বাঙালির ফুটবল আবেগ / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud
ফুটবল খেলার সঙ্গে বাঙালির রয়েছে নাড়ীর টান। জনপ্রিয় এই খেলাটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির মনে-প্রাণে-অন্তরে। ফুটবল খেলাকে বাঙালি যতটা গভীরভাবে ভালোবেসেছে, তাঁর জন্য যে আত্মত্যাগ করেছে, তার কোনো তুলনা হয় না। এই উপমহাদেশের ফুটবল খেলাটাকে জনপ্রিয় করে তুলতে বাঙালির ভূমিকা অবিসংবাদিত। আধুনিক ফুটবলের একদম শুরুতেই ব্রিটিশরা যখন পরাধীন ভারতে ফুটবল নিয়ে আসে, তখন সবার আগে এই খেলাটিকে লুফে নেয় বাঙালিরা। এই খেলাটিকে কেন্দ্র করে ছুঁয়ে যায় বাঙালির আবেগ, বাঙালির উচ্ছ্বাস, বাঙালির ভালোবাসা। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে ফুটবল। বাঙালির মনে-মননে-মানসিকতায় দারুণভাবে প্রভাব ফেলে সহজ-সরল ও রোমাঞ্চকর এ খেলাটি। বাঙালির কারণেই সেই ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের ‘ফুটবলের রাজধানী’ হিসেবে বিবেচিত হতো কলকাতা। ব্রিটিশ-ভারতের সাবেক এই রাজধানীতে ফুটবলের আকর্ষণে বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসতেন উৎসাহী খেলোয়াড়রা। তদানীন্তন এই পূর্ব বাংলার (আজকের বাংলাদেশ) ফুটবলারদের কাছেও তীর্থস্থান হয়ে ওঠেছিল কলকাতা। ফুটবল রীতিমতো জাগিয়ে দিয়েছিল এই ‘আনন্দ নগরী’কে। তবে ব্রিটিশদের ভাবনাটা ছিল ভিন্ন। শাসকরা মনে করেছিল, ফুটবল নামক ‘আফিম’-এর নেশায় বাঙালিদের বুঁদ করে রাখা যাবে। স্তিমিত হয়ে যাবে স্বাধীনতার আন্দোলন। কিন্তু তাঁদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত করে বাঙালিরা। অল্প কিছু দিনের মধ্যে দীক্ষা নিয়ে বাঙালিদের কাছে ফুটবল হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান একটি অস্ত্র। পরাধীন দেশে ব্রিটিশদের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে ওঠা যাচ্ছিল না। প্রতি পদে পদে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর অপমানে গুমরে গুমরে মরছিল বাঙালির আত্মা। তেমন একটা সময়ে খেলার মাঠে ব্রিটিশদের সঙ্গে সমানতালে লড়াই করার মোক্ষম একটা সুযোগ এসে যায়। মাঠের ফুটবলে গোরাদের যখন দেশীয় ফুটবলাররা নাজেহাল করতেন, তা দেখে অন্যরকম সুখ পেত বাঙালিরা। আর বাঙালিদের দল জিতলে তো কথাই নেই। সেদিন উল্লাসে ফেটে পড়তো কলকাতা। ক্ষণিকের জন্য হলেও পাওয়া যেত পরাধীনতার গ্লানি থেকে ‘মুক্তি’র আনন্দ।
কলকাতার ফুটবলের প্রধান তিন দল দল মোহনবাগান-মোহামেডান-ইস্টবেঙ্গল। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই তিন দলকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে বাঙালির ফুটবল। বিশেষ করে, মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলকে উপলক্ষ করে বাঙাল-ঘটি, ইলিশ-চিংড়ির দ্বন্দ্ব তো কলকাতার সামাজিক জীবনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রতিফলন দেখা যায়। মূলত কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে মোহনবাগান এবং পূর্ব বাংলার বাঙালি, যাঁরা কলকাতায় থিতু হন, তাঁদের হৃদয়ে ইস্টবেঙ্গল স্থায়ী আসন করে নেয়। যদিও সেই উন্মাদনা এখন আর আগের মতো নেই। তারপরও সেই ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। পশ্চিম বঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম নির্দশন ফুটবল। ফুটবলদর্শন থেকে কলকাতায় জন্ম হয় বারপুজোর। ফুটবলে সাফল্য লাভের প্রত্যাশায় পয়েলা বৈশাখ এই পুজো উদযাপন করে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাবগুলো। এই পুজার মুখ্য উদ্দেশ্য, প্রথম দিনটি যদি ভালো কাটে, তাহলে সারা বছরই ভালো যাবে। যদিও কলাকাতার ফুটবলে আগের সেই জৌলুস নেই, তারপরও ফুটবল মাঠে সাফল্যের প্রত্যাশায় বারপুজোয় জমজমাট হয়ে ওঠে ক্লাব প্রাঙ্গণ।
দেশভাগের পর পাকিস্তানের ফুটবলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা। যখন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের কোনো দল পরস্পরের মুখোমুখি হতো, তখন পুরোমাত্রায় জেগে ওঠতো বাঙালিদের আবেগ। পশ্চিম পাকিস্তানকে হারাতে পারলে কিংবা তাঁদের কোনো খেলোয়াড় ডজ খেলে উল্লাসে ফেটে পড়তো সমগ্র স্টেডিয়াম। এমনকি ফুটবল নিয়ে বাঙালি-অবাঙালি খেলায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনাও ঘটেছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ফুটবলের দুই আবেগের নাম ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং তারুণ্যের প্রতিনিধি আবাহনী ক্রীড়া চক্র। এই দুই ক্লাবকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়তো পুরো দেশ। চির-প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দলের যেদিন খেলা থাকতো, সেদিন সমস্ত পথ এসে মিলতো ঢাকা স্টেডিয়ামে। পরের দিন বিকেলে খেলা দেখার জন্য টিকিটের আশায় আগের দিন কী যে কষ্ট স্বীকার করে রাতে লাইন দিতেন ভক্ত-অনুরাগীরা! খেলা দেখার জন্য ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। তারপরও প্রিয় দলের খেলা দেখার আনন্দ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চাইতেন না। সাদা-কালো আর আকাশী নীল পতাকায় ছেয়ে যেত পাড়া-মহল্লা। এই দুই দলের খেলা নিয়ে ঘরে ঘরে রাগ-অনুরাগ তো চলতোই। সৃষ্টি হতো মনোমালিন্য ও মনকষাকষি। মোহামেডান-আবাহনী খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়নি, এমন দিন খুব কমই আছে। প্রিয় দলের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না পাঁড় সমর্থকরা। কত জীবনই তো ঝরে গেছে অকালে। তারপরও ফুটবল নিয়ে আবেগ-উত্তেজনার একটুও কমতি ছিল না। হায়! ফুটবলের সেই সোনালি দিনগুলো এখন ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতির পাতায়। তবে বাঙালির বুকের মধ্যে ঠিকই ঘুমিয়ে থাকে ফুটবল। একটুখানি টোকা পড়লেই তা জেগে ওঠতে মোটেও সময় নেয় না।
বাঙালিরা ফুটবল শুধু খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে তো বটেই, ফুটবল নিয়ে বাঙালির আবেগের ছোঁয়া লেগেছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও। বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে ফুটবল। খ্যাতিমান লেখকদের কলমে নানানভাবে বন্দিত হয়েছে দর্শকপ্রিয় এই খেলাটি। ফুটবল নিয়ে আলোচিত উপন্যাসের মধ্যে প্রথম সারিতে আছে মতি নন্দীর ‘স্ট্রাইকার’, ‘ষ্ট্রপার’। কলকাতা মাঠে যে সব কবি-সাহিত্যিক নিয়মিত ফুটবল খেলা দেখতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। স্বর্ণযুগের কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন তিনি।
ফুটবল নিয়ে কত যে গান লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ফুটবল যে বাঙালির আবেগের অপর নাম, সেটা সবার আগে সুর হয়ে বেজেছে কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে’র কণ্ঠে : ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল/কি মধু আছে ঐ তোমার নামেতে আহা ফুটবল’। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং সুরকার নচিকেতা ঘোষের সুরে ১৯৭১ সালে ‘ধন্যি মেয়ে’ চলচ্চিত্রে এই গানটি গাওয়া হলেও এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে বাঙালির ফুটবলপ্রেম। ১৯৮০ সালে কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের খেলায় ১৬ জন নিহত হওয়ার পর মর্মস্পর্শী এই ঘটনায় মান্না দে’র কণ্ঠে ছড়িয়েছে বিষন্নতা, ‘খেলা ফুটবল খেলা’। বাংলাদেশের ব্যান্ড দল ‘সোলস’-এ তপন চৌধুরীর গাওয়া ‘ফুটবল ফুটবল...দুরন্ত ফুটবল, চারিদিকে ফুটবল জয়ধ্বনি’ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
কলকাতায় ফুটবল নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মোহনবাগানের মেয়ে’, ‘ইস্টবেঙ্গলের ছেলে’ ইত্যাদি। এ ছবিগুলো মূলত হাসির। ১৯১১ সালের ২৯ জুলাই আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে খালি পায়ে ফুটবল খেলে ব্রিটিশদের দল ইয়র্কশায়ারকে ২-১ গোলে হারিয়ে বাঙালিদের দল মোহনবাগান ক্লাব শিরোপা জয় করে। এই জয় বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে উসকে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক সেই কাহিনী নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অরুন রায়ের পরিচালনায় নির্মিত হয় গুরুত্বপূর্ণ ছবি ‘এগারো’। বাংলাদেশে অবশ্য ফুটবল নিয়ে খুব একটা সিনেমা হয়নি। তবে এক দল তরুণ ফুটবলারের গল্প নিয়ে খিজির হায়াত খানের ‘জাগো‘ বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
ঘরোয়া ফুটবলের সুদিন না থাকলেও ফুটবলের প্রতি বাঙালিদের আগ্রহ-উৎসাহ-উদ্দীপনা কিন্তু হারিয়ে যায়নি। সেটা অনুধাবন করা যায় বিশ্বকাপ ফুটবল দুয়ারে কড়া নাড়লে। সেই আশির দশক থেকে যখন টেলিভিশনে বিশ্বকাপ ফুটবল সরাসরি সম্প্রচার হয়, তখন থেকেই বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ এই আসরটিকে ঘিরে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে সারা দেশ। বাঙালিদের মধ্যে মূলত ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থকই বেশি। এই দুই দেশকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়েন ফুটবল অনুরাগীরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য দেশের সমর্থকদেরও সংখ্যা বাড়ছে। সারা দেশে যে হারে বিশ্বকাপের ফুটবল দলগুলোর পতাকা উড়তে থাকে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। গ্রামের একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভিন দেশী পতাকা স্থান করে নেয়। ইদানিং প্রিয় দলের কিংবা প্রিয় খেলোয়াড়ের জার্সির কদরও বেড়েছে। ফুটবলপ্রিয় বাঙালির পক্ষেই কেবল এমনটি সম্ভব। নিজের দেশ বিশ্ব ফুটবলের আঙিনায় ভিড়তে না পারলেও পরের দেশকে এতটা গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে বাঙালিরাই। আর এবার তো বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক ব্রাজিল। ফুটবলের দেশ হিসেবে বাঙালিদের অন্তরে আলাদা স্থান করে নিয়েছে পেলে, গ্যারিঞ্চা, রোনালদোর ব্রাজিল। ফুটবল ও সাম্বা নাচ দিয়ে ব্রাজিলীয়রা যে বাঙালিদের হৃদয় দুলিয়ে দেবে, এটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আনন্দময় হয়ে ওঠবে বাঙালির ঘুমহীন রাতগুলো। কেননা, এই ফুটবল ফিয়েস্তার জন্য দীর্ঘ চারটি বছর অপেক্ষায় কাটে বাঙালির। আর অপেক্ষার প্রহর তো মধুরই হয়।
dulalmahmud@yahoo.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন