হকির অন্যতম সেরা রাইট হাফ মোহাম্মদ মহসিন/ দুলাল মাহমুদ
পঞ্চাশ ও ষাট দশক ছিল হকিতে পাকিস্তানের স্বর্ণযুগের একটি অধ্যায়। সে সময় পাকিস্তানের জাতীয় দল তো বটেই, যে কোনো পর্যায়ের দলের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। তারপরও পাকিস্তানের কোনো দলের সঙ্গে খেলার সময় পূর্ব পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের বুকে থাকতো অন্য রকম অনুভূতি। এর কারণ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। একই দেশ হওয়া সত্ত্বেও শোষণ-বঞ্চনা-লাঞ্চনা ও ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবধানটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার প্রতিফলন দেখা যায় খেলার মাঠে। পাকিস্তান হকি দলের সঙ্গে খেলার সময় পূর্ব পাকিস্তানের মনোভাব থাকতো তাদের যে কোনোভাবেই হোক রুখে দিতে হবে। আর এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের স্ট্রাটেজি ছিল ডিফেন্সিভ খেলা। গোল করার চেয়ে গোল করতে না দেয়াটাই ছিল এ নীতির মূল উদ্দেশ্য। আর এক্ষেত্রে সাফল্য দেখান আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের ও মোহাম্মদ মহসীনের সমন্বয়ে গড়া দুর্ধর্ষ রক্ষণভাগ। সেন্টার হাফে সাদেক, লেফট হাফে সাবের ও রাইট হাফে খেলতেন মহসিন। ‘ত্রিরত্ম’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া রক্ষণভাগের এই তিন খেলোয়াড় গড়ে তুলতেন দুর্ভেদ্য দেয়াল। পাকিস্তানের মত দলও তাদের ফাঁকি দিয়ে সহজে গোল করতে পারেনি। বাংলাদেশের হকির ইতিহাসের সেরা ডিফেন্স লাইন হিসেবে তারা বিবেচিত হয়ে থাকেন। এই তিন ডিফেন্ডারের অন্যতম হলেন মোহাম্মদ মহসিন। অথচ তার পরিচয়ের গন্ডিটা একদম সীমিত পরিসরে। খুব বেশি আলোচিতও নন। এর কারণ, অনেকটা নীরবে ও নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন তিনি। যে কারণে প্রচারের আলোটা তার দিকে খুব বেশি ধাবিত ছিল না।
খেলার মাঠে মহসিন ছিলেন অসম্ভব টাফ অ্যান্ড রাফ। নির্দ্বিধায় প্রতিপক্ষকে চার্জ করতেন। সেক্ষেত্রে ভাই হলেও তাকে ছাড় দিতেন না। দলের প্রতি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দলের জয়টাই ছিল তার কাছে আসল। তবে তিনি ছিলেন স্ট্যাইলিশ খেলোয়াড়। তার রিসিভিং, ডেলিভারি ও বল আদান-প্রদান ছিল চোখ ধাঁধানো। মাঠের মহসিনকে মাঠের বাইরে চেনা যায় না। অত্যন্ত অমায়িক ও ভদ্র। সেদিন মোহাম্মদ মহসিনের ধানমন্ডির নিজস্ব ফ্ল্যাটে যাই ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মোঃ ইউসুফ আলীর সঙ্গে। এক পুত্র ও এক কন্যাকে নিয়ে তার সাজানো-গোছানো সংসার।
বাংলাদেশের হকির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এলাকায় মোহাম্মদ মহসিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ১৯৪৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকার মাহুতটুলিতে তিনি ভূমিষ্ঠ হন। মাহুতটুলি ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু হলেও কাস থ্রিতে আরমানিটোলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নতুন পথের সন্ধান পান তিনি। হকি তো ছিলই ফুটবল, ভলিবল, বেসবলসহ নানা খেলায় সরগরম থাকতো স্কুল প্রাঙ্গণ। টিফিন পিরিয়ডে বসতো খেলার মেলা। তাছাড়া স্কুলের ছিল চারটি হাউজ। এই হাউজগুলোর মধ্যে হতো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাতে যারা সফল হতেন, তারাই ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতি পেতেন। আর এক কাঠি সরেস ছিলেন পিটির রশীদ স্যার। এমনিতেই ছাত্ররা ছিল নাচনেওয়ালী, তাতে ঢোলের বাড়ি দিতেন তিনি। এই ভদ্রলোক খেলাধুলাকে মনে করতেন জীবনবোধের অংশ। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠতে হলে খেলার মাঠের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটাকে তিনি বেশ গুরুত্ব দিতেন। তার আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় স্কুলের অনেক ছাত্রই লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাকে নিয়েছিলেন জীবন গড়ার সোপান হিসেবে। তাদের একজন মোহাম্মদ মহসিন। স্কুলের সব রকম খেলাধুলায় অংশ নিলেও হকিটা হয়ে ওঠে তার ফেবারিট। এ প্রসঙ্গে মহসিন বলেন,‘আরমানিটোলা স্কুলের গেট থেকে মূল ভবনে যাবার একটি পাকা রাস্তা ছিল। এই রাস্তাটা অনেককে হকি খেলোয়াড় হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। রাস্তাটা ছিল হকি খেলার উপযোগী। এ রাস্তা থেকে উঠে আসেন বশির আহমদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, আবদুস সাদেকের মতো খ্যাতিমান খেলোয়াড়রা। তারা ছিলেন আমাদের সিনিয়র। তাদের দেখাদেখি আমরাও হকির প্রতি ঝুঁকে পড়ি। সে সময় পরিবেশটাও ছিল অন্যরকম। সিনিয়ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জুনিয়রদের হাত ধরে শিখিয়ে দিতেন। আমরা বশির ভাইয়ের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম। তিনি তখন আমাদের কাছে রীতিমত হিরো। তিনি আমাদের খেলার কলাকৌশল শেখাতেন। আমাদের দলে ছিল আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, ফজলু, সাব্বির ইউসুফ, মুন্নী প্রমুখ। আমরা আরমানিটোলা স্কুলের হয়ে খেলার সুযোগ পাই। আর আরমানিটোলা স্কুলের হয়ে খেলার সুযোগ পাওয়ার অর্থ- জাতীয় পর্যায়ে নিজেকে মেলে ধরার পথ সুগম করা। ১৯৬২-৬৩ সালে বশির ভাই, প্রতাপ দা’রা গঠন করেন কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব। প্রথম বিভাগের এই ক্লাবটিতে প্রথম বছর থেকেই খেলার সুযোগ পেয়ে যাই। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে ইন্টার স্কুল হকিতে চ্যাম্পিয়ন হয় আমাদের আরমানিটোলা স্কুল। এটা ছিল বড় একটা ব্যাপার। চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মুন্নী, ফজলু, সোনা মিয়া, সাব্বির ইউসুফ, মোহন প্রমুখ। এরপর আমার অস্তিত্বজুড়ে ঠাঁই করে নেয় হকি।’
১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রথম বিভাগ হকি লীগে কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন মহসিন। এর মধ্যে ১৯৬৬, ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল। ১৯৭০ সালে যোগ দেন ইস্পাহানী ক্লাবে। সে দলে খেলতেন পাকিস্তানের ইসলাহউদ্দীন এবং পূর্ব পাকিস্তানের আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, সাব্বির ইউসুফ, সোনা মিয়া প্রমুখ। মহসিন তার দক্ষতা ও ক্রীড়াশৈলী দিয়ে শক্তিশালী ইস্পাহানী দলে নিয়মিত খেলেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তার ঠিকানা হয়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এ দলের হয়ে খেলে অবসর নেন। এর মধ্যে আবাহনী ১৯৭৪-৭৫, ১৯৭৫-৭৬, ১৯৭৭-৭৮, ১৯৮০-৮১ সালে লীগ, ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৭, ১৯৭৯ সালে স্বাধীনতা দিবস হকি এবং ১৯৭৩, ১৯৭৪ সালে শহীদ স্মৃতি হকি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও আবাহনীর হয়ে বিভিন্ন খেলা ও টুর্নামেন্টে সাফল্য দেখান।
অনেক দিন হলো মহসিন খেলা ছেড়েছেন। বিস্মৃত হয়েছেন অনেক কিছু। হারিয়েও গেছে অনেক স্মৃতি। এ কারণে পুরনো দিনের হিসাব মেলাতে গিয়ে পাকিয়ে যায় তালগোল। খেলার মাঠে খেলেছেন মনের আনন্দে। তা সঞ্চয় করে রাখার কথা চিন্তা করেননি। মহসিন ১৯৬৭ সালে করাচীতে, ১৯৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে, ১৯৬৯ সালে বাহওয়ালপুরে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেছেন অল-পাকিস্তান ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি পাকিস্তানের এয়ার স্টাফ এয়ার মার্শাল নূর খান পূর্ব পাকিস্তান হকি দলকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সফরের ব্যবস্থা করেন। সে দলে ছিলেন মহসিন। দলের অন্য খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন বশির আহমদ, আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, সোনা মিয়া, রণজিত দাস, মমতাজ, জাম্বু প্রমুখ। তারা পাকিস্তানের করাচী, লাহোর, পিন্ডি, লয়ালপুর, খায়েরপুর প্রভৃতি স্থানে খেলেন। এই খেলা থেকে অর্জন করেন প্রভূত অভিজ্ঞতা। ১৯৬৮-৬৯ সালে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঢাকা ও চট্টগ্রামে খেলেছেন। এক রাতের প্রস্তুতিতে খেলেন সফরকারী মালয়েশিয়ার বিপক্ষে। খেলোয়াড়ী চেতনার কারণে এটি সম্ভব হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তান তথা পরবর্তীকালের বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ঢাকা সফর। ১৯৬৮ সালে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন এ দলটি ১৯৭০ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়। তারা পশ্চিম পাকিস্তান ফেরার পথে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান একাদশের সঙ্গে একটি ম্যাচে খেলে। ম্যাচটি আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য পাকিস্তান দলের অতিরিক্ত খেলোয়াড়দের পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেয় তারা। পূর্ব পাকিস্তান দল সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রাজপথ মিছিলে মিছিলে টালমাটাল। স্বাধিকার আন্দোলনের ঢেউ বাঙালিদের চেতনায় স্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমন এক প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা বাঙালি স্পিরিট নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় পশ্চিম পাকিস্তানের। সে এক ব্যতিক্রমধর্মী ও দুর্ধর্ষ খেলা। শক্তিশালী পাকিস্তানকে রক্ষণভাগে ঢুকতে না দেয়ার ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয় ও অবিচল প্রতিজ্ঞা। সেদিন এক গোলে হারলেও পূর্ব পাকিস্তান দল দেখিয়ে দেয় তাদেরকে দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাস সৃষ্টিকারী পূর্ব পাকিস্তানের সে দলের হয়ে খেলেন মহসিন। সেদিন তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলেন। বাঙালিদের নিয়ে গঠিত অন্যতম সেরা সেই দলটিতে খেলেন রণজিত দাস, জাম্বু, শামসুল বারী, সাব্বির ইউসুফ, আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, আবদুর রাজ্জাক, সোনা মিয়া, মিজান, মীর্জা ফরিদ মিলু, প্রতাপ শংকর হাজরা ও কায়েস। স্ট্যান্ডবাই ছিলেন নূরুল ইসলাম ও শান্টা।
মহসিন ১৯৬৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সাল থেকে খেলেন ইন্টার ইউনিভার্সিটি প্রতিযোগিতা। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাবের হয়ে খেলেন আতিকুল্লাহ কাপ গোল্ডকাপ। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হকি দল নিজেদের উদ্যোগে ভারতে খেলতে যায়। দলটি কলকাতা, চন্ডীগড়, দিল্লী, কানপুরে খেলে। সে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন মহসিন। একই বছর বাংলাদেশ দলের হয়ে দিল্লীতে খেলতে যান একটি টুর্নামেন্ট। জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপে ১৯৭৪ সালে চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা এবং ১৯৭৫ সালে চ্যাম্পিয়ন ঢাকা জেলা দলের হয়ে খেলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার অধিনায়ক। ১৯৭৩ সালে খেলেন ফরিদপুর জেলার হয়ে। ঢাকা হকি লীগে চ্যাম্পিয়ন আবাহনী ক্রীড়াচক্রের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসে শ্রীলংকা জাতীয় হকি দল। তারা বাংলাদেশ সফরে চারটি ম্যাচ খেলে। মহসিন প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি ফরিদপুরে আঞ্চলিক ম্যাচে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। খেলাটি ড্র হয় ১-১ গোলে।
হকি ছাড়াও মহসিন ফুটবলও খেলেছেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে মাহুতটুলি এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে দিলকুশার দলের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অভিষেক হয় ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের হয়ে। মাকরানী ফুটবলারদের দাপট সত্ত্বেও ১৯৭০ সাল পর্যন্ত খেলেছেন এ ক্লাবের হয়ে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে অনিয়মিতভাবে খেলেন। ১৯৭৪ সালে প্রশিক্ষণ নেন আইরিশ ফুটবল কোচ বিল হার্টের অধীনে। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের জন্য ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় যুব দলের ট্রায়ালে ১৬ জনের মধ্যে তিনি ছিলেন। লাহোরে ফাইনাল ট্রায়াল থেকে বাদ পড়ে যান। ১৯৬৮ সালে কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে রাজশাহী ও কুমিল্লায় খেলেন।
স্বাধীনতার পর ইস্পাহানি টিমকে যাদের উদ্যোগে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হকি দলে পরিণত করে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু হয়, তিনি তাদের অন্যতম। এ দলের কাণ্ডারিদের মধ্যে আরো ছিলেন আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, সাব্বির ইউসুফ, শামসুল বারী, আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, নূরুল ইসলাম প্রমুখ। আশি ও নব্বই দশকে মহসিন বেশ কিছুদিন ছিলেন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সদস্য। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় বসে দ্বিতীয় এশিয়ান কাপ হকি প্রতিযোগিতা। শুধু স্বাগতিক হিসেবেই নয়, সাফল্যের দিক দিয়ে এ প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। জুম্মন লুসাইয়ের হ্যাটট্রিকে ইরানকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় পাকিস্তানের। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ০-১ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তান দলের খেলোয়াড় ছিলেন মহসিন। আবার ঘটনাচক্রে লড়াকু বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পাকিস্তানের সঙ্গে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন এহতেশাম সুলতান ও প্রতাপ শংকর হাজরা। আমাকে শেষ মুহূর্তে দায়িত্ব দেয়া হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে আমার স্ট্রাটেজি ছিল ডিফেন্সিভ। বিশ্ব সেরা দলের বিপক্ষে ডিফেন্ড করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তবে ডিফেন্সিভের সাথে সাথে অ্যাটাকও করা হয়।’ জাপানের সঙ্গে ২-২ এবং চীনের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র এবং স্থান নির্ধারণী খেলায় মালয়েশিয়ার কাছে ০-৪ গোলে হেরে দ্বিতীয় এশিয়ান কাপের ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হয় ষষ্ঠ। তবে এ প্রতিযোগিতার পর বাংলাদেশের হকিতে একটা জাগরণ দেখা দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় ফেডারেশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। যে কারণে হকির জাগরণ ধরে রাখা যায়নি। পাকিস্তান আমলে আমরা মাত্র জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাস খেলার সুযোগ পেতাম। আর এখন আলাদা মাঠ হয়েছে, টার্ফ বসানো হয়েছে। সারা বছরই খেলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সেটাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’ মহসিন ভারতের উত্তর প্রদেশে সফরকারী বাংলাদেশ একাদশের ম্যানেজার ছিলেন।
নিজের সেরা খেলা প্রসঙ্গে মহসিন বলেন, ‘১৯৭০ সালে অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমকে হকি চ্যাম্পিয়ন সফরকারী পাকিস্তান জাতীয় দলের বিপক্ষে খেলাটি জীবনের বড় স্মৃতি হয়ে আছে। সে খেলায় আমরা বাঙালি চেতনা নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমি খেলতাম রাইট-হাফে। পাকিস্তান তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা লেফট-হাফ ফজল ও লেফট-আউট জাহাঙ্গীর বাটকে আটকানোর দায়িত্ব ছিল আমার। খেলায় নিজেদের মধ্যে কথার লেন-দেন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। পাকিস্তানী দল পাঞ্জাবী ভাষায় মাঠে কথা চালাচালি করতো। ওরা মনে করতো আমরা ওদের ভাষা জানি না। আসলে আমরাও পাঞ্জাবী ভাষা জানতাম। প্রায়ই পাকিস্তান সফরে যেতে হওয়ায় আমরা পাঞ্জাবী ভাষাটা রপ্ত করে নেই। যে কারণে ওদের পরিকল্পনা ধরে ফেলতে সক্ষম হই। তা কাজে লাগিয়ে জাহাঙ্গীর বাটকে ব্লক করে দেই। সেদিন আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি, বাঙালিরাও হকি খেলতে পারে। এর আগে পাকিস্তান জাতীয় দলের সঙ্গে আমাদের কখনো খেলার সুযোগ হয়নি। সেদিন আমাদের বুকে স্ফূরণ ঘটেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার অগ্নিমশাল। এ খেলা সব দিক দিয়ে আমাদের দারুণভাবে আত্মবিশ্বাসী ও অনুপ্রাণিত করে তোলে। এ ম্যাচ ছাড়া ঢাকা লীগে আবাহনীর চ্যাম্পিয়ন হওয়া বছরগুলোতে আমি বোধহয় নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছি।’ নিজের দেখা সেরা খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে করাচীতে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে করাচী ও ইস্ট পাকিস্তানের খেলা এখনও চোখে লেগে আছে। সে খেলায় আবদুস সাদেক ও প্রতাপ শংকর হাজরা দুর্দান্ত খেলেন। যদিও আমরা ০-১ গোলে হেরে যাই। তাছাড়া পাকিস্তান টিম যখন ন্যাচারাল গ্রাসে খেলতো, তখন আসল কারুকাজ দেখা যেতো। দেখা যেতো ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ক্যারিশমা।’
আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের ও মহসিনের সমন্বয়ে গড়া ডিফেন্স লাইনকে সেরা বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা তিন জন দীর্ঘদিন যাবৎ একসঙ্গে খেলেছি। সেই আরমানিটোলা স্কুল থেকে শুরু করে কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব, ইস্পাহানি, পূর্ব পাকিস্তান দল এবং স্বাধীনতার পর আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। যে কারণে আমাদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে ওঠে। আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারতাম। যে কোনো আক্রমণ রুখে দিতে আমাদের খুব বেশি বেগ পেতে হতো না। আমাদের জমাট ডিফেন্স ভাঙ্গা যে কারো পক্ষেই ছিল কঠিন। মাঠের এই বোঝাপড়া মাঠের বাইরেও অটুট আছে। বয়সের হেরফের সত্ত্বেও আমরা পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু। আমাদের বন্ধুদের দলের আরেকজন হলেন সাব্বির ইউসুফ। সাব্বিরও সেই প্রথম থেকে আমাদের সঙ্গে খেলে আসছেন। তার পজিশন ছিল লেফট-ব্যাক।’ তাছাড়া লেফট-ইন প্রতাপ শংকর হাজরার সঙ্গে মহসিনের একটা ভালো সমঝোতা ছিল। জাতীয় দলের হয়ে এ দু’জন যখন একসঙ্গে খেলেছেন, তখন তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়।
অতীতের সঙ্গে বর্তমানের খেলার পার্থক্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে খেলায় একটা আর্ট ছিল। ছিল ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলক। খেলা দেখলে মন জুড়িয়ে যেতো। অবশ্য এখন আগের চেয়ে খেলা অনেক বেশি অ্যাডভান্সড। স্পিরিট বেড়েছে। স্ট্রেন্থ, বডি ফিটনেস, সায়েন্টিফিক দিক দিয়ে খেলা অনেক বদলে গেছে। এসেছে টার্ফ। আমি অবশ্য টার্ফে খেলিনি। তাই টার্ফে খেলা নিয়ে বলতে পারবো না। তবে আগে ন্যাচারাল গ্রাসে একজন খেলোয়াড় চারটি অলিম্পিক খেলতে পারতেন। এখন দুটির বেশি সম্ভব নয়। খেলোয়াড়ী জীবন খুব বেশি লম্বা করার সুযোগ কমে এসেছে।’
মহসিনদের পরিবারকে ‘হকি পরিবার’ বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি ছাড়াও তার বড় ভাই নাইম ও ছোট ভাই এহসান নাম্মী বাংলাদেশের হকির পরিচিত মুখ। এহসান নাম্মী ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন এবং ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচীতে এশিয়ান কাপ হকি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। তিন ভাই একই সঙ্গে খেলেছেন আবাহনীতে। মামাতো ভাই কায়েশ, আয়েশ, লুলু, চঞ্চল, বরকত উল্লাহ চপল বাংলাদেশের হকির উজ্জ্বল সব মুখ। আরেক মামাতো ভাই খলিলুল্লাহ টুহু হকির আম্পায়ার হিসেবে খ্যাতিমান। ভাতিজা সাবিদ হাসান অনু ছিলেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হকির অধিনায়ক।
নিজের দেখা সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘পাকিস্তান দলের রাইট-হাফ সাইদ আনোয়ার, রাইট-ইন আশফাক আমার মন জয় করতে সক্ষম হয়। তবে পাকিস্তান দলে সব খেলোয়াড়ই ছিল স্ব-স্ব পজিশনে সেরা। আর বাঙালিদের মধ্যে বশির আহমদ, আবদুস সাদেক, প্রতাপ শংকর হাজরা, ইব্রাহীম সাবের, আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, ব্যতিক্রমধর্মী গোলকিপার রণজিত দাস এবং পরবর্তীকালে হারুন অসাধারণ খেলোয়াড়। এখন খুব একটা মাঠে যাওয়া হয় না বিধায় তরুণ প্রজন্মের কারো সম্পর্কে বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
হকিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হকিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা আছে। সবার আগে দরকার অর্থনৈতিক সমর্থন। এরপর দীর্ঘ পরিকল্পনা। তাছাড়া বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট যদি নিয়মিত চালানো যায়, তাহলে ফল পাওয়া যাবে। তবে চেষ্টা থাকলে না পারার কোনো কারণ নেই।’
মহসিন ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হকিতে ‘ব্লু’ অর্জন করেন। উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে তিনি এই সম্মান গ্রহণ করেন।
মহসিনের জীবনের বড় একটি অংশ জুড়ে আছে আবাহনী ক্লাব। একসময় দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। এরপর কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনও জড়িয়ে আছেন ভালোবাসার এই ক্লাবটির সঙ্গে। বাসার কাছের কাবটিতে প্রতিদিনই একবার ঢুঁ না মারলে তার পেটের ভাত হজম হয় না। তাছাড়া খেলার মাঠকে তার বড্ড আপন মনে হয়। জীবনের প্রথম প্রহরে যে মাঠ তাকে কাছে টেনে নেয়, তার মায়া তিনি আজও কাটাতে পারেননি। এই মাঠ কখনো ফিরিয়ে দেয়নি। খেলার জন্য তার অপরিসীম আত্মত্যাগ ও অবদান থাকলেও জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতির বেলায় তিনি বড় বেশি অনাদৃত। #
১৬-১-২০০৮
খেলার মাঠে মহসিন ছিলেন অসম্ভব টাফ অ্যান্ড রাফ। নির্দ্বিধায় প্রতিপক্ষকে চার্জ করতেন। সেক্ষেত্রে ভাই হলেও তাকে ছাড় দিতেন না। দলের প্রতি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দলের জয়টাই ছিল তার কাছে আসল। তবে তিনি ছিলেন স্ট্যাইলিশ খেলোয়াড়। তার রিসিভিং, ডেলিভারি ও বল আদান-প্রদান ছিল চোখ ধাঁধানো। মাঠের মহসিনকে মাঠের বাইরে চেনা যায় না। অত্যন্ত অমায়িক ও ভদ্র। সেদিন মোহাম্মদ মহসিনের ধানমন্ডির নিজস্ব ফ্ল্যাটে যাই ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মোঃ ইউসুফ আলীর সঙ্গে। এক পুত্র ও এক কন্যাকে নিয়ে তার সাজানো-গোছানো সংসার।
বাংলাদেশের হকির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এলাকায় মোহাম্মদ মহসিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ১৯৪৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকার মাহুতটুলিতে তিনি ভূমিষ্ঠ হন। মাহুতটুলি ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু হলেও কাস থ্রিতে আরমানিটোলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নতুন পথের সন্ধান পান তিনি। হকি তো ছিলই ফুটবল, ভলিবল, বেসবলসহ নানা খেলায় সরগরম থাকতো স্কুল প্রাঙ্গণ। টিফিন পিরিয়ডে বসতো খেলার মেলা। তাছাড়া স্কুলের ছিল চারটি হাউজ। এই হাউজগুলোর মধ্যে হতো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাতে যারা সফল হতেন, তারাই ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতি পেতেন। আর এক কাঠি সরেস ছিলেন পিটির রশীদ স্যার। এমনিতেই ছাত্ররা ছিল নাচনেওয়ালী, তাতে ঢোলের বাড়ি দিতেন তিনি। এই ভদ্রলোক খেলাধুলাকে মনে করতেন জীবনবোধের অংশ। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠতে হলে খেলার মাঠের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটাকে তিনি বেশ গুরুত্ব দিতেন। তার আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় স্কুলের অনেক ছাত্রই লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাকে নিয়েছিলেন জীবন গড়ার সোপান হিসেবে। তাদের একজন মোহাম্মদ মহসিন। স্কুলের সব রকম খেলাধুলায় অংশ নিলেও হকিটা হয়ে ওঠে তার ফেবারিট। এ প্রসঙ্গে মহসিন বলেন,‘আরমানিটোলা স্কুলের গেট থেকে মূল ভবনে যাবার একটি পাকা রাস্তা ছিল। এই রাস্তাটা অনেককে হকি খেলোয়াড় হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। রাস্তাটা ছিল হকি খেলার উপযোগী। এ রাস্তা থেকে উঠে আসেন বশির আহমদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, আবদুস সাদেকের মতো খ্যাতিমান খেলোয়াড়রা। তারা ছিলেন আমাদের সিনিয়র। তাদের দেখাদেখি আমরাও হকির প্রতি ঝুঁকে পড়ি। সে সময় পরিবেশটাও ছিল অন্যরকম। সিনিয়ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জুনিয়রদের হাত ধরে শিখিয়ে দিতেন। আমরা বশির ভাইয়ের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম। তিনি তখন আমাদের কাছে রীতিমত হিরো। তিনি আমাদের খেলার কলাকৌশল শেখাতেন। আমাদের দলে ছিল আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, ফজলু, সাব্বির ইউসুফ, মুন্নী প্রমুখ। আমরা আরমানিটোলা স্কুলের হয়ে খেলার সুযোগ পাই। আর আরমানিটোলা স্কুলের হয়ে খেলার সুযোগ পাওয়ার অর্থ- জাতীয় পর্যায়ে নিজেকে মেলে ধরার পথ সুগম করা। ১৯৬২-৬৩ সালে বশির ভাই, প্রতাপ দা’রা গঠন করেন কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব। প্রথম বিভাগের এই ক্লাবটিতে প্রথম বছর থেকেই খেলার সুযোগ পেয়ে যাই। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে ইন্টার স্কুল হকিতে চ্যাম্পিয়ন হয় আমাদের আরমানিটোলা স্কুল। এটা ছিল বড় একটা ব্যাপার। চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মুন্নী, ফজলু, সোনা মিয়া, সাব্বির ইউসুফ, মোহন প্রমুখ। এরপর আমার অস্তিত্বজুড়ে ঠাঁই করে নেয় হকি।’
১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রথম বিভাগ হকি লীগে কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন মহসিন। এর মধ্যে ১৯৬৬, ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল। ১৯৭০ সালে যোগ দেন ইস্পাহানী ক্লাবে। সে দলে খেলতেন পাকিস্তানের ইসলাহউদ্দীন এবং পূর্ব পাকিস্তানের আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, সাব্বির ইউসুফ, সোনা মিয়া প্রমুখ। মহসিন তার দক্ষতা ও ক্রীড়াশৈলী দিয়ে শক্তিশালী ইস্পাহানী দলে নিয়মিত খেলেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তার ঠিকানা হয়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এ দলের হয়ে খেলে অবসর নেন। এর মধ্যে আবাহনী ১৯৭৪-৭৫, ১৯৭৫-৭৬, ১৯৭৭-৭৮, ১৯৮০-৮১ সালে লীগ, ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৭, ১৯৭৯ সালে স্বাধীনতা দিবস হকি এবং ১৯৭৩, ১৯৭৪ সালে শহীদ স্মৃতি হকি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও আবাহনীর হয়ে বিভিন্ন খেলা ও টুর্নামেন্টে সাফল্য দেখান।
অনেক দিন হলো মহসিন খেলা ছেড়েছেন। বিস্মৃত হয়েছেন অনেক কিছু। হারিয়েও গেছে অনেক স্মৃতি। এ কারণে পুরনো দিনের হিসাব মেলাতে গিয়ে পাকিয়ে যায় তালগোল। খেলার মাঠে খেলেছেন মনের আনন্দে। তা সঞ্চয় করে রাখার কথা চিন্তা করেননি। মহসিন ১৯৬৭ সালে করাচীতে, ১৯৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে, ১৯৬৯ সালে বাহওয়ালপুরে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেছেন অল-পাকিস্তান ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি পাকিস্তানের এয়ার স্টাফ এয়ার মার্শাল নূর খান পূর্ব পাকিস্তান হকি দলকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সফরের ব্যবস্থা করেন। সে দলে ছিলেন মহসিন। দলের অন্য খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন বশির আহমদ, আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, সোনা মিয়া, রণজিত দাস, মমতাজ, জাম্বু প্রমুখ। তারা পাকিস্তানের করাচী, লাহোর, পিন্ডি, লয়ালপুর, খায়েরপুর প্রভৃতি স্থানে খেলেন। এই খেলা থেকে অর্জন করেন প্রভূত অভিজ্ঞতা। ১৯৬৮-৬৯ সালে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঢাকা ও চট্টগ্রামে খেলেছেন। এক রাতের প্রস্তুতিতে খেলেন সফরকারী মালয়েশিয়ার বিপক্ষে। খেলোয়াড়ী চেতনার কারণে এটি সম্ভব হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তান তথা পরবর্তীকালের বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ঢাকা সফর। ১৯৬৮ সালে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন এ দলটি ১৯৭০ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়। তারা পশ্চিম পাকিস্তান ফেরার পথে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান একাদশের সঙ্গে একটি ম্যাচে খেলে। ম্যাচটি আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য পাকিস্তান দলের অতিরিক্ত খেলোয়াড়দের পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেয় তারা। পূর্ব পাকিস্তান দল সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রাজপথ মিছিলে মিছিলে টালমাটাল। স্বাধিকার আন্দোলনের ঢেউ বাঙালিদের চেতনায় স্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমন এক প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা বাঙালি স্পিরিট নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় পশ্চিম পাকিস্তানের। সে এক ব্যতিক্রমধর্মী ও দুর্ধর্ষ খেলা। শক্তিশালী পাকিস্তানকে রক্ষণভাগে ঢুকতে না দেয়ার ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয় ও অবিচল প্রতিজ্ঞা। সেদিন এক গোলে হারলেও পূর্ব পাকিস্তান দল দেখিয়ে দেয় তাদেরকে দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাস সৃষ্টিকারী পূর্ব পাকিস্তানের সে দলের হয়ে খেলেন মহসিন। সেদিন তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলেন। বাঙালিদের নিয়ে গঠিত অন্যতম সেরা সেই দলটিতে খেলেন রণজিত দাস, জাম্বু, শামসুল বারী, সাব্বির ইউসুফ, আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, আবদুর রাজ্জাক, সোনা মিয়া, মিজান, মীর্জা ফরিদ মিলু, প্রতাপ শংকর হাজরা ও কায়েস। স্ট্যান্ডবাই ছিলেন নূরুল ইসলাম ও শান্টা।
মহসিন ১৯৬৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সাল থেকে খেলেন ইন্টার ইউনিভার্সিটি প্রতিযোগিতা। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাবের হয়ে খেলেন আতিকুল্লাহ কাপ গোল্ডকাপ। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হকি দল নিজেদের উদ্যোগে ভারতে খেলতে যায়। দলটি কলকাতা, চন্ডীগড়, দিল্লী, কানপুরে খেলে। সে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন মহসিন। একই বছর বাংলাদেশ দলের হয়ে দিল্লীতে খেলতে যান একটি টুর্নামেন্ট। জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপে ১৯৭৪ সালে চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা এবং ১৯৭৫ সালে চ্যাম্পিয়ন ঢাকা জেলা দলের হয়ে খেলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার অধিনায়ক। ১৯৭৩ সালে খেলেন ফরিদপুর জেলার হয়ে। ঢাকা হকি লীগে চ্যাম্পিয়ন আবাহনী ক্রীড়াচক্রের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসে শ্রীলংকা জাতীয় হকি দল। তারা বাংলাদেশ সফরে চারটি ম্যাচ খেলে। মহসিন প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি ফরিদপুরে আঞ্চলিক ম্যাচে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। খেলাটি ড্র হয় ১-১ গোলে।
হকি ছাড়াও মহসিন ফুটবলও খেলেছেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে মাহুতটুলি এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে দিলকুশার দলের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অভিষেক হয় ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের হয়ে। মাকরানী ফুটবলারদের দাপট সত্ত্বেও ১৯৭০ সাল পর্যন্ত খেলেছেন এ ক্লাবের হয়ে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে অনিয়মিতভাবে খেলেন। ১৯৭৪ সালে প্রশিক্ষণ নেন আইরিশ ফুটবল কোচ বিল হার্টের অধীনে। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের জন্য ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় যুব দলের ট্রায়ালে ১৬ জনের মধ্যে তিনি ছিলেন। লাহোরে ফাইনাল ট্রায়াল থেকে বাদ পড়ে যান। ১৯৬৮ সালে কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে রাজশাহী ও কুমিল্লায় খেলেন।
স্বাধীনতার পর ইস্পাহানি টিমকে যাদের উদ্যোগে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হকি দলে পরিণত করে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু হয়, তিনি তাদের অন্যতম। এ দলের কাণ্ডারিদের মধ্যে আরো ছিলেন আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের, সাব্বির ইউসুফ, শামসুল বারী, আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, নূরুল ইসলাম প্রমুখ। আশি ও নব্বই দশকে মহসিন বেশ কিছুদিন ছিলেন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সদস্য। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় বসে দ্বিতীয় এশিয়ান কাপ হকি প্রতিযোগিতা। শুধু স্বাগতিক হিসেবেই নয়, সাফল্যের দিক দিয়ে এ প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। জুম্মন লুসাইয়ের হ্যাটট্রিকে ইরানকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় পাকিস্তানের। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ০-১ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তান দলের খেলোয়াড় ছিলেন মহসিন। আবার ঘটনাচক্রে লড়াকু বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পাকিস্তানের সঙ্গে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন এহতেশাম সুলতান ও প্রতাপ শংকর হাজরা। আমাকে শেষ মুহূর্তে দায়িত্ব দেয়া হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে আমার স্ট্রাটেজি ছিল ডিফেন্সিভ। বিশ্ব সেরা দলের বিপক্ষে ডিফেন্ড করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তবে ডিফেন্সিভের সাথে সাথে অ্যাটাকও করা হয়।’ জাপানের সঙ্গে ২-২ এবং চীনের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র এবং স্থান নির্ধারণী খেলায় মালয়েশিয়ার কাছে ০-৪ গোলে হেরে দ্বিতীয় এশিয়ান কাপের ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হয় ষষ্ঠ। তবে এ প্রতিযোগিতার পর বাংলাদেশের হকিতে একটা জাগরণ দেখা দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় ফেডারেশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। যে কারণে হকির জাগরণ ধরে রাখা যায়নি। পাকিস্তান আমলে আমরা মাত্র জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাস খেলার সুযোগ পেতাম। আর এখন আলাদা মাঠ হয়েছে, টার্ফ বসানো হয়েছে। সারা বছরই খেলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সেটাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’ মহসিন ভারতের উত্তর প্রদেশে সফরকারী বাংলাদেশ একাদশের ম্যানেজার ছিলেন।
নিজের সেরা খেলা প্রসঙ্গে মহসিন বলেন, ‘১৯৭০ সালে অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমকে হকি চ্যাম্পিয়ন সফরকারী পাকিস্তান জাতীয় দলের বিপক্ষে খেলাটি জীবনের বড় স্মৃতি হয়ে আছে। সে খেলায় আমরা বাঙালি চেতনা নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমি খেলতাম রাইট-হাফে। পাকিস্তান তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা লেফট-হাফ ফজল ও লেফট-আউট জাহাঙ্গীর বাটকে আটকানোর দায়িত্ব ছিল আমার। খেলায় নিজেদের মধ্যে কথার লেন-দেন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। পাকিস্তানী দল পাঞ্জাবী ভাষায় মাঠে কথা চালাচালি করতো। ওরা মনে করতো আমরা ওদের ভাষা জানি না। আসলে আমরাও পাঞ্জাবী ভাষা জানতাম। প্রায়ই পাকিস্তান সফরে যেতে হওয়ায় আমরা পাঞ্জাবী ভাষাটা রপ্ত করে নেই। যে কারণে ওদের পরিকল্পনা ধরে ফেলতে সক্ষম হই। তা কাজে লাগিয়ে জাহাঙ্গীর বাটকে ব্লক করে দেই। সেদিন আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি, বাঙালিরাও হকি খেলতে পারে। এর আগে পাকিস্তান জাতীয় দলের সঙ্গে আমাদের কখনো খেলার সুযোগ হয়নি। সেদিন আমাদের বুকে স্ফূরণ ঘটেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার অগ্নিমশাল। এ খেলা সব দিক দিয়ে আমাদের দারুণভাবে আত্মবিশ্বাসী ও অনুপ্রাণিত করে তোলে। এ ম্যাচ ছাড়া ঢাকা লীগে আবাহনীর চ্যাম্পিয়ন হওয়া বছরগুলোতে আমি বোধহয় নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছি।’ নিজের দেখা সেরা খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে করাচীতে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে করাচী ও ইস্ট পাকিস্তানের খেলা এখনও চোখে লেগে আছে। সে খেলায় আবদুস সাদেক ও প্রতাপ শংকর হাজরা দুর্দান্ত খেলেন। যদিও আমরা ০-১ গোলে হেরে যাই। তাছাড়া পাকিস্তান টিম যখন ন্যাচারাল গ্রাসে খেলতো, তখন আসল কারুকাজ দেখা যেতো। দেখা যেতো ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ক্যারিশমা।’
আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের ও মহসিনের সমন্বয়ে গড়া ডিফেন্স লাইনকে সেরা বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা তিন জন দীর্ঘদিন যাবৎ একসঙ্গে খেলেছি। সেই আরমানিটোলা স্কুল থেকে শুরু করে কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব, ইস্পাহানি, পূর্ব পাকিস্তান দল এবং স্বাধীনতার পর আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। যে কারণে আমাদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে ওঠে। আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারতাম। যে কোনো আক্রমণ রুখে দিতে আমাদের খুব বেশি বেগ পেতে হতো না। আমাদের জমাট ডিফেন্স ভাঙ্গা যে কারো পক্ষেই ছিল কঠিন। মাঠের এই বোঝাপড়া মাঠের বাইরেও অটুট আছে। বয়সের হেরফের সত্ত্বেও আমরা পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু। আমাদের বন্ধুদের দলের আরেকজন হলেন সাব্বির ইউসুফ। সাব্বিরও সেই প্রথম থেকে আমাদের সঙ্গে খেলে আসছেন। তার পজিশন ছিল লেফট-ব্যাক।’ তাছাড়া লেফট-ইন প্রতাপ শংকর হাজরার সঙ্গে মহসিনের একটা ভালো সমঝোতা ছিল। জাতীয় দলের হয়ে এ দু’জন যখন একসঙ্গে খেলেছেন, তখন তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়।
অতীতের সঙ্গে বর্তমানের খেলার পার্থক্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে খেলায় একটা আর্ট ছিল। ছিল ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলক। খেলা দেখলে মন জুড়িয়ে যেতো। অবশ্য এখন আগের চেয়ে খেলা অনেক বেশি অ্যাডভান্সড। স্পিরিট বেড়েছে। স্ট্রেন্থ, বডি ফিটনেস, সায়েন্টিফিক দিক দিয়ে খেলা অনেক বদলে গেছে। এসেছে টার্ফ। আমি অবশ্য টার্ফে খেলিনি। তাই টার্ফে খেলা নিয়ে বলতে পারবো না। তবে আগে ন্যাচারাল গ্রাসে একজন খেলোয়াড় চারটি অলিম্পিক খেলতে পারতেন। এখন দুটির বেশি সম্ভব নয়। খেলোয়াড়ী জীবন খুব বেশি লম্বা করার সুযোগ কমে এসেছে।’
মহসিনদের পরিবারকে ‘হকি পরিবার’ বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি ছাড়াও তার বড় ভাই নাইম ও ছোট ভাই এহসান নাম্মী বাংলাদেশের হকির পরিচিত মুখ। এহসান নাম্মী ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন এবং ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচীতে এশিয়ান কাপ হকি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। তিন ভাই একই সঙ্গে খেলেছেন আবাহনীতে। মামাতো ভাই কায়েশ, আয়েশ, লুলু, চঞ্চল, বরকত উল্লাহ চপল বাংলাদেশের হকির উজ্জ্বল সব মুখ। আরেক মামাতো ভাই খলিলুল্লাহ টুহু হকির আম্পায়ার হিসেবে খ্যাতিমান। ভাতিজা সাবিদ হাসান অনু ছিলেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হকির অধিনায়ক।
নিজের দেখা সেরা খেলোয়াড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘পাকিস্তান দলের রাইট-হাফ সাইদ আনোয়ার, রাইট-ইন আশফাক আমার মন জয় করতে সক্ষম হয়। তবে পাকিস্তান দলে সব খেলোয়াড়ই ছিল স্ব-স্ব পজিশনে সেরা। আর বাঙালিদের মধ্যে বশির আহমদ, আবদুস সাদেক, প্রতাপ শংকর হাজরা, ইব্রাহীম সাবের, আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, ব্যতিক্রমধর্মী গোলকিপার রণজিত দাস এবং পরবর্তীকালে হারুন অসাধারণ খেলোয়াড়। এখন খুব একটা মাঠে যাওয়া হয় না বিধায় তরুণ প্রজন্মের কারো সম্পর্কে বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
হকিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হকিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা আছে। সবার আগে দরকার অর্থনৈতিক সমর্থন। এরপর দীর্ঘ পরিকল্পনা। তাছাড়া বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট যদি নিয়মিত চালানো যায়, তাহলে ফল পাওয়া যাবে। তবে চেষ্টা থাকলে না পারার কোনো কারণ নেই।’
মহসিন ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হকিতে ‘ব্লু’ অর্জন করেন। উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে তিনি এই সম্মান গ্রহণ করেন।
মহসিনের জীবনের বড় একটি অংশ জুড়ে আছে আবাহনী ক্লাব। একসময় দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। এরপর কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনও জড়িয়ে আছেন ভালোবাসার এই ক্লাবটির সঙ্গে। বাসার কাছের কাবটিতে প্রতিদিনই একবার ঢুঁ না মারলে তার পেটের ভাত হজম হয় না। তাছাড়া খেলার মাঠকে তার বড্ড আপন মনে হয়। জীবনের প্রথম প্রহরে যে মাঠ তাকে কাছে টেনে নেয়, তার মায়া তিনি আজও কাটাতে পারেননি। এই মাঠ কখনো ফিরিয়ে দেয়নি। খেলার জন্য তার অপরিসীম আত্মত্যাগ ও অবদান থাকলেও জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতির বেলায় তিনি বড় বেশি অনাদৃত। #
১৬-১-২০০৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন