এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ



নিদ্রাদেবীকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একবুক প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী ম্যাচ দেখলাম। স্বাগতিক ব্রাজিলের সঙ্গে খেললো ক্রোয়েশিয়া। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের সঙ্গে তুলনা করলে ক্রোয়েশিয়াকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তবে ইউরোপীয় ঘরানার দেশ হিসেবে ‘ভ্যাটরেনি’দের তেজদীপ্ততা, শক্তিমত্তা ও কৌশলকে উপেক্ষা করার সুযোগও নেই। যে কোনো অঘটন ঘটানোর ক্ষমতা তাদের আছে। সঙ্গত কারণে লাতিন আর ইউরোপীয় ঘরানা পরস্পর বিরোধী হলেও তুমুল একটা লড়াই অপ্রত্যাশিত ছিল না। ক্রোয়েশিয়া ফেবারিট না হলেও লড়াকু দল হিসেবে তাদেরকে সমীহ না করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শৈল্পিক ফুটবলের প্রতিনিধি ব্রাজিল। ষষ্ঠবারের মতো বিশ্ব শিরোপা জয়ের সংকল্প তাদের। সেই লক্ষ্য নিয়ে ৬৪ বছর পর নিজের মাঠে খেলতে নামে ‘সেলেকাও’রা। পরিচিত মাঠ ছাড়াও গ্যালারি ভর্তি সমর্থক আর অনুকূল পরিবেশে ব্রাজিলকে স্বমহিমায় দেখতে পাওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এ কোন ব্রাজিলকে দেখলাম? লিওনিদাস দা সিলভা, নিলটন সান্তোষ, দিদি, গ্যারিঞ্চা, পেলে, গারসন, কার্লোস আলবার্তো তোরেস, জইরজিনহো, রবার্তো রিভেলিনো, টোস্টাও, জিকো, রবার্তো ফালকাও, সক্রেটিস, জুনিয়র, কারেকা, রোমারিও, রোনালদো, রোনালদিনহোর মতো জাত শিল্পীদের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু লিওনার্দো, কাফু, রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, জুনিনহো, আদ্রিয়ানো, কাকা, রবিনহোর সেই ব্রাজিলইবা কোথায়? গতিশীল, ছন্দময়, আনন্দদায়ী ফুটবলের সেই ক্রীড়াশৈলী কি ব্রাজিল হারিয়ে ফেলেছে? দলগত মাধুর্য তো দূরে থাকুক, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলকও খুব একটা ছিল না। মনে গেথে রাখার মতো দৃষ্টিনন্দন ক্রীড়াশৈলী কিংবা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো পায়ের কারুকাজ, হেড, পাসিং, ট্যাকলিং, ওভারল্যাপিং, ফ্রি কিকের মধ্যে যে জাদুময়তা আছে, তা তো বলতে গেলে দেখাই মেলেনি। আর দশটা দলের সঙ্গে ব্রাজিলের খেলায় কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। খেলায় প্রতিপক্ষের তুলনায় বলের নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকলেও শৈল্পিক ও হৃদয়নিংড়ানো ফুটবলের কোনো ছোঁয়া ছিল না। নিজেদের মধ্যে সমঝোতা, বলের নিয়ন্ত্রণ, বডি ফিটনেস, ভারসাম্যতার বেশ খামতি ছিল। আলোচিত ফুটবলার নেইমার দু’টি গোল দিলেও তাঁর খেলায় নান্দনিক ফুটবলের সৌরভ ও চমক দেখা যায়নি। বরং অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অস্কারের খেলায় কিছুটা গতি দেখা যায়। ইনজুরি টাইমে তাঁর করা শেষ গোলটিতেও ছিল বুদ্ধিমত্তার ছাপ। তবে সব মিলিয়ে ব্রাজিল ৩-১ গোলে জিতলেও খেলা দেখে মনে হয়েছে, রেফারির বদান্যতা না পেলে জয়টাও কঠিন হয়ে পড়তো।
ব্রাজিলের খেলা যেমন হতাশ করেছে, তেমনিভাবে তাদের দর্শক ও গ্যালারিও খুব একটা জমিয়ে তুলতে পারেনি। কোথায় ব্রাজিলের গ্যালারির সেই তাল-লয়-সুর-ছন্দ? কোথায় সেই বিখ্যাত সাম্বা নাচ? এমনকি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও সাম্বা নাচের প্রতিফলন দেখা যায়নি। গ্যালারি হলুদময় হয়ে উঠলেও সেই আবেগ-উচ্ছ্বাস-উল্লাস তেমনভাবে অনুভব করা যায়নি। অবশ্য এটাও ঠিক, দূর থেকে কতটাই আর বোঝা যায়? কিন্তু আমরা যে ব্রাজিলকে চিনি-জানি-ভালোবাসি, সেই ব্রাজিলকে তো কখনো কাছ থেকে দেখিনি। হয় সংবাদপত্র পড়ে নতুবা টেলিভিশনে তাদের খেলা দেখে দেখে ব্রাজিলীয় ফুটবল, ফুটবলার আর সাম্বা নাচে দুলে উঠেছে মন-প্রাণ। কিন্তু উদ্বোধনী দিনে যেন তার ছিটেফোটাও হৃদয়ে তরঙ্গ তোলেনি।  এমন কি হতে পারে, ঘুম চোখে আমারই কেবল এমনটি মনে হয়েছে। হতেও পারে। 
তাছাড়া একটি ম্যাচ দেখে ব্রাজিলের মতো একটি দলকে বিচার-বিশ্লেষণ করা বোধকরি ঠিকও নয়। তারপরও প্রবাদে আছে, সকালের সূর্য দেখলেই বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে? তবে এটাও ঠিক, সব সময় এ কথার সত্যতা থাকে না। সত্যতা না থাকলেও এই প্রবাদটিকে একদম অস্বীকার করারও কিন্তু উপায় নেই। তবে আমরা চাই, সুন্দর ও শিল্পিত ফুটবলের স্বার্থে ব্রাজিলের ক্ষেত্রে অন্তত এই প্রবাদটি ভুল প্রমাণিত হোক।
রচনাকাল : ১৩ জুন ২০১৪


dulalmahmud@yahoo.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বকাপ ফুটবল কেন বাংলাদেশের উৎসব? / দুলাল মাহমুদ

আমার সাঁতার জীবন-অরুন নন্দী