ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ
১৯৫৮ সাল ছিল এ অঞ্চলের ফুটবলের জন্য একটি মাইলফলক। সনাতন ধারায় চলে আসা পূর্ব বাংলার ফুটবলে লাগে আধুনিকতার ছোঁয়া। আর এ পরিবর্তন আনেন স্কটিশ ফুটবল কোচ জন ম্যাকব্রাইড। তিনি ছিলেন পাকিস্তানে আসা প্রথম কোনো বিদেশী ফুটবল কোচ। তারই কারণে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ৬ জন বাঙালি ফুটবলার সুযোগ পান পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে। ১৯৫৮ সালে টোকিও এশিয়ান গেমসে নবী চৌধুরীর নেতৃত্বে অংশ নেয়া ফুটবলাররা হলেন মারী, আশরাফ, কবীর, মঞ্জুর হাসান মিন্টু ও গজনবী। এ ঘটনা আলোড়িত করে বাঙালি ফুটবলারদের। পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ম্যাকব্রাইডকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসে ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাছাই করা ১৫ থেকে ২০ জন ফুটবলার তার অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলতে না পারলেও এই প্রশিক্ষণে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তারা ছিলেন বেশ দক্ষ ফুটবলার। ফুটবলার হিসেবে তারা আলাদা স্থান করে নেন। তাদের অন্যতম হলেন কাজী মোবাশ্বার হোসেন। জন ম্যাকব্রাইড শুধু বাঙালি ফুটবলারদের নতুন পথের সন্ধান দেননি, একই সঙ্গে খেলার ধারায় এনেছেন পরিবর্তন। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ অঞ্চলে খেলা হতো দুই ব্যাক, তিন হাফ ও পাঁচ ফরোয়ার্ড পদ্ধতিতে। তিনি তার অধীনে প্রশিক্ষণ নেয়া ফুটবলারদের ‘থ্রি ব্যাক সিস্টেমে’ খেলার তালিম দেন। এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রেখে তিনি দীর্ঘদেহী হওয়ার কারণে কাজী মোবাশ্বার হোসেনকে স্টপার হিসেবে গড়ে তোলেন। ফুটবলের নতুন ঘরানায় মোবাশ্বার হলেন প্রথম বাঙালি স্টপার। এরপর থেকে স্টপার হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। ষাট দশকে তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা স্টপার। তার প্রধান সুবিধা ছিল, তিনি ছিলেন ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন। সে সময় বাঙালিদের মধ্যে বটেই, খেলার মাঠে সচরাচর এত লম্বা খেলোয়াড় দেখা যেত না (ব্যতিক্রম ছিলেন নবী চৌধুরী)। এটাই তাকে বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। হেডগুলো সহজেই কভার করতে পারতেন। এয়ারে তাকে হারানো একরকম অসম্ভব জেনে সাধারণত কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেন না। তাকে এড়িয়ে আশপাশ দিয়ে বল নিয়ে যাওয়াও ছিল দুরূহ। ‘থ্রী ব্যাক সিস্টেমে’ ম্যান টু ম্যান খেলা হতো। প্রতিপক্ষের সেন্টার ফরোয়ার্ড যেখানে যেতেন, সেখানেই তিনি কভার করতেন। তাকে ফাঁকি দিয়ে বল নিয়ে ঢোকা সহজ ছিল না। মাঝে-মধ্যে বুটের টো দিয়ে যে ফ্রি-কিক মারতেন, তাতে বল ছুটে যেত গুলির মতো।
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হন কাজী মোবাশ্বার হোসেন। ১৯৩৮ সালের ৩ মার্চ পাবনা জেলার দাড়িয়াপুরে তার জন্ম। বাড়ির পাশেই ছিল ফুটবল মাঠ। এ মাঠই তার চোখে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দেয়। স্মৃতির জানালা খুলে মোবাশ্বার চলে যান সুদূর কৈশোরে : ‘আমাদের গ্রামের মাঠে তখনকার দিনে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ফুটবল খেলা হতো। প্রতি বছর বিভিন্নজনের নামে আয়োজিত হতো টুর্নামেন্ট। তাতে আশপাশের গ্রামের ফুটবল খেলোয়াড়রা খেলতে আসতেন আমাদের মাঠে। আমাদের গ্রামের টিমটিও ছিল শক্তিশালী। সে দলে আমার বড় ভাই, মামাতো ভাই ও আত্মীয়-স্বজনরা খেলতেন। আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় প্রস্তুতি নিতেন খেলোয়াড়রা। খেলা ও খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দেখে নিজেকে একজন ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার কল্পনা করি। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে কলকাতা থেকে আসতো মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকা। তাতে প্রকাশিত কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কীর্তি-কাহিনী ও খেলোয়াড়দের নিয়ে লেখা প্রতিবেদন এবং ছবি মনোযোগ সহকারে দেখতাম। নিজেকে ভাবতাম জুম্মা খাঁ, তাজ মোহাম্মদ, নূর মোহাম্মদ, আব্বাস মির্জা, হাফেজ রশীদ, রহমত, বাচ্চি খাঁ প্রমুখের মতো। এঁরাই ছিলেন আমার স্বপ্নের নায়ক। এই কিংবদন্তি ফুটবলারদের কারণেই সেই শৈশবেই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে ফুটবল মাঠ।’
একটু বড় হয়ে ঢাকা চলে আসেন মোবাশ্বার। ভর্তি হন নবকুমার স্কুলে। এ স্কুল তখন ফুটবলের পাদপীঠ। তিনি পেয়ে যান ফুটবলার হিসেবে উপরে ওঠার স্বপ্নের সিঁড়ি। স্কুল ফুটবলে দলে নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণ করতে তার বেশি সময় লাগেনি। শৈশব কেটেছে আজিমপুর কলোনিতে। পাড়ার কাছেই থাকতেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা কোচ বজলুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে তিনি প্র্যাকটিস করাতেন। সে সময় খেলার মাঠ থাকতো জমজমাট। মাঠে মাঠে ফুটবলারে সয়লাব। কারো মাঝে ফুটবলের ছিটেফোঁটা প্রতিভার ঝিলিক দেখতে পেলে তিনি তাকে লুফে নিতেন। খেলোয়াড়দের বেসিক বিষয়গুলো তিনি হাতে-কলমে শেখাতেন। লালবাগের খাজে দেওয়ান লেনে তার গড়ে তোলা কামাল স্পোর্টিং ক্লাব ছিল ফুটবলে স্বপ্ন দেখা কিশোর-তরুণদের কাছে নিজেকে মেলে ধরার চমৎকার একটি মাধ্যম। ১৯৫৬ সালে মোবাশ্বার কোচ বজলুর ডাকে নাম লেখান কামাল স্পোর্টিং ক্লাবে। সেন্টার ব্যাকে খেলেন দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোচ বজলুর কথা না বললে আমার খেলোয়াড়ী জীবন কখনোই পূর্ণতা পাবে না। ঢাকায় এসে খেলায় হাতেখড়ি নেয়ার পর বজলু ভাইয়ের সংস্পর্শে আসি। তিনি ছিলেন ফুটবল অন্তঃপ্রাণ। নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফুটবল গড়ার কারিগর। তিনি আমাকে সত্যিকার ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কামাল স্পোর্টিং ক্লাবে নিয়ে নেন। সে সময় ওই কাবে খেলতেন মঞ্জুর হাসান মিন্টু, কামরুজ্জামান, গাউস প্রমুখ। তার হাত ধরেই আত্মপ্রকাশ ঘটে অনেক ফুটবলারের। যারা পরবর্তীকালে দেশবরেণ্য ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বজলু ভাই নিজ হাতে কোচিং দিতেন। কার কোথায় দুর্বলতা, কাকে কোন পজিশনে খেলালে সুবিধা করতে পারবেন, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন রীতিমত জহুরী। এক বছর খেলার পর তিনি আমাকে বললেন, তোমার যা পারফরম্যান্স, তাতে তুমি অনায়াসে প্রথম বিভাগে খেলতে পারবে। বজলু ভাই চাকরি করতেন ফায়ার সার্ভিসে। বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক সিদ্দিকুর রহমান সাহেব ফায়ার সার্ভিসের সর্বময় কর্তা হলেও ফুটবল দল গঠনের দায়িত্বটা তিনি বজলু ভাইয়ের কাঁধেই অর্পণ করেন। ফায়ার সার্ভিস তখন প্রথম বিভাগের দল। আমাকে তিনি ফায়ার সার্ভিসে খেলার সুযোগ করে দেন। আমি সে সময় সেন্টার হাফে খেলি।’ ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে ফায়ার সার্ভিসে খেলার পর ১৯৫৯ সালে মোবাশ্বার যোগ দেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। ওয়ান্ডারার্স তখন শক্তিশালী টিম। কাবের সাধারণ সম্পাদক খ্যাতিমান ক্রীড়া সংগঠক এস এ মোহসীন। সে সময় মাকরানী ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠনের হিড়িক পড়ে যায়। তদানীন্তন সেরা ক্লাব ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান, পিডব্লিউডিতে ছিল মাকরানী ফুটবলারদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। তারপরও মুষ্টিমেয় যে ক’জন বাঙালি ফুটবলার স্বীয় প্রতিভা ও যোগ্যতা দিয়ে সেরা দলে স্থান করে নিতে সক্ষম হন, তিনি তাদের অন্যতম। ওয়ান্ডারার্সে তখন খেলতেন মঞ্জুর হাসান মিন্টু, সাদেক, খসরু, আমিন, গফুর বালুচ, রসুল বক্স, মুসা, লিও, রাব্বানী, মদন, রেমন্ড, সাইফুদ্দিন, প্যাট্রিক, মারী, ইয়াকুব, লারী প্রমুখ। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও ক্যারিশমা দিয়ে দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়ে পরিণত হন তিনি। ১৯৬০ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়ান্ডারার্স। সেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে মোবাশ্বার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকা লীগে এরপর আর ওয়ান্ডারার্স শিরোপা জয় করতে পারেনি। ১৯৬১ সালে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে পাকিস্তানের করাচীতে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবল খেলতে যান। সে দলে ছিলেন মঞ্জুর হাসান মিন্টু, লারী, আমিন, রাব্বানী, গফুর বালুচ, ইয়াকুব, প্রকাশ, প্যাট্রিক, সামাদ, মুরাদ বক্স প্রমুখ। সে টুর্নামেন্টটি মোবাশ্বারের জন্য দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে আছে : ‘প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষের একটি আক্রমণ রুখে দিতে গিয়ে গোলরক্ষক মঞ্জুর হাসান মিন্টু বলটিকে ব্লো মারতে গেলে সরাসরি তা আমার নাকে আঘাত করে। আমার নাক ভেঙ্গে যায়। এ কারণে আমি আর এ টুর্নামেন্ট খেলতে পারিনি।’ ওয়ান্ডারার্সের হয়ে দু’বার খেলেন আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা মোহামেডানে যোগ দেন। মোহামেডানের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মুসা, কবীর, গজনবী, রসুল বক্স, মারী, সামাদ, আশরাফ, মন্টু, জহির, আবিদ হোসেন প্রমুখ। সে বছরই চাকরি পান ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে। ক্রীড়াক্ষেত্রে এ ব্যাংকটি তখন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। রণজিত দাস, বশীর আহমদের মতো ক্রীড়াবিদরা যোগ দিয়ে ব্যাংকটির মর্যাদা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। রণজিত দাস দেশসেরা ক্রীড়াবিদদের নিয়ে ব্যাংক দলটিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। তিনি খন্দকার আবুল হাসান, সামাদ, গাউস, মোবাশ্বার, জলিল, মৃণাল, ফখরুল ইসলাম, মাহমুদ, নূরুন্নবী, মোস্তফা কামাল, সিরাজুল, লিও, মধুসূদন, মিলাল, মধু, আলী হাফিজ, টিপু, এহতেশামের মতো ফুটবলারকে নিয়ে যে দল গঠন করেন, তাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সেরা দল বললে অত্যুক্তি হবে না। রণজিত দাস খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন অসাধারণ, সংগঠক হিসেবেও তার তুলনা মেলা ভার। তিনি সোনালী ব্যাংককে ‘সোনালী প্রজন্মের দল’ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি আজাদ স্পোর্টিং দলটিকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকে চাকরি করায় এটা তার জন্য বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। সোনালী ব্যাংকে যারা চাকরি করতেন, তিনি তাদের সবাইকে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলার জন্য আকৃষ্ট করেন। রণজিত দাসের ভাবমূর্তি এমন ছিল, তার কথা কেউ উপেক্ষা করতে পারতেন না। পারেননি মোবাশ্বারও। মোহামেডান ছেড়ে ১৯৬৩ সাল থেকে সেই যে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে ঠাঁইনাড়া গাড়েন, তারপর আর ক্লাব পরিবর্তনের চিন্তাও করেননি। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আজাদের অন্যতম কাণ্ডারি। এর মধ্যে অবশ্য টাইফয়েড জ্বরের কারণে ১৯৬৪ সালে খেলতে পারেননি। ১৯৬৮ সালে তিনি ছিলেন আজাদের অধিনায়ক। আজাদে খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মার্জিত ও ভদ্র দল হিসেবে আজাদের আলাদা একটা ইমেজ ছিল। তখন আজাদে যারা খেলতেন, তারা অধিকাংশই ছিলেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ কারণে তরুণ সমাজে এ দলটির প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল। আর রণজিত দাসের সম্মোহন প্রলুব্ধ করতো যে কাউকে। তিনি সবার কাছেই আইডল ছিলেন।’
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত খেলেন মোবাশ্বার। অফিস ফুটবল লীগের দুরন্ত দল ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। সে সময় ন্যাশনাল ব্যাংক বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও ময়মনসিংহের সূর্যকান্ত শীল্ডসহ খুলনা, কুমিল্লায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করে। ন্যাশনাল ব্যাংক ক্রীড়াঙ্গনে রীতিমত সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
১৯৬০ সালে ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল টিমের ট্রায়ালে ডাক পান মোবাশ্বার। অসুস্থতার কারণে সেবার খেলতে পারেননি। ১৯৬১ সালে তিনি যখন ফর্মের তুঙ্গে, তখন থেকে প্রভিনশিয়াল ফুটবলের পরিবর্তে প্রবর্তন করা হয় ডিভিশনাল ফুটবল প্রতিযোগিতা। আগে যেখানে ছিল শুধু ইস্ট পাকিস্তান দল, তার পরিবর্তে করা হয় পাঁচটি বিভাগীয় দল- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রেলওয়ে দল। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ডিভিশনাল ফুটবলে খেলেন রাজশাহী বিভাগের হয়ে। ১৯৬৫ সালে অবশ্য যুদ্ধের কারণে খেলা হয়নি। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন অধিনায়ক। ১৯৬১ ও ১৯৬৬ সালে করাচীতে খেলেন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে। ১৯৬১ সালে করাচীতে খেলা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল পাকিস্তান আর্মি দলের সঙ্গে। তখনকার দিনে পাকিস্তান দল খুবই শক্তিশালী। আমাদের দলের ২/১ জন ছাড়া বাকি সবাই এ ধরনের প্রতিযোগিতায় নবাগত। এমনকি কেউ ঢাকা লীগ পর্যন্ত খেলেননি। আমাকে অন্যায়ভাবে ফাউলের মাধ্যমে আহত করে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। এ সুযোগে তারা জয়ী হয় অতিকষ্টে।’ ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাবনার হয়ে খেলেন আন্তঃজেলা ফুটবল। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাবনার অধিনায়ক। এর মধ্যে পাবনা ১৯৬১ ও ১৯৬৭ সালে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৬৫ সালে রানার্সআপ হয়। সে সময় আন্তঃজেলা ফুটবলে একচেটিয়া দাপট ছিল ঢাকা, কুমিল্লা ও বরিশালের। তাদের ডিঙ্গিয়ে প্রথমবারের মতো পদ্মা নদীর ওপারে শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখায় পাবনা। পাবনার যে দলটি প্রথমবারের মতো আন্তঃজেলা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়, সে দলের একমাত্র তিনিই খেলতেন ঢাকা লীগে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঢাকা স্টেডিয়ামে আন্তঃজেলা ফুটবলের সেমিফাইনালে কুমিল্লার মুখোমুখি হওয়ার আগে কুমিল্লার একজন কর্মকর্তা টিটকিরি দিয়ে বলেন, তোমাদের আমরা বেশি গোল দেব না। কুমিল্লা তখন চ্যাম্পিয়ন। অনেক শক্তিশালী দল। তাদের হারানো যে কারো পক্ষেই কঠিন। তারপরও কুমিল্লার ওই কর্মকর্তার কথা আমাদের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। এ কথার যথাযথ জবাব দেয়ার জন্য তাদেরকে হারানোর প্রতিজ্ঞা করি। ইস্পাতদৃঢ় মনোবল নিয়ে মাঠে নামার পর কুমিল্লার উপর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। সবাইকে চমকে দিয়ে কুমিল্লাকে ২-০ গোলে পরাজিত করি। ফাইনালে ঢাকাকে ২-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই।’ পাবনা জেলা দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পেয়ারা, অজিত, মন্টু, চুন্নু, আজিজ, খলিল, লতিফ।
মোবাশ্বার ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে নবকুমার স্কুলের হয়ে খেলেন আন্তঃস্কুল ফুটবল। ১৯৬৩ সালে জগন্নাথ কলেজের হয়ে পাকিস্তানের মুলতানে খেলেন। সে দলে ছিলেন দেবীনাশ, জলিল, কাউয়ুম, রসুল বক্স, রফিক, হাফিজ, প্রতাপ, বলাই দে, বশীর, আনসার প্রমুখ। এ দলের সব খেলোয়াড়ই ছিলেন দেশবরেণ্য ফুটবলার। সবাই অবশ্য জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন না। তিনিও হায়ারে খেলতে যান। সেবার প্রথম এ দলটি ফ্ল্যাডলাইটে খেলে। দলের পারফরম্যান্স ছিল বেশ ভালো। ১৯৬৩ সালে সফরকারী চীনের বিপক্ষে ইস্ট পাকিস্তান বাছাই একাদশের হয়ে তিনি খেলেন।
নিজের সেরা খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫৯ সালে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে, ১৯৬১ সালে আন্তঃজেলা ফুটবলে পাবনার হয়ে এবং ১৯৬৩ সালে জগন্নাথ কলেজের হয়ে মুলতানে খেলাটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।’ তার দেখা সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে বলেন,‘আমার দেখা এ যাবৎকালের সেরা ফুটবলার কালা গফুর। তার মতো সহজাত ফুটবলারের দেখা পাওয়া যাবে না। ইউরোপে জন্ম নিলে তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতেন। এছাড়া মাকরানী ফুটবলারদের মধ্যে তোরাব আলী, গফুর বালুচ, আলী নেওয়াজ, ওমর, কাউয়ুম চেঙ্গেজি, রসুল বক্স এবং বাঙালিদের মধ্যে নবী চৌধুরী, বশীর আহমদ, জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, সামাদ, গাউস, হাফিজ, টিপু, নূরুন্নবী ছিলেন চমৎকার খেলোয়াড়। ঢাকায় কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্টে নবী চৌধুরীকে প্রথম দেখি। লম্বা ও সুদর্শন। তার মতো আর কাউকে লম্বা কিক মারতে দেখিনি। সামাদ ছিলেন হাফের খুব টাফ খেলোয়াড়।’
সে সময় খেলোয়াড়দের আয়-রোজগার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্লাবগুলো মাকরানী ফুটবলারদের ভালো টাকা-পয়সা দিত। এছাড়াও তাদের থাকা-খাওয়া বহন করতো। অথচ বাঙালি ফুটবলারদের টাকা-পয়সা দেয়ার ব্যাপারে একটা অনীহা ছিল। ওয়ান্ডারার্সে যোগ দেয়ার পর অল্প কিছু টাকা পেতাম। সব মিলিয়ে মাকরানীদের সঙ্গে আমাদের একটা সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো।’
কাজী মোবাশ্বার হোসেন বলেন, ‘খেলার টেকনিক এখন অনেক বদলে গেছে। আমরা থ্রী ব্যাক সিস্টেমে খেলতাম। তাতে ছিল ব্যক্তিগত স্কিলের প্রাধান্য। এখন প্রতিটি খেলোয়াড়ের মান সমান না হলে দলের জন্য সমস্য হয়ে দেখা দেয়।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কাজী মোবাশ্বার হোসেনের সঙ্গে খেলার মাঠের কোনো যোগাযোগ নেই। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ তার ফুটবল জীবনের যতি টেনে দেয়। চাকরিতে জড়িয়ে পড়েন ওতপ্রোতভাবে। ১৯৯৮ সালে তিনি সোনালী ব্যাংক থেকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসর নেন। তিনি দু’কন্যা মিলা ও লিমার জনক। দু’জনেই বিবাহিত।
বর্তমানে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে বসবাস করছেন। বয়স সত্তর হলেও এখনও তিনি তারুণ্যের মতো সজীব। তার ফিগার দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না- এককালে তিনি খেলোয়াড় ছিলেন। ছিলেন সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী। মাঠে ও মাঠের বাইরে ছিলেন অনেকেরই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। জীবনে তার তেমন অপূর্ণতা নেই। সুখী দাম্পত্য জীবন তার সুখী জীবনের রেসিপি। আর খেলার মাঠ থেকেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন সফল জীবনের ঠিকানা। #
১-২-২০০৮
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হন কাজী মোবাশ্বার হোসেন। ১৯৩৮ সালের ৩ মার্চ পাবনা জেলার দাড়িয়াপুরে তার জন্ম। বাড়ির পাশেই ছিল ফুটবল মাঠ। এ মাঠই তার চোখে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দেয়। স্মৃতির জানালা খুলে মোবাশ্বার চলে যান সুদূর কৈশোরে : ‘আমাদের গ্রামের মাঠে তখনকার দিনে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ফুটবল খেলা হতো। প্রতি বছর বিভিন্নজনের নামে আয়োজিত হতো টুর্নামেন্ট। তাতে আশপাশের গ্রামের ফুটবল খেলোয়াড়রা খেলতে আসতেন আমাদের মাঠে। আমাদের গ্রামের টিমটিও ছিল শক্তিশালী। সে দলে আমার বড় ভাই, মামাতো ভাই ও আত্মীয়-স্বজনরা খেলতেন। আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় প্রস্তুতি নিতেন খেলোয়াড়রা। খেলা ও খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দেখে নিজেকে একজন ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার কল্পনা করি। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে কলকাতা থেকে আসতো মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকা। তাতে প্রকাশিত কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কীর্তি-কাহিনী ও খেলোয়াড়দের নিয়ে লেখা প্রতিবেদন এবং ছবি মনোযোগ সহকারে দেখতাম। নিজেকে ভাবতাম জুম্মা খাঁ, তাজ মোহাম্মদ, নূর মোহাম্মদ, আব্বাস মির্জা, হাফেজ রশীদ, রহমত, বাচ্চি খাঁ প্রমুখের মতো। এঁরাই ছিলেন আমার স্বপ্নের নায়ক। এই কিংবদন্তি ফুটবলারদের কারণেই সেই শৈশবেই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে ফুটবল মাঠ।’
একটু বড় হয়ে ঢাকা চলে আসেন মোবাশ্বার। ভর্তি হন নবকুমার স্কুলে। এ স্কুল তখন ফুটবলের পাদপীঠ। তিনি পেয়ে যান ফুটবলার হিসেবে উপরে ওঠার স্বপ্নের সিঁড়ি। স্কুল ফুটবলে দলে নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণ করতে তার বেশি সময় লাগেনি। শৈশব কেটেছে আজিমপুর কলোনিতে। পাড়ার কাছেই থাকতেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা কোচ বজলুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে তিনি প্র্যাকটিস করাতেন। সে সময় খেলার মাঠ থাকতো জমজমাট। মাঠে মাঠে ফুটবলারে সয়লাব। কারো মাঝে ফুটবলের ছিটেফোঁটা প্রতিভার ঝিলিক দেখতে পেলে তিনি তাকে লুফে নিতেন। খেলোয়াড়দের বেসিক বিষয়গুলো তিনি হাতে-কলমে শেখাতেন। লালবাগের খাজে দেওয়ান লেনে তার গড়ে তোলা কামাল স্পোর্টিং ক্লাব ছিল ফুটবলে স্বপ্ন দেখা কিশোর-তরুণদের কাছে নিজেকে মেলে ধরার চমৎকার একটি মাধ্যম। ১৯৫৬ সালে মোবাশ্বার কোচ বজলুর ডাকে নাম লেখান কামাল স্পোর্টিং ক্লাবে। সেন্টার ব্যাকে খেলেন দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোচ বজলুর কথা না বললে আমার খেলোয়াড়ী জীবন কখনোই পূর্ণতা পাবে না। ঢাকায় এসে খেলায় হাতেখড়ি নেয়ার পর বজলু ভাইয়ের সংস্পর্শে আসি। তিনি ছিলেন ফুটবল অন্তঃপ্রাণ। নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফুটবল গড়ার কারিগর। তিনি আমাকে সত্যিকার ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কামাল স্পোর্টিং ক্লাবে নিয়ে নেন। সে সময় ওই কাবে খেলতেন মঞ্জুর হাসান মিন্টু, কামরুজ্জামান, গাউস প্রমুখ। তার হাত ধরেই আত্মপ্রকাশ ঘটে অনেক ফুটবলারের। যারা পরবর্তীকালে দেশবরেণ্য ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বজলু ভাই নিজ হাতে কোচিং দিতেন। কার কোথায় দুর্বলতা, কাকে কোন পজিশনে খেলালে সুবিধা করতে পারবেন, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন রীতিমত জহুরী। এক বছর খেলার পর তিনি আমাকে বললেন, তোমার যা পারফরম্যান্স, তাতে তুমি অনায়াসে প্রথম বিভাগে খেলতে পারবে। বজলু ভাই চাকরি করতেন ফায়ার সার্ভিসে। বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক সিদ্দিকুর রহমান সাহেব ফায়ার সার্ভিসের সর্বময় কর্তা হলেও ফুটবল দল গঠনের দায়িত্বটা তিনি বজলু ভাইয়ের কাঁধেই অর্পণ করেন। ফায়ার সার্ভিস তখন প্রথম বিভাগের দল। আমাকে তিনি ফায়ার সার্ভিসে খেলার সুযোগ করে দেন। আমি সে সময় সেন্টার হাফে খেলি।’ ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে ফায়ার সার্ভিসে খেলার পর ১৯৫৯ সালে মোবাশ্বার যোগ দেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। ওয়ান্ডারার্স তখন শক্তিশালী টিম। কাবের সাধারণ সম্পাদক খ্যাতিমান ক্রীড়া সংগঠক এস এ মোহসীন। সে সময় মাকরানী ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠনের হিড়িক পড়ে যায়। তদানীন্তন সেরা ক্লাব ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান, পিডব্লিউডিতে ছিল মাকরানী ফুটবলারদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। তারপরও মুষ্টিমেয় যে ক’জন বাঙালি ফুটবলার স্বীয় প্রতিভা ও যোগ্যতা দিয়ে সেরা দলে স্থান করে নিতে সক্ষম হন, তিনি তাদের অন্যতম। ওয়ান্ডারার্সে তখন খেলতেন মঞ্জুর হাসান মিন্টু, সাদেক, খসরু, আমিন, গফুর বালুচ, রসুল বক্স, মুসা, লিও, রাব্বানী, মদন, রেমন্ড, সাইফুদ্দিন, প্যাট্রিক, মারী, ইয়াকুব, লারী প্রমুখ। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও ক্যারিশমা দিয়ে দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়ে পরিণত হন তিনি। ১৯৬০ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়ান্ডারার্স। সেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে মোবাশ্বার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকা লীগে এরপর আর ওয়ান্ডারার্স শিরোপা জয় করতে পারেনি। ১৯৬১ সালে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে পাকিস্তানের করাচীতে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবল খেলতে যান। সে দলে ছিলেন মঞ্জুর হাসান মিন্টু, লারী, আমিন, রাব্বানী, গফুর বালুচ, ইয়াকুব, প্রকাশ, প্যাট্রিক, সামাদ, মুরাদ বক্স প্রমুখ। সে টুর্নামেন্টটি মোবাশ্বারের জন্য দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে আছে : ‘প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষের একটি আক্রমণ রুখে দিতে গিয়ে গোলরক্ষক মঞ্জুর হাসান মিন্টু বলটিকে ব্লো মারতে গেলে সরাসরি তা আমার নাকে আঘাত করে। আমার নাক ভেঙ্গে যায়। এ কারণে আমি আর এ টুর্নামেন্ট খেলতে পারিনি।’ ওয়ান্ডারার্সের হয়ে দু’বার খেলেন আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা মোহামেডানে যোগ দেন। মোহামেডানের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মুসা, কবীর, গজনবী, রসুল বক্স, মারী, সামাদ, আশরাফ, মন্টু, জহির, আবিদ হোসেন প্রমুখ। সে বছরই চাকরি পান ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে। ক্রীড়াক্ষেত্রে এ ব্যাংকটি তখন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। রণজিত দাস, বশীর আহমদের মতো ক্রীড়াবিদরা যোগ দিয়ে ব্যাংকটির মর্যাদা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। রণজিত দাস দেশসেরা ক্রীড়াবিদদের নিয়ে ব্যাংক দলটিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। তিনি খন্দকার আবুল হাসান, সামাদ, গাউস, মোবাশ্বার, জলিল, মৃণাল, ফখরুল ইসলাম, মাহমুদ, নূরুন্নবী, মোস্তফা কামাল, সিরাজুল, লিও, মধুসূদন, মিলাল, মধু, আলী হাফিজ, টিপু, এহতেশামের মতো ফুটবলারকে নিয়ে যে দল গঠন করেন, তাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সেরা দল বললে অত্যুক্তি হবে না। রণজিত দাস খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন অসাধারণ, সংগঠক হিসেবেও তার তুলনা মেলা ভার। তিনি সোনালী ব্যাংককে ‘সোনালী প্রজন্মের দল’ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি আজাদ স্পোর্টিং দলটিকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকে চাকরি করায় এটা তার জন্য বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। সোনালী ব্যাংকে যারা চাকরি করতেন, তিনি তাদের সবাইকে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলার জন্য আকৃষ্ট করেন। রণজিত দাসের ভাবমূর্তি এমন ছিল, তার কথা কেউ উপেক্ষা করতে পারতেন না। পারেননি মোবাশ্বারও। মোহামেডান ছেড়ে ১৯৬৩ সাল থেকে সেই যে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে ঠাঁইনাড়া গাড়েন, তারপর আর ক্লাব পরিবর্তনের চিন্তাও করেননি। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আজাদের অন্যতম কাণ্ডারি। এর মধ্যে অবশ্য টাইফয়েড জ্বরের কারণে ১৯৬৪ সালে খেলতে পারেননি। ১৯৬৮ সালে তিনি ছিলেন আজাদের অধিনায়ক। আজাদে খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মার্জিত ও ভদ্র দল হিসেবে আজাদের আলাদা একটা ইমেজ ছিল। তখন আজাদে যারা খেলতেন, তারা অধিকাংশই ছিলেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ কারণে তরুণ সমাজে এ দলটির প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল। আর রণজিত দাসের সম্মোহন প্রলুব্ধ করতো যে কাউকে। তিনি সবার কাছেই আইডল ছিলেন।’
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত খেলেন মোবাশ্বার। অফিস ফুটবল লীগের দুরন্ত দল ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। সে সময় ন্যাশনাল ব্যাংক বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও ময়মনসিংহের সূর্যকান্ত শীল্ডসহ খুলনা, কুমিল্লায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করে। ন্যাশনাল ব্যাংক ক্রীড়াঙ্গনে রীতিমত সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
১৯৬০ সালে ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল টিমের ট্রায়ালে ডাক পান মোবাশ্বার। অসুস্থতার কারণে সেবার খেলতে পারেননি। ১৯৬১ সালে তিনি যখন ফর্মের তুঙ্গে, তখন থেকে প্রভিনশিয়াল ফুটবলের পরিবর্তে প্রবর্তন করা হয় ডিভিশনাল ফুটবল প্রতিযোগিতা। আগে যেখানে ছিল শুধু ইস্ট পাকিস্তান দল, তার পরিবর্তে করা হয় পাঁচটি বিভাগীয় দল- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রেলওয়ে দল। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ডিভিশনাল ফুটবলে খেলেন রাজশাহী বিভাগের হয়ে। ১৯৬৫ সালে অবশ্য যুদ্ধের কারণে খেলা হয়নি। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন অধিনায়ক। ১৯৬১ ও ১৯৬৬ সালে করাচীতে খেলেন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে। ১৯৬১ সালে করাচীতে খেলা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল পাকিস্তান আর্মি দলের সঙ্গে। তখনকার দিনে পাকিস্তান দল খুবই শক্তিশালী। আমাদের দলের ২/১ জন ছাড়া বাকি সবাই এ ধরনের প্রতিযোগিতায় নবাগত। এমনকি কেউ ঢাকা লীগ পর্যন্ত খেলেননি। আমাকে অন্যায়ভাবে ফাউলের মাধ্যমে আহত করে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। এ সুযোগে তারা জয়ী হয় অতিকষ্টে।’ ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাবনার হয়ে খেলেন আন্তঃজেলা ফুটবল। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাবনার অধিনায়ক। এর মধ্যে পাবনা ১৯৬১ ও ১৯৬৭ সালে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৬৫ সালে রানার্সআপ হয়। সে সময় আন্তঃজেলা ফুটবলে একচেটিয়া দাপট ছিল ঢাকা, কুমিল্লা ও বরিশালের। তাদের ডিঙ্গিয়ে প্রথমবারের মতো পদ্মা নদীর ওপারে শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখায় পাবনা। পাবনার যে দলটি প্রথমবারের মতো আন্তঃজেলা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়, সে দলের একমাত্র তিনিই খেলতেন ঢাকা লীগে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঢাকা স্টেডিয়ামে আন্তঃজেলা ফুটবলের সেমিফাইনালে কুমিল্লার মুখোমুখি হওয়ার আগে কুমিল্লার একজন কর্মকর্তা টিটকিরি দিয়ে বলেন, তোমাদের আমরা বেশি গোল দেব না। কুমিল্লা তখন চ্যাম্পিয়ন। অনেক শক্তিশালী দল। তাদের হারানো যে কারো পক্ষেই কঠিন। তারপরও কুমিল্লার ওই কর্মকর্তার কথা আমাদের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। এ কথার যথাযথ জবাব দেয়ার জন্য তাদেরকে হারানোর প্রতিজ্ঞা করি। ইস্পাতদৃঢ় মনোবল নিয়ে মাঠে নামার পর কুমিল্লার উপর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। সবাইকে চমকে দিয়ে কুমিল্লাকে ২-০ গোলে পরাজিত করি। ফাইনালে ঢাকাকে ২-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই।’ পাবনা জেলা দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পেয়ারা, অজিত, মন্টু, চুন্নু, আজিজ, খলিল, লতিফ।
মোবাশ্বার ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে নবকুমার স্কুলের হয়ে খেলেন আন্তঃস্কুল ফুটবল। ১৯৬৩ সালে জগন্নাথ কলেজের হয়ে পাকিস্তানের মুলতানে খেলেন। সে দলে ছিলেন দেবীনাশ, জলিল, কাউয়ুম, রসুল বক্স, রফিক, হাফিজ, প্রতাপ, বলাই দে, বশীর, আনসার প্রমুখ। এ দলের সব খেলোয়াড়ই ছিলেন দেশবরেণ্য ফুটবলার। সবাই অবশ্য জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন না। তিনিও হায়ারে খেলতে যান। সেবার প্রথম এ দলটি ফ্ল্যাডলাইটে খেলে। দলের পারফরম্যান্স ছিল বেশ ভালো। ১৯৬৩ সালে সফরকারী চীনের বিপক্ষে ইস্ট পাকিস্তান বাছাই একাদশের হয়ে তিনি খেলেন।
নিজের সেরা খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫৯ সালে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে, ১৯৬১ সালে আন্তঃজেলা ফুটবলে পাবনার হয়ে এবং ১৯৬৩ সালে জগন্নাথ কলেজের হয়ে মুলতানে খেলাটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।’ তার দেখা সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে বলেন,‘আমার দেখা এ যাবৎকালের সেরা ফুটবলার কালা গফুর। তার মতো সহজাত ফুটবলারের দেখা পাওয়া যাবে না। ইউরোপে জন্ম নিলে তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতেন। এছাড়া মাকরানী ফুটবলারদের মধ্যে তোরাব আলী, গফুর বালুচ, আলী নেওয়াজ, ওমর, কাউয়ুম চেঙ্গেজি, রসুল বক্স এবং বাঙালিদের মধ্যে নবী চৌধুরী, বশীর আহমদ, জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, সামাদ, গাউস, হাফিজ, টিপু, নূরুন্নবী ছিলেন চমৎকার খেলোয়াড়। ঢাকায় কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্টে নবী চৌধুরীকে প্রথম দেখি। লম্বা ও সুদর্শন। তার মতো আর কাউকে লম্বা কিক মারতে দেখিনি। সামাদ ছিলেন হাফের খুব টাফ খেলোয়াড়।’
সে সময় খেলোয়াড়দের আয়-রোজগার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্লাবগুলো মাকরানী ফুটবলারদের ভালো টাকা-পয়সা দিত। এছাড়াও তাদের থাকা-খাওয়া বহন করতো। অথচ বাঙালি ফুটবলারদের টাকা-পয়সা দেয়ার ব্যাপারে একটা অনীহা ছিল। ওয়ান্ডারার্সে যোগ দেয়ার পর অল্প কিছু টাকা পেতাম। সব মিলিয়ে মাকরানীদের সঙ্গে আমাদের একটা সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো।’
কাজী মোবাশ্বার হোসেন বলেন, ‘খেলার টেকনিক এখন অনেক বদলে গেছে। আমরা থ্রী ব্যাক সিস্টেমে খেলতাম। তাতে ছিল ব্যক্তিগত স্কিলের প্রাধান্য। এখন প্রতিটি খেলোয়াড়ের মান সমান না হলে দলের জন্য সমস্য হয়ে দেখা দেয়।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কাজী মোবাশ্বার হোসেনের সঙ্গে খেলার মাঠের কোনো যোগাযোগ নেই। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ তার ফুটবল জীবনের যতি টেনে দেয়। চাকরিতে জড়িয়ে পড়েন ওতপ্রোতভাবে। ১৯৯৮ সালে তিনি সোনালী ব্যাংক থেকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসর নেন। তিনি দু’কন্যা মিলা ও লিমার জনক। দু’জনেই বিবাহিত।
বর্তমানে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে বসবাস করছেন। বয়স সত্তর হলেও এখনও তিনি তারুণ্যের মতো সজীব। তার ফিগার দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না- এককালে তিনি খেলোয়াড় ছিলেন। ছিলেন সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী। মাঠে ও মাঠের বাইরে ছিলেন অনেকেরই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। জীবনে তার তেমন অপূর্ণতা নেই। সুখী দাম্পত্য জীবন তার সুখী জীবনের রেসিপি। আর খেলার মাঠ থেকেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন সফল জীবনের ঠিকানা। #
১-২-২০০৮
অাজ ইন্তেকাল করেন।
উত্তরমুছুনMy Heartfelt Condolences For The Legend.May Almighty Keep His Soul In Rest.
উত্তরমুছুন