আমাদের ফুটবলাররা

গৌরবময় অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু

বাংলাদেশ নামক এই দেশটির জন্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টুর নাম। এই দেশটি সৃষ্টির যে প্রসব বেদনা, তার কোনো কোনো মুহূর্ত তিনিও বুকে ধারণ করেছেন। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানিরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঝাঁপিয়ে পড়লে বদলে যায় ইতিহাসের গতিপথ। বাঙালিরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি গানে, কবিতায়, এমনকি খেলার মাঠেও বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লড়াই শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রতিবেশী ভারতের মাটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ফুটবলারদের নিয়ে যে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ গঠন করা হয়, জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন তার অধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বেই ফুটবল মাঠে রচিত হয় গৌরবময় এক অধ্যায়। ২৪ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে স্থানীয় দলের সঙ্গে প্রথম ফুটবল ম্যাচে অংশ নেয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এ ম্যাচ উপলক্ষে ভারতের পাশাপাশি স্বাধীন দেশের জন্য সংগ্রামরত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না পাওয়া একটি দেশের এভাবে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা ছিল এক অভাবিত ঘটনা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতের মাটিতে দারুণভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ১৬টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ১২টিতে জয়ী ও ২টিতে পরাজিত হয়। অবশ্য জয়-পরাজয়ের চেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি ফুটবল দলের এভাবে জনমত সৃষ্টি করা ছিল একটি বিরল ঘটনা। এই একটি কারণেই ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন জাকারিয়া পিন্টু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এগিয়ে চলা ফুটবলের সঙ্গেও জাকারিয়া পিন্টু সম্পৃক্ত। ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে রাষ্ট্রপতি একাদশ ও মুজিবনগর একাদশের মধ্যে প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মুজিবনগর একাদশের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। এছাড়া একই বছর ১৩ মে ঢাকা স্টেডিয়ামে কোলকাতা মোহনবাগানের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচে তিনি বাংলাদেশ নির্বাচিত একাদশের অধিনায়ক এবং আসামের গৌহাটিতে সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই ট্রফিতে ঢাকা একাদশের অধিনায়ক ছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯তম মারদেকা ফুটবলে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন।
বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের ফুটবলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে জাকারিয়া পিন্টু উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও ফুটবলার হিসেবেও তিনি কম উদ্ভাসিত নন। দু’দশকেরও বেশি বিস্তৃত তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার ছিল বর্ণাঢ্য। ফুটবল ছিল তাঁর জীবন-দর্শন ও ধ্যান-ধারণা। মোহাম্মদ জাকারিয়া পিন্টুর জন্ম নওগাঁয় ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি। একদম শৈশবেই তিনি ফুটবল-প্রেমে নিমজ্জিত হন। ১০ বছর বয়সে নওগাঁ শহরের কৃষ্ণদেব হাই স্কুলের খেলার মাঠে তাঁর ফুটবলে হাতেখড়ি হয়। ফুটবলের টানে তিনি চলে যান বরিশাল। মঠবাড়িয়া হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি ফুটবলেই আÍনিবেদন করেন। ১৯৫৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে ফুটবলে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। শুরু থেকেই তিনি খেলতেন রক্ষণভাগে। খেলার পাশাপাশি সমগ্র ফুটবল ক্যারিয়ারে তাঁকে অধিকাংশ সময় অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতে হয়। অধিনায়কের তালিম নেন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৮ ও ’৫৯ সালে তিনি কলেজের অধিনায়ক থাকাকালে তাঁর কলেজ আন্তঃকলেজ টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। জয় করে গভর্নর্স কাপ ও স্যার এ এফ রহমান শিল্ড। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬০ সালে ভর্তি হন বরিশালের বিএম কলেজে। তাঁর কলেজ শের-এ-বাংলা শিল্ডে চ্যাম্পিয়ন এবং আন্তঃকলেজ ফুটবলে রানার্সআপ হয়। øাতক ডিগ্রি নেয়ার পর ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সহজাত কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্ট পাকিস্তান জোনে।
১৯৫৭ সালে কলেজে পড়ার সময় ইস্টএন্ডের দ্বিতীয় বিভাগে খেলার আমন্ত্রণ পান। ট্রায়ালে তাঁর ক্রীড়াশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সরাসরি প্রথম বিভাগে খেলানো হয়। ১৯৫৭ ও ’৫৮ সালে ইস্টএন্ডে খেলার পর ১৯৫৯ সালে যোগ দেন তৎকালীন জনপ্রিয় দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার এই ফুটবলার ওয়ান্ডারার্সের হয়ে হাফ ব্যাকে খেলে সবার নজর কেড়ে নেন। তাঁর অপরিসীম দম, অক্লান্ত ছোটাছুটি ও প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ় মনোবলের কারণে তাকে আখ্যা দেয়া হয় ‘কালো পাহাড়’। ১৯৬০ সালে ওয়ান্ডারার্স লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তা সত্ত্বেও তিনি ১৯৬১ সালে যোগ দেন কৈশোরের লালিত স্বপ্নের দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। এরপর মোহামেডান হয়ে ওঠে তাঁর ভালবাসার নীড়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর মোহামেডানে খেলে ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন। মোহামেডানের সেন্টার হাফে খেলতেন দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় তোরাব আলী। জাতীয় দলের হয়ে খেলতে যেয়ে তোরাব আলী মারাÍক আহত হওয়ায় মোহামেডান সঙ্কটে পড়ে যায়। ক্লাবের অনুরোধে উইং ব্যাক ও হাফ ব্যাক পজিশন ছেড়ে তোরাব আলীর জায়গায় সেন্টার হাফে খেলা শুরু করেন জাকারিয়া পিন্টু। খেলা ছেড়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত স্টপার হিসেবে খেলেছেন। তিনি ছিলেন দেশের সেরা স্টপার। ক্লাবে যোগ দেয়ার প্রথম বছরই মোহামেডান লীগ, স্বাধীনতা দিবস টুর্নামেন্ট ও বরিশালের শের-এ-বাংলা শিল্ডে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৫ সালে যখন খেলা ছেড়ে দেন, সেবার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। এছাড়াও খেলোয়াড় হিসেবে তিনি লীগ শিরোপার স্বাদ পান ১৯৬৩, ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৮ সাল থেকে ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত আট বছর তিনি ছিলেন মোহামেডানের অধিনায়ক। আর কোনো খেলোয়াড়ের টানা এতো বছর মোহামেডানের অধিনায়ক হওয়ার রেকর্ড নেই। ১৯৬৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ১৯৬৯ সালে মোহামেডান লীগ, স্বাধীনতা দিবস ও কুমিল্লা গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তিনি আরো কিছুদিন খেলা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্লাবের কাছে তাঁর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ায় প্রথম বিভাগে ১৯ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানতে হয়।
১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে জাকারিয়া পিন্টু প্রথম অংশ নেন। করাচিতে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬২ সালে এশিয়ান যুব ফুটবলে তৎকালীন পাকিস্তান দলে তাঁকে ও দেবীনাশকে বিনা ট্রায়ালে দলে নেয়া হয়। তিনি খেলতে যাননি। ১৯৬৮ সালে তিনি জাতীয় দলে স্থান করে নেন। তুরস্কের আরসিডি টুর্নামেন্টে তিনি অংশ নেন। এরপর স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত তিনি জাতীয় দলের হয়ে ইরানের ফ্রেন্ডশিপ ফুটবল, নেপালের রাজা মহেন্দ্র কাপে খেলেছেন। এরপর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি ইতিহাস হয়ে আছেন। এছাড়া ভারতের গুজরাটে বরদুলই কাপ ও দিল্লির ডুরান্ড কাপেও খেলেছেন। তাঁর দীর্ঘ ফুটবল জীবনে তিনি অধিকাংশ সময়ই অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৮ সালে তুরস্কের আরসিডি টুর্নামেন্টে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে স্বাগতিক দলের সঙ্গে তাঁর খেলা স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। লেফট ব্যাক হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে সেন্টার ফরোয়ার্ড মওলা বক্স দুটি গোল করেন। এ দু’গোলে প্রথমার্ধে এগিয়ে যায় পাকিস্তান। যদিও শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ঘরানার দল শক্তিশালী তুরস্ক ৪-২ গোলে জয়ী হয়। কিন্তু জাকারিয়া পিন্টুর খেলা দারুণভাবে প্রশংসিত হয়।
খেলা ছেড়ে দেয়ার পর তিনি ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে কিছুদিনের জন্য মোহামেডান দলকে প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফুটবল প্রশিক্ষণের ওপর স্বল্পমেয়াদি ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে প্রীতি ফুটবল ম্যাচে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ, ১৯৮০ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশ দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। জাকারিয়া পিন্টু ১৯৭৮ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার এবং ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে জাকারিয়া পিন্টুর নাম একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। শুধু একজন নন্দিত ফুটবলার হিসেবেই নয়, এদেশের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে স্মরিত হবে তাঁর নাম।


দুরন্ত গতির উইঙ্গার প্রতাপ

তাঁকে সবাই চেনেন ‘হকির প্রতাপ’ হিসেবে। এ পরিচয়টা যে একদমই ভুলÑ তা বলা যাবে না। সব্যসাচী এই ক্রীড়াবিদ জীবনে অনেক খেলাই খেলেছেন; কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবন শেষে কী কারণে যেন হকির সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। সম্ভবত এ কারণেই বর্তমান প্রজন্মের কাছে হকির লোক হিসেবে তাঁর পরিচিতি। অথচ খেলোয়াড় হিসেবে ফুটবল মাঠেই ছিল তাঁর দাপট। সেই ষাট দশকের শুরু থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর দুরন্ত গতির ক্রীড়াশৈলী দর্শকদের বিমোহিত করে রাখে। দেখতে হালকা-পাতলা হলেও সুঠামদেহী এই উইঙ্গার লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে কাট ইন করে চিপ বা লব করতেন। গোল করার চেয়ে বল যোগান দেয়ার ক্ষেত্রে দারুণ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর নিখুঁত বল রিসিভিং, চমৎকার বল কন্ট্রোল আর মাপা লব তাকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিত। পশ্চিম পাকিস্তানের রক্ষণভাগের বিশালদেহী খেলোয়াড়দের তিনি যেভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াতেন, তা ছিল রোমাঞ্চকর। ষাট দশকের শেষ দিকে মোহামেডানের হয়ে তাঁর সঙ্গে গোলাম সারোয়ার টিপুর যে জুটি গড়ে ওঠে, তা ছিল প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমত আতঙ্কজনক।
প্রতাপ শংকর হাজরার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায়। সেই ছোটবেলা থেকেই পুরান ঢাকার ক্রীড়া পরিবেশে বেড়ে ওঠেছেন। যে খেলায় হাত দিয়েছেন, সেটাই তাঁর হাতে সোনা হয়ে ফলেছে। আরমানিটোলা স্কুলের ছাত্র হিসেবে স্বাভাবিক নিয়মেই হকির সম্মোহন থেকে দূরে থাকতে পারেননি। অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদ বশীর আহমেদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় হকির পাশাপাশি ফুটবলেও আকৃষ্ট হন। অল্প সময়ের মধ্যে ফুটবলে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হন। ১৯৬১ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে সে সময়কার শক্তিশালী দল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব দিয়ে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হয়। পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়কে নিয়ে গড়া ভিক্টোরিয়ায় ঠাঁই করে নেয়াটা একজন বাঙালি ফুটবলারের পক্ষে সহজ ব্যাপার ছিল না। ১৯৬২ সালে লীগ এবং আগাখান গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন ভিক্টোরিয়া দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। সেই থেকে মোহামেডান হয়ে ওঠে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। ১৯৭৭ সালে অবসর নেয়া পর্যন্ত মোহামেডানের হয়ে চুটিয়ে খেলেন। মোহামেডানের অনেক সাফল্যের নায়ক তিনি। ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য হওয়া ছাড়াও তিনি ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে আগাখান গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় ছিলেন। এ সময় মোহামেডান লীগে চারবার রানার্সআপ (১৯৬৪, ১৯৬৭, ১৯৬৮ ও ১৯৭৩) এবং আগাখান গোল্ডকাপে দু’বার (১৯৬৬ ও ১৯৬৯) রানার্সআপ হয়। ষাট দশকে মোহামেডানের সেই সোনালী দিনগুলোর একজন রূপকার ছিলেন তিনি।
পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে অল্প যে ক’জন বাঙালি খেলোয়াড় খেলার কৃতিত্ব দেখান, ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার প্রতাপ শংকর হাজরা তাঁদের একজন। ১৯৬৩ সালে তিনি নির্বাচনী শিবিরে আমন্ত্রণ পান। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা অয়েলম্যান বাকু দলের সঙ্গে খেলায় তিনি খেলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি জাতীয় দলের হয়ে শ্রীলংকার সঙ্গে এবং আরসিডি টুর্নামেন্টে খেলেন। পাকিস্তান যুব দলের হয়ে রাশিয়া সফর করেন। ১৯৬৭ সালে সফররত সৌদি আরব জাতীয় দলের সঙ্গে করাচিতে তিনি চমকপ্রদ নৈপুণ্য উপহার দেন। প্রতাপ শংকরের জীবনের একটি গৌরবময় ঘটনা হলোÑ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে গঠিত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে তিনি আসামের গৌহাটিতে সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই শিল্ড ফুটবল প্রতিযোগিতায় ঢাকা একাদশ এবং ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ১৯তম মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী প্রথম জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন।
তুখোড় ফুটবলার প্রতাপ শংকরের খ্যাতি ও সাফল্য হকিতেও নেহাত মন্দ নয়। খুব অল্প বয়সেই হকি খেলোয়াড় হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে খেলা শুরু করার পর দীর্ঘ ২১ বছর হকি অঙ্গনে উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন। ওয়ারীর লেফট ইন রাইট আউট হিসেবে খেলা শুরু করেন। তিন বছর ওয়ারীতে খেলার পর ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ভিক্টোরিয়ায়। ১৯৬৩ সালে সতীর্থ খেলোয়াড় আব্দুস সাদেক, মোঃ মোহসীন ও সাব্বির ইউসুফের সঙ্গে গড়ে তোলেন কম্বাইন্ড স্পোর্টিং নামে নতুন এক হকি ক্লাব। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এই ক্লাবটি ঢাকার হকি অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলেছেন। ৩ বার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ঢাকায় আতিকুল্লাহ টুর্নামেন্টে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র দল হিসেবে ফাইনালে ওঠেন। খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে এই ক্লাবটির পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। স্বাধীনতার পর ফুটবলের পাশাপাশি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মোহামেডানের হয়ে খেলেছেন। অবশ্য এর মাঝে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিন বছর খেলেছেন আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। ১৯৮০ সালে পাতিয়ালায় হকির কোচিং নিতে যাওয়ায় লীগ খেলতে পারেননি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় হকি প্রতিযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান দলের প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনী শিবিরে ডাক পেলেও পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলা হয়নি। সে সময় পাকিস্তান সফরকারী বিভিন্ন বিদেশী দলের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে প্রদর্শনী হকি খেলেন। মালয়েশিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ১৯৭০ সালে এশিয়ান গেমস জয়ী পাকিস্তান জাতীয় দল ঢাকা স্টেডিয়ামে পূর্ব পাকিস্তান দলের সঙ্গে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। অতিকষ্টে তারা ১-০ গোলে জয়ী হয়। পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে যারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, প্রতাপ তাদের একজন। ১৯৭৮ সালে সফরকারী শ্রীলংকা দল শুভেচ্ছা সফরে এলে তিনি বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। ফুটবল ও হকি ছাড়াও প্রতাপ শংকর হাজরা ক্রিকেট, টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলেছেন। ১৯৬১ সালে তিনি প্রাদেশিক টেবিল টেনিসে জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে ব্যাডমিন্টনে তিনি আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বকশীবাজার ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলার পর খেলা ছেড়ে দেন। তিনি ৫ কিংবা ৬ নম্বরে ব্যাটিং করতেন। স্বাধীনতার পর অবাঙালিদের অনুপস্থিতিতে ক্রিকেট অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হলে তিনি আবার ক্রিকেটে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত খেলেন শান্তিনগর ক্লাবে। এরপর আবার ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে লীগের মাঝপথে ক্রিকেটার সংকট সৃষ্টি হলে তিনি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন। সেবার মোহামেডান লীগ, শহীদ দিবস ও স্বাধীনতা দিবস ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন এবং দামাল সামার স্মৃতি ক্রিকেটে রানার্সআপ হয়।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষে হকি ও ফুটবলের রেফারি, কোচ ও কর্মকর্তা হিসেবে জড়িয়ে আছেন। ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে তিনি ইস্টএন্ড ক্লাবের ফুটবল কোচ, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মোহামেডানের হকি কোচ ও অন্যান্য দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় মোহামেডান অনেক সাফল্য পেয়েছে। ১৯৮৪ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জুনিয়র বিশ্বকাপ হকির এশিয়া ও ওশেনিয়া জোনের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমস, ১৯৯৬ সালে সিঙ্গাপুরে জুনিয়র ওয়ার্ল্ড কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে এবং ১৯৯৭ সালে ইতালিতে ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বাংলাদেশ হকি দলের কোচ ছিলেন। তিনি পাতিয়ালায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হকি প্রশিক্ষক। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের কোচ অব দ্য ইয়ার হয়েছেন। ২০০১ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন।
তাঁর সময়ের প্রায় সকল খেলায় পারদর্শী প্রতাপ শংকর হাজরা ফুটবলার হিসেবেই যেমন বেশি সাফল্য দেখিয়েছেন, তেমনি ফুটবলার হিসেবেই পেয়েছেন সুখ্যাতি।


আক্রমণাত্মক স্ট্রাইকার মেজর (অবঃ) হাফিজ

জাতীয় পর্যায়ে টপ ফর্মে থাকা কোনো খেলোয়াড় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এমন ঘটনা খুবই বিরল। এই বিরলতমদের একজন হাফিজউদ্দিন আহমেদ। যিনি মেজর (অবঃ) হাফিজ হিসেবে সুপরিচিতি। তিনি শুধু যুদ্ধই করেননি, যুদ্ধের ময়দানে দেখিয়েছেন অপরিসীম সাহস ও বীরত্ব। আর এ কারণে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে। সাহসী এই বীর খেলার মাঠেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন দেখিয়েছেন। একজন সফল ক্রীড়াবিদ হিসেবে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। বিশেষ করে ফুটবলার হিসেবে তিনি স্বতন্ত্র একটি অবস্থান করে নিতে সক্ষম হন। একজন আক্রমণাতœক স্ট্রাইকার হিসেবে তিনি ছিলেন প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমত ত্রাস। বলের ওপর ছিল তাঁর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ। বল নিয়ে ড্রিবলিং করে গোল করা কিংবা গোল করানোর প্রতি ছিল তাঁর ঝোঁক। যেসব গুণাবলী থাকলে একজন পরিপূর্ণ ফরোয়ার্ড হওয়া যায়, তার কোনো কিছুরই কমতি ছিল না।
মেজর (অবঃ) হাফিজউদ্দিন আহমেদের জন্ম বরিশালে, ১৯৪৪ সালের ২৯ অক্টোবর। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় সম্পৃক্ত হন। তবে তাঁকে প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে খেলাধুলা করতে হয়। কেননা তাঁর খেলাধুলার প্রতি অভিভাবকদের মোটেও সায় ছিল না। দুর্দান্ত ভালোবাসার কারণে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় লেগে থাকেন। তাঁর এক কাজিন ছিলেন দেলোয়ার। ফুটবলার হিসেবে তিনি বরিশালে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। এ কারণে ফুটবল হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া খ্যাতিমান ফুটবলার গজনবী এবং কবিরও তাঁর প্রেরণার অন্যতম উৎস। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন এই ফুটবলারের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৬২ সালে ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের হয়ে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত একই দলে খেলেন। ১৯৬৬ সালে যোগ দেন ওয়ান্ডারার্সে। ওয়ান্ডারার্সে দু’বছর খেলার পর ১৯৬৮ সাল থেকে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে খেলে ১৭ বছরের ক্যারিয়ারের অবসান ঘটান। ১৯৬৯, ১৯৭৫, ১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি ছিলেন অধিনায়ক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব তাঁর। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে তিনি এই কৃতিত্ব দেখান। ১৯৭৬ সালে লীগে টপ স্কোরারদের তিনি একজন। ১৯৬৮ সালে আগাখান গোল্ড কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান।
পাকিস্তান আমলে বাঙালিরা সব দিক দিয়েই ছিল শোষিত ও বঞ্চিত। ক্রীড়াঙ্গনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে বাঙালিদের সুযোগ পাওয়াটা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। যারা অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে পারতেন, তাঁদের বাদ দেয়া সম্ভব হতো না। অল্প যে ক’জন বাঙালি পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে সুযোগ করে নেন, মেজর (অবঃ) হাফিজ তাঁদের একজন। ১৯৬৬ সালে সফরকারী সৌদি আরব জাতীয় দলের সঙ্গে খেলায় তিনি জাতীয় দলে নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে বার্মায় এশিয়া কাপে, ১৯৬৮ সালে ঢাকায় এলসিডি দলের সঙ্গে, সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের অলগা দলের সঙ্গে, ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে, তেহরানে ফ্রেন্ডশিপ কাপে, তুরস্কের আংকারায় আরসিডি টুর্নামেন্টে এবং ১৯৭০ সালে তেহরানে আরসিডি টুর্নামেন্টে তিনি খেলেন। একবার তিনি জাতীয় দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালের ৪ ও ১১ নভেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে কলকাতা ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলায় বাংলাদেশ নির্বাচিত একাদশের অধিনায়ক ছিলেন। মেজর (অবঃ) হাফিজ ফুটবলের পাশাপাশি অ্যাথলেট হিসেবেও খ্যাতি কুড়িয়েছেন। ১৯৬৪, ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট। ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ¡ী। ২০০ মিটারে তাঁর গড়া রেকর্ড ১৯৭৬ সালে ভঙ্গ করেন অ্যাথলেট শাহ আলম।
ফুটবল খেলা থেকে অবসর নেয়ার পর মেজর (অবঃ) হাফিজ মোহামেডানের কোচ ও কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন। চার বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮৬ সালে হন ফেডারেশনের সভাপতি। সাংগঠনিক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে এএফসি কার্যনির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে শতাব্দীর সেরা ফুটবল ব্যক্তিত্ব মনোনীত হন। ঢাকায় তাঁর হাতে ফিফা মেরিট অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন এএফসি সভাপতি মোহাম্মদ বিন হাম্মাম। রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি সাফল্য দেখান। একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ২০০১ সালে পাট এবং পরবর্তী সময়ে পানিসম্পদ মন্ত্রী হন।
সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়েও ফুটবলে নিবেদিতপ্রাণ মেজর (অবঃ) হাফিজ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে ফুটবলের টান কখনোই এড়াতে পারেননি। কারণ ফুটবলই তাঁর জীবনের স্মরলিপি।



ফুটবলের ধ্যানী টিপু

ফুটবলই টিপুর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। অষ্টপ্রহর তিনি ফুটবলেই মগ্ন থাকতে ভালোবাসেন। ফুটবলকে গভীরভাবে অনুধাবন করা, চমৎকারভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা এবং নিজের উপলব্ধিকে অন্যের মাঝে সুন্দরভাবে ছড়িয়ে দেয়ার মতো মেধা, জ্ঞান ও পা-িত্য তাঁর মাঝে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। ফুটবল সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সাবলীল ধারণা তিনি পেয়েছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। নিজে শুধু বড় মাপের ফুটবলারই ছিলেন না, ফুটবলে তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, জানা-শোনার পরিধি ও জানার গভীরতার কারণে তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। খেলোয়াড় হিসেবে টিপু তাঁর সময়ে তাঁর পজিশনে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখেন। লেফট উইঙ্গার হিসেবে চমৎকার খেলেছেন। পায়ে বল পড়লেই টাচ লাইন ধরে তরতরিয়ে এগিয়ে যেতেন। নিখুঁত সেন্টারে গোলপোস্টের সামনে বল পাঠাতেন। আর এ থেকে ফরোয়ার্ডদের গোল পেতে খুব একটা কষ্ট হতো না। কখনো কখনো তিনি তীব্র গতিতে কাট ইন করে প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়তেন। দু’তিন ডিফেন্ডারকে বডি ডজে কুপোকাত করে ডান পায়ের প্রচ- শটে গোল করতেন। প্রখর ফুটবল সেন্স, অফুরন্ত স্ট্যামিনা ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার টিপু তাঁর টপ ফর্মে প্রতিপক্ষের কাছে ছিলেন রীতিমত আতঙ্ক।
এস এম গোলাম সারওয়ার মোস্তফা টিপু ১৯৪৫ সালের ২২ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই ফুটবলের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তবে ফুটবলার হিসেবে তাঁর গড়ে ওঠার পেছনে এককালের কৃতী ফুটবলার চুন্না রশিদ এবং সোনা মিঞার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ১৯৬৩ সালে জুনিয়র লীগে তিনি তেজগাঁও ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন। খেলতেন রাইট ফুল ব্যাক হিসেবে। কিন্তু সোনা মিঞা তাঁকে লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলতে উদ্বুদ্ধ করেন। লেফট উইঙ্গার হিসেবে তাঁর চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলীর কারণে তিনি বড় দলের আমন্ত্রণ পান। পরের বছরই যোগ দেন ইপিজি প্রেসে। এরপর এক বছর করে খেলেন ওয়ারী, রহমতগঞ্জ ও ভিক্টোরিয়ায়। ১৯৬৮ সালে যোগ দেন প্রিয় দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। মোহামেডানে যোগ দেয়ার পর টিপু নিজেকে পুরোপুরিভাবে মেলে ধরেন। ১৯৭০ পর্যন্ত খেলোয়াড়ি জীবনের সেরা তিনটি বছর কাটিয়েছেন তিনি। স্ট্রাইকার আলী নেওয়াজের সঙ্গে তাঁর যে জুটি গড়ে ওঠে, তাতে লাভবান হয় মোহামেডান। ১৯৬৯ সালে মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি যোগ দেন নতুন দল আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। ১৯৭৩ সালে আবাহনীর অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর হয়ে খেলে ১৯৭৫ সালে ফিরে যান মোহামেডানে। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খেলে ফুটবল থেকে অবসর নিতে বাধ্য হন। আরো কিছুদিন খেলার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি নিরুপায় হয়ে সরে দাঁড়ান। অবশ্য বছরখানেকেরও বেশি তিনি দলে নিয়মিত ছিলেন না। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর সফরকারী কোলকাতা মোহামেডানের সঙ্গে খেলায় টিপুর চমৎকার থ্রো থেকে আসলামের গোলে এগিয়ে যায় ঢাকা মোহামেডান। এমন একটি মুহূর্তকে তিনি অবসরের জন্য বেছে নেন। তবে ডান হাঁটুতে আঘাত পাওয়ায় টিপুর খেলায় আগের সেই ধার ছিল না।
পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে অল্প যে ক’জন বাঙালি ফুটবলার খেলেছেনÑ টিপু তাদের একজন। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে তিনি জাতীয় দলের হয়ে ইরান দু’বার, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন, নেপাল ও ভারত সফর করেন। তুরস্কের আরসিডি এবং তেহরানে অনুষ্ঠিত ফ্রেন্ডশিপ ফুটবল টুর্নামেন্টে তিনি অংশ নেন। ১৯৬৫ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত তিনি ইপিএসএফ-এর প্রাদেশিক দলের হয়ে খেলেছেন। এছাড়াও খেলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা জেলার হয়ে। ১৯৭৬ সালে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি কুমিল্লা জেলার অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম ফুটবল ম্যাচে মুজিবনগর একাদশের সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতি একাদশের সহ-অধিনায়ক ছিলেন। আবদুল গফুর ও টিপুর গোলে রাষ্ট্রপতি একাদশ ২-০ গোলে জয়ী হয়। ১৯৭২ সালে আসামের গৌহাটিতে সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই ট্রফি টুর্নামেন্টে তিনি ঢাকা একাদশের হয়ে খেলেন। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ১-৫ গোলে হারলেও একমাত্র গোলটি করেন তিনি।
১৯৬৮ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনাল তাঁর জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে। শ্রীলংকার সঙ্গে খেলায় মোহামেডান যে পাঁচটি গোল দেয়, তার প্রথম দুটি আসে তাঁর পা থেকে। তৃতীয়বারের মতো আগা খান গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান।
একজন ভালো ফুটবলারের যাবতীয় গুণাবলী টিপুর মাঝে ছিল। ফুটবলের সাধনায়ই আজীবন কাটানোর প্রত্যয় এই ধ্যানী ফুটবলারের। কিন্তু খেলার সময় তিনি মাঝে-মধ্যে মেজাজ হারিয়ে ফেলতেন। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত অমায়িক। খেলার মাঠে এবং মাঠের বাইরে তিনি একদম বিপরীত চরিত্রের লোক। ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলেও ফুটবলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়নি। কোচ হিসেবে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮০ সালে কোচ হিসেবে মোহামেডানে অভিষেক হয়। একই বছর ক্লাবের উদ্যোগে ইংল্যান্ড থেকে এফএ ট্রেনিং নিয়ে আসলে আধুনিক ফুটবলের কলা-কৌশলই ভালই রপ্ত হয়ে যায়। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মোহামেডানের কোচ ছিলেন। ১৯৮৭ সালে পুনরায় ইংল্যান্ড থেকে অ্যাডভান্সড কোচিং-এর দীক্ষা নিয়ে আসেন। ১৯৮৯ সালে অগ্রণী ব্যাংকের কোচ ছিলেন। এরপর থেকে মোহামেডানের ঘরের মানুষ হিসেবে বিভিন্ন সময় দলের প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ১৯৮২ সাল থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দলের কোচের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রথম দায়িত্ব পালন করেন ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলের। ১৯৮২ সালে দিল্লীর নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশওয়ারে কায়দে আজম ফুটবল, ১৯৮৬ সালে সিউলে দশম এশিয়ান গেমস, ১৯৯৭ সালে কুয়ালালামপুর ও সৌদি আরবের জেদ্দায় বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, ২০০৩ সালে ঢাকা ও তাজিকিস্তানে বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ফুটবল দলের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন। এছাড়া ১৯৮৪ সালে ঢাকায় ২৪তম এশিয়ান যুব ফুটবলের বাছাই পর্ব এবং ১৯৯৮ সালে ভিয়েতনামে অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল রাউন্ডের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে জার্মানি থেকে এলএ লাইসেন্স অর্জন করেন।
খেলার মাঠে মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলে আলাদা অবস্থান গড়ে নেন টিপু। তাঁর খেলায় থাকতো পরিকল্পনার ছাপ। মেধাবী এই ফুটবলারের অনুধাবন, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাও হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।
সব্যসাচী ফুটবলার অমলেশ

নীরবে-নিভৃতে যে ফুটবলারটি খেলার মাঠে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি হলেন অমলেশ সেন। দূর শৈশবে সেই যে ফুটবলের প্রেমে জড়িয়েছিলেন, তার বন্ধন আজো কাটাতে পারেননি। ফুটবলই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক সর্বোচ্চ পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন। এমনটি সচরাচর দেখা যায় না। অপরিসীম ত্যাগ, নিষ্ঠা ও সাধনা না থাকলে কোনো ফুটবলারের ক্যারিয়ার এতোটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন সব্যসাচী ফুটবলার। গোল কিপিং ছাড়াও দলের প্রয়োজনে সব পজিশনেই খেলেছেন। আক্রমণভাগ, মধ্যমাঠ ও রক্ষণভাগÑ যখন যে পজিশনে খেলেছেন দাপটের সঙ্গেই খেলেছেন। তবে লিঙ্কম্যান হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। বডি ফিটনেসের পাশাপাশি তাঁর স্ট্যামিনা ছিল অফুরন্ত। বল কন্ট্রোল, ডিস্ট্রিবিউশন ও স্ক্রিনিং সেন্স ছিল অসাধারণ। বুদ্ধি খাটিয়ে আক্রমণ গড়ে তুলতেন। যে কোনো স্থান থেকে গোলে আচমকা প্রচ- শট নিয়ে প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দিতেন। দূরপাল্লার শটে অসংখ্য গোল করেছেন। অমলেশ সেনের প্রধান গুণ ছিলÑ তিনি কখনো মাথা গরম করেননি। আচার-আচরণে তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র।
অমলেশ সেনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২ মার্চ বগুড়ায়। খুব অল্প বয়সেই মেতে ওঠেন ফুটবলে। বগুড়ার আলতাফুন্নেসা মাঠে ফুটবল খেলায় হাতেখড়ি। ফুটবল নিয়ে তাঁর আগ্রহ, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলীর কারণে সহজেই বড় আসরে খেলার সুযোগ করে নেন। ১৯৫৭ সালে বগুড়ার বাইটন ক্লাবের হয়ে শুরু হয় তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার। পাঁচ বছর বগুড়াকে মাতিয়ে দিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ফায়ার সার্ভিস এবং ইস্টএন্ডের হয়ে খেলেন। ১৯৭০ সালে খেলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। অমলেশ সেনের জীবনের একটি গৌরবময় ঘটনা হলো ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে খেলা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল খেলেছেন। ১৯৭২ সালে তিনি যোগ দেন নতুন দল আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। এরপর আবাহনী হয়ে ওঠে তাঁর ঘর-সংসার ও ভালোবাসার নীড়। অ-তে অমলেশ আর আ-তে আবাহনী যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ফুটবল খেললেও একই সঙ্গে তিনি ছিলেন আবাহনীর খেলোয়াড়, কোচ ও সংগঠক। এ ক্ষেত্রেও তিনি নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আবাহনীর দুঃসময়ে তিনি যেন নিজেকে আরো বেশি উজাড় করে দেন। আবাহনীর হয়ে ১৩ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে পাঁচবার (১৯৭৪, ১৯৭৭, ১৯৮১, ১৯৮৩ ও ১৯৮৪) লীগ এবং একবার (১৯৮২) ফেডারেশন কাপ ফুটবলের শিরোপা লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। সেবার আবাহনী লীগে রানার্সআপ হয়। আবাহনী-মোহামেডান খেলায় প্রথম গোলটি এসেছে তাঁর পা থেকে। ১৯৭৩ সালে অমলেশ ও সালাউদ্দিনের দেয়া গোলে প্রথম মোকাবিলায় আবাহনী ২-০ গোলে হারায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে। ৫ ফুট সাড়ে ৬ ইঞ্চি উচ্চতার অমলেশ ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আক্রমণভাগে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মধ্যমাঠে এবং ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সাল অব্দি ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত রক্ষণভাগে খেলেছেন।
১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ২১তম মারদেকা ফুটবলে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসেও তিনি দলভুক্ত হন। কিন্তু অধিনায়ক মনোনয়ন নিয়ে বিতর্কের প্রতিবাদে আবাহনীর যে সাতজন ফুটবলার নাম প্রত্যাহার করে নেনÑ তিনি তাদের একজন। ফুটবল খেলার পাশাপাশি প্রশিক্ষক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি আবাহনীর আরেক সিনিয়র খেলোয়াড় আব্দুস সাদেকের সহযোগী ছিলেন। ১৯৮৬ সালে সালাউদ্দিন মাঝপথে সরে দাঁড়ালে কোচ হিসেবে হাল ধরেন অমলেশ ও আশরাফ। তিনি বিভিন্ন সময় আবাহনীর কোনো না কোনো দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। যখনই আবাহনী কোনো সমস্যায় পড়ে, তখনই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে আবাহনীর ওপর যে বিপর্যয় নেমে আসে, সে সময় তিনি আবাহনীকে বুক দিয়ে আগলিয়েছেন। দীর্ঘদিন ক্লাবে আর কাউকে দেখা না গেলেও তিনি আবাহনীর প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। ফুটিয়েছেন ফুল। খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে ছোট-বড় সবার কাছে তিনি পরম প্রিয় দাদা। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের কোচ ছিলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে পুনরায় আবাহনীর কোচের দায়িত্ব পালন করছেন।
ফুটবল ছাড়াও অমলেশ সেন ক্রিকেটও খেলেছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বগুড়া একাদশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ফুুটবল জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে পান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্কের যে রাখীবন্ধন গড়ে তোলেন অমলেশ সেন, তা সযতনে সাধকের নিষ্ঠায় লালন করে এসেছেন।



কুশলী ডিফেন্ডার আশরাফ

রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা একটু মেজাজী ও আক্রমণাÍক হয়ে থাকেন। রক্ষণভাগকে ফাঁকি দিয়ে গোল করার জন্য হন্য হয়ে ওঠা ফরোয়ার্ডদের রুখে দেয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেন রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরীরা। রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের সঙ্গে বল দখলের লড়াইয়ে অনেক সময় প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকাররা আহত হয়ে থাকেন। রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের রাফ চার্জ এর অন্যতম কারণ। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন আশরাফ। ফুটবলের এই দক্ষ ডিফেন্ডার ঠা-া মাথায় খেলতেন। মোটেও আক্রমণাত্মক ছিলেন না। বল ক্লিয়ার করতেন নানা কৌশল প্রয়োগ করে। তাঁর কাছ থেকে বল বের করা ছিল কঠিন। ওপরে উঠে গিয়ে আক্রমণ গড়ে তোলার জন্য বল যোগান দিয়ে ত্বরিত গতিতে নিচে নেমে আসতেন। পায়ের কাজ ও মাথার হেডওয়ার্ক ছিল চমৎকার। হেডের সাহায্যে গোল যেমন রক্ষা করেছেন, তেমনি মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের আক্রমণে সহায়তা করেছেন। অনেক সময় কর্নার কিক থেকে গোল করেছেন হেডের সাহায্যে।
১৯৪৬ সালের মাঝামাঝি কোলকাতায় শেখ আশরাফ আলীর জন্ম। সেখানকার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালে তিনি ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্সে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেন। পিতার বন্ধু মোহনবাগান ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় বিডি চ্যাটার্জী তাঁকে মোহনবাগানের ছোটদের দলে নিয়মিত অনুশীলন করার সুযোগ করে দেন। এই অনুশীলন তাঁকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। একপর্যায়ে তিনি জুনিয়র গ্রুপে কখনো রাইট ইন, কখনো রাইট-আউট পজিশনে খেলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি কোলকাতার পাওয়ার লীগে মোহনবাগানের হয়ে খেলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি খেলেন নিখিল ভারত স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় পশ্চিমবাংলা দলের হয়ে। আসামের শিলংয়ে অনুষ্ঠিত খেলায় তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ওই বছর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ফায়ার সার্ভিসের হয়ে লেফট-ইন পজিশনে খেলেন। এ সময় কোচ বজলুর রহমান তাঁকে গড়ে তোলেন। তিন বছর তিনি ফায়ার সার্ভিসের হয়ে চুটিয়ে খেলেন। ১৯৬৮ সালে মোহামেডান পাকিস্তানের পেশোয়ারে খেলতে যাবার সময় তাঁকে নিয়ে যায়। তাঁর খেলার নৈপুণ্যে আকৃষ্ট হয়ে মোহামেডান সেবার তাঁকে দলভুক্ত করে। তিনি মোহামেডানের হয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড ও ইনসাইড পজিশনে খেলেন। ১৯৭০ সালে যোগ দেন ইস্টএন্ডে। ১৯৭১ সালে তিনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে খেলার গৌরব অর্জন করেন।
১৯৭২ সালে শেখ আশরাফ নতুন প্রজন্মের দল আবাহনী ক্রীড়াচক্রে যোগ দেন। এরপর থেকে আবাহনীই হয়ে ওঠে তাঁর ঠিকানা। স্বাধীনতার পর নতুন ধারার ফুটবলে তিনি নিজেকে স্টপার হিসেবে মানিয়ে নেন। সেই থেকে ১৯৮০ সাল অব্দি আবাহনীর হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। ১৯৮১ সালে ওয়াপদার হয়ে খেলে অবসর নেন। আবাহনীর আধুনিক ও শিল্পিত ফুটবলের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিনিধি। ১৯৭৪ ও ১৯৭৭ সালে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ১৯৭৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওই বছরই ঢাকা লীগে কোনো ক্লাব অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। একই বছর আবাহনী লিবারেশন কাপ ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় ফুটবলে ঢাকা জেলার অধিনায়ক ছিলেন।
৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার আশরাফ ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি একাদশের সঙ্গে মুজিবনগর একাদশের হয়ে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচ খেলেন। ১৩ মে ঢাকা স্টেডিয়ামে কোলকাতা মোহনবাগানের সঙ্গে বাংলাদেশ নির্বাচিত একাদশের হয়ে খেলেন। ১৯৭২ সালে আসামের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই ট্রফিতে ঢাকা একাদশের হয়ে খেলেছেন। জাতীয় দলের হয়ে ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ার ১৯তম মারদেকা ফুটবল এবং ১৯৭৫ সালে ২১তম মারদেকা ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ১৯৬৪ সালে কোলকাতার পাওয়ার লীগে মোহনবাগানের হয়ে খেলাটা তাঁর জীবনে স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে। সে দলে ছিলেন সে সময়কার খ্যাতিমান ফুটবলার জার্নেল সিং, চুনি গোস্বামী, এ.টি. রহমান, কেম্পিয়া, মঙ্গরাজ প্রমুখ। ১৯৭২ সালে সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই টুর্নামেন্টে কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং ১৯৭৩ সালে সফরকারী রাশিয়ার ডায়নামো মিনস্কি দলের সঙ্গে তিনি সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে আশরাফ প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রশিক্ষণে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে দুর্দান্ত খেলে বিআরটিসি। ১৯৮৭ সালে ভিক্টোরিয়ার কোচ হন। ১৯৯১ সালে আবাহনীর সহযোগী এবং ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের কোচ ছিলেন। ১৯৯৪ সালে সৌদি আরব সফরকারী অনূর্ধ্ব-১৯ দলেরও কোচ ছিলেন তিনি।
১৯৯৯ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত হন। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হয়েও ঠা-ামাথার একজন নিবেদিতপ্রাণ ফুটবলার হিসেবেই আশরাফ অনুসরণীয় হয়ে আছেন।



একজন প্রকৃত গোলরক্ষক সান্টু

তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা ছিল যে কোন বাঙালি ক্রীড়াবিদের কাছে একটি স্বপ্ন। শুধু মেধা ও ক্রীড়া কুশলতা দেখালেই চলতো না, অসামান্য পারফরমেন্স প্রদর্শন না করতে পারলে পাত্তাই পাওয়া যেতো না। এ কারণে মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের ২৩ বছরে খুব কম বাঙালি ফুটবলারই পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলতে পেরেছেন। অসাধারণ ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখিয়ে হাতেগোনা যে ক’জন ফুটবলার পাকিস্তান দলে খেলতে পেরেছেন, তাদের একজন গোলরক্ষক শহীদুর রহমান চৌধুরী। যিনি সান্টু নামে ক্রীড়াঙ্গনে সমধিক পরিচিত।
দীর্ঘদেহী এই ফুটবলার ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা গোলরক্ষক। একজন সফল গোলরক্ষকের যাবতীয় গুণাবলী তাঁর মাঝে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। গ্রিপিং, পাঞ্চ, ডাইভ, পজিশন জ্ঞান, গেম রিডিং ছিল চমৎকার। সে সঙ্গে তাঁর উচ্চতা, ঋজু দেহ ও জিমন্যাস্টদের মতো ফিগার, শক্ত স্নায়ু ও সুদৃঢ় মনোবলের কারণে তিনি প্রতিপক্ষের ফুটবলারদের সামনে দাঁড়িয়ে যেতেন অটল পাহাড়ের মতো। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ানো ছিল যে কোনো স্ট্রাইকারের জন্য একটি কঠিন কাজ। তিনি ছিলেন প্রকৃতিজাত ফুটবলার। বুলেটের মতো ধেয়ে আসা বলগুলোকে যেভাবে তিনি অনায়াসে কোলে তুলে নিতেন, তা ছিল দেখার মত। ধনুকের মতো সর্পিল দেহটাকে নিয়ে তিনি হিংস্র চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বলের ওপর। কখনো ডানে, কখনো বাঁয়ে। স্ট্রাইকাররা যেমন তাঁকে ডজ দিতে যেয়ে হিমশিম খেয়ে যেতেন, তেমনি কোনো গোলরক্ষকই তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ¡ী গড়ে উঠতে পারেনি।
১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর রংপুরে জন্ম নেয়া সান্টুর খেলাধুলার সঙ্গে সম্পর্ক সেই শৈশবেই। বড় ভাই ক্রিকেটার আজিজুর রহমান চৌধুরী মিন্টুর অনুপ্রেরণায় খেলাধুলায় আকৃষ্ট হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ মিন্টু পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। ১৯৬০ সাল থেকে রংপুর জেলা স্কুলের পক্ষে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সান্টু সাফল্য দেখিয়েছেন। তবে তাঁর প্রথম প্রেম ছিল ক্রিকেটের সঙ্গে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের এই ন্যাটা বোলার ও ব্যাটসম্যান অলরাউন্ডার হিসেবে মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় রাজশাহীর সানরাইজ ক্লাবের হয়ে ঢাকায় কারদার সামার ক্রিকেট খেলতে এসেছিলেন। প্রথম ম্যাচে ন্যাশনাল স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে খেলায় ১৪ রানে ৭ উইকেট নিয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ঢাকা ইগলেটসের হয়ে আমন্ত্রণ পেয়েও খেলেননি।
১৯৬৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় চলে আসেন। ওই বছরই প্রথম বিভাগে ফুটবল লীগে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে শুরু হয় তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার। আউটার স্টেডিয়ামে একদিন আজাদ স্পোর্টিং-এর খেলা দেখছিলেন। আজাদে গোলকিপার ছিল না। কোচ রঞ্জিত দাস তাকে আজাদে খেলান এবং গড়ে তোলেন নিজের আদলে। অবশ্য প্রথম বিভাগে খেলার আগেই রংপুরের হয়ে আন্তঃজেলা এবং রাজশাহীর হয়ে বিভাগীয় দলে খেলেছেন। বিভাগীয় ফুটবলে ঘটনাক্রমে ঢাকার সঙ্গে ফাইনাল খেলার সুযোগ পেয়ে সেরা খেলোয়াড় হন।
এরপর ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে ওয়ান্ডারার্স, ১৯৬৯ সালে মোহামেডান, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত ওয়ান্ডারার্স, ১৯৭৪ সালে আজাদ স্পোর্টিং, ১৯৭৫ সালে ইস্টএন্ড, ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত মোহামেডান এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও ১৯৮৩ সালে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলে ফুটবল জীবনের অবসান ঘটান। প্রিয় দল মোহামেডানে শেষ পর্যন্ত থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্লাব কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে তিনি ব্রাদার্সে যোগ দিতে বাধ্য হন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে সান্টুর অভিষেক হয় ১৯৬৭ সালে। তদানীন্তন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে আফগানিস্তানে জহির শাহ করোনেশন কাপে খেলতে যান। এরপর ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। জাতীয় দলে প্রথম খেলেন ১৯৬৮ সালে। পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে তুরস্কের আরসিডি টুর্নামেন্টে খেলেন। আরসিডি ও ফ্রেন্ডশিপ কাপ ফুটবল খেলতে দু’বার ইরান সফর করেন। রাশিয়ায় খেলেছেন প্রদর্শনী ফুটবল। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে নেপালে খেলেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি হন দেশের পয়লা নম্বর গোলরক্ষক। ১৯৭২ সালে ঢাকা সফরকারী কোলকাতা মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে বাংলাদেশ নির্বাচিত একাদশের হয়ে প্রদর্শনী ম্যাচে, ভারতের আসামের গৌহাটিতে ঢাকা একাদশের হয়ে, সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই শিল্ডে, ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় ১৯তম মারদেকা ফুটবলে, ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ায় ২১তম মারদেকা ফুটবলে, ১৯৭৬ সালে ব্যাংককে কিংস কাপে, ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এশিয়ান গেমসে, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় সপ্তম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, সিউলে প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে, ১৯৮০ সালে কুয়েতে সপ্তম এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে নৈপুণ্যভাস্বর ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। এর মধ্যে ব্যাংকক কিংস কাপ এবং ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের নেতৃত্ব দেন। সতর্ক বাজপাখির মতো চোখ, টাইমিং সেন্স, পজিশন সেন্স ও অ্যান্টিসিপেশনের জন্য জাতীয় দল ও ক্লাব ফুটবলে কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সান্টু একটানা খেলেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আছে ৬৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও ৫২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ। এ সময় অনেক নিশ্চিত গোল খাওয়া থেকে দলকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ১৯৬৮ সালে তুরস্কের আংকারায় আরসিডি টুর্নামেন্টে স্বাগতিক দলের সঙ্গে একটি পেনাল্টি কিক রক্ষা করেন। এছাড়া তুরস্কের ফরোয়ার্ডের মাঝ মাঠ থেকে বাঁকানো তীব্র শট ডান দিকে শূন্যে লাফিয়ে ব্যাক ডাইভ দিয়ে যেভাবে ঠেকিয়ে দেন, তা ছিল বিস্ময়কর। বুদ্ধি ও চাতুর্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দলকে একাধিকবার রক্ষা করেছেন। এশিয়ান গেমস ফুটবলে মালয়েশিয়ার স্ট্রাইকার সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়েন। সামনে সান্টু একা। মুহূর্তের মধ্যেই ভেবে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে গোলের অ্যাঙ্গেলটা খাটো করেন। আগুয়ান স্ট্রাইকারকে বাধ্য করেন বাঁ দিকে আস্তে করে বল ঠেলে দিতে। এটাই তিনি চেয়েছিলেন। ডাইভ মেরে রক্ষা করেন গোল। ১৯৭৫ সালে ইস্টএন্ডের হয়ে আবাহনীর সালাউদ্দিনের নিশ্চিত একটি গোলের শট অবিশ্বাস্যভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। ওই ম্যাচে আবাহনী ০-৩ গোলে হেরে যায়।
ফুটবলার হওয়ার আগে ক্রিকেটই ছিল সান্টুর ধ্যান-জ্ঞান। সেই শৈশবেই তিনি ক্রিকেটের প্রেমে পড়েন। ফুটবলে জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শ করলেও ক্রিকেট থেকে তিনি দূরে সরে থাকেননি। মোহামেডানের হয়ে তিনি দীর্ঘদিন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে নিয়মিত খেলেছেন। আশির দশকের শুরু পর্যন্ত তিনি ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে অভিষেক হয়। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে খেলেছেন। ১৯৭৫ সালে শান্তিনগরে, ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে মোহামেডানে, ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে বিমানের হয়ে খেলে দলকে চ্যাম্পিয়ন করে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে মোহামেডানে এবং ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খেলেন। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ট্রায়ালে এবং ১৯৭৯ সালে প্রথম আইসিসি ট্রফির জন্য ক্যাম্পে মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে বাংলাদেশ সফরকারী এমসিসির সঙ্গে ময়মনসিংহে দুই দিনের ম্যাচে সেন্ট্রাল জোনের হয়েও তিনি খেলেন। অলরাউন্ডার হলেও তিনি বাঁ-হাতি মিডিয়াম পেসার হিসেবেই বেশি সাফল্য পেয়েছেন। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে মেট্রোপলিশ প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে শান্তিনগরের সঙ্গে তিনি ১৮ রানে ৬ উইকেট এবং ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে মেট্রোপলিশ প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে আবাহনীর সঙ্গে ৪৮ রানে ৬ উইকেটসহ অসংখ্য ম্যাচে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
খেলা ছেড়ে দেবার পর সান্টু ১৯৮৪ সাল থেকে প্রবাস জীবন বেছে নেন। দর্শনশাস্ত্রে এমএ করা এই কৃতী খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল কোচিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দীর্ঘদিন পর ২০০৪ সালে বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় ফুটবল দল এবং ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত নবম সাফ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি সান্টুকে ১৯৭৮ সালে সেরা ফুটবলার এবং ১৯৭৯ সালে শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত করে। বাংলাদেশের রজতজয়ন্তি উপলক্ষে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে সেরা একাদশ নির্বাচিত করে, তাতে সান্টু ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। সান্টু ফুটবল খেলা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তাঁর মতো আরেকজন গোলরক্ষকের আজো দেখা মেলেনি। বাংলাদেশের ফুটবলে তিনিই গোলরক্ষকের মডেল হয়ে আছেন।



কিংবদন্তি ফুটবলার সালাউদ্দিন

আমাদের কৈশোরে তিনি ছিলেন মহানায়ক। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সে সময় তাঁর সমকক্ষ তো দূরে থাকুক, তাঁর কাছাকাছি কেউ ছিলেন না। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবলার সালাউদ্দিন এক কিংবদন্তি হয়ে আছেন। খেলোয়াড়ি জীবনে কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল আর দু’গাল বেয়ে নেমে আসা চওড়া গোঁফের এই ফুটবলার আমাদেরকে দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে রাখেন। সে বয়সে তাঁর খেলায় যতটা না, তার চেয়ে বেশি তাঁর ক্যারিশমা, জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি আমাদের চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। স্বপ্ন ও কল্পনার নায়ক হয়ে ওঠেন তিনি। বলা যায়, ফুটবলের প্রতি ভালো লাগা ও ভালোবাসা গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর ভূমিকাটাই ছিল মুখ্য। ফুটবল খেলা বলতেই তখন আমাদের চোখে ভেসে উঠতো সুদর্শন, স্মার্ট ও ব্যক্তিত্বময়ী সালাউদ্দিনের প্রতিকৃতি। তিনি ছিলেন ফুটবলের একটি মডেল। তিনি শুধু সর্বসাধারণের প্রিয় ফুটবলারই ছিলেন না; ছিলেন ফুটবলারদেরও প্রিয় ফুটবলার। সামনা-সামনি দেখার আগে রেডিওর ধারাবিবরণী এবং টেলিভিশনে খেলা দেখার সুযোগ পেয়ে তিনি আমাদের মনের মাঝে চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নেন। ১৯৭৭ সালে মেট্রোপলিশ ফুটবল লীগে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে রহমতগঞ্জের সঙ্গে দেয়া তাঁর গোলটি এখনো চোখে ছবির মতো লেগে আছে। সেবার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আবাহনী ও রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি। ফাইনালের প্রথম দিন নির্ধারিত ৮০ ও অতিরিক্ত ১৫ মিনিটের খেলা গোলশূন্য থেকে যায়। ২২ সেপ্টেম্বর ফিরতি ফাইনালে প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কুশলী স্ট্রাইকার হাসানের গোলে এগিয়ে যায় রহমতগঞ্জ। এ গোল খাওয়ার পর যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জেগে ওঠে আবাহনী। গোলরক্ষককে রেখে আবাহনীর ১০ জন ফুটবলার উঠে আসেন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে। দর্শকরা প্রত্যক্ষ করেন নান্দনিক ও আক্রমণাÍক ফুটবলের নতুন শৈলী। এ অবস্থায় নান্নু ফ্লিক করলেন মাঠের মধ্যে। বল মাটিতে পড়ার আগেই প্রায় ৪০ গজ বাইরে থেকে ডান পায়ের গোলার মতো আচমকা সুইং শটে সালাউদ্দিন যেভাবে গোলরক্ষক মোতালেবকে পরাস্ত করে খেলায় সমতা নিয়ে আসেন, তা অনেক ফুটবল অনুরাগীর জীবনে স্মরণীয় একটি স্মৃতি হয়ে আছে। সালাউদ্দিনের অসাধারণ এই গোলে অনুপ্রাণিত হয়ে খুরশেদ আলম বাবুল ও কাজী আনোয়ার আরো দুটি গোল দেয়ায় ৩-১ গোলে জয়ী হয়ে মেট্রোপলিশ ফুটবল লীগে প্রথমবারের মতো অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। সেদিনের চমকপ্রদ এই গোলটির মতো অসংখ্য গোল দিয়ে ক্লাব ও জাতীয় দলের অনেক জয়ের নায়ক হয়ে আছেন সালাউদ্দিন। অনেক সময় দল জয় না পেলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দিয়ে তিনি সবার মন জয় করে নিয়েছেন। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্ট্রাইকারের পায়ে বল আসার সঙ্গে সঙ্গেই হরিণের মতো বিস্ময়করভাবে লাফিয়ে উঠে যেভাবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়িয়েছেন, তাতে বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি যে তিনি একজন সহজাত ফুটবলার। অসংখ্য গোল এসেছে তাঁর পায়ের ম্যাজিক থেকে। তাছাড়া মাঠে তাঁর উপস্থিতিই পাল্টে দিতো খেলার দৃশ্যপট। মেধাবী এই ফুটবলারের পায়ে যে ফুটবল-শিল্প ঝিলিক দিয়ে উঠতো, তাতে বুঝিয়ে দিতেন তিনিই মাঠের রাজা।
১৯৫৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্ম নেয়া কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের ফুটবলে হাতে-খড়ি হয় স্কুল জীবনে। ১৯৬৬ সালে ঢাকার শাহীন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় এককালের নামজাদা ফুটবলার চুন্না রশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এরপর তাঁর শুধু এগিয়ে যাবার কাহিনী। ১৯৬৬ সালে তৃতীয় বিভাগের দল গামা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে গোলকীপার হিসেবে দু’টি ম্যাচ খেললেও ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল দিলকুশার হয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলতে নেমে লীগের সর্বাধিক গোলদাতা হন। তাঁর ১৪টি গোল দিলকুশাকে চ্যাম্পিয়ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৬৯ সালে ওয়ারীর হয়ে শুরু হয় তাঁর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ ক্যারিয়ার। প্রথম দিকে সুযোগ পাননি। স্ট্রাইকার নিশীথ হাঁটুতে ব্যথা পাওয়ায় তাঁর পরিবর্তে প্রথম খেলতে নেমে রহমতগঞ্জের সঙ্গে হ্যাটট্রিক করেন। অবাঙালি স্ট্রাইকারদের আধিপত্য সত্ত্বেও ১৮টি গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে ১৯৭০ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব তাকে দলভুক্ত করে। এরপর আসে ১৯৭১। বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় কাল। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরার পাশাপাশি খেলার মাঠে ফুটবলাররা সৃষ্টি করেন নতুন ইতিহাস। প্রতিবেশী ভারতের মাটিতে দেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে পূর্ব বাংলার ফুটবলাররা জনমত সৃষ্টি করার ব্যতিক্রমধর্মী পথ বেছে নেন। আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে’ সালাউদ্দিন যোগ দেন তূর্য হাজরা নামে। গোষ্ঠপাল একাদশ নামে কোলকাতার মোহনবাগানের সঙ্গে খেলায় চমৎকার একটি গোল করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোহামেডানের হয়ে প্রথম স্বাধীনতা দিবস ফুটবলে অংশ নেন। সালাউদ্দিনের হ্যাটট্রিকে সেমিফাইনালে মোহামেডান ৩-০ গোলে বিআইডিসিকে হারায়। ফাইনালে ৩-১ গোলে ইস্টএন্ডকে হারিয়ে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়। সালাউদ্দিন দুটি গোল করেন। ১৯৭২ সালে যোগ দেন নতুন প্রজন্মের দল আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। আবাহনীর ১০ নম্বর জার্সি চিরদিনের জন্য তাঁর হয়ে যায়। এরপর তিনি একের পর এক নতুন ইতিহাস গড়েন। তাঁর পায়ে বল এলে অবশ্যম্ভাবী লক্ষ্য ছিল গোলপোস্ট। ১৯৭৩ সালে ২৪টি গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। ১৯৭৪ সালে সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। দিলকুশার সঙ্গে খেলায় ডাবল হ্যাটট্রিকসহ ৭টি গোল করেন। দিলকুশার নীলু সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও ১৫টি গোল দিয়ে তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে হালবিহীন নৌকার মতো হয়ে পড়ে আবাহনীর অবস্থা। নানা প্রতিকূলতার মাঝে সালাউদ্দিন আবাহনীকে নেতৃত্ব দিয়ে দলের অবস্থান তৃতীয় স্থানে রাখতে সক্ষম হন। ১৯৭৬ সালে লীগে ২ খেলায় ২ গোল দেয়ার পর পেশাদার লীগে ফুটবল খেলার জন্য চলে যান হংকং। ১৯৭৭ সালে শেখ আশরাফের নেতৃত্বে আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সালাউদ্দিন। ১৪ গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। ১৯৭৮ সালে ইনজুরির কারণে সব ম্যাচ খেলতে না পারলেও ৭ খেলায় ৮ গোল করেন। ১৯৭৯ সালে স্বমহিমায় ফিরে আসেন সালাউদ্দিন। ১৪ গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। পরের বছরও ১৫ গোল দিয়ে চতুর্থবারের মতো সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। এরপর আর তিনি ফুটবলের প্রতি খুব বেশি সিরিয়াস ছিলেন না। খুব একটা অনুশীলনও করতেন না। ইনজুরি তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসার প্রতি ঝুঁকে পড়ায় ফুটবল তাঁর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। অথচ ফুটবল জীবনের এই মধ্যগগনে এসেও তিনি দৃপ্ত ও সৌন্দর্যম-িত খেলা উপহার দিয়েছেন। শেষের দিকে গতি কিছুটা কমে গেলেও বিচক্ষণতা দিয়ে পুষিয়ে দেন। উইথ দ্য বল তিনি ছিলেন ক্ষিপ্রগতির স্ট্রাইকার। রানিংয়ের ওপর চমৎকার মাইনাস করে বল নিয়ে কাট করে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ঢুকে নিজেই পোস্টে শট নিতে পারতেন। সবচেয়ে বড় কথা, দর্শকদের চুম্বকের মতো মাঠে টেনে নিতেন। যে কারণে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যান ফুটবল খেলা। খেলায় মন না থাকলেও মাঠে নামলে সহজাত দক্ষতায় ঝলসে উঠতেন তিনি। ফুটবল যে শুধু পায়ের খেলা নয়, মেধা ও প্রজ্ঞারÑ সেটা বুঝতে পারা যেতো সালাউদ্দিনের খেলায়। বল পায়ে রাখতেন অল্পক্ষণ। বল ছেড়ে দিয়ে খেলায় গতি বাড়িয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে থ্রু দিতেন চমৎকার। কিন্তু সহযোগী খেলোয়াড়রা অনেক সময় বুঝতে না পেরে হিমশিম খেয়ে যেতো। খুব বেশি ছোটাছুটি করতেন না। কিছুটা সুযোগ পেলেই গোল করতে পারতেন। যখন যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রয়োজন, ঠিক সেখানেই পৌঁছে যেতেন। বল পায়ে তীব্র গতিতে দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে দিতেন। গোলের জন্য বুভুক্ষু না থাকলেও বল পায়ে পড়লে গোল না করা পর্যন্ত থামতে চাইতেন না। ঢাকা লীগে তাঁর আগে আর কোনো স্ট্রাইকার তাঁর মতো গোল করার ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে পারেননি। তিনিই প্রথম লীগে শতাধিক এবং দেড় শতাধিক গোল করার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। একটি ডাবল হ্যাটট্রিকসহ হ্যাটট্রিক করেছেন দশটি।
ঢাকা ফুটবল লীগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফুটবলেও সালাউদ্দিন তাঁর দ্যুতি ছড়িয়েছেন। ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে তাঁর চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের কারণে জাতীয় যুব দলে খেলেন। ঢাকা বিভাগীয় যুব দলের হয়ে করাচিতে পাকিস্তান জাতীয় যুব ফুটবলে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর প্রতিটি জাতীয় দলে তিনি ছিলেন অপরিহার্য ফুটবলার। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় ১৯তম মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে অভিষেক হয় বাংলাদেশের। থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ টাইব্রেকারে ৫-৩ গোলে জয়ী হয়। খেলার নির্ধারিত সময় ২-২ গোলে অমীমাংসিত ছিল। এনায়েত প্রথম ও সালাউদ্দিন দ্বিতীয় গোল করেন। সালাউদ্দিনের গোলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ায় ২১তম মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে অংশ নেয় বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। ৬ খেলায় বাংলাদেশ ২৭টি গোল হজম করে। এর মধ্যে রয়েছে হংকংয়ের কাছে ১-৯ এবং বার্মার কাছে ১-৭ গোলে বড় পরাজয়। ২৭ গোলের বিপরীতে বাংলাদেশ তিনটি গোল পরিশোধ করে। দলের শোচনীয় ব্যর্থতার মাঝে উজ্জ্বলতা ছড়ান সালাউদ্দিন। দলের তিনটি গোলই আসে তাঁর পা থেকে। থাইল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে একমাত্র যে ড্রটি করে বাংলাদেশ, সেটিরও নায়ক তিনি। হংকংয়ের কাছে বড় ব্যবধানে হারলেও সালাউদ্দিনের খেলায় মুগ্ধ হন হংকংয়ের গোলরক্ষক চিকো কিং। হংকংয়ের পেশাদার ফুটবল লীগে ক্যারোলিন হিল ক্লাবের পক্ষে খেলার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটি শুধু সালাউদ্দিন নয়, বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। ১৯৭৬ সালে ১২টি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হংকং লীগে তিনি ১৮টি খেলায় অংশ নেন। এটি সালাউদ্দিনের ফুটবল ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ মৌসুম হয়ে আছে। ইউএসডি’র সঙ্গে প্রথম ম্যাচে মিডফিল্ডে খেললেও সবার প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হন। সেবার ক্যারোলিন হিল ক্লাব লীগে চতুর্থ হয়। ১৯৭৭ সালেও তিনি আমন্ত্রণ পান। কিন্তু হাঁটুর ইনজুরির কারণে খেলা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে পেশাদার ফুটবল লীগ খেলার একমাত্র দৃষ্টান্ত সালাউদ্দিন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে এশিয়ান গেমসে ফুটবল দলের অধিনায়ক মনোনয়ন নিয়ে ফুটবল ফেডারেশন যে নাটক করে, তার প্রতিবাদে টপ ফর্মে থাকা আবাহনীর যে ৭ জন ফুটবলার দল থেকে সরে দাঁড়ানÑ তাদের অন্যতম হলেন সালাউদ্দিন। যে কারণে সালাউদ্দিনের আর কখনো এশিয়ান গেমসে খেলা হয়নি। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের খেলায় আফগানিস্তানকে ৩-২ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথম সরাসরি জয় পায়। এ খেলায় জয়সূচক গোলটি করেন তিনি। এছাড়া কাতারের সঙ্গেও তিনি একটি গোল করেন। এর ফলে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলে কোয়ালিফাই করে বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত নবম প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে নেতৃত্ব দেন সালাউদ্দিন। ১৯৮০ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত ৭ম এশিয়ান কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দুর্দান্ত লড়াই করে ২-৩ গোলে হেরে যায়। দলের প্রথম গোলটি করেন তিনি। ১৯৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের সদস্য হিসেবে পাঁচটি গোল করেন। ১-১ গোলে ড্র হওয়া নেপালের সঙ্গে একটি, ইরাককে ৩-১ গোলে হারানো ম্যাচে দুটি এবং সেমিফাইনালে ২-৫ গোলে পরাজিত ম্যাচে দুটি গোলই করেন সালাউদ্দিন। ১৯৮২ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে এবং ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে শেষবারের মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেললেও ততোদিনে ফুটবল আর তাঁর কাছে টপ প্রায়োরিটি ছিল না।
দেশ ও দলের পক্ষে অনেক বিজয়ের অনুপম শিল্পী ছিলেন সালাউদ্দিন। করেছেন অনেক দুর্লভ গোল। ১৯৭২ সালে বিদেশি দল হিসেবে প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসে কোলকাতা মোহনবাগান। ১৩ মে ঢাকা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ নির্বাচিত একাদশের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচটি ছিল সমানে সমান লড়াই। বাংলাদেশ একাদশের লিংকম্যান কায়কোবাদ মধ্য মাঠ থেকে একটি বল উঁচু করে শট মারলেন প্রতিপক্ষ দলের বিপদ সীমানার কাছে। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণ ছুটে যান বলের ফ্লাইট ধরে নির্দিষ্ট স্থানে। বলটিকে আর মাটিতে পড়তে না দিয়ে দেহকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে বিপক্ষ দলের গোলপোস্ট লক্ষ্য করে শট নেন। বলের গতি এতো তীব্র ছিল যে, মোহনবাগানের গোলরক্ষক তরুণ ব্যানার্জীর কিছুই করার ছিল না। সালাউদ্দিনের অসাধারণ এই গোলে জয়ী হয় বাংলাদেশ নির্বাচিত একাদশ। এটি ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্থানীয় ফুটবল দলের প্রথম জয়। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা টুর্নামেন্টে বার্মার সঙ্গে গোলটি সালাউদ্দিনের অন্যতম সেরা গোল। বার্মার গোলরক্ষক তখন এশিয়ার অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। রক্ষণভাগও খুবই শক্তিশালী। খেলার প্রথমার্ধে মাঝ মাঠ থেকে বল পেয়ে দ্রুতবেগে কোনাকুনিভাবে ডান দিক দিয়ে তিনি ছুটে যান। ওই সময় বার্মার গোলরক্ষক পোস্ট ছেড়ে কিছুটা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গোলরক্ষক ভেবেছিলেন, সালাউদ্দিন রাইট আউটের খেলোয়াড়কে বল ঠেলে দেবেন। তাই তিনি সেমত পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর তা দেখে সালাউদ্দিন কালবিলম্ব না করে চোখের পলকে ৪৫ গজ দূর থেকে পোস্ট লক্ষ্য করে শট নেন। বলটি গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে জালে প্রবেশ করে। এটি ছিল একজন নিখুঁত স্ট্রাইকারের একটি রোমাঞ্চকর গোল। ১৯৭৯ সালে ঢাকা এশিয়ান কাপ কোয়ালিফাইং রাউন্ডের খেলা শেষের এক মিনিট আগে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাঁ পায়ে সুইং করে জয়সূচক গোল করেন। মাঝ মাঠ থেকে টুটুল একটি থ্রু পাস দেন। বক্সের ডান দিকে থাকা সালাউদ্দিন বল রিসিভ করার ঝুঁকি না নিয়ে রানিং অবস্থায় সেকেন্ড বারে প্লেস করে বল জালে জড়ান। ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে সবুজ দলের হয়ে নেপালের সঙ্গে একটি ও ইরাকের সঙ্গে দুটি চমৎকার গোল করেন। জাতীয় দলের পাশাপাশি আবাহনীর হয়ে অনেক চমদপ্রদ গোল করেছেন। ১৯৭৭ সালে ওয়ান্ডারার্সের সঙ্গে একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে ৪/৫ জনকে কাটিয়ে জিরো অ্যাঙ্গেল থেকে গোল, ১৯৭৯ সালে রহমতগঞ্জের সঙ্গে মাঝমাঠ থেকে দুর্দান্ত একটি গোল করেন। কর্দমাক্ত মাঠে প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক মোতালেব পোস্ট ছেড়ে বাইরে আসেন। প্রায় ৬০ গজ দূর থেকে উঁচু মাপা শটে বিস্ময়করভাবে গোল করেন। একই বছর আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবলে ইরানের সঙ্গে দ্বিতীয় গোলটি ছিল দেখার মতো। বাঁ দিক থেকে ছুটে এসে বল পায়ে বিপক্ষ দলের বিশ্বকাপের খেলোয়াড় হাসান হোসেন বেগিকে ফাঁকি দিয়ে বাঁ পায়ের প্রচ- শটে গোল করেন তিনি। একই টুর্নামেন্টে আফগানিস্তানের সঙ্গে তাঁর হ্যাটট্রিকটি ছিল প্রশংসনীয়। এছাড়া ১৯৮৩ সালে সফররত কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে একটি স্মরণীয় গোল করেছেন। কড়া প্রহরায় ক্ষণিকের মধ্যে ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে আচমকা যে গোলটি করেন, তাতে আবাহনী ২-১ গোলে জয়ী হয়। সালাউদ্দিন এ রকম অসংখ্য চোখ ধাঁধানো গোল করেছেন। কখনো জোরালো শটে, আবার কখনো দর্শনীয় ভঙ্গিতে প্লেসিং করে গোল করেছেন। থ্রু পাস থেকে বল পেয়ে তিনি না থেমেই চলতি বল নিয়েই প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বা যে কোনো এক পাশে সরে গিয়ে গোলে প্রচ- শট করতে পারতেন। দু’পায়েই তাঁর জোরালো শট ছিল। হেডিংয়ে পারদর্শী না হলেও হেডেও গোল করেছেন। একজন কমপ্লিট স্ট্রাইকারের প্রতিকৃতি ছিলেন সালাউদ্দিন। বল বেশি পায়ে রাখতেন না। ওয়ান টাচ বা টু টাচ ফুটবল খেলতেন। গ্যাপ বুঝে দৌড় দিতেন। মিডফিল্ড থেকে বাড়ানো বলগুলো ধরে ডিফেন্ডারদের পাশ কাটিয়ে সর্পিল গতিতে ছুটে যেতেন, আর নিপুণ দক্ষতায় প্রথম সুযোগেই বল জালে জড়িয়ে দিতেন। সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি ছিল না।
বাংলাদেশের ফুটবলের অনেক গৌরবময় ঘটনার রূপকার সালাউদ্দিন। অনেক কৃতিত্বের পাশাপাশি এ দেশের ফুটবলকে আকর্ষণীয় ও গ্ল্যামারাস করার ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ১৯৭৪ সালে আবাহনীর খেলার ধারা পাল্টে দেন আইরিশ ফুটবল কোচ বিল হার্ট। তাঁকে দলে আনার ক্ষেত্রে সালাউদ্দিনের ভূমিকা রয়েছে। গতানুগতিক ধারা থেকে তিনি ফুটবলকে মুক্তি দেন। ফুটবলে তিনি রীতিমত একটা বিপ্লব নিয়ে আসেন। আর পাল্টে দেয়া আবাহনীর ফুটবলে বিল হার্টের অন্যতম নিউক্লিয়াস ছিলেন সালাউদ্দিন। তাঁর পাস, রিসিভ, ডজ, নিখুঁত শুটিং, খেলার স্টাইল, মাঠে বিচরণের ভঙ্গি ও আচরণ, সর্বোপরি সাফল্য, রেকর্ড, প্রচারণা ও জনপ্রিয়তায় তিনি হয়ে ওঠেন রূপকথার নায়ক। লম্বা চুল রেখে ঢাকা মাঠে তিনিই প্রথম খেলতে শুরু করেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল নতুন ফ্যাশন। সামগ্রিকভাবে সালাউদ্দিন নামটি একটি ‘ব্র্যান্ড নেমে’ পরিণত হয়। তাকে এক পলক দেখার জন্য দর্শকরা বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো ছুটে আসতেন স্টেডিয়ামে। তখন সবাই স্বপ্ন দেখতেন সালাউদ্দিনের মতো ফুটবলার হওয়ার। এমন ইমেজ ও জনপ্রিয়তা আজো কেউ গড়ে তুলতে পারেননি। বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে নন্দিত ও বন্দিত এই ফুটবলারের নাম জাড়িয়ে আছে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আবাহনী ও মোহামেডানের খেলায় গোলযোগের অজুহাতে আবাহনীর চারজন ফুটবলারকে জেল ও জরিমানায় দ-িত করে তৎকালীন সামরিক আদালত। চুন্নু, আনোয়ার ও হেলালের সঙ্গে সালাউদ্দিনকে ১৮ দিন জেলে থাকতে হয়। ফুটবল খেলার জন্য তাঁদের যে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে, তা এ দেশের ফুটবলের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হয়ে আছে। দুঃসহ এই স্মৃতিটুকু ছাড়া সালাউদ্দিন দু’হাতেই পেয়েছেন মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা। ১৯৮৪ সালের ১৯ অক্টোবর ফুটবল থেকে তিনি অবসর নেন। অবসান ঘটে ১৭ বছরের বর্ণাঢ্য ও ঝলমলে ফুটবল ক্যারিয়ারের। চিরপ্রতিদ্বন্দ¡ী মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে খেলায় তাঁকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়, এমন নজির আর নেই বললেই চলে। কানায় কানায় ভর্তি ঢাকা স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শক অশ্রু ও ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ১৫ মিনিট করতালির মাধ্যমে তাঁকে বিদায় জানান। তাঁর বিদায়ের ক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখে আবাহনী টুটুলের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। এই বিদায় সম্পর্কে কবি সানাউল হক খান লিখেছিলেন : ‘পেছনে পড়ে রইলো নন্দিত পশ্চাৎ পটভূমি। রয়ে গেল তাঁর আবেদন, কীর্তি, অক্ষয়, অমর, স্মৃতিবিজড়িত ১৭টি বছরের অবদান। সূর্যের মতো চিরউজ্জ্বল, চিরভাস্বর, যৌবনচর্চিত তূর্যের নয়নাভিরাম খেলা। উত্তরসূরিদের কাছে তিনি হলেন বাংলাদেশের মডেল অব ফুটবল। অনুকরণীয় আদর্শ। একাই এক ইনস্টিটিউট।’
ফুটবলে নিজেকে নিবেদন করলেও সালাউদ্দিন ক্রিকেটও চমৎকার খেলতেন। এক সময়ের জনপ্রিয় ক্লাব আজাদ বয়েজের হয়ে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলেছেন। তিন নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে রানের সঞ্চয় নেহাত মন্দ ছিল না। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে মেট্রোপলিশ প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগের দ্বিতীয় সেমিফাইনালের দ্বিতীয় ইনিংসে আবাহনীর বিপক্ষে সেঞ্চুরির কাছাকাছি একটি ইনিংস খেলে সাড়া জাগিয়েছিলেন। ৯২ রানের সেই ইনিংসটি ছাড়াও আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অসংখ্য বড় ইনিংস উপহার দিয়েছেন। সালাউদ্দিন খেলোয়াড়ী জীবনের অবসান ঘটালেও ফুটবলের মোহ থেকে দূরে থাকতে পারেননি। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে আবাহনীর কোচ হিসেবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রথম বছরই সফল। ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে ডিসিএম ট্রফিতে তাঁর অভিষেক হয়। ওই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিলেও আবাহনীর খেলা প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৮৫ সালে আবাহনী ফেডারেশন কাপ এবং লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়। রানার্সআপ হয় এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে। তিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের অফ-সাইড ট্র্যাপ করার পদ্ধতি শেখান। ফুটবলার হিসেবে টানা ১৩ বছর আবাহনীতে খেললেও কোচ হিসেবে তেমনটি হয়নি। আবাহনী ছাড়াও তিনি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মাঝে ১৯৯১ সালে আবাহনী অপরাজিত এবং ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র তাঁর কোচিংয়ে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন এবং লীগে রানার্সআপ হয়। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে অভিষেক হয় ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে। সাফ গেমসে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ ব্লু দলের, ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে নবম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে এবং ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন তিনি। কোচিং ক্যারিয়ার থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
ফুটবলার হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ খ্যাতির শীর্ষে থাকলেও সে তুলনায় সালাউদ্দিন পুরস্কৃত হয়েছেন খুবই কম। সেরা ফুটবলার হিসেবে ১৯৭৯ সালে এবং সেরা কোচ হিসেবে ১৯৯২ সালে তাঁকে সম্মানিত করে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি। তবে সান্ত¡না এই যে, ১৯৯৬ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের রজতজয়ন্তি উপলক্ষে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে সেরা একাদশ নির্বাচন এবং ২০০৫ সালে যে ১০ জন ফুটবলারকে সম্মাননা প্রদান করে, তাতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ছিলেন সালাউদ্দিন। কেননা সালাউদ্দিনকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের কথা চিন্তাই করা যায় না। তিনি ফুটবলকে শো-বিজনেসে পরিণত করেন। স্মার্টনেস, স্কিল, স্ট্যামিনা, বডি ফিটনেস, শারীরিক গঠন ও নৈপুণ্য দিয়ে মাত করে দেন। তবে সালাউদ্দিন ফুটবলের প্রতি আরো সিরিয়াস এবং গোল করায় মনোযোগী হলে মাইলফলক গড়ার দিক দিয়ে কেউ তাঁর কাছাকাছি যেতে পারতো না। সচরাচর একজন সালাউদ্দিনের দেখা মেলে না। সালাউদ্দিনের জন্য যুগ যুগ অপেক্ষায় থাকতে হয়।




প্লে-মেকার এনায়েত

পায়ে বল পেলে প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমত আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াতেন এনায়েত। বিপক্ষের জন্য ত্রাস সৃষ্টিকারী এই স্ট্রাইকার মাঠে থাকলে দলের সমর্থকরা নিশ্চিত থাকতেন। তারা জানতেন, পায়ে বল পড়লে এনায়েত কিছু একটা করবেনই। তাঁকে ঘিরে এই প্রত্যাশার কারণ, তিনি ছিলেন প্লে-মেকার। মাঠজুড়ে খেলতেন। গোটা দলের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতেন তিনি। পরিশ্রমী, শক্ত-সামর্থ্য ও লড়াকু এই ফুটবলার বল প্লে করা, প্রয়োজন মুহূর্তে ড্রিবলিং, ডেড বলে আচমকা শট, বলকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বলের যোগান দেয়া এবং দূর থেকে নিপুণ লক্ষ্যভেদী আচমকা শট দিয়ে গোল করার ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
ঢাকার কালীগঞ্জে ১৯৫১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এনায়েতুর রহমান খানের জন্ম। স্কুল জীবন থেকেই তিনি খেলা পাগল। করটিয়া সা’দত কলেজে পড়ালেখার সময় তিনি টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে ফুটবল খেলতেন। তাঁকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেন ওয়ারী ক্লাবের এককালের ফুটবলার শামসুল ইসলাম দেওয়ান। ১৯৬৭ সালে দ্বিতীয় বিভাগে ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুলের হয়ে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার শুরুহয়। ১৯৬৮ সালে তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তান গভর্নমেন্ট (ইপিজি) প্রেসের হয়ে খেলেন। ইপিজি প্রেসে দু’বছর খেলার পর যোগ দেন শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। সে বছর ১৭টি গোল দিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। হ্যাটট্রিক করেন রহমতগঞ্জের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। কৃষ্ণনগরে প্রথম গোল আসে তাঁর পা থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি বিজেআইসি ক্লাবে যোগ দেন। দু’বছর বিজেআইসিতে খেলেন। ১৯৭৩ সালে ফুটবল লীগে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয় বিজেআইসি। এই দলের সদস্য ছিলেন এনায়েত। দল চ্যাম্পিয়ন হলেও তিনি ১৯৭৪ সালে চলে যান ওয়াপদায়। ১৯৭৫ সালে তিনি পুনরায় বিজেআইসিতে ফিরে যান।
এ সময় এনায়েত হয়ে ওঠেন ঢাকা লীগের অন্যতম আকর্ষণ। তীব্র গতিসম্পন্ন এই ফুটবলারের বুলেটের মতো আচমকা শট ছিল দেখার মত। দূরপাল্লার শটে গোল করার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার। ডজ করার ছিল অসাধারণ ক্ষমতা। ৩/৪ জনকে কাটানো তাঁর কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক এলাকায় সহ-খেলোয়াড়দের গোল করার মতো চমৎকার বল সরবরাহ করাই ছিল তাঁর বিশেষত্ব। নিজে গোল করার চেয়ে দলের খেলোয়াড়দের দিয়ে গোল করিয়ে আনন্দ পেতেন বেশি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত তিনটি বছর বিআইডিসিতে তিনি মন-প্রাণ উজাড় করে খেলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ছিলেন অধিনায়ক। কিন্তু দল আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়ে ফুটবল জীবনের অপরাহ্নে ১৯৭৮ সালে যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। এ বছর মোহামেডান ও এনায়েত একে অপরের সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন। প্রথমবারের মতো অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। এনায়েতও ঢাকা লীগে প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার গৌরব অর্জন করেন। গোল দেন ১৩টি। এ বছরের নৈপুণ্য দিয়ে তিনি মোহামেডানের সমর্থকদের চোখের মণি হয়ে ওঠেন। ১৯৭৯ সালটি তাঁর জীবনের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে ওঠে। রেফারি দলিল খানকে ঘুষি মেরে তিনি আলোচিত হয়ে ওঠেন। এ কারণে তাকে সাসপেন্ড করা হলে সমর্থকরা তাঁর পক্ষে সোচ্চার হন। তাঁদের চাপের মুখে প্রত্যাহার করা হয় তাঁর শাস্তি। কিন্তু এরপর থেকে এনায়েত যেন হারিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৮০ সালে মোহামেডানে খেললেও কর্মকর্তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। দলের প্র্যাকটিসে অনুপস্থিত থাকেন। ১৯৮১ সালে তিনি ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকা লীগে ৯০টির মতো গোল করেছেন এনায়েত। তবে যত না গোল করেছেন, তার চেয়ে বেশি গোলের সুযোগ করে দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম গোল দেয়ার কৃতিত্ব এনায়েতের। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯তম মারদেকা ফুটবল প্রতিযোগিতায় ২৭ জুলাই থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ টাইব্রেকারে ৫-৪ গোলে জয়ী হয়। খেলার নির্ধারিত সময় ২-২ গোলে অমীমাংসিত ছিল। বাংলাদেশের পক্ষে এনায়েত প্রথম এবং সালাউদ্দিন দ্বিতীয় গোলটি করেন। মজার ব্যাপার, টাইব্রেকারে এ দু’জনই গোল করতে ব্যর্থ হন। কুয়েতের সঙ্গে খেলায় সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন এনায়েত। কুয়েতের কাছে ২-১ গোলে হারলেও বাংলাদেশের একমাত্র গোলটি আসে এনায়েতের পা থেকে। এটি তাঁর জীবনে স্মরণীয় গোল হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার ২১তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৭৬ সালে থাইল্যান্ডের কিংস কাপ ফুটবল এবং ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এশিয়ান গেমস ফুটবলে অংশ নেয়ার পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন এনায়েত। ১৯৮৫ সালে মোহামেডানের কোচ ও ম্যানেজার হিসেবে ৭/৮ মাস দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু দায়িত্ব পালনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৮৭ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের কোচ ছিলেন।
মেজাজী ও আবেগপ্রবণ ফুটবলার ছিলেন এনায়েত। স্ট্রাইকার পজিশনে খেললেও মিডফিল্ডারের মতো বল থাকতো তাঁর নিয়ন্ত্রণে। গোল করতে পারতেন এবং সতীর্থদের দিয়েও গোল করাতে জানতেন। হেডিংয়ে তেমন একটা পারদর্শী ছিলেন না। অনেক সময় অতিরিক্ত বল ধরে রাখতেন। তবে তিনি তাঁর উপস্থিতি দিয়ে দলের খেলোয়াড়দের দারুণভাবে উদ্বুব্ধ করতে পারতেন। টিম প্লেয়ার এবং সহসা লক্ষ্যভেদী শট নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন চমৎকার দৃষ্টান্ত।
ফুটবল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে এনায়েতকে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা ফুটবলার এবং ২০০৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। মেজাজী এই ফুটবলারের দূরপাল্লার শটগুলো ট্রেডমার্ক হয়ে আছে। আর ফুটবলার হিসেবে এনায়েত করে নিয়েছেন নিজস্ব স্থান।



সাইড ট্যাকলার নান্নু

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যে ক’জন ফুটবলার ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, ক্রীড়াশৈলী ও ক্যারিশমা দিয়ে স্বতন্ত্র একটি ধারা তৈরি করতে সক্ষম হন, তাঁদের অন্যতম হলেন নান্নু। শান্ত, ধীর প্রকৃতির ও সজ্জন এই ফুটবলার পরিচ্ছন্ন ও নৈপুণ্যভাস্বর খেলা দিয়ে যেমন শক্ত একটা অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হন, তেমনি মেধা, মননশীলতা, রুচি ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে সবার মন জয় করে নেন। সত্তর দশকের সাড়া জাগানো ফুটবলার নান্নু প্রকৃত অর্থে ছিলেন একজন জাত ফুটবলার। প্রথম জীবনে লেফ্ট ব্যাক, মাঝে মিডফিল্ডার এবং শেষ জীবনে স্টপার হিসেবে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন।
১৯৪৮ সালের ২৭ আগস্ট জামালপুরে জন্ম নেয়া মোঃ মনোয়ার হোসেন নান্নু পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারা বেয়ে ফুটবলে সম্পৃক্ত হন। ষাটের দশকে বাড়ির পাশের তৎকালীন ইপিজি প্রেস মাঠে মনের আনন্দে ফুটবল খেলতেন। কখনো-সখনো খেলোয়াড় কম থাকলে বিজি প্রেস ফুটবল দলে খেলার সুযোগ পেতেন। খেলতে খেলতে সেই স্কুল বয়সেই এককালের খ্যাতনামা ফুটবলার চুন্না রশিদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। চুন্না রশিদ (পাকিস্তান জাতীয় দলের ফুটবলার সৈয়দ আব্দুর রশিদ চুন্না) খেলোয়াড় গড়ার সহজাত তাগিদ থেকে নান্নুর প্রতি বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। ১৯৬৫ সালে নান্নু তৃতীয় বিভাগের দল আজাদ স্পোর্টিংয়ের ‘বি’ দলের হয়ে খেলার সুযোগ পান। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল রহমতগঞ্জ স্পোর্টিং এবং ১৯৬৭ সালে দিলকুশা স্পোর্টিংয়ে খেলে পরিপক্ব হয়ে ওঠেন নান্নু। সঙ্গত কারণে ১৯৬৮ সালে আমন্ত্রণ পান প্রথম বিভাগের দল ইপিজি প্রেস (পরবর্তীকালে বিজি প্রেস) দলের। ঢাকা স্টেডিয়ামে জীবনের প্রথম ম্যাচ খেলেন ওয়ান্ডারার্সের সঙ্গে। লেফট ব্যাক পজিশনে। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি। ১৯৬৯ ও ’৭০ সাথে ওয়ারী, ১৯৭২ ও ’৭৩ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব হয়ে ১৯৭৪ সাল থেকে থিতু হন আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। ততোদিনে ঝাঁকড়া চুলের এই ফুটবলার দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন দুর্ধর্ষ লিঙ্কম্যান হিসেবে। মধ্যমাঠে তাঁর বল আদান-প্রদান ছিল চিত্তাকর্ষক। ১৯৭২ সালে দিল্লিতে ডুরান্ড কাপে মোহামেডানের নিয়মিত লিঙ্কম্যান কায়কোবাদ জন্ডিসে আক্রান্ত হলে নান্নু লিঙ্কম্যান হিসেবে খেলতে নামেন। সেদিন একজন পরিপূর্ণ লিঙ্কম্যান হিসেবে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেন। এরপর থেকে এই পজিশনে খেলে খ্যাতি পান। ১৯৭৪ সালে আবাহনী প্রথমবারের মতো লীগ চ্যাম্পিয়ন হলে নান্নুও শিরোপার স্বাদ পান। কিন্তু দুর্ভাগ্য নেমে আসে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারে। পা ভেঙে যাওয়ায় পরের দু’বছর তাঁর ফুটবল জীবন থেকে একদমই হারিয়ে যায়। দু’বছর পর যখন ফের খেলতে নামেন, তখন তাঁর স্পিড, স্টেংথ ও স্ট্যামিনা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। লিঙ্কম্যান পজিশনে খেলা সম্ভব নয় ভেবে নান্নু স্টপার পজিশনে খেলার সিদ্ধান্ত নেন। নতুন ভূমিকায় দ্রুত মানিয়ে নিয়ে রক্ষণভাগে আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। পেনাল্টি শুটে গোল করার ক্ষেত্রেও দক্ষতা দেখান। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার সুঠামদেহী এই ফুটবলার রক্ষণভাগে নেমে এলেও মূলত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ক্ষিপ্রতা, ফাইটিং স্পিরিট, অ্যান্টিসিপেশন, নিখুঁত ট্যাকলিং ও বিচক্ষণতা দিয়ে প্রমাণ করে দেনÑ তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। ১৯৭৭ সালে আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মূলে নান্নুর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ঠা-া মাথায় পরিকল্পিতভাবে বল আদান-প্রদান করে খেলায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ডিপ ডিফেন্স থেকেও লম্বা উঁচু বল, এমনকি মাটি কামড়ানো মাপা থ্রু দিয়েও আক্রমণের সূত্র তৈরি করে দিতেন। তাঁর ট্যাকেল উতরে গোল করা প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। হেডওয়ার্কও ছিল চমৎকার। তাঁর ঠা-া মেজাজ, চমৎকার খেলোয়াড়ী মনোভাব, পজিশন সেন্স, প্লেসিং ও সাইড ট্যাকলিং ছিল দেখার মতো। তাঁকে বলা যায় সাইড ট্যাকলিংয়ের প্রণেতা। এ কারণে একাধিক পজিশনে খেললেও দর্শক হৃদয়ে তিনি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি আবাহনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। সে বছর মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন তাঁর অনুজ শামসুল আলম মঞ্জু। দু’ভাই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ¡ী দলের অধিনায়ক হিসেবে মুখোমুখি হওয়াটা সে সময়ের আলোচিত ঘটনা ছিল। ১৯৭৯ সালটা নান্নুর জন্য কষ্টকর স্মৃতি হয়ে আছে। আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে আবাহনী ৫-১ গোলে আফগানিস্তানকে হারায়; কিন্তু বাঁ পায়ের অ্যাঙ্কেলে আঘাত পান তিনি। পরের খেলা ইরানের সঙ্গে। কর্মকর্তাদের জেদের কারণে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে তাঁকে খেলতে হয়। খেলায় আবাহনী জয়ী হয় ২-১ গোলে। তা সত্ত্বেও আবাহনীতে অন্তর্দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়। নিয়ম-কানুন মানা না হওয়ায় প্রতিবাদ করেন তিনি। এ কারণে তাঁকে দলত্যাগ করতে হয়। অথচ এই আবাহনীর জন্য তিনি ছয় বছর তাঁর রক্ত জল করে দিয়েছেন। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, সংগঠক হিসেবে আবাহনীর বিপদের সময় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে আবাহনীর অবস্থা হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া। এই দুর্যোগময় মুহূর্তে সংগঠক হিসেবে তিনিও ক্লাবের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ফুটবল খেলার পাশাপাশি ১৯৭৬ সাল থেকে আবাহনীর সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দুঃসময়ের বন্ধুকে বাধ্য হয়ে ১৯৮০ সালে রহমতগঞ্জে যোগ দিতে হয়। ১৯৮১-৮২ পর্যন্ত রহমতগঞ্জে স্টপার ব্যাক হিসেবে খেলে ১৭ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারের অবসান ঘটান। তবে তিনি আবাহনীর নান্নু হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।
বর্ণাঢ্য ফুটবল জীবনে নান্নু জাতীয় দলের হয়ে দীর্ঘদিন খেলেছেন। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান একাদশের হয়ে তিনি প্রথম বিদেশ সফরে নেপালে যান। ১৯৭২ সালে ঢাকা একাদশের হয়ে আসামের গৌহাটির সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই শিল্ডে, ১৯৭২-৭৩ সালে মোহামেডানের হয়ে মুম্বাইয়ের ডুরান্ড কাপে, ১৯৭৩ সালে প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে মালয়েশিয়ার ১৯তম মারদেকা টুর্নামেন্টে অংশ নেন। মারদেকা টুর্নামেন্টে নান্নুর গোলে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। ১৯৭৪ সালে আবাহনীর হয়ে আইএফএ শিল্ডে অংশ নেন। এরপর পায়ের ইনজুরির কারণে নান্নুর জাতীয় দলে খেলা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু দৃঢ়চেতা মনোবল আর অপরিসীম নিষ্ঠার ফলে তিনি পাঁচ বছর পর জাতীয় দলে নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত অষ্টম এশিয়ান গেমস ফুটবলে তাকে অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অজ্ঞাত কারণে তাঁর পরিবর্তে অধিনায়ক করা হয় মোহামেডানের গোলরক্ষক শহীদুর রহমান চৌধুরী সান্টুকে। এর প্রতিবাদে নান্নুর নেতৃত্বে আবাহনীর সাতজন ফুটবলার এশিয়ান গেমস থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন। তারা হলেন খন্দকার রকিবুল ইসলাম রকিব, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, খোরশেদ আলম বাবুল, অমলেশ সেন, কাজী সালাউদ্দিন ও আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে শেষবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে খেলেন নান্নু। রক্ষণভাগের দুর্ভেদ্য প্রাচীর নান্নুু জীবনে অনেক স্মরণীয় খেলা উপহার দিয়েছেন। কিন্তু ১৯৭২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ একাদশের হয়ে কোলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এবং একই বছর আসামের গৌহাটিতে সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই শিল্ডে ঢাকা একাদশের হয়ে তার ক্রীড়াশৈলী অনেকের স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ফুটবল ক্যারিয়ারে ১৯৭৪ সালটি নান্নুর জীবনে সেরা বছর হয়ে থাকবে। এর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৭৪ সালে তাকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। ১৯৯৭ সালে রজতজয়ন্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতা-উত্তর যে সেরা একাদশ নির্বাচন করে, তার একজন হলেন তিনি। একজন ফুটবলারের সত্যিকার প্রতিকৃতি হিসেবে নান্নুকে ১৯৯৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। তবে নিজেকে গুটিয়ে রাখা পরিণত এই ফুটবলারের চমৎকার ফুটবল সেন্স ও মেধাকে কাজে লাগানো হয়নি।



ওভারল্যাপিং মাস্টার মঞ্জু

দুরন্ত ঘোড়ার মতো বল পায়ে টগবগিয়ে ছুটতেন মঞ্জু। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হয়েও সাইড লাইন ধরে ওভারল্যাপ করে বিপক্ষ রক্ষণভাগে এসে ত্রাস সৃষ্টি করতেন। মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুলের বলিষ্ঠ ও সাহসী এই ফুটবলার শক্ত ট্যাকলিংয়ে বল কেড়ে নিয়ে নিজ দলের রক্ষণভাগ থেকে আক্রমণের উৎস রচনা করার নিপুণ কারিগর ছিলেন। শক্ত ট্যাকলিং, চমৎকার হেডওয়ার্ক, বল পায়ে বিদ্যুৎ গতি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। ডিফেন্স করার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটাকিং রাইট ব্যাক ধারণার সূচনা করেন তিনি। গতি ও শক্তিমত্তার সঙ্গে মেধার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি শৈল্পিক ফুটবল উপহার দেন। এ কারণেই তাঁকে মনে করা হয় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ফুটবলে সবচেয়ে উঁচু মানের রাইট উইংব্যাক।
পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার শামসুল আলম মঞ্জুর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৪ মার্চ। জামালপুরের ছেলে মঞ্জু শাহীন স্কুল ও তেজগাঁ পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্র থাকাবস্থায় ফুটবলে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় খেলতেন ইনসাইড ফরোয়ার্ড হিসেবে। ১৯৭০ সালে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় তৃতীয় বিভাগের দল তেজগাঁ ফ্রেন্ডস ইউনিয়নের হয়ে। ১৯৭২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে ধানমন্ডির হয়ে রাইট উইংব্যাক হিসেবে খেলার সময় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৩ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অভিষেক হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে। ১৯৭৪ সালে আবাহনী প্রথমবারের মতো ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হলে সে দলের সদস্য ছিলেন তিনি। আবাহনীর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মঞ্জু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ওভারল্যাপিং করলে আক্রমণের ধার বেড়ে যায়। প্রতিপক্ষরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আবাহনীতে আধুনিক ফুটবল প্রবর্তনের রূপকার আইরিশ কোচ বিল হার্ট মঞ্জু সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘ওভারল্যাপিং উইংব্যাক হিসেবে যা কিছু প্রয়োজন, মঞ্জুর মাঝে তার সবই পর্যাপ্ত রয়েছে।’ বিল হার্টের ছোঁয়ায় মঞ্জু যেন আরো পরিণত হয়ে ওঠেন। ওভারল্যাপিং, বল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা, বলের গতি পরিবর্তন ও গতি নিয়ন্ত্রণে অদ্ভুত চাতুরি, বল বিতরণের কৌশল, ব্লকিং সেন্স ও স্কিল ফুটবল দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন টাফ অ্যান্ড রাফ ফুটবলের অন্যতম প্রতিনিধি। ফুটবল শৈলী ও মেধার পাশাপাশি জেদী মনোভাব, পাগলাটে স্বভাব ও স্বেচ্ছাচারী খেয়ালের কারণে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী ফুটবলার। চ্যাম্পিয়ন দল আবাহনী থেকে ১৯৭৫ সালে যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। মোহামেডান হয়ে ওঠে তাঁর প্রকৃত ঠিকানা। ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হলে তিনি টানা তিন বছর চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড় হওয়ার বিরল গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে মঞ্জুর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। এ বছর আবাহনীর অধিনায়ক ছিলেন মঞ্জুর অগ্রজ মনোয়ার হোসেন নান্নু। প্রথম বিভাগে ছয় বছরের ক্যারিয়ারে চারবার চ্যাম্পিয়ন দলে থাকার পর বড় দলের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন মঞ্জু। বিদ্রোহী এই ফুটবলার কোন কিছুতেই আপোষ করতে রাজি ছিলেন না। আবাহনী ও মোহামেডানে খেলে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছালেও অবলীলায় দলত্যাগ করতে মোটেও দ্বিধা করেননি। ১৯৭৯ সালে রহমতগঞ্জে যোগ দিয়ে দলটিকে গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেন। পরের বছর অধিনায়ক হওয়ার পর আবাহনী থেকে বড় ভাই নান্নুকেও রহমতগঞ্জে নিয়ে আসেন। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৮৪ সালে পুনরায় মোহামেডানে খেলেন। অস্থির ও খ্যাপাটে মঞ্জু এক বছর মোহামেডানে খেলার পর ১৯৮৫ সালে চলে যান ওয়ারীতে। সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লীগে ১৩ বছর খেলার পর ওয়ারীর হয়েই শেষ ম্যাচ খেলেন। ১৯৮৫ সালের ১৪ জুলাই ওয়ারীর অধিনায়ক হিসেবে মোহামেডানের সঙ্গে খেলায় অবসর নেন। অবসান ঘটে উজ্জ্বল এক ফুটবল জীবনের। ফ্ল্যামবয়ান্ট মঞ্জু ফুটবল অঙ্গনে ছিলেন জ্বলন্ত মশালের মতো।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে মঞ্জুর অভিষেক হয় অধিনায়ক হিসেবে। ১৯৭৫ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত ১৭তম এশিয়া যুব ফুটবল প্রতিযোগিতার কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বাংলাদেশ জাতীয় যুব ফুটবল দলের নেতৃত্ব দেন। এছাড়া তিনি ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার ২১তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৭৬ সালে ব্যাংককে কিংস কাপ, ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে তিনি বাংলাদেশ লাল দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে আবাহনীর হয়ে সফরকারী সোভিয়েত দল ডায়নামো মিনস্কের সঙ্গে, ১৯৭৫ সালে মোহামেডানের হয়ে আবাহনীর সঙ্গে অসাধারণ খেলেন। ১৯৭৫ সালে কুয়েতে এশীয় যুব ফুটবলে বাহরাইনের সঙ্গে বাংলাদেশ ০-১ গোলে হারলেও অধিনায়ক হিসেবে মঞ্জু যেভাবে শক্ত রক্ষণ দুর্গ গড়ে তোলেন, তা উজ্জ্বল হয়ে আছে। থ্রু, লব, নির্ভুল বল বিতরণের পাশাপাশি কখনো-সখনো দলের প্রয়োজনে গোলও করেছেন। পায়ে একবার বল এলে তা অন্যের দখলে যেতে দিতেন না। খেলার শেষ পর্যন্ত তিনি লড়ে যেতেন। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে মঞ্জু কোচিংয়ে সম্পৃক্ত হলেও খুব বেশিদিন সংশ্লিষ্ট থাকেননি। ১৯৮৬ ও ’৮৭ সালে তিনি রহমতগঞ্জের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনি বাংলাদেশ যুব দলের কোচ ছিলেন। ১৯৮২ সালে মঞ্জু বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন।
১৯৯৭ সালে রজতজয়ন্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে সেরা একাদশ নির্বাচন করে, তাতে মঞ্জুও ছিলেন। বাংলাদেশের ফুটবলে যাঁদের মাধ্যমে নতুন ধারার সূচনা হয়, মঞ্জু তাঁদের একজন।



ক্লান্তিহীন যোদ্ধা আবু ইউসুফ

টানা ২২ বছর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে দাপটের সাথে খেলাটা সহজ ব্যাপার নয়। তদুপরি অধিকাংশ সময়ই খেলেছেন দেশের শীর্ষ ও জনপ্রিয় দুটি ক্লাবে। এই ধারাবাহিক পারফরমেন্সের কারণে দেশের সেরা স্টপারে পরিণত হন ইউসুফ। একদা যিনি ঢাকা মাঠে বড় ইউসুফ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ছিল অফুরন্ত স্ট্যামিনা আর অসাধারণ ফাইটিং স্পিরিট। খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একইভাবে খেলে যেতে পারতেন। তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন এক অসাধারণ যোদ্ধা। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে বলীয়ান ও চমৎকার শারীরিক দক্ষতার অধিকারী এই ডিফেন্ডার টাফ ট্যাকলিং, দুর্দান্ত এরিয়াল টাসল ও প্রচ- শট নেয়ার জন্য প্রতিপক্ষের কাছে সমীহ আদায় করে নিতেন। প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডরা বলে মাথা ছোঁয়ানোর আগেই ডাইভ দিতেন কিংবা সতীর্থ খেলোয়াড়রা যখন পরাস্ত হতেন, তখন তিনি ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়দীপ্ত ও রক্ষণভাগের নির্ভরযোগ্য প্রহরী ইউসুফ বিপক্ষ দলের ফরোয়ার্ডদের নজরবন্দি করে রাখতেন। মাঝে মাঝে নিজেদের সীমানা থেকে বল নিয়ে ঝড়ের গতিতে প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ রচনা করে আবার ফিরে এসে নিজের দায়িত্ব পালন করতেন যথাযথভাবে।
মোহাম্মদ আবু ইউসুফের জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৯ জুন। ঢাকার বকশিবাজারের নবকুমার স্কুল সংলগ্ন আলিয়া মাদ্রাসার বড় মাঠে ফুটবলে হাতেখড়ি হয়। নবকুমার ইন্সটিটিউটের হয়ে আন্তঃস্কুল ফুটবল খেলে প্রতিভার বিকাশ ঘটান। ১৯৭২ সালে তাঁর খেলা দেখে পাড়ার বড় ভাই মাহুতটুলি স্পোর্টিংয়ের ফুটবলার খোরশেদ তাকে নিয়ে যান তৃতীয় বিভাগের দল স্টার অব বাংলাদেশ ক্লাবে। কিন্তু তারা তাঁকে পাত্তা দেয়নি। এরপর মাহুতটুলিতে নেয়া হলে তারাও দলে নিতে আপত্তি জানায়। দু’জায়গায় নিরাশ হওয়ার পর তাঁকে কোচ বজলুর রহমানের কামাল স্পোর্টিং ক্লাবে দেয়া হয়। কামাল স্পোর্টিংয়ের হয়ে তিনি অসমাপ্ত দ্বিতীয় বিভাগ লীগের কয়েকটি ম্যাচ খেলেন। তবে এই খেলার চেয়ে খেলোয়াড় গড়ার কারিগর কোচ বজলুর রহমানের সান্নিধ্য তাঁর জীবনকে পাল্টে দেয়। তিনি ইউসুফকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তোলেন। ১৯৭৩ সালে ফায়ার সার্ভিসের হয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর তিনি যোগ দেন রহমতগঞ্জে। খেলেন টানা ছয় বছর। ১৯৮০ সালে দল পরিবর্তন করে আসেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। তিনটি বছর মোহামেডানের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলেন। এর মধ্যে দু’বার ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। ১৯৮৩ সাল থেকে তাঁর ঠিকানা হয়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। আবাহনীর হয়ে একনাগাড়ে নয় বছর খেলেন। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আবাহনীতে খেলার পর মাঝের দু’বছর কাটিয়ে ১৯৯৪ সালে আবাহনী থেকে অবসর নেন। এ সময় আবাহনী ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে লীগে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও আবাহনী ১৯৮৯-৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আবাহনীর হয়ে তিনি ছয়বার শিরোপার স্বাদ পান। তিনি মোহামেডান ও আবাহনীর হয়ে আটবার লীগ শিরোপা জয়ী দলের খেলোয়াড় ছিলেন। এছাড়া ফেডারেশন কাপ ফুটবলে মোহামেডানের হয়ে তিনবার (১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮২) ও আবাহনীর হয়ে তিনবার (১৯৮৫, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮) চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলেছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন ও লীগে রানার্সআপ হয়। এছাড়াও মোহামেডান ও আবাহনীর দুটি সাফল্যের সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে আছেন। ১৯৮২ সালে ভারতের দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত আশীষ জব্বার স্মৃতি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের কোনো শিরোপাজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে ভারতের শক্তিশালী নাগজি ট্রফিতে তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়ে দারুণভাবে সাড়া জাগায়। ১৯৯১ সালে বিটিসি কাপ চ্যাম্পিয়ন আবাহনী দলের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে আবু ইউসুফের অভিষেক হয় ১৯৭৫ সালে। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২১তম মারদেকা ফুটবলে প্রথম খেলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমস, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, সিউলের নবম প্রেসিডেন্ট কাপ, কুয়েতের সপ্তম এশিয়ান কাপ, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, ১৯৮২ সালে করাচিতে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলে এবং ১৯৮৭ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ ব্লু দলের হয়ে খেলেন। ফর্মে থাকা সত্ত্বেও ১৯৮৩ সালে তাকে জাতীয় দলে নেয়া হয়নি। ১৯৭৯ সালে সিউলে নবম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ দলের সহকারী অধিনায়ক এবং ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলের অধিনায়ক ছিলেন। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার আবু ইউসুফ উচ্চতায় একটু খাটো হলেও একাগ্রতা, অধ্যবসায়, নিরলস সাধনা, ইচ্ছা, পরিশ্রম ও নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ফুটবল খেলেছেন। স্টপার বা উইং ব্যাক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি কখনো-সখনো লিঙ্কম্যান হিসেবেও খেলেছেন। আত্মপ্রত্যয়ী এই ফুটবলার অসংখ্য সেরা ম্যাচ উপহার দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে আসামের গৌহাটিতে বরদুলই ট্রফিতে কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে এবং ১৯৮৫ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবল এবং ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে তিনি প্রশংসনীয় ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। টাফ ট্যাকলিংয়ে অগ্রগণ্য ইউসুফ ফুটবলের বাইরে ক্রিকেটও খেলেছেন। প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগ খেলেছেন ন্যাশনাল স্পোর্টিংয়ের হয়ে।
ফুটবলে নিবেদিতপ্রাণ আবু ইউসুফ খেলোয়াড়ী জীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটবল কোচিংয়ে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৫ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে কোচ হিসেবে তাঁর নতুন জীবন শুরু হয়। ফেডারেশন ও ডামফা কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। ১৯৯৬ সালে তাঁর কোচিং-এ ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ারে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর কোচ ছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম আবাহনী, ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে ভিক্টোরিয়ার কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে তাঁর কোচিং-এ জাতীয় ফুটবল লীগে চমক দেখায় চট্টগ্রাম আবাহনী।
২০০২ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি আবু ইউসুফকে সেরা কোচ নির্বাচিত করে। ফিটনেস ধরে রেখে দীর্ঘদিন একটানা দাপটের সঙ্গে খেলে যে কোন ফুটবলারের জন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইউসুফ।

ফুটবলের নিপুণ শিল্পী চুন্নু

একটা সময় লাতিন ঘরানার শৈল্পিক ও চোখ জুড়ানো আনন্দময় ফুটবলের কদর ছিল সর্বত্র। চিত্তাকর্ষক ফুটবল উপহার দিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেয়াটাই ছিল এই ফুটবলের রীতি। আর এ থেকে বেরিয়ে আসতেন বল পায়ে ফুটবল শিল্পীরা। তারা পা’কে তুলি বানিয়ে ফুটবল মাঠে আঁকতেন নানা রঙের ছবি। তাতে মুগ্ধতায় ভরে যেতো দর্শক-হৃদয়। কিন্তু যেন-তেনভাবে সাফল্যের আশায় ইউরোপীয় প্রাণহীন রক্ষণাত্মক ফুটবলের প্রতি এখন সবাই কম-বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। সঙ্গত কারণে এখন আর শিল্পী ফুটবলারদের খুব একটা দেখা যায় না। চুন্নুর নামটি উচ্চারিত হলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন শিল্পী-ফুটবলারের প্রতিকৃতি। বলকে নিয়ে ইচ্ছেমত খেলতে পারতেন। পায়ের সূক্ষ্ম কাজ দিয়ে তিনি যেন মাঠে নকশী কাঁথা বুনে যেতেন। খুব অল্প জায়গায়, অল্প সময়ের মধ্যে ডজ ও ড্রিবলিং দিয়ে ধাঁধা লাগিয়ে যেভাবে জটলার মধ্য থেকে বেরিয়ে যেতেন, তাতে সবাই বোকা বনে যেতো। তিনি ছিলেন ড্রিবলিং মাস্টার। সাপের মতো এঁকেবেঁকে বিপক্ষ খেলোয়াড়দের ইন সাইড ও আউট সাইড ডজ দিয়ে অনায়াসেই প্রতিপক্ষের বিপদসীমার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারতেন। গোলের উৎস তৈরি এবং প্রয়োজনে গোল করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। কেননা, তাঁর পায়ে বল থাকার অর্থই হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে গোল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এ কারণে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের চিত্তে স্বস্তি থাকতো না। তিনি ছিলেন ফ্রি কিক এক্সপার্ট। তাঁর বাঁকানো নিপুণ স্ক্রু শট ছিল দেখার মতো। অ্যাটাকিং লেফট উইঙ্গার হিসেবে চুন্নু নিজেই নিজের তুলনা।
আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুর জন্ম নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট। এই পাইকপাড়ারই বাসিন্দা ফুটবলের আরেক কিংবদন্তি আলাউদ্দিন খান সেই শৈশব থেকে ছিলেন তাঁর আদর্শ। স্বপ্নের নায়ক আলাউদ্দিন খানের মতো তিনি লেফট আউট পজিশনের প্রতি আকৃষ্ট হন। স্কুলে পড়াকালীন তিনি ফুটবলে ঝুঁকে পড়েন। আর এ সময় পাড়ায় ফুটবল খেলার সময় তিনি আলাউদ্দিন খানের চোখে পড়েন। জহুরীর জহুর চিনতে একদমই সময় লাগেনি। তাঁর হাতেই গড়ে ওঠেন তিনি। তাঁর দীক্ষায় দীক্ষা নিয়ে চুন্নু পা বাড়ান ঢাকায়। ১৯৭৩ সালে দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এবং ১৯৭৪ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে ঢাকা মহানগরী প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর পথচলা। পরের বছর রহমতগঞ্জে খেলার পর ১৯৭৫ সাল থেকে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। এরপর চুন্নু ও আবাহনী একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠেন। আবাহনীর ১২ নম্বর জার্সী খুঁজে পায় আস্থা ও নির্ভরতা। আবাহনীর হয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর তাঁর ছন্দময় ও মনমাতানো ফুটবল দর্শকদের দারুণভাবে আনন্দ দিয়েছে। তাঁর ডজ, টেকনিক ও অনিন্দ্যসুন্দর ক্রীড়াশৈলী আবাহনীকে দিয়েছে নতুন রূপ। যতদিন তিনি ফুটবল খেলেছেন, ততোদিন তিনি প্রতিপক্ষের কাছে ছিলেন আতঙ্ক হয়ে। লেফট আউট পজিশন নিয়েও আবাহনীর কোনো রকম দুশ্চিন্তা ছিলো না। যেদিন চুন্নু খেলতে পারতেন না, সেদিন যেন আবাহনীর ছন্দ থেমে যেত। আবাহনীর সুখেও যেমন ছিলেন, তেমনি দুঃখেও। চুন্নুকে বাদ দিয়ে আবাহনীর ইতিহাস কখনোই সম্পন্ন হবে না। ১৯৭৫ সালে ক্লাবের দুর্যোগময় মুহূর্তে এবং বিভিন্ন সময় নানা প্রলোভনেও তিনি আবাহনীর সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করেননি। পাঁচবার লীগ ও চারবার ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দময় স্মৃতিও রয়েছে তাঁর। ১৯৭৯ সালে তিনি ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। অবশ্য ১৯৮০ সালেও টুটুলের অনুপস্থিতিতে তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আবাহনীর যে চারজন ফুটবলারের জীবনে নেমে এসেছিল দুঃসহ যন্ত্রণা, তিনি তাঁদের একজন। আবাহনী-মোহামেডান খেলায় গোলযোগের দায়ে সালাউদ্দিন, আনোয়ার ও হেলালের সঙ্গে তাকে সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। এক মাসের কারাদ- দেয়া হলেও ১৮ দিন জেলে থাকার পর মুক্তি পান। এটি তাঁর জীবনে একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে আছে।
স্পিড ও স্কিলের সমন¦য়ে চুন্নুর ফুটবল সৌকর্য চোখ ও মনের জন্য ছিল আনন্দের অফুরন্ত উৎস। ফুটবল সেন্স, ড্রিবলিং ও নিখুঁত শুটিং ছিল তাঁর প্রধান সম্পদ। সাইড লাইন দিয়ে যেভাবে বল নিয়ে আগে বাড়তেন, তাতে তাঁর সমর্থকদের বুকে বয়ে যেত আনন্দের হিল্লোল। বল পায়ে দুরন্ত গতিতে দৌড়াতে পারতেন, গোল করতেন এবং অন্যকে দিয়ে গোল করাতে সমান দক্ষ ছিলেন। ঢাকা লীগে এবং বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অসংখ্য গোল করেছেন এবং তাঁর পায়ের শিল্পীত ছোঁয়ায় কিংবা দুর্দান্ত পাস থেকে কত যে গোল হয়েছেÑ তার হিসাব নেই। তবে সতীর্থ খেলোয়াড়দের দিয়ে গোল করিয়েই তিনি আনন্দ পেতেন। তাঁর কাছ থেকে বল পেয়ে অসংখ্য গোল করেছেন সালাউদ্দিন। ঢাকার ফুটবলে আক্রমণভাগের সেরা জুটি ছিলেন সালাউদ্দিন-চুনুœ।
স্ট্রাইকার না হয়েও আন্তর্জাতিক ফুটবলে আসলামের আগে বাংলাদেশের পক্ষে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। ১৯৭৪ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে আসামের বরদুলই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রথম বিদেশ সফর করেন চুন্নু। ১৯৭৫ সালে তিনি সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে ভারত সফর করেন। তবে একই বছর তাঁর আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয়। কুয়েতে অনুষ্ঠিত ১৭তম এশিয়ান যুব ফুটবলে এবং মালয়েশিয়ায় ২১তম মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর যে পদচারণা শুরু হয়, তা অব্যাহত থাকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে ১৯৭৬ সালে ব্যাংককে কিংস কাপ, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় সপ্তম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, সিউলে প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৮০ সালে কুয়েতে সপ্তম এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে সবুজ দলে, ১৯৮২ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে লাল দলে, পাকিস্তানের করাচিতে কায়েদে আজম ফুটবল, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে লাল দলে, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবলে, ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, নেপালে প্রথম সাফ গেমসে, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আজম ফুটবলে এবং বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে কৃতিত্বের সঙ্গে খেলেছেন। অধিনায়ক মনোনয়ন নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত অষ্টম এশিয়ান গেমস ফুটবলে আবাহনীর যে সাতজন ফুটবলার নাম প্রত্যাহার করে নেন, তিনি তাদের একজন। এছাড়া তিনি জাতীয় ও ক্লাব দলের হয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দলের সঙ্গে খেলেছেন। ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম ফুটবল প্রতিযোগিতায় তিনি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। জাতীয় দলের হয়ে চুন্নুর গোলসংখ্যা ২১। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম হ্যাটট্রিকও তাঁর। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দল ঢাকায় এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে সরাসরি প্রথম জয়ের মুখ দেখে। আফগানিস্তানকে ৩-২ গোলে হারায় বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে একটি গোল দিয়ে তিনি গোলের সূচনা করেন। একই বছর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত নবম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে সুদানের সঙ্গে একটি, শ্রীলংকার সঙ্গে একটি, ১৯৮০ সালে কুয়েতে সপ্তম এশিয়ান কাপ ফুটবলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একটি, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে ইরাকের সঙ্গে একটি, ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবলে ওমানের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে নেপালের সঙ্গে তিনি হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন। একই বছর মালয়েশিয়ার ২৭তম মারদেকা ফুটবলে আর্জেন্টিনার সঙ্গে একটি, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি, ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমসে ভুটানের সঙ্গে একটি, মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি, নেপালের সঙ্গে দুটি, ১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে ভারতের সঙ্গে একটি, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে একটি এবং ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আজম ট্রফিতে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে একটি, পাকিস্তান সাদা ও পাকিস্তান সবুজের সঙ্গে একটি করে গোল করেন। বেশিরভাগ গোলই তিনি করেছেন বিদেশের মাটিতে। ১১ বছর জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করে প্রায় ২৫টি দেশের সঙ্গে ৫০-এর কাছাকাছি ম্যাচ খেলেছেন।
পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার চুন্নুর খেলা প্রতিটি ম্যাচই ছিল দেখার মতো। এর মাঝে ১৯৭৭ সালে আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবলে আবাহনীর হয়ে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ব্যাংক ক্লাবের সঙ্গে দু’গোলে পিছিয়ে থেকে যেভাবে সমতা নিয়ে আসেনÑ তা স্মরণীয় একটি স্মৃতি হয়ে আছে। চুন্নুর কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নেয়া যে কোনো ফুটবলারের কাছে ছিল একটা দুঃস্বপ্ন। ড্রিবলিং ও ডজিংয়ের মাধ্যমে যেভাবে বল নিয়ে খরগোশের মতো ছুটতেন, তাতে তিনি প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের টার্গেটে পরিণত হন। এ কারণে তাকে প্রায়শই ইনজুরির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। অতিমাত্রায় ডজ দেয়ার কারণে দর্শকরা তাকে ভালোবেসে ‘কারিগর’ নামে ডাকতেন। ফুটবলের এই শিল্পী ১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ১৬ বছরের বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় ফুটবল জীবনের ইতি টানেন। ওইদিন ফেডারেশন কাপ ফুটবলে মোহামেডানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। নৈপুণ্যভাস্বর শিল্পীত ফুটবল উপহার দেয়ায় চুন্নুকে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৮০ সালে ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ১৯৮৮ সালে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। ফুটবলে অবদান রাখায় ১৯৯৬ সালে তাকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালে রজতজয়ন্তি উপলক্ষে বংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সেরা একাদশ নির্বাচন করে আর তাতে অবশ্যম্ভাবীভাবেই ছিলেন চুন্নু।
ফুটবল খেলা থেকে অবসর নিলেও চুন্নু ফুটবলের বন্ধন কাটাতে পারেননি। ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ওতপ্রোতভাবে। ১৯৮৮-’৮৯ সাল থেকে কখনো আবাহনীর প্রশিক্ষক, কখনো ম্যানেজার, কখনো কো-অর্ডিনেটর, কখনো চীফ-অর্ডিনেটর, কখনো ফুটবল সম্পাদক, কখনো পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর প্রশিক্ষণে প্রথম বছরই আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৯০ সালে ভারতের নাগজি ট্রফিতে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। সে দলেরও ম্যানেজার ছিলেন চুন্নু। বর্তমানে তিনি ফুটবল কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন।
১৯৯৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যানেজার হিসেবে শ্রীলংকা ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন। ২০০৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপ এবং পাকিস্তানের করাচীতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে রানার্স-আপ বাংলাদেশ দলের দলনেতা ছিলেন। ফুটবলের সেই লাবণ্য ও সুষমা এখন তেমনভাবে দেখা না গেলেও ফুটবল শিল্পীদের জয়জয়কার চিরকালীন। আর তাই চুন্নুর পায়ের সুর ও ছন্দ চিরকাল হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাবে।







হাসি মুখের ফুটবলার রকিব

ঢাকার মাঠে যে ফুটবলারটি ফুটবল প্রজ্ঞা, মেধা ও শৈলীর পাশাপাশি তাঁর আচরণ, সম্মোহন ও আকর্ষণীয় ক্ষমতা দিয়ে সবার মন জয় করে নেন, তিনি হলেন রকিব। লাজুক লাজুক হাসির মুখাবয়বটি ছিল তাঁর ট্রেড মার্ক। ফুটবলের মতো রাফ অ্যান্ড টাফ গেমে হাসতে হাসতে কেউ বল নিয়ে প্রতিপক্ষের এলাকায় ছুটতে পারেনÑ রকিবের খেলা না দেখলে এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। এ কারণে রকিব সম্পর্কে কবি সানাউল হক খান লিখেছিলেন : ‘মুখে হাসি, পা’য়ে বল’। মুখে হাসির ঝরণাধারা থাকলেও ফুটবলার হিসেবে তিনি প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের কাছে হাসির পাত্র ছিলেন না। লেফ্ট ব্যাক হিসেবে তিনি স্বতন্ত্র ইমেজ সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর সফ্ট টাচ, অ্যাকুরেসি, দুরন্ত গতি, বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ পজিশন জ্ঞান ছিল দেখার মতো। স্টাইলিশ এই ফুটবলার নিজের ডিফেন্স জোনকে ঠিক রেখে ঝড়ের গতিতে আক্রমণে গতি সঞ্চার করতেন। তবে শেষ মুহূর্তে গোল লাইন থেকে অবিশ্বাস্যভাবে বল ক্লিয়ার করার ব্যাপারে তিনি নিজেই নিজের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।
রকিব নামে সুপরিচিত খন্দকার রকিবুল ইসলামের জন্ম যশোরে, ১ জানুয়ারি ১৯৫৬ সালে। যশোরের মুসলিম একাডেমিতে পড়াকালীন চতুর্থ কি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় ফুটবলে ঝুঁকে পড়েন। খুব অল্প বয়সেই ফুটবলার হিসেবে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসেন। যে কারণে ১৯৭৩ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে তাঁর অভিষেক হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। টানা পাঁচ বছর তিনি মোহামেডানের রক্ষণভাগ দায়িত্বের সঙ্গে আগলে রেখেছিলেন। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার রকিবকে ফাঁকি দিয়ে গোল করা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। লম্বা থ্রো, ডিস্ট্রিবিউশন সেন্স, দ্রুততগতিতে ওভারল্যাপিং ও সময়মত নিজের জায়গায় ফিরে আসতেন। তীক্ষè ফুটবল সেন্স ও দায়িত্বশীলতার কারণে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি ১৯৭৭ সালে মোহামেডানের অধিনায়ক হন। সদা হাস্যময় এই ফুটবলার ১৯৭৮ সালে যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। আবাহনীর হয়ে টানা তিনটি বছর তিনি নিজেকে নিংড়ে দেন। এ সময় আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও রকিবের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য সবাইকে মুগ্ধ করে। ১৯৮১ সালে তিনি বিজেএমসিতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে তিনি বিজেএমসির অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৮৩ সালে বিজেএমসি দ্বিতীয় বিভাগে নেমে গেলে ১৯৮৪ সালে তিনি রহমতগঞ্জে যোগ দেন।
১৯৭৫ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত সপ্তদশ এশিয়ান যুব ফুটবল দিয়ে রকিবের আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে ব্যাংককের কিংস কাপ, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, সিউলে নবম প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৮০ সালে কুয়েতে সপ্তম এশিয়ান কাপ এবং ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে সবুজ দলের হয়ে খেলেন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে অন্তর্ভুক্ত হলেও অধিনায়ক পরিবর্তন নিয়ে ঘটনায় আবাহনীর যে সাতজন ফুটবলার নাম প্রত্যাহার করে নেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। রকিব কুয়েতে সপ্তম এশিয়ান কাপ এবং ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের সহকারী অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে মোহামেডানের অধিনায়ক হিসেবে ভারতের অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে তিনি স্মরণীয় খেলা উপহার দেন। তাঁর প্রচেষ্টায় নিশ্চিত দুটি গোল রক্ষা পায়। ১৯৭৯ সালে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসে কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। আবাহনীর সঙ্গে খেলায় ১-১ গোলে ড্র চলছিল। মোহামেডানের একটি আচমকা আক্রমণ থেকে এগিয়ে থাকা খেলোয়াড় আকবর নিশ্চিত একটি গোলের শট নেন। সবাই তখন গোলের অপেক্ষায়। সে মুহূর্তে দ্রুতগামী বাজপাখীর মতো কোথা থেকে ছুটে এসে রকিব এমনভাবে রক্ষা করেন, তাতে সবাই অবাক হয়ে যায়। এক দশকের ফুটবল ক্যারিয়ারে তিনি এরকম বিস্ময় অনেকবার দেখিয়েছেন। যতদিন খেলেছেনÑ শিল্পিত ও আনন্দময় ফুটবল উপহার দিয়েছেন। খেলেছেন রাজকীয় মেজাজে। খেলতে খেলতে ফুটবলের প্রতি যখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, তখন অবলীলায় ফুটবলকে গুডবাই জানিয়েছেন।



অফুরন্ত দমের ফুটবলার বাবুল

খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে ফুটবলারটি সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন, তিনি হলেন বাবুল। অফুরন্ত দমের অধিকারী সুদর্শন এই ফুটবলার খেলার পুরোটা সময় অবিশ্বাস্যভাবে একনাগাড়ে দৌঁড়িয়ে খেলতে পারতেন। বলের জন্য অপেক্ষা না করে বলের পেছনে ছুটে গিয়ে বল কেড়ে নেয়ার ব্যাপারে একবিন্দু ছাড় দিতেন না। বল নিয়ে কোণাকুণিভাবে যখন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ছুটে যেতেন, তখন নিজ দলের পক্ষে গোল করার চমৎকার একটা সুযোগ সৃষ্টি হতো। সুযোগ বুঝে সতীর্থদের কাছে বল ডিস্ট্রিবিউশন, থ্রু, চিপ এবং প্রয়োজনে নিজেই প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে ঢুকে পড়ে গোল আদায় করে নিতেন।
কুশলী, বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিশ্রমী ফুটবলার মোঃ খুরশেদ আলম বাবুলের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১ মার্চ, টাঙ্গাইলে। পুরনো ঢাকার ইস্টবেঙ্গল ইন্সটিটিউটে পড়াকালীন পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় ফুটবলে হাতে-খড়ি হয় তাঁর। ১৯৭৩ সালে তৃতীয় বিভাগের দল ইউনিভার্সাল একাদশের হয়ে খেলার সময় সবার চোখে পড়েন। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল ঢাকা স্পোর্টিং-এ খেলার সময় কোচ আব্দুর রহিমের সন্ধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়েন তিনি। কোচ রহিম নিজস্ব ইনটিউশন থেকে তাঁকে নিখুঁতভাবে গড়ে তোলেন। তারপর থেকে তিনি এগিয়ে চলেন পরিণত খেলোয়াড়ের মত। দ্বিতীয় বিভাগ লীগ খেলতে নেমে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন। পরিণত একজন লিংকম্যান হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলেন। তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিবেদন দলকে সাফল্য এনে দেয়ার জন্য ছিল যথেষ্ট। পরের বছরই তিনি ভিক্টোরিয়ার অধিনায়ক হন। দ্রুতবেগী, কোণাকুণি দৌড়ের অধিকারী পরিশ্রমী বাবুলের স্বাভাবিকভাবে বড় দলের আমন্ত্রণ পেতে বেশি দেরি হয়নি। ১৯৭৭ সালেই তাঁর গন্তব্য হয় আবাহনী। আবাহনীতে যোগ দেয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন মধ্যমাঠের রাজা। শক্তিশালী রক্ষণভাগ আর অপ্রতিরোধ্য আক্রমণভাগের মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন তিনি। এর ফল পেতে দেরি হয়নি। ১৯৭৭ সালে আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে রয়েছে বাবুলের শ্রম, মেধা ও ক্রীড়াশৈলী। দুরন্ত গতিতে বলের পেছনে ছুটে, বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এবং আক্রমণে বল যোগান দিয়ে প্রতিপক্ষকে বিপর্যস্ত করার ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। হেডেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। ১৯৭৮ সালে হেডের সাহায্যে তিনি বেশ কয়েকটি গোল আদায় করে নেন। ১৯৮১ সালটি বাবুলের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ বছর তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। অধিনায়কত্ব ছাড়াও লিংকে আশীষকে নিয়ে যে জুটি গড়ে তোলেন, বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে এমনটি কমই দেখা গেছে। বুক ভরা অফুরন্ত দম নিয়ে মধ্য মাঠে তারা কাউকে দাঁড়াতে দেননি। বল দখল, জায়গা নিয়ন্ত্রণ, বল বিতরণ ও গোল করার ক্ষেত্রে পরবর্তী বছরগুলোতে এই জুটি প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমত ত্রাস হয়ে ওঠেন। দুর্ধর্ষ এই মধ্যমাঠের কারণে আবাহনী ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর আবাহনীর হয়ে খেলার পর তিনি যেন অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। যে কারণে আবাহনী অন্তপ্রাণ হয়েও ১৯৮৭ সালে তিনি পাড়ি জমান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। বাবুল যে ফুরিয়ে যাননি, মোহামেডানে যেয়ে সেটা তিনি আবারো প্রমাণ করেন। মোহামেডানের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আবাহনীতে পাঁচবার শিরোপার সান্নিধ্য পাবার পর মোহামেডানে যোগ দিয়ে উপর্যুপরি দু’বার শিরোপার দেখা পান। সাতবার চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড় হওয়াটাও একটি অসাধারণ ঘটনা। ৫ ফুট সাড়ে ৭ ইঞ্চি উচ্চতার বাবুল ১৯৯০ সালে ফুটবল খেলা থেকে অবসর নেন।
১৯৭৫ সালে সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লীগ খেলার অভিজ্ঞতা হওয়ার আগেই কুয়েতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান যুুব ফুটবলে লিংকম্যান হিসেবে খেলেন বাবুল। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তিনি বাংলাদেশের অপরিহার্য সদস্য। ১৯৭৬ সালে ব্যাংককের কিংস কাপ, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ ফুটবলের দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, একই বছর সিউলে নবম প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৮০ সালে কুয়েতে ৭ম এশিয়ান কাপ, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, ১৯৮২ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, একই বছর ভারতের দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ার ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, একই বছর নেপালে প্রথম সাফ গেমস, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আজম ফুটবল, একই বছর ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্রুপ তিনের কোয়ালিফাইং রাউন্ড হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল, একই বছর সিউলে দশম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ ব্লু দল এবং সর্বশেষ ভারতের কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে কৃতিত্বের সঙ্গে খেলেন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে এশিয়ান গেমসে অধিনায়ক মনোনয়ন নিয়ে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আবাহনীর যে সাতজন ফুটবলার নাম প্রত্যাহার করে নেনÑ তিনি তাদের একজন। ১৯৭৯ সালে ঢাকা সফরকারী দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচে বাংলাদেশ জাতীয় দল, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ১৯৮৬ সালে সিউলে দশম এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ ফুটবল দল, ১৯৮৭ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ ‘ব্লু’ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
আবাহনীর হয়ে ১৯৭৭ সালে ঢাকা লীগের প্রথম পর্যায়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ১৯৭৯ সালে সফরকারী কোলকাতা মোহামেডান, জাতীয় দলের হয়ে ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং ম্যাচ, সফরকারী দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে ইরাকের সঙ্গে দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। রজতজয়ন্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ১৯৯৭ সালে যে সেরা একাদশ গঠন করে, তাতে তিনিও ছিলেন। ১৯৯২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের নির্বাচক, ২০০০ সালে ব্রিটেন সফরে জাতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজার এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন।
খুরশেদ আলম বাবুল সেসব বিরল ফুটবলারদের একজন, যিনি ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। তাকে মনে হয়েছে দম দেয়া মানুষ। যার কোনো ক্লান্তি নেই। ফুটবল মাঠে নামলেই সারা মাঠজুড়ে খেলতেন। অনেক সময় পরিকল্পনাহীন ছোটাছুটি করলেও ম্যাচ টেম্পারামেন্ট ছিল সুন্দর। মাঠ বড় করে খেলতেন। বাবুলের মত ফুটবলাররা ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছেন।



দুরন্ত গতির বাবলু

লম্বা লম্বা পদক্ষেপে লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটতেন। খেলতেন সারা মাঠজুড়ে। তাঁকে আটকে রাখা প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের জন্য ছিল কঠিন ব্যাপার। যে কোনো রক্ষণভাগ বিদীর্ণ করে ঢুকে পড়তেন। কখনো চাতুর্যতার সঙ্গে, কখনো শর্ট স্প্রিন্ট দিয়ে, আবার কখনো ডামি দৌড়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের পরাস্ত করতেন। বল পায়ে ছিলেন বিপজ্জনক। রিসিভিং ও বল কন্ট্রোল ছিল চমৎকার। চলন্ত বলে দুর্দান্ত পাস দিতেন। স্কিমার কিংবা ফরোয়ার্ড যেটাই বলি না কেন, ছিপছিপে ও হালকা-পাতলা গড়নের বাবলু ছিলেন সত্তর দশকের অন্যতম সেরা ফুটবলার। হেডে দুর্বলতা থাকলেও কুশলী এই ফুটবলার বুদ্ধিমত্তা, চাতুর্যতা ও দুরন্ত গতি দিয়ে চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করে নিজের অবস্থান করে নেন।
এম. ডি. হাসানুজ্জামান খান বাবলু ১৯৫৫ সালের ৫ মে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি ফুটবল খেলায় সম্পৃক্ত হন। স্কুল জীবনে তিনি প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রাখেন। বাবার চাকরি সূত্রে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করায় কোথাও থিতু হতে পারছিলেন না। ১৯৭২ সালে ঢাকায় স্থায়ী হয়ে জড়িয়ে পড়েন ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে। আর ব্রাদার্স ইউনিয়ন মানেই তো গফুর বালুচের পাঠশালা। এ পাঠশালার নিয়মিত ছাত্র ছিলেন তিনি। ব্রাদার্স ইউনিয়নকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এক দল তরুণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে থাকেন। গোপীবাগের ওই ক্লাবের উত্থানে তাঁর রয়েছে বড় ভূমিকা। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ১৯৭২ সালে তৃতীয় বিভাগে এবং ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগে উঠে। আর এ ক্ষেত্রে রয়েছে কোচ গফুর বালুচের প্রশিক্ষণে গড়ে ওঠা এক দল মেধাবী কিশোর ও তরুণের আত্মবিশ্বাসী ক্রীড়াশৈলী। বিশেষ করে ফরোয়ার্ড লাইনে বাবলু ও মোহসীন জুটি কিংবদন্তি হয়ে আছেন। সেই শুরু থেকে ব্রাদার্সের হয়ে এই জুটি রেকর্ডসংখ্যক গোল করেছেন। তারুণ্যের ঝলক দিয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়ন প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে যে চমক সৃষ্টি করে, সে ক্ষেত্রেও রয়েছে বাবলু-মোহসীন জুটির দুর্দান্ত নৈপুণ্য। শীর্ষ ৩/৪টি দলের মধ্যে ব্রাদার্সের অবস্থান অক্ষুণœ রাখার ক্ষেত্রেও এই জুটির অবদান রয়েছে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮২ সালÑ টানা ৮ বছর ব্রাদার্সে খেলেন। ১৯৮৩ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং ১৯৮৪ সালে আবাহনী ক্রীড়াচক্রে খেলেন। ১৯৮৫ সালে পুনরায় ফিরে যান ব্রাদার্সে। ওই বছর কয়েকটি ম্যাচ খেলার পর তিনি অবসর নেন। তবে ব্রাদার্সেই তাঁর সেরা দিনগুলো কেটেছে। সে সময় অসাধারণ খেলেন। মূলত মিডফিল্ডার হলেও তাঁর পা থেকে এসেছে অসংখ্য গোল। ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে তিনি ছিলেন লীগের দ্বিতীয় সর্বাধিক গোলদাতা। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন এই মিডফিল্ডার ঢাকা লীগে ৭০/৭৫টি গোল করার বিরল গৌরব অর্জন করেন। গড়ে প্রতিবছর তিনি ৮/১০টি গোল করেছেন। তবে বাবলু ঢাকা লীগে শিরোপার উষ্ণতা পান ১৯৮৪ সালে আবাহনীর হয়ে খেলার সময়। ১৯৮১ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবলের শিরোপা জয় করে। যদিও ব্রাদার্স যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তদুপরি বাংলাদেশের কোনো ক্লাবের সেটাই ছিল বড় সাফল্য। আর এ শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টিশীল ও চোখ জুড়ানো নৈপুণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৭৭ সালের আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবলে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ১৯৮০ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে ব্রাদার্স ইউনিয়ন প্রথমবারের মতো ফেডারেশন কাপ ফুটবলে মোহামেডানের সঙ্গে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাবলুর অভিষেক হয় ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ২১তম মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে। এরপর ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এশিয়ান গেমস, ঢাকায় ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপে কোয়ালিফাইং রাউন্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে নবম প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৮০ সালে কুয়েতে সপ্তম এশিয়ান কাপ, ঢাকায় ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮১ সালে ব্যাংককে ২২তম এশিয়ান ফুটবলের ফাইনাল রাউন্ড, ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলে এবং ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কায়দে আজম স্মৃতি ফুটবলে খেলেন। ১৯৮০ সালে ঢাকায় ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড এবং ১৯৮১ সালে ব্যাংককে ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের ফাইনাল রাউন্ডে তিনি বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করেন। বাবলু জীবনে অসংখ্য স্মরণীয় ম্যাচ উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৭৫ সালে আগাখান গোল্ডকাপে থাইল্যান্ডের রাজবীথি দলের সঙ্গে চমৎকার খেলেন। তবে আবাহনীর বিপক্ষে যত ম্যাচ খেলেছেন, তার প্রায় প্রতিটিতে তিনি তৃপ্তি পেয়েছেন। খেলেছেন মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে। তবে ১৯৮২ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলে বোমায় আহত মহসিনের অনুপস্থিতিতে আবাহনীর সঙ্গে যে ম্যাচটি খেলেন, তা এক কথায় অনবদ্য। মোহসীনকে ছাড়া ব্রাদার্সের কোনো ম্যাচ চিন্তা করা যেতো না। মোহসীন-বাবলু জুটি ছিলেন ব্রাদার্সের প্রাণ। কিন্তু সেদিন বাবলু মোহসীনের অনুপস্থিতি একদমই অনুভব করতে দেননি। তীব্র প্রতিদ্বন্দি¡তাপূর্ণ ওই ম্যাচ গোলশূন্যভাবে ড্র হয়েছিল।
বাবলু ফুটবল ছাড়াও ভলিবল খেলেছেন। তিনি প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে ব্রাদার্স ইউনিয়নেরও অধিনায়ক ছিলেন। খেলোয়াড়ী জীবন শেষে ফুটবলেই জড়িয়ে পড়েন বাবলু। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে তিনি ব্রাদার্স ইউনিয়ন, ১৯৯৯ সালে মাস তিনেক আবাহনী লিমিটেড এবং ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ ছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় এজ গ্রুপ, ২০০০ সালে ইংল্যান্ডগামী বাংলাদেশ জাতীয় দল এবং হংকং-এ বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং গ্রুপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবলার বাবলু খেলোয়াড় হিসেবে নজর কেড়েছেন, তেমনি স্থান করে নিয়েছেন আমাদের ফুটবল ইতিহাসে।



অ্যাটাকিং রাইট ব্যাক টুটুল

সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এক দশকে যে ক’জন ফুটবলার গ্ল্যামার, সৌন্দর্য ও জনপ্রিয়তা দিয়ে সবার হৃদয়ে স্থান করে নেন, তাঁদের একজন টুটুল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি লাভ করেন আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা। ওভারল্যাপিং ও ছন্দায়িত খেলা দিয়ে সে সময়কার তারুণ্য ও যৌবনের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। দুরন্ত ঘোড়ার মতো তাঁর ছুটে চলার মধ্যে ছিল গতি, শক্তি ও প্রাণময় জীবনের সংমিশ্রণ। কখনো-সখনো ছিলেন দুর্দমনীয় ও দুর্বিনীত। অ্যাটাকিং রাইট ব্যাক হিসেবে বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, যথাযথ স্থানে বল বিতরণ, আদান-প্রদান, লম্বা থ্রু, ক্লোজ মার্কিং সেন্স, টেম্পারামেন্ট, গ্রাউন্ড টাসল, পজিশন জ্ঞানের কোনো কমতি ছিল না। তবে তাঁর স্টেপিং ছিল প্রতিপক্ষের জন্য ভীতিকর। ডিফেন্স জোনকে অটুট রেখে তিনি যেভাবে ঝড়ের গতিতে আক্রমণে উঠে যেতেন, তাতে চোখ জুড়িয়ে যেত। ডিফেন্ডার হয়েও প্রতিপক্ষের ডিফেন্স লাইন তছনছ করে দিতে পারতেন বলে তিনি হয়ে ওঠেন সময়ের প্রতিনিধি। তাঁর শৈল্পিক ফুটবলের সঙ্গে যোগ হয় তাঁর উজ্জ্বল-উচ্ছল জীবন। তরুণ প্রজন্মের কাছে ক্রেজে পরিণত হন টুটুল।
ঢাকার মানিকগঞ্জে ১৯৬০ সালের ১ মার্চ জন্ম নেয়া দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুলের ফুটবলে উত্থানটা চমকপ্রদ। শুরুতে ফুটবল খেলতেন পাড়া-মহল্লায়। ফুটবলার হিসেবে ডিমান্ড থাকায় বিভিন্ন স্থানে হায়ারে খেলতে যেতেন। ১৯৭৪ সালে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় এক ম্যাচে টুটুল রক্ষণভাগে খেলছিলেন। খেলার রেফারি ছিলেন সে সময়কার আবাহনীর লিংকম্যান আলী ইমাম। রেফারিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে এক কিশোর তাঁর দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কিশোরটি কখনো সাইড লাইন দিয়ে, কখনো মধ্য মাঠ দিয়ে ৩/৪ জনকে অনায়াসে কাটিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়ছিলেন। তাঁর স্টেপিং, ডজ, বল কিক করা ও ছুটে চলার মধ্যে পরিপক্বতার ছাপ লক্ষ্য করেন। খেলা শেষে ওই তরুণকে তিনি আবাহনী মাঠে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সে সময় আবাহনী প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলার জন্য কুমিল্লা যায়। কিন্তু দলের নির্ভরযোগ্য রাইটব্যাক শামসুল আলম মঞ্জুর কোনো খোঁজ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায় মঞ্জু মোহামেডানে যোগ দিয়েছেন। তার পরের কাহিনী টুটুলের এগিয়ে যাবার। টুটুল চমৎকারভাবে মঞ্জুর জায়গাই শুধু পূর্ণ করলেন না, তিনি হয়ে উঠলেন আবাহনীর গতিময় ও গ্ল্যামারাস ফুটবলের প্রতিভূ। প্রাথমিক পর্যায়ে সুইপার ব্যাক হিসেবে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করলেও আবাহনীর রাইট ব্যাক হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আবাহনীর হয়ে দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি আবাহনীর সহ-অধিনায়ক এবং ১৯৮০ সালে অধিনায়ক হন। কিন্ত অধিনায়ক হলেও ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনটা কোথায় যেন কেটে যায়। এ কারণে ওই বছর তাকে আবাহনীর অনুশীলনে যেমন দেখা যায়নি এবং খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়ে ওঠেনি। যে কারণে অধিনায়কের দায়িত্ব বর্তায় আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুর কাঁধে। রাগী, সেন্টিমেন্টাল টুটুল প্রিয় ক্লাব ছেড়ে ১৯৮১ সালে পাড়ি জমান ব্রাদার্স ইউনিয়নে। যদিও অন্যান্য ক্লাব তাঁকে দলভুক্ত করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে; কিন্ত তিনি বেছে নেন ব্রাদার্সকে। ১৯৮২ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে ব্রাদার্স চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট অবদান রাখেন। দু’মৌসুম ব্রাদার্সে কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন আপন ঠিকানায়। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সাল ছিল আবাহনীর ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আকাশী-নীল রঙের এই ক্লাবটি হ্যাটট্রিক করার নতুন মাইলফলক অর্জন করে। ১৯৮৪ সালে আবাহনীর নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৮৭ সালে তিনি রহমতগঞ্জে যোগ দিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি পুনরায় আবাহনীতে ফিরে আসেন। ১৯৮৯-৯০ ও ১৯৯১ সালে আবাহনীর হয়ে শিরোপার স্বাদও তিনি পেয়েছেন। যদিও শেষ দিকে তিনি দলে নিয়মিত ছিলেন না। বরং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের ৭ জুন মোহামেডানের সঙ্গে আবাহনীর লীগের শেষ খেলায় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল থেকে অবসর নেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলেও টুটুল নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৭৬ সালে ব্যাংককের কিংস কাপ দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে তেহরানে ১৯তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৭৮ সালে ঢাকায় ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, সিউলে নবম প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দল, ১৯৮২ সালে করাচির কায়দে আজম ফুটবল ও ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে অংশ নেন। এছাড়া অধিনায়ক নিয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আবাহনীর যে সাতজন ফুটবলার ১৯৭৮ সালের ব্যাংকক এশিয়ান গেমস থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন।
পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চি উচ্চতার টুটুল নিজ ডিফেন্স থেকে বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় অনেক দুর্লভ গোল করেছেন। ১৯৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে তাঁর গোলে সবুজ দল ১-০ গোলে উত্তর কোরিয়াকে হারায়। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় এশিয়ান যুব ফুটবলে তিনি দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। তবে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে আবাহনীর হয়ে থাইল্যান্ডের রাজবীথি দলের সঙ্গে তিনি জীবনের সেরা খেলা উপহার দেন। তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে আবাহনী প্রথমার্ধে ৩ গোলে এগিয়ে যায়। পরে অবশ্য রাজবীথি ৩ গোল দিলে খেলা ৩-৩ গোলে অমীমাংসিত থাকে। প্লে-অফ ম্যাচে আবাহনী ২-০ গোলে জয়ী হয়। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ ৩-২ গোলে জয়ী হয়। এটি আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের সরাসরি প্রথম জয়। টুটুলের অসাধারণ পাস থেকে জয়সূচক গোলটি করেন সালাউদ্দিন। বাংলাদেশ চূড়ান্ত পর্বে উঠলেও ওই দলে খেলার সুযোগ হয়নি এই আলোচিত ফুটবলারের। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এরকম অনেকবারই জাতীয় দলে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ হয়নি। ১৯৮৪ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ডিসিএম ট্রফিতে আবাহনীর হয়ে তাঁর দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা সবার প্রশংসা অর্জন করে।
বাংলাদেশের ফুটবলে যাঁদের পায়ে পায়ে গ্ল্যামার এসেছে, তাঁদের অন্যতম হলেন টুটুল। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হয়েও চমকপ্রদ নৈপুণ্য দেখিয়ে মাঠ মাতিয়েছেন, স্মরণীয় হয়ে আছেন।




প্রচণ্ড শুটিং পাওয়ার ছিল মোহসিনের

ঘটনাচক্রে ফুটবল খেলতে এসে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভাবনীয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সবার মন জয় করে নেন মোঃ মোহসিন। কিন্তু দুঃখজনক একটি ঘটনায় দীর্ঘদিন টপ ফর্মে থাকতে পারেননি। দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আক্রমণভাগের কুশলী এই ফুটবলার তাঁর চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী দিয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। খেলেছেন কখনো স্ট্রাইকার, আবার কখনো লিংকম্যান হিসেবে। দু’পজিশনেই ছিলেন তিনি সফল। চমৎকার শারীরিক কাঠামোর অধিকারী মোহসিন গোল করার ক্ষেত্রে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর পায়ে ছিল প্রচ- শুটিং পাওয়ার। ডি-বক্সের বাইরে থেকে গোলার মত শটে গোল করতেন।
১৯৬১ সালের ৩ এপ্রিল রাজশাহীতে মোঃ মোহসিনের জন্ম। বসবাস করতেন ঢাকায়। ছোটবেলায় ফুটবল খেলার প্রতি খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। বরং অ্যাথলেটিক্সের প্রতি ছিল তাঁর ঝোঁক। মিরপুরে থাকলেও পড়তেন পুরান ঢাকার পগোজ স্কুলে। নবম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায় গোপীবাগের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তাদের সংস্পর্শে এসে ফুটবলে আকৃষ্ট হন। বাসায় না জানিয়ে প্রতিদিন স্কুল শেষে সোজা চলে যেতেন গোপীবাগ মাঠে। গোপীবাগ মাঠে তখন কুঁড়ি হয়ে উঁকি মারছে ব্রাদার্স ইউনিয়ন। আর তার পরিচর্যায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের এককালের খ্যাতিমান ফুটবলার গফুর বালুচ। পাকা জহুরী গফুর বালুচ জহর চিনতে ভুল করেননি। পাড়ার ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়নকে গড়ে তোলার জন্য গফুর বালুচের নেতৃত্বে একদল সম্ভাবনাময় ও পরিশ্রমী তরুণ যখন জীবনপাত করে চলেছেন, তখন তাতে শামিল হন মোহসিন। শুরু থেকেই মোহসিন-বাবলু জুটি ব্রাদার্সের জন্য হয়ে ওঠেন সোনায় সোহাগা। ব্রাদার্সের একের পর এক মাইলফলক অতিক্রম করার ক্ষেত্রে এই জুটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মোহসিন ১৯৭৩ সালে তৃতীয় বিভাগ লীগে হ্যাটট্রিক ও ডাবল হ্যাটট্রিকসহ ৩৯টি গোল করেন। পরের বছর দ্বিতীয় বিভাগে গোল করেন ২২টি। গোল করাটা তাঁর কাছে হয়ে ওঠে নেশার মতো। ১৯৭৫ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন প্রথম বিভাগে ওঠার পর ৫ ফুট সাড়ে ৭ ইঞ্চি উচ্চতার মোহসিনেরও অর্ভিষেক হয়। দলের মূল স্ট্রাইকার হিসেবে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেন। ব্রাদার্সকে লীগের শীর্ষ ৩/৪টি দলের মধ্যে রাখার ব্যাপারে তাঁর করা গোলগুলোর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ব্রাদার্স লীগ চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে মোহসিন নিজেকে উদ্ভাসিত করেন। ১৯৮১ সালটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর। সে বছর লীগে ডাবল হ্যাটট্রিকসহ ২০টি গোল দিয়ে সর্বাধিক গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ফর্মের তুঙ্গে থাকায় তাঁকে নিয়ে সর্বত্র কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। খুলনা লীগে খেলতে যেয়ে ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পটকার আঘাতে মারাÍকভাবে আহত হন। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হলেও তাঁর জীবন থেকে সেই উজ্জ্বলতা অনেকটা হারিয়ে যায়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ফুটবল খেললেও আগের মতো সেই ঝিলিক আর পায়ে দেখা যায়নি। অথচ দুর্ঘটনার শিকার না হলে তিনি ফুটবলকে আরো বেশি আলোকিত করতে পারতেন।
ঘরোয়া ফুটবলের পারফরম্যান্স দিয়ে খুব সহজেই জাতীয় দলে স্থান করে নেন। ১৯৭৬ সালে ব্যাংককের কিংস কাপ, ১৯৭৭ সালে তেহরানে ১৯তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে নবম প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৮০ সালে কুয়েতে এশিয়ান কাপ এবং ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাড়াজাগানো ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবলের দ্বিতীয় বাছাইয়ে ৪১ জনের মধ্যে তাঁর নাম ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দলের অধিনায়ক হন তিনি। এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের খেলা সবার মন কেড়ে নেয়। হাসানের গোলে বাংলাদেশ ইয়েমেনের সঙ্গে জয়ী হয়। বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের কোনো দলের সরাসরি এটি প্রথম জয়। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে মোহসিনের পা থেকে আসে একটি গোল। বাহরাইনের সঙ্গে তিনি পেনাল্টি থেকে গোল করে খেলায় সমতা আনেন। অধিনায়ক হিসেবে জাতীয় যুব দলের হয়ে সাফল্য দেখানোর পর তাঁকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং ম্যাচে জাতীয় দলের অধিনায়ক করা হয়। কাতারের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে তিনি একটি গোল করেন। জাতীয় যুব দল এবং জাতীয় দলের পাশাপাশি ১৯৭৯ সালে তিনি ব্রাদার্স ইউনিয়নের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭৯ সালে কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে শ্রীলংকার সঙ্গে স্মরণীয় ম্যাচটি খেলেছেন। ওই ম্যাচে বাংলাদেশ ৩-১ গোলে জয়ী হয়।
খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় ১৯৮৪ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ওয়ারী ও সেনাবাহিনী দলের কোচ ছিলেন। ১৯৯২ সালে ভারতের কেরালায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ যুব দলের কোচ ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে মোহসিন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা ফুটবলার হন।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা সম্ভাবনাময় এই তারকার পূর্ণাঙ্গ স্ফুরণ হয়নি অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায়। তথাপি প্রতিভার ঝলকে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসে।



গোল বুভুক্ষু আসলাম

ঢাকার মাঠে এতো গোলক্ষুধা আর কোনো স্ট্রাইকারের ছিল না। মাঠে নামার পরমুহূর্ত থেকেই গোল করার জন্য শিকারী বাঘের মত হণ্যে হয়ে উঠতেন। নানা কৌশলে আদায় করে নিতেন গোল। কতভাবেই যে গোল করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর চেয়ে বেশি গোল আর কেউ করতে পারেননি। একজন স্ট্রাইকারের যদি গোল করাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রে দেশসেরা হলেন আসলাম। সুঠাম দেহের এ ফুটবলারের পায়ের শটেও ছিল যথেষ্ট পাওয়ার। মাথার কাজ ছিল চমৎকার। তীব্র ও তীক্ষè হেড ওয়ার্ক। হাওয়ায় ভেসে আসা বলে মাথা ছুঁইয়ে গোল করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। ব্যাকভলি নিতে পারতেন দুর্দান্ত। বড় গুণ, ঠিক সময়ে ঠিক স্থানে পজিশন নিতে পারতেন। হঠাৎ হঠাৎ ফল্স দৌড় দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘাবড়ে দিতেন। দূর থেকে প্রতিপক্ষের জালে আচমকা শটেও গোল করেছেন। সহজাত স্ট্রাইকার না হলেও ছিলেন ওয়ার্কিং স্ট্রাইকার। অসম্ভব একাগ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা ও কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আসলাম।
খুলনার ছেলে শেখ মোহাম্মদ আসলামের জন্ম ১ মার্চ ১৯৫৮। সেই শৈশবেই তিনি খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হন। শুরুতে অ্যাথলেটিক্সের প্রতি ছিল তাঁর যাবতীয় আকর্ষণ। ১০০ মিটার দৌড়, লং জাম্প, জ্যাভলিন থ্রো ছিল তাঁর ইভেন্ট। ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা এসেছিলেন বিজেএমসি অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিতে। অ্যাথলেটিক্সের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন ফুটবলে। ১৯৭৪ সালে খুলনা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে টাউন ক্লাবের হয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর খেলেন ওয়াপদায়। এ বছর তাঁর চমকপ্রদ পারফরম্যান্সে রানার্সআপ হয়ে ওয়াপদা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে উন্নীত হয়। ১৯৭৬ সালে ওয়াপদায় খেলার সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৭ সালে তাঁকে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে দলভুক্ত করা হয়। কোচ আব্দুর রহিম আসলামের অ্যাথলেটিক ফিগার, গতি ও ক্ষিপ্রতার মাঝে সম্ভাবনা খুঁজে পান। শুরুতে তিনি খেলতেন রক্ষণভাগে। উচ্চতা, সুঠাম দেহ, দুর্দান্ত হেডওয়ার্ক, প্রচ- শুটিং পাওয়ার ও ক্ষিপ্রতা দেখে তাঁকে আক্রমণভাগে নিয়ে আসেন কোচ। বদলে যান আসলাম। তাঁকে গোলের নেশায় পেয়ে বসে। এর সঙ্গে যোগ হয় তাঁর গতি, ফুটবল সেন্স, টেম্পারামেন্ট, ধীশক্তি ও পরিশ্রম। তবে বল ধরে সুযোগ তৈরি করে গোল করার চেয়ে গোলের সুযোগ সন্ধানে শিকারীর মত ওঁৎ পেতে থাকতেন। অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দল ভিক্টোরিয়ায় তেমন সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। তিন বছর ভিক্টোরিয়ায় খেলার পর ১৯৮০ সালে যোগ দেন বিজেএমসিতে। এরপর আস্তে-ধীরে নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন। শুরুতে বল প্লে, ডজিং, রিসিভিং, স্পটকিক, পেনাল্টি কিক আশানুরূপ ছিল না। নিষ্ঠা, একাগ্রতা, অধ্যবসায়, শারীরিক দক্ষতা ও ফিটনেস দিয়ে তিনি তাঁর সব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠেন। সে সঙ্গে অল্প দূরত্বে ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ানো, দু’পায়ে প্রচ- শট, চমকপ্রদ হেডিং, অ্যাটাকের সময় পজিশন সেন্স, দূরপাল্লার শট, যে কোনো অবস্থান থেকে গোলে আঘাত, গোলমুখে উড়ে আসা লবগুলোকে নিপুণ হেডের সাহায্যে গোল, ফ্রি কিক, ক্রস পাস, থ্রু পাস থেকে প্রচ- শটে গোল, উইং থেকে দেয়া ক্রস পাসে ট্যাপ করে গোল, প্লেসিংয়ের সাহায্যে গোল, চলন্ত বল থেকে গোলসহ একজন স্ট্রাইকারের সব গুণ তাঁর আয়ত্তে এসে যায়। প্রথম বছর বিজেএমসির হয়ে ১৩ গোল দিয়ে উঠে আসেন লাইমলাইটে। আর দুটি গোল দিতে পারলে সর্বোচ্চ গোলদাতার ভাগীদার হতে পারতেন। ১৯৮১ সালে তিনি বিজেএমসির অধিনায়ক ছিলেন। তিনবছর বিজেএমসিতে খেলে ১৯৮৩ সালে মোহামেডানে যোগ দেন। মোহামেডানে খেলার সময় আহত হয়ে লীগের অনেকগুলো ম্যাচ খেলতে পারেননি। ১৯৮৪ সালে আবাহনী ক্রীড়াচক্রে যোগ দেয়ার পর আসলাম যেন পরিপূর্ণভাবে নিজেকে মেলে ধরেন। এরপর থেকে যাবতীয় রেকর্ড যেন আসলামের পায়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। ১৯৮৪ সালে ১৭টি, ১৯৮৫ সালে ১৮টি, ১৯৮৬ সালে ২০টি ও ১৯৮৭ সালে ১৪টি গোল দিয়ে টানা চার বছর লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে নতুন মাইলফলক গড়েন। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের নকিব এই মাইলফলক স্পর্শ করতে সক্ষম হন। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ১১ গোল দিয়ে পাঁচবার সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার নতুন রেকর্ড করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮-৮৯ মৌসুম পর্যন্ত টানা পাঁচ মৌসুমের প্রতিটি লীগে হ্যাটট্রিক করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১৯৯১-৯২ মৌসুম পর্যন্ত টানা সাত মৌসুম আবাহনীর হয়ে ১০৩টি গোল করেন। শতাধিক গোল করার এই নজির প্রথম স্থাপন করেন আবাহনীর সালাউদ্দিন। ভিক্টোরিয়ার হয়ে ১৪টি, বিজেএমসির হয়ে ৩০টি ও মোহামেডানের হয়ে ৭টি গোল করায় ঢাকা লীগে গোলসংখ্যা দাঁড়ায় ১৫৪টি। আবাহনীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৯৩ সালে তিনি মোহামেডানে যোগ দিয়ে ৭টি গোল করেন। ১৯৯৪ সালে পুনরায় আবাহনীতে ফিরে এসে আরো ১৬টি গোল করে ১৯৯৬ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেন। প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ১৭৭টি গোল দিয়ে যে রেকর্ড গড়েছেন, তা অদূর ভবিষ্যতে কারো পক্ষে অতিক্রম করা কঠিন হয়ে পড়বে। আসলাম পাঁচবার লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও ১৯৮০ সাল থেকে অধিকাংশ সময় ছিলেন নিজ দলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টানা সাত মৌসুম দেশীয় ফুটবলারদের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। খুরশেদ আলম বাবুলের পর তিনি সাতবার লীগ শিরোপা জয়ী দলের খেলোয়াড় ছিলেন। এছাড়া ছিলেন চারবার ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে তিনি ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। ঢাকা লীগে ২০ বছরে ১৮টি লীগ খেলাও একটি বিরল ঘটনা। শৃ´খলা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সর্বোপরি পরিশ্রমের মাধ্যমে সবচেয়ে সফল ও সেরা স্ট্রাইকারে পরিণত হন আসলাম। তৈরি সুযোগ ও হাফ চান্সগুলো কাজে লাগিয়ে গোল করা, দুরূহ সব পজিশন ও অ্যাঙ্গেল থেকে অবিশ্বাস্য গোল, উঁচুতে বল চ্যালেঞ্জে তাঁর সঙ্গে ডিফেন্ডারদের পেরে না ওঠা, সাইড ভলি, ব্যাকভলি, বাইসাইকেল কিক, প্লেসিং শট, লং ও ক্লোজ রেঞ্জে তীব্র শটে গোল করা কিংবা প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে কাঁপিয়ে দিয়ে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেন।
ঘরোয়া আসরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দাপটের সঙ্গে খেলেছেন আসলাম। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ যাবতকালের সেরা ফুটবল আসর ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর অভিষেক হয়। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি। একই বছর ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে তিনি অংশ নেন। ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত নবম প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে জাতীয় দলের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে শ্রীলংকার সঙ্গে খেলেন। ০-১ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় বাঁ-পায়ের শটে সমতাসূচক গোল করেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ও বিদেশের মাটিতে এটি তাঁর প্রথম গোল। এ খেলায় বাংলাদেশ ৩-১ গোলে জয়ী হয়। ১৯৮০ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়ান কাপ ফুটবলে এবং ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের বাছাই পর্বে অংশ নেন। বাছাই পর্বে সেন্টার লাইন থেকে প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক এলাকা হতে প্রায় প্রতিটি ম্যাচে গোল করার মতো সুযোগ সৃষ্টি করেন। কড়া মার্কিং সত্ত্বেও বিপক্ষের রক্ষণব্যুহ ভেদ এবং ফল্স দৌড় দিয়ে বিপক্ষ দলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান। ১৯৮১ সালে ব্যাংককে ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের সহকারী অধিনায়ক, ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল এবং ১৯৮২ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নবম এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে দুর্দান্ত খেলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি এবং নেপালের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২৭তম মারদেকা ফুটবল প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার সঙ্গে একটি, ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপে স্বাগতিক দলের সঙ্গে একটি, ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৮৪ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত প্রথম সাফ গেমসে ভুটানের সঙ্গে একটি ও মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি গোল করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি ও ফাইনালে ভারতের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে অংশ নেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে সুইজারল্যান্ডের ভেভে স্পোর্টসের সঙ্গে একটি এবং ফিনল্যান্ডের তুরিনা পলিসেরার সঙ্গে হ্যাটট্রিক করেন। একই বছর সিউলে অনুষ্ঠিত দশম এশিয়ান গেমসে একমাত্র গোলটি আসে তাঁর পা থেকে। এই গোলে বাংলাদেশ নেপালকে হারায়। ১৯৮৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ ‘ব্লু’ দল এবং ১৯৮৯ সালে ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে অংশ নেন। লাল দলের হয়ে থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি এবং ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি গোল করেন। আসলামের হেডে এগিয়ে গেলেও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ গোলে ড্র থাকে। টাইব্রেকারে বাংলাদেশ লাল দল ৪-৩ গোলে জয়ী হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। টাইব্রেকারেও আসলামের একটি গোল রয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে তিনি ইরানের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৯০ সালে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়ে টানা চারটি এশিয়ান গেমসে অংশ নেয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোয় অনুষ্ঠিত পঞ্চম সাফ গেমসে নেপালের সঙ্গে তিনি একটি গোল করেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত অষ্টম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় দল, বাংলাদেশ লাল দল, বাফুফে একাদশের হয়ে আসলাম ২৮টি আন্তর্জাতিক গোল করেন। জাতীয় দলের পক্ষে এটি ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড।
আবাহনীর হয়েও আসলাম আন্তর্জাতিক ফুটবলে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৮৪ সালে নয়াদিল্লির ডিসিএম ট্রফিতে ভারতের শক্তিশালী দল গুর্খা ব্রিগেডকে ৪-১ গোলে হারায় আবাহনী। দুর্দান্ত খেলেন আসলাম। একাই করেন তিনটি গোল। ১৯৮৫ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশীপে আসলামের হ্যাটট্রিকে আবাহনী ৮-১ গোলে মালদ্বীপকে হারায়। এই চ্যাম্পিয়নশীপে আবাহনীর হয়ে ৯ গোল দিয়ে শ্রীলংকার স্যান্ডার্স ক্লাবের প্রেমলালের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। ১৯৯০ সালে ভারতের নাগজি ট্রফিতে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। নাগজি ট্রফির সাড়ে তিন দশকের ইতিহাসে আবাহনীই প্রথম বিদেশি দল হিসেবে এই টুর্নামেন্টে শিরোপা লাভ করে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন আসলাম। প্রথম ম্যাচে কেরালার ক্লাব চ্যাম্পিয়ন ত্রিভান্দ্রামের টাইটোনিয়ামের সঙ্গে আবাহনী ১-০ গোলে জয়ী হয়। খেলার ৮০ মিনিটে রঞ্জিতের দেয়া বল বুক দিয়ে থামিয়ে তীব্র ভলির সাহায্যে গোলরক্ষককে পরাভূত করেন আসলাম। ডাবল লীগের সেমিফাইনালে গোয়ার চ্যাম্পিয়ন এমআরএফ-এর সঙ্গে খেলার ৩২ মিনিটে প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে কাজী কামালের একটি ফ্রি কিক অপূর্ব কৌশলে আসলাম ত্বরিৎ গতিতে মাথা ছোঁয়ালে বল গোলরক্ষকের হাতে যায়। বলের এত স্পিড ছিল যে, গোলরক্ষকের হাত ফসকে বল জালে জড়ালে আবাহনী জয়ী হয়। এমআরএফ-এর সঙ্গে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় ম্যাচে আসলামের অবিশ্বাস্য একটি মাইনাস থেকে ছোট মুন্না গোল করলে আবাহনী ফাইনালে ওঠে। ফাইনালে ভারতের ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী সালগাওকরের সঙ্গে লিংকম্যান রুপুর একটি মাইনাস থেকে বল পেয়ে আসলাম দু’দুজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বাঁ পায়ের তীব্র শটে দেখার মতো একটি গোল করলে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। ৪ ম্যাচে ৩ গোল দিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন তিনি। ১৯৯১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কোলকাতার শীর্ষ ৩টি ও বাংলাদেশের শীর্ষ ৩টি ক্লাব নিয়ে আয়োজিত বিটিসি ক্লাব কাপে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রেও আসলামের কৃতিত্ব রয়েছে। কোলকাতা মোহামেডান এবং ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে তিনি একটি করে গোল করেন।
পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার আসলাম ফুটবল ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে তিন শতাধিক গোল করেছেন। এর মধ্যে অসংখ্য গোল স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতের সঙ্গে ফাইনাল খেলায় প্রায় ৩৫/৪০ গজ দূর থেকে প্রচ- বাঁক খাওয়ানো শটে গোলরক্ষক অতনু ভট্টাচার্যকে বোকা বানিয়ে যেভাবে বল জালে জড়ান, তাতে উল্লসিত হয়ে ওঠেন ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ৫০/৬০ হাজার দর্শক। এক গোলে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ আসলামের গোলে সমতা আনে। অবশ্য টাইব্রেকারে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের বাছাই পর্বে সেরা ফুটবলার হন। ১৯৮৬ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলের সেমি-ফাইনালে মোহামেডানের সঙ্গে খেলায় আবাহনী ৩-৪ গোলে পিছিয়ে। এ সময় বাবুল বাঁ প্রান্ত থেকে একটি নিখুঁত থ্রো দেন আসলামকে। আসলাম মোহামেডানের ২/৩ জনকে কাটিয়ে ডান পায়ের শটে চমকপ্রদভাবে সেকেন্ডবার ঘেঁষে বল জালে জড়ালে খেলায় সমতা আসে। এ খেলায় শ্রীলংকার প্রেমলাল হ্যাটট্রিক করেন এবং আবাহনী টাইব্রেকারে ৮-৫ গোলে জয়ী হয়। আসলাম ১৯৯১ সালে কোলকাতা লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছেন। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৮৪ সালে এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ১৯৯৮ সালে তাকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। ২০০০ সালে আসলামকে দেয়া হয় জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে রজতজয়ন্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের যে সেরা একাদশ নির্বাচন করে এবং ২০০৫ সালে যে ১০ জন ফুটবলারকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সম্মানিত করেÑ তিনি তাঁদের একজন।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্ট্রাইকার হিসেবে আসলামের কিছুটা ঘাটতি ছিল। অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হয়ে ওঠেন। আত্মনিবেদন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি ফুটবলে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

বুদ্ধিদীপ্ত ফরোয়ার্ড বাদল

১৯৮২ সালে ভারতের দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত আশীষ-জব্বার স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। এটি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের কোনো দলের প্রথম শিরোপা জয়। মোহামেডানের কৃতিত্বপূর্ণ এই সাফল্যে নেতৃত্ব দেন বাদল রায়। ছোট বাদল হিসেবেই তিনি ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত সুপরিচিত। তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত ফরোয়ার্ড। নিজে গোল করার চেয়ে সতীর্থদের দিয়েই গোল করাতে পছন্দ করতেন। ফুটবল সেন্স যেমন ছিল, তেমনি ছিল স্কিল। বল নিয়ে অহেতুক ছোটাছুটি না করে গোলের উৎস তৈরি করে সতীর্থ খেলোয়াড়কে পাস দিয়ে দিতেন। আর তা থেকেই অবধারিত গোল। গোল করার অ্যাবিলিটিও ছিল। প্রয়োজনে নিজেও গোল করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেপথ্য নায়ক হয়েই থেকেছেন।
১৯৫৭ সালের ৪ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দিতে বাদল কুমার রায়ের জন্ম। দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ স্কুলে ফুটবলে হাতে-খড়ি হয়। বাড়ির পাশের মাঠেও নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। ১৯৭২ সালে মেট্রিক পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হবার পর ফুটবলে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে সিএন্ডবি’র হয়ে কয়েকটি ম্যাচ খেলেন। ১৯৭৫ সালে ইয়ংম্যান স্পোর্র্র্টিংয়ের হয়ে হ্যাটট্রিকসহ গোলদাতার শীর্ষে অবস্থান করেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম বিভাগে ইয়ংম্যান সোসাইটির এবং ১৯৭৭ সালে আঞ্চলিক সুতাকলের হয়ে খেলে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম লীগে কাস্টমস দলের হয়ে খেলতেন। ১৯৭৭ সালে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফুটবল লীগে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলে দলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। তারই অংশ হিসেবে মোহামেডান বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিভাবান ফুটবলার সংগ্রহ করার দিকে মনোযোগী হয়। এ জন্য মোহামেডানের দুই ফুটবলার ভানু ও নীহার কুমিল্লা যান। ওই বছর আঞ্চলিক সুতাকল কুমিল্লা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তা উদযাপন করার জন্য অন্যান্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে বাদল রায়ও ছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ-খবর পেয়ে ভানু ও নীহার বাদল রায়ের শরণাপন্ন হন। তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। সেই যে মোহামেডানে যোগ দিলেন এরপর সাদা-কালোর জার্সির এই ক্লাবই হয়ে ওঠে তাঁর ঘর-সংসার ও ভালোবাসা। ১৯৭৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মোহামেডানের হয়ে জীবনের প্রথম ম্যাচ খেলেন। ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি হয়ে ওঠেন মোহামেডানের সারথি; মোহামেডানের সুখ-দুঃখের সহচর। ১৯৭৮ সালে প্রথম লীগ খেলতে নেমেই তিনি শিরোপার উষ্ণতা পান। সেবার মোহামেডান অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। লীগে তাঁর দল ছয়বার (১৯৭৮, ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮) চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ১৯৮১ সালে তাঁর নেতৃত্বে মোহামেডান লীগ রানার্সআপ হলেও ১৯৮৬ সালে শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করে। মোহামেডানের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নশীপের পর শুরুটা হয় তাঁর নেতৃত্বে। ১৯৮১ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে মোহামেডান ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়। তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে মোহামেডান ফেডারেশন কাপ ফুটবলে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হয় (১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৭ ও ১৯৮৯)। ১৯৭৯ সালে ধানমন্ডির সঙ্গে লীগের প্রথম খেলায় এবং ১৯৮১ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনালে আবাহনীর সঙ্গে স্মরণীয় খেলা উপহার দেন। ধানমন্ডির সঙ্গে হ্যাটট্রিকসহ চারটি গোল করেন। ১৯৮২ সালে মোহামেডানের আব্দুস সালাম মুর্শেদী ২৭ গোল দিয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও এর সিংহভাগ অবদান বাদল রায়ের। তিনি যেভাবে সালামকে গোলের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। গোল করার সহজ সুযোগ পেয়েও তিনি সালামের পায়ে বল ঠেলে দিয়েছেন। তারপরেও ১৪ গোল দিয়ে তিনি সেবার লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। ঢাকা লীগে অসংখ্য গোল তাঁর পা থেকে এসেছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি মোহামেডানের হয়ে খেলে ফুটবল থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি সংগঠক হিসেবে সম্পৃক্ত হন।
৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার সুদর্শন, অমায়িক ও মিশুক স্বভাবের বাদল রায় ১৯৮১ সাল জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। সেবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে অভিষেক হয়। এরপর ১৯৮২ সালে করাচিতে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, ১৯৮৫ সালে পেশোয়ারে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্রুপ-৩-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ এবং ১৯৮৬ সালে ঢাকায় চতুর্থ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে খেলেছেন। তিনি ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে পাকিস্তানের সঙ্গে, নবম এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার সঙ্গে, পেশোয়ারে কায়েদে আজম ফুটবলে পাকিস্তান সবুজ দলের সঙ্গে একটি করে গোল করেন। ১৯৮২ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে তিনি বাংলাদেশ সবুজ দলের নেতৃত্ব দেন।
খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর বাদল রায় মোহামেডানের ম্যানেজার ছিলেন তিন বছর। ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালে সৌদি আরবে বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন। এছাড়া তিনি ফ্রান্স এবং লস অ্যাঞ্জেলসে ফিফা কংগ্রেসে যোগ দেন। মনের আনন্দে ফুটবলে জড়িয়ে থাকা বাদল দর্শকদেরও আনন্দ দিয়েছেন অপার।


দ্রুতগতির স্ট্রাইকার সালাম মুর্শেদী

দ্রুতগতির কারণে যে স্ট্রাইকারটি প্রতিপক্ষের কাছে সমীহ আদায় করে নিতেন, তিনি হলেন সালাম। তিনি ছিলেন আক্রমণভাগের প্রধান অস্ত্র। বল পায়ে ক্ষিপ্র গতির জন্য যে কোনো রক্ষণভাগকে কাঁপিয়ে দিতে পারতেন। খেলার পুরোটা সময় তাঁর দাপটে প্রতিপক্ষ সন্ত্রস্ত থাকতো। দ্রুততম এই খেলোয়াড়ের বল কন্ট্রোলের দক্ষতা, দূরপাল্লার প্রচ- শট নেয়ার ক্ষমতা ও চোখের পলকের মধ্যে ডজ দিয়ে বিপক্ষ দলের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ার সামর্থের কারণে নিখুঁতভাবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতেন। বক্সের বাইরে থেকে দুই স্টেপ দৌড়ে গিয়ে ডান পায়ে চমৎকারভাবে প্রচণ্ড শট নিতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ থেকে গোল আদায় করে নিতেন। দৈহিক উচ্চতা তেমন না হওয়া সত্ত্বেও এই ঘাটতি পূরণ করে দিতেন ক্ষিপ্রতা দিয়ে। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন এই খেলোয়াড় ছিলেন মূলত সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার। সহযোগীরা গোলের সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে তিনি গোল করতে পারতেন। হেডিং ও বাঁ পায়ের শট ছিল দুর্বল। তাছাড়া অহেতুক বেশি ড্রিবলিং করতে যেয়ে অনেক সময় গোলের সুযোগ নষ্ট করতেন।
আব্দুস সালাম মুর্শেদীর জন্ম খুলনায়, ১৯৬০ সালের ২১ ডিসেম্বর। খেলোয়াড়ী পরিবেশেই বেড়ে উঠেছেন। বড় ভাই জামাল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান দলে ভলিবল খেলেছেন। আরেক ভাই আবুল কালাম আজাদ এককালের সাড়া জাগানো বডিবিল্ডার, যিনি ‘মিঃ বাংলাদেশ’ নামে খ্যাত হয়েছেন। শুরু করেছিলেন অ্যাথলেট হিসেবে। ১০০ ও ২০০ মিটার দৌঁড়ে তিনি সুখ্যাত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে খুলনায় জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতার আসর বসলে তিনি ফুটবলে আকৃষ্ট হন। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে হাতে অফুরন্ত সময়। বল নিয়ে পড়ে থাকেন। চষে বেড়ান পুরো খুলনা। গোল করার মাঝে আনন্দ খুঁজে পান। ফুটবলে তাঁর আগ্রহ ও মনোযোগ দেখে খুলনা ইয়ং মুসলিম ক্লাব ১৯৭৭ সালে তাঁকে দলভুক্ত করে। ক্লাবের কোচ জহির তাঁকে ঘষে-মেজে তৈরি করেন। এই ক্লাবে খেলা অবস্থায় ওই বছরই ঢাকার আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের আমন্ত্রণ পান। রহমতগঞ্জের সঙ্গে লীগের প্রথম ম্যাচেই তিনি দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হন। মাঝ মাঠ থেকে বল পেয়ে ক্ষীপ্র গতিতে ডান পা-বাম পা করে এগিয়ে ডাকসাইটে স্টপার ব্যাক ইউসুফকে এক ঝাঁকিতে পেছনে ফেলে দেন। এরপর বড় ‘ডি’র ওপর থেকে গোলকিপার মোতালেবকে কোনো সুযোগ না দিয়ে বাঁ পায়ের চকিত ভলিতে বুলেট গতিতে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে বল জালে জড়ান। জেলা শহর থেকে এসে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম খেলতে নেমে এভাবে গোল করায় তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৭৮ সালে আজাদের হয়ে আটটি গোল করেন। পরের বছর যোগ দেন বিজেএমসিতে। ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে খেলায় হ্যাটট্রিকসহ ১২ গোল দিয়ে লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। চ্যাম্পিয়ন হয় বিজেএমসি। ১৯৮০ সাল থেকে তাঁর ঠিকানা হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। প্রথম বছরই তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৮২ সাল ছিল সালামের ক্যারিয়ারে সেরা ও স্মরণীয় বছর। ওই বছর ভারতের দুর্গাপুরে আশিষ জব্বার স্মৃতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। বিদেশের মাটিতে এটি কোনো দলের প্রথম শিরোপা। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিকসহ ১০টি গোল করেন। এছাড়া লীগে ২৭টি গোল দিয়ে ১৯৭৩ সালে সালাউদ্দিনের দেয়া ২৪ গোলের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে তিনি সাড়া জাগান। তাঁর এই রেকর্ড এখন পর্যন্ত অটুট রয়েছে। ১৯৮২ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি মোহামেডানের হয়ে খেলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ছিলেন মোহামেডানের অধিনায়ক।
১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশীয় যুব ফুটবল দিয়ে সালামের অভিষেক হয় আন্তর্জাতিক ফুটবলে। এরপর ১৯৮০ সালে কুয়েতে সপ্তম এশিয়ান, ঢাকায় ২২তম ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮১ সালে যুব ফুটবলের চূড়ান্ত রাউন্ড, ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কায়দে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, ১৯৮৫ সালে পেশোয়ারে কায়দে আজম স্মৃতি কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলেন। ২০০৩ সালে সালাম জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান।
গতির ঝড়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে গোল উপহার দেওয়ার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন ক্ষিপ্রগতির সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকার সালাম।


সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার আশীষ

মিডফিল্ডার হিসেবে হাতে গোনা যে ক’জন ফুটবলার আলাদা অবস্থান করে নিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম আশীষ। স্টাইলিস ও কার্যকরী এই ফুটবলারের মাঝ মাঠ থেকে দুই আউটের দিকে বাঁকানো পাসে থাকতো সৃষ্টিশীলতা। আক্রমণ ও রক্ষণভাগের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী হলেও আক্রমণের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। এ কারণে তাঁকে স্ট্রাইকিং পজিশনেও দেখা যেতো। বল পেলে কাট ইন আর লম্বা স্টেপিং করে ড্যাশিংয়ের মাধ্যমে মধ্যমাঠ ছিঁড়েফুঁড়ে বেরিয়ে যেয়ে প্রতিপক্ষের বিপদ সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়তেন। গোলের উৎস তৈরির পাশাপাশি ডান পায়ের জোরালো শটে অসংখ্য গোল করেছেন।
১৯৬০ সালের ১৪ মার্চ চট্টগ্রামে আশীষ ভদ্রের জন্ম। খুব অল্প বয়সেই চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর অবস্থান করে নেন। আর এ ক্ষেত্রে পথ-নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেন প্রাক্তন ফুটবলার ইকবাল খান। চট্টগ্রামের কাজির দেউরি খাজা রিক্রিয়েশন ক্লাবের হয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি চট্টগ্রাম প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলেন। ১৯৭৭ সালে যখন ওই ক্লাবের অধিনায়ক, তখন তিনি কলেজের ছাত্র। ওই বছর জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় সিলেটের সঙ্গে জোনাল ম্যাচে চট্টগ্রামের হয়ে চমৎকার খেলেন। তাঁর দেয়া ২ গোলে চট্টগ্রাম ৩-১ গোলে জয়ী হয়। এ কারণে ঢাকা থেকে আমন্ত্রণ পেতে তাঁকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৭৮ সালে তিনি যোগ দেন রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটিতে। ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে প্রথম খেলতে নেমে সবার প্রশংসা অর্জন করেন। পরিচ্ছন্ন খেলার পাশাপাশি লীগে বেশ কয়েকটি গোল করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিন বছর রহমতগঞ্জে খেলার পর ১৯৮১ সালে তাঁর ঠিকানা হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। আবাহনীর হয়ে তিনি মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলেন। লিংকে আশীষ ও বাবুল জুটি ছিল অপ্রতিরোধ্য। আবাহনীর হয়ে প্রথম বছরেই তিনি শিরোপার স্বাদ পান। তিনি হয়ে ওঠেন আবাহনীর সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারী। ১৯৮৩ সালেই তিনি আবাহনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পান। সে বছর আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু কিছুটা অভিমান করে তিনি ১৯৮৪ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেন। এক বছর পর আবার ফিরে আসেন প্রিয় ক্লাব আবাহনীতে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আবাহনীর হয়ে খেলে অবসর নেন। ৫ ফুট সাড়ে ৭ ইঞ্চি উচ্চতার আশীষ ২/৩ জনকে কাটিয়ে ত্বরিৎ গতিতে সতীর্থদের বল জোগান দেয়ার পাশাপাশি বিপক্ষের রক্ষণভাগ ভেদ করে গোল করার সহজাত দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। ১৯৮১ সালে আগা খান গোল্ডকাপে আবাহনী ৫-০ গোলে ইন্দোনেশিয়াকে হারায়। এই জয়ের নায়ক আশীষ হ্যাটট্রিক করেন।
ভদ্র, ধীর-স্থির ও শান্ত স্বভাবের আশীষ তাঁর নৈপুণ্যভাস্বর খেলা দিয়ে খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক ফুটবলে স্থান করে নেন। ঢাকায় পা দেয়ার প্রথম বছরেই ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত অষ্টম এশিয়ান গেমস ফুটবলে খেলার গৌরব অর্জন করেন। প্রায় এক যুগ জাতীয় দলের হয়ে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৮০ সালে ঢাকায় ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮১ সালে ব্যাংককে ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ভারতের দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার অষ্টম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আজম ফুটবল, বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্র“প ৩-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ, ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় চতুর্থ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, সিউল এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে ভারতের কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে গ্র“প-‘এ’-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনি অংশ নেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে আশীষের বেশ কয়েকটি গোল রয়েছে। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় ২০তম এশীয় যুব ফুটবলে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ১টি, ১৯৮০ সালে ঢাকায় ২২তম এশীয় যুব ফুটবলের বাছাই পর্বে নেপালের সঙ্গে ১টি, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ১টি, ১৯৮২ সালে করাচিতে কায়েদে আজম ট্রফিতে নেপালের সঙ্গে ১টি, দিল্লির নবম এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ১টি, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ১টি, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবলে নেপালের সঙ্গে ১টি, ১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে ভারতের সঙ্গে ১টি এবং পেশোয়ারে কায়েদে আজম ট্রফিতে পাকিস্তান সবুজ দলের সঙ্গে ১টি গোল করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্র“প ৩-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডে আশীষ বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকা স্টেডিয়ামে ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবলে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে খেলাটি আশীষের জীবনের একটি স্মরণীয় খেলা। খেলার প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ০-২ গোলে পিছিয়ে ছিল। হেলালের লব করা বল আশীষ রাইট আউট পজিশন থেকে নিপুণভাবে হেড করে বল জালে জড়ান। এই গোলের পর মহসীন দ্বিতীয় গোল করে খেলায় সমতা আনেন।
নম্র স্বভাব ও ঠাণ্ডা মেজাজের আশীষ খেলার মাঠে কখনোই মাথা গরম করে খেলেননি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি খেলেছেন সাবলীলভাবে। সৃজন আনন্দে বিভোর আশীষের ফুটবল তাই তৃপ্ত করেছে ফুটবলামোদীদের।



স্টাইলিশ রাইট উইঙ্গার ওয়াসিম

সুদর্শন ও স্মার্ট হিসেবে যে ফুটবলার সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন, তিনি হলেন ওয়াসিম। নায়কোচিত চেহারার ওয়াসিম শুধু তাঁর গ্ল্যামার ও সৌন্দর্যের কারণেই সবার প্রিয় ছিলেন না, ফুটবলার হিসেবেও তিনি ছিলেন নজরকাড়া। মধ্য মাঠ থেকে বল পেয়ে সর্পিল গতিতে টাচ লাইন দিয়ে ছুটে যেতেন প্রতিপক্ষের সীমানায়। এমন নিপুণভাবে মাইনাস দিতেন যে, নিজের দলের স্ট্রাইকারদের তা থেকে গোল আদায় করে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হত না। কখনো নিজেই সুযোগ বুঝে গোল করতেন। বল নিয়ন্ত্রণ, রানিং উইথ দ্য বল, নিখুঁত সেন্টার ও চোখ জুড়ানো শট দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন তিনি একজন সৃষ্টিশীল ও স্টাইলিশ ফুটবলার। স্পিড, ট্যাকলিং, বল ডিস্ট্রিবিউশন ও ম্যাচ টেম্পারামেন্টের কারণে তিনি দেশের সেরা রাইট উইঙ্গারে পরিণত হন। তাঁর খেলায় ছিল বৈচিত্র্য, গতি, শক্তি, অনমনীয় দৃঢ়তা ও স্টাইল।
খন্দকার ওয়াসিম ইকবালের জন্ম ঢাকার নওয়াবগঞ্জে, ১৯৬২ সালের ২১ জুন। তবে তিনি ঢাকার গোপীবাগের ছেলে হিসেবেই পরিচিত। আর গোপীবাগ মানেই তো ব্রাদার্স ইউনিয়ন। গোপীবাগের কিশোর ও তরুণদের কাছে ব্রাদার্স একটি স্বপ্ন ও ভালোবাসার নাম। নওয়াবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওয়াসিম ফুটবলে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর ক্রীড়াশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নের প্রাক্তন ফুটবল অধিনায়ক সেলিম তাকে ব্রাদার্সে টেনে আনেন। ১৯৭৮ সালে জুনিয়র ব্রাদার্সের হয়ে অনুশীলনে ওয়াসিম বুঝিয়ে দেন তাঁর মেধা ও প্রতিভা। সঙ্গত কারণে মূল দলে সুযোগ পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ১৯৭৯ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের সঙ্গে খেলা শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে খেলতে নেমে দলে নিজের অবস্থান স্থায়ী করে ফেলেন। সেলিমের অনুপ্রেরণা আর ফুটবলার গড়ার কারিগর গফুর বালুচের পাঠশালায় দীক্ষার কারণে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খুব অল্প সময়েই সবার মন জয় করে নেন। চমৎকার পায়ের কাজ আর কোমরের দোলায় প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ছিটকে ফেলে দিতেন। মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে রাইট উইং দিয়ে ঢুকে পড়ে প্রতিপক্ষের সীমানায় ত্রাস সৃষ্টি করতেন। প্রতি বছর দুর্দান্ত খেলেও ফুটবল লীগে শিরোপা যেন ব্রাদার্সের কাছে অধরা স্বপ্ন হয়ে যায়। তদুপরি যে ক’জন ফুটবলারের কারণে ব্রাদার্স প্রতিপক্ষের কাছে সমীহ আদায় করে নিতে সক্ষম হয়, তাঁদের অন্যতম ছিলেন ওয়াসিম। ১৯৮০ সালে ব্রাদার্স ফেডারেশন কাপ ফুটবলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে যুগ্মভাবে এবং ১৯৮১ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ব্যাংক ক্লাবের সঙ্গে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আগা খান গোল্ডকাপে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হন ওয়াসীম। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর ব্রাদার্স ইউনিয়নের জন্য তিনি মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলেন। এ সময় তাঁর পা থেকে এসেছে ৬০টিরও বেশি গোল। ১৯৮৪ সালে তিনি ছিলেন ব্রাদার্সের অধিনায়ক। ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করে তিনি ১৯৮৮ সালে আবাহনী লিমিটেডে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালের লীগে ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে দুর্দান্ত খেলেন। মধ্য মাঠ থেকে বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় নীরাকে কাটিয়ে বল জালে জড়ান। তিন বছর আবাহনীর হয়ে খেলার পর পুনরায় ফিরে যান ব্রাদার্সে। ১৯৯৩ সালে ব্রাদার্সের হয়ে অবসান ঘটে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের।
১৯৮২ সালে ভারতের দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত আশীষ-জব্বার স্মৃতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ওই টুর্নামেন্টে অতিথি ফুটবলার হিসেবে তিনি অংশ নেন। ১৯৯০ সাল ছিল ওয়াসিম ও আবাহনীর জন্য একটি স্মরণীয় বছর। ওই বছর আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়াও ভারতের নাগজি ট্রফি এবং ফেনীর আজমিরী বেগম গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। আজমিরী বেগম গোল্ডকাপের ফাইনালের ওয়াসিমের গোলে আবাহনী কোলকাতা মোহনবাগানকে হারায়। খেলার ৩৬ মিনিটে রুমির একটি পাস থেকে রাইট উইঙ্গার ওয়াসিম দু’জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে কোণাকুণিভাবে বল জালে জড়ান। মোহনবাগানের গোলকিপার ভাস্কর ঝাঁপিয়ে পড়েও কিছু করতে পারেননি।
আন্তর্জাতিক ফুটবলেও ওয়াসিম দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অর্ভিষেক হওয়ার পর প্রায় এক যুগ তিনি ছিলেন জাতীয় দলের অপরিহার্য সদস্য। ১৯৮০ সালে ঢাকায় ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, ১৯৮১ সালে ব্যাংককে ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ১৯৮২ সালে করাচিতে কায়দে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমস, ১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্র“প-৩ কোয়ালিফাইং রাউন্ড, পেশোয়ারে কায়দে আজম ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলে, সিউল এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে লাহোরে কায়দে আজম ফুটবল, কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে নবম এশিয়া কাপের গ্র“প ‘এ’ কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৯ সালে ঢাকায় ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ লাল দলে, বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ এবং ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে অংশ নেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ওয়াসিমের পা থেকে এসেছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গোল। ১৯৮২ সালে করাচিতে কায়দে আজম স্মৃতি ফুটবলে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি, ১৯৮৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপে ফিলিপাইনের সঙ্গে দুটি, কাঠমান্ডুতে প্রথম সাফ গেমসে নেপালের সঙ্গে দুটি, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি, ১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমসে তিনি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৮৭ সালে কোলকাতা লীগে তিনি খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে।
৫ ফুট সাড়ে ১০ ইঞ্চি উচ্চতার ওয়াসিম দেশ-বিদেশে অসংখ্য স্মরণীয় খেলা উপহার দিয়েছেন। ১৯৭৯ সালে আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে তিনি ইরানের লোরেস্থান ক্লাবের সঙ্গে দুর্দান্ত খেলেন। ১৯৮৩ সালে মারদেকা ফুটবলে বাংলাদেশের যার খেলা সবচেয়ে বেশি দলকে অনুপ্রাণিত করেছে, তিনি হলেন ওয়াসিম। অসাধারণ খেলেছেন। দলের প্রয়োজনে তিনি কখনো মধ্যমাঠ সামলে উইথড্রয়াল ফরোয়ার্ড হিসেবে ওপরে উঠেছেন, আবার স্বচ্ছন্দে নিচে নেমে এসেছেন। তাঁর খেলা প্রতিপক্ষের সমীহ আদায় করে নেয়।
বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ওয়াসিমকে ১৯৮৫ সালের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ২০০৫ সালে যে ১০ জন ফুটবলারকে সম্মানিত করে, ওয়াসিম তাদের একজন। সৌন্দর্যমণ্ডিত ফুটবল উপহার দিয়ে সবাইকে আকৃষ্ট করেছেন ওয়াসিম।

মন্তব্যসমূহ

  1. সব সত্যিকারের ইতিহাস....পড়ার মতোই অবিশ্বাস্য রকমের...একটানে আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে...যেমন আমাকেও নিয়ে গেছে....বাংলাদেশের এ যাবত তাবড় তাবড় রথী ও মহারথী ফুটবল খেলোয়াড়ের কৃতিত্ব ও গৌরবগাঁথা জীবন পড়লাম....ভীষণ ভালো লেগেছে....!!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

ফুটবলে জীবনের জয়গান / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ