ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ






সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ খেলাধুলা। খেলোয়াড়রা ধারণ করেন উন্নত ও উদার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। একটি দেশ বা জাতি তখনই খেলাধুলায় উন্নতি করতে পারে, যখন গড়ে ওঠে তার ক্রীড়া সংস্কৃতি। দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য পেতে হলে কিংবা সবার মাঝে খেলাধুলার উপকারিতা, গুরুত্ব ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে হলে ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে তোলাটা অপরিহার্য। বিশেষত, আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে এটা খুবই প্রয়োজনীয়। এখন মনে হতে পারে, খেলাধুলা তো স্রেফ বিনোদনের অংশ। তার আবার কীসের সংস্কৃতি? এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বলা যেতে পারে, সংগীত, নৃত্য, নাটক, সিনেমা, শিল্পকলাও তো বিনোদনেরই মাধ্যম। এসব মাধ্যম তো সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। নানানভাবে চলছে এর চর্চা। এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাংস্কৃতিক চেতনা। এজন্য আছে অনেক সংগঠন। আছে নানান রকম কার্যক্রম। তাহলে খেলাধুলা কেন নয়? খেলাধুলার চর্চা কি সীমিত পরিসরে বন্দী হয়ে থাকবে? নাকি কেবলই হুজুক হয়ে থাকবে? আমাদের দেশে খেলাধুলার চর্চা চলছে অনেক আগে থেকেই। বিপুল জনগোষ্ঠিকে ছুঁয়ে যায় বিনোদনের এই মাধ্যমটি। দারুণভাবে তাঁদেরকে প্রভাবিতও করে। এমন একটা অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ক্রীড়া সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। খেলাধুলকে ঘিরে নেই নানানমুখী সাংস্কৃতিক ও মননশীল তৎপরতা। যে কারণে তা প্রোথিত করা যায়নি জনজীবনের গভীরে। পৌঁছানো সম্ভব হয়নি উপলব্ধির জগতে। এমনকি খেলাধুলার গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন, এমন মানুষের সংখ্যাও তো খুব বেশি নেই। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তো খুবই খারাপ অবস্থা। শারীরিক সুস্থতার জন্য খেলাধুলা যে অপরিহার্য, এই বোধটুকু সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো সেই উদ্যোগ কোথায়? সেটা না থাকায় আমাদের দেশে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। শারীরিক কসরত করা এমনকি নিশ্বাস নেওয়ার জন্য যথেষ্ট খোলা জায়গা নেই। তবে হাসপাতালের কিন্তু অভাব নেই। পাড়ায় পাড়ায় ক্লিনিক আর ওষুধের দোকানের ছড়াছড়ি। বাড়ছে ইট-পাথর-সিমেন্ট-বালুর অবকাঠামো। সংকুচিত হয়ে পড়ছে জীবনযাপন। জীবনধারা। জীবনবোধ। আমাদের সেই বোধটুকুই নেই যে, কোনটা আমাদের বেশি প্রয়োজন? কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এটা বোঝার জন্যও প্রয়োজন ক্রীড়া সংস্কৃতি। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে গড়ে ওঠবে ক্রীড়া সংস্কৃতি? এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্ন।
প্রথমেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে ক্রীড়া সংস্কৃতিটা আসলে কী? খেলাধুলাকে গভীরভাবে অবলোকন, অনুধাবন, অনুধ্যান এবং তাকে ঘিরে বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলাই ক্রীড়া সংস্কৃতির মুখ্য উদ্দেশ্য। খেলাধুলাকে কেবল ধুলোখেলা মনে না করে, জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে, তাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। পৌঁছে দিতে হবে জনমানসের হৃদয়ের গভীরে। যাতে করে গড়ে ওঠতে পারে সচেতন, সজাগ ও সজ্ঞানী ক্রীড়ানুরাগী। তাঁরা হয়তো মাঠে খেলবেন না, কিন্তু তাঁদের কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় উপকৃত হবে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে থাকবে ক্রীড়াঙ্গনকে নিয়ে গঠনমূলক, বস্তুনিষ্ঠ ও সৃজনশীল লেখালেখি, ক্রীড়া সাহিত্য এবং দায়িত্বশীল ক্রীড়া সাংবাদিকতা। চলবে নিরন্তর গবেষণা। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-কর্মশালা-সংলাপ আয়োজন। থাকবে বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা সহ নানা রকম প্রকাশনা। গড়ে তুলতে হবে ক্রীড়া বিষয়ক লাইব্রেরি, আর্কাইভ ও জাদুঘর। নির্মাণ করতে হবে প্রামাণ্য চিত্র ও চলচ্চিত্র। তুলে আনতে হবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সর্বোপরি ক্রীড়াপ্রেমীদের থাকতে হবে প্রগাঢ় জ্ঞান ও সৃজনশীল মন। সেজন্য প্রয়োজন সৃজনশীল কর্ম তৎপরতা।
ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে বিরাজ করছে বিশৃঙ্খল অবস্থা। কোনো কিছুই বলতে গেলে ঠিক মতো পরিচালিত হচ্ছে না। বোঝা না বোঝার ক্ষেত্রেও রয়ে গেছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। যে কারণে একটা শূন্যতা রয়েই যাচ্ছে। পূর্ণতা পাচ্ছে না। ক্রীড়াঙ্গনে কোনো কিছুই সংরক্ষিত হচ্ছে না। আজকে যেটা অর্জিত হচ্ছে, কালকেই সেটা হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের গর্ভে। আমরা প্রতিদিনই শুরু করছি নতুন নতুনভাবে। আমাদের ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক পুরনো। সেই ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় নিয়মিত ফুটবল লিগ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত হয়েছে ফুটবলের নানা নামের শিল্ড বা কাপ। বনেদিয়ানা ও আভিজাত্যে তার অবস্থান ছিল ওপরের সারিতে। ক্রিকেট খেলাও তো এ অঞ্চলে আয়োজিত হয়েছে ঢের ঢের আগে। পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে জমিদারদের। কোথায় সেই ইতিহাস? পাকিস্তান আমলে সাফল্য দেখিয়েছেন অনেক বাঙালি ক্রীড়াবিদ। বিভিন্ন খেলায় অংশ নিয়েছেন পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে। তাঁরা আজ কোথায়? ক্রীড়া সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ক্রীড়াবিদদের আত্মজীবনী। তা লেখার রীতি বা অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। যে কারণে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের জীবন, তাঁদের কীর্তি, তাঁদের সাফল্য। সেই উজ্জ্বল সময়খণ্ড নিভে যাচ্ছে কালের আবর্তে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলাধুলা হয়েছে কিংবা দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশ যে সব খেলায় অংশ নিয়েছে, তার কোনো প্রকৃত তথ্য কি সংরক্ষণ করা হয়েছে? একটু একটু করে তা হারিয়ে যাচ্ছে সব। ক্রীড়া বিষয়ক কোনো গবেষণা বলতে গেলে হয়নি। তারজন্য সেই পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা বা মন-মানসিকতা নেই। গড়ে ওঠেনি ক্রীড়াবিষয়ক সত্যিকার একটি লাইব্রেরি, আর্কাইভ ও জাদুঘর। এভাবে কি চলতে থাকবে?
এখন পর্যন্ত কোনো খেলাই যথাযথভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। আবেগের বশবর্তী হয়ে পরিচালিত হচ্ছে সব কিছু। প্রকৃত বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। বরাবরই একটা খামতি রয়েই যাচ্ছে। ক্রিকেট এখন আমাদের দেশের জনপ্রিয় খেলা। খেলা দেখার টিকিট না পেলে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠতে অনেকেই দ্বিধা করেন না। কিন্তু এই ক্রিকেট খেলা সত্যিকার অর্থে ক’জন বোঝেন? যখন বলা হয়, ‘ইট’স নট ক্রিকেট’, তার মর্ম কি সবাই অনুধাবন করতে পারেন? এই অনুধাবনটুকু নেই বলেই ২০১১ বিশ্বকাপে ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ ৫৮ রানে অল-আউট হলে ক্যারিবীয় ক্রিকেট দলের বাসে ঢিল ছোঁড়া হয় কিংবা দল হেরে গেলে ক্রিকেটারদের শারীরিক বা মানসিকভাবে আক্রমণ করা হয়। শ্রীলঙ্কায় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে তরুণ ক্রিকেটার আবুল হাসান যখন ইমরান নাজিরের ক্যাচ ফেলে দিয়েছিল এবং বাজে বল করেছিল, তখন তীব্রভাবে তাঁকে সমালোচিত হতে হয়েছিল। কাছে পেলে হাতের সুখ মিটিয়ে নিতে কারো কারো আপত্তি ছিল না। অথচ ক্রিকেটে কিন্তু এমনটি হতেই পারে। কেউ তো আর ইচ্ছে করে ক্যাচ ফেলেন না বা বাজে বল করেন না। ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি বলেই এমন উগ্র ও বেপরোয়া মনোভাব দেখা যায়। অথচ সেই আবুল হাসান যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেন, তখন তাঁকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতে কোনো কার্পণ্য করা হয় না। বাংলাদেশের গৌরব সাকিব আল হাসান খুলনা টেস্টের চতুর্থ দিন সকালে চমৎকার বল করে ১০০ উইকেট ক্লাবের সদস্য হওয়ার পর বিকেলে ৯৭ রানে আউট হয়ে যান। যে ধরনের শট খেলে আউট হন, তেমন শট তিনি আর কখনো খেলতে চাইবেন না। তারমানে কি তিনি পরম কাঙ্খিত সেঞ্চুরি না করে ইচ্ছেকৃতভাবে আউট হয়েছেন? কিংবা তিনি কি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছেন? না হলে পত্রিকায় কেন লেখা হবে, ‘সকালের নায়ক বিকেলের খলনায়ক’। এটা আসলে উপলব্ধি ও বোধগম্যের ব্যাপার। আর এই উপলব্ধি ও বোধগম্য গড়ে ওঠে ক্রীড়া সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে। ক্রীড়া সংস্কৃতি আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারে, আমাদের সাধ্য বা সামর্থ্য কতটুকু? জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমরা যেখানে ব্যর্থ, সেখানে খেলার মাঠে চাইলেই তো যখন-তখন সফল হওয়া যায় না।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেট কিংবা টেস্ট ক্রিকেট খেলবে, সেটা নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাবা যায়নি। কিন্তু কেউ না কেউ তো স্বপ্ন দেখেছেন এবং এই স্বপ্নটা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেটা মুখে হতে পারে কিংবা লিখেও হতে পারে। এই স্বপ্নের বীজ বুনে দেওয়াটাও কিন্তু ক্রীড়া সংস্কৃতি। খেলাধুলাটা আমাদের দেশে কখনই অভিভাবকদের সুনজর পায়নি। সন্তানকে খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন, এমন অভিভাবকের সংখ্যা খুবই বিরল। আর এখন সন্তানকে ক্রিকেটার হিসেবে দীক্ষা দিতে পারলে অনেক অভিভাবকই বর্তে যান। অনেক শিশুই বেড়ে ওঠেন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। এই স্বপ্নটা কিছুটা হলেও চারিয়ে দিয়েছে মিডিয়া। আর এই মিডিয়া তো ক্রীড়া সংস্কৃতির অন্যতম বাহন। বাংলাদেশ গলফ খেলা খুব একটা পরিচিত নয়। এখন সিদ্দিকুর রহমানের কৃতিত্বে গলফ খেলাটা একটু-আধটু আলোচিত হয়। গলফ নিয়ে যখন চর্চা বাড়বে, তখন অনেকেই এরপ্রতি আগ্রহী হবেন। এটাও নির্ভর করছে ক্রীড়া সংস্কৃতির ওপর। গলফকে নানাভাবে উপস্থাপন করাটাই তো ক্রীড়া সংস্কৃতির অংশ হতে পারে। শুধু সাফল্য দিয়ে পাওয়া যাবে কেবল একজন সিদ্দিকুর রহমানকে। আর ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে ওঠলে তখন ওঠে আসবেন অসংখ্য সিদ্দিকুর রহমান।
তবে ক্রীড়া সংস্কৃতির চর্চা যে একদমই হচ্ছে না, সেটা বললে ভুল হবে। বাংলাদেশে যাঁরা বা যেসব প্রতিষ্ঠান ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে তুলছে, তাদের পুরোধা হলো বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি। ইতোমধ্যে সমিতি পেরিয়ে এসেছে ৫০ বছর। এই সময়ে ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট থেকেছে এই সংগঠনটি। দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গনে বড় ধরনের একটা শূন্যতা দেখা দেয়। সেটা খুব বেশি অনুভূত হয় সাংগঠনিক ক্ষেত্রে। ক্রীড়াঙ্গনে হাল ধরার মতো সংগঠক তেমন ছিল না। ছিল না নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার সম্যক ধারণাও। এ কারণে বৈষম্যের শিকার হয় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গন। পাকিস্তানের ক্রীড়া বাজেটের বড় একটা অংশই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। যে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গন হয়ে পড়ে অবহেলিত ও অনাদৃত। তারপরও যেটুকু ক্রীড়াচর্চা হয়, তারও কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা ছিল না। এ অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনের চর্চাটা শুরু হয় মূলত ঢাকার পল্টন ময়দানকে কেন্দ্র করে। ফুটবল খেলাই ছিল সবচেয়ে কাঙ্খিত। এ কারণে ১৯৪৮ সালেই শুরু হয়েছে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ। এই ফুটবল লিগে খেলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান সহ বিদেশি ফুটবলাররা। ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা। করাচিতে ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালে এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় পূর্ব পাকিস্তান দল। ১৯৫৪ সালে নির্মাণ করা হয় ঢাকা স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে ওঠে ক্রীড়াঙ্গন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট টেস্ট, পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড টেস্ট, ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট, পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট, ১৯৬২ সালে পাকিস্তান-ইংল্যান্ড টেস্ট আয়োজিত হয়। ১৯৫৫ ও ১৯৬০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল গেমস। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ও ১৯৫৮ সালে পেশোয়ারে ৮০ মিটার হার্ডলসে রেকর্ডসহ স্বর্ণ পদক জয় করে কাঁপিয়ে দেন অ্যাথলেট লুৎফুন্নেছা বকুল। ১৯৫৮ সালে শুরু হয় আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল। তাতে অংশ নিয়েছে দেশী-বিদেশি দল। এই টুর্নামেন্ট বেশ সাড়া জাগায়। একই বছর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ক্রীড়াঙ্গনকে কাঁপিয়ে দেন সাঁতারু ব্রজেন দাস। এসব কিছু হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। তবে প্রভাবিত করতে পেরেছে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গনকে।
এরসঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে ক্রীড়া লেখনি ও ক্রীড়া সাংবাদিকতা। ক্রীড়ালেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকরা সে সময় ভূমিকা রাখলেও তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল না। তখন তো আর খুব বেশি পত্র-পত্রিকা ছিল না। হাতেগোনা যে ক’টি পত্রিকা ছিল, তাতে খেলার কভারেজ খুব একটা দেওয়া হতো না। আলাদাভাবে ক্রীড়া রিপোর্টারের কথা ভাবাই যেত না। ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় এক-দু’জন স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো কোনো পত্রিকায় ছিল খণ্ডকালীন রিপোর্টার। ফ্রিল্যান্সার ছিলেন কেউ কেউ। এমন একটা অবস্থায় একত্রিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন ক্রীড়ালেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকরা। ১৯৬৪ সালে গঠন করা হয় পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া লেখক সমিতি, আজকে যা পরিচিত বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি নামে। খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়ালেখক আতিকুজ্জামান খানকে সভাপতি ও ক্রীড়া সাংবাদিক আবদুল মান্নান লাড়ৃ ভাইকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত কমিটির সদস্যরা ছিলেন এ বি এম মূসা, তওফিক আজিজ খান, আবদুল আউয়াল খান, আনিসুল মওলা, রেজাউল হক বাচ্চু, সৈয়দ জাফর আলী, মিজানুর রহমান, সৈয়দ এস এম ওজায়ের, হাফিজুল হজ দেশ নবী। প্রত্যেকেই কম-বেশি ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের মতো রুটি-রুজি বা পেশাগত দাবি-দাওয়ার আন্দোলন করার জন্য এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়নি। এ অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। সাংবাদিক ইউনিয়নের শক্তি যাতে দুর্বল এবং তাদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে সাংঘর্ষিক না হয়, সেই বিবেচনা থেকেই নামকরণ করা হয় অপেশাদার এই সংগঠনের। মূলত নিজেদের একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াবিদদের তুলে ধরার ব্রত নিয়ে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। সে সময় বাঙালি ক্রীড়াবিদদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেওয়ার বিষয়টি সর্বাগ্রে গুরুত্ব পায়। পাকিস্তানি সরকার ১৯৫৮ সালে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’, ১৯৬০ সালে ‘তমাঘা-ই-ইমতিয়াজ’ প্রবর্তন করলেও তাতে বাঙালিদের গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এরমধ্যে অবশ্য ফুটবলে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য ১৯৬০ সালে সৈয়দ আবদুস সামাদ, ১৯৬৪ সালে খন্দকার নাসিম আহমেদ, ১৯৬৬ সালে সাহেব আলী এবং ১৯৬০ সালে সাঁতারে ব্রজেন দাস ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ খেতাব পান। সামগ্রিকভাবে সেটা আশাব্যঞ্জক ছিল না।

এ কারণেই ক্রীড়ালেখক সমিতি প্রতি বছর একজন সেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়। ১৯৬৫ সালে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলার জহিরুল হককে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে শুরু হয় সমিতির নতুন পথচলা। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। তখন বেসরকারিভাবে ক্রীড়াবিদদের পুরস্কার প্রদানের রেওয়াজ ছিল না। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা রাখে ক্রীড়ালেখক সমিতি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে পুরস্কৃত করা হয় পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের প্রথম বাঙালি খেলোয়াড় বশীর আহমেদকে। তখন তো টগবগিয়ে ফুটছে পূর্ব বাংলা। বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলনের কারণে সংগঠনটি তার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারেনি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৫ জুলাই ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া লেখক সমিতির নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি’। একই বছর ৪ আগষ্ট আবদুল হামিদকে সভাপতি করে গঠন করা হয় নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সমিতির নামে সরকারিভাবে বরাদ্দ করা হয় একটি কক্ষ। তবে বিভিন্ন সময়ে নানান জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে সমিতির কার্যালয় বর্তমান স্থানে থিতু হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সমিতির প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভা। সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এতে সমিতির সদস্যরা খোলা মনে অকপটে বলতে পারেন। এটাও অন্যান্য ক্রীড়া সংগঠনের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ১৯৭৪ সালের ৪ মার্চ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের জন্য নির্বাচিত সেরা ক্রীড়াবিদদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়। সেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচন ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে সমিতি কখনো সরে যায়নি। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। ২০০৪ সালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান চ্যানেল আইয়ের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সমিতির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছেন দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা। বলা যায়, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি সমিতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বর্ণিল অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাস্ট্রপতি থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এ অনুষ্ঠানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন দেশের তাবৎ ক্রীড়াবিদরাও। সমিতির দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে প্রবর্তন করা হয় জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। পরবর্তীতে এগিয়ে এসেছে অন্যান্য সংগঠনও। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসের বিভিন্ন ইভেন্টের সেরা ক্রীড়াবিদদের সাকুরা রেস্তোরাঁয় বেশ ঘটা করে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এছাড়া দেশ-বিদেশে আয়োজিত বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচন এবং বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়ালেখককে সংবর্ধনা দিয়েছে সমিতি। দেশের জন্য যে সব ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া দল সন্মান বয়ে এনেছে, তাঁদেরকেও সংবর্ধনা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’য়ের ক্রীড়া সাংবাদিক রবিন মার্লারের। ১৯৭৭ সালে সফরকারী এমসিসি দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এলে তাঁকে সংবর্ধনা দেয় সমিতি। তিনি বাংলাদেশ থেকে যেয়ে যে প্রতিবেদন লেখেন, তারই আলোকে বাংলাদেশের আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার পথ সুগম হয়। ১৯৭৭ সালে সমিতি প্রথমবারের মতো একটি স্মরণিকা প্রকাশ করে। তাতে ছিল বাংলাদেশের খেলাধুলার তথ্য ও রেকর্ড। এটিকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এই ধারাবাহিকতায় সমিতি তাদের স্মরণিকায় দেশে-বিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় বাংলাদেশের প্রতিটি খেলার ফল প্রকাশ করেছে। সমিতির সদস্যদের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় ক্রীড়া বিষয়ক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন ও দূতাবাসের সঙ্গে সমিতি প্রীতি ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছে। ক্রীড়া সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন দূতাবাসের সৌজন্যে আয়োজন করা হয়েছে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সমিতির লেখকরা ক্রীড়া বিষয়ক বই প্রকাশ করলে তাদের প্রথম বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এ ধরনের প্রকাশনা ও লেখককে উৎসাহিত করেছে সমিতি। ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিক-নির্দেশনাও দিয়েছে সমিতি। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচনের আয়োজনের প্রথম দৃষ্টান্তও তাদের। ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র প্রবর্তনের জন্য ১৯৯১ সালে আয়োজন করা হয় ‘ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র’ শীর্ষক এক সেমিনার। সমিতির কার্যক্রম দেশব্যাপি ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন জেলায় গঠন করা হয় বিভিন্ন শাখা। এই শাখাগুলোও প্রশংসিত হয়েছে তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ১৯৮৬ সালের ১৭ অক্টোবর হকি স্টেডিয়ামে উদ্বোধন করা হয় সমিতির গ্রন্থাগার। যদিও পরবর্তীকালে সেই গ্রন্থাগারটি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রীতি ম্যাচ আয়োজন ও স্পনসরের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে ক্রীড়া কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রেও সমিতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। পৃষ্টপোষকদের যথাযথভাবে মূল্যায়নও করেছে সমিতি। দুস্থ ক্রীড়া লেখক, ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়াবিদদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেতে সমিতি কখনো কার্পণ্য করেনি। খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ ও সমিতির সদস্যরা পরলোকগমন করলে তাঁদের স্মরণ করা হয় শোকসভার মাধ্যমে। আয়োজন করা হয়েছে ইফতার পার্টি, পুনর্মিলনী, ইনডোর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ফ্যামিলি ডে, বনভোজন, ঢাকার বাইরে বেড়ানোর মতো পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান। বনভোজন আয়োজনটা হয় জমজমাটভাবে। সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার সালেক সুফীর কল্যাণে ১৯৮৯ সালে সিলেটের হরিপুরে একটি চমৎকার ট্যুর আয়োজন করা হয়। সমিতি ঘটা করে আয়োজন করেছে বাংলা নববর্ষও। এসব আয়োজনের মধ্যে দিয়ে সমিতির সদস্যদের মধ্যে গড়ে ওঠেছে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও নিবিড় বন্ধন। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমিতি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। নতুন ক্রীড়া লেখক সৃষ্টি ও ছাত্র-ছাত্রীদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য আয়োজন করা হয়েছে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার। ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার গড়ে তোলার জন্য করা হয়েছে ক্রীড়া ধারাভাষ্য প্রশিক্ষণ কোর্স। প্রকাশ করা হচ্ছে সমিতির মুখপত্র ‘প্রতিযোগী’। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে কভার করার ক্ষেত্রেও অনুসরণীয় হয়ে আছেন সমিতির সদস্যরা। বাংলাদেশ বিশ্বকাপের ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে কবে খেলতে পারবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কিন্তু ১৯৯০ সালের ইতালির বিশ্বকাপ উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলার স্বপ্ন দেখিয়েছে সমিতি। বিভিন্ন খেলার সমস্যা, সংকট নির্ধারণ ও উত্তরণের পথ বাতলে দেওয়ার জন্য আয়োজন করেছে নানা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-কর্মশালা। সমিতি পরিদর্শনে এসেছেন দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা। মহৎ ও মানবিক কাজেও পিছিয়ে নেই সমিতি। সমিতি আয়োজন করেছে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি। তাতে সাড়া দেন ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই। স্বপ্ন দেখাতে কখনো পিছিয়ে থাকেনি ক্রীড়ালেখক সমিতি। যখন কেউ কল্পনা করতে পারেনি বিশ্বকাপে ক্রিকেটে বাংলাদেশ খেলবে, তখন সেই স্বপ্ন দেখিয়েছে সমিতি।

১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনের পর পরই সমিতি আয়োজন করে ‘বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও আমরা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা। আলোচনায় বক্তারা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আলোকপাত করে বলেন, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলবে। কারণ, দলীয় খেলার মধ্যে একমাত্র ক্রিকেটে বিশ্ব পর্যায়ে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।’ এই স্বপ্ন সত্য হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এমনিভাবেই ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে সমিতি। বিভিন্ন জেলা শাখায় সেমিনার আয়োজনেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সমিতি। প্রকাশনার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকেনি। প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলো সমৃদ্ধ করেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে। ক্রীড়াঙ্গনে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯২ সালে সমিতি প্রকাশ করে টেলিফোন গাইড। বিষয়ভিত্তিক এ ধরনের গাইড সমিতির উদ্যোগেই প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমীর বই মেলায় সমিতি প্রথমবারের মতো একটি স্টল নেয়। এই স্টলে কেবল ক্রীড়া বিষয়ক বই-পত্র, ম্যাগাজিন, স্যুভেনির বিক্রি করা হয়। স্টলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো তারকা ক্রীড়াবিদ উপস্থিত থাকতেন। তাঁদের উপস্থিতির ফলে সমিতির স্টলটি বই মেলায় দারুণভাবে সাড়া জাগায়।

সমিতির কর্মকাণ্ড শুধু দেশের পরিসরে সীমিত থাকেনি। পা বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। ১৯৯২ সালের ২৪ নভেম্বর এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস ইউনিয়ন (আসপু)-র সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। সিউলে আসপুর কংগ্রেসে সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সমিতির প্রতিনিধি কাজী আলম বাবু। পরবর্তীকালে আসপুর নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এ এস এম রকিবুল হাসান ও ইকরামউজ্জমান। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯৩ সালে ৭ মে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (এআইপিএস)-এর সদস্য হয় বাংলাদেশ। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এআইপিএসের ৫৬তম এই কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন খান দুলাল। খুলে যায় বাংলাদেশের ক্রীড়ালেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের বদ্ধ দুয়ার। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে আয়োজন করা হয় এআইপিএস কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে অংশ নেন সমিতির সদস্যরা। ক্রীড়ালেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ এই সংস্থায় যোগ দিয়ে পেশাগত ও সাংগঠনিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তাঁরা। জানতে পারছেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার সর্বশেষ হাল-হকিকত। সবচেয়ে বড় কথা, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ক্রীড়লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে গড়ে ওঠছে মৈত্রী ও সম্পর্কের বন্ধন। ১৯৯৩ সালের ১৯ ডিসেম্বরে সমিতির উদ্যোগে ঢাকায় গঠন করা হয় সাউথ এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস কমিশন (সাসপক)। এতে যোগ দেন শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের প্রতিনিধিরা। বিদেশি প্রতিনিধিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সহ যাবতীয় ব্যবস্থাপনায় ছিল সমিতি। আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলন আয়োজন করে সমিতি দেখিয়ে দিয়েছে তার সাংগঠনিক সক্ষমতা। ক্রীড়া বিষয়ক স্টিকারও প্রকাশ করেছে সমিতি।

১৯৯৫ সালের ২ জুলাই প্রথমবারের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও আয়োজন করা হয় ‘বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস’। এ উপলক্ষে সেবার ওয়াকথন, ক্রীড়া বিষয়ক প্রদর্শনী, দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার দুই অগ্রদূত সৈয়দ জাফর আলী ও এ বি এম মূসাকে সংবর্ধনা, ক্রীড়া বিষয়ক চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় শিশু-কিশোররা ক্রীড়া বিষয়ক যে সব ছবি এঁকেছেন, তাতে ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে স্বপ্ন। পরবর্তী সময়ে সেই স্বপ্নের কোনো কোনোটি পূরণও হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি বিশেষ খাম ও সিলমোহর প্রকাশ করে। এরপর থেকে প্রতি বছর দিনটি আড়ম্বর সহকারে উদযাপিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ প্রেস ইন্সস্টিটিউট (পিআইবি)-এর সহযোগিতায় সমিতি আয়োজন করেছে ক্রীড়া বিষয়ক রিপোর্টিং কর্মশিবির। বিভিন্ন খেলার আইন-কানুন ও কলাকৌশলের ওপর আয়োজন করা হয়েছে কর্মশালা। ক্রীড়াঙ্গনে প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করে ‘সরাসরি’ নামে জবাবদিহি অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে এসেছেন ক্রীড়াঙ্গনের নীতি-নির্ধারকরা। তরুণ লেখকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত করে ফিচার ব্যাংক। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের পর আয়োজন করা হয় টেস্ট উৎসব এবং ক্রিকেট প্রদর্শনীর। এই প্রদর্শনীতে স্থান পায় অতীত ও বর্তমান ক্রীড়াঙ্গনের অনেক স্মারক। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শ্রীলঙ্কার তারকা ক্রিকেটার সনথ জয়াসুরিয়া, দীলিপ মেন্ডিস ও চামিন্ডা ভাস। এ প্রদর্শনী ক্রীড়া জাদুঘর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছে। যদিও আজও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পুরণ না হলেও স্বপ্নটা তো আছে। সমিতির সদস্যদের কল্যাণের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ‘কল্যাণ তহবিল’। সমিতির কার্যক্রম দারুণভাবে প্রশংসিত হওয়ায় এআইপিএসের সদর দফতর থেকে ২০০০ সালে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে, To tell you the truth, you are one of the most productive Association's, sending us so many news about your activities. We thank you a lot. নানান রকম কার্যক্রম পরিচালনা করে ক্রীড়া উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সমিতির তৎপরতা মোটেও থেমে নেই।
সমিতি বরাবরই ক্রীড়া সাংবাদিকদের পেশাগত ও ক্রীড়ালেখকদের লেখালেখির ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কম্পিউটর যুগের একদম শুরুর দিকেই সমিতিতে কম্পিউটার সংযোজন করা হয়েছে। আর এখন তো ছোঁয়া লেখেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির। তারবিহীন নেটওয়ার্ক ওয়াই ফাই-এর মাধ্যমে সমিতির সদস্যরা সহজেই নিউজ পাঠাতে পারেন। ক্রীড়ালেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমিতি কখনো পিছিয়ে থাকেনি। লেখালেখি এবং পেশাগত কাজের বাইরে এক বুক তাজা হাওয়া নেওয়ার জন্য আড্ডার কোনো বিকল্প নেই। আর আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অবস্থিত বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির কোনো জুড়ি নেই। জমজমাট এই আড্ডায় এক ঝাঁক তরুণ প্রাণের সঙ্গে যোগ দেন প্রবীণরা। ক্রীড়া সাংবাদিক বা ক্রীড়ালেখকদের পাশাপাশি এই আড্ডায় যোগ দেন খেলোয়াড়, সংগঠক ও ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির স্বপ্নের সারথি তরুণ প্রজন্মের ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়ালেখকরা। আশা করা যায়, এই স্বপ্নবানদের হাত ধরে অনেক দূর এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় সংগঠন ও ভালোবাসার নিকেতন বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি।
dulalmahmud@yahoo.com
লেখক বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল খেলোয়াড় গড়ার কারিগর মোস্তাফা কামাল/ দুলাল মাহমুদ