সুন্দরের দেশে অসুন্দর ফুটবল! দুলাল মাহমুদ




লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’-র হাসির রহস্য আজও উদঘাটন করা যায়নি। কিন্তু আমাদের হৃদয়জুড়ে আছেন ভিঞ্চি এবং তাঁর আঁকা অমলিন এই সৃষ্টি। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর গড়া চোখজুড়ানো সব ভাস্বর্যের কোনো তুলনা হয় না। অমর ও অবিনশ্বর কীর্তি। যুগে যুগে তা মিটিয়ে আসছে সৌন্দর্যপিপাসুদের তৃষ্ণা। সুন্দরের সংজ্ঞা কি আমরা হয়তো ঠিকমতো জানি না। কিন্তু সুন্দর বললেই আমরা বুঝতে পারি ভিঞ্চির চিত্রকলা, অ্যাঞ্জেলোর ভাস্বর্য। ইতালির বুকের মধ্যে ছড়িয়ে আছে সুন্দরের অনুপম সব নিদর্শন। পুরো দেশটি দেখে মনে হয়, কোনো শিল্পী যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে সুরে, ছন্দে ও সৌন্দর্যে গড়ে তুলেছেন। ফ্লোরেন্স, মিলান, ভেনিস যেন সুন্দরের এক একটি উপত্যকা। ফ্যাশন প্যারেডে দেখা যায় কত সুন্দর, কত স্মার্ট, কত ঝলমলে সব তরুণ-তরুণী। যেন স্বর্গের অপ্সরা-অপ্সরী। সেই কবে থেকে সিম্ফনি, কনসার্তো, সোনাতা’র সুর করে দেয় উন্মনা। চিত্রকলা, সংগীত, সাহিত্যের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে যে দেশটি, সৌন্দর্যের প্রতি যাদের পরিপূর্ণ নিবেদন, সেই দেশটির ফুটবল খেলার ইতিহাস দেখলে একদমই বোঝার উপায় নেই তারা সুন্দরের উপাসক। বরং স্বৈরচারী বেনিতো মুসোলিনি আর ফুটবল যেন একাকার হয়ে যায়।
অবশ্য ইতালির ফুটবলের সঙ্গে মুসোলিনির সম্পর্কটা একদম এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। ১৯৩৪ সালের ইতালিতে আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবলকে নিজের প্রচার-প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন এই স্বৈরশাসক। শুধু তাই নয়, এই বিশ্বকাপে ইতালিকে চ্যাম্পিয়ন করার জন্য তিনি অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। আর এজন্য তিনি আশ্রয় নেন নানান রকম কূট-কৌশলের। ইতালির প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ ‘সিরি-এ’ তে খেলতেন আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। এঁদের মধ্যে সেরা কয়েকজনকে জোরপূর্বক তিনি ইতালি জাতীয় দলে খেলতে বাধ্য করেন। এ কারণে লুইস মন্টি নামে আর্জেন্টাইন একজন মিডফিল্ডার আগের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পক্ষে খেললেও পরের বিশ্বকাপে ইতালির হয়ে খেলতে বাধ্য হন। সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালের রেফারি সুইডেনের ইভান একলিন্ডকে খেলার আগে ডেকে নেন মুসোলিনি এবং খেলায় ইতালির পক্ষে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করেন। রেফারির বদান্যতায় চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। এ কারণে এই বিশ্বকাপটি ইতিহাসের পাতায় হয়ে আছে কলঙ্কিত। আর এই কলঙ্ক কখনো ইতালির পিছ ছাড়েনি। ফ্রান্সে পরের বিশ্বকাপে শিরোপা অক্ষুণ্ন রাখে ‘আজ্জুরি’রা। পরবর্তীকালে রক্ষণাত্মক ফুটবলের চর্চা শুরু করে ইতালি। তাদের খেলার কৌশল ‘ডোর-বোল্ট’ অর্থাৎ ইতালীয় ভাষায় ‘কাতানাচ্চিও’ নামে পরিচিত। এর অর্থ খিড়কি দেওয়া দরজা। নিজেদের রক্ষণভাগকে ‘ফেনেসট্রেল্লে’ দুর্গ বানিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাফল্য পাওয়াই এর একমাত্র লক্ষ্য। আর এই দুর্গের অধিপতি হবেন একজন লিবেরো, সুইপার নামেই যার পরিচিতি। তিনি কোনোভাবে বল গোলসীমানার মধ্যে আসতে দেবেন না। ঝাড়ুদারের মতো বল ঝেটিয়ে সরিয়ে দেবেন। নেতিবাচক এই ফুটবল খেলে কুখ্যাতি অর্জন করলেও বিশ্বের সফল দলগুলোর একটি হয়ে উঠে ইতালি। বিশ্বকাপ ফুটবলে চারবার চ্যাম্পিয়ন (১৯৩৪, ১৯৩৮, ১৯৮২ ও ২০০৬), দুইবার রানার্স-আপ (১৯৭০ ও ১৯৯৪), একবার তৃতীয় (১৯৯০) এবং একবার চতুর্থ (১৯৭৮) হয়। যাদের সৌন্দর্য নিয়ে কারবার, তারাই সুন্দর ফুটবলকে বিতাড়িত করে যেন-তেন প্রকারে সাফল্যটাকে মোক্ষম অস্ত্র বানিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইতালির ফুটবলে আগের মতো সেই গোঁড়ামি নেই। এবার তো রীতিমতো পাসিং ফুটবল খেলতে দেখা গেছে। যা ইতালীয় ফুটবলের অতীত ঐতিহ্যের অনেকটা বিপরীত। তবে সুন্দর ফুটবলের পূজারি হিসেবে এখনও সুখ্যাতি অর্জন করতে পারেনি ইতালি। কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন একটি দল আবারো প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেওয়ায় বিশ্বকাপের সৌন্দর্য খানিকটা হলেও ম্লান হয়েছে। এবারের এই ব্যর্থতা সুন্দর ফুটবলের প্রতি ইতালিকে বিরূপ করে তুলবে নাতো?


dulalmahmud@yahoo.com        

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

এক সময়ের দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ মোহামেডানের কামরু/ দুলাল মাহমুদ

এখন সময় মেসির, এখন সময় আর্জেন্টিনার / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ