ষাট দশকের দুরন্ত গোলকিপার রানা/ দুলাল মাহমুদ
‘আমার মন-প্রাণ জুড়ে ছিল শুধুই ক্রিকেট। কিন্তু ঘটনাচক্রে হয়েছি ফুটবলার। ক্রিকেটার হবো বলে সেই লক্ষ্যে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকি। সে সময় থাকতাম মণিপুরপাড়ায়। লেখাপড়ার হাতেখড়ি তেজগাঁও প্রাইমারি স্কুলে। ফার্মগেটের সঙ্গে কলেজ গেটের একটি ক্লাবের মধ্যে নিয়মিত আয়োজিত হতো ক্রিকেট ম্যাচ। খেলা হতো। পাশাপাশি ঝগড়াও। আমি খেলতাম ফার্মগেটের সেভেন বয়েজ ক্লাবে। অল-রাউন্ডার ছিলাম। ক্রিকেটার হিসেবে আলাদা একটা সমীহ পেতাম। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুলে। আমার ক্লাসমেট ছিলেন মঞ্জু। ফুটবল খেলতেন। গোলকিপার ছিলেন। একটু খাটো ছিলেন। এ কারণে একটু দুর্বলতা ছিল। তার সঙ্গে ঘুরতাম। আমার উচ্চতার কারণে চোখে পড়ে যাই গেম টিচার ননী বসাক স্যারের সন্ধানী চোখে। ননী বসাক স্যার ছিলেন দেশসেরা ক্রীড়া সংগঠক, রেফারী ও স্কাউট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। তিনি পকিস্তান স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ডের বিভিন্ন কোচিং ক্যাম্প পরিচালনা করতেন। স্কুল ও কলেজের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের নিয়ে পরিচালিত হতো এই ক্যাম্প। আমাদের স্কুল দলে গোলকিপিং পজিশনে দুর্বলতা থাকায় তিনি আমাকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু আমি মোটেও ফুটবলে আগ্রহী ছিলাম না। আমি ডাইভ দিতে ভয় পেতাম। তাছাড়া ক্রিকেটার হওয়ার ব্যাপারে আমি সংকল্পে অটল থাকি। ননী বসাক স্যারও নাছোড়বান্দা। আমাকে ফুটবলের গোলরক্ষক হিসেবে গড়ে তোলাটাই হয়ে ওঠে তার মিশন। এ কারণে প্রতিদিন বিকেলে পুরান ঢাকা থেকে ছুটে আসতেন। আমাকে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রশিক্ষণ করাতেন। খুব সম্ভবত ১৯৬০ সালে ইন্টার স্কুল ফুটবলে আমাকে খেলতে হয়। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ফাইনালে ওঠে আমাদের স্কুল। ঢাকার কালীমন্দির মাঠে ফাইনালে নবকুমার হাইস্কুলের মুখোমুখি হয় আমাদের তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুল। খেলাধুলায় নবকুমার হাইস্কুলের তখন দারুণ সুখ্যাতি। তৎকালে ইন্টার স্কুল ফুটবলের ফাইনাল হতো বেশ সাড়ম্বরে। এ খেলা দেখার জন্য উপস্থিত থাকতেন দেশের বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদরা। সেদিন উপস্থিত ছিলেন দেশবরেণ্য ক্রীড়াব্যক্তিত্ব রণজিত দাস, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, ক্রীড়া সাংবাদিক আবদুল হামিদ, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, কর্নেল মতিউর রহমান, এম এ জলিল প্রমুখ। খেলায় আমরা একটি পেনাল্টি গোলে হেরে যাই। কিন্তু খেলা শেষে সবাই আমার কাছে ছুটে আসেন। তারা আমার খেলার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। রণজিত দা ও মিন্টু ভাই ননী বসাক স্যারের কাছে জানতে চান- এই ছেলেকে আপনি পেলেন কোথায়? একে ট্রেনিং দেয়া হলে পাকিস্তানের সেরা গোলকিপার হবে। এরপর আর ননী স্যারকে পায় কে? তিনি আমাকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পুরোপুরি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তার কারণে আমি দু’বার পাকিস্তান কোচিং সেন্টারে ট্রেনিং নেয়ার সুযোগ পাই। তারপর তো ফুটবলার হিসেবে আমার পরিচিতি পেতে আর বেগ পেতে হয়নি।’ কথাগুলো এককালের কৃতী ফুটবলার মোঃ রেজাউল হক রানার। অথচ সময়ের পলেস্তারায় ধূসর হয়ে গেছে এ নামটি। ক’জন আর আজ তাকে চেনেন? অথচ একসময় ফুটবলার হিসেবে মাতিয়েছেন খেলার মাঠ। খেলেছেন দেশের সেরা সেরা ক্লাবে। অবশ্য তার স্মৃতিতেও মরচে পড়েছে। জীবনের উজ্জ্বল সময়টার দিনক্ষণ এখন আর ঠিকমত ধরা দেয় না। এলোমেলো হয়ে যায় ঘটনাপঞ্জির ধারাক্রম।
রানার জন্ম কলকাতায় ১৯৪৭ সালের ১ জুলাই। দেশভাগের পর পর তাদের পরিবার চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। ইন্টার স্কুলে ফুটবল খেলায় মোটামুটি সবার চোখে পড়ে যান। তখন বিজি প্রেসের ফুটবলার ও কোচ ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় চুন্না রশীদ। তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। একদিন চুন্না রশীদ তাকে বিজি প্রেসে খেলার প্রস্তাব দেন। সে প্রসঙ্গে রানা বলেন, ‘সে বছরই সম্ভবত ঢাকায় বিদেশী ফুটবলার আমদানি করা হয়। আমদানি করে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। তারা কলকাতা থেকে কালা গফুর, তোরাব আলী, হাসান কিলার, ওমর, আবদুল্লাহ সিনিয়র, রসুল বক্স, আমিন প্রমুখ খ্যাতিমান ফুটবলারদের এনে দল গড়ে। শক্তিশালী এই দলের মুখোমুখি হওয়ার কথা বিজি প্রেসের। বিজি প্রেসের দুই শীর্ষ গোলকিপার ছিলেন মাখন ও নবী খান। তারা দু’জন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানান। বাধ্য হয়ে চুন্না রশীদ আমার শরণাপন্ন হন। সেদিনই প্রথম আমি ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলতে নামি। প্রতিপক্ষ দুর্ধর্ষ ঢাকা মোহামেডান। বাঘা বাঘা ফুটবলারকে নিয়ে দলটি গঠিত। তাদের বল রুখতে হবে আমার মতো একজন স্কুল পড়–য়া ছেলেকে! বাধ্য হয়ে আমাকে খেলতে হয়। খেলা শেষে দর্শকরা আমাকে কাঁধে তুলে নাচতে থাকে। আমাকে নিয়ে ঘুরতে থাকে সারা মাঠ। প্রথমে আমি ভয়ে কেঁদে ফেলি। আমি ভেবেছি, খেলায় আমরা ৬-০ গোলে হেরেছি, তাই আমার কপালে বোধ হয় খারাবি আছে। আসলে খেলায় বড় ব্যবধানে হারলেও আমার খেলায় দর্শকরা ছিলেন মুগ্ধ। এ কারণে আমাকে নিয়ে তারা আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন।’
এই খেলার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রানার জীবন ধাবিত হয় ফুটবলের দিকে। ১৯৬১ সালে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের দল পিডব্লিউডি। সে সময় এ দলে খেলতেন আনজাম, সাদেকের তো ফুটবলাররা। তবে সে বছর তিনি দলে নিয়মিত ছিলেন না। ১৯৬২ সালে খেলেন ইস্টএন্ডে। তার সঙ্গী খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন লালু, রফিক, সাঈদ। ওয়ান্ডারার্সে খেলেন ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। অবশ্য ভিক্টোরিয়ার প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। তখন ভিক্টোরিয়ার গোলকিপার ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় গোলাম হোসেন। তাকে টেক্কা দিয়ে দলে নিজের অবস্থান সুসংহত করাই হয়ে ওঠে তার সাধনা। তাতে তিনি সফল হন। তিনি ছাড়া দলে ১০ জনই ছিলেন মাকরানী ফুটবলার। তিনি যে দু’বছর খেলেন, বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে একবার দলে ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা। প্রথম বছর ভিক্টোরিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শেষ খেলায় প্রতিপক্ষ মোহামেডানের সমর্থকরা গন্ডগোল করায় তাদের সে সুযোগ নস্যাৎ হয়ে যায়। দু’বছর খেলার পর ১৯৬৬ সালে পুনরায় খেলেন ওয়ান্ডারার্সে। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। মোহামেডানে দু’বছর খেলার পর ১৯৬৯ সালে তৃতীয়বারের মতো তার ঠিকানা হয় ওয়ান্ডারার্স। এরপর আর ঢাকা লীগে খেলেননি।
পাকিস্তান জাতীয় যুব দলের হয়ে খেলেছেন রানা। ১৯৬৫ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। সে দলে বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে তিনি ছাড়াও ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা, শামসুল ইসলাম মোল্লা, মনজুর মুরশিদ গাউস ও আনসার। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে। ১৯৬৬-৬৭ সালে পাকিস্তান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান দলের অধিনায়ক। লাহোরকে পরাজিত করে তার দল চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রতাপ কিংবা আনসার জয়সূচক গোলটি করেন। ১৯৬৬, ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে লাহোরে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেন। ১৯৭০ সালে লাহোরে ইস্ট পাকিস্তান কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে তার খেলা প্রশংসিত হয়। তাদের দল রানার্সআপ হয়। সে দলের খেলোয়াড় ছিলেন হাফিজ, পিন্টু, টিপু, আলাউদ্দিন, জালু, শামসু, অমলেশ। ইস্ট পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইলেভেনের হয়ে সফরকারী রাশিয়ার আলগা দল ও বাকু দলের বিপক্ষে খেলেন। ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলেন সফরকারী ইরানের বিপক্ষে। আগা খান গোল্ডকাপে বিআইডিসি ও ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আন্তঃজেলা ফুটবলে খেলেন পাবনা জেলার হয়ে। ১৯৬৮ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে বগুড়া মোহাম্মদ আলী শীল্ডে এবং মুলতানে ইসমাইল গোল্ড শীল্ডে খেলেন। মোহমেডানের হয়ে সে সময় খেলতেন জাকারিয়া পিন্টু, শামসু, নূরুন্নবী, আবদুল্লাহ রাই, খোদা বক্স, এ এইচ খান, মুসা, টিপু, কাদের বক্স, প্রতাপ, করিম, জহির, কালা গফুর, মওলা বক্স প্রমুখ।
ফর্মে থাকাবস্থায় খেলা ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৯ সালে প্রথম বাঙালি ক্রীড়াবিদ হিসেবে পিআইএ’র চাকরিতে যোগদানের সুযোগ পাই। আমি চিন্তা করে দেখলাম, অনেক দিন তো ফুটবল খেললাম। আমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। যতদিন ফর্ম আছে, ততদিন না হয় ফুটবল খেললাম। এরপর কি হবে? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে চাকরিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। অবশ্য পিআইএ কর্তৃপক্ষ আমাকে বলেছিলো, খেলাধুলা করে আমি যে টাকা আয় করি, তা তারা দিতে পারবে না। তখন ঢাকা লীগে খেলে প্রতি মৌসুমে ১০ হাজার টাকা পেতাম। সাপ্তাহিক ভাতা ছিল ২০ টাকা। তবে খেলা হতো বছরে তিন মাস। আমি তাদের শর্ত দিলাম- আমি ফ্লাইট ক্রু হিসেবে যোগ দিতে চাই। ইনজুরড হলে আমাকে ফ্লাইট থেকে নামানো যাবে না। তারা আমার শর্ত মেনে নেয়। আমার পরিবারে এয়ারলাইন্সে চাকরি করার একটা ঐতিহ্য গড়ে ওঠায় এর প্রতি আমার আলাদা একটা দুর্বলতা ছিল। আমাদের পরিবারকে বলা হয় ‘বিমান পরিবার’।’
স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে রানা বলেন, ‘১৯৬০ সালে ইন্টার স্কুল ফুটবল ফাইনালে তেজগাঁও পলিটেকনিকের হয়ে নবকুমার স্কুলের বিপক্ষে আমি দুর্দান্ত খেলেছিলাম। যদিও আমরা পেনাল্টি গোলে হেরে যাই, তদুপরি যারা আমার খেলা দেখেন, তারা মোহিত হন। আগেই বলেছি, বিজি প্রেসের হয়ে ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে এমন খেলা খেলেছি- যার জন্য মাঠের দর্শকরা আমাকে স্বাগত জানান। আমাকে নিয়ে পুরো স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করা হয়। তা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। পরদিন সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় আকারে আমার ছবি প্রকাশিত হয়। বাবা পরিহাস করে বলেন, হাফ ডজন গোল খেয়েও পত্রিকায় ছবি! ১৯৬৮-৬৯ সালে ভৈরব শীল্ডে ভৈরব মার্চেন্ট ক্লাবের বিপক্ষে খেলাটি মনে আঁচড় কেটে আছে। কোন দলের পক্ষে খেলেছিলাম, তা অবশ্য মনে নেই। প্রতিপক্ষের কথা মনে থাকার কারণ, সে দলে খেলেছে পুরো ঢাকা মোহামেডান। দারুণ গতিময় খেলা। তবে মোহামেডানের তীব্র আক্রমণের মুখে আমাকে একাই খেলতে হয়। খেলায় আমরা হেরে যাই ০-১ গোলে। তা সত্ত্বেও খেলার প্রধান অতিথি আমাকে পরিয়ে দেন সেরা ফুটবলারের গোল্ড মেডেল। ১৯৬৪ সালে আন্তঃজেলা ফুটবলে খেলেছি দিনাজপুরের মার্চেন্ট ক্লাবের হয়ে। আমাদের অধিনায়ক ছিলেন মোবাশ্বের। প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালী ডিসি টিম। সে ম্যাচে সাংঘাতিক খেলেছিলাম। তাতে আমরা ১-০ গোলে জয়ী হই। খেলার পর ডিসির ছেলে আমাকে ৫০ টাকা পুরস্কার দেন। সে টাকা থেকে মায়ের জন্য ২০ টাকা দিয়ে একটি শাড়ি কিনেছিলাম। ১৯৬৫ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে ভালো খেলেছিলাম। খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়।’
সমসাময়িক সেরা ফুটবলারদের কথা জানতে চাইলে রানা ভিক্টোরিয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর, মোহামেডানের রাইট ইন আবদুল্লাহ সিনিয়র, কালা গফুর, মোহামেডানের ডিফেন্ডার তোরাব আলী আর বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে কবীর, জহির, প্রতাপ, বশীর, শামসু, আনসার, রণজিত, বলাই, বীরু ও মঞ্জুর হাসান মিন্টুর কথা জানান। মিন্টু প্রসঙ্গে বলেন, ‘মিন্টু ভাইয়ের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে তিন বেলা প্র্যাকটিস করতাম। মিন্টু ভাই ছিলেন স্টাইলিশ গোলকিপার। আমি মিন্টু ভাইকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। এ কারণে আমাকে বলা হতো জুনিয়র মিন্টু।’ নিজের খেলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। দুরূহ যে কোনো বল আমি ডাইভ দিয়ে হলেও সেভ করতাম। যে বলটি থেকে গোল হওয়ার উপক্রম হতো, সেটা আমি নিজেকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে হলেও আটকে দিতাম। তবে আমি যে গোলগুলো খেতাম, তা ছিল ইজি বল থেকে। আমি ঢাকার কায়দে আজম কলেজে পড়ালেখা করতাম। একবার আমার খেলা দেখার জন্য আসেন কলেজের প্রিন্সিপাল ফাতমি সাহেব। বাবাকে চিনতেন। সেদিন আমার বাবাও খেলা দেখতে এসেছিলেন। তিনি আমার বাবাকে বলেন, ছেলেটি ভালো গোলরক্ষক। তবে অনেক সময় সহজ গোল হজম করে।’ গোলকিপার হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঢাকা মোহামেডানের বলাই, করিম, ওয়ান্ডারার্সের হাকিমের কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, তখনকার দেশের পয়লা নম্বর গোলকিপার বলাই ভারতে চলে গেলে তিনি তার জায়গাটি পূরণ করেন।
নিজেদের সময়টাকে মূল্যায়ন করেন তিনি এভাবে- ‘আমাদের সময় খেলাটা বিজ্ঞানভিত্তিক ছিল না। কোচিং ছিল না। প্রশিক্ষকও ছিল না। যা করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি। আর ছোটখাট কিছু পরামর্শ পেয়েছি স্কুলের গেম টিচারের কাছ থেকে। তিনিই-বা কতটুকু জানতেন? তারপরও আমরা খেলেছি মনের আনন্দে। আর এখন তো ফুটবলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বদলে গেছে অনেক কিছু। তবে আমাদের দেশের ফুটবল খুব বেশি বদলাতে পারেনি। ফুটবলকে এগিয়ে নিতে হলে স্কুল পর্যায় থেকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এ পর্যায় থেকে ট্রেনিং দেয়া হলে সুফল পাওয়া যাবে।’
ক্রিকেটটা রানার ছোটবেলা থেকেই প্যাশন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন সেন্ট্রাল গভঃ প্রেস অব পাকিস্তানের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। বাবার চাকরিসূত্রে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করতে হয়েছে। ১৯৫৯-৬০ সালের দিকে থাকতাম করাচীতে। পড়ালেখা করতাম করাচী বাংলা স্কুলে। সে স্কুলের হয়ে ক্রিকেট খেলতাম। একবার মেরিক্লজ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিপক্ষে খেলি। সে স্কুলে পড়তেন টেস্ট ক্রিকেটার হানিফ মোহাম্মদের ভাই মুশতাক মোহাম্মদ ও সাদেক মোহাম্মদ। ওয়ান ডাউনে খেলতে নেমে ওদের স্কুলে বিপক্ষে ৫০ রান করেছিলাম। হানিফ মোহাম্মদের একটি দল ছিল ব্ল্যাক হকস। আমি ভালো ব্যাট করায় ওরা আমাকে ওদের দলে যোগ দিতে বলে। আমি এক বছর সেই ক্লাবে খেলেছিলাম। এরপর ঢাকায় চলে আসি। তবে ক্রিকেটের প্রতি আমার আকর্ষণ গড়ে ওঠে তখনই। ননী স্যার আমাকে ফুটবলে টেনে না নিলে ক্রিকেটেই সঁপে দিতাম নিজেকে। তারপরও ক্রিকেটাকে মন থেকে ছাড়তে পারিনি। আমার ক্রিকেট প্রতিভার কথা ঠিকই জেনে যান ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে নিবেদিতপ্রাণ মুশতাক। তিনিই ঢাকায় আমাকে আজাদ বয়েজ ক্লাবে নিয়ে যান। তার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছেন অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার। আপাদমস্তক ক্রিকেটে নিমজ্জিত মুশতাককে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা হত্যা করে।’
আজাদ বয়েজের পর রানা শান্তিনগর, ন্যাশনাল স্পোর্টিং, বক্সিবাজার, ঢাকা মোহামেডান এবং বাংলাদেশ বিমানের হয়ে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা লীগে খেলেছেন। ১৯৭৭ সালে তার অধিনায়কত্বে জাতীয় ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশীপে হয় বিমান। সে দলে ছিলেন ইউসুফ বাবু, সৈয়দ আশরাফুল, সামিউর রহমান সামি, তামিম, আজহার, সদরুল, জাহাঙ্গীর, অলক, স্বপন, ইফতেখারের মতো ক্রিকেটার। ১৯৬১-৬২ সালে গঠিত ইস্ট পাকিস্তান ক্রিকেট দলে ১৬-এর মধ্যে ছিলেন। কিন্তু ১৩ জনের দল থেকে বাদ পড়ে যান। ক্রিকেটে তার স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জে একটি ম্যাচে ৯৯ রান করে এলবিডব্লিউডি হই। এটা আমার জীবনে অনন্ত এক আক্ষেপ হয়ে আছে। সে সময়কার শক্তিশালী দল পিডব্লিউডির বিপক্ষে শান্তিনগরের হয়ে ৫৪ রান করেছিলাম। পিডব্লিউডিতে খেলতেন ফাস্ট বোলার নিয়াজ। তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট খেলেন। টেস্ট ক্রিকেট খেলে পিডব্লিউডির হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামেন আমাদের বিপক্ষে। তার এক ওভারে প্রথম তিন বলেই তিনটি ছক্কা হাঁকাই। আমি ছিলাম মূলত হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যান। ছক্কা মারার ক্ষেত্রে আমার বেশ নাম-ডাক ছিল। আমার খেলা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম বোলার সোহরাব আমাকে সব সময় হিটিং করতে বারণ করেন। তিনি আমাকে দেখে-শুনে খেলার পরামর্শ দেন।’
ষাট ও সত্তর দশকের ক্রীড়াবিদ মোঃ রেজাউল হক রানা এখন অনেকটা হারিয়ে যাওয়া নাম। অথচ এক সময় ছিলেন পাকিস্তানের সেরা গোলরক্ষকদের একজন। ক্রিকেটার হিসেবেও কম-বেশি পরিচিতি ছিল। জীবনের প্রয়োজনে উড়াল দিয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। দেখেছেন এই পৃথিবীর রূপ-রস-সৌন্দর্য। সঞ্চয়ের ভান্ডার নেহাত মন্দ নয়। এখন জীবনে খানিকটা থিতু হয়েছেন। হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখেন, জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায় কেটেছে খেলার মাঠে। প্রতিপক্ষের নিশ্চিত একটা গোল সেভ করে গ্যালারির কত কত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন! ছক্কা মেরে পেয়েছেন বাহবা। অবসর মুহূর্তে সেসব স্মৃতিমাখা দিনগুলো তাকে নস্টালজিক করে তোলে। তখন খুব ইচ্ছে করে সেই দিনগুলো ফিরে পেতে। হায়! যে দিনগুলো চলে যায়, তা তো আর ফিরে আসে না। #
১-১-২০০৮
রানার জন্ম কলকাতায় ১৯৪৭ সালের ১ জুলাই। দেশভাগের পর পর তাদের পরিবার চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। ইন্টার স্কুলে ফুটবল খেলায় মোটামুটি সবার চোখে পড়ে যান। তখন বিজি প্রেসের ফুটবলার ও কোচ ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় চুন্না রশীদ। তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। একদিন চুন্না রশীদ তাকে বিজি প্রেসে খেলার প্রস্তাব দেন। সে প্রসঙ্গে রানা বলেন, ‘সে বছরই সম্ভবত ঢাকায় বিদেশী ফুটবলার আমদানি করা হয়। আমদানি করে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। তারা কলকাতা থেকে কালা গফুর, তোরাব আলী, হাসান কিলার, ওমর, আবদুল্লাহ সিনিয়র, রসুল বক্স, আমিন প্রমুখ খ্যাতিমান ফুটবলারদের এনে দল গড়ে। শক্তিশালী এই দলের মুখোমুখি হওয়ার কথা বিজি প্রেসের। বিজি প্রেসের দুই শীর্ষ গোলকিপার ছিলেন মাখন ও নবী খান। তারা দু’জন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানান। বাধ্য হয়ে চুন্না রশীদ আমার শরণাপন্ন হন। সেদিনই প্রথম আমি ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলতে নামি। প্রতিপক্ষ দুর্ধর্ষ ঢাকা মোহামেডান। বাঘা বাঘা ফুটবলারকে নিয়ে দলটি গঠিত। তাদের বল রুখতে হবে আমার মতো একজন স্কুল পড়–য়া ছেলেকে! বাধ্য হয়ে আমাকে খেলতে হয়। খেলা শেষে দর্শকরা আমাকে কাঁধে তুলে নাচতে থাকে। আমাকে নিয়ে ঘুরতে থাকে সারা মাঠ। প্রথমে আমি ভয়ে কেঁদে ফেলি। আমি ভেবেছি, খেলায় আমরা ৬-০ গোলে হেরেছি, তাই আমার কপালে বোধ হয় খারাবি আছে। আসলে খেলায় বড় ব্যবধানে হারলেও আমার খেলায় দর্শকরা ছিলেন মুগ্ধ। এ কারণে আমাকে নিয়ে তারা আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন।’
এই খেলার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রানার জীবন ধাবিত হয় ফুটবলের দিকে। ১৯৬১ সালে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের দল পিডব্লিউডি। সে সময় এ দলে খেলতেন আনজাম, সাদেকের তো ফুটবলাররা। তবে সে বছর তিনি দলে নিয়মিত ছিলেন না। ১৯৬২ সালে খেলেন ইস্টএন্ডে। তার সঙ্গী খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন লালু, রফিক, সাঈদ। ওয়ান্ডারার্সে খেলেন ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। অবশ্য ভিক্টোরিয়ার প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। তখন ভিক্টোরিয়ার গোলকিপার ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় গোলাম হোসেন। তাকে টেক্কা দিয়ে দলে নিজের অবস্থান সুসংহত করাই হয়ে ওঠে তার সাধনা। তাতে তিনি সফল হন। তিনি ছাড়া দলে ১০ জনই ছিলেন মাকরানী ফুটবলার। তিনি যে দু’বছর খেলেন, বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে একবার দলে ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা। প্রথম বছর ভিক্টোরিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শেষ খেলায় প্রতিপক্ষ মোহামেডানের সমর্থকরা গন্ডগোল করায় তাদের সে সুযোগ নস্যাৎ হয়ে যায়। দু’বছর খেলার পর ১৯৬৬ সালে পুনরায় খেলেন ওয়ান্ডারার্সে। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। মোহামেডানে দু’বছর খেলার পর ১৯৬৯ সালে তৃতীয়বারের মতো তার ঠিকানা হয় ওয়ান্ডারার্স। এরপর আর ঢাকা লীগে খেলেননি।
পাকিস্তান জাতীয় যুব দলের হয়ে খেলেছেন রানা। ১৯৬৫ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। সে দলে বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে তিনি ছাড়াও ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা, শামসুল ইসলাম মোল্লা, মনজুর মুরশিদ গাউস ও আনসার। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে। ১৯৬৬-৬৭ সালে পাকিস্তান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান দলের অধিনায়ক। লাহোরকে পরাজিত করে তার দল চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রতাপ কিংবা আনসার জয়সূচক গোলটি করেন। ১৯৬৬, ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে লাহোরে পাকিস্তান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেন। ১৯৭০ সালে লাহোরে ইস্ট পাকিস্তান কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে তার খেলা প্রশংসিত হয়। তাদের দল রানার্সআপ হয়। সে দলের খেলোয়াড় ছিলেন হাফিজ, পিন্টু, টিপু, আলাউদ্দিন, জালু, শামসু, অমলেশ। ইস্ট পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইলেভেনের হয়ে সফরকারী রাশিয়ার আলগা দল ও বাকু দলের বিপক্ষে খেলেন। ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলেন সফরকারী ইরানের বিপক্ষে। আগা খান গোল্ডকাপে বিআইডিসি ও ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আন্তঃজেলা ফুটবলে খেলেন পাবনা জেলার হয়ে। ১৯৬৮ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে বগুড়া মোহাম্মদ আলী শীল্ডে এবং মুলতানে ইসমাইল গোল্ড শীল্ডে খেলেন। মোহমেডানের হয়ে সে সময় খেলতেন জাকারিয়া পিন্টু, শামসু, নূরুন্নবী, আবদুল্লাহ রাই, খোদা বক্স, এ এইচ খান, মুসা, টিপু, কাদের বক্স, প্রতাপ, করিম, জহির, কালা গফুর, মওলা বক্স প্রমুখ।
ফর্মে থাকাবস্থায় খেলা ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৬৯ সালে প্রথম বাঙালি ক্রীড়াবিদ হিসেবে পিআইএ’র চাকরিতে যোগদানের সুযোগ পাই। আমি চিন্তা করে দেখলাম, অনেক দিন তো ফুটবল খেললাম। আমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। যতদিন ফর্ম আছে, ততদিন না হয় ফুটবল খেললাম। এরপর কি হবে? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে চাকরিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। অবশ্য পিআইএ কর্তৃপক্ষ আমাকে বলেছিলো, খেলাধুলা করে আমি যে টাকা আয় করি, তা তারা দিতে পারবে না। তখন ঢাকা লীগে খেলে প্রতি মৌসুমে ১০ হাজার টাকা পেতাম। সাপ্তাহিক ভাতা ছিল ২০ টাকা। তবে খেলা হতো বছরে তিন মাস। আমি তাদের শর্ত দিলাম- আমি ফ্লাইট ক্রু হিসেবে যোগ দিতে চাই। ইনজুরড হলে আমাকে ফ্লাইট থেকে নামানো যাবে না। তারা আমার শর্ত মেনে নেয়। আমার পরিবারে এয়ারলাইন্সে চাকরি করার একটা ঐতিহ্য গড়ে ওঠায় এর প্রতি আমার আলাদা একটা দুর্বলতা ছিল। আমাদের পরিবারকে বলা হয় ‘বিমান পরিবার’।’
স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে রানা বলেন, ‘১৯৬০ সালে ইন্টার স্কুল ফুটবল ফাইনালে তেজগাঁও পলিটেকনিকের হয়ে নবকুমার স্কুলের বিপক্ষে আমি দুর্দান্ত খেলেছিলাম। যদিও আমরা পেনাল্টি গোলে হেরে যাই, তদুপরি যারা আমার খেলা দেখেন, তারা মোহিত হন। আগেই বলেছি, বিজি প্রেসের হয়ে ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে এমন খেলা খেলেছি- যার জন্য মাঠের দর্শকরা আমাকে স্বাগত জানান। আমাকে নিয়ে পুরো স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করা হয়। তা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। পরদিন সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় আকারে আমার ছবি প্রকাশিত হয়। বাবা পরিহাস করে বলেন, হাফ ডজন গোল খেয়েও পত্রিকায় ছবি! ১৯৬৮-৬৯ সালে ভৈরব শীল্ডে ভৈরব মার্চেন্ট ক্লাবের বিপক্ষে খেলাটি মনে আঁচড় কেটে আছে। কোন দলের পক্ষে খেলেছিলাম, তা অবশ্য মনে নেই। প্রতিপক্ষের কথা মনে থাকার কারণ, সে দলে খেলেছে পুরো ঢাকা মোহামেডান। দারুণ গতিময় খেলা। তবে মোহামেডানের তীব্র আক্রমণের মুখে আমাকে একাই খেলতে হয়। খেলায় আমরা হেরে যাই ০-১ গোলে। তা সত্ত্বেও খেলার প্রধান অতিথি আমাকে পরিয়ে দেন সেরা ফুটবলারের গোল্ড মেডেল। ১৯৬৪ সালে আন্তঃজেলা ফুটবলে খেলেছি দিনাজপুরের মার্চেন্ট ক্লাবের হয়ে। আমাদের অধিনায়ক ছিলেন মোবাশ্বের। প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালী ডিসি টিম। সে ম্যাচে সাংঘাতিক খেলেছিলাম। তাতে আমরা ১-০ গোলে জয়ী হই। খেলার পর ডিসির ছেলে আমাকে ৫০ টাকা পুরস্কার দেন। সে টাকা থেকে মায়ের জন্য ২০ টাকা দিয়ে একটি শাড়ি কিনেছিলাম। ১৯৬৫ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে ভালো খেলেছিলাম। খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়।’
সমসাময়িক সেরা ফুটবলারদের কথা জানতে চাইলে রানা ভিক্টোরিয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর, মোহামেডানের রাইট ইন আবদুল্লাহ সিনিয়র, কালা গফুর, মোহামেডানের ডিফেন্ডার তোরাব আলী আর বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে কবীর, জহির, প্রতাপ, বশীর, শামসু, আনসার, রণজিত, বলাই, বীরু ও মঞ্জুর হাসান মিন্টুর কথা জানান। মিন্টু প্রসঙ্গে বলেন, ‘মিন্টু ভাইয়ের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে তিন বেলা প্র্যাকটিস করতাম। মিন্টু ভাই ছিলেন স্টাইলিশ গোলকিপার। আমি মিন্টু ভাইকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। এ কারণে আমাকে বলা হতো জুনিয়র মিন্টু।’ নিজের খেলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। দুরূহ যে কোনো বল আমি ডাইভ দিয়ে হলেও সেভ করতাম। যে বলটি থেকে গোল হওয়ার উপক্রম হতো, সেটা আমি নিজেকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে হলেও আটকে দিতাম। তবে আমি যে গোলগুলো খেতাম, তা ছিল ইজি বল থেকে। আমি ঢাকার কায়দে আজম কলেজে পড়ালেখা করতাম। একবার আমার খেলা দেখার জন্য আসেন কলেজের প্রিন্সিপাল ফাতমি সাহেব। বাবাকে চিনতেন। সেদিন আমার বাবাও খেলা দেখতে এসেছিলেন। তিনি আমার বাবাকে বলেন, ছেলেটি ভালো গোলরক্ষক। তবে অনেক সময় সহজ গোল হজম করে।’ গোলকিপার হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঢাকা মোহামেডানের বলাই, করিম, ওয়ান্ডারার্সের হাকিমের কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, তখনকার দেশের পয়লা নম্বর গোলকিপার বলাই ভারতে চলে গেলে তিনি তার জায়গাটি পূরণ করেন।
নিজেদের সময়টাকে মূল্যায়ন করেন তিনি এভাবে- ‘আমাদের সময় খেলাটা বিজ্ঞানভিত্তিক ছিল না। কোচিং ছিল না। প্রশিক্ষকও ছিল না। যা করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি। আর ছোটখাট কিছু পরামর্শ পেয়েছি স্কুলের গেম টিচারের কাছ থেকে। তিনিই-বা কতটুকু জানতেন? তারপরও আমরা খেলেছি মনের আনন্দে। আর এখন তো ফুটবলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বদলে গেছে অনেক কিছু। তবে আমাদের দেশের ফুটবল খুব বেশি বদলাতে পারেনি। ফুটবলকে এগিয়ে নিতে হলে স্কুল পর্যায় থেকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এ পর্যায় থেকে ট্রেনিং দেয়া হলে সুফল পাওয়া যাবে।’
ক্রিকেটটা রানার ছোটবেলা থেকেই প্যাশন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন সেন্ট্রাল গভঃ প্রেস অব পাকিস্তানের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। বাবার চাকরিসূত্রে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করতে হয়েছে। ১৯৫৯-৬০ সালের দিকে থাকতাম করাচীতে। পড়ালেখা করতাম করাচী বাংলা স্কুলে। সে স্কুলের হয়ে ক্রিকেট খেলতাম। একবার মেরিক্লজ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিপক্ষে খেলি। সে স্কুলে পড়তেন টেস্ট ক্রিকেটার হানিফ মোহাম্মদের ভাই মুশতাক মোহাম্মদ ও সাদেক মোহাম্মদ। ওয়ান ডাউনে খেলতে নেমে ওদের স্কুলে বিপক্ষে ৫০ রান করেছিলাম। হানিফ মোহাম্মদের একটি দল ছিল ব্ল্যাক হকস। আমি ভালো ব্যাট করায় ওরা আমাকে ওদের দলে যোগ দিতে বলে। আমি এক বছর সেই ক্লাবে খেলেছিলাম। এরপর ঢাকায় চলে আসি। তবে ক্রিকেটের প্রতি আমার আকর্ষণ গড়ে ওঠে তখনই। ননী স্যার আমাকে ফুটবলে টেনে না নিলে ক্রিকেটেই সঁপে দিতাম নিজেকে। তারপরও ক্রিকেটাকে মন থেকে ছাড়তে পারিনি। আমার ক্রিকেট প্রতিভার কথা ঠিকই জেনে যান ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে নিবেদিতপ্রাণ মুশতাক। তিনিই ঢাকায় আমাকে আজাদ বয়েজ ক্লাবে নিয়ে যান। তার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছেন অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার। আপাদমস্তক ক্রিকেটে নিমজ্জিত মুশতাককে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা হত্যা করে।’
আজাদ বয়েজের পর রানা শান্তিনগর, ন্যাশনাল স্পোর্টিং, বক্সিবাজার, ঢাকা মোহামেডান এবং বাংলাদেশ বিমানের হয়ে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা লীগে খেলেছেন। ১৯৭৭ সালে তার অধিনায়কত্বে জাতীয় ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশীপে হয় বিমান। সে দলে ছিলেন ইউসুফ বাবু, সৈয়দ আশরাফুল, সামিউর রহমান সামি, তামিম, আজহার, সদরুল, জাহাঙ্গীর, অলক, স্বপন, ইফতেখারের মতো ক্রিকেটার। ১৯৬১-৬২ সালে গঠিত ইস্ট পাকিস্তান ক্রিকেট দলে ১৬-এর মধ্যে ছিলেন। কিন্তু ১৩ জনের দল থেকে বাদ পড়ে যান। ক্রিকেটে তার স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জে একটি ম্যাচে ৯৯ রান করে এলবিডব্লিউডি হই। এটা আমার জীবনে অনন্ত এক আক্ষেপ হয়ে আছে। সে সময়কার শক্তিশালী দল পিডব্লিউডির বিপক্ষে শান্তিনগরের হয়ে ৫৪ রান করেছিলাম। পিডব্লিউডিতে খেলতেন ফাস্ট বোলার নিয়াজ। তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট খেলেন। টেস্ট ক্রিকেট খেলে পিডব্লিউডির হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামেন আমাদের বিপক্ষে। তার এক ওভারে প্রথম তিন বলেই তিনটি ছক্কা হাঁকাই। আমি ছিলাম মূলত হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যান। ছক্কা মারার ক্ষেত্রে আমার বেশ নাম-ডাক ছিল। আমার খেলা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম বোলার সোহরাব আমাকে সব সময় হিটিং করতে বারণ করেন। তিনি আমাকে দেখে-শুনে খেলার পরামর্শ দেন।’
ষাট ও সত্তর দশকের ক্রীড়াবিদ মোঃ রেজাউল হক রানা এখন অনেকটা হারিয়ে যাওয়া নাম। অথচ এক সময় ছিলেন পাকিস্তানের সেরা গোলরক্ষকদের একজন। ক্রিকেটার হিসেবেও কম-বেশি পরিচিতি ছিল। জীবনের প্রয়োজনে উড়াল দিয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। দেখেছেন এই পৃথিবীর রূপ-রস-সৌন্দর্য। সঞ্চয়ের ভান্ডার নেহাত মন্দ নয়। এখন জীবনে খানিকটা থিতু হয়েছেন। হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখেন, জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায় কেটেছে খেলার মাঠে। প্রতিপক্ষের নিশ্চিত একটা গোল সেভ করে গ্যালারির কত কত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন! ছক্কা মেরে পেয়েছেন বাহবা। অবসর মুহূর্তে সেসব স্মৃতিমাখা দিনগুলো তাকে নস্টালজিক করে তোলে। তখন খুব ইচ্ছে করে সেই দিনগুলো ফিরে পেতে। হায়! যে দিনগুলো চলে যায়, তা তো আর ফিরে আসে না। #
১-১-২০০৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন