‘মৃত্যুগুহা’ থেকেই উজ্জীবনের গান / দুলাল মাহমুদ
জগতের আনন্দযঞ্জ বিশ্বকাপ ফুটবলের ব্যাপ্তি, বিস্তার ও বিশালত্ব এত বেশি যে, তা কোনো কিছু দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা সহ মানবীয় আবেগ-অনুভূতি তো আছেই, কখনো-সখনো মনে হয় জাগতিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায় এই মহোৎসব। হয়ে উঠে অতিমানবীয়। যা হার মানায় আমাদের কল্পনাকেও। বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই দেখে আসছি শক্তিমানদের জয়জয়কার। তাদের আধিপত্য, তাদের দাপট, তাদের চোখ রাঙানিতে ম্রিয়মাণ থাকতে হয় শক্তিহীনদের। ছলে-বলে-কৌশলে দুনিয়াব্যাপী রাজত্ব করে আসছে এই ভাগ্যবিধাতারা। কোনোভাবেই তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা ভাবাও যায় না। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল এমন একটি পরিসর, যেখানে জগতের শক্তিমানদের কথিত এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো যায়। এখানে ছোট-বড়, দুর্বল-সবল, শক্তিমান-শক্তিহীন বলে কিছু নেই। এখানে সবাই সমান সমান। নিয়ম-নীতিও সবার জন্য এক ও অভিন্ন। ‘ফেয়ার প্লে’র কারণে প্রকৃতঅর্থে কার কী শক্তি আছে, কী সামর্থ্য আছে, কী সৌন্দর্য আছে, সেটা স্বাভাবিক নিয়মেই অবলোকন করা যায়।
ভাবা যায় কোষ্টারিকার কথা? মধ্য আমেরিকার পুচকে একটি দেশ। আয়তনে আমাদের দেশের চেয়েও ছোট। জনসংখ্যা আমাদের তিন ভাগের এক ভাগের মতো হবে। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সবল কোনো দেশ নয়। কনকাকাফ অঞ্চলের এই দেশটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খুব বেশি আলোচিতও নয়। কিন্তু ফুটবল দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে দেশটি। দেশটির ফুটবল ঐতিহ্য অবশ্য নেহাত মন্দ নয়। ১৯২৭ সালে ফিফার সদস্য হয়। ১৯৯০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করে। অভিষেকেই চমকে দেয়। ইউরোপের দুই দেশ স্কটল্যান্ড ও সুইডেনকে হারিয়ে একই গ্রুপ থেকে ব্রাজিলের সঙ্গে উঠে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। পরবর্তী দুই বিশ্বকাপে চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারেনি। আর ২০০২ ও ২০০৬ সালে খেললেও সুবিধা করতে পারেনি। ২০১০ সালেও চূড়ান্ত পর্বে পাড়ি দিতে পারেনি। এবার চূড়ান্ত পর্বে উঠলেও বড় কিছু করার কথা কেউ ভাবেওনি। ভাবারও কথাও নয়। বরং সবচেয়ে দুর্ভাগা দেশ হিসেবে উঠে আসে তাদের নাম। লটারিভাগ্যে তারা এমন একটি গ্রুপভুক্ত হয়, যে গ্রুপটি পরিচিতি পেয়েছে ‘গ্রুপ অব ডেথ’ হিসেবে। এটা যে তাদের কারণে নয়, সেটা বোধকরি না লিখলেও চলে। গ্রুপের অন্য দেশের নাম শুনলেই যে কারোই হৃৎকম্পন শুরু হওয়ার কথা। চারবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি, দুইবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে এবং একবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। বিশ্ব ফুটবলের দাপটশালী এই তিন প্রতিপক্ষের তুলনায় ‘লা সেলে’দের তো নেহাতই দুধভাত হিসেবেই গণ্য করা হয়। যে কারণে ফুটবলের বিশেষঙ্গদের হিসেবে এই দেশটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ইতালি, উরুগুয়ে ও ইংল্যান্ডের মধ্যে কোন দু’টি দেশ দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে, সেটা নিয়েই বিস্তর কথা হয়েছে।
কিন্তু এখন সব কথা থামিয়ে দিয়েছে কোষ্টারিকা। সমস্ত হিসেব-নিকেশ উল্টে-পাল্টে দিয়ে ‘গ্রুপ অব ডেথ’ অর্থাৎ ‘মৃত্যুগুহা’ হিসেবে বিবেচিত ‘ডি’ গ্রুপ থেকে সবার আগে দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করেছে কোষ্টারিকানরা। উরুগুয়েকে ৩-১ এবং ইতালিকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে বিশ্ব ফুটবলকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ছোট-খাট এই দেশটি। ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে ইংল্যান্ডের বিদায়ও। এখন ইতালি এবং উরুগুয়ের মধ্যে কোন দেশ তাদের সঙ্গী হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিশ্ব ফুটবলের প্রভাবশালী দেশগুলোকে এভাবে নাকানিচুবানি খাওয়াবে কোষ্টারিকা, এটা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য ও অস্বাভাবিক মনে হবে। শুধু ফুটবল কেন, কোনোভাবেই ইংল্যান্ড, ইতালি ও উরুগুয়ের মতো দেশের সঙ্গে তুলনা হয় না কোষ্টারিকার। এমনিতে যাদের কথা কারো মনেই হয় না, তারা এখন বিশ্ব মিডিয়ায় সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে, বিশ্বকাপ ফুটবলের কল্যাণে। বিশ্বকাপ ফুটবলই পারে ক্ষমতাহীনকে ক্ষমতাবান করতে। দুর্বলকে সবল করতে। ছোটকে বড় করতে। এটাই বিশ্বকাপ ফুটবলের শক্তি, সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা। আর এ কারণেই বিশ্বকাপ ফুটবল সর্বজনীন এক মহোৎসব।
dulalmahmud@yahoo.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন