ক্লান্তিকর ক্রিকেট, বিরক্তিকর ক্রিকেট



ক্রিকেটটা যখন দূরের ছিল, তখন এক ধরনের রোমান্টিকতা ছিল। এখন ক্রিকেটটা হাতের মুঠোয় চলে আসায় সেই রোমান্টিকতা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। বরং এত বেশি ক্রিকেটের ঠেলায় ‘ত্রাহি মধুসুদন’ দশা। গ্রীষ্মে ক্রিকেট, বর্ষায় ক্রিকেট, শরতে ক্রিকেট, হেমন্তে ক্রিকেট, শীতে ক্রিকেট, বসন্তেও ক্রিকেট। একটুও দম ফেলার ফুসরত নেই। বছরভরই লেগেই আছে ক্রিকেটের মচ্ছব। এমনকি সকাল নেই, দুপুর নেই, রাতও নেই। দিনের পুরোটা সময় এখন ক্রিকেটময়। টিভি খুললেই ক্রিকেট। সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেও ক্রিকেট। চলতি পথে ক্রিকেট। ফিরতি পথেও
ক্রিকেট। জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্রিকেটের অবাধ বিচরণ। ‘ইট ক্রিকেট, স্লিপ ক্রিকেট, লিভ ক্রিকেট’ এখন আর বিজ্ঞাপনের ভাষায় সীমাবদ্ধ নেই। প্রকৃতঅর্থেই খেতে হচ্ছে ক্রিকেট, ঘুমাতে হচ্ছে ক্রিকেটে, বসবাস করতে হচ্ছে ক্রিকেটে। অধিক মুনাফার আশায় ক্রিকেটের এই অতিভোজ অতিষ্ঠ করে তুলেছে জীবন। কারো কারো কাছে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। তারপরও কিন্তু রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রিকেটের আগ্রাসী প্রভাবে বদলে যাচ্ছে সামাজিক জীবনও।
অথচ সেদিন তো বেশি দূরে নয়, যখন ক্রিকেট খেলা হতো কালেভদ্রে। কম খেলা হলেও তার প্রতি অন্য রকম টান ছিল। ছিল ভালোবাসা। তখন তো ইলেকট্রোনিকস মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না। যে কারণে টেলিভিশনে ক্রিকেট তেমনভাবে পাত্তা পেত না। সংবাদপত্রও ছিল হাতেগোনা। তাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যেটুকু খবর থাকতো, তা বুকের মধ্যে এঁকে দিত অন্য রকম আল্পনা। সাদা-কালো সেই ক্রিকেট হৃদয়ে হয়ে আছে অমলিন। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ক্রিকেট বলতে বুঝতাম টেস্ট ক্রিকেট। ওয়ান ডে ক্রিকেটও ছিল। বিশ্বকাপের বাইরে তার খুব বেশি ঔজ্জ্বল্য ছিল না। টেস্ট ক্রিকেটই ছিল তার আভিজাত্য, তার সৌন্দর্য, তার গরীমা নিয়ে। কোনো ব্যাটসম্যান একটি সেঞ্চুরি করলে আর কোনো বোলার পাঁচ উইকেট নিলে ক্রিকেটপ্রেমীরা পেয়ে যেতেন আলোচনার খোরাক। তবে তাতে ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ, রীতি, মেজাজ, স্টাইল, সৌন্দর্য কতটা থাকতো, সেটা নিয়েই চলতো সূক্ষè ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। যেন-তেন প্রকারে রান করলে কিংবা উইকেট নিলে সেটাকে দেখা হতো তীর্যক দৃষ্টিতে। তখন তো ক্রিকেটকে বিবেচনা করা হতো ‘ভদ্রলোকের খেলা’ হিসেবে। একটুখানি এদিক-সেদিক হলেই বলা হতো, ‘ইট’স নট ক্রিকেট’। সেই ক্রিকেটটা বদলে যেতে থাকে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে।
১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেতৃত্বে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ভারতে যেন ক্রিকেটের জাগরণ ঘটে যায়। ক্রিকেট পেয়ে যায় বাণিজ্যের বিশাল বাজার। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশে ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গেলে ক্রিকেট হারাতে থাকে তার মর্যাদা, তার কৌলীন্য, তার সৌরভ। অর্থ যে ক্রিকেটের অনর্থের অন্যতম কারণ, সেটা একটু একটু করে অনুধাবন করা যেতে থাকে। অর্থের প্রলোভনে বাড়তে থাকে ক্রিকেট খেলা। সেই অনুপাতে ক্রমশ দূষিত হতে থাকে ক্রিকেট ও ক্রিকেটীয় পরিবেশ। টাকার প্রলোভনে জড়িয়ে পড়তে থাকেন ক্রিকেটাররা। অধিক লাভের জন্য ক্রিকেট মাঠে হতে থাকে ম্যাচ ফিক্সিং। নানান রকম কারসাজি। বেড়ে যায় জুয়াড়ীর সংখ্যা। পথভ্রষ্ট হতে থাকেন আম্পায়ার, সংগঠকরাও। টি-টুয়েন্টি আসার পর তো সোনায় সোহাগা। এটি হয়ে ওঠে যেন ‘সোনার রাজহাঁস’। ২০০৭ সালে প্রথম টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ভারত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ক্রিকেটের পালে লাগে পাগলা হাওয়া। ১২০ কোটি জনসংখ্যার দেশ যদি কোনো কিছু লুফে নেয়, তাহলে আর তাকে পায় কে। একদিনের ক্রিকেটে প্রথমবার বিশ্বসেরা হওয়ার পর ক্রিকেট হয়ে ওঠে ভারতীয়দের কাছে ধর্মের মতো। এই সুযোগে কর্পোরেট হাউজগুলো টাকার থলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর টি-টুয়েন্টিতে শিরোপা জয় করার পর ভারতে ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি তো আকাশ ছুঁয়েছে। ভারতীয়রা এটা অন্তত বুঝতে পেরেছে, অর্থ, জনসংখ্যা, জনপ্রিয়তা যদি থাকে, তাহলে আর কারো মুখাপেক্ষী না হলেও চলে। আর এ কারণেই ২০০৮ সালে ভারতে চালু করা হয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ। যা ‘আইপিএল’ নামে পেয়েছে ব্র্যান্ড ভ্যালু। এই টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে যেন ডলারের বৃষ্টি হতে থাকে। বিশ্বের তাবৎ ক্রিকেটারদের কাছে এ টুর্নামেন্টে খেলাটা হয়ে ওঠে ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। এখানে খেলতে পারলে আর্থিক নিরাপত্তার হাতছানি। এ কারণে দেশের হয়ে খেলার পরিবর্তে অনেকেই আইপিএলে খেলাটাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। আর যেখানে অর্থের এমন ছড়াছড়ি, সেখানে তো স্বাভাবিক নিয়মেই থাকবে অনিয়ম আর অনৈতিকতা। সেটা এখন পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। একের পর এক নানান দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে ক্রিকেট। ক্রিকেট নিয়ে বাজি তো আগেই ছিল, এখন সেটা ছড়িয়ে পড়েছে অতিমাত্রায়। এছাড়া স্পট ফিক্সিং, অবৈধভাবে টাকা আয় করার বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। বেড়েছে নারী ও মাদকের অবৈধ ব্যবহার। ক্রিকেটকে ঘিরে যে নিত্য-নতুন কত রকম কেলেঙ্কারি হচ্ছে, তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে দূষণ বাড়ছে সামাজিকভাবেও।
আইপিএল-এর দেখিয়ে দেওয়া পথে হাঁটছে ক্রিকেট ঘরানার অন্য দেশগুলোও। এমনিতেই টেস্ট, ওয়ান ডে, টি-টুয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ত সিডিউল, তার ওপর অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে দেশে দেশে আইপিএলের মতো টুর্নামেন্ট আয়োজন করায় দম ফেলার সময়ই পাওয়া যাচ্ছে না। এরফলে ক্রিকেটাররা রীতিমতো ক্লান্ত-শ্রান্ত। ঘন ঘন ইনজুরডও হচ্ছেন। বার্নআউট হয়ে হারিয়ে ফেলছেন শারীরিক সক্ষমতা। বাধ্য হয়ে অনেকেই অকালেই বিদায় নিচ্ছেন ক্রিকেট থেকে। এমনকি মাত্রাতিরিক্ত ক্রিকেটে বিরক্ত দর্শকরাও। তারা আস্তে-ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ক্রিকেট থেকে। এখন আবার রাতেও হবে টেস্ট ক্রিকেট। ক্রিকেটকে এভাবে খোলামকুচির মতো ব্যবহার করে সহজলভ্য ও সস্তা করে ফেলায় ক্রিকেটটা কি অনাকর্ষণীয় ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে না?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বকাপ ফুটবল কেন বাংলাদেশের উৎসব? / দুলাল মাহমুদ