এক সময়ের দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ মোহামেডানের কামরু/ দুলাল মাহমুদ
এখন তার বয়স ৭৬। যদিও এ বয়সে অধিকাংশ ব্যক্তিই অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েন। বয়সের ভারে হয়ে যান ন্যুব্জ। কিন্তু তিনি এখনো সচল, সজীব। বয়সের কাছে তিনি হার মানেননি। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন জীবনকে। চারপাশের রঙ-রূপ-রস ধরা দেয় তার প্রবীণ চোখে। জীবনকে নিয়ে তার অনেক প্রত্যাশা। যদিও তার দেহে ছাপ ফেলেছে সময়ের বলিরেখা। বিরল হয়ে যাওয়া শুভ্র কেশরাজি,
যত্ম করে ছাঁট দেয়া চাপদাড়ি দেখে অনুধাবন করার উপায় নেই যে, এক সময় তিনি ছিলেন ফুটবল মাঠের রীতিমত ত্রাস। সন্ত্রস্ত করে রাখতেন মাঠ ও পরিপার্শ্ব। রাফ অ্যান্ড টাফ ফুটবলারের প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি। তাকে সামনে দেখলে কেঁপে উঠতো প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের বুক। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী। তাকে ফাঁকি দিয়ে বল নিয়ে যাওয়া বিনা পাসপোর্র্টে সীমান্ত অতিক্রম করার মতই ছিল দুরূহ। ফিজিক্যাল ফিটনেস ছিল তার প্রধান সম্পদ। ছিলেন সুঠাম, সুদেহী ও সবল। পরিশ্রমী ছিলেন। আর ছিল অসম্ভব জেদ ও সাহস। যে কাউকে যে কোনো অবস্থায় চ্যালেঞ্জ জানাতে একটুও দ্বিধা করতেন না। সবচেয়ে বড় কথা, কাউকে প্রতিপক্ষই মনে করতেন না তিনি। মনোভাবটা ছিল এমন- রাজত্ব আমার, আমি আবার কাকে পরোয়া করতে যাব। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি ফিগার নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন অটল পাহাড়ের মতো। অবশ্য পাহাড় তো নিশ্চল হয়ে থাকে। তিনি পাহাড়ের মতো দুর্ভেদ্য তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে ছিলেন বাঘের মতো ক্ষিপ্র ও দুরন্ত। নিজের পজিশন থেকে সহজে নড়তেন না। তবে দল কর্নার পেলে সেক্ষেত্রে ছুটে যেতেন এবং কখনো-সখনো গোল করতেন হেডের সাহায্যে। ফুটবল মাঠের একসময়ের দুর্ধর্র্ষ সেই সেন্টার হাফ হলেন কামরুজ্জামান। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি কামরু নামে পরিচিত।
পঞ্চাশ ও ষাট দশকে অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন কামরুজ্জামান। ১৯৩২ সালের ১ মার্চ তার জন্ম সিলেটে। খেলাধুলায় পারিবারিক ঐতিহ্য তাকে খুব শৈশবেই ধাবিত করে ফুটবল মাঠে। সেই ব্রিটিশ আমলে তার দাদা ও পিতার উদ্যোগে সিলেটের মাহমুদাবাদ আখালিয়া অঞ্চলে প্রতি বছর আয়োজিত হতো হাজী ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল শীল্ড ফুটবল প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিত আশপাশ এলাকার অনেক নামী-দামী দল। তবে দেশ ভাগের আগে এ প্রতিযোগিতা জমজমাট ছিল বেশি। ১৯৪৬ সালে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় কলকাতা মোহনবাগান। সে দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার রাখাল মজুমদার। বাড়ির পাশে আয়োজিত হাজী ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল শীল্ড ফুটবল প্রতিযোগিতা ছাড়াও তাকে ফুটবলের প্রতি সম্মোহিত করে স্বর্ণযুগে কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিস্ময়কর সাফল্য। কলকাতা মোহামেডানের জয় কিংবা পরাজয় উদ্বেলিত করতো তাদের। ছুঁয়ে যেত হর্ষ কিংবা বিষাদে। কলকাতা মোহামেডানের কোনো কোনো খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা তখন বসবাস করতেন তাদের বাড়ির কাছে। তারা ছিলেন তার কাছে স্বপ্নের রাজকুমার। কলকাতা মোহামেডানের সাফল্য তার ছোট্ট বুকে এঁকে দেয় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। জীবনের এই লক্ষ্য পূরণে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ পেয়ে সময় লাগেনি ফুটবলে দীক্ষা পেতে। বাড়ির পাশের মাঠে যখন-তখন ছুটতেন দুরন্ত গতিতে। এরপর রাজা ডিসি হাইস্কুল ও সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফুটবল হয়ে ওঠে সার্বক্ষণিক ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা।
স্কুলে থাকতেই ছড়িয়ে পড়ে কামরুজ্জামানের ফুটবল ক্যারিশমা। ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকে সিলেট ফুটবল লীগে তার অভিষেক হয় এ কে ইউনাইটেড ক্লাবের হয়ে। অবশ্য এই ক্লাবের হয়ে প্রথমে তার হাতেখড়ি হয় ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল শীল্ডে। প্রথমদিকে খেলতেন গোলরক্ষক পজিশনে। এরপর পজিশন পরিবর্তন করে চলে আসেন রক্ষণভাগে। পর্যায়ক্রমে সিলেট লীগে খেলেন স্পোর্টিং ইউনিয়ন ও সিলেট টাউন ক্লাবে। তিনি স্পোর্টিং ইউনিয়নের অধিনায়কেরও দায়িত্ব পালন করেন। টাউন ক্লাবে কেটেছে তার বেশিরভাগ সময়। টাউন ক্লাবের ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন পোটো সোম, রাখাল ভট্টাচার্য প্রমুখ। এঁরা পরবর্তীকালে কলকাতা লীগে খেলে প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। দেশ বিভাগের আগে তিনি চা-বাগানের বিদেশী শ্বেতাঙ্গ ফুটবল দলের বিপক্ষে খেলে সুখ্যাতি পান। শ্বেতাঙ্গরা তার খেলা দেখে বিমল আনন্দ পেতেন। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে খেলার সময় তাকেও সবাই শ্বেতাঙ্গ বলে ভুল করতেন। তার ফর্সা গায়ের রঙ, খাড়া নাক ও সুদর্শন চেহারার কারণে বিভ্রম সৃষ্টি হতো। অবশ্য তার মিশকালো চুল চিনিয়ে দিত তার জাত। দেশ ভাগের পরও তিনি করিমগঞ্জ জেলা একাদশের অধিনায়ক হিসেবে আসামের গৌহাটি বরদুলই ট্রফি, স্বাধীনতা দিবস টুর্নামেন্টে বেশ কয়েকবার অংশ নেন। দেশ বিভাগের পর কয়েক বছর সীমান্ত এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে তেমন বাধ্যবাধকতা ছিল না। যে কারণে সে সময় ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলাররা একে অপরের দেশে খুব সহজেই খেলতে পারতেন।
১৯৪৯ সালে কামরুজ্জামান ভর্তি হন সিলেটের বিখ্যাত মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজে। কলেজের হয়ে খেলার সময় তার কদর আরো বেড়ে যায়। ক্ষ্যাপ খেলার জন্য তাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত। হায়ারে বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যেতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি বলেন, ‘১৯৫০-৫১ সালে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খেলতে যাই। প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইলেভেন। এ দলের অধিনায়ক ছিলেন মহারাজ। সে খেলাটি স্মরণীয় হয়ে থাকার অন্যতম কারণ- সেবারই প্রথম বুট পরে খেলার অভিজ্ঞতা হয়।’ তিনি জানান, ১৯৫০ সালে সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার মাঠে এমসি কলেজের হয়ে পুলিশের বিপক্ষে খেলার সময় গন্ডগোল হয়। সেই গন্ডগোলকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ায় শহরে কারফিউ জারি করতে হয়। দেশ ভাগের পর ফুটবল মাঠে গন্ডগোলকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেই প্রথমবারের মতো কারফিউ জারি করতে হয়। কলেজ দলের পাশাপাশি তিনি সিলেট জেলার হয়েও খেলা শুরু করেন। জেলা দলে খেলতেন তার এক বছরের জুনিয়র গোলরক্ষক রণজিত দাস, হেলালউদ্দিন চৌধুরী, এন এইচ খান, মোস্তফাউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। তিনি সিলেট জেলা দলের অধিনায়কও ছিলেন। এরপর খেলেছেন বিভাগীয় দলের হয়ে। তিনি কুমিল্লার পাক ইউনাইটেডের হয়েও প্রায়শই লীগ খেলতেন।
ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে কামরুজ্জামান বলেন, ‘সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে খেলার সময় কলকাতা মোহামেডানে খেলতেন (তার নামটা মনে করতে পারছি না)- এমন একজন ফুটবলারের চোখে পড়ে যাই আমি। তিনি থাকতেন দরগা মহল্লায়। তিনি আমাকে কলকাতা মোহামেডানের গোলকিপার তসলিমের কাছে একটি চিরকুট লিখে পাঠান। তসলিম ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমি তসলিমের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে ফায়ার সার্ভিসে খেলতে বলেন। ফায়ার সার্ভিস দল পছন্দ না হওয়ায় আমি যোগ দেই পিডব্লিউডিতে। সেটা ১৯৫২ সালের কথা। আসলে আমি ঢাকায় বিভিন্ন সময় আসতাম। তখন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে সুবাদে যোগ দেই পিডব্লিউডিতে। সে সময় এ দলে খেলতেন খুব সম্ভবত নবী চৌধুরী, রেমন্ড হালদার, গজনবীর ভাই মঞ্জু প্রমুখ।’ তিন বছর পিডব্লিউডিতে খেলার পর ১৯৫৫ সালে যোগ দেন ইস্টএন্ড ক্লাবে। ইস্টএন্ডে খেলতেন আবদুল হামিদ (পরবর্তীকালে ক্রীড়া সাংবাদিক ও ধারাভাষ্যকর), নূর হোসেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ছোটবেলা থেকেই মোহামেডানে খেলার স্বপ্ন দেখতেন। সেটা অবশ্য ছিল কলকাতা মোহামেডান। দেশ ভাগের কারণে সে দলে খেলা আর সম্ভব হয়নি। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান ঢাকা মোহামেডানে যোগ দিয়ে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কলকাতা মোহামেডানের দিকপাল ফুটবলার মোঃ শাহজাহান ঢাকা মোহামেডান পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন। তিনিও ক্লাব পরিচালনার পাশাপাশি প্রয়োজনে মাঝে-মধ্যে খেলতেন। মোহামেডানের অবস্থা তখন মোটেও ভালো না। ক্লাব টেন্ট নেই। আর্থিক অবস্থাও তথৈবচ। শাহজাহান ভাই বললেন, কাউকে কিছু দিতে পারবো না। কলকাতা থেকে আমি ম্যাসেজম্যান পালোয়ানকে নিয়ে এসেছি। এর ম্যাসেজ পেলে তোমরা একদম চাঙ্গা হয়ে যাবা। তবে তার জন্য সোনায় সোহাগা হয়ে যায় লীগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের দুর্দান্ত সাত ফুটবলার আশরাফ, কবীর, মারী, গজনবী, বাহরাম, আরজু, সখী সামাদ রাগারাগি করে যোগ দেন মোহামেডানে। সামাদ ছিলেন নারায়ণগঞ্জের। রাইট হাফে খেলতেন। একটু সৌখিন প্রকৃতির ছিলেন। সব সময় ধোপদুরস্ত পোশাক পরতেন। ফিটফাট থাকতে ভালোবাসতেন। এজন্য তাকে বলা হতো সখী সামাদ। সেবার অপ্রত্যাশিতভাবে শক্তিশালী দলে পরিণত হয় মোহামেডান। আউটার স্টেডিয়ামে ক্লাবের নতুন ক্লাব ঘর উদ্বোধন করেন তদানীন্তন প্রাদেশিক গভর্নর শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক। সে বছর মোহামেডান লীগে রানার্সআপ হয়ে প্রথম সাফল্য পায়। ১৯৫৭ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে মোহামেডান ওড়ায় বিজয়ের নতুন পতাকা।’ কামরুজ্জামান হয়ে ওঠেন মোহামেডানের সাফল্যের সারথী। তাকে টলিয়ে অন্য কারো পক্ষে তার অবস্থান নেয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি মোহামেডানে খেলেন। এ সময় মোহামেডান ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৯ সাল মোহামেডানের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। সে বছর মোহামেডান লীগ শিরোপা ছাড়াও প্রথমবারের মতো আগা খান গোল্ডকাপ এবং স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘ট্রিপল ক্রাউন’ অর্জন করে। সেবার আগাখান গোল্ড কাপে মোহামেডানের খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- আশরাফ, গজনবী, রণজিত দাস, শাহ আলম, কামরুজ্জামান, বশির আহমদ, আমান, মদন, হাবিব, আবিদ, ইমাম বক্স প্রমুখ। তিনি মোহামেডানে থাকাবস্থায় মোহামেডান ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়। মোহামেডানের এই স্বর্ণযুগে তিনি ১৯৫৮ সালে কলকাতার আইএফএ শীল্ড, পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, চন্দননগরে খেলেন প্রদর্শনী ম্যাচ। একই বছর সফরকারী কলকাতা মোহামেডানের হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেন। ১৯৫৮ সালেই তিনি করাচী কেমারি মোহামেডানের হয়ে ভারতের বোম্বেতে রোভার্স কাপ টুর্নামেন্টে খেলেন। সে দলে তিনি ছাড়াও ছিলেন সাদেক ও দেবীনাশ।
মোহামেডান ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬১ সালে আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবলে পশ্চিম পাকিস্তানে ৫০২ ওয়ার্কশপ দলের সঙ্গে ঢাকা মোহামেডানের খেলা হয়। ওয়ার্কশপ দলের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় আমাদের দলের সম্ভবত কবীর, আশরাফ, গজনবী, আমিসহ পাঁচজনকে সাসপেন্ড করা হয়। গজনবী ও আমাকে সাসপেন্ড করা হয় দু’বছরের জন্য। এর ফলে আমার খেলোয়াড়ী জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ সময় আমার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের তৎকালীন একজন সংগঠক। তিনি ছিলেন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মকর্তা। তার প্রচেষ্টায় আমি সাসপেনশন মওকুফের জন্য আবেদন করলে তা প্রত্যাহার করা হয়। সেই কৃতজ্ঞতায় ১৯৬২ সালে আমি খেলি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে।’ আজাদে সে সময় খেলতেন মুক্তা, আবুল, জলিল আনসারী, গাউস, এজাজ রসুল, ভানু, কাশেম, রণজিত দাস, বাটু, ধনু, নিশিত, মোস্তফা কামাল, লিও, মোর্শেদ, অমল, মোজাম্মেল, নূরুন্নবী, সামাদ প্রমুখ। কামরুজ্জামান সর্বশেষ ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে খেলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। ১৯৬৩ সালে ওয়ান্ডারার্স আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবলে রানার্সআপ হয়। সে দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন হাকিম, গফুর বালুচ, মাসুদ, ইব্রাহীম, সিকান্দার, হানিফ, কামরুজ্জামান, সরসিনা, আজিজ, মহসীন প্রমুখ।
কামরুজ্জামান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী, হায়দরাবাদ, রহিম ইয়ারখান, লাহোর, মুলতান, গুজরানেওয়ালায় খেলেছেন। পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলতে না পারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নবী চৌধুরী ও আমি খেলতাম একই পজিশনে। নবী চৌধুরীর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি ছিলেন অসাধারণ ফুটবলার। তার মতো ফুটবলারের সচরাচর দেখা মেলে না। তার সময়ে না খেললে আমি হয়তো পাকিস্তান দলে খেলতে পারতাম।’
নিজের স্মরণীয় ম্যাচ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বছরটা ঠিক মনে নেই। সে বছর লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। লীগের শেষ ম্যাচ তেজগাঁও ফ্রেন্ডসের সঙ্গে। খেলার সময় আমাদের গোলরক্ষক ভাওয়ালের হাত ভেঙে যায়। আমার যেহেতু গোলরক্ষক হিসেবে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল, এ কারণে আমাকে তার জায়গায় খেলতে হয়। সে খেলায় এক গোলে হেরে গেলে মোহামেডানের অপরাজিত থাকার গৌরব নস্যাৎ হয়ে যায়। তবে আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ১৯৫৯ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচটি। ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল করাচি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (কেএমসি) দল। সে দলের খেলোয়াড় ছিলেন- গোলাম হোসেন, আল্লা বক্স, গফুর, ইয়ার মোহাম্মদ, সালেহ, গোলাম, রসুল বক্স, হারুন, আব্বাস, আবদুল্লাহ ও ইউসুফের মতো দুর্দান্ত ফুটবলাররা। খেলার রেফারি ছিলেন মাসুদুর রহমান। কেএমসি দলের সঙ্গে আমাদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। তাদের ফরোয়ার্ডদের একটির পর একটি আক্রমণ আমরা নস্যাৎ করে দিয়েছিলাম। আমরা সম্ভবত মদন ও আশরাফের গোলে তাদের হারিয়েছিলাম। এ ম্যাচে আমার সম্পর্কে ১৯৫৯ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় লেখা হয়, But the most remarkable thing in the Mohammedan’s defence was the coolness of Qamru. Though he was often fouled by the KMC players he never lost control on himself.
আরেকটি খেলার কথা মনে পড়ছে, পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনালে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান দল। আমাদের গোলরক্ষক ছিলেন রণজিত দাস। তিনি ছিলেন একটু ছোটখাট গড়নের। তার এই খামতিটুকু কাজে লাগিয়ে ফাইনালে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড আচমকা গোল করে জয় ছিনিয়ে নেয়। তাছাড়া ১৯৬০-৬১ সালে চট্টগ্রাম ডিভিশনের খেলায় আমার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা ৩-০ গোলে হারিয়ে দেয় চট্টগ্রাম বিভাগকে। চট্টগ্রামে বিভাগে খেলতেন আইজাক ম্যাকওয়া, মারির মতো দুর্ধর্ষ ফুটবলাররা।’
নিজের খেলা প্রসঙ্গে কামরুজ্জামান বলেন, ‘মাঠের মধ্যে আমি ছিলাম আক্রমণাত্মক ফুটবলার। হেভি মাঠে আমি ছিলাম অত্যন্ত অ্যাফেকটিভ। মাকরানি ফুটবলাররা আমাকে যমের মতো ভয় পেতো। আমার ফিজিক ভালো হওয়ার কারণ- আমার ছিল আর্মি ট্রেনিং। তাছাড়া আমি খুব নিয়ম মেনে চলতাম। আর একটা বিষয় হলো, মফস্বলের ডাকাবুকো ছেলে ছিলাম আমি। এলাকার ছেলেদের সমর্থন নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত ছিলাম। সব সময় নেতৃত্ব দেয়ার প্রবণতা ছিল। এ কারণে আমার ভয়-ডর একটু কম ছিল। তবে খেলা শেষে ঘরে ফিরে আসতাম। নিয়ম-নীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিলাম।’ প্রতিপক্ষ হিসেবে কোন খেলোয়াড়কে সমীহ করতেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাকরানি ফুটবলার ইউসুফ সিনিয়র, নেওয়াজ, আজাদের মুক্তা কখনো-সখনো আমাকে টপকে যেতেন। তবে আমার খেলা ভালো লাগতো শার্প শুটার আশরাফ, কবীর, মারী এবং পরবর্তীকালের সালাউদ্দিন, নান্নু ও মুন্নার খেলা।’
সে সময়কার খেলার ধরন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন টু ব্যাক সিস্টেমে খেলতাম। পরে খেলার ধরন-ধারণ পাল্টে যায়। রক্ষণভাগও সুদৃঢ় করা হয়। ব্যক্তিগত স্কিলের পরিবর্তে দলগত সমঝোতার মাধ্যমে খেলা হয়ে থাকে।’
কামরুজ্জামান ১৯৫১-৫২ সালে রুরাল ডেভলপমেন্টের চাকরিতে যোগ দেন। এই চাকরিতে যোগ দেয়ায় ঢাকায় পিডব্লিউডিতে খেলার ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা ছিল। ১৯৫৪ সালে তিনি যোগ দেন কলকাতার ওষুধ কোম্পানি এলবার্ট ডেভিডে। এই কোম্পানি ঢাকা অফিস লীগে খেলার জন্য একটি ফুটবল দল গঠন করলে তিনি খেলার পাশাপাশি দল গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা নেন। এ দলটি অফিস লীগে ১৯৬০ সালে তার অধিনায়কত্বে চ্যাম্পিয়ন হয়। এ দলের হয়ে খেলেন মুসা, দীপু প্রমুখ।
১৯৫৮ সালে ঢাকায় শুরু হয় ইস্ট পাকিস্তান সফটবল লীগ। সেই লীগে তিনি খেলতেন আমেরিকান এইড দলের হয়ে। ১৯৬১-৬২ সালে তাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়। এ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে দু’জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। বাকিরা বিদেশী। খেলা ছেড়ে দেয়ার পর দীর্ঘদিন তিনি ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বিসিআইসির বিভিন্ন প্রকল্পে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯১ সালে উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্পোরেশনের চাকরি থেকে অবসর নেন। তবে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় চিত্তবিনোদন সমিতির পুষ্প প্রদর্শনী ও বাগান প্রতিযোগিতার কমিটির সদস্য, ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক ও ১৯৭৭-৭৮ সালে কোষাধ্যক্ষ এবং ১৯৯৫-৯৭ সালে সোনালী অতীত ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন। স্ত্রী অধ্যাপিকা নার্গিস আখতার বানু লাকসামস্থ নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দু’কন্যার জনক। ছোট ভাই মমতাজ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলতেন পুলিশের হয়ে।
কিছুদিন আগেও তিনি ফুটবলের আকর্ষণে ছুটে আসতেন খেলার মাঠে। এখন আর তার মাঠে যাওয়া হয় না। তবে ফুটবল আছে তার হৃদয়ের গভীরে। একটু কান পাতলে শোনা যায় তার স্পন্দন।
জীবনের এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে কামরুজ্জামানের বুকের মধ্যে খেলা করে অনেক স্মৃতি। কোনোটা মধুর, কোনোটা বেদনার। দল ও সমর্থকদের জন্য খেলার মাঠে নিজেকে উজাড় করে দিতে তিনি একটুও কার্পণ্য করেননি। প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের গোল করার স্বপ্ন ভেঙে দেয়াটাই ছিল তার স্বপ্ন। এজন্য খেলার মাঠে কতরকম ঘটনাই ঘটেছে। তবে মধুর স্মৃতিগুলোই তাকে বার বার আনমনা করে তোলে। কতজনের সঙ্গে খেলেছেন, কতজনের সঙ্গে মিশেছেন। তাদের অনেকেই আজ হারিয়ে গেছেন। সেই মুখগুলো যখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, তখন জোনাকির মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার দু’চোখ। মুছে যাওয়া দিনগুলো তাকে যেন পিছু ডাকতে থাকে। স্মৃতিরা তখন ছবি আঁকে বেদনার রঙে রঙে। #
১৬-২-২০০৮
যত্ম করে ছাঁট দেয়া চাপদাড়ি দেখে অনুধাবন করার উপায় নেই যে, এক সময় তিনি ছিলেন ফুটবল মাঠের রীতিমত ত্রাস। সন্ত্রস্ত করে রাখতেন মাঠ ও পরিপার্শ্ব। রাফ অ্যান্ড টাফ ফুটবলারের প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি। তাকে সামনে দেখলে কেঁপে উঠতো প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের বুক। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী। তাকে ফাঁকি দিয়ে বল নিয়ে যাওয়া বিনা পাসপোর্র্টে সীমান্ত অতিক্রম করার মতই ছিল দুরূহ। ফিজিক্যাল ফিটনেস ছিল তার প্রধান সম্পদ। ছিলেন সুঠাম, সুদেহী ও সবল। পরিশ্রমী ছিলেন। আর ছিল অসম্ভব জেদ ও সাহস। যে কাউকে যে কোনো অবস্থায় চ্যালেঞ্জ জানাতে একটুও দ্বিধা করতেন না। সবচেয়ে বড় কথা, কাউকে প্রতিপক্ষই মনে করতেন না তিনি। মনোভাবটা ছিল এমন- রাজত্ব আমার, আমি আবার কাকে পরোয়া করতে যাব। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি ফিগার নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন অটল পাহাড়ের মতো। অবশ্য পাহাড় তো নিশ্চল হয়ে থাকে। তিনি পাহাড়ের মতো দুর্ভেদ্য তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে ছিলেন বাঘের মতো ক্ষিপ্র ও দুরন্ত। নিজের পজিশন থেকে সহজে নড়তেন না। তবে দল কর্নার পেলে সেক্ষেত্রে ছুটে যেতেন এবং কখনো-সখনো গোল করতেন হেডের সাহায্যে। ফুটবল মাঠের একসময়ের দুর্ধর্র্ষ সেই সেন্টার হাফ হলেন কামরুজ্জামান। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি কামরু নামে পরিচিত।
পঞ্চাশ ও ষাট দশকে অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন কামরুজ্জামান। ১৯৩২ সালের ১ মার্চ তার জন্ম সিলেটে। খেলাধুলায় পারিবারিক ঐতিহ্য তাকে খুব শৈশবেই ধাবিত করে ফুটবল মাঠে। সেই ব্রিটিশ আমলে তার দাদা ও পিতার উদ্যোগে সিলেটের মাহমুদাবাদ আখালিয়া অঞ্চলে প্রতি বছর আয়োজিত হতো হাজী ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল শীল্ড ফুটবল প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিত আশপাশ এলাকার অনেক নামী-দামী দল। তবে দেশ ভাগের আগে এ প্রতিযোগিতা জমজমাট ছিল বেশি। ১৯৪৬ সালে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় কলকাতা মোহনবাগান। সে দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার রাখাল মজুমদার। বাড়ির পাশে আয়োজিত হাজী ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল শীল্ড ফুটবল প্রতিযোগিতা ছাড়াও তাকে ফুটবলের প্রতি সম্মোহিত করে স্বর্ণযুগে কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিস্ময়কর সাফল্য। কলকাতা মোহামেডানের জয় কিংবা পরাজয় উদ্বেলিত করতো তাদের। ছুঁয়ে যেত হর্ষ কিংবা বিষাদে। কলকাতা মোহামেডানের কোনো কোনো খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা তখন বসবাস করতেন তাদের বাড়ির কাছে। তারা ছিলেন তার কাছে স্বপ্নের রাজকুমার। কলকাতা মোহামেডানের সাফল্য তার ছোট্ট বুকে এঁকে দেয় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। জীবনের এই লক্ষ্য পূরণে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ পেয়ে সময় লাগেনি ফুটবলে দীক্ষা পেতে। বাড়ির পাশের মাঠে যখন-তখন ছুটতেন দুরন্ত গতিতে। এরপর রাজা ডিসি হাইস্কুল ও সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফুটবল হয়ে ওঠে সার্বক্ষণিক ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা।
স্কুলে থাকতেই ছড়িয়ে পড়ে কামরুজ্জামানের ফুটবল ক্যারিশমা। ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকে সিলেট ফুটবল লীগে তার অভিষেক হয় এ কে ইউনাইটেড ক্লাবের হয়ে। অবশ্য এই ক্লাবের হয়ে প্রথমে তার হাতেখড়ি হয় ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল শীল্ডে। প্রথমদিকে খেলতেন গোলরক্ষক পজিশনে। এরপর পজিশন পরিবর্তন করে চলে আসেন রক্ষণভাগে। পর্যায়ক্রমে সিলেট লীগে খেলেন স্পোর্টিং ইউনিয়ন ও সিলেট টাউন ক্লাবে। তিনি স্পোর্টিং ইউনিয়নের অধিনায়কেরও দায়িত্ব পালন করেন। টাউন ক্লাবে কেটেছে তার বেশিরভাগ সময়। টাউন ক্লাবের ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন পোটো সোম, রাখাল ভট্টাচার্য প্রমুখ। এঁরা পরবর্তীকালে কলকাতা লীগে খেলে প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। দেশ বিভাগের আগে তিনি চা-বাগানের বিদেশী শ্বেতাঙ্গ ফুটবল দলের বিপক্ষে খেলে সুখ্যাতি পান। শ্বেতাঙ্গরা তার খেলা দেখে বিমল আনন্দ পেতেন। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে খেলার সময় তাকেও সবাই শ্বেতাঙ্গ বলে ভুল করতেন। তার ফর্সা গায়ের রঙ, খাড়া নাক ও সুদর্শন চেহারার কারণে বিভ্রম সৃষ্টি হতো। অবশ্য তার মিশকালো চুল চিনিয়ে দিত তার জাত। দেশ ভাগের পরও তিনি করিমগঞ্জ জেলা একাদশের অধিনায়ক হিসেবে আসামের গৌহাটি বরদুলই ট্রফি, স্বাধীনতা দিবস টুর্নামেন্টে বেশ কয়েকবার অংশ নেন। দেশ বিভাগের পর কয়েক বছর সীমান্ত এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে তেমন বাধ্যবাধকতা ছিল না। যে কারণে সে সময় ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলাররা একে অপরের দেশে খুব সহজেই খেলতে পারতেন।
১৯৪৯ সালে কামরুজ্জামান ভর্তি হন সিলেটের বিখ্যাত মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজে। কলেজের হয়ে খেলার সময় তার কদর আরো বেড়ে যায়। ক্ষ্যাপ খেলার জন্য তাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত। হায়ারে বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যেতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি বলেন, ‘১৯৫০-৫১ সালে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খেলতে যাই। প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইলেভেন। এ দলের অধিনায়ক ছিলেন মহারাজ। সে খেলাটি স্মরণীয় হয়ে থাকার অন্যতম কারণ- সেবারই প্রথম বুট পরে খেলার অভিজ্ঞতা হয়।’ তিনি জানান, ১৯৫০ সালে সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার মাঠে এমসি কলেজের হয়ে পুলিশের বিপক্ষে খেলার সময় গন্ডগোল হয়। সেই গন্ডগোলকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ায় শহরে কারফিউ জারি করতে হয়। দেশ ভাগের পর ফুটবল মাঠে গন্ডগোলকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেই প্রথমবারের মতো কারফিউ জারি করতে হয়। কলেজ দলের পাশাপাশি তিনি সিলেট জেলার হয়েও খেলা শুরু করেন। জেলা দলে খেলতেন তার এক বছরের জুনিয়র গোলরক্ষক রণজিত দাস, হেলালউদ্দিন চৌধুরী, এন এইচ খান, মোস্তফাউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। তিনি সিলেট জেলা দলের অধিনায়কও ছিলেন। এরপর খেলেছেন বিভাগীয় দলের হয়ে। তিনি কুমিল্লার পাক ইউনাইটেডের হয়েও প্রায়শই লীগ খেলতেন।
ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে কামরুজ্জামান বলেন, ‘সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে খেলার সময় কলকাতা মোহামেডানে খেলতেন (তার নামটা মনে করতে পারছি না)- এমন একজন ফুটবলারের চোখে পড়ে যাই আমি। তিনি থাকতেন দরগা মহল্লায়। তিনি আমাকে কলকাতা মোহামেডানের গোলকিপার তসলিমের কাছে একটি চিরকুট লিখে পাঠান। তসলিম ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমি তসলিমের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে ফায়ার সার্ভিসে খেলতে বলেন। ফায়ার সার্ভিস দল পছন্দ না হওয়ায় আমি যোগ দেই পিডব্লিউডিতে। সেটা ১৯৫২ সালের কথা। আসলে আমি ঢাকায় বিভিন্ন সময় আসতাম। তখন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে সুবাদে যোগ দেই পিডব্লিউডিতে। সে সময় এ দলে খেলতেন খুব সম্ভবত নবী চৌধুরী, রেমন্ড হালদার, গজনবীর ভাই মঞ্জু প্রমুখ।’ তিন বছর পিডব্লিউডিতে খেলার পর ১৯৫৫ সালে যোগ দেন ইস্টএন্ড ক্লাবে। ইস্টএন্ডে খেলতেন আবদুল হামিদ (পরবর্তীকালে ক্রীড়া সাংবাদিক ও ধারাভাষ্যকর), নূর হোসেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ছোটবেলা থেকেই মোহামেডানে খেলার স্বপ্ন দেখতেন। সেটা অবশ্য ছিল কলকাতা মোহামেডান। দেশ ভাগের কারণে সে দলে খেলা আর সম্ভব হয়নি। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান ঢাকা মোহামেডানে যোগ দিয়ে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কলকাতা মোহামেডানের দিকপাল ফুটবলার মোঃ শাহজাহান ঢাকা মোহামেডান পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন। তিনিও ক্লাব পরিচালনার পাশাপাশি প্রয়োজনে মাঝে-মধ্যে খেলতেন। মোহামেডানের অবস্থা তখন মোটেও ভালো না। ক্লাব টেন্ট নেই। আর্থিক অবস্থাও তথৈবচ। শাহজাহান ভাই বললেন, কাউকে কিছু দিতে পারবো না। কলকাতা থেকে আমি ম্যাসেজম্যান পালোয়ানকে নিয়ে এসেছি। এর ম্যাসেজ পেলে তোমরা একদম চাঙ্গা হয়ে যাবা। তবে তার জন্য সোনায় সোহাগা হয়ে যায় লীগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের দুর্দান্ত সাত ফুটবলার আশরাফ, কবীর, মারী, গজনবী, বাহরাম, আরজু, সখী সামাদ রাগারাগি করে যোগ দেন মোহামেডানে। সামাদ ছিলেন নারায়ণগঞ্জের। রাইট হাফে খেলতেন। একটু সৌখিন প্রকৃতির ছিলেন। সব সময় ধোপদুরস্ত পোশাক পরতেন। ফিটফাট থাকতে ভালোবাসতেন। এজন্য তাকে বলা হতো সখী সামাদ। সেবার অপ্রত্যাশিতভাবে শক্তিশালী দলে পরিণত হয় মোহামেডান। আউটার স্টেডিয়ামে ক্লাবের নতুন ক্লাব ঘর উদ্বোধন করেন তদানীন্তন প্রাদেশিক গভর্নর শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক। সে বছর মোহামেডান লীগে রানার্সআপ হয়ে প্রথম সাফল্য পায়। ১৯৫৭ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে মোহামেডান ওড়ায় বিজয়ের নতুন পতাকা।’ কামরুজ্জামান হয়ে ওঠেন মোহামেডানের সাফল্যের সারথী। তাকে টলিয়ে অন্য কারো পক্ষে তার অবস্থান নেয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি মোহামেডানে খেলেন। এ সময় মোহামেডান ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৯ সাল মোহামেডানের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। সে বছর মোহামেডান লীগ শিরোপা ছাড়াও প্রথমবারের মতো আগা খান গোল্ডকাপ এবং স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘ট্রিপল ক্রাউন’ অর্জন করে। সেবার আগাখান গোল্ড কাপে মোহামেডানের খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- আশরাফ, গজনবী, রণজিত দাস, শাহ আলম, কামরুজ্জামান, বশির আহমদ, আমান, মদন, হাবিব, আবিদ, ইমাম বক্স প্রমুখ। তিনি মোহামেডানে থাকাবস্থায় মোহামেডান ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়। মোহামেডানের এই স্বর্ণযুগে তিনি ১৯৫৮ সালে কলকাতার আইএফএ শীল্ড, পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, চন্দননগরে খেলেন প্রদর্শনী ম্যাচ। একই বছর সফরকারী কলকাতা মোহামেডানের হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেন। ১৯৫৮ সালেই তিনি করাচী কেমারি মোহামেডানের হয়ে ভারতের বোম্বেতে রোভার্স কাপ টুর্নামেন্টে খেলেন। সে দলে তিনি ছাড়াও ছিলেন সাদেক ও দেবীনাশ।
মোহামেডান ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬১ সালে আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবলে পশ্চিম পাকিস্তানে ৫০২ ওয়ার্কশপ দলের সঙ্গে ঢাকা মোহামেডানের খেলা হয়। ওয়ার্কশপ দলের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় আমাদের দলের সম্ভবত কবীর, আশরাফ, গজনবী, আমিসহ পাঁচজনকে সাসপেন্ড করা হয়। গজনবী ও আমাকে সাসপেন্ড করা হয় দু’বছরের জন্য। এর ফলে আমার খেলোয়াড়ী জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ সময় আমার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের তৎকালীন একজন সংগঠক। তিনি ছিলেন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মকর্তা। তার প্রচেষ্টায় আমি সাসপেনশন মওকুফের জন্য আবেদন করলে তা প্রত্যাহার করা হয়। সেই কৃতজ্ঞতায় ১৯৬২ সালে আমি খেলি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে।’ আজাদে সে সময় খেলতেন মুক্তা, আবুল, জলিল আনসারী, গাউস, এজাজ রসুল, ভানু, কাশেম, রণজিত দাস, বাটু, ধনু, নিশিত, মোস্তফা কামাল, লিও, মোর্শেদ, অমল, মোজাম্মেল, নূরুন্নবী, সামাদ প্রমুখ। কামরুজ্জামান সর্বশেষ ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে খেলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। ১৯৬৩ সালে ওয়ান্ডারার্স আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবলে রানার্সআপ হয়। সে দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন হাকিম, গফুর বালুচ, মাসুদ, ইব্রাহীম, সিকান্দার, হানিফ, কামরুজ্জামান, সরসিনা, আজিজ, মহসীন প্রমুখ।
কামরুজ্জামান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী, হায়দরাবাদ, রহিম ইয়ারখান, লাহোর, মুলতান, গুজরানেওয়ালায় খেলেছেন। পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলতে না পারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নবী চৌধুরী ও আমি খেলতাম একই পজিশনে। নবী চৌধুরীর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি ছিলেন অসাধারণ ফুটবলার। তার মতো ফুটবলারের সচরাচর দেখা মেলে না। তার সময়ে না খেললে আমি হয়তো পাকিস্তান দলে খেলতে পারতাম।’
নিজের স্মরণীয় ম্যাচ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বছরটা ঠিক মনে নেই। সে বছর লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। লীগের শেষ ম্যাচ তেজগাঁও ফ্রেন্ডসের সঙ্গে। খেলার সময় আমাদের গোলরক্ষক ভাওয়ালের হাত ভেঙে যায়। আমার যেহেতু গোলরক্ষক হিসেবে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল, এ কারণে আমাকে তার জায়গায় খেলতে হয়। সে খেলায় এক গোলে হেরে গেলে মোহামেডানের অপরাজিত থাকার গৌরব নস্যাৎ হয়ে যায়। তবে আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ১৯৫৯ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচটি। ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল করাচি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (কেএমসি) দল। সে দলের খেলোয়াড় ছিলেন- গোলাম হোসেন, আল্লা বক্স, গফুর, ইয়ার মোহাম্মদ, সালেহ, গোলাম, রসুল বক্স, হারুন, আব্বাস, আবদুল্লাহ ও ইউসুফের মতো দুর্দান্ত ফুটবলাররা। খেলার রেফারি ছিলেন মাসুদুর রহমান। কেএমসি দলের সঙ্গে আমাদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। তাদের ফরোয়ার্ডদের একটির পর একটি আক্রমণ আমরা নস্যাৎ করে দিয়েছিলাম। আমরা সম্ভবত মদন ও আশরাফের গোলে তাদের হারিয়েছিলাম। এ ম্যাচে আমার সম্পর্কে ১৯৫৯ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় লেখা হয়, But the most remarkable thing in the Mohammedan’s defence was the coolness of Qamru. Though he was often fouled by the KMC players he never lost control on himself.
আরেকটি খেলার কথা মনে পড়ছে, পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনালে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান দল। আমাদের গোলরক্ষক ছিলেন রণজিত দাস। তিনি ছিলেন একটু ছোটখাট গড়নের। তার এই খামতিটুকু কাজে লাগিয়ে ফাইনালে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড আচমকা গোল করে জয় ছিনিয়ে নেয়। তাছাড়া ১৯৬০-৬১ সালে চট্টগ্রাম ডিভিশনের খেলায় আমার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা ৩-০ গোলে হারিয়ে দেয় চট্টগ্রাম বিভাগকে। চট্টগ্রামে বিভাগে খেলতেন আইজাক ম্যাকওয়া, মারির মতো দুর্ধর্ষ ফুটবলাররা।’
নিজের খেলা প্রসঙ্গে কামরুজ্জামান বলেন, ‘মাঠের মধ্যে আমি ছিলাম আক্রমণাত্মক ফুটবলার। হেভি মাঠে আমি ছিলাম অত্যন্ত অ্যাফেকটিভ। মাকরানি ফুটবলাররা আমাকে যমের মতো ভয় পেতো। আমার ফিজিক ভালো হওয়ার কারণ- আমার ছিল আর্মি ট্রেনিং। তাছাড়া আমি খুব নিয়ম মেনে চলতাম। আর একটা বিষয় হলো, মফস্বলের ডাকাবুকো ছেলে ছিলাম আমি। এলাকার ছেলেদের সমর্থন নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত ছিলাম। সব সময় নেতৃত্ব দেয়ার প্রবণতা ছিল। এ কারণে আমার ভয়-ডর একটু কম ছিল। তবে খেলা শেষে ঘরে ফিরে আসতাম। নিয়ম-নীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিলাম।’ প্রতিপক্ষ হিসেবে কোন খেলোয়াড়কে সমীহ করতেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাকরানি ফুটবলার ইউসুফ সিনিয়র, নেওয়াজ, আজাদের মুক্তা কখনো-সখনো আমাকে টপকে যেতেন। তবে আমার খেলা ভালো লাগতো শার্প শুটার আশরাফ, কবীর, মারী এবং পরবর্তীকালের সালাউদ্দিন, নান্নু ও মুন্নার খেলা।’
সে সময়কার খেলার ধরন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন টু ব্যাক সিস্টেমে খেলতাম। পরে খেলার ধরন-ধারণ পাল্টে যায়। রক্ষণভাগও সুদৃঢ় করা হয়। ব্যক্তিগত স্কিলের পরিবর্তে দলগত সমঝোতার মাধ্যমে খেলা হয়ে থাকে।’
কামরুজ্জামান ১৯৫১-৫২ সালে রুরাল ডেভলপমেন্টের চাকরিতে যোগ দেন। এই চাকরিতে যোগ দেয়ায় ঢাকায় পিডব্লিউডিতে খেলার ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা ছিল। ১৯৫৪ সালে তিনি যোগ দেন কলকাতার ওষুধ কোম্পানি এলবার্ট ডেভিডে। এই কোম্পানি ঢাকা অফিস লীগে খেলার জন্য একটি ফুটবল দল গঠন করলে তিনি খেলার পাশাপাশি দল গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা নেন। এ দলটি অফিস লীগে ১৯৬০ সালে তার অধিনায়কত্বে চ্যাম্পিয়ন হয়। এ দলের হয়ে খেলেন মুসা, দীপু প্রমুখ।
১৯৫৮ সালে ঢাকায় শুরু হয় ইস্ট পাকিস্তান সফটবল লীগ। সেই লীগে তিনি খেলতেন আমেরিকান এইড দলের হয়ে। ১৯৬১-৬২ সালে তাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়। এ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে দু’জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। বাকিরা বিদেশী। খেলা ছেড়ে দেয়ার পর দীর্ঘদিন তিনি ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বিসিআইসির বিভিন্ন প্রকল্পে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯১ সালে উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্পোরেশনের চাকরি থেকে অবসর নেন। তবে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় চিত্তবিনোদন সমিতির পুষ্প প্রদর্শনী ও বাগান প্রতিযোগিতার কমিটির সদস্য, ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক ও ১৯৭৭-৭৮ সালে কোষাধ্যক্ষ এবং ১৯৯৫-৯৭ সালে সোনালী অতীত ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন। স্ত্রী অধ্যাপিকা নার্গিস আখতার বানু লাকসামস্থ নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দু’কন্যার জনক। ছোট ভাই মমতাজ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলতেন পুলিশের হয়ে।
কিছুদিন আগেও তিনি ফুটবলের আকর্ষণে ছুটে আসতেন খেলার মাঠে। এখন আর তার মাঠে যাওয়া হয় না। তবে ফুটবল আছে তার হৃদয়ের গভীরে। একটু কান পাতলে শোনা যায় তার স্পন্দন।
জীবনের এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে কামরুজ্জামানের বুকের মধ্যে খেলা করে অনেক স্মৃতি। কোনোটা মধুর, কোনোটা বেদনার। দল ও সমর্থকদের জন্য খেলার মাঠে নিজেকে উজাড় করে দিতে তিনি একটুও কার্পণ্য করেননি। প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের গোল করার স্বপ্ন ভেঙে দেয়াটাই ছিল তার স্বপ্ন। এজন্য খেলার মাঠে কতরকম ঘটনাই ঘটেছে। তবে মধুর স্মৃতিগুলোই তাকে বার বার আনমনা করে তোলে। কতজনের সঙ্গে খেলেছেন, কতজনের সঙ্গে মিশেছেন। তাদের অনেকেই আজ হারিয়ে গেছেন। সেই মুখগুলো যখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, তখন জোনাকির মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার দু’চোখ। মুছে যাওয়া দিনগুলো তাকে যেন পিছু ডাকতে থাকে। স্মৃতিরা তখন ছবি আঁকে বেদনার রঙে রঙে। #
১৬-২-২০০৮
২০১২ সালের ১৭ জুন ইন্তেকাল করেন কামরুজ্জামান।
উত্তরমুছুন