গোল করাই ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড শওকতের নেশা/ দুলাল মাহমুদ
একটা সময় তিনি ছিলেন অনেকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তার খেলা দেখার জন্য দর্শকরা ছুটে আসতেন স্টেডিয়ামে। তাকে দেখলে আলোড়িত হতেন সমর্থকরা। তার পায়ে যখন বল যেত, সবাই রুদ্ধশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন গোলের। তার কাছে বল যাওয়ার অর্থ একটাই- গোল। আর ফুটবল তো গোলেরই খেলা। গোল দেয়াটা তার কাছে ছিল সবচেয়ে সহজ কাজের একটি। ফুটবল ক্যারিয়ারে কত গোল যে করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তাকে আবার মাঠের অনেকেই অপছন্দ করতেন। এই অপছন্দের তালিকায় আছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় ও গোলরক্ষকরা। তাকে রুখে দেয়া তাদের জন্য ছিল দুরূহ কাজ। এ কারণে তাকে দেখলে হার্টবিট বেড়ে যেত প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের। তুখোড় সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন তিনি। দাপটের সঙ্গে কাঁপিয়েছেন ফুটবল মাঠ। অথচ ফুটবলের শহর হিসেবে পরিচিত ঝলমলে এই ঢাকা নগরী তাকে মনে রাখেনি। সময়ের পলেস্তরায় আড়াল পড়ে গেছেন তিনি। অবশ্য তার সমসাময়িক খেলোয়াড় তো দূরে থাক, তার খেলা দেখেছেন- এমন দর্শকও বিরল। যে কারণে আজ অস্তমিত তার গৌরবরশ্মি। কিন্তু তার কীর্তি তো হারিয়ে যাবার নয়। সময়ের ধুলো ঝেড়ে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় তাকে। দেশের এক প্রান্তে তিনি যাপন করছেন নিভৃত জীবন। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন সাতক্ষীরায় তার বিষণ্ণ বসবাস। তিনি হলেন শওকত হোসেন খান চৌধুরী।
ঢাকা থেকে দূরালাপনীতে যোগাযোগ করে খুঁড়ে বের করা হয় তার অতীত জীবন। ৭৮ বয়স্ক একজন প্রবীণ ফুটবলারের জীবনখন্ড তারে তারে আর কতটাই উদ্ধার করা সম্ভব? অষ্টপ্রহর মুঠোফোনের যতই গুণকীর্তন করা হোক না কেন, সুদূর সাতক্ষীরায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা কথা বলাটা এখনও সহজতর ও সাবলীল হয়ে ওঠেনি। এমনিতেই কথার গতি মন্থর, তার ওপর হারিয়ে যাচ্ছিল কিংবা ভেঙে ভেঙে যেতে থাকে অনেক না-বলা কথা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই ফুটবলার সময় ও জরার কাছে অনেকটাই আত্মসমর্পণ করেছেন। হারিয়ে ফেলেছেন জীবনের অনেক মূল্যবান স্মৃতি। এখন তিনি মেঘের আড়ালে চাপা পড়া উজ্জ্বল সূর্য। খেই ধরিয়ে দিলেও কথার লাগামটা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার মনে পড়ে হীরের টুকরোর মতো স্মৃতিখন্ড। আর তাতেই উঠে এসেছে তার গৌরবময় খেলোয়াড়ী জীবন।
শওকতের জন্ম সাতক্ষীরায় ১৯৩০ সালের ৭ এপ্রিল। শৈশবে তিনি ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। ডানপিটে। সব রকম খেলাধুলায় তার ছিল অবাধ বিচরণ। গ্রামের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে রাখতেন তিনি তার দুরন্তপনা দিয়ে। খেলাধুলায় তার সঙ্গে কেউ পেরে উঠতো না। তবে ফুটবল খেলাটায় তিনি পেতেন প্রাণের স্পর্শ। এক্ষেত্রে তাকে প্রলুব্ধ করেন কলকাতা মোহামেডান ও মোহনবাগানের সেন্টার ফরোয়ার্ড লুৎফর রহমান। তার খেলা তাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। লুৎফর ছিলেন তাদের এলাকার সন্তান। তারা ৯ ভাই ছিলেন ফুটবলার। তাদের অন্যতম হলেন মতিয়ার রহমান, শামসুর রহমান, আজাদ স্পোর্টিং কাবের হাবিবুর রহমান মনু। তাদের প্রেরণায় সবকিছু বাদ দিয়ে তাই তিনি বুঁদ হয়ে যান ফুটবলে। ফুটবলের গন্ধ পেলেই ছুটতেন বল্গা হরিণের মতো। প্রাণনাথ হাইস্কুলে ছিল ফুটবলের পরিবেশ। এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ফুটবল হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। তার ফুটবল প্রতিভার দক্ষতা চারপাশ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালে তার অভিষেক হয় সাতক্ষীরা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে। খেলেন টাউন ক্লাবের হয়ে। দু’বছর খেলার পর যোগ দেন পিকে ইউনিয়নে। সাতক্ষীরার পাশাপাশি খুলনা ও যশোর লীগে তিনি নিয়মিত খেলেন।
সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিলে যে কোনো সময় তার প্রকাশ ঘটবে। প্রতিভাকে কখনো চাপিয়ে রাখা যায় না। সেটি যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সময় ও সুযোগমত প্রতিভা বিকশিত হয় স্বমহিমায়। শওকতের দুরন্ত ক্রীড়াশৈলীর কথা পৌঁছে যায় ঢাকায়। তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দেয় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইপিআর। স্মৃতি খুঁড়ে তিনি জানান, ‘তিন বছর বয়সে আমি আমার পিতাকে হারাই। সৎভাই সংসারের দেখাশোনা করতেন। তবে আমার অভিভাবক ছিলেন আমার মা। ইপিআর থেকে আমার স্কুলের ঠিকানায় চিঠি আসে। স্কুল থেকে আমাকে খবর দিয়ে পাঠানো হয়। স্কুল থেকে বলা হয়, তোমার নামে একটি চিঠি এসেছে। তুমি যদি রাজি থাক, তাহলে তোমাকে চিঠিখানি দেয়া হবে। যাই হোক, আমার নামে চাকরির নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে ইপিআর। আমি মায়ের অনুমতি নিয়ে ১৯৫১ সালের ৪ এপ্রিল যোগ দেই ইপিআর-এ। মাসিক বেতন ছিল ১০৫ টাকা। ১৯৫২ সালে ইপিআরের হয়ে ঢাকায় ‘বি’ ডিভিশনের হয়ে খেলি। আমার পজিশন ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড। বলের জোগান পেলে আমাকে রোখে সাধ্যি কার? আর আমার পায়ে বল পৌঁছে দিতেন লেফট-ইন বাদশা মিঞা। আমাদের পারস্পরিক সমঝোতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইপিআর।’ সে বছর ইপিআর ‘বি’ ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে ওঠে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ইপিআরের হয়ে ঢাকার মাঠে দাপিয়েছেন তিনি। সে সময় ইপিআর টিমের অধিনায়ক ছিলেন রাইট ইন ক্যাপ্টেন নেওয়াজ। এছাড়াও খেলতেন হাফে রফিক, ব্যাকে হাবিব, লেফট আউটে বাদশা। ইপিআর সে সময় প্রতিপক্ষের কাছে ছিল রীতিমত ত্রাস। তাদেরকে হারানো ছিল যে কোনো দলের জন্য কঠিন। ইপিআরে খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের বাদশা ছাড়া খেলার সময় আমাকে মাঠে পারতপক্ষে কেউ সহযোগিতা করতো না। সবাই কেন জানি অবহেলা করতো। তবে আমি ছিলাম ইপিআরের প্রধান আকর্ষণ। আগে ইপিআরের খেলায় দর্শক আসতো না। আমি যোগ দেয়ার পর গ্যালারি ভরে যেত। আমার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমার পায়ে বল এলে দর্শকরা উৎসাহিত হয়ে উঠতেন। আমি দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে যাই। আমার অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ভক্তরা ছুটে আসতেন।’ ইপিআর থেকে রিজাইন করে ১৯৫৭ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কর্নেল ওসমান গনি আমাকে চাকরি ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি আমাকে বলেন, উর্দুভাষীদের সঙ্গে চাকরি করা যায় না। তবে মা ছিলেন আমার সবকিছু। তিনিও সবকিছু শুনে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে বলেন। মায়ের নির্দেশ পেয়ে আমি আর কালবিলম্ব না করে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে থাকার সময় একদিন দেখি খ্যাতিমান ফুটবলার গজনবী আমার কাছে হাজির। তিনি আমাকে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে খেলার জন্য নিয়ে যান। ওয়ান্ডারার্স অন্য খেলোয়াড়দের যা দেয়, আমাকে তাই দেয়ার কথা বলে। এক বছর খেলার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা-পয়সা না দেয়ায় ঢাকা মোহামেডান আমাকে প্রস্তাব দিলে আমি তাদের দলে যোগ দেই। আমাকে নিয়ে যান মোহামেডানের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান। ১৪০০ টাকা দেয়ার কথা দিয়ে আমাকে অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মোহামেডানে নেয়া হয়।’
এরপর আর ঢাকায় তার মন টেকেনি। ঢাকার ফুটবলের গ্ল্যামারাস জগত ছেড়ে ফিরে আসেন গ্রামে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আর্থিক সমস্যার কারণে আমি বেশিদিন ফুটবল খেলতে পারিনি। ১৯৫৩ সালে আমি বিয়ে করি। আমার তো সংসার আছে। আর সংসার চালাতে হলে টাকার প্রয়োজন। আমি ফুটবল মাঠে নিজেকে উজাড় করে দিলেও প্রতিদানে তেমন কিছুই পাইনি। ইপিআরে খেলার সময় যে বেতন পেতাম, তাতে সংসার চলতো না। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ঢাকা মোহামেডান আমাকে যে অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তা তারা পূরণ করেনি। আমি তো আমার পরিবারকে অভুক্ত রেখে ফুটবল খেলতে পারি না। এ কারণে সেরা দলের খেলোয়াড় এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও আমি সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে আসি। কোনো আকর্ষণ, কোনো পিছুটান আমাকে আটকাতে পারেনি।’
দেশ ভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ফুটবলের নতুন করে যাত্রা শুরু হয়। সে সময় ফুটবলার হিসেবে যারা খ্যাতি অর্জন করেন, শওকত ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের ভাওয়ালপুরে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলতে যায় পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দল। সে দলের হয়ে খেলেন তিনি। সেন্টার ফরোয়ার্ড আনোয়ারকে টপকে তিনি স্থান করে নেন দলে। দলের অন্য খেলোয়াড়রা হলেন- খালেক চৌধুরী, ওয়াজেদ মিয়াজী, এস এ জামান মুক্তা, গজনবী, চুন্না রশীদ, কবীর, আবদুর রহিম, ফজলুর রহমান আরজু, রণজিত, নেওয়াজ, হান্নান, সামাদ, উপেন, সাদেক। প্রথম ম্যাচেই বেলুচিস্তানের কাছে ০-১ গোলে ইস্ট পাকিস্তান দল হেরে যায়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে তিনি ডাক পান। কিন্তু পায়ের সমস্যার কারণে খেলতে পারেননি। তার নামে ৩/৪ বার টেলিগ্রাম আসে। তার দু’পা ফুলে যাওয়ায় তিনি সাড়া দিতে পারেননি। ১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা ফুটবল লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতে যান। ২/১টি ম্যাচ খেলার পর পাসপোর্ট সমস্যার কারণে দেশে ফিরে আসেন। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য ইপিআর ও পুলিশের খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হয় আইজিপি একাদশ। এ দলটি সারা দেশে খেলতে যায়। সব মিলিয়ে ১৩টি জেলা। তখন তো জেলা ছিল ১৮/১৯টি। কোথাও আইজিপি দল হারেনি। এ দলটি বিপুলভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। প্রতিটি ম্যাচেই তিনি গোল করার দুর্লভ কৃতিত্ব দেখান।
নিজের স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫৪ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট শীল্ডে আইজিপি টিমের হয়ে খেলি। আমার দেয়া একমাত্র গোলে ঢাকা একাদশকে হারিয়ে দেই। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর ব্যক্তিগত কার্ড দেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গেলে আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমার কপালে জটি ছিল। তিনি আমাকে বলেন, যাদের কপালে জটি থাকে, তারা খুবই ভাগ্যবান।’ শওকত ছাড়াও আইজিপি একাদশের হয়ে খেলেন : নূর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ হোসেন, শফিক আহমেদ, মোমিন, নূরু মিঞা, আবু, রহমান, অধিনায়ক আর এ রশিদ, বাদশা মিঞা, মোহাম্মদ হালিম ও সওদাগর মিয়া। ১৯৫৫ সালটি আমার ফুটবল জীবনের স্মরণীয় বছর। সে বছর লীগে ২৪টিসহ সব মিলিয়ে ১০১টি গোল করেছি। এর মধ্যে আইজিপি দলের হয়ে বিভিন্ন জেলায় খেলতে গিয়ে অসংখ্য গোল করি। ১৯৫৮ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে বগুড়ায় ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে যাই। নর্থ বেঙ্গল একাদশের সঙ্গে খেলায় আমরা ৫-০ গোলে জয়ী হই। পাঁচটি গোলই আসে আমার পা থেকে। প্রথমার্ধে চারটি ও দ্বিতীয়ার্ধে একটি গোল দেই। খেলায় উপস্থিত জেলার ডিসি সাহেব খুশি হয়ে আমাকে একটি রুমাল উপহার দেন। সালটা মনে নেই। ইপিআরের হয়ে খেলার সময় ইস্পাহানিকে ৮-০ গোলে পরাজিত করি। আমি একাই করি ৭ গোল। আরেকবার আজাদ স্পোর্টিং কাবকে ইপিআর ৫-০ গোলে হারায়। আমি একাই দেই ৪ গোল। আমাদের গ্রামের কাছে পারুলিয়ায় ভালো একটি টুর্নামেন্ট হতো। তাতে ভারত থেকে ফুটবলাররা খেলতে আসতেন। আমি সাতক্ষীরা টাউন ক্লাবের হয়ে খেলি। একবার ফাইনাল ম্যাচে আমাদের প্রতিপক্ষ দলের সবাই ছিল ভারত থেকে আসা খেলোয়াড়। আমরা হেরে যাব বলে খেলার আগে কেউ কেউ টিটকিরি দেয়। খেলায় আমরা অনায়াসে জিতে শীল্ড লাভ করি। আমি ২/৩টি গোল করি। ১৯৫৬ কিংবা ১৯৫৭ সাল হবে। আমি ও নবী চৌধুরী যশোরের সিঅ্যান্ডবির হয়ে খেলতে যাই। আমরা যশোরের গ্রীন একাদশকে ২-০ গোলে হারিয়ে দেই। দুটি গোলই আমি করেছিলাম দুর্দান্ত ভলি থেকে। আমার গোল দুটি দেখে নবী চৌধুরী মুগ্ধ হয়ে যান। এরকম কত যে স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছি, তা এখন আর মনে করতে পারি না। স্মরণশক্তি একদমই কমে গেছে।’
খেলোয়াড়ী জীবনে কোচ হিসেবে কাউকে তেমনভাবে পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি নিজের মত করে খেলেছি। তবে কলকাতা মোহামেডানের স্বর্ণযুগের ফুটবলার ও পূর্ব পাকিস্তানের কোচ আবদুস সাত্তার, হাফেজ রশীদ, আবদুর রশীদের অল্প কিছু পরামর্শ পেয়েছি। তার ফলে নিজের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে নেই।’
সাতক্ষীরা চলে আসার পর তাকে নামতে হয় কঠিন জীবন সংগ্রামে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে এসে দোকান দেই। তবে সাতক্ষীরা ও খুলনায় ফুটবল খেলা অব্যাহত রাখি। ঢাকা মোহামেডানে খেলার সময় খুলনা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খুলনা মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলি এবং মুসলিম স্পোর্টিং কাব চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৯-৬০ সালে যশোর লীগে সিঅ্যান্ডবি দলের হয়ে খেলি এবং দল চ্যাম্পিয়ন হয়। কষ্টকর জীবনযাপনের পর ১৯৬০ সালে যোগ দেই ওয়াপদার চাকরিতে। ১৯৬১ সালে রেফারি হিসেবে খেলা পরিচালনা শুরু করি। ১৯৬২ সালে শেষবারের মতো ঢাকায় ইপিআরের হয়ে রোনাল্ডস শীল্ডে খেলি।’
শওকত রেফারি ও কোচিং করান এবং সাতক্ষীরায় সে সময় কোনো সংগঠন না থাকায় তিনি একটি ফুটবল দল গড়ে তোলেন ‘পলাশপোল ট্রেডিং ক্লাব’ নামে। প্রথম বছরেই এ ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬৫ সালে সাতক্ষীরা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারি হন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭৭ সাল থেকে রেফারিং ও মাঝেমধ্যে কোচিং করান। ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা জেলা হলে তিনি ফুটবল প্রশিক্ষক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি হন। ১৯৯১ সালে ওয়াপদার চাকরি থেকে অবসর নেন।
নিজের খেলোয়াড়ী জীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ফুটবল ক্যারিয়ারে মাত্র ৬টি খেলায় পরাজিত হয়েছি। ড্র হয়েছে ২/১টি ম্যাচ।’
পাঁচ ফুট সাড়ে নয় ইঞ্চি লম্বা শওকত নিজের খেলার বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক সময় এককভাবে খেলতাম। অ্যাঙ্গেলে গোল করতে পারতাম। একদম পারফেক্ট গোল। আমার শটের অসম্ভব স্পিড ছিল। হাতে বল লাগলে গোলকিপার ধাক্কার চোটে পেছনে চলে যেতেন এবং তাতেই গোল হয়ে যেত। তাছাড়া আমি ছিলাম সুযোগসন্ধানী। একটু ফাঁক-ফোকর পেলেই অনায়াসে গোল করতাম।’
নিজের দেখা সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি খুব বেশি খেলা দেখার সুযোগ পাইনি। ইপিআরে বেশিরভাগ সময় খেলেছি। যে কারণে আমাদের খেলা দেখার মোটেও সুযোগ ছিল না। প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলার সময় যেটুকু দেখেছি, তা থেকে বলতে পারি- আজাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনোয়ার ছিলেন খুব ফিটফাট। খুবই স্পিডি। ফাউল না করে বল নিয়ে ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যেতে পারতেন। আনোয়ার-মুক্তা-আনজামের কম্বিনেশন ছিল অসাধারণ। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ ভেঙেচুরে দিতে পারতেন।’
১৯৫৫ সালের ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল দলের সহযোগী ফুটবলারদের সম্পর্কে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘গোলরক্ষক ওয়াজেদ মিয়াজীর তখন বয়স হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। সে বয়সেও অসাধারণ খেলতেন। আমার ফুটবল জীবনে আমি প্রতিপক্ষের সব গোলরক্ষককে গোল দিয়েছি। কিন্তু তাকে কখনো বিট করতে পারিনি। চুন্না রশিদ ছিলেন সুযোগ সন্ধানী খেলোয়াড়। তবে তার বাঁ পা ভালো চলতো না। মুক্তার কথা তো আগেই বলেছি। দুর্দান্ত খেলতেন। খালেকও ডাকাবুকো খেলোয়াড় ছিলেন। তাকে টপকানো সহজ ছিল না। কবীর ছিলেন দুরন্ত খেলোয়াড়। রহিম লেফট আউটে খেলতেন। দুর্দান্ত স্পিরিট ছিল। গোলরক্ষক রণজিত দাস ছিলেন ছোটখাট। এ কারণে অনেক সময় গোল খেয়ে যেতেন। খুবই ভদ্রলোক। বল ঠেকাতে ওস্তাদ ছিলেন। তার শরীরে বলের দাগ পড়ে যেত। কখনোই নত হতেন না। খেলোয়াড়দের পায়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে বল ছিনিয়ে নিতেন। গজনবী ছিলেন ডানপিটে। তাকে দেখলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা যমের মতো ভয় পেতেন। নেওয়াজ খেলতেন বিজি প্রেসে। ডিফেন্সের খেলোয়াড়। ভদ্র ও ছিমছাম গোছের। সাদেক ছিলেন আধ-পাগলা। মাঝেমধ্যে ভালো খেলতেন, মাঝেমধ্যে খারাপ খেলতেন। আরজু ছিলেন ছোটখাট গড়নের। রাইট হাফে খেলতেন। দুরন্ত খেলোয়াড়। বল নিয়ে বের হয়ে যেতে পারতেন। সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, পেছন থেকে ছোঁ মেরে বল নিয়ে নিতেন। উপেন মোটামুটি ভালোই খেলতেন। হান্নান, সামাদের খেলার কথা মনে করতে পারছি না।’
তখনকার ফুটবল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় ডাব্লিউ ফরমেশনে খেলা হতো। দুই ব্যাক, তিন হাফ ও পাঁচ ফরোয়ার্ড। ফরোয়ার্ডের খেলোয়াড়রা খুব তেজীয়ান ও গতিশীল হতেন। খুব দ্রুত দৌড়াতেও পারতেন।’
বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে ও চার মেয়ে। কোনোরকম জীবনযাপন করছি। ওয়াপদার চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর অল্প কিছু পেনশন পাই। ১৯৮৩ সাল থেকে প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে মাসোহারা পেতাম। এখন আর পাই না। প্রচুর দেনা মাথায় নিয়ে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আমার অনুপস্থিতিতে অংশীদাররা সব জমিজমা বিক্রি করে দেয়ায় আমার কোনো অবলম্বন নেই। পৈতৃক বাড়িটাও ব্যাংকে বন্ধক। সীমাহীন দারিদ্র্যের মাঝে জীবনযাপন করছি। আর্থিক সাহায্য পেলে এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দুঃসহ জীবন কাটাতে হতো না। তাছাড়া শরীর আর চলতে চায় না। একবার ঢাকায় যেতে মন চায়। সেই সঙ্গতি কোথায়? তবে সাতক্ষীরায় আমি যথেষ্ট সম্মান পাই। সাতক্ষীরায় অনেককে খেলা শিখিয়েছি। তবে তারা খেলাটাকে ধরে রাখতে পারেনি। অর্থনৈতিক সংকট অনেক সময় প্রতিভাকে দমিয়ে রাখে। তবে চেষ্টা থাকলে অবশ্য উঠে আসা যায়।’
খেলোয়াড়ী জীবনে তিনি ছিলেন বাজির ঘোড়ার মতো। তার খেলা দেখার জন্য দর্শকরা ছুটে আসতেন। তখন সময় ছিল কতই না রঙ ঝলমলে। দু’পায়ে শাসন করেছেন ফুটবল মাঠ। তিনি ছিলেন সবার নয়নের মণি। আর আজ পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ আর তাকে স্পর্শ করে না। কারো সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ নেই। ১৯৮৩ সালে স্ত্রী বিয়োগ হয়। বলতে গেলে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যেন অপেক্ষা অন্য জীবনের। অথচ এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। তা নিয়ে অবশ্য তার কোনো ক্ষোভ-দুঃখ-ব্যথা-বেদনা নেই। তবে জীবনের এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে চান একটু স্বস্তি ও সহানুভূতি। #
১-৩-২০০৮
ঢাকা থেকে দূরালাপনীতে যোগাযোগ করে খুঁড়ে বের করা হয় তার অতীত জীবন। ৭৮ বয়স্ক একজন প্রবীণ ফুটবলারের জীবনখন্ড তারে তারে আর কতটাই উদ্ধার করা সম্ভব? অষ্টপ্রহর মুঠোফোনের যতই গুণকীর্তন করা হোক না কেন, সুদূর সাতক্ষীরায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা কথা বলাটা এখনও সহজতর ও সাবলীল হয়ে ওঠেনি। এমনিতেই কথার গতি মন্থর, তার ওপর হারিয়ে যাচ্ছিল কিংবা ভেঙে ভেঙে যেতে থাকে অনেক না-বলা কথা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই ফুটবলার সময় ও জরার কাছে অনেকটাই আত্মসমর্পণ করেছেন। হারিয়ে ফেলেছেন জীবনের অনেক মূল্যবান স্মৃতি। এখন তিনি মেঘের আড়ালে চাপা পড়া উজ্জ্বল সূর্য। খেই ধরিয়ে দিলেও কথার লাগামটা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার মনে পড়ে হীরের টুকরোর মতো স্মৃতিখন্ড। আর তাতেই উঠে এসেছে তার গৌরবময় খেলোয়াড়ী জীবন।
শওকতের জন্ম সাতক্ষীরায় ১৯৩০ সালের ৭ এপ্রিল। শৈশবে তিনি ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। ডানপিটে। সব রকম খেলাধুলায় তার ছিল অবাধ বিচরণ। গ্রামের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে রাখতেন তিনি তার দুরন্তপনা দিয়ে। খেলাধুলায় তার সঙ্গে কেউ পেরে উঠতো না। তবে ফুটবল খেলাটায় তিনি পেতেন প্রাণের স্পর্শ। এক্ষেত্রে তাকে প্রলুব্ধ করেন কলকাতা মোহামেডান ও মোহনবাগানের সেন্টার ফরোয়ার্ড লুৎফর রহমান। তার খেলা তাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। লুৎফর ছিলেন তাদের এলাকার সন্তান। তারা ৯ ভাই ছিলেন ফুটবলার। তাদের অন্যতম হলেন মতিয়ার রহমান, শামসুর রহমান, আজাদ স্পোর্টিং কাবের হাবিবুর রহমান মনু। তাদের প্রেরণায় সবকিছু বাদ দিয়ে তাই তিনি বুঁদ হয়ে যান ফুটবলে। ফুটবলের গন্ধ পেলেই ছুটতেন বল্গা হরিণের মতো। প্রাণনাথ হাইস্কুলে ছিল ফুটবলের পরিবেশ। এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ফুটবল হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। তার ফুটবল প্রতিভার দক্ষতা চারপাশ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালে তার অভিষেক হয় সাতক্ষীরা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে। খেলেন টাউন ক্লাবের হয়ে। দু’বছর খেলার পর যোগ দেন পিকে ইউনিয়নে। সাতক্ষীরার পাশাপাশি খুলনা ও যশোর লীগে তিনি নিয়মিত খেলেন।
সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিলে যে কোনো সময় তার প্রকাশ ঘটবে। প্রতিভাকে কখনো চাপিয়ে রাখা যায় না। সেটি যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সময় ও সুযোগমত প্রতিভা বিকশিত হয় স্বমহিমায়। শওকতের দুরন্ত ক্রীড়াশৈলীর কথা পৌঁছে যায় ঢাকায়। তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দেয় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইপিআর। স্মৃতি খুঁড়ে তিনি জানান, ‘তিন বছর বয়সে আমি আমার পিতাকে হারাই। সৎভাই সংসারের দেখাশোনা করতেন। তবে আমার অভিভাবক ছিলেন আমার মা। ইপিআর থেকে আমার স্কুলের ঠিকানায় চিঠি আসে। স্কুল থেকে আমাকে খবর দিয়ে পাঠানো হয়। স্কুল থেকে বলা হয়, তোমার নামে একটি চিঠি এসেছে। তুমি যদি রাজি থাক, তাহলে তোমাকে চিঠিখানি দেয়া হবে। যাই হোক, আমার নামে চাকরির নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে ইপিআর। আমি মায়ের অনুমতি নিয়ে ১৯৫১ সালের ৪ এপ্রিল যোগ দেই ইপিআর-এ। মাসিক বেতন ছিল ১০৫ টাকা। ১৯৫২ সালে ইপিআরের হয়ে ঢাকায় ‘বি’ ডিভিশনের হয়ে খেলি। আমার পজিশন ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড। বলের জোগান পেলে আমাকে রোখে সাধ্যি কার? আর আমার পায়ে বল পৌঁছে দিতেন লেফট-ইন বাদশা মিঞা। আমাদের পারস্পরিক সমঝোতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইপিআর।’ সে বছর ইপিআর ‘বি’ ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে ওঠে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ইপিআরের হয়ে ঢাকার মাঠে দাপিয়েছেন তিনি। সে সময় ইপিআর টিমের অধিনায়ক ছিলেন রাইট ইন ক্যাপ্টেন নেওয়াজ। এছাড়াও খেলতেন হাফে রফিক, ব্যাকে হাবিব, লেফট আউটে বাদশা। ইপিআর সে সময় প্রতিপক্ষের কাছে ছিল রীতিমত ত্রাস। তাদেরকে হারানো ছিল যে কোনো দলের জন্য কঠিন। ইপিআরে খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের বাদশা ছাড়া খেলার সময় আমাকে মাঠে পারতপক্ষে কেউ সহযোগিতা করতো না। সবাই কেন জানি অবহেলা করতো। তবে আমি ছিলাম ইপিআরের প্রধান আকর্ষণ। আগে ইপিআরের খেলায় দর্শক আসতো না। আমি যোগ দেয়ার পর গ্যালারি ভরে যেত। আমার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমার পায়ে বল এলে দর্শকরা উৎসাহিত হয়ে উঠতেন। আমি দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে যাই। আমার অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ভক্তরা ছুটে আসতেন।’ ইপিআর থেকে রিজাইন করে ১৯৫৭ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কর্নেল ওসমান গনি আমাকে চাকরি ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি আমাকে বলেন, উর্দুভাষীদের সঙ্গে চাকরি করা যায় না। তবে মা ছিলেন আমার সবকিছু। তিনিও সবকিছু শুনে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে বলেন। মায়ের নির্দেশ পেয়ে আমি আর কালবিলম্ব না করে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে থাকার সময় একদিন দেখি খ্যাতিমান ফুটবলার গজনবী আমার কাছে হাজির। তিনি আমাকে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে খেলার জন্য নিয়ে যান। ওয়ান্ডারার্স অন্য খেলোয়াড়দের যা দেয়, আমাকে তাই দেয়ার কথা বলে। এক বছর খেলার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা-পয়সা না দেয়ায় ঢাকা মোহামেডান আমাকে প্রস্তাব দিলে আমি তাদের দলে যোগ দেই। আমাকে নিয়ে যান মোহামেডানের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান। ১৪০০ টাকা দেয়ার কথা দিয়ে আমাকে অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মোহামেডানে নেয়া হয়।’
এরপর আর ঢাকায় তার মন টেকেনি। ঢাকার ফুটবলের গ্ল্যামারাস জগত ছেড়ে ফিরে আসেন গ্রামে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আর্থিক সমস্যার কারণে আমি বেশিদিন ফুটবল খেলতে পারিনি। ১৯৫৩ সালে আমি বিয়ে করি। আমার তো সংসার আছে। আর সংসার চালাতে হলে টাকার প্রয়োজন। আমি ফুটবল মাঠে নিজেকে উজাড় করে দিলেও প্রতিদানে তেমন কিছুই পাইনি। ইপিআরে খেলার সময় যে বেতন পেতাম, তাতে সংসার চলতো না। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ঢাকা মোহামেডান আমাকে যে অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তা তারা পূরণ করেনি। আমি তো আমার পরিবারকে অভুক্ত রেখে ফুটবল খেলতে পারি না। এ কারণে সেরা দলের খেলোয়াড় এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও আমি সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে আসি। কোনো আকর্ষণ, কোনো পিছুটান আমাকে আটকাতে পারেনি।’
দেশ ভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ফুটবলের নতুন করে যাত্রা শুরু হয়। সে সময় ফুটবলার হিসেবে যারা খ্যাতি অর্জন করেন, শওকত ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের ভাওয়ালপুরে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলতে যায় পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দল। সে দলের হয়ে খেলেন তিনি। সেন্টার ফরোয়ার্ড আনোয়ারকে টপকে তিনি স্থান করে নেন দলে। দলের অন্য খেলোয়াড়রা হলেন- খালেক চৌধুরী, ওয়াজেদ মিয়াজী, এস এ জামান মুক্তা, গজনবী, চুন্না রশীদ, কবীর, আবদুর রহিম, ফজলুর রহমান আরজু, রণজিত, নেওয়াজ, হান্নান, সামাদ, উপেন, সাদেক। প্রথম ম্যাচেই বেলুচিস্তানের কাছে ০-১ গোলে ইস্ট পাকিস্তান দল হেরে যায়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে তিনি ডাক পান। কিন্তু পায়ের সমস্যার কারণে খেলতে পারেননি। তার নামে ৩/৪ বার টেলিগ্রাম আসে। তার দু’পা ফুলে যাওয়ায় তিনি সাড়া দিতে পারেননি। ১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা ফুটবল লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতে যান। ২/১টি ম্যাচ খেলার পর পাসপোর্ট সমস্যার কারণে দেশে ফিরে আসেন। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য ইপিআর ও পুলিশের খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হয় আইজিপি একাদশ। এ দলটি সারা দেশে খেলতে যায়। সব মিলিয়ে ১৩টি জেলা। তখন তো জেলা ছিল ১৮/১৯টি। কোথাও আইজিপি দল হারেনি। এ দলটি বিপুলভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। প্রতিটি ম্যাচেই তিনি গোল করার দুর্লভ কৃতিত্ব দেখান।
নিজের স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫৪ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট শীল্ডে আইজিপি টিমের হয়ে খেলি। আমার দেয়া একমাত্র গোলে ঢাকা একাদশকে হারিয়ে দেই। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর ব্যক্তিগত কার্ড দেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গেলে আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমার কপালে জটি ছিল। তিনি আমাকে বলেন, যাদের কপালে জটি থাকে, তারা খুবই ভাগ্যবান।’ শওকত ছাড়াও আইজিপি একাদশের হয়ে খেলেন : নূর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ হোসেন, শফিক আহমেদ, মোমিন, নূরু মিঞা, আবু, রহমান, অধিনায়ক আর এ রশিদ, বাদশা মিঞা, মোহাম্মদ হালিম ও সওদাগর মিয়া। ১৯৫৫ সালটি আমার ফুটবল জীবনের স্মরণীয় বছর। সে বছর লীগে ২৪টিসহ সব মিলিয়ে ১০১টি গোল করেছি। এর মধ্যে আইজিপি দলের হয়ে বিভিন্ন জেলায় খেলতে গিয়ে অসংখ্য গোল করি। ১৯৫৮ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে বগুড়ায় ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে যাই। নর্থ বেঙ্গল একাদশের সঙ্গে খেলায় আমরা ৫-০ গোলে জয়ী হই। পাঁচটি গোলই আসে আমার পা থেকে। প্রথমার্ধে চারটি ও দ্বিতীয়ার্ধে একটি গোল দেই। খেলায় উপস্থিত জেলার ডিসি সাহেব খুশি হয়ে আমাকে একটি রুমাল উপহার দেন। সালটা মনে নেই। ইপিআরের হয়ে খেলার সময় ইস্পাহানিকে ৮-০ গোলে পরাজিত করি। আমি একাই করি ৭ গোল। আরেকবার আজাদ স্পোর্টিং কাবকে ইপিআর ৫-০ গোলে হারায়। আমি একাই দেই ৪ গোল। আমাদের গ্রামের কাছে পারুলিয়ায় ভালো একটি টুর্নামেন্ট হতো। তাতে ভারত থেকে ফুটবলাররা খেলতে আসতেন। আমি সাতক্ষীরা টাউন ক্লাবের হয়ে খেলি। একবার ফাইনাল ম্যাচে আমাদের প্রতিপক্ষ দলের সবাই ছিল ভারত থেকে আসা খেলোয়াড়। আমরা হেরে যাব বলে খেলার আগে কেউ কেউ টিটকিরি দেয়। খেলায় আমরা অনায়াসে জিতে শীল্ড লাভ করি। আমি ২/৩টি গোল করি। ১৯৫৬ কিংবা ১৯৫৭ সাল হবে। আমি ও নবী চৌধুরী যশোরের সিঅ্যান্ডবির হয়ে খেলতে যাই। আমরা যশোরের গ্রীন একাদশকে ২-০ গোলে হারিয়ে দেই। দুটি গোলই আমি করেছিলাম দুর্দান্ত ভলি থেকে। আমার গোল দুটি দেখে নবী চৌধুরী মুগ্ধ হয়ে যান। এরকম কত যে স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছি, তা এখন আর মনে করতে পারি না। স্মরণশক্তি একদমই কমে গেছে।’
খেলোয়াড়ী জীবনে কোচ হিসেবে কাউকে তেমনভাবে পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি নিজের মত করে খেলেছি। তবে কলকাতা মোহামেডানের স্বর্ণযুগের ফুটবলার ও পূর্ব পাকিস্তানের কোচ আবদুস সাত্তার, হাফেজ রশীদ, আবদুর রশীদের অল্প কিছু পরামর্শ পেয়েছি। তার ফলে নিজের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে নেই।’
সাতক্ষীরা চলে আসার পর তাকে নামতে হয় কঠিন জীবন সংগ্রামে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে এসে দোকান দেই। তবে সাতক্ষীরা ও খুলনায় ফুটবল খেলা অব্যাহত রাখি। ঢাকা মোহামেডানে খেলার সময় খুলনা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খুলনা মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলি এবং মুসলিম স্পোর্টিং কাব চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৯-৬০ সালে যশোর লীগে সিঅ্যান্ডবি দলের হয়ে খেলি এবং দল চ্যাম্পিয়ন হয়। কষ্টকর জীবনযাপনের পর ১৯৬০ সালে যোগ দেই ওয়াপদার চাকরিতে। ১৯৬১ সালে রেফারি হিসেবে খেলা পরিচালনা শুরু করি। ১৯৬২ সালে শেষবারের মতো ঢাকায় ইপিআরের হয়ে রোনাল্ডস শীল্ডে খেলি।’
শওকত রেফারি ও কোচিং করান এবং সাতক্ষীরায় সে সময় কোনো সংগঠন না থাকায় তিনি একটি ফুটবল দল গড়ে তোলেন ‘পলাশপোল ট্রেডিং ক্লাব’ নামে। প্রথম বছরেই এ ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬৫ সালে সাতক্ষীরা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারি হন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭৭ সাল থেকে রেফারিং ও মাঝেমধ্যে কোচিং করান। ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা জেলা হলে তিনি ফুটবল প্রশিক্ষক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি হন। ১৯৯১ সালে ওয়াপদার চাকরি থেকে অবসর নেন।
নিজের খেলোয়াড়ী জীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ফুটবল ক্যারিয়ারে মাত্র ৬টি খেলায় পরাজিত হয়েছি। ড্র হয়েছে ২/১টি ম্যাচ।’
পাঁচ ফুট সাড়ে নয় ইঞ্চি লম্বা শওকত নিজের খেলার বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক সময় এককভাবে খেলতাম। অ্যাঙ্গেলে গোল করতে পারতাম। একদম পারফেক্ট গোল। আমার শটের অসম্ভব স্পিড ছিল। হাতে বল লাগলে গোলকিপার ধাক্কার চোটে পেছনে চলে যেতেন এবং তাতেই গোল হয়ে যেত। তাছাড়া আমি ছিলাম সুযোগসন্ধানী। একটু ফাঁক-ফোকর পেলেই অনায়াসে গোল করতাম।’
নিজের দেখা সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি খুব বেশি খেলা দেখার সুযোগ পাইনি। ইপিআরে বেশিরভাগ সময় খেলেছি। যে কারণে আমাদের খেলা দেখার মোটেও সুযোগ ছিল না। প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলার সময় যেটুকু দেখেছি, তা থেকে বলতে পারি- আজাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনোয়ার ছিলেন খুব ফিটফাট। খুবই স্পিডি। ফাউল না করে বল নিয়ে ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যেতে পারতেন। আনোয়ার-মুক্তা-আনজামের কম্বিনেশন ছিল অসাধারণ। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ ভেঙেচুরে দিতে পারতেন।’
১৯৫৫ সালের ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল দলের সহযোগী ফুটবলারদের সম্পর্কে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘গোলরক্ষক ওয়াজেদ মিয়াজীর তখন বয়স হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। সে বয়সেও অসাধারণ খেলতেন। আমার ফুটবল জীবনে আমি প্রতিপক্ষের সব গোলরক্ষককে গোল দিয়েছি। কিন্তু তাকে কখনো বিট করতে পারিনি। চুন্না রশিদ ছিলেন সুযোগ সন্ধানী খেলোয়াড়। তবে তার বাঁ পা ভালো চলতো না। মুক্তার কথা তো আগেই বলেছি। দুর্দান্ত খেলতেন। খালেকও ডাকাবুকো খেলোয়াড় ছিলেন। তাকে টপকানো সহজ ছিল না। কবীর ছিলেন দুরন্ত খেলোয়াড়। রহিম লেফট আউটে খেলতেন। দুর্দান্ত স্পিরিট ছিল। গোলরক্ষক রণজিত দাস ছিলেন ছোটখাট। এ কারণে অনেক সময় গোল খেয়ে যেতেন। খুবই ভদ্রলোক। বল ঠেকাতে ওস্তাদ ছিলেন। তার শরীরে বলের দাগ পড়ে যেত। কখনোই নত হতেন না। খেলোয়াড়দের পায়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে বল ছিনিয়ে নিতেন। গজনবী ছিলেন ডানপিটে। তাকে দেখলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা যমের মতো ভয় পেতেন। নেওয়াজ খেলতেন বিজি প্রেসে। ডিফেন্সের খেলোয়াড়। ভদ্র ও ছিমছাম গোছের। সাদেক ছিলেন আধ-পাগলা। মাঝেমধ্যে ভালো খেলতেন, মাঝেমধ্যে খারাপ খেলতেন। আরজু ছিলেন ছোটখাট গড়নের। রাইট হাফে খেলতেন। দুরন্ত খেলোয়াড়। বল নিয়ে বের হয়ে যেতে পারতেন। সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, পেছন থেকে ছোঁ মেরে বল নিয়ে নিতেন। উপেন মোটামুটি ভালোই খেলতেন। হান্নান, সামাদের খেলার কথা মনে করতে পারছি না।’
তখনকার ফুটবল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় ডাব্লিউ ফরমেশনে খেলা হতো। দুই ব্যাক, তিন হাফ ও পাঁচ ফরোয়ার্ড। ফরোয়ার্ডের খেলোয়াড়রা খুব তেজীয়ান ও গতিশীল হতেন। খুব দ্রুত দৌড়াতেও পারতেন।’
বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে ও চার মেয়ে। কোনোরকম জীবনযাপন করছি। ওয়াপদার চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর অল্প কিছু পেনশন পাই। ১৯৮৩ সাল থেকে প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে মাসোহারা পেতাম। এখন আর পাই না। প্রচুর দেনা মাথায় নিয়ে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আমার অনুপস্থিতিতে অংশীদাররা সব জমিজমা বিক্রি করে দেয়ায় আমার কোনো অবলম্বন নেই। পৈতৃক বাড়িটাও ব্যাংকে বন্ধক। সীমাহীন দারিদ্র্যের মাঝে জীবনযাপন করছি। আর্থিক সাহায্য পেলে এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দুঃসহ জীবন কাটাতে হতো না। তাছাড়া শরীর আর চলতে চায় না। একবার ঢাকায় যেতে মন চায়। সেই সঙ্গতি কোথায়? তবে সাতক্ষীরায় আমি যথেষ্ট সম্মান পাই। সাতক্ষীরায় অনেককে খেলা শিখিয়েছি। তবে তারা খেলাটাকে ধরে রাখতে পারেনি। অর্থনৈতিক সংকট অনেক সময় প্রতিভাকে দমিয়ে রাখে। তবে চেষ্টা থাকলে অবশ্য উঠে আসা যায়।’
খেলোয়াড়ী জীবনে তিনি ছিলেন বাজির ঘোড়ার মতো। তার খেলা দেখার জন্য দর্শকরা ছুটে আসতেন। তখন সময় ছিল কতই না রঙ ঝলমলে। দু’পায়ে শাসন করেছেন ফুটবল মাঠ। তিনি ছিলেন সবার নয়নের মণি। আর আজ পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ আর তাকে স্পর্শ করে না। কারো সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ নেই। ১৯৮৩ সালে স্ত্রী বিয়োগ হয়। বলতে গেলে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যেন অপেক্ষা অন্য জীবনের। অথচ এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। তা নিয়ে অবশ্য তার কোনো ক্ষোভ-দুঃখ-ব্যথা-বেদনা নেই। তবে জীবনের এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে চান একটু স্বস্তি ও সহানুভূতি। #
১-৩-২০০৮
শওকত হোসেন খান চৌধুরী ২০১১ সালের ১১ মার্চ ইন্তেকাল করেন।
উত্তরমুছুন