ইংল্যান্ড কেন কলঙ্ক ঘোচাতে পারছে না? দুলাল মাহমুদ


একসময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ইংল্যান্ডকে নিয়ে নিজের ভিতরে তেমন কোনো উত্তাপ, উচ্ছ্বাস বা উত্তেজনা অনুভব করি না। এর কারণ হতে পারে, বৃটিশদের রক্তে লেগে আছে অনেক অভিশাপ, অনেক কলঙ্ক, অনেক পাপ। সেটা মন থেকে হয়তো মেনে নিতে পারি না। উপমহাদেশে তাঁদের কলঙ্ক ও পাপের যে ধারা, সেটা তো চিরদিনই বইতে হবে। এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবলে ইংল্যান্ড হারলে মনের মধ্যে এমনিতে কোনো হেলদোল হয় না। তবে অনেক ফুটবল অনুরাগীর মতো আমারও আক্ষেপ হয়। অনুগ্রহ হয়। অনুকম্পা হয়। বৃটিশরা যে কেবল আমাদের শাসন ও শোষন করেছে তাই নয়, তাঁদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছিও অনেক। এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না, আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক তো বৃটিশরা। এর আইন-কানুন থেকে শুরু করে ফুটবলের প্রসার ও মানোন্নয়নে তাঁদের সদর্থক ভূমিকা ইতিহাস হয়ে আছে। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফুটবল প্রতিযোগিতা ‘এফএ কাপ’ বৃটিশদের অবদান। ১৮৭১ সাল থেকে এ প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়ে আসছে। প্রথম ফুটবল লিগ প্রবর্তনের কৃতিত্বও বৃটিশদের। ১৮৮৮ সাল থেকে এই ইংলিশ লিগ বিশ্ব ফুটবলকে সমৃদ্ধ করে আসছে। পৃথিবীর যে সব স্থানে বৃটিশরা উপনিবেশ স্থাপন করেছে, সে সব জায়গায় তাঁরা ছড়িয়ে দিয়েছে ফুটবলের বীজ। ফুটবল যে আজ বিশ্বব্যাপী ফলে-ফুলে সুভাস ছড়াচ্ছে, এটা তো তাঁদেরই অবদান। আমরাও তো ফুটবলের পাঠ নিয়েছি বৃটিশদের কাছ থেকেই। এ ক্ষেত্রে আমরা বরং গর্বই করতে পারি। কেননা, আধুনিক ফুটবলের জনকরা নিজেদের দেশে চালু করার পর পরই ফুটবলে দীক্ষা দিয়েছে উপমহাদেশের মানুষদের। ইংলিশ ফুটবল লিগ প্রবর্তনের বছরেই ভারতের হিমাচল প্রদেশে চালু হয় ‘ডোরান্ড কাপ’। ১৮৯৩ সালে শুরু হয় ‘কলকাতা ফুটবল লিগ’। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, বিশ্ব ফুটবলের সেরা দলগুলো হাতেখড়ি নেওয়ার অনেক আগেই উপমহাদেশে ফুটবল প্রচলন ও প্রতিযোগিতামূলক খেলা হয়। কলকাতায় ফুটবল খেলা পল্লবিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ফুটবল। ফুটবল ইতিহাসের পুরনো ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকার ওয়ারী এবং ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। ১৮৯৮ সালে ওয়ারী এবং ১৯০৩ সালে ভিক্টোরিয়া ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৫ সালে প্রবর্তিত হয় ‘ঢাকা ফুটবল লিগ’। ফুটবল যে এ অঞ্চলে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হয়ে উঠে, তার পেছনে বৃটিশদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতেই হয়।
আর এই কৃতজ্ঞতা বোধের কারণে বিশ্ব ফুটবলে ইংল্যান্ড দলের ব্যর্থতা কিছুটা হলেও মন খারাপ করে দেয়। বিশ্বব্যাপী যাঁরা ফুটবলকে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় করেছে, তাঁদের প্রাপ্তিটা তাহলে কী? ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে নিজের মাটিতে যে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়, সেটাও তো যেন সুদূরের কথা। তদুপরি ববি মুরের নেতৃত্বে সেই শিরোপা জয়ে কিছুটা হলেও কলঙ্ক লেগে আছে। ১৯৬৬ সালের ৩০ জুলাই লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে প্রায় এক লাখ দর্শকের মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড এবং পশ্চিম জার্মানি। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ খেলার নির্ধারিত ৯০ মিনিটের ফল ছিল ২-২। অতিরিক্ত সময়ের ১১ মিনিটে অ্যালান বলের ক্রস থেকে স্ট্রাইকার জিওফ হার্স্ট কাছাকাছি অবস্থান থেকে যে শটটি নেন, তা ক্রসবারে লেগে লাইনের ভিতরেই ড্রপ খায়। বল গোললাইন অতিক্রম করেছে কি করেনি, সে বিষয়ে দ্বিধান্বিত সুইস রেফারি পরামর্শের জন্য লাইন্সম্যানের কাছে ছুটে যান। সোভিয়েত ইউনিয়নের লাইন্সম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি ইংল্যান্ডের অনুকূলে রায় দেন। গোলের বিপক্ষে জার্মান খেলোয়াড়রা জোরালো প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয়নি। এই গোলের পর খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ইংলিশরা। এ ফাইনাল ম্যাচটি ফুটবল ইতিহাসের বিতর্কিত ম্যাচের একটি হয়ে আছে। জিওফ হার্স্টের হ্যাটট্টিকে ইংল্যান্ড ৪-২ গোলে জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। কলঙ্কিত সেই শিরোপা জয়ের পর তাঁদের ভাগ্যে আর শিকে ছেঁড়েনি। এরপর তাঁদের সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯৯০ সালে চতুর্থ স্থানে পৌঁছতে পারা।
সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি এবং উরুগুয়ের কাছে হেরে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলও ইংল্যান্ডকে বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছে। ফুটবলের জনক বৃটিশদের ফুটবল নিয়ে এত আবেগ-উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা-ভালোবাসা, তারপরও কেন তাঁরা বার বার ব্যর্থ হয়? ১৯৬৬ সালের ফাইনালে বিতর্কিতভাবে বিশ্ব জয়ের কলঙ্ক কি তাঁদের বয়ে নিতে হবে? যেমনটি বয়ে নিচ্ছে জার্মানি। ১৯৯০ সালের ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মেক্সিকোর রেফারি কোডেসালের কৃতিত্বে ও সৌজন্যে পশ্চিম জার্মানি সেই যে চ্যাম্পিয়ন হয়, এরপর আর তাঁরা সফল হয়নি। তবে জার্মানরা তো বরাবরই সম্ভাবনা জাগিয়ে শিরোপার কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়েছে, বৃটিশরা কেন পারছে না? এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না।


dulalmahmud@yahoo.com  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

মেসিকে নিয়ে আশা, মেসিকে নিয়ে আশঙ্কা / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল খেলোয়াড় গড়ার কারিগর মোস্তাফা কামাল/ দুলাল মাহমুদ