পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

১.
সেই শৈশবে ফুটবল খেলা যখন একটু একটু বুঝতে শিখেছি, তখন কেন জানি মনে হত, ফুটবলার আর পেলে বুঝি একে অপরের পরিপূরক। পেলেকেই মনে করতাম ফুটবলের মডেল। সে সময় তার খেলা দেখার প্রশ্নই আসে না। পেলে কেন, আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গেই তো চাক্ষুস কোনো যোগাযোগ ছিল না। শাদা-কালো টেলিভিশনই দেখতে পেতাম কালে-ভদ্রে, তাতে আন্তর্জাতিক ফুটবল খুব একটা সুলভ ছিল না। আর তখন তো পেলের সঙ্গে মাঠের ফুটবলের তেমন যোগাযোগই নেই। এদিক-সেদিক খেলতে গেলেও ফুটবলের মূলধারার সঙ্গে তার যোগসূত্র অনেক আগেই ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে ব্রাজিল জাতীয় দল এবং ১৯৭৪ সালে কাব দল ‘সান্তোস’য়ের হয়ে খেলা ছেড়ে দেন ‘দ্য কিং অব ফুটবল’। অবসর নেওয়ার পর ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাস্ট্রের ‘নিউইয়র্ক কসমস’ কাবের হয়ে খেলা চালিয়ে যান ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। তারপরও কেন পেলে নামটি বুকের মধ্যে স্থান করে নেয়, ঠিক বলতে পারবো না। তাকে নিয়ে পাঠ্য বইয়ে কি কোনো লেখা ছিল? সম্ভবত ছিল। দুর্বল স্মরণশক্তির কারণে নিশ্চিত হতে পারছি না। পেলে বললে তাকে চিনতে কষ্ট হত। যদি না তার নামের আগে ‘কালো মানিক’ বিশেষণটি আদর করে বসিয়ে দেওয়া হত। ভালোবাসার বন্ধন বোধহয় এমনই, বিশ্বের বিপরীত প্রান্তে বসবাস করেও তাকে মনে হত খুবই আপনজন। দূরত্ব কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পরবর্তীকালে তার গৌরবময় কীর্তিগাথা যত জানতে পেরেছি, তারপ্রতি আকর্ষণ আরো বেশি অনুভব করেছি। ফরোয়ার্ড হিসেবে তার চমৎকার ড্রিবলিং, পাসিং, পাওয়ারফুল শট, ব্যতিক্রমধর্মী হেডিং অ্যাবিলিটি, গোল করার দক্ষতা দিয়ে সবার মন জয় করে নেন। ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল দলের হয়ে শিল্পিত ফুটবলের কারুকাজ, ফুটবল ক্যারিয়ারে এক হাজারেরও বেশি গোল, পরিচ্ছন্ন ফুটবল জীবন, তাকে করে তোলে বিস্ময়কর এক ফুটবল ব্যক্তিত্বে। শুনে শুনে ফুটবলের এই দেবতাকে ‘করিয়াছি জীবনেরও ধ্রুবতারা’। স্বপ্নের সেই ফুটবলারকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। হবে কীভাবে? তিনি তো আর বাংলাদেশে আসেননি।

২.
রৌদ্রতপ্ত তারুণ্যে ফুটবলের সঙ্গে গড়ে ওঠে আত্মার নিবিড় বন্ধন। যখনকার কথা বলছি, তখন তো আমাদের দেশে ফুটবলের উত্তাল ঢেউ। খেলা দেখার জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়াটা ছিল তুচ্ছ ব্যাপার। তাই তো নিহত ফুটবলানুরাগীর ছবি দিয়ে পত্রিকায় কভার স্টোরি লেখা হয়, ‘মৃত্যু মূল্যে ফুটবল চাই’। ফুটবলের যখন এমন রমরমা অবস্থা, তখন ঢোলের বাড়ি দিতে থাকে আন্তর্জাতিক ফুটবল। ততদিনে অনেকটাই সহজলভ্য হয়ে ওঠেছে টেলিভিশন। লেগেছে রঙেরও ছোঁয়া। সেই সুবাদে বিশ্ব ফুটবলের গতিময় ও শৈল্পিক ছন্দ এসে আমাদের বুকে দোলা দিতে থাকে। ১৯৮২ সাল থেকে পুরোপুরি পেতে থাকি বিশ্বকাপ ফুটবলের রোমাঞ্চকর আমেজ। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ তো আমাদেরকে দারুণভাবে আপ্লুত করে দিয়ে যায়। দিয়াগো ম্যারাডোনা নামের এক অতিকায় ফুটবলারের অবিশ্বাস্য কা-কীর্তিতে উথালপাথাল হয় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আমরা যারা পেলের খেলা দেখিনি, তাদের কাছে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন ফুটবলের ঈশ্বর। গতি, ছন্দ ও সাহসের অনুপম নিদর্শন দিয়ে তিনি মাতোয়ারা করে দেন ফুটবল বিশ্বকে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘হ্যান্ড অব গড’ আর ছয়জন খেলোয়াড়কে ড্রিবলিং করে ‘দ্য গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ তাকে পরিণত করে শতাব্দীর অন্যতম সেরা ফুটবলারে। এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলে তিনি হয়ে ওঠেন অলৌকিক এক মহামানব। ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা-পশ্চিম জার্মানীর ফাইনাল ম্যাচে মেক্সিকান রেফারী কোডেসালের বির্তকিত সিদ্ধান্তে একমাত্র পেনাল্টি গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। কোডেসালের ফাঁসির দাবিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিটি রাজপথ আর অলি-গলি। তারপর থেকে ম্যারাডোনাকে নিয়ে আগ্রহে কখনো ভাটা পড়েনি। বিতর্কিত জীবন যাপন করে সব সময়ই তিনি থাকেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সেই ম্যারাডোনাকেও কাছে থেকে দেখার গৌরবের ভাগিদার হতে পারিনি। ম্যারাডোনাও বাংলাদেশে আসেননি। তাহলে আমাদের মত দীনজনদের তাকে দেখার সুযোগইবা কোথায়? একটা আফসোস অবশ্য রয়ে যাচ্ছে, ম্যারাাডোনা যদি এখন আর্জেন্টিনার কোচ থাকতেন, তাহলে তাকে দেখার একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল। যদিও খেলোয়াড় ম্যারাডোনা নয়, দেখা পেতাম মাঠের বাইরে ছটফট করতে থাকা ফুটবল পরিচালককে। তাতে কি? দুধের স্বাদ অন্তত ঘোলে তো মিটতো। কেন যে আর্জেন্টিনা গেল বিশ্বকাপে ভালো করতে পারলো না! আর সে কারণে ম্যারাডোনাকে আমাদের দেখা হলো না। হায়! এই দুঃখ কোথায় রাখি?

৩.
ব্রাজিলের পেলে আর ম্যারাডোনা দুই সময়ের দুই কিংবদন্তি ফুটবলার। তারা শুধু তাদের সময়ের সেরা ফুটবলার নন, ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম দুই সেরা তারকা। পেলের পর জগত কাঁপিয়ে দিতে আসেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার পর কে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। অনাগত সময়ে এর উত্তর পাওয়া যাবে। তবে আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার লিওনেল মেসিকে মনে করা হয়, এই প্রজন্মের সেরা ফুটবলার। অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা সংশয় থাকার কথাও নয়। ইতোমধ্যেই তিনি ‘ইউরোপিয়ান ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ‘ব্যালন ডি’অর’ এবং ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ হয়েছেন। বার্সেলোনার হয়ে স্প্যানিশ লীগে গড়ে চলেছেন একের পর এক মাইলফলক। যদিও পেলে ও ম্যারাডোনার নৈপুণ্যে যেমন বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা, তেমনিভাবে নিজের দেশকে এখনও চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননি মেসি। এ ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। সে সুযোগ তার সামনে এখনও জাজ্বল্যমান। সব মিলিয়ে ফুটবল বিশ্বের সবচে‘ আলোচিত তারকা তিনি। গোল করায় তার অসাধারণ মুন্সিয়ানা, গোল বানিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তার বুদ্ধিদীপ্ত চাতুর্য, সর্বোপরি মাঠে তার উপস্থিতি যেভাবে প্রতিপক্ষকে ধাঁধিয়ে দেয়, তা অবশ্যই ব্যতিক্রমধর্মী। ম্যারাডোনা স্বয়ং তাকে তার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। মেসির খেলা দেখার জন্য উপচে পড়ে গ্যালারী। চমকপ্রদ ক্রীড়ানৈপুণ্য, ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও আবেদন দিয়ে এখন বিশ্বের পয়লা নম্বর সুপারস্টার তিনি। সেই মেসি আর তার দল দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে দেখতে পাওয়াটা অবশ্যই স্বপ্নের মত। পেলে ও ম্যারাডোনাকে দেখতে না পাওয়ার যে মনোবেদনা, যে কষ্ট, যে আক্ষেপ, তা অনেকটাই দূর হয়ে যাবে মেসিকে দেখার পর। আমরা তো কেবল মেসিকে দেখবো না, দেখবো ফুটবলের দুই শিল্পী পেলে ও ম্যারাডোনার একজন যোগ্য উত্তরসূরিকে। পেলে ও ম্যারাডোনা যেমন ছিলেন তাদের সময়ের সেরা তারকা, এই সময়ের তারকা তো মেসি। মেসিকে দেখে খুঁজে পাওয়া যাবে পেলের সময়টাকে। মেসির মাধ্যমে পাওয়া যাবে ম্যারাডোনাকে। পেলে-ম্যারাডোনাকে না দেখতে পাওয়ার আক্ষেপ ঘুচবে মেসিকে দেখে। সুস্বাগতম মেসি।
দৈনিক যুগান্তর, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ফুটবলে জীবনের জয়গান / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

ম্যারাথনবিদ রতন/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা