খন্দকার আবুল হাসান : একের ভেতর তিন/ দুলাল মাহমুদ

গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, রাজা মিডাস যা কিছু স্পর্শ করতেন তাই সোনা হয়ে যেত। এই কাহিনীর অন্তর্নিহিত সারমর্ম যতটুকু অনুধাবন করা যায়, তার তাৎপর্য দাঁড়ায়, এই ‘মিডাস টাচ’ যারা পান, তারা হন সৌভাগ্যের বরপুত্র। আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন তারা যে খেলায় হাত দিয়েছেন, তাতেই দু’হাত ভরে সাফল্য পেয়েছেন। আসলে সহজাত প্রতিভা নিয়েই যেন তারা জন্মগ্রহণ করেন। তাদের ভেতরে প্রতিভার যে আগুন ছিল, সুযোগের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতেই তা দপ করে জ্বলে উঠেছে। সঙ্গত কারণেই নিজেকে মেলে ধরার পাশাপাশি প্রতিভার দীপ্তি দিয়ে তারা উজ্জ্বল করেন ক্রীড়াঙ্গনকে। আর এমন একজন বিরল প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ হলেন খন্দকার আবুল হাসান। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের ক্রীড়াঙ্গনকে যারা আলোকিত করেছেন, তিনি তাদের অন্যতম। ভলিবল, অ্যাথলেটিক্স ও ফুটবলে তার কৃতিত্ব রীতিমত কিংবদন্তি হয়ে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তিনটি খেলায় একই সঙ্গে সমান পারদর্শিতা দেখানো চাট্টিখানি কথা নয়। অথচ এটি তার কাছে ছিল অনায়াস দক্ষতারই অংশ। এই দক্ষতা দেখিয়ে তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আলোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তার মতো সফল ক্রীড়াবিদের সংখ্যা খুব একটা দেখা যায় না।
লালনের দেশ কুষ্টিয়ার সন্তান খন্দকার আবুল হাসান। ১৯৩৯ সালের ৭ মে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। অবারিত মাঠ আর নির্মল বিনোদনের পরিবেশ পেয়ে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় তিনি আকৃষ্ট হন খেলাধুলায়। সহযোগী ও সহপাঠীদের তুলনায় উচ্চতায় খানিকটা বেশি লম্বা হওয়ায় সবকিছুতেই ছিল তার অগ্রগামিতা। দ্রুত ছুটতে পারতেন, লাফাতে পারতেনও বেশি। এ কারণে ক্রীড়াবিদ হিসেবে ‘সাফল্যের ঘোড়া’য় ছুটতে পেরেছেন দুরন্ত গতিতে। খেলাধুলায় পারিবারিক ঐতিহ্য তো ছিলই না, উপরন্তু প্রথম দিকে বাধাই পেয়েছেন। অন্য সবার মতো তার বাবা-মাও চেয়েছেন ছেলে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করুক। পরে খেলাধুলায় তীব্র আগ্রহ আর প্রতিভার ঝলক দেখে তার দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া হয়। নিয়মিত দুধ-ডিম হয় তার প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকার অংশ। পরিবারের সমর্থন পেয়ে খেলাধুলার প্রতি তার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই খেলাধুলায় তার প্রতিভার স্ফূরণ ঘটতে থাকে। কম-বেশি সব খেলায় অংশ নিতেন। তবে মূল আকর্ষণ ছিল অ্যাথলেটিক্স ও ফুটবলে।
স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কারণে সাফল্যটা শুরুতে আসে অ্যাথলেটিক্স থেকে। তবে ফুটবলেও অল্প সময়ের মধ্যে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ১৯৫৫ সালে আন্তঃস্কুল ফুটবলে যশোর রেঞ্জে চ্যাম্পিয়ন হয় কুষ্টিয়ার মুসলিম স্কুল। তিনি ছিলেন দলের অতন্দ্রপ্রহরী। সে সময় তিনি ছিলেন গোলরক্ষক। একই বছর কুষ্টিয়া ফুটবল লীগে খেলা শুরু করেন কুষ্টিয়া অ্যাথলেটিক্স ক্লাবের হয়ে। তবে তার পজিশন নির্দিষ্ট ছিল না। যখন যে পজিশন শূন্য থাকতো, তখন সেই পজিশনে খেলতেন। ফুটবলে তার গুরু ছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আরেক কৃতী সন্তান তাজুল ইসলাম মান্না। কুষ্টিয়ার সন্তান মান্না তখন ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের প্রথিতযশা ফুটবলার। খেলতেন সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে। আর এই মান্নার উপদেশ ও পরামর্শ তার কাছে ছিল বেদবাক্যের মতো। ফুটবলার হওয়ার তালিমটা তিনি তার কাছেই পেয়ে যান। তিনি যেভাবে বলতেন, চেষ্টা করতেন নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে। তার সুফলও তিনি পেয়েছেন।
তবে ফুটবলে এগিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে খন্দকার আবুল হাসান একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকার সে সময়কার একটি সেরা দল ইপিআর ১৯৫৫ সালে চুয়াডাঙ্গায় প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলতে আসে। সে ম্যাচে আমাকে খেলার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আমি সেন্টার হাফে খেলি। বোধহয় ভালোই খেলেছিলাম। খেলা শেষে ইপিআরের সেন্টার ফরোয়ার্ড শওকত আমাকে ঢাকায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হাফের খেলোয়াড় লুৎফর হকের সঙ্গে প্রায়ই ঢাকায় যেতাম। ফুটবলার শওকতের আমন্ত্রণ পেয়ে ঢাকায় ছুটে যাই। ঢাকায় যেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে মান্না ভাইয়ের কাছে উঠি। মান্না ভাই এই হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। একদিন মান্না ভাইয়ের সঙ্গে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে যাই। মান্না ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি আবরার হোসেন সিদ্দিকী সে সময় উপস্থিত হন। তিনি কী ভেবে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোন পজিশনে খেল? আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই। আমার হয়ে মান্না ভাই ত্বরিতগতিতে মুখ ফসকে বলে দেন, লেফট আউট। তিনি তখন মান্না ভাইকে বললেন, আমার বাসায় ওকে নিয়ে এসো। সে সময় ঢাকার বাইরের আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড়রা সাধারণত সিদ্দিকী সাহেবের চাঁনখারপুলের বাসায় থাকতেন। মান্না ভাই আমাকে তার বাসায় নিয়ে যান। সেখানে আমার খেলার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। ১৯৫৬ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ লীগে আমি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে সেন্ট্রাল স্টেশনারি দলের হয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম খেলি। আমার পজিশন ছিল লেফট আউট। সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড মান্না ভাইয়ের কাছ থেকে পাস পেয়ে খেলায় দলের প্রথম গোলও করি। খেলায় আমার বেশ ভালোভাবেই জয়ী হই। এরপর আমি হয়ে যাই আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের নিয়মিত ফুটবলার। শওকত ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা করা হয়নি এবং ইপিআরে যোগ দেয়া হয়নি। তবে খেলার মাঠে শওকত ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হত।’
আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব সে সময় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সবাইকে এই ক্লাবটি জড়িয়ে ফেলতো ভালোবাসার বন্ধনে। খন্দকার আবুল হাসানও এই সম্মোহন এড়াতে পারেননি। আজাদের হয়ে খেলার সময় নিজের মন-প্রাণ ঢেলে দেন। আজাদ হয়ে উঠে তার আপন ভুবনের ঠিকানা। তিনি আজাদের হয়ে প্রতিটি পজিশনেই খেলার বিরল গৌরব অর্জন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজাদ ছিল আমাদের ভালোবাসার নিকেতন। এই ক্লাবের জন্য কিছু করতে পারাটা ছিল আমাদের কাছে বিশাল কিছু। আজাদের কাছে আমাদের কোনো চাওয়া ছিল না। বরং এই ক্লাবের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেয়াটা ছিল জীবনের পরম লক্ষ্য। এ কারণে আজাদে আমি নির্দিষ্ট কোনো পজিশনে খেলিনি। যখন যে পজিশনে প্রয়োজন হয়েছে, তখন সেই পজিশনে খেলেছি। আর আমার সব পজিশনে খেলার কথা মান্না ভাই জানতেন। মান্না ভাই তখন আজাদ স্পোর্টিংয়ের প্রাণ। সেজন্য তিনি যেভাবে চাইতেন, আমিও তা পালন করার চেষ্টা করেছি। নিজের ভাল-মন্দ বিচার-বিবেচনা করিনি। ১৯৫৭ সালে একবার গোলরক্ষক পজিশনেও খেলেছি। সে সময় আজাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দাশ। তিনি তখন দেশসেরা। তার বিকল্প কেউ ছিল না। তিনি আহত হলে দ্বিতীয় গোলরক্ষককেও পাওয়া যায়নি। অগত্যা মান্না ভাইয়ের অনুরোধে আমাকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। আসলে আজাদের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে একদম মিশিয়ে ফেলেছিলাম। ১৯৫৮ সালে আজাদ স্পোর্টিং ঢাকা লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ঢাকা মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব আর মাকরানি ফুটবলারদের দাপটের মধ্যে বাঙালি ছাত্রদের নিয়ে গঠিত আজাদের এই সাফল্য সবাইকে চমকে দিয়েছিল। সেবার চ্যাম্পিয়ন দলটির লাইন-আপ ছিল যতদূর মনে পড়ে- রঞ্জিত, খালেক, হান্নান, মজিদ, আবুল, লুৎফল, রশিদ, মান্না, আনজাম, এজাজ, আবু তাহের বাটু। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর খেলেছি আজাদের হয়ে। ফুটবল ক্যারিয়ারটা এই ক্লাবের হয়েই শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৬৩ সালে লীগের একটি খেলায় আমাদের দল পরাজিত হলে আজাদের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্লাবে এসে খেলোয়াড়দের গালাগালি করেন। তার মতে, খেলোয়াড়রা মন লাগিয়ে খেলে না। আন্তরিক নন। মাঠে যায় শোভাবর্ধনের জন্য। তার এ কথা শুনে আমার মনটা ভেঙ্গে যায়। যে ক্লাব থেকে একটি পয়সা পর্যন্ত নিতাম না, কত কষ্ট স্বীকার করে কুষ্টিয়া থেকে খেলার আগে হাজির হয়ে খেলতে নেমেছি, সর্বোপরি যে ক্লাবের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি, সেই ক্লাবের কর্মকর্তার এমন আচরণে সত্যি সেদিন দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছিলাম। বিবেকে বড্ড লেগেছিল। একান্তে খুব কেঁদেছিলাম। এমন এক মন খারাপ করা বিকেলে সহযোগী ফুটবলার গাউস ফায়ার সার্ভিসে খেলার প্রস্তাব দেন। এমনিতে আজাদের সঙ্গে আমাদের কোনো হিসাব-নিকাশ ছিল না। খেলতাম মনের টানে। শুধু খেলার সময় ক্লাবের সভাপতি সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় থাকতাম। ক্লাব থেকে কোনো টাকা-পয়সাও নিতাম না। ফায়ার সার্ভিস তাদের ক্লাবে খেলার জন্য আমাকে মৌসুমে দেড়/দুই হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয়। তাতে রাজি হয়ে যাই। এতে মনে হতে পারে, আমি টাকা-পয়সার প্রলোভনে পড়ে আজাদ ছেড়ে চলে যাই। আসলে টাকা-পয়সাটা মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল না। মনে যদি আঘাত লাগে, তা কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। আজাদের সঙ্গে আমার ছিল ভালোবাসার বন্ধন। তা ছিন্ন করাটা সত্যিই আমার জন্য ছিল বেদনাদায়ক। তবে সে সময় আজাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দাশ, ব্যাকের হান্নান ও আব্দুল খালেক, লেফট ইন আনজাম, রাইট আউট এম এ রশিদ প্রমুখের খেলার কথা মনে পড়ে। অনেক দিন খেলার পর ফুটবলে প্রথম অর্থ-কড়ি পাই ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে। সে সময় যে টাকা পেতাম, তা নেহাত মন্দ নয়। ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেয়ার পর আমার পজিশন সেন্টার হাফ হিসেবে স্থায়ী হয়ে যায়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিন বছর ফায়ার সার্ভিসের হয়ে খেলেছি। ১৯৬৭ সালে এক বছর খেলি ওয়ারীতে। ১৯৬৮ সাল থেকে যোগ দেই রহমতগঞ্জে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত খেলেছি এই ক্লাবে। তারপর আর ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।’
ফুটবল লীগ ছাড়াও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলেছেন খন্দকার আবুল হাসান। ১৯৫৯ সালে তার কুষ্টিয়া কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ইন্টার কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়। একই বছর পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসে পাকিস্তান এয়ারফোর্স ফুটবল দল। সেই দলে ছিলেন নবী চৌধুরী, মাসুদের মত ফুটবলাররা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে কুষ্টিয়া থেকে খেলেন গোলরক্ষক খায়রুল আলম মন্টু, ব্যাকের সুকুমার ও আবুল হাসান। ১৯৫৯ সালে রাজশাহীতে বসে ইন্টার ইউনিভার্সিটি ফুটবলের ইস্ট জোনের খেলা। ফাইনালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখোমুখি হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সে খেলাটি তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। সে ম্যাচটি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন অত্যন্ত শক্তিশালী দল। পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা খেলতেন। দলে ছিলেন গোলরক্ষক মঞ্জুর হাসান মিন্টু, লেফট ইন হাবিব, এম এ রশিদ, হান্নান, শাহ আলমের মত খ্যাতিমান ফুটবলাররা। এমন শক্তিমান প্রতিপক্ষ দেখেও আমি কিন্তু একটু ঘাবড়ে যাইনি। আমি তখন আজাদে খেলি। আগের বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন আজাদ। সঙ্গত কারণে আমার আত্মবিশ্বাসও তুঙ্গে। সেদিন আমি জীবনবাজি রেখে খেলেছিলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব রক্ষা করাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা তিন শূন্য গোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হারিয়ে ইস্ট জোনে চ্যাম্পিয়ন হই। তিনটি গোলই করেছিলাম আমি। সেই হ্যাটট্রিকটি কথা মনে পড়লে আজও আমাকে রোমাঞ্চিত করে। আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ওয়েস্ট জোনে খেলার সুযোগ পাই। পাঞ্জাবে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির বিপক্ষে আমরা ২-৪ গোলে হেরে যাই। হায়দরাবাদে হায়দরাবাদ ইউনিভার্সিটিকে আমরা ৪-০ গোলে পরাজিত করি। করাচীতে করাচী ইউনিভার্সিটিকে হারাই ২-০ গোলে। পেশোয়ারে শেষ ম্যাচে পেশোয়ার ইউনিভার্সিটির কাছে হেরে যাই ১-২ গোলে। আমাদের দলের অধিনায়ক ছিলেন ঢাকা মোহামেডানের ব্যাকের খেলোয়াড় সাত্তার।’
১৯৬৩-৬৪ সালে অল-পাকিস্তান ডিভিশনাল ফুটবলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অংশ নেয় চারটি দল- ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ। খেলা হয় করাচীতে। আবুল হাসান খেলেন খুলনা বিভাগের হয়ে। খেলেছেন লেফট ইন পজিশনে। ১৯৫৬ সালে কলকাতা ইস্টবেঙ্গল এবং ১৯৫৮ সালে কলকাতা মোহামেডান ঢাকা সফরে এলে তিনি তাদের বিপক্ষে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন। আবুল হাসানের দেখা ফুটবলারদের মধ্যে মাকরানি খেলোয়াড় তোরাব আলী, আবদুল্লাহ, হাসান কিলার, মুসা আর বাঙালীদের মধ্যে রঞ্জিত দাশ, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, জাকারিয়া পিন্টু, বশীর আহমেদ, গোলাম সারোয়ার টিপুর খেলা তার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
খন্দকার আবুল হাসান বিভিন্ন পজিশনে ফুটবল খেললেও কর্নার থেকে তার দীর্ঘ দেহের নিপুণ হেড আর পেনাল্টি থেকে বুটের টো দিয়ে দারুণ শটের সাহায্যে গোল করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সে সময়কার এবং এখনকার ফুটবলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন খেলোয়াড়দের ছিল ব্যক্তিগত ক্যারিশমা। একজন ফুটবলার চাইলে পাঁচ মিনিট ড্র্রিবলিং করতে পারতেন। খেলা তো আনন্দের জন্য। সে সময়কার খেলায় আলাদা একটা সৌন্দর্য ছিল। যা দেখলে মন জুড়িয়ে যেত। এখন তো টোটাল ফুটবলের যুগ। হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে খেলা হয়। টেকনিক বদলে গেছে। আগের মত আকর্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় না।’
ফুটবলের আগেই অ্যাথলেটিক্সে সাফল্য পান খন্দকার আবুল হাসান। ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়া মুসলিম হাইস্কুলের হয়ে ইন্টার স্কুল অ্যাথলেটিক্সে অংশ নেন। তখন তার ইভেন্ট ছিল হাইজাম্প। এতে যশোর রেঞ্জে প্রথম হন তিনি। সেই সুবাদে ঢাকায় গিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ পান। তাতে হাইজাম্পে দ্বিতীয় হন। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে যশোর রেঞ্জে চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৫৬ সাল থেকে হাইজাম্পের পাশাপাশি লংজাম্প, ব্রডজাম্প, হফ স্টেপ অ্যান্ড জাম্প ও শটপুটে অংশ নিয়ে সাফল্য দেখাতে থাকেন। ১৯৫৭ সালে যশোর রেঞ্জে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঢাকায় ইন্টার স্কুল প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেন। হাইজাম্প, লং জাম্প, ব্রডজাম্প, হফ স্টেপ অ্যান্ড জাম্পে প্রথম এবং শটপুট ও ১০০ মিটার ইভেন্টে দ্বিতীয় হয়ে তিনি প্রাদেশিক আন্তঃস্কুল অ্যাথলেটিক মিটে চ্যাম্পিয়ন হন। ব্রডজাম্পে স্কুল রেকর্ড গড়েন। হাইজাম্পে রেকর্ড গড়তে পারতেন বলে খন্দকার আবুল হাসান জানান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাইজাম্পে পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি লাফ দেয়ার পর আরো উঁচুতে লাফ দিতে পারতাম। কিন্তু একজন কর্মকর্তা আমাকে জানান, তুমি তো প্রথম হয়ে গেছ। আর লাফ দেয়ার প্রয়োজন নেই। সে মুহূর্তে সেটি আমি সানন্দে মেনে নিই। পরবর্তীকালে আমি বুঝতে পারি, সেই কর্মকর্তা নিজের রেকর্ড ভেঙ্গে যাবে বলে আমাকে আর পরবর্তী লাফ দেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন। তখন আর আমার কিছু করার ছিল না।’
আবুল হাসান ১৯৫৮ সালে প্রথম জাতীয় পর্যায়ের অ্যাথলেটিক্সে অংশ নেন। প্রাদেশিক অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিয়ে তিনি ব্রডজাম্প ও হাইজাম্পে প্রথম হন। একই বছর অংশ নেন পেশোয়ারে পাকিস্তান অলিম্পিকে। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের ন্যাশনাল অ্যাথলেটিক ট্রেনিং সেন্টার থেকে আড়াই মাসের কোচিং নেন। সে বছর রোমে অল ইউনিভার্সিটি অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সুযোগ পাওয়া একমাত্র বাঙালি ছিলেন তিনি। রোমে হফ স্টেপ অ্যান্ড জাম্প ও ব্রডজাম্পে অংশ নেন। ১৯৫৯ সালে প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকে অংশ নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে। হফ স্টেপ অ্যান্ড জাম্প ও ব্রডজাম্পে রেকর্ডসহ প্রথম এবং হাইজাম্পে তৃতীয় হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ২২ ফুট লাফিয়ে তিনি ব্রডজাম্পে পূর্ব পাকিস্তান রেকর্ড গড়েন। এতে দ্বিতীয় হন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের বশির আহমেদ। আর হফ স্টেপ জাম্পে ৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি লাফিয়ে রেকর্ড গড়েন। আগের রেকর্ডের চেয়ে সোয়া আট ইঞ্চি বেশি লাফান তিনি। দ্বিতীয় হন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের এ বি চৌধুরী ও তৃতীয় ইবি রেলওয়ের পি বি বড়–য়া। ১৯৬০ সালে প্রাদেশিক অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ব্রডজাম্প ও হফ স্টেপ অ্যান্ড জাম্পে প্রথম হন। ২১ ফুট আধা ইঞ্চি লাফিয়ে ব্রডজাম্পে তিনি প্রথম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বশির আহমেদ দ্বিতীয় ও এ বি চৌধুরী তৃতীয় হন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রাদেশিক অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ব্রডজাম্পে ২২ ফুট পৌনে দুই ইঞ্চি লাফিয়ে নিজের গড়া রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েন। তিনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ছাড়াও ঢাকা মোহামেডান ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকে অংশ নিয়েছেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকে হফ স্টেপ অ্যান্ড জাম্প ও ব্রডজাম্পে ব্যতিক্রম বাদে বরাবরই তিনি প্রথম হয়ে বিরল রেকর্ড গড়েন। এছাড়াও অংশ নিয়েছেন পাকিস্তান অলিম্পিকে। কুষ্টিয়া জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েও তিনি সাফল্য পান। তবে এর মাঝে ভলিবলে ঝুঁকে পড়ায় অ্যাথলেটিকে মনোযোগে কিছুটা ভাটা পড়ে। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে তিনি ছিলেন অ্যাথলেটিকের জাজ।
পাকিস্তান অলিম্পিক এবং জাতীয় অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশীপে বাঙালিরা সুবিধা করতে না পারা প্রসঙ্গে আবুল হাসান বলেন, ‘অ্যাথলেটিক্সে আধিপত্য ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। কেননা, তাদের খাওয়া-দাওয়া, বাসস্থান, সুযোগ-সুবিধা ছিল একদমই আলাদা। তারা ভালো ট্রেনিংও পেত। সব মিলিয়ে তাদের ট্রিটমেন্ট ছিল অন্যরকম। আর আমরা যা কিছু করতাম, নিজের প্রচেষ্টায় করতাম। আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। আমাদের কেউ কিছু শেখায়নি। তাছাড়া সে সময় অ্যাথলেটিক্সে এক্সপার্ট কেউ ছিল না। কারো কাছে যে শিখব, তেমন কেউ ছিলেন না। কিছু দেখে, কিছু নিজের চেষ্টায় ভালো করতে চাইতাম। তারপরও সেনাবাহিনীর অ্যাথলেট ছাড়া আমার সঙ্গে কেউ পারতেন না। এমনকি আমার স্টাইল তারা অনুসরণ করতেন। ব্রডজাম্পে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন এবং হফ স্টেপ অ্যান্ড জাম্পে আব্দুর রশিদ। দু’জনেই এশিয়ান গেমসে পদক পেয়েছেন। এছাড়া সে সময় ১০০ মিটারে খালেক খান, হ্যামার থ্রোতে মোঃ আইয়ুব, পোলভল্টে আলাদিতা, জ্যাভলিন থ্রোতে আব্দুল জালান, ডিসট্যান্স রানে মুবারক শাহ এশিয়ান গেমসে সাফল্য প্রদর্শন করেন। আর বাঙালিদের মধ্যে ১০০ ও ২০০ মিটারে সিরাজুল ইসলাম, পোলভল্টে মিরাজ ও মুক্তা ভাই, ডিসট্যান্স রানে কাজী আলমগীর এবং মেয়েদের মধ্যে লুৎফুন্নেছা হক বকুল, ডলি ক্রুজ, কাজী জাহেদা, কাজী শামীমা প্রমুখ ভালো অ্যাথলেট ছিলেন।’
পাকিস্তান আমলে অ্যাথলেটিক্স অঙ্গন সরগরম থাকা প্রসঙ্গে আবুল হাসান বলেন, ‘সে সময় ক্লাবগুলো অ্যাথলেটদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ঢাকা মোহামেডান, আজাদ স্পোর্টিংয়ের মত ক্লাবগুলো এগিয়ে আসায় অ্যাথলেটিক অঙ্গন জমজমাট থাকতো। ক্লাবগুলোর পক্ষে খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়ার সামর্থ্য ছিল না। এই কলাটা, ডিমটা কিংবা একটু লেবু মেশানো পাানি হয়ত দিত। তাতেই সবাই খুশী থাকতেন। কিন্তু এখন কেন ক্লাবগুলো এগিয়ে আসছে না- সেটা আমার বোধগম্য নয়। অথচ অ্যাথলেটিকই হলো খেলাধুলার মেরুদণ্ড ।’
কুষ্টিয়া থাকতেই ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে টুকটাক ভলিবল খেলতেন খন্দকার আবুল হাসান। তারপর আর সেটাকে খুব বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। ঢাকায় প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ খেলতে গিয়ে ভলিবলে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অতীতের সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘১৯৫৬ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে ফুটবল খেলি। সে সময় ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ছিল বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকে। ভিক্টোরিয়ার পাশে খোলা জায়গায় তখন ভলিবল খেলা হত। ফুটবলারদের মধ্যে খেলতেন নবী চৌধুরী, মারী, সিরাজ এবং ভলিবলারদের মধ্যে আমিন, মোর্শেদ প্রমুখ। আমি একদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলাম। হঠাৎ নবী চৌধুরী, মারী প্রমুখ আমাকে খেলতে বলেন। আমি বললাম, খেলতে পারি, তবে আমাকে স্ম্যাশার হিসেবে খেলতে দিতে হবে। তারা রাজি হয়ে যান। আমি স্ম্যাশ করতে শুরু করলে সবাই অবাক হয়ে যান। তখন প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগের ক্লাবগুলো আমাকে তাদের ক্লাবে খেলার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। সে সময় মোর্শেদ খেলতেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। মোর্শেদ ও তার ছোট ভাই গোলাম কুদ্দুস চৌধুরীকে আমি কুষ্টিয়া থাকতে চিনতাম। তখন থেকেই তাদের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা। সে কারণে আমি ১৯৫৭ সালে ঢাকা ভলিবল লীগে মোর্শেদের ক্লাব ভিক্টোরিয়ার হয়ে খেলা শুরু করি। সে বছর আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৮ সালে যোগ দেই আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে। চ্যাম্পিয়ন হয় আজাদ। এ বছর পূর্ব পাকিস্তান দলে নির্বাচিত হই। পাকিস্তান অলিম্পিক খেলার জন্য পেশোয়ার যাই। পেশোয়ারে খেলার পর ইরান সফরে পাকিস্তান দলে নির্বাচিত হই। আমার আগে আর কোনো বাঙালি খেলোয়াড় ভলিবলে পাকিস্তান দলে নির্বাচিত হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে বছর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ইরান সফর হয়নি। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলের ক্যাম্পে আমন্ত্রণ পাই। লাহোরের পুলিশ ক্যাম্পে আড়াই মাস থাকি।’
ঢাকা লীগে আবুল হাসানের সাফল্য অব্যাহত থাকে। যে দলেই খেলেন, সে দলই চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৯ সালে আজাদ, ১৯৬০, ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ করে নেন তিনি। তা নিয়ে অবশ্য জল কম ঘোলা হয়নি। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান গেমসের জন্য গঠিত পাকিস্তান জাতীয় ভলিবল দলে প্রথমে আমাকে সুযোগ দেয়া হয়নি। অথচ আমি তখন ফর্মের তুঙ্গে। শেষ পর্যন্ত স্পেশাল খেলোয়াড় হিসেবে আমাকে নেয়া হয়। জাকার্তায় দলের সঙ্গে প্র্যাকটিস করি। কিন্তু আমাকে খেলতে দেয়া হয়নি। আসলে সে সময় বাঙালিদের দেখা হত অবহেলার চোখে। একদমই পাত্তা দেয়া হত না। এশিয়ান গেমস খেলতে না পারার ঝাল আমি মিটিয়েছিলাম ওই বছর হায়দরাবাদের খায়েরপুরে পাকিস্তান ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে। আমি পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে অংশ নেই। সেবার বিশেষ আমন্ত্রণে এসেছিল ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত খেলেছিলাম। পুলিশ দলের ম্যানেজার ছিলেন ক্রিকেটার ফজল মাহমুদ। তিনি আমার খেলায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। আর ভলিবলের ভাষ্যকার তো আমাকে ‘বাঙাল কা শের’ হিসেবে অভিহিত করেন। আসলে সেদিন নিজেকে নিংড়ে দিয়ে খেলেছিলাম।’
১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন খন্দকার আবুল হাসান। ৩/৪ বার অধিনায়ক ছিলেন তিনি। এর মধ্যে তার অধিনায়কত্বে ১৯৬২ সালে হায়দ্রাবাদের খায়েরপুরে পাকিস্তান ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে পশ্চিম পাকিস্তান কোনো দলের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের কোনো দল জয় পায়। ১৯৬৫ সালে ঢাকায় ফ্রেন্ডশীপ ও সলিডারিটি ভলিবলে ইস্ট পাকিস্তান গ্রীন দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন। ভলিবল দলের হয়ে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি পাকিস্তান অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন। ঢাকা লীগে ১৯৬৩ সালে ওয়ারীতে খেলার পর ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে। এরমধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক এক/দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে দশম জাতীয় ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে সর্বশেষ অংশ নেন।
ছয় ফুট উচ্চতাসম্পন্ন আবুল হাসানের মত দুর্ধর্ষ স্ম্যাশার ভলিবলে তার সময়ে খুব কমই ছিল। অবশ্য অলরাউন্ডার হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল। তার মতে, পশ্চিম পাকিস্তানের নাসিম মির্জা, খালেক খান, এরফান খান, নূর মোহাম্মদ, ফয়েজ বদলা দুর্দান্ত খেলোয়াড় ছিলেন। আর বাঙালিদের মধ্যে স্ম্যাশার গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী, লিফটার মোস্তফা কামাল, স্ম্যাশার জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রমুখ ভালো খেলতেন। সে সময়ের ভলিবল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন ভলিবল ছিল পাওয়ার ওরিয়েন্টেড। আর এখন টেকনিক্যালি অনেক অ্যাডভান্সড। আগে ব্যাক লাইন থেকে স্ম্যাশ করার কথা চিন্তাই করা যেত না। এখন যে কোনো জায়গা থেকে স্ম্যাশ করা হয়। খেলায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। হুক সার্ভিস ফিঙ্গার দিয়ে লিফট করা যেত না। আমরা যা চিন্তা করতে পারিনি, এখন তা অহরহ ঘটছে। খেলাকে আরো গতিশীল করার জন্য এবং সময় যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। আগে যেখানে খেলা শেষ হতে ৩/৪ ঘন্টা লেগে যেত, এখন সেখানে এক/দেড় ঘন্টার বেশি লাগে না।’
খেলা ছেড়ে দিলেও খন্দকার আবুল হাসান সংগঠক ও কোচ হিসেবে খেলাধুলায় জড়িয়ে আছেন। মূলত তার আকর্ষণ ভলিবলকে কেন্দ্র করে। ফুটবল, অ্যাথলেটিক ও ভলিবল সমানতালে খেললেও তিনি নিজেকে ভলিবলের লোক পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ভলিবলকে নিয়েই তার যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা ও ভালোবাসা। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে খেলাধুলাকে উজ্জীবিত করার জন্য তিনজন ক্রীড়াবিদকে পূর্ব জার্মানীর লিপজিগে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। অ্যাথলেটিকে এস এ জামান মুক্তা, বাস্কেটবলে কাজী কামালউদ্দিন আহমদ ও ভলিবলে খন্দকার আবুল হাসান। আট মাসের এই ট্রেনিং নিয়ে এসে তিনি ভলিবলে আত্মনিয়োগ করেন। সেই সময় থেকে তিনি কখনো বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের কোচিং সেক্রেটারি, সিলেকশন কমিটির সেক্রেটারি, সদস্য কিংবা কাউন্সিলর হিসেবে নানাভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৮০ সালে জাতীয় দলের কোচ ও সহকারী ম্যানেজার হিসেবে তুরস্কের ইজমিরে প্রথম ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে যান। সে গেমসে বাংলাদেশ দল লিবিয়া ও সাইপ্রাসকে হারিয়ে পাঁচ দেশের মধ্যে চতুর্র্থ হয়। ১৯৮৬ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেন জাতীয় দলের কোচ হিসেবে। এ টুর্নামেন্টে সাত দেশের মধ্যে ষষ্ঠ হয় বাংলাদেশ। নব্বই দশকে নেপাল সফর করেন ভলিবলের অফিসিয়াল হিসেবে। সোনালী ব্যাংক এবং অন্যান্য ক্লাবের কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মাধ্যমে উঠে আসা খেলোয়াড়দের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি পেয়েছেন গাফ্ফার, মুকুল প্রমুখ।
খন্দকার আবুল হাসান ১৯৬১ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসর নেন। ভলিবলে অবদান রাখায় ১৯৯৫ সালে তাকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করে বিএসজেএ। ২০০৩ সালে কুষ্টিয়ায় তাকে সংবর্ধিত করে ‘মেধা’ নামে একটি সংস্থা। তিনি এক পুত্র ও দুই কন্যার জনক।
ত্রিবেণী সঙ্গমে মিলেছিল গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদী। অনুরূপভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ত্রিধারার সম্মিলন ঘটে খন্দকার আবুল হাসানের নৈপুণ্যভাস্বর ক্রীড়াশৈলীর মাধ্যমে। স্বভাবতই তার নামটি উচ্চারিত হলে বোধহয় একটা দ্বিধার সৃষ্টি হয়- তিনি কি ফুটবলার, নাকি অ্যাথলেট, নাকি ভলিবল খেলোয়াড়? সংগঠক ও কোচ হিসেবে তার পরিচয়টুকু আপাতত না হয় শিকেয় তুলে রাখা যাক। সম্ভবত এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে তার পরিচয় সংকট আজও কাটলো না। যে কারণে জাতীয়ভাবে তার স্বীকৃতির প্রশ্নটি কেন জানি বন্দী হয়ে আছে রহস্যময়তার বেড়াজালে। অথচ তিনটি খেলায় তার যে কৃতিত্ব, তাতে যে কোনো একটি খেলার মূল্যায়ন করা হলে তিনি স্বতন্ত্রভাবে ভলিবল, অ্যাথলেটিক ও ফুটবলে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য অনেক আগেই বিবেচিত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোনোটিরও জন্য বিবেচিত হননি। তার খেলোয়াড়ী জীবনে এত বেশি ঔজ্জ্বল্য, তাতে বোধহয় সবার চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যে কারণে খোলা চোখে তার উপস্থিতি কারো নজরে পড়ে না। আর এজন্য তিনি স্বীকৃতির প্রশ্নে বড় বেশি অনাদৃত ও অবহেলিত। আর এই অনাদার ও অবহেলা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অবক্ষয়েরই প্রতিফলন। অবশ্য জাতীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না পেলেও তাতে তার কৃতিত্ব ম্লান হয়ে যায় না। খন্দকার আবুল হাসানের মত সহজাত প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদরা সচরাচর জন্ম নেন না। তাদের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। আর সেটাই হতে পারে খন্দকার আবুল হাসানের গর্ব ও আনন্দ। #
১-১০-২০০৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল খেলোয়াড় গড়ার কারিগর মোস্তাফা কামাল/ দুলাল মাহমুদ