ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই



পৃথিবীর ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি, তেমন বিস্ময়কর এক নজির স্থাপন করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। খেলার মাঠও যে স্বাধীনতা সংগ্রামের পাদপীঠ হয়ে উঠতে পারে, সেটা তাঁরা বাস্তবিকই বুঝিয়ে দিয়েছেন। ফুটবল মাঠে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীরা। খেলার মাঠের এই বিমূর্ত স্বপ্ন ত্বরান্বি^ত করেছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এ কারণেই ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের আগেই ১৯১১ সালের ২৯ জুলাই মুক্তির আনন্দে উল্লসিত হয় অবিভক্ত ভারতের মুক্তিপাগল ভারতীয়রা। সেদিন সাহেবদের দল ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে হারিয়ে উপমহাদেশের প্রথম দল হিসেবে আইএফএ শিল্ড জয় করে মোহনবাগান ক্লাব। এটি ছিল জয়ের চেয়েও বড় কিছু। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালিদের নিয়ে গড়া ভারতীয় একটি দল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তুখোড় দলগুলোকে হারিয়ে ওড়ায় বিজয়ের পতাকা। চাঞ্চল্যকর এই বিজয়ে ভারতজুড়ে সৃষ্টি হয় অভাবনীয় উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা। এটি পরিণত হয় সর্বজনীন এক মুক্তির উৎসবে। ফুটবল হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার। প্রতিনিয়ত ব্রিটিশদের কাছে নাজেহাল হওয়া ভারতীয়দের কাছে এটি ছিল জাতির মুক্তির সনদ। তাই শিল্ড জয়ের পর এক বৃদ্ধ মোহনবাগানের রাইটব্যাক সুধীর চ্যাটার্জীকে আশীর্বাদ করে ফোর্ট উইলিয়ামে উড়তে থাকা ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাকের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন- শিল্ড তো জয় হলো বাবা, ওটা নামবে কবে? এই মনোভাব ছিল স্বাধীনতাকামী প্রতিটি ভারতীয়র। এই বিজয় ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনকে দারুণভাবে বেগবান করেছিল।
মোহনবাগান শিরোপা জয়ের পর ২৩ বছর ছিল আশাভঙ্গ আর নৈরাশ্যের কাল। এ সময় আর কোনো দল গোরা পল্টনদের বিপক্ষে শিরোপা জিততে পারেনি। ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগ লিগে ওঠার পর আলোড়ন তোলে কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। স্বর্ণযুগের সেই মোহামেডান বিস্ময়করভাবে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত সাতবার লিগ, দুইবার আইএফএ শিল্ড এবং একবার ডুরান্ড কাপ জয় করে। এই সাফল্য ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পূর্বেই স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে দেয় ভারতীয় মুসলমানদের বুকে। এটাকে কেন্দ্র করে মুসলিম জাগরণের সৃষ্টি হওয়ায় পাকিস্তান নামক দেশটির ছবি আঁকা হয়ে যায় তাঁদের উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত হৃদয়ে। বলা যায়, মোহামেডানের এই সাফল্যের পথ বেয়েই আসে ‘লাহোর প্রস্তাব’। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের কাছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে পতন ঘটেছিল মুসলিম সাম্রাজ্যের। এ ঘটনার পর ভারতের মুসলমানরা আশাহত ও হতোদ্যম হয়ে পড়েন। পরাধীনতার গ্লানি তাঁদেরকে নির্জীব করে দেয়। ফুটবলে মোহামেডানের এই অভাবিত সাফল্য মুসলমানদের মধ্যে ফিরিয়ে আনে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে খেলার মাঠও তা থেকে দূরে ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নৃশংসতার মুখে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক ক্রীড়াবিদ আশ্রয় নেন ভারতের মাটিতে। অনেকে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউ কেউ ভিন্নভাবে কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। তাঁদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ছিল কলকাতা মোহনবাগান এবং মোহামেডানের ঐতিহাসিক সাফল্য। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট ছিল একদমই ভিন্ন। কারণ, নিজেদের মাঠে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের বিপক্ষে ফুটবল ম্যাচ খেলার সুযোগ ছিল না। যা কিছু করার করতে হয় ভারতের মাটিতে। সেটাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কেননা, তখন দেশের স্বাধীনতা ছিল অনিশ্চিত। আগামীতে কী হবে, সেটা কেউ জানতেন না। খেলোয়াড়দের বড় একটি অংশ আশ্রয় নেন ত্রিপুরার আগরতলায়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মোহামেডানের কায়কোবাদ, আইনুল, ভিক্টোরিয়ার এনায়েত, নওশের, ওয়াপদার সুভাষ, দিলকুশার নিহার, ফায়ার সার্ভিসের সিতাংশু, চট্টগ্রাম রেলওয়ের বিমল, ওয়ারীর অমল, কুমিল্লা মোহামেডানের তপন, মন্টু, নরসিংদীর মাহমুদ। আগরতলায় সমবেত ফুটবলারদের ভাবনায় ছিল এমন কিছু করার, যাতে অনিবার্য হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভারত এবং বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামী বার্তা। এ চিন্তা থেকেই ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। এতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ‘ত্রিপুরা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’। পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলারদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘শরণার্থী একাদশ’। এ দলটি গঠনে সহযোগিতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ। ১৯৭১ সালের ৪ জুলাই ম্যাচটি আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ম্যাচ আয়োজনের আগেই একই মনোভাব নিয়ে কলকাতায় ‘বাংলাদেশ ফুটবল দল’ গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তারই অংশ হিসেবে খেলোয়াড় সংগ্রহ করার জন্য আগরতলায় আসেন ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’র কর্মকর্তারা। তাঁরা এসে নির্ধারিত ম্যাচের আগেই খেলোয়াড়দের কলকাতায় নিয়ে যেতে চান। কিন্তু ত্রিপুরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। আসাম রাইফেল মাঠে এ খেলায় বাংলাদেশ ১-২ গোলে হেরে যায়। ‘শরণার্থী একাদশ’-এর অধিনায়ক ছিলেন কায়কোবাদ। খেলার টিকিট থেকে প্রাপ্ত অর্থ মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে দেওয়া হয়।
আগরতলা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা মোহামেডানের জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ, নূরুন্নবী, ওয়ান্ডারার্সের আলী ইমাম, ওয়ারীর লুৎফর। পর্যায়ক্রমে কলকাতায় আসেন মোহামেডানের আশরাফ, অমলেশ, খুলনা ওয়াপদার অনিরুদ্ধ, ফায়ার সার্ভিসের গোবিন্দ। মুর্শিদাবাদে ছিলেন ওয়ারীর তসলিম, ২৪ পরগনায় ইপিআইডিসির হাকিম, কুষ্টিয়ার পিয়ারা, বহরামপুরে খোকন, মুক্তিযুদ্ধের রিক্রুটিং ক্যাম্পে ওয়াপদার মোমেন। ভারতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং নিচ্ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের সুরুজ। কলকাতায় যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ সেখানকার লিগের খেলায় অংশ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা ঢাকা লিগের নিবন্ধনকৃত ফুটবলার হওয়ায় ফিফার নিয়ম অনুযায়ী আরেকটি দেশের লিগে খেলার সুযোগ পাননি। এ অবস্থায় নিষ্ক্রিয় বসে না থেকে ফুটবলারদের কেউ কেউ দেশের পক্ষে কিছু একটা করার জন্য ছটফট করতে থাকেন। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন ফুটবলার আলী ইমাম ও লুৎফর রহমান। এই দুই ফুটবলার পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলারদের নিয়ে একটি ফুটবল টিম গঠন এবং বিভিন্ন স্থানে ফুটবল ম্যাচ খেলার পরিকল্পনা করেন। সেই আলোকে তাঁরা বিভিন্ন পত্রিকায় যৌথভাবে একটি বিবৃতি দেন। এ বিবৃতি প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলার এবং অবরুদ্ধ পাকিস্তানে অবস্থানরত খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশ সাড়া জাগায়।
অন্যদিকে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়াভিত্তিক আওয়ামী লীগ নেতা এবং একই সঙ্গে ইস্টএন্ড ক্লাবের সংগঠক ও খেলোয়াড় লুৎফর রহমান, মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, মো. মোহসিন, সাইদুর রহমান প্যাটেল কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। তাঁরাও বাংলাদেশ ফুটবল দল গঠনের ধারণাটি নিয়ে এগিয়ে যান। আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁদের জন্য সুবিধাজনক হয়। আর এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন সে সময়কার ঢাকা জেলা আওয়ামী লিগের সভাপতি ও ঢাকা-৪ আসনের জাতীয় পরিষদ সদস্য মো. সামছুল হক। বিদেশের মাটিতে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার এবং ফুটবল সংস্থার অনুমোদন ছাড়া আনুষ্ঠানিক কোনো ম্যাচ খেলা সম্ভব ছিল না। এজন্য শরণাপন্ন হতে হয় প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের। সামছুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের অভিপ্রায়ের কথা জানান। ফুটবল দল গঠনের প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রী লুফে নেন এবং তিনি এ ব্যাপারে সবরকম সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। দল গঠনের জন্য তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কিছু টাকাও বরাদ্দ দেন। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ফুটবল দল গঠনের বিষয়টি বেতারে ঘোষণা দেওয়া হয়। খেলা পরিচালনার জন্য ১৩ জুন গঠিত হয় একটি কমিটি। তবে ফুটবলের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে অন্যান্য খেলাও আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ কারণে গঠিত কমিটির নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। সামছুল হককে সভাপতি ও লুৎফর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে এ কমিটি গঠন করা হয়। প্রাথমিকভাবে ফুটবল দল গঠন করে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত হয়। সমিতির কার্যক্রম আবর্তিত হয় মুজিবনগর সরকারকে কেন্দ্র করে। ফুটবলারদের থাকার ব্যবস্থা করা হয় মূলত ‘কোকাকোলা ম্যানশন’ নামে পরিচিত কলকাতার কারনানি এস্টেট বিল্ডিংয়ে। ফুটবল দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় যোগাযোগ হয় আরেক উদ্যোক্তা আলী ইমামের সঙ্গে। এরপর সম্মিলিতভাবে ফুটবল দল গঠনে খুব বেশি সময় লাগেনি। মোহামেডানের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে ‘বাঙালিপুর রিসেপশন ক্যাম্প’-এ ছিলেন। সিনিয়র ফুটবলার হিসেবে তাঁকে ডেকে এনে অধিনায়ক ও প্রতাপ শংকর হাজরাকে সহ-অধিনায়ক করা হয়। দলের ম্যানেজার হন তানভির মাজহার তান্না।
প্রাথমিক পর্যায়ে কলকাতায় অবস্থানরত ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠনের প্রক্রিয়া চালানো হয়। কিন্তু শুরুতে দল গঠন করা কঠিন হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পজিশনে পর্যাপ্ত ফুটবলার পাওয়া যায়নি। পরে যথাযথ খেলোয়াড় সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত ফুটবলার ছাড়াও আগরতলা থেকেও অনেকে যোগ দেন। এছাড়াও বিভিন্নভাবে আসেন শাহজাহান, সালাহউদ্দিন, লালু, মুজিবুর, শিরু, সাঈদ, সাত্তার, বীরু, সঞ্জীব, খালেক, মোজাম্মেল। সবার প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত দলের সংখ্যা বেশ বড় হয়ে যায়। ফুটবল দলটি যাতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে খেলতে পারে, সেজন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। এজন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচটি হয় নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। প্রথম ম্যাচ খুব ঘটা করে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ দলের সঙ্গে খেলতে হবেÑ এমন কোনো ভাবনা ছিল না। সে মুহূর্তে যারা প্রথমে সাড়া দিয়েছে, তাদের সঙ্গেই পর্যায়ক্রমে খেলার সিদ্ধান্ত হয়। খেলা শুরু করতে পারাটাই ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল ‘নদীয়া জেলা একাদশ’।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ফুটবলের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। নদীয়ায় ম্যাচ শুরুর আগে দলের কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়রা ভারতীয় জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত বাজানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু স্বীকৃত দেশ নয়, এ কারণে নদীয়া জেলা প্রশাসন তাদের অপারগতা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের কর্মকর্তা, খেলোয়াড় ও উপস্থিত দর্শকদের দাবির মুখে শেষ অব্দি তাঁরা সম্মতি দেয়। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নদীয়ার জেলা প্রশাসক ডি কে ঘোষ। স্বাধীন দেশ না হয়েও সেদিন কৃষ্ণনগর মাঠে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং বাজানো হয় বাংলাদেশের প্রস্তাবিত জাতীয় সংগীত। এরপর খেলোয়াড়রা জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন। এ ঘটনা যুদ্ধরত সবাইকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন দেশছাড়া মানুষরা। কলকাতা থেকে বেশ দূরে প্রথম ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হওয়ায় জাতীয় পর্যায়ের পত্র-পত্রিকায় তা তেমনভাবে প্রচার পায়নি। অবশ্য স্থানীয়ভাবে ম্যাচটি দারুণভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। খেলাটি ড্র হয় ২-২ গোলে। কোনো দেশের মুক্তিসংগ্রামে ফুটবল খেলা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সেদিনই সেটা প্রকৃতঅর্থে অনুভূত হয়।
এই দলটি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ১৩টি ম্যাচে অংশ নেয়। খেলার সময় নানান রকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। দ্বিতীয় ম্যাচে মোহনবাগান মাঠে ‘গোষ্ঠ পাল একাদশ’-এর বিপক্ষে খেলাটি ফলাও করে প্রচারিত হয়। বিহারে খেলার আগে বিরূপ আচরণের শিকার হতে হয় খেলোয়াড়দের। মুম্বাইয়ে প্রতিপক্ষ দলে খেলেন খ্যাতিমান ক্রিকেটার নবাব মনসুর আলী খান। প্রতিটি খেলা থেকে অর্জিত অর্থ মুজিবনগর সরকারের তহবিলে জমা দেওয়া হয়।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরাধীন উপমহাদেশের মানুষরা খেলার মাঠে তাঁদেরকে পরাজিত করার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন। কোনোভাবে তাঁদেরকে পরাস্ত করতে পারলে সেটাই বড় বিজয় বলে মনে হয়েছে। কিন্তু ভারতের কোনো দলের সঙ্গে খেলায় জয়-পরাজয়ের বিষয়টি মুখ্য ছিল না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত সরকার। ফুটবল ম্যাচ আয়োজনটা ছিল তারই অংশ। তবে ভারতে ফুটবল ম্যাচ খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি ও প্রচার-প্রচারণা চালানো সম্ভব হয়। এটা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের যে ফুটবল দলটি, সেটি পরবর্তীতে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ১ম সভাপতি মো. সামসুল হক, ২য় সভাপতি আশরাফ আলী চৌধুরী, ৩য় সভাপতি এন এ চৌধুরী (কালু ভাই), সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, কোষাধ্যক্ষ মো. মোহসীন, সদস্য- এম এ হাকিম, এম এ মতিন, গাজী গোলাম মোস্তফা, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, প্রস্তাবক ও সংগঠক সাইদুর রহমান প্যাটেল, কোচ ননী বসাক, ম্যানেজার তানভির মাজহার তান্না। খেলোয়াড় : পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ (সহ-অধিনায়ক), আইনুল, শাহজাহান, কায়কোবাদ, তসলিম, আলী ইমাম, প্যাটেল, আশরাফ, নূরুন্নবী, নওশের, এনায়েত, সালাহউদ্দিন, লালু, অমলেশ, বিমল, হাকিম, খোকন, সুভাষ, লুৎফর, মুজিবুর, শিরু, সাঈদ, পেয়ারা, নিহার, গোবিন্দ, অনিরুদ্ধ, সাত্তার, বীরু, মোমেন, সুরুজ, মাহমুদ, সঞ্জীব, খালেক, মোজাম্মেল। সহযোগিতায় ছিলেন নাজির হোসেন, মঈন সিনহা,  খসরু, আবুল কাশেম, রকিবুল হাসান, অরুন নন্দী, হেমায়েৎ সিদ্দিকী, ও আতাউল হক মল্লিক।
লেখকের প্রকাশিতব্য ‘খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।
(২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।) 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বকাপ ফুটবল কেন বাংলাদেশের উৎসব? / দুলাল মাহমুদ

আমার সাঁতার জীবন-অরুন নন্দী