বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন : পেছন ফিরে দেখা/ দুলাল মাহমুদ
পেছন ফিরে তাকালে ভিড় করে স্মৃতির মরীচিকা। পাওয়া আর না পাওয়ার যোগ-বিয়োগ। কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? অবশ্য স্মৃতির পাতায় শুধু বেদনা থাকে না, থাকে আনন্দেরও উপলক্ষ। তাই যুগপৎভাবে ফিরে ফিরে আসে আনন্দ-বেদনা। আর এই আনন্দ-বেদনার হলাহল পান করেই এগিয়ে যেতে হয় অনিশ্চিত আগামীর পথে। বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে কী পেলাম আর কী পেলাম না, সেই অঙ্কও কষতে হয়।
দেখতে দেখতে চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গেলে অঙ্কের হিসাব মিলতে চায় না। একটা আশা-নিরাশার দোলচল। অনেকটা ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুলের মতো। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম নায়ক তিনি। তাঁর কৃতিত্বে অনেক গৌরবময় মুহুর্ত অবলোকন করেছে বাংলাদেশ। আবার এ দেশের ক্রিকেটের কলঙ্কের নায়কও তিনি। দূষিত করেছেন ক্রিকেটকে। একই সঙ্গে তিনি গৌরব আর অগৌরবের প্রতিনিধি। তদ্রæপ অবস্থা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেরও। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য যেমন আছে, আছে ব্যর্থতার আহাজারি। আছে গৌরব করার মুহুর্ত, তেমনি আছে অগৌরবের দৃশ্যপট। তবে ক্রীড়াঙ্গনে যতটা এগিয়ে যাবার কথা ছিল, ততটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কেন যায়নি সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
ক্রীড়াঙ্গন বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুটবলের সেই সোনালী দিনগুলো। যে দিনগুলোতে ফুটবলের জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে সারা দেশ। ফুটবলের স্মায়ুক্ষয়ী উত্তেজনায় টগবগিয়ে ফুটেছে ক্রীড়ানুরাগীরা। বিনোদন বলতে ফুটবলই ছিল সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বলা যায়, ফুটবল হয়ে ওঠে আমাদের জীবন যাপনেরই অংশ। আনন্দ উৎসবের প্রধান উপলক্ষ। এই ফুটবলকে কেন্দ্র করে অকালে কত জীবন ঝরেছে, কত শত জন আহত হয়েছেন, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। তাতেও কিন্তু উত্তেজনা থিতু হয়নি। জীবনকে বাজি রেখে দর্শক-সমর্থকরা ছুৃটে আসতেন ফুটবল মাঠে। ফুটবলকে নিয়ে তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। নির্দোষ বিনোদনই ছিল মুখ্য। তবে ফুটবল অনুরাগীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতেন। একদিকে ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালো জার্সির মোহামেডান স্পোর্টিং কাব আর অন্যদিকে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের তারুণ্যের প্রতিনিধি আকাশী-নীলের আবাহনী ক্রীড়া চক্র। এই দুই কাবকে কেন্দ্র্র করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতে সহজাতভাবেই গড়ে ওঠে সমর্থক গোষ্ঠী। দুই দলের খেলা থাকলে পতাকায় পতাকায় ছেয়ে যেত পুরো দেশ। যারা এই আবেগ, এই উচ্ছ¡াস, এই ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করেননি, তাদের কাছে এটি মনে হবে, অলৌকিক কোনো ব্যাপার। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্য না পেলেও দর্শকদের তেমন অতৃপ্তি ছিল না। দর্শকরা ছিলেন নান্দনিক ফুটবলের পূজারী।
দীর্ঘ এক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু হয়ে ফুটবলের পথচলা। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গৌরবকে বুকে নিয়ে ফুটবল মাঠে গড়ায়। ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রদর্শনী ফুটবলে অংশ নেয় রাষ্ট্রপতি একাদশ এবং মুজিবনগর একাদশ। এটিই বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচ। মুজিবনগর একাদশে খেলেন স্বাধীন বাংলার ফুটবলাররা। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম বিদেশি দল কলকাতার মোহনবাগান অ্যাথলেটিক কাব। ঢাকা স্টেডিয়ামে মোহনবাগানের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের নির্বাচিত একাদশ। সালাউদ্দিনের গোলে এ ম্যাচে বাংলাদেশ জয়ী হয়। বাংলাদেশ প্রথম কোনো টুর্নামেন্টে অংশ নেয় ১৯৭২ সালে আসামের গৌহাটিতে লোকপ্রিয় বরদুলই ট্রফিতে। ফিফার স্বীকৃতি না থাকায় সে সময় বাংলাদেশ দল ‘ঢাকা একাদশ’ নামে খেলে এ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। তবে আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ জাতীয় দল প্রথম অংশ নেয় ১৯৭৩ সালে মারদেকা টুর্নামেন্টে। অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। এ টুর্নামেন্টে থাইল্যান্ডের সঙ্গে কোয়ালিফাইং ম্যাচটি নির্ধারিত সময়ে ২-২ গোলে অমীমাংসিত থাকলে টাইব্রেকারে বাংলাদেশ ৫-৪ গোলে জয়লাভ করে। নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে গোল করেন এনায়েত ও সালাউদ্দিন। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আয়োজন ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল টুর্নামেন্ট। এ টুর্নামেন্টে ১৮টি দেশ অংশ নেয়। এত বড় ফুটবল উৎসব আর কখনো আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। সাড়া জাগানো এই টুর্নামেন্টে হাসানের গোলে বাংলাদেশ ইয়েমেনকে হারিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম জয় আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের দ্বিতীয় গ্রæপের খেলায় চুন্নু, হালিম ও সালাউদ্দিনের গোলে বাংলাদেশ ৩-২য়ে জয়ী হয়। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ প্রেসিডেন্টস গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ ‘লাল’ দল। বাংলাদেশ প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে শিরোপা জেতে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে। চার জাতির এই টুনামেন্টে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন মোনেম মুন্না। বাংলাদেশের ফুটবলের গৌরবময় অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের নাম। বাংলাদেশের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৭৬ সালে তিনি হংকং-এর পেশাদার লিগে ‘ক্যারোলিন হিল কাব’-এর হয়ে খেলার গৌরব অর্জন করেন। এই কৃতিত্ব আর কোনো ফুটবলার দেখাতে পারেননি। তবে বাংলাদেশ ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার মোনেম মুন্না ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গল কাবের হয়ে তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের আর কোনো ফুটবলার এতটা সাড়া জাগাতে পারেনি। মুন্না ছাড়াও কলকাতা লিগে খেলেছেন আসলাম, ওয়াসীম, কায়সার হামিদ, রুমী, সাব্বির প্রমুখ। ১৯৯৬ সালে এএফসির দৃষ্টিতে ‘প্লেয়ার অব দ্য মানথ‘ ফুটবলার হন আলফাজ। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্যের মধ্যে রয়েছে ১৯৯৯ সালে জুয়েল রানার নেতৃত্বে সাফ গেমসের ফুটবল স্বর্ণ জয় এবং ২০০৩ সালে সাফ ফুটবলে রজনী কান্ত বর্মণের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। একটা সময় ঢাকার মাঠে আন্তর্জাতিক ফুটবলের রমরমা আসর বসতো। সেই দিনগুলোও হারিয়ে গেছে। বিশেষ করে ১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া ‘আগা খান গোল্ডকাপ’ অসম্ভব জনপ্রিয় একটি টুর্নামেন্ট ছিল। বিদেশি সেরা সেরা দলগুলো এই টুর্নামেন্টে খেলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। ১৯৮১ সালের পর দর্শকপ্রিয় এই টুর্নামেন্টটি আর আয়োজিত হয়নি। তার পরিবর্তে ১৯৮১ সাল থেকে আয়োজিত হয় ‘প্রেসিডেন্টস গোল্ডকাপ’। এই টুর্নামেন্টও দর্শকরা লুফে নিতে দ্বিধা করেনি। এটিও ১৯৯৩ সালে শেষবারের মতো আয়োজিত হয়। এরপর ‘বঙ্গবন্ধু কাপ’ আয়োজন করা হয় মাত্র দুইবার। সর্বশেষ আয়োজন ১৯৯৯ সালে। তবে ঢাকার মাঠে এ যাবৎ কালের আলোচিত ঘটনা ছিল, ২০১১ সালে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও লিওনেল মেসির দল আর্জেন্টিনা এবং নাইজেরিয়ার মধ্যেকার প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন। তারপরও ফুটবল তার আকর্ষণ, গø্যামার, ক্যারিশমা এখনও ফিরে পায়নি। প্রায় দর্শকশূন্য অবস্থায় খেলা হয় ফুটবল। ফুটবল যে দর্শক হৃদয় থেকে হারিয়ে গেছে, এটা বলা যাবে না। বিশ্বকাপ ফুটবল এলেও পুরো দেশ জেগে ওঠে। বিদেশি পতাকায় নতুনভাবে সেজে ওঠে বাংলাদেশ। এমনকি দর্শকরা রাত জেগে বিদেশি লিগের খেলা দেখেন। ভালো ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ ফুটবলের সন্ধান পেলে দর্শকরা ঠিকই ছুটে আসতে দ্বিধা করেন না। ফুটবল এমন একটি খেলা, যারা মায়াবী আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এত আবেগ, এত উচ্ছ¡াস, এত ভালোবাসা সত্তে¡ও ফুটবল সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারছে না। এ দেশের ফুটবলে যে ইতিহাস, যে ঐতিহ্য, তাতে করে ফুটবল এই পর্যায়ে থাকার কথা নয়। এক সময় যে দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ফুটবল খেলেছে কিংবা আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের পরে খেলতে এসেছে, তার আজ অনেক দূরে চলে গেছে। সে সব দেশগুলোর নাগাল পাওয়া এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ফুটবলের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ, সাংগঠনিক ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার কারণেই যে ফুটবলের নামে দর্শকদের বাধভাঙ্গা জোয়ার নামতো, সেই ফুটবলে এখন দর্শক খরায় ধুকছে। এরচেয়ে করুণ পরিণতি আর কী হতে পারে? যথাযথ পরিচর্যা পেলে ফুটবল যে আবার জেগে ওঠতে পারে, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ফুটবলের জনপ্রিয়তায় যখন ভাটা পড়তে থাকে, তখন জেগে ওঠে ক্রিকেট। এ অঞ্চলে ক্রিকেটের চর্চা অনেক আগে থেকে হলেও সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে বেশ সময় লেগে যায়। তবে ক্রিকেটটা মূলত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও কিছুটা জটিল প্রকৃতির হওয়ায় খেলাটি সর্বসাধারণের প্রিয় হয়ে ওঠতে পারেনি। কিন্তু আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বদলে যায় দৃশ্যপট। এখন তো ঘরে ঘরে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়েছে। শিশু থেকে বয়স্ক মানুষের আলোচনায় ক্রিকেট। ড্রয়িং রুম, ছাদ, গাড়ির রাখার গ্যারেজে ক্রিকেট খেলা হয়। এমনকি গ্রামের নদীর তীরে, মেঠোপথে কিংবা এক টুকরো খোলা জায়গা থাকলেই ক্রিকেটের জয়জয়কার। ক্রিকেটটা এখন আর বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা হয়ে ওঠেছে সামাজিকতার অংশ, স্ট্যাটাস সিম্বল।
স্বাধীনতার পর ক্রিকেট খেলা শুরু হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১৯৭৬-৭৭ সালে। সেবার ইংল্যান্ডের বনেদি কাব মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট কাব (এমসিসি) বাংলাদেশ সফরে আসে। এরপর একে একে আসতে থাকে শ্রীলঙ্কা দল, ভারতের পশ্চিম বাংলা দল, পাকিস্তানের ওমর কোরেশি একাদশ। সে সময় বাংলাদেশকে লজ্জাজনক অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার ডাবল ফিগার করতে পারলেই সন্মানজনক মনে করা হতো। রান দেওয়ার ক্ষেত্রে বোলাররা দারুণ উদারতা দেখালেও প্রতিপক্ষের উইকেট পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশ ১৯৭৭ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্য হয়। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করতে হয় ব্রিটিশ সাংবাদিক রবিন মার্লারের কথা। এই সাংবাদিক ভদ্রলোক বাংলাদেশ সফর শেষে তাঁর পত্রিকায় বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে মূল্যবান একটি প্রতিবেদন লেখায় আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার পথ সুগম হয়। ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি খেলতে শুরু করে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে থাকে ১৯৯০ সাল থেকে। সে বছর সৈয়দ কিরমানির নেত্বত্বাধীন ‘হায়দরাবাদ ডেকান বøজ’-এর বিপক্ষে জয়ী হয় ‘বিসিসিবি একাদশ’। নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেত্বত্বে ১৯৯৪ সালে মালয়েশিয়ায় সাত জাতির আন্তর্জাতিক জুনিয়র ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। বছরের শেষ দিকে দ্বিতীয় সার্ক ক্রিকেট ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারায় বাংলাদেশ। ১৯৮২ ও ১৯৯০ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিÑফাইনালে পৌঁছালেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কা। এই দুই দেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। আকরাম খানের নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ অনেক প্রতিকূলতার মাঝে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এই সাফল্য বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আমূল বদলে দেয়। ক্রিকেটের পালে লাগে উদ্দাম হাওয়া। ১৯৯৭ সালে ওয়ান ডে স্ট্যাটাস পেলেও বাংলাদেশ একদিনের ক্রিকেট খেলে আসছে ১৯৮৬ সাল থেকে। সে বছরের ৩১ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ ক্রিকেটে ইমরান খানের পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচ খেলে গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ। ভারতের হায়দরাবাদে কোকাকোলা ত্রিদেশীয় সিরিজে মোহাম্মদ রফিকের অল-রাউন্ড নৈপুণ্যে ১৯৯৮ সালের ১৭ মে কেনিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচে জয়ী হয়। ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম জয় পায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানে। কিন্তু ৩১ মে নর্থাম্পটনের কাউন্টি মাঠে বাংলাদেশ নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করে। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের বাংলাদেশ ৬২ রানে হারিয়ে দেয় ওয়াসীম আকরামের পাকিস্তানকে। ক্রিকেট যেন কুলপ্লাবী স্রোতের মতো সব কিছুকে ভাসিয়ে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায়। একই বছরের ১০ নভেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেত্বত্বে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলে বাংলাদেশ। এরপর বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। ইতোমধ্যে ওয়ান ডে ক্রিকেটে সব দেশের বিপক্ষেই জিতেছে বাংলাদেশ। প্রতিটি দেশই বাংলাদেশকে এখন সমীহর চোখে দেখে। ২০১২ সালে ঢাকায় এশিয়া কাপে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হেরে রানার্স-আপ হয়। ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়েকে ২২৬ রানে হারিয়ে প্রথম টেস্ট এবং ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্ট ড্র করে ১-০তে সিরিজ জয় করে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের ১৩ জুলাই স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৯৫ রানে হারিয়ে বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট এবং পরের টেস্টে ৪ উইকেটে হারিয়ে ২-০তে সিরিজ জয় করে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে চীনে এশিয়ান গেমসে ক্রিকেটে বাংলাদেশ পুরুষ দল স্বর্ণ ও মহিলা দল রৌপ্য পদক জয় করে। ক্রিকেটের মাধ্যমেই এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ প্রথম স্বর্ণ জয়ের গৌরব অর্জন করেছে। ওয়ান ডে স্ট্যাটাস পেয়েছে বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল। সাকিব আল হাসান টেস্ট ও ওয়ান ডে ক্রিকেটে দীর্ঘ সময় বিশ্বের সেরা অল-রাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আয়োজনের দিক দিয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় উইলস এশিয়া কাপ ক্রিকেট। এরপর ১৯৯৮ সালে রজতজয়ন্তী ত্রিদেশীয় স্বাধীনতা কাপ, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ১৯৯৯ সালে মেরিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ২০০০ সালে এশিয়া কাপ, ২০০৩ সালে টিভিএস কাপ, ২০০৮ সালে কিটপ্লে কাপ, ২০০৯ সালে ত্রিজাতি টুর্নামেন্ট, ২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সহ ৮টি ম্যাচ, ২০১২ সালে এশিয়া কাপ টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। ক্রিকেট একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, সবার মনে আশাবাদের সঞ্চার করতে পেরেছে ক্রিকেট। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জড়িত থাকার বিষয়টি বড় লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। তবে এর রেশ দ্রæত কাটিয়ে ওঠে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের হাজারো কিশোর-তরুণ যে স্বপ্ন নিয়ে বড় হচ্ছে, তা কখনো বৃথা যেতে পারে না।
হকিতে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। সেই সম্ভাবনাকে ঠিক মতো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ হকিতে বাংলাদেশের নৈপুণ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। জুম্মন লুসাইয়ের হ্যাটট্টিকে ইরানকে ৩-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। শক্তিশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতা গড়ে তুলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ এক গোলে হেরে যায়। এশিয়া কাপ হকি ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ঢাকা স্টেডিয়াম দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সর্বোপরি সারা দেশে হকির জাগরণ পরিলক্ষিত হয়। পাড়া-মহল্লায় গাছের ডাল দিয়েও হকি খেলতে দেখা যায়। কিন্তু হকির সেই জাগরণ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে ২০০৮ সালে সিঙ্গাপুরে এএইচএফ (এশিয়ান হকি ফেডারেশন) প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০১২ সালেও থাইল্যান্ডে একই টুর্নামেন্টে জয়ী হয় বাংলাদেশ। একই বছর সিঙ্গাপুরে ওয়ার্ল্ড হকি লিগের রাউন্ড ওয়ানে শীর্ষস্থান এবং দিল্লিতে ওয়ার্ল্ড হকি লিগের রাউন্ড টুতে তৃতীয় হয় বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে বিশ্ব একাদশের হয়ে জুম্মন লুসাই, ১৯৮৭ সালে এশিয়া অল-স্টার টিমের হয়ে কেনিয়ায় জামাল হায়দার, ১৯৮৯ সালে এশীয় একাদশের হয়ে দিল্লিতে খাজা রহমতউল্লাহ, ১৯৯৩ সালে হিরোশিমায় মামুনুর রশীদ খেলার গৌরব অর্জন করেন। এছাড়া ২০০২ সালে এশিয়ান অল-স্টার দলে ছিলেন মো. মুসা মিঞা। সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে হকি ইপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারছে না। এই না পারাটা বড় ব্যর্থতা। হকির পদ-পদবী নিয়ে নিজেদের মধ্যে যতটা খেয়াখেয়ি লক্ষ্য করা যায়, খেলাটাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য ততটা মনোযোগী হতে দেখা যায় না।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় বাংলাদেশ নামটি সবার আগে আলোচনায় আসে দাবার মাধ্যমে। ১৯৮৬ সালে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হন নিয়াজ মোরশেদ। প্রতিভাবান এই দাবাড়–কে ঘিরে ক্রীড়াঙ্গনে নতুন আশার সঞ্চার হয়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে সাফল্য বয়ে আনা সম্ভব, এই আত্মবিশ্বাসটুকু অর্জিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাষ্টার পেতে বাংলাদেশকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। ২০০১ সালে গ্র্যান্ডমাষ্টার হন জিয়াউর রহমান। ২০০৫ সালে রিফাত বিন সাত্তার, ২০০৭ সালে আবদুল্লাহ আল রাকিব ও ২০০৮ সালে এনামুল হোসেন রাজীব গ্র্যান্ডমাষ্টার হয়েছেন। তবে দাবায় আলোচিত একটি নাম রানী হামিদ। তিনি ১৯৮৩, ১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সালে বৃটিশ মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন। একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও তাঁর সাফল্য সবাইকে অবাক করে। তবে দাবার সেই সুদিন আজ আর নেই। একটা সময় দেশে দাবার চর্চা বাড়লেও এখন একটা স্তিমিত ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক প্রাপ্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে শ্যুটিং। ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে ১৪তম কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের পেয়ার ইভেন্টে একটি স্বর্ণ এবং ৫০ মিটার ফ্রি পিস্তলের পেয়ার ইভেন্টে একটি ব্রোঞ্জ জয় করে চমক দেখান আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনি। ১৯৯৫ সালে প্রথম কমনওয়েলথ শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ জয় করেন। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে ৫০ মিটার এয়ার রাইফেল প্রোন ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করেন সাবরিনা সুলতানা। ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টারে ১৭তম কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা জেতেন আসিফ হোসেন খান। ২০০৬ সালে অষ্ট্রেলিয়ায় ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের দলীয় ইভেন্টে রৌপ্য পান আসিফ হোসেন খান ও অঞ্জন কুমার সিনহা। ২০১০ সালে দিল্লিতে মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের টিম ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করেন শারমিন আক্তার রত্মা ও সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা। একই ইভেন্টে সর্বাধিক স্কোর থাকায় এই ক্যাটাগরিতে সোনা ওঠেছে রত্মার গলায়। এছাড়া সাফ গেমস ও সাফ শ্যুটিংয়ে নিয়মিতই পদক জয় করেন বাংলাদেশের শ্যুটাররা। এই সাফল্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, শ্যুটিংয়ে আরো মনোযোগ দেওয়া হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আরো বড় সাফল্য বয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু শ্যুটি যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছে না।
নদীমাতৃক দেশ সাঁতারে বাংলাদেশের সাফল্য নির্দিষ্ট গÐির বাইরে যেতে পারেনি। সাঁতার নিয়ে আশাবাদ পরিণত হয়েছে নিরাশায়। সাঁতারের অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্তে¡ও আন্তর্জাতিক মানের সাঁতারু ওঠে আসছে না। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের একটি সুপরিচিত নাম মোশাররফ হোসেন খান। এই সাঁতারু দেশ-বিদেশের অসংখ্য পদক জয় করেছেন। এরমধ্যে আছে এশিয়ান সাঁতার, সাফ গেমস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতা। ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয়ান সাঁতার প্রতিযোগিতায় মোশররফ হোসেন খান একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ, সরওয়ার ইমাম হোসেন লিটু, লুৎফর রহমান, আবদুল লতিফ, লাল মিয়া একটি করে ব্রোঞ্জ পদক পান। মহিলাদের মধ্যে আরিফা আখতার ২টি রৌপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ, সেতারা বেগম ৪টি ব্রোঞ্জ, ফাতেমা খাতুন একটি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন। এছাড়া রিলেতে বাংলাদেশ ২টি রৌপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। ১৯৯৭ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইসলামিক গেমসে ১০০ মিটার ব্যাকষ্ট্রোকে রৌপ্য পদক জয় করেন নিবেদিতা দাস। সাফ গেমসে অনেক পদক পেয়েছেন বাংলাদেশের সাঁতারুরা। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় সাঁতারু মোখলেসুর রহমানের কথা। উপর্যুপরি তিনটি সাফ গেমসে তিনি স্বর্ণ পদক জয় করেন। ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে বাংলাদেশ দলের একমাত্র স্বর্ণটি আসে তাঁর নৈপুণ্যে। সাঁতারে বাংলাদেশের যতটা দূরে যাওয়ার কথা ছিল, ততটা পথ যেতে পারেনি।
এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তিগত পদকটি বক্সার মোশারফ হোসেনের। ১৯৮৬ সালে সিউলে অনুষ্ঠিত ১০ম এশিয়ান গেমসে লাইট হেভিওয়েট ইভেন্টে তিনি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। এরপর এশিয়ান গেমসে ব্যক্তিগত পদক আর আসেনি। তবে ১৯৭৭ সালে ব্যাংককে তৃতীয় কিংস কাপ বক্সিং-এ হেভিওয়েট ক্যাটাগরিতে আবদুর রউফ খান ব্রোঞ্জ পদক পান। একই বছর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ৮ম এশিয়ান অ্যামেচার বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে লাইট ফাইট ওয়েটে আবদুল হালিম এবং লাইট হেভিওয়েটে আবদুর রউফ খান ব্রোঞ্জ লাভ করেন। সাফ গেমসে পদক এলেও দ্বিতীয় একজন মোশারফ হোসেনের সন্ধান মেলেনি।
অ্যাথলেটিক্সে সাফ গেমসের বৃত্তের বাইরে বাংলাদেশের খুব বেশি সাফল্য নেই। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১৯৮০ সালে তুরস্কের ইজমিরে প্রথম ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জ পদক পান মুজিবুর রহমান মল্লিক। ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসে পর পর দুইবার দ্রæততম মানব হওয়ার কৃতিত্ব দেখান শাহ আলম। ১৯৯৩ সালে দ্রæততম মানব হন বিমল চন্দ্র তরফদার। মহিলা অ্যাথলেটিক্সে প্রথম স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব রহিমা খাতুন যুঁথীর। ১৯৯৬ সালে ইসলামাবাদে আমন্ত্রণমূলক মহিলা ইসলামী সংহতি গেমসে তিনি ১৫০০ মিটার স্প্রিন্টে সাফল্য দেখান। ১৯৯৭ সালে ইরানে দ্বিতীয় ইসলামিক গেমসে ৮০০ মিটার স্প্রিন্টেও তিনি স্বর্ণ জয় করেন। ২০০১ সালে ইরানে তৃতীয় ইসলামী গেমসে লং জাম্পে স্বর্ণ জেতেন ফৌজিয়া হুদা জুঁই। সাফ গেমস ছাড়া অ্যাথলেটরা দ্বিপক্ষীয় ও আমন্ত্রণমূলক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পদক পেয়েছেন। কিন্তু বড় আসরে সাফল্য দেখাতে পারছেন না।
বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডিতে সাফল্য ও ব্যর্থতার যুগপৎ মিশেল। ১৯৮০ সালে কলকাতায় প্রথম এশিয়ান কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স-আপ হয় বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে বেজিং এশিয়ান গেমসে রৌপ্য, ১৯৯৪ সালে হিরোশিমায় রৌপ্য, ১৯৯৮ সালে ব্যাংককে ব্রোঞ্জ, ২০০২ সালে বুসানে রৌপ্য ও ২০০৬ সালে দোহায় ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে গুয়াংজু এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো পদক বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। তবে একই ভেন্যুতে বাংলাদেশ মহিলা দল ব্রোঞ্জ পদক পায়। কাবাডি নিজস্ব খেলা হলেও বাংলাদেশ যেন ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে প্রথম পদক আনার কৃতিত্ব জুডোকা কামরুন নাহার হীরুর। এমনকি জুডোর সেরা সাফল্য তাঁর। ১৯৮১ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় চতুর্থ এশিয়ান জুডো প্রতিযোগিতায় ওপেন ক্যাটাগরিতে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।
নতুন খেলার মধ্যে আর্চারিতেও সাফল্য এসেছে। ২০০৯ সালে ইরানে দ্বিতীয় এশিয়ান আর্চারি গ্র্যান্ড প্রিক্সে দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক পায় বাংলাদেশ। একই বছর কলকাতায় চতুর্থ এশিয়ান গ্র্যান্ড পিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ জয় করেন সাজ্জাদ হোসেন। ২০১০ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ইয়ুথ অলিম্পিক গেমসের এশিয়া অঞ্চলের কোয়ালিফাইং টুর্নামেন্টে এশিয়া অঞ্চলে স্বর্ণ জয় করেন ইমদাদুল হক মিলন।
গলফে বাংলাদেশকে পরিচিতি করেছেন সিদ্দিকুর রহমান। ২০১০ সালে ব্রæনাই ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চমকে দেন। এরপর থেকে তিনি পেশাদার গলফ জগতে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।
এছাড়াও বাংলাদেশে সরকার অনুমোদিত যে সব খেলা হয়, তারমধ্যে আছে, ভারোত্তোলন, হ্যান্ডবল, কারাতে, তায়কোয়ান্দো, ভলিবল, কুস্তি, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল, জিমন্যাস্টিকস, খো খো, শরীরগঠন, ক্যারম, স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার, মার্শাল আর্ট, সাইকিং, ব্রিজ, রোলার স্কেটিং। এসব খেলার মধ্যে কোনো কোনো খেলা দীর্ঘ দিন চর্চা হলেও আন্তর্জাতিক সাফল্য নেই। আবার কোনো খেলা থেকে সাফ গেমসে ছিটেফোটা পদক পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সরকারি পর্যায়ে সব রকম খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করা এক ধরনের বিলাসিতা। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে চাইলেই ক্রীড়াঙ্গনে পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে একটা নীতিমালা অনুসরণ করে জনপ্রিয় ও সম্ভাবনাময় কিছু খেলাকে বেছে নিয়ে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন আদর্শ একটি ক্রীড়ানীতি। যদিও একাধিকবার ক্রীড়ানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু সেটা সংশ্লিষ্ট কেউ খুলে দেখার তাগিদ অনুভব করেননি। যে কারণে দেশের ক্রীড়াঙ্গন চলছে হুজুগে নীতিতে। এই নীতি থেকে বের হয়ে যথাযথ পথে না হাঁটলে ক্রীড়াঙ্গনে বড় কিছু আশা করা ঠিক হবে না।
দৈনিক বণিক বার্তা, ৩০-৬-২০১৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন