ডে গোল করে তিনি বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭২ বছরের ইতিহাসে সবচে’ দ্রুততম গোল করেছেন। ব্রাজিল ও জার্মানী এবারই প্রথম বিশ্বকাপে মুখোমুখি হওয়াটা যেমন বিস্ময়ের, তেমনিভাবে খেলতে না নেমেও আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার ক্যানিজিয়ার লাল কার্ড পাওয়াটা কম বিস্ময়ের নয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিলের রোনালদিনহো রঙধনুর মত ফ্রি-কিক থেকে যে গোলটি দিয়েছেন তা আমাদের বুকে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি হয়ে থাকবে।
তবে সবচে’ আশার কথা, কোরিয়া ও জাপান মাঠের খেলা দিয়েই শুধু মুগ্ধ করেনি, আয়োজক হিসেবেও তাদের পারদর্শিতা সবাইকে অবাক করেছে। কোনো রকম অঘটন ছাড়াই বৈরী এই দুই প্রতিবেশী যেভাবে পরস্পরের হাতে হাত মিলিয়ে বিশ্বকাপের সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আয়োজন করেছে, তাতে এশিয়বাসী হিসেবে আমাদেরও গৌরব বেড়েছে। তবে বিশ্বকাপের আলোকে আমরা যখন আমাদের ফুটবলের দিকে তাকাই, তখন দারুণভাবে হতাশ হতে হয়। কেননা, এবারের ‘বিশ্বকাপের বিস্ময়’ কোরিয়ার সঙ্গে আমাদের ফুটবলের বন্ধন দীর্ঘদিনের। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে কোরিয়া এ অঞ্চলে খেলতে আসে। এই আশির দশক অব্দি তাদের সঙ্গে আমাদের ফুটবলের খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। কিন্তু বর্তমানে দু’দেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে দুস্তর ব্যবধান। আমরা ক্রমান¦য়ে পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্বকাপ যায়, বিশ্বকাপ আসে। আমরা দূরের বাসিন্দা হয়ে তা উপভোগ করছি সমঝদার দর্শক হিসেবে। এটাই বুঝি আমাদের নিয়তি! আমরা কি কখনো ঘুরে দাঁড়াবো না? নিশ্চয়ই একদিন দাঁড়াবো। কিন্তু সেই দিনটি কবে আসবে?
ক্রীড়াজগত : ১ জুলাই ২০০২
বিষয় : অন্যান্য
তবুও লিখে যেতে হবে
একটা স্বপ্ন ও আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ছিলাম ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখিতে। অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে কেন জানি না, লেখালেখিতে এখন আর আগের মতো উচ্ছ্বাস খুঁজে পাই না। লিখতে গেলে কলমের ডগায় এসে ভর করে একরাশ আলস্য। একটি প্রশ্ন এসে করোটিতে ধাক্কা মারে অনবরতÑ লেখালেখি করে কি আদৌ কিছু হবে? তখন এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না। বরং বুকের মাঝে অনুভব করি ব্যর্থতার জ্বালা।
আদতে দীর্ঘদিন লেখালেখি করে কী দেশের খেলাধুলার সার্বিক অবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? নাকি আমরা ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই কম-বেশি ঘুরপাক খাচ্ছি একটি বৃত্তের মাঝে? আমার তো মনে হয়Ñ আমরা ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরা যেমন একই কথামালার পুনরাবৃত্তি করে চলেছি, তেমনি ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকরা জ্বালাতে পারছেন না আশার আলো। তাহলে কেন এই মিছে ‘ধূলো-খেলা’? যারা শত প্রতিকূলতার মাঝে আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে চান, তাদের কাছে আমার কথাগুলো চরম হতাশাব্যঞ্জক মনে হবে। কিন্তু তাতে প্রকৃত সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আসলে আমরা এমন একটা রহস্যময় বাহনের আরোহী, যেটা সারা রাত চলার পরও দাঁড়িয়ে আছে মাঝ দরিয়ায়। হয়তো নদীর জোয়ার-ভাটার অবস্থানের তারতম্য ঘটছে; কিন্তু এগিয়ে যেতে পারছে না সামনে। যেন এক গোলক ধাঁধায় আটকা পড়েছে। আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সামগ্রিক দৃশ্যপটও অনুরূপ। স্বাধীনতা-উত্তর দু’দশক ইতোমধ্যে পেরিয়ে এসেছি আমরা। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের যেদিকে দৃষ্টিপাত করি না কেন, চোখে ভেসে ওঠে মরুভূমির ধু-ধু শূন্যতা। এর মাঝে ছিটেফোঁটা সবুজ দৃশ্যমান হলেও তা মোটেও আশা জাগানিয়া নয়। দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদ যেন পথ হারিয়ে ফেলেছেন। বক্সার মোশাররফ হোসেন ১৯৮৬ সালে এশিয়ান গেমসে লাইট হেভিওয়েট বিভাগে ব্রোঞ্জপদক পেয়ে ভীতু বাঙালির বদনাম ঘুচাতে কিছুটা সক্ষম হয়েছিলেন। এটা অবশ্য তেমন কলকে পাওয়ার মতো সাফল্য নয়। এরপর বড় সাফল্য বলতে দু’শুটারের বিস্ময়কর কৃতিত্ব। ১৯৯০ সালে কমনওয়েলথ গেমসে শুটার আতিকুর রহমান ও আব্দুর সাত্তার নিনি ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের দ্বৈত ইভেন্টে স্বর্ণপদক জিতে আমাদের বুকটাকে যেভাবে আকাশের মতো করে দিয়েছিলেন, তাতে আমরা দারুণভাবে আশাবাদী হয়ে উঠি। কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই। কিছুটা বুদ্বুদ সৃষ্টি করে সব যেন মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়। দেশের খেলাধুলার মানচিত্রে এছাড়া আছেই বা কি! সুরিনামের সাঁতারু অ্যান্থনি নেস্টির মতো এমন কেউ কি আছেন, যাকে নিয়ে আমরা সারা জীবন গর্ব করতে পারি? না, তেমন কারো দেখা এখন পর্যন্ত আমরা পেলাম না। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াবার সম্ভাবনা না হয় সুদূর পরাহত, তাই বলে আঞ্চলিক পর্যায়ে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলোÑ আমাদের কাছে ‘অলিম্পিক’ হিসেবে খ্যাত সাফ গেমসেও আমাদের অবস্থান খুবই নাজুক। গর্ব এটুকু যে, মালদ্বীপ ও ভুটানকে এখনও পেছনে রাখতে পেরেছি। কিন্তু ফুটবলেও মালদ্বীপ আমাদের টেক্কা দিয়েছে। এই যদি খেলাধুলার সামগ্রিক চিত্র হয়, তাহলে আমরা যাবো কোথায়? যেখানে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি, সেখানে আমাদের ভবিষ্যতই বা কী?
এদ্দিন খেলাধুলায় আমাদের ব্যর্থতার একটা সান্ত¡না ছিলো স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় এমন হবেই। কিন্তু বছর দুয়েক হলো আমরা প্রত্যাবর্তন করেছি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়। এ সময় কি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে আশানুরূপ কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে। এরও কোনো ইতিবাচক জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এই প্রথম ক্রীড়াক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। সঙ্গত কারণে তার কাছে ক্রীড়ামোদীদের চাহিদা ও প্রত্যাশা অনেকখানি। তিনি কি পেরেছেন প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে? বরং অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছেÑ ক্রীড়াঙ্গন এখন ‘সংকটকালীন অবস্থা’ অতিক্রম করছে। সবক্ষেত্রেই বিরাজ করছে স্থবিরতা। কোথাও কোনো আশা নেই। সবাই যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এমন অবস্থা অতীতে আর কখনো সৃষ্টি হয়নি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক হলোÑ সর্বত্র গণতন্ত্রের অনুশীলন। কিন্তু গভীর ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছেÑ ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অপরিসীম কুণ্ঠা। এর কোনো বাস্তব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ ক্রীড়ামোদীদের দাবিমাফিক ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরা ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচন দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করে আসছেন। কিন্তু তাদের সব লেখাই যাচ্ছে বিফলে। তাহলে লেখালেখির আর কী মূল্য আছে? অনর্থক কাগজ-কলমের অপচয় নয় কী? নিবন্ধটির এখানে সমাপ্তি টানতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। আশা নিয়ে বেঁচে থাকে মানুষ। স্বপ্ন দেখে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। আমরাও আশাবাদী একদিন কেউ না কেউ দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদ, শুটার আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি এবং বক্সার মোশাররফ হোসেনকে অতিক্রম করে ছিনিয়ে আনবে বিজয়ের মালা। ক্রীড়াঙ্গনও বিকশিত হবে গণতন্ত্রের ছোঁয়ায়। এই বদ্ধ জলাশয় আর থাকবে না। আন্তর্জাতিক খ্যাতির আলোয় ভেসে উঠবে বাংলাদেশ। আমরা ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরা তখন আর গাইবো না হতাশার গান। আমাদের কলম মুখরিত হয়ে উঠবে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। সেই সুখের দিনের প্রত্যাশায় আমাদের অবশ্যই লিখে যেতে হবে। কিন্তু কথা হলোÑ সেদিন আসবে কবে?
পাক্ষিক ক্রীড়ালোক : ১-১৫ ডিসেম্বর ১৯৯২
চাই পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ
খেলাধুলায় বিজয়ী হওয়াটা নিঃসন্দেহে গৌরবেরÑ কিন্তু জরুরি কোনো বিষয় নয়। খেলাধুলার সার কথা হচ্ছে, কিশোর ও তরুণদের শারীরিক ও মানসিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ। কেননা, দুর্বল ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্য জাতি গঠনের অন্তরায়। যে কোনো দেশের জনগণের শারীরিক মানচিত্র দেখে সে দেশ সম্পর্কে অনেকটা আঁচ করা যায়। খেলাধুলায় অগ্রসর দেশগুলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও স্বনির্ভর ও উন্নত। উন্নত দেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিক সচ্ছল জীবনের পাশাপাশি সুস্থ ও সবল দেহের অধিকারী। রোগ-তাপ-শোক তাদেরকে সহজে স্পর্শ করতে পারে না। সে কারণে তাদের গড় আয়ুও বেশি। এসব দেশে সরকারকে চিকিৎসা খাতে তেমন অর্থ ব্যয় করতে হয় না। অথচ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে এর বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং অবস্থা অতিমাত্রায় নাজুক।
দেশ ও জাতি গঠনের স্বার্থে খেলাধুলা কিংবা শরীরচর্চার ব্যাপক বিস্তৃতির প্রয়োজন। আর এর অন্যতম বাহন হচ্ছে পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ কিংবা উন্মুক্ত চত্বর। কিন্তু সারা দেশেরই খোলা মাঠ দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে উঠছে। বিশেষত ক্রমবর্ধমান রাজধানী ঢাকা ক্রমান¦য়ে ইট-পাথর, লোহা-লক্কড়, বালু-সিমেন্টের ‘প্রাণহীন’ অরণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নগর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল বায়ু, নির্জন প্রান্তর, নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও খোলা মাঠ। অথচ দু’দশক আগেও পরিস্থিতি এমন নাজুক ছিল না। তখন খেলার মাঠ কিংবা খোলা চত্বর ছাড়া কোনো পাড়া, মহল্লা, জনপদ কল্পনা করা যেতো না। এসব মাঠ, প্রান্তর শিশু-কিশোর-তরুণদের কলকাকলিতে মেতে থাকতো। প্রতিদিন সকাল-বিকাল কোনো না কোনো খেলায় মাঠগুলো ভরপুর হয়ে উঠতো। আর আজ ভোজবাজির মতো মাঠগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় তো দূরে থাক, জাতীয় পর্যায়েও পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ নেই। বাংলাদেশে প্রায় ৩০টির মতো ক্রীড়া ফেডারেশন থাকলেও তাদের অধিকাংশেরই নিজস্ব মাঠ কিংবা জিমন্যাসিয়াম নেই। অন্যান্য খেলাধুলার কথা বাদ দিলেও মাঠের অভাবে বাঙালির প্রাণপ্রিয় খেলা ফুটবল নির্বাসনে যেতে বসেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নিজস্ব কোনো মাঠ নেই। অন্যের ওপর নির্ভর করে সারা বছর তাদের কার্যক্রম চালাতে হয়। এমনকি জাতীয় দলের অনুশীলনের জন্য অনেক সময় মাঠ পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। যখন যেখানে সুযোগ পাওয়া যায়, সেখানেই প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করা হয়। মাঠের স্বল্পতার কারণে প্রায়শঃই ঘরোয়া ফুটবল বন্ধ রেখে জাতীয় দলের অনুশীলন চালাতে হয়। সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লীগ যা হোক নিয়মিত অনুষ্ঠিত হলেও দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ ও পাইওনিয়ার লীগ যথাসময়ে আয়োজন ও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। মাঠ সমস্যাই এর প্রধান কারণ। ঢাকার সিনিয়র, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ ও পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে সব মিলিয়ে ১৪০ থেকে ১৫০টি দল। এর মধ্যে ৮/১০টি কাবের নিজস্ব মাঠ রয়েছে। সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লীগের আবাহনী, রহমতগঞ্জ, ইস্টএন্ড, ধানমন্ডি এবং দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের আদমজী, বিজি প্রেস, সিটি কাব ছাড়া আর কোনো দলের নিজস্ব মাঠ নেই। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ছোট ছোট কাবের কথা ভাবাই যায় না।
এ কারণে কাবগুলোকে বিভিন্ন সংস্থার মাঠ ভাড়া নিয়ে কিংবা দূর-দূরান্তে গিয়ে প্র্যাকটিস করতে হয়। এমনিতেই কাবগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা আশানুরূপ নয়। কাব চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মাঠ সমস্যা তাদের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া স্টেডিয়াম সংলগ্ন কাব মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ারী, ওয়ান্ডারার্স, আজাদ স্পোর্টিং, দিলকুশাকে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে ওসমানী উদ্যানে সংকুলান করা হয়। প্রথমত এতেও কাবগুলোর মাঠ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। দ্বিতীয়ত কাবগুলোর স্থান সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে। অথচ এই কাবগুলোকে পরিকল্পিত উপায়ে সংকুলান করা যেতো।
বড় কাবগুলো যেখানে মাঠ সমস্যায় জর্জরিত, সেখানে ছোট ছোট কাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চরণই ভরসাÑ ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট সে তরী’। কাবগুলো না হয় একটু দূরের ব্যাপার। খেলাধুলার সূতিকাগার স্কুল-কলেজেরও মাঠ সমস্যা প্রকট। অতীতের স্কুল-কলেজগুলোতে কিছু কিছু খেলার মাঠ থাকলেও বর্তমানে নতুন করে যেসব স্কুল-কলেজ গড়ে উঠছে, তার অধিকাংশেরই কোনো খেলার মাঠ নেই। বিশেষত আজকাল বেনিয়া মনোভাব নিয়ে যারা স্কুল-কলেজ গড়ে তুলছেন, তারা খেলার মাঠের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। কয়েকটি কাস রুম থাকলেই হলো। তাতে গাদাগাদি করে দিনের পর দিন ছাত্র-ছাত্রীদের কাস নেয়া হচ্ছে। ফলে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা বদ্ধ পরিবেশে সংকুচিত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। পরবর্তীতে এরা স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে ওঠে। কেননা, শিশু-কিশোর-তরুণদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অস্বাভাবিক পথে। তাছাড়া শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলা থেকে দূরে রাখা হলে পরে আর তারা এর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে না। যে কারণে আজ মাস্তানী, সংঘর্ষ, হত্যা, মাদকাসক্তের সংখ্যা ভয়ানক বেড়ে গেছে। তরুণ, যুবকরা খেলা দেখার চেয়ে ভিসিআরে ‘নীল ছবি’তে দংশিত হতে ভালবাসে। এমনিতেই এ দেশে বিনোদনের তেমন পথ খোলা নেই। খেলাধুলাই যেখানে প্রধান ভরসা, সেখানে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত চত্বর ক্রমান¦য়ে সংকুচিত হয়ে পড়ায় মানুষের মূল্যবোধগুলো ভেঙে পড়ছে। নিষিদ্ধ পথ হয়ে উঠছে অবারিত।
অবশ্য একদিনেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। জনসংখ্যার চাপ দিনে দিনে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। এখন আর কেউ পতিত জমি ফেলে রাখতে চায় না। না সরকার, না জনগণ। আগের দিনে বিশাল এলাকা নিয়ে বাড়িঘর বানানো হতো। এসব বাড়িঘরে থাকতো রুচি-সৌন্দর্যের প্রতিফলন। থাকতো নির্মল বায়ু, গাছ-গাছালি আর ছেলেমেয়েদের খেলার জন্য আঙিনা। কিন্তু আধুনিক জীবনের জটিলতায় মানুষের সেই রুচি ও সৌন্দর্যবোধ ঝরে যাচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা এখন ঘরে-বাইরের গুমোট পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে।
মানুষের চাহিদার কারণে বাসস্থান ও ফসলি জমির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেলেও তাতে কোনো পরিকল্পনার ছাপ থাকছে না। ফলে যেখানে-সেখানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি। যে কারণে হারিয়ে যাচ্ছে খোলা মাঠ, শূন্য প্রান্তর। তাছাড়া রুচি, সৌন্দর্য, নান্দনিক বোধ ও স্থাপত্য-রীতি অনুসরণ না করায় নগরায়নের নামে জঞ্জালের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ হয়ে পড়ছে দূষিত। বেশ কিছুদিন আগে ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকৌশল বিভাগ আয়োজিত একটি সেমিনারের অভিমত এমনÑ ‘বাংলাদেশের রাজধানীতে গগনচুম্বী অফিস ভবন, বিপণন কেন্দ্র, কল-কারখানা ও ভবনাদি দ্রুত প্রসারের ফলে নগরীর স্থানে স্থানে শ্বাসরুদ্ধকর তপ্ত অচলায়তনের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।’ সেমিনারের দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞরা প্রাকৃতিক আলো-হাওয়ায় অবারিত আনাগোনায় সুযোগ রেখে সামঞ্জস্য স্থাপত্যরীতি উদ্ভাবনের আহ্বান জানান। পারিপার্শ্বিকতার তুলনায় ঢাকা নগরীর ভবনাদির ভেতরে তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় স্থানে স্থানে এক দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে তারা সতর্ক করে দেন। সেমিনারের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, খোলা মাঠ কিংবা উন্মুক্ত চত্বর নগরায়নের অপরিহার্য অংশ। অথচ বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও তারা বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে না। ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালতের জন্য খোলা মাঠ ও উন্মুক্ত চত্বর হারিয়ে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতার কারণে কিছু কিছু মাঠের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে আউটার স্টেডিয়ামের কথা বলা যায়। আগে যেখানে হাজার হাজার ফুটবলার একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতে পারতো, সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থে স্টেডিয়াম গড়ে তুলে সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্টেডিয়ামটি হকি ফেডারেশনকে দেয়া হলেও সারা বছরই প্রায় শূন্য পড়ে থাকে। তাছাড়া অবস্থানগত ও পরিবেশগত কারণে এই স্টেডিয়ামটির নির্মাণ যথার্থ নয়। গত কয়েক যুগে রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের প্রভাবে নগর পরিকল্পনার সমস্ত ন্যায়-নীতিকে বিসর্জন দিয়ে অসংখ্য খেলার মাঠকে সুপরিকল্পিতভাবে মুছে দেয়া হয়েছে। আজকের আবাহনী মাঠ একসময় উল্লিখিত ব্যক্তিদের কোপানলে পড়েছিলো। তৎকালীন ক্রীড়ামোদী তরুণ-যুবকদের প্রতিরোধের কারণে আবাহনী মাঠকে গ্রাস করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সবক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিরোধ গড়ে না তুলতে পারায় খেলার মাঠ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
সাপ্তাহিক ছুটি : সেপ্টেম্বর ১৯৯৫
সেই সুদিনের অপেক্ষায়
প্রকৃত মানুষ হতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রচলিত ধারায় যেমন শিক্ষিত হওয়া যায় না (অবশ্য ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না), তেমনিভাবে মাঠ ছাড়া খেলাধুলার কথাও ভাবা যায় না। আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করছি, যেখানে পড়ালেখা করতে চাইলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্রতুলতার কারণে ধুঁকতে হয়, খেলতে চাইলে মাঠের অভাবে ঘরে বসে থাকতে হয়। অথচ ক্রীড়াক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ সাফল্য লাভের স্বপ্ন দেখি। এ জন্য অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা তো দূরে থাকুক, পর্যাপ্ত মাঠ না থাকায় খেলাধুলাই হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। মাঠই যদি না থাকে, তাহলে খেলাধুলায় অগ্রসর হবো কীভাবে?
দেশ ও জাতি গঠনের স্বার্থে খেলাধুলা কিংবা শরীরচর্চার ব্যাপক বিস্তৃতির প্রয়োজন। আর খেলাধুলার অন্যতম বাহন হচ্ছে পর্যাপ্তসংখ্যক খেলার মাঠ কিংবা উন্মুক্ত চত্বর। কিন্তু সারা দেশেই খোলা মাঠ দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে উঠছে। বিশেষত ক্রমবর্ধিষ্ণু রাজধানী ঢাকা ক্রমান¦য়ে ইট-পাথর, লোহা-লক্কড়, বালু-সিমেন্টের ‘প্রাণহীন’ অরণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নগর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল বায়ু, নির্জন প্রান্তর, নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং খোলা মাঠ। অথচ দু’দশক আগেও পরিস্থিতি এমন নাজুক ছিল না। তখন খেলার মাঠ কিংবা খোলা চত্বর ছাড়া কোনো পাড়া, মহল্লা, জনপদ কল্পনা করা যেতো না। এসব মাঠ, প্রান্তর শিশু-কিশোর-তরুণদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকতো। আর আজ ভোজবাজির মতো মাঠগুলো যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে। নগর পরিকল্পনার নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে ঘর-বাড়ি তৈরি করার কারণেই এমনটি হচ্ছে।
কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা বদ্ধ পরিবেশে সংকুচিত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। এদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অস্বাভাবিক পথে। তাছাড়া শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলার সুযোগ না পেলে পরবর্তীতে তারা এর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এমনিতেই দেশে বিনোদনের তেমন পথ খোলা নেই। খেলাধুলাই যেখানে প্রধান অবলম্বন, সেখানে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত চত্বর ক্রমান¦য়ে সীমিত হয়ে পড়ায় নিজেকে মেলে ধরতে না পারায় ভঙে পড়ছে মানুষের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ঐতিহ্য।
তবে আশার কথা, বর্তমান সরকার খেলাধুলার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। খেলাধুলাকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে খেলার মাঠ তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। তারই আলোকে ভূমি মন্ত্রণালয় জেলা, থানা ও ইউনিয়ন প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। অচিরেই হয়তো দেশজুড়ে অসংখ্য মাঠ আগামী দিনের স্বপ্ন আর সাফল্যের অভিযাত্রীদের পদচারণায় প্রাণময় হয়ে উঠবে। সারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সূচিত হবে নতুন দিগন্ত। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায়।
ক্রীড়াজগত : ১ জুন ১৯৯৭
গুডবাই ‘কিং অব চ্যানেল’
অনেকটা চুপিসারে চলে গেলেন ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী সাঁতারু ব্রজেন দাশ। আমরা হারালাম একজন কিংবদন্তীসম ব্যক্তিত্বকে। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির গর্ব। বাঙালির স্বপ্নের অন্যতম রূপকার।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল উপেক্ষিত। নিজেদের মেধা ও প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ বলতে গেলে ছিল না। শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণে বাঙালিরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বঞ্চনা আর আশা ভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়ে বঙ্গোপসাগর বিধৌত আজকের বাংলাদেশ। ব্রজেন দাশকেও স্পর্শ করে এই বঞ্চনা। ১৯৫৫ সালে সমগ্র পাকিস্তানে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ¡ী সাঁতারু। সঙ্গত কারণে পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসে তার প্রতিনিধিত্ব করার কথা। অথচ তাকে অলিম্পিকগামী পাকিস্তান দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তার একমাত্র অপরাধ, তিনি বাঙালি। এই উপেক্ষার মোক্ষম জবাব দেয়ার উপায় খুঁজতে থাকে ব্রজেন দাশের বিদ্রোহী মন। সবাইকে চমকে দেয়ার জন্য বেছে নেন অসম্ভবের পথ। প্রথম এশীয় হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে তাকে উপেক্ষা করার যুৎসই জবাব দেন তিনি। একইসঙ্গে উজ্জ্বল করেন বাঙালির মুখ। চ্যানেল বিজয় ছাড়াও ব্রজেন দাশের মুকুটে শোভা পায় তিনটি বিশ্বরেকর্ড। ১৯৬১ সালে গড়া বিশ্বরেকর্ড তিনটি হচ্ছেÑ ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী দ্রুততম ব্যক্তি, ছয়বার চ্যানেল বিজয়ী এবং একইদিনে একই সময়ে দুটি বিশ্বরেকর্ডের স্রষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্রজেন দাশকে বিশেষ ট্রফি ‘কিং অব চ্যানেল’ প্রদান করে যুক্তরাজ্য সুইমিং এসোসিয়েশন।
বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, ব্রজেন দাশ তাদের অন্যতম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘. . . . . . ব্রজেন দাশও বাঙালি জাতিকে একটি পরিচয় দিয়েছিলেন।’ এই পরিচয় হলোÑ ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।
এ কারণে ব্রজেন দাশের নাম শুধু ক্রীড়াঙ্গনে নয়, বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ‘কিং অব চ্যানেল’ ব্রজেন দাশের মৃত্যুতে একটি জীবন্ত কিংবদন্তীর অবসান হলেও তার কিংবদন্তীর কথা স্মরিত হবে চিরকাল।
ক্রীড়াজগত : ১৬ জুন ১৯৯৮
ক্রীড়াবিষয়ক প্রকাশনা
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে শোকের, গৌরবের ও মর্যাদার। পৃথিবীতে মাতৃভাষার দাবিতে আÍত্যাগের ইতিহাস একমাত্র বাঙালির। এ আমাদের বড় অহঙ্কার। মহান ভাষা শহীদদের আÍোৎসর্গের দিনটি এখন আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এবারই প্রথম আমাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে দেশে দেশে স্মরিত হবে আমাদের আÍত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস।
ভাষা আন্দোলনের মহান শহীদদের অমর একুশে উদযাপনের আরেক গৌরবময় ঐতিহ্য বাংলা একাডেমির বইমেলা। এই মেলা আমাদের মেধা, মনন ও সৃজনশীল চর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ। একে কেন্দ্র করে বয়ে যায় সৃষ্টিশীলতার জোয়ার। নানারকম প্রকাশনায় জমজমাট হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমীর বইমেলা। বাংলা ভাষায় এখন বিজ্ঞান ও কম্পিউটার চর্চা পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যিÑ উপেক্ষিত হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন। ক্রীড়াবিষয়ক প্রকাশনার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।
ক্রীড়া সাহিত্য এখন আর অনাদৃত কোনো বিষয় নয়। বরং সাহিত্যের অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলা স্বীকৃতি পেয়েছে। নেভিল কার্ডাস ক্রীড়া সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। বাংলা ভাষায়ও যে ক্রীড়া সাহিত্য চর্চা সম্ভব, তার অনুপম দৃষ্টান্ত রেখেছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোলকাতার শঙ্করী প্রসাদ বসু, মতি নন্দী, রূপক সাহা প্রমুখ। এদের পাশাপাশি খেলাধুলাকে সর্বজনগ্রাহ্য করার জন্য বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা হচ্ছে বিভিন্ন আইন-কানুনের বই।
অথচ আমাদের দেশ ক্রীড়া প্রকাশনায় যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। এ দেশের মানুষের খেলাধুলার প্রতি যে অপরিসীম আগ্রহ ও ভালবাসা, তার ন্যূনতম প্রতিফলন ক্রীড়া প্রকাশনায় ঘটে না। আমাদের দেশেও প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক আছেন। তাদের লেখা বিভিন্ন দৈনিক ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠকরা তাদের লেখা সাগ্রহে পাঠ করে থাকেন। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারা গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারছেন না। অবশ্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু কিছু বই বের হলেও তার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।
এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক পুরনো হলেও তা সংকলিত না হওয়ায় ক্রমান¦য়ে হারিয়ে যাচ্ছে। শতবর্ষী কাব ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের ইতিহাস, অতীতের খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের কীর্তি কালের মরীচিকায় আড়াল পড়ে যাচ্ছে। এমনকি এ দেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তা এবং হালের ক্রিকেটের সাফল্য ও জোয়ার বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে না। আমরা যদি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অতীতকে হারিয়ে ফেলি, তা হবে দুঃখজনক ঘটনা। কেননা, অতীতের পথ বেয়েই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এমন নয় যে, আমাদের দেশে ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থের পাঠক চাহিদা নেই। বিশেষ করে এ দেশের গরিষ্ঠ তারুণ্যের একটি প্রিয় বিষয় খেলাধুলা। কিন্তু আগ্রহের তুলনায় সরবরাহ না থাকায় তারা অতিমাত্রায় বিদেশি খেলা, খেলোয়াড় ও গ্রন্থের প্রতি ঝুঁকছে। এর ফলে আমাদের খেলা ও খেলোয়াড়রা অবহেলিত হচ্ছেন। এটা আমাদের দেশীয় ক্রীড়াঙ্গনের জন্য আশাপ্রদ ঘটনা নয়।
এ দেশের খেলাধুলার প্রসার ও মানোন্নয়নে ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থ যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে এখনই আমাদের নজর দেয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় যদি সবরকম প্রকাশনা হতে পারে, তাহলে আমরা কেন ক্রীড়াবিষয়ক প্রকাশনায় পিছিয়ে থাকবো?
ক্রীড়াজগত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০০
স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
এখন স্টেডিয়াম পাড়ায় গেলে বড্ড কষ্ট হয়। আগের মত আর প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায় না। সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে। অবশ্য সময় নামক চোরা স্রোতে ভেসে যায় প্রতিদিনের দৃশ্যপট। অমলিন থাকে না কোনো কিছুই। তারপরেও স্টেডিয়াম এলাকার একটা প্রাণোচ্ছ্বল দৃশ্যপট আছে, যা অনেকটা চিরন্তন। এর মেজাজ ও মর্যাদা সম্পূর্ণ আলাদা। হরেক রকম খেলাধুলা, হই-হুল্লোড়, তুমুল আড্ডাবাজি এ এলাকার এক অন্তরঙ্গ প্রতিচ্ছবি।
সন্ধ্যার পর স্টেডিয়াম চত্বরে পা রাখলে দেখতে পাওয়া যায় ছোট ছোট জটলা। জটলাকারীদের গুলতানি মারা ছাড়া দৃশ্যত কোনো কাজ নেই। হয়ত কারো ঘরে চুলোও ঠিকমত জ্বলে না কিংবা জীবনে তাদের নানা জটিলতা, তবুও ঘর বা পারিবারিক জীবন তাকে আটকে রাখতে পারে না। সবকিছু ভুলে স্টেডিয়ামের আড্ডায় তার শামিল হওয়া চাই। এ ব্যাপারে কোন সংশয় নেই যে, এদের সকলেই ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ। খেলা দেখা, দেশ-বিদেশের খেলাধুলার খোঁজ-খবর রাখা এবং তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে ওঠা এদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। তাদের জীবনের অধিকাংশ বেলা খেলায় খেলায় হলো সারা। এদের অনুপস্থিতিতে স্টেডিয়াম চত্বর মনে হয় নি®প্রাণ।
দিনের পর দিন স্টেডিয়াম চত্বরে আড্ডাবাজদের দেখে আসছেন সবাই। বিকেলের পর জমজমাট হয়ে ওঠাটা স্টেডিয়াম এলাকার নিত্যদিনের ছবি। অফিস ফেরতা কর্মজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, বেকার যুবকসহ নানা পেশার নানা বয়েসী মানুষ, যাদের রক্তে ঢুকে গেছে খেলাধুলার বীজ, তাদের অন্ততঃ প্রতিদিন একবার স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুঁ না মারতে পারলে পেটের ভাত হজম হয় না। স্টেডিয়ামে যদি কোনো খেলা থাকে তাহলে খেলার পর জমে ওঠে আড্ডা। খেলার হারজিত নিয়েই আড্ডা সরগরম হয়ে ওঠে। এরপর কাবগুলোর হাড়ির খবর আর খেলোয়াড়দের নাড়ি-নক্ষত্র কে কতটা জানেন, তা নিয়ে চলে মত-বিনিময়। যেসব খবরা-খবর অনেক সাংবাদিকও রাখেন না। এসব খবরে এদের কারো কোনো উপকার না হলেও তারা এক ধরনের আÍতৃপ্তি পান। নিজের জীবনে এরা ‘জিরো’ হলেও ক্রীড়াঙ্গনের হিরোদের মাঝে খুঁজে নেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি। প্রিয় কাব আর প্রিয় খেলোয়াড়ের সাফল্যে তারা হয়ে ওঠেন আনন্দে উচ্ছল। মনে করেন, এটাই তাদের নিজের সাফল্য। এসব আড্ডাবাজের অধিকাংশই কাব সমর্থক। স্টেডিয়াম চত্বরের জটলাগুলোও কাবকেন্দ্রিক। কাবই তাদের ঘর, কাবই তাদের সংসার। তারা নিজেদের এই ঘর-সংসারের জিম্মাদার মনে করেন। যে কারণে নিজের ঘরের প্রতি তারা যতটা না মনোযোগী, তার চেয়ে বেশি আপন মনে করেন কাবকে। কাবকে ঘিরেই তাদের যাবতীয় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। এসব নিয়েই তারা আড্ডায় আড্ডায় কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবনের মূল্যবান দিনগুলো। এ জন্য তাদের একটুও আফসোস নেই। কেননা তাদের নেই কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা। যেখানে কোনো
স্বার্থ থাকে না, সেখানে ভালবাসা হয় গভীর। এই ভালবাসা নিয়েই তাদের প্রতিদিনের জীবন।
এ তো গেল একদিক। আরেক ধরনের আড্ডা হয় স্টেডিয়াম এলাকার বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন আর রেস্তোরাঁগুলোকে ঘিরে। সন্ধ্যার রঙ যত গাঢ় হয়, ততই মশগুল হয় এই আড্ডাগুলো। নানা কিসিমের সংগঠক, সাবেক ও বর্তমান ক্রীড়াবিদ, হালের খেলোয়াড়, সাংবাদিক, ব্যর্থ ক্রীড়াবিদ ও গভীর ক্রীড়ানুরাগীরা এই আড্ডায় সমবেত হন। উদ্দেশ্য একটাইÑ খেলাধুলা। কখনো-সখনো অন্য বিষয় ওঠে এলেও তা খুব একটা স্থায়ী হয় না। এ আড্ডার মানুষগুলো একটু অন্য রকম। তারাও কোনো কিছু পাওয়ার আশায় স্টেডিয়ামে আসেন না। আসেন প্রাণের রসদ যোগাতে। তবে তাদের প্রতিদিনের চিন্তা-ভাবনায় খেলাধুলা। বিনোদনের আরো অনেক দুয়ার খোলা থাকলেও খেলাধুলাই তাদের অষ্ট প্রহরের স্বপ্ন। এই দলের বড় অংশ ক্রীড়া সংগঠক। কী করে দেশের খেলাধুলার মঙ্গল হয় কিংবা নিজের কাব কীভাবে সাফল্য পেতে পারে, তা নিয়ে তাদের অন্তহীন গবেষণা। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেই তারা ব্যস্ত। খেয়ে না খেয়ে তারা মুখ বুঁজে স্টেডিয়ামে বা কাবে পড়ে থাকেন। সংসার কীভাবে চলছেÑ সেটার তারা খোঁজও রাখেন না। নিবেদিতপ্রাণ এই ক্রীড়া সংগঠকরা বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাদের জীবনে কোনো উজ্জ্বলতা নেই। মঞ্চের নেপথ্যের কুশীলবের মত তাদের জীবন। তারা তারকা তৈরি করেন এবং তারকাদের পরিচালনা করেন, এটাই তাদের জীবনের আনন্দ। তাদের কেউ চিনুক কিংবা না চিনুক, তাতে কিছু আসে-যায় না। তবে স্টেডিয়াম এলাকার মূল সুতোটা তাদের হাতেই ধরা থাকে। বলা যায়, এই আড্ডাবাজরা দেশের খেলাধুলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। যে কারণে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই তারা ছুটে যান স্টেডিয়াম এলাকায়।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় গোড়াপত্তন হয় ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামের। আর তখন থেকেই স্টেডিয়ামকে ঘিরে সূত্রপাত হয় আড্ডার। ধীরে ধীরে আড্ডাগুলো জমজমাট হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে স্টেডিয়াম এলাকায় কাব গড়ে উঠার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সংখ্যা ক্রমান¦য়ে বাড়তে থাকলে আড্ডাগুলো সমৃদ্ধ হতে থাকে। পঞ্চাশ দশক থেকে এখনো স্টেডিয়াম এলাকায় আড্ডার মৌতাতে মেতে আছেনÑ এমন লোকের সংখ্যাও বিরল নয়। খেলাধুলা নিয়ে আড্ডা তাদের প্রধান বিনোদন। এ আড্ডায় পাওয়া যায় দেশের খেলাধুলার অনেক অলিখিত ইতিহাস আর টুকরো টুকরো মজার স্মৃতি। বলা যায়, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম আকর্ষণ এই আড্ডা।
আশির দশকের শেষ দিকে স্টেডিয়াম অঙ্গন থেকে কাবগুলো সরিয়ে নেয়া হয়। এ সময় কাবকেন্দ্রিক আড্ডাগুলো কিছুটা হলেও হোঁচট খায়। বিশেষত মোহামেডান স্পোর্টিং কাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, আজাদ স্পোর্টিং, ওয়ারীর মত জনপ্রিয় ও বনেদি কাবগুলো সরে যাওয়ায় স্টেডিয়াম এলাকা অনেকটা প্রাণহীন হয়ে যায়। তবে আড্ডা থেমে যায়নি। সংখ্যা হ্রাস পেলেও আড্ডার ধারা অব্যাহত থাকে। কেননা, জাতীয় স্টেডিয়ামে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সকলকে মাতিয়ে রাখে। তবে স্টেডিয়াম এলাকার যে কোন আড্ডারই প্রাণ হলো ফুটবল। ফুটবল এমন এক খেলা, যার স্বপ্ন দোলায় দোলে সারা দেশ। তাই ফুটবল নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই। প্রতিটি আড্ডাকে সরগরম করে রাখতো ফুটবল।
নব্বই দশকের শেষে এসে ম্রিয়মান হয়ে যায় আড্ডাগুলো। এখন স্টেডিয়াম এলাকায় আড্ডাবাজদের তেমনভাবে চোখে পড়ে না। প্রায় চার দশকের ঐতিহ্য যে আড্ডার, তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এর কারণ ফুটবল। বছর দু’য়েক হলো ফুটবলবিহীন হয়ে পড়েছে ঢাকা নগরী। যে কারণে ফুটবল ক্রেজ হ্রাস পেযেছে অনেকখানি। প্রথমত নিয়মিত ফুটবল আয়োজিত না হওয়া। দ্বিতীয়ত এই শূন্যতায় ক্রিকেটের আড়ালে পড়ে গেছে ফুটবল। ক্রিকেট জনপ্রিয় হলেও ফুটবলের স্থান দখল করতে পারেনি। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা একটা নির্দিষ্ট বলয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফুটবল সর্বজনপ্রিয়। ফুটবল সহজেই সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। যে কেউ ফুটবল নিয়ে সহজেই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। ক্রিকেট নিয়ে সেটি সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণে ফুটবলের অনুপস্থিতিতে স্টেডিয়াম থেকে আড্ডাগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন স্টেডিয়াম এলাকা ঝকঝক করলেও আড্ডা না থাকায় প্রাণের আমেজ পাওয়া যায় না। তবে এই আড্ডাগুলো ফের না জমে উঠলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনও অনুজ্জ্বল থেকে যাবে। আর দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে উজ্জ্বলতা দিতে পারে ফুটবল। ফুটবল ফিরে আসুক তার স্বরূপে, সেই সঙ্গে স্টেডিয়াম এলাকার চিরপরিচিত আড্ডাগুলো হয়ে উঠুক জমজমাট। আমরা সেই আড্ডার প্রতীক্ষায় থাকলাম।
ক্রীড়াজগত : ১ মার্চ ১৯৯৯
খেলাধুলায় মেয়েরা পিছিয়ে কেন
এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে আমরা যখন নারীর চোখে বিশ্ব দেখছি, ঠিক তখন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন কি নারীবিবর্জিত হতে চলেছে? এমনটি বলার কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের উপস্থিতি দারুণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েরা যেখানে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, সেখানে খেলাধুলার প্রতি তারা একদমই আগ্রহ অনুভব করছে না। খেলাধুলার প্রতি এই অনীহার কারণ কি?
ক্রীড়াক্ষেত্রে এ দেশের মেয়েদের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। দেশভাগের পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের সরব পদচারণা। তৎকালীন বিরূপ পরিবেশ, সামাজিক অনুশাসন ও ভ্রƒকুটিকে উপেক্ষা করে মেয়েরা খেলার মাঠে এসেছে। দাপটের সঙ্গে মাঠ মাতিয়েছেন জিনাত আহমেদ, লুৎফুন্নেছা হক বকুল, কাজী জাহেদা আলী, ডলি ক্যাথরিন ক্রুজ, কাজী নাসিমা হামিদ, সুলতানা কামাল, রওশন আরা ছবি, সুফিয়া খাতুন, ইশরাত প্রমুখ। এরা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে খেলার মাঠে মেয়েদের অবস্থানকে সুসংহত করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অনুকূল পরিবেশে মেয়েরা অধিক সংখ্যায় খেলাধুলায় অংশ নেয়। ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের এই রমরমা অবস্থা আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময় রাজিয়া সুলতানা অনু, শামীম আরা টলি, শামীমা সাত্তার মিমু, কামরুন্নেসা লিপি, শর্মিলা রায়ের মতো অ্যাথলেট; রুমানা আহমেদ, কামরুন্নাহার ডানা, মরিয়ম তারেকের মতো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়; মুনিরা রহমান হেলেন, কাজী দিলা, জোবেরা রহমান লিনুর মতো টেবিল টেনিস খেলোয়াড়; খুরশিদা আক্তার খুশী, পারভীন সুলতানা লুসির মতো জিমন্যাস্ট; কামরুন্নার হিরুর মতো জুডোকা; সেতারা, মাহমুদা, শরীফা, ডালিয়ার মতো সাঁতারু; রানী হামিদের মতো দাবাড়ু ক্রীড়া আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে জ্বলেছেন। এরপর থেকে মহিলা ক্রীড়াঙ্গন তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে। অবশ্য এর মাঝে শুটার কাজী শাহানা পারভীন, সাবরিনা সুলতানা; দাবাড়ু শাবানা পারভীন নিপা প্রমুখ মহিলা ক্রীড়াঙ্গনকে উজ্জ্বলতা দিলেও সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। অথচ আগের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা যেমন বেড়েছে, তেমনিভাবে প্রচারের আলোয় নিজেকে প্লাবিত করার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও মেয়েরা যেসব খেলায় সচরাচর অংশ নিয়ে থাকে, সেই অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, সাঁতার, জিমন্যাস্টিক্স, জুডো, দাবা, শুটিংয়ে বলতে গেলে নতুন কোনো মুখ নেই, যাকে নিয়ে গর্ব করা যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই ক্রীড়াঙ্গন মেয়েশূন্য হয়ে পড়বে।
অবশ্য খেলাধুলার প্রতি মেয়েদের ওই অনাগ্রহ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সামগ্রিকভাবে দেশে যে স্খলন ও সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে খেলাধুলা বিচ্ছিন্ন নয়। এখন ছেলেমেয়েরা অবাধে মেলামেশা করলেও মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। যে কারণে নিশ্চিত হয়নি মেয়েদের নিরাপত্তা। মেয়েরা খেলার মাঠে আসতে চাইলেও নোংরা পরিস্থিতির কারণে তারা সরে আসতে বাধ্য হয়। নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠকের অভাবে মেয়েরা এগিয়ে যেতে পারে না। তাছাড়া আগের মতো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খেলাধুলার প্রচলন না থাকায় এবং কাব, ফেডারেশনগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন না করায় খেলোয়াড়ও তৈরি হচ্ছে না। সাধারণত মধ্যবিত্ত, নিু-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে মেয়েরা খেলতে আসে। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অভিভাবকরা মেয়েদের খেলাধুলায় দিতে চান না। কেননা, ক্রীড়ায় সাফল্য পেতে হলে শ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। মেয়েরা এখন আর শারীরিক শ্রম বেশি দিতে রাজি নয়। ইদানীং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার জয়-জয়কার। নাচ, গান, নাটক, মডেলিং করলে খুব দ্রুত গ্ল্যামার ও পরিচিতি পাওয়া যায়। যে জন্য মেয়েরা এর প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকছে। কম-বেশি একটা ধারণা গড়ে উঠেছেÑ খেলাধুলা করলে পড়ালেখার ক্ষতি হয় এবং চেহারার কমনীয়তা নষ্ট হয়। যে কারণে খেলাধুলা আর একবিংশ শতাব্দীর নারীদের প্রলুব্ধ করতে পারছে না।
অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়েরা খেলাধুলায় অংশ নিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। আর আমাদের দেশের মেয়েরা ক্রীড়াক্ষেত্রে ক্রমান¦য়ে পিছিয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় মেয়েদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে মেয়েরা যেখানে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে, সেখানে খেলাধুলায় কেন পিছিয়ে থাকবে? এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মার্চ ২০০০
সিটিয়াস অলটিয়াস ফরটিয়াস
প্রাকৃতিক সম্পদ আর ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে শুরু হয়েছে অন্যরকম এক বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ধ্বংস নয়, সৃষ্টির। এ যুদ্ধ গতি, শক্তি ও দৈর্ঘ্যরে। সৌভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সখ্য, সংহতি ও ভালবাসার। অলিম্পিকের মূলমন্ত্র হলো ‘সিটিয়াস, অলটিয়াস, ফরটিয়াস’। অর্থাৎ আরো দ্রুত, আরো উঁচু, আরো শক্তিশালী। লাতিন এ বাগধারায় উজ্জীবিত হয়ে ক্রীড়ানৈপুণ্যের অবিশ্বাস্য সব নজির স্থাপন করে মর্ত্যলোকের মানুষেরা।
বিশ্বমানবের মহামিলন কেন্দ্র অলিম্পিক গেমস। সেই সুপ্রাচীনকালে গ্রিসের অলিম্পিয়ায় শরীর ও মননচর্চার পাশাপাশি ঐক্য ও সংহতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে অলিম্পিক গেমসের সূচনা হয়। মাঝে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলেও অলিম্পিক তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। বরং ব্যারন দ্য কুবার্তের আধুনিক অলিম্পিকের মর্যাদা, গৌরব, কৌলীন্য ও জৌলুস অনেক বেড়েছে। তাবৎ দুনিয়ার পতাকা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটায় অলিম্পিক গেমস। অবশ্য দুবার বিশ্বযুদ্ধের কারণে আধুনিক অলিম্পিকের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলেও ১৮৯৬ সাল থেকে চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’।
সিডনি অলিম্পিকে ২৮টি খেলায় অংশ নেবে ২০০ দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০,২০০ অ্যাথলেট। সেরা অ্যাথলেটরা নিজেদের নৈপুণ্য মেলে ধরার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। অবশ্য কেউ কেউ এর আগে অলিম্পিকে অংশ নিলেও অধিকাংশ অ্যাথলেট এবারই প্রথম তাদের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাচ্ছেন। পুরনোদের পাশাপাশি নতুন অ্যাথলেটদের কাছে এটা শুধু ক্রীড়া-উৎসব নয়, জীবনযুদ্ধের লড়াই। নিজেকে প্রতিষ্ঠার, নিজের দেশের মর্যাদা রক্ষার তীব্র সংগ্রাম। সিডনি অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও অলিম্পিকের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। অলিম্পিকে নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যৌবনের দূতরা চারটি বছর নিজেদের তৈরি করেন। ‘দুরন্ত যৌবন, অপ্রতিরোধ্য জীবন, অদম্য অস্তিত্ব যেন ক্রীড়াঙ্গনে প্রাণেরই পতাকা তুলে ধরে। দৌড়বাজের দু’খানা ছন্দোবদ্ধ পা যেন হয়ে যায় কবিতা। জিমন্যাস্টিক্সের ভেতর শরীরের সঙ্গীত, হাইজাম্প বা পোলভল্টে যেন পাখি হয়ে উড়ে বেড়ায় অবিশ্বাস্য মানুষেরা। আমাদের দুর্মর কল্পনা বা সীমাবদ্ধ প্রত্যাশার সীমারেখা ভাঙচুর করে আমাদেরই মতো মানুষেরা।’
বর্ণাঢ্যতায় ও ব্যাপকতায় বিশাল অলিম্পিককে ঘিরে কত না অম্ল-মধুর নাটক মঞ্চস্থ হয়। টুকরো টুকরো হাসি-কান্নার কাহিনী গড়ে উঠে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বেদ, রক্ত, পরিশ্রম, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, প্রাপ্তি ও নিরাশা। সৃষ্টি হয় নতুন তারকা। নতুন রেকর্ড। অনেকের স্বপ্ন পূরণ হয়। মুছে যায় রঙিন স্বপ্ন।
আমাদের মত দেশে অলিম্পিক স্বপ্নময় এক ক্রীড়াযজ্ঞ। এ ক্রীড়াযজ্ঞে আমাদের অংশগ্রহণ অনেকটা অতিথির মতো। ‘অলিম্পিক গেমসে বিজয়ী হওয়া নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’ অলিম্পিকের এই মতবাদ আমাদের মতো দেশগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে এবং এটা হুবহু মেনে চলে। এছাড়া কীইবা করার আছে? তবে একেবারে হাল ছেড়ে দেয়াটা যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। কমনওয়েলথ গেমসে আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি শুটিংয়ে স্বর্ণপদক পাবেন কিংবা আমরা এতো শীঘ্র টেস্ট ক্রিকেট খেলবোÑ এটা ছিল আমাদের প্রত্যাশার বাইরে। সিউল অলিম্পিকে সাঁতারের ১০০ মিটার বাটারফাইতে সোনা জিতে অ্যান্থনি নেস্টি চিনিয়ে দেন সুরিনাম নামে একটি দেশ পৃথিবীতে আছে। তাহলে অলিম্পিক গেমসে আমরা কেন হঠাৎ কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করবো না? আজ না হোক, আগামীকালের কাছে সেই প্রত্যাশাটুকু জমা থাকলো।
ক্রীড়াজগত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০০
অলিম্পিকের আনন্দ-বেদনা
বুকের মাঝে একরাশ কান্না নিয়েও ১১০ মিটার হার্ডলসে রুপার পদক জিতেছেন নাইজেরিয়ার গ্লোরি অ্যালেজি। দুর্ঘটনায় হবু বরের মৃত্যু তাকে যথেষ্ট দমিয়ে দিলেও অলিম্পিকের আহ্বানে তিনি সাড়া না দিয়ে পারেননি। এ রকম অসংখ্য আনন্দ-বেদনার ঘটনায় উদ্ভাসিত সিডনি অলিম্পিক। পদক না পেয়েও ঝলমলে একটি নাম এরিক মোসাম্বানি। তিনি শুধু তার দেশ ইকোয়েটোরিয়ান গিনিকে পরিচিত করেননি, পাশাপাশি অলিম্পিকের সুমহান আদর্শকে সমুজ্জ্বল রেখেছেন। ছোট্ট একটি দ্বীপের বাসিন্দা মোসাম্বানির দেশের বড় সুইমিংপুলটির দৈর্ঘ্য মাত্র ২০ মিটার। এ পুলেই চলতি বছরে তার সাঁতারে অভিষেক হয়। যে কারণে অ্যাকুয়াটিক সুইমিং সেন্টারটি তার কাছে অনেকটা ‘সাগরে’ রূপ নেয়। সাঁতারে অনভিজ্ঞ কৃষ্ণাঙ্গ এ যুবকটি একপর্যায়ে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে দর্শকরা তাকে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করলে তিনি অলিম্পিক ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে সাঁতার শেষ করতে সক্ষম হন। কোনো কোনো পরাজয় বিজয়ের চেয়েও মহান। তার চমৎকার দৃষ্টান্ত এরিক মোসাম্বানি। সাঁতার শেষে মোসাম্বানি দর্শকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রতিযোগিতায় পদক জয়ের আশা না থাকা সত্ত্বেও সবার পেছনে থেকেও গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তার যে সর্বাÍক প্রচেষ্টা, এটাই হলো অলিম্পিকের স্পিরিট।
স্বপ্ন পূরণ আর স্বপ্নভঙ্গের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য, ব্যাপক ও বিশাল ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিক গেমস। এবারের অলিম্পিক গেমসে রচিত হয়েছে আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। প্রজ্বলিত হাইটেক মশালের চেয়ে মারিয়ান জোনস, মরিস গ্রিন, ক্যাথি ফ্রিম্যান, মাইকেল জনসনের সাফল্য কোন অংশে অনুজ্জ্বল নয়। গ্রিন-জোনসের দ্রুততম মানব-মানবী হওয়া, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম কোনো আদিবাসী মেয়ে হিসেবে ৪০০ মিটার দৌড়ে ক্যাথি ফ্রিম্যানের স্বর্ণপদক জয়, একই ইভেন্টে মাইকেল জনসনের ইতিহাস গড়া, ম্যারাথনে জাপানের নাওকো তাকাহাসির প্রথম স্বর্ণ জয়, দুই ডাচ সাঁতারু ‘নতুন টারজান’ পিটার ফন ডেন হুগেনব্যান্ড ও ফাইং ডাচ ওয়োম্যান ইঙ্গে ডি ব্রুইনের অভাবিত সাফল্যটা আনন্দের এবং অন্যদিকে বেদনার হলোÑ ফরাসি অ্যাথলেট মেরি হোসে পেরেকের রহস্যময় প্রস্থান এবং ডাক্তারের ভুলে রুমানিয়ার তরুণী জিমন্যাস্ট আন্দ্রিয়া রাদুকানের স্বর্ণপদক হারানো। স্বদেশী কিংবদন্তী নায়িকা নাদিয়া কোমানিচির পর তিনি রুমানিয়ার হয়ে অল অ্যারাউন্ড ইভেন্টে বিজয়ী হয়ে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করলেও তার আনন্দটুকু ছিল ক্ষণস্থায়ী। রাদুকান নির্দোষী হয়েও শিকার হয়েছেন ট্র্যাজেডির। তার দুঃখে সবাই কম-বেশি সমব্যথী হলেও ড্রাগের ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি এবারের অলিম্পিক। যেটি আশঙ্কাজনক, তা হলোÑ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাথলেটদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। ড্রাগের এ আগ্রাসন থামানো না হলে অলিম্পিকের মহিমা ও মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণœ হবে।
সিডনি অলিম্পিকে বিস্ময়করভাবে হেরেছেন ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত কুস্তিগীর আলেকজান্ডার কারেলিন এবং পোলভল্টের জীবন্ত কিংবদন্তী সের্গেই বুবকা। এ দুজন ক্রীড়াবিদ তাদের স্ব-স্ব ইভেন্টে অপ্রতিদ্বন্দ¡ী হলেও সময়ের কাছে তারা হার মেনেছেন। অলিম্পিক হলো শক্তিমান, বেগবান ও ক্ষমতাবানদের। তারই আলোকে এবারে সবচেয়ে দ্রুত দৌড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্টার মরিস গ্রিন, সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছেন একজন পোলভল্টার এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মানব হয়েছেন ইরানের হোসেন রেজা জাদেহ।
সাফল্য-ব্যর্থতা ছাড়াও অলিম্পিকই মহামিলনের প্রধান উৎসব, যেখানে পৃথিবীর তাবৎ দেশের মানুষেরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে বিনিময় করেন নিজেদের ভাষা, পতাকা, সংস্কৃতি। গড়েন বন্ধুত্ব-মৈত্রী-বন্ধন। এটাই অলিম্পিকের বড় বৈশিষ্ট্য। ফের চার বছর পর অলিম্পিকে সবাই একত্রিত হবেন। এ সময় কত কি ঘটে যাবে। কিন্তু অলিম্পিক থাকবে। থাকবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ভালবাসা।
ক্রীড়াজগত : ১ অক্টোবর ২০০০
ক্রীড়াবিদদের বীরোচিত ভূমিকা
স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্রীড়াবিদদের বীরোচিত ভূমিকা ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছে। তাদের আÍত্যাগ ও গৌরবময় অবদানে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে।
পাকিস্তানের ২৪ বছরে শাসকদের বৈষম্যমূলক শাসন ও শোষণের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াজগত ছিল উপেক্ষিত। এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদরা যাতে তাদের প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছতে না পারে, সে জন্য হয় কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। তাদের তাচ্ছিল্য ও পক্ষপাতিত্বের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত বাজেট। জনসংখ্যার অনুপাতে বাজেট বরাদ্দের কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যদি এক কোটি টাকা বরাদ্দ করা হতো, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের (তৎকালীন) জন্য করা হতো এক লাখ। ফলে অবহেলা, উপেক্ষা ও বঞ্চনার মাঝেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও ক্রীড়াশৈলী দেখিয়ে কোনো কোনো ক্রীড়াবিদ সাফল্য দেখালেও তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়া হতো না।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সুযোগ দেয়া তো দূরে থাকুক, এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদরা যাতে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে না পারেন, সর্বদা সে চেষ্টাই করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটারের টেস্ট খেলার যোগ্যতা থাকলেও সর্বসাকুল্যে সুযোগ পেয়েছেন একমাত্র নিয়াজ আহমেদ সিদ্দিকী। তবে তিনিও বাঙালী ছিলেন না। অবহেলা আর উপেক্ষা পেতে পেতে এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষোভের অনলে জ্বলতে থাকে। এ কারণে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে খেলা হলে প্রাদেশিক মনোভাব ও উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়। ’৭১ সালের ১ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল পাকিস্তান এবং কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে। দর্শকরা খেলা উপভোগ করার সময় বেতারে দুপুর ১টার খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অর্ধিবেশন ডাকবেন না। এর অর্থ ছিল বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করা। স্বাধিকারের চেতনায় মুহূর্তেই দর্শকরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠেন এবং মাঠে ঢুকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ধাওয়া করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ক্রীড়াবিদরাও তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ বিশ্বের ক্রীড়া ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ফুটবলারদের অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। অনুরূপভাবে ’৭১-এর ১২ অক্টোবর কোলকাতার কলেজ স্কোয়ারে সাঁতারু অরুণ নন্দী একটানা ৯০ ঘণ্টা সাঁতরে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেন। এছাড়াও সাঁতারু কানাইলাল শর্মাসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব ক্রীড়াবিদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছেন, তাদের কথা জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্রীড়াবিদরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির পাশাপাশি মাতৃভূমির জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছেন। ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নাম ক্রিকেটার জুয়েল, ফুটবলার সারোয়ার, মজিবর, কুটু মনি, বাবুল, অ্যাথলেট সিরাজ, শাহেদ আলী, ক্রীড়া সংগঠক মুশতাক, ক্রীড়া সাংবাদিক আব্দুল মান্নান লাড়ু ভাই স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন সঁপে দিয়েছেন।
মহান এ বিজয় দিবসে স্বাধীনতা সংগ্রামে গৌরবময় ভূমিকা পালনকারী ক্রীড়াবিদদের কথা আমরা স্মরণ করছি।
ক্রীড়াজগত : ১৬ ডিসেম্বর ২০০০
নতুন শতাব্দী, নতুন সহস্রাব্দ
সময়ের পল, অনুপল নিয়ে যে মহাকাল, তার অতলে ডুব দিয়েছে আরো একটি শতাব্দী ও সহস্রাব্দ। উত্তাল কালসমুদ্রে শতাব্দী বা সহস্রাব্দ কিছুটা ঢেউ তুলে মিলিয়ে গেলেও মানব সভ্যতার ইতিহাসকে তা দারুণভাবে আন্দোলিত করে। এ কালখন্ডে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়যাত্রা মানব প্রজাতির জীবনযাত্রা ও চিন্তা-ভাবনাকে আমূল বদলে দেয়ার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনেও সাধিত হয় বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা।
বিংশ শতাব্দী আমাদের উত্তরণের কাল। এ সময় আমরা বৃটিশ ও পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হয়েছি। তবে এ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালির আÍপরিচয়ের যে নির্মিতি, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ক্রীড়াঙ্গনেও যে সাফল্যের আলো, তা আমাদেরও আলোকিত করেছে। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে খেলাধুলায় বাঙালির বলার মত তেমন সাফল্য নেই। তদুপরি ১৯১১ সালের ২৯ জুলাই গোরাদের ফুটবল দল ইস্ট ইয়র্ককে হারিয়ে মোহনবাগানের আইএফএ শীল্ড জয় আমাদেরকেও দারুণভাবে উদ্বেলিত করে। কেননা মোহনবাগান দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় ছিলেন পূর্ব বাংলার। ১৯৩৭ সালের ২১ নভেম্বর আমাদের ফুটবলের একটি যুগান্তরী দিন। বাংলার ছেলেদের নিয়ে গড়া ঢাকা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র পাখী সেনের গোলে এএফসি কোরিন্থিয়ান ক্লাবকে বিস্ময়করভাবে হারিয়ে দেয়। সে সময় ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম দল ছিল এই ইংলিশ ক্লাব।
পাকিস্তান আমলে অন্য সবকিছুর মত ক্রীড়া ক্ষেত্রেও আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের ক্রীড়াবিদদের সুযোগ ছিল সীমিত, তারপরও সম্ভাবনাটুকু কাজে লাগাতে দেয়া হয়নি। এর মাঝে ১৯৫৯ সালে বিক্রমপুরের ছেলে সাঁতারু ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে সাড়া জাগান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালির ইতিহাসে সবচে গৌরবময় ঘটনা। এ সময় বাংলাদেশের সপক্ষে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং সাঁতারু অরুণ নন্দীর রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার পর ক্রীড়াঙ্গনে উড়তে থাকে বিজয়- নিশানা।
দাবায় উপমহাদেশের প্রথম গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, বৃটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন রাণী হামিদ, ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসের দ্রুততম মানব শাহ আলম, ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসের দ্রুততম মানব বিমল চন্দ্র তরফদার, ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসে সর্বাধিক স¦র্ণ ও ১৯৮০ সালে এশিয়ান সাঁতারে রূপাজয়ী মোশাররফ হোসেন খান, ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে বক্সিং-এ ব্রোঞ্জজয়ী মোশাররফ হোসেন, হংকং পেশাদার ফুটবল লীগে প্রথম বাঙালি ফুটবলার সালাউদ্দিন, কোলকাতা লীগ মাতানো ফুটবলার মোনেম মুন্না, এএফসির দৃষ্টিতে ফুটবলার অব দ্য মান্থ আলফাজ, ১৯৯০ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের দ্বৈত ইভেন্টে স্বর্ণজয়ী আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি, কমনওয়েলথ শুটিং-এ স্বর্ণজয়ী সাবরিনা সুলতানা, অভিষেক টেস্টের অধিনায়ক ও ৬ উইকেট লাভকারী নাঈমুর রহমান দুর্জয়, অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক আকরাম খান, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ খালেদ মাহমুদ সুজন, ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মেহরাব হোসেন অপি প্রমুখ ক্রীড়াক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল নাম। ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালের এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে রৌপ্য পদক, ১৯৯৭ সালে সাফ গেমসের ফুটবলে স্বর্ণপদক জয়, ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলা এবং ২০০০ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ ও ১০ নভেম্বর অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলা এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অনন্য ঘটনা। আলাদা মানচিত্র ও লাল-সবুজ পতাকা অর্জনের পর অন্যান্য ক্ষেত্রের মত ক্রীড়াঙ্গনেও বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব সগৌরবে ঘোষণা করছে।
গেল দ্বিতীয় সহস্রাব্দ ও বিংশ শতাব্দীতে খেলাধুলায় বাঙালি নিজেদের ভিত্তি স্থাপন ও সাফল্যের সূচনা করেছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নতুন সহস্রাব্দ ও শতাব্দীতে ক্রীড়া ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা নতুন ধারার সৃষ্টি করবে।
ক্রীড়াজগত : ১ জানুয়ারি ২০০১
ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর চাই
খেলাধুলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা জাদুঘরে যে কোনো ঘটনার উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। তা থেকে ভবিষ্যত প্রজন্ম জানতে পারে অতীতের ঘটনাবলী।
ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘরের ক্ষেত্রে অন্যতম দৃষ্টান্ত অলিম্পিক জাদুঘর। আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিয়ারে দ্য কুবার্তের প্রথম অলিম্পিক জাদুঘর সম্পর্কে ধারণা দেন। ল্যুসানে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)-এর সদর দফতর স্থাপনের পর ১৯১৫ সালে তিনি এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তারই ধারণার আলোকে শুরু হয় অলিম্পিক জাদুঘরের যাত্রা। তবে ১৯৮০ সালে জুয়ান অ্যান্টোনিও সামারাঞ্চ আইওসির সভাপতি হওয়ার পর অলিম্পিক জাদুঘরকে অত্যাধুনিকভাবে ঢেলে সাজানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। নানা রকম ক্রীড়ার ছবি, ক্রীড়াবিদদের ব্যবহৃত পোশাক ও সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দৈনন্দিন সামগ্রী, বই, ডায়রি, চিঠি, স্ট্যাম্প, মুদ্রা ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ভান্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি সামারাঞ্চ ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘরকে জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন। এতে সমন¦য় ঘটানো হয় আধুনিক অডিওভিজ্যুয়াল ও কম্পিউটারের। বর্তমানে অলিম্পিক জাদুঘরে অলিম্পিক আন্দোলন সংক্রান্ত ১৭ সহস্রাধিক গ্রন্থ, ২৫০টি মূল্যবান সাময়িকী, ২০ লাখ ক্যাটালগ, আনুমানিক ১৫ হাজার ঘণ্টার ফিল্ম নিয়ে অডিওভিজ্যুয়াল আর্কাইভ, তিন লাখ ফটো নিয়ে ফটোগ্রাফিক পাঠাগার, ১২ সহস্রাধিক স্ট্যাম্প ও ডাকটিকিট সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলপত্র এবং অলিম্পিক উপলক্ষে প্রকাশিত মুদ্রা রয়েছে। অবশ্য শুধু অলিম্পিক জাদুঘর নয়, ফিফার জাদুঘরও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এছাড়াও রয়েছে নানা রকম ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর।
অথচ এ ক্ষেত্রে আমরা দারুণভাবে পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর ধারণাটি এখনও তেমন স্পষ্ট নয়। আমাদের জাতীয় জাদুঘরে ক্রীড়া সংক্রান্ত ছিটেফোঁটা নিদর্শন থাকলেও তা একদমই অপ্রতুল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের খেলাধুলার মান আশানুরূপ না হলেও এ দেশের খেলাধুলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক দিনের। সঙ্গত কারণে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গড়ে তোলা এবং তা সজ্জিত করার মত অনেক নিদর্শন ও উপকরণ আমাদের দেশে রয়েছে। বাঙালির লোকজ খেলাধুলার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। বৃটিশ আমলে প্রবর্তন ঘটে ফুটবল, ক্রিকেটসহ আধুনিক খেলাধুলার। ১৯৩৭ সালে কোরিন্থিয়ান ফুটবল ক্লাবকে হারানো, ১৯৫৯ সালে সাঁতারু ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফুটবলারদের ঐতিহাসিক ভূমিকা, দাবায় উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, ১৯৯০ সালে কমনওয়েলথ গেমসে আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনির স্বর্ণপদক জয়, বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা, অভিষেক টেস্ট খেলাসহ নানারকম ঘটনাবহুল ঘটনা আমাদের ক্রীড়া ইতিহাসে সঞ্চিত হয়েছে। এসব খেলার ঘটনাবলীর ছবি, ক্রীড়াবিদদের ব্যবহৃত পোশাক ও সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দৈনন্দিন সামগ্রী, বই, ডায়রি, চিঠি, স্ট্যাম্প, মুদ্রা, ভিডিও ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গড়ে তোলা হলে এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। এ বিষয়ে এখনই সচেতন ও সতর্ক না হলে আমরা ইতিহাসের অনেক নিদর্শন ও উপকরণ হারিয়ে ফেলবো।
আমরা আশা করবো, অচিরেই ক্রীড়াবিষয়ক জাদুঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হবে।
ক্রীড়াজগত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন