সুন্দরের কি মৃত্যু হয়? দুলাল মাহমুদ
পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত। আজ যাকে গভীরভাবে ভালোবেসে কাছে ডেকে নিতে একটুও দ্বিধা হয় না, কালই তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে সরিয়ে দেয় দূরে। যেন তাকে চেনেই না! কী অবাক করা ব্যাপার? জীবন কি কোনো অঙ্ক? একটু এদিক-সেদিক হলেই সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যাবে? বদলে যাবে আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, চাওয়া-পাওয়ার মাপকাঠি। এবারের বিশ্বকাপে ফুটবলে এমন বৈরী পরিস্থিতির শিকার স্পেন। কী নির্মমভাবেই না তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের কাছে বিধ্বস্ত এবং চিলির কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে তাদের বিদায় হয়ে যাবার পর সমস্বরে বলে দেওয়া হচ্ছে, মৃত্যু হয়েছে স্প্যনিশ ঘরানার ফুটবলশৈলী ‘তিকি-তাকা’র।
ঔপনিবেশিক শক্তি স্পেনকে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো ভালো লাগা নেই। কিন্তু যাদের যেটুকু পাওনা, সেটুকু দিতে কার্পণ্য বোধ করা উচিত না। স্প্যানিশ গিটারের সুরে যেমন মুগ্ধ হই, তেমনিভাবে বিশ্ব ফুটবলের স্পেনের অবদানের কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ফুটবলকে সুরভিত করার ক্ষেত্রে স্প্যানিশদের ভূমিকা মোটেও হেলাফেলার নয়। এ কথা তো নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিশ্ব সেরা ফুটবল লিগ ‘লা লিগা’। ১৯২৯ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে জনপ্রিয় এই প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ। এই লিগের অন্যতম আকর্ষণ রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, অ্যাথলেটিক বিলবাও, ভ্যালেন্সিয়ার মতো বিশ্ব নন্দিত ক্লাবগুলো। এই লিগ, এই ক্লাবগুলো এখন আর একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। এই লিগে খেলেন আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, ব্রাজিলের নেইমারের মতো দুনিয়া কাঁপানো ফুটবলাররা। বিশ্বের কত কত ফুটবলারের চোখে স্বপ্ন এঁকে দেয় এই লিগ, এই ক্লাবগুলো। এমন স্বপ্ন দেখানো দেশটাকে নিয়ে ফুটবল অনুরাগীদের ভালো লাগার বাতাবরণ তৈরি না হয়ে পারে না।
ফুটবলের এমন একটি হৃদয়দুলানো দেশ হয়েও বিশ্বকাপ ফুটবলে স্পেনের সেই তুলনায় এই সেদিনও বড় কোনো সাফল্য ছিল না। ১৯৩৪ সালে ইতালি বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে হারিয়ে স্পেনের অভিষেক হয়। পরের বিশ্বকাপে অংশ না নিলেও ১৯৫০ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে চতুর্থ হয়। এরপর থেকে বড় সাফল্য হয়ে যায় অধরা। এমনকি কোনো কোনো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বেও খেলার সুযোগ পায়নি। ১৯৮২ সালে নিজের মাটিতেও বেশি দূর যেতে পারেনি। বিশ্ব ফুটবলের শক্তিশালী একটি দেশ হয়েও স্প্যানিশদের ব্যর্থতা ছিল মন খারাপ করার মতো। এ অবস্থায় ২০০৬ সালের দিকে স্পেনে শোনা যেতে থাকে ‘তিকি-তাকা’র কথা। তবে এই ঘরানার ফুটবলের পূর্বসূরি হিসেবে কিংবদন্তি ফুটবলার হল্যান্ডের ইয়োহান ক্রুইফের নামটি উঠে আসে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনা ক্লাবের ম্যানেজার থাকার সময় তিনি নতুন ধরনের ফুটবল খেলার প্রবর্তন করেন। ছোট ছোট পাস আর মুভমেন্টের মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে তুলে খেলায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়াটাই ‘তিকি-তাকা’র সারকথা। ধরনটা এমন, যেন একটু একটু করে ফুলের মালা গেথে কেউ পরিয়ে দিচ্ছে গলায়। খেলার এই শৈলী, সৌন্দর্য ও সুরভি দর্শকদের মুগ্ধ করে। ফুটবলের এই নতুন দর্শন লুফে নেন নেদারল্যান্ডসের লুইস ফন গল, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড, স্পেনের পেপ গার্দিওলার মতো কোচরা। বিশেষ করে গার্দিওলা ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনার ম্যানেজার থাকার সময় এই শৈলী প্রয়োগ করে এনে দেন একের পর এক সাফল্যের মুকুট। আর এ ক্ষেত্রে তাঁর তুরুপের তাস ছিলেন জাভি, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সেস ফ্যাব্রেগাস, লিওনেল মেসির মতো ছোট-খাট গড়নের দুরন্ত ফুটবলাররা। বার্সেলোনার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ল্ইুস আরাগোনেস এবং পরবর্তীতে লুইস দেল বস্ক স্পেন জাতীয় দলে ছড়িয়ে দেন ফুটবলের এই সৌন্দর্য। এর প্রথম সুফল পাওয়া যায় ইউফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে। ২০০৮ সালে এই চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় করে স্পেন। এরপর জাতীয় দলে যোগ দিয়ে দেল বক্স রিয়াল মাদ্রিদের ঘরানার লোক হয়েও পরিপূর্ণভাবে মনোযোগ দেন ‘তিকি-তাকা’র চর্চায়। জাতীয় দলটিকে তিনি সাজান মনের মাধুরী দিয়ে। আর এ ক্ষেত্রে জাভি, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, ডেভিড ভিয়া, কার্লোস পুয়োল, জেরার্ড পিকে, সার্গিও বুসকুয়েটস, পেদ্রোর মতো বার্সেলোনার পরীক্ষিত সৈনিকরা তো ছিলেনই, তার সঙ্গে যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদের ইকার ক্যাসিয়াস, সার্গিও রামোস, জাভি অলোনসোরা। ফুটবল মাঠে ফুল ফোটাতে থাকে ‘লা ফুরিয়া রোজা’। আর এর মাধ্যমে দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হয় স্প্যানিশদের। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ জয় করে স্পেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি শোনা যেতে থাকে ‘তিকি-তাকা’র। ফুটবল রসিকরাও বুঁদ হয়ে যায় এর সৌন্দর্যে, এর মাধুর্যে, এর লালিত্যে। ফুটবলের এই রোমাঞ্চের রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো বাজিমাত স্পেনের। ২০১২ সালে পুনরায় জয় করে ইউফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয় ‘লা ফুরিয়া’।
এবারও বিশ্ব জয় করার লক্ষ্য নিয়ে ব্রাজিল আসে লুইস দেল বস্কের স্পেন। সঙ্গত কারণেই ফেবারিট দল হিসেবে আলোচিত হতে থাকে। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই তাদের মোকাবিলা করতে হয় গতবারের ফাইনালিষ্ট ‘দ্য ফ্ল্যাইং ডাচম্যান’-এর। শুরুতেই এমন কঠিন পরীক্ষায় পড়ে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে চ্যাম্পিয়নরা। আর এর ধাক্কা সামলানোর আগেই একসময়ের উপনিবেশ ‘লা রোজা’ একদমই ধসিয়ে দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে এককালের ডিফেনসিভ মিডফিল্ডার দেল বক্সের কৌশলও মার খায়। তিনি অভিজ্ঞ ঘোড়া দিয়ে রেসে জিততে চেয়েছিলেন। রেসে জিততে হলে কৌশল তো লাগেই, ভাগ্যটাও পক্ষে থাকতে হয়। কিন্তু কোনোটাই তাঁর পক্ষে ছিল না। অথচ রেসে জেতার মতো টগবগে ঘোড়া ও কৌশল যে তার জিম্মায় ছিল, সেটা তো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শেষ ম্যাচে দেখাই গেল। কিন্তু তার আগেই তো রেস থেকে ছিটকে পড়ে তাঁর দল ।
স্পেনের ব্যর্থতায় শোরগোল তোলা হচ্ছে যে, ‘তিকি-তাকা’ যুগের অবসান হয়েছে। একজন ব্যক্তি বা একটি দলের ব্যর্থতায় অনেক দিনের সাধনায় গড়ে উঠা একটি শৈলীর, একটি শিল্পের ও একটি সৌন্দর্যের মৃত্যু হতে পারে না। সুন্দরের কি মৃত্যু হয়? স্পেনের ‘তিকি-তাকা’-রও মৃত্যু হয়নি। অন্তত ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়ে তা চিরজাগরূক হয়ে থাকবে।
dulalmahmud@yahoo.com
ধন্যবাদ দুলাল ভাই।
উত্তরমুছুন