কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে
কাছের কোনো মানুষ চলে গেলে বুকের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সৃষ্টি হয় বিশাল এক শূন্যতা, তখন কোনো কিছূতে মন বসানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রতিদিনের জগতটা কেমন জানি উলোট-পালট হয়ে যায়। এমনিতেই পরিপার্শ্বটা মুড়ানো থাকে শোকের চাদরে। তার সঙ্গে যোগ হয় কেমন জানি একটা গুমোট ও অস্বস্থিকর পরিস্থিতি। বিক্ষিপ্ত মনটা উড়তে থাকে শ্রাবণের মেঘ হয়ে। কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না স্বস্থি ও সুস্থিরতা। বুকের মধ্যে জমাট বাধে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। হঠাৎ হঠাৎ অকারণে ভিজে যায় চোখ। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায় কণ্ঠ। কেমন যেন এক ঘোরলাগা জীবন যাপন। খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছিও। কিন্তু কোথায় যেন কেটে যায় তাল-লয়-সুর। যখনই মনে পড়ে যায় শূন্যতার কথা, সব কিছুই মনে হয় এলোমেলো। ছন্দহীন। জীবনের মধ্যে থেকেও যেন অন্য এক জীবন যাপন। এমন একটা অবস্থায় চিরতরে চলে যাওয়া নিকটজনকে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কিছু লেখা কঠিনতম এক কাজ। এ সময় কোনো যথাযথ শব্দ বা বাক্য মস্তিক্সে ধরা দেয় না। একটা আচ্ছন্নতা ও ধুয়াশার মধ্যে কাটে জীবন। এমন এক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে লেখার দুরূহ দায়িত্ব নিয়ে আমি সত্যিই দিশেহারা। অথৈই জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। তার দৈহিক অনুপস্থিতির শূন্যতাটুকু এখনও কাটিয়ে ওঠতে পারছি না। পারছি না বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মানসিকভাবেও নিজেকে মানিয়ে নিতে। একটা দোলাচলের মধ্যে আছি। কি লিখবো ঠিক বুঝেও ওঠতে পারছি না। এমন একজনকে নিয়ে লিখতে হবে, যার সঙ্গে জড়ানো ছিল আমার জীবন ও আমার যৌবন। শুধু আমার কেন, আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের কাছেই তার আলাদা একটা অবস্থান ও সন্মান। এই লেখালেখি বা ক্রীড়া সাংবাদিকতার জগতে আমার মতো অনেকেরই প্রবেশ তার হাত ধরে। এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন ও ক্রীড়া সাংবাদিকতা তার কাছে অনেকখানি ঋণী। কত তরুণকে দেখিয়েছেন নতুন পথের দিশা। পাল্টে দিয়েছেন জীবনের গতি। কাউকে গড়ে তুলেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে। আবার কাউকে কাউকে উজ্জীবিত করেছেন ক্রীড়াবিদ হিসেবে। আর পথপ্রদর্শকের এমন ভূমিকা এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে হাতেগোনা যে ক’জনের, তিনি তাদের অন্যতম। তিনি সালমা রফিক। সবার কাছে তার পরিচিতি ‘সালমা আপা’ হিসেবেই।
ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গেই ছিল তার রাখীবন্ধন। দূর শৈশবে খেলার মাঠের সঙ্গে সেই যে সই পাতিয়েছিলেন, সেটাই হয়ে ওঠে তার জীবনের একমাত্র বন্ধন। খোলা মাঠ, খোলা প্রান্তর আর দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের মোক্ষ। এ কারণেই গড়ে ওঠতে পেরেছিলেন মুক্ত ও স্বাধীন মানব হিসেবে। কোনো কুসংস্কার, পিছুটান, দুর্বলতা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। তার অনুভব, অনুভূতি, ভাললাগা, ভালোবাসার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় ক্রীড়াঙ্গন। খেলার মাঠ থেকে যে জীবনদর্শন তিনি সঞ্চয় করেছিলেন, সেটাই হয়ে ওঠে তার চলার পথের পাথেয়। জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত খেলার মাঠের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হতে দেননি।
সেই ষাট ও সত্তর দশকে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গন অবারিত ছিল না। অবশ্য এখনই বা কতটুকু অর্গলমুক্ত? তৎকালে পারিবারিক বাধা তো ছিলই, সেইসঙ্গে পশ্চাদপদ ও রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস ও সদিচ্ছা খুব কম মেয়েই দেখাতে পেরেছেন। সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন খেলাধুলায়। পলাশী, বক্সিবাজার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা স্টেডিয়ামে তার ছিল অবাধ বিচরণ। শটপুট, ডিসকাস থ্রো, হার্ডলসে কত না বাধা পেরিয়েছেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক ক্রীড়া, পাকিস্তান অলিম্পিক, জাতীয় অ্যাথলেটিক্স, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়ায় পূর্ব পাকিস্তান দল, আজাদ স্পোটিং ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হলের হয়ে কুড়িয়েছেন খ্যাতি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অংশ নিয়েছেন ‘অল-পাকিস্তান উয়োমেন্স অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ’-এ।
১৯৭৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে ‘অল-ইন্ডিয়া রুরাল গেমস’-এ বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেন ভলিবল, কাবাডি, খো খো খেলায়। খেলার মাঠের সাফল্যের হাতছানি তো ছিলই, আরো ছিল সামাজিক অনুশাসনকে ‘অমান্য’ করার রোখ। নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি কখনো অপোষ করেননি। যখনই কোনো অন্যায় ও অবিচার দেখেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন। নেতৃত্বের একটা সহজাত ক্ষমতা তার ছিল। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রী সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক।
রাজনীতির মাঠে বিচরণ করলে তিনি হয়ত সাফল্য পেতে পারতেন। সে পথ মাড়াননি। খেলার মাঠ ছিল তার হৃদয়ের মণিকোঠায়। তা থেকে দূরে থাকার কথা তিনি কখনো ভাবতে পারেননি। বরং খেলোয়াড়ি জীবন শেষে খেলার মাঠের সঙ্গে ঘনিষ্টতা আরো বাড়িয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করেন বাংলায়। স্বাধীনতার পর পরই বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। মহিলা ক্রীড়া সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। দৈনিক সমাজ, দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা হয়ে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার শুরু থেকেই যোগ দেন। ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। তার আবেগ, তার ভালোবাসা ও দুর্বলতার নামও ছিল ‘ক্রীড়াজগত’। এই পত্রিকাটিকে তিনি লালন করতেন সন্তানের মত। একই সঙ্গে ক্রীড়া সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে তার মিশন। এর মাধ্যমে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচর্যা করতে পারাটাই ছিল তার কাছে আনন্দের। তার লেখনীতে গুরুত্ব পেয়েছে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গন। কত মেয়েকে যে নিয়ে এসেছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। ‘ক্রীড়াজগত’ ও ‘সালমা রফিক’ ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। গত তিন দশকেরও বেশি সময় অসংখ্য পাঠক ও লেখকের হৃদয়ের অধিশ্বরী হয়ে আছেন তিনি। সম্পর্কের মাধুর্য দিয়ে সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। পারতেন নিজের উপস্থিতিকে অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে। এ কারণে তার পরিচয়ের গ-ি ছিল অনেক দূর বিস্তৃত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে।
সংসার ও পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও তিনি নিজেকে মেলে ধরেন। বিশেষ করে, দেশের মহিলা ক্রীড়াঙ্গন ছিল তার কাছে একটা নেশার মত। কীভাবে মেয়েদের খেলাধুলায় আরো বেশি আকৃষ্ট করা যায়, এটা নিয়েই ছিল তার সার্বক্ষণিক চিন্তা-ভাবনা। এ কারণে অনেক সময় সংসারও তার কাছে মনে হয়েছে গুরুত্বহীন। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, ভলিবল ফেডারেশনের মেট্টোপলিস মহিলা কমিটি, কাবাডি ফেডারেশন, ঢাকা মেট্টোপলিস স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন, মহিলা হকি অ্যাসোসিয়েশন সহ বিভিন্ন সংস্থার হয়ে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করেন। মহিলা ভলিবল, মহিলা হকি, মহিলা কাবাডি প্রবর্তনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি অন্তঃপ্রাণ। সমিতির কার্যক্রমেও তার ছিল সরব উপস্থিতি। সরাসরি ক্রীড়া সাংগঠনিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরও মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে তার আগ্রহ ও উদ্দীপনা একটুও টাল খায়নি। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, মেয়েদের খেলা দেখার জন্য মাঠে ছুটে যেতেন। লেখালেখি কিংবা বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরতেন মেয়েদের সমস্যাগুলো। এ ব্যাপারে একটুও ছাড় দিতে চাইতেন না। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনেও তার সম্পৃত্ততা বাড়ছিল। তিনি ছিলেন তেহরানভিত্তিক ইসলামিক উয়োমেন ফেডারেশন অব স্পোর্টস (আইডাব্লিউএফএস)-এর মিডিয়া কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ উয়োমেন স্পোর্টস লিডারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক।
ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে তিনি ঘুরেছেন নানা দেশ। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে এশিয়ান লেডিজ হকি অ্যাসোসিয়েশনে সভা, ১৯৮১ সালে জাপানের কিয়োটোতে প্রথম এশিয়ান মহিলা হকি টুর্নামেন্ট, ১৯৮৭ সালে ভারতের কলকাতায় সাফ গেমস, ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়াডে প্রস্তুতি, ১৯৯১ সালে শ্রীলংকায় সাফ গেমস, ১৯৯৫ সালে কানাডার কুইবেকে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (এআইপিএস) কংগ্রেস, ১৯৯৬ সালে ভারতের নাগপুরে দক্ষিণ এশিয়ান হ্যান্ডবল, ১৯৯৭ সালে ইরানের তেহরানে তৃতীয় ইসলামিক গেমস, ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে কমনওয়েলথ গেমস, ২০০৭ সালে কলকাতায় প্রথম ইন্দো-বাংলা গেমস, ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ইসলামিক মহিলা ক্রীড়া সম্মেলনে যোগ দেন। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড সফর করেন। যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই গড়েছেন বন্ধুত্বের বিনি সূতোর মালা। আধুনিক জীবন যখন আমাদের একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, তখন তিনি সম্পর্ক গড়ে তোলাটাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন।
সারা জীবন কত মানুষের কথা তিনি লিখেছেন। কত শোক-তাপ-অশ্রু তার অনুভূতি ছুঁয়েছে। নীলকণ্ঠ হয়ে কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কত না ক্রীড়াবিদের অবিচ্যুয়ারি। মনে পড়ে, একদিন বলেছিলেন, তিনি অনেকের অবিচ্যুয়ারি লিখেছেন। তার অবিচ্যুয়ারি কে লিখবে? হায়! সত্যি সত্যি যে তার শোকগাঁথা এত তাড়াতাড়ি লিখতে হবে, এটা কেইবা ভেবেছিলেন? জীবন তো এমনই। কখন কি হবে, তা বলতে পারা যায় না। তবে তার মতো প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছ্বল একজন নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের শোকগাঁথা এত তাড়াতাড়ি লেখাটা দুর্ভাগ্যজনক।
ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গেই ছিল তার রাখীবন্ধন। দূর শৈশবে খেলার মাঠের সঙ্গে সেই যে সই পাতিয়েছিলেন, সেটাই হয়ে ওঠে তার জীবনের একমাত্র বন্ধন। খোলা মাঠ, খোলা প্রান্তর আর দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের মোক্ষ। এ কারণেই গড়ে ওঠতে পেরেছিলেন মুক্ত ও স্বাধীন মানব হিসেবে। কোনো কুসংস্কার, পিছুটান, দুর্বলতা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। তার অনুভব, অনুভূতি, ভাললাগা, ভালোবাসার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় ক্রীড়াঙ্গন। খেলার মাঠ থেকে যে জীবনদর্শন তিনি সঞ্চয় করেছিলেন, সেটাই হয়ে ওঠে তার চলার পথের পাথেয়। জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত খেলার মাঠের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হতে দেননি।
সেই ষাট ও সত্তর দশকে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গন অবারিত ছিল না। অবশ্য এখনই বা কতটুকু অর্গলমুক্ত? তৎকালে পারিবারিক বাধা তো ছিলই, সেইসঙ্গে পশ্চাদপদ ও রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস ও সদিচ্ছা খুব কম মেয়েই দেখাতে পেরেছেন। সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন খেলাধুলায়। পলাশী, বক্সিবাজার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা স্টেডিয়ামে তার ছিল অবাধ বিচরণ। শটপুট, ডিসকাস থ্রো, হার্ডলসে কত না বাধা পেরিয়েছেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক ক্রীড়া, পাকিস্তান অলিম্পিক, জাতীয় অ্যাথলেটিক্স, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়ায় পূর্ব পাকিস্তান দল, আজাদ স্পোটিং ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হলের হয়ে কুড়িয়েছেন খ্যাতি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অংশ নিয়েছেন ‘অল-পাকিস্তান উয়োমেন্স অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ’-এ।
১৯৭৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে ‘অল-ইন্ডিয়া রুরাল গেমস’-এ বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেন ভলিবল, কাবাডি, খো খো খেলায়। খেলার মাঠের সাফল্যের হাতছানি তো ছিলই, আরো ছিল সামাজিক অনুশাসনকে ‘অমান্য’ করার রোখ। নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি কখনো অপোষ করেননি। যখনই কোনো অন্যায় ও অবিচার দেখেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন। নেতৃত্বের একটা সহজাত ক্ষমতা তার ছিল। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রী সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক।
রাজনীতির মাঠে বিচরণ করলে তিনি হয়ত সাফল্য পেতে পারতেন। সে পথ মাড়াননি। খেলার মাঠ ছিল তার হৃদয়ের মণিকোঠায়। তা থেকে দূরে থাকার কথা তিনি কখনো ভাবতে পারেননি। বরং খেলোয়াড়ি জীবন শেষে খেলার মাঠের সঙ্গে ঘনিষ্টতা আরো বাড়িয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করেন বাংলায়। স্বাধীনতার পর পরই বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। মহিলা ক্রীড়া সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। দৈনিক সমাজ, দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা হয়ে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার শুরু থেকেই যোগ দেন। ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। তার আবেগ, তার ভালোবাসা ও দুর্বলতার নামও ছিল ‘ক্রীড়াজগত’। এই পত্রিকাটিকে তিনি লালন করতেন সন্তানের মত। একই সঙ্গে ক্রীড়া সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে তার মিশন। এর মাধ্যমে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচর্যা করতে পারাটাই ছিল তার কাছে আনন্দের। তার লেখনীতে গুরুত্ব পেয়েছে মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গন। কত মেয়েকে যে নিয়ে এসেছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। ‘ক্রীড়াজগত’ ও ‘সালমা রফিক’ ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। গত তিন দশকেরও বেশি সময় অসংখ্য পাঠক ও লেখকের হৃদয়ের অধিশ্বরী হয়ে আছেন তিনি। সম্পর্কের মাধুর্য দিয়ে সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। পারতেন নিজের উপস্থিতিকে অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে। এ কারণে তার পরিচয়ের গ-ি ছিল অনেক দূর বিস্তৃত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে।
ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে তিনি ঘুরেছেন নানা দেশ। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে এশিয়ান লেডিজ হকি অ্যাসোসিয়েশনে সভা, ১৯৮১ সালে জাপানের কিয়োটোতে প্রথম এশিয়ান মহিলা হকি টুর্নামেন্ট, ১৯৮৭ সালে ভারতের কলকাতায় সাফ গেমস, ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়াডে প্রস্তুতি, ১৯৯১ সালে শ্রীলংকায় সাফ গেমস, ১৯৯৫ সালে কানাডার কুইবেকে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (এআইপিএস) কংগ্রেস, ১৯৯৬ সালে ভারতের নাগপুরে দক্ষিণ এশিয়ান হ্যান্ডবল, ১৯৯৭ সালে ইরানের তেহরানে তৃতীয় ইসলামিক গেমস, ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে কমনওয়েলথ গেমস, ২০০৭ সালে কলকাতায় প্রথম ইন্দো-বাংলা গেমস, ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ইসলামিক মহিলা ক্রীড়া সম্মেলনে যোগ দেন। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড সফর করেন। যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই গড়েছেন বন্ধুত্বের বিনি সূতোর মালা। আধুনিক জীবন যখন আমাদের একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, তখন তিনি সম্পর্ক গড়ে তোলাটাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন।
সারা জীবন কত মানুষের কথা তিনি লিখেছেন। কত শোক-তাপ-অশ্রু তার অনুভূতি ছুঁয়েছে। নীলকণ্ঠ হয়ে কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কত না ক্রীড়াবিদের অবিচ্যুয়ারি। মনে পড়ে, একদিন বলেছিলেন, তিনি অনেকের অবিচ্যুয়ারি লিখেছেন। তার অবিচ্যুয়ারি কে লিখবে? হায়! সত্যি সত্যি যে তার শোকগাঁথা এত তাড়াতাড়ি লিখতে হবে, এটা কেইবা ভেবেছিলেন? জীবন তো এমনই। কখন কি হবে, তা বলতে পারা যায় না। তবে তার মতো প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছ্বল একজন নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের শোকগাঁথা এত তাড়াতাড়ি লেখাটা দুর্ভাগ্যজনক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন