নেইমারকে নিয়ে কেন এই হাহাকার? দুলাল মাহমুদ
বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী দিনে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচ দেখেই মনে হয়েছিল, এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয়। ইতোমধ্যে সেমি-ফাইনালে উঠলেও যে ব্রাজিলকে বুকের মধ্যে ঠাঁই দিয়েছি, তাকে এখনও খুঁজে পাইনি। কেন পাইনি, এটা তো সহজেই অনুধাবন করা যায়। ব্রাজিলের খেলায় ছিল না সুর-ছন্দ-সুষমা। কেমন যেন একটা কাঠ-খোট্টা দল মনে হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ফাউল করা দলটির নাম ব্রাজিল! কলম্বিয়ার বিপক্ষে খেলায় তো তাদের ফাউলের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ কোন ব্রাজিল? এমন ব্রাজিলের কথা তো কখনো ভাবিনি। পেলে-ডিডি-গ্যারিঞ্চার খেলা দেখিনি। না দেখলেও ইতিহাসের পাতায় এই শিল্পীদের যে বয়ান পাওয়া যায়, তাতেই মনের মধ্যে একটা ছাপ পড়ে যায়। তাতে কিছুটা অতিশয়োক্তি থাকলেও অনুভবটুকু তো মিথ্যে ছিল না। তাছাড়া তাঁরা যে সুন্দর ফুটবলের পথপ্রদর্শক ছিলেন, তার নমুনা তো আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পেয়েছি। আশির দশকের শুরু থেকে যে ব্রাজিলকে দেখেছি, তার সঙ্গে কল্পনার ব্রাজিলের খুব একটা অমিল ছিল না। ছন্দময় ড্রিবলিং, হৃদয়ছোঁয়া পাস, চোখজুড়ানো স্পটকিকের কোনো খামতি ছিল না। খেলার প্রতি মুহুর্তই আবিষ্ট করে রাখতো। খেলায় ছিল তীব্র আবেগ, গভীর ভালোবাসা আর প্রাণখোলা হৃদয়ের সমাবেশ। এখন আর ব্রাজিল সেই ফুটবল খেলছে না।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ব্রাজিলের মতো একটি ফুটবলীয় দেশ এবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকে ২২ বছরের ছেলে নেইমারের কাঁধে ভর করে। এই ছেলের তো ক্যারিয়ার মাত্র শুরু। সবে নাম লিখিয়েছে বার্সেলোনায়। এটাও ঠিক, ফুটবলটা খারাপ খেলছে না। যে কারণে মোটামুটি ভালো অঙ্কের বিনিময়েই তাঁকে দলে ভিড়েয়েছে ‘টিম’। বার্সেলোনা তাঁকে সম্পদ মনে করতেই পারে। তারপরও লিওনেল মেসি, আলেক্সি সানচেজ, পেদ্রো রড্রিগুয়েজের মতো ফরোয়ার্ড, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জোনাথন দস সান্তোস, জাভিয়ার মাচেরানো, সার্জিও বাসকুয়েটস, আলেক্স সং-এর মতো মিডফিল্ডাররা থাকার পরই কেবল তাঁর কথা ভাবা হয়েছে। বার্সেলোনার মতো ক্লাবগুলো ভবিষ্যতের সুবিধার কথা চিন্তা করেই নবীন খেলোয়াড়দের দলভুক্ত করে। নেইমারও তাঁদের একজন। কিন্তু পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের প্রাণভোমরা কী করে নেইমার হয়? নেইমারের ফুটবল কুশলতা নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও এই বয়সী খেলোয়াড়ের তো ব্রাজিলের মূল একাদশের খেলতে পারার জন্য স্বপ্ন দেখার কথা। স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়াটাই তাঁর জন্য হতে পারতো বড় পাওয়া। কোনো কারণে আক্রমণভাগের কোনো খেলোয়াড় কোনো ম্যাচে খেলতে পারলো না, তখনই তাঁর পরিবর্তে নেইমারের বয়সী খেলোয়াড়ের সুযোগ পেতে পারে। অন্তত ব্রাজিল দল তো নেইমারের মতো খেলোয়াড় উপচিয়ে পড়ার কথা। ব্রাজিলে কী প্রতিভার অভাব? ফুটবলারের কি কোনো কমতি আছে? ব্রাজিলের ফাবেলার খ্যাতি তো দুনিয়াজোড়া। আর এই বস্তিতে পেলে, গ্যারিঞ্চা, জইরজিনহো, জিকো, রোমারিও, রবার্তো কার্লোস, রিভালদো, রোনালদো, রবিনয়ো হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কত সহস্র শিশু-কিশোর-তরুণ। কারো কারো স্বপ্ন পূরণ হয়। কারো হয় না। ব্রাজিলের জাতীয় দলে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের প্রতিনিধিত্বই বেশি। শুধু নিজেদের জাতীয় দল কেন, কত কত দেশে ছড়িয়ে আছে ব্রাজিলীয় ফুটবলাররা। এমনকি বিভিন্ন দেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন। অবশ্য অর্থের প্রলোভনে বেশিরভাগই পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপে। এখন তো ফুটবলার রফতানি করে বড় একটা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে ব্রাজিল। আর সেই ব্রাজিলে কিনা ফুটবলারের আকাল?
নেইমারের উপর ব্রাজিল যে কতটা নির্ভরশীল, সেটা তো ইতোমধ্যে দেখাই গেছে। প্রথম রাউন্ডে ব্রাজিলকে উতরে দিয়েছেন এই ফরোয়ার্ড। তাঁর উপস্থিতি যে দলের জন্য বড় একটা টনিক, সেটাই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। লুইস ফেলিপে স্কলারির মতো ঝানু কোচও খোলামেলাভাবেই নেইমারের উপর তাঁর নির্ভরতার কথা জানিয়েছেন। নেইমার না থাকায় ব্রাজিলে এখন হাহাকার পড়ে গেছে। বিশ্বকাপটাই যেন তাদের হাত থেকে পড়ে গেছে। তাঁর পরিবর্তে কাকে খেলানো হবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো শেষ নেই। নেইমারের মতো একজন উদীয়মান তরুণ যদি হয়ে উঠেন দলের প্রধান নির্ভরতা, তা থেকে অনুধাবন করা যায় দলটির শক্তি ও সামর্থ্য। আক্রমণভাগে আর যাঁরা আছেন, তাদের খেলা দেখে আশার আলো দেখা যায়নি। এমন একটি দল নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখাটা আমার কাছে অবাস্তব মনে হয়। এরপরও যদি ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়, বুঝতে হবে বিশ্ব ফুটবলেরও সেই সুদিন নেই।
dulalmahmud@yahoo.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন