এখন সময় মেসির, এখন সময় আর্জেন্টিনার / দুলাল মাহমুদ



আমাদের শৈশবটা ছিল ফুটবলময়। যে কারণে ফুটবল নিয়েই আমাদের বেড়ে উঠা। আমাদের স্বপ্ন দেখা। তখন ঢাকার ফুটবলের যে রমরমা ছিল, তা এখন কল্পনাই করা যায় না। শুধু এটুকু বলা যায়, বিশ্বকাপ ফুটবল এলে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যে মাতামাতি, তারচেয়েও বেশি ছিল মোহামেডান এবং আবাহনীকে নিয়ে উন্মাদনা। সঙ্গত কারণে ফুটবল থেকে আমাদের দূরে থাকার সুযোগ ছিল না। ফুটবলেই সঁপে দিয়েছিলাম মন-প্রাণ। ঢাকার ফুটবলের বাইরে বিশ্ব ফুটবলের যেটুকু টুকরো টুকরো স্পন্দন আমরা টের পেতাম, তার বেশিরভাগই কালো মানিক পেলে আর ব্রাজিলকে কেন্দ্র করে। কী কারণে পেলে ও ব্রাজিল বুকের মরমে পৌঁছে যায়, সেটা গভীরভাবে তলিয়ে দেখিনি। তা বোধকরি অনুভবের ব্যাপার। আমাদের বয়সে ব্রাজিল ছাড়া আর কোনো দল মনোযোগ কাড়তে পারেনি। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত ও দলীয় ক্রীড়াশৈলী দিয়ে অনেক ফুটবলার ও দেশ আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ব্রাজিলের পর সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। লাতিন ঘরানার এই দুই দেশই হয়ে উঠেছে সবার প্রিয়। আসলে ভালো লাগা আর ভালোবাসার ব্যাপার কারো কোনো হাত থাকে না। কীভাবে কীভাবে যেন হয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনাকে সমর্থন নিয়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলে। এখন আর সেটা মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকাশ্যেই এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। এই দুই দলের সমর্থকরা একে অপর দলের মঙ্গল কামনা করেন না। এমনকি এ নিয়ে রেষারেষি, বৈরিতা আর বিরোধও সৃষ্টি হয়। কী কারণে এমনটি হয়, আমার কাছে বিষয়টি বোধগম্য নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক কারণে প্রতিবেশী দুই দেশ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে, সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে তার প্রভাব কেন পড়বে? ফুটবলই যদি আমাদের ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলবে, তাহলে ফুটবলের দুই দেশ নিয়ে কেন এই বিরোধ? ব্রাজিল হেরে গেছে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের অনেকেই খুশি হয়। আবার আর্জেন্টিনা যদি হেরে যায়, ব্রাজিলের সমর্থকদের মুখে দেখা যাবে হাসি। এর আসলে যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। নাকি সব কিছুতে একটা প্রতিপক্ষ, একটা বৈরিতা, একটা বিরোধিতা না থাকলে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। এ ধরনের মনোভাব ভালো কি মন্দ বলতে পারবো না। তবে বিদেশি দু’টি দেশকে সমর্থন নিয়ে এ রকম মনোভাব আমার অন্তত ভালো লাগে না। অবশ্য তাতে কার কীইবা আসে যায়?
জার্মানির কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে বিদায় নেওয়ায় আমারও মন খারাপ হয়েছে। শৈশবের একটি প্রিয় দলের এমন লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অন্য অনেকের মতো আমিও চেয়েছিলাম অল-লাতিন ফাইনালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হোক। সেটা তো আর হলো না। বিশ্বকাপে ইউরোপীয়দের দাপট দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ফাইনালে ইউরোপীয় কোনো দল খেলেনি, ১৯৫৪ সাল থেকে এমন কখনো দেখা যায়নি। এবারও জার্মানি ফাইনালে উঠার পর অল-ইউরোপ ফাইনালের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে দিয়ে আর্জেন্টিনা লাতিনদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এমনিতে ইউরোপ ১০ এবং লাতিনরা ৯ বার বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছে। এবার যদি আর্জেন্টিনা শিরোপা জিততে না পারে, তাহলে ব্যবধানটা বেড়ে যাবে। তাছাড়া লাতিন থেকে ইউরোপের শিরোপা জিততে না পারার অপবাদও ঘুচে যাবে।
তাই এখন সময় লিওনেল মেসি আর আর্জেন্টিনার। লাতিনদের আধিপত্য ও শৈল্পিক ফুটবলের স্বার্থেই জয়ী হওয়া দরকার ‘লা আলবিসেলেস্তে’দের। কিন্তু দুর্ধর্ষ জার্মানিকে হারানোটা খুব একটা সহজ হবে না। সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ একটি দল ‘দ্য টিম’। এরআগে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে এই দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে দুইবার মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে শিরোপা জয় করে। ১৯৯০ সালেও এই দুই দল একে অপরের সঙ্গে খেলে। কিন্তু সেই ফাইনালটি ফুটবল ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে আছে। মেক্সিকোর রেফারি এদগার্ডো কোডেসালের পক্ষপাতমূলক খেলা পরিচালনার কারণে হারতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। আর্জেন্টিনার দু’জন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখানোর পাশাপাশি খেলার শেষ মুহুর্তে পেনাল্টি দিয়ে জার্মানিকে জিতিয়ে দেন রেফারি। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন ম্যারাডোনা আর তাঁর সহযোগী খেলোয়াড়রা। এরপর আর এই দুই দল চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ২০০২ সালে জার্মানি ফাইনালে উঠলেও তাদের রুখে দেয় রোনালদোর ব্রাজিল। আর এবার ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ১৯৯০ সালের দুঃসহ স্মৃতি। সেদিনের সেই পরাজয়ের বেদনা আর ম্যারাডোনার কান্না এখনও অনেকের স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সেই পরাজয়, সেই কান্না ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ এখন আর্জেন্টিনার। আর্জেন্টিনা কি সেজন্য প্রস্তুত?


dulalmahmud@yahoo.com        

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

ফুটবলে জীবনের জয়গান / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ