নিবেদিতপ্রাণ অ্যাথলেট আবদুল খালেক/ দুলাল মাহমুদ
আমাদের মতো দেশে অপেশাদার কাঠামোয় শুধু ক্রীড়াঙ্গনকে অবলম্বন করে জীবনযাপন করা মোটেও সহজ নয়। তারপরও কেউ কেউ খেলাধুলাকে ভালোবেসে এমন একটি অনিশ্চিত জীবনকে বেছে নিতে একটুও দ্বিধা করেন না। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না করেই জীবনের বড় একটি সময় কাটিয়ে দেন খেলার মাঠে। নিজে খেলেন এবং অন্যকে খেলতে উদ্বুদ্ধ করেন। খেলোয়াড়ী জীবন শেষে গড়ে তোলেন নতুন নতুন ক্রীড়াবিদ। এটাই হয়ে ওঠে নেশা ও পেশা। খেলাধুলার প্রতি নিবেদিতপ্রাণদের একজন হলেন মোঃ আবদুল খালেক। জীবনের শুরু থেকেই সেই যে খেলাধুলায় জড়িয়ে পড়েন, তা আর কখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। খেলাকে ভালোবেসে কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবনের সেরা সময়। তিনি জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসতেন। আর এই চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়াটাও ছিল তার পরম পাওয়া। জীবনের শুরুতে ছিলেন স্প্রিন্টার, তাতে যে সফল ছিলেন, তার প্রমাণ এখনও তিনি সেই পরিচয়ে পরিচিত। স্প্রিন্টার হিসেবে তার পাওয়ার ও স্পিড ছিল ন্যাচারাল। সময়ের দাবিতে ট্র্যাক পরিবর্তন করে হন হার্ডলার। এক্ষেত্রেও সাফল্যের শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছেন। অ্যাথলেটিকস মাঠে গড়াতে বিলম্ব হওয়ায় টুপ করে নেমে পড়েন সুইমিংপুলে। তাতেও তিনি বিফল হননি। দলের প্রয়োজনে কাবাডি ও ভলিবল কোর্টে নেমে চমক দেখিয়েছেন। এতকিছুর পর তার কীর্তিগাথা শেষ হচ্ছে না। অ্যাথলেটিকসের কোচ হিসেবে তার সাফল্য যে কারো কাছেই ঈর্ষণীয়।
আবদুল খালেকের জন্ম ঢাকার মুন্সীগঞ্জে ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারি। মুন্সীগঞ্জ ছিল খেলাধুলার লালনক্ষেত্র। সেই শৈশবে জড়িয়ে পড়েন নানাবিধ খেলাধুলায়। যখন যেটায় সুযোগ পেয়েছেন, তখন তার সদ্ব্যবহার করেছেন। কখনো দৌড়াদৌড়ি, কখনো হা-ডু-ডু, কখনো ভলিবল, কখনো সাঁতার কাটতেন। আবার কখনো মনের সুখে ঘুড়ি ওড়াতেন। তবে খেলাধুলায় পুরোপুরি নিবেদিত হওয়ার সেটাই প্রধান কারণ ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, ছোটবেলায় আমি লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগী ছিলাম না। এটা খেয়াল করেন আমার এক মামা আবদুস সোবহান। আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। খুবই মেধাবী ছিলেন। বড় হলেও তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মত। তিনি আমাকে একদিন বললেন, তোকে দিয়ে পড়ালেখা হবে না। খেলাধুলা করলে তুই ভালো করতে পারবি। আমি তখন কাস ফাইভে পড়ি। মামা আমাকে শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি বিদেশী ক্রীড়াবিষয়ক বই-পত্র এনে তা বাংলায় অনুবাদ করে দিতেন। আমি তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম। কোনো একটা জিনিস দেখলে তা সহজেই আমি বুঝে নিতে পারতাম। মাঝেমধ্যে মামা আমাকে নিয়ে যেতেন ঢাকার আমেরিকান তথ্যকেন্দ্রে। খেলার ছবিগুলো আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। এভাবেই একজন ক্রীড়াবিদ হওয়ার দীক্ষা পেতে থাকি। পুঁথিগত যে জ্ঞানটুকু আমি অর্জন করি, তা পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হয় স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। আমি মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলে ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হই। ব্যস, তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে ইন্টার স্কুল, ঢাকা জেলা স্কুল, ঢাকা বিভাগীয় স্কুল এবং জাতীয় স্কুল অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে আমি ছিলাম অপ্রতিদ্বন্দ্বী।’ তার এই কীর্তির কথা পৌঁছে যায় অ্যাথলেটিকসের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে। ১৯৬৭ সালে স্কুলের ছাত্র থাকাকালে তাকে নিয়ে নেয় টিঅ্যান্ডটি। সে বছরই তাদের হয়ে প্রথমবারের মতো তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নেন তিনি। সেদিনের স্মৃতির কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘অনেক উদ্দীপনা নিয়ে স্প্রিন্ট দিতে যাই ঢাকা স্টেডিয়ামে। কিন্তু হিটে খালি পায়ে দৌড়ানোর সময় আমার পা ফেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায় জাতীয় প্রতিযোগিতায় আমার পদক পাওয়ার স্বপ্ন। সে সময় বুয়েটের ছাত্র মামা আবদুস সোবহান ইসলামপুর নিয়ে গিয়ে ১৫ টাকা দিয়ে এক জোড়া রানিং স্যু কিনে দেন। তা পেয়ে আমি তো খুশিতে টগমগ। নতুন উদ্যমে অনুশীলন চালিয়ে যাই। পরের বছর আর আমাকে পায় কে? আমি তখন ময়ূরপঙ্খী ঘোড়া হয়ে আকাশে উড়ছি। সে সময় দ্রুততম মানব ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। অসাধারণ অ্যাথলেট। স্প্রিন্টার হিসেবে তিনি ছিলেন সবার আদর্শ। তাকে হারিয়ে আমি প্রথম হই। সিরাজুল দ্বিতীয় ও মাহবুব তৃতীয় হন। আমি গ্রামের ছেলে। জাতীয় অ্যাথলেটিকস উপলক্ষে ঢাকায় ৩/৪ দিন থাকার পর হাঁপিয়ে ওঠি। যে কারণে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সুবিধা করতে পারিনি। তৃতীয় হই। মাহবুব প্রথম ও শাহজাহান দ্বিতীয় হন। তবে ৪গুণন১০০ মিটার রিলে দৌড়ে প্রথম হই। রিলেতে আমার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব, মিরাজ ও আজিজ। সে বছর ঢাকায় পাকিস্তান গেমসে অংশ নিতে পারিনি। না পারার কারণ- মেক্সিকো অলিম্পিক গেমসের ট্রায়ালের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মিরাজ ও আমাকে মনোনীত করা হয়। ট্রায়াল ক্যাম্প হয় পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে। আমাদেরকে দেয়া হয় আর্মি কমান্ডো ট্রেনিং- যা সিভিলিয়ান অ্যাথলেটদের জন্য খুবই দুরূহ। তবে হকি দলের সমস্যার কারণে পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস দলের মেক্সিকো যাওয়া হয়নি।’
১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে দ্রুততম মানব হন আবদুল খালেক। এছাড়া ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ জয় করেন। রিলে দলে তার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব, সিরাজ ও আজিজ। ১৯৭০ সালে তিনি টানা তৃতীয়বারের মতো ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে প্রথম হন। রিলে দলেও তার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব, সিরাজ ও আজিজ। এছাড়াও তিনি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের করাচিতে এবং ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাকিস্তান অ্যাথলেটিকসে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে অংশ নেন। পাকিস্তান অ্যাথলেটিকসে সুবিধা করতে না পারা প্রসঙ্গে আবদুল খালেক বলেন, ‘পাকিস্তান অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতেন এশিয়ান গেমসে পদকজয়ী অ্যাথলেটরা। সে সময় ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে জন পারমল, ইকবাল সিনওয়ারী, ২০০ মিটার স্প্রিন্টে গোলাম কাদের ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের সঙ্গে পারার প্রশ্নই আসে না। পাকিস্তানের ইতিহাসে পুরুষদের মধ্যে মাত্র তিনজন বাঙালি অ্যাথলেট এসএ জামান মুক্তা, মিরাজ ও সিরাজ পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে পদক পেয়েছেন। তবে একমাত্র স্বর্ণপদকটি পান মিরাজ।’
আবদুল খালেক ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। তিনি ছিলেন চার্লি কোম্পানিতে। এই ট্রেনিংটা অবশ্য বৃথা যায়নি। ১৯৭১ সালে তিনি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার পর আবার তিনি ফিরে আসেন খেলার মাঠে। যোগ দেন বিআইডিসিতে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে বছর সাঁতার দল গঠন করার উদ্যোগ নেয় বিআইডিসি। তাদের স্পোর্টস দেখতেন মাহবুব নামে একজন। দল গঠনের ব্যাপারে তিনি কাজী আবদুল আলীমের শরণাপন্ন হন। তিনি তখন মাহবুবকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আমি তখন মোশাররফ হোসেন খান, শাহজাহান মিজি, বোরহান উদ্দিন, কালিপদ দাস, সুমন্ত কুমার ভাওয়াল, অ্যাথলেট শাহ আলমকে নিয়ে সাঁতার দল গঠন করি। শাহ আলমও সাঁতারু ছিলেন। আমাদের দল রানার্সআপ হয়। সাঁতারু হিসেবে আমার ভূমিকায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা, প্রথম জীবনে আমি মূলত সাঁতারু ছিলাম। স্কুল ও ইন্টার স্কুল সাঁতারে আমি অনেক পদক পেয়েছি। আমাদের মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের পুকুরের খ্যাতি ও ঐতিহ্য ছিল সাঁতারু গড়ে তোলায়। এই পুকুরে সাঁতার কেটে বিখ্যাত হন ভারতের বিখ্যাত সাঁতারু জ্ঞানরঞ্জন দাস ও তার ভাইয়েরা। তাদের একজন আশীষ দাস এশিয়ান মেডেল উইনার। ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে তিনি এ কৃতিত্ব দেখান। এছাড়াও মহিউদ্দিন, অখিল, আবদুল হাই, শাহাবুদ্দিন এ পুকুরে অনুশীলন করতেন। তারা ছিলেন আমাদের সিনিয়র। এরপরই সাঁতারু হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন আমার সমসাময়িক মোশাররফ হোসেন খান, শাহজাহান মিজি, বোরহান উদ্দিন, ধনরঞ্জন দাস, রবীন্দ্র চন্দ্র আইচ, সেলিম মিঞা প্রমুখ। অ্যাথলেটিকসের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণের কারণে সাঁতারে মনোযোগ দেয়া হয়নি।’
সাঁতারের পর ইপিআইডিসি অ্যাথলেটিকস টিম গঠনের সময় ফের কাজী আবদুল আলীমের শরণাপন্ন হলে তিনি আবদুল খালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সেই দল গড়ার ক্ষেত্রেও যোগ্যতার ভিত্তিতে মুন্সীগঞ্জের অ্যাথলেটদের প্রাধান্য ছিল। তাদের অন্যতম হলেন শাহ আলম, শাহজাহান মিজি, আইয়ুব আলী, খোরশেদ আলম। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় বিটিএমসির হয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে তিনি তৃতীয় হন। প্রথম ও দ্বিতীয় হন যথাক্রমে সুবেদার খাদেম হোসেন ও শাহ আলম। ৪গুণন১০০ মিটার রিলে দৌড়ে প্রথম হন। তার সঙ্গে ছিলেন শাহ আলম, হাবিব ও রফিক। ১৯৭৪ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে প্রথম হন। ৫৫ দশমিক ২ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। রিলে দলে ছিলেন শাহ আলম, ইকবাল, রফিক ও খালেক। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে তিনি তৃতীয় হন। ১১ সেকেন্ড সময় নিয়ে সুবেদার খাদেম হোসেন প্রথম ও শাহ আলম দ্বিতীয় হন। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রামে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ১১০ মিটার হার্ডলসে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। সময় নেন ১৭ সেকেন্ড। হাবিলদার এমএ সালাম দ্বিতীয় ও মোঃ খোরশেদ তৃতীয় হন। হার্ডলসে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম দলের কোচ ও সংগঠক। কোন ইভেন্টে কাকে নিলে বেশি পদক পাওয়া যাবে, সেটা দেখার দায়িত্ব ছিল আমার। আমি দেখলাম, আমার ইভেন্ট স্প্রিন্ট হলেও ততদিনে আমাকে প্রতিস্থাপন করার মতো যোগ্য অ্যাথলেট আমাদের দলে এসে গেছে। বরং হার্ডলসে একটা শূন্যতা আছে। এই শূন্যতা পূরণ করার জন্য আমি নেমে পড়ি। অবশ্য তার আগে দীক্ষা নেই হার্ডলার আবদুল মান্নানের কাছে। তিনি তখন জার্মানি থেকে হার্ডলসে কোচিং নিয়ে এসেছেন। প্রথমবার প্রস্তুতির বেশি সময় না পেলেও পরেরবার এক বছর অনুশীলন করি।’ ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে শাহ আলম, রফিক, মোশাররফ হোসেন শামীম ও খালেক প্রথম হন। এবারও গড়েন নতুন রেকর্ড। সে সময় হার্ডলসে খ্যাতি ছিল জুলফু মিয়ার। তিনি ১১০ মিটারে হেরে যাবার পর আবদুল খালেককে ৪০০ মিটার হার্ডলসে চ্যালেঞ্জ জানান। তিনি তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কোচ আবদুল মান্নানের অধীনে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। আসলে যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে জয়ী হতে পারার মধ্যে তিনি আনন্দ খুঁজে পেতেন। ১৯৭৬ সালে যশোরে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৪০০ মিটার হার্ডলসে দ্বিতীয় ফজলুর রহমানকে অনেক পেছনে ফেলে প্রথম হন। সময় নেন ৫৭ দশমিক ৪ সেকেন্ড। তৃতীয় হন মোহাম্মদ আলী। এছাড়া ৪গুণন৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে শাহ আলম মাসলপুল করায় তাকে দৌড়াতে হয়। তবিবুর রহমান, মোঃ তাকি, এনামুল হক ও তাকে নিয়ে গঠিত রিলে দল প্রথম হয়। ১৯৭৬ সালে তাকে সেরা অ্যাথলেট নির্বাচিত করে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি। তিনিই প্রথম সিভিলিয়ান হিসেবে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ২টি স্বর্ণপদক জয় করেন। আবদুল খালেক ১৯৭৭ সালে ময়মনসিংহে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে শেষবারের মতো অংশ নেন। ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে নতুন রেকর্ড গড়ে প্রথম হন। সময় নেন ৪৩ দশমিক শূন্য ৭ সেকেন্ড। তার সঙ্গে ছিলেন রফিক, নজরুল ইসলাম রুমী ও মোশাররফ হোসেন শামীম।
অ্যাথলেট হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুল মাঠের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘অ্যাথলেটিকসে এই মাঠের একটা ঐতিহ্য আছে। আমার আগে এই মাঠ থেকে উঠে এসেছেন মঞ্জু ভাই, আরজান খান, কামরুল ইসলাম প্রমুখ। তাদের দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। আমার বাড়ি ছিল অজপাড়াগাঁয়ে। যাতায়াত ছিল নৌকায়। এ কারণে মুন্সীগঞ্জ মাঠে প্র্যাকটিস শেষে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারে চিত্ত ঘোষের কাছে যেতাম। তিনি আমাদের নাস্তা-পানি খাওয়াতেন। তার কথা আমার চিরজীবন মনে থাকবে। বাড়িতে যখন থাকতাম, তখন প্র্যাকটিস করতে সমস্যা হতো। আমাদের গ্রামে কোনো মাঠ ছিল না। এ কারণে আমার সুবিধার জন্য বাবা বাড়ির সামনে ফসলী জমিতে অল্প একটু জায়গা খালি রাখতেন। ফজরের আজান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ানোর জন্য আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। ১৯৬৬ সালের দিকে অ্যাথলেটিকসে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অ্যাথলেটদের অনুশীলন করাতেন কাজী আবদুল আলীম। তা দেখে দেখে শিখতাম। ১৯৬৮ সালে সবার সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি তাদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাই। তবে আমার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ফখরুদ্দিন আহমেদ, কাজী আলমগীর। বিশেষ করে আলমগীর ভাইয়ের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। তিনি আমাকে তার হলে থাকতে দিতেন, খাওয়া-দাওয়া করাতেন। সে সময় গ্রামের একটা ছেলের জন্য এটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার।’ স্কুলে থাকতেই আবদুল খালেক অনেক বিষয়ে ওয়াকিবহাল হওয়ার সুযোগ পান। তার ফিজিকও ছিল দেখার মতো। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জীবন গড়ার পেছনে আমাদের স্কুলের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর আদিনাথ দত্ত এবং ইংরেজির শিক্ষক সুধীর চক্রবর্তীর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সুধীর চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতা মোহনবাগানের গোলকিপার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংলিশে গোল্ড মেডেল পান। তাদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। শরীরটাকে গড়ে তোলার অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়েছে। রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া, আড্ডা না মারা, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে না যাওয়াসহ অনেক বিষয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হয়।’
আবদুল খালেক ১৯৬৭ সাল থেকে অ্যাথলেট প্রশিক্ষণের সঙ্গে কম-বেশি জড়িত। সে সময় তিনি মুন্সীগঞ্জে যাদের প্রশিক্ষণ দেন, তাদের অন্যতম হলো- শাহ আলম, ইকবাল, পিয়ারী বেগম, মাহফুজ, আইয়ুব আলী প্রমুখ। মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে বিকেলে সবার ঠাঁই হতো না। সবার মধ্যে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। প্রথমদিকে তার কাছে কোচিং নেন সে সময়কার বিটিএমসির অ্যাথলেট শামীম আরা টলি, রাজিয়া সুলতানা অনু, শামীমা সাত্তার মিমু। ১৯৮০-৮১ সালে ভারতের পাতিয়ালা থেকে অ্যাথলেটিকসে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। এরপর তিনি বিটিএমসির কোচ ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার হাতে গড়া অ্যাথলেটদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্প্রিন্টার সাইদুর রহমান ডন, মিজানুর রহমান, আবদুল গনি, মাসুদুল হক সাব্বির, তবিবুর রহমান, ফিরোজা খাতুন, নাজমা হায়দার রাফেজা, সুমিতা গোস্বামী, হার্ডলার মাহবুব আরা গিনি, ওয়াজিউর রহমান, ডিসকাস থ্রোয়ার জ্যোৎস্না আফরোজ প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিটিএমসির ডিরেক্টর ফিন্যান্স ছিলেন কে জেড ইসলাম। তিনি প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকা পড়ে আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠাতেন। কোন স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কোন ছেলে বা মেয়ে ভালো করেছে, তা আমার কাছে জানতে চাইতেন। ভালো অ্যাথলেটকে বিটিএমসিতে নিয়ে আসতে বলতেন। একদিন পত্রিকায় দেখলাম, বগুড়ায় স্কুল ক্রীড়ায় ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে তবিবুর রহমান নামে একটি ছেলে ভালো করেছে। এটা জানানোর পর তিনি দু’দিনের মধ্যে তাকে আনার জন্য নির্দেশ দিলেন। সে সঙ্গে দিলেন টাকার একটি প্যাকেট। আমি ঠিকানা জানি না, কোনো খোঁজ-খবর কিছুই জানি না। শুধু নামটাকে সম্বল করে সে মুহূর্তে বগুড়া ছুটে যাই। বগুড়া গিয়ে জানতে পারি, তবিবুরের বাড়ি সারিয়াকান্দির প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাতের বেলা তবিবুরের বাড়ি গিয়ে হাজির হই। তার বাবা-মাকে আমার আসার কারণ জানালে তার খুশি হয়ে ছেলেকে আমার সঙ্গে দিয়ে দেন। সে রাতেই রওনা দিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তবিবুরকে নিয়ে ঢাকায় আসি। দুপুর বেলা তাকে নিয়ে কে জেড ইসলামের কাছে হাজির করি। নির্ধারিত সময়ের আগেই নিয়ে আসতে পারায় খুব খুশি হন। আসলে এভাবেই আমরা খেলোয়াড় সন্ধান করে গড়ে তুলতাম।’
১৯৮৪ সালে তিনি ভারতের পাতিয়ালা থেকে আইএএএফ ডিপ্লোমা লাভ করেন। একই বছর কুয়েতে আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় তিনি বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। সে সফরে মুজিবুর রহমান মল্লিক লংজাম্প ও ত্রিপল জাম্পে রৌপ্য এবং সাইদুর রব শটপুটে ব্রোঞ্জ পদক পান। ১৯৮৯ সালে ইরানে এশিয়ান ইনডোর ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এবং পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সাফ গেমসে যোগ দেন।
আবদুল খালেক বাংলাদেশ দলের হয়ে কাবাডি খেলেছেন। অবশ্য পরিস্থিতির কারণে তাকে খেলতে হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কাবাডি আমি স্কুলে থাকতেই খেলতাম। তবে সিরিয়াসলি খেলিনি। ১৯৭৪ সালে ভারতের জাতীয় কাবাডি দল বাংলাদেশ আসে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে খেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। পরদিনই খেলা। বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। শ্রমিক নেতা মাহবুব আমার কাছে এসে বলেন, যে করেই হোক রাতের মধ্যে দল গড়তে হবে। আমি বললাম, এটা সম্ভব নয়। রাতের বেলা মাহবুব একজন আর্মি অফিসারকে নিয়ে আমার কাছে ফের আসেন। ভলিবল খেলোয়াড় মিনহাজ, নিখিল ও আমাকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, যেভাবে পার টিম গঠন কর। এজন্য আমাদের পর্যাপ্ত টাকা দেয়া হয়। কাবাডি খেলোয়াড় জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কুমিল্লা গিয়ে খেলোয়াড় নিয়ে আসতে বললাম। আমি যাই টাঙ্গাইল। তখন টাঙ্গাইল ছিল কাবাডি খেলোয়াড়দের ঘাঁটি। কয়েকজন খেলোয়াড় থাকেন প্রত্যন্ত গ্রামে। নদী পার হয়ে নৌকায় যেতে হয়। রাতেরবেলা নৌকা পাব কোথায়? সাঁতরে নদী পার হয়ে খেলোয়াড় আনি। পরদিন সকালে খেলা। পর্যাপ্ত খেলোয়াড় না থাকায় আমাকেও খেলতে হয়।’
কাবাডির পাশাপাশি ভলিবল লীগেও খেলেছেন আবদুল খালেক। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একদিন বিকেলে ভলিবলের খ্যাতিমান খেলোয়াড় নিখিল দা’কে বলে বিটিএমসি দলের হয়ে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলি। দলে বুস্টার ছিলেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু বুস্টার হিসেবে আমার খেলা দেখে দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় মিনহাজ খুশী হন। সে সুবাদে ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে বিটিএমসি দলের হয়ে ভলিবল খেলেছি। সে সময় অন্যতম সেরা দল বিটিএমসি। বিজয় দিবস ভলিবল প্রতিযোগিতায় পর পর দু’বছরই বিটিএমসি চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি স্পট জাম্পে ভালো ছিলাম। আসলে ছোটবেলায় সব ধরনের খেলার অভ্যাস থাকায় যে কোনো খেলাই কম-বেশি খেলতে পারতাম।’
১৯৬৮ সালে জাতীয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় মুন্সীগঞ্জের হয়ে অংশ নেন তিনি।
আবদুল খালেক ১৯৮৮ সালে বিটিএমসির চাকরি ছেড়ে ১৯৮৯ সালে বিকেএসপিতে চিফ কোচ হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে এলপিআরে আছেন। তার দেখা সেরা অ্যাথলেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নজরুল ইসলাম রুমী চেষ্টা করলে লংজাম্প বা ত্রিপল জাম্পে এশিয়ান পর্যায়ে মেডেল জিততে পারতেন। তার মাথা যেমন ছিল, তেমনি ছিল এক্সপ্লোসিভ পাওয়ার। এছাড়া হার্ডলার ওয়াজিউর রহমান, লংজাম্প ও ত্রিপল জাম্পে মজিবুর রহমান মল্লিক, স্প্রিন্টার মিলজার হোসেন, স্প্রিন্টার আফতাব মোল্লা, লংজাম্পে বনি আমিন, হার্ডলার মাহফুজ, স্প্রিন্টার বিমল চন্দ্র তরফদার, মেয়েদের মধ্যে শর্মিলা রায়, লাভলী বেগম বেশ ভালো অ্যাথলেট ছিলেন।’
বর্তমানে অ্যাথলেটিকসের মান অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে আবদুল খালেক মনে করেন। তিনি বলেন, ‘এখন সারা বছর ট্রেনিং, কোচ, মাঠ, টেকনিক্যাল সাপোর্ট- সবই আছে। শুধু নেই রেজাল্ট। যাদের খেলতে আসার কথা, তারা আসে না। আসবে কেন? টাকা-পয়সা নেই। চাকরি নেই। প্রটেকশন নেই। অ্যাথলেট হওয়াটা ন্যাচারাল জিনিস। শরীরে পুষ্টি লাগে। ছোটবেলা থেকে ভালো-মন্দ না খেলে ফিজিক হবে না। এজন্য সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের মাঠে নামাতে হবে। অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা এলেও তাদের পক্ষে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে যে অবস্থা, ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলায় আশাবাদী হওয়ার মতো অবস্থা নেই। এ থেকে উত্তরণের পথ হলো যথাযথ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন।’
আবদুল খালেকের এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে মোঃ রায়হান খালেক প্রিমিয়ার বিভাগ হকি লীগে সোনালী ব্যাংকের হয়ে খেলেছেন। বর্তমানে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। ৮ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে সবার বড় আবদুল খালেক। তার পথ অনুসরণ করে তার পরিবারের অনেকেই ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তার তৃতীয় ভাই আবু তালেব ছিলেন আশির দশকে ৪০০ মিটার হার্ডলার। পঞ্চম ভাই আবদুর রহিম নঈম নব্বই দশকে ৪০০ মিটার হার্ডলসে ছিলেন দেশসেরা। সাফ গেমসে পেয়েছেন রৌপ্য পদক। সপ্তম ভাই আবু বকর সিদ্দিক ২০০ ও ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে জুনিয়র গ্রুপে সাফল্য দেখান। আবু তালেবের ছেলে জাহিদ বিন তালেব শুভ মোহামেডানে ও জামিল বিন তালেব শিহাব আজাদ স্পোর্টিং কাবের হয়ে প্রিমিয়ার বিভাগ হকি লীগে খেলছেন। খেলাধুলায় পরিবারের এত বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও তিনি মনে করেন, পরবর্তীকালে তার বংশের আর কেউ খেলাধুলায় আসবে না। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘খেলাধুলা করে কি লাভ? খেলাধুলা করে কোনো সম্মান পাওয়া যায় না। এরচেয়ে লেখাপড়া করা অনেক ভালো।’ এমনটি মনে করলেও আবদুল খালেক প্রতিদিন ভোরে রামপুরা থেকে ছুটে আসেন ঢাকা স্টেডিয়ামে। আগামী প্রজন্মের অ্যাথলেটদের গড়ে তোলার জন্য তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলস সাধনা। স্বপ্ন দেখেন, তার হাতে গড়ে ওঠা অ্যাথলেটরা একদিন বয়ে আনবেন দেশের সুনাম, সুখ্যাতি। তার মুখে ক্ষোভ থাকলেও বুকে আছে অনন্ত স্বপ্ন। #
১-৬-২০০৮
আবদুল খালেকের জন্ম ঢাকার মুন্সীগঞ্জে ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারি। মুন্সীগঞ্জ ছিল খেলাধুলার লালনক্ষেত্র। সেই শৈশবে জড়িয়ে পড়েন নানাবিধ খেলাধুলায়। যখন যেটায় সুযোগ পেয়েছেন, তখন তার সদ্ব্যবহার করেছেন। কখনো দৌড়াদৌড়ি, কখনো হা-ডু-ডু, কখনো ভলিবল, কখনো সাঁতার কাটতেন। আবার কখনো মনের সুখে ঘুড়ি ওড়াতেন। তবে খেলাধুলায় পুরোপুরি নিবেদিত হওয়ার সেটাই প্রধান কারণ ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, ছোটবেলায় আমি লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগী ছিলাম না। এটা খেয়াল করেন আমার এক মামা আবদুস সোবহান। আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। খুবই মেধাবী ছিলেন। বড় হলেও তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মত। তিনি আমাকে একদিন বললেন, তোকে দিয়ে পড়ালেখা হবে না। খেলাধুলা করলে তুই ভালো করতে পারবি। আমি তখন কাস ফাইভে পড়ি। মামা আমাকে শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি বিদেশী ক্রীড়াবিষয়ক বই-পত্র এনে তা বাংলায় অনুবাদ করে দিতেন। আমি তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম। কোনো একটা জিনিস দেখলে তা সহজেই আমি বুঝে নিতে পারতাম। মাঝেমধ্যে মামা আমাকে নিয়ে যেতেন ঢাকার আমেরিকান তথ্যকেন্দ্রে। খেলার ছবিগুলো আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। এভাবেই একজন ক্রীড়াবিদ হওয়ার দীক্ষা পেতে থাকি। পুঁথিগত যে জ্ঞানটুকু আমি অর্জন করি, তা পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হয় স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। আমি মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলে ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হই। ব্যস, তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে ইন্টার স্কুল, ঢাকা জেলা স্কুল, ঢাকা বিভাগীয় স্কুল এবং জাতীয় স্কুল অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে আমি ছিলাম অপ্রতিদ্বন্দ্বী।’ তার এই কীর্তির কথা পৌঁছে যায় অ্যাথলেটিকসের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে। ১৯৬৭ সালে স্কুলের ছাত্র থাকাকালে তাকে নিয়ে নেয় টিঅ্যান্ডটি। সে বছরই তাদের হয়ে প্রথমবারের মতো তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নেন তিনি। সেদিনের স্মৃতির কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘অনেক উদ্দীপনা নিয়ে স্প্রিন্ট দিতে যাই ঢাকা স্টেডিয়ামে। কিন্তু হিটে খালি পায়ে দৌড়ানোর সময় আমার পা ফেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায় জাতীয় প্রতিযোগিতায় আমার পদক পাওয়ার স্বপ্ন। সে সময় বুয়েটের ছাত্র মামা আবদুস সোবহান ইসলামপুর নিয়ে গিয়ে ১৫ টাকা দিয়ে এক জোড়া রানিং স্যু কিনে দেন। তা পেয়ে আমি তো খুশিতে টগমগ। নতুন উদ্যমে অনুশীলন চালিয়ে যাই। পরের বছর আর আমাকে পায় কে? আমি তখন ময়ূরপঙ্খী ঘোড়া হয়ে আকাশে উড়ছি। সে সময় দ্রুততম মানব ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। অসাধারণ অ্যাথলেট। স্প্রিন্টার হিসেবে তিনি ছিলেন সবার আদর্শ। তাকে হারিয়ে আমি প্রথম হই। সিরাজুল দ্বিতীয় ও মাহবুব তৃতীয় হন। আমি গ্রামের ছেলে। জাতীয় অ্যাথলেটিকস উপলক্ষে ঢাকায় ৩/৪ দিন থাকার পর হাঁপিয়ে ওঠি। যে কারণে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সুবিধা করতে পারিনি। তৃতীয় হই। মাহবুব প্রথম ও শাহজাহান দ্বিতীয় হন। তবে ৪গুণন১০০ মিটার রিলে দৌড়ে প্রথম হই। রিলেতে আমার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব, মিরাজ ও আজিজ। সে বছর ঢাকায় পাকিস্তান গেমসে অংশ নিতে পারিনি। না পারার কারণ- মেক্সিকো অলিম্পিক গেমসের ট্রায়ালের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মিরাজ ও আমাকে মনোনীত করা হয়। ট্রায়াল ক্যাম্প হয় পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে। আমাদেরকে দেয়া হয় আর্মি কমান্ডো ট্রেনিং- যা সিভিলিয়ান অ্যাথলেটদের জন্য খুবই দুরূহ। তবে হকি দলের সমস্যার কারণে পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস দলের মেক্সিকো যাওয়া হয়নি।’
১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে দ্রুততম মানব হন আবদুল খালেক। এছাড়া ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ জয় করেন। রিলে দলে তার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব, সিরাজ ও আজিজ। ১৯৭০ সালে তিনি টানা তৃতীয়বারের মতো ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে প্রথম হন। রিলে দলেও তার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব, সিরাজ ও আজিজ। এছাড়াও তিনি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের করাচিতে এবং ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাকিস্তান অ্যাথলেটিকসে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে অংশ নেন। পাকিস্তান অ্যাথলেটিকসে সুবিধা করতে না পারা প্রসঙ্গে আবদুল খালেক বলেন, ‘পাকিস্তান অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতেন এশিয়ান গেমসে পদকজয়ী অ্যাথলেটরা। সে সময় ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে জন পারমল, ইকবাল সিনওয়ারী, ২০০ মিটার স্প্রিন্টে গোলাম কাদের ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের সঙ্গে পারার প্রশ্নই আসে না। পাকিস্তানের ইতিহাসে পুরুষদের মধ্যে মাত্র তিনজন বাঙালি অ্যাথলেট এসএ জামান মুক্তা, মিরাজ ও সিরাজ পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে পদক পেয়েছেন। তবে একমাত্র স্বর্ণপদকটি পান মিরাজ।’
আবদুল খালেক ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। তিনি ছিলেন চার্লি কোম্পানিতে। এই ট্রেনিংটা অবশ্য বৃথা যায়নি। ১৯৭১ সালে তিনি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার পর আবার তিনি ফিরে আসেন খেলার মাঠে। যোগ দেন বিআইডিসিতে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে বছর সাঁতার দল গঠন করার উদ্যোগ নেয় বিআইডিসি। তাদের স্পোর্টস দেখতেন মাহবুব নামে একজন। দল গঠনের ব্যাপারে তিনি কাজী আবদুল আলীমের শরণাপন্ন হন। তিনি তখন মাহবুবকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আমি তখন মোশাররফ হোসেন খান, শাহজাহান মিজি, বোরহান উদ্দিন, কালিপদ দাস, সুমন্ত কুমার ভাওয়াল, অ্যাথলেট শাহ আলমকে নিয়ে সাঁতার দল গঠন করি। শাহ আলমও সাঁতারু ছিলেন। আমাদের দল রানার্সআপ হয়। সাঁতারু হিসেবে আমার ভূমিকায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা, প্রথম জীবনে আমি মূলত সাঁতারু ছিলাম। স্কুল ও ইন্টার স্কুল সাঁতারে আমি অনেক পদক পেয়েছি। আমাদের মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের পুকুরের খ্যাতি ও ঐতিহ্য ছিল সাঁতারু গড়ে তোলায়। এই পুকুরে সাঁতার কেটে বিখ্যাত হন ভারতের বিখ্যাত সাঁতারু জ্ঞানরঞ্জন দাস ও তার ভাইয়েরা। তাদের একজন আশীষ দাস এশিয়ান মেডেল উইনার। ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে তিনি এ কৃতিত্ব দেখান। এছাড়াও মহিউদ্দিন, অখিল, আবদুল হাই, শাহাবুদ্দিন এ পুকুরে অনুশীলন করতেন। তারা ছিলেন আমাদের সিনিয়র। এরপরই সাঁতারু হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন আমার সমসাময়িক মোশাররফ হোসেন খান, শাহজাহান মিজি, বোরহান উদ্দিন, ধনরঞ্জন দাস, রবীন্দ্র চন্দ্র আইচ, সেলিম মিঞা প্রমুখ। অ্যাথলেটিকসের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণের কারণে সাঁতারে মনোযোগ দেয়া হয়নি।’
সাঁতারের পর ইপিআইডিসি অ্যাথলেটিকস টিম গঠনের সময় ফের কাজী আবদুল আলীমের শরণাপন্ন হলে তিনি আবদুল খালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সেই দল গড়ার ক্ষেত্রেও যোগ্যতার ভিত্তিতে মুন্সীগঞ্জের অ্যাথলেটদের প্রাধান্য ছিল। তাদের অন্যতম হলেন শাহ আলম, শাহজাহান মিজি, আইয়ুব আলী, খোরশেদ আলম। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় বিটিএমসির হয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে তিনি তৃতীয় হন। প্রথম ও দ্বিতীয় হন যথাক্রমে সুবেদার খাদেম হোসেন ও শাহ আলম। ৪গুণন১০০ মিটার রিলে দৌড়ে প্রথম হন। তার সঙ্গে ছিলেন শাহ আলম, হাবিব ও রফিক। ১৯৭৪ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে প্রথম হন। ৫৫ দশমিক ২ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। রিলে দলে ছিলেন শাহ আলম, ইকবাল, রফিক ও খালেক। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে তিনি তৃতীয় হন। ১১ সেকেন্ড সময় নিয়ে সুবেদার খাদেম হোসেন প্রথম ও শাহ আলম দ্বিতীয় হন। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রামে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ১১০ মিটার হার্ডলসে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। সময় নেন ১৭ সেকেন্ড। হাবিলদার এমএ সালাম দ্বিতীয় ও মোঃ খোরশেদ তৃতীয় হন। হার্ডলসে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম দলের কোচ ও সংগঠক। কোন ইভেন্টে কাকে নিলে বেশি পদক পাওয়া যাবে, সেটা দেখার দায়িত্ব ছিল আমার। আমি দেখলাম, আমার ইভেন্ট স্প্রিন্ট হলেও ততদিনে আমাকে প্রতিস্থাপন করার মতো যোগ্য অ্যাথলেট আমাদের দলে এসে গেছে। বরং হার্ডলসে একটা শূন্যতা আছে। এই শূন্যতা পূরণ করার জন্য আমি নেমে পড়ি। অবশ্য তার আগে দীক্ষা নেই হার্ডলার আবদুল মান্নানের কাছে। তিনি তখন জার্মানি থেকে হার্ডলসে কোচিং নিয়ে এসেছেন। প্রথমবার প্রস্তুতির বেশি সময় না পেলেও পরেরবার এক বছর অনুশীলন করি।’ ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে শাহ আলম, রফিক, মোশাররফ হোসেন শামীম ও খালেক প্রথম হন। এবারও গড়েন নতুন রেকর্ড। সে সময় হার্ডলসে খ্যাতি ছিল জুলফু মিয়ার। তিনি ১১০ মিটারে হেরে যাবার পর আবদুল খালেককে ৪০০ মিটার হার্ডলসে চ্যালেঞ্জ জানান। তিনি তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কোচ আবদুল মান্নানের অধীনে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। আসলে যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে জয়ী হতে পারার মধ্যে তিনি আনন্দ খুঁজে পেতেন। ১৯৭৬ সালে যশোরে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৪০০ মিটার হার্ডলসে দ্বিতীয় ফজলুর রহমানকে অনেক পেছনে ফেলে প্রথম হন। সময় নেন ৫৭ দশমিক ৪ সেকেন্ড। তৃতীয় হন মোহাম্মদ আলী। এছাড়া ৪গুণন৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে শাহ আলম মাসলপুল করায় তাকে দৌড়াতে হয়। তবিবুর রহমান, মোঃ তাকি, এনামুল হক ও তাকে নিয়ে গঠিত রিলে দল প্রথম হয়। ১৯৭৬ সালে তাকে সেরা অ্যাথলেট নির্বাচিত করে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি। তিনিই প্রথম সিভিলিয়ান হিসেবে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ২টি স্বর্ণপদক জয় করেন। আবদুল খালেক ১৯৭৭ সালে ময়মনসিংহে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে শেষবারের মতো অংশ নেন। ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে নতুন রেকর্ড গড়ে প্রথম হন। সময় নেন ৪৩ দশমিক শূন্য ৭ সেকেন্ড। তার সঙ্গে ছিলেন রফিক, নজরুল ইসলাম রুমী ও মোশাররফ হোসেন শামীম।
অ্যাথলেট হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুল মাঠের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘অ্যাথলেটিকসে এই মাঠের একটা ঐতিহ্য আছে। আমার আগে এই মাঠ থেকে উঠে এসেছেন মঞ্জু ভাই, আরজান খান, কামরুল ইসলাম প্রমুখ। তাদের দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। আমার বাড়ি ছিল অজপাড়াগাঁয়ে। যাতায়াত ছিল নৌকায়। এ কারণে মুন্সীগঞ্জ মাঠে প্র্যাকটিস শেষে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারে চিত্ত ঘোষের কাছে যেতাম। তিনি আমাদের নাস্তা-পানি খাওয়াতেন। তার কথা আমার চিরজীবন মনে থাকবে। বাড়িতে যখন থাকতাম, তখন প্র্যাকটিস করতে সমস্যা হতো। আমাদের গ্রামে কোনো মাঠ ছিল না। এ কারণে আমার সুবিধার জন্য বাবা বাড়ির সামনে ফসলী জমিতে অল্প একটু জায়গা খালি রাখতেন। ফজরের আজান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ানোর জন্য আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। ১৯৬৬ সালের দিকে অ্যাথলেটিকসে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অ্যাথলেটদের অনুশীলন করাতেন কাজী আবদুল আলীম। তা দেখে দেখে শিখতাম। ১৯৬৮ সালে সবার সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি তাদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাই। তবে আমার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ফখরুদ্দিন আহমেদ, কাজী আলমগীর। বিশেষ করে আলমগীর ভাইয়ের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। তিনি আমাকে তার হলে থাকতে দিতেন, খাওয়া-দাওয়া করাতেন। সে সময় গ্রামের একটা ছেলের জন্য এটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার।’ স্কুলে থাকতেই আবদুল খালেক অনেক বিষয়ে ওয়াকিবহাল হওয়ার সুযোগ পান। তার ফিজিকও ছিল দেখার মতো। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জীবন গড়ার পেছনে আমাদের স্কুলের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর আদিনাথ দত্ত এবং ইংরেজির শিক্ষক সুধীর চক্রবর্তীর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সুধীর চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতা মোহনবাগানের গোলকিপার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংলিশে গোল্ড মেডেল পান। তাদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। শরীরটাকে গড়ে তোলার অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়েছে। রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া, আড্ডা না মারা, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে না যাওয়াসহ অনেক বিষয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হয়।’
আবদুল খালেক ১৯৬৭ সাল থেকে অ্যাথলেট প্রশিক্ষণের সঙ্গে কম-বেশি জড়িত। সে সময় তিনি মুন্সীগঞ্জে যাদের প্রশিক্ষণ দেন, তাদের অন্যতম হলো- শাহ আলম, ইকবাল, পিয়ারী বেগম, মাহফুজ, আইয়ুব আলী প্রমুখ। মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে বিকেলে সবার ঠাঁই হতো না। সবার মধ্যে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। প্রথমদিকে তার কাছে কোচিং নেন সে সময়কার বিটিএমসির অ্যাথলেট শামীম আরা টলি, রাজিয়া সুলতানা অনু, শামীমা সাত্তার মিমু। ১৯৮০-৮১ সালে ভারতের পাতিয়ালা থেকে অ্যাথলেটিকসে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। এরপর তিনি বিটিএমসির কোচ ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার হাতে গড়া অ্যাথলেটদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্প্রিন্টার সাইদুর রহমান ডন, মিজানুর রহমান, আবদুল গনি, মাসুদুল হক সাব্বির, তবিবুর রহমান, ফিরোজা খাতুন, নাজমা হায়দার রাফেজা, সুমিতা গোস্বামী, হার্ডলার মাহবুব আরা গিনি, ওয়াজিউর রহমান, ডিসকাস থ্রোয়ার জ্যোৎস্না আফরোজ প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিটিএমসির ডিরেক্টর ফিন্যান্স ছিলেন কে জেড ইসলাম। তিনি প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকা পড়ে আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠাতেন। কোন স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কোন ছেলে বা মেয়ে ভালো করেছে, তা আমার কাছে জানতে চাইতেন। ভালো অ্যাথলেটকে বিটিএমসিতে নিয়ে আসতে বলতেন। একদিন পত্রিকায় দেখলাম, বগুড়ায় স্কুল ক্রীড়ায় ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে তবিবুর রহমান নামে একটি ছেলে ভালো করেছে। এটা জানানোর পর তিনি দু’দিনের মধ্যে তাকে আনার জন্য নির্দেশ দিলেন। সে সঙ্গে দিলেন টাকার একটি প্যাকেট। আমি ঠিকানা জানি না, কোনো খোঁজ-খবর কিছুই জানি না। শুধু নামটাকে সম্বল করে সে মুহূর্তে বগুড়া ছুটে যাই। বগুড়া গিয়ে জানতে পারি, তবিবুরের বাড়ি সারিয়াকান্দির প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাতের বেলা তবিবুরের বাড়ি গিয়ে হাজির হই। তার বাবা-মাকে আমার আসার কারণ জানালে তার খুশি হয়ে ছেলেকে আমার সঙ্গে দিয়ে দেন। সে রাতেই রওনা দিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তবিবুরকে নিয়ে ঢাকায় আসি। দুপুর বেলা তাকে নিয়ে কে জেড ইসলামের কাছে হাজির করি। নির্ধারিত সময়ের আগেই নিয়ে আসতে পারায় খুব খুশি হন। আসলে এভাবেই আমরা খেলোয়াড় সন্ধান করে গড়ে তুলতাম।’
১৯৮৪ সালে তিনি ভারতের পাতিয়ালা থেকে আইএএএফ ডিপ্লোমা লাভ করেন। একই বছর কুয়েতে আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় তিনি বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। সে সফরে মুজিবুর রহমান মল্লিক লংজাম্প ও ত্রিপল জাম্পে রৌপ্য এবং সাইদুর রব শটপুটে ব্রোঞ্জ পদক পান। ১৯৮৯ সালে ইরানে এশিয়ান ইনডোর ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এবং পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সাফ গেমসে যোগ দেন।
আবদুল খালেক বাংলাদেশ দলের হয়ে কাবাডি খেলেছেন। অবশ্য পরিস্থিতির কারণে তাকে খেলতে হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কাবাডি আমি স্কুলে থাকতেই খেলতাম। তবে সিরিয়াসলি খেলিনি। ১৯৭৪ সালে ভারতের জাতীয় কাবাডি দল বাংলাদেশ আসে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে খেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। পরদিনই খেলা। বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। শ্রমিক নেতা মাহবুব আমার কাছে এসে বলেন, যে করেই হোক রাতের মধ্যে দল গড়তে হবে। আমি বললাম, এটা সম্ভব নয়। রাতের বেলা মাহবুব একজন আর্মি অফিসারকে নিয়ে আমার কাছে ফের আসেন। ভলিবল খেলোয়াড় মিনহাজ, নিখিল ও আমাকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, যেভাবে পার টিম গঠন কর। এজন্য আমাদের পর্যাপ্ত টাকা দেয়া হয়। কাবাডি খেলোয়াড় জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কুমিল্লা গিয়ে খেলোয়াড় নিয়ে আসতে বললাম। আমি যাই টাঙ্গাইল। তখন টাঙ্গাইল ছিল কাবাডি খেলোয়াড়দের ঘাঁটি। কয়েকজন খেলোয়াড় থাকেন প্রত্যন্ত গ্রামে। নদী পার হয়ে নৌকায় যেতে হয়। রাতেরবেলা নৌকা পাব কোথায়? সাঁতরে নদী পার হয়ে খেলোয়াড় আনি। পরদিন সকালে খেলা। পর্যাপ্ত খেলোয়াড় না থাকায় আমাকেও খেলতে হয়।’
কাবাডির পাশাপাশি ভলিবল লীগেও খেলেছেন আবদুল খালেক। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একদিন বিকেলে ভলিবলের খ্যাতিমান খেলোয়াড় নিখিল দা’কে বলে বিটিএমসি দলের হয়ে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলি। দলে বুস্টার ছিলেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু বুস্টার হিসেবে আমার খেলা দেখে দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় মিনহাজ খুশী হন। সে সুবাদে ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে বিটিএমসি দলের হয়ে ভলিবল খেলেছি। সে সময় অন্যতম সেরা দল বিটিএমসি। বিজয় দিবস ভলিবল প্রতিযোগিতায় পর পর দু’বছরই বিটিএমসি চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি স্পট জাম্পে ভালো ছিলাম। আসলে ছোটবেলায় সব ধরনের খেলার অভ্যাস থাকায় যে কোনো খেলাই কম-বেশি খেলতে পারতাম।’
১৯৬৮ সালে জাতীয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় মুন্সীগঞ্জের হয়ে অংশ নেন তিনি।
আবদুল খালেক ১৯৮৮ সালে বিটিএমসির চাকরি ছেড়ে ১৯৮৯ সালে বিকেএসপিতে চিফ কোচ হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে এলপিআরে আছেন। তার দেখা সেরা অ্যাথলেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নজরুল ইসলাম রুমী চেষ্টা করলে লংজাম্প বা ত্রিপল জাম্পে এশিয়ান পর্যায়ে মেডেল জিততে পারতেন। তার মাথা যেমন ছিল, তেমনি ছিল এক্সপ্লোসিভ পাওয়ার। এছাড়া হার্ডলার ওয়াজিউর রহমান, লংজাম্প ও ত্রিপল জাম্পে মজিবুর রহমান মল্লিক, স্প্রিন্টার মিলজার হোসেন, স্প্রিন্টার আফতাব মোল্লা, লংজাম্পে বনি আমিন, হার্ডলার মাহফুজ, স্প্রিন্টার বিমল চন্দ্র তরফদার, মেয়েদের মধ্যে শর্মিলা রায়, লাভলী বেগম বেশ ভালো অ্যাথলেট ছিলেন।’
বর্তমানে অ্যাথলেটিকসের মান অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে আবদুল খালেক মনে করেন। তিনি বলেন, ‘এখন সারা বছর ট্রেনিং, কোচ, মাঠ, টেকনিক্যাল সাপোর্ট- সবই আছে। শুধু নেই রেজাল্ট। যাদের খেলতে আসার কথা, তারা আসে না। আসবে কেন? টাকা-পয়সা নেই। চাকরি নেই। প্রটেকশন নেই। অ্যাথলেট হওয়াটা ন্যাচারাল জিনিস। শরীরে পুষ্টি লাগে। ছোটবেলা থেকে ভালো-মন্দ না খেলে ফিজিক হবে না। এজন্য সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের মাঠে নামাতে হবে। অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা এলেও তাদের পক্ষে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে যে অবস্থা, ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলায় আশাবাদী হওয়ার মতো অবস্থা নেই। এ থেকে উত্তরণের পথ হলো যথাযথ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন।’
আবদুল খালেকের এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে মোঃ রায়হান খালেক প্রিমিয়ার বিভাগ হকি লীগে সোনালী ব্যাংকের হয়ে খেলেছেন। বর্তমানে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। ৮ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে সবার বড় আবদুল খালেক। তার পথ অনুসরণ করে তার পরিবারের অনেকেই ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তার তৃতীয় ভাই আবু তালেব ছিলেন আশির দশকে ৪০০ মিটার হার্ডলার। পঞ্চম ভাই আবদুর রহিম নঈম নব্বই দশকে ৪০০ মিটার হার্ডলসে ছিলেন দেশসেরা। সাফ গেমসে পেয়েছেন রৌপ্য পদক। সপ্তম ভাই আবু বকর সিদ্দিক ২০০ ও ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে জুনিয়র গ্রুপে সাফল্য দেখান। আবু তালেবের ছেলে জাহিদ বিন তালেব শুভ মোহামেডানে ও জামিল বিন তালেব শিহাব আজাদ স্পোর্টিং কাবের হয়ে প্রিমিয়ার বিভাগ হকি লীগে খেলছেন। খেলাধুলায় পরিবারের এত বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও তিনি মনে করেন, পরবর্তীকালে তার বংশের আর কেউ খেলাধুলায় আসবে না। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘খেলাধুলা করে কি লাভ? খেলাধুলা করে কোনো সম্মান পাওয়া যায় না। এরচেয়ে লেখাপড়া করা অনেক ভালো।’ এমনটি মনে করলেও আবদুল খালেক প্রতিদিন ভোরে রামপুরা থেকে ছুটে আসেন ঢাকা স্টেডিয়ামে। আগামী প্রজন্মের অ্যাথলেটদের গড়ে তোলার জন্য তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলস সাধনা। স্বপ্ন দেখেন, তার হাতে গড়ে ওঠা অ্যাথলেটরা একদিন বয়ে আনবেন দেশের সুনাম, সুখ্যাতি। তার মুখে ক্ষোভ থাকলেও বুকে আছে অনন্ত স্বপ্ন। #
১-৬-২০০৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন