হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

আরমানিটোলা স্কুল ও স্কুলের মাঠকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের হকির যে জাগরণ ঘটে, প্রাথমিকভাবে তা বিকশিত হয় আশপাশের এলাকায়। এরপর ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি থেকে পরিবারেও। অনেক পরিবারে ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয় হকি খেলা। এমন একটি পরিবার হলো ‘আদেল পরিবার’। আরমানিটোলা স্কুল থেকে উত্তর দিকে দৃষ্টি দিলে ‘শরফুদ্দীন হাউজ’ নামক যে বনেদী বাড়িটি দৃষ্টিগোচর হয়, সেটাই আদেল পরিবারের আদি বাড়ি। এটি এদেশের হকির অন্যতম সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ বাড়ি থেকে জাতীয় পর্যায়ের বেশ ক’জন খেলোয়াড় উঠে আসার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে হকির প্রসার ও মানোন্নয়নে। এ বাড়িরই কৃতী সন্তান আলমগীর মোহাম্মদ আদেল। এদেশের হকির একটি পরিচিত নাম। খেলোয়াড় হিসেবে যেমন, সংগঠক হিসেবেও তার যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে।
আলমগীর মোহাম্মদ আদেলের জন্ম ঢাকার আরমানিটোলায়, ১৯৩৩ সালের ৩০ নভেম্বর। খেলাধুলায় সংশ্লিষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আরমানিটোলা স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হওয়ার পর খেলাধুলা হয়ে ওঠে আমার জীবনের অন্যতম সোপান। ক্রীড়াক্ষেত্রে এই স্কুলের ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতেন দেশসেরা ক্রীড়াবিদরা। তাদের অন্যতম হলেন ওয়াজির আলী, নূরুল ইসলাম নান্না, ফখরুল ইসলাম, বাহরাম, ইসমাইল, জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। তাদের দেখে এবং কখনো-সখনো তাদের সঙ্গে খেলে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম। আমাদের সমসাময়িক ছিলেন মাহতাব (পরবর্তীকালে সেনা কর্মকর্তা ও প্রাণ গ্রুপের কর্ণধার), আরেফিন, নূরুল হক (পরবর্তীকালে নৌবাহিনী প্রধান) প্রমুখ। খেলাধুলাটাই হয়ে ওঠে আমার নেশা। সব ধরনের খেলাই খেলতাম। তবে হকি ও ফুটবল ছিল প্রধান আকর্ষণ। আমাদের স্কুলে ছিল চারটি হাউজ। আমি ছিলাম কলিন্স হাউজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিটি হাউজের ছিল তিনটি টিম। ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রুপ। আমি ‘সি’ গ্রুপ থেকে ধাপে ধাপে পরবর্তী গ্রুপে উন্নীত হই। তাছাড়া খেলাধুলার জন্য আমাদের আলাদা পিরিয়ড ছিল। তখন আমরা একই কাসের ছাত্ররা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে খেলতাম। আমরা যখন হকি খেলতাম, তখন ঢাকা শহরে হকি স্টিক খুব একটা ছিল না। আর ব্যক্তিগত স্টিক থাকা তো ছিল বিরাট ব্যাপার। আমরা স্কুলে লাইনে দাঁড়িয়ে স্টিক নিতাম। আবার খেলা শেষে ফেরত দিতাম। এভাবেই আমরা হকি খেলাটা রপ্ত করি।’ ১৯৪৯ সালে তিনি ছিলেন আরমানিটোলা স্কুলের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে স্কুল হকি, ফুটবল ও অ্যাথলেটিকসে অংশ নেয়।
খুব অল্প বয়সেই তিনি ঢাকা প্রথম বিভাগ হকি লীগে খেলার সুযোগ পান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ক্রীড়াঙ্গনে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। দেশভাগের আগে ক্রীড়াঙ্গনে ছিল হিন্দু ধর্মালম্বীদের দাপট। তাদের বড় একটি অংশ দেশত্যাগ করায় খেলোয়াড় সংকট দেখা দেয়। সে সময় দুই অভিজাত ও পুরনো কাব ছিল ওয়ারী ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব। এই দুই কাবের ছিল নিজস্ব মাঠ। আমরা তিন বন্ধু হিমু, আহসান ও আমি একদিন ভিক্টোরিয়া ক্লাব মাঠে স্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। খেলোয়াড় স্বল্পতার কারণে ভিক্টোরিয়া মাঠে ৪/৫ জন হকি খেলছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী (পরবর্তীকালে বিচারপতি)। তারা আমাদের দেখে কাছে ডাকেন। আমাদের জিজ্ঞেস করেন, আমরা হকি খেলতে পারি কিনা? যদি পারি, তাহলে পরদিন প্রস্তুতি নিয়ে খেলতে যেতে বলেন। মাহুতটুলি স্পোর্টিং ক্লাব ছিল আমাদের পাড়ার ক্লাব। সে সময় মাহুতটুলি ছিল শক্তিশালী দল। আমার ইচ্ছে ছিল এই ক্লাবের হয়ে খেলা। কিন্তু সুযোগ পাওয়া ছিল খুবই কঠিন। তাই ভিক্টোরিয়া ক্লাব আমন্ত্রণ জানালে তা লুফে নিতে একটুও দ্বিধা করিনি। ভিক্টোরিয়াও ভালো দল। পরিস্থিতির কারণে তারা সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ফাঁকা মাঠ পেয়ে আমরা ভিক্টোরিয়ার মতো দলে খেলার সুযোগ পেয়ে যাই। সেটা ১৯৪৯ সাল। আমি খেলতাম সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে।’
ভিক্টোরিয়ার হয়ে আলমগীরের ক্রীড়াশৈলী দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। যে কারণে মাহুতটুলির মতো দল তাকে দলভুক্ত করতে এবার আর দ্বিতীয় চিন্তা করেনি। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি মাহুতটুলির হয়ে খেলেন। এর মধ্যে ১৯৫২ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় মাহুতটুলি। ১৯৫৪ সালে নূরুল ইসলাম নান্নাসহ বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে চলে যাওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ে মাহুতটুলি। এ কারণে তিনিও দলত্যাগ করে যোগ দেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একটানা একই ক্লাবে খেলেন। ভিক্টোরিয়া তখন বেশ শক্তিশালী দল। এ ক্লাবে খেলতেন আবদুস সালাম, মাহমুদুর রহমান মোমিন, বশীর আহমেদ প্রমুখ। ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে ওয়ারীতে খেলে তিনি অবসর নেন।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের হয়ে খেলেছেন তিনি। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পান। সে দলে বাঙালি ছিলেন দু’জন। তিনি ছাড়া অন্যজন হলেন মাসুদুর রহমান। লাহোরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি সেন্টার ফরোয়ার্ড এবং মাসুদুর রহমান গোলকিপার পজিশনে খেলেন। প্রথম ম্যাচে তাদের দল কাস্টমসের কাছে হেরে যায় ০-৯ গোলে। ১৯৬১ সালে লাহোরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপেও পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলেন তিনি। সেবার দলে প্রাধান্য ছিল বাঙালিদের। খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মাহমুদুর রহমান মোমিন, বশীর আহমেদ, মির্জা ফরিদ মিলু, সোনা মিঞা প্রমুখ।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় হকি খেলার পাশাপাশি অ্যাথলেটিকসে আলমগীর কৃতিত্ব দেখান। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫১ সালে আমি ছিলাম অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। আমার ইভেন্ট ছিল লংজাম্প, হপস্টেপ জাম্প ও ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। তিনটিতেই প্রথম হই। সে বছর ঢাকা কলেজ প্রথম বিভাগ হকি লীগে এন্ট্রি করে। সে দল গড়ার ক্ষেত্রে আমি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করি। আমি ছিলাম কলেজের অ্যাথলেটিক সেক্রেটারি। কলেজের হয়ে ফুটবলেও অংশ নিয়েছি।’
হকির পাশাপাশি ফুটবলেও পারদর্শী ছিলেন আলমগীর। আরমানিটোলা স্কুলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। আর প্রথম বিভাগ লীগে খেলেছেন মাহুতটুলির হয়ে। খুব বেশি দিন অবশ্য খেলেননি। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালে খেলেই ক্ষান্ত দেন। হকিটা ততদিনে মনের মধ্যে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেন হকিতে। যেজন্য সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ফুটবলে আর মনোনিবেশ করেননি।
খেলোয়াড়ী জীবনের স্মরণীয় ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘১৯৫০ সালে ইপিআরের সঙ্গে আমাদের মাহুতটুলির খেলা। তখন ঢাকা স্টেডিয়াম ছিল টিন দিয়ে ঘেরা। শিরোপা নির্ধারণী লীগের শেষ ম্যাচ। খেলায় ১-০ গোলে আমরা এগিয়ে ছিলাম। খেলার এক পর্যায়ে ইপিআরের সদস্যরা বেল্ট খুলে আমাদের পেটাতে শুরু করে। আমাদের ফখরুল আহত হন। আমরা পালিয়ে রক্ষা পাই। খেলা অসম্পন্ন থাকলে আমরা চ্যাম্পিয়ন হই।’
খেলা ছাড়ার পর সংগঠক হিসেবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন আলমগীর মোহাম্মদ আদেল। সংগঠক হওয়াটা এক ধরনের‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র মতো। সে পথ বেছে নিতে তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। পারিবারিকভাবে সচ্ছল ঘরের সন্তান তিনি। অর্থনৈতিক কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল না। যে কারণে খেলার মাঠে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছেন। সংগঠক ও আম্পায়ার হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তান হকি দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কেনিয়া, উগান্ডা ও ইন্দোনেশিয়া সফরে পাকিস্তান হকি টিমের অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার ছিলেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান হকি টিমের অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার হিসেবে ইংল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানী, হল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালী যান। ১৯৬৮ সালে কেনিয়া যান পাকিস্তান হকি দলের অ্যাসোসিয়েটেড ম্যানেজার হিসেবে। ১৯৬৯ সালে লাহোরে জুনিয়র হকি প্রতিযোগিতায় পাকিস্তান হকি দলের ম্যানেজার ছিলেন। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ হকি দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক হকি আম্পায়ার। ১৯৬৯ সালে তিনি যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানী, হল্যান্ড, স্পেন ও কায়রোয় পাকিস্তান দলের সঙ্গে আম্পায়ার হিসেবে যান। ১৯৭৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে জুনিয়র বিশ্বকাপ হকি প্রতিযোগিতায় আম্পায়ার ছিলেন। ১৯৭৮ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে এশিয়ান গেমসে তিনি ছিলেন আম্পায়ার। ১৯৮২ সালে পাকিস্তান এবং ভারতে নিরপেক্ষ আম্পায়ার হিসেবে জুনিয়র দলের টেস্ট ম্যাচ পরিচালনা করেন। ১৯৮২ সালে ভারতের দিল্লীতে এশিয়ান গেমসে হকি জাজ ছিলেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আয়োজিত এশিয়ান কাপ হকির জুরি অব অ্যাপিল ছিলেন। ১৯৮৭ সালে করাচিতে জুনিয়র এশিয়া কাপ হকিতে তিনি ছিলেন টেকনিক্যাল ডেলিগেট। ১৯৮৯ সালে টেকনিক্যাল ডেলিগেট ছিলেন মালয়েশিয়ায় জুনিয়র হকি ওয়ার্ল্ড কাপে। ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিং এশিয়ান গেমসেও তিনি ছিলেন টেকনিক্যাল ডেলিগেট।
১৯৫৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন মাহুতটুলি স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের হকি সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের সিলেকশন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। পাঁচ সদস্যের এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মালিক শাহ নেওয়াজ আর সেক্রেটারি ছিলেন কেএস আসলাম। অপর সদস্যদ্বয় হলেন মোঃ নিয়াজ খান ও মাহমুদুল হাসান। এই কমিটির উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ১৯৬৭ সালে লন্ডনে আয়োজিত হকি ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণকারী এবং ১৯৬৮ সালে মেক্সিকো অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী পাকিস্তান দলের খেলোয়াড় নির্বাচন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সিলেকশন কমিটিতে থাকায় পাকিস্তান দলে আমি আবদুস সাদেককে খেলাতে পেরেছি। পাকিস্তান দলের ম্যানেজার ব্রিগেডিয়ার আতিফকে বলে সাদেককে খেলানো সম্ভব হয়। এছাড়া ইব্রাহীম সাবেরকে পাকিস্তান দলে দলভুক্ত করাই।’
১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আলমগীর মোহাম্মদ আদেল ছিলেন পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক। কিছুদিন তিনি কাবের ফুটবল সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ হকি আম্পায়ার্স বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হকি সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান এবং ঢাকা মহানগরী ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে তিনি ছিলেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন।
আন্তর্জাতিক হকি অঙ্গনেও আলমগীর মোহাম্মদ আদেল ছিলেন পরিচিত মুখ। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এশিয়ান হকি ফেডারেশনের নির্বাচিত সদস্য। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘১৯৮৫ সালে তদানীন্তন হকি ফেডারেশনের সভাপতি মেজর জেনারেল এম এ মতিনকে এশিয়ান হকি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি নির্বাচনে জয়ী করা পেছনে আমি ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম। ভারতের মতো শক্তিশালী দেশকে হারিয়ে তাকে জয়ী করানো হয়।’ ১৯৮৭-৮৮ সালে তিনি ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল হকির আম্পায়ার কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তাকে সেরা আম্পায়ার নির্বাচিত করে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘আমার দেখা হকির ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় হলেন খাজা ইউসুফ রেজা। তার স্টিক ওয়ার্ক ছিল অসাধারণ। ৫/৬ জন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে অনায়াসে কাটাতে পারতেন। এ কারণে তাকে বলা হতো ‘ঢাকা কা মলমল’। আবদুস সাদেকও ছিলেন দুর্দান্ত। পাকিস্তান জাতীয় দলের সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদের স্টাইলে তিনি খেলতেন। বশীর আহমেদের স্টিকওয়ার্ক ছিল ভালো। এছাড়া ইব্রাহীম সাবের ও সাব্বির ইউসুফ ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। পাকিস্তানের লেফট-ইন আসাদ মালিক, সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খান, রাইট ইন জাকাউল্লাহ ও ব্যাকের খেলোয়াড় তানভীর দার দুর্দান্ত খেলতেন।’
হকি খেলায় পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘খেলার রুল অ্যান্ড রেজুলেশন অনেক পাল্টে গেছে। অফসাইড রুল, সাইড লাইন থ্রো বাদ পড়ায় হকি খেলায় গতির সঞ্চার হয়েছে। আগে বল টার্নিং করা যেত না। ঘাষের মাঠে যেভাবে স্টিকওয়ার্ক করা যেত, এখন তা আর সম্ভব নয়। এখন খেলা হয় হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে। খেলায় স্ট্যামিনা লাগে। এজন্য কারো পক্ষে বেশিদিন খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে টার্ফ হওয়ার পর উপমহাদেশের হকি একদমই পিছিয়ে পড়েছে। ভারত, পাকিস্তানে যেখানে পাঁচটি টার্ফ, সেখানে হল্যান্ডে পাঁচ হাজার টার্ফ। উপমহাদেশ থেকে হকির গৌরব সরিয়ে নেয়ার জন্য ইউরোপীয়রা টার্ফ প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়। যখন টার্ফ প্রবর্তন করা হয়, তখন আমি পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এএইচ আতিফের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন, ইউরোপীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় টার্ফ মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের কিছু করণীয় ছিল না।’
বাংলাদেশের হকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের হকির ভবিষ্যৎ খুবই অনুজ্জ্বল। একটি/দুটি টার্ফ দিয়ে কীভাবে হকি খেলা এগিয়ে নেয়া সম্ভব?’
আরমানিটোলা স্কুলের ক্রীড়া ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘আরমানিটোলা স্কুলে আমরা যে মাঠে খেলেছি, সেই মাঠ নেই। যে মাঠ আছে তাতে খেলা সম্ভব নয়। এবড়োথেবড়ো। মাঠ না থাকলে খেলাধুলা হবে কী করে?’
বর্তমান ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন খেলাধুলায় তেমন পরিবেশ নেই। যেখানে গিয়ে সম্মান পাব না, সেখানে যাওয়া যায় না। অথচ জীবনটা কেটেছে খেলাধুলার মাঠে। তবে ওয়ারী ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে নিয়মিত যাই। আড্ডা মারি। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে তেমনভাবে সম্পর্ক নেই বললেই চলে।’
আলমগীর মোহাম্মদ আদেলের পরিবারকে ক্রীড়া পরিবার বললে অত্যুক্তি হবে না। তার ৩ ছেলে ১ মেয়ে। বড় ছেলে ওমর আদেল ওয়াসীম ১৯৭৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে জুনিয়র বিশ্বকাপ হকি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ছিলেন। মোহামেডানে খেলতেন। ছোট ছেলে ওয়াকার আদেল খেলতেন ঊষা ক্রীড়াচক্রে। বড় ভাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল খেলতেন মাহুতটুলীর হয়ে। তার দুই ছেলে সাজেদ আদেল ও শোয়েব আদেল জাতীয় দল ও মোহামেডানের খেলোয়াড় ছিলেন। তার সম্বন্ধী চৌধুরী মমতাজ হোসেন ফরিদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। শ্যালক সাব্বির ইউসুফ ও ফুয়াদ ইউসুফ ছিলেন খ্যাতিমান হকি খেলোয়াড়।
জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে একরাশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন আলমগীর মোহাম্মদ আদেল। তিনি বলেন,‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারকে একদমই গুরুত্বহীন বানিয়ে ফেলা হয়েছে। পুরস্কার প্রদানে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। যার আগে পাওয়ার কথা, তাকে পরে দেয়া হয়েছে কিংবা দেয়া হয়নি। যার পরে পাওয়ার কথা, তাকে দেয়া হয়েছে সময়ের অনেক আগে। এতে অসম্মানিত করা হয়েছে সিনিয়রদের। এ কারণে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার নিয়ে কোনো আগ্রহ অনুভব করি না।’
তবে এটা তো ঠিক, এদেশের হকির ইতিহাস লেখা হলে তা থেকে আলমগীর মোহাম্মদ আদেলকে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। তিনি জড়িয়ে আছেন হকির পরতে পরতে। #
১৬-৮-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে জীবনের জয়গান / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

ম্যারাথনবিদ রতন/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা