আমার সাঁতার জীবন-অরুন নন্দী

অনুলিখন-দুলাল মাহমুদ

এক.
আমি যে গ্রামটিতে জন্মেছি, তার চার পাশে জল আর জল। মায়ের পেটের জল ভেঙ্গে আমি এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জল যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। এটা হয়ে যায় আমার বিধির লিখন। আমি জড়িয়ে পড়ি এর আষ্টেপৃষ্ঠে। এই গ্রহের তিন ভাগের দুই ভাগ জল। কত শক্তি যে সঞ্চিত আছে এই জলভাগে! জল থেকেই তো পৃথিবীর সৃষ্টি। চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণের মতো বোধকরি এই জলদেবতার আছে অলৌকিক এক ক্ষমতা। আমার কেন জানি মনে হয়, যারা সাঁতারু হিসেবে বেড়ে ওঠেন, সম্ভবত তাদের প্রতি জলদেবতার আছে প্রচ্ছন্ন এক আশীর্বাদ। মায়ের পেটে থাকতেই বোধকরি আমি জলদেবতার সেই আশীর্বাদ পেয়ে যাই।
চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী গ্রামে আমার জন্ম। শৈশবের কত স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে এ গ্রামটির সঙ্গে! আমার বুকে সাঁতারু হওয়ার স্বপ্নের বীজ বপন করে দেয় আমার প্রিয় এই গ্রামটি। এমন একটি গ্রামে জন্ম নেয়ায় এর কাছে আমার অশেষ ঋণ। আমি যেখানেই যাই, যত দূরে যাই না কেন, আমার অন্তরজুড়ে থাকে ছায়াঘেরা, পাখিডাকা অমলিন এই গ্রামখানি। এ জীবনে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। মেঘে মেঘে বেলা তো কম হলো না। সেই ১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর এই ধরণীতে এসেছি। বাবা কুমুদ বন্ধু নন্দী। তিনি পাটের ব্যবসা করতেন। মা কিরণ বালা নন্দী। আমরা চার ভাই, তিন বোন। সবার মাঝে আমার অবস্থান চতুর্থ। আমি ছিলাম দুরন্ত প্রকৃতির। সারাক্ষণ ছোটাছুটি করতাম। বাড়ির পাশেই ছিল পুকুর। গ্রামের ছেলেমেয়েরা তো হাঁটতেই শেখার আগেই সাঁতার শেখে। সাঁতারটাই তাদের কাছে প্রধান বিনোদন। আমার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। খুব অল্প বয়সে সাঁতার আমাকে আকর্ষণ করতে থাকে। পুকুর, খাল ও নদীর প্রতি আমি একটা সহজাত টান অনুভব করি। জলে নামলে আমার বুকে বয়ে যায় মৃদু ছন্দের দোলা। তাতে আমি এক ধরনের সম্মোহন অনুভব করি। আমি কি জলের সন্তান!
১৯৪৭ সাল আমার মানসিক পৃথিবীতে হালকা একটা আঁচড় কেটে যায়। কতই বা তখন বয়স আমার! মাত্র ছয় বছর। সে বয়সে স্বপ্ন দিয়ে সাজানো শৈশবের গ্রামখানির সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের নতুন ঠিকানা হয় চাঁদপুরের কদমতলা। এই পরিবর্তন সূক্ষ্মভাবে হলেও আমাকে কিছুটা অন্তর্মুখী করে তোলে। জলদেবতা হয়ে ওঠে আমার সুখ-দুঃখের সহচর। আমার মনের মধ্যে যত কথা কলকলিয়ে ওঠে, আমি তা ব্যক্ত করি জলদেবতার কাছে। আমাকে এই সুযোগ করে দেয় বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল। এই খালটি আমার আপন হয়ে ওঠে। যখনই সময় ও সুযোগ পেতাম, ঝাঁপিয়ে পড়তাম এই খালে। বিরামহীনভাবে সাঁতার কাটতাম। সাঁতারে আমাকে দীক্ষা দেন আমার বাবা। একদিন তিনি আমাকে প্রায় ঘন্টাখানেক সাঁতারে তালিম দেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি। সেই যে সাঁতার কাটা শুরু করি, আজ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাচ্ছি। শৈশবে আমার সাঁতার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন আমার মেঝ দা শ্রীনিবাস নন্দী মনু, মুকুল কর, সুশীল সাহা প্রমুখ।
চাঁদপুরের পুরান বাজারের মিজি বাড়ির কাছে ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে আমার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। তবে এই স্কুলে খুব বেশিদিন আমার পড়া হয়নি। তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হই পুরান বাজার মধুসূদন হাইস্কুলে। এ স্কুলে সাঁতারের জন্য একটি পুকুর ছিল। বোনাস হিসেবে ছিল ডাইভিং পোস্ট। এমন পরিবেশ পেয়ে সাঁতারের প্রতি আমার উৎসাহ বেড়ে যায়। সৃষ্টি হয় প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব। আমাদের স্কুলে চারটি হাউজ ছিল। জগদীস বসু হাউজ, চিত্তরঞ্জন হাউজ, হাজী মুহসিন হাউজ ও ইকবাল হাউজ। এই চারটি হাউজের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হত। পয়েন্টের ভিত্তিতে নির্ধারিত হত চ্যাম্পিয়ন দল। আমি জগদীশ হাউজের হয়ে সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করার জন্য উন্মুুুখ হয়ে থাকতাম। অ্যাথলেটিক্স করলেও সাঁতারে ছোটদের বিভাগে আমার সাফল্য ছিল অবধারিত।
তবে ১৯৫০ সালের একটি ঘটনা আমার জীবনকে বদলে দেয়। আমাদের বাড়ির কাছে একজন ব্রিটিশ সাহেব থাকতেন। তিনি লেজারাস পাট কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। তিনি কোম্পনির পুকুরে আয়োজন করেন একটি সাঁতার প্রতিযোগিতা। আমি সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হই এবং সাহেব আমাকে পুরস্কার দেন একটি স্বর্ণের মেডেল। এই পুরস্কার যেন আমাকে সাঁতারু হতে উস্কে দেয়। আমার বাড়ির পরিবেশ ছিল খেলাধুলার উপযোগী। ভাইরাও কম-বেশি খেলাধুলা করতেন। ১৯৫২ সালে আমার সেঝ ভাই বরুণ নন্দী মহকুমা আন্তঃস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতায় ছোটদের বিভাগে প্রথম হন। সে বছরই আমরা বাসা পাল্টিয়ে চলে আসি নতুন বাজারে। ভর্তি হই ডিএন হাইস্কুলে। এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খেলাধুলায় আমার অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। সাঁতারের পাশাপাশি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। দৌড়ে আমি মহকুমা আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় বেশ ভালোই করতাম। আমার মেঝ ভাই শ্রীনিবাস নন্দীও দৌড়ে ভালো করতেন। সাঁতারটা ছিল আমার প্রধান ঝোঁক। আমি সে সময় মূলত ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১০০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে অংশ নিতাম। ১৯৫৩-৫৪ সালে আমার সাঁতার-সঙ্গীদের অন্যতম ছিলেন নারায়ণ কুন্ডু। ১৯৬৮-৬৯ সালে তিনি ভারতে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চারটি স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলা জুনিয়র গ্রুপ আন্তঃস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমি কয়েকটি পুরস্কার লাভ করি।
স্কুল পর্যায়েই সাঁতারে আমার একটু-আধটু নাম হতে থাকে। তবে তার পরিসর ছিল চাঁদপুর পর্যন্ত। ১৯৫৬ সালে সুযোগ আসে চাঁদপুরের গ-ি ছাড়িয়ে যাবার। সে বছর আমি ডিএন হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ঢাকায় প্রাদেশিক সাঁতারে অংশ নেয়ার জন্য আমরা চারজন মনোনীত হই। মধুসূদন সাহা, জ্যোতিষ বর্ধন, নৃপেন্দ্র বর্ধন ও আমি। প্রথমবারের মতো ঢাকার সুইমিংপুলে সাঁতার কাটার সৌভাগ্য হয়। এটা আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে। আমরা চারজনই জুনিয়র বিভাগে অংশ নিয়ে পুরস্কার নিয়ে যাই। তখন ঢাকা স্টেডিয়াম সংলগ্ন সুইমিংপুলটি সবে হয়েছে। পুলে কোনো গ্যালারি ছিল না। দাঁড়ানোর খানিকটা জায়গা ছিল। তাতেই দর্শকরা কষ্ট করে সাঁতার দেখতেন। এই সুইমিং প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে আমার প্রথম ঢাকা আসা। এটা ছিল আমার জীবনের একটি আনন্দময় ঘটনা। সে সময় সাঁতারু ব্রজেন দাস, আবদুল মালেক, সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস, সরদার মোহাম্মদ নূরুউদ্দিন প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা তখন সিনিয়র বিভাগে সাঁতার কাটতেন। পরবর্তীকালে এই সাঁতারুরা দেশবরেণ্য সাঁতারু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত মধ্যমদের বিভাগে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে আমি তিনবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হই। ১৯৫৬ সালে আমি প্রথম অংশ নিই দূরপাল্লার সাঁতারে। তাতে আমি দ্বিতীয় হই। প্রথম হন নূর মোহাম্মদ। মহকুমার পাশাপাশি জেলা সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করি। দ্বিতীয় হয় আমারই সহপাঠী সমরেন্দ্র দাস। তিনি পরবর্তীকালে ভারতের একজন জাতীয় সাঁতারু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে জুনিয়র গ্রুপে প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের পরিচয় দেই। এ বছর সংগঠক হিসেবেও আমার দীক্ষা হয়। নিজের পাড়া কদমতলায় আয়োজন করি শিশু ও কিশোর ফুটবল প্রতিযোগিতা।
১৯৫৭ সালে আমি কলকাতা বেড়াতে যাই। তবে সে যাওয়াটায় আমার জন্য নিয়ে আসে নতুন এক অভিজ্ঞতা। আমি কলেজ স্কোয়ারে দু’মাস সাঁতারে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পাই। প্রশিক্ষণ নেয়ার পর বুঝতে পারলাম, এতদিন না জেনে, না বুঝে সাঁতার করেছি এবং সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। এই প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আমি সাঁতারের অনেক নিয়ম-কানুন জানতে পারি। সাঁতারের বিষয়ে বদলে যায় আমার দৃষ্টিভঙ্গি। আন্তঃস্কুল আর জেলা সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আমার নিরঙ্কুশ আধিপত্য। খেলাধুলার ব্যাপারে দারুণভাবে উৎসাহিত করতেন আমাদের স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক ফরিদউল্লাহ। ১৯৫৮ সালে কুমিল্লা জেলা আন্তঃস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হই এবং আমাদের স্কুল চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করে। কলকাতার প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ঞঐঊ ঝঞঅঞঊঝগঅঘ পত্রিকায় এ সংক্রান্ত নিউজ প্রকাশিত হয়। এতে আমার উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। সাঁতারের পাশাপাশি বয়োসোচিত কারণে সে সময় আমার মনে একটু একটু করে উঁকি মারতে থাকে রোমাঞ্চের ফুলকুঁড়ি। চোখে তখন রঙিন স্বপ্ন। চারপাশের সবকিছুকে মনে হয় মধুর। রঙধনু চোখে ১৯৫৮ সালে বাড়ির পাশের বাণী দত্ত নামে একটি মেয়েকে ভালো লেগে যায়। আমরা একই গোত্রেরই ছিলাম। কায়স্থ। তবে তার পরিবার ছিল ধনী। মেয়েটি ছিল সুন্দরী ও চাঁদপুরের মোটামুটি আলোচিত উঠতি গায়িকা। এ কারণে বেশ দেমাগ ছিল। আমাকে পাত্তা দেয়নি। মেয়েটি ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা চলে যায়। এটি আমাকে দহন করে। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, আমাকে একদিন বিখ্যাত হতে হবে। মেয়েটির এমন উপেক্ষার জবাব দিতে হবে। পরবর্তীকালে সেটি বোধকরি আমি পেরেছিলাম।
স্মৃতি সততই সুখের। আবার কখনো-সখনো বড্ড প্রতারকও। এ জীবনে কত সুখ-দুঃখ ও আনন্দের স্মৃতি জড়িয়ে আছে! স্মৃতির জাবর কাটলে মনটা নস্টালজিক হয়ে ওঠে। বুকটা কেমন কেমন করে। মনটা ফিরে ফিরে যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। অথচ কর গুণলে দেখা যায়, দিন-মাস-বছর পেরিয়ে এসেছি বানের জলের মতো। জীবনটাকে তো ডায়েরির পাতার মত সাজিয়ে রাখিনি। যে কারণে অনেক কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। কোনটা আগের, আর কোনটা পরের, অনেক সময় ঠাওর করতে পারি না। স্মৃতিরই বা কি দোষ! বয়স তো আর কম হলো না। মস্তিষ্কের নিউরনের কার্যক্ষমতা বোধকরি ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। তবে হঠাৎ হঠাৎ চলার পথে অনেক পুরনো স্মৃতি মাথার মধ্যে চলকে ওঠে। আবার অতীতের কারো সঙ্গে দেখা হলে অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়। অথচ সবকিছু যখন গুছিয়ে মনে করতে চাই, তখন কেন যেন খেই হারিয়ে ফেলি। জীবনের ধর্ম তো এমনই। অনেক কিছু দেয়, আবার কেড়েও নেয়। তবে আমার এই ‘জলে-ভাসা’ জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। যেটুকু স্মৃতি এখনও সজীব আছে, তাই-ই আমার একাকিত্ব জীবনের বেঁচে থাকার প্রেরণা।

দুই.
১৯৫৭ সালে ব্রজেন দাস নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত দূরপাল্লার সাঁতার শুরু করেন। কিন্তু চাঁদপুরের কাছাকাছি এসে ঝড়ের কারণে সাঁতার শেষ করতে পারেননি। পরের বছর তিনি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে জগতবিখ্যাত সাঁতারু হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। এটা আমায় প্রচ-ভাবে আলোড়িত করে। ব্রজেন দাস হয়ে ওঠেন আমার স্বপ্নের নায়ক। মনে মনে পণ করি, তাঁর মতো সাঁতারু হতে হবে। ভেতরে ভেতরে তারই প্রস্তুতি নিতে থাকি। ডাকাতিয়া নদীতে এক মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমি প্রথম হই। তবে ১৯৫৯ সালটা আমার সাঁতার জীবনের জন্য একটা মাইলফলক। এ বছর আমি ভর্তি হই চাঁদপুর কলেজে। আমার কৃতিত্বে আন্তঃকলেজ প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১৪ পয়েন্ট পেয়ে চাঁদপুর কলেজ রানার্স-আপ হয়। তবে আমার বুকের মাঝে তোলপাড় করতে থাকেন ব্রজেন দাস। ব্রজেন দাসের মতো সাঁতারু হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে আমি অবিরাম সাঁতার কেটে মাইলফলক গড়ার পরিকল্পনা করি। আর আমার এই চমকপ্রদ পরিকল্পনা করার কথা জেনে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে এগিয়ে আসেন অনেকেই। মনে পড়ছে বাবু চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরী, বাবু অজিত দে, বন্ধু সুকোমল রায় চৌধুরী, পেয়ারু প্রমুখের কথা। আয়োজনে এগিয়ে আসেন আমার কলেজের বন্ধু-বান্ধবরা। এছাড়া এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পানু ঘোষ, কাজল দি, রুনু দি, দীনেশ দা, রামকৃষ্ণ বানটা, সাধু ওয়াস্তি, গোবিন্দ দা, ডা: নূরুর রহমান, ডা: আমিন আহম্মদ, ডা: গাঙ্গুলী, ডা: শহীদুল্লাহ, বাবু বিষ্ণু পাল, রমেশ পোদ্দার, বাবু বিনোদ বিহারী দত্ত, ডা: অবিনাশ দে, অমিত দে, হিমাংশু দাস, হিমাংশু চৌধুরী, গণেশ চৌধুরী, রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। চাঁদপুরের জোড়পুকুর পাড়ে ১৯৫৯ সালের ২২ আগস্ট সাঁতার আয়োজনের তারিখ নির্ধারিত হয়। এ সাঁতারকে কেন্দ্র করে আলোড়ন সৃষ্টি হয় চাঁদপুরে। আমার সাঁতার উপলক্ষে চাঁদপুরের সব স্কুল ও কলেজ ছুটি দেয়া হয়েছিল। পুরো শহর যেন ভেঙ্গে পড়ে জোড়পুকুর পাড়ে। আমাকে ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে গলায় মালা পরিয়ে আনা হয়। এতে আমার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। রাত ১১টায় শুরু করি সাঁতার। লাইটের মালা গেঁথে জোড়পুকুরকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়। চারপাশ হেসে ওঠে আলোয় আলোয়। সাঁতারের উদ্বোধন ঘোষণা করেন চাঁদপুর কলেজের অধ্যাপক মোহাম্মদ উল্লা। পরবর্তীকালে তিনি হন নোয়াখালী কলেজের অধ্যক্ষ। সারা রাত অগণিত দর্শক ও বন্ধু-বান্ধব আমাকে উৎসাহ জুগিয়ে চলেন। লাইফ সেভাররাও আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। সকালবেলা দেখি চারপাশে লোকে লোকারণ্য। টানা ১৪ ঘন্টা সাঁতার কাটার পর আমাকে থামার ইঙ্গিত দেন আমার কলেজের অধ্যক্ষ এ ডব্লিউ খান চৌধুরী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক শফিউর রহমান, অধ্যাপক শৈলেন রায়, অধ্যাপক মতিউর রহমান, অধ্যাপক সাহাদাৎ হোসেন (নসু), অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক সরোয়ার হোসেন প্রমুখ। অধ্যক্ষ সাহেব আমাকে পুকুর থেকে তুলে আনার জন্য জলে নামেন। সে সময়ের ছোট্ট মফস্বল শহরে এটি হয়ে ওঠে আলোচনার খোরাক। পুকুরে সাঁতার কাটলেও তা গর্জন তোলে সাগরের। আমি জনপ্রিয়তার টেউয়ে ভাসতে থাকি। ডিএন হাইস্কুল, মধুসূদন হাইস্কুল, জুবিলী হাইস্কুল, চাঁদপুর কলেজ, মাতৃপীঠ গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল, লেডী প্রতিমা মিত্র গার্লস হাইস্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আমাকে পুরস্কৃত ও সংবর্ধনা প্রদান করেন। মেয়েদের কাছে আমি হয়ে উঠি হট ফেভারিট। অনেক মেয়ে আমাকে ফুল দিয়ে, চিঠি দিয়ে তাদের ভালোবাসা জানায়। চাঁদপুর কলেজের মেয়েরা তাদের কমনরুমে আমাকে সংবর্ধনা প্রদানের উদ্যোগ নেয়। আমি লজ্জায় সেখানে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করি। কিন্তু মেয়েরা পিয়ন দিয়ে আমাকে একপ্রকার জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তারা আমাকে একটি ঘড়ি উপহার দেয়। ১৯৫৯ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লার আমোদ পত্রিকায় ‘অরুন কুমার নন্দীর ১৪ ঘন্টা সাঁতার’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ঃ ‘স্থানীয় জোর পুকুরে চাঁদ পুরের বিখ্যাত সাঁতারু অরুন কুমার নন্দী অবিরাম ১৪ ঘন্টা সাঁতার কাটিয়া এক বিরাট সাফল্য অর্জন করিয়াছে। চাঁদপুর কলেজের ছাত্রদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এই সাঁতার অনুষ্ঠিত হয়। নন্দী ১৪ ঘন্টাব্যাপী সাঁতার কাটিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তাহার সমপাটি বন্ধুরা এই সাঁতার প্রতিযোগিতার পুরোভাগে সক্রিয় সাহায্য করেন শহরে নন্দীর ১৪ ঘঃ ব্যপি সাঁতার কাটিবার কথা ঘোষণা করিলে জনসাধারনের মনে এক নব জাগরণের সৃষ্টি হয় ২২ আগষ্ট সন্ধ্যা হইতে জোর পুকুরের চারি পাড়ে লোকে লোকারন্য হইয়া যায়। এমন কি বিপুল সংখ্যক মহিলাও ইহা উপভোগ করিবার জন্য উপস্থিত ছিল। পুকুরের চারি পাড়ে আলোকিত করা হয়। ঠিক ১১ - ২০ মিঃ চাঁদ পুর কলেজের অধ্যাপক মৌ: এ কে, এম, মাহামুদ্দলা সাহেব আনুষ্ঠানিক ভাবে সাঁতারের উদ্ভোদণ করেন। এবং দর্শকের বিপুল করতালীতে মিঃ নন্দীকে রাত্রি ঠিক ১১।। টায় পুকুরে অবতরন করে। হাসান আলী হাই স্কুলের ছাত্র দুলালও নন্দীর সংগী হইয়াছিলেন। কিন্তু সে মাত্র ৩ । ৪ ঘন্টা থাকিয়া সাঁতার বন্ধ করে। সারারাত্র ধরিয়া অগনিত জনসাধারন এই সাঁতার দেখে। রাত্রের দিগে মহকুমা হেলথ অফিসার এবং দিনের দিগে স্থানীয় ডাক্তার আমিন আহাম্মদ নৌকায় থাকিয়া তত্বাবধান করেন। সকালের দিকে এই সাঁতারের কথা পুনরায় প্রচারিত হইলে বহু সংখ্যক লোককে পল্লী অঞ্চল হইতেও আসিতে দেখা যায়। অগনিত জনসাধারন ঘন্টার পর ঘন্টা ধরিয়া নন্দীকে করতালি দিয়া উৎসাহিত করে। ইহার জন্য স্থানীয় স্কুল ও কলেজ ছুটি দেওয়া হয়। বেলা ১।। ঘটিকায় মিঃ নন্দীকে পুকুর হইতে উঠাইয়া মাল্য ভূষিত করা হয়। ১৪ ঘন্টার পরও সে আরো কয়েক ঘন্টা সাঁতার কাটিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। কিন্তু ডাক্তার তাহাতে মত দেন নাই। স্থানীয় নেতৃত্ব, স্থানীয় লোকজন, তাহার সমপাটি এবং স্থানীয় গার্লস স্কুল হইতে মিঃ নন্দীকে অনেক কিছু পুরষ্কার দেওয়া হয়।’ আসলে এ ঘটনা আমাকে শুধু রাতারাতি পরিচিতিই এনে দেয়নি, বদলে দেয় ভাবনার জগত।
১৯৫৯ সালে চাঁদপুর ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উদ্যোগে তিন মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। ১৯৫৯ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দু’মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। ডাকাতিয়া নদীতে আয়োজন করা হয় এই প্রতিযোগিতা। তাতে অংশ নেই আমরা ২৯ জন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেক পেছনে ফেলে আমি প্রথম হই। চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ এ ডব্লিউ খান চৌধুরীর চেষ্টায় ১৯৫৯ সালে আমি ঢাকায় আন্তঃকলেজ সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ পাই। কলেজ থেকে একা আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ. রহমান হলের পুকুরে। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ২৬টি কলেজ। আমি একাই কয়েকটি ইভেন্টে প্রথম ও দ্বিতীয় হওয়ায় আমার কলেজ রানার্স-আপ হয়। আমার সঙ্গে যাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল, তাদের মধ্যে স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র মোঃ হাতেম, আমিনুদ্দিন প্রমুখের নাম। সে সময় আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন এককালের খ্যাতিমান ফুটবলার ও জগন্নাথ কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক নূর হোসেন। আমি যখন চাঁদপুরে যাই, তখন কলেজের অধ্যক্ষ এ ডব্লিউ খান চৌধুরী অসম্ভব খুশী হন এবং আমার সম্মানে কলেজ একদিন ছুটি ঘোষণা করেন। এতে আমার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। আসলে যে কোনো উৎসাহই আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জুগিয়েছে।
পঞ্চাশের দশকে চাঁদপুর থেকে চাইলেই যখন-তখন ঢাকা আসা সম্ভব ছিল না। সময় একটা ফ্যাক্টর ছিল। লঞ্চে করে আসতে ৭/৮ ঘন্টা লেগে যেত। তাছাড়া টাকা-পয়সার একটা ব্যাপার তো ছিলই। তারপরও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য অনেক কষ্টে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতাম। সব প্রতিকূলতাকে উজিয়ে ছুটে আসতাম প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার নেশায়। ১৯৫৯ সালে প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেই ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের হয়ে। তখন মোহামেডানের সেক্রেটারি ছিলেন কলকাতা মোহামেডানের স্বর্ণযুগের ফুটবলার মোঃ শাহজাহান। তার সক্রিয়তার কথা আমার খুব মনে পড়ে। আমাদের সাঁতার দলের অধিনায়ক ছিলেন কৃতী সাঁতারু আবদুল মালেক। এই মালেক পরবর্তীকালে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতায় খুব একটা ভালো করতে পারিনি। কারণ আমি সাঁতার কাটতাম পুকুর ও নদীতে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হতো সুইমিংপুলে। পুকুর ও নদীতে সাঁতার কাটার সঙ্গে সুইমিংপুলের সাঁতারের অনেক তফাৎ। সেটা সে সময় অনুধাবন করতে পারি। তবে রিলেতে সাফল্য পাই। একটিতে দ্বিতীয় এবং আরেকটিতে তৃতীয় হই। আমার সাঁতার দেখে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন ক্রীড়াব্যক্তিত্ব কাজী আবদুল আলীম ও নূর হোসেন। তাঁরা আমাকে সুইমিংপুলে সাঁতার অভ্যাস করতে বলেন এবং তা করলে আমি ভালো ফলাফল করতে পারবো বলে জানান। তৎকালীন অবস্থায় এটা ছিল অসম্ভব এক ব্যাপার। মফস্বলে ছিল না কোনো সুইমিং পুল। নিয়মিত ঢাকায় এসে সুইমিংপুলে সাঁতার অভ্যাস করার সঙ্গতিও আমার ছিল না। আর এ কারণে মফস্বলের কত সাঁতার প্রতিভা যে অকালে ঝরে গেছে ! এটা ভাবলে এখনও মন খারাপ হয়ে যায়।
১৯৬০ সালের ১৪ আগস্ট আজাদী দিবস উপলক্ষে চাঁদপুরের জোড়পুকুরে ৩০ ঘন্টা সাঁতার কেটেছিলাম। আমি তখন চাঁদপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার সঙ্গে সাঁতার কাটেন চাঁদপুর হাসান আলী হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র হাফেজ আবদুর রউফ। আমি একই পুকুরে এর আগে ১৪ ঘন্টা সাঁতার কাটলেও হাফেজের এটাই ছিল প্রথম অবিরাম সাঁতার। সাঁতার শেষে রাত ১১টায় ডাঙ্গায় উঠলে বিপুলসংখ্যক মানুষ আমাদের অভিনন্দন জানায়। পরে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের পুরস্কৃত করেন মহকুমা হাকিম।

তিন.
১৯৫৯ সালে ঢাকা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ১৫ এপ্রিল তারিখ নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য এ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা সহজ ছিল না। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে চোখ বুলালে খানিকটা হলেও পরিস্থিতি আঁচ করা যাবে। সে সময় প্রকাশিত রিপোর্টটিতে লেখা হয়, ‘পাকিস্তান চ্যানেল ক্রসিং কমিটির সেক্রেটারি জনাব এস এ মোহসিন গতকল্য (শুক্রবার) জানাইয়াছেন যে, প্রস্তাবিত চাঁদপুর-ঢাকা ৪২ মাইল দীর্ঘ দুর পাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা বিভিন্ন নদীর স্রোতের অবস্থা বিবেচনা করিয়া আগামী ১৩ই এপ্রিলের পরিবর্ত্তে ১৫ এপ্রিল প্রত্যুষে চাঁদপুর হইতে শুরু হইবে। আলোচ্য প্রতিযোগিতায় দেশের কৃতি দুর পাল্লার সাঁতারু এম, এ, মালেক সহ নিম্নোক্ত সাঁতারুগণ অংশ গ্রহণ করিবেন ঃ - কেরানীগঞ্জ হইতে গোলাম নবী, চাঁদপুর হইতে অরুণ কুমার নন্দী, নোয়াখালী হইতে আজিজুল হক, কুষ্টিয়া হইতে কানাইলাল শর্মা এবং ঢাকা হইতে নাসিরুদ্দিন আহমেদ ও ওসমান গনি। জনাব মোহসিন অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগিদের ১৩ই এপ্রিল ঢাকায় পৌঁছিবার জন্য নির্দ্দেশ দিয়াছেন। তিনি জানাইয়াছেন, আলোচ্য সাতার আরম্ভের অন্ততঃ ১২ ঘন্টা পূর্ব্বে সাতারুদের লঞ্চযোগে ঢাকা হইতে চাঁদপুর পৌঁছান হইবে। আলোচ্য সাঁতার প্রতিযোগিতাকে সফল করিবার উদ্দেশ্যে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার জনাব আবুল খায়েরকে চেয়ারম্যান করিয়া একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হইয়াছে। সেক্রেটারি আরও জানান, এই বহু প্রতীক্ষিত দীর্ঘ দুরত্ব সাতার প্রতিযোগিতাকে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর ও আকর্ষণীয় করিবার জন্য বহুবিধ ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিটি সাতারুর পশ্চাতে থাকিবে একটি করিয়া লঞ্চ ও বোয়িং বোট, সাহায্যকারী সাতারুদের জন্য থাকিবে স্পীড বোট, ক্রীড়া বার্তা পরিবেশক ও ক্যামেরাম্যানদের জন্য বিশেষ লঞ্চ, লক্ষ্য পথে সাঁতারুদের পথ প্রদর্শন করাইবার জন্য বড় ‘পাইলট বোট’ প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হইয়াছে। ওয়েবলেস, ট্রানমিশন, সী প্লেন, এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য হেলিকপ্টার বিমান ব্যবস্থা করাতে এই সাতারের আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি হইবে বলিয়া তিনি আশা পোষণ করেন। প্রাদেশিক গবর্ণর ও চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার আলোচ্য প্রতিযোগিতা উদ্বোধনের জন্য যথাসময়ে চাঁদপুর যাত্রা করিবেন এবং সাতারের সমাপ্তিতে নারায়ণগঞ্জে বিজয়ী সাতারুদের অভ্যর্থনা জানাইবার জন্য উপস্থিত থাকিবেন বলিয়া আশা করা যাইতেছে।’ কিন্তু সবকিছু জোগাড়যন্ত করা সহজে সম্ভব না হওয়ায় এই দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা আয়োজন বার বার পিছিয়ে যেতে থাকে। এতে করে অন্যরা হতোদ্যম হয়ে পড়লেও আবদুল মালেক ও আমি উদ্যম হারাইনি। এ কারণে আমাদের দু’জনকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৫৯ সালের ৩০ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকে লেখা হয়Ñ ‘টোকিওতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অংশ গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ সাঁতারু আবদুল মালেক ও আন্তঃ কলেজ প্রতিযোগিতায় রাণার্স আপ সাঁতারু অরুণ নন্দী ঢাকা হইতে চাঁদপুর পর্যন্ত দূরপাল্লার সাঁতার দিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। চাঁদপুরের এই তরুণ সাঁতারুদ্বয় আগামী ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে উক্ত অভিযানে অংশ গ্রহণ করিবেন বলিয়া জানা গিয়াছে। এই উপলক্ষে চাঁদপুরের এস, ডি, ও জনাব সালাহউদ্দিন আহমদ সিএসপি-কে প্রেসিডেন্ট ও আলহাজ্ব আবদুস সালামকে সেক্রেটারি করিয়া একটি কমিটি গঠিত হইয়াছে। এ ব্যাপারে চ্যানেল ক্রসিং কমিটির প্রখ্যাত কোচ জনাব মোহাম্মদ আলীর সাহায্য পাওয়া যাইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে।’ শেষ পর্যন্ত ঢাকা-চাঁদপুর দূরপাল্লার সাঁতার আয়োজিত হয় ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় সর্বসাকুল্যে দু’জনÑ আবদুল মালেক ও আমি। তখন চাঁদপুরের এসডিও সালাহউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) সেক্রেটারি করে সাঁতার কমিটি গঠন করা হয়। সাঁতার শুরুর আগে আবদুল মালেক ও আমার সঙ্গে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, গনেশ সাহা, পরেশ সাহা, পরেশ পাল প্রমুখ। ৩০ অক্টোবর ভোর সাড়ে চারটায় ঢাকার সদরঘাট থেকে সাঁতার শুরু হয়। এই সাঁতারকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। পথিমধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর দু’তীরের উৎসাহী বিপুলসংখ্যক মানুষ আমাদেরকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন। উৎসাহ আর অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। তবে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, পদ্মা ও মেঘনা অতিক্রম করার সময় আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হই। তবে কোনো বাধাই আমাদের থামিয়ে দিতে পারেনি। আমি অবশ্য চাঁদপুরের কাছাকাছি পর্যন্ত যাই। আবদুল মালেক রাত পৌনে আটটায় চাঁদপুরে পৌঁছান। আবদুল মালেক সময় নেন ১৫ ঘন্টা ১৫ মিনিট। আমাদের বরণ করে নেয়ার জন্য চাঁদপুরে অপেক্ষা করছিলেন হাজার হাজার মানুষ। আমরা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা ফেটে পড়েন উল্লাসে। সে সময় এটি তাদের কাছে বিশ্ব জয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের মাল্যভূষিত করেন। সাঁতারের সময় সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন ডা. শহীদুল্লা, শৈলেন ঘোষ, রুনু দে, গনেন্দ্র কর্মকার, হিমাংশু দাস, আবিদ, কামাল, মন্টু প্রমুখ। এই সাঁতার নিয়ে খুবই পরিশ্রম করেন অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক তাজুল ইসলাম, আবদুল মান্নান লাড়– ভাই, দৈনিক ইত্তেফাক-এর মিজানুর রহমান। চাঁদপুর কলেজে আমাদের সংবর্ধনার আয়োজন করেন প্রফেসর আবু সায়িদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ এ ডব্লিউ খান চৌধুরী। তিনি খুব অভিভূত হয়ে পড়েন। সাঁতার জগতে আমাদের নাম যেন বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েÑ সেই আশীর্বাদ করেন। তার এই আশীর্বাদ আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি বলে মনে হয়েছিল।
দূরপাল্লার সাঁতার কাটা তখন আমার নেশায় পরিণত হয়। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অতিক্রম করার একটা তাড়না আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কেটে জলদেবীর আরাধনা করাটা আমার কাছে জীবনের অংশ হয়ে যায়। সাঁতার করা ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো পিছুটান কিংবা চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তখন আমার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় একটাইÑ দূরপাল্লার সাঁতারে এমন কিছু করতে হবে, যাতে আমি সারা জীবন মানুষের ভালোবাসা পেতে পারি। আমি বড্ড মানুষের ভালোবাসার কাঙাল। তাদের আদর-স্নেহ-ভালোবাসাই আমাকে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
আমার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকায় আমাকে সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দিয়ে চৌমুহনী কলেজ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৬১ সালে আমি ভর্তি হই এই কলেজে। তারা আমার কলেজের হোস্টেলে থাকা-খাওয়াসহ লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ বহন করে। এতে সাঁতারে আমার মনোনিবেশ করতে সুবিধা হয়। কলেজের সেরা সাঁতারু হিসেবে আমি আলাদাভাবে সম্মান পাই। সে বছর চৌমুহনী কলেজে বেশ কয়েকটি সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রায় সবগুলো প্রতিযোগিতায় আমি অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। তবে আমার ইচ্ছা ছিল, আন্তঃকলেজ সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজেকে মেলে ধরা। এজন্য আমি একাগ্রচিত্তে অনুশীলন চালিয়ে যাই। দুর্ভাগ্যক্রমে সে বছর থেকে বন্ধ হয়ে যায় আন্তঃকলেজ সাঁতার প্রতিযোগিতা। তবে অনুশীলনী-পর্বটা একদমই বৃথা যায়নি। চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে আয়োজন করা হয় দূরপাল্লার একটা সাঁতার প্রতিযোগিতা। ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের অনেক মধুর স্মৃতি। এই নদীতে কত সাঁতার কেটেছি! এই নদী আমাকে সাঁতার শিখিয়েছে। অথচ প্রতিযোগিতায় আমার শুরুটা কেন যেন ভালো হলো না। যে কারণে আমি দ্বিতীয় হয়ে যাই। ডাকাতিয়া নদীতে প্রথম না হতে পেরে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে আমার মন খারাপটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ডাকাতিয়া নদীতে আবার আয়োজন করা হয় তিন মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতা। আয়োজন করে চাঁদপুর ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। আগেরবারের ব্যর্থতার গ্লানি মোচনের সুযোগ পেয়ে যাই। অনুশীলনে মন-প্রাণ ঢেলে দেই। এবার যাতে ডাকাতিয়া নদী আমাকে বঞ্চিত না করতে পারে, সেজন্য চেষ্টার কোনো কমতি রাখিনি। এই সাঁতার দেখার জন্য নদীর দু’পাশে ভিড় করে অসংখ্য মানুষ। প্রতিযোগিতা শুরুর পর আমার আর হুঁশ ছিল না। তীব্র গতিতে ছুটতে থাকি। কখন যে তিন মাইল পেরিয়ে যাই, তা টেরই পাইনি। অগণিত ক্রীড়ানুরাগী যখন আমাকে জল থেকে টেনে তোলেন, তখন জানতে পারিÑ আমি প্রথম হয়েছি। সেদিন আমি বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। ডাকাতিয়া নদী আমার সম্মান রক্ষা করেছিল।
১৯৬২ সালের গোড়া থেকে আমি কিছুটা আর্থিক সমস্যায় পড়ি। অর্থনৈতিক সংকট থাকলে কোনো কিছুতেই মনোনিবেশ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সাঁতার কাটা একটা পরিশ্রমের কাজ। সাঁতারের ফলে দেহের যে ক্ষয় হয়, তা পূরণ করতে হলে পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য প্রয়োজন হয়। আর পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য প্রয়োজন অঢেল টাকা। অথচ আমার হাতে কোনো টাকা নেই। আমিও যে হতাশ হয়ে পড়িনি, তা নয়। তবে মনের দৃঢ়তা থাকায় কখনোই হতাশাটা আমাকে কাবু করতে পারেনি। সাঁতার থেকে আমাকে কখনোই দূরে রাখা যায়নি। সমস্যায়, সংকটে সাঁতার অনুশীলন চালিয়ে গেছি। এ সময় অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, সাঁতার দিয়ে কি হবে? সাঁতার তো আর্থিক সমস্যা মেটাতে পারবে না। এর চেয়ে একটা চাকরি কিংবা ব্যবসা করলে অর্থনৈতিক সমস্যা থাকবে না। তারা যে অযৌক্তিক কথা বলতেন, সেটা বলা যাবে না। তারা আসলেই আমার মঙ্গল চাইতেন। কিন্তু আমি যে সাঁতারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি! মানুষ প্রেমে পড়লে হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমারও সেই দশা হয়। এটা তো ঠিক, প্রেমের মরা জলে ডোবে না। তাই বোধ হয় আমি ডুবিনি। সাঁতারকেই অবলম্বন করে জীবনের পথ পাড়ি দিচ্ছি।
চাঁদপুরে আমি ছিলাম রাজার মতো। আমি যখন পথ চলতাম, তখন রাস্তার দু’পাশের বাড়ি-ঘরের দরজা-জানালা খুলে যেত। আমাকে দেখার জন্য সবার মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি লেগে যেত। আসলে সে সময় জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বলতে গেলে তেমন কেউ ছিলেন না। কিছুটা নাম করতে পারলে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যাওয়া যেত। এই যে আমাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল ও ভালোবাসা, সেটা আমার মাথায় পরিয়ে দেয় ‘রাজমুকুট’। অদৃশ্য এই রাজমুকুট আজ অব্দি আমি বহন করে চলেছি। যে কারণে জীবনের অন্য কোনো আকর্ষণ আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। কাউকে আমার পরোয়া করতে হয়নি। স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা মন নিয়ে জীবনযাপন করতে পারছি।
১৯৬২ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৪৫ মাইল দীর্ঘ সাঁতার আয়োজন করা হয়। দূরপাল্লার সাঁতারের নাম শুনলে আমার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। তখন নিজেকে আর স্থির রাখতে পারি না। মাইলের পর মাইল আমি সাঁতার কাটছি, এটা ভাবতেই শরীরে অন্যরকম শিহরণ খেলে যায়। দূরপাল্লার সাঁতার তো এক ধরনের রোমাঞ্চকর অভিযান। তাই এই রোমাঞ্চ থেকে দূরে থাকা মুশকিল। আর যারা একবার এর স্বাদ ও সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাদের মন তো হয়ে ওঠে সুদূরের পিয়াসী। সঙ্গত কারণে আমি মনস্থির করি, নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর দূরপাল্লার সাঁতারে আমি অংশ নেব। তবে এ ধরনের সাঁতারে অংশ নেয়ার জন্য যথেষ্ট অনুশীলন করতে হয়। আমার তখন শূন্য হাত। এজন্য সাহায্য চাইলাম চাঁদপুর ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে। তাতে বিফল হতে হয়। আমার বেলায় চাঁদপুর ক্রীড়া সংস্থার কেন জানি একটা কৃপণতা ছিল। অনুশীলন ছাড়া আমার পক্ষে এই সাঁতারে অংশ নেয়া সম্ভব হয় না। সেদিন আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় আমি কেঁদেছিলাম। মনে হয়েছিল, অর্থটাই জীবনের বড় একটা ব্যাপার। যা হোক, ক্ষণিকের এই ভাবনা মন থেকে তাড়িয়ে দিতে সময় লাগেনি। সাঁতারে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত হলেও এর সঙ্গে সম্পৃত্ত হয়ে পড়ি ঘনিষ্ঠভাবে। অংশগ্রহণকারী সাঁতারু আবদুল মালেকের লাইফ সেভার হিসেবে কাজ করি। সে কারণে আমাকে ১৬/১৭ মাইল সাঁতার দিতে হয়। যাকে বলেÑ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের সাঁতারু অংশ নেন। প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন আবদুল মালেক। মালেক ভাইয়ের এই বিজয় সেদিন নিজের বিজয় বলে মনে হয়েছিল। তাছাড়া লাইফ সেভার হিসেবে কাজ করে আমার বেশ উপকার হয়েছিল। আমি অর্জন করেছিলাম অভিজ্ঞতা। আর এই অভিজ্ঞতা সামনের দিনগুলোতে আমার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
চার.
১৯৬৩ সালে আমি ফের কলকাতায় যাই। কলেজ স্ট্রিটের শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল সুইমিং কাবে ১০ রুপি দিয়ে ভর্তি হই। ট্রেনিং নেই এক মাসের। এই ট্রেনিং নিয়ে আমি শিখতে পারি আধুনিক সাঁতারের কলাকৌশল। সে সময় আমাদের দেশে সাঁতার শেখার কোনো মানসম্মত ব্যবস্থা ছিল না। এদিক দিয়ে কলকাতা আমাদের তুলনায় ঢের ঢের এগিয়ে ছিল। আমার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেয়া নারায়ণ কুন্ডু, সমরেন্দ্র দাস প্রমুখ ভারতের আন্তর্জাতিক সাঁতারু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল কাবের পক্ষ থেকে কাব সুইমিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। রিলেতে প্রথম ও ৪০০ মিটারে দ্বিতীয় হই। বিদেশের মাটিতে এই সাফল্য তখনকার দৃষ্টিকোণ থেকে নেহাত ফেলনা ছিল না। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াবিদদের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন ছিল অনেকটা রুদ্ধ। অল্প কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের সুযোগ সহজে মিলতো না। আর আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের সাফল্য পাওয়াটা ছিল অনেকটা সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ঘটনা। প্রতিবেশী দেশ হলেও কলকাতা আমাদের কাছে বিদেশ। আলাদা সীমানা। আলাদা পাসপোর্ট। তাই বিদেশের মাটিতে সাফল্য পেয়ে আমি আনন্দিত হই। কলকাতাকে মনে হতে থাকে আনন্দনগরী। সেবার কলকাতাকে খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়। নানা কিছু ঘুরে-ফিরে দেখি। সাঁতারের বাইরে জীবনে যে আরো কিছু দেখার আছে, সেবার সেই উপলব্ধিটুকু হয়। আমার জগত আর কতটুকুইবা! পুকুর আর নদী বেঁধে রাখে আমার দৃষ্টির সীমানা। এর বাইরে তাকানোর আর অবকাশ কোথায়? তারপর কখনো কখনো মনটা উচাটন করে ওঠে। তখন দৃষ্টিটাকে ভাসিয়ে দেই দূরে। তবে কখনো কখনো হাঁপিয়ে উঠলে কলকাতা আমার জীবনে ফুসফুসের কাজ করে।
১৯৬৪ সাল থেকে আমার জীবনে উড়াউড়ি করতে থাকে একটা কালো মেঘ। বুঝতে পারি সংখ্যালঘু হওয়ার কষ্ট ও যন্ত্রণা। এ মাটির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন শিকড়টা আলগা হয়ে যেতে থাকে। এ বছরের জানুয়ারিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটলে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় আমার হৃদয়। দেশভাগের পর ভারতের বিহার থেকে আসা কিছু সংখ্যক দুর্বৃত্ত সবুজ-শ্যামল এই বাংলার মাটিতে পুঁতে দেয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। তাদেরই ইন্ধন ও সক্রিয়তায় নারায়ণগঞ্জে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ঘটে হতাহতের নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। তাতে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। পরিবারের সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন কলকাতায়। কিন্তু পরিবারের অনেক অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও আমি দেশে রয়ে যাই। এই মাটি, এই মাতৃভূমি তো আমার। একে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? এই অনুভূতি আমাকে দেশ ছাড়তে দেয়নি। বিপদ মাথায় নিয়েও নিজের সংকল্পে অটুট থাকি। কদমতলার বাসায় আমি একা হয়ে যাই। এ সময় আমাদের বাসায় উঠেন সাঁতারু আবদুল মালেক। তাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। চাঁদপুরের তরপছন্দি তার বাড়ি। সেই সময় তিনি ছিলেন বিখ্যাত সাঁতারু। ১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি সাঁতারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ব্লু’ অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে টোকিওতে এশিয়ান গেমসে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি ৪০০ ও ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেন। ইতালির ভূমধ্যসাগরীয় নীল জলাশয়ের দ্বীপ থেকে সমুদ্র সৈকত নেপলস পর্যন্ত এবং খরস্রোতা উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ হিমশীতল ইংলিশ চ্যানেলে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সিনিয়র হলেও তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মত। আমরা একসঙ্গে অনুশীলন করতাম। কিছুদিন পর তিনি চলে যান। আবার আমি সঙ্গীহীন হয়ে পড়ি। একদিন ১০/১২ জন লোক এসে আমাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলে। আমি ভয় পেয়ে যাই। বিষ্ণুপাল ছিলেন আমার পরিচিত। তিনি ছিলেন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি। ডিএন হাইস্কুলের সেক্রেটারি এবং মাতৃপীঠ গার্লস স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সবকিছু নিয়ে তার বাসায় উঠি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এটা ছিল আমার ঠিকানা। এ সময় আমি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে অংশ নেই।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান চ্যানেল ক্রসিং কমিটি চাঁদপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৪২ মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন আবদুল মালেক, গোলাম নবী, ওসমান গণি, আশিকুর রহমান ও আমি। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে আমি নতুন জীবন ফিরে পাই। জীবনের একদম শুরুতেই জলের সঙ্গে মিতালী গড়ে উঠলেও সেদিন জলের শক্তি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। দিনটি ছিল ১৪ কি ১৫ এপ্রিল। সন্ধ্যার সময় আমরা যখন চাঁদপুর থেকে নদীতে ঝাঁপ দেই, তখন আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। কেমন যেন থম-মারা ভাব। মাইল দুয়েক যাবার পর বাতাসের বেগ বেড়ে যায়। ঘন্টাখানেক পর ঘূর্ণিঝড় ভয়ালরূপে চাঁদপুরে আঘাত করে। ১০ মাইল যাবার পর আমরা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ি। আশিকুর রহমান ও ওসমান গণি নদী থেকে উঠে যেতে বাধ্য হন। আবদুল মালেক সাঁতার চালিয়ে যাবার ধণুর্ভঙ্গ পণ করেন। আসলে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের যাদের নিত্য বসবাস, তাদের কাছে প্রকৃতির রুদ্ররূপ খুব একটা অপরিচিত নয়। এ কারণে জলে নামার সময় আমাদের কাছে কোনো বাধাই বাধা মনে হয় না। কিন্তু সেদিন ছিল একদম অন্যরকম। মৃত্যুর মতো নেমে আসা অন্ধকারে কোনো কিছু ঠাওর করতে না পেরে গোলাম নবী ও আমার সঙ্গে সবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে আমি হয়ে যাই একা। মৃত্যু যেন আমাকে টেনে নিতে থাকে অতল সাগরে। আমি তখন জীবন-মৃত্যুর দোলায় দুলছি। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমার তখন আর কিছু করার ছিল না। সেদিন আমি দেখেছিলাম প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি। ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি কতটুকু তা বলে বোঝানো যাবে না। যাদের বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা আছে, তারা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন এর প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসলীলা। আর মাঝ নদীতে দূরপাল্লার সাঁতার কাটার সময় এর মহাপরাক্রম আমি খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি। জল আর বাতাসের সমন্বয়ে এক অলৌকিক শক্তি যেন এই ভূপৃষ্ঠকে লন্ডভন্ড করে দেয়ার জন্য বিপুল বিক্রমে তড়পাতে থাকে। আমি তো তার কাছে পিপীলিকাসম অসহায় এক জীব। জলোচ্ছ্বাস আমাকে নিয়ে যেন পুতুল খেলা খেলতে থাকে। ঘূর্ণিপাক আর আছাড় খেতে খেতে কখন যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন চোখ মেলি, তখন নিজেকে দেখতে পাই হাসপাতালের শয্যায়। সেদিন আসলে আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসি। জলের সন্তান হওয়ায় বিধাতা বুঝিবা আমার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেননি। ১৯৬৪ সালের ১৬ এপ্রিলের ইংরেজি দৈনিক গঙজঘওঘএ ঘঊডঝ-এর রিপোর্ট পাঠ করলে সেদিনের দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও আঁচ করা যাবে।
ঘঙজ’ডঊঝঞঊজ ঋঙজঈঊঝ ঝডওগগঊজঝ ঞঙ ডওঞঐউজঅড-ঈঐঅঘউচটজ-ঘঅজঅণঅঘএঅঘঔ জঅঈঊ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয় : অৎঁহ কঁসধৎ ঘধহফু, যিড় ধষড়হম রিঃয ভড়ঁৎ ড়ঃযবৎ ংরিসসবৎং ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ারহপব ংঃধৎঃবফ ঃযরং বাবহরহম ৪২ সরষব ঁঢ়-ংঃৎবধস ংরিসসরহম ৎধপব ধহফ ধিং সরংংরহম রহ ঃযব ৎরাবৎ গবমযহধ ধিং ধৎড়ঁহফ ধঃ ১ ধ.স. হবধৎ চযড়ড়ষঢ়ঁৎ, ধনড়ঁঃ ঃযৎবব সরষবং ড়ভভ ঈযধহফঢ়ঁৎ.
ঊধৎষরবৎ, রহ ঃযব বাবহরহম, ভরাব ংরিসসবৎং, অৎঁহ কঁসধৎ ঘধহফু, অনফঁষ গধষবশ, এযঁষধস ঘধনর, ঙংসধহ এযধহর ধহফ অংযবয়ঁৎ জধযসধহ লঁসঢ়বফ রহঃড় ঃযব ৎরাবৎ ঃড় ংঃধৎঃ ঃযবরৎ ৪২-সরষব ৎধপব ভৎড়স ঈযধহফঢ়ঁৎ ঃড় ঘধৎধুধহমধহল রহ ধ ফঁষষ ধহফ পষড়ঁফু বিধঃযবৎ. ঝঃৎড়হম রিহফ ংঃধৎঃবফ নষড়রিহম ধং ঃযব ংরিসসবৎং যধফ পড়াবৎবফ ধনড়ঁঃ ধ পড়ঁঢ়ষব ড়ভ সরষবং.
ঙহব যড়ঁৎ ধভঃবৎ ঃযব ংঃধৎঃ ধ ংবাবৎব হড়ৎ’বিংঃবৎ ষধংযবফ ঈযধহফঢ়ঁৎ ধহফ ঃযব ংরিসসবৎং বিৎব ভড়ৎপবফ ঃড় ধনধহফড়হ ঃযব ৎধপব. অংযবয়ঁৎ জধযসধহ ধহফ ঙংসধহ এযধহর রহ ঃযধঃ ড়ৎফবৎ বিৎব ঢ়ঁষষবফ ড়ঁঃ ড়ভ ধিঃবৎ, নঁঃ গধষবশ ৎবভঁংবফ ঃড় রিঃযফৎধ.ি ঞযবৎব বিৎব হড় ঃৎধপবং ভড়ৎ এযঁষধস ঘধনর ধহফ ঘধহফু.
ঞরষষ ধনড়ঁঃ ঃড়ি যড়ঁৎং ধষষ পড়হঃধপঃং রিঃয ঃযব ংরিসসবৎং বিৎব ষড়ংঃ. ডরৎবষবংং পড়সসঁহরপধঃরড়হ ভধরষবফ ঃড় নব রহ ঃড়ঁপয রিঃয ঃযব সড়ঃড়ৎ নড়ধঃং যিরপয বিৎব ভড়ষষড়রিহম ঃযবস. অঃ ১০ ঢ়.স., গধষবশ ধিং ভড়ঁহফ ভষড়ধঃরহম ধনড়ঁঃ ঃড়ি ধহফ যধষভ সরষবং ড়ভভ ঈযধহফঢ়ঁৎ ধহফ ধিং ৎঁংযবফ ঃড় ঈযধহফঢ়ঁৎ ঐড়ংঢ়রঃধষ. এযঁষধস ঘধনর ধিং ভড়ঁহফ ধঃ ১১-১৫ ঢ়.স. ধহফ ধিং ধষংড় ঃধশবহ ঃড় যড়ংঢ়রঃধষ ভড়ৎ ঃৎবধঃসবহঃ.
ইধফ বিধঃযবৎ পড়হফরঃরড়হ ৎবফঁপবফ ারংরনরষরঃু ঃড় ধষসড়ংঃ হরষ. ঘবাবৎঃযবষবংং ারমড়ৎড়ঁং ংবধৎপয ধিং সধফব ভড়ৎ ঘধহফু, যিড় ধিং ভড়ঁহফ ধঃ ১ ধ.স. ধষড়হম রিঃয ঃড়ি ঋরৎব ঝবৎারপব ঢ়বৎংড়হহবষ. ঞযবু ধষষ বিৎব ঃধশবহ ঃড় ঈযধহফঢ়ঁৎ যড়ংঢ়রঃধষ.
চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ দূরপাল্লার সাঁতার প- হওয়ার পর ১৯৬৪ সালের ৯ জুন চাঁদপুর নিউ রোড লেকে ২০ ঘন্টার সাঁতার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। পাকিস্তানের গৌরব ব্রজেন দাসের স্থির আবদ্ধ জলে প্রতিষ্ঠিত ২০ ঘন্টায় ৩৪ মাইল ১৫০০ মিটার সাঁতারে রেকর্ড ভাঙ্গার জন্যই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। এ সাঁতার উপলক্ষে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এর আয়োজক ছিলেন কনভেনশন মুসলিম লীগের জেলা সভাপতি ও চাঁদপুর সাঁতার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আয়েত আলী ভূঞা, ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা মাখন সাহা, ব্যবসায়ী জগদ্বন্ধু সাহা, ক্ষিতিশ সাহা, অমূল্য সাহা, শেখ মতি প্রমুখ। এসডিও এই আয়োজনের পেছনে ছিলেন। বিকেল চারটায় আকর্ষণীয় এই সাঁতার প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন কুমিল্লা জেলার ডেপুটি কমিশনার হাসান নবাব সিএসপি। ছিল জমকালো আলোকসজ্জা ও মিউজিক। প্রতিযোগিতায় আবদুল মালেক ৩৫ মাইল সাঁতার কেটে প্রথম হন এবং আমি ৩০ মাইল সাঁতার কাটি। ১০ জুন দুপুরে সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহকুমা হাকিম ও চাঁদপুর সাঁতার সমিতির প্রেসিডেন্ট মোঃ নূরুল কাদের খান। স্থানীয়ভাবে ও চাঁদপুর কলেজে আমাদেরকে বিরাট সংবর্ধনা দেয়া হয়।
১৯৬৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর দূরপাল্লার সাঁতার হয়। এই সাঁতারে অংশ নেয়ার জন্য আমাকে সহযোগিতা করেন জেলা দুর্নীতি কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ। তিনি আমার অনুশীলনের ব্যয়ভার বহন করেন।


পাঁচ.
জাতীয় পর্যায়ের প্রাদেশিক সাঁতারে অংশ নিতেন মূলত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের সাঁতারুরা। বাইরের জেলা থেকে খুব কম সাঁতারু আসতেন। আমি চাঁদপুর মহকুমার মাধ্যমে অংশ নিতাম। আমাকে কুমিল্লা জেলা থেকে অংশ নিতে বলা হয়। জেলা ও মহকুমা থেকে সাঁতারে অংশগ্রহণের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হতো না। পাওয়া যেত না কোনো টাকা-পয়সা। আসতাম নিজের চেষ্টায়, নিজের পয়সায়। প্রাদেশিক সাঁতারে দু’বার নিজের গরজে অংশ নেই। অর্থের অভাবে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে ফিরে যাই। বুঝতে পারলাম, এভাবে হবে না। আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই। তাই অনেক ভেবে-চিন্তে দূরপাল্লার সাঁতারে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য দেখা করি পাকিস্তান চ্যানেল ক্রসিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এ মোহসিনের সঙ্গে।
১৯৬৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত দূরপাল্লার সাঁতার আয়োজনের তোড়জোড় চলছিল। তিনি আমাকে জানান, এ প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে সাঁতারুরা অংশ নেবেন। তাহলে চাঁদপুর থেকে অংশ নিতে অসুবিধা কোথায়? তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠি। ৪২ মাইলব্যাপী এই সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার কথা ছিল ১৪ জন সাঁতারুর। ঢাকা স্টেডিয়ামে মেডিক্যাল বোর্ড স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদেরকে চূড়ান্ত করে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা জেনে অনেক সাঁতারু প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান। বছরের এ সময় আবহাওয়া দূরপাল্লার সাঁতারের জন্য মোটেও অনুকূলে নয়। আগের বছর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কিছুদূর যাবার পর পরিত্যক্ত হয় চাঁদপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা। বেশ কয়েকজন সাঁতারু ফিরে আসেন মৃত্যুর মুখ থেকে। শেষ অব্দি জীবনের একটা বড় ঝুঁকি নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই ঢাকার আশেকুর রহমান, মোহাম্মদ ওসমান গণি, হেলালউদ্দিন আহমেদ, সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস, চট্টগ্রামের দেলোয়ার হোসেন ও চাঁদপুরের আমি। ২৩ এপ্রিল রাত ১১টা ২৯ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ আইডব্লিউটিএ জেটি ঘাট থেকে আমরা পানিতে ঝাঁপ দেই। দূরপাল্লার সাঁতারের সঙ্গে দুর্যোগের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অবশ্য আয়োজনের সময় এর একটি অন্যতম কারণ। এজন্য যখনই এই সাঁতারে অংশ নেই, তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামনে এসে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। সেদিন ছিল ঝড়ো দখিনা হাওয়া। অশান্ত হয়ে ওঠে নদী। বিশাল বিশাল টেউ এসে আমাদের দুলিয়ে দিয়ে যায়। উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে লড়াই করে চলতে থাকে সাঁতার। কিন্তু এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। প্রচ- ঢেউয়ের সঙ্গে আমাদের মতো দুর্বল মানুষের পক্ষে পেরে ওঠা সহজ নয়। তারপরও প্রথমদিকে আমি ছিলাম এগিয়ে। সময় গড়াতে থাকলে প্রতিযোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করে। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে হার মানেন হেলালউদ্দিন। একজন সঙ্গী উঠে পড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ। বেলা ৫টা ৪৪ মিনিটে অসুস্থ হয়ে পড়েন দেলোয়ার হোসেন। তিনিও উঠে পড়তে বাধ্য হন। একে একে সঙ্গীর সংখ্যা কমতে থাকলে আমরা বাদবাকীরাও যেন ক্রমশ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকি। রাত ৮টায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যান আশেকুর রহমান। এর ১৫ মিনিট পর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে বোটে তুলে নেয়া হয় ওসমান গণিকে। শেষমেশ রয়ে যাই আমি ও সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস। আবহাওয়া চরম আকার ধারণ করলে সাঁতার চালিয়ে যাওয়া সত্যিই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তবুও আমি সাঁতার চালিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আর অগ্রসর হওয়া সমীচীন নয় মনে করে চ্যানেল ক্রসিং কমিটি কেন জানি শুধু আমাকেই এক মাইল আগে উঠিয়ে নেন। ১০টা ৫০ মিনিটে সাঁতার শেষ করে প্রথম হন সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস। এই সাঁতারে অংশ নেয়ার ব্যাপারে আমাকে সহায়তা করেন অজয় ভৌমিক, গনেশ কর্মকার প্রমুখ। এ প্রতিযোগিতার ফলাফলের ভিত্তিতে সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিসকে ইংলিশ চ্যানেল এবং আমাকে ইতালির ক্যাপ্রি থেকে নেপলস ৩৩ মাইল দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ক্যাপ্রি-নেপলস সাঁতার তখন আমাদের কাছে বেশ সুপরিচিত ছিল। এর আগে তাতে অংশ নিয়েছেন ব্রজেন দাস ও আবদুল মালেক। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য অনেক অনুশীলন করি। ব্যয়ও হয় বেশ। ব্যয়টা হয় নিজের গাঁট থেকে। অথচ শেষ পর্যন্ত ইদ্রিস ও আমার অংশ নেয়া হয়নি। বলা হয়, টাকা-পয়সা নেই। টাকা-পয়সা যোগাড় হলে পরে দেখা যাবে। পরবর্তীকালে টাকা-পয়সার যোগাড়-যন্ত্র হলেও আমাদের আর পাঠানো হয়নি। এটা আমার সারা জীবনের আক্ষেপ হয়ে আছে। আমার মনের ছোট্ট কুঠুরিতে সযতনে সাজানো ছিল ব্রজেন দাস ও আবদুল মালেকের মতো ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে যোগ্যতা আমার ছিল। আমাদের দেশে অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দূরপাল্লার সাঁতার কেটেছি। কোনো প্রতিকূলতা আমাকে আটকে রাখতে পারেনি। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে আমার সামনে সুযোগ এসেছিল ক্যাপ্রি-নেপলস সাঁতারে অংশ নেয়ার। এই সুযোগ নষ্ট হওয়ায় আমার বড় ধরনের একটা স্বপ্নভঙ্গ হয়। স্বপ্নভঙ্গের এই বেদনা এখনও বহন করে চলেছি। আসলে সামাজিক অবস্থান শক্ত না হলে কোথাও পাত্তা পাওয়া যায় না। ব্রজেন দাস, আবদুল মালেকরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছেন। আমার অন্তত সে সুযোগ ছিল না। এই ঢাকা শহরে আমি ছিলাম নেহাত অনাহূত। আর্থিক টানাপড়েন তো ছিলই, সে সঙ্গে কারো সুদৃষ্টি পাইনি। আমি কোনো মই পাইনি। আমাকে কেউ টেনেও তোলেননি। যা করেছি, যতটুকু করতে পেরেছি নিজের চেষ্টায়। কত প্রতিকূলতাকে উজিয়ে স্রোতের বিপক্ষে সাঁতার কেটেছি, সে শুধু আমিই জানি। তবে কখনো হতোদ্যম হইনি। ভেঙ্গে পড়িনি। অফুরন্ত মনোবল নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছি। কখনো জিতেছি, কখনো হেরেছি। আসলে হার-জিত নিয়েই তো জীবন। এই দার্শনিক বোধটুকু আমি খুব অল্প বয়সেই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি। যে কারণে পেরেছি জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে। আমি সীমিত গ-ির মধ্যেই আমার আকাশটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি।
ক্যাপ্রি-নেপলস যেতে না পারলেও আমার উৎসাহে কোনো ভাটা পড়েনি। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান চ্যানেল ক্রসিং কমিটি আয়োজন করে দাউদকান্দি-নারায়ণগঞ্জ ৩৫ মাইলব্যাপী দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হই নারায়ণগঞ্জের সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস, ঢাকার আশেকুর রহমান, কুষ্টিয়ার কানাই লাল শর্মা, ঢাকার ওসমান গণি ও আমি। সাঁতারুদের পথ-প্রদর্শন ও দেখাশোনার জন্য সাঁতটি লঞ্চ ও বেশ কয়েকটি দেশী নৌকার ব্যবস্থা করা হয়। সাঁতারুদের খবরা-খবর আদান-প্রদানের জন্য প্রত্যেক লঞ্চের সঙ্গে ঢাকার বেতার যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়। ৯ এপ্রিল শুরু হয় এই প্রতিযোগিতা। রাত সাড়ে ১০টায় প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন কুমিল্লার এডিসি এস হাসান আহমদ। সাঁতারুদের দেয়া হয় বিশেষ সংবর্ধনা। বাদ্য-যন্ত্রসহ উপস্থিত ছিলেন কয়েক হাজার ক্রীড়ানুরাগী। তারা নানাভাবে উৎসাহিত করেন সাঁতারুদের। মেঘনা নদীর উত্তাল তরঙ্গের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাঁতার কাটার জন্য প্রয়োজন অসম্ভব দৃঢ়চেতা মনোবল। দুরূহ এই পথ পাড়ি দেয়ার জন্য থাকতে হয় অদম্য জীবনীশক্তি। সকাল বেলাই ছিটকে পড়েন দু’জন প্রতিযোগী। ভোর সাড়ে ৪টায় ওসমান গণি ও সকাল সাড়ে ৯টায় আশেকুর রহমান হাল ছেড়ে দেন। হাল ছাড়িনি আমরা তিন সাঁতারু। তিনজনই পৌঁছে যাই গন্তব্যে। প্রথম হন সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস। সময় নেন ১৫ ঘন্টা ৩০ মিনিট। ১৬ ঘন্টা ৩২ মিনিট সময় নিয়ে দ্বিতীয় হই আমি। ১৬ ঘন্টা ৪০ মিনিট সময় নিয়ে তৃতীয় হন কানাই লাল শর্মা। কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে ও কানাই লাল শর্মাকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য ভর্তি করা হয় নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে। সাঁতার শেষ করার পর হাজার হাজার মানুষ আমাদের অভিনন্দিত করে। উপস্থিত ছিলেন ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী ব্রজেন দাস, পাকিস্তান চ্যানেল ক্রসিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এ মোহসিন, নারায়ণগঞ্জের এসডিও জনাব ইসলাম প্রমুখ। আমাদেরকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এরপর কুমিল্লা ও চাঁদপুরে অংশ নেই যথাক্রমে ৩ ও ২ মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায়।
দূরপাল্লার সাঁতারে নিয়মিত অংশ নিলেও স্বল্পপাল্লার সাঁতারেও আমার অংশ নেয়ার ইচ্ছে ও আগ্রহ ছিল। কিন্তু তার জন্য ট্রেনিং ও আসা-যাওয়ার জন্য কোনো খরচ দেয়া হয় না। আমি তো চাকরি করতাম না। যে কারণে আর্থিক সমস্যা ছিল। চাঁদপুর থেকে ঢাকায় গিয়ে নিয়মিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমার পক্ষে অংশ নেয়ার সামর্থ্য ছিল না। যে কারণে একবুক অভিমান নিয়ে স্বল্পপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াই। তখন চিন্তা করলাম সাঁতার আমার জীবন। সাঁতারে সঁপে দিয়েছি আমার মন-প্রাণ। সাঁতার থেকে দূরে থাকতে পারবো না। তবে এমন কিছু করতে হবে, যাতে মানুষের মনে দাগ কাটতে সক্ষম হয়। এমন এক চিন্তা থেকে শুরু করি অবিরাম সাঁতার। পালাবদল ঘটে আমার সাঁতার জীবনে। অবিরাম সাঁতার হয়ে ওঠে আমার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা।
আমার এই নতুন পথচলা শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। ফরিদপুরের একটি পুকুরে আয়োজন করা হয় অবিরাম সাঁতার প্রতিযোগিতা। জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত এই সাঁতারে অংশ নেয়ার জন্য নিয়ে যান আমার পূর্বপরিচিত ডিসি এস এ সামাদ ও এডিসি নাসিরউদ্দিন সাহেব। স্থির পানিতে ১২ ঘন্টা একটানা সাঁতার কাটি। তাতে ১৪ মাইলের মতো সাঁতার কাটা হয়ে যায়। এই সাঁতার ফরিদপুরে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সে সময় ফরিদপুরে পরিচয় হয় হালের দুই জনপ্রিয় অভিনেতা পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার অনুজ মানস বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
এরপর অবিরাম সাঁতারে বেশ সাড়া পড়ে যায়। একের পর এক আমন্ত্রণ পেতে থাকি অবিরাম সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য। ১৯৬৮ সালে চাঁদপুরে ৫৩ ঘন্টা, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কুমিল্লায় ৫৮ ঘন্টা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫৩ ঘন্টা সাঁতার কেটেছি। অধিকাংশ জেলায় এর আগে অবিরাম সাঁতার হয়নি। সবার কাছেই এটি নতুন কিছু মনে হয়েছে। নির্দিষ্ট একটি স্থানে ঘন্টার ঘন্টা সাঁতার কাটাটা নতুন ধরনের এক বিনোদন হয়ে দেখা দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপি ছিলেন ওসমান সাহেব। তার ছেলেকে সাঁতার শেখাতাম। এ কারণে তার সঙ্গে আমার একটা হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। সে সময় জমিজমা সংক্রান্ত এক ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে আমার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অবশ্য বেশিক্ষণ কারাগারে রাখা হয়নি। পুলিশের যে দারোগা আমার বাবাকে গ্রেফতার করেন, তাকে শাস্তিস্বরূপ বদলি করে দেন এসপি ওসমান সাহেব। তবে প্রতিপক্ষের অত্যাচারে টিকতে না পেরে বাবা স্থায়ীভাবে চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। এ ঘটনায় মন ভেঙ্গে যায়। তবে সাঁতার চালিয়ে যাই আমি।

ছয়.
দূরপাল্লার ও অবিরাম সাঁতারেই আমি নিজেকে উৎসর্গ করে দেই। অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, এটা তো অলিম্পিক ঘরানার সাঁতার নয়। মূলধারার সাঁতারের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা নেই। এ নিয়ে কেউ কেউ ঘোলা করতে চান জল। আমার অবদানকে রীতিমত অস্বীকার করার জন্য অনেকেই নানাভাবে ঘোট পাকিয়েছেন। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায়-আসে না। আমার সাঁতার জীবনের শুরু থেকেই আমাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেক প্রতিকূলতার। সে সব পাড়ি দিয়ে আমাকে এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে। তবে দূরপাল্লার ও অবিরাম সাঁতার নিয়ে কারো কারো ঈর্ষার কারণ হয়ে ওঠায় এ বিষয়টি নিয়ে কিছুু বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ইংলিশ চ্যানেল তো অলিম্পিক ঘরানার সাঁতার নয়। তাতে কি এর আবেদন ফুরিয়ে যায়? যায় না বলেই ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাসকে নিয়ে ইউরোপে টানাটানি পড়ে যায়। স্বয়ং ইংল্যান্ডের রাণী তার দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে ব্রজেন দাসকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন। এটা কি এমনি এমনি হয়েছে? নিশ্চয়ই এর গুরুত্ব আছে। ব্রজেন দাসের বিস্ময়কর নৈপুণ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই সাঁতারু হয়েছেন। সে সময় তার এই কৃতিত্ব কী যে উন্মাদনা তৈরি করেছিল, তা এখন আর অনুধাবন করা যাবে না! এ অঞ্চলের সাঁতারের ক্ষেত্রে সেটা হয়ে আছে মাইলফলক। আমিও দূরপাল্লার ও অবিরাম সাঁতার কেটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাঁতারে অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। যে এলাকা বা অঞ্চলে সাঁতার কেটেছি, সেখানে আলোড়ন তুলতে পেরেছি। অনেক উৎসাহীকে শিখিয়েছি সাঁতার। এখনও সাঁতার শিখিয়ে চলেছি। এ কথা তো আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমার অনুপ্রেরণা ও প্রশিক্ষণে গড়ে উঠেছে অনেক সাঁতারু। এমনকি যেসব এলাকায় সাঁতারের নাম-গন্ধ ছিল না, সেসব এলাকায় সাঁতার নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বললে হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে, সাঁতারে ব্রজেন দাসের পর অরুন নন্দী নামটি হয়ে ওঠে ব্র্যান্ড নেম। সাঁতার বিষয়ে আলোচনা হলেই অনায়াসে উঠে আসে আমার নাম। যে কারণে আমার উপস্থিতিতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাড়া পরিলক্ষিত হয়। এক জীবনে একজন মানুষ আর কতটা কি করতে পারেন। আমি যতটা পেরেছি করেছি এবং করে চলেছি। সাঁতারটা আমার জীবনের একটা উপাসনা। আমার জীবন থেকে ধর্ম-কর্ম ও সংসার বিসর্জন দিয়েছি। অথচ সাঁতারটাকে কখনোই দূরে ঠেলে দিতে পারিনি। তারপরও সাঁতারে আমার অবদান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে প্রশ্নকারীদের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা ছাড়া আর কীইবা করতে পারি। তবে দূরপাল্লার ও অবিরাম সাঁতারেই আমার অবদান সীমাবদ্ধ নয়। এ ক্ষেত্রে আমি হয়তো ব্যক্তিগতভাবে কৃতিত্ব দেখিয়েছি এবং সাঁতারের প্রসার ও মানোন্নয়নে প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছি। তবে প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে যে অংশ নেইনি তা তো নয়। আন্তঃস্কুল, আন্তঃকলেজ ও প্রাদেশিক সাঁতারেও আমি অংশ নিয়েছি। প্রচলিত এই সাঁতারেও আমি অবদান রেখেছি। তবে যতখানি উজ্জ্বলতা দেখানোর কথা ছিল, ততখানি হয়তো পারিনি। মফস্বলে বসবাস করায় সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে যেটুকু পেরেছি, সেটুকুই করেছি। সে সময় মফস্বল জেলা থেকে ক’জন ক্রীড়াবিদ ঢাকায় এসে টেক্কা মারতে পেরেছেন? দলগত খেলার কথা বাদ দিলে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের খেলায় ঢাকার বাইরের ক্রীড়াবিদদের সাফল্য পাওয়ার সংখ্যা একদমই হাতেগোনা। তার মধ্যেও যে আমার নামটি আলোচনায় উঠে এসেছে, সেটা সম্ভব হয়েছে সাঁতারের প্রতি আমার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কারণে।
অবিরাম সাঁতারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাঁতারের প্রতি আমি ক্রেজ সৃষ্টি করতে সক্ষম হই। ১৯৬৮ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কুমিল্লার রাণীর দীঘিতে অবিরাম সাঁতারের আয়োজন করা হয়। উদ্বোধন করেন কুমিল্লার মহকুমা প্রশাসক জনাব হাফিজউদ্দিন। আমার টার্গেট ছিল ৫৯ ঘন্টা সাঁতার কেটে নতুন মাইলফলক গড়া। কিন্তু ৫৭ ঘন্টা সাঁতার কাটার পর তুমুল বৃষ্টির কারণে আর অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। আমার সঙ্গে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ১৭ ঘন্টা সাঁতার কাটেন দাউদকান্দির আবদুল হামিদ। আমাদের নানাভাবে উৎসাহিত করেন কুমিল্লা কচি-কাঁচার আসরের বারেক সাহেব। মাইকে তার চমৎকার ধারাবিবরণী ছিল সত্যিই প্রেরণাদায়ক। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এই সাঁতার উপভোগ করেন এবং উৎসাহ জোগান। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রধান আবদুস সালাম সিএসপি। আমাদের এই সাঁতার দারুণভাবে সাড়া জাগায়। সংবর্ধনা দেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। মহিলা কলেজ থেকেও সংবর্ধনা দেয়া হয়। মনে পড়ে কুমিল্লা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলাতুন নেছা লিলির কথা। আবেগে আপ্লুত হয়ে এই মেয়েটি তৎকালীন প্রভাবশালী দৈনিক আজাদ পত্রিকায় লেখেন, ‘উৎসাহী জনগণের শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনই যেনো ছিলো অরুণ কুমারের জীবনের পরম পাওয়া। ধন্য হয়েছিলো এই প্রাচীন রাণীর দীঘি, যে দীঘির জল এতোদিন ঘুমিয়ে ছিলো শান্ত হয়ে, সে দীঘির জল যেনো তার আগমনে উছলে উঠেছিলো।’ আসলে সাঁতারের মাধ্যমে কত কত মানুষের মনে দাগ কেটেছিলাম, তার কোনো হিসাব কোথাও নেই। আজ সেসব মানুষ ও স্মৃতি অনেকটাই ধূসর হয়ে পড়েছে। মানুষের এই ভালোবাসাই ছিল আমার চলার পথের পাথেয়। ভালোবাসা তো আর দেখা যায় না। তা কুয়াশার মত সঞ্চিত হয়ে আছে আমার এই বুকে। এটাই আমার বেঁচে থাকার জীয়নকাঠি। যখন নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব আমাকে ঘিরে ফেলে, তখন অতীতের স্মৃতিগুলো আমাকে নতুনভাবে প্রেরণা জোগায়।
সালটা ঠিক মনে নেই। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজন করা হয় মিরপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা। পূর্ব পাকিস্তান অ্যামেচার সুইমিং এসোসিয়েশন আয়োজিত এ প্রতিযোগিতা পরিচালনা করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাঁতারু ব্রজেন দাস। সকাল পৌনে আটটায় আমরা ২২ জন সাঁতারু মিরপুর ব্রিজের কাছ থেকে পানিতে ঝাঁপ দেই। আধা ঘন্টা পর পাঁচজন সরে পড়েন। রোমাঞ্চকর এই সাঁতার প্রতিযোগিতায় অনেক দর্শক নৌকায় করে আমাদের উৎসাহ দেন। আমরা ১৬ জন সদরঘাট আইডব্লিউটিএ ঘাটে পৌঁছাই। ৬ মাইল এই সাঁতার প্রতিযোগিতায় এক ঘন্টা ২২ মিনিট সময় নিয়ে প্রথম হন সাহাবুদ্দিন। এর পরে ছিলেন মহিউদ্দিন, এস এম ইদ্রিস, শরীফুল আলম, এস এম নূরুদ্দীন, নূর আহমেদ নবাব, এ মান্নান, আনিসুর রহমান, আমি, ফজলুল হক, মোঃ সুলতান, জামাল লস্কর, শহীদ উল্লাহ, অমল চৌধুরী রায়, এ লতিফ ও মোবারক হোসেন। সদরঘাট টার্মিনালে আমাদের বরণ করে নেন ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এস এ মহসিন, কে এ সাত্তার, ওবায়দুল কবীর, এ হাসনাত, এম এ জলিল, ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান। খ্যাতিমান সাঁতারুদের টপকে প্রথম হওয়া সাহাবুদ্দিন হঠাৎ চমক দেখালেও এরপর হারিয়ে যান।
১৯৬৯ সালে ফেনীতে ৪৮ ঘন্টা অবিরাম সাঁতার কাটি। ১২ জুলাই বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু করে শেষ করি ১৪ জুলাই বিকেলে। উদ্বোধন করেন মহকুমা প্রশাসক এম এ নূর। এ উপলক্ষে পরিবেশিত হয় জারী গান। আলোকসজ্জা করা হয়। সুরে আর আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ছোট্ট এই শহরটি। প্রায় ২০ হাজার দর্শক এই সাঁতার উপভোগ করেন। আমার সঙ্গে সাঁতারে অংশ নেন স্থানীয় কয়েকজন সাঁতারু। ফেনী এভারগ্রীন কাবের মনু মিয়া ১৮ ঘন্টা, স্থানীয় মোহামেডানের কাশেম ১৭ ঘন্টা, ফেনী কলেজের ছাত্র স্থানীয় মোহামেডানের সামছুর রহমান সামু ১২ ঘন্টা সাঁতার কাটতে সমর্থ হন। সাম্পান ও নৌকা নিয়ে আমাদের উৎসাহ দেয়া হয়। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার আমিনুল হক। ১৯৬৯ সালে আমরা প্রতিষ্ঠা করি চাঁদপুর সুইমিং কাব। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন চাঁদপুরের সাব-ডিভিশনাল অফিসার জনাব জালালউদ্দিন। খেলাধুলার প্রতি তার ছিল অপরিসীম আগ্রহ। আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি। এছাড়া কাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী খাজা আহমেদ, কামরুজ্জামান চৌধুরী, বেলাল, লিয়াকত, কিরণ প্রমুখ। সে বছর এই কাবের হয়ে অংশ নেই প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায়। প্রাদেশিক সাঁতারে অংশ নেয়ার জন্য এসডিও সাহেব পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। সে সময় এই টাকার ওজন ছিল অনেক। তার প্রতিদানও আমরা দিতে পেরেছিলাম। ৫৩ পয়েন্ট পেয়ে রানার্স-আপ হয়ে আমরা সবাইকে চমকে দেই। এরপর আর এমন সাফল্য দেখানো সম্ভব হয়নি। আমরা প্রায় ১৫/১৬ জন সাঁতারু অংশ নিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে ৪ জন ছিল মেয়ে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাদের নাম মনে পড়ছে, তারা হলেন- হানিফ পাটওয়ারী, রাজ্জাক পাটওয়ারী, জাফর পাটওয়ারী, রফিক, বোরহান, ববি সাহা, কামরুজ্জামান, আনোয়ারা। তবে বেশি সাফল্য পান রাজ্জাক পাটওয়ারী। রিলে ও ওয়াটারপোলোতে আমি অংশ নিয়ে পদক লাভ করি। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল টিঅ্যান্ডটি। তারা ছিল শক্তিশালী দল। টাকা-কড়ির কোনো সমস্যা ছিল না। সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস, সরদার মোহাম্মদ নুরুউদ্দীন, আলতাফ প্রমুখ সাঁতরুরা টিঅ্যান্ডটি’র হয়ে অংশ নিতেন। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার সাঁতারুরা যে সুযোগ-সুবিধা পেতেন, আমরা তার কিছুই পেতাম না। তারপরও যখন যতটুকু সুযোগ পেয়েছি, সব ধরনের সাঁতারেই অংশ নেয়ার চেষ্টা করেছি। প্রতিযোগী তো ছিলামই, একই সঙ্গে সংগঠক হিসেবে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। চাঁদপুরের মত একটি জেলায় একটি সাঁতার কাব গড়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। তারপর প্রাদেশিক সাঁতারে অংশ নিয়ে ঢাকার সাঁতারুদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করাটা যে কোনো বিচারে গর্ব করার মত ঘটনা। ১৯৭০ সালে বরিশালের কালেক্টরেট ট্যাংকে ৪২ এবং সিলেটের ধোপা দীঘিতে ৩৫ ঘন্টা অবিরাম সাঁতার কাটি। এ বছরই চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে পাঁচ মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হই আমি। দ্বিতীয় হন ববি সাহা। এটিও বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। আসলে মফস্বলের নিস্তরঙ্গ জীবনে আমার এই অভিনব উদ্যোগ বিশাল ঢেউ হয়ে দুলিয়ে দিয়েছে। বিনোদন তো বটেই, ক্রীড়াঙ্গনে এনেছে প্রাণচাঞ্চল্য। এ কারণে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে আমাকে নেয়ার জন্য ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। সবার আমন্ত্রণে সাড়া দেয়া সম্ভব হতো না। অবিরাম সাঁতার কাটা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। এক একটা সাঁতার আমাকে নিংড়ে দিয়ে নিঃস্ব করে দিত। এর ধকল সামলে উঠতে বেশ সময় লাগতো। তাছাড়া শরীর ফিট রাখতে হলে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য ও বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। আমি এসব কিছুই পেতাম না। শুধু মনের জোরে আমি অংশ নেই একটার পর একটা সাঁতারে।
সাত.
সাঁতার নিয়ে যতই নিমজ্জিত থাকি না কেন, পারিপার্শ্বিকতাকে এড়িয়ে চলা যায় না। জীবন তো আর ঢেউয়ের মতো নির্ভেজাল নয়। ঢেউটাকে প্রতিপক্ষ মনে করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু জীবনের জটিলতার সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। অনেকেই বলেন, খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। কথাটা বোধকরি সবসময় ঠিক নয়। বনে আগুন লাগলে হরিণের পক্ষে মনের আনন্দে চলাফেরা সম্ভব হয় না। ১৯৭১ সালের মার্চে বারুদপোড়া গন্ধ পেতে থাকি। ২৫ মার্চের কালো রাত যে হয়ে ওঠবে অনন্ত এক দু:স্বপ্নের রাত, আমার পক্ষে তা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। তবে খেলাধুলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে থাকলেও দেশের রাজনীতির হালচাল যে এক দমই অনুধাবন করতে পারতাম না, তা বলা ঠিক হবে না। রাজনীতির উত্তাল টেউ এসে আমাদেরও দুলিয়ে দিয়ে যেতো। তবে তাতে গা করার চেষ্টা করিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য ও দোসররা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লে আমাদের অবস্থা হয় বনপোড়া হরিণীর মতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থাকতাম চাঁদপুরে। ভেবেছিলাম, যা হবার মিছিল-মিটিংয়ের শহর ঢাকার উপর দিয়েই যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি ধারণার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মমতার শিকার হতে থাকেন আশপাশের লোকজন। চলতে থাকে রাজাকার, আল-বদরদের তা-ব। বেসামাল পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আর সংখ্যালঘু হওয়াটা ছিল সে সময়ের বড় এক পাপ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু হবার অপরাধে কতো মানুষ যে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। জানতে পারি, সে সময় আমার নামও পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। সঙ্গত কারণে যুদ্ধ শুরু হলে সে তালিকার ভিত্তিতে কিছু একটা ঘটতে পারে বলে সতর্ক হয়ে যাই। মৃত্যুর তালিকা ক্রমশ বাড়তে থাকলে চাঁদপুরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে মাতৃভূমি ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বাধ্য হয়ে ৮ এপ্রিল সঙ্গী-সাথীসহ চাঁদপুর থেকে আগরতলার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করি। এ পথচলাটা ছিল ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা। পথের বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর শীতল হাতছানি। দিনের বেলা পরিচিতদের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েছি। ধাক্কা খেয়েছি। পড়ে গেছি। আহত হয়েছি। কান্তি-শ্রান্তিতে ভেঙে পড়েছি। তবুও পথ চলার বিরাম দেইনি। সে সময় ১৯৫৯ সালে বিকাশ রায় পরিচালিত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিটির কথা মনে পড়ে যায়। ছবিটিতে অভিনয় করেন উত্তম কুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনীল চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রাবতী দেবী, পাহাড়ী সান্যাল, বিকাশ রায় প্রমুখ। সে ছবিতে দেখেছিলাম, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে অবস্থিত হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থকেন্দ্র ‘হিংলাজ’। সে তীর্থে বালুচ মরুভূমি পেরিয়ে যাওয়া কষ্টকর এক সংগ্রাম। সূর্যের গনগনে রোদ। উত্তপ্ত বালু। এক ফোঁটা পানি নেই। নিজের কাছে ‘যক্ষের ধনের’ মতো আগলে রাখা পানি মৃত্যু পথযাত্রী অন্য কাউকে দিতে চান না। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে পড়তে চায়। পায়ে হেঁটে কিংবা উটের পিঠে চড়ে যেতে যেতে কেউ কেউ ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। তবুও মানুষ ছুটে চলেছেন। সেখানে ছিল সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার পরম আকাক্সক্ষা। আর আমাদের যাত্রা ছিল মানুষ নামক পশুদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার আকুলতা। মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে আমরা পালিয়েছি। তারপরও কেন জানি ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিটির কথাই মনে পড়েছে বার বার। মনে হয়েছে যেভাবে হোক আগরতলা না পৌঁছালে নিভে যাবে জীবনদীপ। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় আগরতলা পৌঁছাই। আগরতলায় থাকতেন আমার আপন ছোট বোন। বোন জামাই ফরেস্টে চাকরি করতেন। তাদের বাসায় ওঠি। দীর্ঘদিন পর বোনের সঙ্গে দেখা হয়। ৩/৪ দিন হেসে-খেলে আগরতলায় কাটিয়ে দেই। এরপর রওয়ানা দেই কলকাতা। সে আরেক সংগ্রাম। রাস্তাঘাট ভাঙা। বাসে করে ধর্মপুর যাওয়ার সময় পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি উলট-পালট হওয়ার উপক্রম হয়। ধর্মপুর থেকে ট্রেনে কলকাতা। পাহাড় কেটে ট্রেন লাইন। ট্রেন-যাত্রাটা আগের কষ্টটা ভুলিয়ে দেয়। বাস এবং ট্রেনে গৌহাটি ও আসাম হয়ে কলকাতা যেতে লেগে যায় তিন দিন। আমাকে নেয়ার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে আসেন মেঝ ভাই মন্টু নন্দী। ওঠি বড় ভাই অনিমেষ নন্দীর ১০৪ মদনমোহন ধর্মস্ট্রীটে। মৃত্যুপুরী থেকে পালিয়ে গিয়ে কলকাতায় বেশ কয়েক দিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। তখন তো আমি বল্গা হরিণ। কোনো বাধা নেই। পিছুটান নেই। ভাইয়ের কথায় দেখতে যাই কলকাতার বিখ্যাত সাঁতারের কাবগুলো। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত কলেজ স্ট্রিট। উত্তর কলকাতার এ প্রান্তরটি সারাক্ষণই জমজমাট, প্রাণবন্ত ও কোলাহলময়। এ যেন ইন্টালিয়াকচ্যুয়ালদের ঘাঁটি। ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সী কলেজ, স্কটিশ চার্চ কলেজ, বেথুন কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, হেয়ার স্কুল, হিন্দু স্কুল, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এবং আড্ডার খনি বিখ্যাত কফি হাউস। আর সারি সারি বইয়ের দোকান। দোকান তো নয়, বিশ্ব সাহিত্যের সম্ভার। এর মাঝে চুপটি করে বসে আছে বিদ্যাসাগর সরোবর। ‘কলেজ স্কোয়ার’ নামে যার পরিচয় ও সুখ্যাতি। বিশাল আকারের এ ট্যাংকটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য সুইমিং কাব ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রোজ সকাল-বিকাল সব বয়সী ছেলে-মেয়েরা সাঁতার কাটেন। এমন সুইমিং পুল দেখলে জাত সাঁতারুদের পক্ষে অলস প্রহর কাটানো কঠিন। কিছু না ভেবেই ১০ রুপি দিয়ে ভর্তি হয়ে যাই ৫৩/২ কলেজ স্ট্রীট, বউবাজার ব্যায়াম সমিতির সুইমিং কাবে। ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সুইমিং কাবের আছে গৌরবময় ইতিহাস। এ কাবের খ্যাতিমান সাঁতারুদের মধ্যে আছেন প্রফুল্ল মল্লিক, গৌরহরি দাস, আশু দত্ত, জহর আহির, অমল পাল, আব্দুল মুতলিব, দেব প্রসাদ চন্দ্র, দিলীপ পাল, জয়ন্ত মিত্র, আশীষ দাস, সুশীল ঘোষ, গৌর পুরকায়েত, নিতাই পুরকায়েত, কানাই রায় প্রমুখ। সাঁতারের চমৎকার পরিবেশ পেয়ে চুটিয়ে প্রাকটিস করতে থাকি। আমি দু’বেলাই প্রাকটিস করতাম। আর কোচিং দিতেন কেপি সরকার ও তার সহকারী দেবী দত্ত। ওয়াটার পোলোতে আব্দুল মুতলিব। তিনি ছিলেন ১৯৭০ সালে এশিয়ান গেমসে ওয়াটার পোলোতে রানার্সআপ ভারতীয় দলের সাঁতারু। তারা ছিলেন সাঁতারের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাদের কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে আমি দারুণভাবে উপকৃত হই। পূর্ব পাকিস্তানে সাঁতারের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা ছিল না। ছিল না কোনো কোচ। তাই কলকাতায় আমি সাঁতারের অনেক কিছু শিখতে পারি। চার মাস টানা প্রশিক্ষণ নিয়ে বউবাজার ব্যায়াম সমিতির বাৎসরিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। তাতে আমি চারটি ইভেন্টে প্রথম ও চারটি ইভেন্টে দ্বিতীয় হই। বড়দের গ্রুপে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল, ১০০ মিটার বাটারফাই, ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক ও ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে প্রথম হলে সবাই চমকে যায়। ওয়াটার পোলোতে বউবাজার ব্যায়াম সমিতির পক্ষ থেকে দু’টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। ওয়াটার পোলো ভারতে বেশ জনপ্রিয়। আমার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন বড় ভাই অনিমেষ নন্দী। সাঁতারে এ সাফল্য আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। একদিন পত্রিকায় দেখলাম, বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি গঠন করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলারদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আমিও উৎসাহিত হয়ে উঠি। কিছু একটা করার জন্য আমার মনেও আকুলি-বিকুলি করতে থাকে। কথা প্রসঙ্গে কে যেন একদিন আমাকে বললেন, ভারতের শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল কাবের সাঁতারু দিলীপ দে কলেজ স্কোয়ারে ৭৯ ঘন্টা সাঁতার দিয়ে গড়েছেন এশিয়ান রেকর্ড। তার এ সাঁতার দেখার জন্য অনেক দর্শক সমাগম হয়। তার এ কৃতিত্বের কথা তখন সবার মুখে মুখে। তাছাড়া কোন একটা বইয়ে দেখেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু বি সি মুল ৮৯ ঘন্টা ৩৫ মিনিট সাঁতার কেটে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন। আমার মনে এমন কিছু করার চিন্তা উঁকি দিয়ে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। আর এ স্বাধীনতার জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে। বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় সাফল্য পাওয়ায় তখন আমি পরিচিত ছিলাম ‘জয়বাংলা’র সাঁতারু হিসেবে। মুজিবনগর দফতরে দেখা হয় সাঁতারু ব্রজেন দাস, মুজিবনগর সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা খন্দকার আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তাদের বললাম, ‘আমি অবিরাম সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড গড়তে চাই।’ বউবাজার ব্যায়াম সমিতির হয়ে সাফল্য অর্জন করায় তারা খুব খুশি হন এবং আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, তুই তো দেশের জন্য কিছু করেছিস। আরো বড় কিছু যখন করতে চাচ্ছিস, তাতে আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে। তাদের কাছে আশ্বাস পেয়ে আমি এ বিষয়ে চাঁদপুর সম্মিলনীর উপদেষ্টা চাঁদপুরের সন্তান মেঘনা বিড়ির স্বত্বাধিকারী গণেশ সাহা, অনিমেষ রায় চৌধুরী ও সম্পাদক হিমাংসু চক্রবর্তীসহ অন্যান্য কর্মকর্তার সাথে দেখা করলাম। তারা এ সাঁতারের জন্য কিছু খরচ বহন করতে রাজি হলেন। এরপর বউবাজার ব্যায়াম সমিতি সুইমিং কাবের সম্পাদক নন্দলাল দত্ত, কাচি বাবু, কেপি সরকার ও দেবী দত্তের সাথে এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। তারা সাঁতার আয়োজনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন। চাঁদপুর সম্মিলনী আমার ব্যয়ভার বহনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়, অরুণ নন্দী অবিরাম সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড গড়বে। এ কথা কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দারুণভাবে সাড়া পড়ে যায়। কলকাতার পত্রিকাগুলো বিষয়টি পুরোপুরিভাবে লুফে নিয়ে প্রতিদিনই নিউজ কভারেজ দিতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ এবং বাংলার মানুষের দুঃসময়ে আনন্দ দেয়ার জন্য এ সাঁতার। সাঁতার উদ্বোধনের জন্য বাংলাদেশের মন্ত্রী ও নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, এখন বিশ্বের কাছে আলোচিত ব্যক্তিত্ব হলেন রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। তাকে দিয়ে এই সাঁতারের উদ্বোধন করানো হলে সবাই লুফে নেবে। তবে তারা সবাই অভিমত ব্যক্ত করেন অরুণ নন্দী বিশ্ব রেকর্ড করুক কিংবা না করুক, তার এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে তা স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের জন্য বিরাট ব্যাপার।


আট.
পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক কভারেজের পাশাপাশি পুরো কলকাতা শহরজুড়ে আয়োজকদের তরফ থেকে পোস্টারিং করা হয়। ছড়ানো হয় হ্যান্ডবিল। বেতারেও ঘোষণা দেয়া হয়। আসলে প্রচার-প্রচারণার কোনো কমতি রাখা হয়নি। বিষয়টি আলোচিত হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ, কিছুদিন আগে অবিরাম সাঁতারের একটি এশীয় রেকর্ড প্রত্যক্ষ করেছে কলকাতাবাসী। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন একটি তোলপাড় করা ঘটনা। তার সপক্ষে কোনো কিছু করতে এগিয়ে এলে তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করার ব্যাপারে মুখিয়ে থাকে কলকাতার মানুষ। যে কারণে আমি বিশ্ব রেকর্ড গড়ার আগেই সবার কাছে রীতিমত হিরো হয়ে যাই। আমাকে নিয়ে সবার আগ্রহ ও কৌতূহল বেড়ে যায়। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাঁতারের তারিখ ও সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর সকাল আটটায় সাঁতার শুরু করা হবে। উদ্বোধন করবেন কলকাতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। তিনি তখন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানালে তা সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। হোসেন আলী তখন রীতিমত কিংবদন্তি। তার উপস্থিতির আলাদা একটা মহিমা। হোসেন আলী ছাড়াও উপস্থিত হন আওয়ামী লীগ নেতা ফণীভূষণ মজুমদার, ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাস, চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন (অব:) করিমউদ্দীন এবং মুজিবনগর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কলকাতায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও উপস্থিত হন। ছুটে আসেন সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক মানুষ। কলেজ স্কোয়ার চত্বরে চুল পরিমাণ ঠাঁই ছিল না। সাঁতার শুরুর আগে অতিথিরা বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, অরুন নন্দী রেকর্ড গড়তে নামবেন, রেকর্ড গড়তে পারবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বড় একটি বিজ্ঞাপন। আমি বউবাজার ব্যায়াম সমিতির ভেতরে বিশ্রাম নিয়ে সাঁতার শুরুর প্রস্তুতি নেই। পরনে সুইমিং কস্টিউম। আমিও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখি। আমার বক্তব্যের মূল কথা ছিল- আমাদের মাতৃভূমি আজ শত্রুকবলিত। প্রতিদিনই আমাদের কারো না কারো জীবন ঝরছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা জানি না, আমরা কবে স্বাধীনতা পাব? তবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। আমিও আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থেকে এই সাঁতার করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ উদ্যোগ কতটুকু সার্থকতা অর্জন করবে, সেটাও জানি না। বাংলাদেশ যদি কখনো স্বাধীন না হয়, তাহলে আমার এই ভূমিকার জন্য মাতৃভূমিতে আদৌ আর ফিরতে পারবো কিনা- সেটা ঝুলে আছে বড় এক প্রশ্ন হয়ে। সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার জন্য আমি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আপনারা যে উদ্দীপনা নিয়ে আমাকে উৎসাহিত করতে এসেছেন, তা আমাকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছে। এরপর আমাকে মাল্যভূষিত করা হয়। সাঁতার শুরু করতে করতে সকাল সাড়ে আটটা বেজে যায়। বেজে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বুকটা মুচড়ে-মুচড়ে উঠতে থাকে। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা কান্না অশ্রু হয়ে চোখের কোণে চিক চিক করতে থাকে। সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে একটা দেশাত্মবোধ। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মা-মাটি-মাতৃভূমি।
একবুক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয় আমার সাঁতার। ব্যর্থ হলে ব্যক্তি আমার কিইবা আসে যাবে। কিন্তু আমার উপর নির্ভর করছে স্বাধীনতাকামী আমার দেশের সম্মান। সেই সম্মানটুকু আমাকে যে করে হোক রক্ষা করতে হবে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই নিবেদনটুকু রাখি। জলে নামতেই একের পর ক্যামেরার কিক। লাইফ সেভার হিসেবে শুরুতে আমার সঙ্গে ছিলেন অবিরাম সাঁতারে এশীয় রেকর্ডধারী দিলীপ দে, নারায়ণ কুন্ডু। এছাড়া বউবাজার ব্যায়াম সমিতির জাতীয় পর্যায়ের ২৫/৩০ জন সাঁতারুকে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়।
অবিরাম সাঁতার আমার কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে সর্বোচ্চ একটানা সাঁতার কেটেছি ৫৮ ঘন্টা। ১৯৬৮ সালে কুমিল্লার রাণীর দিঘীতে সেই সাঁতার কাটার সঙ্গে পার্থক্য হলো- এবার পরদেশে অনেক মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে গড়তে হবে বিশ্ব রেকর্ড। এভাবে কোনো একটি টার্গেট করে গন্তব্য পৌঁছানো খুবই কঠিন। আর কঠিনেরে ভালোবেসে আমি পাড়ি দিতে থাকি দুরূহ পথ। মাইকে বাজতে থাকে উদ্দীপনামূলক গান। সকাল, দুপুর পেরিয়ে আসে রাত। রাতের বেলা শরীরটা যেন আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। অনুভব করতে থাকি অস্বস্তি। ক্রমাগত বমি হতে থাকে। ১৪ বার বমি হয়। একইসঙ্গে রক্ত যেতে থাকে। আমি ঘাবড়ে যাই। এমনটি আগে কখনো হয়নি। আসলে অতিরিক্ত চাপ ও টেনশন আমাকে কাবু করে ফেলে। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে থাকি, আমাকে শক্তি দাও, সাহস দাও। দাও বল ও ভরসা। আমাকে ও আমার দেশকে এভাবে হেরে যেতে দিতে পারি না। রাতটাও পাড়ি দিতে সক্ষম হই। ৯ অক্টোবর বমিটা কমে যায়। আসে ১০ অক্টোবর। আমার পায়ে ক্রাম ধরে। মনে হচ্ছিল আমি ক্রমান্বয়ে তলিয়ে যাচ্ছি। আমি আর পারছিলাম না। অপরিসীম জেদ আমাকে ভাসিয়ে রাখে। ক্রাম নিয়ে আমি মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যাই। ডাঃ শ্যামা দাস ও কোচ দেবী দত্ত আমাকে অনবরত সান্ত¡না দিতে থাকেন, ‘অরুন আরেকটু ধৈর্য ধর, অল্পক্ষণের মধ্যে তোমার ক্রাম সেরে যাবে।’ আমি ব্যথা সইতে পারছিলাম না। তারপরও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সাঁতরাতে থাকি। তিন দিন পেরিয়ে আসি। এর আগে এতক্ষণ সাঁতার কাটিনি। আর কতক্ষণ পারবো বুঝতে পারছিলাম না। ১১ অক্টোবর ক্রাম কমে। কিন্তু একটার পর একটা সমস্যায় আক্রান্ত হতে থাকি। আমার বুকে ভীষণ জ্বালা-পোড়া করতে থাকে। হাত দুটো জানিয়ে দেয় তাদের অপারগতার কথা। কান্তিতে ভেঙ্গে পড়া হাত দুটো আর আমাকে ভাসিয়ে রাখতে পারছিল না। ভীষণ যন্ত্রণা। আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া ঘুমে চোখ দুটো মুদে আসছিল। এতটা সময় না ঘুমিয়ে থাকার কী যে যন্ত্রণা, তা অনুভব করতে থাকি পলে পলে। আমার শরীর আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। কষ্ট, যন্ত্রণা ও ব্যথা-বেদনায় চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। অথচ প্রাণ খুলেও কাঁদা যাচ্ছিল না। আমার অসহায়তা ও অক্ষমতা আঁচ করতে পেরে লাইফ সেভার পরেশ দত্ত, আমার ভাই অনিমেষ নন্দী আমাকে উৎসাহিত করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর পর চা, দুধ, পানি দিয়ে আমাকে আপ্যায়িত করেন। চারদিকে বাজতে থাকে ব্যান্ড। এটা আমার জন্য টনিক হিসেবে কাজ করে। এতে বেড়ে যায় আমার মানসিক শক্তি। আমি নিজেকে বললাম. আমাকে হারলে চলবে না। আমাকে যে করেই হোক পারতে হবে। আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অবলীলায় বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের জীবন। অসীম সাহসী সেই বীরেরা কত প্রতিকূলতাকে উজিয়ে মাতৃভূমির জন্য লড়াই করছেন। তারা যদি নিজেদের উৎসর্গ করতে পারে, আর আমি এই তুচ্ছ বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারবো না, এটা কি করে হয়? যাবতীয় কান্তি, অবসাদকে উপেক্ষা করে আমি নতুন উদ্যমে সাঁতরাতে শুরু করি। অজেয়কে জয় করার একটা জেদ আমার শারীরিক জড়তাকে গুরুত্বহীন করে দেয়। একটুখানি ফলের রস খেয়ে শরীরের ঝিমিয়ে পড়া অঙ্গগুলোকে চাঙ্গা করতে সক্ষম হই। ভারতের খ্যাতিমান সাঁতারু দীলিপ দে’র একটানা ৭৯ ঘন্টা অবিরাম সাঁতারের এশীয় রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়ার পর চারদিকে উৎসবের ধুম লেগে যায়। মরা গাঙ্গে যেন নতুন জোয়ার আসে। নতুন উদ্যমে সাঁতরাতে থাকি। তারপরও বিশ্ব রেকর্ডকে মনে হতে থাকে অনেক দূরের পথ। এক একটা মুহূর্ত যেন আমার কাছে অনন্তকাল। আমার বয়স তখন ২৮ বছর হলেও নিজেকে মনে হচ্ছিল কালজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র কিউবান সেই বৃদ্ধ জেলে ‘সান্তিয়াগো’র মত। সেই বৃদ্ধ সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে টানা ৮৪ দিন কোনো মাছের দেখা পেতে ব্যর্থ হন। নিজেকে তিনি দুর্ভাগা ভাবতে থাকেন। কিন্তু তাতেও তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। একবিন্দু আশাও ছাড়েননি। ৮৫তম দিনে অনেক ঝুঁকি নিয়ে সাগরের অনেক গভীরে চলে যান মাছ পাওয়ার আশায়। সেদিন তিনি যথার্থই সফল হন। প্রত্যাশার চেয়েও বিশাল আকারের ‘মারলিন’ নামক একটি মাছ তার জালে আটকাতে সমর্থ হন। এত বড় মাছ ধরেও বিপাকে পড়ে যান তিনি। মাছটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা তার একার পক্ষে প্রকৃতঅর্থেই কঠিন হয়ে পড়ে। জলের শক্তিশালী মাছের সঙ্গে তার মত বৃদ্ধ’র শারীরিক শক্তিতে পেরে ওঠা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মাছকে বাগে আনতে লড়াই করে কেটে যায় দু’দিন দু’রাত। মাছের সঙ্গে লড়াই চালাতে গিয়ে তিনি ক্ষত-বিক্ষত হন। তবুও হাল ছাড়ার পাত্র নন বৃদ্ধ। তৃতীয় দিনে সাহসী সেই বৃদ্ধ মাছটিকে তার হারপুনে গাঁথতে সক্ষম হন। অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ লড়াইয়ে জয়ী হয়ে মাছটিকে নিয়ে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন সান্তিয়াগো। বৃদ্ধ তো দুঃসাহস আর অদম্য মনোবলকে সম্বল করে জয়ী হয়ে ফিরে আসেন, কিন্তু আমার কী হবে? আমিও তো ৮৪ ঘন্টা পেরিয়ে এসেছি। আর মাত্র ৫/৬ ঘন্টা। তাহলেই বিশ্ব রেকর্ড আমার বশীভূত হবে। এই সময়টুকু মহাকালকে যেন থমকে দিয়েছে। সময়ের গতি যে এতটা মন্থর হতে পারে, সেদিন তেমনই মনে হয়েছিল আমার কাছে। মানুষ তো কখনো হারে না। বৃদ্ধ সান্তিয়াগো হারেননি। আর আমি কূলে এসে তরী ডুবিয়ে দেব! তা কী করে হয়? এত উদ্যোগ, এত আয়োজন, এত প্রত্যাশা- সব কি ভেস্তে যাবে? বুক ঠেলে কান্না আসছিল। আমি কেন সবাইকে প্রত্যাশার রঙে রাঙিয়ে দিলাম? আমি ব্যর্থ হলে কত মানুষের মন ভেঙ্গে যাবে, অর্বাচীনের মত কেন এমন করলাম? ব্যর্থতার গ্লানি এসে আমাকে যেন কলেজ স্কোয়ারের ট্যাংকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি যেন তলিয়ে যেতে যেতে আবার ভেসে উঠতে থাকি। আমার কানে কানে ফিসফিসানির মত করে কে যেন বলে যায়, ‘আরে তুই তো জলের মানুষ। তোর জীবন কেটেছে জলে জলে। কত টালমাটাল অবস্থায় এই জলের সঙ্গে লড়াই করে তুই জয়ী হয়েছিস। আর আজ জীবনের একটি বড় অর্জনের কাছাকাছি এসে তুই হেরে যাবি।’ অলৌকিক এক দৈববাণী এসে আমাকে আবার জাগিয়ে দিয়ে যায়। আসলে সেটা কি ছিল কোনো অলৌকিকতা, নাকি নিজের মনের কল্পনা- তা আজ অব্দি বুঝতে পারিনি। আমি আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠি। মনে মনে আওড়াতে থাকি, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’। আমাকে জিততেই হবে। অবিচল এই প্রতিজ্ঞা আমাকে সঞ্জীবিত করে। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য জলে নামেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সাঁতারু ব্রজেন দাস। সে সময় তাকে নাকি আমি অকারণে বেশ বকাঝকা করেছি। ব্রজেন দা পরে আমাকে হেসে হেসে এটা বলেছেন। আসলে আমি তো তখন আর আমার মধ্যে ছিলাম না। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু মনের ইচ্ছেয় সাঁতার কাটতে থাকি। ১২ অক্টোবরের রাত ১২টা পেরিয়ে যায়। গভীর রাত হলেও আলোর কোনো কমতি নেই। এই আলো আমাকে একটু একটু করে নিয়ে যেতে থাকে গন্তব্যের দিকে। চারপাশের হৈ-হল্লা আর উল্লাসের মধ্য দিয়ে আমি বিশ্ব রেকর্ড গড়ি। জয়ী হই দুঃসাহসিক এক চ্যালেঞ্জে। তারপরও অব্যাহত রাখি সাঁতার। আমার শরীর আমাকে সমর্থন না দিলেও মনের জোরে যন্ত্রের মত সাঁতার কাটি।
৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট সাঁতার কাটার পর আমার শুভাকাক্সক্ষীরা আমাকে জল থেকে তুলে নেন। তখন রাত ২টা ৩৫ মিনিট। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের টেউ একটু একটু করে আমাকে দুলিয়ে দিতে থাকে। আমি পুরোপুরি আত্মস্থ না করতে পারলে আমার বোধের মধ্যে প্রবাহিত থাকে তার তরঙ্গ। আমাকে বউবাজার ব্যায়াম সমিতির বিছানায় শুইয়ে দিলে আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই। গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই। কোনো কিছু আর আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।

নয়.
কতক্ষণ যে অচেতন হয়ে ছিলাম, বলতে পারবো না। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে যখন চোখ মেলি, কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হতে থাকে। আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন একজন সুন্দরী মহিলা। আমার দিকে হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এ কি মায়া, বিভ্রম নাকি মরীচিকা! সব কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে। একটা বিভ্রাটের মধ্যে পড়ে যাই। আস্তে-ধীরে ধাতস্থ হয়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করার চেষ্টা করি। মহিলা আমার দিকে ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে বলেন, কেমন আছ অরুন দা? আমাকে চিনতে পেরেছ? তুমি তো বিশ্ব জয় করেছ। সবাই তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমিও তোমাকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে এসেছি। একটু একটু করে ফিরে আসতে থাকে আমার স্মৃতি। মহিলাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। চিনতে গিয়েও চিনতে পারছি না। ভাল করে তাকাতেই হৃদয়ের গভীরে চিরস্থায়ীভাবে ছাপ ফেলা তার টোল খাওয়া মুখাবয়বের মোহময়ী হাসিটা দেখে আমার বুঝতে বাকি থাকে না। এ তো আমার চিরকাক্সিক্ষতা সুচিত্রা সেন! আমার বুকের মধ্যে বয়ে যেতে থাকে খুশীর হিল্লোল। এই সেই মানসকন্যা। আমার প্রথম জীবনের প্রথম ভালোবাসা। যার কাছে নিজেকে নিবেদন করে উপেক্ষিত হয়েছিলাম। প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, একদিন এই উপেক্ষার জবাব আমাকে দিতে হবে। প্রায় এক যুগের ব্যবধানে আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তে তাকে পেলাম। সেই না পাওয়াটা যেন আজ পূর্ণতা পেল। আমরা একান্তে কিছু সময় কথা বলি। আমি আমার জীবনটাকে শূন্য রেখে দিলেও বাণী দত্তের জীবনে যোগ হয়েছে স্বামী ও এক পুত্র। তার স্বামী ও পুত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়। জানতে পারলাম, ছেলের নাম অরুণ। এটা শোনার পর জীবনে এতটা অবাক আর কখনো হইনি। এ নিয়ে আমার মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করলেও তার উত্তর জানার অবকাশ হয়নি। আমাকে তারা তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। একটা আলোড়ন সৃষ্টি করা ঘটনা ঘটানোর পরও বাণী দত্ত যেন আমাকে একটা নস্টালজিয়ার মধ্যে সম্মোহিত করে রেখে যান। তার মৌতাত আমার হৃদয়ে সুখের অনুরণন তোলে। অবশ্য একটু পরই কাটিয়ে উঠি এই হ্যাঙ-ওভার। কেননা, ওঁরা চলে যেতেই আমাকে নিয়ে বয়ে যেতে থাকে উন্মাদনা।
ভোরের আলো ফোটার আগেই চারদিকেই চাউর হয়ে যায় আমার কীর্তির কথা। আমাকে দেখার জন্য বন্যার স্রোতের মত মানুষ আসতে থাকেন। সেদিন আমি পেয়েছিলাম মানুষের বুকভরা ভালোবাসা। অনেকেই আমার জন্য অনেক উপহার নিয়ে আসেন। সেসব বড় তুচ্ছ মনে হয়েছে, মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে গিয়ে। আমাকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে আসেন মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী কামরুজ্জামান, আবদুল মান্নান, ফণীভূষণ মজুমদার, শেখ আবদুল আজিজ, হোসেন আলীসহ নীতি-নির্ধারকদের প্রায় অনেকেই। আসেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, বরেণ্য লেখক অন্নদা শংকর রায়, প্রবোধ কুমার সান্যাল, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব শৈলেন মান্না থেকে শুরু করে কে নন? ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ভারতের ডঃ বিমল চন্দ্র, আরতী সাহাও উপস্থিত ছিলেন। আমার কীর্তিকে তারা নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা হিসেবে। আর কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশের কে আসেননি? শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিকদের যেন ঢল নেমেছিল। সবার উপস্থিতির কথা আমি বলতে পারবো না। তাদের কারো কারো সঙ্গে দেখা হলেও অধিকাংশের উপস্থিতির কথা আমি শুনেছি। তবে আমার এই কীর্তির পর যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের অনেকেই আমাকে জানিয়েছেন, তারা আমার সাঁতার দেখেছেন।
তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তাতে আমার এই কীর্তির কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। খ্যাতিমান সাহিত্যিক শওকত ওসমান ‘স্মৃতিখ- : মুজিবনগর’ গ্রন্থে ডায়রির মত করে লিখেছেন, ‘৯ অক্টোবর ’৭১, চাঁদপুরের ছেলে অরুণ কুমার নন্দী গতকাল থেকে কলকাতার কলেজ স্কোয়ার ট্যাঙ্কে সাঁতার কাটছে বিশ্ব রেকর্ড করার প্রত্যাশায়। বেশ ভিড় জমে যায় চারদিকের পাড়ে। অনেকে ওকে উৎসাহ যোগাচ্ছে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে। দেখা যাক কী হয়। অবিশ্যি অরুণ নন্দী পূর্বেও সাঁতারু হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে।’ ১২ অক্টোবর ’৭১-এ তিনি লেখেন, ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা! সাঁতারু অরুণ কুমার নন্দী এক বিশ্ব রেকর্ড করে বসে আছে। কাছে গিয়ে এই বীরকে অভিনন্দন জানাতে হয়। তার কৃতিত্ব স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অমূল্য অবদান। একটানা লাগাতার সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড ছিল ৮৯ ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট। অরুণ নন্দী ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতারে সেই রেকর্ড চুরমার করে দিয়েছে। আর এক ব্রজেন দাসকে পাওয়া গেল। বাংলাদেশের অধিবাসীর এই তাক-লাগানো ম্যাজিক বিশ্ববাসীকে দুর্দিনে আরো আমাদের কাছে টেনে আনবে। জয় বাংলা! জয় বাংলা! বিখ্যাত সাঁতারু। ইংলিশ-চ্যানেল পারাপারে বিজয়ী।’ এখনও যখন অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তারা আমার বিশ্ব রেকর্ডের কথা স্মরণ করেন। তাদের কেউ কেউ তখন হয়ত বিখ্যাত ছিলেন না, পরবর্তীকালে তারা সাফল্য পেয়েছেন, পেয়েছেন খ্যাতিও। আমার প্রতি তাদের আগ্রহ ও কৌতূহল দেখে অনুধাবন করা যায়, কত লোক যে এই সাঁতারের প্রত্যক্ষদর্র্শী হয়েছিলেন। ভারত ও বাংলাদেশের বেতার ও সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার নেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। আকাশবাণী বেতারের জন্য আমার সাক্ষাৎকার নেন বিখ্যাত বেতারশিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ আমার নিউজ কভারেজ দেয়া হয়। অবশ্য এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত কভারেজ পেয়ে আসছে। এ নিয়ে লেখালেখি কখনও থেমে থাকেনি। প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন-বার্তা পাঠান মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান, হাইকমিশনার হোসেন আলী।
এরপর আমাকে সংবর্ধনা দেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। প্রথম সংবর্ধনা প্রদান করে আমার সাঁতারের আয়োজক ত্রিপুরা সমিতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট হলে আয়োজিত এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ত্রিপুরা সমিতির সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত অনিমেষ রায় চৌধুরী। এ সময় হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সম্পাদক শুধাংসু বাবু, দৈনিক বসুমতি পত্রিকার বার্তা সম্পাদক দক্ষিণারঞ্জন বোস প্রমুখ বক্তৃতা দেন। বিপুলসংখ্যক লোক এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমাকে ‘সন্তরণশ্রী’ খেতাব দেয়া হয়। এছাড়া সংবর্ধনা প্রদান করে বউবাজার ব্যায়াম সমিতি, হাওড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা, গোলাবাড়ী সুইমিং কাব, হাতিরপুল সমিতি, বেহালা যুব সংঘ, রবীন্দ্র সদন, কলেজ স্ট্রীট দোকানদার সমিতি, যাদবপুর সংস্থা প্রভৃতি। প্রায় ৩০টির মত প্রতিষ্ঠান সংবর্ধনা দেয়। তাতে আমাকে অনেক কম্বলসহ নানা উপহার দেয়া হয়। আমি তা বাংলাদেশের দুস্থ লোকদের মধ্যে দেয়ার জন্য বিলিয়ে দিয়েছি। সংবর্ধনা সভাগুলোতে আমাকেও বক্তৃতা দিতে হয়। আমি তো বক্তৃতা দিতে পারদর্শী নই। তবে মনের আবেগটুকু প্রকাশ করতে অসুবিধা হয়নি। আমি বলেছি, পরাধীন মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আমি সাঁতারে এই বিশ্ব রেকর্ড গড়েছি। এই রেকর্ড যদি বিন্দুমাত্র কাউকে অনুপ্রাণিত কিংবা কোনো অবদান রাখতে পারে, তাহলে আমার এই কষ্ট ও পরিশ্রম সার্থক হবে। তবে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমি সবাইকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাই। বলি, আপনারা বাঙালি, আমরাও বাঙালি। আজ পদ্মা-মেঘনা নদী বাঙালিদের রক্তে লাল। আপনারা এগিয়ে না এলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। বক্তৃতা দিতে দিতে আমি বোধহয় আপ্লুত হয়ে উঠি। আমার কথা শুনে সবাই দেখতাম চুপ করে থাকতেন। আমি তাদের বুকের মধ্যে কিছুটা হলেও ঝাঁকুনি দিতে পেরেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে কেউ কেউ আমাকে বলেন, আমি রাজনীতি করি কিনা? আমার বক্তৃতা শুনে তাদের কাছে তেমনটি নাকি মনে হয়েছিল।
সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ডের ঘটনায় আমার একটা ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠে। সর্বত্র আমি ভক্তি-সম্মান পেতে থাকি। যেখানে যাই, সবাই আমাকে খাতির-যতœ করতে থাকেন। আগ বাড়িয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন। কতজন যে আমার অটোগ্রাফ নিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই।
আমার একটা পরিচিতি আসার পর তা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকি। বিশেষতঃ যারা বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, অথচ পরিস্থিতির কারণে অর্থনৈতিক সমস্যায় ছিলেন, তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করি। আমার সঙ্গে ছিলেন চাঁদপুরের এমপি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। পাকিস্তান রেডিওর খবরে বলা হয়, কলকাতার হাওড়া ব্রীজ নাকি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তা শুনে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম। বুঝতে পারছিলাম, আমাদের সুদিন ঘনিয়ে আসছে।
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে অনেক স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে আসি স্বাধীন বাংলাদেশে। এ দেশে আর কখনো ফিরতে পারবো কিনা তা নিয়ে ছিল একরাশ সংশয়। যশোরের বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে মাতৃভূমির মাটি কপালে ছুঁইয়ে যখন শত্রুমুক্ত স্বদেশে প্রবেশ করি, তখন দূর হয়ে যায় সব সংশয়। তবে দেশ পেলেও হারিয়ে ফেলি আশ্রয়। পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসররা আমাদের পৈত্রিক ভিটা ধ্বংস করে দেয়। দখল করে নেয় আমাদের জায়গা-জমি। সেই থেকে ছিন্নমূল হয়ে যাই আমি। নিজ দেশে হয়ে পড়ি ঠিকানাবিহীন। অনিকেত নাগরিক। অবশ্য তা নিয়ে আর হা-পিত্যেশ করিনি। কত মানুষ কত কিছু হারিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। ইজ্জত হারিয়েছেন কত মেয়ে। পঙ্গু হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ। আর আমার তো সামান্য জায়গা-জমি। ভাবলাম, একাকী জীবন কোনোক্রমে চালিয়ে নেয়া তো আর কঠিন হবে না।
আমার স্বপ্ন তখন স্বাধীন বাংলাদেশে সাঁতারের জন্য কিছু করা। নতুন দেশে সবার মনেই তাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নতুন কিছু করার স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। যে সাঁতার নিয়ে আজীবন বুকের মধ্যে স্বপ্নের জাল বুনেছি, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছি, সেই সাঁতারে আরো বড় কিছু করার জন্য টগবগিয়ে ফুটতে থাকি। পরাধীন দেশে যা পারিনি, মুক্ত দেশে মনের মত করে অনেক কিছু করার পরিকল্পনা করতে থাকি। নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণে সাঁতারে রয়েছে আমাদের অপার সম্ভাবনা। পশ্চিম পাকিস্তানীদের কারণে সাঁতারে আমাদের দমিয়ে রাখা হয়। নিজেদের তুলে ধরার জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। স্বাধীন দেশে সম্ভাবনার অবারিত উৎসমুখ খুলে যাওয়ায় সাঁতার নিয়ে মনের মধ্যে অনেক কিছু উঁকি-ঝুঁকি মারতে থাকে।
দশ.
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত। যুদ্ধ সবকিছু যেন এলোমেলো করে দিয়ে যায়। ক্রীড়াঙ্গনও তা থেকে রেহাই পায়নি। অবশ্য পাকিস্তান আমলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ক্রীড়া অবকাঠামো খুব একটা গড়ে ওঠেনি। সাঁতারের অবস্থা ছিল বড্ড নাজুক। সাঁতারে পূর্ব পাকিস্তানের আধিপত্য সত্ত্বেও কোনোরকম গুরুত্ব দেয়া হয়নি। মানসম্মত অবকাঠামো ছিল না। ছিল না দক্ষ কোচ ও সুযোগ-সুবিধা। এমন একটা অবস্থায় ঢাকা স্টেডিয়ামে সাঁতার কাটতে আসেন মোশাররফ হোসেন খান, শাহজাহান মিজি, রওশন আলী, আবদুস সালাম, নজরুল ইসলাম, আবদুল হাই, আবদুর রাজ্জাক, কালীপদ, ছোট শাহজাহান প্রমুখ। তারা নিজেদের উদ্যোগে প্র্যাকটিস করতে থাকেন। তবে তারা তখন ছিলেন টেকনিক্যালি দুর্বল। সেটাই স্বাভাবিক। তাদেরকে গাইড করার জন্য অভিজ্ঞ কেউ ছিলেন না। আমি কলকাতা থেকে শিখে আসা সাঁতারের কলাকৌশল তাদেরকে শেখানোর চেষ্টা করি। বাংলাদেশে তখন ডলফিন সাঁতারের প্রচলন ছিল না। আমি প্রথমে মোশাররফ হোসেন খান, শাহজাহান মিজি, আবদুর রাজ্জাককে দিয়ে ডলফিন দেয়াই। প্রথমে ডলফিন সাঁতারকে কেউ গুরুত্ব দিতে চাননি। পরবর্তীকালে ভারতের পাতিয়ালা থেকে আবদুল কাদের ও মোঃ ইস্রাফিল কোচিং নিয়ে আসার পর ডলফিন সাঁতারের গুরুত্ব বুঝতে পারা যায়। ট্রেনিং নিয়ে আসার পর আবদুল কাদের বাংলাদেশে কোচিং দেয়া শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে মোঃ আলতাফ হোসেন পূর্ব জার্মানি থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসলে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়তে থাকে। সাঁতারের হতদশার মধ্যে একটা জিনিস আমার মন ভরিয়ে দেয়। পত্র-পত্রিকার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যাই আমি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আমি সাঁতারের যে বিশ্বরেকর্ড গড়ি, তা কলকাতার পত্র-পত্রিকায় বিপুলভাবে সমাদৃত হলেও তা ছিল বাংলাদেশের মানুষের বুকে অবরুদ্ধ হয়ে। নিজেদের তেমন পত্র-পত্রিকা না থাকায় আবেগ-উচ্ছ্বাসের সেই ঝরনাধারা শব্দের মালায় গাঁথা হয়ে প্রকাশিত হতে পারেনি। স্বাধীন দেশে পত্র-পত্রিকায় রুদ্ধ আবেগের অর্গল খুলে যায়। আমাকে নিয়ে লেখার যেন হিড়িক পড়ে যায়। এমনকি কোনো কোনো পত্রিকায় আমাকে নিয়ে প্রকাশিত হয় বিশেষ সংখ্যাও। দেশের খ্যাতিমান এবং তরুণ লেখক ও সাংবাদিকদের কলমের শব্দরাজির বন্যায় যেন আমি ডুবে যেতে থাকি। বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আবদুল হামিদ, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, আতাউল হক মল্লিক, আবেদ খান, ইকরামউজ্জমান, মোঃ আবু ইউসুফ, মুহম্মদ শাহজাহান প্রমুখ আমাকে নিয়ে লেখেন। এমন কোনো পত্রিকা নেই, যেখানে আমাকে নিয়ে লেখা হয়নি। ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখকদের কাছে বরাবরই আমি কৃতজ্ঞ ও ঋণী। আমি সব সময় তাদের প্রশ্রয়, ভালোবাসা, সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়ে আসছি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এ ধারা চলে আসছে। আমাকে নিয়ে তাদের যে অনিঃশেষ আগ্রহ ও কৌতূহল, তা আমার জীবনের পরম এক পাওয়া।
১৯৭২ সালের আগস্টে ভারতের মুর্শিদাবাদে দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে যায় বাংলাদেশ দল। তখন মুর্শিদাবাদ থেকে বহরমপুর পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার (প্রায় ৪৮ মাইল) সাঁতার পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ দূরপাল্লার সাঁতার হিসেবে পরিচিত। তাতে অংশ নেন বাংলাদেশ দলের দুই সাঁতারু রাজশাহীর রওশন আলী ও পাবনার আলতাফ হোসেন। ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক সাঁতারু ব্রজেন দাস ও কোচ ছিলাম আমি। এ প্রতিযোগিতায় রওশন আলী প্রথম ও আলতাফ হোসেন তৃতীয় হন। রওশন সময় নেন ১২ ঘন্টা ৪৩ মিনিট। এই সাফল্য দারুণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে রওশন আলীই বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণপদক আনার কৃতিত্বের অধিকারী। তাদের এই সাফল্যের জন্য তারা আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালেও একই প্রতিযোগিতায় রেকর্ড গড়ে প্রথম হন রওশন আলী। ১৯৭২ সালে প্রথম জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। আমিও তাতে অংশ নেই। ঢাকা সুইমিং কাবের হয়ে আমি অংশ নেই ওয়াটারপোলোতে। ১৯৬৩ সালে প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ঢাকা সুইমিং কাব। আমাদের দলের সাঁতারুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেনÑ তালেব আলী, শাহাবুদ্দিন, আবদুল মান্নান প্রমুখ। আমাদের দল সেমিফাইনাল যায়। আমিও গোল করি। অবশ্য ওয়াটারপোলোতে অংশ নেয়ার চেয়ে এ খেলাটির আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে অন্যদের ধারণা দেয়াটাই ছিল আমার জন্য বড় একটি তৃপ্তি। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি কলকাতায় এশিয়ান গেমসে ওয়াটারপোলোতে পদকজয়ী দলের সদস্য মোতালেবের কাছে ওয়াটারপোলোতে জ্ঞান অর্জন করি। সেটাই হয়ে যায় আমার বড় পুঁজি।
১৯৭৩ সালে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় শক্তিশালী দল গঠন করে বস্ত্র শিল্প সংস্থা, বিটিএমসি। সে বছর ছিল তাদের জয়জয়কার। মোশাররফ হোসেন খান, শাহজাহান মিজি, রাজ্জাক পাটওয়ারী দাপট দেখান। ওয়াটারপোলোতে বিটিএমসির হয়ে অংশ নিয়ে আমি ফাইনালেও খেলি। আমাদের দলে ছিলেন কালীপদ, নান্নু, মোঃ সাইদ, নাসির আহমেদ, তালেব আলী, মোঃ সোলেমান ও আমি। ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল সেনাবাহিনী দল। খেলা শুরুর ২ মিনিটের সময় দু’দলের স্কোর যখন ১-১ গোল, তখন বলা-কওয়া নেইÑ রেফারি এস এম ইস্রাফিল হঠাৎ আমাকে পানি থেকে তুলে দেন। তার সিদ্ধান্ত উপস্থিত সবাইকে হতবাক করে দেয়। কী কারণে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা সবার কাছে রহস্য হয়ে আছে। আমার অনুপস্থিতিতে দুর্বল হয়ে পড়ে আমাদের দল। এরপর রেফারির পক্ষপাতিত্বমূলক খেলা পরিচালনার জন্য আমাদের দল সহজেই হেরে যায়। এ বিষয়ে সে সময় পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেবার জাতীয় সাঁতার দেখার জন্য অনেক মহিলা দর্শকও উপস্থিত ছিলেন। চাঁদপুরে সাঁতারে মাসব্যাপী ট্রেনিং ক্যাম্প করি। এর ফলে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ভালো করে চাঁদপুর। কৃতিত্ব দেখান নজরুল, হাই প্রমুখ। ১৯৭৩ সালে ভারতের পাতিয়ালায় সাঁতারে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আমার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা ষড়যন্ত্রের কারণে আমাকে যেতে দেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেতে না দিয়ে বলেন, ভারতে গেলে আমি নাকি আর ফিরবো না। এটা আমার জীবনে বড় কষ্টকর এক স্মৃতি হয়ে আছে।
সে বছরটা আমার কোনো দিক দিয়েই ভালো যায়নি। চাঁদপুরের এক ব্যবসায়ীকে প্রায় ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। এই টাকা ফেরত না পেয়ে আমি অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে যাই। আমার থাকা-খাওয়ার পর্যন্ত কোনো জায়গা ছিল না। এমনকি কমলাপুর রেল স্টেশনে আমাকে রাত কাটাতে হয়েছে। সে এক দুর্বিষহ জীবন! আমি যেন জীবনতরীর প্রচ- এক ঘূূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে যাই। কঠিন এক বাস্তবতায় জীবন সংগ্রামে হাবুডুবু খেতে থাকি। জীবন যে কত কঠিন, তা পলে পলে অনুভব করতে থাকি। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠি। তবে ভেঙে না পড়ে টুকটাক ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। মাসিক ৭০ টাকা দিয়ে ঢাকার যুগীনগরে বাসা ভাড়া নেই। আমার বাসাটা হয়ে ওঠে সাঁতারুদের আড্ডাখানা। মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুরের অনেক সাঁতারু ঢাকা এসে আমার বাসায় আস্তানা গাড়তেন। আমি যেহেতু জাতীয় প্রতিযোগিতায় ওয়াটারপোলো করতাম, এজন্য নিজে প্র্যাকটিস করতাম, অন্যদেরও দেখিয়ে দিতাম।
অনেক দিন আড়ালে থাকার পর ফের বুকের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করতে থাকেÑ দূরপাল্লার সাঁতারে নতুন কিছু করার। ঢাকা-চাঁদপুর সাঁতার কেটে দূরপাল্লার সাঁতারে আবদুল মালেক যে রেকর্ড গড়েন, তারচেয়েও বড় কিছু করার পরিকল্পনা করি। অনেক হিসাব-নিকাশ করে দেখলাম, ঢাকার মিরপুর থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ১১০ কিলোমিটার অর্থাৎ ৭০ মাইল সাঁতার কাটলে দূরপাল্লার সাঁতারে নতুন এশীয় রেকর্ড গড়া সম্ভব হবে। ইতিপূর্বে ১৯৬৮ সালে ভারতের মিহির সেন ৬১ মাইল অতিক্রম করে এশীয় রেকর্ড গড়েন। তার রেকর্ড ভাঙা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়নি। এ নিয়ে অনেকের কাছে ধর্ণা দেই। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দিতে চায়নি। তদানীন্তন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে মুজিবনগর থেকে পরিচয়। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি উদ্যোগী হন। অবশ্য সে সময় নতুন সরকারের একটা পরিকল্পনা ছিল দেশের সুনাম যাতে বৃদ্ধি পায়, তেমন কিছুতে সহযোগিতা করা। এ কারণে তাদের কাছে আমার পরিকল্পনাটি যুৎসই মনে হয়। তাছাড়া অতীতে যেহেতু এমন কীর্তি গড়েছি, তাই সরকার আমার প্রতি আস্থা রাখতে সক্ষম হয়। এ সময় আরো এগিয়ে আসেন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা আমান চৌধুরী, কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কালু চৌধুরী, রাশিদুল হাসান খান প্রমুখ। কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে ১৯৭৪ সালের ১ ডিসেম্বর এ সাঁতার আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। এটা ছিল রোমাঞ্চকর ও দুঃসাহসী এক প্রচেষ্টা। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার প্রধান প্রতিবন্ধকতা তার হীম-শীতল পানি। আমার বুকের গভীরে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার সুপ্ত বাসনা থাকায় তারই প্রস্তুতি হিসেবে শীতকালে ঢাকা-চাঁদপুর সাঁতার কাটার সিদ্ধান্ত নেই। আমার এই প্রচেষ্টায় আমার সঙ্গে আর কেউ সামিল হননি। মিরপুর ব্রিজ থেকে একাই সাঁতার শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। সাঁতার দেখার জন্য চারপাশ লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়। আমার নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুত রাখা হয় ওয়্যারলেস ফিট করা লঞ্চ, স্পিডবোট ও নৌকার বহর। বিকেলে সাঁতার উদ্বোধন করেন তদানীন্তন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি বলেন, এ উদ্যোগ সফল হলে তাতে দেশের সুনাম বাড়বে এবং সাঁতারের ইতিহাসে তা আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সাঁতারু ব্রজেন দাস, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোজাফফর হোসেন পল্টু। অনেক আনন্দ ও উল্লাসের মধ্য দিয়ে ৫টা ৩৬ মিনিটে শুরু করি সাঁতার। আমার সঙ্গে ছিলেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর নূর হোসেন স্যার। আমার লাইফ সেভার ছিলেন গণেশ কর্মকার, মোঃ রফিক, আবদুল হাই মদন, স্বপন ভঞ্জ, সুখরঞ্জন মজুমদার, ওজিদ মজুমদার, দীপক সরকার। বড় গলা করে রেকর্ড ভাঙার অঙ্গীকার করেছি। কিন্তু বিষয়টি সহজ ছিল না। আমাকে পাড়ি দিতে হবে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মতো উত্তাল নদী। সাত-সাতটি নদী পাড়ি দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়! এক-একটা নদীর মেজাজ এক-একরকম। আর জোয়ার-ভাটার চিরন্তন সমস্যা তো আছেই। উজান স্রোত ও কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করে আমাকে এগিয়ে যেতে হয়। সে যে কত কষ্টকর সংগ্রাম, তা বোঝানো যাবে না। কান্তি, অবসন্নতা ও ঘুম এসে আমাকে থামিয়ে দিতে চায়। থৈ থৈ পানির মধ্যে একা ও নিঃসঙ্গ আমি। সামনের দূরত্বকে মনে হয় অসীম। চলার পথ অন্তহীন। এ চলার যেন শেষ নেই। শরীর চলতে চায় না। তারপরও মনের শক্তি ও দৃঢ়তাকে সম্বল করে এগিয়ে যেতে থাকি। আমার চোখের সামনে তখন ভাসছে প্রতিশ্রুতি এবং দেশের সম্মান ও গৌরবের বিষয়টি। তা রক্ষা করার একটা তাগিদ আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তবে দর্শকদের উৎসাহ-উদ্দীপনাও আমাকে প্রেরণা দেয়। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমি গন্তব্যে পৌঁছাই। তখন রাত ১২টা ৪৫ মিনিট। পেরিয়ে এসেছি ৩১ ঘন্টা ১৫ মিনিট সময়। গভীর রাতে আমি চাঁদপুরে পৌঁছানোর পর শীতকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার লোক তুমুল হর্ষধ্বনি সহকারে আমাকে সংবর্ধনা জানায়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আমাকে দ্রুত চাঁদপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমার এই কৃতিত্বে চারপাশে লাগে উৎসবের রঙ। বিশেষ করে চাঁদপুরবাসী ফেটে পড়ে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে।

এগার.
জীবনে বড় একটি স্বপ্ন ছিল ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্রজেন দাস, আবদুল মালেক, ভারতের পশ্চিম বাংলা থেকে মিহির সেন, আরতী সাহাকে দেখেছি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। এঁদের আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম। তারা যেটা পেরেছে, সেটা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। আমি তো তাদের চেয়ে অনেক বেশি দূরপাল্লার সাঁতার কেটেছি। অনেক প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি। ভেতরে ভেতরে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার জন্য প্রস্তুত করি নিজেকে। ইংলিশ চ্যানেলের চেয়ে তিন গুন বেশি পাড়ি দেই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেহেতু ইংলিশ চ্যানেলের আলাদা মর্যাদা ও সুনাম-সুখ্যাতি, তাই মনটা পড়ে থাকে সেখানে। কল্পনায় পাড়ি দিয়েছি ইংলিশ চ্যানেল। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য আমি সব রকম পরিবেশে সাঁতার কেটে নিজেকে গড়ে তুলি। আমার এই কল্পনাকে উসকে দিয়েছে নানাজনের আশ্বাস। যখনই কোনো দূরপাল্লার সাঁতারে সাফল্য দেখিয়েছি, তখন আমাকে আমার ইচ্ছে পূরণের কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু যখন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে চেয়েছি, তখন আর সেই সহযোগিতা পাওয়া হয়নি। এই চ্যানেল পাড়ি দিতে হলে যে ধরনের যোগাযোগ, সহযোগিতা ও অর্থ প্রয়োজন, তা আর পাইনি। অনেকবার চেষ্টার পর এক সময় স্বপ্নের রঙটা ফিকে হয়ে যায়। দূরপাল্লার সাঁতারটা আমার কাছে বরাবরই ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জে আমি সব সময় জয়ী হয়েছি। আমাকে সবাই চেনেন, জানেন এই দূরপাল্লার সাঁতারের জন্য। আর এই দূরপাল্লার সাঁতারের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ইভেন্ট হিসেবে পরিচিত ইংলিশ চ্যানেল আমার কাছে রয়ে যায় অধরা হয়ে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট হয়ে আছে।
স্বাধীনতার পর চাঁদপুরের ক্রীড়াঙ্গন তো বটেই, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমি হয়ে উঠি অপরিহার্য। যে কোনো কর্মকা-ে কিংবা যে কোনো সংগঠন গড়ে উঠলে তাতে আমার সম্পৃক্ততা ছিল। শিশু-কিশোর সংগঠন, সঙ্গীত বিদ্যালয়, জেসাস, সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকায় আমি জড়িয়ে ছিলাম। আমি ঢাকার দৈনিক পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছি। ১৯৭২-৭৩ সালে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় নিজে প্রতিযোগী হওয়ার পাশাপাশি আমি কুমিল্লা জেলা দলের কোচের দায়িত্ব পালন করি। ১৯৭৩ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আর্মিদেরকে এক সপ্তাহের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেই। ১৯৭৫ সালে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ওয়াটারপোলোতে পাবনার হয়ে অংশ নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠি। এটা ছিল প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে আমার শেষ অংশগ্রহণ।
মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হয়নি। বয়সও বেড়েছে। প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে অংশ নেয়ার বয়স ও মন হারিয়ে ফেলি। কিন্তু সাঁতারের প্রতি ভালোবাসা ও মায়া আমি কখনো পরিত্যাগ করতে পারিনি। সাঁতার কোচ ও সংগঠক হিসেবে আগেই জড়িয়েছিলাম। এবার পুরোদমে তাতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। সাঁতারু হিসেবে অবসর নেয়ার পর আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য একটু মনোযোগী হই। চাঁদপুরে অনেক খেটেখুটে একটা কনফেকশনারি দেই। ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে যায় তা। কিন্তু মনটা ক্ষণে ক্ষণে উদাসী হয়ে যায়। আমাকে দুর্নিবার টানতে থাকে সাঁতার। ব্যবসার কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলি। আর যাই হোক, ব্যবসায় ফাঁকি চলে না। বুঝতে পারলাম, আমাকে দিয়ে ব্যবসা হবে না। আমি আবার ফিরে আসি আমার আসল জায়গায়। সাঁতার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কুমিল্লায় আয়োজন করি ওয়াটারপোলো ট্রেনিং ক্যাম্প। ১৯৭৬ সালে মেয়েদের ট্রেনিং ক্যাম্প করাই। প্রশিক্ষণের জন্য যেখান থেকেই আমন্ত্রণ পাই, ছুটে যাই সেখানে। আমার কাছে সাঁতার শিখে অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনÑ ফাতেমা বেগম, বেবী পাল, অনিমা সাহা, মায়া দে, কল্যাণী লোধ, রেবেকা সুলতানা, মীরা দে, সেলিনা আখতার, আলো আফতাব, মাধবী দে, তপু মজুমদার, তপন দে, সায়মন, মোহাম্মদ আলী, হাসেম, কামরুজ্জামান প্রমুখ। স্বাধীনতার পর দূরপাল্লা ও জাতীয় সাঁতারে আমার কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে সাফল্য দেখান চাঁদপুরের আবদুস ছালাম, নজরুল ইসলাম, মোঃ কামরুজ্জামান, মোঃ আবুুল হাশেম, সমর কুমার দে, বাদশা মিয়া প্রমুখ। তাছাড়া বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও শহরে বসবাসকারীদের বড় একটি অংশের সঙ্গে সাঁতারের কোনো যোগাযোগ নেই। এ কারণে সাঁতার না জানা বালক, কিশোর, তরুণদের সাঁতার শেখার উদ্যোগ নেই। অল্প বয়সী সাঁতারুদের মধ্যে আমি আমার স্বপ্নটুকু চারিয়ে দিতে পারছিÑ এটাই এখন আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। ১৯৭৬ সালে সেনাবাহিনী ও ১৯৭৯ সালে বিডিআরের ট্রেনিং ক্যাম্পের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়। আমার কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে মালেক নামের একজন সাঁতারু এশিয়ান গেমসের ওয়াটারপোলোতে জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেন। কুমিল্লার সাঁতারে আমি নিরলসভাবে কাজ করে যাই। কুমিল্লায় সাঁতারের বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করি। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সব বয়সীদের আমি সাঁতার প্রশিক্ষণ দিয়েছি। একাধিকবার কুমিল্লা জেলা দলের কখনো ম্যানেজার, কখনো কোচ হিসেবে ঢাকায় জাতীয় সাঁতারে অংশ নেই। ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপ, তাতে আমি ছিলাম চিফ টার্নিং জাজ। ১৯৯২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাফ সাঁতার প্রতিযোগিতায় যোগ দেই বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে। ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের লাহোরে আন্তর্জাতিক সুইমিং ফেডারেশন ও পাকিস্তান অ্যামেচার সুইমিং ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সুইমিং কোচিং ও টেকনিক্যাল অফিসিয়ালস কিনিকে যোগ দিয়েছিলাম। তাতে আমার সঙ্গে ছিলেন সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান ও লায়লা নূর। একই বছর ঢাকায় ষষ্ঠ সাফ গেমসে চিফ টার্নিং বিচারক ছিলাম এবং মশাল দৌড়ে অংশ নেই। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক হই। এ বছর দিল্লিতে অষ্টম এশিয়ান প্যাসিফিক এজ গ্রুপ সাঁতারে বাংলাদেশ দলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করি। ১৯৯৫ সালে সাফ সুইমিং-এ চিফ জাজ ছিলাম এবং ঢাকা অফিসার্স কাবের কোচ নিযুক্ত হই। অফিসার্স কাবের কোচ হিসেবেই আমার কাছে অনেকেই সাঁতার শিখেছেন। তাছাড়া আমার রুটি-রুজির ক্ষেত্রে বড় একটা অবদান রেখে চলেছে বনেদী এই কাবটি। নতুবা আমি ঢাকা শহরে টিকে থাকতে পারতাম না। ১৯৯৮ সালে সাঁতার ফেডারেশনের সদস্য ও ২০০২ সালে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হই। ২০০৩ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাঁদপুরে আমি অরুন নন্দী সুইমিং কাব গঠন করি। এ কাব জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক পায়। ২০০৩ সালে ভারতের কলকাতায় দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার ছিলাম। ২০০৪ ও ২০০৬ সালে ভারতে বিশ্ব দূরপাল্লার সাঁতারে পর্যবেক্ষক হিসেবে যাই। তবে জীবনে ছোট ছোট না পাওয়াগুলো কখনো কখনো স্মৃতির পাতায় যোগ করে দুঃখ-বেদনা। ২০০৬ সালে কানাডায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপ এবং ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে বাংলাদেশ দলের কোচ কাম ম্যানেজার হিসেবে মনোনীত হয়েও যেতে না পারাটা আমার জীবনের অন্তহীন এক আক্ষেপ হয়ে আছে। কারো কারো বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রের কারণে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমার যাওয়া হয়নি। আমার সাঁতার জীবনে অনেকভাবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছি। তার সঠিক হিসাব আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। তবে ১৯৯৬ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ও সম্মান। এ বছর চাঁদপুরে ঘটা করে আমার নামে একটি সুইমিংপুলের নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে কোনো সাঁতারুর নামে এই প্রথম কোনো ক্রীড়া স্থাপনার নামকরণ হলো। এটা আমার জীবনের জন্য বড় একটি গর্ব ও আনন্দ। চাঁদপুরের মানুষের এই ভালোবাসা ও ঋণ আমি কখনই শোধ করতে পারবো না। তাদের প্রতি আমার অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। চাঁদপুরের মাটিতে জন্ম নিতে পেরে আমার জীবন হয়েছে ধন্য ও সার্থক। সেই শৈশব থেকে আমি চাঁদপুরের মানুষদের বরাবরই আমার পাশে পেয়েছি। তারা আমার সুখে-দুঃখে-আনন্দে হাত বাড়িয়ে দিতে একটুও কার্পণ্য করেননি। সাঁতারে যদি আমার বিন্দুমাত্র অবদান থেকে থাকে, তার পেছনে রয়েছে চাঁদপুরের মানুষের অপরিসীম ভূমিকা।
আমার এ জীবন প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তিতে ভরা। জীবনে অনেক কিছুই হয়তো পাইনি। সংসার, সন্তান, সম্পত্তি কিছুই নেই। পারিবারিক ও আর্থিকভাবে আমি রিক্ত ও নিঃস্ব। মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের একটি কক্ষে নিঃসঙ্গভাবে কাটছে জীবন। অসুস্থ হলে একটুখানি সেবা, একটু আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ নেই। কখন, কোথায় পড়ে থাকি, নিজেই জানি না। তারপরও জীবনে অতৃপ্তি নেই। এ জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছি। জীবিত থাকাকালে আমার নামে চাঁদপুর সুইমিংপুলের নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাঁতারের প্রসঙ্গ এলে আমার নামটিও কম-বেশি আলোচিত হয়। এটা একজন মানুষের জীবনে অনেক বড় পাওয়া। সবচেয়ে বড় কথাÑ এ জীবনে অনেক মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছি। এখনও কারো সঙ্গে দেখা হলে সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। জানতে চান আমার খোঁজ-খবর। আমার প্রতি তাদের ভালোবাসা আছে বলেই না আমার প্রতি তাদের এত আগ্রহ। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় অর্জন জীবনে আর কি আছে? তাই আমি অন্তত বলতে পারি নাÑ ‘এ জীবন লইয়া আমি কী করিব?’

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বকাপ ফুটবল কেন বাংলাদেশের উৎসব? / দুলাল মাহমুদ