মাহুতটুলির নুরুল ইসলাম নান্না/ দুলাল মাহমুদ

ঢাকার নবাবদের মাধ্যমে হকির প্রচলন ঘটলেও হকির সূতিকাগার বলা যায় আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাইস্কুলকে। এই স্কুলকে কেন্দ্র করে প্রসার ও বিকশিত হয়েছে হকি খেলা। সঙ্গত কারণে তার ছোঁয়া লাগে স্কুল সংলগ্ন আশপাশের এলাকায়। সেই ব্রিটিশ আমলে ঢাকা শহরের পরিসর ছিল খুবই সীমিত। মাহুতটুলি ছিল ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এই এলাকায় বসবাসরত বালক ও কিশোরদের বড় একটি অংশ পড়তো আরমানিটোলা স্কুলে। স্কুল ও বাসার মধ্যে একদমই দূরত্ব না থাকায় আরমানিটোলা মাঠে তাদের সার্বক্ষণিক বিনোদনের অংশ হয়ে ওঠে হকি খেলা। অন্যদের মতো মাহুতটুলির একটি পরিবারের ছেলেরাও পড়তো আরমানিটোলা স্কুলে। আরমানিটোলা স্কুলে হকি খেলায় দীক্ষা পেয়ে তারা নিজেরাই গড়ে তোলে মাহুতটুলি ক্লাব। সেই ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠে এ ক্লাবটি। হকিকে জনপ্রিয় করতে এ ক্লাবের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়। আর এই মাহুতটুলি ক্লাবটি গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন মাহুতটুলির যে পরিবার, তাদের ছয় ভাই-ই খেলতেন এই ক্লাবে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্ব পেরিয়ে এই বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত এ পরিবারটি জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় উপহার দিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ খেলেছেন ইস্ট পাকিস্তান দলে, কেউবা খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। সবচেয়ে বড় কথা, এ পরিবারটি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের হকির পথপ্রদর্শক হিসেবে বড় ধরনের অবদান রেখেছে। এ পরিবারের সন্তান মোঃ নুরুল ইসলাম নান্না। বলা যায়, বর্তমানে জীবিত জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনিই জ্যেষ্ঠ। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। সোনালী দিনগুলো পাড়ি দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জীবনের প্রান্তসীমায়। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অনেকগুলো বছর তার চলা-ফেরার গন্ডি সীমাবদ্ধ নিজ ঘরের চৌহদ্দি পর্যন্ত। খুব একটা ঘরের বাইরে যান না। স্ত্রী, পুত্র ও নাতিকে নিয়েই তার ছোট্ট পরিসর। তাদের নিয়েই কাটে তার প্রতিদিনের জীবন।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের হকি যাদের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছে, নুরুল ইসলাম নান্না তাদের অন্যতম। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি যেমন আলাদা একটি স্থান গড়ে তোলেন, কোচ হিসেবেও তার রয়েছে সম্মানজনক অবস্থান। হকিতে নিবেদিতপ্রাণ হলেও ফুটবলার হিসেবে তিনি ছিলেন সমীহ জাগানো নাম। বরং হকিতে খেলা না হলেও ফুটবলে তিনি খেলেছেন পূর্ব পাকিস্তান দলে। এমন বর্ণাঢ্য ও উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের অধিকারী হয়েও তার মূল্যায়নটা হয়নি। আর এখন তো বয়স তাকে কাবু করে ফেলেছে। কোনো কিছু পাওয়া কিংবা না পাওয়া নিয়ে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। জীবনের যাবতীয় অর্জনগুলোও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তার স্মৃতি থেকে। ধূসর হয়ে পড়ছে গৌরবময় দিনগুলো। একসময় খেলেছেন, প্রশিক্ষক ছিলেন- এর বাইরে আর তেমন কোনো কিছু তার স্মরণে নেই। অতীতের খাজাঞ্চিখানা থেকে মূল্যবান স্মৃতিগুলো তুলে আনার জন্য কপালে ভাঁজ পড়লেও চিন্তাসূত্র খেই হারিয়ে ফেলে। টুকরো টুকরো ঘটনা ভেসে আসতে আসতে তলিয়ে যায়। তারপরও যেটুকু মনে পড়ে, তার দিন-ক্ষণ-সাল একদমই মুছে গেছে। তার সঙ্গে খেলেছেন, তার খেলা দেখেছেন কিংবা তার সম্পর্কে জানেন- এমন লোকের সংখ্যাও এখন বিরল। যে কারণে প্রকৃত নুরুল ইসলামকে তুলে আনা সহজ নয়। তার জন্ম মাহুতটুলিতে। ১৯২৮ সালের দিকে। ৭৯ নং মাহুতটুলির যে বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, সেদিন সেই বাড়িতে তার সঙ্গে কথা হয়। এই বাড়িতে জন্ম হয় মাহুতটুলি ক্লাবের। শতাব্দী প্রাচীন এই বাড়িটিও এখন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। তার সঙ্গে কথা বলার সময় উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী ও বড় ছেলে জাতীয় হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় কামরুল ইসলাম কিসমত। আলোচনায় তারাও কিছু কিছু তথ্যের জোগান দেন। খেলোয়াড় হওয়া প্রসঙ্গে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাসার সামনের আরমানিটোলা স্কুল আমাকে খেলাধুলায় আকৃষ্ট করে। এই স্কুলের কারণেই আমার খেলোয়াড় হওয়ার পথ সুগম হয়। তাছাড়া হকিতে ছিল আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। একদম শৈশবেই আমি আমার ভাইদের হকি খেলতে দেখি। তারাও ছিলেন আরমানিটোলা স্কুলের ছাত্র। সে সময় হকি খেলোয়াড় হিসেবে যারা সুনাম অর্জন করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন আমার ভাইয়েরা। আমার বড় ভাই উজির আলী, মেঝ ভাই সাদেক আলী, তৃতীয় নাজির আলী, চতুর্থ ফাখরুল ইসলাম। এরপরই আমি। সবার ছোট শামসুল ইসলাম বাচ্চু। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে আমার ভাইরা মাহুতটুলি ক্লাব গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দেন। আমরা ছয় ভাই একসঙ্গে এ ক্লাবে খেলেছি। মাহুতটুলি ক্লাব ছিল আমাদের কাছে সম্মান, মর্যাদা ও ভালোবাসার প্রতীক। এই ক্লাবটিকে প্রতিষ্ঠিত, জনপ্রিয় ও সাফল্য বয়ে আনার জন্য আমাদের পরিবারের কাছে ছিল রীতিমত চ্যালেঞ্জ। এ কারণে এই ক্লাবটির পেছনে আমরা শ্রম দিয়েছি, অর্থ দিয়েছি, দিয়েছি আমাদের জীবনের সেরা সময়টাকে। তবে খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন বড় ভাই উজির আলী। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তিনি ১৯২৫ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন আরমানিটোলা স্কুল হকি দলের খেলোয়াড় ছিলেন। হকির প্রথম প্রজন্মের তিনি একজন। বাংলাদেশের হকির ইতিহাস লেখা হলে তাকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। এমন একটা পরিবেশে হকি খেলাটা হয়ে ওঠে আমার সহজাত আকর্ষণ। খুব অল্প বয়সেই হকি ও ফুটবল খেলা আমার রপ্ত হয়ে যায়। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র থাকতেই আমি ফার্স্ট ডিভিশন লীগে হকি খেলা শুরু করি। সেটা সম্ভবত ১৯৩৯ সাল। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাহুতটুলি ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু হয়। আমি তো বটেই, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সবাই এই ক্লাবে খেলেছেন।’
নুরুল ইসলাম হকিতে আরমানিটোলা স্কুল ও মাহুতটুলি ক্লাবের সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন। তার সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন চান বাহাদুর রায়, আলী হোসেন প্রমুখ। ১৯৪৪ সালে তিনি আরমানিটোলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। অধিনায়ক ছিলেন মাহুতটুলি ক্লাবের। তবে সে সময় অবাঙালি খেলোয়াড়দের দাপট থাকায় মাহুতটুলি ক্লাবের পক্ষে হকি লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছিল কঠিন। ক্লাবটি কখনো চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কিনা, তা তার মনে নেই। তবে অন্যতম সেরা ক্লাব হিসেবে মাহুতটুলী যে সুখ্যাতি অর্জন করে, সেক্ষেত্রে তার অবদান রয়েছে। দুরন্ত ফরোয়ার্ড হিসেবে অনেক গোল এসেছে তার স্টিক থেকে। তিনি কতটা অপরিহার্য ছিলেন, তার প্রমাণ হলো- তিনি ওয়ান্ডারার্সে যোগ দেয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ে মাহুতটুলি। একবার তিনি ওয়ারীর হয়ে কলকাতার বেটন কাপ হকিতে খেলেন। ওয়ারী ক্লাবে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে দুর্বলতা থাকায় তাকে দলভুক্ত করে। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি হকি লীগে অংশ নেন। ফর্মে থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান হকি দলে তিনি খেলার সুযোগ পাননি। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান হকি দল গঠন করা হয়নি। এরপরও তিনি খেলেছেন বিভিন্ন প্রদর্শনী ম্যাচে।
ফুটবলেও নুরুল ইসলামের হাতেখড়ি আরমানিটোলা স্কুলে। সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে অল্প বয়সেই তিনি দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। যে কারণে স্কুলে পড়ার সময় সে সময়ের দুরন্ত ফুটবল দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে খেলার আমন্ত্রণ পান। পঞ্চাশের দশকে ওয়ান্ডারার্স ফুটবল লীগে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিরল গৌরব অর্জন করে। এই সুবর্ণ সময়ে একবার তিনি ছিলেন ওয়ান্ডারার্সের অধিনায়ক। সেটি বোধ করি ১৯৫৩ সাল। সে বছরই তিনি ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল দলে খেলার গৌরব অর্জন করেন। পাকিস্তানের পেশোয়ারে চতুর্থ জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেন। সে দলের খেলোয়াড়রা হলেন- কে এ আনসারি (অধিনায়ক), এস এ রশীদ (সহকারী অধিনায়ক), রহিম, ফজলু, নান্না, খালেক, ভানু, আরজু, টি রায়, নেওয়াজ, মোমতাজ, শৈলেশ, সাহেব আলী, ভাওয়াল ও এম রহমান। এম এ হক ম্যানেজার, আমানউল্লাহ খান রিসিপশন অফিসার ও জি মোহাম্মদ লিঁয়াজো অফিসার ছিলেন। ১৯৪৬ সালে আন্তঃস্কুল ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ঢাকা কলেজের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। কলকাতার আইএফএ শিল্ডে তার নেতৃত্বে ওয়ান্ডারার্স অংশ নেয়। নক-আউট পর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে মোহনবাগানের কাছে হেরে যায় তার দল। এক বছর তিনি কলকাতা ইস্টবেঙ্গলের হয়েও খেলেন।
১৯৭৫ সালে ভারতের পাতিয়ালা থেকে প্রশিক্ষক হিসেবে হকিতে ট্রেনিং নিয়ে আসেন নুরুল ইসলাম। ১৯৭৬ সালে যোগ দেন তদানীন্তন জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের কোচ হিসেবে।
স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ১৯৭৭ সালের জুলাইতে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে জুনিয়র বিশ্বকাপ হকি খেলতে যায় বাংলাদেশ দল। সে দলের কোচ ছিলেন তিনি। ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন বশীর আহমেদ। খেলোয়াড়রা ছিলেন- হোসেন ইমাম চৌধুরী (অধিনায়ক), আশেকুল্লাহ কায়েস (সহ-অধিনায়ক), আনভীর আদেল, এহসান নাম্মী, আজিজুল আলম, ডনডন লুসাই, আলমগীর চুন্নু, জামাল হায়দার, ওমর মোঃ আদেল, মালেক চুন্নু, মাশেকুল্লা আয়েশ, খাজা ড্যানিয়েল, খাজা জিয়াউদ্দিন, নাসের আহমদ, রামা লুসাই ও হুমায়ুন। স্টাড দেয়া বুট দিয়ে খেলা ছিল বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নতুন অভিজ্ঞতা। তারপরও ১০টি দেশের মধ্যে পঞ্চম হয় বাংলাদেশ। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশী হকি দল বাংলাদেশে খেলতে আসে। শ্রীলংকা জাতীয় দলের সে সফরে বাংলাদেশের কোচ ছিলেন আবদুস সালাম ও নুরুল ইসলাম। ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত দুটি আঞ্চলিক ম্যাচই ড্র হয় ১-১ গোলে। ঢাকায় প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ ০-২ গোলে হেরে গেলেও দ্বিতীয় টেস্ট গোলশূন্যভাবে অমীমাংসিত থাকে। তিনি ঢাকা হকি লীগে ওয়ারী, সাধারণ বীমা এবং বিভিন্ন সার্ভিসেস দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন প্রতাপ শংকর হাজরা, আখতার, রহমত, ছেলে কিসমত প্রমুখ। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে মহিলা হকির প্রচলন হয়। সে সময় তিনি কোচের দায়িত্ব পালন করেন। মহিলা আনসার দলেরও তিনি কোচ ছিলেন।
নুরুল ইসলামদের পরিবারের কাছে এ দেশের হকির অনেক ঋণ। এই পরিবার থেকে যতজন হকি খেলোয়াড় উঠে এসেছে, তা একটি মাইলফলক হয়ে আছে। নুরুল ইসলামরা ছয় ভাই হকি খেলার পাশাপাশি সাংগঠনিক দক্ষতারও পরিচয় দেন। গড়ে তোলেন মাহুতটুলি ক্লাব। এই ক্লাবের মাধ্যমে যতজন হকি খেলোয়াড় উঠে এসেছেন, তা উপমহাদেশের হকির ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মাহুতটুলি ক্লাবটি এখন নাম পরিবর্তন করে উষা ক্রীড়াচক্র নামে পরিচিতি পেয়েছে। উষা ঢাকা হকি লীগের সেরা দলগুলোর একটি। নিজেদের পরিবার থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের সম্পর্কে নুরুল ইসলাম জানান, ‘বড় ভাই উজির আলীর ছেলে সাবির আলী ইস্ট পাকিস্তান হকি দলে খেলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বাবা ও ছেলে একসঙ্গে প্রথম বিভাগ হকি লীগে মাহুতটুলির হয়ে খেলেন। মেঝ ভাই ডা. সাদেক আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলী খেলেছেন মাহুতটুলি, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ও সোনালী ব্যাংকে। এছাড়া আহমেদ আলী, লিয়াকত আলী ও তোফাজ্জল আলী ঢাকা লীগে আজাদে খেলেন। সেঝ ভাই ফখরুল ইসলামের ছেলে নাজমুল ইসলাম খেলেন সাধারণ বীমা, ওয়ান্ডারার্স ও বাংলাদেশ স্পোর্টিং ক্লাবে। আমার ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। বড় ছেলে কামরুল ইসলাম কিসমত বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন। বর্তমানে হকি ফেডারেশনের সদস্য। মেঝ ছেলে মতিউল ইসলাম পাপ্পু আজাদ ও কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব, তৃতীয় ছেলে নজরুল ইসলাম প্রিন্স কম্বাইন্ড ও আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব এবং ছোট ছেলে তাজুল ইসলাম তাজুল কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছে। ছোট ভাই শামসুল ইসলামের ছেলে জহুরুল ইসলাম মিতুল বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলে। মাশুকুল ইসলাম মাশুক মাহুতটুলি ও কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব এবং মীর মনোয়ারুল ইসলাম আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলে। মনোয়ার হকির ‘এ’ গ্রেড আম্পায়ার। বোনের ছেলে আজগর আলী মুন্নী হকিতে সুখ্যাতি অর্জন করে। খেলেছে মাহুতটুলি ও সোনালী ব্যাংকে।’
মাহুতটুলি এলাকার হকির অতীতের সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। অথচ এমন দৃষ্টান্তও আছে, বাংলাদেশ জাতীয় দলের ১৬ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১২ জনই খেলতেন মাহুতটুলি থেকে। বড় বাসে করে খেলোয়াড়রা দল বেঁধে বিমানবন্দরে যাওয়া-আসা করতো। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নানা কারণে মাহুতটুলি তার কৌলীন্য হারিয়ে ফেলেছে। মাঠ একটা বড় সমস্যা। আগে আরমানিটোলা মাঠে ইচ্ছেমত খেলার সুযোগ ছিল। তাতে শুধু পাড়ার ছেলেরা খেলতো। এখন মানুষ বেড়েছে। মাঠের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অন্য পাড়ার ছেলেরা এসে আরমানিটোলা মাঠে খেলে। এতে মাঠের ভাগিদার বেড়ে গেছে। তাছাড়া একই মাঠে হকি, ফুটবলসহ অন্যান্য খেলা হওয়ায় কোনো খেলাই নির্দিষ্টভাবে খেলা যায় না। তাছাড়া হকি লীগ নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয় না। এতে করে হতাশ হয়ে পড়েছেন খেলোয়াড়রা। খেলে যদি পেট চালানোর মতো টাকা-কড়ি পাওয়া না যায়, সে খেলার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যে কারণে খেলাধুলার পরিবর্তে জীবিকা নির্বাহের প্রতি সবাই ঝুঁকেছেন। যদিও আমাদের সময় আমরা খেলতাম মনের আনন্দে। কোনো পয়সা-কড়ি ছিল না। তারপরও খেলতে গিয়ে নাক ভেঙেছি। হাত ভেঙেছি। এখন তো সেদিনের সেই অবস্থা নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে কোনো কিছু টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মাহুতটুলির সেই গৌরব না থাকলেও এখনও কেউ কেউ ভালোবেসে হকির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। ফজলু, জামাল হায়দারদের মতো হকি অন্তঃপ্রাণরা প্রতিদিন সকাল বেলা আরমানিটোলা স্কুল মাঠে নতুনদের প্রশিক্ষণ দেন। এটা একটা আশাব্যঞ্জক দিক। এদের কারণে আবার হয়তো হকির সুদিন ফিরে আসতে পারে।’
হকির জন্য বিখ্যাত মাহুতটুলি। আর এই এলাকার ‘হকি পরিবার’ হিসেবে পরিচিত নুরুল ইসলাম নান্নাদের বাড়ি। মূলত এই পরিবারের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পল্লবিত হয়েছে মাহুতটুলি এলাকায় হকি খেলা। অবশ্য এখন আর এই পরিবারে হকির সেই উজ্জ্বলতা নেই। নেই মাহুতটুলির সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে সেই বাড়িটি। আর মহীরুহ হয়ে আছেন নুরুল ইসলাম নান্না। বাংলাদেশের হকি ইতিহাসের উজ্জ্বলতম দিনগুলোর অন্যতম নায়ক। তার নামটি উচ্চারিত হলে অনেকেই শ্রদ্ধায় অবনত হন। প্রতাপ শংকর হাজরার মতো খ্যাতিমান অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদ বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘আমার ওস্তাদ’। জাতীয় পর্যায়ে কোনো স্বীকৃতি না পেলেও এই শ্রদ্ধা, এই সম্মান ও এই ভালোবাসা নুরুল ইসলাম নান্নার জীবনের বড় প্রাপ্তি। #
১৬-৪-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল খেলোয়াড় গড়ার কারিগর মোস্তাফা কামাল/ দুলাল মাহমুদ