অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

কাজী আনোয়ার হোসেন
চারপাশের হল্লা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন তিনি। একান্তে নিজেকে নিয়ে সৃষ্টি করেছেন নিভৃতে নিজস্ব এক জগত। কে কি বললো, তা তিনি কেয়ার করেন না। আড়ালে থেকে কাজ করতে পছন্দ করেন। তবে যা বলেন স্পষ্ট ও সরাসরি। এ কারণে তাঁর পক্ষেই নির্দ্বিধায় বলা সম্ভবÑ ‘যেমনটি আছি, যে কাজ করছি, তাতে আমি সন্তুষ্ট। এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারতাম বলে মনে হয় না। আমার পক্ষে যা সম্ভব, তাই করেছি। আমার কোনো অভিযোগ নেই।’ ৫৪ বছর বয়সেও উচ্ছল কিশোরের মতো বললেন : আমার ছেলেমানুষী আজও কাটাতে পারলাম না। একটা বয়সে আমি থেমে আছি। আর বোধহয় ‘বড়’ হতে পারবো না। আমিও আর বড় হতে চাই না। যেমন আছি, ভালো আছি। সবাই তো আর বড় হতে পারে না। যাই হোক, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেও নিজের খ্যাতি ও সাফল্যকে আড়াল করতে পারেননি। তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুদ রানা, কুয়াশা ও সেবা প্রকাশনীখ্যাত কাজী আনোয়ার হোসেনের পরিচয় ও প্রতিভা অনেক ক্ষেত্রে বিস্তৃত। সেসব টেনে এনে লাজুক, অন্তর্মুখী কাজী আনোয়ার হোসেনকে বিব্রত করার কোনো মানে হয় না। বরং তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাক।
নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি মনে করি আমার কাজের মাধ্যমে সমাজকে আমি এগিয়ে নিচ্ছি। যাদের জন্য লিখছি কিংবা বই প্রকাশ করছি, তারা তো কিছু শিখছে। তারা আমার বইয়ের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় থাকছে। হয়তো আমার গ-ি সীমিত। তাতে কিছু আসে যায় না। যে কাজ নিয়ে মেতে আছি, তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমার ক্ষমতার মাঝে আমি রয়েছি। এ জন্য আমার কোনো হীনমন্যতা নেই। আমার কাজ সম্পর্কে আমি সচেতন। আমার লাইনে আমি নিজেকে সেরা মনে করি। অনেকে বলতে পারেন আমি একটি ঘরে আটকে আছি। হয়তো গ-ি থেকে বেরুতে পারলে ভালো হতো। এই গ-ি কিন্তু আমার মন্দ লাগছে না।
সমাজ ও রাজনীতি প্রসঙ্গে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, শাসকদের অক্ষমতার কারণে স্বাধীনতার পর থেকে কোনো এক কারণে দেশ ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। সর্বত্রই ঘুষ, দুর্নীতি ও অনাচারে ছেয়ে গেছে। মাস্তানদের হাতে সবাই জিম্মি হয়ে পড়েছে। এটা সুস্থ লক্ষণ নয়। জনসংখ্যার চাপ বিপুল। সরকার সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। প্রকৃত অর্থে ’৪৭-এর পর কোনো উন্নয়ন হয়নি। মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হলে, ভরপেট খেতে পেলে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। এ জন্য গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এলে দম-বন্ধ পরিবেশ কেটে যাবে। এখন কিছুটা সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে গণতন্ত্রের পথে। জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। দেশে গণতন্ত্র প্রবর্তিত হওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। বর্তমানে কেউ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সাহস পাবে না। এমন মনোভাব কেউ পোষণ করলে জনগণ তাকে ছাড়বে না। এদেশের জনগণ ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছে। অতিসম্প্রতি দেশের বুকে পাথরের মতো জেঁকে বসা স্বৈরাচারী দানবকে হটিয়ে দিয়েছে। এটা কম ব্যাপার নয়। একে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে ছাত্রদের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। তারা ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে উঠে আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছেছে। এ অবস্থা আর কখনো দেখিনি।
কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো দলের প্রতি আমার দুর্বলতা নেই। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী দলগুলোকে পছন্দ করি না। আর কাউকে আমার অপছন্দ নয়। সবাই কাজ করছে। কাজ করতে করতে একটা পথ বেরিয়ে আসবে। একদিন এর মাঝ থেকে কোনো একজন প্রতিভাবান নেতা উঠে আসবেন। তাহলে আমরা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে যাবো। তিনি আমাদের এগিয়ে নেবেন। অবশ্য বুড়োদের দিয়ে হবে না। তরুণদের মাঝ থেকেই কেউ বেরিয়ে আসবেন। তাছাড়া যে কোনো অর্জন একদিনে হয় না। কখনো এগিয়ে, কখনো পিছিয়ে মূল লক্ষ্যে এগোতে হবে। সমাজ-সভ্যতা এমনিভাবে এগোচ্ছে। আমাদেরও অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে সমাজতন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদ দিয়ে যে কিছু হবে নাÑ এটা প্রমাণিত হয়েছে। সমাজতন্ত্র হলো শৃঙ্খল। পক্ষান্তরে, পুঁজিবাদ বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। দুটোর সংমিশ্রণে যদি কিছু করা যায়। আসলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নিজের প্রথম প্রেম সম্পর্কে তিনি বলেন, কলেজে থাকতে প্রথম প্রেম করি। মেয়েটি আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল। সামাজিক অবস্থার কারণে তার পরিচয় জানানো সম্ভব নয়। তবে প্রেমে অবশ্যই গভীরতা ছিল। যে বয়সের যে ধর্ম। তখন ভালোলাগার বয়স। কোনো মেয়ে কাছে এলে মন তো উচাটন হবেই। পারিবারিক বাধা ডিঙিয়ে আমরা একে অপরের কাছাকাছি হই। কিন্তু মেয়েটি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারেনি। আমি তখন বেকার। রোজগারের কোনো পথ নেই। ওদিকে পরিবার থেকে তার ওপর চাপ। বাধ্য হয়ে তার মন ঘুরে যায়। এখন আমরা দু’জনে দু’দিকে ভালো আছি। অবশ্য প্রথম প্রেমের জন্য এখনো বুকের মাঝে একটু একটু দুঃখবোধ হয়। তাকে পাওয়ার জন্য এই আকুলতা নয়। অতীতের জন্য, ফেলে আসা ওই বয়সটার জন্য কষ্ট হয়। আমার বিয়ের পর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। ১৯৬২ সালের ১৯ জুলাই আমি শিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে বিয়ে করি। এই বিয়েও প্রেম করে। তখন আমি রেডিও, টিভি ও চলচ্চিত্রে গান গাই। সে সময় প্রেমের সূত্রপাত। তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করে আমাদের বিয়ে হয়। এখন আমাদের এক মেয়ে, দুই ছেলে। বেশ ভালোই আছি।
নারী সম্পর্কে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, নারীকে আমি সম্মান করি। আমার স্ত্রীকে নিয়ে সুখে আছি। পরস্ত্রীর দিকে তাকানোর প্রয়োজন হয় না।
সুখী কিনা? সব মিলিয়ে সুখী মনে করি না। তবে সুখের অনে¦ষায় আছি। পুরোপুরি সুখ পেতে চাই না। চলতে চলতে ছড়ানো-ছিটানো সুখ অনুভব করছি। এও মন্দ কি! পুরোপুরি সুখ খুঁজে পাওয়ার অর্থ তো একটাই দাঁড়ায়Ñ শেষ হয়ে যাওয়া। এমনটা কেইবা চায়?
সমাজ থেকে আপনি বিচ্ছিন্নÑ এ রকম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আমি একটু লাজুক প্রকৃতির। স্টেজ ফেস করতে চাই না। শোম্যানশিপটা আমার ধাতে নেই। আমাকে কেউ দেখুন, এটা আমি চাই না। আমি আড়ালে কাজ করতে পছন্দ করি।
কাজী আনোয়ার হোসেন দিনে ১৪/১৫ ঘণ্টা কাজে ব্যস্ত থাকেন। লেখালেখি, সম্পাদনা, প্রকাশনা ও নতুন লেখক গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এর মাঝে যখন কান্ত হয়ে পড়েন, তখন তিনি যা ভালো লাগে তাই করেন। ভালো বই এখনো রাত জেগে পড়েন। তাছাড়া গান শোনেন। ছবি তোলেন। মাছ ধরেন। শিকারে যান। এজন্য যে কোনো স্থানে ছুটে যেতে দ্বিধা করেন না। তবে তাঁর নিজস্ব একটা আড্ডা আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি ঘণ্টাখানেকের জন্য হলেও ধানমন্ডি লেকে যাই। মাছ ধরতে গেলেও এখন আর সেটা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। সেখানে আমার ক’জন বন্ধু আছে। তাদের কেউ আচার বিক্রি করে। কেউ কন্ট্রাক্টর। কেউ এমএসসি পাস। অর্থাৎ শিক্ষিত-অশিক্ষিত উভয়ে থাকলেও কেউ সমাজের মান্যগণ্য কিংবা বুদ্ধিজীবী নন। কেউ কারো পরিচয়ও ভালোভাবে জানেন না। তাদের মাঝে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। এদের মাঝে আমি গান গাই। তারাও তাদের প্রকাশ ঘটায়। সেখানে গেলে আমি নিজেকে খুব হালকা মনে করি। ধুমসে গুলতানি মারি। এদের টানে আমি প্রতিদিন ছুটে যাই।
নিজের সম্পর্কে কাজী আনোয়ার হোসেনের মূল্যায়ন হচ্ছে এমন : লোকটি পরিশ্রমী। যতখানি পরিশ্রম করছে, পাঠকসমাজ তাকে তার চেয়ে বেশি দিচ্ছে। লোকটার ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো প্রতিভা দেখি না। প্রতিভা বলতে উজ্জ্বল, ঝকমকে কিছু তার নেই। তবে কিছু একটা লক্ষ্য ধরে এগিয়ে যাবার জেদ তার আছে। সব মানুষের কিছু না কিছু গুণ থাকে। কেউ গান গায়, কেউ লেখে, কেউ অভিনয় করে। এর সঙ্গে ইনটেলিজেন্স বা গুণ যোগ হলে প্রতিভা উঁচু কোথাও নিয়ে যায়। কিন্তু লোকটির তেমন কিছু নেই। সেজন্য সে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এই হলো কাজী আনোয়ার হোসেন।
৩ জানুয়ারি ১৯৯১

আসাফ্ উদ্দৌলাহ্
দূর থেকে তাঁকে খুব অচেনা মনে হয়। সামাজিক স্ট্যাটাস, গাম্ভীর্য, আভিজাত্য, সর্বোপরি নিজেকে নিয়ে গড়ে তোলা ঘেরাটোপ যে বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেÑ তাতে এমনটি মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে গেলে অনুভব করা যায় একটা বাউল ও প্রেমিক মন তাঁর সংবেদনশীল হৃদয়কে কুরে কুরে খাচ্ছে। সৃষ্টির বহুমুখী তৃষ্ণা ও অতৃপ্তি তাঁকে রক্তাক্ত করে রেখেছে। বুকের মাঝে অনবরত খেলা করছে সুরের গুঞ্জন কিংবা কবিতার বনলতা সেন। একটুখানি টোকা লাগলেই বিবর থেকে বেরিয়ে আসেন সৌন্দর্য ও প্রেমে নিমগ্ন জীবনবোধসম্পন্ন একজন সাধক। তিনিই প্রকৃত আসাফ্ উদ্দৌলাহ্।
দীর্ঘ ১০০ মিনিটের অন্তরঙ্গ আলাপে বহিরঙ্গের খোলস থেকে উন্মোচিত হন শিল্পী আসাফ্ উদ্দৌলাহ্। কবি আসাফ্ উদ্দৌলাহ্, প্রেমিক আসাফ্ উদ্দৌলাহ্। কাব্যে, সঙ্গীতে, মানসিকতায়, জীবনযাপনে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কথোপকথনে তাঁকে মেজাজী, গর্বিত ও অহঙ্কারী মনে হতে পারে। আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ তা জানেন এবং স্বীকার করেন। কিন্তু কে কি ভাবলেন, তা তিনি পরোয়া করেন না। যা ভাবেন, যা বিশ্বাস করেন, তা স্পষ্ট ও সরাসরি বলেন। অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে তিনি একটুও দ্বিধা করেন না। সবকিছুর পরও আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সান্নিধ্যের মাধুর্য এবং তাঁর অতল রোমান্টিক মন হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। অন্তরকে স্পর্শ করে।
আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ গল্পের সেই নায়কের মতো। যাতেই হাত দেন, তাই সোনা হয়ে ওঠে। এজন্যই তাঁর পক্ষে বলা সম্ভবÑ জীবনে কখনো হারিনি। মরে যাবো, তবুও হারবো না। হয়তো হোঁচট খেয়েছি; কিন্তু পরাজিত হইনি। পরাজয় কাকে বলে আমি চিনি না। এ কথা বলতে বলতে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হন আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ : ‘আমি ছোটবেলা থেকেই জেদী ও একগুয়ে। মন যেটা বলে সেটাই করি। আমি যে কাজই করি, সেটা সবার চেয়ে ভালো করতে চাই। যেটা পারি না, সেটা করি না। পড়ালেখায় বরাবরই ভালো ছিলামÑ গুরুজনরাও এ কথা বলেন। সাঁতারে আমার সময়ে (১৯৫৫-১৯৫৯) আমাকে হারানো অসম্ভব ছিল। ১০০ ও ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে গোটা পাকিস্তানে আমাকে টপকে যাবার কেউ ছিল না। যখন বুঝেছি আর পারবো না, তখন সাঁতার ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে কোনো গানই দু’বারের বেশি শুনতে হয়নি। এমনকি বড়ে গোলাম আলীর ঠুমরি পর্যন্ত। গান যদি গাইতাম, তবে ভারতবর্ষের সেরা হতে পারতাম। আমার এই আত্মবিশ্বাস আছে। যাঁদের গান গাইতে দেখি, তাঁদের অধিকাংশই বুদ্ধিমান নন। ভালো গান গাইতে গেলে বুদ্ধিমান হতে হয়। চল্লিশের দশকে গান গাইতে শুরু করি। নিজের কণ্ঠের ওপর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল। গান নিয়মিত গাইলে অনেকের চেয়ে সেরা হতে পারতাম। আমার যে বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ এবং গান যে পরিমাণে ভালোবাসতাম, তাতে আমি কারো কাছে হারতাম না। এ আত্মবিশ্বাস নিয়ে গান শুরু করি। ভারতের প্রথম সারির শিল্পীদের গান শুনিয়েছি। শোনাবার সময় নিজেকে ছোটো মনে হয়নি। তাঁরাও আমাকে ছোট মনে করেননি। দীর্ঘদিন যাবৎ উপমহাদেশের অনেক নামজাদা শিল্পীর গান শুনছি। এরকম গান গাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ গান শোনার জন্য আমাকে অস্থির হতে হয় না। গানের যে স্তর বা পর্যায়, আমার কাছে তেমন কিছু মনে হয় না। এই গান অর্জনযোগ্য কিংবা আয়ত্তের বাইরে নয়। এসব শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে পারি, তাঁদের গান অপার্থিব কোনো ব্যাপার নয়। যদি আমার কণ্ঠ পরিশীলিত থাকে, এরচেয়ে অনেক ভালো গাইতে পারবো। এ কথায় অনেকে আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন, তবুও আমি নিজ দায়িত্বে তা বলতে পারি।
সেই শৈশবে সুর ও সঙ্গীতের সুধায় আমি মগ্ন হই। গান করতে করতে একটা পর্যায়ে এলাম। তখন মনে হলো গানকে কি পেশাগতভাবে নেবো, নাকি অন্য কিছু করবো। দিগন্ত ছোঁয়া আত্মবিশ্বাস। গান গেয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবো। আসলে এ সময়ের ব্যক্তিগত একটি ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
আমি তখন মুন্সীগঞ্জে ভগ্নিপতি ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে থাকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। এ সময় আমার কাছাকাছি বয়সের এক মেয়ের প্রেমে পড়ি। তখন মেয়েদের বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হতো। মেয়েটিকে তার অভিভাবকরা বিয়ে দিতে চাইলো। আমি তখনো সেটেল্ করিনি। এমএ পড়ি। গান-বাজনা নিয়ে মেতে আছি। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। জীবনের প্রথম ভালোবাসা। চার-পাঁচ বছরের প্রেম। এখনকার মতো ঠুনকো নয়। জীবনে কখনো হার মানিনি। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই মেয়ের বড়ো বোনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। তাঁর স্বামী ছিলেন আর্মির মেজর। আমার প্রস্তাব শুনে থ’ মেরে গেলেন। তাঁদের মনোভাবটা এমন যে, ছেলে কিছু করে নাÑ তার কাছে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি যে গান গাইতাম, সেটাকে তাঁরা পাত্তাই দিলেন না। গায়কের সঙ্গে বিয়ে হয় কি করে! সে সময় গায়কের অর্থ হচ্ছেÑ একটি হারমোনিয়াম নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়ে সংসার চালানো। সিনেমায় সায়গল প্রমুখের অভিনয় দেখে তাঁদের এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়। অন্য ছোটোখাটো যে কোনো চাকরি করলেও তাঁরা আমাকে পাত্র হিসেবে মেনে নিতেন। অথচ গান শুনেই কিন্তু মেয়েটি আমার প্রেমে পড়ে। প্রেম করার সময় সে আমাকে বলতো, ডাঙায় যেমন মাছ মানায় না, তেমনি গান ছাড়া আমাকে কল্পনা করা যায় না। এসব কথা তুলতেই সে আমাকে বড়ো বোনের দোহাই দেয়। আমি তাকে বললাম, প্রেম করার সময় তো বড়ো বোনের অনুমতি নাওনি। আসলে হৃদয়ে তোমাদের গান নেই। মেয়েরা যে কতো বড় মিথ্যেবাদী, সেদিন প্রথম বুঝতে পারলাম। একজন প্রকৌশলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। জীবনে আমার প্রথম এবং সর্বশেষ পরাজয়। সে ঘটনা আজও আমাকে কষ্ট দেয়। সে ঘটনা আমার জীবনে এক পরিবর্তন নিয়ে আসে। গান গেয়ে যখন ভালোবাসার মর্যাদা পেলাম না, সে গানকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আর কি হবে? তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লাম। ১৯৬১ সালে সিএসএস পাস করে চাকরিতে যোগ দিলাম। আমি যখন যা করি, সিরিয়াসলি করি। চাকরি জীবনেও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কাজ নিয়েই দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিতাম। সারাদিন ব্যস্ততা ও পরিশ্রমের পর গান-বাজনার এনার্জি ও মুড থাকতো না।’
বলতে গেলে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর আসাফ্ উদ্দৌলাহ্র সঙ্গে সুর ও সঙ্গীতের তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। অনেকে পুরো জীবনটাই সুর ও সঙ্গীতে উৎসর্গ করেও লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেন না। আর আসাফ্ উদ্দৌলাহ্’র কণ্ঠে সহজাতভাবে সুর বয়ে গেলেও কার্যত আত্ম-অভিমানে তিনি তা থেকে নির্বাসনে চলে যান। তবে তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেনÑ ‘সঙ্গীত পুরোটা চর্চার নয়। চিন্তা ও ভালোবাসারও। তাই চর্চা ছাড়াও গান গাওয়া যায়। অবশ্য যৌবনে এটা বুঝিনি। এখন বুঝছি। এখন যে গান করি, তা চর্চার নয়। চিন্তা ও ভালোবাসার। তবে এ কথা ঠিক, চর্চা করলে গলা পরিষ্কার হয়। গলায় আরো দাপট আসে। আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আবার যাঁরা খুব চর্চা করেন, তাঁদের চিন্তা ও ভালোবাসার অবকাশ কম। ফলে যে গান লোকে বার বার শুনতে চায়, তাই গেয়ে থাকেন। এতে মনের খোরাকের জন্য, ভালোবাসার অবকাশ কম। ফলে যে গান লোকে বার বার শুনতে চায়, তাই গেয়ে থাকেন। এতে মনের খোরাকের জন্য, ভালোবাসার জন্য যে গান, তার সৌন্দর্য ও সুষমা ম্লান হয়ে যায়। গান হয়ে পড়ে পণ্য। তাকে কি আর গান বলা যায়?’
‘বয়সের কথা বলছেন? বয়স একটা ফ্যাক্টর বটে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দম কমে যায়। তাছাড়া আমি আবার ধূমপান করি। ফলে আগের মতো আর দম পাই না। গলায়ও আর আগের মতো সেই কারুকাজ নেই।’
এজন্য কোনো আক্ষেপ? ‘মোটেই না। দম হারালেও বয়সের আরেকটা অমূল্য সম্পদ পেয়েছি। দীর্ঘদিন গানের সংস্পর্শে না থেকে যে ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হয়েছি। কেননা এখন গান বুঝে গাই। ৫৫ বছর বয়সটা গান বোঝার প্রকৃত বয়স। আমি যা যা হারিয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছি। গান বুঝতে পেরেছি। সুর বুঝতে পারি বলে মনে হয়। আজকে সুর ও সঙ্গীতের কিছুটা উপলব্ধি করতে পারি। অভিজ্ঞতা যে কি জিনিস তা বোঝানো যাবে না। আমার গলায় দাপট নেই। তবে অভিজ্ঞতা আছে। আজকালকার গান তো হুজুগ। আসে, চলে যায়। গীটার তো নয়, যেন মেশিনগান! গানের সরঞ্জাম দেখলে আতঙ্ক হয়। শুধু হৈ-হুল্লোড়। এসব গান নয়। মানুষের হৃদয়ে মোটেও রেখাপাত করে না। সঙ্গীত আল্লাহর দেয়া ঐশ্বর্য। সঙ্গীতের প্রতি এই যে অনুভূতি, যৌবনে তা আসে না। প্রতিটি শব্দ ও সুরের আত্মা আছে। শব্দের আত্মায় পৌঁছানোর ধৈর্য ও ইচ্ছা ক’জনার থাকে? সর্বোপরি কোনো কাজেই আক্ষেপ করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। সোনার অলঙ্কার নেই। তাতে কি? ফুলের অলংকার পরাবো।’
অনেক দিন সুরের জগত থেকে দূরে থাকার পর আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ আবার ফিরে এসেছেন। তবে তাঁর এই প্রত্যাবর্তন কাউকে জানান দিয়ে নয়। কেননা, তিনি হৈচৈ ও কোলাহল পছন্দ করেন না। যা করেন নিঃশব্দে। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমতÑ ‘আমি অনুষ্ঠানে গাওয়ার শিল্পী নই। এমনিতেই আমি ছোটবেলা থেকে লাজুক প্রকৃতির। তাছাড়া প্রচার আমি ঘৃণা করি। আমার বিশ্বাসÑ তোমার গুণ থাকলে নীরবে এক জায়গায় জমবে। মানুষ তোমার কাছে আসবে।’
চুপিসারে আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ সুরলোকে প্রত্যাবর্তন করলেও এখন প্রায় প্রতি মাসে তাঁর একটি করে ক্যাসেট বের হচ্ছে। ইতোমধ্যে তিনি গজল, গীত, রাগ-প্রধান, নজরুল গীতি, আধুনিক বাংলা গানের ৬৫টি গান রেকর্ড করেছেন। পাকিস্তানের বৃহত্তম গ্রামোফোন কোম্পানি শালিমার, ভারতের ই-এম-আই, মধ্যপ্রাচ্য ও ঢাকা থেকে গানের ক্যাসেটগুলো বের হয়। সুধীমহলে দারুণ সাড়া জাগিয়েছে। আরো ক্যাসেট বের করার জন্য তাঁর ওপর ক্রমাগত চাপ আসছে। আগামী মাসে ঠুমরির ক্যাসেট বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাছাড়া কাাসিক্যাল গান রেকর্ড করবেন। এখন প্রতিদিন তিনি গানের চর্চা করেন। নির্বাসন থেকে সুরের ভুবনে হঠাৎ ফিরে আসার কারণ কিÑ এ প্রশ্নে একটু বিষণœ ও উদাস হয়ে যান আসাফ্ উদ্দৌলাহ্। একটু কান পেতে শোনা গেলো তাঁর হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস : ‘কৌন সে জখম কা খুলা হ্যায়, কাঁটা আজ ফির দিলমে দর্দ হোতা হ্যায়’ (জানি না কোন ক্ষতের সেলাইয়ের সুতো ছিঁড়ে গেছে। আজ আবার হৃদয়ে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে)।
কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত থেকে তিনি বললেনÑ ‘যে জন্য গান ছেড়েছিলাম, সে জন্যই আবার গান ধরেছি। ১৯৮৮ সালের কথা। গুলশানের এক বাড়িতে গান শুনতে যাই। সে বাড়িতে সমাজের অনেক নামি-দামি ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেনÑ যাঁরা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীতের ‘সমঝদার’। আসলে তাঁরা সবাই মুখোশ পরে থাকেন। ভ-ামি করতে ভালোবাসেন। শিল্প-টিল্প কিছুই বোঝেন না। হাবভাবে প-িতি ভাব দেখান। মেয়ের বিয়ে দেবার সময় কোনো শিল্পীকে পছন্দ করবেন না। তবে সে বাড়িতে আমার একজন প্রিয় শিল্পী গুলাম আলীর টানেই যাই। সেখানে দীর্ঘ ২৮ বছর পর তাঁর সঙ্গে (প্রথম প্রেমিকা) দেখা হয়ে যায়। এখন সে বিধবা। তাকে দেখে আমার বুকে ঝড় বয়ে যায়। জীবনের প্রবঞ্চনা আমাকে নতুন করে আঘাত করে।’ সেদিনের অভিব্যক্তি ও যন্ত্রণা তিনি এঁকেছিলেন দীর্ঘ এক কবিতায়।
এ প্রসঙ্গে আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ আরো বললেন, ‘সেদিন ঘরে ফিরে আবার তানপুরা হাতে তুলে নিলাম। আবার গান ধরলাম। তারপর থেকে কোনো কান্তি আর অবসাদ আমাকে টেনে রাখতে পারেনি। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যা হলেই সুর সাধনায় মগ্ন হই। সন্ধ্যা থেকে সারারাত অব্দি চলে রেওয়াজ। দীর্ঘ এক বছরের সাধনার ফসল সাম্প্রতিক ক্যাসেটগুলো। ২৭-২৮ বছর গানের চর্চা করিনি। তাতে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। উপমহাদেশের সেরা সেরা শিল্পী বর্তমানে যে গান গাইছেন, এমন গান গাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব নয়।’
এক সময় আপনি কাব্যচর্চায় মেতেছিলেন, এখন আপনাকে সরব মনে হয় নাÑ এমন এক প্রশ্নের জবাবে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ বললেন, ‘এক সময় নিয়মিত লিখতাম। ১৯৭০ সালে আমার প্রথম কবিতার বই ‘রুদ্ধ রতি’ বের হয়। এখনো লিখি। তবে খুব কম। মাঝে মাঝে। তাছাড়া রাজ কবিদের দাপটে লেখার প্রতি কিছুটা বিতৃষ্ণা এসে যায়। অবশ্য যা লিখেছি, তা হেলাফেলার নয়। আমার কবিতা শুনে শ্রেষ্ঠ কবিকে পর্যন্ত কেঁপে উঠতে হবে। আমার কবিতা শুনে কেউ একটুখানি শিহরিত হবেন নাÑ তা হতেই পারে না। ১৯৬৪ সাল থেকে আমি আত্মজীবনী লিখছি। জীবনকে যেভাবে দেখেছি, সে সঙ্গে সামাজিক ইতিহাস, রাজনীতির পট-পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক বিবর্তন, মানুষের বাঁচা-মরাসহ যাবতীয় বিষয়-আশয় এই আত্মজীবনীতে স্থান পাবে। এটি আমার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হবে। আমি যা লিখেছি কিংবা লিখবো, তার চেয়ে ভালো গদ্য বাংলা ভাষায় লেখা হবে না। এ কথায় কেউ ভুরু কুঁচকে তাকালেও আমি এমনটি বলবো। এটাই আমার প্রকৃতি।’
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ বলেন, ‘একজন মুসলমান হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মানুষের একটাই জীবন। কিন্তু আমার ইচ্ছে অনেক। এক জীবনে পূরণ হবার নয়। তাই এক জীবনে অনেক জীবনযাপন করার চেষ্টা করেছি। সফল চাকরিজীবী হতে চেয়েছিÑ সরকারের সর্বোচ্চ পদে (বর্তমানে পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব) অধিষ্ঠিত হয়েছি। গানের ক্ষেত্রে নিজেকে সেরা মনে করি। আমার কবিতায় কেউ আলোড়িত হবে না, এমন ভাবা যায় না। ছাত্রজীবনে যখন রাজনীতি করেছি, তখন সবার ওপরে থেকেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একমাত্র আমিই ১৯৫৭ সালে স্বতন্ত্রভাবে ভিপি নির্বাচিত হই। সর্বক্ষেত্রে হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পারিনি।’
নিজেকে সুখী মনে করেন কিনা?
‘ভীষণ অতৃপ্তি নিয়ে প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাই। ঘুম আসে না। ছটফট করি। আরো তো কত ভালো কিছু করা যায়।
আমার আনুপূর্বিক জীবনের অনুপ্রেরণার উৎস আমার পিতা খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল। আমার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা, সাফল্য তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। তিনি বলতেন, নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করো। নিজের ভেতরে স্বপ্নকে সৃষ্টি করো। এ কারণে যখন সাঁতার কাটতাম, কেউ প্রতিদ্বন্দ¡ী না থাকলেও মাথার সামনের ঢেউকে প্রতিদ্বন্দ¡ী মনে করতাম। যদিও জানতাম ওই ঢেউ আমারই সৃষ্টি।
পিতার মৃত্যু আমাকে দারুণভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। পিতার মৃত্যুর চেয়ে আমার জীবনে মর্মান্তিক আর কিছু নেই। তাঁর মৃত্যু আমাকে সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে। ১৯৮১ সালে তিনি যেদিন চলে গেলেন, সেদিন বুঝতে পারলাম আমি কতটা নিঃসঙ্গ। জীবন কত নিরর্থক।’
অবসর কাটে কিভাবে?
‘নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখার জন্য লেখাপড়া করি। ক্যাসেট বিক্রি কিংবা অন্য যে কোনোভাবে পাওয়া অর্থে বই কিনি। বইয়ের মতো প্রয়োজনীয় বন্ধু আর নেই। ভবিষ্যতের ইচ্ছাও তাই। পড়বো ও শিখবো। এছাড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করবো।’
৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১

লুৎফর রহমান সরকার
নিজের সম্পর্কে যাঁর মূল্যায়নটা হচ্ছে এমন : ‘আমি মনে করি সমাজের কাছ থেকে যা পাচ্ছি, যা ভোগ করছি এবং যা কিছু ব্যবহার করছিÑ তা সবই অপরের অবদান। সমাজকে বোধ হয় কিছু দিতে পারলাম না। এই অতৃপ্তি আমাকে তাড়িত করে। আমার কাজের ভেতর দিয়ে, ছোটখাটো সাহিত্যকর্মের মাঝে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য প্রতিনিয়ত কিছু করার চেষ্টা করছিÑ মনে হচ্ছে কিছুই পারিনি’Ñ তিনি লুৎফর রহমান সরকার। এই না পারার অতৃপ্তি নিয়ে মানুষ ও সমাজের কাজ করে চলেছেন লুৎফর রহমান সরকার।
বিশিষ্ট ব্যাংকার ও লেখক পরিচয়ের এই মানুষটি মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা স্বীকার করেন। এমনকি এ কারণে তাঁকে বিগত সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে। তবুও তিনি পিছপা হননি। কেননা, তিনি মনে করেন মানুষ হলো শেষ কথা। মানুষের উন্নয়ন ছাড়া দেশ ও সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশের প্রধান সম্পদ মানুষ। একে হেলাফেলা করে দেখার অবকাশ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মানবসম্পদের উন্নয়ন করে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট পাল্টিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে মানুষের উন্নয়ন ব্যতীত কোনো কিছুর উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবশ্য এ জন্য দরকার উন্নত চিন্তা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি। মানসিকভাবে আমরা এখনো স্বাধীন নই। এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মাঝে ছোটখাটো কাজে অবজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। এটা ঠিক নয়। প্রকৃত শিক্ষিতদের সব ধরনের কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এরকম মানসিকতা গড়ে তুলতে পারলে দেশে কাজের অভাব নেই। তাছাড়া বেঁচে থাকার জন্য অর্থ ও স্ট্যাটাস মূল কথা নয়। মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। সমাজের কাছে প্রতিটি মানুষের ঋণ আছে। সমাজকে কিছু দিতে হবে, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।
একজন শিল্পী কি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ?
‘অবশ্যই। শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমাজের কাছে বড় দায় রয়েছে। তাঁরা লেখার ভেতর দিয়ে, শিল্পকর্মের ভেতর দিয়ে তা শোধ করতে চেষ্টা করেন। যতদিন তাঁরা বেঁচে থাকবেন, ততদিন তাঁদের এই দায় থেকে যায়। আজকাল অবশ্য লেখকদের লেখার মধ্যে কোনো মেসেজ থাকে না। থাকে একটা চমক লাগানোর প্রবণতা। কবিতার মধ্যে পা-িত্য থাকে, কবিত্ব নেই। জীবনকে স্পর্শ করতে না পারলে শিল্পের মূল্য কোথায়? এজন্য লেখায় প্রাণ থাকতে হবে। সব কথার সার কথা হৃদয়। চোখ থাকলেই দেখা যায় না, হৃদয় থাকতে হবে। ’
শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি জীবনের অংশ। সার্বিক প্রতিচ্ছবি। আজকাল মূল্যবোধের অভাব ভয়াবহ মনে হচ্ছেÑ এর পেছনে রয়েছে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শূন্যতা। তবে পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে এই শূন্যতা কাটানো কিংবা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এটা স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হতে হবে। মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করতেই হবে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মুক্তি চাই। কিন্তু মূল্যবোধের সার্বিক উজ্জীবন, প্রচার, প্রসার ও তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন টিকবে না। তবে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি মনের ব্যাপার। অন্তরের শক্তি। অন্তরের শক্তি ছাড়া দেশের ও দশের অগ্রগতি অসম্ভব। মূল্যবোধ জাতির বুনিয়াদ। বুনিয়াদ যত দৃঢ় হবে, একটা দেশ বা জাতি তত সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হবে। মূল্যবোধের সংকট, সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে ঠেকানো যাবে না। মূল্যবোধের উজ্জীবন ও সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। এটা হবে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত।
বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে চার কন্যাসন্তানের জনক লুৎফর রহমান সরকারের অভিমত : মন ও চিন্তার দিক দিয়ে বর্তমান প্রজন্ম অনেক উন্নত। আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। তাদের স্বচ্ছ চিন্তা-ভাবনা আমার দারুণ ভালো লাগে। তারা প্রকৃত জিনিসকে অনুধাবন করতে পারে। কোন পথে অগ্রসর হতে হবে, কি ভালো, কি মন্দÑ তা বুঝতে শিখেছে। অবশ্য কিছুসংখ্যক ছেলেমেয়ে বিপথগামীÑ এটা সব সময় ছিল। এর কারণ আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছি না। তবে তাদের দিকে তাকালে মনে হয় আমাদের সামনে রয়েছে সুন্দর ভবিষ্যৎ। খনি মাটির নিচে নয়, মাটির ওপরে। মানুষই হলো সেই খনি। সম্ভাবনাময় এই প্রজন্মকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ উন্নত হবে। যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যাবে।
রাজনীতির কথা বলছেন? রাজনীতি এখন স্বৈরাচারমুক্ত। দেশ এখন গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য এ মুহূর্তে পরমতসহিষ্ণুতা, ধৈর্য, আন্তরিকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। গণতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। উন্নয়নের সঙ্গে মানুষকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। সেজন্যই প্রয়োজন গণতন্ত্রের। সেটাই রাজনীতির মূল কথা।
চাকরি ও লেখালেখি ছাড়া আর কিছু করি না। প্রথমত সময় নেই। দ্বিতীয়ত আর কিছু করার ইচ্ছে নেই। ক্ষুদ্র এ জীবনে সবকিছু করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো কিছু করতে হলে তা ভালোভাবে করাটা বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন ব্যাপারে জড়িত থাকলে কোনোটাই ঠিকমতো করা হয়ে ওঠে না। যে কোনো একদিক বেছে নেয়াটাই ভালো। তাছাড়া সবকিছুই আমাকে করতে হবে, তার কোনো মানে নেই।
অবসর কাটে কিভাবে?
অবসর আর পাই কোথায়। সময় তো খুব মাপা-জোখা। তবে যেটুকু সময় পাই বই পড়ি। এছাড়া অন্য কোনো অভ্যেস নেই।
প্রেম সম্পর্কে ছয়টি গ্রন্থের প্রণেতা লুৎফর রহমান সরকার এই ৫৭ বছর বয়সেও আর দশজন বাঙালি যুবকের মতোই মুখ-চাপা। তাই এ প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে উত্তর দেন ঘুরপথে : সাধারণ ঘরের ছেলে আমি। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। প্রেম করার সময় হয়ে ওঠেনি। তবে প্রেম ছাড়া মানুষের জীবন অচল। সব মহৎ কর্মের ভিত্তি প্রেম। মানুষের হৃদয় থেকে প্রেম উৎসারিত হয়। হৃদয় তো নিশ্চয়ই সব মানুষের আছে। অবশ্য প্রেমের অবস্থানগত তারতম্যও রয়েছে।
হাল-আমলের প্রেম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনকার ছেলেমেয়েদের হৃদয়বৃত্তি কম। তারা খুব বৈষয়িক। কাকের মতোই চতুর। যা করে ভেবে-চিন্তে। তারা হৃদয়ের আগে মস্তিষ্ককে প্রাধান্য দেয়।
শৈশবের স্বপ্ন প্রসঙ্গে খ্যাতিমান রম্য ও শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান সরকার বলেন : শৈশবে সবারই স্বপ্ন থাকে। আমারও ছিলো সমাজের কাজে লাগবো। বড় কিছু করবো। অনেক রকম আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু কিছুই করা সম্ভব হলো না। ‘শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি....’
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১

রাশিদা মহিউদ্দীন
বাইরের খোলস দেখে ভেতরের মানুষ সম্পর্কে চট করে সিদ্ধান্তে আসা বোকামি।
এতে হোঁচট খেতে হয়। রাশিদা মহিউদ্দিনের বহিরঙ্গের চাকচিক্য ও অভিব্যক্তি দেখে অনেকেই তাঁকে ভুল বোঝেন। ভাবেন, তিনি খুবই দাম্ভিক ও দেমাগী। এ কারণে একটা ভুল দূরত্বে তাঁকে হাঁটতে হয়। দূরত্বটা অবশ্য তিনি কখনো কমিয়ে আনার চেষ্টা করেননি। চাকরি ও ব্যক্তিগত কারণে কিছুটা দূরত্ব তাঁকে রাখতে হয়। সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগে মাস্টার্স রাশিদা মহিউদ্দিনকে পেশাগত কারণে নানা জাতের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। এক্ষেত্রে তাঁর কোনো অস্বস্তি কিংবা দুর্বলতা কেউ খুঁজতে পারেন না। যে কোনো মানুষের সঙ্গে তিনি সহজেই মিশতে পারেন, যে কাউকেই আপন করে নিতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে রাশিদা মহিউদ্দিন বলেন, ‘কেন জানি না অনেকেই আমাকে ভুল বোঝেন। তাঁরা আমার বাইরের চেহারাটাকেই দেখেন। ভেতরের মনটাকে বুঝতে চান না। দূর থেকে একটা ভুল ধারণা গড়ে তোলেন। অবশ্য এখন আর এ নিয়ে মন খারাপ করি না। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় হৃদয়টা যদি তাদের চিরে দেখাতে পারতাম! আমি মানুষটা আসলে খাঁটি মাটির। কর্কট রাশির মেয়ে তো! বাইরের আবরণটা শাঁসালো মনে হলেও ভেতরটা খুবই কোমল। আসলে চাকরির কারণে আমাকে একটা স্ট্যাটাস মেনটেন করতে হয়। তার ওপর রঙ চড়ানোর কোনো মানে নেই।’
হোটেল শেরাটনের পরিচালক (জনসংযোগ) রাশিদা মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ পর্যায়ে আসতে পারায় নিশ্চয়ই আমার কৃতিত্ব রয়েছে। আমার চেহারা ও গ্ল্যামার দেখে আমাকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এর পেছনে রয়েছে আমার নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা। আমার সাফল্যে আমি যতটুকু সন্তুষ্ট, আরো সাফল্যে আরো বেশি সন্তুষ্ট হতে পারতাম। মানুষের আকাক্সক্ষার তো কোনো শেষ নেই। আরো আয় করতে, আরো ওপরে উঠতে, আরো বড় হতে কে না চায়! তবে আমি সব সময় বর্তমান অবস্থাতেই তৃপ্তি পেতে চেষ্টা করি। কৈশোরে আমার স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়াবো। কিছুটা হলেও ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছি।’
একজন মহিলা হিসেবে সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়েরা ভিন্জগতের কোনো বাসিন্দা নন। তাদের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। ছেলে-মেয়ে সবারই একই অনুভূতি। একজন ছেলের পেছনে বাবা-মা’র যতটুকু ত্যাগ-তিতিক্ষা, একজন মেয়ের পেছনেও তা-ই। হ্যাঁ, ‘লেডিস ফার্স্ট’ বলে আমাদের সমাজে একটা কথা চালু আছে। এ কারণে মেয়েরা টুকটাক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর শারীরিক গঠনের কারণে কিছু অসুবিধার কথা অস্বীকার করা যায় না। সন্ধ্যার পর একজন মেয়ের পক্ষে একাকী চলা খুবই কঠিন। এমনকি লাইসেন্সসহ কোনো অস্ত্র নিয়েও ঘোরা সহজ নয়। তাকে বাজে কমেন্ট, টিটকারী কিংবা অশোভন আচরণের মুখোমুখি হতে হয়। পক্ষান্তরে একজন ছেলের এ ধরনের কোনো অসুবিধা নেই। তাকে কোনো মেয়ে উৎপাত করে না।’
‘তবে আগের চেয়ে মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। সর্বত্রই মেয়েরা খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কারণে মেয়েদের পথ অবারিত হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা ধাঁচের প্রভাবেই হোক কিংবা টিভি-ভিসিআরের কল্যাণেই হোক, আস্তে-ধীরে আমাদের ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটছে।’
মানুষ সম্পর্কে রাশিদা মহিউদ্দিন বলেন, ‘মানুষ খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আগে একে অপরের মধ্যে যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য ছিল, এখন তা বিলীন হতে চলেছে। মানুষ ক্রমশ স্বার্থপর হয়ে উঠছে। এমনটি কার্যত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে ঘটছে। মানুষের মাঝে পাওয়া-না পাওয়ার ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। সমাজে কালো টাকার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছে। এ কারণে সমাজের বিপুলসংখ্যক লোকের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকেই মূল্যবোধের দ্রুত অবক্ষয় ঘটছে। এই অবক্ষয়ের জন্য মানুষের মাঝ থেকে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসার সম্পর্কগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। মানুষের এই বদলে যাওয়া আমাকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। আমি মাঝে মাঝে নিভৃতে কাঁদি। এই কান্না আমার ব্যক্তিগত অনুভব থেকে।’
‘আমি রাজনীতিবিদ না হলেও রাজনীতি-সচেতন মানুষ। এ কারণে আমার পক্ষে কোনো কিছুতে নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব নয়। কোনো পালাবদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হতে পারলেও দূর থেকে সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করি। তারপর সুযোগ-সুবিধামতো একটি ফোরামে নিজের চিন্তা-ভাবনা ও উপলব্ধি তুলে ধরতে চেষ্টা করি।’
বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়ে সম্পর্কে রাশিদা মহিউদ্দিন বলেন, ‘ভালো-মন্দ মিলিয়েই এই জেনারেশনের ছেলে-মেয়েরা। এর একটা আলোর, একটা অন্ধকারের। সাম্প্রতিককালের ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করেছে ছাত্র-ছাত্রীদের বোধ, বুদ্ধি ও বিবেক এখনো জাগ্রত রয়েছে। অন্যায়, অসুন্দর ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তারা নিঃশঙ্কচিত্ত। আবার এ প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়েই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজে খারাপ হতে না চাইলে তাকে কেউ খারাপ করতে পারে নাÑ এটা আসলে ঠুনকো কথা। অন্তত আমাদের সামাজিক অবস্থায় এ ধরনের কথার মূল্য খুব কম। কাজ নেই, খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমনকি রাস্তায় হাঁটারও উপায় নেই। জনসংখ্যার স্ফীতি আমাদের নতুন প্রজন্মকে ক্রমান¦য়ে আশ্রয় ও ঠিকানাবিহীন করে তুলছে। সেখানে চাইলেও ভালো থাকা যায় না। সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসংখ্যা রোধ। প্রয়োজনবোধে কঠোর শাস্তির বিধান চালু করতে হবে। কেননা, আমরা আলো চাই, অন্ধকারে থাকতে চাই না।’
‘এগুলো এক দিক। অপরদিকে অভিজাত ঘরের ছেলে-মেয়েরা আজকাল বখে যেতে বসেছে। এরা না চাইতেই সবকিছু হাতের মুঠোয় পায়। তারপরও তাদের অধঃপতনের দিকে যাবার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে বাবা-মা তাদের ঠিকমতো লালন-পালন করতে পারেন না। সঠিক সিদ্ধান্ত তারা পায় না। সবকিছু মিলেমিশে তারাই এজন্য দায়ী। আমার সামনে আগুন ও ফুল আছে... কোন্টা নেবো সেটা আমাকেই ঠিক করতে হবে।’
পণ্য হিসেবে মেয়েদের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদিও অর্থনৈতিক কারণে মেয়েদের অবস্থার শিকার হতে হয়, তবুও আমি বলবোÑ এতোটা নিচে নামা তাদের ঠিক নয়। একদম কোনো কাজ না পারলেও ইট ভেঙে পেট চালানো যেতে পারে। কিন্তু নিজেকে বিকিয়ে দেয়া কিংবা আত্মসমপর্ণ করাকে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি।’
নিজের প্রথম প্রেম এবং প্রেম সম্পর্কে রাশিদা মহিউদ্দিনের ভাষ্য, ‘কৈশোরে একজনের প্রেমে পড়ি। তার সঙ্গে আমার বয়সের অনেক পার্থক্য ছিল। এ প্রেম ছিল একতরফা। তিনি আমার প্রেমের কথা জানতেন না। আমি কখনই জানতে দেইনি। মানসকল্পে তাঁর ছবিটি, সেই বয়সের অনুভূতিটুকু আজও রয়ে গেছে। প্রেমটা সুন্দর অনুভূতি। প্রেম আছে বলেই এখনো কবিতা লেখা হয়, গান লেখা হয়, সৃষ্টির নেশায় মানুষ মগ্ন হয়।
এখন প্রেম করেন কি-না?
‘না, প্রেম করার বয়স চলে গেছে। তবে এখন অন্যরকম প্রেমের অনুভূতি হয়। সুন্দরের প্রতি, সৌন্দর্যের প্রতি। এ কারণে অবসরে কবিতা কিংবা গল্প লিখি। আবৃত্তি করি। মনে মনে গান গাই। বাগান করি। এই প্রেম কারো জন্য নয়। এটা বেঁচে থাকার জন্য।’
আলাপের এক পর্যায়ে প্রেমের রেশ ধরে রাশিদা মহিউদ্দিনকে আলটপকা স্বামী, সন্তান, সংসার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হলো। দায়িত্বশীল চাকুরে, টিভির ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা, ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত রাশিদা মহিউদ্দিন এখনো ‘মিস রাশিদা মহিউদ্দিন’Ñ এ তথ্যটি জানা ছিল না। এর গূঢ় কারণ জানতে চাইলে তিনি একটু যেন উন্মনা হয়ে যান। তাঁর চোখে, মুখে, বুকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জয় গোস্বামী : বাড়ি ফিরে সেই এক সংসার। সেই এক সাধারণ স্বামী। ‘আজ শান্তি, কাল উদাসীন’ কিংবা ‘সেই এক জানালা আর ছাদ।’ ছক-কাটা পথে তিনি জীবনকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষপাতী নন। তাঁর মতে, একটাই তো জীবন। তাকে পিঞ্জরাবদ্ধ করে কী লাভ! বিয়ে না করার জন্য তাঁর মনে কোনো ক্ষোভ কিংবা দুঃখ নেই। সাংসারিক জীবনের জটিলতা, হৃদয়ের টানাপোড়েন, বেঁচে থাকার রুক্ষ ঘাত-প্রতিঘাত তাঁকে খুব কষ্ট দেয়। এ কারণে সংসার-সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়ার কথা ভাবেন না।
নিঃসঙ্গ বোধ করেন কি-না?
এর উত্তরে রাশিদা মহিউদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সে ধরনের অনুভূতি হয়নি। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও কাজের মধ্যে থাকায় নিঃসঙ্গতা তেমন একটা অনুভূত হয় না।’ শেষ মুহূর্তে তিনি বলেন, ‘তবে মনের মতো একজন মানুষ খুঁজছি। অনেক দিন থেকে সেই মানুষকে একটু একটু করে আমার মনের মাঝে গড়ে তুলেছি। তাকে যদি কখনো পেয়ে যাই, তাহলে জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাববো।’
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১

এমআর আখতার মুকুল
কোনো সীমিত পরিসরে এমআর আখতার মুকুলের কর্মবহুল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের বৃত্তান্ত তুলে ধরা কঠিনÑ এ কথা কম-বেশি সবাই জানেন। কবি বেলাল চৌধুরীর ভাষায়Ñ শত্রু-মিত্র সব মহলে সমান জনপ্রিয়। অকৃত্রিমভাবে বন্ধুবৎসল, সদালাপী, সারাক্ষণ হাসি-খুশি, চরম আড্ডাপ্রিয়, কাশফুল মাথা এমআর আখতার মুকুল যে কোনো আড্ডায় মধ্যমণি হয়ে উঠতে সময় নেন না।
পলক মাত্র। একাই একশ’। অতিরিক্ত সিগারেট ফোঁকার ফলে ঈষৎ খর্খুরে গলায় যেমন আছে জলদ গম্ভীর ডাক, তেমনই আছে বুক কাঁপানো বাঘের হাঁক। ফুরফুরে মজলিসি মেজাজ, যার সঙ্গে বৈদগ্ধ ও অসামান্য স্মৃতিশক্তির বিরল সমন¦য় তাঁর আলাপচারিতাকে করে তোলে খাপখোলা তরবারির মতো শাণিত ও ঝকঝকে। সিংহ রাশির জাতক বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য, দুঃসাহসী অথচ সংযত ও সহিষ্ণু ৬১ বছর বয়সের ‘চিরযুবা’ এমআর আখতার মুকুল সেই যে ছোটবেলায় বাঙালি ঘরানার রেয়াজমাফিক দু’দুবার বাড়ি থেকে পলায়ন-পর্ব দিয়ে শুরু করেছিলেন জীবনের প্রথম পাঠ, তারপর থেকে আজ অবধি বহু দুস্তর ও বন্ধুর চড়াই-উৎরাই, বহু উত্থান-পতন ও প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে হলেও আর কখনো তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছপা হননি কোনো পরিস্থিতিতেই।
বর্ণাঢ্য ও বিস্তৃত জীবনের অধিকারী এমআর আখতার মুকুল যে কোনো বিষয়ে অনর্গল লিখতে পারেন, বলতে পারেন। বয়সের ব্যবধান কাটিয়ে তাঁর সঙ্গে রাজনীতি, নারী-প্রেমসহ যাবতীয় বিষয় আলোচনা করতে কোনো অস্বস্তি হয় না। আসন্ন সংসদ নির্বাচন ও দেশের রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন এমনÑ এবারের নির্বাচনে দুটো বিষয় পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে। প্রথমত মৌলবাদীদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে পড়বে। দেয়ালের চিকা দেখে মৌলবাদীদের আন্দাজ করা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, সংসদীয় রাজনীতির সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচে বামপন্থীদের ব্যর্থতা। দুটি বিষয়ের ব্যাখ্যা এভাবে করা যায়Ñ বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার হয়েছিলো মুক্তবুদ্ধি, সুফী, পীর-দরবেশদের মাধ্যমে। তাঁরা এখানে ইসলাম ধর্ম ও স্থানিক ভাষা, সাহিত্য, লোকাচার ইত্যাদির সমন¦য় ঘটিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশে যাঁরা একুশে কিংবা নববর্ষ করছেন, তাঁরাই কিন্তু জুম্মা ও জানাজার নামাজ আদায় করছেন। এটা এমন এক ধরনের জনগোষ্ঠী, যাঁরা ইসলামবিরোধী কথাবার্তা যেমন বরদাশত করেন না, তেমনি রবীন্দ্র-নজরুল থেকে শুরু করে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও স্থানিক লোকাচারের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্যও বরদাশত করেন না। বাংলাদেশের গাঙ্গেয়-বদ্বীপ এলাকায় সবকিছুর সমন¦য় হয়েছে সংঘাতময় প্রক্রিয়ায়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এখানে বার বার ভুল করে যাচ্ছে। এরপর আসে বামপন্থীদের কথা। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকেও গ্রাম-বাংলায় বামপন্থীদের তথা কৃষক আন্দোলনের যে প্রভাব ছিলÑ তা অত্যন্ত দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য শহরে মধ্যবিত্ত মার্কসীয় নেতৃবৃন্দই মোটামুটি দায়ী বলা যায়। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আজ পর্যন্তও মার্কসীয় নেতৃবৃন্দের কথাবার্তা, বক্তৃতার ভাষা, শব্দচয়ন বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে বোধগম্য নয়। প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয় ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২ মাসের শাসনামলের যেসব ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে, সেসব ব্যাপারে আমরা শহরবাসী সমালোচনামুখর হলেও গ্রাম-বাংলার জনগোষ্ঠীর মনে এর তেমন কোনো প্রভাব নেই। এত বড় হত্যাকা-ের কোনো বিচার হয়নিÑ তাদের কাছে সেটাই বড় কথা। বড় কষ্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যায় বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটেনি। সেজন্য বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদীর ‘লেজুড়’ হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয়তাবাদীর ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের কাছে প্রমাণিত হয়নি। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের ফলে একটা দমবন্ধ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মানুষ মনের কথা বলতে না পেরে, লিখতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ে। এ কারণে কিছু কিছু পদস্খলন ঘটতে থাকে। তবে গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে আমি আশাবাদী।
বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে এমআর আখতার মুকুল বলেন, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অপূর্ব। তারা কবিতা, সৌন্দর্য ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। তারা জানতে ইচ্ছুক। এ অত্যাধুনিক যুগে ভিডিও-টিভি দেখার পাশাপাশি তারা ঠিকমতো লেখাপড়াও করছে। আমাদের সময় দুনিয়া অনেক ছোট ছিল। এখনকার দুনিয়া অনেক বড়। ফলে বর্তমান প্রজন্মের জানাশোনার পরিধিও বড়। কেউ কেউ যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না, তা নয়। এর কারণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণী আশানুরূপভাবে এই প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারছে না। তাদের মাঝে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে। শিল্পপতিদের পাশাপাশি তারা তাদের মেধা ও মননকে বাড়ি-গাড়ি গড়ে তোলার দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে। এ কারণে আজকাল সমাজের অভিজাত এলাকায় অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিকদের বাড়ি-ঘর দেখা যায়। তবে ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে নতুন প্রজন্মের মন-মানসিকতার পরিবর্তন দেখে আমি খুশি। নিজের প্রজন্ম সম্পর্কে এমআর আখতার মুকুল বলেন, আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও খুব একটা খারাপ ছিল না। পরবর্তীকালে বিদ্যার তুলনায় আমরা বিত্তের দিকে চলে গেলাম। সাধ্যের বাইরে কাজ-কর্মে জড়িয়ে পড়লাম। এজন্য ইন্ধন জোগানোর ব্যাপারে আমাদের স্ত্রীরাই পরোক্ষভাবে দায়ী। তারাই দিনরাত তাদের স্বামীদের বিত্তের দিকে তাড়িত করেছে।
সামাজিক কোনো পরিবর্তনে আলোড়িত হন কি-না? এর উত্তরে তিনি বলেন, যে কোনো পরিবর্তনই আমাকে আলোড়িত করে। তবে উৎকণ্ঠিত করে না। এখন প্রেমের সংজ্ঞা বদলে গেছে। পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্রের সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটেছে। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওলট-পালট হচ্ছে। এতে আপত্তির কিছু নেই। বরং নিজেকে মানিয়ে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। মানুষের সঙ্গে মানুষের, দেশের সঙ্গে দেশের, মনের-ভাবের সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটছে। এর ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। এটা নির্ভর করে ব্যক্তি মন-মানসিকতার ওপর। তবে নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান থেকে অন্য সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হলে আপত্তির কিছু নেই। পাশ্চাত্য সভ্যতা গলাধঃকরণ করে নিজের সংস্কৃতির বিরোধিতা করা কাক্সিক্ষত হতে পারে না। তবে আমি আমার কাজের মাঝ দিয়ে নতুন প্রজন্মের মন-মানসিকতা বুঝতে পারছি। এমনকি এঁদের কাছ থেকে আমি নিজেও শিখছি। এর ফলে আমি কুয়াশার ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ভুল-ভ্রান্তি দেখলে শুধরে দিতে চেষ্টা করি। কোনো ছেলে-মেয়েকে প্রেম করতে দেখলে আমি বাধা দেই না। আমার দোকানে (সাগর পাবলিশার্স) অনেকেই আসে। দেখে ভালো লাগে। তবে অনেক সময় কোনো কিছুতে অসঙ্গতি দেখলে তাদের বলে দেই। এরকম কয়েকটি মেয়েকে বলেছিÑ ‘তোমার বয়ফ্রেন্ডকে হাত ধরতে দেবে। এর বেশি অগ্রসর হতে দেবে না। তাহলে তুমি উচ্ছিষ্ট হয়ে যাবে।’ এতে কিন্তু তারা মাইন্ড করেনি। বরং আমার ভক্ত হয়ে উঠেছে। আসলে যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারলে কোনো অসুবিধা হয় না।
নিজের কাজ সম্পর্কে এমআর আখতার মুকুল বলেন, আমি জীবিকার তাগিদে অনেক কিছুই করেছি। সে এক বিরাট ফিরিস্তি। এতো কিছুর পরও আমাকে কখনো হাত পাততে হয়নি। কোনো কিছু আমি আগেভাগে ভেবে করি না। যে কোনো পরিবেশে নিজেকে নিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারি। ফুটপাতে বসে চা খেয়ে যেমন আনন্দ পাই, আবার সোনারগাঁও হোটেলেও একই রকম আনন্দ উপভোগ করি। আনন্দই আমার জীবনের মূলমন্ত্র। এ কারণেই নিজেকে নিয়ে আমি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত। সমাজের উপকার নিয়ে চিন্তা করি না। যে কোনো কাজ সুচারুভাবে করাটাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। এই বই বিক্রি করতে এসে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হই। বই বিক্রি করে সুবিধা করতে পারবো না বলে সবার ধারণা ছিল। অথচ এখন আমার দেখাদেখি পাশের দুটি শাড়ির দোকান বইয়ের দোকান হয়েছে। এতে সমাজের কোনো লাভ-ক্ষতি হলো কিনা, সে হিসাব করিনি। কিন্তু আমি আমার কাজের জন্য সন্তুষ্ট। আমার দোকানে স্কার্ট, সালোয়ার-কামিজ পরা হাল ফ্যাশনের মেয়েরা আসে। তারা বিলবোর্ডের ম্যাগাজিন কেনার সময় রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা কিনছে। তখন আমি দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠি।
এমআর আখতার মুকুল বলেন, কৈশোরে যে স্বপ্ন দেখতাম, তা পূরণ হয়নি। না হওয়াটাই আমার জন্য ভালো হয়েছে। হলে সম্ভবত একটা গ-িতে আবদ্ধ হয়ে পড়তাম। এখন নানা কাজের মধ্য দিয়ে বহু বিচিত্র মানুষ দেখছি। বহু রুদ্ধশ্বাস, চাঞ্চল্যকর ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছি। বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছি। বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আমার জীবন। এক জীবনে কম পাওয়া হলো না।
নিজের প্রেম সম্পর্কে তিনি বলেন, রাজনীতি ছিল আমার প্রথম প্রেম। যে কারণে অন্য কোনো প্রেম পাত্তা পায়নি। তবে ১৯৪৭-৪৮ সালে এক মেয়ের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে খেলতে প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু তার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে বাদানুবাদ হতো। তারপর তো জেলেই গেলাম। সে সঙ্গে জীবন থেকে সেই মেয়েও হারিয়ে যায়।
মানুষ সম্পর্কে এমআর আখতার মুকুলের অভিমতÑ এদেশের প্রতিটি মানুষই ভালো। যে লোকটা রূঢ় ব্যবহার করছে, পরবর্তীকালে তারই আবার অমায়িক ব্যবহার। আসলে ওপর থেকে মানুষকে কঠিন মনে হলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিটি মানুষ খুবই কোমল।
২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১

বেলাল চৌধুরী
‘আমি কারুর তোয়াক্কা করি না। কারুর কাছে আমাকে যেতে হয় না। আমি মাথা উঁচু করে হাঁটিÑ এটাই আমার গর্ব। এই গর্বই আমার চলার পাথেয়’Ñ এমন স্পর্ধিত ও গর্বিত উচ্চারণ করার সৎসাহস রাখেন বেলাল চৌধুরী। কবি ও বাউন্ডেলে। বিচিত্র ও বহুমাত্রিক জীবন যাঁর। কাব্যে, জীবনে অভিন্ন সত্তা। অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট অভিধায় তাঁকে নিশানদিহি করা যাবে না। এদেশে একখানই বেলাল চৌধুরী, যিনি নিজেই নিজের দৃষ্টান্ত। কাগজ ও কলম ছাড়া তিনি অন্য কিছুর বশ্যতা স্বীকার করেন না। কোনো বন্ধনে জড়াতে চান না। ‘বেলাল বরারই এ-পথে যেতে গিয়েও ও পথে চলে যেতো’Ñ এটা তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি। সেই দূর শৈশবে ঘর ছাড়েন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পারিবারিক কারণে বাল্যকাল কাটাতে হয়েছিল প্রতিকূলতার মাঝে। আমার স্বাধীন সত্তা তা স্বীকার করেনি। পারিবারিক বৃত্তের মধ্যে আটকে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। স্বাধীন সত্তা বজায় রাখার তাগিদে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়ি। বয়স? তখন আর কতো হবে! কোনো রকমে স্কুলের শেষ পর্ব পর্যন্ত টেনেটুনে পৌঁছেছিলাম আর কী! ঐ পর্যন্তই পড়ালেখা। আর কোনোদিন শিক্ষালয়ে যাইনি। আমার কোনো পরীক্ষার সার্টিফিকেট নেই। আমার যা কিছু পাঠ, ওই প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকেই। ছোটবেলায় আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল ইঞ্জিনের ড্রাইভার হওয়া। বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন যেতো। ট্রেন চালক ও গার্ডের মাঝে লাল-সবুজ পতাকায় সংকেত বিনিময় এবং ইঞ্জিনের হুইসেল আমাকে দারুণভাবে টানতো। পরবর্তীকালেও এ টান আমি এড়াতে পারিনি। আমার জীবন ছিল বাধা-বন্ধনহীন। কোনো পথের গ্রন্থিতে আটকা পড়িনি। আমি অন্যরকম জীবন কাটিয়েছি। যেমন ইচ্ছে। শৈশবকালটাই আমার জীবনের পরম সম্পদ।
অন্তরে তুষের অনল নিয়ে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে বেলাল চৌধুরী এখন কিছুটা থিতু হয়েছেন। এখন তিনি দায়িত্বশীল স্বামী, স্নেহশীল জনক এবং চাকরিজীবী। ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রকাশিত ভারত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক, সে সঙ্গে সমাজ ও সাহিত্যের সঙ্গে অবধারিতভাবে গাঁটছড়া বাঁধা। প্রথম সুযোগেই তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়Ñ নিজের কাজে সন্তুষ্ট কিনা? এর জবাবে কোনো কিছু না ভেবেই প্রতিবাদের সুরে তিনি বলেনÑ না, মোটেও সন্তুষ্ট নই। জীবনযুদ্ধ করতে করতে সময় চলে যাচ্ছে। জীবিকার তাগিদে এতো বেশি বিপর্যস্ত থাকতে হয় যে, কাজ করলে তৃপ্তি পেতাম; সেই কাজের সুযোগ নেই। যে কাজ করার পরিকল্পনা ছিল, সেটা করতে পারছি না। অথচ কাজগুলো করার ভীষণ ইচ্ছে। একা থাকলে সম্ভব হতো। এখন ঘর-সংসার নামক গার্হস্থ্য আশ্রমের ফাঁদে আটকে গেছি। সে সঙ্গে সামাজিক জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছি।
সমাজ-সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবন ক্ষয়ে যাচ্ছে। ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না। তার চেয়ে সুখী মানুষ নেই যে, তার মেধা আর শ্রম দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। এই শহরের জীবন নিছক ভ-ামি। সবই ভান ও মুখোশ। অথচ সবার গা থেকে মাটির গন্ধ বের হয়। শহরের এ পরিবেশে কিছু শেখার নেই। জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে বেলাল চৌধুরী বলেন, পৃথিবীকে বিষাক্ত করার জন্য অল্পবিদ্যা খুবই ভয়ঙ্কর। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথা বলছি। সম্ভব হলে আমি আমার সন্তানকে নিরক্ষর রাখতাম। এটা বলায় সবাই আমাকে পাগল কিংবা মূর্খ ভাববেন। তবুও বলছি, সন্তানদের লেখাপাড়া না শেখালে তারা গ্রামের বাড়িতে নিজের জমি চাষাবাদ করতো। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, মৈথুন নিয়ে মেতে থাকতোÑ ব্যাস। আরামদায়ক জীবনযাপন, কোনো নাগরিক জটিলতা তাদের স্পর্শ করতো না। গ্রামে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও শহরে ভাড়াটে বাড়িতে থাকি। টানাপোড়েনের মাঝে জীবন কাটাই। শহর জীবনকে পর্যুদস্ত করে তুলেছে, নব্য ধনীরা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। হাঁপিয়ে উঠেছি। অবশ্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করলে আমিও তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতাম। কিন্তু সব প্রলোভন এড়িয়ে মাথা উঁচু করে হাঁটিÑ এটা আমার গর্ব। কারো কাছে কিছু চাই না। মনে হয় গ্রামীণ জীবনে ফিরে যেতে পারলে আমি সুখী হতাম। কিন্তু আমি চাইলেও এখন পারি না।
রাজনীতিসচেতন বেলাল চৌধুরীর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিমতÑ যা দেখছি বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরে যাবার জন্য স্বৈরাচারের পতন ঘটানো হয়। এখন বিভিন্ন দল বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পৌঁছানোর পথ বলতে গেলে প্রায় রুদ্ধ হবার পথে। স্বৈরাচারের পতনের পর সাধারণ মানুষ হিসেবে এটা আশা করিনি। সব মিলিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝে আছি। এ অবস্থা থেকে কীভাবে উতরানো যায়, দেশের রাজনীতিবিদরা সেটা ভেবে দেখবেন। এর সমাধান আমি দিতে পারি না। সেসব আমার চায়ের কাপ নয়।
দেশের তরুণদের সম্পর্কে এক সময়ের ‘অপ্রতিরোধ্য তরুণ’ বেলাল চৌধুরী বলেন, তারুণ্যের স্পর্ধা ভালো। স্পর্ধার অর্থ বেয়াদবি নয়। তরুণ সমাজ এগিয়েছে, না পিছিয়েছেÑ তা সমাজবিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন। আমার মনে হয় তরুণদের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এর প্রধান কারণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু দেশে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে স্থিতিশীলতাও এনেছিলেন। কিন্তু গত ১৫ বছর গণতান্ত্রিক সরকার ছিল না। এ সময় বিভ্রান্তি ও মিথ্যা অপপ্রচারের মাধ্যমে সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ থেকে তরুণদের সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরশাসকরা নিজেদের স্বার্থে তরুণদের ব্যবহার করেছে। ছোট, বড়, মাঝারিÑ সব স্বৈরশাসকের একই চেহারা। তাছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পাল্টে যায়। মন-মানসিকতা পাল্টায়। বোকা বাক্সের (টেলিভিশন) ততোধিক বোকা চাকর-বাকরের দৌরাত্ম্যে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। এটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় অপপ্রচার আরো বেড়েছে। দিনকে রাত বলা হয়েছে। অবশ্য সব বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার থেকে তরুণদের নিরাপদ দূরত্বে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। এই দায়িত্ব পালনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এই যে আপনাদের সাপ্তাহিক মূলধারাও তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। পত্রিকায় কি সব ছবি ছাপা হচ্ছে? তাতে তরুণরা কোন পথে যাচ্ছে? এতে কি সমাজ দূষিত হচ্ছে না! তরুণদের পর্নগ্রাফি আকর্ষণ করে। তাই বলে তাদের হাতে তা তুলে দিতে হবে? সামাজিক অবক্ষয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে স্থিতিশীলতা না আসলে, মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন না এলে অবক্ষয় চলতেই থাকবে। সবাই রুখে দাঁড়ালে অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আমার প্রচুর হতাশা। কেননা মানুষ মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে মেলামেশা, মতবিনিময়, ভাবের আদান-প্রদান, বিতর্ক না করতে পারলে ভ্রমণ এবং একের সঙ্গে অপরের পরিচয় গড়ে না উঠলে নৈরাশ্য সৃষ্টি হবেই। হতাশার পাশাপাশি আমি একই সঙ্গে আশাবাদীও। কারণ আমার একার হতাশা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। কেননা একজনকে নিয়ে সমাজ নয়। বিশ্বাস করি, একদিন না একদিন সমাজ পাল্টাবে। মানুষ। সেই যে লালন বলেছেন : ‘সবার উপর মানুষ সত্য’। মানুষের ওপর আমার কোনো অবিশ্বাস নেই। কৈশোরেই মা আমাকে বলতেন মানুষের ওপর বিশ্বাস না হারাতে। এ কারণে আমি মানুষকে ভালোবাসায় বিশ্বাসী। জ্ঞানত কারো ক্ষতির চিন্তা করি না। তাছাড়া সব মানুষের কাছে আমি শিখি। কেননা আমার ‘অঠিক গুরু বেঠিক গুরু, গুরু অগণন’।
নিজের প্রেম সম্পর্কে বেলাল চৌধুরী অবলীলায় বলেনÑ আমি যখন যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি এবং ‘গোপনে মেয়েদের সঙ্গে প্রেম, ভালোবাসাবাসি/অথবা প্রেম প্রেম ইকড়ি-মিকড়ি খেলা/দু’চোখে দেখতে পারতো না বেলাল.../বলত, ওসব অকারণ ফার্ট করা ডিসপেপসিয়ার লক্ষণ/উপরন্তু কেমন যেন গেরস্ত-গন্ধী আদিখ্যেতা/তার চাইতে বনেদী চাল অনেক ভালো/ইয়ারদোস্ত বাগান বাড়ি, বাইজী নাচ, বেশ্যাপাড়া/ফুর্তি বানাও যেমন ইচ্ছে/তার কথা ছিল বিষম স্পষ্ট/আর সোজাসুজি যুক্তাক্ষরবর্জিত/অর্থাৎ মেয়ে পেলেই ধর আর কর/ব্যাস, আর দেখতে হবে না... দেখবে/তুড়ি মেরে দিন কেমন কাটছে খাসা।’ (বেলাল চৌধুরীর কবিতা/কলকাতা থেকে প্রকাশিত)। এক্ষত্রে কবিতার বেলালের চেয়ে বাস্তবের বেলাল চৌধুরী আরো বেশি সাহসী ও খোলামেলা।
নারী সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি নারীকে নারীর মতো দেখি। আমি তাদের বন্দনা করি। এক্ষেত্রে রূপ-অরূপের কোনো ভেদাভেদ আমার কাছে নেই। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল, সুন্দরী-কুৎসিত কেউ নিজ থেকে হন না। তাছাড়া কুৎসিতের ভেতরও সুন্দর থাকতে পারে। যেমনটি কয়লায় হীরা থাকে। দেখার মতো চোখ ও মন থাকলেই হয়।
বিয়ে কিভাবে করেছেন? এর উত্তরে বেলাল চৌধুরী বলেন, অন্যান্য কুলাঙ্গার ছেলে যেভাবে করে থাকে, আমিও সেভাবেই বিয়ে করেছি। দীর্ঘ ১৪ বছর একটানা কলকাতায় থাকার পর ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে আসি। এসেই আবার চলে যাচ্ছিলাম। খুলনা গিয়ে শুনি বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বাধ্য হয়ে ফিরতে হয়। তখন মা বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগেন। দীর্ঘ ১৪ বছর তাঁকে কাঁদিয়েছি। আর কাঁদাতে মন চাইলো না। তাই মায়ের ইচ্ছেমাফিক তাঁর দেখা পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের আগে আমি তাকে দেখিনি। বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল হয়তো ৪০/৪১ বছর।
কলকাতার জীবন সম্পর্কে বেলাল চৌধুরী বলেন, আগেই বলেছি, আমার ধরা-বাঁধা জীবন একদম ভালো লাগে না। এ জন্য বাড়ি ছেড়েছি। চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লায় দীর্ঘদিন বসবাস করেছি। এ সময় নানা কাজ করেছি। তারই এক পর্যায়ে ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারের কাজ করতাম। একবার সুযোগমতো ট্রলার থেকে কলকাতায় নেমে যাই। সেটা ১৯৬১ সাল। বোহেমিয়ান জীবনে অনেক ধরনের কাজ করেছি। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। হাজারটা চাকরি করেছি। গৃহশিক্ষক, ছাপাখানার কাজ থেকে শুরু করে লেখার কাজ। বলা যায়Ñ জুতা সেলাই থেকে চ-িপাঠ পর্যন্ত। তবে কোনো কাজ ভালো না লাগলে ধুত্তোরি বলে মুহূর্তেই ছেড়ে দিয়েছি। বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকানো ছাড়া কখনো পেছনে ফিরে তাকাইনি। এজন্য জীবনে কোনো অনুতাপ নেই। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুরে বেড়াতে আমার দারুণ লাগে। একবার ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বিপদে পড়তে পড়তে বেঁচে যাই। সে সময় কলকাতায় রটে যায় আমি পাকিস্তানের গুপ্তচর। তিন লাখ টাকাসহ ধরা পড়েছি। আসলে এর আগে কোনো কাজ করতাম না। ভবঘুরের মতো ঘুরতাম। এ কারণে আমাকে নিয়ে সবার সন্দেহ হয়। আমি কখনো লেখালেখি করবো ভাবিনি। কিছু একটা করতে হয় মনে করে এ সময় লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়ি। আমি মূলত গদ্যের লোক। কিন্তু কবিতায় শ্রম কম, সম্মান বেশিÑ এ কারণে এদিকেও ঝুঁকে পড়ি।
বেলাল চৌধুরী সাহিত্য পত্রিকা কৃত্তিবাসের তিনটি সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সম্পাদকীয়তে বলেছেনÑ ‘তিনটি সংখ্যা কৃত্তিবাস সম্পাদনা করেছিলেন বেলাল চৌধুরী। যেহেতু চির বোহেমিয়ান, সেহেতু তার পক্ষে আর সম্ভব নয়।’ মদ্যপানের ব্যাপারে বেলাল চৌধুরী একদম খোলামেলা। এ ব্যাপারে তিনি রাখ-ডাক করার পক্ষপাতী নন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মদপানে আমি আনন্দ পাই। এতে কোনো দোষ নেই। এতে লোকে কে কী মনে করলো, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না।’
বেলাল চৌধুরী এই ৫৮ বছর বয়সেও সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে গুডবাই বলে সহাস্যে নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যেতে চান। এ সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি, ‘মনে হয় গেলেই পারি। বুকের বন্দরে তড়পায় চির বোহেমিয়ান বেলালÑ কতোকাল দেখা হয়নি হায় কতো কাল।’ কিন্তু পথের মাঝে এসে দাঁড়ায় স্ত্রী, সন্তান ও সংসারÑ ‘যেতে আমি দিবো না তোমায়।’ তিনি যেতে পারেন না।
১৪ মার্চ ১৯৯১
গৌরী আইয়ুব
আজ তারা কোথায় সব? এমন এক আকুল জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের গভীরে মর্মরিত হয় শূন্যতা, কেবলই শূন্যতা। দীর্ঘ ৪৭ বছরের ব্যবধানে ‘কিশোরী’র স্বপ্নমাখা চোখে খুঁজেছেনÑ ‘ঠোঁট ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে রোজ ভোরে দেখা দিত অন্যসব কাক আর শালিকের হৃষ্ট কোলাহলে’। ছেলেবেলার সে সাথীদের খুঁজে না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেনÑ ‘তারে আর দেখি না কো’। ফেলে আসা দিনগুলোর টানে অনেক অনেক দিন পর নিজ গ্রামে ছুটে গিয়েছিলেন গৌরী আইযুব। যদিও তিনি জন্মেছেন বিহারে; কিন্তু পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সিংরৈই গ্রামে। ১৯৪৪ সালে চলে যাবার পর এই এলেন। এ সম্পর্কে তাঁর অনূভূতিÑ ‘আমাদের গ্রামটা তখনও অখ্যাত ছিলো। কোনো বাড়-বাড়ন্ত ছিলো না। তবে গ্রামে একজন মুসলমান ও একজন হিন্দু জমিদার ছিলেন। হিন্দু জমিদারের চার শরিকের বসত-ভিটে ছিলো। তাঁদের এক শরিক ছিলাম আমরা। এখনো অবশ্য এক শরিকের বাড়ি-ঘর রয়েছে। তবে সেখানে আমাদের কেউ বসবাস করেন না। প্রজাদের একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে মনে হলোÑ ঠিক জায়গায় এসেছি। তিনি আমার পিতাকে চিনতে পারলেন। তাঁর কাছেই জানতে পারলাম দেশ ভাগের পরও আমার পিতা গ্রামে একাধিকবার এসেছেন। গ্রামের লোকজনের খুব আগ্রহ। তাঁরা আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বসতে বললেন। চা খেতে বললেন। কিন্তু তখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে। অন্ধকার হবার আগেই ফিরে এলাম। বেশিক্ষণ থাকা হয়নি। গ্রামের খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। ময়মনসিংহ শহরটা দেখে খুব হতাশ হলাম। শহরে কোনো পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। ময়মনসিংহের পরম সম্পদ ছিলো ব্রহ্মপুত্র নদী। শহরের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া এ নদীটির এক কূল থেকে আরেক কূল দেখা যেতো না। আর এখন কোথাও অগভীর পানি, কোথাও বালু, কংকর। খুবই করুণ! ঢাকায় জীবনে প্রথম এলেও শহরে বেশ প্রাণপ্রাচুর্য দেখতে পেলাম। চারদিকে নানা কিছু গড়ে উঠছে। পক্ষান্তরে ময়মনসিংহ শহরটাকে খুবই জীর্ণ, শ্রীহীন মনে হয়েছে। অবশ্য ময়মনসিংহে ছিলামই কয়েক ঘণ্টা। বাইরে থেকে দেখা। তা থেকেই আমার পর্যবেক্ষণ। তবে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একসময়কার আচার্যদের রাজবাড়ী বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুল হয়েছে দেখে ভালো লাগলো।’ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অনিবার্য মুখ, দর্শনের অধ্যাপিকা এবং খ্যাতিমান সাহিত্যিক আবু সায়ীদ আইয়ুবের সহধর্মিণী গৌরী আইয়ুব ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসেন। হঠাৎ এলেন? নাকি প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে আসা? এর জবাবে ৬০ বছর বয়স্কা গৌরী আইয়ুব জানালেন, ‘হঠাৎ আসিনি। কোনো কিছুই হঠাৎ করে আমি করি না। নেহাত বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আলাপচারিতা এবং ঝুট-ঝামেলা থেকে দূরে থাকার জন্যই এসেছিলাম। কিন্তু তা আর পারলাম কই! আপনাদের (সাংবাদিক) উপদ্রব লেগেই আছে। মাঝে মাঝে খুব বিরক্তিকর লাগে। একই কথা কতোবার বলা যায়? বিশেষ করে যে মানুষের কোনো কীর্তি নেই। আমি আমার স্বামীর আলোকে কতোবার দৃশ্যমান হবো? এই উপদ্রবটুকু বাদ দিলে এমনিতে ভালোই লাগছে। যতোটুকু প্রত্যাশা ছিলো, তার চেয়ে বেশি ভালো লাগছে। আমি তো খুব সচল লোক নই। তেমন একটা চলাফেরা করতে পারি না। লাঠি ঠেকিয়ে হাঁটতে হয়। এর মাঝে ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম গিয়েছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভৌত বিজ্ঞান কেন্দ্র ভালোই লাগলো। এটি গড়ে তুলছেন ড. জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি দীর্ঘ ২৮ বছর কেমব্রিজে থাকার পর বিজ্ঞান চর্চার আশায় দেশে ফিরেছেন। উনি আমার আত্মীয়। আমার স্বামীর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এছাড়া জয় পাহাড়ের একটি বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বাড়িটির নাম ‘সাবজারজার’। সবুজের প্রাচুর্য। এই বাড়ির মালিকও আমার আত্মীয়। তাঁর সঙ্গে অনেকদিন আমার চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তাঁর জীবদ্দশায় আসতে পারিনি।’
দুই বাংলার মধ্যে পার্থক্য কি?
‘আপাতঃ কোনো পার্থক্য নেই। থাকলেও হঠাৎ করে বলা যাবে না। তাছাড়া আমি উপলব্ধি করতে চাই আমি ঢাকা এসেছি। সেটাই অনুভব করছি। ভাষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পার্থক্য থাকবে। তবে যতোটা ভেবেছিলাম, তেমন একটা নেই। ঢাকার ভাষা বেশি বলা হবে ভেবেছিলাম। তেমন দেখছি না। যাঁদের সঙ্গে উঠছি, বসছি, থাকছিÑ অন্তত তাঁদের কথায় বেশি কোনো পার্থক্য পাচ্ছি না। মূলটা নিশ্চয়ই খানিকটা ঢাকার। ক্রিয়াপদ পশ্চিম বাংলার মতো। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে না ভেবে বলা যাবে না। কোনো কিছু না ভেবে আমি বলতে চাই না। তাছাড়া এ বিষয়ে আমি নিজেই লিখবোÑ এক্ষেত্রে আপনাকে সুযোগ দিতে চাই না।’
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তখন শান্তিনিকেতনে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের কথা জেনে আমরা দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হই। এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকতে পেরে এক ধরনের দুঃখবোধ হয়। তবে আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ যখন সে সময় কলকাতা যান, তখন নানারকম কাজে যুক্ত ছিলাম। তাছাড়া ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে মৈত্রেয়ী দেবী ‘নবজাতক’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। তাঁর সঙ্গে আমিও সংশ্লিষ্ট ছিলাম। ওই পত্রিকার মাধ্যমে এ বাংলায় কী ধরনের আন্দোলন চলছে এবং তাঁরা কী চানÑ এসব বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তীকালে মৈত্রেয়ী দেবী ‘পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সাহিত্য সংকলন’ বের করেন। তাঁর সঙ্গেও আমি যুক্ত ছিলাম। এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিষয়কে তুলে ধরেছি।’
‘রাজনীতির সঙ্গে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম না। তবে পাটনায় কিছুটা যোগাযোগ ছিলো, তাও অল্প সময়ের জন্য। শান্তিনিকেতনে এসে আর ছিলো না। রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত না থাকলেও রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা আছে। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তিÑ এ ধরনের কর্মকা-ে মাঝেমধ্যে সক্রিয় হতে হয়।’
গৌরী আইয়ুব মূলত দর্শনের ছাত্রী ও শিক্ষিকা। তিনি সাহিত্যের সঙ্গেও গাঁটছড়া বাঁধেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সেরকমভাবে সাহিত্য চর্চা বলতে গেলে করি না। সৃজনমূলক বা সৃষ্টিশীল সাহিত্যে আমার কোনো ভূমিকা নেই। কাব্য, উপন্যাসে যুক্ত নই। অল্প কিছু গল্প লিখেছি। মূলত প্রবন্ধ লিখি। তাতে সমাজ, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য থাকে। উল্লেখযোগ্য বই নেই। ৬০ বছর বয়সে বলা ধৃষ্টতা, তবুও বলছি... আমার পেছনে কোনো কিছু নেই। যা কিছু সামনেই আছে। অবশ্য আইয়ুবের ৬০ বছর বয়সে প্রথম বই বের হয়। আমি খুব কম প্রতিভা ও যোগ্যতা নিয়ে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।’
দুই বাংলার মহিলাদের সম্পর্কে গৌরী আইয়ুবের অভিমত, ‘বাংলাদেশের মহিলারা সার্বিকভাবে নিজেদের বিভিন্ন কর্মকা-ে নিযুক্ত করেছেন। নানাভাবে নতুন নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সন্তান প্রতিপালন, আতিথেয়তার পাশাপাশি অন্যান্য কাজ যোগ্যতার সঙ্গে করছেন। এ বাংলার মহিলারা অনেকগুলো কাজ দেরিতে করেছেন। এ কারণে উদ্দীপনা ও আগ্রহ বেশি। দুই বাংলার মহিলাদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য এইÑ এই বাংলার মেয়েরা সাংসারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আগেকার মতো। ঐতিহ্য থেকে সরছেন না। সামাজিক এবং যৌথ জীবন দুটোর দাবিই মেটাচ্ছেন। অন্যদিকে ওপার বাংলার মেয়েরা ‘আরবানাইজ’ হয়ে দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছেন। নাগরিক জীবনের প্রয়োজনে জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছেন।’
আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং বিয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শান্তিনিকেতনে আমি তাঁর ছাত্রী ছিলাম। সে সময় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। দীর্ঘ ছয় বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বিয়ে হয়। বিয়েতে অল্প-স্বল্প পারিবারিক বাধা ছিলো। সামাজিক কোনো বাধা ছিলো না। বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় বিয়েটা হয়। দু’জনের বয়সের পার্থক্য ছিলো। আইয়ুবের তখন ৪৪। আমার ১৯। বয়সের ব্যবধানটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর ধর্ম? ধর্ম তো সমাজগত। আমরা শুধু ধর্মটাকে বাইরে থেকে দেখতে পাই। তাছাড়া আমরা এমন কিছু ধর্মাচরণ করতাম না, যাতে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। অন্যরা আমাদের দেখে অবাক হতেন। আইয়ুব নিজে ধার্মিক ছিলেন। তিনি মনে করতেনÑ ‘ধর্মটা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ধর্ম শেখানো উচিত নয়। শিশুদের ধর্ম শেখানো মানে সাম্প্রদায়িকতা শেখানো।’ আমাদের সন্তানকে নির্দিষ্ট ধর্ম শেখাইনি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা তাদের ওপর কোনো ধর্ম আরোপ করবো না। তারা বড়ো হয়ে পছন্দমাফিক ধর্ম বেছে নেবে। এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি।’
গৌরী আইয়ুব অতিসম্প্রতি চাকরি (অধ্যাপনা) থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একদ- অবসরও পান না। মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে অনাথ আশ্রম ‘খেলাঘর’ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়া সারাক্ষণই তাঁর বাসায় আড্ডা লেগেই থাকে। তাই একটুখানি অবসরের আশায় ছুটে এসেছিলেন শৈশবের স্মৃতি জড়ানো এই বাংলায়। কিন্তু এখানেও বড্ড কোলাহল। ১৫ মার্চ গৌরী আইয়ুব চলে গেলেন
২১ মার্চ ১৯৯১


রাহাত খান
জেল্লাদার একটি ইনিংস উপহার দিলেন। বেপরোয়া ব্যাট চালিয়ে ‘হাফ সেঞ্চুরি-আপ’। এখন তিনি সংযত। দেখে-শুনে খেলছেন। বাউন্সারে বাউন্সারে হৃদয়খানি ক্ষত-বিক্ষত। তবে প্রয়োজনে জ্বলে ওঠেন। গত ১৯ ডিসেম্বর খসে গেলো জীবনের পাঁচটি দ্যুতিময় দশক। দেহখানি সেরকম বসে নেই আর। হৃৎপি-ে গড়বড়। বেশি কথা বললে হাঁপ ধরে বুকে। চলাফেরায় আঁটসাঁট শৃঙ্খলিত জীবন। ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। কিন্তু এখনো তিনি হার্ট টু হার্ট। কেননা, তিনি রাহাত খান। মনের দিক দিয়ে রয়ে গেছেন উজ্জ্বল, উচ্ছল, ঝকমকে। সজীব-সতেজ মন তাঁকে বেঁধে রেখেছে তারুণ্যে। তরুণদের সঙ্গেই তাঁর নৈকট্য। টাইট-ফিট ফেডেড জিন্স আর স্লিভলেস গেঞ্জিতে তিনি স্বচ্ছন্দ। বহিঃরঙ্গে নয়, অন্তরেও আধুনিক। এক কথায় ফ্রেমবয়েন্ট। কিশোরী থেকে গৃহিণীÑ সবার কাছে সমান আদরণীয়। বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা। অভিজাত থেকে প্রোলেতারিয়েত। লেখা ও পেশার সুবাদে সমাজের ওপরতলার আগাপাছতলা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। জেনেছেন মানুষের ছল, চাতুরি-ভ-ামি, হৃদয়ের টানাপোড়েন। তুলে ধরেছেন নির্দি¦ধায়। কলমখানি তাঁর অমূল্য সম্পদ। ষাটের দশকের গোড়াতে বাংলা গদ্য চলে যাচ্ছিলো বিমূর্ত রীতির দিকে। তখন যাঁরা এর বাঁক ফেরানোর চেষ্টায় হাল ধরেন, রাহাত খান তাঁদের অন্যতম। আজ অব্দি গদ্যের সেই ধারাই বহমান। কলমবাজি তাঁর নেশা, পেশা ও জীবন। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির কোনো কিছুই তাঁর নজর এড়ায় না। এ সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন রাখ-ঢাকহীন।
নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কথাশিল্পী ও সাংবাদিক রাহাত খান বলেন, ‘আমি স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতি সমর্থন করি। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। জামায়াতের সঙ্গে যারা যায়, তাদের বিশ্বাস করি না। কেননা, স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে জামায়াত তার দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকা পাল্টাবে বলে মনে হয় না। যতদিন তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করবে, ততোদিন তাদের মিত্র ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে বিএনপি এখন ক্ষমতায়। এটা বাস্তব সত্য। তারা চার/পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক। তারপর দেখা যাক তারা ভালো, না মন্দ।’
‘এবারের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণÑ তারা কতোগুলো বিষয় থেকে দূরে সরে গেছে। আত্মসমালোচনা ভুলে গেছে। ছাত্র, যুবক, মহিলা ফ্রন্টে কোনো পরিবর্তন নেই। প্রতিভাবান কোনো ব্যক্তিকে ঢুকতে দেয়া হয় না। ঘুরেফিরে পুরনো কথা বলা হয়। নতুন রক্ত সঞ্চালন না করলে, নতুন কথাবার্তা না বললে চলবে কী করে। তাদের খোলনলচে পাল্টাতে হবে। বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে আসতে হবে। বদলাতে হবে পুরনো ধারা। শেখ হাসিনাকে একা দোষ দেয়া উচিত নয়। পার্টি তো যৌথ নেতৃত্বের ব্যাপার। সেখানে সবার অংশগ্রহণ থাকতে হবে। কিছু লোক আছেন তাঁরা পরাজয়ের দায়ভাগ নেবেন না, অথচ পরাজয়ের কারণ স্বয়ং তাঁরাই। এঁদের সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্য পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজন হারিয়ে শেখ হাসিনা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এ কারণে একার পক্ষে তাঁর কিছু করার সম্ভব নয়। বহু লোক আছেন, যাঁরা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। তাঁরা বাম রাজনীতি করুন আর ডান রাজনীতি করুন, তাঁদের টার্গেট আওয়ামী লীগ। তাঁদের হাতে স্বাধীনতার স্তম্ভ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ টিভিতে সম্প্রচারিত হয় না। তাহলে স্বাধীনতার ইতিহাস থাকে কোথায়? এটা তো আওয়ামী লীগের একার নয়। সমগ্র দেশের। এ ব্যাপারে বিএনপির অনুকূল ভূমিকা থাকা উচিত। জাতির ইতিহাস বাদ দিয়ে কি বিএনপি রাজনীতি করবে? আজ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি বিষয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। ’৫২ থেকে ’৭১Ñ এদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের প্রতিটি পর্বকে বিতর্কের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এর পরিণতি ভয়ঙ্কর। রাজনীতি খুব সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিশেষ মহল নিজেদের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে খেলো করে তুলেছেন। এসব খুবই ক্ষতিকর। অন্ততপক্ষে কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। মনগড়া কথাবার্তা কখনো ইতিহাসের উপাদান হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা হীনমন্যতা। তিনি জাতির জনক। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁকে স্বীকৃতির প্রশ্নে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। জাতীয়ভাবে তাঁর জন্ম-মৃত্যু দিবস পালিত হওয়া উচিত।’
সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে রাহাত খান বলেন, ‘এ দেশ খুবই দরিদ্র। দরিদ্র ব্যক্তির সমাজ, সংস্কৃতি নেই। কোনো সংস্কৃতিবোধ থাকে না। একে তো দরিদ্র সমাজ, খাওয়া-পরার চিন্তাতেই সব সময় চলে যায়। এ কারণে স্থায়ী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এজন্য সমাজে বিচিত্র মানুষ নেই। সমাজের অগ্রগতি হচ্ছে না। সময়ের সঙ্গে গতি রাখতে হবে। কিন্তু সেই গতি নেই।’
‘মূল্যবোধ? ভিক্ষুকের আবার কিসের মূল্যবোধ? মধ্যবিত্তদের অধিকাংশই বেপথু। একটা কোটরে বাস করে।’
তরুণ-তরুণীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এদেশের তরুণ-তরুণীরা খুবই চমৎকার। তাদের তারুণ্যবোধ পৃথিবীর যে কোনো দেশের মতো। এদের গাইড করা গেলে পরম সম্পদ হিসেবে গণ্য হতো। এক্ষেত্রে দায়িত্ব সবার। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। কারো একার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তরুণ-তরুণীরা যতো বিদেশ যাবে, ততো ভালো। সুযোগ? সহজেই কেউ সুযোগ পায় না। সুযোগ করে নিতে হয়।’
মানুষ সম্পর্কে রাহাত খানের অভিমত, ‘এক হিসেবে মানুষ খুব বিচিত্র জীব। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা, শ্রেয়বোধ মানুষকে কতগুলো সীমাবদ্ধতার মাঝে রাখার চেষ্টা করছে। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা চেহারা দাঁড়িয়েছে বটে। সীমাবদ্ধতা মানুষকে শাসন করে ঠিকই, মানুষ সে শাসন মানতে চায় না। সে চায় মুক্তি।’
নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার পেশা নেহাত মন্দ নয়। সাংবাদিকতা একটা চ্যালেঞ্জিং জব। তাছাড়া লোকজনকে জানা যায়। তাহলেও জীবিকার তাগিদে যা করি, সুযোগ থাকলে করতাম না। সারাদিন লিখতে ও পড়তে পারলে খুশি হতাম।’
নিজের সম্পর্কে রাহাত খানের মূল্যায়ন, ‘আমার ধারণা, আমার মতো লোক যারা মৌলিক চিন্তা-ভাবনা করে, তারা ভুল বোঝার শিকার হয়। এজন্য আগে দুঃখ পেতাম। এখন আর পাই না। সত্য অপ্রিয়। তা লিখতেই হবে। সত্যকে সব সময় প্রকাশ করতে নেইÑ এটা কোনো সময় আমি ভাবিনি। এ কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরাগভাজন হয়েছি। কি করছি, অনেক সময় বুঝি না। সমাজ যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে পারলে হয়তো সামাজিকভাবে আরো জনপ্রিয় হতে পারতাম। তবে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। লেখাটাই আসল। ভালো লিখতে পারলে অন্য কিছুতে যায় আসে না। অবশ্য আরো ভালো কাজ করা যেতো। কিন্তু যে সমাজে জন্মেছি, সেখানে সব সময় একটা পিছুটান। কোথাও নড়তে দেয় না। কেউ কাউকে উঠতে দেয় না। চারপাশেই বন্ধন। কোনো প্রশংসা নেই। মৌলিক চিন্তার স্বীকৃতি নেই।’
নারী সম্পর্কে ‘নারী প্রেমিক’ রাহাত খান বলেন, ‘এই সমাজ এতো ছোটো যে, বড়ো কথা বলা যায় না। তবে নারী প্রকৃতির মতো। তারা মর্যাদা পাবার যোগ্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের মর্যাদা দেই। নিজে পারিবারিকভাবে আমি সুখী জীবনযাপন করছি। আমার ৩ ছেলে, ১ মেয়ে। ১ ছেলে ১ মেয়ে স্টেটস-এ থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দেশ-বিদেশ ঘুরেছি, কাজ করছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুমাচ্ছি দু’বেলা, চকচকে ব্লেডে শেভ করছিÑ সব মিলিয়ে একপ্রকার ভালোই আছি।’
রাহাত খান সম্পর্কে মেয়েদের পক্ষপাত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যে কোনো প্রতিভাবান লোককেই মেয়েরা পছন্দ করে। তবে সামগ্রিক অর্থে মেয়েরা সবাইকে পছন্দ করে না। কাউকে করে, কাউকে করে না। দেখা যায়, অনেক কুৎসিত লোকের প্রতি সুন্দরী মহিলাদের বেজায় টান। আবার অনেক হ্যান্ডসাম যুবকের দিকে মেয়েরা ফিরেও তাকায় না। এটা এক রহস্য। এই রহস্যের থই কোথায় আমার জানা নেই।’
২৮ মার্চ ১৯৯১


আতাউস সামাদ
মিটিং-মিছিলে সরব নন। টিভি কিংবা চলচ্চিত্র পর্দায় তাঁকে দেখা যায় না। নেপথ্যে বসবাস, তবুও তিনি আছেন সর্বত্র। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। লাখো মানুষের অন্তরে, ভালোবাসায়, বিশ্বাসে, নির্ভরতায়। ‘সত্য বাবু’ মারা গেলে তিনি হন সত্যের উৎস। সকালে, সন্ধ্যায়, সায়াহ্নে। বেতার তরঙ্গে ছড়িয়ে যায় তাঁর ভাষ্য। রেডিও খুলে সংখ্যাহীন কান ও মন উদগ্রীব থাকে তিনি কি বলেন জানার জন্য। তাঁর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় সংবাদ-তথ্য। তিনি কখনই উস্কে দেন না। বাস্তব ঘটনা তুলে ধরেন। কাছের মানুষ তিনি। কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসে তাঁর কণ্ঠ। তাঁকে চেনেন খুব কম লোকই। তাঁকে জানেন নাÑ এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি নেই। কৃষক, শ্রমিক, মাঠ-মজুর থেকে সব শ্রেণীর মানুষ। বিবিসি’র আতাউস সামাদ। এর বেশি বলার প্রয়োজন পড়ে না। ভয়-ভীতি-প্রলোভনে তাঁকে টলানো যায়নি। যায়নি তাঁর কলম ও কণ্ঠকে স্তব্ধ করা। জুলুমের শিকার হয়েছেন। জেলে গেছেন। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি থেকেছেন অবিচল। ১৯৫৬ সালে সচিত্র সন্ধানী থেকে আজকের বিবিসি। বরাবরই নীতির প্রশ্নে আপোষহীন। একজন প্রকৃত সাংবাদিকের প্রতিকৃতি তিনি। সে সঙ্গে একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড। রুচিবান, পরিশীলিত মানুষ। কাজের প্রতি নিবেদিত। সারাক্ষণই ব্যস্ত। তবে তাঁর যাবতীয় কর্মকা- সাংবাদিকতাকে ঘিরে। প্রতিটি মুহূর্তই তাঁকে থাকতে হয় সজাগ, সতর্ক ও সচেতন। এর মাঝে তাঁকে দু’দ- স্থিরভাবে পাওয়া সত্যিই কঠিন। তাঁর সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট করতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে তাৎক্ষণিকভাবে কথা হয়ে যায়।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আতাউস সামাদের মূল্যায়নÑ ‘রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রত্যাশা ছিল সার্বিক অর্থে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা। এরশাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ছিল এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করার। সংসদ নির্বাচনের দু’মাস হতে চললো। এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বোঝানো হয়ে থাকে। এটা হলে ভালো। তবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিএনপির যদি বিশ্বাস থাকে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে কিংবা রাষ্ট্রপতি ও সংসদের কাছে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে অথবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়Ñ তাহলে এ ব্যাপারে তাদের উচিত হবে তারা কি ব্যবস্থা চায় পরিষ্কারভাবে বলা। অন্যদের উচিত হবে বিএনপির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা। সংসদীয় গণতন্ত্রকামী দলগুলোকে বিএনপির দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে এবং সেই দুর্বলতাগুলো বিএনপি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেÑ সে সম্পর্কে তাদের কাছে জানতে চাওয়া। বিরোধিতার খাতিরে পরস্পরের বিরোধিতার মনোভাব বাদ দিয়ে এ ধরনের আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়ে গণতন্ত্র চর্চার বিকাশ ঘটাতে হবে। ’
‘আমার মতো যারা, যাদের দল নেই এবং সব সময় গণতন্ত্র চেয়ে আসছি, তার সংসদে আলোচনা, জনমতের প্রতিফলন দেখতে চাই। এতে অনেক বিযয় পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে তত্ত্বের নয়, তথ্যের ভিত্তিতে। ১৯৭২ সালের সংবিধান দেখে দেশে-বিদেশের অনেকেই বলেছেন চমৎকার সংবিধান। কিন্তু কোন দুর্বলতার কারণে, জনমত যাচাই না করে হঠাৎ একদলীয় পদ্ধতি কেন প্রবর্তন করা হলো? সারা জীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করে এমন উল্টোমুখী পরিবর্তনের কারণ কি? বর্তমানে চলছে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি। এটা স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্ম দেয়। একজনের কাছে সব ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ফ্রান্স কোনোটারই কাছাকাছি নয়। কোনো মিল নেই। এর ফলে স্বৈরাচারী লোকেরা বিদ্যমান পদ্ধতিতে ব্যাপক সুবিধা পেয়ে থাকে। একনায়কতন্ত্র কী করে সম্ভব? সংবিধানের ধারাগুলোতে আইনের যে বিধান আছে, যে নিয়ম আছে, তাতে কি করে এক ব্যক্তির শাসন কায়েম হয়Ñ বিএনপিকে সৎ মনোভাব নিয়ে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা, বিএনপির সদিচ্ছা ছাড়া সংবিধান সংশোধন কার্যত সম্ভব নয়। বিরোধী দলগুলোকে ‘অনেস্ট এপ্রোচ’ নিয়ে বোঝাতে হবে। খোলা মনে সংবিধানের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। সবাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। কিন্তু সংবিধানে গণতন্ত্র না থাকলে গণতন্ত্র আসবে কোথা থেকে? বর্তমানে সংসদকে সবার ওপর রাখার চেষ্টা চলছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কোনো হস্তক্ষেপ করছেন না। সংসদীয় রীতিনীতিকে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়নি। এজন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। নির্বাচনের সময় তাঁরা একে অপরের প্রতি দুঃখজনক যে প্রচার-পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তা ভুলে যেতে হবে। দেশ ও দশের কথা ভাবতে হবে। নিজেদের মধ্যে বাড়াতে হবে যোগাযোগ। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে যাঁরা গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন, যতোটুকু সম্ভব তাঁদেরও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারীÑ সবার উচিত দলাদলি, ঠেলাঠেলি বাদ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শরিক হওয়া। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলবো, অন্যের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেবোÑ এটা হতে পারে না। একে অপরকে সাহায্য করা এখন সবচেয়ে জরুরি।’
নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে আতাউস সামাদ বলেন, ‘আমি চাই গণতন্ত্র। সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা সব নাগরিকের জন্য নিশ্চিত হোক, সেটা চাই। জীবনে উন্নতির সুযোগ সবাই যেন পায়, সেটা চাই। এজন্য প্রথম ধাপে রাজনৈতিক দলগুলো মুখে যা বলে, যে কর্মসূচি তুলে ধরে, প্রকৃতপক্ষে সেটা পালন করতে হবে। কাজেও সেটা দেখাতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। যাঁরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, তাঁরা নিজেরা সরকারের কাছে থেকে এবং দেশের কোষাগার থেকে ব্যক্তি কিংবা ব্যবসায়ী মহলের জন্য কোনো অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা কিংবা বেআইনিভাবে কাউকে লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন নাÑ এমন প্রতিশ্রুতি কাজে-কর্মে থাকতে হবে। বর্তমানে কোথাও বিনিয়োগ হচ্ছে না। কর্মকা- সবটাই রাজধানীকেন্দ্রিক। অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ। জাতীয় সম্পদ যা আছে, শুধুমাত্র বিনিয়োগটাই যদি বাংলাদেশজুড়ে হয় অর্থাৎ ঢাকার আপাতঃ প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে বাদবাকিটুকু রাজধানীর বাইরে কাজে লাগানো হয়, তাহলে দেশটা সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে। সে সঙ্গে মানুষকে আত্মনির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে নেয়া গেলে জীবনযাত্রার ধারা পাল্টে যাবে। কোথাও থেকে অন্তত শুরু করতে হবে।’
সামাজিক অবক্ষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গাদাগাদি করে থাকলে, ভদ্রভাবে বেঁচে থাকতে না পারলে অবক্ষয় তো হবেই। লোকসংখ্যার চাপে, দলাদলির সুযোগে অযোগ্য ব্যক্তিরা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন। তাঁরা দেশকে শেখাবেনই কি, আর দেবেনইবা কি। এ অবস্থার পরিবর্তন কঠিন। রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি যোগ্য ব্যক্তিকে মর্যাদা দেন, তাহলে উদাহরণ ও চাপ সৃষ্টি হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় সুযোগ সন্ধানীদের জন্য ভালো সুযোগ রয়েছে। কিছু করার নেইÑ এমন লোক বেশি। যাঁরা দল ভারি করতে পারেন, তাঁরাই বিভিন্ন জায়গায় বসছেন।’
বর্তমান জেনারেশন সম্পর্কে আতাউস সামাদ বলেন, ‘এই জেনারেশন সম্পর্কে আমি খুব আশাবাদী। গেল নভেম্বরের শুরুতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। তারা মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের দাপটের মুখে রুখে দাঁড়ায়। এসময় নতুন নতুন মুখ দেখতে পাই। এসব ছেলে সাধারণত মিটিং-মিছিলে আসে না। তারা মনের ভেতর থেকে পরিবর্তনের জন্য তাগিদ অনুভব করতে থাকে। তখন বুঝতে পারি এরশাদ সরকার টিকবে না। আমরা জীবনভর যা দেখে এসেছি, তার সঙ্গে এদের মিল খুঁজে পেয়েছি। ওদের রক্তের স্রোত যেভাবে চলছে, এক সময় আমাদেরও সেভাবে চলেছে। তবে আমাদের জেনারেশন সম্পর্কে আমি খুব নিরাশ। আমরা আত্মকেন্দ্রিক হলাম। গুটিয়ে গেলাম। কেউ কেউ হলো সুযোগ সন্ধানী। দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর কমে গেলো। আত্মার প্রসারতাও কমে গেলো। ক্রমশ হোঁচট খেতে থাকলাম। আমাদের পরের যারা, তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সমঝোতা হয় না। ফারাক রয়ে যায়। আমরা অল্পতে তুষ্ট হয়ে পড়ি। চাওয়ার আশা কম। এ কারণে আমরা কোনো অবদান রাখতে পারি না।’
এদেশের মানুষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এমন উষ্ণ-হৃদয় মানুষ কম পাওয়া যায়। হৃদয়ের উষ্ণতা, দিলখোলা মন। অসম্ভব সাহসী। দুর্যোগ- দুর্বিপাকেও হাসতে পারে। একটু বেশি আবেগপ্রবণ। অবশ্য এই আবেগটুকু আছে বলেই শত বঞ্চনার মাঝে বেঁচে আছে তারা। দেশের মানুষকে আমি খুব ভালোবাসি।’
নিজের সম্পর্কে আতাউস সামাদের মূল্যায়নÑ ‘আমার প্রতিদিন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। যখন যেভাবে থাকি ভালো থাকি। দায়িত্ব থাকলে চিন্তা করি। হাতের কাজ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগে থাকতে হয়। এমনিতে আমি কোনো কেয়ার করি না। ওপরে ওঠার জন্য মাথাব্যথা নেই। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। তাই যথেষ্ট উড়নচ-িও বলা যেতে পাারে আমাকে। আমি অত্যন্ত সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারলে সুখী। কাজের প্রশংসা যেটা শুনতে পাই, আমার পাওনার চেয়ে বেশি মনে করি।’
পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সাংসারিক জীবনে আমি সুখী। পরিবারের জন্য যে সময় দেয়া প্রয়োজন, তা আমি দিতে পারি না। আমার কাজের চাপের কারণে আপনজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কঠিন ব্যাপার। এক্ষেত্রে আমার স্ত্রী ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। তাঁর জন্য আমি গর্বিত।’
দুই কন্যা, এক পুত্রের জনক আতাউস সামাদ নারী সম্পর্কে বলেন, ‘নারীদের আমি খুবই সম্মান করি। কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের আমি আলাদা করে দেখি না। ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে মেয়েরা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের পিছিয়ে থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক।’
২ মে ১৯৯১
শামসুজ্জামান খান
ঘুড়ির সুতা যেন ছিঁড়ে গেছে। দেশ-কাল-সময় বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি। জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে : খাও-পিও-স্বস্তি করো। টেইলর মেড লাইফ। চারপাশে অসংখ্য মানুষ। ছড়ানো-ছিটানো। নানা বর্ণের। নানা ধর্মের। নানা মনের। সারি সারি মানুষ। থৈ মেলা ভার। কিন্তু সব যেন এক পালকের পাখি। প্রত্যেকেই বারুদে ঠাসা। অস্থির, অসহিষ্ণু। আগুনের শিখার মতো লকলকে। একটুখানি টোকা লাগলেই চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার। চলতে-ফিরতে বড্ড ভয়! সংশয়! না জানি মাড়িয়ে যায় কার পা। নগর সভ্যতার উৎকট আবহাওয়ায় বন্দি সবাই। দিনযাপনের গ্লানি আঁচড় কাটছে নগর মানুষের দেহে, মনে। এও তো এক ধরনের নার্সিসাস কমপ্লেক্স। চেনা মানুষকে মনে হয় অচেনা। অনেক দূরের। পাশের মানুষকে দেখা দূরের মানুষকে দেখার চেয়ে অনেক কঠিন। এ তো গেলো সামগ্রিক আশাভঙ্গের কথা। পক্ষান্তরে, মেঘের পাশ থেকে বের হয় আলোকচ্ছটা। এমন কিছু মানুষ আছেন, অন্ধকার যাঁদের আড়াল করতে পারে না। সময়ের কামড় পারে না দংশাতে। জীবন দর্শনের শিকড় তাঁদের হৃদয়ের অনেক গভীরে গাঁথা। এই অবিশ্বাস ও সংশয়ের সময়ে তেমন একজন ব্যক্তি শামসুজ্জামান খান। ব্যক্তিগত জীবনে বাংলা একাডেমীর সিনিয়র পরিচালক। কর্মজীবনে, অভিজ্ঞতায় হরেক পরিচয়ে বাঁধা। সেসবের আড়ালে তিনি জীবন, সময় ও সমাজ সচেতন মানুষ। অন্তরে দুরন্ত সৌন্দর্য পিপাসা। সে সঙ্গে জীবন-সত্যের অনে¦ষক। জীবনযাপনেও ছন্দোবদ্ধ। রুচি ও সৌন্দর্যের ছোঁয়া লাগানো। তবে নীতির প্রশ্নে অটল। ১৯৬৮ সালের সেই উত্তুঙ্গ সময়ে, জগন্নাথ কলেজ সরকারিকরণের প্রতিবাদে অজিত কুমার গুহ ও রাহাত খানের সঙ্গে একযোগে সহকারী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেননি। তিনি বিশ্বাস করেন যুক্তি-তর্কে, অনুসন্ধিৎসায়, বিজ্ঞানে ও গণতান্ত্রিক চেতনায়। নিজেকে তিনি বাঙালি পরিচয়ে ভালোবাসেন। এ কারণে তাঁর ওপর বয়ে গেছে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা। এতে তিনি মোটেও বিচলিত নন। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আপোষহীন। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তাঁর কলমও এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে সরব। ভাষার ঐশ্বর্যে ঋদ্ধ প্রবন্ধগুলোতে প্রতিফলন ঘটে তাঁর উদার সংস্কৃত মনের। সব মিলিয়ে তাঁর সমান আগ্রহ। কোন্টি নয়? সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, প্রেম মায় সেক্স অব্দি। তাঁর নিজের কথায় : ঔধপশ-ড়ভ-ধষষ-ঃৎধফবং নঁঃ সধংঃবৎ ড়ভ হড়হব.
প্রতিক্রিয়াশীলদের হিংস্র নখর কেন আপনার দিকে বাড়ানো?
‘বিশেষ কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে আমি একজন সাধারণ সংস্কৃতিকর্মী। এ কারণে আমার কিছুটা সাংগঠনিক শক্তি আছে। সেটা তাদের জন্য অসুবিধাজনক। তাছাড়া আমার মৌল চিন্তার বিষয় ভাষা আন্দোলন। আমি মনে করি, জাতীয় চেতনায় বিকশিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক চেতনা, গণমানুষের রাষ্ট্র চেতনা, বাঁচার জন্যও আলাদা উদ্বেগ। এটা পশ্চিম বাংলায় নেই। এ কারণে আলাদাভাবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বলার প্রয়োজন দেখি না। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানের মতো একটি খ-িত ভাবনা থেকে উদ্ভূত, যার সঙ্গে গণমানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আশা-আকাক্সক্ষার মিল নেই। নৃতাত্ত্বিকভাবে আমরা বাঙালি। বাঙালিত্বকে মুছে দিয়ে জাতীয়তাবাদী ধারা বজায় থাকে না। সে সঙ্গে আমি গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী। যুক্তিতে, বিজ্ঞানে এবং ধর্মেও বিশ্বাসী। তবে ধর্মটা আমার কাছে স্থবির কিছু নয়। মহাকবি ইকবাল বলেছেনÑ সেই প্রকৃত মুসলমান যিনি অনবরত অনুসন্ধানে জড়িত থাকেন। সম্ভবত এসব কারণে আমি কারো কারো চক্ষুশূল। তবে আমার জীবনীশক্তি প্রচ-। মুষড়ে পড়ি না। কেননা প্রতিপক্ষের নৈতিক বল নেই। এ কারণে আমি আমার বিশ্বাস থেকে একচুল নড়ি না।’
মৌলবাদীদের উত্থান?
‘এ বিযয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। তাদের উত্থান আমাদের সামাজিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিকশিত নয়। এদের উত্থানের কথা বলা হচ্ছে বটে। এর কারণ কিছুটা নেতিবাচক, কিছুটা অর্থনৈতিক। প্রথমত, মৌলবাদী সংগঠনে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের প্রায় সবাই বেতনভোগী। দ্বিতীয়ত, এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাবার সুযোগ ঘটে। অতএব আদর্শগতভাবে এবং দেশের মূল সাংস্কৃতিক চেতনার মধ্য দিয়ে মৌলবাদের বিকাশ ঘটেনি। নির্বাচনে বেশি সিট পেয়েছে বটে, তা অনেকাংশ নেতিবাচক এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে। তাছাড়া এখানকার সংস্কৃতি ছিল মিশ্র। এখনো তাই আছে। এই সংস্কৃতি মৌলবাদকে গ্রহণ করে না। কবি রফিক আজাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় : এখানকার ধর্মপ্রিয় মানুষ মৌলভী সাহেবকে গাছের প্রথম ফলটি দেয়। মুরগি জবাই করলে কল্লাও হয়তো দেয়। কিন্তু দুটো জিনিস দেয় না। এক. ভোট। দুই. মেয়ে বিয়ে। কবির এই উক্তিতে সত্য আছে।’
গণআন্দোলনে সম্প্রতি রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। পতন ঘটেছে এরশাদ সরকারের। শামসুজ্জামান খান মনে করেনÑ স্বৈরাচারের পতন একদিন না একদিন হয়ই। এটা অনিবার্য ছিল। তবে তিনি বলেন, ‘অবিলম্বে দেশের মূল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। সরকার পদ্ধতি নিয়ে যে অস্পষ্টতা, অনিশ্চয়তা ও সিদ্ধান্তহীনতা বিরাজ করছেÑ তা গোটা জাতিকে শঙ্কা ও সংশয়ের মধ্যে রেখেছে। এ অবস্থা জনগণকে হতাশা, বিভ্রান্তি ও লক্ষ্যহীনতার মধ্যে ফেলতে পারে। ফলে জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সরকারের প্রতিও আস্থাহীনতা দেখা দিতে পারে। তাই জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে সরকার পদ্ধতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। তাছাড়া সরকার ও বিরোধী দল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় এলে সরকার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের সুরাহা হতে পারে। অবশ্য সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকারি দল রাজি হলে সহজতর। অন্যথায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। গণতন্ত্র টিকে থাকে এবং বিকশিত হয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দিলে, জনমতকে সংহত হওয়ার সুযোগ দিলে। পরমতসহিষ্ণুতা এর অন্যতম শর্ত। ক্ষুদ্র ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মতামত, চিন্তা-ভাবনা ও আশা-আকাক্সক্ষাকেও পূর্ণ মূল্য দিতে হবে। তবেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।’
আপনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার?
‘এক্ষেত্রে কিছুটা দুঃখবোধ রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সবশেষে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সফল হয়েছি। কিন্তু এখনো শক্তিশালী, বিচক্ষণ, প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক শক্তি ও সামাজিক সংগঠনের অভাবে আমরা সুফল ঘরে তুলতে পারিনি। অথচ বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ উপমহাদেশে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। যেমন ভাষা আন্দোলন। এর মাধ্যমে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশই শুধু নয়, এ উপমহাদেশের দুটি দেশ পাকিস্তান ও ভারত ধর্মীয় ভিত্তিতে ভাগ হলেও বাংলাদেশ প্রকৃত ভৌগোলিক ও জাতিতাত্ত্বিক ধারায় গড়ে উঠেছে। আমাদের এই রাষ্ট্রটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ, সেহেতু এই উপমহাদেশে অনন্য।’
সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘নিজের কাছে এটাকে বড়ো একটা সমস্যা মনে হয় না। তার কারণ বিশ্বের প্রযুক্তিগত বিপুল উন্নতি ঘটেছে। তথ্য মাধ্যমের বিপুল বিস্তার ঘটেছে। পৃথিবীব্যাপী সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া খুবই দ্রুত ঘটছে। সেজন্য কোনো জাতির সংস্কৃতি এখন অটুট নেই। কবি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেনÑ ঈশ্বরগুপ্ত ছিলেন খাঁটি কবি। শেষ বাঙালি কবি। এখন আর খাঁটি বাঙালি হওয়া সম্ভব নয়। উনবিংশ শতাব্দীর বেঙ্গল রেনেসাঁ বঙ্গসমাজের শিক্ষিত সমাজে বহুল পরিমাণে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভাবিত হয়ে গেছে। শিক্ষিত নাগরিক যতখানি বাঙালি, ঠিক ততখানি বিশ্ব নাগরিক। প্রযুক্তি ও তথ্য মাধ্যমের কল্যাণে যে কোনো তরঙ্গ আমাদের সমাজের ওপরের স্তরে ঢেউ তোলে। অবশ্য এক সময় তা থিতিয়ে যায়। প্রত্যেক দেশের সাংস্কৃতিক কাঠামো থাকে। গ্রহণ-বর্জনের ক্ষমতা থাকে। যতটা গ্রহণ করে, ততটা থাকে। সামাজিক শ্রেয়বোধ, সমষ্টিগত রুচি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কোনো কিছুই সহজে গ্রহণ করে না। তবে নির্যাসটুকু, ভালোটুকু গ্রহণ করে লাভই হয়। সেজন্য অবক্ষয় নিয়ে চিন্তিত নই।’
বর্তমান জেনারেশনের উচ্চ প্রশংসা করে শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘এরা আমাদের জেনারেশনের চেয়ে বেশি সজাগ ও সচেতন। সামাজিক, জাতীয় সংকটে, বিপর্যয়ে তরুণ সমাজের অসাধারণ দেশপ্রেম ও তীক্ষè সামাজিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের এগিয়ে যাবার মানসিকতায় আমি দারুণ আশাবাদী। তরুণরা বর্তমানে কিভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার ফলাফল আগামী জেনারেশনে দেখা যাবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমন¦য়ই শ্রেষ্ঠ মানুষ তৈরি করতে পারে। আধুনিক বিশ্বের শিক্ষা হবে উদারনৈতিক। শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতিবান হতে হবে। বিচিত্র বিষয়ে জানতে হবে। তার চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে মানুষই ‘সবচেয়ে সেরা, মানুষই সবচেয়ে সুন্দর’। কোথাও মানুষের ওপর নিপীড়ন চলবে না। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগ, বিজ্ঞান চেতনা, যুক্তিবাদ, গণতান্ত্রিক চেতনা, মানুষের প্রতি আস্থা, শ্রদ্ধাÑ এটা হবে আধুনিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এর হাত ধরাধরি করে আসে তরুণ-তরুণীদের সমস্যা। এদেশের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর জন্য উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়নি। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা মন্থর বলে তাদের খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ও দারুণভাবে অবহেলিত হচ্ছে। তরুণ সমাজের সুস্থ মানসিকতার বিকাশের জন্য আনন্দ চাই। বিনোদন চাই। কিন্তু এর কোনোই সুযোগ নেই। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তরুণদের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকে এই সমাজ ব্যবস্থা শোষণ করছে।’
নারী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সুশিক্ষিত এবং মাতৃত্বসচেতন নারী সমাজ ছাড়া প্রকৃত অগ্রগতি আশা করা যায় না। এখানে তারা নানাভাবে অবহেলিত। তাদের কাজের পরিবেশ নেই। সুস্থভাবে বাঁচার পথ নেই। সুন্দরের সাধনা বা সামাজিক অগ্রগতিতে অবদান রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে ইদানীং কিছুটা পরিবর্তন ঘটছে।’
পঞ্চাশ উত্তীর্ণ শামসুজ্জামান খান প্রেমের ব্যাপারে রাখ-ঢাকহীন। এ সম্পর্কে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমি সামাজিক বিধি-নিষেধ ও কঠোর প্রতিবন্ধকতার মাঝে প্রেম করে বিয়ে করেছি। আমি মনে করি প্রেম করেই বিয়ে হওয়া উচিত। এমনকি তা যদি তিক্ত হয়, তবুও। কারণ এটি ঘটে দু’জন মানুষের চিন্তা-ভাবনার সংযোগ, সমন¦য় এবং মনের লেন-দেনের মাধ্যমে। তাতে কারোই আপত্তি থাকা উচিত নয়।’
আর সেক্স?
‘সমাজ যে পর্যায়ে ‘লাইসেন্স’ দেয়, সেই পর্যায়ে থাকাটাই কাম্য। তবে এর ব্যতিক্রম থাকে। অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী-সাহিত্যিকরা সেক্স নিয়ে যা করেন, সমাজ তাতে কিছু মনে করে না। তাছাড়া এলিট কাসের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো নিয়ম-কানুন নেই। এলিট বা এলিনিয়েটেড রিচ কাসে মূল্যবোধের ব্যাপারটা সীমিত পরিসরে। তারা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। এখানে সমাজের নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে যৌন বিষয়টা জীবনের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় শিক্ষা থাকা দরকার। যৌন ক্ষেত্রে কোনোরকম বঞ্চনা কিংবা নিপীড়ন থাকা উচিত নয়। সমাজের এটা দেখা দরকার।’
নিজের সম্পর্কে শামসুজ্জামান খানের মূল্যায়নটা এমন : ‘আমি যে কাজ করছি, তা নিয়ে সুখী বলা সম্ভব নয়। আরো অনেক কিছু করার প্রয়োজন ছিল। উচিতও ছিলো। ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধার অভাবে তা করা সম্ভব হয়নি। আমি যেক্ষেত্রে কাজ করছি, সেক্ষেত্রে হয়তো আরো ভালো, পরিমাণগতভাবে বেশি কাজ করা সম্ভব হতো। আমার একটা অসুবিধা এই, আমি বহু বিষয়ে উৎসাহী। সংস্কৃতি, ফোকলোর, ভাষা-সাহিত্য, ফুটবল, সমাজ, রাজনীতি নানা বিষয়। এত বিষয়ে নজর দিয়ে কোনো বিষয়ের প্রতি হয়তো সুবিচার করতে পারিনি। তবে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আমার কিছুটা দক্ষতা রয়েছে। এ ব্যাপারে আমি আস্থাবান।’
বাংলা একাডেমীর দায়িত্ববান চাকুরে, বেশ কিছু গ্রন্থের প্রণেতা শামসুজ্জামান খান তিন কন্যার জনক। তিনি কখনো তাঁর কন্যাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। তারা স্বাধীন ও নিজেদের ইচ্ছানুসারে জীবনযাপন করছে। বড় মেয়ে সরণি জামান। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতি পড়ছে। মেঝো মেয়ে সেঁজুতি জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী এবং নওশুরীন লুদমিলা জামান চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। সব মিলিয়ে শামসুজ্জামান খান আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা।
দীর্ঘ আলাপের শেষে এসে তাই শেষ প্রশ্নটি ছিলোÑ আপনি কি সুখী?
‘সাধারণভাবে আমি সুখী। সেটা পারিবারিক পর্যায়ে এবং আংশিকভাবে সামাজিক পর্যায়েও। কিন্তু যখন আমি সব মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ চাই বা সমাজের সুস্থ বিকাশ চাই বা আইন বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খখলার প্রতিষ্ঠা চাইÑ তখন পূর্ণ সুখী হওয়া সম্ভব হয় না।’
৯ মে ১৯৯১
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী
গান এখন যতোটা না শোনার, ততোটাই দেখার। হট মিউজিক। উদ্দাম বিট। তালে তালে হল্লা। দেহের হিল্লোল। নিতম্ব, কটি, বক্ষ, চিবুক, ঠোঁট মিশে যায় জোড়ে জোড়ে। ছড়িয়ে পড়ে উগ্র ফরাসি সুগন্ধ। খিলখিল হাসি। মায়াবি রঙধনু আলোয় ভেসে আসে ম্যাডোনার ‘রেসক্যু মি’ কিংবা রড স্টুয়ার্টের ‘রিদম অফ মাই হার্ট’-এর অনূকরণে পাঁচমিশালী কোনো গান। ব্যসন এবং উত্তাপের ছড়াছড়ি। পশ্চিমা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যাওয়া। স্বপ্নেরা নিলাম হয়। হৃদয় স্পন্দিত হয়। কিন্তু গান? তাকে পাওয়া যায় না কোথাও। জলসায়, চলচ্চিত্রে, টিভিতে, ক্যাসেটেÑ সর্বত্রই ভঙ্গি দিয়ে ভোলানোর প্রয়াস। সঙ্গীতের নামে জগঝম্প। ইদানীং গান আর বুকের মাঝে স্থিতি পায় না। ক্ষণিকের জন্য বুদ্বুদ তুলে মিলিয়ে যায়। মনের তারে সুর বাজে না।
এই হিংটিংছটের মাঝে এক পশলা বৃষ্টির মতো এখনো কিছু কিছু শিল্পীর গান বুকের মরমে গিয়ে পৌঁছায়। নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী তাঁদেরই একজন। সব ধরনের গানেই তিনি সাবলীল। স্বতঃস্ফূর্ত। কাসিক্যাল। ধ্রুপদ। খেয়াল। ঠুমরি। গজল। দাদরা। গীত। ভজন। রাগ। বাংলা গান। তাঁর গান বুকের মাঝে মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। আনন্দ। উচ্ছ্বাস। বিরহ। বেদনা। রোমাঞ্চ। অভিজাত কোনো জলসা কিংবা বনেদী কোনো বাড়ির আঙিনা। পুরু গদি বিছানো। তার ওপর তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসা নিয়াজ মোহাম্মদ। পরনে বাহারী পাঞ্জাবি, শুভ্র পাজামা। গলায় চেইন। মুখে মিষ্টি পান। হাতে ধূমায়িত সিগারেট। পাশেই পানের ডালি। হারমোনিয়াম। তবলচী। ফ্যাক্সভর্তি গরম চা। জগে পানি। টাল খাওয়া রহস্যময় রাত। মৃদু আলো। চারিদিকে মৌ মৌ সৌরভ। ভেসে আসে সুরে ময়ূর। রজনী গাঢ় হয়। সারা পৃথিবী নিদ্রামগ্ন। ঈষৎ ঢুলুঢুলু চোখ। মনের বিষণœতা ছড়ায় প্রকৃতিতে। আস্তে-ধীরে সবাই ঢুকে পড়েন স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বাসরে। বুকের মাঝে চাপ চাপ কষ্ট। শূন্যতা। ‘যেন ডানা ঝাপটায় আহত এক রক্তাক্ত হরিয়াল’। ক্ষণে ক্ষণে হর্ষধ্বনি পরিবেশ হয়ে ওঠে মোহনীয়। চারপাশে কতো গান! কতো সুর! তবুও বৃষ্টিস্নাত দিনের হৃদয়ের তারে বেজে ওঠে, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না মেখে/মনে পড়লো তোমায়/অশ্রু ভরা দুটি চোখ/তুমি ব্যথার কাজল মেখে/লুকিয়ে ছিলে ওই দূর’। অথবা মন যখন ঢেকে থাকে বিষাদে, তখন বুকের মাঝে গুমরে ওঠে ‘দুঃখ আমার পারেনি এখনো/তোমাকে বোঝাতে।’ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতায় এসেছে নতুন সরকার। অবশ্য সরকার পদ্ধতি নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। প্রেসিডেন্সিয়াল, না সংসদীয়। দুুটোরই ভালো-মন্দ আছে। এটা নির্ভর করে ক্ষমতাসীনদের মন-মানসিকতার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি। ব্রিটেন, জাপান, ভারতে সংসদীয় পদ্ধতি। দুটো পদ্ধতিই বেশ ভালোভাবেই চলছে। এসব দেশের মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কোনো পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলা যাবে না। তার আগে দেখতে হবে দেশের সংস্কৃতি ঠিক আছে কি-না। প্রথমেই সংস্কৃতি ঠিক রাখতে হবে। সংস্কৃতি যদি ঠিক থাকে, তাহলে সবকিছুই যথাযথ ও সুষ্ঠুভাবে চলবে। নতুবা কোনো বাগাড়ম্বর কাজে আসবে না।’
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বিশ্বাস করেনÑ মানুষ মানুষের জন্য। সবার ওপরে মানুষ সত্য, তার ওপর কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইদানীং মানুষ আদর্শহীনতা ও আদর্শকেন্দ্রিকতায় ভুগছে। মানবিক সম্পর্কগুলো ভেঙে যাচ্ছে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। স্বার্থ ছাড়া এক চুলও অগ্রসর হতে চায় না। এ কারণে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি এই মমত্ববোধ না থাকলে কখনোই কিছু হবে না। তাছাড়া আমাদের দেশে যোগ্য স্থানে যোগ্য লোক নেই। যে কারণে বাঘে ঘাস খাচ্ছে। ছাগলে মাংস খাচ্ছে। কারো একার পক্ষে এ অবস্থার পরির্বতন করা সম্ভব নয়। এজন্য মানুষকে সত্যিকার অর্থে সুশিক্ষিত ও সচেতন করে তুলতে হবে।’
তবে তিনি বর্তমান জেনারেশন সম্পর্কে আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘এই জেনারেশনের রাজনৈতিক চেতনাবোধ অনেক গুন বেড়েছে। এবারের নির্বাচন তার অনন্য নজির। মানুষ লাইন দিয়ে ভোট দিয়েছে। কেউ কারো অধিকার হরণ করেনি। মানুষের এই মনোভাবকে অটুট রাখতে হবে।’
এদেশের মাটি ও মানুষ সম্পর্কে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী : সার্বিকভাবে মাটিও ভালো। মানুষও ভালো। তবে সবকিছু নির্ভর করে যাদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হয়, তাদের ওপর। দুনিয়ার সর্বত্র যোগ্য লোকদের জয়জয়কার। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। যোগ্যদের ঠাঁই নেই। চল্লিশে পা দিয়ে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী নারীদের সম্পর্কে বলেন, ‘আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। এই শ্রদ্ধা সার্বিক অর্থে। তবে কাউকে ভালোবাসি। কাউকে স্নেহ করি। কাউকে ভয় করি। আমি তো মানুষ। অনেককেই মনে হয় ফুলের মতো। ভালো লেগে যায়। কখনো-সখনো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। সুন্দর কার না ভালো লাগে! শ্রোতার আসনে সুন্দরী মহিলা থাকলে নিশ্চয়ই গানের প্রতি আন্তরিকতা ও দরদ বেড়ে যায়। সুন্দরের জয় সর্বত্র। সুন্দর শুধু দেহে নয়, মনেও।’ নারীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁরা অবদান রাখছেন। নারীরা এগিয়ে না আসলে সংসারে ব্যাঘাত ঘটতো। কর্মক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে আসায় অনেক মূর্খ লোক খারাপ বলে। কুৎসিত মন্তব্য করে। খারাপ হলে যে কোনো স্থানেই খারাপ হওয়া যায়। যাঁরা কর্মক্ষেত্রে আছেন, বরং তাঁদেরই খারাপ হবার সময় নেই।’ নিজের সম্পর্কে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘এই মাত্র আমার জন্ম হলো। এ্যাদ্দিন যা গান করেছি, তা যদি ইরেজ করে দিয়ে আবার গাইতে পারতাম। আমি আমার কাজে মোটেও সন্তুষ্ট নই। তবে যদি বেঁচে থাকি, যে পরিস্থিতিতেই থাকি না কেন, বয়স ৫০ পেরিয়ে গেলে কিছু একটা দাবি করতে পারবো। সেটাই আমার লক্ষ্য। তবে শৈশব-কৈশোরে নির্দিষ্ট বিষয়ে আমার কোনো স্বপ্ন কিংবা আকাক্সক্ষা ছিল না। কিন্তু বাসনা ছিল মানুষ হবো। আমার সন্তানদের একই অভিপ্রায়।’ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী সব মিলিয়ে নিজেকে সুখী মনে করেন। তবে সঙ্গীত নিয়ে তাঁর বুকে একটা ‘অ-সুখ’ রয়েছে। সুরার সঙ্গে সুরের সম্পর্ক আছে কিনাÑ এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যার জন্য প্রযোজ্য, তার জন্য প্রযোজ্য। এটা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। যে কোনো নেশাই হোক না কেন, অন্যের ক্ষতি হলে এর চেয়ে খারাপ কিছু নেই।
গান তো জীবনের জন্য। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লাখ লাখ লোকের জীবন নিভে গেছে। সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য লোক। এক্ষেত্রে আপনার কিছু করণীয় নেই? এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমি যে কোনো সময় এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। আমি তো এ দেশ ও মাটির সন্তান। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নিলে আমি গান গাইতে ইচ্ছুক। কেননা, এর আগে ব্যবসায়িক স্বার্থে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই যত্রতত্র আমি যেতে রাজি নই।’ এদেশের শ্রোতাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেকের রুচি আছে, অ্যাফোর্ড করার ক্ষমতা নেই। আবার অনেকের অ্যাফোর্ড করার ক্ষমতা আছে কিন্তু রুচি নেই।
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বিবাহিত। স্ত্রী সাব্রা নিয়াজও সঙ্গীত শিল্পী। রেডিও, টিভিতে গেয়ে থাকেন। এক কন্যা। মেহনাজ চৌধুরী বারখা। এক পুত্র। ফাইয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী। নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে গান গেয়েছেন। ভারত, বার্মা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, হল্যান্ড, জার্মানি। যদি তিনি কখনো এ দেশে হারিয়েও যান, তাহলেও তাঁকে অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যাবে ফ্রান্স, হল্যান্ড, জার্মানিতে। খোদ সরকারি আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে বড়ো বড়ো জলসায় তিনি গেয়েছেন। কথাবার্তার শেষ পর্যায়ে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বললেন, ‘সঙ্গীতের কোনো ভাষা নেই। ধর্ম নেই। সীমানা নেই। সঙ্গীত সর্বজনীন। সঙ্গীত এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয় অনুভূতি।’
২৩ মে ১৯৯১


রশীদ হায়দার
‘প্রেম ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে রাজি নই। সে প্রেম নারীপ্রেম হোক, প্রকৃতিপ্রেম হোক, ঈশ্বরপ্রেম হোক, পশুপাখি প্রেমÑ যাই হোক না কেন, প্রেমই প্রথম, প্রেমই শেষ। আর সেক্স সম্পর্কে সবিনয়ে বলি, ওটাতে যদি প্রেমই না থাকে, তাহলে স্ত্রীগমনকেও ধর্ষণ বলতে বাধা কোথায়?’ কোনো ভান-ভনিতা নেই। যে কোনো বিষয়ে অবলীলায় বলে ফেলেন। যা বিশ্বাস করেন। যা পছন্দ করেন। যেহেতু তিনি রশীদ হায়দার। দিলখোলা, প্রাণরসে ভরপুর এই মানুষটিকে জানতে-বুঝতে বেশি সময় লাগে না। লেখায়-দেখায় কিংবা দূরালাপনীতে। চট করে কাছে টেনে নেন। কিশোর থেকে জননীÑ সবার কাছেই তাঁর একই রকম কদর। বলার ঢঙে, লেখার ভঙ্গিতে চুম্বক লাগানো। ঈর্ষা জাগানো। আত্মম্ভরিতা বর্জিত। সর্বদাই হাসিখুশি। চারপাশের কপটতা, শঠতা তাঁকে জব্দ করতে পারেনি। বয়সের কাছে বশীভূত হননি। আর মাত্র এক পক্ষকাল, তারপর হবেন পঞ্চাশোর্ধ। কিন্তু এখনো তাঁর চোখে, মুখে, বুকে একজন কিশোরের স্বপ্ন। হৃদয়ে খেলা করে রোমিও’র চাঞ্চল্য, অনুভূতি : ডব সঁংঃ ষড়াব ড়হব ধহড়ঃযবৎ ড়ৎ ফরব. আপাদমস্তক প্রেমিক। কিন্তু সমাজ, সংসার, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি সচেতন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে রশীদ হায়দার বলেন, ‘মনে হচ্ছে ঘোলাটে হতে আর দেরি নেই। নইলে খোদ ক্ষমতাসীনদের মধ্যেই সংশয় ও অসন্তোষ, ছাত্র ঐক্যে বিচ্ছেদ, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর অশুভ তৎপরতা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা না জনগণের, না রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে দায়ী। সব মিলিয়ে মন বলছে, পরিস্থিতি ঘোলাটে।’ সরকার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে রশীদ হায়দার বলেন, ‘সংসদীয় পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি তো গত উনিশ বছর ধরেই দেখছি। কি দেখছি? মূল ক্ষমতাধর ব্যক্তির হয় মর্মান্তিক মৃত্যু, না হয় অবমাননাকর অপসারণ। আমরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করলাম শুধু একজন মানুষের হাত শক্তিশালী করার জন্য, না, তা মানতে রাজি নই।’
মৌলবাদীদের উত্থান?
‘মৌলবাদীরা সারা পৃথিবীতেই একটা বিরাট হুমকি হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ধর্মের ক্ষেত্রে, জাতীয়তার ক্ষেত্রে, মানব কল্যাণের নামে মৌলবাদীদের ক্রিয়াকলাপ আসলে রক্তপাতেরই মহড়া ও বাস্তবায়ন। মৌলবাদের উত্থান সম্পর্কে দেশবাসীকে যতো সজাগ করা যাবে, ততোই মঙ্গল।’
নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিÑ
‘আমি নিজেকে বাঙালি ভাবতে ও বলতে ভালোবাসি। আমি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই কিন্তু বিচ্ছিন্নও নই বলে বলতে চাইÑ যে আদর্শ সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, সেই আদর্শকে যে রাজনৈতিক দল সমুন্নত রাখবে, আমি তাকে সমর্থন দেবো।’
সামাজিক অবক্ষয়Ñ
‘যে দেশে দেশের মাটির কথা ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়, সে দেশে অবক্ষয় খাবো খাবো করে ধরবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অর্থনীতি বলুন, রাজনীতি বলুন, ধর্ম, সংস্কৃতি, লেখাপড়া ইত্যাদি যা-ই বলুন, দেখুন, শুধু ফাঁকি আর গোঁজামিল দেবার চেষ্টা। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মোহের কাছে পরাজিত, চাকচিক্যের কাছে আত্মসমর্পিত আর সেজন্যই অবক্ষয়ের জয়জয়কার।’
বর্তমান জেনারেশনÑ
‘বর্তমান জেনারেশনের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা আদর্শহীনতা। প্রলোভনের জাল সর্বত্র ছড়ানো। ফলে বর্তমান জেনারেশন সেদিকে ছুটে ছুটে এক পর্যায়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসতে চায়; কিন্তু তখন পথটি হয়ে যায় বন্ধ। তবু বলবো, কিছু তরুণ এখনো সুস্থতার পথে এগিয়ে যেতে পারছে বলে আশার দীপটি জ্বালিয়েই রেখেছি। সম্পূর্ণ হতাশা তো মৃত্যুরই নামান্তর। ’
এদেশের মাটি ও মানুষÑ
‘এদেশের মাটি ও মানুষ যেমন কোমল, তেমনই কঠিন। এই কোমল মানুষগুলোই যখন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তখন মনেই হয় না এরা কিছুক্ষণ বা কিছুদিন আগেই ছিলো ভীরু খরগোশ। এদেশের সহজ-সরল মানুষগুলোর শক্তি সম্পর্কে আমি সব সময়ই প্রবল আশাবাদী। আতিথেয়তায়, বিশ্বাসে, জীবনযাপনে এদের সততা প্রশ্নাতীত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সংস্পর্শে এসে আমার গভীর বিশ্বাস জন্মেছে, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসায় এরা আকাশের মতোই উদার ও অকৃপণ।’
দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন সম্পর্কে বাংলা একাডেমীর উপ-পরিচালক রশীদ হায়দার বলেন, ‘দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে কর্মকা- চলছে, তাতে আমি প্রবলভাবে আশাবাদী। নাটকে, গানে, নাচে, চিত্রকলায় দেখুন নানাভাবে মানুষের কথা এসেছে, চিত্রিত হয়েছে। তবে সিনেমা? যা-তা। হ্যাঁ, এর দর্শক সংখ্যা বিপুল; কিন্তু এরা দেখে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায়। আর এদেরকেই একটা ভালো ছবি দিলে ঠিকই লুফে নেবে। অপসংস্কৃতি সম্পর্কে যে হৈচৈ শুনি, তা কিন্তু আসলে থুথুর ফেনা। মানুষ নিজেও জানে না সে সেটাকে কখন পরিত্যাগ করেছে এবং অপসংস্কৃতির ধারক-বাহকরাও টের পান না কখন তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। যতো মাতামাতিই হোক, মানুষ কিন্তু গ্রহণ করে দেশের শিল্পটিকেই।’
চারপাশের মানুষ কেমন বদলে যাচ্ছে। কেউ সহজভাবে কথা বলতে চায় না। চোখে-মুখে রাগী ভাব। মানুষ এমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে কেন? এ ব্যাপারে রশীদ হায়দারের অভিমত : উঠবে না কেন? উঠছে বলেই আমি আশাবাদী যে, অচিরেই একটা পরিবর্তন আসবে। চোখের সামনে যেখানে দেখতে পাচ্ছি চোর-বদমাইশ, ভ , লুচ্চা, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতরা দিব্বি ক’রে-ক’ম্মে হেসে-খেলে দুধ-ঘি-মাখন খেয়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে অসহিষ্ণু না হলেই বরং ভয়ের ব্যাপার হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের জন্য এসেছে। এই অবচেতন ধারণাই সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর অসহিষ্ণুতার মূল কারণ।
নিজের কাজে সন্তুষ্ট কিনাÑ
‘সন্তুষ্ট নই। কাজই যেখানে করলাম না, সেখানে সন্তুষ্টি আর অসন্তুষ্টি! ছিটেফোঁটা যে কাজটুকু করার চেষ্টা করেছি, তা পাতে দেবার যোগ্য নয়। অসন্তুষ্টি থেকেই ব্যর্থতাবোধ, আর তা থেকে বঙ্গবন্ধু-সিরাজউদ্দৌলা, বাইবেলভিত্তিক একটি নাটক ও আমাদের পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে ‘জনক জননী’ নামে বৃহৎ উপন্যাস লিখতে পারবো কিনা জানি না।’
ভবিষ্যৎ সম্পর্কেÑ
‘যদি বৈষয়িক বিষয় হয়, তাহলে বলবোÑ আমি ডাহা ফেল। বাড়ি, টাকা-পয়সা, নিশ্চিত ভবিষ্যৎÑ আমার নেই। বাকি থাকে সাহিত্য। ওই যে আগের প্রশ্নে ভবিষ্যতে করণীয় ইচ্ছার কথা বলেছি, সম্ভব হবে কিনা জানি না। তবে হাত-মাথা যতোদিন সচল থাকে, ততোদিন লিখতে ও পড়তে চাই।’
নারী সম্পর্কেÑ
‘নারী আছে বলেই তো পৃথিবী এত সুন্দর, আকর্ষণীয়, প্রেমপূর্ণ ও আনন্দময়।’
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থানÑ
‘সামান্য হলেও আশানি¦ত হচ্ছি, মেয়েরা তাদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেছে, অনেক ক্ষেত্রে বেড়াজাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। এতে তাদের অবস্থান একটু সম্মানজনক পর্যায়ে উন্নীত হলেও লক্ষ্য করি, মেয়েরা এখনো যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বহু তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা ঘরের বৌ-মেয়েদের মার্জিত দাসী-বাঁদীর ঊর্ধ্বে ভাবতে পারে না।’
দুই কন্যা এবং গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, জীবনী, অনুবাদ, সম্পাদনা ইত্যাদি মিলিয়ে ২৭ গ্রন্থের জনক রশীদ হায়দারের নিজের সম্পর্কে মূল্যায়নÑ ‘যার সাধনা ও বাসনা তিনবেলা ভাত খাওয়া ও ঘুমানো, তাকে পরিশ্রমী, সাহিত্যকর্মী ভাবা সাহিত্যকে অপমান করারই সামিল। বাড়িয়ে বলছিনে, আমি একজন অলস, উদ্যমহীন সুখী গৃহী।’
শৈশবের স্বপ্ন প্রসঙ্গে পঞ্চাশ ছুঁই দুঁই রশীদ হায়দারÑ ‘শৈশব বা কৈশোরের স্বপ্ল তো বাস্তবায়িত হয়ইনি, এ বয়সের স্বপ্নও হবে কিনা জানি না। যখন বুঝতে শিখলাম ফিল্ম দেখা বেশ আনন্দের, তখন ভাবতাম সিনেমা হলের গেটকিপার হবো। পরে যখন দেখলাম ভ্রমণ বিষয়টা মনোরম, তখন বড়ো সাধ জাগলো বারান্দাঅলা টুপি পরে ট্রেনের টিকিট চেকার হবো। কোনোটাই হইনি। এখন ইচ্ছে মহিলা বাসের কন্ডাক্টর হই।’ এই হলো রশীদ হায়দার। চেনা গেলো কি?
৩০ মে, ১৯৯১

মোস্তফা মনোয়ার
মোস্তফা মনোয়ার। সৃষ্টিশীল মানুষ। সৃজনশীল কর্মকা-ে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আজীবন। শিল্প ও শিল্পকলার সব শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। যেখানেই হাত দিয়েছেন, মুঠো ভরে উঠে এসেছে রাশি রাশি সোনা। চিত্রকলা, নাটক, সঙ্গীত, পাপেট শো এবং টিভির সৃষ্টিশীল অনুষ্ঠান নির্মাণে তাঁর সাফল্য ও খ্যাতি অভাবিত। তাঁর সৃজনধর্মী কাজ নিয়ত বেড়েই চলেছে। তবে তিনি কাজ করেন নীরবে। বাহুল্য হৈচৈ পছন্দ করেন না। কোনো স্বীকৃতির জন্য আকুলতা নেই। যা করেন মনের আনন্দে। এদেশের মাটি, মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তাঁর কাজের নেপথ্য প্রেরণা। বহুকালের বহু অবদানে তৈরি যে সংস্কৃতি, তাকে তিনি বুকের মাঝে লালন করেন। এদেশের সাংস্কৃতিক সম্ভার এবং সাংস্কৃতিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় তিনি বিশ্বাসী। যে কারণে পথ খুঁজে নিতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয় না। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে দূর শৈশবে।
মোস্তফা মনোয়ারের জন্ম ১৯৩২ সালে। তৎকালীন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার মনোহরপুর গ্রামে। পিতা কবি গোলাম মোস্তফা। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। মাত্র দু’বছর বয়সে মাকে হারান। পিতার স্নেহে মানুষ। হুগলির কলেজিয়েট স্কুল দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। এরপর বাঁকুরিয়া, ফরিদপুর, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল হয়ে নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। প্রকৌশলী হবার আশায় কলকাতার স্কটিশ চার্চে আইএসসিতে ভর্তি হন। কিন্তু ততোদিনে রঙ-তুলির প্রতি মোহ জন্মেছে। আইএসসি সম্পন্ন না করে কলকাতা আর্ট কলেজে থিতু হন। ১৯৬০ সালে সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার ঝোঁক। এ সম্পর্কে মোস্তফা মনোয়ার বলেন, ‘গঙ্গা নদীর তীরে বাড়ি ছিল। নদীর ঢেউ এসে বাড়ির ঘাটে আছড়ে পড়তো। সূর্যের উদয় ও অস্তেÍর সময় পানির ওপর নানা রঙের খেলা চলতো। বিভিন্ন পাল তোলা নৌকা বয়ে যেত। এসব দৃশ্য শিশুমনে দারুণ প্রভাব ফেলে। মনের খেয়ালে প্রতিদিন ছবি এঁকে যেতাম। সে সময় কলকাতায় একটি চিত্রপ্রদর্শনী দেখার সুযোগ হয়। দু’তিনটি ঘরে অনেক ছবি সাজানো। লোকজন দেখছে। বেশ ভালো লাগলো। ছবি যে লোকজন দেখে বুঝতে পারলাম। বাড়ি ফিরে এসে আমার আঁকা সব ছবি সুতোয় বেঁধে বাড়ির দেয়ালের ফটকে ঝুলিয়ে দিলাম। তখন কতোই আর বয়স? টু’তে পড়ি। এটাই আমার জীবনের প্রথম প্রদর্শনী। আব্বা বাড়ি এসে প্রদর্শনী দেখতে পেলেন। রাগ করলেন না। বরং প্রদর্শনীর মেয়াদ আরো একদিন বাড়ানোর কথা বললেন। ছবি আঁকার ব্যাপারটি আস্তে-ধীরে মনের মাঝে জেঁকে বসতে থাকে। আর্ট কলেজে ভর্তি হবার ব্যাপারটিও অভিনব। আমি তখন বড়ো ভাই ক্যাপ্টেন মোস্তফা আনোয়ারের বাসায় থাকি। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ি। আর ধুমছে ছবি আঁকি। পাশের ফ্যাটে থাকতেন খ্যাতিমান লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি আমার আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হলেন। কলকাতা আর্ট কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ রমেন চক্রবর্তীকে গিয়ে আমার কথা বললেন। রমেন চক্রবর্তী আমার ছবি দেখতে চান। সৈয়দ মুজতবা আলী আমার বেশ কিছু ওয়াটার কালার ছবি তাঁকে দেখালেন। ছবিগুলো তিনি উল্টেপাল্টে দেখলেন। তখন আর্ট কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তির মেয়াদ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি বিশেষ ব্যবস্থায় আমাকে ভর্তি করে নেন। তাছাড়া রমেন চক্রবর্তী ছবি আঁকার ব্যাপারে আমাকে যে দিব্যদৃষ্টি দেখানÑ তা আমার জন্য স্মরণীয়। তিনি একদিন আমাকে তাঁর স্টুডিওতে নিয়ে যান। জানালার একটা অংশ দেখিয়ে বলেনÑ এটাকে আমি প্রতিদিন পূজা করি। এই জানালা দিয়ে প্রতিদিন যে ভোরের আলো আসে, সেই আলোয় আমি একটি করে ছবি আঁকি। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কোনো উপদেশ পেয়েছি বলে মনে হয় না!’
‘আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর বিদেশ যাবার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আমাদের বাড়িতে ছিলেন। তিনি আমাকে কোথাও যেতে বারণ করলেন। তাঁর কথামতো ১৯৬১ সালে ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই।’
বছর তিন-চার আর্ট কলেজে চাকরি করার পর মোস্তফা মনোয়ার টিভিতে চলে আসেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘১৯৬৪ সালে সবে টেলিভিশন চালুর প্রক্রিয়া চলছে। এমন সময় কলিম শরাফী আমাকে টিভিতে আসার আমন্ত্রণ জানান। তিনি ছিলেন আব্বার ছাত্র। তাছাড়া এর আগে আমার পাপেট নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র করেছিলেন। তাই উনি আমাকে কম-বেশি জানতেন। কলিম শরাফী তখন টিভির প্রোগ্রাম ম্যানেজার। তিনি আমাকে স্টেশন ম্যানেজার জামিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আর্ট কলেজের পরিবেশ তখন আমার ভালো লাগছিলো না। সবাই ছবি আঁকতেন। কিন্তু সামগ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে কারো যোগাযোগ ছিল না। আমি এই বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করি। নাটক করি। বসন্ত উৎসবের আয়োজন করি। অন্যরা এটা ভালো চোখে দেখতেন না। পছন্দ করতেন না। এসব কারণে জামিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর সঙ্গে দেখা করে, আলাপ করে বেশ ভালো লাগলো। পরদিন টিভিতে আসতে বললেন। সরাসরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম স্টেশন প্রডিউসার হিসেবে। টিভিতে ঢোকার আগ অব্দি কোনোদিন টিভির অনুষ্ঠান দেখিনি। টিভি অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। নিজের চিন্তা ও কল্পিত ধারণা নিয়ে অগ্রসর হলাম। ছোটদের অনুষ্ঠান ‘ছবি ছবি খেলা’ নিয়ে আমার হাতেখড়ি। জাপানিরা ছিলেন আমাদের গাইড। তাঁরা আমার কাজের প্রশংসা করেন। তাঁদের কাছে জানতে পারলাম ছবি আঁকা, গান, নাটক, পাপেট টিভির জন্য প্রয়োজনীয়। ছোটকাল থেকেই আমি গান শিখতাম। প্রতিদিন বাসায় শিক্ষক আসতেন। অক্ষর পরিচয় হওয়ার আগেই গানের সঙ্গে আমার সখ্য। সেই বয়সে কোন্ রেকর্ডে কোন্ গান আছে বলে দিতে পারতাম। কি করে পারতাম বলা মুশকিল। আমার আব্বার ডায়রিতে এর উল্লেখ আছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামও আমাকে পরীক্ষা করেন। ঠিক ঠিক বলে দেয়ায় তিনি অবাক হন। তাছাড়া অল্প বয়সেই শুনে শুনে গান গাইতে পারতাম। সেই শিশু বয়সে তখনকার একটি জনপ্রিয় হিন্দি গান ‘তুমনে মুঝকো প্রেম শিখায়া শোয়ে হয়ে দিলকো জাগায়া’ ভালো গাইতে পারতাম। সবাই আমাকে এই গানটি গাইতে বলতো। গানের প্রতি ঝোঁক দেখে বাবা আমাকে বিদেশি খেলনা পিয়ানো কিনে দেন। কিছুদিন বাজানোর পর পিয়ানোর ভেতরটা দেখার ইচ্ছে হয়। ফলে পিয়ানোটা তিন তলা থেকে নিচে ফেলে দিলে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এজন্য আব্বা আমাকে রাগ করেননি। তিনি বুঝিয়ে দেন, কোনো কিছু শিখতে হলে ভাঙতে হয় না। আসলে টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো ছোটবেলা থেকেই আগ্রহের সৃষ্টি করে। সেজন্য ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে জেগেছিলো।
আইএসসিতে ভর্তি হয়েছিলাম। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধ সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। কিন্তু বিমান ওড়ে গেলে চেয়ে চেয়ে দেখতাম। পরে পিচবোর্ড দিয়ে বিমান বানানোর চেষ্টা করতাম। একবার সার্কাস দেখে দোতলার বারান্দায় টানানো দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নিচে পড়ে যাই। হাসপাতালে নেয়া হলেও কোনো ক্ষতি হয়নি।
প্রতি সপ্তাহে আমাদের পার্ক সার্কাস বাড়িতে আড্ডা বসতো। আবাসউদ্দীন, জসীমউদ্দীন, কাজী আবুল কাশেম প্রমুখ নিয়মিত আসতেন। কাজী নজরুল ইসলাম আসতেন মাঝে মাঝে। বাড়ির পরিবেশ ও আনুষঙ্গিক ঘটনাবলী আমার মানসিক ভিত্তি এমনভাবে তৈরি করে দেয় যে, শিল্প, সংস্কৃতি আমার মগজে ও মজ্জায় ঢুকে পড়ে। তাছাড়া সম্ভবত মা না থাকায় এই জগতটা নিয়ে মেতে থাকতে ভালো লাগতো। আর্ট কলেজে পড়ার সময় নাটক করতে করতে সেট বদলানো সম্পর্কে ধারণা হয়। তারপর পুরনো বইয়ের দোকানে ‘আর্ট অফ ডিজনিল্যান্ড’ বই পেয়ে আমার মনের জগত পাল্টে যায়। ফ্রান্সের দুঁমিয়রের কাজ দেখে এই ভাবটি আরো দৃঢ় হয়। এ সময় থেকেই পাপেটের দিকে ঝুঁকে পড়ি। শৈশব, কৈশোর ও ছাত্র জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতা টিভিতে কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। ছোটোদের অনুষ্ঠানকে আকর্ষণীয় করে তুলতে টিভির নানাবিধ যন্ত্রপাতির ব্যবহার, সেট নির্মাণ, সীমিত পরিসরে বেশি সুবিধা পাওয়ার পথ খুঁজে বের করি।
বান্ধবীদের সম্পর্কে মোস্তফা মনোয়ার বলেন, ‘আর্ট কলেজের পরিবেশ ভালো ছিল। সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেলামেশা করতাম। গঙ্গার ধারে গিয়ে ছবি আঁকতাম। উঁচু কাসের মেয়েরাও আমার সঙ্গে ওয়াটার কালার আঁকার জন্য আসতেন। এঁদের একজন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী অশোক তরু বন্দোপাধ্যায়ের ছোটো বোন রীতা। তাঁকে সবাই দিদি বলে ডাকতাম। গোঁড়া পরিবারের মেয়ে। অথচ আমার সঙ্গে খুব খাতির ছিল। তাঁদের বাড়িতে যেতাম। তাঁর বিয়ের সময় আমাকে ঢাকা থেকে দাওয়াত করে নিয়ে যান। আমাদের নিচের কাসে পড়তেন অলোকা। পরে অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীর স্ত্রী হন। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। সন্ত্রান্ত পরিবারের মেয়ে স্মিতা। আমরা এক সঙ্গে ছবি আঁকতে বের হতাম। ঢাকার এক বন্ধু আমার কাছে যেতেন। তার সঙ্গে আমি স্মিতার পরিচয় করিয়ে দেই। পরবর্তী সময় তাঁদের বিয়ে হয়। আসলে কাউকে নির্দিষ্ট করে ভালোবাসার কোনো ব্যাপার ছিল না। আমরা ছিলাম স্রেফ বন্ধু। অবশ্য শুধু বন্ধু বললে যেমন ভুল হবে, তেমনি প্রেমিকা বললেও ভুল হবে। আমরা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। একজন আরেকজনের খোঁজ-খবর নিতাম। আজও যখন তাঁদের কাছে যাই, সেই আন্তরিকতাটুকু বজায় রয়েছে। হয়তো এক-আধটু ভলোলাগা, ভালোবাসা ছিল। সেটা মনে মনেই থাকতো। তখন আমাদের মনে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিলো, শিল্পী হতে হলে বহুদিন একা থাকতে হবে। এটা কেন জানি ভেতরে গেড়ে বসেছিলো। বিখ্যাত শিল্পীদের জীবনী পাঠ করে কিংবা তাঁদের সম্পর্কে জেনে এমন ধারণা হয়। তবে কলকাতা ছেড়ে না আসলে পাশাপাশি থাকলে হয়তোবা কারো সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা আরো গাঢ় হতো অথবা বিয়ে হতে পারতো। সেটা ভিন্ন কথা।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে এমন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর মাসখানেক আগে থেকেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে অত্যন্ত চমৎকার সব অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। সংগ্রামী গান, উদ্দীপনামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মনের কথা বলার চেষ্টা করা হয়। ‘সংগ্রাম সংগ্রাম চলবেই চলবেই’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’-এর মতো দেশাত্মবোধক গান সে সময় উঠে আসে। আমি তখন টিভির প্রোগ্রাম ম্যানেজার। কোন্ অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হবে-কি হবে না, তার সব দায়দায়িত্ব আমার। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। এ দিনটি আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনটি ছিল পাকিস্তানের জাতীয় দিবস। সেদিন কয়েকটি ভবন ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। সেদিন অফিসে আসতে আসতে চিন্তাটা হঠাৎ মাথায় খেলে যায়। কোথাও পাকিস্তানের ফ্যাগ ওড়ানো নেই। অথচ টিভির অনুষ্ঠান শেষে ফ্যাগ দেখানোর নিয়ম। ঠিক করলাম, ২৩ তারিখ ফ্যাগ দেখানো হবে না। সন্ধ্যা থেকেই পুরনো ভালো ভালো অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে লাগলাম। সে সময় টিভিতে পাকিস্তানি সৈন্যে ভরা। অনুষ্ঠান সম্প্রচারের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবার পরও টিভি চলছে দেখে পাকিস্তানি সেনা কমান্ডার এসে আমার কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে বললাম, আজ বিশেষ দিন। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এ ব্যবস্থা। তিনি আমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে চলে যান। আমার এই পরিকল্পনার কথা ইঞ্জিনিয়ার খালেদ সালাহউদ্দিন ও উপস্থাপিকা মাসুমাসহ কয়েকজন জানতেন। রাত ১২টা ১ মিনিটে অনুষ্ঠান শেষ করার পর মাসুমা ঘোষণা করলেনÑ আজ ২৪ তারিখ। আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। এরপর পাকিস্তানি পতাকা দেখানো হলো। এটা দারুণ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। পরদিন প্রশংসাসূচক ঘন ঘন টেলিফোন আসতে থাকায় বিপদের আঁচ পেয়ে সতর্ক হয়ে গেলাম। এজন্য ক’দিন গোপনে থাকতে হয়েছে। সম্ভবত এ কারণে ২৫ মার্চ শান্তিনগরে আমার বাসায় হামলা চালানো হয়। আমি বাসায় ছিলাম না। সৈন্যরা বাড়ির দরোজা-জানালা, জিনিসপত্র ভাংচুর এবং গাড়িটা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে যায়। আমার স্ত্রী-কন্যা আত্মগোপন করে রেহাই পায়। পরে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করি।’
শৈশবের স্বপ্ন প্রসঙ্গে মোস্তফা মনোয়ার বলেন, ‘শৈশবে মাল্টিমিডিয়ার প্রতি আমার যে ঝোঁক ছিল, তার দিকে বোধহয় কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছি।’
২২ জুন, ১৯৯১
কামাল লোহানী
সাধাসিধা জীবনযাপনে তিনি অভ্যস্ত। আজীবনের সহচর খদ্দরের পাঞ্জাবি, পাজামা এবং চটিজুতা। এই খোলসের বাইরে তাঁকে কখনো কল্পনা করা যায় না। দেশে কিংবা বিদেশেÑ সর্বত্রই তিনি এক্ষেত্রে অবিচল। অপরিবর্তণীয়। ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে বেশি পাওয়ারের লেন্স। মাথায় শাদা-কালো চুলের যুগপৎ মিশ্রণ। দীর্ঘদেহী চোখে-মুখে তরতাজা অভিব্যক্তি। অবশ্য একবার বয়সের ছুরি তাঁর হার্টে বিদ্ধ হয়েছে। সেই ছুরিটি অবধারিতভাবেই স্ট্রোক। এরপর থেকে তাঁকে সামলে চলতে হয়। নিয়ন্ত্রিত জীবন। এ কারণে একটু যেন থিতিয়ে গেছেন। কাজে-কর্মে আগের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে লব্ধ অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোই তাঁর অভিপ্রায়। কামাল লোহানী সেই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছেন।
১৯৩৬ সালের ২৬ জুন কামাল লোহানীর জন্ম। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। শৈশবেই মাকে হারান। কলকাতার কুচবিহারের মহারানীর স্কুল শিশু বিদ্যাপীঠে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। সেখানে ছোট ফুফুর বাড়িতে থাকতেন। স্কুল পালানো, ঘর পালানো ছিল নিয়মিত ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তা-ব তাঁকেও স্পর্শ করে। কলকাতায় বোমা হামলা কিংবা সাইরেন শুনে ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিয়েছেন। যুদ্ধের বিভীষিকা উপলব্ধি করেছেন। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা ও পৈশাচিকতা দেখে ঘৃণায় দগ্ধ হয়েছি। ওই দাঙ্গা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনা চলে আসি। এই দেশ বিভাগও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৫২ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি। তারপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজে উঠে সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৫৩ সালে করাচিতে ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলায় কয়েকজন ছাত্র মারা যায়। এর প্রতিবাদে পাবনায়ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। তাতে অংশ নেয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ। এই প্রথম সচেতনভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট। পাবনার জিন্নাহ পার্কে (বর্তমানে স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ জেলা সম্মেলনের আয়োজন করে। তাতে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের দেশরক্ষামন্ত্রী সরদার আব্দুর রব নিশতার, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন, কাইয়ুম খান প্রমুখ। আমরা এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করি। ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতেই পা-ারা হামলা চালায়। এতে আমরা সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। কিন্তু ৫/৬ মিনিটের মধ্যে সংগঠিত হয়ে গাছের ডাল, ভাঙা বাঁশ, ইটপাটকেল নিয়ে পাল্টা হামলা চালাই। সম্মেলনের প্যান্ডেল তছনছ করি। এতে তাঁরা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে যান। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। সেবারই প্রথম গ্রেফতার হই। সাতদিন জেলে ছিলাম। এরপরও অসংখ্যবার জেলে যেতে হয়েছে। কিন্তু জীবনে প্রথম জেলে যাবার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। রাজনীতি মাথায় ঢুকে পড়ায় জীবনের অন্য সবকিছু মনে হয়েছে সেকেন্ডারি। ছোট চাচা তাসাদ্দুক লোহানীর কাছে থাকতাম। তিনি বলতেন, পড়ালেখা আগে। আর আমাদের কথা, দেশ আগে।’
রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়ায় ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর কামাল লোহানীর লেখাপড়ার পাট চুকে যায়। জীবনকে তখন অন্যভাবে গড়বার নেশা। চাচার কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা নিয়ে ১৯৫৫ সালে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে তিনি কোনো আত্মীয়স্বজনের দ্বারস্থ হননি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় স্বাধীন সত্তা মনের মাঝে লালন করেছি। নিজের পায়ে দাঁড়াবো বলে কারো কাছে কখনো ধর্না দিইনি। এজন্য খুব কষ্টে-সৃষ্টে জীবন কাটাতে হয়েছে। তবে আমার নিকটাত্মীয় ফতেহ লোহানী নিজ থেকে মাঝে মাঝে আমাতে টাকা-কড়ি দিয়ে সাহায্য করতেন। তাঁর সাহায্য গ্রহণ করতেই হতো। আমার দুরবস্থার কথা জেনে ফজলে লোহানী একদিন দৈনিক মিল্লাত অফিসে নিয়ে যান। তখন ১৭ পুরাতন কোর্ট হাউস থেকে মিল্লাত বের হতো। পত্রিকার মালিক ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিঞা)। সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর। তিনি জানালেন, একজন শিক্ষানবিস সহ-সম্পাদক নেয়া হবে। কিন্তু পত্রিকার মালিকের পাঠানো এক ব্যক্তি এক্ষেত্রে প্রার্থী। বার্তা সম্পাদক নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী বললেন, মনে হচ্ছে তোমার চাকরি হবে না। আমি তখন তাঁকে বললাম, চাকরি না হোক, অন্ততপক্ষে কাজ শিখতে চাই। ফলে বিনে পয়সায় কাজ করতে থাকলাম। এদিকে ঘটনাচক্রে একদিন অফিসে গিয়ে দেখি, শিফট ইন-চার্য হাসানউজ্জামান খান রাগ হয়ে বসে আছেন। আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কি একটা বিষয়ে জানতে চাইলেন। বিষয়টি আমার জানা ছিল। তরতর করে যতোটুকু জানি বলে দিলাম। তিনি পরে আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। পরদিন বললেন, তোমার চাকরি হয়ে গেছে। আমি বললাম, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কই? বেতন কত? তিনি বললেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার লাগবে না। আমাদের কারোরই নেই। তবে তোমার বেতন ৭৫ টাকা। আমি বললাম, আমাকে ১০০ টাকা নিতে হবে। তিনি বললেন, আমি নিজেই ১০০ টাকা পাই! তবে তোমাকে কিছুটা বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবো। তখন আমার বেতন ৮০ টাকা করা হয়েছিলো। সে-ই জীবনে প্রথম চাকরি। আসলে রাজনীতির কারণে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে না পারলেও জেলখানায় থাকাবস্থায় আমার শিক্ষার মৌলিক ভিত গড়ে ওঠে। জেলখানায় ইংরেজি কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। যাঁরা পড়তে পারতেন না, অনুবাদ করে তাঁদের শোনাতাম। তাছাড়া সব পত্রিকার খবরের ওপর প্রতি মাসে একটা রাউন্ডআপ হতো। সংবাদপত্রে চাকরির সময় এই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট কাজে দিয়েছে। ১৯৮১ সাল অব্দি বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছি। মিল্লাত, অর্ধ-সাপ্তাহিক পাকিস্তান, আজাদ, সংবাদ, পয়গাম, পূর্বদেশ, জনপদ, বঙ্গবার্তা, বাংলার বাণী, দৈনিক বার্তা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদে। সহ-সম্পাদক থেকে সম্পাদক পর্যন্ত। এর মধ্যে সেলিম কোরাইশি, শওকত আলী ও আমি মিলে সাপ্তাহিক মিঠেকড়া বের করি। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে মিঠেকড়ার সপ্তম সংখ্যায় এর বিরুদ্ধে মন্তব্য করে তল্পিতল্পা সমেত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদক এবং ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দু’দফায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)-এর সভাপতি ছিলাম। ১৯৭৮ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদক থাকাকালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে তার জের হিসেবে আমাকে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক (জনসংযোগ) করা হয়।’
রাজনীতি ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও অত্যন্ত সুপরিচিত নাম কামাল লোহানী। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল অব্দি তিনি ছায়ানটের সম্পাদক ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে মতবিরোধ দেখা দেয়ায় ১৯৬৭ সালে গঠন করেন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী। সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে মাঠে নামেন। সেবার একুশে উদযাপন উপলক্ষে তাঁদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রায় ৪০ হাজার দর্শক উপস্থিত হন (সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান)। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা আগে ও পরে কামাল লোহানীর ভূমিকা ছিল গৌরবময়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তখন ঝড়ের বেগে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে গিয়েছি। সংগ্রামী গান, বাজনা, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তখনকার যতো উদ্দীপনাময় গান, অধিকাংশই আমার সংগ্রহ করা। বিনে পয়সায় অনুষ্ঠান করেছি। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি শুধু হারমোনিয়াম, তবলা ও চিরুনি দিয়ে সুর করতেন। নৃত্য পরিচালক ছিলেন আমানুল হক। শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, অজিত রায় প্রমুখ। সে একটা সময় গেছে। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন পার্লামেন্টে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্দে উক্তি করলে আমরা তাৎক্ষণিভাবে তার প্রতিবাদ করি। পরবর্তীকালে সব সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে গঠন করা হয় সাংস্কৃতিক স্বাধিকার পরিষদ। ওয়াহিদুল হক ও আমাকে এর যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। আমরা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে চারদিনব্যাপী সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান করি। মোনেম খাঁ অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর জন্য মিরপুর ও মোহাম্মদপুর থেকে সশস্ত্র গু-া নিয়ে আসেন। আমরা কৌশলে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হই।’
নিজের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯৭৯ সালের কথা। লুসাকায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিনিধিদলে দু’জন সাংবাদিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একজন আমি। তখন আমি দৈনিক বার্তা পত্রিকার সম্পাদক। অপরজন আহমেদ হুমায়ুন। তিনি তখন দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর সভাপতি। লুসাকায় যাবার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন। পাসপোর্ট, ভিসা, ট্র্যাভেল চেকÑ এভরিথিংক। যাবার আগের দিন রাষ্ট্রপতির তথ্য উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিশ জানালেনÑ ‘তোমাকে স্যুট-কোট পরিধান করতে হবে’। আমি বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন তিনি আমাকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে চিনতেন না। ফলে আমাকে আমল দিতে চাইলেন না। পাজামা-পাঞ্জাবির প্রতি আমার আসক্তির কারণ সম্পর্কে তিনি কৈফিয়ত চাইলেন। আমি তাঁকে বললাম, এটা আমার আদর্শগত ব্যাপার ও অভ্যাস। আমার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক জীবনের সঙ্গে এটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। তাছাড়া পাজামা-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছু গায়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন তিনি কারো কাছ থেকে কোট-প্যান্ট ধার করতে বলেন। আমি বললাম, পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে কোট-প্যান্ট পরা যায় না। কোট-প্যান্টের সঙ্গে শার্ট, জুতা, টাই লাগে। এসব অন্যেরটা দিয়ে চলে না। তিনি আমার কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। বরং ক্ষুব্ধই হলেন। শেষ অব্দি তিনি আমাকে বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আপনি যেতে পারবেন না। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি যাবো না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। আমার না যাবার কথা শুনে আহমেদ হুমায়ুন বললেন, একা একা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। দাঁড়ান দেখি, কি করা যায়। তিনি সম্ভবত তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ খান কিংবা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো বরফ গলাতে না পেরে তিনিও সিদ্ধান্ত নেন, তিনিও যাবেন না। আমরা দু’জনে সিদ্ধান্ত নেই, টেলিফোন নামিয়ে রাখবো যাতে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে। পরদিন সকালে রাষ্ট্রপতি চলে যান। আমরা থেকেই যাই। বিষয়টি শোভন হবে না বলে আমরা কাউকে জানাইনি। তবুও লন্ডন ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে বক্স আইটেম নিউজ হয়। পরবর্তীকালে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সুবাদে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। তিনি আমাদের বক্তব্য শোনেন। সেই আলোচনায় জাতীয় পোশাক নিয়েও কথা হয়। জিয়াউর রহমান জানান, আগামীতে আপনি পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই বিদেশ যাবেন।’
প্রেম ও বিয়ে সম্পর্কে কামাল লোহানী বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের মনেই রোমান্টিসিজম আছে। সেটা বাদ দিলে কিছু থাকে না। তবে আমার প্রথম প্রেম ছিল রাজনীতি। তাকে বাদ দিয়ে অন্যত্র মন দেয়ার অবকাশ ছিল কম। অবশ্য এর মাঝেই আমার প্রেম গড়ে ওঠে। সেই কলেজ জীবনে আমার কাজিনের সঙ্গে। হ্যাঁ শেষ অব্দি তাঁকে বিয়ে করি। তিনি দীপ্তি লোহানী। আজ আমরা তিন সন্তানের জনক-জননী। ছেলে সাগর লোহানী, মেয়ে বন্যা লোহানী ও উর্মি লোহানী।’ শৈশবের স্বপ্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো খেদ নেই। নির্দিষ্টভাবে কোনো স্বপ্ন ছিল না। তবে একটা পর্যায়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে মনে হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করবো।’
সবশেষে কামাল লোহানী বলেন, ‘শিল্পকলা একাডেমি আমার বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক। তবে অন্য দিক দিয়ে দেখতে গেলে এখানে এসে আমি কিছুটা আটকে গেছি। অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দিতে হয়। অবশ্য ব্যক্তিসত্তা ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে আমি কোনো কিছু ছাড় দিতে রাজি নই।’
২২ জুন ১৯৯১


খান আতাউর রহমান
শিক্ষা মানুষের পাঠশালায়। প্রকৃতি থেকে জীবনের পাঠ। এ কারণে কোথাও থেমে থাকতে হয়নি। বর্ণিল জীবন। জুতা সেলাই থেকে চ-িপাঠ। যে কোনো কাজেই স্বতঃস্ফূর্ত। নিজের মধ্যে নেই কোনো হীনমন্যতাবোধ। লক্ষ্যবিন্দুও স্থির নয়। তবে জীবনটাকে দেখেছেন চেখে চেখে। না পাওয়ার কোনো বঞ্চনা নেই। কিন্তু বেশ মেজাজী। সে সঙ্গে যথেষ্ট আবেগপ্রবণ। কাজে-কর্মেও এর প্রকাশ ঘটে। হরেক পরিচয়ের মানুষ। চলচ্চিত্র প্রযোজক। পরিচালক। অভিনেতা। কাহিনীকার। চিত্রনাট্যকার। গীতি-কবিতা ও সংলাপ রচয়িতা। আবৃত্তিকার। খবর পাঠক। কলাম লেখক। নাট্যকার। নাট্য প্রযোজক। গায়ক। সুরকার। একই অঙ্গে অনেক রূপ। তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিটি কাজই জীবনধর্মী। লোকজ, সহজিয়া সুরে গাঁথা। তিনি খান আতাউর রহমান। চলচ্চিত্রকার হিসেবে খ্যাতিমান। জীবনের দীর্ঘ সিঁড়ি পাড়ি দিয়েছেন। এ মুহূর্তে দ্বিধা-দ্বন্দে¡ ভুগছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন কিনা। মধ্যবিত্তের জীবন থেকে চলচ্চিত্র হারিয়ে যাওয়ায় তিনি খুবই চিন্তিত। কেননা, চলচ্চিত্রে নষ্ট হয়ে যাওয়া বারোয়ারি হাটের সঙ্গে তিনি আর তাল মেলাতে পারছেন না। ভেতরে ভেতরে তিনি একজন কমিটেড কবি। আর কিছু না করলেও তিনি নিয়মিত কবিতা লেখেন। এটাই তাঁর নিভৃতের আনন্দ।
জন্ম ১১ ডিসেম্বর, ১৯২৯ সালে। মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে ভাই-বোন মিলে একটি ফুটবল দল। পাঁচ ভাই, ছয় বোন। তিনি পঞ্চম। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে আইএসসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। ছেলেবেলা থেকেই গান-বাজনা, অভিনয়-আবৃত্তিÑ এসবের দিকে ঝোঁক ছিল। বিএসসি পাস করার পর ১৯৪৮ সালে বাবার অনুমতি না নিয়েই বাড়ি থেকে পালান চলচ্চিত্রের সোনার হরিণ খুঁজতে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল মস্ত কুশলী হবো। কলকাতা ও বোম্বেতে বহু চেষ্টা করেও অসফল হয়ে জাহাজে করে বোম্বে থেকে করাচি গেলাম। ১৯৫০-৫১ সালে করাচির রেডিও পাকিস্তান থেকে বাংলায় খবর পড়তাম। ইস্ট পাকিস্তান এসোসিয়েশনের অন্যতম সংগঠক ছিলাম। একদিন বাঙালি বিদ্বেষী এক অবাঙালি টেকনিশিয়ানের ব্যবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বেধড়ক পিটিয়েছিলাম। ফলে রেডিওর চাকরি গেল। করাচিতে সর্বপ্রথম নাটক প্রযোজনা করি ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে। দেশবরেণ্য শিল্পী এসএম সুলতান সেই নাটকে মীরজাফরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সুলতান আমাদের সঙ্গে বছরখানেক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা এখনো আছে। সেই নাটকে সামান্য লাভই হয়েছিলো, তাই নিয়ে পাড়ি দিলাম লন্ডনে। আশা ছিল যে, সেখানেই চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কিছু শিক্ষা নেবো। কিন্তু সেখানকার ট্রেড ইউনিয়নিজমের কারণে সে আশাও জলাঞ্জলি দিলাম। পরিবর্তে পেশাদারী মঞ্চে নাটক প্রযোজনা শিক্ষার জন্য ঢুকলাম। জীবিকা অর্জন করতাম কোনো সময়ে বিবিসিতে বাংলা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, কোনো সময় রেস্তোরাঁয় বাসন-পেয়ালা ধুয়ে, কোনো সময় কলেজে মাস্টারি করে। কোনো সময়ে পুতুলের দোকানে পুতুলের মডেল তৈরি করে। এর ফাঁকে ফাঁকে রয়েল একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টস-এ ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু ওদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষার দীর্ঘ পাঠ্য দেখে এক টার্ম করার পর পালালাম। লন্ডন ইউনিভার্সিটি এলাকায় সিটি লিটারেরি ইনস্টিটিউট থেকে একটা ডিপ্লোমা নিয়েছিলাম ড্রামাটিক আর্টস-এ। বহুগুণ বেশি শিখেছি বিভিন্ন থিয়েটারে হাতে-কলমে কাজ করে। এদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ইউনিটি থিয়েটার। কমিনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের থিয়েটার ছিল ওটা। আরেকটি ছিল থিয়েটার রয়াল। বর্তমানকালের অন্যতম প্রধান নাট্য প্রযোজক জন লিটলউড, তখন তাঁর জীবনের প্রথম নাটক প্রযোজনা করেন। সেখানে আমার মঞ্চের পেছনে এবং মঞ্চের উভয় জায়গায় কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো।’
এরপর খান আতাউর রহমান দেশে ফিরে আসেন। এই ফিরে আসার পেছনে কাজ করেছে মায়ের চিঠি। এ ব্যাপারে তিনি জানান, ‘১৯৫৪ সালের জুলাইতে আমার ছোট ভাই আনিস পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে দুর্ঘটনায় মারা যায়। সে থেকে মা প্রায়ই কান্নাকাটি করে চিঠি লেখেন। অগত্যা ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হলাম করাচির উদ্দেশে। আট সপ্তাহ লেগেছিলো ধীরে-সুস্থে বিভিন্ন শহর দেখে করাচি পৌঁছতে। সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জীবনে ভুলবার নয়। করাচি এসে যখন পৌঁছলাম, তখন আমি নিতান্তই নিঃস্ব। হাজারো সুখ-দুঃখের সঙ্গী মোটরসাইকেলটিকে বিক্রি করে করাচি থেকে ঢাকা এলাম।’
ঢাকা এসে তিনি জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্রে। অবশ্য শুরুতে নাটক নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেন কিন্তু তাতে সফল হতে পারেননি। এ সম্পর্কে খান আতা বলেন, এসে দেখি নাটক সম্পর্কে যা কিছু শিখে এসেছি, তা প্রয়োগ করার কোনো সুগোগ নেই। একদিকে সেই সুযোগের চেষ্টায় রইলাম, আর বেঁচে থাকার জন্য রেডিওতে ঘোষক এবং ইংরেজি ও বাংলা খবরের কাজজে কলাম লেখক হিসেবে কাজ বেছে নিলাম। এ সময় আমি, হাসান ইমাম এবং কিছু উচ্চপদস্থ আমলা মিলে ‘মুক্তধারা’ নামে একটি নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আইয়ুব খানের মার্শাল ল’র কারণে সে প্রচেষ্টাও অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায। ১৯৫৮ সালে চিত্রপরিচালক এ জে কারদার এলেন ঢাকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ অবলম্বনে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের চিত্রনাট্য নিয়ে ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবিটি করতে। কারদারকে আমি বিলাত থেকে চিনতাম। তিনি আমাকে সে ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে বললেন ভারতের প্রথম সারির অন্যতম শ্রেষ্ঠ মঞ্চ অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের বিপরীতে। এই শুরু হলো চলচ্চিত্র জীবনে পদচারণা। তারপর কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গীতি-কবিতা, সঙ্গীত পরিচালনা ও প্রযোজনাÑ এসব করে হাত পাকিয়ে প্রথম ছবি পরিচালনা ও প্রযোজনা করলাম ১৯৬৪ সালে ‘অনেক দিনের চেনা’। সে সময়কার এফডিসি ও চলচ্চিত্রের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তখনকার দিনে এফডিসিতে একটি মাত্র ফোর ছিল। অল্প পরিসরের এক নম্বর ফোর। চারদিকে জঙ্গল।’
লন্ডনে থাকার সময় একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশন লন্ডন মজলিসের সঙ্গে আমার খুব দহরম-মহরম ছিল। সেই আমি যখন ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশনের (পিএসএফ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলাম, তখন পাকিস্তানের হাইকমিশনার জনাব ইস্পাহানী আমাকে ডেকে বললেন, ‘পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশন হচ্ছে পাকিস্তান হাইকমিশনের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত একটি সংগঠন। এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হয়ে আপনি লন্ডন মজলিসের সঙ্গে মেলামেশা কমান।’ উত্তরে বলেছিলাম, ‘আপনি পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশনকে বছরে ১০০ পাউন্ড অনুদান দেন বলে যদি মনে করেন যে, পিএসএফ আপনার হুকুম মতো চলবে, তাহলে দয়া করে ওই ১০০ পাউন্ডের অনুদান বন্ধ করে দিন। আমরা ছাত্ররা ফেডারেশনের জন্য যা ভালো বুঝি, সেভাবে ফেডারেশন চলবে।’ তাই চলেছে। যতদিন আমার জানা।
তখনকার সঙ্গে এখনকার পরিবেশের পার্থক্য জানতে চাইলে খান আতা বলেন, ‘এখন সেখানে (এফডিসি) ঢুকলে মনে হয় কোনো নতুন রাজত্বে এসেছি। চারদিকে অশ্লীল ব্যবহারের মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত কাপড়-চোপড় পরা এক্সটা শিল্পীরা জটলা পাকাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে ঝাল-মুড়িওয়ালারাও সেখানে দোকান পেতেছে। এই এফসিডির সঙ্গে সেই পবিত্র স্থানটার বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য নেই। সেই মসজিদটা যেন একটা শুঁড়িখানায় পরিণত হয়েছে।’
দেশের হাল-আমলের চলচ্চিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সবাই নালিশ করেন আগের মতো চলচ্চিত্র হয় না কেন ঢাকায়। আমি তাঁদের বলি, আপনারা সিনেমা হলে যান না বলে। অল্প কথায় বলতে গেলে, বর্তমান বাংলাদেশের সিনেমা যে অধঃপাতে গেছে, তার জন্য শুধু চিত্রনির্মাতাকে দোষী করা অন্যায় হবে। এটা একটা দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত সমাজ সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছে এবং সেই জায়গাগুলো দখল করেছে দিনমজুরের দল। তারা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বক্তব্যধর্মী সিনেমা দেখতে চায় না। তারা চায় উত্তেজনা। তা যৌনই হোক কিংবা মারামারিই হোক। তারা চায় বস্তিবাসিনী বউয়ের তুলনায় লক্ষগুণ সুন্দরী মেয়েদের দেহ ও নৃত্যের নামে অশ্লীল ভঙ্গিমা। এও একধরনের নেশা। ভুলে থাকার নেশা। মদ খাওয়ার মতো স্নায়ুকে অবশ করে দিনের জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে থাকার চেষ্টা। প্রশ্ন হতে পারেÑ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ কি? এমন এক অবস্থা যে টাইফয়েড হয়েছে বলে কোরোমাইটিন খাইয়ে দিলে রোগ সেরে যাবে তা নয়। সমাজের প্রতি স্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে নিয়েছে, তার সবটুকু স্থায়ীভাবে বিতাড়িত করতে না পারলে শুধু চলচ্চিত্র কেন, দেশের সংস্কৃতি তথা অন্যান্য সামাজিক কর্মকা-ে সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে না। সমাজ থেকে এই আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব কার?’
নিজের প্রেম সম্পর্কে খান আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রেম একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। যৌবনে কতোবার প্রেম করেছি, কতোবার আঘাত খেয়েছিÑ সে কথা এ বয়সে সবার সামনে না বলাই ভালো মনে করি। তবে এখন নীলুফার ইয়াসমিন, মানে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আনন্দেই আছি।’
এক বিদেশিনীকে ঢাকা হাইকোর্টকে নিজের বাড়ি হিসেবে দেখিয়ে বিয়ে করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা একটা স্টুপিড গল্প। এই গল্প শুধু আমার বেলাতেই নয়, পঞ্চাশের দশকে যাঁরাই ইউরোপীয় স্ত্রী বিয়ে করে এসেছেন, তাঁদের বেলাতেই এই মুখরোচক গল্পটি ছড়াতে সময় লাগতো না। আমার প্রথম স্ত্রী শার্লি উইটন, যাঁর সঙ্গে আমার পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, তিনি লন্ডনের চেলসি আর্ট কলেজের স্নাতক ডিগ্রিধারী। পিতামাতার একমাত্র কন্যা। পিতা ছিলেন এরানটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং মা ছিলেন একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেরর ব্যবস্থাপক। তাঁরা আমার পারিবারিক নাড়ি-নক্ষত্রের খবর নিয়েই তাঁদের অবিবাহিত মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন এবং আমাদের বিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। আমার পিতা ছিলেন কন্যার অভিভাবক এবং আমার দুলাভাই ছিলেন আমার অভিভাবক। তাহলেই বুঝুন, হাইকোর্ট দেখানোর গল্পটা কতখানি মিথ্যা।’
স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে খান আতা বলেন, ‘একাত্তরে আমি দেশে ছিলাম। এখানে থেকে যতটুকু পারা যায়, ততটুকু করেছি। সে সময় আমার টিভিতে কাজ করা নিয়ে কথা উঠেছে। অনেকেই না বুঝে আমার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বলে থাকেন। তখন আমি ছোটদের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছি। তখনকার গানগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রতীকী অর্থে প্রত্যেকটি গানেরই আলাদা ব্যঞ্জনা রয়েছে। আমার কোনো অনুষ্ঠানে কিংবা গানে পাকিস্তান শব্দটি থাকতো না। এজন্য তৎকালীন আইএসপিআর-এর পিআরও মেজর সালেক আমার কাছে এর কারণ জানতে চান। আমি তাঁকে অন্যভাবে বিষয়টি বুঝিয়েছি। ফলে এখন আমার সম্পর্কে কে কি বললো, তা আমি থোড়াই পরোয়া করি।’
সবশেষে খান আতাউর রহমান বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, একজন শিল্পীকে সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে। মানুষের প্রতি তাঁর দরদ হবে অন্তহীন। প্রকৃতির প্রতি তাঁর প্রেম হবে অপার। স্রষ্টার প্রতি তাঁর আনুগত্য হবে ষোল আনা। দেশকে ভালোবাসতে হবে মায়ের মতো। দেশের মানুষকে চিনতে হবেÑ তা সে সর্বশ্রেষ্ঠ প-িতই হোক কিংবা নিরন্ন চাষীই হোক। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। নিজের জাতীয়তাবাদী সত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তাই বলে কূপম-ুকের মতো নিজের দেশকে পৃথিবীর মুক্ত হাওয়া থেকে সরিয়ে রাাখা চলবে না। পৃথিবীর যেখানে যা কিছু ভালো আছে, তা যদি আমার সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে তাকে আমি আমার দেশের রঙে রাঙিয়ে আপন করে নেব। শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য হবে মানুষের মনকে নাড়া দেয়া। তার দুঃখে সমব্যথী হওয়া। তার আনন্দের ভাগীদার হওয়া। তার মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। সত্য কথা বলতে কুণ্ঠিত না হওয়া, ভীত না হাওয়া। আত্মার তাগিদে মন যে কথা বলতে চায়, তা সুস্পষ্ট ভাষায় বলা। আর যাকেই অসন্তুষ্ট করি, সত্য-সুন্দর যেন অসন্তুষ্ট না হয়। এই হচ্ছে আমার শিল্পী জীবনের দর্শন।’
২২ আগস্ট ১৯৯১
সালাউদ্দিন
ঠিক দুপুরবেলা। বাইরে বিমর্ষ আকাশ। টিপ টিপ বৃষ্টি। বিরক্তিকর। শরতের রুপোলি সাদা মেঘ অদৃশ্য। সূর্য মুখ লুকিয়েছে আবডালে। বিষণœতা ছড়ানো প্রকৃতিতে। ঢিমেতালে চলছে মধ্যাহ্ন। হাতে একদম সময় নেই। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছুতে হবে। আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। সময়ের ব্যাপারে তিনি ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সময় মতোই পৌঁছানো গেল। প্রাইভেট সেক্রেটারি বললেন, ‘স্যার এই মাত্র এলেন। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। কিছুক্ষণ বসতে হবে।’ কী আর করা। একটু বাদে তিনি নিজেই এলেন। আই অ্যাম সো স্যরি। একটু ঝামেলায় পড়ে গেছি। আপনাদের কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। আপাদমস্তক ভদ্রলোক। দামি সোফায়, কার্পেটে, পর্দায় সাজানো অফিস। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল। পরিশীলিত রুচির ছাপ সর্বত্র। এসি অন করা। আগেই প্ল্যান করা, আমরা অন্য একজন সালাউদ্দিনকে জানবো। যিনি ফুটবলার সালাউদ্দিন নন। হন্তদন্ত হয়ে ফের এলেন ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন। অসম্ভব ব্যস্ত। ঝকঝকে মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। একটু অন্যমনষ্ক। কোথাও যেন জীবনের তাল কেটে গেছে। এ কারণে প্রথমেই জানতে চাওয়াÑ কেমন আছেন? ঠোঁটে এক চিলতে ম্লান হাসি ঝুলিয়ে বললেন, ‘এই তো কোনো রকমে বেঁচে আছে।’ তাঁর বলার ভঙ্গি ও উত্তরে বিষাদের সুর জড়ানো। এমন অবস্থার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। একটু থমকে যেতে হলো। ফুটবলের এই বরপুত্র অনেক কি বদলে গেছেন! হ্যাঁ, আমাদের অনুমানই ঠিক। জীবনসঙ্গিণী স্ত্রী ইমা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। জটিল রোগ। প্রায় বছরখানেক শয্যাশায়ী। বিশ্বের তা’বড় তা’বড় চিকিৎসকরাও হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যাংককে, যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা হয়েছে। অবস্থার আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এখন আবার লন্ডনে যেতে হবে। স্বভাবতই সালাউদ্দিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। স্ত্রীকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। তাঁর জীবনের যাবতীয় সাফল্যের উৎস স্ত্রী ইমা। স্ত্রী সম্পর্কে বলতে গিয়ে এদেশের ফুটবলের যুবরাজ সালাউদ্দিনের চোখে টলটল করছিলো অশ্রু। এরকমভাবে তাঁকে আর কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ফলে ভেতরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার। এই অন্ধকার কাটিয়ে ওঠার জন্য জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়া হলো। সে সুযোগে প্রসঙ্গান্তরে চলে আসা।
সালাউদ্দিন, আপনি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন? ঝটপট উত্তরÑ ‘কৈ, না তো! এমন কখনোই মনে হয়নি। চেহারায় যদি বুড়ো হয়ে থাকি, সেটা অন্য কথা। বয়স হচ্ছে। তা হতে পারে কিন্তু মনের দিক দিয়ে আমি এখনো সেরকম অনুভব করি না। আসলে এ নিয়ে আমি কখনই চিন্তা করি না। করা উচিতও নয়। ফিজিক্যালি সম্ভবত আমি আনফিট নই। অনেক সময় ওজন বেড়ে যায়। তখন জগিং করি। টেনিস খেলি। সাঁতার কাটি। তবে শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকলে বুড়ো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা নির্ভর করে নিজের ওপর।’
একসময়ের সাড়া জাগানো ফুটবলার সালাউদ্দিন। এখন পুরোমাত্রায় ব্যবসায়ী। কি করে সম্ভব?
‘আমি ব্যবসায়িক পরিবার থেকেই এসেছি। এ কারণে আমার কাছে নতুন কিছু মনে হয়নি। এটা সহজাতভাবেই এসে যায়। তাছাড়া যখন ফুটবল খেলতাম, তখন থেকেই ব্যবসায় হাতেখড়ি।’
খেলাধুলার প্রতি কি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছেন?
‘কখনই নয়। আসলে কোথাও ইনভলব্্ড্ হওয়ার জায়গা পাইনি। না কাব, না জাতীয় পর্যায়ে। এবার আবাহনী ডেকেছে। তেমন একটা ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু স্ত্রীর তাগিদে রাজি হতে হলো। ওঁর কথাÑ ফুটবল নিয়ে মেতে থাকলে মানসিক অশান্তি থেকে দূরে থাকতে পারবো। অনেকেই অনেক রকমভাবে রিলাক্স করে। এটাও আমার রিলাক্সেশন। তা না হলে নানান ঝক্কি-ঝামেলা আর টেনশনের মধ্যে আরেকটি জটিলতায় জড়াতাম না।’
আকাশী রঙের জার্সি গায়ে চড়িয়ে ফুটবলে শিল্প সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকার কারণে সালাউদ্দিনকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাঝপথে ক্ষান্ত দিতে হয়। শাহীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু আর অগ্রসর হতে পারেননি। এ সম্পর্কে তিনি বলেনÑ ‘প্রথমে অর্থনীতিতে ভর্তি হলেও পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চলে আসি। খেলা ও পড়া দুটোই চলছিলো। তখন পরীক্ষার সময়। বাংলাদেশ জাতীয় দল প্রথম বিদেশ যাবে মারদেকা টুর্নামেন্টে অংশ নিতে। ফাঁপরে পড়ে যাইÑ কোনটা বেছে নেব? ফুটবল, না পরীক্ষা? বাবা আমার ওপর ছেড়ে দিলেন। তুমি কোন্ পথে যাবে, সেটা তোমারই সিদ্ধান্ত। তখন ভাবলাম, আমি কখনই চাকরি করবো না। তাহলে আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করে কি হবে? আমি ফুটবল বেছে নিলাম।’
জীবনে সাফল্য পেতে হলে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না? ‘অবশ্যই আছে। তবে আমি এ নিয়ে বিতর্কে যেতে চাই না। আসলে এটা নির্ভর করে জীবনের লক্ষ্য কীÑ তার ওপর, সেই আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার বেলায় যেমন আমি অষ্টম শ্রেণীতে থাকতেই লক্ষ্যটা স্থির করে ফেলি। ব্যবসার প্রতি আমার টান। চাকরি আমার ধাতে নেই। আমার বাবা-মাও কখনই আমাকে চাপ দেননি। লেখাপড়াটা আমি সিরিয়াসলি নিতে পারিনি। এমনকি আমার ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট সার্টিফিকেটও তুলিনি।’
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সালাউদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে বেশিদিন হয়নি। তাদের সম্পর্কে এখনো বলার সময় হয়নি। এখন প্রশংসা কিংবা নিন্দা কোনোটাই করা যাবে না। অনেক সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। সংসদীয় সরকার গুছিয়ে বসুক। তারপর দেখা যাবে।’
রাজনীতির প্রতি আগ্রহ আছে কিনা জানতে চাইলে সালাউদ্দিন বলেন, ‘রাজনীতি কখনো করিনি। কখনই কোনোভাবে জড়িত ছিলাম না। তবে এটাকে যদি রাজনীতি বলেন, তাহলে আমার একমাত্র রাজনীতি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ। তখন মনে-প্রাণে দেশের স্বাধীনতা চেয়েছি। সেটা পেয়েছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি।’
ভবিষ্যতে নির্বাচন করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একদম ইচ্ছে নেই। কেউ অফার দিয়েছিলো কিনাÑ তা বলতে চাই না।’ যুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে সালাউদ্দিন বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে আজো মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লেখা হয়নি। যে কারণে আজকালকার ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানে না। তারা ভুল জানছে। ভুল শিখছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক একজন এক এক রকম বলছেন মূল কথা তুলে ধরা হচ্ছে না। তুলে ধরার দায়িত্ব শেখ মুজিব বা জিয়ার ছিল না, শেখ মুজিব এবং জিয়া একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। এ কারণে রাজনীতিকদের দোষ ধরা ঠিক হবে না। তাঁরা নিজেদের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব বুদ্ধিজীজীদের। তাঁরাই তো জাতির বিবেক, বুদ্ধি, চালিকাশক্তি। তাঁরা কেন এগিয়ে আসছেন না। দু’দশক পেরিয়ে গেছে। আর কবে আসবে?’
দেশ নিয়ে বলতে গিয়ে সালাউদ্দিন থেমে যান। মনে হলো অভিমান জমা হয়ে আছে বুকে। শুধু বললেন, ‘দেশ নিয়ে বলার পর্যায়ে আমি পৌঁছাইনি।’
তারুণ্যের অবক্ষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এজন্য মূলত পিতামাতারাই দায়ী। যে বাসার হাল শক্ত হাতে ধরা, সেই বাসার ছেলেমেয়েরা নষ্ট হতে পারে না। ছেলেমেয়েদের প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব অনেক। শুধু খাওয়ানো-পরানোর মাধ্যমে সেই দায়িত্ব ফুরিয়ে যায় না। আমাদের শৈশবে পিতামাতার নির্দেশ ছিল সূর্য ডোবার আগে বাসায় ফিরে আসবে। যতো আকর্ষণ থাকুক না কেন, আমরা সেই নির্দেশ অমান্য করার সাহস পেতাম না। যেখানেই থাকতাম না কেন, নির্ধারিত সময়ে বাসায় ফিরে আসতাম। ডিসিপ্লিন হলো আসল। এজন্য পিতামাতার ভূমিকা অগ্রগণ্য। সে সঙ্গে তাদেরকে সন্তানের ভালো বন্ধু হতে হবে। আসলে ঘর ঠিক থাকলে সব ঠিক। তবে এ কথাও ঠিক, খেলাধুলার মাঠ নেই। বিনোদনের সুযোগ নেই। এ দিকটাও ভাবনার।’
সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল তরুণদের রাজনীতিতে ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই, আপনারাই দেখছেন।’ স্বার্থানে¦ষী মহল সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ব্যাপারে সালাউদ্দিন বলেন, ‘খেলোয়াড়দের কোনো জাত নেই। তাদের এত জাতের সঙ্গে মিশতে হয় যে, কোনো পার্থক্য করা যাবে না। তারা সব কসমোপলিটন। তবে পৃথিবীর সব গ-গোলের মূলে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা। এটা থাকবে। তা না হলে ধান্ধাবাজরা ফায়দা লুটবে কি করে?’ সংবাদপত্রের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? ‘এ ব্যাপারে বলতে ভয় পাই। বিদেশের সাংবাদিকরা যেরকম সতর্ক থাকেন, আপনারা যদি সেরকম থাকতেন, তাহলে অনেক কথাই স্পষ্ট করে বলতে পারতাম। কিন্তু সেই সুযোগ নেই। আপনাদের হাতে কলম, কলমের খোঁচায় যা খুশি লিখতে পারেন। কার কি ক্ষতি হলো তলিয়ে দেখেন না, প্রতিবাদ দিলে হেলাফেলায় ছাপা হয়। সেটা কোনো কাজে আসে না। যা ক্ষতি হবার হয়ে যায়। এজন্য বললাম, এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’
জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে জনকল্যাণ ও সমাজসেবামূলক কর্মকা-ে কিছু করণীয় আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে সালাউদ্দিন বলেন, ‘কম-বেশি কিছু করছি। বিভিন্ন এতিমখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছি। এক্ষেত্রে আমি খুব সিরিয়াস। আমার পয়সা হলে আমি নিজেই কয়েকটি এতিমখানা করবো। এত আহার-বস্ত্র জোগানোর পাশাপাশি তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকবে। এগুলো হবে ঢাকার বাইরে। আমি যখন ভোরবেলায় ফুটবল প্র্যাকটিস করতাম, তখন অনাথ শিশুদের দেখতাম। আমার হৃদয় মুচড়ে উঠতো। কিছু একটা করার জন্য ছটফট করতাম। সে সময় থেকেই এতিমখানা করার স্বপ্ন দেখি। আমার সাধ্যে যতোটা কুলায়, আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাই।’
আমাদের দেশে এটা নিয়মে পরিণত হয়েছে, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবদ্দশায় তার প্রাপ্ত সম্মান দেয়া হয় না। এখানে মরণোত্তর সম্মান দেয়া হয় বেশি। এ কথাটা কি সঠিক?
ম্লান হেসে সালাউদ্দিন শুধু বললেন, ‘আমি এখনো জাতীয় পুরস্কার পাইনি। তবে দর্শকদের কাছ থেকে আমি আমার প্রাপ্য সম্মান পেয়েছি। অনেক বেশি পেয়েছি। তাদের কাছে আমার কোনো অভিযোগ নেই। এই সম্মানের বাইরে আরো কিছু আছে কিনা আমি জানি না।’
নিজেকে গোছানো স্বভাবের মানুষ মনে করেন কিনা জানতে চাইলে সালাউদ্দিন বলেন, ‘তাহলে তো মানুষ হয়ে যেতাম।’
সালাউদ্দিন বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র দেখেন না। বরং টিভিতে যখন মাঝে মাঝে তা দেখানো হয়, তখন টিভি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, চলচ্চিত্রে কোন্ সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয় বুঝতে পারি না।’ সাহিত্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এদেশের ভাষা ও সাহিত্য উত্তরাধিকার সূত্রে সমৃদ্ধ।’
সালাউদ্দিন তরুণ বয়সে ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কম বয়সে বিয়েটা আমার জন্য কাজ দিয়েছে। বিয়েটা বয়সের ওপর নির্ভরশীল নয়। এটা নির্ভর করে কার কি অ্যাম্বিশন, তার ওপর। কেউ কম বয়সে, আবার কেউ বেশি বয়সে বিয়ে করতে পারেন। আবার কারো বিয়ে করা উচিত নয়। কেননা, কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করার অধিকার কারো নেই।’
এবারের আবাহনী টিম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি গত দু’তিন বছর কোনো খেলা দেখিনি। এ কারণে খেলোয়াড়দের সম্পর্কে জানি না। সাধারণত প্রশিক্ষণ দিলে আমি নিজে দল গঠন করে থাকি। কিন্তু এবার তা করতে পারছি না। এবার দল করছে তান্না। তাঁকে হেলাল সহযোগিতা করছেন। দল ভালো করলে সব ক্রেডিট তাদের। জীবনের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্পর্কে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমার যা উচ্চাকক্সক্ষা, তার সিকিভাগেও পৌঁছতে পারিনি। আরো কতো এগিয়ে যাবার ছিল; কিন্তু পারলাম আর কোথায়!’
সবশেষে সালাউদ্দিন বলেন, আমি জানি, আপনারা আমার সঙ্গে কথা বলে কোনো আরাম পাননি। অনেক কথাই আমি সরাসরি বলতে পারিনি। আমার ফ্রিডম থাকলে আমি অনেক কিছু বলতে পারতাম। যদি সেই নিশ্চয়তা পেতামÑ আমার জন্য আমার সংসারকে কষ্টভোগ করতে হবে না, তাহলে অনেক কিছুই বলতে পারতাম। কিন্তু এখন আমি বলতে পারবো না। আগে অনেক কিছু বলেছি। অনেক সাহস দেখিয়েছি। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং তাতে আমাকে এবং আমার পরিবারকে খেসারত দিতে হয়েছে।’ অনেক না-বলা কথার আভাস অভিমানী সালাউদ্দিনের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠলেও আমরা তা জানতে পারিনি।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯১

কলিম শরাফী
কখনো প্রকাশ্যে, আবার কখনো অপ্রকাশ্যে। বরাবরই তিনি নিষিদ্ধ। পরিবর্তিত হয়েছে মানচিত্র। বদলে গেছে জাতীয় পতাকা। কিন্তু অপরিবর্তিত রয়েছে কলিম শরাফীর ওপর ঝুলে থাকা অদৃশ্য খড়গ। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজের প্রচারবিমুখতা। আড়ালে-আবডালে কাটছে তাঁর জীবন ও সময়। সঙ্গীত তাঁর বুকে, কণ্ঠে, ভালোবাসায়। বিশেষ করে রবীন্দ্র সঙ্গীত তাঁর কণ্ঠে ঝরে পড়ে স্বর্ণরেণু হয়ে। তাঁর গায়ন ভঙ্গিতে মুগ্ধতার পরশ লাগানো। কণ্ঠের মাধুর্যে হৃদয় ভরে ওঠে অনির্বচনীয় অনুভূতিতে। গণসঙ্গীতেও তিনি তুলনারহিত। মুহূর্তেই আগুন ধরিয়ে দেন ধমনীতে। রক্ত ফুটতে থাকে টগবগিয়ে। এখন তাঁকে দেখা যায় কদাচিৎ। অবশ্য গণমাধ্যম কিংবা প্রতিষ্ঠানের বলয়ে তাঁকে কখনোই খুব একটা দেখা যায়নি। কলিম শরাফীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের খয়রাটিতে। ১৯২৪ সালে। জন্মেই দেখেন ক্ষুব্ধ জন্মভূমি। কলকাতা মাদ্রাসা স্কুলে পড়াকালীন জড়িয়ে পড়েন হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনে। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অবমাননার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনের ডাক দেন সুভাষ বোস। বীরভূম থেকে ম্যাট্রিক দেয়ার পর ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট মহাত্মা গান্ধীর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ওতপ্রোতভাবে। এক বছর কারাভোগ। জেল থেকে বেরিয়ে সম্মুখীন হন পঞ্চাশের মন¦ন্তর-এর। রাস্তা-ঘাটে, আনাচে-কানাচে, অলিতে- গলিতে পড়ে থাকতে দেখেন সংখ্যাহীন লাশ। রাশি রাশি লাশ। কেঁদে ওঠে মন। নেমে পড়েন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে। মুখে গান, হাতে থলি। এরপর কৃষ্ণনাথ কলেজ, ক্যাম্বেল মেডিকেল ও কমার্স কলেজে ভর্তি হওয়া। কোনোটাই শেষ করা হয়নি। ততোদিনে মাথায় ঢুকে গেছে গান- বাজনা, রাজনীতির পোকা। এক্ষেত্রে রক্ষণশীল পরিবারের দুস্তর বাধা। আত্মবিশ্বাসে কাটিয়ে ওঠেন সেই বাধা। এর আগেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (আইপিটিএ)। এখানেই তালিম নেন গণসঙ্গীতের। এরই মাঝে প্রত্যক্ষ করেন দাঙ্গার বীভৎসতা। নিজে বেঁচে যান কোনোক্রমে। সপ্তাহখানেক লুকিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে। দেশভাগের আগে কলকাতা রেডিওতে গান গাইতেন। অসহায়ভাবে লক্ষ্য করেন দেশ বিভাগ। তিনি থেকে যান কলকাতয়। আইপিটিএ’র সঙ্গে বিভিন্ন কারণে মনোমালিন্য হওয়ায় বেরিয়ে আসেন সেখান থেকে। নাট্য আন্দোলনের পুরোধা শম্ভু মিত্রের সঙ্গে গঠন করেন বহুরূপী। নাটকের অন্তর্লীন ভাব ও সৌন্দর্যে মেতে থাকেন। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকে যাওয়ায় জীবিকা হিসেবে বেছে নেন গানের টিউশনি। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মন্দাভাব এবং দাঙ্গা অন্তরায় হয়ে ওঠে টিউশনির। তাছাড়া আব্দুল আহাদ, সিকান্দার আাবু জাফর প্রমুখের তাগাদা ঢাকায় আসার। বাবাও থাকতেন ঢাকায়। সবকিছু ভেবে-চিন্তে ঢাকায় পাড়ি জমান। এসে দেখেন কারো সঙ্গে খাপ খায় না চিন্তা-ভাবনার।
‘এ অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে কয়েক মাস বাদেই চলে যাই চট্টগ্রামে। বিভিন্ন রকম রোজগারে ব্যস্ত থাকি। এ সময় ‘প্রান্তিক’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। স্বদেশী গান, গণসঙ্গীত, নানারকম উদ্দীপনামূলক কর্মকা- চলতে থাকে। চট্টগ্রামে থাকার সময় ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশ নেই। সে সময় আবুল ফজল, মাহবুবুল আলম চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী, আজিজ মিসির প্রমুখ সাহসী ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের পর যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ হয়। আমি পালিয়ে চলে যাই কলকাতায়। কিছুদিন পর ঢাকা ফিরে আসি। গান-বাজনা, নাটক-নৃত্য অব্যাহত থাকে। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর আমাকে রেডিওতে নিষিদ্ধ করা হয়। সম্ভবত সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো সরকারি ফাইলে রয়ে গছে।’
টিভি চালুর ক্ষেত্রে কলিম শরাফী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সেটা ১৯৬৪ সালের কথা। টিভি এখানে চালু করাটা ছিল জাপানের একটি পাইলট প্রজেক্ট। তৎকালীন সাংস্কৃতিক কর্মী, বর্তমানে চেম্বার অব কমার্সের সদস্য জিয়াউল হক একদিন এসে জানালেন, জাপানিরা আপনাকে ‘চিফ অব গ্রোগ্রাম’ করতে চায়। আমি আগ্রহী কি-না? প্রজেক্ট ডিরেক্টর মি. ইনুওয়েও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সব জেনেশুনে আমি তাঁদের প্রস্তাবে সম্মত হই। টিভি সম্পর্কে সে সময় আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। এ কারণে জাপানে আমাদের জন্য ট্রেনিং কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের যাবার সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক। হঠাৎ আমার পাসপোর্ট সিজ করা হলো। আমাকে করা হলো ব্ল্যাক লিস্টেড। পরে এর কারণ জানতে পেরেছিলাম। ১৯৬৩ সালে আফসারী খানম, মালিকা আজিম ও আমি কোলকাতা গিয়েছিলাম রবীন্দ্র সম্মেলনে অংশ নিতে। এটা আমার অপরাধ। এ জন্য আফসারী খানমের স্বামী সিএসপি অফিসার খান শামসুর রহমানকেও ধমক দেয়া হয়। তৎকালীন পাসপোর্ট অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর কাজী বাহাউদ্দিন আহমেদ আমার পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। যা হোক, তখন আমার ঘাড়ে দায়িত্ব বর্তায় টিভির জন্য প্রডিউসার খুঁজে বের করার। আতিকুল হক চৌধুরী তখন রেডিওতে। তাঁকে আসতে বললাম। তিনি অনিশ্চয়তার কারণে রাজি হলেন না। মুস্তফা মনোয়ার, আবদুল্লাহ আল মামুন প্রমুখকে সংগ্রহ করি। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো কয়েকজনকে আনলাম। এজন্য আমাকে হুমকিও দেয়া হয়। টিভির উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার টিভি অধিগ্রহণ করে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে আসেন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের জামাই মুসা আহমেদ। তিনি এসে আমাকে নানাভাবে জ্বালাতন করতে থাকেন। ফলে অতিষ্ঠ হয়ে টিভি থেকে রিজাইন করে চলে আসি। এরপর নিজে মতিঝিলে চালু করলাম এইচ.এম.বি’র অফিস। সে সময় হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানির অফিস ছিল করাচিতে। করাচি অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন রাশেদ লতিফ। তাঁর সঙ্গে আমার সুসম্পর্কে গড়ে ওঠে। তাঁরই সহযোগিতায় আমি এদেশে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করি। তিনটি রেকর্ডে আফসারী খানম, সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, রাখী চক্রবর্তী, বিলকিস নাসিরুদ্দিন ও আমার গাওয়া ২০০ গান ধারণ করি। রেকর্ড তো বের করলাম। কিন্তু কিনবে কে? এ জন্য ভালো প্রচার দরকার। আমার মাথায় তখন অন্য একটা বুদ্ধি খেলে যায়। শেখ মুজিব তখন গণমানুষের নেতা। তাছাড়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে খালাস পাবার পর তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদেরই গান। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, সত্তরের নির্বাচনের পর তাঁকে এই রেকর্ড উপহার দেব। বাংলা একাডেমীতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে রেকর্ডগুলো উপহার দিই। এতে খুব সাড়া পড়ে যায়। রেকর্ডগুলো হটকেক হয়ে ওঠে। অল্প সময়েই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আমাকে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ডিরেক্টর জেনারেল করা হয়।’
স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর প্রাক্কালেই কলিম শরাফী লন্ডনে চলে যান। এতে তাঁকে সহযোগিতা করেন রাশেদ লতিফ। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই ভদ্রলোক পাকিস্তানী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। তিনি ঘটনা আগেভাগেই আঁচ করতে পেরে আমার জন্য লন্ডনের একটি টিকিট কেটে রাখেন। লন্ডনে গিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিভিন্ন কর্মকা-ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। স্বাধীনতার পর চলে আসি দেশে। দেশে ফেরার পর পুরোপুরি বেকার। গ্রামোফোন কোম্পানি বন্ধ। তাছাড়া বনিবনা না হওয়ায় সেখান থেকে পদত্যাগ করি। তখন সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুস ডেকে নিয়ে টেক্সটাইলের পাবলিক রিলেশন অফিসার পদে চাকরি দেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার ছয় মাস পরই এক ঘণ্টার নোটিশে অফিস থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়। তারপর বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী এম কে আনোয়ারের শ্বশুর লতিফ বিশ্বাস ডেকে নিয়ে একটি দোকান দিলে ডাইং-এর ব্যবসা শুরু করি। বর্তমানে আমি বেঙ্গল গ্রুপের একজন পরিচালক। এই গ্রুপ থেকে দেশে ও বিদেশে বাংলা গানের প্রসার ও মানোন্নয়নে ‘সপ্তস্বর’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর সার্বিক দায়দায়িত্ব আমার।’ কলিম শরাফী অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গান গেয়ে আসছেন। অথচ সে তুলনায় তাঁর ক্যাসেট কিংবা রেকর্ডের সংখ্যা কম। এমনকি টিভি কিংবা রেডিওতে তাঁর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তিনি নিজেও ইচ্ছে করলেই অসংখ্য ক্যাসেট কিংবা রেকর্ড বের করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আসলে প্রথমত, সুযোগ-সুবিধা ও অর্থকড়ির অভাব। দ্বিতীয়ত, আমি আমার নিজের ক্যাসেট বের করার পক্ষপাতী নই। টিভির দায়িত্বে যখন ছিলাম, তখনো খুব একটা গাইনি। গ্রামোফোন কোম্পানিতে থাকাকালে একই অবস্থা। সব সময় অন্যদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এখনো তাই করছি। তবে আমার কণ্ঠটাকে ধরে রাখার জন্য একটা ক্যাসেট বের করার ইচ্ছে আছে।’
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কলিম শরাফী সুখী নন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। কিন্তু রাজনীতির মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। বিশেষ করে টিভি দেখার পর মনে হয় না আদৌ কোনো পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তান আমলে যা ছিল, এখনো তাই। পাঞ্জাবিদের স্থলে বাঙালি শাসক। সংসদ নির্বাচনের আগে টিভিকে স্বায়ত্তশাসনে অঙ্গীকার করা হয়েছিল। অদ্যাবধি তা হয়নি। একমাত্র শেখ মুজিবের আমলে টিভির কিছুটা স্বাধীনতা ছিল; কেননা তাঁকে বুঝালে বুঝতেন। এরশাদের আমলে টিভি হয়ে ওঠে সাহেব-বিবি-গোলামের। এখন সাহেব না থাকলেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। টিভি তো এখন নিজের আয়ে চলে। স্বায়ত্তশাসিত করতে অসুবিধা কোথায়?’ তিনি বলেন, ‘সবক্ষেত্রেই একটা নেতিবাচক প্রবণতা। ভালো একটা পাবলিক স্টেজ নেই। বেইলী রোডের সীমিত পরিসরে নাটক হয়। শিল্পকলা একাডেমী যেজন্য, তার কিছুই করা হয়নি। অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং কোনো গবেষণা নেই। শিল্পকলা একাডেমী এখন সরকারি অনুষ্ঠান-নির্ভর। নাচের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হলেও উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। ফিল্মের অবস্থা কি? কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে পারেন না। আগে ব্রিটিশদের, পাকিস্তানিদের দোষারোপ করতাম। এখন তো তারা নেই।’ কলিম শরাফী মনে করেন, ‘এটা নির্ভর করে রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। সুস্থ রাজনীতি হলে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা হবে। আজীবন তো এজন্যই সংগ্রাম করেছি। জনণকে সুস্থ সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের। সেই নেতৃত্ব কোথায়? সবাই আছেন নিজ নিজ আখের গোছানোর তালে। দেশে উন্নতির জন্য, দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসারে যোগ্য নেতৃত্ব এবং সচেতন মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। হারানো ঐতিহ্যকে গবেষণা করে খুঁজে বের করা দরকার। নিজের অতীতকে না জানলে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। শিল্প-সংস্কৃতি সরাসরি বিপ্লব করতে পারে না; তবে মানুষকে বিপ্লবের দিকে মোটিভেট করতে পারে।’
তরুণদের অবক্ষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, আসলে গাইড করার কোনো লোক নেই। যাঁর যেটা দায়িত্ব, তিনি সেটা পালন করছেন না। প্রতিভা বিকাশের সুযোগ নেই। অনেকেই ব্যক্তি-উদ্যোগে নাটক, গান-বাজনা, নাচের স্কুল খোলেন। কিন্তু সাহায্য-সহযোগিতার অভাবে অগ্রসর হতে পারেন না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অর্থাৎ সুস্থ জীবনবোধের প্রতি তরুণদের নিয়োজিত করতে না পারলে অবক্ষয় তো হবেই। হ্যাঁ, এ অবস্থা সাময়িক। পরিবর্তন আসবে। সেরকম সময় একদিন আসবে। নিশ্চয়ই অনেকেই এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে।’
তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে কলিম শরাফী বলেন, ‘ইয়ং জেনারেশনের দু’রকম মনোভাব। একদল মনে করে দেশে থেকে কিছু হবে না। তারা বিদেশে চলে যাচ্ছে কিংবা যাবার চেষ্টায় আছে। অপর দল মনে করে যা করার, দেশে থেকেই করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যে কোনো পরিবর্তন হুট করে আসবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্যের। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এজন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে ২৩ বছর। আমরা লড়ে লড়ে হয়রান হয়েছি। শেষে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আসবেই।’
শিল্প-সংস্কৃতির সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবক্ষেত্রেই সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সুন্দর সুন্দর নাটক হচ্ছে। আজ মানুষ টিকিট কেটে নাটক দেখছেন। এক সময় আমি অর্থের বিনিময়ে গান শেখাতে গিয়ে অপমানিত হই। এ কারণে পরবর্তীকালে অর্থের বিনিময়ে আর টিউশনি করিনি। অথচ এখন গানের শিক্ষকদের যথেষ্ট ডিমান্ড। সব ক্ষেত্রে প্রচুর সম্ভাবনা। অবশ্য নিজ নিজ প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলেছে। এজন্য তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। নতুবা তারা হতাশ হয়ে পড়বে।’
সবশেষে নিজের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কলিম শরাফী বলেন, ‘অন্যদের যেভাবে দেখি, সে তুলনায় আমি অনেক ভালোই আছি। কিন্তু কথা বলার স্বাধীনতা নেই। যা বিশ্বাস করি, যা চিন্তা করিÑ তা প্রকাশ করতে পারি না। বলার কিংবা লেখার স্বাধীনতা নেই। সবকিছুই মেপে মেপে বলতে হয়। এটা একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের জন্য দুঃসহ। কিছু বলতে গেলেই নেমে আসবে অদৃশ্য খড়গ। ব্রিটিশদের খেদিয়েছি। পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করেছি। এ জন্যই কি জেল খেটেছি? জুলুম সয়েছি? দু-দু’বার স্বাধীন হয়েছি? দীর্ঘদিন বুকের মাঝে জমে থাকা প্রশ্নগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে কানের কাছে বাজতে থাকে।
২২ সেপ্টেম্বর ১৯৯১

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল খেলোয়াড় গড়ার কারিগর মোস্তাফা কামাল/ দুলাল মাহমুদ