কাবাডির প্রথম তারকা খেলোয়াড় জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী/ দুলাল মাহমুদ

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে পেশাদার অবকাঠামো এখনও গড়ে উঠেনি। তবে একটু একটু করে বোধ করি সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটাররা মাসিক বেতন ও বোনাস পাচ্ছেন। নামকাওয়াস্তে হলেও চালু হয়েছে পেশাদার ফুটবল লীগ। অথচ ষাট ও সত্তর দশকে পেশাদারিত্বের বিষয়টি ছিল অসম্ভব এক চাওয়া। সে সময় খেলাধুলায় পেশাদার মনোভাব পোষণ করার প্রশ্নই আসে না। সবাই খেলতেন মনের আনন্দে। পাশাপাশি কিছুটা পরিচিতি কিংবা খ্যাতি পেলে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। নিজেকে খেলার মাঠে উৎসর্গ করে দেয়ার মানসিকতা খুব কমই দেখা যেত। খেলাধুলাটা যেহেতু রুটি-রোজগারের অবলম্বন ছিল না, তাই তাতে জীবনপাত করার কথা কেউ ভাবতেন না। এঁদের মাঝে ব্যতিক্রম ছিলেন কেউ কেউ। তাদের অন্যতম মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। খেলাধুলাকে নিয়েছিলেন পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গিতে। ক্রীড়াঙ্গন থেকে যে পর্যাপ্ত অর্থ পেতেন, তা মোটেও নয়। কিন্তু মাঠে নামলে জীবনবাজি রেখে খেলতেন। খেলতেন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে। মনোভাবটা ছিল এমন : ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’। কোনো কিছুর পরোয়া করতেন না। যখন যে দলের হয়ে খেলেছেন, সেই দলের জয়-পরাজয়টাকে মনে করতেন নিজের। দলের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ও উৎসর্গীকৃত মনোভাবের কারণে খুব বেশি দলও বদল করেননি।
ফুটবলের লড়াকু ডিফেন্ডার, ভলিবলের দুর্দান্ত স্ম্যাশার আর কাবাডির সাহসী ক্যাচার হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ। দীর্ঘদিন ফুটবলের রণভাগের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তিনি ছিলেন সমীহ জাগানো নাম। তাকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা সামনা-সামনি বল নিয়ে কাটিয়ে ডিফেন্স ভেদ করা প্রতিপরে খেলোয়াড়দের জন্য ছিল দুঃসাহসী এক চ্যালেঞ্জ। ইস্পাতদৃঢ় আর অটল পাহাড়ের মতো তার শক্ত-সামর্থ্য দেহের কাছে বিপ দলের ফরোয়ার্ডরা হয়ে পড়তেন অসহায়। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন রাফ অ্যান্ড টাফ ফুটবলার। ভলিবলে তিনি ছিলেন পাওয়ারফুল হাই অ্যাটাকার। তার প্রায় ছয় ফুটের মত লম্বা বলিষ্ঠ ও দীর্ঘ দেহখানি নিয়ে যখন স্ম্যাশ করতে উঠতেন, তখন প্রতিপক্ষ দলে শুরু হয়ে যেত থরহরি কম্প। নিজের দলও নিশ্চিত থাকতো- তার স্ম্যাশ থেকে পয়েন্ট আসবেই। এ কারণে তার কাছেই যে কোনো প্রকারে বল পৌঁছে দেয়া হত। আর কাবাডিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ক্যাচার ও রেইডার হিসেবে তার কোনো জুড়ি ছিল না। ড্রাইভ দিয়ে তিনি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের ধরতেন। প্রতিপক্ষের রেইডাররা তাকে এড়িয়ে চলতে চাইতেন। তার বাঘের মত ক্ষিপ্রতা আর বাজপাখির মত থাবা থেকে রেহাই পাওয়া সহজ ছিল না। সাধারণ বাঙালির তুলনায় তিনি ব্যতিক্রম। অসম্ভব শক্তিশালী ও সাহসী। কোনো কৌশলের ধার ধারতেন না। শারীরিক শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই আনন্দ পেতেন। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ছিলেন একদমই অন্য ঘরানার।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ১৯৫৫ সালের ১ মে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক পরিবেশের কারণে ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় আকৃষ্ট হন। খেলাধুলায় তাদের ‘চৌধুরী’ পরিবারের আলাদা খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ছিল। এ পরিবারের কিংবদন্তি ফুটবলার আশরাফ চৌধুরী তার আপন চাচা। আশরাফ চৌধুরী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব এবং পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের দুরন্ত স্ট্রাইকার ছিলেন। চাচার হাত ধরে ফুটবল ও ভলিবলে তার দীক্ষা হয়। দাউদকান্দি পাইলট স্কুলে পড়ার সময় খেলাধুলায় তার এক-আধটু নাম হতে থাকে। তবে কুমিল্লার একটি প্রদর্শনী ভলিবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি। সে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য তাদের চৌধুরী বাড়ির খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হয় ‘চৌধুরী ভলিবল দল’। তাতে তিনি স্ম্যাশার হিসেবে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখান এবং তার দল চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি ছিলেন খ্যাতিমান ক্রীড়া সংগঠক ওয়ারী কাবের আবুল হাশেম। তিনি জাহাঙ্গীর আলমের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ওয়ারীতে খেলার আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তিনি যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী ওয়ারী কাবে। অবশ্য ওয়ারীতে যোগ দেয়ার আগে তিনি খেলেন পলাশকুঞ্জ কাবের হয়ে।
১৯৬৯ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ওয়ারীর হয়ে খেলা শুরু করেন। সে বছর দুর্দান্ত খেলেন। সঙ্গত কারণে তাকে উপেক্ষার করার সুযোগ ছিল না। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেন পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে। ১৯৭৩ সালের ১২ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের নয়াদিল্লীতে আয়োজিত হয় গ্রামীণ ক্রীড়া উৎসব। বাংলাদেশ থেকে ভলিবল, কাবাডি, কুস্তি ও মহিলাদের খো খো দল এ উৎসবে যোগ দিয়েছিল। বাংলাদেশ ভলিবল দলের হয়ে তিনি অংশ নেন। এছাড়াও দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন- অধিনায়ক কানু, মিনহাজ, আবু বকর, ফারুক, শাহ আলম, আলাউদ্দীন, ছোট জাহাঙ্গীর ও আলম। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি ওয়ারীর হয়ে খেলেন। এ সময় ওয়ারী ১৯৭২ সালের প্রথম বিজয় দিবস ভলিবল প্রতিযোগিতায় এবং ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৪-৭৫ সালে মহানগরী প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৪ সালে তিনি যোগ দেন কর্মস্থল সোনালী ব্যাংকে। একনাগাড়ে খেলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ভলিবলে তার দেখা সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন খন্দকার আবুল হাসান, সুভাষ, বাদশাহ প্রমুখ। নিজের স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১৯৭৪-৭৫ সালে ভলিবল লীগের ফাইনালে ওয়াপদার বিপক্ষে ওয়ারীর হয়ে খেলা তার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বর্তমান ভলিবল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন ভলিবল খেলা অনেক ফাস্ট। আগে এত দ্রুততা ছিল না। প্রত্যেকের পজিশন নির্দিষ্ট ছিল। এখন সবাইকে সব জায়গায় খেলতে হয়। খেলায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানের খেলার সঙ্গে অতীতের খেলার কোনো মিল পাওয়া যাবে না।’
ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে ওয়ারীতে যোগ দিলেও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ফুটবলও খেলতেন। ১৯৬৮ সালে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ এবং ১৯৬৯ সালে সাধারণ বীমার হয়ে খেলে ফুটবল প্রতিভার ঝিলিক দেখালে তাকে লুফে নেয় ওয়ারী। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ওয়ারীর হয়ে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। স্টপার হিসেবে তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ। তাকে ডিঙ্গিয়ে বল নিয়ে গোল করা ছিল যে কোনো ফরোয়ার্ডের জন্য দুরূহতম কাজ। সে সময় তার ট্যাকলকে ভয় পেতেন না, এমন স্ট্রাইকার খুব কম ছিলেন। তার মন্ত্র ছিল একটাই, তার পাশ দিয়ে কাউকে বল নিয়ে ঢুকতে দেয়া হবে না। তাতে তিনি ছিলেন সফল। নিজেকে সঁপে দিতেন একশ’ শতাংশ। এ কারণে তাকে বলা হত ‘চীনের প্রাচীর’। ১৯৭৫ সালে তিনি ছিলেন ওয়ারীর অধিনায়ক। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় আবাহনী লিমিটেডকে লজ্জা দেয়া হত ‘ওয়ারী আইলো’ বলে। ১৯৭৫ সালে ওয়ারী ২-১ গোলে এবং ১৯৭৬ সালে ৩-২ গোলে আবাহনীকে হারায়। এরপর থেকে বেশ অনেক দিন আবাহনী-ওয়ারী খেলায় ‘ওয়ারী আইলো’ বলে আবাহনী সমর্থকদের খ্যাপানো হত। আর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আবাহনীর সঙ্গে খেলায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলেছিলেন। আবাহনীর সব আক্রমণ যেন তার কাছে এসে থমকে যেত। ১৯৭৬ সালে জাতীয় যুব দলের ট্রায়ালে ডাক পেয়েছিলেন। আসলে তার মারকুটে মনোভাবের কারলে তাকে জাতীয় দলে খেলানোর ব্যাপারে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। যে জন্য রক্ষণভাগের প্রাচীর হয়েও জাতীয় দলে খেলা হয়নি।
ভলিবল ও ফুটবলের পর কাবাডি খেলতে নেমে তারকা খ্যাতি অর্জন করেন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আর কাবাডি খেলোয়াড় হওয়ার পেছনে একটি মজার ঘটনা আছে। যদিও কাবাডি গ্রামের বাড়িতে টুকটাক খেলার অভ্যাস ছিল। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই সরাসরি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে নয়াদিল্লীতে গ্রামীণ ক্রীড়া উৎসবে তিনি গিয়েছিলেন ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে। নিজেদের খেলার ফাঁকে ফাঁকে অন্য দলের খেলা দেখতে যেতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মৃতিচারণ করেন এভাবে : ‘একদিন কাবাডি খেলা দেখতে যাই। গিয়ে দেখি,বাংলাদেশ দল ভারতের হরিয়ানা দলের কাছে হারছে। এতে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমার মনে হলো, আমি নামলে বোধহয় ভালো খেলতে পারবো। কাবাডি দলের ম্যানেজারকে আমার মনোভাবের কথা জানালাম। তিনি কি ভেবে আমার কথায় রাজি হয়ে যান। আমি সেদিন ভালোই খেলেছিলাম। হরিয়ানার সঙ্গে হারতে থাকা ম্যাচ আমরা ড্র করতে সক্ষম হয়েছিলাম।’ এরপর থেকে কাবাডির প্রেমে পড়ে যান জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ভলিবল ও ফুটবল খেলা অব্যাহত রাখলেও কাবাডিই হয়ে উঠে তার মূল আকর্ষণ। ১৯৭৩ সাল থেকেই সোনালী ব্যাংকের হয়ে কাবাডি লীগে খেলা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালটি কাবাডির জন্য মাইলফলক হয়ে আছে। এ বছর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ কাবাডি টেস্ট সিরিজ। ফেব্রুয়ারিতে সে সফরে ভারত পাঁচটি টেস্ট, একটি আঞ্চলিক ও একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। বাংলাদেশ ফরিদপুর টেস্টে ১৭-১৭ পয়েন্টে ও দিনাজপুর টেস্টে ৪-৪ পয়েন্টে ড্র এবং টাঙ্গাইলে আঞ্চলিক ম্যাচে ৩০-১৭ পয়েন্টে জয়ী হয়। বাংলাদেশটি দলটি ছিল এমন : মকবুল হোসেন (অধিনায়ক), মোঃ সালেক (সহ-অধিনায়ক), মোঃ আবদুল হোসেন মৃধা, মেসের খান, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, আমির হোসেন পাটওয়ারী, সুবিমল চন্দ্র দাস, জুলফিকার আলী, রোস্তম আলী, মোঃ এ. রশীদ বেপারী, মোঃ এ. কাদের বীর ও মোঃ বেল্লাল হোসেন। ঢাকা, যশোর, ফরিদপুর, কুমিল্লা ও দিনাজপুরে আয়োজিত পাঁচটি টেস্ট ম্যাচে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কান্ডারি। বিবেচিত হন বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে। আর এই স্বীকৃতি দেন ভারতের ম্যানেজার ওয়ালঞ্জ। পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক চিরঞ্জীব-এর ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন তিনি। কাবাডি অন্তঃপ্রাণ চিরঞ্জীব তার ‘কবাডি কবাডি’ গ্রন্থে ঢাকায় প্রথম টেস্ট নিয়ে লেখেন, ‘প্রথম টেস্টে হারলেও বাংলাদেশকে দুর্বল মনে হল না। অন্তত ভাল ক্যাচার তাদের রয়েছে। বিশেষত জাহাঙ্গীর। সে ভারতের প্রথম শ্রেণীর ক্যাচারদের সমকক্ষ।’ যশোরে দ্বিতীয় টেস্ট নিয়ে লেখেন, ‘দ্বিতীয় টেস্টেও ভারত জিতল ২১-১৭ পয়েন্টে। কিন্তু বাংলাদেশ দলের খেলায় যথেষ্ট উন্নতি দেখা গেল। এদিনও তাদের অধিকাংশ পয়েন্ট এসেছে হানাদের ধরে এবং সে কৃতিত্ব জাহাঙ্গীর আলমের।’ কুমিল্লায় চতুর্থ টেস্টে নিজেদের মাটিতে জাহাঙ্গীর অসাধারণ খেলেন। ১৯৭৯ সালে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফিরতি সফরে ভারত যায়। বাংলাদেশ দলের অন্য খেলোয়াড়রা হলেন- জুলফিকার আলী (সহ-অধিনায়ক), রতন কুমার দাস, আমির হামজা, নূরুল ইসলাম, মোতাহার মোল্লা, গৌর গোপাল ঘোষ, এম কে হোসেন, রৌশন ইয়াজদানী, জহিরুল হক, আফজাল হোসেন ও আবু মোতালেব। সে সফরে বাংলাদেশ বোম্বে, হায়দরাবাদ, ভিলাই, দিল্লী, কলকাতায় পাঁচটি টেস্ট এবং বরোদা, সোলাপুর, কর্ণাটক, নাগপুর ও লক্ষৌয় পাঁচটি আঞ্চলিক ম্যাচ খেলে। দিল্লী টেস্টে ২০-১০ পয়েন্টে এবং বরোদায় ৯-৮ পয়েন্টে, কর্ণাটকে ৯-৭ পয়েন্টে, নাগপুরে ২৫-২১ পয়েন্টে ও লক্ষৌয় ২০-১০ পয়েন্টে আঞ্চলিক ম্যাচে জয়ী হয় বাংলাদেশ। ১৯৮০ সালের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম এশীয় কাবাডি চ্যাম্পিয়নশীপে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেত্বত্বে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দলের অন্য সদস্যরা হলেন- জুলফিকার আলী (সহ-অধিনায়ক), রতন কুমার দাস, আমির হামজা, মোতাহার মোল্লা, খালেদ হোসেন, রৌশন ইয়াজদানী, আবদুল লতিফ গাজী, আমির হোসেন পাটওয়ারী, শফিউদ্দিন ও নূরুল ইসলাম (২)। তিন জাতির (ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ) এ প্রতিযোগিতায় রানার্স-আপ হয় বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ-কর্ণাটক চীফ মিনিস্টার টিম কাউন্টি ম্যাচে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভলিবল লীগে সোনালী ব্যাংকের হয়ে খেলেন। জাতীয় ভলিবলে খেলেন কুমিল্লা জেলা দলের হয়ে। ছয় বছর তিনি কুমিল্লার অধিনায়ক ছিলেন। তার নেতৃত্বে কুমিল্লা ১৯৭৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও কুমিল্লা চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৭৬ সালে। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি ১৯৭৫ সালে তাকে সেরা কাবাডি খেলোয়াড় নির্বাচিত করে। ১৯৭৯ সালে বাঙ্গালোরে কর্ণাটক রাজিয়া অ্যামেচার কাবাডি এসোসিয়েশন সার্টিফিকেট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী কাবাডি কোচ হিসেবে দীক্ষা নেন। ১৯৮১ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড আয়োজিত প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমসে তিনি বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন। ১৯৯৪ সালে এশিয়ান অ্যামেচার কাবাডি ফেডারেশন আয়োজিত টেস্ট পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করেন। ১৯৯৫ সালের মার্চে কলকাতায় সাত জাতির মহিলাদের কাবাডি প্রতিযোগিতায় তিনি কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তিনি লাভ করেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির ডিপ্লোমা। কাবাডির আন্তর্জাতিক রেফারী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
কাবাডি খেলার সময় রেইডার হিসেবে যখন খেলতেন, তখন প্রতিপক্ষের কাছে তার পদযুগল ছিল পরম কাক্সিত। তার পা সাঁড়াশির মত আটকে ধরে তাকে ফাঁদে ফেলতে চাইতেন তারা। সে ক্ষেত্রে তারা বরাবরই ব্যর্থ হতেন। অসম্ভব শক্তিশালী পা’জোড়া দিয়ে ঝটকা মেরে তিনি জয়ীর বেশে বীরের মত ছুটে যেতেন। অথচ সেই পদযুগল এখন শক্তিহীন ও অসহায়। ডায়াবেটিসের কাছে পরাভব মেনেছে সেই অপরাজেয় পদযুগল। ২০০৬ সালে তার বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়। অবশ্য তাতে তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। অদম্য মনোবল আর দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে তিনি নিয়মিত অফিস করছেন। পালন করছেন দৈনন্দিন কর্মকান্ড। আসলে খেলার মাঠে জয়ী হওয়ার যে পাঠ তিনি নিয়েছিলেন, তাতে হার মানার কোনো দীক্ষা তিনি পাননি। জীবনযুদ্ধে অপরাজেয় এক সৈনিক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী খেলা ছেড়ে দেয়ার পর কাবাডি খেলা সাফ গেমস এবং এশিয়ান গেমসে অন্তর্ভুক্ত হলে তাতে বড় সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। এশিয়ান গেমসে সর্বোচ্চ রৌপ্য পদক এসেছে কাবাডির মাধ্যমে। কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে কাবাডিকে জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তিনি তাদের অন্যতম। নিঃসন্দেহে কাবাডির প্রথম তারকা খেলোয়াড় বলা যেতে পারে তাকে। ফুটবলে কাজী সালাউদ্দিন,ক্রিকেটে রকিবুল হাসান,হকিতে আবদুস সাদেক,সাঁতারে মোশাররফ হোসেন খান, ব্যাডমিন্টনে কামরুন্নাহার ডানা,জুডোতে কামরুন নাহার হীরু,দাবায় নিয়াজ মোরশেদ,টেবিল টেনিসে জোবেরা রহমান লীনু,অ্যাথলেটিক্সে মোঃ শাহ আলম যেমন তারকাখ্যাতি পেয়েছেন, অনুরূপভাবে কাবাডির তারকা খেলোয়াড় হলেন মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। কাবাডি খেলায় যেহেতু তেমন গ্ল্যামার নেই, এ কারণে তার নামটি এখন আর সেভাবে আলোচিত হয় না। অথচ একটা সময় তিনি কাবাডি খেলতে নামলে মাঠে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হত। মাঠ মাতানোর দুর্দান্ত কুশীলব ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা কাবাডি খেলোয়াড় নির্বাচন করলে তার নামটি প্রথমেই আসে। অথচ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই তার নামটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এ উপেক্ষার অবসান ঘটানো প্রয়োজন। #
১-১১-২০০৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল খেলোয়াড় গড়ার কারিগর মোস্তাফা কামাল/ দুলাল মাহমুদ