শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ফুল আর পরাধীনতা
পাকিস্তান : ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ
মুশকিল হচ্ছে, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেললে না হয় রাজনীতি চর্চা, না হয় ধর্ম পালন। এ ক্ষেত্রে কাজ করে মতলবী স্বার্থ। নিজেদের স্বার্থের অনুকূল হলে যে কোনো কর্মকা-কে তখন ধর্মের দোহাই দিয়ে হাসিল করার চেষ্টা করা হয়। এমন একটা দ্ব্যর্থক মনোভাব থেকেই পাকিস্তানের জন্ম। কবি মুহাম্মদ আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির স্বপ্ন দেখেছিলেন ১৯৩০ সালে। তার এই স্বপ্ন বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এ কারণে প্রথম অবস্থায় এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ¡ ছিল যথেষ্ট। এমন বিমূর্ত ধারণা কবির কল্পনা বলে সবাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রমাণ মেলে লন্ডনের ওয়ালডর্ফ হোটেলের এক নৈশভোজে। প্রস্তাবিত মুসলমান রাষ্ট্রের ধারণা মুসলমান নেতারা একে ‘অবাস্তব ও মরীচিকাময়’ বলে এক কথায় নাকচ করে দেন। বিষয়টির সেখানেই অংকুরেই বিনাশ ঘটতো। কিন্তু একদল হিসেবী লোক নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে এ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকেন ভেতরে ভেতরে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৪০ সালের লাহোর সম্মেলনে। কবি ইকবালের এই দ্বিজাতিতত্ত্বকে ‘সর্বরোগহরিহর’ হিসেবে গ্রহণ করে মুসলিম লীগ। যে দলটির নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন অভিজাত মুসলমানরা। যাদের জীবনে ধর্মের কোনো প্রভাব ছিল না। এক হাতে হুইস্কি এবং আরেক হাতে শূকর মাংসের স্যান্ডউইচ নিয়ে যার দিনের অধিকাংশ সময় কেটেছে, সেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। অথচ এই জিন্নাহ ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি অব্দি ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সংমিশ্রণের প্রবল বিরোধী ছিলেন। কিন্তু স্বার্থগত টানাপড়েন ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে আদর্শচ্যুত হতে দ্বিধা করেননি তিনি। ‘মোল্লা’ আর মুসলমান ভূস্বামীদের স্বার্থ ও আবেগকে পুঁজি করে পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন ব্যারিস্টার জিন্নাহ। ‘ইসলাম বিপন্ন’ ধ্বনি দিয়ে তিনি দর-কষাকষি শুরু করেন। তার এই দর-কষাকষির খেলায় তার ‘হাতের পুতুল’ হয়ে ওঠেন ধর্মভীরু লাখ লাখ মুসলমান। তাদেরকে সামনে রেখে দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হয় মুসলমানদের ‘স্বপ্নভূমি’ পাকিস্তান। ‘সিজারিয়ান অপারেশন’-এর মাধ্যমে গঠিত পাকিস্তান শুরুতেই সৃষ্টি করে অনেক সংশয় ও প্রশ্ন। যেসব মুসলমান ছিলেন সাচ্চা পাকিস্তানপন্থী, দেশ ভাগের পর তারা পাকিস্তান থেকে দূরে সরে যান। কেননা তাদের অধিকাংশেরই জায়গা-জমি ভারতীয় সীমান্তে পড়ে যায়। এদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ‘প্রিয় পাকভূমি’তে চলে গেলেও ভারতেই বেশিরভাগ মুসলমান রয়ে যান। সাধের পাকিস্তান তাদের কাছে হয়ে যায় মরীচিকা। তাছাড়া চোখে একরাশ স্বপ্ন ও বুকে অপরিমেয় প্রত্যাশা নিয়ে যারা চৌদ্দপুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমান, তারাও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়েন। অন্যদিকে দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দু’টি প্রদেশ নিয়ে একটি অখ- রাষ্ট্র গড়ে তোলা হলেও তার মধ্যে দুস্তর ফারাক থেকে যায়।
ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভাষাগত সমস্যা ছাড়াও উভয়ের মধ্যে স্বার্থের প্রশ্নে তিক্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ অবস্থার সূত্রপাত ঘটে ‘পাকিস্তানের জনক’ মোহাম্মদ আলীর জীবদ্দশায়।
তবে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভায় জিন্নাহ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তানে হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, পার্সি বলে কেউ থাকবেন না। সবাই পাকিস্তানি।’ তার এই বক্তব্যে অবশ্য প্রতীয়মান হয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য তিনি পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেলের কথার সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য ছিল না। শুরুতেই তিনি একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থের ‘ক্রীড়নক’ হয়ে ওঠেন। এর কারণ সম্ভবত তার উত্থান ঘটে ‘মোল্লা’ ও অভিজাতদের ক্ষমতাবলয়কে কেন্দ্র করে। তাদের চটিয়ে জিন্নাহ’র পক্ষে সম্ভব ছিল না কিছু করা। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় তার বলা ‘উদর্ুু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ সবাইকে সন্দিহান করে তোলে। প্রশ্নের সম্মুখীন হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। তথাপি তখন পর্যন্ত সব মুসলমানের প্রতিনিধিত্বশীল নেতা ছিলেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির ১৩ মাসের মাথায় তার মৃত্যু এবং পরবর্তীতে তার অন্যতম অনুসারী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তানে একে একে নানা সমস্যার উদ্ভব ঘটতে থাকে। জিন্নাহ’র ‘বিশ্বাস, আশা ও ঐক্যের’ স্লোগান ক্রমশ শূন্যে মিলিয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জিন্নাহর গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের স্বপ্ন চূর্ণ করে দেয়।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শাসকগোষ্ঠীর অনমনীয় মনোভাব, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বর্বরোচিত নৃশংসতা ও হত্যাকা-Ñ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের পাক-শাসকদের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে টলিয়ে দেয়। সেই থেকে বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গের যাতনা শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ধারণা করা হয়েছিল, সেটাই ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেক।
কিন্তু জন্মের ৪৪ বছর পরও পাকিস্তানের অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে অমীমাংসিত। যা ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যেসব ‘ভারতীয় মুসলমান’ জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন এবং ভারত ছেড়ে চলে এসে নাম পেয়েছেন ‘মোহাজির’, তারা এখন জাতি-দাঙ্গার শিকার। জীবনযাপন করছেন প্রবাসীদের মতো। বেঁচে থাকার জন্য, জীবন ধারণের জন্য তাদের সংগ্রাম নিত্যকার। স্বপ্নের আবাসভূমি পেয়েও মুসলমানরা আজ একে অপরকে দেখছে সন্দেহের চোখে। বর্তমানে ২২টি ভাষা-ভাষীর এই দেশ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত। প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে। জীবনহানি ঘটছে। দেশের বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাব নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে মশগুল। ‘বড় ভাইসুলভ’ মনোভাব ছাড় দিতে রাজি নয়। সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর কোথাও শান্তি নেই। কোনো প্রদেশের সঙ্গে ভাষা, সামাজিক কাঠামো, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের কোনও যোগসূত্র নেই। পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের প্রথমত সিন্ধি, বালুচ, পাঠান বা পাঞ্জাবি, দ্বিতীয়ত মুসলমান এবং সবশেষে পাকিস্তানি বলে মনে করে। আÍপরিচয়ের এই ধারাক্রম কবি ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে এক বিন্দুও মিল খায় না।
এ কারণেই নিজেদের সংকটকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য পাকিস্তানি প্রতিটি শাসককেই কূট-কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। সেটা জিয়ার জঙ্গি শাসন হোক কিংবা ভুট্টোর গণতান্ত্রিক শাসন হোক। একটা জুজুর ভয় সবসময় খাড়া করে রাখা হয়। ধর্মটাই এ ক্ষেত্রে উত্তম পন্থা। একই পথ ধরে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালানো হয় ছলে, বলে, কৌশলে। আর ভারতের সঙ্গে বিরোধের ‘কমন’ বিষয় রেডিমেট তৈরি হয়ে আছে অবধারিতভাবে, সেটা কাশ্মীর। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মুসলমান হওয়ায় পাকিস্তান শাসকরা সর্বদা বাড়তি একটা ফায়দা লুটতে সক্ষম হন। কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রশি টানাটানি চললেও বর্তমানে পাক-ভারত শাসিত কাশ্মীরী জনগণের মাঝে নতুন চেতনা গড়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে তারা কারো অভিভাবকত্বে না থেকে স্বাধীন কাশ্মীর গড়ার স্বপ্ন দেখছে। এটা কোনো অলৌকিক স্বপ্ন নয়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের অন্যতম একটি ‘ট্রাম্প কার্ড’ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
এদিকে আরেক দল মৌলবাদী মুসলমান পাকিস্তানের হালের সমস্যা ও সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য অতীতের বিশুদ্ধ ইসলামের যুগে ফিরে যাবার নসিহত করছে। যার অর্থ দাঁড়াবে পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়ানো। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুশীলন বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকারে ডুব দেয়া। অনেকদিন ধরে এমন ধরনের প্রচ্ছন্ন মনোভাব চলে আসায় প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে পাকিস্তান এমনিতেই পিছিয়ে পড়ছে। এরপর ঘোষণা দিয়ে বিশুদ্ধ ইসলামকে আঁকড়ে ধরার মানে দাঁড়াবে, জাহেলিয়া যুগে পাকিস্তানের ফিরে যাওয়া।
যে স্বপ্ন, যে আকাক্সক্ষা নিয়ে পাকিস্তান নামক দেশটি গড়ে তোলা হয়, সময়ের পরিক্রমায় তা ক্রমান¦য়ে থিতিয়ে আসছে। প্রাদেশিক উগ্রতা, প্রগতিবিমুখ মৌলবাদী মোল্লাদের প্রভাব এবং মুসলমান ভূস্বামীদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর একরতফা আনুকূল্য পাকিস্তানকে ক্রমশ আরো বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যা কবি আল্লামা ইকবালের স্বপ্নকেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে না, স্বপ্ন ভঙ্গ হবে ইতিহাসেরও।
দৈনিক বাংলার বাণী : ২২ নভেম্বর ১৯৯১
জাতিসংঘ : নিধিরাম সর্দার
ধ্বংসের মাঝে যেমনভাবে জেগে ওঠে প্রাণের স্পন্দন, তেমনিভাবে বিশ্ব বিবেকের চৈতন্য জাগ্রত করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাঝেই অনুভূত হয় পৃথিবীকে ‘একটি শান্তির নীড়’ হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ। এগিয়ে আসেন শান্তিকামীরা। মানবতাবাদীরা। তারা সোচ্চার কণ্ঠে বলেন : ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, চাই শান্তি।’ একই সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধ রোধের পাশাপাশি নানা সমস্যা সম্মিলিতভাবে সমাধানের কথা ব্যক্ত হয়। এরই আলোকে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানব মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ‘জাতিসংঘ’ নামের প্রথম ধারণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মিলিত আগ্রাসী শক্তি যখন বিশ্বকে নিজেদের হাতের মুঠোয় বন্দি করতে উদ্ধত, ঠিক তখন ‘জাতিসংঘ’ ধারণা মিত্র জোটের কাছে বাস্তব হয়ে ওঠে। ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতিসংঘ ঘোষণা’য় স্বাক্ষর করে ২৬টি রাষ্ট্র। এ ঘোষণাকে সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল সানফ্রান্সিসকোতে আহ্বান করা হয় ‘একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রশ্নে জাতিসমূহের সম্মেলন’। ‘বিগ ফোর পাওয়ার’ খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনসহ ২৬টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের শেষ দিন ২৬ জুন গৃহীত হয় ‘জাতিসংঘ সনদ’। ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র দিয়ে শুরু হয় জাতিসংঘের যাত্রা। জাতিসংঘের মূল টার্গেট আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানব কল্যাণের ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সেই সঙ্গে মানবাধিকার ও মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ জাগানো। তবে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের কার্যক্রম শুরু হয়।
জাতিসংঘের মূল সংস্থার নাম সাধারণ পরিষদ। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সমন¦য়ে সাধারণ পরিষদ গঠিত হয়। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৫৯। এছাড়া জাতিসংঘের প্রধান পাঁচটি অঙ্গসংস্থা হলো নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয়, অছি পরিষদ, সচিবালয় এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে আবার স্থায়ী সদস্যদের সংখ্যা ৫। এরা হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। এদের প্রত্যেকের ‘ভেটো’ ক্ষমতা রয়েছে। যে কোনো একটি সদস্য রাষ্ট্র কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে কিংবা ভোটদান থেকে বিরত থাকলে সে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। ১৫ জন বিচারপতির সমন¦য়ে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালত সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ বা জাতিসংঘের অন্য কোনো সংস্থাকে আইন সম্পর্কিত ব্যাপারে উপদেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধের আইনগত দিকটি দেখে থাকে। জাতিসংঘের হাতে অর্পিত আÍনিয়ন্ত্রণ অধিকারবঞ্চিত জাতিসমূহের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের স্বাধীনতা লাভের যোগ্য হতে সাহায্য করাই অছি পরিষদের কাজ।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সমন¦য়ে জাতিসংঘের স্বার্থরক্ষা ও কাজ-কর্ম চালানোর জন্যই জাতিসংঘ সচিবালয়। মহাসচিব সচিবালয়ের প্রধান। নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে সাধারণ পরিষদ মহাসচিব নিয়োগদান করে। মহাসচিব বেতনভোগী কর্মচারী হলেও তার পদমর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, তিনিই দুনিয়ার একমাত্র ‘বৈধ শাসনকর্তা’। অবশ্য বাস্তবক্ষেত্রে শাসন কতটা করতে পারেন সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে নরওয়ের ট্রিগ্রভি লিকে পাঁচ বছরের জন্য জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে এই মেয়াদ তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়। কিন্তু এর তীব্র সমালোচনা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যে কারণে লি ১৯৫২ সালে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৩ সালে তার উত্তরাধিকারী হয়ে আসেন সুইডেনের ড্যাগ হ্যামারশোল্ড। ১৯৫৭ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে রোডেশিয়ার উত্তরাঞ্চলে (বর্তমানে জাম্বিয়া) এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। এ সময় মহাসচিব নিয়ে তুমুল বাদানুবাদ চলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব রাখে, তিন সদস্যের কমিটি সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকবে। তবে সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বর্মার উ থান্ট সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন। এ কারণে ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পুনরায় সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের শেষ নাগাদ নির্বাচিত হন অস্ট্রিয়ার কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম। তিনি দু’মেয়াদে কাজ করেন। তারপর ১৯৮২ সালে আসেন হাভিয়ার পেরেজ দ্য কোয়েয়ার। সবশেষে মিসরের বুয়েট্রেস ঘালি জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে সবেমাত্র নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পেয়েছেন।
মহাসচিব পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি জাতিসংঘের শুরু থেকেই। নিজেদের প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে মূল হাতিয়ার মহাসচিব। এই পদ নিয়ে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রতিদ্বন্দি¡তা চলে আসছে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রতিদ্বন্দি¡তা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরে দাঁড়ানোর ফলে এবার মহাসচিব নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঝামেলা দেখা দেয়নি। অনেক প্রতিদ্বন্দ¡ীর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদে ঘালি লোভনীয় পদটি বাগিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত, ক্ষুধার্ত ও নিরক্ষর জনগণের কল্যাণ সাধন করে বিশ্ব শান্তি সুসংহত করাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার কাজ। আর এ জন্য জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থাগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে সাহায্য এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে থাকে। এর মধ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফাও’, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’, শিশুদের আন্তর্জাতিক তহবিল ‘ইউনিসেফ’, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ‘আইএমএফ’ উল্লেখযোগ্য।
একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে। এখন জাতিসংঘের নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। জাতিসংঘ ভবিষ্যৎ বংশধরদের জীবন সুন্দর, মৌলিক মানবাধিকার ও মানুষের মর্যাদা, সব রাষ্ট্রের সমান অধিকার এবং বিশ্বের জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধনের জন্য কাজ করে আসছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে জাতিসংঘ ‘আশার স্তম্ভ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর দেশগুলোর পাশে জাতিসংঘ বন্ধুর মতো পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও সীমিত সাধ্য ও ‘পরনির্ভরশীল’ হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারে না। তবুও এর মাঝে তাদের কার্যক্রম প্রশংসার দাবি রাখে।
জাতিসংঘের ৪৬ বছরের ইতিহাসে সাফল্য যেমন আছে, তেমন ব্যর্থতাও অনেক। কেননা জাতিসংঘের হাত-পা এক জায়গায় বাঁধা। জাতিসংঘ পরিচালিত হয় সাধারণ পরিষদের সদস্যদের চাঁদায়। প্রতিটি রাষ্ট্রের সামর্থ্য ও সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হয় চাঁদার হার। প্রতিটি দেশকেই কম-বেশি চাঁদা দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের বৃহত্তম চাঁদাদাতা দেশ। শুরুতে জাতিসংঘের মোট বাজেটের ৪৯ শতাংশ আসতো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধে তাদের চাঁদার হার ১৯৮২ সালে নামিয়ে আনা হয়। শেষ অবধি তা ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৫৫ সালের পর থেকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দ্রুত বাড়তে থাকায় জাতিসংঘের বাজেটে ঘাটতি পড়ে যায়। নতুন সদস্যদের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। সবাই জাতিসংঘের সাহায্যের জন্য উন্মুখ থাকে। সাহায্য প্রদানে সবার ক্ষেত্রে সমান নজর দেয়া সম্ভব হয় না। এছাড়াও বৃহৎ শক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিশেষ করে মার্কিন প্রভাবাধীন দেশগুলো এক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে। এর কারণ আগেই বলা হয়েছে। জাতিসংঘের আয়ের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র। তাদেরকে চটিয়ে জাতিসংঘের পক্ষে কিছু করা কঠিন। এ যাবৎ জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীরা ছিলেন মার্কিন আজ্ঞাবহ। তারা স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। মার্কিন স্বার্থকেই বরাবর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এ কারণে অনেকাংশে ক্ষুণœ হয়ে পড়েছে। কেননা মার্কিন তাঁবেদার রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হলে জাতিসংঘের ভূমিকা থাকে এক রকম। আবার মার্কিনবিরোধী দেশে অন্যরকম। এ অবস্থা থেকে জাতিসংঘের বের হওয়া কঠিন। ইউনেস্কো স্বাধীনভাবে একবার কাজ করতে গিয়ে সংকটে নিপতিত হয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র ইউনেস্কো থেকে বেরিয়ে আসে। তাছাড়া সুপার পাওয়ারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ হয়ে পড়ায় তারা এখন এককভাবে খোলা মাঠে গোল দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া দাপটের কারণে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ নিজেদের মতো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ-হানাহানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা অনেকটা অসহায় দর্শকের মতো। আদতে জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মনোভাব বুঝে তাকে অগ্রসর হতে হয়। কথায় বলে, ‘ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার’। জাতিসংঘ হচ্ছে অবিকল তাই। তবে নানা সমস্যার মাঝে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ভারসাম্যমূলক পরিস্থিতি বজায় রাখছে। অনেক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে জাতিসংঘ। আজ বিশ্বে যে শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করছে তার মূলে জাতিসংঘেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
দৈনিক বাংলার বাণী : ২৯ নভেম্বর ১৯৯১
একাত্তরের স্মৃতি
আমাদের জীবনে এমন সুসময় যেমন আসেনি, তেমনিভাবে দুঃসময়ও কখনো আসেনি। বলছি ১৯৭১ সালের কথা। বাঙালির সবচেয়ে উজ্জ্বল, বর্ণিল ও ঘটনাবহুল দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অনেকেরই অম্ল-মধুর স্মৃতি। কোনোটা সুখের, কোনোটা বেদনার। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যিক দিনগুলোকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, কিংবা যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তারা প্রত্যক্ষ করেছেন বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনগুলোকে। এমন দিন আর কখনো আসেনি। এমন দিন আর কখনো আসবেও না। কেননা বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার ঈপ্সিত ঠিকানা। পেয়েছে তার নিজস্ব ভূখ-। পেয়েছে লাল-সবুজ পতাকা। ত্রিশ লাখ লোকের জীবনের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক।
অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা এখনো আমাদের হৃদয়ে জেগে আছে উল্কাপি-ের মত। কতইবা আমার তখন বয়স। ৫/৬ বছর। ঊনসত্তর-সত্তর-একাত্তরের আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী সময়ে মতিঝিল কলোনিতে থাকতাম। সব স্মৃতি যে ধরে রাখতে পেরেছি তা নয়। টুকরো টুকরো স্মৃতিখ- এখনো বুকে চির-জাগরুক হয়ে আছে। সে সময়কার জনবিরল ঢাকা নগরীতে মতিঝিল কলোনি তখন রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু। আন্দোলনের ঢেউ এসে আমাদের কলোনিতে ধাক্কা মারলে তার স্পর্শে আমরাও উজ্জীবিত হয়ে উঠি। বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া মিছিলের স্লোগান আমাদের ছোট্ট বুকে গান হয়ে বেজে ওঠে। একা একা গেয়ে উঠতাম; ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার-আমার ঠিকানা’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘টিক্কা খানের টিক্কি লইয়া স্বর্গে যাবো গো’, ‘একটা-দুইটা বিহারি ধরো সকাল-বিকাল নাস্তা করো’। স্লোগানের সব কথা না বুঝলেও অবুঝ মন আন্দোলনের ঝাঁপটা টের পেত। তাতে কেঁপে কেঁপে উঠতাম। বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন চেহারায় বুঝতাম কিছু একটা বিপদ আমাদের সামনে। ঊনসত্তর-সত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোর পর চারদিক কাঁপিয়ে এলো রক্তক্ষয়ী একাত্তর।
মতিঝিলে আমাদের পাশের রুমে সপরিবারে থাকতেন আমার পিতার মামা। অর্থাৎ সম্পর্কে তিনি আমার দাদা। এই দাদা একটা নামজাদা শাড়ির দোকানে চাকরি করতেন। রাত না হলে তিনি ফিরতেন না। সেদিন ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফেরেন। ফিরেই আমার আব্বা ফিরেছেন কিনা জানতে চাইলেন। আব্বার আবার খেলার নেশা। তিনি এমন কোনো খেলা নেই যে, যা থেকে পুরস্কার পাননি। তিনি এক এক সময় এক একটা খেলায় ঝুঁকে পড়েন। সে খেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে অন্যটায় হাত বাড়ান। সে সময় তিনি ক্যারম ও ব্রিজ খেলার নেশায় মাতোয়ারা। বাসায় ফিরতেন ঢের রাত করে। ২৫ মার্চ আব্বার ফিরতে দেরি দেখে দাদা আব্বার উদ্দেশে বকাবকি করতে থাকেন। তার কাছে জানতে পারলাম, সময় খুব খারাপ। পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যাই। কিন্তু চোখে ঘুম এলো না। গুলির শব্দে জেগে উঠি। সে বয়সে গুলির শব্দ কি জানতাম না। বড়দের কথায় বুঝতে পারি এটা গুলির শব্দ। আমরা বাসার সবাই খাটের তলায় আশ্রয় নেই। আমাদের বাসার দেয়াল ভেদ করে গুলি চলে যায়। এর কারণ, আমাদের বাসার সামনে ছিল মতিঝিল গার্লস স্কুল। সে স্কুলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। যে কারণে আমাদের পক্ষে মতিঝিলে থাকা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমন অবস্থা, ঘরের সামনে বারান্দায় পর্যন্ত উঁকি দিতে সাহস পেতাম না। বাধ্য হয়ে পরদিন আমরা গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।
কিন্তু ঘন ঘন কার্ফ্যুর কারণে বাসা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একবার বাসস্টেশন পর্যন্ত যেয়ে ফিরে আসতে হয়। যা হোক, ভালো দিনক্ষণ দেখে সদরঘাট থেকে লঞ্চে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। অনেকটা পথ যাবার পর মাঝ নদীতে লঞ্চ নষ্ট হয়ে যায়। নৌকা ছাড়া আর কোনো যানবাহন নেই যে আমরা যাব। বাধ্য হয়ে নৌকায় যাত্রা। ক্ষুধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। আশপাশে কোথাও দেরি করার উপায় নেই। একে তো কার্ফ্যু, তারপর আন্দাজে কোথায় আশ্রয় নেব! আমাদের নৌকার মাঝির কাছে চাল-ডাল ছিল। কোনো লবণ-মরিচ-মশলা ছিল না। তা ছাড়াই চাল-ডালের মিশেল দিয়ে রান্না করে কোনোক্রমে পেটের ক্ষুধা মেটাই। নৌকায় যাবার সময় দেখতে পেলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা স্পিডবোটে মেশিনগান ফিট করে ছোটাছুটি করছে। তাদের দেখে আব্বা ও আব্বার মামা জিন্নাহ টুপি মাথায় দিয়ে ‘সাচ্চা মুসলমান’ সাজেন। এতে খুশি হয় হানাদার বাহিনী। যে কারণে তারা আমাদের কিছু বলেনি।
গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার পর দেখলাম, রাজাকারদের দাপট। অবশ্য যতই দিন যেতে থাকে, আস্তে-ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নানাবাড়িতে একদিন ইউসুফ গাজী নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন। আমাকে ডেকে বলেন, ভাইগ্না যুদ্ধ করবা নাকি। এই বলে তিনি আমাকে তার বন্দুকটি হাতে দেন। আমি রাইফেলটি ভারি হওয়ায় তুলতে ব্যর্থ হই। একদিন বাড়ির পাশে গুলির শব্দ শুনে মা ও নানী আমাকে খাটের তলায় শুইয়ে দেন। তখন বর্ষাকাল। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে হয় নৌকায়। আমরা খবর পেলাম, পাশের সর্দার বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা হবিকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করেছে। বিকেলে তাকে দেখতে গেলাম। দেখলাম, একটা ফ্লোরে হবি শুয়ে আছেন। তার বুক গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। বুক থেকে রক্ত ঝরছে। রাজাকাররা ছইওয়ালা নৌকায় সর্দার বাড়ির ঘাটে এসে থামে। তারপর হবির পিতাকে বলে, ‘আমরা হবির লোক। তাকে ডেকে দেন।’ হবি এ কথা শুনে বেরিয়ে এলে রাজাকাররা নৌকার সামনের পর্দা সরিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে। সেই প্রথম আমি নিহত কোনো ব্যক্তির লাশ দেখি। এটা দেখে এসে রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি।
একদিন আমাদের বাড়ির পাশে মধুমতি নদী দিয়ে পাকবাহিনীর বড় আকারের একটি যুদ্ধজাহাজ যায়। জাহাজটি ঘুরাতে যেয়ে নদীতে আটকে যায়। তখন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রামের মুরব্বীরা মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করেন। মুরব্বীরা বলেন, শক্তিতে ওদের সঙ্গে পারা যাবে না। ওদের সঙ্গে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। আক্রমণ করলে ওরা এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। মুক্তিযোদ্ধারা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
আরেক দিন খবর পেলাম, আমাদের ডুমদিয়া গ্রামে মিলিটারি আসছে। এ কথা শুনে আমরা নৌকায় করে দূর সম্পর্কের এক আÍীয়র বাড়ি উঠি। সত্যি সত্যি মিলিটারি এসে আমাদের গ্রামের অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা ও চেয়ারম্যান রাঙ্গু গাজীর বাড়ি। আমার আব্বা মিলিটারিদের দেখে তার সাইকেল নানাদের পুকুরে ডুবিয়ে দেন। মিলিটারিরা চলে গেলে তিনি রাঙ্গু গাজীর বাড়ির আগুন নেভাতে সাহায্য করেন। আমাদের ভাগ্য অনেকটা ভালো। আমরা যেদিন যে গ্রামে আশ্রয় নেই, সেই গ্রাম ছেড়ে নিজেদের গ্রামে চলে আসার পরের দিন ওই গ্রামে মিলিটারিরা আগুন ধরিয়ে দেয়।
আমাদের ভাগ্য ভালো হলেও আমার দাদা আসাদ (আব্বার মামা)-এর রাশি ভালো ছিল না। তার পাইককান্দি গ্রামে মিলিটারি এলে আসাদ দাদা পরিবার-পরিজনসহ একটা পরিত্যক্ত ভিটায় আশ্রয় নেন। মিলিটারিরা গ্রামে এসে কাউকে না পেয়ে এক নৌকার মাঝির কাছে পানি খেতে চায়। মাঝি পাকিস্তানিদের উর্দু বুঝতে না পেরে পলাতক অবস্থা থেকে আসাদ দাদাকে ডেকে নিয়ে আসেন। তিনি এসে বাড়ির গাছ থেকে ডাব পেড়ে মিলিটারিদের আপ্যায়িত করেন। আপ্যায়িত হয়ে মিলিটারিরা তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। সেই যে গেছেন আসাদ দাদা, আজও আর ফিরে আসেননি। আমরা এখনো তার প্রতীক্ষায় দিন গুনি।
১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি স্মরণিকায় প্রকাশিত
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত, ফুল আর পরাধীনতা
মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসনে বধ্যভূমিতে রূপ নিয়েছে সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ও ফুলের নন্দনকানন ইরাক। পরাক্রম শক্তির অন্যায় ও অনৈতিক হামলায় প্রাণ দিয়েছেন হাজার হাজার ইরাকী। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাসস্থান ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র, নিঃশেষ হয়ে গেছে হাজার হাজার বছরের সভ্যতার নিদর্শনসমূহÑ সর্বোপরি যারা বেঁচে আছেন তারাও ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে চলেছেন মৃত্যুর পথে। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে একটি সজীব ও প্রাণোচ্ছ্বল দেশের যে মুমূর্ষু অবস্থা হয়েছে, তা কি এড়ানো যেত?
অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও যুদ্ধ প্রকৌশলে সর্বশক্তিমান যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন ইরাকে আগ্রাসন চালানোর হুমকি প্রদান করতে থাকে, তখন তো এটা ধরেই নেয়া হয়, তাদের প্রতিরোধ করার মত শক্তি ও সামর্থ্য ইরাকের নেই। শুধু ইরাক কেন, পৃথিবীর আর কোন দেশেরই বা আছে? ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনও প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা এবং নিজের দুর্বলতার কথা খুব ভালভাবেই জানতেন। জানতেন বলেই জাতিসংঘের নির্দেশনামা মেনে চলেছেন। হ্যান্স ব্লিক্সের নেতৃত্বে জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দলকে ইরাকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হয়। কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ভা-ার খুঁজে বের করার নামে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শক দল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেটুকু অস্ত্র থাকেÑ তাও তন্ন তন্ন করে খুঁজে ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ইরাক ত্যাগের আগে হ্যান্স ব্লিক্স তার প্রতিবেদনে জানিয়ে দেন, ইরাকে আর কোনো জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র নেই। এতে অনুধাবন করা যায়, ইরাকের সামরিক শক্তি অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিশ্বের দ--মু-ের হর্তা-কর্তা তো এমনি এমনি হয়নি। তাদের অর্থ, সম্পদ, রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের ভা-ারই যে শুধু সমৃদ্ধ তা নয়, তাদের কূটকৌশলের দক্ষতা সর্বজনবিদিত। আমরা যেটা আজকে চিন্তা করি, মার্কিনীরা সেটা অনেক আগেই ভেবে রাখে। তারা যে হুট করে ২০ মার্চ ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছেÑ এমনটি ভাবা বোকামির নামান্তর। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ পরিকল্পনা করে এবং সেই অনুযায়ী ছক কেটে একের পর এক ইরাককে একঘরে ও দুর্বল করেছে। তাদের কৌশলী পরিকল্পনায় ইরাক ১৯৯০ সালে নির্বোধের মত কুয়েত দখল করেছে, তারই পথ বেয়ে আরব অঞ্চলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশ কুয়েত, সৌদি আরব, জর্দান, তুরস্ক, মিশর, ইরান, কাতার, আরব আমিরাত, বাহরাইনের সঙ্গে ক্রমান¦য়ে ইরাকের যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার নেপথ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিখুঁত দাবার চাল। পর্যায়ক্রমে বন্ধুহীন ও নিরস্ত্র করার মাধ্যমে ইরাককে শক্তিহীন করে ফেলা হয়েছে। তারপর জাতিসংঘের মাধ্যমে ১৯৯০ সাল থেকে ইরাকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে তাদের অর্থনৈতিক মেরুদ- । নির্দয় অবরোধে, অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় অকালে ঝরেছে ১০ লাখ মানুষের জীবন। সবদিক দিক দিয়ে ইরাক যখন ভেঙ্গে পড়েছে, ঠিক তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে নিরস্ত্র করার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে নখদন্তহীন ইরাকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ বাহিনী। এক্ষেত্রে তারা কোনো নিয়ম-নীতি ও বৈধতার তোয়াক্কা করেনি। এ প্রসঙ্গে ১৯৯৫ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদ জোসেফ রটব্ল্যাটের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য ঃ ‘একজন কুশাসককে উৎখাত করার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে হবে- এটা কোনো বৈধ যুক্তি হতে পারে না। জাতিসংঘের বর্তমান সনদে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অতএব, কোনো রাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যাই করুক, এমনকি সে যদি তার নিজের নাগরিকদের হত্যাও করে, তাহলেও অন্য রাষ্ট্র এসে কোনো যুক্তিতেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারে না।’ অথচ বিশ্ব সংস্থা, বিশ্ব জনমত ও বিশ্ব বিবেককে তোয়াক্কা না করে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাকের ওপর বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের করারই বা কী ছিল? শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও তার ছেলেদের নির্বাসনে যেতে অথবা যুদ্ধ ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টার যে চরমপত্র প্রদান করে, তাতে তিনি কী করতে পারতেন? প্রথম যে পথটি খোলা ছিল তা হলো, সাদ্দাম হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করে আÍসমর্পণ করতে পারতেন। তাতে অন্তত তাৎক্ষণিকভাবে ইরাকি জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও সভ্যতার নির্দশনসমূহ রক্ষা পেত। কিন্তু এতে কি সত্যি সত্যি ইরাকি জনগণ ‘মুক্তি’ পেতেন? যুক্তরাষ্ট্র কি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও তার সহযোগীদের অপসারণে সন্তুষ্ট থাকতো? সেটাই যদি হবে, তাহলে তারা নির্বিচারে ইরাকী নিরীহ মানুষকে হত্যা, ব্যাংক, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট লুট, অগ্নিসংযোগসহ অবকাঠামো ধ্বংস এবং সভ্যতার নিদর্শনসমূহ নিশ্চিহ্ন করছে কেন? সাদ্দাম হোসেন ও তার অনুগতরা যখন দৃশ্যপটে নেই, তখনও কেন লুটপাট, নৈরাজ্য, সহিংসতা, ধ্বংসলীলা ও মৃত্যুর মিছিল চলছে? বেশুমার লুটতরাজে সমগ্র ইরাক বিরান হতে চলেছে, তখন তা প্রতিহত না করে কেন মার্কিন মেরিন সেনারা শুধু তেল স্থাপনাগুলো পাহারা দিচ্ছে? কেন ইরাকি জাতীয় পতাকার পরিবর্তে ওড়ানো হয়েছে মার্কিন পতাকা? যে উদ্দেশ্যের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে, কার্যত সেই উদ্দেশ্যও পূরণ হয়েছে, তাহলে তারা কেন এখনো ইরাকের মাটিতে অবস্থান করছে? তাছাড়া যে ভয়ংকর অস্ত্র ইরাক লুকিয়ে রেখেছে বলে তারা আগ্রাসন চালিয়েছে, কোথায় সেই অস্ত্র?
আসলে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইরাকি জনগণের মুক্তি বা পরাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও নয়। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্র কখনেই কোনো দেশের বন্ধু বা মিত্র ছিল না। বরং এ কথাটি আমরা বরাবরই সত্যি হতে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার আর শত্রুর প্রয়োজন নেই। স্বৈরাচারী, গণধিকৃত ও পরাক্রমশালী শাসকদের যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা সাহায্য ও সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু সুদিনের বন্ধুদেরও যুক্তরাষ্ট্র অবলীলায় দূরে ছুঁড়ে দিতে মোটেও কার্পণ্য করে না। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়েছে, সেখানেই তারা ছলে-বলে-কৌশলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতন্ত্রের কালজয়ী সেই মূলমন্ত্র ঃ ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল অ্যান্ড অফ দ্য পিপল’ এখন কিছু শব্দের কঙ্কালমাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ও যুক্তরাষ্ট্রের সেবায় যারা নিবেদিত, তারাই গণতন্ত্রের মানসপুত্র। যুগে যুগে দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্র এই চ-নীতি অনুসরণ করে এসেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ইরাক। কেননা আরব ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গর্ভস্রাব থেকে সৃষ্টি হয়েছে ইসরাইল নামক একটি অবৈধ রাষ্ট্রের। ইসরাইলকে কেন্দ্র করে সমগ্র আরব ভূখ- নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বা ছক কাটা হয়েছে। আর এ কারণে অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে ইসরাইলকে শুধু শক্তিশালী নয়, একটি দুর্ভেদ্য রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ইসরাইলের কাছে যে পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ভা-ার রয়েছে, তা শিল্পোন্নত অল্প ক’টি দেশ ছাড়া আর কারো নেই। সমগ্র আরব জাহান এক ইসরাইলের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ গুটিকয়েক দেশ ইসরাইলের অস্তিত্ব মেনে না নেয়ায় এখন তাদের নানা ছলে-বলে-কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। নেপথ্যে থেকে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য-সহযোগিতা করায় ইসরাইলের ইশারায় ইরাক হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রধান টার্গেট। এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে ইরাককে ‘সাইজ’ করার পাশাপাশি বাড়তি পাওয়া হয়ে যায় তাদের অফুরন্ত তেলভা-ার। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরাক। তাদের মাটির নিচে সঞ্চিত রয়েছে প্রায় ১১ হাজার ২০০ কোটি ব্যারেল তেল। সাম্প্রতিক আগ্রাসনের আগে ইরাকের তেল রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার। যা মোট রাজস্বের ৯৫ শতাংশ। এই তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রলোভন দীর্ঘদিনের। সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে যায় ইরাকে। সেই থেকে তারা ইরাককে কব্জা করার জন্যে ভেতরে ভেতরে কলকাঠি নাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র তো সবসময় কৈয়ের তেলে কৈ ভেজে এসেছে। ইরাকে হামলা চালিয়ে মার্কিন অর্থনীতিতে যে আঁচড় লেগেছে, তা পূরণ করা ছাড়া কী যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে এক পা নড়বে? এমনিতেই উপসাগরীয় দেশে বছরের পর বছর ধরে তারা যে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে, তার ব্যয়ভার বহন করে আসছে দুই ইসলামী দেশ সৌদি আরব ও কুয়েত। আর যুদ্ধে কোটি কোটি ডলার কী তারা এমনি এমনি ব্যয় করেছে? মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি তাদের ব্যয়ভার সুদে-আসলে তুলে নেয়াটাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে যদি সাদ্দাম হোসেন বাধা হয়ে না দাঁড়াতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তিনিও হতে পারতেন ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’। মোদ্দা কথা, সাদ্দাম হোসেন কিংবা ‘থিফ অব বাগদাদ’ খ্যাত আহমেদ শালাবি কোনো ফ্যাক্টর নয়। এক সময় সাদ্দাম হোসেন তো ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জিগিরি দোস্ত। বন্ধুত্বের সেই মোহ হঠাৎ কেন কেটে গেল? আসলে যার দ্বারা স্বার্থ পূরণ হবে, তাকেই বরণ করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আপাতদৃষ্টিতে সাদ্দাম হোসেন ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেলেও তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথা-ব্যথা নেই। এখন ইরাককে নিজেদের মতো ‘গড়ে তোলা’ই তাদের প্রধান লক্ষ্য। আর এ কারণেই কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন জেনারেল গার্নারকে ‘বাগদাদের শেরিফ’ বানিয়ে ইরাককে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে পুনর্গঠনের যে কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে, তাতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা- ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেয়া হয়েছে মার্কিন বিভিন্ন কোম্পানিকে। সম্ভবত ইরাক পুনর্গঠন করে পকেট ভারি করার জন্য নানা অজুহাতে ইরাকে অকারণে চালানো হয় বেপরোয়া ধ্বংসলীলা। অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন, বিমানবন্দর, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ নির্মাণের বিশাল অংকের কাজ পেয়ে যায় মার্কিন রিপাবলিকান পার্টির সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির কোম্পানি অন্যতম। এতে প্রকৃত ইরাকি জনগণের কোনো ভূমিকা থাকছে না। মার্কিনিদের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পারায় জেগে উঠেছে ইরাকের স্বাধীনচেতা জনগণ। তারা আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এখন এই প্রতিবাদীদের দমন করার জন্যে তাদের হত্যা করা হচ্ছে ঠা-া মাথায়। তাহলে এই কি ইরাকি জনগণের মুক্তি? ইরাকি জনগণ অনুধাবন করতে পারছেন, তারা সাদ্দামের শাসনামলে এর চেয়ে অনেক ভালো ছিলেন। কেইবা চায় নিজের মাটিতে প্রতিনিয়ত দখলদারদের হাতে দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হতে?
পরাক্রমশীল একটি দেশ অন্যায়ভাবে একটি দেশকে হুমকি দেবে, তা মেনে নিয়ে আÍসমর্পণ করাটা স্বাধীন ও আÍমর্যাদাশীল একটি দেশের পক্ষে কি সম্ভব? অতীতেও ইরাককে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, কিন্তু তারা কখনো আগ্রাসন ও পরাধীনতাকে মেনে নেয়নি। পরাধীনতার মতো গ্লানিকর জীবনে আর কিছুই হয় না। এ কারণে যুগে যুগে মানুষ স্বাধীনতার বেদিতে সঁপে দিয়েছে নিজের জীবন ও যৌবন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর জীবন ও যৌবন পার করে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তী নেলসন ম্যান্ডেলাসহ অসংখ্য ব্যক্তিত্ব। অবলীলায় উপেক্ষা করেছেন প্রলোভনের সহস্র হাতছানি। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। তারা পরাধীন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ঘেরাটোপে বন্দি হয়েও পরাধীন জীবনযাপন করতে আগ্রহী নয়।
প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ধুন্দুমার কা--কীর্তি বা তার নৃশংসতা যে কোনো সুস্থ মানুষের পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশী শাসন, শোষণ ও পরাধীনতার শৃ´খলে বন্দি হয়ে থাকাটা ইরাকি নাগরিকদের কাছে মোটেও কাম্য নয়। এটা এক ধরণের আÍহত্যার শামিল। এ কারণে অবধারিত মৃত্যু ও পরাজয় নিশ্চিত জেনেও সাদ্দাম হোসেন, তার অনুগত বাহিনী ও ইরাকি জনগণ মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসনের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত আর অবরোধে অবরোধে নিঃশেষিত ইরাক শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেখানে মার্কিন-বৃটিশ বাহিনী তিন দিনেই ইরাক জয়ের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল, ভেবেছিল ইরাকিরা তাদের ফুল ও সঙ্গীত দিয়ে তাদের বরণ করে নেবে, সেখানে তাদের তিনটি সপ্তাহ রক্তক্ষয়ী মরণপণ লড়াই করতে হয়েছে। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশ। ইরাকিরা পরাজিত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, ধ্বংসলীলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু জয় হয়েছে তাদের নীতির। জয় হয়েছে আদর্শের। জয় হয়েছে নৈতিকতার। বিশ্ববাসী দেখেছে, মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্যে ইরাকিরা যেভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা ইতিহাসে অমর ও অমলিন হয়ে থাকবে। আÍসমর্পণ করা কিংবা আগ্রাসী বাহিনীকে বরণ করে নেয়ার চেয়ে তারা মৃত্যুকে শ্রেয়তর মনে করেছেন। এটা ইরাকিরা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের মুখে তাদের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে মানুষ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে, সে কখনো পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারে না।
অসম শক্তির কাছে পরাজিত হলেও স্বাধীনতার অগ্নিশিখা সবার বুকেই দেদীপ্যমান থাকে। ইরাকিদের এই পরাজয়ও বোধকরি সাময়িক। তারা একদিন পরাধীনতার এই শৃ´খল ভেঙ্গে ফেলবে। কেননা সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ দ্বিতীয় জন পল বলেছেন : ‘আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে ঈশ্বর দুষ্টুদের হাতে ইতিহাসকে ছেড়ে দিয়েছেন, তারপরও ঈশ্বরের সুবিচার ও দুর্গতদের রক্ষায় তার অসীম ক্ষমতার ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ঈশ্বর নীরবতার মধ্যেও যে কোনো সময় আবির্ভূত হতে পারেন।’ ক্যাথলিক পোপের এই বাণীর মধ্যে যে আশাবাদ সুপ্ত আছে, তা আমরা দেখতে পেয়েছি পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে। কোনো আগ্রাসী শক্তি স্বাধীনতাকামী মানুষকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখতে পারলেও চিরতরে পারে না। প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদলেও কারো দিনই একই রকম যায় না। তাহলে মহাক্রমশালী বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধঃপতন ঘটত না এবং বর্তমানে পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অনায়াসেই পৃথিবীব্যাপী বিস্তার করতো তার সাম্রাজ্য।
øায়ুযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ পেলেও শক্তির ভারসাম্যহীনতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একক পরাশক্তির হুংকারে কেঁপে উঠেছে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ। পৃথিবীকে এমন একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ। হঠাৎ কোথা থেকে এসে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাস্তনস্ত’ নামক কী এক অলৌকিক মন্ত্র পড়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক একটি স্বপ্নকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ায় বিশ্বের শক্তিশালী মানুষরা হারিয়ে ফেলেছে নিরাপদ আশ্রয়। জানি না, এ জন্য গর্বাচেভের কোনো অনুশোচনা হয় কি না? আর সেই গর্বাচেভ এখন বলছেন : ‘জগতসংসারের ভিত্তিভূমি আন্তর্জাতিক আইনকেও এ যুদ্ধে (ইরাকে মার্কিন-বৃটিশ আগ্রাসন) মানা হয়নি। আন্তর্জাতিক আইন যদি মূল্য না পায়, এই আইনের সর্বদা মেনে চলার নীতিগুলো এবং তার আলোকে নিষেধাজ্ঞা যদি একক পরাশক্তির জন্যে শুধু ফাঁকা বুলিতেই পরিণত হয়, তাহলে এর পরিণতিতে আমরা দেখতে পাব শক্তির প্রভাব, যথেচ্ছাচার এবং শুধুই নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার ভয়াবহ প্রবণতা আর তাহলে যে বিশাল ঝড়ের উদ্ভব হবেÑ তা থেকে আমেরিকাও রক্ষা পাবে না।’
আমরা যারা অসহায় ও দুর্বল, তাদের কাছে পোপ দ্বিতীয় জন পল এবং মিখাইল গর্বাচেভের বাণীই এখন সান্ত¡না ও স্বস্তি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের সমর্থকদের পতনের অপেক্ষায় আছি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি করে ও অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে ব্যক্তি পৃথিবীর শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে, তার প্রতি রয়েছে শান্তিকামী মানুষের তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণার অনলে নিশ্চয়ই পুড়ে যাবে অশুভ শক্তির আস্ফালন। আজ না হোক, একদিন নিশ্চয়ই পৃথিবীর সব অসহায় মানুষের এই আকাক্সক্ষা অবশ্যই পূরণ হবে। পরাধীনতা চিরায়ত নয়। শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের অনুভূতি ও ফুলের মাধুর্য চিরন্তন। অন্তত ইরাকের বেলায় এ কথা চিরসত্য।
দৈনিক সংবাদ : ২২ এপ্রিল ২০০৩
সার্স : মিশন ইম্পসিবল থ্রি!
ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব থিতু হতে না হতেই ‘সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রম’ বা ‘সার্স’ ভাইরাস নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই রোগে প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য ব্যক্তি এবং মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ‘সার্স’। একমাত্র কানাডা ছাড়া অধিকাংশই আসিয়ানভুক্ত, আসিয়ান সংলগ্ন কিংবা এশিয়ান দেশ। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক। প্রতিদিনই এর বিস্তার ঘটছে। যে হারে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, তাতে অতীতের যে কোনো রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে পাঁচ কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছিল। শুধু গত বছর এইডসে মারা গেছে ৩০ লাখ লোক। একদল বিজ্ঞানী মনে করছেন, স্বাস্থ্যসেবার মান খুবই নিুÑ এমন সব দেশে যদি ‘সার্স’ একবার হানা দেয়, তাহলে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। সেক্ষেত্রে ‘সার্স’ এই পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ অনুধাবন করতে পারছে না। মরণঘাতী ‘সার্স’-এর আগ্রাসন থেকে কীভাবে বাঁচা যাবেÑ তা নিয়ে বিশ্ববাসী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন। আর জনবহুল শহর রাজধানী বেইজিং। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই শহরটা ঘড়ির কাঁটা মেপে মেপে চলে। ২৪ ঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ডই কখন যেন কর্মব্যস্ততায় কেটে যায়! সাধারণত বাসস্ট্যান্ড ও বাসে থাকে উপচে পড়া ভিড়। চলতে থাকে সারি সারি সাইকেল। সারাদিন জীবনের উত্তাপে ফুটতে থাকে বেইজিং। সেই বেইজিংয়ে এখন অবিশ্বাস্যভাবে শুনশান নীরবতা। কোথাও ট্রাফিক জ্যাম নেই। রেস্তোঁরা ও শপিং মলগুলো পরিত্যক্ত শ্মশানের মতো ভূতুড়ে। সিনেমা হলগুলোর ফটক শিকল দিয়ে আটকানো। কোনো সংলাপ ভেসে আসে না। নেই কোনো সুর। খাঁখাঁ করছে ইন্টারনেট ক্যাফে। স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। থেমে গেছে বালক-বালিকাদের চপলতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের থাকতে দেয়া হচ্ছে না। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর জীবন। গুরুতর প্রয়োজনেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য লবণ, তেল, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস ক্রয়ের জন্য দু’একজন লোক মুখোশ এঁটে ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। পুরো শহরই যেন মুখোশ পরিধান করে আছে। সবাই স্বেচ্ছায় এক ধরনের বন্দি জীবনযাপন করছেন। খুঁজছেন নির্জনতা। এর মাঝে ব্যতিক্রম রেলস্টেশন। বেইজিংবাসী শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য ভিড় করছেন রেলস্টেশনে। তবে বাইরের লোকজন যাতে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য বেইজিং-এর বাইরের গ্রামগুলোতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে পুরো সমাজতান্ত্রিক চীন। আর এমনটি হয়েছে ‘সার্স’ নামক এক রহস্যময়ী রোগের প্রাদুর্ভাবে। তবে যতটা না আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তারচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। রহস্যজনক এই রোগটি এখন চীনের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ধস নেমেছে পরিবহন, বিমান, পর্যটন ব্যবসায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ক্রমশ নিুগামী। ‘সার্স’ ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিকে দারুণভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মাস ছয়েক আগে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ গুয়ানডঙে ‘সার্স’-এর সূত্রপাত। শুরুতে চীন সরকার বিষয়টিকে হালকা করে দেখে। চীন তার রুদ্ধ দুয়ার নীতি অনুসারে সব কিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, অজ্ঞাত কোন রোগ যখনই কোথাও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সরকারসহ বিভিন্ন কর্র্তৃপক্ষের মধ্যে ওই রোগটিকে কেন্দ্র করে গঠনমূলক পদক্ষেপের চেয়ে ভীতি, কুসংস্কার, গুজব ছড়ানো ও অজ্ঞতাপ্রসূত মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাছাড়া পুরো বিষয়টি চেপে রাখার যে প্রবণতা, সেক্ষেত্রে চীনাদের ভূমিকা তো প্রবাদে পরিণত হয়েছে। চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঝাং ওয়েনকাং এই রোগটিকে নিয়ে অবজ্ঞা ও উপহাস করতে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ হয়ে ওঠে, তখন তার পক্ষে তা সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতির কথা স্বীকার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রতিনিধিদের বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হু’র প্রতিনিধিরা বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শনে যেয়ে ঘটনার ভয়াবহতা ফাঁস করে দিলে ফুসে ওঠে বেইজিংবাসী। তাদের বিক্ষোভের মুখে ২০ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা লাভের পর এই প্রথম সরকার অসততার জন্য কোনো একজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করলো। একই দিন বরখাস্ত করা হয় বেইজিং-এর মেয়রকে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা যথাযথভাবে জানতে পেরে পরিস্থিতিকে মহামারী হিসেবে ধরে নিয়ে চীনা সরকার যেসব অফিস-আদালত, হোটেল-রেস্তোঁরায় ‘সার্স’ আক্রান্ত রোগীদের পদস্পর্শ পড়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গরোধ করার জন্য বিচ্ছিন্ন করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে দুই সহস্রাধিক স্বাস্থ্যকর্মীকে। বেইজিং হাসপাতপালে আক্রান্তদের মধ্যে আছেন ৭০ জন চিকিৎসক, নার্স ও ২০ জন রোগী। চীনের একটি স্কুলে ‘সার্স’ রোধে কোয়ারেন্টাইন (রোগ-সংক্রমণ প্রতিরোধে পৃথক বা আটক রাখা) সেন্টার স্থাপনকে কেন্দ্র করে ২৭ এপ্রিল রাতে বন্দরনগরী তিয়ানজিনে ব্যাপক দাঙ্গা বেঁধে যায়। বেইজিং বিদেশীদের আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু যে বেইজিং ‘সার্স’-এ আক্রান্ত হয়েছে এবং তারাই যে কেবল এরকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তা নয়। বিশ্বের যেসব দেশ আক্রান্ত হয়েছে, সবারই কম-বেশি একই রকম অবস্থা।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কী এই ‘সার্স’? যে জন্য দেশে দেশে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থার। ‘সার্স’-এর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, মারাÍক অ্যাকিউট শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে তাপমাত্রা বেড়ে যায় ১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এর সঙ্গে থাকে শুকনো কাশি। শ্বাসকষ্ট, মাথা ধরা, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা, শরীরে চাক চাক দাগ, মাংসপেশীতে ব্যথা, কাঁপুনি, পেট খারাপ ইত্যাদি। এই ভাইরাসটি মুখ, নাক ও চোখ দিয়ে শরীরে ঢোকে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি কেউ থাকলে হাঁচি-কাশির সঙ্গে বের হওয়া ভাইরাসে সংক্রমণ ঘটে। কোনো স্থানে ভাইরাসে সংক্রমিত হলে, সেখানে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত তা জীবিত থাকে। সে সময়ের মধ্যে কেউ আক্রান্ত স্থান দিয়ে চলাচল করলে তার দেহেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে মাস্ক, কালো চশমা ও গ্লাভস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কিন্তু সব নিয়ম-নীতি ও আইন লংঘন করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বেপরোয়া আগ্রাসন চালিয়ে যখন ইরাক দখল করে নেয়, ঠিক তখন ‘সার্স’-এর প্রাদুর্ভাব হওয়ার সঙ্গে অনেকে বিষয়টিকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করছেন। যারা এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তাদের যুক্তি কি একদমই উড়িয়ে দেয়া যাবে? একসময়ের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভগ্নাংশ রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, ইরাকের আগ্রাসন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া এবং ওই আগ্রাসনের সময় অন্যতম পরাশক্তি চীনকে তার নিজের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত রাখতে মার্কিনিরাই ‘সার্স’ ভাইরাস ছড়িয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্য চীন ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের অন্যতম বিরোধিতাকারী শক্তিধর দেশ। চীনকে টার্গেট করার আরেকটি কারণও উড়িয়ে দেয়া যায় না। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের পয়লা নম্বর দেশ চীনের প্রতিটি লোকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করা হয়েছে। চীন যেভাবে সস্তায় ও সুলভে পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করতে পারে, তেমনটি কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যে কারণে সারা বিশ্বে ছেয়ে আছে চীনের পণ্যসামগ্রী। এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখল করে আছে চীন। চীনসহ ১১০টিরও বেশি দেশ গ্যাট (জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অব ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড)-এর সদস্য। ১৯৪৭ সালে প্রথম স্বাক্ষরিত গ্যাটের চুক্তি অনুযায়ী সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ২০০৫ সালে মার্কেট উন্মুক্ত হয়ে যাবে। ফলে ট্রেড মার্কযুক্ত এক দেশের পণ্য অন্য দেশসমূহে অবাধে বিক্রি করা সম্ভব হবে। উন্মুক্ত বাণিজ্যের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে চীন। ফলে গ্যাট চুক্তি অনুসারে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চীন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন পরাশক্তি হিসেবে চীনের সঙ্গে অন্য যে কারোই টেক্কা দেয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এমন এক দূরদর্শী কূট-পরিকল্পনা থেকে চীনকে দুর্বল করা হতে পারে।
এক্ষেত্রে রাশিয়ার একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সের বিজ্ঞানী সের্গেই কোলেসনিকভের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ২৫ এপ্রিল সাইবেরিয়ার আর্কতুস্কে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই বিজ্ঞানী বলেন, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী নিউমোনিয়া আদলের রোগ ‘সার্স’-এর ভাইরাস কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং সম্ভবত ব্যাকটেরিয়াঘটিত জীবাণু অস্ত্র হিসেবেই একে প্রয়োগ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের সময় চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ব্যতিব্যস্ত রাখা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্যে পশ্চিমা শক্তির কোনো ক্রীড়নক সংস্থা কৌশলে তা ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে পর্যটন শিল্প ও বিমান পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর ফলে যুদ্ধের চেয়েও এর ক্ষয়ক্ষতি কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশিই হবে। এই বিজ্ঞানী আরো বলেন, ‘সার্স’ ভাইরাস মানুষের সৃষ্ট এবং এটি সম্ভবত একটি জীবাণু অস্ত্র। এই ভাইরাসে এমন উপাদান আছে যা এখনো নির্ণীত হয়নি। এতে যে জেনেটিক উপাদান আছে, তার সঙ্গে মানুষের পরিচিত কোন ভাইরাসের মিল নেই। এগুলো সিনথেটিক ভাইরাস। নিউমোনিয়া ধরনের ‘সার্স’ রোগের ভাইরাস দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণ আর এগুলো হাম, মাম্পসের দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণে গঠিত। প্রাকৃতিকভাবে যা অসম্ভব ধরনের ভাইরাস। এটি কেবল ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত করা হতে পারে। এটা যেহেতু বানানো হয়েছে, তাই এর প্রতিষেধকও তৈরি করা সম্ভব।
‘সার্স’ ভাইরাস দিয়ে চীনে বদ্ধ দুয়ার খোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টার কমতি নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে চীন। চীনকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারলে একে একে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তরায়গুলো দূর হয়ে যাবে। যদিও বিশ্বে রাজনীতি ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়, তারপরও ‘বিশালদেহী’ চীন খ-িত হলে ভেঙ্গে পড়বে বিশ্ব ব্যবস্থা। এ কারণে ‘সার্স’কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বড়শি ফেলা সহজ হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির পাশাপাশি চীনের অভ্যন্তরীণ সংকটও সৃষ্টি করতে পেরেছে। প্রাথমিক অবস্থায় চীন তার রীতি অনুযায়ী ‘সার্স’ রোগ নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখলেও এই রোগের বিস্তার দ্রুত ঘটতে থাকায় তারা এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার সিদ্ধান্ত নেয়। জনদাবির প্রেক্ষিতে স্বচ্ছতার জন্য ক্যারিয়ার-আমলা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী দৃঢ়চেতা উ সিকে ‘সার্স’-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সরকারের তরফ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য ঘেঁষা ও উদারপন্থী এই কূটনীতিককে দায়িত্ব দেয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কারের পথে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে। পার্টির বয়োজ্যেষ্ঠরা দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কারের বিপক্ষে লড়াই চালিয়ে আসছেন, পার্টির একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাও টঙ বলেছেন, জনগণের সমর্থন পাবার এইতো চমৎকার সুযোগ। এর ফলে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হবে। ১৯৮৯ সালে তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে অভ্যুত্থানের পর বাও টঙকে পার্টি থেকে অপসারণ করা হয়। তিনি আরো বলেন, উদধভট ডটভ পণণয ফধশধভথ ধভ ট ঠফটডপ ঠমস মভ র্ধ ডটভ ফধশণ ধভর্ দণ ্রলভ্রদধভণ. অত দণ ডটভর্’র্ টপণ টঢশটর্ভটথণ মতর্ দধ্র ্রর্ধলর্টধমভ টভঢ বমরণ ধর্ভমর্ দণ ্রলভ ভমষ.র্ দণভ ষদণভ? অর্থাৎ চীন একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কিংবা রৌদ্রকরোজ্জ্বল আলোয় বসবাস করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে এবং আলোয় আসতে যদি না পারে, তাহলে আর কবে পারবে? এ কথাগুলো যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন যাবৎ আকারে-ইঙ্গিতে বলে আসছে। চীনকে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চোখে যেন ঘুম নেই। তারা ছলে-বলে-কৌশলে চীনকে গণতন্ত্রের পাঠ দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ‘সার্স’কে কেন্দ্র করে তাদের চাওয়াটা যেন চীনের সংস্কারপন্থী নেতাদের মুখে সরব হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র নিশ্চয়ই উত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু হালে গণতন্ত্রের যে রূপ ফুটে উঠেছে, তাতে আতংকিত না হয়ে পারা যায় না। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার যেভাবে খর্ব করা হয়েছে এবং বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে যেভাবে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়েছে, তেমন গণতন্ত্র নিশ্চয়ই কেউ আশা করেন না। এ কারণে চীনে গণতন্ত্র প্রবর্তনের যে তথাকথিত উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তাতে বিশ্ববাসী সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাবার মতো অবস্থা হয়েছে।
যা হোক, চীনের গণতন্ত্র নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলবে। কিন্তু যেটি ভাবনার বিষয়Ñ সেটি হচ্ছে ‘সার্স’। ‘সার্স’ নিয়ে সারা দুনিয়া আতঙ্কিত হলেও এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন ভাবনা নেই। ছয় মাস পরও যুক্তরাষ্ট্র ‘সার্স’-এ আক্রান্ত হয়নি। এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিংবা কোনো গবেষণার খবরও চোখে পড়ছে না। তারা অনেকটা চুপচাপ ও নির্বিকার। বিষয়টি রহস্যজনক নয় কি? এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর পরিচালক ডা. জুলি গারবার্ডিং যখন বলেন, ‘জানি না, কেন এখনও আমরা সৌভাগ্যবান। তবে আমরা কোনো সুযোগ দেব না’। তখন সেই বাংলা প্রবাদটি কি মনে হয় নাÑ ঠাকুর ঘরে কে রে! আমি কলা খাইনি’র মতো। এখন অবধি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে ‘সার্স’ ভাইরাস কীভাবে এলো, সেটা আবিষ্কার করতে পারেননি। বরং এটা আবিষ্কার করতে যেয়ে একজন বিজ্ঞানীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সবাই ধরে নিয়েছেন, ‘সার্স’ হচ্ছে মানবসৃষ্ট ভাইরাস। কেউ এটা বাজারে ছেড়ে চুপি চুপি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এটা নিয়ন্ত্রণের চাবিটা নিশ্চয়ই তাদের হাতে। উদ্দেশ্য পূরণ হলে সময়মত চাবি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হতে পারে। তাছাড়া পৃথিবী ক্রমশ ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। শত্রু এলাকায় রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশল এটি। অর্থাৎ জীবাণু যুদ্ধে জয়ী শত্রুপক্ষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু মাটি ও সম্পদের কোনো ক্ষতি হবে না। বিজয়ী দেশের মানুষের প্রয়োজন নেই। দরকার মাটি ও সম্পদ।
‘সার্স’ ভাইরাস ঘটনার সঙ্গে হলিউডের ব্যয়বহুল মুভি ‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবির কাহিনীর সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। পাশ্চাত্যের হাইটেক ও জেমস বন্ড মার্কা ছবি দেখে আমাদের কাছে তা আজগুবি, গাঁজাখুরি ও অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর কাছে তেমনটি মনে হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ পাশ্চাত্য ছবিতে আজ যা দেখানো হয়, আমরা তা ভবিষ্যতে সত্যি হতে দেখি। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১২৩ মিনিটের ‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবিটি দেখে এমনটি যে সম্ভব, তা প্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে কল্পনাবিলাস মনে হয়েছে। ছবির কাহিনী অনেকটা এমন : একজন বিজ্ঞানী একটি ভাইরাস আবিষ্কার করেন। যে ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দু’দিনের মধ্যে একজন মানুষের দেহের সব সিস্টেম অকেজো হয়ে যায় এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। অবশ্য এই জীবাণু নষ্ট করার জন্য জেনেটিক্যালি পরিবর্তন করার জন্য ফ্লু জাতীয় রোগবীজের ভয়াবহ জীবাণু প্রতিষেধক ওষুধ রয়েছে। সীন আব্রাহামরূপী ওগরে স্কট নামক একজন ভিলেন একটি বায়ো-টেক ফার্ম থেকে এই জীবাণু চুরি করেন। এর ফলে পৃথিবীর মানুষের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই ভাইরাস যাদের কাছে থাকে, সেই অল্প ক’জন লোক নিয়ন্ত্রণ করবে পুরো পৃথিবী। এই জীবাণু থেকে বিশ্বকে রক্ষার লক্ষ্যে অ্যামব্রোসকে নিবৃত্ত করার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় ইথান হান্টরূপী টম ক্রুজকে। এ জন্য তিনি ঘটনাস্থল অস্ট্রেলিয়ায় যান। সহযোগিতার জন্য রিক্রুট করেন চুরিই যার নেশা ও পেশা এবং অ্যামব্রোসের সাবেক গার্লফ্রেন্ড নিয়াহ হলরূপী কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী টান্ডি নিউটন এবং কম্পিউটার জিনিয়াস লুথাররূপী ভিঙ রামেসকে। যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ইথান হান্ট মুখোমুখি হন অ্যামব্রোসের। পুরো ছবিটি মরণঘাতী ভাইরাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বুদ্ধি, কৌশল ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো ছবিটির পরতে পরতে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা ও রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। মারাÍক জীবাণু উদ্ধার এবং অ্যামব্রোসের উদ্দেশ্য নস্যাৎ করার জন্য ইথান হান্ট একের পর এক দুর্ধর্ষ ও বিস্ময়কর অভিযানে শামিল হন। অ্যামব্রোসের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চালিয়ে শেষ অবধি সফল হয় তার মিশন। ভয়াবহ ভাইরাস থেকে বেঁচে যায় পৃথিবীর মানুষ।
‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবিতে ভাইরাস থেকে পৃথিবীবাসী রেহাই পেলেও প্রায় একই রকম ভাইরাস ‘সার্স’ একের পর এক ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে এবং কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ মানুষের জীবন। মরণঘাতী এই ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন ‘মিশন ইম্পসিবল-থ্রি’ নামের একটি অভিযান। অবশ্য এই অভিযান পরিচালনার জন্য থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। হংকং-এর একটি হাসপাতালের ডা. হেনরি লিকুয়ান নিজেই আক্রান্ত হয়েছিলেন ‘সার্স’ রোগে। সেরেও উঠেছেন এই যাত্রায়। তিনি বলেছেন, ‘আমি এখন রীতিমত এক আগ্রাসী মানুষ। সার্সকে যেভাবেই হোক, আমি জয় করবো।’ এই বিশ্বে আমরা যারা ভীত ও দুর্বল, তারা ‘মিশন ইম্পসিবল-থ্রি’র অপেক্ষায় আছি। যার মাধ্যমে জয় করা যাবে ভয়াবহ ভাইরাস ‘সার্স’-কে।
দৈনিক সংবাদ : ৬ মে ২০০৩
আমরা কি বধির হয়ে যাব?
আজকাল ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিংবা দূরালাপনীতে কথা বললেও আশপাশের মানুষজনও সচকিত হয়ে ওঠেন। কথা বলার ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ তো দূরে থাক, একান্তে বা নিঃশব্দে কথা বলার চল যেন আমাদের জীবন থেকে উঠে গেছে। চিৎকার করে কথা না বললে যেন কেউ কারো কথা শুনতে পান না। এমনটি তো এই কিছুদিন আগেও ছিল না। তাহলে হঠাৎ এমন কি হলো, যে জন্য বদলে যাচ্ছে মানুষ! কথা বলছেন উচ্চ কলরবে। আসলে নাগরিক জীবন আমাদের বদলে দিচ্ছে। ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে কোলাহল। চারপাশের কোলাহলে মানুষ ক্রমশ উচ্চভাষী হয়ে যাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারেÑ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলার কী সম্পর্ক? সম্পর্কটা এখানে, ঢাকায় যে হারে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে যানবাহন। বছর তিনেক আগের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতি বছর ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে পরিবহন বৃদ্ধির হার আনুমানিক ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এই বিপুলসংখ্যক পরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় শব্দ ও বায়ু দূষণের মারাÍক অবনতি ঘটেছে। আর এর ফলে মানুষ ক্রমান¦য়ে বধির হয়ে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, আমরা সবাই কথা বলছি জোরে জোরে, নতুবা একজনের কথা আরেকজনের পক্ষে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে। অনেকটা কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ের সেই দুই বধিরের কথোপকথনের মতো।
পৃথিবীর যে ক’টি শহরে শব্দ দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। মূলত পরিবহন খাত থেকেই শব্দ দূষণের সূত্রপাত। রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন ডিজাইনের গাড়ি চলাচল করে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট বেবিট্যাক্সির উৎপাতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল নাগরিক জীবন। কিন্তু বেবিট্যাক্সি উঠে গেলে বায়ু দূষণ কিছুটা হ্রাস পেলেও শব্দ দূষণের মাত্রা কিন্তু একটুও কমেনি। কেননা, ঢাকায় যেসব নানা কিসিমের যানবাহন চলাচল করে, তাদের অধিকাংশই পুরনো মডেলের। পুরনো মডেল হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু এসব গাড়ির বেশিরভাগই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব গাড়ির কারণে শব্দ ও বায়ু দূষণ বেড়েই চলেছে। কেউ যদি ঢাকার গ-ি ছাড়িয়ে একটুখানি গ্রামের দিকে যান, তিনি পাবেন তাজা ও সতেজ নিঃশ্বাস এবং শব্দহীন এক নির্জন পরিবেশ। ঢাকার তুলনায় গ্রামে দূষণের মাত্রা অনেক কম। বৃষ্টি-মৌসুমে বিশেষত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দূষণের পরিমাণ থাকে অত্যধিক। তবে কোনো মৌসুমেই শব্দ দূষণের হেরফের হয় না। ঢাকায় শব্দ দূষণের উৎপত্তিস্থল যানবাহন ছাড়াও আছে যখন-তখন ও যত্রতত্র নির্বাচনী প্রচারণা, সমাবেশ ও পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য সশব্দে মাইকিং, ইট ভাঙ্গার মেশিন, শিল্প-কারখানা, ঘরে-মিলনায়তনে-গাড়িতে উচ্চ শব্দে গান শোনা, জেনারেটরের তীব্র গর্জন ইত্যাদি। শব্দ দূষণের পাশাপাশি বায়ু দূষণও ঢাকাকে রোগাক্রান্ত করে রেখেছে। যানবাহন, শিল্প-কারখানা, ইটের ভাটাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নির্গত হয় কালো ধোঁয়া। এই কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইডের দূষিত উপাদান। আবাসিক এলাকা ও কর্মস্থলের আশপাশে এসব দূষিত উপাদান ছড়িয়ে পড়লে তা সরাসরি মানুষের দেহে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এ কারণে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি। শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজার লোক অকালে ঝরে যায়। এ তথ্য দিয়েছেন স্বয়ং পরিবেশমন্ত্রী। শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে যে রোগে আক্রান্ত হতে হয়, তার মধ্যে অন্যতমÑ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ব্রঙ্কাইটিস, বধির হয়ে যাওয়া, øায়ুর চাপ, ক্রনিক ডিজিজ ইত্যাদি। এছাড়া অমনোযোগিতা, ঘুমে ব্যাঘাত, মেজাজ চড়ে যাওয়া, আতংকিত হওয়ার মতো মানসিক ব্যাধি তো আছেই। হাসপাতালের রোগীদের মারাÍক অসুবিধা ছাড়াও স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচলের সমস্যা ও পড়ালেখায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রতিবছর মৃত্যু ছাড়াও লাখ লাখ লোক নানারকম শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। শব্দ ও বায়ু দূষণ এড়ানো গেলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬৫ লাখ লোককে চিকিৎসাধীন এবং সাড়ে ৮ কোটি লোককে ছোটখাট অসুখে ভুগতে হতো না। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় পরিবেশ ইউনিটের একজন ঊর্ধ্বতন পরিবেশ বিজ্ঞানী জীতেন্দ্র শাহ এক সমীক্ষায় জানিয়েছেন, শব্দ ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে প্রতি বছর বাংলাদেশ শুধু চিকিৎসা খাতেই ২০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি এড়াতে পারবে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে শব্দ ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০০ সালে ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সরকার প্রায় ২৪ কোটি টাকা ঋণ লাভ করে। কিন্তু সে টাকার কতটুকু সদ্ব্যবহার হয়েছে, তা জানা না গেলেও শব্দ ও বায়ু দূষণের মাত্রা বরং আগের মতোই আছে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা দূষিত হচ্ছে বায়ু, সঙ্গে শব্দ দূষণের তীব্রতা। নাক ও মুখ দিয়ে দূষিত বায়ু ঢুকে শ্বাস-প্রশ্বাসের পাশাপাশি ফুসফুস ঝাঁজরা হয়ে গেলেও এ মুহূর্তে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শব্দ দূষণ। শব্দ দূষণে বধির হয়ে যাওয়াটা একটা মামুলি ঘটনা। কিন্তু এর ফলে আমাদের øায়ু ও মানসিক যে বৈকল্য ঘটছে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে øায়ু ও মানসিক রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ৯৭ শতাংশ ছাত্র জানিয়েছে, গাড়ির হর্নের কারণে তাদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটে। ৮৬ শতাংশ লোক শব্দ দূষণকে বড় সমস্যা বলে স্বীকার করেছেন। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে চালানো এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শব্দ দূষণকে ৭৮ শতাংশ লোক বলেছেন অধিকতর খারাপ, ৭১ শতাংশ বলেছেন শিরঃপীড়ার কারণ, ৪৯ শতাংশ বলেছেন মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। ৪৩ শতাংশ অমনোযোগী হয়ে পড়ে ও ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এবং ৩৩ শতাংশ কানে কম শুনতে পান। এঁদের সবাই কম-বেশি øায়ু ও মানসিক পীড়ায় ভুগছেন। আমাদের দেশে গবেষণার মান আশানুরূপ নয় বিধায় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন কিংবা যারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন কিংবা হন না, তাদের রোগের মূল কারণটা ধরতে পারা যায় না। তবে বিদেশি গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রোগের অন্যতম কারণ শব্দ ও বায়ু দূষণ। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, শব্দ ও বায়ু দূষণ বাংলাদেশে কতটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ শব্দ ও বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ যেহেতু আমরা জানি, সেহেতু এই সমস্যা দূর করাটা কঠিন কোনো বিষয় নয়। প্রধানত যানবাহনের কারণেই হয় শব্দ ও বায়ু দূষণ। বিশেষ করে শব্দ দূষণ সৃষ্টি হয় ট্রাফিক জ্যাম থেকে। অধিকাংশ গাড়ির চালক ট্রাফিক জ্যাম ও সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও অনর্থক হর্ন বাজিয়ে নাভিশ্বাস তোলেন। রিকশা ও পথচারীদের কারণে গাড়ির চালকদের হর্ন বাজাতে হয়। রিকশাওয়ালারা অধিকাংশ সময় ট্রাফিক আইন মানতে চান না। অনেক পথচারী ইচ্ছেমত রাস্তা পারাপার এবং রাস্তার ওপর আড্ডা মারেন। তাছাড়া ফুটপাত হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় পথচারীদের রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হয়। পরিস্থিতির কারণে গাড়ি চালকদের হর্ন বাজানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
ঢাকায় শব্দ ও বায়ু দূষণ দূর করার জন্য জরুরিভিত্তিতে যা করা দরকার : খুব বেশি প্রয়োজন না হলে গাড়ির হর্ন না বাজানো, নির্বাচনী প্রচারণা, সমাবেশ ও বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য মাইকিং নিষিদ্ধ, ট্যানারি, লেদ মেশিনসহ শিল্প-কারখানা করতে না দেয়া, ইট ভাঙ্গার মেশিন নিষিদ্ধ, ২০ বছরের বেশি পুরনো যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ, আনফিট যানবাহন চলাচল বন্ধ, হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ, গাড়ির চালকরা যাতে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন, সেটুকু শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা, বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা বিদ্যুৎ থাকলেও জেনারেটর না চালিয়ে সৌরচুল্লী ব্যবহার করা, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি, ট্রাফিক ও শব্দ দূষণ সংক্রান্ত আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা। সর্বোপরি জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। জনসচেতনতা গড়ে উঠলে শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ দূর করা কঠিন নয়। মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই দেশব্যাপী পলিথিনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে শব্দ ও বায়ু দূষণ সংক্রান্ত লেখা থাকা এবং তা বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ করা; পাশাপাশি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। মানুষ যখন এর অপকারিতা বুঝতে পারবে, তখন তারা এমনি এমনিই সচেতন হয়ে উঠবে। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পাশাপাশি একটুখানি নিরিবিলি থাকতে কে না পছন্দ করে?
নিরিবিলি পরিবেশ ছাড়া মানুষের মৌলিক চিন্তা-ভাবনার প্রসারণ ঘটে না। সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মনীষী ও প-িত ব্যক্তিরা একটু একাকীত্ব থাকতে ভালোবাসেন। জ্ঞানচর্চার জন্য তারা বেছে নেন নির্জন পরিবেশ। এছাড়া কোনো কোনো ব্যস্ত মানুষও চান কাজের ফাঁকে একটুখানি প্রশান্তি। সাপ্তাহিক ছুটিতে সবাই ছুটতে চান এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে, যেখানে নেই কোনো ঝঞ্ঝাট ও শব্দের কোলাহল। কিন্তু ঢাকা থেকে আস্তে আস্তে নির্জন পরিবেশ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। যে হারে ইট-পাথর-সিমেন্টের কর্কশ নিসর্গ গড়ে উঠছে, তার মাঝে একটুখানি স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ নেই। যে সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে রাজধানীর ঢাকার বিকাশ ও বিবর্তন, সেই ঢাকা এখন প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। গাছপালা, সবুজ প্রকৃতি ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে খোলা প্রান্তর, মাঠ, উদ্যান। ক্রমান¦য়ে তা সংকুচিত হয়ে আসছে। এর মাঝে ঢাকার আইল্যান্ডগুলোতে রোপিত বৃক্ষগুলো কিছুটা হলেও আমাদের চোখ ও মনের ভোজন তৃষ্ণা মেটায়, সেই বৃক্ষগুলোও সড়ক উন্নয়নের নামে বিরল হয়ে উঠছে। একদিকে যখন সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে নিসর্গ; অন্যদিকে রাজধানী ঢাকা শব্দ দূষণ ও কোলাহলময় হয়ে উঠছে। প্রতি মুহূর্ত শব্দ তরঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কোথাও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নেই। আমরা যেন শব্দের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে হাবুডুবু খাচ্ছি। নিরন্তন উঁচু উঁচু ভবন গড়ে ওঠায় তার শব্দে প্রতিটি পাড়া-মহল্লার নির্জনতা ও নিরিবিলিটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। একটুখানি বিশ্রাম ও পিন-পতন নীরবতায় ঘুমানো এখন স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। ঘরের বাইরে বের হলে তো কথাই নেই। গাড়ির হর্নে কেঁপে ওঠে আমাদের শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। যে হারে মানুষের জনস্রোত বাড়ছে, সে অনুপাতে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। বাড়ছে শব্দ-নিনাদ। ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে কান, মস্তিষ্কের নিউরন। আর এর ফলে অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বধির হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন অসুস্থ ও বধির হয়ে যাচ্ছেন অসংখ্য লোক। তাহলে কেন জেনে-শুনে আমরা বিষ পান করবো! তাই আমাদের সবারই উচিত শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। এ মুহূর্তে এবং এখনই।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ৮ মে ২০০৩
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়...
একজন কবির ব্যক্তিগত জীবনাচার কিংবা তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে তার কবিতাই পাঠকের কাছে তাঁকে চিনিয়ে দেয়। কবিতায় প্রকাশ পায় তার জীবন-ভাবনা এবং জীবনের নান্দনিক সৌন্দর্য। কবির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার চেয়ে তার কবিতার সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাই আনন্দদায়ক। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কবির কবিতা পাঠ করি। এর মধ্যে কোনো কোনো কবিতা আমাদের সহজেই কাছে টেনে নেয়; আবার কোনো কোনো কবিতা হয়তো আমাদের অন্তরকে স্পর্শও করে না। কে কোন্ কবিতায় অবগাহন করবেনÑ এটা নির্ভর করে পাঠকের রুচি, সৌন্দর্যবোধ ও চিন্তা-ভাবনার ওপর। কোনো কবি হয়তো আমাদের কাছাকাছি বসবাস করে কবিতা লিখছেন কিংবা দূরে মফস্বল থেকেও কেউবা লিখছেন কবিতাÑ এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তার কবিতা যখন আমাদের কাছে পৌঁছে যায়, তখন সেই কবি আমাদের হৃদয়ের আপনজনা হয়ে ওঠেন। অনেক কবির পরিচয় জানা হয় না, সামনাসামনি দেখাও হয় না; কিন্তু তার কাব্য ভাবনা আমাদের মর্মমূল ছুঁয়ে যায়। পাঠকের সঙ্গে এভাবেই গড়ে ওঠে একজন কবির অন্তরের সম্পর্ক। যখন একজন কবির তিরোধানের খবর পত্রিকায় পাঠ করি কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জানতে পাই, তখন একজন ঘনিষ্ঠজনের চলে যাবার অনুভূতি নিয়ে আমরা পাঠকরা কেঁপে উঠি। এছাড়া কিই-বা করতে পারি!
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি সিকদার আমিনুল হকের চলে যাওয়াটায় মনে হচ্ছে একজন প্রিয়জনকে হারালাম। সাহিত্যের অঙ্গন এবং সংবাদপত্রের পাতায় তার নিত্য উপস্থিতিতে আমরা তাঁকে একজন আপনজন হিসেবে মনে করতাম। একই শহরের বাসিন্দা হিসেবে, তার কবিতার পাঠক হিসেবে এবং কখনো-সখনো কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে সিকদার আমিনুল হকের অনুপস্থিতি আমাকে বিষণœ ও বিপর্যস্ত করে দেয়। আমি অবশ্য কবিতার বোদ্ধা পাঠকও নই, কবিতা বুঝি কি বুঝি নাÑ সেটাও কোনো বিষয় নয়। আÍীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মী ছাড়াও এ শহর, এ দেশের এমন কিছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের সাথে কখনো দেখা হয়নি, আদৌ হবে কিনা জানি না; কিন্তু তাঁদের কর্মকা-ে আমরা তাঁকে বা তাঁদের আপনজন হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসি। আর সিকদার আমিনুল হককে তো চিনেছি নানাভাবে। সেই কৈশোরে তার কবিতার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রোমান্টিক তবে অনুচ্চ কণ্ঠে কবিতা পড়তে দেখেছি ‘পদাবলী’র কবিতা পাঠের আসরে। আশির দশকে যখন তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘বিপ্লব’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়, সেটি গুণে, মানে ও স্মার্টনেসে সবার নজর কেড়ে নেয়। তখনকার প্রকাশনার মানের তুলনায় এ পত্রিকাটি ছিল দারুণ ঝকঝকে। আমরা যারা তরুণ ছিলাম, তারা এই পত্রিকার প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু যা কিছু ভালো, তার আয়ু কেন জানি হয় স্বল্পায়ু। আমাদের দেশে এটি যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ‘বিপ্লব’ পত্রিকাটির অকালে ঝরে যাওয়ায় আমরা কষ্ট পেয়েছি। সে সঙ্গে সম্পাদনার ক্ষেত্রে একজন রুচিবান ও পরিশীলিত ব্যক্তির অনুপস্থিতি পলে পলে অনুভব করেছি। এরপর আর তিনি সম্পাদনার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন বলে মনে হয় না। তিনি ছিলেন ষাট দশকের বহুল আলোচিত ‘স্বাক্ষর’ গোষ্ঠীর অন্যতম পুরোধা কর্মী। তার প্রথম সম্পাদিত পত্রিকা ‘সাম্প্রতিক’ এবং পরবর্তীকালে ‘বিপ্লব’-এর মতো দুটি ধারালো পত্রিকা প্রকাশ করে যেহেতু বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি, সম্ভবত সে কারণে সম্পাদনার সঙ্গে নিজেকে আর জড়াননি। হয়তো অভিমান করে দূরে থেকেছেন। এ কারণে আমরা একজন মননশীল, যোগ্য ও মেধাবী সম্পাদককে সম্পাদনার জগত থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলি। আর্থিক অসচ্ছলতা তাকে কখনো স্পর্শ করতে না পারায় শুধু কাব্যচর্চা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন পুরোটা জীবন। পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে না জড়ালেও পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কটা কখনোই তিনি এড়াতে পারেননি। ১৯৮৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সম্পাদনায় (তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক) এবং সাবের হোসের চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় (প্রিন্টার্স লাইন অনুযায়ী তিনি ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। বর্তমানে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর প্রকাশক) ২১/১ ইস্কাটন গার্ডেন রোড থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘মূলধারা’। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ এবং তারুণ্যের দীপ্তিতে ভাস্বর তারুণ্য পেরিয়ে আসা ক’জন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনÑ কবি মোহন রায়হান, কবি মারুফ রায়হান, চিত্রশিল্পী ইউসুফ হাসান (বর্তমানে নিজস্ব বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার), চিত্রশিল্পী রাকিব হাসান (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী), সালাম সালাহউদ্দিন (বর্তমানে দৈনিক আজকের কাগজ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে আছেন)। নিয়মিত লিখতেন কবি আবু কায়সার, হেদায়েত হোসেন মোরশেদ, মতিউর রহমান (বর্তমানে প্রথম আলো সম্পাদক), কবি সানাউল হক খান, আবদুল কাইয়ুম মুকুল (বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলো’র যুগ্ম সম্পাদক), মোজাম্মেল হোসেন (বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলো’র নির্বাহী সম্পাদক), বিভুরঞ্জন সরকার (বর্তমানে মৃদুভাষণ-এর নির্বাহী সম্পাদক), মুহাম্মদ হিলালউদ্দিন (রম্য লেখকখ্যাত হিলাল ফয়েজী), সঞ্জীব চৌধুরী (বর্তমানে দৈনিক যুগান্তর-এর সহকারী সম্পাদক), সারোয়ার কবীর (বর্তমানে সাপ্তাহিক বর্তমান দিনকাল-এ) প্রমুখ খ্যাতিমান ও প্রতিভাবানরা এবং খ-কালীন রিপোর্টার হিসেবে এই নিবন্ধকার। এছাড়া ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন খন্দকার তারেক (পাক্ষিক ক্রীড়াজগত-এ কর্মরত) ও শামসুল হক টেংকু (বর্তমানে দৈনিক ভোরের কাগজ-এ)। পরে পত্রিকাটি ট্যাবলয়েডে পরিণত হলে যোগ দেন মাহমুদ শামসুল হক (বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠে), ফটোগ্রাফার চঞ্চল মাহমুদ, হাবিব ওয়াহিদ শিবলী, নাট্যাভিনেত্রী মুনীরা বেগম মেমী (‘মূলধারা’য় সম্পর্কটা সুদৃঢ় হওয়ায় পরবর্তীকালে শিল্পী ইউসুফ হাসানের গৃহিণী মুনিরা ইউসুফ), চিত্রশিল্পী জুয়েল, ফরহাদ প্রমুখ। উজ্জ্বল, উচ্ছল কখনো-সখনো ‘উচ্ছৃ´খল’ বিভিন্ন মেজাজের এই লেখক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পীসহ সবাইকে এক সুতোর মালায় বেঁধে রেখেছিলেন মেধা ও প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল এবং শান্ত ও ধীর-স্থির স্বভাবের বেনজীর আহমেদ (বর্তমানে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)।
‘মূলধারা’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে সাংঘাতিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রথমে ম্যাগাজিন, তারপর ট্যাবলয়েড আকারে প্রকাশিত হয়ে পত্রিকাটি দারুণভাবে কাঁপিয়ে দেয়। লেখায়, রেখায়, ছাপায়Ñ সব দিক দিয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। চারপাশকে সচকিত ও আলোকিত করে তোলে ‘মূলধারা’। এ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মূলত নির্বাহী সম্পাদক বেনজীর আহমেদকে বৃত্তে রেখে শহরের অন্যতম সেরা আড্ডা, গুলতানি, পারস্পরিক সম্পর্ক আর হৃদয়ের লেনদেনের উষ্ণতায় সরগরম হয়ে উঠতো। আড্ডা ঝলসে উঠতো যেন ধারালো তরবারির মতো। এই ঝলসানো ও মধুময় আড্ডায় কেইবা সামিল হতেন না? সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত, ক্রীড়ার তুখোড়, মৃদ্যুভাষী ও রাগী তরুণরা হঠাৎ হঠাৎ এসে আসর গুলজার করে দিতেন। এঁদের মাঝে নিয়মিত আসতেন কবি সিকদার আমিনুল হক। ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি ‘দীপক’ নামে পরিচিত। ধীর পদক্ষেপে এসে খুবই নীরবে নির্বাহী সম্পাদক বেনজীর আহমেদের কাছাকাছি একটা চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে খুব সম্ভবত মুঠোবন্দী একটির পর একটি সিগারেটে সুখটান দিতেন। হাওয়ায় ধূম্রজাল পাক খেতে থাকলে আড্ডায় সরব হতেন ধীরে-সুস্থে ও মার্জিত ভঙ্গিমায়। তার পোশাক-আশাক, চলাফেরা, বসা ও তার কথা বলার স্টাইলটি ছিল ভারি আকর্ষণীয়। তার সবকিছুতেই ছিল আভিজাত্য ও বনেদিয়ানার ছাপ। স্মিত হাসিটি ছিল মাধুর্যময়। সেই প্রথম তাঁকে অন্তরঙ্গভাবে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। আমার কাছে তাঁকে শুধু একজন আধুনিক কবি হিসেবে নয়, একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। শিক্ষা, মেধা ও পা-িত্যÑ সব দিক দিয়েই যেহেতু আমি পিছিয়ে ছিলাম, সঙ্গত কারণে আড্ডার মিছিলে আমি ছিলাম একজন নির্বাক স্রোতা। তবে সবার প্রাণের উত্তাপ আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করতো, যে কারণে এই আড্ডাকে কখনোই এড়াতে পারতাম না। সাধারণত দেখা যেত, রাত বাড়ার সাথে সাথে আড্ডা ফাঁকা হতে শুরু হলে শেষ অবধি থেকে যেতেন আড্ডার মধ্যমণি বেনজীর আহমেদ, কবি সিকদার আমিনুল হক, অরুণ ও ফরিদ নামের দুই আড্ডাবাজ ভদ্রলোক, আর এই অধম। প্রায় প্রতিদিনই আমরা ইস্কাটন থেকে হেঁটে হেঁটে যেতাম এলিফ্যান্ট রোডে। কবি সিকদার আমিনুল হক ও বেনজীর আহমেদÑ উভয়েরই গন্তব্যস্থল ছিল এলিফ্যান্ট রোড। সেখানে পৌঁছেও রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে গভীর রাতে বাসার দিকে ছুটতাম। কবি সিকদার আমিনুল হকের সঙ্গে এভাবেই ভেতরে ভেতরে একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়। বয়সের ব্যবধান, আপাদমস্তক কবিসুলভ ভারিক্কীয়ানার পাশাপাশি আমার স্বভাবসুলভ লাজুকতা ও নির্লিপ্ত মনোভাবের কারণে তার সঙ্গে কখনোই তেমনভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তারপরেও তার সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গতা অনুভব করতাম। একজন কবি, একজন রুচিশীল মানুষ এবং সর্বোপরি একজন কাছের মানুষ হিসেবে হৃদয়ের জমিনে তার ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
মৃত্যুর পর কবি সিকদার আমিনুল হক সম্পর্কে লেখা হয়েছে : ষাট দশকের শীর্ষস্থানীয় এই কবির আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলা কবিতার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি আমৃত্যু শুদ্ধ কবিতা চর্চায় নিমগ্ন থেকে অন্যদেরকেও অনুপ্রাণিত করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবী, মানবতাবাদী ও প্রেমিক কবি। তার নিরলস ও নিরবচ্ছিন্ন কাব্যসাধনা আবহমান বাংলা কবিতার ধারায় একটি সুস্পষ্ট নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। দুটি প্রবন্ধের বইসহ তার গ্রন্থের সংখ্যা পনেরোর অধিক। তার অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যাও প্রচুর। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেÑ ‘দূরের কার্নিশ’, ‘তিন পাঁপড়ির ফুল’, ‘পারাবাত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’, ‘সতত জানার মানুষ’, ‘কাফকার জামা’, ‘বাতাসের সঙ্গে আলাপ’, ‘বিমর্ষ তাতার’, ‘সুপ্রভাত হে বারান্দা’, ‘সুলতা আমার এলসা’, ‘নির্বাচিত কবিতা’ এবং প্রবন্ধের বই ‘শব্দ থেকে ভাবনায়’ ও ‘আমার হল না গানÑ মৃত্যুচিন্তা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘মূলধারা’ থেকে প্রকাশিত হয় তার ‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থটি পাঠক মহলে আলাদা আবেদন সৃষ্টি করে। বিদগ্ধ পাঠকরা অনুধাবন করতে পারেন কবি সিকদার আমিনুল হকের নতুন কণ্ঠস্বর। এ গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে আমরা ‘মূলধারা’র সবাই সে বছরের বইমেলায় চায়ের স্টলে আড্ডার তুফান ছুটিয়েছি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া চাকমা মেয়েদের আকর্ষণে তাদের পরিবেশিত কাপের পর কাপ চা নিমিষেই উজাড় করে দিয়েছি।
কবি হিসেবে সিকদার আমিনুল হকের মূল্যায়ন করবেন বোদ্ধা, সমালোচক ও বয়ে যাওয়া সময়Ñ সে পথ আমার নয়। কিন্তু একজন সজ্জন, রুচিশীল মানুষ হিসেবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও কথার মাধুর্য দিয়ে যে নিভৃত জগত তিনি গড়েছিলেন, দূর থেকে আমরা যারা ছিলাম তার গুণমুগ্ধ অনুরাগী, তারা তার অনুপস্থিতি অনুভব করবো প্রতিটি মুহূর্ত।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ২২ মে ২০০৩
রাসায়নিক মৌসুমি ফল আর স্বাদহীন ইলিশ
বাঙালির সব ঐতিহ্যই একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বাঙালি খাদ্যের যে সুনাম ও সুখ্যাতি, তা-ও যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে বাঙালির আহার-বিহার ও আতিথেয়তা দেশ-বিদেশে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়ে এসেছে। কিন্তু নষ্ট সময়ের আবর্তে বাঙালির সব গৌরব যেন অস্তমিত হতে চলেছে। মৌসুমি ফল আর পদ্মার ইলিশ বাঙালির জাতীয় গৌরব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। ফল ও ইলিশ দিয়ে মেহমানদের আতিথেয়তা করা বাঙালির চিরায়ত অভ্যাস এবং এটা সব সময় দারুণভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু মৌসুমি ফল ও ইলিশের সেই খ্যাতি এখন আর নেই বললেই চলে। কুচক্রী ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার কাছে সমর্পিত হয়েছে আমাদের যাবতীয় অর্জন। গাছের ফল ও নদীর ইলিশও তা থেকে বাদ যায়নি। বরং এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে মুনাফালোভীরা।
ভেজালে ভেজালে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রতিটি পণ্য। নির্ভেজাল কোনো কিছু পাওয়া এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। বিশেষত খাদ্য জাতীয় পণ্য সয়লাব হয়ে গেছে ভেজালে। আর এই ভেজাল জাতীয় খাদ্য খেয়ে বাংলাদেশে রোগ-বালাই বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। হাট-বাজারে বা মার্কেটে গিয়ে কোনো ক্রেতার পক্ষেই নির্ভেজাল জিনিস যাচাই করে ক্রয় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফলে অধিকাংশ মানুষই এখন ভেজাল জিনিসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে নিয়মিত ভেজাল জিনিস খাচ্ছেন। বিক্রেতাদের কাছে এক ধরনের জিম্মি হয়ে পড়েছে ক্রেতারা। ভেজালকারীরা যতটা সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী, অসংগঠিত ক্রেতাদের তাদের কাছে অসহায় আÍসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাংলাদেশের পণ্যের গুণ ও মান যাচাই করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট (বিএসটিআই) নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু তাদের সক্রিয়তা তেমনভাবে টের পাওয়া যায় না। যে কারণে ভেজাল পণ্য, ভেজাল খাদ্যে পরিবৃত হয়ে ক্রেতারা ক্রমশ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলেছে। তাদের রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ভেজাল পণ্য, ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের মাঝে এতদিন ক্রেতাদের কাছে নির্ভেজাল হয়ে ছিল মৌসুমি ফল এবং শাক-সব্জি। সবারই এমন একটা ধারণা ছিলÑ গাছের ফলমূল ও শাক-সব্জিতে সম্ভবত ভেজাল দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এ ধারণাটাও মিথ্যে হতে চলেছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের তালপাকা গরমে নগরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও মধুমাস হিসেবে জ্যৈষ্ঠের আলাদা একটা মর্যাদা রয়েছে। জ্যৈষ্ঠের পাকা আমের মধুর রসে সবার মুখ হয় রঙিন। এই মাস হরেক রকম মৌসুমি ফলে টইটম্বুর হয়ে থাকে। আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তরমুজ, ফুটি, পেঁপে, কলা এবং মৌসুমি শাক-সব্জিতে সর্বত্র একটা মৌ মৌ সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। অতীতে আমরা দেখেছি, নির্দিষ্ট সময়ে মৌসুমী ফল গাছে ধরেছে এবং নির্দিষ্ট সময় তা পেকেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই টসটসে পাকা আম, তরমুজ, পেঁপে, টমেটো, কলা ইত্যাদি বাজারে এসে যাচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চয়ই ব্যতিক্রমধর্মী। হাজার বছর চলে আসা নিয়মের হঠাৎ করে এভাবে ব্যত্যয় ঘটায় সবাই অবাক হয়ে যায়। সময়ের জিনিস অসময়ে পেয়ে গেলেও তার দাম যেমন সাধারণের নাগালের বাইরে থাকে, তেমনি তার স্বাদও মোটেই মধুর নয়। জানা যায়, বিভিন্ন রকম বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মৌসুমি ফল পাকানো এবং শাক-সব্জি তরতাজা করা হয়। ইথিলিন অক্সাইড দিয়ে কাঁচা আম, পেঁপে, তরমুজ, কলা, টমেটো ইত্যাদি ফল কৃত্রিমভাবে পাকানো এবং ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য মৌসুমি ফল ও শাক-সব্জি সতেজ করার জন্য কার্বাইড পাউডার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইথিলিন অক্সাইডও রাসায়নিক তরল পদার্থ। সাধারণত এটি বিভিন্ন শিল্পের রাসায়নিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটা দাহ্য জাতীয় ও অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল। এর সংস্পর্শে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, ফুসফুস ক্ষত-বিক্ষত, মাথাধরা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট ও সাইনোসিস ছাড়াও ক্যান্সারসহ মারাÍক অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে ফল পাকানোর জন্য। আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলাসহ গ্রীষ্মকালীন কাঁচা ও অপরিপক্ব ফল দ্রুত পাকাতে হলে ফলের ওপর ইথিলিন অক্সাইড ছিটিয়ে দিতে হয়। এরপর সারারাত ঢেকে রাখলে ফলগুলো কৃত্রিমভাবে পেকে এমন রূপ ধারণ করেÑ মনে হবে গাছপাকা ফল। কিন্তু এই রাসায়নিক পদার্থ ফলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। সঙ্গত কারণে ফলগুলো বিষাক্ত হয়ে ওঠে। যা খেলে মারাÍক প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, কার্বাইড হলো এক ধরনের পাউডার। এ পাউডার দিয়ে গ্যাস বেলুনের গ্যাস তৈরিতে লাগে। এ পাউডারে ফলের রঙ পরিবর্তন ও সতেজকরণ করা হয়। কার্বাইড মানবদেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের মারাÍক ক্ষতিসাধন করে থাকে। আর এসব ফল ও শাক-সব্জি খেয়ে ক্রেতারা ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, লিভার ও কিডনির রোগ এবং চর্মরোগসহ নানা মারাÍক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপক সংখ্যায়। বাংলাদেশে মৌসুমি ফল ও শাক-সব্জির অসম্ভব কদর। দাম বেশি হলেও সব ধরনের ক্রেতাই কম-বেশি তা ক্রয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিক্রেতাদের প্রলোভন ও অসচেতনতার কারণে অসংখ্য মানুষ মারাÍক রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় কপার সালফেট ব্যবহার করে কাঁঠাল, কলা ও অন্যান্য ফল পাকানোর খবর জানা যায়। এখানে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কপার সালফেট দিয়ে পাকানো কাঁঠাল খেয়ে একজনের মৃত্যু ও ১১ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সবাই আক্রান্ত হয়েছে জ্বর, পাতলা পায়খানা, বমি ও পেট ব্যথায়।
যুক্তরাষ্ট্রে ইথিলিন অক্সাইড কীটনাশক, কসমেটিক্স ইত্যাদি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। আর যেসব শ্রমিক এসব উৎপাদনের কাজে সম্পৃক্ত, তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ লিউকেমিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মারাÍক রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে ঝরে পড়ছে। আর সেই ইথিলিন অক্সাইড আমরা এখন খাদ্যের সঙ্গে গলাধঃকরণ করছি। বিষয়টি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ইথিলেন অক্সাইড ও কার্বাইড পাউডার সাধারণত সবার হাতে পৌঁছানোর কথা নয়। নির্দিষ্ট প্রেসক্রিপশন কিংবা সার্টিফিকেট ছাড়া ওষুধ বিক্রেতাদের এটা বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ থাকার কথা। কিন্তু মুনাফার আশায় বিক্রেতারা কোনো রকম বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে যার-তার কাছে ইথিলিন অক্সাইড ও কার্বাইড পাউডার বিক্রি করছে। কিছুসংখ্যক লোক এটা বুঝে অধিক মুনাফার লোভে মৌসুমি ফল ও শাক-সব্জিতে ব্যবহার করলেও অধিকাংশ ফল ও শাক-সব্জি বিক্রেতা এর ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে মোটেও ওয়াকিবহাল নয়। তেমনিভাবে ওয়াকিবহাল নয় ক্রেতারাও। কেননা, এমন একটি অভিনব প্রতারণার ফাঁদ যে পাতা হয়েছে, এটা ক্রেতাদের পক্ষে বোঝা বা অনুধাবন করা মোটেও সম্ভব নয়। আর এ জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এই কিছুদিন আগেও স্বাদে-গন্ধে ইলিশ মাছের কোনো তুলনা ছিল না। এক বাড়িতে ইলিশ মাছ রাঁধা হলে তার গন্ধ পেতেন আশপাশের বাড়ির লোকেরা। কিন্তু ইদানীং ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ তো দূরে থাক, খেতেও ইচ্ছে করে না। মাছের রাজা ইলিশ তার গুণাগুণ ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় মৎস্য সম্পদ হলো ইলিশ মাছ। একক প্রজাতি হিসেবে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের শতকরা প্রায় ২০ ভাগই ইলিশ। সেই প্রাচীনকাল থেকে ইলিশের প্রতি বাঙালির আকর্ষণ চিরন্তন। শুধু প্রিয় খাদ্য হিসেবে নয়, জেলেদের আয়ের প্রধান উৎসও ইলিশ। কিন্তু নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মানুষের লোভের কারণে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান¦য়ে হ্রাস পাচ্ছে। সাগর, মোহনাঞ্চল ও নদীতে ইলিশের দেখা মেলে। উপকূলীয় নদ-নদীসমূহে পর্যাপ্তসংখ্যক ইলিশের বিচরণ। এ উপমহাদেশের ৭৫ শতাংশ ইলিশের বিচরণস্থল আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইলিশের খ্যাতি জগতজোড়া। বিশেষ করে কোলকাতায় বসবাসরত পূর্ববাংলার মানুষ এবং অভিবাসী বাংলাদেশীদের কাছে ইলিশ মাছ এক ধরনের নস্টালজিয়া। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফুটবল খেলায় জয়ী হলে ইলিশের চাহিদা দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ। প্রজনন মৌসুমে এ মাছ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে উজান স্রোতে সাঁতার কেটে চলে আসে। ডিম ছাড়ার পর আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। ডিম থেকে পরিপক্ব মাছ হওয়ার মাঝামাঝি সময়টাকে বলা হয় ‘জাটকা’। জাটকা বড় হওয়ার জন্য সমুদ্রে চলে যায়। পরিপক্বতা লাভের পর প্রজননের জন্য সমুদ্র হতে মিঠা পানিতে আসে। কিন্তু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা জাটকা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করায় নদীর ইলিশের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ষাটের দশক থেকে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের নদ-নদীতে আর ইলিশ মাছ দেখা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০০০ সালে ২০ হাজার টন জাটকা ধরা পড়েছে। ১৯৯০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫ হাজার টন। এত জাটকা ধরার পরও বাংলাদেশে বছরে ইলিশ উৎপাদন হয় দেড় লাখ টন। ইলিশ মাছ তার গতিপথ পরিবর্তন করে মিয়ানমারের নাফ ও অন্যান্য নদীতে চলে যাচ্ছে। আগে বাংলাদেশের যেসব নদীতে ৯৫ শতাংশ ইলিশ পাওয়া যেত, এখন সেখানে তা হ্রাস পেয়ে ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আমরা বাজারে যে ইলিশ মাছ দেখতে পাই, তার সিংহভাগই সমুদ্রের ইলিশ এবং মিয়ানমার থেকে আসে। যে কারণে ইলিশ মাছে মিঠা পানির স্বাদ ও গন্ধ নেই।
তবে সরকারিভাবে ইলিশ মাছ হ্রাস পাবার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে নদ-নদীর উজান এলাকায় পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়ায় পদ্মা ও মেঘনাসহ দেশের সব নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় ইলিশের প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট, প্রজনন মৌসুমে অধিকহারে ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা নিধন করায় ইলিশের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত, নদীতে ইলিশের সংখ্যা হ্রাস, প্রবাহিত নদীগুলোর উজানে ফারাক্কাসহ ভারতের বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের নদীতে পানি প্রবাহ হ্রাস ও গতিপথ পরিবর্তিত হওয়া, দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের কারণে নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত এবং কারেন্ট জালের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি। এসব কারণে বাংলাদেশের নদীতে ক্রমান¦য়ে ইলিশ মাছ কমে যাচ্ছে। সে জায়গায় আসছে সমুদ্র ও মিয়ানমারের ইলিশ। যে কারণে বাঙালির প্রিয় খাদ্য ইলিশ মাছ এখন অপ্রিয় খাদ্যে পরিণত হতে চলেছে। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ তার গন্ধ, বর্ণ, সৌন্দর্য হারিয়ে স্বাদহীন মাছে পরিণত হয়েছে। ইলিশ মাছের সেই বনেদিয়ানা ও স্বাদ ফিরিয়ে আনতে হলে জাটকা নিধন রোধ, কারেন্ট জাল বন্ধ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাঙালি তার যাবতীয় অর্জনগুলো হারিয়ে নিঃস্ব হলেও তার খাদ্য ও আতিথেয়তাটুকুর অন্তত সুখ্যাতি ছিল। কিন্তু মৌসুমি ফল আর ঐতিহ্যবাহী পদ্মার ইলিশ এখন বাঙালির রসনাকেই তৃপ্ত করতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে বাঙালি তার আতিথেয়তার দুই প্রিয় উপকরণ দিয়ে কীভাবে অতিথিকে আপ্যায়িত করবে? একে একে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নানা অর্জনগুলো যখন নষ্ট-ভ্রষ্ট হয়ে গেছে, ঠিক তখন মৌসুমি ফল আর পদ্মার ইলিশকে হারিয়ে আমরা আরো বেশি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি।
দৈনিক সংবাদ : ২৩ মে ২০০৩
প্লিজ, গাছ কাটবেন না
প্রতিদিন বাসস্থান থেকে কর্মস্থলে যাবার স্বল্প পরিসরের যে পথটুকু, যা যানজটের কল্যাণে বেশ কিছুটা দীর্ঘ হয়ে যায়, চাই বা না চাই, যাত্রাকালীন সময়টুকু গাড়িতে বসে আশপাশের নানা দৃশ্যাবলী কখনো বাধ্য হয়ে, কখনো একরাশ কৌতূহল নিয়ে দেখতে হয়। এ সময় নানা রকম অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। কখনো-সখনো সাত-সকালে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির পিছে পিছে চলতে হয়। নাকে এসে লাগে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ। কানে তীব্র চিৎকার হয়ে ভেসে আসে পঞ্চাশ ও ষাট দশকে গাছপালা পরিবেষ্টিত অবস্থায় গড়ে ওঠা চমৎকার সব বাড়ি ভাঙ্গার নির্মম শব্দ, দেখতে হয় বহুতল ভবনের শক্ত-গাঁথুনি। শুনতে হয় যানবাহনের অহেতুক হর্ন। ডুবে যেতে হয় নিকষ কালো ধোঁয়ার ধূম্রজালে। যানবাহনের নিয়ম না-মানা তো রুটিনমাফিক দৃশ্য। সড়কগুলোর মানচিত্র বদলে যাওয়া, ট্র্যাফিক সিগন্যালের নিত্য-নতুন নিয়ম-কানুনের ফাঁদে প্রায়শই আটকা পড়তে হয়। সড়কদ্বীপ কিংবা আইল্যান্ডের ওপরে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলোর মন্দভাগ্যসহ ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া রাজধানী ঢাকাকে যেন কখনো উত্তরাধুনিক কবিতার মত দুর্বোধ্য, আবার কখনো গীতল কবিতার মতো সহজবোধ্য মনে হয়। এর মাঝে মনটা তখনই বেশি খারাপ হয়ে যায়, যখন দেখি ইট-পাথর-সিমেন্টের অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের নিসর্গ। কিছুদিন কোনো রাস্তায় যাতায়াত না করলে সে এলাকাকে চিনতে কষ্ট হয়। দু’পাশে সটান দাঁড়িয়ে যায় বহুতল ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট ও ঝলমলে মার্কেট। কিন্তু চোখকে øিগ্ধ ও মনকে ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয়ার জন্য যে গাছগুলো সেখানে ছিল, তার লেশমাত্র চিহ্ন কোথাও থাকে না। প্রতিদিনই নির্মূল হয়ে যাচ্ছে গাছ-গাছালি। এর পাশাপাশি যানজটের সর্বগ্রাসী লাগাম টেনে ধরার জন্য আইল্যান্ডগুলোকে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তাতে গাছের সংখ্যা ক্রমান¦য়ে হ্রাস পাচ্ছে। অথচ সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডগুলোতে অনেক অযতœ-অবহেলা আর বাধা-বিঘœ ও প্রতিকূলতার মাঝে বেড়ে ওঠে এক-একটি গাছ। কত চারা যে গাছ হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যায় অকালে! এর মাঝেও যা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে এই পচা-গলা-নোংরা শহরের শোভা বর্ধন করে, তারও বলি হতে হয় কথিত সড়ক, সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডের উন্নয়ন কর্মকা-ে। এছাড়াও প্রতি বছর ঝড়, বৃষ্টি ও টর্নেডোয় বিনষ্ট হয় হাজার হাজার গাছ। প্রকৃতির ওপরে কারো হাত না থাকলেও অধিকাংশ গাছই উপড়ে পড়ে আমাদের অবহেলায়। এর কারণ সড়ক উন্নয়ন, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ-টেলিফোনসহ নানা কারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করায় রাস্তার পাশের গাছগুলোর মাটি আলগা হয়ে যায়। এছাড়া অধিকাংশ গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত মাটি নেই। এ কারণে একটুখানি বাতাসে বা ঝড়ে গোড়াসহ হেলে পড়ে প্রাচীন ও নবীনÑ সব বয়সী গাছ।
এমনিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মূল্যবান বৃক্ষসম্পদ। তার ওপর জনগণের অজ্ঞতা আর পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে গাছ-গাছালির সংখ্যা। একটা সময় এই ঢাকা ছিল বৃক্ষ ও ফুলের শহর। প্রতিটি বাড়ি ছিল বৃক্ষময়। ছিল নানারকম ফুল ও ফলের সমাহার। কবি বুদ্ধদেব বসু কতই না প্রশস্তি গেয়েছেন এই ঢাকা শহরকে নিয়ে। ঢাকার নিসর্গ ও নির্জনতার কথা কখনোই তিনি ভুলতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসুর স্বপ্নের ঢাকা শহরকে চিনতে এখন বড্ড কষ্ট হয়। ইট-পাথরের আকাশছোঁয়া কংক্রিটে ঢেকে গেছে ঢাকার খোলা আকাশ। ফুল, ফল ও বৃক্ষ দেখতে হলে চলে যেতে হয় নাগরিক কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও। তাছাড়া অল্প কিছু বৃক্ষ যে এখনো দেখা যায়, তার অধিকাংশই অপরিচিতÑ বিদেশি বৃক্ষ। সবকিছুতেই যেখানে বিদেশ-নির্ভরতা, সেখানে গাছই বা বাদ যাবে কেন! বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গাছগুলোর না আছে সৌন্দর্য, না আছে কোনো গুণাবলী। বরং কিছু কিছু গাছ পরিবেশ ও মাটির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। বৃক্ষের পাশাপাশি এখন আর দেখা যায় না নয়নমনোহর ও মাতাল করা বাহারি সুগন্ধী ফুল ও ফলের গাছ। বৃক্ষ, ফল ও ফুল এখন ঢাকা শহরে বিরল হয়ে ওঠায় তা সরকারি উদ্যানে যেয়ে টিকিট কেটে দেখতে হয়। বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট বাড়ির টবে, কোনো কোনো বাড়ির ছাদে কিছু কিছু সৌখিন ব্যক্তি গাছ লাগান; নতুবা অধিকাংশ বাড়িতে প্লাস্টিকের গাছ কিংবা ড্রয়িং রুমে শোভা পায় প্রকৃতির দেয়াল চিত্র।
সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। যে কারণে মরুভূমি এখন মরুদ্যান হয়ে উঠেছে। যেখানে ছিল ধু-ধু বালুকারাশি, সেখানে এখন আশ্চর্যরকমভাবে দিগন্তব্যাপী সবুজের ছোঁয়া। এমন অসম্ভব সম্ভব হয়েছে মানুষের সচেতনতা ও অপরিসীম প্রচেষ্টার কারণে। আর অপরিকল্পিত নগরায়নের নামে ঢাকা শহর বৃক্ষহীন মরু শহরে পরিণত হতে চলেছে। বিশ্বের কোন্ শহরে নগরায়ন হচ্ছে না? সব শহরেই উন্নয়নের পাশাপাশি গাছ, ফল ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর শহরে বৃক্ষকে সাজানো হয়েছে স্থাপত্য শিল্পের মতো করে। দেখলে জুড়িয়ে যায় চোখ ও মন। আর পুরনো লন্ডন শহরকে উদ্যানের শহর বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
গাছ, ফল ও প্রকৃতি মানুষের অনেক পুরনো বন্ধু। মানব জীবনের জন্য গাছ অত্যন্ত অপরিহার্য। গাছের কাছে আমরা কী পাই না? খাদ্য, জ্বালানি, পশুসম্পদ, বাড়ি-ঘর তৈরির উপকরণ, ছায়াময় পরিবেশ, মাটির উর্বরতার পাশাপাশি প্রচ- বৃষ্টিপাত ও প্রবল সামুদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা করে গাছ। সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ, চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যপট ও আবহাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের মূল উপজীব্য অক্সিজেন আমরা গাছ থেকে গ্রহণ করি। বাংলাদেশে যেখানে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল বা গাছ-গাছালি থাকা দরকার, সেখানে আছে মাত্র ৬ শতাংশ। যা পরিবেশের জন্য দারুণ বিপজ্জনক। বিবেকবর্জিত এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের লোভে নির্বিচারে লোপাট করছে বৃক্ষসম্পদ। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জলবায়ু। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে অস্থিরতা ও চঞ্চলতা। যে জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে সামাজিক পরিবেশ। অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। আসলে গাছের সঙ্গে মানুষের যে আÍিক ও হার্দ্যকি সম্পর্ক, তা অনুভবের ও অনুধাবনের বিষয়।
জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষ পরিচর্যার ওপর গুরুত্ব দেয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সর্বত্রই গাছ লাগানো প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে গাছের চারা সরবরাহ, গাছের পরিচর্যা করা ও গাছের গুরুত্ব তুলে ধরে জনমত গড়ে তুলতে হবে। ইদানীং অবশ্য কিছুটা সচেতনতা বেড়েছে। গ্রাম এলাকায় গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে লাগাতে হবে বনজ, ফলজ, ভেষজ ও ঔষধি গাছ। ফুল, ফল, দারুবৃক্ষ, অশ্বত্থ গাছ শুধু প্রকৃতিকে সুন্দর করে না, ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়ে থাকে। দারিদ্র্য দূরীকরণে বৃক্ষ হতে পারে অকৃত্রিম বন্ধু। স্কুল-কলেজ, রাস্তার পাশে, হাইওয়ে, ট্রেন লাইনের দু’পাশে, নদীর তীরে, বাড়ির সামনে এবং খোলা জায়গা পেলে গাছ লাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী একটি গাছ কাটলে অন্তত তিনটি গাছ লাগানো প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে গাছের কোনো বিকল্প নেই।
শুধু গাছ লাগালেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা, গত কয়েক বছরে কোটি কোটি গাছের চারা লাগানো হয়েছে। সে অনুপাতে তা গাছ হয়ে ওঠেনি। এর কারণ, যথাযথ পরিচর্যার অভাব। এই ঢাকা শহরে সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডগুলোতে বিভিন্ন সময় গাছের চারা লাগানো হয়েছে। তার বেশিরভাগই গাছ হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যায়। অনাদরে ও অবহেলায় যে গাছগুলো বেঁচে যায়, সেগুলো নগরায়ন ও সৌন্দর্যের নামে কেটে ফেলা হয়। ফলে ঢাকা শহর ক্রমশ বৃক্ষ ও ছায়াশূন্য হয়ে যাচ্ছে। নগরপিতার প্রতি অনুরোধ, প্লিজ, যে অল্প কিছু গাছ এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, তাকে রক্ষা করুন। আর যাতে কোনো গাছ না কাটা হয়, সে ব্যবস্থা নিন। সে সঙ্গে নতুন নতুন গাছ লাগানোর ব্যবস্থা ও তার যথাযথ পরিচর্যা করে পৃথিবীর অন্যান্য শহরের মতো ঢাকাকেও একটি সুন্দর, নৈসর্গিক ও তিলোত্তমা শহরে পরিণত করুন।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ৩০ মে ২০০৩
বিমল দা’র অকালে চলে যাওয়া
ব্যক্তিগতভাবে আমি দৈনিক পত্রিকার শোক সংবাদের কলাম খুব একটা দেখি না। বলা যায়, দেখতেও চাই না। জানি, মৃত্যু অনিবার্য। তারপরও কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখতে চাই। ভাবটা এমন, আমি পত্রিকায় চোখ না বুলালে ঝরে যাওয়া জীবনগুলো অটুট থেকে যাবে! কিন্তু তাই কি কখনো হয়? ১৭ মে কেন জানি পত্রিকার শোক সংবাদের কলামে হঠাৎ চোখ চলে যায়। অমনি বুকটা ছেঁক করে ওঠে। পত্রিকায় দেখলাম বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও অধ্যাপক বিমল দত্ত ১৫ মে রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। এ বয়সে তিনি এভাবে চলে যাবেন, ভাবতেও পারিনি। আসলে আমাদের ভাবাভাবি নিয়ে বিধাতার কিইবা আসে যায়! বিমল দা’র মৃত্যু সংবাদটা পড়ার পর বুকের মাঝে একরাশ কষ্টকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি যে তার খুব ঘনিষ্ঠ বা কাছাকাছি ছিলামÑ তা হয়তো বলা যাবে না। তাছাড়া পরিচয়ের যেটুকু গ-ি গড়ে উঠেছিল, নির্মম নাগরিক জীবনে ছেড়ে যাওয়া যানজটে আটকেপড়া বাসের মতো তা আস্তে-ধীরে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। তার সঙ্গে কবে শেষ দেখা হয়েছিলÑ সেই স্মৃতিটুকুও স্মরণের জানালা দিয়ে হারিয়ে গেছে। তবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৫ সালের মার্চে; যখন আমি দৈনিক বাংলার বাণীতে শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। বাংলার বাণীতে যেদিন প্রথম যোগ দেই, সেদিনের বিকেলের পালার শিফ্ট-ইন-চার্জ ছিলেন কবি সোহরাব হাসান, যাঁর হাতে আমার দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। চমৎকার ও প্রাণখোলা এই মানুষটি খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে এবং সহসাই আপন করে নিতে পারেন। আমি দুরু দুরু বক্ষে তার সামনে বসতেই তিনি সহজ-সরল হাসি দিয়ে আমাকে আপন করে নেন। একে একে পরিচয় করিয়ে দেন বিকেলের শিফটে কর্মরত শহীদ আশরাফ, নাহিদ আমিন খান, আবদুল হালিম পলাশ, খান মোহাম্মদ সালেক, সুকুমার সরকার, সায়েদুল আরেফীন, অসীম কুমার উকিল, প্রণব সাহা প্রমুখের পাশাপাশি মফস্বল ডেস্কের ইন-চার্জ বিমল দত্তের সঙ্গে। অমায়িক ও মৃদু হাসি দিয়ে তিনি আমাকে বরণ করে নেন। নিপাট ভদ্রলোক বিমল দা’র উপস্থিতি অফিসে খুব একটা টের পাওয়া যেত না। নীরবে-নিভৃতে চুপিসারে কাজ করতেন। অথচ বিভিন্ন জেলার সংবাদদাতাদের উপস্থিতিতে মফস্বল ডেস্ক সরব হয়ে উঠলেও তার আড়ালে থাকতে চাইতেন বিমল দা। তার এই নিভৃতচারী ও নিঃশব্দ কাজ আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। তবে বিমল দা’কে নিয়ে আমার জীবনে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি তখন তেজগাঁও কলেজের ‘নামমাত্র’ ডিগ্রির ছাত্র। আসলে স্কুল-বয়স থেকেই পত্র-পত্রিকার সান্নিধ্যে আসায় পড়ালেখার প্রতি আমার ঝোঁকটা একদমই চলে যায়। অল্প বয়সেই উড়নচ-ি হলেও শহরে বসবাস করে যদি মুর্খ থেকে যাই, সেই লোকলজ্জার ভয়ে পড়ালেখার সঙ্গে সম্পর্কটা থাকে টায়ে টায়ে। এমনিতে ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলাম না, তদুপরি পড়ালেখায় ছিল না কোনো মনোযোগÑ এমন লবডঙ্কা মার্কা ছেলেকে ছাত্র বলাটা ঠিক মানায় কিনা সন্দেহ থেকে যায়। যা হোক, কোনক্রমে এক্কা-দোক্কা করে এক পর্যায়ে তেজগাঁও কলেজের ডিগ্রির ছাত্র হয়ে যাই। কিন্তু কলেজে ক’দিন গিয়েছি, তা হাতে গুনে বলে দেয়া যায়। আমার তখন ধ্যান-জ্ঞান ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখা এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করা। তো একদিন কি মনে করে কলেজে গিয়েছি। ক্লাসের কাউকেই আমি চিনি না। না কোনো সহপাঠীকে, না কোনো শিক্ষককে। যে কারণে কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় দেখি সেখানে বিমল দা এসে হাজির। আগেই বলেছি, বিমল দা তখন বাংলার বাণীতে আমার সহকর্মী। তিনি আমাকে দেখে উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, দুলাল তুমি এখানে? আমি বললাম, আমি তো ক্লাস করতে এসেছি। শুনে তিনি মুচকি মুচকি হাসলেন। পাল্টা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে কী মনে করে? তিনি যে জবাব দিলেন, তাতে আমি লা-জবাব হয়ে যাই। তিনি জানালেন, তিনি এসেছেন ক্লাস নিতে। বিমল দা যে তেজগাঁও কলেজের বিএ’র বাংলার খ-কালীন মাস্টার মশাই, এটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। জানার কথাও নয়। কেননা, ক্লাস শুরুর কয়েক মাস পর সেদিনই আমি বিএ’র প্রথম ক্লাসটা করতে কলেজে গিয়েছি। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। আমি যথারীতি ছাত্রদের আসনে। তিনি শিক্ষকের ভূমিকায়। তবে সেদিন প্রায় সারাক্ষণই তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে চোখে-মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ক্লাস নিতে থাকেন। আর আমি আড়ষ্ট হয়ে কোনোক্রমে তার ক্লাসটি কাটিয়ে দেই। এরপর ডিগ্রি পরীক্ষার আগ অবধি কলেজমুখো হয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাংলার বাণীতে দেখা হলে আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও তিনি কিন্তু সলাজ হাসিতে আমাকে কাছে টেনে নিতে দ্বিধা করতেন না। অবশ্য বেশিদিন তিনি আর আমাকে বিব্রত হতে দেননি। ‘খবর’ দৈনিক হওয়ার পর তিনি সেখানে চলে যান। তারপর থেকে তার সঙ্গে কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু একদিন জানতে পারলাম তিনি মারাÍক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং হারিয়েছেন একটি পা। সেই থেকে শুরু হয় তার আরেকটি সংগ্রামী ও কঠিন জীবন। পা হারিয়েও তার মনোবলে একটুও চিড় ধরেনি। জীবনের কাছে হেরে যাননি। পঙ্গুত্বকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে তিনি জীবন নৌকায় ভেসেছেন। এরপর আর তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। পথে-ঘাটে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত। শুনেছিলাম, তিনি দৈনিক খবর ও তেজগাঁও কলেজ ছেড়ে থিতু হয়েছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মরত ছিলেন সহকারী কলেজ পরিদর্শক হিসেবে। জীবনের সঙ্গে সারাটা জীবন যুদ্ধ করে কেটে গেল বিমল দা’র। তরুণ বয়সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাড়া দিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন, দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে এক পা হারিয়ে জীবনের যুদ্ধ চালিয়েছেন। কিন্তু কখনোই জীবনের কাছে আÍসমর্পণ করেননি। ভেঙ্গে পড়েননি। কিন্তু শেষ অবধি অকালে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন বিমল দত্ত। আমাদের বিমল দা। বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন তিনি।
দৈনিক সংবাদ : ৩০ মে ২০০৩
ইরাকে আগ্রাসন এবং আমাদের শিক্ষা
ইরাকে মার্কিন-বৃটিশ হানাদার বাহিনীর আগ্রাসন ও দখলদারিত্বে পরাধীনতার গ্লানিতে ভুগছেন ইরাকের পাশাপাশি আরববাসীরাও। কিন্তু আগ্রাসী ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীকে ইরাকের মাটিতে স্বাগত জানিয়েছে শিয়া সম্প্রদায় ও কুর্দি গোষ্ঠী। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কেন তারা এমনতরো নিন্দনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো? নিশ্চয়ই এর পেছনে এমন কোনো নিগূঢ় কারণ আছেÑ যে জন্য তারা দখলদার বাহিনীকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই দুই গোষ্ঠী ক্ষমতা থেকে অপসারিত ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দুই যুগের শাসন ও শোষণে নিপীড়িত, বঞ্চিত এবং এক ধরনের পরাধীন জীবনযাপন করেছে। যদিও শিয়া সম্প্রদায় জনসংখ্যার দিক দিয়ে ইরাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু তাদের সঙ্গে আচরণ করা হয়েছে সংখ্যালঘুর মতো। দমন-পীড়ন চালিয়ে সর্বদা তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকসহ মূল স্রোতধারায় তারা কখনই সুবিধা করতে পারেনি। বরং তারা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য তাদের ওপর চালানো হয় নানা রকম নির্যাতন ও নিগ্রহ। রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার কুর্দিকে। এ কথা তো সর্বজনবিদিত, শাসক হিসেবে সাদ্দাম হোসেন ছিলেন একরোখা ও স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন। সামান্য এদিক-সেদিক হলে দূরের মানুষ তো বটেই, রক্ত সম্পর্কীয় আÍীয়-স্বজনকেও পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে একটুও কার্পণ্য করতেন না। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মিসরের জামাল আব্দুল নাসেরের মতো তিনি আরব জাতীয়তাবাদী নেতা হতে চাইলেও তার এসব দুর্বলতার কারণে তিনি ক্রমান¦য়ে ইসলামী দেশগুলোর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। ইরানের সঙ্গে বছর আটেক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে এবং কুয়েতে অনর্থক আগ্রাসন চালিয়ে আরব বিশ্বে তিনি রীতিমত আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ান। এ কারণে প্রতিবেশী দেশ ইরান, কুয়েত, সৌদি আরব, জর্ডান, মিসর, তুরস্ক প্রভৃতি আরব দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কটা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না।
মার্কিন-বৃটিশ বাহিনী আগ্রাসী শক্তি হিসেবে নির্লজ্জের মত ইরাকে হামলা চালালেও এর প্রতিবাদে এক সিরিয়া ছাড়া আর কোনো আরব রাষ্ট্র টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, এমনকি কোনো কোনো দেশ এক ধরনের পুলক অনুভব করেছে। তারা মনে-প্রাণে চেয়েছে সাদ্দাম-যুগের অবসান। সঙ্গত কারণে নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শিয়া সম্প্রদায় এবং কুর্দিরা তাৎক্ষণিক ‘মুক্তি’র উল্লাসে তাদের বরণ করে নিয়েছে। মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনী যে মাত্র ২০ দিনে ইরাক দখল করতে পেরেছে, সেক্ষেত্রে তাদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র এবং ইরাককে জাতিসংঘের মাধ্যমে দুর্বল ও নিরস্ত্রীকরণের বড় ভূমিকা অবশ্যই ছিল। তদুপরি সংখ্যালঘু কুর্দি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের নির্লিপ্ত এবং বিদ্রোহী ভূমিকা ইরাককে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করতে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর জন্য সহজ হয়েছে। কোনো কোনো আরব দেশের নীরব সমর্থন এবং শিয়া ও কুর্দিদের উল্লসিত ভূমিকায় মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসন জায়েজ হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে আগ্রাসী বাহিনী যখন একের পর এক ইরাকের ভূখ- দখল করে নিতে থাকে, ঠিক তখন শিয়া ও কুর্দিরা যেভাবে তাদের সুস্বাগতম জানিয়েছে এবং পাশ্চাত্যের টেলিভিশনের পর্দায় তা যেভাবে ঢালাওভাবে সম্প্রচারিত হয়েছে, তা ছিল অবশ্যই দৃষ্টিকটু। তারা যেভাবে লুটতরাজ, ভাংচুর ও সহিংসতার পথ বেছে নেয়, তাতে বিশ্ববাসী বিহ্বল ও হতবাক হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এ ঘটনায় তাদের সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী মনে হতে পারে। কিন্তু শিয়া ও কুর্দিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে তাদের উচ্ছৃ´খল আচরণের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকে গেলে মানুষ তখন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে চরমতম পথ বেছে নিতে দ্বিধা করে না। আবার অবস্থার পরিবর্তন হলে তারা ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনধারায়। তখন হিসাব কষে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। শিয়া ও কুর্দিরা যখন বুঝতে পেরেছে, তারা বাঘের মুখ থেকে সিংহের মুখে পড়েছে, তখনই তাদের মোহভঙ্গ ঘটে যায়। প্রথম কিছুদিন মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনীকে স্বাগত জানালেও শিয়া ও কুর্দিরা এখন আর ইরাকের মাটিতে তাদের দেখতে চায় না। ইরাকে দখলদার মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিষোদগার ক্রমশঃ বাড়ছে। তারা মার্কিন বাহিনীকে অবিলম্বে ইরাক ত্যাগের দাবি জানিয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা সাদ্দাম হোসেনের পতন কামনা করলেও শাসক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো মেনে নেবে না।
ইরাকের ঘটনায় একটি অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা বিশ্ববাসীর অন্তত হয়েছে যে, দেশের একটি অংশকে ক্ষুব্ধ করে কিংবা দমিয়ে রেখে দেশ পরিচালনার বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইরাকে আগ্রাসন-পরবর্তী নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ মনোভাবের কারণে যে কোনো দেশই যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। সে জন্য দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য যে কোনো হুমকি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক থাকলেই শুধু চলবে না, এ জন্য বৃহত্তর রাজনৈতিক ও জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। আর এ জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সর্বজনীন চেতনা ও ঐক্যের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ না করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব-মৈত্রী-সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। সবার আগে ভেবে দেখতে হবে, কোনো রকম বৈষম্য যেন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়। কোনো জনগোষ্ঠীর মনে যেন পুঞ্জিভূত ক্ষোভের সৃষ্টি না হয়, যাতে তারা নিজেদের অসহায় ও বঞ্চিত মনে করে।
বাংলাদেশে নানা সম্প্রদায়ের বসবাস। এ দেশের জনগণের গরিষ্ঠ অংশ মুসলমান। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের আচার-আচরণ ও মনোভাবে এমনটি যাতে প্রতিফলিত না হয়, যেন তারা সর্বেসর্বা। এমনটি হলে সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। তাহলে দেশের মধ্যে একটা বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর তাহলে সেটা হবে নিজের পায়েই কুড়াল মারার শামিল। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। অনগ্রসরতা ও সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। শক্তি ও সামর্থ্যে প্রতিবেশী দেশগুলো আমাদের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। যে কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বা সংঘাতে আমরা কতটা কী করতে পারবোÑ তা বলা দুষ্কর। যদিও ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ করে জিতেছি। সেটি মুক্তিযুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তখনকার সঙ্গে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির ঢের ঢের তফাৎ। বিশ্বশক্তি এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় এখন কারো নিঃস্বার্থ সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া সহজ নয়। সামরিক সমর্থন ছাড়া শুধু মানসিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার দিন এখন অতীত হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে দেশের মানুষ যদি এক সূতোয় গাঁথা মালা হয়ে আগ্রাসী শক্তির বিপক্ষে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, তাহলে আঘাত হানার আগে প্রতিপক্ষকে একাধিকবার ভাবতে হবে। অবশ্য ১৯৭১ সালে আমাদের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট তিক্ততায় ভরা। এদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সর্বাÍক সাহায্য ও সহযোগিতা করে নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষ করে, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের সদর্থক ভাবনার দিগন্তকে প্রসারিত করতে হবে। এটা অন্তত বুঝতে হবেÑ মাতৃভূমির সাথে বেঈমানি করে সভ্য মানুষ হিসেবে নিজেদের দাবি করা যায় না। ইরাকে আগ্রাসনের ঘটনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, শান্তির প্রতি এবং নিজ দেশের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ও ভালোবাসা অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশে দেশে আÍরক্ষার নতুন কৌশল নিয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতাকারী চারটি ইউরোপীয় দেশ ২৯ এপ্রিল ২০০৩ নিজেদের মধ্যকার সামরিক বন্ধনকে অধিকতর সুদৃঢ় করার বিষয়ে আলোচনার জন্য ব্রাসেলসে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে এই দেশ চারটি অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করায় যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের সঙ্গে তাদের মন-কষাকষির সূত্রপাত ঘটে। ফ্রান্স, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ও বেলজিয়ামÑ এই চারটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইরাকে হামলা এবং তার পরিণতি মূল্যায়নপূর্বক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে প্রতিরক্ষার বন্ধন জোরদার করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বাধুনিক ও ভয়ংকর সব অস্ত্রের যে প্রদর্শনী করেছে এবং যে উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ঠুঁটো জগন্নাথ ও বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইরাকে হামলা চালিয়েছে, তাতে ইউরোপীয় এই দেশগুলো বিচলিত ও ক্ষুব্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভয়ংকর আগ্রাসী চেহারাদৃষ্টে এই দেশ চর্তষ্ঠয়ের নেতারা উপলব্ধি করেছেন যে, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় শক্তির ভারসাম্য রচিত না হলে ইরাকের মতোই অন্য সবার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করবে মাত্র। ইউরোপীয় এই চারটি দেশের এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা অন্য সবাইকেও স্পর্শ করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশের জন্য আশার কথা, মানব সম্পদের দিক দিয়ে দেশটি সমৃদ্ধ। যে কোনো বিচারে ১৪ কোটি লোক বাংলাদেশের জন্য একটি বড় শক্তি। এই শক্তিকে বিভক্ত ও বিভাজন না করে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের আলোকে দেশকে পরিচালনা করা হলে শুধু দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানেরই উন্নতি হবে না, একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লাল-সবুজ পতাকা সমুন্নত থাকবে।
দৈনিক প্রথম আলো : ৪ জুন ২০০৩
ইরাকের অস্তিত্ব কি বিলীন হয়ে যাবে?
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগুতে হচ্ছে। পৃথিবীটা সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট অর্থাৎ যোগ্যদের জন্য। আর এই টিকে থাকতে গিয়ে কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে যুগে যুগে দেশে দেশে যুদ্ধ কিংবা মানুষে মানুষে লড়াই ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। হত্যা, ধ্বংসলীলায় শেষ হয়ে গেছে কত মানুষের জীবন ও সম্পত্তি। এসব যদি এড়ানো যেতো, তাহলে এই পৃথিবী হয়ে উঠতে পারতো স্বর্গীয় উদ্যানে। কিন্তু লোভ, স্বার্থপরতাকে মানুষ প্রশমন করতে পারেনি। যে কারণে হত্যা ও ধ্বংসলীলার কারণে এই পৃথিবী কখনো সুস্থ ও সবল হয়ে উঠতে পারছে না। প্রাচীনকালে কিংবা মধ্যযুগে যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল দখলদারিত্বের মধ্যে। মানুষকে দাসত্বের শৃ´খলে বন্দি রাখা এবং সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে ভোগদখল করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আধুনিককালে যুদ্ধ হলেও তা ছিল পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ছিন্ন হওয়ার সংগ্রাম এবং নানা স্বার্থের টানাপড়েনে সাময়িকভাবে যুদ্ধে বা সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। এতে অবশ্য জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু কোনো দেশ দখলের ঘটনা ঘটেনি। এসব যুদ্ধ ও সংঘাত সম্ভব হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের বন্ধন শিথিল থাকায়। কেননা, এমনটি হতে পেরেছে কোনো নিয়ম-নীতির বালাই ছিল না বলে। যুদ্ধবাজ হিটলার, মুসোলিনির জবরদস্তিমূলক শাসনের অবসানের পর পৃথিবীর মানুষের মনে ফিরে আসে শান্তি। যুদ্ধ, মৃত্যু, ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শান্তিকামী দেশগুলো একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ অনুভব করতে থাকে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে আন্তর্জাতিক আইনের সীমারেখা দৃঢ় হওয়ায় দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষত ছোট ছোট দেশগুলোও সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করছে। বিশ্বের শান্তিকামী সার্বভৌম দেশগুলো নিরাপত্তার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে গঠিত হয় ‘জাতিসংঘ’। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, জাতিতে জাতিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সমস্যা সমাধান এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি নিবেদিত থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার যে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ছায়াতলে আশ্রয় খুঁজে পায় প্রতিটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
অবশ্য জাতিসংঘের হালকা নীল ও সাদা পতাকাতলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সমবেত হলেও যুদ্ধ ও সংঘাতের অবসান হয়নি। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সোভিয়েত ও মার্কিন বলয়ের ঠা-া লড়াই চলতে থাকে। চার দশকের ঠা-া লড়াইয়ে উত্তাপ-উত্তেজনা, øায়ুযুদ্ধ ও রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় যুদ্ধ-উত্তরকালে দুই কোরিয়ার যুদ্ধ, ১৯৫৬ সালে দুই র্ভিয়েতনামের যুদ্ধ, ১৯৫৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করায় মিসরের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নির্লজ্জ সমর্থন, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৩ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭৫ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধ, একই বছর অ্যাঙ্গোলায় গৃহযুদ্ধ, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ, ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ১৯৮২ সালে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ, ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখল, ১৯৯২ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় যুদ্ধ প্রভৃতি ছিল মূলত দুই পরাশক্তির ইন্ধনে আধিপত্য বিস্তার, জবরদখল, গৃহযুদ্ধ, সীমান্ত বিরোধ, গণহত্যা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতিগত সংঘাতকে কেন্দ্র করে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবন ঝরেছে। বিনাশ হয়েছে মূল্যবান সম্পত্তির। এর মধ্যে আরব ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জঠর থেকে সৃষ্টি হয়েছে ‘ইসরাইল’ নামক অবৈধ রাষ্ট্রের। ইসরাইলের আরব ভূখ- দখল, চীনের ভারতের লাদাখ অঞ্চল দখল ছাড়া ভূখ- জবরদখলের আর কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এমনটি সম্ভব হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য। এর মধ্যে শুধু আফগানিস্তানে কিছুটা বিতর্কিত ভূমিকা থাকলেও অধিকাংশ যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, জাতিগত সংঘাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। তারা বরাবরই স্বাধীনতাকামী, শান্তিকামী ও দুর্বল শক্তির পক্ষাবলম্বন করেছে। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সব সময়ই আগ্রাসী, জবরদখলকারী, আধিপত্যবাদী, স্বৈরাচারীদের সপক্ষে। এই দু’পক্ষের মধ্যে একটা øায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ও উত্তেজনা বিরাজ করলেও পরোক্ষভাবে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা বিরাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যা খুশি, তা করতে চাইলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরনের কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। এসব যুদ্ধে নীরব ক্ষত ও স্বার্থের টানাপড়েন রয়ে গেলেও পুরো দেশ দখলের ঘটনা ঘটেনি। ঘটলেও তা ছিল সাময়িক এবং সামান্য কিছু ভূখ-ের মধ্যে সীমিত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে বিশ্বব্যবস্থা। এককেন্দ্রিক পৃথিবীতে এখন একক প্রভু যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র একক সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তার স্বস্তিটুকু হারিয়ে গেছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আগ্রাসন চালিয়ে পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ধমকে এবং অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে যেভাবে ইরাক জবরদখল করে নিয়েছে, তাতে সারা পৃথিবীর মানুষ শুধু স্তম্ভিতই নয়Ñ আতঙ্কিতও হয়ে পড়েছে।
ইসরাইলের স্বার্থ অটুট রাখতে এবং তার জন্য যে বা যারা হুমকি, তাদের ঘায়েল করা, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করা ও তেল সম্পদ ভোগদখলের জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইরাক গ্রাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এটা আধুনিক সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং কলঙ্কজনক তো বটেই। মানুষের জীবন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মূল্যবান; কিন্তু যুদ্ধ, লড়াই, সংঘাতে জীবনহানি এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধের বিরোধী। যুদ্ধের হুঙ্কার পাওয়া গেলেই রাজপথে নেমে আসে শান্তিকামী মানুষ। কিন্তু যুদ্ধবাজদের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। তারা নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে লিপ্ত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। অবশ্য এতে যুদ্ধবাজদের কিছু না হলেও জীবনহানি ঘটে সাধারণ ও নিরীহ নাগরিক এবং দু’মুঠো অন্নের জন্য সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত দরিদ্র সৈনিকদের। যুদ্ধের নৃশংসতা ও বেদনাদায়ক ঘটনাবলী তাই এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না।
তবে আধুনিক যুগে মানুষ সভ্যতার পাঠ নিয়েছে। গণতন্ত্র, মৈত্রী, শান্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসনের প্রতি মানুষ এখন শ্রদ্ধাশীল। যে কোনো বিরোধ পারস্পরিক সমঝোতা কিংবা জাতিসংঘের মাধ্যমে নিরসন করে নিতে পারেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন অখ- অবস্থায় থাকার সময় একটা øায়ুযুদ্ধের চাপ ও তাপ বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করে রাখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর শান্তিকামী মানুষ এই বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলেনÑ যাক, আর যুদ্ধ নয়। পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তির নহবত। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে মানুষ জেনে এসেছে নানা জাতি, ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও গণতন্ত্রের লালনকেন্দ্র হিসেবেÑ যারা বিশ্বকে দিয়েছে বিজ্ঞান ও সভ্যতার আশীর্বাদ। অথচ তাদের নীতি ও নৈতিকতা যখন ভেঙে পড়ে, তখন আর কীভাবে আশাবাদী হওয়া যায়? নানা সমস্যা থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল মুক্ত স্বাধীনতার দেশÑ যা পৃথিবীর জন্য ছিল একটি মডেল। বিভিন্ন সুযোগ, সমৃদ্ধি ও ঝলমলে জীবনধারার টানে বহুজাতিক এই দেশটিতে ছুটে আসে পৃথিবীর নানা প্রান্তের লোক। হ্যামিলনের বংশীবাদকের সুরে সুরে ছুটে আসা এই লোকদের মধ্যে রয়েছে নানা জাতি, ধর্ম ও বংশ পরিচয়ের বিচিত্র ধারার লোক। গণতন্ত্রের শক্তিতে নানা দেশের নানা মানুষকে নিয়ে এক সুতোয় গেঁথেছে বিশ্বের শক্তিমান দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৭৭৬ সালে জন্মের পর থেকে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে এসেছে, তা ছিল তাবৎ পৃথিবীর মানুষের জন্য অভূতপূর্ব। প্রত্যক্ষ ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। হয়তো ভেতরে ভেতরে নানা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, প্রলোভন, কূটকৌশল ও রাজনৈতিক দ্বন্দ¡-সংঘাত চলেছে; কিন্তু সবকিছুর নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায় সরাসরি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত জনগণ। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা পৃথিবীর মানুষের কাছে অসীম আগ্রহ ও কৌতূহলের বিষয়। কিন্তু ২০০০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন মানুষের যাবতীয় আস্থা ও ধারণায় কুঠারাঘাত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে, তা যেন হঠাৎ করে সবার কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত গণতন্ত্রের সত্যিকার পূজারী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে আস্থা, জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসা দিয়ে আমেরিকানদের মন জয় করেন এবং পপুলার ভোটে তার জয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সবাই বুঝতে পারেন ভোটাভুটিতে আল গোরকে হারানো সম্ভব হবে না। নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আল গোরের সাফল্যের বার্তা আসতে থাকে। কিন্তু অস্ত্র ও তেল ব্যবসায়ী ইহুদি লবি তখন অন্য হিসাব কষতে থাকে। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে জুনিয়র জর্জ বুশের জয়ের জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। শেষ খেলাটা দেখান ফ্লোরিডার গভর্নর জর্জ বুশের অনুজ জেব বুশ। ভোট কারচুপির মাধ্যমে এমন একটা ধোঁয়াটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের। সেই আদালতের বিচারক ছিলেন কারা? তাদের নিয়োগদাতা ছিলেন জুনিয়র জর্জ বুশের পিতা সিনিয়র বুশ। আইন, বিচার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মুখে কালিমা লেপন করে তারা পক্ষপাতমূলক ও নির্লজ্জের মতো জুনিয়র জর্জ বুশের পক্ষে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে রায় দেন। এমন একটা লজ্জাজনক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেঁপে উঠলেও কেঁপে ওঠেনি আমেরিকান জনগণ। যারা সামান্য কোনো ঘটনায় বিস্ফোরিত হয়ে ওঠেন, তারা কেন জানি সবকিছু নীরবে মেনে নেন। পরবর্তীতেও এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। মনে হয় সেদিনই শেষ হয়ে যায় মানুষের বোধ, বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা, গণতন্ত্র, মৈত্রী, শান্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়-নীতি। এরই ধারাবাহিকতায় কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছে, আজ অবধি তা নির্ণয় করা না গেলেও তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের যে রণহুংকার ও তা-বÑ তাতে এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার নামে যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজেই সন্ত্রাসবাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে হিংসা ও সহিংসতার মাধ্যমে। আফগানিস্তান, ইরাকে আগ্রাসন, দেশে দেশে ‘লাদেন’ ফোবিয়ার নামে উন্মাদনার সৃষ্টি এবং একের পর এক মানব জাতি, মানবতা ও মানব সভ্যতাবিরোধী নতুন নতুন টার্গেট নির্ধারণ করার ঘোষণা করে চলেছে। পৃথিবীকে তারা কোথায় নিতে চায়- একমাত্র তারা ছাড়া আর কেউ তা জানে না।
এতো কিছু বলার উদ্দেশ্য, যুক্তরাষ্ট্র যে রণোন্মাদ হয়ে গেছেÑ তার মূলে রয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে জুনিয়র বুশের নির্বাচনী বৈতরণী অতিক্রম। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বকে নিয়ে পুতুল নাচের খেলা। তারা শুধু আগ্রাসন, জবরদখল ও আÍসাতের খেলায় মেতে ওঠেনি, পাশাপাশি তারা মেতে উঠেছে সভ্যতা বিধ্বংসী খেলায়। ইরাককে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়ার পাশাপাশি এখন তারা সভ্যতার ইতিহাস ও নিদর্শন মুছে দিতে চাচ্ছে। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগে ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক সংস্থা ইরাকের সভ্যতার নিদর্শনগুলো যাতে যুদ্ধের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইরাক দখল করার পর মার্কিন মেরিন সেনাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় লুট হয়েছে ইরাকি জাদুঘর, পাঠাগার, প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ। ভাংচুর, তছনছ ও লুটতরাজ করা হয়েছে ইরাকি সভ্যতার হাজার বছরের নিদর্শন। মানব সভ্যতার সূর্যোদয় ঘটেছিল ইরাকি ভূখ-ে। দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা ব্যাবিলনীয়, সুমেরীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতার অনেক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন পরিকল্পিতভাবে চিরতরে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া থেকে ইরাকের উদ্ভব। সে সঙ্গে মানব সভ্যতার বিকাশ। সমৃদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ইরাককে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার জন্য ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী সুকৌশলে এগিয়ে চলেছে। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ইরাককে একাধিক খ-ে বিভক্ত করার চক্রান্ত করছে। এ জন্য তারা বিবদমান শিয়া-সুন্নি ও কুর্দিদের গোষ্ঠীদ্বন্দ¡কে উসকে দিয়ে আলাদা নামে ইরাককে খ--বিখ- করতে চাচ্ছেÑ যাতে ইরাক নামক দেশটির অস্তিত্ব কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সে সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাতত্ত্বের ধ্বংসসাধন করে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন লুট ও ধ্বংস করে আরব সভ্যতাকে মুছে দিতে চাইছে। এমনিতে বিশ্বব্যাপী ইয়াঙ্কিদের জয়জয়কার। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মেধার ক্ষেত্রে তারা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে। দুনিয়ার সেরা প্রতিভাবান ও মেধাবীদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে নিয়ে গিয়ে তাদের মেধা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার জয়ঢঙ্কা বাজানো হচ্ছে। ফলে প্রাচ্য ও অনগ্রসর দেশগুলোর জ্ঞানের ভা-ার আরো শূন্য হয়ে যাচ্ছে; ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষা-দীক্ষায়, মেধায়-মননে, বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে ও যোগাযোগ ব্যবস্থায়। কিন্তু পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে ইয়াঙ্কি সভ্যতা আরবীয় সভ্যতা, সৌন্দর্যবোধ ও ঐতিহ্যের তুলনায় সমৃদ্ধ নয়। এ কারণে একটি সূক্ষ্ম ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা থেকে আরব সভ্যতার বিনাশে ইয়াঙ্কিরা বেছে নিয়েছে চরম পন্থা। আমরা অতীতে দেখের্ছি, লুটতরাজ চললেও সভ্যতার নিদর্শনগুলো বরাবরই অক্ষত থেকে যায়। এমনকি যুদ্ধ শেষে লুট করে নিয়ে যাওয়া নিদর্শনগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাদপীঠ প্যারিসের চিত্রকলা, ভাস্কর্যসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর যুদ্ধ শেষে আগ্রাসী জার্মানরা তা ফিরিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফিরিয়ে না দেয়া হলে তা যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এবার আমরা ইরাকে কী দেখছি? ইরাকি সভ্যতার নিদর্শনগুলো শুধু লুটতরাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যাবতীয় সভ্যতার নিদর্শন, প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ, দুর্লভ পা-ুলিপিসহ ইরাকি সভ্যতা ও ইতিহাসের যাবতীয় নিদর্শন ভেঙেচুরে মাটির সাথে এমনভাবে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে, যাতে করে তা উদ্ধার করা না যায়। অর্থাৎ ইরাকি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা সুপরিকল্পিতভাবে মহাকাল থেকে চিরতরে মুছে ফেলা হচ্ছে। হালাকু খান ইরাকি সভ্যতার যে চরম সর্বনাশ করেছিল, বুশ-ব্লেয়ার বাহিনী তার শেষটুকু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তারা কি চাইছে ইরাক নামক একটি দেশকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দিতে? যে ইরাকি সভ্যতা মানুষের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, তাকে বিলীন করে দিতে? ইরাকি সভ্যতাকে তাদের কেন এত ভয়? তার কারণ কি এই নয় যে, আমেরিকান আদিবাসী ইন্ডিয়ান ও উপজাতীয়দের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে শিকড়হীন বহিরাগতদের নিয়ে যেভাবে মিথ্যে মিথের ওপর গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র নামক একটি অভিবাসী দেশ, তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য পৃথিবীর সমৃদ্ধ সভ্যতার সব চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে! নতুবা বিশ্ববাসীর অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে মার্কিন মেরিন সেনাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকায় কেন ইরাকি জাদুঘর, গ্রন্থাগার ও প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ লুণ্ঠন ও ধ্বংস করা হয়েছে? কিন্তু চাইলেই কি মুছে ফেলা যায় কোনো সভ্যতা? এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে যে সভ্যতার চিত্রলিপি, তাকে তো কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। হয়তো নিদর্শনগুলো নিশ্চিহ্ন করা যাবে, সাময়িকভাবে ব্যাহত হবে মানুষের অনুসন্ধিৎসা। কিন্তু এ কথা তো সত্যিÑ সভ্যতার ইতিহাস বয়ে চলে বহতা নদীর মতো।
দৈনিক সংবাদ : ৫ জুন ২০০৩
নৌ-দুর্ঘটনা কি ‘বাৎসরিক পার্বণ’?
পয়লা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর আমরা দিনটি উদযাপন করি। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি বাঙালির চিরায়ত উৎসবের দিন। আনন্দের দিন। এই দিনটিকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রতিটি বাঙালির প্রাণে প্রাণে বেজে ওঠে উৎসবের মাদল। কণ্ঠে কণ্ঠে অনুরণিত হয় : ‘মুছে যাক গ্লানি/ঘুচে যাক জরা/অগ্নিøানে সূচি হোক ধরা’। অন্তরে অন্তরে মূর্ত হয়ে ওঠে মঙ্গলাকাক্সক্ষা। নববর্ষ আবাহন ও বর্ষবরণের উৎসবের পাশাপাশি রুদ্র বৈশাখ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে সংগ্রামী ও লড়াকু জীবনের দৃঢ়তা। কেননা, কালবৈশাখীর তা-বে ল-ভ- হয়ে যায় আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা। হঠাৎ দমকা ঝড়ের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নাগরিক ও গ্রামীণ জীবন। প্রকৃতির এই খেয়ালিপনার সামনে আমরা কেন, পৃথিবীর সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশগুলোও অসহায় হয়ে পড়ে। তবে তারা যত দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেÑ আমাদের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। আমাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক অবস্থান তেমন সুদৃঢ় নয়। এ কারণে কালবৈশাখীর হিংস্র ও নৃশংস থাবায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা আমরা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেই। কালবৈশাখীর রুদ্ররূপ, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ষড়ঋতুর এ দেশে প্রকৃতির ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়াটা কখনো কখনো চরম ভোগান্তি নিয়ে আসলেও কখনো-সখনো আশীর্বাদ হয়েও দেখা দেয়। আর এটাই সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের বৈচিত্র্য। যে কারণে কবি আপ্লুত হয়ে লিখতে পারেন : ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি/সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’।
কালবৈশাখীর রুদ্রমূর্তির কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে আমরা রুখতে না পারলেও আমরা যদি সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করি, তাহলে বড় বড় দুর্ঘটনা সহজেই এড়াতে পারি। কিন্তু ঋতুচক্র অনুযায়ী প্রতি বছর নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি অনেকটা বর্ষপঞ্জির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রমত্ত কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে পড়ে লঞ্চডুবির ঘটনা। প্রতি বছর লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ। এবারো অল্প ক’দিন আগে একই দিনে নারায়ণগঞ্জের পাগলার অদূরে বুড়িগঙ্গায় এবং ভৈরব উপজেলার কাছে মেঘনা নদীতে দুটি লঞ্চডুবিতে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিয়েছে প্রায় দু’শর কাছাকাছি লোক। এ ঘটনার পরও লঞ্চ, কার্গো ও ট্রলারডুবি থেমে নেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। আবহাওয়ার যে ধরন-ধারণ, তাতে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পত্রিকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২৬/২৭ বছরে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ শ’র কাছাকাছি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। যে মানুষগুলো প্রাণ হারাচ্ছে, তারাই শুধু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে না, এতিম করে দিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার-পরিজন ও আÍীয়-স্বজনকে। দরিদ্র দেশ হিসেবে আমরা শুধু অসংখ্য মূল্যবান জীবনই হারাচ্ছি না, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদও। এ মৃত্যু কি আমরা এড়াতে পারি না? যে দুর্ঘটনাগুলো প্রতি বর্ষপঞ্জিতে একইভাবে ঘটে চলেছে, তার কাছে কেন আমরা অসহায় আÍসমর্পণ করছি? এ থেকে কি আমাদের শিক্ষণীয় কিছু নেই?
অবশ্য প্রতি বছর দুর্ঘটনার পরপরই গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। এ পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলোর মুখ দেখেনি, আর যেগুলোর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে অধিকাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনা যতটা না প্রকৃতির খেয়ালে ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে মানুষের বেখেয়ালে। অতি অল্পতেই মুনাফার পাহাড় গড়ার আশায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলাচলের অনুপযোগী নৌযান রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবস্থায় চলাচল, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী ও মালামাল বোঝাই, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও সতর্ক সংকেত উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চ চালানো, অদক্ষ মাস্টার, সারেং ও সুকানি দিয়ে লঞ্চ চালানো, লাইফ-জ্যাকেটসহ জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় একদিকে যেমন নৌ-দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে সে অনুপাতে বাড়ছে জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। অথচ যাত্রীবাহী প্রতিটি লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট, রুট পারমিট ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা, লঞ্চের ডিজাইন ও নির্মাণ পদ্ধতির ত্রুটি নির্ণয় এবং যাত্রী নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়াদি লঞ্চ ছাড়ার আগেই পরীক্ষা করার কথা। আর এ জন্য রয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থাসহ নানা বিভাগ। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল করছে হাজার হাজার নৌযান। সঙ্গত কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। মুনাফালোভী নৌ-মালিকদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনোভাবেই হোকÑ অর্থোপার্জন।
আমাদের দেশের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌ-পরিবহন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের যাতায়াতের প্রধান অবলম্বন এটি। বিশেষ করে নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের চলাচলের জন্য সস্তায় ও সহজে এর চেয়ে ভালো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লোক নৌপথে চলাচল করে। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ যাই হোক না কেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকার তাগিদে নৌপথে তাদের চলাচল করতে হয়। বছরের পর বছর নৌ-দুর্ঘটনায় তারা জীবন দিচ্ছে। কিন্তু এর কোনো বিহিত হচ্ছে না। এমনকি জীবনের নিরাপত্তা তো দূরে থাক, মৃত্যুর পরও তাদের পরিবার-পরিজনকে কোনো রকম ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
নৌপথে মানুষের জীবন ঝরা পাতার মতো অকালে ঝরে গেলেও এ নিয়ে তাৎক্ষণিক হৈ-হুল্লোড় হলেও তারপর পরিস্থিতি দ্রুত থিতিয়ে যায়। এবারও উপর্যুপরি নৌ-দুর্ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকার ঝড়ের মৌসুমে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ঝড়ের মৌসুমে বিকেল ও সন্ধ্যার দিকে সাধারণত বেশি ঝড় হয় বলে চৈত্র মাসের ১৫ তারিখ থেকে বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে এ সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবেÑ তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে একটা প্রক্রিয়া অন্তত শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তা ভালো কি মন্দ, সেটা অনুধাবন করার আগেই লঞ্চ মালিকদের সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লঞ্চ চালালে তাদের লোকসান হবে, তাই এ দু’মাস তারা লঞ্চ চালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। লঞ্চ মালিকদের এ সিদ্ধান্তে লঞ্চ যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রীদের এভাবে জিম্মি করাটা কতটা যৌক্তিক, এটা ভেবে দেখা হয়নি। শেষ অবধি লঞ্চ মালিকদের চাপে এবং আলোচনার প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
লঞ্চ মালিকদের নিশ্চয়ই তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্য আছে। কিন্তু তারা কখনো যাত্রীসেবা কিংবা যাত্রীদের মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য খুব বেশি ভাবে বলে প্রতীয়মান হয় না। তারা যেহেতু ব্যবসায়ী, তারা ব্যবসা করবেনÑ এটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যাত্রীদের প্রতি তারা মোটেও সহানুভূতিশীল নন। এ ক্ষেত্রে সব লঞ্চ মালিকই যে একই পথের যাত্রীÑ সেটা বলছি না। কিন্তু অধিকাংশ মালিকই আইনকে ফাঁকি দিয়ে নৌ-চলাচল ব্যবসা করছে। সরকার যখন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার প্রতিবাদে লঞ্চ মালিকরা ধর্মঘট আহ্বান করলেও তাদের সহযোগীরা যে যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, সে ব্যাপারে তাদের কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। অবশ্যই শুধু লঞ্চ মালিকরা যে নিয়ম ভঙ্গ করছেÑ তা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও আইনের কার্যকর প্রয়োগ করছে না বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অভিযোগ করা হয়েছে। যারা সাধারণ যাত্রী, যাদের জীবন হাতে নিয়ে নৌপথে চলাচল করতে হয়, তারা এখন নিজেদের ভাগ্যকে সঁপে দিয়েছেন অদৃষ্টের হাতে। তারা ধরে নিয়েছেন, লঞ্চ দুর্ঘটনা একটি ‘বাৎসরিক পার্বণ’ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এই ‘পার্বণে’ যাত্রীরা জীবন উৎসর্গ করবেন আর লঞ্চ মালিক ও সংশ্লিষ্ট মহল বসে বসে তা উপভোগ করবেন!
দৈনিক বাংলাবাজার : ১১ জুন ২০০৩
শিক্ষা কি কেবল এলিট শ্রেণীর জন্য?
কোনো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায়, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। একদিকে নিুবিত্ত, অন্যদিকে বিত্তশালীরা। অবশ্য কোনো সমাজ ব্যবস্থাই একক কোনো কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে নেই। একটা ব্যবধান সব সময়ই বিরাজমান। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যে তীব্র ফারাক গড়ে উঠছে, তা অবশ্যই আশঙ্কাজনক। যারা গরিব, তারা আরো গরিব হচ্ছে, আর ধনীরা অর্থ-বিত্তে আরো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা অনেকটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব হলেও ভারসাম্যহীনতা ও ব্যবধান ক্রমশ বাড়তে থাকলে সে সমাজ কাঠামো কখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তার অন্যতম কারণ এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। শুরু থেকেই এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গলদ রয়ে গেছে। সময় সময় শিক্ষা কাঠামো বদলেছে। বদলটা হয়েছে উপরি কাঠামোয়। সত্যিকার অর্থে কোনো বদল হয়নি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থাটা প্রধানত সচ্ছল শ্রেণীর আওতাভুক্ত। ব্রিটিশরা এ দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে, তার সুফল পেয়েছে এ দেশে বসবাসরত ব্রিটিশ পরিবারের সন্তান, নবাব পরিবার এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পৃৃক্ত এক শ্রেণীর পরগাছা। দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বিবেচনা করা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে দারুণভাবে অবহেলা দেখানো হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও শিক্ষা-দীক্ষায় খুব বেশি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে মাছিমারা কেরানি গোষ্ঠী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তনের তেমন হাওয়া লাগেনি। বরং ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ককটেল তৈরি হয়ে একটা আজব কিসিমের শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড়িয়েছে। যুগোপযোগী কোনো শিক্ষানীতি না থাকায় বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা ক্রমান¦য়ে পিছিয়ে পড়ছি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আর এ বৈষম্যের অন্যতম কারণ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত তিন ভাগে বিভক্ত : ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম ও মাদ্রাসা শিক্ষা। ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়ালেখা করে বাংলা মিডিয়ামে। তবে এক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের মধ্যেও পার্থক্য বিদ্যমান। নিুবিত্তদের প্রধান অবলম্বন মাদ্রাসা শিক্ষা। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি, ধর্মীয়সহ বিভিন্ন ধরনের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা শ্রেণীগত ব্যবধান ও বৈষম্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরাও অনেক পিছিয়ে আছে। পুরনো ঐতিহ্য ও পশ্চাৎপদ মন-মানসিকতার কারণে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ব্যবধান গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষার খাত খুব বেশি উন্নত নয়। বাংলাদেশের শিক্ষার আনুমানিক হার ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৫২ শতাংশ এবং মহিলা ২৯ শতাংশ। অন্যান্য নিু আয়ের দেশের তুলনায় এ হার খুবই কম। অন্যত্র এই হার ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশে জিএনপির ২ দশমিক ২ শতাংশ ব্যয় হয় শিক্ষা খাতে। গড়পড়তা আয়ের দেশগুলো এ খাতে ব্যয় করে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ আয়ের দেশগুলো শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশ ব্যয় করে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার ৪০ শতাংশ শিশু কখনোই স্কুলে যায় না। যারা যায়, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলের গ-ি অতিক্রম করে। মাত্র ৭ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়। দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেহাল অবস্থা। ছাত্র-ছাত্রীদের বসার মতো পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল নেই। শিক্ষা উপকরণের দারুণ সংকট। ঝড়-বৃষ্টিতে অনেক স্কুলে ক্লাস করা সম্ভব হয় না। বর্ষাকালে তো অনেক স্কুল ডুবে যায়। খেলার মাঠ অল্প কিছু স্কুলে নামকাওয়াস্তে থাকলেও পাঠাগারের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। দেশের প্রায় ৫৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও জেলা শহরের স্কুলগুলোকে বাদ দিলে অধিকাংশের অবস্থাই শোচনীয়। সর্বজনীন ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা এখন অবধি নিশ্চিত করা যায়নি।
শিক্ষার প্রাথমিক ভিতটা গড়ে ওঠে নিচের পর্যায়ে। প্রাথমিক অবস্থা যেখানে মোটেও আশানুরূপ নয়, সেখানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অবস্থা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক হওয়ার কথা নয়। প্রায় ১২ হাজার মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হালও সুবিধাজনক নয়। øাতক পর্যায়ের কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চলতি শিক্ষা বছরে শিক্ষার্থীর অভাবে øাতক ও øাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজগুলোতে প্রায় সোয়া লাখ আসন শূন্য থাকবে। একজন ছাত্র নিয়েও কোনো কোনো কলেজ চলছে। গ্রামাঞ্চলে এ চিত্র বেশি দেখা যায়। শিক্ষা পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে এখন ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৫০টি øাতক (সম্মান) পর্যায়ের কলেজ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ১১৬০টি কলেজ, ১৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৪টি বিআইটি কলেজে। সব মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসনের সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজার। গতবছর ভর্তির যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৮ জন। ৫ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যায়। চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা শূন্য থাকবে ১ লাখ ১৪ হাজার ২৮২টি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও স্থানীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক কারণে নামমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এতে অপচয় হচ্ছে সরকারি অর্থের। সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষার মান দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। জবাবদিহিতার অভাব, বিনিয়োগে ভারসাম্যহীনতা, মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষা খাতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ এর অন্যতম কারণ। যদিও বাৎসরিক জাতীয় বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বেশি দেখানো হয়। এই বাজেট নানাভাগে ভাগ হয়ে যায়। প্রকৃত অর্থে শিক্ষার জন্য তেমন ব্যয় হয় না। কাটছাঁট করার পর যেটুকু বাজেট বরাদ্দ থাকে, তার সিংহভাগই ব্যয় হয় দালান নির্মাণ, শিক্ষকদের বেতন আর বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য।
দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র আবাসিক সংকট বিদ্যমান। পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল নেই। বিছানা পেতে ঘুমানোর জায়গা নেই। ৪ জনের জায়গায় ১৪ জনকে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়। এমনকি কমনরুম ও ডাইনিং রুমে ছাত্র-ছাত্রীরা গাদাগাদি করে থাকে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। ভর্তি হতে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শতকরা ১৫ জন ভর্তি হতে পারে। তাছাড়া রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের প্রভাবে দলীয়মনা ছাত্রদের ভর্তি করতে হয়। ফলে মেধাবী ছাত্রদের ভর্তির সংখ্যা আরো হ্রাস পায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত শহরের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সুযোগ পায়। দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেমন সুযোগ-সুবিধা পায় না। প্রতি বছর টিউশন ও ফি দেয়ার মতো সামর্থ্য অনেক মেধাবী ছাত্রের নেই। অধিকাংশ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ১৯৭৩ লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, বেসরকারি কলেজ, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, কোচিং সেন্টারসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সমান্তরালভাবে কাজ করছেন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২০০ শিক্ষকের মধ্যে ৪২৫ জন বিনানুমতিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও একই রকম। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘স্বায়ত্তশাসনের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন অমান্য করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক সংকট লেগেই আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দিন দিন কমছে। ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করে না। তাদের মধ্যে ‘ফটোকপি কালচার’ গড়ে উঠেছে। শিক্ষকদের মধ্যে উদাসীনতা ও ভোগবাদিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সর্বস্তরে শিক্ষার সমান অধিকারের কথা বলা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট ও বৈষম্য বেড়েই চলেছে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দেয়ার পর শিক্ষা খাতে বৈষম্য নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ব্যয়বহুল ও মূলত এলিটদের জন্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ও ফি কমপক্ষে ৩৫০০ ডলার। যা খুব কম ছাত্রের পক্ষে বহন করা সম্ভব। অবশ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষাবলম্বনকারীদের অভিমত হচ্ছে : প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আগামীতে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। তাছাড়া ১৯৯২ সালে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুযায়ী ৫ শতাংশ দরিদ্র ছাত্র বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়ায় সাধারণত: অপেক্ষাকৃত গরিব ছাত্ররা পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীরা বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে অন্যদের একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছে। এ দেশের মাটির সঙ্গে তাদের তেমন সম্পর্ক নেই। দেশ ও দেশের মানুষ তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। যে কারণে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি নিয়ে তারা ভাবেনও না। তাছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা কারোই যাচাই করার সুযোগ নেই। তাদের কার্যক্রমও স্পষ্ট নয়। এ কারণে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছেন : ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা রাখা প্রয়োজন। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যয় অনেক বেশি। স্বল্পসংখ্যক ধনী পরিবারের সন্তানই এগুলোতে পড়ালেখার সুযোগ পায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখে কেউ যেন না ভাবেÑ এগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছে কেবল কিছুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর কথা মাথায় রেখে, যাদের অভিভাবকরা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল।’
সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও বুদ্ধিভিত্তিক চর্চাটা অপরিহার্য। শিক্ষার আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত মানুষেরা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাই উপলব্ধি করতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা ন্যায়বান সমাজ গঠনের শক্তিশালী মাধ্যম। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সাহায্য ছাড়া নিুবিত্ত ছাত্রদের পক্ষে উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। নিুবিত্ত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মেধাবী ছাত্রদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে সমাজে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা নিয়ে আসতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জনগণ যে ভর্তুকি দেয়, তাতে সমাজের বিদ্যমান অসাম্য দূর হচ্ছে না। এ জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো, বাস্তবধর্মী ফি কাঠামো, উচ্চ শিক্ষার জন্য গরিব ছাত্রদের ঋণ দেয়া, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত তরুণদের বিশেষ ভর্তি কর্মসূচি, সমাজের বাস্তব চাহিদা ও শিক্ষার কারিকুলামের মধ্যে ব্যবধান, পরীক্ষা পাসের হার বাড়ানো এবং পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।
যদিও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘১৫/২০ টাকা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো সম্ভব নয়।’ তবে এটা তো ঠিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিপণন কেন্দ্র নয়। শিক্ষা কেনা-বেচার পণ্যও নয়Ñ এটা জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র। তাছাড়া শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার। শিক্ষা খাতে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া না হলে শিক্ষা চলে যাবে উচ্চবিত্তদের হাতে। সমাজে বৈষম্য বাড়বে। বাড়বে অস্থিরতা। এমনিতেই শহর ও গ্রামের শিক্ষার মান এক নয় এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবধান গড়ে ওঠায় বৈষম্য বাড়ছে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে। বিদ্যমান বৈষম্য দূর করাই যেখানে কঠিন, সেখানে নতুন করে যাতে বৈষম্য সৃষ্টি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোই উত্তম পন্থা।
দৈনিক সংবাদ : ১৫ জুন ২০০৩
আমাদের বদলে যাওয়া
পেছন ফিরে তাকালে অনুধাবন করা যায় বদলে যাচ্ছে আমাদের সমাজ, আমাদের সংসার। রূপান্তর ঘটছে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের। বদলটা মূলত হয়েছে মানচিত্র ও সময়কে কেন্দ্র করে। একাধিকবার বদলেছে এ অঞ্চলের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। সেই ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে বদলেছে কিছু মানুষ। কেউ কেউ ব্রিটিশদের ফাই-ফরমাশ খেটে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন; আবার কেউ কেউ ব্রিটিশদের চুইয়ে পড়া শিক্ষার আলোকে পুঁজি করে বদলে নিয়েছেন নিজেদের ভাগ্য। প্রধানত গ্রামীণ জনপদ হিসেবে আবহমানকাল থেকে চলে আসা এ অঞ্চলের কিছু মানুষের মধ্যে এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় সামাজিক বিভাজন। অবশ্য এর আগেও সামাজিক বিভাজন ছিল। তা ছিল সীমিত পরিসরে। একদিকে ছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ; অন্যদিকে নবাব বা জমিদার গোছের ব্যক্তিরা। নবাব বা জমিদারের সংখ্যা ক’জনই বা ছিল? তবে দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনে উদ্ভব ঘটে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। পরবর্তীকালে এরাই হয়ে উঠেন এ অঞ্চলের ভাগ্য বিধাতা।
১৯৪৭ সালের দেশভাগে সবচেয়ে বড় সুবিধাবাদী হয়ে ওঠে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। যদিও পাকিস্তানিরা বিভীষণ হয়ে দেখা দেয়, কিন্তু ব্রিটিশের অনুগ্রহভোগীরা ঠিকই তাদের অবস্থান আগের মতোই পাকাপোক্ত করে নেয়। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-নির্যাতনে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও ধর্মের নামে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী শ্রেণী তাদের ‘তৃণভোজী’ হয়ে ওঠে। এছাড়া ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি শাসকরা কিছুটা ছাড় দিলে অল্প কিছু মানুষ এগিয়ে আসে শিক্ষা-দীক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে। শিক্ষকতা, ওকালতি, চিকিৎসা, কেরানিগিরিসহ বিভিন্ন পেশায় অনেকেই এগিয়ে আসে। ফলে সমাজে একটা পালাবদল অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সুদূর আবহমানকাল থেকে এ দেশের মানুষ জীবনধারণ করে এসেছে কৃষিকাজ করে। হাজার বছর ধরে একই রকমভাবে চলে আসা জীবনযাত্রা আস্তে-ধীরে বদলে যেতে থাকে। ক্রমাগত শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনায় আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বাধিকার চেতনাবোধ তীব্র ও তীক্ষè হয়ে ওঠায় পরিবর্তনের হাওয়াটা জোরালো হয়ে ুওঠে। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে নতুন একটি শ্রেণী। যদিও খুব বেশি জৌলুস ছিল না, তারপরও পরিবর্তনটা টের পাওয়া যাচ্ছিল। যারা শিক্ষার পাঠ নিয়েছেন, তারা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের আশায় ছুটতে থাকেন ঢাকায়। ঢাকা শহরও তাদের আপন করে নেয়। শুরুতে গ্রামের বন্ধন কাটিয়ে এক/দু’জন করে শহরমুখো হতে থাকেন। বন্ধন কাটলেও নাড়ি কিন্তু পোঁতা থাকে গ্রামে। গ্রামের সঙ্গে বন্ধনটা কখনোই ছিন্ন হয়নি। ঢাকা শহরে জীবিকা জুটিয়ে নিলেও পরিবার-পরিজন, আÍীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব থাকে গ্রামে। চাকরির ছুটি-ছাটায় গ্রামে ফিরে যাওয়াটা হয়ে ওঠে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। হাজার বছর ধরে চলে আসা যে গ্রামীণ জনপদ, তার যে জীবনধারা, তার সঙ্গে যে নিবিড় সম্পর্ক, তা সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। টিনের, ছনের বা মাটির ঘরে বসবাস, ঢেঁকিতে চাল ভাঙ্গানো, মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া, মাটির হাঁড়িতে ভাত রাঁধা, নিজের হাতে গরু-ছাগলের দুধ দোয়ানো, নদী-পুকুর-খালে মাছ ধরা, যখন-তখন মুড়ি-মুড়কি-গুড়-পিঠা খাওয়া, আঁতুর ঘরে দাইয়ের হাতে সন্তান জন্ম, পিঁড়িতে বা মাদুরে বসে ভাত খাওয়া, তাল পাতার পাখায় বাতাস খাওয়া, হেঁটে বা নৌকায় কিংবা লঞ্চে যাতায়াত, পালকিতে চড়ে বিয়ে করা, রুমাল-চাদর-বালিশে সুতো দিয়ে মেয়েলি হাতের সূক্ষ্ম কারুকাজ, ফুল-পাখি আঁকা কিংবা গভীর ভালোবাসা নিয়ে লেখা ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’, সরিষার তেল সারা শরীরে মেখে পুকুরে বা নদীতে গোসল করা, অবসরে পুঁথি পাঠ বা পল্লীগীতি শোনা, ছেলেরা লুঙ্গি, গেঞ্জি, ধুতি, পাজামা-পাঞ্জাবি; মেয়েরা শাড়ি পরিধান করা, শীতকালে নানা পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম লাগা, বিশেষ করে চুলার পাশে বসে ভাপা পিঠা খাওয়া, অসুখে-বিসুখে বিভিন্ন ঔষধি গাছ বা ফল ব্যবহার করা ইত্যাদি ছিল গ্রামীণ জীবনের চিরকালের অনুষঙ্গ। এই গ-ি থেকে বেরিয়ে আসতে নাগরিক মধ্যবিত্তের বেশ সময় লেগেছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর আমূল বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশ। সৃষ্টি হতে থাকে শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত। হঠাৎ করে পাওয়া স্বাধীনতায় চাকরি, ব্যবসাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করার জন্য গ্রাম থেকে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসতে থাকে শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত ব্যক্তিরা। গ্রামের বন্ধন ছিন্ন করে শহরে গড়ে উঠতে থাকে মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্তকে কেন্দ্র করে নতুন একটা ধারা গড়ে উঠতে থাকে। একদিকে গ্রামের ফেলে আসা জীবনের প্রতি মোহ, অপরদিকে নাগরিক জীবনের আকর্ষণÑ এই দোটানার মাঝে এগিয়ে যেতে থাকে উঠতি মধ্যবিত্ত। ইট-পাথর-সিমেন্টের বাসা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের ব্যবহার, বাসে-ট্রেনে চলাচল, ছেলেরা শার্ট-প্যান্ট, মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ, ঢাউস খোঁপা, চোখে কাজল, সস্তা প্রসাধনী ব্যবহার, রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে বিনোদনের খোরাক মেটানো, সিনেমা দেখতে যাওয়া, রোমান্টিক বাংলা গানে বিভোর হওয়া, চিড়িয়াখানায় যাওয়া, আÍীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়া, সঙ্গে নাবিস্কো বিস্কুট কিংবা গোলপাতায় করে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া, মেহমান এলে সাধ্যমত আপ্যায়ন করা, গানে-কবিতায় মেতে থাকা, ছবি আঁকা, পাড়ায় পাড়ায় নাটক করা, বিকেল বেলায় ছেলেমেয়েদের খেলাধুলায় মেতে থাকা, মার্বেল, সিগারেট প্যাকেট, ডাংগুলি খেলার পাশাপাশি ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ছিল বাধ্যতামূলক। সন্তান প্রসবে নার্স-ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। আস্তে-ধীরে বদলে যেতে থাকে জীবনযাপনের স্টাইল। সবকিছু মিলিয়ে গ্রামের সহজ-সরল জীবনের ছাপ তবুও থেকে যায় নাগরিক জীবনে।
তবে আশির দশক থেকে গ্রামের সঙ্গে গড়ে ওঠা শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের সম্পর্কের বন্ধন ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় বদলে যেতে থাকে গ্রামীণ জীবন। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমের বাজার খুলে যাওয়ায় সরাসরি গ্রাম থেকে ছুটতে থাকে অনেক মানুষ। তাদের পাঠানো টাকা-পয়সায় কিছু কিছু গ্রামের ছুরত পাল্টে যেতে থাকে। পক্ষান্তরে ঢাকা শহরের ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। হঠাৎ করে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায়। সাধারণ চাকরিজীবীর যে বৃত্ত, তা ভেঙ্গে নতুন নতুন কর্মজীবীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে। মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, কোটিপতি, ব্যবসায়ী, টাউট-বাটপারের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। যে কখনো যা ভাবেনি, স্বাধীনতার সুবাদে তাই পেয়ে যাওয়ায় সমাজে দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটে যায়। সে সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানির নানারকম প্রলোভন বদলে দিতে থাকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রা। এমনকি, বদলে যেতে থাকে নাম পর্যন্ত। রহিমুদ্দিন-করিমুদ্দিনের পরিবর্তে আধুনিক নামের বাহার লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা-দীক্ষা, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, মূল্যবোধের পাশাপাশি ঘটে যায় সামাজিক বিবর্তন। একই সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় অবক্ষয় ও অধঃপতনের ধারা। রক্ষণশীলতার ব্যুহে আঘাত হানলেও মন-মানসিকতার দিক দিয়ে মধ্যবিত্তের পক্ষে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। যে কারণে পোশাক-আশাকে রূপান্তর ঘটলেও পশ্চাৎপদ মানসিকতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি। রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন সমাজ কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে নীতি-নৈতিকতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল, তা ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করাটা জটিল হয়ে পড়ে। অসৎ, মাস্তান, টাউট, ধান্দাবাজরা রাজনৈতিক অঙ্গনে জেঁকে বসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি হঠকারী, নিু মন-মানসিকতাসম্পন্ন, মেধাহীনদের দখলে চলে যায়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! যে কারণে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয়, নৈরাজ্য ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার মনোবৃত্তি তার নেই। সবাই এখন আÍকেন্দ্রিক, স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। কত সহজে অর্থ উপার্জন করা যায় এবং কীভাবে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে ওঠা যায়, সে চিন্তায় মশগুল। স্বার্থসিদ্ধির জন্য হেন কোনো পথ নেই, যা অবলম্বন করা হচ্ছে না। বোধ, বুদ্ধি, বিবেক ও বিবেচনা সর্বাংশে লোপ পেতে চলেছে। বিদেশি অনুদানের পাশাপাশি সরকারি সম্পত্তি লোপাট, ঘুষ, চোরাচালানিসহ যাবতীয় দুই নম্বরী পথ বেছে নিয়ে হঠাৎ করে কিছু লোক রমরমা হয়ে উঠেছে। হরদম বিদেশ যাচ্ছে। দািী হোটেলে খাচ্ছে। দেদারসে টাকা ওড়াচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশ বিত্তবান হয়ে ওঠায় সমাজে নতুন একটি শ্রেণীর জন্ম নিয়েছে। এই শ্রেণীর আয় এবং ব্যয়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। নানারকম রহস্যজনক কাজ-কারবারের পাশাপাশি নতুন একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়া। ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত হলেও সমাজের চাবিকাঠি তাদের কাছে। এ কারণে নব্বই দশকে পরিবর্তনের একটি জোয়ার আসে। রঙিন টেলিভিশন, ভিসিআর, ডিশ অ্যান্টেনা, এসি, জেনারেটর, ইউপিএস, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, বাথটাব, দামি দামি অ্যাপার্টমেন্ট, মোবাইল, লেটেস্ট মডেলের পাজেরো, বিদেশি ফ্যাশনেবল ড্রেস, মেক-আপ, সিডি, ব্যান্ড সঙ্গীত, ফ্যাশন শো, বিউটি পার্লার, ম্যাসেজ পার্লার, সুপার মার্কেট, ওয়ান স্টপ মল, কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে, জন্মদিন পার্টি, স্যান্ডউইচ, বার্গার, স্যুপ, চাইনিজ, কোকাকোলা, আইসক্রিম খাওয়া, ঘন ঘন বিদেশ সফরসহ ইউরোপ-আমেরিকার সর্বশেষ ফ্যাশন ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সঙ্গতি অনেকেই অর্জন করেছেন। যে কোনো কিছুই এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। হেরোইন, নেশার দামি ট্যাবলেট, আল্টা মডার্ন নারী চোখের পলকেই হাতের মুঠোয় এসে যায়।
একবিংশ শতাব্দী বিশ্বায়ন ও হাই-টেকের যুগ। সবকিছু এখন অবাধ হতে চলেছে। ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে সারা দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সব বিধি-বিধান পরিচালিত করবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। এ সংস্থার একক ও আধিপত্যবাদী বিধি-বিধানের ফলে দুনিয়াব্যাপী বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। উন্নত বিশ্ব আর উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং ধনী আর দরিদ্রের মাঝে সৃষ্টি হবে তীব্র বৈষম্য। একই সময় প্রবর্তিত পেটেন্ট রাইটসের নামে নিঃস্ব হয়ে যাবে এ দেশের কৃষক-শ্রমিক। এমনিতেই সমাজে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সৃষ্টি হলেও কৃষক ও শ্রমিকদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। খেয়ে-না খেয়ে তারা চালিয়ে যাচ্ছে জীবন-সংগ্রাম। পেটেন্ট রাইটসের কারণে আমাদের দেশের হাজার বছরের কৃষক সম্প্রদায় দ্বারা আবিষ্কৃত ও লালিত বীজ, গাছ ও প্রাণ সম্পদকে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে তুলে দেয়া হবে। বিপন্ন হয়ে পড়বে তাদের জীবন ও জীবিকা। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার খপ্পরে পাল্টে যাবে পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান। পাল্টে যাবে আমাদের মূল্যবোধ ও জীবনযাপনের পদ্ধতি। আমাদের প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতি নতুনভাবে বিন্যস্ত হওয়ায় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। আমাদের সমাজের গরিষ্ঠ অংশ এ পরিবর্তন সম্পর্কে কিছুই জানে না। একটা অপ্রস্তুত অবস্থায় তাদের এই পালাবদলের মুখোমুখি হতে হবে। এমনিতেই আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা ভঙ্গুর, তার ওপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় আমাদের অবস্থা কী দাঁড়ায়Ñ তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ২৩ জুন ২০০৩
মুশকিল হচ্ছে, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেললে না হয় রাজনীতি চর্চা, না হয় ধর্ম পালন। এ ক্ষেত্রে কাজ করে মতলবী স্বার্থ। নিজেদের স্বার্থের অনুকূল হলে যে কোনো কর্মকা-কে তখন ধর্মের দোহাই দিয়ে হাসিল করার চেষ্টা করা হয়। এমন একটা দ্ব্যর্থক মনোভাব থেকেই পাকিস্তানের জন্ম। কবি মুহাম্মদ আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির স্বপ্ন দেখেছিলেন ১৯৩০ সালে। তার এই স্বপ্ন বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এ কারণে প্রথম অবস্থায় এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ¡ ছিল যথেষ্ট। এমন বিমূর্ত ধারণা কবির কল্পনা বলে সবাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রমাণ মেলে লন্ডনের ওয়ালডর্ফ হোটেলের এক নৈশভোজে। প্রস্তাবিত মুসলমান রাষ্ট্রের ধারণা মুসলমান নেতারা একে ‘অবাস্তব ও মরীচিকাময়’ বলে এক কথায় নাকচ করে দেন। বিষয়টির সেখানেই অংকুরেই বিনাশ ঘটতো। কিন্তু একদল হিসেবী লোক নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে এ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকেন ভেতরে ভেতরে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৪০ সালের লাহোর সম্মেলনে। কবি ইকবালের এই দ্বিজাতিতত্ত্বকে ‘সর্বরোগহরিহর’ হিসেবে গ্রহণ করে মুসলিম লীগ। যে দলটির নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন অভিজাত মুসলমানরা। যাদের জীবনে ধর্মের কোনো প্রভাব ছিল না। এক হাতে হুইস্কি এবং আরেক হাতে শূকর মাংসের স্যান্ডউইচ নিয়ে যার দিনের অধিকাংশ সময় কেটেছে, সেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। অথচ এই জিন্নাহ ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি অব্দি ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সংমিশ্রণের প্রবল বিরোধী ছিলেন। কিন্তু স্বার্থগত টানাপড়েন ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে আদর্শচ্যুত হতে দ্বিধা করেননি তিনি। ‘মোল্লা’ আর মুসলমান ভূস্বামীদের স্বার্থ ও আবেগকে পুঁজি করে পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন ব্যারিস্টার জিন্নাহ। ‘ইসলাম বিপন্ন’ ধ্বনি দিয়ে তিনি দর-কষাকষি শুরু করেন। তার এই দর-কষাকষির খেলায় তার ‘হাতের পুতুল’ হয়ে ওঠেন ধর্মভীরু লাখ লাখ মুসলমান। তাদেরকে সামনে রেখে দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হয় মুসলমানদের ‘স্বপ্নভূমি’ পাকিস্তান। ‘সিজারিয়ান অপারেশন’-এর মাধ্যমে গঠিত পাকিস্তান শুরুতেই সৃষ্টি করে অনেক সংশয় ও প্রশ্ন। যেসব মুসলমান ছিলেন সাচ্চা পাকিস্তানপন্থী, দেশ ভাগের পর তারা পাকিস্তান থেকে দূরে সরে যান। কেননা তাদের অধিকাংশেরই জায়গা-জমি ভারতীয় সীমান্তে পড়ে যায়। এদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ‘প্রিয় পাকভূমি’তে চলে গেলেও ভারতেই বেশিরভাগ মুসলমান রয়ে যান। সাধের পাকিস্তান তাদের কাছে হয়ে যায় মরীচিকা। তাছাড়া চোখে একরাশ স্বপ্ন ও বুকে অপরিমেয় প্রত্যাশা নিয়ে যারা চৌদ্দপুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমান, তারাও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়েন। অন্যদিকে দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দু’টি প্রদেশ নিয়ে একটি অখ- রাষ্ট্র গড়ে তোলা হলেও তার মধ্যে দুস্তর ফারাক থেকে যায়।
ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভাষাগত সমস্যা ছাড়াও উভয়ের মধ্যে স্বার্থের প্রশ্নে তিক্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ অবস্থার সূত্রপাত ঘটে ‘পাকিস্তানের জনক’ মোহাম্মদ আলীর জীবদ্দশায়।
তবে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভায় জিন্নাহ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তানে হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, পার্সি বলে কেউ থাকবেন না। সবাই পাকিস্তানি।’ তার এই বক্তব্যে অবশ্য প্রতীয়মান হয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য তিনি পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেলের কথার সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য ছিল না। শুরুতেই তিনি একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থের ‘ক্রীড়নক’ হয়ে ওঠেন। এর কারণ সম্ভবত তার উত্থান ঘটে ‘মোল্লা’ ও অভিজাতদের ক্ষমতাবলয়কে কেন্দ্র করে। তাদের চটিয়ে জিন্নাহ’র পক্ষে সম্ভব ছিল না কিছু করা। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় তার বলা ‘উদর্ুু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ সবাইকে সন্দিহান করে তোলে। প্রশ্নের সম্মুখীন হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। তথাপি তখন পর্যন্ত সব মুসলমানের প্রতিনিধিত্বশীল নেতা ছিলেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির ১৩ মাসের মাথায় তার মৃত্যু এবং পরবর্তীতে তার অন্যতম অনুসারী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তানে একে একে নানা সমস্যার উদ্ভব ঘটতে থাকে। জিন্নাহ’র ‘বিশ্বাস, আশা ও ঐক্যের’ স্লোগান ক্রমশ শূন্যে মিলিয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জিন্নাহর গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের স্বপ্ন চূর্ণ করে দেয়।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শাসকগোষ্ঠীর অনমনীয় মনোভাব, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বর্বরোচিত নৃশংসতা ও হত্যাকা-Ñ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের পাক-শাসকদের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে টলিয়ে দেয়। সেই থেকে বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গের যাতনা শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ধারণা করা হয়েছিল, সেটাই ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেক।
কিন্তু জন্মের ৪৪ বছর পরও পাকিস্তানের অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে অমীমাংসিত। যা ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যেসব ‘ভারতীয় মুসলমান’ জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন এবং ভারত ছেড়ে চলে এসে নাম পেয়েছেন ‘মোহাজির’, তারা এখন জাতি-দাঙ্গার শিকার। জীবনযাপন করছেন প্রবাসীদের মতো। বেঁচে থাকার জন্য, জীবন ধারণের জন্য তাদের সংগ্রাম নিত্যকার। স্বপ্নের আবাসভূমি পেয়েও মুসলমানরা আজ একে অপরকে দেখছে সন্দেহের চোখে। বর্তমানে ২২টি ভাষা-ভাষীর এই দেশ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত। প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে। জীবনহানি ঘটছে। দেশের বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাব নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে মশগুল। ‘বড় ভাইসুলভ’ মনোভাব ছাড় দিতে রাজি নয়। সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর কোথাও শান্তি নেই। কোনো প্রদেশের সঙ্গে ভাষা, সামাজিক কাঠামো, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের কোনও যোগসূত্র নেই। পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের প্রথমত সিন্ধি, বালুচ, পাঠান বা পাঞ্জাবি, দ্বিতীয়ত মুসলমান এবং সবশেষে পাকিস্তানি বলে মনে করে। আÍপরিচয়ের এই ধারাক্রম কবি ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে এক বিন্দুও মিল খায় না।
এ কারণেই নিজেদের সংকটকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য পাকিস্তানি প্রতিটি শাসককেই কূট-কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। সেটা জিয়ার জঙ্গি শাসন হোক কিংবা ভুট্টোর গণতান্ত্রিক শাসন হোক। একটা জুজুর ভয় সবসময় খাড়া করে রাখা হয়। ধর্মটাই এ ক্ষেত্রে উত্তম পন্থা। একই পথ ধরে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালানো হয় ছলে, বলে, কৌশলে। আর ভারতের সঙ্গে বিরোধের ‘কমন’ বিষয় রেডিমেট তৈরি হয়ে আছে অবধারিতভাবে, সেটা কাশ্মীর। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মুসলমান হওয়ায় পাকিস্তান শাসকরা সর্বদা বাড়তি একটা ফায়দা লুটতে সক্ষম হন। কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রশি টানাটানি চললেও বর্তমানে পাক-ভারত শাসিত কাশ্মীরী জনগণের মাঝে নতুন চেতনা গড়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে তারা কারো অভিভাবকত্বে না থেকে স্বাধীন কাশ্মীর গড়ার স্বপ্ন দেখছে। এটা কোনো অলৌকিক স্বপ্ন নয়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের অন্যতম একটি ‘ট্রাম্প কার্ড’ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
এদিকে আরেক দল মৌলবাদী মুসলমান পাকিস্তানের হালের সমস্যা ও সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য অতীতের বিশুদ্ধ ইসলামের যুগে ফিরে যাবার নসিহত করছে। যার অর্থ দাঁড়াবে পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়ানো। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুশীলন বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকারে ডুব দেয়া। অনেকদিন ধরে এমন ধরনের প্রচ্ছন্ন মনোভাব চলে আসায় প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে পাকিস্তান এমনিতেই পিছিয়ে পড়ছে। এরপর ঘোষণা দিয়ে বিশুদ্ধ ইসলামকে আঁকড়ে ধরার মানে দাঁড়াবে, জাহেলিয়া যুগে পাকিস্তানের ফিরে যাওয়া।
যে স্বপ্ন, যে আকাক্সক্ষা নিয়ে পাকিস্তান নামক দেশটি গড়ে তোলা হয়, সময়ের পরিক্রমায় তা ক্রমান¦য়ে থিতিয়ে আসছে। প্রাদেশিক উগ্রতা, প্রগতিবিমুখ মৌলবাদী মোল্লাদের প্রভাব এবং মুসলমান ভূস্বামীদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর একরতফা আনুকূল্য পাকিস্তানকে ক্রমশ আরো বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যা কবি আল্লামা ইকবালের স্বপ্নকেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে না, স্বপ্ন ভঙ্গ হবে ইতিহাসেরও।
দৈনিক বাংলার বাণী : ২২ নভেম্বর ১৯৯১
জাতিসংঘ : নিধিরাম সর্দার
ধ্বংসের মাঝে যেমনভাবে জেগে ওঠে প্রাণের স্পন্দন, তেমনিভাবে বিশ্ব বিবেকের চৈতন্য জাগ্রত করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাঝেই অনুভূত হয় পৃথিবীকে ‘একটি শান্তির নীড়’ হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ। এগিয়ে আসেন শান্তিকামীরা। মানবতাবাদীরা। তারা সোচ্চার কণ্ঠে বলেন : ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, চাই শান্তি।’ একই সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধ রোধের পাশাপাশি নানা সমস্যা সম্মিলিতভাবে সমাধানের কথা ব্যক্ত হয়। এরই আলোকে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানব মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ‘জাতিসংঘ’ নামের প্রথম ধারণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মিলিত আগ্রাসী শক্তি যখন বিশ্বকে নিজেদের হাতের মুঠোয় বন্দি করতে উদ্ধত, ঠিক তখন ‘জাতিসংঘ’ ধারণা মিত্র জোটের কাছে বাস্তব হয়ে ওঠে। ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতিসংঘ ঘোষণা’য় স্বাক্ষর করে ২৬টি রাষ্ট্র। এ ঘোষণাকে সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল সানফ্রান্সিসকোতে আহ্বান করা হয় ‘একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রশ্নে জাতিসমূহের সম্মেলন’। ‘বিগ ফোর পাওয়ার’ খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনসহ ২৬টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের শেষ দিন ২৬ জুন গৃহীত হয় ‘জাতিসংঘ সনদ’। ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র দিয়ে শুরু হয় জাতিসংঘের যাত্রা। জাতিসংঘের মূল টার্গেট আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানব কল্যাণের ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সেই সঙ্গে মানবাধিকার ও মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ জাগানো। তবে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের কার্যক্রম শুরু হয়।
জাতিসংঘের মূল সংস্থার নাম সাধারণ পরিষদ। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সমন¦য়ে সাধারণ পরিষদ গঠিত হয়। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৫৯। এছাড়া জাতিসংঘের প্রধান পাঁচটি অঙ্গসংস্থা হলো নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয়, অছি পরিষদ, সচিবালয় এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে আবার স্থায়ী সদস্যদের সংখ্যা ৫। এরা হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। এদের প্রত্যেকের ‘ভেটো’ ক্ষমতা রয়েছে। যে কোনো একটি সদস্য রাষ্ট্র কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে কিংবা ভোটদান থেকে বিরত থাকলে সে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। ১৫ জন বিচারপতির সমন¦য়ে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালত সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ বা জাতিসংঘের অন্য কোনো সংস্থাকে আইন সম্পর্কিত ব্যাপারে উপদেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধের আইনগত দিকটি দেখে থাকে। জাতিসংঘের হাতে অর্পিত আÍনিয়ন্ত্রণ অধিকারবঞ্চিত জাতিসমূহের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের স্বাধীনতা লাভের যোগ্য হতে সাহায্য করাই অছি পরিষদের কাজ।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সমন¦য়ে জাতিসংঘের স্বার্থরক্ষা ও কাজ-কর্ম চালানোর জন্যই জাতিসংঘ সচিবালয়। মহাসচিব সচিবালয়ের প্রধান। নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে সাধারণ পরিষদ মহাসচিব নিয়োগদান করে। মহাসচিব বেতনভোগী কর্মচারী হলেও তার পদমর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, তিনিই দুনিয়ার একমাত্র ‘বৈধ শাসনকর্তা’। অবশ্য বাস্তবক্ষেত্রে শাসন কতটা করতে পারেন সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে নরওয়ের ট্রিগ্রভি লিকে পাঁচ বছরের জন্য জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে এই মেয়াদ তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়। কিন্তু এর তীব্র সমালোচনা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যে কারণে লি ১৯৫২ সালে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৩ সালে তার উত্তরাধিকারী হয়ে আসেন সুইডেনের ড্যাগ হ্যামারশোল্ড। ১৯৫৭ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে রোডেশিয়ার উত্তরাঞ্চলে (বর্তমানে জাম্বিয়া) এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। এ সময় মহাসচিব নিয়ে তুমুল বাদানুবাদ চলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব রাখে, তিন সদস্যের কমিটি সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকবে। তবে সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বর্মার উ থান্ট সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন। এ কারণে ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পুনরায় সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের শেষ নাগাদ নির্বাচিত হন অস্ট্রিয়ার কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম। তিনি দু’মেয়াদে কাজ করেন। তারপর ১৯৮২ সালে আসেন হাভিয়ার পেরেজ দ্য কোয়েয়ার। সবশেষে মিসরের বুয়েট্রেস ঘালি জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে সবেমাত্র নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পেয়েছেন।
মহাসচিব পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি জাতিসংঘের শুরু থেকেই। নিজেদের প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে মূল হাতিয়ার মহাসচিব। এই পদ নিয়ে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রতিদ্বন্দি¡তা চলে আসছে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রতিদ্বন্দি¡তা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরে দাঁড়ানোর ফলে এবার মহাসচিব নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঝামেলা দেখা দেয়নি। অনেক প্রতিদ্বন্দ¡ীর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদে ঘালি লোভনীয় পদটি বাগিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত, ক্ষুধার্ত ও নিরক্ষর জনগণের কল্যাণ সাধন করে বিশ্ব শান্তি সুসংহত করাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার কাজ। আর এ জন্য জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থাগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে সাহায্য এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে থাকে। এর মধ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফাও’, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’, শিশুদের আন্তর্জাতিক তহবিল ‘ইউনিসেফ’, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ‘আইএমএফ’ উল্লেখযোগ্য।
একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে। এখন জাতিসংঘের নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। জাতিসংঘ ভবিষ্যৎ বংশধরদের জীবন সুন্দর, মৌলিক মানবাধিকার ও মানুষের মর্যাদা, সব রাষ্ট্রের সমান অধিকার এবং বিশ্বের জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধনের জন্য কাজ করে আসছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে জাতিসংঘ ‘আশার স্তম্ভ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর দেশগুলোর পাশে জাতিসংঘ বন্ধুর মতো পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও সীমিত সাধ্য ও ‘পরনির্ভরশীল’ হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারে না। তবুও এর মাঝে তাদের কার্যক্রম প্রশংসার দাবি রাখে।
জাতিসংঘের ৪৬ বছরের ইতিহাসে সাফল্য যেমন আছে, তেমন ব্যর্থতাও অনেক। কেননা জাতিসংঘের হাত-পা এক জায়গায় বাঁধা। জাতিসংঘ পরিচালিত হয় সাধারণ পরিষদের সদস্যদের চাঁদায়। প্রতিটি রাষ্ট্রের সামর্থ্য ও সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হয় চাঁদার হার। প্রতিটি দেশকেই কম-বেশি চাঁদা দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের বৃহত্তম চাঁদাদাতা দেশ। শুরুতে জাতিসংঘের মোট বাজেটের ৪৯ শতাংশ আসতো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধে তাদের চাঁদার হার ১৯৮২ সালে নামিয়ে আনা হয়। শেষ অবধি তা ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৫৫ সালের পর থেকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দ্রুত বাড়তে থাকায় জাতিসংঘের বাজেটে ঘাটতি পড়ে যায়। নতুন সদস্যদের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। সবাই জাতিসংঘের সাহায্যের জন্য উন্মুখ থাকে। সাহায্য প্রদানে সবার ক্ষেত্রে সমান নজর দেয়া সম্ভব হয় না। এছাড়াও বৃহৎ শক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিশেষ করে মার্কিন প্রভাবাধীন দেশগুলো এক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে। এর কারণ আগেই বলা হয়েছে। জাতিসংঘের আয়ের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র। তাদেরকে চটিয়ে জাতিসংঘের পক্ষে কিছু করা কঠিন। এ যাবৎ জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীরা ছিলেন মার্কিন আজ্ঞাবহ। তারা স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। মার্কিন স্বার্থকেই বরাবর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এ কারণে অনেকাংশে ক্ষুণœ হয়ে পড়েছে। কেননা মার্কিন তাঁবেদার রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হলে জাতিসংঘের ভূমিকা থাকে এক রকম। আবার মার্কিনবিরোধী দেশে অন্যরকম। এ অবস্থা থেকে জাতিসংঘের বের হওয়া কঠিন। ইউনেস্কো স্বাধীনভাবে একবার কাজ করতে গিয়ে সংকটে নিপতিত হয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র ইউনেস্কো থেকে বেরিয়ে আসে। তাছাড়া সুপার পাওয়ারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ হয়ে পড়ায় তারা এখন এককভাবে খোলা মাঠে গোল দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া দাপটের কারণে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ নিজেদের মতো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ-হানাহানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা অনেকটা অসহায় দর্শকের মতো। আদতে জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মনোভাব বুঝে তাকে অগ্রসর হতে হয়। কথায় বলে, ‘ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার’। জাতিসংঘ হচ্ছে অবিকল তাই। তবে নানা সমস্যার মাঝে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ভারসাম্যমূলক পরিস্থিতি বজায় রাখছে। অনেক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে জাতিসংঘ। আজ বিশ্বে যে শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করছে তার মূলে জাতিসংঘেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
দৈনিক বাংলার বাণী : ২৯ নভেম্বর ১৯৯১
একাত্তরের স্মৃতি
আমাদের জীবনে এমন সুসময় যেমন আসেনি, তেমনিভাবে দুঃসময়ও কখনো আসেনি। বলছি ১৯৭১ সালের কথা। বাঙালির সবচেয়ে উজ্জ্বল, বর্ণিল ও ঘটনাবহুল দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অনেকেরই অম্ল-মধুর স্মৃতি। কোনোটা সুখের, কোনোটা বেদনার। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যিক দিনগুলোকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, কিংবা যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তারা প্রত্যক্ষ করেছেন বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনগুলোকে। এমন দিন আর কখনো আসেনি। এমন দিন আর কখনো আসবেও না। কেননা বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার ঈপ্সিত ঠিকানা। পেয়েছে তার নিজস্ব ভূখ-। পেয়েছে লাল-সবুজ পতাকা। ত্রিশ লাখ লোকের জীবনের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক।
অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা এখনো আমাদের হৃদয়ে জেগে আছে উল্কাপি-ের মত। কতইবা আমার তখন বয়স। ৫/৬ বছর। ঊনসত্তর-সত্তর-একাত্তরের আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী সময়ে মতিঝিল কলোনিতে থাকতাম। সব স্মৃতি যে ধরে রাখতে পেরেছি তা নয়। টুকরো টুকরো স্মৃতিখ- এখনো বুকে চির-জাগরুক হয়ে আছে। সে সময়কার জনবিরল ঢাকা নগরীতে মতিঝিল কলোনি তখন রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু। আন্দোলনের ঢেউ এসে আমাদের কলোনিতে ধাক্কা মারলে তার স্পর্শে আমরাও উজ্জীবিত হয়ে উঠি। বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া মিছিলের স্লোগান আমাদের ছোট্ট বুকে গান হয়ে বেজে ওঠে। একা একা গেয়ে উঠতাম; ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার-আমার ঠিকানা’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘টিক্কা খানের টিক্কি লইয়া স্বর্গে যাবো গো’, ‘একটা-দুইটা বিহারি ধরো সকাল-বিকাল নাস্তা করো’। স্লোগানের সব কথা না বুঝলেও অবুঝ মন আন্দোলনের ঝাঁপটা টের পেত। তাতে কেঁপে কেঁপে উঠতাম। বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন চেহারায় বুঝতাম কিছু একটা বিপদ আমাদের সামনে। ঊনসত্তর-সত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোর পর চারদিক কাঁপিয়ে এলো রক্তক্ষয়ী একাত্তর।
মতিঝিলে আমাদের পাশের রুমে সপরিবারে থাকতেন আমার পিতার মামা। অর্থাৎ সম্পর্কে তিনি আমার দাদা। এই দাদা একটা নামজাদা শাড়ির দোকানে চাকরি করতেন। রাত না হলে তিনি ফিরতেন না। সেদিন ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফেরেন। ফিরেই আমার আব্বা ফিরেছেন কিনা জানতে চাইলেন। আব্বার আবার খেলার নেশা। তিনি এমন কোনো খেলা নেই যে, যা থেকে পুরস্কার পাননি। তিনি এক এক সময় এক একটা খেলায় ঝুঁকে পড়েন। সে খেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে অন্যটায় হাত বাড়ান। সে সময় তিনি ক্যারম ও ব্রিজ খেলার নেশায় মাতোয়ারা। বাসায় ফিরতেন ঢের রাত করে। ২৫ মার্চ আব্বার ফিরতে দেরি দেখে দাদা আব্বার উদ্দেশে বকাবকি করতে থাকেন। তার কাছে জানতে পারলাম, সময় খুব খারাপ। পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যাই। কিন্তু চোখে ঘুম এলো না। গুলির শব্দে জেগে উঠি। সে বয়সে গুলির শব্দ কি জানতাম না। বড়দের কথায় বুঝতে পারি এটা গুলির শব্দ। আমরা বাসার সবাই খাটের তলায় আশ্রয় নেই। আমাদের বাসার দেয়াল ভেদ করে গুলি চলে যায়। এর কারণ, আমাদের বাসার সামনে ছিল মতিঝিল গার্লস স্কুল। সে স্কুলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। যে কারণে আমাদের পক্ষে মতিঝিলে থাকা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমন অবস্থা, ঘরের সামনে বারান্দায় পর্যন্ত উঁকি দিতে সাহস পেতাম না। বাধ্য হয়ে পরদিন আমরা গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।
কিন্তু ঘন ঘন কার্ফ্যুর কারণে বাসা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একবার বাসস্টেশন পর্যন্ত যেয়ে ফিরে আসতে হয়। যা হোক, ভালো দিনক্ষণ দেখে সদরঘাট থেকে লঞ্চে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। অনেকটা পথ যাবার পর মাঝ নদীতে লঞ্চ নষ্ট হয়ে যায়। নৌকা ছাড়া আর কোনো যানবাহন নেই যে আমরা যাব। বাধ্য হয়ে নৌকায় যাত্রা। ক্ষুধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। আশপাশে কোথাও দেরি করার উপায় নেই। একে তো কার্ফ্যু, তারপর আন্দাজে কোথায় আশ্রয় নেব! আমাদের নৌকার মাঝির কাছে চাল-ডাল ছিল। কোনো লবণ-মরিচ-মশলা ছিল না। তা ছাড়াই চাল-ডালের মিশেল দিয়ে রান্না করে কোনোক্রমে পেটের ক্ষুধা মেটাই। নৌকায় যাবার সময় দেখতে পেলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা স্পিডবোটে মেশিনগান ফিট করে ছোটাছুটি করছে। তাদের দেখে আব্বা ও আব্বার মামা জিন্নাহ টুপি মাথায় দিয়ে ‘সাচ্চা মুসলমান’ সাজেন। এতে খুশি হয় হানাদার বাহিনী। যে কারণে তারা আমাদের কিছু বলেনি।
গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার পর দেখলাম, রাজাকারদের দাপট। অবশ্য যতই দিন যেতে থাকে, আস্তে-ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নানাবাড়িতে একদিন ইউসুফ গাজী নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন। আমাকে ডেকে বলেন, ভাইগ্না যুদ্ধ করবা নাকি। এই বলে তিনি আমাকে তার বন্দুকটি হাতে দেন। আমি রাইফেলটি ভারি হওয়ায় তুলতে ব্যর্থ হই। একদিন বাড়ির পাশে গুলির শব্দ শুনে মা ও নানী আমাকে খাটের তলায় শুইয়ে দেন। তখন বর্ষাকাল। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে হয় নৌকায়। আমরা খবর পেলাম, পাশের সর্দার বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা হবিকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করেছে। বিকেলে তাকে দেখতে গেলাম। দেখলাম, একটা ফ্লোরে হবি শুয়ে আছেন। তার বুক গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। বুক থেকে রক্ত ঝরছে। রাজাকাররা ছইওয়ালা নৌকায় সর্দার বাড়ির ঘাটে এসে থামে। তারপর হবির পিতাকে বলে, ‘আমরা হবির লোক। তাকে ডেকে দেন।’ হবি এ কথা শুনে বেরিয়ে এলে রাজাকাররা নৌকার সামনের পর্দা সরিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে। সেই প্রথম আমি নিহত কোনো ব্যক্তির লাশ দেখি। এটা দেখে এসে রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি।
একদিন আমাদের বাড়ির পাশে মধুমতি নদী দিয়ে পাকবাহিনীর বড় আকারের একটি যুদ্ধজাহাজ যায়। জাহাজটি ঘুরাতে যেয়ে নদীতে আটকে যায়। তখন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রামের মুরব্বীরা মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করেন। মুরব্বীরা বলেন, শক্তিতে ওদের সঙ্গে পারা যাবে না। ওদের সঙ্গে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। আক্রমণ করলে ওরা এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। মুক্তিযোদ্ধারা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
আরেক দিন খবর পেলাম, আমাদের ডুমদিয়া গ্রামে মিলিটারি আসছে। এ কথা শুনে আমরা নৌকায় করে দূর সম্পর্কের এক আÍীয়র বাড়ি উঠি। সত্যি সত্যি মিলিটারি এসে আমাদের গ্রামের অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা ও চেয়ারম্যান রাঙ্গু গাজীর বাড়ি। আমার আব্বা মিলিটারিদের দেখে তার সাইকেল নানাদের পুকুরে ডুবিয়ে দেন। মিলিটারিরা চলে গেলে তিনি রাঙ্গু গাজীর বাড়ির আগুন নেভাতে সাহায্য করেন। আমাদের ভাগ্য অনেকটা ভালো। আমরা যেদিন যে গ্রামে আশ্রয় নেই, সেই গ্রাম ছেড়ে নিজেদের গ্রামে চলে আসার পরের দিন ওই গ্রামে মিলিটারিরা আগুন ধরিয়ে দেয়।
আমাদের ভাগ্য ভালো হলেও আমার দাদা আসাদ (আব্বার মামা)-এর রাশি ভালো ছিল না। তার পাইককান্দি গ্রামে মিলিটারি এলে আসাদ দাদা পরিবার-পরিজনসহ একটা পরিত্যক্ত ভিটায় আশ্রয় নেন। মিলিটারিরা গ্রামে এসে কাউকে না পেয়ে এক নৌকার মাঝির কাছে পানি খেতে চায়। মাঝি পাকিস্তানিদের উর্দু বুঝতে না পেরে পলাতক অবস্থা থেকে আসাদ দাদাকে ডেকে নিয়ে আসেন। তিনি এসে বাড়ির গাছ থেকে ডাব পেড়ে মিলিটারিদের আপ্যায়িত করেন। আপ্যায়িত হয়ে মিলিটারিরা তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। সেই যে গেছেন আসাদ দাদা, আজও আর ফিরে আসেননি। আমরা এখনো তার প্রতীক্ষায় দিন গুনি।
১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি স্মরণিকায় প্রকাশিত
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত, ফুল আর পরাধীনতা
মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসনে বধ্যভূমিতে রূপ নিয়েছে সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ও ফুলের নন্দনকানন ইরাক। পরাক্রম শক্তির অন্যায় ও অনৈতিক হামলায় প্রাণ দিয়েছেন হাজার হাজার ইরাকী। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাসস্থান ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র, নিঃশেষ হয়ে গেছে হাজার হাজার বছরের সভ্যতার নিদর্শনসমূহÑ সর্বোপরি যারা বেঁচে আছেন তারাও ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে চলেছেন মৃত্যুর পথে। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে একটি সজীব ও প্রাণোচ্ছ্বল দেশের যে মুমূর্ষু অবস্থা হয়েছে, তা কি এড়ানো যেত?
অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও যুদ্ধ প্রকৌশলে সর্বশক্তিমান যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন ইরাকে আগ্রাসন চালানোর হুমকি প্রদান করতে থাকে, তখন তো এটা ধরেই নেয়া হয়, তাদের প্রতিরোধ করার মত শক্তি ও সামর্থ্য ইরাকের নেই। শুধু ইরাক কেন, পৃথিবীর আর কোন দেশেরই বা আছে? ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনও প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা এবং নিজের দুর্বলতার কথা খুব ভালভাবেই জানতেন। জানতেন বলেই জাতিসংঘের নির্দেশনামা মেনে চলেছেন। হ্যান্স ব্লিক্সের নেতৃত্বে জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দলকে ইরাকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হয়। কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ভা-ার খুঁজে বের করার নামে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শক দল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেটুকু অস্ত্র থাকেÑ তাও তন্ন তন্ন করে খুঁজে ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ইরাক ত্যাগের আগে হ্যান্স ব্লিক্স তার প্রতিবেদনে জানিয়ে দেন, ইরাকে আর কোনো জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র নেই। এতে অনুধাবন করা যায়, ইরাকের সামরিক শক্তি অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিশ্বের দ--মু-ের হর্তা-কর্তা তো এমনি এমনি হয়নি। তাদের অর্থ, সম্পদ, রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের ভা-ারই যে শুধু সমৃদ্ধ তা নয়, তাদের কূটকৌশলের দক্ষতা সর্বজনবিদিত। আমরা যেটা আজকে চিন্তা করি, মার্কিনীরা সেটা অনেক আগেই ভেবে রাখে। তারা যে হুট করে ২০ মার্চ ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছেÑ এমনটি ভাবা বোকামির নামান্তর। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ পরিকল্পনা করে এবং সেই অনুযায়ী ছক কেটে একের পর এক ইরাককে একঘরে ও দুর্বল করেছে। তাদের কৌশলী পরিকল্পনায় ইরাক ১৯৯০ সালে নির্বোধের মত কুয়েত দখল করেছে, তারই পথ বেয়ে আরব অঞ্চলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশ কুয়েত, সৌদি আরব, জর্দান, তুরস্ক, মিশর, ইরান, কাতার, আরব আমিরাত, বাহরাইনের সঙ্গে ক্রমান¦য়ে ইরাকের যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার নেপথ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিখুঁত দাবার চাল। পর্যায়ক্রমে বন্ধুহীন ও নিরস্ত্র করার মাধ্যমে ইরাককে শক্তিহীন করে ফেলা হয়েছে। তারপর জাতিসংঘের মাধ্যমে ১৯৯০ সাল থেকে ইরাকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে তাদের অর্থনৈতিক মেরুদ- । নির্দয় অবরোধে, অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় অকালে ঝরেছে ১০ লাখ মানুষের জীবন। সবদিক দিক দিয়ে ইরাক যখন ভেঙ্গে পড়েছে, ঠিক তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে নিরস্ত্র করার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে নখদন্তহীন ইরাকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ বাহিনী। এক্ষেত্রে তারা কোনো নিয়ম-নীতি ও বৈধতার তোয়াক্কা করেনি। এ প্রসঙ্গে ১৯৯৫ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদ জোসেফ রটব্ল্যাটের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য ঃ ‘একজন কুশাসককে উৎখাত করার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে হবে- এটা কোনো বৈধ যুক্তি হতে পারে না। জাতিসংঘের বর্তমান সনদে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অতএব, কোনো রাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যাই করুক, এমনকি সে যদি তার নিজের নাগরিকদের হত্যাও করে, তাহলেও অন্য রাষ্ট্র এসে কোনো যুক্তিতেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারে না।’ অথচ বিশ্ব সংস্থা, বিশ্ব জনমত ও বিশ্ব বিবেককে তোয়াক্কা না করে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাকের ওপর বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের করারই বা কী ছিল? শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও তার ছেলেদের নির্বাসনে যেতে অথবা যুদ্ধ ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টার যে চরমপত্র প্রদান করে, তাতে তিনি কী করতে পারতেন? প্রথম যে পথটি খোলা ছিল তা হলো, সাদ্দাম হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করে আÍসমর্পণ করতে পারতেন। তাতে অন্তত তাৎক্ষণিকভাবে ইরাকি জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও সভ্যতার নির্দশনসমূহ রক্ষা পেত। কিন্তু এতে কি সত্যি সত্যি ইরাকি জনগণ ‘মুক্তি’ পেতেন? যুক্তরাষ্ট্র কি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও তার সহযোগীদের অপসারণে সন্তুষ্ট থাকতো? সেটাই যদি হবে, তাহলে তারা নির্বিচারে ইরাকী নিরীহ মানুষকে হত্যা, ব্যাংক, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট লুট, অগ্নিসংযোগসহ অবকাঠামো ধ্বংস এবং সভ্যতার নিদর্শনসমূহ নিশ্চিহ্ন করছে কেন? সাদ্দাম হোসেন ও তার অনুগতরা যখন দৃশ্যপটে নেই, তখনও কেন লুটপাট, নৈরাজ্য, সহিংসতা, ধ্বংসলীলা ও মৃত্যুর মিছিল চলছে? বেশুমার লুটতরাজে সমগ্র ইরাক বিরান হতে চলেছে, তখন তা প্রতিহত না করে কেন মার্কিন মেরিন সেনারা শুধু তেল স্থাপনাগুলো পাহারা দিচ্ছে? কেন ইরাকি জাতীয় পতাকার পরিবর্তে ওড়ানো হয়েছে মার্কিন পতাকা? যে উদ্দেশ্যের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে, কার্যত সেই উদ্দেশ্যও পূরণ হয়েছে, তাহলে তারা কেন এখনো ইরাকের মাটিতে অবস্থান করছে? তাছাড়া যে ভয়ংকর অস্ত্র ইরাক লুকিয়ে রেখেছে বলে তারা আগ্রাসন চালিয়েছে, কোথায় সেই অস্ত্র?
আসলে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইরাকি জনগণের মুক্তি বা পরাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও নয়। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্র কখনেই কোনো দেশের বন্ধু বা মিত্র ছিল না। বরং এ কথাটি আমরা বরাবরই সত্যি হতে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার আর শত্রুর প্রয়োজন নেই। স্বৈরাচারী, গণধিকৃত ও পরাক্রমশালী শাসকদের যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা সাহায্য ও সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু সুদিনের বন্ধুদেরও যুক্তরাষ্ট্র অবলীলায় দূরে ছুঁড়ে দিতে মোটেও কার্পণ্য করে না। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়েছে, সেখানেই তারা ছলে-বলে-কৌশলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতন্ত্রের কালজয়ী সেই মূলমন্ত্র ঃ ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল অ্যান্ড অফ দ্য পিপল’ এখন কিছু শব্দের কঙ্কালমাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ও যুক্তরাষ্ট্রের সেবায় যারা নিবেদিত, তারাই গণতন্ত্রের মানসপুত্র। যুগে যুগে দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্র এই চ-নীতি অনুসরণ করে এসেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ইরাক। কেননা আরব ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গর্ভস্রাব থেকে সৃষ্টি হয়েছে ইসরাইল নামক একটি অবৈধ রাষ্ট্রের। ইসরাইলকে কেন্দ্র করে সমগ্র আরব ভূখ- নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বা ছক কাটা হয়েছে। আর এ কারণে অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে ইসরাইলকে শুধু শক্তিশালী নয়, একটি দুর্ভেদ্য রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ইসরাইলের কাছে যে পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ভা-ার রয়েছে, তা শিল্পোন্নত অল্প ক’টি দেশ ছাড়া আর কারো নেই। সমগ্র আরব জাহান এক ইসরাইলের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ গুটিকয়েক দেশ ইসরাইলের অস্তিত্ব মেনে না নেয়ায় এখন তাদের নানা ছলে-বলে-কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। নেপথ্যে থেকে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য-সহযোগিতা করায় ইসরাইলের ইশারায় ইরাক হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রধান টার্গেট। এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে ইরাককে ‘সাইজ’ করার পাশাপাশি বাড়তি পাওয়া হয়ে যায় তাদের অফুরন্ত তেলভা-ার। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরাক। তাদের মাটির নিচে সঞ্চিত রয়েছে প্রায় ১১ হাজার ২০০ কোটি ব্যারেল তেল। সাম্প্রতিক আগ্রাসনের আগে ইরাকের তেল রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার। যা মোট রাজস্বের ৯৫ শতাংশ। এই তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রলোভন দীর্ঘদিনের। সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে যায় ইরাকে। সেই থেকে তারা ইরাককে কব্জা করার জন্যে ভেতরে ভেতরে কলকাঠি নাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র তো সবসময় কৈয়ের তেলে কৈ ভেজে এসেছে। ইরাকে হামলা চালিয়ে মার্কিন অর্থনীতিতে যে আঁচড় লেগেছে, তা পূরণ করা ছাড়া কী যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে এক পা নড়বে? এমনিতেই উপসাগরীয় দেশে বছরের পর বছর ধরে তারা যে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে, তার ব্যয়ভার বহন করে আসছে দুই ইসলামী দেশ সৌদি আরব ও কুয়েত। আর যুদ্ধে কোটি কোটি ডলার কী তারা এমনি এমনি ব্যয় করেছে? মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি তাদের ব্যয়ভার সুদে-আসলে তুলে নেয়াটাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে যদি সাদ্দাম হোসেন বাধা হয়ে না দাঁড়াতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তিনিও হতে পারতেন ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’। মোদ্দা কথা, সাদ্দাম হোসেন কিংবা ‘থিফ অব বাগদাদ’ খ্যাত আহমেদ শালাবি কোনো ফ্যাক্টর নয়। এক সময় সাদ্দাম হোসেন তো ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জিগিরি দোস্ত। বন্ধুত্বের সেই মোহ হঠাৎ কেন কেটে গেল? আসলে যার দ্বারা স্বার্থ পূরণ হবে, তাকেই বরণ করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আপাতদৃষ্টিতে সাদ্দাম হোসেন ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেলেও তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথা-ব্যথা নেই। এখন ইরাককে নিজেদের মতো ‘গড়ে তোলা’ই তাদের প্রধান লক্ষ্য। আর এ কারণেই কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন জেনারেল গার্নারকে ‘বাগদাদের শেরিফ’ বানিয়ে ইরাককে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে পুনর্গঠনের যে কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে, তাতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা- ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেয়া হয়েছে মার্কিন বিভিন্ন কোম্পানিকে। সম্ভবত ইরাক পুনর্গঠন করে পকেট ভারি করার জন্য নানা অজুহাতে ইরাকে অকারণে চালানো হয় বেপরোয়া ধ্বংসলীলা। অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন, বিমানবন্দর, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ নির্মাণের বিশাল অংকের কাজ পেয়ে যায় মার্কিন রিপাবলিকান পার্টির সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির কোম্পানি অন্যতম। এতে প্রকৃত ইরাকি জনগণের কোনো ভূমিকা থাকছে না। মার্কিনিদের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পারায় জেগে উঠেছে ইরাকের স্বাধীনচেতা জনগণ। তারা আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এখন এই প্রতিবাদীদের দমন করার জন্যে তাদের হত্যা করা হচ্ছে ঠা-া মাথায়। তাহলে এই কি ইরাকি জনগণের মুক্তি? ইরাকি জনগণ অনুধাবন করতে পারছেন, তারা সাদ্দামের শাসনামলে এর চেয়ে অনেক ভালো ছিলেন। কেইবা চায় নিজের মাটিতে প্রতিনিয়ত দখলদারদের হাতে দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হতে?
পরাক্রমশীল একটি দেশ অন্যায়ভাবে একটি দেশকে হুমকি দেবে, তা মেনে নিয়ে আÍসমর্পণ করাটা স্বাধীন ও আÍমর্যাদাশীল একটি দেশের পক্ষে কি সম্ভব? অতীতেও ইরাককে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, কিন্তু তারা কখনো আগ্রাসন ও পরাধীনতাকে মেনে নেয়নি। পরাধীনতার মতো গ্লানিকর জীবনে আর কিছুই হয় না। এ কারণে যুগে যুগে মানুষ স্বাধীনতার বেদিতে সঁপে দিয়েছে নিজের জীবন ও যৌবন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর জীবন ও যৌবন পার করে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তী নেলসন ম্যান্ডেলাসহ অসংখ্য ব্যক্তিত্ব। অবলীলায় উপেক্ষা করেছেন প্রলোভনের সহস্র হাতছানি। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। তারা পরাধীন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ঘেরাটোপে বন্দি হয়েও পরাধীন জীবনযাপন করতে আগ্রহী নয়।
প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ধুন্দুমার কা--কীর্তি বা তার নৃশংসতা যে কোনো সুস্থ মানুষের পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশী শাসন, শোষণ ও পরাধীনতার শৃ´খলে বন্দি হয়ে থাকাটা ইরাকি নাগরিকদের কাছে মোটেও কাম্য নয়। এটা এক ধরণের আÍহত্যার শামিল। এ কারণে অবধারিত মৃত্যু ও পরাজয় নিশ্চিত জেনেও সাদ্দাম হোসেন, তার অনুগত বাহিনী ও ইরাকি জনগণ মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসনের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত আর অবরোধে অবরোধে নিঃশেষিত ইরাক শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেখানে মার্কিন-বৃটিশ বাহিনী তিন দিনেই ইরাক জয়ের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল, ভেবেছিল ইরাকিরা তাদের ফুল ও সঙ্গীত দিয়ে তাদের বরণ করে নেবে, সেখানে তাদের তিনটি সপ্তাহ রক্তক্ষয়ী মরণপণ লড়াই করতে হয়েছে। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশ। ইরাকিরা পরাজিত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, ধ্বংসলীলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু জয় হয়েছে তাদের নীতির। জয় হয়েছে আদর্শের। জয় হয়েছে নৈতিকতার। বিশ্ববাসী দেখেছে, মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্যে ইরাকিরা যেভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা ইতিহাসে অমর ও অমলিন হয়ে থাকবে। আÍসমর্পণ করা কিংবা আগ্রাসী বাহিনীকে বরণ করে নেয়ার চেয়ে তারা মৃত্যুকে শ্রেয়তর মনে করেছেন। এটা ইরাকিরা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের মুখে তাদের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে মানুষ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে, সে কখনো পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারে না।
অসম শক্তির কাছে পরাজিত হলেও স্বাধীনতার অগ্নিশিখা সবার বুকেই দেদীপ্যমান থাকে। ইরাকিদের এই পরাজয়ও বোধকরি সাময়িক। তারা একদিন পরাধীনতার এই শৃ´খল ভেঙ্গে ফেলবে। কেননা সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ দ্বিতীয় জন পল বলেছেন : ‘আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে ঈশ্বর দুষ্টুদের হাতে ইতিহাসকে ছেড়ে দিয়েছেন, তারপরও ঈশ্বরের সুবিচার ও দুর্গতদের রক্ষায় তার অসীম ক্ষমতার ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ঈশ্বর নীরবতার মধ্যেও যে কোনো সময় আবির্ভূত হতে পারেন।’ ক্যাথলিক পোপের এই বাণীর মধ্যে যে আশাবাদ সুপ্ত আছে, তা আমরা দেখতে পেয়েছি পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে। কোনো আগ্রাসী শক্তি স্বাধীনতাকামী মানুষকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখতে পারলেও চিরতরে পারে না। প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদলেও কারো দিনই একই রকম যায় না। তাহলে মহাক্রমশালী বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধঃপতন ঘটত না এবং বর্তমানে পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অনায়াসেই পৃথিবীব্যাপী বিস্তার করতো তার সাম্রাজ্য।
øায়ুযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ পেলেও শক্তির ভারসাম্যহীনতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একক পরাশক্তির হুংকারে কেঁপে উঠেছে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ। পৃথিবীকে এমন একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ। হঠাৎ কোথা থেকে এসে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাস্তনস্ত’ নামক কী এক অলৌকিক মন্ত্র পড়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক একটি স্বপ্নকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ায় বিশ্বের শক্তিশালী মানুষরা হারিয়ে ফেলেছে নিরাপদ আশ্রয়। জানি না, এ জন্য গর্বাচেভের কোনো অনুশোচনা হয় কি না? আর সেই গর্বাচেভ এখন বলছেন : ‘জগতসংসারের ভিত্তিভূমি আন্তর্জাতিক আইনকেও এ যুদ্ধে (ইরাকে মার্কিন-বৃটিশ আগ্রাসন) মানা হয়নি। আন্তর্জাতিক আইন যদি মূল্য না পায়, এই আইনের সর্বদা মেনে চলার নীতিগুলো এবং তার আলোকে নিষেধাজ্ঞা যদি একক পরাশক্তির জন্যে শুধু ফাঁকা বুলিতেই পরিণত হয়, তাহলে এর পরিণতিতে আমরা দেখতে পাব শক্তির প্রভাব, যথেচ্ছাচার এবং শুধুই নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার ভয়াবহ প্রবণতা আর তাহলে যে বিশাল ঝড়ের উদ্ভব হবেÑ তা থেকে আমেরিকাও রক্ষা পাবে না।’
আমরা যারা অসহায় ও দুর্বল, তাদের কাছে পোপ দ্বিতীয় জন পল এবং মিখাইল গর্বাচেভের বাণীই এখন সান্ত¡না ও স্বস্তি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের সমর্থকদের পতনের অপেক্ষায় আছি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি করে ও অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে ব্যক্তি পৃথিবীর শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে, তার প্রতি রয়েছে শান্তিকামী মানুষের তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণার অনলে নিশ্চয়ই পুড়ে যাবে অশুভ শক্তির আস্ফালন। আজ না হোক, একদিন নিশ্চয়ই পৃথিবীর সব অসহায় মানুষের এই আকাক্সক্ষা অবশ্যই পূরণ হবে। পরাধীনতা চিরায়ত নয়। শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের অনুভূতি ও ফুলের মাধুর্য চিরন্তন। অন্তত ইরাকের বেলায় এ কথা চিরসত্য।
দৈনিক সংবাদ : ২২ এপ্রিল ২০০৩
সার্স : মিশন ইম্পসিবল থ্রি!
ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব থিতু হতে না হতেই ‘সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রম’ বা ‘সার্স’ ভাইরাস নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই রোগে প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য ব্যক্তি এবং মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ‘সার্স’। একমাত্র কানাডা ছাড়া অধিকাংশই আসিয়ানভুক্ত, আসিয়ান সংলগ্ন কিংবা এশিয়ান দেশ। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক। প্রতিদিনই এর বিস্তার ঘটছে। যে হারে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, তাতে অতীতের যে কোনো রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে পাঁচ কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছিল। শুধু গত বছর এইডসে মারা গেছে ৩০ লাখ লোক। একদল বিজ্ঞানী মনে করছেন, স্বাস্থ্যসেবার মান খুবই নিুÑ এমন সব দেশে যদি ‘সার্স’ একবার হানা দেয়, তাহলে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। সেক্ষেত্রে ‘সার্স’ এই পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ অনুধাবন করতে পারছে না। মরণঘাতী ‘সার্স’-এর আগ্রাসন থেকে কীভাবে বাঁচা যাবেÑ তা নিয়ে বিশ্ববাসী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন। আর জনবহুল শহর রাজধানী বেইজিং। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই শহরটা ঘড়ির কাঁটা মেপে মেপে চলে। ২৪ ঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ডই কখন যেন কর্মব্যস্ততায় কেটে যায়! সাধারণত বাসস্ট্যান্ড ও বাসে থাকে উপচে পড়া ভিড়। চলতে থাকে সারি সারি সাইকেল। সারাদিন জীবনের উত্তাপে ফুটতে থাকে বেইজিং। সেই বেইজিংয়ে এখন অবিশ্বাস্যভাবে শুনশান নীরবতা। কোথাও ট্রাফিক জ্যাম নেই। রেস্তোঁরা ও শপিং মলগুলো পরিত্যক্ত শ্মশানের মতো ভূতুড়ে। সিনেমা হলগুলোর ফটক শিকল দিয়ে আটকানো। কোনো সংলাপ ভেসে আসে না। নেই কোনো সুর। খাঁখাঁ করছে ইন্টারনেট ক্যাফে। স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। থেমে গেছে বালক-বালিকাদের চপলতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের থাকতে দেয়া হচ্ছে না। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর জীবন। গুরুতর প্রয়োজনেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য লবণ, তেল, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস ক্রয়ের জন্য দু’একজন লোক মুখোশ এঁটে ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। পুরো শহরই যেন মুখোশ পরিধান করে আছে। সবাই স্বেচ্ছায় এক ধরনের বন্দি জীবনযাপন করছেন। খুঁজছেন নির্জনতা। এর মাঝে ব্যতিক্রম রেলস্টেশন। বেইজিংবাসী শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য ভিড় করছেন রেলস্টেশনে। তবে বাইরের লোকজন যাতে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য বেইজিং-এর বাইরের গ্রামগুলোতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে পুরো সমাজতান্ত্রিক চীন। আর এমনটি হয়েছে ‘সার্স’ নামক এক রহস্যময়ী রোগের প্রাদুর্ভাবে। তবে যতটা না আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তারচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। রহস্যজনক এই রোগটি এখন চীনের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ধস নেমেছে পরিবহন, বিমান, পর্যটন ব্যবসায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ক্রমশ নিুগামী। ‘সার্স’ ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিকে দারুণভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মাস ছয়েক আগে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ গুয়ানডঙে ‘সার্স’-এর সূত্রপাত। শুরুতে চীন সরকার বিষয়টিকে হালকা করে দেখে। চীন তার রুদ্ধ দুয়ার নীতি অনুসারে সব কিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, অজ্ঞাত কোন রোগ যখনই কোথাও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সরকারসহ বিভিন্ন কর্র্তৃপক্ষের মধ্যে ওই রোগটিকে কেন্দ্র করে গঠনমূলক পদক্ষেপের চেয়ে ভীতি, কুসংস্কার, গুজব ছড়ানো ও অজ্ঞতাপ্রসূত মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাছাড়া পুরো বিষয়টি চেপে রাখার যে প্রবণতা, সেক্ষেত্রে চীনাদের ভূমিকা তো প্রবাদে পরিণত হয়েছে। চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঝাং ওয়েনকাং এই রোগটিকে নিয়ে অবজ্ঞা ও উপহাস করতে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ হয়ে ওঠে, তখন তার পক্ষে তা সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতির কথা স্বীকার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রতিনিধিদের বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হু’র প্রতিনিধিরা বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শনে যেয়ে ঘটনার ভয়াবহতা ফাঁস করে দিলে ফুসে ওঠে বেইজিংবাসী। তাদের বিক্ষোভের মুখে ২০ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা লাভের পর এই প্রথম সরকার অসততার জন্য কোনো একজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করলো। একই দিন বরখাস্ত করা হয় বেইজিং-এর মেয়রকে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা যথাযথভাবে জানতে পেরে পরিস্থিতিকে মহামারী হিসেবে ধরে নিয়ে চীনা সরকার যেসব অফিস-আদালত, হোটেল-রেস্তোঁরায় ‘সার্স’ আক্রান্ত রোগীদের পদস্পর্শ পড়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গরোধ করার জন্য বিচ্ছিন্ন করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে দুই সহস্রাধিক স্বাস্থ্যকর্মীকে। বেইজিং হাসপাতপালে আক্রান্তদের মধ্যে আছেন ৭০ জন চিকিৎসক, নার্স ও ২০ জন রোগী। চীনের একটি স্কুলে ‘সার্স’ রোধে কোয়ারেন্টাইন (রোগ-সংক্রমণ প্রতিরোধে পৃথক বা আটক রাখা) সেন্টার স্থাপনকে কেন্দ্র করে ২৭ এপ্রিল রাতে বন্দরনগরী তিয়ানজিনে ব্যাপক দাঙ্গা বেঁধে যায়। বেইজিং বিদেশীদের আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু যে বেইজিং ‘সার্স’-এ আক্রান্ত হয়েছে এবং তারাই যে কেবল এরকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তা নয়। বিশ্বের যেসব দেশ আক্রান্ত হয়েছে, সবারই কম-বেশি একই রকম অবস্থা।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কী এই ‘সার্স’? যে জন্য দেশে দেশে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থার। ‘সার্স’-এর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, মারাÍক অ্যাকিউট শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে তাপমাত্রা বেড়ে যায় ১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এর সঙ্গে থাকে শুকনো কাশি। শ্বাসকষ্ট, মাথা ধরা, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা, শরীরে চাক চাক দাগ, মাংসপেশীতে ব্যথা, কাঁপুনি, পেট খারাপ ইত্যাদি। এই ভাইরাসটি মুখ, নাক ও চোখ দিয়ে শরীরে ঢোকে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি কেউ থাকলে হাঁচি-কাশির সঙ্গে বের হওয়া ভাইরাসে সংক্রমণ ঘটে। কোনো স্থানে ভাইরাসে সংক্রমিত হলে, সেখানে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত তা জীবিত থাকে। সে সময়ের মধ্যে কেউ আক্রান্ত স্থান দিয়ে চলাচল করলে তার দেহেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে মাস্ক, কালো চশমা ও গ্লাভস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কিন্তু সব নিয়ম-নীতি ও আইন লংঘন করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বেপরোয়া আগ্রাসন চালিয়ে যখন ইরাক দখল করে নেয়, ঠিক তখন ‘সার্স’-এর প্রাদুর্ভাব হওয়ার সঙ্গে অনেকে বিষয়টিকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করছেন। যারা এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তাদের যুক্তি কি একদমই উড়িয়ে দেয়া যাবে? একসময়ের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভগ্নাংশ রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, ইরাকের আগ্রাসন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া এবং ওই আগ্রাসনের সময় অন্যতম পরাশক্তি চীনকে তার নিজের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত রাখতে মার্কিনিরাই ‘সার্স’ ভাইরাস ছড়িয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্য চীন ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের অন্যতম বিরোধিতাকারী শক্তিধর দেশ। চীনকে টার্গেট করার আরেকটি কারণও উড়িয়ে দেয়া যায় না। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের পয়লা নম্বর দেশ চীনের প্রতিটি লোকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করা হয়েছে। চীন যেভাবে সস্তায় ও সুলভে পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করতে পারে, তেমনটি কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যে কারণে সারা বিশ্বে ছেয়ে আছে চীনের পণ্যসামগ্রী। এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখল করে আছে চীন। চীনসহ ১১০টিরও বেশি দেশ গ্যাট (জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অব ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড)-এর সদস্য। ১৯৪৭ সালে প্রথম স্বাক্ষরিত গ্যাটের চুক্তি অনুযায়ী সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ২০০৫ সালে মার্কেট উন্মুক্ত হয়ে যাবে। ফলে ট্রেড মার্কযুক্ত এক দেশের পণ্য অন্য দেশসমূহে অবাধে বিক্রি করা সম্ভব হবে। উন্মুক্ত বাণিজ্যের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে চীন। ফলে গ্যাট চুক্তি অনুসারে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চীন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন পরাশক্তি হিসেবে চীনের সঙ্গে অন্য যে কারোই টেক্কা দেয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এমন এক দূরদর্শী কূট-পরিকল্পনা থেকে চীনকে দুর্বল করা হতে পারে।
এক্ষেত্রে রাশিয়ার একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সের বিজ্ঞানী সের্গেই কোলেসনিকভের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ২৫ এপ্রিল সাইবেরিয়ার আর্কতুস্কে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই বিজ্ঞানী বলেন, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী নিউমোনিয়া আদলের রোগ ‘সার্স’-এর ভাইরাস কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং সম্ভবত ব্যাকটেরিয়াঘটিত জীবাণু অস্ত্র হিসেবেই একে প্রয়োগ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের সময় চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ব্যতিব্যস্ত রাখা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্যে পশ্চিমা শক্তির কোনো ক্রীড়নক সংস্থা কৌশলে তা ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে পর্যটন শিল্প ও বিমান পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর ফলে যুদ্ধের চেয়েও এর ক্ষয়ক্ষতি কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশিই হবে। এই বিজ্ঞানী আরো বলেন, ‘সার্স’ ভাইরাস মানুষের সৃষ্ট এবং এটি সম্ভবত একটি জীবাণু অস্ত্র। এই ভাইরাসে এমন উপাদান আছে যা এখনো নির্ণীত হয়নি। এতে যে জেনেটিক উপাদান আছে, তার সঙ্গে মানুষের পরিচিত কোন ভাইরাসের মিল নেই। এগুলো সিনথেটিক ভাইরাস। নিউমোনিয়া ধরনের ‘সার্স’ রোগের ভাইরাস দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণ আর এগুলো হাম, মাম্পসের দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণে গঠিত। প্রাকৃতিকভাবে যা অসম্ভব ধরনের ভাইরাস। এটি কেবল ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত করা হতে পারে। এটা যেহেতু বানানো হয়েছে, তাই এর প্রতিষেধকও তৈরি করা সম্ভব।
‘সার্স’ ভাইরাস দিয়ে চীনে বদ্ধ দুয়ার খোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টার কমতি নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে চীন। চীনকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারলে একে একে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তরায়গুলো দূর হয়ে যাবে। যদিও বিশ্বে রাজনীতি ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়, তারপরও ‘বিশালদেহী’ চীন খ-িত হলে ভেঙ্গে পড়বে বিশ্ব ব্যবস্থা। এ কারণে ‘সার্স’কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বড়শি ফেলা সহজ হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির পাশাপাশি চীনের অভ্যন্তরীণ সংকটও সৃষ্টি করতে পেরেছে। প্রাথমিক অবস্থায় চীন তার রীতি অনুযায়ী ‘সার্স’ রোগ নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখলেও এই রোগের বিস্তার দ্রুত ঘটতে থাকায় তারা এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার সিদ্ধান্ত নেয়। জনদাবির প্রেক্ষিতে স্বচ্ছতার জন্য ক্যারিয়ার-আমলা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী দৃঢ়চেতা উ সিকে ‘সার্স’-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সরকারের তরফ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য ঘেঁষা ও উদারপন্থী এই কূটনীতিককে দায়িত্ব দেয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কারের পথে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে। পার্টির বয়োজ্যেষ্ঠরা দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কারের বিপক্ষে লড়াই চালিয়ে আসছেন, পার্টির একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাও টঙ বলেছেন, জনগণের সমর্থন পাবার এইতো চমৎকার সুযোগ। এর ফলে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হবে। ১৯৮৯ সালে তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে অভ্যুত্থানের পর বাও টঙকে পার্টি থেকে অপসারণ করা হয়। তিনি আরো বলেন, উদধভট ডটভ পণণয ফধশধভথ ধভ ট ঠফটডপ ঠমস মভ র্ধ ডটভ ফধশণ ধভর্ দণ ্রলভ্রদধভণ. অত দণ ডটভর্’র্ টপণ টঢশটর্ভটথণ মতর্ দধ্র ্রর্ধলর্টধমভ টভঢ বমরণ ধর্ভমর্ দণ ্রলভ ভমষ.র্ দণভ ষদণভ? অর্থাৎ চীন একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কিংবা রৌদ্রকরোজ্জ্বল আলোয় বসবাস করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে এবং আলোয় আসতে যদি না পারে, তাহলে আর কবে পারবে? এ কথাগুলো যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন যাবৎ আকারে-ইঙ্গিতে বলে আসছে। চীনকে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চোখে যেন ঘুম নেই। তারা ছলে-বলে-কৌশলে চীনকে গণতন্ত্রের পাঠ দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ‘সার্স’কে কেন্দ্র করে তাদের চাওয়াটা যেন চীনের সংস্কারপন্থী নেতাদের মুখে সরব হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র নিশ্চয়ই উত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু হালে গণতন্ত্রের যে রূপ ফুটে উঠেছে, তাতে আতংকিত না হয়ে পারা যায় না। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার যেভাবে খর্ব করা হয়েছে এবং বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে যেভাবে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়েছে, তেমন গণতন্ত্র নিশ্চয়ই কেউ আশা করেন না। এ কারণে চীনে গণতন্ত্র প্রবর্তনের যে তথাকথিত উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তাতে বিশ্ববাসী সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাবার মতো অবস্থা হয়েছে।
যা হোক, চীনের গণতন্ত্র নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলবে। কিন্তু যেটি ভাবনার বিষয়Ñ সেটি হচ্ছে ‘সার্স’। ‘সার্স’ নিয়ে সারা দুনিয়া আতঙ্কিত হলেও এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন ভাবনা নেই। ছয় মাস পরও যুক্তরাষ্ট্র ‘সার্স’-এ আক্রান্ত হয়নি। এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিংবা কোনো গবেষণার খবরও চোখে পড়ছে না। তারা অনেকটা চুপচাপ ও নির্বিকার। বিষয়টি রহস্যজনক নয় কি? এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর পরিচালক ডা. জুলি গারবার্ডিং যখন বলেন, ‘জানি না, কেন এখনও আমরা সৌভাগ্যবান। তবে আমরা কোনো সুযোগ দেব না’। তখন সেই বাংলা প্রবাদটি কি মনে হয় নাÑ ঠাকুর ঘরে কে রে! আমি কলা খাইনি’র মতো। এখন অবধি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে ‘সার্স’ ভাইরাস কীভাবে এলো, সেটা আবিষ্কার করতে পারেননি। বরং এটা আবিষ্কার করতে যেয়ে একজন বিজ্ঞানীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সবাই ধরে নিয়েছেন, ‘সার্স’ হচ্ছে মানবসৃষ্ট ভাইরাস। কেউ এটা বাজারে ছেড়ে চুপি চুপি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এটা নিয়ন্ত্রণের চাবিটা নিশ্চয়ই তাদের হাতে। উদ্দেশ্য পূরণ হলে সময়মত চাবি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হতে পারে। তাছাড়া পৃথিবী ক্রমশ ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। শত্রু এলাকায় রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশল এটি। অর্থাৎ জীবাণু যুদ্ধে জয়ী শত্রুপক্ষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু মাটি ও সম্পদের কোনো ক্ষতি হবে না। বিজয়ী দেশের মানুষের প্রয়োজন নেই। দরকার মাটি ও সম্পদ।
‘সার্স’ ভাইরাস ঘটনার সঙ্গে হলিউডের ব্যয়বহুল মুভি ‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবির কাহিনীর সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। পাশ্চাত্যের হাইটেক ও জেমস বন্ড মার্কা ছবি দেখে আমাদের কাছে তা আজগুবি, গাঁজাখুরি ও অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর কাছে তেমনটি মনে হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ পাশ্চাত্য ছবিতে আজ যা দেখানো হয়, আমরা তা ভবিষ্যতে সত্যি হতে দেখি। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১২৩ মিনিটের ‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবিটি দেখে এমনটি যে সম্ভব, তা প্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে কল্পনাবিলাস মনে হয়েছে। ছবির কাহিনী অনেকটা এমন : একজন বিজ্ঞানী একটি ভাইরাস আবিষ্কার করেন। যে ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দু’দিনের মধ্যে একজন মানুষের দেহের সব সিস্টেম অকেজো হয়ে যায় এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। অবশ্য এই জীবাণু নষ্ট করার জন্য জেনেটিক্যালি পরিবর্তন করার জন্য ফ্লু জাতীয় রোগবীজের ভয়াবহ জীবাণু প্রতিষেধক ওষুধ রয়েছে। সীন আব্রাহামরূপী ওগরে স্কট নামক একজন ভিলেন একটি বায়ো-টেক ফার্ম থেকে এই জীবাণু চুরি করেন। এর ফলে পৃথিবীর মানুষের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই ভাইরাস যাদের কাছে থাকে, সেই অল্প ক’জন লোক নিয়ন্ত্রণ করবে পুরো পৃথিবী। এই জীবাণু থেকে বিশ্বকে রক্ষার লক্ষ্যে অ্যামব্রোসকে নিবৃত্ত করার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় ইথান হান্টরূপী টম ক্রুজকে। এ জন্য তিনি ঘটনাস্থল অস্ট্রেলিয়ায় যান। সহযোগিতার জন্য রিক্রুট করেন চুরিই যার নেশা ও পেশা এবং অ্যামব্রোসের সাবেক গার্লফ্রেন্ড নিয়াহ হলরূপী কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী টান্ডি নিউটন এবং কম্পিউটার জিনিয়াস লুথাররূপী ভিঙ রামেসকে। যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ইথান হান্ট মুখোমুখি হন অ্যামব্রোসের। পুরো ছবিটি মরণঘাতী ভাইরাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বুদ্ধি, কৌশল ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো ছবিটির পরতে পরতে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা ও রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। মারাÍক জীবাণু উদ্ধার এবং অ্যামব্রোসের উদ্দেশ্য নস্যাৎ করার জন্য ইথান হান্ট একের পর এক দুর্ধর্ষ ও বিস্ময়কর অভিযানে শামিল হন। অ্যামব্রোসের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চালিয়ে শেষ অবধি সফল হয় তার মিশন। ভয়াবহ ভাইরাস থেকে বেঁচে যায় পৃথিবীর মানুষ।
‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবিতে ভাইরাস থেকে পৃথিবীবাসী রেহাই পেলেও প্রায় একই রকম ভাইরাস ‘সার্স’ একের পর এক ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে এবং কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ মানুষের জীবন। মরণঘাতী এই ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন ‘মিশন ইম্পসিবল-থ্রি’ নামের একটি অভিযান। অবশ্য এই অভিযান পরিচালনার জন্য থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। হংকং-এর একটি হাসপাতালের ডা. হেনরি লিকুয়ান নিজেই আক্রান্ত হয়েছিলেন ‘সার্স’ রোগে। সেরেও উঠেছেন এই যাত্রায়। তিনি বলেছেন, ‘আমি এখন রীতিমত এক আগ্রাসী মানুষ। সার্সকে যেভাবেই হোক, আমি জয় করবো।’ এই বিশ্বে আমরা যারা ভীত ও দুর্বল, তারা ‘মিশন ইম্পসিবল-থ্রি’র অপেক্ষায় আছি। যার মাধ্যমে জয় করা যাবে ভয়াবহ ভাইরাস ‘সার্স’-কে।
দৈনিক সংবাদ : ৬ মে ২০০৩
আমরা কি বধির হয়ে যাব?
আজকাল ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিংবা দূরালাপনীতে কথা বললেও আশপাশের মানুষজনও সচকিত হয়ে ওঠেন। কথা বলার ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ তো দূরে থাক, একান্তে বা নিঃশব্দে কথা বলার চল যেন আমাদের জীবন থেকে উঠে গেছে। চিৎকার করে কথা না বললে যেন কেউ কারো কথা শুনতে পান না। এমনটি তো এই কিছুদিন আগেও ছিল না। তাহলে হঠাৎ এমন কি হলো, যে জন্য বদলে যাচ্ছে মানুষ! কথা বলছেন উচ্চ কলরবে। আসলে নাগরিক জীবন আমাদের বদলে দিচ্ছে। ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে কোলাহল। চারপাশের কোলাহলে মানুষ ক্রমশ উচ্চভাষী হয়ে যাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারেÑ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলার কী সম্পর্ক? সম্পর্কটা এখানে, ঢাকায় যে হারে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে যানবাহন। বছর তিনেক আগের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতি বছর ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে পরিবহন বৃদ্ধির হার আনুমানিক ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এই বিপুলসংখ্যক পরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় শব্দ ও বায়ু দূষণের মারাÍক অবনতি ঘটেছে। আর এর ফলে মানুষ ক্রমান¦য়ে বধির হয়ে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, আমরা সবাই কথা বলছি জোরে জোরে, নতুবা একজনের কথা আরেকজনের পক্ষে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে। অনেকটা কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ের সেই দুই বধিরের কথোপকথনের মতো।
পৃথিবীর যে ক’টি শহরে শব্দ দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। মূলত পরিবহন খাত থেকেই শব্দ দূষণের সূত্রপাত। রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন ডিজাইনের গাড়ি চলাচল করে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট বেবিট্যাক্সির উৎপাতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল নাগরিক জীবন। কিন্তু বেবিট্যাক্সি উঠে গেলে বায়ু দূষণ কিছুটা হ্রাস পেলেও শব্দ দূষণের মাত্রা কিন্তু একটুও কমেনি। কেননা, ঢাকায় যেসব নানা কিসিমের যানবাহন চলাচল করে, তাদের অধিকাংশই পুরনো মডেলের। পুরনো মডেল হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু এসব গাড়ির বেশিরভাগই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব গাড়ির কারণে শব্দ ও বায়ু দূষণ বেড়েই চলেছে। কেউ যদি ঢাকার গ-ি ছাড়িয়ে একটুখানি গ্রামের দিকে যান, তিনি পাবেন তাজা ও সতেজ নিঃশ্বাস এবং শব্দহীন এক নির্জন পরিবেশ। ঢাকার তুলনায় গ্রামে দূষণের মাত্রা অনেক কম। বৃষ্টি-মৌসুমে বিশেষত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দূষণের পরিমাণ থাকে অত্যধিক। তবে কোনো মৌসুমেই শব্দ দূষণের হেরফের হয় না। ঢাকায় শব্দ দূষণের উৎপত্তিস্থল যানবাহন ছাড়াও আছে যখন-তখন ও যত্রতত্র নির্বাচনী প্রচারণা, সমাবেশ ও পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য সশব্দে মাইকিং, ইট ভাঙ্গার মেশিন, শিল্প-কারখানা, ঘরে-মিলনায়তনে-গাড়িতে উচ্চ শব্দে গান শোনা, জেনারেটরের তীব্র গর্জন ইত্যাদি। শব্দ দূষণের পাশাপাশি বায়ু দূষণও ঢাকাকে রোগাক্রান্ত করে রেখেছে। যানবাহন, শিল্প-কারখানা, ইটের ভাটাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নির্গত হয় কালো ধোঁয়া। এই কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইডের দূষিত উপাদান। আবাসিক এলাকা ও কর্মস্থলের আশপাশে এসব দূষিত উপাদান ছড়িয়ে পড়লে তা সরাসরি মানুষের দেহে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এ কারণে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি। শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজার লোক অকালে ঝরে যায়। এ তথ্য দিয়েছেন স্বয়ং পরিবেশমন্ত্রী। শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে যে রোগে আক্রান্ত হতে হয়, তার মধ্যে অন্যতমÑ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ব্রঙ্কাইটিস, বধির হয়ে যাওয়া, øায়ুর চাপ, ক্রনিক ডিজিজ ইত্যাদি। এছাড়া অমনোযোগিতা, ঘুমে ব্যাঘাত, মেজাজ চড়ে যাওয়া, আতংকিত হওয়ার মতো মানসিক ব্যাধি তো আছেই। হাসপাতালের রোগীদের মারাÍক অসুবিধা ছাড়াও স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচলের সমস্যা ও পড়ালেখায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রতিবছর মৃত্যু ছাড়াও লাখ লাখ লোক নানারকম শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। শব্দ ও বায়ু দূষণ এড়ানো গেলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬৫ লাখ লোককে চিকিৎসাধীন এবং সাড়ে ৮ কোটি লোককে ছোটখাট অসুখে ভুগতে হতো না। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় পরিবেশ ইউনিটের একজন ঊর্ধ্বতন পরিবেশ বিজ্ঞানী জীতেন্দ্র শাহ এক সমীক্ষায় জানিয়েছেন, শব্দ ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে প্রতি বছর বাংলাদেশ শুধু চিকিৎসা খাতেই ২০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি এড়াতে পারবে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে শব্দ ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০০ সালে ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সরকার প্রায় ২৪ কোটি টাকা ঋণ লাভ করে। কিন্তু সে টাকার কতটুকু সদ্ব্যবহার হয়েছে, তা জানা না গেলেও শব্দ ও বায়ু দূষণের মাত্রা বরং আগের মতোই আছে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা দূষিত হচ্ছে বায়ু, সঙ্গে শব্দ দূষণের তীব্রতা। নাক ও মুখ দিয়ে দূষিত বায়ু ঢুকে শ্বাস-প্রশ্বাসের পাশাপাশি ফুসফুস ঝাঁজরা হয়ে গেলেও এ মুহূর্তে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শব্দ দূষণ। শব্দ দূষণে বধির হয়ে যাওয়াটা একটা মামুলি ঘটনা। কিন্তু এর ফলে আমাদের øায়ু ও মানসিক যে বৈকল্য ঘটছে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে øায়ু ও মানসিক রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ৯৭ শতাংশ ছাত্র জানিয়েছে, গাড়ির হর্নের কারণে তাদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটে। ৮৬ শতাংশ লোক শব্দ দূষণকে বড় সমস্যা বলে স্বীকার করেছেন। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে চালানো এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শব্দ দূষণকে ৭৮ শতাংশ লোক বলেছেন অধিকতর খারাপ, ৭১ শতাংশ বলেছেন শিরঃপীড়ার কারণ, ৪৯ শতাংশ বলেছেন মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। ৪৩ শতাংশ অমনোযোগী হয়ে পড়ে ও ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এবং ৩৩ শতাংশ কানে কম শুনতে পান। এঁদের সবাই কম-বেশি øায়ু ও মানসিক পীড়ায় ভুগছেন। আমাদের দেশে গবেষণার মান আশানুরূপ নয় বিধায় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন কিংবা যারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন কিংবা হন না, তাদের রোগের মূল কারণটা ধরতে পারা যায় না। তবে বিদেশি গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রোগের অন্যতম কারণ শব্দ ও বায়ু দূষণ। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, শব্দ ও বায়ু দূষণ বাংলাদেশে কতটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ শব্দ ও বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ যেহেতু আমরা জানি, সেহেতু এই সমস্যা দূর করাটা কঠিন কোনো বিষয় নয়। প্রধানত যানবাহনের কারণেই হয় শব্দ ও বায়ু দূষণ। বিশেষ করে শব্দ দূষণ সৃষ্টি হয় ট্রাফিক জ্যাম থেকে। অধিকাংশ গাড়ির চালক ট্রাফিক জ্যাম ও সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও অনর্থক হর্ন বাজিয়ে নাভিশ্বাস তোলেন। রিকশা ও পথচারীদের কারণে গাড়ির চালকদের হর্ন বাজাতে হয়। রিকশাওয়ালারা অধিকাংশ সময় ট্রাফিক আইন মানতে চান না। অনেক পথচারী ইচ্ছেমত রাস্তা পারাপার এবং রাস্তার ওপর আড্ডা মারেন। তাছাড়া ফুটপাত হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় পথচারীদের রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হয়। পরিস্থিতির কারণে গাড়ি চালকদের হর্ন বাজানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
ঢাকায় শব্দ ও বায়ু দূষণ দূর করার জন্য জরুরিভিত্তিতে যা করা দরকার : খুব বেশি প্রয়োজন না হলে গাড়ির হর্ন না বাজানো, নির্বাচনী প্রচারণা, সমাবেশ ও বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য মাইকিং নিষিদ্ধ, ট্যানারি, লেদ মেশিনসহ শিল্প-কারখানা করতে না দেয়া, ইট ভাঙ্গার মেশিন নিষিদ্ধ, ২০ বছরের বেশি পুরনো যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ, আনফিট যানবাহন চলাচল বন্ধ, হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ, গাড়ির চালকরা যাতে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন, সেটুকু শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা, বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা বিদ্যুৎ থাকলেও জেনারেটর না চালিয়ে সৌরচুল্লী ব্যবহার করা, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি, ট্রাফিক ও শব্দ দূষণ সংক্রান্ত আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা। সর্বোপরি জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। জনসচেতনতা গড়ে উঠলে শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ দূর করা কঠিন নয়। মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই দেশব্যাপী পলিথিনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে শব্দ ও বায়ু দূষণ সংক্রান্ত লেখা থাকা এবং তা বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ করা; পাশাপাশি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। মানুষ যখন এর অপকারিতা বুঝতে পারবে, তখন তারা এমনি এমনিই সচেতন হয়ে উঠবে। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পাশাপাশি একটুখানি নিরিবিলি থাকতে কে না পছন্দ করে?
নিরিবিলি পরিবেশ ছাড়া মানুষের মৌলিক চিন্তা-ভাবনার প্রসারণ ঘটে না। সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মনীষী ও প-িত ব্যক্তিরা একটু একাকীত্ব থাকতে ভালোবাসেন। জ্ঞানচর্চার জন্য তারা বেছে নেন নির্জন পরিবেশ। এছাড়া কোনো কোনো ব্যস্ত মানুষও চান কাজের ফাঁকে একটুখানি প্রশান্তি। সাপ্তাহিক ছুটিতে সবাই ছুটতে চান এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে, যেখানে নেই কোনো ঝঞ্ঝাট ও শব্দের কোলাহল। কিন্তু ঢাকা থেকে আস্তে আস্তে নির্জন পরিবেশ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। যে হারে ইট-পাথর-সিমেন্টের কর্কশ নিসর্গ গড়ে উঠছে, তার মাঝে একটুখানি স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ নেই। যে সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে রাজধানীর ঢাকার বিকাশ ও বিবর্তন, সেই ঢাকা এখন প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। গাছপালা, সবুজ প্রকৃতি ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে খোলা প্রান্তর, মাঠ, উদ্যান। ক্রমান¦য়ে তা সংকুচিত হয়ে আসছে। এর মাঝে ঢাকার আইল্যান্ডগুলোতে রোপিত বৃক্ষগুলো কিছুটা হলেও আমাদের চোখ ও মনের ভোজন তৃষ্ণা মেটায়, সেই বৃক্ষগুলোও সড়ক উন্নয়নের নামে বিরল হয়ে উঠছে। একদিকে যখন সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে নিসর্গ; অন্যদিকে রাজধানী ঢাকা শব্দ দূষণ ও কোলাহলময় হয়ে উঠছে। প্রতি মুহূর্ত শব্দ তরঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কোথাও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নেই। আমরা যেন শব্দের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে হাবুডুবু খাচ্ছি। নিরন্তন উঁচু উঁচু ভবন গড়ে ওঠায় তার শব্দে প্রতিটি পাড়া-মহল্লার নির্জনতা ও নিরিবিলিটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। একটুখানি বিশ্রাম ও পিন-পতন নীরবতায় ঘুমানো এখন স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। ঘরের বাইরে বের হলে তো কথাই নেই। গাড়ির হর্নে কেঁপে ওঠে আমাদের শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। যে হারে মানুষের জনস্রোত বাড়ছে, সে অনুপাতে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। বাড়ছে শব্দ-নিনাদ। ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে কান, মস্তিষ্কের নিউরন। আর এর ফলে অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বধির হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন অসুস্থ ও বধির হয়ে যাচ্ছেন অসংখ্য লোক। তাহলে কেন জেনে-শুনে আমরা বিষ পান করবো! তাই আমাদের সবারই উচিত শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। এ মুহূর্তে এবং এখনই।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ৮ মে ২০০৩
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়...
একজন কবির ব্যক্তিগত জীবনাচার কিংবা তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে তার কবিতাই পাঠকের কাছে তাঁকে চিনিয়ে দেয়। কবিতায় প্রকাশ পায় তার জীবন-ভাবনা এবং জীবনের নান্দনিক সৌন্দর্য। কবির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার চেয়ে তার কবিতার সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাই আনন্দদায়ক। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কবির কবিতা পাঠ করি। এর মধ্যে কোনো কোনো কবিতা আমাদের সহজেই কাছে টেনে নেয়; আবার কোনো কোনো কবিতা হয়তো আমাদের অন্তরকে স্পর্শও করে না। কে কোন্ কবিতায় অবগাহন করবেনÑ এটা নির্ভর করে পাঠকের রুচি, সৌন্দর্যবোধ ও চিন্তা-ভাবনার ওপর। কোনো কবি হয়তো আমাদের কাছাকাছি বসবাস করে কবিতা লিখছেন কিংবা দূরে মফস্বল থেকেও কেউবা লিখছেন কবিতাÑ এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তার কবিতা যখন আমাদের কাছে পৌঁছে যায়, তখন সেই কবি আমাদের হৃদয়ের আপনজনা হয়ে ওঠেন। অনেক কবির পরিচয় জানা হয় না, সামনাসামনি দেখাও হয় না; কিন্তু তার কাব্য ভাবনা আমাদের মর্মমূল ছুঁয়ে যায়। পাঠকের সঙ্গে এভাবেই গড়ে ওঠে একজন কবির অন্তরের সম্পর্ক। যখন একজন কবির তিরোধানের খবর পত্রিকায় পাঠ করি কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জানতে পাই, তখন একজন ঘনিষ্ঠজনের চলে যাবার অনুভূতি নিয়ে আমরা পাঠকরা কেঁপে উঠি। এছাড়া কিই-বা করতে পারি!
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি সিকদার আমিনুল হকের চলে যাওয়াটায় মনে হচ্ছে একজন প্রিয়জনকে হারালাম। সাহিত্যের অঙ্গন এবং সংবাদপত্রের পাতায় তার নিত্য উপস্থিতিতে আমরা তাঁকে একজন আপনজন হিসেবে মনে করতাম। একই শহরের বাসিন্দা হিসেবে, তার কবিতার পাঠক হিসেবে এবং কখনো-সখনো কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে সিকদার আমিনুল হকের অনুপস্থিতি আমাকে বিষণœ ও বিপর্যস্ত করে দেয়। আমি অবশ্য কবিতার বোদ্ধা পাঠকও নই, কবিতা বুঝি কি বুঝি নাÑ সেটাও কোনো বিষয় নয়। আÍীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মী ছাড়াও এ শহর, এ দেশের এমন কিছু ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের সাথে কখনো দেখা হয়নি, আদৌ হবে কিনা জানি না; কিন্তু তাঁদের কর্মকা-ে আমরা তাঁকে বা তাঁদের আপনজন হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসি। আর সিকদার আমিনুল হককে তো চিনেছি নানাভাবে। সেই কৈশোরে তার কবিতার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রোমান্টিক তবে অনুচ্চ কণ্ঠে কবিতা পড়তে দেখেছি ‘পদাবলী’র কবিতা পাঠের আসরে। আশির দশকে যখন তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘বিপ্লব’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়, সেটি গুণে, মানে ও স্মার্টনেসে সবার নজর কেড়ে নেয়। তখনকার প্রকাশনার মানের তুলনায় এ পত্রিকাটি ছিল দারুণ ঝকঝকে। আমরা যারা তরুণ ছিলাম, তারা এই পত্রিকার প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু যা কিছু ভালো, তার আয়ু কেন জানি হয় স্বল্পায়ু। আমাদের দেশে এটি যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ‘বিপ্লব’ পত্রিকাটির অকালে ঝরে যাওয়ায় আমরা কষ্ট পেয়েছি। সে সঙ্গে সম্পাদনার ক্ষেত্রে একজন রুচিবান ও পরিশীলিত ব্যক্তির অনুপস্থিতি পলে পলে অনুভব করেছি। এরপর আর তিনি সম্পাদনার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন বলে মনে হয় না। তিনি ছিলেন ষাট দশকের বহুল আলোচিত ‘স্বাক্ষর’ গোষ্ঠীর অন্যতম পুরোধা কর্মী। তার প্রথম সম্পাদিত পত্রিকা ‘সাম্প্রতিক’ এবং পরবর্তীকালে ‘বিপ্লব’-এর মতো দুটি ধারালো পত্রিকা প্রকাশ করে যেহেতু বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি, সম্ভবত সে কারণে সম্পাদনার সঙ্গে নিজেকে আর জড়াননি। হয়তো অভিমান করে দূরে থেকেছেন। এ কারণে আমরা একজন মননশীল, যোগ্য ও মেধাবী সম্পাদককে সম্পাদনার জগত থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলি। আর্থিক অসচ্ছলতা তাকে কখনো স্পর্শ করতে না পারায় শুধু কাব্যচর্চা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন পুরোটা জীবন। পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে না জড়ালেও পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কটা কখনোই তিনি এড়াতে পারেননি। ১৯৮৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সম্পাদনায় (তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক) এবং সাবের হোসের চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় (প্রিন্টার্স লাইন অনুযায়ী তিনি ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। বর্তমানে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর প্রকাশক) ২১/১ ইস্কাটন গার্ডেন রোড থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘মূলধারা’। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ এবং তারুণ্যের দীপ্তিতে ভাস্বর তারুণ্য পেরিয়ে আসা ক’জন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনÑ কবি মোহন রায়হান, কবি মারুফ রায়হান, চিত্রশিল্পী ইউসুফ হাসান (বর্তমানে নিজস্ব বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার), চিত্রশিল্পী রাকিব হাসান (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী), সালাম সালাহউদ্দিন (বর্তমানে দৈনিক আজকের কাগজ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে আছেন)। নিয়মিত লিখতেন কবি আবু কায়সার, হেদায়েত হোসেন মোরশেদ, মতিউর রহমান (বর্তমানে প্রথম আলো সম্পাদক), কবি সানাউল হক খান, আবদুল কাইয়ুম মুকুল (বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলো’র যুগ্ম সম্পাদক), মোজাম্মেল হোসেন (বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলো’র নির্বাহী সম্পাদক), বিভুরঞ্জন সরকার (বর্তমানে মৃদুভাষণ-এর নির্বাহী সম্পাদক), মুহাম্মদ হিলালউদ্দিন (রম্য লেখকখ্যাত হিলাল ফয়েজী), সঞ্জীব চৌধুরী (বর্তমানে দৈনিক যুগান্তর-এর সহকারী সম্পাদক), সারোয়ার কবীর (বর্তমানে সাপ্তাহিক বর্তমান দিনকাল-এ) প্রমুখ খ্যাতিমান ও প্রতিভাবানরা এবং খ-কালীন রিপোর্টার হিসেবে এই নিবন্ধকার। এছাড়া ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন খন্দকার তারেক (পাক্ষিক ক্রীড়াজগত-এ কর্মরত) ও শামসুল হক টেংকু (বর্তমানে দৈনিক ভোরের কাগজ-এ)। পরে পত্রিকাটি ট্যাবলয়েডে পরিণত হলে যোগ দেন মাহমুদ শামসুল হক (বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠে), ফটোগ্রাফার চঞ্চল মাহমুদ, হাবিব ওয়াহিদ শিবলী, নাট্যাভিনেত্রী মুনীরা বেগম মেমী (‘মূলধারা’য় সম্পর্কটা সুদৃঢ় হওয়ায় পরবর্তীকালে শিল্পী ইউসুফ হাসানের গৃহিণী মুনিরা ইউসুফ), চিত্রশিল্পী জুয়েল, ফরহাদ প্রমুখ। উজ্জ্বল, উচ্ছল কখনো-সখনো ‘উচ্ছৃ´খল’ বিভিন্ন মেজাজের এই লেখক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পীসহ সবাইকে এক সুতোর মালায় বেঁধে রেখেছিলেন মেধা ও প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল এবং শান্ত ও ধীর-স্থির স্বভাবের বেনজীর আহমেদ (বর্তমানে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)।
‘মূলধারা’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে সাংঘাতিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রথমে ম্যাগাজিন, তারপর ট্যাবলয়েড আকারে প্রকাশিত হয়ে পত্রিকাটি দারুণভাবে কাঁপিয়ে দেয়। লেখায়, রেখায়, ছাপায়Ñ সব দিক দিয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। চারপাশকে সচকিত ও আলোকিত করে তোলে ‘মূলধারা’। এ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মূলত নির্বাহী সম্পাদক বেনজীর আহমেদকে বৃত্তে রেখে শহরের অন্যতম সেরা আড্ডা, গুলতানি, পারস্পরিক সম্পর্ক আর হৃদয়ের লেনদেনের উষ্ণতায় সরগরম হয়ে উঠতো। আড্ডা ঝলসে উঠতো যেন ধারালো তরবারির মতো। এই ঝলসানো ও মধুময় আড্ডায় কেইবা সামিল হতেন না? সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত, ক্রীড়ার তুখোড়, মৃদ্যুভাষী ও রাগী তরুণরা হঠাৎ হঠাৎ এসে আসর গুলজার করে দিতেন। এঁদের মাঝে নিয়মিত আসতেন কবি সিকদার আমিনুল হক। ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি ‘দীপক’ নামে পরিচিত। ধীর পদক্ষেপে এসে খুবই নীরবে নির্বাহী সম্পাদক বেনজীর আহমেদের কাছাকাছি একটা চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে খুব সম্ভবত মুঠোবন্দী একটির পর একটি সিগারেটে সুখটান দিতেন। হাওয়ায় ধূম্রজাল পাক খেতে থাকলে আড্ডায় সরব হতেন ধীরে-সুস্থে ও মার্জিত ভঙ্গিমায়। তার পোশাক-আশাক, চলাফেরা, বসা ও তার কথা বলার স্টাইলটি ছিল ভারি আকর্ষণীয়। তার সবকিছুতেই ছিল আভিজাত্য ও বনেদিয়ানার ছাপ। স্মিত হাসিটি ছিল মাধুর্যময়। সেই প্রথম তাঁকে অন্তরঙ্গভাবে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। আমার কাছে তাঁকে শুধু একজন আধুনিক কবি হিসেবে নয়, একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। শিক্ষা, মেধা ও পা-িত্যÑ সব দিক দিয়েই যেহেতু আমি পিছিয়ে ছিলাম, সঙ্গত কারণে আড্ডার মিছিলে আমি ছিলাম একজন নির্বাক স্রোতা। তবে সবার প্রাণের উত্তাপ আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করতো, যে কারণে এই আড্ডাকে কখনোই এড়াতে পারতাম না। সাধারণত দেখা যেত, রাত বাড়ার সাথে সাথে আড্ডা ফাঁকা হতে শুরু হলে শেষ অবধি থেকে যেতেন আড্ডার মধ্যমণি বেনজীর আহমেদ, কবি সিকদার আমিনুল হক, অরুণ ও ফরিদ নামের দুই আড্ডাবাজ ভদ্রলোক, আর এই অধম। প্রায় প্রতিদিনই আমরা ইস্কাটন থেকে হেঁটে হেঁটে যেতাম এলিফ্যান্ট রোডে। কবি সিকদার আমিনুল হক ও বেনজীর আহমেদÑ উভয়েরই গন্তব্যস্থল ছিল এলিফ্যান্ট রোড। সেখানে পৌঁছেও রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে গভীর রাতে বাসার দিকে ছুটতাম। কবি সিকদার আমিনুল হকের সঙ্গে এভাবেই ভেতরে ভেতরে একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়। বয়সের ব্যবধান, আপাদমস্তক কবিসুলভ ভারিক্কীয়ানার পাশাপাশি আমার স্বভাবসুলভ লাজুকতা ও নির্লিপ্ত মনোভাবের কারণে তার সঙ্গে কখনোই তেমনভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তারপরেও তার সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গতা অনুভব করতাম। একজন কবি, একজন রুচিশীল মানুষ এবং সর্বোপরি একজন কাছের মানুষ হিসেবে হৃদয়ের জমিনে তার ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
মৃত্যুর পর কবি সিকদার আমিনুল হক সম্পর্কে লেখা হয়েছে : ষাট দশকের শীর্ষস্থানীয় এই কবির আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলা কবিতার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি আমৃত্যু শুদ্ধ কবিতা চর্চায় নিমগ্ন থেকে অন্যদেরকেও অনুপ্রাণিত করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবী, মানবতাবাদী ও প্রেমিক কবি। তার নিরলস ও নিরবচ্ছিন্ন কাব্যসাধনা আবহমান বাংলা কবিতার ধারায় একটি সুস্পষ্ট নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। দুটি প্রবন্ধের বইসহ তার গ্রন্থের সংখ্যা পনেরোর অধিক। তার অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যাও প্রচুর। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেÑ ‘দূরের কার্নিশ’, ‘তিন পাঁপড়ির ফুল’, ‘পারাবাত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’, ‘সতত জানার মানুষ’, ‘কাফকার জামা’, ‘বাতাসের সঙ্গে আলাপ’, ‘বিমর্ষ তাতার’, ‘সুপ্রভাত হে বারান্দা’, ‘সুলতা আমার এলসা’, ‘নির্বাচিত কবিতা’ এবং প্রবন্ধের বই ‘শব্দ থেকে ভাবনায়’ ও ‘আমার হল না গানÑ মৃত্যুচিন্তা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘মূলধারা’ থেকে প্রকাশিত হয় তার ‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থটি পাঠক মহলে আলাদা আবেদন সৃষ্টি করে। বিদগ্ধ পাঠকরা অনুধাবন করতে পারেন কবি সিকদার আমিনুল হকের নতুন কণ্ঠস্বর। এ গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে আমরা ‘মূলধারা’র সবাই সে বছরের বইমেলায় চায়ের স্টলে আড্ডার তুফান ছুটিয়েছি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া চাকমা মেয়েদের আকর্ষণে তাদের পরিবেশিত কাপের পর কাপ চা নিমিষেই উজাড় করে দিয়েছি।
কবি হিসেবে সিকদার আমিনুল হকের মূল্যায়ন করবেন বোদ্ধা, সমালোচক ও বয়ে যাওয়া সময়Ñ সে পথ আমার নয়। কিন্তু একজন সজ্জন, রুচিশীল মানুষ হিসেবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও কথার মাধুর্য দিয়ে যে নিভৃত জগত তিনি গড়েছিলেন, দূর থেকে আমরা যারা ছিলাম তার গুণমুগ্ধ অনুরাগী, তারা তার অনুপস্থিতি অনুভব করবো প্রতিটি মুহূর্ত।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ২২ মে ২০০৩
রাসায়নিক মৌসুমি ফল আর স্বাদহীন ইলিশ
বাঙালির সব ঐতিহ্যই একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বাঙালি খাদ্যের যে সুনাম ও সুখ্যাতি, তা-ও যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে বাঙালির আহার-বিহার ও আতিথেয়তা দেশ-বিদেশে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়ে এসেছে। কিন্তু নষ্ট সময়ের আবর্তে বাঙালির সব গৌরব যেন অস্তমিত হতে চলেছে। মৌসুমি ফল আর পদ্মার ইলিশ বাঙালির জাতীয় গৌরব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। ফল ও ইলিশ দিয়ে মেহমানদের আতিথেয়তা করা বাঙালির চিরায়ত অভ্যাস এবং এটা সব সময় দারুণভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু মৌসুমি ফল ও ইলিশের সেই খ্যাতি এখন আর নেই বললেই চলে। কুচক্রী ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার কাছে সমর্পিত হয়েছে আমাদের যাবতীয় অর্জন। গাছের ফল ও নদীর ইলিশও তা থেকে বাদ যায়নি। বরং এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে মুনাফালোভীরা।
ভেজালে ভেজালে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রতিটি পণ্য। নির্ভেজাল কোনো কিছু পাওয়া এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। বিশেষত খাদ্য জাতীয় পণ্য সয়লাব হয়ে গেছে ভেজালে। আর এই ভেজাল জাতীয় খাদ্য খেয়ে বাংলাদেশে রোগ-বালাই বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। হাট-বাজারে বা মার্কেটে গিয়ে কোনো ক্রেতার পক্ষেই নির্ভেজাল জিনিস যাচাই করে ক্রয় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফলে অধিকাংশ মানুষই এখন ভেজাল জিনিসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে নিয়মিত ভেজাল জিনিস খাচ্ছেন। বিক্রেতাদের কাছে এক ধরনের জিম্মি হয়ে পড়েছে ক্রেতারা। ভেজালকারীরা যতটা সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী, অসংগঠিত ক্রেতাদের তাদের কাছে অসহায় আÍসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাংলাদেশের পণ্যের গুণ ও মান যাচাই করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট (বিএসটিআই) নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু তাদের সক্রিয়তা তেমনভাবে টের পাওয়া যায় না। যে কারণে ভেজাল পণ্য, ভেজাল খাদ্যে পরিবৃত হয়ে ক্রেতারা ক্রমশ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলেছে। তাদের রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ভেজাল পণ্য, ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের মাঝে এতদিন ক্রেতাদের কাছে নির্ভেজাল হয়ে ছিল মৌসুমি ফল এবং শাক-সব্জি। সবারই এমন একটা ধারণা ছিলÑ গাছের ফলমূল ও শাক-সব্জিতে সম্ভবত ভেজাল দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এ ধারণাটাও মিথ্যে হতে চলেছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের তালপাকা গরমে নগরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও মধুমাস হিসেবে জ্যৈষ্ঠের আলাদা একটা মর্যাদা রয়েছে। জ্যৈষ্ঠের পাকা আমের মধুর রসে সবার মুখ হয় রঙিন। এই মাস হরেক রকম মৌসুমি ফলে টইটম্বুর হয়ে থাকে। আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তরমুজ, ফুটি, পেঁপে, কলা এবং মৌসুমি শাক-সব্জিতে সর্বত্র একটা মৌ মৌ সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। অতীতে আমরা দেখেছি, নির্দিষ্ট সময়ে মৌসুমী ফল গাছে ধরেছে এবং নির্দিষ্ট সময় তা পেকেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই টসটসে পাকা আম, তরমুজ, পেঁপে, টমেটো, কলা ইত্যাদি বাজারে এসে যাচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চয়ই ব্যতিক্রমধর্মী। হাজার বছর চলে আসা নিয়মের হঠাৎ করে এভাবে ব্যত্যয় ঘটায় সবাই অবাক হয়ে যায়। সময়ের জিনিস অসময়ে পেয়ে গেলেও তার দাম যেমন সাধারণের নাগালের বাইরে থাকে, তেমনি তার স্বাদও মোটেই মধুর নয়। জানা যায়, বিভিন্ন রকম বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মৌসুমি ফল পাকানো এবং শাক-সব্জি তরতাজা করা হয়। ইথিলিন অক্সাইড দিয়ে কাঁচা আম, পেঁপে, তরমুজ, কলা, টমেটো ইত্যাদি ফল কৃত্রিমভাবে পাকানো এবং ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য মৌসুমি ফল ও শাক-সব্জি সতেজ করার জন্য কার্বাইড পাউডার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইথিলিন অক্সাইডও রাসায়নিক তরল পদার্থ। সাধারণত এটি বিভিন্ন শিল্পের রাসায়নিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটা দাহ্য জাতীয় ও অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল। এর সংস্পর্শে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, ফুসফুস ক্ষত-বিক্ষত, মাথাধরা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট ও সাইনোসিস ছাড়াও ক্যান্সারসহ মারাÍক অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে ফল পাকানোর জন্য। আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলাসহ গ্রীষ্মকালীন কাঁচা ও অপরিপক্ব ফল দ্রুত পাকাতে হলে ফলের ওপর ইথিলিন অক্সাইড ছিটিয়ে দিতে হয়। এরপর সারারাত ঢেকে রাখলে ফলগুলো কৃত্রিমভাবে পেকে এমন রূপ ধারণ করেÑ মনে হবে গাছপাকা ফল। কিন্তু এই রাসায়নিক পদার্থ ফলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। সঙ্গত কারণে ফলগুলো বিষাক্ত হয়ে ওঠে। যা খেলে মারাÍক প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, কার্বাইড হলো এক ধরনের পাউডার। এ পাউডার দিয়ে গ্যাস বেলুনের গ্যাস তৈরিতে লাগে। এ পাউডারে ফলের রঙ পরিবর্তন ও সতেজকরণ করা হয়। কার্বাইড মানবদেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের মারাÍক ক্ষতিসাধন করে থাকে। আর এসব ফল ও শাক-সব্জি খেয়ে ক্রেতারা ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, লিভার ও কিডনির রোগ এবং চর্মরোগসহ নানা মারাÍক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপক সংখ্যায়। বাংলাদেশে মৌসুমি ফল ও শাক-সব্জির অসম্ভব কদর। দাম বেশি হলেও সব ধরনের ক্রেতাই কম-বেশি তা ক্রয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিক্রেতাদের প্রলোভন ও অসচেতনতার কারণে অসংখ্য মানুষ মারাÍক রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় কপার সালফেট ব্যবহার করে কাঁঠাল, কলা ও অন্যান্য ফল পাকানোর খবর জানা যায়। এখানে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কপার সালফেট দিয়ে পাকানো কাঁঠাল খেয়ে একজনের মৃত্যু ও ১১ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সবাই আক্রান্ত হয়েছে জ্বর, পাতলা পায়খানা, বমি ও পেট ব্যথায়।
যুক্তরাষ্ট্রে ইথিলিন অক্সাইড কীটনাশক, কসমেটিক্স ইত্যাদি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। আর যেসব শ্রমিক এসব উৎপাদনের কাজে সম্পৃক্ত, তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ লিউকেমিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মারাÍক রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে ঝরে পড়ছে। আর সেই ইথিলিন অক্সাইড আমরা এখন খাদ্যের সঙ্গে গলাধঃকরণ করছি। বিষয়টি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ইথিলেন অক্সাইড ও কার্বাইড পাউডার সাধারণত সবার হাতে পৌঁছানোর কথা নয়। নির্দিষ্ট প্রেসক্রিপশন কিংবা সার্টিফিকেট ছাড়া ওষুধ বিক্রেতাদের এটা বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ থাকার কথা। কিন্তু মুনাফার আশায় বিক্রেতারা কোনো রকম বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে যার-তার কাছে ইথিলিন অক্সাইড ও কার্বাইড পাউডার বিক্রি করছে। কিছুসংখ্যক লোক এটা বুঝে অধিক মুনাফার লোভে মৌসুমি ফল ও শাক-সব্জিতে ব্যবহার করলেও অধিকাংশ ফল ও শাক-সব্জি বিক্রেতা এর ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে মোটেও ওয়াকিবহাল নয়। তেমনিভাবে ওয়াকিবহাল নয় ক্রেতারাও। কেননা, এমন একটি অভিনব প্রতারণার ফাঁদ যে পাতা হয়েছে, এটা ক্রেতাদের পক্ষে বোঝা বা অনুধাবন করা মোটেও সম্ভব নয়। আর এ জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এই কিছুদিন আগেও স্বাদে-গন্ধে ইলিশ মাছের কোনো তুলনা ছিল না। এক বাড়িতে ইলিশ মাছ রাঁধা হলে তার গন্ধ পেতেন আশপাশের বাড়ির লোকেরা। কিন্তু ইদানীং ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ তো দূরে থাক, খেতেও ইচ্ছে করে না। মাছের রাজা ইলিশ তার গুণাগুণ ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় মৎস্য সম্পদ হলো ইলিশ মাছ। একক প্রজাতি হিসেবে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের শতকরা প্রায় ২০ ভাগই ইলিশ। সেই প্রাচীনকাল থেকে ইলিশের প্রতি বাঙালির আকর্ষণ চিরন্তন। শুধু প্রিয় খাদ্য হিসেবে নয়, জেলেদের আয়ের প্রধান উৎসও ইলিশ। কিন্তু নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মানুষের লোভের কারণে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান¦য়ে হ্রাস পাচ্ছে। সাগর, মোহনাঞ্চল ও নদীতে ইলিশের দেখা মেলে। উপকূলীয় নদ-নদীসমূহে পর্যাপ্তসংখ্যক ইলিশের বিচরণ। এ উপমহাদেশের ৭৫ শতাংশ ইলিশের বিচরণস্থল আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইলিশের খ্যাতি জগতজোড়া। বিশেষ করে কোলকাতায় বসবাসরত পূর্ববাংলার মানুষ এবং অভিবাসী বাংলাদেশীদের কাছে ইলিশ মাছ এক ধরনের নস্টালজিয়া। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফুটবল খেলায় জয়ী হলে ইলিশের চাহিদা দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ। প্রজনন মৌসুমে এ মাছ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে উজান স্রোতে সাঁতার কেটে চলে আসে। ডিম ছাড়ার পর আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। ডিম থেকে পরিপক্ব মাছ হওয়ার মাঝামাঝি সময়টাকে বলা হয় ‘জাটকা’। জাটকা বড় হওয়ার জন্য সমুদ্রে চলে যায়। পরিপক্বতা লাভের পর প্রজননের জন্য সমুদ্র হতে মিঠা পানিতে আসে। কিন্তু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা জাটকা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করায় নদীর ইলিশের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ষাটের দশক থেকে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের নদ-নদীতে আর ইলিশ মাছ দেখা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০০০ সালে ২০ হাজার টন জাটকা ধরা পড়েছে। ১৯৯০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫ হাজার টন। এত জাটকা ধরার পরও বাংলাদেশে বছরে ইলিশ উৎপাদন হয় দেড় লাখ টন। ইলিশ মাছ তার গতিপথ পরিবর্তন করে মিয়ানমারের নাফ ও অন্যান্য নদীতে চলে যাচ্ছে। আগে বাংলাদেশের যেসব নদীতে ৯৫ শতাংশ ইলিশ পাওয়া যেত, এখন সেখানে তা হ্রাস পেয়ে ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আমরা বাজারে যে ইলিশ মাছ দেখতে পাই, তার সিংহভাগই সমুদ্রের ইলিশ এবং মিয়ানমার থেকে আসে। যে কারণে ইলিশ মাছে মিঠা পানির স্বাদ ও গন্ধ নেই।
তবে সরকারিভাবে ইলিশ মাছ হ্রাস পাবার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে নদ-নদীর উজান এলাকায় পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়ায় পদ্মা ও মেঘনাসহ দেশের সব নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় ইলিশের প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট, প্রজনন মৌসুমে অধিকহারে ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা নিধন করায় ইলিশের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত, নদীতে ইলিশের সংখ্যা হ্রাস, প্রবাহিত নদীগুলোর উজানে ফারাক্কাসহ ভারতের বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের নদীতে পানি প্রবাহ হ্রাস ও গতিপথ পরিবর্তিত হওয়া, দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের কারণে নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত এবং কারেন্ট জালের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি। এসব কারণে বাংলাদেশের নদীতে ক্রমান¦য়ে ইলিশ মাছ কমে যাচ্ছে। সে জায়গায় আসছে সমুদ্র ও মিয়ানমারের ইলিশ। যে কারণে বাঙালির প্রিয় খাদ্য ইলিশ মাছ এখন অপ্রিয় খাদ্যে পরিণত হতে চলেছে। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ তার গন্ধ, বর্ণ, সৌন্দর্য হারিয়ে স্বাদহীন মাছে পরিণত হয়েছে। ইলিশ মাছের সেই বনেদিয়ানা ও স্বাদ ফিরিয়ে আনতে হলে জাটকা নিধন রোধ, কারেন্ট জাল বন্ধ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাঙালি তার যাবতীয় অর্জনগুলো হারিয়ে নিঃস্ব হলেও তার খাদ্য ও আতিথেয়তাটুকুর অন্তত সুখ্যাতি ছিল। কিন্তু মৌসুমি ফল আর ঐতিহ্যবাহী পদ্মার ইলিশ এখন বাঙালির রসনাকেই তৃপ্ত করতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে বাঙালি তার আতিথেয়তার দুই প্রিয় উপকরণ দিয়ে কীভাবে অতিথিকে আপ্যায়িত করবে? একে একে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নানা অর্জনগুলো যখন নষ্ট-ভ্রষ্ট হয়ে গেছে, ঠিক তখন মৌসুমি ফল আর পদ্মার ইলিশকে হারিয়ে আমরা আরো বেশি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি।
দৈনিক সংবাদ : ২৩ মে ২০০৩
প্লিজ, গাছ কাটবেন না
প্রতিদিন বাসস্থান থেকে কর্মস্থলে যাবার স্বল্প পরিসরের যে পথটুকু, যা যানজটের কল্যাণে বেশ কিছুটা দীর্ঘ হয়ে যায়, চাই বা না চাই, যাত্রাকালীন সময়টুকু গাড়িতে বসে আশপাশের নানা দৃশ্যাবলী কখনো বাধ্য হয়ে, কখনো একরাশ কৌতূহল নিয়ে দেখতে হয়। এ সময় নানা রকম অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। কখনো-সখনো সাত-সকালে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির পিছে পিছে চলতে হয়। নাকে এসে লাগে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ। কানে তীব্র চিৎকার হয়ে ভেসে আসে পঞ্চাশ ও ষাট দশকে গাছপালা পরিবেষ্টিত অবস্থায় গড়ে ওঠা চমৎকার সব বাড়ি ভাঙ্গার নির্মম শব্দ, দেখতে হয় বহুতল ভবনের শক্ত-গাঁথুনি। শুনতে হয় যানবাহনের অহেতুক হর্ন। ডুবে যেতে হয় নিকষ কালো ধোঁয়ার ধূম্রজালে। যানবাহনের নিয়ম না-মানা তো রুটিনমাফিক দৃশ্য। সড়কগুলোর মানচিত্র বদলে যাওয়া, ট্র্যাফিক সিগন্যালের নিত্য-নতুন নিয়ম-কানুনের ফাঁদে প্রায়শই আটকা পড়তে হয়। সড়কদ্বীপ কিংবা আইল্যান্ডের ওপরে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলোর মন্দভাগ্যসহ ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া রাজধানী ঢাকাকে যেন কখনো উত্তরাধুনিক কবিতার মত দুর্বোধ্য, আবার কখনো গীতল কবিতার মতো সহজবোধ্য মনে হয়। এর মাঝে মনটা তখনই বেশি খারাপ হয়ে যায়, যখন দেখি ইট-পাথর-সিমেন্টের অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের নিসর্গ। কিছুদিন কোনো রাস্তায় যাতায়াত না করলে সে এলাকাকে চিনতে কষ্ট হয়। দু’পাশে সটান দাঁড়িয়ে যায় বহুতল ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট ও ঝলমলে মার্কেট। কিন্তু চোখকে øিগ্ধ ও মনকে ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয়ার জন্য যে গাছগুলো সেখানে ছিল, তার লেশমাত্র চিহ্ন কোথাও থাকে না। প্রতিদিনই নির্মূল হয়ে যাচ্ছে গাছ-গাছালি। এর পাশাপাশি যানজটের সর্বগ্রাসী লাগাম টেনে ধরার জন্য আইল্যান্ডগুলোকে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তাতে গাছের সংখ্যা ক্রমান¦য়ে হ্রাস পাচ্ছে। অথচ সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডগুলোতে অনেক অযতœ-অবহেলা আর বাধা-বিঘœ ও প্রতিকূলতার মাঝে বেড়ে ওঠে এক-একটি গাছ। কত চারা যে গাছ হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যায় অকালে! এর মাঝেও যা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে এই পচা-গলা-নোংরা শহরের শোভা বর্ধন করে, তারও বলি হতে হয় কথিত সড়ক, সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডের উন্নয়ন কর্মকা-ে। এছাড়াও প্রতি বছর ঝড়, বৃষ্টি ও টর্নেডোয় বিনষ্ট হয় হাজার হাজার গাছ। প্রকৃতির ওপরে কারো হাত না থাকলেও অধিকাংশ গাছই উপড়ে পড়ে আমাদের অবহেলায়। এর কারণ সড়ক উন্নয়ন, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ-টেলিফোনসহ নানা কারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করায় রাস্তার পাশের গাছগুলোর মাটি আলগা হয়ে যায়। এছাড়া অধিকাংশ গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত মাটি নেই। এ কারণে একটুখানি বাতাসে বা ঝড়ে গোড়াসহ হেলে পড়ে প্রাচীন ও নবীনÑ সব বয়সী গাছ।
এমনিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মূল্যবান বৃক্ষসম্পদ। তার ওপর জনগণের অজ্ঞতা আর পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে গাছ-গাছালির সংখ্যা। একটা সময় এই ঢাকা ছিল বৃক্ষ ও ফুলের শহর। প্রতিটি বাড়ি ছিল বৃক্ষময়। ছিল নানারকম ফুল ও ফলের সমাহার। কবি বুদ্ধদেব বসু কতই না প্রশস্তি গেয়েছেন এই ঢাকা শহরকে নিয়ে। ঢাকার নিসর্গ ও নির্জনতার কথা কখনোই তিনি ভুলতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসুর স্বপ্নের ঢাকা শহরকে চিনতে এখন বড্ড কষ্ট হয়। ইট-পাথরের আকাশছোঁয়া কংক্রিটে ঢেকে গেছে ঢাকার খোলা আকাশ। ফুল, ফল ও বৃক্ষ দেখতে হলে চলে যেতে হয় নাগরিক কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও। তাছাড়া অল্প কিছু বৃক্ষ যে এখনো দেখা যায়, তার অধিকাংশই অপরিচিতÑ বিদেশি বৃক্ষ। সবকিছুতেই যেখানে বিদেশ-নির্ভরতা, সেখানে গাছই বা বাদ যাবে কেন! বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গাছগুলোর না আছে সৌন্দর্য, না আছে কোনো গুণাবলী। বরং কিছু কিছু গাছ পরিবেশ ও মাটির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। বৃক্ষের পাশাপাশি এখন আর দেখা যায় না নয়নমনোহর ও মাতাল করা বাহারি সুগন্ধী ফুল ও ফলের গাছ। বৃক্ষ, ফল ও ফুল এখন ঢাকা শহরে বিরল হয়ে ওঠায় তা সরকারি উদ্যানে যেয়ে টিকিট কেটে দেখতে হয়। বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট বাড়ির টবে, কোনো কোনো বাড়ির ছাদে কিছু কিছু সৌখিন ব্যক্তি গাছ লাগান; নতুবা অধিকাংশ বাড়িতে প্লাস্টিকের গাছ কিংবা ড্রয়িং রুমে শোভা পায় প্রকৃতির দেয়াল চিত্র।
সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। যে কারণে মরুভূমি এখন মরুদ্যান হয়ে উঠেছে। যেখানে ছিল ধু-ধু বালুকারাশি, সেখানে এখন আশ্চর্যরকমভাবে দিগন্তব্যাপী সবুজের ছোঁয়া। এমন অসম্ভব সম্ভব হয়েছে মানুষের সচেতনতা ও অপরিসীম প্রচেষ্টার কারণে। আর অপরিকল্পিত নগরায়নের নামে ঢাকা শহর বৃক্ষহীন মরু শহরে পরিণত হতে চলেছে। বিশ্বের কোন্ শহরে নগরায়ন হচ্ছে না? সব শহরেই উন্নয়নের পাশাপাশি গাছ, ফল ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর শহরে বৃক্ষকে সাজানো হয়েছে স্থাপত্য শিল্পের মতো করে। দেখলে জুড়িয়ে যায় চোখ ও মন। আর পুরনো লন্ডন শহরকে উদ্যানের শহর বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
গাছ, ফল ও প্রকৃতি মানুষের অনেক পুরনো বন্ধু। মানব জীবনের জন্য গাছ অত্যন্ত অপরিহার্য। গাছের কাছে আমরা কী পাই না? খাদ্য, জ্বালানি, পশুসম্পদ, বাড়ি-ঘর তৈরির উপকরণ, ছায়াময় পরিবেশ, মাটির উর্বরতার পাশাপাশি প্রচ- বৃষ্টিপাত ও প্রবল সামুদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা করে গাছ। সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ, চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যপট ও আবহাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের মূল উপজীব্য অক্সিজেন আমরা গাছ থেকে গ্রহণ করি। বাংলাদেশে যেখানে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল বা গাছ-গাছালি থাকা দরকার, সেখানে আছে মাত্র ৬ শতাংশ। যা পরিবেশের জন্য দারুণ বিপজ্জনক। বিবেকবর্জিত এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের লোভে নির্বিচারে লোপাট করছে বৃক্ষসম্পদ। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জলবায়ু। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে অস্থিরতা ও চঞ্চলতা। যে জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে সামাজিক পরিবেশ। অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। আসলে গাছের সঙ্গে মানুষের যে আÍিক ও হার্দ্যকি সম্পর্ক, তা অনুভবের ও অনুধাবনের বিষয়।
জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষ পরিচর্যার ওপর গুরুত্ব দেয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সর্বত্রই গাছ লাগানো প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে গাছের চারা সরবরাহ, গাছের পরিচর্যা করা ও গাছের গুরুত্ব তুলে ধরে জনমত গড়ে তুলতে হবে। ইদানীং অবশ্য কিছুটা সচেতনতা বেড়েছে। গ্রাম এলাকায় গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে লাগাতে হবে বনজ, ফলজ, ভেষজ ও ঔষধি গাছ। ফুল, ফল, দারুবৃক্ষ, অশ্বত্থ গাছ শুধু প্রকৃতিকে সুন্দর করে না, ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়ে থাকে। দারিদ্র্য দূরীকরণে বৃক্ষ হতে পারে অকৃত্রিম বন্ধু। স্কুল-কলেজ, রাস্তার পাশে, হাইওয়ে, ট্রেন লাইনের দু’পাশে, নদীর তীরে, বাড়ির সামনে এবং খোলা জায়গা পেলে গাছ লাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী একটি গাছ কাটলে অন্তত তিনটি গাছ লাগানো প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে গাছের কোনো বিকল্প নেই।
শুধু গাছ লাগালেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা, গত কয়েক বছরে কোটি কোটি গাছের চারা লাগানো হয়েছে। সে অনুপাতে তা গাছ হয়ে ওঠেনি। এর কারণ, যথাযথ পরিচর্যার অভাব। এই ঢাকা শহরে সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডগুলোতে বিভিন্ন সময় গাছের চারা লাগানো হয়েছে। তার বেশিরভাগই গাছ হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যায়। অনাদরে ও অবহেলায় যে গাছগুলো বেঁচে যায়, সেগুলো নগরায়ন ও সৌন্দর্যের নামে কেটে ফেলা হয়। ফলে ঢাকা শহর ক্রমশ বৃক্ষ ও ছায়াশূন্য হয়ে যাচ্ছে। নগরপিতার প্রতি অনুরোধ, প্লিজ, যে অল্প কিছু গাছ এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, তাকে রক্ষা করুন। আর যাতে কোনো গাছ না কাটা হয়, সে ব্যবস্থা নিন। সে সঙ্গে নতুন নতুন গাছ লাগানোর ব্যবস্থা ও তার যথাযথ পরিচর্যা করে পৃথিবীর অন্যান্য শহরের মতো ঢাকাকেও একটি সুন্দর, নৈসর্গিক ও তিলোত্তমা শহরে পরিণত করুন।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ৩০ মে ২০০৩
বিমল দা’র অকালে চলে যাওয়া
ব্যক্তিগতভাবে আমি দৈনিক পত্রিকার শোক সংবাদের কলাম খুব একটা দেখি না। বলা যায়, দেখতেও চাই না। জানি, মৃত্যু অনিবার্য। তারপরও কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখতে চাই। ভাবটা এমন, আমি পত্রিকায় চোখ না বুলালে ঝরে যাওয়া জীবনগুলো অটুট থেকে যাবে! কিন্তু তাই কি কখনো হয়? ১৭ মে কেন জানি পত্রিকার শোক সংবাদের কলামে হঠাৎ চোখ চলে যায়। অমনি বুকটা ছেঁক করে ওঠে। পত্রিকায় দেখলাম বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও অধ্যাপক বিমল দত্ত ১৫ মে রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। এ বয়সে তিনি এভাবে চলে যাবেন, ভাবতেও পারিনি। আসলে আমাদের ভাবাভাবি নিয়ে বিধাতার কিইবা আসে যায়! বিমল দা’র মৃত্যু সংবাদটা পড়ার পর বুকের মাঝে একরাশ কষ্টকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি যে তার খুব ঘনিষ্ঠ বা কাছাকাছি ছিলামÑ তা হয়তো বলা যাবে না। তাছাড়া পরিচয়ের যেটুকু গ-ি গড়ে উঠেছিল, নির্মম নাগরিক জীবনে ছেড়ে যাওয়া যানজটে আটকেপড়া বাসের মতো তা আস্তে-ধীরে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। তার সঙ্গে কবে শেষ দেখা হয়েছিলÑ সেই স্মৃতিটুকুও স্মরণের জানালা দিয়ে হারিয়ে গেছে। তবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৫ সালের মার্চে; যখন আমি দৈনিক বাংলার বাণীতে শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। বাংলার বাণীতে যেদিন প্রথম যোগ দেই, সেদিনের বিকেলের পালার শিফ্ট-ইন-চার্জ ছিলেন কবি সোহরাব হাসান, যাঁর হাতে আমার দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। চমৎকার ও প্রাণখোলা এই মানুষটি খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে এবং সহসাই আপন করে নিতে পারেন। আমি দুরু দুরু বক্ষে তার সামনে বসতেই তিনি সহজ-সরল হাসি দিয়ে আমাকে আপন করে নেন। একে একে পরিচয় করিয়ে দেন বিকেলের শিফটে কর্মরত শহীদ আশরাফ, নাহিদ আমিন খান, আবদুল হালিম পলাশ, খান মোহাম্মদ সালেক, সুকুমার সরকার, সায়েদুল আরেফীন, অসীম কুমার উকিল, প্রণব সাহা প্রমুখের পাশাপাশি মফস্বল ডেস্কের ইন-চার্জ বিমল দত্তের সঙ্গে। অমায়িক ও মৃদু হাসি দিয়ে তিনি আমাকে বরণ করে নেন। নিপাট ভদ্রলোক বিমল দা’র উপস্থিতি অফিসে খুব একটা টের পাওয়া যেত না। নীরবে-নিভৃতে চুপিসারে কাজ করতেন। অথচ বিভিন্ন জেলার সংবাদদাতাদের উপস্থিতিতে মফস্বল ডেস্ক সরব হয়ে উঠলেও তার আড়ালে থাকতে চাইতেন বিমল দা। তার এই নিভৃতচারী ও নিঃশব্দ কাজ আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। তবে বিমল দা’কে নিয়ে আমার জীবনে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি তখন তেজগাঁও কলেজের ‘নামমাত্র’ ডিগ্রির ছাত্র। আসলে স্কুল-বয়স থেকেই পত্র-পত্রিকার সান্নিধ্যে আসায় পড়ালেখার প্রতি আমার ঝোঁকটা একদমই চলে যায়। অল্প বয়সেই উড়নচ-ি হলেও শহরে বসবাস করে যদি মুর্খ থেকে যাই, সেই লোকলজ্জার ভয়ে পড়ালেখার সঙ্গে সম্পর্কটা থাকে টায়ে টায়ে। এমনিতে ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলাম না, তদুপরি পড়ালেখায় ছিল না কোনো মনোযোগÑ এমন লবডঙ্কা মার্কা ছেলেকে ছাত্র বলাটা ঠিক মানায় কিনা সন্দেহ থেকে যায়। যা হোক, কোনক্রমে এক্কা-দোক্কা করে এক পর্যায়ে তেজগাঁও কলেজের ডিগ্রির ছাত্র হয়ে যাই। কিন্তু কলেজে ক’দিন গিয়েছি, তা হাতে গুনে বলে দেয়া যায়। আমার তখন ধ্যান-জ্ঞান ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখা এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করা। তো একদিন কি মনে করে কলেজে গিয়েছি। ক্লাসের কাউকেই আমি চিনি না। না কোনো সহপাঠীকে, না কোনো শিক্ষককে। যে কারণে কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় দেখি সেখানে বিমল দা এসে হাজির। আগেই বলেছি, বিমল দা তখন বাংলার বাণীতে আমার সহকর্মী। তিনি আমাকে দেখে উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, দুলাল তুমি এখানে? আমি বললাম, আমি তো ক্লাস করতে এসেছি। শুনে তিনি মুচকি মুচকি হাসলেন। পাল্টা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে কী মনে করে? তিনি যে জবাব দিলেন, তাতে আমি লা-জবাব হয়ে যাই। তিনি জানালেন, তিনি এসেছেন ক্লাস নিতে। বিমল দা যে তেজগাঁও কলেজের বিএ’র বাংলার খ-কালীন মাস্টার মশাই, এটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। জানার কথাও নয়। কেননা, ক্লাস শুরুর কয়েক মাস পর সেদিনই আমি বিএ’র প্রথম ক্লাসটা করতে কলেজে গিয়েছি। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। আমি যথারীতি ছাত্রদের আসনে। তিনি শিক্ষকের ভূমিকায়। তবে সেদিন প্রায় সারাক্ষণই তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে চোখে-মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ক্লাস নিতে থাকেন। আর আমি আড়ষ্ট হয়ে কোনোক্রমে তার ক্লাসটি কাটিয়ে দেই। এরপর ডিগ্রি পরীক্ষার আগ অবধি কলেজমুখো হয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাংলার বাণীতে দেখা হলে আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও তিনি কিন্তু সলাজ হাসিতে আমাকে কাছে টেনে নিতে দ্বিধা করতেন না। অবশ্য বেশিদিন তিনি আর আমাকে বিব্রত হতে দেননি। ‘খবর’ দৈনিক হওয়ার পর তিনি সেখানে চলে যান। তারপর থেকে তার সঙ্গে কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু একদিন জানতে পারলাম তিনি মারাÍক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং হারিয়েছেন একটি পা। সেই থেকে শুরু হয় তার আরেকটি সংগ্রামী ও কঠিন জীবন। পা হারিয়েও তার মনোবলে একটুও চিড় ধরেনি। জীবনের কাছে হেরে যাননি। পঙ্গুত্বকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে তিনি জীবন নৌকায় ভেসেছেন। এরপর আর তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। পথে-ঘাটে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত। শুনেছিলাম, তিনি দৈনিক খবর ও তেজগাঁও কলেজ ছেড়ে থিতু হয়েছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মরত ছিলেন সহকারী কলেজ পরিদর্শক হিসেবে। জীবনের সঙ্গে সারাটা জীবন যুদ্ধ করে কেটে গেল বিমল দা’র। তরুণ বয়সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাড়া দিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন, দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে এক পা হারিয়ে জীবনের যুদ্ধ চালিয়েছেন। কিন্তু কখনোই জীবনের কাছে আÍসমর্পণ করেননি। ভেঙ্গে পড়েননি। কিন্তু শেষ অবধি অকালে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন বিমল দত্ত। আমাদের বিমল দা। বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন তিনি।
দৈনিক সংবাদ : ৩০ মে ২০০৩
ইরাকে আগ্রাসন এবং আমাদের শিক্ষা
ইরাকে মার্কিন-বৃটিশ হানাদার বাহিনীর আগ্রাসন ও দখলদারিত্বে পরাধীনতার গ্লানিতে ভুগছেন ইরাকের পাশাপাশি আরববাসীরাও। কিন্তু আগ্রাসী ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীকে ইরাকের মাটিতে স্বাগত জানিয়েছে শিয়া সম্প্রদায় ও কুর্দি গোষ্ঠী। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কেন তারা এমনতরো নিন্দনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো? নিশ্চয়ই এর পেছনে এমন কোনো নিগূঢ় কারণ আছেÑ যে জন্য তারা দখলদার বাহিনীকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই দুই গোষ্ঠী ক্ষমতা থেকে অপসারিত ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দুই যুগের শাসন ও শোষণে নিপীড়িত, বঞ্চিত এবং এক ধরনের পরাধীন জীবনযাপন করেছে। যদিও শিয়া সম্প্রদায় জনসংখ্যার দিক দিয়ে ইরাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু তাদের সঙ্গে আচরণ করা হয়েছে সংখ্যালঘুর মতো। দমন-পীড়ন চালিয়ে সর্বদা তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকসহ মূল স্রোতধারায় তারা কখনই সুবিধা করতে পারেনি। বরং তারা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য তাদের ওপর চালানো হয় নানা রকম নির্যাতন ও নিগ্রহ। রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার কুর্দিকে। এ কথা তো সর্বজনবিদিত, শাসক হিসেবে সাদ্দাম হোসেন ছিলেন একরোখা ও স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন। সামান্য এদিক-সেদিক হলে দূরের মানুষ তো বটেই, রক্ত সম্পর্কীয় আÍীয়-স্বজনকেও পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে একটুও কার্পণ্য করতেন না। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মিসরের জামাল আব্দুল নাসেরের মতো তিনি আরব জাতীয়তাবাদী নেতা হতে চাইলেও তার এসব দুর্বলতার কারণে তিনি ক্রমান¦য়ে ইসলামী দেশগুলোর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। ইরানের সঙ্গে বছর আটেক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে এবং কুয়েতে অনর্থক আগ্রাসন চালিয়ে আরব বিশ্বে তিনি রীতিমত আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ান। এ কারণে প্রতিবেশী দেশ ইরান, কুয়েত, সৌদি আরব, জর্ডান, মিসর, তুরস্ক প্রভৃতি আরব দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কটা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না।
মার্কিন-বৃটিশ বাহিনী আগ্রাসী শক্তি হিসেবে নির্লজ্জের মত ইরাকে হামলা চালালেও এর প্রতিবাদে এক সিরিয়া ছাড়া আর কোনো আরব রাষ্ট্র টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, এমনকি কোনো কোনো দেশ এক ধরনের পুলক অনুভব করেছে। তারা মনে-প্রাণে চেয়েছে সাদ্দাম-যুগের অবসান। সঙ্গত কারণে নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শিয়া সম্প্রদায় এবং কুর্দিরা তাৎক্ষণিক ‘মুক্তি’র উল্লাসে তাদের বরণ করে নিয়েছে। মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনী যে মাত্র ২০ দিনে ইরাক দখল করতে পেরেছে, সেক্ষেত্রে তাদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র এবং ইরাককে জাতিসংঘের মাধ্যমে দুর্বল ও নিরস্ত্রীকরণের বড় ভূমিকা অবশ্যই ছিল। তদুপরি সংখ্যালঘু কুর্দি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের নির্লিপ্ত এবং বিদ্রোহী ভূমিকা ইরাককে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করতে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর জন্য সহজ হয়েছে। কোনো কোনো আরব দেশের নীরব সমর্থন এবং শিয়া ও কুর্দিদের উল্লসিত ভূমিকায় মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসন জায়েজ হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে আগ্রাসী বাহিনী যখন একের পর এক ইরাকের ভূখ- দখল করে নিতে থাকে, ঠিক তখন শিয়া ও কুর্দিরা যেভাবে তাদের সুস্বাগতম জানিয়েছে এবং পাশ্চাত্যের টেলিভিশনের পর্দায় তা যেভাবে ঢালাওভাবে সম্প্রচারিত হয়েছে, তা ছিল অবশ্যই দৃষ্টিকটু। তারা যেভাবে লুটতরাজ, ভাংচুর ও সহিংসতার পথ বেছে নেয়, তাতে বিশ্ববাসী বিহ্বল ও হতবাক হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এ ঘটনায় তাদের সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী মনে হতে পারে। কিন্তু শিয়া ও কুর্দিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে তাদের উচ্ছৃ´খল আচরণের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকে গেলে মানুষ তখন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে চরমতম পথ বেছে নিতে দ্বিধা করে না। আবার অবস্থার পরিবর্তন হলে তারা ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনধারায়। তখন হিসাব কষে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। শিয়া ও কুর্দিরা যখন বুঝতে পেরেছে, তারা বাঘের মুখ থেকে সিংহের মুখে পড়েছে, তখনই তাদের মোহভঙ্গ ঘটে যায়। প্রথম কিছুদিন মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনীকে স্বাগত জানালেও শিয়া ও কুর্দিরা এখন আর ইরাকের মাটিতে তাদের দেখতে চায় না। ইরাকে দখলদার মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিষোদগার ক্রমশঃ বাড়ছে। তারা মার্কিন বাহিনীকে অবিলম্বে ইরাক ত্যাগের দাবি জানিয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা সাদ্দাম হোসেনের পতন কামনা করলেও শাসক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো মেনে নেবে না।
ইরাকের ঘটনায় একটি অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা বিশ্ববাসীর অন্তত হয়েছে যে, দেশের একটি অংশকে ক্ষুব্ধ করে কিংবা দমিয়ে রেখে দেশ পরিচালনার বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইরাকে আগ্রাসন-পরবর্তী নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ মনোভাবের কারণে যে কোনো দেশই যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। সে জন্য দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য যে কোনো হুমকি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক থাকলেই শুধু চলবে না, এ জন্য বৃহত্তর রাজনৈতিক ও জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। আর এ জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সর্বজনীন চেতনা ও ঐক্যের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ না করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব-মৈত্রী-সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। সবার আগে ভেবে দেখতে হবে, কোনো রকম বৈষম্য যেন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়। কোনো জনগোষ্ঠীর মনে যেন পুঞ্জিভূত ক্ষোভের সৃষ্টি না হয়, যাতে তারা নিজেদের অসহায় ও বঞ্চিত মনে করে।
বাংলাদেশে নানা সম্প্রদায়ের বসবাস। এ দেশের জনগণের গরিষ্ঠ অংশ মুসলমান। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের আচার-আচরণ ও মনোভাবে এমনটি যাতে প্রতিফলিত না হয়, যেন তারা সর্বেসর্বা। এমনটি হলে সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। তাহলে দেশের মধ্যে একটা বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর তাহলে সেটা হবে নিজের পায়েই কুড়াল মারার শামিল। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। অনগ্রসরতা ও সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। শক্তি ও সামর্থ্যে প্রতিবেশী দেশগুলো আমাদের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। যে কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বা সংঘাতে আমরা কতটা কী করতে পারবোÑ তা বলা দুষ্কর। যদিও ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ করে জিতেছি। সেটি মুক্তিযুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তখনকার সঙ্গে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির ঢের ঢের তফাৎ। বিশ্বশক্তি এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় এখন কারো নিঃস্বার্থ সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া সহজ নয়। সামরিক সমর্থন ছাড়া শুধু মানসিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার দিন এখন অতীত হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে দেশের মানুষ যদি এক সূতোয় গাঁথা মালা হয়ে আগ্রাসী শক্তির বিপক্ষে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, তাহলে আঘাত হানার আগে প্রতিপক্ষকে একাধিকবার ভাবতে হবে। অবশ্য ১৯৭১ সালে আমাদের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট তিক্ততায় ভরা। এদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সর্বাÍক সাহায্য ও সহযোগিতা করে নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষ করে, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের সদর্থক ভাবনার দিগন্তকে প্রসারিত করতে হবে। এটা অন্তত বুঝতে হবেÑ মাতৃভূমির সাথে বেঈমানি করে সভ্য মানুষ হিসেবে নিজেদের দাবি করা যায় না। ইরাকে আগ্রাসনের ঘটনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, শান্তির প্রতি এবং নিজ দেশের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ও ভালোবাসা অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশে দেশে আÍরক্ষার নতুন কৌশল নিয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতাকারী চারটি ইউরোপীয় দেশ ২৯ এপ্রিল ২০০৩ নিজেদের মধ্যকার সামরিক বন্ধনকে অধিকতর সুদৃঢ় করার বিষয়ে আলোচনার জন্য ব্রাসেলসে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে এই দেশ চারটি অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করায় যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের সঙ্গে তাদের মন-কষাকষির সূত্রপাত ঘটে। ফ্রান্স, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ও বেলজিয়ামÑ এই চারটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইরাকে হামলা এবং তার পরিণতি মূল্যায়নপূর্বক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে প্রতিরক্ষার বন্ধন জোরদার করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বাধুনিক ও ভয়ংকর সব অস্ত্রের যে প্রদর্শনী করেছে এবং যে উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ঠুঁটো জগন্নাথ ও বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইরাকে হামলা চালিয়েছে, তাতে ইউরোপীয় এই দেশগুলো বিচলিত ও ক্ষুব্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভয়ংকর আগ্রাসী চেহারাদৃষ্টে এই দেশ চর্তষ্ঠয়ের নেতারা উপলব্ধি করেছেন যে, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় শক্তির ভারসাম্য রচিত না হলে ইরাকের মতোই অন্য সবার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করবে মাত্র। ইউরোপীয় এই চারটি দেশের এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা অন্য সবাইকেও স্পর্শ করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশের জন্য আশার কথা, মানব সম্পদের দিক দিয়ে দেশটি সমৃদ্ধ। যে কোনো বিচারে ১৪ কোটি লোক বাংলাদেশের জন্য একটি বড় শক্তি। এই শক্তিকে বিভক্ত ও বিভাজন না করে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের আলোকে দেশকে পরিচালনা করা হলে শুধু দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানেরই উন্নতি হবে না, একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লাল-সবুজ পতাকা সমুন্নত থাকবে।
দৈনিক প্রথম আলো : ৪ জুন ২০০৩
ইরাকের অস্তিত্ব কি বিলীন হয়ে যাবে?
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগুতে হচ্ছে। পৃথিবীটা সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট অর্থাৎ যোগ্যদের জন্য। আর এই টিকে থাকতে গিয়ে কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে যুগে যুগে দেশে দেশে যুদ্ধ কিংবা মানুষে মানুষে লড়াই ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। হত্যা, ধ্বংসলীলায় শেষ হয়ে গেছে কত মানুষের জীবন ও সম্পত্তি। এসব যদি এড়ানো যেতো, তাহলে এই পৃথিবী হয়ে উঠতে পারতো স্বর্গীয় উদ্যানে। কিন্তু লোভ, স্বার্থপরতাকে মানুষ প্রশমন করতে পারেনি। যে কারণে হত্যা ও ধ্বংসলীলার কারণে এই পৃথিবী কখনো সুস্থ ও সবল হয়ে উঠতে পারছে না। প্রাচীনকালে কিংবা মধ্যযুগে যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল দখলদারিত্বের মধ্যে। মানুষকে দাসত্বের শৃ´খলে বন্দি রাখা এবং সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে ভোগদখল করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আধুনিককালে যুদ্ধ হলেও তা ছিল পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ছিন্ন হওয়ার সংগ্রাম এবং নানা স্বার্থের টানাপড়েনে সাময়িকভাবে যুদ্ধে বা সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। এতে অবশ্য জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু কোনো দেশ দখলের ঘটনা ঘটেনি। এসব যুদ্ধ ও সংঘাত সম্ভব হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের বন্ধন শিথিল থাকায়। কেননা, এমনটি হতে পেরেছে কোনো নিয়ম-নীতির বালাই ছিল না বলে। যুদ্ধবাজ হিটলার, মুসোলিনির জবরদস্তিমূলক শাসনের অবসানের পর পৃথিবীর মানুষের মনে ফিরে আসে শান্তি। যুদ্ধ, মৃত্যু, ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শান্তিকামী দেশগুলো একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ অনুভব করতে থাকে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে আন্তর্জাতিক আইনের সীমারেখা দৃঢ় হওয়ায় দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষত ছোট ছোট দেশগুলোও সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করছে। বিশ্বের শান্তিকামী সার্বভৌম দেশগুলো নিরাপত্তার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে গঠিত হয় ‘জাতিসংঘ’। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, জাতিতে জাতিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সমস্যা সমাধান এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি নিবেদিত থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার যে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ছায়াতলে আশ্রয় খুঁজে পায় প্রতিটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
অবশ্য জাতিসংঘের হালকা নীল ও সাদা পতাকাতলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সমবেত হলেও যুদ্ধ ও সংঘাতের অবসান হয়নি। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সোভিয়েত ও মার্কিন বলয়ের ঠা-া লড়াই চলতে থাকে। চার দশকের ঠা-া লড়াইয়ে উত্তাপ-উত্তেজনা, øায়ুযুদ্ধ ও রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় যুদ্ধ-উত্তরকালে দুই কোরিয়ার যুদ্ধ, ১৯৫৬ সালে দুই র্ভিয়েতনামের যুদ্ধ, ১৯৫৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করায় মিসরের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নির্লজ্জ সমর্থন, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৩ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭৫ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধ, একই বছর অ্যাঙ্গোলায় গৃহযুদ্ধ, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ, ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ১৯৮২ সালে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ, ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখল, ১৯৯২ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় যুদ্ধ প্রভৃতি ছিল মূলত দুই পরাশক্তির ইন্ধনে আধিপত্য বিস্তার, জবরদখল, গৃহযুদ্ধ, সীমান্ত বিরোধ, গণহত্যা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতিগত সংঘাতকে কেন্দ্র করে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবন ঝরেছে। বিনাশ হয়েছে মূল্যবান সম্পত্তির। এর মধ্যে আরব ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জঠর থেকে সৃষ্টি হয়েছে ‘ইসরাইল’ নামক অবৈধ রাষ্ট্রের। ইসরাইলের আরব ভূখ- দখল, চীনের ভারতের লাদাখ অঞ্চল দখল ছাড়া ভূখ- জবরদখলের আর কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এমনটি সম্ভব হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য। এর মধ্যে শুধু আফগানিস্তানে কিছুটা বিতর্কিত ভূমিকা থাকলেও অধিকাংশ যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, জাতিগত সংঘাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। তারা বরাবরই স্বাধীনতাকামী, শান্তিকামী ও দুর্বল শক্তির পক্ষাবলম্বন করেছে। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সব সময়ই আগ্রাসী, জবরদখলকারী, আধিপত্যবাদী, স্বৈরাচারীদের সপক্ষে। এই দু’পক্ষের মধ্যে একটা øায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ও উত্তেজনা বিরাজ করলেও পরোক্ষভাবে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা বিরাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যা খুশি, তা করতে চাইলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরনের কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। এসব যুদ্ধে নীরব ক্ষত ও স্বার্থের টানাপড়েন রয়ে গেলেও পুরো দেশ দখলের ঘটনা ঘটেনি। ঘটলেও তা ছিল সাময়িক এবং সামান্য কিছু ভূখ-ের মধ্যে সীমিত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে বিশ্বব্যবস্থা। এককেন্দ্রিক পৃথিবীতে এখন একক প্রভু যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র একক সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তার স্বস্তিটুকু হারিয়ে গেছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আগ্রাসন চালিয়ে পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ধমকে এবং অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে যেভাবে ইরাক জবরদখল করে নিয়েছে, তাতে সারা পৃথিবীর মানুষ শুধু স্তম্ভিতই নয়Ñ আতঙ্কিতও হয়ে পড়েছে।
ইসরাইলের স্বার্থ অটুট রাখতে এবং তার জন্য যে বা যারা হুমকি, তাদের ঘায়েল করা, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করা ও তেল সম্পদ ভোগদখলের জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইরাক গ্রাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এটা আধুনিক সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং কলঙ্কজনক তো বটেই। মানুষের জীবন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মূল্যবান; কিন্তু যুদ্ধ, লড়াই, সংঘাতে জীবনহানি এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধের বিরোধী। যুদ্ধের হুঙ্কার পাওয়া গেলেই রাজপথে নেমে আসে শান্তিকামী মানুষ। কিন্তু যুদ্ধবাজদের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। তারা নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে লিপ্ত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। অবশ্য এতে যুদ্ধবাজদের কিছু না হলেও জীবনহানি ঘটে সাধারণ ও নিরীহ নাগরিক এবং দু’মুঠো অন্নের জন্য সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত দরিদ্র সৈনিকদের। যুদ্ধের নৃশংসতা ও বেদনাদায়ক ঘটনাবলী তাই এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না।
তবে আধুনিক যুগে মানুষ সভ্যতার পাঠ নিয়েছে। গণতন্ত্র, মৈত্রী, শান্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসনের প্রতি মানুষ এখন শ্রদ্ধাশীল। যে কোনো বিরোধ পারস্পরিক সমঝোতা কিংবা জাতিসংঘের মাধ্যমে নিরসন করে নিতে পারেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন অখ- অবস্থায় থাকার সময় একটা øায়ুযুদ্ধের চাপ ও তাপ বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করে রাখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর শান্তিকামী মানুষ এই বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলেনÑ যাক, আর যুদ্ধ নয়। পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তির নহবত। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে মানুষ জেনে এসেছে নানা জাতি, ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও গণতন্ত্রের লালনকেন্দ্র হিসেবেÑ যারা বিশ্বকে দিয়েছে বিজ্ঞান ও সভ্যতার আশীর্বাদ। অথচ তাদের নীতি ও নৈতিকতা যখন ভেঙে পড়ে, তখন আর কীভাবে আশাবাদী হওয়া যায়? নানা সমস্যা থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল মুক্ত স্বাধীনতার দেশÑ যা পৃথিবীর জন্য ছিল একটি মডেল। বিভিন্ন সুযোগ, সমৃদ্ধি ও ঝলমলে জীবনধারার টানে বহুজাতিক এই দেশটিতে ছুটে আসে পৃথিবীর নানা প্রান্তের লোক। হ্যামিলনের বংশীবাদকের সুরে সুরে ছুটে আসা এই লোকদের মধ্যে রয়েছে নানা জাতি, ধর্ম ও বংশ পরিচয়ের বিচিত্র ধারার লোক। গণতন্ত্রের শক্তিতে নানা দেশের নানা মানুষকে নিয়ে এক সুতোয় গেঁথেছে বিশ্বের শক্তিমান দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৭৭৬ সালে জন্মের পর থেকে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে এসেছে, তা ছিল তাবৎ পৃথিবীর মানুষের জন্য অভূতপূর্ব। প্রত্যক্ষ ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। হয়তো ভেতরে ভেতরে নানা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, প্রলোভন, কূটকৌশল ও রাজনৈতিক দ্বন্দ¡-সংঘাত চলেছে; কিন্তু সবকিছুর নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায় সরাসরি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত জনগণ। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা পৃথিবীর মানুষের কাছে অসীম আগ্রহ ও কৌতূহলের বিষয়। কিন্তু ২০০০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন মানুষের যাবতীয় আস্থা ও ধারণায় কুঠারাঘাত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে, তা যেন হঠাৎ করে সবার কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত গণতন্ত্রের সত্যিকার পূজারী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে আস্থা, জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসা দিয়ে আমেরিকানদের মন জয় করেন এবং পপুলার ভোটে তার জয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সবাই বুঝতে পারেন ভোটাভুটিতে আল গোরকে হারানো সম্ভব হবে না। নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আল গোরের সাফল্যের বার্তা আসতে থাকে। কিন্তু অস্ত্র ও তেল ব্যবসায়ী ইহুদি লবি তখন অন্য হিসাব কষতে থাকে। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে জুনিয়র জর্জ বুশের জয়ের জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। শেষ খেলাটা দেখান ফ্লোরিডার গভর্নর জর্জ বুশের অনুজ জেব বুশ। ভোট কারচুপির মাধ্যমে এমন একটা ধোঁয়াটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের। সেই আদালতের বিচারক ছিলেন কারা? তাদের নিয়োগদাতা ছিলেন জুনিয়র জর্জ বুশের পিতা সিনিয়র বুশ। আইন, বিচার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মুখে কালিমা লেপন করে তারা পক্ষপাতমূলক ও নির্লজ্জের মতো জুনিয়র জর্জ বুশের পক্ষে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে রায় দেন। এমন একটা লজ্জাজনক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেঁপে উঠলেও কেঁপে ওঠেনি আমেরিকান জনগণ। যারা সামান্য কোনো ঘটনায় বিস্ফোরিত হয়ে ওঠেন, তারা কেন জানি সবকিছু নীরবে মেনে নেন। পরবর্তীতেও এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। মনে হয় সেদিনই শেষ হয়ে যায় মানুষের বোধ, বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা, গণতন্ত্র, মৈত্রী, শান্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়-নীতি। এরই ধারাবাহিকতায় কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছে, আজ অবধি তা নির্ণয় করা না গেলেও তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের যে রণহুংকার ও তা-বÑ তাতে এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার নামে যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজেই সন্ত্রাসবাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে হিংসা ও সহিংসতার মাধ্যমে। আফগানিস্তান, ইরাকে আগ্রাসন, দেশে দেশে ‘লাদেন’ ফোবিয়ার নামে উন্মাদনার সৃষ্টি এবং একের পর এক মানব জাতি, মানবতা ও মানব সভ্যতাবিরোধী নতুন নতুন টার্গেট নির্ধারণ করার ঘোষণা করে চলেছে। পৃথিবীকে তারা কোথায় নিতে চায়- একমাত্র তারা ছাড়া আর কেউ তা জানে না।
এতো কিছু বলার উদ্দেশ্য, যুক্তরাষ্ট্র যে রণোন্মাদ হয়ে গেছেÑ তার মূলে রয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে জুনিয়র বুশের নির্বাচনী বৈতরণী অতিক্রম। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বকে নিয়ে পুতুল নাচের খেলা। তারা শুধু আগ্রাসন, জবরদখল ও আÍসাতের খেলায় মেতে ওঠেনি, পাশাপাশি তারা মেতে উঠেছে সভ্যতা বিধ্বংসী খেলায়। ইরাককে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়ার পাশাপাশি এখন তারা সভ্যতার ইতিহাস ও নিদর্শন মুছে দিতে চাচ্ছে। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগে ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক সংস্থা ইরাকের সভ্যতার নিদর্শনগুলো যাতে যুদ্ধের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইরাক দখল করার পর মার্কিন মেরিন সেনাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় লুট হয়েছে ইরাকি জাদুঘর, পাঠাগার, প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ। ভাংচুর, তছনছ ও লুটতরাজ করা হয়েছে ইরাকি সভ্যতার হাজার বছরের নিদর্শন। মানব সভ্যতার সূর্যোদয় ঘটেছিল ইরাকি ভূখ-ে। দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা ব্যাবিলনীয়, সুমেরীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতার অনেক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন পরিকল্পিতভাবে চিরতরে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া থেকে ইরাকের উদ্ভব। সে সঙ্গে মানব সভ্যতার বিকাশ। সমৃদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ইরাককে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার জন্য ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী সুকৌশলে এগিয়ে চলেছে। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ইরাককে একাধিক খ-ে বিভক্ত করার চক্রান্ত করছে। এ জন্য তারা বিবদমান শিয়া-সুন্নি ও কুর্দিদের গোষ্ঠীদ্বন্দ¡কে উসকে দিয়ে আলাদা নামে ইরাককে খ--বিখ- করতে চাচ্ছেÑ যাতে ইরাক নামক দেশটির অস্তিত্ব কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সে সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাতত্ত্বের ধ্বংসসাধন করে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন লুট ও ধ্বংস করে আরব সভ্যতাকে মুছে দিতে চাইছে। এমনিতে বিশ্বব্যাপী ইয়াঙ্কিদের জয়জয়কার। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মেধার ক্ষেত্রে তারা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে। দুনিয়ার সেরা প্রতিভাবান ও মেধাবীদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে নিয়ে গিয়ে তাদের মেধা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার জয়ঢঙ্কা বাজানো হচ্ছে। ফলে প্রাচ্য ও অনগ্রসর দেশগুলোর জ্ঞানের ভা-ার আরো শূন্য হয়ে যাচ্ছে; ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষা-দীক্ষায়, মেধায়-মননে, বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে ও যোগাযোগ ব্যবস্থায়। কিন্তু পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে ইয়াঙ্কি সভ্যতা আরবীয় সভ্যতা, সৌন্দর্যবোধ ও ঐতিহ্যের তুলনায় সমৃদ্ধ নয়। এ কারণে একটি সূক্ষ্ম ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা থেকে আরব সভ্যতার বিনাশে ইয়াঙ্কিরা বেছে নিয়েছে চরম পন্থা। আমরা অতীতে দেখের্ছি, লুটতরাজ চললেও সভ্যতার নিদর্শনগুলো বরাবরই অক্ষত থেকে যায়। এমনকি যুদ্ধ শেষে লুট করে নিয়ে যাওয়া নিদর্শনগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাদপীঠ প্যারিসের চিত্রকলা, ভাস্কর্যসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর যুদ্ধ শেষে আগ্রাসী জার্মানরা তা ফিরিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফিরিয়ে না দেয়া হলে তা যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এবার আমরা ইরাকে কী দেখছি? ইরাকি সভ্যতার নিদর্শনগুলো শুধু লুটতরাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যাবতীয় সভ্যতার নিদর্শন, প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ, দুর্লভ পা-ুলিপিসহ ইরাকি সভ্যতা ও ইতিহাসের যাবতীয় নিদর্শন ভেঙেচুরে মাটির সাথে এমনভাবে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে, যাতে করে তা উদ্ধার করা না যায়। অর্থাৎ ইরাকি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা সুপরিকল্পিতভাবে মহাকাল থেকে চিরতরে মুছে ফেলা হচ্ছে। হালাকু খান ইরাকি সভ্যতার যে চরম সর্বনাশ করেছিল, বুশ-ব্লেয়ার বাহিনী তার শেষটুকু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তারা কি চাইছে ইরাক নামক একটি দেশকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দিতে? যে ইরাকি সভ্যতা মানুষের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, তাকে বিলীন করে দিতে? ইরাকি সভ্যতাকে তাদের কেন এত ভয়? তার কারণ কি এই নয় যে, আমেরিকান আদিবাসী ইন্ডিয়ান ও উপজাতীয়দের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে শিকড়হীন বহিরাগতদের নিয়ে যেভাবে মিথ্যে মিথের ওপর গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র নামক একটি অভিবাসী দেশ, তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য পৃথিবীর সমৃদ্ধ সভ্যতার সব চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে! নতুবা বিশ্ববাসীর অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে মার্কিন মেরিন সেনাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকায় কেন ইরাকি জাদুঘর, গ্রন্থাগার ও প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ লুণ্ঠন ও ধ্বংস করা হয়েছে? কিন্তু চাইলেই কি মুছে ফেলা যায় কোনো সভ্যতা? এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে যে সভ্যতার চিত্রলিপি, তাকে তো কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। হয়তো নিদর্শনগুলো নিশ্চিহ্ন করা যাবে, সাময়িকভাবে ব্যাহত হবে মানুষের অনুসন্ধিৎসা। কিন্তু এ কথা তো সত্যিÑ সভ্যতার ইতিহাস বয়ে চলে বহতা নদীর মতো।
দৈনিক সংবাদ : ৫ জুন ২০০৩
নৌ-দুর্ঘটনা কি ‘বাৎসরিক পার্বণ’?
পয়লা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর আমরা দিনটি উদযাপন করি। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি বাঙালির চিরায়ত উৎসবের দিন। আনন্দের দিন। এই দিনটিকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রতিটি বাঙালির প্রাণে প্রাণে বেজে ওঠে উৎসবের মাদল। কণ্ঠে কণ্ঠে অনুরণিত হয় : ‘মুছে যাক গ্লানি/ঘুচে যাক জরা/অগ্নিøানে সূচি হোক ধরা’। অন্তরে অন্তরে মূর্ত হয়ে ওঠে মঙ্গলাকাক্সক্ষা। নববর্ষ আবাহন ও বর্ষবরণের উৎসবের পাশাপাশি রুদ্র বৈশাখ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে সংগ্রামী ও লড়াকু জীবনের দৃঢ়তা। কেননা, কালবৈশাখীর তা-বে ল-ভ- হয়ে যায় আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা। হঠাৎ দমকা ঝড়ের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নাগরিক ও গ্রামীণ জীবন। প্রকৃতির এই খেয়ালিপনার সামনে আমরা কেন, পৃথিবীর সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশগুলোও অসহায় হয়ে পড়ে। তবে তারা যত দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেÑ আমাদের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। আমাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক অবস্থান তেমন সুদৃঢ় নয়। এ কারণে কালবৈশাখীর হিংস্র ও নৃশংস থাবায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা আমরা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেই। কালবৈশাখীর রুদ্ররূপ, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ষড়ঋতুর এ দেশে প্রকৃতির ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়াটা কখনো কখনো চরম ভোগান্তি নিয়ে আসলেও কখনো-সখনো আশীর্বাদ হয়েও দেখা দেয়। আর এটাই সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের বৈচিত্র্য। যে কারণে কবি আপ্লুত হয়ে লিখতে পারেন : ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি/সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’।
কালবৈশাখীর রুদ্রমূর্তির কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে আমরা রুখতে না পারলেও আমরা যদি সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করি, তাহলে বড় বড় দুর্ঘটনা সহজেই এড়াতে পারি। কিন্তু ঋতুচক্র অনুযায়ী প্রতি বছর নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি অনেকটা বর্ষপঞ্জির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রমত্ত কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে পড়ে লঞ্চডুবির ঘটনা। প্রতি বছর লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ। এবারো অল্প ক’দিন আগে একই দিনে নারায়ণগঞ্জের পাগলার অদূরে বুড়িগঙ্গায় এবং ভৈরব উপজেলার কাছে মেঘনা নদীতে দুটি লঞ্চডুবিতে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিয়েছে প্রায় দু’শর কাছাকাছি লোক। এ ঘটনার পরও লঞ্চ, কার্গো ও ট্রলারডুবি থেমে নেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। আবহাওয়ার যে ধরন-ধারণ, তাতে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পত্রিকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২৬/২৭ বছরে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ শ’র কাছাকাছি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। যে মানুষগুলো প্রাণ হারাচ্ছে, তারাই শুধু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে না, এতিম করে দিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার-পরিজন ও আÍীয়-স্বজনকে। দরিদ্র দেশ হিসেবে আমরা শুধু অসংখ্য মূল্যবান জীবনই হারাচ্ছি না, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদও। এ মৃত্যু কি আমরা এড়াতে পারি না? যে দুর্ঘটনাগুলো প্রতি বর্ষপঞ্জিতে একইভাবে ঘটে চলেছে, তার কাছে কেন আমরা অসহায় আÍসমর্পণ করছি? এ থেকে কি আমাদের শিক্ষণীয় কিছু নেই?
অবশ্য প্রতি বছর দুর্ঘটনার পরপরই গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। এ পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলোর মুখ দেখেনি, আর যেগুলোর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে অধিকাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনা যতটা না প্রকৃতির খেয়ালে ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে মানুষের বেখেয়ালে। অতি অল্পতেই মুনাফার পাহাড় গড়ার আশায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলাচলের অনুপযোগী নৌযান রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবস্থায় চলাচল, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী ও মালামাল বোঝাই, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও সতর্ক সংকেত উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চ চালানো, অদক্ষ মাস্টার, সারেং ও সুকানি দিয়ে লঞ্চ চালানো, লাইফ-জ্যাকেটসহ জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় একদিকে যেমন নৌ-দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে সে অনুপাতে বাড়ছে জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। অথচ যাত্রীবাহী প্রতিটি লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট, রুট পারমিট ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা, লঞ্চের ডিজাইন ও নির্মাণ পদ্ধতির ত্রুটি নির্ণয় এবং যাত্রী নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়াদি লঞ্চ ছাড়ার আগেই পরীক্ষা করার কথা। আর এ জন্য রয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থাসহ নানা বিভাগ। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল করছে হাজার হাজার নৌযান। সঙ্গত কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। মুনাফালোভী নৌ-মালিকদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনোভাবেই হোকÑ অর্থোপার্জন।
আমাদের দেশের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌ-পরিবহন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের যাতায়াতের প্রধান অবলম্বন এটি। বিশেষ করে নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের চলাচলের জন্য সস্তায় ও সহজে এর চেয়ে ভালো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লোক নৌপথে চলাচল করে। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ যাই হোক না কেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকার তাগিদে নৌপথে তাদের চলাচল করতে হয়। বছরের পর বছর নৌ-দুর্ঘটনায় তারা জীবন দিচ্ছে। কিন্তু এর কোনো বিহিত হচ্ছে না। এমনকি জীবনের নিরাপত্তা তো দূরে থাক, মৃত্যুর পরও তাদের পরিবার-পরিজনকে কোনো রকম ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
নৌপথে মানুষের জীবন ঝরা পাতার মতো অকালে ঝরে গেলেও এ নিয়ে তাৎক্ষণিক হৈ-হুল্লোড় হলেও তারপর পরিস্থিতি দ্রুত থিতিয়ে যায়। এবারও উপর্যুপরি নৌ-দুর্ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকার ঝড়ের মৌসুমে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ঝড়ের মৌসুমে বিকেল ও সন্ধ্যার দিকে সাধারণত বেশি ঝড় হয় বলে চৈত্র মাসের ১৫ তারিখ থেকে বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে এ সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবেÑ তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে একটা প্রক্রিয়া অন্তত শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তা ভালো কি মন্দ, সেটা অনুধাবন করার আগেই লঞ্চ মালিকদের সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লঞ্চ চালালে তাদের লোকসান হবে, তাই এ দু’মাস তারা লঞ্চ চালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। লঞ্চ মালিকদের এ সিদ্ধান্তে লঞ্চ যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রীদের এভাবে জিম্মি করাটা কতটা যৌক্তিক, এটা ভেবে দেখা হয়নি। শেষ অবধি লঞ্চ মালিকদের চাপে এবং আলোচনার প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
লঞ্চ মালিকদের নিশ্চয়ই তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্য আছে। কিন্তু তারা কখনো যাত্রীসেবা কিংবা যাত্রীদের মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য খুব বেশি ভাবে বলে প্রতীয়মান হয় না। তারা যেহেতু ব্যবসায়ী, তারা ব্যবসা করবেনÑ এটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যাত্রীদের প্রতি তারা মোটেও সহানুভূতিশীল নন। এ ক্ষেত্রে সব লঞ্চ মালিকই যে একই পথের যাত্রীÑ সেটা বলছি না। কিন্তু অধিকাংশ মালিকই আইনকে ফাঁকি দিয়ে নৌ-চলাচল ব্যবসা করছে। সরকার যখন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার প্রতিবাদে লঞ্চ মালিকরা ধর্মঘট আহ্বান করলেও তাদের সহযোগীরা যে যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, সে ব্যাপারে তাদের কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। অবশ্যই শুধু লঞ্চ মালিকরা যে নিয়ম ভঙ্গ করছেÑ তা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও আইনের কার্যকর প্রয়োগ করছে না বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অভিযোগ করা হয়েছে। যারা সাধারণ যাত্রী, যাদের জীবন হাতে নিয়ে নৌপথে চলাচল করতে হয়, তারা এখন নিজেদের ভাগ্যকে সঁপে দিয়েছেন অদৃষ্টের হাতে। তারা ধরে নিয়েছেন, লঞ্চ দুর্ঘটনা একটি ‘বাৎসরিক পার্বণ’ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এই ‘পার্বণে’ যাত্রীরা জীবন উৎসর্গ করবেন আর লঞ্চ মালিক ও সংশ্লিষ্ট মহল বসে বসে তা উপভোগ করবেন!
দৈনিক বাংলাবাজার : ১১ জুন ২০০৩
শিক্ষা কি কেবল এলিট শ্রেণীর জন্য?
কোনো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায়, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। একদিকে নিুবিত্ত, অন্যদিকে বিত্তশালীরা। অবশ্য কোনো সমাজ ব্যবস্থাই একক কোনো কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে নেই। একটা ব্যবধান সব সময়ই বিরাজমান। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যে তীব্র ফারাক গড়ে উঠছে, তা অবশ্যই আশঙ্কাজনক। যারা গরিব, তারা আরো গরিব হচ্ছে, আর ধনীরা অর্থ-বিত্তে আরো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা অনেকটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব হলেও ভারসাম্যহীনতা ও ব্যবধান ক্রমশ বাড়তে থাকলে সে সমাজ কাঠামো কখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তার অন্যতম কারণ এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। শুরু থেকেই এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গলদ রয়ে গেছে। সময় সময় শিক্ষা কাঠামো বদলেছে। বদলটা হয়েছে উপরি কাঠামোয়। সত্যিকার অর্থে কোনো বদল হয়নি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থাটা প্রধানত সচ্ছল শ্রেণীর আওতাভুক্ত। ব্রিটিশরা এ দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে, তার সুফল পেয়েছে এ দেশে বসবাসরত ব্রিটিশ পরিবারের সন্তান, নবাব পরিবার এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পৃৃক্ত এক শ্রেণীর পরগাছা। দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বিবেচনা করা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে দারুণভাবে অবহেলা দেখানো হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও শিক্ষা-দীক্ষায় খুব বেশি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে মাছিমারা কেরানি গোষ্ঠী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তনের তেমন হাওয়া লাগেনি। বরং ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ককটেল তৈরি হয়ে একটা আজব কিসিমের শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড়িয়েছে। যুগোপযোগী কোনো শিক্ষানীতি না থাকায় বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা ক্রমান¦য়ে পিছিয়ে পড়ছি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আর এ বৈষম্যের অন্যতম কারণ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত তিন ভাগে বিভক্ত : ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম ও মাদ্রাসা শিক্ষা। ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়ালেখা করে বাংলা মিডিয়ামে। তবে এক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের মধ্যেও পার্থক্য বিদ্যমান। নিুবিত্তদের প্রধান অবলম্বন মাদ্রাসা শিক্ষা। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি, ধর্মীয়সহ বিভিন্ন ধরনের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা শ্রেণীগত ব্যবধান ও বৈষম্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরাও অনেক পিছিয়ে আছে। পুরনো ঐতিহ্য ও পশ্চাৎপদ মন-মানসিকতার কারণে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ব্যবধান গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষার খাত খুব বেশি উন্নত নয়। বাংলাদেশের শিক্ষার আনুমানিক হার ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৫২ শতাংশ এবং মহিলা ২৯ শতাংশ। অন্যান্য নিু আয়ের দেশের তুলনায় এ হার খুবই কম। অন্যত্র এই হার ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশে জিএনপির ২ দশমিক ২ শতাংশ ব্যয় হয় শিক্ষা খাতে। গড়পড়তা আয়ের দেশগুলো এ খাতে ব্যয় করে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ আয়ের দেশগুলো শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশ ব্যয় করে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার ৪০ শতাংশ শিশু কখনোই স্কুলে যায় না। যারা যায়, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলের গ-ি অতিক্রম করে। মাত্র ৭ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়। দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেহাল অবস্থা। ছাত্র-ছাত্রীদের বসার মতো পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল নেই। শিক্ষা উপকরণের দারুণ সংকট। ঝড়-বৃষ্টিতে অনেক স্কুলে ক্লাস করা সম্ভব হয় না। বর্ষাকালে তো অনেক স্কুল ডুবে যায়। খেলার মাঠ অল্প কিছু স্কুলে নামকাওয়াস্তে থাকলেও পাঠাগারের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। দেশের প্রায় ৫৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও জেলা শহরের স্কুলগুলোকে বাদ দিলে অধিকাংশের অবস্থাই শোচনীয়। সর্বজনীন ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা এখন অবধি নিশ্চিত করা যায়নি।
শিক্ষার প্রাথমিক ভিতটা গড়ে ওঠে নিচের পর্যায়ে। প্রাথমিক অবস্থা যেখানে মোটেও আশানুরূপ নয়, সেখানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অবস্থা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক হওয়ার কথা নয়। প্রায় ১২ হাজার মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হালও সুবিধাজনক নয়। øাতক পর্যায়ের কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চলতি শিক্ষা বছরে শিক্ষার্থীর অভাবে øাতক ও øাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজগুলোতে প্রায় সোয়া লাখ আসন শূন্য থাকবে। একজন ছাত্র নিয়েও কোনো কোনো কলেজ চলছে। গ্রামাঞ্চলে এ চিত্র বেশি দেখা যায়। শিক্ষা পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে এখন ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৫০টি øাতক (সম্মান) পর্যায়ের কলেজ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ১১৬০টি কলেজ, ১৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৪টি বিআইটি কলেজে। সব মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসনের সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজার। গতবছর ভর্তির যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৮ জন। ৫ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যায়। চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা শূন্য থাকবে ১ লাখ ১৪ হাজার ২৮২টি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও স্থানীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক কারণে নামমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এতে অপচয় হচ্ছে সরকারি অর্থের। সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষার মান দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। জবাবদিহিতার অভাব, বিনিয়োগে ভারসাম্যহীনতা, মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষা খাতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ এর অন্যতম কারণ। যদিও বাৎসরিক জাতীয় বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বেশি দেখানো হয়। এই বাজেট নানাভাগে ভাগ হয়ে যায়। প্রকৃত অর্থে শিক্ষার জন্য তেমন ব্যয় হয় না। কাটছাঁট করার পর যেটুকু বাজেট বরাদ্দ থাকে, তার সিংহভাগই ব্যয় হয় দালান নির্মাণ, শিক্ষকদের বেতন আর বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য।
দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র আবাসিক সংকট বিদ্যমান। পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল নেই। বিছানা পেতে ঘুমানোর জায়গা নেই। ৪ জনের জায়গায় ১৪ জনকে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়। এমনকি কমনরুম ও ডাইনিং রুমে ছাত্র-ছাত্রীরা গাদাগাদি করে থাকে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। ভর্তি হতে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শতকরা ১৫ জন ভর্তি হতে পারে। তাছাড়া রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের প্রভাবে দলীয়মনা ছাত্রদের ভর্তি করতে হয়। ফলে মেধাবী ছাত্রদের ভর্তির সংখ্যা আরো হ্রাস পায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত শহরের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সুযোগ পায়। দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেমন সুযোগ-সুবিধা পায় না। প্রতি বছর টিউশন ও ফি দেয়ার মতো সামর্থ্য অনেক মেধাবী ছাত্রের নেই। অধিকাংশ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ১৯৭৩ লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, বেসরকারি কলেজ, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, কোচিং সেন্টারসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সমান্তরালভাবে কাজ করছেন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২০০ শিক্ষকের মধ্যে ৪২৫ জন বিনানুমতিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও একই রকম। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘স্বায়ত্তশাসনের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন অমান্য করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক সংকট লেগেই আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দিন দিন কমছে। ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করে না। তাদের মধ্যে ‘ফটোকপি কালচার’ গড়ে উঠেছে। শিক্ষকদের মধ্যে উদাসীনতা ও ভোগবাদিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সর্বস্তরে শিক্ষার সমান অধিকারের কথা বলা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট ও বৈষম্য বেড়েই চলেছে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দেয়ার পর শিক্ষা খাতে বৈষম্য নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ব্যয়বহুল ও মূলত এলিটদের জন্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ও ফি কমপক্ষে ৩৫০০ ডলার। যা খুব কম ছাত্রের পক্ষে বহন করা সম্ভব। অবশ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষাবলম্বনকারীদের অভিমত হচ্ছে : প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আগামীতে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। তাছাড়া ১৯৯২ সালে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুযায়ী ৫ শতাংশ দরিদ্র ছাত্র বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়ায় সাধারণত: অপেক্ষাকৃত গরিব ছাত্ররা পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীরা বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে অন্যদের একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছে। এ দেশের মাটির সঙ্গে তাদের তেমন সম্পর্ক নেই। দেশ ও দেশের মানুষ তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। যে কারণে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি নিয়ে তারা ভাবেনও না। তাছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা কারোই যাচাই করার সুযোগ নেই। তাদের কার্যক্রমও স্পষ্ট নয়। এ কারণে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছেন : ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা রাখা প্রয়োজন। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যয় অনেক বেশি। স্বল্পসংখ্যক ধনী পরিবারের সন্তানই এগুলোতে পড়ালেখার সুযোগ পায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখে কেউ যেন না ভাবেÑ এগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছে কেবল কিছুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর কথা মাথায় রেখে, যাদের অভিভাবকরা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল।’
সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও বুদ্ধিভিত্তিক চর্চাটা অপরিহার্য। শিক্ষার আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত মানুষেরা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাই উপলব্ধি করতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা ন্যায়বান সমাজ গঠনের শক্তিশালী মাধ্যম। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সাহায্য ছাড়া নিুবিত্ত ছাত্রদের পক্ষে উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। নিুবিত্ত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মেধাবী ছাত্রদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে সমাজে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা নিয়ে আসতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জনগণ যে ভর্তুকি দেয়, তাতে সমাজের বিদ্যমান অসাম্য দূর হচ্ছে না। এ জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো, বাস্তবধর্মী ফি কাঠামো, উচ্চ শিক্ষার জন্য গরিব ছাত্রদের ঋণ দেয়া, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত তরুণদের বিশেষ ভর্তি কর্মসূচি, সমাজের বাস্তব চাহিদা ও শিক্ষার কারিকুলামের মধ্যে ব্যবধান, পরীক্ষা পাসের হার বাড়ানো এবং পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।
যদিও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘১৫/২০ টাকা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো সম্ভব নয়।’ তবে এটা তো ঠিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিপণন কেন্দ্র নয়। শিক্ষা কেনা-বেচার পণ্যও নয়Ñ এটা জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র। তাছাড়া শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার। শিক্ষা খাতে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া না হলে শিক্ষা চলে যাবে উচ্চবিত্তদের হাতে। সমাজে বৈষম্য বাড়বে। বাড়বে অস্থিরতা। এমনিতেই শহর ও গ্রামের শিক্ষার মান এক নয় এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবধান গড়ে ওঠায় বৈষম্য বাড়ছে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে। বিদ্যমান বৈষম্য দূর করাই যেখানে কঠিন, সেখানে নতুন করে যাতে বৈষম্য সৃষ্টি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোই উত্তম পন্থা।
দৈনিক সংবাদ : ১৫ জুন ২০০৩
আমাদের বদলে যাওয়া
পেছন ফিরে তাকালে অনুধাবন করা যায় বদলে যাচ্ছে আমাদের সমাজ, আমাদের সংসার। রূপান্তর ঘটছে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের। বদলটা মূলত হয়েছে মানচিত্র ও সময়কে কেন্দ্র করে। একাধিকবার বদলেছে এ অঞ্চলের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। সেই ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে বদলেছে কিছু মানুষ। কেউ কেউ ব্রিটিশদের ফাই-ফরমাশ খেটে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন; আবার কেউ কেউ ব্রিটিশদের চুইয়ে পড়া শিক্ষার আলোকে পুঁজি করে বদলে নিয়েছেন নিজেদের ভাগ্য। প্রধানত গ্রামীণ জনপদ হিসেবে আবহমানকাল থেকে চলে আসা এ অঞ্চলের কিছু মানুষের মধ্যে এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় সামাজিক বিভাজন। অবশ্য এর আগেও সামাজিক বিভাজন ছিল। তা ছিল সীমিত পরিসরে। একদিকে ছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ; অন্যদিকে নবাব বা জমিদার গোছের ব্যক্তিরা। নবাব বা জমিদারের সংখ্যা ক’জনই বা ছিল? তবে দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনে উদ্ভব ঘটে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। পরবর্তীকালে এরাই হয়ে উঠেন এ অঞ্চলের ভাগ্য বিধাতা।
১৯৪৭ সালের দেশভাগে সবচেয়ে বড় সুবিধাবাদী হয়ে ওঠে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। যদিও পাকিস্তানিরা বিভীষণ হয়ে দেখা দেয়, কিন্তু ব্রিটিশের অনুগ্রহভোগীরা ঠিকই তাদের অবস্থান আগের মতোই পাকাপোক্ত করে নেয়। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-নির্যাতনে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও ধর্মের নামে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী শ্রেণী তাদের ‘তৃণভোজী’ হয়ে ওঠে। এছাড়া ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি শাসকরা কিছুটা ছাড় দিলে অল্প কিছু মানুষ এগিয়ে আসে শিক্ষা-দীক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে। শিক্ষকতা, ওকালতি, চিকিৎসা, কেরানিগিরিসহ বিভিন্ন পেশায় অনেকেই এগিয়ে আসে। ফলে সমাজে একটা পালাবদল অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সুদূর আবহমানকাল থেকে এ দেশের মানুষ জীবনধারণ করে এসেছে কৃষিকাজ করে। হাজার বছর ধরে একই রকমভাবে চলে আসা জীবনযাত্রা আস্তে-ধীরে বদলে যেতে থাকে। ক্রমাগত শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনায় আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বাধিকার চেতনাবোধ তীব্র ও তীক্ষè হয়ে ওঠায় পরিবর্তনের হাওয়াটা জোরালো হয়ে ুওঠে। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে নতুন একটি শ্রেণী। যদিও খুব বেশি জৌলুস ছিল না, তারপরও পরিবর্তনটা টের পাওয়া যাচ্ছিল। যারা শিক্ষার পাঠ নিয়েছেন, তারা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের আশায় ছুটতে থাকেন ঢাকায়। ঢাকা শহরও তাদের আপন করে নেয়। শুরুতে গ্রামের বন্ধন কাটিয়ে এক/দু’জন করে শহরমুখো হতে থাকেন। বন্ধন কাটলেও নাড়ি কিন্তু পোঁতা থাকে গ্রামে। গ্রামের সঙ্গে বন্ধনটা কখনোই ছিন্ন হয়নি। ঢাকা শহরে জীবিকা জুটিয়ে নিলেও পরিবার-পরিজন, আÍীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব থাকে গ্রামে। চাকরির ছুটি-ছাটায় গ্রামে ফিরে যাওয়াটা হয়ে ওঠে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। হাজার বছর ধরে চলে আসা যে গ্রামীণ জনপদ, তার যে জীবনধারা, তার সঙ্গে যে নিবিড় সম্পর্ক, তা সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। টিনের, ছনের বা মাটির ঘরে বসবাস, ঢেঁকিতে চাল ভাঙ্গানো, মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া, মাটির হাঁড়িতে ভাত রাঁধা, নিজের হাতে গরু-ছাগলের দুধ দোয়ানো, নদী-পুকুর-খালে মাছ ধরা, যখন-তখন মুড়ি-মুড়কি-গুড়-পিঠা খাওয়া, আঁতুর ঘরে দাইয়ের হাতে সন্তান জন্ম, পিঁড়িতে বা মাদুরে বসে ভাত খাওয়া, তাল পাতার পাখায় বাতাস খাওয়া, হেঁটে বা নৌকায় কিংবা লঞ্চে যাতায়াত, পালকিতে চড়ে বিয়ে করা, রুমাল-চাদর-বালিশে সুতো দিয়ে মেয়েলি হাতের সূক্ষ্ম কারুকাজ, ফুল-পাখি আঁকা কিংবা গভীর ভালোবাসা নিয়ে লেখা ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’, সরিষার তেল সারা শরীরে মেখে পুকুরে বা নদীতে গোসল করা, অবসরে পুঁথি পাঠ বা পল্লীগীতি শোনা, ছেলেরা লুঙ্গি, গেঞ্জি, ধুতি, পাজামা-পাঞ্জাবি; মেয়েরা শাড়ি পরিধান করা, শীতকালে নানা পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম লাগা, বিশেষ করে চুলার পাশে বসে ভাপা পিঠা খাওয়া, অসুখে-বিসুখে বিভিন্ন ঔষধি গাছ বা ফল ব্যবহার করা ইত্যাদি ছিল গ্রামীণ জীবনের চিরকালের অনুষঙ্গ। এই গ-ি থেকে বেরিয়ে আসতে নাগরিক মধ্যবিত্তের বেশ সময় লেগেছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর আমূল বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশ। সৃষ্টি হতে থাকে শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত। হঠাৎ করে পাওয়া স্বাধীনতায় চাকরি, ব্যবসাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করার জন্য গ্রাম থেকে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসতে থাকে শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত ব্যক্তিরা। গ্রামের বন্ধন ছিন্ন করে শহরে গড়ে উঠতে থাকে মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্তকে কেন্দ্র করে নতুন একটা ধারা গড়ে উঠতে থাকে। একদিকে গ্রামের ফেলে আসা জীবনের প্রতি মোহ, অপরদিকে নাগরিক জীবনের আকর্ষণÑ এই দোটানার মাঝে এগিয়ে যেতে থাকে উঠতি মধ্যবিত্ত। ইট-পাথর-সিমেন্টের বাসা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের ব্যবহার, বাসে-ট্রেনে চলাচল, ছেলেরা শার্ট-প্যান্ট, মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ, ঢাউস খোঁপা, চোখে কাজল, সস্তা প্রসাধনী ব্যবহার, রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে বিনোদনের খোরাক মেটানো, সিনেমা দেখতে যাওয়া, রোমান্টিক বাংলা গানে বিভোর হওয়া, চিড়িয়াখানায় যাওয়া, আÍীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়া, সঙ্গে নাবিস্কো বিস্কুট কিংবা গোলপাতায় করে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া, মেহমান এলে সাধ্যমত আপ্যায়ন করা, গানে-কবিতায় মেতে থাকা, ছবি আঁকা, পাড়ায় পাড়ায় নাটক করা, বিকেল বেলায় ছেলেমেয়েদের খেলাধুলায় মেতে থাকা, মার্বেল, সিগারেট প্যাকেট, ডাংগুলি খেলার পাশাপাশি ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ছিল বাধ্যতামূলক। সন্তান প্রসবে নার্স-ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। আস্তে-ধীরে বদলে যেতে থাকে জীবনযাপনের স্টাইল। সবকিছু মিলিয়ে গ্রামের সহজ-সরল জীবনের ছাপ তবুও থেকে যায় নাগরিক জীবনে।
তবে আশির দশক থেকে গ্রামের সঙ্গে গড়ে ওঠা শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের সম্পর্কের বন্ধন ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় বদলে যেতে থাকে গ্রামীণ জীবন। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমের বাজার খুলে যাওয়ায় সরাসরি গ্রাম থেকে ছুটতে থাকে অনেক মানুষ। তাদের পাঠানো টাকা-পয়সায় কিছু কিছু গ্রামের ছুরত পাল্টে যেতে থাকে। পক্ষান্তরে ঢাকা শহরের ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। হঠাৎ করে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায়। সাধারণ চাকরিজীবীর যে বৃত্ত, তা ভেঙ্গে নতুন নতুন কর্মজীবীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে। মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, কোটিপতি, ব্যবসায়ী, টাউট-বাটপারের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। যে কখনো যা ভাবেনি, স্বাধীনতার সুবাদে তাই পেয়ে যাওয়ায় সমাজে দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটে যায়। সে সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানির নানারকম প্রলোভন বদলে দিতে থাকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রা। এমনকি, বদলে যেতে থাকে নাম পর্যন্ত। রহিমুদ্দিন-করিমুদ্দিনের পরিবর্তে আধুনিক নামের বাহার লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা-দীক্ষা, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, মূল্যবোধের পাশাপাশি ঘটে যায় সামাজিক বিবর্তন। একই সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় অবক্ষয় ও অধঃপতনের ধারা। রক্ষণশীলতার ব্যুহে আঘাত হানলেও মন-মানসিকতার দিক দিয়ে মধ্যবিত্তের পক্ষে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। যে কারণে পোশাক-আশাকে রূপান্তর ঘটলেও পশ্চাৎপদ মানসিকতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি। রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন সমাজ কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে নীতি-নৈতিকতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল, তা ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করাটা জটিল হয়ে পড়ে। অসৎ, মাস্তান, টাউট, ধান্দাবাজরা রাজনৈতিক অঙ্গনে জেঁকে বসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি হঠকারী, নিু মন-মানসিকতাসম্পন্ন, মেধাহীনদের দখলে চলে যায়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! যে কারণে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয়, নৈরাজ্য ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার মনোবৃত্তি তার নেই। সবাই এখন আÍকেন্দ্রিক, স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। কত সহজে অর্থ উপার্জন করা যায় এবং কীভাবে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে ওঠা যায়, সে চিন্তায় মশগুল। স্বার্থসিদ্ধির জন্য হেন কোনো পথ নেই, যা অবলম্বন করা হচ্ছে না। বোধ, বুদ্ধি, বিবেক ও বিবেচনা সর্বাংশে লোপ পেতে চলেছে। বিদেশি অনুদানের পাশাপাশি সরকারি সম্পত্তি লোপাট, ঘুষ, চোরাচালানিসহ যাবতীয় দুই নম্বরী পথ বেছে নিয়ে হঠাৎ করে কিছু লোক রমরমা হয়ে উঠেছে। হরদম বিদেশ যাচ্ছে। দািী হোটেলে খাচ্ছে। দেদারসে টাকা ওড়াচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশ বিত্তবান হয়ে ওঠায় সমাজে নতুন একটি শ্রেণীর জন্ম নিয়েছে। এই শ্রেণীর আয় এবং ব্যয়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। নানারকম রহস্যজনক কাজ-কারবারের পাশাপাশি নতুন একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়া। ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত হলেও সমাজের চাবিকাঠি তাদের কাছে। এ কারণে নব্বই দশকে পরিবর্তনের একটি জোয়ার আসে। রঙিন টেলিভিশন, ভিসিআর, ডিশ অ্যান্টেনা, এসি, জেনারেটর, ইউপিএস, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, বাথটাব, দামি দামি অ্যাপার্টমেন্ট, মোবাইল, লেটেস্ট মডেলের পাজেরো, বিদেশি ফ্যাশনেবল ড্রেস, মেক-আপ, সিডি, ব্যান্ড সঙ্গীত, ফ্যাশন শো, বিউটি পার্লার, ম্যাসেজ পার্লার, সুপার মার্কেট, ওয়ান স্টপ মল, কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে, জন্মদিন পার্টি, স্যান্ডউইচ, বার্গার, স্যুপ, চাইনিজ, কোকাকোলা, আইসক্রিম খাওয়া, ঘন ঘন বিদেশ সফরসহ ইউরোপ-আমেরিকার সর্বশেষ ফ্যাশন ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সঙ্গতি অনেকেই অর্জন করেছেন। যে কোনো কিছুই এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। হেরোইন, নেশার দামি ট্যাবলেট, আল্টা মডার্ন নারী চোখের পলকেই হাতের মুঠোয় এসে যায়।
একবিংশ শতাব্দী বিশ্বায়ন ও হাই-টেকের যুগ। সবকিছু এখন অবাধ হতে চলেছে। ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে সারা দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সব বিধি-বিধান পরিচালিত করবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। এ সংস্থার একক ও আধিপত্যবাদী বিধি-বিধানের ফলে দুনিয়াব্যাপী বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। উন্নত বিশ্ব আর উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং ধনী আর দরিদ্রের মাঝে সৃষ্টি হবে তীব্র বৈষম্য। একই সময় প্রবর্তিত পেটেন্ট রাইটসের নামে নিঃস্ব হয়ে যাবে এ দেশের কৃষক-শ্রমিক। এমনিতেই সমাজে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সৃষ্টি হলেও কৃষক ও শ্রমিকদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। খেয়ে-না খেয়ে তারা চালিয়ে যাচ্ছে জীবন-সংগ্রাম। পেটেন্ট রাইটসের কারণে আমাদের দেশের হাজার বছরের কৃষক সম্প্রদায় দ্বারা আবিষ্কৃত ও লালিত বীজ, গাছ ও প্রাণ সম্পদকে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে তুলে দেয়া হবে। বিপন্ন হয়ে পড়বে তাদের জীবন ও জীবিকা। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার খপ্পরে পাল্টে যাবে পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান। পাল্টে যাবে আমাদের মূল্যবোধ ও জীবনযাপনের পদ্ধতি। আমাদের প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতি নতুনভাবে বিন্যস্ত হওয়ায় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। আমাদের সমাজের গরিষ্ঠ অংশ এ পরিবর্তন সম্পর্কে কিছুই জানে না। একটা অপ্রস্তুত অবস্থায় তাদের এই পালাবদলের মুখোমুখি হতে হবে। এমনিতেই আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা ভঙ্গুর, তার ওপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় আমাদের অবস্থা কী দাঁড়ায়Ñ তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
দৈনিক ভোরের কাগজ : ২৩ জুন ২০০৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন