ম্যারাথনবিদ রতন/ দুলাল মাহমুদ
যারা ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটতে পারেন কিংবা দৌড়াতে পারেন, তারা অন্যদের তুলনায় একটু যেন আলাদা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হলে প্রয়োজন হয় অপরিসীম ধৈর্য, মনোবল, সাহস ও স্ট্যামিনার। সাধারণের তুলনায় হতে হয় অনেক বেশি কষ্টসহিষ্ণু। তাদের মধ্যে কাজ করে হার না মানা অনমনীয় এক লড়াকু মনোভাব। সবাই এটা পারেন না। এ কারণে অ্যাথলেটিকসের অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মর্যাদাকর ইভেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে ম্যারাথন। এ দৌড়ের আয়োজনও করা হয় বেশ ঘটা করে। শুধু ম্যারাথন আয়োজনের জন্য সুপরিচিত পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর। যারা ম্যারাথনে জয়ী হন, তাদের দেখা হয় শ্রদ্ধা ও সমীহর চোখে। আমাদের দেশে ম্যারাথন দৌড় ও ম্যারাথন দৌড়বিদ খুব একটা দেখা যায় না। জাতীয় অ্যাথলেটিকসের অংশ হিসেবেই কোনোক্রমে টিকে আছে ম্যারাথন। অথচ ম্যারাথনবিদ মানে যেন জীবনের জয়গানকে সমুন্নত রাখা, অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা। আর এই অসম্ভবের পথে ছুটে চলাদের একজন হলেন এ কে এম জহুরুল হক রতন। সেই দুরন্ত কৈশোরেই তার অবিরাম ছুটে চলার নেশা। আর এই নেশাটা ধরিয়ে দেন তার বড় ভাই রেজাউল হক বাচ্চু। বাচ্চুও ম্যারাথনবিদ হিসেবে ছিলেন সুখ্যাত। ভাইয়ের দেখাদেখি সেই ষাট দশকে ছোট্ট এই ঢাকা শহরের সংকীর্ণ রাজপথ স্পন্দিত হয়েছে তার পায়ের ছন্দিত তালে। দিনের পর দিন কত পথ যে পাড়ি দিয়েছেন, কত ঘাম ঝরিয়েছেন, তা নিজেও জানেন না। ম্যারাথন দৌড়ের প্রতি তার এই অপরিসীম নিষ্ঠা, সাধনা ও ভালোবাসা একদম বৃথা যায়নি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।
জহুরুল হক রতনের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। তবে তার জন্ম ঢাকার আজিমপুরে। ১৯৫২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। দেশভাগের পর একটু একটু করে বাড়তে থাকা ঢাকা শহরের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল আজিমপুর। সে সময় খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে আজিমপুর এবং সংলগ্ন এলাকা। মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানরা পড়ালেখার পাশাপাশি মশগুল থাকতেন খেলাধুলার চর্চায়। এ কারণে জাতীয় পর্যায়ের খেলাধুলায় বেশ দীর্ঘ একটা সময় ছিল এ এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রাধান্য। তাদের একজন রতন। সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে নস্টালজিক হয়ে ওঠেন তিনি : ‘কী যে ছিল সেই দিনগুলো। আজিমপুরে তখন অসংখ্য মাঠ। প্রতিটি মাঠই ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। কি ছেলে, কি মেয়ে সবার মধ্যে ছিল প্রাণের উচ্ছ্বাস। লেখাপড়ায় যেমন ছিল দুর্দান্ত, তেমনি খেলাধুলায়। পরিবেশটাই ছিল অসাধারণ। অন্যসব বদভ্যাস বাদ দিলেও আড্ডাবাজি পর্যন্ত ছিল না। সবার চোখে-মুখে থাকতো সুস্থ ও সুন্দর জীবনের হাতছানি। আর এই জীবনবোধ গড়ে উঠতো খেলার মাঠে কিংবা সাংস্কৃতিক বা সৃজনশীল কোনো কর্মকান্ডে। আমরা যারা খেলাধুলায় মেতে থাকতাম, তারা সিজনাল খেলা খেলতাম। তবে বেশিরভাগ ছেলেদের পক্ষপাত ছিল ক্রিকেট ও ফুটবলে। দুটি ক্লাব ছিল রেইনবো এবং স্টার ক্লাব। আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টার মাঠে আয়োজিত হতো অনেক টুর্নামেন্ট। আমাদের সমসাময়িক খেলোয়াড় ছিলেন ক্রিকেটার সাজু, জালাল, সালাম, মেকাইল, মুকুল প্রমুখ। তবে আজিমপুরের সেই পরিবেশ এখন আর নেই। মাঠও যেমন কমেছে, তেমনিভাবে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহও অনেক হ্রাস পেয়েছে।’
আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে পড়ার সময় রতন অ্যাথলেট হিসেবে সুনাম কুড়ান। সে সময় ৮০০ ও ১৫০০ মিটার দৌড়ে তিনি নিয়মিতভাবে প্রথম হতেন। স্কুলের শেষ ধাপে এসে ম্যারাথনে ঝুঁকে পড়েন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৬ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ক্যান্ডিডেট। সে বছর আমাকে বড় ভাই বাচ্চু নিয়ে যান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। আমি সিদ্ধান্ত নেই ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেব। কিন্তু মোহামেডানের এককালের খ্যাতিমান ফুটবলার গজনবী আমাকে ম্যারাথন দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তখন দেশসেরা ম্যারাথনবিদ ছিলেন অগ্রজ বাচ্চু ভাই। তিনি ছিলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের অ্যাথলেট। আমাদের দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র একই। যাই হোক, আমাদের দুই ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখার জন্য সবার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। আমি বাচ্চু ভাইকে হারিয়ে প্রথম হই। এরপরে ম্যারাথনে অংশ নেয়া ছেড়ে দেন বাচ্চু ভাই। সকালে ম্যারাথনে অংশ নিয়ে বিকেলে অংশ নেই ১০ হাজার মিটার দৌড়ে। তাতে দ্বিতীয় হই। প্রথম হন জেমস জয় মল্লিক কিংবা কাজী আলমগীর। এই কৃতিত্ব দেখানোর পর একদিন আমার এক বন্ধু জানান, আমি নাকি রাওয়ালপিন্ডির পাকিস্তান অলিম্পিকে সুযোগ পেয়েছি। অবজারভার পত্রিকায় এই নিউজ দেয়া হয়েছে। এটা শুনে আমি দারুণভাবে পুলকিত হই। আমার জন্য এটা ছিল বিশাল কিছু। আমি তখনও স্কুলের গন্ডি পার হইনি। সেবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে অ্যাথলেটদের মধ্যে গিয়েছিলেন যত দূর মনে পড়ে জাহাঙ্গীর ফয়েজ, আলতাফ হোসেন, কাজী আলমগীর, মিরাজ, আরজান খান প্রমুখ। এই দলে আমি ছিলাম সবচেয়ে জুনিয়র। রাওয়ালপিন্ডিতে আমি অবশ্য সুবিধা করতে পারিনি। পারার কথাও নয়। ম্যারাথনে পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাথলেটদের দাপট। তারা তখন ম্যারাথনে এশিয়ান মেডেল হোল্ডার। তবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছিলাম।’
১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান মিটে ম্যারাথনেও রতন প্রথম গৌরব অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অ্যাথলেটিকস মিট না হওয়ায় অধরা রয়ে যায় তার টানা জয়ের সাফল্য। ১৯৭০ সালেও তিনি যথারীতি প্রথম হন। সময় নেন ২ ঘন্টা ৪৮ মিনিট। সুযোগ পান করাচীতে পাকিস্তান অলিম্পিকে অংশ নেয়ার। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আয়োজিত হতে পারেনি অ্যাথলেটিকস মিট। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নিয়ে তিনি প্রথম হন। সময় নেন ২ ঘন্টা ১১ মিনিট ২ সেকেন্ড। ১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বাংলাদেশ ক্রীড়া দল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি গেমসে অংশ নেয় ৯ সদস্যে প্রতিনিধি দল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে তিনি সুযোগ পান। সে দলে আরো ছিলেন শরীফ হোসেন, কাজী আলমগীর, খোকন, নাসির প্রমুখ। এরপর ইনজুরির কারণে তিনি অ্যাথলেটিকস থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অবসর নেয়ার পর আর কোনো সিভিলিয়ান ম্যারাথনে প্রথম হতে পারেননি। জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় দূরপাল্লার বিভিন্ন দৌড়ে অংশ নিয়ে সাফল্য পেলেও জাতীয় পর্যায়ে অংশ না নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় ম্যারাথন প্রথমে হতো। ম্যারাথনে দৌড়ানোর পর শরীরের যে অ্যানার্জি লস হতো, তা সহসা পূরণ করা যেত না। শরীরে একদমই কুলাতো না। তাছাড়া আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ন্যাচারাল যা ছিল, তাই নিয়ে দৌড়াতাম। রাস্তায় অনুশীলন করতাম। গড়ে প্রতিদিন ১৮ মাইল দৌড়াতাম। আমাদের কোনো কোচ ছিল না। কাজী আবদুল আলীম, এস এ জামান মুক্তাদের মতো সিনিয়র অ্যাথলেটরা বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। তারা তো ম্যারাথনবিদ ছিলেন না। এ সম্পর্কে কতটুকুই বা জানতেন। আমাদের প্রপার কোনো গাইডেন্স ছিল না। আসলে দৌড়াতাম গায়ের জোরে। বডি অ্যাঙ্গেল, থাই পরিচর্যা, ওয়েট ট্রেনিং সম্পর্কে সম্যক কোনো জ্ঞান ছিল না। ডায়েট সম্পর্কেও কোনো ধারণাই ছিল না। মাংস-দুধ আচ্ছামত খেতাম। পরবর্তীতে জানতে পেরেছি এর কুফল। দৌড়ানোর পর পানি খেতাম না। অথচ পানি খেলে শরীরে অক্সিজেন চলাচলে সহজ হয়। স্যালাইন ওয়াটারের বালাই ছিল না। এখনকার মতো বিজ্ঞানসম্মত সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা ফাটাফাটি কিছু করতে পারতাম।’ ম্যারাথনে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন আলফাজ, রহিম, মন্টু প্রমুখ।
রতন বলেন, ‘আমাদের সময় অ্যাথলেটরা কাবের হয়ে অংশ নিতেন। শীর্ষ কাবগুলোর মধ্যে ছিল আজাদ স্পোর্টিং, মোহামেডান স্পোর্টিং, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবগুলোর বাইরে ব্যতিক্রম ছিল ইপিআইডিসি। আমি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অংশ নেই মোহামেডানের হয়ে। মোহামেডান তখন চ্যাম্পিয়ন হতো। কিন্তু আমাদের কোনো প্রাপ্তি ছিল না। হয়তো বাটার দিয়ে দুই স্লাইস পাউরুটি দিত। তাই পেয়ে আমরা খুশীতে বাগবাগ থাকতাম।’ স্বাধীনতার পর দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর জন্য এগিয়ে আসে বিটিএমসি, বিজেএমসির মতো প্রতিষ্ঠান। তাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সংস্থাগুলো ছিল দেশের অ্যাথলেটিকসের জিয়নকাঠি। কত অ্যাথলেটের প্রতি তারা বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। আমি নিজেও ১৯৭৩ সালে অ্যাথলেট হিসেবে যোগ দেই বিটিএমসিতে। চাকরির সুবাদে কোচ হিসেবে অ্যাথলেটিকসে জড়িয়ে ছিলাম। ১৯৯৪ সালে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়ে চাকরি ছেড়ে আসি। আসলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সংকুচিত হয়ে আসছে, তেমনিভাবে অ্যাথলেটদের পৃষ্ঠপোষকতার দুয়ারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে অ্যাথলেটিকস হারিয়ে ফেলছে তার কৌলীন্য।’ অ্যাথলেটিকসের বর্তমান দুর্দশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে নিয়মিতভাবে ইন্টার স্কুল, ইন্টার কলেজ, ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট, ইন্টার ডিভিশন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হতো। এর ফলে ক্রীড়াঙ্গন থাকতো জমজমাট। উঠে আসতেন নতুন নতুন অ্যাথলেট। এসবের পেছনে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের খান মজলিশ সাহেব ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। তিনি খেলাধুলা আয়োজনের ব্যাপারে ছিলেন খুবই সক্রিয় ও আন্তরিক। তার মতো ক্রীড়াব্যক্তিত্ব নেই বলে এখন আগের মতো সরকারি পর্যায়ে ক্রীড়াচর্চা হয় না। মাঠও নেই। স্কুল-কলেজে খেলাধুলা না থাকলে অ্যাথলেট আসবে কোথা থেকে? অ্যাথলেট তৈরির কারখানা স্কুল। সেখানে খেলাধুলা হয় না বললেই চলে। ক্রিকেটে যেভাবে টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি, সে তুলনায় উন্নতি নেই। অ্যাথলেটিকস ও ফুটবলে প্যাট্রোনাইজ করা হলে এশিয়া লেবেলের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। অ্যাথলেটিকসে তো স্পন্সর পাওয়া যায় না। একজন অ্যাথলেট যদি এক বছর অনুশীলন করে, তাহলে তার পরিবারের ক্ষতি। আয়ের কোনো সুযোগ নেই। বরং পরিবারের ওপর চাপ পড়ে। অথচ ক্রিকেটে পাওয়া যায় নগদ নগদ। আমাদের সময় মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা খেলার মাঠে আসতেন। আগে স্কুল-কলেজে পড়ালেখার কেয়ার নেয়া হতো। এখন সেটা নেয়া হয় না। তাছাড়াও পড়ালেখাও টাফ হয়ে গেছে। যে কারণে খেলাধুলার মাঠে সময় দেয়াটা বর্তমানে অভিভাবকরা মনে করেন সময়ের অপচয়। এটা বোধ করি ঠিক নয়। সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হলে খেলাধুলাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ক্রীড়াচর্চা ও সৃজনশীল তৎপরতা না থাকায় সমাজে গড়ে উঠেছে নানা বদঅভ্যাস। দেখা দিয়েছে মূল্যবোধের সংকট। আসলে আমি অন্যদের কী বলবো? আমরা স্বামী-স্ত্রী ক্রীড়াবিদ হয়েও নিজের সন্তানদের খেলার মাঠে আকৃষ্ট করতে পারিনি। আসলে আমরা বর্তমান সময়ের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি।’
চুটিয়ে প্রেম করে রতন ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম দ্রুততম মানবী শামীম আরা টলির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কাকতালীয় হলো, বড় ভাই বাচ্চুর অনুপ্রেরণায় রতন ম্যারাথনে আকৃষ্ট হন, তেমনিভাবে তার স্ত্রী টলিও তার বড় বোন কোয়েলের উৎসাহে স্বল্পপাল্লার দৌড়ে খ্যাতি অর্জন করেন। এই দম্পতির এক কন্যা ও এক পুত্র। মেয়ে শায়লা পারভীন ডালিয়া ইংরেজির শিক্ষিকা। ছেলে মঞ্জুরুল হক পলাশ সিএ পড়ছে।
অ্যাথলেটিকসে স্মরণীয় ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৭৩ সালে ঢাকায় বসে জাতীয় অ্যাথলেটিকস মিট। ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয় ম্যারাথন। ডেমরা রোড দিয়ে দৌড়ানোর সময় জগন্নাথ কলেজের ফিজিক্যাল ডিরেক্টর ও ম্যারাথনের বিচারক নূর হোসেন আমার দৌড়ের প্রশংসা করেন। ফেরার পথে ডেমরা আসার পর আমার ডান পা চলছিল না। আমি দৌড় থামিয়ে দেয়ার কথা বললে নূর হোসেন স্যার বলেন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা অ্যাথলেট তোমার চেয়ে প্রায় ৭ মাইল দূরে আছে। তুমি যদি হেঁটেও যাও, তাহলেও প্রথম হবে। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে দৌড় অব্যাহত রাখি এবং প্রথম হই। এরপর চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি পরীক্ষা করে জানান, আমার হার্নিয়া হয়েছে। আরো দেরি করলে বার্স্ট হয়ে মারা যেতে পারতাম। সেটাই ছিল আমার ক্যারিয়ারের শেষ জাতীয় অ্যাথলেটিকস। এরপর আর দৌড়ানো সম্ভব হয়নি। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৬৬ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে ম্যারাথন হয় হিলি রোডে। পাহাড়ি অঞ্চলে আমি দৌড়াতে অভ্যস্ত ছিলাম না। ২১ মাইলের মাথায় একটি পাহাড়ে উঠতে গিয়ে আমার মাসলপুল করে। আমি পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে যাই।’
অ্যাথলেটিকস ছাড়াও ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতেন রতন। ফুটবলে দ্বিতীয় বিভাগ লীগে তেজগাঁও ফ্রেন্ডসের হয়ে খেলতেন। তার সমসাময়িক ফুটবলার ছিলেন নান্নু, মঞ্জু, সুলতান, সালে, আমিন, সামাদ প্রমুখ। ফুটবলে খেলতেন গোলকিপার পজিশনে। বলের ক্রমাগত আঘাত তার সহ্য হয়নি। তাছাড়া ফুটবল খেলায় প্রায়শই মারামারি হতো। তার কাছে মনে হয়েছে, এটি গোঁয়ারের খেলা। ক্রিকেটে খেলতেন টাউন ক্লাবের হয়ে। এই ক্লাবের ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন মাজহারুল ইসলাম তান্না, সৈয়দ আশরাফুল হক, টুনু, মেকাইল, সাজু, জালাল প্রমুখ। ক্রিকেটে তিনি ছিলেন উইকেটকিপার এবং ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতেন। ক্রিকেট ছাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিআইটির পাশের মাঠে খেলা হতো ক্রিকেট ও হকি। ক্রিকেট খেলা হতো ম্যাটে। একদিন ব্যাট করতে নেমেছি। তখন তো ব্যাটসম্যানদের জন্য এখনকার মতো সুরক্ষা ছিল না। আমাকে বল করেন নারায়ণগঞ্জের রেমন্ড। তিনি ছিলেন পেস বোলার। তার একটি বল খেলতে গিয়ে আমার গার্ডে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যাই। সেই যে মনে ভয় ঢুকে যায়, এরপর আর ক্রিকেট খেলতে সাহস পাইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে অ্যাথলেটিকস ভালো। মারামারি নেই, নেই আঘাত পাওয়া। তাই অ্যাথলেটিকস হয়ে ওঠে আমার প্রিয় খেলা।’
সমসাময়িক অ্যাথলেটদের মধ্যে তার ভালো লাগতো স্প্রিন্টার সিরাজ, দূরপাল্লার কাজী আলমগীর, পোলভল্টার মিরাজ, ৪০০ মিটারে শাহেদ আলী, ৪০০ মিটার ও লো হার্ডলসে দেলু, ১১০ মিটার হাই হার্ডলসে জাহাঙ্গীর ফয়েজ, লংজাম্প ও হফ-স্টেপ জাম্পে আলতাফ হোসেনকে। মেয়েদের মধ্যে হাইজাম্পার ইসরাত, লংজাম্পে হাসরাত, লংজাম্প ও হার্ডলসে সুলতানা, ১০০ মিটারে গুল-এ-আফজা, ১০০ ও ২০০ মিটারে সুফিয়া খাতুন।
জাতীয় পর্যায়ে অ্যাথলেটিকসের কোনো আসর বসলে ডাক পেলে ছুটে আসেন রতন। সেক্ষেত্রে ম্যারাথনের চিফ জাজ হওয়াটা তার জন্য একরকম বাধ্যতামূলক। বর্তমানকালের অ্যাথলেটদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় এক বুক দুঃখ নিয়ে বললেন, ‘অ্যাথলেটিকস থেকে সিভিলিয়ানরা ক্রমশ অপসৃত হয়ে যাচ্ছেন। দূরপাল্লার দৌড়ে তাদের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর ম্যারাথন! আর কোনোদিন সিভিলিয়ানরা সাফল্য দেখাতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।’ এমন আশঙ্কা যদি সত্যি হয়, তাহলে এ কে এম জহুরুল হক রতন হয়ে থাকবেন দেশের শেষ সিভিলিয়ান ম্যারাথন বিজয়ী। #
১৬-৫-২০০৮
জহুরুল হক রতনের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। তবে তার জন্ম ঢাকার আজিমপুরে। ১৯৫২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। দেশভাগের পর একটু একটু করে বাড়তে থাকা ঢাকা শহরের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল আজিমপুর। সে সময় খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে আজিমপুর এবং সংলগ্ন এলাকা। মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানরা পড়ালেখার পাশাপাশি মশগুল থাকতেন খেলাধুলার চর্চায়। এ কারণে জাতীয় পর্যায়ের খেলাধুলায় বেশ দীর্ঘ একটা সময় ছিল এ এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রাধান্য। তাদের একজন রতন। সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে নস্টালজিক হয়ে ওঠেন তিনি : ‘কী যে ছিল সেই দিনগুলো। আজিমপুরে তখন অসংখ্য মাঠ। প্রতিটি মাঠই ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। কি ছেলে, কি মেয়ে সবার মধ্যে ছিল প্রাণের উচ্ছ্বাস। লেখাপড়ায় যেমন ছিল দুর্দান্ত, তেমনি খেলাধুলায়। পরিবেশটাই ছিল অসাধারণ। অন্যসব বদভ্যাস বাদ দিলেও আড্ডাবাজি পর্যন্ত ছিল না। সবার চোখে-মুখে থাকতো সুস্থ ও সুন্দর জীবনের হাতছানি। আর এই জীবনবোধ গড়ে উঠতো খেলার মাঠে কিংবা সাংস্কৃতিক বা সৃজনশীল কোনো কর্মকান্ডে। আমরা যারা খেলাধুলায় মেতে থাকতাম, তারা সিজনাল খেলা খেলতাম। তবে বেশিরভাগ ছেলেদের পক্ষপাত ছিল ক্রিকেট ও ফুটবলে। দুটি ক্লাব ছিল রেইনবো এবং স্টার ক্লাব। আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টার মাঠে আয়োজিত হতো অনেক টুর্নামেন্ট। আমাদের সমসাময়িক খেলোয়াড় ছিলেন ক্রিকেটার সাজু, জালাল, সালাম, মেকাইল, মুকুল প্রমুখ। তবে আজিমপুরের সেই পরিবেশ এখন আর নেই। মাঠও যেমন কমেছে, তেমনিভাবে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহও অনেক হ্রাস পেয়েছে।’
আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে পড়ার সময় রতন অ্যাথলেট হিসেবে সুনাম কুড়ান। সে সময় ৮০০ ও ১৫০০ মিটার দৌড়ে তিনি নিয়মিতভাবে প্রথম হতেন। স্কুলের শেষ ধাপে এসে ম্যারাথনে ঝুঁকে পড়েন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৬ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ক্যান্ডিডেট। সে বছর আমাকে বড় ভাই বাচ্চু নিয়ে যান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। আমি সিদ্ধান্ত নেই ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেব। কিন্তু মোহামেডানের এককালের খ্যাতিমান ফুটবলার গজনবী আমাকে ম্যারাথন দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তখন দেশসেরা ম্যারাথনবিদ ছিলেন অগ্রজ বাচ্চু ভাই। তিনি ছিলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের অ্যাথলেট। আমাদের দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র একই। যাই হোক, আমাদের দুই ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখার জন্য সবার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। আমি বাচ্চু ভাইকে হারিয়ে প্রথম হই। এরপরে ম্যারাথনে অংশ নেয়া ছেড়ে দেন বাচ্চু ভাই। সকালে ম্যারাথনে অংশ নিয়ে বিকেলে অংশ নেই ১০ হাজার মিটার দৌড়ে। তাতে দ্বিতীয় হই। প্রথম হন জেমস জয় মল্লিক কিংবা কাজী আলমগীর। এই কৃতিত্ব দেখানোর পর একদিন আমার এক বন্ধু জানান, আমি নাকি রাওয়ালপিন্ডির পাকিস্তান অলিম্পিকে সুযোগ পেয়েছি। অবজারভার পত্রিকায় এই নিউজ দেয়া হয়েছে। এটা শুনে আমি দারুণভাবে পুলকিত হই। আমার জন্য এটা ছিল বিশাল কিছু। আমি তখনও স্কুলের গন্ডি পার হইনি। সেবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে অ্যাথলেটদের মধ্যে গিয়েছিলেন যত দূর মনে পড়ে জাহাঙ্গীর ফয়েজ, আলতাফ হোসেন, কাজী আলমগীর, মিরাজ, আরজান খান প্রমুখ। এই দলে আমি ছিলাম সবচেয়ে জুনিয়র। রাওয়ালপিন্ডিতে আমি অবশ্য সুবিধা করতে পারিনি। পারার কথাও নয়। ম্যারাথনে পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাথলেটদের দাপট। তারা তখন ম্যারাথনে এশিয়ান মেডেল হোল্ডার। তবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছিলাম।’
১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান মিটে ম্যারাথনেও রতন প্রথম গৌরব অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অ্যাথলেটিকস মিট না হওয়ায় অধরা রয়ে যায় তার টানা জয়ের সাফল্য। ১৯৭০ সালেও তিনি যথারীতি প্রথম হন। সময় নেন ২ ঘন্টা ৪৮ মিনিট। সুযোগ পান করাচীতে পাকিস্তান অলিম্পিকে অংশ নেয়ার। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আয়োজিত হতে পারেনি অ্যাথলেটিকস মিট। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নিয়ে তিনি প্রথম হন। সময় নেন ২ ঘন্টা ১১ মিনিট ২ সেকেন্ড। ১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বাংলাদেশ ক্রীড়া দল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি গেমসে অংশ নেয় ৯ সদস্যে প্রতিনিধি দল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে তিনি সুযোগ পান। সে দলে আরো ছিলেন শরীফ হোসেন, কাজী আলমগীর, খোকন, নাসির প্রমুখ। এরপর ইনজুরির কারণে তিনি অ্যাথলেটিকস থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অবসর নেয়ার পর আর কোনো সিভিলিয়ান ম্যারাথনে প্রথম হতে পারেননি। জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় দূরপাল্লার বিভিন্ন দৌড়ে অংশ নিয়ে সাফল্য পেলেও জাতীয় পর্যায়ে অংশ না নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় ম্যারাথন প্রথমে হতো। ম্যারাথনে দৌড়ানোর পর শরীরের যে অ্যানার্জি লস হতো, তা সহসা পূরণ করা যেত না। শরীরে একদমই কুলাতো না। তাছাড়া আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ন্যাচারাল যা ছিল, তাই নিয়ে দৌড়াতাম। রাস্তায় অনুশীলন করতাম। গড়ে প্রতিদিন ১৮ মাইল দৌড়াতাম। আমাদের কোনো কোচ ছিল না। কাজী আবদুল আলীম, এস এ জামান মুক্তাদের মতো সিনিয়র অ্যাথলেটরা বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। তারা তো ম্যারাথনবিদ ছিলেন না। এ সম্পর্কে কতটুকুই বা জানতেন। আমাদের প্রপার কোনো গাইডেন্স ছিল না। আসলে দৌড়াতাম গায়ের জোরে। বডি অ্যাঙ্গেল, থাই পরিচর্যা, ওয়েট ট্রেনিং সম্পর্কে সম্যক কোনো জ্ঞান ছিল না। ডায়েট সম্পর্কেও কোনো ধারণাই ছিল না। মাংস-দুধ আচ্ছামত খেতাম। পরবর্তীতে জানতে পেরেছি এর কুফল। দৌড়ানোর পর পানি খেতাম না। অথচ পানি খেলে শরীরে অক্সিজেন চলাচলে সহজ হয়। স্যালাইন ওয়াটারের বালাই ছিল না। এখনকার মতো বিজ্ঞানসম্মত সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা ফাটাফাটি কিছু করতে পারতাম।’ ম্যারাথনে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন আলফাজ, রহিম, মন্টু প্রমুখ।
রতন বলেন, ‘আমাদের সময় অ্যাথলেটরা কাবের হয়ে অংশ নিতেন। শীর্ষ কাবগুলোর মধ্যে ছিল আজাদ স্পোর্টিং, মোহামেডান স্পোর্টিং, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবগুলোর বাইরে ব্যতিক্রম ছিল ইপিআইডিসি। আমি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অংশ নেই মোহামেডানের হয়ে। মোহামেডান তখন চ্যাম্পিয়ন হতো। কিন্তু আমাদের কোনো প্রাপ্তি ছিল না। হয়তো বাটার দিয়ে দুই স্লাইস পাউরুটি দিত। তাই পেয়ে আমরা খুশীতে বাগবাগ থাকতাম।’ স্বাধীনতার পর দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর জন্য এগিয়ে আসে বিটিএমসি, বিজেএমসির মতো প্রতিষ্ঠান। তাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সংস্থাগুলো ছিল দেশের অ্যাথলেটিকসের জিয়নকাঠি। কত অ্যাথলেটের প্রতি তারা বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। আমি নিজেও ১৯৭৩ সালে অ্যাথলেট হিসেবে যোগ দেই বিটিএমসিতে। চাকরির সুবাদে কোচ হিসেবে অ্যাথলেটিকসে জড়িয়ে ছিলাম। ১৯৯৪ সালে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়ে চাকরি ছেড়ে আসি। আসলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সংকুচিত হয়ে আসছে, তেমনিভাবে অ্যাথলেটদের পৃষ্ঠপোষকতার দুয়ারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে অ্যাথলেটিকস হারিয়ে ফেলছে তার কৌলীন্য।’ অ্যাথলেটিকসের বর্তমান দুর্দশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে নিয়মিতভাবে ইন্টার স্কুল, ইন্টার কলেজ, ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট, ইন্টার ডিভিশন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হতো। এর ফলে ক্রীড়াঙ্গন থাকতো জমজমাট। উঠে আসতেন নতুন নতুন অ্যাথলেট। এসবের পেছনে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের খান মজলিশ সাহেব ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। তিনি খেলাধুলা আয়োজনের ব্যাপারে ছিলেন খুবই সক্রিয় ও আন্তরিক। তার মতো ক্রীড়াব্যক্তিত্ব নেই বলে এখন আগের মতো সরকারি পর্যায়ে ক্রীড়াচর্চা হয় না। মাঠও নেই। স্কুল-কলেজে খেলাধুলা না থাকলে অ্যাথলেট আসবে কোথা থেকে? অ্যাথলেট তৈরির কারখানা স্কুল। সেখানে খেলাধুলা হয় না বললেই চলে। ক্রিকেটে যেভাবে টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি, সে তুলনায় উন্নতি নেই। অ্যাথলেটিকস ও ফুটবলে প্যাট্রোনাইজ করা হলে এশিয়া লেবেলের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। অ্যাথলেটিকসে তো স্পন্সর পাওয়া যায় না। একজন অ্যাথলেট যদি এক বছর অনুশীলন করে, তাহলে তার পরিবারের ক্ষতি। আয়ের কোনো সুযোগ নেই। বরং পরিবারের ওপর চাপ পড়ে। অথচ ক্রিকেটে পাওয়া যায় নগদ নগদ। আমাদের সময় মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা খেলার মাঠে আসতেন। আগে স্কুল-কলেজে পড়ালেখার কেয়ার নেয়া হতো। এখন সেটা নেয়া হয় না। তাছাড়াও পড়ালেখাও টাফ হয়ে গেছে। যে কারণে খেলাধুলার মাঠে সময় দেয়াটা বর্তমানে অভিভাবকরা মনে করেন সময়ের অপচয়। এটা বোধ করি ঠিক নয়। সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হলে খেলাধুলাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ক্রীড়াচর্চা ও সৃজনশীল তৎপরতা না থাকায় সমাজে গড়ে উঠেছে নানা বদঅভ্যাস। দেখা দিয়েছে মূল্যবোধের সংকট। আসলে আমি অন্যদের কী বলবো? আমরা স্বামী-স্ত্রী ক্রীড়াবিদ হয়েও নিজের সন্তানদের খেলার মাঠে আকৃষ্ট করতে পারিনি। আসলে আমরা বর্তমান সময়ের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি।’
চুটিয়ে প্রেম করে রতন ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম দ্রুততম মানবী শামীম আরা টলির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কাকতালীয় হলো, বড় ভাই বাচ্চুর অনুপ্রেরণায় রতন ম্যারাথনে আকৃষ্ট হন, তেমনিভাবে তার স্ত্রী টলিও তার বড় বোন কোয়েলের উৎসাহে স্বল্পপাল্লার দৌড়ে খ্যাতি অর্জন করেন। এই দম্পতির এক কন্যা ও এক পুত্র। মেয়ে শায়লা পারভীন ডালিয়া ইংরেজির শিক্ষিকা। ছেলে মঞ্জুরুল হক পলাশ সিএ পড়ছে।
অ্যাথলেটিকসে স্মরণীয় ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৭৩ সালে ঢাকায় বসে জাতীয় অ্যাথলেটিকস মিট। ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয় ম্যারাথন। ডেমরা রোড দিয়ে দৌড়ানোর সময় জগন্নাথ কলেজের ফিজিক্যাল ডিরেক্টর ও ম্যারাথনের বিচারক নূর হোসেন আমার দৌড়ের প্রশংসা করেন। ফেরার পথে ডেমরা আসার পর আমার ডান পা চলছিল না। আমি দৌড় থামিয়ে দেয়ার কথা বললে নূর হোসেন স্যার বলেন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা অ্যাথলেট তোমার চেয়ে প্রায় ৭ মাইল দূরে আছে। তুমি যদি হেঁটেও যাও, তাহলেও প্রথম হবে। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে দৌড় অব্যাহত রাখি এবং প্রথম হই। এরপর চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি পরীক্ষা করে জানান, আমার হার্নিয়া হয়েছে। আরো দেরি করলে বার্স্ট হয়ে মারা যেতে পারতাম। সেটাই ছিল আমার ক্যারিয়ারের শেষ জাতীয় অ্যাথলেটিকস। এরপর আর দৌড়ানো সম্ভব হয়নি। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৬৬ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে ম্যারাথন হয় হিলি রোডে। পাহাড়ি অঞ্চলে আমি দৌড়াতে অভ্যস্ত ছিলাম না। ২১ মাইলের মাথায় একটি পাহাড়ে উঠতে গিয়ে আমার মাসলপুল করে। আমি পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে যাই।’
অ্যাথলেটিকস ছাড়াও ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতেন রতন। ফুটবলে দ্বিতীয় বিভাগ লীগে তেজগাঁও ফ্রেন্ডসের হয়ে খেলতেন। তার সমসাময়িক ফুটবলার ছিলেন নান্নু, মঞ্জু, সুলতান, সালে, আমিন, সামাদ প্রমুখ। ফুটবলে খেলতেন গোলকিপার পজিশনে। বলের ক্রমাগত আঘাত তার সহ্য হয়নি। তাছাড়া ফুটবল খেলায় প্রায়শই মারামারি হতো। তার কাছে মনে হয়েছে, এটি গোঁয়ারের খেলা। ক্রিকেটে খেলতেন টাউন ক্লাবের হয়ে। এই ক্লাবের ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন মাজহারুল ইসলাম তান্না, সৈয়দ আশরাফুল হক, টুনু, মেকাইল, সাজু, জালাল প্রমুখ। ক্রিকেটে তিনি ছিলেন উইকেটকিপার এবং ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতেন। ক্রিকেট ছাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিআইটির পাশের মাঠে খেলা হতো ক্রিকেট ও হকি। ক্রিকেট খেলা হতো ম্যাটে। একদিন ব্যাট করতে নেমেছি। তখন তো ব্যাটসম্যানদের জন্য এখনকার মতো সুরক্ষা ছিল না। আমাকে বল করেন নারায়ণগঞ্জের রেমন্ড। তিনি ছিলেন পেস বোলার। তার একটি বল খেলতে গিয়ে আমার গার্ডে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যাই। সেই যে মনে ভয় ঢুকে যায়, এরপর আর ক্রিকেট খেলতে সাহস পাইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে অ্যাথলেটিকস ভালো। মারামারি নেই, নেই আঘাত পাওয়া। তাই অ্যাথলেটিকস হয়ে ওঠে আমার প্রিয় খেলা।’
সমসাময়িক অ্যাথলেটদের মধ্যে তার ভালো লাগতো স্প্রিন্টার সিরাজ, দূরপাল্লার কাজী আলমগীর, পোলভল্টার মিরাজ, ৪০০ মিটারে শাহেদ আলী, ৪০০ মিটার ও লো হার্ডলসে দেলু, ১১০ মিটার হাই হার্ডলসে জাহাঙ্গীর ফয়েজ, লংজাম্প ও হফ-স্টেপ জাম্পে আলতাফ হোসেনকে। মেয়েদের মধ্যে হাইজাম্পার ইসরাত, লংজাম্পে হাসরাত, লংজাম্প ও হার্ডলসে সুলতানা, ১০০ মিটারে গুল-এ-আফজা, ১০০ ও ২০০ মিটারে সুফিয়া খাতুন।
জাতীয় পর্যায়ে অ্যাথলেটিকসের কোনো আসর বসলে ডাক পেলে ছুটে আসেন রতন। সেক্ষেত্রে ম্যারাথনের চিফ জাজ হওয়াটা তার জন্য একরকম বাধ্যতামূলক। বর্তমানকালের অ্যাথলেটদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় এক বুক দুঃখ নিয়ে বললেন, ‘অ্যাথলেটিকস থেকে সিভিলিয়ানরা ক্রমশ অপসৃত হয়ে যাচ্ছেন। দূরপাল্লার দৌড়ে তাদের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর ম্যারাথন! আর কোনোদিন সিভিলিয়ানরা সাফল্য দেখাতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।’ এমন আশঙ্কা যদি সত্যি হয়, তাহলে এ কে এম জহুরুল হক রতন হয়ে থাকবেন দেশের শেষ সিভিলিয়ান ম্যারাথন বিজয়ী। #
১৬-৫-২০০৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন