‘বাঙাল কা টাইগার’ খ্যাত হকির সোনা মিয়া/ দুলাল মাহমুদ
এখন কম-বেশি সবাই তাকে চেনেন হকির দেশসেরা সেন্টার ফরোয়ার্ড রাসেল মাহমুদ জিমির পিতা হিসেবে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এটি যেমন তিনি অনুভব করেন, তেমনিভাবে অপরিচিত কারো সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় গর্বিত এক সন্তানের জনক পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে ওঠে তার। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। বরং তাতে তিনি গর্বিত ও আনন্দিত। তার এই গর্ব ও আনন্দ তিনি সগৌরবে জানিয়ে দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না। ছেলের গৌরবে তিনি কতটা গৌরবান্বিত ও বিমোহিত- তা অনুধাবন করা যায় তার সঙ্গে কথা বললে। সর্বক্ষণ তিনি ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটাও জানাতে ভুল করেন না যে, ছেলে তার চেয়ে অনেক বড় খেলোয়াড়। অথচ হকি অঙ্গনে তার পরিচয়ও হেলাফেলার নয়। একজন জাত হকি খেলোয়াড় ছাড়াও হকি কোচ, আম্পায়ার, সংগঠকসহ নানা পরিচয়ে তিনি সমৃদ্ধ। সব মিলিয়ে তিনি হকির একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব।
তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে অল্প যে ক’জন বাঙালি হকি খেলোয়াড় আলাদাভাবে দৃষ্টি কাড়তে পেরেছিলেন, তাদের একজন হলেন আবদুর রাজ্জাক। ‘সোনা মিয়া’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। স্টিকের ভেল্কি তো ছিলই, সে সঙ্গে তার মারকুটে ভঙ্গিমা তাকে চিনিয়ে দেয় আলাদাভাবে। এ কারণে পাকিস্তানী খেলোয়াড়রা পর্যন্ত তাকে যথেষ্ট সমীহ করে খেলতেন। খেতাব পেয়েছিলেন ‘বাঙাল মুলুক কা টাইগার’ হিসেবে। খেলার মাঠে তিনি ছিলেন অসম্ভব টাফ অ্যান্ড রাফ। বল নিয়ে যখন ছুটতেন, কোনো কিছুই পরোয়া করতেন না। মাঠের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেন সাহসের সঙ্গে। দুর্দান্ত এই সেন্টার ফরোয়ার্ডকে রুখে দেয়ার জন্য প্রতিপক্ষ কোনো কূটকৌশলের আশ্রয় নিলে তিনি তা কাটিয়ে উঠতেন চাতুর্যের সঙ্গে। উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। বল পেলে ২/৩ জন খেলোয়াড়কে অনায়াসে কাটিয়ে গোলপোস্টে পৌঁছে যেতেন। নেটের দেখা পেলেই গর্জে উঠতো তার স্টিক। তার ছিল পাওয়ারফুল হিট নেয়ার ক্ষমতা। অসংখ্যবার তার হিটে নেট ছিঁড়ে বল বের হয়ে গেছে। স্টিকের কারুকাজ দিয়ে গোল করার ক্ষেত্রে তিনি যেমন তার মুন্সিয়ানা দেখাতেন, তেমনি তার ওস্তাদি ছিল খেলার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়।
বাংলাদেশের হকির সূতিকাগার পুরান ঢাকা থেকেই উঠে এসেছেন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৪৯ সালের ২ নভেম্বর গোলাম মোস্তফা লেনে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তারপরই আছে তার তিন বোন। শৈশব থেকেই তিনি বেড়ে ওঠেন ক্রীড়াময় পরিবেশে। আকৃষ্ট হন হকি, ফুটবল, ক্রিকেট খেলায়। পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে হওয়ায় বন্ধনহীন ছিল তার শৈশব। পারিবারিকভাবে তাকে কোনো গঞ্জনা সইতে না হওয়ায় খেলাধুলায় মেতেছেন মনের আনন্দে। আর আরমানিটোলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খুলে যায় তার স্বপ্নের দুয়ার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যে সময় ভর্তি হই, তখন আরমানিটোলা স্কুলে হকির রমরমা। প্রতি বছর চ্যাম্পিয়ন হয় আন্তঃস্কুল হকিতে। এই সাফল্য ছুঁয়ে যায় স্কুলের প্রতিটি ছাত্রকে। আর আমরা যারা হকি ভালোবাসতাম ও হকি খেলতাম, তারা তো দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হই। সে সময় আমাদের সমসাময়িক খেলোয়াড় ছিলেন আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মোহাম্মদ মহসিন, সাব্বির ইউসুফ। একটু সিনিয়র ছিলেন বশির আহমেদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, মীর আনোয়ারুল করিম, বুলবান, আনোয়ার। সিনিয়রদের খেলা দেখে আমরা উৎসাহ পাই। তাদের মতো খেলার চেষ্টা করি। স্কুলের চমৎকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে হকির কিছু কলাকৌশল আমি শিখেছি আখতার নামে এক পাকিস্তানী ভদ্রলোকের কাছে। তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর ভগ্নিপতি। লাহোরের অধিবাসী। তাকে খেলতে দেখে আমি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের জমানো টাকা থেকে ইসলামপুর শাহ স্পোর্টস থেকে দেড় টাকা দিয়ে স্টিক ও আট আনা দিয়ে বল কিনে আনি। এরপর তার কাছে তালিম নিতে থাকি। হকি খেলার বেসিক বিষয়গুলো জানতে পারি। ইট কিংবা ডাবের খোসা বসিয়ে অনুশীলন করতাম। তার মধ্যে দিয়ে ডজ দিতাম। আমার খেলার ভিত্তিটা তখনই গড়ে ওঠে। স্কুলে ব্যাচভিত্তিক খেলা হওয়ায় মনের মতো করে খেলার সুযোগ বেশি পেতাম না। এ কারণে নিজে নিজে অনুশীলন চালিয়ে যেতাম। আমার খেলা আমাদের গেমটিচার রশীদ স্যারের চোখে পড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের স্কুলের খেলাধুলার প্রাণ। তার কারণে ইন্টার স্কুল হকিতে সুযোগ পাই। তারপর শুধু এগিয়ে যাবার পালা। হকির পাশাপাশি আমি ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাই। যথারীতি স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করি। অ্যাথলেটিকসে আমার ইভেন্ট ছিল ২০০ ও ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ব্রডজাম্প। এছাড়া ওপেন ইভেন্ট ছিল ৮০০ মিটার স্প্রিন্ট। রিলেতেও অংশ নেই। সবগুলোতে প্রথম হয়ে আমি স্কুল চ্যাম্পিয়ন হই।’ ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। তাতে অবশ্য ক্রীড়াচর্চা একটুও টাল খায়নি। কলেজেও পেয়েছেন খেলাধুলার অবারিত দ্বার। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন, ‘কলেজে পাই নূর হোসেন স্যারকে। তিনি ছিলেন খেলাধুলার প্রতি দারুণ নিবেদিত। ছিলেন যে কোনো উঠতি ক্রীড়াবিদের অভিভাবক। তবে কলেজে আসার পর ক্রিকেটটা ছেড়ে দেই। হকি, ফুটবল তো ছিলই। অ্যাথলেটিকসেও সাফল্য অব্যাহত রাখি। ২০০, ৪০০, ৮০০, ১৫০০ মিটার স্প্রিন্ট ও ৪ গুনন ১০০ মিটার রিলেতে প্রথম হয়ে দু’বছরই কলেজ চ্যাম্পিয়ন হই।’ স্কুলে থাকতেই ছড়িয়ে পড়ে আবদুর রাজ্জাকের খ্যাতি। অল্প বয়সেই প্রথম বিভাগ হকি লীগে খেলার আমন্ত্রণ পান। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে শুরু করেন খেলা। এক্ষেত্রে তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ রণজিত দাসের একটা ভূমিকা আছে। এক বছর আজাদে খেলে ১৯৬৩ সালে যোগ দেন কম্বাইন্ডিং স্পোর্টিং কাবে। একটানা চার বছর খেলার পর ১৯৬৭ সালে চলে যান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। পরের বছর থেকে তার ঠিকানা হয় পিডব্লিউডি ক্লাবে। পিডব্লিউডিতে কর্মরত অবস্থায় বিশেষ অনুমতি নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে খেলেন নতুন ক্লাব আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। এক্ষেত্রে শেখ কামালের বিশেষ অবদান আছে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত খেলেন এ ক্লাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৭৮ সাল পর্যন্ত লীগ খেললেও ১৯৮৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেই। এর মধ্যে জড়িত ছিলাম ক্লাবের কোচ হিসেবে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে লীগের শেষ খেলায় আমাকে অধিনায়ক করে খেলতে নামানো হয়। জীবনের শেষ ম্যাচটি ছিল আমার জন্য আবেগের এক ম্যাচ এবং ক্লাবের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারিখটি স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১০ আগস্ট। খুব একটা খারাপ খেলিনি। খেলায় ২-১ গোলে জয়ী হয় আবাহনী। সেবার আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়।’ এ সময় আবাহনী লীগে ৭৪-৭৫, ৭৫-৭৬, ৭৬-৭৭, শহীদ স্মৃতি প্রতিযোগিতায় ১৯৭৩, ১৯৭৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও তিনি মোহামেডান, ওয়ারী, পিডব্লিউডির হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলেন। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার হয়ে খেলেন জাতীয় হকি প্রতিযোগিতায়। এর মধ্যে ঢাকা জেলা ১৯৭৫, ১৯৭৭, ১৯৭৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৫, ৭৬ ও ৭৭ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার অধিনায়ক। ১৯৬৭ সালটি তার জীবনের একটি স্মরণীয় বছর। এ বছর তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হকি দলে খেলার সুযোগ পান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগের বছরই আমার পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলার কথা ছিল। খেলতে না পেরে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। সে সময় আমাকে সান্ত্বনা দেন বরেণ্য ক্রীড়াবিদ রণজিত দাস। তিনি আমাকে বলেছিলেন, এভাবে হাল ছেড়ে দিও না। তোমার খেলা তোমাকে একদিন সুযোগ এনে দেবেই। তার কথা ফেলতে পারিনি। এর আগেও তিনি আমাকে একটি অনুরোধ করেছিলেন। সেটি গ্রহণ অবশ্য করিনি। তাহলো, আজাদে হকি খেলার সময় ফুটবল দলের অনুশীলনে একদিন আমি উপস্থিত ছিলাম। আমিও তখন ফুটবল খেলতাম। গোলকিপার শান্টু বল ধরার একটা কৌশল দেখে আমি রণজিত দা’কে বলেছিলাম, আমি এরচেয়ে ভালোভাবেই এটি করতে পারবো। তিনি আমাকে বলেন, দেখাও তো। আমি তা দেখাতেই তিনি আমাকে বলেন, তুমি গোলকিপার হিসেবে খেল। অনেক খ্যাতি অর্জন করতে পারবে। রণজিত দা ছিলেন ফুটবলের সেরা গোলকিপার। তার কথার আলাদা গুরুত্ব ছিল। কিন্তু আমি তখন ফুটবলে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলি। গোলকিপার হতে যাব কি কারণে? তবে আমি মনে করি, একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড গোলকিপার হিসেবে যেমন ভালো করতে পারেন, তেমনি গোলকিপারও সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে দক্ষতা দেখাতে পারেন। এর কারণ, দু’জন দু’জনের মনস্তত্ত্ব সহজেই বুঝতে পারেন। যা হোক, সেবার রণজিত দা’র কথা না শুনলেও এবার হকি খেলাটা ভালোভাবেই চালিয়ে যাই। পরের বছরই করাচীতে খেলতে যাই ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে। প্রথম ম্যাচে করাচীর বিপক্ষে আমাকে খেলানো হয়নি। পরের ম্যাচ শক্তিশালী পাকিস্তান নেভির বিপক্ষে খেলার সুযোগ পাই। আমার দেয়া একমাত্র গোলে জয় পায় পূর্ব পাকিস্তান একাদশ। সেটি ছিল কোনো পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের প্রথম জয়। আমাদের দলে ছিলেন মাজেদ, বশির আহমেদ, সাব্বির ইউসুফ, মোহাম্মদ মহসীন, আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মমতাজ, মজিদ, নুরুল ইসলাম, প্রতাপ শংকর হাজরা, আশিক উল্লাহ কায়েশ, এহতেশাম সুলতান। এই চ্যাম্পিয়নশীপে আমার নৈপুণ্যে মুগ্ধ করে সবাইকে। তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ক্যাম্প কমান্ডার লে. কর্নেল আতিফ আমার খেলার প্রশংসা করেন। আবদুস সাদেক ও আমি পাকিস্তান দলের ক্যাম্পে ডাক পাই। তখন অবশ্য একটি ক্যাম্প হলেও সেখান থেকে গঠন করা হতো পাকিস্তান জাতীয় দল ও জুনিয়র দল। এরপর থেকে আমি বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে অংশ নেয়ার সুযোগ পাই। তবে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান জুনিয়র একাদশের হয়ে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আবদুস সাদেক ও আমি খেলি। করাচীর বিভিন্ন স্থানে ৪টি ম্যাচ হয়। খেলায় একটি জয়, একটি পরাজয় ও ড্র হয় ২টি ম্যাচ। সে সময় জুনিয়র দলে খেলেন রাইট আউট অধিনায়ক ইসলাহউদ্দিন, লেফট ইন শাহনেওয়াজ শেখ, ফুলব্যাক তানভীর দার, লেফট উইঙ্গার সামিউল্লাহ, রাইট ইন সাইড জাহেদ, মিডফিল্ডার ওয়াসিম প্রমুখ। এরপর ইউরোপ ট্যুরে আবদুস সাদেক ও আমি সুযোগ পাই। ট্রায়ালে আমার ডান হাতের শোল্ডার ভেঙে যাওয়ায় আমি যেতে পারিনি। তবে আবদুস সাদেক সে সফরে যান।’ পাকিস্তান দলের হয়ে ইউরোপ সফরে যেতে না পারাটা আবদুর রাজ্জাকের ক্যারিয়ারে বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে আছে। তবে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে তিনি তার নৈপুণ্য অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডি এবং ১৯৬৯ সালে বাহওয়ালপুরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি পূর্ব পাকিস্তান একাদশের হয়ে খেলেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি এয়ার মার্শাল নূর খান পূর্ব পাকিস্তান হকি দলকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সফরের ব্যবস্থা করেন। সে দলেও তিনি ছিলেন। ১৯৭০ সালে এশিয়ান হকি চ্যাম্পিয়ন দুর্ধর্ষ পাকিস্তান জাতীয় দলের বিপক্ষেও তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জওহরলাল নেহরু হকি টুর্নামেন্টে ঢাকা একাদশের হয়ে অংশ নেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলটিই ‘ঢাকা একাদশ’ নামে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলে। ১৯৭৮ সালে সফরকারী শ্রীলংকা দলের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। সে সিরিজে খেলা হয় চারটি ম্যাচ। একই বছর দিল্লী এশিয়ান গেমসে ইনজুরির কারণে যেতে না পারাটা তার কাছে হয়ে আছে অনন্ত এক আক্ষেপ। দল রওনা হওয়ার আগেই ভেঙে যায় তার আঙুল।
খেলা ছাড়ার আগেই কোচ হিসেবে আবদুর রাজ্জাকের দীক্ষা হয়। আবাহনীর হয়ে খেলার সময় তিনি দলকে কোচিং দিতেন। আবাহনী, অ্যাজাক্সের পর তিনি মেরিনার্সের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালে অ্যাজাক্স ও ১৯৮৮ সালে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৮ সালে প্রথম মহিলা হকি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলের এবং ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে কোচিং করান। ১৯৮৪ সালে শুরু হয় জাতীয় হকি দলের প্রশিক্ষকের কাজ। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রতাপ শংকর হাজরার সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে সিউলগামী বাংলাদেশ দলের প্রশিক্ষক হিসেবে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে পাকিস্তানে যান। কিন্তু সিউল যেতে পারেননি। ১৯৮৮ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জুনিয়র ওয়ার্ল্ড কাপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। সেবার বাংলাদেশ দল চতুর্থ হয় এবং সুশৃঙ্খল দল হিসেবে ট্রফি লাভ করে। ১৯৮৯ সালে তৃতীয় এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলে কোচ হয়ে ভারত যান। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ হকি দলের প্রশিক্ষক হিসেবে জড়িত হন। ১৯৮৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায়, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানে, ১৯৯৩ সালে ওমানে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন। এছাড়া তিনি একজন প্রথম গ্রেডের আম্পায়ার। আম্পায়ার বোর্ডের সম্পাদক ও হকি ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। তার কাছে কোচিং পেয়ে উঠে এসেছেন লুলু, কামাল, ইশা, মুসা, ইয়ামিন, তপন, নাকিব প্রমুখ।
কোচ ও আম্পায়ার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোচিং করানো ও আম্পায়ার হওয়াটা সহজ কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে পড়ালেখাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সর্বশেষ কোচিং ম্যানুয়াল ও আইন-কানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন বইপত্র পড়া, ভিডিও দেখা। নিজেকে সব সময় আপ-টু-ডেট রাখতে হবে। তাছাড়া জানার জন্য কৌতূহলটা থাকতে হবে।’
নিজের স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে করাচীতে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে পাকিস্তান নেভি দলের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে দুর্দান্ত খেলেছিলাম। খেলায় ফুলব্যাক মমতাজ বল হিট করলে প্রতিপক্ষের গোলকিপার সেভ করে। ফিরতি বল পেয়ে যাই। রাইট সাইড দিয়ে গোল করি আমি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম গোল ও প্রথম জয়। আরেকটি গোলের কথা মনে পড়ে। ১৯৬৮ সালে ভাওয়ালপুরে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে পাকিস্তান পুলিশের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান একাদশের খেলা। মিডফিল্ড থেকে মহসীনের কাছ থেকে বল পেয়ে গোলটি করেছিলাম। এ গোলে আমরা এগিয়ে যাই। খেলায় যখন জয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম, ঠিক তখন খেলায় সমতা আনে প্রতিপক্ষ। খেলা ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকে। তবে জীবনের স্মরণীয় খেলা খেলেছিলাম পাকিস্তান জাতীয় দলের বিপক্ষে। ১৯৭০ সালে বিশ্ব সেরা এই দলটি পূর্ব পাকিস্তান একাদশের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য ঢাকা আসে। খেলার আগে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা ম্যাচটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য পাকিস্তান জাতীয় দলের রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়দের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান দলের শক্তি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। এ অবস্থায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হকি কমিটির সেক্রেটারি মাহমুদুর রহমান মোমিন আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মোহাম্মদ মহসীন ও আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, কি করা যায়? আমরা বললাম, আমাদের দলের যা শক্তি ও সামর্থ্য আছে, তাই নিয়েই খেলবো। বাধ্য হয়ে মোমিন ভাই সংশ্লিষ্টদের তাই জানিয়ে দিলেন। আমরা মনে মনে প্রতীক্ষা করলাম, আমাদের আন্ডারএস্টিমেট করার জবাব আমরা মাঠেই দেব। ঢাকা স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরা দর্শক। পুরো স্টেডিয়ামকে বিস্মিত করে খেলার শুরুর দিকে আমরা পেনাল্টি কর্নার পেয়ে যাই। আবদুস সাদেক বল স্টপ করলে সাব্বির ইউসুফ তা থেকে মারলে বল রিটার্ন এলে আমি কাটিয়ে গোল করি। স্টেডিয়ামে তখন সমুদ্র-গর্জন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে যায়। গোলটি স্টিকের অজুহাতে বাতিল করে দেন আম্পায়ার আলমগীর আদেল। সম্ভবত তার কাছে মনে হয়েছিল, পাকিস্তান দলের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান দল কেন গোল করবে! গোলটি নাকচ হয়ে যাওয়ায় আমরা আরো বেশি মরিয়া হয়ে খেলি। শত চেষ্টা করেও গোল করতে পারছিল না পাকিস্তান দল। তখন পাকিস্তান দলের তানভীর দার পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে আমাদের কাছে অনুরোধ জানাতে থাকে, আরে ইয়ার ছোড় দো না। পাবলিক মার ডালে গা। আমরা রাজি হচ্ছিলাম না। খেলা শেষদিকে গড়িয়ে যেতে থাকলে ওরা ভয় পেয়ে যেতে থাকে। ওদের কেন জানি ধারণা হয়, জিততে না পারলে দর্শকরা তাদের মারধর করবে। এ কারণে ওদের কাকুতি-মিনতি বেড়ে যেতে থাকে। যা হোক, খেলার ৫ মিনিট আগে পাকিস্তান পেনাল্টি কর্নার পায়। তা থেকে গোল করেন তানভীর দার। এক্ষেত্রে আমাদের স্বেচ্ছাকৃত ঢিলেমি ছিল। এক গোলেই খেলার ফলাফল নির্ধারিত হয়।’
অতীত এবং বর্তমান হকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খেলায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সময় যে যার পজিশনে খেলতাম। নিজের পজিশন ছেড়ে খুব একটা বাইরে যেতাম না। বর্তমানে একমাত্র গোলকিপার ছাড়া প্রতিটি খেলোয়াড়কে মাঠের প্রতিটি পজিশনে খেলার সামর্থ্য থাকতে হয়। তাছাড়া অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলাও অত্যন্ত কঠিন। খেলোয়াড়দের দীর্ঘ স্থায়িত্ব কমে গেছে। পাকিস্তান দলের সাইদ আনোয়ার তিনটি অলিম্পিক খেলেছেন। এখন দুটি অলিম্পিক খেলাও সম্ভব হয় না। তবে আমাদের সময় দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মধ্যে সমঝোতা ও বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। খেলোয়াড়দের মধ্যে পারফরম্যান্সের তফাত ছিল উনিশ-বিশ। আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মোহাম্মদ মহসীন, সাব্বির ইউসুফ ও আমার মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল, তাতে একে অপরকে বুঝতে সময় লাগতো না। মিডফিল্ডে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন সাদেক-মহসীন-সাবের। অন্যান্য পজিশনেও ছিল একইরকম। মাঠের এই সম্পর্ক মাঠের বাইরেও রয়ে যায়। অথচ এখন তেমন বোঝাপড়া দেখা যায় না। দু’তিনজনের মধ্যে সমঝোতা থাকলেও পুরো দলের মধ্যে টিম স্পিরিটের ঘাটতি রয়ে যায়। সত্তর দশকের খেলোয়াড়দের তুলনায় এখনকার খেলোয়াড়রা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। সে সময় খেলোয়াড়রা সিনিয়রদের সম্মান, আম্পায়ারদের সাথে তর্ক বা দুর্ব্যবহার করতেন না। আমরা এক মন, এক প্রাণ হয়ে দলের জন্য খেলতাম। বর্তমানে খেলোয়াড়রা যে সুযোগ-সুবিধা পায়, আমাদের সময় তা চিন্তাও করা যেত না। জয়ের জন্য খেললেও আমাদের খেলায় থাকতো একটা সৌন্দর্য। আর এখন ছেলেরা যে কোনো প্রকারেই জিততে চায়। তাছাড়া আমাদের সময় খেলার যে পরিবেশ ছিল, বর্তমানে তার বিপরীত অবস্থা। সুযোগ-সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও আমরা নিজেরাই নিজেদের খেলা উন্নতির চেষ্টা করেছি। ’
বর্তমানে হকির দুরবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে হকির মান অনেক নেমে গেছে। সাংগঠনিক দুর্বলতাই এর অন্যতম কারণ। প্রোপার লোক নেই। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা নেই। এমনকি নেই ভালো মানের কাব। খেলোয়াড়রাও খেলার চেয়ে অর্থটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। হকি ফেডারেশনে গতিশীলতা আনতে হলে সব কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি গঠন করা হলে ভালো হতো। তাতে ফেডারেশনে দক্ষ ও যোগ্যদের স্থান হলে হকিকে এগিয়ে নেয়া যেত। হকিকে এগিয়ে নিতে হলে বয়সভিত্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদী কোচিং ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা দরকার। তাছাড়া হকি ফেডারেশনের উদ্যোগে মনোনীত প্রশিক্ষক দিয়ে জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।’
আবদুর রাজ্জাক মনে করেন, তাদের ১৯৬৭ সালের ব্যাচটাই হকির ইতিহাসের সেরা দল। সে দলের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হচ্ছে এমন : ‘গোলকিপার ছিলেন মাজেদ। পেনাল্টি কর্নার সেভ করার ওস্তাদ ছিলেন। প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের নার্ভাস বা মরালি ডাউন করে দিতেন। তার আই কনট্যাক্ট ছিল দুর্দান্ত। ফুলব্যাক শামসুল বারী পেনাল্টি কর্নার ভালো মারতেন। স্লিম ফিগার। তবে রিস্ট শক্তিশালী। ২৬ আউন্স স্টিক নিয়ে খেলতেন। আরেক ফুলব্যাক সাব্বির ইউসুফের হিট ছিল পাওয়ারফুল ও নিখুঁত। পেনাল্টি এক্সপার্ট ছিলেন। রাইট হাফ মোহাম্মদ মহসীনের গেম প্ল্যানিং ছিল ভালো। ফিনিশিং ছিল দারুণ। আবদুস সাদেকের সঙ্গে ভালো সমন্বয় ছিল। সেন্টার হাফ আবদুস সাদেকের স্কুপিং ছিল পাওয়ারফুল ও নিখুঁত। বল ডিস্ট্রিবিউশন, টাইমিং, ডজিংয়ে কোনো ভুল হতো না। লেফট হাফ ইব্রাহীম সাবেরের পাশ দিয়ে বল বের করা যেত না। পাকিস্তানের খালেদ মাহমুদ তার কাছে হিমশিম খেয়ে যেতেন। তার কথা ছিল, বল গেলে ম্যান যাবে না, ম্যান গেলে বল যাবে না। তিনি ডজ মারতেন না। দ্রুত বল নিয়ে পাস দিয়ে দিতেন। লেফট ইন নুরুল ইসলামের রিস্ট ও গায়ে অনেক শক্তি ছিল। সে সঙ্গে ছিলেন লম্বা। উইথ বল খুবই স্পিডি ছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে খেলাটাকে থামিয়ে দিয়ে চাতুর্যের সঙ্গে বল নিয়ে ঢুকে পড়তেন। বলে যখন হিট করতেন- নেটলাইন ছিঁড়ে ফেলতেন। লেফট বা রাইট ইনে বশীর আহমেদ ছিলেন ড্রিবল মাস্টার। যতক্ষণ খুশী বল রাখতে পারতেন। ফলস ডজ ছিল সুন্দর। লেফট বা রাইট ইন প্রতাপ শংকর হাজরা ফুটবলের স্টাইলে খেলতেন। খেলা থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ দৌড় দিতেন। বল নষ্ট করতেন না। প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে পারতেন। লেফট আউট আশেকউল্লাহ কায়েশ সাংঘাতিক স্পিডি। বল কন্ট্রোল, ড্রিবলে ভালো ছিলেন। পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নিতে পারতেন। ফুলব্যাক মমতাজকে তার অ্যাটিচুডের কারণে প্রতিপক্ষরা ভয় পেতেন। তিনি ছিলেন পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিস্ট। সেন্টার ফরোয়ার্ড আবদুল মজিদ ছিলেন স্টাইলিশ খেলোয়াড়। তবে খুব সফট খেলোয়াড় ছিলেন। ডজ দিয়ে বল নিয়ে পাস দিয়ে দিতেন। কোনো ঝামেলায় যেতে চাইতেন না। এছাড়া গোলরক্ষক জাম্মু ও রাইট ইন সাইড এহতেশাম সুলতান ভালো খেলোয়াড় ছিলেন।’
বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে গোলকিপার বাপ্পী, জাহিদ, ফুলব্যাক মামুন, ইশা, নাকিব, খোকন, রাজীব, ইয়ামীন, বিল্লু, মিডফিল্ডার রাজন, টিটু, হাসান, মুসা, ফরোয়ার্ড জিমি, কামাল, সিনিয়র প্রিন্স ও হাবুলের খেলা তার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
তার প্রিয় খেলোয়াড় হলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক ফুলব্যাক তানভীর দার। তানভীরের খেলা এখনও তার চোখে লেগে আছে : ‘পাকিস্তান জাতীয় দলের ক্যাম্পে তানভীর দারের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। তবে শুরুটা ছিল তিক্ত। অনুশীলনের সময় ও আমার হাঁটুতে মারতো। বাধ্য হয়ে কোচ নবীকেলাতকে জানাই। তাতেও কোনো কাজ না হওয়ার একদিন সুযোগ বুঝে আমিও মারি। বল তার মুখে লেগে কেটে যায়। তা দেখে আমার সঙ্গে হাত মেলান সাইদ আনোয়ার ও আসাদ মালিক। এরপর থেকে তানভীর দার আর আমাকে ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। বরং ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। খেলোয়াড় হিসেবে তার কোনো তুলনা হয় না। ফুলব্যাক পজিশনে খেলতেন। পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিষ্ট। খুবই নিখুঁত ছিলেন। যেখানে বল মারতে চাইতেন, সেখানেই মারতে পারতেন। পেনাল্টি কর্নারে একটি বল পেলে তা থেকেই গোল করতেন। অসম্ভব পাওয়ারফুল হিট ছিল।’
আবদুর রাজ্জাক ৩ মেয়ে ও ২ ছেলের জনক। ছেলে রাসেল মাহমুদ জিমিকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘আমিও যেমন সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলেছি, আমার ছেলেও টপ সেন্টার ফরোয়ার্ড। নিরপেক্ষভাবেই বলতে পারি, আমার চেয়ে জিমি অনেক ভালো খেলোয়াড়। আমি বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে কোনো কিছু না ভেবেই মেরে দিতাম। তাতে অনেক সময় গোলের সুযোগ নষ্ট হতো। আর জিমি ডি-বক্সে ঢুকে ত্বরিত চিন্তা করে, গোল হবে কি হবে না। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর বল মারে। যদি দেখে গোল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন অন্যকে দিয়ে গোল করায়। নিজে গোল করতে পারলো কি পারলো না, সেটা বিবেচনা না করে দলের গোল পাওয়াটাও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া জিমি চোখের পলকে উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে এমন সব গোল করে, তাতে রীতিমত বিস্মিত হতে হয়। জিমিকে তৈরি করার কৃতিত্ব বিকেএসপির কোচ নুরুল ইসলামের।’
ছেলে জিমি ছাড়াও তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে হকি খেলোয়াড় হিসেবে উঠে এসেছেন ভাতিজা জাভেদ, ভাইগ্না পিরু, খোকন।
হকির পাশাপাশি ফুটবলেও আবদুর রাজ্জাক নৈপুণ্য দেখান। প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে তিনি তৎকালীন শক্তিশালী দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের হয়ে ১৯৬৩ সালে, ১৯৬৪ সাল থেকে পুনরায় ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলেন। ফুটবলেও তিনি ছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড। তবে হকি তার বুকের গভীরে ঢুকে যাওয়ায় ফুটবলটাকে খুব বেশি সিরিয়াসলি নেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে তদানীন্তন সেরা ফুটবলার তোরাব আলী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে পেতেন ১২ হাজার টাকা। একই কাবে হকির জন্য সেবার আমি পেয়েছিলাম ৫ হাজার টাকা। নেহাত খারাপ নয়। এ কারণে হকিটাই আমার কাছে হয়ে ওঠে টপ ফেবারিট।’
আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া দূর শৈশবে সেই যে হকির প্রেমে পড়েন- আজ অব্দি তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। নিজে খেলেছেন, কোচ হয়েছেন, ছেলে দাপটে খেলছে। সেটাই প্রধান বিবেচ্য নয়। হকিটা তার প্যাসন। আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালোবাসা। যেখানেই হকি, সেখানেই তিনি। এ কারণে তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। হকি অন্তঃপ্রাণ এমন ব্যক্তি আছেন বলেই এখনো হকিকে নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়। #
১-৫-২০০৮
তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে অল্প যে ক’জন বাঙালি হকি খেলোয়াড় আলাদাভাবে দৃষ্টি কাড়তে পেরেছিলেন, তাদের একজন হলেন আবদুর রাজ্জাক। ‘সোনা মিয়া’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। স্টিকের ভেল্কি তো ছিলই, সে সঙ্গে তার মারকুটে ভঙ্গিমা তাকে চিনিয়ে দেয় আলাদাভাবে। এ কারণে পাকিস্তানী খেলোয়াড়রা পর্যন্ত তাকে যথেষ্ট সমীহ করে খেলতেন। খেতাব পেয়েছিলেন ‘বাঙাল মুলুক কা টাইগার’ হিসেবে। খেলার মাঠে তিনি ছিলেন অসম্ভব টাফ অ্যান্ড রাফ। বল নিয়ে যখন ছুটতেন, কোনো কিছুই পরোয়া করতেন না। মাঠের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেন সাহসের সঙ্গে। দুর্দান্ত এই সেন্টার ফরোয়ার্ডকে রুখে দেয়ার জন্য প্রতিপক্ষ কোনো কূটকৌশলের আশ্রয় নিলে তিনি তা কাটিয়ে উঠতেন চাতুর্যের সঙ্গে। উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। বল পেলে ২/৩ জন খেলোয়াড়কে অনায়াসে কাটিয়ে গোলপোস্টে পৌঁছে যেতেন। নেটের দেখা পেলেই গর্জে উঠতো তার স্টিক। তার ছিল পাওয়ারফুল হিট নেয়ার ক্ষমতা। অসংখ্যবার তার হিটে নেট ছিঁড়ে বল বের হয়ে গেছে। স্টিকের কারুকাজ দিয়ে গোল করার ক্ষেত্রে তিনি যেমন তার মুন্সিয়ানা দেখাতেন, তেমনি তার ওস্তাদি ছিল খেলার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়।
বাংলাদেশের হকির সূতিকাগার পুরান ঢাকা থেকেই উঠে এসেছেন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৪৯ সালের ২ নভেম্বর গোলাম মোস্তফা লেনে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তারপরই আছে তার তিন বোন। শৈশব থেকেই তিনি বেড়ে ওঠেন ক্রীড়াময় পরিবেশে। আকৃষ্ট হন হকি, ফুটবল, ক্রিকেট খেলায়। পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে হওয়ায় বন্ধনহীন ছিল তার শৈশব। পারিবারিকভাবে তাকে কোনো গঞ্জনা সইতে না হওয়ায় খেলাধুলায় মেতেছেন মনের আনন্দে। আর আরমানিটোলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খুলে যায় তার স্বপ্নের দুয়ার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যে সময় ভর্তি হই, তখন আরমানিটোলা স্কুলে হকির রমরমা। প্রতি বছর চ্যাম্পিয়ন হয় আন্তঃস্কুল হকিতে। এই সাফল্য ছুঁয়ে যায় স্কুলের প্রতিটি ছাত্রকে। আর আমরা যারা হকি ভালোবাসতাম ও হকি খেলতাম, তারা তো দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হই। সে সময় আমাদের সমসাময়িক খেলোয়াড় ছিলেন আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মোহাম্মদ মহসিন, সাব্বির ইউসুফ। একটু সিনিয়র ছিলেন বশির আহমেদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, মীর আনোয়ারুল করিম, বুলবান, আনোয়ার। সিনিয়রদের খেলা দেখে আমরা উৎসাহ পাই। তাদের মতো খেলার চেষ্টা করি। স্কুলের চমৎকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে হকির কিছু কলাকৌশল আমি শিখেছি আখতার নামে এক পাকিস্তানী ভদ্রলোকের কাছে। তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর ভগ্নিপতি। লাহোরের অধিবাসী। তাকে খেলতে দেখে আমি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের জমানো টাকা থেকে ইসলামপুর শাহ স্পোর্টস থেকে দেড় টাকা দিয়ে স্টিক ও আট আনা দিয়ে বল কিনে আনি। এরপর তার কাছে তালিম নিতে থাকি। হকি খেলার বেসিক বিষয়গুলো জানতে পারি। ইট কিংবা ডাবের খোসা বসিয়ে অনুশীলন করতাম। তার মধ্যে দিয়ে ডজ দিতাম। আমার খেলার ভিত্তিটা তখনই গড়ে ওঠে। স্কুলে ব্যাচভিত্তিক খেলা হওয়ায় মনের মতো করে খেলার সুযোগ বেশি পেতাম না। এ কারণে নিজে নিজে অনুশীলন চালিয়ে যেতাম। আমার খেলা আমাদের গেমটিচার রশীদ স্যারের চোখে পড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের স্কুলের খেলাধুলার প্রাণ। তার কারণে ইন্টার স্কুল হকিতে সুযোগ পাই। তারপর শুধু এগিয়ে যাবার পালা। হকির পাশাপাশি আমি ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাই। যথারীতি স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করি। অ্যাথলেটিকসে আমার ইভেন্ট ছিল ২০০ ও ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ব্রডজাম্প। এছাড়া ওপেন ইভেন্ট ছিল ৮০০ মিটার স্প্রিন্ট। রিলেতেও অংশ নেই। সবগুলোতে প্রথম হয়ে আমি স্কুল চ্যাম্পিয়ন হই।’ ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। তাতে অবশ্য ক্রীড়াচর্চা একটুও টাল খায়নি। কলেজেও পেয়েছেন খেলাধুলার অবারিত দ্বার। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন, ‘কলেজে পাই নূর হোসেন স্যারকে। তিনি ছিলেন খেলাধুলার প্রতি দারুণ নিবেদিত। ছিলেন যে কোনো উঠতি ক্রীড়াবিদের অভিভাবক। তবে কলেজে আসার পর ক্রিকেটটা ছেড়ে দেই। হকি, ফুটবল তো ছিলই। অ্যাথলেটিকসেও সাফল্য অব্যাহত রাখি। ২০০, ৪০০, ৮০০, ১৫০০ মিটার স্প্রিন্ট ও ৪ গুনন ১০০ মিটার রিলেতে প্রথম হয়ে দু’বছরই কলেজ চ্যাম্পিয়ন হই।’ স্কুলে থাকতেই ছড়িয়ে পড়ে আবদুর রাজ্জাকের খ্যাতি। অল্প বয়সেই প্রথম বিভাগ হকি লীগে খেলার আমন্ত্রণ পান। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে শুরু করেন খেলা। এক্ষেত্রে তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ রণজিত দাসের একটা ভূমিকা আছে। এক বছর আজাদে খেলে ১৯৬৩ সালে যোগ দেন কম্বাইন্ডিং স্পোর্টিং কাবে। একটানা চার বছর খেলার পর ১৯৬৭ সালে চলে যান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। পরের বছর থেকে তার ঠিকানা হয় পিডব্লিউডি ক্লাবে। পিডব্লিউডিতে কর্মরত অবস্থায় বিশেষ অনুমতি নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে খেলেন নতুন ক্লাব আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। এক্ষেত্রে শেখ কামালের বিশেষ অবদান আছে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত খেলেন এ ক্লাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৭৮ সাল পর্যন্ত লীগ খেললেও ১৯৮৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেই। এর মধ্যে জড়িত ছিলাম ক্লাবের কোচ হিসেবে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে লীগের শেষ খেলায় আমাকে অধিনায়ক করে খেলতে নামানো হয়। জীবনের শেষ ম্যাচটি ছিল আমার জন্য আবেগের এক ম্যাচ এবং ক্লাবের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারিখটি স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১০ আগস্ট। খুব একটা খারাপ খেলিনি। খেলায় ২-১ গোলে জয়ী হয় আবাহনী। সেবার আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়।’ এ সময় আবাহনী লীগে ৭৪-৭৫, ৭৫-৭৬, ৭৬-৭৭, শহীদ স্মৃতি প্রতিযোগিতায় ১৯৭৩, ১৯৭৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও তিনি মোহামেডান, ওয়ারী, পিডব্লিউডির হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলেন। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার হয়ে খেলেন জাতীয় হকি প্রতিযোগিতায়। এর মধ্যে ঢাকা জেলা ১৯৭৫, ১৯৭৭, ১৯৭৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৫, ৭৬ ও ৭৭ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার অধিনায়ক। ১৯৬৭ সালটি তার জীবনের একটি স্মরণীয় বছর। এ বছর তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হকি দলে খেলার সুযোগ পান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগের বছরই আমার পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলার কথা ছিল। খেলতে না পেরে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। সে সময় আমাকে সান্ত্বনা দেন বরেণ্য ক্রীড়াবিদ রণজিত দাস। তিনি আমাকে বলেছিলেন, এভাবে হাল ছেড়ে দিও না। তোমার খেলা তোমাকে একদিন সুযোগ এনে দেবেই। তার কথা ফেলতে পারিনি। এর আগেও তিনি আমাকে একটি অনুরোধ করেছিলেন। সেটি গ্রহণ অবশ্য করিনি। তাহলো, আজাদে হকি খেলার সময় ফুটবল দলের অনুশীলনে একদিন আমি উপস্থিত ছিলাম। আমিও তখন ফুটবল খেলতাম। গোলকিপার শান্টু বল ধরার একটা কৌশল দেখে আমি রণজিত দা’কে বলেছিলাম, আমি এরচেয়ে ভালোভাবেই এটি করতে পারবো। তিনি আমাকে বলেন, দেখাও তো। আমি তা দেখাতেই তিনি আমাকে বলেন, তুমি গোলকিপার হিসেবে খেল। অনেক খ্যাতি অর্জন করতে পারবে। রণজিত দা ছিলেন ফুটবলের সেরা গোলকিপার। তার কথার আলাদা গুরুত্ব ছিল। কিন্তু আমি তখন ফুটবলে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলি। গোলকিপার হতে যাব কি কারণে? তবে আমি মনে করি, একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড গোলকিপার হিসেবে যেমন ভালো করতে পারেন, তেমনি গোলকিপারও সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে দক্ষতা দেখাতে পারেন। এর কারণ, দু’জন দু’জনের মনস্তত্ত্ব সহজেই বুঝতে পারেন। যা হোক, সেবার রণজিত দা’র কথা না শুনলেও এবার হকি খেলাটা ভালোভাবেই চালিয়ে যাই। পরের বছরই করাচীতে খেলতে যাই ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে। প্রথম ম্যাচে করাচীর বিপক্ষে আমাকে খেলানো হয়নি। পরের ম্যাচ শক্তিশালী পাকিস্তান নেভির বিপক্ষে খেলার সুযোগ পাই। আমার দেয়া একমাত্র গোলে জয় পায় পূর্ব পাকিস্তান একাদশ। সেটি ছিল কোনো পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের প্রথম জয়। আমাদের দলে ছিলেন মাজেদ, বশির আহমেদ, সাব্বির ইউসুফ, মোহাম্মদ মহসীন, আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মমতাজ, মজিদ, নুরুল ইসলাম, প্রতাপ শংকর হাজরা, আশিক উল্লাহ কায়েশ, এহতেশাম সুলতান। এই চ্যাম্পিয়নশীপে আমার নৈপুণ্যে মুগ্ধ করে সবাইকে। তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ক্যাম্প কমান্ডার লে. কর্নেল আতিফ আমার খেলার প্রশংসা করেন। আবদুস সাদেক ও আমি পাকিস্তান দলের ক্যাম্পে ডাক পাই। তখন অবশ্য একটি ক্যাম্প হলেও সেখান থেকে গঠন করা হতো পাকিস্তান জাতীয় দল ও জুনিয়র দল। এরপর থেকে আমি বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে অংশ নেয়ার সুযোগ পাই। তবে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান জুনিয়র একাদশের হয়ে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আবদুস সাদেক ও আমি খেলি। করাচীর বিভিন্ন স্থানে ৪টি ম্যাচ হয়। খেলায় একটি জয়, একটি পরাজয় ও ড্র হয় ২টি ম্যাচ। সে সময় জুনিয়র দলে খেলেন রাইট আউট অধিনায়ক ইসলাহউদ্দিন, লেফট ইন শাহনেওয়াজ শেখ, ফুলব্যাক তানভীর দার, লেফট উইঙ্গার সামিউল্লাহ, রাইট ইন সাইড জাহেদ, মিডফিল্ডার ওয়াসিম প্রমুখ। এরপর ইউরোপ ট্যুরে আবদুস সাদেক ও আমি সুযোগ পাই। ট্রায়ালে আমার ডান হাতের শোল্ডার ভেঙে যাওয়ায় আমি যেতে পারিনি। তবে আবদুস সাদেক সে সফরে যান।’ পাকিস্তান দলের হয়ে ইউরোপ সফরে যেতে না পারাটা আবদুর রাজ্জাকের ক্যারিয়ারে বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে আছে। তবে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে তিনি তার নৈপুণ্য অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডি এবং ১৯৬৯ সালে বাহওয়ালপুরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি পূর্ব পাকিস্তান একাদশের হয়ে খেলেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি এয়ার মার্শাল নূর খান পূর্ব পাকিস্তান হকি দলকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সফরের ব্যবস্থা করেন। সে দলেও তিনি ছিলেন। ১৯৭০ সালে এশিয়ান হকি চ্যাম্পিয়ন দুর্ধর্ষ পাকিস্তান জাতীয় দলের বিপক্ষেও তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জওহরলাল নেহরু হকি টুর্নামেন্টে ঢাকা একাদশের হয়ে অংশ নেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলটিই ‘ঢাকা একাদশ’ নামে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলে। ১৯৭৮ সালে সফরকারী শ্রীলংকা দলের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। সে সিরিজে খেলা হয় চারটি ম্যাচ। একই বছর দিল্লী এশিয়ান গেমসে ইনজুরির কারণে যেতে না পারাটা তার কাছে হয়ে আছে অনন্ত এক আক্ষেপ। দল রওনা হওয়ার আগেই ভেঙে যায় তার আঙুল।
খেলা ছাড়ার আগেই কোচ হিসেবে আবদুর রাজ্জাকের দীক্ষা হয়। আবাহনীর হয়ে খেলার সময় তিনি দলকে কোচিং দিতেন। আবাহনী, অ্যাজাক্সের পর তিনি মেরিনার্সের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালে অ্যাজাক্স ও ১৯৮৮ সালে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৮ সালে প্রথম মহিলা হকি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলের এবং ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে কোচিং করান। ১৯৮৪ সালে শুরু হয় জাতীয় হকি দলের প্রশিক্ষকের কাজ। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রতাপ শংকর হাজরার সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে সিউলগামী বাংলাদেশ দলের প্রশিক্ষক হিসেবে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে পাকিস্তানে যান। কিন্তু সিউল যেতে পারেননি। ১৯৮৮ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জুনিয়র ওয়ার্ল্ড কাপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। সেবার বাংলাদেশ দল চতুর্থ হয় এবং সুশৃঙ্খল দল হিসেবে ট্রফি লাভ করে। ১৯৮৯ সালে তৃতীয় এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলে কোচ হয়ে ভারত যান। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ হকি দলের প্রশিক্ষক হিসেবে জড়িত হন। ১৯৮৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায়, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানে, ১৯৯৩ সালে ওমানে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন। এছাড়া তিনি একজন প্রথম গ্রেডের আম্পায়ার। আম্পায়ার বোর্ডের সম্পাদক ও হকি ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। তার কাছে কোচিং পেয়ে উঠে এসেছেন লুলু, কামাল, ইশা, মুসা, ইয়ামিন, তপন, নাকিব প্রমুখ।
কোচ ও আম্পায়ার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোচিং করানো ও আম্পায়ার হওয়াটা সহজ কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে পড়ালেখাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সর্বশেষ কোচিং ম্যানুয়াল ও আইন-কানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন বইপত্র পড়া, ভিডিও দেখা। নিজেকে সব সময় আপ-টু-ডেট রাখতে হবে। তাছাড়া জানার জন্য কৌতূহলটা থাকতে হবে।’
নিজের স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে করাচীতে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে পাকিস্তান নেভি দলের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে দুর্দান্ত খেলেছিলাম। খেলায় ফুলব্যাক মমতাজ বল হিট করলে প্রতিপক্ষের গোলকিপার সেভ করে। ফিরতি বল পেয়ে যাই। রাইট সাইড দিয়ে গোল করি আমি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম গোল ও প্রথম জয়। আরেকটি গোলের কথা মনে পড়ে। ১৯৬৮ সালে ভাওয়ালপুরে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে পাকিস্তান পুলিশের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান একাদশের খেলা। মিডফিল্ড থেকে মহসীনের কাছ থেকে বল পেয়ে গোলটি করেছিলাম। এ গোলে আমরা এগিয়ে যাই। খেলায় যখন জয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম, ঠিক তখন খেলায় সমতা আনে প্রতিপক্ষ। খেলা ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকে। তবে জীবনের স্মরণীয় খেলা খেলেছিলাম পাকিস্তান জাতীয় দলের বিপক্ষে। ১৯৭০ সালে বিশ্ব সেরা এই দলটি পূর্ব পাকিস্তান একাদশের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য ঢাকা আসে। খেলার আগে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা ম্যাচটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য পাকিস্তান জাতীয় দলের রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়দের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান দলের শক্তি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। এ অবস্থায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হকি কমিটির সেক্রেটারি মাহমুদুর রহমান মোমিন আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মোহাম্মদ মহসীন ও আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, কি করা যায়? আমরা বললাম, আমাদের দলের যা শক্তি ও সামর্থ্য আছে, তাই নিয়েই খেলবো। বাধ্য হয়ে মোমিন ভাই সংশ্লিষ্টদের তাই জানিয়ে দিলেন। আমরা মনে মনে প্রতীক্ষা করলাম, আমাদের আন্ডারএস্টিমেট করার জবাব আমরা মাঠেই দেব। ঢাকা স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরা দর্শক। পুরো স্টেডিয়ামকে বিস্মিত করে খেলার শুরুর দিকে আমরা পেনাল্টি কর্নার পেয়ে যাই। আবদুস সাদেক বল স্টপ করলে সাব্বির ইউসুফ তা থেকে মারলে বল রিটার্ন এলে আমি কাটিয়ে গোল করি। স্টেডিয়ামে তখন সমুদ্র-গর্জন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে যায়। গোলটি স্টিকের অজুহাতে বাতিল করে দেন আম্পায়ার আলমগীর আদেল। সম্ভবত তার কাছে মনে হয়েছিল, পাকিস্তান দলের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান দল কেন গোল করবে! গোলটি নাকচ হয়ে যাওয়ায় আমরা আরো বেশি মরিয়া হয়ে খেলি। শত চেষ্টা করেও গোল করতে পারছিল না পাকিস্তান দল। তখন পাকিস্তান দলের তানভীর দার পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে আমাদের কাছে অনুরোধ জানাতে থাকে, আরে ইয়ার ছোড় দো না। পাবলিক মার ডালে গা। আমরা রাজি হচ্ছিলাম না। খেলা শেষদিকে গড়িয়ে যেতে থাকলে ওরা ভয় পেয়ে যেতে থাকে। ওদের কেন জানি ধারণা হয়, জিততে না পারলে দর্শকরা তাদের মারধর করবে। এ কারণে ওদের কাকুতি-মিনতি বেড়ে যেতে থাকে। যা হোক, খেলার ৫ মিনিট আগে পাকিস্তান পেনাল্টি কর্নার পায়। তা থেকে গোল করেন তানভীর দার। এক্ষেত্রে আমাদের স্বেচ্ছাকৃত ঢিলেমি ছিল। এক গোলেই খেলার ফলাফল নির্ধারিত হয়।’
অতীত এবং বর্তমান হকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খেলায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সময় যে যার পজিশনে খেলতাম। নিজের পজিশন ছেড়ে খুব একটা বাইরে যেতাম না। বর্তমানে একমাত্র গোলকিপার ছাড়া প্রতিটি খেলোয়াড়কে মাঠের প্রতিটি পজিশনে খেলার সামর্থ্য থাকতে হয়। তাছাড়া অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলাও অত্যন্ত কঠিন। খেলোয়াড়দের দীর্ঘ স্থায়িত্ব কমে গেছে। পাকিস্তান দলের সাইদ আনোয়ার তিনটি অলিম্পিক খেলেছেন। এখন দুটি অলিম্পিক খেলাও সম্ভব হয় না। তবে আমাদের সময় দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মধ্যে সমঝোতা ও বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। খেলোয়াড়দের মধ্যে পারফরম্যান্সের তফাত ছিল উনিশ-বিশ। আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, মোহাম্মদ মহসীন, সাব্বির ইউসুফ ও আমার মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল, তাতে একে অপরকে বুঝতে সময় লাগতো না। মিডফিল্ডে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন সাদেক-মহসীন-সাবের। অন্যান্য পজিশনেও ছিল একইরকম। মাঠের এই সম্পর্ক মাঠের বাইরেও রয়ে যায়। অথচ এখন তেমন বোঝাপড়া দেখা যায় না। দু’তিনজনের মধ্যে সমঝোতা থাকলেও পুরো দলের মধ্যে টিম স্পিরিটের ঘাটতি রয়ে যায়। সত্তর দশকের খেলোয়াড়দের তুলনায় এখনকার খেলোয়াড়রা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। সে সময় খেলোয়াড়রা সিনিয়রদের সম্মান, আম্পায়ারদের সাথে তর্ক বা দুর্ব্যবহার করতেন না। আমরা এক মন, এক প্রাণ হয়ে দলের জন্য খেলতাম। বর্তমানে খেলোয়াড়রা যে সুযোগ-সুবিধা পায়, আমাদের সময় তা চিন্তাও করা যেত না। জয়ের জন্য খেললেও আমাদের খেলায় থাকতো একটা সৌন্দর্য। আর এখন ছেলেরা যে কোনো প্রকারেই জিততে চায়। তাছাড়া আমাদের সময় খেলার যে পরিবেশ ছিল, বর্তমানে তার বিপরীত অবস্থা। সুযোগ-সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও আমরা নিজেরাই নিজেদের খেলা উন্নতির চেষ্টা করেছি। ’
বর্তমানে হকির দুরবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে হকির মান অনেক নেমে গেছে। সাংগঠনিক দুর্বলতাই এর অন্যতম কারণ। প্রোপার লোক নেই। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা নেই। এমনকি নেই ভালো মানের কাব। খেলোয়াড়রাও খেলার চেয়ে অর্থটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। হকি ফেডারেশনে গতিশীলতা আনতে হলে সব কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি গঠন করা হলে ভালো হতো। তাতে ফেডারেশনে দক্ষ ও যোগ্যদের স্থান হলে হকিকে এগিয়ে নেয়া যেত। হকিকে এগিয়ে নিতে হলে বয়সভিত্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদী কোচিং ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা দরকার। তাছাড়া হকি ফেডারেশনের উদ্যোগে মনোনীত প্রশিক্ষক দিয়ে জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।’
আবদুর রাজ্জাক মনে করেন, তাদের ১৯৬৭ সালের ব্যাচটাই হকির ইতিহাসের সেরা দল। সে দলের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হচ্ছে এমন : ‘গোলকিপার ছিলেন মাজেদ। পেনাল্টি কর্নার সেভ করার ওস্তাদ ছিলেন। প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের নার্ভাস বা মরালি ডাউন করে দিতেন। তার আই কনট্যাক্ট ছিল দুর্দান্ত। ফুলব্যাক শামসুল বারী পেনাল্টি কর্নার ভালো মারতেন। স্লিম ফিগার। তবে রিস্ট শক্তিশালী। ২৬ আউন্স স্টিক নিয়ে খেলতেন। আরেক ফুলব্যাক সাব্বির ইউসুফের হিট ছিল পাওয়ারফুল ও নিখুঁত। পেনাল্টি এক্সপার্ট ছিলেন। রাইট হাফ মোহাম্মদ মহসীনের গেম প্ল্যানিং ছিল ভালো। ফিনিশিং ছিল দারুণ। আবদুস সাদেকের সঙ্গে ভালো সমন্বয় ছিল। সেন্টার হাফ আবদুস সাদেকের স্কুপিং ছিল পাওয়ারফুল ও নিখুঁত। বল ডিস্ট্রিবিউশন, টাইমিং, ডজিংয়ে কোনো ভুল হতো না। লেফট হাফ ইব্রাহীম সাবেরের পাশ দিয়ে বল বের করা যেত না। পাকিস্তানের খালেদ মাহমুদ তার কাছে হিমশিম খেয়ে যেতেন। তার কথা ছিল, বল গেলে ম্যান যাবে না, ম্যান গেলে বল যাবে না। তিনি ডজ মারতেন না। দ্রুত বল নিয়ে পাস দিয়ে দিতেন। লেফট ইন নুরুল ইসলামের রিস্ট ও গায়ে অনেক শক্তি ছিল। সে সঙ্গে ছিলেন লম্বা। উইথ বল খুবই স্পিডি ছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে খেলাটাকে থামিয়ে দিয়ে চাতুর্যের সঙ্গে বল নিয়ে ঢুকে পড়তেন। বলে যখন হিট করতেন- নেটলাইন ছিঁড়ে ফেলতেন। লেফট বা রাইট ইনে বশীর আহমেদ ছিলেন ড্রিবল মাস্টার। যতক্ষণ খুশী বল রাখতে পারতেন। ফলস ডজ ছিল সুন্দর। লেফট বা রাইট ইন প্রতাপ শংকর হাজরা ফুটবলের স্টাইলে খেলতেন। খেলা থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ দৌড় দিতেন। বল নষ্ট করতেন না। প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে পারতেন। লেফট আউট আশেকউল্লাহ কায়েশ সাংঘাতিক স্পিডি। বল কন্ট্রোল, ড্রিবলে ভালো ছিলেন। পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নিতে পারতেন। ফুলব্যাক মমতাজকে তার অ্যাটিচুডের কারণে প্রতিপক্ষরা ভয় পেতেন। তিনি ছিলেন পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিস্ট। সেন্টার ফরোয়ার্ড আবদুল মজিদ ছিলেন স্টাইলিশ খেলোয়াড়। তবে খুব সফট খেলোয়াড় ছিলেন। ডজ দিয়ে বল নিয়ে পাস দিয়ে দিতেন। কোনো ঝামেলায় যেতে চাইতেন না। এছাড়া গোলরক্ষক জাম্মু ও রাইট ইন সাইড এহতেশাম সুলতান ভালো খেলোয়াড় ছিলেন।’
বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে গোলকিপার বাপ্পী, জাহিদ, ফুলব্যাক মামুন, ইশা, নাকিব, খোকন, রাজীব, ইয়ামীন, বিল্লু, মিডফিল্ডার রাজন, টিটু, হাসান, মুসা, ফরোয়ার্ড জিমি, কামাল, সিনিয়র প্রিন্স ও হাবুলের খেলা তার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
তার প্রিয় খেলোয়াড় হলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক ফুলব্যাক তানভীর দার। তানভীরের খেলা এখনও তার চোখে লেগে আছে : ‘পাকিস্তান জাতীয় দলের ক্যাম্পে তানভীর দারের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। তবে শুরুটা ছিল তিক্ত। অনুশীলনের সময় ও আমার হাঁটুতে মারতো। বাধ্য হয়ে কোচ নবীকেলাতকে জানাই। তাতেও কোনো কাজ না হওয়ার একদিন সুযোগ বুঝে আমিও মারি। বল তার মুখে লেগে কেটে যায়। তা দেখে আমার সঙ্গে হাত মেলান সাইদ আনোয়ার ও আসাদ মালিক। এরপর থেকে তানভীর দার আর আমাকে ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। বরং ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। খেলোয়াড় হিসেবে তার কোনো তুলনা হয় না। ফুলব্যাক পজিশনে খেলতেন। পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিষ্ট। খুবই নিখুঁত ছিলেন। যেখানে বল মারতে চাইতেন, সেখানেই মারতে পারতেন। পেনাল্টি কর্নারে একটি বল পেলে তা থেকেই গোল করতেন। অসম্ভব পাওয়ারফুল হিট ছিল।’
আবদুর রাজ্জাক ৩ মেয়ে ও ২ ছেলের জনক। ছেলে রাসেল মাহমুদ জিমিকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘আমিও যেমন সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলেছি, আমার ছেলেও টপ সেন্টার ফরোয়ার্ড। নিরপেক্ষভাবেই বলতে পারি, আমার চেয়ে জিমি অনেক ভালো খেলোয়াড়। আমি বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে কোনো কিছু না ভেবেই মেরে দিতাম। তাতে অনেক সময় গোলের সুযোগ নষ্ট হতো। আর জিমি ডি-বক্সে ঢুকে ত্বরিত চিন্তা করে, গোল হবে কি হবে না। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর বল মারে। যদি দেখে গোল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন অন্যকে দিয়ে গোল করায়। নিজে গোল করতে পারলো কি পারলো না, সেটা বিবেচনা না করে দলের গোল পাওয়াটাও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া জিমি চোখের পলকে উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে এমন সব গোল করে, তাতে রীতিমত বিস্মিত হতে হয়। জিমিকে তৈরি করার কৃতিত্ব বিকেএসপির কোচ নুরুল ইসলামের।’
ছেলে জিমি ছাড়াও তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে হকি খেলোয়াড় হিসেবে উঠে এসেছেন ভাতিজা জাভেদ, ভাইগ্না পিরু, খোকন।
হকির পাশাপাশি ফুটবলেও আবদুর রাজ্জাক নৈপুণ্য দেখান। প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে তিনি তৎকালীন শক্তিশালী দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের হয়ে ১৯৬৩ সালে, ১৯৬৪ সাল থেকে পুনরায় ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলেন। ফুটবলেও তিনি ছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড। তবে হকি তার বুকের গভীরে ঢুকে যাওয়ায় ফুটবলটাকে খুব বেশি সিরিয়াসলি নেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে তদানীন্তন সেরা ফুটবলার তোরাব আলী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে পেতেন ১২ হাজার টাকা। একই কাবে হকির জন্য সেবার আমি পেয়েছিলাম ৫ হাজার টাকা। নেহাত খারাপ নয়। এ কারণে হকিটাই আমার কাছে হয়ে ওঠে টপ ফেবারিট।’
আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া দূর শৈশবে সেই যে হকির প্রেমে পড়েন- আজ অব্দি তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। নিজে খেলেছেন, কোচ হয়েছেন, ছেলে দাপটে খেলছে। সেটাই প্রধান বিবেচ্য নয়। হকিটা তার প্যাসন। আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালোবাসা। যেখানেই হকি, সেখানেই তিনি। এ কারণে তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। হকি অন্তঃপ্রাণ এমন ব্যক্তি আছেন বলেই এখনো হকিকে নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়। #
১-৫-২০০৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন