বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

 (পরলোকগত বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের জনক শঙ্করীপ্রসাদ বসুকে নিয়ে ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাক্ষিক ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা।)





ক্রিকেট কি শুধু পরিসংখ্যানের খেলা? পরিসংখ্যানে কতটুকু সত্য থাকে? কোনো মহাকাব্যিক ইনিংস কি অনুভব করা যাবে পরিসংখ্যান দেখে? ১৯৬০ সালে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার টাই টেস্টের পরতে পরতে যে উত্তেজনা ও অবিশ্বাস্য নাটকীয়ত স্নায়ুকে বিকল করে দিয়েছিল, তা কি ফুটে ওঠে পরিসংখ্যানের কঙ্কালে? ক্রিকেটের বর্ণাঢ্য চরিত্র ‘বুড়ো শয়তান’ খ্যাত ডব্লিউ জি গ্রেস কিংবা সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে সম্মানিত ডন ব্রাডম্যানকে পরিসংখ্যানে কতটুকু চেনা যায়? চেনা যায় না বলেই যুগে যুগে ক্রিকেট লিখিয়েরা তাদের মিষ্টি-মধুর কলমে পরিবেশন করেছেন ক্রিকেটের রূপ-রস-সৌন্দর্য। তাদের কলমের আঁচড়ে স্মরণীয় হয়ে আছে মহান ক্রিকেটারদের অমর কীর্তি আর মহাকাব্যিক ইনিংসের লাবণ্য ও সুষমা। সাহিত্যের অধ্যাপক হীরেন চট্টোপাধ্যায় যেমনটি বলেছেন : ‘আসলে ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে লেখা মানে যে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান পেশ করা নয়, তাকে যে প্রাণবন্ত করে তোলা যায়, একটি সুন্দর ইনিংস যে মোৎজার্টের একটি সিম্ফনি বা বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের বিলম্বিত ও মধ্যলয়ের শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীর সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পারে, এই আবিষ্কারই তো ওইসব লেখার প্রতি আমাদের মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল।’ ক্রিকেট যেমন বৃটিশদের গর্ভজাত, তেমনি ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেট সাহিত্যও তাদের দান। এ বিষয়ে রাখাল ভট্টাচার্যের অভিমত হচ্ছে : ‘খেলার রাজ্যে ভাবোদ্বেল সাহিত্য সৃষ্টির অবকাশ ক্রিকেটে যত আছে, এত আর কোনো কিছুতে নেই। ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেট-সাহিত্য যারা পাঠ করেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, মহাসমৃদ্ধশালী ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পংক্তিতে স্থান পাবার যোগ্যতা তার আছে। যে রসসমৃদ্ধ, অলঙ্কারম-িত ও ছন্দময়। ক্রিকেটের বিকল্প নয় সে সাহিত্যপাঠ; ক্রিকেট দেখার থেকে সূক্ষ্ম রসানুভূতি মেলে তাতে। আমি তো বলি, ক্রিকেটের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস ব্যাট থেকে উৎসারিত হয়নি, তা হয়েছে একজনের কলম থেকে, তার নাম নেভিল কার্ডাস। কার্ডাস মূলত সঙ্গীত-সমালোচক। সঙ্গীতেরই তাল-লয়-যতি, মীড়-মূর্ছনা-গমক, সব তার কাছে ধরা পড়েছে, ক্রিকেটেও এবং এত কিছু যে ক্রিকেটে আছে, তারও খবর লোকে জেনেছে সঙ্গীত-সমালোচক কার্ডাসের ক্রিকেট-সমালোচনা পড়ে।’
বাঙালির রক্তে ক্রিকেট নেই- পঙ্কজ রায় অল্প কিছু পরিমাণে এবং সৌরভ গাঙ্গুলি তা পুরোপুরি খণ্ডন করে দিয়েছেন। এখন তো বাঙালিদের একটি দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলছে। তবে ক্রিকেট খেলায় নাম কুড়ানোর আগেই সমঝদার হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছে বাঙালিরা। যদিও কথাসাহিত্যিক শঙ্করের মত বাঙালিরা শুরুতে মনে করতেন : ‘ক্রিকেটটা কোনো খেলা নয়, কলোনিয়াল কালচারের একটি বর্বর প্রকাশ মাত্র, ফলে দু’জন লোক লাঠি হাতে সারাদিন খাটায় একাদশ নির্দোষ মানুষকে।’ অথচ একদিকে বাঙালিরা ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছে, অন্যদিকে মজেছে ক্রিকেট রসে। আস্তে-ধীরে বাঙালিরা আত্মস্থ করে নিয়েছেন ‘ক্রিকেট-কালচার’কে। আর এ থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলা ক্রিকেট-সাহিত্যের। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে পূর্ণতা দিয়েছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু (জন্ম : ২১ অক্টোবর, ১৯২৮, হাওড়া, কোলকাতা)। ষাটের দশকটা ছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, চিত্রকলার উজ্জ্বল সময়। সে একটা সময় ছিল, যখন হেমন্ত-লতা-কিশোরের রোমান্টিক গান বুকে সুর হয়ে বেজেছে। উত্তম-সুচিত্রার মিষ্টি প্রেমের ছবি মনকে করেছে উতলা। সুনীল-শক্তির কাব্যরসে আপ্লুত হয়েছেন পাঠক। চিত্রকরের রঙিন ক্যানভাস রূপতৃষ্ণায় ভরিয়ে দিয়েছে দু’চোখ। সৃষ্টিশীল এমন এক সময়ে ‘গদ্যের মধ্যে পদ্য করে ক্রিকেট-সুন্দরীর গায়ে রঙ-বেরঙের নকশা’ কেটেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। বিশিষ্ট সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর ভাষায়, ‘ক্রিকেট রসিক’ এই ভদ্রলোকের হাতে জন্ম সুনিপুণ ক্রিকেট সাহিত্যের। রাজকীয় ও কেতাদুরস্ত ক্রিকেটে ইংরেজি ভাষায় যতটা লাবণ্য ধরে, বাংলা ভাষায় কি ততটা মাধুর্য পাওয়া যায়? এমন একটা দোলাচল বরাবরই ছিল। সাহিত্যের অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের মরুভূমিতে শুধু ফুলই ফোটাননি, তারই হাতে পরিস্ফুটিত ও বিকশিত হয়েছে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের সুবাসিত এক বাগানের। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের যে সোনার খনির সন্ধান দিয়েছেন, তা থেকে পাঠকরা এখনও তুলে নিচ্ছেন মুঠো মুঠো সোনা। শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং তার ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে লিখতে যেয়ে প্রতি মুহূর্তে তারই লেখার স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। ক্রিকেট নিয়ে তার কল্পনা, তার সৃষ্টি, তার অনুবাদ এমনই আবিষ্ট করে রাখে যে, এর বাইরে নতুন ভাবনা কিংবা শব্দচয়ন খুবই দুর্বল ও অপ্রতুল মনে হয়। তাকে জানার সোজাপথ হলো তার লেখা পাঠ করা। এ কারণে এ লেখায় তার লেখার উদ্ধৃতি ও বাক্য অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ তিনি শুধু ক্রীড়া লেখক ছিলেন না। তার গবেষণার আলোয় আলোকিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা দিক। সাহিত্যের অধ্যাপক অমিয় দত্তের মতে : ‘বৈদগ্ধ্যের বৈভবে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ভাবমূর্তি হিমালয়-সদৃশ। কত দিকেই না তার মানসাভিসার। বৈষ্ণব সাহিত্যের রসময় আলোচনায়, ক্রিকেট সাহিত্যের সৌরভময় দুনিয়ায়, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা-সুভাস চন্দ্রের ঐতিহাসিক আবির্ভাবের গবেষণাধর্মী মহাগ্রন্থ রচনায় তার অসামান্যতা সর্বজনবিদিত।’
বাঙালির জীবনচর্যা ও সংস্কৃতিতে বহুল উচ্চারিত শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখনী নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন কথাসাহিত্যিক হর্ষ বসু : ‘সে এক গভীর বিস্ময়, বাকরুদ্ধ স্তব্ধতা। কেবলই মনে হয়ছে, শুধু নিষ্ঠা বা মেধার জোরে এমন কালজয়ী কাজ করে ওঠা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জন্মগত বিরল প্রতিভা। শঙ্করীপ্রসাদ সেই বিরল প্রতিভাসম্পন্নদের মধ্যে একজন- যাঁরা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। কিন্তু যাদের সৃষ্টি প্রবহমান মানবসভ্যতাকে এক অপতিরোধ্য ঋণের জালে বেঁধে রেখেছে।’ জীবন ও সৃষ্টির নানাদিক নিয়ে মেতে উঠলেও শঙ্করীপ্রসাদ বসু স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলার ‘নেভিল কার্ডাস’ হিসেবে। ‘খেলার মাঠকে তিনি সারস্বত সাধনার ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন।’ প্রথম যৌবনে তিনি যখন ছিলেন ক্রিকেট নেশাগ্রস্ত, তখন ‘ক্রিকেটের নেশা আমাকে যখন পেয়ে বসলো তখন একদিকে জীবনের মধুর শীতের দুপুরগুলি কাটাতে শুরু করলুম ইডেনের গ্যালারীতে বসে, অন্যদিকে বাড়ি ফিরে এসে চোখ ডুবিয়ে দিলুম ইংরেজিতে লেখা ক্রিকেটের অপূর্ব সব কাহিনীতে। ক্রিকেট যারা ভালবাসে- তারা খেলা কেবল মাঠেই দেখে না, বইয়ের পাতাতেও দেখে থাকে’- এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটের রসকে কাগজে-কলমে রূপায়িত করেছেন। চোখের দেখা, ইংরেজি ক্রিকেট সাহিত্য আর পরিসংখ্যানের ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে আহরণ করেছেন ক্রিকেটের মাধুর্য। মহাজীবনের গাঁথা (১৯৫৩), মধ্যযুগের কবি ও কাব্য (১৯৫৫) ও চ-ীদাস ও বিদ্যাপতির (১৯৬০) লেখক শঙ্করীপ্রসাদ বসু ১৯৬০ সালে ‘ইডেনে শীতের দুপুর’ লিখে কাঁপিয়ে দেন বাংলার ক্রিকেটানুরাগীদের। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘শঙ্করীপ্রসাদ বসুও সেই দুর্লভ বাকশক্তির অধিকারী, অন্যের মনশ্চক্ষুকে যা অতি অকেশে খুলে দেয়। ছাত্রমহল জানে, তিনি একজন খ্যাতিমান  অধ্যাপক; ক্রীড়ামহল জানে, তিনি একজন দক্ষ দর্শক এবং পাঠকমহল জানে, তিনি একজন শক্তিমান লেখক, বাচনভঙ্গির চাতুর্যে নেপথ্যের ঘটনাকেও যিনি দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন। আমি তার এই বই (ইডেনে শীতের দুপুর) পড়েছি এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ঘরে বসেই ক্রিকেট খেলা দেখেছি। দেখা সম্ভব হতো না, তার ভাষা যদি-না বর্ণনাময় এবং বর্ণনা যদি-না নিখুঁত হতো। আসল কথা, ক্রিকেটকে তিনি ভালবাসেন। ভালবাসার বস্তুটিকে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। দূরের থেকে কাছে টেনে এনেছেন। এ অতি শক্ত কাজ, তাতে সন্দেহ নেই।’ লেখকের বসবাস কলকাতায় হওয়ায় ইডেন গার্ডেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মধুময় স্মৃতি। ইডেন গার্ডেনে কাছ থেকে খেলতে দেখেছেন বিশ্ব-সেরা ক্রিকেটারদের। কোনো কোনো ক্রিকেটার তার মন জয় করে নেন। তাঁদের ক্রিকেটশৈলী ও ব্যক্তিত্ব তাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। মূলত এদেরকে কেন্দ্র করে ‘ইডেনে শীতের দুপুর’-এ যেন শব্দ দিয়ে বাজানো হয়েছে হৃদয়ের সুর। ক্রিকেটের আলোয় খুঁজে পাওয়া যায় জীবন-জগতের নতুন ব্যঞ্জনা। ‘এর নাম ইডেন গার্ডেন’ শিরোনামের লেখায় ফিরে ফিরে আসে শৈশব-কৈশোরের মধুমাখা দিনগুলো।  লেখক তার গুণেনদার হাত ধরে সেই কবে গিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেনে, সেই থেকে যাবার পর প্রতিবারই ফিরে আসার সময় চোখের তৃষ্ণা  পিছনে ফেলে এসেছেন। তারই তাড়নায় আবার গিয়েছেন। এমনি চলেছে বছরের পর বছর। ইডেন গার্ডেনের মায়া থেকে নিস্তার পাননি। পাননি বলেই ভুলতে পারেননি জীবনের সেইসব আনন্দময় দিনগুলোর কথা : ‘কিভাবে শীতের সকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখতে লাইন দিয়েছি ইডেন গার্ডেনে। খুব ভিড়ের সম্ভাবনা, সিজন টিকিটের পয়সা জোটেনি। ভোর-ভোর বেরুতে হয়েছে। যখন মাঠে পৌঁছেছি, অলস ঘুমের মতো তখনও কুয়াশা জড়িয়ে আছে পাইন-দেবদারুর পাতায় পাতায়। ওধারে হাইকোর্টের চূড়োটি কেমন মায়াময়। আবছা আলোয় গড়ের মাঠ। কালো নোঙর-করা নৌকোর মত টেন্টগুলো। ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে মাথা-নামানো ব্রোঞ্জের সৈনিক দুটোর ভঙ্গিতে সুকোমল নমস্কার। দৌড়ে-দৌড়ে আসতে হয়েছে। ইতোমধ্যে লাইন খুব কম হয়নি। আমরা আছি পাঁচজন। তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে দু’জনকে পাঠিয়ে দেয়া হলো খোঁজ-খবরে আমাদের লাইনটা ঠিক লাইন কি না, অন্য গেটে ছোট লাইন আছে কি না, চেনাশোনা কেউ আগে আছে কি না, সেখানে ঢোকার চান্স কি রকম? কাঁধের ঝোলাগুলো, একবার নেড়েচেড়ে নিই। ঠিক আছে’। ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ হয়ে যারা ছুটে যান ক্রিকেট মাঠে, এ তো তাদের জীবনের দিনলিপি- যা চমৎকারভাবে এঁকেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তখন সময়টা আসলেই অন্যরকম ছিল। সবকিছুতেই ছিল সুরুচির একটা প্রচ্ছন্ন ছাপ। ভাল বই, ভাল গান আর ক্রিকেট ছিল বাঙালির মন্থর নগর জীবনের প্রধান বিনোদন। তবে সবার পক্ষে ক্রিকেট মাঠে যাওয়া সম্ভব না হলেও বেতারের ধারাবিবরণী কানে মধবৃষ্টি বর্ষণ করতো। সংবাদপত্রে খেলার বিবরণী কিছুটা তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হতো। কিন্তু শঙ্করীপ্রসাদ বসু যেন বাঙালিদের ক্রিকেট রসে মজিয়ে দেন। দৈনিক পত্রিকার গতানুগতিক রিপোর্টিং- এর বাইরে নতুন এক ধারার প্রবর্তক তিনি। এ যে ক্রিকেট সাহিত্য! বাঙালির আটপৌঢ়ে জীবনে এক নতুন রসদ।
বাঙালিরা যে ক্রিকেট খেলতে পারেন, এটা প্রমাণ করেছিলেন, পঙ্কজ রায়। বর্তমানে ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ও ক্রিকেটার ‘বাঙালি-বাবু’ সৌরভ গাঙ্গুলির আগে পঙ্কজ রায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ব্যাটসম্যান। সে সময়কার ভেতো ও ভীতু বাঙালি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ‘চরিত্রশক্তিতে অনন্যভাবে সমৃদ্ধ’ ছিলেন তিনি। বলা যায়, পঙ্কজ রায়কে দিয়ে বাঙালির ক্রিকেটে নববসন্তের সূচনা। এ কারণে অন্য অনেকের মত পঙ্কজ রায় ছিলেন লেখকের প্রথম জীবনের ভালবাসা। তাকে পেয়েছিলেন ‘ক্ষ্যাপা আনন্দের জগতে নন্দন চরিত্ররূপে’।  ভালবাসার মানুষটিকে বাঙময় করে তুলেছেন এভাবে: ‘কিন্তু সেদিন পঙ্কজের মধ্যে যা দেখেছিলুম, তা আর দেখবার আশা করি না। ছেলেটির সমস্ত দেহের মধ্যে থেকে একটা জিনিস বিচ্ছুরিত হচ্ছিল- আত্মবিশ্বাস। চলা-ফেরা, ব্যাট ধরা, স্ট্রোক করা- সবকিছু সহজ দর্প এবং প্রফুল্লতার ভঙ্গিতে বাঁধা। কোনো বলই তার কাছে সমস্যা নয়। তাই বলে কি সেগুলিকে নিরন্তর বাউন্ডারিতে পাঠাচ্ছিলেন? মোটেই নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু থামাচ্ছিলেন, মারছিলেন মাত্র মারবার বলটি। কিন্তু যেভাবে ক্রিজের উপর ঘোরাফেরা করলেন, যে প্রত্যয়ের অনায়াস গতিতে, সে জিনিস একমাত্র তার পক্ষেই করা সম্ভব, যে জীবনের প্রসন্ন মুখ দেখেছে, সেই গৌরবর্ণ খর্বকায় বাবু চেহারার যুবকটি আমাদের মনে একটি সানন্দ মহিমার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। (ইডেনে শীতের দুপুর)। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৩টি টেস্ট খেলে ৩২ দশমিক ৫৬ গড়ে ২৪৪২ রান করেছেন পঙ্কজ রায়। এর মধ্যে ৫টি সেঞ্চুরি। ১৯৫৬ সালে মাদ্রাজে ভিনু মানকদকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম উইকেট জুটিতে যে ৪১৩ রান করেন, তা আজো রেকর্ড বইয়ের পাতায় অম্লান হয়ে আছে। উপর্যুপরি ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন। পরিসংখ্যানে কি আমরা প্রকৃত পঙ্কজ রায়কে চিনতে পারবো? পারবোনা বলেই বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়কে তিনি আমাদের মানসপটে ছবির মত এঁকে দিয়েছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তী সুঁটে ব্যানার্জি, মুস্তাক আলী, লালা অমরনাথ, বিজয় মার্চেন্ট, বিজয় হাজারে, রুসী মোদী, পল উমরিগড়, জি এস রামচাঁদ, দাত্তু ফাদকার, ভিনু মানকদকে জীবন্ত করে রেখেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। এই ক্রিকেটাররা গেয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের নবজীবনের গান। অপরিণত ভারতীয় ক্রিকেট দলকে এরাই দিয়েছিলেন নতুন পথের ঠিকানা। ১৯৩২ সালের জুনে লর্ডসে প্রথম টেস্ট খেলার প্রায় ২০ বছর পর ভারত ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাদ্রাজে ইংল্যান্ডের সঙ্গে পঞ্চম টেস্টে ইনিংস ও ৮ রানে প্রথম জয়ের মুখ দেখে। এই জয়ে ভিনু মানকদের অসাধারণ বোলিং, পল উমরিগড় ও পঙ্কজ রায়ের দায়িত্বশীল সেঞ্চুরি ছাড়াও লালা অমরনাথ, অধিনায়ক বিজয় হাজারে প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।  এদের অন্যতম মুস্তাক আলীর মধ্যে লেখক খুঁজে পেয়েছিলেন ‘রৌদ্রতপ্ত দূর ভারতের রহস্যময় সৌন্দর্য’। কল্পনা ও প্রতিভায় পূর্ণ এই ক্রিকেটার সহসা ঝলসে উঠে রাঙিয়ে দিতে পারতেন আকাশপ্রান্ত। তার দায়িত্বহীন সৌন্দর্য- বিলাস সবাইকে মুগ্ধ করতো। তার আউট হওয়া মানে চঞ্চল অথচ সুন্দরের মৃত্যু। মুস্তাক আলী আউট হওয়ার মুহূর্তটি  লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন এখনও তা যে কাউকে আপ্লুত করবে: ‘মুস্তাক আলী নামলেন। ক্রিকেটের নবকুমারকে অভ্যর্থনা জানাতে সে কি বিপুল করতালি! সমস্ত মাঠ মেতে উঠল দিনশেষে মুস্তাকের উদয়ে। রামাধীন বল করতে শুরু করলেন- প্রথম বল- মুস্তাক সুন্দরভাবে আটকালেন। দ্বিতীয় বল- যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছেন মুস্তাক- রামাধীনকে আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না- বোলারের মাথার উপর দিয়ে উঁচু করে বলটি চালিয়ে দিলেন। কিন্তু হায়, যথেষ্ট উঁচু হলো না বল এবং খর্বকায় রামাধীন একটি অদ্ভুত লাফ দিয়ে বলটি ধরে নিলেন। কট আউট। সকলের হৃৎপি- যেন লাফিয়ে উঠল। কণ্ঠে কণ্ঠে সাঁড়াশির চাপ- শব্দমাত্র নেই- শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ- কালির বোতল গড়িয়ে পড়েছে- এমন সময় সুমধুর রবে বেজে উঠল ভারতীয় ব্যান্ডের সুবিখ্যাত আনন্দগীত; তালে-তালে লুটোপুটি করতে লাগল সুর রঙ্গভরে। দর্শকরা এমন নিস্তব্ধ যে, শোনা গেল সুরের মৃদুতম ধ্বনি পর্যন্ত। সেই থেকে বন্ধ হয়ে গেল খেলার মধ্যে ব্যান্ডবাদ্য’ (ইডেনে শীতের দুপুর)। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করার গৌরব লালা অমরনাথের। ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে মুম্বাইতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে তার অভিষেক টেস্টে এই সেঞ্চুরি করেন। লেখক লালা অমরনাথকে বলেছেন, ‘প্রাকৃতিকতার ক্রীড়ারণ্যে সচল বনস্পতি’ এবং ‘সমুদ্র আর মরুভূমির মাঝখানে বিস্তৃত অমরনাথের জীবন’।  ‘আত্মক্ষয়ী প্রতিভা’ লালা অমরনাথকে ‘সমুদ্র-সন্তান’ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন: ‘মহান সি কে নাইডু সর্বাঙ্গীনতায় ভারতীয় ক্রিকেটে অনতিক্রান্ত। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, ক্যাপ্টেন্সি- কোথায় সি কে মহীয়ান নন? তার শক্তি অনেক সময়ই প্রাকৃতিক, তার ব্যাটিং ক্রিকেটের ধর্ম-সমাজে ‘ব্রাত্য’ সকল বেড়ার বাইরে। তবু, তাকে সম্মান জানিয়েই বলব, শক্তির উদ্ধত প্রকাশে অতুলনীয় সি কে-ও এক জায়গায় অমরনাথের কাছে হেরে গেছেন- শক্তির প্রকাশ-লাবণ্যে। সি কে আমাদের যখন স্তম্ভিত ক’রে রাখেন, তখন অমরনাথের ব্যাটে বিপ্লবের বীণা বাজে। ঝড়ের রাতের সেই সঙ্গীত অমরনাথের বিধিদত্ত’। (ইডেনে শীতের দুুপুর)। অধিনায়ক বিজয় হাজারে ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক শূন্যকে পূর্ণ করেছেন, অনেক ভগ্নকে করেছেন উত্তোলন। প্রয়োজনের বেদীতে বারবার বলি দিয়েছেন সৌন্দর্যকে। লেখকের মতে, ‘মুস্তাক আলীর মুখরতা, সি এস নাইডুর কোলাহল, সি কে’র অট্টহাস্য, অমরনাথের রণধ্বনি কিংবা মার্চেন্টের বিদগ্ধ বচন না থাকলেও ‘ক্রিকেট পৃথিবীতে মহৈশ্বর্যে নম্র ও সম্পদে ভীত এক শান্ত মহিমার নাম বিজয় হাজারে’। তার চওড়া ব্যাটে ও চওড়া বুকে সকল আঘাত সহ্য করতে পারতেন। লেখকের বর্ণনা গুণে বিজয় হাজারের খেলা ভেসে উঠে মানসনেত্রে: ‘অথচ হাজারে কী করেছেন- দিনের পর দিন দেখেছি বিষাক্ততম বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তার অবিচলিত নিপুণতা। আহত সর্পের মতো বলগুলো ফণা বাড়িয়ে ছোবল দিতে চাইছে উইকেটে, আর অদ্ভুত সহজ কৌশলে পা এবং হাত বাড়িয়ে ফণার মুখে হাজারে পেতে দিচ্ছেন ব্যাটের ব্লেডটিকে। পিচের ‘লাল’ দাগ ফুটে উঠছে ব্যাটের কাষ্টদেহে, কিন্তু উইকেট অক্ষত। হাজারের খেলা দেখে কতবার মনে হয়েছে- কি আশ্চর্য, এই যোদ্ধা তরবারি ফেলে দিয়ে যেন শুধু ঢাল দিয়ে বিপক্ষের তরবারির আঘাত প্রতিহত করার কৌতুককর খেলায় মত্ত। তরবারির ফলক ঝিলিক দিয়ে এগিয়ে আসে দেহস্পর্শের জন্য, তার আগে পেয়ে যায় ঢালের নির্বিকার প্রতিরোধকে। তারপর একসময় দেখি, কখন যেন যোদ্ধা কুড়িয়ে নিয়েছেন তার তলোয়ার। তার আঘাতে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে বিপক্ষের অস্ত্র। হাজারের ড্রাইভগুলো চোখ ধাঁধিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাউন্ডারির সীমানায়’। (ইডেনে শীতের দুপুর)। ভারতের অন্যতম  শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ভিনু মানকদ। রেকর্ডবুকে তার সময়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্রিকেটার। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম সময়ে ১০০ উইকেট এবং হাজার রানের কীর্তি গড়েন। ব্যাটসম্যান হিসেবে সাহসী ও কল্পনাপ্রিয় ভিনু মানকদ টেস্ট ম্যাচের উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি এবং দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করা ভারতের প্রথম ক্রিকেটার। ভিনু মানকদের মধ্যে লেখক খুঁজে পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চরিত্রকে: ‘ভিনুর দিকে একবার তাকান আর ভারতের জাতীয় স্বভাব স্মরণ করুন। এদেশের জীবনের ধীর লয়, অব্যস্ত গতি, প্রসন্ন সহিষ্ণুতা, শান্ত প্রতিরোধ, অহিংস অসহযোগিতা; এ দেশের প্রান্তর, কৃষক, গরুর গাড়ি, ধানকাটা, তাঁত বোনা; আর মনে করুন ভিনু মানকদকে। এদের মধ্যে কোথাও কি একটা ঐক্য নেই।’ (ইডেনে শীতের দুপুর)। এমন কাব্যময় বর্ণনা ক্রিকেট মাঠের একজন কবি ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে রাখাল ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘কবির দৃষ্টিতে অতি সাধারণ বস্তুও রূপময় হয়ে ওঠে। বর্তমান লেখকের কবিতা রচনার অভ্যাস আছে কিনা জানি না, কিন্তু বিভিন্ন ক্রিকেটারের খেলার ধরন অনুধাবন করে, তিনি যেভাবে তার বিশ্লেষণ করেছেন, জীবন ও প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশের সঙ্গে উপমা দিয়ে তাকে বাক্সময় সাকার রূপ দিয়েছেন, তা যে কবিকৃতি, তাতে সন্দেহ নেই’।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘রমণীয় ক্রিকেট’। ১৯৬০ সালের ৯ থেকে ১৪ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্য ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি’র পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট। মহান অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মুখোমুখি রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে গ্যারি সোবার্সের সৌন্দর্যপূর্ণ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে করা ১৩২, সলোমন ৬৫, ফ্রাঙ্ক ওরেল ৬৫, আলেকজান্ডার ৬০ ও ওয়েস হলের ৫০ রানের সুবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ ৪৫৩। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিডসন নেন ৫টি উইকেট। জবাবে অস্ট্রেলিয়া নর্মান ও’নীলের কষ্টসাধ্য ১৮১, সিম্পসনের ৯২ ও ম্যাকডোনাল্ডের ৫৭ রানে ৫০৫ রান করে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে যায়। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ওয়েস হল ৪টি উইকেট নেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্রাঙ্ক ওরেলের ৬৫, রোহান কানহাইয়ের ৫৪ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮৪ রান করলে জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়ায় ২৩৩ রান। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিডসন ৬টি উইকেট নেন। কিন্তু বুনো বোলিংয়ে ভয়ঙ্কর ওয়েস হলের তা-বে ৯২ রানে অস্ট্রেলিয়ার ৬টি উইকেটের পতন ঘটলে ক্যারিবীয়দের পুরু ঠোঁটে ক্যালিপসো সুর ভাসতে থাকে। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ডেভিডসন ও অধিনায়ক রিচি বেনো ক্যারিবীয়দের সুর থামিয়ে দেন। সলোমনের দুর্দান্ত থ্রোতে ডেভিডসনকে ৮০ রানে ফিরিয়ে দিলেও বেনো থাকায় জয়ের তরী অস্ট্রেলীয় বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় থাকে। শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৬ রান। হাতে ৩টি উইকেট। বল হাতে ‘দানবীয়’ হল। হলের বাউন্সারে বেনো ধরাশায়ী হলে যন্ত্রণার-আবেগের-উৎকণ্ঠার লাভা গড়িয়ে পড়তে থাকে মাঠে। ২৩২ রানের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার শেষ দুই ব্যাটসম্যান গ্রাউট ও মেকিফ রান আউট হলে ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত ‘টাই’ হয়। ‘মানুষের সাধনা ও বিধাতার বাসনার যৌথ সৃষ্টি ঐ ‘টাই’।এরপর ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে চেন্নাইতে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যেকার দ্বিতীয় ‘টাই’ হলেও প্রথম ‘টাই’ ম্যাচে যে আবেগ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাস ও স্মায়ুর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তা তুলনারহিত। লেখকের বর্ণনায় ঝরে পড়ে মুগ্ধতা : ‘১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসের ব্রিসবেন টেস্ট সম্বন্ধে লিখতে আমার সংকোচ হচ্ছে। যে খেলা সম্বন্ধে বলা হয়েছে- না দেখলে তাকে সত্য বলে বিশ্বাস হবে না, দেখলেও বিশ্বাস হওয়া শক্ত- যে খেলা দেখতে দেখতে রসিক দর্শকের মনে অপূর্ব অব্যক্ততার চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে- সে খেলার সত্যরূপ ফোটাব কি ক’রে? আমি তো ছার, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে কলম দিলেও তিনি কুন্ঠাবোধ করবেন, কারণ স্রষ্টাও শেষ পর্যন্ত সৃষ্টির সব রহস্য জানেন না। তাছাড়া, সৃষ্টির ব্যাপারে তার ভূমিকা অনেকটা নাট্যকারের মতো। নাট্যকার নাটক লেখেন কিন্তু সে নাটক প্রাণ পায় অভিনয়ে। ক্রিকেট-বিধাতা অদৃশ্য থেকে ব্রিসবেনের টেস্ট নাটকটি লিখে দিয়েছিলেন- কিন্তু সে নাটকের মাঠ রূপের সফলতা এনেছিলেন কয়েকজন ক্রিকেটার-অভিনেতা, তাদের অভিব্যক্তির স্বাধীনতায়।’ . . . . .  ‘চঞ্চলতায়, বিহ্বলতায় আন্দোলিত খেলা- বৈদ্যুতিক উত্তেজনা এবং স্মায়ুধ্বংসী সংকটে পূর্ণ- বেনো ভাবছিলেন- আশা নৈরাশ্যের অবিরত ওঠাপড়ার যন্ত্রণা- এ কী ক্রিকেট। যা দেখলুম। যা খেললুম! ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা কিভাবে অনিবার্য পরাজয়কে রক্তজমা ‘টাই’-এ পরিবর্তিত করল। তাদের সাহসের শক্তি, তাদের প্রয়াসের মহত্ত্বে বেনো  প্রশংসাবোধ করেন। ‘নৈরাশ্য’? হ্যাঁ, নৈরাশ্য একই সঙ্গে মনে জাগে- এত লড়াইয়ের পরেও আমরা জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় একটি মাত্র রান জোগাড় করতে পারলুম না’। (রমণীয় ক্রিকেট)। শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটকে মনে করেন ‘খেলার রাজা’, ‘ক্রিকেট মহান খেলা’। কারণ, ‘ক্রিকেটের সাহিত্য আছে। খেলার সাহিত্য যদি একমাত্র ক্রিকেটের থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ক্রিকেটই সবচেয়ে জীবনময় খেলা’। . . . . .‘জীবন বলতে কেবল উত্তেজনা বোঝায় না। জীবন অনেক ব্যাপক। উত্তেজনা, আবেগ ও ধীরতার নানারূপী বিন্যাস সেখানে। জীবনে আছে সূচনা ও সমাপ্তি। উভয়ের মধ্যে ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তনের তরঙ্গ গতি। ক্রিকেট সেই খেলা। ক্রিকেট জীবনের ক্রীড়া-সংস্করণ’। তিনি অসাধারণ যে দৃশ্যপট এঁকেছেন, তাতে ক্রিকেট রাজ্যে সবাই রাজা: ‘এসব কথাও ভুলে যান। মনে রাখুন একটি শীতের অপরাহ্নকে। সোনালী রোদের মদ। সবুজ মাঠ। আতপ্ত সুতৃপ্ত অবসর। আপনি সেই অবসরের অধীশ্বর। আপনার ইচ্ছার সম্মানে সাদা ফানেলে ঢাকা ব্যাট-বল হাতে কয়েকটি অভিনেতা। আপনি রাজা, সত্যই রাজা। রূপকথাগুলো এখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি- স্বপ্নে ও কামনায় একটি নিতান্ত রাজা। রাজা হয়ে বসে আপনি খেলা দেখছেন- দেখছেন খেলার রাজাকে। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই খেলার রাজত্বে। (রমণীয় ক্রিকেট)। এছাড়া ‘রমণীয় ক্রিকেট’ গ্রন্থে ‘চায়ের পেয়ালায় ক্রিকেট’, ‘রমণীয় ক্রিকেট’, ‘নাতি রমণীয় ক্রিকেট’, ‘সমালোচকের সমালোচক’, ‘অস্ট্রেলিয়ানিজম’, ‘ক্রিকেটের কুরুক্ষেত্র’, ‘ক্রিকেটারের বউ’, ‘কলমে ক্রিকেট’, ‘ইডেন-গার্ডেনে’ লেখাগুলো ভিন্ন স্বাদের।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসের সব মহান ও মহৎ চরিত্ররা। ডব্লিউ জি গ্রেসের মত এতটা আকর্ষণীয়, রোমাঞ্চকর এবং অবিশ্বাস্য সব কীর্তি ও কুকীর্তি আর কোনো ক্রিকেটারের ঝুলিতে নেই- এ কথা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়। ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটগাঁথার এই নায়কের গোটা জীবনটাই ক্রিকেটময়। ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেললেও ৪৪ বছরের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ১২৪টি সেঞ্চুরি ও ২৫১টি হাফ-সেঞ্চুরিসমেত ৮৭০ ম্যাচে ৫৪ হাজার ২১১ রান, ২৮০৯টি উইকেট আর ৮৭৬টি ক্যাচ নিয়ে তিনি এক কিংবদন্তী হয়ে আছেন। ‘দ্য ডক্টর’ নামে খ্যাত গ্রেসকে বলা যায়, আধুনিক ব্যাটিং পদ্ধতির প্রবর্তক। বিশাল চেহারা, লম্বা দাঁড়ি ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির এই ক্রিকেটার তার মহত্ব, তার চালাকি ও তার অনবদ্য ছেলেমানুষি দিয়ে ক্রিকেটের রূপকথার নায়কে পরিণত হয়েছেন।  ক্রিকেটের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য এই চরিত্র ডব্লিউ জি গ্রেসকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে: ‘ক্রিকেট, গ্রেসের কাছে ক্রীড়ামাত্র ছিল না, ছিল জীবনের অঙ্গ। ক্রিকেট এবং জীবনবোধ- একই কথা এবং জীবন যেহেতু সাজানো ড্রইংরুম নয়, তাতে কৌতুক আছে, কৌশল আছে, ভদ্রতা এবং পরিমিত মাত্রায় ইতরতা- সবই আছে- গ্রেসের ক্রিকেটেও তাই ছিল। আনন্দোচ্ছ্বল দুর্বৃত্ততার গুণে জিতে গিয়েছিলেন গ্রেস। তার চরিত্রও ঐ রকমই ছিল। সাধারণ ইংরেজদের চরিত্রও তাই- সহানুভূতি, সহৃদয়তা, সংকীর্ণতা ও রক্ষণশীলতার বিচিত্র সমন¦য়। অন্য বিখ্যাত খেলোয়াড়রাও অনেকে খেলার মধ্যে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু তাদের সেই ব্যক্তিরূপ তাদের জাতিরূপের একাংশকে মাত্র প্রকাশ করেছে। অপরপক্ষে ডাঃ গ্রেস ছিলেন সকল সাধারণ ইংরেজের প্রতিনিধি। সুতরাং সাধারণের স্বভাব অনুযায়ী তিনি খেলা থেকে কৌতুকময় দুষ্টুমি বা ভদ্র স্বার্থপরতা বাদ দিতে পারেননি।’ (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
সুরে, সুধায় ও জীবনকে যারা মিলিয়েছেন ক্রিকেটের রাখীবন্ধনে, সেই ক্যারিবীয় দ্বীপের ক্যালিপসো সুর যেন শঙ্করীপ্রসাদ বসুর কলমে গেয়ে ওঠে গুণগুণ করে: ‘সারাক্ষণ বিদ্যুৎগতিতে খেলা চলে একসময় শেষ হলো। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। খেলোয়াড়রা মাঠের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল হাত-পা ছড়িয়ে। পরক্ষণেই আবার লাফিয়ে উঠে একটা গোটা বোতল গলায় ঢেলে দিল ঢক্-ঢক্ করে। ততক্ষণে সকলে ফিরে এসেছে। নারকেল গাছের তলায়, তেঁতুল গাছের অন্ধকারে, জ্বলে উঠেছে একে একে মশাল। খানাপিনা শুরু হয়। প্রচুর প্রচুর খায়, পানও করে তেমনি। পানে-ভোজনে-স্ফূর্তিতে মাতাল সবাই। মশালগুলো নিভে আসে, কিন্তু আকাশে ওঠে চাঁদ। তার আলো দুধের মতো গড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। দূর থেকে ভেসে আসে সমুদ্রের গর্জন। হু-হু ক’রে বাতাস বয়ে যায়। শিউরে ওঠে নারকেল বন। বাজনা বেজে ওঠে, বেজে ওঠে এক সুরে শত শত কণ্ঠ। সেই চন্দ্রধৌত রাত্রে সমুদ্রতটে, সরল উচ্ছ্বল মানবের প্রাণতটে, আছড়ে পড়তে লাগল সুরের পূর্ণ তরঙ্গ। শুরু হলো নৃত্য।’ (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
ক্রিকেট পৃথিবী রোমাঞ্চিত ও সঙ্গীতময় হয়ে ওঠেছিল পঞ্চাশের দশকে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের রাজপুত্র ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, মন্ত্রীপুত্র এভারটন উইকস ও কোটালপুত্র কাইভ ওয়ালকট। বার্বাডোসের সেন্ট মাইকেলে ত্রিশের দশকের মাত্র ১৮ মাসের ব্যবধানে জন্ম নেয়া বিশ্বখ্যাত এই তিন ক্রিকেটার ফুলে-ফলে ভরিয়ে দেন ক্রিকেটের বাগান। ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকালে অর্ভিষেক হওয়া বিখ্যাত এই তিন ‘ডাব্লিউ’র রানে ও গানে উছলে ওঠে ক্যালিপসো সুর। পৃৃথিবীর ক্রিকেট ইতিহাসে এমনভাবে তিনজনের সম্মিলন আর ঘটেনি। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে, কোনো টেস্টে তিনজনের একজনও কিছু করতে পারেননি। ‘মর্যাদার লাবণ্যে অনতিক্রান্ত ওরেল, আঘাতে আক্রমণে উন্মুক্ত উইকস, ঋজু শক্তির বহির্বিকাশে সুদৃঢ় ওয়ালকট’। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ১৫ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ৯টিতে জয়ী, ৩টি পরাজিত, ২টিতে ড্র ও একটিতে টাই করেন। ওরেলের ব্যাটের হাসি আর মুখের হাসি একাকার হয়ে গেছে। তার ভুবনভুলানো অতুলনীয় হাসিটি ক্রিকেটের সেরা সম্পদ হয়ে আছে। ওরেল ক্রিকেটে গেয়েছেন জীবনের গান। তিনি মনে করতেন” ‘সুখের সঙ্গে মানুষের মতো বেঁচে থাকো, তোমার কথা লিখে ইতিহাস মানুষের ইতিহাস হয়ে উঠুক’। ওরেলকে মনে করা হয় ‘সোজা ব্যাটের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যময় খেলোয়াড়’। ওরেলের মহানুভবতা ও রুচির আভিজাত্য ছিল তার সহজাত। মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনি মর্যাদার সঙ্গে খেলেছেন। উইজডেনের মতে, ‘মারের সৌন্দর্যে ক্রিকেটের ইতিহাসে ওরেলকে কেউ অতিক্রম করতে পারেননি’। ক্রিকেটকে যারা সুর-ছন্দ ও মাধুর্য দিয়ে কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে সেরা হলেন তিন ক্যারিবীয় শিল্পী ক্রিকেটার ওরেল-উইকস-ওয়ালকট। তারা ক্রিকেট খেলেছেন হৃদয় দিয়ে। ফ্র্যাংক ওরেলকে ‘প্রিন্স অব ডেনমার্ক’ অভিহিত করে শঙ্করীপ্রসাদ বসু যেভাবে গেঁথেছেন শব্দের মালা: ‘ফ্রাঙ্কি ওরেলের জন্য আমরা তাই প্রতীক্ষা করিÑ প্রতীক্ষা ক’রে থাকব চিরদিন। ওরেলরা আমাদের বর্ণহীন পৃথিবীতে সু-বর্ণময়। রুশো বলেছিলেন, ফিরে যাও। প্রকৃতির কাছে থাকলে তোমরা আরও বেশি ‘মানুষ’ থাকবে। জীবনের হারানো আনন্দকে খুঁজে পাবে দুয়োরানীর কুটিরে। কাউন্টি খেলার ব্যবসায়িকতা যখন ক্রিকেটকে বণিকবৃত্তিতে পর্যবসিত করেছে, কিংবা শেফিল্ড-শীল্ডের দুঃসাহসী ছোকরারা যখন ক্রিকেটে এনেছে ধারাবাহিক ভীতি-শিহরণ, তখন ওরেলরা ক্রিকেটের মুক্তিদূত। বাল্যের সহজ সুস্থ পবিত্র আনন্দকে যেন খুঁজে পাই এদের মধ্যে- ক্রিকেট খুঁজে পায় তার নির্মলতাকে। এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে ইডেন গার্ডেনে ওরেলের খেলা। শীতের দুপুরে একটি মিঠে প্রেমকাহিনীর মতো অলস আনন্দের ক্রীড়াবিস্তার। আক্রমণ নেই, আঘাত নেই- শুধু ব্যাট-বলের মধুস্পর্শ। সুখের খুশির বিহ্বল বিলাস। তার আঘাতকেও আঘাত বলে মনে হয়নি, এমনই আঘাতের ছন্দ। অতি বড় কঠিন কথাকেও সেদিন ওরেল বলেছিলেন কবির মতোই অবহেলার লাবণ্য-ভঙ্গিমায়। ক্রিকেটের একজন কবির নাম ফ্রাঙ্কি ওরেল। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)। এভারটন উইকসের ব্যাটে পাহাড়ের নদীর মতো রানের স্রোত নেমে আসে দুদ্দাড় করে। সেই ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে টেস্টে তিনি টানা পাঁচটি ইনিংসে সেঞ্চুরি করে যে রেকর্ড গড়েছেন, তা আজও অটুট আছে। টেস্টে দ্রুততম সহস্র রানের অধিকারী, ওই ক্রিকেটারের ‘তার স্বাভাবিকতা, তার অনায়াস প্রত্যয়, তার নিখুঁত সংহার, তার অচঞ্চল সমাপ্তি’ দিয়ে এমনই মাদকতা তৈরি করেছেন, যে কারণে দেশের পরাজয়ের মাঝেও প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারের প্রশস্তিতে মজে যান শঙ্করীপ্রসাদ বসু: ‘উইকসের সেঞ্চুরি মানে কলকাতার মাঠে ভারতের জেতার আশা শূন্যের দিকে সরে যাওয়া। কিংবা পরপর ইনিংসে টেস্ট-সেঞ্চুরি উইকসের গৌরব যত বাড়াচ্ছে, ভারতের গৌরব ঠিক পরিমাণে কমাচ্ছেÑ অবিশ্বাস্য বিশ্ব রেকর্ডটি করা হচ্ছে ভারতের বোলিং ও ফিল্ডিংকে ধূলায় মিশিয়ে। ওসব কোনো কথাই তখন আমাদের মনে হয়নি। কেবল দেখলুম। ব্যাটের তলোয়ার, বলের মৃত্যু, ফিল্ডারের বেড়ার দিকে পলায়ন। উইকস আমাদের সম্মোহিত করে, আমাদের সকল আঞ্চলিক, পেশাগত ও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতাকে জয় করে, একটি সুদীর্ঘ বাহবা আদায় ক’রে নিলেন। যে বাহবা গল্পের সুপরিচিত আত্মঘাতী বাহবার তুল্য; তরবারির অপূর্ব কৌশলে নিজ পুত্রকে বিভক্ত অথচ অবিচ্ছিন্ন দেখে দেশের প্রবীণ শস্ত্রবীর যেমন তারিফ করেছিলেন নবাগত চ্যাম্পিয়নকে। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
ওরেল-ওয়ালকট-উইকসরা ক্রিকেট মাঠে গেয়েছেন জীবনের গান। তাদের ব্যাটে যেমন ছিল সুরের নৃত্যগীত, তেমনি ক্রিকেটকে ভরিয়ে দিয়েছেন আনন্দের ঝরণাধারায়। ‘এরা খেলায় অনেক কিছু দিয়েছেন। এঁরা খেলাকে বাঁচিয়েছেন মৃত্যুর হাত থেকে। দ্রুত রানের বদলে ধীর রানের পৃথিবীব্যাপী প্রতিযোগিতার হিসাব-খাতা এঁরা পুড়িয়ে দিয়েছেন। কয়েদীর মৃত্যুশীতল চাহনি নিয়ে ক্রিকেটাররা যেখানে চেয়ে থাকে- সেখানে এঁরা গেয়েছেন জীবনের গান। এই তিন ক্রিকেট-মাস্কেটিয়ার্স উৎফুল্ল শৌর্যে অনতিক্রান্ত। অপরিসীম অর্থক্ষুধায় ক্রিকেটকে মারছে একদিকে কর্তৃপক্ষ, আনন্দলক্ষ্মী শিউরে উঠছেন কুবের-সঞ্চয় দেখে, অন্যদিকে পরাজয়ভীতি আচ্ছন্ন করেছে অধিনায়ক ও খেলোয়াড়দের। বক্সিংয়ের প্রদর্শনী-যুদ্ধের মতো ড্র করার প্রাণহীন ক্রিকেটযুদ্ধ। হারবো না- আগে বলত বীরপুরুষ। তারা হয় হারত, নয় জিতত। হারবো না- বলছে এখনকার সাবধানী ক্রিকেটাররা। ফলে তারা প্রায়ই হারছে কাপুরুষের মতো, জিতছে আরো কম, বেশি করছে ড্র। নিশ্চিত-নিরাপদ একটি মাঝারিপনা গ্রাস করেছে ক্রিকেটকে। বিলেতি ওল্ডদের রুচিহীন পোশাক আর নি®প্রাণ নাচের আড়ম্বরে ধরা পড়েছে ক্রিকেট’। (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)। অস্ট্রেলিয়ান  ক্রিকেটের ‘দুষ্টু বালক’ খ্যাত সিড বার্নসকে নিয়ে লিখেছেন ‘শেরউড বনের ক্রিকেটার’। ডন ব্রাডম্যানের দলের এই ক্রিকেটারের খ্যাতি ও অখ্যাতি তুমুলভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। বার্নসের ব্যক্তি জীবনের চমকপ্রদ দীর্ঘ কাহিনী তুলে ধরে লেখক লিখেছেন: ‘শেরউড বন গেল কোথায়! বার্নসের ভিতরে একটা অবুঝ দুরন্ত ক্রন্দন ও সন্ধান। সেই হাহাকারের স্বরূপ বার্নস নিজে সম্পূর্ণ বোঝেন নি। রবিন হুডের কয়েক শতাব্দী পরে তিনি জন্মেছেন। রবিনের সাম্রাজ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ভিতরের উৎকণ্ঠা যত তীব্র হয়েছে বাইরের জগতে তত উগ্র ও বেখাপ্পা হয়ে পড়েছেন। জীবনে বেড়া টপকানোর শেষ হলো না।’ (বল
পড়ে ব্যাট নড়ে)।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’। এই গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত। মহান ক্রিকেটার ভিক্টর ট্রাম্পার ‘বিদ্যুতের অক্ষরে ক্রিকেটে মহাকাব্যের অনেকগুলি পৃষ্ঠা লিখে গিয়েছিলেন মাঠে-মাঠে’। স্বপ্নের নায়ক ট্রাম্পারকে জীবনে প্রথম আউট করার পর স্পিনার আর্থার মেইলীর অনুভূতি হয়েছিল এমন : ‘অপসৃয়মান সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে কিন্তু কোনো জয়ের আলো ছিল না। একটি সুন্দর পাখীকে আমি মেরে ফেলেছিÑ হ্যাঁ, ঠিক তাই করেছিÑ আমি অনুভব করেছিলুম’। ট্রাম্পার মারা যাবার পর বলা হয়েছিল- ‘ঈগলের পাখা থেমে গেছে, এখন কাক আর চিলের কাল’। তার সম্পর্কে লিখেছেন: ‘পরমোজ্জ্বল সুপ্রখর প্রতিভা, অথচ সদানন্দ সুস্মিত মানুষ। প্রচ-তম আক্রমণের মধ্যেও সৌজন্যøিগ্ধ। সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাট করতে গিয়েছেন। মাঠ ভিজে, ভিজে মাঠের মহাপাতক জ্যাক স্যান্ডার্স বল করছেন। তার প্রথম বল ট্রাম্পারকে হারিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্যান্ডার্স ভাবলেন- পেয়েছি। সকলেই তাই ভাবল। ট্রাম্পার হাসলেন। এগিয়ে গিয়ে বললেন- পুরনো দোস্তের সঙ্গে একী ব্যবহার? যা হোক ভায়া, আজ তোমার দিন কি আমার দিন। সে দিনটা কারো নয়- একমাত্র ক্রিকেট-দেবতার। ট্রাম্পার ষাট মিনিটে একটি দেবভোগ্য সেঞ্চুরি করলেন’। (ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট)।
শ্রেষ্ঠতম ক্রীড়ার মহান নীতির প্রতিপালক আম্পায়ার। আম্পায়ার ছাড়া ক্রিকেট খেলার কথা ভাবা না গেলেও তাদের অবদানকে কেউ গুরুত্ব দিতে চান না। ক্রিকেট মাঠে তাদের অবহেলিত উপস্থিতি। আম্পায়ারদের প্রসঙ্গে শঙ্করীপ্রসাদ বসু চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন: ‘হিন্দু বিয়ে বাড়িতে পুরোহিতের ঐ একই অবস্থা। উৎসবের অগ্নিসাক্ষী ও মন্ত্রপাঠ যিনি করাচ্ছেন, তিনি কে, কি রকম দেখতে- তা কি ভালো ক’রে চেয়ে দেখা হয়? তিনি না এলে চেঁচামেচি, থাকলে খেয়াল নেই। কাজকর্ম মিটবার পরে ভক্তিমতী স্থূলাঙ্গী বাড়ির গৃহিণী গলায় কাপড় দিয়ে হাঁসফাঁস ক’রে তাকে প্রণাম করেন, তিনি যদি অধিকন্তু হৃদয়াবতী হন, তাহলে মিছরির জলের সঙ্গে পান্তুয়ার অর্ডার দিয়ে সোরগোল তোলেন, তারপরে জানিয়ে দেন বিগলিত শ্রদ্ধায়- ‘ঠাকুরমশাই তো আর কিছু খাবেন না’। এদিকে যে-সব ছেলে-ছোকরা কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পরিবেশনের নামে হট্টগোল করেছে, কনেকে ঘুরিয়েছে সাতপাক, পাউডার-ঘষা ঘাড় উঁচু ক’রে বরের ফ্রেন্ডরূপে বিয়ে দেখতে গিয়ে ভালো ক’রে দেখেছে কনের ফ্রেন্ডদের- তাদের কাছে চিরকালই পুরুতব্যাটা পাজি, মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে টাকা হাতাবার যম। দয়া ক’রে যদি তারা বিবাহ-সম্পাদক আর্য ব্রাহ্মণটিকে কত ধরে দেয়া হয়েছে খোঁজ নিতেন! আম্পায়ারের ‘মাহিনা’ কত খোঁজ নিয়েছেন আপনারা?’ (ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট)।
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘নটআউট’। ১৯৬৪ সালে ইডেন গার্ডেনে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচের শীতের তীব্র হাওয়া হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও পাঁচ দিনের খেলা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। ক্রিকেট থেকে ‘অনিত্যের মধুপান’ করেছেন। তার রোমান্টিক চোখে ক্রিকেটীয় সুধা পান করার পাশাপাশি ক্রিকেট মাঠের রসিকতাটুকুও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। পঞ্চ দিনস্থায়ী বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশটি তার কাছে মনে হয়েছে বিশ্বজীবনের খ-রূপে। তাই ম্যাচ শেষে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর হৃদয়ে বয়ে যায় আরেক অনুভূতির মিশ্র অনুভূতি: ‘.........আমরা সকলে যখন পঞ্চম দিনের শেষে হাজির হলুম- যখন মাঠ ছেড়ে যাবার সময় এল- তখন সহসা অভাবিত নিঃস্বতায় ভরে গেল মন- ক্রিকেট হারালুম বলে নয়, অনেক মানুষের সঙ্গ হারালুম বলে। ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে বহু মানুষের সঙ্গ পাই আমরা- আজ ক্রিকেট আমাদের সামাজিক উৎসব।
একটা অদ্ভুত সত্য অনুভব করলুম- ফুটবল জাতীয় ক্রীড়া হলেও সামাজিক অনুষ্ঠানের চেতনা মনে জাগায় না। ক্রিকেট তেমন মনোভাবকে জাগাতে পারে এই জন্য যে, সে অনেকগুলি মানুষকে অনেকক্ষণ একত্র রাখে। নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়, নতুন সান্নিধ্যের। রেলের কামরায় বহু ঘণ্টার যাত্রা যেমন মানুষকে এনে দেয় অচেনা মানুষের কাছে, এখানেও তেমনি- বিদায় নেবার আগে এখানেও আবার ফিরে  দেখা হওয়ার কামনা- যে ইচ্ছার জীবন যদিও পথে নামার পরেই পায়ে-পায়ে গুঁড়িয়ে যাবে।’ (নট আউট)। ক্রিকেট মাঠের উপেক্ষিত দ্বাদশ-ব্যক্তিদের মনোবেদনা লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি: ‘তাকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্রিকেটের এই বাধ্য বাহনটি অঙ্গে জিন চড়িয়ে রেডি থাকবেন- কখন ছুটতে হয়। নিজ দলের ব্যাটিং ও ফিল্ডিং কোনো সময়েই তার অব্যাহতি নেই। সারাক্ষণ জামা-জুতো পরে তটস্থ। যখন নিজ দল ফিল্ডিং করছে, তখন তো ‘ঘরের বাহিরে দ-ে শতবার’। কারণ এগারোজন খেলোয়াড় বিনা অসুস্থতায় মাঠে বিরাজ করতে পারে না, কিন্তু যখন নিজ দল ব্যাটিং করছে, তখনো অ্যাটেনশন। নিজ দলের ফিল্ডিং করার সময়ে দ্বাদশ ব্যক্তি মাঠে নামলে তবু কিছু মর্যাদা পায়। কারণ সাধারণভাবে সে ফিল্ডিং-এ পারদর্শী এবং  বোলার ও উইকেটকিপার ছাড়া সকলেই এক জাতীয় ফিল্ডার। (নট আউট)।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘লাল বল লারউড’ গ্রন্থে বডিলাইন সিরিজের অন্যতম নায়ক ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউডকে কেন্দ্র করে বডিলাইন সিরিজের গোটা ইতিহাসের রোমাঞ্চকরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ট্রাজিক চরিত্র হ্যারল্ড লারউড। তার জীবনে ছিল নাটকীয়তা ও রোমাঞ্চের সমন¦য়। নটিংহ্যাম্পশায়ারের কয়লাখনির এই শ্রমিক খনির অন্ধকারের মধ্যে কাজ করার সময় ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখতেন। অদম্য মনোবল ও তীব্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তিনি ওঠে আসেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাদপ্রদীপে। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে ইংল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়া সফরটি কুখ্যাতি পায় ‘বডিলাইন’ সিরিজ হিসেবে। অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী ডন ব্রাডম্যানকে টার্গেট করার ক্ষেত্রে উদ্ধত, কঠিন শীতল সাহস ও উত্তেজক মেজাজের ধুরন্ধর অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের হাতের পুতুল হয়ে ওঠেন লারউড। বিরল জাতের এই ফাস্ট বোলার অস্ট্র্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের মাথা ও শরীর লক্ষ্য করে গোলার মত যে মরণঘাতি বাউন্সার ও বাম্পার ছুঁড়ে মারেন, যা লেগ-থিয়োরি হিসেবে খ্যাত, তা তীব্র বিতর্কের জন্ম নেয়। এমনকি এ নিয়ে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেকার সম্পর্ক ক্ষুণœ হওয়ার উপক্রম হয়। যাবতীয় বিতর্ক ও সমালোচনাকে মাথা পেতে নিয়ে সমস্ত শক্তি নিংড়ে বল করে সিরিজ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হ্যারল্ড লারউড। অথচ অকারণ অপবাদের কারণে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে ইংল্যান্ড দলের হয়ে তার আর ক্রিকেট খেলা হয়নি। বডিলাইনের শিকারী এবং শিকার যিনি একদেহেÑ সেই লারউডের নামে ইতিহাসনাট্যের যবনিকামোচন করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। লারউডের উঠে আসার কাহিনী বিস্ময়কর : ‘আগের গোটা রাত্রি সে কাজ করেছে কোলিয়ারীতে। তবু খেলতে নামল ম্যাচে। এত গরীব যে, ক্রিকেট-বুট জোটাতে পারেনি। সাধারণ জুতো পরেই খেলছে। কয়েক ওভার বল করার পর নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। সঙ্গী খেলোয়াড়রা বলল, যাও যাও, বিশ্রাম করো, আর খেলে কাজ নেই। ছেলেটি শুনল না। বল ক’রে চলল- কারণ, সে খনির অন্ধকারের মধ্যে কাজ করার সময়ে ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখে। অন্ধকারেই সে কল্পনার বল ছোঁড়ে- বল গিয়ে ছিটকে দেয় স্টাম্প- তার শব্দ ছড়িয়ে পড়ে- ঘুরপাক খায় টানেলের গায়ে-গায়েÑ কল্পনার কানে সে শোনে। সেখানে এই সত্যকার খেলায়- জীবনের প্রথম এই বড় খেলায়- ঘেমে যাবে সামান্য নাকের রক্তের জন্য? কখনো না, কখনো না। রক্ত মুছে ছেলেটি ছুটতে শুরু করে আরও জোরে। আরও জোরে বল- আরও জোরে। রক্ত পড়া বেড়ে যায়। গলগলিয়ে ঝরে পড়ে- জামা রক্তে রাঙা। সবাই বলে- চলে যাও, চলে যাও। না- না- না। হঠাৎ ছিটকে পড়ে মিডলস্টাম্প- আঃ! রক্ত-মোছা হাতে আবার বল ছোঁড়ে- রক্তপাতে আর অসহ্য আনন্দে দুর্বল হয়ে পড়ে সে। তবু- তৃতীয় বল- ভেঙে গেল অফস্টাম্প। রক্তের মূল্যে ছেলেটি জীবনের প্রথম হ্যাটট্রিক পেল! সে ক্রিকেট খেলবে না? ক্রিকেট যে তার কাছে বাঁচার একমাত্র কারণ!’ (লাল বল লারউড)।
দ্রুতগামী বোলারের মনের কথাকে লেখক ভাষা দিয়েছেন এভাবে: ‘বোলিং হয়েছে তীব্র থেকে তীব্রতর। নিজের শরীর লাল ক’রে ফাস্ট-বোলারকে বল করতে হয়। তাদের বিষয়ে বলা হয়, পায়ের বুট-জুতোর মধ্যে তাদের মাথা লুকিয়ে থাকে। ঘর্ষণে-ঘর্ষণে পায়ের চামড়া উঠে যায়, শরীর জ্বলতে থাকে যন্ত্রণায়, লুটিয়ে পড়ে কান্তিতে, কিন্তু যখন ছিটকে যায় উইকেট- আঃ অপরূপ সে সঙ্গীত! যখন ব্যাটসম্যানের শরীরকে হিম ক’রে দিয়ে গা ছুঁয়ে বেরিয়ে যায় উষ্ণ বলÑ তখন কিবা উপভোগ্য সেই আতঙ্ক! -আমার বলে খেলার সময়ে ভুল করা চলবে না, কদাপি না, আমি ফাস্ট-বোলার! যদি ভুল নড়েছÑ উড়িয়ে নিয়ে গেঁথে দেব স্ক্রীনে। আমি ফাস্ট-বোলার- হ্যাঁ, আমার আক্রমণ শারীরিক আক্রমণ। আমার রক্তে পুড়ে ঐ আগুনের গোলার মতো বল ছুটেছে? ফাস্ট-বোলিংকে ভয় করে না কে?’ (লাল বল লারউড)।
শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সপ্তম গ্রন্থ ‘সারাদিনের খেলা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন তিন কৃতী ‘ভারতীয়’ ক্রিকেটার কে এস রণজিৎ সিংজী, কে এস দলীপ সিংজী ও পতৌদির নবাব ইফতিখার আলী খান। এদেরকে নিয়ে ইংরেজ ক্রিকেট লিখিয়েদের মন্তব্যগুলো খুঁজে পেয়েছে তার ক্রিকেট-পিপাসু মন। পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজদের মত করে ক্রিকেট খেলতেন রণজিৎ সিংজী। তার বিদায় ইংরেজদের ক’রে তোলে আবেগমথিত: ‘শেষ বল গড়িয়ে গেছে মাঠের উপর দিয়ে। এবারের মতো খেলা শেষ। .... লর্ডসের গ্র্যান্ড-স্ট্যান্ড নির্জন, শূন্য। ক্রিকেটকে বিদায় দিয়েছি আমরা, আর বিদায় দিয়েছি ক্রিকেটের রাজাকে। ক্রিকেট আবার আসবে যখন ফিরবে বসন্ত, নতুন তৃণ, তরু। কিন্তু রাজা ফিরবেন না। কারণ জামসাহেব এখন চল্লিশে পৌঁছে গেছেন। দেহ হয়ে পড়েছে স্থূল। সেই সঙ্গে তার রাজ্য নবনগর। সেখানকার মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, উজ্জ্বল রৌদ্র, মসলাগন্ধ, তালীবন তাকে ডাকছে রাজকর্তব্য পালনের জন্য। প্যাভিলিয়নের সিঁড়ি দিয়ে মুখভরা হাসি নিয়ে লঘুপদে নেমে আসতে আর তাকে দেখা যাবে না। সুখরৌদ্রের মধ্যে আসীন থেকে তার অতুলনীয় রূপকলা দেখতে দেখতে সারাদিন কেটে যেত। তারপর যখন সন্ধ্যার ছায়া আড়াআড়ি রেখা টেনে দিত তৃণাস্তীর্ণ মাঠের উপরে, তখন আমরা ফিরে যেতাম মাঠ থেকে তৃপ্তিভরা মন নিয়ে- না, তা আর ঘটবে না। বহু সমাদৃত ধন্য অভিনেতা শেষ রজনীর শেষে বিদায় নিয়েছেন। এখন তিনি শুধু স্মৃতি-সুখস্মৃতির রাজ্যে। নমস্কার করি, নমস্কার! জাম সাহেব। ক্ষুদ্র রাজ্যে রাজকুমার-বৃহৎ খেলার সম্রাট’। (সারাদিনের খেলা)।
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ¡ী সম্রাট শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলাদেশে খুব বেশি পরিচিত বলে মনে হয় না। যে কারণে তার কোনো গ্রন্থ খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব। তবে ক্রিকেট-পিপাসু কিছু অনুরাগী আছেন, যারা তার লেখার সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচিত। এদের একজন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ নূরুল আনোয়ার। রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ক্রিকেটের পাগলপ্রেমিক এই ভদ্রলোক শুধু তার অনুরাগীই নন, তাকে ‘সর্বদাই অত্যুক্তিতে উদ্ব্যস্ত’ করে চলেছেন। যে জন্য প্রতিটি গ্রন্থে ডঃ নূরুল আনোয়ারকে প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন লেখক। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে অধ্যাপক নূরুল আনোয়ারের মূল্যায়নটা এমন: ‘ইডেনে শীতের দুুপুর’ (১৯৬০), ‘রমণীয় ক্রিকেট’ (১৯৬১), ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ (১৯৬২), ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’ (১৯৬৩), ‘নট আউট’ (১৯৬৫), ‘লাল বল লারউড’ (১৯৬৭) এবং ‘সারাদিনের খেলা’ (১৯৭৬)- এই সাতটি ক্রিকেট-কাসিকের যে কোনোটিই পড়তে থাকলে ঐন্দ্রজালিক কথোপকথন, দুর্লভ বাক্শক্তি, চাতুর্যপূর্ণ লেখার শক্তি ও মনোরমময় বর্ণনা পাঠককে নিমেষে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলবে (যেমন হয়ে থাকে উচ্চতর প্রতিভাবান গায়ক-গায়িকার উচ্চতর রীতির গান শুনে), স্বচক্ষে দেখা বা শোনা ক্রিকেট খেলা, খেলোয়াড়দের চরিত্র, ক্রিকেট-ঘটনা পাঠকের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং বিমূর্ত ভাব সৃষ্টি করবে। পাঠকের সৌভাগ্য, বৈষ্ণব সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছ থেকে- জীবন থেকে টেনে এনে, অন্তরঙ্গ অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টি ক্রিকেটের বহু চরিত্র ও ঘটনাকে তারা অনুপম সাহিত্য মাধ্যমে পড়তে পেরেছেন। সংস্কৃতিমান বাঙালি ক্রিকেট-অনুরাগী সন্ধান পেয়েছেন অবিশ্বাস্য আনন্দলাভের এক দুর্লভ উৎস। ক্রিকেট-অনুরাগীদের মধ্যে যারা সমাজসচেতন ও মননসমৃদ্ধ, যারা সকল ঘটনা বিশ্লেষণধর্মী মন নিয়ে দেখে থাকেন এবং সঙ্গীত, সাহিত্য ও ক্রীড়া দিয়ে অবিমিশ্ররূপে যাদের মন তৈরি, তাদের কাছে শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট গ্রন্থগুলো মূল্যবান দলিল ও অমূল্য শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হবে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির গভীরতর বিষয়কে ধারণ করতে পেরেছেন বলেই শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট-লেখা শীলিত ও আলোকিত ও বর্ণাঢ্যময় এবং বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে উত্তীর্ণ’।
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের রূপকার শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটবিষয়ক সাতটি অসাধারণ গ্রন্থ লিখে চুকিয়ে দিয়েছেন তার লেনদেন। এ কারণে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: ‘ক্রিকেট লেখার সময় সারাক্ষণ মাথায় ক্রিকেট ঘুরত। অনেকগুলো ক্রিকেট বই লেখার পর মনে হল, আমার যতদূর সাধ্য লিখে ফেলেছি। আরও ভালো কিছু লেখার ক্ষমতা নেই। এখন ইতি টানাই উচিত। তাছাড়া আমার মূল কর্মবৃত্তির সঙ্গে এই ক্রিকেট-লেখক ভূমিকার একটা সংঘাত ছিলই’।
শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেট লেখা থেকে দূরে সরে গেলেও পাঠকরা কিন্তু তাকে কখনো ভুলতে পারেনি। ক্রীড়া সাহিত্যের যে রস তিনি উপহার দিয়েছেন, তা পাঠকদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। আর কোনো লেখক এখন অব্দি তার শূন্যস্থান পূরণ করতে না পারায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু পাঠকের মনের মণিকোঠায় চির-অম্লান হয়ে আছেন। তার লেখা এখনকার পাঠকদের দারুণভাবে আপ্লুত করে। আর এ কারণে তার সাতটি গ্রন্থের সমন¦য়ে ১৯৭৬ সালে দুই খণ্ডে ‘ক্রিকেট অমনিবাস’ এবং ১৯৯৯ সালে বাছাইকৃত লেখা নিয়ে ‘বাছাই ক্রিকেট’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
ষাট দশকের মাঝামাঝি গগনচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাবস্থায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখির সঙ্গে তার রাখীবন্ধন ছিন্ন করেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে কোলকাতায় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসলে একটুখানি নড়ে বসেন তিনি। প্রায় তিন দশকে বদলে গেছে ক্রিকেট। ওয়ানডে ম্যাচ ক্রিকেটে রীতিমত বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ধ্রুপদী ক্রিকেটের পরিবর্তে এখন একদিনের রোমাঞ্চকর ক্রিকেট। শুধু ক্রিকেট নয়, দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও অনেক বদল ঘটেছে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুও মনে করেন: ‘যুগ বদলেছে। ক্রিকেটের পঞ্চদিবসী অবসর বিনোদনে মানুষের মন নেই। বাঙালি জাতি এখন ঘোর-ওয়ার্ক-কালচারী-অফিস-আদালতে সে দমবন্ধ ক’রে খেটে যাচ্ছে। সে জন্য টানা পাঁচদিন অফিসে কলম-ধর্মঘট না ক’রে একদিনের ধুদ্ধুমার ক্রিকেটের নাচনে মেতেছে।’ পরিবর্তনের এই হাওয়াকে শঙ্করীপ্রসাদ বসু অস্বীকার করেননি। বড় ধরনের ধাক্কা খেলেও মেনে নিয়েছেন যুগ-রুচিকে। যুগের চাহিদাকে।
‘সুপারহিট ক্রিকেটিলা’ শিরোনামে ‘দেশ’ পত্রিকায় তিনি লেখেন: ‘এখন হিসেবি উত্তেজনা। এখন ঘড়ির খেলা আর কড়ির খেলা। ওভার মেপে, ঘড়ি ধরে বলতে হবে, ওহে ব্যাটধারী, এইবার তুমি ঠ্যাঙাড়ে হও, খেপে যাও, এসে গেছে ধাতানি-পর্ব (স্লগ-ওভারস্)। এখন-মার কাটারি, ধুন্ধুমার। নবমীর পাঁঠাবলি। ড্যাংডাং, ড্যাড্যাং পাঁঠা পড়ছে আর রক্তপাগল ভক্তরা হিংস্র উল্লাসে মাঠ .......একদিনের ক্রিকেটকে ঠেকানো যাবে কী ক’রে এই মুক্ত অর্থনীতির দিনে। যখন ফাস্ট ফুডে বাজার ছেয়ে গেছে! সুতরাং পুরনো রীতি- দূর হঠো দূর হঠো। রক্তে আমার ঝড়ের মাতামাতি, যায় যদি যাক নিভে আমার প্রাচীন শ´েখর বাতি’। এরপর তিনি সোনায় মোড়া তার ক্রিকেট সাহিত্যের কলমখানি সম্ভবতঃ চিরদিনের মত রেখে দিয়েছেন দেরাজে। শিক্ষক অলোক দাসের ভাষায়: ‘বৈষ্ণব শাস্ত্রের গভীর পাণ্ডিত্য ও অভিজ্ঞান ক্রমে ক্রমে বিবেকানন্দ লোকমাতার গৈরিক বর্ণে আচ্ছন্ন হ’ল। হারিয়ে গেল ইডেনের সবুজ মাঠ’। কিন্তু শঙ্করীপ্রসাদ বসুর যারা অনুরাগী পাঠক, তারা তার অনুপস্থিতি অনুভব করেন পলে পলে। তাদের একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রসেনজিৎ বন্দোপাধ্যায় : ‘সকালের খবরের কাগজের জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকতাম। কাগজ পেয়ে প্রথমেই খেলার পাতাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা! চুলোয় যাক পরিষ্কার চোখ রাঙানি, বাবার ধমকানি। এই খেলার পাতাতেই প্রথম তার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং প্রথম দর্শনেই (পঠনেই) গভীর প্রেম। কে এই শঙ্করীপ্রসাদ বসু? ইনি তো কোন কাগজের সাংবাদিক নন! লেখার শৈলীটিও তো সাধারণ ক্রীড়া সাংবাদিকের মতো নয়! এ এক নতুন ধারা, নতুন রীতি। ক্রিকেট যে সাহিত্য হতে পারে, সাহিত্যের মন্দিরে এদেশে এতদিনের ব্রাত্য ক্রিকেটের যে অনায়াস গমনাগমন থাকতে পারে, আমার কিশোর চোখ আগে তা দেখেনি। খ্যাতনামা ইংরেজ ক্রিকেট-সাহিত্যিকদের কোনো লেখা তার আগে পড়িনি। ‘শঙ্করীপ্রসাদের’ হাত ধরেই প্রথম ক্রিকেট সাহিত্যের আঙিনায় উঁকি দিলাম এবং স্তব্ধ হয়ে গেলাম এর বিশাল সমারোহ এবং আভিজাত্য দেখে। তারপর থেকে তার হাত আর ছাড়িনি।’ . .........ষাটের দশকে যে অসাধারণ চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট-সাহিত্যের রস আস্বাদন করেছি, আজ এই সহস্রাব্দের মুখে দাঁড়িয়ে তার অভাবে নিদারুণ তৃষ্ণার্ত আমরা। এই ফরমাইসী, চটুল, অন্তঃসারশূন্য, ক্রীড়া-সাংবাদিকতার যুগে শঙ্করীদা’র মতো উচ্চ শ্রেণীর লেখনীর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। বিশ্বাস করি, তার লেখা পড়লে নতুন প্রজন্মের মানুষরা সৎ ক্রীড়া-সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত না হয়ে পারত না। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? এই বয়সে কি আর তিনি নতুন কলমে নতুন কালি ভরে নতুন চশমা পরে খেলার কথা লিখবেন? জানি না। বোধ হয় লিখবেন না, খেলার প্রেরণা অনুভব করবেন না। তার মন এখন অন্য গগনচুম্বী, যেখানে ঠাকুর-স্বামীজি-নেতাজির জীবন তাকে আরও গভীরভাবে আকর্ষণ করে। হয়তবা এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতির গভীরতর আকর্ষণে তিনি বস্তুজীবনের কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আর তেমন টান অনুভব করেন না। হয়তবা কাঞ্চন-কৌলীন্যের দাস, হৃদয়হীন, কম দক্ষ খেলোয়াড়ের ক্রীড়াদক্ষতা আর তাকে সেভাবে চঞ্চল করে না। হয়তবা তরলমতি পাঠকদের পড়াশুনার গভীরতা বা ব্যাপ্তির বিষয়েই তিনি সন্দেহমুক্ত নন। সে যাই হোক, আপন পথে চলেই তিনি বিজয় পতাকা ওড়ান। তাতে আমাদের মত গুণমুগ্ধদের আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু যদি কখনও, কোনোদিন কলমে আবার খেলাকে তুলে নেন, যদি আবার গদ্যের মধ্যে পদ্য করে ক্রিকেট-সুন্দরীর গায়ে
রঙ-বেরঙের নকশা কাটেন, যদি ময়দানের খেলুড়েরা রাজপুত্র, কোটালপুত্র হয়ে তার ক্রিকেট-রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়ে, যদি অলস শীতের দুপুরে গ্যালারিতে বসে থাকা মানুষেরা তার ক্রিকেট-অ্যাম্ফিথিয়েটারে ঢুকে পড়ে- তবে? তবে আমি আবার ইডেনে আসব, তার হাত ধরে’।
এখন অনেক পাল্টে গেছে ক্রিকেট। এসেছে ওয়ানডে ক্রিকেটের জোয়ার। ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলার বোলের মত ক্রিকেটেও দ্রুততার ঝড় বইছে। ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে যেমন উত্তাল সমুদ্রের প্রলয়ঙ্করী ঢেউ, তেমনি বোলারদের বলে মহাকাশ যানের তীব্র গতি। ক্রিকেটে এখন রঙের বাহার। নানা রঙে ধাঁধিয়ে যায় চোখ। ২৪ ঘণ্টাই এখন ক্রিকেটের। দিনেও ক্রিকেট, রাতেও ক্রিকেট। ফাড লাইটের আলোয় ক্রিকেটের রূপ খোলতাই হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ড্রইংরুমে নিয়ে এসেছে ক্রিকেটকে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায় ক্রিকেটের মাধুর্য। টিভি আম্পায়াররা যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে সিদ্ধান্ত দেন, তেমনি দর্শকরা একই বল নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে পারেন। সঙ্গে নানা গ্র্যাফিক্স ও তথ্যের সমাহার। ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেটার ও ক্রিকেট প-িতদের পু´খানুপু´খ বিশ্লেষণ। সবই টাটকা। এখন সবচেয়ে সহজলভ্য পণ্য ক্রিকেট! পণ্য তো বটেই; কেননা ক্রিকেটকে ঘিরে বিশাল ব্যবসা গড়ে ওঠেছে। আর এই ব্যবসায়ীরা তাদের মর্জিমাফিক পরিচালনা করছেন ক্রিকেটকে। যে কারণে ক্রিকেটের সেই বনেদীয়ানাটা হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্রিকেটকে ঘিরে কত গল্প আর কাহিনীর ঘনঘটা। ইলেট্রনিক্স মিডিয়া আলাদীনের চেরাগের মত ক্রিকেটের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় দর্শকের দরবারে হাজির করলেও তাতে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। কল্পনাশক্তি আর রসের ভিয়েন মিশিয়ে কলমের ক্রিকেটের ঐন্দ্রজালিকতা পাঠককে যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়। অথচ ক্রিকেটের নতুন দিনের সুর, ছন্দ ও রোমাঞ্চকে শব্দে শব্দে খোদাই করার জন্য নেভিল কার্ডাস, জ্যাক ফিঙ্গলটন কিংবা পেলহ্যাম ওয়ার্নারের মত সহজাত সৃজনী ক্ষমতার অধিকারী ক্রিকেট লিখিয়েদের অভাব এখন দারুণভাবে অনুভূত হয়ে আসছে। এরা ক্রিকেট সাহিত্যকে মহাসমৃদ্ধশালী ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পংক্তিতে স্থান করে দেয়ার পাশাপাশি চিরঞ্জীব করে রেখেছেন সেই সময়ের ক্রিকেটার ও ক্রিকেটকে। বাংলা ভাষায় ক্রিকেটকে ভালবেসে এই কাজটি করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তিনি স্বপ্ন, কল্পনা ও ভালবাসা দিয়ে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে যে পথ দেখিয়ে গেছেন, তা এ কালের ক্রিকেট রসিকদের কাছে মনোবেদনার কারণ হয়ে আছে। কেননা শঙ্করীপ্রসাদ বসু সরে দাঁড়ানোর পর বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য যেন হঠাৎ থমকে গেছে। কলমের ক্রিকেটের সেই মাধুর্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালির ব্যাটে-বলে যখন নতুন দিনের সূর্য, তখন বাঙালির ক্রিকেট সাহিত্যে যেন অস্তগামী সূর্যের আভা। বাঙালিদের একটি দল যখন টেস্ট ক্রিকেট খেলছে এবং সৌরভ গাঙ্গুলি শুধু ভারতকে নেতৃত্বই দিচ্ছেন না, বিশ্ব ক্রিকেটে গড়ছেন নতুন নতুন মাইলফলক, তখন বাঙালি ক্রিকেট লিখিয়েদের কলমে কেন বেলা শেষের গান? এমন একটা সন্ধিক্ষণে বারবার মনে পড়ে যায় শঙ্করীপ্রসাদের কথা। তার মিষ্টি-মধুর কলমের কথা।
তথ্য সূত্র :
১) বাছাই ক্রিকেট : শঙ্করীপ্রসাদ বসু
২) শঙ্করীপ্রসাদ : ব্যক্তি ও সৃষ্টি : শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থ

ক্রীড়াজগত : ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৫

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

ফুটবলে জীবনের জয়গান / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ