স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই-৩

২৪ জুলাই জাতীয় ক্রীড়া দিবস চাই

ক্রীড়াচর্চা সকল নারী-পুরুষের জন্মগত অধিকার। সঙ্গত কারণে দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে ক্রীড়া সচেতনতা সৃষ্টি করা অপরিহার্য। আর এ কারণেই জাতীয়ভাবে প্রয়োজন একটি ক্রীড়া দিবস।
জাতীয় ক্রীড়া দিবসকে কেন্দ্র করে সুস্থ ক্রীড়াচর্চা ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টির মাধ্যমে কৈশোর ও যৌবনকে সংহত এবং জাতির যুবশক্তির স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও চিরায়ত বিকাশ ঘটানো সম্ভব। ক্রীড়াকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে ক্রীড়া দিবস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ক্রীড়ায় অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে। সারাদেশে ক্রীড়া ক্ষেত্রে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নবজাগরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ক্রীড়া দিবস হতে পারে চমৎকার উপলক্ষ। প্রতি বছর জাতীয় ক্রীড়া দিবস উপলক্ষে যে কর্মকা- চালানো হবে, তাতে দেশব্যাপী ক্রীড়া সচেতনতা গড়ে উঠবে। জনগণ ক্রীড়া চর্চার প্রতি আকৃষ্ট হবে। কেননা খেলাধুলা জাতীয় সুস্বাস্থ্যের অন্যতম পূর্বশর্ত। ক্রীড়া দিবস জাতীয় সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্রীড়ানৈপুণ্য অর্জনের সোপান হিসেবে কাজ করবে। আমাদের দেশ অনেক রকম দিবস থাকলেও আজ অব্দি ক্রীড়া দিবস ঘোষণা করা হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের তিন দশক পেরিয়ে যাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন। জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় ক্রীড়াঙ্গন ভালয়-মন্দ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে ক্রীড়াঙ্গনে যে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, তাতে জাতীয় ক্রীড়া দিবসের প্রয়োজনীয়তা দারুণভাবে উপলব্ধ হচ্ছে।
কোন্ তারিখে জাতীয় ক্রীড়া দিবস ঘোষণা করা হবে। তা নিয়ে অবশ্য আলোচনা হতে পারে। যে তারিখে জাতীয় ক্রীড়া দিবস ঘোষণা করা হবে; তার গুরুত্ব, মর্যাদা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য খেলাধুলাকেন্দ্রিক হওয়া আবশ্যক। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, ২৪ জুলাইকে জাতীয় ক্রীড়া দিবস ঘোষণা করা হোক। কেননা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের সোনালী ইতিহাস। মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তৎকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সমর্থনে গঠন করা হয় ‘জয়বাংলা ফুটবল দল’। এ দল গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনসমর্থন ও তহবিল গড়ে তোলা। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জয়বাংলা ফুটবল দল তাদের প্রথম ম্যাচে অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলটি খেলার আগে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তখন অব্দি ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান না করায় জাতীয় সঙ্গীত বাজানো এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দল এ বিষয়ে নিষ্পত্তি না হলে মাঠে না নামার সিদ্ধান্ত নেয়। এ অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে নদীয়ার জেলা প্রশাসক নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সম্মতি দেন। এর ফলে খেলার মাঠে খেলার মাধ্যমে এই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামরত একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় স্বাধীন দেশের মর্যাদায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। দর্শনীর বিনিময়ে আয়োজিত এ প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচে ব্যাপক দর্শক সমাগম হয়। জয়বাংলা ফুটবল দলটি ভারতে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ফুটবল মাঠে ফুটবল দলের এই ভিন্নধর্মী লড়াই শুরু হয় ২৪ জুলাই। সঙ্গত কারণে ২৪ জুলাই এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী দিন।
এ দিনটির সঙ্গে একদিকে যেমন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যদিকে আমাদের খেলাধুলার সোনালী অধ্যায় জড়িয়ে আছে। এমন একটি দিনকে জাতীয় ক্রীড়া দিবস ঘোষণা করা হলে সব দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হবে। আমরা চাই, ২৪ জুলাই জাতীয় ক্রীড়া দিবস ঘোষণা করা হোক।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মার্চ ২০০১


সন্ত্রাস ও খেলাধুলা

যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ওয়াশিংটনের অহংকার পেন্টাগন আর নিউইয়র্কের গৌরব টুইন টাওয়ারই শুধু ধসে পড়েনি, একই সঙ্গে আলগা হয়ে পড়েছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন। যত দূরেই থাকুক না কেন, এর আঁচ এসে লেগেছে খেলার মাঠেও। আশা-নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে স্থগিত হয়ে গেল নবম সাফ গেমস।
ওসামা বিন লাদেন কিংবা মোল্লা ওমরদের সঙ্গে খেলার মাঠের কোন সম্পর্ক না থাকলেও ইসলামাবাদ ও কাবুলের মানসিক ও ভৌগোলিক দূরত্ব খুব বেশি নয়। যে কারণে জর্জ বুশের রণ-হুংকারে শুধু আফগানিস্তান নয়, কেঁপে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ। দেবালয়ে যখন আগুন লাগে, তখন রক্ষা পায় না পর্ণকুটিরও। আর রণোন্মাদ জর্জ বুশ যখন বলেন, হয় আমাদের পক্ষে থাক, নয় বিপক্ষে; তখন কারো পক্ষে স্বস্তিতে থাকা সম্ভব হয় না। কেননা ইয়াংকিদের আর কখনো এতটা ক্ষিপ্ত ও বিচলিত মনে হয়নি। ইয়াংকিরা এমনিতেই নাচনেওয়ালী, তার উপর পড়েছে ঢোলের বাড়ি। দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে যুদ্ধের যে সাজ-প্রস্তুতি, তাতে যে কোনো মুহূর্তে রণদামামা বেজে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। এমন একটা অবস্থায় যত নিরীহ ও নির্দোষ হোক না কেন, একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকে সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করায় এমনিতেই পাকিস্তান তালেবানদের হুমকির সম্মুখীন, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশে ইসলামপন্থী ও মৌলবাদীদের ধমকানি।
সঙ্গত কারণে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও শেষ মুহূর্তে স্থগিত করতে হয় নবম সাফ গেমস।
সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমকে এখন আর দূরে সরিয়ে রাখার উপায় নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসের দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে আমাদের বোধ, বুদ্ধি ও বিবেক। তা থেকে খেলার মাঠেরও রেহাই পাবার উপায় নেই। অথচ আমরা তো জানি, সেই শাশ্বত বাণী ঃ ‘প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়া নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা।’ এর সারকথা হলো, খেলার মাঠে গড়ে উঠবে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার মনোভাব। মানব সাগরের মহামিলনের সর্বোত্তম কেন্দ্র হলো খেলার মাঠ। মানব জাতির ইতিহাসে দেশে দেশে অনেক হিংসা, বিদ্বেষ ও রেষারেষির অবসান ঘটেছে এই খেলার মাঠেই। আজ যখন সন্ত্রাসও খেলার মাঠের টার্গেট হয়ে যায়, তখন আমরা সত্যি সত্যি অসহায় হয়ে পড়ি। সুস্থ দেহ, সুস্থ মন ও নির্মল আনন্দের জন্য যে খেলার মাঠ, তাকে নিরাপদ রাখা গেলে আমরা সবাই নিরাপদে থাকতে পারবো। আমরা যারা খেলার মাঠের লোক, তাদেরকে এ ব্যাপারে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে।
নবম সাফ গেমস স্থগিত হওয়াটা দক্ষিণ এশিয়ার ক্রীড়ানুরাগীদের কাছে দারুণ হতাশাব্যঞ্জক। কেননা এ অঞ্চলের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের বৃহত্তম ক্রীড়া উৎসব এই সাফ গেমস। দু’বছর অন্তর আয়োজিত এই গেমসকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশÑ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার ক্রীড়াবিদরা প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সাফল্য ও প্রতিভা মেলে ধরার ক্ষেত্রে সাফ গেমস অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে। এ কারণে এই গেমসকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। কেননা, সীমিত সাধ্য ও সামর্থ্যরে কারণে বড় মাপের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করা এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদদের পক্ষে পারতপক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। সাফ গেমস স্থগিত হওয়ায় হোঁচট খেল ক্রীড়াবিদদের প্রস্তুতি। স্থগিত হলেও ফের কখন অনুষ্ঠিত হবে কিংবা আদৌ হবে কিনা, এমন একটা দোটানায় কারো পক্ষে খেলাধুলায় মনোনিবেশ করা কঠিন। তাছাড়া আমাদের মত দেশের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাবার আর্থিক সঙ্গতিও নেই।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হলো। তাই আমরা যে কোন ধরনের হিংসা ও সন্ত্রাসের নিন্দা জানাই।
ক্রীড়াজগত : ১ অক্টোবর ২০০১


সুস্থ দেহ সুস্থ মন সুস্থ জীবন

সুস্থ দেহ, সুস্থ মন ও সুস্থ জীবনের জন্য শারীরিক পরিশ্রম ও নিয়মিত শরীরচর্চার কোন বিকল্প নেই। এ কারণেই ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল কথা ছিল: ‘শরীর সচল রাখুন- সুস্থ থাকুন’।
একটি সুস্থ ও সবল জাতি গঠনে জনগণের স্বাস্থ্য পরিচর্যার গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ আমাদের দেশে স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়টি দারুণভাবে উপেক্ষিত। এ কারণে রোগী ও হাসপাতালের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না খেলার মাঠ ও জিমনেসিয়াম। জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি না হওয়ায় আমরা একটি অসুস্থ ও দুর্বল জাতি হিসেবে গড়ে উঠছি। রোগ-ব্যাধি আমাদের জীবনযাত্রাকে বিকল করে দিচ্ছে। বিশেষ করে, আজ ঘরে ঘরে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, গ্রন্থিবাত, মেদের আধিক্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব রোগের চিকিৎসা যেমন জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ, তেমনি মৃত্যু-ঝুঁকিও অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, এ কারণে ব্যাহত হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন। কেননা, জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ প্রতিনিয়ত রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। যে কারণে একদিকে উন্নয়ন কর্মকা-ে জনশক্তির পূর্ণ অংশগ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন খাতে প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এমনকি কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে অনেকেই প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাতায়াত করছেন। সব মিলিয়ে চিকিৎসা খাতে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার কিয়দংশ ক্রীড়া ও শরীরচর্চার কাজে লাগানো হলে আমরা একটি উজ্জ্বল, উচ্ছ্বল ও প্রাণবন্ত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু এটি সম্ভব হচ্ছে না খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রতি আমাদের নিদারুণ অনীহা ও অজ্ঞতার কারণে। যে জন্য আমরা জেনে কিংবা না জেনেই খেলার মাঠ, ফসলের জমি কিংবা এক টুকরো জমি খালি রাখছি না। গড়ে তুলছি ইট-পাথরের জঞ্জাল। ফলে খেলাধুলা, শরীরচর্চা কিংবা একটুখানি মুক্ত বায়ু সেবনের পরিসর কমে আসছে। আমরা ক্রমশ আটকা পড়ছি বদ্ধ খাঁচায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিক জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা। এখন আর মানুষ হাঁটতে চায় না। সামান্য দূরত্বও সবাই রিকশায় অতিক্রম করেন। ঘরের বাইরে চিত্ত-বিনোদনের তেমন সুযোগ না থাকায় মানুষ এখন ঘরকুনো হয়ে পড়েছেন। রিমোট কন্ট্রোল কিংবা কী-বোর্ড বিনোদনের প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠায় মানুষ এখন অলস হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রম ও শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহ অনুভব করেন না।
শরীরচর্চা ও শারীরিক পরিশ্রম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুস্বাস্থ্য অর্জন এবং মানসিক কল্যাণ সাধন করে। প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রম ও নিয়মিত শরীরচর্চায় কর্মক্ষমতা বাড়ায়, অবসন্নতা দূর, শরীরে অতিরিক্ত কোলেস্টরেল ও রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ও খেলাধুলা যুবকদের স্বাভাবিক ও মানসিক উন্নয়নে সহায়ক। বয়স্ক ব্যক্তিদের নিঃসঙ্গতা দূর করে এবং আÍপ্রত্যয় ও সফলতা অর্জনে আস্থা বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই, প্রতিদিন সামান্য শারীরিক কাজ ও শরীরচর্চা করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হালকা কাজ বা শরীরচর্চা কিংবা যখন পারেন, যতটা পারেন হাঁটুন, সময় পেলে খেলা করুন, স্কেটিং অথবা সাইকেল চালান, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করুন, জগিং করুন কিংবা সিঁড়ি বেয়ে উঠুন। সুস্বাস্থ্যের জন্য পরিশ্রম করুন।
ক্রীড়াজগত : ১৬ এপ্রিল ২০০২


স্কুল-কলেজে খেলাধুলা চর্চার প্রয়োজন

ইদানীং স্কুল-কলেজে খেলাধুলার চর্চা হয় না বললেই চলে। যে কারণে তৃণমূল পর্যায় থেকে তেমনভাবে খেলোয়াড় উঠে আসছে না। ফলে বিভিন্ন ক্রীড়ায় জাতীয় পর্যায়ে নতুন মুখের তেমন সমাহার না থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উৎসমুখ হলো স্কুল-কলেজ। স্কুল-কলেজে ইদানীং ক্রীড়াচর্চা হ্রাস পাওয়ায় ক্রীড়াঙ্গনের চঞ্চলতাটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় পর্যন্ত প্রতিটি স্কুল ও কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আন্তঃস্কুল বা আন্তঃকলেজ ক্রীড়া, বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছাড়াও সারা বছরই ছাত্র-ছাত্রীরা একটা ক্রীড়াচর্চার মধ্যে থাকতো। আজ অব্দি জাতীয় পর্যায়ে যত খেলোয়াড় ওঠে এসেছেন, তাদের গরিষ্ঠ অংশেরই হাতেখড়ি হয়েছে স্কুল-কলেজে। বিশেষ করে নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট এ দেশের ক্রিকেটের খোলনলচে অনেকটা পাল্টে দেয়। আগে স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলা ছিল বাধ্যতামূলক। খেলার জন্য ছিল আলাদা নম্বর। ফলে সবাই কম-বেশি ক্রীড়াচর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় খেলার মাঠে উপস্থিত না থাকলে ডিগ্রী কিংবা সাবসিডিয়ারি পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়া হতো না। এতে করে নতুন নতুন খেলোয়াড় শুধু উঠে আসতো না, পাশাপাশি একটা ক্রীড়া অনুকূল পরিবেশ থাকায় ছাত্ররা খেলাধুলা ও পড়ালেখা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতো। এর বাইরে অন্যত্র মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পেতো না।
আর এখন স্কুল-কলেজে খেলাধুলা ক্রমান¦য়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। এ বিষয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকরা মোটেও গুরুত্ব দেন না। সবচে বড় যেটি সমস্যা, অধিকাংশ স্কুল-কলেজে খেলার মাঠ নেই। এখন পাড়ায়-মহল্লায় স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে। এক টুকরো জায়গা পেলেই হলো, স্কুল-কলেজ তো মামুলি ব্যাপার, বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! মাঠ তো দূরে থাকুক, ক্লাসরুমের বাইরে একটু হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়ানো বা বসারও ব্যবস্থা থাকে না। একটা বদ্ধ খাঁচায় বন্দী পাখির মত পেরিয়ে যাচ্ছে কৈশোর ও তারুণ্যের উজ্জ্বল-উচ্ছ্বল দিনগুলো। আর এ কারণেই আমাদের সমাজ জীবনে ঘটছে নিদারুণ নৈতিক অবক্ষয়। কেননা, কিশোর, তরুণ ও যুবকদের সুস্থ চিন্তা, সুস্থ বিনোদন ও সুস্থভাবে বসবাস করার সুযোগ না দিলে তারুণ্য ও যৌবনের অধঃপতনকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিশোর, তরুণ ও যুবকদের খেলার মাঠে ফিরিয়ে আনা গেলে সমাজ জীবনে যে অস্থিরতা ও অবক্ষয়ের ধস নেমেছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
বর্তমান সরকার এ বিষয়টি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ কারণে গত ২২ আগস্ট জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মিলনায়তনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ক্রীড়া উন্নয়ন তহবিলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী বলেছেন, স্কুল-কলেজ থেকে খেলাধুলা হারিয়ে যেতে বসেছে। স্কুল-কলেজের খেলাধুলার হৃত গৌরব আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি জানান। এ ছাড়া খেলার মাঠের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় কিশোর, তরুণ ও যুবকরা খেলাধুলা করতে পারছে না বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। মাঠের সমস্যা সমাধানে জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন। প্রতি বছর বিভিন্ন জেলায় পর্যায়ক্রমে একটি করে খেলার মাঠ তৈরি করার জন্য আগামী বাজেট থেকে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে তিনি জানান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী শুধু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীই নন, বর্তমান সরকারের নীতি-নির্ধারকদেরও একজন; তিনি যে দেশের খেলাধুলার মূল সমস্যাকে অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার যে অঙ্গীকার করেছেন, তাতে উপকৃত হবে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। একই সঙ্গে তারুণ্য ও যৌবনের যে অবক্ষয় ঘটছে, তা থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। এছাড়া স্কুল-কলেজে খেলাধুলাকে চাঙ্গা করার জন্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীও গুরুত্বারোপ করেছেন। এ জন্য স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে খেলাধুলা আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
স্কুল-কলেজে ক্রীড়াচর্চা এবং মাঠ সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কার্যকর করা হলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস দেশের ক্রীড়াঙ্গন আবারো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠবে।
ক্রীড়াজগত : ১ সেপ্টেম্বর ২০০২


কাবাডি আমাদের সম্মান ও গৌরব

কাবাডি আবার আমাদের সম্মান রক্ষা করলো। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অনুষ্ঠিত ১৪তম এশিয়ান গেমসে রৌপ্য পদক জয় করেছে বাংলাদেশ। কাবাডি শুধু বাংলাদেশের জাতীয় খেলাই নয়; আমাদের গৌরব ও অহংকারও বটে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের যা কিছু প্রাপ্তিÑ তাতে দেদীপ্যমান কাবাডি। অলিম্পিক গেমসের পর যাকে বিবেচনা করা হয়, সেই এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য কাবাডিতে। ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়াডে কাবাডি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের সাফল্যের সূচনা হয়। ১৯৯৪ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ উপর্যুপরি দ্বিতীয়বারের মত কাবাডিতে রৌপ্য পদক জয় করে। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ব্যাংকক এশিয়াডে বাংলাদেশের গৌরব-রবি কিছুটা অস্তমিত হয়। কেননা, বাংলাদেশকে ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এরপর আরো বড় আঘাত আসে কাবাডিতে। ১৯৯৯ সালে নেপাল সাফ গেমসে বাংলাদেশ মারাÍক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সেবার কাবাডিতে কোনো পদক পাওয়া যায়নি। উপরন্তু অসদাচরণের জন্য বাংলাদেশ দলের বিপক্ষে নেয়া হয় ডিসিপ্লিন্যারি ব্যবস্থা। এতে কাবাডির অবস্থানের অবনমনের পাশাপাশি ক্ষুণœ হয় দেশের মান ও মর্যাদা। এটা বাংলাদেশের কাবাডির জন্য কলঙ্কিত ঘটনা হয়ে আছে। এরপর কাবাডির চর্চা এবং কাবাডিকে নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে। এমন একটা প্রতিকূল অবস্থায় এবারের এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ তার চির-কা´িখত রৌপ্য পদক জয়ের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করেছে দেশের গৌরব ও সম্মান।
কাবাডিতে রৌপ্য পদক পাওয়াটাই এখন আমাদের বড় প্রাপ্তি। কেননা, ভারত কাবাডিতে অত্যন্ত শক্তিশালী দল হওয়ায় তাদের টপকে স্বর্ণ পদক জয় করাটা বাংলাদেশের কাছে দুরূহ স্বপ্ন। বরং অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে পাকিস্তান আমাদের কাছে কাবাডির হাতে-খড়ি নিয়েছে, তারাও কখনো-সখনো আমাদের টেক্কা মারছে। ব্যাংকক এশিয়ান গেমস এবং সাফ গেমসেও আমরা পাকিস্তানের কাছে পরাজিত হয়েছি। এটা আমাদের জন্য যুগপৎ লজ্জা ও বেদনার। অবশ্য এবার পাকিস্তানকে হারিয়ে আমরা আমাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করলেও এই প্রথম অপ্রত্যাশিতভাবে জাপানের কাছে হার মেনেছি। যে জাপানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে কাবাডির কোনো সম্পর্ক নেই, তাদের কাছে যখন আমরা হেরেছি, তখন বুঝতে পারা যায়, আমরা ক্রমশ: পিছিয়ে পড়ছি। অতীতে ভারতই ছিল আমাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ¡ী। এখন প্রতিদ্বন্দ¡ীর সংখ্যা ক্রমান¦য়ে বাড়ছে। পাকিস্তান ও জাপানের কাছে আমাদের হারার অভিজ্ঞতা হয়েছে। মালয়েশিয়াও ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেললে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা, যে জাপানের কাছে আমরা হেরেছি, সেই জাপানকে অনায়াসে হারিয়েছে মালয়েশিয়া। চারটি এশিয়ান গেমসে তিনটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পদক পেলেও আগামীতে আমরা পদক পাবÑ এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে অভিজ্ঞতাও আমাদের সর্বশেষ সাফ গেমসে হয়েছে। এছাড়া আমাদের প্রতিদ্বন্দ¡ীরা দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় কাবাডিকে নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এ জন্য গতানুগতিক ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। কাবাডি খেলা অনেক পাল্টে যাচ্ছে। এবারই প্রথম কাবাডি খেলা হয় ম্যাটে। অথচ আমাদের ম্যাটে খেলার অভ্যাস নেই। যে কারণে বুসানে আমাদের খেলোয়াড়রা যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেন। শেষ পর্যন্ত নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত জয় পায়। তবে আগামীতে খুব সহজে সাফল্য পাওয়া সম্ভব হবে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদেরকে অচিরেই ম্যাটে খেলার উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া কাবাডির নিয়মিত চর্চা, অনুশীলন এবং নতুন নতুন খেলোয়াড় তুলে আনার ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।
কাবাডি আমাদের কাছে নিছক কোনো খেলা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যে সব উপাদানের সমন¦য়ে এ অঞ্চলের লোকায়ত সহজিয়া জীবনধারা গড়ে ওঠেছে, কাবাডি তার অন্যতম। কাবাডি এশিয়ান গেমসের মত আন্তর্জাতিক পরিসরে ঠাঁই পেয়েছে, এটা আমাদের জন্য কম গৌরবের নয়। একই সঙ্গে কাবাডির মাধ্যমে এশিয়ান গেমসে আমাদের পদক প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। এমনি অবস্থায় আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমুজ্জ্বল রাখার পাশাপাশি আমাদের সাফল্যকে অব্যাহত রাখতে হলে কাবাডিকে শুধু জাতীয় খেলার মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেই হবে না, কাবাডি যাতে দেশের গৌরব ও সম্মান অব্যাহত রাখতে পারে, সে বিষয়ে সর্বাÍক ভূমিকা রাখতে হবে।
ক্রীড়াজগত : ১৬ অক্টোবর ২০০২


মানদ- নির্ধারণ করা প্রয়োজন

বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশে ক্রীড়া ফেডারেশনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। প্রায় প্রতিটি ক্রীড়া ফেডারেশন ও সংস্থাকে সরকার বাৎসরিক ক্রীড়া অনুদান প্রদান করে থাকে। যার ফলে ক্রীড়াঙ্গনের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে, তা বিভাজিত হয়ে যায়। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় খেলাগুলোকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয় না। এ কারণে দেশের ক্রীড়ানুরাগীরা কিছু ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে কয়েকটি খেলাকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং বাদবাকী খেলাগুলো বেসরকারীভাবে পরিচালনার দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে বেসরকারীভাবে যে খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হবে, তা যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য পায় কিংবা জনপ্রিয়তা অর্জন করে, সে ক্ষেত্রে সে খেলাগুলোকে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করবে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে বর্তমান সরকার এমন একটি পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ প্রায় ৩১ বছর পেরিয়ে এলেও এখনও ক্রীড়াঙ্গনে আমরা কা´িখত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। অথচ এই সময়ে খুব কম অর্থ যে ব্যয় হয়েছে, তা নয়। চাহিদা অনুসারে খুব বেশি অর্থ হয়ত ব্যয় করা যায়নি। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের অবস্থান এতটা নাজুক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এমনটি হয়েছে সঠিক দিক-নির্দেশনা ও পরিকল্পনার অভাবে। ক্রীড়া খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ আমরা যথাযথভাবে সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। আয় বুঝে ব্যয় করার নীতি আমরা মেনে চলিনি। আমাদের মত দেশে সব ধরনের খেলায় অংশ নেয়ার বিলাসিতা শোভা পায় না। অথচ এই বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা ক্রমান¦য়ে ক্রীড়া ফেডারেশনের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছি। অবশ্য ফেডারেশনের সংখ্যা বাড়ানোটা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। কিন্তু নতুন নতুন ফেডারেশন চালু করে সরকারী অনুদান ও পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াটাই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য একটা বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গড়ে প্রতি বছর একটির বেশি ফেডারেশন হচ্ছে। এর ফলে ক্রীড়া বাজেট ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে কোনো খেলায় আমরা প্রত্যাশিত সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারছি না। আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গন পিছিয়ে থাকার এটি অন্যতম একটি কারণ। এ বিষয়টি যেহেতু ক্রীড়াঙ্গনের সবাই কম-বেশি অনুধাবন করতে পেরেছেন, সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সাফল্য, গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ১০টি খেলাকে সরকারী অনুদান ও পৃষ্ঠপোষকতা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও থাকতে পারে দুটি ক্যাটাগরি। প্রথম ক্যাটাগরিতে পাঁচটি এবং দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে পাঁচটি। দেশের ক্রীড়া বাজেটের বড় অংশ ১০টি খেলায় দেয়া হলে অবশ্যই তাতে সুফল পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, ততই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য মঙ্গলজনক। অবশ্য এ সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব সহজ হবে না। দেশের খেলাধুলার উন্নতির চেয়ে যারা ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেন, তারা এ ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু দেশের খেলাধুলার স্বার্থে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে উপকৃত হবে এ দেশের খেলাধুলা। সরকারী অনুদান ও পৃষ্ঠপোষকতা ১০টি খেলাকে দেয়া হলেও বাদবাকী খেলাগুলোর চর্চাও অব্যাহত থাকবে। তবে তা চলবে বেসরকারী পর্যায়ে। এর মধ্যে কোনো খেলা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে কিংবা জনপ্রিযতা অর্জন করতে পারলে, সে ক্ষেত্রে সরকারী অনুদান ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া যেতে পারে।
ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে ক্রীড়ায় অনুদান ও পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরেকটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। নির্দিষ্ট মানদ- অর্জন না করা পর্যন্ত কোনো খেলায় বিদেশে দল প্রেরণ না করা। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তিনি ক্রীড়ানুরাগীদের সঙ্গে মত-বিনিময় করছেন। এটি একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত। কেননা, অধিকাংশ ক্রীড়া ফেডারেশনের নিয়মিত কোনো কার্যক্রম না থাকলেও বিদেশে দল প্রেরণের ব্যাপারে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। মানদন্ড বিচার-বিশ্লেষণ করলে অধিকাংশ খেলার আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার যোগ্যতা নেই। অথচ অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে পাইকারী হারে বিদেশ সফর করায় দেশের মান-মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার পাশাপাশি দেশের দরিদ্র মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হয়। খেলাধুলায় অভিজ্ঞতার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণটাই যদি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তেমন অভিজ্ঞতা না হলে কিছু আসবে-যাবে না। এ অবস্থায় মাননীয় যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বিদেশে ক্রীড়া দল প্রেরণের ক্ষেত্রে যে মানদন্ড নির্ধারণের কথা উল্লেখ করেছেন, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে অর্থ সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি উপকৃত হবে দেশের খেলাধুলা।
ক্রীড়াজগত : ১৬ নভেম্বর ২০০২


ছেলেমেয়েরা খেলবে কোথায়

রাজধানী ঢাকা থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত প্রান্তর। ফলে খেলাধুলার পরিধি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য ঢাকার নাগরিকদের আইনের আশ্রয় নিতে হয়েছে। অবশ্য এ ছাড়া গত্যন্তরও ছিল না।
আগামী ৬ মাসের মধ্যে সকল উন্মুক্ত স্থানের সীমানা নির্ধারণ করতে হাইকোর্ট ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও রাজউককে নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রতি দু’মাস অন্তর অন্তর আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে হাইকোর্ট ১৯৫৩ সালের নগর উন্নয়ন আইন, ১৯৮৩ সালের ঢাকা পৌর কমিশন অধ্যাদেশ এবং ২০০০ সালের উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ আইনের অধীনে ৬১টি পার্ক ও ১০টি খেলার মাঠের রক্ষণাবেক্ষণ এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার নির্দেশ কেন দেয়া হবে নাÑ এই মর্মে সরকারকে কারণ দর্শাতে নির্দেশ দিয়েছে। পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়েরকৃত রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মোঃ তফাজ্জল ইসলাম ও বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের সমন¦য়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ ১১ মে এ নির্দেশ দেন। শুনানিতে বলা হয়, ঢাকা শহরের পার্ক, উদ্যান, বাগান এবং খেলার মাঠগুলোর অবৈধ দখল এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জনগণের সম্পত্তির বিকৃতি সাধন করা হচ্ছে। বেআইনী নির্মাণ এবং অন্যান্য কারণে এসব আকর্ষণীয় স্থানগুলো দ্রুত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। ওসমানী উদ্যান, কাওরান বাজার, শিশু পার্ক, সায়েদাবাদ শিশু পার্ক, গুলশান পার্ক, বাহাদুর শাহ পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শহীদ আনোয়ার পার্ক, হাটখোলার শিশু পার্ক, নিমতলী শিশু পার্ক, রমনা পার্ক ইত্যাদির বেহাল অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, বর্তমানে এসব স্থান খেলার মাঠ ও পার্ক হিসেবে নয়, বরং অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানের এ ধরনের অব্যবস্থা শহরবাসীকে সৌন্দর্য, বিনোদন এবং নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
একটা সময় রাজধানী ঢাকায় ছিল পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, খোলা প্রান্তর, পার্ক, উদ্যান, বাগান ইত্যাদি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার পাশাপাশি সব বয়সী মানুষ খেলাধুলায় মেতে থাকতেন। বিকেল বেলা এসব স্থানে বসে যেত মেলা। খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অধিকাংশ মানুষই অন্য বাজে কাজে মনোযোগ দিতেন না। ফলে চুরি, রাহাজানি, মাস্তানি, মাদকাসক্তিসহ নানা সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ তেমনভাবে হত না। কিন্তু ঢাকার লোকসংখ্যা ক্রমান¦য়ে বাড়তে থাকায় খেলার মাঠ, পার্ক, উদ্যান, উন্মুক্ত প্রান্তরের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। খেলাধুলা তো দূরে থাকুক, একটুখানি নিঃশ্বাস নেয়ার মত এক টুকরো ফাঁকা জায়গা এখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে। ইট-পাথরের নিসর্গে মানুষ এখন ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। ঢাকায় রোগ-ব্যাধির সংখ্যা দারুণভাবে বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়মূলক ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। স্বস্তিতে চলাফেরা করা দায় হয়ে উঠেছে। আমাদের খেলাধুলার মান আন্তর্জাতিক মানদ-ে কখনোই আশানুরূপ ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ বড় কোনো সাফল্য প্রাপ্তির মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু খেলোয়াড় ও ক্রীড়ানুরাগীদের স্বল্পতা কখনোই ছিল না। প্রতিটি খেলায় অসংখ্য ক্রীড়াবিদ অংশ নিতেন। যে কোনো জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হলে ক্রীড়াঙ্গনের পরিবেশ হয়ে উঠত উৎসবমুখর। মানুষ খেলাধুলায় অংশ নিতেন এবং ভালবাসতেন খেলাধুলা। এখন যে তারা খেলাধুলার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছেনÑ এমনটি ভাবা ভুল হবে। আসলে রাজধানীতে খেলার সেই পরিবেশ তেমন আর নেই। এর অন্যতম কারণÑ খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত প্রান্তরের অনুপস্থিতি। যতই দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি নিদারুণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ক্রমান¦য়ে বিরল হয়ে উঠছে খেলার মাঠ, উন্মুক্ত প্রান্তর। যেগুলো এখানো কোনোক্রমে টিকে আসে, সেগুলোও রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অন্তত: আউটডোরের খেলাগুলো ক্রমান¦য়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার মানে এই নয় যে, ইনডোর খেলার সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত। আসলে আউটডোর ও ইনডোরÑ কোনোটিরই অবস্থা সুবিধাজনক নয়। খেলার মাঠ ও খেলার পরিবেশ যদি না থাকে, তাহলে ছেলেমেয়েরা খেলবে কোথায়?
আমরা সবাই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাফল্যের আলোয় উজ্জ্বল হতে চাই। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে যদি খেলাধুলা না হয়, তাহলে খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক কীভাবে উঠে আসবেন? খেলাধুলায় সাফল্য পেতে হলে নিশ্চিত করতে হবে সবার জন্য খেলাধুলা। আর তা করতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও খোলা প্রান্তর; যাতে ছেলেমেয়েরা তাদের ইচ্ছেমত খেলাধুলা করতে পারে। নতুবা জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় ও সংগঠক গড়ে তো উঠবেনই না; বরং শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলার মাধ্যমে বিনোদনেরও সামান্যতম সুযোগও মিলবে না। ভবিষ্যতে এমন একটা প্রজন্ম গড়ে উঠবেÑ যাদের জীবনে খেলাধুলার কোনো সুযোগই থাকবে না। সে ক্ষেত্রে কিশোর-তরুণ-যুবকরা স্বাভাবিক নিয়মেই বিপথে ধাবিত হবে। এখনই যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে সামনের দিনগুলোতে কী হয়Ñ তা ভাবাটাও দুঃস্বপ্নের নামান্তর।
তরুণ প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য খেলার মাঠ, উন্মুক্ত প্রান্তর, পার্কের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিদ্যমান খেলার মাঠ, খোলা প্রান্তর, পার্কসমূহ রক্ষা, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরুরিভিত্তিতে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কেননা, সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি হলে তার সর্বনাশা ছোবল থেকে আমরা কেউই রক্ষা পাব না।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মে ২০০৩


জাতীয় বাজেট ও আমাদের খেলাধুলা

চলতি মাসে জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে আগামী অর্থবছরের বাজেট। জাতীয় সংসদে আলোচনার পর যে বাজেট অনুমোদিত হবে, তাতে প্রতিফলিত হবে পরবর্তী বছরের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনও।
জাতীয় বাজেট দেশের অর্থনীতির দিক-নির্দেশক। সাংবাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ ছাড়াও কোন্ খাতকে গুরুত্ব দেয়া হবে, কোন্টাকে দেয়া হবে নাÑ তার পরিমাপক জাতীয় বাজেট। জাতীয় বাজেট বিচার-বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করা যায় দেশের অর্থনীতির গতিচিত্র। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এর জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করতে হিমশিম খেতে হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কখনোই তেমন সুদৃঢ় ছিল না। বিদেশী সাহায্য ব্যতীত জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান এমন যে, জাতীয় রাজস্ব থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ উঠে আসে না। প্রতি বছরই সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে চলতে হয়। কাপড়ের বহর মাপে এত ছোট যে, একদিকে টানলে আরেক দিকে খাটো হয়ে যায়। এ অবস্থার মধ্যেই সবকিছু সামলে চলতে হয়।
ক্রীড়াঙ্গনও জাতীয় বাজেট থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পর জাতীয় বাজেটে খেলাধুলার কথা বিবেচনা করা হয়। যে কারণে ক্রীড়াঙ্গনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাফল্যের তরীতে ভাসতে হলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ে, তা সংকুলান করা সম্ভব হয় না। মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নিচের দিকে। খুব সম্ভবতঃ বিশ্বের ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। এই যদি হয় মাথাপিছু আয়ের অবস্থা, সে ক্ষেত্রে ক্রীড়া খাতে মাথাপিছু ব্যয় বরাদ্দ দূরবীন দিয়ে দেখা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। ইচ্ছে করলেই যে ক্রীড়া খাতে মাথাপিছু ব্যয় বৃদ্ধি করা যাবেÑ তেমনটি ভাবার অবকাশ নেই। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা খাতেই প্রয়োজনীয় অর্থ সংকুলান করা যায় না। সবসময় একটা টানাটানি থেকে যায়। অবশ্য আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শক্তিশালী করা গেলে বিভিন্ন চাহিদা অনুপাতে ব্যয় করা খুব বেশি কঠিন ছিল না। কিন্তু রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি বরাবরই থেকে যায়। বিত্তহীনদের যেটুকু করের সীমানা, সেটা তাদের পক্ষে দেয়া কঠিন হলেও তারা তা দিতে কার্পণ্য করে না। কিন্তু বিত্তশালীরা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ভিতকে দুর্বল করে দিচ্ছে। রাজস্ব কর ফাঁকি শক্ত হাতে দমন করা হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার চালচিত্র অনেকাংশে পাল্টে যেত বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
হঠাৎ করে অর্থনীতির এই কচকচানি এমনি এমনি করা হচ্ছে না। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে যেয়ে শুধু খেলাধুলার কথা আলাদাভাবে ভাবলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে যারা আরো দ্রুত ছুটছেন, আরো উঁচুতে উঠছেন এবং আরো শক্তিশালী হচ্ছেনÑ তাদের সঙ্গে পাল্লা দেয়া আমাদের পক্ষে সহজ নয়। কেননা, যারা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্যের আলোতে উদ্ভাসিত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। এর মাঝে যারা ব্যতিক্রম, তারা সহজাত প্রতিভা দিয়ে সাফল্য পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের সহজাত প্রতিভা আছে কিনা, সেটা যাচাই করার মত অর্থনৈতিক অবস্থা ও কাঠামো আমাদের নেই। এ অবস্থায় বড় ধরনের সাফল্য আশা করাটা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।
তবে এটা ঠিক, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে খেলাধুলাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে সুস্থ দেহ, সুস্থ মনের বিকল্প নেই। সঙ্গত কারণে ক্রীড়াঙ্গনকে হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই। এ কারণে আজ অব্দি ক্রীড়াঙ্গনে পর্যাপ্ত অর্থ ঢালা না হলেও খুব কম অর্থ যে ঢালা হয়েছেÑ তা বলা যাবে না। কিন্তু যেভাবে দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে অনুপাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ছে না। তবে অর্থ দিয়েই যে ক্রীড়াঙ্গনের সব সমস্যার সমাধান করা যাবে, সেটা ভাবাও ভুল।
শুধু সরকারের পক্ষে দেশের খেলাধুলাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকরা বরাবরই ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকরা যাতে আরো এগিয়ে আসেন, সে জন্য সরকারের তরফ থেকে পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকরা যে পরিমাণ অর্থ ক্রীড়াঙ্গনে ব্যয় করবেন, তার কর মওকুফ করে দেয়া হলে অনেকেই খেলাধুলায় উৎসাহী হবেন। অতীতে এমনটি যে করা হয়নি, তা নয়। কিন্তু তার পরিমাণ সীমিত অংকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ক্রীড়াঙ্গনে যে পরিমাণ টাকা পৃষ্ঠপোষকরা ব্যয় করবেন, তার পুরোটার কর মওকুফ করা হলে ক্রীড়াঙ্গনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এছাড়া বাংলাদেশে যেসব খেলা জনপ্রিয়, তার অধিকাংশ ক্রীড়া সরঞ্জামই ব্যয়বহুল। সবার পক্ষে তা ক্রয় করা সম্ভব হয় না। এ কারণে দেশীয় তৈরি ক্রীড়া সরঞ্জামের পাশাপাশি যেসব ক্রীড়া সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, তার শুল্ক হ্রাস করা যেতে পারে। ক্রীড়া সরঞ্জামের দাম নাগালের মধ্যে থাকলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে। তৈরি হবে নতুন নতুন খেলোয়াড়। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আশানুরূপ সাফল্যের পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ প্রভাব ফেলবে। দেশের খেলাধুলার বৃহত্তর স্বার্থে আসন্ন জাতীয় বাজেটে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে বলে আমরা আশা করছি।
ক্রীড়াজগত : ১ জুন ২০০৩


ক্রীড়াবিষয়ক ইতিহাস সংরক্ষণ করা প্রয়োজন

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস সংরক্ষণ কিংবা তা নিয়ে কোনো গবেষণামূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া হয়নি বললেই চলে। এ কারণে অনাদর ও অবহেলায় আড়ালে চলে যাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অথচ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সর্বোপরি ক্রীড়াঙ্গনের বৃহত্তর স্বার্থে এ দেশের খেলাধুলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখ-ে খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। লোকায়ত গ্রামীণ খেলাধুলার ইতিহাস হাজার বছরের। জীবনযাত্রা ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্ভব ঘটেছে বিভিন্ন খেলাধুলার। কিছু কিছু খেলা এখনও অব্যাহত থাকলেও অসংখ্য খেলা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। এইসব খেলা হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হারিয়েছি এই জনপদের অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। আবহমান বাংলার গ্রামীণ খেলাধুলার যেসব খেলা এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাও ক্রমশ বিলুপ্ত হতে চলেছে। অবশ্য বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ হলেও গ্রামীণ খেলাধুলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণামূলক ও পা-িত্যপূর্ণ কোনো কাজ এখন অবধি হয়নি। গ্রামীণ খেলাধুলার পাশাপাশি বৃটিশরা এ অঞ্চলে আসার পর প্রচলন ঘটে বিভিন্ন বিদেশী খেলাধুলার। আজ আমরা যেসব খেলাধুলা খেলছি, তার অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত। বৃটিশরা তাদের শাসন-শোষণের পাশাপাশি বিনোদন হিসেবে যেসব খেলাধুলা করত, সময়ের পরিক্রমায় সেইসব খেলাধুলাই এখন আমাদের নিজস্ব খেলাধুলায় পরিণত হয়েছে। এইসব খেলাধুলার বয়সও দেখতে দেখতে কম দিন হলো না। অন্তত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কারণে আমরা কিছু কিছু খেলা নিয়ে অবশ্যই গর্ব করতে পারি। সাফল্য না পেলেও আমরা যখন থেকে ফুটবল খেলছি, বর্তমানে ফুটবলে পরাশক্তি অনেক দেশেই তখন ফুটবলের প্রচলন ছিল না। তবে সেই বৃটিশ আমল থেকে খেলাধুলায় কম-বেশি যা কিছু সাফল্য বা গর্ব করার মত ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষেরা। ১৯১১ সালে আইএফএ শীল্ড জিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে মোহনবাগান ক্লাব। এই জয় ছিল বৃটিশদের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষের বিজয়। এ জয় ছিল প্রতিশোধের, প্রতিবাদের। গোরাদের দল ইস্ট ইয়র্ককে হারিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত হয় এ অঞ্চলের মানুষ। সেই দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় ছিলেন এই অঞ্চলের। ১৯৩৭ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকার ফুটবল ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাংলার দামাল ছেলেদের নিয়ে গড়া ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র পাখী সেনের দেয়া গোলে ইংলিশ ফুটবল লীগের ক্লাব এএফসি কোরিন্থিয়ান ক্লাবকে হারিয়ে দারুণভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় চির-অম্লান হয়ে আছে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আজ অবধি দলগত সাফল্যের পাশাপাশি অনেক ক্রীড়াবিদই ব্যক্তিগত প্রতিভা দিয়ে উজ্জ্বল করেছেন দেশের মুখ। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও অনেকেই খেলাধুলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে রক্ষণশীল সমাজের অর্গল ভেঙ্গে বৈরী পরিবেশে যে সব নারী পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অনেক উজ্জ্বল ও বর্ণাঢ্য চরিত্র আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছেন। এক একজন ক্রীড়াবিদ বিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস খানিকটা মলিন হয়ে যায়। কেননা, এসব ক্রীড়াবিদের ভূমিকা ও অবদান লিপিবদ্ধ বা ধরে রাখার তেমন ব্যবস্থা নেই।
ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হলে ক্রীড়াবিষয়ক বই-পুস্তক, গবেষণা, আর্কাইভ, জাদুঘর, ওয়েবসাইট ইত্যাদি চালুর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে নানা বই-পুস্তক প্রকাশিত হলেও ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থ অত্যন্ত অপ্রতুল। হাতে গোনা যে ক’টি গ্রন্থ বের হয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশই আশানুরূপ নয়। খেলাধুলা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো গবেষণাধর্মী কাজ হয়নি। অবশ্য গবেষণার মত দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ কাজ করার জন্য যে অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন, সে ধরনের মানসিকতা ও পরিবেশ এখনও বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। আর আর্কাইভ ও জাদুঘর করাটা এখনও আমাদের ভাবনায় ঠাঁই পায়নি। যে কারণে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শন ও তথ্য ক্রমান¦য়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ওয়েবসাইট তথ্য প্রযুক্তির অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। ওয়েবসাইট খুললেই চোখের পলকেই ভেসে ওঠে সারি সারি তথ্য। এই তথ্যসমুদ্রে ডুব দিলেই যে কোনো বিষয়ে খুব গভীরভাবে জানা যায়। এক ক্রিকইনফোতে ঢুকলেই জানা যায় ক্রিকেটের সাতকাহন। এরকমভাবে প্রতিটি খেলা নিয়ে গড়ে ওঠেছে আলাদা আলাদা ওয়েব সাইট। অথচ বাংলাদেশ এখনও এ বিষয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
ইতিহাস মানুষকে পথ দেখায়। ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে সভ্যতার এগিয়ে চলা। ইতিহাসের আয়নায় প্রতিফলন ঘটে যে অভিজ্ঞতার, তারই আলোকে আলোকিত করা যায় আগামীর দিনগুলো। ক্রীড়াক্ষেত্রেও আমাদের এগিয়ে যেতে হলে ক্রীড়াবিষয়ক ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। আর এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কেননা, আমরা ইতিহাসের সন্তান। তাই আমাদের নিজেদেরই প্রয়োজনে ইতিহাসকে ধরে রাখতে হবে।
ক্রীড়াজগত : ১ জুলাই ২০০৪


মহামিলনের ক্রীড়া উৎসব

বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অলিম্পিক গেমস ১০৭ বছর পর ফিরে এসেছে জন্মভূমিতে। আগামী ১৩ থেকে ২৯ আগস্ট গ্রীসের রাজধানী অ্যাথেন্সে বসছে অলিম্পিকের ২৮তম আসর। খেলাধুলা ও অলিম্পিজমের পাশাপাশি এই ক্রীড়া উৎসবে সম্মিলন ঘটবে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শান্তির।
অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রচলন আছে অনেক গল্পগাথাঁ ও কিংবদন্তী। তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসেবে যেটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, তা হলোÑ খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে গ্রীক দেবতা জিউসের পূজো উপলক্ষে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। গ্রীসের একটি রাজ্য এলিসের রাজধানী অলিম্পিয়ায় প্রথম অলিম্পিকের আসর বসে। শহরের নামানুসারে প্রতিযোগিতার নামকরণ করা হয়। প্রাচীন গ্রীসে সব খেলার মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ছিল অলিম্পিক গেমসে। চার বছর অন্তর আয়োজিত অলিম্পিক গেমসে শুধু সেরা অ্যাথলেটরাই অংশ নিতেন না, একত্রিত হতেন ভাস্কর, কবি, লেখক, বক্তা ও রাজনীতিবিদরা। নিজেদেরকে জানা ও অন্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়াটা ছিল প্রধান লক্ষ্য। দার্শনিক সক্রেটেস, পিথাগোরাস, অ্যারিস্টোটলের মত মনীষী, এমনকি চিকিৎসাবিদ্যার জনক হিপোক্রেটস গেমসে যোগদান ও অংশগ্রহণ করেন। আরেকজন বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জয়ী হন। বিবিধ আবেগের একটি উৎস অলিম্পিক গেমস। এই আবেগ ক্রীড়া, কলা, সংস্কৃতি ও সংগ্রহকে একত্রিত করে। রোমানরা গ্রীস দখল করার পর বন্ধ হয়ে যায় প্রাচীন অলিম্পিক গেমস। তবে যে গ্রীসে প্রাচীন অলিম্পিক গেমসের মশাল নিভেছিল, সেই গ্রীসেই শুরু হয় আধুনিক অলিম্পিক গেমসের যাত্রা। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ফ্রান্সের শিক্ষাব্রতী ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তে। সারা বিশ্বের ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকদের এক জায়গায় মিলিত হওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে আধুনিক অলিম্পিক গেমস প্রবর্তন করা হয়, তা এখন মহামিলনের উৎসবে পরিণত হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে শান্তির মহান প্রতীক অলিম্পিক গেমস।
অলিম্পিক গেমস শুধু ক্রীড়া উৎসব নয়, এটি জীবনযুদ্ধের লড়াইও। বড় পরিসরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা ও দেশের মর্যাদা রক্ষা করার চমৎকার সুযোগ। আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জেমস কনোলির। তিনি ট্রিপল জাম্পে এই মাইলফলক গড়েন। অন্যতম আকর্ষণ ম্যারাথনে জয়ী হন গ্রীসের ডাক বিভাগের কর্মী স্পিরিডন লুইস। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের গত ২৪টি আসরে কত মহানায়কের উত্থান ঘটেছে। তারা তাদের পরিশ্রম ও লড়াই দিয়ে জয় করেছেন বিশ্বের মানুষকে। তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র হলোÑ সিটিয়াস, অলটিয়াস ও ফর্টিয়াস। আরো দ্রুত ছুটে চলা, আরো উঁচুতে ওঠা ও আরো শক্তিশালী হওয়ার লড়াইয়ে জয়ী হয়ে কিংবদন্তী হয়ে আছেন দূরপাল্লার দৌড়বিদ ফিনল্যান্ডের পাভো নুরমি, যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু জনি ওয়েসমুলার, কৃষ্ণকায় অ্যাথলেট যুক্তরাষ্ট্রের জেসি ওয়েন্স, হল্যান্ডের অ্যাথলেট ফ্যানি ব্লাঙ্কার্স কোয়েন, চেকোশ্লোভাকিয়ার অ্যাথলেট এমিল জেটোপেক, ইথিওপিয়ার আবেবে বিকিলা, রাশিয়ান জিমন্যাস্ট ওলগা করবুট, যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু মার্ক স্পিৎস, রুমানিয়ার জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানিচি, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাথলেট কার্ল লুইস, জার্মানীর সাঁতারু ক্রিস্টিন অটো, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাথলেট মাইকেল জনসন, অস্ট্রেলিয়ার সাঁতারু ইয়ান থর্প প্রমুখ। এদের মধ্যে পাভো নুরমি ১৯২০, ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালের অলিম্পিকে ৯টি স্বর্ণ, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে এমিল জেটোপেকের ১৯৫২ সালে ৩টি স্বর্ণ, ১৯৪৮ সালে দুই সন্তানের জননী ফানি ব্ল্যাঙ্কার্স কোয়েনের ৪টি স্বর্ণ, ইথিওপিয়ার রাজার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী আবেবে বিকিলার ১৯৬০ ও ১৯৬৪ সালের অলিম্পিক ম্যারাথনে স্বর্ণ, ১৯৭২ সালে মার্ক স্পিৎসের ৭টি স্বর্ণ, ১৯৭৬ সালে নাদিয়া কোমানিচির জিমন্যাস্টিক্সে পারফেক্ট টেন অর্জন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রতিটি অলিম্পিকে কার্ল লুইস ৯টি স্বর্ণপদক জয় করে অসাধারণ কীর্তি গড়েছেন। এই মহানায়কদের পাশাপাশি ১৯০৮ সালের অলিম্পিকে ইতালির ম্যারাথন দৌড়বিদ ডোরান্ডো গিয়েত্রি, ২০০০ সালের অলিম্পিকে ইকোয়েটোরিয়ান গিনির সাঁতারু এরিক মোসাম্বানি আলাদাভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। গিয়েত্রি সবার আগে স্টেডিয়ামে ঢুকে লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু মনের তীব্র জোরে একজন চিকিৎসক ও কর্মকর্তার সাহায্যে শেষ পর্যন্ত টেপ স্পর্শ করেন। অন্যের সাহায্য নিয়ে বিজয়ী হওয়ায় তাকে পদক দেয়া না হলেও তিনি দর্শকদের ভালবাসা পান। এরিক মোসাম্বানির ছোট্ট দেশটিতে কোনো সুইমিংপুল না থাকলেও সিডনিতে এসে সাঁতারে অংশ নিতে যেয়ে হাবুডুবু খেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় নিয়ে অতিকষ্টে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হন। দর্শকরা তাকে দারুণভাবে অভিনন্দিত করেন।
প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেমসে ৯টি খেলায় ১৩টি দেশের ৩১১ জন পুরুষ প্রতিযোগী অংশ নেন। আর এবার অ্যাথেন্স অলিম্পিকে ২৮টি খেলায় দু’শতাধিক দেশের প্রায় ১১ হাজার অ্যাথলেট অংশ নেবেন। দিনে দিনে অলিম্পিক গেমসের ব্যাপ্তি বেড়েই চলেছে। মিলনের এই মহা-উৎসবে জয়টাই সবচেয়ে বড় কথা নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা। কেননা, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিজয় নয়, লড়াইটাই আসল। আর এই লড়াইয়ে অন্যান্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশও সামিল হবে।
ক্রীড়াজগত : ১ আগস্ট ২০০৪


অ্যাথেন্স অলিম্পিক : অতীত ও আধুনিকতার মেলবন্ধন

অলিম্পিক গেমস পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও বর্ণিল ক্রীড়া আসরই নয়, এটি মহামানবের মহামিলন মেলা হিসেবেও স্বীকৃত। শিল্প, সৌন্দর্য ও লড়াইয়ের এই মহামঞ্চে এবার যোগ হয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ ও মহাকাব্য। অতীত ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে অ্যাথেন্স অলিম্পিকে।
একটি অলিম্পিক গেমস আয়োজন করা যে কোন দেশের জন্য গৌরব ও অহংকার। তবে অলিম্পিক গেমস আয়োজন করা সহজ ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়। অলিম্পিক গেমস আয়োজন করার জন্য নির্মাণ ও সংস্কার খাতে এত বেশি অর্থ ব্যয় হয় যে, তা পুষিয়ে নেয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। এক-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া অলিম্পিক গেমস আয়োজন করে অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি লাভবান হওয়া যায়নি। এ কারণে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো, এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কারো পক্ষে অলিম্পিক গেমস আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপের দুর্বল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত অ্যাথেন্সে পুনরায় অলিম্পিক গেমস আয়োজন করাটা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অলিম্পিকের শতবর্ষ পূর্তির আসরটিতে গ্রীসের স্বাগতিক হওয়ার দাবি ও আবেগ জড়িয়ে থাকলেও সে সময় তাদের দেয়া হয়নি। এ কারণে ১৯৯৭ সালে গ্রীসকে ২০০৪ সালের অলিম্পিকের স্বাগতিক নির্বাচিত করা হলেও একটা পর্যায়ে তারা আয়োজন করতে পারবে কিনাÑ তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। বলতে গেলে প্রথম তিনটি বছর কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চাপে সক্রিয় হয় গ্রীস এবং এ যাবৎকালের অন্যতম সেরা অলিম্পিক গেমস আয়োজনের অঙ্গীকার করে তারা।
অ্যাথেন্স অলিম্পিক গেমসের অতীতের সবগুলোকে ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও বিশালত্বের দিক দিয়ে অ্যাথেন্স অলিম্পিক নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ১৭ দিনব্যাপী এই মহাক্রীড়াযজ্ঞে ৩৮টি ভেন্যুতে ২৮টি ক্রীড়ায় ৩০১টি পদকের জন্য প্রতিদ্বন্দি¡তা করছেন ২০১টি দেশের ১০ হাজার ৫০০ অ্যাথলেট। তাদের সঙ্গে রয়েছেন সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তা। ২২ হাজার সাংবাদিক এই গেমস কভার করবেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সদস্য। অলিম্পিক গেমস শান্তি ও সম্প্রীতির মিলন মেলা হলেও নিরাপত্তার বিষয়টি ইদানীং শংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তা থেকে দূরে নেই অলিম্পিক গেমসও। নিরাপত্তা হুমকির কারণে অলিম্পিক গেমসে এটি ব্যয়ের বড় একটি খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অলিম্পিকে রাজনৈতিক মত-পার্থক্যের বিষয়টি অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ১৯৩৬ সালের হিটলারের বার্লিন অলিম্পিক থেকে øায়ুযুদ্ধের সময় মস্কো ও লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক বয়কটের ঘটনাসহ বিভিন্ন সময় রাজনীতি অলিম্পিক গেমসকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু মহান প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মানবতার বন্ধনের যে অলিম্পিক আদর্শ, তার প্রতিফলন অ্যাথেন্স অলিম্পিক। এই গেমস অলিম্পিক স্বপ্ন পূরণের একটা চমৎকার উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইরাকের অ্যাথলেটদের অংশগ্রহণ, তালেবানের পতনের পর ট্র্যাকস্যুট ও হেডস্কার্ফ পরিধান করে এই প্রথম কোনো আফগান নারীর যোগদান এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের øায়ুযুদ্ধরত উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একই সঙ্গে মার্চপাস্টে অংশগ্রহণ অলিম্পিকের মহান আদর্শকে সমুন্নত রেখেছে। এই আদর্শকে সর্বত্রই কার্যকর করা হলে দেশে দেশে গড়ে উঠবে শান্তি-মৈত্রী-বন্ধুত্বের বন্ধন।
চার বছর পর পর আয়োজিত অলিম্পিক গেমস ক্রীড়াবিদদের কাছে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির ক্রীড়া উৎসব। অলিম্পিকে পদক প্রাপ্তির জন্য ক্রীড়াবিদরা বছরের পর বছর অনুশীলন ও পরিশ্রম করে থাকেন। অলিম্পিকে পদক জয় করাটা তাদের জীবনের একটি স্বপ্ন। মরক্কোর কিংবদন্তী অ্যাথলেট হিশাম এল গুরুজ ১৫০০ মিটার দৌড়ে সাফল্যের বরপুত্র হলেও অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয় করতে না পারাটা তার কাছে ভীষণ ব্যর্থতা হয়ে আছে। এবার তিনি শেষবারের মত এই ব্যর্থতা দূর করার চেষ্টা করবেন। এমনিভাবে প্রতিটি অলিম্পিক গেমসে ক্রীড়াবিদরা ছুটে আসেন স্বপ্ন পূরণের আশায়। অলিম্পিক গেমসের ১০৮ বছরের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)-র সদস্যভুক্ত ৮৬টি দেশ কখনোই পদক জিততে পারেনি। এর মধ্যে আফ্রিকার ৩২টি, এশিয়ার ১৮টি, লাতিন আমেরিকার ১৬টি, ওশেনিয়ার ১২টি ও ইউরোপের ৮টি দেশ। একটি দেশের অ্যাথলেটরা যখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করছেন এবং সাফল্য পাচ্ছেন, অন্যদিকে আরেকটি দেশের অ্যাথলেটরা অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের ছাড়পত্র পেতে হিমসিম খেয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার মতো দেশের অ্যাথলেটরা যখন নিজেদের ছাড়িয়ে যাবার সাধনায় মগ্ন, তখন আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, ইরান, ইরাকের অ্যাথলেটদের অংশগ্রহণটাই বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মার্কিন আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত ইরাকের একমাত্র নারী প্রতিনিধি আলা হেকমত। যুদ্ধ, নিরাপত্তাহীনতা ও প্রাণহানির আশংকা মাথায় নিয়ে এই ইরাকি অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্সে অংশ নেবেন। ইরানের একমাত্র নারী অ্যাথলেট নাসিম হাসানপুর ছোটবেলা থেকেই জিমন্যাস্টিক্স ভালবাসলেও রক্ষণশীল সমাজের কাছে তার ভালবাসাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্কার্ফ ও বোরখা গায়ে দিয়ে তাকে অংশ নিতে হবে শুটিংয়ে। ইসরাইল অধিকৃত গাজা উপত্যকায় সৈন্যদের তাক করা বন্দুকের গুলি ও সমাজের ভ্রƒকুটি উপেক্ষা করে অলিম্পিকে অংশ নেবেন সানা আবু বিখিত। অলিম্পিকে প্যালেস্টাইনের প্রথম মহিলা অ্যাথলেট বিখিত ট্রাক অ্যান্ড ফিল্ডে অংশ নেবেন। আফগানিস্তানের মেয়েরাও অংশ নেবেন অ্যাথেন্স অলিম্পিক গেমসে। প্রতি পদে পদে বাধার পাহাড় অতিক্রম করে অলিম্পিকে অংশ নিতে পেরে এই মেয়েরা সন্তুষ্ট।
অলিম্পিক গেমসে বড় বড় দেশের অ্যাথলেটরা সাফল্য দেখালেও তাদের জন্য মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ান অখ্যাত দেশের অ্যাথলেটরা। এবারের অলিম্পিকে সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের কিম কলিন্স ১০০ মিটার স্প্রিন্টে, ডোমিনিকান রিপাবলিকের ফেলিক্স সানচেজ ৪০০ মিটার হার্ডলসে, গ্রেনাডার অ্যালেইন ফ্রান্সিক ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে, মাল্টার শ্যুটার উইলিয়াম কেটকুটির মত ক্রীড়াবিদরা সাফল্য দেখালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অলিম্পিক গেমসে ১০ সেকেন্ডে ঘটে যায় কত রোমাঞ্চকর ঘটনা। ১৭ দিনব্যাপী গেমসের প্রতি মুহূর্তে ঘটবে কত শত ঘটনা। এই ঘটনাগুলো ইতিহাসের পাতায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। এর পাশাপাশি আমরা প্রত্যক্ষ করবো জন্মভূমিতে অলিম্পিক গেমস। এটা আমাদের অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে থাকবে।
ক্রীড়াজগত : ১৬ আগস্ট ২০০৪


স্মরণীয় অলিম্পিক গেমস

ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে অ্যাথেন্স অলিম্পিক গেমস। জন্মভূমিতে অলিম্পিক গেমসের ফিরে আসাটা একদিকে যেমন গৌরবের, অন্যদিকে চমৎকার আয়োজনের জন্য তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
একটি অলিম্পিক গেমস আয়োজন করার অর্থ হলো সভ্যতার এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। অলিম্পিক গেমসের জন্ম যেহেতু অ্যাথেন্সে, এ কারণে এবারের গেমসকে সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য গ্রীসের প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর হলেও ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সম্মানের কথা বিবেচনা করে গ্রীস কোনো কিছুতেই পিছপা হয়নি। দেনার দায়ে ডুবে যাবার সম্ভাবনা সত্ত্বেও কোনো কিছুতেই কমতি রাখেনি গ্রীস। অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সুরে, ছন্দে, জাঁকজমকে সবাইকে ম্লান করে দেয়। আলোর বিচ্ছুরণ ও আতশবাজির মনোরম ঝলকানি আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বিশ্বের প্রাচীন ইতিহাস। আধুনিকতার সংমিশ্রণ ফুটিয়ে উপস্থাপন করা হয় গ্রীসের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও সৌন্দর্যের স্বপ্নীল সম্ভার। গ্রীকদের আবেগ ও কল্পনায় বিশ্ববাসী অতীত ও বর্তমানের গ্রীসকে দেখতে পেয়েছে।
জন্মভূমিতে অলিম্পিক গেমস আয়োজনের পাশাপাশি এবারের গেমস স্মরণীয় হয়ে থাকবে মার্কিন সাঁতারু মাইকেল ফেলপসের কৃতিত্বে। ১৯ বছরের অসাধারণ প্রতিভাবান এই সাঁতারু ৬টি স্বর্ণ ও ২টি ব্রোঞ্জ পদক জিতে এবারের অলিম্পিককে মহিমানি¦ত করেছেন। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে মার্ক স্পিৎজের সাতটি স্বর্ণজয়ের রেকর্ড ম্লান করতে না পারলেও তিনি যা করেছেনÑ তা কম ক্রীড়াবিদই করতে পেরেছেন। তার আগে একমাত্র ১৯৮০ সালে মস্কোতে সোভিয়েত জিমন্যাস্ট আলেকজান্ডার ফিতিয়েতিন এক অলিম্পিকে আটটি পদক জিততে সক্ষম হন। অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্সে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিন গ্যাটলিন দ্রুততম মানব হলেও দ্রুততম মানবী হয়েছেন বেলারুশের ইউলিয়া নেস্টেরেঙ্কো। মহিলা পোলভল্টে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েন রাশিয়ার ইয়েলিনা ইসিনবায়েভা। অলিম্পিকের পুরুষ অ্যাথলেটিক্সে চীনের কোনো স্বর্ণপদক ছিল না। এবারই ১১০ মিটার হার্ডলসে প্রথম স্বর্ণ জয় করেন লিউ জিয়াং। পোল্যান্ডের রবার্ট কোরজেনিউস্কি ৫০ কিলোমিটার হাঁটায় চতুর্থবারের মত স্বর্ণ জয়ের বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের প্রথম স্বর্ণ এসেছে ফেলিক্স সানচেজের সাফল্যে। ৪০০ মিটার হার্ডলসে তিনি সবাইকে টপকে যান। ক্যারিবীয় দ্বীপ বাহামাকে অলিম্পিকে প্রথম স্বর্ণ এনে দেন টনিক উইলিয়ামস ডার্লিং। মেয়েদের ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে জয়ী হয়ে তিনি দেশকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে দেন। চিলির পক্ষে প্রথম স্বর্ণ জেতেন নিকোলাস মাসু। টেনিসের পুরুষ এককে বিশ্বসেরাদের হারিয়ে তিনি চমক দেখান। সাঁতারের ২০০ মিটারের ব্যাকস্ট্রোকে সোনা জিতেছেন জিম্বাবুয়ের কার্স্টি কভেন্ট্রি। অলিম্পিকে এটি জিম্বাবুয়ের প্রথম পদক। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ আহমেদ বিন মোহাম্মদ বিন হাশর আল মাখতুম শুটিংয়ে স্বর্ণ জিতে দেশের পক্ষে প্রথম পদক জয়ের গৌরব অর্জন করেন। থাইল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম স্বর্ণ লাভ করেন উদমপন পলম্যাক, মহিলা ভারোত্তোলনে। তার এই সাফল্যে থাইল্যান্ডে খুশীর জোয়ার বয়ে যায়। মহিলাদের নৌকাবাইচে ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক থেকে অ্যাথেন্স অলিম্পিক পর্যন্ত ৮টি স্বর্ণসহ ১২টি পদক জিতে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন জার্মানীর বিরজিট ফিশার। ১৫০০ মিটার স্প্রিন্টে চারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী মরক্কোর হিশাম এল গুরুজের অধরা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এবারের অলিম্পিকে। মাঝারীপাল্লার দৌড়ের অপ্রতিদ্বন্দ¡ী এই অ্যাথলেট অলিম্পিকে স্বর্ণ জয় ছাড়া সবকিছুই জিতেছিলেন। জীবনের এই শেষ অলিম্পিকে শেষ পর্যন্ত তিনি স্বর্ণ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। আবারো অলিম্পিকে সবচেয়ে শক্তিশালী মানব হয়েছেন ইরানের হোসেন রেজা জাদেহ। ভারোত্তোলনের সুপার হেভিওয়েটে স্বর্ণ জিতে তিনি আখ্যা পেয়েছেন এ যুগের ‘হারকিউলিস মানব’ হিসেবে। বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম শক্তি আর্জেন্টিনা অলিম্পিকে কখনো পদক জিততে পারেনি। এবার তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কোনো পদক না পেয়েও অখুশী নয় ইরাক। মার্কিন আগ্রাসনে জীবন-মৃত্যুর লড়াই আর প্রতিরোধ সংগ্রামের মাঝেও ইরাকী ফুটবল দল এবারের অলিম্পিকে চতুর্থ হয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষে একমাত্র পদকটি লাভ করেন ভারতের শুটার রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর। তিনি রৌপ্যপদক জয় করেন। অলিম্পিক হকিতে অসংখ্যবার স্বর্ণজয়ী ভারতের ব্যক্তিগত কোনো ইভেন্টে এটিই সর্বোচ্চ পদক। অলিম্পিকে পদক জয় বাংলাদেশের কাছে অলৌকিক স্বপ্ন হলেও এবারের গেমসে বাংলাদেশের পারফরমেন্স খুব একটা খারাপ নয়। শুটার আসিফ হোসেন খান না পারলেও দুই সাঁতারু জুয়েল আহমেদ ও ডলি আখতার এবং অ্যাথলেট শামসুদ্দিন তাদের সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করাটা কম গৌরবজনক নয়। টানা সপ্তম অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়ে ৪৪ বছর বয়স্কা অ্যাথলেট মারলিন ওটি বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন।
সাফল্যের অপর পিঠেই থাকে ব্যর্থতা। বাস্কেটবলের অপ্রতিদ্বন্দ¡ী দল যুক্তরাষ্ট্র। অলিম্পিকে ১২ বার শিরোপাধারী এই ‘ড্রিম টিম’টি এবার সেমিফাইনালে বিদায় নিয়েছে। অলিম্পিকের মহিলা অ্যাথলেটিক্সে পাঁচটি পদক জয়ের একমাত্র গৌরব যুক্তরাষ্ট্রের মারিয়ন জোনসের।সিডনি অলিম্পিকে তিনটি স্বর্ণ ও দুটি ব্রোঞ্জ পদকজয়ী এই অ্যাথলেট এবারের অলিম্পিকে কোনো পদক না পেয়ে ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। তারই মত এবার শূন্য হাতে ফিরে গেছেন দূরপাল্লার দৌড়বিদ ইথিওপিয়ার হেইলে গেব্রেসেলাসি, হার্ডলার গেইল ডেভার্স, ৮০০ মিটার দৌড়ে সোনাজয়ী মোজাম্বিকের মারিয়া মুতোলা, রাশিয়ার সাঁতারু আলেকজান্ডার পোপভ, টেনিস খেলোয়াড় সুইজারল্যান্ডের রজার ফেদেরার প্রমুখ। খেলাধুলার সঙ্গে মাদকের সংশ্লিষ্টতা ক্রমান¦য়ে বাড়ছে। এ থেকে অলিম্পিকও পিছিয়ে নেই। ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিকে কানাডার বেন জনসনের দ্রুততম মানবের পদক প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তা দারুণ সাড়া জাগায়। এবার স্বর্ণপদক কেড়ে নেয়া হয় রাশিয়ার শটপুটার ইরিনা করঝানেনকোভ ও হাঙ্গেরীর ডিসকাস থ্রোয়ার রবার্ট ফাজেকাসের। এবারের অলিম্পিকে সৌন্দর্য ও শৈল্পিক ক্রীড়া জিমন্যাস্টিক্স তার সৌন্দর্য কিছুটা হারিয়েছে। বিচারকদের পক্ষপাতের কারণে রাশিয়ার আলেক্সেই নেমভ, সভেৎলিনা খরকিনার মত জিমন্যাস্টরা বঞ্চিত হন।
অলিম্পিক গেমস মানব সভ্যতার অগ্রগতির একটি বড় ধাপ। এই গেমসে কোনো কালিমা ও মালিন্য স্পর্শ করলে তা দুঃখজনক। এই গেমস আগামীতে আরো যাতে নিখুঁত ও নির্ভেজালভাবে আয়োজন করা যায়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
ক্রীড়াজগত : ১ সেপ্টেম্বর ২০০৪

গ্রামীণ খেলাধুলা এবং আমাদের অস্তিত্বের সংকট

ইদানীং একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে সম্প্রচারিত হচ্ছে মেগা সিরিয়াল ‘রঙের মানুষ’। এর প্রতিটি পর্বে গ্রাম-বাংলার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনার যে অন্তরঙ্গ ছবি ফুটে উঠে, তা তো হাজার বছরের বাঙালির চিরকালের ছবি। আবহমান বাংলার চিরায়ত দৃশ্য। অভাব-অনটন, আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝে মন্থর ও গতিহীন জীবনে ছিল অখ- অবসর ও বিনোদনের নানা উপকরণ। জীবনের গ-ি ছিল সীমাবদ্ধ। এর মাঝেও তারা নানাভাবে খুঁজে নিয়েছেন আনন্দময় জীবন। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর কিংবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে মেতে উঠেছেন গান-বাজনা ও খেলাধুলায়। জীবনকে উপভোগ করেছেন নিজেদের মত করে। তারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কুস্তি লড়েছেন। নিরালায় খেলেছেন ‘বাঘবন্দী’। কখনো সখনো উড়িয়েছেন ঘুড্ডি। রঙমেহের গ্রামের মাঞ্জেলাকে পাবার জন্য কুস্তি রশিদ ও হানেফ পালোয়ানের চ্যালেঞ্জ দিয়ে লড়াই গ্রামবাসীদের কাছে ছিল উপভোগ্যময়। কুস্তি এখন অব্দি টিকে থাকলেও তা ‘রেসলিং’ নাম নিয়ে যেভাবে আমাদের কাছে পরিবেশিত হয়, তা অনেকেরই কাছে কুৎসিত ও ভয়ঙ্কর বলে প্রতীয়মান হয়। গ্রাম-বাংলার সেই কুস্তি যাহোক, এখনও আমাদের আমোদিত করে। কিন্তু ‘রঙের মানুষ’-এর নায়িকা রাঙা নায়ক বদন শাহকে যখন ‘বাঘবন্দী’ খেলার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, তা রোমান্টিক আবহ তৈরি করলেও ‘বাঘবন্দী’ খেলা আমাদের অনেকেরই কাছে অপরিচিত মনে হয়। বাঘবন্দী! সে আবার কী খেলা? অথচ বাঘবন্দী ছিল গ্রামীণ জনপদের খেলা। এটা এক ধরনের যুদ্ধের খেলা। এতে দাবা খেলার মত আÍরক্ষা ও আক্রমণের প্রতি লক্ষ্য রেখে ঘুঁটির চাল কেটে বাঘবন্দীর ছক তৈরি করা হয়। আয়তকার একটি ছকের অভ্যন্তরে আলম্ব ও উল্লম্বভাবে ১৬টি ছকের দাগগুলো হয় সব সরল রেখা। এই ছকের চারটি মূল কেন্দ্রে পাঁচটি করে মোট ২০টি ঘুঁটি বসানো হয়। এগুলোকে বলা হয় ‘বকরি’। ‘বাঘ’ নামে অপেক্ষাকৃত বড় দুটি ঘুঁটি অন্য যে কোনো স্থানে বসানো হয়। এরপর দু’পক্ষের একজন বাঘ, অপরজন বকরি ঘুঁটির চাল দেয়। বকরির চেষ্টা হলো বাঘের গতিরোধ করা। আর বাঘের চেষ্টা হলো চালের সুযোগ নিয়ে একটি একটি করে বকরি শিকার করা। সরলরেখা বরাবর লাফ দিয়ে ফাঁকা ঘরে পৌঁঁছাতে পারলে একটি বকরি মারা পড়ে। ফাঁকা ঘর না পেলে বাঘ লাফ দিতে পারে না অর্থাৎ তার চাল বন্ধ হয়ে যায়। বাঘের চাল বন্ধ হলে বকরির জয়। আর সব বকরি শিকার করলে বাঘের জয়। তাই ভেবে-চিন্তে খুব সতর্কতার সঙ্গে ঘুঁটির চাল দিতে হয়। নতুবা পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। বদন শাহকে ‘টাইট’ দেয়ার জন্য রাঙা এমন একটি খেলা বেছে নেন, যাতে আছে সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও কৌশলের মারপ্যাঁচ, তেমনি আছে বিনোদনের খোরাক। বাঘবন্দী’র মত অসংখ্য খেলা জন্ম হয়েছে বাঙালির সহস্র বছরের লোকায়ত জীবনে। যা ছিল পল্লীর মানুষের আনন্দ ও অবসরের সুলভ বিনোদন।
এই সেদিনও গ্রামকেন্দ্রিক ছিল আমাদের জীবনযাত্রা। গ্রামীণ জীবন ছিল লোকজ সহজিয়া সুরে বাঁধা। দু’মুঠো ভাতের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলার পাশাপাশি নানা অভাব-অনটনের মাঝেও বিনোদনের মোটেও কমতি ছিল না। অবশ্য ফোকলোর বিশেষজ্ঞ ড. আশরাফ সিদ্দিকীর ভাষায় ঃ ‘খাদ্য প্রাচুর্য, ভূমির উর্বরতা, সহজলভ্য জীবন ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, নদী মেখলা অরণ্য-কান্তার বেষ্টিত প্রাকৃতিক আকর্ষণ ইত্যাদির জন্য বর্তমান ভূখ- ছিল স্বর্গতুল্য’। এ কারণে শরীরচর্চা, চিত্তবিনোদন, অবসর যাপন ইত্যাদি কারণে প্রাচীনকাল থেকে গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকের বসবাস গ্রামে। গ্রামীণ জীবন মূলতঃ কৃষিনির্ভর। জমি চাষ ও ফসল কাটার সঙ্গে অবসরের বিষয়টি নির্ভরশীল। এর সঙ্গে ষড়ঋতুরও একটা প্রভাব রয়েছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত অনুযায়ী মৌসুমী খেলাধুলার প্রচলন ঘটেছে। অবসর মুহূর্তকে আনন্দময় করে তোলার জন্য জন্ম হয়েছে নানারকম খেলাধুলার। পরিবেশ-পরিস্থিতি, জীবনযাত্রা, আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আবির্ভাব ঘটেছে রকমারী খেলাধুলার। গ্রামীণ জীবনযাপন ছিল যেমন অনাড়ম্বর, খেলাধুলাও সহজ-সরল। অর্থনৈতিক অবস্থা যেহেতু খুব বেশি সচ্ছল ছিল না, যে কারণে নির্দোষ বিনোদনই ছিল প্রধান লক্ষ্য। উপকরণ বা সরঞ্জামের তেমন প্রয়োজন হতো না। যা প্রয়োজন পড়তো, তা ছিল খুবই সহজলভ্য। ব্যয়বহুল ছিল না। হাত বাড়ালেই পাওয়া যেতো। দেহ ও মনের চাহিদা অনুসারে গ্রামীণ খেলার উৎপত্তি, বিকাশ ও লালন-পালন হয়ে এসেছে।
বাংলার গ্রামীণ জনপদের খেলাগুলো হারিয়ে গেলেও কিছু কিছু খেলা এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যদিও অনেকটা রূপান্তরিত হয়ে।
হা-ডু-ডু খেলা এ অঞ্চলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচলন। বিশেষতঃ বরিশাল, মাদারীপুর, ফরিদপুর অঞ্চলে। জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ খেলাটি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে হা-ডু-ডু কাবাডি হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯২৩ সালে কাবাডি খেলার নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করা হয়। খুব সম্ভবতঃ ১৯৭৪ সালে কাবাডির ঠাঁই হয় আন্তর্জাতিক পরিসরে। সেবার বাংলাদেশে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম কাবাডি টেস্ট খেলা হয়। ১৯৮০ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম এশীয় কাবাডি চ্যাম্পিয়নশীপ। ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমস এবং ১৯৯৯ সালের বেইজিং এশিয়ান গেমস থেকে নিয়মিত কাবাডি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাঙালির নিজস্ব এই খেলাটিও ক্রমশঃ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের গ্রামের মানুষ হাঁটতে শেখার আগে খাল-বিল, পুকুর-নদীতে সাঁতার কাটে। অথচ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সাঁতারুরা মোটেও সুবিধা করতে পারছেন না। ১৯৫৯ সালে ব্রজেন দাশ বিপদসঙ্কুল ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অরুণ নন্দী কোলকাতায় একটানা ৯০ ঘণ্টারও বেশি সাঁতার কেটে দারুণভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ‘মরুভূমি’ দেশের লোকদের কাছেও বাংলাদেশ সাঁতারে পেরে উঠছে না।
বাংলার গ্রামীণ জনপদের প্রধান বাহন নৌকা। সেই আবহমান কাল থেকে হাওর ও নদীতে নৌকাবাইচ হয়ে আসছে। নৌকাবাইচ এ অঞ্চলের অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নৌকাবাইচ ‘রোইং’ হিসেবে প্রচলিত। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
কুস্তি, শরীর গঠন, লাঠি খেলা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে দারুণভাবে সমাদৃত হয়। শক্তিমানের খেলা হলেও বাঙালিরা এতে যেন ক্রমশঃ আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। ঘুড়ি উড়ানো, ঘোড় দৌড়, মোরগ লড়াই মোঘল-পাঠান আমল থেকে ঢাকার নবাব পরিবার, সৌখিন গ্রামীণ জমিদার ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। বর্তমানে সীমিত কিছু অঞ্চলে এই খেলা হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আলোকিত না হলেও বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে অসংখ্য খেলার প্রচলন রয়েছে। যে খেলাগুলো বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবহমান বাংলার যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, তার অন্যতম উপাদান হলো গ্রাম-বাংলার এই লোকক্রীড়া। বাঙালির জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই লোকক্রীড়ার উদ্ভব ও বিকাশ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোল্লাছুট, ডাংগুলি, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌ-ছি, বাঘবন্দী, ষোল ঘুঁটি, বত্রিশ ঘুঁটি, পাইত, আক্কেলবন্দী, ছাউসি, টোপ বাড়ি, চোর-চোর, চোর-পুলিশ, চার তাস, চরকি ঘোরানো, কাঠবিড়ালী, তিনকাঠি, ছোঁয়াছুঁয়ি, ডুব সাঁতার, অপেন্টি বায়োস্কোপ, রুমাল চুরি, মার্বেল বা গুল্লি খেলা, ছি-বুড়ি, সাত চাঁড়া, লাটিম, ছি কুৎকুৎ, পাশা, কাছি টানাটানি, গরু দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, অ্যাঙ্গা-অ্যাঙ্গা, এক্কা দোক্কা, কড়ি খেলা, গাইগোদানি, পোলাপ টগর, চিক্কা, চুঙ্গা খেলা, এলাটিং বেলাটিং, নুনতা, মোরগের লড়াই, কুস্তি, বলী খেলা, লাঠিখেলা, লুকোচুরি, হাডুডু, পানি ঝুপ্পা, লাই খেলা, সাঁতার, হোলডুগ, ঘুড়ি ওড়ানো, শরীর গঠন। এসবই আবহমান বাংলার চিরায়ত খেলা। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম, গঞ্জ, থানা, ইউনিয়ন, জেলা, অঞ্চল ভেদে রয়েছে অসংখ্য খেলা। ঢাকা মেট্রোপলিটন শহর হয়ে উঠার আগে এবং এই সেদিনও শহরের কিশোর-কিশোরীদের বিনোদনের প্রধান অবলম্বন ছিল গ্রামীণ খেলাধুলা।
বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় পাল্টে যাচ্ছে লোকায়ত বাংলার জীবনধারা। কোকাকোলা, বার্গার, মোবাইল ফোন, অ্যাপার্টমেন্ট, কম্পিউটার আর টিভি চ্যানেলের আগ্রাসনে পল্লীর জীবনযাত্রাও আর আগের মত নেই। শিল্পায়ন, নাগরিকতা ও লোকায়ত জীবনের টানাপড়েনে হাজার বছর ধরে চলে আসা গ্রামীণ জীবনযাত্রার সুর ও ছন্দ ক্রমান¦য়ে বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তনের ধাক্কায় রূপান্তর ঘটছে আবহমান বাংলার কাঠামোয়। অতীতের জীবনে ধুম-ধাড়াক্কা ছিল না, আমোদ-প্রমোদই ছিল গ্রামীণ জীবনযাত্রার লক্ষ্য। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পাল্টে যাবার পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ মানুষের বিনোদনও। গ্রামীণ জীবনে দিন বদলের ঘণ্টাধ্বনি বাজলেও এখনও দেশের অধিকাংশ অঞ্চল ও মানুষ গ্রামীণ জীবনবোধ ও গ্রামীণ সংস্কৃতি দ্বারা লালিত-পালিত। দেশের সকল নাগরিকের মানসিক বিনোদন ও দৈহিক সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হলে গ্রামীণ খেলাধুলারও পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। পল্লীর মানুষের আনন্দ ও অবসরকে সুখময় করে তোলার পাশাপাশি আবহমান বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও লোকক্রীড়াকে ধরে রাখা প্রয়োজন। সমাজ জীবনের পরম্পরায় গ্রামীণ জনপদে অসংখ্য খেলার জন্ম ও বিকাশ হলেও কিছু কিছু বিদেশী খেলা এ দেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। মোগল ও বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এ অঞ্চলে বেশকিছু খেলার প্রচলন ঘটে। বিশেষ করে ফুটবলের উত্তেজনা, আকর্ষণ ও সম্মোহনে এ অঞ্চলের মানুষেরা আকৃষ্ট হয়। বিদেশী খেলা হলেও ফুটবলকে এ অঞ্চলের মানুষেরা আপন করে নেন। সেও কম দিন হলো না। ইতোমধ্যে প্রায় ১৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ফুটবল এ অঞ্চলের মানুষের রক্ত-মজ্জায় ও অস্তিত্বে মিশে গেছে। ফুটবলকে এখন আর এ অঞ্চলের মানুষ বিদেশী খেলা হিসেবে বিবেচনা করে না। ফুটবলের পাশাপাশি ইদানীং ক্রিকেটও বিশ্বায়নের খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ছে গ্রামীণ জনপদে। ধানকাটা জমিতে কিংবা এক খ- খোলা জায়গা পেলে এখন ক্রিকেট নিয়ে গ্রামের ছেলেদের মেতে থাকতে দেখা যায়। অবশ্য কিছুটা হলেও ক্রিকেট খেলায় বাঙালিরা অভ্যস্ত। তারা দীর্ঘদিন ধরে যে ডাংগুলি খেলে আসছে, তা ক্রিকেটের গ্রাম্য সংস্করণ বললে অত্যুক্তি হবে না। ফুটবলে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ও ক্রিকেটে সাফল্যের হাতছানি থাকলেও অন্যান্য বিদেশী খেলাগুলোতেও প্রাপ্তি না থাকার পরও বছরের পর বছর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। বিদেশী খেলার আগ্রাসনে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্ব ঘরানার খেলা। আস্তে-ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের লোকায়ত জীবনধারা, সংস্কৃতি ও লোকক্রীড়া। আধুনিকতার স্পর্শে পরিবর্তনের যে হাওয়া বইছে তাকে আটকে রাখা যাবে না। তবে নিজস্ব স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে দিলে বাঙালির অস্তিত্বের সংকট বড় হয়ে দেখা দেবে। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলতে চাই না।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা : ১৬ এপ্রিল ২০০৪


খেলার মাঠে আমাদের নায়কেরা

সুরিনাম কিংবা সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস নামক দেশটিকে আমরা ক’জনইবা চিনতাম? অলিম্পিক সাঁতারে সোনা জিতে অখ্যাত সুরিনামকে রাতারাতি চিনিয়ে দেন অ্যান্থনি নেস্টি। ২০০৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশীপে দ্রুততম মানব হয়ে ক্রীড়া বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন কিম কলিন্স। কলিন্সের কৃতিত্বে আমরা জানতে পারলাম সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস নামে ক্যারিবীয় একটি দেশ আছে। এ কারণেই খেলোয়াড়দের বলা হয় ‘দেশের দূত’। তারা যত সহজে একটি দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে পারেন, অন্য কোনোভাবেই তা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তেমন সাফল্য না থাকলেও বাংলাদেশকে একদম অপরিচিত বলা যাবে না। উপমহাদেশ, মহাদেশ ও আন্তঃমহাদেশীয় গ-িতে ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিচিতি ক্রমশঃ বাড়ছে। দলীয় খেলায় বড় মাপের কোন সাফল্য না থাকলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝিলিক দেখিয়েছেন বাংলাদেশের ক’জন ক্রীড়াবিদ। আমাদের অনুজ্জ্বল ক্রীড়াঙ্গনে তারাই আমাদের নায়ক, আমাদের আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালবাসা ও স্বপ্ন।
এই নিবন্ধে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সাফল্যগুলো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে উল্লেখ করা হয়েছে। পু´খানুপু´খভাবে প্রতিটি সাফল্যের কথা বলার সুযোগ ছিল না। যে সাফল্যগুলো দারুণভাবে সাড়া জাগিয়েছে, সেগুলোর কথাই মোটামুটিভাবে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে যে নামটি সবার আগে সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তিনি হলেন দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদ। ১৯৮৬ সালে দাবায় উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের মডেল। তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। তবে যে প্রতিভা ও সম্ভাবনা নিয়ে নিয়াজ এসেছিলেন, পরবর্তীকালে তিনি সেই ধারা অব্যাহত রাখতে পারেননি। দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার পেতে বাংলাদেশের ১৫ বছর লেগে যায়। ২০০১ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন জিয়াউর রহমান। তবে দাবায় বাংলাদেশকে সবার আগে পরিচিত করেন রানী হামিদ। তিনি ১৯৮৩, ১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সালে বৃটিশ মহিলা দাবায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে দারুণ সাড়া জাগান।
নিয়াজ মোরশেদ গ্র্যান্ডমাস্টার হবার পর সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের স্বর্ণ জয়। ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের দ্বৈত ইভেন্টে স্বর্ণ ও ব্রোঞ্জ জেতেন আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি। দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে অন্যতম সেরা সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আতিক ও সাত্তার সাফ গেমসেও একাধিক স্বর্ণপদক জয় করেছেন। তবে মহিলাদের মধ্যে সেরা সাফল্য শুটার সাবরিনা সুলতানার। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কমনওয়েলথ শুটিং-এ ইংলিশ ম্যাচ রাইফেল প্রোণ ইভেন্টে স্বর্ণ জেতেন তিনি। ‘স্বর্ণকন্যা’ হিসেবে বিবেচিত সাবরিনা ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ সালের সাফ গেমস সহ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দলীয় ও ব্যক্তিগত ইভেন্টে ৯টি স্বর্ণ, ৩টি রৌপ্য ও ৫টি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেছেন। ২০০২ সালের আগস্টে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ১৭তম কমনওয়েলথ গেমস এবং ২০০৪ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত নবম সাফ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে স্বর্ণ জিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তরুণ শুটার আসিফ হোসেন খান। শুটার সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি ১৯৯১ সালের সাফ গেমসে ১টি রৌপ্য, ১৯৯৩ সাফ গেমসে ২টি ও ১৯৯৫ সাফ গেমসে ৩টি স্বর্ণ এবং ১৯৯৫ সালের প্রথম কমনওয়েলথ শুটিং চ্যাম্পিয়নশীপে ১টি রৌপ্য ও ১টি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। শুটার কাজী শাহানা পারভীন ১৯৯১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে সাফ গেমসে ২টি ব্যক্তিগত ও ১টি দলীয় স্বর্ণপদক জিতেছেন। শুটার জি এম হায়দার ১৯৯১ সাফ গেমসে রৌপ্য ও ১৯৯৩ সাফ গেমসে দুটি স্বর্ণপদক পান। শুটার মোঃ নাসির উদ্দিন জনি ১৯৯১ সাফ গেমসে দুটি ব্রোঞ্জ, ১৯৯৩ সাফ গেমসে একটি স্বর্ণ, একটি রৌপ্য ও ১৯৯৫ সাফ গেমসে একটি স্বর্ণপদক পান। ২০০৪ সালে সাফ গেমসে স্বর্ণপদক লাভ করেছেন শুটার শারমিন আক্তার। এছাড়াও সাফ গেমসে শুটিং-এ পদক পেয়েছেন ফজলে রাব্বী, এ ফয়েজ, লাভলী চৌধুরী আঁখি, ফৌজিয়া করিম, আসিফ হোসেন, ফারজানা হোসেন সোমা, কামরুল ইসলাম, ফিরোজ হোসেন পাখি, হোসেন জাহান মনির, সুরাইয়া, সাগর, শোয়েব, আনোয়ার, সেলিম, তৌফিক প্রমুখ।
সাঁতারের কিংবদন্তী ব্রজেন দাশ। চ্যানেল বিজয়ী এই সাঁতারুর পথ বেয়ে মোশাররফ হোসেন খান ১৯৮০ সালে ঢাকায় এশিয়ান সাঁতারে রৌপ্য এবং ১৯৭৭ সাল থেকে সাফ গেমস সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিশটি স্বর্ণ ও বেশকিছু রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাঁতারে অংশ নিয়ে সাফল্য দেখিয়েছেন। সাঁতারু মোঃ রওশন আলী ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ৭৪ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতারে দু’বার স্বর্ণপদক লাভ করেন। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে এটি বাংলাদেশের প্রথম পদক। উপর্যুপরি তিনটি সাফ গেমসে স্বর্ণ জিতে অসাধারণ সাফল্য প্রদর্শন করেন মোখলেসুর রহমান। ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে, ১৯৯১ সালে কলম্বো সাফ গেমসে ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ও ১৯৯৩ সালে ঢাকা সাফ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি স্বর্ণপদক পান। এর মধ্যে ১৯৮৯ সালের ইসলামাবাদ সাফ গেমসে পাওয়া স্বর্ণপদকটির যথেষ্ট গুরুত্ব ও আলাদা মর্যাদা রয়েছে। কেননা, সেবার বাংলাদেশের একমাত্র স্বর্ণপদকটি জয় করার কৃতিত্ব লাভ করেন মোখলেসুর রহমান। নতুবা পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর আর কোনো সুযোগ ছিল না। কারার মিজানুর রহমান ১৯৯৩ সালে ঢাকা ও ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণপদক জিতেছেন। এছাড়াও তার একাধিক আন্তর্জাতিক পদক রয়েছে। সাঁতারু মোঃ মাহবুবুর রহমান সাফ গেমসে অংশ নিয়ে একটি স্বর্ণ, নয়টি রৌপ্য ও পাঁচটি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। মোঃ বজলুর রহমান ১৯৮৫ সাফ গেমসে দলীয়ভাবে একটি স্বর্ণ, এককে দুটি রৌপ্য, ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসে বুক সাঁতারে একটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য, ১৯৮৯ সাফ গেমসে দুটি রৌপ্য ও ১৯৯১ সাফ গেমসে একটি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। ১৯৮৫ সাফ গেমসে রফিকুল ইসলাম একটি স্বর্ণ, একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। ১৯৮৫ সাফ গেমসে ব্রোঞ্জ ও ১৯৮৭ সাফ গেমসে ১০০ মিটার বাটারফ্লাইতে স্বর্ণ জেতেন মোঃ আব্দুস সালাম। ২০০৪ সাফ গেমসে একটি স্বর্ণ ও দুটি রৌপ্য জিতেছেন রুবেল রানা। এছাড়া সাঁতারু হারুন, এম এ এইচ ঢালী, নিয়াজ আলী, কারার সামেদুল ইসলাম, কাজী মনিরুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল হামিদ রিপন, জুয়েল আহমেদ, আতিক প্রমুখ সাফ গেমসে পদক পেয়েছেন। মহিলাদের মধ্যে সাঁতারে সর্বোচ্চ সাফল্য সেতারা বেগমের। ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান সাঁতারে তিনি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। নিবেদিতা দাস ১৯৯৭ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইসলামিক গেমসে ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে রৌপ্য পদক জয় করেন। ১৯৯৯ সালের সাফ গেমসে মহিলাদের ৪*১০০ মিটার মিডলে রিলেতে রৌপ্য পদক লাভ করেন কমলা আক্তার, সবুরা খাতুন, লিপি আক্তার ও ডলি আক্তার। এছাড়া সবুরা খাতুন চারটি ব্রোঞ্জ, ডলি আক্তার তিনটি ব্রোঞ্জ, কমলা আক্তার তিনটি ব্রোঞ্জ ও লিপি আক্তার দুটি ব্রোঞ্জ পদক পান।
১৯৮৬ সালে সিউলে অনুষ্ঠিত ১০ম এশিয়ান গেমসে লাইট হেভিওয়েট ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জেতেন বক্সার মোশাররফ হোসেন। এশিয়ান গেমসে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটিই বাংলাদেশের একমাত্র পদক। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসেও তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ৮ম এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশীপে লাইট হেভিওয়েটে আব্দুর রৌফ এবং লাইট ফ্লাইওয়েটে এম এ হালিম ব্রোঞ্জ পদক পান। আব্দুল হালিমের পদক জয়টা ছিল কৃতিত্বপূর্ণ। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে ৫১ কেজি ফ্লাইওয়েটে স্বর্ণ জেতেন মোজাম্মেল হক। এছাড়াও সাফ গেমসে পদক পেয়েছেন মোঃ ইসমাইল হোসেন, কাঞ্চন আলী, মোঃ জামাল হোসেন, খলিলুর রহমান, গুলজার হোসেন, রায়হান আলী, তাহাজ্জেল হোসেন, আলাউদ্দিন প্রমুখ।
১৯৭৩ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া রুরাল গেমসের ব্রড জাম্পে রৌপ্য পদক পান অ্যাথলেট সুলতানা আহমেদ। ১৯৮৫ সালে ঢাকা ও ১৯৮৭ সালে কোলকাতা সাফ গেমসে উপর্যুপরি দু’বার দ্রুততম মানব হওয়ায় দুর্দান্ত সাফল্য দেখান শাহ আলম। এছাড়া তিনি ৪*১০০ মিটার রিলে দলের হয়ে একাধিক স্বর্ণপদক পান। শাহ আলমের পর ১৯৯৩ সালে ঢাকা সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হওয়ার গৌরব অর্জন করেন বিমল চন্দ্র তরফদার। ১০ দশমিক ৬১ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি নতুন রেকর্ড গড়েন। মুজিবুর রহমান মল্লিক ১৯৮৪ সালের সাফ গেমসে ট্রিপল জাম্পে স্বর্ণ, ৪*১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ এবং ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসে ব্রড জাম্পে রৌপ্য পদক লাভ করেন। শাহজালাল মোবিন ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের ২১তম জাতীয় গেমস এবং ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের ২২তম জাতীয় গেমসে দ্রুততম মানব হন। ৪*১০০ মিটার রিলে দলের হয়ে তিনি স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক জয় করেন। গোলাম আম্বিয়া ১৯৯৩ সালে পাকিস্তান গেমসে ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে ২০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণ ও ৪*১০০ মিটার রিলেতে রৌপ্য পদক জেতেন মাহবুব আলম। ১৯৯৯ সালে কাঠমা-ু সাফ গেমসে ২০০ মিটারে ফটো ফিনিশিং-এ তাকে রৌপ্য পদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এছাড়াও তিনি ১০০ মিটার দৌড়ে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। মহিলা অ্যাথলেটিক্সে প্রথম স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব রহিমা খাতুন যুঁথীর। ১৯৯৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত আমন্ত্রণমূলক মহিলা ইসলামী সংহতি গেমসে তিনি ১৫০০ মিটারে এই কৃতিত্ব দেখান। ১৯৯৭ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইসলামিক গেমসে ৮০০ মিটার দৌড়েও তিনি স্বর্ণপদক পান। ২০০১ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইসলামী গেমসের লংজাম্পে স্বর্ণপদক লাভ করেন ফৌজিয়া হুদা জুঁই। এছাড়াও পদক পেয়েছেন অ্যাথলেট মিলজার হোসেন, মোঃ শাহানউদ্দিন চৌধুরী, ওয়াজিউর রহমান, শর্মিলা রায়, ফিরোজা খাতুন, মনিমুল হক প্রমুখ।
১৯৭৬ সালে হংকং পেশাদার লীগে ‘কেরোলিন হিল’ দলের হয়ে ফুটবল খেলার বিরল গৌরব অর্জন করেন সালাউদ্দিন। ‘ফুটবলারদের ফুটবলার’ হিসেবে পরিচিত সালাউদ্দিন এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে কিংবদন্তী হয়ে আছেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে কোলকাতা সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লীগ খেলতে যান মোনেম মুন্না। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে তিনি পুরো কোলকাতা মাতিয়ে তোলেন। দু’বারই মুন্নার নৈপুণ্যে ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়। বিদেশের মাটিতে মুন্নার মত আর কোন খেলোয়াড় জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। ১৯৯৫ সালে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতির ফুটবলে মুন্নার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এটি বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা জয়। ১৯৯৬ সালের আগস্টে এএফসি’র দৃষ্টিতে ‘ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন আলফাজ।
১৯৮৫ সালে বিশ্ব একাদশের হয়ে হকি খেলার গৌরব অর্জন করেন জুম্মন লুসাই। ১৯৮৭ সালে এশিয়া অল-স্টার টিমের হয়ে কেনিয়াতে তিনটি ম্যাচ খেলেন জামাল হায়দার। এছাড়াও এশীয় একাদশের হয়ে ১৯৮৯ সালে দিল্লীতে খাজা রহমতউল্লাহ এবং ১৯৯৩ সালে হিরোশিমায় মামুনুর রশীদ খেলেছেন। ২০০২ সালে এশিয়ান অল স্টার দলে ছিলেন মোঃ মুসা মিয়া। কামরুন নাহার হীরু ১৯৮১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ এশিয়ান জুডো প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক পান। জাতীয় টেবিল টেনিসে ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গ্রীনিজ বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম লিখিয়েছেন জোবেরা রহমান লিনু। এটি লিনুর ব্যক্তিগত সাফল্য হলেও বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের ব্যর্থতাও বটে। কুস্তিতে মোঃ দবিরউদ্দিন ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসে ব্রোঞ্জ, ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের কায়েদে আজম ইন্টারন্যাশনাল গেমসে ব্রোঞ্জ ও ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসে ব্যান্টমওয়েটে রৌপ্য পদক লাভ করেন। সাফ গেমসে কুস্তিতে পদক পেয়েছেন কামাল হোসেন, জামালউদ্দিন প্রমুখ। ভারোত্তোলনে ফারুক আহমেদ ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসে রৌপ্য পদক পান। সাফ গেমসে ভারোত্তোলনে পদক পেয়েছেন বিদ্যুৎ কুমার রায়, প্রদীপ চন্দ্র, আকরামুল হক, হামিদুল ইসলাম প্রমুখ। জুডোতে ঢাকায় দ্বিতীয় দক্ষিণ এশীয় গেমসে স্বর্ণপদক পান মোঃ আমিনুল ইসলাম এবং ১৯৮৯ সালে দিল্লীতে তৃতীয় দক্ষিণ এশীয় জুডো চ্যাম্পিয়নশীপ ৫৫ কেজি ওজন শ্রেণীতে রৌপ্য পান জানে আলম। ১৯৯৯ সাফ গেমসে কারাতে ৫০ কেজি ওজন শ্রেণীতে রেজাউল করিম ও অনূর্ধ্ব-৪৮ কেজি ওজন শ্রেণীতে রবিনা আক্তার সুইটি রৌপ্য পদক জয় করেন। এছাড়াও পদক পেয়েছেন অনামিকা হক মুক্তা, বিবি মরিয়ম স্মৃতি, শোয়েব খান অপু, বদরুল আলম ও হোসেন আলী। ২০০৪ সালের সাফ গেমসে সারোয়ার হোসেন ও আব্দুল মান্নান রৌপ্য পদক লাভ করেন। এছাড়া ব্রোঞ্জ পেয়েছেন আল-মাসুদ। সাফ গেমসে তায়কোয়ানডোতে পদক পেয়েছেন ফারজানা রওশন সেতু, মিজানুর রহমান সাগর, রাজিব ও ফারজানা রওশন উর্মি।
এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে রৌপ্য এবং সাফ গেমসের ফুটবলে স্বর্ণপদক পেলেও দলীয় খেলা হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য ক্রিকেটে টেস্ট ও ওয়ানডে স্ট্যাটাস অর্জন। যদিও ক্রিকেট খেলা সীমিত কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তথাপি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পাদপ্রদীপের আলোয় ওঠে এসেছে ক্রিকেটের মাধ্যমে। একটা সময় ফুটবল এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা এবং ফুটবলাররা সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এখন জনপ্রিয়তায় এগিয়ে গেছে ক্রিকেট। টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ব্যক্তিগত কিছু নৈপুণ্যের ঝিলিক দেখিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্থান করে নিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে কুয়েতে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলেছেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কোলকাতায় শ্রীলংকার সঙ্গে ওয়ানডে ম্যাচে অপরাজিত ৭৮ রান করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন আতহার আলী খান। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার অন্যতম নায়ক হলেন আকরাম খান। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে বৃষ্টির কারণে নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়ে যায় বাংলাদেশের। সেমিফাইনালে ওঠার জন্যে হল্যান্ডের সঙ্গে জয় ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো পথ ছিল না। হল্যান্ডের ১৭১ রানের জবাবে খেলতে নেমে বাংলাদেশের ১৫ রানে ৪টি উইকেটের পতন ঘটে। এ পর্যায়ে খেলতে নামেন অধিনায়ক আকরাম খান। বৃষ্টির কারণে খেলা বিঘিœত হওয়ায় বাংলাদেশকে নতুন টার্গেট দেয়া হয় ৩৩ ওভারে ১৪১ রান। আকরাম খানের সাহসী ও মারকুটে ব্যাটিং-এ বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। আকরামের ৫৪ বলে অপরাজিত ৬৭ রানের সুবাদে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী হয়ে সেমিফাইনালে ওঠে। ফলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়। যদিও বাংলাদেশ সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ড এবং ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বাঁহাতি অর্থডক্স স্পিনার ও টেইল অ্যান্ড ব্যাটসম্যান মোঃ রফিকের কৃতিত্বে ১৯৯৮ সালের ১৭ মে হায়দ্রাবাদে কেনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে জয়ী হয়। ৭৭ রানের পাশাপাশি ৩টি উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়ের অন্যতম নায়ক মোঃ রফিক। ২০০৫ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় জিম্বাবুয়ের সঙ্গে পঞ্চম ওয়ানডে ম্যাচে তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। ২০০৩ সালের মে মাসে ঢাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে দ্বিতীয় টেস্টে ৭৭ রানে ৬ উইকেট নিয়ে রফিক ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। এছাড়া ২০০৩ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের সাব্বির আহমেদের সঙ্গে তিনি যৌথভাবে ১৭টি করে উইকেট নেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেন মেহরাব হোসেন অপি। ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত খেলায় তিনি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১০১ রান করেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। ১৯৯৯ সালের ২৪ মে ইংল্যান্ডের এডিনবরায় নান্নু স্কটল্যান্ডের সঙ্গে অপরাজিত ৬৮ ও একটি উইকেট নেয়ায় বাংলাদেশ বিশ্বকাপে প্রথম জয় পায়। ১৯৯৯ সালের ৩১ মে ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সঙ্গে জয়ী হয় বাংলাদেশ। কোন টেস্ট দলের সঙ্গে এটি বাংলাদেশের প্রথম জয়। ২৭ রান ও ৩টি উইকেট নিয়ে ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন খালেদ মাহমুদ সুজন। ২০০০ সালের নভেম্বরে ঢাকায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ১৪৫ রান করার অসাধারণ নৈপুণ্য দেখান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজ দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন। একই টেস্টে অধিনায়কত্বের পাশাপাশি নাঈমুর রহমান দুর্জয় ৬টি উইকেট নেন। সপ্তম বোলার হিসেবে তিনি অভিষেক টেস্টে ৫ বা ততোধিক উইকেট নিয়েছেন। তবে ৬ উইকেট নিয়ে তার অবস্থান দ্বিতীয়। ডানহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান জাভেদ ওমর বেলিম ২০০১ সালের এপ্রিলে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার অভিষেক টেস্টে ক্যারিং থ্রু দ্য উইকেট থেকে তৃতীয় ওপেনার হিসেবে অভিষেক টেস্টে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করেন। জাভেদ ওমর অপরাজিত ৮৫ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। টেস্ট ক্রিকেটে সবচে কম বয়সে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। ২০০১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কলম্বো টেস্টে শ্রীলংকার বিপক্ষে তিনি ১৬ বছর ৩৬৪ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করে ৪০ বছর আগে দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে গড়া পাকিস্তানের মুস্তাক মোহাম্মদের রেকর্ড ম্লান করে দেন। এটি ছিল বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি। শ্রীলংকার মুত্তিয়া মুরালিধরনের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। ২০০৩ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত টিভিএস কাপে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে খেলায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ আশরাফুল। ২০০৪ সালের ১০ মার্চ হারারেতে অনুষ্ঠিত জিম্বাবুয়ের সঙ্গে তৃতীয় একদিনের ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশ ৮ রানে জয়ী হয়। ওয়ানডে ম্যাচে এটি বাংলাদেশের চতুর্থ জয়। এ জয়ের অন্যতম নায়ক মোঃ আশরাফুল ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। ২০০৪ সালের ১৭ থেকে ২০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে অপরাজিত ১৫৮ রানের একটি অসাধারণ ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ আশরাফুল। ২০০২ সালে শ্রীলংকায় তিন ম্যাচের সিরিজে ১০৬ রান ও ৩ ক্যাচ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ম্যান অব দ্য সিরিজ হন উইকেটকিপার ও ডানহাতি লোয়ার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট। ২০০৩ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের সঙ্গে পেশোয়ার টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন লেগ ব্রেক বোলার ও ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান অলক কাপালি। পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসের শেষ তিন ব্যাটসম্যান সাব্বির আহমেদ, দানিশ কানেরিয়া ও উমর গুলকে দু’ওভারের পরপর তিন বলে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি এই কৃতিত্ব দেখান। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে চট্টগ্রাম টেস্টে ২ ও ৮৫ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন অলক কাপালি। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান হাবিবুল বাশার সুমন। বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে প্রথম সহস্র ও দ্বি-সহস্র রান করেছেন তিনি। ২০০৩ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সঙ্গে তিন টেস্টের সিরিজে দু’দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭৯ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। ২০০৪ সালের জুনে সেন্ট লুসিয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে খেলে প্রথম টেস্ট ড্রয়ের গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেরা এই সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন প্রথম ইনিংসে হাবিবুল বাশার সুমন ও মোহাম্মদ রফিক এবং দ্বিতীয় ইনিংসে খালেদ মাসুদ পাইলটের সেঞ্চুরি। টেস্ট ক্রিকেটের ১২৭ বছরের ইতিহাসে ত্রয়োদশ ক্রিকেটার হিসেবে নয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমে সেঞ্চুরি করেন মোঃ রফিক। ২০০৪ সালের ৫ নভেম্বর নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ওয়ানডে ম্যাচে অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন আফতাব আহমেদ। তিনি ৩৯ রানে ৫টি উইকেট নিয়ে দেশের পক্ষে সেরা বোলিং নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারতকে ১৫ রানে হারিয়ে দেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে জয় পায় বাংলাদেশ। এটি ছিল বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে ম্যাচ। এ ম্যাচে অল-রাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন পেসার মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে লাল হরফে লেখা থাকবে ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি। এদিন টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। বাংলাদেশ তার ৩৫তম টেস্টে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়েকে ২২৬ রানে হারিয়ে টেস্ট জয়ের স্বপ্ন পূরণ করেছে। স্বপ্নের এই ম্যাচে ৪৫ রানে ৬টি উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের প্রধান নায়ক হলেন এনামুল হক জুনিয়র। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে দুু’টেস্টের সিরিজে ২০০৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ১-০ টেস্টে জয়ী হয় বাংলাদেশ। এই সিরিজে ১৮টি উইকেট নিয়ে এনামুল ম্যান অব দ্য সিরিজ হন। ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে কম বয়সে ৭ উইকেট নিয়ে ওয়াকার ইউনিসের রেকর্ড এবং টেস্টে সবচেয়ে কম বয়সে ১০ বা তার চেয়ে বেশি উইকেট নিয়ে ওয়াসিম আকরামের রেকর্ড ভঙ্গ করেন এনামুল হক জুনিয়র। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওয়ানডে ম্যাচে ২০০৫ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এবং ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন স্পিনার মানজারুল ইসলাম রানা।
খেলার মাঠে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে অনেকেই নেপথ্য নায়ক হয়ে আছেন। তাদের অবদান তেমনভাবে লাইম লাইটে না এলেও তারাও দেশের ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। স্বল্প পরিসরে সবার অবদান তুলে ধরা সম্ভব না হলেও দেশ ও জাতি তাদের কাছে সমানভাবে কৃতজ্ঞ। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের বড় মাপের সাফল্য না থাকলেও আস্তে-ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তিন টেস্টের সিরিজে বাংলাদেশ সমানতালে লড়ে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে শেষ মুহূর্তে পরাজিত হয়েছে। লড়াই করে প্রথমবারের মত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্ট ড্র করেছে বাংলাদেশ। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল হলেও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রথম টেস্ট সিরিজ এবং প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ের গৌরব অর্জন করেছে। তবে এই সাফল্যে আমাদের এই আÍবিশ্বাসটুকু জন্মেছে, বড় দলের সঙ্গে বাংলাদেশের জয় খুব বেশি দূরে নয়। আর জয় যখন হাতের নাগালে চলে আসবে, তখন জন্ম নেবে নতুন নতুন নায়ক। তাদের দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ।
ক্রীড়াজগত : ১৬ জানুয়ারি ২০০৫



প্রসঙ্গক্রমে

সেই আশির দশকের শুরুতে স্কুলের গ-ী পেরিয়ে কলেজে পা দিয়েই কোনো এক অজানা মোহে জড়িয়েছিলাম ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখিতে। এতো এতো বিষয় থাকতে কেন যে খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম, তা আজও জানি না। খেলাধুলায় খুব বেশি পারদর্শী ছিলামÑ তাও তো নয়। শৈশবের সোনাঝরা সেই দিনগুলোতে মার্বেল আর সিগারেট প্যাকেট দিয়ে এক ধরনের তাস খেলায় মেতে থেকে খুঁজে নিয়েছি বিনোদনের সস্তা উপকরণ। আর এর ফাঁকে ফাঁকে মনের সুখে আকাশের ঠিকানায় উড়িয়েছি নানা রঙের ঘুড্ডি। স্কুল ছুটির পর জীবনের কত দুপুর আর বিকেল যে মার্বেল, সিগারেট প্যাকেট আর ঘুড্ডির পেছনে কাটিয়ে দিয়েছি, এখন ভাবলে সত্যি কষ্ট হয়। একটু সাহস দেখিয়ে যদি ব্যাটে-বলে সঁপে দিতাম মন-প্রাণ, আর কিছু না হোক, টুয়েলভথ ম্যান হতে পারলেও জীবনের খাতায় যোগ হতে পারতো কিছু সঞ্চয়। অল্প বয়স থেকেই ছিলাম ভীতু টাইপের। আঘাত পাওয়া যায়Ñ এমন কোনো খেলায় দর্শক হিসেবে থাকতেই পছন্দ করতাম। কাঠের বলের ভয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় দায়িত্ব পালন করেছি শিক্ষানবিস স্কোরার হিসেবে। এমনও হতে পারে, স্কোর লিখতে লিখতে অবচেতন মনে ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখির প্রতি আকর্ষণটা গড়ে উঠেছে। খেলতে না পারলেও খেলা দেখতে তো অপছন্দ করতাম না। সেই বয়সে একদিকে যেমন রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ গোগ্রাসে গিলেছি, তেমনি ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ক্যালিপসো সুর আর ব্রাজিলীয় ফুটবলের সাম্বা নাচে নেচে উঠেছে মন-প্রাণ। অবশ্য তখন থেকেই কেন জানি না, খেলার চেয়ে খেলার বাইরের ঘটনাগুলোর প্রতি দারুণ টান অনুভব করতাম। ক্যালিপসো সুর, সাম্বা নাচ, খেলোয়াড়দের বর্ণিল জীবনটা দারুণ আকর্ষণীয় মনে হয়। এর কারণ হতে পারে, নিজে বরাবরই ছিলাম গ্যালারির দর্শক, খেলাধুলাটা তেমনভাবে অনুভবের বিষয় হয়ে ওঠেনি। খেলার নিয়ম-কানুনগুলো এখনও বড্ড নীরস মনে হয়। খেলার জগতে গভীরভাবে ডুব না দিয়েও চুপি চুপি সর খাওয়ার মতো করে উপভোগ করেছি খেলার বাইরের রূপ-রসকে। আর এ কারণেই টেনিসের গ্ল্যামার গার্ল আনা কুর্নিকোভার আমি একজন পরম সুহৃদ। খেলায় হার-জিতটা আমার কাছে কখনোই মুখ্য মনে হয়নি। চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বলে কি কুর্নিকোভার রূপ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া যাবে না? ভিভ রিচার্ডসের চোখে যখন অশ্রু টলমল করেছে, তখন কেন জানি না উথাল-পাথাল করে উঠেছে আমার বুকটাও। কিং রিচার্ডসের চোখে জল! এমন সব অভাবিত ঘটনাই আমাকে বার বার নাড়া দিয়ে যায়।
১৯৮২ সাল থেকে ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখিতে জড়ানোর পর দেশে-বিদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অনেক ঘটনাই দাগ কেটেছে হৃদয়ে। কোনো কোনো ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে আবেগে আপ্লুত করেছে। আবার কোনো কোনোটি হৃদয়কে পরিপূর্ণ করেছে রাগ সঙ্গীতের মতো করে। তবে মনকে স্পর্শ করলেও সব ঘটনাই লেখা হয়ে ওঠেনি। আর যেটুকু লিখেছি, তাও সংরক্ষণ করতে মন চায়নি। কিছু কিছু লেখা যা হাতের কাছে পাওয়া গেছে, তা থেকে বাছাই করে ঠাঁই দেয়া হয়েছে এ গ্রন্থে। এ লেখাগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। পড়তে যেয়ে যাতে পাঠকদের হোঁচট খেতে না হয়, সে জন্য প্রতিটি লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে লেখা প্রকাশের দিন-ক্ষণ। একটি গ্রন্থ প্রকাশের ঝঞ্ঝাট নেহাত মন্দ নয়। আর এ ক্ষেত্রে অকৃত্রিমভাবে সহযোগিতার উদার হাত বাড়িয়ে দেন প্রথিতযশা শিল্পী ও লেখক পঙ্কজ পাঠক, প্রতিভাবান ও মেধাবী লেখক এবং চিকিৎসক হিসেবেও যার হাতযশ হতে শুরু করেছে, সেই জহিরুল ইসলাম নাদিম, দৈনিক আজকের কাগজের ক্রীড়া সম্পাদক বন্ধুবৎসল আরিফ সোহেল, ‘ক্রীড়াজগত’-এর দুই নিবেদিত কর্মী ইমাম হোসেন ও
মহিউদ্দিন চৌধুরী। এদের সবার কাছে আমি দারুণভাবে কৃতজ্ঞ।

দুলাল মাহমুদ, ঢাকা

পূর্বকথন

স্বাধীনতার পর আমাদের ক্রীড়া সাহিত্যের শুরু অসম্পূর্ণতা ও শূন্যগর্ভতা নিয়ে। এর আগে এই দেশে বাংলায় ক্রীড়া সাহিত্য বলতে যা বুঝায়, তার একক কৃতিত্বের অধিকারী হলেন বদরুল হুদা চৌধুরী। তিনি ক্রিকেটের উপর দু’টি বই লিখেছেন। এর পর ক্রীড়া সাহিত্যের ধারা অব্যাহত থাকলেও গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়নি। অনেকগুলো বছর পর আশির দশকের শুরু থেকে ক্রীড়া লেখনীতে পাওয়া গেছে সাহিত্যের নতুন স্বাদ। সেই সঞ্চয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ক্রীড়া লেখনীতে সাহিত্যের স্বাদের যোগান দেবার জন্য আশির দশকের প্রায় গোড়া থেকে যারা এগিয়ে এসেছিলেনÑ দুলাল মাহমুদ তাদের অন্যতম। দুলাল মাহমুদ গত আট বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সবচেয়ে পুরনো ক্রীড়া পাক্ষিকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার লেখনীতে আছে অন্য এক ধরনের মেজাজ ও স্বাদ। দুলাল মাহমুদ তার মিষ্টি অথচ বলিষ্ঠ লেখনী দিয়ে যেভাবে ক্রীড়া সাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করার পেছনে অবদান রেখেছেনÑ তা সত্যি অনন্য। তার লেখনী সাড়া জাগিয়েছে। তিনি প্রতিধ্বনি সৃষ্টি
করতে সক্ষম হয়েছেন। দুলাল মাহমুদ প্রচারবিমুখ, নির্ঝঞ্ঝাট, অথচ একশতভাগ রোমান্টিক ও আবেগপ্রবণ একজন মানুষ। দুলালের সান্নিধ্য তার আপনজনদেরকে সবসময় আনন্দিত করে।
গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। লক্ষ্য করেছি, ক্রীড়া লেখনীতে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দেখা এমন কিছু তার লেখনীতে ফুটে উঠেÑ যা অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমী। তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাদুকরী লেখা তাই পাঠকদের সবসময় টানে। তিনি আমাদেরকে মুগ্ধ করেছেন। তার রচনাবলী আনন্দ দিয়েছে। খেলাকে ভালবেসে দুলাল ধরা পড়ে গেছেন। এখন আর তার নিস্তার নেই। আর তার প্রমাণ হলো এ ক্ষেত্রে তার লেখনীর গভীরতা। আর সেখান থেকে বের করে আনা রসম-িত সাহিত্যের স্বাদ।
ক্রীড়া লেখনীতে একনাগাড়ে দীর্ঘ তেইশ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা মোটেও কম নয়। তার লেখনীতে যেটা লক্ষণীয়, তা হলো তিনি কখনো তার অভিজ্ঞতার সীমানা অতিক্রম করেন না। তার লেখনীতে আবেগ আছেÑ আর তা প্রয়োজনীয়। তার রচনার মানই হচ্ছে আসল কথা। সেই বিচারে তিনি টিকে গেছেন। স্বাধীন বাংলায় ক্রীড়া সাহিত্যে তার স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, আর সে স্থানটি একেবারে প্রথম সারির। এ ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত কমিটমেন্ট গর্ব করার মতো। দুলাল মাহমুদের ‘স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ এটি তার দ্বিতীয় প্রকাশিত গ্রন্থ। এর আগে ১৯৯৮ সালে দুলালের প্রথম গ্রন্থ ‘দেখা হলো লংকায়’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে এবং তা সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দুলাল বেশ কয়েক বছর পর আবার দ্বিতীয় গ্রন্থটির কথা ভেবেছেন। যেটা হবার কথা নয়। কিছুটা নিজকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখার স্বভাব এবং পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধ অবস্থা তা হতে দেয়নি হয়তো! এতে কিন্তু আমরা পাঠকরা রসঘন ক্রীড়া সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
দুলাল মাহমুদ মাঠের খেলাকে সাহিত্যের উদ্যানে তুলতে নীরবে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। খেলাধুলাকে যারা ভালবাসেন, তারা তো কেবল মাঠে বা টিভিতে খেলা দেখেন না, বইয়ের পাতাতেও দেখে থাকেন। এই গ্রন্থে দুলালের ক্রিকেটের উপর ২৫টি লেখা, ফুটবলে ১০টি এবং অন্য বিষয়ের আরো ২৬টি লেখা স্থান পেয়েছেÑ যা ১৯৮৮ সাল থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও তার সম্পাদিত ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ক্রিকেট লেখনীর প্রতি আছে দুলালের এক ধরনের বিশেষ দুর্বলতা। সত্যি তো, খেলার রাজ্যে ভাবোদ্বেল সাহিত্য সৃষ্টির অবকাশ ক্রিকেটে যত আছেÑ আর অন্য কোনো খেলাতে তেমনটি নেই। তার প্রমাণও দুলাল তার ক্রিকেট বিষয়ক লেখনীতে রেখেছেন। তার রসসমৃদ্ধ, অলঙ্কারখচিত ও ছন্দময় লেখা ক্রীড়া রসিকদের ভালো লাগবে। ফুটবলের লেখাগুলোতে আছে অন্য এক ধরনের স্বাদ। যা পাঠে আনন্দ মিলবে অনেক। তাছাড়া অন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় লেখাগুলোতে আছে এক ধরনের আবেদনÑ যা ক্রীড়াঙ্গনের দলিল হিসেবে কাজ করবে। দুলালের সহজ-সরল ভাষা আর নিখুঁত বর্ণনা পাঠকদের সবসময় টানেÑ এখানেই তার সার্থকতা। তার চিত্তাকর্ষণ বিবরণ, দূরকে কাছে টেনে আনার মুন্সিয়ানা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। তিনি তার ভালবাসার বস্তুটিকে দিয়েছেন প্রাণ। করেছেন সতেজ এবং জীবন্ত। সুখপাঠ্য ক্রীড়া সাহিত্য উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। বর্ণময় খেলাকে বর্ণরঞ্জিত করেছেন দুলাল তার লেখনীর মাধ্যমে। ‘স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গ্রন্থে পাঠকরা পাবেন লেখকের তৃতীয় নয়নে দেখা অন্য এক স্বাদ। আর এই সুখপাঠ্য ক্রীড়া সাহিত্য পড়তে শুরু করলে গ্রোগ্রাসে গিলবেন পাঠক মহল। দুলালকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। তিনি শুধু নিজে খেলার রস আর সৌন্দর্য উপভোগ করবেন নাÑ আমাদেরকেও উপহার দেবেন।

ইকরামউজ্জমান
ক্রীড়া লেখক ও কলামিষ্ট


স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা
আজ আর নেই



স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা
আজ আর নেই
দুলাল মাহমুদ


অক্ষরবৃত্ত ॥ ঢাকা

ত্র লেখক
প্রথম প্রকাশ
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫

প্রকাশক
অক্ষরবৃত্ত
৪৮/১ পশ্চিম আগারগাও
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
ফোন : ৮১১৪৫৪৩

প্রচ্ছদ
পঙ্কজ পাঠক

মুদ্রণ
নাহিদা আর্ট প্রেস
৬৪-এফ, আর কে মিশন রোড
গোপীবাগ, ঢাকা-১২০৩

দাম
একশত পঁচিশ টাকা
টঝ $ ৫

ওঝইঘ : ৯৮৪ - ৩২ - ২০১৩ - ৭

ঝঃধফরঁসবৎ ঝযবর অফফধঃধ অধল ঊৎ ঘবর নু উঁষধষ গধযসঁফ
চঁনষরংযবফ নু অশংযধৎনৎরঃঃধ, ৪৮/১ ডবংঃ অমধৎমধড়হ
গড়যধসসধফঢ়ঁৎ, উযধশধ-১২০৭.
চৎরপব ঞশ. ঙহব যঁহফৎবফ ঃবিহঃু ভরাব ড়হষু.


যাদের অম্ল-মধুর সান্নিধ্যে কেটে গেল
জীবনের অনেকটা সময়,
তাদের সবার প্রতি আমার
অপরিসীম কৃতজ্ঞতা

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

এক সময়ের দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ মোহামেডানের কামরু/ দুলাল মাহমুদ

এখন সময় মেসির, এখন সময় আর্জেন্টিনার / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ