এককালের দুরন্ত হার্ডলার জাহাঙ্গীর ফয়েজ/ দুলাল মাহমুদ

তিনি যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যান, সহজেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নেন। অন্য সবার চেয়ে একটু যেন আলাদা। গড়পড়তা বাঙালির তুলনায় বেশ দীর্ঘদেহী। সুস্বাস্থ্য ও সুদেহের অধিকারী। সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই। বয়সের কারণে কিছুটা টাল খেলেও চেহারায় লালিত্য ও ঝলমলে ভাবটা এখনও স্পষ্ট। আভিজাত্য পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। শারীরিক কাঠামোর কারণে নিজেকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিলেও ক্রীড়াঙ্গনের তিনি অত্যন্ত পরিচিতি মুখ। অ্যাথলেটিকস অঙ্গনে তাকে সবাই তাকে চেনেন। সমীহ করেন। নিজে অ্যাথলেট ছিলেন। ছিলেন দুঁদে সংগঠকও। তিনি এবিএম জাহাঙ্গীর ফয়েজ।
১৯৪৩ সালের ২ জানুয়ারি তার জন্ম। ঢাকার আড়াইহাজারে তার পৈতৃক নিবাস হলেও তিনি জন্মেছেন নাটোরে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাবা ছিলেন সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর ছিল বদলির চাকরি। এ কারণে নানা জায়গায় তাকে ঘুরতে হয়। চাকরিসূত্রে নাটোরে থাকাবস্থায় আমার জন্ম।’ শৈশবেই খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃত্ত হন তিনি। অ্যাথলেটিকস ও ফুটবলের সঙ্গে গড়ে তোলেন তার মিতালী। খেলাধুলার জন্য বাবা-মা’র অনেক বকা আর মারধর খেতে হয়েছে। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি জানান,‘নানা জায়গায় ভাসতে ভাসতে চট্টগ্রামে গিয়ে থিতু হই। ১৯৫২ সালে কাস থ্রিতে ভর্তি হই চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে। এই স্কুলে থাকতেই খেলাধুলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম গভঃ কলেজে পড়ার সময় খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। তখন কোনো নির্দিষ্ট খেলাধুলায় আবদ্ধ ছিলাম না। সব রকম খেলাধুলায় অংশ নিতাম। আসলে খেলাধুলার মাধ্যমে বিনোদন পাওয়াটাই ছিল মুখ্য ব্যাপার। তবে ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেটে ঝোঁক ছিল বেশি।’তবে খেলার মাঠে জাহাঙ্গীর ফয়েজ নজর কাড়তে সক্ষম হন ময়মনসিংহ যাবার পর। ১৯৬০ সালের শেষদিকে তিনি ভর্তি হন আনন্দমোহন কলেজে। এই কলেজের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই শুরু হয় তার স্পোর্টস ক্যারিয়ার। উজ্জ্বল সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ক্রীড়াঙ্গনে আমার সুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। এই কলেজের হয়ে প্রতিবারই আমি অ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন হই। আমার ইভেন্ট ছিল ১০০ মিটার স্প্রিন্ট, ১১০ মিটার হার্ডলস, রিলে, ব্রডজাম্প, হপ-স্টেপ জাম্প। কলেজের হয়ে ময়মনসিংহ প্রথম বিভাগ লীগে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলেছি। ক্রীড়াবিদ হিসেবে কলেজে আমার আলাদা একটা পরিচিতি গড়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে পাস করার আগে আমি কলেজের অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি হই।’
জাহাঙ্গীর ফয়েজ ১৯৬২ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ছিল বর্ণিল ও রঙিন। স্মার্ট, সুদর্শন, ঝকঝকে ও খেলার মাঠের উদীয়মান তারকা হিসেবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিনি অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যান তার ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতা দিয়ে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি খেলার মাঠে আলোড়ন তোলেন। তবে অ্যাথলেটিক্সটাকেই তিনি প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেন। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একের পর এক সাফল্য দিয়ে সাড়া জাগান। এজন্য অবশ্য অনুশীলনে তাকে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়। ১৯৬২ সাল থেকে তিনি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা হল অ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন হন। বিশেষ করে ১১০ মিটার হার্ডলসে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি আমেরিকান কোচ ওটিট কফির কছে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ওটিট কফি পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬০ সাল ছিল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘পাকিস্তানের টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম অধিনায়ক আবদুল হাফিজ কারদার ছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বে। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে নতুন নতুন খেলোয়াড় সন্ধান করতেন। ১৯৬০ সালে তিনি আনন্দমোহন কলেজে আসলে আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হই। আমাকে তিনি পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ন্যাশনাল ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত করেন। ১৯৬২ সালেও আমি একই ক্যাম্পে যোগ দেই। পূর্ব পাকিস্তান থেকে খুব কমসংখ্যক ক্রীড়াবিদ এই ক্যাম্পে সুযোগ পান।’ ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তানের লাহোরে ত্রিদেশীয় (ইন্দোনেশিয়া,তুরস্ক ও পাকিস্তান) অ্যাথলেটিকস মিটে অংশ নেন। তার সঙ্গে ছিলেন হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন ও আরজান খান।
জাহাঙ্গীর ফয়েজ ১৯৬০ সাল থেকে ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। ১১০ মিটার হার্ডলসে টানা তিন বছর রৌপ্য পদক পান। ১৯৬৪ সাল ছিল তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর। সে বছর তিনি ১১০ মিটার হার্ডলসে স্বর্ণ জয় করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন ‘ব্লু’। করাচীতে ইন্টার ইউনিভার্সিটি অ্যাথলেটিকসে অংশ নেন তিনি। অ্যাথলেট হিসেবে ছিল সেটাই তার শেষ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে তিনি বাস্কেটবলে প্রতিনিধিত্ব করেন। ঢাকা হল থেকে অংশ নেন ফুটবল ও ক্রিকেটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এসএসএস করেন। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী ছাত্রদের একজন ছিলেন তিনি। কাঁপিয়েছেন রাজনীতির মাঠ।
জাহাঙ্গীর ফয়েজ ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের সদস্য হন। ১৯৮৯ সালে হন যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৯৮ সালে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকসে একজন জাজ। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে তিনি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, গ্রীস, জার্মানী, ইংল্যান্ড সফর করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক দলের ম্যানেজার, ১৯৮৬ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক দলের ম্যানেজার, ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সাফ গেমসে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস দলের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন।
তার পরলোকগত স্ত্রী মবিনা খাতুন ছিলেন ইস্পাহানী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যার জনক। খেলোয়াড়ী জীবন শেষে ঠিকাদারী ব্যবসায়ে তিনি মনোনিবেশ করে। বর্তমানে তিনি পিডব্লিউডি’র ঠিকাদার সমিতির সভাপতি।
তার সময়ের সেরা অ্যাথলেট প্রসঙ্গে তিনি এস এ জামান মুক্তা, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন, কাজী আলমগীর, আরজান খান, মিরাজ, হাবিব এবং মহিলাদের মধ্যে লুৎফুন্নেছা হক বকুল, কাজী শামীমার কথা উল্লেখ করেন। সে সময়কার অ্যাথলেটিকস সম্পর্কে তার অভিমত হচ্ছে, ‘তখন অ্যাথলেটদের মধ্যে ডেডিকেশন ছিল। বলা যায়, কিছুই পাওয়া যেত না। বছরে একবার ট্রেনিং পাওয়া দেয়া হত। তাও সবার পক্ষে এটা পাওয়া সম্ভব হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রীড়াবিদরা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলেও পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াবিদরা তা থেকে বঞ্চিত হন। তারপরও সাফল্য পাওয়ার জন্য সবাই নিজেকে নিংড়ে দিতেন। আর এখন নানা রকম সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। ট্রেনিং থেকে শুরু করে কত রকম ফ্যাসিলিটি! কিন্তু সে অনুপাতে কোনো সাফল্য নেই।’
জাহাঙ্গীর ফয়েজ কখনোই অ্যাথলেটিকস অঙ্গন ছাড়তে পারেননি। নানাভাবে জড়িয়ে ছিলেন। জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে। তার বুকের মধ্যে আলাদাভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে অ্যাথলেটিকস। যখনই পেরেছেন অ্যাথলেটিকসের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। কখনো সফল হয়েছেন। কখনো হতে পারেননি। তবে অ্যাথলেটিকসে খারাপ কিছু দেখলে তার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। অ্যাথলেট জীবনে যেভাবে একটির পর একটি হার্ডলস পেরিয়ে দেখা পেয়েছেন সাফল্যের, তেমনিভাবে তিনি স্বপ্ন দেখেন অ্যাথলেটিকসের প্রতিবন্ধকতা দূর করে দিয়ে সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত করতে। তিনি না পারলেও কেউ না কেউ একদিন তার স্বপ্ন সফল করবেন। #
১-৭-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে জীবনের জয়গান / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

ম্যারাথনবিদ রতন/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা