নূর আহমেদ : ছিলেন ব্যাডমিন্টনে, ছিলেন ফুটবলেও/ দুলাল মাহমুদ

খেলার মাঠে তার উপস্থিতি এখন খুব একটা দেখা যায় না। অবশ্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে একটা সময় তিনি নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নেন। তারপর আড়ালে চলে যাবার পর তার খোঁজ আর কেউ নেয়নি। তিনিও আর ফিরে আসার তাগিদ বোধ করেননি। তবে যারা বাংলাদেশ বেতারের শ্রোতা,তাদের কাছে তিনি এখনও পরিচিত নাম। ধারাভাষ্যকর কিংবা ক্রীড়া বিশ্লেষক হিসেবে এবং কখনো-সখনো নাট্যশিল্পী হিসেবে তার কণ্ঠ পৌঁছে যায় অনেকের কাছে। কদাচিৎ টেলিভিশনেও তার উপস্থিতি দেখা যায়।
অথচ একটা সময় ফুটবলার ও ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। ফুটবল খেলেছেন কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে আর ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশীপে। তার এই অসাধারণ কীর্তি চাপা পড়ে গেছে কালের বিবর্তনে। বর্তমানে তার বয়স ৭৩। সারা দেহে সময়ের আঁচড়। তাকে দেখলে এখন আর বোঝার উপায় নেই যে, একটা সময় তিনি ছিলেন কতটা দেদীপ্যমান। কতটা উজ্জ্বল। বহমান সময় কেড়ে নিয়েছে তার সেই ঔজ্জ্বল্য।
তিনি নূর আহমেদ। তার পরিচয়ের গন্ডি অনেক দূর বিস্তৃত। ফুটবলার, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়, কোচ এবং সর্বোপরি ধারাভাষ্যকর হিসেবে ক্রীড়াঙ্গনে আলাদা একটা অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হন তিনি। তবে তার গৌরবময় কৃতিত্বের অনেকখানি জুড়েই আছে ভারত। এর কারণ, তার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার বারাসাতের কাজীপাড়ায়। ১৯৩৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। সঙ্গত কারণে জন্মস্থানেই খেলাধুলার তালিম পান। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মোরশেদ আলী ভালো ফুটবলার ছিলেন। বারাসাত সাব-ডিভিশনে ফুটবল খেলতেন। সেটা ছিল আমার জন্য বড় এক অনুপ্রেরণা। তবে আমাদের পাড়ায় চারজন ভদ্রলোক ছিলেন,তারা প্রতি শীত মৌসুমে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। আমাদের বয়সী কয়েকজন তাদের ফাই-ফরমাশ খাটতাম। হয়ত ব্যাডমিন্টন কোর্ট ঝাড়ু দিয়ে দিতাম কিংবা অন্যান্য টুকটাক কাজ করতাম। এর উদ্দেশ্য ছিল, তাদের পরিত্যক্ত শাটলটি যাতে আমরা পেতে পারি। তা পাওয়ার পর আমাদের বুকে খুশির বান ডেকে যেত। আমরা গরুর রানের হাড় চেয়ে-চিন্তে আনতাম। তা শুকিয়ে র‌্যাকেট বানিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। এভাবেই আমাদের বয়সী ছেলেরা ব্যাডমিন্টন পাকা হয়ে ওঠে। ক্লাস ফোরে ওঠার পর বাবা ঘোষণা দেন,পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারলের‌ র‌্যাকেট কিনে দেবেন। বাবাকে খুশী করতে পারায় পেয়ে যাই ঝকঝকে একটি নতুন র‌্যাকেট। সেই বয়সে সেটি ছিল স্বপ্নের মত ব্যাপার! তবে ব্যাডমিন্টনে আমার বেসিকটা তৈরি হয় গরুর হাড় দিয়ে খেলতে খেলতে। তাতে চোখের নিশানা ঠিক হয়ে যায়। আর ব্যাডমিন্টন খেলায় চোখের নিশানা ঠিক থাকলে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।’
ব্যাডমিন্টন খেলায় নূর আহমেদের সাফল্য পাওয়া শুরু হয় সাব-ডিভিশন পর্যায়ে। ১৯৫২ সালে কাজীপাড়া উত্তরহাট ক্লাবের হয়ে তিনি অংশ নেন বারাসাত সাব-ডিভিশন ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায়। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে তিনি বলেন,‘প্রথমবারই আমি এককে চ্যাম্পিয়ন হই। পরের বছর এককের পাশাপাশি যোগ হয় ডাবলস। ডাবলসে আমার পার্টনার ছিলেন প্রীতিশ সেন। এর পরের বছর থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত একক, দ্বৈত ও মিক্সড ডাবলসে টানা চ্যাম্পিয়ন হই। মিক্সড ডাবলসে আমার পার্টনার ছিলেন প্রীতিশ সেনের বোন উমা সেন।’
তবে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র অভিনেতা বিশ্বজিৎ তার মানসনয়ন খুলে দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘বিশ্বজিৎ তখনও জনপ্রিয় অভিনেতা নন। তবে ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে মোটামুটি সবাই তাকে চেনেন। তিনি বারাসাতে আসেন প্রদর্শনী ব্যাডমিন্টন খেলতে। আমার সঙ্গে খেলায় তিনি সহজেই হেরে যান। খেলার পর তিনি আমাকে কলকাতায় খেলার আমন্ত্রণ জানান। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া টুর্নামেন্টে খেলতে যাই। এ প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা অংশ নেন। পর পর দু’বছর খেলি। তাতে অবশ্য খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি। তবে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী ইন্দোনেশিয়ার তান হো ডকের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলাম।’এই শিক্ষাটা তিনি কাজে লাগাতে পেরেছিলেন ১৯৫৫ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এশিয়ান জুনিয়র ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশীপে। গৌরবময় সেই স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন,‘অনূর্ধ্ব-১৯ এই প্রতিযোগিতায় ভারত থেকে আমি অংশ নেয়ার সুযোগ পাই। আমার সঙ্গে আরো দু’জন ছিলেন। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ছিল মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, চীন, থাইল্যান্ড, হংকং, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভারত। সবাইকে টপকে ফাইনালে আমি মালয়েশিয়ার এস এম নূরীর মুখোমুখি হই এবং তাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করি। আমার আগে ভারতের আর কারো এই কৃতিত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে অবশ্য প্রকাশ পাড়ুকান এবং সৈয়দ মোদি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।’ এমন সাফল্য পেলেও এর কোনো স্মারক তার কাছে নেই। বার বার ঠিকানা পরিবর্তন করতে হওয়ায় হারিয়ে গেছে মূল্যবান সব সম্পদ।
নূর আহমেদ ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ২৪ পরগনা জেলা ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় এককে চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬৪ সালে ফাইনালে উঠলেও খেলতে পারেননি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাওয়ায় আত্মগোপন করায় আর খেলা হয়নি। এরপর বশীরহাট চলে যান এবং সেখান থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ফলে তার জীবনের উজ্জ্বল এক অধ্যায় আড়াল পড়ে যায়।
তার খেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি ছিলেন ট্রিকি শটে ওস্তাদ। কব্জির মোচড়ে শাটলকে এমনভাবে প্লেসিং করতেন,প্রতিপক্ষ সহজে বুঝতে পারতেন না।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসার পর নতুন এক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন নূর আহমেদ। খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা দিনগুলো পেছনে ফেলে এলেও তখনও তিনি বেলা শেষের গান হয়ে যাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ঢাকায় আসার পর আমি যোগাযোগ করি আমার দূর সম্পর্কের এক দুলাভাই এম এ রশীদের সঙ্গে। তিনি তখন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। তার কথায় ভিক্টোরিয়ার হয়ে অংশ নেই প্রুভিনশিয়াল ব্যাডমিন্টনে। ফাইনালে পিআইএ’র নাসিরউদ্দীনের কাছে হেরে যাই। পরের বছর ফাইনালে হারি আমাদের ক্লাবের রিয়াজের কাছে।’
নিজের সেরা খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘চলচ্চিত্র অভিনেতা বিশ্বজিৎকে হারানোটা স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি তখন পশ্চিমবঙ্গের চ্যাম্পিয়ন। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার একজন খেলোয়াড় ভারতে আসেন। তার সঙ্গে আমার যেদিন খেলা, সেদিন আমি রোজা ছিলাম। রোজা রেখে মাগরিবের নামাজ পড়ে তার মুখোমুখি হই। একটি শটের কথা খুব মনে পড়ে। থার্ড কোর্ট থেকে লাফ দিয়ে যেভাবে প্লেসিং করেছিলাম, আজও আমার কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হয়।’
নূর আহমেদ ১৯৭২ সাল পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এরপর তিনি কোচিংয়ে মনোযোগী হন। এ বি এস সাফদার বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার পর কমনওয়েলথ স্পনসরশীপের একটি সুযোগ আসে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘১৯৭৯ সালে ব্যাডমিন্টনে ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্য একটি কমনওয়েলথ বৃত্তি বরাদ্দ করা হয়। তিন দেশ থেকে একজন। এজন্য প্রতিটি দেশে আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার খাতা দেখা হয় ইংল্যান্ডে। এতে আমি নির্বাচিত হই। এক বছরের বৃত্তি নিয়ে আমি ইংল্যান্ড যাই। এই কোর্সে সারা পৃথিবী থেকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ৪৮ জন। আমাদের চিফ কোচ ছিলেন ড.হ্যারি জার্ভিস। আমি ডিস্টিংসসহ পাস করি।’
দেশে ফিরে আসার পর তিনি কোচিংয়ে আত্মনিয়োগ করেন। এ প্রসঙ্গে বলেন,‘আমি ব্যাডমিন্টনে আধুনিক কলাকৌশল শিখে আসার পর দেশে তা প্রয়োগ করি। এর ফলে ব্যাডমিন্টনের মান বেশ উন্নত হতে থাকে। আমার কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে সাফল্য অর্জন করেন গোলাম আজিজ জিলানী,মনোয়ারুল আলম বাবুল,সুলতান আরেফিন বদর,শেখ আবুল হাশেম,সাদেক প্রমুখ।’
আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হিসেবেও নূর আহমেদ স্বীকৃতি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে স্কলারশীপ করার সময় তিনি এই স্বীকৃতি অর্জন করেন। ১৯৭৮-৭৯ থেকে তিনি আম্পায়ারিং শুরু করেন। ১৯৮১ সালে থাইল্যান্ডে এশিয়ান ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশীপ এবং ১৯৮২ সালে সিঙ্গাপুরে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে আম্পায়ারিং করেন। ১৯৮৪ সালে সিডনিতে প্রাক-অলিম্পিক টুর্নামেন্টে মনোনীত হয়েও অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি যেতে পারেননি। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার কাম কোচ হিসেবে চীনে আমন্ত্রণমূলক ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশীপে এবং ১৯৮৩ সালে চীনে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে অংশ নেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সদস্য এবং যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৮২ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ এবং ১৯৮৪ সালে চীনে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে বাংলাদেশ দলের কর্মকর্তা ছিলেন।
১৯৮৫ সালে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন নূর আহমেদ। বাধ্য হয়ে তিনি ক্রীড়াঙ্গন থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর আর কেউ তাকে ডাকেনি। তিনিও আর গরজ অনুভব করেননি।
অতীত এবং বর্তমানের ব্যাডমিন্টন খেলার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন,‘এখন ব্যাডমিন্টন খেলা অনেক উন্নত হয়েছে। আমাদের সময় কোচিংয়ের কোনো বালাই ছিল না। বাইরের খেলার সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না। তারপরও ব্যাডমিন্টনে আমাদের যতটা এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, ততটা এগোনো সম্ভব হয়নি। ভারত আগে আমাদের সঙ্গে পারতো না। অথচ এখন তারা কত এগিয়ে গেছে! সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না। আসলে আমাদের কোচিংয়ের মান আশানুরূপ নয়।’
তার উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। এই উচ্চতা নিয়েও ব্যাডমিন্টন কোর্টে বিচরণ করেছেন দাপটের সঙ্গে। নিজের উচ্চতা সম্পর্কে তিনি বলেন,‘অনেকেই মনে করেন এই উচ্চতা নিয়ে আমি ব্যাডমিন্টনে কীভাবে সাফল্য পেতাম। আসলে ব্যাডমিন্টনে পৃথিবীর ভালো খেলোয়াড়রা খাটোই ছিলেন। লম্বাদের বরং খেলতে একটু সমস্যা হয়। শরীরের রিফেক্স ঠিকমত করতে পারেন না।’
তার দেখা সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘নারায়ণগঞ্জের ফুটবলার সামাদ খুব ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতেন। এছাড়া এস ইসলাম মেহেদী,মোজাম্মেল হক মন্টু,আমিনুল ইসলামের খেলা ছিল চোখে পড়ার মত।’
নূর আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার-পর্বটি যখন শেষ হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়- আর কোনো খেলায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি যে উত্তর দেন, তাতে যেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বের হয়ে আসে সাপ। তিনি যে একজন খ্যাতিমান ফুটবলার ছিলেন- এ প্রশ্নের আগে ঘুনাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি। স্মৃতির প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়ে তিনি বলেন, ‘ফুটবলই আমার প্রথম ভালোবাসা। ছোটবেলা থেকেই সারাক্ষণ ফুটবলে মেতে থাকতাম। কিন্তু বাবা খেলতে দিতেন না। এতে করে হলো কি, বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখলেও কেন জানি জ্বর আসতো। আমি নিয়মিত অসুখে ভুগতে থাকি। বাবা তখন তার ঘনিষ্ঠ ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে নিয়ে যান। তিনি সবকিছু শুনে বলেন, ছেলেকে খেলতে না দিলে অসুখ তো হবেই। এরপর বাবা আমাকে খেলার অনুমতি দেন। একবার আমাদের গ্রামে বিবাহিত আর অবিবাহিতদের মধ্যে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ হয়। আমি লেফট হাফে আর প্রতিপক্ষে বাবা রাইট হাফে খেলেন। এর ফলে আমরা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে যাই। খেলার এক পর্যায়ে আমার শট নেয়া বল বাবার দেহে লাগলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। এভাবে খেলতে খেলতে একসময় কলকাতা মোহামেডানের হয়ে পাওয়ার লীগে খেলার সুযোগ পেয়ে যাই। সেটা ছিল ১৯৫৫ সাল। এভাবে দু’বছর জুনিয়র এই লীগে খেলি। ১৯৫৭ সালে আইএফএ শীল্ডে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সঙ্গে মোহামেডানের খেলা। তখন খেলায় ড্র হলে পরদিন আবার খেলা হতো। দ্বিতীয় দিনে খেলা অমীমাংসিত থাকলে তৃতীয় দিন খেলা গড়াত। তৃতীয় দিনে ফলাফল না হলে অতিরিক্ত সময়ে খেলা হয়। তাতেও মীমাংসা না হলে টসের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো খেলার ফলাফল। ড্র হওয়া প্রথম দিনের খেলায় মোহামেডানের রাইট হাফ আব্বাস আহত হয়ে মাঠ ছেড়ে যান। এর ফলে মোহামেডানকে ১০ জন নিয়ে খেলতে হয়। আব্বাসের পরিবর্তে হায়দরাবাদ থেকে একজন খেলোয়াড় আনার চেষ্টা করা হয়। এর পাশাপাশি আমাকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল। পরের দিন আমি গ্যালারীতে বসে ছিলাম। এমন সময় আমাকে লোক মারফত ডেকে পাঠানো হয়। কারণ, হায়দরাবাদ থেকে খেলোয়াড় আনা সম্ভব হয়নি। খেলা শুরুর আগে সবাইকে এক গ্লাস লেমনের সঙ্গে একটুখানি ব্র্যান্ডি মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। জীবনে সেই প্রথম আমার ব্র্যান্ডি খাওয়া। খাওয়ার পর মাথাটা কেমন যেন ঝিম মেরে যায়। একটু পরই তরতাজা হয়ে উঠি। খেলতে নামার পর আমার পৃথিবীটা যেন দুলে ওঠে। আমি যেন খেই রাখতে পারছিলাম না। আমার খেলায় দর্শকরা চটে যায়। আমি থ্রো মারতে গেলে গ্যালারী থেকে আমাকে ভ‍ৎর্সনা করা হয়। তবে সেদিন বোধহয় ভাগ্যটা আমার পক্ষে ছিল। আমি খেলায় তাল মেলাতে না পারলেও একটি অভাবিত ঘটনা ঘটে যায়। খেলার এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা আমাদের রক্ষণভাগে উঠে আসেন। আমাদের গোলরক্ষক রসুল বক্স নিশ্চিত একটি গোল হজম করতে যাচ্ছিল। ঠিক সে মুহূর্তে আমি হঠাৎ কী ভেবে দৌড় দেই। রসুলের পা লেগে আমি পড়ে যাই। এটা প্রতিপক্ষরা খেয়াল করতে পারেননি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সে সময় প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডের ফাঁকা গোলপোস্টের দিকে মারা শট আমার মাথায় লেগে বাইরে চলে যায়। নিশ্চিত একটি গোল খাওয়া থেকে আমরা বেঁচে যাই। পরদিন অতিরিক্ত সময়ের খেলা। প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক ভরদ্বাজ। তিনি তখন ভারতের পয়লা নম্বর গোলকিপার। আমার নেয়া একটা শটের বল বাইরে চলে যাচ্ছে মনে করে ভরদ্বাজ বল ধরার কোনো চেষ্টাই করেননি। বাঁক খেয়ে বল জালে জড়ালে হতভম্ব হয়ে যান গোলরক্ষক। সেই এক গোলে জয়ী হই আমরা। এরপর আমি হিরো হয়ে যাই। দেশত্যাগের আগে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আমি কলকাতা মোহামেডানে খেলি। এর মধ্যে ১৯৫৭ সালে মোহামেডান লীগ ও আইএফএ শীল্ড এবং ১৯৫৯ সালে লীগ, আইএফএ শীল্ড, রোভার্স কাপ, দিল্লী ক্লথ মিলস শীল্ড জয় করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর সেভাবে আর খেলা হয়নি। তবে ১৯৬৮ সাল থেকে বিশেষ অনুরোধে দ্বিতীয় বিভাগের দল ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলি। ১৯৭০ সালে ইকবাল স্পোর্টিং এবং দিলকুশা ক্লাবের পয়েন্ট সমান হয়ে যায়। অথচ যে কোনো একটি দল প্রথম বিভাগে উন্নীত হবে। এমন এক অবস্থায় লীগের শেষ খেলায় আমার দেয়া একমাত্র গোলে দিলকুশাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইকবাল স্পোর্টিং। এই ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাবই স্বাধীনতার পর পরিচিত হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে।’
খেলোয়াড় ও কোচ ছাড়াও নূর আহমেদের আরেকটি পরিচয় ক্রীড়া ধারাভাষ্যকর হিসেবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ভারতে কোনো খেলা হলে তাতে ধারাভাষ্যকর হিসেবে থাকতেন পুষ্পেন সরকার, অজয় বসু প্রমুখ। তারা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। আমাদের পাড়ায় যখন খেলাধুলা হতো, আমি তাদের অনুকরণ করে মাইকে ধারাবিবরণী দিতাম। অল্প বয়সেই এতে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠি। আমি ঢাকা বেতারের নাটকের শিল্পী ছিলাম। একদিন রেডিওতে গিয়ে দেখি মোহাম্মদ শাহজাহান এবং আবদুল হামিদ দাঁড়িয়ে আছেন। শাহজাহান ভাই কলকাতা থাকতে আমাকে ফুটবলার হিসেবে চিনতেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী জন্য এসেছো? আমি বললাম। তখন তিনি হামিদ ভাইকে বললেন, এঁকে দিয়েই হবে। এই বলে তারা আমাকে ধারাভাষ্যকর হিসেবে রেডিওতে অডিশন দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তাতে আমি উত্তীর্ণ হই। সেটা ছিল ১৯৬৪ সালে সেপ্টেম্বর মাস। সে বছরই ঢাকা স্টেডিয়ামে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের দু’দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের খেলায় ধারাভাষ্যকর হিসেবে নেয়া হয়। সে সময় এই দুটি ছিল খুবই দাপুটে কাব। কথা ছিল, আমি পাঁচ মিনিট ধারাবিবরণী দেব। এ সময় পেটের পীড়ার কারণে হামিদ ভাই বাথরুমে গেলে শাহজাহান ভাই একাই কমেন্ট্রি করতে থাকেন। হঠাৎ তার বুকে ব্যথা অনুভূত হওয়ায় তিনি আমাকে কমেন্ট্রি করতে দেন। অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও আমি একাই কমেন্ট্রি চালিয়ে যাই। এক মুহূর্তের জন্যও অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিনি। সেই যে শুরু হয়, তারপর এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি বেতারে বিভিন্ন ক্রীড়াবিষয়ক অনুষ্ঠান গ্রন্থনা ও পর্যালোচনা করে আসছি।’
নূর আহমেদ এক কন্যা আনোয়ারা আহমেদ মুক্তি এবং এক পুত্র তওহীদ আহমেদ দীপুর জনক। ১৯৬৪ সালে সাধারণ বীমায় যোগ দিয়ে ২০০০ সালে ম্যানেজার হিসেবে তিনি অবসর নেন।
নূর আহমেদের জীবনে বড় একটা আক্ষেপ হলো, তার জীবনের বর্ণময় সময়টা কেটেছে ভারতের মাটিতে। তার যা কিছু কীর্তি ফেলে আসা সেই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ভারতে থাকলে নিশ্চয়ই তার সেই কীর্তি উদ্ভাসিত হতো। মিলতো স্বীকৃতি। সেই জীবনটা তাকে মাঝেমধ্যে নস্টালজিক করে তোলে। তিনি তখন নিজেকে হারিয়ে খোঁজেন। #
১-৮-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে জীবনের জয়গান / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

ম্যারাথনবিদ রতন/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা