বিশ্বকাপ ফুটবল কেন বাংলাদেশের উৎসব? / দুলাল মাহমুদ
বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে’। প্রকৃতি থেকে বসন্ত কবেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু এই গ্রীষ্মেও আমাদের চারপাশে যেন মৌ মৌ করছে বসন্ত। সর্বত্রই মধুর মিলনের আবাহন। উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে সারা দেশ। তবে এই উৎসব, এই বসন্ত একটু অন্যরকম। নয়নজুড়ানো লাল টকটকে কৃষ্ণচুড়া, কোকিলের কুহতান, বাসন্তী সাজে উজ্জ্বল-উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণী, সুরে সুরে মাতাল করা পরিবেশ না থাকলেও তারচেয়ে কোনো অংশেই কম নয় এই উৎসব, এই বসন্ত। আর এই উৎসব, এই বসন্ত নিয়ে এসেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রকৃত ফুলের সৌরভ, পাখির কলতান না থাকলেও সবার বুকের মধ্যে যেন ফুটেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফুল আর পাখির কূজন। পোশাকেও লেগেছে বাসন্তী হাওয়া। তবে বসন্ত ঋতু উদযাপনের মতো তা শুধু লাল-হলুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কত রকম রঙে নিজেদের রাঙিয়েছেন ফুটবল অনুরাগীরা। হলুদ-নীল, আকাশী-নীল, লাল, কমলা, নীল, সাদা, কালো, সবুজ, হলুদের বিচ্ছুরণে মনের আকাশে খেলে যায় রঙধনু। তবে হলুদ আর আকাশী নীলের বর্ণিল সমাহারই বেশি। ঘরে ঘরে লাতিন ঘরানার ফুটবলের দুই শিল্পিত দেশ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জার্সির জয়জয়কার। বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে হারে বিভিন্ন দেশের জার্সি বিক্রি হয়, বোধকরি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেনেও তাদের জার্সির এত কদর নেই। আর বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর পতাকা কতভাবেই না শোভা পাচ্ছে। শহরের প্রতিটি এলাকা তো বটেই, এমনকি এক একটি গ্রাম হয়ে উঠেছে জাতিসংঘের সদর দফতর। নানান দেশের পতাকায় পতাকায় সেজে উঠেছে দেশের প্রতিটি অলি-গলি-পাড়া-মহল্লা। বহুতল ভবন থেকে শুরু করে টিনের ঘর, গাছ-গাছালি, ফসলের জমি, বিদ্যুতের খুঁটি, গাড়িতে, লঞ্চে, নৌকায় পতাকার রকমারি বাহার। আকার-আকৃতিতেও চমক লাগানো। কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে চলছে তার তীব্র প্রতিযোগিতা। এমনকি রেষারেষিও। ঢাউস ঢাউস পতাকা দেখলে বিদেশিরাও অবাক হয়ে যাবেন। ফিফা র্যাংকিং-এ ১৬৭তম স্থানে থাকলেও বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে মাতামাতিতে র্যাংকিং-এর শীর্ষে স্থান পেতে পারে বাংলাদেশ। পেশাদার আর অপেশাদার শিল্পীদের হাতে পতাকার রঙে রঙে সজ্জিত হয়েছে বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, খোলা চত্বর, পরিত্যক্ত দেওয়াল। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে ধুম পড়ে গেছে টেলিভিশন ক্রয়ের। বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে জায়ান্ট স্ক্রীন। ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত বাজছে বিশ্বকাপের থিম সং জেনিফার লোপেজ, পিটবুল ও ক্লওদিয়া লেত্তির সম্মিলিত গান ‘উই আর ওয়ান ওলে ওলে ওলে’। তবে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে গতবারের অফিসিয়াল সংগীত শিল্পী শাকিরার ‘লা লা লা লা লা লা’। রাত জেগে খেলা দেখার জন্য চলছে নানান রকম আয়োজন। বিশ্বকাপ ফুটবলের এই ডামাডোলে কুমার বিশ্বজিৎ-এর গানটি ফুটবলপ্রেমীদের বুকের মধ্যে গুঞ্জন তুলছে ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে/ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে’।
বিশ্বকাপ ফুটবলকে উপলক্ষে আমাদের জীবনে যে একটি উৎসব যোগ হয়েছে, এটি কি বাংলাদেশের উৎসব? বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে বাংলাদেশের যে যোজন যোজন দূরত্ব, তারপরও কী করে এটি আমাদের উৎসব হয়ে উঠলো? কীভাবে বিশ্বকাপকে এত আপন করে নিল এ দেশের মানুষ? হৃদয়ে কেন এত তোলাপাড় চলে বিশ্বকাপকে ঘিরে? কেন ভিন দেশী জার্সি ও পতাকা নিয়ে এত মাতামাতি? আসলে অল্প কথায় এর সদুত্তর দেওয়া কঠিন। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের মতো ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ জাতি বিশ্বে খুবই কম আছে। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। শক্তির আরাধনা করে। ভালোবাসার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে দ্বিধা করে না। আর বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো মহোৎসবে সুন্দরতা, শক্তিময়তা ও ভালো লাগা একই ধারায় এসে মিলে যায়। আর এমন একটি উপলক্ষ পেলে তো বাঙালির রক্তে নাচন লাগবেই। যে কারণে দূরের হলেও বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। হয়ে উঠেছে আমাদের নিজস্ব উৎসব।
১২ জুন ২০১৪,
dulalmahmud@yahoo.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন