মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ




বিশ্ব ফুটবলের কোন দলটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখে অনুধাবন করা যায়, ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার যে কোনো একটি দল হবে। অনুধাবন কেন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে এক চক্কর ঘুরে আসলেই যে কেউ এর সদুত্তর পেয়ে যাবেন। অধিকাংশ এলাকায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের জাতীয় পতাকা সগৌরবে উড়ছে কিংবা এই দুই দেশের জার্সি গায়ে কেউ না কেউ মনের আনন্দে ঘুরছেন। কোথাও কোথাও এই দুই দলকে নিয়ে আঁকা হয়েছে দেওয়াল চিত্র।
তবে দীর্ঘ একটা সময় কালো মানিক পেলে, প্রতিভার বরপুত্র গ্যারিঞ্চার মতো শিল্পী ফুটবলার আর শৈল্পিক ফুটবলের কারণে এ দেশে ব্রাজিলের একচেটিয়া সমর্থন ছিল। সে সময় তাদের কোনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল না বললেই চলে। কিন্তু দিয়াগো ম্যারাডোনা নামের একজন অতিমানবীয় ফুটবলারের বিস্ময়কর নৈপুণ্যে ও অধিনায়কত্বে ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলে ব্রাজিলের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়। আর একইসঙ্গে পেলের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেন ম্যারাডোনা। বিশেষ করে, সেবারের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে চাতুর্যের সঙ্গে করা প্রথম গোল ‘হ্যান্ড অব গড’ এবং ৬০ মিটার ড্রিবল করে পাঁচজন ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে করা দ্বিতীয় গোলটি ‘দ্য গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলে ম্যারাডোনা হয়ে উঠেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ষ্ট্রাইকার। অনন্যসাধারণ এই নৈপুণ্যের জন্য ম্যারাডোনার ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যা দ্রুতই বেড়ে যায়। ১৯৯০ সালে ইতালির বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে আর্জেন্টিনা ও অধিনায়ক ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের প্রতি বিপুলভাবে সহানুভূতিশীল করে তোলে ফুটবল অনুরাগীদের। সেই বিতর্কিত ও কলঙ্কিত ফাইনালে খেলার শেষ মুহুর্তে লেফট ব্যাক আন্দ্রেস ব্রেমার পেনাল্টি গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় পশ্চিম জার্মানি। কিন্তু মেক্সিকোর রেফারি এডগার্ডো কোডেসালের খেলার পরিচালনা ছিল চরম বিতর্কিত ও পক্ষপাতিত্বমূলক। তিনি যেন সেদিন পণ করে রোমের স্টাডিও অলিম্পিকো স্টেডিয়ামে নেমেছিলেন, যেভাবেই হোক আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দিতে হবে। ওইদিন তিনি কী করেননি? আর্জেন্টিনাকে ন্যায্য পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করেছেন, পশ্চিম জার্মানির পক্ষে অকারণেই পেনাল্টি দিয়েছেন এবং আর্জেন্টিনার দু’জন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দিয়ে দলটিকে একেবারে পঙ্গু করে দেন। তাঁর একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ফাইনালের ম্যাচের সৌন্দর্যকেই শুধু বিঘিœত করেনি, সেই ম্যাচটি ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম ম্যাচ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আগের বিশ্বকাপে অতিমানবীয় নৈপুণ্যে ম্যারাডোনার প্রতি মুগ্ধ সমর্থকরা এটা কোনোভাবে মেনে নিতে পারেননি। আর পরের বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনার প্রতি বঞ্চনায় সঙ্গত কারণেই ক্ষোভের আগুনে জ্বলে উঠে বাংলাদেশ। রেফারি কোডেসালের বিপক্ষে নিন্দা, সমালোচনায় উত্তাল হয়ে উঠে সারা দেশ। কোডেসালের বিচার ও ফাঁসি দাবি করে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এমন ঘটনা ফুটবল ইতিহাসে বিরল হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও বাংলাদেশের ক্ষোভ ও বিক্ষোভের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। সেই থেকে আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনা বাংলাদেশের সমর্থকদের কাছে আলাদা মর্যাদা পেয়ে আসছেন। এরপর আর আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও এবং ম্যারাডোনা অনেক বিতর্কিত কার্যকলাপ করলেও তাতে কিন্তু সমর্থন একবিন্দুও কমেনি। বরং দিনে দিনে জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে।
আর্জেন্টিনা দলের বাংলাদেশ সফরে আরেক দফা সমর্থন বৃদ্ধি পায়। কিংবদন্তি পেলে ও ম্যারাডোনার পর বিশ্ব ফুটবলের বরপুত্র হিসেবে স্বীকৃত লিওনেল মেসি। তাঁর নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দল ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরে আসে। আর্জেন্টিনা দলকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। কোনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল ইতোপূর্বে ঢাকায় খেলতে আসেনি। মেসির মতো বিশ্বখ্যাত ফুটবলারেরও দেখা পায়নি বাংলাদেশ। সফরের দ্বিতীয় দিন ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়া জাতীয় দলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলে ‘লা আলবিসেলেস্তে’রা। খেলায় আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে হারায় ‘সুপার ঈগলস’কে। মেসি কোনো গোল করতে না পারলেও দলের গোল করার পেছনে ছিল তাঁর ম্যাজিক টাচ। এই সফরের পর বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের আরো কাছাকাছি চলে আসে আর্জেন্টিনা এবং মেসি। যথাযথ কারণেই এই দলটির সাফল্য-ব্যর্থতায় দারুণভাবে প্রভাবিত হয় এ দেশের আর্জেন্টাইন সমর্থকরা।
আবার যখন ফিরে এসেছে বিশ্বকাপ ফুটবল, তখন আর্জেন্টিনাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন সমর্থকরা। তাঁদের কত হিসেব-নিকেশ? কত জল্পনা-কল্পনা? কত প্রত্যাশা? আর সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন মহানায়ক লিওনেল মেসি। ক্লাব ফুটবলে তাঁর নজরকাড়া নৈপুণ্য আর অবিশ্বাস্য কীর্তির কারণে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন তাঁর অনুরাগীরা। সবার কম-বেশি ধারণা, দীর্ঘ ২৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটাবেন ফুটবলের এই রাজপুত্র। কেননা, তাঁকে কল্পনা করা হয় ম্যারাডোনার উত্তরসূরি হিসেবে। ম্যারাডোনা ২৬ বছরে বয়সে আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব শিরোপা এনে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন দলের অধিনায়ক। এখন লিওনেল মেসির বয়সও ২৬। তিনিও দলের অধিনায়ক। এই দুই সমীকরণকে সামনে রেখে স্বপ্নের জাল বুনছেন অনুরাগীরা। নবাগত বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোবিনাকে হারিয়ে শুভ সূচনা করেছে আর্জেন্টিনা। সবচেয়ে বড় কথা, আট বছর পর বিশ্বকাপে ফুটবলে গোল করে স্বপ্নটাকে উসকে দিয়েছেন মেসি। এই গোলটা তাঁকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। যদিও ‘ড্রাগনস’রা যেভাবে চেপে ধরেছিল, তাতে আশঙ্কার কালো ছায়া ঘিরে ধরেছিল। শুরুতেই যদি আত্মঘাতি গোল না হতো, তাহলে খেলার ফল উল্টে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। মেসি, সার্গিও আগুইরো, গঞ্জালো হিগুয়েনের মতো দুর্ধর্ষ আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের নিয়ে যেভাবে আর্জেন্টিনা জয়ী হয়েছে, তাতে সমর্থকরা সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তবে প্রথম ম্যাচে জয় দিয়ে শুরু করায় আশ্বস্ত হতে পারেন সমর্থকরা। কিন্তু প্রত্যাশা তো শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। সেক্ষেত্রে মেসিকে নিয়ে আশা যেমন আছে, আছে আশঙ্কাও। কোনটার জয় হবে, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।


dulalmahmud@yahoo.com    
 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

কোথায় সেই ফুটবল?

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল খেলোয়াড় গড়ার কারিগর মোস্তাফা কামাল/ দুলাল মাহমুদ