রোনাল্ডো ইউসেবিও হতে পারলেন না / দুলাল মাহমুদ


ব্রাজিলকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্বল হয়ে পড়ে এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি পর্তুগাল। এরপর আর তারা ফিরে পায়নি সেই আধিপত্য, সেই দাপট, সেই আগ্রাসী মনোভাব। সেও তো কম দিন হলো না। অন্য সব কিছু বাদ দিলেও ভূ-পর্যটক ভাস্কো দা গামার এই দেশটির নিশ্চয়ই এখন সবচেয়ে বড় দুঃখ হয়, বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজেদের ব্যর্থতায়। হওয়ারই কথা। তাদের সাবেক উপনিবেশ ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলকে অনেকটাই বানিয়ে ফেলেছে নিজেদের বাড়ি-ঘর। আর ‘প্রভু’ হয়েও তাদের কিনা গাইতে হয় বঞ্চনার গান। এরচেয়ে কষ্ট, এরচেয়ে দুর্ভাগ্য, এরচেয়ে যন্ত্রণা আর কী হতে পারে? তাছাড়া তাদের জন্য এটা তো কম অপমানজনক নয় যে, বিশ্বকাপ ফুটবলের শুরু থেকেই খেলছে ব্রাজিল। অথচ তাদের অভিষেক হয় ১৯৬৬ সালে। অভিষেক হওয়ার পর ব্যর্থতার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকে পর্তুগিজরা। ১৯৭০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনি। এরপর ১৯৮৬ সালে করলেও ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কোয়ালিফাই করতে পারেনি। এরপর অবশ্য নিয়মিত খেলছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা ধার নেই। আজ অব্দি বড় কোনো শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি।
পর্তুগাল বিশ্ব ফুটবলে তেমন সাড়া জাগাতে না পারলেও উপহার দিয়েছে একজন রূপকথার নায়ককে। তিনি হলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ইউসেবিও। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও কিছুটা খাদ রয়ে গেছে। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ হিসেবে পরিচিত এই ফুটবলারের জন্ম পর্তুগালের আরেকটি সাবেক উপনিবেশ মোজাম্বিকে। তবে ফুটবলার হিসেবে তাঁর পরিচিতি, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা সবই পর্তুগালের হয়ে। গতি, কৌশল, অ্যাথলেটিকজম আর ক্ষিপ্রতায় তিনি ছিলেন চিতাবাঘের মতো। আর ছিল অসম্ভব গোলক্ষুধা। গোল না করা পর্যন্ত আহত বাঘের মতো মাঠময় দাপিয়ে বেড়াতেন। ডান পায়ের নিখুঁত শটে কত যে গোল করেছেন। ২২ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারে ৭৪৩ ম্যাচে তাঁর গোলের সংখ্যা ৭৪৯। ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর প্রলোভন এড়িয়ে খেলেছেন ভালোবাসার দল এস এল বেনফিকায়। পর্তুগিজ এই ক্লাবে ১৫ বছর খেলে ৬১৪ ম্যাচে ৬৩৮ গোল করেন। এমন কৃতিত্ব আর কোনো ফুটবলারের নেই। জাতীয় দলের হয়ে ৬৪ ম্যাচ খেলে গোল করেন ৪১টি। ১৯৬৫ সালে ভূষিত হন ইউরোপীয় ব্যালন ডি’অর খেতাবে। তবে বিশ্ব ফুটবলে তাঁর নামটি বেশিরভাগ সময় আলোচিত হয় ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যায় পর্তুগাল। সঙ্গে ইউসেবিও। গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও ব্রাজিলকে উড়িয়ে দেয় ‘এ সেলেকাও’রা। এমন দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্সের পর বড় ধাক্কা খায় কোয়ার্টার-ফাইনালে। কোথা থেকে উড়ে জুড়ে এসে বসা উত্তর কোরিয়া ২৫ মিনিটের মধ্যে তিন গোল দিয়ে বেসামাল করে দেয় পর্তুগিজদের। এরপরই জন্ম নেয় রূপকথার। একাই পর পর চার গোল দেন ‘দ্য কিং’ ইউসেবিও। তাঁর এমন অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যে ৫-৪ গোলে জয়ী হয় পর্তুগাল। কিন্তু সেমি-ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে রূপকথার অবসান ঘটে। তবে স্থান নির্ধারণী ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে তৃতীয় হয় পর্তুগাল। এটাই বিশ্বকাপে পর্তুগালের সেরা সাফল্য। আর সাফল্যের নায়ক ছিলেন ইউসেবিও। সর্বাধিক ৯ গোল দিয়ে গোল্ডেন বুট জয় করেন রূপকথার এই নায়ক।
ইউসেবিও’র পর পর্তুগালের সোনালি প্রজন্মের নেতা হিসেবে আসেন লুই ফিগো। তাঁর নেতৃত্বে আবার স্বপ্ন দেখতে থাকে পর্তুগিজরা। মধ্যমাঠের এই খেলোয়াড় স্প্যানিশ লিগে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের হয়ে খেলে মাতিয়ে দেন। ২০০১ সালে হন ফিফা প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার। পর্তুগালের হয়ে সর্বাধিক ১২৭ ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেন। গোল করেছেন ৩২টি। তাঁর কুশলী নেতৃত্বে পর্তুগাল ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে অ্যাঙ্গোলা, ইরান ও মেক্সিকোকে, নক-আউট রাউন্ডে নেদারল্যান্ডসকে এবং কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিলেও সেমি-ফাইনালে হেরে যায় ফ্রান্সের জিনেদাইন জিদানের কাছে। স্থান নির্ধারণী খেলায় জার্মানির কাছে হেরে চতুর্থ হয়। অধরা থেকে যায় বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।
ইউসেবিও, লুই ফিগোর দলের পর এবার ব্রাজিল বিশ্বকাপে আলোচনায় উঠে আসে পর্তুগাল। অবশ্য এটা যতটা না দলীয় শক্তির জোরে, তারচেয়ে বেশি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ক্যারিশমায়। ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি ফুটবলারদের একজন তিনি। ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের পর রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়েও গোলের ¯্রােত থেমে নেই ‘সিআর সেভেন’-এর। ২০০৮ ও ২০১৩ সালে ফিফা ব্যালন ডি’অর হন। পর্র্তুগালের হয়ে সর্বাধিক অর্ধ-শতাধিক গোল তাঁর। ২০০৬ ও ২০১০ সালের বিশ্বকাপেও খেলেছেন। বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসির সঙ্গে তাঁর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। দু’জন খেলেন স্প্যানিশ লিগের দুই চির-প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার হয়ে। সমানে সমান টেক্কা মেরে চলেছেন। যে কারণে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে আলোচিত তারকা ফুটবলার হলেন মেসি, ব্রাজিলের নেইমার আর রোনাল্ডো। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দিক দিয়ে সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু দলীয় নৈপুণ্যের বিষয়টি আলাদা। সেখানে নেইমারের সঙ্গে আছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। মেসির সঙ্গে আছে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। আর রোনাল্ডো? এ ক্ষেত্রে তিনি একা ও নিঃসঙ্গ। তাঁর দলটিও তেমন শক্তিশালী নয়। আর তিনি তো ম্যারাডোনা কিংবা নিদেনপক্ষে ইউসেবিও নন। সেই শক্তি, সামর্থ্য ও কুশলতা তাঁর নেই। যে কারণে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হয়েছে রোনাল্ডোকে। ইউসেবিও ও লুই ফিগো হয়ে উঠা হলো না তাঁর।


dulalmahmud@yahoo.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

এক সময়ের দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ মোহামেডানের কামরু/ দুলাল মাহমুদ

এখন সময় মেসির, এখন সময় আর্জেন্টিনার / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ