আফ্রিকান গর্জন আছে, কিন্তু ......দুলাল মাহমুদ



কেন জানি না, আফ্রিকানদের প্রতি আলাদা একটা দুর্বলতা অনুভব করি। কালো কালো মানুষদের ইতিহাস কষ্টের ইতিহাস, যন্ত্রণার ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস। সেই ইতিহাসে লেগে আছে কত অশ্রু, কত বেদনা, কত রক্ত। অথচ আফ্রিকাকে মনে করা হয় মানবজাতির আতুরঘর হিসেবে। আধুনিক মানুষের উৎপত্তি, রূপান্তর ও বিকাশ তো বৈচিত্র্যময় এই মহাদেশকে কেন্দ্র করে। শুধু কি তাই? সভ্য পৃথিবী গড়ে তোলার পেছনে আফ্রিকানদের ত্যাগ-তিতিক্ষাই সবচেয়ে বেশি। আফ্রিকানদের কাছে মানবজাতির অনেক ঋণ। আর এই আফ্রিকানরাই সবচেয়ে অবহেলিত, সবচেয়ে অনাদৃত, সবচেয়ে উপেক্ষিত। এই অনাদর, এই অবহেলা, এই উপেক্ষা বুকের মধ্যে কষ্ট হয়ে বাজে। সে কারণে আফ্রিকানরা কোথাও সফল হলে দূর থেকে খুশি হই। মনে মনে বাহবা দেই।
বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই শুনতে পাই আফ্রিকান সিংহের গর্জন। মনে হয়, এবার বোধহয় কিছু একটা হয়ে যাবে। মনে-প্রাণে কামনা করি, জয় হোক কালো মানুষের। জয় হোক আফ্রিকার। জয় হোক মানবতার। কিন্তু প্রতিবারই ভুলি আশার ছলনে। এত তর্জন, গর্জন কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
বিশ্বকাপ ফুটবলে আফ্রিকার যোগাযোগটা সভ্যতার অন্যতম পাদপীঠ মিশরের মাধ্যমে। ১৯৩৪ সালে ইতালি বিশ্বকাপে অংশ নেয় মিশর। এরপর ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আর কোনো দেশ অংশ নেয়নি। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে মরক্কো অংশ নেওয়ার পর থেকে নিয়মিতভাবে খেলছে আফ্রিকানরা। ১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানির বিশ্বকাপে জায়ারে, ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে তিউনিসিয়া, ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপে আলজেরিয়া ও ক্যামেরুন, ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে আলজেরিয়া ও মরক্কো, ১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপে ক্যামেরুন ও মিশর, ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া ও মরক্কো, ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে ক্যামেরুন, মরক্কো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তিউনিসিয়া, ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান বিশ্বকাপে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সেনেগাল ও তিউনিসিয়া, ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে অ্যাঙ্গোলা, আইভরি কোষ্ট, ঘানা, টোগো ও তিউনিসিয়া, ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, আইভরি কোষ্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া ও স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা অংশ নেয়। কিন্তু মাঝে-মধ্যে বড় বড় দলগুলোকে হারিয়ে দিলেও খুব বেশি দূর যেতে পারেনি আফ্রিকানরা। এরমধ্যে ‘অদম্য সিংহ’ ক্যামেরুন ১৯৯০, ‘তেরঙ্গার সিংহ’ সেনেগাল ২০০২, ‘ব্ল্যাক স্টারস’ ঘানা ২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারে। তারপরই থেমে যায় তাদের হাঁকডাক। আলজেরিয়ার বেল্লোমি, ক্যামেরুনের ওমাম বিয়িক, রজার মিলা, টমাস এনকোনো, স্যামুয়েল ইতো, অ্যালেক্স সঙ, নাইজেরিয়ার রশিদ ইয়েকিনি, ইমানুয়েল এমুনেকা, ড্যানিয়েল অ্যামোকাচি, জে জে ওকাচা, নয়ানকো কানু, তারিবো ওয়েষ্ট, ভিক্টর ইকপেবা, জন ওবি মিকেল, সেনেগালের পাপা বুবা দিউফ, হেনরি কামারা, এল হাজি দিউফ, আইভরি কোষ্টের দিদিয়ের দ্রগবা, ইয়াইয়া তোরে, ঘানার আবেদি পেলে, টনি ইয়োবোয়াহ, আসমোয়াহ গিয়ান, সুলে মনতারি, মাইকেল এসিয়েন, কেভিন-প্রিন্স বোয়াতেঙ, লাইবেরিয়ার জর্জ উইয়াহ, মিশরের হোসাম হাসান, মরক্কোর মুস্তফা হাজি প্রমুখ ফুটবলাররা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন।
এবারের বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে আলজেরিয়া, আইভরি কোষ্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন। মেক্সিকো ও ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে ইতোমধ্যে ছুটি হয়ে গেছে ক্যামেরুনের। জাপানকে হারিয়ে এবং কলম্বিয়ার কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার ভালোই সম্ভাবনা আছে আইভরি কোষ্টের। নাইজেরিয়া ইরানের সঙ্গে ড্র এবং বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাকে হারিয়ে লড়াইয়ে টিকে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হারার পর দুর্দান্ত ফুটবলশৈলীর ঝলক দেখিয়ে ঘানা জার্মানিকে রুখে দিলেও পরবর্তী রাউন্ডে খেলতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করছে অনেক যদি’র উপর। আর আলজেরিয়া বেলজিয়ামের কাছে হারার পর দক্ষিণ কোরিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার আশা জাগিয়ে রেখেছে।
নির্দিষ্ট একটি সীমানার মধ্যে আটকে আছে আফ্রিকানরা। মাঝে-মধ্যে দুরন্ত ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখিয়ে মাত করে দিলেও সীমানার বাইরে তারা যেতে পারছে না। যদিও এবারের বিশ্বকাপে অনেক অপ্রত্যাশিত ফল দেখা যাচ্ছে, তারপরও আফ্রিকানদের নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। তবে কোনো একদিন আফ্রিকানরা সীমানা অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, তেমন স্বপ্ন সত্যি হলে খুবই খুশি হব।


dulalmahmud@yahoo.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

এক সময়ের দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ মোহামেডানের কামরু/ দুলাল মাহমুদ

এখন সময় মেসির, এখন সময় আর্জেন্টিনার / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ