আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও
‘একজন শচীন টেন্ডুলকারের অকালে ঝরে যাওয়া’
১৯৮৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। এ দিনটি হতে পারতো বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য গৌরবময় একটি দিন। বিশ্বসেরা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে অভিষেক হয় একজন নবীন ক্রিকেটারের। বুদ্ধুদের মত ক্ষণস্থায়ী ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি যে প্রতিভার ঝিলিক দেখিয়েছিলেন, তাতে প্রকৃত ক্রিকেটপ্রেমীরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছিলেনÑ হাজারো তারার মাঝে আরো একটি ধ্রুবতারার জন্ম হতে যাচ্ছে। কিন্তু তখন তো আর গর্ডন গ্রীনিজ, এডি বার্লো কিংবা ডেভ হোয়াটমোরের মত জহুরী ছিল না যে জহর চিনবে। নিদেনপক্ষে মোহসিন কামালও যদি থাকতেন, তাহলে যথাযথ মূল্যায়নের অভাবে অকালে ঝরে যাওয়া অনেক প্রতিভার মতো সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটারও হারিয়ে যেতেন না। এতে অবশ্য হারিয়ে যাওয়া ওই ক্রিকেটারের কোনো ক্ষতি না হলেও ক্রিকেটানুরাগীরা বঞ্চিত হয়েছেন আরেকজন শচীন টেন্ডুলকারের জন্ম হওয়া থেকে (তখন তো টেন্ডুলকারকেও কেউ চিনতেন না)।
ঘটনাটা খুলেই বলা যাক। স্থানÑ ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ। দিনটি শুক্রবার। প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি মুখোমুখি হয়েছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কাবের। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খেলায় অংশ নিলেও দলটি বেশ শক্তিশালী। দলটিতে রয়েছেন শিক্ষকতায় সদ্য যোগ দেয়া তরুণরা। এঁদের আবার কেউ কেউ ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে দাপটের সঙ্গে নিয়মিত খেলে থাকেন। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির দলটিতে এক সময়ের দু’চারজন ক্রিকেটার থাকলেও সামগ্রিকভাবে দলটি মোটেও শক্তিশালী নয়। ১১ জন নিয়ে দল গঠন করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সমিতির একজন সদস্য হিসেবে আমি গিয়েছিলাম ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগ করতে। সেদিন সকালে ক্রীড়া লেখক সমিতির পক্ষে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হওয়া একাদশতম ব্যক্তি ছিলাম আমি। মাঠে আমাকে আসতে দেখে আগেই উপস্থিত হওয়া ক্রীড়া লেখক সমিতির ১০ জন সদস্য উল্লসিত হয়ে ওঠেন। কী ব্যাপার! আমাকে দেখে এত উল্লাস কেন? আমি একটু ঘাবড়ে যাই। কাছাকাছি যেতেই সমিতির সিনিয়র সদস্যরা জানালেনÑ যাক, সময়মত এসে ভালোই করেছো। তুমি না আসায় আমরা খেলা শুরু করতে পারছিলাম না। আমি কিছু বুঝতে না পেরে তাদের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকি। তারা আমাকে বললেন, আরে! চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? তাড়াতাড়ি রেডি হও। আমি বললাম, রেডি হবো মানে? তারা বললেন, তুমি আসায় আমাদের ১১ জন ক্রিকেটারের কোটা পূরণ হয়েছে। তোমাকে খেলতে হবে। আমি বললাম, বলেন কি? আমি খেলবো ক্রিকেট!
কাঠের বলের ভয়ে মাঠে নামা তো দূরে থাকুক, ক্রিকেট মাঠের কাছাকাছি থাকলেও আমার বুক কেঁপে ওঠে। জীবনে বলতে গেলে কখনোই ক্রিকেট খেলিনি। কিন্তু আমার এ কথা কারো কাছে পাত্তাই পেল না। আমি না খেললে ক্রিকেট ম্যাচ নাকি হবে না! আমাকে খেলতেই হবে। অগত্যা খেলার স্বার্থে, সমিতির ভাবমূর্তির স্বার্থে রাজি না হয়ে আর উপায় থাকে না। সবাই করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানায়। মনোভাবটা এমন, আমি যেন ভিভ রিচার্ডস! যা হোক, আমাদের দল প্রথমেই ব্যাট করতে নামে। ৩৫ ওভারের খেলা। ভাবলাম আমার আগের ১০ জন ব্যাটসম্যান অনায়াসেই এই ৩৫ ওভার খেলে আসবেন। আমার নিশ্চয়ই মাঠে নামার প্রয়োজন হবে না। যেমনটি হয়েছিল ভিভ রিচার্ডসের বেলায়। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন শ্রীলংকার সঙ্গে যেদিন তার ওয়ানডে ম্যাচে অভিষেক হয়, দল আগেই জিতে যাওয়ায় তার আর নামতে হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরে ব্যাট করায় ভিভ এ সুবিধাটুকু পেয়েছিলেন। অন্তত জীবনের প্রথম ম্যাচে ব্যাট করার যন্ত্রণা তাকে পোহাতে হয়নি। ওমা! আমি ভাবলাম কি আর হলো কি! ১৬ দশমিক ৪ ওভারে ৬৬ রানেই ফিরে গেছেন আমাদের ৯ জন ব্যাটসম্যান। এখন আমার না নেমে উপায় কি? গ্লাভস, থাই গার্ড, হেলমেট, চেস্ট গার্ড, হ্যান্ড গার্ড, শিন গার্ড, অ্যাবডমিন্যাল গার্ড পরেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রীতিমত কাঁপতে থাকি। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে দুরু দুরু বুকে ক্রিজের দিকে যখন রওনা হলাম, তখন আমাদের দলের আউট হয়ে আসা সদস্যরা আমাকে এমনভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন, যেন নিদেনপক্ষে আমি মাইকেল হোল্ডিং-এর মতো একটি দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে আসি। ১৯৮৪ সালে ৩১ মে ওল্ড ট্রাফোর্ডে টেক্সাকো ট্রফির প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৪৩ রানে ডেসমন্ড হেইন্স, গর্ডন গ্রীনিজ ও রিচি রিচার্ডসন ফিরে গেলে ব্যাট করতে নামেন ভিভ রিচার্ডস। রিচার্ডস স্বভাবসুলভ মারকুটে ভঙ্গিমায় একদিকে রানের ফোয়ারা ছোটালেও তার সঙ্গীরা একে একে খুব দ্রুত ফিরে যেতে থাকেন। গোমেজ, কাইভ লয়েড, ডুজন, মার্শাল, ব্যাপটিস্ট ও গার্নার আউট হয়ে গেলে তখন সবেধন নীলমণি হয়ে খেলতে নামেন মাইকেল হোল্ডিং। হোল্ডিংকে নিয়ে কিং রিচার্ডস যে ইনিংস খেলেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে। এই জুটি অপরাজেয় ১০৬ রান যোগ করে দশম উইকেটে নতুন রেকর্ড গড়েন। সাঈদ আনোয়ার ভেঙে দেয়ার আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল রিচার্ডসের সেই অপরাজেয় ১৮৯। রেকর্ডটি ভেঙে গেলেও ইনিংসটির রূপ-রস-মাধুর্য আজও এতটুকু ম্লান হয়নি। মাইকেল হোল্ডিং ২৭ বল খেলে ১২ রানে অপরাজিত ছিলেন। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি হয়ে অবিচল দৃঢ়তায় ভিভকে সঙ্গ দেন হোল্ডিং। আমি যে মাইকেল হোল্ডিংয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবো, আমার সঙ্গী তো আর ভিভ রিচার্ডস নন। আর তাছাড়া তখন তো আমার সামনে এই দৃষ্টান্তও ছিল না। যা হোক, ক্রিজে যেয়ে আমার আত্মুা খাচারাম ছাড়া হওয়ার জোগাড়! আমাকে দুর্ধর্ষ পেসার ওবায়দুল হক আযমের মুখোমুখি হতে হবে। এই সেই আযম, যিনি ১৯৮১ সালের ২ ও ৩ জানুয়ারি ফরিদপুরে ২ দিনের ম্যাচে সফরকারী এমসিসি দলকে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন। ৭৯ রানে গুটিয়ে যায় এমসিসির প্রথম ইনিংস। হাটন, মার্ক নিকোলাস, হ্যাম্পশায়ার, নিডহ্যাম, জেমসন, লুইসের মতো খ্যাতিমান ব্যাটসম্যানদের অবস্থা দাঁড়ায় ত্রাহি মধুসূদন। ১৮ রানে ৭টি উইকেট নিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের কাছে রূপকথার নায়ক। টপ ফর্মে থাকা সেই আ-যমের বলের মুখোমুখি হবো আমি! যে কিনা পাড়ার রাম-শ্যাম-যদু-মধুর বলও কখনো খেলেনি। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মতো বুকে ফুঁ দিয়ে গার্ড নিলাম। বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকি। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। মনে হচ্ছিল, আযম নয়, যেন যম ছুটে আসছিলেন আমার আত্মা কেড়ে নেয়ার জন্য। প্রথম বলটি চোখ-কান বন্ধ করে কোনোক্রমে ঠেকিয়ে দেই। পরের বলটি কীভাবে যেন ব্যাটে লেগে রান হয়ে যায়। জীবনের প্রথম রান। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম সঞ্চয়। খুশিতে বাগ বাগ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু দুশ্চিন্তায় আমার মুখ শুকিয়ে যায়। কারণ, সেটি ছিল ওভারের শেষ বল। আমাকে আবার বোলারের মুখোমুখি হতে হবে! আমি যাই বঙ্গে, আমার কপালও যায় সঙ্গে। আমি যতই ব্যাট না করার জন্য ছটফট করতে থাকি, ততই আমাকে বোলারের মুখোমুখি হতে হয়। তবে সৃষ্টিকর্তার বোধহয় কিছুটা রহম হয় আমার ওপর। ১৭ ওভার খেলা হয়ে যাওয়ায় তখন পানি পানের বিরতি। যাক, গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয়া যাবে। দলের বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য সহযোগী খেলোয়াড়রা আমাকে উজ্জীবিত করতে থাকেন। আমি বোধহয় তাতে কিছুটা অনুপ্রাণিত হই। উৎসাহ পেয়ে সুনীল গাভাস্কারের মতো স্টাঞ্চ নিয়ে আরো পাঁচটি ডট বল খেলে বোল্ড হয়ে সগর্বে ফিরে আসি। অভিষেক ম্যাচ হিসেবে পারফরম্যান্স নেহাত মন্দ নয়। ওয়ানডে’র অভিষেক ম্যাচে ক্রিকেট কিংবদন্তি গ্যারি সোবার্স ৬ বল খেলে ০, সেলিম মালিক ২ বল খেলে ০, শচীন টেন্ডুলকার ২ বল খেলে ০ এবং হালের সেনসেশন বীরেন্দর শেবাগ ২ বল খেলে যেখানে ১ রান করেছেন, সেখানে সার্বিক বিচারে আমার পারফরম্যান্স তো অবশ্যই আশা জাগানিয়া। ০ কিংবা ১ রান দিয়ে যাত্রা করে শচীন টেন্ডুলকার, সেলিম মালিক, বীরেন্দর শেবাগরা যদি ক্রিকেট বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমি কেন পারবো না? প্রথম ম্যাচ খেলে এ আত্মবিশ্বাসটুকু অন্তত আমার হয়ে যায় (সে সময় টেন্ডুলকার, শেবাগদের দৃষ্টান্ত থাকলে আমি নিশ্চয়ই আরো বেশি অনুপ্রাণিত হতাম)।
আমি আত্মবিশ্বাসী হলে হবে কি! আমার খেলা দেখে আমার সহযোগীরা মোটেও আত্মবিশ্বাসী হতে পারেননি। যে কারণে আমি বিপদের বন্ধু হিসেবে খেলতে নেমে প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রাখলেও (প্রতিভাকে তো আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না) পরবর্তীকালে আমাকে কেউ আর দলে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। এতে আমার আর কতটুকু ক্ষতি হয়েছে? আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে এ পোড়া দেশের! ভারতের শচীন টেন্ডুলকারের আগেই বাংলাদেশ পেতে পারতো একজন শচীন টেন্ডুলকার। অথচ প্রতিভার দামটা কেউ দিল না। সে নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভও নেই। তবে আড়ালে-আবডালে শুনতে পেয়েছি, আমার ব্যাটিং নাকি বিনোদনের যথেষ্ট খোরাক জুগিয়েছিল। আমি আত্মরক্ষার জন্য যেভাবে ব্যাট করেছি, তাতে নাকি প্রতিপক্ষের বোলার, ফিল্ডার ও সমর্থকরা তো হেসেছেনই, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আমার সহযোগীরাও। আর আমার ফিল্ডিং! সে কথা না হয় আরেকদিন বলা যাবে।
প্রতিযোগী, জুন ২০০৫
ক্রিকেটের রেকর্ড বুকে যে রেকর্ড নেই!
যারা ইন্টারনেট নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাদের কাছে ক্রিকইনফো খুব একটা অপরিচিত নয়। এই ওয়েবসাইটটি ক্রিকেটের তথ্য ও পরিসংখ্যানের আকর হিসেবে পরিচিত। যারা ক্রিকেট খেলেন এবং খেলেছেন, তাদের সবার প্রোফাইল ও ছবি কম-বেশি ক্রিকইনফোতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু অতীব দুঃখজনক যে, আমার মতো একজন স্বনামখ্যাত ক্রিকেটারের ছবি ও প্রোফাইল ক্রিকইনফোতে নেই! এটা কি তাদের ওয়েবসাইটের অপূর্ণতা নয়? আমার তো মনে হয়, এতে তাদের গর্ব অনেকখানি ম্লান হয়ে গেছে। আমার ক্রিকেট ব্যাকগ্রাউন্ড কি এতোটাই অনুজ্জ্বল? অবশ্য এ জন্য মন খারাপ করে লাভ নেই। বরং ছবি ও প্রোফাইল না থাকায় ঢের খুশি হয়েছি। ক্রিকেটের প-িতরা তো স্কোরকার্ডকে একটি গাধা হিসেবেই মনে করেন। জেনে-শুনে কে আর গাধার ভারবাহী হতে চায়? যাক সে কথা। এবার না হয় ক্রিকেটার হিসেবে আমার উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের কথা আপনাদের জানিয়ে দেই। নিজের ঢোল যদি নিজে না পেটাই, অন্যের হাতে দিলে তা ফাটিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। আপনাদের হৃদয়ে যদি স্থান করে নিতে পারি, তাহলে রেকর্ড বুকে আমার কথা না থাকলে কীই-বা আসে যায়?
ক্রিকেটার রকিবুল হাসানকে কে না চেনেন? বাংলাদেশ ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার আগে ক্রিকেটার বলতে যে ক’জনের ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, তিনি তাদের একজন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক ছিলেন অনেক নবীন ও তরুণ ক্রিকেটার এবং ক্রিকেটানুরাগীর স্বপ্নের মানুষ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দলের হয়ে ইন্টারন্যাশনাল একাদশের সঙ্গে চারদিনের ম্যাচ খেলে হয়ে ওঠেন বাঙালির রূপকথার নায়ক। আর সেই রকিবুল হাসানের নেতৃত্বে আমি ক্রিকেট খেলেছি! এ থেকে নিশ্চয়ই অনুধাবন করা যায়Ñ ক্রিকেটার হিসেবে আমি নিশ্চয়ই একদম হেলাফেলার কেউ নই। রকিবুল হাসানের নেতৃত্বে খেলার পরও যদি ক্রিকইনফোতে ঠাঁই না পাওয়া যায়, সেটা কার অযোগ্যতা? আমার, না ক্রিকইনফোর?
ঘটনাচক্রেই আমাকে রকিবুল হাসানের নেতৃত্বে ক্রিকেট খেলতে হয়েছে। ঘটনাচক্রে বলার কারণ, আমার ক্রিকেট খেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা আগ্রহ ছিল না। বুয়েট মাঠে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচে সমিতির হয়ে আমাকে বাধ্য হয়ে খেলতে হয়। সমিতির অধিনায়ক ছিলেন রকিবুল হাসান। এমনিতেই মেজাজী খ্যাতিমান এই ক্রিকেটার যখন মাঠে খেলতে নামতেন, তখন রীতিমত বাঘ হয়ে যেতেন। দলের কেউ একটু ভুল করলে তাঁর গর্জনে সবারই অবস্থা হয় ত্রাহি মধুসূদন। যে আমি টেনিস বল দিয়ে কখনো ক্রিকেট খেলিনি, তাকে কি-না কাঠের বল দিয়ে ফিল্ডিং করতে হয়েছে। তাও আবার রকিবুল হাসানের অধীনে! রকিবুল হাসান তো জানেন নাÑ আমি কোন্ জাতের ক্রিকেটার? তিনি তো হয়তো আমাকে ভেবে থাকবেন জন্টি রোডসের মতো একজন ফিল্ডার। অথচ ক্রিকেট মাঠের পজিশন সম্পর্কেই আমার কোনো ধারণা নেই। তিনি আমাকে মিড উইকেটে দাঁড়াতে বললে আমি ডিপ এক্সট্রা কভারে গিয়ে দাঁড়াই অথবা তিনি লং অনে যেতে বললে আমি যাই থার্ড ম্যানে। তিনি যথারীতি আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাছাড়া আমাকে এমনসব পজিশনে ফিল্ডিং করতে দেন, যেখানে ক্যাচ ধরা সহজ হয় কিংবা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা সহজে রান না করতে পারেন। আর আমি বল ধরার ভয়ে খুঁজে খুঁজে এমন পজিশনে গিয়ে দাঁড়াই, যাতে বল আমার কাছে না যায়। রকিবুল হাসান আমাকে যতবার ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াতে বলেন, আমি তাঁর অগোচরে ততবারই ডিপ লং লেগে গিয়ে দাঁড়াই। ধমক খেয়ে একবার আমি ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের ওই পজিশনে ছিল লংজাম্প কোর্ট। ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে একবার আমার কাছে বল এলে রকিবুল হাসানের ধমক খাবার ভয়ে আমি দু’হাত বাড়িয়ে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি, যাতে বল ফসকে যেতে না পারে। কিন্তু দুর্দান্ত ফিল্ডিং সত্ত্বেও আমার দু’হাত ভরে উঠে আসে রাশি রাশি বালু। আর বল আমাকে ফাঁকি দিয়ে বাউন্ডারি সীমানার দিকে চলে যেতে থাকে। আমি ভয়ে-আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে ভগ্ন-মনোরথে বলের পেছনে পেছনে প্যাভিলিয়নের দিকে চলে যাই। ক্রিকেট ইতিহাসে সেবারই প্রথম ফিল্ডার ইনজুরি না হওয়া সত্ত্বেও একজন সাবস্টিটিউট ফিল্ডারকে মাঠে নামতে হয়েছিল। ক্রিকইনফো কিংবা উইজডেনে কতোসব আজগুবি তথ্য থাকে, আর এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটুকু যে কেন নেই বুঝতে পারি না!
প্রতিযোগী, আগস্ট ২০০৫
বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
তৎকালীন পাকিস্তান আমলে কোনো বাঙালির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে চাওয়াটা ছিল অলীক কল্পনা। আর টেস্ট ক্রিকেট খেলার চিন্তাটা ছিল সুদূরের স্বপ্ন হয়ে। ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে চারদিনের ম্যাচে অংশ নেয় ইন্টারন্যাশনাল একাদশ এবং বিসিসিপি একাদশ। পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড অর্থাৎ বিসিসিপি একাদশের হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র খেলার সুযোগ পান রকিবুল হাসান। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নেমে উভয় ইনিংসেই তিনি ১ রান করে মোট ২ রান করেছিলেন। রকিবুল হাসান কত রান করেছিলেনÑ সেটা সে সময় মোটেও বিবেচ্য বিষয় ছিল না। একজন বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে তিনি এমন একটি ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেনÑ এটাই ছিল অভাবিত ও আলোচিত ঘটনা। এই খেলতে পারাটা সে সময়ের মানদ-ে ছিল একটি বড় ব্যাপার।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের ঐতিহ্য তেমন গৌরবোজ্জ্বল না হওয়ায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট এগুতে থাকে ঢিমে-তেতলা তালে। ঘরোয়া ক্রিকেটের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে ইংল্যান্ডের জগতবিখ্যাত ক্রিকেট কাব এমসিসি বাংলাদেশ সফরে এলে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক মেজাজের সঙ্গে পরিচিত হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশেও যে ক্রিকেট খেলা হয়Ñ সে সময় এটা বিশ্বকে জানানোটাই ছিল আসল কথা। সত্তর দশকে বাংলাদেশের হয়ে যারা ক্রিকেট খেলেছেন, তাদের মূল লক্ষ্যটা ছিল ক্রিকেট নেশন হিসেবে দেশকে তুলে ধরা। তাছাড়া এ সময় যারা ক্রিকেট খেলেছেন, খেলাটাই তাদের কাছে প্রধান উপলক্ষ ছিল না। খেলাটা ছিল বিনোদনের অংশ। অধিকাংশই ছিলেন সামাজিকভাবে অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান। লেখাপড়ার পাশাপাশি মনের আনন্দে ক্রিকেট খেলেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে খেলতে সম্পৃক্ত হয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে। সবাই যে খুব বেশি বড় আসরে খেলতে পেরেছেন, তা নয়। বিদেশী দলের সঙ্গে খেলতে পারাটাই ছিল বড় ধরনের প্রাপ্তি। কেননা, সে সময় বিজ্ঞানভিত্তিক কোচিং অর্থাৎ কোচ, ফিজিও, ভিডিও, সিডি, কম্পিউটার অ্যানালিস্ট ইত্যাদি তো দূরে থাকুক, ক্রিকেটের একাডেমিক বিষয়েই অনেকে অবহিত ছিলেন না। বেসিক ব্যাপারগুলো নিজেদেরকে ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়েছে। সঙ্গত কারণে তাদের কাছে বড় কিছু আশা করা যায়নি। তখন ক্রিকেটারদের মনোভাবটা ছিল এমন : ‘আমাদের এই পথ চলাতেই আনন্দ’। সত্তর ও সত্তর-পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ক্রিকেটাররা হলেনÑ শামীম কবীর, রকিবুল হাসান, মাইনুল হক মাইনু, সৈয়দ আশরাফুল হক, ওমর খালেদ রুমী, এস এম ফারুক, শফিকুল হক হীরা, ইউসুফ রহমান বাবু, দৌলত-উজ-জামান, দীপু রায় চৌধুরী, খন্দকার নজরুল কাদের লিন্টু, তানভীর মাজহার তান্না, আহমেদ ইকবাল বাচ্চু, সামিউর রহমান সামী, জি এম হাসান তামীম, মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম, তানভীর হায়দার, জিয়াউল ইসলাম মাসুদ, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, নাজমুল নূর রবীন, মজিবুল হক মন্টু, বেলায়েত হোসেন বেলাল, ইশতিয়াক আহমেদ, অলোক চক্রবর্তী, রফিকুল আলম, সদরুল আনাম, আনোয়ারুল আজীম আজহার, ওবায়দুল হক আজম, তানজীব আহসান সাদ, নেহাল হাসনাইন, ফয়সল হায়দার, গোলাম ফারুক সুরু, নাজিম সিরাজী, আসাদুজ্জামান মিশা, ওয়াহিদুল গনি, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু প্রমুখ। সত্তর দশকে বাংলাদেশে আসা এমসিসি, শ্রীলংকা, ভারতের ডেকান ব্লুজ, হায়দ্রাবাদ ব্লুজ ও পাকিস্তানের পিআইএ দলের সফর বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে দেখা দেয়। সফরকারী দলগুলো ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া ক্রিকেটারদের পাশাপাশি নবীন ক্রিকেটারদের সমন¦য়ে গঠিত। দলগুলো খুব বেশি শক্তিশালী না হলেও অনভিজ্ঞ বাংলাদেশের তুলনায় তারা ছিল বেশ অভিজ্ঞ। যে কারণে বাংলাদেশ কিংবা আঞ্চলিক দলগুলোর এক একটা ইনিংস গুটিয়ে যায় ৪২, ৫৫, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৮৪, ৮৮, ৯৩, ৯৭ রানের মতো স্কোরে। এমসিসির ডাফ, ভার্নন, পিয়ারচুড, বার্কলে, লিউইংটন, মেরি, স্টুয়ার্ট, উইলসন, মন্ট্রিয়েথ, নিডহাম, শ্রীলংকার টনি ওপাথা, ইল্লেপেরুমা, জগন্নাথন, ডি সিলভা, গুণাতিলক, কাল্লুপেরুমা, রাণাসিঙ্গে, ডেকান ব্লুজের নরসিমা রাও, হায়দ্রাবাদের রাকেশ শুকা, গায়কোয়াডের মতো বোলারদের বলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। তাদের বলে উইকেট পড়েছে নামতার মতো করে। পেস, মিডিয়াম কিংবা স্পিনÑ সব রকম বলের সামনেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাট থেকে সেঞ্চুরি তো দূরে থাকুক, কালে-ভদ্রে দেখা মিলতো হাফ সেঞ্চুরির। রকিবুল হাসান, সৈয়দ আশরাফুল হক, ইউসুফ রহমান বাবু, শফিকুল হক হীরা, নাজিম সিরাজী, মিজান, আসাদুজ্জামান মিশারা কখনো-সখনো ফিফটি হাঁকালে তার মাধুর্যে আপ্লুত হতেন ক্রিকেটানুরাগীরা। দুর্লভ সম্পদ হিসেবে তা চিরদিনের জন্য হৃদয়ের মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখতেন সযতনে। বাংলাদেশের বোলারদের নির্বিষ বলগুলো যখন এমসিসির বার্কলে, নরম্যান, জেমসন, সিসি হান্ট, কার্ক, নিকোলাস, শ্রীলংকার ওয়ার্নাপুরা, টেনিকুন, মেন্ডিস, ওয়েটিমুনি, ডেকান ব্লুজের অজিত ওয়াদেকার, পিআইএ’র রেজওয়ানুজ্জামানের মতো ব্যাটসম্যানরা নির্দয়ভাবে পিটিয়ে বাউন্ডারির বাইরে আছড়ে ফেলতেন, তখন তাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকতো না। উইকেট পাওয়াটা যেখানে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতো, সেখানে প্রতি ম্যাচে চার-পাঁচটি উইকেট পাওয়ার প্রত্যাশা করার প্রশ্নই ওঠে না। এর মাঝেও খন্দকার নজরুল কাদের লিন্টু, দৌলত-উজ-জামান, ইউসুফ রহমান বাবু, ওবায়দুল হক আযম, তানভীর হায়দার, ওমর খালেদ রুমী, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, আনোয়ারুল আমীন আজহাররা হঠাৎ হঠাৎ দুর্দান্ত বল করলে তা হয়ে উঠতো গর্ব ও আনন্দের অফুরন্ত উৎস। বিশেষ করে ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে ফরিদপুরে এমসিসির সঙ্গে বিসিসিবির দু’দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে আযমের দুরন্ত বোলিং ক্রিকেটানুরাগীদের কাছে মধুর এক স্মৃতি হয়ে আছে। ১৮ রানে ৭ উইকেট নিয়ে তিনি এমসিসির প্রথম ইনিংস ৭৯ রানে বিধ্বস্ত করে দেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পরাজয়টা যেখানে ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার, সেখানে এরকম অভাবিত প্রাপ্তি ছিল খুবই বিরল। শামীম কবীর, রকিবুল হাসান ও শফিকুল হক হীরার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দলের শিক্ষানবিশী অব্যাহত থাকে প্রায় আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তবে এ সময় বাংলাদেশের ক্রিকেট তার পরিচয় সংকট কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়। ১৯৭৭ সালের ২৬ জুলাই আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার পর বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। শফিকুল হক হীরার নেতৃত্বে প্রথম আইসিসি ট্রফিতে কানাডা ও ডেনমার্কের কাছে হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশ খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। প্রথম বিদেশ যাত্রাই ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে আনন্দদায়ক ঘটনা। আইসিসি ট্রফি তখন ক্রিকেটারদের কাছে বিশ্বকাপের মর্যাদা পেত। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ে এবং তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনির কাছে পরাজিত হলেও এক ধাপ উন্নতি হয় বাংলাদেশের। এবারও নেতৃত্বে ছিলেন শফিকুল হক হীরা।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসে। আর এই পরিবর্তনটা আনেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, আজহার হোসেন শান্টু, জাহিদ রাজ্জাক মাসুম, নূরুল আবেদীন নোবেল, গোলাম নওশের প্রিন্স, হাফিজুর রহমান সানি, শহীদুর রহমান শহীদ, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, নাসির আহমেদ নাসু, আতহার আলী খান, হারুনুর রশীদ লিটনরা। এই প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট খেলাটা কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় খেলার মাঝেও বেশ পরিবর্তন আসে। এই ক্রিকেটাররা আধুনিক ক্রিকেটের কলাকৌশল সম্পর্কে অবহিত হতে পেরেছেন। এ সময় বেশ কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ সফরে আসতে থাকে শক্তিশালী ক্রিকেট দল। টেস্ট স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত শ্রীলংকা, ইমরান খানের নেতৃত্বে ওমর কোরেশী দল, পশ্চিমবঙ্গ দল ইত্যাদি। এই দলগুলোর সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা আস্তে-ধীরে সাহস সঞ্চার করতে থাকেন। জেতার কথা চিন্তা না করলেও সম্মানজনক পরাজয়ের কথা ভাবতে থাকেন। ১৯৮৬ সালের শুরুতেই গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে পাকিস্তান সফরে যায় বাংলাদেশ। নর্থ জোনের বিপক্ষে ১ রান ও জোন ‘এ’র সঙ্গে ৬৮ রানে জয়ী হয়। সেঞ্চুরির দেখা পান নূরুল আবেদীন নোবেল। প্রতিপক্ষ খুব বেশি শক্তিশালী না হলেও পাকিস্তানের যে কোনো পর্যায়ের দলের বিপক্ষে জয়ী হওয়া এবং সেঞ্চুরি করাটা অবশ্যই কৃতিত্বপূর্ণ। ১৯৮৬ সালের মার্চে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার গৌরব অর্জন করে। আর এটি সম্ভব হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন দিনের হাওয়া লাগায়। শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়া কাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। মুখোমুখি হয় পাকিস্তান ও শ্রীলংকার। এটি ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি মাইলফলক। আগের ক্রিকেটারদের সঙ্গে নব্বই দশকের শুরুতে যোগ দেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, মাহবুবুর রহমান সেলিম, জাহাঙ্গীর তালুকদার দুলু, ফারুক আহমেদ, শাহনেওয়াজ শহীদ শানু, এনামুল হক মনি, সেলিম শাহেদ, জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ আলী, আনিসুর রহমান, মোঃ সাইফুল ইসলাম খান প্রমুখ। সৈয়দ কিরমানির নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে হায়দ্রাবাদ ডেকান ব্লুজের যে দলটি বাংলাদেশে আসে, তাতে ছিলেন চেতন শর্মা, রমন লাম্বা, প্রভিন আমরে ও শ্রীধরের মতো ক্রিকেটাররা। অথচ এই দলটিকে বিসিসিবি লাল দল ৫ উইকেটে, বিসিসিবি শাদা দল ৪ উইকেটে হারিয়ে দেয়। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাবার পূর্বাভাস। একই বছর শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারলেও বাংলাদেশের খেলায় আগের চেয়ে উন্নতি হয়। ভারতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ এশিয়া কাপ থেকে শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের মাইলফলক অর্জন। কোলকাতায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অপরাজিত ৭৮ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন আতহার আলী খান। আগের প্রজন্মের ক্রিকেটাররা যেখানে পরাজয়ের ভীতিতে আতঙ্কিত থাকতেন, সেখানে এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা সাহসী হয়ে উঠতে থাকেন। গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় আইসিসি ট্রফিতে খারাপ করলেও ১৯৯০ সালে চতুর্থ আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনালে পৌঁছায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি টার্নিং পয়েন্ট ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় যুব ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি হিসেবে খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল ইংল্যান্ড সফরে যায়। এই সফর থেকে উঠে আসে উঠতি, মেধাবী ও প্রতিভাবান একদল ক্রিকেটার। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খালেদ মাহমুদ সুজন, জাভেদ ওমর বেলিম গুল্লু, হাবিবুল বাশার সুমন, নাইমুর রহমান দুর্জয় প্রমুখ। চমৎকার একটি সফর শেষে দলটি ঢাকায় প্রথম এশীয় যুব ক্রিকেটে অংশ নিয়ে প্রশংসনীয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করে যথাক্রমে ১০ ও ৩২ রানে হারলেও মালয়েশিয়াকে ২০৪ ও সিঙ্গাপুরকে ২৫৯ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে সেলিম শাহেদ অপরাজিত ১২১ ও আমিনুল ইসলাম বুলবুল ১০০ রান করেন। এ টুর্নামেন্টেই শোনা যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের পদধ্বনি।
নব্বই দশকে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও ফারুক আহমেদের নেতৃত্বে জাতীয় ক্রিকেট দলের বড় কোনো সাফল্য না এলেও ১৯৯২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক ক্রিকেটে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ৭ উইকেটে হারিয়ে দেয়। ১৯৯৪ সালে পঞ্চম আইসিসি ট্রফিতে ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সিনিয়ররা খুব বেশি আশানি¦ত করতে না পারলেও তরুণরা বেশ এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৯৪ সালের আগস্টে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের ৭ জাতির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয় নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্বে। এই সাফল্যে উদ্দীপিত হয়ে আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়। শ্রীলঙ্কাকে ৫ উইকেটে এবং ভারতকে ১ রানে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি আকরাম খানের নেতৃত্বে সাফল্য প্রত্যাশী একদল ক্রিকেটারের সমাবেশ ঘটে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনÑ আমিনুল ইসলাম বুলবুল, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, হাবিবুল বাশার সুমন, সেলিম শাহেদ, খালেদ মাসুদ পাইলট, সাইফুল ইসলাম খান, মোঃ রফিক, আনিসুর রহমান, হাসিবুল হোসেন শান্ত, জাহাঙ্গীর আলম, খালেদ মাহমুদ সুজন, সানোয়ার হোসেন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, জাভেদ ওমর বেলিম গুল্লু, জাকির হোসেন, আল শাহরিয়ার রোকন, মেহরাব হোসেন অপি, মাহবুবুর রহমান সেলিম, মোরশেদ আলী খান, মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, ফাহিম মুনতাসির সুমিত প্রমুখ এবং অপেক্ষাকৃত তিন সিনিয়র আতহার আলী খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও এনামুল হক মনি। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন নতুন ঠিকানায়। এ পর্যায়ে এসে ক্রিকেটারদের কাছে ক্রিকেটই হয়ে ওঠে ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। বিদেশী কোচের অধীনে এঁরা নিজেদের দুর্বলতাগুলো দূর করতে পেরেছেন। আগে যাদের বল খেলতে বুক কেঁপে উঠতো, তাদের বল খেলতে আর ভয় পান না। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির এই ক্রিকেটাররা একটির পরু একটি মাইলফলক অতিক্রম করে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম এসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে মালয়েশিয়ায় বহু আকাক্সিক্ষত ষষ্ঠ আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ যেভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়, তা ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার ছাড়পত্র পাবার পাশাপাশি ওই বছরের ১৫ জুন ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। ১৯৯৮ সালে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের সাউদার্নের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেন আল-শাহরিয়ার রোকন। ভারতের হায়দরাবাদে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে কেনিয়াকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ রফিক। ১৯৯৯ সালের মার্চে ঢাকায় মেরিল ইন্টারন্যাশনাল কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন মেহরাব হোসেন অপি। মে মাসে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে স্কটল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে প্রথম জয় এবং পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে খালেদ মাহমুদ সুজন ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। টেস্ট স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত কোনো দেশকে হারানোর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। আকরাম খান ও আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে এতোসব সাফল্যের পর বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেক হয় নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্বে। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর শুরু হওয়া অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ২০০১ সালে এপ্রিলে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ক্যারিং থ্রু দ্য ইনিংস খেলে ৮৫ রানে অপরাজিত জাভেদ ওমর বেলিম ম্যান অব দ্য ম্যাচ এবং সেপ্টেম্বরে কলম্বোয় শ্রীলংকার সঙ্গে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি করে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি মুরালিধরনের সঙ্গে যুগ্মভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ আশরাফুল। ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশ গৌরবময় বেশ কিছু মাইলফলক স্থাপন করার পর নেতৃত্বে আসেন খালেদ মাসুদ পাইলট, খালেদ মাহমুদ সুজন ও হাবিবুল বাশার। এ সময় পাকিস্তানের মুলতান টেস্টে জয়ের কাছাকাছি এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সেন্ট লুসিয়া টেস্টে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে প্রথমবারের মতো খেলে ড্র করার পাশাপাশি বিভিন্ন টেস্ট দেশের বিপক্ষে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে সিরিজ খেলার অভিজ্ঞতা হয় বাংলাদেশের। ২০০২ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ম্যান অব দ্য সিরিজ হন খালেদ মাসুদ পাইলট, ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন অলক কাপালি এবং ২০০৩ সালে ঢাকায় ২য় টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ রফিক। আগস্টে পেশোয়ারে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন অলক কাপালি। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের ক্রিকেটারদের টেস্ট খেলা তো দূরে থাকুক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাটা ছিল স্বপ্নের মতো। আর বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেটারদের অভিষেক হয় টেস্ট অথবা ওয়ানডে ক্রিকেটে। যোগ্যতা দিয়ে এটা তারা আদায় করে নিতে পেরেছেন। হাবিবুল বাশার সুমনের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক সময়ে উুঠে এসেছেন নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। এই ক্রিকেটারদের চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি একদমই অন্যরকম। আগের প্রজন্মের ক্রিকেটাররা যেখানে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হতেন, সেখানে নতুন প্রজন্মের এই ক্রিকেটারদের মধ্যে একটা লড়াকু মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। আক্রমণাত্মক ও সংগ্রামী ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত মোঃ রফিক, খালেদ মাসুদ পাইলট, জাভেদ ওমর বেলিমদের সঙ্গে সম্মিলন ঘটেছে মোঃ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তালহা জুবায়ের, তাপস বৈশ্য, রাজিন সালেহ, এনামুল হক জুনিয়র, নাফিস ইকবাল, আফতাব আহমেদদের। এই দলের সঙ্গে অনিয়মিতভাবে থাকেন মুশফিকুর রহমান, অলক কাপালি, হান্নান সরকার, মানজারুল ইসলাম রানা প্রমুখ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নানারকম অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আধুনিক ক্রিকেটের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে বর্তমান দলটি। কোচ হিসেবে পেয়েছে ডেভ হোয়াটমোরের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ ও সফল কোচকে। তারুণ্যের ছটায় উদ্ভাসিত নতুন প্রজন্মের এই দলটি কাউকেই পরোয়া করে না। বল যত স্পিডেই আসুক কিংবা স্পিনের যতই জাদুময়তা থাকুকÑ বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ায় এই ব্যাটসম্যানরা। বিশ্বের যতই নামী ব্যাটসম্যান হোক না কেন, উইকেট ছিটকে ফেলতে একটুও দ্বিধা করেন না নতুন প্রজন্মের বোলাররা। গত নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টে বোলার হলেও তাপস বৈশ্যের ব্যাটে দেখা যায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তৃতীয় দিনেই খেলার ফলাফল নিশ্চিত হয়ে যাওয়া এ টেস্টে ৮ উইকেটে ২১০ রান নিয়ে চতুর্থ দিনে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। যে কোনো মুহূর্তে খেলার সমাপ্তি হয়ে যাবেÑ এমন একটা মনোভাবই ছিল সবার। মোঃ রফিক ৩০ ও তাপস বৈশ্য ১৫ রান নিয়ে ব্যাট করতে নামেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশ চতুর্থ দিন ৫২ রান যোগ করে। এর মধ্যে ১ রান যোগ করেন রফিক। বাকি ৫১ রান আসে তাপসের বিধ্বংসী ব্যাট থেকে। সব মিলিয়ে ৪৭ বলে ৬৬ রান করলেও ৩৬ বলে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম ফিফটি করেন। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে মোঃ আশরাফুল ১৫৮ রানের অপরাজেয় যে ইনিংসটি খেলেন, তা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম একটি সেরা ইনিংসের স্বীকৃতি পেয়েছে। ইনিংসটির পরতে পরতে ছিল সাহস, আত্মবিশ্বাস ও নান্দনিক সৌন্দর্য। টেস্টে হারলেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন আশরাফুল। জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে নাফিস ইকবালের ১২১ এবং ওয়ানডেতে আফতাব আহমেদের অপরাজেয় ৮১ রানের বিস্ফোরক ইনিংসের মধ্যে যে স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়, এমনটি অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। নাফিস ইনিংসটি দায়িত্বশীলতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ধৈর্য, দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ভূমিকা রাখেন। একই সঙ্গে কোনো প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিয়ে রাজিন সালেহ ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংসটিও দায়িত্বশীলতার প্রতিমূর্তি। ওয়ানডে ম্যাচে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে আফতাব আহমেদ ও মোহাম্মদ রফিক যেভাবে ব্যাট করেন, তা ছিল অবিশ্বাস্য। তারা ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেন সনাথ জয়াসুরিয়া, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শহীদ আফ্রিদি, বীরেন্দর শেবাগের মতো দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যানদের। ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান আফতাব চিগুমবুরার এক ওভারে ২৪ রান নিয়ে ৩২ বলে ফিফটি করেন। এই একটি ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশ পুরনো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে নতুন বাংলাদেশ রূপে। মাশরাফি বিন মর্তুজা, তাপস বৈশ্য, এনামুল হক জুনিয়রের মতো বোলাররা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছেন। ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে রাহুল দ্রাবিড়কে মাশরাফি বিন মর্তুজা বোল্ড করা এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এনামুল হক জুনিয়রের জাদুময় বলগুলো নতুন বাংলাদেশেরই সংস্করণ। ২০০৪ সালে মার্চে হারারেতে তৃতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ৮ রানে জয়ী এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ আশরাফুল। হারারেতে জিততে না পারলেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন খালেদ মাহমুদ সুজন। নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৩৯ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন আফতাব আহমেদ। ডিসেম্বরে ভারতকে ১৫ রানে হারিয়ে দেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে জয়ের ক্ষেত্রে অলরাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী মাশরাফি বিন মর্তুজা ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্রিকেটে জয়ী হয় বাংলাদেশ। ৪৫ রানে ৬টি উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন এনামুল হক জুনিয়র। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সিরিজে জয়ী হলে ১৮টি উইকেট নিয়ে এনামুল ম্যান অব দ্য সিরিজ হন। একই মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজে ৩-২ ম্যাচে জয়ী হয় বাংলাদেশ। ০-২-এ পিছিয়ে যাওয়ার পরও শেষ ৩ ম্যাচ জেতায় সিরিজ আসে বাংলাদেশের ঘরে। তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচে মানজারুল ইসলাম রানা এবং পঞ্চম ম্যাচে মোঃ রফিক ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটে-বলে ক্রমান¦য়ে সাফল্য দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
নাজমুল হোসেন, এনামুল হক জুনিয়র, আফতাব আহমেদ, নাফিস ইকবাল, রাজিন সালেহ, মাশরাফি বিন মর্তুজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, তাপস কুমার বৈশ্যরা বাংলাদেশের ক্রিকেটের আগামী দিনের বিজ্ঞাপন। ১৮ থেকে ২২ বছর বয়েসী এই তরুণরা তারুণ্যের দীপ্তিতে ভাস্বর। রকিবুল হাসানদের কাছে যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাটা ছিল স্বপ্ন, সেখানে নতুন প্রজন্মের এই ক্রিকেটাররা দাপটের সঙ্গে খেলে জয়ের স্বপ্ন দেখেনÑ এটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের বদলে যাবার সত্যিকার চিত্র।
পড়শি, মে ২০০৫
ক্রিকেট : খেলা না ভিডিও গেমস
ত্রিকেটকে খেলা বলা যায় কিনা ইদানীং এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। যে কোনো খেলায় একজন দর্শকের প্রাপ্তি তাৎক্ষণিক উত্তেজনা, অনির্বচনীয় আনন্দ ও সূক্ষ্ম রস; কিন্তু ক্রিকেট থেকে এ বিষয়গুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনিতে ক্রিকেট কখনোই সর্বসাধারণের খেলা হয়ে উঠতে পারেনি। না পারার সঙ্গত কারণও রয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের গর্ভে ক্রিকেটের জন্ম এবং তারাই ক্রিকেটের লালন-পালন ও পরিচর্যা করে এসেছে। আর ব্রিটিশদের সম্পর্কে খুব বেশি ভালো ধারণা অন্তত আমাদের নেই, আমরা যারা ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিলাম। এখনো গোরা সাহেবদের চাবুকের সেই দাগ আমাদের শরীরে লেগে আছে। অবশ্য সাধারণ ব্রিটিশদের কাছেও ক্রিকেট খেলাটি খুব বেশি আদরণীয় নয়।
সেই সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে ব্রিটিশ ঘরানার জমিদার ও অভিজাতরা। আর এ সম্প্রদায়ের অর্থবিত্ত-প্রতিপত্তি কীভাবে গড়ে ওঠে, সেটা সাধারণ মানুষ পলে পলে অনুভব করতে পারেন। উচ্চবিত্ত এ সম্প্রদায় নিজেদের বিনোদনের খোরাক হিসেবে বেছে নেয় ক্রিকেটকে। তাদের তো আর অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থান নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমনÑ লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন! জীবনের মূল কথা ছিলÑ খাও-পিও-মস্তি করো। হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। অলস সময়টুকু উপভোগের অন্যতম একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে ক্রিকেট। মিঠে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে পানপাত্রে একটু একটু চুমুক দিয়ে মেতে উঠতেন ক্রিকেটের ‘সুধা’রসে। ক্রিকেটের বিচরণ ছিল নির্দিষ্ট একটি গ-িতে আবদ্ধ। সাধারণ মানুষ এর নাগাল পেতেন না। পেতেন তখন যখন ক্রিকেটের সরঞ্জাম আর পানপাত্র আনা-নেয়া কিংবা তাদের সেবায় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হতো। যে খেলাটি ছিল কিছু লোকের বিলাস-ব্যসন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিল না, তাকে খেলা হিসেবে কতটা বিবেচনা করা যায়!
ক্রিকেটের গ-িটা তখনই কিছুটা সম্প্রসারিত হয়। যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ক্রমেই ছলে-বলে-কৌশলে বিস্তার লাভ করতে থাকে। উচ্চ শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে সৈনিক, বণিক ও পাদ্রীরা ক্রিকেটকে সঙ্গে নিয়ে যান। তাতে যে ক্রিকেট নতুন নতুন অঞ্চলে প্রসার লাভ করেছেÑ তা নয়। খেলাটি সীমাবদ্ধ থেকেছে বনেদী, অভিজাত ও শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এলেও ক্রিকেট যে খুব বেশি চাউর হয়েছেÑ সে কথাও বলা যাবে না। যুগ যুগ ধরে ক্রিকেটে দাপট দেখিয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড এবং জিম্বাবুয়ের শ্বেতাঙ্গরা। এসব দেশে যারা ক্রিকেট খেলেন, তারা তো ব্রিটিশদের একটি সংস্করণ। এদের বাইরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশ। এক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোয় ক্রিকেট এসেছে ব্রিটিশদের গুণগ্রাহী রাজ-রাজরাদের হাত ধরে। ভারতীয় উপমহাদেশের শুরুর দিকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করতেন রাজা-মহারাজারা। ব্যাটিং-বোলিংয়ে পারদর্শিতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী না থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রধান গুণ, তারা ছিলেন নীল রক্তের অধিকারী। ক্যারিবীয়রা ভালোবেসে ক্রিকেট খেলেছেন, তেমনটি বলা যাবে না। তাছাড়া দু’একটি ছাড়া এখন অবধি কোনো দেশেই ক্রিকেট কিন্তু জনপ্রিয়তম খেলা নয়। সামগ্রিকভাবে ক্রিকেটটা ছিল শোষক-শাসকদের আভিজাত্য ও বনেদিয়ানার একটি প্রকাশ। তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদাÑ এটার প্রকাশ ঘটতো ক্রিকেটের মাধ্যমে। ক্রিকেটের পরিসর সীমিত গ-িতে আবদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ ক্রিকেটকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ কখনোই আপন ভাবতে পারেনি। ব্যয়বহুল এ খেলাটির পেছনে যে অর্থ ও সময় অপচয় হয়, তা সাধারণ মানুষের কাছে এক ধরনের বিলাসিতা। এটা তাদের কাছে বিনোদন হয়ে উঠতে পারেনি। ইদানীং অবশ্য কোনো কোনো দেশে ক্রিকেটটা হুজুগ হয়ে দেখা দিয়েছে।
শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে ক্রিকেটকে মনে হয়েছে অভিজাত সম্প্রদায়ের একটি ব্যাপার-স্যাপার। তেমনি প্রতীয়মান হযেছে দুর্বোধ্য একটি বিষয় হিসেবে। পোশাক-আশাকের ভারিক্কিয়ানা, চলন-বলন আর নানা এটিকেট তো আছেই, সে সঙ্গে ক্রিকেটে এত বেশি নিয়ম-কানুন আর জটিলতাÑ তার প্যাঁচ খুলে রসাস্বাদন করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। প্রতিটি বল ও প্রতিটি শটের যে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তা বোঝা রীতিমত গবেষণার ব্যাপার। কত আইন, কত পরিসংখ্যান, কত রেকর্ডÑ তার কোনো ইয়ত্তা নেই। খেলাধুলা মানেই তো জীবনের যাবতীয় জটিলতা থেকে ক্ষণিকের মুক্তি, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ ও নির্মল বিনোদন। অথচ ক্রিকেটে আছে এক ধরনের জটিলতা, আইন-কানুন, পরিসংখ্যান ও রেকর্ডের মারপ্যাঁচ। মুক্তি, আনন্দ ও বিনোদন তো দূরে থাকুক, উপরন্তু ক্রিকেট মাঠে জেঁকে বসে এক রাশ কান্তি, অবসন্নতাÑ সর্বোপরি অবোধ্য এক ধাঁধা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে থাকতে পেয়ে বসে একঘেয়েমি। একটানা মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ক্রিকেটের এমন কিছু নিয়ম-কানুন আছে যার কোনো সদুত্তর আজো মেলেনি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের যে পালাবদল ঘটছে, তাতে ক্রিকেটকে আদৌ খেলা বলা যায় কিনাÑ সে প্রশ্নটি আরো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। যে কোনো খেলায় চটজলদি যে উল্লাস ও আনন্দ, ক্রিকেটে তা লুপ্ত হতে চলেছে। ক্রিকেটে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের ভূমিকাই বড় হয়ে উঠছে। ক্রিকেটে প্রযুক্তির ব্যবহার যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে ক্রিকেটকে কম্পিউটার বা ভিডিও গেমসের সম্প্রসারণ বললে অত্যুক্তি হবে না। ক্রিকেটের সঙ্গে টেলিভিশনের মেলবন্ধন ঘটে ১৯৩৬ সালে। ওই বছর নভেম্বরে লন্ডনে প্রথম ক্রিকেট খেলা সম্প্রচার করা হয়। সত্তর দশকে খেলাধুলায় টেলিভিশনের যুগ শুরু। স্পোর্টস কভারেজের ক্ষেত্রে রীতিমত বিপ্লব নিয়ে আসে টেলিভিশন। টেস্ট ক্রিকেটকে শ্লথ ও মন্থর আখ্যা দিয়ে ১৯৭১ সালে প্রবর্তন করা হয় ওয়ানডে ক্রিকেট। ওয়ানডে ক্রিকেটের খোলনলচে পাল্টে দেন ধনকুবের কেরি প্যাকার। অস্ট্রেলিয়ার চ্যানেল নাইন টিভির মালিক এ ভদ্রলোক ক্রিকেটে প্রাণ আনার জন্য ১৯৭৭ সালে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। অন্যান্য খেলার মতো ক্রিকেটে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য ক্রিকেটকে রঙিন করে তোলেন। প্রবর্তন করেন দিন-রাতের ক্রিকেট। ফাডলাইটে খেলার আয়োজন করা হয়। খেলোয়াড়দের গায়ে চড়ান নানারঙের পোশাক। টেলিভিশনে স্লো-মোশনে রানআউট, স্ট্যাম্পিং কোজ ক্যাচ ইত্যাদি নির্ধারণ এবং মেয়েদের দিয়ে মাঠে রোলার টানা, ড্রিংকস সার্ভ করাসহ নানাভাবে ক্রিকেটকে গতিময় ও গ্ল্যামারাস করা হয়। নিরুত্তাপ ও প্রাণহীন ক্রিকেটে খেলার উত্তাপ, উত্তেজনা ও প্রাণপ্রাচুর্য সংযোজন ঘটানোর কতোই না কসরত! আর এ প্রবর্তনগুলো ধীরে ধীরে মেনে নিতে বাধ্য হয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি। ১৯৭৯ সালে সিডনি ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটের প্রথম ওয়ার্ল্ড সিরিজ আনুষ্ঠানিকভাবে খেলা হয় ফাডলাইটে। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করা হয় থার্ড আম্পায়ারের। কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশয় সৃষ্টি কিংবা ফিল্ডারদের ক্রমাগত চাপের মুখে দুই আম্পায়ারকে থার্ড আম্পায়ারের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। থার্ড আম্পায়ার স্লো-মোশনে বারবার ভিডিও রিপ্লে দেখে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেন, তাতে গতিহীন খেলা ক্রিকেট আরো বেশি মন্থর হয়ে পড়ছে। আম্পায়ারদের ভূমিকা ক্রমেই গৌণ হয়ে যাচ্ছে। তারা রীতিমত রোবট হয়ে পড়ছেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি তাদের চালিত করছে। রানআউট, স্ট্যাম্পিং, কটবিহাইন্ড, কোজ ক্যাচ, বাউন্ডারির পাশাপাশি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত সুপার সিরিজে প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করা হয় টিভি রিপ্লে দেখে এলবিডব্লিউ ও নো-বলের সিদ্ধান্ত প্রদান। আম্পায়ারদের কোমরে ওয়্যারলেস, কানে বিশেষ ধরনের হেডফোন এবং সিদ্ধান্তের জন্য প্রতি মুহূর্তে থার্ড আম্পায়ারের অপেক্ষায় থাকায় প্রশ্ন উঠেছেÑ আম্পায়ার কি ডিসিশন মেকার, নাকি কোট-হ্যাঙ্গারস? থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত প্রদান করতে গিয়ে মাঠে সৃষ্টি হয় এক ধরনের নাটকীয়তা। থার্ড আম্পায়ার সিদ্ধান্ত দেয়ার পর খেলোয়াড়রা তাৎক্ষণিক সাফল্য উদযাপন ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতে পারেন না। খেলোয়াড় ও দর্শকরা যে আনন্দটুকু পান, তা ভিডিও বা কম্পিউটার গেমস খেলার বা দেখার আনন্দ। খেলার আনন্দের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
ক্রিকেটের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে জটিলতা। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রবর্তন করা হয় ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওয়ানডে ম্যাচে ওভার কার্টেল হলে খেলার ফলাফল নির্ধারণে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। দুরূহ এ নিয়ম বুঝতে হলে অঙ্কশাস্ত্রে রীতিমত প-িত হতে হয়। তারপরও হিসাব মেলানো সহজ নয়। আর এ নিয়ম এমনই অদ্ভুত কিসিমের যে, যার আগা-মাথা পাওয়া যায় না। ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দ্বিতীয় সেমিফাইনালটির কথাই ধরা যাক। ইংল্যান্ডের সঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে ব্যাহত হলে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকাকে টার্গেট দেয়া হয় ১ বলে ২২ রান করার জন্য। এটা কি সম্ভব? এমন সব অবাস্তব ও অসম্ভব বিষয়ই ক্রিকেটের শোভাবর্ধন করে চলেছে। ক্রিকেটটা যে খেলা হয়ে উঠতে পারেনি, তার কারণ নিত্যনতুন অদ্ভুত সব নিয়ম-কানুন। সম্প্রতি ওয়ানডে ক্রিকেটে বদলি ক্রিকেটার ও ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনের যে বিধিবিধান জারি করা হয়েছে, তা স্বয়ং ক্রিকেটাররাই ঠিকমত বুঝতে পারছেন না। যে নিয়ম খেলোয়াড়দের জন্য প্রযোজ্য, তারাই যদি সেটা অনুধাবন না করতে পারেন, তাহলে তা খেলার অংশ হয় কিভাবে?
আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ড মনে করেন, আগামী দিনগুলোতে ক্রিকেটে বড় ভূমিকা রাখবে টেলিভিশন ও কম্পিউটার প্রযুক্তি। সেক্ষেত্রে এখন যা হোক ক্রিকেটের কিছুটা ভূমিকা রয়েছে; কিন্তু আসছে দিনগুলোতে ক্রিকেট হবে কম্পিউটার গেমসের একটি উন্নত সংস্করণ। তখন হয়তো দর্শকদের মাঠে আসার প্রয়োজন পড়বে না। বাড়িতে বসেই তারা হয়তো কি-বোর্ডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ক্রিকেট খেলা।
দৈনিক সমকাল, ১ নভেম্বর ২০০৫
ক্রিকেটে প্রযুক্তি
ক্রিকেটে প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে বিতর্কের কোনো শেষ নেই। প্রযুক্তি কি ক্রিকেটকে এগিয়ে দিচ্ছে? নাকি ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে? এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো না গেলেও প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণটা বেড়েই চলেছে। ক্রিকেট খেলাটিকে এমনভাবে নিখুঁত করতে চাওয়া হচ্ছেÑ যা কেবলই কম্পিউটারে সম্ভব। এর ফলে মাঠের ভূমিকা ক্রমশ গৌণ হয়ে পড়ছে।
ক্রিকেট তো ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ক্রিকেটে ফেয়ার প্লে নিয়ে গর্ব করা হয়। বলা হয়, স্পিরিট অব ক্রিকেট কেবল অটুট আছে ক্রিকেটে। ক্রিকেটে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তার এখতিয়ার নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন না। প্রশ্নটা করাটা ক্রিকেটোচিত নয়। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। সত্তর দশকে শুরু হয় টেলিভিশন যুগ। খেলাধুলার কভারেজের ক্ষেত্রে টিভি যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেÑ ক্রিকেটও তা থেকে এখন আর দূরে নয়। আগামী দিনগুলোতে খেলাধুলায় টিভির ভূমিকা সম্পর্কে কেউ কল্পনাও করতে পারছেন না। টিভি কভারেজ ক্রমশ পেশাদারিত্ব অর্জন করছে। লাইভ কভারেজ ক্রিকেটের ক্ষেত্রে দারুণ প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বড় কথা, আম্পায়ারের ভূমিকাও পাল্টে দিচ্ছে টিভি। ক্রিকেটে আম্পায়ার হলেন জাজ, জুরি ও রায়দাতা। সেটাও এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ক্যামেরার চোখ আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ক্যামেরার চোখে আম্পায়ারের ভুল, নিখুঁত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সংশয় এবং সর্বোপরি আম্পায়ারের নিখুঁত সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে টিভি ক্যামেরা সহযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে কি নাÑ তা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। আর এসব কারণে ১৯৯২ সালে মেনে নেয়া হয় প্রযুক্তির ভূমিকাকে। প্রথমবারের মত থার্ড আম্পায়ার ক্রিকেটের অংশ হয়ে ওঠে। থার্ড আম্পায়ার অ্যাকশন রিপ্লে দেখে মাঠের আম্পায়ারকে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। শুরুতে রান আউট ও স্ট্যাম্পিং-এর সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল। প্রযুক্তির এই নতুন ভূমিকা ক্রিকেটের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ায় তার আধিপত্য ক্রমান¦য়ে বাড়তে থাকে। এরপর কোজ ক্যাচ, কট বিহাইন্ড, বাউন্ডারির সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে থার্ড আম্পায়ারের শরণাপন্ন হওয়ার বিধান চালু হয়। ২০০২ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রযুক্তির নতুন সংযোজন হয়। প্রবর্তন করা হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হকআই। এছাড়াও ব্যবহার করা হয় স্ট্যাম্প মাইক্রোফোন। এর সাহায্যে এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। আম্পায়ারকে দেয়া হয় হেড ফোন। যাতে বলÑ ব্যাট ও বল-প্যাডের সংঘর্ষের শব্দ শুনে তিনি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। সে সময় যে পরীক্ষা চালানো হয়, তারই ধারাবাহিকতায় এবার অস্ট্রেলিয়ায় সুপার সিরিজে থার্ড আম্পায়ার টিভি রিপ্লে দেখে এলবিডব্লিউ ও নো-বলের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
ক্রিকেটে একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল, ব্যাটসম্যানদের বেনিফিট অব ডাউট সুবিধা দেয়া। এর অর্থ হলো, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আম্পায়ারের কোনো রকম সংশয় থাকলে, সেক্ষেত্রে সুবিধাটুকু ব্যাটসম্যানের অনুকূলে দেয়া হয়। এ বিষয়টি নিয়ে এখন প্রযুক্তি প্রশ্ন করছে। এখন এ বিষয়ে আম্পায়ারের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর কারণ, ক্যামেরা দুটি ডাইমেনশনাল ছবি উপস্থাপন করে। ছবিগুলো নেয়া হয় সুনির্দিষ্ট কোণ, উচ্চতা ও দূরত্ব থেকে। এর অর্থ, একটি কোণ থেকে ছবি দেখলে পুরো চিত্র দেখা সম্ভব নয়। দেখা যায় খি ত অংশ। অনেক সময় দুটি ডাইমেনশনাল ছবি দেখেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। ২০০২ সালের নভেম্বরে অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার জাস্টিন ল্যাঙ্গার ক্যাচ নেন মাইকেল ভনের। ল্যাঙ্গারের নেয়া ক্যাচটি যথাযথ হওয়া সত্ত্বেও বলটি মাটি স্পর্শ করেছে কি না, রিপ্লে যথাযথভাবে উত্তর দিতে না পারায় বেঁচে যান ভন। যেখানে ১৯ রানে শেষ হয়ে যেতে পারতো তার ইনিংস, সেখানে তিনি ১৭৭ রান করেন। পরের মাসে ইংল্যান্ড-ভারত টেস্ট সিরিজে ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসাইনের ক্যাচ নেন বীরেন্দ্রর শেবাগ। এটি ছিল লো ক্যাচ। হুসাইন মনে করেন, শেবাগ ক্যাচটি মাটি থেকে নিয়েছেন। যথারীতি থার্ড আম্পায়ার একাধিকবার রিপ্লে দেখে নিশ্চিত হতে না পারায় বেনিফিট অব ডাউট পান নাসের হুসাইন। প্রযুক্তি সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিষয়গুলো নির্ভর করে ক্যামেরার উচ্চতা, কোণ, স্পিড অব দ্য ফ্রেম, দুটি ডাইমেনশনাল ইমেজ ও ঘটনাস্থল থেকে ক্যামেরার দূরত্বের ওপর। প্রযুক্তি পরামর্শ প্রদান করতে পারে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।
ক্রিকেট খেলা ধীরে ধীরে পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিপুল অর্থ। এ কারণে খেলোয়াড় ও দর্শকরা চান নিখুঁত সিদ্ধান্ত। অনেক সময় আম্পায়ারের একটি ভুল সিদ্ধান্তে একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে অনেকেই আম্পায়ারের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। তাদের কাছে প্রযুক্তিই শেষ কথা। অন্য পক্ষের অভিমত হচ্ছে, অতিমাত্রায় প্রযুক্তি-নির্ভরশীলতার কারণে ক্রিকেটের নান্দনিক সৌন্দর্য আর থাকছে না। ক্রিকেট তো একটা খেলা। বিজ্ঞান নয়। সবকিছুই নিখুঁত হবেÑ এমন তো কথা নয়। আম্পায়ারের কিছুটা ভুল-ভ্রান্তি হতেই পারে। মানবিক ভুল তো খেলারই একটি অংশ। খেলার মাঠের লোকেরা যদি সৎ থাকেন, তাহলে তো কোনো সমস্যা থাকে না। ক্রিকেট তো যুগ যুগ ধরে ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ খেলায় আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটসম্যানের তো মাঠ ছেড়ে চলে যাবার কথা কিংবা আউট না হলে তো ফিল্ডারের আবেদন করার কথা নয়। এটাই তো স্পোর্টসম্যানশীপ। এটাই তো স্পিরিট অব দ্য ক্রিকেট।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ নভেম্বর ২০০৫
বিশ্ব ক্রিকেটের ‘সোনার রাজহাঁস’ উপমহাদেশ
ক্রিকেট খেলাটা ব্রিটিশদের হলেও এর জনপ্রিয়তা মূলত সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এলাকায়। সত্যিকার অর্থে ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া। এ দেশগুলোতে ব্রিটিশদের পা না পড়লে ক্রিকেট খেলাটা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া হিসেবে স্থান করে নিতে পারতো কিনা সন্দেহ থেকে যায়। তারপরও ক্রিকেটের যতই বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেয়া হোক না কেন, এখনো এর চৌহদ্দি খুবই সীমিত। চাঁছা-ছোলাভাবে বললে বলা যায়Ñ এখন ক্রিকেটের সঞ্জীবনী হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া। জনপ্রিয়তার মানদ-টা নিজেদের প্রান্তে হেলানো তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরও দাঁড় করানোর কৃতিত্ব তাদের। আসলে ক্রিকেট নামক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বদলে গেছে দক্ষিণ এশিয়া। আরো সংক্ষেপে বলা যায়Ñ উপমহাদেশের জীবনযাত্রা। উপমহাদেশে ক্রিকেটটা এখন আর খেলা নয়, হয়ে উঠেছে প্রাত্যহিকতার অংশ। অধিকাংশ লোক হয় ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করেন, নতুবা টেলিভিশনে খেলা দেখেন। খেলা চলাকালে টান টান উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকেন কোটি কোটি দর্শক। এটা যেন হয়ে উঠেছে উপাসনার মতো। খেলার দিনটিতে কোনো কোনো এলাকা অঘোষিতভাবে পরিণত হয় সরকারি ছুটিতে। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেটানুরাগীরা ক্রিকেট খেলার সর্বশেষ আপডেট জানার জন্য প্রতি মুহূর্তে ইন্টারনেটের ক্রিকেট ওয়েবসাইটে কত বিলিয়ন ‘হিট’ করে থাকেন, তা বলা মুশকিল। মজার বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের বড় একটা অংশ বিদেশে পাড়ি দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। অথচ প্রবাসী হওয়ার পর মন পড়ে থাকে নিজ দেশের ক্রিকেট খেলার খবর জানার জন্য। বিশ্বব্যাপী উপমহাদেশের মানুষের পরিচয় জাহির হয় ক্রিকেটের মধ্যে কেন্দ্রীভূত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং আবেগময় অনুভূতির মাধ্যমে। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা মানসিক যন্ত্রণার কারণ হলেও ক্রিকেটটা বুক ফুলিয়ে বলার মতো একটা ‘ব্র্যান্ড নেম’-এ পরিণত হয়েছে। ইন্ডিয়ান কারির মতো ক্রিকেটও পেয়েছে সর্বব্যাপিতা। উপমহাদেশে বিতর্ক, বাদানুবাদ ও আলোচনার অভিন্ন বিষয় ক্রিকেট টিম, ক্রিকেটার, ক্রিকেটিং শট, পিচ ও খেলার কৌশল। এটা এমন একটা ক্ষেত্র যেখানে শ্রেণী, ধর্ম ও জাতীয়তা এক হয়ে যায়। তাছাড়া নিজেদের ক্রিকেট টিম নিয়ে যেভাবে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হয়, তাতে এ বিষয়ে লেখা যেতে পারে অসংখ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ। উপমহাদেশে যে কোনো জয়েই জাতীয় উৎসব এবং খেলোয়াড়রা দেবতা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। আর পরাজয়ের অর্থ জাতীয় বিপর্যয়।
উপমহাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ভারত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের স্বাগতিক ভারত এবং পাকিস্তান, ১৯৯২ সালের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এবং চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা, ১৯৯৯ সালের আসরে রানার্সআপ পাকিস্তান এবং ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের রানার্সআপ ভারত। প্রথম দুটি ব্যতীত প্রতিটি বিশ্বকাপে উপমহাদেশের কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বকাপ পর্যায়ের আর কোনো খেলায় উপমহাদেশের এমন সাফল্য কিংবা এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা নেই। মানুষ সাফল্যের পূজারী। সে সঙ্গে চায় বিজয়ী এবং বীরের সান্নিধ্য। ক্রিকেটেই কেবল এটা সম্ভব। দলীয়ভাবে সাফল্য না এলেও ক্রিকেটে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে দর্শক হৃদয় জয় করে নেয়া যায়। আর এক্ষেত্রে টেক্কা মেরেছে উপমহাদেশের ক্রিকেটাররা। ব্যক্তিগত রেকর্ড এবং ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের দিক দিয়ে তারা তুলনারহিত। উপমহাদেশে ব্যক্তিপূজা তো প্রবাদের পর্যায়ে পড়ে। ক্রিকেটে এ সুযোগটা সহজেই পাওয়া যায়। আর তা কাজে লাগানের জন্য মুখিয়ে থাকে কর্পোরেট হাউসগুলো। জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যদি মাপা হয়, সেদিক দিয়েও দক্ষিণ এশিয়ার জয়জয়কার। বিশ্বকাপে এ যাবৎ অংশ নিয়েছে ১৭টি দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ৪টি বাদ দিলে বাকি ১৩টি দেশের মোট জনসংখ্যা ২৫ কোটিও হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ১৫০ কোটি। এই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ক্রিকেট অনুরাগী। জনসংখ্যার ২০ শতাংশও যদি ক্রিকেটের সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলেও বাদবাকি দেশের জনসংখ্যার তুলনায় তা বেশি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও উপমহাদেশের অবস্থানটা সুসংহত। কর্পোরেট জগতে উপমহাদেশ যেন একটি সোনার রাজহাঁস। আর এই রাজহাঁসের বদান্যতায় ফুলে-ফেঁপে উঠছে ক্রিকেট দুনিয়া। একদিনে টানা প্রায় আট ঘণ্টা খেলা হওয়া এবং তাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের রমরমা সুযোগ আর কোথায় মিলবে? ১৯৯২ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বাজেট ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। অথচ বর্তমানে বিশ্বের ধনী ক্রিকেট বোর্ড তারা। বছরে আয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ১৯৯৯ এবং ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অর্থনৈতিক সাফল্যের হার ছিল অনেক বেশি। এর কারণ, ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান এবং ২০০৩ সালের ফাইনালে ভারতের খেলায় রাজস্ব আয় বেড়ে যায় হু হু করে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে বিজ্ঞাপন খাতে ব্যয় হয় প্রায় ২২২ মিলিয়ন ডলার। এর অধিকাংশই এসেছে ভারতীয় কর্পোরেট হাউস থেকে।
রেকর্ড পরিমাণ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যে সম্প্রচার রাইট কেনা হয়, তার মূল টার্গেট উপমহাদেশের ক্রিকেট উন্মাদনা। এই ক্রিকেট-ক্ষেপামিকে পুঁজি করে বিলিয়ন ডলারের জুয়ায় নামে স্পোর্টস চ্যানেলগুলো। এখন ক্রিকেট বিপণনের ক্ষেত্রে সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠা ভারত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ রাজস্ব সরবরাহ করে থাকে। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের রোজ বৌলে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উদ্বোধনী ম্যাচে স্থানীয় কোম্পানির একটিও বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড ছিল না। প্রতিটি বিজ্ঞাপনদাতাই ছিল উপমহাদেশের কোম্পানি। টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ভারত শুরুতে খেলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে মাথায় হাত পড়ে যায় আইসিসির। শেষ পর্যন্ত ভারত রাজি হওয়ায় তাদের মধ্যে ফিরে আসে স্বস্তি। আইসিসি ভালো করেই জানে, ভারত না খেললে সে টুর্নামেন্টের কর্পোরেট মূল্য খুব বেশি থাকে না। আইসিসির প্রধান নির্বাহী ম্যালকম স্পিড মনে করেন, অন্য যে কোনো দেশের যে কোনো খেলার তুলনায় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলা নিয়ে আবেগ-উচ্ছ্বাস ঢের ঢের বেশি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ ক্রিকেট এখন কড়া নাড়ছে দুয়ারে। আর এ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে উপমহাদেশীয়দের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। বিক্রি হয়ে গেছে বিশ্বকাপে ভারত এবং বাংলাদেশের ম্যাচের টিকিটের ৯০ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয়, বাংলাদেশী এবং শ্রীলঙ্কানরা তাদের দেশের খেলা দেখার জন্য বুকিং দিয়েছেন মেলবোর্নের ফেডারেশন স্কোয়ারের ঢাউস সাইজের স্ক্রিন। এ দুটি দেশের যা পারফরমেন্স, তাতে এ ধরনের হুজুগে অন্যরা অবাক হয়ে যায়। ক্রিকেটের দুর্ধর্ষ টিম অস্ট্রেলিয়ায়ও ক্রিকেট নিয়ে এত হুল্লোড় নেই। বস্তুুত দক্ষিণ এশিয়ায় এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। এখানে হুজুগটাই প্রধান আকর্ষণ। এমনিতেই ক্রিকেটে হুজুগের কোনো কমতি নেই। আর বিশ্বকাপ এলে তো ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবারই পোয়াবারো।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭
সাগরতীরে ক্রিকেটের মহোৎসব
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অভিষেক হয় ক্রিকেটের কুলীন দেশ ইংল্যান্ডে। উপর্যুপরি তিনবার ক্রিকেটের মাতৃভূমিতে আয়োজিত হওয়ার পর ভাবা হয়েছিল, বিশ্বকাপটা বোধ হয় পরিণত হলো ব্রিটিশদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে। কিন্তু ভুলটা ভেঙে যায় ১৯৮৭ সালে। বলা যায়, আমাদের বাড়ির আঙিনায় বসে বিশ্বকাপের আসর। উপমহাদেশের দুই পরাক্রম শক্তি ভারত এবং পাকিস্তান ছিল আয়োজক। এরপর তো বিশ্বকাপটা পর্যায়ক্রমে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা, ফের ইংল্যান্ড এবং সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার ‘আতিথ্য’ পেলেও কোথায় সেই ক্যালিপসো সুর? যেখানে ফুল, অর্ঘ্য আর সমর্পণ দিয়ে আরাধনা করা হয় ক্রিকেটকে, যেখানে ক্রিকেটের মাধ্যমে গাঁথা হয় ভালোবাসা আর ঐক্যের মালা, সেখানে কেন বসে না বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহোৎসব? অন্তহীন এক প্রশ্ন হয়ে ঝুলতে থাকে মনের নৈর্ঋত কোণে। এমনিতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে কৌতূহলের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামক ভূখ-টির দৃশ্যপট যখন আমাদের চোখে উদ্ভাসিত হয়, তাতে হৃদয়ে জ্বালিয়ে দেয় খুশির রঙমশাল। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের আনন্দনিকেতনে আকাশজুড়ে নীল রোমান্টিকতা, সাগরের কোলে নয়ন জুড়ানো নক্ষত্রের মতো দ্বীপমালা, নারকেলবীথিকা, সবুজের নান্দনিক নিসর্গ, শ্বেত-শুভ্র সৈকতে সার বেঁধে থাকা পাম গাছ, মহাসাগরের ফেনিল ঢেউ, গাঙচিলের উদাসীনভাবে উড়ে যাওয়া, দ্বীপের বৈচিত্র্যময় ও স্পন্দনশীল জীবনযাত্রা হৃদয়কে রাঙিয়ে দেয় সপ্তবর্ণে। এর সঙ্গে বর্ণিল ক্রিকেট যোগ হয়ে মনটাকে করে দেয় উন্মনা।
ক্যারিবীয় অঞ্চলে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে খেলাটা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত উৎসব। ক্রিকেটটা সেখানে নিছক কোনো খেলা নয়। এটা এমন একটা জীবনধারা, যার মূল কথা খাও-পিও-মস্তি করো। খেলার সময় ঢেউ হয়ে উপচে পড়ে রঙ এবং সঙ্গীত। বঙ্গোস আর শিঙ্গার সম্মিলনে বাজতে থাকে ঝাঁজালো ক্যালিপসো। এছাড়াও কত রকমের সুর ও সঙ্গীত যে আন্দোলিত করেÑ ডান্সহল, মেন্টো, রেঁগে, স্কা, সোকা। জীবনের সঙ্গে তারা মিলিয়েছেন সঙ্গীতকে। সঙ্গীতের বাদ্য-যন্ত্র ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্রিকেটটা থেকে যায় অসম্পূর্ণ। ছন্দোময় আবহ তৈরির জন্য দর্শকরা স্টেডিয়ামে নিয়ে যান শাঁখ, ড্রামসহ নানা সরঞ্জাম। তবে খেলায় বিঘœ সৃষ্টি হয়Ñ এমন কিছু তারা কখনোই করেন না। বলে বলে নয়, খেলার ফাঁকে ফাঁকে বেজে ওঠে সুরের উদ্দামতা। দৃশ্যত খেলার অবস্থার সঙ্গে সঙ্গীতের মেজাজের তারতম্য ঘটে। কেউ একজন শুরু করার পর পুরো গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে সুর। নানারকম উন্মাতাল নাচ তো আছেই। নাচে-গানে স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে কনসার্ট-হল। একই সঙ্গে প্রকাশ ঘটে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি, ঝলমলে জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্যের।
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ বাঁধা আছে আবেগময় বন্ধনে। আর এই বন্ধনের মূল সূত্র হলো ক্রিকেট। আটলান্টিক আর ক্যারিবীয় সাগরের কোল ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে ছবির মতো সাজানো দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক কোনো বন্ধন নেই। অবশ্য আত্মিক একটা সম্পর্ক তো আছেই। মহাসাগরের ঢেউ এসে একই সঙ্গে এ দেশগুলোকে দুলিয়ে দিয়ে যায়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাপনের সুর তো একই তার থেকে উৎসারিত। এ কারণেই তারা পেরেছেন সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি আর ভালোবাসার মালা গাঁথতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ‘বোধ’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ক্রিকেটটা ব্রিটিশদের খেলা হলেও তাকে সুর আর ছন্দ দিয়ে প্রাণময় করেছেন তারা। ক্রিকেটটাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেও তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। কেননা, ক্রিকেটকে তারা রাঙিয়েছেন জীবনের রঙে। এই রঙে রঙিন হয়েছেন দেশ-বিদেশের তাবৎ ক্রিকেটানুরাগী। তার আগে রাজ-রাজড়াদের খেলা হিসেবে ক্রিকেট সর্বসাধারণের কাছে তেমনভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এক সময়ের পরাধীন কালো মানুষেরা ক্রিকেটকে আপন করে নেয়ার পর তা লুফে নেয় সব জাতি, সব শ্রেণী, সব ধরনের মানুষ। তারা ক্রিকেটটাকে নেন ‘বিউটিফুল গেম’ হিসেবেÑ যেখানে নিয়ম ও লক্ষ্য সবার জন্য এক ও অভিন্ন। কোনো ভেদাভেদ না রেখে হাতে হাত মিলিয়ে মেতে ওঠা যায় ক্রিকেটের আনন্দযজ্ঞে। ছোট ছোট দ্বীপ থেকে উঠে এসেছেন অনেক বড় মাপের ক্রিকেটার। ক্রিকেটার হিসেবে যেমন তাদের তুলনা হয় না, মানুষ হিসেবেও তারা অনুসরণীয়। তাদের জীবনবোধ, জীবনদর্শন ও জীবনভেদ ক্রিকেটকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। তাদের মহত্ত্ব, মহানুভবতা ও মহাবল আকৃষ্ট করেছে পিছিয়ে পড়া মানুষদের।
ক্রিকেটের যেখানে এত রূপ, এত রস, এত গন্ধÑ সেখানে যখন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসর বসছে, তখন তো সোনায় সোহাগা। এমনিতেই প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর জগতবিখ্যাত ক্রিকেটারদের মাতৃভূমি হিসেবে ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোর অন্যরকম আর্কষণ রয়েছে, এর সঙ্গে যোগ হবে উৎসবের আনন্দ। কিংবদন্তি জর্জ হ্যাডলি, আলফ ভ্যালেন্টাইন, মাইকেল হোল্ডিং, লরেন্স রো, জেফ ডুজন, কোর্টনি ওয়ালশ, জিমি অ্যাডামস, ক্রিস গেইলের দেশ জ্যামাইকার ‘সাবিনা পার্ক স্টেডিয়ামে’ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ও একটি সেমিফাইনালসহ অনুষ্ঠিত হবে সাতটি ম্যাচ। স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়াও এ ভেন্যুতে খেলবে পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ড। অন্যান্য ভেন্যু থেকে কিছুটা দূরের মসলাদার এই ভূখ-ে আছে দীর্ঘদেহী ‘ব্লু মাউন্টেন’, দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডা পরিচিত স্যার ভিভ রিচার্ডস, অ্যান্ডি রবার্টস, রিচি রিচার্ডসন, কার্টলি অ্যামব্রোসের দেশ হিসেবে। নবনির্মিত অত্যাধুনিক ‘স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে’ অনুষ্ঠিত হবে সুপার এইট পর্বের ছয়টি ম্যাচ। বাড়তি আকর্ষণ ঐতিহাসিক পোতাশ্রয় ‘নেলসন্স ডকইয়ার্ড’, সাগরে সহজাতভাবে গড়ে ওঠা তোরণ ‘ডেভিলস্ সেতু’, সুস্বাদু খাবার। দুরন্ত সাগরের নীল ঢেউ তো আছেই। কিথ আর্থারটন, স্টুয়ার্ট উইলিয়ামস, রুনাকো মর্টনের ‘সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস’ দেশটি খুবই ছোট্ট। একান্ত নিভৃতে গড়ে ওঠা স্টোন-কটেজগুলো সাজানো অ্যান্টিক ও গ্রন্থ দিয়ে। জুয়েলারি, ঘড়ি ও পানীয়’র জন্য খ্যাত দ্বীপটির নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা ‘ওয়ার্নার পার্ক স্টেডিয়ামে’ ছয়টি ম্যাচে খেলবে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, হল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড। ভেন্যু হিসেবে বিশ্বকাপের আয়োজক হলেও ক্রিকেটে মোটেও সুখ্যাতি নেই সেন্ট লুসিয়ার। বিমুগ্ধকর পাহাড়ঘেরা দৃশ্যপট এবং বিস্ময়কর সৈকতের জন্য এ দ্বীপটিকে ‘রোমান্টিক আইল্যান্ড’ বলা হয়। বঁসেজর স্টেডিয়ামে খেলা হবে একটি সেমিফাইনালসহ সাতটি ম্যাচ। খেলবে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও কেনিয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ক্রিকেটীয় লাবণ্য, সুষমা ও সৌন্দর্য দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে বার্বাডোস। ‘নীলপদ্ম ফুল’ হয়ে ফুটে ক্রিকেট বিশ্বকে সুরভিত করেছেন স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভার্টন উইকস, কাইভ ওয়ালকট, কনরাড হান্ট, স্যার গারফিল্ড সোবার্স, ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ, সেম্যুর নার্স, গর্ডন গ্রীনিজ, জোয়েল গার্নার, ডেসমন্ড হেইন্স, ম্যালকম মার্শালের মতো কিংবদন্তিরা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বাধিক ক্রিকেটার উঠে এসেছেন এই দ্বীপ থেকে। ক্রিকেটের এমন একটি স্বর্ণখনির ‘কেনসিংটন স্টেডিয়ামে’ সুপার এইটের ছয়টি ছাড়াও অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল ম্যাচটি। দ্বীপটিতে আছে নানারকম বাগান, মনকাড়া ঘর-বাড়ি, সাফারি ট্যুর এবং সমুদ্রে দুঃসাহসী অভিযানের হাতছানি। ক্রিকেট ঐশ্বর্যে গ্রেনেডা খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। এ দ্বীপের ক্রিকেটার জুনিয়র মুরে, ডেভন স্মিথ খুব বেশি পরিচিত নন। ‘কুইন্স পার্ক গ্রেনাডায়’ খেলা হবে সুপার এইটের ছয় ম্যাচ। হারিকেন আর আগ্নেয়গিরির জন্য কুখ্যাত এ দ্বীপটিতে সৌন্দর্যেরও কমতি নেই। গাছপালা, গির্জা, দুর্গ, জাদুঘর, স্মৃতিস্তম্ভ, মিউজিক উৎসব এর প্রধান আকর্ষণ। সৈকত তো আছেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে পুরনো মাঠ ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর ‘কুইন্স পার্ক ওভাল’। লিয়ারি কনস্টানটাইন, সনি রামাধীন, ডেরেক মারি, ল্যারি গোমস, গাস লগি, ফিল সিমন্স, ইয়ান বিশপ, ব্রায়ান লারার দেশেই খেলবে বাংলাদেশ। এই গ্রুপে আরো আছে ভারত, শ্রীলংকা ও বারমুডা। ম্যাচ হবে ছয়টি। নির্জন সৈকত, অরণ্য, প্রবাল-প্রাচীর, বোটানিক গার্ডেন্স, নেচার সেন্টার, ঐতিহাসিক ভবনসমূহ, জলপ্রপাতের মধুর কল্লোলিনীও মনকে আপ্লুত করে। অশ্রু ফোঁটার মতো ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম গায়ানা। মাটির সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা বেশি। দেশটির সীমানা অনেক দূর প্রসারিত। ক্রিকেটেও গায়ানার ইতিহাস ঝলমলে। এ দ্বীপ থেকে উঠে এসেছেন বাসিল বুচার, রোহান কানহাই, ল্যান্স গিবস, কাইভ লয়েড, রয় ফ্রেডরিকস, আলভিন কালিচরন, কলিন ক্রফট, কার্ল হুপার, রজার হার্পার, শিবনারায়ণ চন্দরপল, রামনরেশ সারওয়ানের মতো দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার। আছে থিম পার্ক, অবকাশ কেন্দ্র, আফ্রিকান ঐতিহ্যের অসাধারণ সব সংগ্রহ। সদ্য গড়ে তোলা ‘প্রভিন্স স্টেডিয়ামে’ হবে সুপার এইটের ছয়টি ম্যাচ। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্যÑ সমুদ্রকে তারা স্থান দিয়েছে দেবতার আসনে। আর এই দেবতার আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য তারা প্রতিটি স্টেডিয়ামই নির্মাণ করেছে সাগরতীর ঘেঁষে।
সাগর-দেবতাকে নৈবেদ্য দেয়ার উপলক্ষ হয়ে উঠেছে ক্যারিবীয় ক্রিকেট। এ দু’য়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ক্যারিবীয় জীবনধারা। এর অংশ হিসেবে তারা ক্রিকেট মাঠ এবং মাঠ সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতে নাচে, গানে, হল্লায়, হাসিতে নিজেদেরকে উজাড় করে দিয়ে সমর্পণ করে। এবার বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে তাদের সামনে এসেছে আনন্দের অফুরন্ত সম্ভার। এই আনন্দে সম্মিলিতভাবে অবগাহন করবে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। তার রেশ ছড়িয়ে পড়বে দেশে দেশে। এর সঙ্গে সামিল হবে বাংলাদেশও।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ মার্চ ২০০৭
ভালোবাসা ও ঐক্যের দেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট
যে সুর লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইনের বুকে বেজেছে, সেই একই সুরে আন্দোলিত হন রায়াত রিয়ান এমরিত। কনস্টান্টাইন তরুণ বয়সে ক্রিকেট খেলতে যান ইংল্যান্ডে। সেটি ছিল ১৯০০ সাল। ক্রিকেটের তীর্থকেন্দ্র লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন তিনি। যদিও ১১৬ রানের ইনিংসটির প্রথম শ্রেণীর স্ট্যাটাস ছিল না। কিন্তু ইতিহাস গড়ার ক্ষেত্রে এ ইনিংসটির গুরুত্ব ও মর্যাদা কোনো অংশেই কমতি ছিল না। বরং তা অক্ষয় হয়ে আছে কালের খাতায়। বিংশ শতাব্দীর সে সময়টা ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কসের দুনিয়া কাঁপানো কালজয়ী মতবাদ ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আব্রাহাম লিঙ্কনের বহুল আলোচিত ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’-এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রায় মানুষের স্বাধীনতা ও সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এবং দাসপ্রথা বিলোপের প্রক্রিয়া সীমিত পরিসরে শুরু হয়। তবে সভ্যতার এই বিকাশলগ্নে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার তখনো বন্ধনমুক্ত হয়নি। আলোর পরশ এসে পৌঁছায়নি ঔপনিবেশিক অঞ্চলে। এমন একটা প্রতিকূল অবস্থায় বসবাস করেও একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ঔপনিবেশিক শক্তির হৃৎপি-ে শিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে কব্জির মোচড়ে বল সীমানাছাড়া করছেন। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যতই মধুর হোক না কেন, শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের পক্ষে তা হজম করা কঠিন ছিল। আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার যুগলবন্দিতে ত্রিনিদাদের কনস্টান্টাইন সেদিন যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, তা শুধু একটি ইনিংসের গৌরবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল শোষিত, বঞ্চিত ও সর্বহারা কালো মানুষদের মুক্তির পথ। ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও বিজয়ের জয়গান। ক্রিকেট মাঠে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ‘বদলা’ নেয়ার এমন অভিনব পন্থা দেখতে পেয়ে তারা দারুণভাবে আলোড়িত হন। জীবনের সব ক্ষেত্রে পর্যুদস্ত ক্যারিবীয়দের মনের কোণে সেদিনই উঁকি মেরেছিল ক্রিকেটের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এই স্বপ্নের পথ বেয়ে রচিত হয় রূপকথার গল্প।
আটলান্টিক আর ক্যারিবীয় সাগরের উপকূলে মুক্তোর দানার মতো দ্বীপগুলো নিয়ে দৃশ্যত সৃষ্টি হয়েছে একটা মণিহার। প্রকৃতি এ দ্বীপগুলোকে দু’হাতে অপরূপভাবে সাজিয়ে দেয়। অবারিত সৌন্দর্যের হাতছানি এবং পর্যটনের সম্ভাবনায় ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ছুটে আসে ঔপনিবেশিক শক্তি। ব্রিটিশ, যুক্তরাষ্ট্র, ফরাসী, ডাচরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। ভাগাভাগির এ প্রতিযোগিতায় জয়ের পাল্লাটা ভারি থাকে ব্রিটিশদের দিকে। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও সৌন্দর্যের এই নন্দনকাননে মানুষের কোনো প্রাণস্পন্দন ছিল না। পৃথিবীর এক প্রান্তের এই নির্জন, জনশূন্য ও নিভৃত এলাকায় কেইবা আসবে বসতি গড়তে? উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ঔপনিবেশিক শক্তি বেছে নেয় অমানবিক ও নিষ্ঠুর পথ। তারা মূলত আফ্রিকা থেকে শিকড় উপড়ে ফেলে দাস হিসেবে নিয়ে আসে কৃষ্ণাঙ্গদের। এছাড়া সংখ্যালঘু হিসেবে ছিল ইন্ডিয়ানস, চাইনিজ, ক্যারিব এবং ‘প্রভু’ হিসেবে কিছু ইউরোপিয়ান। তাদের দিয়েই গড়ে তোলা হয় বসতি। ব্রিটিশরা যেখানেই যাক না কেন, সঙ্গে করে নিয়ে যায় ইংরেজি ভাষা, পাদ্রী ও ক্রিকেট। সঙ্গত কারণে এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায় উপনিবেশের মানুষেরা। অধিবাসীদের মধ্যে সঙ্গত কারণেই খ্রিস্টানদের সংখ্যাই বেশি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্যাথলিক, কিছু হিন্দু, কিছু মুসলমান। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ক্রিকেটটা হয়ে ওঠে আফিমের মতো। তাদের গ-ি তো ছিল খুবই ছোট্ট। চার পাশে সমুদ্র পরিবেষ্টিত। শৃঙ্খলের বন্ধনে আটকে থাকায় কোথাও যাবার সুযোগ ছিল না। বিনোদনের একমাত্র অবলম্বন ছিল ক্রিকেট খেলা। দিনমান কেটে যেত ক্রিকেটে ক্রিকেটে। তাছাড়া ধোপদুরস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ পরা মনিবদের ক্রিকেট খেলতে দেখা এবং কখনো-সখনো তাদের সঙ্গে খেলতে পারাটা হয়ে ওঠে মর্যাদার বিষয়। শৈশবে দেখা সাহেবিয়ানার সবকিছুই ছাপ ফেলতো ছোট্ট বুকে, বেড়ে ওঠাও তা অনুসরণ করে। গায়ের কালো রঙটা ছাড়া তারা বদলে ফেলে নিজেকে। পূর্বপুরুষের শিকড় শিথিল হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। অবশ্য বুকের ভেতরে গেড়ে বসা মূলটাকে তো শূন্য করে দেয়া যায় না। কোনো না কোনোভাবে রয়েই যায়। আফ্রিকা থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গদের বুকের গভীরে সুর হয়ে বাজে মাতৃভূমির জন্য কান্না আর গান। ক্যারিবীয় দ্বীপে ছিটকে আসার পর অপরিচিত পরিবেশে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল সঙ্গীত। সঙ্গীতটা হয়ে ওঠে জীবনের অংশ। ক্রিকেটের সঙ্গে সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে গড়ে ওঠে নতুন এক জীবনধারা। সে এক ভিন্ন মেজাজের ক্যারিবীয় ঘরানা।
ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থ’ান করে নেয়াটা ক্যারিবীয়দের জন্য খুব সহজ ছিল না। স্বাভাবিক নিয়মেই নানা প্রতিকূলতা সামনে এসে দাঁড়ায়। জীবনের দায় মেটানো ছিল যেখানে কঠিন এক সংগ্রাম, সেখানে ‘রাজার খেলা’ ক্রিকেট রপ্ত করাটা ছিল দুরূহ এক সাধনা। প্রতিদিন উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুঃসহ জীবনের ঘানি টেনে চলার ফাঁকে ফাঁকে অবসরের বিনোদন হয়ে ওঠে ক্রিকেট। দিনযাপনের গ্লানির মাঝে ক্রিকেট যেন এনে দেয় এক টুকরো মুক্তির স্বাদ। ক্রিকেট নামক খোলা জানালা দিয়ে পাওয়া যায় এগিয়ে যাবার সোপান। ক্রিকেট খেলাটা আয়ত্তে আনার পাশাপাশি মোটামুটি একটা অবস্থান করে নেয়ার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের আভিজাত্য আর অহমিকা যাতে টাল না খায়, সে বিষয়ে তারা ছিলেন পুরোপুরি ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ মনোভাবাপন্ন। ক্রিকেটের বনেদিয়ানায় ‘দাসানুদাসরা’ স্থান করে নেবেÑ এটা তারা মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। সীমিত পরিসরে ক্রিকেট খেলাটা মেনে নিলেও ‘এলিট পর্যায়ে’ তাদের অনুমতি দেয়া হতো না। অথচ ততদিনে কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রিকেটটাকে ভালোই আয়ত্তে এনেছে। ১৮৯৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু হলেও তাতে অ- শ্বেতাঙ্গদের অংশগ্রহণ খুব একটা ছিল না। ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে যেটুকু সুবিধা মিলতো, তাতেই প্রকাশ পেত সুপ্ত প্রতিভা। এমনি এক অবস্থায় ‘দেবদূত’ হয়ে আসেন লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইন। তিনি যে উন্মুক্ত আকাশের সন্ধান দেন, তার পথ বেয়ে স্বপ্নের ঠিকানায় এগিয়ে আসতে থাকেন স্বপ্নহীন মানুষেরা। তারা অনুভব করতে পারেন নিজেদের ‘শক্তি’ সম্পর্কে। কিন্তু তারা তো তখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। মূল দ্বীপ প্রায় ২৪টি হলেও ছোট-বড় মিলিয়ে সমুদ্রবর্তী দ্বীপ যে কতটিÑ তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। মহাসমুদ্রের কোথায় কখন কোন দ্বীপ ভেসে উঠছে কিংবা ডুবে যাচ্ছে, তার হিসাব রাখা মুশকিল। তবে আনুমানিক দ্বীপের সংখ্যা ২২০ থেকে ২৩০টি। কারো সঙ্গে কারো তেমন কোনো যোগাযোগ হতো না। কনস্টান্টাইনের কৃতিত্ব তাদের মধ্যে যে চেতনা জাগ্রত করে, তার ফলে তারা একত্রিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা থাকলেও ক্রিকেট তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে নিবিড় বন্ধন। ব্রিটিশ-শাসিত ক্যারিবীয় উপনিবেশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফেডারেশন। বহুজাতিক ও ইংরেজিভাষীদের নিয়ে গড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডে সংযুক্ত হয় অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডা, বাহামা, বার্বাডোস, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, জ্যামাইকা, সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেইন্ট লুসিয়া, সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডিন্স এবং ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো। এই ১০টি দেশ ষাট ও সত্তর দশকে পর্যায়ক্রমে স্বাধীন হয়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বর্তমানে ব্রিটিশ শাসিত অ্যানগুলিয়া, বারমুডা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, কেম্যান আইল্যান্ডস, মন্টসেরাত ও তুর্কস অ্যান্ড কাইকোস আইল্যান্ডস। এছাড়াও ছিল ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজভুক্ত বেলিজ এবং ব্রিটিশ গায়ানা। পরবর্তীকালে ‘ব্রিটিশ’ বাদ দিয়ে হয়ে যায় গায়ানা। অবশ্য রাজনৈতিক কারণে দ্বীপগুলোর অবস্থান বদলে যায় বার বার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড ১৯২৬ সালে যোগ দেয় ইম্পিরিয়াল ক্রিকেট কাউন্সিলে। এই কাউন্সিল পরবর্তীকালে পরিচিতি পায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) হিসেবে। ১৯২৮ সালের ২৩ জুন টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ঘরানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের নামটা চাউর হলেও তাতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধিত্ব খুব বেশি ছিল না। তবে এর মাঝে ব্যতিক্রম ছিলেন লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইনের পুত্র লিয়ারি নিকোলাস কনস্টান্টাইন এবং জর্জ হ্যাডলি। ইংল্যান্ডে লর্ডসে প্রথম টেস্টে অভিষেক হয় কনস্টান্টাইনের। কাকতালীয় বিষয় হলো, যে লর্ডসে পিতা সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ক্যারিবীয় কৃষ্ণাঙ্গদের বুকে জ্বালিয়েছিলেন আশার আলো, সেই লর্ডসে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে পুত্র স্থান করে নেন ইতিহাসের পাতায়। এক ইনিংস বল করার সুযোগ পেয়ে নেন ৪ উইকেট। ১৯৩০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ গায়ানার জর্জটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর এই জয়ের নায়ক ছিলেন জর্জ হ্যাডলি এবং লিয়ারি কনস্টান্টাইন। চার টেস্টের সিরিজ ২-২-এ অমীমাংসিত থাকে। সিরিজের সর্বাধিক ৭০৩ রান আসে হ্যাডলির ব্যাট থেকে আর সর্বাধিক ১৮ উইকেট নেন কনস্টান্টাইন। কনস্টান্টাইন ক্রিকেটার ছাড়াও ধারাভাষ্যকার, প্রশাসক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত পান। অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন হ্যাডলি। তাকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’। পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য থেকে বের হয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষ্ণাঙ্গ-শক্তি। এরপর তো ক্যারিবীয় ক্রিকেটের জয়জয়কার। সত্তর-আশির দশকে তারাই ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ‘ব্ল্যাক-পাওয়ার’ হিসেবে তারা দাপিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বে। ইতিহাসে তারা জন্ম দিয়েছেন কিংবদন্তি সব ক্রিকেটার। ক্যারিবীয়রা ক্রিকেট বিশ্বকে উপহার দিয়েছে নতুন ঘরানার। এই সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছে অনেক দ্বীপ রাষ্ট্র।
ক্রিকেট দিয়েই ক্যারিবীয়রা মানুষের মন জয় করে নেয়নি, একই সঙ্গে তারা শুধু ক্রিকেটের মাধ্যমেই অনেকগুলো দেশ একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এক বিস্ময়ের। ঐক্য ও বন্ধনের এই ইতিহাস শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তাতে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। মজার ব্যাপার, ওয়েস্ট ইন্ডিজভুক্ত অনেক দেশেই ক্রিকেটের তেমন কোনো প্রচলন নেই। কিন্তু তারাও জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন ২৬০ জন ক্রিকেটার। এর মধ্যে বার্বাডোসের ৭১, জ্যামাইকার ৬৩, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর ৫৭, গায়ানার ৪০, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার ১০, সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডিনসের ৬, ডোমিনিকানের ৪, সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের ৪, গ্রেনাডার ৩, অ্যানগুলিয়ার ১ ও ১ জন ইংলিশম্যান। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলেছেন বার্বাডোসের ১৭, গায়ানার ১২, জ্যামাইকার ১০, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর ১০, সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডিনসের ৩ ও সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের ২ জন। এর বাইরেও অনেক দেশ রয়েছে যাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। তারপরও তারা কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে? আসলে তারা আবদ্ধ ঐক্য আর ভালোবাসার বন্ধনে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বশেষ নাম লিখিয়েছেন ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর রায়াত রিয়ান এমরিত। ২০০৭ সালের ২৭ জানুয়ারি চেন্নাইতে ওয়ানডে ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয় এই অলরাউন্ডারের। শত বছরের বেশি সময় আগে লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইনের হাতে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের যে বিজয় মশাল প্রজ্বলিত হয়েছিল, সেই আলোকবর্তিকা বহন করে নিয়ে চলেছেন এমরিতরা। তারা জানেন, তারা যে যেখান থেকে উঠে আসুন না কেন, তাদের পরিচয় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বা উইন্ডিজ হিসেবে। এমনিতে ছোট ছোট দ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান অনেকটা দূর আকাশের তারার মতো। এরকম কত ‘তারা’ই তো পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাদের খবর ক’জনাই বা জানেন? সেদিক দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘরানার দেশগুলো সৌভাগ্যবান যে, তারা ক্রিকেটের বদান্যতায় ‘সন্ধ্যাতারা’ হয়ে জ্বলছে। এক্ষেত্রে তারা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে বার্বাডোস, জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, গায়ানার মতো ক্রিকেট-শক্তির দেশগুলোকে। এ দেশগুলোর সাফল্যের আলোয় আলোকিত হচ্ছেন তারা। এছাড়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট তাদের কাছে এসেছে সার্চ-লাইট হিসেবে। এই সার্চ-লাইটের আলোর বন্যায় ভেসে উঠবে সমগ্র ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাত্রা। এমন সুযোগ সচরাচর আসে না। তবে ক্রিকেট ক্যারিবীয়দের বুকে যে সুরের অনুরণন তোলে, তার সিম্ফনি কিন্তু ভালোবাসা ও ঐক্য। এই সিম্ফনি তাদের প্রত্যেকের বুকেই বাজায় আনন্দ ও গৌরবের বীণা।
দৈনিক আজকের কাগজ, ১৩ মার্চ ২০০৭
আকরাম খানের সেই ইনিংস
আকরাম খানের অপরাজেয় সেই ৬৮ রানের ইনিংসের মহিমা তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। ১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফিতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নাটকীয় জয়ের আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটটা আমাদের কাছে ছিল সুদূরের এক স্বপ্ন। আমরা যারা দেখনদারি, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম; যারা গুণবিচারি, তারাই কি ভাবতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ কখনো বিশ্বকাপে খেলবে? এমনকি ক্রিকেটাররা পর্যন্ত তাদের কল্পনাটাকে এতখানি লাগামহীন হতে দেননি। আইসিসি ট্রফির চৌকাঠ পার হওয়াটা ছিল যেখানে অসম্ভব এক স্বপ্ন, সেখানে বিশ্বকাপ! প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সব বিস্ময় আর প্রশ্নের উত্তর হয়ে আসে আকরাম খানের সেই লড়াকু ইনিংস। সেই ইনিংসের পর বদলে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট মানচিত্র।
আকরাম খানের ইনিংসটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়তো খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। আইসিসি ট্রফিটা পাতে দেয়ার মতো কোনো প্রতিযোগিতা নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল ইনিংস দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনাÑ সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এমন লেখায় অনেকে বিষয়টিকে আবেগতাড়িত ও অতিশয়োক্তিপূর্ণ ভাবতেই পারেন। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে তেমনটি মনে করার কোনো সুযোগ নেই। একটি ইনিংস একটি দেশের ক্রিকেটের খোলনলচে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছেÑ এমনটি ক্রিকেট ইতিহাসে বোধ করি দেখা যায়নি। সেই ইনিংসটির আগে বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল বর্ণহীন এবং গন্তব্যহীন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রূপ-রস-গন্ধ স্পর্শ করলেও তাতে আমাদের অংশগ্রহণ খুব বেশি ছিল না। না থাকারই কথা। ফেল করা ছাত্রকে কেইবা পাত্তা দিতে চায়? ‘আইসিসি ট্রফি’ নামক পরীক্ষায় বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হতে পারছিল না কোনোভাবেই। ক্রিকেটের ‘জাতে’ উঠতে হলে এই সিঁড়ি টপকানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ বাংলাদেশের সামনে খোলা ছিল না। বাংলাদেশ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবারই আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয়, আর প্রতিবারই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরে আসে। স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায় শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ে এবং একবার ‘নকল রাজা’ সাজা সংযুক্ত আরব আমিরাত। বার বারই জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায় আশার আলো। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় আয়োজিত আইসিসি ট্রফিতেও আবারো ফিকে হয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশের স্বপ্নের রঙ। পচা শামুকে পা কাটার মতো নেদারল্যান্ডস এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সে সঙ্গে ছিল প্রকৃতির খামখেয়ালি। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ১২ কোটি মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে ‘হারকিউলিস’ হয়ে যান অধিনায়ক আকরাম খান। মহাকায় এক ইংিনস খেলে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের হৃদয়।
আকরাম খানের মহামূল্যবান ও অতিকায় সেই ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট। বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। তারপর সব তো ইতিহাস। একের পর এক স্বপ্নের সিঁড়ি পেরিয়ে যায় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ, ওয়ানডে এবং এলিট ঘরানার টেস্ট স্ট্যাটাস। ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেকটা হয় স্বপ্নের মতো। স্কটল্যান্ড আর পাকিস্তানকে হারিেেয় তুমুলভাবে সাড়া জাগায় বাংলাদেশ। এরপর ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। যদিও অভিজ্ঞতা মোটেও মধুর নয়। সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজে পরবর্তী বিশ্বকাপ। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা যাই হোক না কেন, এক একটি বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ক্রিকেটের আকাশটাকে অনেক বড় করে দিয়ে যায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার ভা-ারে সঞ্চয় হয়েছে অনেক কিছু। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন মোটামুটি পরিচিত নাম। বাংলাদেশের অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, অনেক সাফল্য অর্জিত হয়নি। আগামীতে অনেক পথ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। কোনো একদিন হয়তো বাংলাদেশ জয় করবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা। তবে বিশ্বকাপে যতদিন অংশ নেবে বাংলাদেশ, ততদিন স্মরিত হবে আকরাম খানের নাম।
পড়শি, মার্চ-এপ্রিল ২০০৭
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ঘুম ভাঙিয়ে দিল বাংলাদেশ
অন্তহীন প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এসেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এসেছে জাগরণে জাগরণে বিভাবরী কাটিয়ে দিতে। কিন্তু কেন জানি না, ক্রিকেটের এই আনন্দযজ্ঞ শুরুর দিকে নির্ঘুম করে দিতে পারছিল না আমাদের রাতগুলোকে। মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন কেটে গেছে তাল-লয়-ছন্দ। ক্যালিপসো সুর যেন ঠিকমত বুকে বাজছিল না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মনকাড়া সুর, গান ও রঙের বাহার ঠিকই ধাঁধিয়ে দিয়েছে চোখ, রাঙিয়ে দিয়েছে মন। তদুপরি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে আমাদের অদম্য কৌতূহল তো চিরকালের। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাঁকে ফাঁকে ক্যামেরার তীক্ষè দৃষ্টিক্ষুধা দিয়ে দেখতে পাওয়া যায় মন কেমন করা সৌন্দর্যের রতœসম্ভার! খেলা চলাকালে কখনো-সখনো বিভ্রম লেগে যায়Ñ ফিল্ডাররা সমুদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে নয় তো! ছক্কা মারা বলগুলো হাওয়ায় ভেসে ভেসে অতল সাগরে হারিয়ে যাবে কি? নিশিরাতে ক্রিকেট সুধায় ডুবে থাকলে এমন কৌতূহল তো হরহামেশা মস্তিষ্কে ঘাই মারারই কথা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমুদ্র উপকূলবর্তী ক্রিকেটের বিভিন্ন মাঠকে দূর থেকে মনে হয় এক মায়াকানন। এর কুহক, মোহমুগ্ধতা ও মাধুর্য বুকের মাঝে সৃষ্টি করতে পারে অনির্বচনীয় এক অনুভূতির।
ক্রিকেটের ‘স্বর্গোদ্যান’ থেকে মাধুরী ও মাধুকরী সংগ্রহের এমন সুযোগ পেয়ে সবার মনই আনন্দে নেচে ওঠার কথা। কিন্তু তা যেন আকৃষ্ট করছিল না। মিডিয়ার মাদলও তো অনেক আগেই ঘুম ভাঙানো গান গাইতে থাকে। বিশ্বকাপ শুরুর পর বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করে মিডিয়ার উদ্যমী কর্মীরা অষ্টপ্রহর পৌঁছে দিতে থাকেন মসলাদার নানা সুস্বাদু ব্যঞ্জন। তবুও মন টানছিল না। বাংলাদেশ তো ঢুলছিল না ঢুলু ঢুলু চোখে। কান্ত, বিধ্বস্ত ও অবসন্ন দেহে অফিস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তেমনভাবে কেউ ছুটছিলেন না। বিশ্বকাপ ক্রিকেট কি এতটা পানসে? আমরা তো এমনিতেই নাচনেওয়ালি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি পড়লে আর রক্ষে নেই। হুজুগের উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে পুরো দেশ। কিন্তু কোথায় কি!
এখন তো বাংলাদেশের সন্ধ্যাগুলো হয়ে যায় রাত। বিদ্যুতের লোডশেডিং কমিয়ে আনার জন্য সন্ধ্যা সাতটার পর বন্ধ রাখা হয় সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। নেমে আসে অদ্ভুত এক আঁধার। বলতে গেলে রাতের সেই মোহন আকর্ষণ নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে অফুরন্ত অবসরের হাতছানি। চুটিয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলা উপভোগ করার কত না সুযোগ! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ক্রিকেটে মন ডুবিয়ে দেয়া যায়। না, মন তাতে বুঝি সায় দিচ্ছিল না। এমনটি মনে হওয়াটাও কি মনের বিভ্রান্তি? ঠিক ঝুঝে ওঠা যাচ্ছিল না। আসলে এমন তো এমনি এমনি মনে হচ্ছিল না। মনে হওয়ার যথেষ্ট কার্যকারণ ছিল দৃশ্যমান। বিশ্বকাপ নিয়ে দেখা যাচ্ছিল না কোনো মাতামাতি। রাস্তা-ঘাটে চলা-ফেরায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল না বিশ্বকাপ ক্রিকেট। বিলবোর্ডে কিংবা বিজ্ঞাপনে কোনো পণ্য ক্রয় করার জন্য ছিল না কোনো ক্রিকেটারের মধুর সম্ভাষণ। কেমন যেন খামোশ মেরে গেছিল। মজার বিষয়, ক্রিকেট নিয়ে হালে একটা ক্রেজ সৃষ্টি হয়েছে। দেশে কিংবা বিদেশে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেখানে খেলুক না কেন, আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়। তাকে পুঁজি করে কত না ঘনঘটা।
আগের দুটি বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ ও উদ্দীপনার মোটেও কমতি ছিল না বৈকি। এবারও বিশ্বকাপে খেলছে বাংলাদেশ। তাও তো মস্ত এক স্বপ্ন নিয়ে। খেলতে চায় সুপার এইট। প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে রচনা করে তেমনই এক স্বপ্নের সোপান। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশকে নিয়ে মাতামাতিটা হওয়ার কথা ছিল ‘বাড়াবাড়ি’ পর্যায়ের। অথচ তেমনটি কি মনে হচ্ছিল? কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বাংলাদেশকে। এই তো গেল বছর বিশ্বকাপ ফুটবল যেভাবে জাগিয়ে দিয়ে গেল, ক্রিকেটটা সেভাবে পারছিল না। বিশ্বকাপ ফুটবলের ধারে-কাছেও থাকে না বাংলাদেশ। অথচ তাকে কেন্দ্র করে আবেগে-উচ্ছ্বাসে-আনন্দে ফেটে পড়ে সমগ্র দেশ। সর্বত্রই বয়ে যায় খুশির জোয়ার। ভিন দেশের পতাকায় পতাকায় ছেয়ে যায় শহর-বন্দর-গ্রাম। প্রস্তুতির কোনো কমতি থাকে না। বিশ্বকাপ ফুটবল পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, তার ছোঁয়া লাগে বাংলাদেশে। সে সময় মনে হতে পারে বাংলাদেশ যেন বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলছে! ফুটবল এদেশের মানুষের হৃদয়ের খেলা। ৯০ মিনিটের ফুটবল খেলা যেভাবে মানুষকে উদ্বেলিত করে, ৮ ঘণ্টার ক্রিকেটের পক্ষে তা অর্জন করা খুবই কঠিন। তাই বলে বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রাণহীন হয়ে যাবে? মনে হচ্ছিল, ব্যাটে-বলে যেন মিলছিল না। ক্রিকেট উপভোগ করার জন্য হৃদয়ে যে সুরের মূর্ছনা ও মনে রঙ থাকতে হয়, তা কি তবে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল? কিছুই খেলছিল না মাথায়। ১৭ মার্চের পর মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বদলে যায় সব হিসাব। ক্রিকেটানুরাগীরা যে এখন আর অল্পতে সন্তুষ্ট নন, সেটাই যেন বুঝিয়ে দিলেন। ভারতকে হেসে-খেলে ৫ উইকেটে হারিয়ে দিয়ে জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। আড়মোড়া ভেঙে সবাই এখন গাইছেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জয়গান। এখন থেকে হয়তো দিনগুলোকে সংক্রমিত করবে রাতের আঁধার আর রাতগুলো রূপান্তরিত হবে দিবাকরে। ভারতকে হারিয়ে শুধু বাংলাদেশই শুধু জেগে ওঠেনি, ভাঙিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার তাবৎ ক্রিকেটানুরাগীর ঘুমও।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ মার্চ ২০০৭
দিন বদলের গান
বুকে অবরুদ্ধ কান্না আর নীল বেদনা নিয়ে যে লড়াইয়ের মঞ্চে নামা যায় এবং সেটাই যে হয়ে উঠতে পারে অনুপ্রেরণার অগ্নিমশাল, তা বুঝিয়ে দিলেন মাশরাফি-বিন-মর্তুজা এবং ‘টিম বাংলাদেশ’। প্রিয় বন্ধু, সহযোগী ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানার আকস্মিক মৃত্যুর খবর শুনে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে ঘুম ভাঙে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। বিশ্বকাপ ক্রিকেট মিশন শুরুর প্রথম দিনে এমন একটা আঘাত যে কাউকেই থমকে দিতে পারে। সঙ্গত কারণে হতচকিত করে দিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকেও। এমন একটা মর্মবিদারী ঘটনার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। অশ্রু প্লাবনে ভেসেছিলেন দলের সবাই। দেশ থেকে আসার আগে যার স্মৃতি-স্পর্শ একদম টাটকা হয়ে আছে হৃদয় মন্দিরে, যিনি হতে পারতেন দলের সহযাত্রী, তার এভাবে মর্মান্তিকভাবে চলে যাওয়াটা কাছের মানুষদের জন্য কী যে কষ্ট ও যন্ত্রণার, তা তো কেবল ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারেন। কষ্ট ও যন্ত্রণাটুকু বুকে চেপে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। মানসিকভাবে মুষড়ে পড়া ক্রিকেটাররা খেলার মাঠে কতটা কি করতে পারবেন, তা ছিল টিমের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের কাছে ভাবনার বিষয়। প্রতিপক্ষ তো যেমন-তেমন কেউ নয়Ñ শিরোপা প্রত্যাশী ভারত! যাদের তূণে শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলির মতো মস্ত মস্ত নাম ও রানের ভা-ারী আর আছে মাস্ত মাস্ত ক্রিকেটার বীরেন্দর শেবাগ, যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা। এমন এক শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলতে নামাটা যে কোনো দলের জন্য থরহরি কম্প হওয়ার কথা। কিন্তু সেদিন দিব্যদৃষ্টিতে যা দেখেছিলাম, কখনো কখনো মনে হয়েছিল রাত জাগা কান্ত চোখ ভুল দেখছে না তো! বাংলাদেশের উদ্বোধনী দুই পেসার মাশরাফি আর তার সহযোগী সৈয়দ রাসেল যেভাবে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন-আপকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেন, তাতে হাঁসফাঁস করতে থাকেন তারা। ব্যাটসম্যানদের অঙ্গভঙ্গিতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, কামানের গোলার মতো ছুটে আসা ‘হামলা’ থেকে কখন তারা একটু স্বস্তি পাবেন। বিশ্বসেরা পেসারদের যারা অবলীলায় খেলেছেন, হাঁকিয়েছেন বিশাল বিশাল ছক্কা, তাদের কম্পিত অবস্থা দেখে চোখজোড়া বার বার কচলিয়েছি আর ভেবেছি, এ কি সত্য! পরমুহূর্তে মনে হয়েছে, মধুর ক্ষণ তো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এরপর নিশ্চয় দুঃখ পেতে হবে। পেসারদের ‘বেয়াদবি’র শোধ ব্যাটসম্যানরা নিশ্চয়ই স্পিনারদের ওপর দিয়ে তুলবেন। শঙ্কিত হয়েছি স্পিনারদের কথা ভেবে। আহ্, বেচারাদের হতে হবে তুলোধুনো। হায়! কার দোষে কে পস্তায়! ঘাপটি মেরে থাকা বহুদর্শী ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা বোধ করি সুযোগের অপেক্ষায়। স্পিনারদের খেলার ব্যাপারে এমনিতেই তাদের কোনো জুড়ি নেই। তদুপরি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছোট মাঠগুলো ব্যাটসম্যানদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ, তার ওপর সমুদ্রের কূল ঘেঁষে স্টেডিয়ামÑ না জানি কতবার হারিয়ে যায় বলগুলো! এমনসব উল্টোপাল্টা ভাবনার মাঝে মাশরাফি এবং রাসেলের পরিবর্তে এলেন স্পিনাররা। ভাবলাম কি আর ঘটছে কি! সব ম্যাজিক নাকি? বাংলাদেশ যা যা করতে চাচ্ছে, অবিকল যেন তাই ঘটে চলেছে। আবদুর রাজ্জাক, সাকিবুল হাসান ও মোহাম্মদ রফিকের মায়াবী ঘূর্ণিবল মন্ত্রমুগ্ধ রাখে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছে, বলের এমন জাদু এর আগে তারা আর দেখেননি। ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা যেন হয়ে যান এক একজন জন্টি রোডস। বিনা আয়েশে একটি রানও তারা নিতে দেননি। ভারতের ইনিংস ১৯১ রানে গুটিয়ে দিয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। ব্যাটিংয়ে রীতিমত ভেল্কি দেখায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী দেখলো তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম আর সাকিবুল হাসানকে। শোককে শক্তিতে পরিণত করা টিন-এজ এই তরুণদের ব্যাটে ছিল আগুনের ফুলকি। ভারতীয় বোলারদের বলগুলো তারা যেভাবে দুলকিচালে হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তাতে ছিল একটা সহজাত আত্মবিশ্বাস। কাউকে রেয়াত করছিলেন না, আবার তা নিয়ে খুশিতে আত্মহারাও হচ্ছিলেন না। মনোভাব দেখে মনে হয়েছে, এমনই তো খেলার কথা!
এ যেন এক নতুন বাংলাদেশ। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রত্যয়ী এই বাংলাদেশের দেখা মিলেছে। সেই ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে প্রবর্তন হয় ক্রিকেট খেলা। তখন ক্রিকেটের এত প্রসার ছিল না। তবে পাকিস্তান আমলে ক্রিকেটের চর্চাটা বাড়তে থাকে। পাকিস্তানের টেস্ট স্ট্যাটাস এবং তাদের সাফল্য পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের অনুপ্রাণিত করে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিভাবান অনেক ক্রিকেটার উঠে আসতে থাকেন। কিন্তু পশ্চিমাদের বাঙালি বিদ্বেষ ও বৈষম্যের কারণে এ অঞ্চলের ক্রিকেটাররা পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে পারেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ক্রিকেটটা শুরু হয় নতুনভাবে। প্রথমদিকে ক্রিকেট নিজস্ব অবস্থান গড়ে তোলার প্রয়াস চালায়। সে সময় বিদেশীদের সঙ্গে খেলতে পারাটা ছিল পরম কাক্সিক্ষত। এরপর আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে আইসিসি ট্রফিতে খেলাটা ছিল একধাপ অগ্রগতি। এক্ষেত্রে নেতৃত্বে ছিলেন শফিকুল হক হীরা, সৈয়দ আশরাফুল হক, রকিবুল হাসান, ওমর খালেদ রুমী, ইউসুফ রহমান বাবু, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, দীপু রায় চৌধুরী, গাজী আশরাফ হোসেন লিপুরা। বেশ কিছুদিন খেলার পর স্বপ্ন হয়ে ওঠে আইসিসি ট্রফিতে সাফল্য অর্জন। এই সাফল্য পাওয়াটা হয়ে ওঠে মরীচিকার মতো। তখনো বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে বড় কিছু ভাবা যায়নি। বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরাটা ছিল সুদূরের কল্পনা। ১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বদলে যায় পরিস্থিতি। এ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আতহার আলী খান, ফারুক আহমেদ, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আকরাম খান, এনামুল হক, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, মেহরাব হোসেন অপি, জাভেদ ওমর বেলিম, হাবিবুল বাশার সুমন, আল-শাহরিয়ার রোকন, মোঃ রফিক, খালেদ মাসুদ পাইলটরা। ওয়ানডে স্ট্যাটাস, বিশ্বকাপে খেলা এবং টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন সেই ধারাবাহিকতারই প্রতিফলন। ক্রিকেটের অভিজাত সারিতে স্থান করে নেয়ার পরও বাংলাদেশের প্রত্যাশাটা খুব বেশি বড় ছিল না। ব্যক্তিগত কিছু নৈপুণ্যের ঝিলিক কিংবা দলগত টুকটাক অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল চাওয়া-পাওয়ার চৌহদ্দি। এরপর একের পর এক অর্জিত হতে থাকে বিভিন্ন সাফল্য। সাফল্য আনেন মঞ্জুরুল ইসলাম, তাপস বৈশ্য, মোহাম্মদ আশরাফুল, অলক কাপালি, আবদুর রাজ্জাক, আফতাব আহমেদ, রাজিন সালেহ, মানজারুল ইসলাম রানা, নাফিজ ইকবাল, এনামুল হক জুনিয়র, মেহরাব হোসেন জুনিয়র, নাজমুল হোসেনরা। এ দলে আছেন মাশরাফি-বিন-মর্তুজা, সৈয়দ রাসেল, শাহাদত হোসেনরাও। এদের সঙ্গে সবে যোগ দিয়েছেন শাহরিয়ার নাফীস, সাকিবুল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবালরা। এ জেনারেশন একদমই অন্যরকম। বয়সটা একদম কম হলেও বয়োসোচিত কোনো চাপল্য নেই। একটা পরিপক্বতা নিয়েই যেন তারা ক্রিকেট খেলতে এসেছেন। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্য কোনো দেশ বা কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গে নিজেদের কোনো ব্যবধান তারা খুঁজে পান না। ক্রিকেটে আত্মবিশ্বাস আর দৃষ্টিভঙ্গি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে তাদের কোনো খামতি নেই। নতুন প্রজন্মের এই ক্রিকেটারদের সঙ্গে আগের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের যোজন যোজন পার্থক্য। এটা যে কাউকেই আশাবাদী করে তুলবে। বাংলাদেশের সুপার এইটে খেলতে চাওয়াটা এখন যেমন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না, আগামীতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হতে চাওয়াটাও বোধ করি অবাস্তব মনে হবে না। দিন বদলের এই গান আমাদের শুনিয়েছেন নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটাররা।
দৈনিক আজকের কাগজ, ২১ মার্চ ২০০৭
সেই ক্যালিপসো, সেই নস্টালজিয়া
অনুভূতি নামক শক্তিশালী এক অ্যান্টেনায় কখনো কখনো এমন কিছু ‘ধারণ’ হয়ে যায়, যার সম্পর্কে আগেভাগে কোনো ধারণাই থাকে না। অথচ না জানা সেই বোধ বুকের মাঝে জন্ম দেয় অন্য রকম এক অনুভূতির। সেই বালক বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের প্রেমে পড়াটা অনেকটা এমনই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। না তাদের ভৌগোলিক, না রাজনৈতিক, না অন্য কিছু। এমনকি অবুঝ মনটা ক্যারিবীয় যে ক্রিকেটে সম্মোহিত হয়েছিল, সেই ক্রিকেটটাই বা কতটুকু জানা ছিল? নিজের মনে যেটুকু ধারণা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়ে উঠেছিল, তাতে অনুমান করা গিয়েছিল, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ যেহেতু নাম, নিশ্চয় করে প্রতিবেশী ‘ইন্ডিয়ার’ কোনো ‘আত্মীয়-স্বজন’ হবে বোধ করি। সে নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। তবুও কেন জানি না বুকের মাঝে শুনতে পাওয়া যেতো ক্যারিবীয় সাগরের দূরাগত গর্জন-ধ্বনি। সাগরের ঢেউ এসে বালুচরে কখনো-সখনো রেখে যায় কিছু কিছু মুক্তা-মাণিক্য, শামুক-ঝিনুক, মূল্যবান কিংবা মূল্যহীন কত কিছু। অনুরূপভাবে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ঢেউ এসে বুকের কন্দরে ধীরে ধীরে গড়ে দিতে থাকে সঞ্চয়ের ভা-ার। মায়ের পেটে একটু একটু করে যেভাবে বেড়ে ওঠে সন্তান, অনেকটা সেভাবেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট সম্পর্কে জন্ম নিতে থাকে উপলব্ধির জগত।
সত্তর দশকের গোড়ায় দিকে দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে বের হয়ে আসার রণতূর্য। ‘বিট জেনারেশন’-এর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও তার ঢেউ তখনো মৃদু মৃদু দুলিয়ে দিতে থাকে। বুকের মধ্যে উন্মাতাল হয়ে বাজতে থাকে ফান্ক আর ডিসকো মিউজিক। অধিকারহারা মানুষের প্রতি তৈরি হয় সহানুভূতি ও সমবেদনা। দুুনিয়ার তাবৎ কালো মানুষের জন্য বুকের গহীনে জমে থাকে কান্না। তখন তো এত বিস্তার ছিল না মিডিয়ার। সাদা-কালো টেলিভিশন দেখা মিলতো কালে-ভদ্রে। বেতার ছিল ‘অনুরোধের আসর’ আর ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’ নিয়ে। আর ছিল লাল আটার মতো দেখতে নিউজপ্রিন্টের সংবাদপত্র। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে এই। খুব যে বেতারের মনোযোগী শ্রোতা কিংবা সংবাদপত্রের নিবিষ্ট পাঠক ছিলাম তা বলা যাবে না। ফাঁক-ফোঁকর গলে মর্মে পৌঁছে যেত অনুভবের নির্যাসটুকু। তা আহরণ করে গড়ে ওঠে ভালোলাগা, মন্দলাগা। তেমন এক মুহূর্তে হয়তো হৃদয়তন্ত্রীতে পৌঁছে যায় ক্যালিপসো সুর। সস্তার কালো কালিতে নিউজপ্রিন্টে অস্পষ্টভাবে মাঝেমধ্যে ছাপা হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনো ব্যাটসম্যান কিংবা কোনো বোলারের ভয়ঙ্কর অ্যাকশন। কালো কালিতে মাখামাখি হয়ে কৃষ্ণকায় ক্রিকেটারের যে অবয়বটুকু দেখা যেতো, তাতে উদ্ভাসিত হতো কেবল সাদা দাঁত আর উজ্জ্বল মণিটুকু। ভীতি সৃষ্টি করা সেই দুরন্ত ভঙ্গিই হৃদয়ে আঁকা হয়ে যায় সৌন্দর্য আর সুষমা নিয়ে। ভালোবাসার অঙ্কুরোদ্গম ঘটে যায় না-জানা না-দেখা ক্যারিবীয় সেই ক্রিকেটের প্রতি। প্রথম প্রেমের মতো তীব্র আকর্ষণ যেন তখন পুরোমাত্রায় ধাবিত হয় তাতে।
বিকেলের সূর্য হয়ে তখনও জ্বলছেন পঞ্চাশ দশকে ক্যারিয়ার শুরু করা কিংবদন্তি গ্যারি সোবার্স, রোহান কানহাই, ল্যান্স গিবসরা। ষাট দশকের শেষভাগে আসা কাইভ লয়েড, রয় ফ্রেডরিকস, আলভিন কালিচরণরা ফর্মের মধ্য গগনে। সত্তর দশকে দুনিয়া কাঁপাতে এসে যান গর্ডন গ্রীনিজ, ভিভ রিচার্ডস, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, ল্যারি গোমস, কলিন ক্রফট, জোয়েল গার্নার, ডেসমন্ড হেইন্স, ম্যালকম মার্শালরা। বদলে যাওয়া সেই সময়ে এই ক্রিকেটারদের ক্যারিশমা, লাইফ স্টাইল, জীবনবোধ, খেলার ধারা যোগ করে অন্য এক মাত্রা। ক্রিকেটটা কলোনিয়াল কালচারের অংশ হলেও তাতে তাল-লয়-সুর-ছন্দ দিয়ে পরিপূর্ণতা এনে দেন ক্যারিবীয়রা। ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় কালচারের সঙ্গে আফ্রিকান ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে গড়ে তোলা হয় যে ক্যারিবীয় সংস্কৃতি, তার অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে ক্রিকেট। ব্যাটে-বলে তারা মিলিয়েছেন জীবনের রঙধনু। শোষণ-বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভুলে থাকতে ক্রিকেটটাকে করে নেন জীবনের অংশ। খেলেছেন চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট। মন কেমন করা ক্রিকেট। ক্রিকেটে জয়টাকে তারা বড় করে দেখেননি। তারা জিতলেও হেসেছেন, হেসেছেন হারলেও। একই সঙ্গে পানে, ভোজনে, স্ফুর্তিতে হয়েছেন মাতোয়ারা। ক্রিকেটের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায় সুর, সুরা ও নৃত্য। সমুদ্রতটে, পাম গাছের তলায়, মশালের আলোয় কিংবা জ্যোৎস্নাধৌত রাতেও ক্রিকেট নিয়ে আসে অন্য ব্যঞ্জনা। ক্রিকেটটাকে তারা যে জীবনবোধের অংশীদার করে নেন, তা অনুপ্রেরণা হয়ে আসে ক্রিকেট ঘরানার অনগ্রসর দেশগুলোতে। সাফল্য দিয়েও ক্রিকেট বিশ্বকে আলোকিত করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই প্রথম থেকে টেস্ট ক্রিকেটে ঘটনাবহুল ও চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী ছাড়াও অসংখ্য কিংবদন্তি ও বর্ণাঢ্য ক্রিকেটব্যক্তিত্ব উঠে এসেছেন ক্যারিবীয় ছোট ছোট দ্বীপ থেকে। ওয়ানডে ক্রিকেট প্রবর্তনের পর ক্রিকেট পৃথিবীকে রোমাঞ্চিত ও আনন্দময় করে তোলে ক্যারিবীয়রা। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৮৩ সালে রানার্সআপ হওয়া ছাড়াও সত্তর দশকে ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। ব্যাটের প্রতাপে আর বলের ত্রাসে ক্রিকেট বিশ্বে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলেও ক্যারিবীয়রা ক্রিকেটে গেয়েছেন জীবনের জয়গান। এই গান ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। দরিদ্র, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে তৈরি করে বিস্ময় আর মুগ্ধতা। পুরু ঠোঁট, কোঁকড়ানো চুল আর মিশকালো গায়ের রঙের আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে আসা মানুষদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি উজ্জীবিত করে তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাৎপদ মানুষদের। তাদের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে ক্যারিবীয় ক্রিকেট।
সত্তর দশক কাঁপালেও ক্যারিবীয় ক্রিকেটকে লালিত্য দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে, আভিজাত্য দিয়ে নতুন সুধারসে জারিত করার কৃতিত্ব লিয়ারি কনস্টানটাইন, জর্জ হ্যাডলি, ফ্রাঙ্ক ওরেল, কাইড ওয়ালকট, এভার্টন উইকস, ওয়েস হল, কনরাড হান্ট, সনি রামাধীন, আলফ্রেড ভ্যালেন্টাইদের। বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকে থ্রি ‘ডব্লিউ’ হিসেবে খ্যাত ওরেল, ওয়ালকট ও উইকস ক্রিকেটকে শুধু সুরে সুরে ভরিয়ে দেননিÑ খেলার মাঠে তারা প্রতিফলন ঘটিয়েছেন যে জীবন-দর্শনের, তা হয়ে উঠেছে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের পরম সম্পদ। এঁদের জীবন-দর্শনকে অনুসরণ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। শুধু তাই নয়, তা সম্মোহিত করে জগতের অনুভূতিসম্পন্ন ও আবেগপ্রবণ মানুষদের। রৌদ্রকরোজ্জ্বল একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পাম ট্রি আর ক্রিকেট স্ট্যাম্পস এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে খয়েরি-লাল বর্ণ নিয়ে তৈরি করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতাকা হয়ে ওঠে ক্রিকেটপিপাসুদের প্রাণের নিশান।
অধিনায়কের ব্যাটনটা যেদিন ‘কিং’ ভিভ রিচার্ডস তারই স্বদেশী রিচি রিচার্ডসনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন, সেদিনই ‘অস্ত’ যেতে শুরু করে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের মাত-। ফ্রাঙ্ক ওরেল, কাইভ লয়েড এবং ভিভ রিচার্ডসের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাফল্যের সৌধ গড়ে ওঠার পাশাপাশি সম্মিলন ঘটে সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধন। ক্রিকেটার ও অধিনায়ক হিসেবে সফলতা পেলেও বিনিসুতার মালা দিয়ে গড়ে ওঠা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলেন রিচি রিচার্ডসন। প্রহাদকুলে ‘দৈত্য’ হয়ে দেখা দেন তিনি। রিচি যে মন-মানসিকতা নিয়ে হাল ধরেন, তার সঙ্গে একদমই খাপ খায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের। সেই থেকে হারিয়ে যেতে থাকে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের গৌরব-রশ্মি, মহিমা ও মর্যাদা। বিশ্ব ক্রিকেটের ‘বিটলস’ হয়ে যারা সুপারহিট থেকেছে টপ চার্টে, তাদের কাছ থেকে এখন শুনতে হচ্ছে ‘ব্যাক স্ট্রিট বয়েজ’-এর দুর্বল প্যারোডি। পরবর্তীকালে কার্টলি অ্যামব্রোস, কার্ল হুপার, কোর্টনি ওয়ালশ, সর্বোপরি ব্রায়ান লারার মতো বিরল জাতের ক্রিকেটারের দেখা মিললেও কিন্তু কোথায় সেই ক্যালিপসো সুর? যে জীবনবোধ, যে জীবন-দর্শন, যে সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্যালিপসো ক্রিকেটের ‘অবয়ব’, তাতে এখন যেন চলছে ‘চন্দ্রগ্রহণ’। এমন একটা মন্দাক্রান্ত সময় কারিবীয় ক্রিকেটানুরাগীদের হৃদয় ভারাক্রান্ত ও নস্টালজিক না করে পারে না। তবে এবারই প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসায় হারানো দিনগুলো ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও উঁকি মারছে মনের কোণায়। সেটুকুই সান্ত¡না।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ এপ্রিল ২০০৭
আর নয় পাকিস্তান, ভারত...
ক্রিকেটের বড় আসরে আগে আমাদের দেশটির তেমন মর্যাদাকর অবস্থান ছিল না। না থাকারই কথা। কোনো কিছুর শুরুতে মোটামুটিভাবে সবার একই অবস্থা হয়। নিজের দেশ না থাকলে তখন হৃদয় দখল করে নেয় অন্য কোনো দেশ। মৌমাছি তো ফুলের কাছে যাবেই মধু আহরণে। মানুষ স্বভাবগতভাবে বীর পূজারী। সাফল্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। তখন সে ছুটে যায় তার পিছে পিছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সমর্থন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। কেউ পাকিস্তান, কেউ ভারত কিংবা কেউ অন্য কোনো দেশের অনুরাগী। এ ক্ষেত্রে ক্রিকেটপ্রেমীরা অনেক সময় পোপের চেয়েও অধিক ক্যাথলিক হয়ে যান। এমনকি পছন্দের দেশটি নিজের দেশের মুখোমুখি হলেও অনেকেরই কা-জ্ঞান পর্যন্ত লোপ পেয়ে যায়। গুরুত্বহীন হয়ে যায় মাতৃভূমিও। ঢাকার মাঠে বিদেশী ক্রিকেট দলের সফরে এ বঙ্গের বিবিধ রূপ দেখতে পাওয়া গেছে। সৃষ্টি হয়েছে অনেক অপ্রীতিকর ও নোংরা ঘটনার।
এখন সময় এসেছে বদলে যাবার। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট পাল্টে দিতে পারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির। প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়েছে অনেকেরই প্রিয় দল পাকিস্তান এবং ভারত। বিশ্বকাপে উপমহাদেশের ক্রিকেটের এই দুই পরাশক্তির গৌরব-রশ্মি যখন অস্তমিত, তখন প্রজ্বলিত হয়েছে নতুন শক্তি বাংলাদেশের সাফল্যের সূর্য। কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে, ১৯৯৯ সালে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ, তেমনিভাবে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতকে পরাজিত করে কাঁপিয়ে দিয়েছে ক্রিকেট দুনিয়া। মূলত বাংলাদেশের কাছে হেরেই বিদায় নিয়েছে সুপারস্টারদের সমন্বয়ে গড়া ভারত। প্রথম মিশনে স্কটল্যান্ড আর পাকিস্তানকে হারিয়েও পদ্ধতিগত কারণে বেশি দূর যেতে পারেনি বাংলাদেশ। এবারের মিশনে ভারত এবং বারমুডাকে পরাজিত করে ১৬ জাতির এই টুর্নামেন্টে অর্জন করেছে সুপার এইটে খেলার গৌরব। আরো অনেক দূরে যাবার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়। অতীতের সাফল্যকে হালকা না করেও বলা যায়Ñ সেটা ছিল হঠাৎ জ্বলে ওঠা বাংলাদেশের পরম বিস্ময়। কিন্তু এখন আর বাংলাদেশের কৃতিত্বকে তেমনটি বলার উপায় নেই। যেভাবে বলে-কয়ে ভারতকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে, তাতে গত্যন্তর নেই শ্রেয়তর দল হিসেবে বাংলাদেশকে না মেনে নেয়া ছাড়া। বাংলাদেশ যে আর দুর্বল প্রতিপক্ষ নয়, এটা হাড়ে হাড়ে টের ুেপয়েছে ১৯৮৩ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলার শুরুতে যে স্নায়ুর চাপে পেয়ে বসে, সেটাই শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দেয় ব্যক্তিগত রান আর বিজ্ঞাপনের চাপে নুইয়ে পড়া ভারতকে। যাদেরকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার কথা, তারাই যদি মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না চুপিসারে কোথাও একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। অবশ্য বাংলাদেশ যে কাউকে যে ছেড়ে কথা বলবে নাÑ সেটা তারা বুঝিয়ে দিয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচে। অপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে আকাশে উড়তে থাকা নিউজিল্যান্ডকে মাটিতে নামিয়ে আনে বাংলাদেশ। রেকর্ড বুকে এ বিজয় লেখা না থাকলেও বাংলাদেশের ওজনটা যাদের বুঝে নেয়ার, তারা বুঝে নিয়েছে ঠিকই। রূপান্তরিত বাংলাদেশ ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে ক্রিকেট-বিশ্লেষকদের। এমনকি বাংলাদেশকে ‘চুনোপুঁটি’ মনে করা ক্রিকেটের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশ সুপার এইটে উঠেছে যোগ্যতর দল হিসেবেই।
যা কিছু আপন, তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। নিজের পরিম-ল, নিজের দেশকে ভালোবাসেন সবাই। ক্রীড়াক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। পরাজিত দলকে নিয়ে কেইবা আর মাতামাতি করবে? হালে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। নিজের দেশকে ভালোবাসার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে ক্রিকেট। এখন তো আর অন্য দেশকে নিয়ে মাতামাতি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ক্রিকেট দুনিয়ার সমীহ আদায় করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলার আগে প্রতিপক্ষকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। কাটতে হচ্ছে নানা ছক আর কৌশলের মারপ্যাঁচ। এ পর্যায়ে এটি অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। বিশ্ব ক্রিকেটের তারকা আর মহাতারকাদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে বাংলাদেশের উঠতি ক্রিকেটাররা। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল, সাকিবুল হাসান, মুশফিকুর রহিমরা। তাদের প্রতিভার দীপ্তিতে চমকিত হচ্ছেন ক্রিকেট কিংবদন্তিরা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবং ক্রিকেটাররা আকর্ষণ করতে পেরেছেন ভিনদেশীদেরও। অনেকেই ছুটে আসেন তাদের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য। এ কারণেই বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকা ‘দ্য এজ’কে এক বুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়া একটি দল মাত্র। নিশ্চিত করে বলতে পারিÑ এবার আর অটোগ্রাফের জন্য তাদের পেছনে (বাংলাদেশের) কেউ ছুটবে না। একটা সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যেখানে প্রতিপক্ষের কাছে ছুটে গিয়ে আহাদিত হতেন, আর এখন সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটানুরাগীদের মোহ কেটে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং এখন পকিস্তান, ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশ নিয়ে মেতে থাকাটা হবে নিজেদের দৈন্য আর দেউলিয়াপনার লক্ষণ।
বাংলাদেশ সবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ এখনই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে কিংবা প্রতিনিয়ত জয়ের স্বাদ পাবেÑ এমনটি আশা করা যায় না। তবে বাংলাদেশের পক্ষে যে সম্ভব, সেই সম্ভাবনাটুকু জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশ কেন পারবে না? এ দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস পৃথিবীর কাছে এক বিস্ময়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, তা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সারা দুনিয়ার মানুষ। এদেশের বীর জনতা সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম করে অভ্যুদয় ঘটিয়েছে একটি নতুন দেশেরÑ যা অবাক করা এক কীর্তি হয়ে আছে পৃথিবীর কাছে। বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে নতুনের কেতন ওড়ানোর জন্য। ক্রিকেটে সে পথেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ এপ্রিল ২০০৭
ফুটবলের সেই আবেগ কোথায়?
ফুটবলের সেই প্রাণচঞ্চলতা কোথায়? কোথায় সেই উন্মাদনা? ফুটবল কি তার সোনালী দিনগুলো হারিয়ে ফেলেছে? সত্তর ও আশির দশকের যে কোনো ফুটবল অনুরাগীর বুকে এ প্রশ্নগুলো বেদনার সুর হয়ে বাজে। অবশ্য এই আবেগ, এই অনুভূতি বর্তমান সময়ের ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়ে দোলা দেয় কিনাÑ সে প্রশ্নটা সঙ্গত কারণে উঠতেই পারে। এ সময়ের দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, জীবন-দর্শন নিশ্চয়ই অন্যরকম হবে। হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। তাদের বুকে তো আর নস্টালজিয়া নেই। নেই অতীতের জন্য মন কেমন করা। তারা হয়তো বর্তমান সময়টাকে সেরা ভাবতেই পারেন। ভাবাটা অসঙ্গত নয়। এ সময়ের তারুণ্য তো আর অতীতকে দেখেননি। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের তারতম্যটা তারা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? তাছাড়া সময় যত গড়ায়, ততই অর্জিত হয় পরিপক্বতা। আসে সাফল্য। আর এটা তো চিরন্তন নিয়ম, বয়স একটু হেলে পড়লেই একটা নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে। সবাই কম-বেশি হয়ে পড়েন অতীতমুখী, স্মৃতিকাতর। ফেলে আসা দিনগুলোকে মনে হয় স্বর্ণরেণু দিয়ে মোড়ানো। নিজেদের সময়টাকে সবাই গভীরভাবে ভালোবাসেন। মূল্যায়নটা করেন রঙিন চোখে। আসলে নিজের জীবনের সঙ্গে যে সময়টার রাখীবন্ধন, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসা। এ কারণে কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবনের দিনগুলো একজন মানুষের প্রধান সম্পদ হয়ে ওঠে। এ সময়টা মানুষের জীবনে বার বার ফিরে আসে। এর আগে কিংবা পরের সময়টা তাদের বুকে সেভাবে আসন করে নিতে পারে না। সঙ্গত কারণে কোনো কিছুর সার্বিক মূল্যায়ন করতে গেলে ঘুরে-ফিরে নিজের সময়টা গুরুত্ব পেয়ে যায়। অন্য অনেকের মতো আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
দেশভাগের পর এ অঞ্চলের নিস্তরঙ্গ জীবনে গতিময়তা নিয়ে আসে ফুটবল। পঞ্চাশ ও ষাট দশক ফুটবলে অনেক উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে লড়াই করে বাঙালি ফুটবলাররা নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার জন্য যে কষ্টকর টিকে থাকার সংগ্রাম করেছেন, তা ছিল প্রেরণাদায়ক ও উদ্দীপনামূলক। পশ্চিমাদের শোষণ-বঞ্চনার জবাব বাঙালি ফুটবলাররা দিয়েছেন খেলার মাঠে। বাঙালি ফুটবলারদের পায়ে বল এলে এ অঞ্চলের মানুষেরা আবেগে আপ্লুত হয়েছেন।ু একটা ডজ, একটা গোল তাদের বুকে অন্যরকম এক আবেগের জন্ম দিয়েছে। সে সময় যেসব বাঙালি ফুটবলার খেলার মাঠে আলো ছড়িয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেনÑ ওয়াজেদ আলী মিয়াজি, সৈয়দ আবদুর রশিদ ছুন্না, ফজলুর রহমান আরজু, নবী চৌধুরী, আবদুস সামাদ, তারাপদ রায়, কবীর আহমেদ, চিংহামং চৌধুরী মারী, আশরাফ চৌধুরী, তাজুল ইসলাম মান্না, গজনবী, দেবীনাশ শাংমা, মোঃ জহীর, বলাই চন্দ্র দে, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, আবদুর রহিম, খন্দকার নূরুন্নবী, আবুল খায়ের, সেকান্দার আলী, কাজী মাহমুদ হাসান, জাকারিয়া পিন্টু, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, গোলাম সারোয়ার টিপু, শহীদুর রহমান সান্টু প্রমুখ। পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলা এই ফুটবলাররা প্রত্যেকেই ছিলেন বাঙালির স্বপ্নের নায়ক। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিত্ব ও ইমেজ দিয়ে তারা পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছিলেন। তৎকালীন পরাধীন দেশে তারা যে আশার আলো জ্বালিয়েছিলেন, তা ছিল এক কথায় অতুলনীয়। তাঁরা শুধু ফুটবলশৈলী দিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেননি, তাঁদের পায়ে পায়ে ধাবিত হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ফুটবল মাঠে যেন নবজাগরণের ঢেউ লাগে। নতুন প্রজন্মের ফুটবলারদের সৃষ্টিশীল ও চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল ফুটবল নবউন্মাদনার সৃষ্টি করে। ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের পাশাপাশি টগবগে তারুণ্য ও যৌবনের পূজারী আবাহনী ক্রীড়াচক্রের আবির্ভাব ফুটবল অঙ্গনকে দারুণভাবে মাতিয়ে দেয়। চিরায়ত সাদা-কালো আর মোহনীয় আকাশী-নীল রঙের জার্সি শুধু তীব্র প্রতিদ্বন্দি¡তারই জন্ম দেয়নি, ফুটবলকে করেছে প্রাণবন্ত, চিত্তাকর্ষক ও গ্ল্যামারাস। বিল হার্টের প্রশিক্ষণে আবাহনীর শৈল্পিক ও আধুনিক ফুটবল নতুন একটি ধারার জন্ম দেয়। গতানুগতিকতার পরিবর্তে গতি ও ছন্দময় ফুটবলের নীল রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্ম। সত্তর দশকের অস্থির ও টালমাটাল সময়ে ফুটবলের স্বপ্নে প্লাবিত হয় বলতে গেলে পুরো দেশ। ফুটবলের জনপ্রিয়তার ঢেউ উপচে পড়ে শহর-বন্দর-নগরে, গ্রাম-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়। ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেন বড় নাজির, অমলেশ, নান্নু, বাটু, কাজী সাত্তার, মোঃ মালা, অনিরুদ্ধ, গোবিন্দ কু-ু, কায়কোবাদ, আলী ইমাম, এনায়েত, নওশের, শেখ আশরাফ, সালাউদ্দিন, গফুর, ছোট নাজির, মোতালেব, মঞ্জু, সেলিম, আবু ইউসুফ, চুন্নু, বাবলু, বড় বাদল, রকিব, খোরশেদ বাবুল, নীলু, কালা, মোকসেদ, টুটুল, ভানু, রামা লুসাই, বাসু, হালিম, মোহসিন, সুহাস, আবুল, মঈন, কাওসার আলী, আশীষ, আসলাম, কাজী আনোয়ার, মুকুল, হাসান, হেলাল, সালাম মুর্শেদী, স্বপন কুমার, লোভন, পিন্টু, ছোট ইউসুফ, লাল মোহাম্মদ, আজমত, গাফফার, ওয়াসিম, মোসাব্বের প্রমুখ। সে সময় তরুণ প্রজন্মের সামনে তেমন কোনো রোল-মডেল ছিলেন না। ফুটবলাররাই হয়ে ওঠেন কল্পনার রোল-মডেল। বিশেষ করে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, গ্ল্যামার ও জনপ্রিয়তা দিয়ে আলাদা স্থান করে নেন সালাউদ্দিন, এনায়েত, নান্নু, মঞ্জু, চুন্নু, টুটুল প্রমুখ। সালাউদ্দিন তো রীতিমত কিংবদন্তী হয়ে ওঠেন। সে সময়ের ফুটবল বিশ্বের রোমান্টিক নায়ক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জর্জ বেস্টের আদলে ঘাড় অব্দি নেমে আসা ঝাঁকড়া চুল, বোহেমিয়ান না হলেও কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন আর হরিণের ন্যায় দুরন্ত গতিতে ছুটে মনমাতানো ফুটবল দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের মডেল হয়ে ওঠেন সালাউদ্দিন।
কাব ফুটবলের পাশাপাশি আগা খান গোল্ডকাপ, প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ, সফরকারী বিদেশী দলের সঙ্গে স্থানীয় দলের প্রীতি ম্যাচসহ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের খেলাগুলোর জন্য ফুটবল দর্শকরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। তবে দেশের মাটিতে যেসব টুর্নামেন্ট ও ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা দেখার জন্য মানুষের ঢল নামতো। ঢাকা স্টেডিয়াম একতলা থেকে দোতলা এবং ফাডলাইটে খেলা আয়োজন করেও দর্শকদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আয়োজন ২০তম এশীয় যুব ফুটবল টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ১৮টি দেশ নিয়ে আয়োজিত এ টুর্নামেন্টটি ফুটবলের এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে। দর্শক উন্মাদনার ক্ষেত্রে এ টুর্নামেন্ট নতুন এক ইতিহাস রচনা করে। এক্ষেত্রে মেয়েরা মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না। সেবারই প্রথম মহিলাদের জন্য আলাদা গ্যালারির ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারি ছিল পরিপূর্ণ। ইরাকের হারিস মোহাম্মদ, আদনান দারজাল, খলিল মোহাম্মদ, সৌদি আরবের ইশা গাওয়ারগি, দায়িশ মোহাম্মদ প্রমুখ তরুণীদের চোখে এঁকে দেন স্বপ্নের অঞ্জন। সাহসী তরুণীদের ঠোঁটের আগ্রাসী ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এই তরুণ ফুটবলাররা। ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসার ছোঁয়া বরাবরই বিদেশীরা পেয়ে এসেছেন। বলা যায়Ñ ফুটবল উন্মাদনার দিক দিয়ে সত্তর ও আশির দশকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় বাংলাদেশ। সে সময় ফুটবল ছিল হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। যেখানেই ফুটবল, সেখানেই মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে গেছেন। মজার ব্যাপার হলো, সে সময় আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের তেমন কোনো সাফল্য ছিল না। বিদেশী দলগুলোর সঙ্গে কাবগুলোর চমকপ্রদ নৈপুণ্য ও ফুটবলারদের ব্যক্তিগত ক্রীড়াশৈলী মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। টেনে নিয়েছে ফুটবল মাঠে। এ অবস্থা নব্বই দশকে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিলেও এরপর থেকে ফুটবলে প্রাণচাঞ্চল্য ও উন্মাদনা নেই বললেই চলে।
আশির দশক পর্যন্ত চলে আসা টইটম্বুর ও সম্মোহনী ফুটবল নব্বই দশকে এসে হঠাৎ যেন পথ হারিয়ে ফেলে। ফুটবলের ভরা গাঙে চর পড়তে শুরু করে। প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে স্থবির হয়ে পড়তে থাকে প্রাণোচ্ছ্বল ফুটবল। ফুটবল অনুরাগীরা হারিয়ে ফেলেন সেই আবেগ, উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা। অথচ নব্বই দশকে এসে ফুটবলের মুকুটে সংযোজিত হয় সাফল্যের পালক। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্যের মুখ দেখে। মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে মিয়ানমার চার জাতির ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৯৯৯ সালে সাফ গেমসের ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলেরও চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশের শক্তিমত্তাকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। সাফল্যের বিচারে আশি-উত্তর দশকই এগিয়ে থাকবে। কিন্তু জনপ্রিয়তা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে কোন সময়টাকে সেরা বলা যাবে? আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্য দেখানো সত্ত্বেও বর্তমানে ফুটবলের সেই আবেগ কোথায়? সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জে ওঠা সেই উন্মাদনা কোথায়? নব্বই দশকের আগে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য সেই সকাল থেকে মানুষের যে স্রোত নামতোÑ তা আজ কোথায়? মোহামেডান ও আবাহনীর খেলাকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে যে আবেগ, উচ্ছ্বাস ও প্রস্তুতি, তা কেন চুপসে গেল? এ প্রশ্নগুলো বিচার-বিশ্লেষণ এবং সাম্প্রতিক অবস্থায় অনুধাবন করা যায়Ñ ফুটবলের সেই সুদিন আজ নেই। আসলে নব্বই দশকের আগে যে প্রাণবন্ত, চিত্তাকর্ষক, গ্ল্যামারাস ও শৈল্পিক ফুটবলের সুধারস ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়-মন কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছে, সেই ফুটবল এখন আর নেই। মানুষ ফুটবল মাঠে ছুটে যেতে চায় তাৎক্ষণিক আনন্দে সিক্ত হতে; গতি, ছন্দ ও চোখ ধাঁধানো সৃষ্টিশীল ফুটবলের জারক রসে হৃদয়-মনকে পরিপূর্ণ করতে। সেই ফুটবল এখন আর মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না। এই না পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সব্যসাচী ফুটবলার অমলেশ সেন মনে করেন, তাঁদের সময়ের ফুটবলাররা অনেক বেশি স্কিল্ড ছিলেন। পাস, রিসিভিং, ড্রিবলিং, শুটিং অনেক বেটার ছিল। যদিও এখনকার ফুটবলাররা স্ট্যামিনার দিক দিয়ে আগের ফুটবলারদের চেয়ে এগিয়ে। টেকনিক্যাল দিক দিয়েও তাঁরা উন্নতি করেছেন। কিন্তু ফুটবলশৈলীর দিক দিয়ে বর্তমানকালের ফুটবলাররা অনেক পিছিয়ে আছেন। তবে বর্তমান সময়ের তারকা ফুটবলার-গোলকিপার মোঃ আমিনুল হক মনে করেন, ‘আগেকার তারকা ফুটবলারদের কোচ কোনো নির্দেশ দিতেন না। ফলে তাঁরা ইচ্ছেমত অনেকক্ষণ বল পায়ে রেখে খেলতে পারতেন। ড্রিবলিং করতেন। এখনকার ফুটবলারদের সে সুযোগ নেই। বর্তমান ফুটবলাররা গতিনির্ভর ওয়ানটাচ ফুটবল খেলছেন। তাই আগের মতো স্কিল্ড ফুটবলার চোখে পড়ে না।’ এই যুক্তিটা না হয় অনুধাবন করা গেল; কিন্তু ুযে প্রশ্নটা মনের মাঝে গুনগুনিয়ে ওঠে, তা হলোÑ ফুটবলের সেই আবেগটা কোথায় গেল?
দৈনিক সমকাল, ৬ ডিসেম্বর ২০০৫
ফুটবল ফিয়েস্তা
‘এ টাইম টু মেক ফ্রেন্ডস’ শ্লোগান নিয়ে আগামী ৯ জুন থেকে শুরু হচ্ছে ১৮তম বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবলের এই মহোৎসবে জার্মানীর ১২টি শহরে খেলবে ৩২টি দেশ। বিশ্বের ২০৩টি দেশের ফুটবল অনুরাগীদের মতো বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরাও রাত জেগে উপভোগ করবেন মাসব্যাপী ৬৪টি ম্যাচের এই ফুটবল ফিয়েস্তা।
ফুটবল খেলাটা মানবজাতির অগ্রগতির অন্যতম এক নিদর্শন। এই খেলাটির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্যসমূহ। জীবনের সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়েছে বলেই ফুটবল এই পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। কি ধনী, কি গরীব, কি শাদা, কি কালো, কি খ্রিস্টান, কি মুসলমানÑ সবার কাছে ফুটবল সমান আকর্ষণীয়। ফুটবল যদি শুধু বায়ুভর্তি একটি চামড়ার গোলক হতো, তাহলে তা পৃথিবীর প্রায় ৫০০ কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারতো না। ফুটবল, খেলার চেয়েও বেশি। ফুটবলপ্রেমীদের অব্যক্ত অনুভূতির চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সব্যসাচী লেখক জে.বি. প্রিস্টলির কথায় : ‘ফুটবল যদি শুধুই মাঠে বাইশটা ভাড়াটে লোকের একটা বলে লাথি মারা হয়, তাহলে বেহালাও শুধুমাত্র কাঠ আর তাঁত, হ্যামলেটও তাহলে কাগজের ওপর খানিকটা কালি।’ ফুটবলে যেমন আছে সুর-ছন্দ-নাটকীয়তা, তেমনি আছে রাগ-দ্বেষ-হিংস্রতা। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির চমৎকার সমন¦য় ঘটেছে ফুটবলে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিয়ত ফুটবল খেলা হলেও বিশ্বকাপের রূপ-মাধুর্যই আলাদা। সেই ১৯৩০ সালে শুরু হয়ে প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবল নতুন মাত্রা নিয়ে আসে। মহাযুদ্ধের কারণে দুটি আসর হারিয়ে গেলেও বিশ্বকাপ ফুটবলেই সুর হয়ে বাজে মিলনের মর্মবাণী। বিশ্বকাপ ফুটবল পৃথিবীর মানুষকে শান্তি-সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে বন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। চূড়ান্ত পর্বে সীমিতসংখ্যক দেশ খেললেও এর সঙ্গে কম-বেশি পৃথিবীর প্রতিটি দেশই একাÍবোধ করে। ফুটবলের চিরন্তন আবেদন ছাড়াও বিশ্বকাপ ফুটবল হয়ে উঠেছে মানব জাতির সর্বজনীন এক উৎসব। বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে বিভিন্ন দেশের চাওয়া-পাওয়াটা নানামুখী হলেও সবাই মেতে ওঠেন ফুটবলের অনাবিল আনন্দে। আর আনন্দ-বেদনার তো আলাদা কোন রঙ নেই। সঙ্গত কারণে একই রঙে, একই সুরে নেচে ওঠে সবার মন। আনন্দের প্রকাশটা হয়তো আলাদা। ইউরোপীয়রা রুটি, টাটকা মাছ, সসেজ বিয়ার সহযোগে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মূর্ছনায় উদ্বেলিত হন। আর লাতিনদের রক্তে সহজাতভাবেই দোলা দেয় নিজস্ব ঘরানার সঙ্গীত, নৃত্য ও ফুটবল। সে সঙ্গে সুরা তো আছেই। বিশ্বকাপ ফুটবলে বিভিন্ন সংস্কৃতিরও মেলবন্ধন ঘটে। পৃথিবীতে ছড়ানো-ছিটানো কত গান, কত ফ্যাশন, কত সংস্কৃতি। সাধারণত এ সবের সঙ্গে সবার খুব একটা পরিচয় হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে এর পাশাপাশি হরেক রকম উল্কি, ফ্যাশন ও বাহারী মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। একটি বিশ্বকাপ মানুষের জানাশোনার পরিধিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামু বলেছেন : ‘মানুষের দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা সম্পর্কে যা কিছু জেনেছি, তার জন্য আমি ঋণী ফুটবলের কাছে।’
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলে জৌলুস যেমন বেড়েছে, তেমনি ফুটবল খেলাও হয়েছে আরো গতিময়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুটবলেও এসেছে নতুন নতুন কৌশল। ভারতের ফুটবল কিংবদন্তী চুনী গোস্বামী যেমনটি বলেছেন, ‘একজন স্ট্রাইকার বলটা ঠিকভাবে রিসিভ করবেন, পাস দেবেন, ট্যাপ করবেন, ঠিকভাবে গোলে শট নেবেন। তেমনি ডিফেন্ডার যথাযথভাবে বল ট্যাকেল করবেন, বিপক্ষের ফুটবলারের কাছ থেকে বল কেড়ে নেবেন, ঠিকঠাক ডিস্ট্রিবিউশন করতে হবে তাকে। সা রে গা মাÑ সুরের সাত মাত্রার যাবতীয় অদলবদলে যেমন গান, তেমনি ফুটবলেও রিসিভিং, ড্রিবল, ট্যাকল, ট্যাপিং, শুটিং কয়েকটা প্রাথমিক জিনিসের ওপর ভিত্তি করেই যুগে যুগে নতুন নতুন স্ট্রাটেজি জন্ম নিয়েছে।’ প্রাথমিক শর্তগুলো ঠিক থাকলেও ফুটবল খেলার রূপ-রস-সৌন্দর্যে পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপীয় প্রযুক্তির ফুটবল আর লাতিন ঘরানার শৈল্পিক ফুটবলের মধ্যে বেশ তারতম্য পরিলক্ষিত হলেও উভয়ের উদ্দেশ্য কিন্তু অভিন্ন।
একটা বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে এত কিছু জড়ানো থাকে যে, তার থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে রাখা সহজ নয়। বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরের হলেও ফুটবলের সুর-ছন্দ ও চিরায়ত আবেদন থেকে আমরা মোটেও দূরে নই। এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদেরকে আবেগে আপ্লুত করে। আর আমরা অপেক্ষায় থাকি বিশ্বকাপ ফুটবলের।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ জুন ২০০৬
বিশ্বকাপ ফুটবল : অন্তহীন এক দীর্ঘশ্বাস
পৃথিবী নামক এক বিশাল ভূখ-ে যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কমপক্ষে ২০৪টি দেশ আছে, তা জানা সম্ভব হয়েছে ফুটবলের কল্যাণে। ভাবতেও অবাক লাগে, এত এত দেশ ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সদস্য! এর চেয়ে বেশি দেশ আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক আর কোনো সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত নেইÑ এটা অন্তত বলেই দেয়া যায়। সাধারণত নিজ দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানব কল্যাণ, শান্তি, নিরাপত্তাসহ নানা কারণে বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক রকমারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। অথচ দেখা যাচ্ছে, সর্বোচ্চসংখ্যক দেশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ফুটবলকে। এমনকি সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার জন্য জাতিসংঘকে গুরুত্ব না দিয়ে কোনো কোনো দেশ ফিফার সদস্য পদকে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করেছে। সব মিলিয়ে ফুটবলের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে অধিকসংখ্যক দেশ এবং অধিকসংখ্যক মানুষ। গত ১৭টি বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত আসরে কখনো না কখনো খেলেছে ৭২টি দেশ। এর মধ্যে এক বা দু’বার খেলেছেÑ এমন দেশের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। আর ঘুরেফিরে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাত্র সাতটি দেশÑ উরুগুয়ে, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। এবারের জার্মানি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলবে ইউরোপের ইউক্রেন, মধ্য আমেরিকার ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, আফ্রিকার আইভরি কোস্ট, অ্যাঙ্গোলা, ঘানা ও টোগো। নতুন নতুন দেশ খেললেও সম্ভবত এবারো শিরোপা সীমাবদ্ধ থাকবে বনেদি দেশগুলোর মধ্যে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭৬ বছরের ইতিহাসে চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে বা খেলবে ৭৮টি দেশ। এই সংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ থেকে দেশের সংখ্যা ২৪ থেকে ৩২-এ উন্নীত করায়। আর শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে শামিল হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ। অবশ্য অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশের স্বপ্ন থাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছানোর। কিন্তু সবার পক্ষে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর কিংবা কাছাকাছি সময়ে অংশ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে যুগোস্লাভিয়া, বেলজিয়াম, চিলি, প্যারাগুয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, সুইডেন, হাঙ্গেরি, হল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, মিসর, নরওয়ে, কিউবা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস প্রভৃতি দেশ আজ অবধি চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ইতোমধ্যে এ দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই পিছিয়ে পড়েছে এবং কোনো কোনো রাষ্ট্র ভেঙেচুরে জন্ম নিয়েছে নতুন দেশে। নবীন অনেক দেশ এগিয়ে এসেছে বিশ্ব ফুটবলের নতুন শক্তি হিসেবে। সবার পক্ষে শিরোপা জয় করা সম্ভব না হলেও চূড়ান্ত পর্বে খেলা এবং শিরোপা জয়ের স্বপ্নে মশগুল থাকাটা তাদের জন্য অনুপ্রেরণার বড় এক উৎস।
পৃথিবীর প্রায় ছয়শ’ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রতিটি বিশ্বকাপে খুব বেশি হলে একশ’ কোটি লোকের প্রতিনিধিত্ব থাকে (অবশ্য চীন খেললে সংখ্যাটা এক লাফেই হয়ে যায় দ্বিগুণ)। বিশ্বকাপ ফুটবল তাদের কাছে আনন্দের উপলক্ষ হয়ে আসে। বাদবাকিদের কাছে বিশ্বকাপ ফুটবল অন্তহীন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০ নম্বরে। বাংলাদেশের ফুটবলের অগ্রগতির যে ধারা, তাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার চিন্তা করাটাও অসম্ভব এক কল্পনা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফুটবলেই বাংলাদেশ নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। বরং এক সময়ের অভূতপূর্ব জনপ্রিয় ফুটবল এখন মন্থর ও ম্লান হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ফুটবল এখন আর দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারে না। এ অবস্থায় চার বছর পর পর যখন বিশ্বকাপ ফুটবল দুয়ারে কড়া নাড়ে, তখন একটা মর্মযাতনায় ভুগতে থাকেন এদেশের ফুটবল অনুরাগীরা। কেননা, বিশ্বকাপ ফুটবল তাদের কাছে এক অধরা স্বপ্নের নাম। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কখনো খেলার তো প্রশ্নই আসে না, অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আর কোনো কিছুতে সম্ভাবনা না থাকলে তা নিয়ে আগ্রহ থাকারও কথা নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীরা। দেশের ফুটবল নিয়ে অভিমান ও মর্মবেদনা থাকলেও ফুটবল থেকে তারা মোটেও দূরে থাকতে রাজি নয়। ফুটবলে আছে রূপ-রস-সৌন্দর্য ও সুষমা। আছে আবেগ-উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা। আর এসবের প্রতি এদেশের মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। ফুটবলের রূপসাগরে ডুব দিয়ে তারা খুঁজে পান ‘অন্তর মম বিকশিত কর’-এর হীরা-জহরত ও মণি-মাণিক্য। অমূল্য এই অধরা সম্পদ ফুটবল ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? তাই এদেশের ফুটবল ঝিমিয়ে পড়লেও এদেশের মানুষের হৃদয়ে কিন্তু ফুটবলের জন্য লাল গালিচা বিছানো। ফুটবলে একটুখানি টোকা পড়লে তাদের দারুণভাবে দুলিয়ে দেয়। বিশ্বকাপ ফুটবল তো রসের আকর আর রূপের ডালি সাজিয়ে সমাগত হয়। রসগ্রাহী ও সৌন্দর্যপিয়াসী ফুটবল সমঝদারদের তখন বাঁধন-ছেঁড়া না হয়ে উপায়ই-বা কি। স্বভাবতই বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যতই আক্ষেপ, দীর্ঘশ্বাস ও না পাওয়ার বেদনা থাকুক না কেন, ফুটবলের এই মহোৎসব থেকে তো দূরে থাকার উপায় নেই।
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জুন ২০০৬
আমাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের পায়ে পায়ে এ অঞ্চলে ফুটবল এলেও বিনোদনের সস্তা উপকরণ হিসেবে ফুটবল খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জটিলতাহীন এ খেলাটিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজেই আপন করে নেয়। সহজ-সরল লোকায়ত জীবনযাত্রার বিনোদনের নির্মল বাহন হয়ে ওঠে ফুটবল। ফুটবলের ইতিহাস এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্রিটিশদের রাজত্বকাল বিচার-বিশ্লেষণ করলে এ অঞ্চলের মানুষ ফুটবল নিয়ে গর্ব করতেই পারে। প্রায় আড়াইশ’ বছর ধরে এ অঞ্চলে ঘটা করে ফুটবল খেলা হয়ে আসছে। এতটা বছর খেলা হওয়ার পর বলা যায়, ফুটবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যে পরিণত হলেও ফুটবল নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ খুব বেশি গর্ব করতে পারেন না। যদিও গৌরব করার মতো কিছু কিছু মাইলফলক রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। আধুনিক ফুটবলের জন্মদাতা ব্রিটিশদের সঙ্গে টেক্কা মারার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এ অঞ্চলের হত-দরিদ্র মানুষ। দেশভাগের আগ পর্যন্ত কলকাতা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র। ব্রিটিশদের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ফুটবলারদের চোখ জুড়ানো নৈপুণ্যে উদ্ভাসিত হয়েছে আইএফএ শীল্ড, কোলকাতা ফুটবল লীগসহ জনপ্রিয় ফুটবল আসরসমূহ। সঙ্গত কারণে তাতে ছিল গোরাদের একচেটিয়া আধিপত্য। কিন্তু একদম ছেড়ে কথা কয়নি এ অঞ্চলের অসহায় ও নিঃস্ব মানুষেরা। রাজনৈতিক মঞ্চে তারা যেমন রুখে দাঁড়িয়েছেন; অনুরূপভাবে ফুটবল মাঠেও তারা গড়ে তোলেন শক্ত প্রতিরোধ। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের আইএফএ শীল্ড জয় তো অসাধারণ কীর্তি হয়ে আছে। ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের শ্বেতাঙ্গদের ২-১ গোলে হারিয়ে ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে দেয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কালো মানুষেরা। কোলকাতা লীগে মোহামেডান, মোহনবাগান ও ইস্ট বেঙ্গল কাবের সাফল্য তো অনেকটা রূপকথার মতো। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর লীগ শিরোপা জিতে অবিস্মরণীয় এক ঘটনার জন্ম দেয় মোহামেডান। ১৯৩৬ সালে তারা একই সঙ্গে জয় করে আইএফএ শীল্ড। সে সময়টা মোহামেডানের স্বর্ণযুগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৩৭ সালে ঢাকা সফরকারী ইংল্যান্ডের এএফসি কোরিন্থিয়ান্স কাবকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন। জয়সূচক একমাত্র গোলটি করে পাখী সেন। কোরিন্থিয়ান্সের সেবারের সফরে তারা একমাত্র ঢাকায় পরাজিত হয়। বিশ্ব ফুটবলের প্রভাবশালী একটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দি¡তা গড়ে তুলে কখনো-সখনো জয়ের মুকুট মাথায় দেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এ অঞ্চলের ফুটবলাররা। ফুটবল জাদুকর সামাদ তো বিশ্ব ফুটবলের এক চমকপ্রদ কিংবদন্তি। খেলার মাঠে খামখেয়ালিপনা, গোল করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা আর কীর্তিগাথা দিয়ে ফুটবলে অমর হয়ে আছেন তিনি। জন্ম দিয়েছেন বিস্ময়কর সব ঘটনার। এমন ফুটবলার বিশ্ব ফুটবলে বিরল। এত উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কেন জানি অনুজ্জ্বল হয়ে আছে। অথচ গত ২০০/২৫০ বছর আন্তর্জাতিক মানচিত্রে অস্তিত্ব ছিল নাÑ এমন অনেক দেশ এবং যেসব দেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক পরে ফুটবলে হাতেখড়ি নিয়েছে, তারাও ঢের ঢের এগিয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়ে উঠেছে বিশ্ব ফুটবলের মস্ত শক্তি। তারা দ্রুত এগিয়ে গেলেও ফুটবলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। এই পিছিয়ে পড়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট একটা বড় কারণ হতে পারে। কিন্তু আফ্রিকার অন্ধকার থেকে ওঠে আসা ফুটবলাররা যখন বিশ্ব ফুটবলকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন, তখন অর্থনৈতিক বিষয়টি খুব বেশি ধোপে টেকে না। আসলে তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফুটবল পিছিয়ে পড়াটা অন্তহীন এক রহস্য হয়ে আছে। আর এই রহস্য উন্মোচন করা না গেলে এ অঞ্চলের ফুটবলের গন্তব্য অনিশ্চিত হয়ে থাকবে।
১৯৩০ সালে ফুটবল প্রবর্তনের পর বিশ্বকাপ ইতোমধ্যে ৭৬ বছর পেরিয়ে এসেছে। এখন অবধি বিশ্ব ফুটবলে অপাংক্তেয় হয়ে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলা তো দূরে থাকুক, তার কাছাকাছি যাওয়াও একটা বড় দুঃস্বপ্ন। এ অবস্থায় প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য অস্বস্তি নিয়ে আসে। বিশ্বকাপে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও ব্যতিক্রম এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। কেননা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১৫০ কোটি লোকের বিশ্বকাপে কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও বিশ্বকাপের রসাস্বাদন থেকে তো আর বঞ্চিত হওয়া যায় না। তাই বিশ্বকাপের কোনো না কোনো দল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের প্রিয় দল হয়ে ওঠে। সেই দলকে কেন্দ্র করে পল্লবিত হয় তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। প্রিয় দলের সাফল্য ও ব্যর্থতা হয়ে ওঠে নিজ দলের সাফল্য ও ব্যর্থতা। নিজ দেশের খেলতে না পারার যে কষ্টকর অনুভূতিÑ তা থেকে অন্তত কিছুটা ভুলে থাকা যায়। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি! এছাড়া কীইবা করার আছে দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার হতভাগ্য ফুটবল অনুরাগীদের?
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১৬ জুন ২০০৬
কর্পোরেট সংস্কৃতির বিশ্বকাপ ফুটবল
মহাকাব্যিক সৌন্দর্য ও সুষমা নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের মনকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। রাত জেগে জেগে আমরা উপভোগ করছি বিশ্ব ফুটবলের সৌন্দর্য-সুধা। খেলার ফলাফল ও নানা ঘটনায় আমরা কখনো আনন্দিত হয়েছি, কখনো হচ্ছি বেদনার্ত। আর এই আনন্দ-বেদনার নির্যাসটুকু আমাদের একঘেয়েমি জীবনে নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করছে। এক জীবনে আমরা কতটুকুই বা দেখতে বা জানতে পাই। অল্প কিছু সৌভাগ্যবানকে বাদ দিলে এ জীবন তো অপূর্ণতায় ভরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরই জীবন শাদা-কালো। যে জীবনে খুব বেশি বৈচিত্র্য নেই। কিন্তু একটি বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের জীবনে নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে আসে। জীবনটাকে খানিকটা রাঙিয়ে দিয়ে যায়। অনেকখানি পূর্ণ করে দেয় অভিজ্ঞতার ভা ারকে।
আমাদের মতো হতমানদের কথাই শুধু বলি কেন, বিশ্বকাপ ফুটবল এই পৃথিবীর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। সভ্যতার অন্যতম এক নিদর্শন। পৃথিবী নামক গ্রহটি যে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে এবং একটি সিস্টেমে চলছে, তা অনুধাবন করা যায় বিশ্বকাপ ফুটবলের সামগ্রিক কর্মকাে । পৃথিবীতে ২০৭টি দেশ আছে, সেটা আমরা জানতে পারি ফিফার সদস্য সংখ্যা দেখে। ফিফা ছাড়া আর কোনো সংস্থার সদস্য এতগুলো দেশ নেই। সদস্যগুলো শুধু নামেই তাদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেÑ সেটা ভাবা ভুল হবে। প্রতিটি দেশই বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নিয়ে থাকে। চূড়ান্ত পর্বে ৩২টি দেশ খেললেও এর আগে প্রায় দু’বছরব্যাপী যে বাছাই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সবগুলো দেশকে খেলতে হয়। যে প্রক্রিয়ায় এই বাছাইপর্ব হয়ে থাকে, তা অভাবিত ও অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। কোথাও সিস্টেমের নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। সবাইকে ফিফার নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয় কঠোরভাবে। হতে পারেন তিনি বিশ্বের সর্বময় কর্তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, হতে পারেন তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানÑ কারো কোনো কর্তৃত্ব ফিফার কাছে পাত্তা পায় না। বোধকরি ফিফা যে কর্তৃত্বে ও সিস্টেমে বিশ্ব ফুটবল পরিচালনা করে থাকে, তেমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। এই সিস্টেমটি অন্যান্য ক্ষেত্রে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে সম্ভবত এই পৃথিবীর চেহারা অনেকখানি বদলে যেত।
তবে ফিফার কার্যক্রম যে একদম ধোয়া তুলশি পাতা তা অবশ্য বলা যাবে না। কাড়ি কাড়ি টাকার লেন-দেন যেখানে হয়ে থাকে, সেখানে কিছু উল্টা-সিধা না হয়ে পারে না। তাছাড়া কর্পোরেট সিস্টেমে ফিফা চালাতে গিয়ে কিছু কিছু নিয়ম-নীতি ও আদর্শ যে বিসর্জন দিতে হয় নাÑ তাও জোর গলায় বলা যাবে না। বিশাল আয়ের পথ সুগম রাখতে গিয়ে অনেক সময়ই জেনে-শুনেই কাঁটা গিলতে হয়। এ কারণে ফিফার বিপক্ষে নানা অভিযোগ, সমালোচনা ও গুঞ্জন। কর্পোরেট হাউজের রাঘব-বোয়ালদের ইঙ্গিতে গোপনে গোপনে পাল্টে যায় কত কিছু। কর্পোরেট সংস্কৃতির রমরমা ভাবটা আমরা দেখতে পেলেও ভেতরে ভেতরে এর যে কদর্য রূপÑ তা আমাদের অগোচরে থেকে যায়। অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলো। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে স্বাগতিক দলের সঙ্গে খেলায় সুপারস্টার রোনালদোর অসুস্থতা ও অনুজ্জ্বল পারফরমেন্স অন্তহীন এক রহস্য হয়ে আছে। কর্পোরেট সংস্কৃতির কাঠামো এতটাই সুদৃঢ় যে, আজ পর্যন্ত সেই রহস্যের উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিটি বিশ্বকাপেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে। অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে শেষ মুহূর্তে উল্টে যায় পাশার দান।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলেও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে। শাদা চোখে যা অনুধাবন করা যায় না। কাক্সিক্ষত দেশগুলোকে নানা কৌশলে পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বে অস্ট্রেলিয়াকে যেভাবে হারিয়ে ইতালিকে পরবর্তী রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া হয়, তা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। ইউরোপ থেকে অন্য মহাদেশের কাপ জয় করাটা খুব একটা সহজ নয়। খেলার নৈপুণ্য দিয়ে সাফল্য পেলে কারো কিছু বলার থাকে না। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে স্বাগতিক জার্মানিকে কাপটা তুলে দিতে পারলে ফিফার কর্তারা খুশি হবেন। অবশ্য এ ধরনের অনুমানভিত্তিক কিছু লেখাটা শোভনীয় নয়। জার্মানি তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং এবার তারা খেলছেও ভালো। তাদের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখা মোটেও উচিত নয়। তবে মন বলে একটা ব্যাপার আছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেই মন বলছে, এবার কাপটা থেকে যাবে ইউরোপেই। সেটা যেভাবেই হোক। এমনিতেই কর্পোরেট সংস্কৃতি ফুটবলের ছন্দ, সুষমা ও লাবণ্য শুষে নিচ্ছে, তারপর যদি আগেই চ্যাম্পিয়নশীপ নির্ধারণ হয়ে থাকে, তা হবে বিশ্ব ফুটবলের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তেমনটি না হলে আমরা অবশ্যই খুশি হবো।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ জুলাই ২০০৭
সর্বজনীন উৎসব বিশ্বকাপ ফুটবল
এই পৃথিবীতে উৎসবের কোনো কমতি নেই। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে হরেক রকম উৎসব। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সর্বজনীন কোনো উৎসব নেই, যে উৎসবকে কেন্দ্র করে সবাই একই সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠতে পারে। দুনিয়ার তাবৎ মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি বিশ্বজনীন উৎসব হলে মন্দ হতো না।
তবে বিশ্বকাপ ফুটবলকে বিশ্বজনীন উৎসব বলাই যেতে পারে। ফুটবল এমন একটি খেলা, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষের প্রিয়। পৃথিবীর এমন এলাকা খুব কমই আছে যেখানে ফুটবল খেলা হয় না। এই গ্রহের ৬০০ কোটি লোকের প্রায় ৫০০ কোটি লোকই ফুটবল ভালোবাসেন। কোটি কোটি লোক ফুটবল খেলায় অংশ নেন এবং তার চেয়েও বেশি লোক ফুটবল খেলা দেখতে পছন্দ করেন। ফুটবলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ এটি সহজ ও অ-জটিল একটি খেলা। ফুটবল খেলার জন্য খুব বেশি সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই। একটি বল কিংবা গোলাকৃতির শক্ত কিছু হলেই ফুটবল খেলা যায় কিংবা ফুটবলের আনন্দে মেতে ওঠা যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সী মানুষই ফুটবল খেলতে পারেন। এমনকি খেলতে পারেন মেয়েরাও। ক্রিকেট খেলায় অনেক সরঞ্জামাদি লাগে। বাস্কেটবলে দীর্ঘদেহী না হলে খুব বেশি সুবিধা করা যায় না। ফুটবলে তেমন অর্থ লাগে না। আবার সুপারম্যানও হওয়ার প্রয়োজন নেই। ফুটবলের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলোÑ বিশ্ব জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠই দরিদ্র। অপুষ্টিজনিত কারণে তাদের শারীরিক গড়ন আশানুরূপ না হলেও তাতে কিছু যায় আসে না। দরিদ্র ও অপুষ্ট দেহের জীর্ণ-শীর্ণ মানুষেরা ফুটবল খেলতে পারেন। এ যাবৎ কিংবদন্তী ও বিশ্বসেরা যেসব ফুটবলার উঠে এসেছেন, তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আসলে ফুটবল খেলায় ধনী ও গরিবের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকে না। ফুটবল খেলায় দেখতে পাওয়া যায় সৌন্দর্য, উন্মাদনা, নৈতিকতা ও সামাজিক পরিবর্তন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফুটবল সংস্কৃতিতে খুব বেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ফুটবল খেলা নিয়ে কোথাও উন্মাদনার কমতি নেই। বুয়েন্স এয়ারসের ট্যাক্সি ড্রাইভার, রিও ডি জানেরিও’র পানশালার পরিবেশিকা, লন্ডনের পাতাল ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট কিংবা ঢাকার গার্মেন্ট শ্রমিকÑ সবার কাছে ফুটবল খেলা সমান আকর্ষণীয় ও আদরণীয়। ফুটবলের গন্ধ পেলে নেচে ওঠে সবারই মন-প্রাণ। তবে দেশে দেশে আনন্দ বা উদযাপনের ভঙ্গিমা হয়তো আলাদা। লাতিন আমেরিকায় কিংবা ইউরোপে সামনা-সামনি সম্ভব না হলে দর্শকরা পানশালা কিংবা ক্যাফেতে টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ব্রাজিলের রিও থেকে আমাজন পর্যন্ত পুরো দেশ ফুটবলের মাদকতায় সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো চলকে চলকে ওঠে। ফুটবল উপচে পড়ে সুরে, আতশবাজিতে, পতাকায়, সংবাদপত্রে। নিজের দেশ কিংবা প্রিয় কাব পরাজিত হলে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন ব্রিটিশরা। রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। এই আচরণ কি ফুটবলের, নাকি কেবলই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি? অবশ্য ফুটবলকে একেকজন একেকরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে থাকেন। ব্রাজিলীয় কিংবদন্তী পেলে ফুটবলকে অভিহিত করেছেন ‘দি বিউটিফুল গেম’ হিসেবে। আবার ডাচ কোচ রাইনাস মিসেলস মনে করেন ‘ফুটবল একটি যুদ্ধ’। এ বিতর্কে না গিয়ে বাংলাদেশের দর্শকরা রাত জেগে ঘরোয়া পরিবেশে উপভোগ করেন ফুটবলের উত্তেজনাপূর্ণ নান্দনিক সুষমা।
বিশ্বায়নের খোলা দুয়ার দিয়ে চলছে মুক্ত অর্থনীতি ও মুক্ত বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা। এ থেকে ফুটবলও খুব বেশি দূরে নয়। এক দেশের ফুটবলার খেলছেন আরেক দেশে। ফুটবল মাঠে ঘুচে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক বিভেদ, গড়ে উঠছে ‘বিশ্ব সংস্কৃতি’। কোনো কোনো দেশে ফুটবল খেলার চেয়েও বেশি কিছু। এটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ফুটবল একটি শিল্প। সঙ্গীত, নৃত্য ও ফুটবল ছাড়া ব্রাজিলিয়ানরা ভাবতেই পারেন না। ব্রাজিলীয় ফুটবলের সোনার ছেলে রোনালদিনহোর কথা যে কারো হৃদয়ে মধুর আবেশ ছড়িয়ে দেবে : ‘আমরা তো এমনই, মুখে হাসি নিয়ে জন্মাই। এভাবেই জীবন কাটিয়ে দেই। কারণ দিন শেষে ব্রাজিলিয়ানরা খুব সুখী মানুষ। সবচেয়ে যা ভালোবাসি, তা-ই করি আমরা। আর সেটা হলো ফুটবল খেলা।’ কম-বেশি সব ব্রাজিলিয়ানের মনোভাবটাই এমন। ফুটবল শুধু উৎসবের উপলক্ষ এনে দেয় না, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানলেও ফুটবল নিয়ে যে কারো সঙ্গে কথা বলাটা সমস্যা নয়। ফুটবলের ভাষা একটি। এ ভাষার মর্মার্থ যে কেউ অনায়াসে বুঝে নিতে পারেন। ব্রাজিলের রোনালদিনহো, ক্যামেরুনের স্যামুয়েল ইতো, আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, সুইডেনের হেনরিক লারসেন, পর্তুগালের ডেকো, মেক্সিকোর রাফায়েল মারকুয়েজ, স্পেনের কার্লোস পুয়োল, হল্যান্ডের জিওভানি ফন ব্রোঙ্কহর্স্ট কিংবা ফ্রান্সের লুডোভিক জুলির ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ আলাদা হলেও তারা স্পেনের বার্সেলোনার হয়ে যখন খেলেছেন, তখন তাদের সবকিছু মিলেছে একই মোহনায়। আর এ কারণেই বার্সেলোনা স্প্যানিশ লীগ এবং ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে। খেলার মাঠে বিভিন্ন ফুটবলার ও দেশকে একত্রিত করে ফুটবল।
ফুটবল একটি ধর্মও। আর এই ধর্মের মূল কথা হচ্ছেÑ মিলবে আর মেলাবে। মানুষের মিলনের চেয়ে আর কোনো বড় ধর্ম নেই। সাম্য, মৈত্রী ও মিলনের গান গাওয়ায় ফুটবল হয়ে উঠেছে বিশ্বের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব। আর এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন। ৩২টি দেশ চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও বাছাই পর্বে অংশ নেয় প্রায় প্রতিটি দেশ। বাছাই প্রক্রিয়াটা এক ধরনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের মতো। এটি যখন শুরু হয়, তখন থেকেই তো বিশ্বকাপ ফুটবলের উৎসবে রঙ লাগতে থাকে। চূড়ান্ত পর্বে এটি পূর্ণতা পায়। যে কারণে চূড়ান্ত পর্বে সেরা দলগুলো খেললেও বিশ্বকাপে ফুটবলের বাছাই পর্বে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশেই উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া বিনোদনের চমৎকার একটি মাধ্যম হিসেবে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা। ৯০ মিনিটের এ খেলায় যে কাউকে পৌঁছে দেয় জাদুময় এক জগতে। এমন একটি মোহময় জগতের বাসিন্দা কে না হতে চায়?
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল টেলিভিশনে দেখবেন বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোক। এটা তো একটি স্বপ্নীল ব্যাপার! পৃথিবীর আর কোনো উৎসব কি আছেÑ যেখানে এত এত লোককে একই সঙ্গে উৎসবের আনন্দে ভাসিয়ে দিতে পারে? বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে চন্দ্র-সূর্যের আবর্তনও বোধকরি একাকার হয়ে যাবে! কেননা, পৃথিবীর সকাল-দুপুর-রাতগুলো মিলিত হবে একই বিন্দুতে। একই সময় বিশ্বের তাবৎ ফুটবল অনুরাগী একই সঙ্গে উপভোগ করবেন ফুটবল ফিয়েস্তা। তারা সমভাবে আনন্দিত কিংবা বেদনার্ত হবেন, দোলায়িত হবেন একই সুরে, একই ছন্দে।
দৈনিক আজকের কাগজ, ৭ জুন ২০০৭
ঢাকার ফুটবল অন্ধকারে ঢাকা
একটা সময় রাজধানী ঢাকার পরিচয় ছিল ফুটবলের নগরী হিসেবে। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় এ অঞ্চলের ফুটবল। শুরুটা হয় ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনীকে কেন্দ্র করে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয়দের মাঝে। ফুটবলকে ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন কাব। উপমহাদেশের প্রাচীন কাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকার ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব, ইস্টএন্ড কাব, লক্ষ্মীবাজার কাব, ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান প্রভৃতি। এ কাবগুলো শুধু এ অঞ্চলের ফুটবলকেই বিকশিত করেনি, সেই আমলে কলকাতা ফুটবলের রাজধানী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানও রেখেছে। অনেক খ্যাতিমান ফুটবলার ও সংগঠক গড়ে তোলার সূতিকাগার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় আলাদাভাবে স্থান করে নেয় এ কাবগুলো। তবে ঢাকার ফুটবলকে শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়ে দেয় ১৯৩০ সালে গঠিত ‘ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন’। এ এসোসিয়েশন গঠনের পর ঢাকার ফুটবলে সৃষ্টি হয় প্রাণচাঞ্চল্যের। ১৯৩৭ সালে ঢাকা সফরকারী শক্তিশালী ব্রিটিশ ফুটবল দল ইলিংটন কোরিন্থিয়ান্সকে পাখী সেনের গোলে হারিয়ে মাইলফলক স্থাপন করে ‘ঢাকা একাদশ’।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার ইতিহাসখ্যাত ঢাকা শহর। পশ্চিম পাকিস্তান, সমগ্র পাকিস্তানের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু হলেও ফুটবলটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম আকর্ষণ। এ কারণে দেশভাগের ফলে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেলেও ঢাকায় ফুটবল শুরু হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালেই প্রবর্তন করা হয় ঢাকা ফুটবল লীগ। এ লীগ জনপ্রিয়তা অর্জন করে অত্যন্ত দ্রুত। ভিক্টোরিয়া, ইপি জিমখানা, ওয়ান্ডারার্স, ইপিজি প্রেস, আজাদ স্পোর্টিং, মোহামেডান, ইপিআইডিসির মতো কাবগুলো উন্নতমানের ক্রীড়াশৈলী দিয়ে ফুটবলানুরাগীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। এ কারণে ঢাকা লীগে অংশ নেয়ার জন্য কলকাতা এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও ছুটে আসেন অনেক নামজাদা ফুটবলার। ঢাকার ফুটবলের মায়াবী টানে অনেকের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যায় ঢাকা নগরী। সঙ্গত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে ঢাকা। ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে ঢাকায় আয়োজিত হয় পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জাতীয় ফুটবলের ভেন্যু হিসেবে ঢাকাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ১৯৫৫ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রথম স্বাদ পায় ঢাকা। বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং পাকিস্তানকে নিয়ে আয়োজন করা হয় কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট। তবে ঢাকার ফুটবলে নতুন মাত্রা যোগ করে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল। ১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রতিযোগিতা ঢাকার ফুটবলে এনে দেয় আন্তর্জাতিক ফেবার। ১০০ ভরি ওজনের এই কাপের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দূরÑদূরান্তে। আগা খান গোল্ডকাপে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সেরা দলগুলো ছাড়াও অংশ নেয় ভারত, ইরান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, নেপাল, বার্মা (হালের মিয়ানমার), ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের জাতীয় কিংবা কাব দল। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আরসিডি ফুটবলে অংশ নেয় ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও বঞ্চনা সত্ত্বেও ফুটবল নগরী হয়ে উঠতে ঢাকার সামনে কোনো কিছুই প্রতিকূলতা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এর কারণ ছিল, এ অঞ্চলের মানুষের ফুটবলের প্রতি সহজাত ভালোবাসা এবং দীর্ঘ ফুটবল ঐতিহ্য।
১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের ফুটবলে নামে বাঁধ ভাঙা জোয়ার। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও ফুটবলটা টপ-প্রায়োরিটি লিস্টেই থাকে। স্বাধীন দেশের পথ চলা শুরু হয় আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালোবাসা আর ফুটবল নিয়ে। ১৯৭২ সালেই ঘরোয়া ফুটবলের প্রধান আকর্ষণ ঢাকা ফুটবল লীগের যাত্রা শুরু হয়। এর পাশাপাশি শুরু হয় ‘শের-এ-বাংলা কাপ’ নামে পরিচিত জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা এবং ‘সোহরাওয়ার্দী কাপ’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় যুব ফুটবল প্রতিযোগিতা। পরবর্তীকালে ‘পাইওনিয়ার লীগ’ প্রবর্তন করা হলে ঢাকার অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়ে ফুটবল। বিশেষ করে ঢাকা লীগের দুই প্রধান শক্তি মোহামেডান স্পোর্টিং কাব এবং আবাহনী ক্রীড়াচক্রকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পুরো দেশ। উৎসবের প্রতীক ছিল সাদা-কালো আর হলুদ-আকাশী রঙ। নিত্য-নৈমিত্তিক ভাংচুর এবং কালে-ভদ্রে দু’একটি জীবন ঝরলেও ফুটবলটা কখনো বিতৃষ্ণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। নানা ঝঞ্ঝাট ও দুর্ঘটনা সত্ত্বেও ঢাকার নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিকতার অংশ হয়ে যায় ফুটবল। ফুটবলকে উপলক্ষ করে খোলামকুচির মতো উড়তে থাকে টাকা। সেরা দল গড়ার জন্য অর্থটা কোনো ফ্যাক্টরই ছিল না। মোহামেডান কিংবা আবাহনী কাবের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃত্ত হতে পারাটাই ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। ঢাকা লীগের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির মধুতে আকৃষ্ট হয়ে মৌমাছির মতো দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসতে থাকেন ভিনদেশী ফুটবলাররা। এমনকি এর প্রলোভন এড়াতে পারেননি বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলাররা পর্যন্ত। তখন ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠাটা ছিল অনেক কিশোর ও তরুণের স্বপ্ন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থানটাও ছিল অত্যন্ত মধুর। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ পাওয়াটা ছিল নিয়মিত ব্যাপার। ফলাফলটা আশাব্যঞ্জক না হলেও বাংলাদেশকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ ছিল না। এর পাশাপাশি ‘আগা খান গোল্ডকাপ’ এবং পরবর্তীকালে আগা খান গোল্ডকাপের পরিবর্তে চালু হওয়া ‘প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ’ ঢাকার ফুটবলের খান্দানের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপীয় ধাঁচের অবকাঠামো কিংবা সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও ফুটবল নগরী হওয়ার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ঢাকা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর এ কারণেই ১৯৭৮ সালে ঢাকায় বসে ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল প্রতিযোগিতার কোয়ালিফাইং রাউন্ড। ১৮টি দেশ নিয়ে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতা বোধ করি বাংলাদেশের সেরা ‘ফুটবল ফিয়েস্তা’ হয়ে আছে। উন্নতমানের আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন ছাড়াও ঢাকায় এসেছে সাড়া জাগানো অনেক খ্যাতিমান জাতীয় এবং কাব পর্যায়ের ফুটবল দল। ফুটবল খেলাটা শুধু বিনোদনের উপকরণ হিসেবেই নয়, ঢাকা শহরের একটা পরিচিতির অংশ হয়ে যায়। আর এ পরিচয়ের জন্য ঢাকাবাসীরা ছিলেন গর্বিত ও আনন্দিত।
নব্বই দশকের শুরু থেকে ফুটবলকে নিয়ে ঢাকার এ পরিচয়টা আস্তে-ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। অনিয়মটা একটু একটু করে উঁকি মারতে থাকে তখন থেকেই। সভ্যতা যে কাঁটা মেপে এগিয়ে চলেছেÑ এটা অনুধাবন করা যায় চলমান ঘড়ি এবং ইউরোপীয় ফুটবল লীগের নিয়মিত আয়োজন দেখে। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো সামান্য এদিক-সেদিক হতে পারে; কিন্তু ইউরোপীয় কোনো লীগের এক চুলও হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্য দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ সারা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিলে এবং এর সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় সবকিছুই যখন এলোমেলো হয়ে যায়, তখন অবশ্য সাময়িকভাবে থমকে দাঁড়াতে হয় ইউরোপীয় লীগকে। নতুবা যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে যাক না কেন, ফুটবল লীগ নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠিত হবেই। ১৮৭১ সালে শুরু হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফুটবল প্রতিযোগিতা এফএ চ্যালেঞ্জ কাপ, ১৮৮৮ সালের ইংলিশ ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল লীগ, ১৮৯৮ সালের ইতালীয় সিরি এ লীগ, ১৯০২ সালের জার্মানির বুন্দেশ লীগ, ১৯২৮ সালের স্প্যানিশ লীগ, ১৯৩২ সালের ফ্রেঞ্চ লীগকে বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া থামানো সম্ভব হযনি। অথচ যে ফুটবল লীগটা এই ঢাকা শহরকে আলাদা একটা পরিচয় এনে দিয়েছে, সেই লীগ সময়মত তো দূরে থাকুক, প্রতি বছর আয়োজন করাই সম্ভব হয় না। ১৯৮৭ সালের পর থেকে লীগটা অনিয়মিত হয়ে যায়। একই সঙ্গে ১৯৮৭ সাল থেকে অনেকটা দ্বিবার্ষিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে ‘শের-এ-বাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল’। গত দু’দশকে ২০ বার আয়োজনের কথা থাকলেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ১১ বার। ফুটবলারদের উঠে আসার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত পাইওনিয়ার লীগের ‘জীবন’ থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেলেও ‘সোহ্রাওয়ার্দী কাপ জাতীয় যুব ফুটবল’ অনেকটা বিলীন হতে চলেছে। এমনিভাবে ফুটবলের লালনক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত নিয়মিত আসরগুলোর ‘পঞ্চত্বপ্রাপ্তি’ ঘটছে। সঙ্গত কারণেই স্তিমিত হয়ে পড়েছে ঢাকার ফুটবল।
প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের পর ঢাকায় নিয়মিতভাবে আর কোনো আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং আন্তর্জাতিক মানসম্মত অনেক ফুটবল দল ঢাকায় এলেও ফুটবল তার জৌলুস ও গ্ল্যামার অটুট রাখতে পারেনি। ফুটবল তার প্রাণচাঞ্চল্য ও ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলার অনেক কারণের মধ্যে প্রধান হচ্ছে সাংগঠনিক ব্যর্থতা। নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসায় ফুটবল এখন পরিণত হয়েছে সুুবিধাবাদীদের হাতিয়ারে। মূলত তাদের কারণেই ঢাকার যে ফুটবল ছিল আলোয় ঝলমল, তা এখন অন্ধকারে ঢাকা। তবে এটা তো ঠিক, অন্ধকার কখনো স্থায়ী হয় না। শুধু এ নগর নয়, এদেশের অধিকাংশ মানুষের বুকের মাঝে সযতনে ঘুমিয়ে আছে ফুটবলের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, একদিন তা নিশ্চয়ই জেগে উঠবে। তখন আবার আলোয় আলোয় হেসে উঠবে ঢাকার ফুটবল। আমরা সেদিনের অপেক্ষায়।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭
ছোট আকাশের বড় তারা
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড কিংবা সাঁতারের মতো খেলাগুলোর আকর্ষণ অন্যরকম। মানব সভ্যতা যে এগিয়ে চলেছে, এ দুটি খেলা দেখে তা অনেকাংশে অনুধাবন করা যায়। জলে এবং স্থলে প্রতিনিয়ত সময়কে জয় করার নিরন্তর প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে ১০ সেকেন্ডের নিচে নেমে আসাটা মানব সভ্যতার অন্যতম একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর এই বিস্ময়কর ঘটনার জন্ম দেন ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো সিটি অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিম হাইনস। এরপর তা নিয়মিত একটি বিষয়ে পরিণত করেছেন কার্ল লুইস, লিনফোর্ড ক্রিস্টি, ক্যালভিন স্মিথ, মরিস গ্রিন, জাস্টিন গ্যাটলিনরা। সর্বশেষ জ্যামাইকার আসাফা পাওয়েল যখন ৯ দশমিক ৭৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটার অতিক্রম করেন, তখন মনে হয় অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য মানুষের এই যে ছুটে চলা, তার শেষ কোথায়? কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানটা কোথায়?
অলিম্পিক গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশীপ, বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপ, এমনকি বাড়ির পাশের এশিয়ান গেমসের মতো আসরগুলো আমাদের কাছে হয়ে আছে দূরের আকাশ। এই আকাশের বাসিন্দা অ্যাথলেট রেমন্ড ইউইরি বা কার্ল লুইস কিংবা সাঁতারু মার্ক স্পিটজ বা ম্যাট বিয়ন্তির মতো মহাতারকারা আমাদের কাছে অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে আছেন। অলিম্পিক গেমসে ইউরির ১০ স্বর্ণ; স্পিটজের ৯ স্বর্ণ, ১ রৌপ্য, ১ ব্রোঞ্জ; কার্ল লুইসের ৯ স্বর্ণ, ১ রৌপ্য এবং ম্যাট বিয়ন্তির ৮ স্বর্ণ, ২ রৌপ্য ও ১ ব্রোঞ্জ শাশ্বত এক কীর্তি। বিশ্ব আসরে এমন কীর্তির বিপরীতে বাংলাদেশ নামক দেশটির কোনো অস্তিত্ব নেই। সুরিনাম নামক একটি অজ্ঞাত দেশের অজ্ঞাতকুলশীল সাঁতারু অ্যান্থনি নেস্টি অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণপদক জিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশের কাছে কীর্তির সেই পথ অন্তহীন এক দূরত্ব হয়ে আছে।
আমাদের আকাশটা খুবই ছোট। অথচ আমরাও তো সাফল্যের কীর্তিতে উদ্ভাসিত হতে চাই। এ কারণে আমাদের মতো পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে আমরা আকাশটাকে ছোট করে নিয়েছি। আর সেই আকাশের নাম ‘সাফ গেমস’Ñ হালের ‘এসএ গেমস’। এই আকাশের তারা হয়ে যারা উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন, তারাই আমাদের কাছে বড় তারা হয়ে আছেন। আমাদের মার্ক স্পিটজ হলেন মোশাররফ হোসেন খান। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের অনুজ্জ্বল ক্রীড়া আকাশে ক্রমান্বয়ে দ্যুতি ছড়াতে থাকেন। কলম্বো, কলকাতা, কেরালা, ইসলামাবাদ থেকে স্বর্ণপদক এনে তিনি আঁধার ঘরে বাতি জ্বালান। ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয়ান সাঁতারে তিনি একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পেলে আমরা এশিয়ান গ-িতে প্রবেশের ছাড়পত্র পাই। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সাফ গেমসের আসর বসলে ঢাকা স্টেডিয়ামের ছোট্ট পুলটিতে ৩৩ বছর বয়সে মোশাররফ ঝড় তুললে আমরা গর্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। তিনি পাঁচটি স্বর্ণ ও দুটি রৌপ্যপদক জিতলে সত্যি সত্যিই আমরা তার মাঝে খুঁজে পেয়েছিলাম একজন মার্ক স্পিটজকে।
কার্ল লুইসের মতো দারিদ্র্যের কঠিন সংগ্রামে জর্জরিত ছিলেন শাহ আলম। মেহেরপুরের কৃষক পরিবারের ছেলে শাহ আলম সেই ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত গতিতে ছুটতে পারতেন। কিন্তু নিজেকে মেলে ধরার কোনো প্লাটফরম তার ছিল না। এমন এক প্রতিকূল অবস্থায় সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দিয়ে তিনি বড় একটি ক্ষেত্র পেয়ে যান। তার মধ্যে অ্যাথলেট হওয়ার যে প্রতিভা ও মেধা সুপ্ত অবস্থায় ছিল, তা বিকশিত হতে একদমই সময় নেয়নি। অ্যাথলেট ক্যারিয়ারের শুরুতে জাতীয় পর্যায়ে ২০০ মিটার ¯িপ্রন্টেই তিনি সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমসে ৪ী১০০ মিটার রিলেতে সাইদুর রহমান ডন, আফতাব মোল্লা ও মুজিবুর রহমান মল্লিকের সাথে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদকটি পান। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে তার কোনো সাফল্যই ছিল না। অথচ ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসে সবার ধারণাকে তিনি পাল্টে দেন। তবে তার মধ্যে সাফল্যের একটা ক্ষুধা দেখতে পেয়েছিলাম। কি এক কাজে সাফ গেমস শুরুর বেশ কিছুদিন আগে এরশাদ আর্মি স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি পুরো স্টেডিয়াম নিস্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই। এর মধ্যে একা একাই অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন শাহ আলম। সেদিন তিনি সাফল্যের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তার মুখের মৃদু হাসিতে সেই আশাবাদ ঝলমল করছিল। সাফ গেমস শুরু হলে সেই আর্মি স্টেডিয়ামেই দ্রুততম মানব হয়ে সবাইকে চমকে দেয়ার পর মনে হয়েছিল, শাহ আলম নিশ্চয়ই অবাক হননি। তিনি যে সাফল্য পাবেন, এমন দৃঢ় প্রত্যয় তার আগেই ছিল। সেবার ৪ী১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ জয়ের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ব্যাটনটাও তার হাতে ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার শত কোটি মানুষের দ্রুততম মানব হওয়াটা অবশ্যই গৌরবের। দেশের মাটিতে এমন কৃতিত্বে শাহ আলমের নিশ্চয়ই মন ভরেনি। সম্ভবত ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে তিনি অংশ নেন একটা অতৃপ্তি নিয়ে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে সেদিন দুরন্ত হরিণের মতো ছুটেছিলেন শাহ আলম। ১০ দশমিক ৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েন। উপর্যুপরি দুটি সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হয়ে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান শাহ আলম। অল্পের জন্য তার অন্যতম ফেভারিট ২০০ মিটার ¯িপ্রন্টের স্বর্ণটা জিততে পারেননি। ২০০ মিটারের পাশাপাশি ৪ী১০০ মিটার রিলে দৌড়ে রৌপ্য পদক জয় করেন। আমাদের হয়তো কার্ল লুইস নেই, আমরা একজন শাহ আলমকে পেয়েছিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু ম্যাট বিয়ন্ডি টানা তিনটি অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলেন। আমাদের কাছে অলিম্পিক হিসেবে খ্যাত সাফ গেমসে এমন কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন বুক সাঁতারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মোখলেসুর রহমান। সাঁতারের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জের কাশীপুরের ছেলে মোখলেস সহজাত প্রতিভা নিয়ে উঠে এসেছিলেন। ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ব্রোঞ্জ পদক জিতে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে হাত মক্শো করেন। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সাফ গেমসে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজবে কিনা এবং জাতীয় পতাকা উড়বে কিনাÑ তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। এমন অবস্থায় দেশের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করেন মোখলেসুর রহমান। তিনি ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ১ মিনিট ১০.০৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন সাফ রেকর্ড গড়েন। এটি ছিল বাংলাদেশের একমাত্র স্বর্ণপদক। ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোয় ১০০ মিটার বুক সাঁতারে ফেভারিট হলেও তিনি রৌপ্য পদক পান। কিন্তু ২০০ মিটার বুক সাঁতারে নতুন রেকর্ডসহ স্বর্ণ জিতে তা পুষিয়ে দেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সাফ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণ জিতে টানা তিনটি গেমসে স্বর্ণ জয়ের বিরল গৌরব অর্জন করেন। অনেকগুলো স্বর্ণ জিততে না পারলেও টানা তিনটি গেমসে স্বর্ণ জিতে মোখলেসুর রহমান হয়ে আছেন আমাদের ম্যাট বিয়ন্ডি।
১৯৯৩ ঢাকা গেমসের আগে বিমল চন্দ্র তরফদার একদমই পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে তার খেলাধুলায় ভীষণ ঝোঁক ছিল। এ কারণে তাকে বাড়ির পাশের বিকেএসপিতে ভর্তি করে দেয়া হয়। তবে চীন, ফিলিপাইন ঘুরে এলেও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তার কোনো সাফল্য ছিল না। দেশসেরা ¯িপ্রন্টার গোলাম আম্বিয়ার মাসল পুলের কারণে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়লে দেশের অ্যাথলেটিক্স অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সাফ গেমসের প্রথম তিন দিন বাংলাদেশের ঘরে স্বর্ণপদক নেই। এমন এক মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আবির্ভূত হন ১৯ বছরের বিমল চন্দ্র তরফদার। আগের গেমসের দ্রুততম মানব শ্রীলঙ্কার দিশানায়েকেকে টপকে তিনি দ্রুততম মানব হন। শুরুতে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও ঝড়ের গতিতে ছুটে ১০.৬১ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। বিমল এখনো বাংলাদেশের দ্রুততম মানব হয়ে আছেন। এরপর আর বাংলাদেশ দ্রুততম মানব পায়নি ।
ইতোমধ্যে সাফ গেমস, এসএ গেমস হলেও বাংলাদেশের আকাশটা আরো বেশি ছোট হয়ে গেছে। মোশাররফ হোসেন খান, শাহ আলম, মোখলেসুর রহমান ও বিমল চন্দ্র তরফদাররা যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, সেটাই এখন অবিনস্বর হয়ে আছে। আকাশটাও যেমন ছোট হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে ছোট হয়েছে তারকার বহরও।
মোশাররফ হোসেন খান ঢাকা স্টেডিয়ামের যে সুইমিংপুলে রেকর্ড গড়েছিলেন, সেই সুইমিংপুলটাকে এখন আর কেউ চেনেন না। শাহ আলম যে আর্মি স্টেডিয়ামে প্রথমবার দ্রুততম মানব হন, সেই স্টেডিয়ামের রমরমাটা এখন নেই। মোখলেসুর রহমান মিরপুরের যে সুইমিংপুলে সাফ গেমসে স্বর্ণ জয়ের হ্যাটট্রিক করেন, সেই পুলটি এখন অনুজ্জ্বল। বিমল চন্দ্র তরফদার মিরপুরে যে অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামে দ্রুততম মানব হন, স্টেডিয়ামের সেই ট্র্যাক হারিয়ে অ্যাথলেটিক্স হয়ে পড়েছে ঠিকানাবিহীন। সাফল্যের ধারক সেই স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুল অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ার পাশাপাশি দেশে সুবিধা করতে না পেরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ছোট আকাশের আমাদের বড় তারকা মোশাররফ হোসেন খান, মোখলেসুর রহমান ও বিমল চন্দ্র তরফদার। আর ১৯৯০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর শিকার হয়েছেন অ্যাথলেট শাহ আলম। একই সঙ্গে অকালমৃত্যু ঘটছে দেশের অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার অঙ্গনেও। এই অকালমৃত্যু কি আমাদের বিধিলিপি?
দৈনিক যায়যায়দিন, ১৪ আগস্ট ২০০৬
১৯৮৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। এ দিনটি হতে পারতো বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য গৌরবময় একটি দিন। বিশ্বসেরা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে অভিষেক হয় একজন নবীন ক্রিকেটারের। বুদ্ধুদের মত ক্ষণস্থায়ী ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি যে প্রতিভার ঝিলিক দেখিয়েছিলেন, তাতে প্রকৃত ক্রিকেটপ্রেমীরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছিলেনÑ হাজারো তারার মাঝে আরো একটি ধ্রুবতারার জন্ম হতে যাচ্ছে। কিন্তু তখন তো আর গর্ডন গ্রীনিজ, এডি বার্লো কিংবা ডেভ হোয়াটমোরের মত জহুরী ছিল না যে জহর চিনবে। নিদেনপক্ষে মোহসিন কামালও যদি থাকতেন, তাহলে যথাযথ মূল্যায়নের অভাবে অকালে ঝরে যাওয়া অনেক প্রতিভার মতো সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটারও হারিয়ে যেতেন না। এতে অবশ্য হারিয়ে যাওয়া ওই ক্রিকেটারের কোনো ক্ষতি না হলেও ক্রিকেটানুরাগীরা বঞ্চিত হয়েছেন আরেকজন শচীন টেন্ডুলকারের জন্ম হওয়া থেকে (তখন তো টেন্ডুলকারকেও কেউ চিনতেন না)।
ঘটনাটা খুলেই বলা যাক। স্থানÑ ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ। দিনটি শুক্রবার। প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি মুখোমুখি হয়েছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কাবের। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খেলায় অংশ নিলেও দলটি বেশ শক্তিশালী। দলটিতে রয়েছেন শিক্ষকতায় সদ্য যোগ দেয়া তরুণরা। এঁদের আবার কেউ কেউ ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে দাপটের সঙ্গে নিয়মিত খেলে থাকেন। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির দলটিতে এক সময়ের দু’চারজন ক্রিকেটার থাকলেও সামগ্রিকভাবে দলটি মোটেও শক্তিশালী নয়। ১১ জন নিয়ে দল গঠন করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সমিতির একজন সদস্য হিসেবে আমি গিয়েছিলাম ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগ করতে। সেদিন সকালে ক্রীড়া লেখক সমিতির পক্ষে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হওয়া একাদশতম ব্যক্তি ছিলাম আমি। মাঠে আমাকে আসতে দেখে আগেই উপস্থিত হওয়া ক্রীড়া লেখক সমিতির ১০ জন সদস্য উল্লসিত হয়ে ওঠেন। কী ব্যাপার! আমাকে দেখে এত উল্লাস কেন? আমি একটু ঘাবড়ে যাই। কাছাকাছি যেতেই সমিতির সিনিয়র সদস্যরা জানালেনÑ যাক, সময়মত এসে ভালোই করেছো। তুমি না আসায় আমরা খেলা শুরু করতে পারছিলাম না। আমি কিছু বুঝতে না পেরে তাদের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকি। তারা আমাকে বললেন, আরে! চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? তাড়াতাড়ি রেডি হও। আমি বললাম, রেডি হবো মানে? তারা বললেন, তুমি আসায় আমাদের ১১ জন ক্রিকেটারের কোটা পূরণ হয়েছে। তোমাকে খেলতে হবে। আমি বললাম, বলেন কি? আমি খেলবো ক্রিকেট!
কাঠের বলের ভয়ে মাঠে নামা তো দূরে থাকুক, ক্রিকেট মাঠের কাছাকাছি থাকলেও আমার বুক কেঁপে ওঠে। জীবনে বলতে গেলে কখনোই ক্রিকেট খেলিনি। কিন্তু আমার এ কথা কারো কাছে পাত্তাই পেল না। আমি না খেললে ক্রিকেট ম্যাচ নাকি হবে না! আমাকে খেলতেই হবে। অগত্যা খেলার স্বার্থে, সমিতির ভাবমূর্তির স্বার্থে রাজি না হয়ে আর উপায় থাকে না। সবাই করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানায়। মনোভাবটা এমন, আমি যেন ভিভ রিচার্ডস! যা হোক, আমাদের দল প্রথমেই ব্যাট করতে নামে। ৩৫ ওভারের খেলা। ভাবলাম আমার আগের ১০ জন ব্যাটসম্যান অনায়াসেই এই ৩৫ ওভার খেলে আসবেন। আমার নিশ্চয়ই মাঠে নামার প্রয়োজন হবে না। যেমনটি হয়েছিল ভিভ রিচার্ডসের বেলায়। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন শ্রীলংকার সঙ্গে যেদিন তার ওয়ানডে ম্যাচে অভিষেক হয়, দল আগেই জিতে যাওয়ায় তার আর নামতে হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরে ব্যাট করায় ভিভ এ সুবিধাটুকু পেয়েছিলেন। অন্তত জীবনের প্রথম ম্যাচে ব্যাট করার যন্ত্রণা তাকে পোহাতে হয়নি। ওমা! আমি ভাবলাম কি আর হলো কি! ১৬ দশমিক ৪ ওভারে ৬৬ রানেই ফিরে গেছেন আমাদের ৯ জন ব্যাটসম্যান। এখন আমার না নেমে উপায় কি? গ্লাভস, থাই গার্ড, হেলমেট, চেস্ট গার্ড, হ্যান্ড গার্ড, শিন গার্ড, অ্যাবডমিন্যাল গার্ড পরেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রীতিমত কাঁপতে থাকি। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে দুরু দুরু বুকে ক্রিজের দিকে যখন রওনা হলাম, তখন আমাদের দলের আউট হয়ে আসা সদস্যরা আমাকে এমনভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন, যেন নিদেনপক্ষে আমি মাইকেল হোল্ডিং-এর মতো একটি দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে আসি। ১৯৮৪ সালে ৩১ মে ওল্ড ট্রাফোর্ডে টেক্সাকো ট্রফির প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৪৩ রানে ডেসমন্ড হেইন্স, গর্ডন গ্রীনিজ ও রিচি রিচার্ডসন ফিরে গেলে ব্যাট করতে নামেন ভিভ রিচার্ডস। রিচার্ডস স্বভাবসুলভ মারকুটে ভঙ্গিমায় একদিকে রানের ফোয়ারা ছোটালেও তার সঙ্গীরা একে একে খুব দ্রুত ফিরে যেতে থাকেন। গোমেজ, কাইভ লয়েড, ডুজন, মার্শাল, ব্যাপটিস্ট ও গার্নার আউট হয়ে গেলে তখন সবেধন নীলমণি হয়ে খেলতে নামেন মাইকেল হোল্ডিং। হোল্ডিংকে নিয়ে কিং রিচার্ডস যে ইনিংস খেলেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে। এই জুটি অপরাজেয় ১০৬ রান যোগ করে দশম উইকেটে নতুন রেকর্ড গড়েন। সাঈদ আনোয়ার ভেঙে দেয়ার আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল রিচার্ডসের সেই অপরাজেয় ১৮৯। রেকর্ডটি ভেঙে গেলেও ইনিংসটির রূপ-রস-মাধুর্য আজও এতটুকু ম্লান হয়নি। মাইকেল হোল্ডিং ২৭ বল খেলে ১২ রানে অপরাজিত ছিলেন। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি হয়ে অবিচল দৃঢ়তায় ভিভকে সঙ্গ দেন হোল্ডিং। আমি যে মাইকেল হোল্ডিংয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবো, আমার সঙ্গী তো আর ভিভ রিচার্ডস নন। আর তাছাড়া তখন তো আমার সামনে এই দৃষ্টান্তও ছিল না। যা হোক, ক্রিজে যেয়ে আমার আত্মুা খাচারাম ছাড়া হওয়ার জোগাড়! আমাকে দুর্ধর্ষ পেসার ওবায়দুল হক আযমের মুখোমুখি হতে হবে। এই সেই আযম, যিনি ১৯৮১ সালের ২ ও ৩ জানুয়ারি ফরিদপুরে ২ দিনের ম্যাচে সফরকারী এমসিসি দলকে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন। ৭৯ রানে গুটিয়ে যায় এমসিসির প্রথম ইনিংস। হাটন, মার্ক নিকোলাস, হ্যাম্পশায়ার, নিডহ্যাম, জেমসন, লুইসের মতো খ্যাতিমান ব্যাটসম্যানদের অবস্থা দাঁড়ায় ত্রাহি মধুসূদন। ১৮ রানে ৭টি উইকেট নিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের কাছে রূপকথার নায়ক। টপ ফর্মে থাকা সেই আ-যমের বলের মুখোমুখি হবো আমি! যে কিনা পাড়ার রাম-শ্যাম-যদু-মধুর বলও কখনো খেলেনি। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মতো বুকে ফুঁ দিয়ে গার্ড নিলাম। বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকি। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। মনে হচ্ছিল, আযম নয়, যেন যম ছুটে আসছিলেন আমার আত্মা কেড়ে নেয়ার জন্য। প্রথম বলটি চোখ-কান বন্ধ করে কোনোক্রমে ঠেকিয়ে দেই। পরের বলটি কীভাবে যেন ব্যাটে লেগে রান হয়ে যায়। জীবনের প্রথম রান। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম সঞ্চয়। খুশিতে বাগ বাগ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু দুশ্চিন্তায় আমার মুখ শুকিয়ে যায়। কারণ, সেটি ছিল ওভারের শেষ বল। আমাকে আবার বোলারের মুখোমুখি হতে হবে! আমি যাই বঙ্গে, আমার কপালও যায় সঙ্গে। আমি যতই ব্যাট না করার জন্য ছটফট করতে থাকি, ততই আমাকে বোলারের মুখোমুখি হতে হয়। তবে সৃষ্টিকর্তার বোধহয় কিছুটা রহম হয় আমার ওপর। ১৭ ওভার খেলা হয়ে যাওয়ায় তখন পানি পানের বিরতি। যাক, গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয়া যাবে। দলের বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য সহযোগী খেলোয়াড়রা আমাকে উজ্জীবিত করতে থাকেন। আমি বোধহয় তাতে কিছুটা অনুপ্রাণিত হই। উৎসাহ পেয়ে সুনীল গাভাস্কারের মতো স্টাঞ্চ নিয়ে আরো পাঁচটি ডট বল খেলে বোল্ড হয়ে সগর্বে ফিরে আসি। অভিষেক ম্যাচ হিসেবে পারফরম্যান্স নেহাত মন্দ নয়। ওয়ানডে’র অভিষেক ম্যাচে ক্রিকেট কিংবদন্তি গ্যারি সোবার্স ৬ বল খেলে ০, সেলিম মালিক ২ বল খেলে ০, শচীন টেন্ডুলকার ২ বল খেলে ০ এবং হালের সেনসেশন বীরেন্দর শেবাগ ২ বল খেলে যেখানে ১ রান করেছেন, সেখানে সার্বিক বিচারে আমার পারফরম্যান্স তো অবশ্যই আশা জাগানিয়া। ০ কিংবা ১ রান দিয়ে যাত্রা করে শচীন টেন্ডুলকার, সেলিম মালিক, বীরেন্দর শেবাগরা যদি ক্রিকেট বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমি কেন পারবো না? প্রথম ম্যাচ খেলে এ আত্মবিশ্বাসটুকু অন্তত আমার হয়ে যায় (সে সময় টেন্ডুলকার, শেবাগদের দৃষ্টান্ত থাকলে আমি নিশ্চয়ই আরো বেশি অনুপ্রাণিত হতাম)।
আমি আত্মবিশ্বাসী হলে হবে কি! আমার খেলা দেখে আমার সহযোগীরা মোটেও আত্মবিশ্বাসী হতে পারেননি। যে কারণে আমি বিপদের বন্ধু হিসেবে খেলতে নেমে প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রাখলেও (প্রতিভাকে তো আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না) পরবর্তীকালে আমাকে কেউ আর দলে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। এতে আমার আর কতটুকু ক্ষতি হয়েছে? আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে এ পোড়া দেশের! ভারতের শচীন টেন্ডুলকারের আগেই বাংলাদেশ পেতে পারতো একজন শচীন টেন্ডুলকার। অথচ প্রতিভার দামটা কেউ দিল না। সে নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভও নেই। তবে আড়ালে-আবডালে শুনতে পেয়েছি, আমার ব্যাটিং নাকি বিনোদনের যথেষ্ট খোরাক জুগিয়েছিল। আমি আত্মরক্ষার জন্য যেভাবে ব্যাট করেছি, তাতে নাকি প্রতিপক্ষের বোলার, ফিল্ডার ও সমর্থকরা তো হেসেছেনই, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আমার সহযোগীরাও। আর আমার ফিল্ডিং! সে কথা না হয় আরেকদিন বলা যাবে।
প্রতিযোগী, জুন ২০০৫
ক্রিকেটের রেকর্ড বুকে যে রেকর্ড নেই!
যারা ইন্টারনেট নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাদের কাছে ক্রিকইনফো খুব একটা অপরিচিত নয়। এই ওয়েবসাইটটি ক্রিকেটের তথ্য ও পরিসংখ্যানের আকর হিসেবে পরিচিত। যারা ক্রিকেট খেলেন এবং খেলেছেন, তাদের সবার প্রোফাইল ও ছবি কম-বেশি ক্রিকইনফোতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু অতীব দুঃখজনক যে, আমার মতো একজন স্বনামখ্যাত ক্রিকেটারের ছবি ও প্রোফাইল ক্রিকইনফোতে নেই! এটা কি তাদের ওয়েবসাইটের অপূর্ণতা নয়? আমার তো মনে হয়, এতে তাদের গর্ব অনেকখানি ম্লান হয়ে গেছে। আমার ক্রিকেট ব্যাকগ্রাউন্ড কি এতোটাই অনুজ্জ্বল? অবশ্য এ জন্য মন খারাপ করে লাভ নেই। বরং ছবি ও প্রোফাইল না থাকায় ঢের খুশি হয়েছি। ক্রিকেটের প-িতরা তো স্কোরকার্ডকে একটি গাধা হিসেবেই মনে করেন। জেনে-শুনে কে আর গাধার ভারবাহী হতে চায়? যাক সে কথা। এবার না হয় ক্রিকেটার হিসেবে আমার উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের কথা আপনাদের জানিয়ে দেই। নিজের ঢোল যদি নিজে না পেটাই, অন্যের হাতে দিলে তা ফাটিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। আপনাদের হৃদয়ে যদি স্থান করে নিতে পারি, তাহলে রেকর্ড বুকে আমার কথা না থাকলে কীই-বা আসে যায়?
ক্রিকেটার রকিবুল হাসানকে কে না চেনেন? বাংলাদেশ ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার আগে ক্রিকেটার বলতে যে ক’জনের ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, তিনি তাদের একজন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক ছিলেন অনেক নবীন ও তরুণ ক্রিকেটার এবং ক্রিকেটানুরাগীর স্বপ্নের মানুষ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দলের হয়ে ইন্টারন্যাশনাল একাদশের সঙ্গে চারদিনের ম্যাচ খেলে হয়ে ওঠেন বাঙালির রূপকথার নায়ক। আর সেই রকিবুল হাসানের নেতৃত্বে আমি ক্রিকেট খেলেছি! এ থেকে নিশ্চয়ই অনুধাবন করা যায়Ñ ক্রিকেটার হিসেবে আমি নিশ্চয়ই একদম হেলাফেলার কেউ নই। রকিবুল হাসানের নেতৃত্বে খেলার পরও যদি ক্রিকইনফোতে ঠাঁই না পাওয়া যায়, সেটা কার অযোগ্যতা? আমার, না ক্রিকইনফোর?
ঘটনাচক্রেই আমাকে রকিবুল হাসানের নেতৃত্বে ক্রিকেট খেলতে হয়েছে। ঘটনাচক্রে বলার কারণ, আমার ক্রিকেট খেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা আগ্রহ ছিল না। বুয়েট মাঠে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচে সমিতির হয়ে আমাকে বাধ্য হয়ে খেলতে হয়। সমিতির অধিনায়ক ছিলেন রকিবুল হাসান। এমনিতেই মেজাজী খ্যাতিমান এই ক্রিকেটার যখন মাঠে খেলতে নামতেন, তখন রীতিমত বাঘ হয়ে যেতেন। দলের কেউ একটু ভুল করলে তাঁর গর্জনে সবারই অবস্থা হয় ত্রাহি মধুসূদন। যে আমি টেনিস বল দিয়ে কখনো ক্রিকেট খেলিনি, তাকে কি-না কাঠের বল দিয়ে ফিল্ডিং করতে হয়েছে। তাও আবার রকিবুল হাসানের অধীনে! রকিবুল হাসান তো জানেন নাÑ আমি কোন্ জাতের ক্রিকেটার? তিনি তো হয়তো আমাকে ভেবে থাকবেন জন্টি রোডসের মতো একজন ফিল্ডার। অথচ ক্রিকেট মাঠের পজিশন সম্পর্কেই আমার কোনো ধারণা নেই। তিনি আমাকে মিড উইকেটে দাঁড়াতে বললে আমি ডিপ এক্সট্রা কভারে গিয়ে দাঁড়াই অথবা তিনি লং অনে যেতে বললে আমি যাই থার্ড ম্যানে। তিনি যথারীতি আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাছাড়া আমাকে এমনসব পজিশনে ফিল্ডিং করতে দেন, যেখানে ক্যাচ ধরা সহজ হয় কিংবা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা সহজে রান না করতে পারেন। আর আমি বল ধরার ভয়ে খুঁজে খুঁজে এমন পজিশনে গিয়ে দাঁড়াই, যাতে বল আমার কাছে না যায়। রকিবুল হাসান আমাকে যতবার ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াতে বলেন, আমি তাঁর অগোচরে ততবারই ডিপ লং লেগে গিয়ে দাঁড়াই। ধমক খেয়ে একবার আমি ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের ওই পজিশনে ছিল লংজাম্প কোর্ট। ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে একবার আমার কাছে বল এলে রকিবুল হাসানের ধমক খাবার ভয়ে আমি দু’হাত বাড়িয়ে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি, যাতে বল ফসকে যেতে না পারে। কিন্তু দুর্দান্ত ফিল্ডিং সত্ত্বেও আমার দু’হাত ভরে উঠে আসে রাশি রাশি বালু। আর বল আমাকে ফাঁকি দিয়ে বাউন্ডারি সীমানার দিকে চলে যেতে থাকে। আমি ভয়ে-আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে ভগ্ন-মনোরথে বলের পেছনে পেছনে প্যাভিলিয়নের দিকে চলে যাই। ক্রিকেট ইতিহাসে সেবারই প্রথম ফিল্ডার ইনজুরি না হওয়া সত্ত্বেও একজন সাবস্টিটিউট ফিল্ডারকে মাঠে নামতে হয়েছিল। ক্রিকইনফো কিংবা উইজডেনে কতোসব আজগুবি তথ্য থাকে, আর এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটুকু যে কেন নেই বুঝতে পারি না!
প্রতিযোগী, আগস্ট ২০০৫
বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
তৎকালীন পাকিস্তান আমলে কোনো বাঙালির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে চাওয়াটা ছিল অলীক কল্পনা। আর টেস্ট ক্রিকেট খেলার চিন্তাটা ছিল সুদূরের স্বপ্ন হয়ে। ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে চারদিনের ম্যাচে অংশ নেয় ইন্টারন্যাশনাল একাদশ এবং বিসিসিপি একাদশ। পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড অর্থাৎ বিসিসিপি একাদশের হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র খেলার সুযোগ পান রকিবুল হাসান। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নেমে উভয় ইনিংসেই তিনি ১ রান করে মোট ২ রান করেছিলেন। রকিবুল হাসান কত রান করেছিলেনÑ সেটা সে সময় মোটেও বিবেচ্য বিষয় ছিল না। একজন বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে তিনি এমন একটি ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেনÑ এটাই ছিল অভাবিত ও আলোচিত ঘটনা। এই খেলতে পারাটা সে সময়ের মানদ-ে ছিল একটি বড় ব্যাপার।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের ঐতিহ্য তেমন গৌরবোজ্জ্বল না হওয়ায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট এগুতে থাকে ঢিমে-তেতলা তালে। ঘরোয়া ক্রিকেটের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে ইংল্যান্ডের জগতবিখ্যাত ক্রিকেট কাব এমসিসি বাংলাদেশ সফরে এলে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক মেজাজের সঙ্গে পরিচিত হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশেও যে ক্রিকেট খেলা হয়Ñ সে সময় এটা বিশ্বকে জানানোটাই ছিল আসল কথা। সত্তর দশকে বাংলাদেশের হয়ে যারা ক্রিকেট খেলেছেন, তাদের মূল লক্ষ্যটা ছিল ক্রিকেট নেশন হিসেবে দেশকে তুলে ধরা। তাছাড়া এ সময় যারা ক্রিকেট খেলেছেন, খেলাটাই তাদের কাছে প্রধান উপলক্ষ ছিল না। খেলাটা ছিল বিনোদনের অংশ। অধিকাংশই ছিলেন সামাজিকভাবে অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান। লেখাপড়ার পাশাপাশি মনের আনন্দে ক্রিকেট খেলেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে খেলতে সম্পৃক্ত হয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে। সবাই যে খুব বেশি বড় আসরে খেলতে পেরেছেন, তা নয়। বিদেশী দলের সঙ্গে খেলতে পারাটাই ছিল বড় ধরনের প্রাপ্তি। কেননা, সে সময় বিজ্ঞানভিত্তিক কোচিং অর্থাৎ কোচ, ফিজিও, ভিডিও, সিডি, কম্পিউটার অ্যানালিস্ট ইত্যাদি তো দূরে থাকুক, ক্রিকেটের একাডেমিক বিষয়েই অনেকে অবহিত ছিলেন না। বেসিক ব্যাপারগুলো নিজেদেরকে ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়েছে। সঙ্গত কারণে তাদের কাছে বড় কিছু আশা করা যায়নি। তখন ক্রিকেটারদের মনোভাবটা ছিল এমন : ‘আমাদের এই পথ চলাতেই আনন্দ’। সত্তর ও সত্তর-পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ক্রিকেটাররা হলেনÑ শামীম কবীর, রকিবুল হাসান, মাইনুল হক মাইনু, সৈয়দ আশরাফুল হক, ওমর খালেদ রুমী, এস এম ফারুক, শফিকুল হক হীরা, ইউসুফ রহমান বাবু, দৌলত-উজ-জামান, দীপু রায় চৌধুরী, খন্দকার নজরুল কাদের লিন্টু, তানভীর মাজহার তান্না, আহমেদ ইকবাল বাচ্চু, সামিউর রহমান সামী, জি এম হাসান তামীম, মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম, তানভীর হায়দার, জিয়াউল ইসলাম মাসুদ, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, নাজমুল নূর রবীন, মজিবুল হক মন্টু, বেলায়েত হোসেন বেলাল, ইশতিয়াক আহমেদ, অলোক চক্রবর্তী, রফিকুল আলম, সদরুল আনাম, আনোয়ারুল আজীম আজহার, ওবায়দুল হক আজম, তানজীব আহসান সাদ, নেহাল হাসনাইন, ফয়সল হায়দার, গোলাম ফারুক সুরু, নাজিম সিরাজী, আসাদুজ্জামান মিশা, ওয়াহিদুল গনি, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু প্রমুখ। সত্তর দশকে বাংলাদেশে আসা এমসিসি, শ্রীলংকা, ভারতের ডেকান ব্লুজ, হায়দ্রাবাদ ব্লুজ ও পাকিস্তানের পিআইএ দলের সফর বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে দেখা দেয়। সফরকারী দলগুলো ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া ক্রিকেটারদের পাশাপাশি নবীন ক্রিকেটারদের সমন¦য়ে গঠিত। দলগুলো খুব বেশি শক্তিশালী না হলেও অনভিজ্ঞ বাংলাদেশের তুলনায় তারা ছিল বেশ অভিজ্ঞ। যে কারণে বাংলাদেশ কিংবা আঞ্চলিক দলগুলোর এক একটা ইনিংস গুটিয়ে যায় ৪২, ৫৫, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৮৪, ৮৮, ৯৩, ৯৭ রানের মতো স্কোরে। এমসিসির ডাফ, ভার্নন, পিয়ারচুড, বার্কলে, লিউইংটন, মেরি, স্টুয়ার্ট, উইলসন, মন্ট্রিয়েথ, নিডহাম, শ্রীলংকার টনি ওপাথা, ইল্লেপেরুমা, জগন্নাথন, ডি সিলভা, গুণাতিলক, কাল্লুপেরুমা, রাণাসিঙ্গে, ডেকান ব্লুজের নরসিমা রাও, হায়দ্রাবাদের রাকেশ শুকা, গায়কোয়াডের মতো বোলারদের বলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। তাদের বলে উইকেট পড়েছে নামতার মতো করে। পেস, মিডিয়াম কিংবা স্পিনÑ সব রকম বলের সামনেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাট থেকে সেঞ্চুরি তো দূরে থাকুক, কালে-ভদ্রে দেখা মিলতো হাফ সেঞ্চুরির। রকিবুল হাসান, সৈয়দ আশরাফুল হক, ইউসুফ রহমান বাবু, শফিকুল হক হীরা, নাজিম সিরাজী, মিজান, আসাদুজ্জামান মিশারা কখনো-সখনো ফিফটি হাঁকালে তার মাধুর্যে আপ্লুত হতেন ক্রিকেটানুরাগীরা। দুর্লভ সম্পদ হিসেবে তা চিরদিনের জন্য হৃদয়ের মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখতেন সযতনে। বাংলাদেশের বোলারদের নির্বিষ বলগুলো যখন এমসিসির বার্কলে, নরম্যান, জেমসন, সিসি হান্ট, কার্ক, নিকোলাস, শ্রীলংকার ওয়ার্নাপুরা, টেনিকুন, মেন্ডিস, ওয়েটিমুনি, ডেকান ব্লুজের অজিত ওয়াদেকার, পিআইএ’র রেজওয়ানুজ্জামানের মতো ব্যাটসম্যানরা নির্দয়ভাবে পিটিয়ে বাউন্ডারির বাইরে আছড়ে ফেলতেন, তখন তাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকতো না। উইকেট পাওয়াটা যেখানে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতো, সেখানে প্রতি ম্যাচে চার-পাঁচটি উইকেট পাওয়ার প্রত্যাশা করার প্রশ্নই ওঠে না। এর মাঝেও খন্দকার নজরুল কাদের লিন্টু, দৌলত-উজ-জামান, ইউসুফ রহমান বাবু, ওবায়দুল হক আযম, তানভীর হায়দার, ওমর খালেদ রুমী, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, আনোয়ারুল আমীন আজহাররা হঠাৎ হঠাৎ দুর্দান্ত বল করলে তা হয়ে উঠতো গর্ব ও আনন্দের অফুরন্ত উৎস। বিশেষ করে ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে ফরিদপুরে এমসিসির সঙ্গে বিসিসিবির দু’দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে আযমের দুরন্ত বোলিং ক্রিকেটানুরাগীদের কাছে মধুর এক স্মৃতি হয়ে আছে। ১৮ রানে ৭ উইকেট নিয়ে তিনি এমসিসির প্রথম ইনিংস ৭৯ রানে বিধ্বস্ত করে দেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পরাজয়টা যেখানে ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার, সেখানে এরকম অভাবিত প্রাপ্তি ছিল খুবই বিরল। শামীম কবীর, রকিবুল হাসান ও শফিকুল হক হীরার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দলের শিক্ষানবিশী অব্যাহত থাকে প্রায় আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তবে এ সময় বাংলাদেশের ক্রিকেট তার পরিচয় সংকট কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়। ১৯৭৭ সালের ২৬ জুলাই আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার পর বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। শফিকুল হক হীরার নেতৃত্বে প্রথম আইসিসি ট্রফিতে কানাডা ও ডেনমার্কের কাছে হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশ খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। প্রথম বিদেশ যাত্রাই ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে আনন্দদায়ক ঘটনা। আইসিসি ট্রফি তখন ক্রিকেটারদের কাছে বিশ্বকাপের মর্যাদা পেত। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ে এবং তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনির কাছে পরাজিত হলেও এক ধাপ উন্নতি হয় বাংলাদেশের। এবারও নেতৃত্বে ছিলেন শফিকুল হক হীরা।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসে। আর এই পরিবর্তনটা আনেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, আজহার হোসেন শান্টু, জাহিদ রাজ্জাক মাসুম, নূরুল আবেদীন নোবেল, গোলাম নওশের প্রিন্স, হাফিজুর রহমান সানি, শহীদুর রহমান শহীদ, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, নাসির আহমেদ নাসু, আতহার আলী খান, হারুনুর রশীদ লিটনরা। এই প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট খেলাটা কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় খেলার মাঝেও বেশ পরিবর্তন আসে। এই ক্রিকেটাররা আধুনিক ক্রিকেটের কলাকৌশল সম্পর্কে অবহিত হতে পেরেছেন। এ সময় বেশ কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ সফরে আসতে থাকে শক্তিশালী ক্রিকেট দল। টেস্ট স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত শ্রীলংকা, ইমরান খানের নেতৃত্বে ওমর কোরেশী দল, পশ্চিমবঙ্গ দল ইত্যাদি। এই দলগুলোর সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা আস্তে-ধীরে সাহস সঞ্চার করতে থাকেন। জেতার কথা চিন্তা না করলেও সম্মানজনক পরাজয়ের কথা ভাবতে থাকেন। ১৯৮৬ সালের শুরুতেই গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে পাকিস্তান সফরে যায় বাংলাদেশ। নর্থ জোনের বিপক্ষে ১ রান ও জোন ‘এ’র সঙ্গে ৬৮ রানে জয়ী হয়। সেঞ্চুরির দেখা পান নূরুল আবেদীন নোবেল। প্রতিপক্ষ খুব বেশি শক্তিশালী না হলেও পাকিস্তানের যে কোনো পর্যায়ের দলের বিপক্ষে জয়ী হওয়া এবং সেঞ্চুরি করাটা অবশ্যই কৃতিত্বপূর্ণ। ১৯৮৬ সালের মার্চে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার গৌরব অর্জন করে। আর এটি সম্ভব হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন দিনের হাওয়া লাগায়। শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়া কাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। মুখোমুখি হয় পাকিস্তান ও শ্রীলংকার। এটি ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি মাইলফলক। আগের ক্রিকেটারদের সঙ্গে নব্বই দশকের শুরুতে যোগ দেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, মাহবুবুর রহমান সেলিম, জাহাঙ্গীর তালুকদার দুলু, ফারুক আহমেদ, শাহনেওয়াজ শহীদ শানু, এনামুল হক মনি, সেলিম শাহেদ, জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ আলী, আনিসুর রহমান, মোঃ সাইফুল ইসলাম খান প্রমুখ। সৈয়দ কিরমানির নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে হায়দ্রাবাদ ডেকান ব্লুজের যে দলটি বাংলাদেশে আসে, তাতে ছিলেন চেতন শর্মা, রমন লাম্বা, প্রভিন আমরে ও শ্রীধরের মতো ক্রিকেটাররা। অথচ এই দলটিকে বিসিসিবি লাল দল ৫ উইকেটে, বিসিসিবি শাদা দল ৪ উইকেটে হারিয়ে দেয়। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাবার পূর্বাভাস। একই বছর শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারলেও বাংলাদেশের খেলায় আগের চেয়ে উন্নতি হয়। ভারতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ এশিয়া কাপ থেকে শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের মাইলফলক অর্জন। কোলকাতায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অপরাজিত ৭৮ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন আতহার আলী খান। আগের প্রজন্মের ক্রিকেটাররা যেখানে পরাজয়ের ভীতিতে আতঙ্কিত থাকতেন, সেখানে এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা সাহসী হয়ে উঠতে থাকেন। গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় আইসিসি ট্রফিতে খারাপ করলেও ১৯৯০ সালে চতুর্থ আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনালে পৌঁছায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি টার্নিং পয়েন্ট ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় যুব ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি হিসেবে খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল ইংল্যান্ড সফরে যায়। এই সফর থেকে উঠে আসে উঠতি, মেধাবী ও প্রতিভাবান একদল ক্রিকেটার। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খালেদ মাহমুদ সুজন, জাভেদ ওমর বেলিম গুল্লু, হাবিবুল বাশার সুমন, নাইমুর রহমান দুর্জয় প্রমুখ। চমৎকার একটি সফর শেষে দলটি ঢাকায় প্রথম এশীয় যুব ক্রিকেটে অংশ নিয়ে প্রশংসনীয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করে যথাক্রমে ১০ ও ৩২ রানে হারলেও মালয়েশিয়াকে ২০৪ ও সিঙ্গাপুরকে ২৫৯ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে সেলিম শাহেদ অপরাজিত ১২১ ও আমিনুল ইসলাম বুলবুল ১০০ রান করেন। এ টুর্নামেন্টেই শোনা যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের পদধ্বনি।
নব্বই দশকে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও ফারুক আহমেদের নেতৃত্বে জাতীয় ক্রিকেট দলের বড় কোনো সাফল্য না এলেও ১৯৯২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক ক্রিকেটে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ৭ উইকেটে হারিয়ে দেয়। ১৯৯৪ সালে পঞ্চম আইসিসি ট্রফিতে ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সিনিয়ররা খুব বেশি আশানি¦ত করতে না পারলেও তরুণরা বেশ এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৯৪ সালের আগস্টে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের ৭ জাতির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয় নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্বে। এই সাফল্যে উদ্দীপিত হয়ে আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়। শ্রীলঙ্কাকে ৫ উইকেটে এবং ভারতকে ১ রানে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি আকরাম খানের নেতৃত্বে সাফল্য প্রত্যাশী একদল ক্রিকেটারের সমাবেশ ঘটে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনÑ আমিনুল ইসলাম বুলবুল, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, হাবিবুল বাশার সুমন, সেলিম শাহেদ, খালেদ মাসুদ পাইলট, সাইফুল ইসলাম খান, মোঃ রফিক, আনিসুর রহমান, হাসিবুল হোসেন শান্ত, জাহাঙ্গীর আলম, খালেদ মাহমুদ সুজন, সানোয়ার হোসেন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, জাভেদ ওমর বেলিম গুল্লু, জাকির হোসেন, আল শাহরিয়ার রোকন, মেহরাব হোসেন অপি, মাহবুবুর রহমান সেলিম, মোরশেদ আলী খান, মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, ফাহিম মুনতাসির সুমিত প্রমুখ এবং অপেক্ষাকৃত তিন সিনিয়র আতহার আলী খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও এনামুল হক মনি। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন নতুন ঠিকানায়। এ পর্যায়ে এসে ক্রিকেটারদের কাছে ক্রিকেটই হয়ে ওঠে ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। বিদেশী কোচের অধীনে এঁরা নিজেদের দুর্বলতাগুলো দূর করতে পেরেছেন। আগে যাদের বল খেলতে বুক কেঁপে উঠতো, তাদের বল খেলতে আর ভয় পান না। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির এই ক্রিকেটাররা একটির পরু একটি মাইলফলক অতিক্রম করে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম এসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে মালয়েশিয়ায় বহু আকাক্সিক্ষত ষষ্ঠ আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ যেভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়, তা ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার ছাড়পত্র পাবার পাশাপাশি ওই বছরের ১৫ জুন ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। ১৯৯৮ সালে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের সাউদার্নের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেন আল-শাহরিয়ার রোকন। ভারতের হায়দরাবাদে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে কেনিয়াকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ রফিক। ১৯৯৯ সালের মার্চে ঢাকায় মেরিল ইন্টারন্যাশনাল কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন মেহরাব হোসেন অপি। মে মাসে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে স্কটল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে প্রথম জয় এবং পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে খালেদ মাহমুদ সুজন ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। টেস্ট স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত কোনো দেশকে হারানোর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। আকরাম খান ও আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে এতোসব সাফল্যের পর বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেক হয় নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্বে। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর শুরু হওয়া অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ২০০১ সালে এপ্রিলে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ক্যারিং থ্রু দ্য ইনিংস খেলে ৮৫ রানে অপরাজিত জাভেদ ওমর বেলিম ম্যান অব দ্য ম্যাচ এবং সেপ্টেম্বরে কলম্বোয় শ্রীলংকার সঙ্গে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি করে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি মুরালিধরনের সঙ্গে যুগ্মভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ আশরাফুল। ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশ গৌরবময় বেশ কিছু মাইলফলক স্থাপন করার পর নেতৃত্বে আসেন খালেদ মাসুদ পাইলট, খালেদ মাহমুদ সুজন ও হাবিবুল বাশার। এ সময় পাকিস্তানের মুলতান টেস্টে জয়ের কাছাকাছি এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সেন্ট লুসিয়া টেস্টে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে প্রথমবারের মতো খেলে ড্র করার পাশাপাশি বিভিন্ন টেস্ট দেশের বিপক্ষে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে সিরিজ খেলার অভিজ্ঞতা হয় বাংলাদেশের। ২০০২ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ম্যান অব দ্য সিরিজ হন খালেদ মাসুদ পাইলট, ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন অলক কাপালি এবং ২০০৩ সালে ঢাকায় ২য় টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ রফিক। আগস্টে পেশোয়ারে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন অলক কাপালি। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের ক্রিকেটারদের টেস্ট খেলা তো দূরে থাকুক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাটা ছিল স্বপ্নের মতো। আর বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেটারদের অভিষেক হয় টেস্ট অথবা ওয়ানডে ক্রিকেটে। যোগ্যতা দিয়ে এটা তারা আদায় করে নিতে পেরেছেন। হাবিবুল বাশার সুমনের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক সময়ে উুঠে এসেছেন নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। এই ক্রিকেটারদের চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি একদমই অন্যরকম। আগের প্রজন্মের ক্রিকেটাররা যেখানে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হতেন, সেখানে নতুন প্রজন্মের এই ক্রিকেটারদের মধ্যে একটা লড়াকু মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। আক্রমণাত্মক ও সংগ্রামী ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত মোঃ রফিক, খালেদ মাসুদ পাইলট, জাভেদ ওমর বেলিমদের সঙ্গে সম্মিলন ঘটেছে মোঃ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তালহা জুবায়ের, তাপস বৈশ্য, রাজিন সালেহ, এনামুল হক জুনিয়র, নাফিস ইকবাল, আফতাব আহমেদদের। এই দলের সঙ্গে অনিয়মিতভাবে থাকেন মুশফিকুর রহমান, অলক কাপালি, হান্নান সরকার, মানজারুল ইসলাম রানা প্রমুখ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নানারকম অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আধুনিক ক্রিকেটের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে বর্তমান দলটি। কোচ হিসেবে পেয়েছে ডেভ হোয়াটমোরের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ ও সফল কোচকে। তারুণ্যের ছটায় উদ্ভাসিত নতুন প্রজন্মের এই দলটি কাউকেই পরোয়া করে না। বল যত স্পিডেই আসুক কিংবা স্পিনের যতই জাদুময়তা থাকুকÑ বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ায় এই ব্যাটসম্যানরা। বিশ্বের যতই নামী ব্যাটসম্যান হোক না কেন, উইকেট ছিটকে ফেলতে একটুও দ্বিধা করেন না নতুন প্রজন্মের বোলাররা। গত নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টে বোলার হলেও তাপস বৈশ্যের ব্যাটে দেখা যায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তৃতীয় দিনেই খেলার ফলাফল নিশ্চিত হয়ে যাওয়া এ টেস্টে ৮ উইকেটে ২১০ রান নিয়ে চতুর্থ দিনে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। যে কোনো মুহূর্তে খেলার সমাপ্তি হয়ে যাবেÑ এমন একটা মনোভাবই ছিল সবার। মোঃ রফিক ৩০ ও তাপস বৈশ্য ১৫ রান নিয়ে ব্যাট করতে নামেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশ চতুর্থ দিন ৫২ রান যোগ করে। এর মধ্যে ১ রান যোগ করেন রফিক। বাকি ৫১ রান আসে তাপসের বিধ্বংসী ব্যাট থেকে। সব মিলিয়ে ৪৭ বলে ৬৬ রান করলেও ৩৬ বলে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম ফিফটি করেন। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে মোঃ আশরাফুল ১৫৮ রানের অপরাজেয় যে ইনিংসটি খেলেন, তা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম একটি সেরা ইনিংসের স্বীকৃতি পেয়েছে। ইনিংসটির পরতে পরতে ছিল সাহস, আত্মবিশ্বাস ও নান্দনিক সৌন্দর্য। টেস্টে হারলেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন আশরাফুল। জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে নাফিস ইকবালের ১২১ এবং ওয়ানডেতে আফতাব আহমেদের অপরাজেয় ৮১ রানের বিস্ফোরক ইনিংসের মধ্যে যে স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়, এমনটি অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। নাফিস ইনিংসটি দায়িত্বশীলতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ধৈর্য, দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ভূমিকা রাখেন। একই সঙ্গে কোনো প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিয়ে রাজিন সালেহ ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংসটিও দায়িত্বশীলতার প্রতিমূর্তি। ওয়ানডে ম্যাচে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে আফতাব আহমেদ ও মোহাম্মদ রফিক যেভাবে ব্যাট করেন, তা ছিল অবিশ্বাস্য। তারা ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেন সনাথ জয়াসুরিয়া, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শহীদ আফ্রিদি, বীরেন্দর শেবাগের মতো দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যানদের। ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান আফতাব চিগুমবুরার এক ওভারে ২৪ রান নিয়ে ৩২ বলে ফিফটি করেন। এই একটি ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশ পুরনো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে নতুন বাংলাদেশ রূপে। মাশরাফি বিন মর্তুজা, তাপস বৈশ্য, এনামুল হক জুনিয়রের মতো বোলাররা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছেন। ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে রাহুল দ্রাবিড়কে মাশরাফি বিন মর্তুজা বোল্ড করা এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এনামুল হক জুনিয়রের জাদুময় বলগুলো নতুন বাংলাদেশেরই সংস্করণ। ২০০৪ সালে মার্চে হারারেতে তৃতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ৮ রানে জয়ী এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মোঃ আশরাফুল। হারারেতে জিততে না পারলেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন খালেদ মাহমুদ সুজন। নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৩৯ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন আফতাব আহমেদ। ডিসেম্বরে ভারতকে ১৫ রানে হারিয়ে দেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে জয়ের ক্ষেত্রে অলরাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী মাশরাফি বিন মর্তুজা ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্রিকেটে জয়ী হয় বাংলাদেশ। ৪৫ রানে ৬টি উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন এনামুল হক জুনিয়র। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সিরিজে জয়ী হলে ১৮টি উইকেট নিয়ে এনামুল ম্যান অব দ্য সিরিজ হন। একই মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজে ৩-২ ম্যাচে জয়ী হয় বাংলাদেশ। ০-২-এ পিছিয়ে যাওয়ার পরও শেষ ৩ ম্যাচ জেতায় সিরিজ আসে বাংলাদেশের ঘরে। তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচে মানজারুল ইসলাম রানা এবং পঞ্চম ম্যাচে মোঃ রফিক ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটে-বলে ক্রমান¦য়ে সাফল্য দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
নাজমুল হোসেন, এনামুল হক জুনিয়র, আফতাব আহমেদ, নাফিস ইকবাল, রাজিন সালেহ, মাশরাফি বিন মর্তুজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, তাপস কুমার বৈশ্যরা বাংলাদেশের ক্রিকেটের আগামী দিনের বিজ্ঞাপন। ১৮ থেকে ২২ বছর বয়েসী এই তরুণরা তারুণ্যের দীপ্তিতে ভাস্বর। রকিবুল হাসানদের কাছে যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাটা ছিল স্বপ্ন, সেখানে নতুন প্রজন্মের এই ক্রিকেটাররা দাপটের সঙ্গে খেলে জয়ের স্বপ্ন দেখেনÑ এটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের বদলে যাবার সত্যিকার চিত্র।
পড়শি, মে ২০০৫
ক্রিকেট : খেলা না ভিডিও গেমস
ত্রিকেটকে খেলা বলা যায় কিনা ইদানীং এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। যে কোনো খেলায় একজন দর্শকের প্রাপ্তি তাৎক্ষণিক উত্তেজনা, অনির্বচনীয় আনন্দ ও সূক্ষ্ম রস; কিন্তু ক্রিকেট থেকে এ বিষয়গুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনিতে ক্রিকেট কখনোই সর্বসাধারণের খেলা হয়ে উঠতে পারেনি। না পারার সঙ্গত কারণও রয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের গর্ভে ক্রিকেটের জন্ম এবং তারাই ক্রিকেটের লালন-পালন ও পরিচর্যা করে এসেছে। আর ব্রিটিশদের সম্পর্কে খুব বেশি ভালো ধারণা অন্তত আমাদের নেই, আমরা যারা ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিলাম। এখনো গোরা সাহেবদের চাবুকের সেই দাগ আমাদের শরীরে লেগে আছে। অবশ্য সাধারণ ব্রিটিশদের কাছেও ক্রিকেট খেলাটি খুব বেশি আদরণীয় নয়।
সেই সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে ব্রিটিশ ঘরানার জমিদার ও অভিজাতরা। আর এ সম্প্রদায়ের অর্থবিত্ত-প্রতিপত্তি কীভাবে গড়ে ওঠে, সেটা সাধারণ মানুষ পলে পলে অনুভব করতে পারেন। উচ্চবিত্ত এ সম্প্রদায় নিজেদের বিনোদনের খোরাক হিসেবে বেছে নেয় ক্রিকেটকে। তাদের তো আর অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থান নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমনÑ লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন! জীবনের মূল কথা ছিলÑ খাও-পিও-মস্তি করো। হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। অলস সময়টুকু উপভোগের অন্যতম একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে ক্রিকেট। মিঠে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে পানপাত্রে একটু একটু চুমুক দিয়ে মেতে উঠতেন ক্রিকেটের ‘সুধা’রসে। ক্রিকেটের বিচরণ ছিল নির্দিষ্ট একটি গ-িতে আবদ্ধ। সাধারণ মানুষ এর নাগাল পেতেন না। পেতেন তখন যখন ক্রিকেটের সরঞ্জাম আর পানপাত্র আনা-নেয়া কিংবা তাদের সেবায় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হতো। যে খেলাটি ছিল কিছু লোকের বিলাস-ব্যসন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিল না, তাকে খেলা হিসেবে কতটা বিবেচনা করা যায়!
ক্রিকেটের গ-িটা তখনই কিছুটা সম্প্রসারিত হয়। যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ক্রমেই ছলে-বলে-কৌশলে বিস্তার লাভ করতে থাকে। উচ্চ শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে সৈনিক, বণিক ও পাদ্রীরা ক্রিকেটকে সঙ্গে নিয়ে যান। তাতে যে ক্রিকেট নতুন নতুন অঞ্চলে প্রসার লাভ করেছেÑ তা নয়। খেলাটি সীমাবদ্ধ থেকেছে বনেদী, অভিজাত ও শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এলেও ক্রিকেট যে খুব বেশি চাউর হয়েছেÑ সে কথাও বলা যাবে না। যুগ যুগ ধরে ক্রিকেটে দাপট দেখিয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড এবং জিম্বাবুয়ের শ্বেতাঙ্গরা। এসব দেশে যারা ক্রিকেট খেলেন, তারা তো ব্রিটিশদের একটি সংস্করণ। এদের বাইরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশ। এক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোয় ক্রিকেট এসেছে ব্রিটিশদের গুণগ্রাহী রাজ-রাজরাদের হাত ধরে। ভারতীয় উপমহাদেশের শুরুর দিকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করতেন রাজা-মহারাজারা। ব্যাটিং-বোলিংয়ে পারদর্শিতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী না থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রধান গুণ, তারা ছিলেন নীল রক্তের অধিকারী। ক্যারিবীয়রা ভালোবেসে ক্রিকেট খেলেছেন, তেমনটি বলা যাবে না। তাছাড়া দু’একটি ছাড়া এখন অবধি কোনো দেশেই ক্রিকেট কিন্তু জনপ্রিয়তম খেলা নয়। সামগ্রিকভাবে ক্রিকেটটা ছিল শোষক-শাসকদের আভিজাত্য ও বনেদিয়ানার একটি প্রকাশ। তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদাÑ এটার প্রকাশ ঘটতো ক্রিকেটের মাধ্যমে। ক্রিকেটের পরিসর সীমিত গ-িতে আবদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ ক্রিকেটকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ কখনোই আপন ভাবতে পারেনি। ব্যয়বহুল এ খেলাটির পেছনে যে অর্থ ও সময় অপচয় হয়, তা সাধারণ মানুষের কাছে এক ধরনের বিলাসিতা। এটা তাদের কাছে বিনোদন হয়ে উঠতে পারেনি। ইদানীং অবশ্য কোনো কোনো দেশে ক্রিকেটটা হুজুগ হয়ে দেখা দিয়েছে।
শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে ক্রিকেটকে মনে হয়েছে অভিজাত সম্প্রদায়ের একটি ব্যাপার-স্যাপার। তেমনি প্রতীয়মান হযেছে দুর্বোধ্য একটি বিষয় হিসেবে। পোশাক-আশাকের ভারিক্কিয়ানা, চলন-বলন আর নানা এটিকেট তো আছেই, সে সঙ্গে ক্রিকেটে এত বেশি নিয়ম-কানুন আর জটিলতাÑ তার প্যাঁচ খুলে রসাস্বাদন করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। প্রতিটি বল ও প্রতিটি শটের যে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তা বোঝা রীতিমত গবেষণার ব্যাপার। কত আইন, কত পরিসংখ্যান, কত রেকর্ডÑ তার কোনো ইয়ত্তা নেই। খেলাধুলা মানেই তো জীবনের যাবতীয় জটিলতা থেকে ক্ষণিকের মুক্তি, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ ও নির্মল বিনোদন। অথচ ক্রিকেটে আছে এক ধরনের জটিলতা, আইন-কানুন, পরিসংখ্যান ও রেকর্ডের মারপ্যাঁচ। মুক্তি, আনন্দ ও বিনোদন তো দূরে থাকুক, উপরন্তু ক্রিকেট মাঠে জেঁকে বসে এক রাশ কান্তি, অবসন্নতাÑ সর্বোপরি অবোধ্য এক ধাঁধা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে থাকতে পেয়ে বসে একঘেয়েমি। একটানা মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ক্রিকেটের এমন কিছু নিয়ম-কানুন আছে যার কোনো সদুত্তর আজো মেলেনি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের যে পালাবদল ঘটছে, তাতে ক্রিকেটকে আদৌ খেলা বলা যায় কিনাÑ সে প্রশ্নটি আরো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। যে কোনো খেলায় চটজলদি যে উল্লাস ও আনন্দ, ক্রিকেটে তা লুপ্ত হতে চলেছে। ক্রিকেটে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের ভূমিকাই বড় হয়ে উঠছে। ক্রিকেটে প্রযুক্তির ব্যবহার যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে ক্রিকেটকে কম্পিউটার বা ভিডিও গেমসের সম্প্রসারণ বললে অত্যুক্তি হবে না। ক্রিকেটের সঙ্গে টেলিভিশনের মেলবন্ধন ঘটে ১৯৩৬ সালে। ওই বছর নভেম্বরে লন্ডনে প্রথম ক্রিকেট খেলা সম্প্রচার করা হয়। সত্তর দশকে খেলাধুলায় টেলিভিশনের যুগ শুরু। স্পোর্টস কভারেজের ক্ষেত্রে রীতিমত বিপ্লব নিয়ে আসে টেলিভিশন। টেস্ট ক্রিকেটকে শ্লথ ও মন্থর আখ্যা দিয়ে ১৯৭১ সালে প্রবর্তন করা হয় ওয়ানডে ক্রিকেট। ওয়ানডে ক্রিকেটের খোলনলচে পাল্টে দেন ধনকুবের কেরি প্যাকার। অস্ট্রেলিয়ার চ্যানেল নাইন টিভির মালিক এ ভদ্রলোক ক্রিকেটে প্রাণ আনার জন্য ১৯৭৭ সালে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। অন্যান্য খেলার মতো ক্রিকেটে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য ক্রিকেটকে রঙিন করে তোলেন। প্রবর্তন করেন দিন-রাতের ক্রিকেট। ফাডলাইটে খেলার আয়োজন করা হয়। খেলোয়াড়দের গায়ে চড়ান নানারঙের পোশাক। টেলিভিশনে স্লো-মোশনে রানআউট, স্ট্যাম্পিং কোজ ক্যাচ ইত্যাদি নির্ধারণ এবং মেয়েদের দিয়ে মাঠে রোলার টানা, ড্রিংকস সার্ভ করাসহ নানাভাবে ক্রিকেটকে গতিময় ও গ্ল্যামারাস করা হয়। নিরুত্তাপ ও প্রাণহীন ক্রিকেটে খেলার উত্তাপ, উত্তেজনা ও প্রাণপ্রাচুর্য সংযোজন ঘটানোর কতোই না কসরত! আর এ প্রবর্তনগুলো ধীরে ধীরে মেনে নিতে বাধ্য হয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি। ১৯৭৯ সালে সিডনি ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটের প্রথম ওয়ার্ল্ড সিরিজ আনুষ্ঠানিকভাবে খেলা হয় ফাডলাইটে। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করা হয় থার্ড আম্পায়ারের। কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশয় সৃষ্টি কিংবা ফিল্ডারদের ক্রমাগত চাপের মুখে দুই আম্পায়ারকে থার্ড আম্পায়ারের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। থার্ড আম্পায়ার স্লো-মোশনে বারবার ভিডিও রিপ্লে দেখে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেন, তাতে গতিহীন খেলা ক্রিকেট আরো বেশি মন্থর হয়ে পড়ছে। আম্পায়ারদের ভূমিকা ক্রমেই গৌণ হয়ে যাচ্ছে। তারা রীতিমত রোবট হয়ে পড়ছেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি তাদের চালিত করছে। রানআউট, স্ট্যাম্পিং, কটবিহাইন্ড, কোজ ক্যাচ, বাউন্ডারির পাশাপাশি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত সুপার সিরিজে প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করা হয় টিভি রিপ্লে দেখে এলবিডব্লিউ ও নো-বলের সিদ্ধান্ত প্রদান। আম্পায়ারদের কোমরে ওয়্যারলেস, কানে বিশেষ ধরনের হেডফোন এবং সিদ্ধান্তের জন্য প্রতি মুহূর্তে থার্ড আম্পায়ারের অপেক্ষায় থাকায় প্রশ্ন উঠেছেÑ আম্পায়ার কি ডিসিশন মেকার, নাকি কোট-হ্যাঙ্গারস? থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত প্রদান করতে গিয়ে মাঠে সৃষ্টি হয় এক ধরনের নাটকীয়তা। থার্ড আম্পায়ার সিদ্ধান্ত দেয়ার পর খেলোয়াড়রা তাৎক্ষণিক সাফল্য উদযাপন ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতে পারেন না। খেলোয়াড় ও দর্শকরা যে আনন্দটুকু পান, তা ভিডিও বা কম্পিউটার গেমস খেলার বা দেখার আনন্দ। খেলার আনন্দের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
ক্রিকেটের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে জটিলতা। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রবর্তন করা হয় ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওয়ানডে ম্যাচে ওভার কার্টেল হলে খেলার ফলাফল নির্ধারণে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। দুরূহ এ নিয়ম বুঝতে হলে অঙ্কশাস্ত্রে রীতিমত প-িত হতে হয়। তারপরও হিসাব মেলানো সহজ নয়। আর এ নিয়ম এমনই অদ্ভুত কিসিমের যে, যার আগা-মাথা পাওয়া যায় না। ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দ্বিতীয় সেমিফাইনালটির কথাই ধরা যাক। ইংল্যান্ডের সঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে ব্যাহত হলে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকাকে টার্গেট দেয়া হয় ১ বলে ২২ রান করার জন্য। এটা কি সম্ভব? এমন সব অবাস্তব ও অসম্ভব বিষয়ই ক্রিকেটের শোভাবর্ধন করে চলেছে। ক্রিকেটটা যে খেলা হয়ে উঠতে পারেনি, তার কারণ নিত্যনতুন অদ্ভুত সব নিয়ম-কানুন। সম্প্রতি ওয়ানডে ক্রিকেটে বদলি ক্রিকেটার ও ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনের যে বিধিবিধান জারি করা হয়েছে, তা স্বয়ং ক্রিকেটাররাই ঠিকমত বুঝতে পারছেন না। যে নিয়ম খেলোয়াড়দের জন্য প্রযোজ্য, তারাই যদি সেটা অনুধাবন না করতে পারেন, তাহলে তা খেলার অংশ হয় কিভাবে?
আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ড মনে করেন, আগামী দিনগুলোতে ক্রিকেটে বড় ভূমিকা রাখবে টেলিভিশন ও কম্পিউটার প্রযুক্তি। সেক্ষেত্রে এখন যা হোক ক্রিকেটের কিছুটা ভূমিকা রয়েছে; কিন্তু আসছে দিনগুলোতে ক্রিকেট হবে কম্পিউটার গেমসের একটি উন্নত সংস্করণ। তখন হয়তো দর্শকদের মাঠে আসার প্রয়োজন পড়বে না। বাড়িতে বসেই তারা হয়তো কি-বোর্ডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ক্রিকেট খেলা।
দৈনিক সমকাল, ১ নভেম্বর ২০০৫
ক্রিকেটে প্রযুক্তি
ক্রিকেটে প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে বিতর্কের কোনো শেষ নেই। প্রযুক্তি কি ক্রিকেটকে এগিয়ে দিচ্ছে? নাকি ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে? এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো না গেলেও প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণটা বেড়েই চলেছে। ক্রিকেট খেলাটিকে এমনভাবে নিখুঁত করতে চাওয়া হচ্ছেÑ যা কেবলই কম্পিউটারে সম্ভব। এর ফলে মাঠের ভূমিকা ক্রমশ গৌণ হয়ে পড়ছে।
ক্রিকেট তো ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ক্রিকেটে ফেয়ার প্লে নিয়ে গর্ব করা হয়। বলা হয়, স্পিরিট অব ক্রিকেট কেবল অটুট আছে ক্রিকেটে। ক্রিকেটে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তার এখতিয়ার নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন না। প্রশ্নটা করাটা ক্রিকেটোচিত নয়। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। সত্তর দশকে শুরু হয় টেলিভিশন যুগ। খেলাধুলার কভারেজের ক্ষেত্রে টিভি যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেÑ ক্রিকেটও তা থেকে এখন আর দূরে নয়। আগামী দিনগুলোতে খেলাধুলায় টিভির ভূমিকা সম্পর্কে কেউ কল্পনাও করতে পারছেন না। টিভি কভারেজ ক্রমশ পেশাদারিত্ব অর্জন করছে। লাইভ কভারেজ ক্রিকেটের ক্ষেত্রে দারুণ প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বড় কথা, আম্পায়ারের ভূমিকাও পাল্টে দিচ্ছে টিভি। ক্রিকেটে আম্পায়ার হলেন জাজ, জুরি ও রায়দাতা। সেটাও এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ক্যামেরার চোখ আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ক্যামেরার চোখে আম্পায়ারের ভুল, নিখুঁত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সংশয় এবং সর্বোপরি আম্পায়ারের নিখুঁত সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে টিভি ক্যামেরা সহযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে কি নাÑ তা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। আর এসব কারণে ১৯৯২ সালে মেনে নেয়া হয় প্রযুক্তির ভূমিকাকে। প্রথমবারের মত থার্ড আম্পায়ার ক্রিকেটের অংশ হয়ে ওঠে। থার্ড আম্পায়ার অ্যাকশন রিপ্লে দেখে মাঠের আম্পায়ারকে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। শুরুতে রান আউট ও স্ট্যাম্পিং-এর সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল। প্রযুক্তির এই নতুন ভূমিকা ক্রিকেটের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ায় তার আধিপত্য ক্রমান¦য়ে বাড়তে থাকে। এরপর কোজ ক্যাচ, কট বিহাইন্ড, বাউন্ডারির সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে থার্ড আম্পায়ারের শরণাপন্ন হওয়ার বিধান চালু হয়। ২০০২ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রযুক্তির নতুন সংযোজন হয়। প্রবর্তন করা হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হকআই। এছাড়াও ব্যবহার করা হয় স্ট্যাম্প মাইক্রোফোন। এর সাহায্যে এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। আম্পায়ারকে দেয়া হয় হেড ফোন। যাতে বলÑ ব্যাট ও বল-প্যাডের সংঘর্ষের শব্দ শুনে তিনি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। সে সময় যে পরীক্ষা চালানো হয়, তারই ধারাবাহিকতায় এবার অস্ট্রেলিয়ায় সুপার সিরিজে থার্ড আম্পায়ার টিভি রিপ্লে দেখে এলবিডব্লিউ ও নো-বলের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
ক্রিকেটে একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল, ব্যাটসম্যানদের বেনিফিট অব ডাউট সুবিধা দেয়া। এর অর্থ হলো, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আম্পায়ারের কোনো রকম সংশয় থাকলে, সেক্ষেত্রে সুবিধাটুকু ব্যাটসম্যানের অনুকূলে দেয়া হয়। এ বিষয়টি নিয়ে এখন প্রযুক্তি প্রশ্ন করছে। এখন এ বিষয়ে আম্পায়ারের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর কারণ, ক্যামেরা দুটি ডাইমেনশনাল ছবি উপস্থাপন করে। ছবিগুলো নেয়া হয় সুনির্দিষ্ট কোণ, উচ্চতা ও দূরত্ব থেকে। এর অর্থ, একটি কোণ থেকে ছবি দেখলে পুরো চিত্র দেখা সম্ভব নয়। দেখা যায় খি ত অংশ। অনেক সময় দুটি ডাইমেনশনাল ছবি দেখেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। ২০০২ সালের নভেম্বরে অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার জাস্টিন ল্যাঙ্গার ক্যাচ নেন মাইকেল ভনের। ল্যাঙ্গারের নেয়া ক্যাচটি যথাযথ হওয়া সত্ত্বেও বলটি মাটি স্পর্শ করেছে কি না, রিপ্লে যথাযথভাবে উত্তর দিতে না পারায় বেঁচে যান ভন। যেখানে ১৯ রানে শেষ হয়ে যেতে পারতো তার ইনিংস, সেখানে তিনি ১৭৭ রান করেন। পরের মাসে ইংল্যান্ড-ভারত টেস্ট সিরিজে ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসাইনের ক্যাচ নেন বীরেন্দ্রর শেবাগ। এটি ছিল লো ক্যাচ। হুসাইন মনে করেন, শেবাগ ক্যাচটি মাটি থেকে নিয়েছেন। যথারীতি থার্ড আম্পায়ার একাধিকবার রিপ্লে দেখে নিশ্চিত হতে না পারায় বেনিফিট অব ডাউট পান নাসের হুসাইন। প্রযুক্তি সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিষয়গুলো নির্ভর করে ক্যামেরার উচ্চতা, কোণ, স্পিড অব দ্য ফ্রেম, দুটি ডাইমেনশনাল ইমেজ ও ঘটনাস্থল থেকে ক্যামেরার দূরত্বের ওপর। প্রযুক্তি পরামর্শ প্রদান করতে পারে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।
ক্রিকেট খেলা ধীরে ধীরে পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিপুল অর্থ। এ কারণে খেলোয়াড় ও দর্শকরা চান নিখুঁত সিদ্ধান্ত। অনেক সময় আম্পায়ারের একটি ভুল সিদ্ধান্তে একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে অনেকেই আম্পায়ারের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। তাদের কাছে প্রযুক্তিই শেষ কথা। অন্য পক্ষের অভিমত হচ্ছে, অতিমাত্রায় প্রযুক্তি-নির্ভরশীলতার কারণে ক্রিকেটের নান্দনিক সৌন্দর্য আর থাকছে না। ক্রিকেট তো একটা খেলা। বিজ্ঞান নয়। সবকিছুই নিখুঁত হবেÑ এমন তো কথা নয়। আম্পায়ারের কিছুটা ভুল-ভ্রান্তি হতেই পারে। মানবিক ভুল তো খেলারই একটি অংশ। খেলার মাঠের লোকেরা যদি সৎ থাকেন, তাহলে তো কোনো সমস্যা থাকে না। ক্রিকেট তো যুগ যুগ ধরে ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ খেলায় আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটসম্যানের তো মাঠ ছেড়ে চলে যাবার কথা কিংবা আউট না হলে তো ফিল্ডারের আবেদন করার কথা নয়। এটাই তো স্পোর্টসম্যানশীপ। এটাই তো স্পিরিট অব দ্য ক্রিকেট।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ নভেম্বর ২০০৫
বিশ্ব ক্রিকেটের ‘সোনার রাজহাঁস’ উপমহাদেশ
ক্রিকেট খেলাটা ব্রিটিশদের হলেও এর জনপ্রিয়তা মূলত সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এলাকায়। সত্যিকার অর্থে ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া। এ দেশগুলোতে ব্রিটিশদের পা না পড়লে ক্রিকেট খেলাটা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া হিসেবে স্থান করে নিতে পারতো কিনা সন্দেহ থেকে যায়। তারপরও ক্রিকেটের যতই বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেয়া হোক না কেন, এখনো এর চৌহদ্দি খুবই সীমিত। চাঁছা-ছোলাভাবে বললে বলা যায়Ñ এখন ক্রিকেটের সঞ্জীবনী হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া। জনপ্রিয়তার মানদ-টা নিজেদের প্রান্তে হেলানো তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরও দাঁড় করানোর কৃতিত্ব তাদের। আসলে ক্রিকেট নামক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বদলে গেছে দক্ষিণ এশিয়া। আরো সংক্ষেপে বলা যায়Ñ উপমহাদেশের জীবনযাত্রা। উপমহাদেশে ক্রিকেটটা এখন আর খেলা নয়, হয়ে উঠেছে প্রাত্যহিকতার অংশ। অধিকাংশ লোক হয় ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করেন, নতুবা টেলিভিশনে খেলা দেখেন। খেলা চলাকালে টান টান উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকেন কোটি কোটি দর্শক। এটা যেন হয়ে উঠেছে উপাসনার মতো। খেলার দিনটিতে কোনো কোনো এলাকা অঘোষিতভাবে পরিণত হয় সরকারি ছুটিতে। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেটানুরাগীরা ক্রিকেট খেলার সর্বশেষ আপডেট জানার জন্য প্রতি মুহূর্তে ইন্টারনেটের ক্রিকেট ওয়েবসাইটে কত বিলিয়ন ‘হিট’ করে থাকেন, তা বলা মুশকিল। মজার বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের বড় একটা অংশ বিদেশে পাড়ি দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। অথচ প্রবাসী হওয়ার পর মন পড়ে থাকে নিজ দেশের ক্রিকেট খেলার খবর জানার জন্য। বিশ্বব্যাপী উপমহাদেশের মানুষের পরিচয় জাহির হয় ক্রিকেটের মধ্যে কেন্দ্রীভূত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং আবেগময় অনুভূতির মাধ্যমে। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা মানসিক যন্ত্রণার কারণ হলেও ক্রিকেটটা বুক ফুলিয়ে বলার মতো একটা ‘ব্র্যান্ড নেম’-এ পরিণত হয়েছে। ইন্ডিয়ান কারির মতো ক্রিকেটও পেয়েছে সর্বব্যাপিতা। উপমহাদেশে বিতর্ক, বাদানুবাদ ও আলোচনার অভিন্ন বিষয় ক্রিকেট টিম, ক্রিকেটার, ক্রিকেটিং শট, পিচ ও খেলার কৌশল। এটা এমন একটা ক্ষেত্র যেখানে শ্রেণী, ধর্ম ও জাতীয়তা এক হয়ে যায়। তাছাড়া নিজেদের ক্রিকেট টিম নিয়ে যেভাবে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হয়, তাতে এ বিষয়ে লেখা যেতে পারে অসংখ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ। উপমহাদেশে যে কোনো জয়েই জাতীয় উৎসব এবং খেলোয়াড়রা দেবতা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। আর পরাজয়ের অর্থ জাতীয় বিপর্যয়।
উপমহাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ভারত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের স্বাগতিক ভারত এবং পাকিস্তান, ১৯৯২ সালের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এবং চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা, ১৯৯৯ সালের আসরে রানার্সআপ পাকিস্তান এবং ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের রানার্সআপ ভারত। প্রথম দুটি ব্যতীত প্রতিটি বিশ্বকাপে উপমহাদেশের কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বকাপ পর্যায়ের আর কোনো খেলায় উপমহাদেশের এমন সাফল্য কিংবা এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা নেই। মানুষ সাফল্যের পূজারী। সে সঙ্গে চায় বিজয়ী এবং বীরের সান্নিধ্য। ক্রিকেটেই কেবল এটা সম্ভব। দলীয়ভাবে সাফল্য না এলেও ক্রিকেটে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে দর্শক হৃদয় জয় করে নেয়া যায়। আর এক্ষেত্রে টেক্কা মেরেছে উপমহাদেশের ক্রিকেটাররা। ব্যক্তিগত রেকর্ড এবং ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের দিক দিয়ে তারা তুলনারহিত। উপমহাদেশে ব্যক্তিপূজা তো প্রবাদের পর্যায়ে পড়ে। ক্রিকেটে এ সুযোগটা সহজেই পাওয়া যায়। আর তা কাজে লাগানের জন্য মুখিয়ে থাকে কর্পোরেট হাউসগুলো। জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যদি মাপা হয়, সেদিক দিয়েও দক্ষিণ এশিয়ার জয়জয়কার। বিশ্বকাপে এ যাবৎ অংশ নিয়েছে ১৭টি দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ৪টি বাদ দিলে বাকি ১৩টি দেশের মোট জনসংখ্যা ২৫ কোটিও হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ১৫০ কোটি। এই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ক্রিকেট অনুরাগী। জনসংখ্যার ২০ শতাংশও যদি ক্রিকেটের সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলেও বাদবাকি দেশের জনসংখ্যার তুলনায় তা বেশি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও উপমহাদেশের অবস্থানটা সুসংহত। কর্পোরেট জগতে উপমহাদেশ যেন একটি সোনার রাজহাঁস। আর এই রাজহাঁসের বদান্যতায় ফুলে-ফেঁপে উঠছে ক্রিকেট দুনিয়া। একদিনে টানা প্রায় আট ঘণ্টা খেলা হওয়া এবং তাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের রমরমা সুযোগ আর কোথায় মিলবে? ১৯৯২ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বাজেট ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। অথচ বর্তমানে বিশ্বের ধনী ক্রিকেট বোর্ড তারা। বছরে আয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ১৯৯৯ এবং ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অর্থনৈতিক সাফল্যের হার ছিল অনেক বেশি। এর কারণ, ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান এবং ২০০৩ সালের ফাইনালে ভারতের খেলায় রাজস্ব আয় বেড়ে যায় হু হু করে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে বিজ্ঞাপন খাতে ব্যয় হয় প্রায় ২২২ মিলিয়ন ডলার। এর অধিকাংশই এসেছে ভারতীয় কর্পোরেট হাউস থেকে।
রেকর্ড পরিমাণ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যে সম্প্রচার রাইট কেনা হয়, তার মূল টার্গেট উপমহাদেশের ক্রিকেট উন্মাদনা। এই ক্রিকেট-ক্ষেপামিকে পুঁজি করে বিলিয়ন ডলারের জুয়ায় নামে স্পোর্টস চ্যানেলগুলো। এখন ক্রিকেট বিপণনের ক্ষেত্রে সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠা ভারত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ রাজস্ব সরবরাহ করে থাকে। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের রোজ বৌলে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উদ্বোধনী ম্যাচে স্থানীয় কোম্পানির একটিও বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড ছিল না। প্রতিটি বিজ্ঞাপনদাতাই ছিল উপমহাদেশের কোম্পানি। টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ভারত শুরুতে খেলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে মাথায় হাত পড়ে যায় আইসিসির। শেষ পর্যন্ত ভারত রাজি হওয়ায় তাদের মধ্যে ফিরে আসে স্বস্তি। আইসিসি ভালো করেই জানে, ভারত না খেললে সে টুর্নামেন্টের কর্পোরেট মূল্য খুব বেশি থাকে না। আইসিসির প্রধান নির্বাহী ম্যালকম স্পিড মনে করেন, অন্য যে কোনো দেশের যে কোনো খেলার তুলনায় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলা নিয়ে আবেগ-উচ্ছ্বাস ঢের ঢের বেশি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ ক্রিকেট এখন কড়া নাড়ছে দুয়ারে। আর এ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে উপমহাদেশীয়দের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। বিক্রি হয়ে গেছে বিশ্বকাপে ভারত এবং বাংলাদেশের ম্যাচের টিকিটের ৯০ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয়, বাংলাদেশী এবং শ্রীলঙ্কানরা তাদের দেশের খেলা দেখার জন্য বুকিং দিয়েছেন মেলবোর্নের ফেডারেশন স্কোয়ারের ঢাউস সাইজের স্ক্রিন। এ দুটি দেশের যা পারফরমেন্স, তাতে এ ধরনের হুজুগে অন্যরা অবাক হয়ে যায়। ক্রিকেটের দুর্ধর্ষ টিম অস্ট্রেলিয়ায়ও ক্রিকেট নিয়ে এত হুল্লোড় নেই। বস্তুুত দক্ষিণ এশিয়ায় এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। এখানে হুজুগটাই প্রধান আকর্ষণ। এমনিতেই ক্রিকেটে হুজুগের কোনো কমতি নেই। আর বিশ্বকাপ এলে তো ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবারই পোয়াবারো।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭
সাগরতীরে ক্রিকেটের মহোৎসব
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অভিষেক হয় ক্রিকেটের কুলীন দেশ ইংল্যান্ডে। উপর্যুপরি তিনবার ক্রিকেটের মাতৃভূমিতে আয়োজিত হওয়ার পর ভাবা হয়েছিল, বিশ্বকাপটা বোধ হয় পরিণত হলো ব্রিটিশদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে। কিন্তু ভুলটা ভেঙে যায় ১৯৮৭ সালে। বলা যায়, আমাদের বাড়ির আঙিনায় বসে বিশ্বকাপের আসর। উপমহাদেশের দুই পরাক্রম শক্তি ভারত এবং পাকিস্তান ছিল আয়োজক। এরপর তো বিশ্বকাপটা পর্যায়ক্রমে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা, ফের ইংল্যান্ড এবং সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার ‘আতিথ্য’ পেলেও কোথায় সেই ক্যালিপসো সুর? যেখানে ফুল, অর্ঘ্য আর সমর্পণ দিয়ে আরাধনা করা হয় ক্রিকেটকে, যেখানে ক্রিকেটের মাধ্যমে গাঁথা হয় ভালোবাসা আর ঐক্যের মালা, সেখানে কেন বসে না বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহোৎসব? অন্তহীন এক প্রশ্ন হয়ে ঝুলতে থাকে মনের নৈর্ঋত কোণে। এমনিতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে কৌতূহলের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামক ভূখ-টির দৃশ্যপট যখন আমাদের চোখে উদ্ভাসিত হয়, তাতে হৃদয়ে জ্বালিয়ে দেয় খুশির রঙমশাল। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের আনন্দনিকেতনে আকাশজুড়ে নীল রোমান্টিকতা, সাগরের কোলে নয়ন জুড়ানো নক্ষত্রের মতো দ্বীপমালা, নারকেলবীথিকা, সবুজের নান্দনিক নিসর্গ, শ্বেত-শুভ্র সৈকতে সার বেঁধে থাকা পাম গাছ, মহাসাগরের ফেনিল ঢেউ, গাঙচিলের উদাসীনভাবে উড়ে যাওয়া, দ্বীপের বৈচিত্র্যময় ও স্পন্দনশীল জীবনযাত্রা হৃদয়কে রাঙিয়ে দেয় সপ্তবর্ণে। এর সঙ্গে বর্ণিল ক্রিকেট যোগ হয়ে মনটাকে করে দেয় উন্মনা।
ক্যারিবীয় অঞ্চলে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে খেলাটা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত উৎসব। ক্রিকেটটা সেখানে নিছক কোনো খেলা নয়। এটা এমন একটা জীবনধারা, যার মূল কথা খাও-পিও-মস্তি করো। খেলার সময় ঢেউ হয়ে উপচে পড়ে রঙ এবং সঙ্গীত। বঙ্গোস আর শিঙ্গার সম্মিলনে বাজতে থাকে ঝাঁজালো ক্যালিপসো। এছাড়াও কত রকমের সুর ও সঙ্গীত যে আন্দোলিত করেÑ ডান্সহল, মেন্টো, রেঁগে, স্কা, সোকা। জীবনের সঙ্গে তারা মিলিয়েছেন সঙ্গীতকে। সঙ্গীতের বাদ্য-যন্ত্র ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্রিকেটটা থেকে যায় অসম্পূর্ণ। ছন্দোময় আবহ তৈরির জন্য দর্শকরা স্টেডিয়ামে নিয়ে যান শাঁখ, ড্রামসহ নানা সরঞ্জাম। তবে খেলায় বিঘœ সৃষ্টি হয়Ñ এমন কিছু তারা কখনোই করেন না। বলে বলে নয়, খেলার ফাঁকে ফাঁকে বেজে ওঠে সুরের উদ্দামতা। দৃশ্যত খেলার অবস্থার সঙ্গে সঙ্গীতের মেজাজের তারতম্য ঘটে। কেউ একজন শুরু করার পর পুরো গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে সুর। নানারকম উন্মাতাল নাচ তো আছেই। নাচে-গানে স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে কনসার্ট-হল। একই সঙ্গে প্রকাশ ঘটে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি, ঝলমলে জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্যের।
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ বাঁধা আছে আবেগময় বন্ধনে। আর এই বন্ধনের মূল সূত্র হলো ক্রিকেট। আটলান্টিক আর ক্যারিবীয় সাগরের কোল ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে ছবির মতো সাজানো দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক কোনো বন্ধন নেই। অবশ্য আত্মিক একটা সম্পর্ক তো আছেই। মহাসাগরের ঢেউ এসে একই সঙ্গে এ দেশগুলোকে দুলিয়ে দিয়ে যায়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাপনের সুর তো একই তার থেকে উৎসারিত। এ কারণেই তারা পেরেছেন সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি আর ভালোবাসার মালা গাঁথতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ‘বোধ’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ক্রিকেটটা ব্রিটিশদের খেলা হলেও তাকে সুর আর ছন্দ দিয়ে প্রাণময় করেছেন তারা। ক্রিকেটটাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেও তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। কেননা, ক্রিকেটকে তারা রাঙিয়েছেন জীবনের রঙে। এই রঙে রঙিন হয়েছেন দেশ-বিদেশের তাবৎ ক্রিকেটানুরাগী। তার আগে রাজ-রাজড়াদের খেলা হিসেবে ক্রিকেট সর্বসাধারণের কাছে তেমনভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এক সময়ের পরাধীন কালো মানুষেরা ক্রিকেটকে আপন করে নেয়ার পর তা লুফে নেয় সব জাতি, সব শ্রেণী, সব ধরনের মানুষ। তারা ক্রিকেটটাকে নেন ‘বিউটিফুল গেম’ হিসেবেÑ যেখানে নিয়ম ও লক্ষ্য সবার জন্য এক ও অভিন্ন। কোনো ভেদাভেদ না রেখে হাতে হাত মিলিয়ে মেতে ওঠা যায় ক্রিকেটের আনন্দযজ্ঞে। ছোট ছোট দ্বীপ থেকে উঠে এসেছেন অনেক বড় মাপের ক্রিকেটার। ক্রিকেটার হিসেবে যেমন তাদের তুলনা হয় না, মানুষ হিসেবেও তারা অনুসরণীয়। তাদের জীবনবোধ, জীবনদর্শন ও জীবনভেদ ক্রিকেটকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। তাদের মহত্ত্ব, মহানুভবতা ও মহাবল আকৃষ্ট করেছে পিছিয়ে পড়া মানুষদের।
ক্রিকেটের যেখানে এত রূপ, এত রস, এত গন্ধÑ সেখানে যখন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসর বসছে, তখন তো সোনায় সোহাগা। এমনিতেই প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর জগতবিখ্যাত ক্রিকেটারদের মাতৃভূমি হিসেবে ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোর অন্যরকম আর্কষণ রয়েছে, এর সঙ্গে যোগ হবে উৎসবের আনন্দ। কিংবদন্তি জর্জ হ্যাডলি, আলফ ভ্যালেন্টাইন, মাইকেল হোল্ডিং, লরেন্স রো, জেফ ডুজন, কোর্টনি ওয়ালশ, জিমি অ্যাডামস, ক্রিস গেইলের দেশ জ্যামাইকার ‘সাবিনা পার্ক স্টেডিয়ামে’ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ও একটি সেমিফাইনালসহ অনুষ্ঠিত হবে সাতটি ম্যাচ। স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়াও এ ভেন্যুতে খেলবে পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ড। অন্যান্য ভেন্যু থেকে কিছুটা দূরের মসলাদার এই ভূখ-ে আছে দীর্ঘদেহী ‘ব্লু মাউন্টেন’, দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডা পরিচিত স্যার ভিভ রিচার্ডস, অ্যান্ডি রবার্টস, রিচি রিচার্ডসন, কার্টলি অ্যামব্রোসের দেশ হিসেবে। নবনির্মিত অত্যাধুনিক ‘স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে’ অনুষ্ঠিত হবে সুপার এইট পর্বের ছয়টি ম্যাচ। বাড়তি আকর্ষণ ঐতিহাসিক পোতাশ্রয় ‘নেলসন্স ডকইয়ার্ড’, সাগরে সহজাতভাবে গড়ে ওঠা তোরণ ‘ডেভিলস্ সেতু’, সুস্বাদু খাবার। দুরন্ত সাগরের নীল ঢেউ তো আছেই। কিথ আর্থারটন, স্টুয়ার্ট উইলিয়ামস, রুনাকো মর্টনের ‘সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস’ দেশটি খুবই ছোট্ট। একান্ত নিভৃতে গড়ে ওঠা স্টোন-কটেজগুলো সাজানো অ্যান্টিক ও গ্রন্থ দিয়ে। জুয়েলারি, ঘড়ি ও পানীয়’র জন্য খ্যাত দ্বীপটির নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা ‘ওয়ার্নার পার্ক স্টেডিয়ামে’ ছয়টি ম্যাচে খেলবে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, হল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড। ভেন্যু হিসেবে বিশ্বকাপের আয়োজক হলেও ক্রিকেটে মোটেও সুখ্যাতি নেই সেন্ট লুসিয়ার। বিমুগ্ধকর পাহাড়ঘেরা দৃশ্যপট এবং বিস্ময়কর সৈকতের জন্য এ দ্বীপটিকে ‘রোমান্টিক আইল্যান্ড’ বলা হয়। বঁসেজর স্টেডিয়ামে খেলা হবে একটি সেমিফাইনালসহ সাতটি ম্যাচ। খেলবে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও কেনিয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ক্রিকেটীয় লাবণ্য, সুষমা ও সৌন্দর্য দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে বার্বাডোস। ‘নীলপদ্ম ফুল’ হয়ে ফুটে ক্রিকেট বিশ্বকে সুরভিত করেছেন স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভার্টন উইকস, কাইভ ওয়ালকট, কনরাড হান্ট, স্যার গারফিল্ড সোবার্স, ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ, সেম্যুর নার্স, গর্ডন গ্রীনিজ, জোয়েল গার্নার, ডেসমন্ড হেইন্স, ম্যালকম মার্শালের মতো কিংবদন্তিরা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বাধিক ক্রিকেটার উঠে এসেছেন এই দ্বীপ থেকে। ক্রিকেটের এমন একটি স্বর্ণখনির ‘কেনসিংটন স্টেডিয়ামে’ সুপার এইটের ছয়টি ছাড়াও অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল ম্যাচটি। দ্বীপটিতে আছে নানারকম বাগান, মনকাড়া ঘর-বাড়ি, সাফারি ট্যুর এবং সমুদ্রে দুঃসাহসী অভিযানের হাতছানি। ক্রিকেট ঐশ্বর্যে গ্রেনেডা খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। এ দ্বীপের ক্রিকেটার জুনিয়র মুরে, ডেভন স্মিথ খুব বেশি পরিচিত নন। ‘কুইন্স পার্ক গ্রেনাডায়’ খেলা হবে সুপার এইটের ছয় ম্যাচ। হারিকেন আর আগ্নেয়গিরির জন্য কুখ্যাত এ দ্বীপটিতে সৌন্দর্যেরও কমতি নেই। গাছপালা, গির্জা, দুর্গ, জাদুঘর, স্মৃতিস্তম্ভ, মিউজিক উৎসব এর প্রধান আকর্ষণ। সৈকত তো আছেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে পুরনো মাঠ ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর ‘কুইন্স পার্ক ওভাল’। লিয়ারি কনস্টানটাইন, সনি রামাধীন, ডেরেক মারি, ল্যারি গোমস, গাস লগি, ফিল সিমন্স, ইয়ান বিশপ, ব্রায়ান লারার দেশেই খেলবে বাংলাদেশ। এই গ্রুপে আরো আছে ভারত, শ্রীলংকা ও বারমুডা। ম্যাচ হবে ছয়টি। নির্জন সৈকত, অরণ্য, প্রবাল-প্রাচীর, বোটানিক গার্ডেন্স, নেচার সেন্টার, ঐতিহাসিক ভবনসমূহ, জলপ্রপাতের মধুর কল্লোলিনীও মনকে আপ্লুত করে। অশ্রু ফোঁটার মতো ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম গায়ানা। মাটির সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা বেশি। দেশটির সীমানা অনেক দূর প্রসারিত। ক্রিকেটেও গায়ানার ইতিহাস ঝলমলে। এ দ্বীপ থেকে উঠে এসেছেন বাসিল বুচার, রোহান কানহাই, ল্যান্স গিবস, কাইভ লয়েড, রয় ফ্রেডরিকস, আলভিন কালিচরন, কলিন ক্রফট, কার্ল হুপার, রজার হার্পার, শিবনারায়ণ চন্দরপল, রামনরেশ সারওয়ানের মতো দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার। আছে থিম পার্ক, অবকাশ কেন্দ্র, আফ্রিকান ঐতিহ্যের অসাধারণ সব সংগ্রহ। সদ্য গড়ে তোলা ‘প্রভিন্স স্টেডিয়ামে’ হবে সুপার এইটের ছয়টি ম্যাচ। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্যÑ সমুদ্রকে তারা স্থান দিয়েছে দেবতার আসনে। আর এই দেবতার আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য তারা প্রতিটি স্টেডিয়ামই নির্মাণ করেছে সাগরতীর ঘেঁষে।
সাগর-দেবতাকে নৈবেদ্য দেয়ার উপলক্ষ হয়ে উঠেছে ক্যারিবীয় ক্রিকেট। এ দু’য়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ক্যারিবীয় জীবনধারা। এর অংশ হিসেবে তারা ক্রিকেট মাঠ এবং মাঠ সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতে নাচে, গানে, হল্লায়, হাসিতে নিজেদেরকে উজাড় করে দিয়ে সমর্পণ করে। এবার বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে তাদের সামনে এসেছে আনন্দের অফুরন্ত সম্ভার। এই আনন্দে সম্মিলিতভাবে অবগাহন করবে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। তার রেশ ছড়িয়ে পড়বে দেশে দেশে। এর সঙ্গে সামিল হবে বাংলাদেশও।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ মার্চ ২০০৭
ভালোবাসা ও ঐক্যের দেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট
যে সুর লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইনের বুকে বেজেছে, সেই একই সুরে আন্দোলিত হন রায়াত রিয়ান এমরিত। কনস্টান্টাইন তরুণ বয়সে ক্রিকেট খেলতে যান ইংল্যান্ডে। সেটি ছিল ১৯০০ সাল। ক্রিকেটের তীর্থকেন্দ্র লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন তিনি। যদিও ১১৬ রানের ইনিংসটির প্রথম শ্রেণীর স্ট্যাটাস ছিল না। কিন্তু ইতিহাস গড়ার ক্ষেত্রে এ ইনিংসটির গুরুত্ব ও মর্যাদা কোনো অংশেই কমতি ছিল না। বরং তা অক্ষয় হয়ে আছে কালের খাতায়। বিংশ শতাব্দীর সে সময়টা ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কসের দুনিয়া কাঁপানো কালজয়ী মতবাদ ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আব্রাহাম লিঙ্কনের বহুল আলোচিত ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’-এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রায় মানুষের স্বাধীনতা ও সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এবং দাসপ্রথা বিলোপের প্রক্রিয়া সীমিত পরিসরে শুরু হয়। তবে সভ্যতার এই বিকাশলগ্নে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার তখনো বন্ধনমুক্ত হয়নি। আলোর পরশ এসে পৌঁছায়নি ঔপনিবেশিক অঞ্চলে। এমন একটা প্রতিকূল অবস্থায় বসবাস করেও একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ঔপনিবেশিক শক্তির হৃৎপি-ে শিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে কব্জির মোচড়ে বল সীমানাছাড়া করছেন। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যতই মধুর হোক না কেন, শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের পক্ষে তা হজম করা কঠিন ছিল। আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার যুগলবন্দিতে ত্রিনিদাদের কনস্টান্টাইন সেদিন যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, তা শুধু একটি ইনিংসের গৌরবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল শোষিত, বঞ্চিত ও সর্বহারা কালো মানুষদের মুক্তির পথ। ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও বিজয়ের জয়গান। ক্রিকেট মাঠে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ‘বদলা’ নেয়ার এমন অভিনব পন্থা দেখতে পেয়ে তারা দারুণভাবে আলোড়িত হন। জীবনের সব ক্ষেত্রে পর্যুদস্ত ক্যারিবীয়দের মনের কোণে সেদিনই উঁকি মেরেছিল ক্রিকেটের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এই স্বপ্নের পথ বেয়ে রচিত হয় রূপকথার গল্প।
আটলান্টিক আর ক্যারিবীয় সাগরের উপকূলে মুক্তোর দানার মতো দ্বীপগুলো নিয়ে দৃশ্যত সৃষ্টি হয়েছে একটা মণিহার। প্রকৃতি এ দ্বীপগুলোকে দু’হাতে অপরূপভাবে সাজিয়ে দেয়। অবারিত সৌন্দর্যের হাতছানি এবং পর্যটনের সম্ভাবনায় ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ছুটে আসে ঔপনিবেশিক শক্তি। ব্রিটিশ, যুক্তরাষ্ট্র, ফরাসী, ডাচরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। ভাগাভাগির এ প্রতিযোগিতায় জয়ের পাল্লাটা ভারি থাকে ব্রিটিশদের দিকে। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও সৌন্দর্যের এই নন্দনকাননে মানুষের কোনো প্রাণস্পন্দন ছিল না। পৃথিবীর এক প্রান্তের এই নির্জন, জনশূন্য ও নিভৃত এলাকায় কেইবা আসবে বসতি গড়তে? উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ঔপনিবেশিক শক্তি বেছে নেয় অমানবিক ও নিষ্ঠুর পথ। তারা মূলত আফ্রিকা থেকে শিকড় উপড়ে ফেলে দাস হিসেবে নিয়ে আসে কৃষ্ণাঙ্গদের। এছাড়া সংখ্যালঘু হিসেবে ছিল ইন্ডিয়ানস, চাইনিজ, ক্যারিব এবং ‘প্রভু’ হিসেবে কিছু ইউরোপিয়ান। তাদের দিয়েই গড়ে তোলা হয় বসতি। ব্রিটিশরা যেখানেই যাক না কেন, সঙ্গে করে নিয়ে যায় ইংরেজি ভাষা, পাদ্রী ও ক্রিকেট। সঙ্গত কারণে এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায় উপনিবেশের মানুষেরা। অধিবাসীদের মধ্যে সঙ্গত কারণেই খ্রিস্টানদের সংখ্যাই বেশি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্যাথলিক, কিছু হিন্দু, কিছু মুসলমান। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ক্রিকেটটা হয়ে ওঠে আফিমের মতো। তাদের গ-ি তো ছিল খুবই ছোট্ট। চার পাশে সমুদ্র পরিবেষ্টিত। শৃঙ্খলের বন্ধনে আটকে থাকায় কোথাও যাবার সুযোগ ছিল না। বিনোদনের একমাত্র অবলম্বন ছিল ক্রিকেট খেলা। দিনমান কেটে যেত ক্রিকেটে ক্রিকেটে। তাছাড়া ধোপদুরস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ পরা মনিবদের ক্রিকেট খেলতে দেখা এবং কখনো-সখনো তাদের সঙ্গে খেলতে পারাটা হয়ে ওঠে মর্যাদার বিষয়। শৈশবে দেখা সাহেবিয়ানার সবকিছুই ছাপ ফেলতো ছোট্ট বুকে, বেড়ে ওঠাও তা অনুসরণ করে। গায়ের কালো রঙটা ছাড়া তারা বদলে ফেলে নিজেকে। পূর্বপুরুষের শিকড় শিথিল হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। অবশ্য বুকের ভেতরে গেড়ে বসা মূলটাকে তো শূন্য করে দেয়া যায় না। কোনো না কোনোভাবে রয়েই যায়। আফ্রিকা থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গদের বুকের গভীরে সুর হয়ে বাজে মাতৃভূমির জন্য কান্না আর গান। ক্যারিবীয় দ্বীপে ছিটকে আসার পর অপরিচিত পরিবেশে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল সঙ্গীত। সঙ্গীতটা হয়ে ওঠে জীবনের অংশ। ক্রিকেটের সঙ্গে সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে গড়ে ওঠে নতুন এক জীবনধারা। সে এক ভিন্ন মেজাজের ক্যারিবীয় ঘরানা।
ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থ’ান করে নেয়াটা ক্যারিবীয়দের জন্য খুব সহজ ছিল না। স্বাভাবিক নিয়মেই নানা প্রতিকূলতা সামনে এসে দাঁড়ায়। জীবনের দায় মেটানো ছিল যেখানে কঠিন এক সংগ্রাম, সেখানে ‘রাজার খেলা’ ক্রিকেট রপ্ত করাটা ছিল দুরূহ এক সাধনা। প্রতিদিন উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুঃসহ জীবনের ঘানি টেনে চলার ফাঁকে ফাঁকে অবসরের বিনোদন হয়ে ওঠে ক্রিকেট। দিনযাপনের গ্লানির মাঝে ক্রিকেট যেন এনে দেয় এক টুকরো মুক্তির স্বাদ। ক্রিকেট নামক খোলা জানালা দিয়ে পাওয়া যায় এগিয়ে যাবার সোপান। ক্রিকেট খেলাটা আয়ত্তে আনার পাশাপাশি মোটামুটি একটা অবস্থান করে নেয়ার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের আভিজাত্য আর অহমিকা যাতে টাল না খায়, সে বিষয়ে তারা ছিলেন পুরোপুরি ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ মনোভাবাপন্ন। ক্রিকেটের বনেদিয়ানায় ‘দাসানুদাসরা’ স্থান করে নেবেÑ এটা তারা মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। সীমিত পরিসরে ক্রিকেট খেলাটা মেনে নিলেও ‘এলিট পর্যায়ে’ তাদের অনুমতি দেয়া হতো না। অথচ ততদিনে কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রিকেটটাকে ভালোই আয়ত্তে এনেছে। ১৮৯৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু হলেও তাতে অ- শ্বেতাঙ্গদের অংশগ্রহণ খুব একটা ছিল না। ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে যেটুকু সুবিধা মিলতো, তাতেই প্রকাশ পেত সুপ্ত প্রতিভা। এমনি এক অবস্থায় ‘দেবদূত’ হয়ে আসেন লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইন। তিনি যে উন্মুক্ত আকাশের সন্ধান দেন, তার পথ বেয়ে স্বপ্নের ঠিকানায় এগিয়ে আসতে থাকেন স্বপ্নহীন মানুষেরা। তারা অনুভব করতে পারেন নিজেদের ‘শক্তি’ সম্পর্কে। কিন্তু তারা তো তখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। মূল দ্বীপ প্রায় ২৪টি হলেও ছোট-বড় মিলিয়ে সমুদ্রবর্তী দ্বীপ যে কতটিÑ তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। মহাসমুদ্রের কোথায় কখন কোন দ্বীপ ভেসে উঠছে কিংবা ডুবে যাচ্ছে, তার হিসাব রাখা মুশকিল। তবে আনুমানিক দ্বীপের সংখ্যা ২২০ থেকে ২৩০টি। কারো সঙ্গে কারো তেমন কোনো যোগাযোগ হতো না। কনস্টান্টাইনের কৃতিত্ব তাদের মধ্যে যে চেতনা জাগ্রত করে, তার ফলে তারা একত্রিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা থাকলেও ক্রিকেট তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে নিবিড় বন্ধন। ব্রিটিশ-শাসিত ক্যারিবীয় উপনিবেশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফেডারেশন। বহুজাতিক ও ইংরেজিভাষীদের নিয়ে গড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডে সংযুক্ত হয় অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডা, বাহামা, বার্বাডোস, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, জ্যামাইকা, সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেইন্ট লুসিয়া, সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডিন্স এবং ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো। এই ১০টি দেশ ষাট ও সত্তর দশকে পর্যায়ক্রমে স্বাধীন হয়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বর্তমানে ব্রিটিশ শাসিত অ্যানগুলিয়া, বারমুডা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, কেম্যান আইল্যান্ডস, মন্টসেরাত ও তুর্কস অ্যান্ড কাইকোস আইল্যান্ডস। এছাড়াও ছিল ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজভুক্ত বেলিজ এবং ব্রিটিশ গায়ানা। পরবর্তীকালে ‘ব্রিটিশ’ বাদ দিয়ে হয়ে যায় গায়ানা। অবশ্য রাজনৈতিক কারণে দ্বীপগুলোর অবস্থান বদলে যায় বার বার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড ১৯২৬ সালে যোগ দেয় ইম্পিরিয়াল ক্রিকেট কাউন্সিলে। এই কাউন্সিল পরবর্তীকালে পরিচিতি পায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) হিসেবে। ১৯২৮ সালের ২৩ জুন টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ঘরানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের নামটা চাউর হলেও তাতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধিত্ব খুব বেশি ছিল না। তবে এর মাঝে ব্যতিক্রম ছিলেন লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইনের পুত্র লিয়ারি নিকোলাস কনস্টান্টাইন এবং জর্জ হ্যাডলি। ইংল্যান্ডে লর্ডসে প্রথম টেস্টে অভিষেক হয় কনস্টান্টাইনের। কাকতালীয় বিষয় হলো, যে লর্ডসে পিতা সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ক্যারিবীয় কৃষ্ণাঙ্গদের বুকে জ্বালিয়েছিলেন আশার আলো, সেই লর্ডসে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে পুত্র স্থান করে নেন ইতিহাসের পাতায়। এক ইনিংস বল করার সুযোগ পেয়ে নেন ৪ উইকেট। ১৯৩০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ গায়ানার জর্জটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর এই জয়ের নায়ক ছিলেন জর্জ হ্যাডলি এবং লিয়ারি কনস্টান্টাইন। চার টেস্টের সিরিজ ২-২-এ অমীমাংসিত থাকে। সিরিজের সর্বাধিক ৭০৩ রান আসে হ্যাডলির ব্যাট থেকে আর সর্বাধিক ১৮ উইকেট নেন কনস্টান্টাইন। কনস্টান্টাইন ক্রিকেটার ছাড়াও ধারাভাষ্যকার, প্রশাসক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত পান। অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন হ্যাডলি। তাকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’। পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য থেকে বের হয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষ্ণাঙ্গ-শক্তি। এরপর তো ক্যারিবীয় ক্রিকেটের জয়জয়কার। সত্তর-আশির দশকে তারাই ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ‘ব্ল্যাক-পাওয়ার’ হিসেবে তারা দাপিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বে। ইতিহাসে তারা জন্ম দিয়েছেন কিংবদন্তি সব ক্রিকেটার। ক্যারিবীয়রা ক্রিকেট বিশ্বকে উপহার দিয়েছে নতুন ঘরানার। এই সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছে অনেক দ্বীপ রাষ্ট্র।
ক্রিকেট দিয়েই ক্যারিবীয়রা মানুষের মন জয় করে নেয়নি, একই সঙ্গে তারা শুধু ক্রিকেটের মাধ্যমেই অনেকগুলো দেশ একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এক বিস্ময়ের। ঐক্য ও বন্ধনের এই ইতিহাস শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তাতে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। মজার ব্যাপার, ওয়েস্ট ইন্ডিজভুক্ত অনেক দেশেই ক্রিকেটের তেমন কোনো প্রচলন নেই। কিন্তু তারাও জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন ২৬০ জন ক্রিকেটার। এর মধ্যে বার্বাডোসের ৭১, জ্যামাইকার ৬৩, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর ৫৭, গায়ানার ৪০, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার ১০, সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডিনসের ৬, ডোমিনিকানের ৪, সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের ৪, গ্রেনাডার ৩, অ্যানগুলিয়ার ১ ও ১ জন ইংলিশম্যান। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলেছেন বার্বাডোসের ১৭, গায়ানার ১২, জ্যামাইকার ১০, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর ১০, সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডিনসের ৩ ও সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের ২ জন। এর বাইরেও অনেক দেশ রয়েছে যাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। তারপরও তারা কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে? আসলে তারা আবদ্ধ ঐক্য আর ভালোবাসার বন্ধনে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বশেষ নাম লিখিয়েছেন ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর রায়াত রিয়ান এমরিত। ২০০৭ সালের ২৭ জানুয়ারি চেন্নাইতে ওয়ানডে ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয় এই অলরাউন্ডারের। শত বছরের বেশি সময় আগে লেবরান স্যামুয়েল কনস্টান্টাইনের হাতে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের যে বিজয় মশাল প্রজ্বলিত হয়েছিল, সেই আলোকবর্তিকা বহন করে নিয়ে চলেছেন এমরিতরা। তারা জানেন, তারা যে যেখান থেকে উঠে আসুন না কেন, তাদের পরিচয় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বা উইন্ডিজ হিসেবে। এমনিতে ছোট ছোট দ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান অনেকটা দূর আকাশের তারার মতো। এরকম কত ‘তারা’ই তো পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাদের খবর ক’জনাই বা জানেন? সেদিক দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘরানার দেশগুলো সৌভাগ্যবান যে, তারা ক্রিকেটের বদান্যতায় ‘সন্ধ্যাতারা’ হয়ে জ্বলছে। এক্ষেত্রে তারা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে বার্বাডোস, জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, গায়ানার মতো ক্রিকেট-শক্তির দেশগুলোকে। এ দেশগুলোর সাফল্যের আলোয় আলোকিত হচ্ছেন তারা। এছাড়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট তাদের কাছে এসেছে সার্চ-লাইট হিসেবে। এই সার্চ-লাইটের আলোর বন্যায় ভেসে উঠবে সমগ্র ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাত্রা। এমন সুযোগ সচরাচর আসে না। তবে ক্রিকেট ক্যারিবীয়দের বুকে যে সুরের অনুরণন তোলে, তার সিম্ফনি কিন্তু ভালোবাসা ও ঐক্য। এই সিম্ফনি তাদের প্রত্যেকের বুকেই বাজায় আনন্দ ও গৌরবের বীণা।
দৈনিক আজকের কাগজ, ১৩ মার্চ ২০০৭
আকরাম খানের সেই ইনিংস
আকরাম খানের অপরাজেয় সেই ৬৮ রানের ইনিংসের মহিমা তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। ১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফিতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নাটকীয় জয়ের আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটটা আমাদের কাছে ছিল সুদূরের এক স্বপ্ন। আমরা যারা দেখনদারি, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম; যারা গুণবিচারি, তারাই কি ভাবতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ কখনো বিশ্বকাপে খেলবে? এমনকি ক্রিকেটাররা পর্যন্ত তাদের কল্পনাটাকে এতখানি লাগামহীন হতে দেননি। আইসিসি ট্রফির চৌকাঠ পার হওয়াটা ছিল যেখানে অসম্ভব এক স্বপ্ন, সেখানে বিশ্বকাপ! প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সব বিস্ময় আর প্রশ্নের উত্তর হয়ে আসে আকরাম খানের সেই লড়াকু ইনিংস। সেই ইনিংসের পর বদলে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট মানচিত্র।
আকরাম খানের ইনিংসটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়তো খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। আইসিসি ট্রফিটা পাতে দেয়ার মতো কোনো প্রতিযোগিতা নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল ইনিংস দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনাÑ সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এমন লেখায় অনেকে বিষয়টিকে আবেগতাড়িত ও অতিশয়োক্তিপূর্ণ ভাবতেই পারেন। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে তেমনটি মনে করার কোনো সুযোগ নেই। একটি ইনিংস একটি দেশের ক্রিকেটের খোলনলচে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছেÑ এমনটি ক্রিকেট ইতিহাসে বোধ করি দেখা যায়নি। সেই ইনিংসটির আগে বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল বর্ণহীন এবং গন্তব্যহীন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রূপ-রস-গন্ধ স্পর্শ করলেও তাতে আমাদের অংশগ্রহণ খুব বেশি ছিল না। না থাকারই কথা। ফেল করা ছাত্রকে কেইবা পাত্তা দিতে চায়? ‘আইসিসি ট্রফি’ নামক পরীক্ষায় বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হতে পারছিল না কোনোভাবেই। ক্রিকেটের ‘জাতে’ উঠতে হলে এই সিঁড়ি টপকানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ বাংলাদেশের সামনে খোলা ছিল না। বাংলাদেশ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবারই আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয়, আর প্রতিবারই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরে আসে। স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায় শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ে এবং একবার ‘নকল রাজা’ সাজা সংযুক্ত আরব আমিরাত। বার বারই জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায় আশার আলো। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় আয়োজিত আইসিসি ট্রফিতেও আবারো ফিকে হয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশের স্বপ্নের রঙ। পচা শামুকে পা কাটার মতো নেদারল্যান্ডস এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সে সঙ্গে ছিল প্রকৃতির খামখেয়ালি। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ১২ কোটি মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে ‘হারকিউলিস’ হয়ে যান অধিনায়ক আকরাম খান। মহাকায় এক ইংিনস খেলে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের হৃদয়।
আকরাম খানের মহামূল্যবান ও অতিকায় সেই ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট। বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। তারপর সব তো ইতিহাস। একের পর এক স্বপ্নের সিঁড়ি পেরিয়ে যায় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ, ওয়ানডে এবং এলিট ঘরানার টেস্ট স্ট্যাটাস। ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেকটা হয় স্বপ্নের মতো। স্কটল্যান্ড আর পাকিস্তানকে হারিেেয় তুমুলভাবে সাড়া জাগায় বাংলাদেশ। এরপর ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। যদিও অভিজ্ঞতা মোটেও মধুর নয়। সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজে পরবর্তী বিশ্বকাপ। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা যাই হোক না কেন, এক একটি বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ক্রিকেটের আকাশটাকে অনেক বড় করে দিয়ে যায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার ভা-ারে সঞ্চয় হয়েছে অনেক কিছু। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন মোটামুটি পরিচিত নাম। বাংলাদেশের অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, অনেক সাফল্য অর্জিত হয়নি। আগামীতে অনেক পথ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। কোনো একদিন হয়তো বাংলাদেশ জয় করবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা। তবে বিশ্বকাপে যতদিন অংশ নেবে বাংলাদেশ, ততদিন স্মরিত হবে আকরাম খানের নাম।
পড়শি, মার্চ-এপ্রিল ২০০৭
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ঘুম ভাঙিয়ে দিল বাংলাদেশ
অন্তহীন প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এসেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এসেছে জাগরণে জাগরণে বিভাবরী কাটিয়ে দিতে। কিন্তু কেন জানি না, ক্রিকেটের এই আনন্দযজ্ঞ শুরুর দিকে নির্ঘুম করে দিতে পারছিল না আমাদের রাতগুলোকে। মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন কেটে গেছে তাল-লয়-ছন্দ। ক্যালিপসো সুর যেন ঠিকমত বুকে বাজছিল না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মনকাড়া সুর, গান ও রঙের বাহার ঠিকই ধাঁধিয়ে দিয়েছে চোখ, রাঙিয়ে দিয়েছে মন। তদুপরি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে আমাদের অদম্য কৌতূহল তো চিরকালের। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাঁকে ফাঁকে ক্যামেরার তীক্ষè দৃষ্টিক্ষুধা দিয়ে দেখতে পাওয়া যায় মন কেমন করা সৌন্দর্যের রতœসম্ভার! খেলা চলাকালে কখনো-সখনো বিভ্রম লেগে যায়Ñ ফিল্ডাররা সমুদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে নয় তো! ছক্কা মারা বলগুলো হাওয়ায় ভেসে ভেসে অতল সাগরে হারিয়ে যাবে কি? নিশিরাতে ক্রিকেট সুধায় ডুবে থাকলে এমন কৌতূহল তো হরহামেশা মস্তিষ্কে ঘাই মারারই কথা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমুদ্র উপকূলবর্তী ক্রিকেটের বিভিন্ন মাঠকে দূর থেকে মনে হয় এক মায়াকানন। এর কুহক, মোহমুগ্ধতা ও মাধুর্য বুকের মাঝে সৃষ্টি করতে পারে অনির্বচনীয় এক অনুভূতির।
ক্রিকেটের ‘স্বর্গোদ্যান’ থেকে মাধুরী ও মাধুকরী সংগ্রহের এমন সুযোগ পেয়ে সবার মনই আনন্দে নেচে ওঠার কথা। কিন্তু তা যেন আকৃষ্ট করছিল না। মিডিয়ার মাদলও তো অনেক আগেই ঘুম ভাঙানো গান গাইতে থাকে। বিশ্বকাপ শুরুর পর বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করে মিডিয়ার উদ্যমী কর্মীরা অষ্টপ্রহর পৌঁছে দিতে থাকেন মসলাদার নানা সুস্বাদু ব্যঞ্জন। তবুও মন টানছিল না। বাংলাদেশ তো ঢুলছিল না ঢুলু ঢুলু চোখে। কান্ত, বিধ্বস্ত ও অবসন্ন দেহে অফিস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তেমনভাবে কেউ ছুটছিলেন না। বিশ্বকাপ ক্রিকেট কি এতটা পানসে? আমরা তো এমনিতেই নাচনেওয়ালি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি পড়লে আর রক্ষে নেই। হুজুগের উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে পুরো দেশ। কিন্তু কোথায় কি!
এখন তো বাংলাদেশের সন্ধ্যাগুলো হয়ে যায় রাত। বিদ্যুতের লোডশেডিং কমিয়ে আনার জন্য সন্ধ্যা সাতটার পর বন্ধ রাখা হয় সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। নেমে আসে অদ্ভুত এক আঁধার। বলতে গেলে রাতের সেই মোহন আকর্ষণ নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে অফুরন্ত অবসরের হাতছানি। চুটিয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলা উপভোগ করার কত না সুযোগ! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ক্রিকেটে মন ডুবিয়ে দেয়া যায়। না, মন তাতে বুঝি সায় দিচ্ছিল না। এমনটি মনে হওয়াটাও কি মনের বিভ্রান্তি? ঠিক ঝুঝে ওঠা যাচ্ছিল না। আসলে এমন তো এমনি এমনি মনে হচ্ছিল না। মনে হওয়ার যথেষ্ট কার্যকারণ ছিল দৃশ্যমান। বিশ্বকাপ নিয়ে দেখা যাচ্ছিল না কোনো মাতামাতি। রাস্তা-ঘাটে চলা-ফেরায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল না বিশ্বকাপ ক্রিকেট। বিলবোর্ডে কিংবা বিজ্ঞাপনে কোনো পণ্য ক্রয় করার জন্য ছিল না কোনো ক্রিকেটারের মধুর সম্ভাষণ। কেমন যেন খামোশ মেরে গেছিল। মজার বিষয়, ক্রিকেট নিয়ে হালে একটা ক্রেজ সৃষ্টি হয়েছে। দেশে কিংবা বিদেশে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেখানে খেলুক না কেন, আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়। তাকে পুঁজি করে কত না ঘনঘটা।
আগের দুটি বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ ও উদ্দীপনার মোটেও কমতি ছিল না বৈকি। এবারও বিশ্বকাপে খেলছে বাংলাদেশ। তাও তো মস্ত এক স্বপ্ন নিয়ে। খেলতে চায় সুপার এইট। প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে রচনা করে তেমনই এক স্বপ্নের সোপান। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশকে নিয়ে মাতামাতিটা হওয়ার কথা ছিল ‘বাড়াবাড়ি’ পর্যায়ের। অথচ তেমনটি কি মনে হচ্ছিল? কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বাংলাদেশকে। এই তো গেল বছর বিশ্বকাপ ফুটবল যেভাবে জাগিয়ে দিয়ে গেল, ক্রিকেটটা সেভাবে পারছিল না। বিশ্বকাপ ফুটবলের ধারে-কাছেও থাকে না বাংলাদেশ। অথচ তাকে কেন্দ্র করে আবেগে-উচ্ছ্বাসে-আনন্দে ফেটে পড়ে সমগ্র দেশ। সর্বত্রই বয়ে যায় খুশির জোয়ার। ভিন দেশের পতাকায় পতাকায় ছেয়ে যায় শহর-বন্দর-গ্রাম। প্রস্তুতির কোনো কমতি থাকে না। বিশ্বকাপ ফুটবল পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, তার ছোঁয়া লাগে বাংলাদেশে। সে সময় মনে হতে পারে বাংলাদেশ যেন বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলছে! ফুটবল এদেশের মানুষের হৃদয়ের খেলা। ৯০ মিনিটের ফুটবল খেলা যেভাবে মানুষকে উদ্বেলিত করে, ৮ ঘণ্টার ক্রিকেটের পক্ষে তা অর্জন করা খুবই কঠিন। তাই বলে বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রাণহীন হয়ে যাবে? মনে হচ্ছিল, ব্যাটে-বলে যেন মিলছিল না। ক্রিকেট উপভোগ করার জন্য হৃদয়ে যে সুরের মূর্ছনা ও মনে রঙ থাকতে হয়, তা কি তবে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল? কিছুই খেলছিল না মাথায়। ১৭ মার্চের পর মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বদলে যায় সব হিসাব। ক্রিকেটানুরাগীরা যে এখন আর অল্পতে সন্তুষ্ট নন, সেটাই যেন বুঝিয়ে দিলেন। ভারতকে হেসে-খেলে ৫ উইকেটে হারিয়ে দিয়ে জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। আড়মোড়া ভেঙে সবাই এখন গাইছেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জয়গান। এখন থেকে হয়তো দিনগুলোকে সংক্রমিত করবে রাতের আঁধার আর রাতগুলো রূপান্তরিত হবে দিবাকরে। ভারতকে হারিয়ে শুধু বাংলাদেশই শুধু জেগে ওঠেনি, ভাঙিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার তাবৎ ক্রিকেটানুরাগীর ঘুমও।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ মার্চ ২০০৭
দিন বদলের গান
বুকে অবরুদ্ধ কান্না আর নীল বেদনা নিয়ে যে লড়াইয়ের মঞ্চে নামা যায় এবং সেটাই যে হয়ে উঠতে পারে অনুপ্রেরণার অগ্নিমশাল, তা বুঝিয়ে দিলেন মাশরাফি-বিন-মর্তুজা এবং ‘টিম বাংলাদেশ’। প্রিয় বন্ধু, সহযোগী ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানার আকস্মিক মৃত্যুর খবর শুনে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে ঘুম ভাঙে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। বিশ্বকাপ ক্রিকেট মিশন শুরুর প্রথম দিনে এমন একটা আঘাত যে কাউকেই থমকে দিতে পারে। সঙ্গত কারণে হতচকিত করে দিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকেও। এমন একটা মর্মবিদারী ঘটনার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। অশ্রু প্লাবনে ভেসেছিলেন দলের সবাই। দেশ থেকে আসার আগে যার স্মৃতি-স্পর্শ একদম টাটকা হয়ে আছে হৃদয় মন্দিরে, যিনি হতে পারতেন দলের সহযাত্রী, তার এভাবে মর্মান্তিকভাবে চলে যাওয়াটা কাছের মানুষদের জন্য কী যে কষ্ট ও যন্ত্রণার, তা তো কেবল ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারেন। কষ্ট ও যন্ত্রণাটুকু বুকে চেপে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। মানসিকভাবে মুষড়ে পড়া ক্রিকেটাররা খেলার মাঠে কতটা কি করতে পারবেন, তা ছিল টিমের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের কাছে ভাবনার বিষয়। প্রতিপক্ষ তো যেমন-তেমন কেউ নয়Ñ শিরোপা প্রত্যাশী ভারত! যাদের তূণে শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলির মতো মস্ত মস্ত নাম ও রানের ভা-ারী আর আছে মাস্ত মাস্ত ক্রিকেটার বীরেন্দর শেবাগ, যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা। এমন এক শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলতে নামাটা যে কোনো দলের জন্য থরহরি কম্প হওয়ার কথা। কিন্তু সেদিন দিব্যদৃষ্টিতে যা দেখেছিলাম, কখনো কখনো মনে হয়েছিল রাত জাগা কান্ত চোখ ভুল দেখছে না তো! বাংলাদেশের উদ্বোধনী দুই পেসার মাশরাফি আর তার সহযোগী সৈয়দ রাসেল যেভাবে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন-আপকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেন, তাতে হাঁসফাঁস করতে থাকেন তারা। ব্যাটসম্যানদের অঙ্গভঙ্গিতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, কামানের গোলার মতো ছুটে আসা ‘হামলা’ থেকে কখন তারা একটু স্বস্তি পাবেন। বিশ্বসেরা পেসারদের যারা অবলীলায় খেলেছেন, হাঁকিয়েছেন বিশাল বিশাল ছক্কা, তাদের কম্পিত অবস্থা দেখে চোখজোড়া বার বার কচলিয়েছি আর ভেবেছি, এ কি সত্য! পরমুহূর্তে মনে হয়েছে, মধুর ক্ষণ তো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এরপর নিশ্চয় দুঃখ পেতে হবে। পেসারদের ‘বেয়াদবি’র শোধ ব্যাটসম্যানরা নিশ্চয়ই স্পিনারদের ওপর দিয়ে তুলবেন। শঙ্কিত হয়েছি স্পিনারদের কথা ভেবে। আহ্, বেচারাদের হতে হবে তুলোধুনো। হায়! কার দোষে কে পস্তায়! ঘাপটি মেরে থাকা বহুদর্শী ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা বোধ করি সুযোগের অপেক্ষায়। স্পিনারদের খেলার ব্যাপারে এমনিতেই তাদের কোনো জুড়ি নেই। তদুপরি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছোট মাঠগুলো ব্যাটসম্যানদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ, তার ওপর সমুদ্রের কূল ঘেঁষে স্টেডিয়ামÑ না জানি কতবার হারিয়ে যায় বলগুলো! এমনসব উল্টোপাল্টা ভাবনার মাঝে মাশরাফি এবং রাসেলের পরিবর্তে এলেন স্পিনাররা। ভাবলাম কি আর ঘটছে কি! সব ম্যাজিক নাকি? বাংলাদেশ যা যা করতে চাচ্ছে, অবিকল যেন তাই ঘটে চলেছে। আবদুর রাজ্জাক, সাকিবুল হাসান ও মোহাম্মদ রফিকের মায়াবী ঘূর্ণিবল মন্ত্রমুগ্ধ রাখে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছে, বলের এমন জাদু এর আগে তারা আর দেখেননি। ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা যেন হয়ে যান এক একজন জন্টি রোডস। বিনা আয়েশে একটি রানও তারা নিতে দেননি। ভারতের ইনিংস ১৯১ রানে গুটিয়ে দিয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। ব্যাটিংয়ে রীতিমত ভেল্কি দেখায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী দেখলো তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম আর সাকিবুল হাসানকে। শোককে শক্তিতে পরিণত করা টিন-এজ এই তরুণদের ব্যাটে ছিল আগুনের ফুলকি। ভারতীয় বোলারদের বলগুলো তারা যেভাবে দুলকিচালে হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তাতে ছিল একটা সহজাত আত্মবিশ্বাস। কাউকে রেয়াত করছিলেন না, আবার তা নিয়ে খুশিতে আত্মহারাও হচ্ছিলেন না। মনোভাব দেখে মনে হয়েছে, এমনই তো খেলার কথা!
এ যেন এক নতুন বাংলাদেশ। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রত্যয়ী এই বাংলাদেশের দেখা মিলেছে। সেই ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে প্রবর্তন হয় ক্রিকেট খেলা। তখন ক্রিকেটের এত প্রসার ছিল না। তবে পাকিস্তান আমলে ক্রিকেটের চর্চাটা বাড়তে থাকে। পাকিস্তানের টেস্ট স্ট্যাটাস এবং তাদের সাফল্য পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের অনুপ্রাণিত করে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিভাবান অনেক ক্রিকেটার উঠে আসতে থাকেন। কিন্তু পশ্চিমাদের বাঙালি বিদ্বেষ ও বৈষম্যের কারণে এ অঞ্চলের ক্রিকেটাররা পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে পারেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ক্রিকেটটা শুরু হয় নতুনভাবে। প্রথমদিকে ক্রিকেট নিজস্ব অবস্থান গড়ে তোলার প্রয়াস চালায়। সে সময় বিদেশীদের সঙ্গে খেলতে পারাটা ছিল পরম কাক্সিক্ষত। এরপর আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে আইসিসি ট্রফিতে খেলাটা ছিল একধাপ অগ্রগতি। এক্ষেত্রে নেতৃত্বে ছিলেন শফিকুল হক হীরা, সৈয়দ আশরাফুল হক, রকিবুল হাসান, ওমর খালেদ রুমী, ইউসুফ রহমান বাবু, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, দীপু রায় চৌধুরী, গাজী আশরাফ হোসেন লিপুরা। বেশ কিছুদিন খেলার পর স্বপ্ন হয়ে ওঠে আইসিসি ট্রফিতে সাফল্য অর্জন। এই সাফল্য পাওয়াটা হয়ে ওঠে মরীচিকার মতো। তখনো বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে বড় কিছু ভাবা যায়নি। বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরাটা ছিল সুদূরের কল্পনা। ১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বদলে যায় পরিস্থিতি। এ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আতহার আলী খান, ফারুক আহমেদ, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আকরাম খান, এনামুল হক, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, মেহরাব হোসেন অপি, জাভেদ ওমর বেলিম, হাবিবুল বাশার সুমন, আল-শাহরিয়ার রোকন, মোঃ রফিক, খালেদ মাসুদ পাইলটরা। ওয়ানডে স্ট্যাটাস, বিশ্বকাপে খেলা এবং টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন সেই ধারাবাহিকতারই প্রতিফলন। ক্রিকেটের অভিজাত সারিতে স্থান করে নেয়ার পরও বাংলাদেশের প্রত্যাশাটা খুব বেশি বড় ছিল না। ব্যক্তিগত কিছু নৈপুণ্যের ঝিলিক কিংবা দলগত টুকটাক অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল চাওয়া-পাওয়ার চৌহদ্দি। এরপর একের পর এক অর্জিত হতে থাকে বিভিন্ন সাফল্য। সাফল্য আনেন মঞ্জুরুল ইসলাম, তাপস বৈশ্য, মোহাম্মদ আশরাফুল, অলক কাপালি, আবদুর রাজ্জাক, আফতাব আহমেদ, রাজিন সালেহ, মানজারুল ইসলাম রানা, নাফিজ ইকবাল, এনামুল হক জুনিয়র, মেহরাব হোসেন জুনিয়র, নাজমুল হোসেনরা। এ দলে আছেন মাশরাফি-বিন-মর্তুজা, সৈয়দ রাসেল, শাহাদত হোসেনরাও। এদের সঙ্গে সবে যোগ দিয়েছেন শাহরিয়ার নাফীস, সাকিবুল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবালরা। এ জেনারেশন একদমই অন্যরকম। বয়সটা একদম কম হলেও বয়োসোচিত কোনো চাপল্য নেই। একটা পরিপক্বতা নিয়েই যেন তারা ক্রিকেট খেলতে এসেছেন। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্য কোনো দেশ বা কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গে নিজেদের কোনো ব্যবধান তারা খুঁজে পান না। ক্রিকেটে আত্মবিশ্বাস আর দৃষ্টিভঙ্গি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে তাদের কোনো খামতি নেই। নতুন প্রজন্মের এই ক্রিকেটারদের সঙ্গে আগের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের যোজন যোজন পার্থক্য। এটা যে কাউকেই আশাবাদী করে তুলবে। বাংলাদেশের সুপার এইটে খেলতে চাওয়াটা এখন যেমন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না, আগামীতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হতে চাওয়াটাও বোধ করি অবাস্তব মনে হবে না। দিন বদলের এই গান আমাদের শুনিয়েছেন নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটাররা।
দৈনিক আজকের কাগজ, ২১ মার্চ ২০০৭
সেই ক্যালিপসো, সেই নস্টালজিয়া
অনুভূতি নামক শক্তিশালী এক অ্যান্টেনায় কখনো কখনো এমন কিছু ‘ধারণ’ হয়ে যায়, যার সম্পর্কে আগেভাগে কোনো ধারণাই থাকে না। অথচ না জানা সেই বোধ বুকের মাঝে জন্ম দেয় অন্য রকম এক অনুভূতির। সেই বালক বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের প্রেমে পড়াটা অনেকটা এমনই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। না তাদের ভৌগোলিক, না রাজনৈতিক, না অন্য কিছু। এমনকি অবুঝ মনটা ক্যারিবীয় যে ক্রিকেটে সম্মোহিত হয়েছিল, সেই ক্রিকেটটাই বা কতটুকু জানা ছিল? নিজের মনে যেটুকু ধারণা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়ে উঠেছিল, তাতে অনুমান করা গিয়েছিল, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ যেহেতু নাম, নিশ্চয় করে প্রতিবেশী ‘ইন্ডিয়ার’ কোনো ‘আত্মীয়-স্বজন’ হবে বোধ করি। সে নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। তবুও কেন জানি না বুকের মাঝে শুনতে পাওয়া যেতো ক্যারিবীয় সাগরের দূরাগত গর্জন-ধ্বনি। সাগরের ঢেউ এসে বালুচরে কখনো-সখনো রেখে যায় কিছু কিছু মুক্তা-মাণিক্য, শামুক-ঝিনুক, মূল্যবান কিংবা মূল্যহীন কত কিছু। অনুরূপভাবে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ঢেউ এসে বুকের কন্দরে ধীরে ধীরে গড়ে দিতে থাকে সঞ্চয়ের ভা-ার। মায়ের পেটে একটু একটু করে যেভাবে বেড়ে ওঠে সন্তান, অনেকটা সেভাবেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট সম্পর্কে জন্ম নিতে থাকে উপলব্ধির জগত।
সত্তর দশকের গোড়ায় দিকে দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে বের হয়ে আসার রণতূর্য। ‘বিট জেনারেশন’-এর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও তার ঢেউ তখনো মৃদু মৃদু দুলিয়ে দিতে থাকে। বুকের মধ্যে উন্মাতাল হয়ে বাজতে থাকে ফান্ক আর ডিসকো মিউজিক। অধিকারহারা মানুষের প্রতি তৈরি হয় সহানুভূতি ও সমবেদনা। দুুনিয়ার তাবৎ কালো মানুষের জন্য বুকের গহীনে জমে থাকে কান্না। তখন তো এত বিস্তার ছিল না মিডিয়ার। সাদা-কালো টেলিভিশন দেখা মিলতো কালে-ভদ্রে। বেতার ছিল ‘অনুরোধের আসর’ আর ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’ নিয়ে। আর ছিল লাল আটার মতো দেখতে নিউজপ্রিন্টের সংবাদপত্র। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে এই। খুব যে বেতারের মনোযোগী শ্রোতা কিংবা সংবাদপত্রের নিবিষ্ট পাঠক ছিলাম তা বলা যাবে না। ফাঁক-ফোঁকর গলে মর্মে পৌঁছে যেত অনুভবের নির্যাসটুকু। তা আহরণ করে গড়ে ওঠে ভালোলাগা, মন্দলাগা। তেমন এক মুহূর্তে হয়তো হৃদয়তন্ত্রীতে পৌঁছে যায় ক্যালিপসো সুর। সস্তার কালো কালিতে নিউজপ্রিন্টে অস্পষ্টভাবে মাঝেমধ্যে ছাপা হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনো ব্যাটসম্যান কিংবা কোনো বোলারের ভয়ঙ্কর অ্যাকশন। কালো কালিতে মাখামাখি হয়ে কৃষ্ণকায় ক্রিকেটারের যে অবয়বটুকু দেখা যেতো, তাতে উদ্ভাসিত হতো কেবল সাদা দাঁত আর উজ্জ্বল মণিটুকু। ভীতি সৃষ্টি করা সেই দুরন্ত ভঙ্গিই হৃদয়ে আঁকা হয়ে যায় সৌন্দর্য আর সুষমা নিয়ে। ভালোবাসার অঙ্কুরোদ্গম ঘটে যায় না-জানা না-দেখা ক্যারিবীয় সেই ক্রিকেটের প্রতি। প্রথম প্রেমের মতো তীব্র আকর্ষণ যেন তখন পুরোমাত্রায় ধাবিত হয় তাতে।
বিকেলের সূর্য হয়ে তখনও জ্বলছেন পঞ্চাশ দশকে ক্যারিয়ার শুরু করা কিংবদন্তি গ্যারি সোবার্স, রোহান কানহাই, ল্যান্স গিবসরা। ষাট দশকের শেষভাগে আসা কাইভ লয়েড, রয় ফ্রেডরিকস, আলভিন কালিচরণরা ফর্মের মধ্য গগনে। সত্তর দশকে দুনিয়া কাঁপাতে এসে যান গর্ডন গ্রীনিজ, ভিভ রিচার্ডস, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, ল্যারি গোমস, কলিন ক্রফট, জোয়েল গার্নার, ডেসমন্ড হেইন্স, ম্যালকম মার্শালরা। বদলে যাওয়া সেই সময়ে এই ক্রিকেটারদের ক্যারিশমা, লাইফ স্টাইল, জীবনবোধ, খেলার ধারা যোগ করে অন্য এক মাত্রা। ক্রিকেটটা কলোনিয়াল কালচারের অংশ হলেও তাতে তাল-লয়-সুর-ছন্দ দিয়ে পরিপূর্ণতা এনে দেন ক্যারিবীয়রা। ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় কালচারের সঙ্গে আফ্রিকান ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে গড়ে তোলা হয় যে ক্যারিবীয় সংস্কৃতি, তার অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে ক্রিকেট। ব্যাটে-বলে তারা মিলিয়েছেন জীবনের রঙধনু। শোষণ-বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভুলে থাকতে ক্রিকেটটাকে করে নেন জীবনের অংশ। খেলেছেন চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট। মন কেমন করা ক্রিকেট। ক্রিকেটে জয়টাকে তারা বড় করে দেখেননি। তারা জিতলেও হেসেছেন, হেসেছেন হারলেও। একই সঙ্গে পানে, ভোজনে, স্ফুর্তিতে হয়েছেন মাতোয়ারা। ক্রিকেটের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায় সুর, সুরা ও নৃত্য। সমুদ্রতটে, পাম গাছের তলায়, মশালের আলোয় কিংবা জ্যোৎস্নাধৌত রাতেও ক্রিকেট নিয়ে আসে অন্য ব্যঞ্জনা। ক্রিকেটটাকে তারা যে জীবনবোধের অংশীদার করে নেন, তা অনুপ্রেরণা হয়ে আসে ক্রিকেট ঘরানার অনগ্রসর দেশগুলোতে। সাফল্য দিয়েও ক্রিকেট বিশ্বকে আলোকিত করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই প্রথম থেকে টেস্ট ক্রিকেটে ঘটনাবহুল ও চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী ছাড়াও অসংখ্য কিংবদন্তি ও বর্ণাঢ্য ক্রিকেটব্যক্তিত্ব উঠে এসেছেন ক্যারিবীয় ছোট ছোট দ্বীপ থেকে। ওয়ানডে ক্রিকেট প্রবর্তনের পর ক্রিকেট পৃথিবীকে রোমাঞ্চিত ও আনন্দময় করে তোলে ক্যারিবীয়রা। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৮৩ সালে রানার্সআপ হওয়া ছাড়াও সত্তর দশকে ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। ব্যাটের প্রতাপে আর বলের ত্রাসে ক্রিকেট বিশ্বে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলেও ক্যারিবীয়রা ক্রিকেটে গেয়েছেন জীবনের জয়গান। এই গান ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। দরিদ্র, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে তৈরি করে বিস্ময় আর মুগ্ধতা। পুরু ঠোঁট, কোঁকড়ানো চুল আর মিশকালো গায়ের রঙের আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে আসা মানুষদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি উজ্জীবিত করে তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাৎপদ মানুষদের। তাদের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে ক্যারিবীয় ক্রিকেট।
সত্তর দশক কাঁপালেও ক্যারিবীয় ক্রিকেটকে লালিত্য দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে, আভিজাত্য দিয়ে নতুন সুধারসে জারিত করার কৃতিত্ব লিয়ারি কনস্টানটাইন, জর্জ হ্যাডলি, ফ্রাঙ্ক ওরেল, কাইড ওয়ালকট, এভার্টন উইকস, ওয়েস হল, কনরাড হান্ট, সনি রামাধীন, আলফ্রেড ভ্যালেন্টাইদের। বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকে থ্রি ‘ডব্লিউ’ হিসেবে খ্যাত ওরেল, ওয়ালকট ও উইকস ক্রিকেটকে শুধু সুরে সুরে ভরিয়ে দেননিÑ খেলার মাঠে তারা প্রতিফলন ঘটিয়েছেন যে জীবন-দর্শনের, তা হয়ে উঠেছে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের পরম সম্পদ। এঁদের জীবন-দর্শনকে অনুসরণ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। শুধু তাই নয়, তা সম্মোহিত করে জগতের অনুভূতিসম্পন্ন ও আবেগপ্রবণ মানুষদের। রৌদ্রকরোজ্জ্বল একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পাম ট্রি আর ক্রিকেট স্ট্যাম্পস এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে খয়েরি-লাল বর্ণ নিয়ে তৈরি করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতাকা হয়ে ওঠে ক্রিকেটপিপাসুদের প্রাণের নিশান।
অধিনায়কের ব্যাটনটা যেদিন ‘কিং’ ভিভ রিচার্ডস তারই স্বদেশী রিচি রিচার্ডসনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন, সেদিনই ‘অস্ত’ যেতে শুরু করে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের মাত-। ফ্রাঙ্ক ওরেল, কাইভ লয়েড এবং ভিভ রিচার্ডসের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাফল্যের সৌধ গড়ে ওঠার পাশাপাশি সম্মিলন ঘটে সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধন। ক্রিকেটার ও অধিনায়ক হিসেবে সফলতা পেলেও বিনিসুতার মালা দিয়ে গড়ে ওঠা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলেন রিচি রিচার্ডসন। প্রহাদকুলে ‘দৈত্য’ হয়ে দেখা দেন তিনি। রিচি যে মন-মানসিকতা নিয়ে হাল ধরেন, তার সঙ্গে একদমই খাপ খায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের। সেই থেকে হারিয়ে যেতে থাকে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের গৌরব-রশ্মি, মহিমা ও মর্যাদা। বিশ্ব ক্রিকেটের ‘বিটলস’ হয়ে যারা সুপারহিট থেকেছে টপ চার্টে, তাদের কাছ থেকে এখন শুনতে হচ্ছে ‘ব্যাক স্ট্রিট বয়েজ’-এর দুর্বল প্যারোডি। পরবর্তীকালে কার্টলি অ্যামব্রোস, কার্ল হুপার, কোর্টনি ওয়ালশ, সর্বোপরি ব্রায়ান লারার মতো বিরল জাতের ক্রিকেটারের দেখা মিললেও কিন্তু কোথায় সেই ক্যালিপসো সুর? যে জীবনবোধ, যে জীবন-দর্শন, যে সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্যালিপসো ক্রিকেটের ‘অবয়ব’, তাতে এখন যেন চলছে ‘চন্দ্রগ্রহণ’। এমন একটা মন্দাক্রান্ত সময় কারিবীয় ক্রিকেটানুরাগীদের হৃদয় ভারাক্রান্ত ও নস্টালজিক না করে পারে না। তবে এবারই প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসায় হারানো দিনগুলো ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও উঁকি মারছে মনের কোণায়। সেটুকুই সান্ত¡না।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ এপ্রিল ২০০৭
আর নয় পাকিস্তান, ভারত...
ক্রিকেটের বড় আসরে আগে আমাদের দেশটির তেমন মর্যাদাকর অবস্থান ছিল না। না থাকারই কথা। কোনো কিছুর শুরুতে মোটামুটিভাবে সবার একই অবস্থা হয়। নিজের দেশ না থাকলে তখন হৃদয় দখল করে নেয় অন্য কোনো দেশ। মৌমাছি তো ফুলের কাছে যাবেই মধু আহরণে। মানুষ স্বভাবগতভাবে বীর পূজারী। সাফল্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। তখন সে ছুটে যায় তার পিছে পিছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সমর্থন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। কেউ পাকিস্তান, কেউ ভারত কিংবা কেউ অন্য কোনো দেশের অনুরাগী। এ ক্ষেত্রে ক্রিকেটপ্রেমীরা অনেক সময় পোপের চেয়েও অধিক ক্যাথলিক হয়ে যান। এমনকি পছন্দের দেশটি নিজের দেশের মুখোমুখি হলেও অনেকেরই কা-জ্ঞান পর্যন্ত লোপ পেয়ে যায়। গুরুত্বহীন হয়ে যায় মাতৃভূমিও। ঢাকার মাঠে বিদেশী ক্রিকেট দলের সফরে এ বঙ্গের বিবিধ রূপ দেখতে পাওয়া গেছে। সৃষ্টি হয়েছে অনেক অপ্রীতিকর ও নোংরা ঘটনার।
এখন সময় এসেছে বদলে যাবার। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট পাল্টে দিতে পারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির। প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়েছে অনেকেরই প্রিয় দল পাকিস্তান এবং ভারত। বিশ্বকাপে উপমহাদেশের ক্রিকেটের এই দুই পরাশক্তির গৌরব-রশ্মি যখন অস্তমিত, তখন প্রজ্বলিত হয়েছে নতুন শক্তি বাংলাদেশের সাফল্যের সূর্য। কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে, ১৯৯৯ সালে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ, তেমনিভাবে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতকে পরাজিত করে কাঁপিয়ে দিয়েছে ক্রিকেট দুনিয়া। মূলত বাংলাদেশের কাছে হেরেই বিদায় নিয়েছে সুপারস্টারদের সমন্বয়ে গড়া ভারত। প্রথম মিশনে স্কটল্যান্ড আর পাকিস্তানকে হারিয়েও পদ্ধতিগত কারণে বেশি দূর যেতে পারেনি বাংলাদেশ। এবারের মিশনে ভারত এবং বারমুডাকে পরাজিত করে ১৬ জাতির এই টুর্নামেন্টে অর্জন করেছে সুপার এইটে খেলার গৌরব। আরো অনেক দূরে যাবার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়। অতীতের সাফল্যকে হালকা না করেও বলা যায়Ñ সেটা ছিল হঠাৎ জ্বলে ওঠা বাংলাদেশের পরম বিস্ময়। কিন্তু এখন আর বাংলাদেশের কৃতিত্বকে তেমনটি বলার উপায় নেই। যেভাবে বলে-কয়ে ভারতকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে, তাতে গত্যন্তর নেই শ্রেয়তর দল হিসেবে বাংলাদেশকে না মেনে নেয়া ছাড়া। বাংলাদেশ যে আর দুর্বল প্রতিপক্ষ নয়, এটা হাড়ে হাড়ে টের ুেপয়েছে ১৯৮৩ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলার শুরুতে যে স্নায়ুর চাপে পেয়ে বসে, সেটাই শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দেয় ব্যক্তিগত রান আর বিজ্ঞাপনের চাপে নুইয়ে পড়া ভারতকে। যাদেরকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার কথা, তারাই যদি মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না চুপিসারে কোথাও একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। অবশ্য বাংলাদেশ যে কাউকে যে ছেড়ে কথা বলবে নাÑ সেটা তারা বুঝিয়ে দিয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচে। অপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে আকাশে উড়তে থাকা নিউজিল্যান্ডকে মাটিতে নামিয়ে আনে বাংলাদেশ। রেকর্ড বুকে এ বিজয় লেখা না থাকলেও বাংলাদেশের ওজনটা যাদের বুঝে নেয়ার, তারা বুঝে নিয়েছে ঠিকই। রূপান্তরিত বাংলাদেশ ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে ক্রিকেট-বিশ্লেষকদের। এমনকি বাংলাদেশকে ‘চুনোপুঁটি’ মনে করা ক্রিকেটের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশ সুপার এইটে উঠেছে যোগ্যতর দল হিসেবেই।
যা কিছু আপন, তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। নিজের পরিম-ল, নিজের দেশকে ভালোবাসেন সবাই। ক্রীড়াক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। পরাজিত দলকে নিয়ে কেইবা আর মাতামাতি করবে? হালে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। নিজের দেশকে ভালোবাসার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে ক্রিকেট। এখন তো আর অন্য দেশকে নিয়ে মাতামাতি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ক্রিকেট দুনিয়ার সমীহ আদায় করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলার আগে প্রতিপক্ষকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। কাটতে হচ্ছে নানা ছক আর কৌশলের মারপ্যাঁচ। এ পর্যায়ে এটি অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। বিশ্ব ক্রিকেটের তারকা আর মহাতারকাদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে বাংলাদেশের উঠতি ক্রিকেটাররা। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল, সাকিবুল হাসান, মুশফিকুর রহিমরা। তাদের প্রতিভার দীপ্তিতে চমকিত হচ্ছেন ক্রিকেট কিংবদন্তিরা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবং ক্রিকেটাররা আকর্ষণ করতে পেরেছেন ভিনদেশীদেরও। অনেকেই ছুটে আসেন তাদের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য। এ কারণেই বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকা ‘দ্য এজ’কে এক বুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়া একটি দল মাত্র। নিশ্চিত করে বলতে পারিÑ এবার আর অটোগ্রাফের জন্য তাদের পেছনে (বাংলাদেশের) কেউ ছুটবে না। একটা সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যেখানে প্রতিপক্ষের কাছে ছুটে গিয়ে আহাদিত হতেন, আর এখন সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটানুরাগীদের মোহ কেটে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং এখন পকিস্তান, ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশ নিয়ে মেতে থাকাটা হবে নিজেদের দৈন্য আর দেউলিয়াপনার লক্ষণ।
বাংলাদেশ সবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ এখনই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে কিংবা প্রতিনিয়ত জয়ের স্বাদ পাবেÑ এমনটি আশা করা যায় না। তবে বাংলাদেশের পক্ষে যে সম্ভব, সেই সম্ভাবনাটুকু জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশ কেন পারবে না? এ দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস পৃথিবীর কাছে এক বিস্ময়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, তা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সারা দুনিয়ার মানুষ। এদেশের বীর জনতা সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম করে অভ্যুদয় ঘটিয়েছে একটি নতুন দেশেরÑ যা অবাক করা এক কীর্তি হয়ে আছে পৃথিবীর কাছে। বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে নতুনের কেতন ওড়ানোর জন্য। ক্রিকেটে সে পথেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ এপ্রিল ২০০৭
ফুটবলের সেই আবেগ কোথায়?
ফুটবলের সেই প্রাণচঞ্চলতা কোথায়? কোথায় সেই উন্মাদনা? ফুটবল কি তার সোনালী দিনগুলো হারিয়ে ফেলেছে? সত্তর ও আশির দশকের যে কোনো ফুটবল অনুরাগীর বুকে এ প্রশ্নগুলো বেদনার সুর হয়ে বাজে। অবশ্য এই আবেগ, এই অনুভূতি বর্তমান সময়ের ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়ে দোলা দেয় কিনাÑ সে প্রশ্নটা সঙ্গত কারণে উঠতেই পারে। এ সময়ের দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, জীবন-দর্শন নিশ্চয়ই অন্যরকম হবে। হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। তাদের বুকে তো আর নস্টালজিয়া নেই। নেই অতীতের জন্য মন কেমন করা। তারা হয়তো বর্তমান সময়টাকে সেরা ভাবতেই পারেন। ভাবাটা অসঙ্গত নয়। এ সময়ের তারুণ্য তো আর অতীতকে দেখেননি। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের তারতম্যটা তারা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? তাছাড়া সময় যত গড়ায়, ততই অর্জিত হয় পরিপক্বতা। আসে সাফল্য। আর এটা তো চিরন্তন নিয়ম, বয়স একটু হেলে পড়লেই একটা নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে। সবাই কম-বেশি হয়ে পড়েন অতীতমুখী, স্মৃতিকাতর। ফেলে আসা দিনগুলোকে মনে হয় স্বর্ণরেণু দিয়ে মোড়ানো। নিজেদের সময়টাকে সবাই গভীরভাবে ভালোবাসেন। মূল্যায়নটা করেন রঙিন চোখে। আসলে নিজের জীবনের সঙ্গে যে সময়টার রাখীবন্ধন, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসা। এ কারণে কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবনের দিনগুলো একজন মানুষের প্রধান সম্পদ হয়ে ওঠে। এ সময়টা মানুষের জীবনে বার বার ফিরে আসে। এর আগে কিংবা পরের সময়টা তাদের বুকে সেভাবে আসন করে নিতে পারে না। সঙ্গত কারণে কোনো কিছুর সার্বিক মূল্যায়ন করতে গেলে ঘুরে-ফিরে নিজের সময়টা গুরুত্ব পেয়ে যায়। অন্য অনেকের মতো আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
দেশভাগের পর এ অঞ্চলের নিস্তরঙ্গ জীবনে গতিময়তা নিয়ে আসে ফুটবল। পঞ্চাশ ও ষাট দশক ফুটবলে অনেক উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে লড়াই করে বাঙালি ফুটবলাররা নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার জন্য যে কষ্টকর টিকে থাকার সংগ্রাম করেছেন, তা ছিল প্রেরণাদায়ক ও উদ্দীপনামূলক। পশ্চিমাদের শোষণ-বঞ্চনার জবাব বাঙালি ফুটবলাররা দিয়েছেন খেলার মাঠে। বাঙালি ফুটবলারদের পায়ে বল এলে এ অঞ্চলের মানুষেরা আবেগে আপ্লুত হয়েছেন।ু একটা ডজ, একটা গোল তাদের বুকে অন্যরকম এক আবেগের জন্ম দিয়েছে। সে সময় যেসব বাঙালি ফুটবলার খেলার মাঠে আলো ছড়িয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেনÑ ওয়াজেদ আলী মিয়াজি, সৈয়দ আবদুর রশিদ ছুন্না, ফজলুর রহমান আরজু, নবী চৌধুরী, আবদুস সামাদ, তারাপদ রায়, কবীর আহমেদ, চিংহামং চৌধুরী মারী, আশরাফ চৌধুরী, তাজুল ইসলাম মান্না, গজনবী, দেবীনাশ শাংমা, মোঃ জহীর, বলাই চন্দ্র দে, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, আবদুর রহিম, খন্দকার নূরুন্নবী, আবুল খায়ের, সেকান্দার আলী, কাজী মাহমুদ হাসান, জাকারিয়া পিন্টু, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, গোলাম সারোয়ার টিপু, শহীদুর রহমান সান্টু প্রমুখ। পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলা এই ফুটবলাররা প্রত্যেকেই ছিলেন বাঙালির স্বপ্নের নায়ক। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিত্ব ও ইমেজ দিয়ে তারা পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছিলেন। তৎকালীন পরাধীন দেশে তারা যে আশার আলো জ্বালিয়েছিলেন, তা ছিল এক কথায় অতুলনীয়। তাঁরা শুধু ফুটবলশৈলী দিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেননি, তাঁদের পায়ে পায়ে ধাবিত হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ফুটবল মাঠে যেন নবজাগরণের ঢেউ লাগে। নতুন প্রজন্মের ফুটবলারদের সৃষ্টিশীল ও চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল ফুটবল নবউন্মাদনার সৃষ্টি করে। ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের পাশাপাশি টগবগে তারুণ্য ও যৌবনের পূজারী আবাহনী ক্রীড়াচক্রের আবির্ভাব ফুটবল অঙ্গনকে দারুণভাবে মাতিয়ে দেয়। চিরায়ত সাদা-কালো আর মোহনীয় আকাশী-নীল রঙের জার্সি শুধু তীব্র প্রতিদ্বন্দি¡তারই জন্ম দেয়নি, ফুটবলকে করেছে প্রাণবন্ত, চিত্তাকর্ষক ও গ্ল্যামারাস। বিল হার্টের প্রশিক্ষণে আবাহনীর শৈল্পিক ও আধুনিক ফুটবল নতুন একটি ধারার জন্ম দেয়। গতানুগতিকতার পরিবর্তে গতি ও ছন্দময় ফুটবলের নীল রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্ম। সত্তর দশকের অস্থির ও টালমাটাল সময়ে ফুটবলের স্বপ্নে প্লাবিত হয় বলতে গেলে পুরো দেশ। ফুটবলের জনপ্রিয়তার ঢেউ উপচে পড়ে শহর-বন্দর-নগরে, গ্রাম-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়। ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেন বড় নাজির, অমলেশ, নান্নু, বাটু, কাজী সাত্তার, মোঃ মালা, অনিরুদ্ধ, গোবিন্দ কু-ু, কায়কোবাদ, আলী ইমাম, এনায়েত, নওশের, শেখ আশরাফ, সালাউদ্দিন, গফুর, ছোট নাজির, মোতালেব, মঞ্জু, সেলিম, আবু ইউসুফ, চুন্নু, বাবলু, বড় বাদল, রকিব, খোরশেদ বাবুল, নীলু, কালা, মোকসেদ, টুটুল, ভানু, রামা লুসাই, বাসু, হালিম, মোহসিন, সুহাস, আবুল, মঈন, কাওসার আলী, আশীষ, আসলাম, কাজী আনোয়ার, মুকুল, হাসান, হেলাল, সালাম মুর্শেদী, স্বপন কুমার, লোভন, পিন্টু, ছোট ইউসুফ, লাল মোহাম্মদ, আজমত, গাফফার, ওয়াসিম, মোসাব্বের প্রমুখ। সে সময় তরুণ প্রজন্মের সামনে তেমন কোনো রোল-মডেল ছিলেন না। ফুটবলাররাই হয়ে ওঠেন কল্পনার রোল-মডেল। বিশেষ করে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, গ্ল্যামার ও জনপ্রিয়তা দিয়ে আলাদা স্থান করে নেন সালাউদ্দিন, এনায়েত, নান্নু, মঞ্জু, চুন্নু, টুটুল প্রমুখ। সালাউদ্দিন তো রীতিমত কিংবদন্তী হয়ে ওঠেন। সে সময়ের ফুটবল বিশ্বের রোমান্টিক নায়ক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জর্জ বেস্টের আদলে ঘাড় অব্দি নেমে আসা ঝাঁকড়া চুল, বোহেমিয়ান না হলেও কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন আর হরিণের ন্যায় দুরন্ত গতিতে ছুটে মনমাতানো ফুটবল দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের মডেল হয়ে ওঠেন সালাউদ্দিন।
কাব ফুটবলের পাশাপাশি আগা খান গোল্ডকাপ, প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ, সফরকারী বিদেশী দলের সঙ্গে স্থানীয় দলের প্রীতি ম্যাচসহ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের খেলাগুলোর জন্য ফুটবল দর্শকরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। তবে দেশের মাটিতে যেসব টুর্নামেন্ট ও ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা দেখার জন্য মানুষের ঢল নামতো। ঢাকা স্টেডিয়াম একতলা থেকে দোতলা এবং ফাডলাইটে খেলা আয়োজন করেও দর্শকদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আয়োজন ২০তম এশীয় যুব ফুটবল টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ১৮টি দেশ নিয়ে আয়োজিত এ টুর্নামেন্টটি ফুটবলের এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে। দর্শক উন্মাদনার ক্ষেত্রে এ টুর্নামেন্ট নতুন এক ইতিহাস রচনা করে। এক্ষেত্রে মেয়েরা মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না। সেবারই প্রথম মহিলাদের জন্য আলাদা গ্যালারির ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারি ছিল পরিপূর্ণ। ইরাকের হারিস মোহাম্মদ, আদনান দারজাল, খলিল মোহাম্মদ, সৌদি আরবের ইশা গাওয়ারগি, দায়িশ মোহাম্মদ প্রমুখ তরুণীদের চোখে এঁকে দেন স্বপ্নের অঞ্জন। সাহসী তরুণীদের ঠোঁটের আগ্রাসী ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এই তরুণ ফুটবলাররা। ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসার ছোঁয়া বরাবরই বিদেশীরা পেয়ে এসেছেন। বলা যায়Ñ ফুটবল উন্মাদনার দিক দিয়ে সত্তর ও আশির দশকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় বাংলাদেশ। সে সময় ফুটবল ছিল হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। যেখানেই ফুটবল, সেখানেই মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে গেছেন। মজার ব্যাপার হলো, সে সময় আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের তেমন কোনো সাফল্য ছিল না। বিদেশী দলগুলোর সঙ্গে কাবগুলোর চমকপ্রদ নৈপুণ্য ও ফুটবলারদের ব্যক্তিগত ক্রীড়াশৈলী মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। টেনে নিয়েছে ফুটবল মাঠে। এ অবস্থা নব্বই দশকে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিলেও এরপর থেকে ফুটবলে প্রাণচাঞ্চল্য ও উন্মাদনা নেই বললেই চলে।
আশির দশক পর্যন্ত চলে আসা টইটম্বুর ও সম্মোহনী ফুটবল নব্বই দশকে এসে হঠাৎ যেন পথ হারিয়ে ফেলে। ফুটবলের ভরা গাঙে চর পড়তে শুরু করে। প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে স্থবির হয়ে পড়তে থাকে প্রাণোচ্ছ্বল ফুটবল। ফুটবল অনুরাগীরা হারিয়ে ফেলেন সেই আবেগ, উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা। অথচ নব্বই দশকে এসে ফুটবলের মুকুটে সংযোজিত হয় সাফল্যের পালক। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্যের মুখ দেখে। মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে মিয়ানমার চার জাতির ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৯৯৯ সালে সাফ গেমসের ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলেরও চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশের শক্তিমত্তাকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। সাফল্যের বিচারে আশি-উত্তর দশকই এগিয়ে থাকবে। কিন্তু জনপ্রিয়তা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে কোন সময়টাকে সেরা বলা যাবে? আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্য দেখানো সত্ত্বেও বর্তমানে ফুটবলের সেই আবেগ কোথায়? সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জে ওঠা সেই উন্মাদনা কোথায়? নব্বই দশকের আগে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য সেই সকাল থেকে মানুষের যে স্রোত নামতোÑ তা আজ কোথায়? মোহামেডান ও আবাহনীর খেলাকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে যে আবেগ, উচ্ছ্বাস ও প্রস্তুতি, তা কেন চুপসে গেল? এ প্রশ্নগুলো বিচার-বিশ্লেষণ এবং সাম্প্রতিক অবস্থায় অনুধাবন করা যায়Ñ ফুটবলের সেই সুদিন আজ নেই। আসলে নব্বই দশকের আগে যে প্রাণবন্ত, চিত্তাকর্ষক, গ্ল্যামারাস ও শৈল্পিক ফুটবলের সুধারস ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়-মন কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছে, সেই ফুটবল এখন আর নেই। মানুষ ফুটবল মাঠে ছুটে যেতে চায় তাৎক্ষণিক আনন্দে সিক্ত হতে; গতি, ছন্দ ও চোখ ধাঁধানো সৃষ্টিশীল ফুটবলের জারক রসে হৃদয়-মনকে পরিপূর্ণ করতে। সেই ফুটবল এখন আর মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না। এই না পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সব্যসাচী ফুটবলার অমলেশ সেন মনে করেন, তাঁদের সময়ের ফুটবলাররা অনেক বেশি স্কিল্ড ছিলেন। পাস, রিসিভিং, ড্রিবলিং, শুটিং অনেক বেটার ছিল। যদিও এখনকার ফুটবলাররা স্ট্যামিনার দিক দিয়ে আগের ফুটবলারদের চেয়ে এগিয়ে। টেকনিক্যাল দিক দিয়েও তাঁরা উন্নতি করেছেন। কিন্তু ফুটবলশৈলীর দিক দিয়ে বর্তমানকালের ফুটবলাররা অনেক পিছিয়ে আছেন। তবে বর্তমান সময়ের তারকা ফুটবলার-গোলকিপার মোঃ আমিনুল হক মনে করেন, ‘আগেকার তারকা ফুটবলারদের কোচ কোনো নির্দেশ দিতেন না। ফলে তাঁরা ইচ্ছেমত অনেকক্ষণ বল পায়ে রেখে খেলতে পারতেন। ড্রিবলিং করতেন। এখনকার ফুটবলারদের সে সুযোগ নেই। বর্তমান ফুটবলাররা গতিনির্ভর ওয়ানটাচ ফুটবল খেলছেন। তাই আগের মতো স্কিল্ড ফুটবলার চোখে পড়ে না।’ এই যুক্তিটা না হয় অনুধাবন করা গেল; কিন্তু ুযে প্রশ্নটা মনের মাঝে গুনগুনিয়ে ওঠে, তা হলোÑ ফুটবলের সেই আবেগটা কোথায় গেল?
দৈনিক সমকাল, ৬ ডিসেম্বর ২০০৫
ফুটবল ফিয়েস্তা
‘এ টাইম টু মেক ফ্রেন্ডস’ শ্লোগান নিয়ে আগামী ৯ জুন থেকে শুরু হচ্ছে ১৮তম বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবলের এই মহোৎসবে জার্মানীর ১২টি শহরে খেলবে ৩২টি দেশ। বিশ্বের ২০৩টি দেশের ফুটবল অনুরাগীদের মতো বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরাও রাত জেগে উপভোগ করবেন মাসব্যাপী ৬৪টি ম্যাচের এই ফুটবল ফিয়েস্তা।
ফুটবল খেলাটা মানবজাতির অগ্রগতির অন্যতম এক নিদর্শন। এই খেলাটির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্যসমূহ। জীবনের সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়েছে বলেই ফুটবল এই পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। কি ধনী, কি গরীব, কি শাদা, কি কালো, কি খ্রিস্টান, কি মুসলমানÑ সবার কাছে ফুটবল সমান আকর্ষণীয়। ফুটবল যদি শুধু বায়ুভর্তি একটি চামড়ার গোলক হতো, তাহলে তা পৃথিবীর প্রায় ৫০০ কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারতো না। ফুটবল, খেলার চেয়েও বেশি। ফুটবলপ্রেমীদের অব্যক্ত অনুভূতির চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সব্যসাচী লেখক জে.বি. প্রিস্টলির কথায় : ‘ফুটবল যদি শুধুই মাঠে বাইশটা ভাড়াটে লোকের একটা বলে লাথি মারা হয়, তাহলে বেহালাও শুধুমাত্র কাঠ আর তাঁত, হ্যামলেটও তাহলে কাগজের ওপর খানিকটা কালি।’ ফুটবলে যেমন আছে সুর-ছন্দ-নাটকীয়তা, তেমনি আছে রাগ-দ্বেষ-হিংস্রতা। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির চমৎকার সমন¦য় ঘটেছে ফুটবলে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিয়ত ফুটবল খেলা হলেও বিশ্বকাপের রূপ-মাধুর্যই আলাদা। সেই ১৯৩০ সালে শুরু হয়ে প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবল নতুন মাত্রা নিয়ে আসে। মহাযুদ্ধের কারণে দুটি আসর হারিয়ে গেলেও বিশ্বকাপ ফুটবলেই সুর হয়ে বাজে মিলনের মর্মবাণী। বিশ্বকাপ ফুটবল পৃথিবীর মানুষকে শান্তি-সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে বন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। চূড়ান্ত পর্বে সীমিতসংখ্যক দেশ খেললেও এর সঙ্গে কম-বেশি পৃথিবীর প্রতিটি দেশই একাÍবোধ করে। ফুটবলের চিরন্তন আবেদন ছাড়াও বিশ্বকাপ ফুটবল হয়ে উঠেছে মানব জাতির সর্বজনীন এক উৎসব। বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে বিভিন্ন দেশের চাওয়া-পাওয়াটা নানামুখী হলেও সবাই মেতে ওঠেন ফুটবলের অনাবিল আনন্দে। আর আনন্দ-বেদনার তো আলাদা কোন রঙ নেই। সঙ্গত কারণে একই রঙে, একই সুরে নেচে ওঠে সবার মন। আনন্দের প্রকাশটা হয়তো আলাদা। ইউরোপীয়রা রুটি, টাটকা মাছ, সসেজ বিয়ার সহযোগে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মূর্ছনায় উদ্বেলিত হন। আর লাতিনদের রক্তে সহজাতভাবেই দোলা দেয় নিজস্ব ঘরানার সঙ্গীত, নৃত্য ও ফুটবল। সে সঙ্গে সুরা তো আছেই। বিশ্বকাপ ফুটবলে বিভিন্ন সংস্কৃতিরও মেলবন্ধন ঘটে। পৃথিবীতে ছড়ানো-ছিটানো কত গান, কত ফ্যাশন, কত সংস্কৃতি। সাধারণত এ সবের সঙ্গে সবার খুব একটা পরিচয় হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে এর পাশাপাশি হরেক রকম উল্কি, ফ্যাশন ও বাহারী মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। একটি বিশ্বকাপ মানুষের জানাশোনার পরিধিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামু বলেছেন : ‘মানুষের দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা সম্পর্কে যা কিছু জেনেছি, তার জন্য আমি ঋণী ফুটবলের কাছে।’
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলে জৌলুস যেমন বেড়েছে, তেমনি ফুটবল খেলাও হয়েছে আরো গতিময়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুটবলেও এসেছে নতুন নতুন কৌশল। ভারতের ফুটবল কিংবদন্তী চুনী গোস্বামী যেমনটি বলেছেন, ‘একজন স্ট্রাইকার বলটা ঠিকভাবে রিসিভ করবেন, পাস দেবেন, ট্যাপ করবেন, ঠিকভাবে গোলে শট নেবেন। তেমনি ডিফেন্ডার যথাযথভাবে বল ট্যাকেল করবেন, বিপক্ষের ফুটবলারের কাছ থেকে বল কেড়ে নেবেন, ঠিকঠাক ডিস্ট্রিবিউশন করতে হবে তাকে। সা রে গা মাÑ সুরের সাত মাত্রার যাবতীয় অদলবদলে যেমন গান, তেমনি ফুটবলেও রিসিভিং, ড্রিবল, ট্যাকল, ট্যাপিং, শুটিং কয়েকটা প্রাথমিক জিনিসের ওপর ভিত্তি করেই যুগে যুগে নতুন নতুন স্ট্রাটেজি জন্ম নিয়েছে।’ প্রাথমিক শর্তগুলো ঠিক থাকলেও ফুটবল খেলার রূপ-রস-সৌন্দর্যে পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপীয় প্রযুক্তির ফুটবল আর লাতিন ঘরানার শৈল্পিক ফুটবলের মধ্যে বেশ তারতম্য পরিলক্ষিত হলেও উভয়ের উদ্দেশ্য কিন্তু অভিন্ন।
একটা বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে এত কিছু জড়ানো থাকে যে, তার থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে রাখা সহজ নয়। বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরের হলেও ফুটবলের সুর-ছন্দ ও চিরায়ত আবেদন থেকে আমরা মোটেও দূরে নই। এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদেরকে আবেগে আপ্লুত করে। আর আমরা অপেক্ষায় থাকি বিশ্বকাপ ফুটবলের।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ জুন ২০০৬
বিশ্বকাপ ফুটবল : অন্তহীন এক দীর্ঘশ্বাস
পৃথিবী নামক এক বিশাল ভূখ-ে যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কমপক্ষে ২০৪টি দেশ আছে, তা জানা সম্ভব হয়েছে ফুটবলের কল্যাণে। ভাবতেও অবাক লাগে, এত এত দেশ ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সদস্য! এর চেয়ে বেশি দেশ আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক আর কোনো সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত নেইÑ এটা অন্তত বলেই দেয়া যায়। সাধারণত নিজ দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানব কল্যাণ, শান্তি, নিরাপত্তাসহ নানা কারণে বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক রকমারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। অথচ দেখা যাচ্ছে, সর্বোচ্চসংখ্যক দেশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ফুটবলকে। এমনকি সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার জন্য জাতিসংঘকে গুরুত্ব না দিয়ে কোনো কোনো দেশ ফিফার সদস্য পদকে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করেছে। সব মিলিয়ে ফুটবলের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে অধিকসংখ্যক দেশ এবং অধিকসংখ্যক মানুষ। গত ১৭টি বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত আসরে কখনো না কখনো খেলেছে ৭২টি দেশ। এর মধ্যে এক বা দু’বার খেলেছেÑ এমন দেশের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। আর ঘুরেফিরে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাত্র সাতটি দেশÑ উরুগুয়ে, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। এবারের জার্মানি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলবে ইউরোপের ইউক্রেন, মধ্য আমেরিকার ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, আফ্রিকার আইভরি কোস্ট, অ্যাঙ্গোলা, ঘানা ও টোগো। নতুন নতুন দেশ খেললেও সম্ভবত এবারো শিরোপা সীমাবদ্ধ থাকবে বনেদি দেশগুলোর মধ্যে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ৭৬ বছরের ইতিহাসে চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে বা খেলবে ৭৮টি দেশ। এই সংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ থেকে দেশের সংখ্যা ২৪ থেকে ৩২-এ উন্নীত করায়। আর শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে শামিল হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ। অবশ্য অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশের স্বপ্ন থাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছানোর। কিন্তু সবার পক্ষে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর কিংবা কাছাকাছি সময়ে অংশ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে যুগোস্লাভিয়া, বেলজিয়াম, চিলি, প্যারাগুয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, সুইডেন, হাঙ্গেরি, হল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, মিসর, নরওয়ে, কিউবা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস প্রভৃতি দেশ আজ অবধি চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ইতোমধ্যে এ দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই পিছিয়ে পড়েছে এবং কোনো কোনো রাষ্ট্র ভেঙেচুরে জন্ম নিয়েছে নতুন দেশে। নবীন অনেক দেশ এগিয়ে এসেছে বিশ্ব ফুটবলের নতুন শক্তি হিসেবে। সবার পক্ষে শিরোপা জয় করা সম্ভব না হলেও চূড়ান্ত পর্বে খেলা এবং শিরোপা জয়ের স্বপ্নে মশগুল থাকাটা তাদের জন্য অনুপ্রেরণার বড় এক উৎস।
পৃথিবীর প্রায় ছয়শ’ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রতিটি বিশ্বকাপে খুব বেশি হলে একশ’ কোটি লোকের প্রতিনিধিত্ব থাকে (অবশ্য চীন খেললে সংখ্যাটা এক লাফেই হয়ে যায় দ্বিগুণ)। বিশ্বকাপ ফুটবল তাদের কাছে আনন্দের উপলক্ষ হয়ে আসে। বাদবাকিদের কাছে বিশ্বকাপ ফুটবল অন্তহীন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০ নম্বরে। বাংলাদেশের ফুটবলের অগ্রগতির যে ধারা, তাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার চিন্তা করাটাও অসম্ভব এক কল্পনা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফুটবলেই বাংলাদেশ নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। বরং এক সময়ের অভূতপূর্ব জনপ্রিয় ফুটবল এখন মন্থর ও ম্লান হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ফুটবল এখন আর দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারে না। এ অবস্থায় চার বছর পর পর যখন বিশ্বকাপ ফুটবল দুয়ারে কড়া নাড়ে, তখন একটা মর্মযাতনায় ভুগতে থাকেন এদেশের ফুটবল অনুরাগীরা। কেননা, বিশ্বকাপ ফুটবল তাদের কাছে এক অধরা স্বপ্নের নাম। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কখনো খেলার তো প্রশ্নই আসে না, অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আর কোনো কিছুতে সম্ভাবনা না থাকলে তা নিয়ে আগ্রহ থাকারও কথা নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীরা। দেশের ফুটবল নিয়ে অভিমান ও মর্মবেদনা থাকলেও ফুটবল থেকে তারা মোটেও দূরে থাকতে রাজি নয়। ফুটবলে আছে রূপ-রস-সৌন্দর্য ও সুষমা। আছে আবেগ-উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা। আর এসবের প্রতি এদেশের মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। ফুটবলের রূপসাগরে ডুব দিয়ে তারা খুঁজে পান ‘অন্তর মম বিকশিত কর’-এর হীরা-জহরত ও মণি-মাণিক্য। অমূল্য এই অধরা সম্পদ ফুটবল ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? তাই এদেশের ফুটবল ঝিমিয়ে পড়লেও এদেশের মানুষের হৃদয়ে কিন্তু ফুটবলের জন্য লাল গালিচা বিছানো। ফুটবলে একটুখানি টোকা পড়লে তাদের দারুণভাবে দুলিয়ে দেয়। বিশ্বকাপ ফুটবল তো রসের আকর আর রূপের ডালি সাজিয়ে সমাগত হয়। রসগ্রাহী ও সৌন্দর্যপিয়াসী ফুটবল সমঝদারদের তখন বাঁধন-ছেঁড়া না হয়ে উপায়ই-বা কি। স্বভাবতই বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যতই আক্ষেপ, দীর্ঘশ্বাস ও না পাওয়ার বেদনা থাকুক না কেন, ফুটবলের এই মহোৎসব থেকে তো দূরে থাকার উপায় নেই।
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জুন ২০০৬
আমাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের পায়ে পায়ে এ অঞ্চলে ফুটবল এলেও বিনোদনের সস্তা উপকরণ হিসেবে ফুটবল খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জটিলতাহীন এ খেলাটিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজেই আপন করে নেয়। সহজ-সরল লোকায়ত জীবনযাত্রার বিনোদনের নির্মল বাহন হয়ে ওঠে ফুটবল। ফুটবলের ইতিহাস এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্রিটিশদের রাজত্বকাল বিচার-বিশ্লেষণ করলে এ অঞ্চলের মানুষ ফুটবল নিয়ে গর্ব করতেই পারে। প্রায় আড়াইশ’ বছর ধরে এ অঞ্চলে ঘটা করে ফুটবল খেলা হয়ে আসছে। এতটা বছর খেলা হওয়ার পর বলা যায়, ফুটবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যে পরিণত হলেও ফুটবল নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ খুব বেশি গর্ব করতে পারেন না। যদিও গৌরব করার মতো কিছু কিছু মাইলফলক রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। আধুনিক ফুটবলের জন্মদাতা ব্রিটিশদের সঙ্গে টেক্কা মারার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এ অঞ্চলের হত-দরিদ্র মানুষ। দেশভাগের আগ পর্যন্ত কলকাতা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র। ব্রিটিশদের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ফুটবলারদের চোখ জুড়ানো নৈপুণ্যে উদ্ভাসিত হয়েছে আইএফএ শীল্ড, কোলকাতা ফুটবল লীগসহ জনপ্রিয় ফুটবল আসরসমূহ। সঙ্গত কারণে তাতে ছিল গোরাদের একচেটিয়া আধিপত্য। কিন্তু একদম ছেড়ে কথা কয়নি এ অঞ্চলের অসহায় ও নিঃস্ব মানুষেরা। রাজনৈতিক মঞ্চে তারা যেমন রুখে দাঁড়িয়েছেন; অনুরূপভাবে ফুটবল মাঠেও তারা গড়ে তোলেন শক্ত প্রতিরোধ। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের আইএফএ শীল্ড জয় তো অসাধারণ কীর্তি হয়ে আছে। ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের শ্বেতাঙ্গদের ২-১ গোলে হারিয়ে ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে দেয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কালো মানুষেরা। কোলকাতা লীগে মোহামেডান, মোহনবাগান ও ইস্ট বেঙ্গল কাবের সাফল্য তো অনেকটা রূপকথার মতো। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর লীগ শিরোপা জিতে অবিস্মরণীয় এক ঘটনার জন্ম দেয় মোহামেডান। ১৯৩৬ সালে তারা একই সঙ্গে জয় করে আইএফএ শীল্ড। সে সময়টা মোহামেডানের স্বর্ণযুগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৩৭ সালে ঢাকা সফরকারী ইংল্যান্ডের এএফসি কোরিন্থিয়ান্স কাবকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন। জয়সূচক একমাত্র গোলটি করে পাখী সেন। কোরিন্থিয়ান্সের সেবারের সফরে তারা একমাত্র ঢাকায় পরাজিত হয়। বিশ্ব ফুটবলের প্রভাবশালী একটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দি¡তা গড়ে তুলে কখনো-সখনো জয়ের মুকুট মাথায় দেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এ অঞ্চলের ফুটবলাররা। ফুটবল জাদুকর সামাদ তো বিশ্ব ফুটবলের এক চমকপ্রদ কিংবদন্তি। খেলার মাঠে খামখেয়ালিপনা, গোল করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা আর কীর্তিগাথা দিয়ে ফুটবলে অমর হয়ে আছেন তিনি। জন্ম দিয়েছেন বিস্ময়কর সব ঘটনার। এমন ফুটবলার বিশ্ব ফুটবলে বিরল। এত উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কেন জানি অনুজ্জ্বল হয়ে আছে। অথচ গত ২০০/২৫০ বছর আন্তর্জাতিক মানচিত্রে অস্তিত্ব ছিল নাÑ এমন অনেক দেশ এবং যেসব দেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক পরে ফুটবলে হাতেখড়ি নিয়েছে, তারাও ঢের ঢের এগিয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়ে উঠেছে বিশ্ব ফুটবলের মস্ত শক্তি। তারা দ্রুত এগিয়ে গেলেও ফুটবলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। এই পিছিয়ে পড়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট একটা বড় কারণ হতে পারে। কিন্তু আফ্রিকার অন্ধকার থেকে ওঠে আসা ফুটবলাররা যখন বিশ্ব ফুটবলকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন, তখন অর্থনৈতিক বিষয়টি খুব বেশি ধোপে টেকে না। আসলে তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফুটবল পিছিয়ে পড়াটা অন্তহীন এক রহস্য হয়ে আছে। আর এই রহস্য উন্মোচন করা না গেলে এ অঞ্চলের ফুটবলের গন্তব্য অনিশ্চিত হয়ে থাকবে।
১৯৩০ সালে ফুটবল প্রবর্তনের পর বিশ্বকাপ ইতোমধ্যে ৭৬ বছর পেরিয়ে এসেছে। এখন অবধি বিশ্ব ফুটবলে অপাংক্তেয় হয়ে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলা তো দূরে থাকুক, তার কাছাকাছি যাওয়াও একটা বড় দুঃস্বপ্ন। এ অবস্থায় প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য অস্বস্তি নিয়ে আসে। বিশ্বকাপে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও ব্যতিক্রম এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। কেননা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১৫০ কোটি লোকের বিশ্বকাপে কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও বিশ্বকাপের রসাস্বাদন থেকে তো আর বঞ্চিত হওয়া যায় না। তাই বিশ্বকাপের কোনো না কোনো দল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের প্রিয় দল হয়ে ওঠে। সেই দলকে কেন্দ্র করে পল্লবিত হয় তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। প্রিয় দলের সাফল্য ও ব্যর্থতা হয়ে ওঠে নিজ দলের সাফল্য ও ব্যর্থতা। নিজ দেশের খেলতে না পারার যে কষ্টকর অনুভূতিÑ তা থেকে অন্তত কিছুটা ভুলে থাকা যায়। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি! এছাড়া কীইবা করার আছে দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার হতভাগ্য ফুটবল অনুরাগীদের?
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১৬ জুন ২০০৬
কর্পোরেট সংস্কৃতির বিশ্বকাপ ফুটবল
মহাকাব্যিক সৌন্দর্য ও সুষমা নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের মনকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। রাত জেগে জেগে আমরা উপভোগ করছি বিশ্ব ফুটবলের সৌন্দর্য-সুধা। খেলার ফলাফল ও নানা ঘটনায় আমরা কখনো আনন্দিত হয়েছি, কখনো হচ্ছি বেদনার্ত। আর এই আনন্দ-বেদনার নির্যাসটুকু আমাদের একঘেয়েমি জীবনে নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করছে। এক জীবনে আমরা কতটুকুই বা দেখতে বা জানতে পাই। অল্প কিছু সৌভাগ্যবানকে বাদ দিলে এ জীবন তো অপূর্ণতায় ভরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরই জীবন শাদা-কালো। যে জীবনে খুব বেশি বৈচিত্র্য নেই। কিন্তু একটি বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের জীবনে নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে আসে। জীবনটাকে খানিকটা রাঙিয়ে দিয়ে যায়। অনেকখানি পূর্ণ করে দেয় অভিজ্ঞতার ভা ারকে।
আমাদের মতো হতমানদের কথাই শুধু বলি কেন, বিশ্বকাপ ফুটবল এই পৃথিবীর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। সভ্যতার অন্যতম এক নিদর্শন। পৃথিবী নামক গ্রহটি যে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে এবং একটি সিস্টেমে চলছে, তা অনুধাবন করা যায় বিশ্বকাপ ফুটবলের সামগ্রিক কর্মকাে । পৃথিবীতে ২০৭টি দেশ আছে, সেটা আমরা জানতে পারি ফিফার সদস্য সংখ্যা দেখে। ফিফা ছাড়া আর কোনো সংস্থার সদস্য এতগুলো দেশ নেই। সদস্যগুলো শুধু নামেই তাদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেÑ সেটা ভাবা ভুল হবে। প্রতিটি দেশই বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নিয়ে থাকে। চূড়ান্ত পর্বে ৩২টি দেশ খেললেও এর আগে প্রায় দু’বছরব্যাপী যে বাছাই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সবগুলো দেশকে খেলতে হয়। যে প্রক্রিয়ায় এই বাছাইপর্ব হয়ে থাকে, তা অভাবিত ও অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। কোথাও সিস্টেমের নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। সবাইকে ফিফার নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয় কঠোরভাবে। হতে পারেন তিনি বিশ্বের সর্বময় কর্তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, হতে পারেন তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানÑ কারো কোনো কর্তৃত্ব ফিফার কাছে পাত্তা পায় না। বোধকরি ফিফা যে কর্তৃত্বে ও সিস্টেমে বিশ্ব ফুটবল পরিচালনা করে থাকে, তেমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। এই সিস্টেমটি অন্যান্য ক্ষেত্রে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে সম্ভবত এই পৃথিবীর চেহারা অনেকখানি বদলে যেত।
তবে ফিফার কার্যক্রম যে একদম ধোয়া তুলশি পাতা তা অবশ্য বলা যাবে না। কাড়ি কাড়ি টাকার লেন-দেন যেখানে হয়ে থাকে, সেখানে কিছু উল্টা-সিধা না হয়ে পারে না। তাছাড়া কর্পোরেট সিস্টেমে ফিফা চালাতে গিয়ে কিছু কিছু নিয়ম-নীতি ও আদর্শ যে বিসর্জন দিতে হয় নাÑ তাও জোর গলায় বলা যাবে না। বিশাল আয়ের পথ সুগম রাখতে গিয়ে অনেক সময়ই জেনে-শুনেই কাঁটা গিলতে হয়। এ কারণে ফিফার বিপক্ষে নানা অভিযোগ, সমালোচনা ও গুঞ্জন। কর্পোরেট হাউজের রাঘব-বোয়ালদের ইঙ্গিতে গোপনে গোপনে পাল্টে যায় কত কিছু। কর্পোরেট সংস্কৃতির রমরমা ভাবটা আমরা দেখতে পেলেও ভেতরে ভেতরে এর যে কদর্য রূপÑ তা আমাদের অগোচরে থেকে যায়। অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলো। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে স্বাগতিক দলের সঙ্গে খেলায় সুপারস্টার রোনালদোর অসুস্থতা ও অনুজ্জ্বল পারফরমেন্স অন্তহীন এক রহস্য হয়ে আছে। কর্পোরেট সংস্কৃতির কাঠামো এতটাই সুদৃঢ় যে, আজ পর্যন্ত সেই রহস্যের উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিটি বিশ্বকাপেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে। অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে শেষ মুহূর্তে উল্টে যায় পাশার দান।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলেও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে। শাদা চোখে যা অনুধাবন করা যায় না। কাক্সিক্ষত দেশগুলোকে নানা কৌশলে পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বে অস্ট্রেলিয়াকে যেভাবে হারিয়ে ইতালিকে পরবর্তী রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া হয়, তা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। ইউরোপ থেকে অন্য মহাদেশের কাপ জয় করাটা খুব একটা সহজ নয়। খেলার নৈপুণ্য দিয়ে সাফল্য পেলে কারো কিছু বলার থাকে না। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে স্বাগতিক জার্মানিকে কাপটা তুলে দিতে পারলে ফিফার কর্তারা খুশি হবেন। অবশ্য এ ধরনের অনুমানভিত্তিক কিছু লেখাটা শোভনীয় নয়। জার্মানি তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং এবার তারা খেলছেও ভালো। তাদের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখা মোটেও উচিত নয়। তবে মন বলে একটা ব্যাপার আছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেই মন বলছে, এবার কাপটা থেকে যাবে ইউরোপেই। সেটা যেভাবেই হোক। এমনিতেই কর্পোরেট সংস্কৃতি ফুটবলের ছন্দ, সুষমা ও লাবণ্য শুষে নিচ্ছে, তারপর যদি আগেই চ্যাম্পিয়নশীপ নির্ধারণ হয়ে থাকে, তা হবে বিশ্ব ফুটবলের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তেমনটি না হলে আমরা অবশ্যই খুশি হবো।
পাক্ষিক ক্রীড়াজগত, ১ জুলাই ২০০৭
সর্বজনীন উৎসব বিশ্বকাপ ফুটবল
এই পৃথিবীতে উৎসবের কোনো কমতি নেই। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে হরেক রকম উৎসব। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সর্বজনীন কোনো উৎসব নেই, যে উৎসবকে কেন্দ্র করে সবাই একই সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠতে পারে। দুনিয়ার তাবৎ মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি বিশ্বজনীন উৎসব হলে মন্দ হতো না।
তবে বিশ্বকাপ ফুটবলকে বিশ্বজনীন উৎসব বলাই যেতে পারে। ফুটবল এমন একটি খেলা, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষের প্রিয়। পৃথিবীর এমন এলাকা খুব কমই আছে যেখানে ফুটবল খেলা হয় না। এই গ্রহের ৬০০ কোটি লোকের প্রায় ৫০০ কোটি লোকই ফুটবল ভালোবাসেন। কোটি কোটি লোক ফুটবল খেলায় অংশ নেন এবং তার চেয়েও বেশি লোক ফুটবল খেলা দেখতে পছন্দ করেন। ফুটবলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ এটি সহজ ও অ-জটিল একটি খেলা। ফুটবল খেলার জন্য খুব বেশি সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই। একটি বল কিংবা গোলাকৃতির শক্ত কিছু হলেই ফুটবল খেলা যায় কিংবা ফুটবলের আনন্দে মেতে ওঠা যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সী মানুষই ফুটবল খেলতে পারেন। এমনকি খেলতে পারেন মেয়েরাও। ক্রিকেট খেলায় অনেক সরঞ্জামাদি লাগে। বাস্কেটবলে দীর্ঘদেহী না হলে খুব বেশি সুবিধা করা যায় না। ফুটবলে তেমন অর্থ লাগে না। আবার সুপারম্যানও হওয়ার প্রয়োজন নেই। ফুটবলের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলোÑ বিশ্ব জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠই দরিদ্র। অপুষ্টিজনিত কারণে তাদের শারীরিক গড়ন আশানুরূপ না হলেও তাতে কিছু যায় আসে না। দরিদ্র ও অপুষ্ট দেহের জীর্ণ-শীর্ণ মানুষেরা ফুটবল খেলতে পারেন। এ যাবৎ কিংবদন্তী ও বিশ্বসেরা যেসব ফুটবলার উঠে এসেছেন, তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আসলে ফুটবল খেলায় ধনী ও গরিবের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকে না। ফুটবল খেলায় দেখতে পাওয়া যায় সৌন্দর্য, উন্মাদনা, নৈতিকতা ও সামাজিক পরিবর্তন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফুটবল সংস্কৃতিতে খুব বেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ফুটবল খেলা নিয়ে কোথাও উন্মাদনার কমতি নেই। বুয়েন্স এয়ারসের ট্যাক্সি ড্রাইভার, রিও ডি জানেরিও’র পানশালার পরিবেশিকা, লন্ডনের পাতাল ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট কিংবা ঢাকার গার্মেন্ট শ্রমিকÑ সবার কাছে ফুটবল খেলা সমান আকর্ষণীয় ও আদরণীয়। ফুটবলের গন্ধ পেলে নেচে ওঠে সবারই মন-প্রাণ। তবে দেশে দেশে আনন্দ বা উদযাপনের ভঙ্গিমা হয়তো আলাদা। লাতিন আমেরিকায় কিংবা ইউরোপে সামনা-সামনি সম্ভব না হলে দর্শকরা পানশালা কিংবা ক্যাফেতে টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ব্রাজিলের রিও থেকে আমাজন পর্যন্ত পুরো দেশ ফুটবলের মাদকতায় সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো চলকে চলকে ওঠে। ফুটবল উপচে পড়ে সুরে, আতশবাজিতে, পতাকায়, সংবাদপত্রে। নিজের দেশ কিংবা প্রিয় কাব পরাজিত হলে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন ব্রিটিশরা। রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। এই আচরণ কি ফুটবলের, নাকি কেবলই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি? অবশ্য ফুটবলকে একেকজন একেকরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে থাকেন। ব্রাজিলীয় কিংবদন্তী পেলে ফুটবলকে অভিহিত করেছেন ‘দি বিউটিফুল গেম’ হিসেবে। আবার ডাচ কোচ রাইনাস মিসেলস মনে করেন ‘ফুটবল একটি যুদ্ধ’। এ বিতর্কে না গিয়ে বাংলাদেশের দর্শকরা রাত জেগে ঘরোয়া পরিবেশে উপভোগ করেন ফুটবলের উত্তেজনাপূর্ণ নান্দনিক সুষমা।
বিশ্বায়নের খোলা দুয়ার দিয়ে চলছে মুক্ত অর্থনীতি ও মুক্ত বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা। এ থেকে ফুটবলও খুব বেশি দূরে নয়। এক দেশের ফুটবলার খেলছেন আরেক দেশে। ফুটবল মাঠে ঘুচে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক বিভেদ, গড়ে উঠছে ‘বিশ্ব সংস্কৃতি’। কোনো কোনো দেশে ফুটবল খেলার চেয়েও বেশি কিছু। এটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ফুটবল একটি শিল্প। সঙ্গীত, নৃত্য ও ফুটবল ছাড়া ব্রাজিলিয়ানরা ভাবতেই পারেন না। ব্রাজিলীয় ফুটবলের সোনার ছেলে রোনালদিনহোর কথা যে কারো হৃদয়ে মধুর আবেশ ছড়িয়ে দেবে : ‘আমরা তো এমনই, মুখে হাসি নিয়ে জন্মাই। এভাবেই জীবন কাটিয়ে দেই। কারণ দিন শেষে ব্রাজিলিয়ানরা খুব সুখী মানুষ। সবচেয়ে যা ভালোবাসি, তা-ই করি আমরা। আর সেটা হলো ফুটবল খেলা।’ কম-বেশি সব ব্রাজিলিয়ানের মনোভাবটাই এমন। ফুটবল শুধু উৎসবের উপলক্ষ এনে দেয় না, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানলেও ফুটবল নিয়ে যে কারো সঙ্গে কথা বলাটা সমস্যা নয়। ফুটবলের ভাষা একটি। এ ভাষার মর্মার্থ যে কেউ অনায়াসে বুঝে নিতে পারেন। ব্রাজিলের রোনালদিনহো, ক্যামেরুনের স্যামুয়েল ইতো, আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, সুইডেনের হেনরিক লারসেন, পর্তুগালের ডেকো, মেক্সিকোর রাফায়েল মারকুয়েজ, স্পেনের কার্লোস পুয়োল, হল্যান্ডের জিওভানি ফন ব্রোঙ্কহর্স্ট কিংবা ফ্রান্সের লুডোভিক জুলির ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ আলাদা হলেও তারা স্পেনের বার্সেলোনার হয়ে যখন খেলেছেন, তখন তাদের সবকিছু মিলেছে একই মোহনায়। আর এ কারণেই বার্সেলোনা স্প্যানিশ লীগ এবং ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে। খেলার মাঠে বিভিন্ন ফুটবলার ও দেশকে একত্রিত করে ফুটবল।
ফুটবল একটি ধর্মও। আর এই ধর্মের মূল কথা হচ্ছেÑ মিলবে আর মেলাবে। মানুষের মিলনের চেয়ে আর কোনো বড় ধর্ম নেই। সাম্য, মৈত্রী ও মিলনের গান গাওয়ায় ফুটবল হয়ে উঠেছে বিশ্বের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব। আর এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন। ৩২টি দেশ চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও বাছাই পর্বে অংশ নেয় প্রায় প্রতিটি দেশ। বাছাই প্রক্রিয়াটা এক ধরনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের মতো। এটি যখন শুরু হয়, তখন থেকেই তো বিশ্বকাপ ফুটবলের উৎসবে রঙ লাগতে থাকে। চূড়ান্ত পর্বে এটি পূর্ণতা পায়। যে কারণে চূড়ান্ত পর্বে সেরা দলগুলো খেললেও বিশ্বকাপে ফুটবলের বাছাই পর্বে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশেই উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া বিনোদনের চমৎকার একটি মাধ্যম হিসেবে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা। ৯০ মিনিটের এ খেলায় যে কাউকে পৌঁছে দেয় জাদুময় এক জগতে। এমন একটি মোহময় জগতের বাসিন্দা কে না হতে চায়?
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল টেলিভিশনে দেখবেন বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোক। এটা তো একটি স্বপ্নীল ব্যাপার! পৃথিবীর আর কোনো উৎসব কি আছেÑ যেখানে এত এত লোককে একই সঙ্গে উৎসবের আনন্দে ভাসিয়ে দিতে পারে? বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে চন্দ্র-সূর্যের আবর্তনও বোধকরি একাকার হয়ে যাবে! কেননা, পৃথিবীর সকাল-দুপুর-রাতগুলো মিলিত হবে একই বিন্দুতে। একই সময় বিশ্বের তাবৎ ফুটবল অনুরাগী একই সঙ্গে উপভোগ করবেন ফুটবল ফিয়েস্তা। তারা সমভাবে আনন্দিত কিংবা বেদনার্ত হবেন, দোলায়িত হবেন একই সুরে, একই ছন্দে।
দৈনিক আজকের কাগজ, ৭ জুন ২০০৭
ঢাকার ফুটবল অন্ধকারে ঢাকা
একটা সময় রাজধানী ঢাকার পরিচয় ছিল ফুটবলের নগরী হিসেবে। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় এ অঞ্চলের ফুটবল। শুরুটা হয় ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনীকে কেন্দ্র করে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয়দের মাঝে। ফুটবলকে ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন কাব। উপমহাদেশের প্রাচীন কাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকার ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব, ইস্টএন্ড কাব, লক্ষ্মীবাজার কাব, ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান প্রভৃতি। এ কাবগুলো শুধু এ অঞ্চলের ফুটবলকেই বিকশিত করেনি, সেই আমলে কলকাতা ফুটবলের রাজধানী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানও রেখেছে। অনেক খ্যাতিমান ফুটবলার ও সংগঠক গড়ে তোলার সূতিকাগার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় আলাদাভাবে স্থান করে নেয় এ কাবগুলো। তবে ঢাকার ফুটবলকে শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়ে দেয় ১৯৩০ সালে গঠিত ‘ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন’। এ এসোসিয়েশন গঠনের পর ঢাকার ফুটবলে সৃষ্টি হয় প্রাণচাঞ্চল্যের। ১৯৩৭ সালে ঢাকা সফরকারী শক্তিশালী ব্রিটিশ ফুটবল দল ইলিংটন কোরিন্থিয়ান্সকে পাখী সেনের গোলে হারিয়ে মাইলফলক স্থাপন করে ‘ঢাকা একাদশ’।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার ইতিহাসখ্যাত ঢাকা শহর। পশ্চিম পাকিস্তান, সমগ্র পাকিস্তানের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু হলেও ফুটবলটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম আকর্ষণ। এ কারণে দেশভাগের ফলে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেলেও ঢাকায় ফুটবল শুরু হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালেই প্রবর্তন করা হয় ঢাকা ফুটবল লীগ। এ লীগ জনপ্রিয়তা অর্জন করে অত্যন্ত দ্রুত। ভিক্টোরিয়া, ইপি জিমখানা, ওয়ান্ডারার্স, ইপিজি প্রেস, আজাদ স্পোর্টিং, মোহামেডান, ইপিআইডিসির মতো কাবগুলো উন্নতমানের ক্রীড়াশৈলী দিয়ে ফুটবলানুরাগীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। এ কারণে ঢাকা লীগে অংশ নেয়ার জন্য কলকাতা এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও ছুটে আসেন অনেক নামজাদা ফুটবলার। ঢাকার ফুটবলের মায়াবী টানে অনেকের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যায় ঢাকা নগরী। সঙ্গত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে ঢাকা। ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে ঢাকায় আয়োজিত হয় পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জাতীয় ফুটবলের ভেন্যু হিসেবে ঢাকাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ১৯৫৫ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রথম স্বাদ পায় ঢাকা। বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং পাকিস্তানকে নিয়ে আয়োজন করা হয় কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট। তবে ঢাকার ফুটবলে নতুন মাত্রা যোগ করে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল। ১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রতিযোগিতা ঢাকার ফুটবলে এনে দেয় আন্তর্জাতিক ফেবার। ১০০ ভরি ওজনের এই কাপের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দূরÑদূরান্তে। আগা খান গোল্ডকাপে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সেরা দলগুলো ছাড়াও অংশ নেয় ভারত, ইরান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, নেপাল, বার্মা (হালের মিয়ানমার), ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের জাতীয় কিংবা কাব দল। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আরসিডি ফুটবলে অংশ নেয় ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও বঞ্চনা সত্ত্বেও ফুটবল নগরী হয়ে উঠতে ঢাকার সামনে কোনো কিছুই প্রতিকূলতা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এর কারণ ছিল, এ অঞ্চলের মানুষের ফুটবলের প্রতি সহজাত ভালোবাসা এবং দীর্ঘ ফুটবল ঐতিহ্য।
১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের ফুটবলে নামে বাঁধ ভাঙা জোয়ার। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও ফুটবলটা টপ-প্রায়োরিটি লিস্টেই থাকে। স্বাধীন দেশের পথ চলা শুরু হয় আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালোবাসা আর ফুটবল নিয়ে। ১৯৭২ সালেই ঘরোয়া ফুটবলের প্রধান আকর্ষণ ঢাকা ফুটবল লীগের যাত্রা শুরু হয়। এর পাশাপাশি শুরু হয় ‘শের-এ-বাংলা কাপ’ নামে পরিচিত জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা এবং ‘সোহরাওয়ার্দী কাপ’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় যুব ফুটবল প্রতিযোগিতা। পরবর্তীকালে ‘পাইওনিয়ার লীগ’ প্রবর্তন করা হলে ঢাকার অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়ে ফুটবল। বিশেষ করে ঢাকা লীগের দুই প্রধান শক্তি মোহামেডান স্পোর্টিং কাব এবং আবাহনী ক্রীড়াচক্রকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পুরো দেশ। উৎসবের প্রতীক ছিল সাদা-কালো আর হলুদ-আকাশী রঙ। নিত্য-নৈমিত্তিক ভাংচুর এবং কালে-ভদ্রে দু’একটি জীবন ঝরলেও ফুটবলটা কখনো বিতৃষ্ণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। নানা ঝঞ্ঝাট ও দুর্ঘটনা সত্ত্বেও ঢাকার নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিকতার অংশ হয়ে যায় ফুটবল। ফুটবলকে উপলক্ষ করে খোলামকুচির মতো উড়তে থাকে টাকা। সেরা দল গড়ার জন্য অর্থটা কোনো ফ্যাক্টরই ছিল না। মোহামেডান কিংবা আবাহনী কাবের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃত্ত হতে পারাটাই ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। ঢাকা লীগের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির মধুতে আকৃষ্ট হয়ে মৌমাছির মতো দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসতে থাকেন ভিনদেশী ফুটবলাররা। এমনকি এর প্রলোভন এড়াতে পারেননি বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলাররা পর্যন্ত। তখন ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠাটা ছিল অনেক কিশোর ও তরুণের স্বপ্ন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থানটাও ছিল অত্যন্ত মধুর। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ পাওয়াটা ছিল নিয়মিত ব্যাপার। ফলাফলটা আশাব্যঞ্জক না হলেও বাংলাদেশকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ ছিল না। এর পাশাপাশি ‘আগা খান গোল্ডকাপ’ এবং পরবর্তীকালে আগা খান গোল্ডকাপের পরিবর্তে চালু হওয়া ‘প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ’ ঢাকার ফুটবলের খান্দানের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপীয় ধাঁচের অবকাঠামো কিংবা সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও ফুটবল নগরী হওয়ার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ঢাকা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর এ কারণেই ১৯৭৮ সালে ঢাকায় বসে ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল প্রতিযোগিতার কোয়ালিফাইং রাউন্ড। ১৮টি দেশ নিয়ে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতা বোধ করি বাংলাদেশের সেরা ‘ফুটবল ফিয়েস্তা’ হয়ে আছে। উন্নতমানের আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন ছাড়াও ঢাকায় এসেছে সাড়া জাগানো অনেক খ্যাতিমান জাতীয় এবং কাব পর্যায়ের ফুটবল দল। ফুটবল খেলাটা শুধু বিনোদনের উপকরণ হিসেবেই নয়, ঢাকা শহরের একটা পরিচিতির অংশ হয়ে যায়। আর এ পরিচয়ের জন্য ঢাকাবাসীরা ছিলেন গর্বিত ও আনন্দিত।
নব্বই দশকের শুরু থেকে ফুটবলকে নিয়ে ঢাকার এ পরিচয়টা আস্তে-ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। অনিয়মটা একটু একটু করে উঁকি মারতে থাকে তখন থেকেই। সভ্যতা যে কাঁটা মেপে এগিয়ে চলেছেÑ এটা অনুধাবন করা যায় চলমান ঘড়ি এবং ইউরোপীয় ফুটবল লীগের নিয়মিত আয়োজন দেখে। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো সামান্য এদিক-সেদিক হতে পারে; কিন্তু ইউরোপীয় কোনো লীগের এক চুলও হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্য দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ সারা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিলে এবং এর সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় সবকিছুই যখন এলোমেলো হয়ে যায়, তখন অবশ্য সাময়িকভাবে থমকে দাঁড়াতে হয় ইউরোপীয় লীগকে। নতুবা যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে যাক না কেন, ফুটবল লীগ নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠিত হবেই। ১৮৭১ সালে শুরু হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফুটবল প্রতিযোগিতা এফএ চ্যালেঞ্জ কাপ, ১৮৮৮ সালের ইংলিশ ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল লীগ, ১৮৯৮ সালের ইতালীয় সিরি এ লীগ, ১৯০২ সালের জার্মানির বুন্দেশ লীগ, ১৯২৮ সালের স্প্যানিশ লীগ, ১৯৩২ সালের ফ্রেঞ্চ লীগকে বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া থামানো সম্ভব হযনি। অথচ যে ফুটবল লীগটা এই ঢাকা শহরকে আলাদা একটা পরিচয় এনে দিয়েছে, সেই লীগ সময়মত তো দূরে থাকুক, প্রতি বছর আয়োজন করাই সম্ভব হয় না। ১৯৮৭ সালের পর থেকে লীগটা অনিয়মিত হয়ে যায়। একই সঙ্গে ১৯৮৭ সাল থেকে অনেকটা দ্বিবার্ষিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে ‘শের-এ-বাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল’। গত দু’দশকে ২০ বার আয়োজনের কথা থাকলেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ১১ বার। ফুটবলারদের উঠে আসার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত পাইওনিয়ার লীগের ‘জীবন’ থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেলেও ‘সোহ্রাওয়ার্দী কাপ জাতীয় যুব ফুটবল’ অনেকটা বিলীন হতে চলেছে। এমনিভাবে ফুটবলের লালনক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত নিয়মিত আসরগুলোর ‘পঞ্চত্বপ্রাপ্তি’ ঘটছে। সঙ্গত কারণেই স্তিমিত হয়ে পড়েছে ঢাকার ফুটবল।
প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের পর ঢাকায় নিয়মিতভাবে আর কোনো আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং আন্তর্জাতিক মানসম্মত অনেক ফুটবল দল ঢাকায় এলেও ফুটবল তার জৌলুস ও গ্ল্যামার অটুট রাখতে পারেনি। ফুটবল তার প্রাণচাঞ্চল্য ও ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলার অনেক কারণের মধ্যে প্রধান হচ্ছে সাংগঠনিক ব্যর্থতা। নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসায় ফুটবল এখন পরিণত হয়েছে সুুবিধাবাদীদের হাতিয়ারে। মূলত তাদের কারণেই ঢাকার যে ফুটবল ছিল আলোয় ঝলমল, তা এখন অন্ধকারে ঢাকা। তবে এটা তো ঠিক, অন্ধকার কখনো স্থায়ী হয় না। শুধু এ নগর নয়, এদেশের অধিকাংশ মানুষের বুকের মাঝে সযতনে ঘুমিয়ে আছে ফুটবলের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, একদিন তা নিশ্চয়ই জেগে উঠবে। তখন আবার আলোয় আলোয় হেসে উঠবে ঢাকার ফুটবল। আমরা সেদিনের অপেক্ষায়।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭
ছোট আকাশের বড় তারা
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড কিংবা সাঁতারের মতো খেলাগুলোর আকর্ষণ অন্যরকম। মানব সভ্যতা যে এগিয়ে চলেছে, এ দুটি খেলা দেখে তা অনেকাংশে অনুধাবন করা যায়। জলে এবং স্থলে প্রতিনিয়ত সময়কে জয় করার নিরন্তর প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে ১০ সেকেন্ডের নিচে নেমে আসাটা মানব সভ্যতার অন্যতম একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর এই বিস্ময়কর ঘটনার জন্ম দেন ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো সিটি অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিম হাইনস। এরপর তা নিয়মিত একটি বিষয়ে পরিণত করেছেন কার্ল লুইস, লিনফোর্ড ক্রিস্টি, ক্যালভিন স্মিথ, মরিস গ্রিন, জাস্টিন গ্যাটলিনরা। সর্বশেষ জ্যামাইকার আসাফা পাওয়েল যখন ৯ দশমিক ৭৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটার অতিক্রম করেন, তখন মনে হয় অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য মানুষের এই যে ছুটে চলা, তার শেষ কোথায়? কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানটা কোথায়?
অলিম্পিক গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশীপ, বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপ, এমনকি বাড়ির পাশের এশিয়ান গেমসের মতো আসরগুলো আমাদের কাছে হয়ে আছে দূরের আকাশ। এই আকাশের বাসিন্দা অ্যাথলেট রেমন্ড ইউইরি বা কার্ল লুইস কিংবা সাঁতারু মার্ক স্পিটজ বা ম্যাট বিয়ন্তির মতো মহাতারকারা আমাদের কাছে অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে আছেন। অলিম্পিক গেমসে ইউরির ১০ স্বর্ণ; স্পিটজের ৯ স্বর্ণ, ১ রৌপ্য, ১ ব্রোঞ্জ; কার্ল লুইসের ৯ স্বর্ণ, ১ রৌপ্য এবং ম্যাট বিয়ন্তির ৮ স্বর্ণ, ২ রৌপ্য ও ১ ব্রোঞ্জ শাশ্বত এক কীর্তি। বিশ্ব আসরে এমন কীর্তির বিপরীতে বাংলাদেশ নামক দেশটির কোনো অস্তিত্ব নেই। সুরিনাম নামক একটি অজ্ঞাত দেশের অজ্ঞাতকুলশীল সাঁতারু অ্যান্থনি নেস্টি অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণপদক জিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশের কাছে কীর্তির সেই পথ অন্তহীন এক দূরত্ব হয়ে আছে।
আমাদের আকাশটা খুবই ছোট। অথচ আমরাও তো সাফল্যের কীর্তিতে উদ্ভাসিত হতে চাই। এ কারণে আমাদের মতো পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে আমরা আকাশটাকে ছোট করে নিয়েছি। আর সেই আকাশের নাম ‘সাফ গেমস’Ñ হালের ‘এসএ গেমস’। এই আকাশের তারা হয়ে যারা উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন, তারাই আমাদের কাছে বড় তারা হয়ে আছেন। আমাদের মার্ক স্পিটজ হলেন মোশাররফ হোসেন খান। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের অনুজ্জ্বল ক্রীড়া আকাশে ক্রমান্বয়ে দ্যুতি ছড়াতে থাকেন। কলম্বো, কলকাতা, কেরালা, ইসলামাবাদ থেকে স্বর্ণপদক এনে তিনি আঁধার ঘরে বাতি জ্বালান। ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয়ান সাঁতারে তিনি একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পেলে আমরা এশিয়ান গ-িতে প্রবেশের ছাড়পত্র পাই। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সাফ গেমসের আসর বসলে ঢাকা স্টেডিয়ামের ছোট্ট পুলটিতে ৩৩ বছর বয়সে মোশাররফ ঝড় তুললে আমরা গর্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। তিনি পাঁচটি স্বর্ণ ও দুটি রৌপ্যপদক জিতলে সত্যি সত্যিই আমরা তার মাঝে খুঁজে পেয়েছিলাম একজন মার্ক স্পিটজকে।
কার্ল লুইসের মতো দারিদ্র্যের কঠিন সংগ্রামে জর্জরিত ছিলেন শাহ আলম। মেহেরপুরের কৃষক পরিবারের ছেলে শাহ আলম সেই ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত গতিতে ছুটতে পারতেন। কিন্তু নিজেকে মেলে ধরার কোনো প্লাটফরম তার ছিল না। এমন এক প্রতিকূল অবস্থায় সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দিয়ে তিনি বড় একটি ক্ষেত্র পেয়ে যান। তার মধ্যে অ্যাথলেট হওয়ার যে প্রতিভা ও মেধা সুপ্ত অবস্থায় ছিল, তা বিকশিত হতে একদমই সময় নেয়নি। অ্যাথলেট ক্যারিয়ারের শুরুতে জাতীয় পর্যায়ে ২০০ মিটার ¯িপ্রন্টেই তিনি সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমসে ৪ী১০০ মিটার রিলেতে সাইদুর রহমান ডন, আফতাব মোল্লা ও মুজিবুর রহমান মল্লিকের সাথে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদকটি পান। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে তার কোনো সাফল্যই ছিল না। অথচ ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসে সবার ধারণাকে তিনি পাল্টে দেন। তবে তার মধ্যে সাফল্যের একটা ক্ষুধা দেখতে পেয়েছিলাম। কি এক কাজে সাফ গেমস শুরুর বেশ কিছুদিন আগে এরশাদ আর্মি স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি পুরো স্টেডিয়াম নিস্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই। এর মধ্যে একা একাই অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন শাহ আলম। সেদিন তিনি সাফল্যের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তার মুখের মৃদু হাসিতে সেই আশাবাদ ঝলমল করছিল। সাফ গেমস শুরু হলে সেই আর্মি স্টেডিয়ামেই দ্রুততম মানব হয়ে সবাইকে চমকে দেয়ার পর মনে হয়েছিল, শাহ আলম নিশ্চয়ই অবাক হননি। তিনি যে সাফল্য পাবেন, এমন দৃঢ় প্রত্যয় তার আগেই ছিল। সেবার ৪ী১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ জয়ের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ব্যাটনটাও তার হাতে ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার শত কোটি মানুষের দ্রুততম মানব হওয়াটা অবশ্যই গৌরবের। দেশের মাটিতে এমন কৃতিত্বে শাহ আলমের নিশ্চয়ই মন ভরেনি। সম্ভবত ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে তিনি অংশ নেন একটা অতৃপ্তি নিয়ে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে সেদিন দুরন্ত হরিণের মতো ছুটেছিলেন শাহ আলম। ১০ দশমিক ৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েন। উপর্যুপরি দুটি সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হয়ে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান শাহ আলম। অল্পের জন্য তার অন্যতম ফেভারিট ২০০ মিটার ¯িপ্রন্টের স্বর্ণটা জিততে পারেননি। ২০০ মিটারের পাশাপাশি ৪ী১০০ মিটার রিলে দৌড়ে রৌপ্য পদক জয় করেন। আমাদের হয়তো কার্ল লুইস নেই, আমরা একজন শাহ আলমকে পেয়েছিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু ম্যাট বিয়ন্ডি টানা তিনটি অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলেন। আমাদের কাছে অলিম্পিক হিসেবে খ্যাত সাফ গেমসে এমন কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন বুক সাঁতারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মোখলেসুর রহমান। সাঁতারের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জের কাশীপুরের ছেলে মোখলেস সহজাত প্রতিভা নিয়ে উঠে এসেছিলেন। ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ব্রোঞ্জ পদক জিতে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে হাত মক্শো করেন। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সাফ গেমসে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজবে কিনা এবং জাতীয় পতাকা উড়বে কিনাÑ তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। এমন অবস্থায় দেশের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করেন মোখলেসুর রহমান। তিনি ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ১ মিনিট ১০.০৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন সাফ রেকর্ড গড়েন। এটি ছিল বাংলাদেশের একমাত্র স্বর্ণপদক। ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোয় ১০০ মিটার বুক সাঁতারে ফেভারিট হলেও তিনি রৌপ্য পদক পান। কিন্তু ২০০ মিটার বুক সাঁতারে নতুন রেকর্ডসহ স্বর্ণ জিতে তা পুষিয়ে দেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সাফ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণ জিতে টানা তিনটি গেমসে স্বর্ণ জয়ের বিরল গৌরব অর্জন করেন। অনেকগুলো স্বর্ণ জিততে না পারলেও টানা তিনটি গেমসে স্বর্ণ জিতে মোখলেসুর রহমান হয়ে আছেন আমাদের ম্যাট বিয়ন্ডি।
১৯৯৩ ঢাকা গেমসের আগে বিমল চন্দ্র তরফদার একদমই পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে তার খেলাধুলায় ভীষণ ঝোঁক ছিল। এ কারণে তাকে বাড়ির পাশের বিকেএসপিতে ভর্তি করে দেয়া হয়। তবে চীন, ফিলিপাইন ঘুরে এলেও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তার কোনো সাফল্য ছিল না। দেশসেরা ¯িপ্রন্টার গোলাম আম্বিয়ার মাসল পুলের কারণে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়লে দেশের অ্যাথলেটিক্স অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সাফ গেমসের প্রথম তিন দিন বাংলাদেশের ঘরে স্বর্ণপদক নেই। এমন এক মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আবির্ভূত হন ১৯ বছরের বিমল চন্দ্র তরফদার। আগের গেমসের দ্রুততম মানব শ্রীলঙ্কার দিশানায়েকেকে টপকে তিনি দ্রুততম মানব হন। শুরুতে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও ঝড়ের গতিতে ছুটে ১০.৬১ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। বিমল এখনো বাংলাদেশের দ্রুততম মানব হয়ে আছেন। এরপর আর বাংলাদেশ দ্রুততম মানব পায়নি ।
ইতোমধ্যে সাফ গেমস, এসএ গেমস হলেও বাংলাদেশের আকাশটা আরো বেশি ছোট হয়ে গেছে। মোশাররফ হোসেন খান, শাহ আলম, মোখলেসুর রহমান ও বিমল চন্দ্র তরফদাররা যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, সেটাই এখন অবিনস্বর হয়ে আছে। আকাশটাও যেমন ছোট হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে ছোট হয়েছে তারকার বহরও।
মোশাররফ হোসেন খান ঢাকা স্টেডিয়ামের যে সুইমিংপুলে রেকর্ড গড়েছিলেন, সেই সুইমিংপুলটাকে এখন আর কেউ চেনেন না। শাহ আলম যে আর্মি স্টেডিয়ামে প্রথমবার দ্রুততম মানব হন, সেই স্টেডিয়ামের রমরমাটা এখন নেই। মোখলেসুর রহমান মিরপুরের যে সুইমিংপুলে সাফ গেমসে স্বর্ণ জয়ের হ্যাটট্রিক করেন, সেই পুলটি এখন অনুজ্জ্বল। বিমল চন্দ্র তরফদার মিরপুরে যে অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামে দ্রুততম মানব হন, স্টেডিয়ামের সেই ট্র্যাক হারিয়ে অ্যাথলেটিক্স হয়ে পড়েছে ঠিকানাবিহীন। সাফল্যের ধারক সেই স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুল অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ার পাশাপাশি দেশে সুবিধা করতে না পেরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ছোট আকাশের আমাদের বড় তারকা মোশাররফ হোসেন খান, মোখলেসুর রহমান ও বিমল চন্দ্র তরফদার। আর ১৯৯০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর শিকার হয়েছেন অ্যাথলেট শাহ আলম। একই সঙ্গে অকালমৃত্যু ঘটছে দেশের অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার অঙ্গনেও। এই অকালমৃত্যু কি আমাদের বিধিলিপি?
দৈনিক যায়যায়দিন, ১৪ আগস্ট ২০০৬
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন