‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ
এদেশের ফুটবলের আছে সোনালী এক ইতিহাস। সেই ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত ফুটবলে জন্ম নিয়েছে অনেক রত্মখচিত তারকা ফুটবলার। সেই ফুটবলারদের অনেকেই হারিয়ে যেতে বসেছেন কালের মরীচিকায়। অবশ্য বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে আমরা আমাদের ইতিহাসের নায়কদের ভুলতে বসেছি। অথচ একটা সময় তাদের কীর্তির ছটায় উদ্ভাসিত হয়েছে দেশ ও দেশের মানুষ। সাতচল্লিশের দেশভাগ আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক দেশটির অভ্যুদয় ঘটলেও ফুটবলের ইতিহাসটা যেন বিনি সুতোয় গাঁথা মালা হয়ে আছে। সেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় ষাট দশক। আর এ দশকের এক ব্যতিক্রমী নায়ক বলাই দে।
বলাই দে এখন বাংলাদেশের ফুটবলের এক হারিয়ে যাওয়া নাম। অথচ যাদের ক্রীড়াশৈলীতে এ অঞ্চলের ফুটবল আলোকিত হয়েছে, তিনি তাদের একজন। অবশ্য টপ ফর্মে থাকাবস্থায় ভারতে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশে তিনি হয়ে গেছেন পরদেশী। ফুটবলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার আধিপত্য থাকলেও পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে বাঙালি ফুটবলারদের সুযোগ পাওয়াটা ছিল সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ঘটনা। আর সেই ‘সোনার হরিণ’-এর নাগাল যারা নিজেদের ব্যক্তিগত ক্রীড়াশৈলী ও ক্যারিশমা দিয়ে আদায় করে নিতে পেরেছেন, তাদের অন্যতম হলেন বলাই দে। শুধু তাই নয়, বলাই দে একমাত্র বাঙালি ফুটবলার, যিনি পাকিস্তান ও ভারত- উভয় জাতীয় দলে খেলার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। উপমহাদেশের ফুটবলের বর্ণাঢ্য এই ব্যক্তিত্বের খেলোয়াড়ী জীবনটাও আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময়।
২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর কলকাতা গিয়ে বলাই দে’কে খুঁজে বের করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কলকাতা ফুটবলে তিনি একটি পরিচিত নাম। সে সময় তিনি কর্মরত ছিলেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়। টেলিফোনে যোগাযোগ করে ব্যাংকের সদর দফতরে গিয়ে উপস্থিত হই খ্যাতিমান সাঁতারু অরুণ নন্দী ও পশ্চিম বাংলার বরেণ্য ক্রীড়া সাংবাদিক পবিত্র দাসকে সঙ্গে নিয়ে। ব্যাংকের নবম তলায় ছিল তার অফিস। চমৎকার পরিবেশ। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে চিরায়ত গঙ্গা নদী। বহুতল ভবনের জানালা দিয়ে তাকালে মনটা ফ্রেশ হয়ে যায়। নদী ও নদীর দু’কূল ঘেঁষে গড়ে উঠা ইতিহাসের নানা উপাদান। অফিসে বলাই দে যে অত্যন্ত জনপ্রিয়- তা বুঝতে সময় লাগলো না। সহযোগী সবাই তার সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। ব্যাংকের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তারা সবাই ছুটে এলেন। তুলে ধরেন বলাই দে’র নানা কীর্তির কথা। এমন একজন সহকর্মী পেয়ে তারাও গর্বিত।
বলাই দে’র জন্ম ১৯৪৬ সালের ১১ অক্টোবর গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার গুয়াখোলা গ্রামে। বাবার চাকরিসূত্রে খুব অল্প বয়সেই খুলনায় বসবাস ও সেখানেই পড়ালেখা। ফুটবলে পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করাটা সহজ ছিল না। বড় সংসার। ৫ ভাই ও ৫ বোন। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন। এ কারণে শুধু খেলাধুলায় মেতে থাকার সুযোগ ছিল না। খেলাধুলায় বাধা না দিলেও বাবা চাইতেন ছেলে পড়ালেখা মনোযোগ দিয়ে করুক। প্রথমে খুলনা সত্যনারায়ণ স্কুল এবং পরবর্তীকালে সেন্ট যোসেফ হাইস্কুলে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক অব্দি লেখাপড়া করেন। সে সময় ফুটবলে তার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। গোলরক্ষক হিসেবে তিনি আলাদা অবস্থান গড়ে তোলেন। অবশ্য তার শুরুটা কিন্তু লেফট আউট হিসেবে। ১৯৫৭ কি ১৯৫৮ সালের কথা। একটি মজার ঘটনায় বদলে যায় তার পজিশন। তার যমজ ভাই কানাই খেলতেন গোলে। খুলনা স্পোর্টিং কাবের একটি ম্যাচ গোলরক্ষক সংকট দেখা দিলে কানাই মনে করে তার পরিবর্তে বলাইকে গোলপোস্টে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। কানাই হিসেবে খেলে যান তিনি। আসলে ভাগ্যে লেখা ছিল গোলরক্ষক হওয়া। বিধির লিখন খন্ডাবে কে?
১৯৬১ সালের আরেকটি ঘটনা তাকে পুরোপুরিভাবে বানিয়ে দেয় গোলরক্ষক। খুলনার দুই জনপ্রিয় কাব টাউন কাব এবং খুলনা হিরোজের মধ্যে মর্যাদার এক লড়াই। খেলার আগে খুলনা হিরোজের গোলকিপার হাতে আঘাত পেলে তার পক্ষে খেলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাব কর্তৃপক্ষ পাশের মাঠ থেকে খুলনা ফ্রেন্ডসের গোলকিপার বলাইকে তুলে আনেন। খুলনা স্টেডিয়ামে জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। বলাইয়ের বয়স তখন মাত্র ১৫। সে ম্যাচে অসাধারণ খেলেন তিনি। দুর্দান্ত কিছু সেভ করেন। এরপর গোলকিপার হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। এ খেলা দিয়েই সে বছর খুলনা জেলার হয়ে খুলনা ডিভিশনে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। তখন খুলনা, যশোর, রাজশাহী ও বরিশাল জেলাকে নিয়ে ছিল খুলনা ডিভিশন। এরপর খুলনা প্রথম বিভাগ লীগে তার চমকপ্রদ ক্রীড়ানৈপুণ্য ফুটবলানুরাগীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ১৯৬১ সালে খুলনা হিরোজ, ১৯৬২ সালে মুসলিম কাব এবং ১৯৬৩ সালে টাউন কাবে খেলেন। ১৯৬৩ সালে ডিভিশনাল ফুটবলে অসাধারণ গোলকিপিং করে আলোচনায় উঠে আসেন। তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে ঢাকা মোহামেডানের দুই তারকা ফুটবলার কবীর ও গজনবী তাকে ঢাকায় নিয়ে যান। ঢাকা মোহামেডান হয়ে উঠে তার ঠিকানা। মোহামেডানের হয়ে খেলতে নেমে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে হয়ে উঠেন দেশসেরা গোলকিপার। ১৯৬৩ সালের লীগে প্রকৃত অর্থে বুক দিয়ে আগলে রাখেন মোহামেডানের রক্ষণভাগ। সে বছর মোহামেডানের লীগ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি। বলাই দে ছাড়াও সে বছর আবিদ হোসেনের নেতৃত্বে মোহামেডানে খেলেন দেবিনাশ সাংমা, জাকারিয়া পিন্টু, রসুল বক্স, কাউয়ুম আল চেঙ্গিজি, মুসা, জহিরুল হক, প্রতাপ শংকর হাজরা, রহমতউল্লাহ, বশির আহমেদ প্রমুখ। মোহামেডানের হয়ে খেলেন করাচী, লাহোর, পেশোয়ার ও মুলতানে। সুযোগ পেয়েছিলেন জাতীয় দলের ট্রায়ালে। ১৯৬৪ সালেও মোহামেডানের হয়ে দুর্দান্ত খেলা প্রদর্শন করেন। তার অতুলনীয় ফুটবলশৈলীতে আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। বার্মা, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকার বিপক্ষে তিনি স্মরণীয় নৈপুণ্য দেখান। আর এই পারফরম্যান্স দিয়ে তিনি পাকিস্তান জাতীয় দলে স্থান করে নেন।
মাকরানীদের অধিপত্যের মাঝেও ১৯৬৪ সালে চীনের প্রজাতন্ত্র দিবস ফুটবলে খেলতে যান পাকিস্তান দলের হয়ে। এ দল গঠনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের নিয়ে ঢাকা, পেশোয়ার ও লাহোরে ট্রেনিং ক্যাম্প হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পান বলাই দে ও জহুরুল হক। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের বাকু ইলেভেন পাকিস্তান সফরে আসে। এ দলটি চট্টগ্রাম, ঢাকা, করাচী ও লাহোরে ম্যাচ খেলে। পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন বলাই দে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার এ ফুটবলার দুর্ধর্ষ নৈপুণ্য দেখিয়ে সবাইকে মাত করে দেন। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ করে নেন। কিন্তু পারিবারিক বাধার কারণে সেই সফরে তার যাওয়া হয়নি।
১৯৬৫ সালের ৩ জানুয়ারি চলে যান ভারতের কলকাতায়। থিতু হন হাওড়ার লিলুয়ায়। এ প্রসঙ্গে ১৯৮২ সালে কলকাতার ‘খেলার কাগজ’ পত্রিকায় ‘পদ্মা থেকে গঙ্গা’ শিরোনামে জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র লিখেছেন : ‘খুলনা থেকে পাকিস্তানের পাসপোর্ট হাতে একটি বাঙালি হিন্দু ছেলে কলকাতার মাটি ছুঁয়েছিল। উদ্দেশ্য, কয়েক দিন আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে কলকাতা বেড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনটা কম-বেশি একটা নাটক। সেই নাটকই ছেলেটির কয়েকদিন কলকাতায় থাকার সুযোগে ওর জীবনের গতিপথটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। ছেলেটির পরিচয় কিন্তু নেহাত সাদামাটা ছিল না। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের গোলকিপারের জার্সিটা তখন বেশ পাকাপোক্তভাবে ছেলেটির দখলে। অতএব, কলকাতায় ছেলেটির উপস্থিতি খুব স্বাভাবিকভাবেই ফুটবল মহলে কয়েকদিনের মধ্যেই বিজ্ঞাপিত হলো। ছেলেটির কাছে প্রথম আমন্ত্রণ এল বিএন রেলওয়ে থেকে। কিন্তু ফিফার আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র অনুমোদনের ব্যাপারে একটু বেশি গা ঘামালো ইস্টবেঙ্গল কাব আর বেশিভাবে বরং জ্যোতিষ গুহ। ছেলেটি আবার ফিরে চলল কলকাতা থেকে খুলনায়। এবারের উদ্দেশ্য জন্মভূমিকে, শৈশব, কৈশোর, যৌবনের ক্রীড়াভূমিকে, জীবনের প্রথম প্রতিষ্ঠার পবিত্র ভূমিকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো। যাওয়ার সময় সামনে ছিল পরিচিত জায়গায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ফিরে আসার সময় সামনে অজানা ভবিষ্যতের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। পরিচিত পরিবেশ, স্বীকৃত প্রতিষ্ঠাকে পেছনে ফেলে অজানা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নেমে পড়া। ছেলেটি তাই যখন খুলনায় ফিরে এসে ঘোষণা করল, আমি কলকাতায় যাচ্ছি, তখন ওর বন্ধু-বান্ধবরা, ওর শুভ্যানুধায়ীরা প্রত্যেকেই ওর এই সিদ্ধান্তে নেতিবাচক মতামত দিলো। প্রত্যেকেই বললো, তুমি রাশিয়া সফরে পাকিস্তান ফুটবল দলে চান্স পেয়েছ। তুমি এখানে জাতীয় দলে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। আর এখন তুমি কলকাতায় যেতে চাইছ! কলকাতায় গেলে তোমাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে। কোটি কোটি লোকের কলকাতায় তুমি হয়তো হারিয়েই যাবে। তুমি যেও না। এমন পাগলামি করো না। কিন্তু স্বাস্থ্যবান, টগবগে ছেলেটির নিজের ওপর অগাধ আস্থা। এত সদুপদেশেও ছেলেটি দমলো না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো- সুযোগ যখন পাচ্ছি কলকাতায় আমাকে খেলতেই হবে। আর আমার যোগ্যতা নিয়ে খেলেই প্রমাণ করব কোটির মধ্যেও বলাই দে একজন। হ্যাঁ, ঐ ছেলেটাই হচ্ছে দুটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা একমাত্র বাঙালি ফুটবলার বলাই দে। একদিন তাই খুলনাকে বিদায় জানিয়ে জীবনের প্রথম অধ্যায়কে পেছনে ফেলে রেখে পদ্মা পারের ছেলে বলাই দে এসে দাঁড়ালেন গঙ্গার পাড়ে কলকাতায়।’
তবে পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় হওয়ায় আগে থেকেই তার সুখ্যাতি ছিল ভারতের ফুটবলানুরাগীদের কাছে। সে সুবাদে তাকে লুফে নেয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ফুটবল দল ইস্টবেঙ্গল। তখন ইস্টবেঙ্গলের গোলরক্ষক ভারতবিখ্যাত পিটার থঙ্গরাজ। যার ছবি বলাই দে’র বুকের অ্যালবামে সযতনে সাজানো। তার সান্নিধ্য পাওয়াটাই বলাই দে’র জন্য রোমাঞ্চকর। সেই থঙ্গরাজের ছায়ায় ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে ইস্টবেঙ্গলে মেঘে ঢাকা রোদ হয়ে থাকার পর ১৯৬৭ সালে যোগ দেন এরিয়ান্স কাবে। নিজেকে মেলে ধরার জন্য দল পরিবর্তনটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বলাই দে’কে। এবছর তিনি বেঙ্গল টিমের হয়ে খেলেন সন্তোষ ট্রফিতে। সুযোগ পান ভারতীয় জাতীয় দলের ট্রায়ালে। খেলার মাঠের নায়ক হলেও জীবনের মাঠে তখনও শক্ত ভিত খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পাবার জন্য চাকরির জন্য হন্য হয়ে উঠেন। কিন্তু কোথাও তরী ভিড়াতে পারছিলেন না। বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে ১৯৬৮ সালে যোগ দেন মোহনবাগান দলে। এর পরপরই চাকরি হয়ে যায় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়। ফিরে পান নতুন আত্মবিশ্বাস। পাকিস্তান জাতীয় দলের পর ১৯৬৯ সালে ভারতের জাতীয় দলে খেলার গৌরব অর্জন করেন। মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ ফুটবল এবং সিঙ্গাপুর ফ্রেন্ডশিপ টুর্নামেন্টে তিনি অংশ নেন। মারদেকায় তিনি ‘ইন্ডিয়ান রক’ হিসেবে উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে ইরানে ফ্রেন্ডশিপ টুর্নামেন্টে খেলেন। চার বছর মোহনবাগানে খেলার পর ১৯৭২ সালে পুনরায় যোগ দেন ইস্টবেঙ্গলে। দু’বছর চুটিয়ে খেলার পর ১৯৭৪ সালে একটি ম্যাচ খেলে ফুটবল থেকে অবসর নেন। এরমধ্যে ১৯৬৬, ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে ইস্টবেঙ্গল এবং ১৯৬৯ সালে মোহনবাগান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। কলকাতা লীগে তিনি পরিচিতি পান ‘ইন্ডিয়ান রাবার’ হিসেবে। এছাড়া তার চমকপ্রদ নৈপুণ্যে মোহনবাগান ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১ সালে রোভার্স কাপ, ১৯৬৯ সালে আইএফএ শীল্ড এবং ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৭২, ১৯৭৩ সালে আইএফএ শীল্ড, ১৯৬৬ সালে ট্রেডস কাপ, ১৯৭২ সালে যুগ্ম ও ১৯৭৩ সালে এককভাবে রোভার্স কাপ, ১৯৭২ সালে ডুরান্ড কাপে ও বরদুলই ট্রফি এবং ১৯৭৩ সালে ডিসিএম ও বরদুলই ট্রফির শিরোপা জয় করে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত খেলেছেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার হয়ে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল লীগ সন্তোষ ট্রফি খেলেন বেঙ্গল দলের হয়ে। এর মধ্যে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৬৯ সালে এবং দু’বার রানার্সআপ।
ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের লাইফ মেম্বার বলাই দে খেলোয়াড়ী জীবন শেষে জড়িত হন সাব-জুনিয়র কোচিং সেন্টারের সঙ্গে। ভারতীয় জাতীয় দল ও মোহনবাগানের গোলরক্ষক সন্তোষ বোস, ভারতীয় জাতীয় দল ও ইস্টবেঙ্গলের তাপস চক্রবর্তী, রেলওয়ের কিট্টু তার হাতে গড়া ফুটবলার। লিলুয়ার বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। মাতৃভূমির কথা তিনি এখনও ভুলতে পারেন না। তার বুকে হানা দেয় গোপালগঞ্জ, খুলনা ও ঢাকার অনেক স্মৃতি। বন্ধুদের কথা মনে পড়লে নস্টালজিক হয়ে পড়েন। বন্ধুদের কাছে তার অনেক ঋণ। বন্ধুবর বীরু, খুলনা মোহামেডানের জহির, সাত্তার, গোলরক্ষক মোশারফের অবদানের কথা স্বীকার করেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। তাদের অনুপ্রেরণায় ফুটবলার হিসেবে উপরে উঠার পথ সুগম হয়। চোখ বন্ধ করলে তার মনে পড়ে যায় দেশের কথা ও বন্ধুদের কথা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ভারতের মাটিতে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ফুটবল দল। এ দলটি ‘গোষ্ঠপাল একাদশ’ নামে পরিচিত মোহনবাগান দলের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ খেলে। চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে গোষ্ঠপাল একাদশের গোলরক্ষক ছিলেন তিনি। সে ম্যাচটি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন বলাই দে : ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে আমরা যে ম্যাচটি খেলেছিলাম, তার অনুভূতি ছিল অন্যরকম। বিশেষ করে আমার জন্য ম্যাচটি ছিল মানসিক দোদুল্যমানতার কারণ। আমার জন্মভূমি শত্রুকবলিত। যাদের সঙ্গে একসময় খেলেছি, তারা আজ গৃহহীন এবং মৃত্যুর হুমকি নিয়ে জীবনযাপন করছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং আমারও কাছের লোকেরা দেশে মৃত্যুর বিভীষিকা ও অনিশ্চিত অবস্থায় আছেন। এমন একটা অনুভূতি আমাকে আবেগমথিত করে তোলে। সেদিনের সে ম্যাচটিতে ছিল না জয়ের জন্য কোনো মরিয়া প্রচেষ্টা। একদিকে যারা প্রতিপক্ষ তাদের সঙ্গে একসময় খেলেছি এবং অন্যদিকে আমার বর্তমান দল। দু’য়ের মাঝামাঝি আমি। আমরা খেলেছিলাম আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে। এ ম্যাচের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কিছু একটা করতে পেরেছিলাম, সেটা ছিল আমার জন্য বড় একটা গৌরবের ব্যাপার।’
১৯৭২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরে সর্বপ্রথম খেলতে আসে কলকাতার ইস্টবেঙ্গল কাব। সে দলের হয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে খেলতে আসেন বলাই দে। তারা ঢাকা, রাজশাহী, খুলনায় খেলেন। দর্শক মাঠে ঢুকে যাওয়ায় চট্টগ্রামে খেলা অসমাপ্ত রাখতে হয়। খুলনায় খেলাটা তাকে নস্টালজিক করে তোলে। তাদের আপ্যায়নের কথা এখনও তাকে নাড়া দিয়ে যায়।
বলাই দে’র প্রিয় ফুটবলার চিংহামং চৌধুরী মারী এবং জাকারিয়া পিন্টু। গোলকিপার হিসেবে মঞ্জুর হাসান মিন্টু, রঞ্জিত দাসের খেলা ভালো লাগতো। এছাড়া ফুটবলার কবীর, গজনবী, প্রতাপ ও বশীর আহমদের ঋণের কথা স্মরণ করেন। বিশেষ করে কবীরের সহযোগিতা ছাড়া তিনি ফুটবলার হিসেবে পরিচিতি পেতেন না বলে জানান। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের আবিদ হোসেন, ওমর, মুসা, হাসান, সাত্তার প্রমুখ ফুটবলারের খেলা তাকে মুগ্ধ করে। ভারতে তার প্রিয় গোলরক্ষক থঙ্গরাজ, সনৎ শেঠ ও ভাস্বর গাঙ্গুলি। প্রিয় খেলোয়াড় চুনী গোস্বামী, বলরাম, পি কে ব্যানার্জী। প্রিয় কোচ অমল দত্ত ও পি কে ব্যানার্জী।
বলাই দে স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৬৭ সালে এরিয়ান্সের হয়ে মোহনবাগানের বিপক্ষে খেলাটি আমার জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আছে। খেলায় এরিয়ান্স জয়ী হয় ২-১ গোলে। সে খেলার মাধ্যমে আমার নতুন করে আত্মপ্রকাশ ঘটে। কলকাতার দর্শকরা সেদিন আমাকে আপন করে নেন। এ ম্যাচের পর মোহনবাগানও লুফে নেয় আমাকে। এছাড়া ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মোহনবাগানের হয়ে আমাকে বিলিয়ে দেই। মোহনবাগান পায় অসংখ্য সাফল্য। এ সময়ের খেলাগুলো আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। পাকিস্তান পর্বেও আছে ফুটবল ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল এক অধ্যায়। ১৯৬২ সালে খুলনা জেলার হয়ে যশোরের বিরুদ্ধে প্রথম স্মরণীয় ম্যাচ খেলি। খুলনা জয়ী হয় ১-০ গোলে। সেরা খেলোয়াড় হই আমি। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় মোহামেডানের হয়ে লীগে ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে খেলাটিও আমার খেলোয়াড়ী জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতির অন্যতম। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। খেলার এক উত্তেজনাকর মুহূর্তে ড্রাইভ দিয়ে নিশ্চিত একটি গোল বাঁচিয়ে দেই। এর খেসারতও দিতে হয় আমাকে। ভেঙ্গে যায় নাকের হাড়। তার রেশ আজও আমার দেহে রয়ে গেছে। অবজারভার, আজাদ, মর্নিং নিউজ পত্রিকায় আমার খেলা নিয়ে দারুণভাবে প্রশংসা করা হয়। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নেরর শক্তিশালী বাকু দলের বিপক্ষে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলে পাকিস্তানের প্রতিটি জাতীয় পত্রিকায় উপাধি দেয়া হয় ‘ফ্লাইং বার্ড’।’
ঢাকার জগন্নাথ কলেজে আইএতে এবং পরবর্তীকালে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও খেলার জন্য বলাই দে’র বেশি দূর লেখাপড়া হয়নি। ১৯৭১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এক মেয়ে গ্রাজুয়েশন করার পর তাকে বিয়ে দেন। মেয়ের জামাই প্রকৌশলী। আর আছে ফুটফুটে নাতনি সুইটি। জীবনে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর এখন কিছুটা হলেও খুঁজে পেয়েছেন শান্তির ঠিকানা। লিলুয়ায় ভাই-বোনদের নিয়ে আনন্দেই আছেন। এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয়। সবাই তাকে চেনেন এক নামে। সবার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। যে কোনো সংকটে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান তাকে বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না। সবার পাশেই তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকতে চান।
স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ২০০৬ সালের অক্টোবরে চাকরি থেকে অবসর নেন। চাকরি শেষে অবসরের আশ্রয় মোহনবাগান কাব ও সাব-জুনিয়র দল।
বলাই দে মনে করেন, ইচ্ছা, নিষ্ঠা, বিশ্বাস ও পরিশ্রম করলে যে কোনো খেলোয়াড়ই সাফল্য পাবেন এবং সে সঙ্গে সম্ভব নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। এই উপলব্ধি তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত। বাংলাদেশ ঘুমিয়ে আছে তার বুকের গভীরে। এদেশের মানুষকে জানিয়েছেন তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নমস্কার। সুযোগ পেলে ছুটে আসতে চান বাংলাদেশে। অন্তত কোচিং করার সুযোগ পেলে পূর্ণ হতো জীবনের একটি অপূর্ণ স্বাদ। জীবনের যে বীজ খুলনায় বোনা হয়েছে, সেই খুলনায় অন্তত একটিবারের জন্যও ফিরে আসতে চান কোচ হিসেবে। মাতৃভূমির টান যে এড়ানো যায় না। #
১৬-৮-২০০৭
বলাই দে এখন বাংলাদেশের ফুটবলের এক হারিয়ে যাওয়া নাম। অথচ যাদের ক্রীড়াশৈলীতে এ অঞ্চলের ফুটবল আলোকিত হয়েছে, তিনি তাদের একজন। অবশ্য টপ ফর্মে থাকাবস্থায় ভারতে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশে তিনি হয়ে গেছেন পরদেশী। ফুটবলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার আধিপত্য থাকলেও পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে বাঙালি ফুটবলারদের সুযোগ পাওয়াটা ছিল সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ঘটনা। আর সেই ‘সোনার হরিণ’-এর নাগাল যারা নিজেদের ব্যক্তিগত ক্রীড়াশৈলী ও ক্যারিশমা দিয়ে আদায় করে নিতে পেরেছেন, তাদের অন্যতম হলেন বলাই দে। শুধু তাই নয়, বলাই দে একমাত্র বাঙালি ফুটবলার, যিনি পাকিস্তান ও ভারত- উভয় জাতীয় দলে খেলার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। উপমহাদেশের ফুটবলের বর্ণাঢ্য এই ব্যক্তিত্বের খেলোয়াড়ী জীবনটাও আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময়।
২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর কলকাতা গিয়ে বলাই দে’কে খুঁজে বের করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কলকাতা ফুটবলে তিনি একটি পরিচিত নাম। সে সময় তিনি কর্মরত ছিলেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়। টেলিফোনে যোগাযোগ করে ব্যাংকের সদর দফতরে গিয়ে উপস্থিত হই খ্যাতিমান সাঁতারু অরুণ নন্দী ও পশ্চিম বাংলার বরেণ্য ক্রীড়া সাংবাদিক পবিত্র দাসকে সঙ্গে নিয়ে। ব্যাংকের নবম তলায় ছিল তার অফিস। চমৎকার পরিবেশ। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে চিরায়ত গঙ্গা নদী। বহুতল ভবনের জানালা দিয়ে তাকালে মনটা ফ্রেশ হয়ে যায়। নদী ও নদীর দু’কূল ঘেঁষে গড়ে উঠা ইতিহাসের নানা উপাদান। অফিসে বলাই দে যে অত্যন্ত জনপ্রিয়- তা বুঝতে সময় লাগলো না। সহযোগী সবাই তার সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। ব্যাংকের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তারা সবাই ছুটে এলেন। তুলে ধরেন বলাই দে’র নানা কীর্তির কথা। এমন একজন সহকর্মী পেয়ে তারাও গর্বিত।
বলাই দে’র জন্ম ১৯৪৬ সালের ১১ অক্টোবর গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার গুয়াখোলা গ্রামে। বাবার চাকরিসূত্রে খুব অল্প বয়সেই খুলনায় বসবাস ও সেখানেই পড়ালেখা। ফুটবলে পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করাটা সহজ ছিল না। বড় সংসার। ৫ ভাই ও ৫ বোন। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন। এ কারণে শুধু খেলাধুলায় মেতে থাকার সুযোগ ছিল না। খেলাধুলায় বাধা না দিলেও বাবা চাইতেন ছেলে পড়ালেখা মনোযোগ দিয়ে করুক। প্রথমে খুলনা সত্যনারায়ণ স্কুল এবং পরবর্তীকালে সেন্ট যোসেফ হাইস্কুলে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক অব্দি লেখাপড়া করেন। সে সময় ফুটবলে তার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। গোলরক্ষক হিসেবে তিনি আলাদা অবস্থান গড়ে তোলেন। অবশ্য তার শুরুটা কিন্তু লেফট আউট হিসেবে। ১৯৫৭ কি ১৯৫৮ সালের কথা। একটি মজার ঘটনায় বদলে যায় তার পজিশন। তার যমজ ভাই কানাই খেলতেন গোলে। খুলনা স্পোর্টিং কাবের একটি ম্যাচ গোলরক্ষক সংকট দেখা দিলে কানাই মনে করে তার পরিবর্তে বলাইকে গোলপোস্টে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। কানাই হিসেবে খেলে যান তিনি। আসলে ভাগ্যে লেখা ছিল গোলরক্ষক হওয়া। বিধির লিখন খন্ডাবে কে?
১৯৬১ সালের আরেকটি ঘটনা তাকে পুরোপুরিভাবে বানিয়ে দেয় গোলরক্ষক। খুলনার দুই জনপ্রিয় কাব টাউন কাব এবং খুলনা হিরোজের মধ্যে মর্যাদার এক লড়াই। খেলার আগে খুলনা হিরোজের গোলকিপার হাতে আঘাত পেলে তার পক্ষে খেলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাব কর্তৃপক্ষ পাশের মাঠ থেকে খুলনা ফ্রেন্ডসের গোলকিপার বলাইকে তুলে আনেন। খুলনা স্টেডিয়ামে জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। বলাইয়ের বয়স তখন মাত্র ১৫। সে ম্যাচে অসাধারণ খেলেন তিনি। দুর্দান্ত কিছু সেভ করেন। এরপর গোলকিপার হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। এ খেলা দিয়েই সে বছর খুলনা জেলার হয়ে খুলনা ডিভিশনে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। তখন খুলনা, যশোর, রাজশাহী ও বরিশাল জেলাকে নিয়ে ছিল খুলনা ডিভিশন। এরপর খুলনা প্রথম বিভাগ লীগে তার চমকপ্রদ ক্রীড়ানৈপুণ্য ফুটবলানুরাগীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ১৯৬১ সালে খুলনা হিরোজ, ১৯৬২ সালে মুসলিম কাব এবং ১৯৬৩ সালে টাউন কাবে খেলেন। ১৯৬৩ সালে ডিভিশনাল ফুটবলে অসাধারণ গোলকিপিং করে আলোচনায় উঠে আসেন। তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে ঢাকা মোহামেডানের দুই তারকা ফুটবলার কবীর ও গজনবী তাকে ঢাকায় নিয়ে যান। ঢাকা মোহামেডান হয়ে উঠে তার ঠিকানা। মোহামেডানের হয়ে খেলতে নেমে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে হয়ে উঠেন দেশসেরা গোলকিপার। ১৯৬৩ সালের লীগে প্রকৃত অর্থে বুক দিয়ে আগলে রাখেন মোহামেডানের রক্ষণভাগ। সে বছর মোহামেডানের লীগ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি। বলাই দে ছাড়াও সে বছর আবিদ হোসেনের নেতৃত্বে মোহামেডানে খেলেন দেবিনাশ সাংমা, জাকারিয়া পিন্টু, রসুল বক্স, কাউয়ুম আল চেঙ্গিজি, মুসা, জহিরুল হক, প্রতাপ শংকর হাজরা, রহমতউল্লাহ, বশির আহমেদ প্রমুখ। মোহামেডানের হয়ে খেলেন করাচী, লাহোর, পেশোয়ার ও মুলতানে। সুযোগ পেয়েছিলেন জাতীয় দলের ট্রায়ালে। ১৯৬৪ সালেও মোহামেডানের হয়ে দুর্দান্ত খেলা প্রদর্শন করেন। তার অতুলনীয় ফুটবলশৈলীতে আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। বার্মা, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকার বিপক্ষে তিনি স্মরণীয় নৈপুণ্য দেখান। আর এই পারফরম্যান্স দিয়ে তিনি পাকিস্তান জাতীয় দলে স্থান করে নেন।
মাকরানীদের অধিপত্যের মাঝেও ১৯৬৪ সালে চীনের প্রজাতন্ত্র দিবস ফুটবলে খেলতে যান পাকিস্তান দলের হয়ে। এ দল গঠনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের নিয়ে ঢাকা, পেশোয়ার ও লাহোরে ট্রেনিং ক্যাম্প হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পান বলাই দে ও জহুরুল হক। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের বাকু ইলেভেন পাকিস্তান সফরে আসে। এ দলটি চট্টগ্রাম, ঢাকা, করাচী ও লাহোরে ম্যাচ খেলে। পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন বলাই দে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার এ ফুটবলার দুর্ধর্ষ নৈপুণ্য দেখিয়ে সবাইকে মাত করে দেন। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ করে নেন। কিন্তু পারিবারিক বাধার কারণে সেই সফরে তার যাওয়া হয়নি।
১৯৬৫ সালের ৩ জানুয়ারি চলে যান ভারতের কলকাতায়। থিতু হন হাওড়ার লিলুয়ায়। এ প্রসঙ্গে ১৯৮২ সালে কলকাতার ‘খেলার কাগজ’ পত্রিকায় ‘পদ্মা থেকে গঙ্গা’ শিরোনামে জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র লিখেছেন : ‘খুলনা থেকে পাকিস্তানের পাসপোর্ট হাতে একটি বাঙালি হিন্দু ছেলে কলকাতার মাটি ছুঁয়েছিল। উদ্দেশ্য, কয়েক দিন আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে কলকাতা বেড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনটা কম-বেশি একটা নাটক। সেই নাটকই ছেলেটির কয়েকদিন কলকাতায় থাকার সুযোগে ওর জীবনের গতিপথটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। ছেলেটির পরিচয় কিন্তু নেহাত সাদামাটা ছিল না। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের গোলকিপারের জার্সিটা তখন বেশ পাকাপোক্তভাবে ছেলেটির দখলে। অতএব, কলকাতায় ছেলেটির উপস্থিতি খুব স্বাভাবিকভাবেই ফুটবল মহলে কয়েকদিনের মধ্যেই বিজ্ঞাপিত হলো। ছেলেটির কাছে প্রথম আমন্ত্রণ এল বিএন রেলওয়ে থেকে। কিন্তু ফিফার আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র অনুমোদনের ব্যাপারে একটু বেশি গা ঘামালো ইস্টবেঙ্গল কাব আর বেশিভাবে বরং জ্যোতিষ গুহ। ছেলেটি আবার ফিরে চলল কলকাতা থেকে খুলনায়। এবারের উদ্দেশ্য জন্মভূমিকে, শৈশব, কৈশোর, যৌবনের ক্রীড়াভূমিকে, জীবনের প্রথম প্রতিষ্ঠার পবিত্র ভূমিকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো। যাওয়ার সময় সামনে ছিল পরিচিত জায়গায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ফিরে আসার সময় সামনে অজানা ভবিষ্যতের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। পরিচিত পরিবেশ, স্বীকৃত প্রতিষ্ঠাকে পেছনে ফেলে অজানা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নেমে পড়া। ছেলেটি তাই যখন খুলনায় ফিরে এসে ঘোষণা করল, আমি কলকাতায় যাচ্ছি, তখন ওর বন্ধু-বান্ধবরা, ওর শুভ্যানুধায়ীরা প্রত্যেকেই ওর এই সিদ্ধান্তে নেতিবাচক মতামত দিলো। প্রত্যেকেই বললো, তুমি রাশিয়া সফরে পাকিস্তান ফুটবল দলে চান্স পেয়েছ। তুমি এখানে জাতীয় দলে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। আর এখন তুমি কলকাতায় যেতে চাইছ! কলকাতায় গেলে তোমাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে। কোটি কোটি লোকের কলকাতায় তুমি হয়তো হারিয়েই যাবে। তুমি যেও না। এমন পাগলামি করো না। কিন্তু স্বাস্থ্যবান, টগবগে ছেলেটির নিজের ওপর অগাধ আস্থা। এত সদুপদেশেও ছেলেটি দমলো না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো- সুযোগ যখন পাচ্ছি কলকাতায় আমাকে খেলতেই হবে। আর আমার যোগ্যতা নিয়ে খেলেই প্রমাণ করব কোটির মধ্যেও বলাই দে একজন। হ্যাঁ, ঐ ছেলেটাই হচ্ছে দুটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা একমাত্র বাঙালি ফুটবলার বলাই দে। একদিন তাই খুলনাকে বিদায় জানিয়ে জীবনের প্রথম অধ্যায়কে পেছনে ফেলে রেখে পদ্মা পারের ছেলে বলাই দে এসে দাঁড়ালেন গঙ্গার পাড়ে কলকাতায়।’
তবে পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় হওয়ায় আগে থেকেই তার সুখ্যাতি ছিল ভারতের ফুটবলানুরাগীদের কাছে। সে সুবাদে তাকে লুফে নেয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ফুটবল দল ইস্টবেঙ্গল। তখন ইস্টবেঙ্গলের গোলরক্ষক ভারতবিখ্যাত পিটার থঙ্গরাজ। যার ছবি বলাই দে’র বুকের অ্যালবামে সযতনে সাজানো। তার সান্নিধ্য পাওয়াটাই বলাই দে’র জন্য রোমাঞ্চকর। সেই থঙ্গরাজের ছায়ায় ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে ইস্টবেঙ্গলে মেঘে ঢাকা রোদ হয়ে থাকার পর ১৯৬৭ সালে যোগ দেন এরিয়ান্স কাবে। নিজেকে মেলে ধরার জন্য দল পরিবর্তনটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বলাই দে’কে। এবছর তিনি বেঙ্গল টিমের হয়ে খেলেন সন্তোষ ট্রফিতে। সুযোগ পান ভারতীয় জাতীয় দলের ট্রায়ালে। খেলার মাঠের নায়ক হলেও জীবনের মাঠে তখনও শক্ত ভিত খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পাবার জন্য চাকরির জন্য হন্য হয়ে উঠেন। কিন্তু কোথাও তরী ভিড়াতে পারছিলেন না। বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে ১৯৬৮ সালে যোগ দেন মোহনবাগান দলে। এর পরপরই চাকরি হয়ে যায় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়। ফিরে পান নতুন আত্মবিশ্বাস। পাকিস্তান জাতীয় দলের পর ১৯৬৯ সালে ভারতের জাতীয় দলে খেলার গৌরব অর্জন করেন। মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ ফুটবল এবং সিঙ্গাপুর ফ্রেন্ডশিপ টুর্নামেন্টে তিনি অংশ নেন। মারদেকায় তিনি ‘ইন্ডিয়ান রক’ হিসেবে উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে ইরানে ফ্রেন্ডশিপ টুর্নামেন্টে খেলেন। চার বছর মোহনবাগানে খেলার পর ১৯৭২ সালে পুনরায় যোগ দেন ইস্টবেঙ্গলে। দু’বছর চুটিয়ে খেলার পর ১৯৭৪ সালে একটি ম্যাচ খেলে ফুটবল থেকে অবসর নেন। এরমধ্যে ১৯৬৬, ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে ইস্টবেঙ্গল এবং ১৯৬৯ সালে মোহনবাগান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। কলকাতা লীগে তিনি পরিচিতি পান ‘ইন্ডিয়ান রাবার’ হিসেবে। এছাড়া তার চমকপ্রদ নৈপুণ্যে মোহনবাগান ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১ সালে রোভার্স কাপ, ১৯৬৯ সালে আইএফএ শীল্ড এবং ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৭২, ১৯৭৩ সালে আইএফএ শীল্ড, ১৯৬৬ সালে ট্রেডস কাপ, ১৯৭২ সালে যুগ্ম ও ১৯৭৩ সালে এককভাবে রোভার্স কাপ, ১৯৭২ সালে ডুরান্ড কাপে ও বরদুলই ট্রফি এবং ১৯৭৩ সালে ডিসিএম ও বরদুলই ট্রফির শিরোপা জয় করে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত খেলেছেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার হয়ে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল লীগ সন্তোষ ট্রফি খেলেন বেঙ্গল দলের হয়ে। এর মধ্যে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৬৯ সালে এবং দু’বার রানার্সআপ।
ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের লাইফ মেম্বার বলাই দে খেলোয়াড়ী জীবন শেষে জড়িত হন সাব-জুনিয়র কোচিং সেন্টারের সঙ্গে। ভারতীয় জাতীয় দল ও মোহনবাগানের গোলরক্ষক সন্তোষ বোস, ভারতীয় জাতীয় দল ও ইস্টবেঙ্গলের তাপস চক্রবর্তী, রেলওয়ের কিট্টু তার হাতে গড়া ফুটবলার। লিলুয়ার বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। মাতৃভূমির কথা তিনি এখনও ভুলতে পারেন না। তার বুকে হানা দেয় গোপালগঞ্জ, খুলনা ও ঢাকার অনেক স্মৃতি। বন্ধুদের কথা মনে পড়লে নস্টালজিক হয়ে পড়েন। বন্ধুদের কাছে তার অনেক ঋণ। বন্ধুবর বীরু, খুলনা মোহামেডানের জহির, সাত্তার, গোলরক্ষক মোশারফের অবদানের কথা স্বীকার করেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। তাদের অনুপ্রেরণায় ফুটবলার হিসেবে উপরে উঠার পথ সুগম হয়। চোখ বন্ধ করলে তার মনে পড়ে যায় দেশের কথা ও বন্ধুদের কথা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ভারতের মাটিতে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ফুটবল দল। এ দলটি ‘গোষ্ঠপাল একাদশ’ নামে পরিচিত মোহনবাগান দলের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ খেলে। চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে গোষ্ঠপাল একাদশের গোলরক্ষক ছিলেন তিনি। সে ম্যাচটি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন বলাই দে : ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে আমরা যে ম্যাচটি খেলেছিলাম, তার অনুভূতি ছিল অন্যরকম। বিশেষ করে আমার জন্য ম্যাচটি ছিল মানসিক দোদুল্যমানতার কারণ। আমার জন্মভূমি শত্রুকবলিত। যাদের সঙ্গে একসময় খেলেছি, তারা আজ গৃহহীন এবং মৃত্যুর হুমকি নিয়ে জীবনযাপন করছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং আমারও কাছের লোকেরা দেশে মৃত্যুর বিভীষিকা ও অনিশ্চিত অবস্থায় আছেন। এমন একটা অনুভূতি আমাকে আবেগমথিত করে তোলে। সেদিনের সে ম্যাচটিতে ছিল না জয়ের জন্য কোনো মরিয়া প্রচেষ্টা। একদিকে যারা প্রতিপক্ষ তাদের সঙ্গে একসময় খেলেছি এবং অন্যদিকে আমার বর্তমান দল। দু’য়ের মাঝামাঝি আমি। আমরা খেলেছিলাম আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে। এ ম্যাচের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কিছু একটা করতে পেরেছিলাম, সেটা ছিল আমার জন্য বড় একটা গৌরবের ব্যাপার।’
১৯৭২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরে সর্বপ্রথম খেলতে আসে কলকাতার ইস্টবেঙ্গল কাব। সে দলের হয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে খেলতে আসেন বলাই দে। তারা ঢাকা, রাজশাহী, খুলনায় খেলেন। দর্শক মাঠে ঢুকে যাওয়ায় চট্টগ্রামে খেলা অসমাপ্ত রাখতে হয়। খুলনায় খেলাটা তাকে নস্টালজিক করে তোলে। তাদের আপ্যায়নের কথা এখনও তাকে নাড়া দিয়ে যায়।
বলাই দে’র প্রিয় ফুটবলার চিংহামং চৌধুরী মারী এবং জাকারিয়া পিন্টু। গোলকিপার হিসেবে মঞ্জুর হাসান মিন্টু, রঞ্জিত দাসের খেলা ভালো লাগতো। এছাড়া ফুটবলার কবীর, গজনবী, প্রতাপ ও বশীর আহমদের ঋণের কথা স্মরণ করেন। বিশেষ করে কবীরের সহযোগিতা ছাড়া তিনি ফুটবলার হিসেবে পরিচিতি পেতেন না বলে জানান। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের আবিদ হোসেন, ওমর, মুসা, হাসান, সাত্তার প্রমুখ ফুটবলারের খেলা তাকে মুগ্ধ করে। ভারতে তার প্রিয় গোলরক্ষক থঙ্গরাজ, সনৎ শেঠ ও ভাস্বর গাঙ্গুলি। প্রিয় খেলোয়াড় চুনী গোস্বামী, বলরাম, পি কে ব্যানার্জী। প্রিয় কোচ অমল দত্ত ও পি কে ব্যানার্জী।
বলাই দে স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৬৭ সালে এরিয়ান্সের হয়ে মোহনবাগানের বিপক্ষে খেলাটি আমার জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আছে। খেলায় এরিয়ান্স জয়ী হয় ২-১ গোলে। সে খেলার মাধ্যমে আমার নতুন করে আত্মপ্রকাশ ঘটে। কলকাতার দর্শকরা সেদিন আমাকে আপন করে নেন। এ ম্যাচের পর মোহনবাগানও লুফে নেয় আমাকে। এছাড়া ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মোহনবাগানের হয়ে আমাকে বিলিয়ে দেই। মোহনবাগান পায় অসংখ্য সাফল্য। এ সময়ের খেলাগুলো আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। পাকিস্তান পর্বেও আছে ফুটবল ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল এক অধ্যায়। ১৯৬২ সালে খুলনা জেলার হয়ে যশোরের বিরুদ্ধে প্রথম স্মরণীয় ম্যাচ খেলি। খুলনা জয়ী হয় ১-০ গোলে। সেরা খেলোয়াড় হই আমি। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় মোহামেডানের হয়ে লীগে ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে খেলাটিও আমার খেলোয়াড়ী জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতির অন্যতম। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। খেলার এক উত্তেজনাকর মুহূর্তে ড্রাইভ দিয়ে নিশ্চিত একটি গোল বাঁচিয়ে দেই। এর খেসারতও দিতে হয় আমাকে। ভেঙ্গে যায় নাকের হাড়। তার রেশ আজও আমার দেহে রয়ে গেছে। অবজারভার, আজাদ, মর্নিং নিউজ পত্রিকায় আমার খেলা নিয়ে দারুণভাবে প্রশংসা করা হয়। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নেরর শক্তিশালী বাকু দলের বিপক্ষে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলে পাকিস্তানের প্রতিটি জাতীয় পত্রিকায় উপাধি দেয়া হয় ‘ফ্লাইং বার্ড’।’
ঢাকার জগন্নাথ কলেজে আইএতে এবং পরবর্তীকালে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও খেলার জন্য বলাই দে’র বেশি দূর লেখাপড়া হয়নি। ১৯৭১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এক মেয়ে গ্রাজুয়েশন করার পর তাকে বিয়ে দেন। মেয়ের জামাই প্রকৌশলী। আর আছে ফুটফুটে নাতনি সুইটি। জীবনে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর এখন কিছুটা হলেও খুঁজে পেয়েছেন শান্তির ঠিকানা। লিলুয়ায় ভাই-বোনদের নিয়ে আনন্দেই আছেন। এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয়। সবাই তাকে চেনেন এক নামে। সবার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। যে কোনো সংকটে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান তাকে বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না। সবার পাশেই তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকতে চান।
স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ২০০৬ সালের অক্টোবরে চাকরি থেকে অবসর নেন। চাকরি শেষে অবসরের আশ্রয় মোহনবাগান কাব ও সাব-জুনিয়র দল।
বলাই দে মনে করেন, ইচ্ছা, নিষ্ঠা, বিশ্বাস ও পরিশ্রম করলে যে কোনো খেলোয়াড়ই সাফল্য পাবেন এবং সে সঙ্গে সম্ভব নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। এই উপলব্ধি তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত। বাংলাদেশ ঘুমিয়ে আছে তার বুকের গভীরে। এদেশের মানুষকে জানিয়েছেন তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নমস্কার। সুযোগ পেলে ছুটে আসতে চান বাংলাদেশে। অন্তত কোচিং করার সুযোগ পেলে পূর্ণ হতো জীবনের একটি অপূর্ণ স্বাদ। জীবনের যে বীজ খুলনায় বোনা হয়েছে, সেই খুলনায় অন্তত একটিবারের জন্যও ফিরে আসতে চান কোচ হিসেবে। মাতৃভূমির টান যে এড়ানো যায় না। #
১৬-৮-২০০৭
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন