বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ
ক্রীড়াঙ্গনটা বড্ড অদ্ভুত এক জায়গা। যতক্ষণ দ্রুত ছুটতে পারা যায়, উঁচুতে উঠতে পারা যায় এবং শক্তিশালী প্রমাণ করা যায়, ততক্ষণই থাকা যায় পাদপ্রদীপের আলোয়। আলো নিভে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রাস করে রাশি রাশি অন্ধকার। জীবনের এ এক বিচিত্র নিয়ম- যতটা দেয়, আবার ফিরিয়েও নেয় ততটা। আজকের অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির অন্ধকারে। তাদের কীর্তি ধূসর হয়ে আড়াল পড়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন তো আরো এক ধাপ এগিয়ে। হিরোকে জিরো বানাতে মোটেও সময় লাগে না। আবেগ, উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসায় যাকে বরণ করে নেয়া হয়, তাকে আবার দূরে সরিয়ে দিতে আমরা খুবই পারঙ্গম। কত কীর্তিমান যে সময়ের পলেস্তরায় চাপা পড়ে গেছেন, তার হদিস করা হয়ে উঠছে না।
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এমন একজন ক্রীড়াবিদ হলেন সাঁতারু মোহাম্মদ আরশাদ হোসেন। এই প্রজন্মের অনেকেই তাকে চেনেন না। চেনার কথাও নয়। ক্রীড়াঙ্গনে এখন আর তিনি সরব নন। বেছে নিয়েছেন নিভৃতচারী এক জীবন। অথচ এদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে তার নামটি সোনার হরফে লেখা থাকার কথা। তার যে কীর্তিগাথা- তা যে কোনো বাঙালির কাছে গৌরবের স্মারক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সেই পাকিস্তান আমলে কোনো বাঙালির আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক পাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। কেননা তখন তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সুযোগ পাওয়াটা ছিল বড় ব্যাপার। বাঙালিদের সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কার্পণ্য রীতিমতো প্রবাদ হয়ে আছে। এর মধ্যেও নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন আরশাদ হোসেন। শুধু তাই নয়, তিনি সম্ভবত একমাত্র বাঙালি ক্রীড়াবিদ, যিনি পাকিস্তান আমলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে স্বর্ণপদক জয় করার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। অসাধারণ কীর্তি গড়ে বাঙালির মুখ আলোকিত করলেও তিনি রয়ে গেছেন বরাবরই প্রচারের আড়ালে।
পাকিস্তান আমলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাঙালির সাফল্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরশাদ হোসেনের নামটি উঠে আসে কিংবদন্তি সাঁতারু অরুণ নন্দীর মুখে। তার কাছে নামটি জানার পর আরশাদ হোসেনের বিষয়ে কৌতূহল বেড়ে যায়। এ বিষয়ে আগ্রহ দেখান প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানও। তিনি আরশাদ হোসেন সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। অরুণ নন্দীর সহযোগিতায় আরশাদ হোসেনকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। উদ্ধার করা সম্ভব হয় বিস্মৃত একটি অধ্যায়। আরশাদ হোসেনের বর্তমান অবয়ব, দৈহিক গড়ন ও কাঠামো দেখলে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়- এক সময় তিনি ছিলেন সাঁতারু। বয়স ৭২ হলেও শারীরিক জরা তাকে কাবু করতে পারেনি। সাঁতারুদের শরীর কখনো নুইয়ে পড়ে না- প্রচলিত এ ধারণা প্রবীণ এই সাঁতারুকে দেখলে কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যায়। এখনও অনবরত ছুটতে পারেন তরুণের মতো।
আরশাদ হোসেন তার সাফল্য ও অর্জন নিয়ে এখন আর কোনো তাগিদ অনুভব করেন না। বলা যায়, খেলোয়াড়ী জীবনে গড়া তার গৌরবগাথা নিয়ে অনেকটাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। নিজের জীবনের সেরা সময়টা খেলাধুলায় সঁপে দিয়েও প্রাপ্তির খাতায় তার খুব বেশি সঞ্চয় নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি বা সম্মাননা তার এখন অব্দি জোটেনি। তিনি হারিয়ে ফেলেছেন খেলার মাঠের অনেক সঞ্চয় ও স্মৃতি। এ নিয়ে অবশ্য তার কোনো আক্ষেপ নেই। এখন তিনি আর কোনো কিছু প্রত্যাশা করেন না। জীবনের সোনালী দিনগুলো মেলে ধরার ব্যাপারেও তার অপরিসীম কুন্ঠা।
১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দিতে মোহাম্মদ আরশাদ হোসেনের জন্ম। খুব অল্প বয়সেই সাঁতারটা হয়ে উঠে তার জীবনযাপনের অংশ। গ্রামের বাড়ির পুকুরে শারীরিক ব্যায়ামের অংশ হিসেবে প্রতিদিনই সাঁতার কাটতেন। সুস্থ দেহ, সুস্থ মন- এই জীবনদর্শন তাকে সাঁতারু হতে অনুপ্রাণিত করে। স্কুলে যাবার আগে সাঁতার কাটা তার প্রাত্যহিক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। গৌরীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে অংশ নেন। ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বুকসাঁতার। ছুটতে পারতেন সবার আগে। ১৯৫০ সালে কুমিল্লার পুলিশ লাইন পুকুরে আন্তঃস্কুল সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে প্রথম তিনি সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হন। ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি প্রথম হন।
১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর যোগ দেন নৌবাহিনীতে। এরপর সাঁতারে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ইন্টার সার্ভিস সাঁতারে তার সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক, ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ও ওয়াটারপোলোতে অংশ নিয়ে তার সাফল্য ছিল অবধারিত। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ইন্টার সার্ভিস সাঁতারে তার ইভেন্টে তাকে হারানো ছিল একরকম অসম্ভব। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান সাঁতারে আরশাদের কলাকৌশলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তার হাতে তুলে দেন পদক।
ইন্টার সার্ভিস সাঁতারে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে পাকিস্তান জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে আরশাদ হোসেন নৌবাহিনীর হয়ে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। পাকিস্তান আমলে ক্রীড়াক্ষেত্রেও বাঙালিরা ছিলেন নিগৃহীত ও অবহেলিত। যে কারণে পাকিস্তানের জাতীয় পর্যায়ের খেলাধুলায় বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত এবং সাফল্য ছিল আনুপাতিক হারে আরো কম। অল্প যে ক’জন ক্রীড়াবিদ বাঙালিদের মুখ উজ্জ্বল করেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি কতটি পদক পেয়েছেন, তা এখন আর তার স্মৃতিতে লেখা নেই। তবে তার কাছে রক্ষিত কিছু সনদপত্রে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার কীর্তির দীপ্তচ্ছটা। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়েও তিনি কাঁপিয়ে দেন পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গন। সে সময় বাঙালি সাঁতারুদের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাস এবং জাতীয় পর্যায়ে সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস ছাড়া আর কেউ খুব বেশি আলোচিত ছিলেন না। এদের কাছাকাছি সময়ে উত্থান ঘটে আরশাদ হোসেনের। অবশ্য তার সমসাময়িক বাঙালি সাঁতারুদের মধ্যে আরো ছিলেন ইংলিশ চ্যানেল জয়ী আবদুল মালেক, সরদার নুরুউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, আবদুল কাদির, এসএম ইসহাক প্রমুখ। পাকিস্তান নৌবাহিনীর হয়ে অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন এবং চাকরি সূত্রে করাচীতে অবস্থান করায় আরশাদ হোসেনের নামটি পূর্ব পাকিস্তানে তেমনভাবে চাউর হয়নি। অথচ তার মতো কৃতিত্ব খুব কম বাঙালি সাঁতারু দেখিয়েছেন।
১৯৫৯ সালের অক্টোবরে লাহোরে ষষ্ঠ পাকিস্তান জাতীয় সাঁতারে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি জাতীয় রেকর্ডসহ প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দেন। সময় নেন ১ মিনিট ২০ দশমিক শূন্য সেকেন্ড। ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ২ মিনিট ৫৮ দশমিক ৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে দ্বিতীয় হন এবং ৪ গুণন ১০০ মিটার মিডলে রিলেতে রানার্সআপ হয় তার দল পাকিস্তান নৌবাহিনী। তিনি ছিলেন মিডলে রিলে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পরবর্তীকালে একের পর এক চমক দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের অন্যতম সেরা সাঁতারু। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ঢাকায় সপ্তম পাকিস্তান জাতীয় সাঁতারে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ১ মিনিট ২০ দশমিক পাঁচ শূন্য সেকেন্ড এবং ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ২ মিনিট ৫৯ দশমিক ১ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের রিসালপুরে অষ্টম পাকিস্তান জাতীয় সাঁতারে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ১ মিনিট ২২ দশমিক ০ সেকেন্ড এবং ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ২ মিনিট ৫৯ দশমিক ১ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হন। এছাড়া ৪ গুণন ১০০ মিটার মিডলে রিলেতে রানার্সআপ দলের সদস্য ছিলেন তিনি।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে একটি জাতীয় রেকর্ডসহ তিনটি স্বর্ণপদক জয় করে সুইমিংপুলে ঝড় তোলেন আরশাদ হোসেন। ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে নতুন পাকিস্তান রেকর্ড গড়েন ১ মিনিট ১৮ দশমিক ৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে। ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ৩ মিনিট ০ দশমিক ৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হন এবং ৪ গুণন ২০০ মিটার মিডলে রিলেতে স্বর্ণজয়ী পাকিস্তান নেভির সদস্য ছিলেন তিনি। পুরস্কার গ্রহণ করেন গভর্নর আজম খানের কাছ থেকে। ১৯৬৪ সাল ছিল তার খেলোয়াড়ী জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। সে বছর ইরানের তেহরানে ২০ থেকে ২২ আগস্ট পাকিস্তান-ইরান সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেয়। সেখানে পাকিস্তানের ১৯ জন সাঁতারু অংশ নেন। তার মধ্যে বাঙালি ছিলেন তিনজন- সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস, লিডিং স্টোর অ্যাসিস্ট্যান্ট (এলএসএ) এম আরশাদ ও নায়েক মোহাম্মদ সোলায়মান। মোহাম্মদ আরশাদ জানান, সেবার পাকিস্তানের একমাত্র স্বর্ণপদকটি আসে তার কৃতিত্বে। ২২ আগস্ট ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তার সাফল্যে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে আমজাদিয়াহ স্টেডিয়াম। তার কৃতিত্বে উচ্ছ্বসিত নৌবাহিনী কমান্ডার-ইন-চিফ রিয়ার অ্যাডমিরাল এআর খান এলএসএ থেকে প্রমোশন দিয়ে তাকে পেটি অফিসার করেন।
জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপ ছাড়াও আরশাদ হোসেন করাচী সুইমিং এসোসিয়েশন আয়োজিত বার্ষিক চ্যাম্পিয়নশীপে জয় করেছেন অসংখ্য স্বর্ণপদক। ১৯৬২ সালে পাক সুইমিং স্কুল আয়োজিত অল পাকিস্তান সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপে ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি প্রথম হন। আর আন্তঃসার্ভিস সাঁতারে গড়েছেন অনেক রেকর্ড। তার আরো কৃতিত্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৬০ কিংবা ১৯৬২ সালে করাচীর কুইন্স রোডে টানা ১২ ঘন্টা বুক সাঁতার কাটা।
সাঁতার ছাড়াও আরশাদ হোসেন অ্যাথলেট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইন্টার সার্ভিস অ্যাথলেটিক্সে তিনি হার্ডলস ও লংজাম্পে পদক পেয়েছেন।
৩৪ বছর চাকরি জীবন শেষে ১৯৮৭ সালে নৌবাহিনী থেকে লেঃ কমান্ডার হিসেবে অবসর নেন আরশাদ হোসেন। সাঁতারের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে ছিলেন নানাভাবে। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের সদস্য। ১৯৮৫ সালের ২২ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের বোম্বাইতে দ্বিতীয় এশিয়ান এজ গ্রুপ চ্যাম্পিয়নশীপে মিট অফিসিয়াল হিসেবে যোগ করেন। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)-এর ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা বিশেষভাবে জোরদারের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকদের সমন্বয়ে সাঁতারের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, তার সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালের ৫ থেকে ১৪ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে নেতাজী সুভাস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টসে সাঁতারের সার্ক কোচিং ক্যাম্পে অংশ নেন।
১৯৮৭ সালে থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিকেএসপির চিফ ইন্সট্রাক্টর। তার হাতে গড়ে ওঠা ছাত্রদের মধ্যে আছেন বিকেএসপির প্রথম ব্যাচের কারার মিজানুর রহমান। সাঁতারে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন পুরস্কার-২০০৫ প্রদান করা হয়।
অতীতের সঙ্গে বর্তমান সাঁতারের তুলনা প্রসঙ্গে আরশাদ হোসেন বলেন, ‘এখন সাঁতারে নতুন নতুন টেকনিক হয়েছে। আগে সুইমিংপুল ছিল না। ছিল না কোনো টেকনিক। বর্তমানে অনেক আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার- স্পোর্টস মেডিসিন বদলে দিয়েছে সাঁতারকে।’
আরশাদ হোসেনের জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দেয়া উৎসাহ। এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘১৯৫৮ সালে করাচীর পিএনএস দেলোয়ারে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টার ইউনিভার্সিটি সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপ। ওই প্রতিযোগিতায় ১৫০০ মিটার ফ্রিস্ট্রাইল সাঁতারে প্রথম হওয়ায় ব্রজেন দাসকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত এবং দীর্ঘ সাঁতারে তার সাফল্য কামনা করেন সোহরাওয়ার্দী। প্রদর্শনী সাঁতারের ওপেন ইভেন্টে আমি নৈপুণ্য প্রদর্শন করায় খুশী হন এবং আমাকে উৎসাহিত করেন তিনি। এই উৎসাহ আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।’
বাঙালি হওয়ায় আরশাদ হোসেনকে বঞ্চনাও সইতে হয়। বুকের মধ্যে চেপে রাখা দুঃখটায় একটু টোকা পড়তেই বিষণ্ণ হয়ে উঠেন তিনি, ‘১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে অংশ নেয়ার জন্য সুযোগ পাই পাকিস্তান জাতীয় দলে। সে সময় কর্তব্যরত ছিলাম করাচিতে। কিন্তু আমাকে ছাড়াই দল লাহোর থেকে চলে যায়। আমাকে পাঠানোর জন্য মেসেজ পাঠানো হয়। হিংসাপরায়ণ হয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তোফায়েল আমাকে কিছুই জানাননি। এটা জানতে পেরে আমি এ বিষয়ে সহকারী নৌ-প্রধান কমডোর আব্দুর রশিদের কাছে অভিযোগ করি এবং তিনি তোফায়েলকে সাসপেন্ড করেন। সাসপেন্ড করলে কী হবে? জীবনের বড় একটি অর্জন থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি।’
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘বিগত বছরগুলোতে যাচাই-বাছাই না করে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেয়া হয়। প্রকৃত রেকর্ড ও দলিলপত্র না দেখে অনেকে মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার পেয়েছেন।
সাঁতারু ব্রজেন দাস সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত আরশাদ হোসেন, ‘তিনি পরিচিত করেছেন বাংলার মানচিত্রকে। বিশ্বরেকর্ড গড়ে সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল, তিনি অবিরাম অনুশীলন করতেন। তার মতো সাঁতারু আর হবে না।’ মোশাররফ হোসেন খান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতারে তার স্টাইল, টেকনিক ও দক্ষতা ছিল চমৎকার।’
সময়ের মরীচিকা পড়তে পড়তে ইতোমধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের অনেক গৌরবময় অর্জন ও ইতিহাস। আমাদের এই বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন সাঁতারু আরশাদ হোসেন। পাকিস্তান আমলে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পেতেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অবহেলা। খেলার মাঠে অল্প কয়েকজন ব্যক্তি এই অবহেলার জবাব দিতে পেরেছেন। তাদের একজন আরশাদ হোসেন। যারা এই দেশ ও এই মাটিকে এনে দিয়েছেন পরিচিতি, আরশাদ হোসেন তাদেরও একজন। অথচ এমন একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে আমরা সম্মানিত করতে পারিনি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অবশ্যই দুঃখজনক। আর এ কারণে অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের মান ও গুরুত্ব। এই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। যাদের আগে পাবার কথা, তারা না পেয়ে তাদের ছাত্র কিংবা সন্তানের বয়সী ক্রীড়াবিদরা এ পুরস্কার পেয়েছেন। এতে বোধ করি কেউই সম্মানিত হননি। যা ঘটে গেছে, তাকে তো আর বদলে ফেলা যাবে না। তবে আমরা আমাদের ব্যর্থতার দায়ভার কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারি- আরশাদ হোসেনের মতো যেসব ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার কিংবা এ মাপের কোনো পুরস্কার এখনও পাননি, দাঁড়িয়ে আছেন জীবনের প্রান্তসীমায়, তাদের জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত কিংবা সম্মানিত করে। পুরস্কার পেলে কিংবা না পেলে আরশাদ হোসেনের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু জীবদ্দশায় যোগ্য ব্যক্তিকে সমাদর করা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। সবকিছুই যখন নিয়মের মাঝে আনার প্রক্রিয়া চলছে, তখন ক্রীড়াঙ্গনের জাতীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের সম্মানিত করার অনিয়মটা দূর করা খুব বেশি কঠিন কিছু নয়।
এক পুত্র ও এক কন্যার জনক আরশাদ হোসেন জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও সাঁতারের টান এড়াতে পারেন না। এ বয়সেও নেভি সুইমিংপুলে গিয়ে অনুশীলন করেন এবং অনেককে তালিম দেন সাঁতারে। সাঁতারের সঙ্গে তার যে নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছে, তা তাকে এখনও আন্দোলিত করে। তার সঙ্গে কথা বললে উন্মথিত হয় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সোনালী দিনগুলো। সে দিনগুলোকে হয়ত আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে তার মাঝে আমরা ফিরে ফিরে পাই আমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে- যে ইতিহাস আমাদের সামনে এগিয়ে চলার সোপান। #
১-৮-২০০৭ইং
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এমন একজন ক্রীড়াবিদ হলেন সাঁতারু মোহাম্মদ আরশাদ হোসেন। এই প্রজন্মের অনেকেই তাকে চেনেন না। চেনার কথাও নয়। ক্রীড়াঙ্গনে এখন আর তিনি সরব নন। বেছে নিয়েছেন নিভৃতচারী এক জীবন। অথচ এদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে তার নামটি সোনার হরফে লেখা থাকার কথা। তার যে কীর্তিগাথা- তা যে কোনো বাঙালির কাছে গৌরবের স্মারক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সেই পাকিস্তান আমলে কোনো বাঙালির আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক পাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। কেননা তখন তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সুযোগ পাওয়াটা ছিল বড় ব্যাপার। বাঙালিদের সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কার্পণ্য রীতিমতো প্রবাদ হয়ে আছে। এর মধ্যেও নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন আরশাদ হোসেন। শুধু তাই নয়, তিনি সম্ভবত একমাত্র বাঙালি ক্রীড়াবিদ, যিনি পাকিস্তান আমলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে স্বর্ণপদক জয় করার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। অসাধারণ কীর্তি গড়ে বাঙালির মুখ আলোকিত করলেও তিনি রয়ে গেছেন বরাবরই প্রচারের আড়ালে।
পাকিস্তান আমলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাঙালির সাফল্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরশাদ হোসেনের নামটি উঠে আসে কিংবদন্তি সাঁতারু অরুণ নন্দীর মুখে। তার কাছে নামটি জানার পর আরশাদ হোসেনের বিষয়ে কৌতূহল বেড়ে যায়। এ বিষয়ে আগ্রহ দেখান প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানও। তিনি আরশাদ হোসেন সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। অরুণ নন্দীর সহযোগিতায় আরশাদ হোসেনকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। উদ্ধার করা সম্ভব হয় বিস্মৃত একটি অধ্যায়। আরশাদ হোসেনের বর্তমান অবয়ব, দৈহিক গড়ন ও কাঠামো দেখলে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়- এক সময় তিনি ছিলেন সাঁতারু। বয়স ৭২ হলেও শারীরিক জরা তাকে কাবু করতে পারেনি। সাঁতারুদের শরীর কখনো নুইয়ে পড়ে না- প্রচলিত এ ধারণা প্রবীণ এই সাঁতারুকে দেখলে কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যায়। এখনও অনবরত ছুটতে পারেন তরুণের মতো।
আরশাদ হোসেন তার সাফল্য ও অর্জন নিয়ে এখন আর কোনো তাগিদ অনুভব করেন না। বলা যায়, খেলোয়াড়ী জীবনে গড়া তার গৌরবগাথা নিয়ে অনেকটাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। নিজের জীবনের সেরা সময়টা খেলাধুলায় সঁপে দিয়েও প্রাপ্তির খাতায় তার খুব বেশি সঞ্চয় নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি বা সম্মাননা তার এখন অব্দি জোটেনি। তিনি হারিয়ে ফেলেছেন খেলার মাঠের অনেক সঞ্চয় ও স্মৃতি। এ নিয়ে অবশ্য তার কোনো আক্ষেপ নেই। এখন তিনি আর কোনো কিছু প্রত্যাশা করেন না। জীবনের সোনালী দিনগুলো মেলে ধরার ব্যাপারেও তার অপরিসীম কুন্ঠা।
১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দিতে মোহাম্মদ আরশাদ হোসেনের জন্ম। খুব অল্প বয়সেই সাঁতারটা হয়ে উঠে তার জীবনযাপনের অংশ। গ্রামের বাড়ির পুকুরে শারীরিক ব্যায়ামের অংশ হিসেবে প্রতিদিনই সাঁতার কাটতেন। সুস্থ দেহ, সুস্থ মন- এই জীবনদর্শন তাকে সাঁতারু হতে অনুপ্রাণিত করে। স্কুলে যাবার আগে সাঁতার কাটা তার প্রাত্যহিক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। গৌরীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে অংশ নেন। ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বুকসাঁতার। ছুটতে পারতেন সবার আগে। ১৯৫০ সালে কুমিল্লার পুলিশ লাইন পুকুরে আন্তঃস্কুল সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে প্রথম তিনি সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হন। ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি প্রথম হন।
১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর যোগ দেন নৌবাহিনীতে। এরপর সাঁতারে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ইন্টার সার্ভিস সাঁতারে তার সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক, ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ও ওয়াটারপোলোতে অংশ নিয়ে তার সাফল্য ছিল অবধারিত। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ইন্টার সার্ভিস সাঁতারে তার ইভেন্টে তাকে হারানো ছিল একরকম অসম্ভব। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান সাঁতারে আরশাদের কলাকৌশলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তার হাতে তুলে দেন পদক।
ইন্টার সার্ভিস সাঁতারে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে পাকিস্তান জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে আরশাদ হোসেন নৌবাহিনীর হয়ে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। পাকিস্তান আমলে ক্রীড়াক্ষেত্রেও বাঙালিরা ছিলেন নিগৃহীত ও অবহেলিত। যে কারণে পাকিস্তানের জাতীয় পর্যায়ের খেলাধুলায় বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত এবং সাফল্য ছিল আনুপাতিক হারে আরো কম। অল্প যে ক’জন ক্রীড়াবিদ বাঙালিদের মুখ উজ্জ্বল করেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি কতটি পদক পেয়েছেন, তা এখন আর তার স্মৃতিতে লেখা নেই। তবে তার কাছে রক্ষিত কিছু সনদপত্রে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার কীর্তির দীপ্তচ্ছটা। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়েও তিনি কাঁপিয়ে দেন পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গন। সে সময় বাঙালি সাঁতারুদের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাস এবং জাতীয় পর্যায়ে সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস ছাড়া আর কেউ খুব বেশি আলোচিত ছিলেন না। এদের কাছাকাছি সময়ে উত্থান ঘটে আরশাদ হোসেনের। অবশ্য তার সমসাময়িক বাঙালি সাঁতারুদের মধ্যে আরো ছিলেন ইংলিশ চ্যানেল জয়ী আবদুল মালেক, সরদার নুরুউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, আবদুল কাদির, এসএম ইসহাক প্রমুখ। পাকিস্তান নৌবাহিনীর হয়ে অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন এবং চাকরি সূত্রে করাচীতে অবস্থান করায় আরশাদ হোসেনের নামটি পূর্ব পাকিস্তানে তেমনভাবে চাউর হয়নি। অথচ তার মতো কৃতিত্ব খুব কম বাঙালি সাঁতারু দেখিয়েছেন।
১৯৫৯ সালের অক্টোবরে লাহোরে ষষ্ঠ পাকিস্তান জাতীয় সাঁতারে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি জাতীয় রেকর্ডসহ প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দেন। সময় নেন ১ মিনিট ২০ দশমিক শূন্য সেকেন্ড। ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ২ মিনিট ৫৮ দশমিক ৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে দ্বিতীয় হন এবং ৪ গুণন ১০০ মিটার মিডলে রিলেতে রানার্সআপ হয় তার দল পাকিস্তান নৌবাহিনী। তিনি ছিলেন মিডলে রিলে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পরবর্তীকালে একের পর এক চমক দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের অন্যতম সেরা সাঁতারু। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ঢাকায় সপ্তম পাকিস্তান জাতীয় সাঁতারে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ১ মিনিট ২০ দশমিক পাঁচ শূন্য সেকেন্ড এবং ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ২ মিনিট ৫৯ দশমিক ১ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের রিসালপুরে অষ্টম পাকিস্তান জাতীয় সাঁতারে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ১ মিনিট ২২ দশমিক ০ সেকেন্ড এবং ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ২ মিনিট ৫৯ দশমিক ১ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হন। এছাড়া ৪ গুণন ১০০ মিটার মিডলে রিলেতে রানার্সআপ দলের সদস্য ছিলেন তিনি।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে একটি জাতীয় রেকর্ডসহ তিনটি স্বর্ণপদক জয় করে সুইমিংপুলে ঝড় তোলেন আরশাদ হোসেন। ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে নতুন পাকিস্তান রেকর্ড গড়েন ১ মিনিট ১৮ দশমিক ৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে। ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ৩ মিনিট ০ দশমিক ৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হন এবং ৪ গুণন ২০০ মিটার মিডলে রিলেতে স্বর্ণজয়ী পাকিস্তান নেভির সদস্য ছিলেন তিনি। পুরস্কার গ্রহণ করেন গভর্নর আজম খানের কাছ থেকে। ১৯৬৪ সাল ছিল তার খেলোয়াড়ী জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। সে বছর ইরানের তেহরানে ২০ থেকে ২২ আগস্ট পাকিস্তান-ইরান সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেয়। সেখানে পাকিস্তানের ১৯ জন সাঁতারু অংশ নেন। তার মধ্যে বাঙালি ছিলেন তিনজন- সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস, লিডিং স্টোর অ্যাসিস্ট্যান্ট (এলএসএ) এম আরশাদ ও নায়েক মোহাম্মদ সোলায়মান। মোহাম্মদ আরশাদ জানান, সেবার পাকিস্তানের একমাত্র স্বর্ণপদকটি আসে তার কৃতিত্বে। ২২ আগস্ট ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তার সাফল্যে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে আমজাদিয়াহ স্টেডিয়াম। তার কৃতিত্বে উচ্ছ্বসিত নৌবাহিনী কমান্ডার-ইন-চিফ রিয়ার অ্যাডমিরাল এআর খান এলএসএ থেকে প্রমোশন দিয়ে তাকে পেটি অফিসার করেন।
জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপ ছাড়াও আরশাদ হোসেন করাচী সুইমিং এসোসিয়েশন আয়োজিত বার্ষিক চ্যাম্পিয়নশীপে জয় করেছেন অসংখ্য স্বর্ণপদক। ১৯৬২ সালে পাক সুইমিং স্কুল আয়োজিত অল পাকিস্তান সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপে ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি প্রথম হন। আর আন্তঃসার্ভিস সাঁতারে গড়েছেন অনেক রেকর্ড। তার আরো কৃতিত্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৬০ কিংবা ১৯৬২ সালে করাচীর কুইন্স রোডে টানা ১২ ঘন্টা বুক সাঁতার কাটা।
সাঁতার ছাড়াও আরশাদ হোসেন অ্যাথলেট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইন্টার সার্ভিস অ্যাথলেটিক্সে তিনি হার্ডলস ও লংজাম্পে পদক পেয়েছেন।
৩৪ বছর চাকরি জীবন শেষে ১৯৮৭ সালে নৌবাহিনী থেকে লেঃ কমান্ডার হিসেবে অবসর নেন আরশাদ হোসেন। সাঁতারের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে ছিলেন নানাভাবে। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের সদস্য। ১৯৮৫ সালের ২২ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের বোম্বাইতে দ্বিতীয় এশিয়ান এজ গ্রুপ চ্যাম্পিয়নশীপে মিট অফিসিয়াল হিসেবে যোগ করেন। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)-এর ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা বিশেষভাবে জোরদারের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকদের সমন্বয়ে সাঁতারের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, তার সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালের ৫ থেকে ১৪ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে নেতাজী সুভাস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টসে সাঁতারের সার্ক কোচিং ক্যাম্পে অংশ নেন।
১৯৮৭ সালে থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিকেএসপির চিফ ইন্সট্রাক্টর। তার হাতে গড়ে ওঠা ছাত্রদের মধ্যে আছেন বিকেএসপির প্রথম ব্যাচের কারার মিজানুর রহমান। সাঁতারে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন পুরস্কার-২০০৫ প্রদান করা হয়।
অতীতের সঙ্গে বর্তমান সাঁতারের তুলনা প্রসঙ্গে আরশাদ হোসেন বলেন, ‘এখন সাঁতারে নতুন নতুন টেকনিক হয়েছে। আগে সুইমিংপুল ছিল না। ছিল না কোনো টেকনিক। বর্তমানে অনেক আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার- স্পোর্টস মেডিসিন বদলে দিয়েছে সাঁতারকে।’
আরশাদ হোসেনের জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দেয়া উৎসাহ। এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘১৯৫৮ সালে করাচীর পিএনএস দেলোয়ারে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টার ইউনিভার্সিটি সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপ। ওই প্রতিযোগিতায় ১৫০০ মিটার ফ্রিস্ট্রাইল সাঁতারে প্রথম হওয়ায় ব্রজেন দাসকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত এবং দীর্ঘ সাঁতারে তার সাফল্য কামনা করেন সোহরাওয়ার্দী। প্রদর্শনী সাঁতারের ওপেন ইভেন্টে আমি নৈপুণ্য প্রদর্শন করায় খুশী হন এবং আমাকে উৎসাহিত করেন তিনি। এই উৎসাহ আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।’
বাঙালি হওয়ায় আরশাদ হোসেনকে বঞ্চনাও সইতে হয়। বুকের মধ্যে চেপে রাখা দুঃখটায় একটু টোকা পড়তেই বিষণ্ণ হয়ে উঠেন তিনি, ‘১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে অংশ নেয়ার জন্য সুযোগ পাই পাকিস্তান জাতীয় দলে। সে সময় কর্তব্যরত ছিলাম করাচিতে। কিন্তু আমাকে ছাড়াই দল লাহোর থেকে চলে যায়। আমাকে পাঠানোর জন্য মেসেজ পাঠানো হয়। হিংসাপরায়ণ হয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তোফায়েল আমাকে কিছুই জানাননি। এটা জানতে পেরে আমি এ বিষয়ে সহকারী নৌ-প্রধান কমডোর আব্দুর রশিদের কাছে অভিযোগ করি এবং তিনি তোফায়েলকে সাসপেন্ড করেন। সাসপেন্ড করলে কী হবে? জীবনের বড় একটি অর্জন থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি।’
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘বিগত বছরগুলোতে যাচাই-বাছাই না করে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেয়া হয়। প্রকৃত রেকর্ড ও দলিলপত্র না দেখে অনেকে মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার পেয়েছেন।
সাঁতারু ব্রজেন দাস সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত আরশাদ হোসেন, ‘তিনি পরিচিত করেছেন বাংলার মানচিত্রকে। বিশ্বরেকর্ড গড়ে সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল, তিনি অবিরাম অনুশীলন করতেন। তার মতো সাঁতারু আর হবে না।’ মোশাররফ হোসেন খান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতারে তার স্টাইল, টেকনিক ও দক্ষতা ছিল চমৎকার।’
সময়ের মরীচিকা পড়তে পড়তে ইতোমধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের অনেক গৌরবময় অর্জন ও ইতিহাস। আমাদের এই বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন সাঁতারু আরশাদ হোসেন। পাকিস্তান আমলে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পেতেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অবহেলা। খেলার মাঠে অল্প কয়েকজন ব্যক্তি এই অবহেলার জবাব দিতে পেরেছেন। তাদের একজন আরশাদ হোসেন। যারা এই দেশ ও এই মাটিকে এনে দিয়েছেন পরিচিতি, আরশাদ হোসেন তাদেরও একজন। অথচ এমন একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে আমরা সম্মানিত করতে পারিনি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অবশ্যই দুঃখজনক। আর এ কারণে অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের মান ও গুরুত্ব। এই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। যাদের আগে পাবার কথা, তারা না পেয়ে তাদের ছাত্র কিংবা সন্তানের বয়সী ক্রীড়াবিদরা এ পুরস্কার পেয়েছেন। এতে বোধ করি কেউই সম্মানিত হননি। যা ঘটে গেছে, তাকে তো আর বদলে ফেলা যাবে না। তবে আমরা আমাদের ব্যর্থতার দায়ভার কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারি- আরশাদ হোসেনের মতো যেসব ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার কিংবা এ মাপের কোনো পুরস্কার এখনও পাননি, দাঁড়িয়ে আছেন জীবনের প্রান্তসীমায়, তাদের জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত কিংবা সম্মানিত করে। পুরস্কার পেলে কিংবা না পেলে আরশাদ হোসেনের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু জীবদ্দশায় যোগ্য ব্যক্তিকে সমাদর করা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। সবকিছুই যখন নিয়মের মাঝে আনার প্রক্রিয়া চলছে, তখন ক্রীড়াঙ্গনের জাতীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের সম্মানিত করার অনিয়মটা দূর করা খুব বেশি কঠিন কিছু নয়।
এক পুত্র ও এক কন্যার জনক আরশাদ হোসেন জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও সাঁতারের টান এড়াতে পারেন না। এ বয়সেও নেভি সুইমিংপুলে গিয়ে অনুশীলন করেন এবং অনেককে তালিম দেন সাঁতারে। সাঁতারের সঙ্গে তার যে নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছে, তা তাকে এখনও আন্দোলিত করে। তার সঙ্গে কথা বললে উন্মথিত হয় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সোনালী দিনগুলো। সে দিনগুলোকে হয়ত আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে তার মাঝে আমরা ফিরে ফিরে পাই আমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে- যে ইতিহাস আমাদের সামনে এগিয়ে চলার সোপান। #
১-৮-২০০৭ইং
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন