এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে? দুলাল মাহমুদ
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে কে সফল হবে কিংবা কে ব্যর্থ হবে, সেটা এখনই বলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একের পর এক ঘটছে চমকজাগানিয়া ঘটনা। আরো চমকের অপেক্ষায় ফুটবল অনুরাগীরা। এমন একটি অবস্থায় এশিয়ান দলগুলোকে নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। বিশেষ করে, আর্জেন্টিনার সঙ্গে ইরান এবং রাশিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ কোরিয়া যে চমৎকার ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছে, তাতে আশার আলো এখনও নিভিয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু অতীতের ইতিহাস আমাদের খুব একটা আশাবাদী করে না। বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা তো দূরে থাকুক, শীর্ষ চার দেশের মধ্যে পৌঁছতে পেরেছে মাত্র একবারই। সেক্ষেত্রে এশিয়ান দেশগুলোকে নিয়ে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়?
আমরা যদি পেছন ফিরে দেখি, তাহলে আমাদের বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নেয় ইন্দোনেশিয়া। ১৯৩৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে দলটি অংশ নেয় ‘ডাচ ইষ্ট ইন্ডিজ’ নামে। তখন দেশটি ছিল নেদারল্যান্ডসের অধীন। এশিয়ার প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে ১৯৫০ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় ভারত। কিন্তু সে সুযোগ তারা হেলায় হাতছাড়া করে। অর্থনৈতিক কারণে তাতে তারা অংশ নেয়নি। ইতিহাস গড়ার অসাধারণ সুযোগ হাতের নাগালে পেয়েও দূরে ঠেলে দেয় ভারত। এরপর আর উপমহাদেশের কোনো দেশ বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সুযোগ পায়নি। এই আক্ষেপ কবে ঘুচবে, সেটা কেবল ফুটবল বিধাতাই জানেন। সত্যিকার অর্থে ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ ফুটবলে এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে দক্ষিণ কোরিয়া। এরপর দুই বিশ্বকাপে এশিয়ার কোনো প্রতিনিধি ছিল না। ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে উত্তর কোরিয়া প্রথমবার এশিয়ার কোনো দেশ হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে। ইতালিকে হারিয়ে এই কৃতিত্ব দেখায় ‘চোল্লিমা’রা। কোয়ার্টার-ফাইনালে পর্তুগালের সঙ্গে তাদের ম্যাচটি ফুটবল ইতিহাসের একটি ক্ল্যাসিক ম্যাচ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। খেলার ২৫ মিনিটের মধ্যে কোরিয়ানরা তিন গোল দিয়ে বিস্মিত করে দেন। কিন্তু নাটকের তখন অনেক বাকি ছিল। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ হিসেবে পরিচিত ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ইউসেবিও ম্যাজিক টাচ দিয়ে সেদিন পর্তুগালকে জয়ী করে সবাইকে হতবাক করে দেন। তিনি একাই পর পর চারটি গোল দিলে ‘এ সেলেকাও’রা খেলায় ৫-৩ গোলে জয়লাভ করে। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইসরাইল, ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে ইরান, ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপে কুয়েত, ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইরাক ও দক্ষিণ কোরিয়া, ১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া ও সৌদি আরব অংশ নেয়। উত্তর কোরিয়ার পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার গৌরব অর্জন করে সৌদি আরব। মরক্কো ও বেলজিয়ামকে হারিয়ে দেয় সৌদিরা। বেলজিয়ামের বিপক্ষে খেলার ৫ মিনিটে সৌদি আরবের সাইদ আল ওয়াইরান যে গোলটি করেন, সেটি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে আলোচিত হয়। শেষ ১৬তে সুইডেনের কাছে হেরে বিদায় নেয় ‘গ্রীন ফ্যালকনস’। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপ থেকে এশিয়ার চারটি দেশ অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। সেবার অংশ নেয় দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, জাপান ও ইরান। যুগোশ্লাভিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচে জয়ী হয় একমাত্র ইরান। ফুটবল ইতিহাসের প্রথমবার যৌথভাবে এশিয়ার দুই দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ২০০২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন করে। স্বাগতিক দুই দেশ ছাড়াও এশিয়া থেকে অংশ নেয় সৌদি আরব ও চীন। পোল্যান্ড ও পর্তুগালকে হারিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ড্র করে ‘ডি’ গ্রুপ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া এবং রাশিয়া ও তিউনিসিয়াকে হারিয়ে এবং বেলজিয়ামের সঙ্গে ড্র করে ‘এইচ’ গ্রুপ থেকে জাপান গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে উঠার গৌরব অর্জন করে। শেষ ১৬তে তুরস্কের কাছে হেরে জাপানের স্বপ্নভঙ্গ হলেও ইতালিকে ২-১ গোলে হারিয়ে এশিয়ার দ্বিতীয় দল হিসেবে কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠে দক্ষিণ কোরিয়া। স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবার সেমি-ফাইনালে খেলার গৌরব অর্জন করে। সেমি-ফাইনালে জার্মনির কাছে এবং তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় তুরস্কের কাছে হেরে চতুর্থ হয় ‘তায়েজেউক ওরিয়র্স’রা। বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে এশিয়ার কোনো দেশের এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য। ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে জাপান, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সৌদি আরব এবং ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়া অংশ নেয়। আফ্রিকায় দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলে।
আর এবার অংশ নিচ্ছে ইরান, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। দুই ম্যাচে হেরে সবার আগেই বিদায় নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া একটি ম্যাচ খেলে এক পয়েন্ট নিয়ে এবং জাপান ও ইরান দু’টি করে ম্যাচ খেলে একটিতে ড্র করে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেটা কত দূর? অতীত অভিজ্ঞতা আর বর্তমান পারফরম্যান্স দেখে এটুকু বলা যায়, আকাশ ছোঁয়ার মতো অবস্থানে এখনও পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি এশিয়ান দেশগুলো। কিন্তু কেন?
বিশ্বের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই বসবাস করে এশিয়ায়। ফুটবল অনুরাগীও এ অঞ্চলে বেশি। আদি ফুটবলের জন্মভূমি চীন। তারপরেও কেন এশিয়ান দেশগুলো বিশ্বকাপ ফুটবলে পিছিয়ে আছে? এটা কি জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, প্রাকৃতিক, শারীরিক, মানসিক নাকি অন্য কোনো সমস্যা? বিশ্বকাপ ফুটবলে এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে নাকি শ্রেষ্ঠত্বের আসনে উপনীত হবে, বিষয়টি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
dulalmahmud@yahoo.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন