এস এ জামান মুক্তা : স্বর্ণেরত্মেশোভনলোভন/ দুলাল মাহমুদ
কথা ছিল তার বাসায় যাওয়ার। টেলিফোনে কথা বলে তার খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া বাসার ঠিকানা জেনে নেই। তখন তিনি অসুস্থ থাকলেও সার্বক্ষণিক চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন না। বাসায় থাকতেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। তার সঙ্গে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। যখন তার সঙ্গে দেখা হয়, তখন তিনি শুধু হাসপাতালেই থিতু নন, দুলছেন জীবন-মৃত্যুর দোলায়। অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেলেও কথা বলতে পারছেন না। কিডনি ডায়ালিসিসের মত কঠিন এক চিকিৎসা নিয়ে কোনো রকমে আঁকড়ে আছেন জীবন। খেলোয়াড়ী জীবনে তিনি ছিলেন সুঠাম ও সুদেহী। তার মাংসপেশী ও শারীরিক গড়ন ছিল চমৎকার। সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। তার সৌন্দর্য ছিল আলোচনার বিষয়। অথচ আজ তাকে দেখলে চেনাই যায় না। খেলোয়াড় হিসেবে এক সময় মাঠ কাঁপিয়েছেন। কোচ হিসেবে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ডাকসাইটে সংগঠক ছিলেন। প্রকৃত অর্থেই অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতিমান এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হলেন এস এ জামান (শামসুজ্জামান আমিনুজ্জামান)। সবার কাছে তিনি পরিচিত মুক্তা নামে। ঢাকার গ্রীন রোডের রেনাল হাসপাতালের ছোট্ট একটি কক্ষে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন ক্রীড়াঙ্গনের এক সময়ের এই মহীরূহ। বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই এই সেই প্রাণোচ্ছ্বল মানুষ, যিনি ছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যমণি। অনেকটা নিথর ও নিঃশব্দ। কঙ্কালসার দেহ। জীবনের স্পন্দন আছে কিনা বোঝা যায় না। তার শরীরে লাগানো অক্সিজেন মাস্কের নল। কাউকে তিনি চিনতে পারেন না। তার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনসঙ্গিনী রওশন আরা। সকাল-দুপুর-রাত কেটে যায় অন্তহীন এক প্রতীক্ষায়। যে ঝলমলে মানুষটিকে নিয়ে জীবনের অনেকগুলো বছর পার করেছেন, সেই মানুষটি আজ যেন অচেনা। বুকের মধ্যে একটা হাহাকার নিয়ে পরম যত্ম ও ভালোবাসায় স্বামীর সেবা-শুশ্রূষা করে যাচ্ছেন তিনি। জানেন না কাছের মানুষটিকে আবার আগের মত পাবেন কিনা!
ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান এস এ জামান মুক্তা। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি জন্ম। সাত ভাই ও দু’বোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় তিনি ছিলেন মুক্তবিহঙ্গের মত। তাদের পারিবারিক পরিবেশটাই ছিল খেলাধুলার উপযোগী। বড় ভাইদের খেলাধুলা করতে দেখে তাতে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। গ্রামের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশে ছুটেছেন বল্গা হরিণের মত। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার মধ্যেই ছিল তার ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রাথমিক পাঠ। তবে প্রকৃতির কাছে তার অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। অবারিত প্রকৃতি তাকে যুগিয়েছে খেলোয়াড় হওয়ার রসদ : ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে। উঁচু টিলার মত বাড়ি থেকে নামতে গিয়ে কিছুটা বেগ পেতে হত। প্রতিদিন বাড়িতে উঠা-নামা করতে গিয়ে শারীরিকভাবে এক ধরনের শক্তি অনুভব করতাম। আবার কখনো-সখনো খেলাচ্ছলে বাড়ি থেকে নামার সময় মাটিতে গড়িয়ে পড়তাম। ধুলা-বালি মাখামাখি হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম বাড়ির পাশের পুকুরে। সাঁতার কাটতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। শৈশবের সেই দুরন্তপনা, লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি থেকে অর্জিত বাড়তি শক্তিটুকু হয়ে ওঠে খেলোয়াড়ী জীবনের বড় এক সঞ্চয়।’
শমসপুর গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় খেলাধুলায় নিয়মিত অংশ নেন মুক্তা। তারপর ঢাকায় এসে ভর্তি হন নবকুমার ইনস্টিটিউটে। এ স্কুলটি খেলাধুলার লালনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। সঙ্গত কারণে এটি তার জন্য হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় নিজেকে বিকশিত করার এমন সুযোগ পেয়ে তাকে আর পায় কে! খেলার মাঠ যেন তাকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত ডেকে নিয়ে যায়। তিনি এই সম্মোহন কখনোই এড়াতে পারেননি। তার সময়ের আলোচিত এমন কোনো খেলা নেই, যাতে তিনি অংশ নেননি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো খেলায় তাকে খেলতে দেখা যেত। এমনকি একই দিনে একাধিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নিয়েছেন। যখন যে খেলায় সুযোগ পেয়েছেন, তাতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। ফুটবল, অ্যাথলেটিক, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, জিমন্যাস্টিক্স...আরো যে কত কি! যেখানেই যে কোনো খেলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত, তাতে তার উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। অনেক সময় শরীর কুলিয়ে ওঠতে চাইতো না, তবুও খেলা থেকে পিছু হঠতেন না। খেলে যে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন, তা নয়। তখন তো আর খেলাধুলায় অর্থ-কড়ি ছিল না। পুরো বিষয়টা ছিল সৌখিনতার বলয়ে বন্দি। নিছক ভালোবাসার টানে খেলার মাঠে ছুটে যেতেন। খেলোয়াড় হিসেবে একটু নাম করতে পারলে পাওয়া যেত মানুষের ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসাই তাকে খেলোয়াড় হওয়ার উৎসাহ যোগায়।
আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মুক্তা ছিলেন রীতিমত তারকা ক্রীড়াবিদ। তার বয়সীরা তো বটেই, তার সিনিয়ররাও তাকে দেখলে সমীহ করতেন। স্কুল পর্যায়ে তিনি যে কত সাফল্য দেখিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। তার কৃতিত্বে উদ্ভাসিত হয়েছে তার স্কুল। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অসংখ্যবার। অ্যাথলেটিকে প্রথম সাফল্য প্রসঙ্গে তার স্মৃতিচারণ : ‘১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম একটি প্রদর্শনী মেলার আয়োজন করা হয়। সেই মেলায় ছিল একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় পোলভল্টে কাজী আবদুল আলীমের সঙ্গে ক্ষুদে ক্রীড়াবিদ হিসেবে আমিও অংশ নেই। তাতে আমি তৃতীয় হই। এ সাফল্য আমাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। অ্যাথলেট হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সংকল্প করি। এ বছর রহমতগঞ্জের মোসলেম ভাই স্কুল ও কলেজের ক্রীড়া পাগল একদল ছাত্র সংগ্রহ করে আজাদ স্পোর্টিং নামে একটি কাব গঠন করেন। এ কাবের হয়ে আনোয়ার, খালেক, গেদা, বুলু, আমি প্রমুখ বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নেই। মূলত ফুটবল খেলায় প্রাধান্য দেয়া হলেও অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়। আর এ ক্ষেত্রে আমার একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়।’ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিজেকে আরো বড় পরিসরে মেলে ধরার সুযোগ পান মুক্তা। আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ এবং আন্তঃকলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতায় কয়েকটি রেকর্ড গড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোয়াড় হিসেবেও তার ছিল আলাদা খ্যাতি ও মর্যাদা।
ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও এস এ জামান মুক্তা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অ্যাথলেট। অ্যাথলেট হিসেবে তার রয়েছে অসংখ্য কীর্তি। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তঃস্কুল, আন্তঃজেলা ও প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পর পর পাঁচবার পোলভল্ট ও ডিসকাস থ্রোতে প্রথম হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা জগন্নাথ কলেজ অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে পোলভল্ট, ডিসকাস থ্রো ও হপ-স্টেপ-জাম্পে টানা পাঁচবার প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। জগন্নাথ কলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ এবং আন্তঃকলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতায় কয়েকটি রেকর্ড গড়েন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিকে অংশ নেন। সে সময়ের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন এভাবে : ‘১৯৫২ সালে টিনের বেড়ায় ঘেরা ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপ। এ প্রতিযোগিতায় আজাদ স্পোর্টিং কাবের হয়ে আমি পোলভল্টে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেই। শুধু পোলভল্টেই নয়, হপ-স্টেপ-জাম্পে দ্বিতীয় ও চাকতি নিক্ষেপে তৃতীয় হলে আমি সুনাম অর্জন করার পাশাপাশি পরিচিতি পায় আমার ক্লাব আজাদ। ১৯৫৩ সালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আজাদের অ্যাথলেটিক দল গঠন করে জাতীয় অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। সেবার আমাদের দলের খন্দকার আবুল হাসান লং জাম্প ও হপ-স্টেপ-জাম্পে, সিরাজুল ইসলাম ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়, আরজান খান ৮০০, ১৫০০ ও ম্যারাথন দৌড় এবং আমি পোলভল্ট, হপ-স্টেপ-জাম্প, চাকতি নিক্ষেপ ও রিলে দৌড়ে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকটি স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক পাই। আমি প্রতিযোগী ছাড়াও ছিলাম দলের প্রশিক্ষক।’ ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালে যথাক্রমে পেশোয়ার, ঢাকা, লাহোর ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান অলিম্পিকে পর পর চারবার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার অনন্য এক মাইলফলক গড়েন তিনি। এ সম্পর্কে তার স্মৃতিচারণ : ‘১৯৫৫ সালের মার্চে ঢাকায় চতুর্থ ন্যাশনাল অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে আজাদের হয়ে পোলভল্টে অংশ নিয়ে আমি তৃতীয় হই। প্রথম হন এশিয়ার খ্যাতিমান অ্যাথলেট ওয়াদি খান। তিনি ১২ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা অতিক্রম করেন। আর দ্বিতীয় হন আল্লা দিতা। ক্রমান্বয়ে নিজ চেষ্টা ও সাধনায় পোলভল্টে আধিপত্য বিস্তার করি এবং ইস্ট পাকিস্তানের একমাত্র বাঙালি অ্যাথলেট হিসেবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান অলিম্পিকে পর পর তিনবার তৃতীয় হয়েছি।’ পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকে পোলভল্টে ব্রোঞ্জ পদক জিতে নতুন এক ইতিহাস গড়েন মুক্তা। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাঙালি পুরুষ অ্যাথলেট হিসেবে তিনি পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটে কোনো পদক জয়ের বিরল গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালের মার্চে পেশোয়ারে ন্যাশনাল গেমসের পোলভল্টে ১৩ ফুট সোয়া ৫ ইঞ্চি লাফিয়ে পাকিস্তান রেকর্ড গড়ে প্রথম হয়েছেন ওয়াদি খান। আল্লা দিতা দ্বিতীয় ও মুক্তা তৃতীয় হন। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সপ্তম ন্যাশনাল গেমসে ১৩ ফুট ৬ ইঞ্চি লাফিয়ে আল্লা দিতা প্রথম, সাহিব খান দ্বিতীয় এবং ইলিয়াস ও মুক্তা তৃতীয় হন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অষ্টম ন্যাশনাল গেমসে ১৩ ফুট লাফিয়ে আল্লা দিতা প্রথম, সাপারাশ খান দ্বিতীয় ও মুক্তা তৃতীয় হন। পোলভল্টে মুক্তার রেকর্ড ছিল ১২ ফুট লাফানোর। ১৯৫৯ সালে ত্রিনিদাদে বিশ্ববিদ্যালয় গেমসের জন্য মনোনীত হয়েও যেতে পারেননি। অর্থের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকেসহ চারজন অ্যাথলেটকে যেতে দেয়নি। বাকি তিনজন হলেন- কাজী আবদুল আলীম, মুনির হোসেন ও আবুল বাশার। ১৯৬১ সালে লাহোরে ইয়থ অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি স্বর্ণপদক জয় করেন। বাঙালিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই এই দুর্লভ কৃতিত্ব দেখান। ১৯৬২ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে প্রথম বাঙালি অ্যাথলেট হিসেবে অংশ নেন। এ উপলক্ষে পাকিস্তানে নয় মাসের ট্রেনিং-এ অংশ নেয়া ২৯ জনের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি। পূর্ব পাকিস্তান পোলভল্টে তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম।
অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদ এস এ জামান মুক্তার প্রথম জীবনের ভালোবাসা ফুটবল। রাইট ইন পজিশনে তিনি ছিলেন দুরন্ত গতির এক খেলোয়াড়। বল নিয়ে নিয়ে ছুটতেন দুরন্ত গতিতে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ডজ দিয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়তেন রক্ষণভাগে। সহযোগী খেলোয়াড়দের নিয়ে খেলিয়ে নিতে পারতেন। আন্তঃকলেজ ফুটবল, স্যার এ এফ রহমান শীল্ড, রোনাল্ড শীল্ড, স্বাধীনতা দিবস শীল্ড, আগা খান গোল্ড কাপ, আইএফএ শীল্ডে তার নৈপুণ্যভাস্বর খেলা ছিল দেখার মত। জগন্নাথ কলেজের হয়ে আন্তঃকলেজ ফুটবল খেলার পর তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেন স্যার এফ এ রহমান শীল্ড, রোনাল্ড শীল্ড, স্বাধীনতা দিবস প্রতিযোগিতায়। সে বছর স্বাধীনতা দিবস ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ঢাকা ফুটবল লীগে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ও মুক্তা যেন একে অপরের পরিপূরক। আজাদ তার ভালোবাসার নিকেতন। এই কাবটি যাদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে, তিনি তাদের অন্যতম। খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে ক্লাবটি গড়ে তোলার পেছনে তার রয়েছে শ্রম-ঘাম-মেধা। সে সময় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আজাদ ছিল প্রিয় ক্লাব। ১৯৪৯ সালে তিনি এ ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে খেলা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে স্যার নাসিম আলী শীল্ড বিজয়ী রমনা মুকুল ফৌজ ফুটবল দলটির খেলোয়াড়দের নিয়েই মূলত গঠন করা হয় আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। সে দলের খেলোয়াড়রা হলেন- তোফাজ্জল, আমিন, মুক্তা, বেনজির, নূরু মিয়া, ওয়াহেদুল হক, আনোয়ার, মোয়াজ্জেম, শফি, আনজাম, ময়না, ছোট মুক্তা। কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন মোসলেম মিয়া, আতিকুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, আউয়াল প্রমুখ। ১৯৫০ সালে ক্লাবটি প্রথম বিভাগ লীগে উন্নীত হলে তিনি হন ক্লাবের অন্যতম স্তম্ভ। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের ফরোয়ার্ড লাইনে আনজাম-আনোয়ার-মুক্তা ছিলেন প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমত ত্রাস। এই ট্রায়োর অসাধারণ পারফরম্যান্সে সে সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। ইনসাইড ফরোয়ার্ড আনজাম হোসেন এবং এস এ জামান মুক্তা সামনের দিকে বল ঠেলে দিলে তা থেকে গোল করতেন আনোয়ার। এই ত্রয়ীর মেলবন্ধনে দর্শকরা দেখেছেন অসংখ্য গোল। সেন্টার ফরোয়ার্ড আনোয়ার, লেফট ইন আনজাম ও রাইট ইন মুক্তা ছিলেন একই ডালে তিনটি ফুল। খেলার গতি, বল নিয়ন্ত্রণ, হেডিং ও দ্রুততায় মুক্তা ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তার সঙ্গে আউটের খেলোয়াড়রা অতি সহজেই মানিয়ে নিতে পারতেন। ১৯৫৩ সালে রংপুরের গোবিন্দলাল ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৫৫ সালে রোনাল্ডস শীল্ড বিজয়ী, ১৯৫৮ সালে ঢাকা লীগ চ্যাম্পিয়ন ও রোনাল্ড শীল্ডে রানার্সআপ আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। খেলেছেন আগা খান গোল্ড কাপ ও আইএফএ শীল্ড ফুটবলে। তিনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ছাড়া অন্য কোনো কাবে খেলার কথা চিন্তাই করেননি। আজাদই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি আজাদের হয়ে খেলে অবসর নেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়। ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে যথাক্রমে ভাওয়ালপুর, করাচি, ঢাকা ও মুলতানে খেলেছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, কলকাতার শীর্ষ তিন কাব মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মোহামেডানের বিপক্ষে খেলেন। ১৯৫২ সালে কলকাতার ইস্টবেঙ্গল কাবের রাইট-ইনের তুখোড় খেলোয়াড় আপ্পারাও অবসর নিলে তার জায়গায় খেলার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু বয়স, দূরত্ব ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে তিনি খেলতে যাননি। ১৯৫২ সালে তিনি আজাদের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
এস এ জামান মুক্তা প্রসঙ্গে প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের মূল্যায়নটা এমন : ‘মুক্তা অ্যাথলেট হিসেবে বড়, না ফুটবলার হিসেবে বড়- তা এতদিন পরেও আমি ঠিক বিচার করতে পারিনি। তবে পঞ্চাশের দশকের অ্যাথলেটিকসের সেরা ফুটবলার এস এ জামান মুক্তা যে সে সময়ের সেরা রাইট ইনসাইট ফরোয়ার্ড- সে বিষয় কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তিনি যেমন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিকে পোলভল্টে বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, তেমনি তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় ফুটবলে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে ইনসাইড ফরোয়ার্ড হয়ে কৃতিত্বের সাথে খেলেছেন। বল নিয়ে তার রান ডাউন বা দৌড়ানোর ভঙ্গি দেশী আর কোনো খেলোয়াড়ের মাঝে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ওয়ান্ডারার্স কাবের খ্যাতিমান কর্মকর্তা ও তুখোড় ফুটবল অনুরাগী মতি সর্দার আজাদের খেলা দেখতে যেতেন শুধু মুক্তার জন্য। মুক্তার খেলা ছিল তার দারুণ পছন্দ।’
ক্রিকেটার হিসেবে মুক্তা ১৯৪৬-৪৭ সালে ঢাকা শহর আন্তঃস্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তার স্কুলের হয়ে খেলা শুরু করেন। ঢাকা লীগে খেলেছেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। ক্রিকেটে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিল তার সুখ্যাতি। হকিতেও স্কুলের পক্ষে ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর আন্তঃস্কুল হকি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেন আতিকুল্লা কাপ হকি। ঢাকা লীগে আজাদের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ব্যাডমিন্টন ও আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় তিনি আজাদের হয়ে অংশ নেন।
খেলা ছেড়ে দেবার পরও ক্রীড়াঙ্গন হয়ে ওঠে মুক্তার ঘর-সংসার। সংগঠক ও কোচ হিসেবে তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন। অবশ্য খেলোয়াড়ী জীবনেই এ দু’ক্ষেত্রে হাত পাকিয়েছেন। বিশেষ করে নিজেদের হাতে গড়া কাব আজাদ স্পোর্টিংকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তার আবেগ-উচ্ছ্বাস-স্বপ্ন-ভালোবাসা। এই ক্লাবের সুখ-দুঃখের তিনি ছিলেন অন্যতম সহচর। প্রাণপ্রিয় এই ক্লাবকে ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার চেষ্টার কমতি ছিল না। সেই ষাট দশকে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গন খুব বেশি সরব ছিল না। রক্ষণশীলতার দুর্ভেদ্য দেয়ালে বন্দী ছিল মেয়েদের পদচারণা। এমন এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনকে জাগিয়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নেন তিনি। অভিভাবকদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেয়েদের খেলার মাঠে টেনে আনার নিরন্তন প্রয়াস চালান। দুরূহ এই প্রচেষ্টায় সাফল্য পান নিবেদিতপ্রাণ এই ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। হয়ে ওঠেন সমাজ-প্রগতির অগ্রদূত। মেয়েদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তার সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ ও নিরলস সাধনায় ষাট ও সত্তর দশকে অ্যাথলেটিক অঙ্গনকে মাতিয়ে রাখেন আজাদের মহিলা অ্যাথলেটরা। পাকিস্তান অলিম্পিক ও পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেক বেশি পদক পায় এবং কয়েকটি ইভেন্টে নতুন জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। তার হাত ধরে মহিলা অ্যাথলেটিক্সে উঠে আসাদের অন্যতম হলেন থ্রোয়ার লুলু বিলকিস, রাজিয়া, স্প্রিন্টার কোয়েল, স্প্রিন্টার আয়েশা সিদ্দিকা আশু, হার্ডলার রওশন আখতার ছবি, স্প্রিন্টার হামিদা বেগম, থ্রোয়ার মোমতাজ বেগম, থ্রোয়ার সালমা রফিক, স্প্রিন্টার মারেফা, হাইজাম্পার ইসরাত আরা, স্প্রিন্টার হাসরাত আরা, লংজাম্পার শাহানী, জ্যাভলার রুনী, থ্রোয়ার রেহানা আখতার বেবী, রিলের রুমী, রাণী, হাইজাম্পার চুমকি, স্প্রিন্টার হাসি, স্প্রিন্টার বিউটি, মাঝারিপাল্লার দৌড়বিদ ফজিলুতুন্নেছা রোজী, স্প্রিন্টার শামীম আরা টলি, মাঝারিপাল্লার দৌড়বিদ রাজিয়া সুলতানা অনু, স্প্রিন্টার কামরুন্নেছা লিপি প্রমুখ। সে সময়টা মুক্তাকে নস্টালজিক করে তোলে : ‘সে সময় মেয়েদের দলের পোশাক ছিল উপরের জামাটি লাল ও নিচে হাঁটু পর্যন্ত হলুদ প্যান্ট। তখন মেয়ে দলের কৃতিত্ব পূর্ব পাকিস্তানীদের কাছে আলোচনা ও গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছিল। লাল-হলুদ পোশাক দেখলেই তারা বুঝে নিতো আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবকে।’ বর্তমানে অ্যাথলেটিকে মন্দাবস্থার কারণ হিসেবে তার মূল্যায়নটা হচ্ছে এমন : ‘অ্যাথলেটিক্সকে সরগরম করে রেখেছিল আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। আজাদের হয়ে আমি, আবুল হাসান, সিরাজুল ইসলাম, আলম, এনাম, কোয়েল, ছবি, টলি, ইসরাত আরা, হামিদা, অনু, লিপি পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকে ৭৯টি স্বর্ণ, ১৮টি রৌপ্য ও ৫টি ব্রোঞ্জসহ ১০২টি পদক লাভ করি। অথচ স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড কাব থেকে কেউ সরাসরি জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না বলে নতুন নিয়ম চালু করায় অ্যাথলেটিক্স থেকে বিদায় নেয় আজাদ স্পোর্টিং কাবের মত অ্যাথলেটিক্সের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত দেশের শক্তিশালী কাবগুলো। এর ফলে দুর্বল হয়ে যায় অ্যাথলেটিক্স।’
মুক্তা সম্পর্কে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট রাজিয়া সুলতানা অনুর অনুভূতিটা এমন : ‘আমি যদি কিছু হয়ে থাকি, তার পুরো কৃতিত্ব মুক্তা ভাইয়ের। আমার ক্যারিয়ারের পেছনে তার অবদানই বেশি। তার হাতেই আমার হাতেখড়ি। তিনি ১৯৭২ সালে জার্মানী থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার পর একটি ক্যাম্প আহ্বান করেন। আমার মত অনেকেই সেই ক্যাম্পে যোগ দেন। তার ট্রেনিং ক্যাপালিটি ছিল খুব সুন্দর। তখন তো আর মডার্ন ইকুইপমেন্ট পাওয়া যেত না। ছিল না মাল্টি-জিম। কিন্তু মুক্তা ভাই নিজেই প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য নানা রকম পদ্ধতি আবিষ্কার করতেন এবং সেভাবেই আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। আমি তার কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে ১৯৭৩ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় ৪০০ মিটার ও ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলেতে প্রথম এবং ২০০ মিটারে দ্বিতীয় হই। তখন আমি ছিলাম স্কুল ছাত্রী। এরপর তো আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।’
এস এ জামান মুক্তা ছিলেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি কাবের যুগ্ম সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহ-সভাপতি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি তার মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের ক্রিকেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭২ সালে পূর্ব জার্মানীর লিপজিগ থেকে লাভ করেন অ্যাথলেটিকে ডিপ্লোমা। একই বছর বার্লিনে ‘অলিম্পিক মিট’-এর অতিথি বিচারক মনোনীত হন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এশিয়ান গেমসে অ্যাথলেটিক্স দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সালে তিনি ছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক। ১৯৮০-৮১ সালে বাংলাদেশ অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৫ সালে সাফ গেমসে অ্যাথলেটিক্সের বিচারক ছিলেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে বিকেএসপির চীফ কোচ ছিলেন। ১৯৭৯ সালে পান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। বাংলাদেশ অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশন তাকে ‘গোল্ডেন বয় অব বাংলাদেশ’ হিসেবে ভূষিত করে। তিনি ক্রীড়াসহ নানা কারণে প্রায় ৪০টি দেশ সফর করেছেন।
বর্তমান সময়ের খেলাধুলা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। তার মতে,‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি খেলাধুলাকে অনেক বদলে দিয়েছে। খেলাধুলায় এসেছে অনেক নতুনত্ব। সুযোগ-সুবিধা ও টাকা-পয়সার লেন-দেন নেহাত মন্দ নয়। কিন্তু বাড়েনি খেলার মান। তাছাড়া নতুন নতুন খেলোয়াড়ও উঠে আসছে না। বিরাজ করছে একটা স্থবিরতা। অথচ আমাদের সময় খেলাধুলার তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ছিল না কোনো টাকা-পয়সা। তবে একটা জিনিস ছিল। সেটা ছিল আন্তরিকতা। আমরা যা করতাম, একাগ্রতা ও ভালোবাসা নিয়ে করতাম। বুকের ভেতর ছিল আত্মনিবেদন।’
এস এ জামান মুক্তার মত সব্যসাচী ক্রীড়াবিদ এখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে। খেলোয়াড়, কোচ ও সংগঠক হিসেবে ত্রিমাত্রিক ভুমিকায় সফল ক্রীড়াবিদ খুব বেশি দেখা যায় না। বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি বিবেচিত হয়ে থাকেন। প্রশিক্ষক হিসেবেও তিনি সাফল্য অর্জনকারীদের একজন। আর সংগঠক হিসেবেও তার তুলনা মেলাভার। একটি মাত্র কাবকে কেন্দ্র করে কখনো খেলোয়াড়, কখনো কোচ ও কখনো কর্মকর্তা হিসেবে ৫৯ বছর পেরিয়ে আসা বিরল এক ঘটনা। ক্রীড়াক্ষেত্রে তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা-আন্তরিকতা ও ভালোবাসা অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রাণহীন ক্রীড়াঙ্গনকে প্রাণোচ্ছ্বল করার জন্য তার মত বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন, ত্যাগী, নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক ক্রীড়াবিদের এখন খুবই প্রয়োজন। এস এ জামান মুক্তা সুস্থ হয়ে ফিরে আসার প্রত্যাশায় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। #
১৬-১১-২০০৭
ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান এস এ জামান মুক্তা। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি জন্ম। সাত ভাই ও দু’বোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় তিনি ছিলেন মুক্তবিহঙ্গের মত। তাদের পারিবারিক পরিবেশটাই ছিল খেলাধুলার উপযোগী। বড় ভাইদের খেলাধুলা করতে দেখে তাতে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। গ্রামের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশে ছুটেছেন বল্গা হরিণের মত। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার মধ্যেই ছিল তার ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রাথমিক পাঠ। তবে প্রকৃতির কাছে তার অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। অবারিত প্রকৃতি তাকে যুগিয়েছে খেলোয়াড় হওয়ার রসদ : ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে। উঁচু টিলার মত বাড়ি থেকে নামতে গিয়ে কিছুটা বেগ পেতে হত। প্রতিদিন বাড়িতে উঠা-নামা করতে গিয়ে শারীরিকভাবে এক ধরনের শক্তি অনুভব করতাম। আবার কখনো-সখনো খেলাচ্ছলে বাড়ি থেকে নামার সময় মাটিতে গড়িয়ে পড়তাম। ধুলা-বালি মাখামাখি হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম বাড়ির পাশের পুকুরে। সাঁতার কাটতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। শৈশবের সেই দুরন্তপনা, লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি থেকে অর্জিত বাড়তি শক্তিটুকু হয়ে ওঠে খেলোয়াড়ী জীবনের বড় এক সঞ্চয়।’
শমসপুর গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় খেলাধুলায় নিয়মিত অংশ নেন মুক্তা। তারপর ঢাকায় এসে ভর্তি হন নবকুমার ইনস্টিটিউটে। এ স্কুলটি খেলাধুলার লালনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। সঙ্গত কারণে এটি তার জন্য হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় নিজেকে বিকশিত করার এমন সুযোগ পেয়ে তাকে আর পায় কে! খেলার মাঠ যেন তাকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত ডেকে নিয়ে যায়। তিনি এই সম্মোহন কখনোই এড়াতে পারেননি। তার সময়ের আলোচিত এমন কোনো খেলা নেই, যাতে তিনি অংশ নেননি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো খেলায় তাকে খেলতে দেখা যেত। এমনকি একই দিনে একাধিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নিয়েছেন। যখন যে খেলায় সুযোগ পেয়েছেন, তাতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। ফুটবল, অ্যাথলেটিক, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, জিমন্যাস্টিক্স...আরো যে কত কি! যেখানেই যে কোনো খেলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত, তাতে তার উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। অনেক সময় শরীর কুলিয়ে ওঠতে চাইতো না, তবুও খেলা থেকে পিছু হঠতেন না। খেলে যে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন, তা নয়। তখন তো আর খেলাধুলায় অর্থ-কড়ি ছিল না। পুরো বিষয়টা ছিল সৌখিনতার বলয়ে বন্দি। নিছক ভালোবাসার টানে খেলার মাঠে ছুটে যেতেন। খেলোয়াড় হিসেবে একটু নাম করতে পারলে পাওয়া যেত মানুষের ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসাই তাকে খেলোয়াড় হওয়ার উৎসাহ যোগায়।
আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মুক্তা ছিলেন রীতিমত তারকা ক্রীড়াবিদ। তার বয়সীরা তো বটেই, তার সিনিয়ররাও তাকে দেখলে সমীহ করতেন। স্কুল পর্যায়ে তিনি যে কত সাফল্য দেখিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। তার কৃতিত্বে উদ্ভাসিত হয়েছে তার স্কুল। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অসংখ্যবার। অ্যাথলেটিকে প্রথম সাফল্য প্রসঙ্গে তার স্মৃতিচারণ : ‘১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম একটি প্রদর্শনী মেলার আয়োজন করা হয়। সেই মেলায় ছিল একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় পোলভল্টে কাজী আবদুল আলীমের সঙ্গে ক্ষুদে ক্রীড়াবিদ হিসেবে আমিও অংশ নেই। তাতে আমি তৃতীয় হই। এ সাফল্য আমাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। অ্যাথলেট হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সংকল্প করি। এ বছর রহমতগঞ্জের মোসলেম ভাই স্কুল ও কলেজের ক্রীড়া পাগল একদল ছাত্র সংগ্রহ করে আজাদ স্পোর্টিং নামে একটি কাব গঠন করেন। এ কাবের হয়ে আনোয়ার, খালেক, গেদা, বুলু, আমি প্রমুখ বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নেই। মূলত ফুটবল খেলায় প্রাধান্য দেয়া হলেও অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়। আর এ ক্ষেত্রে আমার একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়।’ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিজেকে আরো বড় পরিসরে মেলে ধরার সুযোগ পান মুক্তা। আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ এবং আন্তঃকলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতায় কয়েকটি রেকর্ড গড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোয়াড় হিসেবেও তার ছিল আলাদা খ্যাতি ও মর্যাদা।
ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও এস এ জামান মুক্তা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অ্যাথলেট। অ্যাথলেট হিসেবে তার রয়েছে অসংখ্য কীর্তি। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তঃস্কুল, আন্তঃজেলা ও প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পর পর পাঁচবার পোলভল্ট ও ডিসকাস থ্রোতে প্রথম হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা জগন্নাথ কলেজ অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে পোলভল্ট, ডিসকাস থ্রো ও হপ-স্টেপ-জাম্পে টানা পাঁচবার প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। জগন্নাথ কলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ এবং আন্তঃকলেজ চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতায় কয়েকটি রেকর্ড গড়েন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিকে অংশ নেন। সে সময়ের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন এভাবে : ‘১৯৫২ সালে টিনের বেড়ায় ঘেরা ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপ। এ প্রতিযোগিতায় আজাদ স্পোর্টিং কাবের হয়ে আমি পোলভল্টে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেই। শুধু পোলভল্টেই নয়, হপ-স্টেপ-জাম্পে দ্বিতীয় ও চাকতি নিক্ষেপে তৃতীয় হলে আমি সুনাম অর্জন করার পাশাপাশি পরিচিতি পায় আমার ক্লাব আজাদ। ১৯৫৩ সালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আজাদের অ্যাথলেটিক দল গঠন করে জাতীয় অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। সেবার আমাদের দলের খন্দকার আবুল হাসান লং জাম্প ও হপ-স্টেপ-জাম্পে, সিরাজুল ইসলাম ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়, আরজান খান ৮০০, ১৫০০ ও ম্যারাথন দৌড় এবং আমি পোলভল্ট, হপ-স্টেপ-জাম্প, চাকতি নিক্ষেপ ও রিলে দৌড়ে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকটি স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক পাই। আমি প্রতিযোগী ছাড়াও ছিলাম দলের প্রশিক্ষক।’ ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালে যথাক্রমে পেশোয়ার, ঢাকা, লাহোর ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান অলিম্পিকে পর পর চারবার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার অনন্য এক মাইলফলক গড়েন তিনি। এ সম্পর্কে তার স্মৃতিচারণ : ‘১৯৫৫ সালের মার্চে ঢাকায় চতুর্থ ন্যাশনাল অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে আজাদের হয়ে পোলভল্টে অংশ নিয়ে আমি তৃতীয় হই। প্রথম হন এশিয়ার খ্যাতিমান অ্যাথলেট ওয়াদি খান। তিনি ১২ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা অতিক্রম করেন। আর দ্বিতীয় হন আল্লা দিতা। ক্রমান্বয়ে নিজ চেষ্টা ও সাধনায় পোলভল্টে আধিপত্য বিস্তার করি এবং ইস্ট পাকিস্তানের একমাত্র বাঙালি অ্যাথলেট হিসেবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান অলিম্পিকে পর পর তিনবার তৃতীয় হয়েছি।’ পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকে পোলভল্টে ব্রোঞ্জ পদক জিতে নতুন এক ইতিহাস গড়েন মুক্তা। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাঙালি পুরুষ অ্যাথলেট হিসেবে তিনি পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটে কোনো পদক জয়ের বিরল গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালের মার্চে পেশোয়ারে ন্যাশনাল গেমসের পোলভল্টে ১৩ ফুট সোয়া ৫ ইঞ্চি লাফিয়ে পাকিস্তান রেকর্ড গড়ে প্রথম হয়েছেন ওয়াদি খান। আল্লা দিতা দ্বিতীয় ও মুক্তা তৃতীয় হন। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সপ্তম ন্যাশনাল গেমসে ১৩ ফুট ৬ ইঞ্চি লাফিয়ে আল্লা দিতা প্রথম, সাহিব খান দ্বিতীয় এবং ইলিয়াস ও মুক্তা তৃতীয় হন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অষ্টম ন্যাশনাল গেমসে ১৩ ফুট লাফিয়ে আল্লা দিতা প্রথম, সাপারাশ খান দ্বিতীয় ও মুক্তা তৃতীয় হন। পোলভল্টে মুক্তার রেকর্ড ছিল ১২ ফুট লাফানোর। ১৯৫৯ সালে ত্রিনিদাদে বিশ্ববিদ্যালয় গেমসের জন্য মনোনীত হয়েও যেতে পারেননি। অর্থের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকেসহ চারজন অ্যাথলেটকে যেতে দেয়নি। বাকি তিনজন হলেন- কাজী আবদুল আলীম, মুনির হোসেন ও আবুল বাশার। ১৯৬১ সালে লাহোরে ইয়থ অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি স্বর্ণপদক জয় করেন। বাঙালিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই এই দুর্লভ কৃতিত্ব দেখান। ১৯৬২ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে প্রথম বাঙালি অ্যাথলেট হিসেবে অংশ নেন। এ উপলক্ষে পাকিস্তানে নয় মাসের ট্রেনিং-এ অংশ নেয়া ২৯ জনের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি। পূর্ব পাকিস্তান পোলভল্টে তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম।
অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদ এস এ জামান মুক্তার প্রথম জীবনের ভালোবাসা ফুটবল। রাইট ইন পজিশনে তিনি ছিলেন দুরন্ত গতির এক খেলোয়াড়। বল নিয়ে নিয়ে ছুটতেন দুরন্ত গতিতে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ডজ দিয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়তেন রক্ষণভাগে। সহযোগী খেলোয়াড়দের নিয়ে খেলিয়ে নিতে পারতেন। আন্তঃকলেজ ফুটবল, স্যার এ এফ রহমান শীল্ড, রোনাল্ড শীল্ড, স্বাধীনতা দিবস শীল্ড, আগা খান গোল্ড কাপ, আইএফএ শীল্ডে তার নৈপুণ্যভাস্বর খেলা ছিল দেখার মত। জগন্নাথ কলেজের হয়ে আন্তঃকলেজ ফুটবল খেলার পর তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেন স্যার এফ এ রহমান শীল্ড, রোনাল্ড শীল্ড, স্বাধীনতা দিবস প্রতিযোগিতায়। সে বছর স্বাধীনতা দিবস ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ঢাকা ফুটবল লীগে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ও মুক্তা যেন একে অপরের পরিপূরক। আজাদ তার ভালোবাসার নিকেতন। এই কাবটি যাদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে, তিনি তাদের অন্যতম। খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে ক্লাবটি গড়ে তোলার পেছনে তার রয়েছে শ্রম-ঘাম-মেধা। সে সময় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আজাদ ছিল প্রিয় ক্লাব। ১৯৪৯ সালে তিনি এ ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে খেলা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে স্যার নাসিম আলী শীল্ড বিজয়ী রমনা মুকুল ফৌজ ফুটবল দলটির খেলোয়াড়দের নিয়েই মূলত গঠন করা হয় আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। সে দলের খেলোয়াড়রা হলেন- তোফাজ্জল, আমিন, মুক্তা, বেনজির, নূরু মিয়া, ওয়াহেদুল হক, আনোয়ার, মোয়াজ্জেম, শফি, আনজাম, ময়না, ছোট মুক্তা। কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন মোসলেম মিয়া, আতিকুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, আউয়াল প্রমুখ। ১৯৫০ সালে ক্লাবটি প্রথম বিভাগ লীগে উন্নীত হলে তিনি হন ক্লাবের অন্যতম স্তম্ভ। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের ফরোয়ার্ড লাইনে আনজাম-আনোয়ার-মুক্তা ছিলেন প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমত ত্রাস। এই ট্রায়োর অসাধারণ পারফরম্যান্সে সে সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। ইনসাইড ফরোয়ার্ড আনজাম হোসেন এবং এস এ জামান মুক্তা সামনের দিকে বল ঠেলে দিলে তা থেকে গোল করতেন আনোয়ার। এই ত্রয়ীর মেলবন্ধনে দর্শকরা দেখেছেন অসংখ্য গোল। সেন্টার ফরোয়ার্ড আনোয়ার, লেফট ইন আনজাম ও রাইট ইন মুক্তা ছিলেন একই ডালে তিনটি ফুল। খেলার গতি, বল নিয়ন্ত্রণ, হেডিং ও দ্রুততায় মুক্তা ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তার সঙ্গে আউটের খেলোয়াড়রা অতি সহজেই মানিয়ে নিতে পারতেন। ১৯৫৩ সালে রংপুরের গোবিন্দলাল ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৫৫ সালে রোনাল্ডস শীল্ড বিজয়ী, ১৯৫৮ সালে ঢাকা লীগ চ্যাম্পিয়ন ও রোনাল্ড শীল্ডে রানার্সআপ আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। খেলেছেন আগা খান গোল্ড কাপ ও আইএফএ শীল্ড ফুটবলে। তিনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ছাড়া অন্য কোনো কাবে খেলার কথা চিন্তাই করেননি। আজাদই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি আজাদের হয়ে খেলে অবসর নেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়। ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে যথাক্রমে ভাওয়ালপুর, করাচি, ঢাকা ও মুলতানে খেলেছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, কলকাতার শীর্ষ তিন কাব মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মোহামেডানের বিপক্ষে খেলেন। ১৯৫২ সালে কলকাতার ইস্টবেঙ্গল কাবের রাইট-ইনের তুখোড় খেলোয়াড় আপ্পারাও অবসর নিলে তার জায়গায় খেলার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু বয়স, দূরত্ব ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে তিনি খেলতে যাননি। ১৯৫২ সালে তিনি আজাদের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
এস এ জামান মুক্তা প্রসঙ্গে প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের মূল্যায়নটা এমন : ‘মুক্তা অ্যাথলেট হিসেবে বড়, না ফুটবলার হিসেবে বড়- তা এতদিন পরেও আমি ঠিক বিচার করতে পারিনি। তবে পঞ্চাশের দশকের অ্যাথলেটিকসের সেরা ফুটবলার এস এ জামান মুক্তা যে সে সময়ের সেরা রাইট ইনসাইট ফরোয়ার্ড- সে বিষয় কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তিনি যেমন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিকে পোলভল্টে বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, তেমনি তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় ফুটবলে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে ইনসাইড ফরোয়ার্ড হয়ে কৃতিত্বের সাথে খেলেছেন। বল নিয়ে তার রান ডাউন বা দৌড়ানোর ভঙ্গি দেশী আর কোনো খেলোয়াড়ের মাঝে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ওয়ান্ডারার্স কাবের খ্যাতিমান কর্মকর্তা ও তুখোড় ফুটবল অনুরাগী মতি সর্দার আজাদের খেলা দেখতে যেতেন শুধু মুক্তার জন্য। মুক্তার খেলা ছিল তার দারুণ পছন্দ।’
ক্রিকেটার হিসেবে মুক্তা ১৯৪৬-৪৭ সালে ঢাকা শহর আন্তঃস্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তার স্কুলের হয়ে খেলা শুরু করেন। ঢাকা লীগে খেলেছেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। ক্রিকেটে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিল তার সুখ্যাতি। হকিতেও স্কুলের পক্ষে ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর আন্তঃস্কুল হকি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেন আতিকুল্লা কাপ হকি। ঢাকা লীগে আজাদের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ব্যাডমিন্টন ও আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় তিনি আজাদের হয়ে অংশ নেন।
খেলা ছেড়ে দেবার পরও ক্রীড়াঙ্গন হয়ে ওঠে মুক্তার ঘর-সংসার। সংগঠক ও কোচ হিসেবে তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন। অবশ্য খেলোয়াড়ী জীবনেই এ দু’ক্ষেত্রে হাত পাকিয়েছেন। বিশেষ করে নিজেদের হাতে গড়া কাব আজাদ স্পোর্টিংকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তার আবেগ-উচ্ছ্বাস-স্বপ্ন-ভালোবাসা। এই ক্লাবের সুখ-দুঃখের তিনি ছিলেন অন্যতম সহচর। প্রাণপ্রিয় এই ক্লাবকে ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার চেষ্টার কমতি ছিল না। সেই ষাট দশকে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গন খুব বেশি সরব ছিল না। রক্ষণশীলতার দুর্ভেদ্য দেয়ালে বন্দী ছিল মেয়েদের পদচারণা। এমন এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনকে জাগিয়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নেন তিনি। অভিভাবকদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেয়েদের খেলার মাঠে টেনে আনার নিরন্তন প্রয়াস চালান। দুরূহ এই প্রচেষ্টায় সাফল্য পান নিবেদিতপ্রাণ এই ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। হয়ে ওঠেন সমাজ-প্রগতির অগ্রদূত। মেয়েদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তার সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ ও নিরলস সাধনায় ষাট ও সত্তর দশকে অ্যাথলেটিক অঙ্গনকে মাতিয়ে রাখেন আজাদের মহিলা অ্যাথলেটরা। পাকিস্তান অলিম্পিক ও পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেক বেশি পদক পায় এবং কয়েকটি ইভেন্টে নতুন জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। তার হাত ধরে মহিলা অ্যাথলেটিক্সে উঠে আসাদের অন্যতম হলেন থ্রোয়ার লুলু বিলকিস, রাজিয়া, স্প্রিন্টার কোয়েল, স্প্রিন্টার আয়েশা সিদ্দিকা আশু, হার্ডলার রওশন আখতার ছবি, স্প্রিন্টার হামিদা বেগম, থ্রোয়ার মোমতাজ বেগম, থ্রোয়ার সালমা রফিক, স্প্রিন্টার মারেফা, হাইজাম্পার ইসরাত আরা, স্প্রিন্টার হাসরাত আরা, লংজাম্পার শাহানী, জ্যাভলার রুনী, থ্রোয়ার রেহানা আখতার বেবী, রিলের রুমী, রাণী, হাইজাম্পার চুমকি, স্প্রিন্টার হাসি, স্প্রিন্টার বিউটি, মাঝারিপাল্লার দৌড়বিদ ফজিলুতুন্নেছা রোজী, স্প্রিন্টার শামীম আরা টলি, মাঝারিপাল্লার দৌড়বিদ রাজিয়া সুলতানা অনু, স্প্রিন্টার কামরুন্নেছা লিপি প্রমুখ। সে সময়টা মুক্তাকে নস্টালজিক করে তোলে : ‘সে সময় মেয়েদের দলের পোশাক ছিল উপরের জামাটি লাল ও নিচে হাঁটু পর্যন্ত হলুদ প্যান্ট। তখন মেয়ে দলের কৃতিত্ব পূর্ব পাকিস্তানীদের কাছে আলোচনা ও গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছিল। লাল-হলুদ পোশাক দেখলেই তারা বুঝে নিতো আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবকে।’ বর্তমানে অ্যাথলেটিকে মন্দাবস্থার কারণ হিসেবে তার মূল্যায়নটা হচ্ছে এমন : ‘অ্যাথলেটিক্সকে সরগরম করে রেখেছিল আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। আজাদের হয়ে আমি, আবুল হাসান, সিরাজুল ইসলাম, আলম, এনাম, কোয়েল, ছবি, টলি, ইসরাত আরা, হামিদা, অনু, লিপি পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকে ৭৯টি স্বর্ণ, ১৮টি রৌপ্য ও ৫টি ব্রোঞ্জসহ ১০২টি পদক লাভ করি। অথচ স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড কাব থেকে কেউ সরাসরি জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না বলে নতুন নিয়ম চালু করায় অ্যাথলেটিক্স থেকে বিদায় নেয় আজাদ স্পোর্টিং কাবের মত অ্যাথলেটিক্সের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত দেশের শক্তিশালী কাবগুলো। এর ফলে দুর্বল হয়ে যায় অ্যাথলেটিক্স।’
মুক্তা সম্পর্কে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট রাজিয়া সুলতানা অনুর অনুভূতিটা এমন : ‘আমি যদি কিছু হয়ে থাকি, তার পুরো কৃতিত্ব মুক্তা ভাইয়ের। আমার ক্যারিয়ারের পেছনে তার অবদানই বেশি। তার হাতেই আমার হাতেখড়ি। তিনি ১৯৭২ সালে জার্মানী থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার পর একটি ক্যাম্প আহ্বান করেন। আমার মত অনেকেই সেই ক্যাম্পে যোগ দেন। তার ট্রেনিং ক্যাপালিটি ছিল খুব সুন্দর। তখন তো আর মডার্ন ইকুইপমেন্ট পাওয়া যেত না। ছিল না মাল্টি-জিম। কিন্তু মুক্তা ভাই নিজেই প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য নানা রকম পদ্ধতি আবিষ্কার করতেন এবং সেভাবেই আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। আমি তার কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে ১৯৭৩ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় ৪০০ মিটার ও ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলেতে প্রথম এবং ২০০ মিটারে দ্বিতীয় হই। তখন আমি ছিলাম স্কুল ছাত্রী। এরপর তো আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।’
এস এ জামান মুক্তা ছিলেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি কাবের যুগ্ম সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহ-সভাপতি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি তার মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের ক্রিকেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭২ সালে পূর্ব জার্মানীর লিপজিগ থেকে লাভ করেন অ্যাথলেটিকে ডিপ্লোমা। একই বছর বার্লিনে ‘অলিম্পিক মিট’-এর অতিথি বিচারক মনোনীত হন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এশিয়ান গেমসে অ্যাথলেটিক্স দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সালে তিনি ছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক। ১৯৮০-৮১ সালে বাংলাদেশ অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৫ সালে সাফ গেমসে অ্যাথলেটিক্সের বিচারক ছিলেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে বিকেএসপির চীফ কোচ ছিলেন। ১৯৭৯ সালে পান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। বাংলাদেশ অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশন তাকে ‘গোল্ডেন বয় অব বাংলাদেশ’ হিসেবে ভূষিত করে। তিনি ক্রীড়াসহ নানা কারণে প্রায় ৪০টি দেশ সফর করেছেন।
বর্তমান সময়ের খেলাধুলা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। তার মতে,‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি খেলাধুলাকে অনেক বদলে দিয়েছে। খেলাধুলায় এসেছে অনেক নতুনত্ব। সুযোগ-সুবিধা ও টাকা-পয়সার লেন-দেন নেহাত মন্দ নয়। কিন্তু বাড়েনি খেলার মান। তাছাড়া নতুন নতুন খেলোয়াড়ও উঠে আসছে না। বিরাজ করছে একটা স্থবিরতা। অথচ আমাদের সময় খেলাধুলার তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ছিল না কোনো টাকা-পয়সা। তবে একটা জিনিস ছিল। সেটা ছিল আন্তরিকতা। আমরা যা করতাম, একাগ্রতা ও ভালোবাসা নিয়ে করতাম। বুকের ভেতর ছিল আত্মনিবেদন।’
এস এ জামান মুক্তার মত সব্যসাচী ক্রীড়াবিদ এখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে। খেলোয়াড়, কোচ ও সংগঠক হিসেবে ত্রিমাত্রিক ভুমিকায় সফল ক্রীড়াবিদ খুব বেশি দেখা যায় না। বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি বিবেচিত হয়ে থাকেন। প্রশিক্ষক হিসেবেও তিনি সাফল্য অর্জনকারীদের একজন। আর সংগঠক হিসেবেও তার তুলনা মেলাভার। একটি মাত্র কাবকে কেন্দ্র করে কখনো খেলোয়াড়, কখনো কোচ ও কখনো কর্মকর্তা হিসেবে ৫৯ বছর পেরিয়ে আসা বিরল এক ঘটনা। ক্রীড়াক্ষেত্রে তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা-আন্তরিকতা ও ভালোবাসা অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রাণহীন ক্রীড়াঙ্গনকে প্রাণোচ্ছ্বল করার জন্য তার মত বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন, ত্যাগী, নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক ক্রীড়াবিদের এখন খুবই প্রয়োজন। এস এ জামান মুক্তা সুস্থ হয়ে ফিরে আসার প্রত্যাশায় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। #
১৬-১১-২০০৭
২০০৭ সালের ৩০ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন এস এ জামান মুক্তা।
উত্তরমুছুন