সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ
(আটচল্লিশ)
একটি আত্মঘাতী গোল ঢাকা মোহামেডান কাবের লীগ চ্যাম্পিয়নশীপের স্বপ্নকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের প্রথম পর্বের শেষ খেলায় লীগ প্রত্যাশী দুটি দল মোহামেডান এবং ভিক্টোরিয়া ১২-৭-৬৩ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে তাদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফুটবল লড়াইয়ে নেমেছিল। দর্শকে ভরা স্টেডিয়াম খেলার গতি, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, দলীয় সমঝোতা, সুন্দর বল আদান-প্রদান আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ সব মিলিয়ে একটি উঁচু মানের ফুটবল খেলা উপভোগ করেছিল দর্শকরা। দু’দলের খেলোয়াড়রা মন উজাড় করে খেলছি সেদিন, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা বেশ জমে উঠেছিল, উপভোগ্য হয়েছিল। উত্তেজনা যেমন মাঠের ভেতর ছিল, তেমনি ছিল গ্যালারিতে। গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয়েছিল প্রথমার্ধ। দু’দলই গোল করার জন্য সব ধরনের কলাকৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছিল দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম থেকেই। মাঝামাঝি (দ্বিতীয়ার্ধের সময় ভিক্টোরিয়ার বামদিক দিয়ে একটি আক্রমণ আমাদের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়লে লেফট আউট বড় ইউসুফ তার দলের খেলোয়াড়দের উদ্দেশে সেন্টার করেÑ যা আমাদের ডিফেন্ডার কিয়ার করতে গিয়ে বল কাট করলে নিজ গোলে ঢুকে যায়, গোলারক্ষক আটকাবার সুযোগই পায়নি। গোল...। আমরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। গোলের কৃতিত্বটা ইউসুফের নামে ধরা হয়েছিল। খেলার বাকি সময় আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমরা গোলের দেখা পাইনি। ১-০ গোলে হেরে মাথা নিচু করে সন্ধ্যায় কাব টেন্টে ঢুকেছিলাম। দু’দলের খেলোয়াড় তালিকা
ভিক্টোরিয়া : গোলাম হোসেন (গোলকিপার), খোদা বক্স, কামিসা, হাসান, মুরাদ বকস, গফুর, ইউসুফ (জুনিয়র), আবদুল্লাহ, ওমর, আব্বাস এবং ইউসুফ (সিনিয়র)।
মোহামেডান : বলাই দে (গোলরক্ষক), জহির, দেবীনাশ, পিন্টু, আবিদ, রসুল বক্স, কবির, রহমত উল্লাহ, কাইয়ুম, বশীর এবং মুসা।
লীগ খেলার প্রথম পর্ব ঢাকা মোহামেডান ৪ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ করেছিল এবং ভিক্টোরিয়া কাব তখন কোন পয়েন্ট নষ্ট করেনি। রিটার্ন লীগের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব দুর্বল রেল দলের সাথে ২-২ গোলে ড্র (২৪-৭-৬৩)। ফিরতি লীগে আমরা ওয়ারী কাবকে ৫-০ গোলে (কাইয়ুম ৪, রসুল বক্স ১ গোল), প্রেস দলকে ৫-১ গোলে (কাইয়ুম ৩, সামাদ ১, প্রতাপ ১ গোল), রেল দলকে ৩-২ গোলে হারিয়েছিলাম। কাইয়ুম ২, রসুল বক্স ১ গোলের বিপরীতে এবং রেল দলের বশীর ও মেকওয়া গোল করেছিল। এখানে একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ করছি, হকি লীগ ম্যাচ খেলতে গিয়ে পেয়েছিলাম ইপিআর টিমের বশীরকে আর ফুটবল লীগে পেয়েছিলাম রেল দলের বশীরকে। আমরা তিনজনেই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। আজাদ স্পোর্টিং কাবকে আমরা ৭-১ গোলে পরাজিত করে আমাদের জয়ের ধারাকে বজায় রেখেছিলাম। সে খেলায় আমি ৩ গোল, কাইয়ুম ২ গোল, রসুল বক্স ও প্রতাপ ১টি করে গোল করেছিল এবং মারী দা আজাদের পক্ষে ১টি গোল শোধ দিয়েছিলেন। পরবর্তী খেলায় রহমত উল্লাহর দেয়া ২ গোলের সুবাদে মোহামেডান পিডব্লিউডিকে ২-০ গোলে হারায়। স্টেশনারী টিমকে আমরা ৪-১ গোলে হারিয়েছিলাম, যার মধ্যে কবির ভাই ২ গোল, কাইয়ুম ও আমি ১ গোল করেছিলাম এবং হোসেন আলী ১টি গোল শোধ করেছিল। পরবর্তী খেলায় কবির ভাইয়ের দেয়া একমাত্র গোলে আমরা পুলিশ টিমকে হারিয়ে আমাদের জয়ের চাকা সচল রেখেছিলাম। ইস্পাহানী আমাদের ওয়াকওভার দিলে পূর্ণ ২ পয়েন্ট পেয়ে এবং ঢাকা সেন্ট্রাল জেল টিমকে কাইয়ুম ২ গোল, প্রতাপ এবং আনসার ১টি করে গোল করলে আমরা ৪-০ গোলে জয় পেয়ে রিটার্ন লীগে কোন পয়েন্ট না হারিয়ে লীগের শেষের দিকে এগিয়ে যাই।
স্বাধীনতা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য ১০-১৪ আগস্ট পর্যন্ত লীগ খেলা বন্ধ ছিল। এ টুর্নামেন্টে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য আমার মনে নেই, তাই লেখা থেকে বিরত থেকে পরবর্তী লীগের খেলায় চলে যাই আর সেটা ছিল মোহামেডানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের সাথে ২২-৮-৬৩ তারিখে ফিরতি লীগের খেলা। ওয়ান্ডারার্স-মোহামেডান মানেই অন্যরকম খেলা, অন্যরকম পরিবেশ, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। এ পর্বেও আমরা ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিলাম, আমার ও মুসার গোলের বিপক্ষে সেকেন্দার ১টি গোল শোধ করতে পেরেছিল। আমরা আর কোন পয়েন্ট না হারিয়ে রিটার্ন লীগ শেষ করেছিলাম এবং ভিক্টোরিয়া শেষ করেছিল ৫ পয়েন্ট খুইয়ে। ১৯৬৩ সালে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল আর আমি সেই গর্বিত টিমের একজন সৌভাগ্যবান খেলোয়াড় ছিলাম। ভিক্টোরিয়া রানার্সআপ হয়েছিল। সেবার লীগে স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকের খেলা আমার ভাল লেগেছিল, আমাদের কাবের শামসুর কথা বলতেই হয়। আমার খেলোয়াড়ী জীবনে এত বড় টিমের এত বড় আইলসা (অলস), এত কম প্র্যাকটিস করে এত ভাল পারফর করা খেলোয়াড় আমি দেখিনি। সে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনের খেলোয়াড়, পজিশন জ্ঞান, সার্প শুটার, দক্ষতার সাথে গোল করা ছিল তার বিশেষ গুণ। তার অন্তরঙ্গ স্বভাব এবং নিজস্ব ভাষায় রসালো কথাবার্তা সবাই খুব উপভোগ করতো, আজও টেলিফোনে তার কথা শুনে ভাল লাগে। ইস্পাহানী টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনের খেলোয়াড় নিশিথ লীগে দুটি হ্যাটট্রিকসহ বেশ কয়েকটা গোল করেছিল। শরীরকে সোজা রেখে দৌড়াতো অনেকটা মাকরানী খেলোয়াড় আব্বাসের মতো। রেল দলের রাইট-ইন প্রকাশ, সুন্দর পায়ের কাজ, ছিমছাম খেলা, আমরা একবার পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল ক্যাম্পে বেশ কিছুদিন একসাথে কাটিয়েছিলাম। রেল দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড শংকরও ছিল চটপটে খেলোয়াড়, দ্রুত পজিশন বদল করে খেলা এবং গোল করায় সে ছিল দক্ষ। পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড ধীরেন, গফুর সাত্তারসহ আরো কিছু খেলোয়াড়ের কথা পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছা আছে।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ন্যাশনাল ব্যাংক দিনাজপুরে শেরে বাংলা গোল্ডকাপ (প্রথমবারের মত আরম্ভ হওয়া) ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিল। আমি আগেই বলেছি যে, আমাদের ব্যাংক ফুটবল টিম বেশ শক্তিশালী ছিল। আমরা দেশের বিভিন্ন যায়গায় ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতাম। দিনাজপুর যাওয়াটা ছিল খুব তড়িঘড়ি করে, যার জন্য আমার বাবাকে বলে যেতে পারিনি। আমি যেখানে যেতাম, বিশেষ করে যে কোন খেলায় যেতাম ঢাকায় কিংবা ঢাকার বাইরে, বাবাকে বলে যেতাম, ফিরে আসলে তাকে রেজাল্টটা বলতাম। তিনি হাত তুলে দোয়া করতেন। শেষের দিকে তিনি বিছানায় শুয়েই থাকতেন, সেদিন যে আমার কি হয়েছিল বুঝতেই পারিনি। ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছিল, তাই ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, বাবাকে বলতে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ট্রেনে উঠে সবার সাথে এমনিভাবে মেতে উঠেছিলাম যে, বাবার কথা আর মনে জাগেনি। দিনাজপুরে রাতে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। পরদিন ২৮-১১-৬৩ আমাদের প্রথম খেলা কোন টিমের বিরুদ্ধে খেলা কিছুই মনে ছিল না। বহু বছর পর আমার এক সহকর্মীর আত্মীয়র সাথে পরিচয় হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন তাদের সাথে আমরা ১ গোলে হেরেছিলাম এবং তিনিই সেই গোলের নায়ক। তার নাম আতিয়ার রহমান। তিনি ডিসি দিনাজপুর টিমের হয়ে সেদিন আমাদের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। তাদের টিমে দিনাজপুরেরর কৃতি ফুটবলার সালামও খেলেছিলেন। পরদিন সকালেই আমরা দিনাজপুর ছেড়ে আসবো। সব গোছগাছ করে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; কারণ খুব ভোরে ট্রেন ছেড়ে যাবে। হেরে যাওয়ার কিছুটা দুঃখ থাকলেও দীর্ঘ পথ ট্রেন জার্নির কান্তির কথা মনে হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতেই মন বেশি চাচ্ছিল। পাশাপাশি দুটো খাটে রঞ্জিত দা এবং আমি ঘুমিয়েছিলাম। ট্রেন এবং মাঠের কান্তিতে শরীর অবশ প্রায় একটি অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল, আমি অস্বস্তিতে ছটফট করছিলাম। রঞ্জিত দাও উঠে পড়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? স্বপ্ন দেখেছি, বাবা মারা গেছেন, তারপরই দেখেছি আমি হকি খেলছি। তিনি সান্ত্বনার সুরে বললেন, স্বপ্ন স্বপ্নইÑ শুয়ে পড়। রাত প্রায় শেষ, ঘুম আর হলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই জেগে উঠেছিল, স্টেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মনের ভেতর একটা অজানা আশংকা নিয়ে সকালে সবার সাথে আমিও ট্রেনে উঠে বসেছিলাম। দিনাজপুর যাওয়ার সময় মনে যেমন উচ্ছ্বাস ছিল, ফেরার পথে সেটা হারিয়ে গিয়েছিল। ভোর ছ’টায় ট্রেন ছেড়েছিল। দীর্ঘ পথ, কতক্ষণ মনে চিন্তা নিয়ে চুপ করে থাকা যায়! অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গল্প-গুজবে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়ে রাত প্রায় ৮টার দিকে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে আমাদের ট্রেন এসে থেমেছিল। ট্রেন থেকে নেমে আমার বন্ধু দাবির সিদ্দিকী এবং শফিককে দেখে অবাক হয়ে বকাবকি করে বলেছিলাম, কি রে, আমার কি পদ বেড়ে গেছে যে, আমাকে রিসিভ করার জন্য স্টেশনে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিস। কোন উত্তর পাইনি গত রাতের স্বপ্ন দেখার কথা মনে আসেনি একবারও। দাবিরের জিপে গিয়ে বসলাম, স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয় আমার মাহুৎটুলীর বাসা। স্টেশন থেকে সোজা নাজিরাবাজার পার হয়ে বংশাল চৌরাস্তার ডান মোড় ঘুরে একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাম দিক ঘুরলেই মাহুৎটুলী। জিপ গলিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো হ্যাজাকের আলো। তখনই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো, মনে পড়লো রাতের স্বপ্ন। আমাকে পেয়ে মা কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘মরার সময়ও তোকে দেখার জন্য তোর বাবা কি রকম ছটফট করেছে।’ বাবা মারা যাওয়ার সময় আমার খোঁজ করেছেন। বলেছিলেন, পাগলটা এখনও এলো না। আমি দিনাজপুর চলে গেলে বাবা আক্ষেপ করে মাকে বলেছিলেন, “পাগলটা গেল, আমাকে তো বলে গেল না।” এ কথাটা আমাকে এখনও পোড়ায়, যতদিন বেঁচে থাকবোÑ এই কষ্টটা বুকের ভেতর ক্ষত হয়ে থাকবে। ভোররাতে দিনাজপুরে যে স্বপ্ন দেখছিলাম, ঢাকায় সেটা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল! বাবা সকাল ১০টার দিকে মারা গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে সংবাদ পাঠানো হয়েছিল। আমরা রওনা হয়ে গেছি খবর পেয়ে জানাজা পড়িয়ে লাশ আমার জন্য রাখা হয়েছিল। স্টেশন থেকে ফিরে হাতের ব্যাগ রেখেই বাবার লাশ দাফন করতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল ২৯ নভেম্বর ১৯৬৩। বাবাকে কবর দিয়ে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। আত্মীয়স্বজন ভর্তি বাসায়। আমার স্বপ্নের কথা সবাইকে বললাম। মা বললেন, তোর বাবা মারা যাওয়ার সময়ও এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল, তোকে খুঁজছিল আর বলছিলোÑ এখনও আসলো না! শুনে বুকটা ফেটে কান্না পেল। মা-ভাইবোন সবাই কিছুক্ষণ কাঁদলাম। বাবার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে বলতে রাতটা কেটে গিয়েছিল। পরদিন কান্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়েছিলাম। তখন বেলা দশটা কিংবা এগারোটা হবে। সাবের আলী বাসায় এসেছিল। বন্ধু সাবের আলী ব্যাংকের হকি খেলোয়াড় বললো, ‘প্রতাপ বলেছে আজ ব্যাংক টিম আমাদের কাছে হারবে। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাব শক্তিশালী হকি টিম। আমাদের পাড়ার টিম, আমরাই এই কাব গঠন করেছি। দেশের অনেক কৃতী হকি খেলোয়াড়রা এই টিমের খেলোয়াড় ছিলেন। সাবের বলে চলেছে, তুমি খেলবা না, ওরা জেনেশুনে চ্যালেঞ্জ করছে। ন্যাশনাল ব্যাংক হেরে যাবে, ভাবতে কেমন জানি লাগছিল। সাবেরকে বললাম, লুকিয়ে আমার খেলার ব্যাগ এবং হকিস্টিক নিয়ে যাও, সুযোগ পেলে মাঠে যাব। খেলার সময় যত এগিয়ে আসছিল, মাঠে যাওয়ার জন্য মন ততই ছটফট করছে। কিন্তু মাকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। বাসাভর্তি আত্মীয়স্বজন, তারাইবা কি ভাববে। “মা, মনটা ভাল লাগছে না, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি”Ñ সাহস করে বলেই ফেললাম মা রাজি হওয়ার সাথে সাথে ছুটে গেলাম, ওয়ারী মাঠে (আউটার স্টেডিয়াম)। সবাইকে অবাক করে স্টিক হাতে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। আমরা ১-০ গোলে জিতেছিলাম; তবে খেলা শেষে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম মাঠে। লাড়– ভাই সেদিন খুব বকা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন খেলার কি খুব জরুরি ছিল,শরীর যদি বেশি খারাপ হয়ে যেত! ইনজুরড যদি হতে তাহলে তো ভবিষ্যত শেষ হয়ে যেত।
সবার সাথে আমিও ট্রেনে উঠে বসেছিলাম। দিনাজপুর যাওয়ার সময় মনে যেমন উচ্ছ্বাস ছিল, ফেরার পথে সেটা হারিয়ে গিয়েছিল। ভোর ছ’টায় ট্রেন ছেড়েছিল। দীর্ঘ পথ, কতক্ষণ মনে চিন্তা নিয়ে চুপ করে থাকা যায়! অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গল্প-গুজবে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়ে রাত প্রায় ৮টার দিকে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে আমাদের ট্রেন এসে থেমেছিল। ট্রেন থেকে নেমে আমার বন্ধু দাবির সিদ্দিকী এবং শফিককে দেখে অবাক হয়ে বকাবকি করে বলেছিলাম, কি রে, আমার কি পদ বেড়ে গেছে যে, আমাকে রিসিভ করার জন্য স্টেশনে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিস। কোন উত্তর পাইনি গত রাতের স্বপ্ন দেখার কথা মনে আসেনি একবারও। দাবিরের জিপে গিয়ে বসলাম, স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয় আমার মাহুৎটুলীর বাসা। স্টেশন থেকে সোজা নাজিরাবাজার পার হয়ে বংশাল চৌরাস্তার ডান মোড় ঘুরে একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাম দিক ঘুরলেই মাহুৎটুলী। জিপ গলিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো হ্যাজাকের আলো। তখনই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো, মনে পড়লো রাতের স্বপ্ন। আমাকে পেয়ে মা কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘মরার সময়ও তোকে দেখার জন্য তোর বাবা কি রকম ছটফট করেছে।’ বাবা মারা যাওয়ার সময় আমার খোঁজ করেছেন। বলেছিলেন, পাগলটা এখনও এলো না। আমি দিনাজপুর চলে গেলে বাবা আক্ষেপ করে মাকে বলেছিলেন, “পাগলটা গেল, আমাকে তো বলে গেল না।” এ কথাটা আমাকে এখনও পোড়ায়, যতদিন বেঁচে থাকবোÑ এই কষ্টটা বুকের ভেতর ক্ষত হয়ে থাকবে। ভোররাতে দিনাজপুরে যে স্বপ্ন দেখছিলাম, ঢাকায় সেটা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল! বাবা সকাল ১০টার দিকে মারা গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে সংবাদ পাঠানো হয়েছিল। আমরা রওনা হয়ে গেছি খবর পেয়ে জানাজা পড়িয়ে লাশ আমার জন্য রাখা হয়েছিল। স্টেশন থেকে ফিরে হাতের ব্যাগ রেখেই বাবার লাশ দাফন করতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল ২৯ নভেম্বর ১৯৬৩। বাবাকে কবর দিয়ে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। আত্মীয়স্বজন ভর্তি বাসায়। আমার স্বপ্নের কথা সবাইকে বললাম। মা বললেন, তোর বাবা মারা যাওয়ার সময়ও এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল, তোকে খুঁজছিল আর বলছিলোÑ এখনও আসলো না! শুনে বুকটা ফেটে কান্না পেল। মা-ভাইবোন সবাই কিছুক্ষণ কাঁদলাম। বাবার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে বলতে রাতটা কেটে গিয়েছিল। পরদিন কান্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়েছিলাম। তখন বেলা দশটা কিংবা এগারোটা হবে। সাবের আলী বাসায় এসেছিল। বন্ধু সাবের আলী ব্যাংকের হকি খেলোয়াড় বললো, ‘প্রতাপ বলেছে আজ ব্যাংক টিম আমাদের কাছে হারবে। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাব শক্তিশালী হকি টিম। আমাদের পাড়ার টিম, আমরাই এই কাব গঠন করেছি। দেশের অনেক কৃতী হকি খেলোয়াড়রা এই টিমের খেলোয়াড় ছিলেন। সাবের বলে চলেছে, তুমি খেলবা না, ওরা জেনেশুনে চ্যালেঞ্জ করছে। ন্যাশনাল ব্যাংক হেরে যাবে, ভাবতে কেমন জানি লাগছিল। সাবেরকে বললাম, লুকিয়ে আমার খেলার ব্যাগ এবং হকিস্টিক নিয়ে যাও, সুযোগ পেলে মাঠে যাব। খেলার সময় যত এগিয়ে আসছিল, মাঠে যাওয়ার জন্য মন ততই ছটফট করছে। কিন্তু মাকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। বাসাভর্তি আত্মীয়স্বজন, তারাইবা কি ভাববে। “মা, মনটা ভাল লাগছে না, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি”Ñ সাহস করে বলেই ফেললাম মা রাজি হওয়ার সাথে সাথে ছুটে গেলাম, ওয়ারী মাঠে (আউটার স্টেডিয়াম)। সবাইকে অবাক করে স্টিক হাতে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। আমরা ১-০ গোলে জিতেছিলাম; তবে খেলা শেষে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম মাঠে। লাড়– ভাই সেদিন খুব বকা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন খেলার কি খুব জরুরি ছিল,শরীর যদি বেশি খারাপ হয়ে যেত! ইনজুরড যদি হতে তাহলে তো ভবিষ্যত শেষ হয়ে যেত।
বাবা মারা যাওয়ার স্বপ্ন এবং সেটি বাস্তব হয়ে যাওয়ার পুরো ঘটনাটি আমার কাছে আজও অলৌকিক বলে মনে হয়।
সংশোধনী :
গত সংখ্যায় আমরা লেখায় মোহামেডান বনাম ওয়ান্ডারার্স খেলায় (১৪-৬-৬৩ ইং) মোহামেডান কাবের প্লেয়ার লিস্টের শেষ নামটি মারীর পরিবর্তে হবে মুসা এবং ৯-৭-৬৩ তারিখে মোহামেডান বনাম ইপিআর খেলায় মোহামেডান কাবের প্লেয়ার লিস্টের শেষ নামটি মুসার পরিবর্তে হবে প্রতাপ।
(ঊনপঞ্চাশ) ১৬ এপ্রিল
আগা খান গোল্ডকাপ ছিল সে সময়ে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট। গত আসরের চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব এবারের (১৯৬৩) টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ না করাটা ছিল দুঃখজনক। সদ্যসমাপ্ত ঢাকা লীগে তাদের খেলোয়াড় সাসপেনশন জটিলতাকে কেন্দ্র করে তারা গোল্ডকাপ বর্জন করেছিল। ইন্দোনেশিয়া এবং নেপাল দুটি বিদেশী দল, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচটি এবং স্বাগতিক নয়টি দলের মধ্যে প্রথমে এলিমিনেশন রাউন্ড, পরে রাউন্ড রবিন লীগ, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছিল টুর্নামেন্টের ফিকশ্চার। ভিক্টোরিয়ার সব মাকরানী খেলোয়াড় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবে যোগ দিয়ে টিমকে খুব শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
এলিমিনেশন রাউন্ডে বালুচ একাদশের কাছে স্থানীয় ইস্পাহানী টিম ০-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। স্থানীয় পুলিশ টিমের সাথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিয়ন টিম ৫-৩ গোলে হেরে এবং পূর্ব-পাক রেল দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের কাছে ০-৮ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। এমএন জাহানের হ্যাটট্রিক এবং ইদ্রিসের গোলের সুবাদে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল ৪-০ গোলে ঢাকার ওয়ারী কাবকে হারালে ওয়ারী কাব টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। পরবর্তীতে ঢাকা মোহামেডান কাবের সাথে হেরে বেলুচ একাদশ টুর্নামেন্ট থেকে চিটকে যায়। পাকিস্তানের ওয়ারসেক টিম স্থানীয় আজাদ স্পোর্টিংকে ১-০ গোলে আর পিআইএ স্থানীয় পিডব্লিউডি টিমকে ৩-০ গোলে হারিয়ে দিলে পরাজিত টিমগুলো টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। এলিমিনেশন রাউন্ড থেকে ছয়টি টিমের সাথে বিদেশী দুটি টিম যোগ করে আটটি টিমকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে রাউন্ড রবিন লীগ পদ্ধতিতে এগিয়ে গিয়েছিল টুর্নামেন্ট। এ গ্রুপ ঢাকা মোহামেডান, ইন্দোনেশিয়া, ওয়ারসেক এবং পিআইএ। বি গ্রুপ- ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, নেপাল এবং পুলিশ।
১৫ অক্টোবর ’৬৩ শুরু হয়েছিল আগা খান গোল্ডকাপের রাউন্ড রবিন লীগের খেলা ঢাকা মোহামেডান এবং ওয়ারসেক টিমের মধ্য দিয়ে। মুসা এবং রহমত উল্লাহর দুটি গোলের বিপরীতে ওয়ারসেক টিমের গফুর একটি গোল করলে মোহামেডান ২-১ গোলে জয়ী হয়েছিল। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ৭-০ গোলে পুলিশকে হারিয়ে তাদের শুভ সূচনা করেছিল। আব্বাস, ওমর, গনি প্রত্যেকের দুটি করে গোল আর ইউসুফ জুনিয়র করেছিল ১ গোল। পিআইএ হেরেছিল ০-৩ গোলেওয়ারসেক টিমের কাছে। জয়ী টিমের আমিন ১ গোল এবং সরফরাজ ২টি গোল করেছিল। পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম নেপাল একাদশকে ৮-০ গোলে পরাজিত করে ঢাকার দর্শকদের কাছে নিজেদের শক্তিশালী টিম হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাদের ইদ্রিস ডবল হ্যাটট্রিক, জাহান এবং তালেব একটি করে গোল করেছিল। এ গ্রুপের পরবর্তী খেলায় সাইদের হ্যাটট্রিকের সুবাদে পিআইএ ৩-২ গোলে ইন্দোনেশিয়াকে পরাজিত করেছিল। আলভান্ডু এবং সোয়েমারনো দুটি গোল শোধ করেছিল। ঢাকা ওয়ান্ডারার্র্স নেপাল একাদশকে ৭-০ গোলে পরাজিত করে আবারও প্রমাণ দিয়েছিল যে, তারা শক্তিশালী টিম। ওমর ৩ গোল, আব্বাস ও আব্দুল্লাহ দুটি করে গোল করেছিল। ওমর এবং ইউসুফের দেয়া ২-০ গোলে পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে পরাজিত করে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অব্যাহত রেখেছিল। এ গ্রুপের অপর খেলায় মুসা, কাইয়ুম এবং আমার দেয়া গোলে আমরা ইন্দোনেশিয়াকে ৩-১ গোলে (ডেমিকাস) পরাজিত করেছিলাম। প্রকাশের দেয়া গোলে নেপাল পুলিশকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ইন্দোনেশিয়া ডেমিকাসের ২ গোল এবং সুজিতনোর ২ গোলের সুবাদে ওয়ারসেক দলকে ৪-১ গোলে (নুরুল্লাহ) পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পাক ওয়েস্টার্ন রেল দল তালেব ও ইদ্রিসের দেয়া ২ গোলের ব্যবধানে পুলিশ দলকে পরাজিত করেছিল।
রাউন্ড রবিন লীগ শেষে এ গ্রুপ থেকে ঢাকা মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন এবং ইন্দোনেশিয়া রানার্সআপ হয়েছিল আর বি গ্রুপ থেকে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স চ্যাম্পিয়ন এবং পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে রানার্সআপ হয়েছিল।
প্রথম সেমিফাইনাল ২৬ অক্টোবর ’৬৩ ঢাকা ওয়ান্ডারার্স বনাম ইন্দোনেশিয়া। ইউসুফের (সিনিয়র) হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল এবং গফুরের দেয়া ১ গোলের সুবাদে ৫-০ গোলে ইন্দোনেশিয়াকে পরাজিত করে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। দ্বিমুকুট প্রত্যাশী (লীগ ও গোল্ডকাপ) ঢাকা মোহামেডান ২৭ অক্টোবর দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিমের। মোহামেডানের গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন ফুটবলের বিরুদ্ধে উচ্চতাসম্পন্ন খেলোয়াড়দের লম্বা লম্বা পাস আর শূন্যে বল খেলা ছিল মূল স্ট্র্যাটেজি। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যদিয়ে খেলা শুরু হয়েছিল। রহমত উল্লাহর দেয়া গোল অল্প সময়ের জন্য আমাদেরকে জয়ের স্বপ্ন দেখালেও রেলের ইদ্রিসের গোলে খেলায় সমতা আসে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এভাবেই প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে তালেব তাদের রেল দলকে এগিয়ে দিলেও মুসা গোল শোধ করলে খেলায় আবার উত্তেজনা বেড়ে যায়। গোল করার জন্য দুই টিমই আক্রমণ করে খেলার চেষ্টা চালায় এবং একসময় রেলওয়ে টিমের রমজান গোল করলে খেলায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ওয়ান্ডারার্স দলের সমর্থকরা রেল টিমকে সমর্থন জানানো নিয়ে গ্যালারিতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গোল শোধ করার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠি এবং একের পর এক আক্রমণ চালাই। আক্রমণের সুফলও আমরা পেয়েছিলাম একটি পেনাল্টির মাধ্যমে। গোলপোস্টে ফ্রি কিক বা পেনাল্টি কিক মারায় দক্ষ কাইয়ুম; কাইয়ুমই মেরেছিল সেদিনের পেনাল্টি কিকটি। কিন্তু মিস করেছিল, এর সাথেই ভেঙ্গে গিয়েছিল ঢাকা মোহামেডান কাবের আগা খান গোল্ডকাপ জয়ের স্বপ্ন।
পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম : লতিফ, আবদুল হক, রমজান, রশিদ, ইউনুস, তালিব, আলম, সেলিম, ইদ্রিস, এমএন জাহান এবং জাওয়াইদ।
ঢাকা মোহামেডান : বলাই, জহির, দেবীনাশ, রসুল বক্স, পিন্টু, আবিদ হোসেন (অধিনায়ক), কবির, রহমত উল্লাহ, কাইয়ুম, বশীর ও মুসা।
রেফারি : মাসুদুর রহমান।
২৯-১০-৬৩ তারিখে আগা খান গোল্ডকাপের ফাইনাল খেলায় মুখোমুখি হয়েছিল ঢাকার ওয়ান্ডারার্স কাব এবং পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে। রাউন্ড রবিন লীগে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাব ২-০ গোলে ওয়েস্টার্ন রেল দলকে পরাজিত করেছিল। স্বভাবত কারণে ওয়ান্ডারার্স টপ ফেভারিট টিম ছিল। তাছাড়া ফাইনাল খেলাটি পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তান রূপ নিয়েছিল। দর্শকে পরিপূর্ণ স্টেডিয়াম।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দলের সাপোর্টাররা তাদের দলের নিশ্চিত জয় ভেবে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে গ্যালারিতে উপস্থিত হয়েছিলেন। জয়ের উৎসব উদযাপনের জন্য কাবও তৈরি ছিল কিন্তু সবার আশা-আকাক্সা চুরমার করে দিয়েছিল খেলার ফলাফল। পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে ২-১ গোলে ঢাকা ওয়ান্ডার্স কাবকে পরাজিত করে শিরোপা জয় করেছিল। রেল দলের জাহান এবং ইদ্রিস গোল করেছিল আর ওয়ান্ডারার্স দলের ১টি গোল শোধ করেছিল ওমর।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দলের খেলোয়াড় : গোলাম হোসেন, খোদা বক্স, গফুর বেলুচ, আমিন, মুরাদ, গফুর, ইউসুফ (জুনিয়র), আবদুল্লাহ, ওমর, আব্বাস।
রেফারি : মাসুদুর রহমান। #
(ক্রমশ.)
(পঞ্চাশ) ১ মে
৩ মার্চ ১৯৬৩ ঢাকা ক্রিকেট লীগের ফাইনাল ম্যাচ। লীগ ডিসাইডিং ম্যাচ। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব ঢাকা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল ওয়ারী কাবের। যে দল জয়লাভ করবে, সে দল হবে লীগ চ্যাম্পিয়ন। ওয়ারী-ভিক্টোরিয়া কাব দুটোর সম্পর্ক সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। সুকুমার, মঈনু বকুল, দৌলত সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত এবং চৌকস খেলোয়াড়রা ওয়ারী কাবে খেলতো, আমাদের ভিক্টোরিয়ার সালাম ভাই, রফিক, মন্টুও ভাল ক্রিকেটার ছিল। টসে জয়লাভ করে ওয়ারী প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ভিক্টোরিয়ার ফাস্টবোলার রফিকের মারাত্মক বোলিং এবং মন্টুর ঘূর্ণি বলে ওয়ারীর ব্যাটসম্যানরা মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়ে গিয়েছিল সেদিন। রফিক ৩৬ রানে ৫ উইকেট এবং মন্টু ২৭ রানে ৩ উইকেট নিলে ওয়ারী চাপের মধ্যে পড়ে যায়। ওয়ারীর উদ্বোধনী জুটি এরফান এবং হেলাল মাত্র ৪ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছিল। পরবর্তীতে জাভেদ ও ইব্রাহিম জুটি টিমকে ৪৬ রানে নিয়ে গিয়েছিল। ইব্রাহিম ব্যক্তিগত ৫ রানে আউট হলে মঈনু এসে ২ রান করে আউট হয়ে যায়। তখন ওয়ারীর রান সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫। সুকুমার এসে জাভেদের সাথে যোগ দিয়ে টিমকে ৯৬ রানে পৌঁছে দেয়। রফিকের বলে জাভেদ বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যায়। শেষ পর্যন্ত ওয়ারী কাবের ইনিংস ১১৬ রানে সমাপ্ত হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ব্যাটিং করতে নেমে মাত্র ১৪ রানে ৫টি উইকেট হারিয়ে একেবারে বেহাল অবস্থায় পড়ে যায়। মেহেদী এবং মন্টু দলকে ২৫ রানে নিয়ে যায়। আমি ব্যাট করতে নামি বেশ আস্থার সাথে। তিনটি বাউন্ডারীসহ ১৭ রান করেছিলাম। আমার পরিচিত স্টেডিয়ামটিতে খেলে। (১৯৫৭ সাল থেকে অ্যাথলেটিক্স, হকি, ফুটবল, খেলতে আসা) ক্রিকেট খেলতে গেলে মনে হতো কি বিরাট স্টেডিয়াম, গায়ের জোরে ব্যাট চালালেও চার (বাউন্ডারি) হতে চাইতো না। আমার আউটটি আজও আমাকে পোড়ায়। দৌলত বল করেছিল, আমি ড্রাইভ মেরেই রান নেয়ার জন্য এগিয়েছি। বল সোজা দৌলতের হাতে, রান নেয়া হয়নি, ব্যাট ক্রিজে (সীমানার ভেতর) শরীরটা বাইরে, দাঁড়িয়ে ছিলাম। দৌলতের হাতে বল, সে আমাকে লক্ষ্য করে বল ছুঁড়ে মেরেছিল। ভয়ে আমি শূন্যে লাফিয়ে উঠেছিলাম, বল সোজা স্ট্যাম্পে আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গে আম্পায়ার আঙুল উঁচিয়ে আউটের সংকেত দিলেন। আমি বোকা বনে গিয়েছিলাম। খেলার আইন না জানার অজ্ঞতার কারণে সেই আউটের কথা মনে হলে আজও হাসি পায়। তখন আমাদের স্কোর ছিল ৫১। পরে আরো ২ রান যোগ করে আমরা (ভিক্টোরিয়া) ৫৩ রান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দৌলত ২৫ রানে আমাদের ৫ উইকেট নিয়েছিল আর বকুল ২৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে আমাদের ব্যাটিং-এ ধস নামিয়ে দিয়েছিল। আমরা ৬৩ রানে ওয়ারীর কাছে হেরেছিলাম। ওয়ারী লীগ চ্যাম্পিয়ন।
জগন্নাথ কলেজ শীতের এক সকালে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফরিদপুর কলেজের বিরুদ্ধে আন্তঃকলেজ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছিল; যার বিবরণ দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকা এভাবে দিয়েছিল :
ঞযব ঔধমধহহধঃয ঈড়ষষবমব ৎবঃধরহবফ ঃযব উধপপধ উরারংরড়হ রহঃবৎ-ঈড়ষষবমব ঐড়পশবু ঈযধসঢ়রড়হংযরঢ় যবৎব ুবংঃবৎফধু যিবহ ঃযবু ফবভবধঃবফ ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঈড়ষষবমব নু ঐধষভ ধ ফড়ুবহ মড়ধষং ধঃ ঃযব উধপপধ ংঃধফরঁস ুবংঃবৎফধু সড়ৎহরহম. ইধংযরৎ, ধহ রহঃবৎহধঃরড়হধষ ঢ়ষধুবৎ ধিং ঃযব পযরবভ ধৎপযরঃবপঃ ড়ভ ঃযরং নরম ারপঃড়ৎু. ঐব ংপড়ৎবফ ধ যধঃ-ঃৎরপশ ংঃধৎঃরহম রিঃয ঃযব াবৎু ভরৎংঃ মড়ধষ ড়ভ ঃযব সধঃপয. ঐব ফবষরমযঃবফ ঃযব ংঢ়বপঃধঃড়ৎং নু যরং হবধঃ ধহফ ধৎঃরংঃরপ ংঃরপশ ড়িৎশ.
ঋৎড়স ঃযব াবৎু নবমরহরহম ঃযব ঔধমধহহধঃয ঈড়ষষবমব ঃবধস বিৎব রহ ঃযব ড়ভভবহংরাব ধহফ রঃ ধিং যধৎফ ভড়ৎ ঃযব ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঈড়ষষবমব ঃড় রিঃযংঃধহফ ঃযব সড়ঁহঃরহম ঢ়ৎবংঁৎব ড়ভ ঃযবরৎ পড়হপবৎঃবফ ধঃঃধপশ.
ইবংরফবং ইধংযরৎ, ঃযব ড়ঃযবৎ ংপড়ৎবৎং বিৎব ঢ়ৎধঃধঢ়. ঐধলৎধ ধহফ অভুধষ.
ঞযব ধঃঃপশ ড়ভ ঃযব ারংরঃড়ৎং ধিং বিষষ-পড়ড়ৎফরহধঃবফ ধহফ ঃযবু ষড়ংঃ ধ ভবি পযধহপবং ঃযধঃ পধসব ঃযবরৎ ধিু ফঁব ঃড় ষধপশ ড়ভ ভরহরংয.
ঞযব ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঈড়ষষবমব ঃবধস ংঃধৎঃবফ ঃযব ফধু রিঃয ৎবসধৎশধনষব পড়ঁৎধমব ধহফ ফবঃবৎসরহধঃরড়হ ইঁঃ. রিঃয ঃযব ঢ়ধংংধমবড়ভ ঃরসব ঃযবু ভধফবফ ধধিু.
গধলরফ ঃযব পধঢ়ঃধরহ ড়ভ ঃযব ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঃবধস ংযড়বিফ ফবভরহরঃব ংরমহং ড়ভ ঢ়ৎড়সরংব যিড়ংব সধহু ংযড়ঃং সরংংবফ ঃযব হবঃং ড়হষু নু যধরৎং নৎবধফঃয. ঐধফ ফধসব ভড়ৎঃঁহব ভধাড়ঁৎবফ ঃযব ারংরঃড়ৎং ঃযবু পড়ঁষফ যধাব ৎবফঁপবফ ঃযব সধৎমরহ.
‘রোনাল্ডসে শিল্ড’ ফুটবল টুর্নামেন্ট
রোনাল্ডসে শিল্ড নামকরণের সঠিক ইতিহাস আমার জানা নেই; তবে রোনাল্ড এই অঞ্চলের কোন বরণীয় ব্যক্তি হবেন বলে আমার ধারণা। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই টুর্নামেন্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতো, পরবর্তীতে ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলাধুলার চাপ কমাতে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামে এই টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়া হতো দুটো উদ্দেশ্যে : একটি হলো খেলার আনন্দ, অপরটি হতো বেড়ানো, অনেকটা পিকনিক করার মতো। ১৯৬৩ জগন্নাথ কলেজ এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রথমদিকে আমরা যারা কলেজের ছাত্র, তারাই খেলে ফাইনালে উঠেছিলাম এবং পরে নূরু ভাই (কলেজের গেম ইনস্ট্রাক্টর), বড় নাজির, জামিল আক্তার, আলী, হাফিজ, দিপু, আনসার, জাম্বুকে দলে নিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করেছিলেন। আমরা রোনাল্ডসে শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ফিরে আসলে কলেজ আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছিল। মহসিন ভাই সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট পাকিস্তানের অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য একটি টুর্নামেন্ট। সমগ্র পাকিস্তান থেকে ভাল ভাল টিম এখানে অংশ নিতো। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ঢাকা মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স কাবও এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতো। লীগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব ১৯৬৩ সালের মোহাম্মদ আলী কাপে অংশগ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি আর্মি স্টেডিয়ামে এই ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৫০২ ওয়ার্কশপের সাথে আমরা খেলেছিলাম। এই টুর্নামেন্টে মোহামেডান কাবের কোন সফলতা আসেনি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের আর একটি শহর মুলতানে ফাডলাইটে ফুটবল টুর্নামেন্টও বেশ জমজমাট হতো। পিন্ডিতে থাকতেই খবর পেয়েছিলাম যে, জগন্নাথ কলেজ সেই টুর্নামেন্ট খেলতে মুলতান আসছে এবং মোহামেডান কাবের কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করবে। ঢাকা মোহামেডান পিন্ডি ছেড়ে গেলেও আমরা মুলতান গিয়ে জগন্নাথ কলেজের সাথে যোগ দিয়েছিলাম। যোগ দিয়েছিলাম না বলে যদি আমরা এভাবে বলি যে, ঢাকা মোহামেডানের খেলোয়াড়রাই জার্সি বদল করে জগন্নাথ কলেজের জার্সি গায়ে খেলেছিল। নূরু ভাই মুলতান যাওয়ার সময় কলেজের জলিল, রফিক, মোবাশ্বের, হাফিজসহ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন; বাকি খেলোয়াড় মোহামেডানের যেমন দেবীনাশ, কাইয়ুম চেঙ্গেজী, রসুল বকশ, প্রতাপ, বলাই, আমি এবং আনসার। টুর্নামেন্টের আকর্ষণীয় দিক ছিল রাতে ফাডলাইড ফুটবল খেলা। আমাদের জন্য ছিল একেবারেই নতুন। আমাদের টিমটিও ছিল শক্তিশালী। একই টিমের খেলোয়াড় হওয়ায় খেলাটাকে আমরা বেশ উপভোগ করতাম। খেলা শেষ হতো অনেক রাতে, রাত প্রায় বারটা-একটার সময় কান্ত শরীরে মাঠ থেকে হোটেলে যাওয়া ছিল আনন্দের। নির্জন রাস্তা, গাড়িঘোড়া নেই, হাসি-ঠাট্টা করতে করতে হেঁটে হেঁটে পথচলা কী যে আনন্দেরÑ যা আজও লিখতে বসে ভাল লাগছে। চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে। আমরা সে টুর্নামেন্টে ফাইনালে যেতে পারিনি; তবে দু’তিনটি ম্যাচ জেতার আনন্দের কথা ভুলতে পারিনি।
ঢাকা মোহামেডানের ফুটবল মৌসুম ’৬৩তে শেষ হয়েছিল করাচিতে একটি চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচ খেলার মধ্য দিয়ে। কেএমসি মাঠে ঢাকা মোহামেডান বনাম করাচি। পাকিস্তানের প্রখ্যাত স্টপার তোরাব আলী করাচির পক্ষে খেলেছিল, প্রচুর দর্শক হয়েছিল। চ্যারিটি বা প্রদর্শনী ম্যাচে সাধারণত যে ফলাফল হয়ে থাকে, এ ম্যাচের ফলাফলও সেই ড্র দিয়ে খেলা শেষ হয়েছিল। # (ক্রমশ:)
(একান্ন) ১৬ মে
পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে ১৯৬৩ সালের জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত বছরের লাহোরে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নশীপে আমাদের টিমের সার্বিক অবস্থা ছিল খুবই ছন্নছাড়া, মাঠে খেলা ছিল যেমন অগোছালো, টিমকে নির্দেশ করার মত কেউ ছিল না, তেমনি দলের অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। প্রতি বছরের ন্যায় সেবারও প্রথম ম্যাচেই বিদায়। ইপিএসএফ পাকিস্তান হকি কর্তৃপক্ষের নিকট সহযোগিতা চেয়ে পাঠালে পাকিস্তানের কোচ মি. নবী কালাতকে ঢাকায় পাঠিয়ে ছিল পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমকে কোচিং করার জন্য। নবী কালাত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অভিজ্ঞ, দক্ষ কোচ। আমরা যারা হকি খেলোয়াড় বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি এ অঞ্চলের খেলোয়াড়দের খেলার উন্নতি করাতে পারবেন। তার আন্তরিকতায় হকি অঙ্গনে একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সবার প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। তার হকি কোচিং আমাদের নিকট ছিল ব্যতিক্রম, সকলে আগ্রহ নিয়েই ট্রেনিং করেছিলাম, টিমেরও বেশ উন্নতিও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সে সময় আবাসিক ক্যাম্প করে ট্রেনিং হতো না অর্থনৈতিক কারণে নইলে আরো সুফল পাওয়া যেত, তাছাড়া তিনি এসেছিলেন খুবই সীমিত সময়ের জন্য, মাসখানিকের মধ্যেই আমাদের ট্রেনিং, সিলেকশন হয়ে রাওয়াল পিন্ডির উদ্দেশ্য প্লেন ধরেছিলাম।
ফুটবলের মত হকি খেলাতেও পাকিস্তান থেকে খেলোয়াড় ঢাকায় এসে খেলার প্রচলন শুরু হয়েছিল তবে খুবই কম সংখ্যক। ঢাকায় চাকুরি করার সুবাদে কয়েকজন খেলোয়াড় ঢাকায় বিভিন্ন কাবে লীগ খেলায় অংশগ্রহণ করতো। প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করতো সেরা, মামলী, তারা ওয়ারী কাবে খেলতো, পিডাব্লিউডি কাব, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইপিআর এবং আর্মিতেও পাকিস্তানী খেলোয়াড়রা খেলতো। পেশোয়ারে জন্ম নেয়া সামি খান, দেশ বিভাগের পর ভারত থেকে ঢাকায় এসে আস্তানা গাড়ে, আলমগীর ভাই মোমিনভাইয়ের সাথে থেকে এ অঞ্চলের হকির সাথে জড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমে ও গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমে সেবারও বেশ কয়েকজন পাকিস্তান থেকে ঢাকায় হকি লীগ খেলতে আসা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিল এবং টিমের সাথে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত হকি চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তান টিম - সেলিম জাম্বু (গোলরক্ষক), আহম্মদ, মোমতাজ, মোমিন, হাসিম, নিয়াজ, মূয়ীদ , মির্জা ফরিদ, প্রতাপ শংকর, ফরিদ, বশীর।
ম্যানেজার- আলমগীর আদেল, কোচ নবী কালাত।
আমরা পিআইএ যোগে লাহের তারপর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছিলাম। স্টেশনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন টুর্নামেন্ট কমিটির সদস্যগণ তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন সেনাসদস্য। আমাদের খাবার ব্যবস্থা সেরকম কোন উন্নতি হয়নি, সেই স্কুল হোস্টেল। খুলনার সবুর খান সাহেব সে সময় পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি আমাদের পুরোটিমকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সবুরখান সাহেব রাজনীতিবিদ হলেও তিনি ছিলেন স্পোর্টস মাইন্ডেড, তিনি ছিলেন ক্রীড়া সংগঠক, খুলনায় মুসলিম কাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, ঐ কাবের ফুটবল টিম খুব শক্তিশালী, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার, গৌরবও তাদের ছিল। ঢাকা থেকে বহু খেলোয়াড়, সে কাবের হয়ে লীগ খেলায় অংশগ্রহণ করতো। আমি অবশ্য টাউন কাবের (খুলনা কাবের) হয়ে খেলতাম। মন্ত্রী মহোদয় তার সরকারি বাসভবনে আমাদের টিমকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন আপ্যায়ন করিয়েছিলেন। আমরা পিন্ডিতে যতদিন ছিলাম, যাতায়াত এবং বেড়াবার জন্য একটি গাড়ি দিয়ে রেখেছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত করা হবে। নতুন রাজধানীর কাজ শুরু হয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন রাস্তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক মাইল দীর্ঘ কালো পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা, রাস্তার পাশে স্ট্রিট লাইটের পোস্ট গুলো সমানভাবে অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে। কোথায়ও এতটুকু উঁচুনীচু নেই দেখার মত। সে রাস্তা দিয়ে আমরা ইসলামাবাদ গিয়েছিলাম। সরকারি বাসভবন তখনও তৈরি হয়নি। একটি মাত্র তিনতলা ভবন ইস্ট ওয়েস্ট পাকিস্তান ফ্রেন্ডশীপ ভবন। মার্বেল পাথরে তৈরি মেঝে, দেয়াল অ™ভুত সুন্দর। তখন প্রথম মার্বেল পাথর দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমাদের হকি টিমের সুসজ্জা দেখে সবাই ভেবেছিল এবার আমরা ভালো ফলাফল করবো, কিন্তু সবাইকে হতাশ করে আমরা প্রথম ম্যাচেই পিন্ডি টিমের সাথে বিদায় নিয়েছিলাম।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান স্পোর্টস এন্ড রিক্রিয়েশিয়ান কাব, ঢাকার হকি টিমের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৩-৬৪ হকি মৌসুমে। সে সময় হকি ছিল শীতকালীন খেলা আর শীত মৌসুম ধরা হতো সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।দেশের খেলাধুলাকে মৌসুম ভিত্তিক বিন্যাস করা হতো। বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসেও গরম থাকে তাছাড়া খেলাধুলার প্রসার ঘটায় দেশের ক্রীড়াপঞ্জির আমূল পরিবর্তন এসেছে। খেলার সংখ্যা, বেড়েছে, অবকাঠামো বেড়েছে, ভিন্ন ভিন্ন খেলা তাদের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিম কত তারিখে প্রথম খেলা খেলেছিল সেটা মনে নেই তবে জয় দিয়ে শুভ সূচনা হয়েছিল সে জয় যে শেষ অবধি অুণœ রাখতে পেরেছিলাম সেটার জন্য আজও লিখতে বসে গর্ব অনুভব করছি। আমরা যারা খেলোয়াড় হিসেবে ব্যাংকে চাকরিরত ছিলাম তাদের দিয়ে পুরোটিম গঠন করা যেত না, তাই দু চারজন খেলোয়াড়কে ব্যাংক টিমে নিয়ে লীগ খেলা শুরু করেছিলাম। তাদের মধ্যে অন্যতম ফুলব্যাক মোমতাজ উদ্দিন, ইকবাল, কামাল পোটলা, দ্রুতগতি সম্পন্ন রাইট আউট আবদুল হক। আমাদের টিমের জন্য কোন গোল কিপার জোগার করতে পারিনি। ক্রিকেট খেলোয়াড় মানু, (ক্রীড়া সংগঠক) প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের গোলরক্ষকের দায়িত্ব্ পালন করতে এগিয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে আমাদের ব্যাংক ফুটবল দলের গোলরক্ষক, দেশের ফুটবলের খ্যাতিমান গোলরক্ষক, রঞ্জিত দাসকে গোলকিপার বানিয়ে গোলবারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি ফুটবলের সাহসী গোলরক্ষক হিসেবে খুব প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। হকিতেও তিনি সাহসের সাথেই হকি সিজন পার করে দিয়েছিলেন, তবে আমাদের ডিপ ডিফেন্স ভেদ করে বিপক্ষ দলের ‘ডি’তে ঢোকা ছিল কষ্টকর কারণ দেশের দুই কৃতি ফুলব্যাক মোমতাজ এবং সাবের আলী আমাদের টিমের ফুল ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করতো। আমাদের টিমের মূল শক্তি ছিল আমাদের আক্রমণভাগ। রাইটউইং দিয়ে ছুটে আবদুল হকের ক্রশগুলোকে মির্জা ফরিদ মিলু নয়তো আমি সদ্ব্যবহার করে। গোল করার চেষ্টা করেছি। মির্জা ফরিদ মিলু রাইট ইনের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়, গোল করায় সে ছিল দক্ষ। সেন্টারফরোয়ার্ড আমাদের ছিল না, লেফট আউটপজিশনের খেলোয়াড় মীর আনোয়ার করিমকেই খেলাতে হতো। ব্যাংক টিমে লেফট ইনে আমি সব সময় ভাল খেলার চেষ্টা করেছি, আমাদের লেফট আউট আসগতর আলী মুন্নী ধীরস্থির, প্রকৃতির খেলোয়াড় ছিল। ফখরুল আলম মাহমুদ ভাই, আমাদের সিনিয়র ছিলেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন, ভাল ফুটবল খেলোয়াড়, পাকিস্তান ফুটবল টিম ট্রায়েলেও চান্স পেয়েছিলেন, খেলতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়ে তার সব শেষ হয়ে গিয়েছিল, এমনকি চাকরী ও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা ফিরে তিনি ব্যাংক হকি খেলোয়াড় হিসেবে জয়েন করেছিলেন। তিনি আমাদের টিমের সেন্টার হাফ পজিশনের দায়িত্ব খুব সাহসিকতার সাথে পালন করতেন। রাইট হাফে কামাল পোটলা আর লেফট হাফে আনোয়ার, আনোয়ার বেশ নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ছিল বিশেষ করে তার পজিশনে। পরবর্তীতে সে ইস্ট পাকিস্তান টিমেও চান্স পেয়েছিল। আমাদের টিম ম্যানেজমেন্টের উৎসাহ আমাদের প্রেরণা জোগাতো, সবসময় তাদেরকে কাছে পাওয়া যেত, মাঠে তারা হাজির থাকতেন। টিমের সম্মিলিত চেষ্টা, আন্তরিকতা ছিল আমাদের সফলতার মূল কারণ। ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিম প্রথম বছরেই (১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে) ঢাকা হকি লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
(বায়ান্ন) ১৬ জুন
এক পাঠানের বাসায় চুরি করতে এসে চোর ধরা পড়ে যায়। গৃহকর্তা চোরের পা তার চারপাইয়ের (খাটের) সাথে রশি দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে রেখে পুলিশকে খবর দিতে থানায় গেলে পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, চোর কোথায়? গৃহকর্তা বললেনÑ বাসায়, চারপাইয়ের পায়ার সাথে পা বেঁধে রেখে এসেছি। পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, চোরের হাত তো খোলা, এতক্ষণে নিশ্চয়ই চোর হাত দিয়ে বাঁধন খুলে পালিয়ে গেছে। গৃহকর্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, চিন্তার কোন কারণ নেই স্যার, চোর ব্যাটাও আমার মত একজন পাঠান। পাঠানদের নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প শোনা যায়। পাঠানরা সহজ-সরল এবং কঠিন স্বভাবের মানুষ। সেই পাঠান মুল্লুকে অর্থাৎ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের রাজধানী পেশাওয়ারে ১৯৬৪ সালে হকি খেলতে গিয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে লীগ (১৯৬৩-৬৪ সাল) শেষ হওয়ার পরপরই পেশাওয়ারে হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য টিম প্রস্তুত করতে হয়েছিল। টিমের অনুশীলন করার সুযোগও সেরকম পাওয়া যায়নি, অনেকটা লীগ খেলার ওপর ভিত্তি করে টিম গঠন করা হয়েছিল।
গোলরক্ষক : সেলিম জাম্বু ও মান্নান। ফুলব্যাক-সালাম, সেরা ও মোমতাজ। হাফব্যাক : মোমিন, আহমেদ হোসেন, সাদেক ও আবিদ। ফরোয়ার্ড-বশীর (ক্যাপ্টেন), ওসমানী, ফরিদ (ভাইস ক্যাপ্টেন), মোবিন, নাসিম, নিয়াজ ও বুলবান। ম্যানেজার-আলমগীর আদেল এবং সহকারী ম্যানেজার-সামি খান।
২ মার্চ ১৯৬৪ সকাল ১০টায় তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে পিআইএযোগে লাহোরের উদ্দেশে আমরা ঢাকা ত্যাগ করি। প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর যখন আমরা লাহোর এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম, তখন বিকেল। সে রাতেই আমরা পেশাওয়ারের পথে ট্রেনে চেপে বসেছিলাম। পরদিন সকালে রেলস্টেশনে নেমে টের পেলাম আমরা শীতকালে পেশাওয়ার এসেছি, ভীষণ শীত। আমরা উঠেছিলাম একটি একতলা স্কুলে। চারদিকে দেয়াল ঘেরা, মাঝখানে বিরাট উঁচু একটি গাছ। দিনের বেলায় রোদে গাছে একটা আয়না লাগিয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাড়ি কাটার কাজ সারতো, কারণ ঘরে পর্যাপ্ত আলো ছিল না। চারপাইয়ে কম্বল পাতা, গায়ে দুটো করে কম্বল, তারপরও শীত যাচ্ছিল না। এ অবস্থাতে দু’তিনদিন কেটে গেল। ৭ মার্চ আমরা হায়দ্রাবাদ ‘বি’ টিমের বিরুদ্ধে মাঠে নামলাম। হায়দ্রাবাদ ‘বি’ টিম আমাদের টিমের মতই, নিচের সারির টিম। তারপরও বলবোÑ তাদের খেলা আমাদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। রিসিভিং, পাসিং, ডজ, রানিং উইথ দ্য বল, ব্যক্তিগত স্কিলগুলো এবং দলীয় কম্বিনেশন আমাদের চেয়ে উন্নত। আমাদের ফুল ব্যাকদ্বয় সবসময় ভাল। হাফ লাইনটাও মোটামুটি ভাল। আমাদের ফরোয়ার্ড লাইনটাই ছিলো টিমের সবচেয়ে দুর্বল স্থান। আমি ইস্ট পাকিস্তান হকি টিমে ১৯৬০ সাল থেকে খেলে আসছি। এযাবৎ মানসম্মত ফরোয়ার্ড লাইন পাইনি, খেলে কখনও সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমাদের ফরোয়ার্ডদের দুর্বলতার কারণে আমরা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ হকিতে একটি ম্যাচও জিততে পারিনি। হায়দ্রাবাদ ‘বি’ টিম এবং আমাদের টিম প্রায় সমমানের হওয়ায় খেলাটি বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উত্তেজনাপূর্ণ হয়েছিল। বরাবরের মত এবারও আমাদের ফুলব্যাকদ্বয় মোমতাজ ও সেরা হায়দ্রাবাদ টিমের আক্রমণগুলো প্রতিহত করতে ব্যস্ত ছিল আর হাফ লাইন মোমিন, সাদেক ও আবিদ ফরোয়ার্ডদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আমরা ফরোয়ার্ডরা দক্ষতা এবং সমঝোতার অভাবে বল অল্প সময়ের জন্যও ওপরে ধরে রাখতে পারছিলাম না। খেলাটা বেশিরভাগ সময় মাঝমাঠে সীমাবদ্ধ ছিল। এমনি করে খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা শট কর্নার (পেনাল্টি কর্নার) আমাদেরকে অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়েছিল।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হকি সেক্রেটারি লালা আইয়ুব বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী একজন ক্রীড়া সংগঠক। পেশাওয়ারে তার হোটেল ব্যবসা ছিল। চমৎকার তার ব্যবহার, ছোট-বড় সবাই তাকে সমাদরের চোখে দেখতো। আমাদের ম্যানেজার আলমগীর আদেলের শ্বশুর ছিলেন রাজনীতিবিদ, পাকিস্তান এসেম্বলিতে তিনি ছিলেন চিফ হুইপ, আমাদের সহকারী ম্যানেজার সামি খান একজন পাঠান, তার জন্মস্থান পেশাওয়ারে। সেজন্য আমরা পেশাওয়ারে যে ক’দিন ছিলাম, আলাদা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বেশ আরামে কাটিয়েছিলাম। শোনা যায়, পাঠানরা নাকি বছরে একবার গোসল করে। প্রতিদিন গোসল করা অভ্যাস আমাদের। আমরাও পেশাওয়ারে গোসল করতে চাইতাম না শীতের ভয়ে। তবে পেশাওয়ারে গোসল করার ভাল ব্যবস্থা ছিল। চুল কাটার সেলুনের সাথে একটি হামমাম (গোসলখানা) যেখানে গরম পানি আর ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা থাকতো। আমরা সেখানে দু’একদিন করে গোসল করেছিলাম।
একদিন রেস্টুরেন্টে চা খেতে গিয়েছিলাম। চা তো নয়, কাওয়া। হাল্কা রং চা, তবে তাতে এলাচ-দারুচিনি দেয়া। একটি টি-পটে কাওয়া, সাথে ছোট ছোট বাটির মত কাপ। সবগুলোই ভাঙ্গা, আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি মা ভাঙ্গা প্লেট-কাপে খেতে দিতেন না। বলতেন, ভাঙ্গা থালা-বাসনে খেলে কপালটা ছোট হয়ে যায়। টি-বয়কে ডেকে বললাম, এগুলো নিয়ে যাও, নতুন করে ভালো চায়ের সরঞ্জামে করে নিয়ে আস। টি-বয় উত্তর দিল, দোকানের সব জিনিসপত্র একইরকম জোড়া লাগানো। ভাবলাম, চায়ের দোকানের মালিক গরিব, তাই জোড়া লাগিয়ে কাজ চালাচ্ছে। অন্য একদিন বড় এক দোকানে খেতে গিয়ে যা দেখলাম, সেখানকার থালা-বাসনগুলো মিউজিয়ামে রাখার মত! টি-পট কয়েক টুকরো, চায়ের কাপও বেশ অনেকগুলো টুকরো, জোড়া লাগানো, টি-পট এবং কাপের আসল রূপটি পরিবর্তন হয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছিল ওগুলোর ওপর পোকা-মাকড় মরে লেপটে রয়েছে। রেস্টুরেন্ট মালিককে জিজ্ঞেস করায় আসল রহস্য বের হয়ে আসল। যে দোকানের চায়ের কাপ যত বেশি ভাঙ্গা-জোড়া লাগানো থাকবেÑ সেটাই আসল খানদানী, সেটাই তাদের ঐতিহ্য।
‘লান্ডি-কোতাল’ : উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের শেষ সীমানা, আফগানিস্তানের বর্ডার সংলগ্ন একটি স্থান বা মার্কেট। ল্যান্ডি-কোতাল মার্কেট হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিদেশী জিনিসপত্র পাওয়া যেত বলে সবার কাছে আকর্ষণীয় মার্কেটও ছিল সেটা। লালা আইয়ুব গাড়ি ও একজন মানুষ দিয়ে আমাদেরকে লান্ডি-কোতাল বেড়াতে পাঠিয়ে ছিলেন। এক সকালে আমরা রওনা দিলাম, কয়েক মাইল যাবার পর গাড়ি আর আগে যেতে পারছিল না। লাইন করে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে গেছে, মানুষ সব সামনের দিকে তাকিয়ে। গোলাগুলির শব্দ শুনছে। সামনেই দুই কাবিলার (গোষ্ঠী) মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ চলছে, তাই সাহস করে গাড়ি আর সামনে এগুচ্ছে না, অপেক্ষা করছে। কখন গোলাগুলি শেষ হবে, তারপর গাড়ি চলবে। এ জায়গাটার নাম জানি না, সমতল ভূমি, রাস্তার দু’ধারে দুটো দুর্গের মত। গোষ্ঠীগতভাবে এরা দুর্গের মত প্রাচীর দিয়ে ঘিরে তার ভেতর বাড়িঘর তৈরি করে বসবাস করে। আলাদাভাবে বানানো ঘরবাড়ি এ এলাকায় চোখে পড়েনি। শোনা যায়, পাঠানদের জাতিগত-গোষ্ঠীগত বিবাদ শেষ হয় না, বংশের পর বংশ চলতে থাকে।
ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করে। মনে হলো এরকম ঘটনা এখানে প্রায় ঘটে এবং স্বাভাবিক ঘটনা বলে সবাই ধরে নেয়। পাকিস্তান সরকারও এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে পারতো না, পাঠানদের নিজস্ব আইনেই তারা চলতো। গাড়ি ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরের দিকে চলছিল। আঁকাবাঁকা যে পথ ধরে আমরা যাচ্ছিলাম, সেটাই হলো খাইবার পাস বা খাইবার গিরিপথ।
আমাদের গাড়ি তখন পাহাড়ের অনেক উঁচুতে নিচে তাকাতে ভয় লাগছিল, কয়েক হাজার ফুটের খাদ, একবার দুর্ঘটনা ঘটলে আর রক্ষা নেই। কিছুক্ষণ পর একটি সেতুর কাছে গিয়ে গাড়ি থেমেছিল। সেতুর নাম ভুলে গেছি। দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করেছে সরু এই সেতুটি। সেতুর দু’ধারে চেকিং হয়। পাশাপাশি দুটো গাড়ি চলতে পারে না বলে একধার দিয়ে গাড়ি চললে অন্য ধারে গাড়ি বন্ধ থাকেÑ এভাবেই সেতুর চলাচল ব্যবস্থা। সেতুর ওপর খুব ধীরগতিতে গাড়ি চলছিল, নিচে তাকিয়েছিলাম, মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। কয়েক হাজার ফুট নিচে সরু একটি নদী বয়ে যাচ্ছে। দু’তিন মিনিট লেগেছিল ব্রিজ পার হতে। গাড়ি আর এক পাহাড়ের গা ঘেঁষে নিচে নামতে শুরু করে দিয়েছিল। আমরা পাহাড়ের কোলেই দু’তিন ঘন্টা কাটিয়ে আবার সমতলে এসে হাফ ছেড়েছিলাম। কিছুদূর চলার পর আমাদের সাথে আসা লালা আইয়ুবের লোক গাড়ি থামার নির্দেশ দিলেন। গাড়ি থেকে নেমে আমরা ভদ্রলোকের পেছন পেছন কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটি বাড়ির সামনে এসে থামলেন, তার সঙ্গে বাসার ভেতর ঢুকেছিলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলামÑ এগুলো কি সত্যি সত্যি পিস্তল, নাকি খেলনা। এরই মধ্যে একজন লোক হাতে করে দুটো পিস্তল এনে আলমগীর ভাইয়ের সামনে ধরে বললো, বলেন তো কোনটা জার্মানির তৈরি আর কোনটা আমাদের এখানের তৈরি? চিনতে পারবেন না, একই রকম দেখতে, কাজও করবে একইরকম। চেনা মুশকিল, কোনটা আসল কোনটা নকল।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো এবং কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের গন্তব্যস্থল লান্ডি-কোতাল এসে থামলো। গুলিস্তান হকার্স মার্কেটের মত টিনশেডের ছোট ছোট দোকান। বিদেশী কাপড়চোপড়, ক্রোকারিজ, মেয়েদের সাজসজ্জার জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা ছোট ছোট দোকানগুলো।
পাকিস্তানে বিদেশী জিনিসপত্র নিষিদ্ধ ছিল, বিশেষ করে ইন্ডিয়ার জিনিস একেবারেই ব্যান্ড ছিল। লান্ডি-কোতালে ইন্ডিয়ান ছবির গানের রেকর্ড সবার কাছে ছিল লোভনীয়। সে সময় লং প্লে রেকর্ডের পাশাপাশি নতুন বের হওয়া সিডির ন্যায় পাতলা রেকর্ড পাওয়া যেত। অনেকে সেগুলো কিনেছিল।
আমি জাপানি টোয়েবরো শার্টের কাপড় কিনেছিলাম। সাদা রংয়ের। সবেমাত্র সুতি সিনথেটিক্স মিক্স করা কাপড় বাজারে এসেছে লোভনীয় কাপড়। বোন এবং ভাবীর জন্য কাপড়, সাবান, কিছু সাজগোজের জিনিস কিনেছিলাম। চায়নার তৈরি ড্রাগনের ছবিওয়ালা একটি কফিসেট কিনেছিলাম। ছোট্ট ব্লু রং-এর কফিসেটটি আজো আমার শোকেসে সযতেœ রক্ষিত রয়েছে। যখনই সেটার ওপর চোখ পড়ে, লান্ডি-কোতালের ভ্রমণটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। খোলা আকাশের নিচে স্তূপ করা বন্দুক-পিস্তলের গুলি এমনভাবে রাখা ছিল যেমন আমাদের দেশে বড় টুকরিতে কালোজাম স্তূপ করে রাখা হয়। পিস্তল এবং দেশী বন্দুক বিক্রি হচ্ছিল অন্যান্য জিনিসপত্রের মত। এক অদ্ভুত মার্কেট লান্ডি-কোতাল। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল, ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিদেও পেয়েছিল। আমাদের সাথে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি আমাদেরকে এক গোস্তের দোকানে নিয়ে গেলেন। আমাদের দেশের খাসির মাংসের দোকানে যেমন জবাই করা খাসি দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়, তেমনি দুম্বার মাংসগুলো দড়িতে ঝোলানো, পাশেই জ্বলন্ত চুলায় বড় কড়াই। কত সের মাংস লাগবে বলার সাথে সাথে কসাই ঝুলন্ত মাংস থেকে মাংস কেটে নিমিষেই টুকরো করে কড়াইতে ফেলে দিয়েছিল। মাংস ধোয়া-বাছা নেই, রক্ত লেগে রয়েছে। কসাই ব্যাটা বাটি থেকে অল্প লবণ মাংসের ওপর ছিটিয়ে দিয়েছিল। অন্য একটি দোকান থেকে অল্প টমেটো কিনে এনে দিলে সেটাও মাংসের মধ্যে দিয়েছিল। কারো দেরি সহ্য হচ্ছিল না, কড়াই থেকে মাংস নিয়ে খাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। খাওয়ার আগে মনে হয়েছিল কি যে খাব আল্লাহই জানেন। মাংসের টুকরো মুখে দিতেই মনে হয়েছিল অমৃত! এটাই চাপলি কাবাব। সেরকম সুস্বাদু মাংস আমি আজ পর্যন্ত খাইনি।
পাঠান মুলুকে এভাবেই শেষ হয়েছিল আমার হকি সফর। #
(ক্রমশ:)
(তেপ্পান্ন) ১ জুলাই
সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের জাতীয় হকি টিম দু’সপ্তাহের ট্যুরে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সফরে এসে তিনটি হকি টেস্ট ম্যাচ এবং সাতটি প্রদর্শনী হকি ম্যাচ খেলেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের খেলা শেষ করে জাপানি হকি দল পূর্ব পাকিস্তানে শেষ প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে ঢাকায় এসেছিল।
পেশাওয়ার থেকে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা শেষে ঢাকায় ফিরেই হকি স্টিক তুলে রেখেছিলাম এবং আমি সে সময় আসন্ন ফুটবল মৌসুমের জন্য নিজেকে তৈরি করতে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। মেতে উঠেছিলাম ফুটবল নিয়ে। এরই মধ্যে জাপান জাতীয় হকি দলের ঢাকায় প্রদর্শনী ম্যাচের সংবাদ পেয়ে আবার ফিরে যেতে হয়েছিল হকি মাঠে। হকি কর্মকর্তারা তড়িঘড়ি ট্রায়াল ডেকে টিম গঠন করে সে টিমের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আমাকে মনোনীত করেছিল।
ইতোমধ্যে (ঢাকায় আসার পূর্বে) জাপানি হকি টিম তিনটি টেস্ট ম্যাচের প্রথমটি রাওয়ালপিন্ডিতে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান টিমের সাথে ড্র করে নিজেদের শক্তির আভাস দিয়েছিল; তবে পরবর্তী লাহোর এবং করাচি টেস্টে পাকিস্তান তাদের পরাজিত করে সিরিজ জয় করে নিয়েছিল। পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর এবং কোয়েটায় জাপান দল প্রদর্শনী ম্যাচ জিতলেও হায়দ্রাবাদ, মুলতান, লায়ালপুর ও পেশাওয়ারে পরাজিত হয়েছিল এবং তাদের সফরের শেষ প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য ১৯ এপ্রিল ’৬৪ ঢাকায় পৌঁছেছিল।
সময় স্বল্পতার জন্য আমাদের টিম প্র্যাকটিস সেরকম করা হয়নি। তাছাড়া আমাদের হকি খেলোয়াড়দের ইতিপূর্বে কোনো আন্তর্জাতিক দলের সাথে খেলার সৌভাগ্য হয়নি। জাপানি দলের সাথে প্রথম খেলা; সুতরাং টিমওয়ার্ক, অভিজ্ঞতা, দক্ষতাÑ সবকিছুরই ঘাটতি নিয়ে আমরা সেদিন বিকেল চারটায় ঢাকা স্টেডিয়ামে জাপানি জাতীয় টিমের মুখোমুখি হয়েছিলাম। খেলা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে মিলিত হয়েছিলেন প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী হাফিজুর রহমান। খেলার শুরু থেকে আমরা যেমন প্রাধান্য বিস্তার করার চেষ্টা করছিলাম, তেমনি জাপান দলও খেলাটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল; তাই প্রথম থেকেই খেলা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। জাপান দলের ছোট ছোট পাস এবং বল কন্ট্রোল স্থানীয়দের প্রশংসা কুড়িয়েছিল; বিশেষ করে তাদের দুই উইং চমৎকার খেলা প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে আমাদের উইং দুটো ছিল নিষ্প্রভ। রাইট আউট প্রতাপ বল পেয়ে খেলার চেষ্টা করলেও লেফট আউট মোবারক এতটাই ব্যর্থ ছিল যে, বল ধরতেই পারছিল না; তার কাছে বল গেলেই দর্শকরা চিৎকার করে তাকে আরও নার্ভাস করে দিচ্ছিল। আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড মজিদও ভাল খেলতে পারছিল না; সুতরাং আক্রমণভাগ ছিল ব্যর্থ আর সে সুযোগে জাপানি ডিফেন্স খুব স্বচ্ছন্দের সাথে খেলছিল। জাপানি গোলরক্ষক হাসহিমোটো একবারের জন্যও পরীক্ষিত হয়নি। জাপান দলের লেফট ইন ওকাবে এবং লেফট উইং কিহারা উভয়ের মধ্যে সমঝোতা এবং বল আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের ডিফেন্সের কাছে রীতিমত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। খেলার দশ মিনিটের সময় লেফট উইং কিহারা বল ড্রিবল করে আমাদের ডিফেন্সকে পরাজিত করে ‘ডি’র ভেতর ঢুকে পড়ে এবং তাদের রাইট উইঙ্গার টাকিজাওয়ার উদ্দেশে বল পুশ করে দেয় কিন্তু রাইট উইঙ্গার স্টিকে বল কানেক্ট করতে ব্যর্থ হলে জাপান নিশ্চিত একটি গোল থেকে বঞ্চিত হয়। প্রথমার্ধের শেষদিকে আমাদের ডিফেন্স এবং গোলরক্ষক জাম্বুর ভুল বোঝাবুঝির জন্য জাপান দলের সেন্টার হাফ বল পেয়ে যায় এবং ফাঁকা পোস্টে হিট বাইরে মেরে আরও একটি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করে। আমাদের ফুলব্যাকদ্বয় মোমতাজ এবং সেরা বিপক্ষ দলের আক্রমণগুলো দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করছিল। রাইট হাফ মোমিন ভাই এবং লেফট হাফ হাশিম দ্রুতগতিসম্পন্ন জাপানি দুই উইংকে ভালভাবেই সামাল দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমার্ধে জাপান টিম একটি শর্ট কর্নার এবং একটি লং কর্নার পেয়েও সেটা থেকে কোনো সুফল লাভ করতে পারেনি। গোলশূন্য অবস্থায় প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মিনিটের সময় জাপান দলের লেফট ইন ওকাবের কাছ থেকে একটি থু্রু পাস পেয়ে লেফট উইঙ্গার কিহারা দ্রুতগতিতে স্ট্রাইকিং সার্কেলে ঢুকে পোস্টে হিট চালায়Ñ যা জাম্বুর ব্যর্থতার জন্য গোলে পরিণত হয়। গোল শোধ করার জন্য আমরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, সুযোগও পেয়েছিলাম দ্বিতীয়ার্ধের ২৮ মিনিটের সময়। আমি একটি বল পেয়ে দু’তিনজন জাপানি ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে স্ট্রাইকিং সার্কেলে ঢুকে সজোরে হিটের মাধ্যমে গোল করি কিন্তু দুর্ভাগ্য! আম্পায়ারের বাঁশি, স্টিক, গোল বাতিল। গোলে হিট করার মুহূর্তে আমার স্টিক আমার কাঁধের ওপরে উঠেছিলÑ এ অপরাধে গোল বাতিল করেছিলেন আমাদেরই আম্পায়ার। শেষ পর্যন্ত জাপান আন্তর্জাতিক হকি টিম শেষ প্রদর্শনী ম্যাচে আমাদের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে জয়ী হয়ে তাদের সফর শেষ করেছিল।
খেলা শেষে কেন্দ্রীয় যোগাযোগমন্ত্রী খান এ সবুর দু’দলের খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। প্রাদেশিক যোগাযোগমন্ত্রী নওয়াব খাজা হাসান আসকারী এবং স্পিনার প্রাদেশিক এসেম্বলি আবদুল হামিদ মাঠে উপস্থিত থেকে খেলা উপভোগ করেন।
দু’টিমের খেলোয়াড় : জাপান : হাসিমোটো, টি ইয়োজাকি, এ টাকাসিমা, কে. ইয়োজাকি, কে. ইওয়াহসি, টি. ইয়ামাওকা, কে. টাকিজাওয়া, এস. কাওকু এইচ, টানাকা, এসওকাবে এবং এস কিহারা।
পূর্ব পাকিস্তান : মো. সেলিম জাম্বু, মোমতাজ, এসএম সেবা, মোমিন, সাদেক, হাশিম, প্রতাপ, নিয়াজ, মজিদ, বশীর এবং মোবারক।
আম্পায়ার : এসএম আইয়ুব এবং আলমগীর আদেল।
পরদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকা লিখেছিল : পূর্ব পাকিস্তানী খেলোয়াড়গণ যদিও কোন আন্তর্জাতিক দলের সহিত ইতিপূর্বে খেলার সৌভাগ্য লাভ করে নাই, সেই তুলনায় প্রথম খেলা খুব একটা আশার ব্যাপার না হইলেও নৈরাশ্যজনক নয় ও বশীর যে ধরনের ক্রীড়া প্রদর্শন করিয়াছে, তাহা অনেককেই আশান্বিত করিয়াছে। তার বল কাটাইবার পদ্ধতি জাপান আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের মাঝে মাঝে হতচকিত করিয়া দিয়াছে।
দৈনিক আজাদ লিখেছিল : ‘পূর্ব পাকিস্তান দল পরাজিত হইলেও গতকল্য তাহারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত খেলার সূচনা করে কিন্তু দলীয় সমঝোতার অভাব এবং আক্রমণভাগ বিশেষ করিয়া লেফট আউট মোবারক, সেন্টার ফরোয়ার্ড মজিদের ব্যর্থতার দরুন তাহারা অনেক সুযোগ পাইয়াও কোন কাজে লাগাইতে পারে নাই। পূর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক লেফট-ইন বশীর নিঃসন্দেহেই অনবদ্য ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। কিন্তু সহযোগীদের ব্যর্থতা তাহার কৃতিত্বকে ম্লান করিয়া দেয়।
জাপান জাতীয় হকি টিম দেশে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাদের টিম লিডার মি. কে. ইওয়াহাসি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘ঐব ধিং ঃধশবহ ধনধপশ নু ঃযব ঢ়বৎভড়ৎসধহপব ড়ভ ঃযব ঊধংঃ চধশরংঃধহ ঃবধস রহ ঃযব ঊীবনরঃরড়হ সধঃপয ড়হ সড়হফধু ধহফ পড়ঁষফ যধৎফষু নবষরবাব রঃ ঃযধঃ যরং ঃবধস ধিং ৎবংঃৎরপঃবফ ঃড় ধ ংড়ষরঃধৎু মড়ধষ ারপঃড়ৎু.’ অংশবফ রভ ধহু ড়ভ ঃযব বধংঃ চধশরংঃধহ নড়ুং রসঢ়ৎবংংবফ যরস, যব সবহঃরড়হবফ ইধংযরৎ রহ ঃযব ভড়ৎধিৎফ ষরহব যিড় যব ংধরফ, ধংঃড়হরংযবফ যরস রিঃয যরং ধৎঃরংঃরপ ংঃরপশ ড়িৎশ ধহফ পষবধহ ঢ়ষধু ধহফ ফবভরহরঃবষু ঢ়ঁঃ ঁঢ় ধ ংযড়ি নবঃঃবৎ ঃযধহ ংড়সব ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ ঘধঃরড়হধষ চষধুবৎং’.
(ক্রমশ:)
(চুয়ান্ন) ১৬ জুলাই
গত বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং কাব বনাম ফায়ার সার্ভিস টিমের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল রিটার্ন লীগ পদ্ধতিতে ১৯৬৪ সালের ফুটবল লীগ। টিমগুলো ছিল মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, পিডব্লিউডি, আজাদ, ওয়ারী, বিজি প্রেস, সেন্ট্রাল স্টেশনারি, রেলওয়ে, পুলিশ, ইস্পাহানী ও সেন্ট্রাল জেল ফুটবল দল। ৪ মে আরম্ভ হওয়া লীগের শুভসূচনা করেছিল মোহামেডান ৩-০ গোলে ফায়ার সার্ভিস টিমকে পরাজিত করে, যার দুটি গোল করেছিল আনসার এবং একটি গোল ছিল আবদুল্লাহর। লীগের ২য় দিনের খেলায় বল মাঠে গড়ায়নি। ইস্পাহানী বনাম স্টেশনারি টিমের খেলা ছিল। হঠাৎ করেই ইস্পাহানী টিম লীগ খেলা থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়, তাই সেবারের লীগে এগারটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। পিডব্লিউডি পুলিশ টিমকে ৩-০ গোলে হারিয়ে আরম্ভটা ভালই করেছিল (আঞ্জাম-২, মঞ্জু-১ গোল করেছিল)। আজাদ স্পোর্টিং তাদের প্রথম খেলায় ৩-১ গোলে প্রেস টিমকে হারিয়ে লীগ শুরু করেছিল। নিশিথ ২ এবং মুক্তা করেছিল ১ গোল। আমাদের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল রেল দলের বিরুদ্ধে। এ খেলায় আবদুল্লাহ ২, প্রতাপ ও আমি ১টি করে গোল করায় আমরা ৪-০ গোলে জয়লাভ করি। সেবারের লীগের প্রথম হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্বটা ছিল ফায়ার সার্ভিস টিমের হাকিমের, সে সুবাদে ফায়ার সার্ভিস ৬-০ গোলে সেন্ট্রাল জেল দলকে পরাজিত করেছিল। ৯-৫-৬৪ তারিখে ছিল ভিক্টোরিয়া টিমের প্রথম খেলা আজাদ স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে। প্রথম ম্যাচেই ভিক্টোরিয়া জানিয়ে দিয়েছিল যে, তারা কত দুর্ধর্ষ টিম। আজাদ স্পোর্টিংকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে তারা ৯-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। ওমর একাই দুটি হ্যাটট্রিকসহ ৬ গোল এবং আব্বাস, ফাতেহ মোহাম্মদ ও ইউসুফ সিনিয়র ১টি করে গোল করেছিল। পুলিশ দল তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে ৪-১ গোলে প্রেসকে পরাজিত করে। সামিউদ্দিনের হ্যাটট্রিকটি ছিল ওয়ারী কাবের পক্ষে, যার দ্বারা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে ৩-১ গোলে (আজিজ) পরাজিত করেছিল। পিডব্লিউডি টিমও মাকরানী খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়ে শক্তিশালী করেছিল। জব্বার, আবু জান তাদের মধ্যে কৃতী খেলোয়াড় ছিল, যার সুবাদে পরবর্তী খেলায় তারা রেল দলকে ৬-০ গোলে পরাজিত করেছিল। আবু জান ৪, রহিম ও জব্বার ১টি করে গোল করে। ১১-৫-৬৪ তারিখের মোহামেডানের খেলায় মুসা একাই ৫ গোল (হ্যাটট্রিকসহ) করে স্টেশনারি দলকে ৫-০ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পরদিনই আব্বাসের হ্যাটট্রিক এবং ইউসুফ সিনিয়র ও হাসানের ১টি করে গোল দ্বারা ভিক্টোরিয়া পুলিশকে ৫-০ গোলে পরাজিত করে। ৮-১২ মে মাত্র পাঁচদিনে ৬টি হ্যাটট্রিক হয়েছিল, যা এর পূর্বে কখনও এরকম হয়নি। পিডব্লিউডি টিম যে শক্তিশালী টিম হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ তারা পরবর্তী খেলাগুলোতে দিতে শুরু করেছিল ডিসি জেল টিমকে ১০-১ গোলে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। ভিক্টোরিয়া তাদের পরবর্তী (১৬-৫-৬৪) খেলায় তান্ডব চালিয়েছিল রেল টিমের ওপর। ফতেহ মোহাম্মদের হ্যাটট্রিক (৩ গোল) ইউসুফ সিনিয়র ৩, আব্বাস ৩, কামাল ২ গোলের সুবাদে রেল দলকে উড়িয়ে দিয়েছিল।
আজাদ স্পোর্টিং ২-১ গোলে ওয়ারীকে, ফায়ার সার্ভিস প্রেসকে ৩-১ গোলে, পিডব্লিউডি ১-০ গোলে স্টেশনারি টিমকে, মুসার ৩ গোল, আঙ্গুর ও প্রতাপ ১টি করে গোল করলে মোহামেডান পুলিশ দলকে ৫-০ গোলে পরাজিত করার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছিল ফুটবল লীগ।
লীগের প্রথম অঘটন ঘটেছিল ২০-৫-৬৪ তারিখে যখন দুর্ধর্ষ ভিক্টোরিয়া কাব দুর্বল প্রেস টিমের সাথে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। জালাল গোল করে তার প্রেস দলকে কিছুক্ষণের জন্য জয়ের আসা দেখালেও দেশের প্রখ্যাত সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর গোল শোধ করে ভিক্টোরিয়ার মান বাঁচিয়েছিল। লীগের সবচেয়ে নিচের সারির দল ডিসি জেল ৩-১ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে পরাজিত করে চমক দিয়েছিল। লীগের পরবর্তী খেলাগুলোর মধ্যে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে ওয়ারীকে, ওয়ান্ডারার্স ৬-০ গোলে জেল টিমকে, মোহামেডান ৬-১ গোলে আজাদকে পরাজিত করলেও প্রেস দলের ২-০ গোলে ওয়ান্ডারার্সকে হারানোটাই ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। আজাদ ও রেল ১-১ গোলে করে ১-১ পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া গফুর, ওমর, আব্বাস ও ইউসুফ সিনিয়রের দেয়া ৪-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে পরাজিত করে তাদের জয়ের চাকা সচল রেখেছিল। পুলিশ ২-০ গোলে ওয়ারীকে, মোহামেডান ২-১ গোলে পিডব্লিউডিকে, স্টেশনারি ২-১ আজাদকে, রেল দল ওয়ান্ডারার্স কাবের সাথে ০-০ ড্র, ফায়ার সার্ভিস ১-০ গোলে পুলিশকে, পিডব্লিউডি টিম ৪-০ গোলে প্রেসকে, রেল দল ৩-০ গোলে পুলিশকে, ওয়ান্ডারার্স এবং আজাদ গোলশূন্য ড্র, ওয়ারী ২-১ গোলে প্রেসকে পরাজিত করে। ফায়ার সার্ভিস ২-১ গোলে পিডব্লিউডি টিমকে, স্টেশনারি ৪-১ গোলে ডিসি জেলকে পরাজিত করে লীগের প্রথম পর্বের শেষের দিকে এগিয়ে যায়।
ঢাকার দুটি ঐতিহ্যবাহী টিম ঢাকা মোহামেডান এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স টিমের মধ্যে খেলা হয়েছিল ৭ জুন ’৬৪ ঢাকা স্টেডিয়ামে। দুটি টিম যখনই মুখোমুখি হয়েছে, তখনই মাঠে এবং বাইরে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এই মর্যাদার ফুটবল ম্যাচে আমরা অর্থাৎ মোহামেডান কাব মুসার দেয়া একমাত্র গোলে ওয়ান্ডারার্স কাবকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। জামিল আক্তারের হ্যাটট্রিক (৩ গোল), জাম্বু ও শামসুদ্দিনের ১টি করে গোলের সুবাদে ওয়ারী ৫-১ গোলে রেল দলকে পরাজিত করেছিল। ভিক্টোরিয়া ১১-১ গোলের বড় ব্যবধানে ডিসি জেল দলকে পরাজিত করে তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঢাকা মোহামেডানও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে প্রেসকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে ছুটে চলেছিল। রেল ২-১ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া তাদের আর এক প্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে হারিয়েছিল ওমর এবং ইউসুফ জুনিয়রের দেয়া ৪ গোলে। আজাদ ১-০ গোলে পুলিশকে, স্টেশনারি ৩-০ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল এবং সমমানের দুটি টিম ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ফায়ার সার্ভিসের খেলা ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। মোহামেডান তাদের পরবর্তী খেলায় (১৩-৬-৬৪) আবিদ-মুসা দু’ভাইয়ের দেয়া ৫ গোল এবং আনসারের করা ২ গোলের সুবাদে ওয়ারী কাবকে ৭-০ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নশিপের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। পরদিনই অর্থাৎ ১৪-৬-৬৪ তারিখে শক্তিশালী ভিক্টোরিয়ার খেলা পিডব্লিউডি টিমের সাথে ২-২ গোলে ড্র হলে তাদের চলার গতিটা কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে যায়। লীগের অন্যান্য খেলায় ওয়ারী ১-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে, পুলিশ ৬-০ গোলে জেল টিমের বিরুদ্ধে বড় জয় পেয়েছিলÑ যার মধ্যে সাত্তারের ৩ গোল, আক্তার ২, ধীরেন করেছিল ১ গোল। সাত্তার ছোটখাটো গড়নের খেলোয়াড়, সারাক্ষণ ছুটোছুটি করে খেলতো; মাঠে তার পায়ের চেয়ে মুখ চলতো বেশি। বিপক্ষ খেলোয়াড়দের সাথে তার লেগেই থাকতো, কখনও ফাউল করে কখনও গালাগালি করে। নিজের খেলোয়াড়কেও বকাবকি করতে ছাড়তো না। তবে তার আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না, খুবই পরিশ্রমী একজন খেলোয়াড় ছিল সে। আক্তার পুলিশ দলের দ্রুতগতির উইঙ্গার, হকি খেলারও সে ছিল দ্রুতগতির লেফট আউটের কৃতী খেলোয়াড়। পিডব্লিউডি টিম আজাদ স্পোর্টিংকে ১-০ গোলে এবং প্রেস টিম জেল দলকে ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে জয়ী হয়েছিল। পুলিশের সেই ছোটখাটো সাত্তারের দেয়া দু’গোলের সুবাদে শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে ২-১ পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল পুলিশ ফুটবল দল। পিডব্লিউডি ২-০ গোলে ওয়ারীকে হারিয়েছিল। ১৮-৬-৬৪ ফুটবল লীগের প্রথম পর্বের শেষ খেলা ছিল লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ প্রত্যাশী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী টিম মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া কাবের মধ্যে ১৮ জুন ১৯৬৪ তারিখে। খেলার মান-মর্যাদার লড়াই দেখতে স্টেডিয়ামে উপচেপড়া দর্শক দুপুর থেকে ভিড় করেছিল। দু’টিমের খেলা মানেই আলাদা চাপ। খেলার ভেতর আর গ্যালারির দর্শকদের প্রত্যাশার চাপ সব মিলিয়ে দু’দলই বেশ সতর্ক হয়ে খেলা শুরু করেছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ধীরে ধীরে খেলা জমে উঠেছিল। আমাদের পক্ষে দু’ভাই আবিদ মুসা দু’গোল করলে ভিক্টোরিয়ার ছোট-বড় দুই ইউসুফও দু’গোল করেছিল এবং দু’দলই আত্মঘাতী গোল খেলে ৩-৩ গোলে খেলাটি ড্র হয়েছিল।
দু’দলে যারা খেলেছিল : ঢাকা মোহামেডানÑ গোলরক্ষক আক্তার, ফুলব্যাক-জহির ও দেবীনাশ, হাফব্যাক-রসুল বক্স, পিন্টু, আবিদ, ফরোয়ার্ড- প্রতাপ, আবদুল্লাহ, রহমত উল্লাহ,বশীর ও মুসা।
ভিক্টোরিয়া স্পোর্র্টিং : গোলরক্ষক-গোলাম হোসেন, ফুলব্যাক- খোদা বকশ ও খামিসা, হাফ ব্যাক- হাসান মুরাদ, গফুর, ফরোয়ার্ড- ইউসুফ জুনিয়র, আকবর, ওমর আব্বাস ও ইউসুফ সিনিয়র। রেফারি ছিলেন মাসুদুর রহমান।
ফিরতি লীগের শুরুতেই আমরা হোঁচট খেয়েছিলাম ফায়ার সার্ভিস টিমের সাথে ২-৩ গোলে হেরে গিয়ে। জামান করেছিল ২ গোল আর ওবায়েদ করেছিল ১ গোল। জামানÑ দেশের প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক সেদিনের তুখোড় ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলোয়াড় আর কর্নেল (অব.) ওবায়েদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। মোহামেডানের পক্ষে মুসা ও রহমত উল্লাহ দুটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। পরবর্তী খেলায় আমরা আবার জয়ের ধারায় ফিরেছিলাম মুসার হ্যাটট্রিক, আবদুল্লাহর ১ গোলের সুবাদে ৪-০ গোলের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে ভিক্টোরিয়া তাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল পুলিশকে ৩-০, আজাদকে ৭-১, পিডব্লিউডিকে ৭-১ গোলে বড় ব্যবধানে হারালেও ১-৭-৬৪ তারিখে তারা ওয়ারী কাবকে ১৩-০ গোলে হারিয়ে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। ওমর একাই তিনটি হ্যাটট্রিকসহ ১০ গোল করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। বাকি গোলের ২টি করে আবদুল্লাহ ছোট ও মুরাদ করেছিল ১টি গোল। মোহামেডান স্পোর্টিং কাবও পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছিল ৫-০ গোলে স্টেশনারি টিমকে, প্রেসকে ৪-২ গোলে, পুলিশকে ৬-০, পিডব্লিউডিকে ৪-২ গোলে, আজাদ স্পোর্টিংকে ৪-০ গোলে, ওয়ারীকে ৫-১ গোলে হারিয়ে কিন্তু ফিরতি লীগে এসে ভিক্টোরিয়াকে কিছুতেই আটকানো সম্ভব হয়নি। ভিক্টোরিয়া যে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছিল, মোহামেডান সে গতিতে ১-৫ গোলের ব্যবধানে উড়ে গিয়ে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে ছিটকে বাইরে পড়ে গিয়েছিল। রিটার্ন লীগ পদ্ধতিতে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব ২০টি খেলায় প্রথম পর্বে মাত্র ৩টি টিমের সাথে বিজি প্রেস, পিডব্লিউডি এবং ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের সাথে ড্র করে ৩ পয়েন্ট হারিয়ে ৩৭ পয়েন্ট নিয়ে ১২ গোল হজম করে ১৯৬৪ সালের অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। ঢাকা মোহামেডান তিনটি হার ও একটি ড্র করে দ্বিতীয় স্থানে লীগ শেষ করেছিল। ভিক্টোরিয়া কাবের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর ৩৩টি গোল করে লীগের সর্বোচ্চ গোল করার সম্মান অর্জন করেছিল। # (ক্রমশ:)
(পঞ্চান্ন) ১ আগস্ট
সেলুনে বসে চুল কাটাচ্ছিলাম। সামনে রাখা ছিল মর্নিং নিউজ পেপার। ‘চধশরংঃধহ ঐড়পশবু ঞবধস অহহড়ঁহপবফ’. চোখে পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি পেপারটা হাতে তুলে নিয়ে দুরু দুরু বুকে লেখাটার ওপর চোখ বুলালাম। ‘বি’ অক্ষরটা চোখে পরলো না, মনে করলাম তাড়াতাড়ি চোখ বুলাতে গিয়ে চোখে পড়েনি। মনোযোগ দিয়ে পুরো লেখাটা পড়লাম। না, কোথাও ইধংযরৎ নামটা চোখে পড়ছে না! আবার পড়লাম, আমার নামটা পেপারে না দেখে মনটা হতাশায় ভরে উঠেছিল। দুঃখে-কষ্টে চুল কাটানোটা অসহ্য লাগছিল। বেচারাম দেউরির সেলুনের মালিক ও বারবার খানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে মন চাচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু বললামÑ তাড়াতাড়ি করো, ভাল লাগছে না। বাসায় ফিরে সোজা বাথরুমে, মাথার ওপর সাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে ভাবতে লাগলামÑ এটা কেমন হলো? চিফ কোচ দারা সাহেব ক্যাম্প শেষে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে ফুটবল খেলবে না, হকির চর্চায় থাকবে, ফাইনাল সিলেকশনটা পত্রিকার মাধ্যমে জানানো হবে। তারপরও কেন পত্রিকায় নাম নেই?
১৯৬৪ টোকিও অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পাকিস্তান হকি দলের ক্যাম্প লাহোর ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে করা হয়েছিল। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের কাঠফাটা গরমে অনুশীলন ক্যাম্প ছিল খুবই কষ্টের। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল স্টেডিয়ামের গ্যালারির নিচে তৈরি করা কক্ষগুলোতে। আমাদের ঢাকা স্টেডিয়ামের সে সময় এরকমই ব্যবস্থা ছিল। গ্যালারির নিচে তৈরি করা হয়েছিল প্লেয়ার্স লাউঞ্চ, সেখানেই আমাদের পূর্ব পাকিস্তান হকি, ফুটবল ক্যাম্প করা হতো। লাহোরের গরম বাতাস বড় বড় জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরে থাকা অসহ্য করে তুলতো। জানালা বন্ধ রাখাও সম্ভব হতো না; কারণ বাইরের তাপ ঘরের ভেতরটা বয়লারের মত হয়ে যেত। তাই কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক ঘরে একটি করে বড় বালতি, তার মধ্যে বরফেন পাটা (বড় বড় টুকরা) দিয়ে ঘরকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেছিল। গরম বাতাস ঠেকাতে বড় বড় জানালাকে বাঁশের তৈরি চিক (পাটি) দ্বারা বাইরে থেকে ঢেকে দেয়া হতো এবং চিকটাকে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে রাখা হতো। চারপাইয়ের ওপর পাতলা তোষক, বালিশ, চাদর ঘুমাবার জন্য ছিল; তবে রাতে ঘরের ভেতর ঘুমাতে পারা যেত না। কারণ সারাদিনের গরমের তাপ রাতে যেন বেড়ে যেত। দেয়াল থেকে গরমের তাপ যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতো। ঘুম হতো না, তাই গ্যালারির ওপরে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিকেলে আমরা অনুশীলনে গেলে বেয়ারা ঘরের চারপাইগুলোকে গ্যালারির ওপর নিয়ে লাইন করে সাজিয়ে রেখে যেত।
লাহোর স্টেডিয়াম শহর থেকে একটু দূরে বিরাট এলাকাজুড়ে। পাশেই নতুন শহর গড়ে উঠছিল, নাম দেয়া হয়েছিল গুলবার্গ। স্টেডিয়ামের ভেতরটা (মাঠ এলাকা) যেমন বড়, তেমনি পঞ্চাশ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা নিয়ে গ্যালারিটাও তদ্রূপ বড়। এই তো সেদিন ২৬-০৭-২০১০ তারিখে এএফসি থেকে ডেভেলপমেন্ট অফিসার ইমতিয়াজ রহমান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে এসেছিলেন আমাদের রেফারিজ কমিটির কার্যক্রম সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে। ইমতিয়াজ পাকিস্তানী। তার কাছেই শুনেছি যে, লাহোর ন্যাশনাল স্টেডিয়াম পূর্বের মতই আছে এবং হকির বড় খেলাগুলো সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। উন্নতির মধ্যে পাশে দুটো স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে, একটি সাইক্লিং ভ্যালোড্রাম, অন্যটি গাদ্দাফি স্টেডিয়াম, ক্রিকেটের জন্য। ভ্যালোড্রামটি সে সময় তৈরি হয়েছিল, তবে সম্পূর্ণ হয়নি। আমার দেখা প্রথম ভ্যালোড্রাম। সাইকেল রাস্তায় চলে, রোড রেস হয়, মাঠেও সাইকেল রেস হয় কিন্তু মাটির নিচে স্টেডিয়ামে, সুইমিংপুলের মতো গোলাকৃতিÑ যার পাড় কোথাও কিছুটা খাড়া, আবার কিছুদূর চেতানো। প্রথম দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম এই ভেবে যে, সাইকেল নিয়ে সাইক্লিস্টরা স্লিপ করে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় না কেন! ঢাকায় ফিরে এসে বন্ধুদের আড্ডায় ভ্যালোড্রাম নিয়ে গল্প করেছিলাম।
লাহোর স্টেডিয়ামের বিশেষত্ব হলো গ্যালারির নিচে যেখানে থাকার ব্যবস্থা, সেখান থেকে টানেলের (সুড়ঙ্গ পথ) ভেতর দিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে মাঠে যেতে হতো। প্রবেশ করতে মাঠের একপাশে চাকা লাগানো একটি বড় ঢাকনা দিয়ে সুড়ঙ্গ পথটি ঢেকে রাখা হয়। সকালে দু’ঘন্টা, বিকেলে আড়াই ঘন্টা অনুশীলনে যেতে হতো এই পথে। সকালের অনুশীলনে এই বিরাট স্টেডিয়ামের ৪ চক্কর থাকতো ওয়ার্মআপের জন্য। তারপর আর্মি থেকে আসা ট্রেনার করাতেন ব্যায়াম। শুয়ে ব্যায়ামের জন্য প্রত্যেকের জন্য একটি করে চিক বা পার্টি মাঠে বিছানো থাকতো, তার ওপর ব্যায়াম সারতে হতো। তারপর ব্যক্তিগত স্কিল, সেট প্র্যাকটিস, টিম প্র্যাকটিস চলতো পাক্কা দু’ঘন্টা। সকালের অনুশীলন শেষে আর্মি টিমের সেন্টার হাফ জাফর হায়াত বিরাট স্টেডিয়ামে নেমে পড়তো। ৩/৪/৫ চক্কর দৌড়াতো। তার সাথে আমিও দৌড়াতাম। মাঠ থেকে শেষে আমরা দুজন বের হতাম। ডাইনিং হলের পাশেই স্টেডিয়ামের দেয়াল ঘেঁষে রান্নার জন্য তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী রান্নাঘর। তন্দুর ছিল, বড় বড় চুলা ছিল। গরম গরম তন্দুরী রুটি আর মাংস খেতে খুব ভাল লাগতো। খাওয়া-দাওয়ার মান এবং পরিবেশ ছিল সম্মানজনক। বিকেল ৫টায় অনুশীলনের জন্য টানেল দিয়ে মাঠে গিয়ে উঠতেই প্রথম ধাক্কা খেতাম গরম বাতাসের। মনে হতো মুখটা বুঝি আগুনে ঝলসে গেল। ওয়ার্মআপ করেই গেমস খেলতে হতো, টিম আগে থেকে বানানো থাকতো। প্রতিদিনের প্রাকটিস ম্যাচ খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতো। প্রত্যেকেই খুব সিরিয়াস থাকতো মাঠে। প্রতিদিনের খেলা নিয়ে আলোচনা করতেন চিফ কোচ। বিকালের অনুশীলন শেষ করে ফ্রেশ হয়ে আমরা সেজেগুঁজে ডাইনিং হলে যেতাম, প্যান্টের সাথে ফুলহাতা শার্ট এবং পায়ে কালো জুতা পরতে হতো। ডিনার সেরে আমরা হাঁটতে বের হতাম। স্টেডিয়ামের ধরেকাছে দু’চারটি বাড়িঘর উঠলেও মাইলখানেক দূরে নতুন শহর গড়ে উঠেছিল; নাম দিয়েছিল গুলবার্গ। গুলবার্গের শপিং মার্কেটে কিছুক্ষণ বেরিয়ে ঠান্ডা পানি খেয়ে ফিরে আসতাম। সবচেয়ে ভালো লাগতো রাতের বেলায়। গ্যালারির ওপর খোলা আকাশের নিচে চারপাইয়ের ওপর শুয়ে আকাশের তারা গোনা আর নানারকম চিন্তা করা। প্রথমদিকে অস্বস্তি লাগতো, ঘুম হতো না; ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানের কৃতী ফুলব্যাক মুনীর দারের চারপাইয়ের আশপাশেই ছিল আমার চারপাই। মজার মজার গল্প শোনাতেন। উপদেশ দিতেন, অনেক রাত পর্যন্ত বকবক করে যেতেন, ক্লান্তিতে আমরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়তাম; কিন্তু তিনি তার কথা চালিয়েই যেতেন। আশ্চর্য হতাম, যখন দেখতাম সবার আগে তিনি মাঠে উপস্থিত। আমাদের প্রতিদিনের রুটিন প্রায় একইরকম ছিল।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মাসের গরম সহ্য করে প্রায় ৩৬ দিন ক্যাম্পের কঠিন অনুশীলন শেষ করেছিলাম এবং আশা করেছিলাম যে, পাকিস্তান হকি টিমের সদস্য হয়ে ১০ অক্টোবর থেকে আরম্ভ হওয়া টোকিও অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করার যে স্বপ্ন দেখতামÑ তা পূরণ হবে। কিন্তু মর্নিং নিউজ পত্রিকার ‘চধশরংঃধহ ঐড়পশবু ঞবধস অহহড়ঁহপবফ’ সংবাদটি আমার সে স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছিল।
ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ১৯৬৪ সালের ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার দুঃখ নিয়ে ঐতিহ্যবাহী আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল। স্থানীয় সাতটি দল- ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, পিডব্লিউডি, আজাদ স্পোর্টিং, ওয়ারী ক্লাব, ফায়ার সার্ভিস, সেন্ট্রাল স্টেশনারি এবং পাকিস্তান থেকে চারটি দল ইস্ট-ওয়েস্ট ক্লাব, কেপিটি (করাচি পোর্ট ট্রাস্ট), ওয়ারসেক এবং পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম-এর সাথে তিনটি বিদেশী টিম বার্মা, সিলোন এবং ইন্দোনেশিয়া মোট ১৫টি টিম নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে ১৬ অক্টোবর ১৯৬৪ থেকে গোল্ডকাপ শুরু হয়েছিল। প্রথমে এলিমিনেশন রাউন্ড, পরে রাউন্ড রবিন লীগ পদ্ধতিতে টুর্নামেন্টটিকে সাজানো হয়েছিল। এলিমিনেশন রাউন্ড শেষে আট টিমকে ২টি গ্রুপে ভাগ করে রাউন্ড রবিন লীগের মাধ্যমে খেলার ফিকশ্চার করা হয়েছিল।
গ্রুপ ‘এ’ : পাক ওয়েস্টান রেলওয়ে, বার্মা, ওয়ারসেক ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব।
গ্রুপ ‘বি’ : ইন্দোনেশিয়া, সিলোন (শ্রীলংকা), কেপিটি ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
২৫ অক্টোবর বার্মা এবং ওয়ারসেক খেলা দিয়ে শুরু হয়েছিল রাউন্ড রবিন লীগের খেলা। বার্মা ১-০ গোলে জয়লাভ করে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। ২৬ অক্টোবরের খেলা স্থগিত হয়েছিল। ২৭ তারিখে ভিক্টোরিয়া ৪-০ গোলে ওয়ারসেককে পরাজিত করেছিল। ২৯/১০/৬৪ তারিখে দুটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম খেলায় কেপিটি এবং সিলোন ২-২ গোলে ড্র করেছিল এবং দ্বিতীয় খেলাটি ঢাকা মোহামেডান এবং ইন্দোনেশিয়াও ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। ৩১ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়া ৪-২ গোলে সিলোনকে পরাজিত করে। ১ নভেম্বর দুটো শক্তিশালী টিম ভিক্টোরিয়া এবং ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করলেও কেউ জিততে পারেনি; ০-০ ড্র। ২/১১/৬৪ আমরা (মোহামেডান) কেপিটির কাছে ০-১ গোলে হেরেছিলাম। শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া টিমও বার্মার কাছে ১-২ গোলে হেরে যায় ৩-১১-৬৪। ৪ তারিখের খেলায় কেপিটি ইন্দোনেশিয়াকে ২-১ গোলে পরাজিত করে ৫ তারিখে রেলওয়ে ২-০ গোলে ওয়ারসেক টিমকে সহজে পরাজিত করেছিল। রাউন্ড রবিন লীগের শেষ খেলায় আমরা সিলোনকে ৩-০ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
‘এ’ গ্রুপ থেকে বার্মা ২টি জয় এবং ১টি ড্র করে ৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষ থেকে সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। গ্রুপের অন্য দল রেলওয়ে ১টি জয়, ২টি ড্র করায় ৪ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। গ্রুপের শক্তিশালী দল ভিক্টোরিয়া ৩টি খেলার মধ্যে ১টি জয় এবং ১টি ড্র ও ১টি পরাজয়ের সুবাদে মোট ৩ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের তৃতীয় স্থান নিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে যায়।
‘বি’ গ্রুপ থেকে কেপিটি ২টি জয় এবং ১টি ড্র করে ৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থেকে সেমিফাইনালে চলে যায়। দ্বিতীয় টিম হিসেবে দুটি টিমের ৩ পয়েন্ট করে থাকায় গোল পার্থক্যে ঢাকা মোহামেডান ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। দুটো টিমেরই ২টি জয়, ১টি ড্র ও ১টি হার। তবে মোহামেডানের পক্ষে ৪ গোল, বিপক্ষে ২ গোল অর্থাৎ +২ গোল আর ইন্দোনেশিয়ার পক্ষে ৬ গোল, বিপক্ষে ৫ গোল অর্থাৎ +১। ৭ নভেম্বরে প্রথম সেমিফাইনাল কেপিটি বনাম পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে। কেপিটি ২-০ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে ফাইনালে উঠে যায় আর দ্বিতীয় সেমিফাইনালে আমরাও বার্মাকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উঠেছিলাম।
ফাইনাল খেলা ১০ নভেম্বর ’৬৪ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে তিল ধারণেরও অবস্থা ছিল না। সকাল ১১টা থেকে মানুষ স্টেডিয়ামে প্রবেশ করছিল। বেলা ২টায় গ্যালারি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। স্টেডিয়াম এলাকায় লোকে লোকারণ্য, মানুষ মানুষ আর মানুষ!
এত দর্শক হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল মানুষ মনে করতো পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে খেলা। দু’দলের নির্ভুল খেলোয়াড় তালিকা দেয়া সম্ভব নয়। ভুলে গেছি; তবে আমাদের গোলরক্ষক বলাই দে সম্ভবত ভারতে চলে গিয়েছিল। তার জায়গায় গোলপোস্টে খেলেছিল আক্তার। ফুলব্যাক- জহির (ক্যাপ্টেন), দেবীনাশ, রসুল বক্স। হাফে- পিন্টু আবিদ হোসেন, ফরোয়ার্ড- প্রতাপ, আব্দুল্লা, বশীর ও মুসা এবং কেপিটি টিমের মধ্যে আব্দুর রহমান, তোরাব আলী, তাকি প্রমুখ। খেলা খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। দু’দলই গোল করার সুযোগ নষ্ট করে। শেষ পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য ড্র হলে কর্তৃপক্ষ কেপিটি ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে জয়েন্ট চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৬৪ সালের আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের গৌরব দিয়ে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবছরের লীগ শিরোপা না পাওয়ার দুঃখকে কিছুটা হলেও লাঘব করতে সক্ষম হয়েছিল। #
(ক্রমশ:)
(ছাপ্পান্ন) ১৬ আগস্ট
ঢাকা হকি লীগের চূড়ান্ত (নির্ধারণী ম্যাচ) খেলা। ওয়ারী ক্লাব বনাম ই.বি. রেলওয়ে। জয়ী দল ১৯৬৪ সালের হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। লীগ শিরোপা অর্জনের জন্য গত বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান হকি টিম, ইবি রেলওয়ে, ওয়ারী, পিডব্লিউডি, কম্বাইন্ড টিমের মধ্যে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। আমরা অর্থাৎ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান বেশ কয়েকটি ম্যাচে সহজ গোল পায়নি, ড্র করে পিছিয়ে পড়েছিলাম।
‘সলিমুল্লাহ অরফানেজ’ নামে নতুন একটি হকি টিম সেবার লীগ খেলায় অংশ নিয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামের এক নম্বর মাঠে ওয়ারী এবং রেল দলের খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রেল দল চট্টগ্রাম বেইসড। চট্টগ্রাম থেকে খেলতে আসে। তাদের প্রায় সব খেলোয়াড় অবাঙ্গালি; সুতরাং ঢাকার দলগুলোর সাথে একটা পার্থক্য সব সময় থাকে। যদিও ওয়ারীর কয়েকজন অবাঙ্গালি খেলোয়াড় ছিল, তবুও খেলাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং বাঙ্গালি-অবাঙ্গালির রূপ নিয়ে নেয়। রেল দলের ক্রীড়ানৈপুণ্যের জন্য ঢাকার উল্লেখযোগ্য দর্শক তাদের সাপোর্টার ছিল। খেলার মান অনুযায়ী ওয়ারী-রেলের খেলাটি সেরকম উন্নত ছিল না; তবে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। খেলার প্রথমার্ধে ওয়ারী প্রাধান্য বিস্তার করে খেললেও রেল দলের রক্ষণভাগের দৃঢ়তার জন্য তাদের গোল করার পর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের চিত্র ছিল একেবারেই উল্টো। রেল দল খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রথম থেকেই ওয়ারীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং তিন মিনিটের সময় রেল দলের রাইট-ইন আনোয়ার হোসেন একক প্রচেষ্টায় গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। গোল খাওয়ার পর ওয়ারী অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে কিন্তু তাদের রক্ষণভাগে মমতাজ এবং শেরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রেল দলের আক্রমণগুলো প্রতিহত করে দেয়। রেলের একটি নিশ্চিত গোল আম্পায়ার ফরিদি বাতিল করে দেন। পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদি, ছ’ফুটের ওপর লম্বা, ফর্সা, একজন মানানসই পুলিশ অফিসার কিন্তু আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট। বিতর্কিত আম্পায়ার হিসেবে ঢাকার হকি মাঠে তার বদনাম ছিল। শেষ পর্যন্ত রেল দল ১ গোলেই সন্তুষ্ট থেকে ১৯৬৫ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
রেল দল : নবী (গোলরক্ষক), ইদ্রিস, নিয়াজ, ইসলাম, কালিম, আবিদ, জুলফিকার, জাহির, রহিম, আনোয়ার ও আলী।
ওয়ারী ক্লাব : সেলিম (গোলরক্ষক), মমতাজ, শেরা, পটলা, মোমিন, শামিম, হানিফ, সিকেন্দার, আহমেদ, ইউসুফ ও নুরুল।
১৯৬৫ সালের হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ পাঞ্জাবের ছোট্ট শহর লায়ালপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা থেকে লাহোর বিমানে এবং সেখান থেকে ট্রেনে করে লায়ালপুর। সবুজে ঘেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম সুন্দর শহর লায়ালপুর। এ চ্যাম্পিয়নশিপ সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখতে পারছি না; কারণ বহু স্মৃতি মাঝে মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি। তবে আমরা যে প্রথম খেলায় হেরে গিয়ে পত্রপাঠ বিদায় নিয়েছিলামÑ এটা সঠিক। এ মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠছে লায়ালপুরের ছোট্ট স্টেডিয়াম, পরিষ্কার গ্যালারি আর সবুজ সমতল খেলার মাঠটি। আর মনে পড়ছে পুরনো আমলের বিরাট গেট, আমাদের ছোট কাটারার মত, ওরা বলে দরওয়াজা, সেটাকে ঘিরে ছোট্ট মার্কেট, মার্কেটের একটি দোকান যে দোকানটি ‘রাবড়ি’ দুধের খির-এর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আমরা যে ক’দিন লায়ালপুর ছিলাম, প্রতিদিন সন্ধ্যায় দল বেঁধে এসে রাবড়ি খেতাম। আজও ভুলতে পারি না চুলায় চড়ানো ইয়া বড় কড়াইতে গরম গরম রাবড়ি, উহ! কি যে মজাদার!
অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ১৯৬৫ সালের ফুটবল লীগও দুর্দান্তভাবে শুরু করেছিল (১৭-৫-৬৫) রহমতগঞ্জ এমএফএ ক্লাবকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করার মধ্য দিয়ে। জব্বর হ্যাটট্রিক ৪ গোল, ওমর ২ গোল এবং আব্বাস ১ গোল করেছিল। লীগ চ্যাম্পিয়ন প্রত্যাশী ঢাকা মোহামেডান ৫-০ গোলে পিডব্লিউডিকে পরাজিত করে শুভযাত্রা করেছিল। গোল করেছিল এএন খান, আবিদ, আবদুল্লাহ গফুর, মুসা। এএন খান কোলকাতা থেকে এসেছিল, কোলকাতা লীগে খেলে থাকে। ছিপছিপে গড়ন, লম্বা লম্বা পাস দিয়ে খেলে, গোল করায় দক্ষ। আজাদ এবং রেল গোলশূন্য ড্র করে লীগ খেলা শুরু করেছিল। ওয়ারী পুলিশকে ১-০ গোলে হারিয়ে লীগ আরম্ভ করেছিল। আজাদ ০-৪ গোলে ভিক্টোরিয়ার কাছে হেরে হতাশ হয়েছিল। রহমতগঞ্জ তাদের প্রথম হারের বদলা নিয়েছিল রেল দলের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলের জয় দিয়ে। ফুটবল লীগের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব বিজি প্রেসকে ২-০ গোলে পরাজিত করে এগিয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস টিম ৩-১ গোলে স্টেশনারি টিমকে পরাজিত করে শুভ সূচনা করেছিল। লীগের অন্যতম শক্তিশালী ফুটবল টিম পিডব্লিউডি ৪-১ গোলে ওয়ারীকে পরাজিত করে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। আবিদ হোসেনের হ্যাটট্রিকের সুবাদে মোহামেডান ৯-২ গোলে পুলিশকে পরাজিত করে তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল। অন্যদিকে শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া দলের আব্বাস ৩, আবদুল্লাহ ৩, ওমর ৪ এবং জব্বরের ১ গোলের মাধ্যমে দুর্বল স্টেশনারি দলকে ধরাশায়ী করে দেয়। সমমানের ফায়ার সার্ভিস এবং রহমতগঞ্জ গোলশূন্য ড্র করে আবার নিচের সারির দল পুলিশ এবং আজাদ স্পোর্টিংও গোলশূন্য ড্র করে। মোহামেডান স্পোর্টিং দুর্বল বিজি প্রেস দলকে মুসার একমাত্র গোলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। ওয়ারী ও রহমতগঞ্জ ২-২ গোলে ড্র, পিডাব্লিউডি ২-১ গোলে স্টেশনারিকে, ভিক্টোরিয়া ৩-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে, প্রেস ৩-০ গোলে ওয়ারীকে পরাজিত করলেও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স আজাদের সাথে ০-০ ড্র করেছিল। দুর্বল স্টেশনারি ৩-২ গোলে রহমতগঞ্জকে হারিয়েছিল এবং প্রেস ও পিডব্লিউডি ১-১ গোলে ড্র করলে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ অনেকটা ভিক্টোরিয়া এবং মোহামেডান ক্লাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্বাসের ৪ গোল, জব্বারের ২ গোল, ওমর ও ইউসুফের গোলের সুবাদে ৮-১ গোলের ব্যবধানে ভিক্টোরিয়া ওয়ারীকে পরাজিত করে তাদের জয়ের চাকা সচল রেখেছিল।
লীগের পরবর্তী খেলাগুলো পুলিশ ২-১ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারালেও ওয়ান্ডারার্স-রহমতগঞ্জ ১-১ ড্র, আজাদ-স্টেশনারি ১-১ ড্র; এমনকি লীগ শিরোপা প্রত্যাশী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ৪-৬-৬৫ তারিখে ফায়ার সার্ভিস টিমের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে ১টি মূল্যবান পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। লীগের প্রথম অঘটনটি ঘটেছিল ৫-৬-৬৫ তারিখে, যখন শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া টিম পিডব্লিউডি টিমের কাছে ২-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল। পিডব্লিউডি টিমের মঞ্জুর এবং আদম ১টি করে গোল করেছিল এবং কানু করেছিল পেনাল্টি থেকে একটি গোল। পক্ষান্তরে ওমর এবং আব্বাস দুটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। গত তিন বছরের অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভঙ্গ হয় এবং ভিক্টোরিয়া প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছিল সেদিন।
৭-৬-৬৫ তারিখে আজাদ স্পোর্টিং ২-০ গোলে পিডব্লিউডি টিমকে পরাজিত করেছিল। যার একটি গোল করেছিল জামান, বর্তমানের প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক। অপরটি করেছিল বাটু। ৮-৬-৬৫ তারিখে ঢাকা মোহামেডান ক্লাব তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মুখোমুখি হয়েছিল। মোহামেডান এবং ওয়ান্ডারার্স মানেই উত্তেজনা, সেদিনও সেটার কমতি ছিল না। এএন খান এবং শামসু (মোহামেডান) দু’গোল এবং আমিনের (ওয়ান্ডারার্স) ১ গোল দু’দলকে খেলার শেষ পর্যন্ত চরম উত্তেজনায় রেখেছিল। অবশেষে মোহামেডানের মুখেই হাসি ফুটেছিল। পরদিনই অর্থাৎ ৯-৬-৬৫ তারিখে লীগের অন্যতম দুর্বল টিম বিজি প্রেসের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে মূল্যবান আরও একটি পয়েন্ট নষ্ট করেছিল ভিক্টোরিয়া।
শামসুর ২ গোল আর প্রতাপের ১ গোলের সুবাদে মোহামেডান তাদের পরবর্তী খেলায় ৩-০ গোলে স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। বিজি প্রেস ও রহমতগঞ্জ ৩-৩ গোলে ড্র, আজাদ ও ফায়ার সার্ভিস ১-১ গোলে, ওয়ারী ও রেল ২-২ গোলে ড্র, এমনকি ভিক্টোরিয়াও ২-২ গোলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সাথে ড্র করে চ্যাম্পিয়নশিপ দৌড়ে মোহামেডান থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। মোহামেডান তাদের পরবর্তী খেলায় শামসুর ৩ গোল, এএন খান, আবদুল্লাহ মুসা ও আমার দেয়া গোলে ৭-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবকে পরাজিত করে জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল। লীগের অন্যান্য খেলায় পিডব্লিউডি ১-০ গোলে রহমতগঞ্জকে, ভিক্টোরিয়া ৩-০ গোলে পুলিশকে, ওয়ারী ১-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে, পিডব্লিউডি ৫-০ গোলে রেলকে পরাজিত করেছিল। প্রতাপের দেয়া ৩ গোল, শামসুর ২ গোল, মুসা এবং আবদুল্লার গোলে মোহামেডান ৭-০ গোলের বড় জয় পেয়েছিল রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে। লীগের প্রথম পর্বের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ২০-৬-৬৫ তারিখে ঢাকা মোহামেডান বনাম ভিক্টোরিয়া ক্লাবের ম্যাচকে ঘিরে। খেলাটিকে চ্যারেটি ম্যাচ ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশের সেরা দুটো টিম। মাকরানী-নির্ভর ভিক্টোরিয়া দুর্ধর্ষ একটি টিম আর মোহামেডান স্থানীয় সাপোর্টার-নির্ভর শক্তিশালী টিম। দু’দলের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রশংসা করার মত। তাছাড়া তাদের দলগত সমঝোতা খুবই নিখুঁত। সুতরাং সেদিনের খেলাটি অত্যন্ত উঁচুমানের, আকর্ষণীয় এবং আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটি হয়ে উঠেছিল প্রতিদ্বন্দ্বিমূলক এবং উত্তেজনায় ভরপুর। মোহামেডানের এএন খান ও শামসু এবং ভিক্টোরিয়ার আব্দুল্লাহ আকবরের গোলে চ্যারিটি ম্যাচের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল। মোহামেডান ২-১ গোলে জয়ী হয়েছিল। প্রথম পর্বের পয়েন্টে ভিক্টোরিয়া মোহামেডান থেকে পিছিয়ে পড়ে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রথম পর্বের খেলায় ভিক্টোরিয়া ৯-০ গোলে রেল দলকে পরাস্ত করেছিল (ওমর ৪, আব্বাস ২, মুরাদ ১, জব্বর ১, ইউসুফ গোল করেছিল)। তাদের পরবর্তী খেলায় জব্বরের ডবল হ্যাটট্রিকের সুবাদে এবং আব্বাস ২, ইউসুফ গোল করায় রহমতগঞ্জকে ৯-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল। ফিরতি খেলায় রেল দলকে ইউসুফ ও আব্বাসের জোড়া হ্যাট্রিক এবং জব্বারের দেয়া গোলে ১০-০ গোলের বিরাট জয় পেয়েছিল। স্টেশনারি টিমকে তারা ৬-১ গোলে হারিয়ে তাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু ১৬-৭-৬৫ তারিখে তারা ফায়ার সার্ভিসের দ্বারা আবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ১-১ গোলে ড্র করে পয়েন্ট হারিয়ে। অন্যদিকে মোহামেডান ধীরগতিতে রেল দলকে ৫-০ গোলে হারিয়ে, ৫-০ গোলে ওয়ারীকে, প্রেসকে ২-১ গোলে, আজাদকে ২-০ গোলে, স্টেশনারিকে ৪-০ গোলে, ফায়ার সার্ভিসকে ২-০ গোলে এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে পুনরায় ১-০ গোলে পরাজিত করে জয়ের চাকাকে সচল রেখেছিল। ভিক্টোরিয়া পুলিশকে ৩-০ গোলে হারিয়ে আবার জয়ের ধারায় ফিরে যায় এবং তারা ৫-০ গোলে ওয়ারীকে, ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ৩-১ গোলে হারিয়ে লীগের দ্বিতীয় পর্বে পুনরায় মোহামেডানের মুখোমুখি হয়েছিল ৮-৮-৬৫ তারিখে। সেদিন ভিক্টোরিয়া অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মোহামেডানের মোকাবিলা করেছিল। আব্বাসের দেয়া একমাত্র গোলে তারা মোহামেডানকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে লীগে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করে মোহামেডান। আমাদের পরবর্তী খেলা ওয়ারীর সাথে। আবিদ মুসা ২ এবং আমার দেয়া গোলে আমরা ৪-০ গোলে জয়লাভ করি। ১১-৮-৬৫ থেকে ১৪-৮-৬৫ পর্যন্ত স্বাধীনতা দিবস ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া অংশগ্রহণ করেছিল এবং ফাইনালে এ দু’টিমেরই দেখা হয়েছিল। ওমরের দেয়া দু’গোলের সুবাদে তারা আমাদেরকে হারিয়ে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ১৫ আগস্ট ৬৫ পুনরায় লীগ খেলা শুরু হয়েছিল পিডব্লিউডি এবং পুলিশের মধ্যে (০-০) গোলশূন্য ড্র’র মধ্য দিয়ে। হাশেম ও আবদুল্লাহ আকবরের দেয়া দু’গোলে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে আজাদকে পরাজিত করে। আমরাও দ্বিতীয় পর্বে পিডব্লিউডিকে মুসার দেয়া একমাত্র গোলে হারিয়েছিলাম। লীগের শেষ খেলায় আমরা ১-০ গোলে পুলিশকে হারিয়েছিলাম কিন্তু ভিক্টোরিয়া তাদের শেষ খেলায় পিডব্লিউডি টিমের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে।
লীগ শেষে মোহামেডান ১টি হার, ১টি ড্র, গোল দিয়েছে ৭২, গোল হজম করেছে ৮, মোট ৪১ পয়েন্ট নিয়ে লীগ টেবিলে শীর্ষে অবস্থান এবং ভিক্টোরিয়া ২টি হার, ৩টি ড্র গোল দিয়েছে ৯৪টি, হজম করেছে ১৬টি, মোট পয়েন্ট ৩৭ নিয়ে লীগ টেবিলে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করে।
১৯৬৫ সালের ঢাকা ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। (ক্রমশ:)
(সাতান্ন) ১ সেপ্টেম্বর
চালিয়ে, তাকিয়ে দেখি মোটা কবির ভাই। তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে তিনি আবার বললেন, হামারা সাং স্টেডিয়াম সায়েংগা। আমি ঢাকার ছেলে বলে তিনি মজা করে আমার সাথে এরকম করেই কথা বলতেন। মোটা কবির ভাই মোহামেডান ক্লাবের কর্মকর্তা, অনেকটা ম্যানেজারের মত, খেলোয়াড়দের আবদার পূরণ করার চেষ্টা করতেন। শুনেছিলাম তিনিও ফুটবল খেলতেন, তবে আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি কোন কালে ফুটবল খেলেছেন। মোটাসোটা মানুষ, সবসময় সাদা পায়জামা, সাদা পাঞ্জাবি পরতেন; কিন্তু তার পেটটা দেখে মনে হতো পাঞ্জাবি ফেঁড়ে বের হয়ে যাবেÑ বেসাইজের পেট, শরীর থেকে একটু দূরে মনে হতো। সে সময় আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে ফুটবল নিয়ে একা একা নকিং করছিলাম, আরো খেলোয়াড় মাঠে আসলে খেলবো বলে। যদিও সে সময়টা ছিল শীত মওসুম। খেলাধুলার মধ্যে হকি এবং ক্রিকেট লীগ পুরোদমে চলছিল। আমি নিজেও ন্যাশনাল ব্যাংকের পক্ষে হকি লীগ নিয়মিত খেলছিলাম। স্টেডিয়ামে প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্সের জন্য খেলা এক সপ্তাহের বিরতি, তাই সেই ছুটিটাকে কাজে লাগাতে ইউনিভার্সিটি মাঠে গিয়েছিলাম। কবির ভাইকে বলেছিলাম আমি ফুটবল প্র্যাকটিস করবো, কোথাও যাবো না। কবির ভাই বললেন, স্টেডিয়ামে গজনবী ভাইসহ আরো অনেকে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি আমার সাথে যাবেন, একটা দৌড় দিয়ে আবার চলে আসবেন। তার কাছ থেকে বাঁচার জন্য বললাম, দৌড়াবার জন্য রানিং সু প্রয়োজন। সেটা তো বাসায়। তিনি নাছোড়বান্দা। বললেন, সব পাবেন, তাড়াতাড়ি চলেন। গজনবী ভাই বলেছেন, আমাকে যেতে হবে, তাকে আমি অনেক সম্মান করি। অগত্যা মোটা কবির ভাইয়ের সাথে সেদিন বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলাম। সে বিকেলটা ছিল প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্সের শেষ বিকেল। ২৫-২৭ ফেব্রুয়ারি ৬৬ এই তিনদিন ছিল অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগিতা। মোহামেডান শিবিরের প্রায় মুখই চেনা। আবুল, হাফিজ, আরজান খান, বজলু, জাহাঙ্গীর, ফয়েজ, আলতাফ আরও অনেকে। মাত্র বছর দুই হবে অ্যাথলেটিক্স থেকে একটু দূরে আছি। আমার পায়ের ৫ নম্বরের একজোড়া রানিং সু জোগাড় করে আনা হলো, বুকে মোহামেডান লেখা একটা গেঞ্জি দেয়া হলো। ব্যাস, আমি তৈরি। মোহামেডানের ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে গেলাম মোহামেডানের অ্যাথলেট। ৪ী১০০ মিটার রিলে রেসের একজন সদস্য। সেসময় প্রভিন্সিয়াল স্পোর্টসকে অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন, সার্ভিসেস, পুলিশ, রেল, ইউনিভার্সিটির সাথে ঢাকার ক্লাবগুলোকেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়া হতো। সে সুবাদে ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্র্স, ইপিআইডিসি, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবগুলো সেবার অংশগ্রহণ করেছিল।
মোহামেডান ক্লাবের রিলে টিমের সদস্যরা দেশসেরা ক্রীড়াবিদ। সেদিনের প্রথম পর্বে অর্থাৎ সকালের প্রগ্রামে ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে সিরাজ শুধু প্রথম স্থান অধিকারই করেনি, সে ইস্ট পাকিস্তান নতুন ১০.৮ সেকেন্ড টাইমিং করে রেকর্ড করেছিল। সেদিনের আরও একটি রেকর্ড হয়েছিল, সেটা মহিলাদের শটপুটেÑ যা ডলি ক্রুজ করেছিলেন ২৭ ফুট দেড় ইঞ্চি দূরত্বে নিক্ষেপ করে। হাফিজুদ্দিন আহমেদ ২০০ মি., আরজান খান ৪০০ মি.-এর কৃতী দৌড়বিদ। তাদের সাথে আমাকেও দৌড়াতে হবে। অল্প হলেও বুকটা ধুকধুক করছিল, ওয়ার্ম করে তৈরি হলাম। প্রথম দৌড়াবে হাফিজ, দ্বিতীয় আরজান খান, তৃতীয় আমি এবং ফিনিশিং দেবে সিরাজ। প্রতিযোগিতায় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি, খুলনা জেলা, পুলিশ আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা সবাই যে যার নির্ধারিত যায়গায় প্রস্তুত। স্টার্টিং পয়েন্টে পিস্তলের গুলির শব্দ, দৌড় শুরু, সমর্থকদের চিৎকার। উল্কার মত হাফিজ ছুটছে, নিমিষেই হাফিজের জায়গায় আরজান খান দৌড়াচ্ছে, চোখের পলকে আরজান খান আমার কাছে চলে এসেছে। কখন যে ওর সাথে দৌড় শুরু করেছি, কখন যে ওর হাত থেকে বেটন নিয়েছি- বাম হাত থেকে বেটন কখন ডান হাতে নিয়ে দৌড় শুরু করেছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ করে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার পাশে যে দৌড়াচ্ছিল, সে আমাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। সে কি উত্তেজনাকর মুহূর্ত! গায়ে যত শক্তি ছিল সব শক্তি দিয়ে দৌড়াতে চেষ্টা করছিলাম, সে যেন কোন অবস্থাতেই আমাকে ছেড়ে চলে না যেতে পারে। এরই মধ্যে দেখছি সিরাজের হাত, সেও আমার সাথে দৌড়াচ্ছে, বেটনটা মনে হলো আপনাআপনি আমার হাত থেকে ওর হাতে চলে গেল আর ওটাকে নিয়ে সিরাজ উল্কার মত ছুটে গেল এবং চোখের পলকে ফিনিশিং টেপ ছুঁয়ে অনেক দূরে চলে গেল।
মোহামেডান সমর্থকদের চিৎকারে কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ৪ী১০০ রিলে রেসে মোহামেডান টিম প্রথম স্থান অধিকার করেছে। চ্যাম্পিয়নশিপের শেষদিনের শেষ ইভেন্টের নতুন রেকর্ড সৃষ্টিকারী (৪৪.২ সেকেন্ড পূর্বের রেকর্ড ৪৪.৬ সেকেন্ড) আমরা চার ক্রীড়াবিদ হাফিজুদ্দিন আহমেদ, আরজান খান, সিরাজুল ইসলাম এবং আমি। তিনদিনের প্রতিযোগিতা শেষে প্রাদেশিক এসেম্বলির স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী বিজয়ীদের মধ্যে সার্টিফিকেট এবং পুরস্কার বিতরণ করেন। পুচকি ছোট একটা কাপ আমিও পেয়েছিলাম আর সেটা ছিল আমার কাছে আনন্দের, গৌরবের এবং সম্মানের। লিখতে বসে সেদিনের পুরো ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, খুব ভাল লাগছে, গর্ব অনুভব হচ্ছে।
হকি-ক্রিকেটের ভরা মৌসুমে হঠাৎ করে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ান কনসুলেট একাদশ বনাম ইপিএসএফ একাদশের মধ্যে। অনির্ধারিত প্রীতি ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৬। শীতকালীন খেলা হকি-ক্রিকেট লীগ ঢাকা স্টেডিয়ামে পুরোদমে চলছিল। সব খেলা বাতিল করে ফুটবল খেলা, সময়টা ছিল ফুটবলের অফ সিজন। যতটুকু মনে পড়ে, সে সময় ইন্দোনেশিয়ার একটি যুুদ্ধজাহাজ ‘গুডউইল টুর’-এর অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ভিড়েছিল। তাদের ক্রুদের জন্য এই প্রীতি ফুটবলের আয়োজন। ঢাকার ফুটবল অনুরাগীরা ফুটবলের অফসিজনেও প্রমাণ করেছিল যে, এদেশে ফুটবল কত জনপ্রিয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক সেদিন মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। মাঠে প্রবেশ ফি ছিল না। খেলা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার কনসুলার জেনারেল মি. এসএম নূর এবং ইপিএসএফ সভাপতি গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর সাথে।
খেলা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে মুসার গোল সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলে এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে মুসার হ্যাটট্রিক মাঠে উপস্থিত দর্শকদের কাছে ছিল একটি আশ্চর্য ঘটনা। এত দ্রুত গোলগুলো হজম করে ইন্দোনেশিয়ার পুরো টিম ছন্দছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তারা মাঠে শুধু আমাদের আটকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, খেলায় কোনপ্রকার দক্ষতা লক্ষ্য করা যায়নি। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য খুবই কম থাকায় দলগত সমঝোতা সেরকম গড়ে ওঠেনি। হাফ টাইমের কিছু আগে রহমতউল্লা গোল করলে আমরা ৪-০ গোলে এগিয়ে যাই।
বিরতির পর ইন্দোনেশিয়া কিছুটা গুছিয়ে খেলার চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ার্ধে পনের মিনিটের সময় আমি একটি বল পেয়ে ইন্দোনেশিয়ার দু’তিনজন ডিফেন্সকে কাটিয়ে একক প্রচেষ্টায় একটি গোল করি। আমরা ৫-০ গোলে জয়লাভ করছিলাম। প্রায় ২০ মিনিটের পর ইন্দোনেশিয়ার রাইট আউট ওমর বল নিয়ে দ্রুতগতিতে আমাদের ডিফেন্সের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং সজোরে গোলপোস্টে কিক করলে বল গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে জালে জড়িয়ে যায়। সে সময় তাদেরকে গোছানো ফুটবল খেলতে দেখা যায়। ৫-১ গোলে যখন খেলা চলছিল, তখন ইন্দোনেশিয়া একটি পেনাল্টি পেয়ে যায় এবং সেটা থেকে তাদের লেফট ইন ইয়ানটো একটি গোল করলে খেলার ফল ৫-২ দাঁড়ায়। আমাদের রাইট সাইড থেকে একটি সম্মিলিত আক্রমণে আরও একটি গোল হলে শেষ পর্যন্ত ৬-২ গোলে আমরা জয়লাভ করি। খেলার ফলাফল যাই হোক, সেদিন মাঠে একটা প্রীতির বা বন্ধুত্বের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যেটা আমরা সেদিন খেলার চেয়ে বেশি উপভোগ করেছিলাম। (ক্রমশ:)
(আটান্ন) ১৬ সেপ্টেম্বর
“ইধংযরৎ ঝপড়ৎবং ১৩ এড়ধষং” ২৪ ডিসেম্বর ’৬৫ তারিখে দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার উল্লিখিত শিরোনাম দিয়ে আমার এবারের লেখা শুরু করতে যাচ্ছিÑ যা ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং টিটি সেন্টারের মধ্যে অনুষ্ঠিত হকি খেলায় ঢাকা হকি লীগে আমার ব্যক্তিগত (একটি খেলা) গোলের রেকর্ড। আমার হকি জীবনের এটি একটি স্মরণীয় ম্যাচÑ যা লিখতে বসে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেদিনের খেলা সম্বন্ধে দৈনিক মর্নিং নিউজ এবং দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা যা প্রকাশ করেছিলÑ তা তুলে ধরছি : ঘইচ পধৎৎরবফ ঃযব ফধু রিঃয ১৮-০ ারপঃড়ৎু’ অভঃবৎ ংপড়ৎরহম ৩ ংঃধু মড়ধষং, রহংরফব ষবভঃ ইধংযরৎ নবমধহ যরং ংঃরপশ ড়িৎশ যিবহ ঃযব ংপড়ৎব ধিং ৮-০, ঐব ফরফ হড়ঃ মরাব ধ পযধহপব ঃড় ধহু ড়ঃযবৎ ড়হ ঃযব ভরবষফ ভড়ৎ ঃযব ভরহধষ ংযড়ড়ঃরহম ধঃ ঃযব হবঃ. ঐব ংঃড়ঢ়ঢ়বফ ধঃ ষধংঃ যিবহ ঃযব ংপড়ৎব ধিং ১৭-০, ঈড়সঢ়ষবঃরহম ঃযৎবব যধঃঃৎপরপশং রহ ধ ৎড়.ি’
ইধংযরৎ ধিং ঃযব ভরৎংঃ সধহ ঃড় যধাব ঃযব যড়হড়ঁৎ ড়ভ ঃৎরঢ়ষব যধঃ ঃৎরপশং ংড় ভধৎ রহ ঃযব যড়পশবু ষবধমঁব.
অবশিষ্ট ৫টি গোল আমাদের ফরোয়ার্ড মীর ৩ গোল এবং ফুলব্যাক সাবের আলী ২ গোল করেছিল।
আমাদের মৌসুমী খেলা এবং খেলার মাঠÑ এ দুটোর সমন্বয় করে বাৎসরিক ক্রীড়াপঞ্জি তৈরি করা হতো বলেই ১৯৬৬ সালের ঢাকা হকি লীগ শুরু হয়েছিল পূর্ববর্তী বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে। লীগের উদ্বোধনী খেলায় ওয়ারী ক্লাব ১২-০ গোলের বন্যা বইয়ে ফায়ার সার্ভিস দলের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। ওয়ারীর লেফট-ইন শেরা এবং রাইট আউট মহসিন প্রত্যেকে একটি করে হ্যাটট্রিক করেছিল। অপর গোলগুলো ইব্রাহিম সাবের, শফিক কামাল ও অন্যরা করেছিল।
১০ ডিসেম্বর তারিখের খেলার বিবরণ পরদিন দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় ছেপেছিল : অুধফ ঃৎড়ঁহপবফ নু ঘধঃরড়হধষ ইধহশ ড়ভ চধশরংঃধহ. ‘উড়ঁনষব যধঃঃৎরপশ নু ইধংযরৎ’. ওহংরফব ষবভঃ ইধংযরৎ ংঃড়ষব ঃযব ষরসবষরমযঃ ড়ভ ঃযব সধঃপয ংপড়ৎরহম ফড়ঁনষব যধঃঃৎরপশ (ধং সধহু ধং ৮ মড়ধষং) যিরপয ধিং যধষভ ড়ভ ঃযব ঃড়ঃধষ ংপড়ৎব.
খেলা শুরু হওয়ার ৬ মিনিটে আমি প্রথম গোল করি এবং ৫ মিনিটের মধ্যে আমার প্রথম হ্যাটট্রিক সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক করেছিলাম। মীর এবং মিলু ২টি করে গোল করেছিল এবং মাহমুদ, আনোয়ার, আবদুল হক, মনি মিলে ৮ গোল করলে আমরা ১৬-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবকে পরাজিত করেছিলাম।
১৫ ডিসেম্বর আরো একটি গোলের ছড়াছড়ি হকি মাঠে ঘটেছিল আর সেটাও ছিল আজাদ স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে ইস্পাহানীর ১৪ গোল। নুরুল ৫, হায়দার ৩, জাফর, সাগির ও অন্যারা মিলে গোল করেছিল।
২২ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংক ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে ৯-০ গোলে পরাজিত করেছিল। মিলু ৩, সাবের ২, মীর, মনি, এহতেশাম সবাই মিলে গোলগুলো করেছিল।
২৩ ডিসেম্বর পুলিশ টিম শক্তিশালী কম্বাইন্ড স্পোর্টিংকে রুখে দিয়েছিল। খেলা ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। পুলিশের রাইট-ইন মবিন গোল করে টিমকে এগিয়ে দিয়েছিল কিন্তু কম্বাইন্ডের লেফট-ইন প্রতাপ গোল করে সমতা এনেছিল।
কম্বাইন্ড পুনরায় ২৮ ডিসেম্বর ভিক্টোরিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে ১ পয়েন্ট হারিয়েছিল। ৩০ তারিখের খেলাটিও মোহামেডান ও পাকিস্তান এয়ারফোর্স ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল। মোহামেডানের পক্ষে শাকুর ও ইফতেখার গোল করেছিল এবং এয়ারফোর্সের মধ্যে শাহী হামিদ ও জুবায়ের গোল করেছিল। আমাদের পরবর্তী খেলায় আমরা ভিক্টোরিয়াকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিলাম, যার একটি গোল ছিল আমার এবং অপরটি ছিল আমাদের লেফট আউট মনির। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং গত দু’ম্যাচে দুটি ড্র করার পর ২-১-৬৬ তারিখে তারা পিডব্লিউডিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। পিডব্লিউডি দলের সেলিম রেজা গোল করে দলকে এগিয়ে দিলে বিরতির পর কম্বাইন্ডের রাইট আউট রাজ্জাক (সোনা মিয়া) খেলায় সমতা আনে। খেলার বিশ মিনিটের সময় কম্বাইন্ড একটি পেনাল্টি স্ট্রোক পায়। আব্দুস সাদেক গোল করলে ২-১ গোলে কম্বাইন্ড এগিয়ে যায় এবং খেলার শেষদিকে রাজ্জাক আরও একটি গোল করে দলকে ৩-১ গোলে জয়ী করে। ৩ জানুয়ারিতে ওয়ারী ক্লাব টিটি সেন্টারকে ৬-০ গোলে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। কোরেশি শেবা ২, শফিক, হাশেম গোল করেছিল। এখানে উল্লেখ্য, সেদিনের খেলায় ওয়ারী দলের গোলরক্ষক ছিলেন মাসুদুর রহমান, যিনি একাধারে হকির আম্পায়ার ও দেশবরেণ্য ফিফা রেফারি।
স্টেডিয়ামের ২ নম্বর গ্রাউন্ডে ইস্পাহানী ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিকে সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দারের করা ২ গোলে জয়ী করেছিল। এখানে উল্লেখ্য, ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রতিদিন দুটি করে খেলা হতো। পশ্চিমদিকে গ্যালারি সংলগ্ন মাঠকে ১নং গ্রাউন্ড এবং পূর্বদিকের গ্যালারির সামনের মাঠকে ২নং গ্রাউন্ড বলা হতো। মাঝখানে ক্রিকেট পিচকে অক্ষত অবস্থায় রেখে স্টেডিয়ামকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছিল। একই সময় দুটি খেলা চলতো, খেলার একই রকম বাঁশিতে খেলায় যাতে অসুবিধা না হয়Ñ সেদিকে খেয়াল রেখে দু’রকম বাঁশির ব্যবস্থা করা হতো। পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে মোহামেডানকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা অক্ষুন্ন রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল এবং ১৩ জানুয়ারি রেলওয়ে ৩-০ গোলে ইস্পাহানীকে পরাজিত করে লীগ প্রতিযোগিতাকে এগিয়ে নিচ্ছিল। রেল দলের লেফ-ইন নিয়াজের প্রশংসা করে পত্রিকা লিখেছিল : ওহংরফব ষবভঃ ঘবধু রসঢ়ৎবংংব যরং ধৎঃরংঃরপ ংঃরপশ ড়িৎশ যিরপয বহধনষবফ যরস ঃড় ঃরিপব পধঃপয সড়যংরহ, ঃযব ওংঢ়ধযধহর মবধষশববঢ়বৎ ড়হ ঃযব ৎিড়হম ধহফ যবষঢ় ঃযব জধরষধিু ঃড় সধশব রঃ ২-০ নবভড়ৎব যধষভ ঃরসব.
রেল দলের অপর গোল করেছিল কায়ফুল।
২নং গ্রাউন্ডের খেলায় পিডব্লিউডি ফায়ার সার্ভিসকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল। এয়ারফোর্স প্রথম পয়েন্ট হারিয়েছিল ১৪ জানুয়ারি কম্বাইন্ডের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। সেদিনই ২নং গ্রাউন্ডে আমার দেয়া দুটি গোলের সুবাদে ন্যাশনাল ব্যাংক ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিক ২-১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যায়।
ইন্দোনেশিয়ান কনসুলেট একাদশ বনাম ইপিএসএফ একাদশের মধ্যে অনির্ধারিত একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচের জন্য এবং ঈদের জন্য বেশ কিছুদিন হকি লীগ বন্ধ থাকার পর প্রথম ফেব্রুয়ারি থেকে পুনরায় হকি লীগের খেলা শুরু হয়েছিল। আর সে খেলায় ওয়ারী ৮-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে হারিয়েছিল।
অপর খেলায় পিডব্লিউডি ৪-০ গোলে টিটি সেন্টারকে হারিয়েছিল। ন্যাশনাল ব্যাংকের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী কম্বাইন্ড স্পোর্টিং আর এ দু’টিমের খেলা অত্যন্ত গতিসম্পন্ন এবং উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। দু’টিমই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করে খেলছিল। খেলার ৫ মিনিটে কম্বাইন্ড একটি পেনাল্টি কর্নার পায়; তা থেকে প্রতাপের উড়ন্ত শটটি রঞ্জিত দক্ষতার সাথে রক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত খেলাটি গোলশূন্য শেষ হলে ব্যাংক হকি লীগের প্রথম পয়েন্ট হারায়। পরদিন অর্থাৎ ৪-২-৬৬ তারিখে ওয়ারী প্রথম হারের স্বাদ পেয়েছিল তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সাথে ১-২ গোলে পরাজয়ের ভেতর দিয়ে। ভিক্টোরিয়ার বুলান এবং মুশিফ গোল করলে ওয়ারীর ফুলব্যাক মমতাজ একটি গোল শোধ করতে পেরেছিল। ১০ ফেব্রুয়ারি ওয়ারী ইস্পাহানীর সাথে ১-১ গোলে ড্র করে আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। এর ফলে ওয়ারী চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। অপর খেলায় রেল দল চট্টগ্রাম থেকে সময়মত পৌঁছাতে পারেনি বলে পিডব্লিউডি ওয়াকওভার লাভ করে। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং তাদের পরবর্তী খেলায় পাকিস্তান স্পোর্টিংকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে, যার দুটি গোল করেছিল সাদেক, প্রতাপ ও রাজ্জাক একটি করে করেছিল। আলমগীর আদেল এবং শামসুল বারীর প্রত্যেকে ৩টি করে গোল করার সুবাদে মাহুৎটুলী ফায়ার সার্ভিসকে ৬-০ গোলে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। ২নং গ্রাউন্ডেও ছয় গোল করেছিল রেল দল আজাদ স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে। শক্তিশালী এয়ারফোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির কাছে ০-২ গোলে পরাজিত হয়েছিল। ওয়ারী আবারও একটি মূল্যবান পয়েন্ট পিডব্লিউডির সাথে গোলশূন্য ড্র করে হারিয়েছিল এবং ওয়ারী ক্লাব লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলÑ চার পয়েন্ট নষ্ট করে তা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। ১৯-২-৬৬ আমরা (এনবিপি) দুর্বল বাংলাদেশ স্পোর্টিং-এর সাথে হাফ টাইম পর্যন্ত কোন গোল না পেয়ে কিছুটা মানসিক দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। বিরতির তিন মিনিটের সময় আমি একটি বল নিয়ে বিপক্ষ ডিফেন্সে ঢুকে দু’তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে ডি-এর ভেতর প্রবেশ করলে মমতাজ গোলপোস্ট ছেড়ে ছুটে এগিয়ে আসে গোল বাঁচাবার উদ্দেশ্যে। আমি তার পাশ কাটিয়ে সুন্দরভাবে বল পুশ করে গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দিলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দ্বিতীয় গোল করেছিল মিলু এবং শেষ বাঁশি বাজার কিছু আগে আমি একক প্রচেষ্টায় আরও একটি গোল করলে আমরা ৩-০ গোলে জয়ী হয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
২০ ফেব্রুয়ারি হকি লীগে প্রথম অপ্রীতিকর ঘটনা। কম্বাইন্ড এবং মাহুৎটুলী ক্লাবের মধ্যকার খেলায় শুরু থেকে উভয় দলের খেলোয়াড়দের মাথা গরম এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করে খেলতে দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা ভীষণ রাফ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ার্ধে একসময় দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে গালাগাল, হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। মাঠের চারপাশ থেকে সবাই গিয়ে নিবৃত্ত করলে বড় অঘটন হতে বেঁচে যায়। খেলা প্রায় ৮ মিনিট বন্ধ ছিল। খেলা শুরু হলে ২০ মিনিটের সময় কম্বাইন্ডের রাইটইন বুলবান একক প্রচেষ্টায় ডি’র ভেতর ঢুকে আরফিনকে (গোলরক্ষক) পরাস্ত করে। খেলার ৭ মিনিট বাকি থাকতে কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফজলু আরও একটি গোল করলে কম্বাইন্ড ২-০ গোলে জয় নিয়ে মাঠ ত্যাগ করে। এখানে উল্লেখ্য, মাহুৎটুলী এবং কম্বাইন্ড একই এলাকার টিম। আরমানিটোলা স্কুল খেলার মাঠ এদের ভিত্তি। অপর খেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ১-০ গোলে পিডব্লিউডিকে পরাজিত করে। আমাদের পরবর্তী খেলায় মোহামেডানকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিলাম। ফরিদ, মিলু এবং আমি গোল করেছিলাম। মোহামেডানের পক্ষে নায়িম একটি শোধ দিয়েছিল। অপর খেলায় এয়ারফোর্স এবং ভিক্টোরিয়া পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয়। ১৬তম প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য স্টেডিয়ামের সব খেলা ২৮ তারিখ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহ বিরতির পর হকি লীগের খেলায় কম্বাইন্ড ৩-০ গোলে ভিক্টোরিয়াকে পরাজিত করে। ৩ মার্চ হকি মাঠে দ্বিতীয়বারের মত মারামারি হয়েছিল রেলের কাইফুল এবং পিডব্লিউডির আইয়ুব-এর মধ্যে। এর ফলে খেলা কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল। নিয়াজের চমৎকার স্টিকওয়ার্কে ঘায়েল হয়ে পিডব্লিউডি ১ গোল খায় এবং পরবর্তীতে রহিম সেটাকে বর্ধিত করে ২-০গোলে রেল দলকে জয়ী করে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদের একা ৪ গোল এবং মনির ১ গোলের সুবাদে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে ৫-০ গোলে হারাই। ৯ মার্চ ছিল আমাদের বড় একটা ম্যাচ, রেল দলের বিরুদ্ধে। চঊ জধরষ মড় ফড়হি নু ংড়ষরঃধৎু মড়ধষ ধহফ ঃযব মড়ধষ ঃযধঃ যবষঢ়বফ ঃযব ঘধঃরড়হধষ ইধহশ ঃড় পড়সব ঃযৎড়ঁময রিঃয ভঁষষ যড়হড়ঁৎং ধিং ংষধসসবফ রহ নু রহংরফব ষবভঃ ইধংযরৎ অযসবফ ধহফ ঃযব ড়হব ঃড় রহভষরপঃ ঃযব ফধসধমব ধহফ ংধঃঃবৎ ঃযব ংবিবঃ যড়ঢ়ং ড়ভ ঃযব জধরষধিু ঃবধস ধিং ঃযব ইধহশ রহংরফব ষবভঃ.
জবপবরাবফ ঃযব নধষষ ভৎড়স ঃযব সরফফষব ইধংযরৎ সড়াবফ ংঢ়ষবহফরফষু ঃযৎড়ঁময ঃযব ড়ঃযবৎ’ং ফবভবহপব ধহফ সবধঃষু ড়ঁঃ ৎিরঃঃবফ ধ ভৎধহঃরপ ঃৎুরহম ঘধনর ইধশংয ঁহফবৎ ঃযব জধরষধিু নধৎ ঃড় ংপড়ৎব ধ ৎবধষষু মড়ড়ফ মড়ধষ.
দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় খেলার বিবরণ তুলে ধরেছি। রেল দলের সাথে আমাদের খেলা ছিল উচ্চমানের, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের খেলায় বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। যা হোক, আমরা বড় একটা বাধা অতিক্রম করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম সেদিন বিকেলে। আশ্চর্যজনকভাবে পরদিনই আমরা মাহুৎটুলীর কাছে এক পয়েন্ট হারিয়ে লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলাম। পূর্বেই আমরা এক পয়েন্ট হারিয়েছিলাম কম্বাইন্ডের সাথে ড্র করে। ওয়ারী ক্লাব এবং লীগ চ্যাম্পিয়ন রেলওয়ে উভয়ই চার পয়েন্ট করে হারিয়ে আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল। আমাদের ড্রতে দু’টিমই খুশি হয়েছিল। ওয়ারী এবং ইস্পাহানীর বিরুদ্ধে আমাদের খেলা বাকি ছিল। দিনের অপর খেলায় রেল দল এয়ারফোর্সকে ৩-২ গোলে হারিয়ে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে আমাদের কাছাকাছি অবস্থানেই ছিল। আউটার স্টেডিয়াম নং-২তে অনুষ্ঠিত দিনের তৃতীয় ম্যাচে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ২-১ গোলে আজাদকে পরাজিত করেছিল। ১১ মার্চ স্টেডিয়ামের ১নং গ্রাউন্ডে ওয়ারী ১-০ গোলে এয়ারফোর্সকে, ২নং গ্রাউন্ডে মোহামেডান পিডব্লিউডিকে ১-০ গোলে এবং দিনের তৃতীয় খেলায় কম্বাইন্ড ৪-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে পরাজিত করেছিল। প্রতাপ কম্বাইন্ডের পক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিল এবং সিকেন্দার করেছিল ১ গোল।
১৩ মার্চ ন্যাশনাল ব্যাংক আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট হারিয়েছিল চ্যাম্পিয়নশিপ দাবিদার ওয়ারী ক্লাবের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র করে। দুটি গোলই হয়েছিল প্রথমার্ধে। এ নিয়ে আমরা তিনটি পয়েন্ট খুইয়েছিলাম আর এই পয়েন্ট হারানোতে সবচেয়ে খুশী হয়েছিল কম্বাইন্ড স্পোর্টিং; কারণ তারাও আমাদের মত মাত্র তিন পয়েন্ট হারিয়ে পয়েন্ট তালিকায় আমাদের সাথে চলে এসেছিল। রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিতব্য ১৬তম ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপে ইস্ট পাকিস্তান হকি টিমের অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা হকি লীগের খেলা স্থগিত করা হয়েছিল।
দৈনিক আজাদ পত্রিকা লিখেছিল, ‘মাসাধিককাল বিরতির পর পুনরায় হকি লীগের খেলা শুরু। উদ্বোধনী খেলায় ন্যাশনাল ব্যাংক দল অতিসহজেই পুলিশ দলকে ৫-০ গোলে পরাজিত করিয়া তাহাদের বিজয় অভিযান অব্যাহত রাখিয়াছে। ন্যাশনাল ব্যাংক দলের রাইট ইন বশীর দর্শনীয়ভাবে উপর্যুপরি ৩টি গোল করিয়া হ্যাটট্রিক অর্জনের গৌরব অর্জন করেন।’
মোহামেডান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি টিমের খেলায় ইশতিয়াকের হ্যাটট্রিকের সুবাদে মোহামেডান ৩-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। সেদিনের অপর খেলায় পাকিস্তান স্পোর্টিং ভিক্টোরিয়াকে ওয়াকওভার দিয়েছিল। ১৬ এপ্রিল হকি লীগের খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলা, ওয়ারী বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। সেদিনের খেলার ফলাফল লীগ শিরোপা নির্ধারণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। টেনশনে ভরা সেদিনের খেলায় জোরালো আক্রমণে কোন দলই গোল করতে পারেনি। ছন্নছাড়া গোছের খেলা। খেলায় ওয়ারী ক্লাব ২-১ গোলে জয়লাভ করে। খেলার ৮ মিনিটে ওয়ারীর মামলি গোল করে দলকে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধে তাদের সিকেন্দার আরও একটি গোল করলে কম্বাইন্ডের প্রতাপ একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। সেদিনের ফলাফলে ওয়ারী এবং কম্বাইন্ড উভয় দলই ৫ পয়েন্ট করে হারিয়ে লীগ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করে নিয়েছিল। মবিন এবং আকবরের দেয়া দু’গোলে পুলিশ মোহামেডানকে তাদের শেষ খেলায় হারিয়েছিল।
২৬ এপ্রিল ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিমের হকি লীগ শিরোপা পুনরুদ্ধার। ইস্পাহানীকে ২-০ গোলে পরাজিত করে আমরা ১৯৬৬ সালের অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দু’অর্ধে দুটো গোল হয়েছিল।
ঘইচ রহংরফব ষবভঃ ইধহংযরৎ ঈড়হভরফবহঃষু ঢ়ড়ঁহপবফ ড়হ ঃযব নধষষ নঁৎংঃ ঃযৎড়ঁময জরহম ড়ভ ওংঢ়ধযধহর ফবভবহপব ধহফ ংষধসসবফ ঃযব নড়ধৎফং যিরষব ধ ভষধনবরমধংঃবফ গধযংরহ ষড়ড়শবফ ড়হ.
আমাদের রাইট-ইন মিলুর পাস রাইট আউট আবদুল হক দ্রুতগতিতে আয়ত্তে নিয়ে ডি-এর ভেতর ঢুকে সজোরে হিট করলে তা থেকে দ্বিতীয় গোলটি হয়। ন্যাশনাল ব্যাংক ১৬ ম্যাচে ৩টি ড্র করে ৩ পয়েন্ট হারিয়ে এবং ২৯ পয়েন্ট নিয়ে অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিল। কম্বাইন্ড এবং ওয়ারী ক্লাব সমান পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলোয়াড় তালিকা : রঞ্জিত দাস, মীর সাবের আলী, ইকবাল, এহতেশাম সুলতান, আলম মাহমুদ, আনোয়ার, আব্দুল হক, মির্জা ফরিদ, মীর, ফরিদ, বশীর আহমেদ, শাহ আলী আসগর মনি। #
(ক্রমশ:)
(ঊনষাট) ১ অক্টোবর
ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ রাওয়ালপিন্ডি ’৬৬তে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ৫১ জন হকি খেলোয়াড়কে ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল। ৩ মার্চ থেকে দু’সপ্তাহের ক্যাম্পের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল শাহনুর এবং সামিউদ্দিন খানকে। সে সময়ের দেশের সেরা হকি খেলোয়াড়দের রেকর্ড সংরক্ষণের লক্ষ্যে তাদের নামের তালিকা নিম্নে দেয়া হলো।
ন্যাশনাল ব্যাংক : বশীর, মির্জা ফরিদ মিলু, মীর সাবের আলী, রঞ্জিত দাস, আনোয়ার হোসেন খান, মীর আনোয়ার করিম, এহতেশাম সুলতান এবং ফরিদ।
ওয়ারী ক্লাব : মমতাজ উদ্দিন, এএম শেরা, মাহমুদুর রহমান মমিন, ইব্রাহিম সাবের, কামাল পোটলা, নিয়াজ আহমেদ, নেওয়াজিশ এবং শফিক।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং : প্রতাপ শংকর, আবদুস সাদেক, মোহাম্মদ মহসিন, আব্দুর রাজ্জাক (সোনা মিয়া), সাব্বির ইউসুফ, সৈয়দ রফিক হোসেন বুলবান।
পিডব্লিউডি : আইয়ুব খান, রানা, মজিদ এবং রাইস।
মোহামেডান : আব্দুস সালাম, মো. সেলিম (জাম্বু), ফালু।
ভিক্টোরিয়া: বুলান, হাবিব উল্লাহ, ইরশাদ এবং মাহমুদ।
মাহুৎটুলী : হাসান, মুজিব, আরেফিন, নাসির উল্লাহ, হাফিজুল্লাহ এবং শামসুল বারি।
ইস্পাহানী : হায়দার এবং খাজা।
পুলিশ : মান্নান, মোহাম্মদ আলী এবং আকবর।
পাকিস্তান স্পোর্টিং : মোমতাজ।
ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব : লস্কর এবং সালাম।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি : আজাদ, সান্টা, জাফর এবং সাহিদ।
হকি ক্যাম্প এবং হকি লীগ একইসাথে চলছিল। ক্যাম্পে অনুশীলন সকালের অধিবেশনে সীমাবদ্ধ থাকতো। সে সময় হকি লীগ পুরোদমে চলছিল এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি স্থানে অবস্থান করছিল ন্যাশনাল ব্যাংক, কম্বাইন্ড, ওয়ারী এবং রেল দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল, যার জন্য লীগের খেলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল। লীগ বন্ধ করে ক্যাম্প পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১৪ এবং ১৫ তারিখে ট্রায়াল ম্যাচের পর ১৫ জনের একটি টিম নির্বাচন করা হয়েছিল। ওয়ারী ক্লাবের এএম শেরাকে ক্যাপ্টেন এবং কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের আবদুস সাদেককে তার সহকারী নির্বাচন করা হয়েছিল।
পুরো টিম : গোলকিপার- মো. সেলিম (জাম্বু) ও রঞ্জিত দাস।
ফুল ব্যাক : এএম শেরা, মোমতাজ উদ্দিন এবং মীর সাবের আলী।
হাফ ব্যাক : ইব্রাহিম সাবের, আব্দুস সাদেক, মাহমুদুর রহমান মোমিন ও কামাল পোটলা।
ফরোয়ার্ডস : মাহমুদ, হাসান মাহমুদ (মামলি), বুলবান, বশীর, প্রতাপ শংকর এবং খাজা জাফর।
৩ জন কর্মকর্তাকে মনোনীত করা হয়েছিল।
ম্যানেজার : শামি খান।
সহকারী ম্যানেজার : সাদেক আলী মির্জা।
কোচ : শাহনূর।
ইপিএসএফ হকি টিমের ১৯ মার্চ রাওয়ালপিন্ডি যাত্রার দিন ধার্য করা হয়েছিল এবং ফিকশ্চার অনুসারে ২৪ মার্চ কোয়েটা টিমের বিরুদ্ধে আমাদের খেলা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
১৯ মার্চ লাহোরের উদ্দেশে আমরা ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর ত্যাগ করেছিলাম এবং বিকেলে লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণের পরপরই চলে গিয়েছিলাম লাহোর স্টেশনে রাওয়ালপিন্ডির ট্রেন ধরার লক্ষ্যে। ২০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডি রেলস্টেশনে ট্রেন পৌঁছালে যাত্রীরা সব তাড়াহুড়ো করে স্টেশন ত্যাগ করে গেলেও শুধু আমরা স্টেশনে রয়ে গিয়েছিলাম, কারণ রেলস্টেশনেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রথম শ্রেণীর কামরায় গদিওয়ালা সিটে চাদর বিছিয়ে নিজ নিজ যায়গা বেছে নিয়েছিলাম। টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে কোন টিম এরকম রেলস্টেশনে এবং ট্রেনের বগিতে অবস্থান করেছে বলে আমার জানা নেই। মজার ব্যাপার হলো ট্রেনের কামরায় আমরা হয়তো গল্প করছি, এমন সময় ট্রেন চলতে শুরু করে দিত। আরে দাঁড়াও, আমাদের টিমের আরো সদস্য বাইরে রয়েছে, তাদেরকে ছেড়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ট্রেনটি, কিছুদূর গিয়ে থেমে গিয়ে আবার পেছনে চলতে শুরু করে দিত। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সানটিং হচ্ছে অর্থাৎ আমাদের বগি যে লাইনে ছিল, সেটাকে অন্য লাইনে নিয়ে যাওয়া। প্রথম রাতে আরও মজার ঘটনা ঘটেছিল, রাতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সকালে উঠে দেখলাম আমরা স্টেশনের যেখানে রাতে ছিলাম সেখানে নেই, বেশ দূরে পুরনো অনেক ট্রেনের মাঝে আমাদের বগিটির ঠাঁই হয়েছে। আমরা থাকতাম ট্রেনের বগিতে কিন্তু খেতে যেতে হতো স্টেশনের বাইরে, হোটেলে। বেশি সমস্যা হতো বাথরুম নিয়ে। বিশেষ করে সকালবেলা ১৮ সদস্যের একসাথে বাথরুমের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না, পানির অভাবে ঠিকমত গোসল করাও যেত না। সুতরাং স্টেশনে বগিতে থাকাটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের হয়ে পড়েছিল। কর্তৃপক্ষ তারপর আমাদের জন্য একটি হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে। হোস্টেলটি ছিল পাঁচতারা কন্টিন্যান্টাল হোস্টেলের প্রায় গাঁ ঘেষেÑ মজা করে বলতাম আমরা কন্টিন্যান্টাল হোটেলে থাকি। ১৬তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে ২৪টি টিম অংশগ্রহণ করেছিল। রাওয়ালপিন্ডি, সারগোদা, লাহোর, করাচি এবং পাকিস্তান আর্মির প্রত্যেকের দুটি করে দল (এ ও বি);এর সাথে পিআইএ, পুলিশ, রেলওয়ে, হায়দ্রাবাদ, পেশওয়ার, কোয়েটা, লায়ালপুর। ইস্ট পাকিস্তান টিমগুলো নিয়ে নকআউট পদ্ধতিতে চ্যাম্পিয়নশিপের ফিকশ্চার করা হয়েছিল।
আমরা রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছাবার পর থেকেই সেখানে বৃষ্টি হচ্ছিল। অনেকে ঠাট্টা করে বলতো, আমরা নাকি ঢাকা থেকে বৃষ্টি সাথে করে নিয়ে গেছি।
২০ তারিখে বৃষ্টির কারণে হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি। দু’দিন পিছিয়ে ২২ তারিখে উদ্বোধনের তারিখ করা হয়েছিল।
হকির কিংবদন্তি খেলোয়াড় নাসির বুন্দার ভাওয়ালপুর এবং আর্মি ব্লু টিমের খেলার মাধ্যমে আর্মি স্টেডিয়ামে বেলা ২টায় জেনারেল মুসা চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধন করেন। আমাদের খেলা নির্ধারিত ২৪ তারিখে কোয়েটার সাথেই হয়েছিল। বেশ কয়েকজন বয়স্ক খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত কোয়েটা টিমের তুলনায় আমাদের টিম ছিল তরুণদের নিয়ে গড়া, তাই মনে করেছিলাম সহজেই আমরা জিতবো। খেলা আরম্ভ হলে সে ধারণা পাল্টে গিয়েছিল। পাল্লা দিয়ে তারা আমাদের ওপর চড়াও হচ্ছিল। তাদের অভিজ্ঞ বয়স্ক খেলোয়াড়রা ছিল খুব পরিশ্রমী; বিশেষ করে তাদের লেফট ইন কাগাসু ছিল টিমের অন্যতম চালকাশক্তি। বরাবরের মতই আমাদের আক্রমণগুলো এলোমেলো হচ্ছিল, সফল হচ্ছিল না। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের একপর্যায়ে সেই কাগাসু (তিন সন্তানের জনক- শোনা কথা) গোল করে তাদের দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। গোল খাওয়ার পর আমরা যেন জেগে উঠি, আক্রমণের ধার আমাদের বেড়ে যায়। পরপর কয়েকটা আক্রমণের সুফল আমরা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের লেফট আউট হাসান (মামলি) গোল শোধ করায় আমরা কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তি পেয়েছিলাম কিন্তু বিরতির বাঁশি বাজার কিছুক্ষণ আগে তাদের রাইট ইন আব্বাস গোল করলে আমরা আবারও পিছিয়ে পড়ি। দ্বিতীয়ার্ধের পুরো সময়টাই আমরা গোল শোধ করার চেষ্টা করেছিলাম। কোয়েটা টিমও তাদের গোলের সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এতে খেলা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং মোটামুটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা ১-২ গোলে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল ৩১ মার্চ পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে এবং করাচি ‘এ’ ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। রেল দলের খুরশীদ এবং বিশ্বনন্দিত সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খান করাচি ‘এ’ দলের পক্ষে গোল করেছিল। ওয়েস্টার্ন রেল দল এবং করাচি ‘এ’ দলের মধ্যকার ফিরতি ম্যাচে রেলওয়ে করাচি ‘এ’ দলকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে আর্মি ‘এ’ দলের সাথে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। পিআইএ টিম আর্মি ‘বি’ টিমকে ১-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। অপর সেমিফাইনালে আর্মি ‘এ’ টিম ২-০ গোলে রেলওয়ে টিমকে পরাজিত করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল।
৫ এপ্রিল ’৬৬ ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। আর্মি স্টেডিয়াম দর্শকে পরিপূর্ণ। খেলার পূর্বে পিআইএ টিম এবং আর্মি ‘এ’ টিমের সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়্বু খানের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। পাঁচজন অলিম্পিয়ান এবং চারজন ইন্টারন্যাশনাল খেলোয়াড় নিয়ে গড়া শক্তিশালী পিআইএ টিম ২-০ গোলে আর্মি রেড (এ) টিমকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। লেফট-ইন আসাদ মালিক এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজি অনবদ্য ক্রীড়া প্রদর্শন করে উভয় একটি করে গোল করেছিল। ১৯৬৪ সালে পিআইএ প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এবং ১৯৬৬ সালে তারা শিরোপা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। খেলা শেষে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন।
ঐতিহ্যবাহী অল-পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট ১৪টি টিম নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে ৭ এপ্রি ’৬৬ থেকে শুরু হয়েছিল। হকি লীগ তখনও পুরোদমে চলছিল, রেলওয়ে, ওয়ারী ক্লাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং এবং আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) লীগ শিরোপা লাভের জন্য জোর লড়াই করে যাচ্ছিলাম। ১৯৬৩ সালে আমরা অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলেও আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট জয় করা সম্ভব হয়নি। এবারের টুর্নামেন্ট আমাদের চৌদ্দ দলের মধ্যে জয় ছিল অনেকটা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। নকআউট পদ্ধতিতে খেলা শেষে চারটি টিম ওয়ারী ক্লাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, রেলওয়ে টিম এবং আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম।
স্টেডিয়ামে প্রতি ফুটবল ম্যাচ, ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে হকি ক্যাম্প এবং দলের পিন্ডি খেলতে যাওয়া প্রভৃতি কারণে বার বার হকি লীগের ছন্দপতন ঘটেছে বিধায় লম্বা সময় ধরে (চার মাস) হকি লীগ চলে আসছিল। তার ওপর আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট, একই সাথে দুটো খেলা, আমাদের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে আমার কাছে তো বটেই; কারণ আমি সবগুলো খেলাতেই অংশগ্রহণ করেছিলাম।
২৪ এপ্রিল প্রথম সেমিফাইনাল ওয়ারী ক্লাবের বিরুদ্ধে আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) মাঠে নেমেছিলাম। আমাদের দুটি দলেই বেশ কয়েকজন ভাল খেলোয়াড় থাকায় দুটি টিমই ছিল শক্তিশালী, সমমানের। খেলার শুরু থেকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কিন্তু খেলায় কোন গোল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত গোল-শূন্য ড্র হয় এবং পুনরায় খেলার সিদ্ধান্ত হয়।
২৫ এপ্রিল কম্বাইন্ড স্পোর্টিং এবং রেলওয়ের মধ্যকার দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেলাটিও জোর প্রতিযোগিতামূলক হয়েছিল। খেলার মান ছিল উন্নত, আক্রমণেও ছিল ক্ষুরধার। উত্তেজনাকর এবং আকর্ষণীয় খেলাটি আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্ত খেলার ফলাফলকে বিতর্কিত করে দিয়েছিল সেদিন। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের আগুয়ান একটি বল রেল দলের গোললাইন অতিক্রম করলেও আম্পায়ারের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কম্বাইন্ডের রাইন আউট সোনা মিয়া সে বল ‘ডি’র ভেতর তাদের রাইট-ইন বুলবানকে পাস দিলে বুলবান সজোরে হিটের মাধ্যমে গোল করে। রেল দলের প্রতিবাদে আম্পায়ার কোনপ্রকার কর্ণপাত না করে খেলা চালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ১-০ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ড্র হওয়া সেমিফাইনাল ২৯ এপ্রিলে পুনরায় অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরই মধ্যে ২৬ এপ্রিলে ছিল আমাদের লীগের শেষ খেলা। আমাদের জন্য লীগ ডিভাইডিং ম্যাচ। আমরা ইস্পাহানীকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ১৯৬৬ সালের অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওয়ারীর বিরুদ্ধে পুনরায় আমাদেরকে মাঠে নামতে হয়েছিল ফিরতি সেমিফাইনালে। ওয়ারী ক্লাবের গোলরক্ষক ফ্রান্সিস থেকে শুরু করে ১১ নম্বরের লেফট-আউট এনায়েত পর্যন্ত ভাল খেলা প্রদর্শন করেছিল। পক্ষান্তরে আমাদের ফুলব্যাক সাবের আলী এবং লেফট হকি আনোয়ার ভাল খেলতে না পারায় আমাদের রক্ষণভাগ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং এরই সুযোগে ওয়ারী, বার বার আক্রমণ চালাতে সক্ষম হচ্ছিল। প্রথমার্ধের ১৫ মিনিটে ওয়ারীর লেফট-আউট এনায়েতের সজোরে হিট করা ক্রশ নেওয়াজ (রাইট আউট) ধরে ‘ডি’র ভেতর আলমগীরকে দিলে সেন্টার ফরোয়ার্ড আলমগীর প্লেসিং-এর মাধ্যমে গোলরক্ষক রঞ্জিতকে পরাস্ত করেন।
আলমগীর মোহাম্মদ আদেল (যিনি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক হকি আম্পায়ার) ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি, বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার গৌরব লাভ করেছিলেন। গোল পরিশোধ করার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে আমরা অনেকগুলো আক্রমণ করলেও কোনটাই সফলতার মুখ দেখিনি। আমার ‘ডি’র ভেতর থেকে নেয়া হিট ফ্রান্সিস দক্ষতার সাথে রক্ষা করে। দ্বিতীয়ার্ধের ২৫ মি. আমরা একটা পেনাল্টি কর্নার পেলে উভয় দলে উত্তেজনা বেড়ে যায় কিন্তু ফুলব্যাক সাবের আলী তা কাজে লাগাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আমরা ০-১ গোলে ওয়ারীর কাছে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
৩ মে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল, ওয়ারী ক্লাব বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। শক্তিশালী দুটো টিমের ফাইনাল দেখার জন্য উল্লেখযোগ্য হকি দর্শক স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন। দেশের সেরা খেলোয়াড়দের কিছু দক্ষ খেলোয়াড় দু’দলে থাকায় খেলার মান ছিল উল্লেখ্য। ব্যক্তিগত এবং গলগত নৈপুণ্য দ্বারা খেলাকে তারা করে তুলেছিল আকর্ষণীয়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা হয়ে উঠেছিল খুব উপভোগ্য। খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। কিন্তু গোল করা কোন দলের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। সুন্দর একটি ফাইনাল খেলার গোলশূন্য ড্র দেখে এবং এরকমই প্রাণবন্ত আর এক ফাইনাল দেখার আশা নিয়ে দর্শকরা তৃপ্তিসহকারে সেদিন মাঠ ত্যাগ করেছিলেন।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং এবং ওয়ারী ক্লাব আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন। উভয় দল পুনরায় ফাইনাল খেলতে রাজি না হওয়ায় ১৮ মে কম্বাইন্ডের সাধারণ সম্পাদক মরহুম দাবীর আহমেদ সিদ্দিকী, ওয়ারী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মরহুম শামসুল হুদা এবং ইপিএসএফ-এর সাধারণ সম্পাদক মরহুম এএ সিদ্দিকী মিলে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। এখানে একটি মজার ঘটনা হলো ওয়ারী আর কম্বাইন্ড টিম দুটো আবার সমানসংখ্যক পয়েন্ট নিয়ে লীগ শেষ করায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। যদিও গোল এভারেজে ওয়ারী ক্লাব এগিয়ে ছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব : গোলরক্ষক সাদেক (সিনিয়র), ফুলব্যাক- কাদের ও সাব্বির ইউসুফ, হাফ ব্যাক-সিকেন্দার, সাদেক ও মহসিন, ফরোয়ার্ড-রাজ্জাক (সোনা মিয়া) বুলবান, ইকবাল, প্রতাপ হাজরা এবং রহমান।
ওয়ারী ক্লাব : ফ্রান্সিস পালমার (গোলরক্ষক), এএম শেরা ও মোমতাজ, মোমিন, ইব্রাহিম সাবের ও খাজা, ফরোয়ার্ডস-নেয়াজ আহমেদ রানা, আলমগীর আদেল, হাসান মামলি ও এনায়েত। (ক্রমশ:)
(ষাট) ১৬ অক্টোবর
অল পাকিস্তান মোহাম্মদ আলী বগুড়া মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট তৃতীয়বারের মত ১৫ জুন ১৯৬৬ রাওয়ালপিন্ডি আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল। আল হেলাল ক্লাব, গুজরানওয়ালা বনাম ৫০২ ওয়ার্কশপ, রাওয়ালপিন্ডি টিমের খেলার মধ্য দিয়ে টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেছিলেন ন্যাশনাল এসেমব্লির স্পিকার আব্দুল জব্বার খান। তিনি খেলার মাঠে ফুটবল কিক করে শুভ উদ্বোধন করেছিলেন। উদ্বোধনী ম্যাচে আল-হেলাল ক্লাব ৩-১ গোলে ৫০২ ওয়ার্কশপ টিমকে পরাজিত করেছিল। তাদের তারেক হাসান ২ গোল এবং মোহাম্মদ হোসেন ১ গোল করলে বিপক্ষ দলের তৈমুর ১ গোল শোধ দিতে পেরেছিল। জুন মাসের প্রখর তাপ এবং প্রচন্ড গরমের জন্য টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষ ৯০ মিনিট খেলার নির্ধারিত সময়কে কমিয়ে ৭০ মিনিট খেলার সময় নির্ধারণ করে।
ঢাকার তিনটি ক্লাব সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিল। ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি। পূর্ববর্তী (১৯৬৫) আসরের চ্যাম্পিয়ন টিম ঢাকার ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব এবছর টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ না করায় ইপিআইডিসি টিম অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে যায়। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি প্রথমবারের মত এ টুর্নামেন্টে অংশ নিলেও আমরা গত দু’আসরেই অংশ নিয়েছিলাম। টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাওয়া মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্যবৃন্দ : টিমের ক্যাপ্টেন-জহিরুল হক, ম্যানেজার-কাজী শামসুল ইসলাম, সহকারী ম্যানেজার-গজনবী ভাই। টিমের অন্যান্য সদস্য : গোলরক্ষক-হাশেম দীন ও নূরুন নবী। ফুলব্যাক ও হাফ- জহির, তোরাব আলী, আসলাম, রসুল বকশ আবদুল গফুর ও গোলাম কাদের, পিন্টু। ফরোয়ার্ড : আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর, মুসা, প্রতাপ, জালাল।
২৩ জুন আমরা রাওয়ালপিন্ডির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলাম এবং লাহোর হয়ে রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছেছিলাম ২৪ জুন। ২৫ জুন পিএএফ (পাকিস্তান বিমানবাহিনী) লায়ালপুর ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনকে ২-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হয়। তাদের লেফট আউট আকরাম দু’অর্ধে দুটো গোল করে।
দিনের অপর ম্যাচে ওয়ারসাক ক্লাব পেশাওয়ার, নিউ ক্যাপিটাল হিরোস, রাওয়ালপিন্ডিকে অতি সহজে ৬-০ গোলে পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায়। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড নাসির উল্লাহ ৪ গোল করে এবং রাইট আউট গফুর ও রাইট ইন নাজির একটি করে গোল করে। জুন-২৬ পিআইএ লাহোর জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনকে ইউসুফ সিনিয়রের দেয়া একমাত্র গোল দ্বারা পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হয়। অপর খেলায় পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে যারা গত বছর এ টুর্নামেন্টের রানার্সআপ টিম, মুলতান জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ইপিআইডিসির মোকাবেলা করবে। তাদের আইয়ুব দার ২ গোল এবং সাদিক ১ গোল করেছিল।
ঢাকা মোহামেডান বনাম ওয়ারসাক ক্লাব পেশাওয়ার, কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। শারীরিক শক্তিশালী ওয়ারসাক টিমের খেলার মান উন্নত। সুতরাং আমাদের সাথে তাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। লম্বা লম্বা খেলোয়াড় বেশিরভাগ ওপরে খেলতে অভ্যস্ত। তাদের রাইট-আউট আমিন বক্সের ভেতর উড়ন্ত একটি বল আয়ত্তে এনে সজোরে কিক করে হাশেমদীনকে পরাস্ত করে। আমরা এক গোলে পিছিয়ে পড়ে গোল শোধ করতে মরিয়া হয়ে উঠি। একটার পর একটা আক্রমণ চালিয়ে যাই। এমনি একটি আক্রমণধারায় শামসু গোল করলে কিছুটা স্বস্তি আসে টিমে। তারপর থেকে আমরা গুছিয়ে খেলতে চেষ্টা করি। আমাদের বলের আদান-প্রদান সুন্দর হয় এবং আমার দেয়া একটি থ্রু পাস লেফট আউট মুসা ধরে নিজস্ব চেষ্টায় বক্সে ঢুকে গোলপোস্টে কিক করলে বল জালে জড়িয়ে যায়; এর সাথে আমরা ভারমুক্ত হয়ে বাকি সময়টা ভাল খেলেই জয় নিয়ে মাঠ ত্যাগ করি।
পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ইপিআইডিসি টিমকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। পিআইএ কোয়ার্টার ফাইনালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কাছে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল আর ঢাকা ওয়ান্ডারার্স পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল।
প্রথম সেমিফাইনাল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স বনাম পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে। দক্ষতা এবং ক্রীড়ানৈপুণ্য দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকায় খেলাটা বেশ জমে উঠেছিল। রেল দল লম্বা লম্বা পাসে খেললেও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ছোট ছোট পাসে খেলে দলকে সুসংহত করে ফেলেছিল। দু’দিকেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ খেলাকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত ওয়ান্ডারার্স ১-০ গোলে জয়ী হয়ে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ৫ জুলাই দ্বিতীয় সেমিফাইনালে আমরা ওয়েস্ট পাকিস্তান প্রেস, করাচির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলাম। করাচির মাকরানী খেলোয়াড়রা খুব শক্তভাবে আমাদের ধরেছিল, কোন প্রকার ছাড় দিচ্ছিল না; যেখানে আমরা, সেখানেই তারা। বল ধরতে দিচ্ছিল না। আমাদের আটকাতে যে কোন উপায় অবলম্বন করছিল। আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলা খেলতেই পারছিলাম না। প্রথমার্ধ খুবই অশান্তিতে রেখেছিল প্রেস দল। দ্বিতীয়ার্ধে মুসা (লেফট আউট) নিজস্ব প্রচেষ্টায় একটা গোল করলে আমরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলায় ফিরতে পেরেছিলাম, বল নিজেদের মধ্যে রাখতে এবং আদান-প্রদান করে বেশ কয়েকটা সফল আক্রমণ করতে পেরেছিলাম। এরই একটা আক্রমণ থেকে আমি দলের দ্বিতীয় গোলটি করলে আমাদের টিমের সবাই ফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ৬ জুলাই নির্ধারিত ফাইনাল খেলা বৃষ্টির কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। ফাইনাল খেলা দেখার জন্য আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মঈনুল ইসলাম সাহেব পিন্ডি উড়ে গিয়েছিলেন। বৃষ্টিতে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। খেলোয়াড়দের অনেকে আমাকে বলেছিল প্রেসিডেন্ট সাহেবকে বলার জন্য যে, এ আবহাওয়ায় আমরা ঠান্ডা হয়ে গেছি, ১০০ টাকা করে বোনাস পেলে আমরা আগামীকাল চাঙ্গা হয়ে খেলতে পারবো। প্রেসিডেন্ট সাহেবকে সকলের কথাটা জানালে তার কালো গোঁফের ফাঁক দিয়ে সাদা দাঁতে ঝিলিক দেখতে পেয়ে বুঝে নিয়েছিলাম আমাদের আরজি মঞ্জুর হয়েছে। তিনি সবাইকে ১০০ টাকা করে দিলে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম।
৭ জুলাই ঢাকার দুই ঐতিহ্যবাহী টিমের মধ্যে ফাইনাল খেলা। ঢাকা মোহামেডান এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটো টিমের খেলা মানে মর্যাদার লড়াই, যুদ্ধ যুদ্ধ আবহাওয়া তৈরি হয়ে যায় মাঠে। ঢাকার মাঠ হোক কিংবা বাইরে কোন মাঠে হোক। পিন্ডির আর্মির মাঠেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঢাকা তথা দেশের সেরা দুটো টিমের খেলা উপভোগ করার জন্যা মাঠভর্তি দর্শক। খেলার পূর্বে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের সাথে খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ চাপের মধ্যে থাকা দু’টিমই উত্তেজিত হয়ে খেলা শুরু করেছিল। দু’দলেই উঁচুমানের খেলোয়াড় থাকায় তাদের দক্ষতা, ক্রীড়ানৈপুণ্যে কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। আমাদের দলের কম্বিনেশন অত্যন্ত চমৎকার ছিল, বিশেষ করে আবদুল্লাহ ও আমি, দুই ইন, সারা মাঠজুড়ে খেলে ডিফেন্স এবং অফেন্সের মাঝে সুন্দর সমঝোতা গড়ে তুলতে পেরেছিলাম; যার জন্য বলের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগ সময় আমরা রাখতে সক্ষম হচ্ছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি যখন হাফ এবং আউটের সাথে ট্রায়ো বানিয়ে বল আদান-প্রদান করতাম, তখন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের খেলোয়াড়রা উত্তেজিত হয়ে গালাগাল দিত, বিশেষ করে মাকরানী প্লেয়াররা এবং রাফ টেকলিং করার লক্ষ্যে ছুটে আসতো। তখন আমরা খুব মজা পেতাম। ওয়ান্ডারার্সের জুনিয়র ইউসুফ, ওমর, আব্বাস, গাজীর আক্রমণ ছিল ক্ষুরধার। আমরা আমাদের উইংদের ব্যবহার করে আক্রমণকে সচল রাখছিলাম। বল খুবই দ্রুত এ সীমানা ও সীমানা করছিল। এমনই যখন খেলার ধারা, তখন আমাদের রাইট আউট প্রতাপ বিপক্ষ দলের বক্সের কাছাকাছি একটা বল পেয়ে আচমকা গোল পোস্টে কিক করলে হাকিম (গোলরক্ষক) কিছু বুঝে ওঠার আগেই বল গোলপোস্টের ভেতর, জালে। গোল, গোল, চারদিক থেকে চিৎকার। এক গোলে পিছিয়ে পড়ে ওয়ান্ডারার্স প্রাণপণ গোল শোধ করার চেষ্টা করে বিশেষ করে দেশের কৃতী দুই ফরোয়ার্ড ওমর এবং আব্বাস কিন্তু আমাদের ছিল তোরাব আলীÑ সে সময়ের দেশসেরা স্টপার, সাথে ছিল জহির-আসলাম। তারা গোল শোধ দিতে পারেনি বরং আমাদের লেফট আউট মুসা একক প্রচেষ্টায় আরও একটি গোল করলে আমাদের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আমরা ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ২-০ গোলে পরাজিত করে অল পাকিস্তান মোহাম্মদ আলী বগুড়া ফুটবল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মো. আইয়ুব খান খেলা শেষে খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। ক্লাব প্রেসিডেন্ট সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন, আমাদেরকে রাতে ডিনার খাইয়েছিলেন। #
(ক্রমশ:)
(একষট্টি) ১ নভেম্বর
১৯৬৬ সালে ঢাকায় আমরা দুটো ফুটবল লীগ খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। একটি ঢাকা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে, ডিডিএসএ ফুটবল লীগ অপরটি ইপিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে ঢাকার প্রচলিত প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ। ডিডিএসএ ফুটবল লীগে ঢাকার প্রায় সবগুলো ক্লাব যারা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণ করে থাকে, তারা সেই লীগেও অংশ নিয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, ফায়ার সার্ভিস, পাক পিডব্লিউডি, ইপিজি প্রেস, আজাদ স্পোর্টিং, পুলিশ এসি, সেন্ট্রাল প্রিন্টিং এবং স্টেশনারী, ইপিআইডিসি, প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সাথে প্যানারোমা ক্লাব, হোল্ডেন একাদশ, আজাদ পাক ক্লাব, টিটি সেন্টার। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ওয়ারী ক্লাব অংশগ্রহণে বিরত থাকে। ডিডিএসএ ফুটবল লীগ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি টিম মাঠে সর্বোচ্চ পাঁচ জন প্রথম বিভাগের খেলোয়াড় নামাতে পারবে।
২৯ এপ্রিল ’৬৬ ঢাকা ডিস্ট্রিক স্পোর্টস এসোসিয়েশন ফুটবল লীগ আউটার স্টেডিয়ামের ১নং গ্রাউন্ডে ফায়ার সার্ভিস বনাম প্যানারোমা ক্লাবের খেলার মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয়েছিল। খেলা বেশ জমজমাট হয়েছিল। প্যানারোমা ক্লাবের গোলরক্ষক রাজা তার অনবদ্য খেলা প্রদর্শন করে উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল।
আউটার স্টেডিয়ামের ৪নং গ্রাউন্ডে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব টিটি সেন্টারকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ১নং গ্রাউন্ডে ইপিজি প্রেস এবং ইপিআইডিসি ১-১ গোলে ড্র করে পয়েন্ট বন্টন করে নেয়। ইপিআইডিসির হাশেম ও প্রেসের বাদল গোল করেছিল।
পুলিশ ৩-০ গোলে হোল্ডেনকে পরাজিত করেছিল। পুলিশের নূরুল ইসলাম, নাসির ও ননি গোপাল গোল করেছিল। ৬ মে ইপিআইডিসি ৪-০ গোলে হারিয়েছিল পুলিশকে। ৮ মে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্যানারোমা ক্লাবের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে প্রথম পয়েন্ট হারায়। মোহামেডানের পক্ষে গফুর এবং প্যানারোমার পক্ষে আজিজ গোল করেছিল। ১০ মে তারিখে ১নং এবং ৪নং গ্রাউন্ডে দুটো খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং দুটো খেলাই গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ক্লাব বনাম হোল্ডেন একাদশ এবং আজাদ স্পোর্টিং বনাম আজাদ পাকিস্তান ক্লাব। ১১ মে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব বিজি প্রেসকে কোন গোল করতে না পারায় আরও একটি পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। সেই দিনে ৪নং গ্রাউন্ডে ফায়ার সার্ভিস ৩-০ গোলে টিটি সেন্টারকে হারায় এবং তাদের হয়ে গোল করেছিল সামাদ এবং আবুল। ১৪ মে মোহামেডান বনাম আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের খেলা; আজাদ খেলতে অস্বীকৃতি জানায় কারণ মোহামেডানের খেলোয়াড়দের মধ্যে ৮ জন ছিল প্রথম ডিভিশনের খেলোয়াড় যা ডিডিএসএ ফুটবল বাইলজের পরিপন্থী। আব্দুল গফুর নুরুন নবী এবং রসুল বক্সের নাম মোহামেডান-প্লেয়ার লিস্টে ছিল না। অথচ তারা মাঠে নেমেছিল। জহির তোরাব আসলাম শামসু-মুসা এই পাঁচজনের নাম প্লেয়ার লিস্টে ছিল। ১৭ মে, ১নং গ্রাউন্ডে মোহামেডানের খেলা হোল্ডেন একাদশের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে দিন তারা মাঠে উপস্থিত হয়নি। খেলোয়াড় স্বল্পতা এবং ২০ মে থেকে অনুষ্ঠিতব্য সিনিয়র ডিভিশন (প্রথম বিভাগ) ফুটবল লীগে অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কারণ দেখিয়ে মাঠে উপস্থিত হয়নি এবং ডিডিএসএ ফুটবল লীগ থেকে মোহামেডান তাদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
১৯৬৬ সালের প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ শুরু হয়েছিল ২০ মে তারিখ থেকে। গত মৌসুমে লীগে অংশ নেয়া ১২টি দলের সাথে নতুন ইপিআইডিসি দলসহ মোট ১৩টি টিমের ফিরতি লীগ (রিটার্ন লীগ) পদ্ধতিতে ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়াম এবং আউটার স্টেডিয়ামে প্রতিদিন দুটো করে খেলা অনুষ্ঠিত হওয়া লীগের উদ্বোধন করেছিলেন ইপিএসএফ এর সভাপতি জনাব এসবি চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব এ এ সিদ্দিকী, ইপিআইডিসি বনাম রহমতগঞ্জ এবং ওয়ারী ক্লাব বনাম রেলওয়ে। দুটো ম্যাচের পূর্বে চারদলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় সভাপতি মহোদয়ের এবং পরে তিনি মাঠের মাঝখানে বল কিক মেরে সেবারের লীগ খেলার উদ্বোধন করেছিলেন। ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে রহমতগঞ্জকে এবং ওয়ারী ক্লাবও রেলওয়েকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে উভয় দল শুভ সূচনা করেছিল।
জাতীয় দলের কৃতি সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমরের দেয়া ২ গোলের সুবাদে শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল প্রেসকে ২-১ গোলে হারাতে ঘাম ঝরাতে হয়েছিল। ভুট্টো প্রেস দলের পক্ষে ১টি গোল শোধ করেছিল। আউটার স্টেডিয়ামে লীগের অপর খেলায় স্টেশনারী ফায়ার সার্ভিস দলকে কাবিলের দেয়া গোলে (১-০) পরাজিত করে পূর্ন পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ারী ক্লাব নিশিথ, জামিল আক্তার এবং এন ইসলামের দেখা ৩ গোলের উপর ভর করে পুলিশ টিমকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল। পুলিশের রহিম ১ গোল শোধ দিতে পেরেছিল। ফুটবল মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিক ইপিআইডিসি দলের ইমামের (৩ গোল) ১ গোল জব্বরের এই চার গোলের সুবাদে ৪-০ গোলে তারা রেলওয়েকে হারিয়েছিল। অপর খেলায় কৃতি সেন্টার ফরোয়ার্ড সুলানের উপর ভর করে রহমতগঞ্জ ৫-০ গোলে স্টেশনারীকে বিধ্বস্থ করে দিয়েছিল। মাহমুদের দেয়া ৩ গোলে বিজি প্রেস ফায়ার সার্ভিসকে হারাতে পেরেছিল। ২৫-৫-৬৬ তারিখের খেলায় পুলিশ দলকে বিধ্বস্ত করে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তাদের আক্রমণ ভাগ কতটকু শক্তিশালী। ফরোয়ার্ড লাইনের ওমর, আব্বাস-২, ইউসুফ (জু,) হাফিজ এবং গাজী প্রত্যেকেই গোল পেয়েছিল। দিনের অপর খেলায় আজাদ এবং রেল ১-১ গোলে ড্র করেছিল, গোল করেছিল দেবু ও বর্মন। জাতীয় দলের কৃতি লেফট আউট মূসার ৩ গোল, প্রতাপ ও শামসুর করা ৫ গোলের ব্যবধানে ঢাকা মোহামেডান স্টেশনারীকে হারিয়েছিল (২৬-৫-৬৬) অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া ৩-১ গোলে রেলদলের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিল। ইপিআইডিসি ৩-১ গোলে ফায়ারকে এবং রহমতঞ্জ ২-০ গোলে পুলিশকে হারানোর মধ্য দিয়ে লীগ খেলা এগিয়ে যায়।
৩০-৫-৬৬ তারিখে মূসার ২ গোল, শামসু ও আমার দেয়া ৪ গোলের সাহায্যে মোহামেডান ৪-০ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল। পুলিশ ১-০ গোলে স্টেশনারীকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। পরদিন রহমতগঞ্জ নাজিরের দেয়া একমাত্র গোলে ভিক্টোরিয়াকে হারিয়েছিল এবং অপর খেলায় শারফুদ্দিনও আলমের দেয়া গোলে ফায়ার সার্ভিস রেলদলকে ২-১ গোলে হারাতে পেরেছিল। রেলের অলক একটি গোল শোধ দিয়েছিল।
১লা জুন ফুটবল লীগের প্রথম অঘটন ঘটেছিল যখন শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব পিডব্লিউডি ক্লাবের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে মূল্যবান একটি পয়েন্ট হারিয়েছিল। হাফিজ গোল করেছিল ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে আর মনজুর করেছিল পিডব্লিউডি ক্লাবের পক্ষে। ইপিজি প্রেস মাহমুদ ও ভুট্টোর দেয়া গোলে ওয়ারী ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল এবং ইপিআইডিডিসি জব্বর ও হাশিমের করা ৩ গোলের বিপক্ষে একটি গোলও শোধ দিতে পারেনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। মূসা, আবদুল্লাহ এবং আমার দেয়া ৩ গোলে আমরা ভিক্টোরিয়াকে হারিয়েছিলাম। ফায়ার সার্ভিস আবুলের ২ গোলের সুবাদে রহমতগঞ্জকে ২-১ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। নাজির ১ গোল শোধ দিয়েছিল। অপর খেলায় বাবন ও দেবুর দেয়া গোলে আজাদ ২-০ গোলে স্টেশনারীকে পরাজিত করেছিল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ওয়ান্ডারার্স ২-১ গোলে ইপিআইডিসিকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। জব্বরের ২ গোলের বিপক্ষে আমিন করেছিল ১ গোল। পুলিশের নবী হ্যাটট্রিকসহ একাই ৬ গোল করেছিল এবং তারা রেলকে ৭-০ গোলে হারিয়েছিল। পিডব্লিউডি ক্লাবের বাবুল জোসি এবং সুজার করা ৩ গোলের কাছে ওয়ারী হার মেনে নিয়েছিল। অপর খেলায় প্রেস ক্লাবও রহমতগঞ্জের নয়া, সুলতান ও গফুরের দেয়া ৩ গোলের সুবাদে ৩-১ গোলের হার মেনে নিয়েছিল তবে প্রেসের সামাদ ১টি গোল শোধ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল।
৮-৬-৬৬ তারিখে মোহামেডান তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু-২, মূসা ও প্রতাপের করা গোলের সাহায্যে পুলিশকে ৪-০ হারিয়েছিল। অপর খেলায় রেলওয়ে পিডব্লিউডি টিমের কাছে ৮-১ গোলে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল। সুজা একাই ৪ গোল, জানি, মনজুর ওয়াহিদ মিলে বাকি ৪ গোল করেছিল বিপরীতে রেলের অলক ১ গোল শোধ দিতে পেরেছিল। ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে ওয়ারীকে হারিয়ে ছিল এবং প্রেস ও স্টেশনারী ১-১ গোলে ড্র করেছিল। ওয়ান্ডারার্স ৫-০ গোলের বড় জয় পেয়েছিল রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে আর তাদের পক্ষে গোল করেছিল আব্বাস-২, আসলাম-২ ও আবিদ। ভিক্টোরিয়া এবং আজাদ তাদের নিজ নিজ দলের জয় পেয়েছিল ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ টিমের বিরুদ্ধে ১-০ গোলের। প্রতাপ, শামসু ও মূসার ৩ গোল পিডব্লিউডি টিমের বিরুদ্ধে মোহামেডানের জয় এসেছিল এবং সেদিনই অপর খেলায় ওয়ারী ক্লাবকে তপন, ইউনুসের-২, নিশিথের দেয়া ৪ গোলের জয় এনে দিয়েছিল স্টেশনারী দলের কাছ থেকে।
ইপিআইডিসি পরবর্তী খেলায় প্রেসকে ৫-২ গোলে হারিয়েছিল জব্বর, হাবিব-২, আবদুল্লা আকবর এবং সলিমুল্লাহর গোলের বিপরীতে মাহমুদ ও শিবলী দু গোল শোধ দিয়েছিল। নাজিরের দেয়া দু গোলের সাহায্যে রহমতগঞ্জ ২-০ গোলে রেলকে হারিয়েছিল। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স পুনরায় প্রমাণ করেছিল যে, তাদের আক্রমণভাগ কত শক্তিশালী যখন আসলাম, হাফিজ, আব্বাস, রহমতউল্লাহ মিলে আজাদের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দিনের অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিস ৩-২ গোলে পুলিশকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট পেয়েছিল। পরদিনের খেলায় ওয়ারী ও ভিক্টোরিয়া ১-১ গোলে ড্র করলে, পিডাব্লিউডি জিতেছিল ১-০ গোলে স্টেশনারীর বিরুদ্ধে। মূসা তার ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দ্বারা হ্যাটট্রিকসহ ৫ গোল এবং কামালের এক গোলের কাছে রেলদল নতি স্বীকার করেছিল ৬-০ গোলের। ১৬-৬-৬৬) অপর খেলায় আজাদ ১-০ গোলে হারিয়েছিল প্রেসকে যার গোল করেছিল চট্টগ্রামের কৃতি ফুটবলার লেফট আউট বাটু। ১৭-৬-৬৬ তারিখ ওয়ান্ডারার্স ক্লাব লীগ চ্যাম্পিয়নশীপের দৌড়ে আরও এককদম পিছিয়ে পরেছিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। ওয়ারী ৪-০ গোলের পরাজয় মেনে নিয়েছিল যখন ফায়ার সার্ভিস টিমের আশরাফ-৩ ও শাহাবুদ্দিন চার গোল করেছিল। গফুর ও নাজিরের করা ২ গোল রহমতগঞ্জকে পিডব্লিউডির বিরুদ্ধে ২-১ গোলে জয়ী করেছিল। সুজা ১ গোল শোধ করার সুযোগ পেয়েছিল। রেল দল ২-১ গোলে জিতেছিল স্টেশনারীকে, মুকুল ও ইয়াকুব রেলের পক্ষে আর আজিজ গোল করেছিল স্টেশনারীর পক্ষে। ইউসুফ, ওমর, আনসার ও হাফিজ ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের চার ফরোয়ার্ড ৪ গোল করে ফায়ার সার্ভিসকে পরাজিত করেছিল। (২১-৬-৬৬) অপর খেলায় জালালের ২ গোল এবং নিমাইয়ের ১ গোলের সুবাদে প্রেস স্টেশনারীকে ৩-১ গোলে (ওয়াসী) হারিয়েছিল। ইপিআইডিসি ৩-১ গোলে স্টেশনারীকে এবং রহমতগঞ্জ নাজির ও গফুরের দেয়া ২-০ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল। পিডব্লিউডি ৬-২ গোলের বড় ব্যবধানে পুলিশকে হারিয়েছিল। গোল করেছিল সুজা-২,লাল মোহাম্মদ, কানু, জোসি পুলিশের নূরু এবং সাত্তার দুটো গোল শোধ দিয়েছিল। ২৪ থেকে ২৮ জুন বড় কোন দলের খেলা ছিল না। ভিক্টোরিয়া প্রেসকে ২-০ গোলে হারায়। পিডব্লিউডি ফায়ারের খেলায় কেউ গোল করতে পারেনি, প্রেস সেলিমের জন্য পুলিশকে ১ গোল দিতে পেরেছিল। ভিক্টোরিয়া আজিমের ৩-গোল এবং মনসুরের ১ গোলের উপর ভর করে আজাদকে ৪-০ গোলে হারালেও তাদেরকে আবার পিডাব্লিউডি ক্লাবের নিকট ০-৫ গোলে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। ফায়ার আজাদ ১-১ গোলে ড্র।
ভিক্টোরিয়া ১-০ গোলে স্টেশনারীকে হারায়। আসলাম ও আব্বাস দু গোল করে আর হাফিজ এবং ইউসুফ এক গোল করে মোট ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে ওয়ান্ডারার্স ওয়ারীকে হারালেও (১১-৭-৬৬) তারিখের অপর খেলায় পিডাব্লিউডি এবং আজাদের খেলায় কোন গোল হয়নি। ১৪-৭-৬৬ তারিখে আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট নষ্ট করেছিল ইপিআইভিসি, পিডব্লিউডি টিমের সাথে ২-২ গোলের ড্র করে। হাশিম এবং সলিমুল্লাহ ইপিআইডিসির পক্ষে গোল করলে বিপক্ষ দলের পক্ষে গোল করেছিল গনি এবং মনজুর। সেলিমের দেয়া ২ গোলে প্রেস জিতেছিল রেলের সাথে।
১৫-৭-৬৬ শামসুর দেয়া একমাত্র গোল মোহামেডানকে অক্ষত রেখেছিল। প্রথমার্ধের ১৮ মিনিটে আজাদের। বিরুদ্ধে শামসুর গোলটি আমাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছিল। সেদিন আমাদের আক্রমণভাগ ছিল দারুণভাবে ব্যর্থ। পক্ষান্তরে আজাদের রক্ষণভাগ অসাধারণ ভাল খেলে মোহামেডানের সকল আক্রমণকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। বিশেষ করে তাদের স্টপার কাজী মোবাশশার হোসেন অত্যান্ত দক্ষতার সাথে ইন্টারসেপ্ট এবং ক্ষিপ্রতার সাথে টেকলিং করে খেলে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাদের ফুলব্যাকদ্বয় আহমেদ এবং আব্দুর রব দৃঢ়তার সাথে আমাদের সকল আক্রমণ রুখতে সক্ষম হয়েছিল। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড় (গোলরক্ষক) ইয়ার মোহাম্মদ আহমেদ-মোবাশশার এবং এ রব, লালু এবং সাদেক, দেবু, নাসিম, মানিক বর্মন, সাবের এবং নজরুল।
পরের দিনের দুটো খেলা ইপিআইডিসি ৩-১ গোলে ভিক্টোরিয়াকে এবং পুলিশ ৩-২ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারিয়েছিল। ১৭ জুলাই তারিখে ছিল লীগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খেলা, ঢাকা মোহামেডান বনাম ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। সে সময় সিলেটে ভীষণ বন্যায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে খেলাটিকে চ্যারিটি ম্যাচ করা হয়েছিল। পূব গ্যালারি ১ রুপি এবং পশ্চিম গ্যালারি ২ রুপি টিকিটের মূল্য ধার্য করা হয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শকে পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে খেলার পূর্বে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী জনাব এস এম আমজাদ হোসেনের সাথে উভয় দলের খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
খেলা শুরু থেকে আমাদের আক্রমণভাগ অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ডিফেন্সকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। মোহামেডান এবং ওয়ান্ডারার্স খেলা যেমন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব সেটা খুব একটা ছিল না। ওমর এবং আব্বাস তাদের নামের মত খেলতে পারছিল না, পুরোপুরি ব্যর্থ ছিল, সুতরাং তাদের আক্রমণে সেরকম ধার ছিল না ফলে আমাদের রক্ষণভাগ ছিল সুদৃঢ়। আমাদের আক্রমণ ছিল ক্ষুরধার, বারবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। পাঁচ মিনিটেই আমরা কর্নার লাভ করি। মূসার কর্নার থেকে বল পেয়ে আমি সজোরে কিক করলে তা পোস্টের উপর দিয়ে চলে যায়। ১৭ ও ২১ মিনিটেও আমরা কর্নার থেকে কোনরকম সুফল পাইনি। মূসার একটি দুর্বল কিক হাকিমের হাতে ধরা পরে, প্রায় ৫ গজ থেকে আবদুল্লাহ বাইরে মেরে সহজ গোল থেকে আমরা বঞ্চিত হই। বিরতির পর ছ মিনিটে প্রতাপের একটি কিক গোলবার ছুঁয়ে বাইরে চলে যায়। ওয়ান্ডারার্সের চতুর রাইট উইং ইউসুফের (জুনিয়র) হেড আমাদের সাইডবারে লেগে ফেরত গেলে আমরা নিশ্চিত একটি গোল খেতে খেতে রক্ষা পাই। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় লেফট আউট মূসা একক প্রচেষ্টায় বাম দিক দিয়ে ঢুকে সজোরে কিকের দ্বারা হাকিমকে পরাস্ত করলে স্টেডিয়াম আনন্দে ফেটে পরে।
আমরা অনেকটা ভারমুক্ত হয়ে খেলে বাকী সময়টা কাটিয়ে দিয়েছিলাম এবং মূসার গোলটাই আমাদেরকে চ্যারেটি ম্যাচ জয় এনে দিয়েছিল এবং লীগের জয়ের ধারাকে অক্ষুণœ রেখেছিল। চ্যারেটি ম্যাচের টিকিট বিক্রয়কৃত অর্থ ৩১,৯৬৮/- রুপি বন্যাদুর্গত ফান্ডে প্রদান করা হয়েছিল। চ্যারিটি ম্যাচে যারা খেলেছিল-
মোহামেডান : হাশেম দীন (গোলরক্ষক) জহির-তোরাব আলী, আসলাম, (ব্যাক) পিন্টু এবং গফুর। (হাফ) প্রতাপ আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর এবং মূসা (ফরোয়ার্ড)।
ওয়ান্ডারার্স : হাকিম (গোলরক্ষক), দেবীনাশ-হাসান, খামিসা (ব্যাক) আলাউদ্দিন ও আলী হাফিজ (হাফ), ইউসুফ (জু), আসলাম, ওমর, আব্বাস এবং গাজী।
সে দিনের রেফারি ছিলেন মাসুদুর রহমান।
(ক্রমশ.)
(বাষট্টি) ১৬ নভেম্বর
খেলার ৩০ মিনিটে হাশিমের দেয়া একমাত্র গোলে শক্তিশালী ইপিআইডিসি টিম পুলিশকে হারাতে পেরেছিল। গোলপোস্টে দুর্বল এবং এলোমেলো কিক তাদেরকে বেশি গোল পেতে দেয়নি। তাছাড়া পুলিশের তিন ডিফেন্ডার আক্তার, নবী চৌধুরী এবং হাফিজ দৃঢ়তার সাথে খেলে তাদের আক্রমণ সফল হতে দেয়নি। উপরন্তু খেলার শেষ মুহূর্তে পুলিশের সাত্তারের সজোরে কিক ইপিআইডিসি’র ক্রসবারে লেগে ফিরে আসলে পুরো দু’পয়েন্টের সন্তুষ্টি নিয়ে সেদিন ইপিআইডিসি মাঠ ছেড়েছিল।
পুলিশ টিমে যারা খেলেছিল : চন্দন (গোলরক্ষক), আক্তার, নবী চৌধুরী, এবং হাফিজ, কায়াসউদ্দিন এবং এরশাদ, সাত্তার, নাজির, ধীরেন, গাফফার এবং এন ইসলাম।
সেদিনের লীগের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং ২-১ গোলে অপেক্ষাকৃত জোরদার টিম রহমতগঞ্জকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। আজাদের নজরুল এবং দেবু গোল পেয়েছিল। প্রথমার্ধে ফায়ার সার্ভিস আমাদের কোন গোল করতে না দেয়ায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। গোলের সুযোগগুলো আমরা যেভাবে নষ্ট করেছি চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে ছিল বড়ই লজ্জার। ফায়ারের ডিফেন্স অত্যন্ত সতর্কতা এবং দক্ষতার সাথে আমাদের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল, বিশেষ করে প্রথমার্ধে। দ্বিতীয়ার্ধের ৪ মিনিটে আবদুল্লাহ গোল করে আমাদেরকে স্বস্তি এনে দিয়েছিল। গফুর গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং খেলার প্রায় শেষ সময়ে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু গোল করলে আমরা ৩-০ গোলে জয়ী হয়েছিলাম।
ফায়ার সার্ভিস দলের খেলোয়াড় : মোতালেব (গোলরক্ষক), মুজিবর রহমান জলিল, আনসারি এবং বিমল, আবুল হাসান এবং সামাদ, আবুল সারফুদ্দিন, সাহাবুদ্দিন, আশরাফ এবং ওহাব।
অপর খেলায় গনি এবং জোসির গোলের সুবাদে পিডব্লিউডি ২-১ গোলে (বিমল) রেলকে হারিয়েছিল। ২০ জুলাই ওয়ান্ডারার্সের ৭-০ গোলের বড় জয় আমাদের চিন্তিত করে দিয়েছিল; কারণ মাত্র দু’পয়েন্ট হারিয়ে তারা আমাদের কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলছিল। স্টেশনারী প্রথমার্ধে ভাল খেলে একমাত্র আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়েছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আর সামাল দিতে পারেনি। আব্বাস ২ মিনিটে দু’গোল, ওমরও পাঁচ মিনিটে দু’গোল করে, ছ’নম্বর গোল আব্বাস এবং শেষ গোল ছিল আসলামের। পরের খেলায় ওয়ারী এবং রেল পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল ১-১ গোল করে।
২১ জুলাই এর বিকেলটা ছিল আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসুর। সে একাই হ্যাটট্রিকসহ ৬ গোল করেছিল, সেই সাথে আমাদের ১১ গোলের ঝড়ে রহমতগঞ্জ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। লীগের এ খেলাটি ছিল আমাদের দশ নম্বর খেলা এবং শামসুর হ্যাটট্রিক ছিল মৌসুমের চতুর্থ হ্যাটট্রিক। আবদুল্লাহ প্রথম গোলের দরজা খুলেছিল এবং শামসু ৫, ৬ এবং ৭ নম্বর গোলের সাহায্যে হ্যাটট্রিক করেছিল। প্রতাপ ও মুসা ১ গোল করে করলে আমিও গোল করতে পিছিয়ে থাকিনি। ২ গোল করেছিলাম। তবে রহমতগঞ্জের সেন্টার ফরোয়ার্ড আফজাল ছিল মাঠের আনন্দিত খেলোয়াড় যে একক প্রচেষ্টায় মোহামেডানের ডিফেন্সকে কাটিয়ে দর্শনীয় একটি গোল করে সবাইকে চমকে দিয়েছিল (১১-১), সেই সাথে রহমতগঞ্জের মান বাঁচিয়ে ছিল।
রহমতগঞ্জ টিমের খেলোয়াড় : আমান (গোলরক্ষক), ফারুক, হাসনাত এবং দীপু, রফিক, নাজির, রোকন, সুলতান, আফজাল, গফুর, টিপু।
অপর খেলায় পুলিশের খেলোয়াড় নাজিরের দেয়া একমাত্র গোলে আজাদ হেরেছিল। ৩-১ গোলে ভিক্টোরিয়া প্রেসকে হারিয়েছিল। সুজার দর্শনীয় হ্যাটট্রিকের সুবাদে পিডব্লিউডি স্টেশনারীকে ৪-২ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। সিরাজ গোল করে প্রেসকে এগিয়ে নিলে গনি খেলায় সমতা আনে (১-১)। হাশেম গোল করে আবারও প্রেসকে এগিয়ে দেয়। (২-১)। তার পর সুজা পরপর তিনটি গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে। ২৩ জুলাই ছিল লীগের গুরুত্বপূর্ণ খেলা, মোহামেডান বনাম ইপিআইডিসি, লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী টিম। তিন পয়েন্ট হারিয়ে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের পেছনে থেকে শিরোপা জয়ের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। পুনরায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া খেলাটি পূর্বের খেলায় গ্যালারিতে উচ্ছৃংখল দর্শকদের মারামারির জন্য পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন পর্যন্ত খেলা ২-২ গোলে ড্র ছিল। সে সময় আমরা দু’দল মাঠের মাঝখানে বসে দর্শকদের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমন দেখে হা-হুতাশ করছিলাম।
ঢাকা স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। খেলার পূর্বে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে সেদিনের বিশেষ অতিথি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার আলমের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে স্কো. লিডার আলম পাক-ভারত যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে বিমান যুদ্ধ করে সফলতা অর্জন করেছিলেন এবং সবার ‘হিরো’ হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। স্কোয়াড্রন লিডার এমএম আলম তার বাবার মৃত্যুতে ঢাকায় এসেছিলেন, তারা আজিমপুর কলোনিতে থাকতেন বিধায় আজিমপুর এস্টেট ওয়েলফেয়ার সোসাইটি তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। খেলা শুরু থেকেই দু’দলের খেলোয়াড়রা উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। এমতাবস্থায় আমরা আকর্ষণীয় খেলা উপহার দিতে পারছিলাম না; বিশেষ করে আমাদের এলোমেলো, অগোছালো খেলা ইপিআইডিসি টিমকে ভাল খেলার সুযোগ করে দিচ্ছিল। আমাদের ফুলব্যাকদ্বয় জহির ভাই এবং আসলাম ব্যর্থ ছিলেন। এ সুযোগে বিপক্ষ ফরোয়ার্ড হাশিমউদ্দিন, জব্বর, সলিমুল্লাহ এবং হাবিবের সম্মিলিত আক্রমণের ধার বেড়ে গিয়েছিল। তবে স্টপার তোরাব আলী অত্যন্ত পরিশ্রম এবং দক্ষতার সাথে তাদের আক্রমণগুলোকে সফল হতে দেয়নি। তার দর্শনীয় খেলা, এন্টিসিপেশন, উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ইপিআইডিসির হাফ মুসা ও আবদুল্লাহ আকবর এবং ফুল ব্যাকে আমিন দৃঢ়তার সাথে আমাদের আক্রমণগুলোকে ঠেকিয়েছে। আমাদের দলের মুসার লক্ষ্যভ্রষ্ট বল মারা, আবদুল্লাহর মাঠে অযথা দৌড়াদৌড়ি এবং আমার মাঠে নি®প্রভ থাকা আমাদের আক্রমণকে জোরদার করতে পারছিল না। পক্ষান্তরে খেলার বিশ মিনিটে আমাদের ফুটব্যাক আসলামের অসাবধানতার কারণে ইপিআইডিসির হাশিম গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। এর আগে মূসার একটি থ্রু পাস আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু স্বপন (গোলরক্ষক)কে একা পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। গোল খেয়ে আমাদের এলোমেলো টিম গুছিয়ে আনতে সময় চলে যাচ্ছিল। দ্বিতীয়ার্ধের ২৪ মিনিটের সময় শামসু সাইফুদ্দিন এবং গফুর বেলুচকে ড্রিবল করে একক প্রচেষ্টায় গোল করে মোহামেডান সাপোর্টারদের স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিল। গোল করার পর আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গিয়েছিল এবং খেলার গতিটাও বেড়ে গিয়েছিল। খেলা শেষ হওয়ার ৩ মিনিট আগে প্রতাপ মুসার উদ্দেশে বিপক্ষ দলের বক্সের কাছাকাছি একটি বল দিলে মুসা পোস্টে সজোরে মেরে স্বপনকে পরাস্ত করলে বিজয় উল্লাসের চিৎসারে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে ওঠে। এক গোলে পিছিয়ে পড়া মোহামেডান খেলার অন্তিম মুহূর্তে ২-১ গোলে জয়ী হয়ে লীগের সে সময় পর্র্যন্ত শতভাগ জয়লাভের গৌরব অজন করতে সক্ষম হয়েছিল।
মোহামেডানে যারা খেলেছিল : গোলরক্ষক - হাশেমদীন, ব্যাক-জহির, তোরাব আলী ও আসলাম। হাফ-জাকারিয়া পিন্টু ও গফুর। ফরোয়ার্ড-প্রতাপ, আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর ও মুসা।
ইপিআইডিসি টিম : গোলরক্ষক-স্বপন, ব্যাক-আমিন, গফুর বেলুচ ও সাইফুদ্দিন, হাফ-মুসা ও আবদুল্লাহ আকবর। ফরোয়ার্ড-সলিমুল্লাহ, হাশিম, হাবিব, জব্বর ও টুলু।
রেফারি-ঈশা খান।
আমাদের লীগের প্রথম পর্বের শেষ খেলা ছিল ওয়ারীর বিরুদ্ধেÑ যা আমরা সফলভাবে ৮-১ গোলের জয় দিয়ে শেষ করেছিলাম। গফুর ২ গোল, মুসা ৩ গোল, শামসু ২ গোল এবং প্রতাপ করেছিল ১ গোল।
লীগের প্রথম রাউন্ড শেষে তিন টিমের অবস্থান
দল খেলা জয় ড্র পরা পক্ষে বি. পঃ
মোহামেডান ১২ ১২ ০ ০ ৫১ ৪ ২৪
ওয়ান্ডারার্স ১২ ৯ ২ ১ ৫৩ ৭ ২০
ইপিআইডিসি ১২ ৯ ১ ২ ৩২ ১১ ১৯
(ক্রমশ.)
(তেষট্টি) ১ ডিসেম্বর
আজাদী দিবস ফুটবল ১৯৬৬
প্রতিবছরের মত সে বছরও ইপিএসএফ-এর ফুটবল কমিটির ব্যবস্থাপনায় আজাদী দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট বেশ ঘটা করে আয়োজন করা হয়েছিল। ফুটবল লীগ তখনও পুরোদমে চলছিল। মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি লীগ শিরোপা লাভের দৌড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। ৭-১৪ আগস্ট পর্যন্ত লীগ খেলা স্থগিত রেখে শুরু হয়েছিল আজাদী দিবস ফুটবল। সাতটি টিম এতে অংশ নিয়েছিল। গতবারের চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি, ভিক্টোরিয়া, পিডব্লিউডি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এবং আইজিপি একাদশ। ৮ আগস্ট ইপিআইডিসি বনাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিমের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল টুর্নামেন্ট। ঢাকা ইউনিভার্সিটি এবং কলেজের কৃতী খেলোয়াড় যারা বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে লীগে অংশগ্রহণ করে থাকে, তাদেরকে নিয়ে বেশ শক্তিশালী টিম গঠন করেছিল। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ পত্রিকা মারফত খেলোয়াড়দের তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। সে অনুযায়ী টিমে যারা ছিল- হাফিজ উদ্দিন (ক্যাপ্টেন), প্রতাপ শংকর হাজরা (ভাইস ক্যাপ্টেন), হাসান, সাবের, কায়কোবাদ, মনিরুল হক, শাহজাহান, টিপু, রফিক, অনাথ, আজম, সাইদুর, নুরুজ্জামান, আবদুল হক, আতাউর এবং গিয়াসউদ্দিন।
সমমানের দুটি টিমের খেলা। ইউনিভার্সিটি দলের ভাইস ক্যাপ্টেন প্রতাপ শংকর মাঠে উপস্থিত ছিল না। খেলা শুরু থেকেই দু’টিমের খেলোয়াড়ের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল এবং ভার্সিটি টিমের খেলোয়াড়রা রাফ ট্যাকলিং করে খেলছিল। খেলার একপর্যায়ে ইউনিভার্সিটি টিমের লেফট আউট টিপু এবং ইপিআইডিসি টিমের রাইট আউট সলিমউল্লাহর মধ্যে উত্তপ্ত কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে ইউনিভার্সিটির হাসান দৌড়ে গিয়ে সলিম উল্লাহকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। এতে ইপিআইডিসি টিম কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তার ওপর ইপিআইডিসির নির্ভরযোগ্য স্টপার গফুর বালুচ হাঁটুতে আঘাত পেয়ে রাইট আউট পজিশনে গিয়ে দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে সময় পার করছিল। তাদের হাফলাইনে মুসা এবং ব্যাকে আমিন ও সাইফুদ্দিন ইউনিভার্সিটির সব আক্রমণ দৃঢ়তার সাথে সামাল দিয়েছিল। ইপিআইডিসির আক্রমণভাগে হাশিম, জব্বর এবং আনসার ইউনিভার্সিটির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে গিয়েছিল। তাদের লেফট আউট আনসার বিপক্ষ দলের বক্সের কাছে একটি বল পেয়ে সজোরে কিক করলে অলক (গোলরক্ষক) ধরতে ব্যর্থ হয় এবং ইপিআইডিসি ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। এরপর ইউনিভার্সিটি সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালাতে থাকে। পরপর তিনটি সুযোগ তারা হাতছাড়া করে। ইপিআইডিসির আনসার বাম দিক থেকে পুশের মাধ্যমে জব্বরকে পাস দিলে সে দক্ষতার সাথে গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেয়। দুই গোলে পিছিয়ে পড়ে ইউনিভার্সিটি গোল শোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে এবং বিরতির কিছু আগে মুনিরের জোরালো শট স্বপনের (গোলরক্ষক) হাত ফসকে বল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফরোয়ার্ড শাজাহানের কাছে গেলে তা থেকে শাহজাহান গোল করে (২-১)। খেলায় আবারও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে মাঝামাঝি সময় আনসার সুন্দর একটি থ্রু পাস হাশিম উদ্দিনকে দিলে সে গোল করে দলকে ৩-১ গোলের জয় এনে দেয়; সে সাথে দল সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ৯-৮-৬৬ ঢাকা ওয়ান্ডারার্স আইজিপি একাদশকে ৫-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিল। খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল আব্বাসের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। পুলিশ দলের খেলোয়াড়সহ অন্যান্য টিমের খেলোয়াড়কে নিয়ে আইজিপি টিম গঠন করা হয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স আরো বেশি গোলে জয়লাভ করতে পারতো, শুধু আবাসের হ্যাটট্রিকের জন্য ইউসুফ ওমর আবদুল্লাহ গোল করা থেকে বিরত ছিল। আইজিপি টিমের নবী চৌধুরী ওয়ান্ডারার্স দলের অনেকগুলো আক্রমণ নস্যাৎ করে দলকে আরও বেশি গোলের পরাজয় থেকে বাঁচিয়েছিল। খেলা শুরু হলে প্রায় দশ মিনিটে ওয়ান্ডারার্সের আলী হাফিজ একক প্রচেষ্টায় ড্রিবলিং করে সাত্তার নিশিথ এবং হাফিজকে কাটিয়ে সীতাংশুকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে ঢুকিয়ে একটি দর্শনীয় গোল করেছিল। বিরতির কিছুক্ষণ আগে একটি বল নবী চৌধুরী ধরতে ব্যর্থ হলে ওমর ধরে গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। আইজিপি একাদশও মাঝে মাঝে আক্রমণ চালিয়ে ওয়ান্ডারার্সকে ব্যস্ত করে তোলে; তবে ওয়ান্ডারার্সের শক্তিশালী ডিফেন্সের কাছে সেগুলো পাত্তা পায়নি। বিরতির পর আব্বাস দলের পক্ষে তৃতীয় এবং চতুর্থ গোল করলে দলের অন্যান্য খেলোয়াড় তাকে হ্যাটট্রিক করার জন্য সহযোগিতা করতে থাকে। তারা গোলের সহজ সুযোগেরও ব্যবহার করছিল না। অবশেষে রহমত উল্লাহ লেফট আউট পজিশন থেকে একটি লব দিলে আব্বাস সেটা থেকে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল।
আইজিপি একাদশ : সীতাংশু (গোলরক্ষক), মুজিবর, নবী চৌধুরী এবং আইনুল, হাসান এবং সামাদ, খোকন, সাত্তার, নিশিথ, হাফিজ এবং মাহমুদ।
১১-৮-৬৬ ভিক্টোরিয়া ৩-১ গোলে পিডব্লিউডিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। সমশক্তির দুটো টিম। তবে দুর্ভাগ্য পিডব্লিউডি টিমের যে, ভাল খেলেও পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। বলের নিয়ন্ত্রণ তাদেরই বেশি ছিল, আক্রমণও তারা বেশি করেছিল; শুধু ভাগ্য তাদের সাথে ছিল না। পক্ষান্তরে ভিক্টোরিয়া যে ক’টা সুযোগ পেয়েছিলÑ সব ক’টাতেই সফল হয়েছিল। ভিক্টোরিয়ার রাইট আউট ইউনুসের একটি লব সেন্টার ফরোয়ার্ড আজিম হেড করে গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর পিডব্লিউডি টিমের ফুলব্যাক হামিদ হেড করে গোলরক্ষক মতিনকে ব্যাক পাস দিতে গেলে ভিক্টোরিয়ার আজিম মাঝপথে বল ধরে পুস করে পোস্টে ঢুকিয়ে দিলে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। পিডব্লিউডি দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড জালাল স্বীয় চেষ্টায় একটি গোল দিলে খেলা বেশ জমে উঠে। পিডব্লিউডির মঞ্জু বিরতির পূর্বে একটি নিশ্চিত গোল মিস করলে ড্র থেকে বঞ্চিত হয় পিডব্লিউডি। দ্বিতীয়ার্ধে ভিক্টোরিয়ার ইউনুস বল নিয়ে বিপক্ষ বক্সে ঢুকলে পিডব্লিউডির খেলোয়াড় ফাউল করলে ভিক্টোরিয়া পেনাল্টি পায় এবং তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আজিম হ্যাটট্রিকের আশায় পেনাল্টি মারে, তবে মিস করে। আজিম অবশ্য পরবর্তীতে একক চেষ্টায় গোল করে হ্যাটট্রিকের স্বাদ পূর্ণ করতে পেরেছিল। সে সাথে সেমিফাইনাল খেলাও নিশ্চিত হয়েছিল।
পিডব্লিউডি টিম : মতিন (গোলরক্ষক), কানু, হামিদ এবং লাল মোহাম্মদ সালেহ এবং ওয়াহিদ, রহিম, গনি, জালাল, জানি এবং মনজুর।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ইপিআইডিসিকে হারিয়ে ফাইনালে। আব্বাসের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইপিআইডিসি ২-৪ গোলে পরাজিত। খেলা শুরু থেকে ওয়ান্ডারার্স প্রচন্ড আক্রমণ চালায় এবং ইপিআইডিসি সমানতালে লড়ে যায়। ওয়ান্ডারার্সের ডিফেন্স সেদিন খুব একটা ভূমিকা পালন করতে পারছিল না; বিশেষ করে মোবাশ্বের অনেকটা ‘সেকি’ ছিল এবং খামিসাও মানসম্মত খেলা খেলতে পারছিল না। তবে দেবীনাশ দৃঢ়তার সাথে তার রোবাস্ট ট্যাকলিং দ্বারা ইপিআইডিসির আক্রমণকে রুখতে সক্ষম হয়েছিল। প্রায় পনের মিনিটের সময় মোবাশ্বেরের হাতে বল লাগার কারণে ইপিআইডিসি পেনাল্টি পায় এবং আমিন গোল করে তার দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। ওমরের একটি হেড দর্শনীয়ভাবে স্বপন (গোলরক্ষক) রক্ষা করলে ওয়ান্ডারার্স ড্র হতে বঞ্চিত হয়। ওয়ান্ডারার্সের গোলরক্ষক হাকিমের একটি পাঞ্চ করা বল হাবিবের কাছে গেলে সে জোরে মেরে হাকিমকে পরাস্ত করে এবং ইপিআইডিসি ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। বিরতির কিছু আগে উঁচু হয়ে আসা একটি বলের ফ্লাইট গোলরক্ষক স্বপন মিস করলে ওমর সেটার সদ্ব্যবহার করেছিল (২-১)। হাফটাইমের পর ওয়ান্ডারার্স পুরো শক্তি লাগিয়ে দেয়। হাসানের লব ওমর আয়ত্তে এনে আব্বাসকে দিলে তা থেকে আব্বাস গোল করে ২-২ গোলের সমতা এনে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় ওমর একটি বল নিয়ে দ্রুতগতিতে বিপক্ষ দলের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়ে এবং আব্বাসকে বল বানিয়ে দিলে আব্বাস তার দ্বিতীয় গোল খুব সহজেই করে দলকে ৩-২ গোলে এগিয়ে দেয়। খেলার একপর্যায়ে ওয়ান্ডারার্সের জব্বর আলী হাফিজের সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে গেলে আলী হাফিজ জব্বরকে বুট দিয়ে আঘাত করে; আর সে কারণে রেফারি ননী বসাক তাকে মাঠ থেকে বের করে দেন। শেষ বাঁশি বাজার আগ মুহূর্তে আবারও ওমর বিপক্ষ দলের বক্সে ঢুকে আব্বাসের হ্যাটট্রিকের সুযোগ করে দিলে আব্বাস গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে; সেই সাথে ওয়ান্ডারার্স ৪-২ গোলে ইপিআইডিসিকে হারিয়ে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
১২-৮-৬৬ শামসুর জোড়া গোলে সেমিফাইনালে ভিক্টোরিয়া পরাজিত হয়। মোহামেডান ১৪ আগস্ট ওয়ান্ডারার্সের মুখোমুখি হয়। ভাল ফুটবল দেখার আশায় মাঠে প্রচুর দর্শক উপস্থিত হয়েছিল কিন্তু দু’টিমের খেলোয়াড়রা রাফ এবং টাফ খেলতে গিয়ে গায়ের বল প্রয়োগ করলে খেলার সৌন্দর্য হারিয়ে গিয়েছিল। যা দেখে দর্শকরা হতাশ হয়েছিলেন। খেলোয়াড়রা স্বাভাবিক খেলার পরিবর্তে ধাক্কাধাক্কি, লাথি মারা সবই চলছিল মাঠে। রেফারি ঈশা খান খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে মোহামেডানের আবদুল্লাহকে ভিক্টোরিয়ার নাজির ঘুষি মারলে রেফারি দুজনকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করে দেন। এরপর থেকে ভিক্টোরিয়া এলোমেলো খেলতে থাকে। আক্রমণভাগে একমাত্র ইউনুস পরিশ্রম করে খেলে, কোনপ্রকার দলের কাছ থেকে সহযোগিতা না পেলে তার পরিশ্রম কোন কাজে আসেনি। ইউনিভার্সিটি টিমের ভাইস ক্যাপ্টেন প্রতাপ হাজরাকে মোহামেডানের রাইট আউট পজিশনে খেলতে দেখে পত্রিকা বিরূপ মন্তব্য করেছিল। প্রথমার্ধের ৩০ মিনিটে শামসুর মাটি কামড়ানো কিক ভিক্টোরিয়ার গোলরক্ষক রানা ধরতে ব্যর্থ হলে আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। মুসার একটি সুন্দর থ্রু পাস শামসু ধরে দর্শনীয় গোল করে আমাদেরকে ২-০ গোলের জয় এনে দেয় এবং দলকে ফাইনাল খেলার সুযোগ করে দেয়।
রোববার ১৪ আগস্ট আজাদী দিবস ফুটবল ফাইনাল। ছুটির দিনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। শক্তিশালী দুটো টিম মোহামেডান এবং ওয়ান্ডারার্স, দেশসেরা খেলোয়াড়দের ভিড়, স্বাভাবিকভাবে দর্শকদের প্রত্যাশা একটি সুন্দর ফুটবল দেখার। কিন্তু দু’দলের খেলোয়াড়দের অপরিকল্পিত এবং অগোছালো ফুটবল দেখে দর্শকরা হতাশ হয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। এমনিতেই মোহামেডান-ওয়ান্ডারার্স খেলা মানেই চরম উত্তেজনা। তার ওপর যদি খেলোয়াড়দের দৈহিক শক্তি যোগ হয়, তাহলে আকর্ষণীয় খেলা আর থাকে না। তাই রেফারি মাসুদুর রহমান একপর্যায়ে দু’টিমকে ডেকে সতর্ক করে দেন। আমরা তুলনামূলকভাবে ভাল খেলছিলাম। কয়েকবার আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমাদের লেফট ব্যাক আসলাম উঁচু করে বিপক্ষ দলের বক্সের ভেতর বল মারলে ওয়ান্ডারার্সের স্টপার মোবাশ্বের ফ্লাইট মিস করলে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু বল আয়ত্তে নিয়ে গোলপোস্টে মেরে হাকিমকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে গেলে খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় ২৫ মিনিটে আমাদের লেফট আউট মুসা ওয়ান্ডারার্সের গোলকিপার হাকিমকে বিপজ্জনকভাবে ফাউল করলে রেফারি মাসুদুর রহমান মুসাকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করেন। শক্তিশালী ওয়ান্ডারার্স টিমের বিপক্ষে দশজন নিয়ে খেলতে আমাদেরকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। রহমতউল্লার একটি থ্রু পাস ওমরের কাছে গেলে ওমর সেটাকে ধরে গোলে রূপান্তরিত করে। ফলে খেলা ১-১ গোলে ড্র। শেষ পর্যন্ত ফলাফলের কোন পরিবর্তন না হওয়ায় উভয় দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। প্রাদেশিক এসেম্বলির স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। আজাদী দিবস ফুটবলের একক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন না করতে পারলেও লটারির মাধ্যমে প্রথম ছ’মাস কাপ রাখার অধিকার পেয়ে আমাদের সমর্থকরা অত্যন্ত খুশী হয়ে মাঠ ত্যাগ করেছিলেন।
মোহামেডান : হাশেম দীন (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব আলী এবং আসলাম, পিন্টু এবং গফুর, প্রতাপ, আবদুল্লাহ শামসু, বশীর এবং মুসা।
ওয়ান্ডারার্স : হাকিম (গোলরক্ষক), আলাউদ্দিন, খামিশা এবং দেবীনাশ, হাসান এবং আবিদ, রহমতউল্লাহ, ওমর, আব্বাস, আসলাম এবং হাফিজ।
রেফারি : মাসুদুর রহমান। # (ক্রমশ.)
(চৌষট্টি) ১৬ ডিসেম্বর
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব তাদের রিটার্ন লীগের খেলা শুরু করেছিল (২৪-৭-৬৬) প্রথম পর্বের মতই দাপটের সাথে খেলে পুলিশকে ৬-০ গোলে পরাজিত করার মাধ্যমে। খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল দেশের দুই কৃতী ফরোয়ার্ড ওমর এবং আব্বাসের জোড়া হ্যাটট্রিক। খেলা আরম্ভ হতেই ইউনুসের একটি থ্রু পাস ওমর ধরে তা থেকে সুন্দর একটি গোল করে। এরপর আব্বাসের দেয়া পাসের দ্বারা ওমর দ্বিতীয় গোল করলে হ্যাটট্রিকের জন্য পুরো ফরোয়ার্ড লাইন ওমরের সহযোগিতায় নেমে পড়ে এবং গাজীর একটি লব থেকে হেড করে ওমর তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। বিরতির পূর্বে আব্বাস দলের পক্ষে চতুর্থ গোল এবং বিরতির পর দলের অন্য কাউকে সুযোগ না দিয়ে দু’গোল করে হ্যাটট্রিক করতে সক্ষম হয়েছিল। সেদিনের অপর খেলায় সাহাবুদ্দিন এবং শারফুদ্দিনের দেয়া গোলে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনারিকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল। রহমতগঞ্জ প্রথম রাউন্ডে ইপিআইডিসি টিমের কাছে ০-৩ গোলে হেরেছিল এবং রিটার্ন লীগে (২৫-৭-৬৬) তারা ইপিআইডিসিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। ইপিআইডিসির এই পরাজয়ে তাদের লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ধুলায় মিশে যায়। তিনটি হার ও একটি ড্র তাদের লীগ দৌড় থেকে বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। রহমতগঞ্জের গোলরক্ষক অনাথ থেকে শুরু করে ১১ নম্বর নয়া পর্যন্ত সবাই পরিশ্রম করে ম্যান টু ম্যান খেলেছিল বলেই এই সফলতা। ইপিআইডিসির ডিফেন্স সেদিন ছিল সেকি, একে অন্যের সাথে সমঝোতার অভাব, পুরো টিমের পারফরমেন্স ছিল নিম্নমানের। প্রথমার্ধের শেষের দিকে নাজির গোল করে রহমতগঞ্জকে এগিয়ে নেয়। এর পরপরই টিপু গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করলে ইপিআইডিসি ০-২ পিছিয়ে পড়ে। হাফ টাইমের বাঁশির আগ মুহূর্তে হাবিব দর্শনীয় একটি গোল করে গোলের ব্যবধানটা কমিয়ে আনে (২-১)। দ্বিতীয়ার্ধে আবদুল্লাহ আকবর ইপিআইডিসির পক্ষে গোল করলে খেলায় সমতা আসে (২-২)। সাথে সাথে খেলায় গতি এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা জমে ওঠে। এমনি ধারায় খেলা শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। রহমতগঞ্জের লেফট আউট নয়া পোস্টের কাছে একটি বল পেয়ে আচমকা বুলেটের মত শট পোস্টে মেরে স্বপনকে (গোলরক্ষক) পুতুলের মত দাঁড় করিয়ে দিয়ে দলকে জয় এনে দেয়। সেদিনের অপর খেলায় প্রেসের মাহমুদ এবং শিবলির দেয়া দুটি গোলের বিপরীতে আজাদের নজরুল একটি গোল করায় প্রেস ২-১ গোলে জয়ী হয়। পরদিন ফায়ারের বিরুদ্ধে মিন্টুর একমাত্র গোল ভিক্টোরিয়াকে জয় এনে দিয়েছিল।
অপরাজিত মোহামেডান রিটার্ন লীগ শুরু করেছিল দুর্বল রেল টিমের বিপক্ষে কষ্টের দু’গোলের জয় দিয়ে। গতবারের চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে আমাদের অধিক গোলে জয়লাভ করা উচিত ছিল কিন্তু রেল দল হাফ টাইম পর্যন্ত আমাদেরকে মাত্র ১ গোলে বেঁধে রেখেছিল। লীগের প্রথম পর্বে আমরা তাদেরকে ৬-০ গোলে পরাজিত করেছিলাম। আমরা ২৭ মিনিট পর্যন্ত রেল দলের ওপর আক্রমণের ঝড় তুলেও গোল করতে পারিনি। প্রায় ৩০ মিনিটের সময় আমাদের শামসু রেল দলের গোলরক্ষক নূর মিয়াকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। বিরতির পর ১০ মিনিটের সময় আবদুল্লাহ খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে হেড দ্বারা গোল করলে আমরা স্বস্তি ফিরে পাই।
রেল দল : নূর মিয়া (গোলরক্ষক), আবদুল সামাদ, নিরঞ্জন এবং মোজাম্মেল, শাহ মোহাম্মদ এবং মানিক বর্মণ, আজাদ, কুতুবুদ্দিন, ওয়াসি, ইয়াকুব এবং মুকুল। রেফারি- ফায়ার সার্ভিসের নাজার মোহাম্মদ।
সেদিনের অপর খেলায় দুর্বল স্টেশনারি রহমতগঞ্জকে হারিয়ে চমক দিয়েছিল। যে রহমতগঞ্জ লীগের প্রথম পর্বে ৫-০ গোলে তাদের হারিয়েছিল এবং শক্তিশালী ইপিআইডিসিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল (২৫-৭-৬৬), সেই স্টেশনারি সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াসের ১ গোলের কাছে হার মানতে হয়েছিল। ২৯-৭-৬৬ তারিখে ওয়ান্ডারার্স তাদের শক্তি-সামর্থ্যরে মহড়া দিয়ে ওয়ারীকে ৭-২ গোলে পরাজিত করেছিল। ওমর আব্বাস প্রত্যেকের তিন গোল তাদের ক্রীড়ানৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছিল আর ১ গোল করেছিল আসলাম। ওয়ারীর চতুর সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ এবং রাইট-ইন জামিল আক্তার দু’গোল শোধ করে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল।
৩০-৭-৬৬ ইপিআইডিসির আজাদের বিরুদ্ধে ৬-১ গোলের সহজ জয়। খেলাটি ছিল একতরফা। ইপিআইডিসি যতগুলো গোলের সুযোগ পেয়েছে, সবগুলো কাজে লাগিয়েছে। হাশিম ১৮ এবং ২৪ মিনিটে দুটো গোল করে এবং টুলু সেটাকে ৩-০ গোলে নিয়ে যায়। বিরতির পর মারী দা দর্শনীয় গোল করে দলকে ৪-০ গোলে পৌঁছে দেন। আবদুল্লাহ আকবর পঞ্চম গোল করার পর মারী দা দলের গোলসংখ্যা অর্ধডজনে পরিণত করেন। আজাদের মানিক বর্মণ ১টি গোল শোধ দিতে পেরেছিল।
আজাদ : ইয়ার মোহাম্মদ (গোলরক্ষক), আহমেদ মোবাশ্বের এবং আব্দুর রব। রাধা এবং লালু, নজরুল, নাসিম, মানিক বর্মণ, সাবের এবং বাটু।
দ্বিতীয়ার্ধে জনির একমাত্র গোলে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে পিবব্লউডি পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল (৩১-৭-৬৬)। প্রথম পর্বে পিডব্লিউডি ৫-১ গোলে ভিক্টোরিয়াকে উড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু রিটার্ন লীগে ভিক্টোরিয়া বিরতি পর্যন্ত তাদেরকে পোস্টের কাছে ভিড়তে দেয়নি। তাদের রক্ষণভাগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বিপক্ষ আক্রমণ রুখে দিচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক গোলের হার মেনে নিতে হয়েছিল এবং এটি ছিল পিডব্লিউডি টিমের কষ্টের জয়।
ভিক্টোরিয়া : দুলু আফেন্দি (গোলরক্ষক), আবদুল্লাহ, আলী মোহাম্মদ এবং নরেশ, হাশেম এবং মাসুদ, ইউনুস, মনসুর, আজিম, ফতেহ মোহাম্মদ এবং মিন্টু সরকার।
১ আগস্ট শক্তিশালী ওয়ান্ডারার্স ক্লাব দুর্বল রেল দলকে পরাজিত করতে প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। এ খেলাটি গত ১৩ জুলাই বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিল। পুনরায় অনুষ্ঠিত খেলায় ওয়ান্ডারার্স ক্লাব প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। ইউসুফের থ্রু পাসে ওমর দলের পক্ষে প্রথম গোল করেছিল। এর কিছুক্ষণ পর আসলাম গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছিল। দু’গোলে পিছিয়ে পড়া রেল দল বিরতির পর ঘুরে দাঁড়ায়। রেল দলের লেফট আউট নিতাই ওয়াসির উদ্দেশ্যে একটি বল বানিয়ে দিলে সেটা থেকে ওয়াসি গোল করে গোলের ব্যবধান কমিয়ে আনে এবং এর পাঁচ মিনিট পরই হিরনের কাছ থেকে বল পেয়ে নিতাই একক প্রচেষ্টায় গোল করে ওয়ান্ডারার্সের সাথে ২-২ গোলে সমতা আনে। সে সময় ওয়ান্ডারার্স চাপের মধ্যে পড়ে যায় এবং পুরো টিম তখন রক্ষণাত্মক খেলতে শুরু করে। অপরদিকে রেল দল পরপর দুটো গোল করে জয়ের নেশায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওয়ান্ডারার্স দলের অভিজ্ঞতার কাছে তারা সফল হতে পারেনি। উপরšুÍ রহমত উল্লাহর সুন্দর একটি পাস দ্বারা ইউসুফ গোল করে টিমকে স্বস্তি এনে দিয়েছিল এবং শেষ বাঁশির মিনিটখানেক আগে আব্বাসের লব থেকে আসলাম হেডের সাহায্যে দর্শনীয় গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে ৪-২ গোলে জয় এনে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিস ২-১ গোলে ওয়ারীকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের তসলিম এবং আশরাফের গোলের বিপরীতে ওয়ারীর তপন একটি গোল শোধ করতে পেরেছিল। ২-৮-৬৬ তারিখে মোহামেডান ৬-০ গোলে প্রেসকে উড়িয়ে দিয়েছিল। খেলাটি একতরফা নিম্নমানের হওয়ায় পত্রিকার মন্তব্য এরকম ছিল যে, খেলার বিবরণ পত্রিকায় ছাপা মানে সময়ের অপচয়। প্রেস দল সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘উদ্দেশ্যবিহীন এ দলের খেলা শুধু মাঠে দৌড়াদৌড়ি ছাড়া আর কিছু নয়, যে কোন তৃতীয় ডিভিশনের টিম ও এটিমের চাইতে ভাল খেলবে।’ মোহামেডান টিমে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। হাফে গফুরের পরিবর্তে কাদেরকে খেলানো হয়েছিল। আাক্রমণভাগে শামসুর বদলে কামাল এবং আমার জায়গায় এএন খান খেলেছিল। এএন খান হাঁটুর আঘাতজনিত কারণে তার সুনামের মত করে খেলতে পারেনি। মুসার মাপা পাসে প্রতাপ পা লাগিয়ে প্রথম গোল করেছিল। মুসা তার একক প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় গোল করে। এরপর কামাল এবং আবদুল্লাহ পরপর দুটি গোল করলে মোহামেডান বিরতির আগে ৪-০ এগিয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে এএন খানের কাছ থেকে বল পেয়ে মুসা সজোরে কিকের মাধ্যমে পঞ্চম গোল করলে আবদুল্লাহ সেটাকে অর্ধডজনে পূর্ণ করে। ৩-৮-৬৬ তারিখে ওয়ান্ডারার্সের আসলাম ওমরের কাছ থেকে বল পেয়ে গোললাইন থেকে মাপা শটে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। এর কিছুক্ষণ পর আব্বাস মাঝ মাঠ থেকে একটি বল নিয়ে বিপক্ষ কয়েকজনকে কাটিয়ে গোলরক্ষককে একা পেয়ে তাকে বিট করতে গিয়ে বল বাইরে মেরে একটা নিশ্চিত গোল মিস করেছিল। পুনরায় আব্বাস সম্মিলিত আক্রমণ থেকে একটি গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয়। বিরতির পর ওমর সুন্দর একটি গোল করলে ওয়ান্ডারার্স ৩-০ গোলে রহমতগঞ্জকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। অপর খেলায় ইপিআইডিসির ৯-১ গোলের চাপায় পরে স্টেশনারি বিধ্বস্ত হয়েছিল। জব্বর ৩, হাশেম ২, এবং মারী, মুসা, আবদুল্লাহ আকবর, টুলু এক গোল করেছিল। ইলিয়াস একটি গোল করে স্টেশনারির মান বাঁচিয়েছিল। ৩ আগস্ট পিডব্লিউডি ৩-০ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল এবং অপর খেলায় ওয়ারী ও আজাদ ২-২ গোলে ড্র করে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ৬-৮-৬৬ তারিখে ইপিআইডিসি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল পুলিশ টিমকে খেলার শেষ মিনিটে জয়সূচক গোল করে। পুলিশ টিম প্রচন্ড লড়াই করে ৪-৩ গোলে হার মেনে নিয়েছিল। হাফ টাইমে ইপিআইডিসি ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল। হাশিম এবং জব্বর দ্রুত দুটো গোল করার পর ইপিআইডিসি আরো কয়েকটি গোল মিস করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ১৫ মিনিটে পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড সাত্তার গোল করলে ইপিআইডিসি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে এবং আক্তার দ্বিতীয় গোল করে সমতা আনলে ইপিআইডিসি চাপের মধ্যে পড়ে যায়। তখন খেলায় বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। মুসার গোল ইপিআইডিসিকে পুনরায় এগিয়ে দিয়েছিল; তবে খুব অল্প সময়ের জন্য। কারণ পুলিশের নাজির গোল করে ৩-৩ গোলে ড্র করে দিয়েছিল। খেলার মিনিটখানিক বাকি। ফলাফল ড্র ভেবে দর্শকরা মাঠ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত, তখনই দ্রুতগতির রাইট আউট সলিম উল্লাহ বল নিয়ে তার গতিকে ব্যবহার করে পোস্টে কিক করলে ইপিআইডিসি শিবির গোল বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তারপরই রেফারির শেষ বাঁশি। # (ক্রমশ.)
(পঁয়ষট্টি) জানুয়ারি-১
আজাদী দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষে পুনরায় লীগের খেলা শুরু হয়েছিল ১৫ আগস্ট থেকে রহমতগঞ্জ এবং ওয়ারীর খেলা দিয়ে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রহমতগঞ্জ ওয়ারীকে ৩-২ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। রহমতগঞ্জের শাজাহানের ২ গোল এবং ওয়ারীর নিশিথের ২ গোলের সমতাকে ভেঙ্গে দিয়েছিল টিপুর একটি গোল। সেদিনের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং রেলের বিপক্ষে নজরুলের ২ গোল এবং দেবুর ১ গোলের সুবাদে ৩-০ জয়লাভ করেছিল। পরদিন আমরা পুলিশ টিমকে ৪-১ গোলে হারিয়ে জয়ের চাকাকে সচল রেখেছিলাম। মুসা করেছিল ২ গোল আর গফুর এবং আমি একটি করে গোল করলে পুলিশের নবী চৌধুরী একটি গোল শোধ দিয়েছিলেন। সেদিন ফায়ার সার্ভিসও রেল টিমকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল, যার গোলগুলো শাহাবুদ্দিনের ২ গোল আর একটি করে গোল আসে আশরাফ এবং তসলিমের কাছ থেকে। রাফ এন্ড টাফ খেলায় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ৫-১ গোলে জয়লাভ করে। ওমরের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। মারাত্মক ফাউল করে খেলার জন্য দু’দলের দুজন করে চারজনকে মাঠ থেকে বহিষ্কার। একটি সুন্দর ফুটবল খেলা দেখার আশায় ১৭ আগস্ট স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু দু’দলের খেলোয়াড়রা খেলা শুরু থেকে দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে খেলে খেলার ছন্দ এবং সৌন্দর্য নষ্ট করে উপস্থিত দর্শকদের হতাশ করেছিল। মাঠে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, ধাক্কাধাক্কি, কিল-ঘুষি সবই চলছিল কিন্তু রেফারি ননী বসাক খেলাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলেন না।
খেলার ষষ্ঠ মিনিটে ওয়ান্ডারার্স কাবের ওমর গোল করে দলকে এগিয়ে দেয় কিন্তু জয়টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পাঁচ মিনিট পর ভিক্টোরিয়ার ইউনুস গোল শোধ করে দিলে খেলায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এমনি ধারায় খেলা যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভিক্টোরিয়ার পেনাল্টি বক্সের ভেতর তাদের খেলোয়াড় আবদুল্লাহ আকবর হাত দিয়ে বল ধরলে রেফারি ননী বসাক পেনাল্টির নির্দেশ দেন। পেনাল্টি থেকে ওমর গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। পেনাল্টি নিয়ে ভিক্টোরিয়ার হাসান রেফারির সাথে অসদাচরণ করলে রেফারি তাকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করে দেন। খেলার প্রথমার্ধের শেষদিকে ওয়ান্ডারার্সের আলী হাফিজ ওমরের উদ্দেশে একটি সুন্দর পাস দিলে তা থেকে ওমর গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে। ভিক্টোরিয়ার খালিদ এবং ওয়ান্ডারার্স কাবের রহমতউল্লাহ খেলার একপর্যায়ে হাতাহাতিতে লিপ্ত হলে রেফারি তাদেরকে মাঠ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। মাঠে আর স্বাভাবিক খেলা ফিরে আসেনি, এরই ভেতর আলী হাফিজ দলের পক্ষে চতুর্থ গোল করে এবং পঞ্চম গোলটি আসে আব্বাসের পা থেকে।
১৮-৮-৬৬ তারিখে পিডব্লিউডি সবাইকে অবাক করে দিয়ে শক্তিশালী ইপিআইডিসিকে ৪-১ গোলে পরাজিত করেছিল। বিরতির পূর্বে ইপিআইডিসির এক গোলের বিপক্ষে পিডব্লিউডি ২ গোল করে এগিয়ে থাকে। লীগের প্রথম পর্বের খেলায় তারা ২-২ গোলে ড্র করেছিল। এ দিনটিতে ইপিআইডিসি হতাশাজনক খেলা প্রদর্শন করেছিল। আক্রমণভাগে জববর এবং হাসিম সাধ্যমত খেলার চেষ্টা করলেও বাকি খেলোয়াড়রা ছিল ব্যর্থ। আবদুল্লাহ আকবর এবং মুসা খুব বাজে খেলেছিল। অপরপক্ষে পিডব্লিউডি চমৎকার খেলা প্রদর্শন করে মাঠে তারা সেরা দল হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিল। তারা বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ নষ্ট না করলে আরো বেশি গোলে জয়লাভ করতে পারতো। খেলা আরম্ভ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গনির দেয়া গোলে পিডব্লিউডি এগিয়ে যায়। তবে অল্প সময়ের ভেতর সে গোল জব্বর শোধ করে দিলে খেলায় ১-১ গোলের সমতা আসে এবং খেলা বেশ জমে ওঠে। পিডব্লিউডির খেলোয়াড়রা পরিশ্রম করে খেলে বলের নিয়ন্ত্রণ তাদের মধ্যে রেখে নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করে খেলতে থাকে এবং সুন্দর সুন্দর আক্রমণ রচনা করে ইপিআইডিসির ডিফেন্সকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। আমিন অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং বুদ্ধি দিয়ে খেলে পিডব্লিউডির আক্রমণগুলোকে ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। কিন্তু গনির একটি পাসে রাইট আউট কানুর দর্শনীয় গোলকে আটকাতে পারেনি। বিরতির আগে পিডব্লিউডি ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। বিরতির পর পিডব্লিউডি খেলার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে রাখতে সক্ষম হয় এবং খেলার ধারা অনুযায়ী আরো দুটো গোল দিয়ে হালি পূর্ণ করে। ৭ মিনিটের ব্যবধানে মনজুর এবং জানি গোল দুটি করেছিল।
দুই টিমে সেদিন যারা খেলেছিল
পিডব্লিউডি : মতিন (গোলরক্ষক), হামিদ, সালেহ এবং ওয়াহিদ, লাল মোহাম্মদ এবং মালাং, কানু, গনি, গুপ্তা, জানি এবং মনজুর।
ইপিআইডিসি : স্বপন (গোলরক্ষক), মোরশেদ, আমিন ও সাইফুদ্দিন, আবদুল্লাহ আকবর ও মুসা, সলিমুল্লাহ, হাশিম, ইমাম বক্স, জব্বার এবং টুলু।
২০-৮-৬৬ তারিখে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দুর্বল স্টেশনারি টিমকে অতিকষ্টে ৩-২ গোলে হারিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল। শেষ বাঁশির মিনিটখানিক আগে আসলাম দুর্দান্ত কিক দ্বারা গোল করে ২-২ গোলের সমতা ঘুচিয়ে দলকে পূর্ণ পয়েন্ট পাইয়ে দিয়েছিল। লীগের প্রথম পর্বে ওয়ান্ডারার্স ৭-০ গোলে স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। খেলা শুরু হলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসলাম সুন্দর প্লেসিং শট দ্বারা গোলরক্ষক বাচ্চুকে পরাস্ত করে ওয়ান্ডারার্সকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। স্টেশনারির সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াসের একটি দুর্বল শট বারে লেগে গোলপোস্টে ঢুকে পড়লে খেলায় ১-১ গোলে ড্র হয়। রহমত উল্লাহ সুন্দর একটি বল বানিয়ে দিলে ওমর গোল করে আবার ওয়ান্ডারার্সকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। একক প্রচেষ্টায় ইলিয়াস আরো একটি গোল করে খেলায় ২-২ গোলের সমতায় ফেরায়। খেলা নিশ্চিত ড্র, মাত্র দু’এক মিনিট বাকি খেলা শেষে হতেÑ এমন অবস্থায় গোলপোস্টে আসলামের আচমকা জোরালো শটটি ওয়ান্ডারার্সকে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় প্রেস পুলিশকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ৬-১ গোলের বড় জয় পেয়েছিল ওয়ারী তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভিক্টোরিয়া কাবের বিরুদ্ধে। ওয়ারী সুসংহত আর শক্তিশালী দল হিসেবে জয়লাভ করেছিল। তাদের গোলরক্ষক দুলু আফেন্দি থেকে শুরু করে ১১ নম্বর সুলতান প্রত্যেক খেলোয়াড় দলের জন্য খেলেছে। সবার বোঝাপড়া ছিল সুন্দর আর জয়ের প্রবল স্পৃহা তাদেরকে বিরতির আগেই ৪-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। খেলার ১০ মিনিটের মধ্যে তপনের কাছ থেকে বল পেয়ে ওয়ারীর কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ দলকে এগিয়ে দেয়। জামিল আক্তার গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে। তপন করে ৩-০ আর নিশিথ সেটাকে এক হালিতে পরিণত করে দলের অবস্থা মজবুত করে দেয়। বিরতির পরপরই ভিক্টোরিয়ার লেফট আউট নিতাই একটি গোল করে (৪-১) ব্যবধান কমায়। নিশিথ আবারও গোল করে তার ৩ গোল আর দলের পক্ষে পঞ্চম গোল করে এবং গোলের সংখ্যা অর্ধডজন পূর্ণ করে তপন। সেদিন অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিসের তসলিম এবং রহমতগঞ্জের সুলতান একটি করে গোল করলে দু’টিম পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয়। ২২ আগস্ট ফুটবল লীগের ড্র করার দিন। গোলশূন্য ড্র করেছিল ভিক্টোরিয়া আর পুলিশ এবং ২-২ গোলের ড্র করেছিল স্টেশনারি ও রেল। স্টেশনারির সিরাজ এবং স্বপন গোল করলে রেলের গোল করেছিল আজাদ এবং মুকুল। সেদিনটি (২৩-৮-৬৬) ছিল কেবলই আমাদের লেফট আউট মুসার। আজাদের বিরুদ্ধে সবগুলো গোলই সে করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল মাত্র ১৩ মিনিটে। খেলার ২য় মিনিটে মুসা গফুরের লব থেকে হেড দ্বারা প্রথম গোল করেছিল। এর চার মিনিট পর শামসুর পাসে দ্বিতীয় গোল করলে আমরা সবাই তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করার জন্য সহযোগিতায় নেমে পড়ি। আমাদের আক্রমণে আজাদ অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। একটার পর একটা সুযোগ নষ্ট করে মুসা শেষ পর্যন্ত একটা ফ্রি-কিক থেকে গোল আদায় করে নেয় এবং তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে খেলার প্রথমার্ধেই।
২৪-৮-৬৬ এদিন ফুটবল লীগের বড় দুটো টিম খেলেছিল লীগের দুর্বল দুটো টিমের বিরুদ্ধে। ওয়ান্ডারার্স ৩-০ গোলে জয়লাভ করেছিল প্রেসের বিরুদ্ধে। তবে ইপিআইডিসি জয় করতে পারেনি। ০-০ ড্র করেছিল রেলের সাথে। ওয়ান্ডারার্সের ওমর ১ গোল করলে আব্বাস করেছিল ২ গোল। ২৫-৮-৬৬ পিডব্লিউডি ২-১ গোলে রহমতগঞ্জকে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। লীগের প্রথম পর্বের খেলায় রহমতগঞ্জ পিডব্লিউডিকে একই ব্যবধানে হারিয়েছিল। ০-১ গোলে পুরো প্রথমার্ধ পিছিয়ে থেকে পিডব্লিউডি দ্বিতীয়ার্ধে পরপর দুটো গোল করে পূর্ণ ২ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত মাঠে দুটি সমশক্তির টিম ভাল খেলা উপহার দিতে পারেনি। রহমতগঞ্জ খেলার ১৫ মিনিটে রাইট আউটের একটি কর্নার কিক থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড সুলতান হেড দিয়ে গোল করলে রহমতগঞ্জ খেলার ১৫ মিনিটে ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। রহমতগঞ্জে গোলসংখ্যা বৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়েও সফল হতে পারেনি। বিরতির পরপরই পিডব্লিউডি দলের সালেহ’র প্রায় ৩০/৩৫ গজ দূর থেকে একটি বাঁকানো শট রহমতগঞ্জের গোলরক্ষককে হতবাক করে জালে জড়িয়ে যায়। খেলায় ১-১ গোলে সমতা আসলে খেলায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তখন পিডব্লিউডি খেলায় ফিরে আসে। উভয় টিম আক্রমণ করে খেলে। খেলার এ অবস্থায় পিডব্লিউডির গনি টিমের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে সেটাই ছিল ম্যাচ উইনিং গোল। সেদিনের অপর খেলায় পুলিশ এবং স্টেশনারি ০-০ ড্র করেছিল।
সেদিন (২৬-৮-৬৬) ফুটবল লীগে মোহামেডানের জয়ের ধারাকে রুখে দিয়েছিল ইপিআইডিসি। তারা আমাদেরকে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। মোট ৬ গোলের মধ্যে সমান ভাগ বসিয়ে ৩ গোল শুধু করেনি বরং জয়ের সুযোগও করে নিয়েছিল। লীগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান ইপিআইডিসিকে প্রথম পর্বে ২-১ গোলে হারিয়েছিল কিন্তু চলতি লীগে আমরা তাদের কাছে প্রথম পয়েন্ট হারালাম। খেলার শুরুটা আমরা চমৎকার করেছিলাম। প্রথমার্ধেই আমরা ৩-১ গোলে এগিয়ে সুবিধাজনক স্থান করে নিয়েছিলাম। নইলে দ্বিতীয়ার্ধে আমরা যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিলাম, তাতে সৌভাগ্যক্রমে আমরা পরাজয় এড়িয়ে ফিরতে পেরেছিলাম। আমাদের রক্ষণভাগের স্তম্ভ তোরাব আলী সেদিন ছিল ব্যর্থ। জহির ভাইও ভাল খেলতে পারছিলেন না। শুধু আমাদের লেফট ব্যাক আসলাম দৃঢ়তার সাথে খেলে ইপিআইডিসির আক্রমণগুলোকে রুখে টিমকে আগলে রেখেছিল। খেলার ১০ মিনিটের মধ্যে জব্বারের জোরালো শট হাশেম দীনকে পরাস্ত করে সাইডবারে লেগে গোলপোস্টে ঢুকে যায়। গোল খেয়ে আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম এবং পরমুহূর্তে আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকি। অল্প সময়ের মধ্যে সে সুযোগ চলে আসে। মুসার মারা ফ্রি-কিক বিপক্ষ দলের গোলমুখে পড়লে প্রতাপ সেটাকে আয়ত্তে এনে গোল করে দলকে ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়। এর অল্প পর ইপিআইডিসির হাশিমের কিক আমাদের গোলপোস্টের বাইরে চলে গেলে তারা একটি গোল থেকে বঞ্চিত হয়। এর ১০ মিনিট পর ইপিআইডিসির গোলরক্ষক স্বপন একটি কমন বল ধরতে শামসুর দিকে ছুটে গেলে শামসু পুশ করে মুসাকে দিলে মুসা গোল করলে আমরা ২-১ এগিয়ে যাই। মুসার মারা একটি ফ্রি-কিক ধরে আমাদের রাইট আউট প্রতাপ সেটাকে গোলে রূপান্তরিত করলে আমরা বিরতির আগেই ৩-১ গোলের মজবুত স্থান করে নেই।
বিরতির পর খেলা অনেকটা আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে। মনে হচ্ছিল ইপিআইডিসি হার মেনে নিয়ে খেলায় মনোযোগ দিচ্ছিল না। কিন্তু হাশিম এবং জব্বর খেলাকে চাঙ্গা করে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। হাশিম তার একক প্রচেষ্টায় দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় একটি দর্শনীয় গোল করে ইপিআইডিসিকে জাগিয়ে তোলে। তাদের আক্রমণের ধার বেড়ে যায়। উল্টো আমরা চাপে পড়ে গিয়েছিলাম এবং খেলার ফলাফলকে ৩-২ গোলের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম। খেলার শেষ ৫ মিনিট ইপিআইডিসি আমাদের ওপর চেপে বসে এবং তাদের ক্যাপ্টেন মারী দা সুন্দর একটি গোল করে ৩-৩ গোলের সমতা এনে দেন দলকে। শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ৩-৩ গোলের ড্র মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
মোহামেডান : হামেশ দীন (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব আলী এবং আসলাম, পিন্টু ও গফুর, প্রতাপ, আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর ও মুসা।
ইপিআইডিসি : স্বপন (গোলরক্ষক), সলিমউল্লাহ, আমিন এবং সাইফুদ্দিন, আবদুল্লাহ আকবর এবং মুসা, প্রতুল হাশিমউদ্দিন, মারী, জব্বর ও টুলু। রেফারি : মাসুদুর রহমান। #
জানুয়ারি-১৬
(ছেষট্টি)
ওয়ারী ৪-১ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল। ওয়ারীর পক্ষে গোল করেছিল জামিল আক্তার ২ নিশিথ এবং ইসলাম একটি করে। আর প্রেসের ভুট্টো একটি গোল শোধ দিয়েছিল। ২৭-৮-৬৬ তারিখে ফায়ার ৪-০ গোলে পিডব্লিউডিকে হারিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। আশরাফ, আবুল, শাহাবুদ্দিন এবং তসলিম গোলগুলো করেছিল। অপর খেলায় স্টেশনারি একমাত্র গোলে আজাদকে পরাজিত করেছিল। পরদিন ওয়ান্ডারার্স লীগের অন্যতম দুর্বল টিম রেলওয়ের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে মূল্যবান একটি পয়েন্ট হারিয়েছিল। তাদের পক্ষে গোল করেছিল ওমর এবং আব্বাস আর রেলের পক্ষে গোল করেছিল ওয়াসিম ও মুকুল। অপর খেলায় সাত্তারের একমাত্র গোলে পুলিশ রহমতগঞ্জকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। ২৯-৮-৬৬ তারিখে আমাদের ৮-০ গোলের ঝড়ে ওয়ারী উড়ে গিয়েছিল। মুসা হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল, শামসু ২ গোল, রসুল বক্স এবং আমার একটি করে গোল ছিল। অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া ২-১ গোলে রেল দলকে হারিয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স আসলামের দেয়া একমাত্র গোলে পিডব্লিউডিকে ১-০ গোলে হারিয়ে একটি শক্ত বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। ইপিআইডিসি ৬-১ গোলে হারিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসকে। যার গোলগুলো হাশিম ২, জব্বর ২, গফুর বেলুচ ১, হাবিব ১ এর পা থেকে এসেছিল। অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া আজিমের দেয়া একমাত্র গোলে স্টেশনারিকে পরাজিত করতে পেরেছিল। ২-৯-৬৬ তারিখে গফুর, মুসা, শামসু, রসুল বক্স এবং প্রতাপের করা গোলে আমরা রহমতগঞ্জকে ৫-০ গোলে হারিয়ে আমাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম।
৭-৯-৬৬ তারিখে আজাদ স্পোর্টিং হারের মানসিকতা নিয়ে খেলতে নেমেছিল। কারণ প্রথম পর্বে তারা ভিক্টোরিয়ার কাছে ৪-০ গোলে হেরেছিল। কিন্তু তাদের দেবু গোল করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং পুরো দল আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিক্টোরিয়ার ফতেহ মোহাম্মদ গোল করে ১-১ সমতা আনে। বিরতির পর দু’টিমই গোল করার জন্য জোর প্রতিযোগিতা চালায়। খেলার ২৫ মিনিটে ভিক্টোরিয়ার মাসুদ দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। আজাদ গোল শোধ করার জন্য পরিশ্রম করে খেলতে থাকে এবং খেলা শেষ হওয়ার মাত্র তিন মিনিট পূর্বে আবারও দেবু গোল করে দলকে ২-২ গোলে সমতায় ফেরায়। শেষ পর্যন্ত তারা ১ পয়েন্ট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। দিনের অপর খেলায় ভাগ্যের সহায়তায় ওয়ারী পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল আর রহমতগঞ্জ ভাল খেলেও ২-৩ গোলে হার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। খেলার ১০ মিনিটে ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড প্রথম গোল করেছিল কিন্তু সে গোল কিছুক্ষণের মধ্যে শোধ করে দিয়েছিল রহমতগঞ্জর লেফট আউট টিপু। সমমানের দুটো টিম জেতার জন্য জোর চেষ্টা চালাতে থাকে এবং টিপু আবারও গোল করে তার দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। এবারও নিশিথ গোল করে দলকে সমতায় ফেরায়। ২-২ গোলের ড্র দিয়ে খেলা শেষের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই ওয়ারীর লেফট-ইন বদরুল গোল করে দলের সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে ৩-২ গোলের জয় এনে দেয়।
৮-৯-৬৬ তারিখে মোহামেডান ৯-০ গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের ওপর। মুসা হ্যাটট্রিকসহ অর্ধডজন গোল করেছিল। মুসা এ নিয়ে লীগের চতুর্থ হ্যাটট্রিকের মালিক হয়েছিল। প্রথম পর্বে তারা হেরেছিল ৩-০ গোলে। সেদিনের ম্যাচে তোরাব আলী এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু টিমে ছিল না; তারপরও মোহামেডান ডজন গোল থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। খেলার শুরুতে ফায়ার কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল কিন্তু ১০ মিনিটেই আমার থ্রু পাসে মুসা তার গোল করা শুরু করে। কামালের দেয়া লব থেকে হেড করে ২য় গোল এবং আমার পাস থেকে গোল করে সে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেÑ যা ছিল লীগে তার চতুর্থ হ্যাটট্রিক। কামালের কাছ থেকে বল পেয়ে মুসা দলকে ৪-০ গোলে এগিয়ে দেয় আর আব্দুল্লাহ করে পঞ্চম গোল। মুসা তার একক প্রচেষ্টায় দলের জন্য অর্ধডজন গোল করে। কামাল সেটাকে ৭ নম্বর গোলে নিয়ে যায় এবং ৮/৯ মিনিট পরই মুসা দর্শনীয় একটি গোল করার মাধ্যমে তার করা গোলের সংখ্যা অর্ধডজনে পরিণত করে। সবাই যখন গোল করছিল, তখন আর আমি গোল করা থেকে পিছিয়ে থাকতে পারিনি; আমার গোলটাই ছিল দলের শেষ গোল এবং আমরা জিতেছিলাম ৯-০ গোলে।
কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথের হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোলের ওপর ভর করে ওয়ারী পুলিশের বিরুদ্ধে ৫-২ গোলের বড় জয় পেয়েছিল।
১০/৯/৬৬ : লীগ শিরোপা প্রত্যাশী ওয়ান্ডারার্স ফায়ার সার্ভিসের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে আরও এক পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। এতে তারা ৬ষ্ঠ পয়েন্ট হারিয়ে লীগের ২য় স্থানে থাকলেও তাদের লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রথম পর্বে ফায়ার ০-৪ গোলে পরাজিত হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস ম্যান টু ম্যান খেলে ওয়ান্ডারার্সকে তাদের আয়ত্তের মধ্যে রাখে। মোতালেব খুব দক্ষতার সাথে রহমতগঞ্জের গোলপোস্ট সামলাতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল যখন ওমর একটি বল ধরে একক প্রচেষ্টায় গোল করেছিল। বিরতির পর ফায়ার সার্ভিস নতুন উদ্যম নিয়ে খেলতে শুরু করে। এর ফলও তারা পেয়ে যায়। স্লিপারি মাঠে শারফুদ্দিনের সজোরে মাটি কামড়ানো শটটি হাকিমকে পরাস্ত করে দলকে ১-১ গোলে ড্র উপহার দেয়। প্রেসও ১-১ গোলে ড্র করেছিল স্টেশনারির সাথে। আমরা আরও একটি পয়েন্ট হারিয়েছিলাম পিডব্লিউডি টিমের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। খেলার পূর্বে দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছিল কায়েদে আজম মো. আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার আত্মার শান্তির জন্য। প্রথম পর্বে পিডব্লিউডি আমাদের কাছে ৩-০ গোলে হেরেছিল। কর্দমাক্ত মাঠে উন্নতমানের খেলা প্রদর্শন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া আমাদের স্কোরার শামসু না খেলায় স্কোর করার কাজটি আমরা সঠিকভাবে করতে পারছিলাম না। সহজ সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। অন্যদিকে পিডব্লিউডি প্রথম পর্বের চেয়ে অনেক উন্নত মানের খেলা খেলছিল এবং আক্রমণ চালিয়ে বেশ কয়েকটা গোল করার সুযোগও তারা সৃষ্টি করেছিল। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজা দু-দু’বার গোল করার সুযোগ নষ্ট করেছিল। গনিও একটি নিশ্চিত গোল মিস করেছিল। আমাদের গোলরক্ষক হাশিম দিন তার অনবদ্য ভাল খেলা দিয়ে আমাদেরকে হারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সেদিনের অন্য ম্যাচে ফায়ার ২-১ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল।
১৩/৯/৬৬ ওয়ান্ডারার্স ইপিআইডিসি কর্তৃক অপদস্থ। রিটার্ন লীগে ইপিআইডিসি এবং ওয়ান্ডারার্স টিমের চরম উত্তেজনাকর খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পূর্বে ওয়ান্ডারার্স খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। সে সময় ইপিআইডিসি ৪-১ গোলে অগ্রগামী ছিল। খেলা শেষ হওয়ার ১ বা ২ মিনিট বাকি থাকতে ওয়ান্ডারার্স রেফারির কাছে আলো স্বল্পতার জন্য প্রটেস্ট করে এবং খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে গোলরক্ষক হাকিম বল ধরে রেখে খেলায় বাধা সৃষ্টি করে। রেফারি বল ছেড়ে দিয়ে খেলাকে সচল রাখার অনুরোধ করে কিন্তু হাকিম খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। রেফারি তখন শেষ বাঁশি বাজিয়ে খেলা শেষ করেন। খেলার ১৬ মিনিটে ইপিআইডিসি রাইট আউট সলিমউল্লাহ ডান প্রান্ত থেকে লব করলে সেন্টার ফরোয়ার্ড হাবিব দর্শনীয় হেড করে গোল করে টিমকে ১-০তে এগিয়ে দেয়। এরপর তাদের লেফট আউট টুলু হাফ ভলি মেরে সুন্দর গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে। বিরতির ৪ মিনিট পর সলিমউল্লাহর পাস থেকে জব্বর তৃতীয় গোল করে দলকে ৩-০ নিয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের ২৪ মি. রহমতউল্লাহর একটি শট বিপক্ষ দলের পেনাল্টি এরিয়াতে পড়লে ইপিআইডিসির খেলোয়াড় হাত দিয়ে ধরলে রেফারি পেনাল্টি দেনÑ যা থেকে আসলাম গোল করে (৩-১)। প্রায় খেলা শেষের দিকে গড়াতে থাকে। এমন সময় ইপিআইডিসির হাশিম বুলেটের মত শট মেরে হাকিমকে পরাস্ত করে দলকে ৪-১ গোলে অগ্রগামী করে। সেদিনের অপর খেলায় রহমতগঞ্জ ৪-১ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে।
বদরুলের হ্যাটট্রিক ওয়ারীকে ৩-২ গোলে জিততে সাহায্য করেছিল। পিডব্লিউডির বিরুদ্ধে খেলার ২৩ মিনিটে নিশিথের পাস থেকে বদরুল প্রথম গোল করে। বিরতির পর লেফট ইন আজিজের কাছ থেকে বল পেয়ে জোরে শট করে তার দ্বিতীয় গোল করে। কিছুক্ষণ পর বদরুল তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে দলকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সুজার কাছ থেকে বল পেয়ে জানি একটি গোল শোধ করে। এর দশ মিনিট পর গনি দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। পিডব্লিউডি গোল শোধ দেয়ার জন্য প্রচ চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওয়ারী বিজয়ের হাসি হেসে মাঠ ত্যাগ করে। অপর খেলায় ফায়ার ৩-০ গোলে প্রেসকে হায়। ১৫/৮/৬৬ তারিখে আমাদের খেলা ছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে। দ্বিতীয়ার্ধে পাঁচ মিনিটে গ্যালারিতে দু’টিমের সমর্থকের মারামারিতে খেলা প হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে আমার কাছ থেকে বল পেয়ে আবদুল্লাহ দ্বিতীয় গোল করলে দর্শক-সমর্থকদের ধারণা আবদুল্লাহ তখন অবসাইডে ছিল। দর্শকরা রেফারির ওপর ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারে। এতে সাতজন ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। অবস্থা খারাপ দেখে পুলিশ ডাকা হয়। তখন পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে; তবে খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। প্রথমার্ধে ২১ মিনিটে শামসুর কাছ থেকে বল পেয়ে আমি প্রথম গোল করেছিলাম।
পুলিশ অবাক করে দিয়ে পিডব্লিউডিকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। প্রথম পর্বে পিডব্লিউডি ৬-২ গোলে জয়লাভ করেছিল। কর্দমাক্ত মাঠে দু’দলই ভাল খেলার চেষ্টা করে; তবে সেদিন পুলিশ ভাল খেলছিল। বিরতি পর্যন্ত গোলশূন্য ড্র ছিল। বিরতির পরপরই মোবিন গোল করে পুলিশকে (১-০) এগিয়ে দেয়। গোল খেয়ে পিডব্লিউডি শোধ করার জন্য জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু পুলিশের সাত্তার গোল করে দলের গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয় (২-০)। মোবিন আরও এক গোল করে পুলিশকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত পিডব্লিউডিকে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। অপর খেলা ওয়ান্ডারার্স এবং আজাদ আলোর স্বল্পতার জন্য ৫ মিনিট বাকি থাকতে খেলা বাতিল হয়ে যায়। তখন ওয়ান্ডারার্স ৩-০ গোলে এগিয়ে ছিল। ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে ভিক্টোরিয়াকে পরাজিত করেছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর ছিল আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলা আর সেটা ছিল ওয়ান্ডারার্সের বিরুদ্ধে। সেদিনের জয়ের ওপর নির্ভর করছিল লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় ওয়ান্ডারার্স ০-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল। আমাদের এ খেলাটি ১৪-৯-৬৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু সমর্থকদের মারামারিতে খেলা প হয়ে গিয়েছিল। সে সময় পর্যন্ত আমরা ২-০ গোলে জিততে ছিলাম। ওয়ান্ডারার্স সেদিন ভাল খেলা প্রদর্শন করতে পারেনি। হাফিজকে লেফট আউটে দর্শকের ভূমিকায় রাখা হয়েছিল। ওমর আব্বাস আসলামও ছিল ব্যর্থ। রহমতউল্লাহ আক্রমণভাগকে চালাতে সক্রিয় ছিল। তার সহযোগিতায় আক্রমণ চালালেও অন্যরা ছিল ব্যর্থ। অন্যদিকে আমাদের খেলায় ছিল পরিকল্পনার ছাপ, আমাদের সম্মিলিত আক্রমণগুলোকে দৃঢ়তার সাথে রুখে দিচ্ছিল ওয়ান্ডারার্সের আলাউদ্দিন, হাসান এবং দেবীনাশ। ২০ মিনিটে আবদুল্লাহর থ্রু পাস থেকে মুসা একক প্রচেষ্টায় প্লেসিং শট দ্বারা হাকিমকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধেও ওয়ান্ডারার্সের খেলায় কোন উন্নতি হয়নি; উপরন্তু শামসু গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে। মুসা তার দ্বিতীয় গোল এবং দলের তৃতীয় গোল করলে ওয়ান্ডারার্স খেলা ছেড়ে দিয়ে রাফ খেলায় মেতে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আমরা তাদের ৩-০ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিলাম; সে সাথে মোহামেডানের ১৯৬৬ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।
মোহামেডানের খেলোয়াড় লিস্ট
গোলরক্ষক-হাশিমদীন, ফুলব্যাক-জহীর, আসলাম, স্টপার-তোরাব আলী, হাফ-পিন্টু, গফুর, ফরোয়ার্ড-প্রতাপ, আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর ও মুসা।
পরবর্তী খেলায় আমরা স্টেশনারিকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিলাম এবং আমাদের শেষ খেলা ছিল ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে। তারা আমাদেরকে ওয়াকওভার দিলে আমরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। ১৯৬৬ মোহামেডান ২৪টি ম্যাচ খেলে ২২টি জয় ও ২টি ড্র করে। পক্ষে ১০২টি গোল, বিপক্ষে ৯টি গোল এবং মোট ৪৬ পয়েন্ট পেয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নশিপের সম্মান অর্জন করেছিল। #
ফেব্রুয়ারি-১
(সাতষট্টি)
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে ঐতিহ্যবাহী আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতে পারেনি; তাই ১৯৬৬ সালের টুর্নামেন্টের গুরুত্বটা একটু বেড়ে গিয়েছিল। ১৭টি টিম এতে অংশগ্রহণ করেছিল; যার মধ্যে ৩টি বিদেশী ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং সিলোন; ৫টি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেপিটি, পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, পাকিস্তান আর্মি, পিআইএ এবং পশ্চিম পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস; তার সাথে স্থানীয় ৯টি দলÑ যেমন ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি, ওয়ারী, আজাদ স্পোর্টিং, ফায়ার সার্ভিস, পিডব্লিউডি, ইপিজি প্রেস এবং রহমতগঞ্জ। প্রত্যেক রাউন্ডের চ্যাম্পিয়ন দল রাউন্ড রবিন লীগ খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। ইন্দোনেশিয়া এবং ইরানকে সরাসরি রাউন্ড রবিন লীগে রেখে ফিকশ্চার করা হয়েছিল। বগুড়া মোহাম্মদ আলী ফুটবল টুর্নামেন্টের ফলাফলের ভিত্তিতে পরাজিত করে গোল্ডকাপ মিশনে তাদের শুভসূচনা করেছিল। ১৭ অক্টোবর আজাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড দেবু একাই দু’গোল করে আজাদকে দ্বিতীয় রাউন্ডে নিয়ে গিয়েছিল পিডব্লিউকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। ১৮ তারিখে ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস গোলশূন্য ড্র করেছিল। ১৯ তারিখে টুর্নামেন্টের প্রথম অঘটন ঘটিয়ে ইপিআইডিসি ১৯৬৩ সালের আগাখান গোল্ডকাপ শিরোপাজয়ী পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে ২-১ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়েছিল। টুলু এবং সলিমুল্লাহর গোলের বিপরীতে রেলের মজিদ একটি গোল দিতে পেরেছিল। ১৯ তারিখেও ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস কেউ কাউকে হারাতে পারেনি ফলে তাদের খেলা ২০ তারিখে রাখা হয়েছিল। ১৮, ১৯, ২০ তারিখে পরপর তিনদিন খেলেও ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস কোন ফলাফল বের করতে পারেনি; তাই তাদেরকে ২১ তারিখে সকালে খেলার সময় নির্ধারণ করা হয়।
২১ তারিখে স্টেডিয়ামে সকাল ৭.৩০, দুপুর ২টা এবং বিকেল ৩.৪৫ মি. তিনটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরপর তিনদিন ড্র করার পর চতুর্থ দিন সকাল ৭.৩০টায় ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস ফলাফল বের করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যদেবতা ওয়ারীর পক্ষে হেসেছিল। ওয়ারী ২-১ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ারীর কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিত দুটো গোল করে ফায়ার সার্ভিসের কবল থেকে দলকে মুক্ত করেছিল। ৩০৮ মিনিট ফায়ারের বিরুদ্ধে লড়াই করার পর দুপুর ২টায় পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে আরও ৭০ মিনিট লড়াই করে আর্মিকে ২-০ গোলে পরাজিত করে এক অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। সেই কুশলী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথের গোলে ওয়ারী এগিয়ে গিয়েছিল এবং দ্বিতীয় গোলটি এসেছিল আজিজের পা থেকে। সেদিন যারা খেলেছিল, তারা হলোÑ
ওয়ারী : তপন (গোলরক্ষক), নূরুল আমিন, মো. আমিন এবং নূরুল ইসলাম, মহসিন, বদরুল, আজিজ, জাহাঙ্গীর, নিশিথ, জামিল আক্তার এবং মনজুর।
ফায়ার সার্ভিস : সিতাংশু (গোলরক্ষক), মো. আলী, আশরাফ, মজিবুর রহমান, বদরুল, কায়েস উদ্দিন, ওহাব, শারফুদ্দিন, হাবিব (আবুল হোসেন), শোভা এবং তসলিম।
সেদিন বিকেলের খেলায় ইপিআইডিসি এবং কেপিটির খেলা গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। পরদিনও খেলাটি ড্র হয়েছিল। অতিরিক্ত সময় খেলতে অপারগতা জানিয়ে ইপিআইডিসির আগামীদিন খেলার জোর দাবিটি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি এবং বাইলজ ভাঙ্গার দায়ে কেপিটিকে জয়ী ঘোষণা করেছিল। ২৪-১০-৬৬ রহমতগঞ্জের নাজির এবং টিপুর করা দুটি গোলের কাছে পশ্চিম পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস নতিস্বীকার করে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছিল। রহমতগঞ্জের পরবর্তী খেলা সিলোনের সাথে, জয়ী টিম রাউন্ড রবিন লীগ খেলার যোগ্যতা পাবে। পরদিন পিআইএ আজাদকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। তবে খেলার ধারা অনুযায়ী আজাদের হারা উচিত ছিল না। খেলাটি খুব প্রতিদ্বন্দ্বিপূর্ণ ছিল। শুধুমাত্র স্কোরারের অভাবে আজাদের এই পরাজয়। পিআইএ টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড গোলাম আহম্মদ দুটি গোল এবং শেষ গোলটি করেছিল মোহাম্মদ আহম্মদ। দিনের অপর খেলায় মোহামেডান ওয়ারীর বিরুদ্ধে ২-০ অগ্রগামী থাকা অবস্থায় রেফারি ঈশা খান বৈরী আবহাওয়ার জন্য খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। পরদিন (২৬/১০/৬৬) পুনঃনির্ধারিত খেলায় মোহামেডানের কাছে ওয়ারী ১৩-১ গোলে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। ওয়ারী প্রথম গোল করে আমাদেরকে ভড়কে দিয়েছিল। তারপর এক এক করে ১৩ গোল হজম করতে হয়েছিল তাদেরকে। কাদের ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়ার পর শামসু, মুসা, আবদুল্লাহ দলের পক্ষে ৫ নম্বর গোল করলে হাফ টাইম পর্যন্ত মোহামেডান ৫-১ গোলে এগিয়ে থাকে। বিরতির পর কাদের ৬ নম্বর গোল করার পর মুসা পরপর তিনটি গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। কাদের ১০ নম্বর গোল, মুসা ১১ নম্বর, শামসু ১২ নম্বর এবং শেষ ১৩ নম্বর গোলটি করেছিল প্রতাপ। ২৭ তারিখে ওয়ান্ডারার্স খেলার দ্বিতীয়ার্ধে হাফিজুদ্দিনের হেডে করা গোলে পিআইএকে ১-০ গোলে পরাজিত করে টুর্নামেন্ট থেকে বের করে দিয়েছিল। রাউন্ড রবিন লীগে ছয়টি টিম খেলার যোগ্যতা লাভ করেছিল। তাদেরকে দু’গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল।
গ্রুপ-এ : কেপিটি, মোহামেডান এবং ইন্দোনেশিয়া।
গ্রুপ-বি : সিলোন, ওয়ান্ডারার্স এবং ইরান।
রবিন লীগের প্রথম খেলা মোহামেডান বনাম কেপিটি। কেপিটির আকবর, তাকি, মাহমুদ এবং তাদের দুই উইং মিরদাদ ও মজিদ ভাল খেলে সবার প্রশংসা কুড়ায়। তাদের চতুর খেলোয়াড় তাকি সুন্দর প্লেসিং শট দ্বারা হাশেমদীনকে পরাস্ত করে কেপিটি ১-০ এগিয়ে দেয়। গোল খেয়ে আমরা সংঘবদ্ধ আক্রমণ করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। গফুরের একটি শট ক্রসবারে লেগে ফিরে আসলে আবদুল্লাহ সহজ গোল করতে ব্যর্থ হয়। আরও দু’তিনটি সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের লেফট আউট মুসাকে ইসমাইল তাদের বক্সের বাইরে ফাউল করলে গফুর ফ্রি-কিকটি মারে। সে বল পেয়ে আমি গোলপোস্টে সজোরে কিক চালিয়ে দেই। সহ-খেলোয়াড়রা ছুটে আসে আমাকে গোল করার অভিনন্দন জানাতে। খেলা ১-১ ড্র হয়।
দশ মিনিট পর গফুরের কাছ থেকে বল পেয়ে মুসা একক প্রচেষ্টায় দর্শনীয় গোল করলে মোহামেডান সমর্থকরা খুশিতে কেটে পড়েন। আমরা ২-১ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনালে যাই। দ্বিতীয় খেলাটি ছিল ইন্দোনেশিয়ার সাথে কেপিটির। ইন্দোনেশিয়া শুরু থেকে কেপিটিকে চেপে ধরে এবং ৪-১ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনাল খেলা নিশ্চিত করেছিল। কেপিটি প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। খেলার তৃতীয় মিনিটেই ইন্দোনেশিয়ার দক্ষ ফরোয়ার্ড সুজি আপতু গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। স্টেডিয়ামের ২০ হাজার দর্শকের হাততালি শেষ হওয়ার আগেই সুজি আপতু আবারও গোল করে ২-০ গোলে তার দলকে এগিয়ে দেয়। কেপিটির মিরদাদের পাশে মাহমুদ গোল করে ব্যবধান কমায় (২-১)। ছ’মিনিট পর সুজি আপতু তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। ১ নভেম্বর গোল্ডকাপের খেলা ছিল ইরান এবং সিলনের। নিম্নমানের খেলায় গোলশূন্য ড্র করে দু’দলই পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। সুঠাম দেহের অধিকারী তেহরান সিনিয়র ডিভিশন লীগ চ্যাম্পিয়ন পিএএস কাবের খেলার মান সিলোন দলের চেয়ে অনেক উন্নত। খেলোয়াড়দের ক্রীড়ানৈপুণ্য ও দলীয় সমঝোতাও খুবই ভাল। সিলোন টিম রক্ষণাত্মক খেলার মাধ্যমে ইরানের আক্রমণকে ঠেকাতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে একত্রিত করে প্রভিন্সিয়াল কৃষিমন্ত্রী ফকির আবদুল মান্নানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। রবিন লীগে আমাদের গ্রুপের শেষ খেলা ইন্দোনেশিয়ার সাথে। আমরা ভাল খেলেও হেরে গিয়েছিলাম, যার দরুন ইন্দোনেশিয়া গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে উঠে যায় এবং গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে আমরাও সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করি। আমাদের ফরোয়ার্ড লাইন সেদিন এলোমেলো খেলা খেললেও ডিফেন্স ছিল প্রাচীরের মত শক্তিশালী। বিশেষ করে আমাদের স্টপার তোরাব আলী ছিল স্তম্ভ; কাদের ও গফুর ছিল তার দুই সহযোগী। ইন্দোনেশিয়া খেলেছিল একটি টিম হিসেবে। তোরাব আলী ইন্দোনেশিয়ার কুশলী ফরোয়ার্ড সুজি আপতুকে কড়া মার্কে রাখলেও অমন দ্রুত খেলোয়াড়কে সারাক্ষণ আটকে রাখা মুশকিল হয়। খেলার পূর্বে উভয় দলের খেলোয়াড়দের সাথে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস এ আর কর্নোলিউয়াসের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। খেলা শুরু হওয়ার সাথে সাথে বল চলে যায় আমাদের বাম ফ্যাংকে মুসার কাছে। মুসা আমাকে বল বানিয়ে দিলে আমি পোস্টে মারি কিন্তু বল বিপক্ষ এক খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে ফিরে আসলে আবদুল্লাহ সেটা ধরে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। দ্রুত গোল খেয়ে ইন্দোনেশিয়া চাপের মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে গোল পরিশোধ করার লক্ষ্য আক্রমণ চালায়। তাদের লেফট আউট বব মেথিয়াস আমাদের পেনাল্টি বক্সে একটি বল ফেললে সুজি আপতু দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে বুলেটের মত বল কিক করলে হাশিমদীন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বল জালে জড়িয়ে যায়। খেলা ১-১ ড্র। এর চার মিনিট পর বিপক্ষ দলের তাহির ইউসুফ লেফআউট বব মেথিয়াসকে বল দিলে সে বল আয়ত্তে এনে গোলপোস্টে মেরে গোল করে, সে সাথে ইন্দোনেশিয়া ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। খেলা শেষ হওয়ার পূর্বে মুসা দুটি সহজ সুযোগ নষ্ট করলে গ্যালারির ৫০/৬০ হাজার দর্শক ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং লোহার গেট ভেঙ্গে মাঠে ঢুকে খেলা ভন্ডুল করে দেয়।
(ক্রমশ.)
ফেব্রুয়ারি-১৬
(আটষট্টি)
রবিন লীগের ‘বি’ গ্রুপের শেষ খেলায় ইরান তাদের দক্ষ স্কোরারের অভাবে ওয়ান্ডারার্সের সাথে গোলশূন্য ড্র করেছিল এবং গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার সাথে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ইরান উন্নতমানের খেলা প্রদর্শন করে। তাদের খেলার গতি, দলীয় সমঝোতা এবং আক্রমণ সবই ছিল প্রশংসনীয়। তারা ডজনখানেক গোল করার সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেছিল। পক্ষান্তরে ওয়ান্ডারার্স অত্যন্ত নিম্নমানের খেলা প্রদর্শন করে দর্শকদের হতাশ করেছিল। ওয়ান্ডারার্সের ফুল ব্যাক কামিশা পুরো রক্ষণভাগকে আগলে রেখেছিল। খেলার তৃতীয় মিনিটে ওমর যে সহজ গোল মিস করেছিল, তার জন্য তাকে ক্ষমা করা যায় না। খেলার অন্তিম সময়ে ইউসুফ ও ওমরের মিলিত আক্রমণ থেকে আব্বাসকে বল দিলে সে জঘন্যভাবে গোল করতে ব্যর্থ হলে গ্রুপের রানার্সআপ হয়ে ঢাকা মোহামেডানের সাথে সেমিফাইনালে খেলতে পারার সন্তুষ্টি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল। পিএএস কাব (ইরান) দলের খেলোয়াড় : গোলরক্ষক- নূরুদ্দিন, হায়দারী, মাগরানী, মোহাজরিয়ান এবং আগাইর, হাবিবি এবং সারাখি, মালিয়ান, বয়গান, শারাফী এবং সুলেমান (আবাসনাসান)। ৪ নভেম্বর প্রথম সেমিফাইনাল ইরান বনাম ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়া মাঠে সেরা টিম হিসেবেই ইরানকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল। খেলার গতি, খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য, দলীয় সমঝোতা সব দিক দিয়েই তারা উন্নত ছিল।
৫ নভেম্বর দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দুটি টিম ঢাকা মোহামেডান এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের মধ্যে। মোহামেডান-ওয়ান্ডারার্স মানেই উত্তেজনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, টাফ-রাফ খেলা। ওয়ান্ডারার্স দেবিনাশের বদলে ইমাম বক্সকে ফুলব্যাকে খেলিয়ে বড় ভুল করেছিল। ইমাম বক্স একেবারেই ফপ ছিল। তাদের আক্রমণে ওমর মূল ভূমিকা পালন করলেও ইনদ্বয় আব্বাস ও হাফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে সহযোগিতা পায়নি।
সেদিনের রেফারিং ছিল বিতর্কিত। রেফারি মাসুদুর রহমান তার লাইন্সম্যানদ্বয়ের (ননী বসাক এবং মহিউদ্দিন চৌধুরী) কাছ থেকে সহযোগিতা পাননি। তাদের সিদ্ধান্তগুলোতে গরমিল ছিল, সহযোগীদের ফ্যাগগুলো সময়মত এবং সঠিকভাবে দেখানো নিয়ে রেফারির সাথে মিলছিল না। এতে গ্যালারির দর্শকরা দুয়ো দিচ্ছিল।
আমাদের টিম বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে খেলছিল। আমাদের খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যতা, সমঝোতা অত্যন্ত ভাল ছিল। আমাদের রক্ষণভাগ কাদের তোরাব আলী এবং আসলামের সাথে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ রসুল বক্স এবং গফুর মিলে খুবই শক্তিশালী ডিফেন্স গড়ে উঠেছিল। যারা ওয়ান্ডারার্সের আক্রমণ সামলাতে যথেষ্ট ছিল। আমাদের দ্রুতগতির আক্রমণভাগকে ঠেকাতে তারা হিমশিম খাচ্ছিল। খেলার ২ মিনিটেই প্রতাপের পাস পেয়ে শামসু ওয়ান্ডারার্সের পোস্টে মারে। তা ক্রসবারে লেগে প্রতাপের কাছে ফেরত আসলে প্রতাপ সহজেই পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। আমরা ১-০ এগিয়ে যাই। ওয়ান্ডারার্সের রাইট আউট ইউসুফের লব আসলাম হেড করলে হাশেম দীন দর্শনীয়ভাবে সেভ করে। বিরতির পূর্বে মুসা কামিসাকে কাটিয়ে একটি সুন্দর বল বানিয়ে প্রতাপকে দিলে প্রতাপ গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেয়। আবদুল্লাহ তৃতীয় গোল করলে আমাদের ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়। ইউসুফের লব থেকে ওমর হেড দিয়ে গোল করে ব্যবধান কমায়। আমরা ৩-১ গোলে ওয়ান্ডারার্সকে হারিয়ে ফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার মুখোমুখি হয়েছিলাম।
৬ নবেম্বর ঐতিহ্যবাহী আগাখান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা ইন্দোনেশিয়ার পারসাপুয়ান সেপাকবোলা সেলুরুহ কাব বনাম স্থানীয় লীগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব। দর্শক পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে
ঢাকা মোহামেডানকে ২-১ গোলে পরাজিত করে ঐতিহ্যবাহী আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নাটেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হওয়া গোল্ডকাপ ইন্দোনেশিয়া দ্বিতীয়বারের মত এ গৌরবের অধিকারী হয়েছিল। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে হারিয়ে তারা প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এর আগের বছর ১৯৬০ তারা কোলকাতা মোহামেডানের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবও ১৯৫৯ সালে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৬৪ সালে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন (করাচি পোর্ট ট্রাস্ট-এর সাথে) হওয়ার গৌরব রয়েছে। আমরা ভাল খেলেও ভাগ্য আমাদের সাথে না থাকায় জয়ী হতে পারিনি। গোল করার কয়েকটা সুযোগ এসেছিল কিন্তু শার্ফ শুটারের অভাবে আমরা গোল পাইনি। খেলার আগে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খানের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
খেলা শুরু হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়ার ক্যাপ্টেন সুজেপতু গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। কিক অফ করেই সে আমাদের ডিফেন্সে ঢুকে পড়ে। সাথে সাথে তাহির ইউসুফ তাকে লক্ষ্য করে বল দিলে সে বল ধরেই মাটি কামরানো শট মারে, যা হাশেম দীনের পাস দিয়ে পোস্টে ঢুকে যায়। হাশেম দীন একটু সতর্ক থাকলে হয়তো গোল বাঁচানো সম্ভব হতো। এত দ্রুত গোল খেয়ে আমাদের টিম হকচকিয়ে যায় এবং টিম গুছিয়ে আনতে বেশ সময় লাগে। ২০ মিনিটে আমাদের টিম সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালিয়ে গোলের সুযোগ পেলেও দক্ষ শুটারের অভাবে গোল শোধ করতে পারিনি। ২৮ মিনিটে ইন্দোনেশিয়ার বক্সের বাইরে একটি ফ্রি কিক পাই। গফুরের মারা বুলেটের মত শটটি গোলরক্ষক জুডোকে কোন সুযোগ না দিয়ে বল জালে জড়িয়ে যায়। খেলা ১-১ ড্র। বিরতির পর ইন্দোনেশিয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ড আলি আন্দো মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় তোরাব আলী এবং আসলামকে কাটিয়ে দেখার মত একটি গোল করলে গ্যালারির দর্শকদের প্রশংসায় ভাসে। খেলা শেষ হওয়ার আগে প্রতাপের একটি থ্রু পাস আবদুল্লাহ ধরেও পোস্টে মারতে ব্যর্থ হওয়ার সাথেই আমাদের গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।
দু’টিমের খেলোয়াড়রা
ইন্দোনেশিয়া : জুডো (গোলরক্ষক), খলিল, মাহফুল, বাশির, জন সিমসন, এফ তেল ফং, লিউ সু লিয়াং, তাহির ইউসুফ, আলি আন্দু, সুজিপ্তু এবং বব ম্যাথিয়াস।
মোহামেডান : হাশিম দীন (গোলরক্ষক), আসলাম, তোরাব আলী, গোলাম কাদের, রসুল বক্স, আবদুল গফুর, প্রতাপ হাজরা, আবদুল্লা রাহি, শামসু, বশীর আহমেদ এবং মুসা।
চ্যারিটি ম্যাচে ইন্দোনেশিয়া ৪-৩ গোলে জয়লাভ করে। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের ফান্ড বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগাখান গোল্পকাপ জয়ী ইন্দোনেশিয়া বনাম ইপিআইডিসি টিমের মধ্যে ৭ নভেম্বর চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। এই ম্যাচের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল আসলামের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। ইন্দোনেশিয়ার মূল আকর্ষণ তাদের ক্যাপ্টেন সুজিপ্তু এ ম্যাচে অংশগ্রহণ করেনি। আলি আন্দু ক্যাপ্টেন্সি করেছিল। ইন্দোনেশিয়া আবারও তাদের গতিসম্পন্ন গোছানো ফুটবল উপহার দিয়ে ঢাকার দর্শকদের প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছিল। খেলার তৃতীয় মিনিটে সলিমুল্লাহর কাছ থেকে বল পেয়ে আসলাম সুন্দর একটি গোল করে ইপিআইডিসিকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। দ্রুত গোল খেয়ে ইন্দোনেশিয়া কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও ২০ মিনিটে টেক ফং গোল করে সমতা আনে। গফুর বেলুচ আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারছিল না। বক্সের ভেতর ফাউল করলে পেনাল্টি পায় ইন্দোনেশিয়া। আর সেটা থেকে টেক ফং তার দ্বিতীয় গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। ছয় মিনিট পর বার্টজে সেটাকে ৩-১ গোলে নিয়ে যায়। পেনাল্টি সীমানার কাছাকাছি গফুর বেলুচের হাতে বল লাগাতে ইন্দোনেশিয়া ফ্রি কিক পায় আর জুলকারনাইন কোনাকুনি শটের মাধ্যমে স্বপনকে পরাস্থ করে ইন্দোনেশিয়াকে ৪-১ গোলে এগিয়ে দেয়। সলিমুল্লাহর ক্রসে আসলাম চমৎকার হেড করে গোল করে (৪-২)। খেলা শেষে হওয়ার মিনিট পাঁচেক থাকতে আসলাম তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে। এই জয়ের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়া তাদের ঢাকা সফর অপরাজিত থেকে দেশে ফিরেছিল।
চ্যারিটি ম্যাচে দু’টিমের খেলোয়াড় :
পিএসএস (ইন্দোনেশিয়া) : সুজি আন্টো (গোলরক্ষক), কে টিক লিওঙ, মানগুয়ান্ডাপ, মারকফুল এবং খলিল, টেক ফং এবং ম্যাক্সি, লিয়াম, এস লিয়াং, আলি আন্দু, বার্টজে এবং জুলকারনাইন।
ইপিআইডিসি : স্বপন (গোলরক্ষক), আমিন খান, গফুর বেলুচ এবং সাইফুদ্দিন, আব্দুল্লা আকবর এবং মূসা, সলিমুল্লাহ, সারফুদ্দিন, আসলাম, জব্বার এবং শাজাহান।
রেফারি- নজর মোহাম্মদ।
চ্যারিটি ম্যাচে আশা অনুযায়ী গেটমানি পাওয়া যায়নি। মাত্র ৪৬৫১ রুপি উঠেছিল। অথচ আগাখান গোল্ডকাপে ইন্দোনেশিয়া বানাম ঢাকা মোহামেডান কাবের মধ্যে ফাইনাল খেলায় গেটমানি উঠেছিল ৬০,১০৫ রুপি।
৯ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়া টিমকে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব উষ্ণ বিদায় সংবর্ধনা জানিয়েছিল। ঢাকার তেজগাঁ বিমানবন্দর রেস্টুরেন্টে বিদায়ের প্রাক্কালে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। মোহামেডানের সভাপতি মঈনুল ইসলাম ইন্দোনেশিয়া দলের সাফল্যে অভিনন্দন জানান। জবাবে ঢাকায় অবস্থানরত ইন্দোনেশিয়ার কনসুলার জেনারেল এস এম নূর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এস এ মহসিন জাতীয় রিক্রিয়েশন সমিরত সাধারণ সম্পাদক (ইস্ট পাক শাখা) তার বক্তব্যে বলেন, ইন্দোনেশিয়ার খেলতে আসা প্রতিটি সফরেই দু’দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়।
(ক্রমশ.)
মার্চ-১
(ঊনসত্তর)
আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট সবসময় মর্যাদার প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে ছাত্রদের কাছে এটি উত্তেজনার প্রতিযোগিতা। আর আমরা যারা বিভিন্ন কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি টিমে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতাম, আমাদের কাছে সেটা হতো চ্যালেঞ্জিং এবং সমমানের। ১৯৬৬ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যখন আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট পুরোদমে চলছিল এবং আমরা (জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ ও এবং আমি) ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের পক্ষে শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে লড়ে যাচ্ছিলাম। দুটো খেলাই ছিল আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা স্টেডিয়াম এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠ পর্যায়ক্রমে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল এবং আগাখান গোল্ড কাপ খেলতে হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। ঢাকা মোহামেডানের পক্ষে শক্তিশালী কেপিটি টিমের বিরুদ্ধে খেলার পর ৩০ তারিখে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে নামতে হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিরুদ্ধে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় টিম শক্তিশালী দল। উভয় দলই সেদিন জয়ের জন্য লড়ছিল। দারুণ খেলা। খেলায় যেমন ছিল গতি, তেমন ছিল আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ এবং প্রতিমিনিটে গোল হওয়ার সম্ভাবনাসহ প্রচুর উত্তেজনা। উভয় দলই গোলমুখে গোল করার সহজ সুযোগ নষ্ট করার মহড়ায় নেমেছিল। আমাদের রাইট ইন শাজাহান ১০ গজ দূর থেকে যে গোল মিস করেছিল, তার জন্য তাকে ক্ষমা করা যায় না। শাহজাহান জগন্নাথ কলেজের ছাত্র; প্রতাপ, অনাথ ও আমিও সে কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি টিমে চান্স পেয়েছিলাম। শাহজাহান এবং প্রতাপ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গর্বিত খেলোয়াড় হিসেবে সবার সম্মানের পাত্র হয়েছিল। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি প্রথমার্ধে খেলাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং ভাল খেলে আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটি সুযোগও সৃষ্টি করেছিল। খেলার ধারা যখন এমন ছিল, তখনই আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হাফিজুদ্দিন বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় বিপক্ষ দলের তিন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে পোস্টে জোরালো শট করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ গোল করে রাখতে পারিনি। দু’মিনিটের মধ্যেই রাজশাহীর অনাথকে (গোলরক্ষক) পরাস্ত করে খেলায় ১-১ সমতা আসে। খেলায় এবং খেলার বাইরে প্রচুর উত্তেজনা, দু’দলের গোল করার আপ্রাণ চেষ্টায় খেলা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল। প্রায় দশ মিনিট বাকি, এমনি সময় প্রতাপের একটি মাপা কর্নার থেকে চমৎকার হেড দ্বারা আমি গোল করলে আমাদের টিমের ২-১ গোলের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
দুই ইউনিভার্সিটি টিমের খেলোয়াড়
ঢাকা ইউনিভার্সিটি : অনাথ (গোলরক্ষক), সাদেক এবং হাসান, মতিন, পিন্টু এবং কায়কোবাদ, প্রতাপ, শাজাহান, হাফিজউদ্দিন, বশীর এবং টিপু।
রাজশাহী ইউনিভার্সিটি : শাজাহান (গোলরক্ষক), মনসুর এবং সাইফুল, মান্নান, জহুরুল ও মহসিন, মনিরুজ্জামান, আউয়াল, মতিন, ইসলাম এবং আমির আলী।
পরদিনই ৩১.১০.৬৬ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি টিমের বিরুদ্ধে আমাদের খেলতে হয়েছিল। আমরা ৩-০ গোলে হারিয়েছিলাম তাদেরকে। প্রভিন্সিয়াল দলের একগাদা খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিমের সাথে বিপক্ষ টিমের কোন ক্ষেত্রেই তুলনা হয় না। খেলাটি শুধু একতরফা হয়েছিল। খেলার ছ’মিনিটে আমাদের লেফট আউট টিপু গোল করে ১-০ এগিয়ে দিলেও ভুরি ভুরি গোল মিস করে আমরা হাফ টাইম পর্যন্ত ঐ গোলকে পুঁজি করে ধরে রেখেছিলাম।
আমাদের রাইট-ইন শাহজাহানকে হাফটাইমে পরিবর্তন করে নুরুজ্জামানকে নামানো হয়। সে একাই দু’গোল করলে আমাদের টিম ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। নুরুজ্জামান হ্যাটট্রিকের আশায় একের পর এক গোল মিস করে যায় এবং আমরাও গোল করার সুযোগ কাজে লাগাতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমরা ৩-০ গোলের জয় নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ মুহূর্তে তাদের টিম প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিন টিমের মধ্যে লীগ পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে জয়লাভ করায় আমাদের টিম অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। পরদিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে রানার্সআপ হয়েছিল। এরই সাথে শেষ হয়েছিল আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতা আর আমরা ফিরে গেলাম ঢাকা স্টেডিয়ামে আমাদের পরবর্তী খেলা ২ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে খেলার জন্য (আগা খান গোল্ডকাপের পরবর্তী খেলাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে পূর্বের সংখ্যায়)।
৬ নভেম্বর আগাখান গোল্ডকাপ ফাইনাল খেলা শেষ করে রাতেই সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় টিমের সাথে রাজশাহীগামী ট্রেনে চড়ে বসলাম। উদ্দেশ্য ৭ নভেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ।
১৯৬০ সালের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল প্রভিন্সিয়াল টিমগুলোর অংশগ্রহণের শেষ প্রতিযোগিতা, যা পূর্ব পাকিস্তান প্রভিন্সিয়াল টিম হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। আমিও সেই চ্যাম্পিয়ন টিমের একজন গর্বিত অংশীদার।
পরবর্তীতে ডিভিশনাল পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতা শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তানে ৪টি ডিভিশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনার সাথে পুলিশ, রেলওয়ে এবং সম্মিলিত ইউনিভার্সিটিসহ মোট ৭টি টিম নিয়ে জাতীয় ফুটবলের ইস্টার্ন জোনের প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল রাজশাহী ডিএসএ’তে। এখানে চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ দুটো টিম মূল পর্বের প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। আরও দুটো টিম গতবারের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়ন টিম এবং রানার্সআপ সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।
কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটি টিমের খেলোয়াড়রা যারা ১৯৬৬ সালে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছিল : আব্দুস সাদেক-ক্যাপ্টেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, জহুর- ভাইস ক্যাপ্টেন, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি
অন্যান্য খেলোয়াড়-অনাথ, হাসান, পিন্টু, কায়কোবাদ, প্রতাপ হাজরা, বশীর আহমেদ, হাফিজউদ্দিন, গোলাম সরওয়ার টিপু, নুরুজ্জামান, সাইদুর রহমান- ঢাকা ইউনিভার্সিটি। লক্ষ্মী, সাইফুল ইসলাম, আনসার, মতিন এবং চুন্নু- রাজশাহী ইউনিভার্সিটি।
শান্তা, মঞ্জুর এবং পট্টু- ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি। এইচএম মোস্তফা-ম্যানেজার, সাহেব আলী-কোচ।
জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা পরিচালনা করার জন্য ইপরোয়া (ইস্ট পাকিস্তান রেফারি এন্ড আম্পায়ার্স এসোসিয়েশন) ৭ জন রেফারিকে মনোনীত করেছিল। তারা হলেন : জহুরুল আলম, মহিউদ্দিন চৌধুরী, ঈশা খান, মাসুদুর রহমান, ননী বসাক, মোহাম্মদ আলী এবং সাহেব আলী।
এ প্রতিযোগিতায় ফিফার নতুন আইন সংযোজন করা হয়। খেলা ৮০ মিনিটের পরিবর্তে ৯০ মি. মূল সময় নির্ধারণ করা হয়। ৪৫+৫+৪৫।
খেলোয়াড় পরিবর্তন : খেলার যে কোন সময় গোলকিপার পরিবর্তন করা যাবে।
শুধু হাফ টাইমের পূর্বে যে কোন খেলোয়াড় পরিবর্তন করা যাবে।
প্রটেস্ট : খেলার শেষ বাঁশি থেকে তিন ঘন্টার ভেতর ১০০ টাকা প্রটেস্ট ফি জমা দিয়ে প্রটেস্ট করতে হবে।
৭ নভেম্বর ১.৪৮ মিনিটে ইস্ট জোনের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধনী খেলা রাজশাহী স্টেডিয়ামে রাজশাহী ডিএসএ বনাম পুলিশ এসি’র মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজশাহী ডিএসএ জয়লাভ করে পরবর্তী রাউন্ডে উন্নীত হয়। একইদিনে ৩.৩০ মিনিটে খেলেছিল চট্টগ্রাম ডিএসএ ইস্টার্ন রেলওয়ের সাথে এবং রেল দল জয়লাভ করে উঠে যায় পরবর্তী রাউন্ডে।
৮ নভেম্বর ১.৪৫ মিনিটে (সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি) আমাদের প্রথম খেলাতে খুলনা ডিএসএকে ৪-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিলাম। সেদিনই ৩.৩০ মি. রাজশাহী ডিএসএ রেলকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ৯ নভেম্বর আমরা ঢাকার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলাম। টুর্নামেন্টের আসল ফাইনাল ছিল সেদিনই। টুর্নামেন্টের আয়োজক রাজশাহী, তাদের সুবিধামত ফিকশ্চার করে ফাইনাল খেলার সুযোগ করে নিয়েছিল। ঢাকা কম্বাইন্ড বিশ্ববিদ্যালয় দলের মধ্যে ফাইনাল খেলা হলে মানসম্মত ফাইনাল হতো। জাতীয় দলের চৌকস খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ঢাকা টিম। প্রচুর দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং আমাদের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সমর্থন দিয়ে গেছেন। খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা হয়। আমরা প্রাণপণ লড়ে গেছি। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য সবই ছিল খেলায় কিন্তু ঢাকা দলের দলগত সমঝোতা, আক্রমণের ধার আর দৈহিক সামর্থ্যরে কাছে আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়াও ঢাকা দলের আমিন, আসলাম, তোরাব আলী, গফুর, কাদের এদের দ্বারা পাহাড় সমান শক্তিশালী রক্ষণভাগ যা ভেদ করা আমাদের পক্ষে ছিল কষ্টকর। ইউসুফ জুনিয়র, আবদুল্লাহ, আসলাম, জব্বার ছিল দলকে জয়ী করার মূল চালিকাশক্তি।
ঢাকার পক্ষে আসলাম এবং জব্বর প্রত্যেকে দু’গোল করেছিল আর আমাদের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড হাফিজউদ্দিন একাই দু’গোল করতে সক্ষম হয়েছিল। ঢাকা দল আত্মঘাতী একটি গোল খেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা ঢাকা সিএসএ দলের কাছে ৩-৪ গোলে পরাজিত হয়ে মূল জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। ১০ নভেম্বর ইস্ট জোনের ফাইনাল খেলায় ঢাকা ডিএসএ চ্যাম্পিয়ন এবং রাজশাহী ডিএসএ রানার্সআপ দল হিসেবে করাচিতে অনুষ্ঠানরত জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিনশিপে সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। #
(ক্রমশ.)
মার্চ-১৬
(সত্তর)
জাতীয় যুব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ-১৯৬৬।
পূর্ব পাকিস্তান ইস্ট উইং এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে ওয়েস্ট উইং ২টি জোনে ভাগ করে নিজ নিজ জোনের ডিভিশনাল যুব ফুটবল দল এবং সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি দলগুলো নিয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জোনাল চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ করা হতো। পরবর্তীতে ইস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন এবং ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন টিমের মধ্যে ফাইনাল খেলায় জয়ী দলই জাতীয় যুব টিমের ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতো।
ইস্ট উইং (পূর্ব পাকিস্তান) জোনাল ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী যুব দলগুলো ছিল ঢাকা ডিএসএ, রাজশাহী ডিএসএ, খুলনা ডিএসএ এবং সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দল। ১১ অক্টোবর ঢাকা স্টেডিয়ামে খুলনা ডিএসএ যুব দল এবং সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলের খেলার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ইস্ট উইং জোনাল যুব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় টিম ৭-০ গোলে খুলনা যুব দলকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড শাজাহান আক্রমণাত্মক খেলা প্রদর্শন করে একাই ৪ গোল করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় দলের রাইট আউট লতিফ তার একক প্রচেষ্টায় খুলনার গোলরক্ষক ধীরেন দাসকে পরাস্ত করার মাধ্যমে গোলের সূচনা করে। তারপর থেকে শাহজান পরপর গোল করে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন। বিরতির পর টিপু ও নূরুজ্জামান গোল করেছিল।
সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দল জোনাল ফাইনাল খেলায় ঢাকা ডিএসএ যুব দলের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল। বৃষ্টি আর কর্দমাক্ত মাঠে ভাল খেলা প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল না; তবুও দু’দল জেতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল। ঢাকার রক্ষণভাগ অত্যন্ত মজবুত রফিক এবং কাদের সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। তাদেরকে ভেদ করা বিশ্ববিদ্যালয় দলের পক্ষে সহজ ছিল না। তারপরও কৃতী দুই অ্যাটাকার টিপু আর শাজাহান যে সুযোগ তারা পেয়েছিলÑ তা কাজে লাগাতে পারেনি। খেলার শুরুতেই একটা জটলা থেকে সুলতান গোল করে ঢাকা দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। দু’মিনিট পর টিপু গোল রক্ষককে একা পেয়েও গোল করতে পারেনি। আট মিনিট পর আবারও টিপু একটি সহজ গোল মিস করে। ঢাকার গোল এরিয়ার ভেতর রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড়ের হাতে বল লাগলে রেফারি পেনাল্টি দেন, টিপু সেটা থেকে গোল শোধ করলে খেলার গতি বেড়ে যায়Ñ সে সাথে খেলোয়াড়দের মাঝেও শক্তি প্রয়োগটা বেড়ে যায়। এতে খেলা বেশ টাফ হয়ে ওঠে। খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল, মিনিট দু’এক বাকি থাকতে ঢাকা একটি ফ্রি কিক লাভ করে। কিক নেয় কাদের গোলপোস্টের কাছে দাঁড়ানো সুলতানের কাছে বল গেলে সুলতান বল ধরেই সজোরে পোস্টে কিক চালিয়ে দেয়। অনাথ (গোলরক্ষক) ধরার আগেই বল জালে জড়িয়ে যায়। ঢাকা যুব ফুটবল দল ২-১ গোলে জয়লাভ করে জোনাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে এবং ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন টিমের সাথে ১৫ অক্টোবর ঢাকা স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলে যারা খেলেছিল : অনাথ (গোলরক্ষক), সাদেক, হাসান এবং করিম, গিয়াসউদ্দিন এবং কায়কোবাদ, লতিফ নুরুজ্জামান, শাজাহান, সিকান্দার এবং টিপু।
ওয়েস্ট উইং জোনাল যুব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল করাচি কেএমসি স্টেডিয়ামে। প্রতিযোগিতার ফাইনালে করাচি এবং কোয়েটা মুখোমুখি হয়েছিল। করাচি ৩-১ গোলে কোয়েটাকে পরাজিত করে ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। করাচি দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড মাওলা বক্স তার দলের পক্ষে ৩টি গোলই করেছিল। খেলার ১৫ মিনিটেই কোয়েটার সেন্টার ফরোয়ার্ড নবী বুলেট শট মেরে কোয়েটাকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড মংলা বক্স একক প্রচেষ্টায় এক জোরালো শটে ১-১ গোলে সমতা আনে। ২৭ মিনিটে মাওলা বক্স আরও একটি গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। এ সময় কোয়েটা দল দুটো সহজ গোল মিস করে। বিরতির পর দু’দলই পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চালিয়ে খেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু দুটো টিমই গোলপোস্টের দেখা পাচ্ছিল না। খেলা যখন এমনি চলছিল, তখন করাচির রাইট আউট ইসহাকের একটি মাপা লব থেকে মাওলা বক্স সুন্দর হেডের সাহায্যে গোল করে দলকে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে আর সেই সাথে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করে। করাচি ডিএসএ যুব দল ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঢাকায় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল।
১৫ অক্টোবর জাতীয় যুব ফুটবলের ফাইনাল খেলা। ইস্ট উইং চ্যাম্পিয়ন বনাম ওয়েস্ট উইং চ্যাম্পিয়ন। ঢাকা এবং করাচির যুব দলের ফাইনাল। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের কর্দমাক্ত মাঠকে আরও একটু খারাপ করে দিয়ে গেল। এ মাঠে ভাল খেলা উপহার দেয়া দু’দলের পক্ষে ছিল কষ্টকর। তারপরও দু’দল ভাল খেলে জয়লাভ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছিল। দু’টিমই গোল করার সুযোগ পেয়ে দুর্বল শট, সময়মত গোলপোস্টে শট না নেয়া, অনর্থক বল নিজের কাছে ধরে রাখা বা ড্রিব্লিং করা ইত্যাদির কারণে গোল করতে পারেনি। করাচি যুব দলের চেয়ে ঢাকার ছেলেরা অধিক সংঘবদ্ধ ছিল এবং তারা আক্রমণ করেছেও বেশি কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি। ইজাজ, করাচির গোলরক্ষক, ভাল খেলে দর্শনীয়ভাবে বেশ কয়েকটা গোল সেভ করেছে। ঢাকা দলের কাদের তার দক্ষতা এবং নৈপুণ্য দ্বারা প্রমাণ করেছে যে, সে যেমন রক্ষণভাগে সামাল দিয়েছেÑ তেমনি আক্রমণকে সহযোগিতা দিয়ে সচল রেখেছে। তপন বারপোস্টের নিচে খুব সুন্দর খেলেছে। খেলার ৫ মিনিটেই করাচির সেন্টার ফরোয়ার্ড মাওলা বক্স এক সহজ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। গোলশূন্য অবস্থায় বিরতির বাঁশি বেজেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা যুব দল গোল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে করাচি দলকে রক্ষণাত্মক খেলা খেলে সময় অতিবাহিত করার দিয়ে সচেষ্ট থাকতে দেখা যাচ্ছিল। এ অবস্থায় সুলতান যে দুটো সহজ গোল মিস করেছে, তাতে ঢাকা যুব দলের চ্যাম্পিয়ন না হওয়র জন্য তাকে দায়ী করা যায়। মাঠের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ায় অতিরিক্ত সময় না দিয়ে নির্ধারিত সময় শেষে খেলা সমাপ্ত করা হয়েছিল। সে সময় পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য ড্র ছিল। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা ডিএসএ যুব দল এবং করাচি ডিএসএ যুব দলকে জাতীয় যুব ফুটবলের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
দু’দলে যারা খেলেছিল
ঢাকা যুব দল : তপন (গোলরক্ষক), বেলাল রফিক (অধিনায়ক) এবং শওকত, গণেশ এবং কাদের (সহ-অধিনায়ক), ভুট্টো, সেলিম, সুলতান, লালু ও রওশন।
করাচি যুব দল : ইজাজ (গোলরক্ষক), আনিস এবং গোলাম আব্বাস, সিদ্দিক, ইয়াকুব এবং আরিফ, ইশহাক, আল্লা বক্স, মাওলা বক্স, আকবর এবং লাল মোহাম্মদ।
রেফারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন ননী বসাক।
সেবারের (১৯৬৬) জাতীয় ফুটবলের মূল আসর বসেছিল করাচিতে। ভেন্যু ছিল করাচির কেএমসি স্টেডিয়াম। ১৯টি টিম নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রতিযোগিতা। গতবারের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে এবং রানার্সআপ করাচি দলকে এবং ইস্ট উইং থেকে জোনাল চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্স টিম মোট ৪টি টিমকে সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে রেখে ফিকশ্চার সাজানো হয়েছিল। ইস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপ যা রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখান থেকে ঢাকা ডিএসএ চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ রাজশাহী ডিএসএ দল মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করেছিল। প্রতিযোগিতার অন্যান্য টিমÑ হায়দ্রাবাদ, কালাত, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, সারগোদা, কোয়েটা, পেশাওয়ার, মুলতান, খায়েরপুর, দেরাইস মাইল খান, পুলিশ, পাক আর্মি, পাক নেভি, পাক এয়ারফোর্স, পশ্চিম পাকিস্তান সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি।
জাতীয় দলের কৃতী লেফট আউট মুসার নেতৃত্বে একগাদা পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় সমন্বয়ে ঢাকা ডিএসএ টিম গঠন করা হয়েছিল।
‘গোলরক্ষক : মতিন, তপন), আমিন, আসলাম, তোরাব আলী, রফিক, আবদুল্লাহ, আকবর, গফুর, কাদের, ইউসুফ, সিনিয়র, আবদুল্লাহ, শারফুদ্দিন, হাশিম উদ্দিন, সুলতান, আসলাম এবং জব্বার।
৩০ অক্টোবর হায়দ্রাবাদ ডিএসএ এবং কালাত ডিএসএ ম্যাচ দিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপের শুরু। উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি খান এ সবুর।
ইস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন ঢাকা প্রথম খেলায় পেশাওয়ারের মুখোমুখি হয়েছিল। ছ’জন পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় নিয়েও পেশাওয়ারের সাথে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। পেশাওয়ারের সুঠাম দেহী খেলোয়াড়রা ক্রীড়ানৈপুণ্যে ভরপুর। জব্বারের কাছ থেকে বল পেয়ে ঢাকার হাশিম যে গোল দিয়ে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল, তা পেশাওয়ারের রাইট ইন ফিরিয়ে দিয়ে দলকে ১-১ গোলের সমতা এনে দিয়েছিল। বাকি সময় ঢাকার চৌকস খেলোয়াড়রা চেষ্টা করেও জয় পায়নি।
পরদিন ১৪ নভেম্বর ঢাকাকে পুনরায় পেশাওয়ারের সাথে খেলার জন্য মাঠে নামতে হয়েছিল এবং সেদিন তারা তাদের ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ২-০ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। সেদিনের অপর কোয়ার্টার ফাইনালে আমাদের রাজশাহী টিম খেলেছিল লাহোরের সাথে এবং তারা ১-১১ গোলের শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে আমাদের ফুটবলকে লজ্জায় ডুবিয়েছিল।
১৫ নভেম্বর প্রথম সেমিফাইনাল শক্তিশালী এবং শিরোপা প্রত্যাশী করাচি অতিসহজেই লাহোরকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
১৬ নভেম্বর ছিল দ্বিতীয় সেমিফাইনাল গতবারের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল বনাম ঢাকা। জাতীয় দলের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দুটো দলই ছিল শক্তিশালী। আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্য খেলা দু’দলই দর্শকদের উপহার দিলেও রেল দলের পক্ষে ভাগ্য হেসেছিল বিধায় গোল করার সুযোগগুলো তারা কাজে লাগাতে পেরেছিল আর ঢাকা সুযোগ পেয়েও সদ্ব্যবহার করতে পারেনি, তাই তাদেরকে ০-৩ গোলের পরাজয় মেনে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। রেল দল এবারও ফাইনালে করাচির দেখা পাওয়ার জন্য ১৮ তারিখের অপেক্ষায় ছিল।
১৮ নভেম্বর, শুক্রবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা। রেল দল বনাম করাচি। করাচির হোম গ্রাউন্ড এই দু’দল পরপর দু’বছর ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল। প্রচুর দর্শক খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন। দেশের অনেক নামি-দামি খেলোয়াড় নিয়ে দু’টিমই ব্যালেন্সড টিম। রেল দলে পাঞ্জাবি খেলোয়াড় বেশি হলেও মাকরানী খেলোয়াড় দ্বারা গঠিত করাচি দল, রেল দল লম্বা লম্বা খেলায় অভ্যস্ত আর করাচির খেলোয়াড়রা ছোট ছোট পাসে দ্রুত গতিতে খেলতে পারদর্শী। দু’টিম তাদের দু’রকম স্ট্র্যাটেজি নিয়ে খেলা আরম্ভ করে। রেল দলের রক্ষণভাগ ছিল পর্বতসম শক্তিশালী। দৈহিক উচ্চতাসম্পন্ন ডিফেন্ডাররা তাদের দায়িত্ব ভালভাবেই পালন করেছিল, বিশেষ করে কাইয়ুম রক্ষণভাগকে সুন্দরভাবে সামাল দিচ্ছিল। করাচির চতুর আর দ্রুতগতির খেলোয়াড়দের আক্রমণ সেখানে গিয়েই শেষ হচ্ছিল। রেল দলের লম্বা লম্বা পাসের সাহায্যে আক্রমণগুলো করাচির ডিফেন্সকে বিচলিত করে রেখেছিল। খেলা খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। খেলার ১৪ মিনিটে রেলের গোলরক্ষক লতিফ আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়লে তারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু বদলি গোলকিপার ফারুক ভাল খেলা প্রদর্শন করে সবার প্রশংসাই কুড়িয়েছিল। করাচির আক্রমণের মূল ভূমিকা পালন করেছিল ইউসুফ (জুনিয়র)। খেলার প্রায় ৭৯ মিনিটে করাচির লেফট আউট মজিদ উঁচু করে একটি শট গোলপোস্টে মেরেছিলÑ যা শূন্যে বাঁক খেয়ে দ্বিতীয় বারের কোণাকুণি দিয়ে পোস্টে ঢুকেছিল। এ অবস্থায় গোলরক্ষক ফারুক ফাই করে পাঞ্চের মাধ্যমে গোল রক্ষা করে। সে সময় গোলরক্ষকের এক পা গোল লাইনের ভেতরে ছিল বলে করাচির খেলোয়াড়রা জোর দাবি জানায়। দর্শকরাও তাদের সাথে মিলে মাঠে গোল গোল চিৎকার শুরু করলে রেফারি ঈশা খান ঘাবড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থেকে লাইন্সম্যানের সাথে পরামর্শ করে বাঁশি বাজিয়ে গোলের সিদ্ধান্ত দেন। অন্যদিকে রেল দল রেফারির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে মাঠে হৈ চৈ করতে থাকে এবং গোলের সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য রেফারির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। রেফারি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। কর্তৃপক্ষ রেল দলকে খেলায় ফিরে আসার জন্য অনুরোধ জানালেও রেল দল গোলের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানায় এবং খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। রেফারি পুরো ১৬ মিনিট অপেক্ষা করে লম্বা বাঁশি দিয়ে খেলা সমাপ্ত করেন। রেল দলের খেলতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে কর্তৃপক্ষ করাচি টিমকে জয়ী এবং ১৯৬৬ সালের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে ঘোষণা করে।
(একাত্তর)
ঢাকা বিভাগের আন্তঃসাবডিভিশনাল ফুটবল টুর্নামেন্ট খুবই জমজমাট এবং আকর্ষণীয় হতো। প্রচুর দর্শকের সমাগম হতো। মহিলারাও মাঠে এসে খেলা উপভোগ করতেন। ১৯৬৬ সালের ঢাকা ডিভিশনের সাবডিভিশনাল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজক ছিল নারায়ণগঞ্জ স্পোর্টস এসোসিয়েশন। ২০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যাল মাঠে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এম কে আনোয়ার (যিনি ঢাকা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন) টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেছিলেন। আমরা (ঢাকা সদর দক্ষিণ) নারায়ণগঞ্জ ‘বি’ দলের বিরুদ্ধে উদ্বোধনী ম্যাচে ২-০ গোলের জয় দিয়ে শুরু করেছিলাম টুর্নামেন্ট। নারায়ণগঞ্জ ‘বি ’ দলের তরুণ খেলোয়াড়রা ভাল খেলা প্রদর্শন করে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আমাদের পক্ষে দুটো গোলই করেছিল জাহাঙ্গীর।
২১ নভেম্বর মানিকগঞ্জ ঢাকা সদর উত্তর টিমকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে পরবর্তী রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। মানিকগঞ্জ বেশ শক্তিশালী দল। তাদের ডিফেন্স যেমন ভাল, তেমনি জোরদার ছিল তাদের আক্রমণ। দলীয় সমঝোতা অত্যন্ত সুন্দর। বিরতির পূর্বেই তারা ঢাকা সদর উত্তরকে, বাটু এবং পর্বতের দেয়া ২-০ গোলে এগিয়ে যায় এবং বিরতির পর তারাই এক এক গোল করে ‘একহালি’ গোল পূর্ণ করে মানিকগঞ্জকে জয় এনে দিয়েছিল।
২২ নভেম্বর আমাদের টিম ঢাকা সদর দক্ষিণ মুন্সীগঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ খেলা মানেই হাইভোল্টেজ ম্যাচ। রাফ এন্ড টাফ ম্যাচ। খেলায় এরকম আবহ সৃষ্টি করতো মুন্সীগঞ্জের পক্ষে প্রতাপ। গাউস, জলিল আনসারী, নজরুল তাকে সহায়তা করতো। আমাদের পক্ষে হাসনাত, নয়া সুলতান, নাজির সব সময় জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতো। খেলা গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। যেদিন আমি খেলায় অংশ নিতে পারিনি, আমাদের ব্যাংক ফুটবল দলের (ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ঢাকা) পক্ষে খেলায় অংশ নিতে কুমিল্লায় যেতে হয়েছিল।
২২ নভেম্বর ‘রকিবউদ্দিন আহম্মদ মেমোরিয়াল গোল্ড কাপ’ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা। স্থানীয় কুমিল্লাা মোহামেডান কাব বনাম ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ঢাকা। একই সাথে এতগুলো ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে আমি ব্যস্ত এবং কান্ত হয়ে পড়েছিলাম। লীগ শেষ করেই আগাখান গোল্ডকাপ একই সাথে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতা, জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ এবং একইসাথে খেলতে হচ্ছে আন্তঃসাবডিভিশনাল ফুটবল আর রকিব উদ্দিন আহম্মদ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমাদের ব্যাংক ফুটবল টিমের শিরোপা জয় করার বহু নজির রয়েছে।
রকিবউদ্দিন আহম্মদ গোল্ডকাপ কুমিল্লা তথা চট্টগ্রাম অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নামকরা ফুটবল টুর্নামেন্ট। জাঁকজমক এবং আকর্ষণীয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। দেশের বড় বড় কাব এতে অংশগ্রহণ করতো। আমাদের ব্যাংক দলের গোলরক্ষক নুরুন্নবী ঢাকা মোহামেডান কাবেরও গোলরক্ষক ছিলেন, পাকিস্তান জাতীয় যুব দলের হয়ে খেলেছেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর গ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি দুটো বইও লিখেছেন। আমাদের ফুল খেলেছিলেন জহির এবং দেবীনাশ; দুজনই পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছেন। আমাদের তিন হাফ আবুল গাউস ও সামাদ ঢাকার বড় বড় কাবের খেলোয়াড়। আমাদের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে ছিল দুর্বল। এক ইন ছিল ওয়ারীর জামিল আক্তার; অপর ইন আমি তখন ঢাকা মোহামেডান কাবের খেলোয়াড় ছিলাম আর লেফট আউট কামালও মোহামেডানে খেলতো। দক্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড ও স্কোরারের ভীষণ অভাব ছিল আমাদের টিমে। অপরদিকে কুমিল্লা মোহামেডান স্থানীয়ভাবে খুবই জনপ্রিয় দল। কুমিল্লা মাঠে তাদেরকে হারানো ছিল দুরূহ ব্যাপার। মাঠের সবরকম সহযোগিতা পেয়ে তারা দাপটের সাথে খেলতো। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াসি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুড়াপাড়ার ছেলে, ছোটখাটো গাট্টা-গোট্টা গড়ন, দ্রুতগতি গোল করায় পারদর্শী। লেফট ইন জগলুলের সাথে চমৎকার বোঝাপড়া, সেও একজন দক্ষ স্কোরার। কুমিল্লার আর এক কৃতী ফুটবলার সলিমউল্লাহ ঢাকায় ইপিআইডিসিটির রাইট আউট, কুমিল্লা মোহামেডানের অন্তঃপ্রাণ খেলোয়াড়। তাদের নির্ভরযোগ্য হাফ মদনের ছোট ভাই লক্ষ্মণ। মদন ১৯৫৯ সালে আমার সাথে অপর ইনের খেলোয়াড়, সেবার আগাখান গোল্ডকাপে আমরা দুজন ঢাকা মোহামেডানের পক্ষে খেলেছিলাম এবং চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
আগে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ডেপুটি কমিশনারের সাথে, তিনি কুমিল্লা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন।
খেলা খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূল হয়েছিল। কুমিল্লা মাঠে সেদিন দশ হাজারেরও অধিক দর্শক দু’দলের এই উঁচু মানের খেলা উপভোগ করেছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলার আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। আমাদের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং সমঝোতার সাথে খেলে উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। খেলার শুরুটা আমাদের চমৎকার হয়েছিল এবং খেলার নিয়ন্ত্রণটাও আমাদের কাছে চলে আসে। আমরা বেশ কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে লেফট আউট কামালের দেয়া গোলে ১-০ এগিয়ে যাই। বিরতি পর্যন্ত আমরা ঐ গোল ধরে রাখলেও বিরতির পর মাঠের চিত্র পাল্টে যায়। আমরা গোল খাব নাÑ এরকম চিন্তা থেকে দল রক্ষণাত্মক খেলার প্রতি ঝুঁকে পড়ে আর এ সুযোগে কুমিল্লা মোহামেডান গোল শোধ করার জন্য সম্মিলিত চেষ্টা চালাতে শুরু করে এবং দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মিনিটে ওয়াসি সফল হয়। গোল করে দলকে সমতায় ফেরায়। খেলা ধীরে ধীরে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আমাদের আক্রমণগুলো সার্প শুটারের অভাবে গোলের সন্ধান পাচ্ছিল না অথচ কুমিল্লা মোহামেডানের লেফট ইন জগলু গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে নেয়।
গোল খেয়ে আমরা রক্ষণাত্মক খেলার চিন্তা বাদ দিয়ে আবার আক্রমণাত্মক খেলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালতে থাকি। গোল করার বেশ কয়েকটি সুযোগও সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আহমেদ হোসেনের ব্যর্থতায় তা সফল হয়নি। খেলা যখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে, ঠিক তখনই সেই চতুর ছটফটে সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াসি তার চাতুর্যের চমক দেখিয়ে নুরুন্নবীকে পরাস্ত করে দলের জন্য তৃতীয় গোলের উপহার এনে দেয়। আর সে সুবাদে কুমিল্লা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব ন্যাশনাল ব্যাংক টিমকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে রাকিব উদ্দিন আহমেদ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন ডেপুটি কমিশনার।
জনপ্রিয় এই ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য গোল্ডকাপটি ডোনেট করেছিলেন মঈনুল ইসলাম, যিনি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের সভাপতি ছিলেন। তিনি তার দাদার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ টুর্নামেন্টের প্রবর্তন করেছিলেন।
কুমিল্লা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব : কবির (গোলরক্ষক), কানু, নুরু, লক্ষ্মণ, বিমল, নিরঞ্জন, সলিমউল্লাহ, মন্টু, ওয়াসি, জগলু এবং মুকুল।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান : নূরুন্নবী (গোলরক্ষক), জহির, দেবীনাশ, আবুল হাসান, গাউস, সামাদ, শাহাবুদ্দিন, জামিল আক্তার, বশীর আহমেদ ও কামাল।
কুমিল্লা থেকে ফিরে আবার নারায়ণগঞ্জ মাঠে নামতে হয়েছিল ২৪ নভেম্বর ড্র হওয়া মুন্সীগঞ্জের সাথে আমাদের (ঢাকা সদর দক্ষিণ) সাবডিভিশনাল ফুটবল ম্যাচ খেলার জন্য। সেদিনও ফলাফল নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। গোলশূন্য ড্র। খেলা হয়েছে ফাটাফাটি। দু’দলের রক্ষণভাগ ছিল মারমুখী। খেলোয়াড়দের দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে খেলার প্রবণতা, তার ওপর ফরোয়ার্ডদের চোখে পড়ার মত ব্যর্থতা আর সবচেয়ে বেশি খেলাকে কলঙ্কিত করেছিল একটি দলের সমর্থকরা মাঠে ঢুকে মারিমারি করায়। খেলা প্রায় ১০ মিনিট বন্ধ ছিল। খেলা শুরু হলে আমাদের সুলতান খুব বাজেভাবে গোল মিস করলে আমরা জয়বঞ্চিত হয়েছিলাম। মজিবুর প্রতাপকে ফাউল করলে, বক্সের বাইরে ফ্রিকিক প্রতাপ মেরেছিল। অল্পের জন্য আমরা বেঁচে যাই। ফলাফল নির্ধারণের জন্য ম্যাচটি তৃতীয় দিনে গড়িয়েছিল।
আগের দিন অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ মানিকগঞ্জকে হারিয়ে ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করে ফেলেছিল। মানিকগঞ্জ দলের দুর্বলতা চোখে পড়ার মত, বিশেষ করে খেলোয়াড়দের সমঝোতার অভাব, ভুল পাস, গোলপোস্টে শট মারার অদক্ষতা। অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ খেলার ১১ মিনিটেই একটি পাল্টা আক্রমণে তাদের লেফট আউট নওয়াবের দেয়া গোলের মাধ্যমে এগিয়ে যায়। ২৮ মিনিটে মানিকগঞ্জের লেফট ইন পর্বতের সজোরে শট গোলরক্ষক স্বপন দর্শনীয়ভাবে রক্ষা করে নারায়ণগঞ্জ সমর্থকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। মানিকগঞ্জের সকল আক্রমণ নারায়ণগঞ্জের শক্তিশালী রক্ষণভাগে গিয়ে হারিয়ে যেত। বিরতির পর নারায়ণগঞ্জ নতুন উদ্যম নিয়ে আক্রমণ চালায়। ৮ মিনিটে নিশিথের শট গোলপোস্টের ওপর দিয়ে চলে যায়। নারায়ণগঞ্জের ফুলব্যাক বিনয় হাত দিয়ে বল খেললে বক্সের বাইরে পাওয়া ফ্রিকিক মানিকগঞ্জের সেন্টার ফরোয়ার্ড জালালের শট ক্রশবারে লেগে বাইরে চলে যায়। দু’দলই যখন গোল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখনই নারায়ণগঞ্জের লেফট ইন গফুর গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয়। খেলা শেষ হওয়ার ৭ মিনিট থাকতে নারায়ণগঞ্জের নূরুল্লাহ গোল করে দলকে ৩-০ গোলের জয় এনে দেয়।
মানিকগঞ্জ খেলোয়াড়রা : তপন (গোলরক্ষক), আফজাল, এরশাদ, নওয়াব আলী, দিপু, বেলাল, তপন, বাটু, জালাল, বরকত এবং আমান। (ক্রমশ.)
এপ্রিল-১৬
(বাহাত্তর)
‘দান দান তিনদান’-এই প্রচলিত কথার মতই আমরা ২৫ নভেম্বর তিনদিনের দিন মুন্সীগঞ্জকে হারাতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাও আবার এক-তিন গোলের ব্যবধানে আর তিনটি গোলই করেছিল ঢাকা সদর দক্ষিণের কৃতী লেফট আউট নাজির। দর্শনীয় হ্যাটট্রিক হয়েছিল। দু’দলের জমজমাট আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে আকর্ষণীয় খেলা খুবই আনন্দ দিয়েছিল উপস্থিত দর্শকদের। ৩০ মিনিট পর্যন্ত উভয় দলই গোল করার যতরকম কসরতÑ সবই করেছিল এবং ৩২ মিনিটে শরফুদ্দিনের এক পাস নাজিরকে প্রথম গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিল। বিরতি পর্যন্ত আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে থাকি। বিরতির পর ১০ মিনিটে সামাদের উঁচু করে দেয়া পাস ধরে নাজির দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে আমরা কিছুটা নির্ভার হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
প্রায় ৩০ মিনিটের সময় শাজাহান সুন্দর একটি লব পোস্টের কাছে দিলে সেটা আরও সুন্দরভাবে হেডের মাধ্যমে নাজির দলের তৃতীয় গোল এবং তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। এরই সাথে আমরা ফাইনাল খেলার জন্য নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম।
মুন্সীগঞ্জের প্লেয়ার লিস্ট : মোতালেব (গোলরক্ষক), হামিদ এবং মধু, আরমান খান, মহসিন, গাউস, নজরুল, রশিদ, সাবের, প্রতাপ এবং নুরু।
২৭ নভেম্বর আন্তঃডিভিশনাল (ঢাকা) ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল। নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ বনাম ঢাকা সদর দক্ষিণ। স্বাগতিক দলকে সমর্থন জানাতে প্রচুর দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিল। মাঠে উপচেপড়া দর্শক সীমানা দাগের ওপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখা খেলোয়াড়দের স্বচ্ছন্দে খেলার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দল শক্তিশালী হলেও নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ দল ছিল খুব কম্বাইন্ড। বহুদিন ধরে তারা খেলছে।
জেতার জন্য দু’দলই খেলার শুরু থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়েছিল। আমরা বলের নিয়ন্ত্রণ প্রথম থেকে নিতে সক্ষম হয়েছিলাম এবং পরপর কয়েকটি আক্রমণ করে বিপক্ষ দলকে কোণঠাসা করে রাখি। কিন্তু তাদের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের দৃঢ়তার জন্য আমরা সফল হতে পারছিলাম না। আচমকা নিশিথ গোল করে আমাদেরকে অবাক করে দিয়েছিল তখন। খেলা মাত্র ১২ মিনিট গড়িয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের রাইট আউট নুরুল্লাহ আমাদের গোল এরিয়ায় একটি লব করলে নিশিথ কোত্থেকে এসে লাফিয়ে উঠে সবার মাথার ওপর দিয়ে হেড করে জালে বল পাঠিয়ে দিয়ে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। আমরা গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকি। এমনকি আমাদের পুরো দলই আক্রমণে উঠে যায় কিন্তু কিছুই হচ্ছিল না। উপরন্তু বিরতির ঠিক পূর্বমুহূর্তে নারায়ণগঞ্জের লেফট ইন আমিনের কাছ থেকে বল পেয়ে লেফট আউট নওয়াব বুলেটের মত শট মেরে আমাদের গোলরক্ষক ইউসুফকে পরাস্ত করে ২ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। বিরতির পর আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলা ভুলে গিয়ে গোল করার জন্য মেতে উঠেছিলাম। সম্মিলিত আক্রমণের পরিবর্তে একক প্রচেষ্টায় গোল করার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম কিন্তু নারায়ণগঞ্জের দলগত শক্তিকে আমরা পরাস্ত করতে পারছিলাম না। এতটুকুও ছাড় দিচ্ছিল না ওরা। তাছাড়া আমাদের এলোমেলো খেলায় শুধু সময় নষ্ট হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ০-২ গোলের হার মেনে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। খেলা শেষে বোর্ড অব রেভিনিউ’র সদস্য গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পুরস্কার বিতরণ করেন।
এখানে একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, নারায়ণগঞ্জ জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশন উপর্যুপরি সাত বছর এই ফুটবল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিরল গৌরব অর্জন করেছিল।
নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ দল : স্বপন (গোলরক্ষক), বিনয়, গিয়াসউদ্দিন, নুরুল ইসলাম, কানু, নুরুল আমিন, নুরুল্লাহ, প্রতুল, নিশিথ, গফুর ও নবাব আলী।
ঢাকা সদর দক্ষিণ : ইউসুফ (গোলরক্ষক), মজিবর, হাসনাত, নয়া রফিক, সামাদ, শাজাহান, শরফুদ্দিন, সুলতান, বশীর এবং নাজির।
১৯৬৬ সালে রাশিয়ার ফুটবল টিম পাকিস্তান সফরে এসেছিল। রাশিয়ার কিরঘিজস্তান প্রজাতন্ত্রের আলগা ফুটবল কাব ১৬ দিনের সফরে করাচি, লাহোর এবং ঢাকায় তিনটি টেস্ট ম্যাচ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পেশাওয়ার ও সারগোদা আর পূর্ব পাকিস্তানে চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৪টি এক্সিবিশন ম্যাচ খেলার উদ্দেশ্যে ২০ নভেম্বর করাচি এসে পৌঁছেছিল।
পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশন তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য তোরাব আলীর নেতৃত্বে ২২ জন খেলোয়াড় বাছাই করেছিল।
গোলরক্ষক-আব্দুল লতিফ (রেলওয়ে), পারভেজ (আর্মি); রাইন ফুলব্যাক- মুরাদ বক্স (করাচি), আসলাম (লাহোর), লেফট ফুল ব্যাক- কাদের বক্স (ঢাকা), হোসেন বক্স (করাচি), রাইট হাফ-ইউনুস (রেলওয়ে), মাওলা বক্স (জুনিয়র, করাচি), সেন্টার হাফ- তোরাব আলী (অধিনায়ক, ঢাকা), ইসমাইল রুশো (করাচি), লেফট হাফ-আব্দুল গফুর (ঢাকা), গফফার (করাচি), রাইট আউট-গফুর (পেশাওয়ার), মীর দাদ (করাচি), রাইট ইন-আইয়ুব দার (রেলওয়ে), মাওলানা বক্স (সিনিয়র, করাচি), সেন্টার ফরোয়ার্ড-ওমর (ঢাকা), আসলাম (ঢাকা), লেফট ইন-আব্দুল হাশিম (ঢাকা), মোহাম্মদ তাকি (করাচি), লেফট আউট-মুসা (ঢাকা), মজিদ (করাচি)।
এখানে একটি বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য পাকিস্তান দলে সাতজন খেলোয়াড় ঢাকার প্রতিনিধিত্ব করেছিল অথচ একজন খেলোয়াড়ও ঢাকার অধিবাসী ছিল না বা পূর্ব পাকিস্তানী বা বাঙালি ছিল না; সবাই ছিল করাচির।
২১ নভেম্বর করাচিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল হকি কাব অব পাকিস্তান স্টেডিয়ামে। স্বাগতিক পাকিস্তান টিম শুরুটা ভাল করেছিল; বিশেষ করে দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমরের খেলা প্রশংসিত হয়েছিল এবং তারই করা গোলে পাকিস্তান টিম ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। আলগা কাব দলকে গুছিয়ে নিতে একটু সময় নিয়েছিল। তারপর তাদের দলীয় ক্রীড়ানৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়ে পাকিস্তানকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে তাদের ফুটবল সফরের শুভ সূচনা করেছিল।
আলগা ফুটবল কাব তাদের প্রথম প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল পেশাওয়ার একাদশের বিরুদ্ধে। প্রধান অতিথি হিসেবে খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সিইনসি এয়ার মার্শাল নূর খানের সাথে। তিনি সে সময় পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। সফরকারী দল ৩-০ গোলে জয়লাভ করে তাদের জয়যাত্রা অুন্ন রেখেছিল। পরবর্তী প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলতে আলগা ফুটবল কাব উপস্থিত হয়েছিল লায়ালপুরে। সারগোদা ডিভিশনাল ফুটবল ফেডারেশনের সম্পাদক চৌধুরী গোলাম রসুল যিনি পাকিস্তান জাতীয় দলের হকি খেলোয়াড় ছিলেন (অলিম্পিয়ান), তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
লায়ালপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের প্রধান অতিথি ছিলেন সারগোদা ডিভিশনের কমিশনার মোহাম্মদ হোসেন। খেলোয়াড়দের তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। ৪-০ গোলের জয় আলগা ফুটবল কাবের জয়ের চাকাকে সচল রেখেছিল। ২৭ নভেম্বর লাহোরে দ্বিতীয় ফুটবল টেস্টে আলগা ফুটবল কাব ২-০ গোলে পাকিস্তান ফুটবল টিমকে হারিয়ে সিরিজ জয় করেছিল। স্বাগতিক দল খুব খারাপ খেলে সবাইকে হতাশ করেছিল, বিশেষ করে আক্রমণভাগের খেলা ছিল জঘন্যতম। পশ্চিম পাকিস্তানে খেলা শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে দুটি প্রদর্শনী ম্যাচ এবং একটি টেস্ট ম্যাচ খেলার উদ্দেশ্যে আলগা কাব ২৮ নভেম্বর লাহোর থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল। চট্টগ্রাম এবং খুলনায় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন ২৫ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করেছিল। বাছাইকৃত খেলোয়াড়রা হলো : গোলরক্ষক-রানা এবং অনাথ। ফুলব্যাক-কাদের, তোরাব আলী, রফিক সালেহ এবং সামাদ। হাফব্যাক-গফুর, আলী হাফিজ, কায়কোবাদ, ফারুক, পিন্টু এবং আব্দুল্লা আকবর। ফরোয়ার্ড-সলিমউল্লাহ, প্রতাপ, বশীর, হাফিজউদ্দিন, আসলাম, ওয়াসি, গফুর, সুলতান, জামিল আক্তার, টিপু এবং হাশিম। কোচ-এসএ রশিদ।
২৯ নভেম্বর আলগা ফুটবল কাবের বাংলাদেশে প্রথম প্রদর্শনী খেলা গভর্নর একাদশের বিরুদ্ধে। দর্শকে পরিপূর্ণ নিয়াজ স্টেডিয়ামে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফুটবলপ্রিয় মানুষ মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন একটি প্রাণবন্ত এবং আকর্ষণীয় ফুটবল ম্যাচ দেখার উদ্দেশ্যে। অনেকে আবার স্মরণ করলেন দু’বছর আগে রাশিয়ার বাকু অয়েল ফুটবল টিম চট্টগ্রামে এসে ম্যাচ খেলে যাওয়ার। সেদিনও নিয়াজ স্টেডিয়াম দর্শকে পরিপূর্ণ ছিল। তারা উপভোগ করেছিলেন বাকু অয়েল ফুটবল টিমের ব্যক্তিগত এবং দলগত ক্রীড়ানৈপুণ্য আর মনমাতানো খেলা।
আলগা ফুটবল কাব ও তাদের উঁচুমানের খেলা প্রদর্শন করে শুরু থেকে আমাদের ওপর চেপে বসেছিল। তাদের দলীয় সমঝোতা এবং নিখুঁত পাস ছিল খেলার মূল আকর্ষণ। দেশের কৃতী খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া আমাদের টিম তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে খেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু তাদের দলের রাইট-ইন স্ট্রেল্টজভ দক্ষতার সাথে গোল করে বিরতির আগেই তার দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির পর আমরা গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। খেলা আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে বেশ জমে উঠেছিল। গোল শোধ করার সুযোগও এসেছিল কিন্তু পোস্টে এলোমেলো আর দুর্বল শুটিং-এর জন্য আমরা সফলতা পাচ্ছিলাম না। অন্যদিকে আলগা ফুটবল কাব বিরতির পর যেন জ্বলে উঠেছিল। তাদের খেলার গতি বেড়ে গিয়েছিল। তাদের ছন্দময় খেলা প্রতিরোধ করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম, বিশেষ করে তাদের গতিসম্পন্ন আক্রমণ রুখতে আমাদের ডিফেন্সকে ভীষণ পরিশ্রম এবং দৃঢ়তার সাথে খেলতে হচ্ছিল। তবে তাদের দলীয় সমঝোতা এবং উপযুক্ত পরিকল্পনার কাছে আমরা হার মানতে বাধ্য হয়েছিলাম। অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড দলীয় অধিনায়ক মেরজিলিকিন দু’গোল এবং রাইট-ইন স্টেল্টজভ করেছিল দুটি গোল।
আলগা ফুটবল কাব পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রথম প্রদর্শনী খেলায় ৪-০ গোলের জয় দিয়ে সফর শুরু করেছিল। তাদের দ্বিতীয় প্রদর্শনী ম্যাচ ছিল খুলনায় পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট একাদশের বিপক্ষে। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন খানএ সবুর এবং তার বাড়ি খুলনায়। তার সম্মানার্থে প্রদর্শনী ম্যাচ খুলনায় আয়োজন করা হয়েছিল। ১ ডিসেম্বর খুলনা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ম্যাচে প্রধান অতিথি হিসেবে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন। শেষ প্রদর্শনী খেলার ফলাফলটাও আলগা ফুটবল কাব নিজেদের করে নিয়েছিল ৩-০ গোল দিয়ে।
(ক্রমশ.)
মে-১
(তেয়াত্তর)
৩ ডিসেম্বর ছিল তৃতীয় এবং ফাইনাল টেস্ট ম্যাচ। রাশিয়ার আলগা ফুটবল কাব পাকিস্তানকে ৭-২ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনাল টেস্টের জন্য পূর্ব গ্যালারির টিকিট ২ রুপি এবং পশ্চিম গ্যালারি ৪ রুপি ধার্য করা হয়েছিল। আলগা ফুটবল কাব সফরের শেষ খেলায় তাদের ক্রীড়াশৈলী উজাড় করে দিয়েছিল ঢাকা মাঠে। তাদের দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলা ঢাকার দর্শকরা দারুণ উপভোগ করেছিল। তাদের ব্যক্তিগত এবং দলগত নৈপুণ্য পাকিস্তান খেলোয়াড়দের চেয়ে অনেক উন্নতÑ যা মাঠে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। পাকিস্তানের খেলা দেখে কেউ বুঝতে পারছিল না যে, একটা জাতীয় দলের খেলা। খেলোয়াড়দের ফিটনেসের যেমন অভাব, তেমনি দলীয় সমঝোতার অভাব, এলোমেলো খেলা, অগোছালো আক্রমণ, দুর্বল শুটিং, বিশেষ করে গোলপোস্টে কখন কেমন করে মারতে হবেÑ সেটাও যেন তারা ভুলে গিয়েছিল! সব মিলিয়ে এতই হতচ্ছিরি খেলাÑ যা দেখে দর্শকরা শুধু হতাশই হননি বরং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আলগা ফুটবল কাব পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল টিমকে নিয়ে সেদিন মাঠে ছেলেখেলা খেলেছিল। পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের- তাদের পেছনে ছুটোছুটি করতে দেখে দর্শকরা হাসাহাসি করেছিলেন। রক্ষণভাগে মুরাদ বক্স এবং কাদের বক্স পরিশ্রম করে না খেললে গোলের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেত। গফুর ও তোরাব আলী আলগা কাবের আক্রমণকে সামাল দিলেও তারা তাদের সেরাটা খেলতে পারেনি। রাশিয়ার প্রত্যেকটি খেলোয়াড় চমৎকার খেলা প্রদর্শন করলেও তাদের ক্যাপ্টেন মেরজিলিকিনের খেলা সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল; বিশেষ করে তার গোলপোস্টে নিখুঁত শুটিং এবং গোল করার দক্ষতা অপূর্ব। এক বাক্যে বলা যায়Ñ সে মাঠের সেরা খেলোয়াড়।
খেলা শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান জাতীয় দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর গোল করার একটা সুযোগ নষ্ট করে। এরপরই রাইট আউট গাফফার আরেকটি সুযোগ বাজেভাবে মিস করেছিল। খেলার শুরুতে পাকিস্তানী আক্রমণ আলগা কাবকে কিছুটা অস্থির করে তুললেও তারা নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যেই। নিখুঁত পাশিং এবং দ্রুতগতির আক্রমণে খেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তারা। খেলার চল্লিশ মিনিটে তারা গোল করতে সফল হয়েছিল। গোল করেছিল স্ট্রাইকার স্ট্রেসোট, ১-০। তার পাঁচ মিনিট পর দলের অধিনায়ক মেরজেলিকিন গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে (২-০)। বিরতি আগ মুহূর্তে মুসা গোল করে ব্যবধান কমায় (২-১)। বিরতির পর খেলা সম্পূর্ণ আলগা কাবের কাছে চলে যায় এবং অধিনায়ক মেরজিলিকিন দ্রুত গোল করে ৩-১ দলকে এগিয়ে নেয়। ২০ মিনিটে রাইট উইংগার সুবিন দলের ৪র্থ গোল করেছিল দুর্দান্ত কিক মেরে (৪-১)। পাকিস্তানও দুটি ফ্রি-কিক পেয়েছিল আলগা কাবের পোস্টের কাছে কিন্তু কাজে লাগাতে পারেনি। ৩৫ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় ফেমিন গোল করে দলকে (৫-১) বড় জয়ের দিকে নিয়ে যায়। একটি কমন বল ধরতে গিয়ে গোলরক্ষক কোজায়েভ এবং হাশিমুদ্দিনের সাথে ধাক্কা লেগে বল গোলপোস্টে ঢুকে যায়। সাথে সাথে পাকিস্তানের পক্ষে গোলের সংকেত দেন রেফারি মাসুদুর রহমান (৫-২)। খেলা শেষ হওয়ার আগে অল্প ব্যবধানে অধিনায়ক মেরজিলিকিন আরও দু’গোল করে দলকে (৭-২) বড় ব্যবধানের জয় এনে দেয়। রাশিয়ার আলগা ফুটবল কাব অপরাজিত থেকে তাদের ১৬ দিনের পাকিস্তান সফর শেষ করেছিল।
আলগা ফুটবল কাব : কেরায়েভ (কোজায়েভ), সুলতানোভ-মাকারোভ, শেভচেনকভ এবং মিটনেসনকভ, বিবেয়ি এবং ইনজভ, স্ট্রেল্টভ মেরজিলিকিন, সুভিন এবং ইয়াগোশভ।
পাকিস্তান জাতীয় দল : লতিফ (গোলরক্ষক), মুরাদ বক্স, তোরাব আলী এবং হোসেন বক্স, কাদের এবং আবদুল গফুর, গাফফার (আইয়ুব দার), মাওলা বক্স, ওমর, হাশিম উদ্দিন এবং মুসা।
পূর্ব পাকিস্তনের গভর্নর আবদুল মোমেন খান আলগা ফুটবল কাব এবং পাকিস্তান ফুটবল দলকে বঙ্গভবনে চা-চক্রে আপ্যায়িত করেছিলেন এবং ইপিএসএফ হোটেল শাহবাগে নৈশভোজের আয়োজন করেছিল।
১৯৬৬ সালে ঢাকায় আমরা দুটো ফুটবল লীগ খেলার মাধ্যমে ফুটবল মৌসুম শুরু করেছিলাম। প্রথমটি ঢাকা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে ডিডিএসএ ফুটবল লীগ, যা ২৯ এপ্রিল শুরু হয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি ছিল ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ, যা শুরু হয়েছিল ২০ মে থেকে। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব দুটো লীগে অংশ নিলেও পরবর্তীতে ডিডিএসএ ফুটবল লীগ থেকে দল প্রত্যাহার করে নেয়ায় আমার সে লীগে খেলার আর সুযোগ হয়নি; যার জন্য সে লীগ সম্বন্ধে বিস্তারিত লেখাও সম্ভব হয়নি। তবে ডিডিএসএ লীগ শেষে অংশ নেয়া ১১ দলের অবস্থান কি ছিলÑ তা সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি।
দল খেলা জয় ড্র পরাজয় পক্ষে বিপক্ষে পয়েন্ট
ইপিআইডিসি ১০ ৭ ৩ ০ ৩২ ১ ১৭
পুলিশ ১০ ৭ ২ ১ ১৭ ৬ ১৬
ফায়ার সার্ভিস ১০ ৬ ৪ ০ ১৩ ৬ ১৬
আজাদ স্পোর্টিং ১০ ৪ ২ ৪ ৬ ১১ ১০
হোল্ডেন একাদশ ১০ ৩ ৪ ৩ ৬ ২২ ১০
বিজি প্রেস ১০ ৩ ৩ ৪ ৫ ২৪ ৯
আজাদ পাকিস্তান ১০ ৩ ২ ৫ ৫ ২০ ৮
টিটি সেন্টার ১০ ৩ ২ ৫ ৫ ২৭ ৮
প্যানোরমা ১০ ২ ২ ৬ ৩ ৮ ৬
ভিক্টোরিয়া ১০ ১ ২ ৭ ৬ ১০ ৪
পাক পিডব্লুডি ১০ ১ ২ ৭ ৩ ৭ ৪
১৯৬৬ সালেও পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গন সাংগঠনিক দিক দিয়ে গুছিয়ে উঠতে পারেনি। সুশৃংখল এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক খেলাধুলার নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালনার দায়িত্ব ইপিএসএফ-এর ওপর ন্যস্ত থাকলেও এপিএসএফ-এর পাশাপাশি কয়েকটি খেলা নিজস্ব এসোসিয়েশনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। যেমন ইস্ট পাকিস্তান সাইকিং এসোসিয়েশন, যার সভাপতি ছিলেন এসএম জহুরুদ্দিন, জিমন্যাস্টিক এসোসিয়েশন অব ইস্ট পাকিস্তান, যার সভাপতি ছিলেন এ এ সিদ্দিকী এবং সহ-সভাপতি সৈয়দ ওদুদ চৌধুরী; অ্যামেচার রেসলিং এসোসিয়েশন অব ইস্ট পাকিস্তান, যার সভাপতি ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান এবং সহ-সভাপতি ছিলেন এসএ মহসিন।
জাতীয় ফেডারেশন কর্তৃক এই তিনটি এসোসিয়েশন বিলুপ্ত ঘোষণা করে ইপিএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ক্রীড়াঙ্গনকে আরও সুচারুভাবে পরিচালনা এবং স্থবির হয়ে পড়া (প্রশাসনের গতি সঞ্চারের কারণ দেখিয়ে) ১৯৬২ সালের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতা বলে ইপিএসএফ সভাপতি নির্বাচিত দ্য ইউনাইটেড স্পোর্টসম্যান কাউন্সিল যারা স্পোর্টস প্রমোটারস ফ্রন্টকে পরাজিত করে কমিটি গঠন করেছিল, ১৯ অক্টোবর ১৯৬৬ সে কমিটি ভেঙ্গে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট শক্তিশালী এডভাইজরি কমিটি গঠন করেছিলেন- যা নিচে উপস্থাপন করা হলো।
সভাপতি এসবি চৌধুরী, ডিভিশনাল কমিশনার, ঢাকা; সহা-সভাপতি এম কে আনোয়ার, ডেপুটি কমিশনার, ঢাকা; সাধারণ সম্পাদক আজহার উদ্দিন খান, সহকারী চিফ ইঞ্জিনিয়ার, সিএন্ডবি,
ট্রেজারার মঈনুদ্দিন চৌধুরী, চেয়ারম্যান, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি
সদস্য : এসএ মজিদ (ডিডিএসএ), সাইফুদ্দিন আহমেদ (আজাদ স্পোর্টিং), সৈয়দ মফিজউদ্দিন (মোহামেডান স্পোর্টিং), এস হুদা (ওয়ারী), একেএম জাকারিয়া (বিজি প্রেস), এ তৌফিক (পিআইএ), এ গফুর (পিই রেলওয়ে), এসএম হুদা (বার্মা ইস্টার্ন), এ মালেক (ভিক্টোরিয়া), এ এ সিদ্দিকী (প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, ইপিএসএফ), সিদ্দিকুর রহমান (ফায়ার সার্ভিস), মতিউর রহমান (ঢাকা ইউনিভার্সিটি), ওয়াজেদ আলী (ঢাকা ওয়ান্ডারার্স), নওয়াব খাজা হাসান আসকারি এবং মাওলানা গফুর (ইপরোয়া), আলহাজ্ব কফিলুদ্দিন (পাক পিডব্লুডি) এবং এস ইসলাম (আনসার)। দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ক্রীড়া সংগঠকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য আসবে বলে সবাই উৎসাহিত হয়েছিল।
১৯৬৭ হকি মৌসুমটা আমরা যারা ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হকি খেলোয়াড় ছিলাম, আমাদের জন্য ছিল অনিশ্চয়তার। কারণ এবার আমাদের টিম লীগ খেলায় এন্ট্রি করেনি। ১৯৬৩-৬৪ সালে প্রথম এন্ট্রি করে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। গত বছরের (১৯৬৫-৬৬) অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন যে টিম এবারের প্রথম বিভাগ হকি লীগে অংশগ্রহণ করবে না, এটা যেন ক্রীড়াঙ্গনে একটা আশ্চর্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবার একটাই প্রশ্নÑ কেন ব্যাংক টিম হকি লীগ খেলছে না? সঠিক উত্তর আমাদেরও জানা ছিল না। শুধু এটুকু শুনেছি যে, কাজের ক্ষতি করে ব্যাংকের অর্থ অপচয় করে খেলাধুলার প্রয়োজন নেই। হয়তোবা ব্যাংকের মুনাফা প্রয়োজন অনুযায়ী অর্জন হয়নি কিংবা অন্য কারণ থাকতে পারে। এদিকে হকি লীগ শুরু হয়ে গিয়েছিল ডিসেম্বর ’৬৬। গতবারের যুগ্ম রানার্স দল ওয়ারী এবং কম্বাইন্ড লীগ ম্যাচে অংশ নিচ্ছে অথচ আমরা খেলতে পারছিলাম নাÑ এটা ছিল আমাদের জন্য খুবই কষ্টের। আমরা যারা ১৯৫৯ সালে ব্যাংকে চাকরিতে ঢুকেই ব্যাংকের খেলাধুলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম, হকি লীগে অংশগ্রহণ না করার ব্যাংক সিদ্ধান্তটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমরা খেলোয়াড়রাই তখন ক্রীড়াঙ্গনে যারা উচ্চ পর্যায় ছিলেন, যারা সুপরিচিত সংগঠক, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, যারা আমাদেরকে স্নেহ করতেনÑ তাদের দ্বারস্থ হয়ে ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে হকি লীগে ন্যাশনাল ব্যাংকের টিমে এন্ট্রি করার জন্য রাজি করানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সে সময়ের ক্রীড়াব্যক্তিত্ব এবং সবার সম্মানের পাত্র মহসিন ভাই আমাদের ডিএমডি মি. মেকেকনি সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলে ডিএমডি সাহেব রাজি হয়েছিলেন এবং লীগের বেশ কয়েকটি খেলা হয়ে যাওয়ার পরও গত বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংক ১৯৬৭ সালে প্রথম বিভাগ হকি লীগ খেলার সুযোগ পেয়েছিল। ১৫টি টিম নিয়ে হকি লীগ শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত ১৬টি টিম লীগ খেলায় অংশ নিয়েছিল : ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ঢাকা, ওয়ারী কাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে, ইস্পাহানী, মাহুৎটুলী, ঢাকা মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, আজাদ স্পোর্টিং, পাকিস্তান স্পোর্টিং, পাক পিডব্লিউডি, পুলিশ এসি, ফায়ার সার্ভিস, ইস্ট বেঙ্গল কাব, পাকিস্তান এয়ারফোর্স।
মে-১৬
(চুয়াত্তর)
১৯৬৭ সালের ঢাকা প্রথম বিভাগ হকি লীগ ওয়ারী কাব এবং পুলিশ এসি’র খেলার মধ্য দিয়ে ২৮ ডিসেম্বর ’৬৬ শুরু হয়েছিল। গতবারের লীগে যুগ্ম রানার্সআপ দল ওয়ারী কাব সহজেই ৩-১ গোলে পুলিশকে হারিয়েছিল। ওয়ারীর সহিদ দু’গোল এবং শেরার এক গোলের বিপরীতে পুলিশের আখতার একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। পরদিন গতবারের লীগে অপর যুগ্ম রানার্স টিম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং প্রতাপ শংকর হাজরার দর্শনীয় হ্যাটট্রিক এবং বুলবানের দেয়া এক গোলের সুবাদে আজাদ স্পোর্টিংকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে লীগের শুভসূচনা করেছিল। দিনের অপর খেলায় সাজিদের একমাত্র গোলের ওপর ভর করে পিডব্লিউডি ১-০ গোলে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। বছরের শেষদিনে ইস্পাহানী কাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে রেকর্ডসংখ্যক ১৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। ইস্পাহানীর ইসলাহউদ্দিন তার যাদুকরী স্টিক ওয়ার্ক এবং দ্রুতগতির সাহায্য দুটি দর্শনীয় হ্যাটট্রিকসহ এগারো গোল একাই করেছিল। ইসলাহ করাচি থেকে ঢাকায় লীগ খেলার জন্য এসেছিল। পরবর্তীতে সে একজন চৌকস রাইট আউট হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে অলিম্পিক, ওয়ার্ল্ডকাপসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন্সি করেছে। জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছে। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের ডিফেন্স একেবারেই ভেঙ্গে গিয়েছিল গোল করতে বাধা দেয়ার কেউ ছিল না। ইস্পাহানীর ফুলব্যাক শফিক, সেও করাচির খেলোয়াড়, এক গোল করেছিল, সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার দু’গোল করলে বাকি একটি গোলও করাচির খেলোয়াড় লেফট-ইন আজিজ করেছিল। ইস্পাহানী টিমে সেদিন যারা খেলেছিল, তাদের তালিকা : আফজাল (গোলরক্ষক), সোলায়মান, শফিক এবং জাওয়েদ, আফসার এবং জাফর, মোদাস্সার ইসলাহউদ্দিন, হায়দার আজিজ এবং আজিম। আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় রেলটিমের নিয়াজের প্রথমার্ধের একমাত্র গোলে পাকিস্তান স্পোর্টিং পরাজিত হয়েছিল। খেলাটি বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল, দু’টিমই জেতার জন্য খেলেছিল। ০১-০১-৬৭ তারিখে রেল দল ৯ গোলের বিরাট জয় দিয়ে শুভ নববর্ষ উদযাপন করেছিল। তারা আজাদ স্পোর্টিংকে ৯-০ গোলে হারিয়েছিল। দিনটি ছিল লেফট-ইন নিয়াজের। স্টিকের ঝলকানি দিয়ে সে একাই করেছিল ছয় গোল। বাকি তিনটি গোল এসেছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড কলিম, রাইট-ইন আমিন এবং রাইট আউট হামিদের স্টিক থেকে।
রেল দলের খেলোয়াড় তালিকা : নবী (গোলরক্ষক), আখতার এবং ইদ্রিস, সামি কলিম এবং আবিদ, হামিদ, নাসিম, কাইফুল, নিয়াজ এবং মোহাম্মদ আলী।
দিনের অপর খেলায় ওয়ারী ২-১ গোলে এয়ারফোর্স টিমকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ারীর পক্ষে গোল করেছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড শহিদ এবং রাইট আউট নাওয়াজিস আর এয়ারফোর্সের গোল করেছিল লেফট-ইন আফজাল। বছরের দ্বিতীয় দিনে মোহামেডান চিরশত্রু ওয়ান্ডারার্সকে ৪-১ গোলে হারিয়ে হকি লীগ শুরু করেছিল। লেফট-ইন জিয়া এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড উভয় দু’গোল করে করেছিল মোহামেডানের পক্ষে আর ওয়ান্ডারার্সের বজলু একটি গোল করে ব্যবধান কমাতে পেরেছিল। অপর খেলায় পুলিশ এবং পিডব্লিউডি ১-১ গোলে ড্র করে পুলিশের মোহাম্মদ আলী আর পিডব্লিউডি’র রানা গোল করেছিল।
৩ জানুয়ারি ইস্পাহানী এবং মাহুতটুলী নিজ নিজ খেলায় বড় ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল। ইস্পাহানী পুলিশ টিমকে ৫-০ গোলে হারিয়েছিল। হাফ টাইমের পূর্বেই তারা ৪-০ গোলে এগিয়ে যায়। রাইট-ইন-ইসলাহউদ্দিন ৩ গোল করেছিল বাকি ২ গোল সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার এবং লেফট-ইন আজিজ করেছিল। মাত্র দুই ম্যাচেই ইসলাহউদ্দিন ১৪ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার দৌড়ে অনেক দূর এগিয়ে যায়। আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় মাহুতটুলী ইস্টবেঙ্গল কাবকে ৮-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। চমৎকার হ্যাটট্রিক করেছিল তাদের লেফট-ইন ফজলু। মাহুতটুলী টিমে যারা সেদিন খেলেছিল- আরেফিন (গোলরক্ষক), হাসান এবং বারী, মহসিন মজিবুর এবং পুতুল, খায়ের হাফিজুল্লাহ ইকবাল ফজলু এবং নাঈম। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব আজাদ স্পোর্টিংকে ৪-১ গোলে হারিয়ে তাদের জয়ের ঢাকা সচল রেখেছিল। আবদুর রাজ্জাক দর্শনীয় হ্যাটট্রিক করেছিল যার সব কৃতিত্ব তারই পাওনা। চতুর্থ গোল করেছিল লেফট-ব্যাক কামার এবং আজাদের রাইট-ইন টিপু একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। স্টেডিয়ামে মাহুতটুলী প্রথম তাদের পয়েন্ট খুইয়েছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। মাহুতটুলী লেফট আউট নাঈমের দেয়া গোলে এগিয়ে যায় কিন্তু পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর রাজা গোল করে দলকে সমতায় ফেরায়। পাকিস্তান স্পোর্র্টিং কাবের হয়ে যারা খেলেছিল : মোমতাজ (গোলরক্ষক), নাঈম এবং কামাল, তাইমুর, হাফিজ এবং আনোয়ার, রশীদ, নাসের, রাজা, লতিফ এবং বুলবুল।
পিডব্লিউডি টিমের আরেকটি হার (২য় হার)। ইস্পাহানী টিমের ১-০ গোলে জয়লাভ আর জয়ের নায়ক হলো সেই ইসলাহউদ্দিন যে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলের অধিকারী। পিচ্ছিল মাঠে দু’টিমই খুব সতর্কতার সাথে খেলছিল, খেলাটিও হয়েছিল খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। প্রথমার্ধের প্রায় বিশ মিনিটে ইস্পাহানীর লেফট ইন আজিজ ক্ষিপ্রতার সাথে বিপক্ষ খেলোয়াড়দের ডজ দিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে পরে ইসলাহকে বল দিলে গোলরক্ষক রাস করে আসলে ইসলাহ চাতুর্যের সাথে বল পুষ করে জালে জড়িয়ে দেয়। বিরতির পর পিডব্লিউডি গোল শোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কিন্তু সফল হতে পারেনি। পিডাব্লিউডি টিম লিস্ট : ইলিয়াস (গোলরক্ষক), মেরু এবং আইয়ুব খান, মকবুল পাঠান জাফর হোসেন, শেখ গনি, মজিদ রানা এবং ইফতেখার।
এখানে একটি বিষয়ে জানাতে চাই যে, পিডব্লিউডি টিমের রাইট ফুলব্যাক মেরু, পাকিস্তান মাঠের কাছে তার বাড়ি, সুন্দর একটি তরুণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে চাকরিরত অবস্থায় সে নিহত হয়েছিল। পুলিশ ৫-০ গোলে ওয়ান্ডারার্সকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট লাভ করেছিল। পুলিশ টিম প্রথমার্ধে মাত্র একটি গোল দিতে পেরেছিল আর সে গোলটি করেছিল নাজির। বিরতির পর আখতার দুই গোল এবং নাজির করেছিল আরও দু’গোল। পুলিশ টিমের প্লেয়ার লিস্ট : মান্নান (গোলরক্ষক), আখতার এবং শুক্কুর, রকিব, রফিক এবং আয়নুল, আকবর, গফুর, নাজির, মোহাম্মদ আলী এবং শরিফ।
১০ জানুয়ারি শক্তিশালী কম্বাইন্ড স্পোর্টিং বিমান বাহিনীকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল। প্রতাপের পাশ থেকে বুলবান প্রথম গোল করে। এরপরই বিমানবাহিনীর আফজাল ডি বক্সের ভেতর সিকান্দার আলীকে পাস দিলে সে বাইরে মেরে একটি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করে। কম্বাইন্ড ও অনুরূপ একটি গোল করার সুযোগ নষ্ট করেছিল যখন প্রতাপের দেয়া পাশ ওমেদ তালগোল পাকিয়ে বল পোস্টে হিট করতে ব্যর্থ হয়েছিল। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটে প্রতাপ একক চেষ্টায় ডি’তে ঢুকে সজোরে হিটের মাধ্যমে গোলরক্ষককে পরাস্থ করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিমান বাহিনী বিরতির পর খেলায় ফিরে আসে এবং বেশ অনেকগুলো আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাদের দক্ষ হিটারের অভাবে গোল পায়নি। খেলার শেষের দিকে ওমেদ আলী দলের গোলসংখ্যা বাড়িয়ে ৩-০ গোলের জয় এনে দেয়।
কম্বাইন্ড প্লেয়ার লিস্ট : সাদেক (বড়) (গোলরক্ষক), কাদের এবং সাব্বির, লস্কর, সাদেক এবং মহসিন, সিকেন্দার, বুলবান ওমেদ, প্রতাপ এবং রহমান।
বিমানবাহিনী : নূর আলম (গোলরক্ষক), তারেক এবং শফিক, হাবিব ইকবাল এবং সাঈদ, রিয়াজ, নিয়াজি, সিকান্দার আলী, আফজাল, আমানউল্লাহ।
১৯৬৬ সালে এশিয়ান গেমসে পাকিস্তান ভারতের কাছে শিরোপা হারানোর পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সিএনসি এয়ার মার্শাল নূর খানকে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালনের নির্দেশ প্রদান করেন। সেটা ছিল অক্টোবর মাস। নভেম্বর মাসেই নূর খান ফেডারেশনের হেড কোয়ার্টার রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিজ কর্মস্থল পেশাওয়ারে নিয়ে যান এবং বিশ্ব হকিতে পাকিস্তানের প্রাধান্য বজায় রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ জানুয়ারিতে হল্যান্ড জাতীয় হকি টিম দু’সপ্তাহের হকি সফরে পাকিস্তানে এসেছিল। জানুয়ারি ২৫ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ দিনে লাহোর, ঢাকা এবং করাচিতে তিনটি হকি টেস্ট এবং হায়দ্রাবাদ, বাহাওয়ালপুর, মুলতান, লায়ালপুর, পেশাওয়ার এবং রাওয়ালপিন্ডি ছয়টি জোনাল ম্যাচ খেলেছিল।
হল্যান্ড জাতীয় হকি দলের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য পাকিস্তান জাতীয় দল গঠনের লক্ষে সমগ্র দেশের ৩৫ জন হকি খেলোয়াড়কে স্বল্প সময়ের ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল যা ১৫ জানুয়ারি থেকে লাহোর স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল। খেলোয়াড়রা হলো : ১। গোলরক্ষক- সালাহউদ্দিন (পিএএফ), আখতার (রেলওয়ে) এবং হাদী (সারগোদা), ফুলব্যাক-রিয়াজউদ্দিন (পিআইএ), তানভীর দার (রেলওয়ে), লোদী (লাহোর), ইজাজ বাট (লাহোর), তারিক আজিজ (সারগোদা), আসলাম (সারগোদা), হাফ-ব্যাক- আব্দুর রশিদ (আর্মি), সামি (কাস্টম), আনোয়ার শাহ (রেলওয়ে) সাঈদ আনোয়ার (পিআইএ), আল এ মুজতবা (করাচি), রিয়াজ আহমেদ (আর্মি), ফজল আহমেদ (পিআইএ), দিলওয়ার (লাহোর), আখতার (রেলওয়ে) এবং গুলরেজ (কাস্টম); ফরোয়ার্ড- মাহমুদ (কাস্টমস), ইসমাইল (কাস্টম), বশীর (ইস্ট পাকিস্তান), ইসলাহ (করাচি), খুরশিদ আযম (রেলওয়ে), জাবিদ (আর্মি) হায়াত মাহমুদ (পিআইএ), তারিক নিয়াজি (পিআইএ), মুদাসসির (রাওয়ালপিন্ডি), লাইক (পিএএফ), আসাদ মালিক (পিআইএ), মেহেদী (লাহোর), জাহাঙ্গীর (কাস্টম), খিজির বাজওয়া (সারাগোদা) এবং সাবির (লাহোর)।
ক্যাম্প কমান্ডেন্ট এবং ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন মেজর হামিদ (পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক, অলিম্পিয়ান) কোচের দায়িত্ব পালনের জন্য ছ’জন কোচকে নিয়োজিত করা হয়েছিল।
সর্বজনাব শেখ রহমত উল্লাহ, এ জি খান, লতিফ মীর, নাসির বুন্দা আখতার হোসেন এবং ফজলুর রহমান।
(ক্রমশ.)
জুন-১
(পঁচাত্তর)
সিলেকশন কমিটি : এয়ার মার্শাল নূর খানকে প্রধান করে এবং ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ, কর্নেল আতিফ, মাহমুদ (কাস্টমস ও সাবেক অলিম্পিয়ান), নিয়াজ খান। মাত্র ১০ দিনের কোচিং শেষে তিনটি টেস্ট ম্যাচে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তান জাতীয় দল গঠন করা হয়েছিল। দল গঠন করার পর দলীয়ভাবে অনুশীলন করার সময় এবং সুযোগ পাওয়া যায়নি এবং খাজা মোহাম্মদ আসলামকে নিয়ে সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়েছিল যারা হল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার জন্য পাকিস্তান হকি টিমের খেলোয়াড় নির্বাচন করেছিলেন।
২৬ জানুয়ারি হল্যান্ড জাতীয় হকি টিম পাকিস্তানে তাদের সফর শুরু করেছিল হায়দ্রাবাদ জোনাল হকি টিমকে ৪-০ গোলে পরাজিত করার মধ্যে দিয়ে। তাদের পাঁচ অলিম্পিয়ান ফোক্কার, এলফারস, ভেনভ্রন, সুইটস এবং হুফটস খেলায় অংশগ্রহণ করেছিল। পরদিনই দ্বিতীয় জোনাল ম্যাচে তাদের জয়রথ থামিয়ে দিয়েছিল ভাওয়ারপুর জোন ১-১ গোলে ড্র করে। স্বাগতিক দলের রাইটইন ফায়জুল হাসান বাজি গোল করে দলকে প্রথমার্থে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ডাচ দল গোল করার জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। এসময় তারা ৭টি কর্নার ৩টি পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নেয়; এমনি একটি কর্নার হিটের বল ধরে তাদের রাইট-ইন টার হার গোল করে দলের সম্মান বাঁচিয়েছিল। শক্তিশালী হল্যান্ড টিম পাকিস্তান সফরে ২৯ জানুয়ারি প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিল মুলতান জোন হকি টিমের কাছে। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উঁচুমানের খেলায় মুলতান জোন ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। মুলতান টিমের লেফট-ইন ইসলাহ উদ্দিন এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড কাশানী একটি করে গোল করেছিল আর ডাচ দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড স্পিট একটি গোল করে গোলের ব্যবধান কমাতে সক্ষম হয়েছিল। পরদিনই হল্যান্ড টিম সারগোদাকে ২-০ গোলে হারিয়ে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। প্রথমার্ধে ডাচ দলের লেফট-উইংগার ডি কাইজার গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে সেটাকে ২-০ গোলে পরিণত করেছিল দলের লেফট-হাফ ডি লেনয় মেইয়ার। পরদিনই অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি পেশাওয়ার জোনের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে হল্যান্ড টিম। ডাচ দলের অলিম্পিয়ান ডিউট গোল করে দলকে এগিয়ে নিলেও তা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। পেশাওয়ার দলের (আর্মি টিমের) বোগদাদি গোল করে দলকে ১-১ গোলের ড্র এনে দেয়। শক্তিশালী হল্যান্ড টিম রাওয়ালপিন্ডি জোনের সাথেও গোলশূন্য ড্র করে শেষ করেছিল পাকিস্তানে তাদের জোনাল ম্যাচ পর্ব।
১ম টেস্ট ম্যাচের জন্য খালেদ মাহমুদকে ক্যাপ্টেন করে পাকিস্তান জাতীয় টিম ঘোষণা করা হয়েছিল।
গোলরক্ষক- সালাহউদ্দিন, ফুলব্যাক-রিয়াজউদ্দিন এবং তারিক আজিজ, হাফব্যাক-রশিদ, সাইদ আনোয়ার এবং গুলরেজ, ফরোয়ার্ড-খালেদ মাহমুদ, খুরশীদ আজম, তারিক নিয়াজী, লাইক এবং জাহাঙ্গীর বাট, ম্যানেজার-মেজর হামিদ।
৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৭ লাহোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান জাতীয় হকি টিম বনাম হল্যান্ড জাতীয় হকি টিমের মধ্যে ১ম টেস্ট ম্যাচ। দু’দলই নিম্নমানের খেলা প্রদর্শন করে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। পাকিস্তানের সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজি ডি’র কাছে রাইট ইন খুরশীদকে পাস দিলে সে নিয়াজিকে ডি’র ভেতর রিটার্ন পাস দেয়Ñ যা নিয়াজি সজোরে পোস্টে হিট করে কিন্তু হল্যান্ডের গোলরক্ষক প্যাড করে কিয়ার করলে বল কাছে দাঁড়ানো লেফট ইন লাইকের কাছে চলে যায়। লাইক পুষ করে বল জালে জড়িয়ে দেয়। গোল খেয়ে হল্যান্ড দল গোল শোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড সুইটস পাকিস্তানের ডি’র ভেতর সুযোগটা পেয়ে যায়। সে ফিক করে পোস্টের বাম কোণ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিয়ে খেলায় সমতা আনে এবং খেলা শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র থাকে।
ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচের জন্য পাকিস্তান দলের সেন্টার হাফ সাঈদ আনোয়ারকে ক্যাপ্টেন করে টিম ঘোষণা হয়। গোলরক্ষক-সালাহউদ্দিন, ফুলব্যাক-রিয়াজউদ্দিন এবং তানভীর দার, হাফব্যাক-রশিদ, সাঈদ আনোয়ার এবং আখতার, ফরোয়ার্ড-বশীর আহমেদ, খুরশীদ আজম, তারিক নিয়াজী, লাইক এবং সাব্বির মালিক।
৫ ফেব্রুয়ারি ’৬৭ ঢাকা স্টেডিয়ামে ২য় হকি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক সফরকারী হল্যান্ড দলের কাছে আবারও প্রমাণ করেছিল যে, তারা খেলাকে কত ভালবাসে। পাকিস্তান ৩-১ গোলে জয়লাভ করে তিন টেস্ট ম্যাচের সিরিজের এক ম্যাচে এগিয়ে গিয়েছিল। হল্যান্ড পাকিস্তান সফরের পূর্বে ভারতের দুটো টেস্ট ম্যাচ ড্র করে এসেছিল। খেলার ১৫ মিনিটের মধ্যেই খেলা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমাদের দৃষ্টিনন্দন স্টিক ওয়ার্ক, ছোট ছোট পাস এবং দলগত সমঝোতা স্টেডিয়ামে উপস্থিত পঁচিশ হাজার দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। হল্যান্ড টিমের ক্যাপ্টেন ফোক্কার এবং রাইট ফুলব্যাক টেরলিংজেন আমাদের ফরোয়ার্ডদের কড়া পাহারায় রেখেছিল, যার জন্য গোল করার সুযোগ তৈরি করতে পারছিলাম না। অন্যদিকে হল্যান্ড টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফ্রাংক জিওয়েটস এবং লেফট-ইন হুপ্ট দ্রুতগতির খেলোয়াড় এবং চমৎকার বল কন্ট্রোল। দুজনের মধ্যে ভাল সমঝোতা আমাদের ডিফেন্সকে সব সময় ব্যস্ত করে রেখেছিল। আমাদের ফুল ব্যাক তানভীর দার তার নির্ভুল এন্টিসিপেশন দ্বারা বিপক্ষ দলের আক্রমণগুলো ব্যর্থ করতে সমর্থ হচ্ছিল। নিঃসন্দেহে সে মাঠের সেরা খেলোয়াড় ছিল সেদিন। আমাদের অপর ফুল ব্যাক রিয়াজউদ্দিনের সাথে তার চমৎকার বোঝাপড়া ছিল, যার জন্য হল্যান্ডের আক্রমণগুলো সফলতা পায়নি। আমাদের (ক্যাপ্টন) সেন্টার হাফ অলিম্পিয়ান সাঈদ আনোয়ার বিশ্বমানের খেলা প্রদর্শন করতে পারেনি। তবে টিমের সাথে মানানসই খেলাই খেলেছে। তার সহযোগী দুই হাফ চোখে পড়ার মত খেলা খেলেনি। আমি নিজেও আশানুরূপ খেলতে পারিনি। কিছুটা নার্ভাস ছিলাম; কারণ অনুশীলনে ঘাটতি ছিল। ঢাকা লীগ শুরু হয়েছিল অথচ আমার টিম এন্ট্রি না করায় খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলাম। দ্বিতীয়ত জাতীয় কোচিং ক্যাম্পে মাত্র ১০ দিনের অনুশীলনে টিমের সাথে কম্বিনেশন গড়ে তোলার সুযোগ পাওয়া যায়নি। আমাদের লেফট উইংগার সাবির মালিকও ভাল খেলতে পারেনি। টিমের সাথে কিছুদিন অনুশীলন করতে পারলে নিশ্চিত করে ভালো খেলা যেত। আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজী অনবদ্য খেলেছে। দুুই ইন খুরশীদ ও লাইক তাদের মত করে খেলেছে। তবে এই ট্রায়ো সব সময়ই হল্যান্ডের জন্য বিপজ্জনক ছিল। আমাদের গোলরক্ষক সালাহউদ্দিনকে তার দায়িত্ব পালনে আস্থার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। বল কিয়ারিং নিখুঁত ছিল না।
৩-১৫ মি. খেলা আরম্ভ হয়। ৯ মিনিটে তারিক নিয়াজি তার স্টিকের চমক দেখিয়ে হল্যান্ডের ডিফেন্স ভেদ করে লেফট-ইন লাইককে দিলে তার দুর্বল হিট গোলরক্ষক সহজেই ফিরিয়ে দেয়। এরপরই হল্যান্ড টিম একটি লং কর্নার লাভ করে এবং সেটাই পেনাল্টি কর্নার হয় আর সেটা থেকেই হল্যান্ডের আম্পায়ারের পেনাল্টি স্ট্রোক সিদ্ধান্ত সবাইকে অবাক করে দেয়। ডাচ দলের রাইট ফুলব্যাক টেরলিংজেন সালাহউদ্দিনকে পরাস্থ করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। ১৫ মিনিটের সময় আমরা পেনাল্টি কর্নার লাভ করলে আমাদের ফুলব্যাক রিয়াজউদ্দিনের হিট বাইরে চলে যায়। আমরা একটা সুযোগ হারাই। এর এক মিনিট পরই আমাদের রাইট ইন খুরশীদ একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে চমৎকার পুশ দ্বারা গোল করে খেলায় সমতা আনে। তারপর থেকে আমাদের টিম যেন জেগে ওঠে। বিপক্ষ দলের ওপর আমাদের হামলা জোরদার হয়ে যায় কিন্তু হল্যান্ডের ক্যাপ্টন ফোক্কর এবং টেরলিংজেন দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে যায়। ডি’র ভেতর হল্যান্ডের ফুল ব্যাক আমাদের খেলোয়াড়কে ফাউল করলে আমরা পেনাল্টি স্ট্রোক লাভ করি, যা তারিক নিয়াজি সফলতার সাথে গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। আরও গোল করার জন্য আমাদের আক্রমণভাগ তৎপর হয়ে ওঠে কিন্তু ডাচ দলের টেরলিংজেন এবং সেবোইবেন্স সতর্কতার সাথে আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। উল্টো তারা সমতা আনার জন্য আমাদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে এবং সুযোগও পেয়ে যায়। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড জিউটেস অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বল নিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে পড়ে এবং সজোরে পোস্টে হিট চালায় কিন্তু আমাদের গোলরক্ষক খুবই চমৎকারভাবে সেভ করলে আমরা গোল খাওয়া থেকে বেঁচে যাই। বিরতির পর আমাদের টিম নতুন উদ্যম নিয়ে মাঠে নামে। আমরা আমাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখে গোল বাড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম কিন্তু শক্তিশালী হল্যান্ড ডিফেন্স ভেদ করা সহজ হচ্ছিল না। খেলা যখন এমনি এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন এক পর্যায়ে ডি’র ভেতর লাইক বল পেয়ে জোরে গোল পোস্টে পুশ করে ডাচ গোলরক্ষক জুটস বক্স সেভ করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। ৩-১ গোলের ফলাফল খেলার শেষ পর্যন্ত অুন্ন ছিল। আমরা দ্বিতীয় হকি টেস্ট ম্যাচ ৩-১ গোলে জয়লাভ করে তিন ম্যাচ সিরিজের ১-০তে এগিয়ে থাকি।
হল্যান্ড টিমে যারা খেলেছিল : গোলরক্ষক-অর্টব্রেডোর রোডি, ফুলব্যাক- থিও টেরলিং জেন এবং সেবো এবেন্স, হাফব্যাক-আরিফ-ডি-কাইজার, জন পিট ফক্কোর (ক্যাপ্টেন) এবং জন এল ফেরস, ফরোয়ার্ড-থিও ভ্যান ভ্যারুন হবেন, অটো টের হার, ফ্রাংক জি উরটস, ফ্রান্সিস, ভেন্ট হু কটস এবং আর এইচবিডি ল্যানয় মেইজার।
আম্পায়ারদ্বয় : এ এফপি ল্যাথওয়ার (হল্যান্ড) এবং শাহ আবরার আহমেদ (পাকিস্তান)।
৭ ফেব্রুয়ারি করাচিতে ফাইনাল হকি টেস্টে পাকিস্তান হল্যান্ডকে ২-০ গোলে পরাজিত করে সিরিজ জয় করেছিল। করাচি টেস্টে আমার পজিশনে ইসলাহউদ্দিন খেলেছিল। সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজী এবং লেফট-ইন লাইক খেলার দ্বিতীয়ার্ধে দুটো গোল করে দলকে জিতিয়ে ছিল হল্যান্ড দল তাদের ১৪ দিনের পাকিস্তান সফর শেষ করে ৮ ফেব্রুয়ারি ’৬৭ নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। #
(ক্রমশ.)
জুন-১৬
(ছিয়াত্তর)
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ঢাকা, হকি টিম শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালের হকি লীগ খেলার অনুমতি পেয়েছিল। ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট তাদের হকি টিম এন্ট্রি করার অনুমতি দিলেও লীগ কমিটির অনুমতি পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের বাধা এবং বিভিন্ন মহলের সমালোচনা, সময়মত ব্যাংক দলের এন্ট্রি না করা, এতদিনে প্রত্যেক দল ৩/৪টি করে ম্যাচ খেলে ফেলেছিল। দুবার ফিকশ্চার করা হয়েছে। সে অনুযায়ী খেলা এগিয়ে চলেছে। এ মুহূর্তে ব্যাংক টিমকে এন্ট্রি দিলে ফিকশ্চার পরিবর্তন করে নতুন ফিকশ্চার করা, টিমগুলোকে ঘন ঘন ম্যাচ খেলতে হবেÑ নানান সমস্যার কথা উঠেছিল। কিন্তু ইপিএসএফ কর্তৃপক্ষ হকি খেলার বৃহত্তর স্বার্থে গত দু’বছরের অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন টিমকে লীগ খেলায় অনুমতি প্রদান করলে আমরা পুরো উদ্যম নিয়ে মাঠে নেমে পড়ি। সে সময় ছয়টি টিম অপরাজিত ছিল, ওয়ারী কাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, পিই রেলওয়ে, ইস্পাহানী স্পোর্টিং, মোহামেডান স্পোর্টিং এবং মাহুৎটুলী স্পোর্টিং কাব আর আজাদ, ইস্টবেঙ্গল, এয়ারফোর্স, ওয়ান্ডারার্স এবং ফায়ার সার্ভিস তখনও কোন পয়েন্ট পায়নি।
বিশেষ কার্যক্রমের জন্য স্টেডিয়ামের সব খেলা ১৩-২৩ জানুয়ারি স্থগিত করা হয়েছিল এবং হকি লীগ পুনরায় শুরু হয় ২৪ জানুয়ারি থেকে। সেদিন চারটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যাংক (মৌসুমের) লীগের প্রথম খেলা খেলেছিল ফায়ার সার্ভিস টিমের সাথে স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড-১, ২-১৫ মিনিটে। ব্যাংক দল ভাল খেলে ৩-০ গোলে জয় জয়লাভ করেছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিমের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি খেলায় আমি অংশগ্রহণ করেছি। এই প্রথম ব্যাংক হকি দল আমাকে ছাড়া ম্যাচ খেলেছে; কারণ সেসময় আমি লাহোরে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ক্যাম্পে ছিলাম। ব্যাংক দলের লেফট ইন মীর, রাইট আউট আব্দুল হক এবং এহতেশাম গোল করেছিল।
ব্যাংক দলের খেলোয়াড় : রঞ্জিত দাস (গোলরক্ষক), সাবের আলী ও ইকবাল, এহতেশাম, মাহমুদ এবং আনোয়ার, আব্দুল হক, মিলুু, ফরিদ, মীর এবং মুন্নি।
ব্যাংক টিম যখন ফায়ারের সাথে খেলছিল পাশের মাঠে অর্থাৎ স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড নং-২-এ, তখন মাহুৎটুলী এবং মোহামেডান স্পোর্টিং-এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল। খেলার প্রায় ২২ মিনিটে মাহুৎটুলীর গোলরক্ষক আরফিনের সামান্য ভুলের জন্য মোহামেডানের জিয়া জয়সূচক গোল করেছিল যা শক্তিশালী মাহুৎটুলী টিম সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও শোধ দিতে পারেনি। সালাম ভাইয়ের চমৎকার এন্টিসিপেশন আর দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা মাহুৎটুলীর আক্রমণগুলোকে সফল হতে দেয়নি। পুরো মোহামেডান টিমকে তিনি ভাল খেলার জন্য সাহস জুগিয়েছিলেন। তাছাড়াও জাম্বু চমৎকারভাবে গোলপোস্ট সামলে রেখেছিল। বিরতির পর মাহুৎটুলীর একটি হিট জাম্বুর প্যাডে লেগে গোললাইন ক্রস করেছে বলে জোর দাবিকে আম্পায়ার ঈশা খান ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে নাকচ করে দিলে মাঠে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরও মাহুৎটুলী একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে গেছে কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায়তা করেনি। দিনের (২৪-১-৬৭) অপর দুটো ম্যাচ হয়েছিল স্টেডিয়ামের পাশাপাশি দুটো গ্রাউন্ডে বেলা ৩-১৫ মিনিটে। ১নং গ্রাউন্ডে কম্বাইন্ড এবং পুলিশের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল আর ২নং গ্রাউন্ডে পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং আজাদ স্পোর্টিং-এর মধ্যে চলছিল নিম্নমানের হকির প্রদর্শনী। প্রথমার্ধে কম্বাইন্ড-পুলিশ আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চালিয়েও কেউ কারও বশ্যতা স্বীকার করেনি। তবে এ অর্ধে পুলিশের খেলা দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বিরতির পর কম্বাইন্ডের রাইট আউট সিকান্দার একটি গোল করলে দলের ভেতর প্রাণের সঞ্চার হয় এবং এরপরই একটি ফ্রি হিট আয়ত্তে এনে প্রতাপ দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে টিম ভারমুক্ত হয়। পুলিশ টিম পুরো উদ্যমের সাথে গোল শোধ করার জন্য খেলতে থাকে এবং তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড নাজির একটি গোল শোধ দিয়ে টিমকে চাঙ্গা করে তোলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলের ফলাফল নিয়েই তাদেরকে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। ২নং গ্রাউন্ডের খেলার ফলাফল ছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং ৪-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে পরাজিত করেছিল, যার দুটি গোল করেছিলেন নাসির, মাশফিক ও বুলবুল করেছিল একটি করে। নাসির একজন ভাল হকি খেলোয়াড়। নম্র-ভদ্র মানুষ হিসেবে পাকিস্তান মাঠ (বর্তমানে বাংলাদেশ মাঠ) এলাকায় তার সুনাম ছিল। হকি অঙ্গনে তাকে সবাই সমীহ করতো আর আমি তাকে বড় ভাইয়ের মত সম্মান করতাম; কারণ আমার বড় ভাইয়ের নামও ছিল নাসির আহমেদ। আজ দুজনেই আমাদের মাঝে নেই।
২৫ জানুয়ারি রেল দলের জন্য একটি অশুভ দিন। তারা ওয়ারী কাবের কাছে ১-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল সেদিন। সত্যিকার অর্থে মামলির স্টিক ওয়ার্কের কাছে তারা হেরেছিল। হাফ টাইমের আগেই সে ২ গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। রেল দলের হারার মূল কারণ ছিল তাদের গোলরক্ষক নবী বক্স এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড হাজী বারীর বাজে পারফরমেন্স। অন্যদিকে ওয়ারীর প্রায় সব খেলোয়াড়ই ভাল খেলেছে, বিশেষ করে তাদের লেফট ইন মামলি এবং রাইট ইন শহীদ অত্যন্ত ভাল খেলেছিল। তাদের দুজনের বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। তাদের সম্মিলিত আক্রমণ রেল দলকে সব সময় চাপের মধ্যে রেখেছিল। রেল দলের কলিমের অনবদ্য খেলা রেল দলকে আরো বেশি গোল খাওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। সে ছিল রেল দলের মেরুদন্ড। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময় মামলি একক প্রচেষ্টায় রেল দলের ডি’তে ঢুকে পড়ে। পোস্টে সজোরে হিট করে কিন্তু নবী প্যাড করে কিয়ার করার চেষ্টা করে। বল আবারও মামলির কাছে চলে যায়। দ্বিতীয়বার সে বল হিট না করে পুষ করে বল জালে জড়িয়ে দেয় (১-০)। গোল শোধ করার জন্য রেল দল চেষ্টা চালাতে থাকে, সুযোগও তৈরি করে নেয় কিন্তু তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হাজী বারী বেশক’টি সহজ সুযোগ নষ্ট করে। মামলি তার দ্বিতীয় গোল করে দলকে ২-০তে এগিয়ে নেয়। বিরতির পর রেল দল আক্রমণ করে খেলতে থাকে এবং একটি শট-কর্নার লাভ করে কিন্তু সেটার সুফল লাভ করতে পারেনি। রেলের আক্রমণের একপর্যায়ে তাদের মোস্তাক ওয়ারীর ফুলব্যাক মোমতাজকে ডজ দিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে গোলপোস্টে পুষ করলে গোলরক্ষক ‘বিটেন’ হলেও গোললাইনের ওপর থেকে ওয়ারীর অপর ব্যাক শেরা গোল বাঁচিয়ে বল কিয়ার করতে গিয়ে আবারও বল রেলের জামাল খানের কাছে চলে যায়। বল ধরে জামাল খান নাটকটি শেষ করে গোলের মাধ্যমে (২-১)। খেলা জমে ওঠে। খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায়, গতিও বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড শরীফ গোল করে ওয়ারীকে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে দেয়।
ওয়ারীর হয়ে যারা খেলেছিল : ফ্রান্সিস পালমার (গোলরক্ষক), মোমতাজ এবং এএম শেরা, কামাল হায়দার, মোমিন এবং হায়াত, নাওয়াজিশ, নিয়াজ খান, শহীদ, মামলি এবং শফিক।
রেল দল : নবী বক্স (গোলরক্ষক), ইদ্রিস খান এবং আকবর, খোরশেদ আলম খান, কালিম এবং আবিদ খান, এইচ জামান খান, খাজা ডাব্লিউ খান, হাজী বারি, নিয়াজ আহমেদ এবং আইয়ুব খান।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের (২৫-১-৬৭) অপর খেলায় মাহুতটুলী শক্তিশালী ন্যাশনাল ব্যাংক টিমকে গোলশূন্য ড্র রাখতে বাধ্য করেছিল। ব্যাংক দল অনেকগুলো সহজ সুযোগ নষ্ট করেছিল, বিশেষ করে মীর এবং আবদুল হক যে দুটো গোল মিস করেÑ তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। মাহুৎটুলী টিমের আক্রমণ সেরকম জোরালো না হলেও তাদের রক্ষণভাগ ছিল খুবই সুদৃঢ়, যার দরুন ব্যাংক টিমকে জয় ছাড়াই মাঠ ছাড়তে হয়েছিল।
২৬ জানুয়ারি ইস্পাহানী তাদের ফুলব্যাক শফিকের পেনাল্টি কর্নারে করা একমাত্র গোলে মোহামেডানকে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ইস্পাহানীর কৃতী খেলোয়াড়, সর্বোচ্চ গোলদাতা ইসলাহউদ্দিন পাকিস্তান জাতীয় হকি ক্যাম্পে থাকায় খেলায় অংশ নিতে পারেনি। বিরতির পূর্বেই ইস্পাহানী মোহামেডানের কাছ থেকে ৭টি পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নেয়, যার একটিতে মাত্র ফল পেয়েছিল। বিরতির পর মোহামেডান গোল শোধ দেয়ার চেষ্টা চালায়, বিশেষ করে তাদের আক্রমণভাগে জিয়া এবং লেফট-ইন বেগ সারাক্ষণ ইস্পাহানীর রক্ষণভাগকে চাপের মধ্যে রেখেছিল। কিন্তু ইস্পাহানীর অভিজ্ঞ রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা তা ভালভাবেই প্রতিহত করতে পেরেছিল বলে মোহামেডান শেষ পর্যন্ত ১ গোলের হারটাকে মেনে নিয়েছিল।
ইস্পাহানী-মোহামেডানের খেলায় যার খেলা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তিনি সালাম ভাই। মোহামেডানের রক্ষণভাগে যিনি প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ইস্পাহানীর শক্তিশালী আক্রমণ তাকে ভেঙ্গে গোল করতে সক্ষম হয়নি। লিখতে বসে সালাম ভাইয়ের কথা খুব করে মনে পড়ছে। তার অনুপ্রেরণাতেই এবং তার সহযোগিতায় আমরা কিছু ক্রিকেট-হকি খেলোয়াড় আরমানিটোলা গভ. হাইস্কুলের মাঠের বাইরে এসে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন একজন খেলোয়াড়, যার ভেতর ছিল খেলোয়াড়দের মাঠে নেয়ার সম্মোহনী শক্তি। ইয়ং খেলোয়াড়দের প্রায় সময়ই দেখা যেত সালাম ভাইকে ঘিরে থাকতে এবং তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াতে। সালাম ভাইয়ের জীবনটাও শেষ হয়েছিল ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ইয়ং খেলোয়াড়দের মাঝে, খেলার মাঠে।
মোহামেডান কাবের খেলোয়াড়রা : জাম্বু (গোলরক্ষক), সালাম এবং ফালু, পারভী, সাবের এবং সেলিম, সালিমউল্লাহ, জগলু জিয়া, বেগ এবং আলমগীর।
২৬-১-৬৭ তারিখের অপর খেলায় পরপর চারবার বিপক্ষ দলের গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে হ্যাটট্রিক অর্জনকারীদের দলে নাম লেখিয়েছিল রেল দলের কৃতী লেফট ইন নিয়াজ আহমেদ খান। বাকি গোলদাতাদের মধ্যে হাজী বারী যে ওয়ারীর বিরুদ্ধে সহজ গোল মিস করেছিল, সেই হাজী বারি দু’গোল করেছিল আর অপর গোলটি করেছিল রাইট আউট নুরুল্লাহ। সে সুবাদে ফায়ার সার্ভিস ০-৬ গোলের বড় পরাজয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল।
সেদিনের (২৬-১-৬৭) অপর দুটো খেলা বিমানবাহিনী এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাব নিজ নিজ খেলায় প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল। বিমানবাহিনী ২-০ গোলে ইস্টবেঙ্গল কাবকে হারিয়েছিল আর ঢাকা ওয়ান্ডারার্সও প্রথম জয় পেয়েছিল ১-০ গোলে আজাদের বিরুদ্ধে। বিমানবাহিনীর পারভী এবং আমান উল্লাহ গোল করেছিল আর ওয়ান্ডারার্সের গোল করেছিল শামসান।
২৭-১-৬৭ তারিখের দিনটি ছিল হকি লীগের ড্র করার দিন। ভিক্টোরিয়া এবং বিমানবাহিনী ড্র করেছিল ১-১ গোলে। রাজ্জাক গোল করেছিল ভিক্টোরিয়ার পক্ষে আর নিয়াজী গোল শোধ দিয়েছিল বিমানবাহিনীর হয়ে। সেদিনের অপর খেলাটিও গোলশূন্য ড্র করেছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং পুলিশ টিম।
(ক্রমশ.)
১ জুলাই
(সাতাত্তর)
ন্যাশনাল ব্যাংক আরও একটি পয়েন্ট খুইয়েছিল ওয়ারীর সাথে গোলশূন্য ড্র করে আর ওয়ারীর ছিল এটি প্রথম পয়েন্ট হারানো। গত মৌসুমের অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন ব্যাংক এবং যুগ্ম রানার্সআপ ওয়ারী পয়েন্ট হারালেও গতবারের অন্য এক যুগ্ম রানার্সআপ দল কম্বাইন্ড তখনও লীগে অপরাজিত ছিল। ইস্পাহানী তখনও কোন পয়েন্ট হারায়নি। বহু দর্শক মাঠে এসেছিল একটি ভাল হকি খেলা দেখার জন্য কিন্তু তারা হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন উদ্দেশ্যহীন হিটিং আর এলোমেলো খেলা দেখে। অনেকটা ফায়ার সার্ভিস, আজাদ, ইস্টবেঙ্গল দলের খেলার মতোই। মনে হচ্ছিল দু’টিমের হিটিং প্র্যাকটিস চলছিল, চার কোণে লম্বা লম্বা হিট যেন সময়টা কাটানো। এর মধ্যে ওয়ারী কিছুটা খেলার চেষ্টা করেছিল। এমনিভাবে তারা কাটিয়ে দিয়েছিল খেলার অর্ধেক সময়। বিরতির পর দু’টিমই যেন জেগে ওঠে। খেলায় গতি বৃদ্ধি পায়, টিমের মধ্যে বোঝাপড়াটাও ভাল হয়। যার জন্য দু’টিই আক্রমণ করে খেলে, গোল করার চেষ্টা করে, খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। ফলে খেলাটা জমে ওঠে। খেলা সেরকম উঁচুমানের না হলেও কিছু সময়ের জন্য দর্শকরা খেলাটা উপভোগ করেছিলেন। ব্যাস, ঐ পর্যন্ত। গোলের মুখ কেউ দেখতে পায়নি।
সেদিনের ২৮-১-৬৭ অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিসকে আরও একটি হার হজম করতে হয়েছিল পিডব্লিউডি টিমের কাছে। ২-৩ গোলের হারটি ছিল তাদের জন্য কষ্টের। বিরতি পর্যন্ত তারা ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড সাবের এবং লেফট ব্যাক রশীদ গোল করে ২-০ লিড এনে দিয়েছিল। পিডব্লিউডি দলের রাইট ইন গোল করে ব্যবধান কমিয়ে ১-২ গোলে পিছিয়েছিল। বিরতির পর খেলার ধারাটাই বদলে যায় আর পিডব্লিউডি দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড মকবুল আর রাইট আউট জাফর দু’গোল করে দলকে জয় এনে দিয়েছিল (৩-২)।
ইস্পাহানী টিমের হকি লীগে প্রথম পয়েন্ট হারানো। রেল দলের সাথে তারা গোলশূন্য ড্র করেছিল। জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় রেল দল তুলনামূলকভাবে ভাল খেলেছিল। প্রথমার্ধে ইস্পাহানী নিজেদের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকায় রেল দল চড়াও হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিল।। রেল দলের সেদিনের মূল নায়ক ছিল নিয়াজ এবং কলিম। তাদের ুরধার আক্রমণ ইস্পাহানীকে কয়েকবার বেকায়দায় ফেলে দিলেও সেন্টার ফরোয়ার্ড হাজী বারী স্লো হওয়ায় আক্রমণগুলো সফলতা পায়নি। বিরতির পর ইস্পাহানী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তাদের লেফট-ইন আজিম রেল দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ার্ধে রেল দল কিছুটা রক্ষণাত্মক খেলার প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল। এর ফলে ইস্পাহানী মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের পক্ষে নিয়ে রেলের ওপর চড়াও হয়ে আক্রমণের ঝড় তুলে দেয় কিন্তু তারাও সফল হতে পারেনি। ১ পয়েন্ট করে নিয়ে দু’টিমকে মাঠ ছাড়তে হয়েছে।
দিনের (২৯-১-৬৭) অপর খেলায় শক্তিশালী মাহুৎটুলী টিমকে পুলিশ ২-১ গোলে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। পুলিশ টিমের রাইট আউট আকবর এবং রাইট হাফ রফিক একটি করে গোল করলে মাহুৎটুলী আরফিন একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল।
৩০ জানুয়ারি ওয়ারী কাবের সেন্টার হাফ মাহমুদুর রহমানের (মোমিন) পেনাল্টি পুশে দেয়া একমাত্র গোলে পিডব্লিউ পরাজিত হয়েছিল। এখানে মমিন ভাই সম্বন্ধে মজার ব্যাপার বলতে চাই। তিনি যে টিমেই খেলতেন, টিমের পক্ষে পাওয়া ফ্রি হিট কাউকে মারতে দিতেন না, মাঠে যে কোন স্থানেই হোক, দৌড়ে যাবেন। কেউ যদি মারতে যায়, তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই হিট করবেন। শেষে এমন দাঁড়িয়ে ছিল যে, খেলার প্রয়োজনে দ্রুত হিট করতে হবে কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে হতো, আমরা এ নিয়ে হাসাহাসি করতাম। আজকে লিখতে বসে মমিন ভাইয়ের হিট মারার জন্য দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার সম্বন্ধে আর একটু বলি, তিনি ফুটবল-হকি সমান তালে ভাল খেলতেন। সেই স্কুলে থাকতে তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ানো, এক সাথে ফুটবল হকি খেলা, আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। খেলার কথায় ফিরে আসি। সেদিন ওয়ারীর কৃতী খেলোয়াড় মামলী ভাল খেলতে না পারায় আক্রমণ ছিল খুবই দুর্বল। বিরতির পর পিডব্লিউডি গোল শোধ করার জন্য জোর লাগিয়ে ছিল কিন্তু দক্ষ স্কোরারের অভাবে গোল শোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ওয়ারী সেই পেনাল্টির গোলে জয় নিয়ে কাবে ফিরেছিল।
দিনের (৩০-১-৬৭) অপর খেলায়ও রেল দলের কৃতী লেফট-ইন নিয়াজের দেয়া একমাত্র উইনিং গোলে রেলওয়ে টিম পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ৩১-১-৬৭ তারিখে পুলিশের জয় আসে ফায়ারকে ৪-০ গোলে হারিয়ে। ফায়ার সার্ভিস টিম সে সময় পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচের সবগুলোই হেরে ছিল। পুলিশের আখতার ২ গোল, আর মোহাম্মদ আলী এবং গাফফার ১টি করে গোল করেছিল। দিনের অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলের অঘটন ঘটিয়েছিল শক্তিশালী মাহুৎটুলী টিমকে হারিয়ে। ভিক্টোরিয়ার লেফট-ইন আজিজ এবং লেফট আউট হোসেন ১টি করে গোল করেছিল।
১৯৬২ সালের ইপিএসএফ-এর গঠনতন্ত্রের ২৫ ধারার বলে সভাপতি এসবি চৌধুরী (ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার), ১৯ অক্টোবর, ১৯৬৬ তারিখে নির্বাচিত ইপিএসএফ-এর সাধারণ এবং গভর্নিং বডি ভেঙ্গে ২৫ জনের একটি এডভাইজারি কমিটি গঠন করেছিলেন যারা ফেডারেশনের দৈনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করতেন। কিন্তু গঠনতন্ত্র মোতাবেক ৮৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে গভর্নিং বডি গঠন করতে হবে বিধায় সভাপতি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিটি গঠন করেছিলেন। এ হাসান অতিরিক্ত কমিশনারকে (ঢাকা বিভাগ) চেয়ারম্যান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন। এ রউফ চৌধুরী, ডেপুটি সেক্রেটারি (এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট), এএনএম মোমতাজ উদ্দিন চৌধুরী, ডেপুটি ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন, ঢাকা বিভাগ এবং আজহারউদ্দিন খান, সহকারী চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং ইপিএসএফএর সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (ডেভেলমেন্ট) ঢাকাকে মেম্বার সেক্রেটারি হিসেবে কমিটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন দেশের ৯৬ জন সাধারণ কাউন্সিলর দ্বারা নির্বাচিত গভর্নিং বডি গঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ঢাকা সিটি থেকে ২৩ জন কাউন্সিলর এবং বাকি কাউন্সিলররা দেশের বিভিন্ন জেলা, ডিভিশন থেকে মনোনীত/নির্বাচিত হয়ে আসতেন। ঢাকা সিটির ২৩ জন কাউন্সিলর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং ইপিএসএফ-এর দায়িত্ব পালনকালে তারা মুখ্য ভূমিকা রাখেন বিধায় ঢাকা সিটির কাউন্সিলররা একটি আলাদা গুরত্ব/মর্যাদা বহন করে থাকে। ঢাকা সিটির ১০৮টি কাব, এই ২৩ জন কাউন্সিলর নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ইপিএসএফ-এর গভর্নিং বডি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন।
ঢাকা সিটির ২৩ জন কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য দুটি ক্রীড়া সংগঠন দি ইউনাইটেড স্পোর্টসম্যান কাউন্সিল এবং স্পোর্টস প্রমোটার্স ফ্রন্ট দুটি প্যানেলের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেছিল। ২৩ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আবব্দুল হক (বক্সিং থেকে), আব্দুল মালেক (কুস্তি থেকে), এসএ মান্নান (জিমন্যাস্টিক থেকে) এবং হাকিম (রাইফেল শুটিং থেকে)। পরবর্তীতে ১৯ জন কাউন্সিলরকে ১০২ জন ভোটার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন। নির্বাচিত কাউন্সিলররা হলেন :
ক্রিকেট থেকে কাউন্সিলর
১। রাইসউদ্দিন আহমেদ (২১টি ভোট পেয়েছিলেন), গেন্ডারিয়া কাবের প্রতিনিধি
২। এ রেজা (২১ ভোট) ভিক্টোরিয়া কাব
৩। এবিএম মুসা (২১ ভোট), ইপিজি প্রেস
৪। সফিউদ্দিন আহমেদ (২০ ভোট), ব্রাদার্স ইউনিয়ন
৫। আনিসুর রহমান (২০ ভোট), আজাদ স্পোর্টিং
৬। মোজাফফর হোসেন পল্টু (১৯ ভোট), শান্তিনগর ক্রিকেট কাব
হকি থেকে কাউন্সিলর
১। আলমগীর মোহাম্মদ আদেল (১০ ভোট), মাহুৎটুলী এসসি
২। দাবীর উদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকী (৯ ভোট), কম্বাইন্ড স্পোর্টিং
৩। সাদেক আলী মির্জা (৮ ভোট), ইস্পাহানী
৪। সাহিদুর রহমান (৭ ভোট), ভিক্টোরিয়া
ফুটবল থেকে কাউন্সিলর
১। সিরাজুল ইসলাম (২২ ভোট), নবারুণ সংসদ
২। নাসিরুদ্দিন আহমেদ (২২ ভোট), আজাদ বয়েজ
৩। জহিরুল হক (২১ ভোট), দয়াগঞ্জ স্পোর্টিং কাব
৪। এ আউয়াল (২১ ভোট), রহমতগঞ্জ এমএফএস
৫। এসএ জামান (১৯ ভোট), আজাদ স্পোর্টিং কাব
ভলিবল এবং ব্যাডমিন্টন থেকে কাউন্সিলর
১। আশরাফউদ্দিন খন্দকার (১২ ভোট), বাসাবো টিএস
২। এসএম খালেক (৪ ভোট), ইস্টএন্ড কাব
বাস্কেটবল থেকে কাউন্সিলর
১। আলম (৫ ভোট), ইগলেটস সিসি
সুইমিং থেকে কাউন্সিলর
১। নূর হোসেন (৪ ভোট) টাউন কাব
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ৪ জন কাউন্সিলরসহ ১৯ মোট ২৩ জন একই সংগঠন দি ইউনাইটেড স্পোর্টসম্যান কাউন্সিলের প্যানেলভুক্ত প্রতিনিধি।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান-হল্যান্ড ম্যাচ এবং ঢাকা সিটি কাবসমূহের কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য স্টেডিয়ামের সব খেলাধুলা এবং কর্মকান্ড ১-১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল।
১৫ দিন (১-১৫ ফেব্রুয়ারি) হকি লীগ বন্ধ থাকার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি পুনরায় খেলা শুরু হয়েছিল। সেদিনের প্রথম খেলা স্টেডিয়ামের ১নং গ্রাউন্ডে ফায়ার সার্ভিস সময়মত অর্থাৎ ২-৪৫ মিনিটে মাঠে উপস্থিত হতে পারেনি, এসেছিল দেরি করে; ফলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এরই মধ্যে ওয়াকওভার পেয়ে পূর্ণ পয়েন্টের মালিক বনে যায়। একই সময় পাশাপাশি মাঠে (গ্রাউন্ড নং-২) লীগের অন্যতম দুর্বল টিম ইস্ট বেঙ্গলকে আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) ৮-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলাম। আমি এবং মিলু ৩টি করে গোল করলেও হ্যাটট্রিক করতে পারেনি। বাকি গোল দুটো করেছিল আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ। সেদিনের বিকেল ৪টার খেলাতে গোলের ছড়াছড়ি। দর্শনীয় ডবল হ্যাট্রিকসহ ৮টি গোল করেছিল ওয়ারীর কৃতী লেফট-ইন মামলি। ওয়ারী ১০-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে পরাজিত করেছিল। বাকি দুটো গোল তাজু এবং শেরার। দিনের শেষ খেলা কম্বাইন্ড এবং মোহামেডানের মধ্যে। উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় একমাত্র গোলে কম্বাইন্ড জয়ী হয়েছিল আর উইনিং গোলটি করেছিল প্রতাপ। পরদিনও কম্বাইন্ডকে ইস্ট বেঙ্গল টিমের সাথে খেলতে হয়েছিল। বিরতির পূর্বে প্রতাপ এবং সাদেক ২টি করে গোল করে ৪-০ গোলে দলকে এগিয়ে নেয়। বিরতির পর বুলবান, মহসিন, সাব্বির এবং সিকেন্দার গোল করলে কম্বাইন্ড ৮-০ গোলে জয়লাভ করে। সেদিনের অপর খেলায় ওয়ান্ডারার্স কাব মাঠে না এসে মাহুৎটুলীকে বিনা পরিশ্রমে পূর্ণ পয়েন্ট পাইয়ে দেয়।
(ক্রমশ.)
১৬ জুলাই
(আটাত্তর)
হকি লীগে পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা শক্তিশালী ইস্পাহানী ১৮ ফেব্রুয়ারি আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট খুইয়েছিল। পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। তুলনামূলক দুর্বল পাকিস্তান স্পোর্টিং সমান তালে লড়ে প্রথমার্ধে গোলশূন্য রেখেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই পাকিস্তান স্পোর্টিং ইস্পাহানীর ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে এবং বেশ ক’বার তাদের সীমানায় হামলা চালায়। এরই এক হামলায় ওসমান গোল করে ইস্পাহানীকে চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। গোল খেয়ে ইস্পাহানী দিশেহারা হয়ে গোল শোধ করার জন্য দলের সবাই তৎপর হয়ে ওঠে এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে আক্রমণ চালাতে এগিয়ে যায় কিন্তু পাকিস্তান স্পোর্টিং ডিফেন্স শক্ত হাতে সেগুলো প্রতিহত করে। শেষ পর্যন্ত লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ইসলাহউদ্দিন ইস্পাহানীর ত্রাণদাতা হিসেবে একটি গোল করে টিমকে হারের লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছিল। দিনের দ্বিতীয় খেলায় আমাদের ব্যাংক টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে একমাত্র গোল করে আমাদেরকে পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে সাহায্য করেছিল। সেদিনের তৃতীয় খেলায় বিমানবাহিনী পিডব্লিউডিকে ৩-২ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। সেটি ছিল বিমানবাহিনীর দ্বিতীয় জয়। তাদের মোস্তাক দুটি গোল করেছিল আর তৃতীয় গোলটি করেছিল সাত্তার এবং পিডব্লিউডি টিমের পক্ষে দুটি গোল করেছিল মেরু আর জাফর। দিনের চতুর্থ খেলায় কম্বাইন্ড পরিশ্রম ছাড়াই দু’পয়েন্ট পেয়েছিল ওয়ান্ডারার্স কাবের দেয়া ওয়াকওভারের বদৌলতে। ২০-২-৬৭ তারিখে চারটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইস্পাহানী ২-১ গোলে বিমানবাহিনীকে হারিয়েছিল। তাদের গোল করেছিল ইসলাহউদ্দিন এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার আর একটি গোল ফিরিয়ে দিয়েছিল বিমানবাহিনীর লেফট ইন। দ্বিতীয় খেলায় ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে ফায়ারকে হারিয়েছিল, যার গোল দুটো এসেছিল মনসুর এবং শুকুরের স্টিক থেকে। সেদিনের তৃতীয় খেলায় আমি হ্যাটট্রিক করেছিলাম আজাদের বিরুদ্ধে। আমরা ৮-০ গোলে জয়ী হয়েছিলাম। বাকি গোলগুলো করেছিল ফরিদ ২ গোল, আনোয়ার মিলু এবং আবদুল হক। দিনের চতুর্থ খেলাটি অঘটন দিয়ে শেষ হয়েছিল। শক্তিশালী রেল টিমকে পুলিশ ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে চমক দিয়েছিল। তাদের ফুলব্যাক আখতার এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড আকবর গোল করে এই অঘটন ঘটিয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি কম্বাইন্ড তাদের প্রথম পয়েন্ট হারিয়েছিল রেলের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। উত্তেজনায় ভরপুর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলাটি শুরু থেকে শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত একই তালে চলেছিল। দু’দলই বার বার দু’দলের সীমানায় হানা দিয়েছে কিন্তু একটি করে গোল করা ছাড়া আর বেশি কিছু করতে পারেনি। খেলার প্রায় ৩০ মিনিটে কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনু দলীয় আক্রমণের ফসল হিসেবে ‘ডি’র ভেতর একটি বল পেয়ে যায়, যা সজোরে হিট করে রেলের গোলরক্ষক নবী বকশকে পরাজিত করে দলকে ১-০ গোলে লিড এনে দেয়। বিরতির পর রেল দল একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যায় কিন্তু কম্বাইন্ডের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সেগুলো মোকাবেলা করে। কম্বাইন্ডও তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিল এবং সুযোগও পেয়েছিল কিন্তু ফিনিশিং-এর অভাবে গোলের সংখ্যা বাড়াতে পারেনি। খেলা প্রায় শেষের দিকে। রেলের সেন্টার ফরোয়ার্ড মোস্তাক বল আয়ত্তে নিতে ছুটে যায়। সে সময় কম্বাইন্ডের গোলরক্ষক সাদেক (বড়)ও তাকে বাধা দিতে ছুটে যায় কিন্তু মোস্তাকের গতি বেশি থাকায় সে দৌড়ের ওপর গোলপোস্টের দিকে হিট চালিয়ে দিলে সেখানে ফাঁকায় দাঁড়ানো রেলের লেফট-ইন নিয়াজ বল ধরে যা করার তা সফলতার সাথে সম্পন্ন করে এবং ফাও একটি গোল করে রেলকে নিশ্চিত হারের হাত থেকে রক্ষা করে। হকি লীগে কোন পয়েন্ট না পাওয়া ফায়ার সার্ভিসের সেদিনের খেলায়ও তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা হেরেছে ০-২ পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর সাথে। সেন্টার ফরোয়ার্ড ওসমান এবং লেফট-ইন মুনীর গোল করেছিল। দিনের অপর একটি খেলায় মাহুৎটুলী আজাদকে ৪-০ গোলে পরাজিত করেছিল। যার চার গোলের তিন গোলই করেছিল লেফট ব্যাক শামসুল বারি। অবশিষ্ট গোলটি করেছিল ফজলু।
২৩ ফেব্রুয়ারি হকি লীগের চারটি খেলার প্রথমটি ছিল ইস্পাহানী বনাম ইস্টবেঙ্গল। ফলাফল যথারীতি ০-৬ গোলে ইস্টবেঙ্গলের হার। ইস্পাহানীর পক্ষে গোল করেছিল জাফর ৩, আকবর ২ এবং আজিম ১। একই সময় পাশের গ্রাউন্ড-২তে তখন পিডব্লিউডি দলের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড মজিদ ওয়ান্ডারার্সের গোলপোস্টে এক এক করে গোল দিয়ে যাচ্ছিল এবং চমৎকার হ্যাটট্রিক করে থেমেছিল। রানার আরও একটি গোলের সুবাদে পিডব্লিউডি ৪-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। মজিদ শুধু হকি খেলোয়াড় ছিল না, সে ফুটবলেরও কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিল। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট টিমের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিল। একটি খেলার কথা মনে পড়ে। আমরা জগন্নাথ কলেজের ফুটবল টিম চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম একটি টুর্নামেন্ট খেলতে। মজিদকেও সাথে নিয়েছিলাম। কোন্ টিমের বিরুদ্ধে খেলেছিলাম মনে নেই। মনে আছে সেদিন ৫-০ গোলে আমরা হেরেছিলাম। আমাদের টিম ৫ গোল খাওয়ার মত ছিল না বা আমরা এতগুলো গোল খাওয়ার মত খেলাও খেলিনি। যারা মাঠে খেলা দেখেছেন তারাই বলেছেন। মজিদ সেদিন এতই ব্যর্থ ছিল যে, যদি সে গোলের সুযোগগুলো সফল ব্যবহার করতে পারতো, তাহলে আমরা উল্টো ৪/৫ গোলে জয় পেতাম। সুন্দর গোল, সুন্দর পাসÑ হোক সেটা নিজ টিমের কিংবা বিপক্ষ টিমের পক্ষেÑ মজিদের মুখ থেকে প্রশংসা বের হবেই। ওহ্ রোজেস, বিউটিফুল প্রভৃতি কথা খেলতে খেলতে সে বলতো। সেদিনের খেলায় আমরা গোল খেয়েছি। মজিদ বলে উঠলোÑ বিউটিফুল গোল! মজিদ আসলেই একজন ‘বিউটিফুল’ মনের মানুষ। এটাই আমার লেখার উদ্দেশ্য। এত ধীর-স্থির-শান্ত, নম্র-ভদ্র খেলোয়াড় আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। এখনও সে একইরকম ভদ্র এবং পরহেজগার জীবনযাপন করে চলেছে। ফুটবল ফেডারেশনের ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছে।
লেখায় ফিরে আসি। সেদিনের তৃতীয় খেলায় একচেটিয়া খেলেও ভাগ্যের সহায়তা বঞ্চিত বিমানবাহিনী পুলিশের কাছে ০-১ গোলের পরাজয়বরণ করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে উত্তেজিত দু’টিমের খেলোয়াড়রা হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়েছিল, হাল্কা স্টিকের ব্যবহারও হয়েছিল। খেলা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল। আম্পায়ারিং দুর্বলতার জন্য খেলায় এরকম দৃশ্য প্রায় দেখা যেত। দিনের চতুর্থ খেলায় ওয়ারী মোহামেডানকে ৫-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ওয়ারীর কৃতী লেফট-ইন মামলীর চমৎকার হ্যাটট্রিক মোহামেডানকে বড় ব্যবধানে হারাতে ভূমিকে রেখেছিল। ওয়ারীর গোলপোস্টে মোহামেডান একবারই হিট করার সুযোগ পেয়েছিল। বাকি সময় তারা ওয়ারীর আক্রমণ সামলাতেই ব্যস্ত ছিল অর্থাৎ খেলাটি একতরফাই বলা যেতে পারে। খেলা শুরু থেকেই ওয়ারীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং তারা ৮ মিনিটেই পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করে এগিয়ে যায় (১-০)। ওয়ারীর লেফট আউট শফিকের হিট গোলরক্ষক গুলখান প্যাড করে ফিরিয়ে দিলেও তা ডি-এর ভেতর দাঁড়ানো মামলীর কাছে গেলে সে পুশ করে বল জালে জড়িয়ে দেয় (২-০)। ২০ মিনিট এবং ২৩ মিনিটে মামলী পরপর আরও দুটি গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে মোহামেডানকে মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি তারা শুধু গোল রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনরকম সময় পার করাটাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যার জন্য খেলাটি খুবই নিম্নমানের এবং দর্শকদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। খেলার শেষ মুহূর্তে মামলী তার চতুর্থ গোল করেছিল। পরদিনই মোহামেডান আজাদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবধানে ২-১ গোলে জয় পেয়েছিল। বিরতি পর্যন্ত খেলা ড্র ছিল (০-০)। বিরতির পর আজাদের সফল আক্রমণে রাইট আউট শহিদুল্লাহ মোহামেডানের গোলরক্ষক জাম্বুকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে লিড এনে দিয়েছিল কিন্তু আজাদ সে লিড বেশি সময় পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। মোহামেডানের সেন্টার ফরোয়ার্ড বেগ গোল করে দলকে ১-১ গোলে সমতায় ফেরায় এবং এর কিছুক্ষণ পর লেফট আউট করিম গোল করলে মোহামেডান ২-১ গোলের লিড নিয়েই মাঠ ছেড়েছিল। সেদিনের শেষ ম্যাচে ওয়ান্ডারার্স হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা মাঠে পরিশ্রম না করেই পূর্ণ পয়েন্ট পেয়েছিলাম। ইস্পাহানী স্পোর্টিং নিঃসন্দেহে মাহুৎটুলী স্পোর্টিং-এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী টিম। তারা শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেই ২৫ ফেব্রুয়ারি মাহুৎটুলীকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল। তারা আরও অধিক গোলে জয়ী হতে পারতো কিন্তু মাহুৎটুলীর রক্ষণভাগের দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা ইস্পাহানীকে তিন গোলের মধ্যেই বেঁধে রেখেছিল। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময় ইস্পাহানীর লেফট-ইন নাঈম গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দেয়। মাহুৎটুলী গোল শোধ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হতে পারেনি। বিরতির পর খেলা ইস্পাহানীর দিকে ঝুঁকে পরে। তারা আক্রমণ শানাতে থাকে। আক্রমণের একপর্যায়ে নাঈম চমৎকারভাবে তার দ্বিতীয় গোল করে দলকে নির্ভার করে (২-০)। ইস্পাহানীর সর্বোচ্চ গোলদাতা কৃতী রাইট-ইন ইসলাহউদ্দিন না খেলাতে তাদের আক্রমণের ধার খুব শাণিত ছিল না। তারপরও তাদের সম্মিলিত আক্রমণ সামাল দেয়া ছিল মাহুৎটুলীর জন্য কঠিন। এরকমই আক্রমণে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার গোল করে দলকে ৩-০ গোল জয় নিশ্চিত করে। ভাগ্যজোরে আর খোদাপ্রদত্ত গোলে ওয়ারী ১-০ গোলে ফায়ারকে হারাতে পেরেছিল আর সেই সৌভাগ্যের গোলটি এসেছিল রাইট-আউট তাজুর স্টিক থেকে। খেলাটি ছিল সেদিনের দ্বিতীয় খেলা। সেদিনের তৃতীয় খেলায় পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড নাজিরের ২ গোল, মোহাম্মদ আলীর ১ গোল এবং মোবিনের দেয়ার ১ গোলের সুবাদে পুলিশ ৪-০ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল। দিনের চতুর্থ বা শেষ খেলা ছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং বিমানবাহিনীর মধ্যে, যা ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের হকি লীগে একটি অনাকাক্সিত ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল আর সেটা ঘটেছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল ব্যাংক এবং বিমানবাহিনীর খেলায়। প্রথম থেকেই আমরা আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করি। উদ্দেশ্য, দ্রুত গোল করে দলকে ভারমুক্ত করা। বিমানবাহিনী সমানতালে আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়; ফলে খেলা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে ওঠে। খেলার মান সেরকম উন্নত না হলেও খেলায় গতি এবং গোল করার চেষ্টা খেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। খেলার ২২ মিনিটের সময় আমরা একটি পেনাল্টি স্ট্রোক লাভ করি। আমাদের রাইট হাফ এহতেশাম সেটা থেকে গোল করে। সেসময় এয়ারম্যানরা প্রতিবাদ জানায়। তারপর তারা খেলায় অংশ নেয় এবং ২৬ মিনিট পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যায়। হঠাৎ করেই তাদের কিছু অফিসার এবং সমর্থকের উস্কানিতে তারা মাঠ ছেড়ে চলে যায়, আর খেলায় ফিরে আসেনি। একটি সুশৃংখল বাহিনীর কাছে এরূপ নিয়ম ভঙ্গ করা এবং অখেলোয়াড়োচিত আচরণ মাঠে উপস্থিত সবাইকে হতাশ করেছিল।
সেদিনের দ্বিতীয় খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ওমেদের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক আর তার হ্যাটট্রিকের সহযোগিতায় কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ওয়ান্ডারার্সকে ৬-০ গোলে হারিয়েছিল। রাইট-ইন বুলবান, লেফট-ইন ফুয়াদ এবং কৃতী সেন্টার হাফ আব্দুস সাদেক ১টি করে গোল করেছিল। দিনের তৃতীয় খেলাতেও একটি হ্যাটট্রিক হয়েছিল আর সেটি করেছিল পিডব্লিউডি টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওসমান। ওসমান পূর্ব পাকিস্তান দলেরও চৌকস সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলোয়াড় ছিল। পিডব্লিউডি ইস্টবেঙ্গলকে ৮-১ গোলে পরাজিত করেছিল। গোল করেছিল ওসমান ৪, খুরশীদ ৩, নাসের ১। আর ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ১টি গোল শোধ দিতে সক্ষম হয়েছিল। #
১ আগস্ট
(ঊনআশি)
আমার হকি ক্যারিয়ারের একটি অবিস্মরণীয় জয় এবং আমার করা স্মরণীয় দুটি গোল যা আমার স্মৃতিতে আজও জাগরুক আর সে অভূতপূর্ব ম্যাচটি ছিল ১৯৬৭ সালের ঢাকা হকি লীগে ইস্পাহানি স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে।
ইস্পাহানি সেবার খুব শক্তিশালী টিম গঠন করেছিল। করাচি থেকে ৪/৫ জন হকি খেলোয়াড় এনে টিমের শক্তিবৃদ্ধি করেছিল। তাদের ফুলব্যাক শফিক খুবই দক্ষ, নির্ভরশীল খেলোয়াড়। সে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিল। তাদের আক্রমণভাগের ইসলাহ উদ্দিনের কথা আগের পর্বে লিখেছি। লেফট-ইন এবং লেফট আউটে দুই ভাই আজিজ ও আজিম চমৎকার স্টিক ওয়ার্ক এবং দ্রুতগতির খেলোয়াড়। তাদেরই এক ভাই হানিফ খান পরবর্তীতে পাকিস্তান জাতীয় দলের লেফট-ইনের খেলোয়াড় হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তারা ঢাকায় এসে প্রথম ম্যাচেই দুর্বল ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ১৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে আকাশে উড়ছিল। পরের ম্যাচে ৫-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারিয়ে নিজেদেরকে আলাদা কিছু ভাবতে শুরু করেছিল। পরের ম্যাচেও পিডব্লিউডিকে হারিয়ে স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রতি তাদের তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে উঠেছিল এবং কথাবার্তায় অহঙ্কার ঝরে পড়তো। বলতো, ‘হার টিমকো গিন গিনকে গোল দে সাক্তা হুঁ। বাঙ্গালিকো খেল শিখা দুংগা ইত্যাদি। বিশেষ করে দুই ভাই আজিজ এবং আজিম যাদের নাম মোমিন ভাই দিয়েছিলেন পাপ্পান আর ছাপ্পান, ভীষণ বাকপটু। তাদের কথাগুলো শুনে রাগে-কষ্টে নিজে নিজেই ফুঁশতাম, জবাব দেবার সুযোগ ছিল না; কারণ সে সময় আমাদের টিম (ন্যাশনাল ব্যাংক) লীগে এন্ট্রি না করায় আমাদের খেলা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তবে মনের জ্বালাটা বেড়ে যাচ্ছিল। ভাবতাম সুযোগ পেলে বুঝিয়ে দিতাম, গুনে গুনে গোল দেয়া অত সহজ নয়। পরবর্তীতে আমাদের টিম এন্ট্রি করলেও প্রথমদিকে আমার খেলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি; কারণ তখন আমি লাহোরে পাকিস্তান হকি ক্যাম্পে ছিলাম। সে সময় ইসলাহউদ্দিনও ক্যাম্পে ছিল।
আমাদের সাথে ইস্পাহানির দেখা হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি স্টেডিয়ামের ২ নং গ্রাউন্ডে। খেলার দিন ব্যাংকে সবাইকে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। খেলার পূর্বে সহ-খেলোয়াড়দের উদ্দেশে আমার একটাই কথা ছিলÑ এ ম্যাচে আমাদের জিততে হবে। দেখাতে হবে বাঙ্গালিরাও হকি খেলতে পারে। ফখরুল আলম মাহমুদ ভাইকে বলেছিলাম, ইসলাহউদ্দিন যেন বল ধরতে না পারে, সারাক্ষণ তার সাথে সাথে থাকতে হবে, তার বল ধরার আগেই বাধা দিতে হবে, প্রয়োজনে টাফ হকি খেলতে হবে। দুই ব্যাক সাবের এবং ইকবালের প্রতি আমার নির্দেশ ছিল পাপ্পান ও ছাপ্পান যেন বেশি কেরামতি না দেখাতে পারে, শক্ত হাতে খেলতে হবে।
উষ্ণ মেজাজ আর উত্তেজনায় ভরপুর দু’টিমের খেলোয়াড়রা হার্ড হিটিং আর টাফ হকি দিয়ে খেলা শুরু করেছিল। খেলার মাত্র তিন মিনিট, আমি হাফ লাইনের কাছাকাছি একটি বল ধরে দ্রুতবেগে বিপক্ষ দলের সীমানার দিকে ছুটছি। দু’একজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ইস্পাহানির সীমানায় পৌঁছেই চোখে পড়লো সাদা চুনের দাগ। বল তখন আমার ডান দিকে, রং সাইডে। ডান পায়ের ওপর, পা বদল করার বা বলকে বাম দিকে নেয়ারও সুযোগ নেই। আমি শরীরকে ডান পায়ের ওপর ভর দিয়ে ডান কাত হয়ে দৌড়ের মধ্যেই (যেটাকে হকির ভাষায় রং ফুট হিট বলে) সজোরে হিট করলাম। গোলরক্ষক মো. শফি, যাকে ইপিআর টিম থেকে আনা হয়েছিল মহসিন ভাইয়ের বদলি হিসেবে। মহসিন ভাই ক্রিকেটের উইকেটরক্ষক কিপার ছিলেন। শফি তার বাম পা বাড়াবার সময় পায়নি, বল সেকেন্ডবারের কোনাদিয়ে গোল পোস্টে ঢুকে ব্যাকবোর্ডে জোরে আওয়াজ তুললো আর বাইরে আমাদের সমর্থকগণ চিৎকার দিয়ে উঠলো, গোল। স্বপ্নের মত একটা গোল নিপুণ এক শিল্পীর আঁকা ছবির মত একটি গোলÑ যা আজও আমার মনের ভেতর আঁকা রয়েছে। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে গেলাম। ইস্পাহানি এত তাড়াতাড়ি গোল খাবে ভাবতে পারেনি। গোল খাওয়ার পর তারা গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায়। টাফ হকি রাফ হকির দিকে এগিয়ে যায়; তবে দু’টিমের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটা উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। দু’টিমই দুটো করে পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নিয়েছিল কিন্তুু এর ফায়দা কোন দলই নিতে পারেনি। দু’দলের উত্তেজিত খেলোয়াড়রা মাঝেমধ্যেই বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে খেলায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। খেলা ধীরে ধীরে আম্পায়ারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং খেলার ২৫ মিনিটে দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে দু’দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে খেলা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আম্পায়ারদ্বয় আলমগীর ভাই এবং মোমিন ভাই দু’টিমকে শান্ত করে দ্রুত খেলা শুরু করেন। খেলা শুরু হওয়ার পরপরই আমি একটি বল বিপক্ষ দলের মাঝমাঠে পেয়ে একক প্রচেষ্টায় ইস্পাহানির ডি’র ভেতর ঢুকে সজোরে হিট মারি। এবারও শফি সেভ করার সুযোগ পায়নি। বল গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে চলে গিয়েছিল। সোজা গোলপোস্টের ভেতর এবং খুঁজে নিয়েছিল জাল। অ™ভুত সুন্দর একটি গোল করেছিলাম যা লিখতে বসে আবেগে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। পরদিন মর্নিং নিউজ পত্রিকা লিখেছিল : ডরঃয ইধংযরৎ নধপশ রহ ঃযব ধঃঃধপশ, ঘধঃরড়হধষ ইধহশ, যধং ধ ফবভরহরঃব বফমব ড়াবৎ ওংঢ়ধযধহর ংঢ়ড়ৎঃরহম. ইধংযরৎ ংপড়ৎবফ ঃযব ইধহশং ঝবপড়হফ মড়ধষ রহ ভরহব ংড়ষড় ভধংযরড়হ. আমরা ২-০ এগিয়ে যাই। এর মিনিট পর আমরা একটা পেনাল্টি কর্নার পাই। আমাদের ফুল ব্যাক সাবের আলী কর্নার কিক মারে। ইস্পাহানির গোলরক্ষক রাশ করার সময় সাবেরের সাথে ধাক্কা লাগে। ফলে সাবেরের ফাউলসহ সবুজ কার্ড, আলমগীর ভাই তাকে সাইড লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেন। আমরা দশজনের দল, শক্তিশালী ইস্পাহানিকে আটকাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। আমরা রক্ষণাত্মক খেলে তাদের আক্রমণগুলোকে ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার তাকে মাঠে ডাকা হয়েছিল। তখন আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলায় ফিরে গেলাম। বিরতি পর্যন্ত আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে ছিলাম। বিরতির পরও আমাদের আক্রমণের ধারা অব্যাহত ছিল। এরকমই একটি সম্মিলিত আক্রমণে আমাদের রাইট ইন মিলু দলের পক্ষে তৃতীয় গোল করে। তিন গোল খাওয়ার পরও ইস্পাহানি টিমের মধ্যে কোনপ্রকার নিরাশ ভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তারা একই রকম খেলা খেলতে থাকে এবং আক্রমণ চালাতে থাকে। আমাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দাস খুবই দক্ষতার সাথে দুটো গোল সেভ করেছিলেন। খেলা শেষ হওয়ার মিনিটখানেক আগে ইসলাহউদ্দিন চমৎকার পুশ দ্বারা একটি গোল শোধ দিতে সক্ষম হয়েছিল। আমরা শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলের একটি স্মরণীয় জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলোয়াড় : রঞ্জিত দাস (গোলরক্ষক), সাবেক আলী এবং মো. ইকবাল, এহতেশাম, মাহমুদ এবং আনোয়ার, আবদুল হক, মিলু, ফরিদ, বশির, মনি।
ইস্পাহানি টিম : মো. শফি (গোলরক্ষক), সোলায়মান এবং শফিক আজিম, আকবর এবং জাফর, মোদাসসার, ইসলাহউদ্দিন, হায়দার, নাঈম এবং আজিজ।
২৫ মার্চ ১৯৬৭ থেকে করাচিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় হকি চ্যাম্পিনশিপে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান হকি টিম গঠনের জন্য দেশের ৬৮ জন হকি খেলোয়াড়কে প্রাথমিক ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল। দেশের হকি খেলোয়াড়দের রেকর্ড রাখার জন্য নামগুলো এখানে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
ন্যাশনাল ব্যাংক : রণজিত দাস, সাবের আলী, আনোয়ার হোসেন, এহতেশাম সুলতান, ফখরুল আলম মাহমুদ, আব্দুল হক মির্জা ফরিদ মিলু, বশীর আহেমদ, মীর আনোয়ার কলিম এবং আলী আসগর।
ওয়ারী কাব : ফ্রান্সিস পালসার, মোমতাজ, এসএম শেরা, কামাল হায়দার, মাহমুদুর রহমান, মামলী, সহিদ, শফিক এবং নওয়াজিদ।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং : সাব্বির ইউসুফ, মহসিন, আব্দুস সাদেক, বুলবান, ওমেদ আলী, প্রতাপ শংকর এবং কাদের।
মোহামেডান স্পোর্টিং : মো. সেলিম জাম্বু, ইব্রাহিম সাবের, জিয়া, রহিম বেগ, খাজা সলিমউল্লাহ, জগলু, ফালু এবং সালাম।
ইস্পাহানী স্পোর্টিং : শফিক, জাফর, আজিজ, এব্রার, আজিম, ইসলাহউদ্দিন, হায়দার, মোদাসসার এবং নাঈম।
মাহুৎটুলী স্পোর্টিং : আরেফীন, হাসান, শামসুল বারী, পুতুল, মোহন, ফজলু, হাফিজ উল্লাহ এবং মুজিবর।
ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং : নূরুল ইসলাম, এরশাদ, রাজ্জাক, মাহমুদ, আজিজ এবং হাবিবউল্লাহ।
পিডব্লিউডি কাব : মিরু, মজিদ এবং রানা।
পাকিস্তান স্পোর্টিং : মোমতাজ, ওসমান এবং বুলবুল।
পুলিশ এসি : মান্নান, মোহাম্মদ আলী, গফুর এবং সারুফ।
আজাদ স্পোর্টিং : মাজেদ। (ক্রমশ.)
১৬ আগস্ট
(আশি)
মোহামেডান ০-২ গোলে পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর কাছে হেরে গিয়েছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারির প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় যে কোন দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় খেলাটি জমজমাট হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর ওসমান ও খুরশীদ দুটো গোল করে মোহামেডানকে থামিয়ে দিয়েছিল।
সেদিনের দ্বিতীয় খেলাটি আরো বেশি ফাটাফাটির। পিডব্লিউডি আর মাহুৎটুলী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দু’টিমই জেতার জন্য লড়েছে। এই খেলার লড়াই দেখে মাঠে উপস্থিত দর্শকরা প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলেন। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের প্রথম সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছিল পিডব্লিউডি’র কৃতী খেলোয়াড় মজিদ। প্রথমার্ধের ১-০ গোলের লিড দ্বিতীয়ার্ধের মাহুৎটুলীর ঝড়ে পিডব্লিউডি বেসামাল হয়ে পেনাল্টি স্ট্রোকের দন্ডে দন্ডিত হয়েছিল, যার সফল বাস্তবায়ন করেছিল শামসুল বারী। খেলায় ১-১ গোলের সমতা। তারপরও দু’দল তাদের শক্তির সবটুকু লাগিয়েও কেউ কাউকে পরাস্ত করতে পারেনি।
সুকুর, বুললান এবং কোরাইশীর করা ৩-০ গোলে ভিক্টোরিয়া ইস্টবেঙ্গলকে দিনের তৃতীয় খেলায় পরাজিত করেছিল। চতুর্থ খেলাটি একতরফা বিমানবাহিনী ৫-১ গোলে ফায়ারকে বিধ্বস্ত করেছিল। তাদের পক্ষে নিয়াজী একাই তিন গোল করেছিল। লেফট-ইন আফসার এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড সুরাওমা একটি করে গোল করলে ফায়ারের পক্ষ থেকে রশীদ একটি গোল ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল।
হকির মক্কা খ্যাত মাহুৎটুলী এলাকার দুটি টিম। খেলার ধরন-ধারণ এক খেলার মান এক শক্তিশালী দল হিসেবে কেউ কারো চেয়ে কম নয়- রেষারেষিটাও কম ছিল নাÑ যার প্রমাণ মাঠে দেখা যেত। ২৮-২-৬৭ তারিখের ম্যাচটিও এর ব্যক্তিক্রম ছিল না। মাঠে জেতার নেশা দু’টিমেরই ছিল বলে দু’টিমই প্রচুর আক্রমণ চালিয়েছে। তবে আক্রমণগুলোয় পরিকল্পনার অভাব থাকায় সফল হতে পারছিল না। অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রথমার্ধের শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত। মাহুৎটুলী টিমের লেফট-ইন ফজলু একজনকে কাটিয়েই সজোরে হিটের মাধ্যমে কম্বাইন্ডের গোলরক্ষককে চমকে দিয়েছিল কিন্তু সমশক্তির দলকে মাহুৎটুলী বেশিক্ষণ সামলে দিয়ে রাখতে পারেনি।কয়েক মিনিটের মধ্যে কম্বাইন্ডের কৃতী সেন্টার হাফ সাদেক গোল করে খেলায় সমতা এনে দেয়। বিরতির পর দু’দলই জেতার জন্য লড়াই করে গেছে কিন্তু কোন দলই জিততে পারেনি, ১-১ গোলের ড্র নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে হয়েছে। গত ২৮ মে ২০১১ ঢাকা কাবে প্রাক্তন হকি খেলোয়াড়দের মিলনমেলায় দীর্ঘদিন পর ফজলুর সাথে দেখা হয়েছিল। প্রথমে চিনতে পারিনি, এ সময়ের দেশের কৃতী স্ট্রাইকার কামাল পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, আমার মামা, ফজলু। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম! এই সেই ফজলু- যাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। খেলার মাঠে শান্ত, ভদ্র, বিপক্ষ দু’তিন খেলোয়াড়কে কাটানো (ডজ দেয়া) যার কাছে কোন ব্যাপারই ছিল না, এর কি দশা! তরুণ সুন্দর ফজলু ইয়া বড় বড় সাদা দাড়ি, আল্লাওয়ালা ফজলু, আমার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ফজলু ঢাকাইয়া কথায় বললো, ‘খেলমে ম্যায়, একজোন (একজন), দোজোন (দুজন) তিনজোন (তিনজন) কো কাটাকে বি ‘ডি’ খোজকে পাতে থে নাই, ইসলিয়ে আপ হামকো কায়তে থে, আরে ফাজলু, তু আগে যাতা, না পিছে যাতা।’ অর্থাৎ (ফজলু বলছিল) আমি একজন, দুজন, তিনজনকে কাটিয়েও ‘ডি’ খুঁজে পেতাম না, তখন আপনি আমাকে বলতেন, আরে ফজলু, তুই সম্মুখে যাচ্ছিস না পেছনে যাচ্ছিস। আসলে ফজলুর স্টিক-বলের কন্ট্রোল ছিল খুবই চমৎকার, ডজ করাটা ছিল তার সহজাত বা ন্যাচারাল আর খেলার বৈশিষ্ট্যই ছিল ডজ দিয়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে কাটানো কিন্তু সমস্যাটা ছিল সে ডজ করতো সাইডওয়ে। ডজ করার উদ্দেশ্য যে, ডজ দিয়ে বিপক্ষ একজন খেলোয়াড়কে পেছনে ফেলে মাঠের দূরত্ব কমিয়ে আনা এবং নিজস্ব খেলোয়াড়কে স্বচ্ছন্দে সুন্দর একটা পাস দেয়া। ফজলুর কাছ থেকে সেরকম ডজ না পেয়ে আমি উপরোক্ত কথাগুলো ওকে বলতাম। পুরনো ঢাকাইয়া কথা বললে সে হাসছিল।
সেদিনের দ্বিতীয় খেলায় পিডব্লিউডির কৃতী খেলোয়াড় মজিদের চমৎকার দুই গোলের সুবাদে তারা মোহামেডানকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল। দিনের তৃতীয় খেলায় আজাদ ২-১ গোলের ব্যবধানে ফায়ার সার্ভিসকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। আজাদে জাহিদুল্লাহ এবং জাহিদ গোল দুটো করেছিল আর ফায়ারের পক্ষে গোল করেছিল জিল্লুর।
সেদিনের চতুর্থ খেলায় পুলিশও সুযোগ পেয়েছিল বেশি বেশি গোল করার। ইস্টবেঙ্গলকে তারা ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। তাদের আকবর, মোহাম্মদ আলী, গফুর, আখতার গোল করার সুযোগটা নিয়েছিল।
১ মার্চ শক্তিশালী ইস্পাহানী তাদের মূল্যবান একটি পয়েন্ট বিসর্জন দিয়েছিল ভিক্টোরিয়ার কাছে। তারা গোলশূন্য ড্র করেছিল। সেদিনের দ্বিতীয় খেলায় ওয়ারী ২-১ গোলে পাকিস্তান স্পোর্টিংকে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট পেয়েছিল। ওয়ারীর সহিদ এবং নেওয়াজিশ গোল করলে খুরশীদ তার দলের হয়ে এক গোল শোধ করেছিল। সেদিনের তৃতীয় খেলায় আমরা ভাগ্যের জোরে পুলিশকে হারিয়ে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়তে পেরেছিলাম আর উইনিং গোলটি করেছিল আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ। দিনের শেষ ম্যাচে পিডব্লিউডি ৩-১ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল। #
১ সেপ্টেম্বর
(একাশি)
৩ মার্চ ওয়ারী এবং কম্বাইন্ডের খেলাটি ইপিএসএফ-এর হকি লীগ কমিটি পসপন্ড করেছিল; কারণ দু’টিমই বিশেষ কারণ দেখিয়ে খেলা স্থগিত চেয়েছিল। কম্বাইন্ড কারণ দেখিয়েছিলÑ তাদের একজন খেলোয়াড় জাতীয় ফুটবল টিমের ট্রায়াল খেলতে পশ্চিম পাকিস্তান গেছে আর ওয়ারী তাদের সাথে সুর মিলিয়ে কয়েকজন খেলোয়াড়ের অসুস্থতাকে দাঁড় করেছিল। ব্যাস, খেলা স্থগিত। সেদিন একটি মাত্র খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া বনাম ওয়ান্ডারার্স। ভিক্টোরিয়া ৫-০ গোলে জিতেছিল। লেফট আউট শুকুর তিন গোল, সেন্টার ফরোয়ার্ড কোরেশী এবং বাবু খান একটি করে ভিক্টোরিয়ার পক্ষে গোল করেছিল। বিমানবাহিনীর ‘প্রোটেস্ট গ্র্যান্ট’ হকি লীগের একটি কলঙ্কিত সিদ্ধান্ত, যা হকি অঙ্গনে খুব সমালোচিত হয়েছিল। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের সাথে (ন্যাশনাল ব্যাংক) বিমানবাহিনীর খেলায় যে অনাকাক্সিত ঘটনা ঘটেছিল অর্থাৎ বিমানবাহিনী ২৬ মিনিট পর্যন্ত খেলা চলাকালীন অবস্থায় মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আর খেলায় ফিরে আসেনি। আমরা সে সময় পেনাল্টি স্ট্রোকে এক গোলে এগিয়ে ছিলাম। বিমানবাহিনীর অফিসার এবং বাইরের কিছু সমর্থকের উস্কানিতে তারা এরকম অখেলোয়াড়ী কান্ড করেছিল। তারাই আবার প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিসের ভিত্তিতে প্রচেষ্টা হয়েছিলÑ সেটাও জানা যায়নি। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য হবে নাÑ সেটাও সবার জানা। হকির ‘বাইলজ’-এ আছেÑ কোন দল যদি খেলতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে বিপক্ষ দলকে পূর্ণ পয়েন্ট প্রদান করা হবে। হকি লীগ কমিটি নোটিস জারি করেছিল যে, হকি খেলার বৃহত্তর স্বার্থে বিমানবাহিনীর প্রটেস্ট গ্র্যান্ট করা হলো এবং ভবিষ্যতে খেলার মাঠে এরকম আচরণ বরদাশত করা হবে না। লীগ কমিটির এরূপ স্বেচ্ছাচারিতাকে মেনে নিয়ে আমরা ৪-৩-৬৭ তারিখে বিমানবাহিনীর সাথে খেলতে আবার মাঠে নেমেছিলাম। বিমানবাহিনী তাদের সব শক্তি লাগিয়ে মাঠে নেমেছিল; ট্রাক ভরে এয়ারম্যানদেরও এনেছিল তাদের সমর্থন জোগাতে। অন্যদিকে মাঠে উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা এবং সমর্থন পেয়েও খেলায় যেন উৎসাহ পাচ্ছিলাম না আমরা। বিরক্তিকর মন নিয়ে খেলতে গিয়ে বার বার ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছিল। মাঠে আমরা সংঘবদ্ধ হতে পারছিলাম না; আমাদের আক্রমণও জোরালো হচ্ছিল না। সুতরাং গোলও পাচ্ছিলাম না। সে সুযোগে বিমানবাহিনী বার বার আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ডিফেন্সকে চাপের মধ্যে রেখেছিল কিন্তু সফলতা পায়নি। শেষ পর্যন্ত খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল, যা দলের জন্য ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল।
ওয়ারী বনাম কম্বাইন্ড ৩-৩-৬৭ তারিখের খেলাটি তারা ইপিএসএফ হকি কমিটির ওপর প্রভাব খাটিয়ে পসপন্ড করিয়ে নিয়েছিল। কারণ দেখিয়েছিলÑ একটি দলের খেলোয়াড় ফুটবল ট্রায়াল খেলতে পশ্চিম পাকিস্তান গেছে আর অন্য টিম তাদের কয়েকজন খেলোয়াড়ের অসুস্থতাকে কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। পরদিনই দু’টিম মাঠে নেমেছিল দুটো ভিন্ন টিমের বিরুদ্ধে খেলার জন্য। একদিনেই তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল কি করেÑ এটা ছিল সবার প্রশ্ন। আসলে ওয়ারী এবং কম্বাইন্ড লীগের ঐ অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চায়নি। লীগ শিরোপ লড়াইয়ের কূটবুদ্ধি ছিল ঐ পসপন্ডের অন্তরালে। ৪-৩-৬৭ তারিখে ওয়ারী ওয়ান্ডারার্সকে অতিসহজেই ৬-২ গোলে পরাজিত করলেও কম্বাইন্ড ভাগ্যগুণে ১-০ গালে ভিক্টোরিয়াকে হারাতে পেরেছিল। ওয়ারীর কৃতী লেফট ইন মামলী, দেশসেরা লেফট ফুলব্যাক মোমতাজ এবং নওয়াজিশ প্রত্যেকে দু’গোল করেছিল আর হেলাল এবং ওয়ান্ডারার্সের পক্ষে ওয়াহিদ দু’ইন দুটো গোল শোধ দিতে পেরেছিল।
রাইট ফুলব্যাক কাদের খেলার অন্তিম মুহূর্তে পেনাল্টি কর্নার থেকে একটি গোল করে কম্বাইন্ডকে উদ্ধার করেছিল। আমাদের লীগ চ্যাম্পিয়ন শিরোপা ধরে রাখা কঠিন করে দিয়েছিল ৫-৩-৬৭ তারিখে রেল দল আমাদের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। এ মৌসুমেও লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের যে স্বপ্ন আমরা দেখছিলাম, এই ড্র’র ফলে চার পয়েন্ট হারিয়ে সে স্বপ্নটা অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। এ ড্র’র ফলে রেল দলের কোন ক্ষতির কারণ হয়নি বরং লাভই হয়েছে বেশি। আমরা শিরোপা দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছিলাম আর এ পয়েন্ট হারানোর জন্য আমরাই দায়ী, বিশেষ করে আমাদের ফরোয়ার্ডরা সেদিন ছিল মহাফপ। আমাদের মাঝমাঠ ছিল ছন্নছাড়া; আক্রমণ তৈরিতে ছিল ব্যর্থ। শুধুমাত্র আমাদের রক্ষণ ছিল সুদৃঢ়, নইলে হার দিয়ে ফলাফল লিখতে হতো। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে কিছু সময়ের জন্য মাঠের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের। সেসময় তাদের আক্রমণগুলোও সফলতা পায়নি তাদের স্কোরারের ব্যর্থতায়। দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় বিশ মিনিটের সময় মিলুর একটি গোল আম্পায়ার ঈশা খান নাকচ করে দেন। কেন গোল বাতিল করেছেনÑ তার সঠিক ব্যাখ্যা রেফারি দিতে পারেননি। আমরা তাকে ঘেরাও করে গোল বাতিলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গোল দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলাম কিন্তু ঈশা খাঁ তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় আমাদের ব্যাংক দল উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এতে খেলা প্রায় পাঁচ মিনিট বন্ধ ছিল। তারপরও দু’দল জেতার জন্য খেলা চালিয়ে যায় কিন্তু খেলার বন্ধাত্ব ঘুচানো সম্ভব হয়নি। দিনের শেষ খেলাটি ছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে মোহামেডানের, যা বিনা পরিশ্রমেই ভিক্টোরিয়া দু’পয়েন্ট পেয়েছিল। মোহামেডান মাঠে উপস্থিত না হওয়ার কারণে পরদিনই অর্থাৎ ৬ মার্চ মোহামেডান শক্ত মনোবল নিয়ে মাঠে নেমেছিল আমাদের (ন্যাশনাল ব্যাংক) বিরুদ্ধে খেলতে এবং জয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও হেরে গিয়েছিল ২-১ গোলের ব্যবধানে। তারা ১-০ গোলের লিড নিয়ে শেষ করেছিল প্রথমার্ধ। গত ম্যাচের মতো সেদিনও আমরা ফরোয়ার্ডরা গোল করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝ মাঠ থেকে প্রচুর বলের জোগান পেয়েছি, আক্রমণও হয়েছে অনেক কিন্তু গোলপোস্টে এলোমেলো হিট মেরে অনেক সুযোগ আমরা নষ্ট করেছিলাম। এমনকি পেনাল্টি কর্নার পেয়েও ফিনিশিং-এর অভাবে গোল পাইনি। অন্যদিকে মোহামেডানের রক্ষণভাগ সালাম ভাইয়ের নেতৃত্বে মজবুত ভিত তৈরি করেছিল আর ইব্রাহিম সাবের মধ্যমাঠ সামাল দিচ্ছিল এবং আক্রমণে রহিম বেগ ব্যাংক দলের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমার্ধের বিশ মিনিটে ব্যাংক দল পেনাল্টি স্ট্রোকে গোল খেয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিল। ইব্রাহিম সাবের আমাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দা’কে কোন সুযোগ না দিয়ে গোল করে দলকে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাংক দল গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। খেলার শেষ প্রান্তে এসে পরপর দুটো গোল করে ব্যাংক টিমকে নিশ্চিত হারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম। প্রথমটি আমরা একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে ড্রিবল করে মোহামেডানের দুজন ডিফেন্সকে কাটিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে সুন্দর প্লেসমেন্টের সাহায্যে জাম্বুকে পরাস্ত করেছিলাম এবং দ্বিতীয় গোলটি করেছিলাম একইভাবে ড্রিবল করে মোহামেডানের ডিফেন্সের ভেতর দিয়ে ঢুকে ‘ডি’র মাথা থেকে সজোরে হিট! বল উড়ে গিয়ে জালে জড়িয়ে যায়। জাম্বু চেষ্টা করেও সেভ করতে পারেনি, যদিও সেদিন সে খুবই চমৎকার গোলকিপিং করেছিল এবং মোহামেডানকে আরো বেশিসংখ্যক গোলের হার থেকে রক্ষা করেছিল।
সেদিনের অপর খেলায় বিমানবাহিনী ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ১১-০ গোলের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিল এবং তাদের ইনসাইড লেফট আফসার পাঁচ গোল করাসহ একটি হ্যাটট্রিক করে হকি লীগে হ্যাটট্রিকের গর্বিত একজন অংশীদার হয়ে গিয়েছিল।
মোস্তাক করেছিল তিন গোল, ইনসাইড রাইট নিয়াজী দু’গোল করলে বাকি এক গোল করেছিল রাইট আউট রিয়াজ। এখানে দুঃখের সাথে বলতে হয়, ঐতিহ্যবাহী একটি কাব এরকম দুর্বলতম টিম গঠন করে কাবকে হেয় করার কোন যুক্তি নেই। দিনের অন্য একটি ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল প্রথম পয়েন্ট অর্জন করেছিল; কারণ ফায়ার মাঠে তাদের সম্পূর্ণ দল নামাতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে। আর এ পয়েন্ট পেয়েই ইস্টবেঙ্গল খুব আনন্দ করেছিল সেদিনের শেষ ম্যাচের পর।
পরদিনই (৭-৩-৬৭) আমাদেরকে পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। যদিও আমাদের টিম তাদের তুলনায় বেশ শক্তিশালী, তারপরও তাদেরকে সমীহ করে মাঠে নামতে হয়েছে। প্রত্যেক দলকেই তাদের সাথে খেলতে একটু আলাদাভাবে চিন্তা-ভাবনা করে মাঠে নামতে হতো। কারণ তারা খুবই লড়াকু টিম; মানবিক দিক দিয়ে তারা খুবই দৃঢ়চেতা। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যায়; বিশেষ করে তাদের রক্ষণভাগে গোলরক্ষক মোমতাজ, ব্যাক কামাল, আনোয়ার, খুরশীদÑ এরা ছিল ‘মারু প্লেয়ার’। এদেরকে মাথায় রেখেই মাঠে নেমেছিলাম সেদিন। পাকিস্তান স্পোর্টিং শুরু থেকেই আমাদের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে। আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ডিফেন্সকে চাপের মধ্যে রাখে এবং গোল করার বেশক’টি সুযোগও তৈরি করে কিন্তু সফল হতে পারেনি। পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর ডিফেন্সে ঢুকে গোল করা একটু কঠিন হতো; কারণ ‘এই বুঝি স্টিকটা এসে পড়লো বলে’Ñ এ ধরনের আতঙ্ক নিয়ে খেলতে হতো। এর মধ্যে আমরাও আক্রমণ চালিয়ে খেলছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা একটা শট কর্নার (বর্তমানে পেনাল্টি কর্নার) পেলাম। আমাদের ফুলব্যাক সাবের আলী সজোরে হিটের মাধ্যমে মোমতাজকে পরাস্ত করলে আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। গোল খেয়ে পাকিস্তান স্পোর্টিং মরিয়া হয়ে হয়ে ওঠে এবং গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকে। এভাবে প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে খেলার ধারা একইরকম চলছিল। এরই মধ্যে আমি একটি বল নিয়ে দ্রুত গতিতে বিপক্ষ দলের ডিফেন্সকে কাটিয়ে ‘ডি’র দিকে ঢুকছি, পেছন থেকে দু’ব্যাক ধেয়ে আসছিল আর সম্মুখ থেকে গোলরক্ষক মোমতাজ ছুটে আসছে। টপ অব দ্য ডি থেকে আগুয়ান গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে বল পুশ করে দিয়েছিলাম পোস্টে। বল গোলপোস্টের বার ঘেঁষে বোর্ডে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। চমৎকার একটি গোল করতে পেরে সেদিন বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম। আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান স্পোর্টিং মরিয়া হয়ে ওঠে এবং গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকে। এভাবে প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে খেলার ধারা একইরকম চলছিল। এরই মধ্যে আমি একটি বল নিয়ে দ্রুতগতিতে বিপক্ষ দলের ডিফেন্সকে কাটিয়ে ‘ডি’র দিকে ঢুকছি। পেছন থেকে দু’ব্যাক ধেয়ে আসছিল আর সম্মুখ থেকে গোলরক্ষক মোমতাজ ছুটে আসছে। টপ অব দ্য ডি থেকে আগুয়ান গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে বল পুশ করে দিয়েছিলাম পোস্টে, বল গোলপোস্টের বার ঘেঁষে বোর্ডে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। চমৎকার একটি গোল করতে পেরে সেদিন বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম। আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান স্পোটিং-এর খেলায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। তারা একইরকম আক্রমণ চালিয়ে ভাল খেলা প্রদর্শন করে যায় শেষ পর্যন্ত।
ক্রমশ.
১৬ সেপ্টেম্বর
(বিরাশি)
দিনের অপর খেলায় রেল দল ইস্টবেঙ্গলকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল, যার তিন গোল করেছিল তাদের কৃতী লেফট ইন নিয়াজ, রাইট ইন কায়ফুল করেছিল দু’গোল এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড নাসরুল্লাহ ও রাইট আউট হামিদ করেছিল এক গোল করে। সেদিনের শেষ ম্যাচেও বিমানবাহিনী মোহামেডানের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলের বড় জয় পেয়েছিল। সেদিন মোহামেডান খুবই বাজে খেলে, বিশেষ করে তাদের ডিফেন্স এবং হাফ জঘন্য খেলেছিল বলে বিমানবাহিনী এত গোল করার সুযোগ পেয়েছিল। মাঠে ধুলাবালির ঝড়, আলোর স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে মোহামেডান খেলা বন্ধ রাখার আবেদন করলেও আম্পায়ার নিয়াজ আহমেদ খান কর্ণপাত না করে খেলা শেষ করেন। বিমানবাহিনীর সেন্টার ফরোয়ার্ড মোস্তাক এবং লেফট ইন আফসার দু’গোল করে করেছিল, রাইট ইন নিয়াজী এবং রাইট আউট রিয়াজ একটি করে গোল করেছিল।
সমমানের দুটো টিম পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং পিডব্লিউডি ১৬ মার্চ মাঠে লড়েছে সব শক্তি দিয়ে কিন্তু ভাগ্য সেদিন পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর পক্ষে ছিল বলে তারা ৩-১ গোলে জয়ী হয়ে মাঠ ছেড়েছিল। তাদের লেফট আউট চুং, ইনসাইড রাইট ওসমান এবং খুরশীদ গোল করলে জাফর এক গোল করে ব্যবধান কমিয়েছিল। দিনের অপর খেলাও ছিল সমমানের, তবে নিচের দিকে। ইস্টবেঙ্গল এবং আজাদ স্পোর্টিং-এর মধ্যে। তারাও জেতার জন্য লড়েছিল কিন্তু উভয় দলই ১-১ গোল করার পর আর কারো পক্ষে গোল করা সম্ভব হয়নি। আজাদ স্পোর্টিং প্রথম গোল করেছিল তাদের রাইট ব্যাক রউফের নিখুঁত কর্নার হিটের মাধ্যমে আর শোধ দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের রাইট আউট মজিদ। দিনের শেষ খেলায় ওয়ান্ডারার্স কাব দেরিতে মাঠে আসায় তাদের বিপক্ষ রেল দল ওয়াকওভার পেয়ে যায়।
১৭ মার্চ ফায়ার সার্ভিস বিরতি পর্যন্ত মোহামেডানকে ড্র রাখতে বাধ্য করেছিল কিন্তু পরে তারা আর মোহামেডানকে ধরে রাখতে পারেনি। জিয়া পরপর দু’গোল করে দলকে এগিয়ে দিলে রাইট ব্যাক সালাম ভাই এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড রহিম বেগ গোল করে দলকে ৪-০ গোলের জয় এনে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় ওয়ারী ওয়াকওভার পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল কাব মাঠে না আসায়। দিনের বাকি দুটো ম্যাচ বৃষ্টির কারণে হতে পারেনি। ম্যাচ দুটো ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক বনাম কম্বাইন্ড এবং রেল বনাম পিডব্লিউডি।
ওয়ারী কাব ১৮ মার্চের খেলায় কোনরকম পুরো দুটি পয়েন্ট ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছিল কম্বাইন্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে। এই জয় পেতে ওয়ারীকে পুরো সময় কম্বাইন্ডের সাথে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে। জয়টা যে কোন দলের হতে পারতো; শেষ পর্যন্ত ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড শহিদের স্টিক দিয়েই জয়টা এসেছিল। সেদিনের দ্বিতীয় ম্যাচে রেল দল সহজেই মাহুতটুলীকে ৪-২ গোলে পাজিত করেছিল। বিজয়ী দলের হামিদ, মোহাম্মদ আলী, নাসিরুল্লাহ এবং নিয়াজ একটি গোল করেছিল আর মাহুতটুলীর পক্ষে দুটি গোল শোধ দিয়েছিল নাঈম এবং হাফিজ। দিনের তৃতীয় ম্যাচে লেফট ইন বুললান এবং সেন্টার হাফ ওমরের গোলের সুবাদে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে পুলিশকে হারিয়েছিল।
দিনের শেষ ম্যাচে ইস্পাহানী দুর্বল টিম আজাদকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। তাদের জাফর দু’গোল এবং তানভীর এক গোল করেছিল। ১৯ মার্চ হকি লীগের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল শক্তিশালী এবং লীগ শিরোপা প্রত্যাশী ইস্পাহানী টিম পুলিশকে ওয়াকওভার দেয়ায়। তারা মাঠেই উপস্থিত হয়নি। দিনের অপর খেলায় মোহামেডান জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাহুতটুলীকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। আর একমাত্র গোলটি করেছিল রাইট-ইন সেলিম। ২০ মার্চ ওয়ারী দ্বিতীয় পয়েন্ট খুইয়েছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে গোলশূন্য ড্র করে। পয়েন্ট খোয়াবার জন্য ওয়ারীর খেলোয়াড়রাই দায়ী। খেলাটাকে তারা খুবই হাল্কাভাবে নিয়েছিল, পুরো টিম ছন্দছাড়া, এলোমেলো খেলা বিশেষ করে তাদের আক্রমণভাগ ছিল একেবারেই ব্যর্থ। বেশক’টি সহজ সুযোগ তারা কাজে লাগাতে পারেনি। অন্যদিকে সেদিন ভিক্টোরিয়া খুব ভাল খেলেছে। প্রত্যেক বিভাগেই তাদের খেলোয়াড়রা সেরাটা খেলেছে, এমনকি আক্রমণ করে গোলেরও সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সফল হলে হয়তো ফলাফলটা অন্যরকম হতো। ওয়ারী দু’পয়েন্ট হারিয়েও হকি লীগের পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষস্থানেই অবস্থান করছিল। ওয়াকওভারের কোনরকম শাস্তি না থাকায় হকি লীগে যখন-তখন ওয়াকওভার দেয়াটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমন সেদিনের শেষ খেলাটায় পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর মত ভাল একটি টিম কম্বাইন্ডকে ওয়াকওভার দিয়েছিল।
১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের অংশগ্রহণ এবং প্রস্তুতির জন্য ঢাকা হকি লীগ আরও একবার বন্ধ হয়েছিল। করাচিতে ২৫ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হবে। পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে চ্যাম্পিয়নশিপের অর্গানাইজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পাকিস্তান কাস্টমস এন্ড সেন্ট্রাল অ্যাকসাজ স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ডের ওপর। এয়ার মার্শাল নূর খান পাকিস্তান হকি ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর হকি উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এরই অংশ হিসেবে সে বছর থেকে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে প্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। যেমন অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে প্রথমে বাছাইপর্ব খেলতে হবে। পরবর্তীতে বাছাইকৃত দলসমূহ টুর্নামেন্টের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। পূর্বে কোন কোন জোন বা ইউনিট চ্যাম্পিয়নশিপে দুটো করে টিম এন্ট্রি করতো, যেমন করাচি ‘এ’ এবং করাচি ‘বি’। অনুরূপভাবে লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি জোনও দুটো টিম এন্ট্রি করতো; আর্মি করতো আর্মি রেড এবং আর্মি গ্রীন নামে। সে সুযোগ বন্ধ করে ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হকি ফেডারেশনের আওতাভুক্ত প্রত্যেক ইউনিট থেকে একটি মাত্র টিম এ চ্যাম্পিয়নশিপে এন্ট্রি নিতে পারবে।
এই টুর্নামেন্টে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, খেলাগুলো লীগ এবং নকআউট পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্ব হবে লীগ এবং পরবর্তী পর্ব হবে নকআউট ভিত্তিতে। বিগত বছরগুলো জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হতো শুধু নকআউট পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে দুর্বল দলগুলোকে একটি ম্যাচ খেলে হেরেই বিদায় নিতে হতো। দলগুলোকে একটি বছর অপেক্ষা করে, অনেক পরিশ্রম, অনেক অর্থ ব্যয় করে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করতে হতো। তারপর যদি মাত্র একটি ম্যাচ খেলেই বিদায় নিতে হয়, সেটা খুবই দুঃখের। এ পদ্ধতিতে হকি উন্নয়নে কোন অবদান রাখার সুযোগ ছিল না। ভাল খেলোয়াড়দের সাথে খেলায় অংশ নিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। আমি ১৯৬০ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের হয়ে নিয়মিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে আসছিলাম। প্রথমবার ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে ভারতের ওপর দিয়ে তিন/চারদিন পর করাচিতে পৌঁছে প্রথম ম্যাচে ৯-০ গোলে হেরে বিদায়। এত কষ্ট করে এত দূর গিয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে হলে খুব বিরক্ত লাগে।
পরের বছরগুলোতে আমরা বিমানে চড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে যেতাম। ট্রেন ভ্রমণের কান্তি না হলেও ফলাফল ঐ একই রকম হতো, প্রথম ম্যাচ খেলেই বিদায়। পরবর্তীতে এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া অনেকটা প্রমোদ ভ্রমণের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৯৬৭ সালের জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে অর্গানাইজিং কমিটি টুর্নামেন্টের পূর্ণ কর্মসূচি সাজিয়েছিল এভাবে :
পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের আওতাভুক্ত ২০টি ইউনিট বা টিম চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করবে। যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুটো দল ইপিএস এবং পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে (সার্ভিসেস টিম হিসেবে)। টিমগুলোকে চারটি গ্রুপে বিভক্ত করে প্রত্যেক গ্রুপে ৫টি করে টিম যারা নিজ নিজ গ্রুপে লীগ পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে খেলবে। প্রত্যেক গ্রুপের ১ এবং ২ স্থান অধিকারী টিমগুলো অর্থাৎ ৪ গ্রুপের ৮টি টিম কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সব খেলা হবে নকআউট পদ্ধতিতে।
অংশগ্রহণকারী টিমগুলোকে গ্রুপওয়ারী ভাগ করা হয়েছিল :
গ্রুপ এ- পিআইএ, লাহোর, পেশওয়ার, হায়দ্রাবাদ এবং কোয়েটা।
গ্রুপ-বি : পাক আর্মি, রাওয়ালপিন্ডি, বাহাওয়ালপুর, খায়েরপুর এবং দেরাইশ মাইল খান (ডিআই খান)।
গ্রুপ-সি : পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, সারগোদা, করাচি, নেভি এবং ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন।
গ্রুপ-ডি : পাকিস্তান কাস্টম, ওয়েস্ট পাকিস্তান পুলিশ, পাকিস্তান এয়ারফোর্স, মুলতান এবং পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে।
২৫ মার্চ ৪-৩০ মিনিটে হকি কাব অব পাকিস্তান, স্টেডিয়াম পাকিস্তান কাস্টম এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্সের খেলার মধ্যে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধন হবে। উদ্বোধন করবেন সেন্ট্রাল ফাইন্যান্স মিনিস্টার মি. ইউএম ওকেলি। প্রতিদিন দুটো মাঠে হকি কাব অব পাকিস্তান, স্টেডিয়াম এবং ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ৪/৫টি করে ম্যাচ খেলার শিডিউল করা হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তান হকি টিম গঠনের লক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি মাঠে মার্চ ১০-১২ তিন দিন ট্রায়াল ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। ১২ মার্চ রাতে বাংলাদেশ হকি টিমের নাম ঘোষণা করা হয়। ১৮ সদস্যের টিম। আমাকে ক্যাপ্টেন এবং আবদুস সাদেককে ভাইস ক্যাপ্টেন মনোনীত করা হয়েছিল। পূর্ণ টিমের তালিকা : গোলরক্ষক-রণজিত দাস এবং মো. সেলিম জাম্বু, ফুলব্যাক-মো. মোমতাজ, এএম সেরা এবং শফিক; হাফব্যাক- আব্দুস সাদেক, এহতেশাম সুলতান, ইব্রাহিম সাবের, আজিজ এবং মো. মহসিন; ফরোয়ার্ড- বশীর আহমেদ, মাহমুদ মামলী, আরবার মাহমুদ, আব্দুর রাজ্জাক (সোনা মিয়া), মীর আনোয়ার করিম।
৬ জন খেলোয়াড়কে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছিল। ফ্রান্সিস পালসার গোলরক্ষক, কামাল হায়দার, সাবের আলী, আব্দুল হক, বুলবান এবং আজিম।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে দ্বিতীয় টিম হিসেবে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে সুযোগ পেয়েছিল। তাদের নির্বাচিত টিম : গোলরক্ষক-এমএ কাদের এবং নবী বকশ; ফুলব্যাক- ইদ্রিস খান, মনসুর এবং আকবর; হাফব্যাক-খুরশীদ আলম, কালিম, আবিদ খান এবং মাহবুব; ফরোয়ার্ডস-হামিদ খান, কেডাব্লিউ খান, রাইস আহমেদ, নিয়াজ আহমেদ, মুস্তাক আহমেদ, নুরুল্লাহ বেগ এবং মোহাম্মদ আমিন।
১৭ সদস্য টিমের ক্যাপ্টেন আবিদ খান এবং ভাইস ক্যাপ্টেন ইদ্রিস খান আর টিমের ম্যানেজার মনোনীত হয়েছিলেন সিদ্দিকী।
১ অক্টোবর ২০১১
(তিরাশি)
জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত ২৫ মার্চ তারিখে উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি। একদিন পিছিয়ে ২৬ মার্চ উদ্বোধন করা হয়েছিল। অনেক জাঁকজমকের সাথে উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ ২০টি টিমের পতাকা উত্তোলন, বেলুন ওড়ানো, স্থানীয় ম্যারিকোলাকো স্কুলের ছাত্ররা গার্ড অব অনার প্রদর্শন এবং ২০টি টিমের মার্চপাস্টÑ যার লিড দিয়েছিল বিমানবাহিনী আর প্রধান অতিথি কর্তৃক সালাম গ্রহণ। পাকিস্তান টিমের সাবেক অধিনায়ক কাস্টমস দলের সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খানের খেলোয়াড়দের পক্ষে ওথ নেয়া, ফাইন্যান্স মিনিস্টার মি. ওকিলি কর্তৃক ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের শুভ উদ্বোধন ঘোষণাÑ সব মিলিয়ে জমকালো ও আকর্ষণীয় এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল।
উদ্বোধনী ম্যাচের দু’টিম কাস্টমস এবং এয়ারফোর্সের খেলোয়াড়দের সাথে প্রধান অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। কাস্টমস ৩-০ গোলে এয়ারফোর্সকে পরাজিত করেছিল। তাদের ফুলব্যাক খুরশীদ আলম পেনাল্টি কর্নার থেকে দুটি গোল করলে তৃতীয় গোলটি করেছিল লেফট-ইন লাইক। পরদিন থেকে দুটো মাঠে প্রতিদিন ৩/৪টি করে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
পিআইএ তাদের প্রথম খেলায় লাহোরকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড তারেক নিয়াজী দুটো গোল করলেও মিস করেছে বেশ কয়েকটা আর মিস করেছে হাটট্রিক করার সুবর্ণ সুযোগ।
টুর্নামেন্টের প্রথম হ্যাটিট্রিক করার গৌরব অর্জন করেছিল দেরাইশ মাইল খানের লেফট উইংগার মাহমুদ। বিপক্ষ দলটি ছিল বাহাওয়ালপুর। তারা ৫-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে ২-১ গোলে নেভিকে হারিয়ে ছিল। হায়দ্রাবাদ জিতেছিল ১-০ গোলে কোয়েটাকে। পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান রেল দল মুলতানের সাথে ২-২ গোলের ড্র করে প্রশংসিত হয়েছিল। আমাদের প্রথম খেলা ছিল শক্তিশালী করাচির সাথে। আমরা জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ০-১ গোলে পরাজিত হয়েছিলাম। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, করাচি টিমের রাইট-ইন ইসলাহউদ্দিন ঢাকায় ইস্পাহানি টিমের হয়ে লীগে খেলার সুবাদে আমাদের ইপিএসএফ টিমে নির্বাচিত হয়েছিল কিন্তু অসুস্থতার অজুহাতে টিমের সাথে না এসে পরবর্তীতে করাচি টিমের পক্ষে অংশ নেয় এবং আমাদের বিরুদ্ধেই খেলে জয়ী হয়।
১৯৬৭ সালের ফাস্ট এপ্রিল আমাদের হকির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন। জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের জন্মলগ্ন থেকে আমরা (ইপিএসএফ টিম) কোনদিন কোন টিমকে হারাতে পারিনি। সেবারই আমরা প্রথমবারের মত জয়ের মুখ দেখেছিলাম নেভিকে ১-০ গোলে পরাজিত করে। আমাদের জন্য যা ছিল গর্বের, আনন্দের। এ জয় ভবিষ্যতে ভাল হকি খেলার প্রেরণা হয়ে থাকবে। খেলার প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং হকি খেলার মানোন্নয়নে অনেকে এগিয়ে আসবেন। খেলার প্রথমার্ধে ২৭ মিনিটে আমরা একটা পেনাল্টি কর্নার পেয়েছিলাম। ফুলব্যাক মোমতাজ পোস্টে হিট করেছিল। বল গোলরক্ষকের প্যাড থেকে রিবাউন্ড হয়ে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়ার কাছে চলে যায়, আর সে চমৎকারভাবে সেটা থেকে গোল করলে আমাদের পুরো টিম আনন্দে মেতে ওঠে। গোল শোধ করার জন্য নেভি টিম আক্রমণ চালাতে থাকে। নেভি টিমের চাপ সামলাতে আমরা অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলতে থাকি। টিমের সবাই যেন গোল না খাওয়ার পণ করে যে যার দায়িত্ব দৃঢ়তার সাথে পালন করে গেছি আর জয়টাকে ধরে রাখতে আমরা লড়ে গেছি খেলার শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত। প্রথম জয়ের আনন্দ, বিশেষ একটা অনুভূত্ িযেমনটা হয়েছিল সাত বছর আগে এই করাচির ফুটবল মাঠে ১৯৬০ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের প্রথমবারের মত ফুটবল শিরোপা জয় করে। করাচিতে বসবাসরত বাঙালি ভাইয়েরাও আমাদের আনন্দে শামিল হয়েছিলেন। টুর্নামেন্টের কর্মকর্তা এবং সমর্থকরাও এগিয়ে এসেছিলেন আমাদেরকে অভিনন্দন জানাতে।
আমাদের টিমে সেদিন খেলেছিল : গোলরক্ষক-রণজিত দাস, ফুলব্যাক- মোমতাজ ও শফিক, হাফব্যাক-আজিজ, সাদেক এবং ইব্রাহিম সাবের, ফরোয়ার্ড-এহতেশাম, বশীর, রাজ্জাক, মোহাম্মদ হাসান এবং শেরা।
আমাদের পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশের কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হয়েছিল। খেলায় প্রচুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল পূর্ব রেল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারেননি শক্তিশালী দলটিকে। অন্যান্য ম্যাচের মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী মুলতানকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। পেশওয়ার কোয়েটাকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। পাকিস্তান আর্মি দেরাইশ মাইল খানকে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলÑ যা ছিল ডিআই খানের জন্য খুবই হতাশাজনক হার; কারণ তারা গতদিনেই একই ফলাফল করে জয়লাভ করেছিল বাহাওয়ালপুর দলের সাথে। খেলা শুরুর ৭ মিনিটেই আর্মি টিমের লেফট-ইন জামির ডান দিক থেকে আসা একটি ক্রস রিসিভ করেই গোল করে। রাইট ফুল সাজ্জাদ পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড জাভেদ তৃতীয় গোল করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে লেফট ফুলব্যাক নাজিমুদ্দিন ৪র্থ গোল করলে ডিআই খানের গত গেমে হ্যাটট্রিক করা লেফট উইংগার মাহমুদ গোল করে ব্যবধান কমায়। পেনাল্টি কর্নারে আর্মির ফুলব্যাক সাজ্জাদ তার দ্বিতীয় গোল এবং রাইট-ইন আশফাক দলের পক্ষে গোলের সংখ্যা অর্ধডজন পূর্ণ করে। আর্মি টিম তাদের গোলের চাকা সচল রেখে পরদিন অর্থাৎ ৩ এপ্রিল বাহাওয়ালপুরকে ৫-০ গোলে পরাস্ত করে। গ্রুপের সবগুলো ম্যাচ জিতে আর্মি টিম গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর বাহাওয়ালপুর গ্রুপের সবগুলো ম্যাচ হেরেছিল। আর্মি টিমের তুখোড় লেফট-ইন জামির দু’গোল করা ছাড়াও সে ছিল আক্রমণভাগের প্রধান স্কিমার। খেলা শুরুর ১০ মিনিটের মধ্যেই আর্মি টিমের রাইট ফুল ব্যাক সাজ্জাদ পেনাল্টি কর্নারে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড জাভেদ এবং লেফট ইন জামির গোল করলে আর্মি বিরতির আগেই ৩-০ গোলের লিড নিয়ে নেয়। জামির দলের ৪র্থ গোল এবং জাভেদ গোল করে দলকে ৫-০ গোলের জয় এনে দেয়। কাস্টমস পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েকে ৫-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপের শীর্ষস্থানে অবস্থান করে। পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ টিমের লেফট ইন সাইডের খেলোয়াড় নাঈম মুলতানের বিরুদ্ধে চমৎকার হ্যাটট্রিক করে দলকে জয় এনে দিয়েছিল। পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল করাচিকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল আর পিআইএ গোলবন্যায় ভাসিয়ে ৯-০ গোলে হারিয়েছিল পেশাওয়ারকে। লাহোরও জয়লাভ করেছিল হায়দ্রাবাদকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে। আম্পায়াররা মাঠে উপস্থিত না থাকার কারণে নেভি আর সারগোদার ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
৫ এপ্রিল আমরা পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের কাছে ০-৭ গোলে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়েছিলাম। এই হারটা ছিল আমাদের জন্য খুবই হতাশার। শুরু থেকে তারা খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাঠে প্রাধান্য বিস্তার করে খেলতে থাকে। মাঠে আমাদের উপস্থিতি লক্ষ্যই করা যাচ্ছিল না। সারা মাঠজুড়ে অবাধে তারা বিচরণ করেছে।
আমরা তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেও পারছিলাম না। বিশেষ করে আফজাল মান্না, আখতার আর খুরশীদ আজম ‘ট্রায়ো’ মুহুর্মুহু আমাদের সীমানায় হানা দিয়ে ডিফেন্সকে তছনছ করে দিচ্ছিল আর এক এক করে গোল দিয়ে যাচ্ছিল। আফজাল মান্না জাতীয় দলের লেফট-ইন, লম্বা গড়ন, স্টিক বলে লম্বা লম্বা টান আর লম্বা স্টেপে আমাদের ডি বক্সে ঢুকে পড়াÑ কোনভাবেই তাকে রোধ করা যাচ্ছিল না। সে দু’গোল করলেও আখতার করেছে তিন গোল আর খুরশীদ আজম করেছে এক গোল। বাকি গোলটিও করেছিল আক্রমণভাগের খেলোয়াড় রাইট উইংগার ফারুক খান।
পিআইএ কোয়েটাকে ৫-০ গোলের পরাজিত করে গ্রুপের শীর্ষস্থান দখল করে নেয়। পিআইএ ‘ট্রায়ো’ হায়াত নিয়াজী আসাদ খুব একটা সফলতা পায়নি; নইলে গোলের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেত। বিরতি পর্যন্ত পিআইএ মাত্র ১টি গোল করতে পেরেছিল। হায়াত দু’গোল, নিয়াজী ও আসাদ বেশক’টি গোল মিস করার পর ১টি করে গোল করেছিল। নিয়াজী গোল করেছিল পেনাল্টি স্ট্রোক থেকে।
শক্তিশালী লাহোরকে দুর্বল পেশাওয়ার ১-১ গোলে বেঁধে রেখেছিল। যদিও লাহোর খেলার তৃতীয় মিনিটেই তারিক মিরের পাশে ইন সাইড লেফট রশীদ মালিকের দেয়া গোলে এগিয়ে যায়। জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে প্রথমার্ধ শেষ হয়। দ্বিতীয়ার্ধে পেশাওয়ার গোল শোধ করার জন্য লাহোরের ওপর চেপে বসে এবং শেষ পর্যন্ত রাইট ইন আমান উল্লাহ গোল শোধ করে ছাড়ে। লাহোর অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, খেলা ১-১ ড্র থাকে।
হাফ টাইম পর্যন্ত আমাদের পূর্ব পাক রেল দল লেফট-ইন ইকবালের দেয়া গোলে ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল। সেটা শোধ দিয়েছিল বিমানের রাইট-ইন গুলজার। আবারও ইকবাল তার দ্বিতীয় গোল করে পূর্ব রেল দল ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। খেলার শেষ মুহূর্তে বিমানবাহিনীর নিয়াজী গোল করলে আমাদের পূর্ব পাকিস্তান রেল দল জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মত জয়লাভের সম্মান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। খেলা ২-২ গোলে ড্র। প্রতিযোগিতামূলক খেলায় সারগোদা নেভিতে ১-০ গোলে হারিয়েছিল তাদের রাইট ইন আমিনের দেয়া গোলে। টুর্নামেন্টের অন্য একটি খেলায় ডিআই খান ৪-১ গোলে খায়েরপুরকে হারিয়েছিল।
৬ এপ্রিল আমরা সারগোদার সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ১-০ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। সেদিনের অপর একটি খেলায় পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন পুলিশ এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্সের খেলাটি ড্র হয়েছিল। নির্ধারিত সময় এবং অতিরিক্ত সময়েও কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। খেলার ধারা অনুসারে এয়ারফোর্সের জয় পাওয়া উচিত ছিল। তাদের দুর্ভাগ্য যে, তারা গোল পায়নি। অন্যদিকে খেলার ফলাফল ড্র হওয়ায় পুলিশের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছিল। তারা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। সেদিনে আরো একটি ম্যাচে রাওয়ালপিন্ডি সংঘবদ্ধ টিম হিসেবে চমৎকার খেলা প্রদর্শন করে ৪-০ গোলে খায়েরপুরকে হারিয়ে গ্রুপে দ্বিতীয় টিম হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল।
করাচির নাজমাবাদ কোম্পেনিয়ন স্পোর্টস ক্লাবের সভাপতি মোস্তাফিজ আহমেদ সিদ্দিকী আমাদের পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন করাচি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। খেলার পর সন্ধ্যায় আমরা গিয়েছিলাম। ইপিএসএফ হকি সেক্রেটারি আলমগীর আদেল, আমাদের টিম ম্যানেজার মাহমুদুর রহমান মোমিন, সেন্ট্রাল এক্সাইজ এন্ড ল্যান্ড কাস্টমসের কালেক্টর কমান্ডার এ হামিদ, পিডব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব কাফিলুদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। বক্তারা দুই উইং-এর মাঝে খেলাধুলার মাধ্যমে সেতুবন্ধন তৈরি করার কথা বলেন এবং খেলাধুলার উন্নতির সাথে দুই অঞ্চলের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খেলোয়াড়-সংগঠক সিভিল এবং মিলিটারির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। #
১৬ অক্টোবর ২০১১
(চুরাশি)
লিগ খেলা শেষে যে ৮টি দল কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল, সে দলগুলো হলো : পিআইএ, কাস্টমস, আর্মি, ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, ওয়েস্ট পাকিস্তান পুলিশ এবং লাহোর।
ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে রাওয়ালপিন্ডি জোনকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে প্রথম টিম হিসেবে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে রেল দল শক্তিশালী দল। তারপরও বিরতি পর্যন্ত খেলায় বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। প্রথমার্ধের ২০ মি. রেলের সেন্টার ফরোয়ার্ড খুরশীদ আজম আফজাল মান্নার কাছ থেকে বল পেয়ে প্রথম গোল করে। বিরতির ১০ মিনিটের মধ্যেই পিন্ডি টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড মোদাসসার গোল শোধ করলে তাদেরই দলের রাইট-ইন জুবায়ের পেনাল্টি কর্নারের রিবাউন্ড বলে গোল করে দিয়ে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। এ সময় পিন্ডি দল ডিফেন্সিভ হয়ে রেল দলকে গোল করার কোন সুযোগ দেয়নি। রেল দল গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং বেশ টাফ ও রাফ হয়ে ওঠে। রেল দলের খেলোয়াড়রা শক্তি প্রয়োগ করলে আম্পায়ার রেল দলের লেফট ফুলব্যাক আসলাম এবং লেফট ইন আফজাল মান্নাকে মাঠ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেন। পরবর্তীতে আম্পায়ার বহিষ্কৃত খেলোয়াড়দ্বয়কে যখন মাঠে খেলায় ফিরে আসার নির্দেশ দেন, তখন রেল দল যেন
জ্বলে ওঠে এবং পিন্ডি টিমের ওপর আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে থাকে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা
প্রায় ২০ মিনিটে, রেল দলের অলিম্পিয়ান লেফট আউট মতিউল্লাহ পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করলে ২-২ গোলের সমতা আনে। খেলার শেষ সময়ে পরপর দু’গোল করে রেল দল ৪-২ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে আর তাদের গোল করে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় আফজাল মান্না এবং খুরশীদ আজম।
অপর কোয়ার্টার ফাইনাল আর্মি এবং করাচি গোলশূন্য ড্র হয়। অতিরিক্ত ১৫ মিনিটেও কেউ কাউকে গোল দিতে পারেনি। করাচি টিমের তুলনায় আর্মি শক্তিশালী টিম কিন্তু আক্রমণভাগ খুবই বাজে খেলেছে। অন্যদিকে করাচি খেলার প্রথমদিকে কিছুক্ষণ নার্ভাস থাকলেও পরবর্তীতে তাদের লেফট ফুল ব্যাক মোমতাজ এবং লেফট হাফ ওয়াসিম বারী যেভাবে আর্মির রাইট ফ্ল্যাংককে সামাল দিয়েছে, তাতে তারা প্রশংসার দাবিদার। তাদের দৃঢ়তাপূর্ণ এবং তীক্ষè এন্টিসিপেশন দর্শকদের বাহবা কুড়ায়। করাচির সেন্টার হাফ মুজতবার দর্শনীয় খেলা দর্শকদের প্রচুর আনন্দ দেয়। আর্মি ৮৫ মিনিটে একটি সুযোগ পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয়। তারা ৮/৯টি পেনাল্টি কর্নার পেয়ে কোন সুফল লাভ করতে পারেনি।
৮ এপ্রিল পিআইএ ৪-০ গোলে পুলিশকে পরাজিত করে। কাস্টমস ৫-০ গোলে লাহোরকে এবং ফিরতি খেলায় আর্মি ২-১ গোলে করাচিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়। সেমিফাইনালের চতুর্থ টিম পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে পিন্ডিকে হারিয়ে আগেই উঠে গিয়েছিল।
পিআইএ খুবই স্কিলফুল টিম। সেদিন তাদের ডিফেন্স অ™ভুত সুন্দর খেলে পুলিশের আক্রমণকে একেবারেই অকেজো করে রাখে। পিআইএ গোল পেতে ২২ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। লেফট-ইন আসাদ মালিকের কাছ থেকে বল পেয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজী লম্বা লম্বা কদমে দ্রুত পুলিশের ডি’তে ঢুকে প্রচন্ড জোরে হিট দ্বারা গোলরক্ষককে পরাস্ত করে (১-০)। আসাদ মালিক বল নিয়ে একক চেষ্টায় ডি-বক্সে ঢুকে হিট করলে গোলরক্ষক প্যাড করে ফিরিয়ে দিলে পিআইএ দলের আগুয়ান সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজীর কাছে বল গেলে সেটার সদ্ব্যবহার করে দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেয়। দু’গোলে পিছিয়ে পুলিশ সমান তালে লড়তে থাকে এবং গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকে কিন্তু পিআইএ টিমের ডিফেন্স অত্যন্ত সুন্দর খেলে পুলিশের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করে। হায়াত মাহমুদ পিআইএ’র রাইট-ইন পরপর দু’গোল করে টিমকে ৪-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে। কাস্টমস অতিসহজেই লাহোরকে ৫-০ গোলে পরাজিত করে সেমিফাইনালে ওঠে। বিরতি পর্যন্ত তারা দু’গোলে এগিয়ে ছিল। সব দিক দিয়ে কাস্টমস ছিল শক্তিশালী দল। সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খান এবং ফুল ব্যাক খুরশীদ আসলামের বিপক্ষ দলের আক্রমণের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি থাকায় তারা সফল হতে পারেনি।
লাইক তার নিজস্ব স্টাইলে বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে হিট মারার পূর্বে বিপক্ষ খেলোয়াড় দ্বারা অবৈধ বাধা পায়। ফলে পেনাল্টি কর্নার যা থেকে ফুলব্যাক খুরশীদ আসলাম দলের পক্ষে প্রথম গোল করে। সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াহিদ লেফট ইন লাইক এবং লেফট আউট জাহাঙ্গীরের সম্মিলিত আক্রমণে ওয়াহিদ সেটার সুন্দর সমাপ্তি ঘটায় টিম ২-০ গোলে লিড নেয়। দু’গোল খাওয়ার পর লাহোর অনেকটাই হাল ছেড়ে দেয়। মজুতবার একটি সুন্দর পাশে রাইট আউট খালেদ মাহমুদ দলের পক্ষে ৩ নম্বর গোল করে। লাইক ডি’র ভেতর ঢুকে গোলপোস্টে হিট করার সুযোগ না পেয়ে আনোয়ারকে বল দিলে সে সেটা থেকে গোল করে ৪-০। গোলটি ছিল অ™ভুত সুন্দর। কাস্টমসের মুজতবা এবং লাহোরের লেফট ফুলব্যাক হুমায়ুনের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে স্টিক দিয়ে আঘাত করতে উদ্ধত হলে আম্পায়ার দুজনকেই মাঠ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেন, যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদেরকে খেলায় ডাকা হয়। রাইট আউট খালেদ মাহমুদ খুবই সুন্দর খেলা প্রদর্শন করে এবং শেষ গোলটিও সে করে।
অপর কোয়ার্টার ফাইনাল যা আগের দিনে ড্র ছিল আর্মি বনাম করাচি, খেলার ৫ মিনিটেই আর্মির সেন্টার ফরোয়ার্ড শাফাত বোগদাদী গোল করে দলকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। বিরতি পর্যন্ত সেটাই ছিল রেজাল্ট। দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মি. লেফট হাফ পারভেজ ডি’র বাইরে থেকে একটি ফ্রি হিট মারলে রশীদ সেটা থেকে গোল করে আর্মি দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেয়। এর এক মিনিট পরই করাচির রাইট-ইন ইসলাহ গোল করে ১-২ গোলের ব্যবধান কমায়। উল্লেখ্য, করাচির ইসলাহউদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তান টিমে চান্স দেয়া হয়েছিল কিন্তু সে অসুস্থতার ভান করে আমাদের টিমে না খেলে করাচির পক্ষে খেলেছে। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। করাচি গোল শোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কিন্তু করাচির সেন্টার ফরোয়ার্ড খালেক সব চেষ্টার ওপর পানি ঢেলে দেয় অনেকগুলো গোলের সুযোগ নষ্ট করে; নইলে খেলার ফলাফল অন্যরকম হতো। তারপরও বলতে হয়Ñ করাচি খুব ভাল খেলেছে। ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম দল হিসেবে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল আর্মিকে ১-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উঠেছিল। গোলটি করেছিল রেল দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড আক্তার। প্রথমার্ধের ১০ মিনিটের এ গোলটি শেষ পর্যন্ত ফলাফল নির্ধারণ করে দিয়েছিল। খেলা নিয়ে সবার প্রত্যাশা ছিল যে, খেলা মানসম্মত এবং উপভোগ্য হবে। বাস্তবে তা হয়নি। দুই টিমই গোল করার সুযোগ নষ্ট করেছে। রেল দলের আক্রমণভাগ ভাল খেলেছেও। তাদের ডিফেন্সের দুর্বলতা মাঠে স্পষ্ট দেখা গেছে কিন্তু আর্মি সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বলেই হার স্বীকার করতে হয়েছে। তবে নৈপুণ্যের ঝলক মাঠে উপস্থিত দর্শকরা যে মাঝেমধ্যে দেখেননিÑ তা বলা যাবে না। কাস্টমস এবং পিআইএ’র অপর সেমিফাইনালটি ১-১ গোলে ড্র হওয়ায় আগামী দিন বিকেল ৪-৪৫ মি. পুনরায় খেলাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ফাইনাল খেলাটিও পিছিয়ে দিয়ে আগামী ১১ এপ্রিল তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
নৈপুণ্যে ভরপুর দুটো টিম কাস্টমস এবং পিআইএ হকি ক্লাব অব পাকিস্তান স্টেডিয়ামে দর্শকদের বিমোহিত করে রেখেছিল পুরো সময়। খেলা খুবই দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিল, মুহূর্তে মুহূর্তে সীমানা বদল হচ্ছিল বলের। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ আর উপভোগ্য হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে বল কাস্টমসের কাছেই বেশি ছিল। পিআইএ দলের রাইট-ইন হায়াত প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে দ্রুতগতিতে তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজীকে দিলে সে খুব চমৎকার একটি গোল করে। তারপর থেকে কাস্টমস গোল শোধ করার চেষ্টা করে যায়। মুজতবার নেয়া ডি’র ভেতর থেকে গোলপোস্টে হিট করলে গোলরক্ষক তা ফিরিয়ে দেয়। এর কিছুক্ষণ পরই কাস্টমস একটি পেনাল্টি কর্নার লাভ করে এবং তা ফুলব্যাক খুরশীদ আলম হিট করে। পিআইএ দলের গোলরক্ষক হামিদ প্যাড করলে বল গোললাইনেই থাকে আর রাইট আউট খালেদ মাহমুদ ছুটে গিয়ে তা গোলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দলকে সমতায় ফেরায় (১-১)। শেষ পর্যন্ত কোন দলই আর গোলের দেখা পায়নি।
১০ এপ্রিল পিআইএ ফাইনাল খেলার যোগ্যতা পেল আর কাস্টমকে দুর্ভাগ্যবশত শেষ মিনিটে গোল খেয়ে বিদায় নিতে হলো। জয়সূচক গোলটি এসেছিল আসাদ মালিকের স্টিকের ছোঁয়ায়। এ খেলায়ও ছিল দৃষ্টিনন্দন স্টিকের ঝলকানি। জেতার জন্য জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধের ৩৪ মি. পিআইএ দলের ফুলব্যাক কামার আলী খান পেনাল্টি কর্নার হিট করে। কাস্টমসের গোলরক্ষক জহুর প্যাড দিয়ে তা আটকালেও বল চলে যায় ছুটে আসা লেফট ইন আসাদ মালিকের কাছে আর সে সুন্দরভাবে পুশ করে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। কাস্টমসের খালেদ মাহমুদের বানিয়ে দেয়া বল ওয়াহিদ মিস করাটা ছিল অমার্জনীয়। অবশ্য পিআইএ দলের হায়াতও দুটো গোল মিস করেছিল। বিশ্বের সেরা সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খানের (কাস্টমস) অবাক করা ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন মাঠের দর্শকরা আনন্দের সাথে উপভোগ করেছে। খেলার পূর্বে দু’দলের খেলোয়াড়দের পাকিস্তান নেভির সিএনসি রিয়াল এডমিরাল আহসানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
১১ এপ্রিল ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ ’৬৭-এর ফাইনাল খেলা। প্রায় ২০ হাজার দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ মুসা, এয়ার মার্শাল এম নূর খান, সিএনসি পাকিস্তান এয়ারফোর্স এসএম জাফরি, ভাইস চেয়ারম্যান ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন ব্যুরো সৈয়দ দরবার আলী শাহ, করাচির কমিশনার, ঊর্ধ্বতন সিভিল এবং মিলিটারি কর্মকর্তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় ফাইনাল খেলাটি উপভোগ করেছিলেন।
১ নভেম্বর ২০১১
(পঁচাশি)
পিআইএ দলের দ্রুতগতিসম্পন্ন রাইট উইংগার শওকত আলী অতিরিক্ত সময়ের ১৫ মিনিটের দুই অর্ধে দুটো গোল করে রীতিমত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
খেলার পুরো ৭০ মিনিট হকি ক্লাব অব পাকিস্তান স্টেডিয়ামের দর্শকরা ফাইনাল খেলাটি সত্যিকার অর্থে ফাইনাল খেলাই দেখেছিলেন। উত্তেজনায় ভরপুর দুই টিমের জেতার লড়াই, গোল করার সব কলাকৌশল প্রয়োগ, ব্যক্তিগত ও দলগত নৈপুণ্য, উন্নতমানের হকি ফাইনালে সবই ছিল, শুধু ছিল না গোল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটি প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠলেও কোন দলই গোল পাচ্ছিল না।
খেলার ১৭ মিনিটে রেল দল আফজাল মান্নার সেন্টার ফরোয়ার্ড আক্তারের উদ্দেশে মাঠচেরা থ্রু পাস দিয়ে প্রথম পিআইএ দলের সার্কেলে হানা দেয় কিন্তু আক্তারের হিট গোলরক্ষক হামিদ পেনাল্টি কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেছিল। পেনাল্টি কর্নারও কোন সুফল দিতে পারেনি। পিআইএ টিমের লেফট ইন আসাদ মালিকের দুর্বল হিট পোস্টের বাইরে চলে গেলে তারা একটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফুলব্যাক রিয়াজের পেনাল্টি কর্নারের হিট ‘স্টিক’-এর কারণে বাতিল হলে পিআইএ এ সুযোগও নষ্ট করে দেয়। পিআইএ দলের আক্রমণ তাদের অন্যান্য দিনের ম্যাচের মত তত ক্ষুরধার ছিল না; কারণ সেদিন তাদের লেফট ব্যাক সচল ছিল না। তাদের বেশিরভাগ আক্রমণ হচ্ছিল ডান দিক দিয়ে। রেল দলের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে খেলেছিল, বিশেষ করে তাদের রাইট হাফ জাফর ইকবাল এবং সেন্টার হাফ আনোয়ার শাহ খুবই সতর্কতার সাথে পিআইএ’র আক্রমণ ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একসময় খেলোয়াড়দের বেশ উত্তেজিত হয়ে খেলতে দেয়া যায়। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটে আম্পায়ার খুরশীদ পিআইএ দলের আসাদ মালিক এবং রেল দলের আসলামকে রাফ খেলার কারণে মাঠ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে খেলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। খেলার ধারানুযায়ী যে কোন দল গোল করে চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করতে পারতো কিন্তু ভাগ্য পিআইএ দলের দিকে থাকায় তাদের শওকত আলী আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় শূন্য অ্যাঙ্গেল থেকে গোল করতে পেরেছিল। খেলার অতিরিক্ত ১৫ মিনিটের দুই অর্ধে দুই গোল করে মাঠে চাঞ্চল্যের সৃষ্টিই করেনি বরং শওকত আলী টিমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং উজ্জ্বল নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ফাইনালে ‘হিরো’ হয়ে গিয়েছিল।
পিআইএ টিম : গোলরক্ষক-হামিদ, ব্যাক-রিয়াজ ও কামার আলী খান, হাফ-আনোয়ার, সাঈদ আনোয়ার এবং ফজলুর রহমান, ফরোয়ার্ড-শওকত, হায়াত, তারিক, নিয়াজী, আসাদ মালিক।
পাক ওয়েস্টার্ন রেল : গোলরক্ষক-আক্তার (জুনিয়র), ব্যাক-জাফর বেগ ও এম আসলাম, হাফ-জাফর ইকবার, শওকত ও আক্তার সিনিয়ার, ফরোয়ার্ড-ফারুক খান, খুরশীদ আজম, আখতার, আফজাল মান্না ও মতিউল্লাহ।
১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় পজিশনের জন্য কাস্টমস এবং পাক আর্মি খেলেছিল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে লেফট-ইন লাইকের দেয়া একমাত্র গোলে কাস্টম তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল।
এয়ার মার্শাল নূর খান পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের দায়িত্ব নেয়ার পর তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ ’৬৭ সম্পূর্ণ নতুন ফরমেটে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। তারই নির্দেশে পেশাওয়ারে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মাধ্যমে নতুন খেলোয়াড় তৈরি এবং জাতীয় দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে নির্বাচন কমিটি ৫৮ খেলোয়াড়কে বাছাই করেছিলÑ যারা পরবর্তীতে ট্রায়ালের মাধ্যমে পেশাওয়ার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ খান এবং নির্বাচকমন্ডলী লে. কর্নেল এমএইচ আতিফ, খাজা আসলাম, নেওয়াজ খান ও মাহমুদ এপ্রিলের ৮ ও ৯ এবং ১২ ও ১৩ তারিখে হকি ক্লাব অব পাকিস্তান, স্টেডিয়ামে ট্রায়াল ডেকে সেখান থেকে ৪৪ খেলোয়াড়কে পরবর্তীতে পেশাওয়ারে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য নির্বাচন করেছিলেন।
নির্বাচিত খেলোয়াড়রা
গোলরক্ষক-হামিদ, আখতার (জুনিয়র), সালাহউদ্দিন, জাফর এবং আনোয়ার। ফুলব্যাক-তানভীর দার, সাজ্জাদ, আখতারুল ইসলাম এবং ইজাজ বাট। হাফব্যাক-রশিদ, আনোয়ার শাহ, সামি, কাইয়ুম নিয়াজী, সাঈদ আনোয়ার, রিয়াজ, আলে মোজতবা, বশীর (লাহোর), আখতার (সিনিয়র), দেলাওয়ার, গুলরেজ এবং ফজলুর রহমান। ফরোয়ার্ড-খালেদ মাহমুদ, ফারুক খান, বশীর আহমেদ (ইস্ট পাকিস্তান), ইসমাইল, খুরশীদ আজম, ইসলাহ উদ্দিন, আশফাক, আমান উল্লাহ, তারিক নিয়াজী, শাফকাত বোগদাদী, মোদাসসির, কাসানী, লাইক, আসাদ মালিক, জামির, রশিদ, জাহাঙ্গীর বাট, মতিউল্লাহ, সাব্বির, মাহবুব এবং খিজির বাজওয়া। ৮ খেলোয়াড়কে স্ট্যান্ডবাই : ইসলাম, রঞ্জিত দাস, সাদেক, ফারুক মীর, মেহেদী, হাজী নেওয়াজ, ইব্রাহিম সাবেরকে।
এয়ার মার্শাল নূর খানের হকি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হকি খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করার জন্য ‘গোল্ড স্টার’, ‘সিলভার স্টার’ এবং ‘সিলভার প্লেট’ এই তিন ধরনের পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছিল। হকি খেলায় যারা বিশেষ অবদান রেখেছে, তাদের খেলার ক্যারিয়ার অনুযায়ী এ পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হকি উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা/অর্গানাইজারদেরকেও ‘সিলভার প্লেট’ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ শেষে ১২ এপ্রিল করাচিতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। যারা এ পুরস্কার পেয়েছিল, তারা হলো : আনোয়ার আহমেদ খান (কাস্টমস-এর খেলোয়াড়) তার স্বর্ণোজ্জ্বল ক্যারিয়ার পাকিস্তান হকিতে অশেষ অবদান রাখার জন্য হকি ফেডারেশন তাকে ‘গোল্ড স্টার’ পুরস্কার প্রদান করে। সাইদ আনোয়ার (পিআইএ’র খেলোয়াড়) পাকিস্তান হকি দলের সাবেক অধিনায়ক এবং অলিম্পিয়ানকে ‘সিলভার স্টার’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কামার আলী খান (পিআইএ’র খেলোয়াড়) দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় হকি দলের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ফুলব্যাকের দায়িত্ব পালন করে গেছে, তাকে ‘সিলভার প্লেট’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। পাকিস্তান হকিকে দীর্ঘদিন যাবৎ সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছে পাকিস্তান কাস্টমস, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে ‘সিলভার প্লেট’ প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়। করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে দারুণ একটা সুখবর পেলাম। পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া লেখক সমিতি ৭ এপ্রিল তাদের সভায় আমাকে ১৯৬৬-৬৭ সালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করেছে। ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদানের দিন ঠিক করা হলেও উক্ত দিনে আমাকে হকি ট্রায়ালের জন্য করাচিতে অবস্থান করতে হয়েছিল; সেজন্য অনুষ্ঠানের তারিখ পিছিয়ে ১৬ এপ্রিল করা হয়।
পুরস্কার পাওয়া সব সময়ই আনন্দের। স্কুলে পড়ার সময় থেকে ক্রীড়াঙ্গনের বহু পুরস্কার পেয়েছি; তবে ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ এরকম মর্যাদা আর সম্মানের পুরস্কার পাওয়ার ইচ্ছা মনে গোপন করে রেখেছিলাম অনেক দিন ধরে। এ পুরস্কারের জন্য ক্রীড়াবিদরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে, সবার ভাগ্যে এ সম্মান জোটে না। সেদিক দিয়ে আমি ভাগ্যবান, আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করেছেন- তাকে শুকরিয়া জানাই। পুরস্কারের সংবাদটি আমাকে অত্যন্ত আনন্দিত করলেও আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ আমি পাইনি। ঢাকায় পা রেখেই আমাকে হকি মাঠে সকাল-বিকাল অনুশীলনে কাটাতে হচ্ছিল। একদিকে হকি লিগে শিরোপা জয়ের লড়াই, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সম্মান বাঁচানোর লড়াই। ১৬ এপ্রিল বিকাল চারটায় ঢাকা স্টেডিয়ামের প্লেয়ার্স লাউঞ্জে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ১নং গেট দিয়ে ঢুকে হাতের ডান দিকে, এখন যেখানে লিফট লাগানো হয়েছে, ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান ছিল না, ছিল ফাঁকা যায়গা, সেখানে প্রভিন্সিয়াল হকি ফুটবলের ক্যাম্প করা হতো) সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার মত মানানসই কাপড় বাসায় খুঁজে পেলাম না। একটা সাদা হাফ হাওয়াই শার্ট আর একটা প্যান্ট পরে চলে গেলাম।
অনুষ্ঠানও আমার পোশাকের মত সাদামাটা। বিস্তারিত আমার মনে নেই। তবে শাহ আজিজুর রহমান, জহিরুদ্দিন, কেজি মোস্তফা, লাডু ভাই, তৌফিক আজিজ ভাই, বদি ভাই, মূসা ভাইÑ এদের কথা মনে আছে আর আতিকুজ্জামান খান সাহেবের চশমা পরা সৌম্য-ভদ্র চেহারাটা লিখতে বসেও চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সেদিন যারা আমার পরিচিতজন ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন। বেঁচে আছেন মূসা ভাই, আল্লাহ তার হায়াত দারাজ করুন। টিভি টকশোতে মূসা ভাইকে দেখলে আমার সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার নেয়ার দিনটির কথা মনে পড়ে যায়, কানে ভেসে আসে ‘ভাল করে খেলবা, বাঙালিদের ইজ্জত রাখবা।’ মনে পড়ে যায় সেদিন তাদের কাছ থেকে যে অকৃত্তিম স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছিলাম, যা আজও আমাকে ক্রীড়াঙ্গনে চলার প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলার প্রতি তাদের যে নিখাদ ভালবাসা দেখেছি, তাদের মাঝে যে আন্তরিকতা দেখেছি, সম্মানবোধ দেখেছিÑ সেটা ভোলার নয়। সে পথ ধরে ক্রীড়াঙ্গনে আমি হাঁটার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বড় একটা কাপ পুরস্কার পাওয়ার সাথে এতসব গুণীজনের আদর-স্নেহ সেদিন ছিল আমার কাছে অনেক পাওয়া।
ক্রীড়ালেখক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জামান খানের ডোনেশন দেয়া কাপটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ডিআইটির চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। লিখতে বসে তার কাছ থেকে পুরস্কার নেয়ার দৃশ্যটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আসছে। উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিদের অভিনন্দন গ্রহণ এবং বিনিময়ে ধন্যবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে কখন যে অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল টের পাইনি। মনের আনন্দে কাপ হাতে রিকশা করে বাসায় ফিরলে এত বড় কাপ দেখে সহজ-সরল মা আমার খুবই খুশি হয়েছিলেন সেদিন। ড্রইংরুমে আমার পাওয়া ছোট ছোট কাপগুলোর পাশে এই বড় কাপটি রেখেছিলামÑ যা আজও ড্রইংরুমে মাথা উঁচু করে আমাকে আমার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে; আমার সব ক্রীড়া কর্মকান্ডের জন্য প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে।
১৬ নভেম্বর ২০১১
(ছিয়াশি)
পরদিন পত্রিকার মন্তব্য ছিল এরকম (অংশবিশেষ)Ñ ‘ঞযব চড়ষষংঃবৎং যধফ হড় ফরভভরপঁষঃু রহ ৎবধপযরহম ধ ফবপরংরড়হ ইধংযরৎ অযসবফ ৎবধপযষু ফবংবৎাবং ঃযব যড়হড়ঁৎ. ঐব যধং ৎবঢ়ৎবংবহঃবফ ঊধংঃ চধশরংঃধহ নড়ঃয রহ ভড়ড়ঃ নধষষ ধহফ যড়পশবু. ইঁঃ ঃযরং ঃৎড়ঢ়যু রং হড়ঃ ধধিৎফবফ ড়হ চষধুরহম ধনরষরঃু ধষড়ষহব. ইবযধারড়ঁৎ ড়হ ধহফ ড়ভভ ঃযব ভরবষফ রং মৎবধঃ রসঢ়ড়ৎঃধহপব. অ ফরংঢ়ষধু ড়ভ ঃধহঃৎঁসং, রসসবফরধঃবষু ফরংয়ঁধষরভরবং ধ ঢ়ষধুবৎ, যড়বিাবৎ মড়ড়ফ যব সধু নব. ঞযব রফবধ নবযরহফ ঃযব ধধিৎফরহম ড়ভ ঃযরং ঃৎড়ঢ়যু রং ঃযব ভড়ংঃবৎরহম ড়ভ ঃযব ংঢ়ড়ৎঃরহম ংঢ়রৎরঃ; রঃ রং পড়সসবহফধনষব.”
গড়ৎহরহম হবংি (১৭.৪.৬৭) পত্রিকার মন্তব্য ছিল, ‘অ ঠরৎরষ ধহফ ুড়ঁহম ঢ়ষধুবৎ ইধংযরৎ যধং ধ ষড়হম ংঢ়ড়ৎঃরহম পধৎববৎ ধযবধফ ড়ভ যরস. ঝঢ়বধশবৎং ধঃ ঃযব ভঁহপঃরড়হ ুবংঃবৎফধু সধরহঃধরহবফ ঃযধঃ যড়হড়ঁৎ নবংঃড়বিফ ড়হ ইধংযরৎ পড়ঁষফ নব পড়হংরফবৎবফ ধং যড়হড়ঁৎ ভড়ৎ ধষষ ঃযব ংঢ়ড়ৎঃংসবহ. ঞযবু পধষষবফ ঃড় ভড়ষষড়ি যরং ভড়ড়ঃংঃবঢ়ং ধহফ সধরহঃধরহ ফবপরঢ়ষরহব রহ ধহফ ড়ঁঃ ড়ভ ভরবষফ.’
১৭ এপ্রিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি খেলার মাঠে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সৌজন্যমূলক হকি খেলা। পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি হকি টিম পূর্ব পাকিস্তানে ইউনিভার্সিটিগুলোর সাথে সৌজন্যমূলক হকি খেলার জন্য এসেছিল। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাথে প্রথম ম্যাচ। দুপুর বেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। আমরা কিছুটা খুশি হয়েছিলাম বৃষ্টি হয়েছিল বলে। আমাদের ধারণা পশ্চিম পাকিস্তানের বৃষ্টি কম হয়; সুতরাং বৃষ্টির মাঠে তারা তাদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারবে না। পিচ্ছিল মাঠের সুবিধা নিয়ে আমরা তাদের চেয়ে ভাল খেলা প্রদর্শন করে জয়লাভ করতে পারবো। মাঠে নেমেই বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের ধারণাটা একেবারেই ভুল। খেলা শুরু হলে আমাদের সব জল্পনা-কল্পনা ভেঙ্গে দিয়ে তারাই স্বাভাবিক খেলা খেলছিল আর আমরাই বরং পিচ্ছিল মাঠে খেলতে অসুবিধা বোধ করছিলাম। বল কন্ট্রোল, ডজিং, পাশিং সবই তাদের স্বাভাবিক ছিল। তবে গতি কিছুটা ধীর ছিল, সে তুলনায় আমাদের সব টেকনিক ছিল অস্বাভাবিক, বল কন্ট্রোল হচ্ছিল না, পাসিং ছিল এলোমেলো, বল নিয়ে দ্রুতগতিতে ছোটা ছিল অনেকটা অসম্ভব।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ইউনিভার্সিটিগুলো থেকে বাছাই করা খেলোয়াড়দের খেলার সমঝোতার কিছু অভাব দেখা গেলেও আমাদের টিমের অবস্থা ছিল ছন্নছাড়া। আমরা যারা পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমের হয়ে এ মাসের প্রথম দিকে খেলতে করাচি গিয়েছিলাম, তারাই কিছুটা খেলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। খেলোয়াড়দের দমের অভাব, সমন্বয়ের অভাব, প্র্যাক্টিসের অভাব, চোখে পড়ার মত বাজে পারফরমেন্স। সম্মিলিত ইউনিভার্সিটির টিম আমাদের তুলনায় অনেক ভাল টিমÑ তা মাঠে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সফরকারী দল প্রথম থেকেই প্রাধান্য বিস্তার করে খেলছিল এবং আমাদের ওপর চড়াও হয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। খেলার ১০ মিনিটেই তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড মোদাস্সির গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দেয়। খেলার ১৫ মিনিটেই তারা আরও একটি গোল করে নির্ভার হয়ে খেলতে থাকে। ধীরে ধীরে আমরাও তাদের সাথে অ্যাডজাস্ট হয়ে উঠি এবং স্বাভাবিক খেলার চেষ্টা করি এবং বিরতির পর আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকি। আমাদের রক্ষণভাগ দৃঢ়তার সাথে তাদের আক্রমণ সামলাতে থাকে। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে ২০ মিনিটে আমি বল পেয়ে একক প্রচেষ্টায় বিপক্ষ দলের ডি-বক্সে ঢুকে সজোরে হিটের মধ্যে গোল করলে গোলের ব্যবধান কমে ২-১ দাঁড়ায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা চিৎকার দিয়ে আমাদের উৎসাহ জোগাতে থাকে। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণে খেলাটা চরম উত্তেজনার সৃষ্টি করে। সফরকারী হকি টিম তখন কিছুটা চাপের মুখে পড়ে যায়। আমরা সে সুযোগে আমাদের আক্রমণকে জোরদার করি এবং তার ফলও আমরা পেয়েছিলাম একটি পেনাল্টি স্ট্রোকের আশীর্বাদ পেয়ে কিন্তু সাদেক সেটা মিস করলে গোল শোধ করার সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায়। খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে আমাদের ডিফেন্সের অসতর্কতার জন্য সফরকারী দল আরো একটি গোল করলে আমরা ১-৩ গোলে হেরে যাই।
পশ্চিম পাকিস্তান সম্মিলিত ইউনির্ভার্সিটি টিমে যারা খেলেছিলÑ
হারুন, রাজ্জাক এবং খালেদ, ওমর, খায়ের এবং আফজাল, তাহির নাজির, সাঈদ, মোদাসসির, আজিজ এবং আলতাফ।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি দল : রশিদ, ইকবাল এবং রাব্বী, এহতেশাম, সাদেক এবং ইব্রাহিম সাবের, আব্দুল হক, বশীর, বুলবান, প্রতাপ এবং মীর আনোয়ার করিম।
১৮ এপ্রিল থেকে হকি লীগ পুনরায় শুরু হয়েছিল। জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে দুটো টিম অংশগ্রহণ করায় ঢাকার হকি লীগ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। বারবার খেলা স্থগিত হওয়ার ফলে ক্লাব কর্মকর্তা, সংগঠক এমনকি দর্শকগণের কাছেও লীগের গুরুত্বটা কমে গিয়েছিল। লীগের অবশিষ্ট খেলার প্রতিও তারা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল। রেলওয়ে পাক পিডব্লিউডিকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করার মধ্যদিয়ে বন্ধ থাকা লীগের দরজা খুলেছিল। রেলদলের ৭ গোলের ৪ গোলই করেছিল তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড রাইস। বাকি ৩ গোল করেছিল ফুরব্যাক ওয়াহিদুল্লাহ, দুই ইন নাসিরুল্লাহ ও নিয়াজ। প্রথম দিনের অপর খেলা ন্যাশনাল ব্যাংক বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং-এর খেলা বৃষ্টির জন্য বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
কম্বাইন্ড তাদের ১৯ তারিখের খেলায় পাক পিডব্লিউডিকে দ্বিতীয়ার্ধের শেষ মুহূর্তে ২-০ গোলে জয়লাভ করে লীগ শিরোপা জয়ের আশা জিইয়ে রেখেছিল। তাদের দুই ইন বুরবান এবং প্রতাপ গোল দুটো করেছিল। স্লিপারী মাঠে খেলাটি খুবই বাজে হয়েছিল। দিনের অপর খেলা রেল বনাম ভিক্টোরিয়া। বৃষ্টির কারণে মাঠে অনুপযুক্ত থাকায় খেলাটি বাতিল করা হয়।
আমাদের খেলা কম্বাইন্ডের সাথে।
খেলা শুরু থেকে কম্বাইন্ড ভাল খেলছিল এবং বেশ কয়েকটা সহজ সুযোগ নষ্ট করেছিল, বিশেষ করে তাদের রাইট-ইন বুলবান এবং রাইটআউট সিকান্দার যে মিস করেছে তা ছিল অমার্জনীয়। তবে তারাই প্রথম গোল করেছিল তাদের লেফট-আউট ফুয়াদের মাধ্যমে। গোল শোধ করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম এবং এক পর্যায় আমাদের টিম ড্র করতে সক্ষম হয়েছিল আমার দেয়া গোলের সাহায্যে। আমাদের দুটিমের খেলা ড্র হওয়ায় দু টিমের পয়েন্টও সমান হয়েছিল। আমরা উভয় টিমই ৫ পয়েন্ট করে নষ্ট করেছিলাম। তবে আমরা পাঁচ টিমের সাথে ড্র করেছিলাম আর কম্বাইন্ড ওয়ারীর কাছে হেরেছিল এবং মাহুৎটুলী, রেলওয়ে এবং আমাদের সাথে ড্র করেছিল। আমরা ড্র করেছিলাম ওয়ারী, বিমানবাহিনী, রেলওয়ে মাহুৎটুলী এবং কম্বাইন্ডের সাথে। হকি লীগ কমিটি আমাদের দু টিমকেই যুগ্ম রানার্সআপ ঘোষণা করেছিল। এর আগেই ওয়ারী ক্লাব পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করায় (তারা তিন খেলায় মাহুৎটুলী, ভিক্টোরিয়া এবং আমাদের সাথে ড্র করে ৩ পয়েন্ট নষ্ট করেছিল এবং সে সুবাদে ১৯৬৭ সালের হকি লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
ক্রীড়ালেখক সমিতি ১৯৬৬-৬৭ সালের জন্য আমাকে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কৃত করায় কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি (মরহুম) চৌধুরী দাবীর আহমেদ সিদ্দিকী আমার সম্মানে ২৮-৪-৬৭ তারিখে একটি মধ্যহ্ন ভোজের আয়োজন করেছিল চুং ওয়াহ চাইনিজ হোটেলে। মধ্যহ্ন ভোজে ক্লাবের সদস্য ছাড়াও খেলোয়াড়, সংগঠক এবং ক্রীড়া সাংবাদিকগণ উপস্থিত হয়েছিলেন। আমি সে সময় কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সেদিন বন্ধুদের প্রীতিভোজ আমাকে এক আবেগময় ভালবাসায় ভাসিয়ে ছিল।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট পরবর্তীতে ‘অল পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ’ হিসেবে পাকিস্তানের সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেছিল এবং প্রথমবারের মত ১৯৬৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের দুটো টিম অংশগ্রহণ করায় টুর্নামেন্টের গুরুত্ব এবং আকর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক, করাচি এবং করাচি কাস্টমসসহ মোট ১৫টি টিম টুর্নামেন্টে এন্ট্রি করেছিল। ঢাকার লীগে অংশ নেয়া প্রায় প্রত্যেকটি টিম যেমন, ওয়ারী, ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, পুলিশ এসি, ঢাকা মোহামেডান ভিক্টোরিয়া, রেলওয়ে, পাক পিডব্লিউডি, বিমানবাহিনী, ইপিআর এবং ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সি তাছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে সাইয়েদপুর রেলওয়ে এবং চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া টুর্নামেন্টের প্রথম খেলা ৩.১৫ মি. ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা বনাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি এবং দ্বিতীয় ম্যাচ ৪.৩০ মি. ওয়ারী বনাম পুলিশ।
উদ্বোধনী খেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি টিম মাঠে উপস্থিত না হওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা টিমের ওয়াক-ওভার পাওয়ার মধ্যদিয়ে আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল। যা ছিল দুঃখজনক।
দ্বিতীয় খেলা ওয়ারী বনাম পুলিশ। আম্পায়ারদের দুর্বল আম্পায়ারিং এ খেলাটিকেও হাস্যরসে পরিণত করেছিল। এর জন্য সম্পূর্ণ দোষ ছিল পুলিশ টিমের। তারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে দু দুবার খেলায় গন্ডগোল পাকিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রথমবার পুলিশের লেফট-আউট শরিফ আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আম্পায়ার কামার সহিদকে গাল দিলে আম্পায়ার তাকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করে এতে শরিফ আরো উত্তেজিত হয়ে অস্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুরু করে এতে খেলা স্থগিত হয়। সহ আম্পায়ার ঈশা খান তাদের ক্যাপ্টেনকে ডেকে শরিফকে মাঠ ত্যাগ করতে বলেন। পাঁচ মিনিট পর শরিফ মাঠে ঢুকে উত্তেজিতভাবে খেলা শুরু করে। এদিকে ওয়ারী শক্তিশালী দল হিসেবে ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। প্রথম গোল করেছিল ওয়ারীর লেফটআউট শফি আর দ্বিতীয়টি করেছিল নিয়াজ আহমেদ। প্রথম গোল খাওয়ার পর থেকে পুলিশ দল আম্পায়ারিং এর বিরোধিতা করে বারবার খেলায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে খেলা স্থতিগত করে দিচ্ছিল যা দর্শকদের নিকট হাস্যরসে পরিণত হয়ে উঠেছিল। আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের শুরুটা ভাল হয়নি। ২৬ তারিখের খেলার রাইফেল ম্যানদের দৃঢ়তায় শেষ মুহ’র্তে ইপিআর ২-১ গোলে মোহামেডানকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। জয়সূচক গোল করেছিল তাদের রাইট-ইন ফরমান আলী। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দিনের খেলায় ঢাকা মোহামেডান ইপিআর এর বিরুদ্ধে প্রথমার্ধের দেয়া ১ গোলের লীড নিয়ে তা খেলা শেষ হওয়ার আগ মুহ’র্তে পর্যন্ত ধরে রেখেছিল। জয় যখন নিশ্চিত তখনই ইপিআর টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড কর্নেল শফি মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় মোহামেডানের ‘ডি’ বক্সে ঢুকে উড়ন্ত হিটে গোলরক্ষক জাম্বুকে পরাস্ত করে দলকে ১-১ গোলের সমতায় ফেরায়। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ। অতিরিক্ত সময় দু দলই সাবধানতা অবলম্বন করে রক্ষণাত্মক খেলা শুরু করে এবং গোল শূন্য প্রথমার্ধ শেষ করে। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে ইপিআর দল যেন জেগে ওঠে। তাদের রাইট আউট খুরশীদ রাইটইন ফরমান আলী এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড কর্নেল শফির সম্মিলিত আক্রমণ মোহামেডানের রক্ষণভাগকে বিচলিত করে তোলে। খেলা শেষ হওয়ার প্রায় ৩ মিনিট আগে তাদের ট্রায়োর এক সম্মিলিত আক্রমণে রাইট-ইন ফরমান আলী গোল করে দলকে ২-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
২৮ এপ্রিলের সকালের খেলায় ইস্টার্ন রেল পাক পিডব্লিউডিকে ২-১ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। গত দিন তারা ১-১ গোলে ড্র করেছিল। খেলাটি খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। সমমানের দুটিম আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ করে খেলতে থাকায় খেলায় বেশ আকষণ বেড়ে গিযেছিল। দু টিমের মধ্যে একটি মিল ছিল। দু টিমেই বেশিরভাগ খেলোয়াড় ছিল অবাঙালী। রেল দলের কৃতি লেফট-ইন নিয়াজ গোল করে দলকে ১-০ গোলের লীড এনে দিলে তা কিছুক্ষণের মধ্যেই মকবুল শোধ করে দেয় ১-১। অতিরিক্ত সময় ১৫ মিনিটও ড্র। অগত্যা ফলাফলের জন্য ‘সাডেন ডেথ’ পদ্ধতিতে খেলা শুরু হলে তা আরও কিছুক্ষণ খেলা চলে , প্রায় ১৫ মিনিটের সময় আবারও নিয়াজ রেল দলকে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয়। তারা শেষ পর্যন্ত হকির যুদ্ধে ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। ২৯ তারিখে বৃষ্টির জন্য খেলা মাঠে গড়ায় নাই। ৩০ তারিখে সকালে কম্বাইন্ড চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল। বিকেলে রেল দল বিমান বাহিনীকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। অপর খেলায় আমরা ৫-০ গোলে সৈয়দপুর রেলওয়ে হারিয়েছিলাম। কম্বাইন্ডের পক্ষে প্রথম গোল করেছিল বুলবান আর দ্বিতীয় গোল করেছিল প্রতাপ।
আমাদের খেলায় উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল আমাদের রাইট-ইন মিলুর অনবদ্য হ্যাটট্রিক। যদিও খেলার প্রথমার্ধে ফরিদ এবং আমি ২ গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলাম। ১ মে তারিখে দুটো খেলাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গত দিনে ওয়ারী এবং ইপিআর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। ১-১ গোলে অমিমাংসিত খেলাটি পুনরায় আরম্ভ করেছিল দু টিমই জয়ের আশা নিয়ে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর উত্তেজনাকর খেলায় প্রথমেই ইপিআর দলের ফরমান আলী গোল করে দলকে এগিয়ে দেয় কিন্তু পরক্ষণই তা শোধ করে দেয় ওয়ারীর নিয়াজ আহমেদ। দুদলই গোল না খাওয়ার পদ্ধতিতে খেলে নির্র্ধারিত সময় শেষ করে। অতিরিক্ত সময়ের দু অর্ধে ইপিআর দলের ক্যাপ্টেন মোক্তার দু গোল করলে সদ্য লীগ চ্যাম্পিয়ন ওয়ারী ক্লাব ১-৩ গোলের হার মেনে নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল।
ইপিআর দলের টিম লিস্ট : মো. শফি (গোলরক্ষক), খালিক দাদ ও রশীদ আহমেদ, মুনসিফ, ক্যাপ্টেন মোক্তার ও মো. হাবিব, মো. খুরশীদ, ওসমান আলী, কর্নেল মো. শফি, ফরমান আলী ও আলী আকবর।
ওয়ারী ক্লাব : ফ্রান্সিস (গোলরক্ষক), এসহক ও মোমতাজ, পোটলা, মোমিন ও আনোয়ার, নেওয়াজিস, নিয়াজ আহমেদ খান, তানভীর, মজিদ ও শফিক।
১ ডিসেম্বর ২০১১
(সাতাশি)
দিনের অপর খেলার কম্বাইন্ড ১-০ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল। খেলার ধারা অনুযায়ী যে কোন দল জয়ী হতে পারতো। খেলাটি খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। ওয়ারী ক্লাবের ফুলব্যাক শেরা কম্বাইন্ডের পক্ষে খেলায় দুই ব্যাক কাদের এবং শেরা তাদের ডিফেন্সকে শক্তিশালী করেছিল এবং দৃঢ়তার সাথে খেলে রেলের আক্রমণগুলোকে ভাল ভাবেই সামাল দিয়েছিল। সেন্টার হাফ সাদেক সেদিন চমৎকার খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল। খেলার ছয় মিনিটে কম্বাইন্ড পেনাল্টি কর্নার লাভ করে আর শেরা জুটিকে গোলে রূপান্তরিত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত সেই গোলই তাদেরকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দিয়েছিল।
২ মে আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা), ইপিআরকে ২-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিলাম। রাইফেলম্যানরা ওয়ারীর বিরুদ্ধে যে খেলা প্রদর্শন করেছিল সে খেলা আমাদের বিরুদ্ধে খুঁজে পাওয়া যায়নাই। সারা খেলা তারা রক্ষণাত্মক খেলা খেলেছিল বিশেষ করে তাদের আক্রমণ রচনার মূল নায়ক কর্নেল শফি তার স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারছিল না যার জন্য তাদের আক্রমণভাগ ছিল ব্যর্থ। প্রথমার্ধের শেষ সময়ে আমরা বিপক্ষে দলের ডি বক্সের কাছাকাছি একটি ফ্রি হিট পেয়েছিলাম। এহতেশামের ফ্রি হিট আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ ধরে ডি এর ভেতর ঢুকেই সজোরে হিট করার সাথে সাথে গোল বোর্ডে আওয়াজ, ইপিআর গোলরক্ষক মো. শফি পরাস্ত। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। দ্বিতীয়ার্ধে ইপিআর টিম গোলশোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে উপরšুÍ ফরিদ সুন্দর একটি প্লেসিং হিট দ্বারা শফিকে ২য় বার পরাস্থ করে তার দ্বিতীয় গোল করার সাথে আমাদেরকে সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ এনে দেয়। ৩ মে ন্যাশনাল ব্যাংক করাচি এবং কম্বাইন্ড প্রথম সেমিফাইনাল বৃষ্টির জন্য মাঠে গড়াতে পারেনি তাই তারা ৪ মে পুনরায় মাঠে নেমেছিল। খেলার শুরু থেকেই দু টিমের খেলোয়াড়দের উত্তেজিতভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও খেলার ছন্দ ছিল না, এলোমেলো আক্রমণ, সমঝোতার অভাব তাই খেলা সেরকম আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। ন্যাশনাল ব্যাংক সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালালেও সফল হতে পারেনাই বিশেষ করে কম্বাইন্ডের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তিার সাথে মোকাবেলা করেছিল তবে কিছুটা রাফ খেলার প্রবণতা ছিল যার জন্য কম্বাইন্ডের রাইটহাফ মহসিন এবং ন্যাশনাল ব্যাংক করাচির সাঈদকে আম্পায়ার সাময়িক বহিষ্কার করে খেলাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে দু টিমই জেতার জন্য খেলা শুরু করে। ন্যাশনাল ব্যাংক, করাচির আক্রমণ অন্যান্য দিনের মত ক্ষুরধার ছিল না, কিছুটা অগোছালো আর গোল করার ব্যর্থতা, তারপরও তারা তুলনামূলকভাবে ভাল খেলা খেলছিল শুধুমাত্র অতর্কিত একটি গোল, করাচির এই টিমকে টুর্নামেন্ট থেকে বের করে দিয়েছিল। আর এর জন্য কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনু প্রশংসার দাবিদার। বিপক্ষ দল ডি এর ভেতর আনুকে ফাউল করলে কম্বাইন্ড পেনাল্টি কর্নার লাভ করে। পেনাল্টি কর্নার হিট ফুলব্যাক শেরা করেছিল। গোলরক্ষক প্যাড করলে বল রিবাউন্ড হয়ে প্রতাপের কাছে চলে যায় : প্রতাপ সেটা ঠেলে দেয় আনুকে আর আনু সেটা থেকে গোল করে টিমকে জয় এনে দেয় এবং কম্বাইন্ডকে ফাইনাল খেলার সুযোগ করে দেয়। আনু সম্বন্ধে অল্প কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরছি। আনুর আসল নাম শামসুল আলম। আনু পরনো ঢাকার। আরমানিীটোলা গভ. হাই স্কুলের ছাত্র, আমার সহপাঠি এবং একই এলাকার। তার পুরো পরিবার ক্রীড়াবিদ পরিবার। বাবা আমজাদ সাহেব মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ওয়ারী ক্লাবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বড় ভাই নুরুভাই ফুটবল গোলরক্ষক, খেলেছেন মাহুৎটুলী ক্লাবে। মেজো ভাই ফখরুল আলম, পাকিস্তান বিমানবাহিনী ফুটবল দলের লেফট আউট, ঢাকায় ফিরে চাকরি নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা টিমে আমাদের সাথে ফুটবল হকি খেলেছেন। আনু স্কুল টিমে হকি খেলেছে, করাচিতে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় ফিরে কম্বাইন্ডে হকি খেলেছে। ওয়ারী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
২য় সেমিফাইনাল করাচি কাস্টমস বনাম ন্যাশনাল ব্যাংক ঢাকা। পাকিস্তান জাতীয় দলের ছয়জন খেলোয়াড় নিয়ে গড়া কাস্টমস টিম অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা আমাদেরকে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। গোলের সংখ্যা বেশি হলেও আমরা ভাল খেলার চেষ্টা করেছি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার সর্বাধিক চেষ্টা চালিয়ে গেছি। বিশেষ করে আমাদের ফুলব্যাক সাবের অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে কাস্টমসের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করেছে। হাফলাইনে এহতেশাম প্রশংসনীয় খেলা প্রদর্শন করেছিল, আমাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দাস দক্ষতার সাথে কাস্টমসের অনেকগুলো গোল সেভ করে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছিল, নইলে আমরা আরো অধিক গোলে পরাজিত হতাম, আমরা যে গোলগুলো খেয়েছিলাম তাতে রঞ্জিত দাসের কোন ত্রুটি ছিল না।
খেলার ছয় মিনিটেই কাস্টমস পেনাল্টি কর্নার লাভ করে এবং তাদের লেফটব্যাক ইকবাল শাহ গোল করে দলকে ১-০ গোলের লীড এনে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় লাইক গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছিল (২-০)। এর কিছুক্ষণ পর আবারও লাইক গোল করে দলকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পূর্বে আরও দু’বার আমাদের গোল বোর্ডে আওয়াজ তুলেছিল কাস্টমস দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড কাসানীর হিট করা বলের আঘাতে। আমাদের টিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল খাওয়ার মত টিম না, বেশ কয়েকবার আমরাও তাদের সীমানায় আঘাত করে মাঝেমধ্যে কাস্টমসকে বেকায়দায় ফেলেদিয়েছি, এমনি একটি আক্রমণের ফসল হিসেবে আম্পাদের রাইট ইন মির্জা ফরিদ (মিলু) ১টি গোল শোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিরতির পূর্বেই আমরা ১-৫ গোলে পিছিয়ে পড়েছিলাম। বিরতির পর খেলাটা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। কাসানীর হ্যাটট্রিকের জন্য অন্যান্য খেলোয়াড়রা গোল করতে আগ্রহী না থাকায় কাস্টমসের খেলা ছিল কাসানীকে লক্ষ্য করে। সবাই কাসানীকে দিয়ে হ্যাটট্রিক করাবার জন্য ব্যস্ত থাকায় খেলাটা আকর্ষণহীন হয়ে পড়েছিল। খেলা প্রায় শেষেরদিকে গড়াচ্ছিল, এমনি সময় কাসানী তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১-৬ গোলে পরাজিত হয়ে আমাদেরকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
করাচি কাস্টমসের অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়। কম্বাইন্ড ৫-০ গোলে পরাজিত।
৫ মে অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল। করাচি কাস্টমস বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। খেলার পূর্বে ঢাকা স্টেডিয়ামে ইস্ট পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট পাকিস্তান হকি যুদ্ধের একটা আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাঙালিরা সবাই কম্বাইন্ডের দিকে আর অবাঙালিরা ছিল করাচির পক্ষে। একদিকে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়সমৃদ্ধ করাচি কাস্টমস আর অন্যদিকে তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। ব্যক্তিগত এবং দলগত নৈপুণ্যে ভরপুর কাস্টমস দলের বিরুদ্ধে তরুণ কম্বাইন্ডের খেলোয়াড়রা যথেষ্ট ভাল খেলা প্রদর্শন করে তাদের সমর্থকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল; বিশেষ করে দুই ইন বুলবান এবং প্রতাপ আক্রমণভাগের মূল চালকাশক্তি হিসেবে আক্রমণকে সচল করে রেখেছিল আর কম্বাইন্ডের ডিফেন্স অত্যন্ত পরিশ্রম করে কাস্টমসের শক্তিশালী আক্রমণগুলোকে সামাল দিয়েছিল।
খেলা শুরুর সাথে সাথে কাস্টমসের সংঘবদ্ধ আক্রমণ কম্বাইন্ডের সীমানায় হানা দিয়ে ডিফেন্সকে অস্থির করে তুলেছিল। ৫ মিনিটের মধ্যে তারা দুটো পেনাল্টি কর্নার পেয়ে যায় কিন্তু কম্বাইন্ডের গোলরক্ষকের দৃঢ়তায় গোল হয়নি। কিছুক্ষণ পরই তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড কাসানি একক প্রচেষ্টায় ডি-এর ভেতর ঢুকে যায় কিন্তু ফুলব্যাক শেরা চমৎকার ট্যাকল দিয়ে বল ছিনিয়ে নিলে তারা গোলবঞ্চিত হয়। পিচ্ছিল আর কর্দমাক্ত মাঠ থাকায় আকর্ষণীয় হকি দর্শকরা দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারপরও কাস্টমসের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত এবং দলগত নৈপুণ্যের ঝলক মাঝে মাঝে দর্শকরা উপভোগ করেছিলেন, বিশেষ করে তাদের আন্তর্জাতিক লেফট-ইন লাইকের লম্বা লম্বা ডজ দিয়ে দ্রুত সীমানায় পৌঁছে যাওয়া দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে। প্রায় ২০ মিনিটের সময় লাইক তার নিজস্ব স্টাইলে বল নিয়ে কম্বাইন্ডের দুজন খেলোয়াড়কে ডজ দিয়ে ‘ডি’তে ঢুকে চমৎকার ক্লিকের সাহায্যে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নিয়েছিল। এরপরই আরেক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় লেফট-আউট জাহাঙ্গীর বাট দ্রুতগতিতে কম্বাইন্ডের গোল সীমানায় পৌঁছেই সজোরে হিট করলে বল কম্বাইন্ডের ব্যাক শেরার স্টিকে লেগে দিক পরিবর্তন করে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে পোস্টে ঢুকে যায় (২-০)।
বিরতির পূর্বে কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনু এবং কাস্টমসের ফুলব্যাক জাফর পরস্পরের দিকে স্টিক উঁচিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করলে খেলা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে।
দ্বিতীয়ার্ধে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাস্টমসের সেন্টার ফরোয়ার্ড কাসানি পরপর দু’গোল করেছিল। প্রথমটি লাইকের পাস থেকে, দ্বিতীয়টি মাহমুদের পাস থেকে (৪-০)। খেলা শেষ হওয়ার মিনিটখানেক বাকি থাকতে পেনাল্টি কর্নার থেকে ফুলব্যাক ইকবাল শাহ গোল করলে কাস্টমস ৫-০ গোলে জয়ী হয়ে অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
করাচি কাস্টমস টিমের প্লেয়ার লিস্ট : জহুর (গোলরক্ষক), জাফর ও ইকবাল শাহ, আবরার, সামি ও গুলরেজ, ইসমাইল, খালেদ মাহমুদ, কাসানি, লাইক এবং জাহাঙ্গীর বাট।
কম্বাইন্ড টিমের প্লেয়ার লিস্ট : সাদেক (বড়) (গোলরক্ষক), কাদের ও শেরা, মহসিন, সাদেক ও ইব্রাহিম সাবের, সিকান্দার, বুলবান, আনু প্রতাপ ও রহমান।
১৬ ডিসেম্বর ২০১১
(অষ্টাশি)
দ্বিতীয় শ্রেণীর হকি আম্পায়ারদের ১ম শ্রেণীতে উন্নীতকরণ প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা হিসেবে অল পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিংকে ধরা হয়েছিল এবং পরীক্ষক হিসেবে আলমগীর আদেল, আন্তর্জাতিক হকি আম্পায়ারকে পাকিস্তান হকি আম্পায়ার এসোসিয়েশন তাদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল। অংশগ্রহণকারী আম্পায়াররা ছিলেনÑ খুরশীদ জাহেদী, আবু জাফর, মাহমুদুর রহমান (মোমিন), শামি খান, ঈশা খান, আইয়ুব খান এবং এসএস ফরিদি।
লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল ইপরোয়া (ইস্ট পাকিস্তান রেফারি আম্পায়ার এসোসিয়েশন) টেন্টে। ৭ মে ১৯৬৭ তারিখে রেজিস্ট্রেশন ফি ৫ রুপি দিয়ে অংশগ্রহণকারী আম্পায়ারদের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।
অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথে সৈয়দ আনোয়ার আলীর মৃত্যুসংবাদে হকি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হকির একজন মুরব্বি, ভদ্র এবং ভাল মানুষ হিসেবে আমাদের অনেক সম্মানের ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ক্যালকাটা মোহামেডান ক্লাবের হকি ক্যাপ্টেন এবং সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমের ম্যানেজার হিসেবে আমাদের সাথে ট্রেনে করে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ভারতের ওপর দিয়ে ৩/৪ দিনে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। সেই ভ্রমণের অনেক স্মৃতি আজ লিখতে বসে মনে পড়ে যাচ্ছে।
হকি থেকে ফুটবল, মাত্র সাতদিনের ব্যবধান, ৫ মে অল পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল হকি মৌসুম আর মাত্র এক সপ্তাহ পর ১২ মে ফুটবল লিগের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ফুটবল মৌসুম। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) মৌসুমী খেলাগুলো একের পর এক সাজানো হতো আর আমাকে সে অনুযায়ী হকি, ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স খেলতে হতো। অনুশীলন করার মতো আমি সময় পেতাম না। সেবারের ফুটবল লিগ খেলতে গিয়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ৪ মে হকি টুর্নামেন্ট শেষ করেই ১২ মে স্টেডিয়ামে ফুটবল লিগ ম্যাচ খেলতে নামতে হয়েছিল। ব্যক্তিগত বা দলগত অনুশীলন করার সুযোগই পাওয়া যায়নি।
গত ফুটবল মৌসুমে ২য় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১ম বিভাগে উন্নীত হওয়া রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিমসহ ১ম বিভাগের অন্যান্য টিম যেমন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ইপিআইডিসি, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ারী ক্লাব, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ এসি, পাক পিডব্লিউডি, রহমতগঞ্জ এমএফএস, আজাদ স্পোর্টিং সেন্ট্রাল স্টেশনারি, বিজি প্রেসসহ মোট ১৩টি দল নিয়ে ইপিএসএফ ফুটবল কমিটি কর্তৃক আয়োজিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ১ম বিভাগ ফুটবল লিগ। লিগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান বনাম ১ম বিভাগে উন্নীত রেলওয়ে পাইওনিয়ারের ম্যাচ দিয়ে ১২ মে শুরু হয়েছিল ফুটবল লিগ। লিগ চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে শুরুটা আমাদের মোটেও ভাল হয়নি, বিশেষ করে নতুন টিম হিসেবে সদ্য উন্নীত রেলওয়ে পাইওনিয়ারের বিপক্ষে। আমরা ৩-০ গোলে জয়লাভ করলেও শিশু টিম হিসেবে তারা আমাদের শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ টিমের বিরুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়নি বরং যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথে খেলে প্রথমার্ধে ০-২ গোলে পিছিয়ে গিয়েছিল। খেলা শুরুর পাঁচ মিনিটেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমাদের রাইট আউট কামাল খুবই সহজ একটি গোল মিস করে সেই সুযোগ হাতছাড়া করে দেয়। অনুরূপভাবে রেলওয়ে পাইওনিয়ারের লেফট আউট নওয়াব সুন্দর একটি বল বানিয়ে দিয়েছিল তার লেফট ইনকে। সে আমাদের গোলরক্ষক নূরুন্নবীকে একা পেয়েও গোল করতে পারেনি। আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হাফিজউদ্দিনের দেয়া পাসে কামাল সুন্দর একটি গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পূর্বে আমার দুর্বল শট গোলরক্ষক ধরতে গিয়েও হাত ফসকে গোলপোস্টের ভেতর ঢুকে গেলে আমরা ২-০ এগিয়ে যাই।
খেলার শেষ বাঁশির কিছুক্ষণ আগে আমরা একটি ফ্রি-কিক পেলে গফুর সরাসরি গোলপোস্টে মেরে দর্শনীয় গোল করে। ৩-০ গোলের জয় দিয়ে আমাদে লিগের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড় তালিকা : নুরুন্নবী (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব ও রফিক, রসুল বখশ ও গফুর, কামাল আব্দুল্লাহ, হাফিজউদ্দিন, বশীর ও মুসা।
রেলওয়ে পাইওনিয়ার : মহিউদ্দিন (গোলরক্ষক), আলম, কানাই ও গিয়াস, শাহ আলম ও ফজল, নুরুল্লাহ, আলিম, জেমস, মনোজ ও নওয়াব।
ভিক্টোরিয়া এবং ফায়ার সার্ভিসের খেলায় দুই টিম মিলে ৪ গোল করেছিল। সমশক্তির টিম দুটির খেলা বেশ জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল। ফায়ারের শরফুদ্দিন গোল করে দলকে এগিয়ে দিলেও বেশিক্ষণ তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নিÑ ভিক্টোরিয়ার ইমাম তা শোধ করে দেয়। সমতার ফলে খেলায় আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে গিয়ে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ বেড়ে যায়। খেলা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ভিক্টোরিয়ার রাইট ফুলব্যাক, আব্দুল্লাহ হোসেন এবং রাইট হাফ আলী মোহাম্মদ খুব ভাল খেলা প্রদর্শন করলেও তাদের গোলরক্ষক দুলু আফেন্দী ছিল নার্ভাস। অন্যদিকে ফায়ারের শরফুদ্দিন এবং ওহাব পরিশ্রম করে খেলে আক্রমণের চাকাকে সচল রেখেছিল এবং তাদের হাফ লাইনে সামাদ এবং জলিল আনসারী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খেলে মাঝ মাঠকে সুরক্ষিত রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের গোলরক্ষক মোতালেব দর্শনীয় খেলা খেলে দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ভিক্টোরিয়ার পক্ষে ইব্রাহিম সাবের গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দিলেও আইনুল কর্নার কিক থেকে হেডের সাহায্যে গোল করে ফায়ারকে সমতায় ফেরায়। খেলা ২-২ গোলে ড্র।
যারা সেদিন খেলেছিল
ফায়ার সার্ভিস : মোতালেব (গোলরক্ষক) মজিবর রহমান, আইনুল ও আবুল, সামাদ ও জলিল, কালাম, শরফুদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, আশরাফ ও ওহাব।
ভিক্টোরিয়া : দুলু আফিন্দী (গোলরক্ষক), আব্দুল্লাহ হোসেন, সালেহ ও সাদেক আলী মোহাম্মদ ও খসরু, ইব্রাহিম সাবের, ইউসুফ, ইমাম, আজিম ও টিপু।
শাজাহানের চমৎকার দুটি গোলে রহমতগঞ্জ স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেদিনের লিগের অপর খেলাটিতে দু’অর্ধে দুটি গোল হয়েছিল। স্টেশনারি চেষ্টা করেও ফলাফল পরিবর্তন করতে পারেনি।
রহমতগঞ্জের খেলোয়াড় : অনাথ (গোলরক্ষক), নাজির গাউস ও হাসনাত, কায়কোবাদ ও লালু, কাজী আলমগীর, শাহজাহান, সুলতান, আফজাল এবং নয়া।
স্টেশনারি : বাচ্চু (গোলরক্ষক), রফিক সিরাজ ও এনতাজ, মোশাররফ মনোয়ার, নুরু, আজিজ ইলিয়াস জামান এবং কামাল।
১৪ মে ইপিআইডিসির উৎসাহজনক লিগ আরম্ভ। পাক পিডব্লিউডির দেরিতে খেলায় ফেরা। প্রথমার্ধেই ইপিআইডিসি ৩ গোল করে পিডব্লিউডিকে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে বিরতির পূর্বে একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল পিডব্লিউডি (৩-১)। উদ্দেশ্যহীন আর অগোছালো দু’টিমের খেলা সেরকম মানসম্মত ছিল না। তুলনামূলকভাবে ইপিআইডিসি ভাল খেলা প্রদর্শন করেছিল, যদিও পিডব্লিউডি শেষ পর্যন্ত দু’গোল শোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। খেলা শুরু হলে ইপিআইডিসির লেফট ইন জব্বার গোলপোস্টে কিক করলে গোলরক্ষক মতিন বল ধরতে পজিশন নেয়, মাঝপথে তাদের স্টপার কানু হেড করলে বল দিক পরিবর্তন করে সোজা পোস্টে ঢুকে যায়। এর কিছুক্ষণ পর জব্বর সুন্দর একটি পাস হাশিমকে দিলে সেটা থেকে গোল হয়ে দলের গোলসংখ্যা দাঁড়ায় ২-০ এবং দু’মিনিট পরই হাশিম গাজীর সেন্টার থেকে গোল করে দলকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির বাঁশি বাজার আগে পিডব্লিউডির এক বিচ্ছিন্ন আক্রমণে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা ওহাব বল পেয়ে যায় এবং সেটা থেকে গোল করে ব্যবধান কমায় ৩-১।
বিরতির পর হাশিমের হ্যাটট্রিকের জন্য সতীর্থ খেলোয়াড়রা চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি; উপরন্তু ফ্রি-কিক থেকে পাওয়া বলে হেড করে ওহাব দলের পক্ষে গোল করে দলকে সম্মানজনক হার এনে দেয় ২-৩।
ইপিআইডিসি প্লেয়ার লিস্ট : হাকিম (গোলরক্ষক) আমিন, গফুর, বালুচ ও সাইফুদ্দিন, গৌর ও মুসা, সলিম উল্লাহ, আলী হাফিজ, হাশিম উদ্দিন, জব্বর ও গাজী।
পিডব্লিউডির প্লেয়ারলিস্ট : মতিন (গোলরক্ষক), হামিদ, কানু ও বাটু, বিমল ও আকরাম, রোকন, বাবুল, ধীরেন, ওহাব এবং হাশেম উদ্দিন।
শিশু টিম আজাদকে হারিয়ে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় সদ্য প্রমোশন পাওয়া তরুণ রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিম আজাদ স্পোর্টিংকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার আভাস দিয়েছিল, তাদের প্রথম খেলায় লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের বিরুদ্ধে ০-৩ হেরেও লড়াই করার মনোবল তাদের রয়েছেÑ এটা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বিরতি পর্যন্ত ড্র ছিল। লেফট-ইন আলিম এবং রাইট ইন নুরুল্লাহর গোলে তাদের জয় নিশ্চিত হয়েছিল।
আজাদ স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড়রা : এহতেশাম (গোলরক্ষক), সিরাজ,
মোবাশ্বের ও আহম্মদ, নজরুল ও গিয়াস, দেবু, নাসিম, আবুল হাসান, মিন্টু ও বাবু।
১ জানুয়ারি ২০১২
(ঊননব্বই)
১৬ মে আমরা (মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব) ওয়ারীকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে আমাদের জয়ের ধারাকে অক্ষুন্ন রেখেছিলাম। ওয়ারীর রক্ষণভাগের দুর্বলতার সুযোগে আমরা তাদের ওপর চেপে বসি। বিশেষ করে তাদের রাইট ব্যাক নুরুল ইসলাম আমাদের পাসগুলো সঠিক ইন্টারসেপ্ট করতে পারছিল না, তার সহযোগী ডিফেন্সের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিল না আর আমরা সেদিক দিয়েই আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত করে রেখেছিলাম। তবে তাদের থার্ড ব্যাক হামিদ প্রথমবারের মত লিগ খেলায় অংশ নিয়ে চমৎকার খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাদের লেফট ব্যাক শওকত যদি আরও দৃঢ়তার সাথে এবং শক্ত ট্যাকেল করে খেলতো, তাহলে আমরা অত সহজে গোল করতে পারতাম না। সম্মিলিত আক্রমণের জন্য আমাদের আক্রমণভাগ প্রশংসার দাবি করলেও রক্ষণভাগ ছিল হতাশাজনক, বিশেষ করে আমাদের রাইট ফুল জহির ভাই ছিলেন ফ্লপ। ওয়ারীর লেফট আউট মাহমুদকে আটকাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। বিপক্ষ খেলোয়াড়ের জার্সি ধরে টেনে রাখা, হাত ধরে রাখা, বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে আটকাতে চেষ্টা করছিলেনÑ যা ছিল দৃষ্টিকটু। খেলার এক পর্যায়ে অসৎ আচরণের জন্য জহির ভাই এবং মুসাকে রেফারি ঈসা খান সতর্ক করে দেন। সেদিন আমাদের টিমের তরুণ খেলোয়াড় জালু রাজশাহী থেকে এসে প্রথমবারের মত লিগে অংশ নিয়ে চমৎকার দুটো গোল করে সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। জালু রাজশাহীর কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসুর ছোট ভাই। খেলার শুরুতেই গফুরের একটি থ্রু পাস আশরাফ ভাই ধরতে ব্যর্থ হলে সহজ একটি গোল হাতছাড়া হয়ে যায়। মুসার দেয়া পাস আব্দুল্লাহ বুঝতেই পারেনি বলে আরেকটি গোল পাওয়া হলো না। খেলার ৫ মিনিটের সময় ওয়ারী একটি আক্রমণে জামিল আখতার মাহমুদকে একটি বল বানিয়ে দেয়, মাহমুদ সে বল পোস্টে মারলে বল বারপোস্টে লেগে নিশিথের কাছে ফেরত আসে। নিশিথ আমাদের গোলরক্ষক নূরুন্নবীকে পরাস্ত করলেও গোললাইনের ওপর থেকে তোরাব আলী ক্লিয়ার করে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি; কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা ওয়ারীর রাইট আউট ভুট্টো বল পেয়ে যায় আর সে ওয়ারীকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। গোল খেয়ে আমরা শোধ করতে জোর চেষ্টা চালাতে থাকি। আশরাফ ভাইয়ের ব্যাক ভলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এর পরপরই বাম প্রান্ত থেকে গফুরের লব হাফিজউদ্দিন হেড করলে বল বারপোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর মুসার কিক গোলপোস্টে লেগে ফেরত এলে মুসা দ্বিতীয় সুযোগে গোল করে আমাদের দলকে ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়। এর স্বল্প পরেই জালু গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পর আমাদের টিম পুরো উদ্যমে খেলা শুরু করে এবং আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় আবদুল্লাহ জালুর উদ্দেশে একটি থ্রু পাস দিলে জালু সেটার সদ্ব্যবহার করে দলকে ৩-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ এবং লেফট আউট মাহমুদের সম্মিলিত আক্রমণে ভুট্টো সহজ একটি গোল মিস করলে শেষ পর্যন্ত আমরা ৩-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
ওয়ারীর খেলোয়াড় তালিকা : তপন (গোলরক্ষক), নুরুল ইসলাম, হামিদ ও শওকত বেলাল ও খলিল, ভুট্টো, আজিজ, নিশিথ, জামিল আখতার ও মাহমুদ।
১নং আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দিনের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং সেন্ট্রাল স্টেশনারিকে ১-১ গোলে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। খেলার ১৫ মিনিটেই স্টেশনারির কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াস গোল করে দলকে এগিয়ে নেয় এবং বিরতি পর্যন্ত স্টেশনারি লিডটাকে ধরে রেখেছিল। বিরতির পর ১০ মিনিটে আজাদ একটি পেনাল্টি লাভ করে কিন্তু নজরুল গোলরক্ষক বাচ্চুকে পরাস্ত করতে না পারায় পুরো টিম হতাশ হয়ে পড়ে। আজাদ গোল শোধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়; এরই এক পর্যায়ে লেফট আউট বাটু একটি সুযোগ পেয়ে গোলপোস্টে সজোরে কিক করে, গোলরক্ষক বাচ্চু বল ধরার জন্য পজিশন নেয় কিন্তু তাদের রাইট ব্যাক এনতাজ মাঝখানে চলে আসে এবং বল তার গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে সরাসরি গোলপোস্টে ঢুকে যায়। গোলরক্ষক বাচ্চুর শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া করার আর কিছুই ছিল না। ফলাফল ১-১ ড্র।
১৭ তারিখের খেলায় ফায়ার সার্ভিসের গোলরক্ষকের ভুলের জন্য রহমতগঞ্জ পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। সমমানের দুটি দলের মধ্যে কে ভাল বলা কঠিন। প্রথমার্ধ যদি রহমতগঞ্জের হয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয়ার্ধটা ছিল ফায়ার সার্ভিসের। প্রথমার্ধে ফায়ারম্যানরা কমপক্ষে তিনটি সুযোগ নষ্ট করেছিল। সুযোগগুলো নষ্ট করার মূলে ছিল সেলিম। রহমতগঞ্জ শুরুটা ভাল করেছিল। তাদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে খেলার পাঁচ মিনিটেই তাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল কিন্তু রাইট-আউট নাজিরের জঘন্যভাবে মিস করাতে গোল পাওয়া সম্ভব হয়নি। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটে রহমতগঞ্জের রাইট-ইন শাজাহান দূর থেকে উঁচু করে একটি বল গোলপোস্টে কিক করলে গোলকিপার সীতাংসু প্রথমে বুঝতে পারেনি যে সেকি করবে। সে বল ধরার জন্য পোস্ট ছেড়ে এগিয়ে আসে কিন্তু সে বলের ফ্লাইট মিস করে ফেলে, বল সরাসরি গোলপোস্টের কোনা দিয়ে ভেতরে ঢুতে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের পুরোটা সময় ফায়ার সার্ভিস গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে কিন্তু সফল হতে পারেনি। সীতাংশুর ভুলের মাশুল টিমকে মেটাতে হয়েছে ১ গোলের পরাজয়বরণ করার মাধ্যমে।
রহমতগঞ্জের খেলোয়াড় : অনাথ (গোলরক্ষক), ফারুক, গাউস ও হাসনাত, লালু ও কায়কোবাদ, নাজির, শাহজাহান, সুলতান, গফুর ও নয়া।
ফায়ার : সীতাংশু (গোলরক্ষক), আবুল আইনুল ও জলিল, দিপু ও সামাদ, কামাল, শরফুদ্দিন, সালিম, সাহাবুদ্দিন ও আশরাফ।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত খেলায় পিডব্লিউডি এবং প্রেস নিজেদের মধ্যে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল, ফলে ১-১ গোলে ড্র করে। প্রেসের মোখতার প্রথম গোল করেছিল পিডব্লিউডির লেফট-ইন আবেদ।
ওয়ান্ডারার্স অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল আর রেলওয়ে পাইওনিয়ার লড়াই করে পরাজয়বরণ করেছিল। ১৮ মে তরুণ রেলওয়ে পাইওনিয়ার তাদের শক্তিশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে চমৎকার খেলা প্রদর্শন করেছিল। প্রথমার্ধে ওয়ান্ডারার্স অগোছালো খেলা আর অপরিকল্পিত আক্রমণ এবং লক্ষ্যহীন শুটিং করে বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ নষ্ট করেছিল; তারপরও তারা ২-১ গোলে এগিয়ে থেকে প্রথমার্ধ শেষ করেছিল। তাদের লেফট ফুল ব্যাক আসলাম করাচি থেকে প্রথমবারের মত এসে লিগে অংশ নিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। বিশেষ করে স্টপার নবী বখশের সাথে বোঝাপড়া হচ্ছিল না। খেলা শুরু হলে ওয়ান্ডারার্সের হাবিব সাদেক ও রিয়াজের সম্মিলিত আক্রমণে রেলওয়ে পাইওনিয়ারের গোলরক্ষক মহিউদ্দিন পরাজিত হলে তারা ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। রেল পাইওনিয়ারের স্টপার ফজলের দুর্বল ক্লিয়ারেন্সের বল রিয়াজ ধরে সুন্দর প্লেসমেন্টের সাহায্যে গোল করে দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেয়। বিরতির কিছু পূর্বে ফুল ব্যাক আসলাম এবং স্টপার নবী বখশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ফলস্বরূপ আসলাম দলীয় গোলরক্ষক সান্টুকে দিতে গিয়ে বল নিজ গোলেই ঢুকিয়ে দেয় ২-১। বিরতির পর রেলওয়ে পাইওনিয়ারের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। প্রায় ৮ মিনিটের সময় তাদের রাইট-ইন আমান উল্লাহ বল নিয়ে ওয়ান্ডারার্সের সীমানায় ঢুকে আসলামকে কাটিয়ে ছুটে আসা গোলরক্ষক সান্টুকেও কাটিয়ে বল পোস্টে ঠেলে দিয়ে দলকে ২-২ গোলের সমতায় ফেরায়। কিছুক্ষণের মধ্যে নুরুল্লাহ চমৎকার একটি শটের মাধ্যমে সান্টুকে পরাস্ত করে দলকে ৩-২ গোলের লিড এনে দেয়। গোল খেয়ে ওয়ান্ডারার্স যেন জেগে ওঠে এবং গোল শোধ করতে প্রচ চাপ প্রয়োগ করতে থাকে আর লেফট-ইন সাদেক ত্রাণকর্তা হিসেবে সেদিন তার একক নৈপুণ্য দ্বারা শুধু গোলই শোধ করেনি বরং পরপর দু’গোল করে দলকে ৪-৩ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। শেষ বাঁশি বাজার আগে হাবিব ও সাদেকের সহযোগিতায় আলাউদ্দিন আরও একটি গোল করলে ওয়ান্ডারার্স ৫-৩ গোলের জয় দিয়ে মাঠ ছাড়ে।
ওয়ান্ডারার্সের প্লেয়ার লিস্ট : সান্টু (গোলরক্ষক), আফজাল, নবী বখশ ও আসলাম, রিয়াজ ও ইসমাইল, রুশো, আনসার, আলাউদ্দিন, হাবিব, সাদেক ও তসলিম।
সেদিনের অপর খেলায় ইপিআইডিসি টিমের কাছে পুলিশ দাঁড়াতেই পারেনি; তবে খেলার শুরুতেই পুলিশের আরশাদ মল্লিক গোল করে ইপিআইডিসিকে চমক দিয়েছিল। প্রতিশোধ নিতে ইপিআইডিসি আক্রমণ চালাতে শুরু করে এবং সফলও হয় হাশিম উদ্দিনের করা গোলের মাধ্যমে ১-১। ইপিআইডিসি মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সারামাঠ বিচরণ করে খেলতে থাকে। পুলিশের তরফ থেকে সেরকম জোরদার বাধা পাচ্ছিল না। তাদের লেফট-ইন জব্বর বল ধরে পুলিশের ৩/৪ জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল করে দলকে ২-১ গোলের এগিয়ে দেয়।
আসলাম গোল করে দলকে ৩-১ গোলে লিড এনে দেয় আর পুলিশের নুরুল্লাহ ব্যাক পাস করতে গিয়ে নিজের গোল পোস্টে বল ঢুকিয়ে দিয়ে ১-৪ গোলের হার মেনে নিয়ে মাঠ ছেড়ে যায়।
মোহামেডানের প্রথম পয়েন্ট হারানো, ফায়ারের সাথে চার গোলের ভাগাভাগি, তৃতীয় ম্যাচেই আমাদের ১ পয়েন্ট খোয়ানো ছিল চিন্তার বিষয়। যদিও ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানানো উচিত যে, আমরা দুটো পয়েন্ট হারাইনি বলে। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া আমাদের শক্তিশালী দল ফায়ার সার্ভিস যে লড়াকু টিমÑ সেটাকে আমলেই নেয়নি। গোল না পাওয়ার জন্য যেমন আমাদের আক্রমণভাগ দায়ী, তেমনি গোল খাওয়ার জন্য আমাদের রক্ষণভাগও দায়ী। ফায়ার সার্ভিসের দ্বিতীয়ার্ধের খেলা ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। আমাদের সীমানায় হানা দিয়ে গোলপোস্টে কিক করে আমাদের চমকে দিয়েছিল। বিশেষ করে ফায়ারের শরফুদ্দিন জহির ভাই ও পিন্টুকে কাটিয়ে খালি পোস্টে কিক করতে পারেনি বলে আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। একটু পরই শরফুদ্দিন একটি বল বানিয়ে দিয়েছিল শাহাবুদ্দিনকে, সেটাও মিস হয়ে যাওয়ায় আমরা আবারও বেঁচে গিয়েছিলাম। ১৯ মে’র খেলায় দুজন খেলোয়াড় দর্শকদের দৃষ্টি কেড়েছিলÑ প্রথম আমাদের স্টপার পাকিস্তান দলের কৃতী খেলোয়াড় তোরাব আলী এবং অপরজন ফায়ারের শরফুদ্দিন। তাদের দর্শনীয় খেলা সেদিন উপস্থিত দর্শকরা উপভোগ করেছিলেন। এখানে শরফুদ্দিন সম্বন্ধে দু’চারটি কথা না বললেই নয়। নম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী কৃতী খেলোয়াড়টির সাথে আমার অনেক বছর পর দেখা হয়েছিল, দাড়ি রেখে আল্লাহওয়ালা মানুষ। কথা প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম (ডেপুটি চেয়ারম্যান-রেফারিজ কমিটি, বাফুফে) বললো, শরফুদ্দিন গত রোজার মাসে মারা গেছেন! আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন। শরফুদ্দিন ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করতো এবং খেলতো। বিয়ের জন্য সবাই চাপ দিচ্ছে। আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না বিধায় ফায়ার সার্ভিসের এবং দেশের ফুটবলের অন্যতম সংগঠক সিদ্দিকুর রহমান তাকে এক বছরের জন্য অন্য টিমে খেলার জন্য সুযোগ দিয়েছিলেন, যাতে সে অন্য টিমে খেলে টাকা পেয়ে সে টাকা দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করতে পারে। তারপরও তার বিয়ে হয়নি। কেন হয়নি জানি না; তবে সে একা জীবন কাটিয়েছে এবং সে অবস্থায় মারা গেছে।
ফায়ারের গোলরক্ষক সীতাংশু চমৎকার খেলেছিল। অনেক গোল সে সেভ করেছে। আমাদের টিম ফায়ারের তুলনায় অনেক শক্তিশালী, বার বার আক্রমণ করেও ফল আসছিল না। গফুরের একটি লব প্রতাপ হেড করলে তা ক্রশবারে লেগে ফেরত আসেÑ যা কাছেই দাঁড়ানো আবদুল্লাহ দৌড়ে গিয়ে সে বলটাকে পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। খেলার প্রায় ৩০ মিনিটের সময় শাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে বল পেয়ে শরফুদ্দিন একক প্রচেষ্টায় আমাদের বক্সে ঢুকে প্রচন্ড কিকের সাহায্যে নূরুন্নবীকে পরাস্ত করে ১-১। বিরতির পর ফায়ারম্যানরা ফায়ারের মত জ্বলে ওঠে এবং আক্রমণ চালিয়ে আমাদের রক্ষণভাগকে নাড়িয়ে দেয়। নুরুন্নবী একের পর এক গোল সেভ করে যায়। শরফুদ্দিন ও শাহাবুদ্দিন আমাদের ডিফেন্সে আতংক সৃষ্টি করে। এরকমই একটি আক্রমণে শরফুদ্দিন আবারও দর্শনীয় একটি গোল করে তার দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। পুরো গ্যালারি হাততালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানায়। গোল খেলে আমরা অনেকটা দিশেহারার মত হয়ে পড়ি এবং গোল শোধ করার জন্য সবাই চেষ্টা চালাতে থাকি। আমরা একটার পর একটা কর্নার আদায় করলেও প্রতি কর্নার কিক সীতাংশু তার দীর্ঘদেহের সুবাদে বল ধরে ফেলছিল কিংবা বল পাঞ্চ করে গোল সেভ করে দিচ্ছিল। এমনি একটি কর্নার কিক ক্রশবারে লেগে ছোট বক্সে ড্রপ পড়লে সীতাংশু বল ধরার জন্য ডাইভ দেয় কিন্তু কাছেই দাঁড়ানো মুসা তার আগেই পুশ করে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয় আর এতেই আমরা পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাই (২-২ গোলে) এবং ভাগ্যগুণে ১ পয়েন্ট নিয়ে টেন্টে ফিরে যাই।
১৬ জানুয়ারি ২০১২
(নব্বই)
খেলার ধারা অনুযায়ী ১৯-৫-৬৭ তারিখের খেলায় ওয়ারীর জয় পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু তাদের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের ব্যর্থতার কারণে স্টেশনারি টিমের সাথে গোলশূন্য ড্র করে একরাশ হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। পরদিন পুলিশ টিম প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল প্রেসকে ২-০ গোলে হারিয়ে। চার খেলায় তারা তিন পয়েন্ট পেলেও প্রেস তিন খেলায় মাত্র এক পয়েন্ট পেয়ে তালিকার শেষ দল হিসেবে অবস্থান করছিল। পুলিশের গফুর ও সাত্তার দুটি গোল করে দলকে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সহায়তা করেছিল। দিনের অপর খেলা যা আউটার স্টেডিয়ামে আজাদ স্পোর্টিং এবং পিডব্লিউডি টিমের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিলÑ তা ছিল উদ্দেশ্যহীন আর রাফ খেলার প্রদর্শন, যা দর্শকদের কাছে ছিল বিরক্তিকর। এক পয়েন্ট করে পেয়ে দু’দলই মাঠ ছেড়েছিল। ভিক্টোরিয়া নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী দল, বিশেষ করে দুর্বল স্টেশনারি দলের তুলনায়। তারপরও তাদেরকে দীর্ঘ ৫৫ মিনিট লড়াই করে বিপক্ষ গোলপোস্টের দুয়ারে ঢুকতে হয়েছিল। বিরতির ২০ মিনিটে রাইট আউট ইউসুফের কর্নার কিক বাতাসে বাঁক খেয়ে সরাসরি স্টেশনারির গোলপোস্টে ঢুকে পড়ে। গোলরক্ষক বাচ্চুর পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। কিছুক্ষণ পর আজিমের কাছ থেকে বল পেয়ে ইব্রাহিম সাবের গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করলে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলের জয় দিয়ে ২০-৫-৬৭ তারিখের খেলাটি শেষ করেছিল।
২০-৫-৬৭ ইং লিগের অপর খেলাটি ছিল আউটার স্টেডিয়ামে রহমতগঞ্জ বনাম রেলওয়ে পাইওনিয়ার। সে সময় ১নং আউটার স্টেডিয়াম ফুটবল খেলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছিল। সকাল থেকে বাইরের ছেলেপেলেদের এই মাঠে খেলা শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। রোদ-বৃষ্টির কোন বালাই নেই, খেলা আর খেলাÑ মাঠের জীবন শেষ। তার ওপর লিগের খেলা। মাঠ সংস্কারেরও কোনো বালাই নেই। এখানেই খেলতে হবেÑ কর্তৃপক্ষের আদেশ, শেষ করতে হবে লিগ, নইলে ইজ্জত যাবে। খেলোয়াড়দের প্রতি নজর নেই, এই মাঠে খেলোয়াড়রা আঘাত পেতে পারে, পরোয়া নেই, খেলার মান নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই; ফুটবলের উন্নয়নে কারো চিন্তা নেই! একটাই তাদের চিন্তাÑ আসন আগলে রাখা। রহমতগঞ্জ রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। সেন্টার ফরোয়ার্ড বেলাল প্রথম গোল করে এবং পরপর আরো দু’গোল করে শাজাহান এবং গফুর। দ্বিতীয়ার্ধে রেলওয়ে পাইওনিয়ার একটি পেনাল্টি লাভ করলেও তাদের জেমস সেটি বাইরে মেরে দলকে গোলবঞ্চিত করে।
২১-৫-৬৭ তারিখে আমাদের ক্লাবে (ঢাকা মোহামেডান) একটা উৎসব উৎসব ভাব লক্ষ্য করলাম। নতুন কমিটি হয়েছে। ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ক্লাব সভাপতি মঈনুল ইসলামসহ আরো ১১ জন কর্মকর্তা যারা ১৯৬৭-৬৮ সালের জন্য ক্লাব পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।
সহ-সভাপতি সর্বজনাব লতিফুর রহমান, মোখলেসুর রহমান, এটিএমএফ করিম, আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম এবং সৈয়দ জিয়াউল আহসান। জেনারেল সেক্রেটারি- সৈয়দ মফিজউদ্দিন। জয়েন্ট সেক্রেটারি- মোল্লা আবদুল মজিদ এবং কে এ খালেক। ট্রেজারার আবুল হাশেম খান। চেয়ারম্যান ফুটবল কমিটি- শাহজাহান। ফুটবল সেক্রেটারি -কাজী শামসুল ইসলাম।
২২ মে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি খেলা। শক্তিশালী দুটি টিমের খেলা। একটি উচ্চমানের এবং জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা দেখার আশা নিয়ে প্রচুর দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন কিন্তু দু’টিমই সেদিন উপহার দিয়েছিল উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন আর নিম্নমানের খেলাÑ যাতে স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক-সমর্থকরা মর্মাহত এবং হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। দু’টিমের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের কাছ থেকে যেমন এলোমেলো খেলা আশা করেনি, তেমনি তাদের কাছ থেকে বল প্রয়োগ করে রাফ খেলাও প্রত্যাশা করেনি কেউ।
খেলার শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স তাদের বামদিক দিয়ে লেফট আউট তসলিমের মাধ্যমে আক্রমণ চালায়। তসলিম বল নিয়ে ইপিআইডিসির সীমানায় ঢুকে গোল পোস্টে কিক নিতে গেলে ব্যাক আমিন বাধা দিলে বল গোলপোস্টের বাইরে চলে যায়। এরপরই ইপিআইডিসির লেফট ইন জব্বর একক প্রচেষ্টায় দু’তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়েও দলের অন্য খেলোয়াড়দের সহযোগিতার অভাবে গোল করতে ব্যর্থ হয়। খেলার ২০ মিনিটে ওয়ান্ডারার্স এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ পেয়েছিল, ডান পাশ থেকে আনসারের লব হেড করার কিংবা ফাঁকা যায়গা থেকে কিক নেয়ার মত কোন খেলোয়াড় সময়মত সেখানে পৌঁছাতে না পারায়। আবারও তসলিম ইপিআইডিসির গোলরক্ষককে একা পেয়েও কিক নিতে দেরি করায় গোলরক্ষক হাকিম ডাইভ দিয়ে তসলিমের পা থেকে বল ছিনিয়ে নেয়। গোল মিস আর খেলোয়াড়দের শক্তি প্রয়োগ করে এলোমেলো খেলা দেখে দর্শকরা অতিষ্ঠ হয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে চিৎকার দিচ্ছিলেন। এমনি সময় হাফ টাইমের বাঁশি তাদেরকে স্বস্তি এনে দিয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমেই ওয়ান্ডারার্স গোল পেয়ে যায়। তসলিম বল নিয়ে দ্রুতগতিতে বিপক্ষ সীমানায় ঢুকে ক্রশ করে রাইট আউট ধর বল পেয়ে পোস্টে কিক নিতে গেলে ইপিআইডিসির লেফট ব্যাক সাইফুদ্দিন বাধা দেয়, বল তার পায়ে লেগে চলে যায়। ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা রাইট-ইন সাদেকের কাছে আর সে সুযোগের সঠিক ব্যবহার করে ওয়ান্ডারার্সকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। ওয়ান্ডারার্স আরও দুটো গোলের সুযোগ পেয়েছিলÑ যা সাদেক গোল করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে আনসারের বানিয়ে দেয়া বল গোলপোস্টে একা গোলরক্ষককে পেয়েও গোল করতে না পারাটা ছিল অমার্জনীয়। ইপিআইডিসি টিমও গোল শোধ করার চেষ্টা চালায় এবং ২২ মিনিটে সুযোগও এসেছিল। রাইট আউট সলিমুল্লাহ দ্রুতগতিতে বল নিয়ে ওয়ান্ডারার্সের বক্সে ঢুকে গোলমুখে রাইট-ইন হাশেমকে দিলে হাশেম বল ধরার আগেই ওয়ান্ডারার্সের গোলরক্ষক ফেরদৌস ডাইভ দিয়ে বল তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। খেলা প্রায় শেষদিকে ওয়ান্ডারার্সের রক্ষণভাগের ভুল বোঝাবুঝির জন্য হাশিম ফেরদৌসকে পরাস্ত করে একটি ‘গডগিফটেড’ গোল পেয়ে যায়; সে সাথে দলকে হারের হাত থেকে রক্ষা করে ১-১।
ওয়ান্ডারার্সের খেলোয়াড় : ফেরদৌস (গোলরক্ষক), আফাজ, নবী বখশ এবং আসলাম, রিয়াজ ও ইসমাইল রুশো, ধর আনসার, সাদেক, আলাউদ্দিন এবং তসলিম।
ইপিআইডিসির খেলোয়াড় : হাকিম (গোলরক্ষক) আমিন গফুল বেলুচ এবং সাইফুদ্দিন, আলী হাফিজ ও মুসা, সলিম উল্লাহ, হাশিম, বদরুল জব্বর এবং গাজী।
ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস দু’টিম মিলে ৬ গোল করেছিল কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। ২৩ মে স্টেডিয়ামে তারা ৩-৩ গোলের ড্র করেছিল। প্রথমার্ধে ওয়ারী দাপট দেখালে দ্বিতীয়ার্ধে ছিল ফায়ারের কর্তৃত্ব। ওয়ারী চার ম্যাচ খেলে একটিও জয়ের মুখ দেখতে পায়নি। ৩টি ড্র আর একটি হেরেছে, অন্যদিকে ফায়ার খেলেছে পাঁচটি ম্যাচÑ একটি জয়, তিনটি ড্র আর একটি হার। সমমানের দুটি টিম এবং খেলাও খেলেছে বেশ উন্নতমানের, যা দর্শকরা বেশ উপভোগ করেছেন। ওয়ারী শুরুটা খুব ভালভাবেই করেছিল। ফায়ারের ওউপর চাপ সৃষ্টি করে খেলে ১০ মিনিটে গোলের একটি সুযোগ আদায় করে নেয়। কিন্তু টি. চৌধুরীর গোলপোস্টে মারা শটটি বারপোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে যায়। রাইট আউট টি. চৌধুরী তার ইন জামির আক্তারকে একটি বল বানিয়ে দিলে সে ফায়ারের গোলপোস্টে কোণাকুণি মারে, বল বারপোস্টে লেগে কাছেই দাঁড়ানো মাহমুদের কাছে চলে যায়। কিন্তু সে মারতে ব্যর্থ হয়; তার আগেই বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় বল ক্লিয়ার করে দেয়। ফায়ারের সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিন এবং লেফট-ইন আশরাফের সম্মিলিত আক্রমণের একটি বল তপন সেভ করে। বক্সের ভেতর ফায়ারের স্টপার আইনুল হ্যান্ডবল করলে ওয়ারীর রাইট হাফ নজর পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ার্ধে ফায়ার সার্ভিস গোল শোধ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় এবং রাইট আউট মুনীরের পাশ থেকে শরফুদ্দিন গোল করে দলকে সমতায় ফেরায় (১-১)। জেতার জন্য দু’টিমই আক্রমণ করে খেলতে থাকে। খেলায় যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি খেলার আকর্ষণও বৃদ্ধি পায়। টি. চৌধুরীর বানিয়ে দেয়া পাশে জামিল আখতার গোল করে আবারও দলকে এগিয়ে দেয় ২-১। গোল খেয়ে ফায়ার হতাশ হয়ে পড়ে এবং কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে খেলতে থাকে। এ সুযোগে ওয়ারী ফায়ারের ওপর আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং এরই ধারাবাহিকতায় টি. চৌধুরী গোলপোস্টে সজোরে কিক করে যা গোলরক্ষক সীতাংশুর হাত ফসকে বল কাছেই দাঁড়ানো ভুট্টোর কাজে গেলে সে আলতো টোকা দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দেয় ৩-১। গোল খেয়ে ফায়ার আরেকবার চেষ্টা চালায় গোলের ব্যবধান কমানোর এবং ২৮ মিনিটে সুযোগ আসে আশরাফ এবং শাহাবুদ্দিনের সম্মিলিত আক্রমণ শাহাবুদ্দিনের গোলের মাধ্যমে (৩-২)। এ সময় খেলা বেশ জমে ওঠে। ফায়ার তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখে ওয়ারীকে কোণঠাসা করে রাখে, তাতে ওয়ারী বেসামাল হয়ে পড়ে। তাদের রাইটব্যাক নুরুল ইসলাম বক্সের ভেতর তাড়াহুড়ো করে বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে হ্যান্ডবল করে বসে। ফায়ারের লেফট-হাফ সামাদ পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ৩-৩ গোলের সমতায় ফেরায়।
ওয়ারীর খেলোয়াড় : তপন (গোলরক্ষক), নুরুল ইসলাম-মোহাম্মদ হোসেন ও সালামাত উল্লাহ, নজর ও খলিল, টি. চৌধুরী, জামিল আক্তার ভুট্টো, এইচ খান এবং মাহমুদ।
ফায়ারের খেলোয়াড় : সিতাংশু (গোলরক্ষক), মুজিবর রহমান, আইনুল ও আবুল, দিপু ও সামাদ, মুনীর, শরফুদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, আশরাফ এবং আরমান।
রহমতগঞ্জ প্রথম পয়েন্ট খুইয়েছিল দুর্বল প্রেসের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। রহমতগঞ্জ জয়ের জন্য সবরকম সুযোগ পেয়েও জয়লাভ করতে পারেনি তাদের আক্রমণভাগের ব্যর্থতার কারণে। বিশেষ করে তাদের রাইট আউট নাজির একাই ৩টি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করেছিল। এর মধ্যে গোলরক্ষক মাখনকে একা পেয়েও বল বাইরে মেরেছে, তার জন্য তাকে ক্ষমা করা যায় না। প্রেসের রক্ষণভাগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রহমতগঞ্জের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করেছে। প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল গোলশূন্যভাবে।
দ্বিতীয়ার্ধের চিত্র ছিল ভিন্ন। প্রেস প্রথম থেকেই রহমতগঞ্জের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে এবং ২০ মিনিটে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড এআর খান বল নিয়ে দ্রুতগতিতে রহমতগঞ্জের সীমানায় ঢুকে পড়ে। রহমতগঞ্জের লেফট-ব্যাক হাসনাত তাকে আটকাতে না পেরে জার্সি ধরে টেনে রাখে। যার ফলে রেফারি মুনীর হোসেন পেনাল্টির নির্দেশ দেন।
প্রেসের এরশাদ পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। গোল খেয়ে রহমতগঞ্জ খেলার ছন্দ হারিয়ে এলোমেলো খেলতে থাকে। কিছু সময় পর দুই ইন সুলতান ও শাহজাহানের নেতৃত্বে পুরো আক্রমণভাগ গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত শাহজাহানের গোলেই রহমতগঞ্জ পূর্ণ পয়েন্ট খোয়ানো থেকে বেঁচে যায়। ১-১ গোলের ড্র নিয়ে প্রেস খুশিমনে মাঠ ত্যাগ করে।
১ ফেব্রুয়ারি ২০১২
(একানব্বই)
লন্ডন হকি ফেসটিভ্যালে পাকিস্তান হকি দলের অংশগ্রহণ এবং অস্ট্রেলিয়া জাতীয় হকি দলের পাকিস্তান সফরকে সামনে রেখে দু’সপ্তাহের জন্য প্রাক-বাছাই ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়েছিল। সমগ্র পাকিস্তান থেকে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য যে ৫৬ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করা হয়েছিল (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে), তাদেরকে প্রাক-বাছাই ট্রেনিং ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমি ছাড়াও তিনজন স্ট্যান্ডবাই খেলোয়াড় আব্দুস সাদেক, ইব্রাহিম সাবের এবং গোলরক্ষক রঞ্জিত দাসকে ক্যাম্পে যোগদানের জন্য ডাকা হয়েছিল।
ঢাকায় তখন ফুটবল লিগ খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের পক্ষে আমি প্রথম ম্যাচ খেলেও ফেলেছিলাম। এমন সময় হকি ক্যাম্পের সংবাদ পেলাম আমাকে ক্যাম্পে যোগ দিতে হবে। এ অবস্থায় আমাকে পেশওয়ার ছুটতে হয়েছিল। পেশওয়ারের ইসলামিয়া কলেজে ক্যাম্প করা হয়েছিল। শহর থেকে কিছু দূরে বিশাল এলাকাজুড়ে ইসলামিয়া কলেজ, সবুজ গাছপালার মাঝে মোগল স্থাপনার ধাঁচে নির্মিত তাদের প্রধান কলেজ বিল্ডিং, কলেজের হোস্টেলে হকি ক্যাম্প, পাশেই মাঠ, সুন্দর পরিবেশ পড়াশোনা, খেলাধুলার জন্য আদর্শ স্থান।
১৫ মে থেকে ট্রেনিং শুরু হয়েছিল। ক’দিন আগেই হকি শেষ করে এক সপ্তাহের মধ্যে ফুটবল লিগ খেলতে মাঠে নেমে পড়তে হয়েছিল; নিজেকে খেলার জন্য তৈরি করতে পারিনি, আবার ফুটবল ছেড়ে ক্যাম্পে হকি ধরতে গিয়ে ওলট-পালট লাগছিল। আসলে হকি-ফুটবল কোনো খেলার জন্যই নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করার সময়-সুযোগ পাইনি। তবে সব সময় খেলার মধ্যে ছিলাম বলে ফিজিক্যাল ফিটনেসে সমস্যা হয়নি।
ক্যাম্প কমান্ডেন্ট মেজর আব্দুল হামিদ, অলিম্পিয়ান, পাকিস্তান দলের সাবেক ক্যাপ্টেন এবং তার সাথে কোচ ছিলেন লতিফ মীর, আব্দুর রশিদ, শেখ রহমতউল্লাহ, এজি খান এবং আখতার হোসেন। সমগ্র পাকিস্তানের বাছাই করা খেলোয়াড়। প্রত্যেক পজিশনে ৪-৫ জন করে দক্ষ-অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, নিজেদের সেরাটা দিয়ে সবার সেরা হওয়ার চেষ্টা। ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রাইটআউট পজিশনেও আমরা চারজন ছিলাম। খালেদ মাহমুদ এবং ফারুক খান দুজনই পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছে। খালেদ মাহমুদ পাকিস্তান দলকে সে সময় নেতৃত্ব দিচ্ছিল। খালেদ মাহমুদ কাস্টমসের খেলোয়াড় ব্যতীত আরও একজন কাস্টমসের খেলোয়াড় রাইট আউট পজিশনে আমাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল, তার নাম ইসমাইল।
সকাল-বিকাল দু’বেলা জোর ট্রেনিং। সকালে ফিজিক্যাল ফিটনেস আর টেকনিক্যাল ট্রেনিংটা সামাল দিলেও বিকেলের ট্রেনিংটা ছিল খুবই সিরিয়াস, বিশেষ করে প্র্যাকটিস ম্যাচ। প্রতিদিনের পারফর্মেন্স তীক্ষèভাবে লক্ষ্য করতেন ক্যাম্প কমান্ডেন্ট। তার রিপোর্টকে সিলেকশন কমিটি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমার রাইট আউট পজিশন অনেকটা পরুনির্ভরশীল। রাইট ইন এবং রাইট হাফ সহযোগিতা না করলে একা একা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা কঠিন। তাই অনেক সময় পাঞ্জাব, করাচি কিংবা টিমের খেলোয়াড় হিসেবে একে অন্যকে সহযোগিতা করার সুযোগ থাকে, সে হিসেবে আমি একাই সাধ্যমত ভাল করার চেষ্টা করে যেতাম।
২৯, ৩০, ৩১ মে তিনদিন ট্রায়াল শেষে ৩৫ জনকে বাছাই করা হয়েছিল দ্বিতীয় পর্ব ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য। এখান থেকেই পরবর্তীতে ১৮ জনের চূড়ান্ত দল বাছাই করা হবেÑ যারা সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া দলের পাকিস্তান সফরে ৩টি টেস্ট ম্যাচে অংশ নেবে এবং অক্টোবর মাসের ১০-২২ লন্ডন হকি ফ্যাস্টিভেলে অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচন কমিটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ খান নির্বাচিত ৩৫ জনের নাম ঘোষণা করেছিলেন :
গোলরক্ষক : জাকির (রাওয়ালপিন্ডি), জাফর (রেলওয়ে), ইফতেখার (আর্মি) এবং ইসলাম (রেলওয়ে)।
রাইট ফুল ব্যাক : তানভীর দার (পিআইএ), এজাজ বাট (কাস্টমস), সাজ্জাদ (আর্মি),
লেফট ফুলব্যাক : তারিক আজিজ (সারগোদা) এবং রিয়াজউদ্দিন (পিআইএ)।
রাইট হাফ : রশিদ (আর্মি), আনোয়ার শাহ (রেলওয়ে) ও দেলোয়ার (লাহোর)।
সেন্টার হাফ : সাঈদ আনোয়ার (পিআইএ), রিয়াজ (আর্মি) এবং কাইয়ুম নিয়াজী (করাচি)।
লেফট হাফ : ফাজাল (পিআইএ), গুলরেজ (কাস্টমস) এবং আখতার (রেলওয়ে)।
রাইট আউট : খালেদ মাহমুদ (কাস্টমস) এবং বশীর আহমেদ (ইস্ট পাকিস্তান)।
রাইট ইন : আশফাক (আর্মি), আমান উল্লাহ (পেশাওয়ার), খুরশীদ আজম (রেলওয়ে), রশিদ (ডিআই খান) এবং ইসলাহ (করাচি)।
সেন্টার ফরোয়ার্ড : তারিক নিয়াজী (পিআইএ), মোদাসসির (রাওয়ালপিন্ডি), ফারুক মীর (লাহোর), কাসানী (কাস্টমস)।
লেফট ইন : লাইক (কাস্টম), আসাদ মালিক (পিআইএ), রশিদ মালিক (লাহোর)।
লেফট আউট : জাহাঙ্গীর বাট (কাস্টমস), মাহবুব (ডিআই খান) এবং রশীদ (পিআইএ)।
২৬ মে ফায়ার সার্ভিস ওয়ান্ডারার্সকে ৩-০ গোল করে চমকে দিয়েছিল আর সে সাথে তাদের শরফুদ্দিন মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেছিল। ওয়ান্ডারার্স এই প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছিল। তারা ৪ ম্যাচে দুটি জয় এবং একটি ড্র করে। ফায়ার সার্ভিস ভাল খেলেই জয় পেয়েছিল, বিশেষ করে তাদের রাইট ইন শরফুদ্দিন চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল, যার জন্য পরদিন মর্নিং নিউজ পত্রিকা লিখেছিল : ‘ঝযধৎভঁফফরহ’ং নড়ড়ঃং ধঢ়ঢ়বৎধৎবফ ঃড় যধাব যধফ ঃযধঃ ঃড়ঁপয ড়ভ সধমরপ ধনড়ঁঃ রঃ. ঞড়ি ড়ভ ঃযৎবব মড়ধষং ঃযধঃ যব ংপড়ৎবফ বিৎব ঃৎঁষু সধমহরভরপবহ ড়হবং. ঞযবংব ঃড়ি বিৎব ঃযব ংবপড়হফ ধহফ ঃযব ঃযরৎফ, ইড়ঃয মড়ধষং নবরিষফবৎববফ ঃযব ধিহফবৎং শববঢ়বৎ, ংযধহঃড়.’
ওয়ান্ডারার্স দলের গোলরক্ষক সান্টু থেকে শেষ নম্বর তসলিম সবার খেলা ছিল হতাশ করার মত। তাদের দুই ইন হাবিব এবং আলাউদ্দিনের খেলা ছিল একেবারে জঘন্য। বিশেষ করে তাদের গোল মিসগুলো অমার্জনীয়। সাদেকও ছিল ব্যর্থ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনসার। তার গোলপোস্টে অনর্থক এবং লক্ষ্যহীন শটগুলো ছিল বিরক্তিকর।
ফায়ার খেলার পাঁচ মিনিটেই গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে চমকে দেয়। আশরাফ ও শরফুদ্দিনের মিলিত আক্রমণে শরফুদ্দিন জোরালো গ্রাউন্ড শট দ্বারা সান্টুকে পরাস্ত করে ১-০। গোল খেয়ে ওয়ান্ডারার্স নড়েচড়ে ওঠে এবং লেফট আউট তসলিম দ্রুতগতিতে বল নিয়ে ফায়ারের সীমানায় ঢুকে সেন্টার ফরোয়ার্ডকে দিলে বল ধরার আগেই গোলরক্ষক সীতাংশু ছোঁ মেরে বল নিয়ে নেয়। তসলিম আবারও বল নিয়ে বিপক্ষ পোস্টের কাছে সাদেকের উদ্দেশে বল দিলে সে দুর্বল শটে সীতাংশুকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। বল চলে যায় সামনে দাঁড়ানো আনসারের কাছে। শতভাগ গোলের চান্স সে জঘন্যভাবে বাইরে মেরে দলকে এবং সমর্থকদের হতাশ করে দেয়।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স ড্র করার একটা সুযোগ পায়। রুশোর সেরা পাস তসলিম দ্রুত বক্সে ঢুকে গ্রাউন্ডার শট মারে, বল সাইড বারে লাগে। আউদ্দিনের কাছে গেলে সে বাইরে মেরে সেই সুযোগটাও সে হাতছাড়া করে দেয়। ওয়ান্ডারার্সের গোল মিসের মধ্যে ফায়ারের ডানপ্রান্ত থেকে আসা একটি লব শরফুদ্দিন আলতো পা লাগিয়ে বল গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দেয় ২-০। ওয়ান্ডারার্স মরিয়া হয়ে ওঠে এবং গোল করার যতরকম পন্থাÑ সব অবলম্বন করতে থাকে কিন্তু ফায়ারম্যানরা রক্ষণাত্মক খেলা খেলে গোল না খাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। খেলার অন্তিম মুহূর্তে শরফুদ্দিনের বুটের ছোঁয়ায় আরও একটি গোল আসে। শরফুদ্দিন মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিকের গৌরব অর্জন করে; সে সাথে দলকে ৩-০ গোলের জয় এনে দেয়।
২৬ মে আউটার স্টেডিয়ামে লিগের অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে ৪-০ গোলে পরাজিত করেছিল। রেলওয়ে পাইওনিয়ার দলের তরুণ খেলোয়াড়রা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্পিটেড খেলা প্রদর্শন করেছিল, শুধু তারা অভিজ্ঞতা আর স্কোরারের অভাবে গোল পায়নি। ২৫ মিনিটে ভিক্টোরিয়ার জানি গোল করে এগিয়ে নিলে হাই তা দ্বিগুণ করে। কিবরতির পর আলী ইমামের দু’গোলের সুবাদে ৪ গোলের জয় পায় ভিক্টোরিয়া। পরদিন ওয়ারী এবং আজাদের খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। জামিল আখতারের বানিয়ে দেয়া বলে নিশিথ টোকা দিয়ে গোল করে ওয়ারীকে এগিয়ে দিলেও তাদের গোলরক্ষক আউয়াল এবং স্টপার মাহমুদ বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় আর বল ধীরে ধীরে গোলপোস্টে ঢুকে পড়ে। ১-১ ড্র। খেলার অবশিষ্ট সময় দু’দলই গোল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং তাদেরকে এক পয়েন্ট নিয়েই ফিরতে হয়। দিনের অপর খেলায় ইপিআইডিসি স্টেশনারিকে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করে। তাদের পক্ষে জব্বার একাই তিন গোল করেছিল; বাকি দু’গোল ছিল আব্দুল্লাহ আকবর এবং আসলামের। ২৮ মে মোহামেডান প্রেসের বিরুদ্ধে ৭-১ গোলের বড় জয় পেয়েছিল; তবে খেলার শুরুতে ৬ মিনিটেই মোহামেডান ভানুর দেয়া গোল খেয়ে চমকে গিয়েছিল। তারপর মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ার মত অবস্থা হয়েছিল প্রেসের। মোহামেডান এক এক করে পাঁচ গোল দিয়ে গোল খাওয়ার জ্বালাটা মিটিয়েছিল। এটাই ছিল লিগের সর্বাধিক গোলের জয়। গোল শোধ দিতে ৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল মোহামেডানকে। মুসা সমতা আনে (১-১)। পরের গোলটিও মুসার। দলের তৃতীয় গোল রাইট আউট জালু করলেও ৪র্থ গোলটিও মুসার এবং পঞ্চম গোলটি করে হাফিজউদ্দিন (৫-১) বিরতির পর জালু ৬ষ্ঠ গোল এবং দলের শেষ গোলটিও করেছিল মুসা (৭-১)।
কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজার দর্শনীয় এক হ্যাটট্রিকের সুবাদে আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেদিনের অপর খেলায় পিডব্লিউডি পুলিশকে ৪-০ পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এটা ছিল মৌসুমের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। সমমানের দুটো টিম, পুলিশ টিম ৪ গোল খাওয়ার মত নয়; আক্রমণভাগের ব্যর্থতাই তাদের হারের মূল কারণ। খেলার মাঝামাঝি সময় পিডব্লিউডি টিমের আবিদ গোল করে দলকে এগিয়ে নেয় এবং দশ মিনিটেই সুজা সেটাকে দ্বিগুণ করে। বিরতির পরই সুজা দলকে ৩-০ গোলের লিড এনে দেয়; সে সাথে তার হ্যাটট্রিকের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়। সহ-খেলোয়াড়দের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত সুজা হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল আর পিডব্লিউডিকে ৪-০ গোলের জয় উপহার দিয়েছিল।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২
(বিরানব্বই)
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব আরও একটি হোঁচট খেয়েছিল যখন রহমতগঞ্জ তাদের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২৯ মে স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শকের উপস্থিতিতে তারা মানসম্মত খেলা উপহার দিতে পারেনি। খেলার ৫ মিনিটেই ওয়ান্ডারার্স গোল করে এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তারা সেটাকে ধরে রাখতে পারেনি। ৩০ মিনিটে রহমতগঞ্জ শোধ করে দেয় (১-১)। এ ড্র’র ফলে ওয়ান্ডারার্স পাঁচ ম্যাচ খেলে চার পয়েন্ট হারায়। ফায়ার সার্ভিসের সাথে তারা হ্যাটট্রিকসহ ৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল আর ইপিআইডিসি এবং রহমতগঞ্জের সাথে ড্র করায় মোট চার পয়েন্ট হারিয়ে তারা লিগ চ্যাম্পিয়নের দৌড়ে পেছনে পড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে রহমতগঞ্জ পাঁচ ম্যাচ খেলে ২টিতে জয় এবং ২টিতে ড্র করে মাত্র ২ পয়েন্ট হারিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে অন্যদের সাথে সমানতালে এগিয়ে গিয়েছিল।
ওয়ান্ডারার্স এবং রহমতগঞ্জ দলের ম্যাচ রেফারি ননী বসাক খেলা শেষ করে প্যাভিলিয়নে ফিরছিলেন, পথে কিছু উচ্ছৃংখল সমর্থক তাকে আক্রমণ করে এবং পানি খাওয়ার বোতল দিয়ে আঘাত করে তাকে গুরুতর আহত করে। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। এ ব্যাপারে রমনা থানায় সাধারণ ডাইরিও করা হয়েছিল।
২১ মে’র অপর খেলাটিও ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিমের তরুণ খেলোয়াড়রা অভিজ্ঞ এবং পরিণত দল ফায়ার সার্ভিসকে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। তারা সমান তালে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করে খেলে এক পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। খেলার ৩২ মিনিটে ফায়ারের রাইট আউট আবুল কালাম সম্মিলিত আক্রমণে রেলওয়ে পাইওনিয়ারের গোলরক্ষক মহিউদ্দিনকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে লিড এনে দেয় এবং এই লিড হাফ টাইম পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে। বিরতির পর দু’টিমই জোর আক্রমণ চালিয়ে খেলতে থাকে। ফায়ার অভিজ্ঞ দল পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশি বেশি আক্রমণ চালালেও পরিশ্রমী রেল পাইওনিয়ার দলের খেলোয়াড়রা দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণও চালাচ্ছিল। ফলে খেলা বেশ জমে উঠেছিল। খেলার ধারা এভাবেই শেষের দিকে গড়াচ্ছিল। তখনই ফায়ারেরর রাইট ব্যাক মুজিবর বক্সের ভেতর হ্যান্ডবল করে বসে, সাথে সাথে রেফারি মীর কবির পেনাল্টির নির্দেশ দেন। রেল পাইওনিয়ারের লেফট ব্যাক গিয়াসউদ্দিন গোল করে ১-১ গোলে সমতা আনে। অবশিষ্ট সময় ফায়ার চেষ্টা করেও ফলাফল পরিবর্তন করতে পারেনি।
৩০ মে ইপিআইডিসি এবং ওয়ারী মিলে চার গোল করেছিল। কোন দলই একক প্রাধান্য বিস্তার করে খেলতে পারেনি। মাঠে ইপিআইডিসি টিমকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়বে। কিন্তু খেলার শুরুতেই ওয়ারী জামিল আক্তারের মাধ্যমে আক্রমণ চালায়। সে উঁচু করে রাইট আউট তপনকে বল দিলে সে গোল মুখে আজিজকে বানিয়ে দেয় কিন্তু গোলভীতু আজিজ গোলরক্ষক হাকিমকে একা পেয়েও গোল করতে পারেনি। এরপরই ইপিআইডিসির সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলামের একটি হেড গোলপোস্টের সামান্য বাইরে চলে যায়। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটের সময় ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ তপনের পাস থেকে দর্শনীয় একটি গোল করে দলকে ১-০ গোল এগিয়ে দেয়।
বিরতির পর আসলাম ওয়ারীর দু’তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে সুন্দর একটি গোল করে ১-১ গোলের সমতা আনে। কিছুক্ষণ পর ইপিআইডিসির রাইট আউট সলিমউল্লাহ বল নিয়ে দ্রুত ছুটে ওয়ারীর সীমানায় পৌঁছেই গোলপোস্টে দারুণ শট করেÑ যা বারুেপাস্টে লেগে কাছেই দাঁড়ানো হাশেমের কাছে গেলে সে পুশ করে বল জালে ঢুকিয়ে দেয় (২-১)। ওয়ারী গোল শোধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং আক্রমণ চালাতে থাকে। খেলার ধারাবাহিকতায় ওয়ারী একটি কর্নার লাভ করে। বিজেএমসির আলী হাফিজ কর্নারের বল ক্লিয়ার করার সময় বল নিজ গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দেয় (২-২)। অবশিষ্ট সময় দু’দলই গোল করার চেষ্টা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলী হাফিজের আত্মঘাতী গোলের মাসুল দিয়ে ইপিআইডিসি ওয়ারীর সাথে ২-২ গোলের ড্রকে মেনে নিয়েছিল।
৩০ মে ’৬৭ ঐতিহ্যবাহী মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাবের নতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটিতে আমিও একজন গর্বিত সদস্য ছিলাম। মাহুৎটুলী পুরনো ঢাকার একটি মহল্লা। মাহুৎটুলী ক্রীড়াঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। বিশেষ করে হকি খেলার সাথে এ নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাহুৎটুলী আমার জন্মস্থান। মাহুৎটুলী কবি শামসুর রহমানের জন্মস্থান। মাহুৎটুলী বহু ক্রীড়াবিদের জন্মস্থান। মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশ বিভক্তির কাছাকাছি সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের দিকে। মীর ওয়াজির আলী, ফখরুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, শামসুল ইসলাম সহোদর ভাইরা, সহপাঠী খেলোয়াড়, পাড়ার খেলোয়াড়দের নিয়ে নিজ বাড়ি ৭৯ নং মাহুৎটুলীতে মহল্লার নামে গঠন করেছিলেন ‘মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাব’। পঞ্চাশ দশকে ঢাকার মাঠে দাপটের সাথে ফুটবল-হকি খেলেছে মাহুৎটুলী ক্লাব। সে সময় ক্লাবের হয়ে যারা খেলতেন, তাদের মধ্যে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা চার ভাই ছাড়াও বাহরাম, আলমগীর আদেল, ইসমাইল, জাহাঙ্গীর আদেল, নুরু উল্লেখযোগ্য নাম। আরো অনেকের নাম এ মুহূর্তে মনে আসছে না।
ষাট দশকে মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাবের পারফরমেন্স ধীরে ধীরে নিচের দিকে যাচ্ছিল। ক্লাবের জৌলুসও হারিয়ে যাচ্ছিল। তখন মহল্লার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিরা ক্লাবের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। সে উদ্দেশ্যেই ৩০ মে ১৯৬৭ সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৬৭-৬৮ সালের জন্য মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাবের কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মদ সিদ্দিক, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউসুফ আলী চৌধুরী, এসএ মহসিন, আনোয়ার হোসেন, চান্দ সরদার, সাকী সরদার, জেনারেল সেক্রেটারি আলমগীর মো. আদেল, জয়েন্ট সেক্রেটারি শামসুদ্দিন আহমেদ, ট্রেজারার মোহাম্মদ খান, ফুটবল সেক্রেটারি শামসুল বারী, হকি সেক্রেটারি আরেফিন খান, ক্রিকেট সেক্রেটারি আতাউর রহমান। ১১ জন সদস্য : এফ কে হায়দার, সামিউদ্দিন খান, এএম সেরা, বশীর আহমেদ, মাহমুদুর রহমান মমিন, হেদায়েতুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, ফাজলুল হক, আকমল ইউসুফ, সৈয়দ মকবুল জামিল, লুৎফুল আলম, মঈনুল ইসলাম এবং জাহাঙ্গীর মো. আদেল ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
৩১ মে স্টেডিয়ামে ভিক্টোরিয়ার কাছে বিজি প্রেস হেরেছিল ৪-১ গোলে আর সেদিন আউটার স্টেডিয়ামে পুলিশ একমাত্র গোলে স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। প্রেস টিম শুরুটা ভালই করেছিল; এমনকি গোল করার সুযোগও তৈরি করেছিল কিন্তু দক্ষ স্ট্রাইকারের অভাবে গোল পায়নি; উল্টো খেলার মাঝিমাঝি সময় ভিক্টোরিয়ার লেফট-ইন জানির বানিয়ে দেয়া বল আলী ইমামের দেয়া গোল হজম করতে হয়েছিল। গোল খাওয়ার পর প্রেস আর দাঁড়াতে পারেনি। এরপরই আলী ইমামের পাসে টিপু গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পর প্রেসের জিল্লু একটি গোল শোধ দিলে কিছুক্ষণের জন্য প্রেস খেলায় প্রায় ফিরে আসে। ভিক্টোরিয়া জয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আক্রমণ করে খেলতে থাকে এবং অনুরূপ একটি আক্রমণে লেফট-ইন জানি গোল করলে দর্শকরা অফ-সাইড বলে চিৎকার করে রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকে এবং মাঠে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে; ফলে খেলা কিছু সময় বন্ধ থাকে। পুনরায় খেলা শুরু হলে ভিক্টোরিয়ার রাইট আউট কবির গোল দিয়ে গোলের সংখ্যা ‘হালিতে’ পূর্ণ করে এবং দলকে ৪-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলাটি ছিল ঢিলেঢালা, মেড়মেড়ে; খেলার মান ছিল তৃতীয় বিভাগের মতো। খেলার একমাত্র উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল এরশাদের গোল, যার দ্বারা পুলিশ স্টেশনারিকে ১-০ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
১ জুনে ওয়ান্ডারার্স আরও একটি পয়েন্ট হারিয়েছিল পিডব্লিউডির সাথে গোলশূন্য ড্র করে। একটি বোরিং ফুটবল খেলায় ওয়ান্ডারার্স তাদের পঞ্চম পয়েন্ট হারিয়ে সমর্থকদের লজ্জায় ভাসিয়েছিল। দু’দলের খেলা ছিল নিম্নমানের, বিশেষ করে দু’দলের গোল মিস ছিল আরও জঘন্যÑ যা দর্শকদের হতাশ করেছিল। খেলার শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স এগিয়ে যেতে পারতো কিন্তু লেফট-আউট মনজুর ধীরেনের কাছে থেকে বল পেয়ে সহজ একটি গোল মিস করে পোস্টের ওপর দিয়ে বল মেরে। এরপর পিডব্লিউডির আবুল হোসেন ভাগ্যদোষে গোল পায়নি, ওয়ান্ডরার্সের গোলরক্ষক পরাস্ত হলেও তার মারা শট ক্রসবারে লেগে ফেরত আসে। এভাবেই এলোমেলো খেলা দিয়ে শেষ হয় প্রথমার্ধ। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স গোল করার সুযোগ পেয়েছিল কিন্তুু তসলিম পোস্টে বল মারতে দেরি করায় সহজ একটি গোল পাওয়া থেকে ওয়ান্ডারার্স বঞ্চিত হয়েছিল। খেলার শেষ পর্যন্ত দু’টিমই গোল করার চেষ্টা চালায়; তবে পরিকল্পনাহীন আক্রমণ আর লক্ষ্যভ্রষ্ট শটনির্ভর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দু’টিমই লড়ে গিয়েছিল, ফলাফল শূন্য।
ওয়ারীর প্রথম জয়। আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় তারা ৫-০ গোলে রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে বিধ্বস্ত করেছিল। খুবই লজ্জাজনক পারফরমেন্স ছিল তরুণ রেলওয়ে পাইওনিয়ার খেলোয়াড়দের। আগের খেলাগুলো তারা যেভাবে সাহসিকতার সাথে খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল, তা ওয়ারীর সাথে বিসর্জন দিয়ে দেয়। অপরদিকে ওয়ারী খুবই পরিকল্পিত এবং দলীয় সমঝোতা দিয়ে বিপক্ষকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। জামিল আখতার ওয়ারীর পক্ষে প্রথম গোল করে এগিয়ে দিলে সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ পরপর দু’গোল করে দলকে বিরতির পূর্বে ৩-০ গোলের লিড এনে দেয়। বিরতির পর ওয়ারীর দ্রুতগতির রাইট আউট তপন দুটি গোল করে দলকে ৫-০ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
১ মার্চ ২০১২
(তিরানব্বই)
২ জুন। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের জন্য একটি বিশেষ দিন, যে দিনটিতে তারা ফুটবল লিগে প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল; সে সাথে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শিবলী হ্যাটট্রিক করার গৌরবও অর্জন করেছিল। ফায়ারম্যানরা আজাদের কাছ থেকে এরকম একটা ধাক্কা খাবে ভাবতে পারেনি। তুলনামূলকভাবে আজাদের চেয়ে ফায়ার সার্ভিস শক্তিশালী দল। খেলা দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা আজাদকে আমলেই নেয়নি, হাল্কাভাবে নিয়েছিল, ‘ওভার কনফিডেন্ট’-এর মোহে তারা আক্রান্ত ছিল। দু’দলই পরিকল্পনাহীন এলোমেলো খেলা খেলে সময় নষ্ট করছিল। তবে মাঠে আজাদ বেশি তৎপর ছিল এবং গোল করার সুযোগও সৃষ্টি করেছিল কিন্তু ফায়ারের রক্ষণভাগের সতর্কতা এবং দৃঢ়তার জন্য কোনপ্রকার অঘটন ঘটাতে পারেনি। খেলার প্রথমার্ধ ছিল গোলশূন্য।
বিরতির পর ফায়ারের তরফ থেকে প্রথম আক্রমণ শানিয়েছিল তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিন, সে মাঠ কামরানো শট মেরে আজাদের গোলরক্ষক আমানকে পরীক্ষা করেছিল। ফায়ার তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখে রাইট আউট আবুল কালাম ডান প্রান্ত দিয়ে আজাদের সীমানায় ঢুকে প্রচন্ড জোরে গোলপোস্টে কিক করলে বল অল্পের জন্য ক্রশবারের ওপর দিয়ে চলে যায়। আবারও আবুল কালাম একক প্রচেষ্টায় আজাদের বক্সে ঢুকে সুন্দর প্লেসিং শটে আমানকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। গোল খেয়ে আজাদের পুরো দল গোল শোধ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে বিশেষ করে ফরোয়ার্ডরা তাদের আক্রমণ জোরদার করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় বক্সের ভেতর রাইট আউট আবুল বল পেয়ে পোস্টে শট চালায় কিন্তু বল বারপোস্টে লেগে খেলায় ফেরত আসে এবং আজাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শিবলীর কাছে গেলে সে টোকা দিয়ে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয় (১-১)। গোল শোধ করার পর আজাদের আক্রমণ জোরদার হয়ে ওঠে। নজরুলের দেয়া থ্রু পাস শিবলী ধরে চমৎকার গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। ফায়ার পিছিয়ে পরে মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। শরফুদ্দিনের একটি লব ধরে সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিন পোস্টের ওপর দিয়ে মেরে একটি সহজ গোল মিস করে। খেলা প্রায় শেষের দিকে ফায়ারের আক্রমণ অব্যাহত, এমনি একটি কাউন্টার অ্যাটাক থেকে লেফট-আউট বাটু বল পেয়ে তা সুন্দরভাবে বানিয়ে দিলে গোল করতে শিবলীর কোন বেগ পেতে হয়নি। এই গোলের মাধ্যমে শিবলীর হ্যাটট্রিক পূর্ণ হয়, সেই সাথে আজাদও লিগের প্রথম জয়ের স্বাদ গ্রহণ করে (৩-১)। মৌসুমের তৃতীয় হ্যাটট্রিকের মালিক শিবলী।
আজাদের পক্ষে সেদিন যারা খেলেছিল : আমান (গোলরক্ষক), আহমেদ মোবাশ্বের এবং নূরুদ্দিন, গিয়াস এবং মালিক, আবুল হাসান, নাসিম, শিবলী, নজরুল এবং বাটু।
আউটার স্টেডিয়াম নং-১-এ অনুষ্ঠিত সেদিনে লিগের অপর খেলায় রহমতগঞ্জ ও পুলিশ নিজেদের মধ্যে পয়েন্ট ভাগ করে নিয়েছিল। সমমানের দুটি টিম। দু’টিমই প্রাধান্য বিস্তার করে জয়ের জন্য আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করে খেলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খেলাটিকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল। উপস্থিত দর্শকরা প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলেন মাঝারি মানের দুটি টিমের খেলায়। রহমতগঞ্জের রাইট-ইন শাজাহান তার নিজস্ব স্টাইলে গোল করে প্রমাণ করে যে, সে রহমতগঞ্জের প্রধান স্কোরার। গোল শোধের সব রকম চেষ্টা চালাতে থাকে পুলিশ এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যায় সেই সুযোগ যখন ডান প্রান্ত থেকে উড়ে আসা একটি বল লেফট ইন গফুর নিপুণভাবে রিসিভ করে গ্রাউন্ডার শট দ্বারা বিপক্ষ গোলরক্ষক অনাথকে পরাস্ত করে খেলায় ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়। ড্র-ই ছিল খেলার ফলাফল।
পুলিশ টিমের খেলোয়াড় তালিকা : মালাকার (গোলরক্ষক), আখতার, কায়েম এবং মোহাম্মদ আলী, নুরুল ইসলাম এবং ফজলুর রহমান এরশদা, আব্দুর রব, মফিজ, গফুর এবং সাত্তার।
ফুটবল লিগের সেদিনের (৩ জুন) একটি মাত্র খেলায় চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান দুর্বল স্টেশনারিকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল। স্লো এবং ডাল ম্যাচে শক্তিশালী মোহামেডান গোল মিসের মহড়া দিয়ে প্রথমার্ধ গোলশূন্য ড্র রেখে দ্বিতীয়ার্ধে ৩ গোল করতে সক্ষম হয়েছিল। খেলায় চোখে পড়ার মত বিষয় ছিল মোহামেডানের ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতা। ম্যাচের পুরোপুরি কর্তৃত্ব নেয়া মোহামেডান বিপক্ষ গোল সীমানায় পৌঁছে সফলতা না পাওয়াটা ছিল অস্বাভাবিক। অন্যদিকে স্টেশনারি অতিরক্ষণাত্মক খেলে মোহামেডানের গোল ঠেকাও নীতি অবলম্বন করে সফল হয়েছিল। তদুপরি তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াস মোহামেডানের সীমানায় হানা দিয়ে গোলরক্ষক রানাকে চমকে দিয়েছিল, কোন অঘটন ঘটেনি। বিরতির পরও অর্ধেক সময় কেটে গিয়েছিল, তখনও কোন গোল হয়নি, এমনি যখন অবস্থা তখন মুসা তার একক প্রচেষ্টায় স্টেশনারির দু’তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে তার নিজস্ব স্টাইলে প্লেসিং শট দ্বারা গোলরক্ষক বাচ্চুকে পরাস্ত করলে মোহামেডান শিবির হাফ ছেড়ে বাঁচে। এর কিছুক্ষণ পর একটি সুযোগ পেয়ে আবদুল্লাহ পোস্টে কিক করলে জটলায় দাঁড়ানো ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে বাচ্চুকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়িয়ে যায় (২-০)। খেলার শেষ মুহূর্তে শামসুর বানিয়ে দেয়া বলে হাফিজউদ্দিন গোল করে মোহামেডানকে ৩-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে দেয়।
ইপিআইডিসি প্রমাণ করেছিল যে, তারা ফায়ারম্যানদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ৪ জুন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের খেলায় তারা ফায়ার সার্ভিসকে ৫-১ গোলে পরাজিত করেছিল। সব গোলই প্রথমার্ধে হয়েছিল। ইপিআইডিসি একনাগাড়ে চার গোল করার পর ফায়ার এক গোল শোধ করেছিল। এ লজ্জাজনক পরাজয়ের জন্য ফায়ারের ডিফেন্স দায়ী, বিশেষ করে মজিবর, আইনুল এবং জলিলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে। যে ফায়ার দল চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে প্রশংসিত হয়েছিল, তারাই ইপিআইডিসির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল। রোববার ছুটির দিনে অনেক দর্শক মাঠে এসেছিল কিন্তু নিম্নমানের খেলায় কোনরকম উত্তেজনা বা আকর্ষণ না থাকলেও রাফ খেলার প্রবণতা দু’টিমেই ছিল আর সেজন্য রেফারি ঈশা খানকে বেশ কয়েকবার দু’দলের খেলোয়াড়দের সতর্ক করে দিয়েও মাঠের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। ইপিআইডিসি জয়ের লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছিল আর খেলা শুরুর দুই মিনিটেই রাইট-ইন প্রতুল প্রচন্ড শটে গোলরক্ষক সীতাংশুকে পরাজিত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। গোল খেয়ে ফায়ার কিছুটা সজাগ হয়ে আক্রমণ চালাতে এগিয়েও গিয়েছিল কিন্তু তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকায় কোন আক্রমণই রূপ নেয়নি বরং ১০ মিনিটের সময় রাইট ব্যাক আমিনের ভলি করা বল হাশিম দক্ষতার সাথে বল আয়ত্তে এনে সুন্দর একটা গোল করে দলকে ২-০ গোলে লিড এনে দেয়। ১৮ মিনিটে আসলামের দুর্দান্ত শট সীতাংশুকে সেভ করার কোন সুযোগ না দিয়ে সোজা জালে জড়িয়ে যায়। সেই সাথে ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। ২৩ মিনিটে ইপিআইডিসির একটি আক্রমণ ফায়ারের ডিফেন্স বিপদমুক্ত করতে গিয়ে বল ইপিআইডিসির লেফট হাফ মুসার কাছে চলে যায়। আর মুসা দেরি না করে বলে আলতো টোকা মেরে পোস্টে ঢুকিয়ে দিয়ে গোলের সংখ্যা হালিতে পূর্ণ করে (৪-০)। বিরতি ৭ মিনিট থাকতে ফায়ার আচমকা একটি আক্রমণ চালায় এবং তাদের আশরাফ এই আক্রমণ থেকেই গোল করে ব্যবধান কমায় (৪-১)। হাফ টাইমের বাঁশি বাজার পূর্ব মুহূর্তে আসলাম গোল করে দলের গোলসংখ্যা বৃদ্ধি করে (৫-১)।
দ্বিতীয়ার্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ফায়ারের গোলরক্ষক সীতাংশু খেলার মাঠেই অসুস্থ হয়ে মাঠ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল আর ফায়ারকে বাকি সময় ১০ জন নিয়ে খেলতে হয়েছিল। সীতাংশু জ্বর নিয়ে খেলতে নেমেছিল, মনে করেছিল মাঠে নামলে জ্বর সেরে যাবে কিন্তু জ্বর আরও বেশি হওয়ায় তাকে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। তার জায়গায় রাইট হাফ আবুল হাসান গোলপোস্ট সামলাতে এগিয়ে এসেছিল এবং ইপিআইডিসির দূর থেকে পোস্টে মারা বল সেভও করেছিল।
বিজি প্রেস লিগে প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল। আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দিনের অপর খেলায় তারা রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিমকে ৪-১ গোলে পরাজিত করেছিল। বিরতির পূর্বেই প্রেসম্যানরা ২ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। খেলায় আকর্ষণীয় কোন ঘটনা না থাকলেও প্রেস সেদিন ভাল খেলেই জয়লাভ করেছিল। পাইওনিয়ার আগের ম্যাচগুলোতে যে খেলা খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল, সে খেলা আর খেলতে পারছিল না। খেলা শুরুর ৫ মিনিটেই প্রেসের সেন্টার ফরোয়ার্ড খালেক গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। মোখতার গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে (২-০)। বিরতির পর সামাদ দলের জন্য তৃতীয় গোল এনে দেয় (৩-০) পাইওনিয়ারের পক্ষে একটি মাত্র গোল শোধ দিতে পেরেছিল মনোজ। খেলার শেষদিকে দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড খালেজ দলের গোলের সংখ্যা হালিতে পূর্ণ করে দলকে ৪-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
ভিক্টোরিয়া একমাত্র গোলে আজাদকে হারাতে পেরেছিল। জয়সূচক গোলটি এসেছিল ভিক্টোরিয়ার লেফট-আউট টিপুর বুট থেকে। ৫ জুনের খেলায় শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া ছিল অগোছালো, আত্মবিশ্বাসের অভাব স্কোরারের অভাব যদিও তারা খেলার ১৫ মিনিটে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে রেখেছিল। বিরতির পর আজাদ কিছু সময়ের জন্য নড়েচড়ে উঠেছিল। লেফট আউট নজরুল পরিশ্রম করে খেলে গোল করার দুটো সুযোগ তৈরি করেছিলÑ যা সফল হতে হতেও পারেনি। ভিক্টোরিয়াকেও আজাদের গোল সীমানায় হানা দিতে দেখা গেলেও আজাদের গোলরক্ষক এহতেশাম দক্ষতার সাথে সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছে। এহতেশামের সুন্দর গোল কিপিং সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। সেদিনের খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল কবির আইমেদের খেলায় অংশগ্রহণ। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন ভাইস ক্যাপ্টেন, রাইট আউট পজিশনের একজন চৌকস খেলোয়াড় যিনি দীর্ঘদিন ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হয়ে মাঠে নেমে পুরনো দিনের খেলার ঝলক কিছুটা দেখিয়ে উপস্থিত দর্শকদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি সেই কবির প্রমাণ করলেন যে, তিনি এখনও নতুন খেলোয়াড়দের কাছে তার অভিজ্ঞতা, বল নিয়ে স্পিড, স্ট্যামিনা এখনও অনুকরণীয়। খেলার ফলাফল শেষ পর্যন্ত ধরে রেখে ভিক্টোরিয়া জয়ের হাসি নিয়েই টেন্টে ফিরেছিল। #
১৬ মার্চ ২০১২
(চুরানব্বই)
মোহামেডানের বড় জয়, সেই সাথে মুসার হ্যাটট্রিক। স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৬ জুনের খেলায় পুলিশ ৭-০ গোলে পরাজিত হয়েছিল। খেলার ফলাফলই বলে দিচ্ছিল একতরফা খেলায় লজ্জাজনক হারের চিত্র। মোহামেডান সেদিন খুব পরিমিত এবং পরিকল্পিত আক্রমণ দ্বারা পুলিশকে কোণঠাসা করে পুরো মাঠে দাপটের সাথে বিচরণ করেছে। তারা আরো অধিক গোলে জয়লাভ করতে পারতো কিন্তু তারা আগ্রহ দেখায়নি। পুলিশ তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও মোহামেডানের দক্ষতা আর নৈপুণ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। চ্যাম্পিয়নদের পুলিশের গোলমুখ খুলতে ১৬ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল যখন গফুরের ঝড়ের বেগে শটটি মালাকারের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে জালে জড়িয়ে গিয়েছিল। ৭ গোল হজম করলেও মালাকার সেদিন বেশ অনেকগুলো গোল কৃতিত্বের সাথে সেভ করেছিল; নইলে তারা আরও বেশি গোলে হারতো। ২০ মিনিটে শামসু গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পূর্বে মুসা ৩২ এবং ৩৪ মিনিটে পরপর দু’গোল করে দলকে ৪-০ গোলে লিড এনে দেয়; সেই সাথে তার হ্যাটট্রিকের আভাস জানিয়ে দেয়। বিরতির পর পুলিশ পরিশ্রম করে খেলে দলকে গোছানোর চেষ্টা করে; এমনকি তারা আক্রমণ করে মোহামেডানের পোস্টেও হামলা চালায় কিন্তু সফল হতে পারেনি। মুসার হ্যাটট্রিকের জন্য দলীয় খেলোয়াড়রা গোল করতে আগ্রহী না হওয়ায় মোহামেডানের গোলসংখ্যা বাড়াতে পারেনি। ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর মুসা তার কাক্সিক্ষত গোলটি পেয়ে যায়, সেই সাথে হ্যাটট্রিকের তকমাটাও তার গলায় ঝুলিয়ে নেয়। মুসার সেটা ছিল প্রথম হ্যাটট্রিক এবং লিগের ছিল চতুর্থ হ্যাটট্রিক। খেলার শেষ মুহূর্তে রসুল বখশ দু’গোল করে মোহামেডানের ৭-০ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজার দুটো দর্শনীয় গোলের সাহায্যে পিডব্লিউডি রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় পরাজিত করেছিল। প্রথমার্ধ ছিল গোলশূন্য। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথমদিকেই দ্রুত দুটি গোল খেয়ে পাইওনিয়ারে তরুণ খেলোয়াড়রা ভেবাচেকা খেয়ে যায়; তারপরও তারা গোল শোধ করার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে কিন্তু ফলাফল অপরিবর্তিত অবস্থায় খেলা শেষ হয়।
৭ জুন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের খেলায় ইপিআইডিসি অতিসহজেই ৯-১ গোল বন্যায় ভাসিয়ে প্রেসকে পরাজিত করেছিল। প্রেস প্রথমার্ধে মাত্র ৩ গোল খেয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেয়েছিল ৬ গোল আর এটি হয়েছিল লিগের সর্বাধিক গোলের হার। খেলার ফলাফলই বলে দেয় খেলার চিত্র। প্রথমার্ধের ২৫ মিনিট প্রেস অত্যন্ত ভাল খেলেছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তাদেরকে মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা মাঠে জঘন্যভাবে ব্যর্থ হয়ে ইপিআইডিসিকে অর্ধডজন গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এতগুলো গোল হওয়া সত্ত্বেও কোন হ্যাটট্রিক হয়নি। খেলার শুরু থেকে ইপিআইডিসি প্রেসের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে এবং গোল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। প্রেসও তাদের গোল ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে কিন্তু ইপিআইডিসির হাশিমকে আটকানো সম্ভব হয়নি, সে ১২ মিনিটে প্রেসের গোলমুখ খুলতে সক্ষম হয়েছিল (১-০)। ইপিআইডিসি অনবরত আক্রমণ চালিয়েও যখন সফল হতে পারছিল না, তখন লেফট ইন হাশিম আবারও গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির বাঁশি বাজার এক মিনিট আগে লেফট আউট গাজী গোল করে দলের গোলসংখ্যা ৩-০ গোলে উন্নীত করেছিল।
বিরতির পর প্রেস লড়াকু মনোভাব নিয়ে খেলতে শুরু করলেও ইপিআইডিসির শক্তির কাছে হার মানতেই হয়েছিল। প্রেসের পক্ষে ইপিআইডিসির গোলক্ষুধাকে নিভৃত করা সম্ভব হচ্ছিল না। রাইট ইন প্রতুল আসলামের পাস থেকে গোল করে দলকে ৪-০ এগিয়ে দেয়। গাজী আরও একটি গোল করে গোলের সংখ্যা ৫-০তে নিয়ে যায় আর সেটা অর্ধডজন পূর্ণ করতে জামানকে মাত্র ১ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
লাল মোহাম্মদের লব ধরে গাজী তার তৃতীয় গোল করলে ইপিআইডিসি ৭-০ গোলের বড় ব্যবধানে জয় নিশ্চিত করে। খেলা প্রায় শেষের দিকে ইপিআইডিসির স্টপার গফুর বেলুচ বক্সের ভেতর হ্যান্ডবল করলে প্রেসের এরশাদ পেনাল্টি মারতে কোন ভুল করেনি (৭-১)। শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে গোল করে প্রেস গোল উৎসবে মেতে উঠেছিল কিন্তু ইপিআইডিসির সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলাম দ্রুত পরপর দুটি গোল করে তাদের ক্ষণিকের আনন্দকে স্তব্ধ করে দিয়ে দলকে ৯-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিলÑ যা ছিল মৌসুমের অধিক গোলের জয়।
ইপিআইডিসির টিমে সেদিন যারা খেলেছিল : হাকিম (গোলরক্ষক) আমিন, গফুর বেলুচ এবং সাইফুদ্দিন, লাল মোহাম্মদ এবং আলী হাফিজ, এস জামান, প্রতুল আসলাম, হাশিম এবং গাজী।
রেফারি খেলা শুরু করার জন্য বাঁশি দিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু দু’টিমের কোন টিমই খেলার জন্য এগিয়ে আসছিল না; যদিও দু’টিমই মাঠে উপস্থিত ছিল। ওয়ারী মাঠের ভেতর ঘোরাফেরা করছিল আর রহমতগঞ্জ মাঠের বাইরে ওয়ার্মআপ করছিল। রেফারি তার দু’জন সহকারী নিয়ে প্রস্তুত। দুই ক্যাপ্টেন বাঁশি শুনতে পায়নিÑ এমনি ভাব করে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিল, যা ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। নির্ধারিত সময়ের ২০ মিনিট দেরিতে আরম্ভ হয়েছিল ৮ জুন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের ওয়ারী বনাম রহমতগঞ্জের খেলাটি। রহমতগঞ্জের গোলরক্ষক অনাথ সময়মত মাঠে পৌঁছাতে না পারার জন্য দু’টিমের এ জঘন্য নাটকÑ যা ছিল ফুটবলের একটি কলংকময় ঘটনা।
দু’টিম মাঠে নামার পর চিত্রটি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। পূর্বে তাদের মধ্যে না খেলার যে মনোভাব, সেটি একেবারেই উবে গিয়েছিল। প্রথম থেকেই দু’টিম গোল করার জন্য আক্রমণ চালায়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যা গত দু’দিনের খেলা দেখে দর্শকরা নিরুৎসাহিত হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। অবশ্য এ খেলাটি বেশ উপভোগ করেছিলেন। রহমতগঞ্জের দিকে খেলাটি ঝুঁকেছিল এবং মনে হয়েছিল তারা পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে ফিরবে। তাদের দ্রুতগতির ফরোয়ার্ডরা একাধিকবার ওয়ারীর সীমানায় হানা দিয়ে তাদেরকে চেপে ধরেছিল এবং শাজাহানের মাধ্যমে সহজ দুটো গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত অল্পের জন্য গোলের মুখ দেখতে পায়নি। ওয়ারীর বিচ্ছিন্ন আক্রমণ কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দু’সীমানায় যখন হামলা হচ্ছিল, তখন শাজাহানের বানিয়ে দেয়া বলে রাইট আউট নাজির গোলরক্ষক তপনকে পরাজিত করলে রহমতগঞ্জ ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। লেফট-আউট নয়া গোল পোস্টে বল মারতে দেরি না করলে তাদের গোলসংখ্যা দ্বিগুণ হতো।
বিরতির বাঁশি বাজার আগে ওয়ারীর জামিল আখতারের দেয়া বক্সের ভেতরে একটি একশত ভাগ গোল করার বল সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ মিস করে দলকে সমতায় ফেরাতে পারেনি। তবে বিরতির পাঁচ মিনিটেই ভুট্টোর থ্রু থেকে বল পেয়ে রাইট-আউট তপন চৌধুরীর ঝড়ের বেগে শটটি অনাথকে পরাস্ত করে দলকে ১-১ গোলে সমতায় ফিরিয়েছিল। খেলার নিয়ন্ত্রণ ওয়ারীর কাছে চলে যায়। জামিল আখতারের শট পোস্টে প্রতিহত হয়ে বক্সে দাঁড়ানো নিশিথের কাছে গেলে সে টোকা দিয়ে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। ওয়ারী ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। রহমতগঞ্জ গোল শোধ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে থাকে, বিশেষ করে শাজাহান অক্লান্ত পরিশ্রম করে খেলে বিপক্ষ দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। নাজির ও নয়াকে সাথে নিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় নাজিরের পাস থেকে শাজাহান অত্যন্ত সুন্দর একটি গোল করে দলকে ২-২ গোলের সমতায় ফেরায়। জয়ী হতে দু’দলই সুন্দর ফুটবল উপহার দেয় কিন্তু দু’দলের রক্ষণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খেলে কোন অঘটন ঘটতে দেয়নি।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় স্টেশনারি ফায়ারকে রুখে দিয়েছিল। মাঠে ফায়ারের খেলোয়াড়দের ভীষণ ক্লান্ত এবং হতাশ দেখাচ্ছিল, যা তাদের খেলার মধ্যেও ফুটে উঠেছিল। তারা তাদের স্বাভাবিক খেলাটাও খেলতে পারছিল না। তাদের বিচ্ছিন্ন আক্রমণ বিপক্ষ দলকে পরাজিত করতে পারেনি। অন্যপক্ষ স্টেশনারি ফায়ারের দুর্বলতার সুযোগে তাদের ফরোয়ার্ডরা আক্রমণ করে বিপক্ষ রক্ষণকে চাপের মধ্যে রাখে। ফায়ারের ডিফেন্স সতর্কতার সাথে না খেললে স্টেশনারি জয় নিয়েই মাঠ ছাড়তো। গোলশূন্য ড্র ছাড়া খেলার আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।
ওয়ান্ডারার্সের ঘাম ঝরানো জয়। ৯ জুন স্টেডিয়ামে তারা ২-১ গোলে আজাদকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবকেও লিগ চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে ভাবা হয়েছিল কিন্তু এরই মধ্যে তারা পাঁচ পয়েন্ট হারিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে গিয়েছিল। তাদেরকে এগিয়ে যেতে হলে দলের শক্তি বাড়াতে হতো। বাম প্রান্তে তসলিম এবং ওয়ার্সী যারা এবছরই প্রথম লিগে অংশ নিচ্ছিল, তারা ভালই খেলছিল। ওয়ার্সী ছোটখাটো গড়নের খুব ছটফট আর গতিসম্পন্ন খেলোয়াড়। অল্প জায়গাতে বল ফাটানো, দ্রুত শরীরকে ঘুরানো ছিল তার বৈশিষ্ট্য। ওয়ান্ডারার্সের ডিফেন্স বেশ শক্তিশালী আর তাদের নির্ভরশীল গোলরক্ষক সান্টু রয়েছে। শুধু প্রয়োজন ছিল দক্ষ স্কোরারের।
আজাদ সেদিন খুবই চমৎকার খেলা প্রদর্শন করেছিল তাদের শক্তিশালী বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে। স্ট্যামিনায় ভরপুর আজাদের খেলোয়াড়রা অত্যন্ত পরিশ্রম করে সমান তালে লড়েছিল শক্তিশালী ওয়ান্ডারার্স দলের সাথে। বিশেষ করে আজাদের দীর্ঘদেহী স্টপার কাজী মোবাশ্বের হোসেন পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে বিপক্ষ দলের আক্রমণগুলোকে রুখে দিয়েছিল, তার জোরালো ট্যাকলিং, সময়মতো ইন্টারসেপ্ট ছিল অপূর্ব যার জন্য ওয়ান্ডারার্সের পক্ষে গোল করা সহজ হচ্ছিল না। আজাদের রাইট আউট আবুল ছিল সেদিন খুবই উজ্জীবিত, সে ওয়ান্ডারার্সের ডিফেন্সকে ব্যস্ত করে রেখেছিল।
বিরতির পূর্বে দু’দল দুটি অপ্রত্যাশিত গোল হজম করেছিল। খেলার মাত্র দু’মিনিটে আনসারের দেয়া পাসে জিয়া আজাদের পোস্টে দুর্বল শট মারলে গোলরক্ষক আমান বল ধরার জন্য প্রস্তুত কিন্তু দ্রুতগতিতে ওয়ার্সী ছুটে এসে বলে পা ছোঁয়ালে বল আমানের পাস দিয়েই পোস্টে ঢুকে যায় ১-০। ‘ফ্লুক’ গোল খেয়ে আজাদ গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং খুব তাড়াতাড়ি সুযোগও এসে গিয়েছিল শিবলির মাধ্যমে, সে ওয়ান্ডারার্সের পেনাল্টি বক্সের বাইরে একটি বল পেয়ে পোস্টে কিক চালায়।
সাটুর বুক বরাবর বল সহজভাবে ‘গ্রিপ’ (হাতে ধরতে) করতে গেলে বল সান্টুর হাত ফসকে জালে জড়িয়ে যায়। গোল শোধ করার পর আজাদ ওয়ান্ডারার্সের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে। এর জের ধরে তারা বক্সের বাইরে একটি ফ্রিকিক লাভ করে। দেবুর ফ্রি কিকটি ক্রসবারে লেগে ফিরে আসলে (পরাজিত) সান্টু এবং ওয়ান্ডারার্স হাফ ছেড়ে বাঁচে।
বিরতির পর ওয়ান্ডারার্স খেলায় ফিরে আসে এবং গোলের কয়েকটা সুযোগ সৃষ্টি করে, গোলও মিস করে। তাদের আক্রমণের ধারাবাহিকতায় জিয়া এবং ওয়ার্সী নিজেদের মধ্যে বল আদান-প্রদান করে আজাদের সীমানায় পৌঁছে বক্সের কাছে আনসারকে দিলে সে দ্রুততার সাথে আজাদের একজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বুলেটের মত শট দিয়ে আমানকে পরাস্ত করেছিল আর সেটাই ছিল ওয়ান্ডারার্সের ২-১ গোলের জয়।
একটি আত্মঘাতী গোল ঢাকা মোহামেডান কাবের লীগ চ্যাম্পিয়নশীপের স্বপ্নকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের প্রথম পর্বের শেষ খেলায় লীগ প্রত্যাশী দুটি দল মোহামেডান এবং ভিক্টোরিয়া ১২-৭-৬৩ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে তাদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফুটবল লড়াইয়ে নেমেছিল। দর্শকে ভরা স্টেডিয়াম খেলার গতি, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, দলীয় সমঝোতা, সুন্দর বল আদান-প্রদান আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ সব মিলিয়ে একটি উঁচু মানের ফুটবল খেলা উপভোগ করেছিল দর্শকরা। দু’দলের খেলোয়াড়রা মন উজাড় করে খেলছি সেদিন, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা বেশ জমে উঠেছিল, উপভোগ্য হয়েছিল। উত্তেজনা যেমন মাঠের ভেতর ছিল, তেমনি ছিল গ্যালারিতে। গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয়েছিল প্রথমার্ধ। দু’দলই গোল করার জন্য সব ধরনের কলাকৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছিল দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম থেকেই। মাঝামাঝি (দ্বিতীয়ার্ধের সময় ভিক্টোরিয়ার বামদিক দিয়ে একটি আক্রমণ আমাদের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়লে লেফট আউট বড় ইউসুফ তার দলের খেলোয়াড়দের উদ্দেশে সেন্টার করেÑ যা আমাদের ডিফেন্ডার কিয়ার করতে গিয়ে বল কাট করলে নিজ গোলে ঢুকে যায়, গোলারক্ষক আটকাবার সুযোগই পায়নি। গোল...। আমরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। গোলের কৃতিত্বটা ইউসুফের নামে ধরা হয়েছিল। খেলার বাকি সময় আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমরা গোলের দেখা পাইনি। ১-০ গোলে হেরে মাথা নিচু করে সন্ধ্যায় কাব টেন্টে ঢুকেছিলাম। দু’দলের খেলোয়াড় তালিকা
ভিক্টোরিয়া : গোলাম হোসেন (গোলকিপার), খোদা বক্স, কামিসা, হাসান, মুরাদ বকস, গফুর, ইউসুফ (জুনিয়র), আবদুল্লাহ, ওমর, আব্বাস এবং ইউসুফ (সিনিয়র)।
মোহামেডান : বলাই দে (গোলরক্ষক), জহির, দেবীনাশ, পিন্টু, আবিদ, রসুল বক্স, কবির, রহমত উল্লাহ, কাইয়ুম, বশীর এবং মুসা।
লীগ খেলার প্রথম পর্ব ঢাকা মোহামেডান ৪ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ করেছিল এবং ভিক্টোরিয়া কাব তখন কোন পয়েন্ট নষ্ট করেনি। রিটার্ন লীগের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব দুর্বল রেল দলের সাথে ২-২ গোলে ড্র (২৪-৭-৬৩)। ফিরতি লীগে আমরা ওয়ারী কাবকে ৫-০ গোলে (কাইয়ুম ৪, রসুল বক্স ১ গোল), প্রেস দলকে ৫-১ গোলে (কাইয়ুম ৩, সামাদ ১, প্রতাপ ১ গোল), রেল দলকে ৩-২ গোলে হারিয়েছিলাম। কাইয়ুম ২, রসুল বক্স ১ গোলের বিপরীতে এবং রেল দলের বশীর ও মেকওয়া গোল করেছিল। এখানে একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ করছি, হকি লীগ ম্যাচ খেলতে গিয়ে পেয়েছিলাম ইপিআর টিমের বশীরকে আর ফুটবল লীগে পেয়েছিলাম রেল দলের বশীরকে। আমরা তিনজনেই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। আজাদ স্পোর্টিং কাবকে আমরা ৭-১ গোলে পরাজিত করে আমাদের জয়ের ধারাকে বজায় রেখেছিলাম। সে খেলায় আমি ৩ গোল, কাইয়ুম ২ গোল, রসুল বক্স ও প্রতাপ ১টি করে গোল করেছিল এবং মারী দা আজাদের পক্ষে ১টি গোল শোধ দিয়েছিলেন। পরবর্তী খেলায় রহমত উল্লাহর দেয়া ২ গোলের সুবাদে মোহামেডান পিডব্লিউডিকে ২-০ গোলে হারায়। স্টেশনারী টিমকে আমরা ৪-১ গোলে হারিয়েছিলাম, যার মধ্যে কবির ভাই ২ গোল, কাইয়ুম ও আমি ১ গোল করেছিলাম এবং হোসেন আলী ১টি গোল শোধ করেছিল। পরবর্তী খেলায় কবির ভাইয়ের দেয়া একমাত্র গোলে আমরা পুলিশ টিমকে হারিয়ে আমাদের জয়ের চাকা সচল রেখেছিলাম। ইস্পাহানী আমাদের ওয়াকওভার দিলে পূর্ণ ২ পয়েন্ট পেয়ে এবং ঢাকা সেন্ট্রাল জেল টিমকে কাইয়ুম ২ গোল, প্রতাপ এবং আনসার ১টি করে গোল করলে আমরা ৪-০ গোলে জয় পেয়ে রিটার্ন লীগে কোন পয়েন্ট না হারিয়ে লীগের শেষের দিকে এগিয়ে যাই।
স্বাধীনতা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য ১০-১৪ আগস্ট পর্যন্ত লীগ খেলা বন্ধ ছিল। এ টুর্নামেন্টে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য আমার মনে নেই, তাই লেখা থেকে বিরত থেকে পরবর্তী লীগের খেলায় চলে যাই আর সেটা ছিল মোহামেডানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের সাথে ২২-৮-৬৩ তারিখে ফিরতি লীগের খেলা। ওয়ান্ডারার্স-মোহামেডান মানেই অন্যরকম খেলা, অন্যরকম পরিবেশ, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। এ পর্বেও আমরা ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিলাম, আমার ও মুসার গোলের বিপক্ষে সেকেন্দার ১টি গোল শোধ করতে পেরেছিল। আমরা আর কোন পয়েন্ট না হারিয়ে রিটার্ন লীগ শেষ করেছিলাম এবং ভিক্টোরিয়া শেষ করেছিল ৫ পয়েন্ট খুইয়ে। ১৯৬৩ সালে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল আর আমি সেই গর্বিত টিমের একজন সৌভাগ্যবান খেলোয়াড় ছিলাম। ভিক্টোরিয়া রানার্সআপ হয়েছিল। সেবার লীগে স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকের খেলা আমার ভাল লেগেছিল, আমাদের কাবের শামসুর কথা বলতেই হয়। আমার খেলোয়াড়ী জীবনে এত বড় টিমের এত বড় আইলসা (অলস), এত কম প্র্যাকটিস করে এত ভাল পারফর করা খেলোয়াড় আমি দেখিনি। সে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনের খেলোয়াড়, পজিশন জ্ঞান, সার্প শুটার, দক্ষতার সাথে গোল করা ছিল তার বিশেষ গুণ। তার অন্তরঙ্গ স্বভাব এবং নিজস্ব ভাষায় রসালো কথাবার্তা সবাই খুব উপভোগ করতো, আজও টেলিফোনে তার কথা শুনে ভাল লাগে। ইস্পাহানী টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনের খেলোয়াড় নিশিথ লীগে দুটি হ্যাটট্রিকসহ বেশ কয়েকটা গোল করেছিল। শরীরকে সোজা রেখে দৌড়াতো অনেকটা মাকরানী খেলোয়াড় আব্বাসের মতো। রেল দলের রাইট-ইন প্রকাশ, সুন্দর পায়ের কাজ, ছিমছাম খেলা, আমরা একবার পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল ক্যাম্পে বেশ কিছুদিন একসাথে কাটিয়েছিলাম। রেল দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড শংকরও ছিল চটপটে খেলোয়াড়, দ্রুত পজিশন বদল করে খেলা এবং গোল করায় সে ছিল দক্ষ। পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড ধীরেন, গফুর সাত্তারসহ আরো কিছু খেলোয়াড়ের কথা পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছা আছে।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ন্যাশনাল ব্যাংক দিনাজপুরে শেরে বাংলা গোল্ডকাপ (প্রথমবারের মত আরম্ভ হওয়া) ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিল। আমি আগেই বলেছি যে, আমাদের ব্যাংক ফুটবল টিম বেশ শক্তিশালী ছিল। আমরা দেশের বিভিন্ন যায়গায় ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতাম। দিনাজপুর যাওয়াটা ছিল খুব তড়িঘড়ি করে, যার জন্য আমার বাবাকে বলে যেতে পারিনি। আমি যেখানে যেতাম, বিশেষ করে যে কোন খেলায় যেতাম ঢাকায় কিংবা ঢাকার বাইরে, বাবাকে বলে যেতাম, ফিরে আসলে তাকে রেজাল্টটা বলতাম। তিনি হাত তুলে দোয়া করতেন। শেষের দিকে তিনি বিছানায় শুয়েই থাকতেন, সেদিন যে আমার কি হয়েছিল বুঝতেই পারিনি। ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছিল, তাই ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, বাবাকে বলতে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ট্রেনে উঠে সবার সাথে এমনিভাবে মেতে উঠেছিলাম যে, বাবার কথা আর মনে জাগেনি। দিনাজপুরে রাতে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। পরদিন ২৮-১১-৬৩ আমাদের প্রথম খেলা কোন টিমের বিরুদ্ধে খেলা কিছুই মনে ছিল না। বহু বছর পর আমার এক সহকর্মীর আত্মীয়র সাথে পরিচয় হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন তাদের সাথে আমরা ১ গোলে হেরেছিলাম এবং তিনিই সেই গোলের নায়ক। তার নাম আতিয়ার রহমান। তিনি ডিসি দিনাজপুর টিমের হয়ে সেদিন আমাদের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। তাদের টিমে দিনাজপুরেরর কৃতি ফুটবলার সালামও খেলেছিলেন। পরদিন সকালেই আমরা দিনাজপুর ছেড়ে আসবো। সব গোছগাছ করে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; কারণ খুব ভোরে ট্রেন ছেড়ে যাবে। হেরে যাওয়ার কিছুটা দুঃখ থাকলেও দীর্ঘ পথ ট্রেন জার্নির কান্তির কথা মনে হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতেই মন বেশি চাচ্ছিল। পাশাপাশি দুটো খাটে রঞ্জিত দা এবং আমি ঘুমিয়েছিলাম। ট্রেন এবং মাঠের কান্তিতে শরীর অবশ প্রায় একটি অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল, আমি অস্বস্তিতে ছটফট করছিলাম। রঞ্জিত দাও উঠে পড়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? স্বপ্ন দেখেছি, বাবা মারা গেছেন, তারপরই দেখেছি আমি হকি খেলছি। তিনি সান্ত্বনার সুরে বললেন, স্বপ্ন স্বপ্নইÑ শুয়ে পড়। রাত প্রায় শেষ, ঘুম আর হলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই জেগে উঠেছিল, স্টেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মনের ভেতর একটা অজানা আশংকা নিয়ে সকালে সবার সাথে আমিও ট্রেনে উঠে বসেছিলাম। দিনাজপুর যাওয়ার সময় মনে যেমন উচ্ছ্বাস ছিল, ফেরার পথে সেটা হারিয়ে গিয়েছিল। ভোর ছ’টায় ট্রেন ছেড়েছিল। দীর্ঘ পথ, কতক্ষণ মনে চিন্তা নিয়ে চুপ করে থাকা যায়! অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গল্প-গুজবে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়ে রাত প্রায় ৮টার দিকে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে আমাদের ট্রেন এসে থেমেছিল। ট্রেন থেকে নেমে আমার বন্ধু দাবির সিদ্দিকী এবং শফিককে দেখে অবাক হয়ে বকাবকি করে বলেছিলাম, কি রে, আমার কি পদ বেড়ে গেছে যে, আমাকে রিসিভ করার জন্য স্টেশনে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিস। কোন উত্তর পাইনি গত রাতের স্বপ্ন দেখার কথা মনে আসেনি একবারও। দাবিরের জিপে গিয়ে বসলাম, স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয় আমার মাহুৎটুলীর বাসা। স্টেশন থেকে সোজা নাজিরাবাজার পার হয়ে বংশাল চৌরাস্তার ডান মোড় ঘুরে একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাম দিক ঘুরলেই মাহুৎটুলী। জিপ গলিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো হ্যাজাকের আলো। তখনই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো, মনে পড়লো রাতের স্বপ্ন। আমাকে পেয়ে মা কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘মরার সময়ও তোকে দেখার জন্য তোর বাবা কি রকম ছটফট করেছে।’ বাবা মারা যাওয়ার সময় আমার খোঁজ করেছেন। বলেছিলেন, পাগলটা এখনও এলো না। আমি দিনাজপুর চলে গেলে বাবা আক্ষেপ করে মাকে বলেছিলেন, “পাগলটা গেল, আমাকে তো বলে গেল না।” এ কথাটা আমাকে এখনও পোড়ায়, যতদিন বেঁচে থাকবোÑ এই কষ্টটা বুকের ভেতর ক্ষত হয়ে থাকবে। ভোররাতে দিনাজপুরে যে স্বপ্ন দেখছিলাম, ঢাকায় সেটা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল! বাবা সকাল ১০টার দিকে মারা গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে সংবাদ পাঠানো হয়েছিল। আমরা রওনা হয়ে গেছি খবর পেয়ে জানাজা পড়িয়ে লাশ আমার জন্য রাখা হয়েছিল। স্টেশন থেকে ফিরে হাতের ব্যাগ রেখেই বাবার লাশ দাফন করতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল ২৯ নভেম্বর ১৯৬৩। বাবাকে কবর দিয়ে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। আত্মীয়স্বজন ভর্তি বাসায়। আমার স্বপ্নের কথা সবাইকে বললাম। মা বললেন, তোর বাবা মারা যাওয়ার সময়ও এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল, তোকে খুঁজছিল আর বলছিলোÑ এখনও আসলো না! শুনে বুকটা ফেটে কান্না পেল। মা-ভাইবোন সবাই কিছুক্ষণ কাঁদলাম। বাবার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে বলতে রাতটা কেটে গিয়েছিল। পরদিন কান্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়েছিলাম। তখন বেলা দশটা কিংবা এগারোটা হবে। সাবের আলী বাসায় এসেছিল। বন্ধু সাবের আলী ব্যাংকের হকি খেলোয়াড় বললো, ‘প্রতাপ বলেছে আজ ব্যাংক টিম আমাদের কাছে হারবে। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাব শক্তিশালী হকি টিম। আমাদের পাড়ার টিম, আমরাই এই কাব গঠন করেছি। দেশের অনেক কৃতী হকি খেলোয়াড়রা এই টিমের খেলোয়াড় ছিলেন। সাবের বলে চলেছে, তুমি খেলবা না, ওরা জেনেশুনে চ্যালেঞ্জ করছে। ন্যাশনাল ব্যাংক হেরে যাবে, ভাবতে কেমন জানি লাগছিল। সাবেরকে বললাম, লুকিয়ে আমার খেলার ব্যাগ এবং হকিস্টিক নিয়ে যাও, সুযোগ পেলে মাঠে যাব। খেলার সময় যত এগিয়ে আসছিল, মাঠে যাওয়ার জন্য মন ততই ছটফট করছে। কিন্তু মাকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। বাসাভর্তি আত্মীয়স্বজন, তারাইবা কি ভাববে। “মা, মনটা ভাল লাগছে না, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি”Ñ সাহস করে বলেই ফেললাম মা রাজি হওয়ার সাথে সাথে ছুটে গেলাম, ওয়ারী মাঠে (আউটার স্টেডিয়াম)। সবাইকে অবাক করে স্টিক হাতে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। আমরা ১-০ গোলে জিতেছিলাম; তবে খেলা শেষে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম মাঠে। লাড়– ভাই সেদিন খুব বকা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন খেলার কি খুব জরুরি ছিল,শরীর যদি বেশি খারাপ হয়ে যেত! ইনজুরড যদি হতে তাহলে তো ভবিষ্যত শেষ হয়ে যেত।
সবার সাথে আমিও ট্রেনে উঠে বসেছিলাম। দিনাজপুর যাওয়ার সময় মনে যেমন উচ্ছ্বাস ছিল, ফেরার পথে সেটা হারিয়ে গিয়েছিল। ভোর ছ’টায় ট্রেন ছেড়েছিল। দীর্ঘ পথ, কতক্ষণ মনে চিন্তা নিয়ে চুপ করে থাকা যায়! অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গল্প-গুজবে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়ে রাত প্রায় ৮টার দিকে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে আমাদের ট্রেন এসে থেমেছিল। ট্রেন থেকে নেমে আমার বন্ধু দাবির সিদ্দিকী এবং শফিককে দেখে অবাক হয়ে বকাবকি করে বলেছিলাম, কি রে, আমার কি পদ বেড়ে গেছে যে, আমাকে রিসিভ করার জন্য স্টেশনে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিস। কোন উত্তর পাইনি গত রাতের স্বপ্ন দেখার কথা মনে আসেনি একবারও। দাবিরের জিপে গিয়ে বসলাম, স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয় আমার মাহুৎটুলীর বাসা। স্টেশন থেকে সোজা নাজিরাবাজার পার হয়ে বংশাল চৌরাস্তার ডান মোড় ঘুরে একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাম দিক ঘুরলেই মাহুৎটুলী। জিপ গলিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো হ্যাজাকের আলো। তখনই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো, মনে পড়লো রাতের স্বপ্ন। আমাকে পেয়ে মা কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘মরার সময়ও তোকে দেখার জন্য তোর বাবা কি রকম ছটফট করেছে।’ বাবা মারা যাওয়ার সময় আমার খোঁজ করেছেন। বলেছিলেন, পাগলটা এখনও এলো না। আমি দিনাজপুর চলে গেলে বাবা আক্ষেপ করে মাকে বলেছিলেন, “পাগলটা গেল, আমাকে তো বলে গেল না।” এ কথাটা আমাকে এখনও পোড়ায়, যতদিন বেঁচে থাকবোÑ এই কষ্টটা বুকের ভেতর ক্ষত হয়ে থাকবে। ভোররাতে দিনাজপুরে যে স্বপ্ন দেখছিলাম, ঢাকায় সেটা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল! বাবা সকাল ১০টার দিকে মারা গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে সংবাদ পাঠানো হয়েছিল। আমরা রওনা হয়ে গেছি খবর পেয়ে জানাজা পড়িয়ে লাশ আমার জন্য রাখা হয়েছিল। স্টেশন থেকে ফিরে হাতের ব্যাগ রেখেই বাবার লাশ দাফন করতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল ২৯ নভেম্বর ১৯৬৩। বাবাকে কবর দিয়ে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। আত্মীয়স্বজন ভর্তি বাসায়। আমার স্বপ্নের কথা সবাইকে বললাম। মা বললেন, তোর বাবা মারা যাওয়ার সময়ও এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল, তোকে খুঁজছিল আর বলছিলোÑ এখনও আসলো না! শুনে বুকটা ফেটে কান্না পেল। মা-ভাইবোন সবাই কিছুক্ষণ কাঁদলাম। বাবার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে বলতে রাতটা কেটে গিয়েছিল। পরদিন কান্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়েছিলাম। তখন বেলা দশটা কিংবা এগারোটা হবে। সাবের আলী বাসায় এসেছিল। বন্ধু সাবের আলী ব্যাংকের হকি খেলোয়াড় বললো, ‘প্রতাপ বলেছে আজ ব্যাংক টিম আমাদের কাছে হারবে। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাব শক্তিশালী হকি টিম। আমাদের পাড়ার টিম, আমরাই এই কাব গঠন করেছি। দেশের অনেক কৃতী হকি খেলোয়াড়রা এই টিমের খেলোয়াড় ছিলেন। সাবের বলে চলেছে, তুমি খেলবা না, ওরা জেনেশুনে চ্যালেঞ্জ করছে। ন্যাশনাল ব্যাংক হেরে যাবে, ভাবতে কেমন জানি লাগছিল। সাবেরকে বললাম, লুকিয়ে আমার খেলার ব্যাগ এবং হকিস্টিক নিয়ে যাও, সুযোগ পেলে মাঠে যাব। খেলার সময় যত এগিয়ে আসছিল, মাঠে যাওয়ার জন্য মন ততই ছটফট করছে। কিন্তু মাকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। বাসাভর্তি আত্মীয়স্বজন, তারাইবা কি ভাববে। “মা, মনটা ভাল লাগছে না, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি”Ñ সাহস করে বলেই ফেললাম মা রাজি হওয়ার সাথে সাথে ছুটে গেলাম, ওয়ারী মাঠে (আউটার স্টেডিয়াম)। সবাইকে অবাক করে স্টিক হাতে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। আমরা ১-০ গোলে জিতেছিলাম; তবে খেলা শেষে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম মাঠে। লাড়– ভাই সেদিন খুব বকা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন খেলার কি খুব জরুরি ছিল,শরীর যদি বেশি খারাপ হয়ে যেত! ইনজুরড যদি হতে তাহলে তো ভবিষ্যত শেষ হয়ে যেত।
বাবা মারা যাওয়ার স্বপ্ন এবং সেটি বাস্তব হয়ে যাওয়ার পুরো ঘটনাটি আমার কাছে আজও অলৌকিক বলে মনে হয়।
সংশোধনী :
গত সংখ্যায় আমরা লেখায় মোহামেডান বনাম ওয়ান্ডারার্স খেলায় (১৪-৬-৬৩ ইং) মোহামেডান কাবের প্লেয়ার লিস্টের শেষ নামটি মারীর পরিবর্তে হবে মুসা এবং ৯-৭-৬৩ তারিখে মোহামেডান বনাম ইপিআর খেলায় মোহামেডান কাবের প্লেয়ার লিস্টের শেষ নামটি মুসার পরিবর্তে হবে প্রতাপ।
(ঊনপঞ্চাশ) ১৬ এপ্রিল
আগা খান গোল্ডকাপ ছিল সে সময়ে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট। গত আসরের চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব এবারের (১৯৬৩) টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ না করাটা ছিল দুঃখজনক। সদ্যসমাপ্ত ঢাকা লীগে তাদের খেলোয়াড় সাসপেনশন জটিলতাকে কেন্দ্র করে তারা গোল্ডকাপ বর্জন করেছিল। ইন্দোনেশিয়া এবং নেপাল দুটি বিদেশী দল, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচটি এবং স্বাগতিক নয়টি দলের মধ্যে প্রথমে এলিমিনেশন রাউন্ড, পরে রাউন্ড রবিন লীগ, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছিল টুর্নামেন্টের ফিকশ্চার। ভিক্টোরিয়ার সব মাকরানী খেলোয়াড় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবে যোগ দিয়ে টিমকে খুব শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
এলিমিনেশন রাউন্ডে বালুচ একাদশের কাছে স্থানীয় ইস্পাহানী টিম ০-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। স্থানীয় পুলিশ টিমের সাথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিয়ন টিম ৫-৩ গোলে হেরে এবং পূর্ব-পাক রেল দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের কাছে ০-৮ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। এমএন জাহানের হ্যাটট্রিক এবং ইদ্রিসের গোলের সুবাদে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল ৪-০ গোলে ঢাকার ওয়ারী কাবকে হারালে ওয়ারী কাব টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। পরবর্তীতে ঢাকা মোহামেডান কাবের সাথে হেরে বেলুচ একাদশ টুর্নামেন্ট থেকে চিটকে যায়। পাকিস্তানের ওয়ারসেক টিম স্থানীয় আজাদ স্পোর্টিংকে ১-০ গোলে আর পিআইএ স্থানীয় পিডব্লিউডি টিমকে ৩-০ গোলে হারিয়ে দিলে পরাজিত টিমগুলো টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। এলিমিনেশন রাউন্ড থেকে ছয়টি টিমের সাথে বিদেশী দুটি টিম যোগ করে আটটি টিমকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে রাউন্ড রবিন লীগ পদ্ধতিতে এগিয়ে গিয়েছিল টুর্নামেন্ট। এ গ্রুপ ঢাকা মোহামেডান, ইন্দোনেশিয়া, ওয়ারসেক এবং পিআইএ। বি গ্রুপ- ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, নেপাল এবং পুলিশ।
১৫ অক্টোবর ’৬৩ শুরু হয়েছিল আগা খান গোল্ডকাপের রাউন্ড রবিন লীগের খেলা ঢাকা মোহামেডান এবং ওয়ারসেক টিমের মধ্য দিয়ে। মুসা এবং রহমত উল্লাহর দুটি গোলের বিপরীতে ওয়ারসেক টিমের গফুর একটি গোল করলে মোহামেডান ২-১ গোলে জয়ী হয়েছিল। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ৭-০ গোলে পুলিশকে হারিয়ে তাদের শুভ সূচনা করেছিল। আব্বাস, ওমর, গনি প্রত্যেকের দুটি করে গোল আর ইউসুফ জুনিয়র করেছিল ১ গোল। পিআইএ হেরেছিল ০-৩ গোলেওয়ারসেক টিমের কাছে। জয়ী টিমের আমিন ১ গোল এবং সরফরাজ ২টি গোল করেছিল। পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম নেপাল একাদশকে ৮-০ গোলে পরাজিত করে ঢাকার দর্শকদের কাছে নিজেদের শক্তিশালী টিম হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাদের ইদ্রিস ডবল হ্যাটট্রিক, জাহান এবং তালেব একটি করে গোল করেছিল। এ গ্রুপের পরবর্তী খেলায় সাইদের হ্যাটট্রিকের সুবাদে পিআইএ ৩-২ গোলে ইন্দোনেশিয়াকে পরাজিত করেছিল। আলভান্ডু এবং সোয়েমারনো দুটি গোল শোধ করেছিল। ঢাকা ওয়ান্ডারার্র্স নেপাল একাদশকে ৭-০ গোলে পরাজিত করে আবারও প্রমাণ দিয়েছিল যে, তারা শক্তিশালী টিম। ওমর ৩ গোল, আব্বাস ও আব্দুল্লাহ দুটি করে গোল করেছিল। ওমর এবং ইউসুফের দেয়া ২-০ গোলে পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে পরাজিত করে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অব্যাহত রেখেছিল। এ গ্রুপের অপর খেলায় মুসা, কাইয়ুম এবং আমার দেয়া গোলে আমরা ইন্দোনেশিয়াকে ৩-১ গোলে (ডেমিকাস) পরাজিত করেছিলাম। প্রকাশের দেয়া গোলে নেপাল পুলিশকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ইন্দোনেশিয়া ডেমিকাসের ২ গোল এবং সুজিতনোর ২ গোলের সুবাদে ওয়ারসেক দলকে ৪-১ গোলে (নুরুল্লাহ) পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পাক ওয়েস্টার্ন রেল দল তালেব ও ইদ্রিসের দেয়া ২ গোলের ব্যবধানে পুলিশ দলকে পরাজিত করেছিল।
রাউন্ড রবিন লীগ শেষে এ গ্রুপ থেকে ঢাকা মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন এবং ইন্দোনেশিয়া রানার্সআপ হয়েছিল আর বি গ্রুপ থেকে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স চ্যাম্পিয়ন এবং পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে রানার্সআপ হয়েছিল।
প্রথম সেমিফাইনাল ২৬ অক্টোবর ’৬৩ ঢাকা ওয়ান্ডারার্স বনাম ইন্দোনেশিয়া। ইউসুফের (সিনিয়র) হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল এবং গফুরের দেয়া ১ গোলের সুবাদে ৫-০ গোলে ইন্দোনেশিয়াকে পরাজিত করে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। দ্বিমুকুট প্রত্যাশী (লীগ ও গোল্ডকাপ) ঢাকা মোহামেডান ২৭ অক্টোবর দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিমের। মোহামেডানের গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন ফুটবলের বিরুদ্ধে উচ্চতাসম্পন্ন খেলোয়াড়দের লম্বা লম্বা পাস আর শূন্যে বল খেলা ছিল মূল স্ট্র্যাটেজি। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যদিয়ে খেলা শুরু হয়েছিল। রহমত উল্লাহর দেয়া গোল অল্প সময়ের জন্য আমাদেরকে জয়ের স্বপ্ন দেখালেও রেলের ইদ্রিসের গোলে খেলায় সমতা আসে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এভাবেই প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে তালেব তাদের রেল দলকে এগিয়ে দিলেও মুসা গোল শোধ করলে খেলায় আবার উত্তেজনা বেড়ে যায়। গোল করার জন্য দুই টিমই আক্রমণ করে খেলার চেষ্টা চালায় এবং একসময় রেলওয়ে টিমের রমজান গোল করলে খেলায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ওয়ান্ডারার্স দলের সমর্থকরা রেল টিমকে সমর্থন জানানো নিয়ে গ্যালারিতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গোল শোধ করার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠি এবং একের পর এক আক্রমণ চালাই। আক্রমণের সুফলও আমরা পেয়েছিলাম একটি পেনাল্টির মাধ্যমে। গোলপোস্টে ফ্রি কিক বা পেনাল্টি কিক মারায় দক্ষ কাইয়ুম; কাইয়ুমই মেরেছিল সেদিনের পেনাল্টি কিকটি। কিন্তু মিস করেছিল, এর সাথেই ভেঙ্গে গিয়েছিল ঢাকা মোহামেডান কাবের আগা খান গোল্ডকাপ জয়ের স্বপ্ন।
পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম : লতিফ, আবদুল হক, রমজান, রশিদ, ইউনুস, তালিব, আলম, সেলিম, ইদ্রিস, এমএন জাহান এবং জাওয়াইদ।
ঢাকা মোহামেডান : বলাই, জহির, দেবীনাশ, রসুল বক্স, পিন্টু, আবিদ হোসেন (অধিনায়ক), কবির, রহমত উল্লাহ, কাইয়ুম, বশীর ও মুসা।
রেফারি : মাসুদুর রহমান।
২৯-১০-৬৩ তারিখে আগা খান গোল্ডকাপের ফাইনাল খেলায় মুখোমুখি হয়েছিল ঢাকার ওয়ান্ডারার্স কাব এবং পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে। রাউন্ড রবিন লীগে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাব ২-০ গোলে ওয়েস্টার্ন রেল দলকে পরাজিত করেছিল। স্বভাবত কারণে ওয়ান্ডারার্স টপ ফেভারিট টিম ছিল। তাছাড়া ফাইনাল খেলাটি পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তান রূপ নিয়েছিল। দর্শকে পরিপূর্ণ স্টেডিয়াম।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দলের সাপোর্টাররা তাদের দলের নিশ্চিত জয় ভেবে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে গ্যালারিতে উপস্থিত হয়েছিলেন। জয়ের উৎসব উদযাপনের জন্য কাবও তৈরি ছিল কিন্তু সবার আশা-আকাক্সা চুরমার করে দিয়েছিল খেলার ফলাফল। পাক-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে ২-১ গোলে ঢাকা ওয়ান্ডার্স কাবকে পরাজিত করে শিরোপা জয় করেছিল। রেল দলের জাহান এবং ইদ্রিস গোল করেছিল আর ওয়ান্ডারার্স দলের ১টি গোল শোধ করেছিল ওমর।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দলের খেলোয়াড় : গোলাম হোসেন, খোদা বক্স, গফুর বেলুচ, আমিন, মুরাদ, গফুর, ইউসুফ (জুনিয়র), আবদুল্লাহ, ওমর, আব্বাস।
রেফারি : মাসুদুর রহমান। #
(ক্রমশ.)
(পঞ্চাশ) ১ মে
৩ মার্চ ১৯৬৩ ঢাকা ক্রিকেট লীগের ফাইনাল ম্যাচ। লীগ ডিসাইডিং ম্যাচ। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব ঢাকা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল ওয়ারী কাবের। যে দল জয়লাভ করবে, সে দল হবে লীগ চ্যাম্পিয়ন। ওয়ারী-ভিক্টোরিয়া কাব দুটোর সম্পর্ক সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। সুকুমার, মঈনু বকুল, দৌলত সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত এবং চৌকস খেলোয়াড়রা ওয়ারী কাবে খেলতো, আমাদের ভিক্টোরিয়ার সালাম ভাই, রফিক, মন্টুও ভাল ক্রিকেটার ছিল। টসে জয়লাভ করে ওয়ারী প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ভিক্টোরিয়ার ফাস্টবোলার রফিকের মারাত্মক বোলিং এবং মন্টুর ঘূর্ণি বলে ওয়ারীর ব্যাটসম্যানরা মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়ে গিয়েছিল সেদিন। রফিক ৩৬ রানে ৫ উইকেট এবং মন্টু ২৭ রানে ৩ উইকেট নিলে ওয়ারী চাপের মধ্যে পড়ে যায়। ওয়ারীর উদ্বোধনী জুটি এরফান এবং হেলাল মাত্র ৪ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছিল। পরবর্তীতে জাভেদ ও ইব্রাহিম জুটি টিমকে ৪৬ রানে নিয়ে গিয়েছিল। ইব্রাহিম ব্যক্তিগত ৫ রানে আউট হলে মঈনু এসে ২ রান করে আউট হয়ে যায়। তখন ওয়ারীর রান সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫। সুকুমার এসে জাভেদের সাথে যোগ দিয়ে টিমকে ৯৬ রানে পৌঁছে দেয়। রফিকের বলে জাভেদ বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যায়। শেষ পর্যন্ত ওয়ারী কাবের ইনিংস ১১৬ রানে সমাপ্ত হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ব্যাটিং করতে নেমে মাত্র ১৪ রানে ৫টি উইকেট হারিয়ে একেবারে বেহাল অবস্থায় পড়ে যায়। মেহেদী এবং মন্টু দলকে ২৫ রানে নিয়ে যায়। আমি ব্যাট করতে নামি বেশ আস্থার সাথে। তিনটি বাউন্ডারীসহ ১৭ রান করেছিলাম। আমার পরিচিত স্টেডিয়ামটিতে খেলে। (১৯৫৭ সাল থেকে অ্যাথলেটিক্স, হকি, ফুটবল, খেলতে আসা) ক্রিকেট খেলতে গেলে মনে হতো কি বিরাট স্টেডিয়াম, গায়ের জোরে ব্যাট চালালেও চার (বাউন্ডারি) হতে চাইতো না। আমার আউটটি আজও আমাকে পোড়ায়। দৌলত বল করেছিল, আমি ড্রাইভ মেরেই রান নেয়ার জন্য এগিয়েছি। বল সোজা দৌলতের হাতে, রান নেয়া হয়নি, ব্যাট ক্রিজে (সীমানার ভেতর) শরীরটা বাইরে, দাঁড়িয়ে ছিলাম। দৌলতের হাতে বল, সে আমাকে লক্ষ্য করে বল ছুঁড়ে মেরেছিল। ভয়ে আমি শূন্যে লাফিয়ে উঠেছিলাম, বল সোজা স্ট্যাম্পে আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গে আম্পায়ার আঙুল উঁচিয়ে আউটের সংকেত দিলেন। আমি বোকা বনে গিয়েছিলাম। খেলার আইন না জানার অজ্ঞতার কারণে সেই আউটের কথা মনে হলে আজও হাসি পায়। তখন আমাদের স্কোর ছিল ৫১। পরে আরো ২ রান যোগ করে আমরা (ভিক্টোরিয়া) ৫৩ রান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দৌলত ২৫ রানে আমাদের ৫ উইকেট নিয়েছিল আর বকুল ২৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে আমাদের ব্যাটিং-এ ধস নামিয়ে দিয়েছিল। আমরা ৬৩ রানে ওয়ারীর কাছে হেরেছিলাম। ওয়ারী লীগ চ্যাম্পিয়ন।
জগন্নাথ কলেজ শীতের এক সকালে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফরিদপুর কলেজের বিরুদ্ধে আন্তঃকলেজ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছিল; যার বিবরণ দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকা এভাবে দিয়েছিল :
ঞযব ঔধমধহহধঃয ঈড়ষষবমব ৎবঃধরহবফ ঃযব উধপপধ উরারংরড়হ রহঃবৎ-ঈড়ষষবমব ঐড়পশবু ঈযধসঢ়রড়হংযরঢ় যবৎব ুবংঃবৎফধু যিবহ ঃযবু ফবভবধঃবফ ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঈড়ষষবমব নু ঐধষভ ধ ফড়ুবহ মড়ধষং ধঃ ঃযব উধপপধ ংঃধফরঁস ুবংঃবৎফধু সড়ৎহরহম. ইধংযরৎ, ধহ রহঃবৎহধঃরড়হধষ ঢ়ষধুবৎ ধিং ঃযব পযরবভ ধৎপযরঃবপঃ ড়ভ ঃযরং নরম ারপঃড়ৎু. ঐব ংপড়ৎবফ ধ যধঃ-ঃৎরপশ ংঃধৎঃরহম রিঃয ঃযব াবৎু ভরৎংঃ মড়ধষ ড়ভ ঃযব সধঃপয. ঐব ফবষরমযঃবফ ঃযব ংঢ়বপঃধঃড়ৎং নু যরং হবধঃ ধহফ ধৎঃরংঃরপ ংঃরপশ ড়িৎশ.
ঋৎড়স ঃযব াবৎু নবমরহরহম ঃযব ঔধমধহহধঃয ঈড়ষষবমব ঃবধস বিৎব রহ ঃযব ড়ভভবহংরাব ধহফ রঃ ধিং যধৎফ ভড়ৎ ঃযব ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঈড়ষষবমব ঃড় রিঃযংঃধহফ ঃযব সড়ঁহঃরহম ঢ়ৎবংঁৎব ড়ভ ঃযবরৎ পড়হপবৎঃবফ ধঃঃধপশ.
ইবংরফবং ইধংযরৎ, ঃযব ড়ঃযবৎ ংপড়ৎবৎং বিৎব ঢ়ৎধঃধঢ়. ঐধলৎধ ধহফ অভুধষ.
ঞযব ধঃঃপশ ড়ভ ঃযব ারংরঃড়ৎং ধিং বিষষ-পড়ড়ৎফরহধঃবফ ধহফ ঃযবু ষড়ংঃ ধ ভবি পযধহপবং ঃযধঃ পধসব ঃযবরৎ ধিু ফঁব ঃড় ষধপশ ড়ভ ভরহরংয.
ঞযব ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঈড়ষষবমব ঃবধস ংঃধৎঃবফ ঃযব ফধু রিঃয ৎবসধৎশধনষব পড়ঁৎধমব ধহফ ফবঃবৎসরহধঃরড়হ ইঁঃ. রিঃয ঃযব ঢ়ধংংধমবড়ভ ঃরসব ঃযবু ভধফবফ ধধিু.
গধলরফ ঃযব পধঢ়ঃধরহ ড়ভ ঃযব ঋধৎরফঢ়ঁৎ ঃবধস ংযড়বিফ ফবভরহরঃব ংরমহং ড়ভ ঢ়ৎড়সরংব যিড়ংব সধহু ংযড়ঃং সরংংবফ ঃযব হবঃং ড়হষু নু যধরৎং নৎবধফঃয. ঐধফ ফধসব ভড়ৎঃঁহব ভধাড়ঁৎবফ ঃযব ারংরঃড়ৎং ঃযবু পড়ঁষফ যধাব ৎবফঁপবফ ঃযব সধৎমরহ.
‘রোনাল্ডসে শিল্ড’ ফুটবল টুর্নামেন্ট
রোনাল্ডসে শিল্ড নামকরণের সঠিক ইতিহাস আমার জানা নেই; তবে রোনাল্ড এই অঞ্চলের কোন বরণীয় ব্যক্তি হবেন বলে আমার ধারণা। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই টুর্নামেন্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতো, পরবর্তীতে ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলাধুলার চাপ কমাতে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামে এই টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়া হতো দুটো উদ্দেশ্যে : একটি হলো খেলার আনন্দ, অপরটি হতো বেড়ানো, অনেকটা পিকনিক করার মতো। ১৯৬৩ জগন্নাথ কলেজ এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রথমদিকে আমরা যারা কলেজের ছাত্র, তারাই খেলে ফাইনালে উঠেছিলাম এবং পরে নূরু ভাই (কলেজের গেম ইনস্ট্রাক্টর), বড় নাজির, জামিল আক্তার, আলী, হাফিজ, দিপু, আনসার, জাম্বুকে দলে নিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করেছিলেন। আমরা রোনাল্ডসে শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ফিরে আসলে কলেজ আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছিল। মহসিন ভাই সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট পাকিস্তানের অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য একটি টুর্নামেন্ট। সমগ্র পাকিস্তান থেকে ভাল ভাল টিম এখানে অংশ নিতো। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ঢাকা মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স কাবও এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতো। লীগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব ১৯৬৩ সালের মোহাম্মদ আলী কাপে অংশগ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি আর্মি স্টেডিয়ামে এই ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৫০২ ওয়ার্কশপের সাথে আমরা খেলেছিলাম। এই টুর্নামেন্টে মোহামেডান কাবের কোন সফলতা আসেনি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের আর একটি শহর মুলতানে ফাডলাইটে ফুটবল টুর্নামেন্টও বেশ জমজমাট হতো। পিন্ডিতে থাকতেই খবর পেয়েছিলাম যে, জগন্নাথ কলেজ সেই টুর্নামেন্ট খেলতে মুলতান আসছে এবং মোহামেডান কাবের কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করবে। ঢাকা মোহামেডান পিন্ডি ছেড়ে গেলেও আমরা মুলতান গিয়ে জগন্নাথ কলেজের সাথে যোগ দিয়েছিলাম। যোগ দিয়েছিলাম না বলে যদি আমরা এভাবে বলি যে, ঢাকা মোহামেডানের খেলোয়াড়রাই জার্সি বদল করে জগন্নাথ কলেজের জার্সি গায়ে খেলেছিল। নূরু ভাই মুলতান যাওয়ার সময় কলেজের জলিল, রফিক, মোবাশ্বের, হাফিজসহ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন; বাকি খেলোয়াড় মোহামেডানের যেমন দেবীনাশ, কাইয়ুম চেঙ্গেজী, রসুল বকশ, প্রতাপ, বলাই, আমি এবং আনসার। টুর্নামেন্টের আকর্ষণীয় দিক ছিল রাতে ফাডলাইড ফুটবল খেলা। আমাদের জন্য ছিল একেবারেই নতুন। আমাদের টিমটিও ছিল শক্তিশালী। একই টিমের খেলোয়াড় হওয়ায় খেলাটাকে আমরা বেশ উপভোগ করতাম। খেলা শেষ হতো অনেক রাতে, রাত প্রায় বারটা-একটার সময় কান্ত শরীরে মাঠ থেকে হোটেলে যাওয়া ছিল আনন্দের। নির্জন রাস্তা, গাড়িঘোড়া নেই, হাসি-ঠাট্টা করতে করতে হেঁটে হেঁটে পথচলা কী যে আনন্দেরÑ যা আজও লিখতে বসে ভাল লাগছে। চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে। আমরা সে টুর্নামেন্টে ফাইনালে যেতে পারিনি; তবে দু’তিনটি ম্যাচ জেতার আনন্দের কথা ভুলতে পারিনি।
ঢাকা মোহামেডানের ফুটবল মৌসুম ’৬৩তে শেষ হয়েছিল করাচিতে একটি চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচ খেলার মধ্য দিয়ে। কেএমসি মাঠে ঢাকা মোহামেডান বনাম করাচি। পাকিস্তানের প্রখ্যাত স্টপার তোরাব আলী করাচির পক্ষে খেলেছিল, প্রচুর দর্শক হয়েছিল। চ্যারিটি বা প্রদর্শনী ম্যাচে সাধারণত যে ফলাফল হয়ে থাকে, এ ম্যাচের ফলাফলও সেই ড্র দিয়ে খেলা শেষ হয়েছিল। # (ক্রমশ:)
(একান্ন) ১৬ মে
পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে ১৯৬৩ সালের জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত বছরের লাহোরে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নশীপে আমাদের টিমের সার্বিক অবস্থা ছিল খুবই ছন্নছাড়া, মাঠে খেলা ছিল যেমন অগোছালো, টিমকে নির্দেশ করার মত কেউ ছিল না, তেমনি দলের অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। প্রতি বছরের ন্যায় সেবারও প্রথম ম্যাচেই বিদায়। ইপিএসএফ পাকিস্তান হকি কর্তৃপক্ষের নিকট সহযোগিতা চেয়ে পাঠালে পাকিস্তানের কোচ মি. নবী কালাতকে ঢাকায় পাঠিয়ে ছিল পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমকে কোচিং করার জন্য। নবী কালাত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অভিজ্ঞ, দক্ষ কোচ। আমরা যারা হকি খেলোয়াড় বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি এ অঞ্চলের খেলোয়াড়দের খেলার উন্নতি করাতে পারবেন। তার আন্তরিকতায় হকি অঙ্গনে একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সবার প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। তার হকি কোচিং আমাদের নিকট ছিল ব্যতিক্রম, সকলে আগ্রহ নিয়েই ট্রেনিং করেছিলাম, টিমেরও বেশ উন্নতিও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সে সময় আবাসিক ক্যাম্প করে ট্রেনিং হতো না অর্থনৈতিক কারণে নইলে আরো সুফল পাওয়া যেত, তাছাড়া তিনি এসেছিলেন খুবই সীমিত সময়ের জন্য, মাসখানিকের মধ্যেই আমাদের ট্রেনিং, সিলেকশন হয়ে রাওয়াল পিন্ডির উদ্দেশ্য প্লেন ধরেছিলাম।
ফুটবলের মত হকি খেলাতেও পাকিস্তান থেকে খেলোয়াড় ঢাকায় এসে খেলার প্রচলন শুরু হয়েছিল তবে খুবই কম সংখ্যক। ঢাকায় চাকুরি করার সুবাদে কয়েকজন খেলোয়াড় ঢাকায় বিভিন্ন কাবে লীগ খেলায় অংশগ্রহণ করতো। প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করতো সেরা, মামলী, তারা ওয়ারী কাবে খেলতো, পিডাব্লিউডি কাব, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইপিআর এবং আর্মিতেও পাকিস্তানী খেলোয়াড়রা খেলতো। পেশোয়ারে জন্ম নেয়া সামি খান, দেশ বিভাগের পর ভারত থেকে ঢাকায় এসে আস্তানা গাড়ে, আলমগীর ভাই মোমিনভাইয়ের সাথে থেকে এ অঞ্চলের হকির সাথে জড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমে ও গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমে সেবারও বেশ কয়েকজন পাকিস্তান থেকে ঢাকায় হকি লীগ খেলতে আসা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিল এবং টিমের সাথে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত হকি চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তান টিম - সেলিম জাম্বু (গোলরক্ষক), আহম্মদ, মোমতাজ, মোমিন, হাসিম, নিয়াজ, মূয়ীদ , মির্জা ফরিদ, প্রতাপ শংকর, ফরিদ, বশীর।
ম্যানেজার- আলমগীর আদেল, কোচ নবী কালাত।
আমরা পিআইএ যোগে লাহের তারপর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছিলাম। স্টেশনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন টুর্নামেন্ট কমিটির সদস্যগণ তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন সেনাসদস্য। আমাদের খাবার ব্যবস্থা সেরকম কোন উন্নতি হয়নি, সেই স্কুল হোস্টেল। খুলনার সবুর খান সাহেব সে সময় পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি আমাদের পুরোটিমকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সবুরখান সাহেব রাজনীতিবিদ হলেও তিনি ছিলেন স্পোর্টস মাইন্ডেড, তিনি ছিলেন ক্রীড়া সংগঠক, খুলনায় মুসলিম কাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, ঐ কাবের ফুটবল টিম খুব শক্তিশালী, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার, গৌরবও তাদের ছিল। ঢাকা থেকে বহু খেলোয়াড়, সে কাবের হয়ে লীগ খেলায় অংশগ্রহণ করতো। আমি অবশ্য টাউন কাবের (খুলনা কাবের) হয়ে খেলতাম। মন্ত্রী মহোদয় তার সরকারি বাসভবনে আমাদের টিমকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন আপ্যায়ন করিয়েছিলেন। আমরা পিন্ডিতে যতদিন ছিলাম, যাতায়াত এবং বেড়াবার জন্য একটি গাড়ি দিয়ে রেখেছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত করা হবে। নতুন রাজধানীর কাজ শুরু হয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন রাস্তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক মাইল দীর্ঘ কালো পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা, রাস্তার পাশে স্ট্রিট লাইটের পোস্ট গুলো সমানভাবে অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে। কোথায়ও এতটুকু উঁচুনীচু নেই দেখার মত। সে রাস্তা দিয়ে আমরা ইসলামাবাদ গিয়েছিলাম। সরকারি বাসভবন তখনও তৈরি হয়নি। একটি মাত্র তিনতলা ভবন ইস্ট ওয়েস্ট পাকিস্তান ফ্রেন্ডশীপ ভবন। মার্বেল পাথরে তৈরি মেঝে, দেয়াল অ™ভুত সুন্দর। তখন প্রথম মার্বেল পাথর দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমাদের হকি টিমের সুসজ্জা দেখে সবাই ভেবেছিল এবার আমরা ভালো ফলাফল করবো, কিন্তু সবাইকে হতাশ করে আমরা প্রথম ম্যাচেই পিন্ডি টিমের সাথে বিদায় নিয়েছিলাম।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান স্পোর্টস এন্ড রিক্রিয়েশিয়ান কাব, ঢাকার হকি টিমের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৩-৬৪ হকি মৌসুমে। সে সময় হকি ছিল শীতকালীন খেলা আর শীত মৌসুম ধরা হতো সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।দেশের খেলাধুলাকে মৌসুম ভিত্তিক বিন্যাস করা হতো। বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসেও গরম থাকে তাছাড়া খেলাধুলার প্রসার ঘটায় দেশের ক্রীড়াপঞ্জির আমূল পরিবর্তন এসেছে। খেলার সংখ্যা, বেড়েছে, অবকাঠামো বেড়েছে, ভিন্ন ভিন্ন খেলা তাদের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিম কত তারিখে প্রথম খেলা খেলেছিল সেটা মনে নেই তবে জয় দিয়ে শুভ সূচনা হয়েছিল সে জয় যে শেষ অবধি অুণœ রাখতে পেরেছিলাম সেটার জন্য আজও লিখতে বসে গর্ব অনুভব করছি। আমরা যারা খেলোয়াড় হিসেবে ব্যাংকে চাকরিরত ছিলাম তাদের দিয়ে পুরোটিম গঠন করা যেত না, তাই দু চারজন খেলোয়াড়কে ব্যাংক টিমে নিয়ে লীগ খেলা শুরু করেছিলাম। তাদের মধ্যে অন্যতম ফুলব্যাক মোমতাজ উদ্দিন, ইকবাল, কামাল পোটলা, দ্রুতগতি সম্পন্ন রাইট আউট আবদুল হক। আমাদের টিমের জন্য কোন গোল কিপার জোগার করতে পারিনি। ক্রিকেট খেলোয়াড় মানু, (ক্রীড়া সংগঠক) প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের গোলরক্ষকের দায়িত্ব্ পালন করতে এগিয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে আমাদের ব্যাংক ফুটবল দলের গোলরক্ষক, দেশের ফুটবলের খ্যাতিমান গোলরক্ষক, রঞ্জিত দাসকে গোলকিপার বানিয়ে গোলবারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি ফুটবলের সাহসী গোলরক্ষক হিসেবে খুব প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। হকিতেও তিনি সাহসের সাথেই হকি সিজন পার করে দিয়েছিলেন, তবে আমাদের ডিপ ডিফেন্স ভেদ করে বিপক্ষ দলের ‘ডি’তে ঢোকা ছিল কষ্টকর কারণ দেশের দুই কৃতি ফুলব্যাক মোমতাজ এবং সাবের আলী আমাদের টিমের ফুল ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করতো। আমাদের টিমের মূল শক্তি ছিল আমাদের আক্রমণভাগ। রাইটউইং দিয়ে ছুটে আবদুল হকের ক্রশগুলোকে মির্জা ফরিদ মিলু নয়তো আমি সদ্ব্যবহার করে। গোল করার চেষ্টা করেছি। মির্জা ফরিদ মিলু রাইট ইনের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়, গোল করায় সে ছিল দক্ষ। সেন্টারফরোয়ার্ড আমাদের ছিল না, লেফট আউটপজিশনের খেলোয়াড় মীর আনোয়ার করিমকেই খেলাতে হতো। ব্যাংক টিমে লেফট ইনে আমি সব সময় ভাল খেলার চেষ্টা করেছি, আমাদের লেফট আউট আসগতর আলী মুন্নী ধীরস্থির, প্রকৃতির খেলোয়াড় ছিল। ফখরুল আলম মাহমুদ ভাই, আমাদের সিনিয়র ছিলেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন, ভাল ফুটবল খেলোয়াড়, পাকিস্তান ফুটবল টিম ট্রায়েলেও চান্স পেয়েছিলেন, খেলতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়ে তার সব শেষ হয়ে গিয়েছিল, এমনকি চাকরী ও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা ফিরে তিনি ব্যাংক হকি খেলোয়াড় হিসেবে জয়েন করেছিলেন। তিনি আমাদের টিমের সেন্টার হাফ পজিশনের দায়িত্ব খুব সাহসিকতার সাথে পালন করতেন। রাইট হাফে কামাল পোটলা আর লেফট হাফে আনোয়ার, আনোয়ার বেশ নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ছিল বিশেষ করে তার পজিশনে। পরবর্তীতে সে ইস্ট পাকিস্তান টিমেও চান্স পেয়েছিল। আমাদের টিম ম্যানেজমেন্টের উৎসাহ আমাদের প্রেরণা জোগাতো, সবসময় তাদেরকে কাছে পাওয়া যেত, মাঠে তারা হাজির থাকতেন। টিমের সম্মিলিত চেষ্টা, আন্তরিকতা ছিল আমাদের সফলতার মূল কারণ। ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিম প্রথম বছরেই (১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে) ঢাকা হকি লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
(বায়ান্ন) ১৬ জুন
এক পাঠানের বাসায় চুরি করতে এসে চোর ধরা পড়ে যায়। গৃহকর্তা চোরের পা তার চারপাইয়ের (খাটের) সাথে রশি দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে রেখে পুলিশকে খবর দিতে থানায় গেলে পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, চোর কোথায়? গৃহকর্তা বললেনÑ বাসায়, চারপাইয়ের পায়ার সাথে পা বেঁধে রেখে এসেছি। পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, চোরের হাত তো খোলা, এতক্ষণে নিশ্চয়ই চোর হাত দিয়ে বাঁধন খুলে পালিয়ে গেছে। গৃহকর্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, চিন্তার কোন কারণ নেই স্যার, চোর ব্যাটাও আমার মত একজন পাঠান। পাঠানদের নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প শোনা যায়। পাঠানরা সহজ-সরল এবং কঠিন স্বভাবের মানুষ। সেই পাঠান মুল্লুকে অর্থাৎ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের রাজধানী পেশাওয়ারে ১৯৬৪ সালে হকি খেলতে গিয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে লীগ (১৯৬৩-৬৪ সাল) শেষ হওয়ার পরপরই পেশাওয়ারে হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য টিম প্রস্তুত করতে হয়েছিল। টিমের অনুশীলন করার সুযোগও সেরকম পাওয়া যায়নি, অনেকটা লীগ খেলার ওপর ভিত্তি করে টিম গঠন করা হয়েছিল।
গোলরক্ষক : সেলিম জাম্বু ও মান্নান। ফুলব্যাক-সালাম, সেরা ও মোমতাজ। হাফব্যাক : মোমিন, আহমেদ হোসেন, সাদেক ও আবিদ। ফরোয়ার্ড-বশীর (ক্যাপ্টেন), ওসমানী, ফরিদ (ভাইস ক্যাপ্টেন), মোবিন, নাসিম, নিয়াজ ও বুলবান। ম্যানেজার-আলমগীর আদেল এবং সহকারী ম্যানেজার-সামি খান।
২ মার্চ ১৯৬৪ সকাল ১০টায় তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে পিআইএযোগে লাহোরের উদ্দেশে আমরা ঢাকা ত্যাগ করি। প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর যখন আমরা লাহোর এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম, তখন বিকেল। সে রাতেই আমরা পেশাওয়ারের পথে ট্রেনে চেপে বসেছিলাম। পরদিন সকালে রেলস্টেশনে নেমে টের পেলাম আমরা শীতকালে পেশাওয়ার এসেছি, ভীষণ শীত। আমরা উঠেছিলাম একটি একতলা স্কুলে। চারদিকে দেয়াল ঘেরা, মাঝখানে বিরাট উঁচু একটি গাছ। দিনের বেলায় রোদে গাছে একটা আয়না লাগিয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাড়ি কাটার কাজ সারতো, কারণ ঘরে পর্যাপ্ত আলো ছিল না। চারপাইয়ে কম্বল পাতা, গায়ে দুটো করে কম্বল, তারপরও শীত যাচ্ছিল না। এ অবস্থাতে দু’তিনদিন কেটে গেল। ৭ মার্চ আমরা হায়দ্রাবাদ ‘বি’ টিমের বিরুদ্ধে মাঠে নামলাম। হায়দ্রাবাদ ‘বি’ টিম আমাদের টিমের মতই, নিচের সারির টিম। তারপরও বলবোÑ তাদের খেলা আমাদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। রিসিভিং, পাসিং, ডজ, রানিং উইথ দ্য বল, ব্যক্তিগত স্কিলগুলো এবং দলীয় কম্বিনেশন আমাদের চেয়ে উন্নত। আমাদের ফুল ব্যাকদ্বয় সবসময় ভাল। হাফ লাইনটাও মোটামুটি ভাল। আমাদের ফরোয়ার্ড লাইনটাই ছিলো টিমের সবচেয়ে দুর্বল স্থান। আমি ইস্ট পাকিস্তান হকি টিমে ১৯৬০ সাল থেকে খেলে আসছি। এযাবৎ মানসম্মত ফরোয়ার্ড লাইন পাইনি, খেলে কখনও সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমাদের ফরোয়ার্ডদের দুর্বলতার কারণে আমরা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ হকিতে একটি ম্যাচও জিততে পারিনি। হায়দ্রাবাদ ‘বি’ টিম এবং আমাদের টিম প্রায় সমমানের হওয়ায় খেলাটি বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উত্তেজনাপূর্ণ হয়েছিল। বরাবরের মত এবারও আমাদের ফুলব্যাকদ্বয় মোমতাজ ও সেরা হায়দ্রাবাদ টিমের আক্রমণগুলো প্রতিহত করতে ব্যস্ত ছিল আর হাফ লাইন মোমিন, সাদেক ও আবিদ ফরোয়ার্ডদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আমরা ফরোয়ার্ডরা দক্ষতা এবং সমঝোতার অভাবে বল অল্প সময়ের জন্যও ওপরে ধরে রাখতে পারছিলাম না। খেলাটা বেশিরভাগ সময় মাঝমাঠে সীমাবদ্ধ ছিল। এমনি করে খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা শট কর্নার (পেনাল্টি কর্নার) আমাদেরকে অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়েছিল।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হকি সেক্রেটারি লালা আইয়ুব বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী একজন ক্রীড়া সংগঠক। পেশাওয়ারে তার হোটেল ব্যবসা ছিল। চমৎকার তার ব্যবহার, ছোট-বড় সবাই তাকে সমাদরের চোখে দেখতো। আমাদের ম্যানেজার আলমগীর আদেলের শ্বশুর ছিলেন রাজনীতিবিদ, পাকিস্তান এসেম্বলিতে তিনি ছিলেন চিফ হুইপ, আমাদের সহকারী ম্যানেজার সামি খান একজন পাঠান, তার জন্মস্থান পেশাওয়ারে। সেজন্য আমরা পেশাওয়ারে যে ক’দিন ছিলাম, আলাদা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বেশ আরামে কাটিয়েছিলাম। শোনা যায়, পাঠানরা নাকি বছরে একবার গোসল করে। প্রতিদিন গোসল করা অভ্যাস আমাদের। আমরাও পেশাওয়ারে গোসল করতে চাইতাম না শীতের ভয়ে। তবে পেশাওয়ারে গোসল করার ভাল ব্যবস্থা ছিল। চুল কাটার সেলুনের সাথে একটি হামমাম (গোসলখানা) যেখানে গরম পানি আর ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা থাকতো। আমরা সেখানে দু’একদিন করে গোসল করেছিলাম।
একদিন রেস্টুরেন্টে চা খেতে গিয়েছিলাম। চা তো নয়, কাওয়া। হাল্কা রং চা, তবে তাতে এলাচ-দারুচিনি দেয়া। একটি টি-পটে কাওয়া, সাথে ছোট ছোট বাটির মত কাপ। সবগুলোই ভাঙ্গা, আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি মা ভাঙ্গা প্লেট-কাপে খেতে দিতেন না। বলতেন, ভাঙ্গা থালা-বাসনে খেলে কপালটা ছোট হয়ে যায়। টি-বয়কে ডেকে বললাম, এগুলো নিয়ে যাও, নতুন করে ভালো চায়ের সরঞ্জামে করে নিয়ে আস। টি-বয় উত্তর দিল, দোকানের সব জিনিসপত্র একইরকম জোড়া লাগানো। ভাবলাম, চায়ের দোকানের মালিক গরিব, তাই জোড়া লাগিয়ে কাজ চালাচ্ছে। অন্য একদিন বড় এক দোকানে খেতে গিয়ে যা দেখলাম, সেখানকার থালা-বাসনগুলো মিউজিয়ামে রাখার মত! টি-পট কয়েক টুকরো, চায়ের কাপও বেশ অনেকগুলো টুকরো, জোড়া লাগানো, টি-পট এবং কাপের আসল রূপটি পরিবর্তন হয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছিল ওগুলোর ওপর পোকা-মাকড় মরে লেপটে রয়েছে। রেস্টুরেন্ট মালিককে জিজ্ঞেস করায় আসল রহস্য বের হয়ে আসল। যে দোকানের চায়ের কাপ যত বেশি ভাঙ্গা-জোড়া লাগানো থাকবেÑ সেটাই আসল খানদানী, সেটাই তাদের ঐতিহ্য।
‘লান্ডি-কোতাল’ : উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের শেষ সীমানা, আফগানিস্তানের বর্ডার সংলগ্ন একটি স্থান বা মার্কেট। ল্যান্ডি-কোতাল মার্কেট হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিদেশী জিনিসপত্র পাওয়া যেত বলে সবার কাছে আকর্ষণীয় মার্কেটও ছিল সেটা। লালা আইয়ুব গাড়ি ও একজন মানুষ দিয়ে আমাদেরকে লান্ডি-কোতাল বেড়াতে পাঠিয়ে ছিলেন। এক সকালে আমরা রওনা দিলাম, কয়েক মাইল যাবার পর গাড়ি আর আগে যেতে পারছিল না। লাইন করে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে গেছে, মানুষ সব সামনের দিকে তাকিয়ে। গোলাগুলির শব্দ শুনছে। সামনেই দুই কাবিলার (গোষ্ঠী) মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ চলছে, তাই সাহস করে গাড়ি আর সামনে এগুচ্ছে না, অপেক্ষা করছে। কখন গোলাগুলি শেষ হবে, তারপর গাড়ি চলবে। এ জায়গাটার নাম জানি না, সমতল ভূমি, রাস্তার দু’ধারে দুটো দুর্গের মত। গোষ্ঠীগতভাবে এরা দুর্গের মত প্রাচীর দিয়ে ঘিরে তার ভেতর বাড়িঘর তৈরি করে বসবাস করে। আলাদাভাবে বানানো ঘরবাড়ি এ এলাকায় চোখে পড়েনি। শোনা যায়, পাঠানদের জাতিগত-গোষ্ঠীগত বিবাদ শেষ হয় না, বংশের পর বংশ চলতে থাকে।
ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করে। মনে হলো এরকম ঘটনা এখানে প্রায় ঘটে এবং স্বাভাবিক ঘটনা বলে সবাই ধরে নেয়। পাকিস্তান সরকারও এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে পারতো না, পাঠানদের নিজস্ব আইনেই তারা চলতো। গাড়ি ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরের দিকে চলছিল। আঁকাবাঁকা যে পথ ধরে আমরা যাচ্ছিলাম, সেটাই হলো খাইবার পাস বা খাইবার গিরিপথ।
আমাদের গাড়ি তখন পাহাড়ের অনেক উঁচুতে নিচে তাকাতে ভয় লাগছিল, কয়েক হাজার ফুটের খাদ, একবার দুর্ঘটনা ঘটলে আর রক্ষা নেই। কিছুক্ষণ পর একটি সেতুর কাছে গিয়ে গাড়ি থেমেছিল। সেতুর নাম ভুলে গেছি। দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করেছে সরু এই সেতুটি। সেতুর দু’ধারে চেকিং হয়। পাশাপাশি দুটো গাড়ি চলতে পারে না বলে একধার দিয়ে গাড়ি চললে অন্য ধারে গাড়ি বন্ধ থাকেÑ এভাবেই সেতুর চলাচল ব্যবস্থা। সেতুর ওপর খুব ধীরগতিতে গাড়ি চলছিল, নিচে তাকিয়েছিলাম, মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। কয়েক হাজার ফুট নিচে সরু একটি নদী বয়ে যাচ্ছে। দু’তিন মিনিট লেগেছিল ব্রিজ পার হতে। গাড়ি আর এক পাহাড়ের গা ঘেঁষে নিচে নামতে শুরু করে দিয়েছিল। আমরা পাহাড়ের কোলেই দু’তিন ঘন্টা কাটিয়ে আবার সমতলে এসে হাফ ছেড়েছিলাম। কিছুদূর চলার পর আমাদের সাথে আসা লালা আইয়ুবের লোক গাড়ি থামার নির্দেশ দিলেন। গাড়ি থেকে নেমে আমরা ভদ্রলোকের পেছন পেছন কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটি বাড়ির সামনে এসে থামলেন, তার সঙ্গে বাসার ভেতর ঢুকেছিলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলামÑ এগুলো কি সত্যি সত্যি পিস্তল, নাকি খেলনা। এরই মধ্যে একজন লোক হাতে করে দুটো পিস্তল এনে আলমগীর ভাইয়ের সামনে ধরে বললো, বলেন তো কোনটা জার্মানির তৈরি আর কোনটা আমাদের এখানের তৈরি? চিনতে পারবেন না, একই রকম দেখতে, কাজও করবে একইরকম। চেনা মুশকিল, কোনটা আসল কোনটা নকল।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো এবং কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের গন্তব্যস্থল লান্ডি-কোতাল এসে থামলো। গুলিস্তান হকার্স মার্কেটের মত টিনশেডের ছোট ছোট দোকান। বিদেশী কাপড়চোপড়, ক্রোকারিজ, মেয়েদের সাজসজ্জার জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা ছোট ছোট দোকানগুলো।
পাকিস্তানে বিদেশী জিনিসপত্র নিষিদ্ধ ছিল, বিশেষ করে ইন্ডিয়ার জিনিস একেবারেই ব্যান্ড ছিল। লান্ডি-কোতালে ইন্ডিয়ান ছবির গানের রেকর্ড সবার কাছে ছিল লোভনীয়। সে সময় লং প্লে রেকর্ডের পাশাপাশি নতুন বের হওয়া সিডির ন্যায় পাতলা রেকর্ড পাওয়া যেত। অনেকে সেগুলো কিনেছিল।
আমি জাপানি টোয়েবরো শার্টের কাপড় কিনেছিলাম। সাদা রংয়ের। সবেমাত্র সুতি সিনথেটিক্স মিক্স করা কাপড় বাজারে এসেছে লোভনীয় কাপড়। বোন এবং ভাবীর জন্য কাপড়, সাবান, কিছু সাজগোজের জিনিস কিনেছিলাম। চায়নার তৈরি ড্রাগনের ছবিওয়ালা একটি কফিসেট কিনেছিলাম। ছোট্ট ব্লু রং-এর কফিসেটটি আজো আমার শোকেসে সযতেœ রক্ষিত রয়েছে। যখনই সেটার ওপর চোখ পড়ে, লান্ডি-কোতালের ভ্রমণটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। খোলা আকাশের নিচে স্তূপ করা বন্দুক-পিস্তলের গুলি এমনভাবে রাখা ছিল যেমন আমাদের দেশে বড় টুকরিতে কালোজাম স্তূপ করে রাখা হয়। পিস্তল এবং দেশী বন্দুক বিক্রি হচ্ছিল অন্যান্য জিনিসপত্রের মত। এক অদ্ভুত মার্কেট লান্ডি-কোতাল। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল, ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিদেও পেয়েছিল। আমাদের সাথে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি আমাদেরকে এক গোস্তের দোকানে নিয়ে গেলেন। আমাদের দেশের খাসির মাংসের দোকানে যেমন জবাই করা খাসি দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়, তেমনি দুম্বার মাংসগুলো দড়িতে ঝোলানো, পাশেই জ্বলন্ত চুলায় বড় কড়াই। কত সের মাংস লাগবে বলার সাথে সাথে কসাই ঝুলন্ত মাংস থেকে মাংস কেটে নিমিষেই টুকরো করে কড়াইতে ফেলে দিয়েছিল। মাংস ধোয়া-বাছা নেই, রক্ত লেগে রয়েছে। কসাই ব্যাটা বাটি থেকে অল্প লবণ মাংসের ওপর ছিটিয়ে দিয়েছিল। অন্য একটি দোকান থেকে অল্প টমেটো কিনে এনে দিলে সেটাও মাংসের মধ্যে দিয়েছিল। কারো দেরি সহ্য হচ্ছিল না, কড়াই থেকে মাংস নিয়ে খাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। খাওয়ার আগে মনে হয়েছিল কি যে খাব আল্লাহই জানেন। মাংসের টুকরো মুখে দিতেই মনে হয়েছিল অমৃত! এটাই চাপলি কাবাব। সেরকম সুস্বাদু মাংস আমি আজ পর্যন্ত খাইনি।
পাঠান মুলুকে এভাবেই শেষ হয়েছিল আমার হকি সফর। #
(ক্রমশ:)
(তেপ্পান্ন) ১ জুলাই
সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের জাতীয় হকি টিম দু’সপ্তাহের ট্যুরে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সফরে এসে তিনটি হকি টেস্ট ম্যাচ এবং সাতটি প্রদর্শনী হকি ম্যাচ খেলেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের খেলা শেষ করে জাপানি হকি দল পূর্ব পাকিস্তানে শেষ প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে ঢাকায় এসেছিল।
পেশাওয়ার থেকে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা শেষে ঢাকায় ফিরেই হকি স্টিক তুলে রেখেছিলাম এবং আমি সে সময় আসন্ন ফুটবল মৌসুমের জন্য নিজেকে তৈরি করতে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। মেতে উঠেছিলাম ফুটবল নিয়ে। এরই মধ্যে জাপান জাতীয় হকি দলের ঢাকায় প্রদর্শনী ম্যাচের সংবাদ পেয়ে আবার ফিরে যেতে হয়েছিল হকি মাঠে। হকি কর্মকর্তারা তড়িঘড়ি ট্রায়াল ডেকে টিম গঠন করে সে টিমের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আমাকে মনোনীত করেছিল।
ইতোমধ্যে (ঢাকায় আসার পূর্বে) জাপানি হকি টিম তিনটি টেস্ট ম্যাচের প্রথমটি রাওয়ালপিন্ডিতে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান টিমের সাথে ড্র করে নিজেদের শক্তির আভাস দিয়েছিল; তবে পরবর্তী লাহোর এবং করাচি টেস্টে পাকিস্তান তাদের পরাজিত করে সিরিজ জয় করে নিয়েছিল। পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর এবং কোয়েটায় জাপান দল প্রদর্শনী ম্যাচ জিতলেও হায়দ্রাবাদ, মুলতান, লায়ালপুর ও পেশাওয়ারে পরাজিত হয়েছিল এবং তাদের সফরের শেষ প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য ১৯ এপ্রিল ’৬৪ ঢাকায় পৌঁছেছিল।
সময় স্বল্পতার জন্য আমাদের টিম প্র্যাকটিস সেরকম করা হয়নি। তাছাড়া আমাদের হকি খেলোয়াড়দের ইতিপূর্বে কোনো আন্তর্জাতিক দলের সাথে খেলার সৌভাগ্য হয়নি। জাপানি দলের সাথে প্রথম খেলা; সুতরাং টিমওয়ার্ক, অভিজ্ঞতা, দক্ষতাÑ সবকিছুরই ঘাটতি নিয়ে আমরা সেদিন বিকেল চারটায় ঢাকা স্টেডিয়ামে জাপানি জাতীয় টিমের মুখোমুখি হয়েছিলাম। খেলা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে মিলিত হয়েছিলেন প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী হাফিজুর রহমান। খেলার শুরু থেকে আমরা যেমন প্রাধান্য বিস্তার করার চেষ্টা করছিলাম, তেমনি জাপান দলও খেলাটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল; তাই প্রথম থেকেই খেলা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। জাপান দলের ছোট ছোট পাস এবং বল কন্ট্রোল স্থানীয়দের প্রশংসা কুড়িয়েছিল; বিশেষ করে তাদের দুই উইং চমৎকার খেলা প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে আমাদের উইং দুটো ছিল নিষ্প্রভ। রাইট আউট প্রতাপ বল পেয়ে খেলার চেষ্টা করলেও লেফট আউট মোবারক এতটাই ব্যর্থ ছিল যে, বল ধরতেই পারছিল না; তার কাছে বল গেলেই দর্শকরা চিৎকার করে তাকে আরও নার্ভাস করে দিচ্ছিল। আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড মজিদও ভাল খেলতে পারছিল না; সুতরাং আক্রমণভাগ ছিল ব্যর্থ আর সে সুযোগে জাপানি ডিফেন্স খুব স্বচ্ছন্দের সাথে খেলছিল। জাপানি গোলরক্ষক হাসহিমোটো একবারের জন্যও পরীক্ষিত হয়নি। জাপান দলের লেফট ইন ওকাবে এবং লেফট উইং কিহারা উভয়ের মধ্যে সমঝোতা এবং বল আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের ডিফেন্সের কাছে রীতিমত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। খেলার দশ মিনিটের সময় লেফট উইং কিহারা বল ড্রিবল করে আমাদের ডিফেন্সকে পরাজিত করে ‘ডি’র ভেতর ঢুকে পড়ে এবং তাদের রাইট উইঙ্গার টাকিজাওয়ার উদ্দেশে বল পুশ করে দেয় কিন্তু রাইট উইঙ্গার স্টিকে বল কানেক্ট করতে ব্যর্থ হলে জাপান নিশ্চিত একটি গোল থেকে বঞ্চিত হয়। প্রথমার্ধের শেষদিকে আমাদের ডিফেন্স এবং গোলরক্ষক জাম্বুর ভুল বোঝাবুঝির জন্য জাপান দলের সেন্টার হাফ বল পেয়ে যায় এবং ফাঁকা পোস্টে হিট বাইরে মেরে আরও একটি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করে। আমাদের ফুলব্যাকদ্বয় মোমতাজ এবং সেরা বিপক্ষ দলের আক্রমণগুলো দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করছিল। রাইট হাফ মোমিন ভাই এবং লেফট হাফ হাশিম দ্রুতগতিসম্পন্ন জাপানি দুই উইংকে ভালভাবেই সামাল দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমার্ধে জাপান টিম একটি শর্ট কর্নার এবং একটি লং কর্নার পেয়েও সেটা থেকে কোনো সুফল লাভ করতে পারেনি। গোলশূন্য অবস্থায় প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মিনিটের সময় জাপান দলের লেফট ইন ওকাবের কাছ থেকে একটি থু্রু পাস পেয়ে লেফট উইঙ্গার কিহারা দ্রুতগতিতে স্ট্রাইকিং সার্কেলে ঢুকে পোস্টে হিট চালায়Ñ যা জাম্বুর ব্যর্থতার জন্য গোলে পরিণত হয়। গোল শোধ করার জন্য আমরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, সুযোগও পেয়েছিলাম দ্বিতীয়ার্ধের ২৮ মিনিটের সময়। আমি একটি বল পেয়ে দু’তিনজন জাপানি ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে স্ট্রাইকিং সার্কেলে ঢুকে সজোরে হিটের মাধ্যমে গোল করি কিন্তু দুর্ভাগ্য! আম্পায়ারের বাঁশি, স্টিক, গোল বাতিল। গোলে হিট করার মুহূর্তে আমার স্টিক আমার কাঁধের ওপরে উঠেছিলÑ এ অপরাধে গোল বাতিল করেছিলেন আমাদেরই আম্পায়ার। শেষ পর্যন্ত জাপান আন্তর্জাতিক হকি টিম শেষ প্রদর্শনী ম্যাচে আমাদের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে জয়ী হয়ে তাদের সফর শেষ করেছিল।
খেলা শেষে কেন্দ্রীয় যোগাযোগমন্ত্রী খান এ সবুর দু’দলের খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। প্রাদেশিক যোগাযোগমন্ত্রী নওয়াব খাজা হাসান আসকারী এবং স্পিনার প্রাদেশিক এসেম্বলি আবদুল হামিদ মাঠে উপস্থিত থেকে খেলা উপভোগ করেন।
দু’টিমের খেলোয়াড় : জাপান : হাসিমোটো, টি ইয়োজাকি, এ টাকাসিমা, কে. ইয়োজাকি, কে. ইওয়াহসি, টি. ইয়ামাওকা, কে. টাকিজাওয়া, এস. কাওকু এইচ, টানাকা, এসওকাবে এবং এস কিহারা।
পূর্ব পাকিস্তান : মো. সেলিম জাম্বু, মোমতাজ, এসএম সেবা, মোমিন, সাদেক, হাশিম, প্রতাপ, নিয়াজ, মজিদ, বশীর এবং মোবারক।
আম্পায়ার : এসএম আইয়ুব এবং আলমগীর আদেল।
পরদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকা লিখেছিল : পূর্ব পাকিস্তানী খেলোয়াড়গণ যদিও কোন আন্তর্জাতিক দলের সহিত ইতিপূর্বে খেলার সৌভাগ্য লাভ করে নাই, সেই তুলনায় প্রথম খেলা খুব একটা আশার ব্যাপার না হইলেও নৈরাশ্যজনক নয় ও বশীর যে ধরনের ক্রীড়া প্রদর্শন করিয়াছে, তাহা অনেককেই আশান্বিত করিয়াছে। তার বল কাটাইবার পদ্ধতি জাপান আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের মাঝে মাঝে হতচকিত করিয়া দিয়াছে।
দৈনিক আজাদ লিখেছিল : ‘পূর্ব পাকিস্তান দল পরাজিত হইলেও গতকল্য তাহারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত খেলার সূচনা করে কিন্তু দলীয় সমঝোতার অভাব এবং আক্রমণভাগ বিশেষ করিয়া লেফট আউট মোবারক, সেন্টার ফরোয়ার্ড মজিদের ব্যর্থতার দরুন তাহারা অনেক সুযোগ পাইয়াও কোন কাজে লাগাইতে পারে নাই। পূর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক লেফট-ইন বশীর নিঃসন্দেহেই অনবদ্য ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। কিন্তু সহযোগীদের ব্যর্থতা তাহার কৃতিত্বকে ম্লান করিয়া দেয়।
জাপান জাতীয় হকি টিম দেশে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাদের টিম লিডার মি. কে. ইওয়াহাসি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘ঐব ধিং ঃধশবহ ধনধপশ নু ঃযব ঢ়বৎভড়ৎসধহপব ড়ভ ঃযব ঊধংঃ চধশরংঃধহ ঃবধস রহ ঃযব ঊীবনরঃরড়হ সধঃপয ড়হ সড়হফধু ধহফ পড়ঁষফ যধৎফষু নবষরবাব রঃ ঃযধঃ যরং ঃবধস ধিং ৎবংঃৎরপঃবফ ঃড় ধ ংড়ষরঃধৎু মড়ধষ ারপঃড়ৎু.’ অংশবফ রভ ধহু ড়ভ ঃযব বধংঃ চধশরংঃধহ নড়ুং রসঢ়ৎবংংবফ যরস, যব সবহঃরড়হবফ ইধংযরৎ রহ ঃযব ভড়ৎধিৎফ ষরহব যিড় যব ংধরফ, ধংঃড়হরংযবফ যরস রিঃয যরং ধৎঃরংঃরপ ংঃরপশ ড়িৎশ ধহফ পষবধহ ঢ়ষধু ধহফ ফবভরহরঃবষু ঢ়ঁঃ ঁঢ় ধ ংযড়ি নবঃঃবৎ ঃযধহ ংড়সব ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ ঘধঃরড়হধষ চষধুবৎং’.
(ক্রমশ:)
(চুয়ান্ন) ১৬ জুলাই
গত বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং কাব বনাম ফায়ার সার্ভিস টিমের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল রিটার্ন লীগ পদ্ধতিতে ১৯৬৪ সালের ফুটবল লীগ। টিমগুলো ছিল মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, পিডব্লিউডি, আজাদ, ওয়ারী, বিজি প্রেস, সেন্ট্রাল স্টেশনারি, রেলওয়ে, পুলিশ, ইস্পাহানী ও সেন্ট্রাল জেল ফুটবল দল। ৪ মে আরম্ভ হওয়া লীগের শুভসূচনা করেছিল মোহামেডান ৩-০ গোলে ফায়ার সার্ভিস টিমকে পরাজিত করে, যার দুটি গোল করেছিল আনসার এবং একটি গোল ছিল আবদুল্লাহর। লীগের ২য় দিনের খেলায় বল মাঠে গড়ায়নি। ইস্পাহানী বনাম স্টেশনারি টিমের খেলা ছিল। হঠাৎ করেই ইস্পাহানী টিম লীগ খেলা থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়, তাই সেবারের লীগে এগারটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। পিডব্লিউডি পুলিশ টিমকে ৩-০ গোলে হারিয়ে আরম্ভটা ভালই করেছিল (আঞ্জাম-২, মঞ্জু-১ গোল করেছিল)। আজাদ স্পোর্টিং তাদের প্রথম খেলায় ৩-১ গোলে প্রেস টিমকে হারিয়ে লীগ শুরু করেছিল। নিশিথ ২ এবং মুক্তা করেছিল ১ গোল। আমাদের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল রেল দলের বিরুদ্ধে। এ খেলায় আবদুল্লাহ ২, প্রতাপ ও আমি ১টি করে গোল করায় আমরা ৪-০ গোলে জয়লাভ করি। সেবারের লীগের প্রথম হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্বটা ছিল ফায়ার সার্ভিস টিমের হাকিমের, সে সুবাদে ফায়ার সার্ভিস ৬-০ গোলে সেন্ট্রাল জেল দলকে পরাজিত করেছিল। ৯-৫-৬৪ তারিখে ছিল ভিক্টোরিয়া টিমের প্রথম খেলা আজাদ স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে। প্রথম ম্যাচেই ভিক্টোরিয়া জানিয়ে দিয়েছিল যে, তারা কত দুর্ধর্ষ টিম। আজাদ স্পোর্টিংকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে তারা ৯-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। ওমর একাই দুটি হ্যাটট্রিকসহ ৬ গোল এবং আব্বাস, ফাতেহ মোহাম্মদ ও ইউসুফ সিনিয়র ১টি করে গোল করেছিল। পুলিশ দল তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে ৪-১ গোলে প্রেসকে পরাজিত করে। সামিউদ্দিনের হ্যাটট্রিকটি ছিল ওয়ারী কাবের পক্ষে, যার দ্বারা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে ৩-১ গোলে (আজিজ) পরাজিত করেছিল। পিডব্লিউডি টিমও মাকরানী খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়ে শক্তিশালী করেছিল। জব্বার, আবু জান তাদের মধ্যে কৃতী খেলোয়াড় ছিল, যার সুবাদে পরবর্তী খেলায় তারা রেল দলকে ৬-০ গোলে পরাজিত করেছিল। আবু জান ৪, রহিম ও জব্বার ১টি করে গোল করে। ১১-৫-৬৪ তারিখের মোহামেডানের খেলায় মুসা একাই ৫ গোল (হ্যাটট্রিকসহ) করে স্টেশনারি দলকে ৫-০ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পরদিনই আব্বাসের হ্যাটট্রিক এবং ইউসুফ সিনিয়র ও হাসানের ১টি করে গোল দ্বারা ভিক্টোরিয়া পুলিশকে ৫-০ গোলে পরাজিত করে। ৮-১২ মে মাত্র পাঁচদিনে ৬টি হ্যাটট্রিক হয়েছিল, যা এর পূর্বে কখনও এরকম হয়নি। পিডব্লিউডি টিম যে শক্তিশালী টিম হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ তারা পরবর্তী খেলাগুলোতে দিতে শুরু করেছিল ডিসি জেল টিমকে ১০-১ গোলে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। ভিক্টোরিয়া তাদের পরবর্তী (১৬-৫-৬৪) খেলায় তান্ডব চালিয়েছিল রেল টিমের ওপর। ফতেহ মোহাম্মদের হ্যাটট্রিক (৩ গোল) ইউসুফ সিনিয়র ৩, আব্বাস ৩, কামাল ২ গোলের সুবাদে রেল দলকে উড়িয়ে দিয়েছিল।
আজাদ স্পোর্টিং ২-১ গোলে ওয়ারীকে, ফায়ার সার্ভিস প্রেসকে ৩-১ গোলে, পিডব্লিউডি ১-০ গোলে স্টেশনারি টিমকে, মুসার ৩ গোল, আঙ্গুর ও প্রতাপ ১টি করে গোল করলে মোহামেডান পুলিশ দলকে ৫-০ গোলে পরাজিত করার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছিল ফুটবল লীগ।
লীগের প্রথম অঘটন ঘটেছিল ২০-৫-৬৪ তারিখে যখন দুর্ধর্ষ ভিক্টোরিয়া কাব দুর্বল প্রেস টিমের সাথে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। জালাল গোল করে তার প্রেস দলকে কিছুক্ষণের জন্য জয়ের আসা দেখালেও দেশের প্রখ্যাত সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর গোল শোধ করে ভিক্টোরিয়ার মান বাঁচিয়েছিল। লীগের সবচেয়ে নিচের সারির দল ডিসি জেল ৩-১ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে পরাজিত করে চমক দিয়েছিল। লীগের পরবর্তী খেলাগুলোর মধ্যে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে ওয়ারীকে, ওয়ান্ডারার্স ৬-০ গোলে জেল টিমকে, মোহামেডান ৬-১ গোলে আজাদকে পরাজিত করলেও প্রেস দলের ২-০ গোলে ওয়ান্ডারার্সকে হারানোটাই ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। আজাদ ও রেল ১-১ গোলে করে ১-১ পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া গফুর, ওমর, আব্বাস ও ইউসুফ সিনিয়রের দেয়া ৪-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে পরাজিত করে তাদের জয়ের চাকা সচল রেখেছিল। পুলিশ ২-০ গোলে ওয়ারীকে, মোহামেডান ২-১ গোলে পিডব্লিউডিকে, স্টেশনারি ২-১ আজাদকে, রেল দল ওয়ান্ডারার্স কাবের সাথে ০-০ ড্র, ফায়ার সার্ভিস ১-০ গোলে পুলিশকে, পিডব্লিউডি টিম ৪-০ গোলে প্রেসকে, রেল দল ৩-০ গোলে পুলিশকে, ওয়ান্ডারার্স এবং আজাদ গোলশূন্য ড্র, ওয়ারী ২-১ গোলে প্রেসকে পরাজিত করে। ফায়ার সার্ভিস ২-১ গোলে পিডব্লিউডি টিমকে, স্টেশনারি ৪-১ গোলে ডিসি জেলকে পরাজিত করে লীগের প্রথম পর্বের শেষের দিকে এগিয়ে যায়।
ঢাকার দুটি ঐতিহ্যবাহী টিম ঢাকা মোহামেডান এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স টিমের মধ্যে খেলা হয়েছিল ৭ জুন ’৬৪ ঢাকা স্টেডিয়ামে। দুটি টিম যখনই মুখোমুখি হয়েছে, তখনই মাঠে এবং বাইরে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এই মর্যাদার ফুটবল ম্যাচে আমরা অর্থাৎ মোহামেডান কাব মুসার দেয়া একমাত্র গোলে ওয়ান্ডারার্স কাবকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। জামিল আক্তারের হ্যাটট্রিক (৩ গোল), জাম্বু ও শামসুদ্দিনের ১টি করে গোলের সুবাদে ওয়ারী ৫-১ গোলে রেল দলকে পরাজিত করেছিল। ভিক্টোরিয়া ১১-১ গোলের বড় ব্যবধানে ডিসি জেল দলকে পরাজিত করে তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঢাকা মোহামেডানও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে প্রেসকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে ছুটে চলেছিল। রেল ২-১ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া তাদের আর এক প্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে হারিয়েছিল ওমর এবং ইউসুফ জুনিয়রের দেয়া ৪ গোলে। আজাদ ১-০ গোলে পুলিশকে, স্টেশনারি ৩-০ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল এবং সমমানের দুটি টিম ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ফায়ার সার্ভিসের খেলা ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। মোহামেডান তাদের পরবর্তী খেলায় (১৩-৬-৬৪) আবিদ-মুসা দু’ভাইয়ের দেয়া ৫ গোল এবং আনসারের করা ২ গোলের সুবাদে ওয়ারী কাবকে ৭-০ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নশিপের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। পরদিনই অর্থাৎ ১৪-৬-৬৪ তারিখে শক্তিশালী ভিক্টোরিয়ার খেলা পিডব্লিউডি টিমের সাথে ২-২ গোলে ড্র হলে তাদের চলার গতিটা কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে যায়। লীগের অন্যান্য খেলায় ওয়ারী ১-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে, পুলিশ ৬-০ গোলে জেল টিমের বিরুদ্ধে বড় জয় পেয়েছিলÑ যার মধ্যে সাত্তারের ৩ গোল, আক্তার ২, ধীরেন করেছিল ১ গোল। সাত্তার ছোটখাটো গড়নের খেলোয়াড়, সারাক্ষণ ছুটোছুটি করে খেলতো; মাঠে তার পায়ের চেয়ে মুখ চলতো বেশি। বিপক্ষ খেলোয়াড়দের সাথে তার লেগেই থাকতো, কখনও ফাউল করে কখনও গালাগালি করে। নিজের খেলোয়াড়কেও বকাবকি করতে ছাড়তো না। তবে তার আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না, খুবই পরিশ্রমী একজন খেলোয়াড় ছিল সে। আক্তার পুলিশ দলের দ্রুতগতির উইঙ্গার, হকি খেলারও সে ছিল দ্রুতগতির লেফট আউটের কৃতী খেলোয়াড়। পিডব্লিউডি টিম আজাদ স্পোর্টিংকে ১-০ গোলে এবং প্রেস টিম জেল দলকে ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে জয়ী হয়েছিল। পুলিশের সেই ছোটখাটো সাত্তারের দেয়া দু’গোলের সুবাদে শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে ২-১ পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল পুলিশ ফুটবল দল। পিডব্লিউডি ২-০ গোলে ওয়ারীকে হারিয়েছিল। ১৮-৬-৬৪ ফুটবল লীগের প্রথম পর্বের শেষ খেলা ছিল লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ প্রত্যাশী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী টিম মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া কাবের মধ্যে ১৮ জুন ১৯৬৪ তারিখে। খেলার মান-মর্যাদার লড়াই দেখতে স্টেডিয়ামে উপচেপড়া দর্শক দুপুর থেকে ভিড় করেছিল। দু’টিমের খেলা মানেই আলাদা চাপ। খেলার ভেতর আর গ্যালারির দর্শকদের প্রত্যাশার চাপ সব মিলিয়ে দু’দলই বেশ সতর্ক হয়ে খেলা শুরু করেছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ধীরে ধীরে খেলা জমে উঠেছিল। আমাদের পক্ষে দু’ভাই আবিদ মুসা দু’গোল করলে ভিক্টোরিয়ার ছোট-বড় দুই ইউসুফও দু’গোল করেছিল এবং দু’দলই আত্মঘাতী গোল খেলে ৩-৩ গোলে খেলাটি ড্র হয়েছিল।
দু’দলে যারা খেলেছিল : ঢাকা মোহামেডানÑ গোলরক্ষক আক্তার, ফুলব্যাক-জহির ও দেবীনাশ, হাফব্যাক-রসুল বক্স, পিন্টু, আবিদ, ফরোয়ার্ড- প্রতাপ, আবদুল্লাহ, রহমত উল্লাহ,বশীর ও মুসা।
ভিক্টোরিয়া স্পোর্র্টিং : গোলরক্ষক-গোলাম হোসেন, ফুলব্যাক- খোদা বকশ ও খামিসা, হাফ ব্যাক- হাসান মুরাদ, গফুর, ফরোয়ার্ড- ইউসুফ জুনিয়র, আকবর, ওমর আব্বাস ও ইউসুফ সিনিয়র। রেফারি ছিলেন মাসুদুর রহমান।
ফিরতি লীগের শুরুতেই আমরা হোঁচট খেয়েছিলাম ফায়ার সার্ভিস টিমের সাথে ২-৩ গোলে হেরে গিয়ে। জামান করেছিল ২ গোল আর ওবায়েদ করেছিল ১ গোল। জামানÑ দেশের প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক সেদিনের তুখোড় ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলোয়াড় আর কর্নেল (অব.) ওবায়েদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। মোহামেডানের পক্ষে মুসা ও রহমত উল্লাহ দুটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। পরবর্তী খেলায় আমরা আবার জয়ের ধারায় ফিরেছিলাম মুসার হ্যাটট্রিক, আবদুল্লাহর ১ গোলের সুবাদে ৪-০ গোলের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে ভিক্টোরিয়া তাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল পুলিশকে ৩-০, আজাদকে ৭-১, পিডব্লিউডিকে ৭-১ গোলে বড় ব্যবধানে হারালেও ১-৭-৬৪ তারিখে তারা ওয়ারী কাবকে ১৩-০ গোলে হারিয়ে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। ওমর একাই তিনটি হ্যাটট্রিকসহ ১০ গোল করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। বাকি গোলের ২টি করে আবদুল্লাহ ছোট ও মুরাদ করেছিল ১টি গোল। মোহামেডান স্পোর্টিং কাবও পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছিল ৫-০ গোলে স্টেশনারি টিমকে, প্রেসকে ৪-২ গোলে, পুলিশকে ৬-০, পিডব্লিউডিকে ৪-২ গোলে, আজাদ স্পোর্টিংকে ৪-০ গোলে, ওয়ারীকে ৫-১ গোলে হারিয়ে কিন্তু ফিরতি লীগে এসে ভিক্টোরিয়াকে কিছুতেই আটকানো সম্ভব হয়নি। ভিক্টোরিয়া যে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছিল, মোহামেডান সে গতিতে ১-৫ গোলের ব্যবধানে উড়ে গিয়ে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে ছিটকে বাইরে পড়ে গিয়েছিল। রিটার্ন লীগ পদ্ধতিতে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব ২০টি খেলায় প্রথম পর্বে মাত্র ৩টি টিমের সাথে বিজি প্রেস, পিডব্লিউডি এবং ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের সাথে ড্র করে ৩ পয়েন্ট হারিয়ে ৩৭ পয়েন্ট নিয়ে ১২ গোল হজম করে ১৯৬৪ সালের অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। ঢাকা মোহামেডান তিনটি হার ও একটি ড্র করে দ্বিতীয় স্থানে লীগ শেষ করেছিল। ভিক্টোরিয়া কাবের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর ৩৩টি গোল করে লীগের সর্বোচ্চ গোল করার সম্মান অর্জন করেছিল। # (ক্রমশ:)
(পঞ্চান্ন) ১ আগস্ট
সেলুনে বসে চুল কাটাচ্ছিলাম। সামনে রাখা ছিল মর্নিং নিউজ পেপার। ‘চধশরংঃধহ ঐড়পশবু ঞবধস অহহড়ঁহপবফ’. চোখে পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি পেপারটা হাতে তুলে নিয়ে দুরু দুরু বুকে লেখাটার ওপর চোখ বুলালাম। ‘বি’ অক্ষরটা চোখে পরলো না, মনে করলাম তাড়াতাড়ি চোখ বুলাতে গিয়ে চোখে পড়েনি। মনোযোগ দিয়ে পুরো লেখাটা পড়লাম। না, কোথাও ইধংযরৎ নামটা চোখে পড়ছে না! আবার পড়লাম, আমার নামটা পেপারে না দেখে মনটা হতাশায় ভরে উঠেছিল। দুঃখে-কষ্টে চুল কাটানোটা অসহ্য লাগছিল। বেচারাম দেউরির সেলুনের মালিক ও বারবার খানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে মন চাচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু বললামÑ তাড়াতাড়ি করো, ভাল লাগছে না। বাসায় ফিরে সোজা বাথরুমে, মাথার ওপর সাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে ভাবতে লাগলামÑ এটা কেমন হলো? চিফ কোচ দারা সাহেব ক্যাম্প শেষে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে ফুটবল খেলবে না, হকির চর্চায় থাকবে, ফাইনাল সিলেকশনটা পত্রিকার মাধ্যমে জানানো হবে। তারপরও কেন পত্রিকায় নাম নেই?
১৯৬৪ টোকিও অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পাকিস্তান হকি দলের ক্যাম্প লাহোর ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে করা হয়েছিল। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের কাঠফাটা গরমে অনুশীলন ক্যাম্প ছিল খুবই কষ্টের। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল স্টেডিয়ামের গ্যালারির নিচে তৈরি করা কক্ষগুলোতে। আমাদের ঢাকা স্টেডিয়ামের সে সময় এরকমই ব্যবস্থা ছিল। গ্যালারির নিচে তৈরি করা হয়েছিল প্লেয়ার্স লাউঞ্চ, সেখানেই আমাদের পূর্ব পাকিস্তান হকি, ফুটবল ক্যাম্প করা হতো। লাহোরের গরম বাতাস বড় বড় জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরে থাকা অসহ্য করে তুলতো। জানালা বন্ধ রাখাও সম্ভব হতো না; কারণ বাইরের তাপ ঘরের ভেতরটা বয়লারের মত হয়ে যেত। তাই কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক ঘরে একটি করে বড় বালতি, তার মধ্যে বরফেন পাটা (বড় বড় টুকরা) দিয়ে ঘরকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেছিল। গরম বাতাস ঠেকাতে বড় বড় জানালাকে বাঁশের তৈরি চিক (পাটি) দ্বারা বাইরে থেকে ঢেকে দেয়া হতো এবং চিকটাকে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে রাখা হতো। চারপাইয়ের ওপর পাতলা তোষক, বালিশ, চাদর ঘুমাবার জন্য ছিল; তবে রাতে ঘরের ভেতর ঘুমাতে পারা যেত না। কারণ সারাদিনের গরমের তাপ রাতে যেন বেড়ে যেত। দেয়াল থেকে গরমের তাপ যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতো। ঘুম হতো না, তাই গ্যালারির ওপরে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিকেলে আমরা অনুশীলনে গেলে বেয়ারা ঘরের চারপাইগুলোকে গ্যালারির ওপর নিয়ে লাইন করে সাজিয়ে রেখে যেত।
লাহোর স্টেডিয়াম শহর থেকে একটু দূরে বিরাট এলাকাজুড়ে। পাশেই নতুন শহর গড়ে উঠছিল, নাম দেয়া হয়েছিল গুলবার্গ। স্টেডিয়ামের ভেতরটা (মাঠ এলাকা) যেমন বড়, তেমনি পঞ্চাশ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা নিয়ে গ্যালারিটাও তদ্রূপ বড়। এই তো সেদিন ২৬-০৭-২০১০ তারিখে এএফসি থেকে ডেভেলপমেন্ট অফিসার ইমতিয়াজ রহমান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে এসেছিলেন আমাদের রেফারিজ কমিটির কার্যক্রম সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে। ইমতিয়াজ পাকিস্তানী। তার কাছেই শুনেছি যে, লাহোর ন্যাশনাল স্টেডিয়াম পূর্বের মতই আছে এবং হকির বড় খেলাগুলো সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। উন্নতির মধ্যে পাশে দুটো স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে, একটি সাইক্লিং ভ্যালোড্রাম, অন্যটি গাদ্দাফি স্টেডিয়াম, ক্রিকেটের জন্য। ভ্যালোড্রামটি সে সময় তৈরি হয়েছিল, তবে সম্পূর্ণ হয়নি। আমার দেখা প্রথম ভ্যালোড্রাম। সাইকেল রাস্তায় চলে, রোড রেস হয়, মাঠেও সাইকেল রেস হয় কিন্তু মাটির নিচে স্টেডিয়ামে, সুইমিংপুলের মতো গোলাকৃতিÑ যার পাড় কোথাও কিছুটা খাড়া, আবার কিছুদূর চেতানো। প্রথম দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম এই ভেবে যে, সাইকেল নিয়ে সাইক্লিস্টরা স্লিপ করে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় না কেন! ঢাকায় ফিরে এসে বন্ধুদের আড্ডায় ভ্যালোড্রাম নিয়ে গল্প করেছিলাম।
লাহোর স্টেডিয়ামের বিশেষত্ব হলো গ্যালারির নিচে যেখানে থাকার ব্যবস্থা, সেখান থেকে টানেলের (সুড়ঙ্গ পথ) ভেতর দিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে মাঠে যেতে হতো। প্রবেশ করতে মাঠের একপাশে চাকা লাগানো একটি বড় ঢাকনা দিয়ে সুড়ঙ্গ পথটি ঢেকে রাখা হয়। সকালে দু’ঘন্টা, বিকেলে আড়াই ঘন্টা অনুশীলনে যেতে হতো এই পথে। সকালের অনুশীলনে এই বিরাট স্টেডিয়ামের ৪ চক্কর থাকতো ওয়ার্মআপের জন্য। তারপর আর্মি থেকে আসা ট্রেনার করাতেন ব্যায়াম। শুয়ে ব্যায়ামের জন্য প্রত্যেকের জন্য একটি করে চিক বা পার্টি মাঠে বিছানো থাকতো, তার ওপর ব্যায়াম সারতে হতো। তারপর ব্যক্তিগত স্কিল, সেট প্র্যাকটিস, টিম প্র্যাকটিস চলতো পাক্কা দু’ঘন্টা। সকালের অনুশীলন শেষে আর্মি টিমের সেন্টার হাফ জাফর হায়াত বিরাট স্টেডিয়ামে নেমে পড়তো। ৩/৪/৫ চক্কর দৌড়াতো। তার সাথে আমিও দৌড়াতাম। মাঠ থেকে শেষে আমরা দুজন বের হতাম। ডাইনিং হলের পাশেই স্টেডিয়ামের দেয়াল ঘেঁষে রান্নার জন্য তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী রান্নাঘর। তন্দুর ছিল, বড় বড় চুলা ছিল। গরম গরম তন্দুরী রুটি আর মাংস খেতে খুব ভাল লাগতো। খাওয়া-দাওয়ার মান এবং পরিবেশ ছিল সম্মানজনক। বিকেল ৫টায় অনুশীলনের জন্য টানেল দিয়ে মাঠে গিয়ে উঠতেই প্রথম ধাক্কা খেতাম গরম বাতাসের। মনে হতো মুখটা বুঝি আগুনে ঝলসে গেল। ওয়ার্মআপ করেই গেমস খেলতে হতো, টিম আগে থেকে বানানো থাকতো। প্রতিদিনের প্রাকটিস ম্যাচ খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতো। প্রত্যেকেই খুব সিরিয়াস থাকতো মাঠে। প্রতিদিনের খেলা নিয়ে আলোচনা করতেন চিফ কোচ। বিকালের অনুশীলন শেষ করে ফ্রেশ হয়ে আমরা সেজেগুঁজে ডাইনিং হলে যেতাম, প্যান্টের সাথে ফুলহাতা শার্ট এবং পায়ে কালো জুতা পরতে হতো। ডিনার সেরে আমরা হাঁটতে বের হতাম। স্টেডিয়ামের ধরেকাছে দু’চারটি বাড়িঘর উঠলেও মাইলখানেক দূরে নতুন শহর গড়ে উঠেছিল; নাম দিয়েছিল গুলবার্গ। গুলবার্গের শপিং মার্কেটে কিছুক্ষণ বেরিয়ে ঠান্ডা পানি খেয়ে ফিরে আসতাম। সবচেয়ে ভালো লাগতো রাতের বেলায়। গ্যালারির ওপর খোলা আকাশের নিচে চারপাইয়ের ওপর শুয়ে আকাশের তারা গোনা আর নানারকম চিন্তা করা। প্রথমদিকে অস্বস্তি লাগতো, ঘুম হতো না; ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানের কৃতী ফুলব্যাক মুনীর দারের চারপাইয়ের আশপাশেই ছিল আমার চারপাই। মজার মজার গল্প শোনাতেন। উপদেশ দিতেন, অনেক রাত পর্যন্ত বকবক করে যেতেন, ক্লান্তিতে আমরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়তাম; কিন্তু তিনি তার কথা চালিয়েই যেতেন। আশ্চর্য হতাম, যখন দেখতাম সবার আগে তিনি মাঠে উপস্থিত। আমাদের প্রতিদিনের রুটিন প্রায় একইরকম ছিল।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মাসের গরম সহ্য করে প্রায় ৩৬ দিন ক্যাম্পের কঠিন অনুশীলন শেষ করেছিলাম এবং আশা করেছিলাম যে, পাকিস্তান হকি টিমের সদস্য হয়ে ১০ অক্টোবর থেকে আরম্ভ হওয়া টোকিও অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করার যে স্বপ্ন দেখতামÑ তা পূরণ হবে। কিন্তু মর্নিং নিউজ পত্রিকার ‘চধশরংঃধহ ঐড়পশবু ঞবধস অহহড়ঁহপবফ’ সংবাদটি আমার সে স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছিল।
ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ১৯৬৪ সালের ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার দুঃখ নিয়ে ঐতিহ্যবাহী আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল। স্থানীয় সাতটি দল- ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, পিডব্লিউডি, আজাদ স্পোর্টিং, ওয়ারী ক্লাব, ফায়ার সার্ভিস, সেন্ট্রাল স্টেশনারি এবং পাকিস্তান থেকে চারটি দল ইস্ট-ওয়েস্ট ক্লাব, কেপিটি (করাচি পোর্ট ট্রাস্ট), ওয়ারসেক এবং পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম-এর সাথে তিনটি বিদেশী টিম বার্মা, সিলোন এবং ইন্দোনেশিয়া মোট ১৫টি টিম নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে ১৬ অক্টোবর ১৯৬৪ থেকে গোল্ডকাপ শুরু হয়েছিল। প্রথমে এলিমিনেশন রাউন্ড, পরে রাউন্ড রবিন লীগ পদ্ধতিতে টুর্নামেন্টটিকে সাজানো হয়েছিল। এলিমিনেশন রাউন্ড শেষে আট টিমকে ২টি গ্রুপে ভাগ করে রাউন্ড রবিন লীগের মাধ্যমে খেলার ফিকশ্চার করা হয়েছিল।
গ্রুপ ‘এ’ : পাক ওয়েস্টান রেলওয়ে, বার্মা, ওয়ারসেক ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব।
গ্রুপ ‘বি’ : ইন্দোনেশিয়া, সিলোন (শ্রীলংকা), কেপিটি ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
২৫ অক্টোবর বার্মা এবং ওয়ারসেক খেলা দিয়ে শুরু হয়েছিল রাউন্ড রবিন লীগের খেলা। বার্মা ১-০ গোলে জয়লাভ করে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। ২৬ অক্টোবরের খেলা স্থগিত হয়েছিল। ২৭ তারিখে ভিক্টোরিয়া ৪-০ গোলে ওয়ারসেককে পরাজিত করেছিল। ২৯/১০/৬৪ তারিখে দুটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম খেলায় কেপিটি এবং সিলোন ২-২ গোলে ড্র করেছিল এবং দ্বিতীয় খেলাটি ঢাকা মোহামেডান এবং ইন্দোনেশিয়াও ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। ৩১ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়া ৪-২ গোলে সিলোনকে পরাজিত করে। ১ নভেম্বর দুটো শক্তিশালী টিম ভিক্টোরিয়া এবং ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে টিম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করলেও কেউ জিততে পারেনি; ০-০ ড্র। ২/১১/৬৪ আমরা (মোহামেডান) কেপিটির কাছে ০-১ গোলে হেরেছিলাম। শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া টিমও বার্মার কাছে ১-২ গোলে হেরে যায় ৩-১১-৬৪। ৪ তারিখের খেলায় কেপিটি ইন্দোনেশিয়াকে ২-১ গোলে পরাজিত করে ৫ তারিখে রেলওয়ে ২-০ গোলে ওয়ারসেক টিমকে সহজে পরাজিত করেছিল। রাউন্ড রবিন লীগের শেষ খেলায় আমরা সিলোনকে ৩-০ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
‘এ’ গ্রুপ থেকে বার্মা ২টি জয় এবং ১টি ড্র করে ৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষ থেকে সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। গ্রুপের অন্য দল রেলওয়ে ১টি জয়, ২টি ড্র করায় ৪ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। গ্রুপের শক্তিশালী দল ভিক্টোরিয়া ৩টি খেলার মধ্যে ১টি জয় এবং ১টি ড্র ও ১টি পরাজয়ের সুবাদে মোট ৩ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের তৃতীয় স্থান নিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে যায়।
‘বি’ গ্রুপ থেকে কেপিটি ২টি জয় এবং ১টি ড্র করে ৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থেকে সেমিফাইনালে চলে যায়। দ্বিতীয় টিম হিসেবে দুটি টিমের ৩ পয়েন্ট করে থাকায় গোল পার্থক্যে ঢাকা মোহামেডান ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। দুটো টিমেরই ২টি জয়, ১টি ড্র ও ১টি হার। তবে মোহামেডানের পক্ষে ৪ গোল, বিপক্ষে ২ গোল অর্থাৎ +২ গোল আর ইন্দোনেশিয়ার পক্ষে ৬ গোল, বিপক্ষে ৫ গোল অর্থাৎ +১। ৭ নভেম্বরে প্রথম সেমিফাইনাল কেপিটি বনাম পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে। কেপিটি ২-০ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে ফাইনালে উঠে যায় আর দ্বিতীয় সেমিফাইনালে আমরাও বার্মাকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উঠেছিলাম।
ফাইনাল খেলা ১০ নভেম্বর ’৬৪ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে তিল ধারণেরও অবস্থা ছিল না। সকাল ১১টা থেকে মানুষ স্টেডিয়ামে প্রবেশ করছিল। বেলা ২টায় গ্যালারি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। স্টেডিয়াম এলাকায় লোকে লোকারণ্য, মানুষ মানুষ আর মানুষ!
এত দর্শক হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল মানুষ মনে করতো পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে খেলা। দু’দলের নির্ভুল খেলোয়াড় তালিকা দেয়া সম্ভব নয়। ভুলে গেছি; তবে আমাদের গোলরক্ষক বলাই দে সম্ভবত ভারতে চলে গিয়েছিল। তার জায়গায় গোলপোস্টে খেলেছিল আক্তার। ফুলব্যাক- জহির (ক্যাপ্টেন), দেবীনাশ, রসুল বক্স। হাফে- পিন্টু আবিদ হোসেন, ফরোয়ার্ড- প্রতাপ, আব্দুল্লা, বশীর ও মুসা এবং কেপিটি টিমের মধ্যে আব্দুর রহমান, তোরাব আলী, তাকি প্রমুখ। খেলা খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। দু’দলই গোল করার সুযোগ নষ্ট করে। শেষ পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য ড্র হলে কর্তৃপক্ষ কেপিটি ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে জয়েন্ট চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৬৪ সালের আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের গৌরব দিয়ে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবছরের লীগ শিরোপা না পাওয়ার দুঃখকে কিছুটা হলেও লাঘব করতে সক্ষম হয়েছিল। #
(ক্রমশ:)
(ছাপ্পান্ন) ১৬ আগস্ট
ঢাকা হকি লীগের চূড়ান্ত (নির্ধারণী ম্যাচ) খেলা। ওয়ারী ক্লাব বনাম ই.বি. রেলওয়ে। জয়ী দল ১৯৬৪ সালের হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। লীগ শিরোপা অর্জনের জন্য গত বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান হকি টিম, ইবি রেলওয়ে, ওয়ারী, পিডব্লিউডি, কম্বাইন্ড টিমের মধ্যে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। আমরা অর্থাৎ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান বেশ কয়েকটি ম্যাচে সহজ গোল পায়নি, ড্র করে পিছিয়ে পড়েছিলাম।
‘সলিমুল্লাহ অরফানেজ’ নামে নতুন একটি হকি টিম সেবার লীগ খেলায় অংশ নিয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামের এক নম্বর মাঠে ওয়ারী এবং রেল দলের খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রেল দল চট্টগ্রাম বেইসড। চট্টগ্রাম থেকে খেলতে আসে। তাদের প্রায় সব খেলোয়াড় অবাঙ্গালি; সুতরাং ঢাকার দলগুলোর সাথে একটা পার্থক্য সব সময় থাকে। যদিও ওয়ারীর কয়েকজন অবাঙ্গালি খেলোয়াড় ছিল, তবুও খেলাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং বাঙ্গালি-অবাঙ্গালির রূপ নিয়ে নেয়। রেল দলের ক্রীড়ানৈপুণ্যের জন্য ঢাকার উল্লেখযোগ্য দর্শক তাদের সাপোর্টার ছিল। খেলার মান অনুযায়ী ওয়ারী-রেলের খেলাটি সেরকম উন্নত ছিল না; তবে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। খেলার প্রথমার্ধে ওয়ারী প্রাধান্য বিস্তার করে খেললেও রেল দলের রক্ষণভাগের দৃঢ়তার জন্য তাদের গোল করার পর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের চিত্র ছিল একেবারেই উল্টো। রেল দল খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রথম থেকেই ওয়ারীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং তিন মিনিটের সময় রেল দলের রাইট-ইন আনোয়ার হোসেন একক প্রচেষ্টায় গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। গোল খাওয়ার পর ওয়ারী অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে কিন্তু তাদের রক্ষণভাগে মমতাজ এবং শেরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রেল দলের আক্রমণগুলো প্রতিহত করে দেয়। রেলের একটি নিশ্চিত গোল আম্পায়ার ফরিদি বাতিল করে দেন। পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদি, ছ’ফুটের ওপর লম্বা, ফর্সা, একজন মানানসই পুলিশ অফিসার কিন্তু আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট। বিতর্কিত আম্পায়ার হিসেবে ঢাকার হকি মাঠে তার বদনাম ছিল। শেষ পর্যন্ত রেল দল ১ গোলেই সন্তুষ্ট থেকে ১৯৬৫ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
রেল দল : নবী (গোলরক্ষক), ইদ্রিস, নিয়াজ, ইসলাম, কালিম, আবিদ, জুলফিকার, জাহির, রহিম, আনোয়ার ও আলী।
ওয়ারী ক্লাব : সেলিম (গোলরক্ষক), মমতাজ, শেরা, পটলা, মোমিন, শামিম, হানিফ, সিকেন্দার, আহমেদ, ইউসুফ ও নুরুল।
১৯৬৫ সালের হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ পাঞ্জাবের ছোট্ট শহর লায়ালপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা থেকে লাহোর বিমানে এবং সেখান থেকে ট্রেনে করে লায়ালপুর। সবুজে ঘেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম সুন্দর শহর লায়ালপুর। এ চ্যাম্পিয়নশিপ সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখতে পারছি না; কারণ বহু স্মৃতি মাঝে মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি। তবে আমরা যে প্রথম খেলায় হেরে গিয়ে পত্রপাঠ বিদায় নিয়েছিলামÑ এটা সঠিক। এ মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠছে লায়ালপুরের ছোট্ট স্টেডিয়াম, পরিষ্কার গ্যালারি আর সবুজ সমতল খেলার মাঠটি। আর মনে পড়ছে পুরনো আমলের বিরাট গেট, আমাদের ছোট কাটারার মত, ওরা বলে দরওয়াজা, সেটাকে ঘিরে ছোট্ট মার্কেট, মার্কেটের একটি দোকান যে দোকানটি ‘রাবড়ি’ দুধের খির-এর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আমরা যে ক’দিন লায়ালপুর ছিলাম, প্রতিদিন সন্ধ্যায় দল বেঁধে এসে রাবড়ি খেতাম। আজও ভুলতে পারি না চুলায় চড়ানো ইয়া বড় কড়াইতে গরম গরম রাবড়ি, উহ! কি যে মজাদার!
অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ১৯৬৫ সালের ফুটবল লীগও দুর্দান্তভাবে শুরু করেছিল (১৭-৫-৬৫) রহমতগঞ্জ এমএফএ ক্লাবকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করার মধ্য দিয়ে। জব্বর হ্যাটট্রিক ৪ গোল, ওমর ২ গোল এবং আব্বাস ১ গোল করেছিল। লীগ চ্যাম্পিয়ন প্রত্যাশী ঢাকা মোহামেডান ৫-০ গোলে পিডব্লিউডিকে পরাজিত করে শুভযাত্রা করেছিল। গোল করেছিল এএন খান, আবিদ, আবদুল্লাহ গফুর, মুসা। এএন খান কোলকাতা থেকে এসেছিল, কোলকাতা লীগে খেলে থাকে। ছিপছিপে গড়ন, লম্বা লম্বা পাস দিয়ে খেলে, গোল করায় দক্ষ। আজাদ এবং রেল গোলশূন্য ড্র করে লীগ খেলা শুরু করেছিল। ওয়ারী পুলিশকে ১-০ গোলে হারিয়ে লীগ আরম্ভ করেছিল। আজাদ ০-৪ গোলে ভিক্টোরিয়ার কাছে হেরে হতাশ হয়েছিল। রহমতগঞ্জ তাদের প্রথম হারের বদলা নিয়েছিল রেল দলের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলের জয় দিয়ে। ফুটবল লীগের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব বিজি প্রেসকে ২-০ গোলে পরাজিত করে এগিয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস টিম ৩-১ গোলে স্টেশনারি টিমকে পরাজিত করে শুভ সূচনা করেছিল। লীগের অন্যতম শক্তিশালী ফুটবল টিম পিডব্লিউডি ৪-১ গোলে ওয়ারীকে পরাজিত করে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। আবিদ হোসেনের হ্যাটট্রিকের সুবাদে মোহামেডান ৯-২ গোলে পুলিশকে পরাজিত করে তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল। অন্যদিকে শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া দলের আব্বাস ৩, আবদুল্লাহ ৩, ওমর ৪ এবং জব্বরের ১ গোলের মাধ্যমে দুর্বল স্টেশনারি দলকে ধরাশায়ী করে দেয়। সমমানের ফায়ার সার্ভিস এবং রহমতগঞ্জ গোলশূন্য ড্র করে আবার নিচের সারির দল পুলিশ এবং আজাদ স্পোর্টিংও গোলশূন্য ড্র করে। মোহামেডান স্পোর্টিং দুর্বল বিজি প্রেস দলকে মুসার একমাত্র গোলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। ওয়ারী ও রহমতগঞ্জ ২-২ গোলে ড্র, পিডাব্লিউডি ২-১ গোলে স্টেশনারিকে, ভিক্টোরিয়া ৩-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে, প্রেস ৩-০ গোলে ওয়ারীকে পরাজিত করলেও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স আজাদের সাথে ০-০ ড্র করেছিল। দুর্বল স্টেশনারি ৩-২ গোলে রহমতগঞ্জকে হারিয়েছিল এবং প্রেস ও পিডব্লিউডি ১-১ গোলে ড্র করলে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ অনেকটা ভিক্টোরিয়া এবং মোহামেডান ক্লাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্বাসের ৪ গোল, জব্বারের ২ গোল, ওমর ও ইউসুফের গোলের সুবাদে ৮-১ গোলের ব্যবধানে ভিক্টোরিয়া ওয়ারীকে পরাজিত করে তাদের জয়ের চাকা সচল রেখেছিল।
লীগের পরবর্তী খেলাগুলো পুলিশ ২-১ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারালেও ওয়ান্ডারার্স-রহমতগঞ্জ ১-১ ড্র, আজাদ-স্টেশনারি ১-১ ড্র; এমনকি লীগ শিরোপা প্রত্যাশী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ৪-৬-৬৫ তারিখে ফায়ার সার্ভিস টিমের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে ১টি মূল্যবান পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। লীগের প্রথম অঘটনটি ঘটেছিল ৫-৬-৬৫ তারিখে, যখন শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া টিম পিডব্লিউডি টিমের কাছে ২-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল। পিডব্লিউডি টিমের মঞ্জুর এবং আদম ১টি করে গোল করেছিল এবং কানু করেছিল পেনাল্টি থেকে একটি গোল। পক্ষান্তরে ওমর এবং আব্বাস দুটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। গত তিন বছরের অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভঙ্গ হয় এবং ভিক্টোরিয়া প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছিল সেদিন।
৭-৬-৬৫ তারিখে আজাদ স্পোর্টিং ২-০ গোলে পিডব্লিউডি টিমকে পরাজিত করেছিল। যার একটি গোল করেছিল জামান, বর্তমানের প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক। অপরটি করেছিল বাটু। ৮-৬-৬৫ তারিখে ঢাকা মোহামেডান ক্লাব তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মুখোমুখি হয়েছিল। মোহামেডান এবং ওয়ান্ডারার্স মানেই উত্তেজনা, সেদিনও সেটার কমতি ছিল না। এএন খান এবং শামসু (মোহামেডান) দু’গোল এবং আমিনের (ওয়ান্ডারার্স) ১ গোল দু’দলকে খেলার শেষ পর্যন্ত চরম উত্তেজনায় রেখেছিল। অবশেষে মোহামেডানের মুখেই হাসি ফুটেছিল। পরদিনই অর্থাৎ ৯-৬-৬৫ তারিখে লীগের অন্যতম দুর্বল টিম বিজি প্রেসের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে মূল্যবান আরও একটি পয়েন্ট নষ্ট করেছিল ভিক্টোরিয়া।
শামসুর ২ গোল আর প্রতাপের ১ গোলের সুবাদে মোহামেডান তাদের পরবর্তী খেলায় ৩-০ গোলে স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। বিজি প্রেস ও রহমতগঞ্জ ৩-৩ গোলে ড্র, আজাদ ও ফায়ার সার্ভিস ১-১ গোলে, ওয়ারী ও রেল ২-২ গোলে ড্র, এমনকি ভিক্টোরিয়াও ২-২ গোলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সাথে ড্র করে চ্যাম্পিয়নশিপ দৌড়ে মোহামেডান থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। মোহামেডান তাদের পরবর্তী খেলায় শামসুর ৩ গোল, এএন খান, আবদুল্লাহ মুসা ও আমার দেয়া গোলে ৭-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবকে পরাজিত করে জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল। লীগের অন্যান্য খেলায় পিডব্লিউডি ১-০ গোলে রহমতগঞ্জকে, ভিক্টোরিয়া ৩-০ গোলে পুলিশকে, ওয়ারী ১-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে, পিডব্লিউডি ৫-০ গোলে রেলকে পরাজিত করেছিল। প্রতাপের দেয়া ৩ গোল, শামসুর ২ গোল, মুসা এবং আবদুল্লার গোলে মোহামেডান ৭-০ গোলের বড় জয় পেয়েছিল রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে। লীগের প্রথম পর্বের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ২০-৬-৬৫ তারিখে ঢাকা মোহামেডান বনাম ভিক্টোরিয়া ক্লাবের ম্যাচকে ঘিরে। খেলাটিকে চ্যারেটি ম্যাচ ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশের সেরা দুটো টিম। মাকরানী-নির্ভর ভিক্টোরিয়া দুর্ধর্ষ একটি টিম আর মোহামেডান স্থানীয় সাপোর্টার-নির্ভর শক্তিশালী টিম। দু’দলের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রশংসা করার মত। তাছাড়া তাদের দলগত সমঝোতা খুবই নিখুঁত। সুতরাং সেদিনের খেলাটি অত্যন্ত উঁচুমানের, আকর্ষণীয় এবং আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটি হয়ে উঠেছিল প্রতিদ্বন্দ্বিমূলক এবং উত্তেজনায় ভরপুর। মোহামেডানের এএন খান ও শামসু এবং ভিক্টোরিয়ার আব্দুল্লাহ আকবরের গোলে চ্যারিটি ম্যাচের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল। মোহামেডান ২-১ গোলে জয়ী হয়েছিল। প্রথম পর্বের পয়েন্টে ভিক্টোরিয়া মোহামেডান থেকে পিছিয়ে পড়ে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রথম পর্বের খেলায় ভিক্টোরিয়া ৯-০ গোলে রেল দলকে পরাস্ত করেছিল (ওমর ৪, আব্বাস ২, মুরাদ ১, জব্বর ১, ইউসুফ গোল করেছিল)। তাদের পরবর্তী খেলায় জব্বরের ডবল হ্যাটট্রিকের সুবাদে এবং আব্বাস ২, ইউসুফ গোল করায় রহমতগঞ্জকে ৯-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল। ফিরতি খেলায় রেল দলকে ইউসুফ ও আব্বাসের জোড়া হ্যাট্রিক এবং জব্বারের দেয়া গোলে ১০-০ গোলের বিরাট জয় পেয়েছিল। স্টেশনারি টিমকে তারা ৬-১ গোলে হারিয়ে তাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু ১৬-৭-৬৫ তারিখে তারা ফায়ার সার্ভিসের দ্বারা আবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ১-১ গোলে ড্র করে পয়েন্ট হারিয়ে। অন্যদিকে মোহামেডান ধীরগতিতে রেল দলকে ৫-০ গোলে হারিয়ে, ৫-০ গোলে ওয়ারীকে, প্রেসকে ২-১ গোলে, আজাদকে ২-০ গোলে, স্টেশনারিকে ৪-০ গোলে, ফায়ার সার্ভিসকে ২-০ গোলে এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে পুনরায় ১-০ গোলে পরাজিত করে জয়ের চাকাকে সচল রেখেছিল। ভিক্টোরিয়া পুলিশকে ৩-০ গোলে হারিয়ে আবার জয়ের ধারায় ফিরে যায় এবং তারা ৫-০ গোলে ওয়ারীকে, ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ৩-১ গোলে হারিয়ে লীগের দ্বিতীয় পর্বে পুনরায় মোহামেডানের মুখোমুখি হয়েছিল ৮-৮-৬৫ তারিখে। সেদিন ভিক্টোরিয়া অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মোহামেডানের মোকাবিলা করেছিল। আব্বাসের দেয়া একমাত্র গোলে তারা মোহামেডানকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে লীগে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করে মোহামেডান। আমাদের পরবর্তী খেলা ওয়ারীর সাথে। আবিদ মুসা ২ এবং আমার দেয়া গোলে আমরা ৪-০ গোলে জয়লাভ করি। ১১-৮-৬৫ থেকে ১৪-৮-৬৫ পর্যন্ত স্বাধীনতা দিবস ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া অংশগ্রহণ করেছিল এবং ফাইনালে এ দু’টিমেরই দেখা হয়েছিল। ওমরের দেয়া দু’গোলের সুবাদে তারা আমাদেরকে হারিয়ে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ১৫ আগস্ট ৬৫ পুনরায় লীগ খেলা শুরু হয়েছিল পিডব্লিউডি এবং পুলিশের মধ্যে (০-০) গোলশূন্য ড্র’র মধ্য দিয়ে। হাশেম ও আবদুল্লাহ আকবরের দেয়া দু’গোলে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে আজাদকে পরাজিত করে। আমরাও দ্বিতীয় পর্বে পিডব্লিউডিকে মুসার দেয়া একমাত্র গোলে হারিয়েছিলাম। লীগের শেষ খেলায় আমরা ১-০ গোলে পুলিশকে হারিয়েছিলাম কিন্তু ভিক্টোরিয়া তাদের শেষ খেলায় পিডব্লিউডি টিমের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে।
লীগ শেষে মোহামেডান ১টি হার, ১টি ড্র, গোল দিয়েছে ৭২, গোল হজম করেছে ৮, মোট ৪১ পয়েন্ট নিয়ে লীগ টেবিলে শীর্ষে অবস্থান এবং ভিক্টোরিয়া ২টি হার, ৩টি ড্র গোল দিয়েছে ৯৪টি, হজম করেছে ১৬টি, মোট পয়েন্ট ৩৭ নিয়ে লীগ টেবিলে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করে।
১৯৬৫ সালের ঢাকা ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। (ক্রমশ:)
(সাতান্ন) ১ সেপ্টেম্বর
চালিয়ে, তাকিয়ে দেখি মোটা কবির ভাই। তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে তিনি আবার বললেন, হামারা সাং স্টেডিয়াম সায়েংগা। আমি ঢাকার ছেলে বলে তিনি মজা করে আমার সাথে এরকম করেই কথা বলতেন। মোটা কবির ভাই মোহামেডান ক্লাবের কর্মকর্তা, অনেকটা ম্যানেজারের মত, খেলোয়াড়দের আবদার পূরণ করার চেষ্টা করতেন। শুনেছিলাম তিনিও ফুটবল খেলতেন, তবে আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি কোন কালে ফুটবল খেলেছেন। মোটাসোটা মানুষ, সবসময় সাদা পায়জামা, সাদা পাঞ্জাবি পরতেন; কিন্তু তার পেটটা দেখে মনে হতো পাঞ্জাবি ফেঁড়ে বের হয়ে যাবেÑ বেসাইজের পেট, শরীর থেকে একটু দূরে মনে হতো। সে সময় আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে ফুটবল নিয়ে একা একা নকিং করছিলাম, আরো খেলোয়াড় মাঠে আসলে খেলবো বলে। যদিও সে সময়টা ছিল শীত মওসুম। খেলাধুলার মধ্যে হকি এবং ক্রিকেট লীগ পুরোদমে চলছিল। আমি নিজেও ন্যাশনাল ব্যাংকের পক্ষে হকি লীগ নিয়মিত খেলছিলাম। স্টেডিয়ামে প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্সের জন্য খেলা এক সপ্তাহের বিরতি, তাই সেই ছুটিটাকে কাজে লাগাতে ইউনিভার্সিটি মাঠে গিয়েছিলাম। কবির ভাইকে বলেছিলাম আমি ফুটবল প্র্যাকটিস করবো, কোথাও যাবো না। কবির ভাই বললেন, স্টেডিয়ামে গজনবী ভাইসহ আরো অনেকে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি আমার সাথে যাবেন, একটা দৌড় দিয়ে আবার চলে আসবেন। তার কাছ থেকে বাঁচার জন্য বললাম, দৌড়াবার জন্য রানিং সু প্রয়োজন। সেটা তো বাসায়। তিনি নাছোড়বান্দা। বললেন, সব পাবেন, তাড়াতাড়ি চলেন। গজনবী ভাই বলেছেন, আমাকে যেতে হবে, তাকে আমি অনেক সম্মান করি। অগত্যা মোটা কবির ভাইয়ের সাথে সেদিন বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলাম। সে বিকেলটা ছিল প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্সের শেষ বিকেল। ২৫-২৭ ফেব্রুয়ারি ৬৬ এই তিনদিন ছিল অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগিতা। মোহামেডান শিবিরের প্রায় মুখই চেনা। আবুল, হাফিজ, আরজান খান, বজলু, জাহাঙ্গীর, ফয়েজ, আলতাফ আরও অনেকে। মাত্র বছর দুই হবে অ্যাথলেটিক্স থেকে একটু দূরে আছি। আমার পায়ের ৫ নম্বরের একজোড়া রানিং সু জোগাড় করে আনা হলো, বুকে মোহামেডান লেখা একটা গেঞ্জি দেয়া হলো। ব্যাস, আমি তৈরি। মোহামেডানের ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে গেলাম মোহামেডানের অ্যাথলেট। ৪ী১০০ মিটার রিলে রেসের একজন সদস্য। সেসময় প্রভিন্সিয়াল স্পোর্টসকে অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন, সার্ভিসেস, পুলিশ, রেল, ইউনিভার্সিটির সাথে ঢাকার ক্লাবগুলোকেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়া হতো। সে সুবাদে ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্র্স, ইপিআইডিসি, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবগুলো সেবার অংশগ্রহণ করেছিল।
মোহামেডান ক্লাবের রিলে টিমের সদস্যরা দেশসেরা ক্রীড়াবিদ। সেদিনের প্রথম পর্বে অর্থাৎ সকালের প্রগ্রামে ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে সিরাজ শুধু প্রথম স্থান অধিকারই করেনি, সে ইস্ট পাকিস্তান নতুন ১০.৮ সেকেন্ড টাইমিং করে রেকর্ড করেছিল। সেদিনের আরও একটি রেকর্ড হয়েছিল, সেটা মহিলাদের শটপুটেÑ যা ডলি ক্রুজ করেছিলেন ২৭ ফুট দেড় ইঞ্চি দূরত্বে নিক্ষেপ করে। হাফিজুদ্দিন আহমেদ ২০০ মি., আরজান খান ৪০০ মি.-এর কৃতী দৌড়বিদ। তাদের সাথে আমাকেও দৌড়াতে হবে। অল্প হলেও বুকটা ধুকধুক করছিল, ওয়ার্ম করে তৈরি হলাম। প্রথম দৌড়াবে হাফিজ, দ্বিতীয় আরজান খান, তৃতীয় আমি এবং ফিনিশিং দেবে সিরাজ। প্রতিযোগিতায় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি, খুলনা জেলা, পুলিশ আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা সবাই যে যার নির্ধারিত যায়গায় প্রস্তুত। স্টার্টিং পয়েন্টে পিস্তলের গুলির শব্দ, দৌড় শুরু, সমর্থকদের চিৎকার। উল্কার মত হাফিজ ছুটছে, নিমিষেই হাফিজের জায়গায় আরজান খান দৌড়াচ্ছে, চোখের পলকে আরজান খান আমার কাছে চলে এসেছে। কখন যে ওর সাথে দৌড় শুরু করেছি, কখন যে ওর হাত থেকে বেটন নিয়েছি- বাম হাত থেকে বেটন কখন ডান হাতে নিয়ে দৌড় শুরু করেছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ করে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার পাশে যে দৌড়াচ্ছিল, সে আমাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। সে কি উত্তেজনাকর মুহূর্ত! গায়ে যত শক্তি ছিল সব শক্তি দিয়ে দৌড়াতে চেষ্টা করছিলাম, সে যেন কোন অবস্থাতেই আমাকে ছেড়ে চলে না যেতে পারে। এরই মধ্যে দেখছি সিরাজের হাত, সেও আমার সাথে দৌড়াচ্ছে, বেটনটা মনে হলো আপনাআপনি আমার হাত থেকে ওর হাতে চলে গেল আর ওটাকে নিয়ে সিরাজ উল্কার মত ছুটে গেল এবং চোখের পলকে ফিনিশিং টেপ ছুঁয়ে অনেক দূরে চলে গেল।
মোহামেডান সমর্থকদের চিৎকারে কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ৪ী১০০ রিলে রেসে মোহামেডান টিম প্রথম স্থান অধিকার করেছে। চ্যাম্পিয়নশিপের শেষদিনের শেষ ইভেন্টের নতুন রেকর্ড সৃষ্টিকারী (৪৪.২ সেকেন্ড পূর্বের রেকর্ড ৪৪.৬ সেকেন্ড) আমরা চার ক্রীড়াবিদ হাফিজুদ্দিন আহমেদ, আরজান খান, সিরাজুল ইসলাম এবং আমি। তিনদিনের প্রতিযোগিতা শেষে প্রাদেশিক এসেম্বলির স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী বিজয়ীদের মধ্যে সার্টিফিকেট এবং পুরস্কার বিতরণ করেন। পুচকি ছোট একটা কাপ আমিও পেয়েছিলাম আর সেটা ছিল আমার কাছে আনন্দের, গৌরবের এবং সম্মানের। লিখতে বসে সেদিনের পুরো ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, খুব ভাল লাগছে, গর্ব অনুভব হচ্ছে।
হকি-ক্রিকেটের ভরা মৌসুমে হঠাৎ করে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ান কনসুলেট একাদশ বনাম ইপিএসএফ একাদশের মধ্যে। অনির্ধারিত প্রীতি ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৬। শীতকালীন খেলা হকি-ক্রিকেট লীগ ঢাকা স্টেডিয়ামে পুরোদমে চলছিল। সব খেলা বাতিল করে ফুটবল খেলা, সময়টা ছিল ফুটবলের অফ সিজন। যতটুকু মনে পড়ে, সে সময় ইন্দোনেশিয়ার একটি যুুদ্ধজাহাজ ‘গুডউইল টুর’-এর অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ভিড়েছিল। তাদের ক্রুদের জন্য এই প্রীতি ফুটবলের আয়োজন। ঢাকার ফুটবল অনুরাগীরা ফুটবলের অফসিজনেও প্রমাণ করেছিল যে, এদেশে ফুটবল কত জনপ্রিয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক সেদিন মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। মাঠে প্রবেশ ফি ছিল না। খেলা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার কনসুলার জেনারেল মি. এসএম নূর এবং ইপিএসএফ সভাপতি গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর সাথে।
খেলা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে মুসার গোল সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলে এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে মুসার হ্যাটট্রিক মাঠে উপস্থিত দর্শকদের কাছে ছিল একটি আশ্চর্য ঘটনা। এত দ্রুত গোলগুলো হজম করে ইন্দোনেশিয়ার পুরো টিম ছন্দছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তারা মাঠে শুধু আমাদের আটকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, খেলায় কোনপ্রকার দক্ষতা লক্ষ্য করা যায়নি। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য খুবই কম থাকায় দলগত সমঝোতা সেরকম গড়ে ওঠেনি। হাফ টাইমের কিছু আগে রহমতউল্লা গোল করলে আমরা ৪-০ গোলে এগিয়ে যাই।
বিরতির পর ইন্দোনেশিয়া কিছুটা গুছিয়ে খেলার চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ার্ধে পনের মিনিটের সময় আমি একটি বল পেয়ে ইন্দোনেশিয়ার দু’তিনজন ডিফেন্সকে কাটিয়ে একক প্রচেষ্টায় একটি গোল করি। আমরা ৫-০ গোলে জয়লাভ করছিলাম। প্রায় ২০ মিনিটের পর ইন্দোনেশিয়ার রাইট আউট ওমর বল নিয়ে দ্রুতগতিতে আমাদের ডিফেন্সের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং সজোরে গোলপোস্টে কিক করলে বল গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে জালে জড়িয়ে যায়। সে সময় তাদেরকে গোছানো ফুটবল খেলতে দেখা যায়। ৫-১ গোলে যখন খেলা চলছিল, তখন ইন্দোনেশিয়া একটি পেনাল্টি পেয়ে যায় এবং সেটা থেকে তাদের লেফট ইন ইয়ানটো একটি গোল করলে খেলার ফল ৫-২ দাঁড়ায়। আমাদের রাইট সাইড থেকে একটি সম্মিলিত আক্রমণে আরও একটি গোল হলে শেষ পর্যন্ত ৬-২ গোলে আমরা জয়লাভ করি। খেলার ফলাফল যাই হোক, সেদিন মাঠে একটা প্রীতির বা বন্ধুত্বের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যেটা আমরা সেদিন খেলার চেয়ে বেশি উপভোগ করেছিলাম। (ক্রমশ:)
(আটান্ন) ১৬ সেপ্টেম্বর
“ইধংযরৎ ঝপড়ৎবং ১৩ এড়ধষং” ২৪ ডিসেম্বর ’৬৫ তারিখে দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার উল্লিখিত শিরোনাম দিয়ে আমার এবারের লেখা শুরু করতে যাচ্ছিÑ যা ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং টিটি সেন্টারের মধ্যে অনুষ্ঠিত হকি খেলায় ঢাকা হকি লীগে আমার ব্যক্তিগত (একটি খেলা) গোলের রেকর্ড। আমার হকি জীবনের এটি একটি স্মরণীয় ম্যাচÑ যা লিখতে বসে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেদিনের খেলা সম্বন্ধে দৈনিক মর্নিং নিউজ এবং দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা যা প্রকাশ করেছিলÑ তা তুলে ধরছি : ঘইচ পধৎৎরবফ ঃযব ফধু রিঃয ১৮-০ ারপঃড়ৎু’ অভঃবৎ ংপড়ৎরহম ৩ ংঃধু মড়ধষং, রহংরফব ষবভঃ ইধংযরৎ নবমধহ যরং ংঃরপশ ড়িৎশ যিবহ ঃযব ংপড়ৎব ধিং ৮-০, ঐব ফরফ হড়ঃ মরাব ধ পযধহপব ঃড় ধহু ড়ঃযবৎ ড়হ ঃযব ভরবষফ ভড়ৎ ঃযব ভরহধষ ংযড়ড়ঃরহম ধঃ ঃযব হবঃ. ঐব ংঃড়ঢ়ঢ়বফ ধঃ ষধংঃ যিবহ ঃযব ংপড়ৎব ধিং ১৭-০, ঈড়সঢ়ষবঃরহম ঃযৎবব যধঃঃৎপরপশং রহ ধ ৎড়.ি’
ইধংযরৎ ধিং ঃযব ভরৎংঃ সধহ ঃড় যধাব ঃযব যড়হড়ঁৎ ড়ভ ঃৎরঢ়ষব যধঃ ঃৎরপশং ংড় ভধৎ রহ ঃযব যড়পশবু ষবধমঁব.
অবশিষ্ট ৫টি গোল আমাদের ফরোয়ার্ড মীর ৩ গোল এবং ফুলব্যাক সাবের আলী ২ গোল করেছিল।
আমাদের মৌসুমী খেলা এবং খেলার মাঠÑ এ দুটোর সমন্বয় করে বাৎসরিক ক্রীড়াপঞ্জি তৈরি করা হতো বলেই ১৯৬৬ সালের ঢাকা হকি লীগ শুরু হয়েছিল পূর্ববর্তী বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে। লীগের উদ্বোধনী খেলায় ওয়ারী ক্লাব ১২-০ গোলের বন্যা বইয়ে ফায়ার সার্ভিস দলের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। ওয়ারীর লেফট-ইন শেরা এবং রাইট আউট মহসিন প্রত্যেকে একটি করে হ্যাটট্রিক করেছিল। অপর গোলগুলো ইব্রাহিম সাবের, শফিক কামাল ও অন্যরা করেছিল।
১০ ডিসেম্বর তারিখের খেলার বিবরণ পরদিন দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় ছেপেছিল : অুধফ ঃৎড়ঁহপবফ নু ঘধঃরড়হধষ ইধহশ ড়ভ চধশরংঃধহ. ‘উড়ঁনষব যধঃঃৎরপশ নু ইধংযরৎ’. ওহংরফব ষবভঃ ইধংযরৎ ংঃড়ষব ঃযব ষরসবষরমযঃ ড়ভ ঃযব সধঃপয ংপড়ৎরহম ফড়ঁনষব যধঃঃৎরপশ (ধং সধহু ধং ৮ মড়ধষং) যিরপয ধিং যধষভ ড়ভ ঃযব ঃড়ঃধষ ংপড়ৎব.
খেলা শুরু হওয়ার ৬ মিনিটে আমি প্রথম গোল করি এবং ৫ মিনিটের মধ্যে আমার প্রথম হ্যাটট্রিক সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক করেছিলাম। মীর এবং মিলু ২টি করে গোল করেছিল এবং মাহমুদ, আনোয়ার, আবদুল হক, মনি মিলে ৮ গোল করলে আমরা ১৬-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবকে পরাজিত করেছিলাম।
১৫ ডিসেম্বর আরো একটি গোলের ছড়াছড়ি হকি মাঠে ঘটেছিল আর সেটাও ছিল আজাদ স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে ইস্পাহানীর ১৪ গোল। নুরুল ৫, হায়দার ৩, জাফর, সাগির ও অন্যারা মিলে গোল করেছিল।
২২ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংক ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে ৯-০ গোলে পরাজিত করেছিল। মিলু ৩, সাবের ২, মীর, মনি, এহতেশাম সবাই মিলে গোলগুলো করেছিল।
২৩ ডিসেম্বর পুলিশ টিম শক্তিশালী কম্বাইন্ড স্পোর্টিংকে রুখে দিয়েছিল। খেলা ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। পুলিশের রাইট-ইন মবিন গোল করে টিমকে এগিয়ে দিয়েছিল কিন্তু কম্বাইন্ডের লেফট-ইন প্রতাপ গোল করে সমতা এনেছিল।
কম্বাইন্ড পুনরায় ২৮ ডিসেম্বর ভিক্টোরিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে ১ পয়েন্ট হারিয়েছিল। ৩০ তারিখের খেলাটিও মোহামেডান ও পাকিস্তান এয়ারফোর্স ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল। মোহামেডানের পক্ষে শাকুর ও ইফতেখার গোল করেছিল এবং এয়ারফোর্সের মধ্যে শাহী হামিদ ও জুবায়ের গোল করেছিল। আমাদের পরবর্তী খেলায় আমরা ভিক্টোরিয়াকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিলাম, যার একটি গোল ছিল আমার এবং অপরটি ছিল আমাদের লেফট আউট মনির। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং গত দু’ম্যাচে দুটি ড্র করার পর ২-১-৬৬ তারিখে তারা পিডব্লিউডিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। পিডব্লিউডি দলের সেলিম রেজা গোল করে দলকে এগিয়ে দিলে বিরতির পর কম্বাইন্ডের রাইট আউট রাজ্জাক (সোনা মিয়া) খেলায় সমতা আনে। খেলার বিশ মিনিটের সময় কম্বাইন্ড একটি পেনাল্টি স্ট্রোক পায়। আব্দুস সাদেক গোল করলে ২-১ গোলে কম্বাইন্ড এগিয়ে যায় এবং খেলার শেষদিকে রাজ্জাক আরও একটি গোল করে দলকে ৩-১ গোলে জয়ী করে। ৩ জানুয়ারিতে ওয়ারী ক্লাব টিটি সেন্টারকে ৬-০ গোলে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। কোরেশি শেবা ২, শফিক, হাশেম গোল করেছিল। এখানে উল্লেখ্য, সেদিনের খেলায় ওয়ারী দলের গোলরক্ষক ছিলেন মাসুদুর রহমান, যিনি একাধারে হকির আম্পায়ার ও দেশবরেণ্য ফিফা রেফারি।
স্টেডিয়ামের ২ নম্বর গ্রাউন্ডে ইস্পাহানী ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিকে সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দারের করা ২ গোলে জয়ী করেছিল। এখানে উল্লেখ্য, ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রতিদিন দুটি করে খেলা হতো। পশ্চিমদিকে গ্যালারি সংলগ্ন মাঠকে ১নং গ্রাউন্ড এবং পূর্বদিকের গ্যালারির সামনের মাঠকে ২নং গ্রাউন্ড বলা হতো। মাঝখানে ক্রিকেট পিচকে অক্ষত অবস্থায় রেখে স্টেডিয়ামকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছিল। একই সময় দুটি খেলা চলতো, খেলার একই রকম বাঁশিতে খেলায় যাতে অসুবিধা না হয়Ñ সেদিকে খেয়াল রেখে দু’রকম বাঁশির ব্যবস্থা করা হতো। পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে মোহামেডানকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা অক্ষুন্ন রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল এবং ১৩ জানুয়ারি রেলওয়ে ৩-০ গোলে ইস্পাহানীকে পরাজিত করে লীগ প্রতিযোগিতাকে এগিয়ে নিচ্ছিল। রেল দলের লেফ-ইন নিয়াজের প্রশংসা করে পত্রিকা লিখেছিল : ওহংরফব ষবভঃ ঘবধু রসঢ়ৎবংংব যরং ধৎঃরংঃরপ ংঃরপশ ড়িৎশ যিরপয বহধনষবফ যরস ঃড় ঃরিপব পধঃপয সড়যংরহ, ঃযব ওংঢ়ধযধহর মবধষশববঢ়বৎ ড়হ ঃযব ৎিড়হম ধহফ যবষঢ় ঃযব জধরষধিু ঃড় সধশব রঃ ২-০ নবভড়ৎব যধষভ ঃরসব.
রেল দলের অপর গোল করেছিল কায়ফুল।
২নং গ্রাউন্ডের খেলায় পিডব্লিউডি ফায়ার সার্ভিসকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল। এয়ারফোর্স প্রথম পয়েন্ট হারিয়েছিল ১৪ জানুয়ারি কম্বাইন্ডের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। সেদিনই ২নং গ্রাউন্ডে আমার দেয়া দুটি গোলের সুবাদে ন্যাশনাল ব্যাংক ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিক ২-১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যায়।
ইন্দোনেশিয়ান কনসুলেট একাদশ বনাম ইপিএসএফ একাদশের মধ্যে অনির্ধারিত একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচের জন্য এবং ঈদের জন্য বেশ কিছুদিন হকি লীগ বন্ধ থাকার পর প্রথম ফেব্রুয়ারি থেকে পুনরায় হকি লীগের খেলা শুরু হয়েছিল। আর সে খেলায় ওয়ারী ৮-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে হারিয়েছিল।
অপর খেলায় পিডব্লিউডি ৪-০ গোলে টিটি সেন্টারকে হারিয়েছিল। ন্যাশনাল ব্যাংকের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী কম্বাইন্ড স্পোর্টিং আর এ দু’টিমের খেলা অত্যন্ত গতিসম্পন্ন এবং উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। দু’টিমই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করে খেলছিল। খেলার ৫ মিনিটে কম্বাইন্ড একটি পেনাল্টি কর্নার পায়; তা থেকে প্রতাপের উড়ন্ত শটটি রঞ্জিত দক্ষতার সাথে রক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত খেলাটি গোলশূন্য শেষ হলে ব্যাংক হকি লীগের প্রথম পয়েন্ট হারায়। পরদিন অর্থাৎ ৪-২-৬৬ তারিখে ওয়ারী প্রথম হারের স্বাদ পেয়েছিল তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সাথে ১-২ গোলে পরাজয়ের ভেতর দিয়ে। ভিক্টোরিয়ার বুলান এবং মুশিফ গোল করলে ওয়ারীর ফুলব্যাক মমতাজ একটি গোল শোধ করতে পেরেছিল। ১০ ফেব্রুয়ারি ওয়ারী ইস্পাহানীর সাথে ১-১ গোলে ড্র করে আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। এর ফলে ওয়ারী চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। অপর খেলায় রেল দল চট্টগ্রাম থেকে সময়মত পৌঁছাতে পারেনি বলে পিডব্লিউডি ওয়াকওভার লাভ করে। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং তাদের পরবর্তী খেলায় পাকিস্তান স্পোর্টিংকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে, যার দুটি গোল করেছিল সাদেক, প্রতাপ ও রাজ্জাক একটি করে করেছিল। আলমগীর আদেল এবং শামসুল বারীর প্রত্যেকে ৩টি করে গোল করার সুবাদে মাহুৎটুলী ফায়ার সার্ভিসকে ৬-০ গোলে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। ২নং গ্রাউন্ডেও ছয় গোল করেছিল রেল দল আজাদ স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে। শক্তিশালী এয়ারফোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির কাছে ০-২ গোলে পরাজিত হয়েছিল। ওয়ারী আবারও একটি মূল্যবান পয়েন্ট পিডব্লিউডির সাথে গোলশূন্য ড্র করে হারিয়েছিল এবং ওয়ারী ক্লাব লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলÑ চার পয়েন্ট নষ্ট করে তা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। ১৯-২-৬৬ আমরা (এনবিপি) দুর্বল বাংলাদেশ স্পোর্টিং-এর সাথে হাফ টাইম পর্যন্ত কোন গোল না পেয়ে কিছুটা মানসিক দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। বিরতির তিন মিনিটের সময় আমি একটি বল নিয়ে বিপক্ষ ডিফেন্সে ঢুকে দু’তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে ডি-এর ভেতর প্রবেশ করলে মমতাজ গোলপোস্ট ছেড়ে ছুটে এগিয়ে আসে গোল বাঁচাবার উদ্দেশ্যে। আমি তার পাশ কাটিয়ে সুন্দরভাবে বল পুশ করে গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দিলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দ্বিতীয় গোল করেছিল মিলু এবং শেষ বাঁশি বাজার কিছু আগে আমি একক প্রচেষ্টায় আরও একটি গোল করলে আমরা ৩-০ গোলে জয়ী হয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
২০ ফেব্রুয়ারি হকি লীগে প্রথম অপ্রীতিকর ঘটনা। কম্বাইন্ড এবং মাহুৎটুলী ক্লাবের মধ্যকার খেলায় শুরু থেকে উভয় দলের খেলোয়াড়দের মাথা গরম এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করে খেলতে দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা ভীষণ রাফ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ার্ধে একসময় দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে গালাগাল, হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। মাঠের চারপাশ থেকে সবাই গিয়ে নিবৃত্ত করলে বড় অঘটন হতে বেঁচে যায়। খেলা প্রায় ৮ মিনিট বন্ধ ছিল। খেলা শুরু হলে ২০ মিনিটের সময় কম্বাইন্ডের রাইটইন বুলবান একক প্রচেষ্টায় ডি’র ভেতর ঢুকে আরফিনকে (গোলরক্ষক) পরাস্ত করে। খেলার ৭ মিনিট বাকি থাকতে কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফজলু আরও একটি গোল করলে কম্বাইন্ড ২-০ গোলে জয় নিয়ে মাঠ ত্যাগ করে। এখানে উল্লেখ্য, মাহুৎটুলী এবং কম্বাইন্ড একই এলাকার টিম। আরমানিটোলা স্কুল খেলার মাঠ এদের ভিত্তি। অপর খেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ১-০ গোলে পিডব্লিউডিকে পরাজিত করে। আমাদের পরবর্তী খেলায় মোহামেডানকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিলাম। ফরিদ, মিলু এবং আমি গোল করেছিলাম। মোহামেডানের পক্ষে নায়িম একটি শোধ দিয়েছিল। অপর খেলায় এয়ারফোর্স এবং ভিক্টোরিয়া পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয়। ১৬তম প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য স্টেডিয়ামের সব খেলা ২৮ তারিখ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহ বিরতির পর হকি লীগের খেলায় কম্বাইন্ড ৩-০ গোলে ভিক্টোরিয়াকে পরাজিত করে। ৩ মার্চ হকি মাঠে দ্বিতীয়বারের মত মারামারি হয়েছিল রেলের কাইফুল এবং পিডব্লিউডির আইয়ুব-এর মধ্যে। এর ফলে খেলা কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল। নিয়াজের চমৎকার স্টিকওয়ার্কে ঘায়েল হয়ে পিডব্লিউডি ১ গোল খায় এবং পরবর্তীতে রহিম সেটাকে বর্ধিত করে ২-০গোলে রেল দলকে জয়ী করে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদের একা ৪ গোল এবং মনির ১ গোলের সুবাদে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে ৫-০ গোলে হারাই। ৯ মার্চ ছিল আমাদের বড় একটা ম্যাচ, রেল দলের বিরুদ্ধে। চঊ জধরষ মড় ফড়হি নু ংড়ষরঃধৎু মড়ধষ ধহফ ঃযব মড়ধষ ঃযধঃ যবষঢ়বফ ঃযব ঘধঃরড়হধষ ইধহশ ঃড় পড়সব ঃযৎড়ঁময রিঃয ভঁষষ যড়হড়ঁৎং ধিং ংষধসসবফ রহ নু রহংরফব ষবভঃ ইধংযরৎ অযসবফ ধহফ ঃযব ড়হব ঃড় রহভষরপঃ ঃযব ফধসধমব ধহফ ংধঃঃবৎ ঃযব ংবিবঃ যড়ঢ়ং ড়ভ ঃযব জধরষধিু ঃবধস ধিং ঃযব ইধহশ রহংরফব ষবভঃ.
জবপবরাবফ ঃযব নধষষ ভৎড়স ঃযব সরফফষব ইধংযরৎ সড়াবফ ংঢ়ষবহফরফষু ঃযৎড়ঁময ঃযব ড়ঃযবৎ’ং ফবভবহপব ধহফ সবধঃষু ড়ঁঃ ৎিরঃঃবফ ধ ভৎধহঃরপ ঃৎুরহম ঘধনর ইধশংয ঁহফবৎ ঃযব জধরষধিু নধৎ ঃড় ংপড়ৎব ধ ৎবধষষু মড়ড়ফ মড়ধষ.
দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় খেলার বিবরণ তুলে ধরেছি। রেল দলের সাথে আমাদের খেলা ছিল উচ্চমানের, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের খেলায় বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। যা হোক, আমরা বড় একটা বাধা অতিক্রম করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম সেদিন বিকেলে। আশ্চর্যজনকভাবে পরদিনই আমরা মাহুৎটুলীর কাছে এক পয়েন্ট হারিয়ে লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলাম। পূর্বেই আমরা এক পয়েন্ট হারিয়েছিলাম কম্বাইন্ডের সাথে ড্র করে। ওয়ারী ক্লাব এবং লীগ চ্যাম্পিয়ন রেলওয়ে উভয়ই চার পয়েন্ট করে হারিয়ে আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল। আমাদের ড্রতে দু’টিমই খুশি হয়েছিল। ওয়ারী এবং ইস্পাহানীর বিরুদ্ধে আমাদের খেলা বাকি ছিল। দিনের অপর খেলায় রেল দল এয়ারফোর্সকে ৩-২ গোলে হারিয়ে লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে আমাদের কাছাকাছি অবস্থানেই ছিল। আউটার স্টেডিয়াম নং-২তে অনুষ্ঠিত দিনের তৃতীয় ম্যাচে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ২-১ গোলে আজাদকে পরাজিত করেছিল। ১১ মার্চ স্টেডিয়ামের ১নং গ্রাউন্ডে ওয়ারী ১-০ গোলে এয়ারফোর্সকে, ২নং গ্রাউন্ডে মোহামেডান পিডব্লিউডিকে ১-০ গোলে এবং দিনের তৃতীয় খেলায় কম্বাইন্ড ৪-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে পরাজিত করেছিল। প্রতাপ কম্বাইন্ডের পক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিল এবং সিকেন্দার করেছিল ১ গোল।
১৩ মার্চ ন্যাশনাল ব্যাংক আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট হারিয়েছিল চ্যাম্পিয়নশিপ দাবিদার ওয়ারী ক্লাবের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র করে। দুটি গোলই হয়েছিল প্রথমার্ধে। এ নিয়ে আমরা তিনটি পয়েন্ট খুইয়েছিলাম আর এই পয়েন্ট হারানোতে সবচেয়ে খুশী হয়েছিল কম্বাইন্ড স্পোর্টিং; কারণ তারাও আমাদের মত মাত্র তিন পয়েন্ট হারিয়ে পয়েন্ট তালিকায় আমাদের সাথে চলে এসেছিল। রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিতব্য ১৬তম ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপে ইস্ট পাকিস্তান হকি টিমের অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা হকি লীগের খেলা স্থগিত করা হয়েছিল।
দৈনিক আজাদ পত্রিকা লিখেছিল, ‘মাসাধিককাল বিরতির পর পুনরায় হকি লীগের খেলা শুরু। উদ্বোধনী খেলায় ন্যাশনাল ব্যাংক দল অতিসহজেই পুলিশ দলকে ৫-০ গোলে পরাজিত করিয়া তাহাদের বিজয় অভিযান অব্যাহত রাখিয়াছে। ন্যাশনাল ব্যাংক দলের রাইট ইন বশীর দর্শনীয়ভাবে উপর্যুপরি ৩টি গোল করিয়া হ্যাটট্রিক অর্জনের গৌরব অর্জন করেন।’
মোহামেডান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি টিমের খেলায় ইশতিয়াকের হ্যাটট্রিকের সুবাদে মোহামেডান ৩-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। সেদিনের অপর খেলায় পাকিস্তান স্পোর্টিং ভিক্টোরিয়াকে ওয়াকওভার দিয়েছিল। ১৬ এপ্রিল হকি লীগের খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলা, ওয়ারী বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। সেদিনের খেলার ফলাফল লীগ শিরোপা নির্ধারণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। টেনশনে ভরা সেদিনের খেলায় জোরালো আক্রমণে কোন দলই গোল করতে পারেনি। ছন্নছাড়া গোছের খেলা। খেলায় ওয়ারী ক্লাব ২-১ গোলে জয়লাভ করে। খেলার ৮ মিনিটে ওয়ারীর মামলি গোল করে দলকে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধে তাদের সিকেন্দার আরও একটি গোল করলে কম্বাইন্ডের প্রতাপ একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। সেদিনের ফলাফলে ওয়ারী এবং কম্বাইন্ড উভয় দলই ৫ পয়েন্ট করে হারিয়ে লীগ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করে নিয়েছিল। মবিন এবং আকবরের দেয়া দু’গোলে পুলিশ মোহামেডানকে তাদের শেষ খেলায় হারিয়েছিল।
২৬ এপ্রিল ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিমের হকি লীগ শিরোপা পুনরুদ্ধার। ইস্পাহানীকে ২-০ গোলে পরাজিত করে আমরা ১৯৬৬ সালের অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দু’অর্ধে দুটো গোল হয়েছিল।
ঘইচ রহংরফব ষবভঃ ইধহংযরৎ ঈড়হভরফবহঃষু ঢ়ড়ঁহপবফ ড়হ ঃযব নধষষ নঁৎংঃ ঃযৎড়ঁময জরহম ড়ভ ওংঢ়ধযধহর ফবভবহপব ধহফ ংষধসসবফ ঃযব নড়ধৎফং যিরষব ধ ভষধনবরমধংঃবফ গধযংরহ ষড়ড়শবফ ড়হ.
আমাদের রাইট-ইন মিলুর পাস রাইট আউট আবদুল হক দ্রুতগতিতে আয়ত্তে নিয়ে ডি-এর ভেতর ঢুকে সজোরে হিট করলে তা থেকে দ্বিতীয় গোলটি হয়। ন্যাশনাল ব্যাংক ১৬ ম্যাচে ৩টি ড্র করে ৩ পয়েন্ট হারিয়ে এবং ২৯ পয়েন্ট নিয়ে অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিল। কম্বাইন্ড এবং ওয়ারী ক্লাব সমান পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলোয়াড় তালিকা : রঞ্জিত দাস, মীর সাবের আলী, ইকবাল, এহতেশাম সুলতান, আলম মাহমুদ, আনোয়ার, আব্দুল হক, মির্জা ফরিদ, মীর, ফরিদ, বশীর আহমেদ, শাহ আলী আসগর মনি। #
(ক্রমশ:)
(ঊনষাট) ১ অক্টোবর
ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ রাওয়ালপিন্ডি ’৬৬তে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ৫১ জন হকি খেলোয়াড়কে ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল। ৩ মার্চ থেকে দু’সপ্তাহের ক্যাম্পের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল শাহনুর এবং সামিউদ্দিন খানকে। সে সময়ের দেশের সেরা হকি খেলোয়াড়দের রেকর্ড সংরক্ষণের লক্ষ্যে তাদের নামের তালিকা নিম্নে দেয়া হলো।
ন্যাশনাল ব্যাংক : বশীর, মির্জা ফরিদ মিলু, মীর সাবের আলী, রঞ্জিত দাস, আনোয়ার হোসেন খান, মীর আনোয়ার করিম, এহতেশাম সুলতান এবং ফরিদ।
ওয়ারী ক্লাব : মমতাজ উদ্দিন, এএম শেরা, মাহমুদুর রহমান মমিন, ইব্রাহিম সাবের, কামাল পোটলা, নিয়াজ আহমেদ, নেওয়াজিশ এবং শফিক।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং : প্রতাপ শংকর, আবদুস সাদেক, মোহাম্মদ মহসিন, আব্দুর রাজ্জাক (সোনা মিয়া), সাব্বির ইউসুফ, সৈয়দ রফিক হোসেন বুলবান।
পিডব্লিউডি : আইয়ুব খান, রানা, মজিদ এবং রাইস।
মোহামেডান : আব্দুস সালাম, মো. সেলিম (জাম্বু), ফালু।
ভিক্টোরিয়া: বুলান, হাবিব উল্লাহ, ইরশাদ এবং মাহমুদ।
মাহুৎটুলী : হাসান, মুজিব, আরেফিন, নাসির উল্লাহ, হাফিজুল্লাহ এবং শামসুল বারি।
ইস্পাহানী : হায়দার এবং খাজা।
পুলিশ : মান্নান, মোহাম্মদ আলী এবং আকবর।
পাকিস্তান স্পোর্টিং : মোমতাজ।
ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব : লস্কর এবং সালাম।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি : আজাদ, সান্টা, জাফর এবং সাহিদ।
হকি ক্যাম্প এবং হকি লীগ একইসাথে চলছিল। ক্যাম্পে অনুশীলন সকালের অধিবেশনে সীমাবদ্ধ থাকতো। সে সময় হকি লীগ পুরোদমে চলছিল এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি স্থানে অবস্থান করছিল ন্যাশনাল ব্যাংক, কম্বাইন্ড, ওয়ারী এবং রেল দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল, যার জন্য লীগের খেলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল। লীগ বন্ধ করে ক্যাম্প পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১৪ এবং ১৫ তারিখে ট্রায়াল ম্যাচের পর ১৫ জনের একটি টিম নির্বাচন করা হয়েছিল। ওয়ারী ক্লাবের এএম শেরাকে ক্যাপ্টেন এবং কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের আবদুস সাদেককে তার সহকারী নির্বাচন করা হয়েছিল।
পুরো টিম : গোলকিপার- মো. সেলিম (জাম্বু) ও রঞ্জিত দাস।
ফুল ব্যাক : এএম শেরা, মোমতাজ উদ্দিন এবং মীর সাবের আলী।
হাফ ব্যাক : ইব্রাহিম সাবের, আব্দুস সাদেক, মাহমুদুর রহমান মোমিন ও কামাল পোটলা।
ফরোয়ার্ডস : মাহমুদ, হাসান মাহমুদ (মামলি), বুলবান, বশীর, প্রতাপ শংকর এবং খাজা জাফর।
৩ জন কর্মকর্তাকে মনোনীত করা হয়েছিল।
ম্যানেজার : শামি খান।
সহকারী ম্যানেজার : সাদেক আলী মির্জা।
কোচ : শাহনূর।
ইপিএসএফ হকি টিমের ১৯ মার্চ রাওয়ালপিন্ডি যাত্রার দিন ধার্য করা হয়েছিল এবং ফিকশ্চার অনুসারে ২৪ মার্চ কোয়েটা টিমের বিরুদ্ধে আমাদের খেলা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
১৯ মার্চ লাহোরের উদ্দেশে আমরা ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর ত্যাগ করেছিলাম এবং বিকেলে লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণের পরপরই চলে গিয়েছিলাম লাহোর স্টেশনে রাওয়ালপিন্ডির ট্রেন ধরার লক্ষ্যে। ২০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডি রেলস্টেশনে ট্রেন পৌঁছালে যাত্রীরা সব তাড়াহুড়ো করে স্টেশন ত্যাগ করে গেলেও শুধু আমরা স্টেশনে রয়ে গিয়েছিলাম, কারণ রেলস্টেশনেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রথম শ্রেণীর কামরায় গদিওয়ালা সিটে চাদর বিছিয়ে নিজ নিজ যায়গা বেছে নিয়েছিলাম। টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে কোন টিম এরকম রেলস্টেশনে এবং ট্রেনের বগিতে অবস্থান করেছে বলে আমার জানা নেই। মজার ব্যাপার হলো ট্রেনের কামরায় আমরা হয়তো গল্প করছি, এমন সময় ট্রেন চলতে শুরু করে দিত। আরে দাঁড়াও, আমাদের টিমের আরো সদস্য বাইরে রয়েছে, তাদেরকে ছেড়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ট্রেনটি, কিছুদূর গিয়ে থেমে গিয়ে আবার পেছনে চলতে শুরু করে দিত। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সানটিং হচ্ছে অর্থাৎ আমাদের বগি যে লাইনে ছিল, সেটাকে অন্য লাইনে নিয়ে যাওয়া। প্রথম রাতে আরও মজার ঘটনা ঘটেছিল, রাতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সকালে উঠে দেখলাম আমরা স্টেশনের যেখানে রাতে ছিলাম সেখানে নেই, বেশ দূরে পুরনো অনেক ট্রেনের মাঝে আমাদের বগিটির ঠাঁই হয়েছে। আমরা থাকতাম ট্রেনের বগিতে কিন্তু খেতে যেতে হতো স্টেশনের বাইরে, হোটেলে। বেশি সমস্যা হতো বাথরুম নিয়ে। বিশেষ করে সকালবেলা ১৮ সদস্যের একসাথে বাথরুমের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না, পানির অভাবে ঠিকমত গোসল করাও যেত না। সুতরাং স্টেশনে বগিতে থাকাটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের হয়ে পড়েছিল। কর্তৃপক্ষ তারপর আমাদের জন্য একটি হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে। হোস্টেলটি ছিল পাঁচতারা কন্টিন্যান্টাল হোস্টেলের প্রায় গাঁ ঘেষেÑ মজা করে বলতাম আমরা কন্টিন্যান্টাল হোটেলে থাকি। ১৬তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে ২৪টি টিম অংশগ্রহণ করেছিল। রাওয়ালপিন্ডি, সারগোদা, লাহোর, করাচি এবং পাকিস্তান আর্মির প্রত্যেকের দুটি করে দল (এ ও বি);এর সাথে পিআইএ, পুলিশ, রেলওয়ে, হায়দ্রাবাদ, পেশওয়ার, কোয়েটা, লায়ালপুর। ইস্ট পাকিস্তান টিমগুলো নিয়ে নকআউট পদ্ধতিতে চ্যাম্পিয়নশিপের ফিকশ্চার করা হয়েছিল।
আমরা রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছাবার পর থেকেই সেখানে বৃষ্টি হচ্ছিল। অনেকে ঠাট্টা করে বলতো, আমরা নাকি ঢাকা থেকে বৃষ্টি সাথে করে নিয়ে গেছি।
২০ তারিখে বৃষ্টির কারণে হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি। দু’দিন পিছিয়ে ২২ তারিখে উদ্বোধনের তারিখ করা হয়েছিল।
হকির কিংবদন্তি খেলোয়াড় নাসির বুন্দার ভাওয়ালপুর এবং আর্মি ব্লু টিমের খেলার মাধ্যমে আর্মি স্টেডিয়ামে বেলা ২টায় জেনারেল মুসা চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধন করেন। আমাদের খেলা নির্ধারিত ২৪ তারিখে কোয়েটার সাথেই হয়েছিল। বেশ কয়েকজন বয়স্ক খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত কোয়েটা টিমের তুলনায় আমাদের টিম ছিল তরুণদের নিয়ে গড়া, তাই মনে করেছিলাম সহজেই আমরা জিতবো। খেলা আরম্ভ হলে সে ধারণা পাল্টে গিয়েছিল। পাল্লা দিয়ে তারা আমাদের ওপর চড়াও হচ্ছিল। তাদের অভিজ্ঞ বয়স্ক খেলোয়াড়রা ছিল খুব পরিশ্রমী; বিশেষ করে তাদের লেফট ইন কাগাসু ছিল টিমের অন্যতম চালকাশক্তি। বরাবরের মতই আমাদের আক্রমণগুলো এলোমেলো হচ্ছিল, সফল হচ্ছিল না। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের একপর্যায়ে সেই কাগাসু (তিন সন্তানের জনক- শোনা কথা) গোল করে তাদের দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। গোল খাওয়ার পর আমরা যেন জেগে উঠি, আক্রমণের ধার আমাদের বেড়ে যায়। পরপর কয়েকটা আক্রমণের সুফল আমরা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের লেফট আউট হাসান (মামলি) গোল শোধ করায় আমরা কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তি পেয়েছিলাম কিন্তু বিরতির বাঁশি বাজার কিছুক্ষণ আগে তাদের রাইট ইন আব্বাস গোল করলে আমরা আবারও পিছিয়ে পড়ি। দ্বিতীয়ার্ধের পুরো সময়টাই আমরা গোল শোধ করার চেষ্টা করেছিলাম। কোয়েটা টিমও তাদের গোলের সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এতে খেলা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং মোটামুটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা ১-২ গোলে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল ৩১ মার্চ পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে এবং করাচি ‘এ’ ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। রেল দলের খুরশীদ এবং বিশ্বনন্দিত সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খান করাচি ‘এ’ দলের পক্ষে গোল করেছিল। ওয়েস্টার্ন রেল দল এবং করাচি ‘এ’ দলের মধ্যকার ফিরতি ম্যাচে রেলওয়ে করাচি ‘এ’ দলকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে আর্মি ‘এ’ দলের সাথে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। পিআইএ টিম আর্মি ‘বি’ টিমকে ১-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। অপর সেমিফাইনালে আর্মি ‘এ’ টিম ২-০ গোলে রেলওয়ে টিমকে পরাজিত করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল।
৫ এপ্রিল ’৬৬ ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। আর্মি স্টেডিয়াম দর্শকে পরিপূর্ণ। খেলার পূর্বে পিআইএ টিম এবং আর্মি ‘এ’ টিমের সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়্বু খানের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। পাঁচজন অলিম্পিয়ান এবং চারজন ইন্টারন্যাশনাল খেলোয়াড় নিয়ে গড়া শক্তিশালী পিআইএ টিম ২-০ গোলে আর্মি রেড (এ) টিমকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। লেফট-ইন আসাদ মালিক এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজি অনবদ্য ক্রীড়া প্রদর্শন করে উভয় একটি করে গোল করেছিল। ১৯৬৪ সালে পিআইএ প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এবং ১৯৬৬ সালে তারা শিরোপা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। খেলা শেষে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন।
ঐতিহ্যবাহী অল-পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট ১৪টি টিম নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে ৭ এপ্রি ’৬৬ থেকে শুরু হয়েছিল। হকি লীগ তখনও পুরোদমে চলছিল, রেলওয়ে, ওয়ারী ক্লাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং এবং আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) লীগ শিরোপা লাভের জন্য জোর লড়াই করে যাচ্ছিলাম। ১৯৬৩ সালে আমরা অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলেও আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট জয় করা সম্ভব হয়নি। এবারের টুর্নামেন্ট আমাদের চৌদ্দ দলের মধ্যে জয় ছিল অনেকটা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। নকআউট পদ্ধতিতে খেলা শেষে চারটি টিম ওয়ারী ক্লাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, রেলওয়ে টিম এবং আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম।
স্টেডিয়ামে প্রতি ফুটবল ম্যাচ, ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে হকি ক্যাম্প এবং দলের পিন্ডি খেলতে যাওয়া প্রভৃতি কারণে বার বার হকি লীগের ছন্দপতন ঘটেছে বিধায় লম্বা সময় ধরে (চার মাস) হকি লীগ চলে আসছিল। তার ওপর আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট, একই সাথে দুটো খেলা, আমাদের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে আমার কাছে তো বটেই; কারণ আমি সবগুলো খেলাতেই অংশগ্রহণ করেছিলাম।
২৪ এপ্রিল প্রথম সেমিফাইনাল ওয়ারী ক্লাবের বিরুদ্ধে আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) মাঠে নেমেছিলাম। আমাদের দুটি দলেই বেশ কয়েকজন ভাল খেলোয়াড় থাকায় দুটি টিমই ছিল শক্তিশালী, সমমানের। খেলার শুরু থেকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কিন্তু খেলায় কোন গোল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত গোল-শূন্য ড্র হয় এবং পুনরায় খেলার সিদ্ধান্ত হয়।
২৫ এপ্রিল কম্বাইন্ড স্পোর্টিং এবং রেলওয়ের মধ্যকার দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেলাটিও জোর প্রতিযোগিতামূলক হয়েছিল। খেলার মান ছিল উন্নত, আক্রমণেও ছিল ক্ষুরধার। উত্তেজনাকর এবং আকর্ষণীয় খেলাটি আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্ত খেলার ফলাফলকে বিতর্কিত করে দিয়েছিল সেদিন। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের আগুয়ান একটি বল রেল দলের গোললাইন অতিক্রম করলেও আম্পায়ারের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কম্বাইন্ডের রাইন আউট সোনা মিয়া সে বল ‘ডি’র ভেতর তাদের রাইট-ইন বুলবানকে পাস দিলে বুলবান সজোরে হিটের মাধ্যমে গোল করে। রেল দলের প্রতিবাদে আম্পায়ার কোনপ্রকার কর্ণপাত না করে খেলা চালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ১-০ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ড্র হওয়া সেমিফাইনাল ২৯ এপ্রিলে পুনরায় অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরই মধ্যে ২৬ এপ্রিলে ছিল আমাদের লীগের শেষ খেলা। আমাদের জন্য লীগ ডিভাইডিং ম্যাচ। আমরা ইস্পাহানীকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ১৯৬৬ সালের অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওয়ারীর বিরুদ্ধে পুনরায় আমাদেরকে মাঠে নামতে হয়েছিল ফিরতি সেমিফাইনালে। ওয়ারী ক্লাবের গোলরক্ষক ফ্রান্সিস থেকে শুরু করে ১১ নম্বরের লেফট-আউট এনায়েত পর্যন্ত ভাল খেলা প্রদর্শন করেছিল। পক্ষান্তরে আমাদের ফুলব্যাক সাবের আলী এবং লেফট হকি আনোয়ার ভাল খেলতে না পারায় আমাদের রক্ষণভাগ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং এরই সুযোগে ওয়ারী, বার বার আক্রমণ চালাতে সক্ষম হচ্ছিল। প্রথমার্ধের ১৫ মিনিটে ওয়ারীর লেফট-আউট এনায়েতের সজোরে হিট করা ক্রশ নেওয়াজ (রাইট আউট) ধরে ‘ডি’র ভেতর আলমগীরকে দিলে সেন্টার ফরোয়ার্ড আলমগীর প্লেসিং-এর মাধ্যমে গোলরক্ষক রঞ্জিতকে পরাস্ত করেন।
আলমগীর মোহাম্মদ আদেল (যিনি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক হকি আম্পায়ার) ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি, বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার গৌরব লাভ করেছিলেন। গোল পরিশোধ করার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে আমরা অনেকগুলো আক্রমণ করলেও কোনটাই সফলতার মুখ দেখিনি। আমার ‘ডি’র ভেতর থেকে নেয়া হিট ফ্রান্সিস দক্ষতার সাথে রক্ষা করে। দ্বিতীয়ার্ধের ২৫ মি. আমরা একটা পেনাল্টি কর্নার পেলে উভয় দলে উত্তেজনা বেড়ে যায় কিন্তু ফুলব্যাক সাবের আলী তা কাজে লাগাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আমরা ০-১ গোলে ওয়ারীর কাছে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
৩ মে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল, ওয়ারী ক্লাব বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। শক্তিশালী দুটো টিমের ফাইনাল দেখার জন্য উল্লেখযোগ্য হকি দর্শক স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন। দেশের সেরা খেলোয়াড়দের কিছু দক্ষ খেলোয়াড় দু’দলে থাকায় খেলার মান ছিল উল্লেখ্য। ব্যক্তিগত এবং গলগত নৈপুণ্য দ্বারা খেলাকে তারা করে তুলেছিল আকর্ষণীয়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা হয়ে উঠেছিল খুব উপভোগ্য। খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। কিন্তু গোল করা কোন দলের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। সুন্দর একটি ফাইনাল খেলার গোলশূন্য ড্র দেখে এবং এরকমই প্রাণবন্ত আর এক ফাইনাল দেখার আশা নিয়ে দর্শকরা তৃপ্তিসহকারে সেদিন মাঠ ত্যাগ করেছিলেন।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং এবং ওয়ারী ক্লাব আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন। উভয় দল পুনরায় ফাইনাল খেলতে রাজি না হওয়ায় ১৮ মে কম্বাইন্ডের সাধারণ সম্পাদক মরহুম দাবীর আহমেদ সিদ্দিকী, ওয়ারী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মরহুম শামসুল হুদা এবং ইপিএসএফ-এর সাধারণ সম্পাদক মরহুম এএ সিদ্দিকী মিলে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। এখানে একটি মজার ঘটনা হলো ওয়ারী আর কম্বাইন্ড টিম দুটো আবার সমানসংখ্যক পয়েন্ট নিয়ে লীগ শেষ করায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। যদিও গোল এভারেজে ওয়ারী ক্লাব এগিয়ে ছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব : গোলরক্ষক সাদেক (সিনিয়র), ফুলব্যাক- কাদের ও সাব্বির ইউসুফ, হাফ ব্যাক-সিকেন্দার, সাদেক ও মহসিন, ফরোয়ার্ড-রাজ্জাক (সোনা মিয়া) বুলবান, ইকবাল, প্রতাপ হাজরা এবং রহমান।
ওয়ারী ক্লাব : ফ্রান্সিস পালমার (গোলরক্ষক), এএম শেরা ও মোমতাজ, মোমিন, ইব্রাহিম সাবের ও খাজা, ফরোয়ার্ডস-নেয়াজ আহমেদ রানা, আলমগীর আদেল, হাসান মামলি ও এনায়েত। (ক্রমশ:)
(ষাট) ১৬ অক্টোবর
অল পাকিস্তান মোহাম্মদ আলী বগুড়া মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট তৃতীয়বারের মত ১৫ জুন ১৯৬৬ রাওয়ালপিন্ডি আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল। আল হেলাল ক্লাব, গুজরানওয়ালা বনাম ৫০২ ওয়ার্কশপ, রাওয়ালপিন্ডি টিমের খেলার মধ্য দিয়ে টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেছিলেন ন্যাশনাল এসেমব্লির স্পিকার আব্দুল জব্বার খান। তিনি খেলার মাঠে ফুটবল কিক করে শুভ উদ্বোধন করেছিলেন। উদ্বোধনী ম্যাচে আল-হেলাল ক্লাব ৩-১ গোলে ৫০২ ওয়ার্কশপ টিমকে পরাজিত করেছিল। তাদের তারেক হাসান ২ গোল এবং মোহাম্মদ হোসেন ১ গোল করলে বিপক্ষ দলের তৈমুর ১ গোল শোধ দিতে পেরেছিল। জুন মাসের প্রখর তাপ এবং প্রচন্ড গরমের জন্য টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষ ৯০ মিনিট খেলার নির্ধারিত সময়কে কমিয়ে ৭০ মিনিট খেলার সময় নির্ধারণ করে।
ঢাকার তিনটি ক্লাব সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিল। ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি। পূর্ববর্তী (১৯৬৫) আসরের চ্যাম্পিয়ন টিম ঢাকার ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব এবছর টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ না করায় ইপিআইডিসি টিম অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে যায়। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি প্রথমবারের মত এ টুর্নামেন্টে অংশ নিলেও আমরা গত দু’আসরেই অংশ নিয়েছিলাম। টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাওয়া মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্যবৃন্দ : টিমের ক্যাপ্টেন-জহিরুল হক, ম্যানেজার-কাজী শামসুল ইসলাম, সহকারী ম্যানেজার-গজনবী ভাই। টিমের অন্যান্য সদস্য : গোলরক্ষক-হাশেম দীন ও নূরুন নবী। ফুলব্যাক ও হাফ- জহির, তোরাব আলী, আসলাম, রসুল বকশ আবদুল গফুর ও গোলাম কাদের, পিন্টু। ফরোয়ার্ড : আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর, মুসা, প্রতাপ, জালাল।
২৩ জুন আমরা রাওয়ালপিন্ডির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলাম এবং লাহোর হয়ে রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছেছিলাম ২৪ জুন। ২৫ জুন পিএএফ (পাকিস্তান বিমানবাহিনী) লায়ালপুর ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনকে ২-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হয়। তাদের লেফট আউট আকরাম দু’অর্ধে দুটো গোল করে।
দিনের অপর ম্যাচে ওয়ারসাক ক্লাব পেশাওয়ার, নিউ ক্যাপিটাল হিরোস, রাওয়ালপিন্ডিকে অতি সহজে ৬-০ গোলে পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায়। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড নাসির উল্লাহ ৪ গোল করে এবং রাইট আউট গফুর ও রাইট ইন নাজির একটি করে গোল করে। জুন-২৬ পিআইএ লাহোর জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনকে ইউসুফ সিনিয়রের দেয়া একমাত্র গোল দ্বারা পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হয়। অপর খেলায় পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে যারা গত বছর এ টুর্নামেন্টের রানার্সআপ টিম, মুলতান জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ইপিআইডিসির মোকাবেলা করবে। তাদের আইয়ুব দার ২ গোল এবং সাদিক ১ গোল করেছিল।
ঢাকা মোহামেডান বনাম ওয়ারসাক ক্লাব পেশাওয়ার, কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। শারীরিক শক্তিশালী ওয়ারসাক টিমের খেলার মান উন্নত। সুতরাং আমাদের সাথে তাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। লম্বা লম্বা খেলোয়াড় বেশিরভাগ ওপরে খেলতে অভ্যস্ত। তাদের রাইট-আউট আমিন বক্সের ভেতর উড়ন্ত একটি বল আয়ত্তে এনে সজোরে কিক করে হাশেমদীনকে পরাস্ত করে। আমরা এক গোলে পিছিয়ে পড়ে গোল শোধ করতে মরিয়া হয়ে উঠি। একটার পর একটা আক্রমণ চালিয়ে যাই। এমনি একটি আক্রমণধারায় শামসু গোল করলে কিছুটা স্বস্তি আসে টিমে। তারপর থেকে আমরা গুছিয়ে খেলতে চেষ্টা করি। আমাদের বলের আদান-প্রদান সুন্দর হয় এবং আমার দেয়া একটি থ্রু পাস লেফট আউট মুসা ধরে নিজস্ব চেষ্টায় বক্সে ঢুকে গোলপোস্টে কিক করলে বল জালে জড়িয়ে যায়; এর সাথে আমরা ভারমুক্ত হয়ে বাকি সময়টা ভাল খেলেই জয় নিয়ে মাঠ ত্যাগ করি।
পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ইপিআইডিসি টিমকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। পিআইএ কোয়ার্টার ফাইনালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কাছে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল আর ঢাকা ওয়ান্ডারার্স পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল।
প্রথম সেমিফাইনাল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স বনাম পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে। দক্ষতা এবং ক্রীড়ানৈপুণ্য দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকায় খেলাটা বেশ জমে উঠেছিল। রেল দল লম্বা লম্বা পাসে খেললেও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ছোট ছোট পাসে খেলে দলকে সুসংহত করে ফেলেছিল। দু’দিকেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ খেলাকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত ওয়ান্ডারার্স ১-০ গোলে জয়ী হয়ে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ৫ জুলাই দ্বিতীয় সেমিফাইনালে আমরা ওয়েস্ট পাকিস্তান প্রেস, করাচির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলাম। করাচির মাকরানী খেলোয়াড়রা খুব শক্তভাবে আমাদের ধরেছিল, কোন প্রকার ছাড় দিচ্ছিল না; যেখানে আমরা, সেখানেই তারা। বল ধরতে দিচ্ছিল না। আমাদের আটকাতে যে কোন উপায় অবলম্বন করছিল। আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলা খেলতেই পারছিলাম না। প্রথমার্ধ খুবই অশান্তিতে রেখেছিল প্রেস দল। দ্বিতীয়ার্ধে মুসা (লেফট আউট) নিজস্ব প্রচেষ্টায় একটা গোল করলে আমরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলায় ফিরতে পেরেছিলাম, বল নিজেদের মধ্যে রাখতে এবং আদান-প্রদান করে বেশ কয়েকটা সফল আক্রমণ করতে পেরেছিলাম। এরই একটা আক্রমণ থেকে আমি দলের দ্বিতীয় গোলটি করলে আমাদের টিমের সবাই ফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ৬ জুলাই নির্ধারিত ফাইনাল খেলা বৃষ্টির কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। ফাইনাল খেলা দেখার জন্য আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মঈনুল ইসলাম সাহেব পিন্ডি উড়ে গিয়েছিলেন। বৃষ্টিতে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। খেলোয়াড়দের অনেকে আমাকে বলেছিল প্রেসিডেন্ট সাহেবকে বলার জন্য যে, এ আবহাওয়ায় আমরা ঠান্ডা হয়ে গেছি, ১০০ টাকা করে বোনাস পেলে আমরা আগামীকাল চাঙ্গা হয়ে খেলতে পারবো। প্রেসিডেন্ট সাহেবকে সকলের কথাটা জানালে তার কালো গোঁফের ফাঁক দিয়ে সাদা দাঁতে ঝিলিক দেখতে পেয়ে বুঝে নিয়েছিলাম আমাদের আরজি মঞ্জুর হয়েছে। তিনি সবাইকে ১০০ টাকা করে দিলে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম।
৭ জুলাই ঢাকার দুই ঐতিহ্যবাহী টিমের মধ্যে ফাইনাল খেলা। ঢাকা মোহামেডান এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটো টিমের খেলা মানে মর্যাদার লড়াই, যুদ্ধ যুদ্ধ আবহাওয়া তৈরি হয়ে যায় মাঠে। ঢাকার মাঠ হোক কিংবা বাইরে কোন মাঠে হোক। পিন্ডির আর্মির মাঠেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঢাকা তথা দেশের সেরা দুটো টিমের খেলা উপভোগ করার জন্যা মাঠভর্তি দর্শক। খেলার পূর্বে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের সাথে খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ চাপের মধ্যে থাকা দু’টিমই উত্তেজিত হয়ে খেলা শুরু করেছিল। দু’দলেই উঁচুমানের খেলোয়াড় থাকায় তাদের দক্ষতা, ক্রীড়ানৈপুণ্যে কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। আমাদের দলের কম্বিনেশন অত্যন্ত চমৎকার ছিল, বিশেষ করে আবদুল্লাহ ও আমি, দুই ইন, সারা মাঠজুড়ে খেলে ডিফেন্স এবং অফেন্সের মাঝে সুন্দর সমঝোতা গড়ে তুলতে পেরেছিলাম; যার জন্য বলের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগ সময় আমরা রাখতে সক্ষম হচ্ছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি যখন হাফ এবং আউটের সাথে ট্রায়ো বানিয়ে বল আদান-প্রদান করতাম, তখন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের খেলোয়াড়রা উত্তেজিত হয়ে গালাগাল দিত, বিশেষ করে মাকরানী প্লেয়াররা এবং রাফ টেকলিং করার লক্ষ্যে ছুটে আসতো। তখন আমরা খুব মজা পেতাম। ওয়ান্ডারার্সের জুনিয়র ইউসুফ, ওমর, আব্বাস, গাজীর আক্রমণ ছিল ক্ষুরধার। আমরা আমাদের উইংদের ব্যবহার করে আক্রমণকে সচল রাখছিলাম। বল খুবই দ্রুত এ সীমানা ও সীমানা করছিল। এমনই যখন খেলার ধারা, তখন আমাদের রাইট আউট প্রতাপ বিপক্ষ দলের বক্সের কাছাকাছি একটা বল পেয়ে আচমকা গোল পোস্টে কিক করলে হাকিম (গোলরক্ষক) কিছু বুঝে ওঠার আগেই বল গোলপোস্টের ভেতর, জালে। গোল, গোল, চারদিক থেকে চিৎকার। এক গোলে পিছিয়ে পড়ে ওয়ান্ডারার্স প্রাণপণ গোল শোধ করার চেষ্টা করে বিশেষ করে দেশের কৃতী দুই ফরোয়ার্ড ওমর এবং আব্বাস কিন্তু আমাদের ছিল তোরাব আলীÑ সে সময়ের দেশসেরা স্টপার, সাথে ছিল জহির-আসলাম। তারা গোল শোধ দিতে পারেনি বরং আমাদের লেফট আউট মুসা একক প্রচেষ্টায় আরও একটি গোল করলে আমাদের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আমরা ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ২-০ গোলে পরাজিত করে অল পাকিস্তান মোহাম্মদ আলী বগুড়া ফুটবল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মো. আইয়ুব খান খেলা শেষে খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। ক্লাব প্রেসিডেন্ট সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন, আমাদেরকে রাতে ডিনার খাইয়েছিলেন। #
(ক্রমশ:)
(একষট্টি) ১ নভেম্বর
১৯৬৬ সালে ঢাকায় আমরা দুটো ফুটবল লীগ খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। একটি ঢাকা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে, ডিডিএসএ ফুটবল লীগ অপরটি ইপিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে ঢাকার প্রচলিত প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ। ডিডিএসএ ফুটবল লীগে ঢাকার প্রায় সবগুলো ক্লাব যারা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণ করে থাকে, তারা সেই লীগেও অংশ নিয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, ফায়ার সার্ভিস, পাক পিডব্লিউডি, ইপিজি প্রেস, আজাদ স্পোর্টিং, পুলিশ এসি, সেন্ট্রাল প্রিন্টিং এবং স্টেশনারী, ইপিআইডিসি, প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সাথে প্যানারোমা ক্লাব, হোল্ডেন একাদশ, আজাদ পাক ক্লাব, টিটি সেন্টার। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ওয়ারী ক্লাব অংশগ্রহণে বিরত থাকে। ডিডিএসএ ফুটবল লীগ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি টিম মাঠে সর্বোচ্চ পাঁচ জন প্রথম বিভাগের খেলোয়াড় নামাতে পারবে।
২৯ এপ্রিল ’৬৬ ঢাকা ডিস্ট্রিক স্পোর্টস এসোসিয়েশন ফুটবল লীগ আউটার স্টেডিয়ামের ১নং গ্রাউন্ডে ফায়ার সার্ভিস বনাম প্যানারোমা ক্লাবের খেলার মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয়েছিল। খেলা বেশ জমজমাট হয়েছিল। প্যানারোমা ক্লাবের গোলরক্ষক রাজা তার অনবদ্য খেলা প্রদর্শন করে উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল।
আউটার স্টেডিয়ামের ৪নং গ্রাউন্ডে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব টিটি সেন্টারকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ১নং গ্রাউন্ডে ইপিজি প্রেস এবং ইপিআইডিসি ১-১ গোলে ড্র করে পয়েন্ট বন্টন করে নেয়। ইপিআইডিসির হাশেম ও প্রেসের বাদল গোল করেছিল।
পুলিশ ৩-০ গোলে হোল্ডেনকে পরাজিত করেছিল। পুলিশের নূরুল ইসলাম, নাসির ও ননি গোপাল গোল করেছিল। ৬ মে ইপিআইডিসি ৪-০ গোলে হারিয়েছিল পুলিশকে। ৮ মে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্যানারোমা ক্লাবের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে প্রথম পয়েন্ট হারায়। মোহামেডানের পক্ষে গফুর এবং প্যানারোমার পক্ষে আজিজ গোল করেছিল। ১০ মে তারিখে ১নং এবং ৪নং গ্রাউন্ডে দুটো খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং দুটো খেলাই গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ক্লাব বনাম হোল্ডেন একাদশ এবং আজাদ স্পোর্টিং বনাম আজাদ পাকিস্তান ক্লাব। ১১ মে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব বিজি প্রেসকে কোন গোল করতে না পারায় আরও একটি পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। সেই দিনে ৪নং গ্রাউন্ডে ফায়ার সার্ভিস ৩-০ গোলে টিটি সেন্টারকে হারায় এবং তাদের হয়ে গোল করেছিল সামাদ এবং আবুল। ১৪ মে মোহামেডান বনাম আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের খেলা; আজাদ খেলতে অস্বীকৃতি জানায় কারণ মোহামেডানের খেলোয়াড়দের মধ্যে ৮ জন ছিল প্রথম ডিভিশনের খেলোয়াড় যা ডিডিএসএ ফুটবল বাইলজের পরিপন্থী। আব্দুল গফুর নুরুন নবী এবং রসুল বক্সের নাম মোহামেডান-প্লেয়ার লিস্টে ছিল না। অথচ তারা মাঠে নেমেছিল। জহির তোরাব আসলাম শামসু-মুসা এই পাঁচজনের নাম প্লেয়ার লিস্টে ছিল। ১৭ মে, ১নং গ্রাউন্ডে মোহামেডানের খেলা হোল্ডেন একাদশের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে দিন তারা মাঠে উপস্থিত হয়নি। খেলোয়াড় স্বল্পতা এবং ২০ মে থেকে অনুষ্ঠিতব্য সিনিয়র ডিভিশন (প্রথম বিভাগ) ফুটবল লীগে অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কারণ দেখিয়ে মাঠে উপস্থিত হয়নি এবং ডিডিএসএ ফুটবল লীগ থেকে মোহামেডান তাদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
১৯৬৬ সালের প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ শুরু হয়েছিল ২০ মে তারিখ থেকে। গত মৌসুমে লীগে অংশ নেয়া ১২টি দলের সাথে নতুন ইপিআইডিসি দলসহ মোট ১৩টি টিমের ফিরতি লীগ (রিটার্ন লীগ) পদ্ধতিতে ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়াম এবং আউটার স্টেডিয়ামে প্রতিদিন দুটো করে খেলা অনুষ্ঠিত হওয়া লীগের উদ্বোধন করেছিলেন ইপিএসএফ এর সভাপতি জনাব এসবি চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব এ এ সিদ্দিকী, ইপিআইডিসি বনাম রহমতগঞ্জ এবং ওয়ারী ক্লাব বনাম রেলওয়ে। দুটো ম্যাচের পূর্বে চারদলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় সভাপতি মহোদয়ের এবং পরে তিনি মাঠের মাঝখানে বল কিক মেরে সেবারের লীগ খেলার উদ্বোধন করেছিলেন। ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে রহমতগঞ্জকে এবং ওয়ারী ক্লাবও রেলওয়েকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে উভয় দল শুভ সূচনা করেছিল।
জাতীয় দলের কৃতি সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমরের দেয়া ২ গোলের সুবাদে শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল প্রেসকে ২-১ গোলে হারাতে ঘাম ঝরাতে হয়েছিল। ভুট্টো প্রেস দলের পক্ষে ১টি গোল শোধ করেছিল। আউটার স্টেডিয়ামে লীগের অপর খেলায় স্টেশনারী ফায়ার সার্ভিস দলকে কাবিলের দেয়া গোলে (১-০) পরাজিত করে পূর্ন পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ারী ক্লাব নিশিথ, জামিল আক্তার এবং এন ইসলামের দেখা ৩ গোলের উপর ভর করে পুলিশ টিমকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল। পুলিশের রহিম ১ গোল শোধ দিতে পেরেছিল। ফুটবল মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিক ইপিআইডিসি দলের ইমামের (৩ গোল) ১ গোল জব্বরের এই চার গোলের সুবাদে ৪-০ গোলে তারা রেলওয়েকে হারিয়েছিল। অপর খেলায় কৃতি সেন্টার ফরোয়ার্ড সুলানের উপর ভর করে রহমতগঞ্জ ৫-০ গোলে স্টেশনারীকে বিধ্বস্থ করে দিয়েছিল। মাহমুদের দেয়া ৩ গোলে বিজি প্রেস ফায়ার সার্ভিসকে হারাতে পেরেছিল। ২৫-৫-৬৬ তারিখের খেলায় পুলিশ দলকে বিধ্বস্ত করে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তাদের আক্রমণ ভাগ কতটকু শক্তিশালী। ফরোয়ার্ড লাইনের ওমর, আব্বাস-২, ইউসুফ (জু,) হাফিজ এবং গাজী প্রত্যেকেই গোল পেয়েছিল। দিনের অপর খেলায় আজাদ এবং রেল ১-১ গোলে ড্র করেছিল, গোল করেছিল দেবু ও বর্মন। জাতীয় দলের কৃতি লেফট আউট মূসার ৩ গোল, প্রতাপ ও শামসুর করা ৫ গোলের ব্যবধানে ঢাকা মোহামেডান স্টেশনারীকে হারিয়েছিল (২৬-৫-৬৬) অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া ৩-১ গোলে রেলদলের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিল। ইপিআইডিসি ৩-১ গোলে ফায়ারকে এবং রহমতঞ্জ ২-০ গোলে পুলিশকে হারানোর মধ্য দিয়ে লীগ খেলা এগিয়ে যায়।
৩০-৫-৬৬ তারিখে মূসার ২ গোল, শামসু ও আমার দেয়া ৪ গোলের সাহায্যে মোহামেডান ৪-০ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল। পুলিশ ১-০ গোলে স্টেশনারীকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। পরদিন রহমতগঞ্জ নাজিরের দেয়া একমাত্র গোলে ভিক্টোরিয়াকে হারিয়েছিল এবং অপর খেলায় শারফুদ্দিনও আলমের দেয়া গোলে ফায়ার সার্ভিস রেলদলকে ২-১ গোলে হারাতে পেরেছিল। রেলের অলক একটি গোল শোধ দিয়েছিল।
১লা জুন ফুটবল লীগের প্রথম অঘটন ঘটেছিল যখন শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব পিডব্লিউডি ক্লাবের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে মূল্যবান একটি পয়েন্ট হারিয়েছিল। হাফিজ গোল করেছিল ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে আর মনজুর করেছিল পিডব্লিউডি ক্লাবের পক্ষে। ইপিজি প্রেস মাহমুদ ও ভুট্টোর দেয়া গোলে ওয়ারী ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল এবং ইপিআইডিডিসি জব্বর ও হাশিমের করা ৩ গোলের বিপক্ষে একটি গোলও শোধ দিতে পারেনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। মূসা, আবদুল্লাহ এবং আমার দেয়া ৩ গোলে আমরা ভিক্টোরিয়াকে হারিয়েছিলাম। ফায়ার সার্ভিস আবুলের ২ গোলের সুবাদে রহমতগঞ্জকে ২-১ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। নাজির ১ গোল শোধ দিয়েছিল। অপর খেলায় বাবন ও দেবুর দেয়া গোলে আজাদ ২-০ গোলে স্টেশনারীকে পরাজিত করেছিল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ওয়ান্ডারার্স ২-১ গোলে ইপিআইডিসিকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। জব্বরের ২ গোলের বিপক্ষে আমিন করেছিল ১ গোল। পুলিশের নবী হ্যাটট্রিকসহ একাই ৬ গোল করেছিল এবং তারা রেলকে ৭-০ গোলে হারিয়েছিল। পিডব্লিউডি ক্লাবের বাবুল জোসি এবং সুজার করা ৩ গোলের কাছে ওয়ারী হার মেনে নিয়েছিল। অপর খেলায় প্রেস ক্লাবও রহমতগঞ্জের নয়া, সুলতান ও গফুরের দেয়া ৩ গোলের সুবাদে ৩-১ গোলের হার মেনে নিয়েছিল তবে প্রেসের সামাদ ১টি গোল শোধ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল।
৮-৬-৬৬ তারিখে মোহামেডান তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু-২, মূসা ও প্রতাপের করা গোলের সাহায্যে পুলিশকে ৪-০ হারিয়েছিল। অপর খেলায় রেলওয়ে পিডব্লিউডি টিমের কাছে ৮-১ গোলে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল। সুজা একাই ৪ গোল, জানি, মনজুর ওয়াহিদ মিলে বাকি ৪ গোল করেছিল বিপরীতে রেলের অলক ১ গোল শোধ দিতে পেরেছিল। ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে ওয়ারীকে হারিয়ে ছিল এবং প্রেস ও স্টেশনারী ১-১ গোলে ড্র করেছিল। ওয়ান্ডারার্স ৫-০ গোলের বড় জয় পেয়েছিল রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে আর তাদের পক্ষে গোল করেছিল আব্বাস-২, আসলাম-২ ও আবিদ। ভিক্টোরিয়া এবং আজাদ তাদের নিজ নিজ দলের জয় পেয়েছিল ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ টিমের বিরুদ্ধে ১-০ গোলের। প্রতাপ, শামসু ও মূসার ৩ গোল পিডব্লিউডি টিমের বিরুদ্ধে মোহামেডানের জয় এসেছিল এবং সেদিনই অপর খেলায় ওয়ারী ক্লাবকে তপন, ইউনুসের-২, নিশিথের দেয়া ৪ গোলের জয় এনে দিয়েছিল স্টেশনারী দলের কাছ থেকে।
ইপিআইডিসি পরবর্তী খেলায় প্রেসকে ৫-২ গোলে হারিয়েছিল জব্বর, হাবিব-২, আবদুল্লা আকবর এবং সলিমুল্লাহর গোলের বিপরীতে মাহমুদ ও শিবলী দু গোল শোধ দিয়েছিল। নাজিরের দেয়া দু গোলের সাহায্যে রহমতগঞ্জ ২-০ গোলে রেলকে হারিয়েছিল। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স পুনরায় প্রমাণ করেছিল যে, তাদের আক্রমণভাগ কত শক্তিশালী যখন আসলাম, হাফিজ, আব্বাস, রহমতউল্লাহ মিলে আজাদের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দিনের অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিস ৩-২ গোলে পুলিশকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট পেয়েছিল। পরদিনের খেলায় ওয়ারী ও ভিক্টোরিয়া ১-১ গোলে ড্র করলে, পিডাব্লিউডি জিতেছিল ১-০ গোলে স্টেশনারীর বিরুদ্ধে। মূসা তার ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দ্বারা হ্যাটট্রিকসহ ৫ গোল এবং কামালের এক গোলের কাছে রেলদল নতি স্বীকার করেছিল ৬-০ গোলের। ১৬-৬-৬৬) অপর খেলায় আজাদ ১-০ গোলে হারিয়েছিল প্রেসকে যার গোল করেছিল চট্টগ্রামের কৃতি ফুটবলার লেফট আউট বাটু। ১৭-৬-৬৬ তারিখ ওয়ান্ডারার্স ক্লাব লীগ চ্যাম্পিয়নশীপের দৌড়ে আরও এককদম পিছিয়ে পরেছিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। ওয়ারী ৪-০ গোলের পরাজয় মেনে নিয়েছিল যখন ফায়ার সার্ভিস টিমের আশরাফ-৩ ও শাহাবুদ্দিন চার গোল করেছিল। গফুর ও নাজিরের করা ২ গোল রহমতগঞ্জকে পিডব্লিউডির বিরুদ্ধে ২-১ গোলে জয়ী করেছিল। সুজা ১ গোল শোধ করার সুযোগ পেয়েছিল। রেল দল ২-১ গোলে জিতেছিল স্টেশনারীকে, মুকুল ও ইয়াকুব রেলের পক্ষে আর আজিজ গোল করেছিল স্টেশনারীর পক্ষে। ইউসুফ, ওমর, আনসার ও হাফিজ ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের চার ফরোয়ার্ড ৪ গোল করে ফায়ার সার্ভিসকে পরাজিত করেছিল। (২১-৬-৬৬) অপর খেলায় জালালের ২ গোল এবং নিমাইয়ের ১ গোলের সুবাদে প্রেস স্টেশনারীকে ৩-১ গোলে (ওয়াসী) হারিয়েছিল। ইপিআইডিসি ৩-১ গোলে স্টেশনারীকে এবং রহমতগঞ্জ নাজির ও গফুরের দেয়া ২-০ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল। পিডব্লিউডি ৬-২ গোলের বড় ব্যবধানে পুলিশকে হারিয়েছিল। গোল করেছিল সুজা-২,লাল মোহাম্মদ, কানু, জোসি পুলিশের নূরু এবং সাত্তার দুটো গোল শোধ দিয়েছিল। ২৪ থেকে ২৮ জুন বড় কোন দলের খেলা ছিল না। ভিক্টোরিয়া প্রেসকে ২-০ গোলে হারায়। পিডব্লিউডি ফায়ারের খেলায় কেউ গোল করতে পারেনি, প্রেস সেলিমের জন্য পুলিশকে ১ গোল দিতে পেরেছিল। ভিক্টোরিয়া আজিমের ৩-গোল এবং মনসুরের ১ গোলের উপর ভর করে আজাদকে ৪-০ গোলে হারালেও তাদেরকে আবার পিডাব্লিউডি ক্লাবের নিকট ০-৫ গোলে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। ফায়ার আজাদ ১-১ গোলে ড্র।
ভিক্টোরিয়া ১-০ গোলে স্টেশনারীকে হারায়। আসলাম ও আব্বাস দু গোল করে আর হাফিজ এবং ইউসুফ এক গোল করে মোট ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে ওয়ান্ডারার্স ওয়ারীকে হারালেও (১১-৭-৬৬) তারিখের অপর খেলায় পিডাব্লিউডি এবং আজাদের খেলায় কোন গোল হয়নি। ১৪-৭-৬৬ তারিখে আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট নষ্ট করেছিল ইপিআইভিসি, পিডব্লিউডি টিমের সাথে ২-২ গোলের ড্র করে। হাশিম এবং সলিমুল্লাহ ইপিআইডিসির পক্ষে গোল করলে বিপক্ষ দলের পক্ষে গোল করেছিল গনি এবং মনজুর। সেলিমের দেয়া ২ গোলে প্রেস জিতেছিল রেলের সাথে।
১৫-৭-৬৬ শামসুর দেয়া একমাত্র গোল মোহামেডানকে অক্ষত রেখেছিল। প্রথমার্ধের ১৮ মিনিটে আজাদের। বিরুদ্ধে শামসুর গোলটি আমাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছিল। সেদিন আমাদের আক্রমণভাগ ছিল দারুণভাবে ব্যর্থ। পক্ষান্তরে আজাদের রক্ষণভাগ অসাধারণ ভাল খেলে মোহামেডানের সকল আক্রমণকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। বিশেষ করে তাদের স্টপার কাজী মোবাশশার হোসেন অত্যান্ত দক্ষতার সাথে ইন্টারসেপ্ট এবং ক্ষিপ্রতার সাথে টেকলিং করে খেলে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাদের ফুলব্যাকদ্বয় আহমেদ এবং আব্দুর রব দৃঢ়তার সাথে আমাদের সকল আক্রমণ রুখতে সক্ষম হয়েছিল। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড় (গোলরক্ষক) ইয়ার মোহাম্মদ আহমেদ-মোবাশশার এবং এ রব, লালু এবং সাদেক, দেবু, নাসিম, মানিক বর্মন, সাবের এবং নজরুল।
পরের দিনের দুটো খেলা ইপিআইডিসি ৩-১ গোলে ভিক্টোরিয়াকে এবং পুলিশ ৩-২ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারিয়েছিল। ১৭ জুলাই তারিখে ছিল লীগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খেলা, ঢাকা মোহামেডান বনাম ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। সে সময় সিলেটে ভীষণ বন্যায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে খেলাটিকে চ্যারিটি ম্যাচ করা হয়েছিল। পূব গ্যালারি ১ রুপি এবং পশ্চিম গ্যালারি ২ রুপি টিকিটের মূল্য ধার্য করা হয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শকে পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে খেলার পূর্বে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী জনাব এস এম আমজাদ হোসেনের সাথে উভয় দলের খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
খেলা শুরু থেকে আমাদের আক্রমণভাগ অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ডিফেন্সকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। মোহামেডান এবং ওয়ান্ডারার্স খেলা যেমন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব সেটা খুব একটা ছিল না। ওমর এবং আব্বাস তাদের নামের মত খেলতে পারছিল না, পুরোপুরি ব্যর্থ ছিল, সুতরাং তাদের আক্রমণে সেরকম ধার ছিল না ফলে আমাদের রক্ষণভাগ ছিল সুদৃঢ়। আমাদের আক্রমণ ছিল ক্ষুরধার, বারবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। পাঁচ মিনিটেই আমরা কর্নার লাভ করি। মূসার কর্নার থেকে বল পেয়ে আমি সজোরে কিক করলে তা পোস্টের উপর দিয়ে চলে যায়। ১৭ ও ২১ মিনিটেও আমরা কর্নার থেকে কোনরকম সুফল পাইনি। মূসার একটি দুর্বল কিক হাকিমের হাতে ধরা পরে, প্রায় ৫ গজ থেকে আবদুল্লাহ বাইরে মেরে সহজ গোল থেকে আমরা বঞ্চিত হই। বিরতির পর ছ মিনিটে প্রতাপের একটি কিক গোলবার ছুঁয়ে বাইরে চলে যায়। ওয়ান্ডারার্সের চতুর রাইট উইং ইউসুফের (জুনিয়র) হেড আমাদের সাইডবারে লেগে ফেরত গেলে আমরা নিশ্চিত একটি গোল খেতে খেতে রক্ষা পাই। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় লেফট আউট মূসা একক প্রচেষ্টায় বাম দিক দিয়ে ঢুকে সজোরে কিকের দ্বারা হাকিমকে পরাস্ত করলে স্টেডিয়াম আনন্দে ফেটে পরে।
আমরা অনেকটা ভারমুক্ত হয়ে খেলে বাকী সময়টা কাটিয়ে দিয়েছিলাম এবং মূসার গোলটাই আমাদেরকে চ্যারেটি ম্যাচ জয় এনে দিয়েছিল এবং লীগের জয়ের ধারাকে অক্ষুণœ রেখেছিল। চ্যারেটি ম্যাচের টিকিট বিক্রয়কৃত অর্থ ৩১,৯৬৮/- রুপি বন্যাদুর্গত ফান্ডে প্রদান করা হয়েছিল। চ্যারিটি ম্যাচে যারা খেলেছিল-
মোহামেডান : হাশেম দীন (গোলরক্ষক) জহির-তোরাব আলী, আসলাম, (ব্যাক) পিন্টু এবং গফুর। (হাফ) প্রতাপ আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর এবং মূসা (ফরোয়ার্ড)।
ওয়ান্ডারার্স : হাকিম (গোলরক্ষক), দেবীনাশ-হাসান, খামিসা (ব্যাক) আলাউদ্দিন ও আলী হাফিজ (হাফ), ইউসুফ (জু), আসলাম, ওমর, আব্বাস এবং গাজী।
সে দিনের রেফারি ছিলেন মাসুদুর রহমান।
(ক্রমশ.)
(বাষট্টি) ১৬ নভেম্বর
খেলার ৩০ মিনিটে হাশিমের দেয়া একমাত্র গোলে শক্তিশালী ইপিআইডিসি টিম পুলিশকে হারাতে পেরেছিল। গোলপোস্টে দুর্বল এবং এলোমেলো কিক তাদেরকে বেশি গোল পেতে দেয়নি। তাছাড়া পুলিশের তিন ডিফেন্ডার আক্তার, নবী চৌধুরী এবং হাফিজ দৃঢ়তার সাথে খেলে তাদের আক্রমণ সফল হতে দেয়নি। উপরন্তু খেলার শেষ মুহূর্তে পুলিশের সাত্তারের সজোরে কিক ইপিআইডিসি’র ক্রসবারে লেগে ফিরে আসলে পুরো দু’পয়েন্টের সন্তুষ্টি নিয়ে সেদিন ইপিআইডিসি মাঠ ছেড়েছিল।
পুলিশ টিমে যারা খেলেছিল : চন্দন (গোলরক্ষক), আক্তার, নবী চৌধুরী, এবং হাফিজ, কায়াসউদ্দিন এবং এরশাদ, সাত্তার, নাজির, ধীরেন, গাফফার এবং এন ইসলাম।
সেদিনের লীগের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং ২-১ গোলে অপেক্ষাকৃত জোরদার টিম রহমতগঞ্জকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। আজাদের নজরুল এবং দেবু গোল পেয়েছিল। প্রথমার্ধে ফায়ার সার্ভিস আমাদের কোন গোল করতে না দেয়ায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। গোলের সুযোগগুলো আমরা যেভাবে নষ্ট করেছি চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে ছিল বড়ই লজ্জার। ফায়ারের ডিফেন্স অত্যন্ত সতর্কতা এবং দক্ষতার সাথে আমাদের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল, বিশেষ করে প্রথমার্ধে। দ্বিতীয়ার্ধের ৪ মিনিটে আবদুল্লাহ গোল করে আমাদেরকে স্বস্তি এনে দিয়েছিল। গফুর গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং খেলার প্রায় শেষ সময়ে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু গোল করলে আমরা ৩-০ গোলে জয়ী হয়েছিলাম।
ফায়ার সার্ভিস দলের খেলোয়াড় : মোতালেব (গোলরক্ষক), মুজিবর রহমান জলিল, আনসারি এবং বিমল, আবুল হাসান এবং সামাদ, আবুল সারফুদ্দিন, সাহাবুদ্দিন, আশরাফ এবং ওহাব।
অপর খেলায় গনি এবং জোসির গোলের সুবাদে পিডব্লিউডি ২-১ গোলে (বিমল) রেলকে হারিয়েছিল। ২০ জুলাই ওয়ান্ডারার্সের ৭-০ গোলের বড় জয় আমাদের চিন্তিত করে দিয়েছিল; কারণ মাত্র দু’পয়েন্ট হারিয়ে তারা আমাদের কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলছিল। স্টেশনারী প্রথমার্ধে ভাল খেলে একমাত্র আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়েছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আর সামাল দিতে পারেনি। আব্বাস ২ মিনিটে দু’গোল, ওমরও পাঁচ মিনিটে দু’গোল করে, ছ’নম্বর গোল আব্বাস এবং শেষ গোল ছিল আসলামের। পরের খেলায় ওয়ারী এবং রেল পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল ১-১ গোল করে।
২১ জুলাই এর বিকেলটা ছিল আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসুর। সে একাই হ্যাটট্রিকসহ ৬ গোল করেছিল, সেই সাথে আমাদের ১১ গোলের ঝড়ে রহমতগঞ্জ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। লীগের এ খেলাটি ছিল আমাদের দশ নম্বর খেলা এবং শামসুর হ্যাটট্রিক ছিল মৌসুমের চতুর্থ হ্যাটট্রিক। আবদুল্লাহ প্রথম গোলের দরজা খুলেছিল এবং শামসু ৫, ৬ এবং ৭ নম্বর গোলের সাহায্যে হ্যাটট্রিক করেছিল। প্রতাপ ও মুসা ১ গোল করে করলে আমিও গোল করতে পিছিয়ে থাকিনি। ২ গোল করেছিলাম। তবে রহমতগঞ্জের সেন্টার ফরোয়ার্ড আফজাল ছিল মাঠের আনন্দিত খেলোয়াড় যে একক প্রচেষ্টায় মোহামেডানের ডিফেন্সকে কাটিয়ে দর্শনীয় একটি গোল করে সবাইকে চমকে দিয়েছিল (১১-১), সেই সাথে রহমতগঞ্জের মান বাঁচিয়ে ছিল।
রহমতগঞ্জ টিমের খেলোয়াড় : আমান (গোলরক্ষক), ফারুক, হাসনাত এবং দীপু, রফিক, নাজির, রোকন, সুলতান, আফজাল, গফুর, টিপু।
অপর খেলায় পুলিশের খেলোয়াড় নাজিরের দেয়া একমাত্র গোলে আজাদ হেরেছিল। ৩-১ গোলে ভিক্টোরিয়া প্রেসকে হারিয়েছিল। সুজার দর্শনীয় হ্যাটট্রিকের সুবাদে পিডব্লিউডি স্টেশনারীকে ৪-২ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। সিরাজ গোল করে প্রেসকে এগিয়ে নিলে গনি খেলায় সমতা আনে (১-১)। হাশেম গোল করে আবারও প্রেসকে এগিয়ে দেয়। (২-১)। তার পর সুজা পরপর তিনটি গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে। ২৩ জুলাই ছিল লীগের গুরুত্বপূর্ণ খেলা, মোহামেডান বনাম ইপিআইডিসি, লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী টিম। তিন পয়েন্ট হারিয়ে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের পেছনে থেকে শিরোপা জয়ের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। পুনরায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া খেলাটি পূর্বের খেলায় গ্যালারিতে উচ্ছৃংখল দর্শকদের মারামারির জন্য পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন পর্যন্ত খেলা ২-২ গোলে ড্র ছিল। সে সময় আমরা দু’দল মাঠের মাঝখানে বসে দর্শকদের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমন দেখে হা-হুতাশ করছিলাম।
ঢাকা স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। খেলার পূর্বে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে সেদিনের বিশেষ অতিথি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার আলমের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে স্কো. লিডার আলম পাক-ভারত যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে বিমান যুদ্ধ করে সফলতা অর্জন করেছিলেন এবং সবার ‘হিরো’ হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। স্কোয়াড্রন লিডার এমএম আলম তার বাবার মৃত্যুতে ঢাকায় এসেছিলেন, তারা আজিমপুর কলোনিতে থাকতেন বিধায় আজিমপুর এস্টেট ওয়েলফেয়ার সোসাইটি তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। খেলা শুরু থেকেই দু’দলের খেলোয়াড়রা উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। এমতাবস্থায় আমরা আকর্ষণীয় খেলা উপহার দিতে পারছিলাম না; বিশেষ করে আমাদের এলোমেলো, অগোছালো খেলা ইপিআইডিসি টিমকে ভাল খেলার সুযোগ করে দিচ্ছিল। আমাদের ফুলব্যাকদ্বয় জহির ভাই এবং আসলাম ব্যর্থ ছিলেন। এ সুযোগে বিপক্ষ ফরোয়ার্ড হাশিমউদ্দিন, জব্বর, সলিমুল্লাহ এবং হাবিবের সম্মিলিত আক্রমণের ধার বেড়ে গিয়েছিল। তবে স্টপার তোরাব আলী অত্যন্ত পরিশ্রম এবং দক্ষতার সাথে তাদের আক্রমণগুলোকে সফল হতে দেয়নি। তার দর্শনীয় খেলা, এন্টিসিপেশন, উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ইপিআইডিসির হাফ মুসা ও আবদুল্লাহ আকবর এবং ফুল ব্যাকে আমিন দৃঢ়তার সাথে আমাদের আক্রমণগুলোকে ঠেকিয়েছে। আমাদের দলের মুসার লক্ষ্যভ্রষ্ট বল মারা, আবদুল্লাহর মাঠে অযথা দৌড়াদৌড়ি এবং আমার মাঠে নি®প্রভ থাকা আমাদের আক্রমণকে জোরদার করতে পারছিল না। পক্ষান্তরে খেলার বিশ মিনিটে আমাদের ফুটব্যাক আসলামের অসাবধানতার কারণে ইপিআইডিসির হাশিম গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। এর আগে মূসার একটি থ্রু পাস আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু স্বপন (গোলরক্ষক)কে একা পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। গোল খেয়ে আমাদের এলোমেলো টিম গুছিয়ে আনতে সময় চলে যাচ্ছিল। দ্বিতীয়ার্ধের ২৪ মিনিটের সময় শামসু সাইফুদ্দিন এবং গফুর বেলুচকে ড্রিবল করে একক প্রচেষ্টায় গোল করে মোহামেডান সাপোর্টারদের স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিল। গোল করার পর আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গিয়েছিল এবং খেলার গতিটাও বেড়ে গিয়েছিল। খেলা শেষ হওয়ার ৩ মিনিট আগে প্রতাপ মুসার উদ্দেশে বিপক্ষ দলের বক্সের কাছাকাছি একটি বল দিলে মুসা পোস্টে সজোরে মেরে স্বপনকে পরাস্ত করলে বিজয় উল্লাসের চিৎসারে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে ওঠে। এক গোলে পিছিয়ে পড়া মোহামেডান খেলার অন্তিম মুহূর্তে ২-১ গোলে জয়ী হয়ে লীগের সে সময় পর্র্যন্ত শতভাগ জয়লাভের গৌরব অজন করতে সক্ষম হয়েছিল।
মোহামেডানে যারা খেলেছিল : গোলরক্ষক - হাশেমদীন, ব্যাক-জহির, তোরাব আলী ও আসলাম। হাফ-জাকারিয়া পিন্টু ও গফুর। ফরোয়ার্ড-প্রতাপ, আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর ও মুসা।
ইপিআইডিসি টিম : গোলরক্ষক-স্বপন, ব্যাক-আমিন, গফুর বেলুচ ও সাইফুদ্দিন, হাফ-মুসা ও আবদুল্লাহ আকবর। ফরোয়ার্ড-সলিমুল্লাহ, হাশিম, হাবিব, জব্বর ও টুলু।
রেফারি-ঈশা খান।
আমাদের লীগের প্রথম পর্বের শেষ খেলা ছিল ওয়ারীর বিরুদ্ধেÑ যা আমরা সফলভাবে ৮-১ গোলের জয় দিয়ে শেষ করেছিলাম। গফুর ২ গোল, মুসা ৩ গোল, শামসু ২ গোল এবং প্রতাপ করেছিল ১ গোল।
লীগের প্রথম রাউন্ড শেষে তিন টিমের অবস্থান
দল খেলা জয় ড্র পরা পক্ষে বি. পঃ
মোহামেডান ১২ ১২ ০ ০ ৫১ ৪ ২৪
ওয়ান্ডারার্স ১২ ৯ ২ ১ ৫৩ ৭ ২০
ইপিআইডিসি ১২ ৯ ১ ২ ৩২ ১১ ১৯
(ক্রমশ.)
(তেষট্টি) ১ ডিসেম্বর
আজাদী দিবস ফুটবল ১৯৬৬
প্রতিবছরের মত সে বছরও ইপিএসএফ-এর ফুটবল কমিটির ব্যবস্থাপনায় আজাদী দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট বেশ ঘটা করে আয়োজন করা হয়েছিল। ফুটবল লীগ তখনও পুরোদমে চলছিল। মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি লীগ শিরোপা লাভের দৌড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। ৭-১৪ আগস্ট পর্যন্ত লীগ খেলা স্থগিত রেখে শুরু হয়েছিল আজাদী দিবস ফুটবল। সাতটি টিম এতে অংশ নিয়েছিল। গতবারের চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি, ভিক্টোরিয়া, পিডব্লিউডি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এবং আইজিপি একাদশ। ৮ আগস্ট ইপিআইডিসি বনাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিমের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল টুর্নামেন্ট। ঢাকা ইউনিভার্সিটি এবং কলেজের কৃতী খেলোয়াড় যারা বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে লীগে অংশগ্রহণ করে থাকে, তাদেরকে নিয়ে বেশ শক্তিশালী টিম গঠন করেছিল। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ পত্রিকা মারফত খেলোয়াড়দের তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। সে অনুযায়ী টিমে যারা ছিল- হাফিজ উদ্দিন (ক্যাপ্টেন), প্রতাপ শংকর হাজরা (ভাইস ক্যাপ্টেন), হাসান, সাবের, কায়কোবাদ, মনিরুল হক, শাহজাহান, টিপু, রফিক, অনাথ, আজম, সাইদুর, নুরুজ্জামান, আবদুল হক, আতাউর এবং গিয়াসউদ্দিন।
সমমানের দুটি টিমের খেলা। ইউনিভার্সিটি দলের ভাইস ক্যাপ্টেন প্রতাপ শংকর মাঠে উপস্থিত ছিল না। খেলা শুরু থেকেই দু’টিমের খেলোয়াড়ের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল এবং ভার্সিটি টিমের খেলোয়াড়রা রাফ ট্যাকলিং করে খেলছিল। খেলার একপর্যায়ে ইউনিভার্সিটি টিমের লেফট আউট টিপু এবং ইপিআইডিসি টিমের রাইট আউট সলিমউল্লাহর মধ্যে উত্তপ্ত কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে ইউনিভার্সিটির হাসান দৌড়ে গিয়ে সলিম উল্লাহকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। এতে ইপিআইডিসি টিম কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তার ওপর ইপিআইডিসির নির্ভরযোগ্য স্টপার গফুর বালুচ হাঁটুতে আঘাত পেয়ে রাইট আউট পজিশনে গিয়ে দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে সময় পার করছিল। তাদের হাফলাইনে মুসা এবং ব্যাকে আমিন ও সাইফুদ্দিন ইউনিভার্সিটির সব আক্রমণ দৃঢ়তার সাথে সামাল দিয়েছিল। ইপিআইডিসির আক্রমণভাগে হাশিম, জব্বর এবং আনসার ইউনিভার্সিটির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে গিয়েছিল। তাদের লেফট আউট আনসার বিপক্ষ দলের বক্সের কাছে একটি বল পেয়ে সজোরে কিক করলে অলক (গোলরক্ষক) ধরতে ব্যর্থ হয় এবং ইপিআইডিসি ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। এরপর ইউনিভার্সিটি সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালাতে থাকে। পরপর তিনটি সুযোগ তারা হাতছাড়া করে। ইপিআইডিসির আনসার বাম দিক থেকে পুশের মাধ্যমে জব্বরকে পাস দিলে সে দক্ষতার সাথে গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেয়। দুই গোলে পিছিয়ে পড়ে ইউনিভার্সিটি গোল শোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে এবং বিরতির কিছু আগে মুনিরের জোরালো শট স্বপনের (গোলরক্ষক) হাত ফসকে বল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফরোয়ার্ড শাজাহানের কাছে গেলে তা থেকে শাহজাহান গোল করে (২-১)। খেলায় আবারও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে মাঝামাঝি সময় আনসার সুন্দর একটি থ্রু পাস হাশিম উদ্দিনকে দিলে সে গোল করে দলকে ৩-১ গোলের জয় এনে দেয়; সে সাথে দল সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ৯-৮-৬৬ ঢাকা ওয়ান্ডারার্স আইজিপি একাদশকে ৫-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিল। খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল আব্বাসের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। পুলিশ দলের খেলোয়াড়সহ অন্যান্য টিমের খেলোয়াড়কে নিয়ে আইজিপি টিম গঠন করা হয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স আরো বেশি গোলে জয়লাভ করতে পারতো, শুধু আবাসের হ্যাটট্রিকের জন্য ইউসুফ ওমর আবদুল্লাহ গোল করা থেকে বিরত ছিল। আইজিপি টিমের নবী চৌধুরী ওয়ান্ডারার্স দলের অনেকগুলো আক্রমণ নস্যাৎ করে দলকে আরও বেশি গোলের পরাজয় থেকে বাঁচিয়েছিল। খেলা শুরু হলে প্রায় দশ মিনিটে ওয়ান্ডারার্সের আলী হাফিজ একক প্রচেষ্টায় ড্রিবলিং করে সাত্তার নিশিথ এবং হাফিজকে কাটিয়ে সীতাংশুকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে ঢুকিয়ে একটি দর্শনীয় গোল করেছিল। বিরতির কিছুক্ষণ আগে একটি বল নবী চৌধুরী ধরতে ব্যর্থ হলে ওমর ধরে গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। আইজিপি একাদশও মাঝে মাঝে আক্রমণ চালিয়ে ওয়ান্ডারার্সকে ব্যস্ত করে তোলে; তবে ওয়ান্ডারার্সের শক্তিশালী ডিফেন্সের কাছে সেগুলো পাত্তা পায়নি। বিরতির পর আব্বাস দলের পক্ষে তৃতীয় এবং চতুর্থ গোল করলে দলের অন্যান্য খেলোয়াড় তাকে হ্যাটট্রিক করার জন্য সহযোগিতা করতে থাকে। তারা গোলের সহজ সুযোগেরও ব্যবহার করছিল না। অবশেষে রহমত উল্লাহ লেফট আউট পজিশন থেকে একটি লব দিলে আব্বাস সেটা থেকে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল।
আইজিপি একাদশ : সীতাংশু (গোলরক্ষক), মুজিবর, নবী চৌধুরী এবং আইনুল, হাসান এবং সামাদ, খোকন, সাত্তার, নিশিথ, হাফিজ এবং মাহমুদ।
১১-৮-৬৬ ভিক্টোরিয়া ৩-১ গোলে পিডব্লিউডিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। সমশক্তির দুটো টিম। তবে দুর্ভাগ্য পিডব্লিউডি টিমের যে, ভাল খেলেও পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। বলের নিয়ন্ত্রণ তাদেরই বেশি ছিল, আক্রমণও তারা বেশি করেছিল; শুধু ভাগ্য তাদের সাথে ছিল না। পক্ষান্তরে ভিক্টোরিয়া যে ক’টা সুযোগ পেয়েছিলÑ সব ক’টাতেই সফল হয়েছিল। ভিক্টোরিয়ার রাইট আউট ইউনুসের একটি লব সেন্টার ফরোয়ার্ড আজিম হেড করে গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর পিডব্লিউডি টিমের ফুলব্যাক হামিদ হেড করে গোলরক্ষক মতিনকে ব্যাক পাস দিতে গেলে ভিক্টোরিয়ার আজিম মাঝপথে বল ধরে পুস করে পোস্টে ঢুকিয়ে দিলে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। পিডব্লিউডি দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড জালাল স্বীয় চেষ্টায় একটি গোল দিলে খেলা বেশ জমে উঠে। পিডব্লিউডির মঞ্জু বিরতির পূর্বে একটি নিশ্চিত গোল মিস করলে ড্র থেকে বঞ্চিত হয় পিডব্লিউডি। দ্বিতীয়ার্ধে ভিক্টোরিয়ার ইউনুস বল নিয়ে বিপক্ষ বক্সে ঢুকলে পিডব্লিউডির খেলোয়াড় ফাউল করলে ভিক্টোরিয়া পেনাল্টি পায় এবং তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আজিম হ্যাটট্রিকের আশায় পেনাল্টি মারে, তবে মিস করে। আজিম অবশ্য পরবর্তীতে একক চেষ্টায় গোল করে হ্যাটট্রিকের স্বাদ পূর্ণ করতে পেরেছিল। সে সাথে সেমিফাইনাল খেলাও নিশ্চিত হয়েছিল।
পিডব্লিউডি টিম : মতিন (গোলরক্ষক), কানু, হামিদ এবং লাল মোহাম্মদ সালেহ এবং ওয়াহিদ, রহিম, গনি, জালাল, জানি এবং মনজুর।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ইপিআইডিসিকে হারিয়ে ফাইনালে। আব্বাসের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইপিআইডিসি ২-৪ গোলে পরাজিত। খেলা শুরু থেকে ওয়ান্ডারার্স প্রচন্ড আক্রমণ চালায় এবং ইপিআইডিসি সমানতালে লড়ে যায়। ওয়ান্ডারার্সের ডিফেন্স সেদিন খুব একটা ভূমিকা পালন করতে পারছিল না; বিশেষ করে মোবাশ্বের অনেকটা ‘সেকি’ ছিল এবং খামিসাও মানসম্মত খেলা খেলতে পারছিল না। তবে দেবীনাশ দৃঢ়তার সাথে তার রোবাস্ট ট্যাকলিং দ্বারা ইপিআইডিসির আক্রমণকে রুখতে সক্ষম হয়েছিল। প্রায় পনের মিনিটের সময় মোবাশ্বেরের হাতে বল লাগার কারণে ইপিআইডিসি পেনাল্টি পায় এবং আমিন গোল করে তার দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। ওমরের একটি হেড দর্শনীয়ভাবে স্বপন (গোলরক্ষক) রক্ষা করলে ওয়ান্ডারার্স ড্র হতে বঞ্চিত হয়। ওয়ান্ডারার্সের গোলরক্ষক হাকিমের একটি পাঞ্চ করা বল হাবিবের কাছে গেলে সে জোরে মেরে হাকিমকে পরাস্ত করে এবং ইপিআইডিসি ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। বিরতির কিছু আগে উঁচু হয়ে আসা একটি বলের ফ্লাইট গোলরক্ষক স্বপন মিস করলে ওমর সেটার সদ্ব্যবহার করেছিল (২-১)। হাফটাইমের পর ওয়ান্ডারার্স পুরো শক্তি লাগিয়ে দেয়। হাসানের লব ওমর আয়ত্তে এনে আব্বাসকে দিলে তা থেকে আব্বাস গোল করে ২-২ গোলের সমতা এনে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় ওমর একটি বল নিয়ে দ্রুতগতিতে বিপক্ষ দলের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়ে এবং আব্বাসকে বল বানিয়ে দিলে আব্বাস তার দ্বিতীয় গোল খুব সহজেই করে দলকে ৩-২ গোলে এগিয়ে দেয়। খেলার একপর্যায়ে ওয়ান্ডারার্সের জব্বর আলী হাফিজের সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে গেলে আলী হাফিজ জব্বরকে বুট দিয়ে আঘাত করে; আর সে কারণে রেফারি ননী বসাক তাকে মাঠ থেকে বের করে দেন। শেষ বাঁশি বাজার আগ মুহূর্তে আবারও ওমর বিপক্ষ দলের বক্সে ঢুকে আব্বাসের হ্যাটট্রিকের সুযোগ করে দিলে আব্বাস গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে; সেই সাথে ওয়ান্ডারার্স ৪-২ গোলে ইপিআইডিসিকে হারিয়ে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
১২-৮-৬৬ শামসুর জোড়া গোলে সেমিফাইনালে ভিক্টোরিয়া পরাজিত হয়। মোহামেডান ১৪ আগস্ট ওয়ান্ডারার্সের মুখোমুখি হয়। ভাল ফুটবল দেখার আশায় মাঠে প্রচুর দর্শক উপস্থিত হয়েছিল কিন্তু দু’টিমের খেলোয়াড়রা রাফ এবং টাফ খেলতে গিয়ে গায়ের বল প্রয়োগ করলে খেলার সৌন্দর্য হারিয়ে গিয়েছিল। যা দেখে দর্শকরা হতাশ হয়েছিলেন। খেলোয়াড়রা স্বাভাবিক খেলার পরিবর্তে ধাক্কাধাক্কি, লাথি মারা সবই চলছিল মাঠে। রেফারি ঈশা খান খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে মোহামেডানের আবদুল্লাহকে ভিক্টোরিয়ার নাজির ঘুষি মারলে রেফারি দুজনকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করে দেন। এরপর থেকে ভিক্টোরিয়া এলোমেলো খেলতে থাকে। আক্রমণভাগে একমাত্র ইউনুস পরিশ্রম করে খেলে, কোনপ্রকার দলের কাছ থেকে সহযোগিতা না পেলে তার পরিশ্রম কোন কাজে আসেনি। ইউনিভার্সিটি টিমের ভাইস ক্যাপ্টেন প্রতাপ হাজরাকে মোহামেডানের রাইট আউট পজিশনে খেলতে দেখে পত্রিকা বিরূপ মন্তব্য করেছিল। প্রথমার্ধের ৩০ মিনিটে শামসুর মাটি কামড়ানো কিক ভিক্টোরিয়ার গোলরক্ষক রানা ধরতে ব্যর্থ হলে আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। মুসার একটি সুন্দর থ্রু পাস শামসু ধরে দর্শনীয় গোল করে আমাদেরকে ২-০ গোলের জয় এনে দেয় এবং দলকে ফাইনাল খেলার সুযোগ করে দেয়।
রোববার ১৪ আগস্ট আজাদী দিবস ফুটবল ফাইনাল। ছুটির দিনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। শক্তিশালী দুটো টিম মোহামেডান এবং ওয়ান্ডারার্স, দেশসেরা খেলোয়াড়দের ভিড়, স্বাভাবিকভাবে দর্শকদের প্রত্যাশা একটি সুন্দর ফুটবল দেখার। কিন্তু দু’দলের খেলোয়াড়দের অপরিকল্পিত এবং অগোছালো ফুটবল দেখে দর্শকরা হতাশ হয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। এমনিতেই মোহামেডান-ওয়ান্ডারার্স খেলা মানেই চরম উত্তেজনা। তার ওপর যদি খেলোয়াড়দের দৈহিক শক্তি যোগ হয়, তাহলে আকর্ষণীয় খেলা আর থাকে না। তাই রেফারি মাসুদুর রহমান একপর্যায়ে দু’টিমকে ডেকে সতর্ক করে দেন। আমরা তুলনামূলকভাবে ভাল খেলছিলাম। কয়েকবার আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমাদের লেফট ব্যাক আসলাম উঁচু করে বিপক্ষ দলের বক্সের ভেতর বল মারলে ওয়ান্ডারার্সের স্টপার মোবাশ্বের ফ্লাইট মিস করলে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু বল আয়ত্তে নিয়ে গোলপোস্টে মেরে হাকিমকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে গেলে খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় ২৫ মিনিটে আমাদের লেফট আউট মুসা ওয়ান্ডারার্সের গোলকিপার হাকিমকে বিপজ্জনকভাবে ফাউল করলে রেফারি মাসুদুর রহমান মুসাকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করেন। শক্তিশালী ওয়ান্ডারার্স টিমের বিপক্ষে দশজন নিয়ে খেলতে আমাদেরকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। রহমতউল্লার একটি থ্রু পাস ওমরের কাছে গেলে ওমর সেটাকে ধরে গোলে রূপান্তরিত করে। ফলে খেলা ১-১ গোলে ড্র। শেষ পর্যন্ত ফলাফলের কোন পরিবর্তন না হওয়ায় উভয় দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। প্রাদেশিক এসেম্বলির স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। আজাদী দিবস ফুটবলের একক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন না করতে পারলেও লটারির মাধ্যমে প্রথম ছ’মাস কাপ রাখার অধিকার পেয়ে আমাদের সমর্থকরা অত্যন্ত খুশী হয়ে মাঠ ত্যাগ করেছিলেন।
মোহামেডান : হাশেম দীন (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব আলী এবং আসলাম, পিন্টু এবং গফুর, প্রতাপ, আবদুল্লাহ শামসু, বশীর এবং মুসা।
ওয়ান্ডারার্স : হাকিম (গোলরক্ষক), আলাউদ্দিন, খামিশা এবং দেবীনাশ, হাসান এবং আবিদ, রহমতউল্লাহ, ওমর, আব্বাস, আসলাম এবং হাফিজ।
রেফারি : মাসুদুর রহমান। # (ক্রমশ.)
(চৌষট্টি) ১৬ ডিসেম্বর
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব তাদের রিটার্ন লীগের খেলা শুরু করেছিল (২৪-৭-৬৬) প্রথম পর্বের মতই দাপটের সাথে খেলে পুলিশকে ৬-০ গোলে পরাজিত করার মাধ্যমে। খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল দেশের দুই কৃতী ফরোয়ার্ড ওমর এবং আব্বাসের জোড়া হ্যাটট্রিক। খেলা আরম্ভ হতেই ইউনুসের একটি থ্রু পাস ওমর ধরে তা থেকে সুন্দর একটি গোল করে। এরপর আব্বাসের দেয়া পাসের দ্বারা ওমর দ্বিতীয় গোল করলে হ্যাটট্রিকের জন্য পুরো ফরোয়ার্ড লাইন ওমরের সহযোগিতায় নেমে পড়ে এবং গাজীর একটি লব থেকে হেড করে ওমর তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। বিরতির পূর্বে আব্বাস দলের পক্ষে চতুর্থ গোল এবং বিরতির পর দলের অন্য কাউকে সুযোগ না দিয়ে দু’গোল করে হ্যাটট্রিক করতে সক্ষম হয়েছিল। সেদিনের অপর খেলায় সাহাবুদ্দিন এবং শারফুদ্দিনের দেয়া গোলে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনারিকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল। রহমতগঞ্জ প্রথম রাউন্ডে ইপিআইডিসি টিমের কাছে ০-৩ গোলে হেরেছিল এবং রিটার্ন লীগে (২৫-৭-৬৬) তারা ইপিআইডিসিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। ইপিআইডিসির এই পরাজয়ে তাদের লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ধুলায় মিশে যায়। তিনটি হার ও একটি ড্র তাদের লীগ দৌড় থেকে বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। রহমতগঞ্জের গোলরক্ষক অনাথ থেকে শুরু করে ১১ নম্বর নয়া পর্যন্ত সবাই পরিশ্রম করে ম্যান টু ম্যান খেলেছিল বলেই এই সফলতা। ইপিআইডিসির ডিফেন্স সেদিন ছিল সেকি, একে অন্যের সাথে সমঝোতার অভাব, পুরো টিমের পারফরমেন্স ছিল নিম্নমানের। প্রথমার্ধের শেষের দিকে নাজির গোল করে রহমতগঞ্জকে এগিয়ে নেয়। এর পরপরই টিপু গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করলে ইপিআইডিসি ০-২ পিছিয়ে পড়ে। হাফ টাইমের বাঁশির আগ মুহূর্তে হাবিব দর্শনীয় একটি গোল করে গোলের ব্যবধানটা কমিয়ে আনে (২-১)। দ্বিতীয়ার্ধে আবদুল্লাহ আকবর ইপিআইডিসির পক্ষে গোল করলে খেলায় সমতা আসে (২-২)। সাথে সাথে খেলায় গতি এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা জমে ওঠে। এমনি ধারায় খেলা শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। রহমতগঞ্জের লেফট আউট নয়া পোস্টের কাছে একটি বল পেয়ে আচমকা বুলেটের মত শট পোস্টে মেরে স্বপনকে (গোলরক্ষক) পুতুলের মত দাঁড় করিয়ে দিয়ে দলকে জয় এনে দেয়। সেদিনের অপর খেলায় প্রেসের মাহমুদ এবং শিবলির দেয়া দুটি গোলের বিপরীতে আজাদের নজরুল একটি গোল করায় প্রেস ২-১ গোলে জয়ী হয়। পরদিন ফায়ারের বিরুদ্ধে মিন্টুর একমাত্র গোল ভিক্টোরিয়াকে জয় এনে দিয়েছিল।
অপরাজিত মোহামেডান রিটার্ন লীগ শুরু করেছিল দুর্বল রেল টিমের বিপক্ষে কষ্টের দু’গোলের জয় দিয়ে। গতবারের চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে আমাদের অধিক গোলে জয়লাভ করা উচিত ছিল কিন্তু রেল দল হাফ টাইম পর্যন্ত আমাদেরকে মাত্র ১ গোলে বেঁধে রেখেছিল। লীগের প্রথম পর্বে আমরা তাদেরকে ৬-০ গোলে পরাজিত করেছিলাম। আমরা ২৭ মিনিট পর্যন্ত রেল দলের ওপর আক্রমণের ঝড় তুলেও গোল করতে পারিনি। প্রায় ৩০ মিনিটের সময় আমাদের শামসু রেল দলের গোলরক্ষক নূর মিয়াকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। বিরতির পর ১০ মিনিটের সময় আবদুল্লাহ খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে হেড দ্বারা গোল করলে আমরা স্বস্তি ফিরে পাই।
রেল দল : নূর মিয়া (গোলরক্ষক), আবদুল সামাদ, নিরঞ্জন এবং মোজাম্মেল, শাহ মোহাম্মদ এবং মানিক বর্মণ, আজাদ, কুতুবুদ্দিন, ওয়াসি, ইয়াকুব এবং মুকুল। রেফারি- ফায়ার সার্ভিসের নাজার মোহাম্মদ।
সেদিনের অপর খেলায় দুর্বল স্টেশনারি রহমতগঞ্জকে হারিয়ে চমক দিয়েছিল। যে রহমতগঞ্জ লীগের প্রথম পর্বে ৫-০ গোলে তাদের হারিয়েছিল এবং শক্তিশালী ইপিআইডিসিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল (২৫-৭-৬৬), সেই স্টেশনারি সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াসের ১ গোলের কাছে হার মানতে হয়েছিল। ২৯-৭-৬৬ তারিখে ওয়ান্ডারার্স তাদের শক্তি-সামর্থ্যরে মহড়া দিয়ে ওয়ারীকে ৭-২ গোলে পরাজিত করেছিল। ওমর আব্বাস প্রত্যেকের তিন গোল তাদের ক্রীড়ানৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছিল আর ১ গোল করেছিল আসলাম। ওয়ারীর চতুর সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ এবং রাইট-ইন জামিল আক্তার দু’গোল শোধ করে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল।
৩০-৭-৬৬ ইপিআইডিসির আজাদের বিরুদ্ধে ৬-১ গোলের সহজ জয়। খেলাটি ছিল একতরফা। ইপিআইডিসি যতগুলো গোলের সুযোগ পেয়েছে, সবগুলো কাজে লাগিয়েছে। হাশিম ১৮ এবং ২৪ মিনিটে দুটো গোল করে এবং টুলু সেটাকে ৩-০ গোলে নিয়ে যায়। বিরতির পর মারী দা দর্শনীয় গোল করে দলকে ৪-০ গোলে পৌঁছে দেন। আবদুল্লাহ আকবর পঞ্চম গোল করার পর মারী দা দলের গোলসংখ্যা অর্ধডজনে পরিণত করেন। আজাদের মানিক বর্মণ ১টি গোল শোধ দিতে পেরেছিল।
আজাদ : ইয়ার মোহাম্মদ (গোলরক্ষক), আহমেদ মোবাশ্বের এবং আব্দুর রব। রাধা এবং লালু, নজরুল, নাসিম, মানিক বর্মণ, সাবের এবং বাটু।
দ্বিতীয়ার্ধে জনির একমাত্র গোলে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে পিবব্লউডি পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল (৩১-৭-৬৬)। প্রথম পর্বে পিডব্লিউডি ৫-১ গোলে ভিক্টোরিয়াকে উড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু রিটার্ন লীগে ভিক্টোরিয়া বিরতি পর্যন্ত তাদেরকে পোস্টের কাছে ভিড়তে দেয়নি। তাদের রক্ষণভাগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বিপক্ষ আক্রমণ রুখে দিচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক গোলের হার মেনে নিতে হয়েছিল এবং এটি ছিল পিডব্লিউডি টিমের কষ্টের জয়।
ভিক্টোরিয়া : দুলু আফেন্দি (গোলরক্ষক), আবদুল্লাহ, আলী মোহাম্মদ এবং নরেশ, হাশেম এবং মাসুদ, ইউনুস, মনসুর, আজিম, ফতেহ মোহাম্মদ এবং মিন্টু সরকার।
১ আগস্ট শক্তিশালী ওয়ান্ডারার্স ক্লাব দুর্বল রেল দলকে পরাজিত করতে প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। এ খেলাটি গত ১৩ জুলাই বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিল। পুনরায় অনুষ্ঠিত খেলায় ওয়ান্ডারার্স ক্লাব প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। ইউসুফের থ্রু পাসে ওমর দলের পক্ষে প্রথম গোল করেছিল। এর কিছুক্ষণ পর আসলাম গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছিল। দু’গোলে পিছিয়ে পড়া রেল দল বিরতির পর ঘুরে দাঁড়ায়। রেল দলের লেফট আউট নিতাই ওয়াসির উদ্দেশ্যে একটি বল বানিয়ে দিলে সেটা থেকে ওয়াসি গোল করে গোলের ব্যবধান কমিয়ে আনে এবং এর পাঁচ মিনিট পরই হিরনের কাছ থেকে বল পেয়ে নিতাই একক প্রচেষ্টায় গোল করে ওয়ান্ডারার্সের সাথে ২-২ গোলে সমতা আনে। সে সময় ওয়ান্ডারার্স চাপের মধ্যে পড়ে যায় এবং পুরো টিম তখন রক্ষণাত্মক খেলতে শুরু করে। অপরদিকে রেল দল পরপর দুটো গোল করে জয়ের নেশায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওয়ান্ডারার্স দলের অভিজ্ঞতার কাছে তারা সফল হতে পারেনি। উপরšুÍ রহমত উল্লাহর সুন্দর একটি পাস দ্বারা ইউসুফ গোল করে টিমকে স্বস্তি এনে দিয়েছিল এবং শেষ বাঁশির মিনিটখানেক আগে আব্বাসের লব থেকে আসলাম হেডের সাহায্যে দর্শনীয় গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে ৪-২ গোলে জয় এনে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিস ২-১ গোলে ওয়ারীকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের তসলিম এবং আশরাফের গোলের বিপরীতে ওয়ারীর তপন একটি গোল শোধ করতে পেরেছিল। ২-৮-৬৬ তারিখে মোহামেডান ৬-০ গোলে প্রেসকে উড়িয়ে দিয়েছিল। খেলাটি একতরফা নিম্নমানের হওয়ায় পত্রিকার মন্তব্য এরকম ছিল যে, খেলার বিবরণ পত্রিকায় ছাপা মানে সময়ের অপচয়। প্রেস দল সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘উদ্দেশ্যবিহীন এ দলের খেলা শুধু মাঠে দৌড়াদৌড়ি ছাড়া আর কিছু নয়, যে কোন তৃতীয় ডিভিশনের টিম ও এটিমের চাইতে ভাল খেলবে।’ মোহামেডান টিমে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। হাফে গফুরের পরিবর্তে কাদেরকে খেলানো হয়েছিল। আাক্রমণভাগে শামসুর বদলে কামাল এবং আমার জায়গায় এএন খান খেলেছিল। এএন খান হাঁটুর আঘাতজনিত কারণে তার সুনামের মত করে খেলতে পারেনি। মুসার মাপা পাসে প্রতাপ পা লাগিয়ে প্রথম গোল করেছিল। মুসা তার একক প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় গোল করে। এরপর কামাল এবং আবদুল্লাহ পরপর দুটি গোল করলে মোহামেডান বিরতির আগে ৪-০ এগিয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে এএন খানের কাছ থেকে বল পেয়ে মুসা সজোরে কিকের মাধ্যমে পঞ্চম গোল করলে আবদুল্লাহ সেটাকে অর্ধডজনে পূর্ণ করে। ৩-৮-৬৬ তারিখে ওয়ান্ডারার্সের আসলাম ওমরের কাছ থেকে বল পেয়ে গোললাইন থেকে মাপা শটে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। এর কিছুক্ষণ পর আব্বাস মাঝ মাঠ থেকে একটি বল নিয়ে বিপক্ষ কয়েকজনকে কাটিয়ে গোলরক্ষককে একা পেয়ে তাকে বিট করতে গিয়ে বল বাইরে মেরে একটা নিশ্চিত গোল মিস করেছিল। পুনরায় আব্বাস সম্মিলিত আক্রমণ থেকে একটি গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয়। বিরতির পর ওমর সুন্দর একটি গোল করলে ওয়ান্ডারার্স ৩-০ গোলে রহমতগঞ্জকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। অপর খেলায় ইপিআইডিসির ৯-১ গোলের চাপায় পরে স্টেশনারি বিধ্বস্ত হয়েছিল। জব্বর ৩, হাশেম ২, এবং মারী, মুসা, আবদুল্লাহ আকবর, টুলু এক গোল করেছিল। ইলিয়াস একটি গোল করে স্টেশনারির মান বাঁচিয়েছিল। ৩ আগস্ট পিডব্লিউডি ৩-০ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল এবং অপর খেলায় ওয়ারী ও আজাদ ২-২ গোলে ড্র করে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ৬-৮-৬৬ তারিখে ইপিআইডিসি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল পুলিশ টিমকে খেলার শেষ মিনিটে জয়সূচক গোল করে। পুলিশ টিম প্রচন্ড লড়াই করে ৪-৩ গোলে হার মেনে নিয়েছিল। হাফ টাইমে ইপিআইডিসি ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল। হাশিম এবং জব্বর দ্রুত দুটো গোল করার পর ইপিআইডিসি আরো কয়েকটি গোল মিস করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ১৫ মিনিটে পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড সাত্তার গোল করলে ইপিআইডিসি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে এবং আক্তার দ্বিতীয় গোল করে সমতা আনলে ইপিআইডিসি চাপের মধ্যে পড়ে যায়। তখন খেলায় বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। মুসার গোল ইপিআইডিসিকে পুনরায় এগিয়ে দিয়েছিল; তবে খুব অল্প সময়ের জন্য। কারণ পুলিশের নাজির গোল করে ৩-৩ গোলে ড্র করে দিয়েছিল। খেলার মিনিটখানিক বাকি। ফলাফল ড্র ভেবে দর্শকরা মাঠ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত, তখনই দ্রুতগতির রাইট আউট সলিম উল্লাহ বল নিয়ে তার গতিকে ব্যবহার করে পোস্টে কিক করলে ইপিআইডিসি শিবির গোল বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তারপরই রেফারির শেষ বাঁশি। # (ক্রমশ.)
(পঁয়ষট্টি) জানুয়ারি-১
আজাদী দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষে পুনরায় লীগের খেলা শুরু হয়েছিল ১৫ আগস্ট থেকে রহমতগঞ্জ এবং ওয়ারীর খেলা দিয়ে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রহমতগঞ্জ ওয়ারীকে ৩-২ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। রহমতগঞ্জের শাজাহানের ২ গোল এবং ওয়ারীর নিশিথের ২ গোলের সমতাকে ভেঙ্গে দিয়েছিল টিপুর একটি গোল। সেদিনের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং রেলের বিপক্ষে নজরুলের ২ গোল এবং দেবুর ১ গোলের সুবাদে ৩-০ জয়লাভ করেছিল। পরদিন আমরা পুলিশ টিমকে ৪-১ গোলে হারিয়ে জয়ের চাকাকে সচল রেখেছিলাম। মুসা করেছিল ২ গোল আর গফুর এবং আমি একটি করে গোল করলে পুলিশের নবী চৌধুরী একটি গোল শোধ দিয়েছিলেন। সেদিন ফায়ার সার্ভিসও রেল টিমকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল, যার গোলগুলো শাহাবুদ্দিনের ২ গোল আর একটি করে গোল আসে আশরাফ এবং তসলিমের কাছ থেকে। রাফ এন্ড টাফ খেলায় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ৫-১ গোলে জয়লাভ করে। ওমরের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। মারাত্মক ফাউল করে খেলার জন্য দু’দলের দুজন করে চারজনকে মাঠ থেকে বহিষ্কার। একটি সুন্দর ফুটবল খেলা দেখার আশায় ১৭ আগস্ট স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু দু’দলের খেলোয়াড়রা খেলা শুরু থেকে দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে খেলে খেলার ছন্দ এবং সৌন্দর্য নষ্ট করে উপস্থিত দর্শকদের হতাশ করেছিল। মাঠে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, ধাক্কাধাক্কি, কিল-ঘুষি সবই চলছিল কিন্তু রেফারি ননী বসাক খেলাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলেন না।
খেলার ষষ্ঠ মিনিটে ওয়ান্ডারার্স কাবের ওমর গোল করে দলকে এগিয়ে দেয় কিন্তু জয়টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পাঁচ মিনিট পর ভিক্টোরিয়ার ইউনুস গোল শোধ করে দিলে খেলায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এমনি ধারায় খেলা যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভিক্টোরিয়ার পেনাল্টি বক্সের ভেতর তাদের খেলোয়াড় আবদুল্লাহ আকবর হাত দিয়ে বল ধরলে রেফারি ননী বসাক পেনাল্টির নির্দেশ দেন। পেনাল্টি থেকে ওমর গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। পেনাল্টি নিয়ে ভিক্টোরিয়ার হাসান রেফারির সাথে অসদাচরণ করলে রেফারি তাকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করে দেন। খেলার প্রথমার্ধের শেষদিকে ওয়ান্ডারার্সের আলী হাফিজ ওমরের উদ্দেশে একটি সুন্দর পাস দিলে তা থেকে ওমর গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে। ভিক্টোরিয়ার খালিদ এবং ওয়ান্ডারার্স কাবের রহমতউল্লাহ খেলার একপর্যায়ে হাতাহাতিতে লিপ্ত হলে রেফারি তাদেরকে মাঠ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। মাঠে আর স্বাভাবিক খেলা ফিরে আসেনি, এরই ভেতর আলী হাফিজ দলের পক্ষে চতুর্থ গোল করে এবং পঞ্চম গোলটি আসে আব্বাসের পা থেকে।
১৮-৮-৬৬ তারিখে পিডব্লিউডি সবাইকে অবাক করে দিয়ে শক্তিশালী ইপিআইডিসিকে ৪-১ গোলে পরাজিত করেছিল। বিরতির পূর্বে ইপিআইডিসির এক গোলের বিপক্ষে পিডব্লিউডি ২ গোল করে এগিয়ে থাকে। লীগের প্রথম পর্বের খেলায় তারা ২-২ গোলে ড্র করেছিল। এ দিনটিতে ইপিআইডিসি হতাশাজনক খেলা প্রদর্শন করেছিল। আক্রমণভাগে জববর এবং হাসিম সাধ্যমত খেলার চেষ্টা করলেও বাকি খেলোয়াড়রা ছিল ব্যর্থ। আবদুল্লাহ আকবর এবং মুসা খুব বাজে খেলেছিল। অপরপক্ষে পিডব্লিউডি চমৎকার খেলা প্রদর্শন করে মাঠে তারা সেরা দল হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিল। তারা বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ নষ্ট না করলে আরো বেশি গোলে জয়লাভ করতে পারতো। খেলা আরম্ভ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গনির দেয়া গোলে পিডব্লিউডি এগিয়ে যায়। তবে অল্প সময়ের ভেতর সে গোল জব্বর শোধ করে দিলে খেলায় ১-১ গোলের সমতা আসে এবং খেলা বেশ জমে ওঠে। পিডব্লিউডির খেলোয়াড়রা পরিশ্রম করে খেলে বলের নিয়ন্ত্রণ তাদের মধ্যে রেখে নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করে খেলতে থাকে এবং সুন্দর সুন্দর আক্রমণ রচনা করে ইপিআইডিসির ডিফেন্সকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। আমিন অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং বুদ্ধি দিয়ে খেলে পিডব্লিউডির আক্রমণগুলোকে ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। কিন্তু গনির একটি পাসে রাইট আউট কানুর দর্শনীয় গোলকে আটকাতে পারেনি। বিরতির আগে পিডব্লিউডি ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। বিরতির পর পিডব্লিউডি খেলার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে রাখতে সক্ষম হয় এবং খেলার ধারা অনুযায়ী আরো দুটো গোল দিয়ে হালি পূর্ণ করে। ৭ মিনিটের ব্যবধানে মনজুর এবং জানি গোল দুটি করেছিল।
দুই টিমে সেদিন যারা খেলেছিল
পিডব্লিউডি : মতিন (গোলরক্ষক), হামিদ, সালেহ এবং ওয়াহিদ, লাল মোহাম্মদ এবং মালাং, কানু, গনি, গুপ্তা, জানি এবং মনজুর।
ইপিআইডিসি : স্বপন (গোলরক্ষক), মোরশেদ, আমিন ও সাইফুদ্দিন, আবদুল্লাহ আকবর ও মুসা, সলিমুল্লাহ, হাশিম, ইমাম বক্স, জব্বার এবং টুলু।
২০-৮-৬৬ তারিখে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দুর্বল স্টেশনারি টিমকে অতিকষ্টে ৩-২ গোলে হারিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল। শেষ বাঁশির মিনিটখানিক আগে আসলাম দুর্দান্ত কিক দ্বারা গোল করে ২-২ গোলের সমতা ঘুচিয়ে দলকে পূর্ণ পয়েন্ট পাইয়ে দিয়েছিল। লীগের প্রথম পর্বে ওয়ান্ডারার্স ৭-০ গোলে স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। খেলা শুরু হলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসলাম সুন্দর প্লেসিং শট দ্বারা গোলরক্ষক বাচ্চুকে পরাস্ত করে ওয়ান্ডারার্সকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। স্টেশনারির সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াসের একটি দুর্বল শট বারে লেগে গোলপোস্টে ঢুকে পড়লে খেলায় ১-১ গোলে ড্র হয়। রহমত উল্লাহ সুন্দর একটি বল বানিয়ে দিলে ওমর গোল করে আবার ওয়ান্ডারার্সকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। একক প্রচেষ্টায় ইলিয়াস আরো একটি গোল করে খেলায় ২-২ গোলের সমতায় ফেরায়। খেলা নিশ্চিত ড্র, মাত্র দু’এক মিনিট বাকি খেলা শেষে হতেÑ এমন অবস্থায় গোলপোস্টে আসলামের আচমকা জোরালো শটটি ওয়ান্ডারার্সকে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় প্রেস পুলিশকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ৬-১ গোলের বড় জয় পেয়েছিল ওয়ারী তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভিক্টোরিয়া কাবের বিরুদ্ধে। ওয়ারী সুসংহত আর শক্তিশালী দল হিসেবে জয়লাভ করেছিল। তাদের গোলরক্ষক দুলু আফেন্দি থেকে শুরু করে ১১ নম্বর সুলতান প্রত্যেক খেলোয়াড় দলের জন্য খেলেছে। সবার বোঝাপড়া ছিল সুন্দর আর জয়ের প্রবল স্পৃহা তাদেরকে বিরতির আগেই ৪-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। খেলার ১০ মিনিটের মধ্যে তপনের কাছ থেকে বল পেয়ে ওয়ারীর কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ দলকে এগিয়ে দেয়। জামিল আক্তার গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে। তপন করে ৩-০ আর নিশিথ সেটাকে এক হালিতে পরিণত করে দলের অবস্থা মজবুত করে দেয়। বিরতির পরপরই ভিক্টোরিয়ার লেফট আউট নিতাই একটি গোল করে (৪-১) ব্যবধান কমায়। নিশিথ আবারও গোল করে তার ৩ গোল আর দলের পক্ষে পঞ্চম গোল করে এবং গোলের সংখ্যা অর্ধডজন পূর্ণ করে তপন। সেদিন অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিসের তসলিম এবং রহমতগঞ্জের সুলতান একটি করে গোল করলে দু’টিম পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয়। ২২ আগস্ট ফুটবল লীগের ড্র করার দিন। গোলশূন্য ড্র করেছিল ভিক্টোরিয়া আর পুলিশ এবং ২-২ গোলের ড্র করেছিল স্টেশনারি ও রেল। স্টেশনারির সিরাজ এবং স্বপন গোল করলে রেলের গোল করেছিল আজাদ এবং মুকুল। সেদিনটি (২৩-৮-৬৬) ছিল কেবলই আমাদের লেফট আউট মুসার। আজাদের বিরুদ্ধে সবগুলো গোলই সে করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল মাত্র ১৩ মিনিটে। খেলার ২য় মিনিটে মুসা গফুরের লব থেকে হেড দ্বারা প্রথম গোল করেছিল। এর চার মিনিট পর শামসুর পাসে দ্বিতীয় গোল করলে আমরা সবাই তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করার জন্য সহযোগিতায় নেমে পড়ি। আমাদের আক্রমণে আজাদ অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। একটার পর একটা সুযোগ নষ্ট করে মুসা শেষ পর্যন্ত একটা ফ্রি-কিক থেকে গোল আদায় করে নেয় এবং তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে খেলার প্রথমার্ধেই।
২৪-৮-৬৬ এদিন ফুটবল লীগের বড় দুটো টিম খেলেছিল লীগের দুর্বল দুটো টিমের বিরুদ্ধে। ওয়ান্ডারার্স ৩-০ গোলে জয়লাভ করেছিল প্রেসের বিরুদ্ধে। তবে ইপিআইডিসি জয় করতে পারেনি। ০-০ ড্র করেছিল রেলের সাথে। ওয়ান্ডারার্সের ওমর ১ গোল করলে আব্বাস করেছিল ২ গোল। ২৫-৮-৬৬ পিডব্লিউডি ২-১ গোলে রহমতগঞ্জকে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। লীগের প্রথম পর্বের খেলায় রহমতগঞ্জ পিডব্লিউডিকে একই ব্যবধানে হারিয়েছিল। ০-১ গোলে পুরো প্রথমার্ধ পিছিয়ে থেকে পিডব্লিউডি দ্বিতীয়ার্ধে পরপর দুটো গোল করে পূর্ণ ২ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত মাঠে দুটি সমশক্তির টিম ভাল খেলা উপহার দিতে পারেনি। রহমতগঞ্জ খেলার ১৫ মিনিটে রাইট আউটের একটি কর্নার কিক থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড সুলতান হেড দিয়ে গোল করলে রহমতগঞ্জ খেলার ১৫ মিনিটে ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। রহমতগঞ্জে গোলসংখ্যা বৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়েও সফল হতে পারেনি। বিরতির পরপরই পিডব্লিউডি দলের সালেহ’র প্রায় ৩০/৩৫ গজ দূর থেকে একটি বাঁকানো শট রহমতগঞ্জের গোলরক্ষককে হতবাক করে জালে জড়িয়ে যায়। খেলায় ১-১ গোলে সমতা আসলে খেলায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তখন পিডব্লিউডি খেলায় ফিরে আসে। উভয় টিম আক্রমণ করে খেলে। খেলার এ অবস্থায় পিডব্লিউডির গনি টিমের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে সেটাই ছিল ম্যাচ উইনিং গোল। সেদিনের অপর খেলায় পুলিশ এবং স্টেশনারি ০-০ ড্র করেছিল।
সেদিন (২৬-৮-৬৬) ফুটবল লীগে মোহামেডানের জয়ের ধারাকে রুখে দিয়েছিল ইপিআইডিসি। তারা আমাদেরকে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। মোট ৬ গোলের মধ্যে সমান ভাগ বসিয়ে ৩ গোল শুধু করেনি বরং জয়ের সুযোগও করে নিয়েছিল। লীগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান ইপিআইডিসিকে প্রথম পর্বে ২-১ গোলে হারিয়েছিল কিন্তু চলতি লীগে আমরা তাদের কাছে প্রথম পয়েন্ট হারালাম। খেলার শুরুটা আমরা চমৎকার করেছিলাম। প্রথমার্ধেই আমরা ৩-১ গোলে এগিয়ে সুবিধাজনক স্থান করে নিয়েছিলাম। নইলে দ্বিতীয়ার্ধে আমরা যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিলাম, তাতে সৌভাগ্যক্রমে আমরা পরাজয় এড়িয়ে ফিরতে পেরেছিলাম। আমাদের রক্ষণভাগের স্তম্ভ তোরাব আলী সেদিন ছিল ব্যর্থ। জহির ভাইও ভাল খেলতে পারছিলেন না। শুধু আমাদের লেফট ব্যাক আসলাম দৃঢ়তার সাথে খেলে ইপিআইডিসির আক্রমণগুলোকে রুখে টিমকে আগলে রেখেছিল। খেলার ১০ মিনিটের মধ্যে জব্বারের জোরালো শট হাশেম দীনকে পরাস্ত করে সাইডবারে লেগে গোলপোস্টে ঢুকে যায়। গোল খেয়ে আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম এবং পরমুহূর্তে আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকি। অল্প সময়ের মধ্যে সে সুযোগ চলে আসে। মুসার মারা ফ্রি-কিক বিপক্ষ দলের গোলমুখে পড়লে প্রতাপ সেটাকে আয়ত্তে এনে গোল করে দলকে ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়। এর অল্প পর ইপিআইডিসির হাশিমের কিক আমাদের গোলপোস্টের বাইরে চলে গেলে তারা একটি গোল থেকে বঞ্চিত হয়। এর ১০ মিনিট পর ইপিআইডিসির গোলরক্ষক স্বপন একটি কমন বল ধরতে শামসুর দিকে ছুটে গেলে শামসু পুশ করে মুসাকে দিলে মুসা গোল করলে আমরা ২-১ এগিয়ে যাই। মুসার মারা একটি ফ্রি-কিক ধরে আমাদের রাইট আউট প্রতাপ সেটাকে গোলে রূপান্তরিত করলে আমরা বিরতির আগেই ৩-১ গোলের মজবুত স্থান করে নেই।
বিরতির পর খেলা অনেকটা আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে। মনে হচ্ছিল ইপিআইডিসি হার মেনে নিয়ে খেলায় মনোযোগ দিচ্ছিল না। কিন্তু হাশিম এবং জব্বর খেলাকে চাঙ্গা করে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। হাশিম তার একক প্রচেষ্টায় দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় একটি দর্শনীয় গোল করে ইপিআইডিসিকে জাগিয়ে তোলে। তাদের আক্রমণের ধার বেড়ে যায়। উল্টো আমরা চাপে পড়ে গিয়েছিলাম এবং খেলার ফলাফলকে ৩-২ গোলের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম। খেলার শেষ ৫ মিনিট ইপিআইডিসি আমাদের ওপর চেপে বসে এবং তাদের ক্যাপ্টেন মারী দা সুন্দর একটি গোল করে ৩-৩ গোলের সমতা এনে দেন দলকে। শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ৩-৩ গোলের ড্র মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
মোহামেডান : হামেশ দীন (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব আলী এবং আসলাম, পিন্টু ও গফুর, প্রতাপ, আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর ও মুসা।
ইপিআইডিসি : স্বপন (গোলরক্ষক), সলিমউল্লাহ, আমিন এবং সাইফুদ্দিন, আবদুল্লাহ আকবর এবং মুসা, প্রতুল হাশিমউদ্দিন, মারী, জব্বর ও টুলু। রেফারি : মাসুদুর রহমান। #
জানুয়ারি-১৬
(ছেষট্টি)
ওয়ারী ৪-১ গোলে প্রেসকে হারিয়েছিল। ওয়ারীর পক্ষে গোল করেছিল জামিল আক্তার ২ নিশিথ এবং ইসলাম একটি করে। আর প্রেসের ভুট্টো একটি গোল শোধ দিয়েছিল। ২৭-৮-৬৬ তারিখে ফায়ার ৪-০ গোলে পিডব্লিউডিকে হারিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। আশরাফ, আবুল, শাহাবুদ্দিন এবং তসলিম গোলগুলো করেছিল। অপর খেলায় স্টেশনারি একমাত্র গোলে আজাদকে পরাজিত করেছিল। পরদিন ওয়ান্ডারার্স লীগের অন্যতম দুর্বল টিম রেলওয়ের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে মূল্যবান একটি পয়েন্ট হারিয়েছিল। তাদের পক্ষে গোল করেছিল ওমর এবং আব্বাস আর রেলের পক্ষে গোল করেছিল ওয়াসিম ও মুকুল। অপর খেলায় সাত্তারের একমাত্র গোলে পুলিশ রহমতগঞ্জকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। ২৯-৮-৬৬ তারিখে আমাদের ৮-০ গোলের ঝড়ে ওয়ারী উড়ে গিয়েছিল। মুসা হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল, শামসু ২ গোল, রসুল বক্স এবং আমার একটি করে গোল ছিল। অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া ২-১ গোলে রেল দলকে হারিয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স আসলামের দেয়া একমাত্র গোলে পিডব্লিউডিকে ১-০ গোলে হারিয়ে একটি শক্ত বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। ইপিআইডিসি ৬-১ গোলে হারিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসকে। যার গোলগুলো হাশিম ২, জব্বর ২, গফুর বেলুচ ১, হাবিব ১ এর পা থেকে এসেছিল। অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া আজিমের দেয়া একমাত্র গোলে স্টেশনারিকে পরাজিত করতে পেরেছিল। ২-৯-৬৬ তারিখে গফুর, মুসা, শামসু, রসুল বক্স এবং প্রতাপের করা গোলে আমরা রহমতগঞ্জকে ৫-০ গোলে হারিয়ে আমাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম।
৭-৯-৬৬ তারিখে আজাদ স্পোর্টিং হারের মানসিকতা নিয়ে খেলতে নেমেছিল। কারণ প্রথম পর্বে তারা ভিক্টোরিয়ার কাছে ৪-০ গোলে হেরেছিল। কিন্তু তাদের দেবু গোল করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং পুরো দল আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিক্টোরিয়ার ফতেহ মোহাম্মদ গোল করে ১-১ সমতা আনে। বিরতির পর দু’টিমই গোল করার জন্য জোর প্রতিযোগিতা চালায়। খেলার ২৫ মিনিটে ভিক্টোরিয়ার মাসুদ দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। আজাদ গোল শোধ করার জন্য পরিশ্রম করে খেলতে থাকে এবং খেলা শেষ হওয়ার মাত্র তিন মিনিট পূর্বে আবারও দেবু গোল করে দলকে ২-২ গোলে সমতায় ফেরায়। শেষ পর্যন্ত তারা ১ পয়েন্ট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। দিনের অপর খেলায় ভাগ্যের সহায়তায় ওয়ারী পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল আর রহমতগঞ্জ ভাল খেলেও ২-৩ গোলে হার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। খেলার ১০ মিনিটে ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড প্রথম গোল করেছিল কিন্তু সে গোল কিছুক্ষণের মধ্যে শোধ করে দিয়েছিল রহমতগঞ্জর লেফট আউট টিপু। সমমানের দুটো টিম জেতার জন্য জোর চেষ্টা চালাতে থাকে এবং টিপু আবারও গোল করে তার দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। এবারও নিশিথ গোল করে দলকে সমতায় ফেরায়। ২-২ গোলের ড্র দিয়ে খেলা শেষের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই ওয়ারীর লেফট-ইন বদরুল গোল করে দলের সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে ৩-২ গোলের জয় এনে দেয়।
৮-৯-৬৬ তারিখে মোহামেডান ৯-০ গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের ওপর। মুসা হ্যাটট্রিকসহ অর্ধডজন গোল করেছিল। মুসা এ নিয়ে লীগের চতুর্থ হ্যাটট্রিকের মালিক হয়েছিল। প্রথম পর্বে তারা হেরেছিল ৩-০ গোলে। সেদিনের ম্যাচে তোরাব আলী এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু টিমে ছিল না; তারপরও মোহামেডান ডজন গোল থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। খেলার শুরুতে ফায়ার কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল কিন্তু ১০ মিনিটেই আমার থ্রু পাসে মুসা তার গোল করা শুরু করে। কামালের দেয়া লব থেকে হেড করে ২য় গোল এবং আমার পাস থেকে গোল করে সে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেÑ যা ছিল লীগে তার চতুর্থ হ্যাটট্রিক। কামালের কাছ থেকে বল পেয়ে মুসা দলকে ৪-০ গোলে এগিয়ে দেয় আর আব্দুল্লাহ করে পঞ্চম গোল। মুসা তার একক প্রচেষ্টায় দলের জন্য অর্ধডজন গোল করে। কামাল সেটাকে ৭ নম্বর গোলে নিয়ে যায় এবং ৮/৯ মিনিট পরই মুসা দর্শনীয় একটি গোল করার মাধ্যমে তার করা গোলের সংখ্যা অর্ধডজনে পরিণত করে। সবাই যখন গোল করছিল, তখন আর আমি গোল করা থেকে পিছিয়ে থাকতে পারিনি; আমার গোলটাই ছিল দলের শেষ গোল এবং আমরা জিতেছিলাম ৯-০ গোলে।
কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথের হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোলের ওপর ভর করে ওয়ারী পুলিশের বিরুদ্ধে ৫-২ গোলের বড় জয় পেয়েছিল।
১০/৯/৬৬ : লীগ শিরোপা প্রত্যাশী ওয়ান্ডারার্স ফায়ার সার্ভিসের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে আরও এক পয়েন্ট নষ্ট করেছিল। এতে তারা ৬ষ্ঠ পয়েন্ট হারিয়ে লীগের ২য় স্থানে থাকলেও তাদের লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রথম পর্বে ফায়ার ০-৪ গোলে পরাজিত হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস ম্যান টু ম্যান খেলে ওয়ান্ডারার্সকে তাদের আয়ত্তের মধ্যে রাখে। মোতালেব খুব দক্ষতার সাথে রহমতগঞ্জের গোলপোস্ট সামলাতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল যখন ওমর একটি বল ধরে একক প্রচেষ্টায় গোল করেছিল। বিরতির পর ফায়ার সার্ভিস নতুন উদ্যম নিয়ে খেলতে শুরু করে। এর ফলও তারা পেয়ে যায়। স্লিপারি মাঠে শারফুদ্দিনের সজোরে মাটি কামড়ানো শটটি হাকিমকে পরাস্ত করে দলকে ১-১ গোলে ড্র উপহার দেয়। প্রেসও ১-১ গোলে ড্র করেছিল স্টেশনারির সাথে। আমরা আরও একটি পয়েন্ট হারিয়েছিলাম পিডব্লিউডি টিমের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। খেলার পূর্বে দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছিল কায়েদে আজম মো. আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার আত্মার শান্তির জন্য। প্রথম পর্বে পিডব্লিউডি আমাদের কাছে ৩-০ গোলে হেরেছিল। কর্দমাক্ত মাঠে উন্নতমানের খেলা প্রদর্শন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া আমাদের স্কোরার শামসু না খেলায় স্কোর করার কাজটি আমরা সঠিকভাবে করতে পারছিলাম না। সহজ সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। অন্যদিকে পিডব্লিউডি প্রথম পর্বের চেয়ে অনেক উন্নত মানের খেলা খেলছিল এবং আক্রমণ চালিয়ে বেশ কয়েকটা গোল করার সুযোগও তারা সৃষ্টি করেছিল। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজা দু-দু’বার গোল করার সুযোগ নষ্ট করেছিল। গনিও একটি নিশ্চিত গোল মিস করেছিল। আমাদের গোলরক্ষক হাশিম দিন তার অনবদ্য ভাল খেলা দিয়ে আমাদেরকে হারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সেদিনের অন্য ম্যাচে ফায়ার ২-১ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল।
১৩/৯/৬৬ ওয়ান্ডারার্স ইপিআইডিসি কর্তৃক অপদস্থ। রিটার্ন লীগে ইপিআইডিসি এবং ওয়ান্ডারার্স টিমের চরম উত্তেজনাকর খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পূর্বে ওয়ান্ডারার্স খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। সে সময় ইপিআইডিসি ৪-১ গোলে অগ্রগামী ছিল। খেলা শেষ হওয়ার ১ বা ২ মিনিট বাকি থাকতে ওয়ান্ডারার্স রেফারির কাছে আলো স্বল্পতার জন্য প্রটেস্ট করে এবং খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে গোলরক্ষক হাকিম বল ধরে রেখে খেলায় বাধা সৃষ্টি করে। রেফারি বল ছেড়ে দিয়ে খেলাকে সচল রাখার অনুরোধ করে কিন্তু হাকিম খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। রেফারি তখন শেষ বাঁশি বাজিয়ে খেলা শেষ করেন। খেলার ১৬ মিনিটে ইপিআইডিসি রাইট আউট সলিমউল্লাহ ডান প্রান্ত থেকে লব করলে সেন্টার ফরোয়ার্ড হাবিব দর্শনীয় হেড করে গোল করে টিমকে ১-০তে এগিয়ে দেয়। এরপর তাদের লেফট আউট টুলু হাফ ভলি মেরে সুন্দর গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে। বিরতির ৪ মিনিট পর সলিমউল্লাহর পাস থেকে জব্বর তৃতীয় গোল করে দলকে ৩-০ নিয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের ২৪ মি. রহমতউল্লাহর একটি শট বিপক্ষ দলের পেনাল্টি এরিয়াতে পড়লে ইপিআইডিসির খেলোয়াড় হাত দিয়ে ধরলে রেফারি পেনাল্টি দেনÑ যা থেকে আসলাম গোল করে (৩-১)। প্রায় খেলা শেষের দিকে গড়াতে থাকে। এমন সময় ইপিআইডিসির হাশিম বুলেটের মত শট মেরে হাকিমকে পরাস্ত করে দলকে ৪-১ গোলে অগ্রগামী করে। সেদিনের অপর খেলায় রহমতগঞ্জ ৪-১ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে।
বদরুলের হ্যাটট্রিক ওয়ারীকে ৩-২ গোলে জিততে সাহায্য করেছিল। পিডব্লিউডির বিরুদ্ধে খেলার ২৩ মিনিটে নিশিথের পাস থেকে বদরুল প্রথম গোল করে। বিরতির পর লেফট ইন আজিজের কাছ থেকে বল পেয়ে জোরে শট করে তার দ্বিতীয় গোল করে। কিছুক্ষণ পর বদরুল তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে দলকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সুজার কাছ থেকে বল পেয়ে জানি একটি গোল শোধ করে। এর দশ মিনিট পর গনি দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। পিডব্লিউডি গোল শোধ দেয়ার জন্য প্রচ চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওয়ারী বিজয়ের হাসি হেসে মাঠ ত্যাগ করে। অপর খেলায় ফায়ার ৩-০ গোলে প্রেসকে হায়। ১৫/৮/৬৬ তারিখে আমাদের খেলা ছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে। দ্বিতীয়ার্ধে পাঁচ মিনিটে গ্যালারিতে দু’টিমের সমর্থকের মারামারিতে খেলা প হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে আমার কাছ থেকে বল পেয়ে আবদুল্লাহ দ্বিতীয় গোল করলে দর্শক-সমর্থকদের ধারণা আবদুল্লাহ তখন অবসাইডে ছিল। দর্শকরা রেফারির ওপর ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারে। এতে সাতজন ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। অবস্থা খারাপ দেখে পুলিশ ডাকা হয়। তখন পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে; তবে খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। প্রথমার্ধে ২১ মিনিটে শামসুর কাছ থেকে বল পেয়ে আমি প্রথম গোল করেছিলাম।
পুলিশ অবাক করে দিয়ে পিডব্লিউডিকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। প্রথম পর্বে পিডব্লিউডি ৬-২ গোলে জয়লাভ করেছিল। কর্দমাক্ত মাঠে দু’দলই ভাল খেলার চেষ্টা করে; তবে সেদিন পুলিশ ভাল খেলছিল। বিরতি পর্যন্ত গোলশূন্য ড্র ছিল। বিরতির পরপরই মোবিন গোল করে পুলিশকে (১-০) এগিয়ে দেয়। গোল খেয়ে পিডব্লিউডি শোধ করার জন্য জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু পুলিশের সাত্তার গোল করে দলের গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয় (২-০)। মোবিন আরও এক গোল করে পুলিশকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত পিডব্লিউডিকে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। অপর খেলা ওয়ান্ডারার্স এবং আজাদ আলোর স্বল্পতার জন্য ৫ মিনিট বাকি থাকতে খেলা বাতিল হয়ে যায়। তখন ওয়ান্ডারার্স ৩-০ গোলে এগিয়ে ছিল। ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে ভিক্টোরিয়াকে পরাজিত করেছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর ছিল আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলা আর সেটা ছিল ওয়ান্ডারার্সের বিরুদ্ধে। সেদিনের জয়ের ওপর নির্ভর করছিল লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় ওয়ান্ডারার্স ০-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল। আমাদের এ খেলাটি ১৪-৯-৬৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু সমর্থকদের মারামারিতে খেলা প হয়ে গিয়েছিল। সে সময় পর্যন্ত আমরা ২-০ গোলে জিততে ছিলাম। ওয়ান্ডারার্স সেদিন ভাল খেলা প্রদর্শন করতে পারেনি। হাফিজকে লেফট আউটে দর্শকের ভূমিকায় রাখা হয়েছিল। ওমর আব্বাস আসলামও ছিল ব্যর্থ। রহমতউল্লাহ আক্রমণভাগকে চালাতে সক্রিয় ছিল। তার সহযোগিতায় আক্রমণ চালালেও অন্যরা ছিল ব্যর্থ। অন্যদিকে আমাদের খেলায় ছিল পরিকল্পনার ছাপ, আমাদের সম্মিলিত আক্রমণগুলোকে দৃঢ়তার সাথে রুখে দিচ্ছিল ওয়ান্ডারার্সের আলাউদ্দিন, হাসান এবং দেবীনাশ। ২০ মিনিটে আবদুল্লাহর থ্রু পাস থেকে মুসা একক প্রচেষ্টায় প্লেসিং শট দ্বারা হাকিমকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধেও ওয়ান্ডারার্সের খেলায় কোন উন্নতি হয়নি; উপরন্তু শামসু গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে। মুসা তার দ্বিতীয় গোল এবং দলের তৃতীয় গোল করলে ওয়ান্ডারার্স খেলা ছেড়ে দিয়ে রাফ খেলায় মেতে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আমরা তাদের ৩-০ গোলে হারাতে সক্ষম হয়েছিলাম; সে সাথে মোহামেডানের ১৯৬৬ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।
মোহামেডানের খেলোয়াড় লিস্ট
গোলরক্ষক-হাশিমদীন, ফুলব্যাক-জহীর, আসলাম, স্টপার-তোরাব আলী, হাফ-পিন্টু, গফুর, ফরোয়ার্ড-প্রতাপ, আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর ও মুসা।
পরবর্তী খেলায় আমরা স্টেশনারিকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিলাম এবং আমাদের শেষ খেলা ছিল ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে। তারা আমাদেরকে ওয়াকওভার দিলে আমরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। ১৯৬৬ মোহামেডান ২৪টি ম্যাচ খেলে ২২টি জয় ও ২টি ড্র করে। পক্ষে ১০২টি গোল, বিপক্ষে ৯টি গোল এবং মোট ৪৬ পয়েন্ট পেয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নশিপের সম্মান অর্জন করেছিল। #
ফেব্রুয়ারি-১
(সাতষট্টি)
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে ঐতিহ্যবাহী আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতে পারেনি; তাই ১৯৬৬ সালের টুর্নামেন্টের গুরুত্বটা একটু বেড়ে গিয়েছিল। ১৭টি টিম এতে অংশগ্রহণ করেছিল; যার মধ্যে ৩টি বিদেশী ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং সিলোন; ৫টি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেপিটি, পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, পাকিস্তান আর্মি, পিআইএ এবং পশ্চিম পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস; তার সাথে স্থানীয় ৯টি দলÑ যেমন ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি, ওয়ারী, আজাদ স্পোর্টিং, ফায়ার সার্ভিস, পিডব্লিউডি, ইপিজি প্রেস এবং রহমতগঞ্জ। প্রত্যেক রাউন্ডের চ্যাম্পিয়ন দল রাউন্ড রবিন লীগ খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। ইন্দোনেশিয়া এবং ইরানকে সরাসরি রাউন্ড রবিন লীগে রেখে ফিকশ্চার করা হয়েছিল। বগুড়া মোহাম্মদ আলী ফুটবল টুর্নামেন্টের ফলাফলের ভিত্তিতে পরাজিত করে গোল্ডকাপ মিশনে তাদের শুভসূচনা করেছিল। ১৭ অক্টোবর আজাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড দেবু একাই দু’গোল করে আজাদকে দ্বিতীয় রাউন্ডে নিয়ে গিয়েছিল পিডব্লিউকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। ১৮ তারিখে ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস গোলশূন্য ড্র করেছিল। ১৯ তারিখে টুর্নামেন্টের প্রথম অঘটন ঘটিয়ে ইপিআইডিসি ১৯৬৩ সালের আগাখান গোল্ডকাপ শিরোপাজয়ী পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে ২-১ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়েছিল। টুলু এবং সলিমুল্লাহর গোলের বিপরীতে রেলের মজিদ একটি গোল দিতে পেরেছিল। ১৯ তারিখেও ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস কেউ কাউকে হারাতে পারেনি ফলে তাদের খেলা ২০ তারিখে রাখা হয়েছিল। ১৮, ১৯, ২০ তারিখে পরপর তিনদিন খেলেও ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস কোন ফলাফল বের করতে পারেনি; তাই তাদেরকে ২১ তারিখে সকালে খেলার সময় নির্ধারণ করা হয়।
২১ তারিখে স্টেডিয়ামে সকাল ৭.৩০, দুপুর ২টা এবং বিকেল ৩.৪৫ মি. তিনটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরপর তিনদিন ড্র করার পর চতুর্থ দিন সকাল ৭.৩০টায় ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস ফলাফল বের করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যদেবতা ওয়ারীর পক্ষে হেসেছিল। ওয়ারী ২-১ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ারীর কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিত দুটো গোল করে ফায়ার সার্ভিসের কবল থেকে দলকে মুক্ত করেছিল। ৩০৮ মিনিট ফায়ারের বিরুদ্ধে লড়াই করার পর দুপুর ২টায় পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে আরও ৭০ মিনিট লড়াই করে আর্মিকে ২-০ গোলে পরাজিত করে এক অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। সেই কুশলী সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথের গোলে ওয়ারী এগিয়ে গিয়েছিল এবং দ্বিতীয় গোলটি এসেছিল আজিজের পা থেকে। সেদিন যারা খেলেছিল, তারা হলোÑ
ওয়ারী : তপন (গোলরক্ষক), নূরুল আমিন, মো. আমিন এবং নূরুল ইসলাম, মহসিন, বদরুল, আজিজ, জাহাঙ্গীর, নিশিথ, জামিল আক্তার এবং মনজুর।
ফায়ার সার্ভিস : সিতাংশু (গোলরক্ষক), মো. আলী, আশরাফ, মজিবুর রহমান, বদরুল, কায়েস উদ্দিন, ওহাব, শারফুদ্দিন, হাবিব (আবুল হোসেন), শোভা এবং তসলিম।
সেদিন বিকেলের খেলায় ইপিআইডিসি এবং কেপিটির খেলা গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। পরদিনও খেলাটি ড্র হয়েছিল। অতিরিক্ত সময় খেলতে অপারগতা জানিয়ে ইপিআইডিসির আগামীদিন খেলার জোর দাবিটি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি এবং বাইলজ ভাঙ্গার দায়ে কেপিটিকে জয়ী ঘোষণা করেছিল। ২৪-১০-৬৬ রহমতগঞ্জের নাজির এবং টিপুর করা দুটি গোলের কাছে পশ্চিম পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস নতিস্বীকার করে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছিল। রহমতগঞ্জের পরবর্তী খেলা সিলোনের সাথে, জয়ী টিম রাউন্ড রবিন লীগ খেলার যোগ্যতা পাবে। পরদিন পিআইএ আজাদকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। তবে খেলার ধারা অনুযায়ী আজাদের হারা উচিত ছিল না। খেলাটি খুব প্রতিদ্বন্দ্বিপূর্ণ ছিল। শুধুমাত্র স্কোরারের অভাবে আজাদের এই পরাজয়। পিআইএ টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড গোলাম আহম্মদ দুটি গোল এবং শেষ গোলটি করেছিল মোহাম্মদ আহম্মদ। দিনের অপর খেলায় মোহামেডান ওয়ারীর বিরুদ্ধে ২-০ অগ্রগামী থাকা অবস্থায় রেফারি ঈশা খান বৈরী আবহাওয়ার জন্য খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। পরদিন (২৬/১০/৬৬) পুনঃনির্ধারিত খেলায় মোহামেডানের কাছে ওয়ারী ১৩-১ গোলে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। ওয়ারী প্রথম গোল করে আমাদেরকে ভড়কে দিয়েছিল। তারপর এক এক করে ১৩ গোল হজম করতে হয়েছিল তাদেরকে। কাদের ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়ার পর শামসু, মুসা, আবদুল্লাহ দলের পক্ষে ৫ নম্বর গোল করলে হাফ টাইম পর্যন্ত মোহামেডান ৫-১ গোলে এগিয়ে থাকে। বিরতির পর কাদের ৬ নম্বর গোল করার পর মুসা পরপর তিনটি গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। কাদের ১০ নম্বর গোল, মুসা ১১ নম্বর, শামসু ১২ নম্বর এবং শেষ ১৩ নম্বর গোলটি করেছিল প্রতাপ। ২৭ তারিখে ওয়ান্ডারার্স খেলার দ্বিতীয়ার্ধে হাফিজুদ্দিনের হেডে করা গোলে পিআইএকে ১-০ গোলে পরাজিত করে টুর্নামেন্ট থেকে বের করে দিয়েছিল। রাউন্ড রবিন লীগে ছয়টি টিম খেলার যোগ্যতা লাভ করেছিল। তাদেরকে দু’গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল।
গ্রুপ-এ : কেপিটি, মোহামেডান এবং ইন্দোনেশিয়া।
গ্রুপ-বি : সিলোন, ওয়ান্ডারার্স এবং ইরান।
রবিন লীগের প্রথম খেলা মোহামেডান বনাম কেপিটি। কেপিটির আকবর, তাকি, মাহমুদ এবং তাদের দুই উইং মিরদাদ ও মজিদ ভাল খেলে সবার প্রশংসা কুড়ায়। তাদের চতুর খেলোয়াড় তাকি সুন্দর প্লেসিং শট দ্বারা হাশেমদীনকে পরাস্ত করে কেপিটি ১-০ এগিয়ে দেয়। গোল খেয়ে আমরা সংঘবদ্ধ আক্রমণ করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। গফুরের একটি শট ক্রসবারে লেগে ফিরে আসলে আবদুল্লাহ সহজ গোল করতে ব্যর্থ হয়। আরও দু’তিনটি সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের লেফট আউট মুসাকে ইসমাইল তাদের বক্সের বাইরে ফাউল করলে গফুর ফ্রি-কিকটি মারে। সে বল পেয়ে আমি গোলপোস্টে সজোরে কিক চালিয়ে দেই। সহ-খেলোয়াড়রা ছুটে আসে আমাকে গোল করার অভিনন্দন জানাতে। খেলা ১-১ ড্র হয়।
দশ মিনিট পর গফুরের কাছ থেকে বল পেয়ে মুসা একক প্রচেষ্টায় দর্শনীয় গোল করলে মোহামেডান সমর্থকরা খুশিতে কেটে পড়েন। আমরা ২-১ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনালে যাই। দ্বিতীয় খেলাটি ছিল ইন্দোনেশিয়ার সাথে কেপিটির। ইন্দোনেশিয়া শুরু থেকে কেপিটিকে চেপে ধরে এবং ৪-১ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনাল খেলা নিশ্চিত করেছিল। কেপিটি প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। খেলার তৃতীয় মিনিটেই ইন্দোনেশিয়ার দক্ষ ফরোয়ার্ড সুজি আপতু গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। স্টেডিয়ামের ২০ হাজার দর্শকের হাততালি শেষ হওয়ার আগেই সুজি আপতু আবারও গোল করে ২-০ গোলে তার দলকে এগিয়ে দেয়। কেপিটির মিরদাদের পাশে মাহমুদ গোল করে ব্যবধান কমায় (২-১)। ছ’মিনিট পর সুজি আপতু তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। ১ নভেম্বর গোল্ডকাপের খেলা ছিল ইরান এবং সিলনের। নিম্নমানের খেলায় গোলশূন্য ড্র করে দু’দলই পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। সুঠাম দেহের অধিকারী তেহরান সিনিয়র ডিভিশন লীগ চ্যাম্পিয়ন পিএএস কাবের খেলার মান সিলোন দলের চেয়ে অনেক উন্নত। খেলোয়াড়দের ক্রীড়ানৈপুণ্য ও দলীয় সমঝোতাও খুবই ভাল। সিলোন টিম রক্ষণাত্মক খেলার মাধ্যমে ইরানের আক্রমণকে ঠেকাতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে একত্রিত করে প্রভিন্সিয়াল কৃষিমন্ত্রী ফকির আবদুল মান্নানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। রবিন লীগে আমাদের গ্রুপের শেষ খেলা ইন্দোনেশিয়ার সাথে। আমরা ভাল খেলেও হেরে গিয়েছিলাম, যার দরুন ইন্দোনেশিয়া গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে উঠে যায় এবং গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে আমরাও সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করি। আমাদের ফরোয়ার্ড লাইন সেদিন এলোমেলো খেলা খেললেও ডিফেন্স ছিল প্রাচীরের মত শক্তিশালী। বিশেষ করে আমাদের স্টপার তোরাব আলী ছিল স্তম্ভ; কাদের ও গফুর ছিল তার দুই সহযোগী। ইন্দোনেশিয়া খেলেছিল একটি টিম হিসেবে। তোরাব আলী ইন্দোনেশিয়ার কুশলী ফরোয়ার্ড সুজি আপতুকে কড়া মার্কে রাখলেও অমন দ্রুত খেলোয়াড়কে সারাক্ষণ আটকে রাখা মুশকিল হয়। খেলার পূর্বে উভয় দলের খেলোয়াড়দের সাথে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস এ আর কর্নোলিউয়াসের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। খেলা শুরু হওয়ার সাথে সাথে বল চলে যায় আমাদের বাম ফ্যাংকে মুসার কাছে। মুসা আমাকে বল বানিয়ে দিলে আমি পোস্টে মারি কিন্তু বল বিপক্ষ এক খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে ফিরে আসলে আবদুল্লাহ সেটা ধরে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। দ্রুত গোল খেয়ে ইন্দোনেশিয়া চাপের মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে গোল পরিশোধ করার লক্ষ্য আক্রমণ চালায়। তাদের লেফট আউট বব মেথিয়াস আমাদের পেনাল্টি বক্সে একটি বল ফেললে সুজি আপতু দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে বুলেটের মত বল কিক করলে হাশিমদীন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বল জালে জড়িয়ে যায়। খেলা ১-১ ড্র। এর চার মিনিট পর বিপক্ষ দলের তাহির ইউসুফ লেফআউট বব মেথিয়াসকে বল দিলে সে বল আয়ত্তে এনে গোলপোস্টে মেরে গোল করে, সে সাথে ইন্দোনেশিয়া ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। খেলা শেষ হওয়ার পূর্বে মুসা দুটি সহজ সুযোগ নষ্ট করলে গ্যালারির ৫০/৬০ হাজার দর্শক ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং লোহার গেট ভেঙ্গে মাঠে ঢুকে খেলা ভন্ডুল করে দেয়।
(ক্রমশ.)
ফেব্রুয়ারি-১৬
(আটষট্টি)
রবিন লীগের ‘বি’ গ্রুপের শেষ খেলায় ইরান তাদের দক্ষ স্কোরারের অভাবে ওয়ান্ডারার্সের সাথে গোলশূন্য ড্র করেছিল এবং গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার সাথে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ইরান উন্নতমানের খেলা প্রদর্শন করে। তাদের খেলার গতি, দলীয় সমঝোতা এবং আক্রমণ সবই ছিল প্রশংসনীয়। তারা ডজনখানেক গোল করার সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেছিল। পক্ষান্তরে ওয়ান্ডারার্স অত্যন্ত নিম্নমানের খেলা প্রদর্শন করে দর্শকদের হতাশ করেছিল। ওয়ান্ডারার্সের ফুল ব্যাক কামিশা পুরো রক্ষণভাগকে আগলে রেখেছিল। খেলার তৃতীয় মিনিটে ওমর যে সহজ গোল মিস করেছিল, তার জন্য তাকে ক্ষমা করা যায় না। খেলার অন্তিম সময়ে ইউসুফ ও ওমরের মিলিত আক্রমণ থেকে আব্বাসকে বল দিলে সে জঘন্যভাবে গোল করতে ব্যর্থ হলে গ্রুপের রানার্সআপ হয়ে ঢাকা মোহামেডানের সাথে সেমিফাইনালে খেলতে পারার সন্তুষ্টি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল। পিএএস কাব (ইরান) দলের খেলোয়াড় : গোলরক্ষক- নূরুদ্দিন, হায়দারী, মাগরানী, মোহাজরিয়ান এবং আগাইর, হাবিবি এবং সারাখি, মালিয়ান, বয়গান, শারাফী এবং সুলেমান (আবাসনাসান)। ৪ নভেম্বর প্রথম সেমিফাইনাল ইরান বনাম ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়া মাঠে সেরা টিম হিসেবেই ইরানকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল। খেলার গতি, খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য, দলীয় সমঝোতা সব দিক দিয়েই তারা উন্নত ছিল।
৫ নভেম্বর দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দুটি টিম ঢাকা মোহামেডান এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের মধ্যে। মোহামেডান-ওয়ান্ডারার্স মানেই উত্তেজনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, টাফ-রাফ খেলা। ওয়ান্ডারার্স দেবিনাশের বদলে ইমাম বক্সকে ফুলব্যাকে খেলিয়ে বড় ভুল করেছিল। ইমাম বক্স একেবারেই ফপ ছিল। তাদের আক্রমণে ওমর মূল ভূমিকা পালন করলেও ইনদ্বয় আব্বাস ও হাফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে সহযোগিতা পায়নি।
সেদিনের রেফারিং ছিল বিতর্কিত। রেফারি মাসুদুর রহমান তার লাইন্সম্যানদ্বয়ের (ননী বসাক এবং মহিউদ্দিন চৌধুরী) কাছ থেকে সহযোগিতা পাননি। তাদের সিদ্ধান্তগুলোতে গরমিল ছিল, সহযোগীদের ফ্যাগগুলো সময়মত এবং সঠিকভাবে দেখানো নিয়ে রেফারির সাথে মিলছিল না। এতে গ্যালারির দর্শকরা দুয়ো দিচ্ছিল।
আমাদের টিম বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে খেলছিল। আমাদের খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যতা, সমঝোতা অত্যন্ত ভাল ছিল। আমাদের রক্ষণভাগ কাদের তোরাব আলী এবং আসলামের সাথে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ রসুল বক্স এবং গফুর মিলে খুবই শক্তিশালী ডিফেন্স গড়ে উঠেছিল। যারা ওয়ান্ডারার্সের আক্রমণ সামলাতে যথেষ্ট ছিল। আমাদের দ্রুতগতির আক্রমণভাগকে ঠেকাতে তারা হিমশিম খাচ্ছিল। খেলার ২ মিনিটেই প্রতাপের পাস পেয়ে শামসু ওয়ান্ডারার্সের পোস্টে মারে। তা ক্রসবারে লেগে প্রতাপের কাছে ফেরত আসলে প্রতাপ সহজেই পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। আমরা ১-০ এগিয়ে যাই। ওয়ান্ডারার্সের রাইট আউট ইউসুফের লব আসলাম হেড করলে হাশেম দীন দর্শনীয়ভাবে সেভ করে। বিরতির পূর্বে মুসা কামিসাকে কাটিয়ে একটি সুন্দর বল বানিয়ে প্রতাপকে দিলে প্রতাপ গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেয়। আবদুল্লাহ তৃতীয় গোল করলে আমাদের ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়। ইউসুফের লব থেকে ওমর হেড দিয়ে গোল করে ব্যবধান কমায়। আমরা ৩-১ গোলে ওয়ান্ডারার্সকে হারিয়ে ফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার মুখোমুখি হয়েছিলাম।
৬ নবেম্বর ঐতিহ্যবাহী আগাখান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা ইন্দোনেশিয়ার পারসাপুয়ান সেপাকবোলা সেলুরুহ কাব বনাম স্থানীয় লীগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব। দর্শক পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে
ঢাকা মোহামেডানকে ২-১ গোলে পরাজিত করে ঐতিহ্যবাহী আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নাটেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হওয়া গোল্ডকাপ ইন্দোনেশিয়া দ্বিতীয়বারের মত এ গৌরবের অধিকারী হয়েছিল। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে হারিয়ে তারা প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এর আগের বছর ১৯৬০ তারা কোলকাতা মোহামেডানের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবও ১৯৫৯ সালে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৬৪ সালে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন (করাচি পোর্ট ট্রাস্ট-এর সাথে) হওয়ার গৌরব রয়েছে। আমরা ভাল খেলেও ভাগ্য আমাদের সাথে না থাকায় জয়ী হতে পারিনি। গোল করার কয়েকটা সুযোগ এসেছিল কিন্তু শার্ফ শুটারের অভাবে আমরা গোল পাইনি। খেলার আগে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খানের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
খেলা শুরু হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়ার ক্যাপ্টেন সুজেপতু গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। কিক অফ করেই সে আমাদের ডিফেন্সে ঢুকে পড়ে। সাথে সাথে তাহির ইউসুফ তাকে লক্ষ্য করে বল দিলে সে বল ধরেই মাটি কামরানো শট মারে, যা হাশেম দীনের পাস দিয়ে পোস্টে ঢুকে যায়। হাশেম দীন একটু সতর্ক থাকলে হয়তো গোল বাঁচানো সম্ভব হতো। এত দ্রুত গোল খেয়ে আমাদের টিম হকচকিয়ে যায় এবং টিম গুছিয়ে আনতে বেশ সময় লাগে। ২০ মিনিটে আমাদের টিম সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালিয়ে গোলের সুযোগ পেলেও দক্ষ শুটারের অভাবে গোল শোধ করতে পারিনি। ২৮ মিনিটে ইন্দোনেশিয়ার বক্সের বাইরে একটি ফ্রি কিক পাই। গফুরের মারা বুলেটের মত শটটি গোলরক্ষক জুডোকে কোন সুযোগ না দিয়ে বল জালে জড়িয়ে যায়। খেলা ১-১ ড্র। বিরতির পর ইন্দোনেশিয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ড আলি আন্দো মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় তোরাব আলী এবং আসলামকে কাটিয়ে দেখার মত একটি গোল করলে গ্যালারির দর্শকদের প্রশংসায় ভাসে। খেলা শেষ হওয়ার আগে প্রতাপের একটি থ্রু পাস আবদুল্লাহ ধরেও পোস্টে মারতে ব্যর্থ হওয়ার সাথেই আমাদের গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।
দু’টিমের খেলোয়াড়রা
ইন্দোনেশিয়া : জুডো (গোলরক্ষক), খলিল, মাহফুল, বাশির, জন সিমসন, এফ তেল ফং, লিউ সু লিয়াং, তাহির ইউসুফ, আলি আন্দু, সুজিপ্তু এবং বব ম্যাথিয়াস।
মোহামেডান : হাশিম দীন (গোলরক্ষক), আসলাম, তোরাব আলী, গোলাম কাদের, রসুল বক্স, আবদুল গফুর, প্রতাপ হাজরা, আবদুল্লা রাহি, শামসু, বশীর আহমেদ এবং মুসা।
চ্যারিটি ম্যাচে ইন্দোনেশিয়া ৪-৩ গোলে জয়লাভ করে। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের ফান্ড বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগাখান গোল্পকাপ জয়ী ইন্দোনেশিয়া বনাম ইপিআইডিসি টিমের মধ্যে ৭ নভেম্বর চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। এই ম্যাচের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল আসলামের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। ইন্দোনেশিয়ার মূল আকর্ষণ তাদের ক্যাপ্টেন সুজিপ্তু এ ম্যাচে অংশগ্রহণ করেনি। আলি আন্দু ক্যাপ্টেন্সি করেছিল। ইন্দোনেশিয়া আবারও তাদের গতিসম্পন্ন গোছানো ফুটবল উপহার দিয়ে ঢাকার দর্শকদের প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছিল। খেলার তৃতীয় মিনিটে সলিমুল্লাহর কাছ থেকে বল পেয়ে আসলাম সুন্দর একটি গোল করে ইপিআইডিসিকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। দ্রুত গোল খেয়ে ইন্দোনেশিয়া কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও ২০ মিনিটে টেক ফং গোল করে সমতা আনে। গফুর বেলুচ আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারছিল না। বক্সের ভেতর ফাউল করলে পেনাল্টি পায় ইন্দোনেশিয়া। আর সেটা থেকে টেক ফং তার দ্বিতীয় গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। ছয় মিনিট পর বার্টজে সেটাকে ৩-১ গোলে নিয়ে যায়। পেনাল্টি সীমানার কাছাকাছি গফুর বেলুচের হাতে বল লাগাতে ইন্দোনেশিয়া ফ্রি কিক পায় আর জুলকারনাইন কোনাকুনি শটের মাধ্যমে স্বপনকে পরাস্থ করে ইন্দোনেশিয়াকে ৪-১ গোলে এগিয়ে দেয়। সলিমুল্লাহর ক্রসে আসলাম চমৎকার হেড করে গোল করে (৪-২)। খেলা শেষে হওয়ার মিনিট পাঁচেক থাকতে আসলাম তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে। এই জয়ের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়া তাদের ঢাকা সফর অপরাজিত থেকে দেশে ফিরেছিল।
চ্যারিটি ম্যাচে দু’টিমের খেলোয়াড় :
পিএসএস (ইন্দোনেশিয়া) : সুজি আন্টো (গোলরক্ষক), কে টিক লিওঙ, মানগুয়ান্ডাপ, মারকফুল এবং খলিল, টেক ফং এবং ম্যাক্সি, লিয়াম, এস লিয়াং, আলি আন্দু, বার্টজে এবং জুলকারনাইন।
ইপিআইডিসি : স্বপন (গোলরক্ষক), আমিন খান, গফুর বেলুচ এবং সাইফুদ্দিন, আব্দুল্লা আকবর এবং মূসা, সলিমুল্লাহ, সারফুদ্দিন, আসলাম, জব্বার এবং শাজাহান।
রেফারি- নজর মোহাম্মদ।
চ্যারিটি ম্যাচে আশা অনুযায়ী গেটমানি পাওয়া যায়নি। মাত্র ৪৬৫১ রুপি উঠেছিল। অথচ আগাখান গোল্ডকাপে ইন্দোনেশিয়া বানাম ঢাকা মোহামেডান কাবের মধ্যে ফাইনাল খেলায় গেটমানি উঠেছিল ৬০,১০৫ রুপি।
৯ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়া টিমকে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব উষ্ণ বিদায় সংবর্ধনা জানিয়েছিল। ঢাকার তেজগাঁ বিমানবন্দর রেস্টুরেন্টে বিদায়ের প্রাক্কালে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। মোহামেডানের সভাপতি মঈনুল ইসলাম ইন্দোনেশিয়া দলের সাফল্যে অভিনন্দন জানান। জবাবে ঢাকায় অবস্থানরত ইন্দোনেশিয়ার কনসুলার জেনারেল এস এম নূর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এস এ মহসিন জাতীয় রিক্রিয়েশন সমিরত সাধারণ সম্পাদক (ইস্ট পাক শাখা) তার বক্তব্যে বলেন, ইন্দোনেশিয়ার খেলতে আসা প্রতিটি সফরেই দু’দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়।
(ক্রমশ.)
মার্চ-১
(ঊনসত্তর)
আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট সবসময় মর্যাদার প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে ছাত্রদের কাছে এটি উত্তেজনার প্রতিযোগিতা। আর আমরা যারা বিভিন্ন কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি টিমে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতাম, আমাদের কাছে সেটা হতো চ্যালেঞ্জিং এবং সমমানের। ১৯৬৬ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যখন আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট পুরোদমে চলছিল এবং আমরা (জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ ও এবং আমি) ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের পক্ষে শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে লড়ে যাচ্ছিলাম। দুটো খেলাই ছিল আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা স্টেডিয়াম এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠ পর্যায়ক্রমে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল এবং আগাখান গোল্ড কাপ খেলতে হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। ঢাকা মোহামেডানের পক্ষে শক্তিশালী কেপিটি টিমের বিরুদ্ধে খেলার পর ৩০ তারিখে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে নামতে হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিরুদ্ধে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় টিম শক্তিশালী দল। উভয় দলই সেদিন জয়ের জন্য লড়ছিল। দারুণ খেলা। খেলায় যেমন ছিল গতি, তেমন ছিল আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ এবং প্রতিমিনিটে গোল হওয়ার সম্ভাবনাসহ প্রচুর উত্তেজনা। উভয় দলই গোলমুখে গোল করার সহজ সুযোগ নষ্ট করার মহড়ায় নেমেছিল। আমাদের রাইট ইন শাজাহান ১০ গজ দূর থেকে যে গোল মিস করেছিল, তার জন্য তাকে ক্ষমা করা যায় না। শাহজাহান জগন্নাথ কলেজের ছাত্র; প্রতাপ, অনাথ ও আমিও সে কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি টিমে চান্স পেয়েছিলাম। শাহজাহান এবং প্রতাপ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গর্বিত খেলোয়াড় হিসেবে সবার সম্মানের পাত্র হয়েছিল। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি প্রথমার্ধে খেলাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং ভাল খেলে আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটি সুযোগও সৃষ্টি করেছিল। খেলার ধারা যখন এমন ছিল, তখনই আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হাফিজুদ্দিন বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় বিপক্ষ দলের তিন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে পোস্টে জোরালো শট করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ গোল করে রাখতে পারিনি। দু’মিনিটের মধ্যেই রাজশাহীর অনাথকে (গোলরক্ষক) পরাস্ত করে খেলায় ১-১ সমতা আসে। খেলায় এবং খেলার বাইরে প্রচুর উত্তেজনা, দু’দলের গোল করার আপ্রাণ চেষ্টায় খেলা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল। প্রায় দশ মিনিট বাকি, এমনি সময় প্রতাপের একটি মাপা কর্নার থেকে চমৎকার হেড দ্বারা আমি গোল করলে আমাদের টিমের ২-১ গোলের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
দুই ইউনিভার্সিটি টিমের খেলোয়াড়
ঢাকা ইউনিভার্সিটি : অনাথ (গোলরক্ষক), সাদেক এবং হাসান, মতিন, পিন্টু এবং কায়কোবাদ, প্রতাপ, শাজাহান, হাফিজউদ্দিন, বশীর এবং টিপু।
রাজশাহী ইউনিভার্সিটি : শাজাহান (গোলরক্ষক), মনসুর এবং সাইফুল, মান্নান, জহুরুল ও মহসিন, মনিরুজ্জামান, আউয়াল, মতিন, ইসলাম এবং আমির আলী।
পরদিনই ৩১.১০.৬৬ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি টিমের বিরুদ্ধে আমাদের খেলতে হয়েছিল। আমরা ৩-০ গোলে হারিয়েছিলাম তাদেরকে। প্রভিন্সিয়াল দলের একগাদা খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিমের সাথে বিপক্ষ টিমের কোন ক্ষেত্রেই তুলনা হয় না। খেলাটি শুধু একতরফা হয়েছিল। খেলার ছ’মিনিটে আমাদের লেফট আউট টিপু গোল করে ১-০ এগিয়ে দিলেও ভুরি ভুরি গোল মিস করে আমরা হাফ টাইম পর্যন্ত ঐ গোলকে পুঁজি করে ধরে রেখেছিলাম।
আমাদের রাইট-ইন শাহজাহানকে হাফটাইমে পরিবর্তন করে নুরুজ্জামানকে নামানো হয়। সে একাই দু’গোল করলে আমাদের টিম ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। নুরুজ্জামান হ্যাটট্রিকের আশায় একের পর এক গোল মিস করে যায় এবং আমরাও গোল করার সুযোগ কাজে লাগাতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমরা ৩-০ গোলের জয় নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ মুহূর্তে তাদের টিম প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিন টিমের মধ্যে লীগ পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে জয়লাভ করায় আমাদের টিম অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। পরদিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে রানার্সআপ হয়েছিল। এরই সাথে শেষ হয়েছিল আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতা আর আমরা ফিরে গেলাম ঢাকা স্টেডিয়ামে আমাদের পরবর্তী খেলা ২ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে খেলার জন্য (আগা খান গোল্ডকাপের পরবর্তী খেলাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে পূর্বের সংখ্যায়)।
৬ নভেম্বর আগাখান গোল্ডকাপ ফাইনাল খেলা শেষ করে রাতেই সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় টিমের সাথে রাজশাহীগামী ট্রেনে চড়ে বসলাম। উদ্দেশ্য ৭ নভেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ।
১৯৬০ সালের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল প্রভিন্সিয়াল টিমগুলোর অংশগ্রহণের শেষ প্রতিযোগিতা, যা পূর্ব পাকিস্তান প্রভিন্সিয়াল টিম হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। আমিও সেই চ্যাম্পিয়ন টিমের একজন গর্বিত অংশীদার।
পরবর্তীতে ডিভিশনাল পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতা শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তানে ৪টি ডিভিশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনার সাথে পুলিশ, রেলওয়ে এবং সম্মিলিত ইউনিভার্সিটিসহ মোট ৭টি টিম নিয়ে জাতীয় ফুটবলের ইস্টার্ন জোনের প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল রাজশাহী ডিএসএ’তে। এখানে চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ দুটো টিম মূল পর্বের প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। আরও দুটো টিম গতবারের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়ন টিম এবং রানার্সআপ সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।
কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটি টিমের খেলোয়াড়রা যারা ১৯৬৬ সালে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছিল : আব্দুস সাদেক-ক্যাপ্টেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, জহুর- ভাইস ক্যাপ্টেন, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি
অন্যান্য খেলোয়াড়-অনাথ, হাসান, পিন্টু, কায়কোবাদ, প্রতাপ হাজরা, বশীর আহমেদ, হাফিজউদ্দিন, গোলাম সরওয়ার টিপু, নুরুজ্জামান, সাইদুর রহমান- ঢাকা ইউনিভার্সিটি। লক্ষ্মী, সাইফুল ইসলাম, আনসার, মতিন এবং চুন্নু- রাজশাহী ইউনিভার্সিটি।
শান্তা, মঞ্জুর এবং পট্টু- ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি। এইচএম মোস্তফা-ম্যানেজার, সাহেব আলী-কোচ।
জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা পরিচালনা করার জন্য ইপরোয়া (ইস্ট পাকিস্তান রেফারি এন্ড আম্পায়ার্স এসোসিয়েশন) ৭ জন রেফারিকে মনোনীত করেছিল। তারা হলেন : জহুরুল আলম, মহিউদ্দিন চৌধুরী, ঈশা খান, মাসুদুর রহমান, ননী বসাক, মোহাম্মদ আলী এবং সাহেব আলী।
এ প্রতিযোগিতায় ফিফার নতুন আইন সংযোজন করা হয়। খেলা ৮০ মিনিটের পরিবর্তে ৯০ মি. মূল সময় নির্ধারণ করা হয়। ৪৫+৫+৪৫।
খেলোয়াড় পরিবর্তন : খেলার যে কোন সময় গোলকিপার পরিবর্তন করা যাবে।
শুধু হাফ টাইমের পূর্বে যে কোন খেলোয়াড় পরিবর্তন করা যাবে।
প্রটেস্ট : খেলার শেষ বাঁশি থেকে তিন ঘন্টার ভেতর ১০০ টাকা প্রটেস্ট ফি জমা দিয়ে প্রটেস্ট করতে হবে।
৭ নভেম্বর ১.৪৮ মিনিটে ইস্ট জোনের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধনী খেলা রাজশাহী স্টেডিয়ামে রাজশাহী ডিএসএ বনাম পুলিশ এসি’র মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজশাহী ডিএসএ জয়লাভ করে পরবর্তী রাউন্ডে উন্নীত হয়। একইদিনে ৩.৩০ মিনিটে খেলেছিল চট্টগ্রাম ডিএসএ ইস্টার্ন রেলওয়ের সাথে এবং রেল দল জয়লাভ করে উঠে যায় পরবর্তী রাউন্ডে।
৮ নভেম্বর ১.৪৫ মিনিটে (সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি) আমাদের প্রথম খেলাতে খুলনা ডিএসএকে ৪-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিলাম। সেদিনই ৩.৩০ মি. রাজশাহী ডিএসএ রেলকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ৯ নভেম্বর আমরা ঢাকার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলাম। টুর্নামেন্টের আসল ফাইনাল ছিল সেদিনই। টুর্নামেন্টের আয়োজক রাজশাহী, তাদের সুবিধামত ফিকশ্চার করে ফাইনাল খেলার সুযোগ করে নিয়েছিল। ঢাকা কম্বাইন্ড বিশ্ববিদ্যালয় দলের মধ্যে ফাইনাল খেলা হলে মানসম্মত ফাইনাল হতো। জাতীয় দলের চৌকস খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ঢাকা টিম। প্রচুর দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং আমাদের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সমর্থন দিয়ে গেছেন। খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা হয়। আমরা প্রাণপণ লড়ে গেছি। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য সবই ছিল খেলায় কিন্তু ঢাকা দলের দলগত সমঝোতা, আক্রমণের ধার আর দৈহিক সামর্থ্যরে কাছে আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়াও ঢাকা দলের আমিন, আসলাম, তোরাব আলী, গফুর, কাদের এদের দ্বারা পাহাড় সমান শক্তিশালী রক্ষণভাগ যা ভেদ করা আমাদের পক্ষে ছিল কষ্টকর। ইউসুফ জুনিয়র, আবদুল্লাহ, আসলাম, জব্বার ছিল দলকে জয়ী করার মূল চালিকাশক্তি।
ঢাকার পক্ষে আসলাম এবং জব্বর প্রত্যেকে দু’গোল করেছিল আর আমাদের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড হাফিজউদ্দিন একাই দু’গোল করতে সক্ষম হয়েছিল। ঢাকা দল আত্মঘাতী একটি গোল খেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা ঢাকা সিএসএ দলের কাছে ৩-৪ গোলে পরাজিত হয়ে মূল জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। ১০ নভেম্বর ইস্ট জোনের ফাইনাল খেলায় ঢাকা ডিএসএ চ্যাম্পিয়ন এবং রাজশাহী ডিএসএ রানার্সআপ দল হিসেবে করাচিতে অনুষ্ঠানরত জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিনশিপে সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। #
(ক্রমশ.)
মার্চ-১৬
(সত্তর)
জাতীয় যুব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ-১৯৬৬।
পূর্ব পাকিস্তান ইস্ট উইং এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে ওয়েস্ট উইং ২টি জোনে ভাগ করে নিজ নিজ জোনের ডিভিশনাল যুব ফুটবল দল এবং সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি দলগুলো নিয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জোনাল চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ করা হতো। পরবর্তীতে ইস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন এবং ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন টিমের মধ্যে ফাইনাল খেলায় জয়ী দলই জাতীয় যুব টিমের ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতো।
ইস্ট উইং (পূর্ব পাকিস্তান) জোনাল ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী যুব দলগুলো ছিল ঢাকা ডিএসএ, রাজশাহী ডিএসএ, খুলনা ডিএসএ এবং সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দল। ১১ অক্টোবর ঢাকা স্টেডিয়ামে খুলনা ডিএসএ যুব দল এবং সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলের খেলার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ইস্ট উইং জোনাল যুব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় টিম ৭-০ গোলে খুলনা যুব দলকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড শাজাহান আক্রমণাত্মক খেলা প্রদর্শন করে একাই ৪ গোল করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় দলের রাইট আউট লতিফ তার একক প্রচেষ্টায় খুলনার গোলরক্ষক ধীরেন দাসকে পরাস্ত করার মাধ্যমে গোলের সূচনা করে। তারপর থেকে শাহজান পরপর গোল করে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন। বিরতির পর টিপু ও নূরুজ্জামান গোল করেছিল।
সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দল জোনাল ফাইনাল খেলায় ঢাকা ডিএসএ যুব দলের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল। বৃষ্টি আর কর্দমাক্ত মাঠে ভাল খেলা প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল না; তবুও দু’দল জেতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল। ঢাকার রক্ষণভাগ অত্যন্ত মজবুত রফিক এবং কাদের সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। তাদেরকে ভেদ করা বিশ্ববিদ্যালয় দলের পক্ষে সহজ ছিল না। তারপরও কৃতী দুই অ্যাটাকার টিপু আর শাজাহান যে সুযোগ তারা পেয়েছিলÑ তা কাজে লাগাতে পারেনি। খেলার শুরুতেই একটা জটলা থেকে সুলতান গোল করে ঢাকা দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। দু’মিনিট পর টিপু গোল রক্ষককে একা পেয়েও গোল করতে পারেনি। আট মিনিট পর আবারও টিপু একটি সহজ গোল মিস করে। ঢাকার গোল এরিয়ার ভেতর রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড়ের হাতে বল লাগলে রেফারি পেনাল্টি দেন, টিপু সেটা থেকে গোল শোধ করলে খেলার গতি বেড়ে যায়Ñ সে সাথে খেলোয়াড়দের মাঝেও শক্তি প্রয়োগটা বেড়ে যায়। এতে খেলা বেশ টাফ হয়ে ওঠে। খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল, মিনিট দু’এক বাকি থাকতে ঢাকা একটি ফ্রি কিক লাভ করে। কিক নেয় কাদের গোলপোস্টের কাছে দাঁড়ানো সুলতানের কাছে বল গেলে সুলতান বল ধরেই সজোরে পোস্টে কিক চালিয়ে দেয়। অনাথ (গোলরক্ষক) ধরার আগেই বল জালে জড়িয়ে যায়। ঢাকা যুব ফুটবল দল ২-১ গোলে জয়লাভ করে জোনাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে এবং ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন টিমের সাথে ১৫ অক্টোবর ঢাকা স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলে যারা খেলেছিল : অনাথ (গোলরক্ষক), সাদেক, হাসান এবং করিম, গিয়াসউদ্দিন এবং কায়কোবাদ, লতিফ নুরুজ্জামান, শাজাহান, সিকান্দার এবং টিপু।
ওয়েস্ট উইং জোনাল যুব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল করাচি কেএমসি স্টেডিয়ামে। প্রতিযোগিতার ফাইনালে করাচি এবং কোয়েটা মুখোমুখি হয়েছিল। করাচি ৩-১ গোলে কোয়েটাকে পরাজিত করে ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। করাচি দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড মাওলা বক্স তার দলের পক্ষে ৩টি গোলই করেছিল। খেলার ১৫ মিনিটেই কোয়েটার সেন্টার ফরোয়ার্ড নবী বুলেট শট মেরে কোয়েটাকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড মংলা বক্স একক প্রচেষ্টায় এক জোরালো শটে ১-১ গোলে সমতা আনে। ২৭ মিনিটে মাওলা বক্স আরও একটি গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। এ সময় কোয়েটা দল দুটো সহজ গোল মিস করে। বিরতির পর দু’দলই পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চালিয়ে খেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু দুটো টিমই গোলপোস্টের দেখা পাচ্ছিল না। খেলা যখন এমনি চলছিল, তখন করাচির রাইট আউট ইসহাকের একটি মাপা লব থেকে মাওলা বক্স সুন্দর হেডের সাহায্যে গোল করে দলকে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে আর সেই সাথে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করে। করাচি ডিএসএ যুব দল ওয়েস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঢাকায় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল।
১৫ অক্টোবর জাতীয় যুব ফুটবলের ফাইনাল খেলা। ইস্ট উইং চ্যাম্পিয়ন বনাম ওয়েস্ট উইং চ্যাম্পিয়ন। ঢাকা এবং করাচির যুব দলের ফাইনাল। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের কর্দমাক্ত মাঠকে আরও একটু খারাপ করে দিয়ে গেল। এ মাঠে ভাল খেলা উপহার দেয়া দু’দলের পক্ষে ছিল কষ্টকর। তারপরও দু’দল ভাল খেলে জয়লাভ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছিল। দু’টিমই গোল করার সুযোগ পেয়ে দুর্বল শট, সময়মত গোলপোস্টে শট না নেয়া, অনর্থক বল নিজের কাছে ধরে রাখা বা ড্রিব্লিং করা ইত্যাদির কারণে গোল করতে পারেনি। করাচি যুব দলের চেয়ে ঢাকার ছেলেরা অধিক সংঘবদ্ধ ছিল এবং তারা আক্রমণ করেছেও বেশি কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি। ইজাজ, করাচির গোলরক্ষক, ভাল খেলে দর্শনীয়ভাবে বেশ কয়েকটা গোল সেভ করেছে। ঢাকা দলের কাদের তার দক্ষতা এবং নৈপুণ্য দ্বারা প্রমাণ করেছে যে, সে যেমন রক্ষণভাগে সামাল দিয়েছেÑ তেমনি আক্রমণকে সহযোগিতা দিয়ে সচল রেখেছে। তপন বারপোস্টের নিচে খুব সুন্দর খেলেছে। খেলার ৫ মিনিটেই করাচির সেন্টার ফরোয়ার্ড মাওলা বক্স এক সহজ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। গোলশূন্য অবস্থায় বিরতির বাঁশি বেজেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা যুব দল গোল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে করাচি দলকে রক্ষণাত্মক খেলা খেলে সময় অতিবাহিত করার দিয়ে সচেষ্ট থাকতে দেখা যাচ্ছিল। এ অবস্থায় সুলতান যে দুটো সহজ গোল মিস করেছে, তাতে ঢাকা যুব দলের চ্যাম্পিয়ন না হওয়র জন্য তাকে দায়ী করা যায়। মাঠের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ায় অতিরিক্ত সময় না দিয়ে নির্ধারিত সময় শেষে খেলা সমাপ্ত করা হয়েছিল। সে সময় পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য ড্র ছিল। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা ডিএসএ যুব দল এবং করাচি ডিএসএ যুব দলকে জাতীয় যুব ফুটবলের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
দু’দলে যারা খেলেছিল
ঢাকা যুব দল : তপন (গোলরক্ষক), বেলাল রফিক (অধিনায়ক) এবং শওকত, গণেশ এবং কাদের (সহ-অধিনায়ক), ভুট্টো, সেলিম, সুলতান, লালু ও রওশন।
করাচি যুব দল : ইজাজ (গোলরক্ষক), আনিস এবং গোলাম আব্বাস, সিদ্দিক, ইয়াকুব এবং আরিফ, ইশহাক, আল্লা বক্স, মাওলা বক্স, আকবর এবং লাল মোহাম্মদ।
রেফারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন ননী বসাক।
সেবারের (১৯৬৬) জাতীয় ফুটবলের মূল আসর বসেছিল করাচিতে। ভেন্যু ছিল করাচির কেএমসি স্টেডিয়াম। ১৯টি টিম নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রতিযোগিতা। গতবারের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে এবং রানার্সআপ করাচি দলকে এবং ইস্ট উইং থেকে জোনাল চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্স টিম মোট ৪টি টিমকে সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে রেখে ফিকশ্চার সাজানো হয়েছিল। ইস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপ যা রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখান থেকে ঢাকা ডিএসএ চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ রাজশাহী ডিএসএ দল মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করেছিল। প্রতিযোগিতার অন্যান্য টিমÑ হায়দ্রাবাদ, কালাত, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, সারগোদা, কোয়েটা, পেশাওয়ার, মুলতান, খায়েরপুর, দেরাইস মাইল খান, পুলিশ, পাক আর্মি, পাক নেভি, পাক এয়ারফোর্স, পশ্চিম পাকিস্তান সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি।
জাতীয় দলের কৃতী লেফট আউট মুসার নেতৃত্বে একগাদা পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় সমন্বয়ে ঢাকা ডিএসএ টিম গঠন করা হয়েছিল।
‘গোলরক্ষক : মতিন, তপন), আমিন, আসলাম, তোরাব আলী, রফিক, আবদুল্লাহ, আকবর, গফুর, কাদের, ইউসুফ, সিনিয়র, আবদুল্লাহ, শারফুদ্দিন, হাশিম উদ্দিন, সুলতান, আসলাম এবং জব্বার।
৩০ অক্টোবর হায়দ্রাবাদ ডিএসএ এবং কালাত ডিএসএ ম্যাচ দিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপের শুরু। উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি খান এ সবুর।
ইস্ট উইং জোনাল চ্যাম্পিয়ন ঢাকা প্রথম খেলায় পেশাওয়ারের মুখোমুখি হয়েছিল। ছ’জন পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় নিয়েও পেশাওয়ারের সাথে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। পেশাওয়ারের সুঠাম দেহী খেলোয়াড়রা ক্রীড়ানৈপুণ্যে ভরপুর। জব্বারের কাছ থেকে বল পেয়ে ঢাকার হাশিম যে গোল দিয়ে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল, তা পেশাওয়ারের রাইট ইন ফিরিয়ে দিয়ে দলকে ১-১ গোলের সমতা এনে দিয়েছিল। বাকি সময় ঢাকার চৌকস খেলোয়াড়রা চেষ্টা করেও জয় পায়নি।
পরদিন ১৪ নভেম্বর ঢাকাকে পুনরায় পেশাওয়ারের সাথে খেলার জন্য মাঠে নামতে হয়েছিল এবং সেদিন তারা তাদের ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ২-০ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। সেদিনের অপর কোয়ার্টার ফাইনালে আমাদের রাজশাহী টিম খেলেছিল লাহোরের সাথে এবং তারা ১-১১ গোলের শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে আমাদের ফুটবলকে লজ্জায় ডুবিয়েছিল।
১৫ নভেম্বর প্রথম সেমিফাইনাল শক্তিশালী এবং শিরোপা প্রত্যাশী করাচি অতিসহজেই লাহোরকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
১৬ নভেম্বর ছিল দ্বিতীয় সেমিফাইনাল গতবারের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল বনাম ঢাকা। জাতীয় দলের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দুটো দলই ছিল শক্তিশালী। আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্য খেলা দু’দলই দর্শকদের উপহার দিলেও রেল দলের পক্ষে ভাগ্য হেসেছিল বিধায় গোল করার সুযোগগুলো তারা কাজে লাগাতে পেরেছিল আর ঢাকা সুযোগ পেয়েও সদ্ব্যবহার করতে পারেনি, তাই তাদেরকে ০-৩ গোলের পরাজয় মেনে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। রেল দল এবারও ফাইনালে করাচির দেখা পাওয়ার জন্য ১৮ তারিখের অপেক্ষায় ছিল।
১৮ নভেম্বর, শুক্রবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা। রেল দল বনাম করাচি। করাচির হোম গ্রাউন্ড এই দু’দল পরপর দু’বছর ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল। প্রচুর দর্শক খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন। দেশের অনেক নামি-দামি খেলোয়াড় নিয়ে দু’টিমই ব্যালেন্সড টিম। রেল দলে পাঞ্জাবি খেলোয়াড় বেশি হলেও মাকরানী খেলোয়াড় দ্বারা গঠিত করাচি দল, রেল দল লম্বা লম্বা খেলায় অভ্যস্ত আর করাচির খেলোয়াড়রা ছোট ছোট পাসে দ্রুত গতিতে খেলতে পারদর্শী। দু’টিম তাদের দু’রকম স্ট্র্যাটেজি নিয়ে খেলা আরম্ভ করে। রেল দলের রক্ষণভাগ ছিল পর্বতসম শক্তিশালী। দৈহিক উচ্চতাসম্পন্ন ডিফেন্ডাররা তাদের দায়িত্ব ভালভাবেই পালন করেছিল, বিশেষ করে কাইয়ুম রক্ষণভাগকে সুন্দরভাবে সামাল দিচ্ছিল। করাচির চতুর আর দ্রুতগতির খেলোয়াড়দের আক্রমণ সেখানে গিয়েই শেষ হচ্ছিল। রেল দলের লম্বা লম্বা পাসের সাহায্যে আক্রমণগুলো করাচির ডিফেন্সকে বিচলিত করে রেখেছিল। খেলা খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। খেলার ১৪ মিনিটে রেলের গোলরক্ষক লতিফ আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়লে তারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু বদলি গোলকিপার ফারুক ভাল খেলা প্রদর্শন করে সবার প্রশংসাই কুড়িয়েছিল। করাচির আক্রমণের মূল ভূমিকা পালন করেছিল ইউসুফ (জুনিয়র)। খেলার প্রায় ৭৯ মিনিটে করাচির লেফট আউট মজিদ উঁচু করে একটি শট গোলপোস্টে মেরেছিলÑ যা শূন্যে বাঁক খেয়ে দ্বিতীয় বারের কোণাকুণি দিয়ে পোস্টে ঢুকেছিল। এ অবস্থায় গোলরক্ষক ফারুক ফাই করে পাঞ্চের মাধ্যমে গোল রক্ষা করে। সে সময় গোলরক্ষকের এক পা গোল লাইনের ভেতরে ছিল বলে করাচির খেলোয়াড়রা জোর দাবি জানায়। দর্শকরাও তাদের সাথে মিলে মাঠে গোল গোল চিৎকার শুরু করলে রেফারি ঈশা খান ঘাবড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থেকে লাইন্সম্যানের সাথে পরামর্শ করে বাঁশি বাজিয়ে গোলের সিদ্ধান্ত দেন। অন্যদিকে রেল দল রেফারির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে মাঠে হৈ চৈ করতে থাকে এবং গোলের সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য রেফারির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। রেফারি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। কর্তৃপক্ষ রেল দলকে খেলায় ফিরে আসার জন্য অনুরোধ জানালেও রেল দল গোলের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানায় এবং খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। রেফারি পুরো ১৬ মিনিট অপেক্ষা করে লম্বা বাঁশি দিয়ে খেলা সমাপ্ত করেন। রেল দলের খেলতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে কর্তৃপক্ষ করাচি টিমকে জয়ী এবং ১৯৬৬ সালের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে ঘোষণা করে।
(একাত্তর)
ঢাকা বিভাগের আন্তঃসাবডিভিশনাল ফুটবল টুর্নামেন্ট খুবই জমজমাট এবং আকর্ষণীয় হতো। প্রচুর দর্শকের সমাগম হতো। মহিলারাও মাঠে এসে খেলা উপভোগ করতেন। ১৯৬৬ সালের ঢাকা ডিভিশনের সাবডিভিশনাল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজক ছিল নারায়ণগঞ্জ স্পোর্টস এসোসিয়েশন। ২০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যাল মাঠে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এম কে আনোয়ার (যিনি ঢাকা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন) টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেছিলেন। আমরা (ঢাকা সদর দক্ষিণ) নারায়ণগঞ্জ ‘বি’ দলের বিরুদ্ধে উদ্বোধনী ম্যাচে ২-০ গোলের জয় দিয়ে শুরু করেছিলাম টুর্নামেন্ট। নারায়ণগঞ্জ ‘বি ’ দলের তরুণ খেলোয়াড়রা ভাল খেলা প্রদর্শন করে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আমাদের পক্ষে দুটো গোলই করেছিল জাহাঙ্গীর।
২১ নভেম্বর মানিকগঞ্জ ঢাকা সদর উত্তর টিমকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে পরবর্তী রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। মানিকগঞ্জ বেশ শক্তিশালী দল। তাদের ডিফেন্স যেমন ভাল, তেমনি জোরদার ছিল তাদের আক্রমণ। দলীয় সমঝোতা অত্যন্ত সুন্দর। বিরতির পূর্বেই তারা ঢাকা সদর উত্তরকে, বাটু এবং পর্বতের দেয়া ২-০ গোলে এগিয়ে যায় এবং বিরতির পর তারাই এক এক গোল করে ‘একহালি’ গোল পূর্ণ করে মানিকগঞ্জকে জয় এনে দিয়েছিল।
২২ নভেম্বর আমাদের টিম ঢাকা সদর দক্ষিণ মুন্সীগঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ খেলা মানেই হাইভোল্টেজ ম্যাচ। রাফ এন্ড টাফ ম্যাচ। খেলায় এরকম আবহ সৃষ্টি করতো মুন্সীগঞ্জের পক্ষে প্রতাপ। গাউস, জলিল আনসারী, নজরুল তাকে সহায়তা করতো। আমাদের পক্ষে হাসনাত, নয়া সুলতান, নাজির সব সময় জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতো। খেলা গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। যেদিন আমি খেলায় অংশ নিতে পারিনি, আমাদের ব্যাংক ফুটবল দলের (ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ঢাকা) পক্ষে খেলায় অংশ নিতে কুমিল্লায় যেতে হয়েছিল।
২২ নভেম্বর ‘রকিবউদ্দিন আহম্মদ মেমোরিয়াল গোল্ড কাপ’ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা। স্থানীয় কুমিল্লাা মোহামেডান কাব বনাম ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ঢাকা। একই সাথে এতগুলো ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে আমি ব্যস্ত এবং কান্ত হয়ে পড়েছিলাম। লীগ শেষ করেই আগাখান গোল্ডকাপ একই সাথে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতা, জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ এবং একইসাথে খেলতে হচ্ছে আন্তঃসাবডিভিশনাল ফুটবল আর রকিব উদ্দিন আহম্মদ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমাদের ব্যাংক ফুটবল টিমের শিরোপা জয় করার বহু নজির রয়েছে।
রকিবউদ্দিন আহম্মদ গোল্ডকাপ কুমিল্লা তথা চট্টগ্রাম অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নামকরা ফুটবল টুর্নামেন্ট। জাঁকজমক এবং আকর্ষণীয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। দেশের বড় বড় কাব এতে অংশগ্রহণ করতো। আমাদের ব্যাংক দলের গোলরক্ষক নুরুন্নবী ঢাকা মোহামেডান কাবেরও গোলরক্ষক ছিলেন, পাকিস্তান জাতীয় যুব দলের হয়ে খেলেছেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর গ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি দুটো বইও লিখেছেন। আমাদের ফুল খেলেছিলেন জহির এবং দেবীনাশ; দুজনই পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছেন। আমাদের তিন হাফ আবুল গাউস ও সামাদ ঢাকার বড় বড় কাবের খেলোয়াড়। আমাদের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে ছিল দুর্বল। এক ইন ছিল ওয়ারীর জামিল আক্তার; অপর ইন আমি তখন ঢাকা মোহামেডান কাবের খেলোয়াড় ছিলাম আর লেফট আউট কামালও মোহামেডানে খেলতো। দক্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড ও স্কোরারের ভীষণ অভাব ছিল আমাদের টিমে। অপরদিকে কুমিল্লা মোহামেডান স্থানীয়ভাবে খুবই জনপ্রিয় দল। কুমিল্লা মাঠে তাদেরকে হারানো ছিল দুরূহ ব্যাপার। মাঠের সবরকম সহযোগিতা পেয়ে তারা দাপটের সাথে খেলতো। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াসি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুড়াপাড়ার ছেলে, ছোটখাটো গাট্টা-গোট্টা গড়ন, দ্রুতগতি গোল করায় পারদর্শী। লেফট ইন জগলুলের সাথে চমৎকার বোঝাপড়া, সেও একজন দক্ষ স্কোরার। কুমিল্লার আর এক কৃতী ফুটবলার সলিমউল্লাহ ঢাকায় ইপিআইডিসিটির রাইট আউট, কুমিল্লা মোহামেডানের অন্তঃপ্রাণ খেলোয়াড়। তাদের নির্ভরযোগ্য হাফ মদনের ছোট ভাই লক্ষ্মণ। মদন ১৯৫৯ সালে আমার সাথে অপর ইনের খেলোয়াড়, সেবার আগাখান গোল্ডকাপে আমরা দুজন ঢাকা মোহামেডানের পক্ষে খেলেছিলাম এবং চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
আগে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ডেপুটি কমিশনারের সাথে, তিনি কুমিল্লা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন।
খেলা খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূল হয়েছিল। কুমিল্লা মাঠে সেদিন দশ হাজারেরও অধিক দর্শক দু’দলের এই উঁচু মানের খেলা উপভোগ করেছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলার আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। আমাদের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং সমঝোতার সাথে খেলে উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। খেলার শুরুটা আমাদের চমৎকার হয়েছিল এবং খেলার নিয়ন্ত্রণটাও আমাদের কাছে চলে আসে। আমরা বেশ কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে লেফট আউট কামালের দেয়া গোলে ১-০ এগিয়ে যাই। বিরতি পর্যন্ত আমরা ঐ গোল ধরে রাখলেও বিরতির পর মাঠের চিত্র পাল্টে যায়। আমরা গোল খাব নাÑ এরকম চিন্তা থেকে দল রক্ষণাত্মক খেলার প্রতি ঝুঁকে পড়ে আর এ সুযোগে কুমিল্লা মোহামেডান গোল শোধ করার জন্য সম্মিলিত চেষ্টা চালাতে শুরু করে এবং দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মিনিটে ওয়াসি সফল হয়। গোল করে দলকে সমতায় ফেরায়। খেলা ধীরে ধীরে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আমাদের আক্রমণগুলো সার্প শুটারের অভাবে গোলের সন্ধান পাচ্ছিল না অথচ কুমিল্লা মোহামেডানের লেফট ইন জগলু গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে নেয়।
গোল খেয়ে আমরা রক্ষণাত্মক খেলার চিন্তা বাদ দিয়ে আবার আক্রমণাত্মক খেলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালতে থাকি। গোল করার বেশ কয়েকটি সুযোগও সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আহমেদ হোসেনের ব্যর্থতায় তা সফল হয়নি। খেলা যখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে, ঠিক তখনই সেই চতুর ছটফটে সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াসি তার চাতুর্যের চমক দেখিয়ে নুরুন্নবীকে পরাস্ত করে দলের জন্য তৃতীয় গোলের উপহার এনে দেয়। আর সে সুবাদে কুমিল্লা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব ন্যাশনাল ব্যাংক টিমকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে রাকিব উদ্দিন আহমেদ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন ডেপুটি কমিশনার।
জনপ্রিয় এই ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য গোল্ডকাপটি ডোনেট করেছিলেন মঈনুল ইসলাম, যিনি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের সভাপতি ছিলেন। তিনি তার দাদার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ টুর্নামেন্টের প্রবর্তন করেছিলেন।
কুমিল্লা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব : কবির (গোলরক্ষক), কানু, নুরু, লক্ষ্মণ, বিমল, নিরঞ্জন, সলিমউল্লাহ, মন্টু, ওয়াসি, জগলু এবং মুকুল।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান : নূরুন্নবী (গোলরক্ষক), জহির, দেবীনাশ, আবুল হাসান, গাউস, সামাদ, শাহাবুদ্দিন, জামিল আক্তার, বশীর আহমেদ ও কামাল।
কুমিল্লা থেকে ফিরে আবার নারায়ণগঞ্জ মাঠে নামতে হয়েছিল ২৪ নভেম্বর ড্র হওয়া মুন্সীগঞ্জের সাথে আমাদের (ঢাকা সদর দক্ষিণ) সাবডিভিশনাল ফুটবল ম্যাচ খেলার জন্য। সেদিনও ফলাফল নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। গোলশূন্য ড্র। খেলা হয়েছে ফাটাফাটি। দু’দলের রক্ষণভাগ ছিল মারমুখী। খেলোয়াড়দের দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে খেলার প্রবণতা, তার ওপর ফরোয়ার্ডদের চোখে পড়ার মত ব্যর্থতা আর সবচেয়ে বেশি খেলাকে কলঙ্কিত করেছিল একটি দলের সমর্থকরা মাঠে ঢুকে মারিমারি করায়। খেলা প্রায় ১০ মিনিট বন্ধ ছিল। খেলা শুরু হলে আমাদের সুলতান খুব বাজেভাবে গোল মিস করলে আমরা জয়বঞ্চিত হয়েছিলাম। মজিবুর প্রতাপকে ফাউল করলে, বক্সের বাইরে ফ্রিকিক প্রতাপ মেরেছিল। অল্পের জন্য আমরা বেঁচে যাই। ফলাফল নির্ধারণের জন্য ম্যাচটি তৃতীয় দিনে গড়িয়েছিল।
আগের দিন অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ মানিকগঞ্জকে হারিয়ে ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করে ফেলেছিল। মানিকগঞ্জ দলের দুর্বলতা চোখে পড়ার মত, বিশেষ করে খেলোয়াড়দের সমঝোতার অভাব, ভুল পাস, গোলপোস্টে শট মারার অদক্ষতা। অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ খেলার ১১ মিনিটেই একটি পাল্টা আক্রমণে তাদের লেফট আউট নওয়াবের দেয়া গোলের মাধ্যমে এগিয়ে যায়। ২৮ মিনিটে মানিকগঞ্জের লেফট ইন পর্বতের সজোরে শট গোলরক্ষক স্বপন দর্শনীয়ভাবে রক্ষা করে নারায়ণগঞ্জ সমর্থকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। মানিকগঞ্জের সকল আক্রমণ নারায়ণগঞ্জের শক্তিশালী রক্ষণভাগে গিয়ে হারিয়ে যেত। বিরতির পর নারায়ণগঞ্জ নতুন উদ্যম নিয়ে আক্রমণ চালায়। ৮ মিনিটে নিশিথের শট গোলপোস্টের ওপর দিয়ে চলে যায়। নারায়ণগঞ্জের ফুলব্যাক বিনয় হাত দিয়ে বল খেললে বক্সের বাইরে পাওয়া ফ্রিকিক মানিকগঞ্জের সেন্টার ফরোয়ার্ড জালালের শট ক্রশবারে লেগে বাইরে চলে যায়। দু’দলই যখন গোল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখনই নারায়ণগঞ্জের লেফট ইন গফুর গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয়। খেলা শেষ হওয়ার ৭ মিনিট থাকতে নারায়ণগঞ্জের নূরুল্লাহ গোল করে দলকে ৩-০ গোলের জয় এনে দেয়।
মানিকগঞ্জ খেলোয়াড়রা : তপন (গোলরক্ষক), আফজাল, এরশাদ, নওয়াব আলী, দিপু, বেলাল, তপন, বাটু, জালাল, বরকত এবং আমান। (ক্রমশ.)
এপ্রিল-১৬
(বাহাত্তর)
‘দান দান তিনদান’-এই প্রচলিত কথার মতই আমরা ২৫ নভেম্বর তিনদিনের দিন মুন্সীগঞ্জকে হারাতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাও আবার এক-তিন গোলের ব্যবধানে আর তিনটি গোলই করেছিল ঢাকা সদর দক্ষিণের কৃতী লেফট আউট নাজির। দর্শনীয় হ্যাটট্রিক হয়েছিল। দু’দলের জমজমাট আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে আকর্ষণীয় খেলা খুবই আনন্দ দিয়েছিল উপস্থিত দর্শকদের। ৩০ মিনিট পর্যন্ত উভয় দলই গোল করার যতরকম কসরতÑ সবই করেছিল এবং ৩২ মিনিটে শরফুদ্দিনের এক পাস নাজিরকে প্রথম গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিল। বিরতি পর্যন্ত আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে থাকি। বিরতির পর ১০ মিনিটে সামাদের উঁচু করে দেয়া পাস ধরে নাজির দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে আমরা কিছুটা নির্ভার হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
প্রায় ৩০ মিনিটের সময় শাজাহান সুন্দর একটি লব পোস্টের কাছে দিলে সেটা আরও সুন্দরভাবে হেডের মাধ্যমে নাজির দলের তৃতীয় গোল এবং তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। এরই সাথে আমরা ফাইনাল খেলার জন্য নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম।
মুন্সীগঞ্জের প্লেয়ার লিস্ট : মোতালেব (গোলরক্ষক), হামিদ এবং মধু, আরমান খান, মহসিন, গাউস, নজরুল, রশিদ, সাবের, প্রতাপ এবং নুরু।
২৭ নভেম্বর আন্তঃডিভিশনাল (ঢাকা) ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল। নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ বনাম ঢাকা সদর দক্ষিণ। স্বাগতিক দলকে সমর্থন জানাতে প্রচুর দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিল। মাঠে উপচেপড়া দর্শক সীমানা দাগের ওপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখা খেলোয়াড়দের স্বচ্ছন্দে খেলার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দল শক্তিশালী হলেও নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ দল ছিল খুব কম্বাইন্ড। বহুদিন ধরে তারা খেলছে।
জেতার জন্য দু’দলই খেলার শুরু থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়েছিল। আমরা বলের নিয়ন্ত্রণ প্রথম থেকে নিতে সক্ষম হয়েছিলাম এবং পরপর কয়েকটি আক্রমণ করে বিপক্ষ দলকে কোণঠাসা করে রাখি। কিন্তু তাদের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের দৃঢ়তার জন্য আমরা সফল হতে পারছিলাম না। আচমকা নিশিথ গোল করে আমাদেরকে অবাক করে দিয়েছিল তখন। খেলা মাত্র ১২ মিনিট গড়িয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের রাইট আউট নুরুল্লাহ আমাদের গোল এরিয়ায় একটি লব করলে নিশিথ কোত্থেকে এসে লাফিয়ে উঠে সবার মাথার ওপর দিয়ে হেড করে জালে বল পাঠিয়ে দিয়ে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। আমরা গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকি। এমনকি আমাদের পুরো দলই আক্রমণে উঠে যায় কিন্তু কিছুই হচ্ছিল না। উপরন্তু বিরতির ঠিক পূর্বমুহূর্তে নারায়ণগঞ্জের লেফট ইন আমিনের কাছ থেকে বল পেয়ে লেফট আউট নওয়াব বুলেটের মত শট মেরে আমাদের গোলরক্ষক ইউসুফকে পরাস্ত করে ২ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। বিরতির পর আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলা ভুলে গিয়ে গোল করার জন্য মেতে উঠেছিলাম। সম্মিলিত আক্রমণের পরিবর্তে একক প্রচেষ্টায় গোল করার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম কিন্তু নারায়ণগঞ্জের দলগত শক্তিকে আমরা পরাস্ত করতে পারছিলাম না। এতটুকুও ছাড় দিচ্ছিল না ওরা। তাছাড়া আমাদের এলোমেলো খেলায় শুধু সময় নষ্ট হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ০-২ গোলের হার মেনে নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। খেলা শেষে বোর্ড অব রেভিনিউ’র সদস্য গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পুরস্কার বিতরণ করেন।
এখানে একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, নারায়ণগঞ্জ জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশন উপর্যুপরি সাত বছর এই ফুটবল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিরল গৌরব অর্জন করেছিল।
নারায়ণগঞ্জ ‘এ’ দল : স্বপন (গোলরক্ষক), বিনয়, গিয়াসউদ্দিন, নুরুল ইসলাম, কানু, নুরুল আমিন, নুরুল্লাহ, প্রতুল, নিশিথ, গফুর ও নবাব আলী।
ঢাকা সদর দক্ষিণ : ইউসুফ (গোলরক্ষক), মজিবর, হাসনাত, নয়া রফিক, সামাদ, শাজাহান, শরফুদ্দিন, সুলতান, বশীর এবং নাজির।
১৯৬৬ সালে রাশিয়ার ফুটবল টিম পাকিস্তান সফরে এসেছিল। রাশিয়ার কিরঘিজস্তান প্রজাতন্ত্রের আলগা ফুটবল কাব ১৬ দিনের সফরে করাচি, লাহোর এবং ঢাকায় তিনটি টেস্ট ম্যাচ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পেশাওয়ার ও সারগোদা আর পূর্ব পাকিস্তানে চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৪টি এক্সিবিশন ম্যাচ খেলার উদ্দেশ্যে ২০ নভেম্বর করাচি এসে পৌঁছেছিল।
পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশন তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য তোরাব আলীর নেতৃত্বে ২২ জন খেলোয়াড় বাছাই করেছিল।
গোলরক্ষক-আব্দুল লতিফ (রেলওয়ে), পারভেজ (আর্মি); রাইন ফুলব্যাক- মুরাদ বক্স (করাচি), আসলাম (লাহোর), লেফট ফুল ব্যাক- কাদের বক্স (ঢাকা), হোসেন বক্স (করাচি), রাইট হাফ-ইউনুস (রেলওয়ে), মাওলা বক্স (জুনিয়র, করাচি), সেন্টার হাফ- তোরাব আলী (অধিনায়ক, ঢাকা), ইসমাইল রুশো (করাচি), লেফট হাফ-আব্দুল গফুর (ঢাকা), গফফার (করাচি), রাইট আউট-গফুর (পেশাওয়ার), মীর দাদ (করাচি), রাইট ইন-আইয়ুব দার (রেলওয়ে), মাওলানা বক্স (সিনিয়র, করাচি), সেন্টার ফরোয়ার্ড-ওমর (ঢাকা), আসলাম (ঢাকা), লেফট ইন-আব্দুল হাশিম (ঢাকা), মোহাম্মদ তাকি (করাচি), লেফট আউট-মুসা (ঢাকা), মজিদ (করাচি)।
এখানে একটি বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য পাকিস্তান দলে সাতজন খেলোয়াড় ঢাকার প্রতিনিধিত্ব করেছিল অথচ একজন খেলোয়াড়ও ঢাকার অধিবাসী ছিল না বা পূর্ব পাকিস্তানী বা বাঙালি ছিল না; সবাই ছিল করাচির।
২১ নভেম্বর করাচিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল হকি কাব অব পাকিস্তান স্টেডিয়ামে। স্বাগতিক পাকিস্তান টিম শুরুটা ভাল করেছিল; বিশেষ করে দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমরের খেলা প্রশংসিত হয়েছিল এবং তারই করা গোলে পাকিস্তান টিম ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। আলগা কাব দলকে গুছিয়ে নিতে একটু সময় নিয়েছিল। তারপর তাদের দলীয় ক্রীড়ানৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়ে পাকিস্তানকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে তাদের ফুটবল সফরের শুভ সূচনা করেছিল।
আলগা ফুটবল কাব তাদের প্রথম প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল পেশাওয়ার একাদশের বিরুদ্ধে। প্রধান অতিথি হিসেবে খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সিইনসি এয়ার মার্শাল নূর খানের সাথে। তিনি সে সময় পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। সফরকারী দল ৩-০ গোলে জয়লাভ করে তাদের জয়যাত্রা অুন্ন রেখেছিল। পরবর্তী প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলতে আলগা ফুটবল কাব উপস্থিত হয়েছিল লায়ালপুরে। সারগোদা ডিভিশনাল ফুটবল ফেডারেশনের সম্পাদক চৌধুরী গোলাম রসুল যিনি পাকিস্তান জাতীয় দলের হকি খেলোয়াড় ছিলেন (অলিম্পিয়ান), তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
লায়ালপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের প্রধান অতিথি ছিলেন সারগোদা ডিভিশনের কমিশনার মোহাম্মদ হোসেন। খেলোয়াড়দের তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। ৪-০ গোলের জয় আলগা ফুটবল কাবের জয়ের চাকাকে সচল রেখেছিল। ২৭ নভেম্বর লাহোরে দ্বিতীয় ফুটবল টেস্টে আলগা ফুটবল কাব ২-০ গোলে পাকিস্তান ফুটবল টিমকে হারিয়ে সিরিজ জয় করেছিল। স্বাগতিক দল খুব খারাপ খেলে সবাইকে হতাশ করেছিল, বিশেষ করে আক্রমণভাগের খেলা ছিল জঘন্যতম। পশ্চিম পাকিস্তানে খেলা শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে দুটি প্রদর্শনী ম্যাচ এবং একটি টেস্ট ম্যাচ খেলার উদ্দেশ্যে আলগা কাব ২৮ নভেম্বর লাহোর থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল। চট্টগ্রাম এবং খুলনায় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন ২৫ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করেছিল। বাছাইকৃত খেলোয়াড়রা হলো : গোলরক্ষক-রানা এবং অনাথ। ফুলব্যাক-কাদের, তোরাব আলী, রফিক সালেহ এবং সামাদ। হাফব্যাক-গফুর, আলী হাফিজ, কায়কোবাদ, ফারুক, পিন্টু এবং আব্দুল্লা আকবর। ফরোয়ার্ড-সলিমউল্লাহ, প্রতাপ, বশীর, হাফিজউদ্দিন, আসলাম, ওয়াসি, গফুর, সুলতান, জামিল আক্তার, টিপু এবং হাশিম। কোচ-এসএ রশিদ।
২৯ নভেম্বর আলগা ফুটবল কাবের বাংলাদেশে প্রথম প্রদর্শনী খেলা গভর্নর একাদশের বিরুদ্ধে। দর্শকে পরিপূর্ণ নিয়াজ স্টেডিয়ামে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফুটবলপ্রিয় মানুষ মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন একটি প্রাণবন্ত এবং আকর্ষণীয় ফুটবল ম্যাচ দেখার উদ্দেশ্যে। অনেকে আবার স্মরণ করলেন দু’বছর আগে রাশিয়ার বাকু অয়েল ফুটবল টিম চট্টগ্রামে এসে ম্যাচ খেলে যাওয়ার। সেদিনও নিয়াজ স্টেডিয়াম দর্শকে পরিপূর্ণ ছিল। তারা উপভোগ করেছিলেন বাকু অয়েল ফুটবল টিমের ব্যক্তিগত এবং দলগত ক্রীড়ানৈপুণ্য আর মনমাতানো খেলা।
আলগা ফুটবল কাব ও তাদের উঁচুমানের খেলা প্রদর্শন করে শুরু থেকে আমাদের ওপর চেপে বসেছিল। তাদের দলীয় সমঝোতা এবং নিখুঁত পাস ছিল খেলার মূল আকর্ষণ। দেশের কৃতী খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া আমাদের টিম তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে খেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু তাদের দলের রাইট-ইন স্ট্রেল্টজভ দক্ষতার সাথে গোল করে বিরতির আগেই তার দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির পর আমরা গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। খেলা আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে বেশ জমে উঠেছিল। গোল শোধ করার সুযোগও এসেছিল কিন্তু পোস্টে এলোমেলো আর দুর্বল শুটিং-এর জন্য আমরা সফলতা পাচ্ছিলাম না। অন্যদিকে আলগা ফুটবল কাব বিরতির পর যেন জ্বলে উঠেছিল। তাদের খেলার গতি বেড়ে গিয়েছিল। তাদের ছন্দময় খেলা প্রতিরোধ করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম, বিশেষ করে তাদের গতিসম্পন্ন আক্রমণ রুখতে আমাদের ডিফেন্সকে ভীষণ পরিশ্রম এবং দৃঢ়তার সাথে খেলতে হচ্ছিল। তবে তাদের দলীয় সমঝোতা এবং উপযুক্ত পরিকল্পনার কাছে আমরা হার মানতে বাধ্য হয়েছিলাম। অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড দলীয় অধিনায়ক মেরজিলিকিন দু’গোল এবং রাইট-ইন স্টেল্টজভ করেছিল দুটি গোল।
আলগা ফুটবল কাব পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রথম প্রদর্শনী খেলায় ৪-০ গোলের জয় দিয়ে সফর শুরু করেছিল। তাদের দ্বিতীয় প্রদর্শনী ম্যাচ ছিল খুলনায় পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট একাদশের বিপক্ষে। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন খানএ সবুর এবং তার বাড়ি খুলনায়। তার সম্মানার্থে প্রদর্শনী ম্যাচ খুলনায় আয়োজন করা হয়েছিল। ১ ডিসেম্বর খুলনা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ম্যাচে প্রধান অতিথি হিসেবে দু’দলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন। শেষ প্রদর্শনী খেলার ফলাফলটাও আলগা ফুটবল কাব নিজেদের করে নিয়েছিল ৩-০ গোল দিয়ে।
(ক্রমশ.)
মে-১
(তেয়াত্তর)
৩ ডিসেম্বর ছিল তৃতীয় এবং ফাইনাল টেস্ট ম্যাচ। রাশিয়ার আলগা ফুটবল কাব পাকিস্তানকে ৭-২ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনাল টেস্টের জন্য পূর্ব গ্যালারির টিকিট ২ রুপি এবং পশ্চিম গ্যালারি ৪ রুপি ধার্য করা হয়েছিল। আলগা ফুটবল কাব সফরের শেষ খেলায় তাদের ক্রীড়াশৈলী উজাড় করে দিয়েছিল ঢাকা মাঠে। তাদের দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলা ঢাকার দর্শকরা দারুণ উপভোগ করেছিল। তাদের ব্যক্তিগত এবং দলগত নৈপুণ্য পাকিস্তান খেলোয়াড়দের চেয়ে অনেক উন্নতÑ যা মাঠে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। পাকিস্তানের খেলা দেখে কেউ বুঝতে পারছিল না যে, একটা জাতীয় দলের খেলা। খেলোয়াড়দের ফিটনেসের যেমন অভাব, তেমনি দলীয় সমঝোতার অভাব, এলোমেলো খেলা, অগোছালো আক্রমণ, দুর্বল শুটিং, বিশেষ করে গোলপোস্টে কখন কেমন করে মারতে হবেÑ সেটাও যেন তারা ভুলে গিয়েছিল! সব মিলিয়ে এতই হতচ্ছিরি খেলাÑ যা দেখে দর্শকরা শুধু হতাশই হননি বরং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আলগা ফুটবল কাব পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল টিমকে নিয়ে সেদিন মাঠে ছেলেখেলা খেলেছিল। পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের- তাদের পেছনে ছুটোছুটি করতে দেখে দর্শকরা হাসাহাসি করেছিলেন। রক্ষণভাগে মুরাদ বক্স এবং কাদের বক্স পরিশ্রম করে না খেললে গোলের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেত। গফুর ও তোরাব আলী আলগা কাবের আক্রমণকে সামাল দিলেও তারা তাদের সেরাটা খেলতে পারেনি। রাশিয়ার প্রত্যেকটি খেলোয়াড় চমৎকার খেলা প্রদর্শন করলেও তাদের ক্যাপ্টেন মেরজিলিকিনের খেলা সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল; বিশেষ করে তার গোলপোস্টে নিখুঁত শুটিং এবং গোল করার দক্ষতা অপূর্ব। এক বাক্যে বলা যায়Ñ সে মাঠের সেরা খেলোয়াড়।
খেলা শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান জাতীয় দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর গোল করার একটা সুযোগ নষ্ট করে। এরপরই রাইট আউট গাফফার আরেকটি সুযোগ বাজেভাবে মিস করেছিল। খেলার শুরুতে পাকিস্তানী আক্রমণ আলগা কাবকে কিছুটা অস্থির করে তুললেও তারা নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যেই। নিখুঁত পাশিং এবং দ্রুতগতির আক্রমণে খেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তারা। খেলার চল্লিশ মিনিটে তারা গোল করতে সফল হয়েছিল। গোল করেছিল স্ট্রাইকার স্ট্রেসোট, ১-০। তার পাঁচ মিনিট পর দলের অধিনায়ক মেরজেলিকিন গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে (২-০)। বিরতি আগ মুহূর্তে মুসা গোল করে ব্যবধান কমায় (২-১)। বিরতির পর খেলা সম্পূর্ণ আলগা কাবের কাছে চলে যায় এবং অধিনায়ক মেরজিলিকিন দ্রুত গোল করে ৩-১ দলকে এগিয়ে নেয়। ২০ মিনিটে রাইট উইংগার সুবিন দলের ৪র্থ গোল করেছিল দুর্দান্ত কিক মেরে (৪-১)। পাকিস্তানও দুটি ফ্রি-কিক পেয়েছিল আলগা কাবের পোস্টের কাছে কিন্তু কাজে লাগাতে পারেনি। ৩৫ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় ফেমিন গোল করে দলকে (৫-১) বড় জয়ের দিকে নিয়ে যায়। একটি কমন বল ধরতে গিয়ে গোলরক্ষক কোজায়েভ এবং হাশিমুদ্দিনের সাথে ধাক্কা লেগে বল গোলপোস্টে ঢুকে যায়। সাথে সাথে পাকিস্তানের পক্ষে গোলের সংকেত দেন রেফারি মাসুদুর রহমান (৫-২)। খেলা শেষ হওয়ার আগে অল্প ব্যবধানে অধিনায়ক মেরজিলিকিন আরও দু’গোল করে দলকে (৭-২) বড় ব্যবধানের জয় এনে দেয়। রাশিয়ার আলগা ফুটবল কাব অপরাজিত থেকে তাদের ১৬ দিনের পাকিস্তান সফর শেষ করেছিল।
আলগা ফুটবল কাব : কেরায়েভ (কোজায়েভ), সুলতানোভ-মাকারোভ, শেভচেনকভ এবং মিটনেসনকভ, বিবেয়ি এবং ইনজভ, স্ট্রেল্টভ মেরজিলিকিন, সুভিন এবং ইয়াগোশভ।
পাকিস্তান জাতীয় দল : লতিফ (গোলরক্ষক), মুরাদ বক্স, তোরাব আলী এবং হোসেন বক্স, কাদের এবং আবদুল গফুর, গাফফার (আইয়ুব দার), মাওলা বক্স, ওমর, হাশিম উদ্দিন এবং মুসা।
পূর্ব পাকিস্তনের গভর্নর আবদুল মোমেন খান আলগা ফুটবল কাব এবং পাকিস্তান ফুটবল দলকে বঙ্গভবনে চা-চক্রে আপ্যায়িত করেছিলেন এবং ইপিএসএফ হোটেল শাহবাগে নৈশভোজের আয়োজন করেছিল।
১৯৬৬ সালে ঢাকায় আমরা দুটো ফুটবল লীগ খেলার মাধ্যমে ফুটবল মৌসুম শুরু করেছিলাম। প্রথমটি ঢাকা জেলা স্পোর্টস এসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে ডিডিএসএ ফুটবল লীগ, যা ২৯ এপ্রিল শুরু হয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি ছিল ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ, যা শুরু হয়েছিল ২০ মে থেকে। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব দুটো লীগে অংশ নিলেও পরবর্তীতে ডিডিএসএ ফুটবল লীগ থেকে দল প্রত্যাহার করে নেয়ায় আমার সে লীগে খেলার আর সুযোগ হয়নি; যার জন্য সে লীগ সম্বন্ধে বিস্তারিত লেখাও সম্ভব হয়নি। তবে ডিডিএসএ লীগ শেষে অংশ নেয়া ১১ দলের অবস্থান কি ছিলÑ তা সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি।
দল খেলা জয় ড্র পরাজয় পক্ষে বিপক্ষে পয়েন্ট
ইপিআইডিসি ১০ ৭ ৩ ০ ৩২ ১ ১৭
পুলিশ ১০ ৭ ২ ১ ১৭ ৬ ১৬
ফায়ার সার্ভিস ১০ ৬ ৪ ০ ১৩ ৬ ১৬
আজাদ স্পোর্টিং ১০ ৪ ২ ৪ ৬ ১১ ১০
হোল্ডেন একাদশ ১০ ৩ ৪ ৩ ৬ ২২ ১০
বিজি প্রেস ১০ ৩ ৩ ৪ ৫ ২৪ ৯
আজাদ পাকিস্তান ১০ ৩ ২ ৫ ৫ ২০ ৮
টিটি সেন্টার ১০ ৩ ২ ৫ ৫ ২৭ ৮
প্যানোরমা ১০ ২ ২ ৬ ৩ ৮ ৬
ভিক্টোরিয়া ১০ ১ ২ ৭ ৬ ১০ ৪
পাক পিডব্লুডি ১০ ১ ২ ৭ ৩ ৭ ৪
১৯৬৬ সালেও পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গন সাংগঠনিক দিক দিয়ে গুছিয়ে উঠতে পারেনি। সুশৃংখল এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক খেলাধুলার নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালনার দায়িত্ব ইপিএসএফ-এর ওপর ন্যস্ত থাকলেও এপিএসএফ-এর পাশাপাশি কয়েকটি খেলা নিজস্ব এসোসিয়েশনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। যেমন ইস্ট পাকিস্তান সাইকিং এসোসিয়েশন, যার সভাপতি ছিলেন এসএম জহুরুদ্দিন, জিমন্যাস্টিক এসোসিয়েশন অব ইস্ট পাকিস্তান, যার সভাপতি ছিলেন এ এ সিদ্দিকী এবং সহ-সভাপতি সৈয়দ ওদুদ চৌধুরী; অ্যামেচার রেসলিং এসোসিয়েশন অব ইস্ট পাকিস্তান, যার সভাপতি ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান এবং সহ-সভাপতি ছিলেন এসএ মহসিন।
জাতীয় ফেডারেশন কর্তৃক এই তিনটি এসোসিয়েশন বিলুপ্ত ঘোষণা করে ইপিএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ক্রীড়াঙ্গনকে আরও সুচারুভাবে পরিচালনা এবং স্থবির হয়ে পড়া (প্রশাসনের গতি সঞ্চারের কারণ দেখিয়ে) ১৯৬২ সালের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতা বলে ইপিএসএফ সভাপতি নির্বাচিত দ্য ইউনাইটেড স্পোর্টসম্যান কাউন্সিল যারা স্পোর্টস প্রমোটারস ফ্রন্টকে পরাজিত করে কমিটি গঠন করেছিল, ১৯ অক্টোবর ১৯৬৬ সে কমিটি ভেঙ্গে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট শক্তিশালী এডভাইজরি কমিটি গঠন করেছিলেন- যা নিচে উপস্থাপন করা হলো।
সভাপতি এসবি চৌধুরী, ডিভিশনাল কমিশনার, ঢাকা; সহা-সভাপতি এম কে আনোয়ার, ডেপুটি কমিশনার, ঢাকা; সাধারণ সম্পাদক আজহার উদ্দিন খান, সহকারী চিফ ইঞ্জিনিয়ার, সিএন্ডবি,
ট্রেজারার মঈনুদ্দিন চৌধুরী, চেয়ারম্যান, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি
সদস্য : এসএ মজিদ (ডিডিএসএ), সাইফুদ্দিন আহমেদ (আজাদ স্পোর্টিং), সৈয়দ মফিজউদ্দিন (মোহামেডান স্পোর্টিং), এস হুদা (ওয়ারী), একেএম জাকারিয়া (বিজি প্রেস), এ তৌফিক (পিআইএ), এ গফুর (পিই রেলওয়ে), এসএম হুদা (বার্মা ইস্টার্ন), এ মালেক (ভিক্টোরিয়া), এ এ সিদ্দিকী (প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, ইপিএসএফ), সিদ্দিকুর রহমান (ফায়ার সার্ভিস), মতিউর রহমান (ঢাকা ইউনিভার্সিটি), ওয়াজেদ আলী (ঢাকা ওয়ান্ডারার্স), নওয়াব খাজা হাসান আসকারি এবং মাওলানা গফুর (ইপরোয়া), আলহাজ্ব কফিলুদ্দিন (পাক পিডব্লুডি) এবং এস ইসলাম (আনসার)। দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ক্রীড়া সংগঠকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য আসবে বলে সবাই উৎসাহিত হয়েছিল।
১৯৬৭ হকি মৌসুমটা আমরা যারা ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হকি খেলোয়াড় ছিলাম, আমাদের জন্য ছিল অনিশ্চয়তার। কারণ এবার আমাদের টিম লীগ খেলায় এন্ট্রি করেনি। ১৯৬৩-৬৪ সালে প্রথম এন্ট্রি করে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। গত বছরের (১৯৬৫-৬৬) অপরাজিত হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন যে টিম এবারের প্রথম বিভাগ হকি লীগে অংশগ্রহণ করবে না, এটা যেন ক্রীড়াঙ্গনে একটা আশ্চর্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবার একটাই প্রশ্নÑ কেন ব্যাংক টিম হকি লীগ খেলছে না? সঠিক উত্তর আমাদেরও জানা ছিল না। শুধু এটুকু শুনেছি যে, কাজের ক্ষতি করে ব্যাংকের অর্থ অপচয় করে খেলাধুলার প্রয়োজন নেই। হয়তোবা ব্যাংকের মুনাফা প্রয়োজন অনুযায়ী অর্জন হয়নি কিংবা অন্য কারণ থাকতে পারে। এদিকে হকি লীগ শুরু হয়ে গিয়েছিল ডিসেম্বর ’৬৬। গতবারের যুগ্ম রানার্স দল ওয়ারী এবং কম্বাইন্ড লীগ ম্যাচে অংশ নিচ্ছে অথচ আমরা খেলতে পারছিলাম নাÑ এটা ছিল আমাদের জন্য খুবই কষ্টের। আমরা যারা ১৯৫৯ সালে ব্যাংকে চাকরিতে ঢুকেই ব্যাংকের খেলাধুলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম, হকি লীগে অংশগ্রহণ না করার ব্যাংক সিদ্ধান্তটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমরা খেলোয়াড়রাই তখন ক্রীড়াঙ্গনে যারা উচ্চ পর্যায় ছিলেন, যারা সুপরিচিত সংগঠক, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, যারা আমাদেরকে স্নেহ করতেনÑ তাদের দ্বারস্থ হয়ে ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে হকি লীগে ন্যাশনাল ব্যাংকের টিমে এন্ট্রি করার জন্য রাজি করানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সে সময়ের ক্রীড়াব্যক্তিত্ব এবং সবার সম্মানের পাত্র মহসিন ভাই আমাদের ডিএমডি মি. মেকেকনি সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলে ডিএমডি সাহেব রাজি হয়েছিলেন এবং লীগের বেশ কয়েকটি খেলা হয়ে যাওয়ার পরও গত বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংক ১৯৬৭ সালে প্রথম বিভাগ হকি লীগ খেলার সুযোগ পেয়েছিল। ১৫টি টিম নিয়ে হকি লীগ শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত ১৬টি টিম লীগ খেলায় অংশ নিয়েছিল : ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ঢাকা, ওয়ারী কাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে, ইস্পাহানী, মাহুৎটুলী, ঢাকা মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, আজাদ স্পোর্টিং, পাকিস্তান স্পোর্টিং, পাক পিডব্লিউডি, পুলিশ এসি, ফায়ার সার্ভিস, ইস্ট বেঙ্গল কাব, পাকিস্তান এয়ারফোর্স।
মে-১৬
(চুয়াত্তর)
১৯৬৭ সালের ঢাকা প্রথম বিভাগ হকি লীগ ওয়ারী কাব এবং পুলিশ এসি’র খেলার মধ্য দিয়ে ২৮ ডিসেম্বর ’৬৬ শুরু হয়েছিল। গতবারের লীগে যুগ্ম রানার্সআপ দল ওয়ারী কাব সহজেই ৩-১ গোলে পুলিশকে হারিয়েছিল। ওয়ারীর সহিদ দু’গোল এবং শেরার এক গোলের বিপরীতে পুলিশের আখতার একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। পরদিন গতবারের লীগে অপর যুগ্ম রানার্স টিম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং প্রতাপ শংকর হাজরার দর্শনীয় হ্যাটট্রিক এবং বুলবানের দেয়া এক গোলের সুবাদে আজাদ স্পোর্টিংকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে লীগের শুভসূচনা করেছিল। দিনের অপর খেলায় সাজিদের একমাত্র গোলের ওপর ভর করে পিডব্লিউডি ১-০ গোলে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। বছরের শেষদিনে ইস্পাহানী কাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে রেকর্ডসংখ্যক ১৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। ইস্পাহানীর ইসলাহউদ্দিন তার যাদুকরী স্টিক ওয়ার্ক এবং দ্রুতগতির সাহায্য দুটি দর্শনীয় হ্যাটট্রিকসহ এগারো গোল একাই করেছিল। ইসলাহ করাচি থেকে ঢাকায় লীগ খেলার জন্য এসেছিল। পরবর্তীতে সে একজন চৌকস রাইট আউট হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে অলিম্পিক, ওয়ার্ল্ডকাপসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন্সি করেছে। জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছে। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের ডিফেন্স একেবারেই ভেঙ্গে গিয়েছিল গোল করতে বাধা দেয়ার কেউ ছিল না। ইস্পাহানীর ফুলব্যাক শফিক, সেও করাচির খেলোয়াড়, এক গোল করেছিল, সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার দু’গোল করলে বাকি একটি গোলও করাচির খেলোয়াড় লেফট-ইন আজিজ করেছিল। ইস্পাহানী টিমে সেদিন যারা খেলেছিল, তাদের তালিকা : আফজাল (গোলরক্ষক), সোলায়মান, শফিক এবং জাওয়েদ, আফসার এবং জাফর, মোদাস্সার ইসলাহউদ্দিন, হায়দার আজিজ এবং আজিম। আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় রেলটিমের নিয়াজের প্রথমার্ধের একমাত্র গোলে পাকিস্তান স্পোর্টিং পরাজিত হয়েছিল। খেলাটি বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল, দু’টিমই জেতার জন্য খেলেছিল। ০১-০১-৬৭ তারিখে রেল দল ৯ গোলের বিরাট জয় দিয়ে শুভ নববর্ষ উদযাপন করেছিল। তারা আজাদ স্পোর্টিংকে ৯-০ গোলে হারিয়েছিল। দিনটি ছিল লেফট-ইন নিয়াজের। স্টিকের ঝলকানি দিয়ে সে একাই করেছিল ছয় গোল। বাকি তিনটি গোল এসেছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড কলিম, রাইট-ইন আমিন এবং রাইট আউট হামিদের স্টিক থেকে।
রেল দলের খেলোয়াড় তালিকা : নবী (গোলরক্ষক), আখতার এবং ইদ্রিস, সামি কলিম এবং আবিদ, হামিদ, নাসিম, কাইফুল, নিয়াজ এবং মোহাম্মদ আলী।
দিনের অপর খেলায় ওয়ারী ২-১ গোলে এয়ারফোর্স টিমকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ারীর পক্ষে গোল করেছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড শহিদ এবং রাইট আউট নাওয়াজিস আর এয়ারফোর্সের গোল করেছিল লেফট-ইন আফজাল। বছরের দ্বিতীয় দিনে মোহামেডান চিরশত্রু ওয়ান্ডারার্সকে ৪-১ গোলে হারিয়ে হকি লীগ শুরু করেছিল। লেফট-ইন জিয়া এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড উভয় দু’গোল করে করেছিল মোহামেডানের পক্ষে আর ওয়ান্ডারার্সের বজলু একটি গোল করে ব্যবধান কমাতে পেরেছিল। অপর খেলায় পুলিশ এবং পিডব্লিউডি ১-১ গোলে ড্র করে পুলিশের মোহাম্মদ আলী আর পিডব্লিউডি’র রানা গোল করেছিল।
৩ জানুয়ারি ইস্পাহানী এবং মাহুতটুলী নিজ নিজ খেলায় বড় ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল। ইস্পাহানী পুলিশ টিমকে ৫-০ গোলে হারিয়েছিল। হাফ টাইমের পূর্বেই তারা ৪-০ গোলে এগিয়ে যায়। রাইট-ইন-ইসলাহউদ্দিন ৩ গোল করেছিল বাকি ২ গোল সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার এবং লেফট-ইন আজিজ করেছিল। মাত্র দুই ম্যাচেই ইসলাহউদ্দিন ১৪ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার দৌড়ে অনেক দূর এগিয়ে যায়। আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় মাহুতটুলী ইস্টবেঙ্গল কাবকে ৮-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। চমৎকার হ্যাটট্রিক করেছিল তাদের লেফট-ইন ফজলু। মাহুতটুলী টিমে যারা সেদিন খেলেছিল- আরেফিন (গোলরক্ষক), হাসান এবং বারী, মহসিন মজিবুর এবং পুতুল, খায়ের হাফিজুল্লাহ ইকবাল ফজলু এবং নাঈম। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব আজাদ স্পোর্টিংকে ৪-১ গোলে হারিয়ে তাদের জয়ের ঢাকা সচল রেখেছিল। আবদুর রাজ্জাক দর্শনীয় হ্যাটট্রিক করেছিল যার সব কৃতিত্ব তারই পাওনা। চতুর্থ গোল করেছিল লেফট-ব্যাক কামার এবং আজাদের রাইট-ইন টিপু একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল। স্টেডিয়ামে মাহুতটুলী প্রথম তাদের পয়েন্ট খুইয়েছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। মাহুতটুলী লেফট আউট নাঈমের দেয়া গোলে এগিয়ে যায় কিন্তু পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর রাজা গোল করে দলকে সমতায় ফেরায়। পাকিস্তান স্পোর্র্টিং কাবের হয়ে যারা খেলেছিল : মোমতাজ (গোলরক্ষক), নাঈম এবং কামাল, তাইমুর, হাফিজ এবং আনোয়ার, রশীদ, নাসের, রাজা, লতিফ এবং বুলবুল।
পিডব্লিউডি টিমের আরেকটি হার (২য় হার)। ইস্পাহানী টিমের ১-০ গোলে জয়লাভ আর জয়ের নায়ক হলো সেই ইসলাহউদ্দিন যে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলের অধিকারী। পিচ্ছিল মাঠে দু’টিমই খুব সতর্কতার সাথে খেলছিল, খেলাটিও হয়েছিল খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। প্রথমার্ধের প্রায় বিশ মিনিটে ইস্পাহানীর লেফট ইন আজিজ ক্ষিপ্রতার সাথে বিপক্ষ খেলোয়াড়দের ডজ দিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে পরে ইসলাহকে বল দিলে গোলরক্ষক রাস করে আসলে ইসলাহ চাতুর্যের সাথে বল পুষ করে জালে জড়িয়ে দেয়। বিরতির পর পিডব্লিউডি গোল শোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কিন্তু সফল হতে পারেনি। পিডাব্লিউডি টিম লিস্ট : ইলিয়াস (গোলরক্ষক), মেরু এবং আইয়ুব খান, মকবুল পাঠান জাফর হোসেন, শেখ গনি, মজিদ রানা এবং ইফতেখার।
এখানে একটি বিষয়ে জানাতে চাই যে, পিডব্লিউডি টিমের রাইট ফুলব্যাক মেরু, পাকিস্তান মাঠের কাছে তার বাড়ি, সুন্দর একটি তরুণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে চাকরিরত অবস্থায় সে নিহত হয়েছিল। পুলিশ ৫-০ গোলে ওয়ান্ডারার্সকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট লাভ করেছিল। পুলিশ টিম প্রথমার্ধে মাত্র একটি গোল দিতে পেরেছিল আর সে গোলটি করেছিল নাজির। বিরতির পর আখতার দুই গোল এবং নাজির করেছিল আরও দু’গোল। পুলিশ টিমের প্লেয়ার লিস্ট : মান্নান (গোলরক্ষক), আখতার এবং শুক্কুর, রকিব, রফিক এবং আয়নুল, আকবর, গফুর, নাজির, মোহাম্মদ আলী এবং শরিফ।
১০ জানুয়ারি শক্তিশালী কম্বাইন্ড স্পোর্টিং বিমান বাহিনীকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল। প্রতাপের পাশ থেকে বুলবান প্রথম গোল করে। এরপরই বিমানবাহিনীর আফজাল ডি বক্সের ভেতর সিকান্দার আলীকে পাস দিলে সে বাইরে মেরে একটি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করে। কম্বাইন্ড ও অনুরূপ একটি গোল করার সুযোগ নষ্ট করেছিল যখন প্রতাপের দেয়া পাশ ওমেদ তালগোল পাকিয়ে বল পোস্টে হিট করতে ব্যর্থ হয়েছিল। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটে প্রতাপ একক চেষ্টায় ডি’তে ঢুকে সজোরে হিটের মাধ্যমে গোলরক্ষককে পরাস্থ করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিমান বাহিনী বিরতির পর খেলায় ফিরে আসে এবং বেশ অনেকগুলো আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাদের দক্ষ হিটারের অভাবে গোল পায়নি। খেলার শেষের দিকে ওমেদ আলী দলের গোলসংখ্যা বাড়িয়ে ৩-০ গোলের জয় এনে দেয়।
কম্বাইন্ড প্লেয়ার লিস্ট : সাদেক (বড়) (গোলরক্ষক), কাদের এবং সাব্বির, লস্কর, সাদেক এবং মহসিন, সিকেন্দার, বুলবান ওমেদ, প্রতাপ এবং রহমান।
বিমানবাহিনী : নূর আলম (গোলরক্ষক), তারেক এবং শফিক, হাবিব ইকবাল এবং সাঈদ, রিয়াজ, নিয়াজি, সিকান্দার আলী, আফজাল, আমানউল্লাহ।
১৯৬৬ সালে এশিয়ান গেমসে পাকিস্তান ভারতের কাছে শিরোপা হারানোর পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সিএনসি এয়ার মার্শাল নূর খানকে পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালনের নির্দেশ প্রদান করেন। সেটা ছিল অক্টোবর মাস। নভেম্বর মাসেই নূর খান ফেডারেশনের হেড কোয়ার্টার রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিজ কর্মস্থল পেশাওয়ারে নিয়ে যান এবং বিশ্ব হকিতে পাকিস্তানের প্রাধান্য বজায় রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ জানুয়ারিতে হল্যান্ড জাতীয় হকি টিম দু’সপ্তাহের হকি সফরে পাকিস্তানে এসেছিল। জানুয়ারি ২৫ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ দিনে লাহোর, ঢাকা এবং করাচিতে তিনটি হকি টেস্ট এবং হায়দ্রাবাদ, বাহাওয়ালপুর, মুলতান, লায়ালপুর, পেশাওয়ার এবং রাওয়ালপিন্ডি ছয়টি জোনাল ম্যাচ খেলেছিল।
হল্যান্ড জাতীয় হকি দলের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য পাকিস্তান জাতীয় দল গঠনের লক্ষে সমগ্র দেশের ৩৫ জন হকি খেলোয়াড়কে স্বল্প সময়ের ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল যা ১৫ জানুয়ারি থেকে লাহোর স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল। খেলোয়াড়রা হলো : ১। গোলরক্ষক- সালাহউদ্দিন (পিএএফ), আখতার (রেলওয়ে) এবং হাদী (সারগোদা), ফুলব্যাক-রিয়াজউদ্দিন (পিআইএ), তানভীর দার (রেলওয়ে), লোদী (লাহোর), ইজাজ বাট (লাহোর), তারিক আজিজ (সারগোদা), আসলাম (সারগোদা), হাফ-ব্যাক- আব্দুর রশিদ (আর্মি), সামি (কাস্টম), আনোয়ার শাহ (রেলওয়ে) সাঈদ আনোয়ার (পিআইএ), আল এ মুজতবা (করাচি), রিয়াজ আহমেদ (আর্মি), ফজল আহমেদ (পিআইএ), দিলওয়ার (লাহোর), আখতার (রেলওয়ে) এবং গুলরেজ (কাস্টম); ফরোয়ার্ড- মাহমুদ (কাস্টমস), ইসমাইল (কাস্টম), বশীর (ইস্ট পাকিস্তান), ইসলাহ (করাচি), খুরশিদ আযম (রেলওয়ে), জাবিদ (আর্মি) হায়াত মাহমুদ (পিআইএ), তারিক নিয়াজি (পিআইএ), মুদাসসির (রাওয়ালপিন্ডি), লাইক (পিএএফ), আসাদ মালিক (পিআইএ), মেহেদী (লাহোর), জাহাঙ্গীর (কাস্টম), খিজির বাজওয়া (সারাগোদা) এবং সাবির (লাহোর)।
ক্যাম্প কমান্ডেন্ট এবং ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন মেজর হামিদ (পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক, অলিম্পিয়ান) কোচের দায়িত্ব পালনের জন্য ছ’জন কোচকে নিয়োজিত করা হয়েছিল।
সর্বজনাব শেখ রহমত উল্লাহ, এ জি খান, লতিফ মীর, নাসির বুন্দা আখতার হোসেন এবং ফজলুর রহমান।
(ক্রমশ.)
জুন-১
(পঁচাত্তর)
সিলেকশন কমিটি : এয়ার মার্শাল নূর খানকে প্রধান করে এবং ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ, কর্নেল আতিফ, মাহমুদ (কাস্টমস ও সাবেক অলিম্পিয়ান), নিয়াজ খান। মাত্র ১০ দিনের কোচিং শেষে তিনটি টেস্ট ম্যাচে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তান জাতীয় দল গঠন করা হয়েছিল। দল গঠন করার পর দলীয়ভাবে অনুশীলন করার সময় এবং সুযোগ পাওয়া যায়নি এবং খাজা মোহাম্মদ আসলামকে নিয়ে সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়েছিল যারা হল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার জন্য পাকিস্তান হকি টিমের খেলোয়াড় নির্বাচন করেছিলেন।
২৬ জানুয়ারি হল্যান্ড জাতীয় হকি টিম পাকিস্তানে তাদের সফর শুরু করেছিল হায়দ্রাবাদ জোনাল হকি টিমকে ৪-০ গোলে পরাজিত করার মধ্যে দিয়ে। তাদের পাঁচ অলিম্পিয়ান ফোক্কার, এলফারস, ভেনভ্রন, সুইটস এবং হুফটস খেলায় অংশগ্রহণ করেছিল। পরদিনই দ্বিতীয় জোনাল ম্যাচে তাদের জয়রথ থামিয়ে দিয়েছিল ভাওয়ারপুর জোন ১-১ গোলে ড্র করে। স্বাগতিক দলের রাইটইন ফায়জুল হাসান বাজি গোল করে দলকে প্রথমার্থে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ডাচ দল গোল করার জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। এসময় তারা ৭টি কর্নার ৩টি পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নেয়; এমনি একটি কর্নার হিটের বল ধরে তাদের রাইট-ইন টার হার গোল করে দলের সম্মান বাঁচিয়েছিল। শক্তিশালী হল্যান্ড টিম পাকিস্তান সফরে ২৯ জানুয়ারি প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিল মুলতান জোন হকি টিমের কাছে। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উঁচুমানের খেলায় মুলতান জোন ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। মুলতান টিমের লেফট-ইন ইসলাহ উদ্দিন এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড কাশানী একটি করে গোল করেছিল আর ডাচ দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড স্পিট একটি গোল করে গোলের ব্যবধান কমাতে সক্ষম হয়েছিল। পরদিনই হল্যান্ড টিম সারগোদাকে ২-০ গোলে হারিয়ে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। প্রথমার্ধে ডাচ দলের লেফট-উইংগার ডি কাইজার গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে সেটাকে ২-০ গোলে পরিণত করেছিল দলের লেফট-হাফ ডি লেনয় মেইয়ার। পরদিনই অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি পেশাওয়ার জোনের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে হল্যান্ড টিম। ডাচ দলের অলিম্পিয়ান ডিউট গোল করে দলকে এগিয়ে নিলেও তা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। পেশাওয়ার দলের (আর্মি টিমের) বোগদাদি গোল করে দলকে ১-১ গোলের ড্র এনে দেয়। শক্তিশালী হল্যান্ড টিম রাওয়ালপিন্ডি জোনের সাথেও গোলশূন্য ড্র করে শেষ করেছিল পাকিস্তানে তাদের জোনাল ম্যাচ পর্ব।
১ম টেস্ট ম্যাচের জন্য খালেদ মাহমুদকে ক্যাপ্টেন করে পাকিস্তান জাতীয় টিম ঘোষণা করা হয়েছিল।
গোলরক্ষক- সালাহউদ্দিন, ফুলব্যাক-রিয়াজউদ্দিন এবং তারিক আজিজ, হাফব্যাক-রশিদ, সাইদ আনোয়ার এবং গুলরেজ, ফরোয়ার্ড-খালেদ মাহমুদ, খুরশীদ আজম, তারিক নিয়াজী, লাইক এবং জাহাঙ্গীর বাট, ম্যানেজার-মেজর হামিদ।
৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৭ লাহোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান জাতীয় হকি টিম বনাম হল্যান্ড জাতীয় হকি টিমের মধ্যে ১ম টেস্ট ম্যাচ। দু’দলই নিম্নমানের খেলা প্রদর্শন করে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। পাকিস্তানের সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজি ডি’র কাছে রাইট ইন খুরশীদকে পাস দিলে সে নিয়াজিকে ডি’র ভেতর রিটার্ন পাস দেয়Ñ যা নিয়াজি সজোরে পোস্টে হিট করে কিন্তু হল্যান্ডের গোলরক্ষক প্যাড করে কিয়ার করলে বল কাছে দাঁড়ানো লেফট ইন লাইকের কাছে চলে যায়। লাইক পুষ করে বল জালে জড়িয়ে দেয়। গোল খেয়ে হল্যান্ড দল গোল শোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড সুইটস পাকিস্তানের ডি’র ভেতর সুযোগটা পেয়ে যায়। সে ফিক করে পোস্টের বাম কোণ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিয়ে খেলায় সমতা আনে এবং খেলা শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র থাকে।
ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচের জন্য পাকিস্তান দলের সেন্টার হাফ সাঈদ আনোয়ারকে ক্যাপ্টেন করে টিম ঘোষণা হয়। গোলরক্ষক-সালাহউদ্দিন, ফুলব্যাক-রিয়াজউদ্দিন এবং তানভীর দার, হাফব্যাক-রশিদ, সাঈদ আনোয়ার এবং আখতার, ফরোয়ার্ড-বশীর আহমেদ, খুরশীদ আজম, তারিক নিয়াজী, লাইক এবং সাব্বির মালিক।
৫ ফেব্রুয়ারি ’৬৭ ঢাকা স্টেডিয়ামে ২য় হকি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক সফরকারী হল্যান্ড দলের কাছে আবারও প্রমাণ করেছিল যে, তারা খেলাকে কত ভালবাসে। পাকিস্তান ৩-১ গোলে জয়লাভ করে তিন টেস্ট ম্যাচের সিরিজের এক ম্যাচে এগিয়ে গিয়েছিল। হল্যান্ড পাকিস্তান সফরের পূর্বে ভারতের দুটো টেস্ট ম্যাচ ড্র করে এসেছিল। খেলার ১৫ মিনিটের মধ্যেই খেলা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমাদের দৃষ্টিনন্দন স্টিক ওয়ার্ক, ছোট ছোট পাস এবং দলগত সমঝোতা স্টেডিয়ামে উপস্থিত পঁচিশ হাজার দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। হল্যান্ড টিমের ক্যাপ্টেন ফোক্কার এবং রাইট ফুলব্যাক টেরলিংজেন আমাদের ফরোয়ার্ডদের কড়া পাহারায় রেখেছিল, যার জন্য গোল করার সুযোগ তৈরি করতে পারছিলাম না। অন্যদিকে হল্যান্ড টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফ্রাংক জিওয়েটস এবং লেফট-ইন হুপ্ট দ্রুতগতির খেলোয়াড় এবং চমৎকার বল কন্ট্রোল। দুজনের মধ্যে ভাল সমঝোতা আমাদের ডিফেন্সকে সব সময় ব্যস্ত করে রেখেছিল। আমাদের ফুল ব্যাক তানভীর দার তার নির্ভুল এন্টিসিপেশন দ্বারা বিপক্ষ দলের আক্রমণগুলো ব্যর্থ করতে সমর্থ হচ্ছিল। নিঃসন্দেহে সে মাঠের সেরা খেলোয়াড় ছিল সেদিন। আমাদের অপর ফুল ব্যাক রিয়াজউদ্দিনের সাথে তার চমৎকার বোঝাপড়া ছিল, যার জন্য হল্যান্ডের আক্রমণগুলো সফলতা পায়নি। আমাদের (ক্যাপ্টন) সেন্টার হাফ অলিম্পিয়ান সাঈদ আনোয়ার বিশ্বমানের খেলা প্রদর্শন করতে পারেনি। তবে টিমের সাথে মানানসই খেলাই খেলেছে। তার সহযোগী দুই হাফ চোখে পড়ার মত খেলা খেলেনি। আমি নিজেও আশানুরূপ খেলতে পারিনি। কিছুটা নার্ভাস ছিলাম; কারণ অনুশীলনে ঘাটতি ছিল। ঢাকা লীগ শুরু হয়েছিল অথচ আমার টিম এন্ট্রি না করায় খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলাম। দ্বিতীয়ত জাতীয় কোচিং ক্যাম্পে মাত্র ১০ দিনের অনুশীলনে টিমের সাথে কম্বিনেশন গড়ে তোলার সুযোগ পাওয়া যায়নি। আমাদের লেফট উইংগার সাবির মালিকও ভাল খেলতে পারেনি। টিমের সাথে কিছুদিন অনুশীলন করতে পারলে নিশ্চিত করে ভালো খেলা যেত। আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজী অনবদ্য খেলেছে। দুুই ইন খুরশীদ ও লাইক তাদের মত করে খেলেছে। তবে এই ট্রায়ো সব সময়ই হল্যান্ডের জন্য বিপজ্জনক ছিল। আমাদের গোলরক্ষক সালাহউদ্দিনকে তার দায়িত্ব পালনে আস্থার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। বল কিয়ারিং নিখুঁত ছিল না।
৩-১৫ মি. খেলা আরম্ভ হয়। ৯ মিনিটে তারিক নিয়াজি তার স্টিকের চমক দেখিয়ে হল্যান্ডের ডিফেন্স ভেদ করে লেফট-ইন লাইককে দিলে তার দুর্বল হিট গোলরক্ষক সহজেই ফিরিয়ে দেয়। এরপরই হল্যান্ড টিম একটি লং কর্নার লাভ করে এবং সেটাই পেনাল্টি কর্নার হয় আর সেটা থেকেই হল্যান্ডের আম্পায়ারের পেনাল্টি স্ট্রোক সিদ্ধান্ত সবাইকে অবাক করে দেয়। ডাচ দলের রাইট ফুলব্যাক টেরলিংজেন সালাহউদ্দিনকে পরাস্থ করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। ১৫ মিনিটের সময় আমরা পেনাল্টি কর্নার লাভ করলে আমাদের ফুলব্যাক রিয়াজউদ্দিনের হিট বাইরে চলে যায়। আমরা একটা সুযোগ হারাই। এর এক মিনিট পরই আমাদের রাইট ইন খুরশীদ একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে চমৎকার পুশ দ্বারা গোল করে খেলায় সমতা আনে। তারপর থেকে আমাদের টিম যেন জেগে ওঠে। বিপক্ষ দলের ওপর আমাদের হামলা জোরদার হয়ে যায় কিন্তু হল্যান্ডের ক্যাপ্টন ফোক্কর এবং টেরলিংজেন দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে যায়। ডি’র ভেতর হল্যান্ডের ফুল ব্যাক আমাদের খেলোয়াড়কে ফাউল করলে আমরা পেনাল্টি স্ট্রোক লাভ করি, যা তারিক নিয়াজি সফলতার সাথে গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। আরও গোল করার জন্য আমাদের আক্রমণভাগ তৎপর হয়ে ওঠে কিন্তু ডাচ দলের টেরলিংজেন এবং সেবোইবেন্স সতর্কতার সাথে আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। উল্টো তারা সমতা আনার জন্য আমাদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে এবং সুযোগও পেয়ে যায়। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড জিউটেস অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বল নিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে পড়ে এবং সজোরে পোস্টে হিট চালায় কিন্তু আমাদের গোলরক্ষক খুবই চমৎকারভাবে সেভ করলে আমরা গোল খাওয়া থেকে বেঁচে যাই। বিরতির পর আমাদের টিম নতুন উদ্যম নিয়ে মাঠে নামে। আমরা আমাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখে গোল বাড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম কিন্তু শক্তিশালী হল্যান্ড ডিফেন্স ভেদ করা সহজ হচ্ছিল না। খেলা যখন এমনি এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন এক পর্যায়ে ডি’র ভেতর লাইক বল পেয়ে জোরে গোল পোস্টে পুশ করে ডাচ গোলরক্ষক জুটস বক্স সেভ করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। ৩-১ গোলের ফলাফল খেলার শেষ পর্যন্ত অুন্ন ছিল। আমরা দ্বিতীয় হকি টেস্ট ম্যাচ ৩-১ গোলে জয়লাভ করে তিন ম্যাচ সিরিজের ১-০তে এগিয়ে থাকি।
হল্যান্ড টিমে যারা খেলেছিল : গোলরক্ষক-অর্টব্রেডোর রোডি, ফুলব্যাক- থিও টেরলিং জেন এবং সেবো এবেন্স, হাফব্যাক-আরিফ-ডি-কাইজার, জন পিট ফক্কোর (ক্যাপ্টেন) এবং জন এল ফেরস, ফরোয়ার্ড-থিও ভ্যান ভ্যারুন হবেন, অটো টের হার, ফ্রাংক জি উরটস, ফ্রান্সিস, ভেন্ট হু কটস এবং আর এইচবিডি ল্যানয় মেইজার।
আম্পায়ারদ্বয় : এ এফপি ল্যাথওয়ার (হল্যান্ড) এবং শাহ আবরার আহমেদ (পাকিস্তান)।
৭ ফেব্রুয়ারি করাচিতে ফাইনাল হকি টেস্টে পাকিস্তান হল্যান্ডকে ২-০ গোলে পরাজিত করে সিরিজ জয় করেছিল। করাচি টেস্টে আমার পজিশনে ইসলাহউদ্দিন খেলেছিল। সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজী এবং লেফট-ইন লাইক খেলার দ্বিতীয়ার্ধে দুটো গোল করে দলকে জিতিয়ে ছিল হল্যান্ড দল তাদের ১৪ দিনের পাকিস্তান সফর শেষ করে ৮ ফেব্রুয়ারি ’৬৭ নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। #
(ক্রমশ.)
জুন-১৬
(ছিয়াত্তর)
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ঢাকা, হকি টিম শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালের হকি লীগ খেলার অনুমতি পেয়েছিল। ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট তাদের হকি টিম এন্ট্রি করার অনুমতি দিলেও লীগ কমিটির অনুমতি পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের বাধা এবং বিভিন্ন মহলের সমালোচনা, সময়মত ব্যাংক দলের এন্ট্রি না করা, এতদিনে প্রত্যেক দল ৩/৪টি করে ম্যাচ খেলে ফেলেছিল। দুবার ফিকশ্চার করা হয়েছে। সে অনুযায়ী খেলা এগিয়ে চলেছে। এ মুহূর্তে ব্যাংক টিমকে এন্ট্রি দিলে ফিকশ্চার পরিবর্তন করে নতুন ফিকশ্চার করা, টিমগুলোকে ঘন ঘন ম্যাচ খেলতে হবেÑ নানান সমস্যার কথা উঠেছিল। কিন্তু ইপিএসএফ কর্তৃপক্ষ হকি খেলার বৃহত্তর স্বার্থে গত দু’বছরের অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন টিমকে লীগ খেলায় অনুমতি প্রদান করলে আমরা পুরো উদ্যম নিয়ে মাঠে নেমে পড়ি। সে সময় ছয়টি টিম অপরাজিত ছিল, ওয়ারী কাব, কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, পিই রেলওয়ে, ইস্পাহানী স্পোর্টিং, মোহামেডান স্পোর্টিং এবং মাহুৎটুলী স্পোর্টিং কাব আর আজাদ, ইস্টবেঙ্গল, এয়ারফোর্স, ওয়ান্ডারার্স এবং ফায়ার সার্ভিস তখনও কোন পয়েন্ট পায়নি।
বিশেষ কার্যক্রমের জন্য স্টেডিয়ামের সব খেলা ১৩-২৩ জানুয়ারি স্থগিত করা হয়েছিল এবং হকি লীগ পুনরায় শুরু হয় ২৪ জানুয়ারি থেকে। সেদিন চারটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যাংক (মৌসুমের) লীগের প্রথম খেলা খেলেছিল ফায়ার সার্ভিস টিমের সাথে স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড-১, ২-১৫ মিনিটে। ব্যাংক দল ভাল খেলে ৩-০ গোলে জয় জয়লাভ করেছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক হকি টিমের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি খেলায় আমি অংশগ্রহণ করেছি। এই প্রথম ব্যাংক হকি দল আমাকে ছাড়া ম্যাচ খেলেছে; কারণ সেসময় আমি লাহোরে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ক্যাম্পে ছিলাম। ব্যাংক দলের লেফট ইন মীর, রাইট আউট আব্দুল হক এবং এহতেশাম গোল করেছিল।
ব্যাংক দলের খেলোয়াড় : রঞ্জিত দাস (গোলরক্ষক), সাবের আলী ও ইকবাল, এহতেশাম, মাহমুদ এবং আনোয়ার, আব্দুল হক, মিলুু, ফরিদ, মীর এবং মুন্নি।
ব্যাংক টিম যখন ফায়ারের সাথে খেলছিল পাশের মাঠে অর্থাৎ স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড নং-২-এ, তখন মাহুৎটুলী এবং মোহামেডান স্পোর্টিং-এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল। খেলার প্রায় ২২ মিনিটে মাহুৎটুলীর গোলরক্ষক আরফিনের সামান্য ভুলের জন্য মোহামেডানের জিয়া জয়সূচক গোল করেছিল যা শক্তিশালী মাহুৎটুলী টিম সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও শোধ দিতে পারেনি। সালাম ভাইয়ের চমৎকার এন্টিসিপেশন আর দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা মাহুৎটুলীর আক্রমণগুলোকে সফল হতে দেয়নি। পুরো মোহামেডান টিমকে তিনি ভাল খেলার জন্য সাহস জুগিয়েছিলেন। তাছাড়াও জাম্বু চমৎকারভাবে গোলপোস্ট সামলে রেখেছিল। বিরতির পর মাহুৎটুলীর একটি হিট জাম্বুর প্যাডে লেগে গোললাইন ক্রস করেছে বলে জোর দাবিকে আম্পায়ার ঈশা খান ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে নাকচ করে দিলে মাঠে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরও মাহুৎটুলী একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে গেছে কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায়তা করেনি। দিনের (২৪-১-৬৭) অপর দুটো ম্যাচ হয়েছিল স্টেডিয়ামের পাশাপাশি দুটো গ্রাউন্ডে বেলা ৩-১৫ মিনিটে। ১নং গ্রাউন্ডে কম্বাইন্ড এবং পুলিশের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল আর ২নং গ্রাউন্ডে পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং আজাদ স্পোর্টিং-এর মধ্যে চলছিল নিম্নমানের হকির প্রদর্শনী। প্রথমার্ধে কম্বাইন্ড-পুলিশ আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চালিয়েও কেউ কারও বশ্যতা স্বীকার করেনি। তবে এ অর্ধে পুলিশের খেলা দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বিরতির পর কম্বাইন্ডের রাইট আউট সিকান্দার একটি গোল করলে দলের ভেতর প্রাণের সঞ্চার হয় এবং এরপরই একটি ফ্রি হিট আয়ত্তে এনে প্রতাপ দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করলে টিম ভারমুক্ত হয়। পুলিশ টিম পুরো উদ্যমের সাথে গোল শোধ করার জন্য খেলতে থাকে এবং তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড নাজির একটি গোল শোধ দিয়ে টিমকে চাঙ্গা করে তোলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলের ফলাফল নিয়েই তাদেরকে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। ২নং গ্রাউন্ডের খেলার ফলাফল ছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং ৪-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে পরাজিত করেছিল, যার দুটি গোল করেছিলেন নাসির, মাশফিক ও বুলবুল করেছিল একটি করে। নাসির একজন ভাল হকি খেলোয়াড়। নম্র-ভদ্র মানুষ হিসেবে পাকিস্তান মাঠ (বর্তমানে বাংলাদেশ মাঠ) এলাকায় তার সুনাম ছিল। হকি অঙ্গনে তাকে সবাই সমীহ করতো আর আমি তাকে বড় ভাইয়ের মত সম্মান করতাম; কারণ আমার বড় ভাইয়ের নামও ছিল নাসির আহমেদ। আজ দুজনেই আমাদের মাঝে নেই।
২৫ জানুয়ারি রেল দলের জন্য একটি অশুভ দিন। তারা ওয়ারী কাবের কাছে ১-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল সেদিন। সত্যিকার অর্থে মামলির স্টিক ওয়ার্কের কাছে তারা হেরেছিল। হাফ টাইমের আগেই সে ২ গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। রেল দলের হারার মূল কারণ ছিল তাদের গোলরক্ষক নবী বক্স এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড হাজী বারীর বাজে পারফরমেন্স। অন্যদিকে ওয়ারীর প্রায় সব খেলোয়াড়ই ভাল খেলেছে, বিশেষ করে তাদের লেফট ইন মামলি এবং রাইট ইন শহীদ অত্যন্ত ভাল খেলেছিল। তাদের দুজনের বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। তাদের সম্মিলিত আক্রমণ রেল দলকে সব সময় চাপের মধ্যে রেখেছিল। রেল দলের কলিমের অনবদ্য খেলা রেল দলকে আরো বেশি গোল খাওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। সে ছিল রেল দলের মেরুদন্ড। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময় মামলি একক প্রচেষ্টায় রেল দলের ডি’তে ঢুকে পড়ে। পোস্টে সজোরে হিট করে কিন্তু নবী প্যাড করে কিয়ার করার চেষ্টা করে। বল আবারও মামলির কাছে চলে যায়। দ্বিতীয়বার সে বল হিট না করে পুষ করে বল জালে জড়িয়ে দেয় (১-০)। গোল শোধ করার জন্য রেল দল চেষ্টা চালাতে থাকে, সুযোগও তৈরি করে নেয় কিন্তু তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হাজী বারী বেশক’টি সহজ সুযোগ নষ্ট করে। মামলি তার দ্বিতীয় গোল করে দলকে ২-০তে এগিয়ে নেয়। বিরতির পর রেল দল আক্রমণ করে খেলতে থাকে এবং একটি শট-কর্নার লাভ করে কিন্তু সেটার সুফল লাভ করতে পারেনি। রেলের আক্রমণের একপর্যায়ে তাদের মোস্তাক ওয়ারীর ফুলব্যাক মোমতাজকে ডজ দিয়ে ডি’র ভেতর ঢুকে গোলপোস্টে পুষ করলে গোলরক্ষক ‘বিটেন’ হলেও গোললাইনের ওপর থেকে ওয়ারীর অপর ব্যাক শেরা গোল বাঁচিয়ে বল কিয়ার করতে গিয়ে আবারও বল রেলের জামাল খানের কাছে চলে যায়। বল ধরে জামাল খান নাটকটি শেষ করে গোলের মাধ্যমে (২-১)। খেলা জমে ওঠে। খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায়, গতিও বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড শরীফ গোল করে ওয়ারীকে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে দেয়।
ওয়ারীর হয়ে যারা খেলেছিল : ফ্রান্সিস পালমার (গোলরক্ষক), মোমতাজ এবং এএম শেরা, কামাল হায়দার, মোমিন এবং হায়াত, নাওয়াজিশ, নিয়াজ খান, শহীদ, মামলি এবং শফিক।
রেল দল : নবী বক্স (গোলরক্ষক), ইদ্রিস খান এবং আকবর, খোরশেদ আলম খান, কালিম এবং আবিদ খান, এইচ জামান খান, খাজা ডাব্লিউ খান, হাজী বারি, নিয়াজ আহমেদ এবং আইয়ুব খান।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের (২৫-১-৬৭) অপর খেলায় মাহুতটুলী শক্তিশালী ন্যাশনাল ব্যাংক টিমকে গোলশূন্য ড্র রাখতে বাধ্য করেছিল। ব্যাংক দল অনেকগুলো সহজ সুযোগ নষ্ট করেছিল, বিশেষ করে মীর এবং আবদুল হক যে দুটো গোল মিস করেÑ তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। মাহুৎটুলী টিমের আক্রমণ সেরকম জোরালো না হলেও তাদের রক্ষণভাগ ছিল খুবই সুদৃঢ়, যার দরুন ব্যাংক টিমকে জয় ছাড়াই মাঠ ছাড়তে হয়েছিল।
২৬ জানুয়ারি ইস্পাহানী তাদের ফুলব্যাক শফিকের পেনাল্টি কর্নারে করা একমাত্র গোলে মোহামেডানকে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ইস্পাহানীর কৃতী খেলোয়াড়, সর্বোচ্চ গোলদাতা ইসলাহউদ্দিন পাকিস্তান জাতীয় হকি ক্যাম্পে থাকায় খেলায় অংশ নিতে পারেনি। বিরতির পূর্বেই ইস্পাহানী মোহামেডানের কাছ থেকে ৭টি পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নেয়, যার একটিতে মাত্র ফল পেয়েছিল। বিরতির পর মোহামেডান গোল শোধ দেয়ার চেষ্টা চালায়, বিশেষ করে তাদের আক্রমণভাগে জিয়া এবং লেফট-ইন বেগ সারাক্ষণ ইস্পাহানীর রক্ষণভাগকে চাপের মধ্যে রেখেছিল। কিন্তু ইস্পাহানীর অভিজ্ঞ রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা তা ভালভাবেই প্রতিহত করতে পেরেছিল বলে মোহামেডান শেষ পর্যন্ত ১ গোলের হারটাকে মেনে নিয়েছিল।
ইস্পাহানী-মোহামেডানের খেলায় যার খেলা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তিনি সালাম ভাই। মোহামেডানের রক্ষণভাগে যিনি প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ইস্পাহানীর শক্তিশালী আক্রমণ তাকে ভেঙ্গে গোল করতে সক্ষম হয়নি। লিখতে বসে সালাম ভাইয়ের কথা খুব করে মনে পড়ছে। তার অনুপ্রেরণাতেই এবং তার সহযোগিতায় আমরা কিছু ক্রিকেট-হকি খেলোয়াড় আরমানিটোলা গভ. হাইস্কুলের মাঠের বাইরে এসে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন একজন খেলোয়াড়, যার ভেতর ছিল খেলোয়াড়দের মাঠে নেয়ার সম্মোহনী শক্তি। ইয়ং খেলোয়াড়দের প্রায় সময়ই দেখা যেত সালাম ভাইকে ঘিরে থাকতে এবং তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াতে। সালাম ভাইয়ের জীবনটাও শেষ হয়েছিল ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ইয়ং খেলোয়াড়দের মাঝে, খেলার মাঠে।
মোহামেডান কাবের খেলোয়াড়রা : জাম্বু (গোলরক্ষক), সালাম এবং ফালু, পারভী, সাবের এবং সেলিম, সালিমউল্লাহ, জগলু জিয়া, বেগ এবং আলমগীর।
২৬-১-৬৭ তারিখের অপর খেলায় পরপর চারবার বিপক্ষ দলের গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে হ্যাটট্রিক অর্জনকারীদের দলে নাম লেখিয়েছিল রেল দলের কৃতী লেফট ইন নিয়াজ আহমেদ খান। বাকি গোলদাতাদের মধ্যে হাজী বারী যে ওয়ারীর বিরুদ্ধে সহজ গোল মিস করেছিল, সেই হাজী বারি দু’গোল করেছিল আর অপর গোলটি করেছিল রাইট আউট নুরুল্লাহ। সে সুবাদে ফায়ার সার্ভিস ০-৬ গোলের বড় পরাজয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল।
সেদিনের (২৬-১-৬৭) অপর দুটো খেলা বিমানবাহিনী এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাব নিজ নিজ খেলায় প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল। বিমানবাহিনী ২-০ গোলে ইস্টবেঙ্গল কাবকে হারিয়েছিল আর ঢাকা ওয়ান্ডারার্সও প্রথম জয় পেয়েছিল ১-০ গোলে আজাদের বিরুদ্ধে। বিমানবাহিনীর পারভী এবং আমান উল্লাহ গোল করেছিল আর ওয়ান্ডারার্সের গোল করেছিল শামসান।
২৭-১-৬৭ তারিখের দিনটি ছিল হকি লীগের ড্র করার দিন। ভিক্টোরিয়া এবং বিমানবাহিনী ড্র করেছিল ১-১ গোলে। রাজ্জাক গোল করেছিল ভিক্টোরিয়ার পক্ষে আর নিয়াজী গোল শোধ দিয়েছিল বিমানবাহিনীর হয়ে। সেদিনের অপর খেলাটিও গোলশূন্য ড্র করেছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং পুলিশ টিম।
(ক্রমশ.)
১ জুলাই
(সাতাত্তর)
ন্যাশনাল ব্যাংক আরও একটি পয়েন্ট খুইয়েছিল ওয়ারীর সাথে গোলশূন্য ড্র করে আর ওয়ারীর ছিল এটি প্রথম পয়েন্ট হারানো। গত মৌসুমের অপরাজিত লীগ চ্যাম্পিয়ন ব্যাংক এবং যুগ্ম রানার্সআপ ওয়ারী পয়েন্ট হারালেও গতবারের অন্য এক যুগ্ম রানার্সআপ দল কম্বাইন্ড তখনও লীগে অপরাজিত ছিল। ইস্পাহানী তখনও কোন পয়েন্ট হারায়নি। বহু দর্শক মাঠে এসেছিল একটি ভাল হকি খেলা দেখার জন্য কিন্তু তারা হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন উদ্দেশ্যহীন হিটিং আর এলোমেলো খেলা দেখে। অনেকটা ফায়ার সার্ভিস, আজাদ, ইস্টবেঙ্গল দলের খেলার মতোই। মনে হচ্ছিল দু’টিমের হিটিং প্র্যাকটিস চলছিল, চার কোণে লম্বা লম্বা হিট যেন সময়টা কাটানো। এর মধ্যে ওয়ারী কিছুটা খেলার চেষ্টা করেছিল। এমনিভাবে তারা কাটিয়ে দিয়েছিল খেলার অর্ধেক সময়। বিরতির পর দু’টিমই যেন জেগে ওঠে। খেলায় গতি বৃদ্ধি পায়, টিমের মধ্যে বোঝাপড়াটাও ভাল হয়। যার জন্য দু’টিই আক্রমণ করে খেলে, গোল করার চেষ্টা করে, খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। ফলে খেলাটা জমে ওঠে। খেলা সেরকম উঁচুমানের না হলেও কিছু সময়ের জন্য দর্শকরা খেলাটা উপভোগ করেছিলেন। ব্যাস, ঐ পর্যন্ত। গোলের মুখ কেউ দেখতে পায়নি।
সেদিনের ২৮-১-৬৭ অপর খেলায় ফায়ার সার্ভিসকে আরও একটি হার হজম করতে হয়েছিল পিডব্লিউডি টিমের কাছে। ২-৩ গোলের হারটি ছিল তাদের জন্য কষ্টের। বিরতি পর্যন্ত তারা ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড সাবের এবং লেফট ব্যাক রশীদ গোল করে ২-০ লিড এনে দিয়েছিল। পিডব্লিউডি দলের রাইট ইন গোল করে ব্যবধান কমিয়ে ১-২ গোলে পিছিয়েছিল। বিরতির পর খেলার ধারাটাই বদলে যায় আর পিডব্লিউডি দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড মকবুল আর রাইট আউট জাফর দু’গোল করে দলকে জয় এনে দিয়েছিল (৩-২)।
ইস্পাহানী টিমের হকি লীগে প্রথম পয়েন্ট হারানো। রেল দলের সাথে তারা গোলশূন্য ড্র করেছিল। জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় রেল দল তুলনামূলকভাবে ভাল খেলেছিল। প্রথমার্ধে ইস্পাহানী নিজেদের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকায় রেল দল চড়াও হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিল।। রেল দলের সেদিনের মূল নায়ক ছিল নিয়াজ এবং কলিম। তাদের ুরধার আক্রমণ ইস্পাহানীকে কয়েকবার বেকায়দায় ফেলে দিলেও সেন্টার ফরোয়ার্ড হাজী বারী স্লো হওয়ায় আক্রমণগুলো সফলতা পায়নি। বিরতির পর ইস্পাহানী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তাদের লেফট-ইন আজিম রেল দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ার্ধে রেল দল কিছুটা রক্ষণাত্মক খেলার প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল। এর ফলে ইস্পাহানী মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের পক্ষে নিয়ে রেলের ওপর চড়াও হয়ে আক্রমণের ঝড় তুলে দেয় কিন্তু তারাও সফল হতে পারেনি। ১ পয়েন্ট করে নিয়ে দু’টিমকে মাঠ ছাড়তে হয়েছে।
দিনের (২৯-১-৬৭) অপর খেলায় শক্তিশালী মাহুৎটুলী টিমকে পুলিশ ২-১ গোলে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। পুলিশ টিমের রাইট আউট আকবর এবং রাইট হাফ রফিক একটি করে গোল করলে মাহুৎটুলী আরফিন একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল।
৩০ জানুয়ারি ওয়ারী কাবের সেন্টার হাফ মাহমুদুর রহমানের (মোমিন) পেনাল্টি পুশে দেয়া একমাত্র গোলে পিডব্লিউ পরাজিত হয়েছিল। এখানে মমিন ভাই সম্বন্ধে মজার ব্যাপার বলতে চাই। তিনি যে টিমেই খেলতেন, টিমের পক্ষে পাওয়া ফ্রি হিট কাউকে মারতে দিতেন না, মাঠে যে কোন স্থানেই হোক, দৌড়ে যাবেন। কেউ যদি মারতে যায়, তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই হিট করবেন। শেষে এমন দাঁড়িয়ে ছিল যে, খেলার প্রয়োজনে দ্রুত হিট করতে হবে কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে হতো, আমরা এ নিয়ে হাসাহাসি করতাম। আজকে লিখতে বসে মমিন ভাইয়ের হিট মারার জন্য দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার সম্বন্ধে আর একটু বলি, তিনি ফুটবল-হকি সমান তালে ভাল খেলতেন। সেই স্কুলে থাকতে তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ানো, এক সাথে ফুটবল হকি খেলা, আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। খেলার কথায় ফিরে আসি। সেদিন ওয়ারীর কৃতী খেলোয়াড় মামলী ভাল খেলতে না পারায় আক্রমণ ছিল খুবই দুর্বল। বিরতির পর পিডব্লিউডি গোল শোধ করার জন্য জোর লাগিয়ে ছিল কিন্তু দক্ষ স্কোরারের অভাবে গোল শোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ওয়ারী সেই পেনাল্টির গোলে জয় নিয়ে কাবে ফিরেছিল।
দিনের (৩০-১-৬৭) অপর খেলায়ও রেল দলের কৃতী লেফট-ইন নিয়াজের দেয়া একমাত্র উইনিং গোলে রেলওয়ে টিম পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ৩১-১-৬৭ তারিখে পুলিশের জয় আসে ফায়ারকে ৪-০ গোলে হারিয়ে। ফায়ার সার্ভিস টিম সে সময় পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচের সবগুলোই হেরে ছিল। পুলিশের আখতার ২ গোল, আর মোহাম্মদ আলী এবং গাফফার ১টি করে গোল করেছিল। দিনের অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলের অঘটন ঘটিয়েছিল শক্তিশালী মাহুৎটুলী টিমকে হারিয়ে। ভিক্টোরিয়ার লেফট-ইন আজিজ এবং লেফট আউট হোসেন ১টি করে গোল করেছিল।
১৯৬২ সালের ইপিএসএফ-এর গঠনতন্ত্রের ২৫ ধারার বলে সভাপতি এসবি চৌধুরী (ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার), ১৯ অক্টোবর, ১৯৬৬ তারিখে নির্বাচিত ইপিএসএফ-এর সাধারণ এবং গভর্নিং বডি ভেঙ্গে ২৫ জনের একটি এডভাইজারি কমিটি গঠন করেছিলেন যারা ফেডারেশনের দৈনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করতেন। কিন্তু গঠনতন্ত্র মোতাবেক ৮৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে গভর্নিং বডি গঠন করতে হবে বিধায় সভাপতি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিটি গঠন করেছিলেন। এ হাসান অতিরিক্ত কমিশনারকে (ঢাকা বিভাগ) চেয়ারম্যান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন। এ রউফ চৌধুরী, ডেপুটি সেক্রেটারি (এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট), এএনএম মোমতাজ উদ্দিন চৌধুরী, ডেপুটি ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন, ঢাকা বিভাগ এবং আজহারউদ্দিন খান, সহকারী চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং ইপিএসএফএর সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (ডেভেলমেন্ট) ঢাকাকে মেম্বার সেক্রেটারি হিসেবে কমিটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন দেশের ৯৬ জন সাধারণ কাউন্সিলর দ্বারা নির্বাচিত গভর্নিং বডি গঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ঢাকা সিটি থেকে ২৩ জন কাউন্সিলর এবং বাকি কাউন্সিলররা দেশের বিভিন্ন জেলা, ডিভিশন থেকে মনোনীত/নির্বাচিত হয়ে আসতেন। ঢাকা সিটির ২৩ জন কাউন্সিলর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং ইপিএসএফ-এর দায়িত্ব পালনকালে তারা মুখ্য ভূমিকা রাখেন বিধায় ঢাকা সিটির কাউন্সিলররা একটি আলাদা গুরত্ব/মর্যাদা বহন করে থাকে। ঢাকা সিটির ১০৮টি কাব, এই ২৩ জন কাউন্সিলর নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ইপিএসএফ-এর গভর্নিং বডি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন।
ঢাকা সিটির ২৩ জন কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য দুটি ক্রীড়া সংগঠন দি ইউনাইটেড স্পোর্টসম্যান কাউন্সিল এবং স্পোর্টস প্রমোটার্স ফ্রন্ট দুটি প্যানেলের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেছিল। ২৩ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আবব্দুল হক (বক্সিং থেকে), আব্দুল মালেক (কুস্তি থেকে), এসএ মান্নান (জিমন্যাস্টিক থেকে) এবং হাকিম (রাইফেল শুটিং থেকে)। পরবর্তীতে ১৯ জন কাউন্সিলরকে ১০২ জন ভোটার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন। নির্বাচিত কাউন্সিলররা হলেন :
ক্রিকেট থেকে কাউন্সিলর
১। রাইসউদ্দিন আহমেদ (২১টি ভোট পেয়েছিলেন), গেন্ডারিয়া কাবের প্রতিনিধি
২। এ রেজা (২১ ভোট) ভিক্টোরিয়া কাব
৩। এবিএম মুসা (২১ ভোট), ইপিজি প্রেস
৪। সফিউদ্দিন আহমেদ (২০ ভোট), ব্রাদার্স ইউনিয়ন
৫। আনিসুর রহমান (২০ ভোট), আজাদ স্পোর্টিং
৬। মোজাফফর হোসেন পল্টু (১৯ ভোট), শান্তিনগর ক্রিকেট কাব
হকি থেকে কাউন্সিলর
১। আলমগীর মোহাম্মদ আদেল (১০ ভোট), মাহুৎটুলী এসসি
২। দাবীর উদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকী (৯ ভোট), কম্বাইন্ড স্পোর্টিং
৩। সাদেক আলী মির্জা (৮ ভোট), ইস্পাহানী
৪। সাহিদুর রহমান (৭ ভোট), ভিক্টোরিয়া
ফুটবল থেকে কাউন্সিলর
১। সিরাজুল ইসলাম (২২ ভোট), নবারুণ সংসদ
২। নাসিরুদ্দিন আহমেদ (২২ ভোট), আজাদ বয়েজ
৩। জহিরুল হক (২১ ভোট), দয়াগঞ্জ স্পোর্টিং কাব
৪। এ আউয়াল (২১ ভোট), রহমতগঞ্জ এমএফএস
৫। এসএ জামান (১৯ ভোট), আজাদ স্পোর্টিং কাব
ভলিবল এবং ব্যাডমিন্টন থেকে কাউন্সিলর
১। আশরাফউদ্দিন খন্দকার (১২ ভোট), বাসাবো টিএস
২। এসএম খালেক (৪ ভোট), ইস্টএন্ড কাব
বাস্কেটবল থেকে কাউন্সিলর
১। আলম (৫ ভোট), ইগলেটস সিসি
সুইমিং থেকে কাউন্সিলর
১। নূর হোসেন (৪ ভোট) টাউন কাব
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ৪ জন কাউন্সিলরসহ ১৯ মোট ২৩ জন একই সংগঠন দি ইউনাইটেড স্পোর্টসম্যান কাউন্সিলের প্যানেলভুক্ত প্রতিনিধি।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান-হল্যান্ড ম্যাচ এবং ঢাকা সিটি কাবসমূহের কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য স্টেডিয়ামের সব খেলাধুলা এবং কর্মকান্ড ১-১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল।
১৫ দিন (১-১৫ ফেব্রুয়ারি) হকি লীগ বন্ধ থাকার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি পুনরায় খেলা শুরু হয়েছিল। সেদিনের প্রথম খেলা স্টেডিয়ামের ১নং গ্রাউন্ডে ফায়ার সার্ভিস সময়মত অর্থাৎ ২-৪৫ মিনিটে মাঠে উপস্থিত হতে পারেনি, এসেছিল দেরি করে; ফলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এরই মধ্যে ওয়াকওভার পেয়ে পূর্ণ পয়েন্টের মালিক বনে যায়। একই সময় পাশাপাশি মাঠে (গ্রাউন্ড নং-২) লীগের অন্যতম দুর্বল টিম ইস্ট বেঙ্গলকে আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক) ৮-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলাম। আমি এবং মিলু ৩টি করে গোল করলেও হ্যাটট্রিক করতে পারেনি। বাকি গোল দুটো করেছিল আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ। সেদিনের বিকেল ৪টার খেলাতে গোলের ছড়াছড়ি। দর্শনীয় ডবল হ্যাট্রিকসহ ৮টি গোল করেছিল ওয়ারীর কৃতী লেফট-ইন মামলি। ওয়ারী ১০-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে পরাজিত করেছিল। বাকি দুটো গোল তাজু এবং শেরার। দিনের শেষ খেলা কম্বাইন্ড এবং মোহামেডানের মধ্যে। উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় একমাত্র গোলে কম্বাইন্ড জয়ী হয়েছিল আর উইনিং গোলটি করেছিল প্রতাপ। পরদিনও কম্বাইন্ডকে ইস্ট বেঙ্গল টিমের সাথে খেলতে হয়েছিল। বিরতির পূর্বে প্রতাপ এবং সাদেক ২টি করে গোল করে ৪-০ গোলে দলকে এগিয়ে নেয়। বিরতির পর বুলবান, মহসিন, সাব্বির এবং সিকেন্দার গোল করলে কম্বাইন্ড ৮-০ গোলে জয়লাভ করে। সেদিনের অপর খেলায় ওয়ান্ডারার্স কাব মাঠে না এসে মাহুৎটুলীকে বিনা পরিশ্রমে পূর্ণ পয়েন্ট পাইয়ে দেয়।
(ক্রমশ.)
১৬ জুলাই
(আটাত্তর)
হকি লীগে পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা শক্তিশালী ইস্পাহানী ১৮ ফেব্রুয়ারি আরও একটি মূল্যবান পয়েন্ট খুইয়েছিল। পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। তুলনামূলক দুর্বল পাকিস্তান স্পোর্টিং সমান তালে লড়ে প্রথমার্ধে গোলশূন্য রেখেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই পাকিস্তান স্পোর্টিং ইস্পাহানীর ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে এবং বেশ ক’বার তাদের সীমানায় হামলা চালায়। এরই এক হামলায় ওসমান গোল করে ইস্পাহানীকে চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। গোল খেয়ে ইস্পাহানী দিশেহারা হয়ে গোল শোধ করার জন্য দলের সবাই তৎপর হয়ে ওঠে এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে আক্রমণ চালাতে এগিয়ে যায় কিন্তু পাকিস্তান স্পোর্টিং ডিফেন্স শক্ত হাতে সেগুলো প্রতিহত করে। শেষ পর্যন্ত লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ইসলাহউদ্দিন ইস্পাহানীর ত্রাণদাতা হিসেবে একটি গোল করে টিমকে হারের লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছিল। দিনের দ্বিতীয় খেলায় আমাদের ব্যাংক টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে একমাত্র গোল করে আমাদেরকে পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে সাহায্য করেছিল। সেদিনের তৃতীয় খেলায় বিমানবাহিনী পিডব্লিউডিকে ৩-২ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। সেটি ছিল বিমানবাহিনীর দ্বিতীয় জয়। তাদের মোস্তাক দুটি গোল করেছিল আর তৃতীয় গোলটি করেছিল সাত্তার এবং পিডব্লিউডি টিমের পক্ষে দুটি গোল করেছিল মেরু আর জাফর। দিনের চতুর্থ খেলায় কম্বাইন্ড পরিশ্রম ছাড়াই দু’পয়েন্ট পেয়েছিল ওয়ান্ডারার্স কাবের দেয়া ওয়াকওভারের বদৌলতে। ২০-২-৬৭ তারিখে চারটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইস্পাহানী ২-১ গোলে বিমানবাহিনীকে হারিয়েছিল। তাদের গোল করেছিল ইসলাহউদ্দিন এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার আর একটি গোল ফিরিয়ে দিয়েছিল বিমানবাহিনীর লেফট ইন। দ্বিতীয় খেলায় ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে ফায়ারকে হারিয়েছিল, যার গোল দুটো এসেছিল মনসুর এবং শুকুরের স্টিক থেকে। সেদিনের তৃতীয় খেলায় আমি হ্যাটট্রিক করেছিলাম আজাদের বিরুদ্ধে। আমরা ৮-০ গোলে জয়ী হয়েছিলাম। বাকি গোলগুলো করেছিল ফরিদ ২ গোল, আনোয়ার মিলু এবং আবদুল হক। দিনের চতুর্থ খেলাটি অঘটন দিয়ে শেষ হয়েছিল। শক্তিশালী রেল টিমকে পুলিশ ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে চমক দিয়েছিল। তাদের ফুলব্যাক আখতার এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড আকবর গোল করে এই অঘটন ঘটিয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি কম্বাইন্ড তাদের প্রথম পয়েন্ট হারিয়েছিল রেলের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। উত্তেজনায় ভরপুর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলাটি শুরু থেকে শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত একই তালে চলেছিল। দু’দলই বার বার দু’দলের সীমানায় হানা দিয়েছে কিন্তু একটি করে গোল করা ছাড়া আর বেশি কিছু করতে পারেনি। খেলার প্রায় ৩০ মিনিটে কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনু দলীয় আক্রমণের ফসল হিসেবে ‘ডি’র ভেতর একটি বল পেয়ে যায়, যা সজোরে হিট করে রেলের গোলরক্ষক নবী বকশকে পরাজিত করে দলকে ১-০ গোলে লিড এনে দেয়। বিরতির পর রেল দল একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যায় কিন্তু কম্বাইন্ডের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সেগুলো মোকাবেলা করে। কম্বাইন্ডও তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিল এবং সুযোগও পেয়েছিল কিন্তু ফিনিশিং-এর অভাবে গোলের সংখ্যা বাড়াতে পারেনি। খেলা প্রায় শেষের দিকে। রেলের সেন্টার ফরোয়ার্ড মোস্তাক বল আয়ত্তে নিতে ছুটে যায়। সে সময় কম্বাইন্ডের গোলরক্ষক সাদেক (বড়)ও তাকে বাধা দিতে ছুটে যায় কিন্তু মোস্তাকের গতি বেশি থাকায় সে দৌড়ের ওপর গোলপোস্টের দিকে হিট চালিয়ে দিলে সেখানে ফাঁকায় দাঁড়ানো রেলের লেফট-ইন নিয়াজ বল ধরে যা করার তা সফলতার সাথে সম্পন্ন করে এবং ফাও একটি গোল করে রেলকে নিশ্চিত হারের হাত থেকে রক্ষা করে। হকি লীগে কোন পয়েন্ট না পাওয়া ফায়ার সার্ভিসের সেদিনের খেলায়ও তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা হেরেছে ০-২ পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর সাথে। সেন্টার ফরোয়ার্ড ওসমান এবং লেফট-ইন মুনীর গোল করেছিল। দিনের অপর একটি খেলায় মাহুৎটুলী আজাদকে ৪-০ গোলে পরাজিত করেছিল। যার চার গোলের তিন গোলই করেছিল লেফট ব্যাক শামসুল বারি। অবশিষ্ট গোলটি করেছিল ফজলু।
২৩ ফেব্রুয়ারি হকি লীগের চারটি খেলার প্রথমটি ছিল ইস্পাহানী বনাম ইস্টবেঙ্গল। ফলাফল যথারীতি ০-৬ গোলে ইস্টবেঙ্গলের হার। ইস্পাহানীর পক্ষে গোল করেছিল জাফর ৩, আকবর ২ এবং আজিম ১। একই সময় পাশের গ্রাউন্ড-২তে তখন পিডব্লিউডি দলের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড মজিদ ওয়ান্ডারার্সের গোলপোস্টে এক এক করে গোল দিয়ে যাচ্ছিল এবং চমৎকার হ্যাটট্রিক করে থেমেছিল। রানার আরও একটি গোলের সুবাদে পিডব্লিউডি ৪-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। মজিদ শুধু হকি খেলোয়াড় ছিল না, সে ফুটবলেরও কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিল। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট টিমের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিল। একটি খেলার কথা মনে পড়ে। আমরা জগন্নাথ কলেজের ফুটবল টিম চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম একটি টুর্নামেন্ট খেলতে। মজিদকেও সাথে নিয়েছিলাম। কোন্ টিমের বিরুদ্ধে খেলেছিলাম মনে নেই। মনে আছে সেদিন ৫-০ গোলে আমরা হেরেছিলাম। আমাদের টিম ৫ গোল খাওয়ার মত ছিল না বা আমরা এতগুলো গোল খাওয়ার মত খেলাও খেলিনি। যারা মাঠে খেলা দেখেছেন তারাই বলেছেন। মজিদ সেদিন এতই ব্যর্থ ছিল যে, যদি সে গোলের সুযোগগুলো সফল ব্যবহার করতে পারতো, তাহলে আমরা উল্টো ৪/৫ গোলে জয় পেতাম। সুন্দর গোল, সুন্দর পাসÑ হোক সেটা নিজ টিমের কিংবা বিপক্ষ টিমের পক্ষেÑ মজিদের মুখ থেকে প্রশংসা বের হবেই। ওহ্ রোজেস, বিউটিফুল প্রভৃতি কথা খেলতে খেলতে সে বলতো। সেদিনের খেলায় আমরা গোল খেয়েছি। মজিদ বলে উঠলোÑ বিউটিফুল গোল! মজিদ আসলেই একজন ‘বিউটিফুল’ মনের মানুষ। এটাই আমার লেখার উদ্দেশ্য। এত ধীর-স্থির-শান্ত, নম্র-ভদ্র খেলোয়াড় আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। এখনও সে একইরকম ভদ্র এবং পরহেজগার জীবনযাপন করে চলেছে। ফুটবল ফেডারেশনের ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছে।
লেখায় ফিরে আসি। সেদিনের তৃতীয় খেলায় একচেটিয়া খেলেও ভাগ্যের সহায়তা বঞ্চিত বিমানবাহিনী পুলিশের কাছে ০-১ গোলের পরাজয়বরণ করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে উত্তেজিত দু’টিমের খেলোয়াড়রা হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়েছিল, হাল্কা স্টিকের ব্যবহারও হয়েছিল। খেলা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল। আম্পায়ারিং দুর্বলতার জন্য খেলায় এরকম দৃশ্য প্রায় দেখা যেত। দিনের চতুর্থ খেলায় ওয়ারী মোহামেডানকে ৫-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ওয়ারীর কৃতী লেফট-ইন মামলীর চমৎকার হ্যাটট্রিক মোহামেডানকে বড় ব্যবধানে হারাতে ভূমিকে রেখেছিল। ওয়ারীর গোলপোস্টে মোহামেডান একবারই হিট করার সুযোগ পেয়েছিল। বাকি সময় তারা ওয়ারীর আক্রমণ সামলাতেই ব্যস্ত ছিল অর্থাৎ খেলাটি একতরফাই বলা যেতে পারে। খেলা শুরু থেকেই ওয়ারীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং তারা ৮ মিনিটেই পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করে এগিয়ে যায় (১-০)। ওয়ারীর লেফট আউট শফিকের হিট গোলরক্ষক গুলখান প্যাড করে ফিরিয়ে দিলেও তা ডি-এর ভেতর দাঁড়ানো মামলীর কাছে গেলে সে পুশ করে বল জালে জড়িয়ে দেয় (২-০)। ২০ মিনিট এবং ২৩ মিনিটে মামলী পরপর আরও দুটি গোল করে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে মোহামেডানকে মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি তারা শুধু গোল রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনরকম সময় পার করাটাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যার জন্য খেলাটি খুবই নিম্নমানের এবং দর্শকদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। খেলার শেষ মুহূর্তে মামলী তার চতুর্থ গোল করেছিল। পরদিনই মোহামেডান আজাদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবধানে ২-১ গোলে জয় পেয়েছিল। বিরতি পর্যন্ত খেলা ড্র ছিল (০-০)। বিরতির পর আজাদের সফল আক্রমণে রাইট আউট শহিদুল্লাহ মোহামেডানের গোলরক্ষক জাম্বুকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে লিড এনে দিয়েছিল কিন্তু আজাদ সে লিড বেশি সময় পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। মোহামেডানের সেন্টার ফরোয়ার্ড বেগ গোল করে দলকে ১-১ গোলে সমতায় ফেরায় এবং এর কিছুক্ষণ পর লেফট আউট করিম গোল করলে মোহামেডান ২-১ গোলের লিড নিয়েই মাঠ ছেড়েছিল। সেদিনের শেষ ম্যাচে ওয়ান্ডারার্স হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা মাঠে পরিশ্রম না করেই পূর্ণ পয়েন্ট পেয়েছিলাম। ইস্পাহানী স্পোর্টিং নিঃসন্দেহে মাহুৎটুলী স্পোর্টিং-এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী টিম। তারা শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেই ২৫ ফেব্রুয়ারি মাহুৎটুলীকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল। তারা আরও অধিক গোলে জয়ী হতে পারতো কিন্তু মাহুৎটুলীর রক্ষণভাগের দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা ইস্পাহানীকে তিন গোলের মধ্যেই বেঁধে রেখেছিল। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময় ইস্পাহানীর লেফট-ইন নাঈম গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দেয়। মাহুৎটুলী গোল শোধ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হতে পারেনি। বিরতির পর খেলা ইস্পাহানীর দিকে ঝুঁকে পরে। তারা আক্রমণ শানাতে থাকে। আক্রমণের একপর্যায়ে নাঈম চমৎকারভাবে তার দ্বিতীয় গোল করে দলকে নির্ভার করে (২-০)। ইস্পাহানীর সর্বোচ্চ গোলদাতা কৃতী রাইট-ইন ইসলাহউদ্দিন না খেলাতে তাদের আক্রমণের ধার খুব শাণিত ছিল না। তারপরও তাদের সম্মিলিত আক্রমণ সামাল দেয়া ছিল মাহুৎটুলীর জন্য কঠিন। এরকমই আক্রমণে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হায়দার গোল করে দলকে ৩-০ গোল জয় নিশ্চিত করে। ভাগ্যজোরে আর খোদাপ্রদত্ত গোলে ওয়ারী ১-০ গোলে ফায়ারকে হারাতে পেরেছিল আর সেই সৌভাগ্যের গোলটি এসেছিল রাইট-আউট তাজুর স্টিক থেকে। খেলাটি ছিল সেদিনের দ্বিতীয় খেলা। সেদিনের তৃতীয় খেলায় পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড নাজিরের ২ গোল, মোহাম্মদ আলীর ১ গোল এবং মোবিনের দেয়ার ১ গোলের সুবাদে পুলিশ ৪-০ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল। দিনের চতুর্থ বা শেষ খেলা ছিল পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং বিমানবাহিনীর মধ্যে, যা ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের হকি লীগে একটি অনাকাক্সিত ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল আর সেটা ঘটেছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল ব্যাংক এবং বিমানবাহিনীর খেলায়। প্রথম থেকেই আমরা আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করি। উদ্দেশ্য, দ্রুত গোল করে দলকে ভারমুক্ত করা। বিমানবাহিনী সমানতালে আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়; ফলে খেলা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে ওঠে। খেলার মান সেরকম উন্নত না হলেও খেলায় গতি এবং গোল করার চেষ্টা খেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। খেলার ২২ মিনিটের সময় আমরা একটি পেনাল্টি স্ট্রোক লাভ করি। আমাদের রাইট হাফ এহতেশাম সেটা থেকে গোল করে। সেসময় এয়ারম্যানরা প্রতিবাদ জানায়। তারপর তারা খেলায় অংশ নেয় এবং ২৬ মিনিট পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যায়। হঠাৎ করেই তাদের কিছু অফিসার এবং সমর্থকের উস্কানিতে তারা মাঠ ছেড়ে চলে যায়, আর খেলায় ফিরে আসেনি। একটি সুশৃংখল বাহিনীর কাছে এরূপ নিয়ম ভঙ্গ করা এবং অখেলোয়াড়োচিত আচরণ মাঠে উপস্থিত সবাইকে হতাশ করেছিল।
সেদিনের দ্বিতীয় খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ওমেদের দর্শনীয় হ্যাটট্রিক আর তার হ্যাটট্রিকের সহযোগিতায় কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ওয়ান্ডারার্সকে ৬-০ গোলে হারিয়েছিল। রাইট-ইন বুলবান, লেফট-ইন ফুয়াদ এবং কৃতী সেন্টার হাফ আব্দুস সাদেক ১টি করে গোল করেছিল। দিনের তৃতীয় খেলাতেও একটি হ্যাটট্রিক হয়েছিল আর সেটি করেছিল পিডব্লিউডি টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওসমান। ওসমান পূর্ব পাকিস্তান দলেরও চৌকস সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলোয়াড় ছিল। পিডব্লিউডি ইস্টবেঙ্গলকে ৮-১ গোলে পরাজিত করেছিল। গোল করেছিল ওসমান ৪, খুরশীদ ৩, নাসের ১। আর ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ১টি গোল শোধ দিতে সক্ষম হয়েছিল। #
১ আগস্ট
(ঊনআশি)
আমার হকি ক্যারিয়ারের একটি অবিস্মরণীয় জয় এবং আমার করা স্মরণীয় দুটি গোল যা আমার স্মৃতিতে আজও জাগরুক আর সে অভূতপূর্ব ম্যাচটি ছিল ১৯৬৭ সালের ঢাকা হকি লীগে ইস্পাহানি স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে।
ইস্পাহানি সেবার খুব শক্তিশালী টিম গঠন করেছিল। করাচি থেকে ৪/৫ জন হকি খেলোয়াড় এনে টিমের শক্তিবৃদ্ধি করেছিল। তাদের ফুলব্যাক শফিক খুবই দক্ষ, নির্ভরশীল খেলোয়াড়। সে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিল। তাদের আক্রমণভাগের ইসলাহ উদ্দিনের কথা আগের পর্বে লিখেছি। লেফট-ইন এবং লেফট আউটে দুই ভাই আজিজ ও আজিম চমৎকার স্টিক ওয়ার্ক এবং দ্রুতগতির খেলোয়াড়। তাদেরই এক ভাই হানিফ খান পরবর্তীতে পাকিস্তান জাতীয় দলের লেফট-ইনের খেলোয়াড় হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তারা ঢাকায় এসে প্রথম ম্যাচেই দুর্বল ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ১৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে আকাশে উড়ছিল। পরের ম্যাচে ৫-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারিয়ে নিজেদেরকে আলাদা কিছু ভাবতে শুরু করেছিল। পরের ম্যাচেও পিডব্লিউডিকে হারিয়ে স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রতি তাদের তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে উঠেছিল এবং কথাবার্তায় অহঙ্কার ঝরে পড়তো। বলতো, ‘হার টিমকো গিন গিনকে গোল দে সাক্তা হুঁ। বাঙ্গালিকো খেল শিখা দুংগা ইত্যাদি। বিশেষ করে দুই ভাই আজিজ এবং আজিম যাদের নাম মোমিন ভাই দিয়েছিলেন পাপ্পান আর ছাপ্পান, ভীষণ বাকপটু। তাদের কথাগুলো শুনে রাগে-কষ্টে নিজে নিজেই ফুঁশতাম, জবাব দেবার সুযোগ ছিল না; কারণ সে সময় আমাদের টিম (ন্যাশনাল ব্যাংক) লীগে এন্ট্রি না করায় আমাদের খেলা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তবে মনের জ্বালাটা বেড়ে যাচ্ছিল। ভাবতাম সুযোগ পেলে বুঝিয়ে দিতাম, গুনে গুনে গোল দেয়া অত সহজ নয়। পরবর্তীতে আমাদের টিম এন্ট্রি করলেও প্রথমদিকে আমার খেলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি; কারণ তখন আমি লাহোরে পাকিস্তান হকি ক্যাম্পে ছিলাম। সে সময় ইসলাহউদ্দিনও ক্যাম্পে ছিল।
আমাদের সাথে ইস্পাহানির দেখা হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি স্টেডিয়ামের ২ নং গ্রাউন্ডে। খেলার দিন ব্যাংকে সবাইকে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। খেলার পূর্বে সহ-খেলোয়াড়দের উদ্দেশে আমার একটাই কথা ছিলÑ এ ম্যাচে আমাদের জিততে হবে। দেখাতে হবে বাঙ্গালিরাও হকি খেলতে পারে। ফখরুল আলম মাহমুদ ভাইকে বলেছিলাম, ইসলাহউদ্দিন যেন বল ধরতে না পারে, সারাক্ষণ তার সাথে সাথে থাকতে হবে, তার বল ধরার আগেই বাধা দিতে হবে, প্রয়োজনে টাফ হকি খেলতে হবে। দুই ব্যাক সাবের এবং ইকবালের প্রতি আমার নির্দেশ ছিল পাপ্পান ও ছাপ্পান যেন বেশি কেরামতি না দেখাতে পারে, শক্ত হাতে খেলতে হবে।
উষ্ণ মেজাজ আর উত্তেজনায় ভরপুর দু’টিমের খেলোয়াড়রা হার্ড হিটিং আর টাফ হকি দিয়ে খেলা শুরু করেছিল। খেলার মাত্র তিন মিনিট, আমি হাফ লাইনের কাছাকাছি একটি বল ধরে দ্রুতবেগে বিপক্ষ দলের সীমানার দিকে ছুটছি। দু’একজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ইস্পাহানির সীমানায় পৌঁছেই চোখে পড়লো সাদা চুনের দাগ। বল তখন আমার ডান দিকে, রং সাইডে। ডান পায়ের ওপর, পা বদল করার বা বলকে বাম দিকে নেয়ারও সুযোগ নেই। আমি শরীরকে ডান পায়ের ওপর ভর দিয়ে ডান কাত হয়ে দৌড়ের মধ্যেই (যেটাকে হকির ভাষায় রং ফুট হিট বলে) সজোরে হিট করলাম। গোলরক্ষক মো. শফি, যাকে ইপিআর টিম থেকে আনা হয়েছিল মহসিন ভাইয়ের বদলি হিসেবে। মহসিন ভাই ক্রিকেটের উইকেটরক্ষক কিপার ছিলেন। শফি তার বাম পা বাড়াবার সময় পায়নি, বল সেকেন্ডবারের কোনাদিয়ে গোল পোস্টে ঢুকে ব্যাকবোর্ডে জোরে আওয়াজ তুললো আর বাইরে আমাদের সমর্থকগণ চিৎকার দিয়ে উঠলো, গোল। স্বপ্নের মত একটা গোল নিপুণ এক শিল্পীর আঁকা ছবির মত একটি গোলÑ যা আজও আমার মনের ভেতর আঁকা রয়েছে। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে গেলাম। ইস্পাহানি এত তাড়াতাড়ি গোল খাবে ভাবতে পারেনি। গোল খাওয়ার পর তারা গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায়। টাফ হকি রাফ হকির দিকে এগিয়ে যায়; তবে দু’টিমের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটা উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। দু’টিমই দুটো করে পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নিয়েছিল কিন্তুু এর ফায়দা কোন দলই নিতে পারেনি। দু’দলের উত্তেজিত খেলোয়াড়রা মাঝেমধ্যেই বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে খেলায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। খেলা ধীরে ধীরে আম্পায়ারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং খেলার ২৫ মিনিটে দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে দু’দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে খেলা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আম্পায়ারদ্বয় আলমগীর ভাই এবং মোমিন ভাই দু’টিমকে শান্ত করে দ্রুত খেলা শুরু করেন। খেলা শুরু হওয়ার পরপরই আমি একটি বল বিপক্ষ দলের মাঝমাঠে পেয়ে একক প্রচেষ্টায় ইস্পাহানির ডি’র ভেতর ঢুকে সজোরে হিট মারি। এবারও শফি সেভ করার সুযোগ পায়নি। বল গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে চলে গিয়েছিল। সোজা গোলপোস্টের ভেতর এবং খুঁজে নিয়েছিল জাল। অ™ভুত সুন্দর একটি গোল করেছিলাম যা লিখতে বসে আবেগে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। পরদিন মর্নিং নিউজ পত্রিকা লিখেছিল : ডরঃয ইধংযরৎ নধপশ রহ ঃযব ধঃঃধপশ, ঘধঃরড়হধষ ইধহশ, যধং ধ ফবভরহরঃব বফমব ড়াবৎ ওংঢ়ধযধহর ংঢ়ড়ৎঃরহম. ইধংযরৎ ংপড়ৎবফ ঃযব ইধহশং ঝবপড়হফ মড়ধষ রহ ভরহব ংড়ষড় ভধংযরড়হ. আমরা ২-০ এগিয়ে যাই। এর মিনিট পর আমরা একটা পেনাল্টি কর্নার পাই। আমাদের ফুল ব্যাক সাবের আলী কর্নার কিক মারে। ইস্পাহানির গোলরক্ষক রাশ করার সময় সাবেরের সাথে ধাক্কা লাগে। ফলে সাবেরের ফাউলসহ সবুজ কার্ড, আলমগীর ভাই তাকে সাইড লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেন। আমরা দশজনের দল, শক্তিশালী ইস্পাহানিকে আটকাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। আমরা রক্ষণাত্মক খেলে তাদের আক্রমণগুলোকে ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার তাকে মাঠে ডাকা হয়েছিল। তখন আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলায় ফিরে গেলাম। বিরতি পর্যন্ত আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে ছিলাম। বিরতির পরও আমাদের আক্রমণের ধারা অব্যাহত ছিল। এরকমই একটি সম্মিলিত আক্রমণে আমাদের রাইট ইন মিলু দলের পক্ষে তৃতীয় গোল করে। তিন গোল খাওয়ার পরও ইস্পাহানি টিমের মধ্যে কোনপ্রকার নিরাশ ভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তারা একই রকম খেলা খেলতে থাকে এবং আক্রমণ চালাতে থাকে। আমাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দাস খুবই দক্ষতার সাথে দুটো গোল সেভ করেছিলেন। খেলা শেষ হওয়ার মিনিটখানেক আগে ইসলাহউদ্দিন চমৎকার পুশ দ্বারা একটি গোল শোধ দিতে সক্ষম হয়েছিল। আমরা শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলের একটি স্মরণীয় জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলোয়াড় : রঞ্জিত দাস (গোলরক্ষক), সাবেক আলী এবং মো. ইকবাল, এহতেশাম, মাহমুদ এবং আনোয়ার, আবদুল হক, মিলু, ফরিদ, বশির, মনি।
ইস্পাহানি টিম : মো. শফি (গোলরক্ষক), সোলায়মান এবং শফিক আজিম, আকবর এবং জাফর, মোদাসসার, ইসলাহউদ্দিন, হায়দার, নাঈম এবং আজিজ।
২৫ মার্চ ১৯৬৭ থেকে করাচিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় হকি চ্যাম্পিনশিপে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান হকি টিম গঠনের জন্য দেশের ৬৮ জন হকি খেলোয়াড়কে প্রাথমিক ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল। দেশের হকি খেলোয়াড়দের রেকর্ড রাখার জন্য নামগুলো এখানে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
ন্যাশনাল ব্যাংক : রণজিত দাস, সাবের আলী, আনোয়ার হোসেন, এহতেশাম সুলতান, ফখরুল আলম মাহমুদ, আব্দুল হক মির্জা ফরিদ মিলু, বশীর আহেমদ, মীর আনোয়ার কলিম এবং আলী আসগর।
ওয়ারী কাব : ফ্রান্সিস পালসার, মোমতাজ, এসএম শেরা, কামাল হায়দার, মাহমুদুর রহমান, মামলী, সহিদ, শফিক এবং নওয়াজিদ।
কম্বাইন্ড স্পোর্টিং : সাব্বির ইউসুফ, মহসিন, আব্দুস সাদেক, বুলবান, ওমেদ আলী, প্রতাপ শংকর এবং কাদের।
মোহামেডান স্পোর্টিং : মো. সেলিম জাম্বু, ইব্রাহিম সাবের, জিয়া, রহিম বেগ, খাজা সলিমউল্লাহ, জগলু, ফালু এবং সালাম।
ইস্পাহানী স্পোর্টিং : শফিক, জাফর, আজিজ, এব্রার, আজিম, ইসলাহউদ্দিন, হায়দার, মোদাসসার এবং নাঈম।
মাহুৎটুলী স্পোর্টিং : আরেফীন, হাসান, শামসুল বারী, পুতুল, মোহন, ফজলু, হাফিজ উল্লাহ এবং মুজিবর।
ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং : নূরুল ইসলাম, এরশাদ, রাজ্জাক, মাহমুদ, আজিজ এবং হাবিবউল্লাহ।
পিডব্লিউডি কাব : মিরু, মজিদ এবং রানা।
পাকিস্তান স্পোর্টিং : মোমতাজ, ওসমান এবং বুলবুল।
পুলিশ এসি : মান্নান, মোহাম্মদ আলী, গফুর এবং সারুফ।
আজাদ স্পোর্টিং : মাজেদ। (ক্রমশ.)
১৬ আগস্ট
(আশি)
মোহামেডান ০-২ গোলে পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর কাছে হেরে গিয়েছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারির প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় যে কোন দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় খেলাটি জমজমাট হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর ওসমান ও খুরশীদ দুটো গোল করে মোহামেডানকে থামিয়ে দিয়েছিল।
সেদিনের দ্বিতীয় খেলাটি আরো বেশি ফাটাফাটির। পিডব্লিউডি আর মাহুৎটুলী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দু’টিমই জেতার জন্য লড়েছে। এই খেলার লড়াই দেখে মাঠে উপস্থিত দর্শকরা প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলেন। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের প্রথম সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছিল পিডব্লিউডি’র কৃতী খেলোয়াড় মজিদ। প্রথমার্ধের ১-০ গোলের লিড দ্বিতীয়ার্ধের মাহুৎটুলীর ঝড়ে পিডব্লিউডি বেসামাল হয়ে পেনাল্টি স্ট্রোকের দন্ডে দন্ডিত হয়েছিল, যার সফল বাস্তবায়ন করেছিল শামসুল বারী। খেলায় ১-১ গোলের সমতা। তারপরও দু’দল তাদের শক্তির সবটুকু লাগিয়েও কেউ কাউকে পরাস্ত করতে পারেনি।
সুকুর, বুললান এবং কোরাইশীর করা ৩-০ গোলে ভিক্টোরিয়া ইস্টবেঙ্গলকে দিনের তৃতীয় খেলায় পরাজিত করেছিল। চতুর্থ খেলাটি একতরফা বিমানবাহিনী ৫-১ গোলে ফায়ারকে বিধ্বস্ত করেছিল। তাদের পক্ষে নিয়াজী একাই তিন গোল করেছিল। লেফট-ইন আফসার এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড সুরাওমা একটি করে গোল করলে ফায়ারের পক্ষ থেকে রশীদ একটি গোল ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল।
হকির মক্কা খ্যাত মাহুৎটুলী এলাকার দুটি টিম। খেলার ধরন-ধারণ এক খেলার মান এক শক্তিশালী দল হিসেবে কেউ কারো চেয়ে কম নয়- রেষারেষিটাও কম ছিল নাÑ যার প্রমাণ মাঠে দেখা যেত। ২৮-২-৬৭ তারিখের ম্যাচটিও এর ব্যক্তিক্রম ছিল না। মাঠে জেতার নেশা দু’টিমেরই ছিল বলে দু’টিমই প্রচুর আক্রমণ চালিয়েছে। তবে আক্রমণগুলোয় পরিকল্পনার অভাব থাকায় সফল হতে পারছিল না। অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রথমার্ধের শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত। মাহুৎটুলী টিমের লেফট-ইন ফজলু একজনকে কাটিয়েই সজোরে হিটের মাধ্যমে কম্বাইন্ডের গোলরক্ষককে চমকে দিয়েছিল কিন্তু সমশক্তির দলকে মাহুৎটুলী বেশিক্ষণ সামলে দিয়ে রাখতে পারেনি।কয়েক মিনিটের মধ্যে কম্বাইন্ডের কৃতী সেন্টার হাফ সাদেক গোল করে খেলায় সমতা এনে দেয়। বিরতির পর দু’দলই জেতার জন্য লড়াই করে গেছে কিন্তু কোন দলই জিততে পারেনি, ১-১ গোলের ড্র নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে হয়েছে। গত ২৮ মে ২০১১ ঢাকা কাবে প্রাক্তন হকি খেলোয়াড়দের মিলনমেলায় দীর্ঘদিন পর ফজলুর সাথে দেখা হয়েছিল। প্রথমে চিনতে পারিনি, এ সময়ের দেশের কৃতী স্ট্রাইকার কামাল পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, আমার মামা, ফজলু। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম! এই সেই ফজলু- যাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। খেলার মাঠে শান্ত, ভদ্র, বিপক্ষ দু’তিন খেলোয়াড়কে কাটানো (ডজ দেয়া) যার কাছে কোন ব্যাপারই ছিল না, এর কি দশা! তরুণ সুন্দর ফজলু ইয়া বড় বড় সাদা দাড়ি, আল্লাওয়ালা ফজলু, আমার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ফজলু ঢাকাইয়া কথায় বললো, ‘খেলমে ম্যায়, একজোন (একজন), দোজোন (দুজন) তিনজোন (তিনজন) কো কাটাকে বি ‘ডি’ খোজকে পাতে থে নাই, ইসলিয়ে আপ হামকো কায়তে থে, আরে ফাজলু, তু আগে যাতা, না পিছে যাতা।’ অর্থাৎ (ফজলু বলছিল) আমি একজন, দুজন, তিনজনকে কাটিয়েও ‘ডি’ খুঁজে পেতাম না, তখন আপনি আমাকে বলতেন, আরে ফজলু, তুই সম্মুখে যাচ্ছিস না পেছনে যাচ্ছিস। আসলে ফজলুর স্টিক-বলের কন্ট্রোল ছিল খুবই চমৎকার, ডজ করাটা ছিল তার সহজাত বা ন্যাচারাল আর খেলার বৈশিষ্ট্যই ছিল ডজ দিয়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে কাটানো কিন্তু সমস্যাটা ছিল সে ডজ করতো সাইডওয়ে। ডজ করার উদ্দেশ্য যে, ডজ দিয়ে বিপক্ষ একজন খেলোয়াড়কে পেছনে ফেলে মাঠের দূরত্ব কমিয়ে আনা এবং নিজস্ব খেলোয়াড়কে স্বচ্ছন্দে সুন্দর একটা পাস দেয়া। ফজলুর কাছ থেকে সেরকম ডজ না পেয়ে আমি উপরোক্ত কথাগুলো ওকে বলতাম। পুরনো ঢাকাইয়া কথা বললে সে হাসছিল।
সেদিনের দ্বিতীয় খেলায় পিডব্লিউডির কৃতী খেলোয়াড় মজিদের চমৎকার দুই গোলের সুবাদে তারা মোহামেডানকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল। দিনের তৃতীয় খেলায় আজাদ ২-১ গোলের ব্যবধানে ফায়ার সার্ভিসকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। আজাদে জাহিদুল্লাহ এবং জাহিদ গোল দুটো করেছিল আর ফায়ারের পক্ষে গোল করেছিল জিল্লুর।
সেদিনের চতুর্থ খেলায় পুলিশও সুযোগ পেয়েছিল বেশি বেশি গোল করার। ইস্টবেঙ্গলকে তারা ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। তাদের আকবর, মোহাম্মদ আলী, গফুর, আখতার গোল করার সুযোগটা নিয়েছিল।
১ মার্চ শক্তিশালী ইস্পাহানী তাদের মূল্যবান একটি পয়েন্ট বিসর্জন দিয়েছিল ভিক্টোরিয়ার কাছে। তারা গোলশূন্য ড্র করেছিল। সেদিনের দ্বিতীয় খেলায় ওয়ারী ২-১ গোলে পাকিস্তান স্পোর্টিংকে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট পেয়েছিল। ওয়ারীর সহিদ এবং নেওয়াজিশ গোল করলে খুরশীদ তার দলের হয়ে এক গোল শোধ করেছিল। সেদিনের তৃতীয় খেলায় আমরা ভাগ্যের জোরে পুলিশকে হারিয়ে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়তে পেরেছিলাম আর উইনিং গোলটি করেছিল আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ। দিনের শেষ ম্যাচে পিডব্লিউডি ৩-১ গোলে আজাদকে হারিয়েছিল। #
১ সেপ্টেম্বর
(একাশি)
৩ মার্চ ওয়ারী এবং কম্বাইন্ডের খেলাটি ইপিএসএফ-এর হকি লীগ কমিটি পসপন্ড করেছিল; কারণ দু’টিমই বিশেষ কারণ দেখিয়ে খেলা স্থগিত চেয়েছিল। কম্বাইন্ড কারণ দেখিয়েছিলÑ তাদের একজন খেলোয়াড় জাতীয় ফুটবল টিমের ট্রায়াল খেলতে পশ্চিম পাকিস্তান গেছে আর ওয়ারী তাদের সাথে সুর মিলিয়ে কয়েকজন খেলোয়াড়ের অসুস্থতাকে দাঁড় করেছিল। ব্যাস, খেলা স্থগিত। সেদিন একটি মাত্র খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া বনাম ওয়ান্ডারার্স। ভিক্টোরিয়া ৫-০ গোলে জিতেছিল। লেফট আউট শুকুর তিন গোল, সেন্টার ফরোয়ার্ড কোরেশী এবং বাবু খান একটি করে ভিক্টোরিয়ার পক্ষে গোল করেছিল। বিমানবাহিনীর ‘প্রোটেস্ট গ্র্যান্ট’ হকি লীগের একটি কলঙ্কিত সিদ্ধান্ত, যা হকি অঙ্গনে খুব সমালোচিত হয়েছিল। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের সাথে (ন্যাশনাল ব্যাংক) বিমানবাহিনীর খেলায় যে অনাকাক্সিত ঘটনা ঘটেছিল অর্থাৎ বিমানবাহিনী ২৬ মিনিট পর্যন্ত খেলা চলাকালীন অবস্থায় মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আর খেলায় ফিরে আসেনি। আমরা সে সময় পেনাল্টি স্ট্রোকে এক গোলে এগিয়ে ছিলাম। বিমানবাহিনীর অফিসার এবং বাইরের কিছু সমর্থকের উস্কানিতে তারা এরকম অখেলোয়াড়ী কান্ড করেছিল। তারাই আবার প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিসের ভিত্তিতে প্রচেষ্টা হয়েছিলÑ সেটাও জানা যায়নি। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য হবে নাÑ সেটাও সবার জানা। হকির ‘বাইলজ’-এ আছেÑ কোন দল যদি খেলতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে বিপক্ষ দলকে পূর্ণ পয়েন্ট প্রদান করা হবে। হকি লীগ কমিটি নোটিস জারি করেছিল যে, হকি খেলার বৃহত্তর স্বার্থে বিমানবাহিনীর প্রটেস্ট গ্র্যান্ট করা হলো এবং ভবিষ্যতে খেলার মাঠে এরকম আচরণ বরদাশত করা হবে না। লীগ কমিটির এরূপ স্বেচ্ছাচারিতাকে মেনে নিয়ে আমরা ৪-৩-৬৭ তারিখে বিমানবাহিনীর সাথে খেলতে আবার মাঠে নেমেছিলাম। বিমানবাহিনী তাদের সব শক্তি লাগিয়ে মাঠে নেমেছিল; ট্রাক ভরে এয়ারম্যানদেরও এনেছিল তাদের সমর্থন জোগাতে। অন্যদিকে মাঠে উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা এবং সমর্থন পেয়েও খেলায় যেন উৎসাহ পাচ্ছিলাম না আমরা। বিরক্তিকর মন নিয়ে খেলতে গিয়ে বার বার ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছিল। মাঠে আমরা সংঘবদ্ধ হতে পারছিলাম না; আমাদের আক্রমণও জোরালো হচ্ছিল না। সুতরাং গোলও পাচ্ছিলাম না। সে সুযোগে বিমানবাহিনী বার বার আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ডিফেন্সকে চাপের মধ্যে রেখেছিল কিন্তু সফলতা পায়নি। শেষ পর্যন্ত খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল, যা দলের জন্য ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল।
ওয়ারী বনাম কম্বাইন্ড ৩-৩-৬৭ তারিখের খেলাটি তারা ইপিএসএফ হকি কমিটির ওপর প্রভাব খাটিয়ে পসপন্ড করিয়ে নিয়েছিল। কারণ দেখিয়েছিলÑ একটি দলের খেলোয়াড় ফুটবল ট্রায়াল খেলতে পশ্চিম পাকিস্তান গেছে আর অন্য টিম তাদের কয়েকজন খেলোয়াড়ের অসুস্থতাকে কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। পরদিনই দু’টিম মাঠে নেমেছিল দুটো ভিন্ন টিমের বিরুদ্ধে খেলার জন্য। একদিনেই তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল কি করেÑ এটা ছিল সবার প্রশ্ন। আসলে ওয়ারী এবং কম্বাইন্ড লীগের ঐ অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চায়নি। লীগ শিরোপ লড়াইয়ের কূটবুদ্ধি ছিল ঐ পসপন্ডের অন্তরালে। ৪-৩-৬৭ তারিখে ওয়ারী ওয়ান্ডারার্সকে অতিসহজেই ৬-২ গোলে পরাজিত করলেও কম্বাইন্ড ভাগ্যগুণে ১-০ গালে ভিক্টোরিয়াকে হারাতে পেরেছিল। ওয়ারীর কৃতী লেফট ইন মামলী, দেশসেরা লেফট ফুলব্যাক মোমতাজ এবং নওয়াজিশ প্রত্যেকে দু’গোল করেছিল আর হেলাল এবং ওয়ান্ডারার্সের পক্ষে ওয়াহিদ দু’ইন দুটো গোল শোধ দিতে পেরেছিল।
রাইট ফুলব্যাক কাদের খেলার অন্তিম মুহূর্তে পেনাল্টি কর্নার থেকে একটি গোল করে কম্বাইন্ডকে উদ্ধার করেছিল। আমাদের লীগ চ্যাম্পিয়ন শিরোপা ধরে রাখা কঠিন করে দিয়েছিল ৫-৩-৬৭ তারিখে রেল দল আমাদের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। এ মৌসুমেও লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের যে স্বপ্ন আমরা দেখছিলাম, এই ড্র’র ফলে চার পয়েন্ট হারিয়ে সে স্বপ্নটা অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। এ ড্র’র ফলে রেল দলের কোন ক্ষতির কারণ হয়নি বরং লাভই হয়েছে বেশি। আমরা শিরোপা দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছিলাম আর এ পয়েন্ট হারানোর জন্য আমরাই দায়ী, বিশেষ করে আমাদের ফরোয়ার্ডরা সেদিন ছিল মহাফপ। আমাদের মাঝমাঠ ছিল ছন্নছাড়া; আক্রমণ তৈরিতে ছিল ব্যর্থ। শুধুমাত্র আমাদের রক্ষণ ছিল সুদৃঢ়, নইলে হার দিয়ে ফলাফল লিখতে হতো। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে কিছু সময়ের জন্য মাঠের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের। সেসময় তাদের আক্রমণগুলোও সফলতা পায়নি তাদের স্কোরারের ব্যর্থতায়। দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় বিশ মিনিটের সময় মিলুর একটি গোল আম্পায়ার ঈশা খান নাকচ করে দেন। কেন গোল বাতিল করেছেনÑ তার সঠিক ব্যাখ্যা রেফারি দিতে পারেননি। আমরা তাকে ঘেরাও করে গোল বাতিলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গোল দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলাম কিন্তু ঈশা খাঁ তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় আমাদের ব্যাংক দল উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এতে খেলা প্রায় পাঁচ মিনিট বন্ধ ছিল। তারপরও দু’দল জেতার জন্য খেলা চালিয়ে যায় কিন্তু খেলার বন্ধাত্ব ঘুচানো সম্ভব হয়নি। দিনের শেষ খেলাটি ছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে মোহামেডানের, যা বিনা পরিশ্রমেই ভিক্টোরিয়া দু’পয়েন্ট পেয়েছিল। মোহামেডান মাঠে উপস্থিত না হওয়ার কারণে পরদিনই অর্থাৎ ৬ মার্চ মোহামেডান শক্ত মনোবল নিয়ে মাঠে নেমেছিল আমাদের (ন্যাশনাল ব্যাংক) বিরুদ্ধে খেলতে এবং জয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও হেরে গিয়েছিল ২-১ গোলের ব্যবধানে। তারা ১-০ গোলের লিড নিয়ে শেষ করেছিল প্রথমার্ধ। গত ম্যাচের মতো সেদিনও আমরা ফরোয়ার্ডরা গোল করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝ মাঠ থেকে প্রচুর বলের জোগান পেয়েছি, আক্রমণও হয়েছে অনেক কিন্তু গোলপোস্টে এলোমেলো হিট মেরে অনেক সুযোগ আমরা নষ্ট করেছিলাম। এমনকি পেনাল্টি কর্নার পেয়েও ফিনিশিং-এর অভাবে গোল পাইনি। অন্যদিকে মোহামেডানের রক্ষণভাগ সালাম ভাইয়ের নেতৃত্বে মজবুত ভিত তৈরি করেছিল আর ইব্রাহিম সাবের মধ্যমাঠ সামাল দিচ্ছিল এবং আক্রমণে রহিম বেগ ব্যাংক দলের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমার্ধের বিশ মিনিটে ব্যাংক দল পেনাল্টি স্ট্রোকে গোল খেয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিল। ইব্রাহিম সাবের আমাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দা’কে কোন সুযোগ না দিয়ে গোল করে দলকে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাংক দল গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। খেলার শেষ প্রান্তে এসে পরপর দুটো গোল করে ব্যাংক টিমকে নিশ্চিত হারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম। প্রথমটি আমরা একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে ড্রিবল করে মোহামেডানের দুজন ডিফেন্সকে কাটিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে সুন্দর প্লেসমেন্টের সাহায্যে জাম্বুকে পরাস্ত করেছিলাম এবং দ্বিতীয় গোলটি করেছিলাম একইভাবে ড্রিবল করে মোহামেডানের ডিফেন্সের ভেতর দিয়ে ঢুকে ‘ডি’র মাথা থেকে সজোরে হিট! বল উড়ে গিয়ে জালে জড়িয়ে যায়। জাম্বু চেষ্টা করেও সেভ করতে পারেনি, যদিও সেদিন সে খুবই চমৎকার গোলকিপিং করেছিল এবং মোহামেডানকে আরো বেশিসংখ্যক গোলের হার থেকে রক্ষা করেছিল।
সেদিনের অপর খেলায় বিমানবাহিনী ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ১১-০ গোলের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিল এবং তাদের ইনসাইড লেফট আফসার পাঁচ গোল করাসহ একটি হ্যাটট্রিক করে হকি লীগে হ্যাটট্রিকের গর্বিত একজন অংশীদার হয়ে গিয়েছিল।
মোস্তাক করেছিল তিন গোল, ইনসাইড রাইট নিয়াজী দু’গোল করলে বাকি এক গোল করেছিল রাইট আউট রিয়াজ। এখানে দুঃখের সাথে বলতে হয়, ঐতিহ্যবাহী একটি কাব এরকম দুর্বলতম টিম গঠন করে কাবকে হেয় করার কোন যুক্তি নেই। দিনের অন্য একটি ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল প্রথম পয়েন্ট অর্জন করেছিল; কারণ ফায়ার মাঠে তাদের সম্পূর্ণ দল নামাতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে। আর এ পয়েন্ট পেয়েই ইস্টবেঙ্গল খুব আনন্দ করেছিল সেদিনের শেষ ম্যাচের পর।
পরদিনই (৭-৩-৬৭) আমাদেরকে পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। যদিও আমাদের টিম তাদের তুলনায় বেশ শক্তিশালী, তারপরও তাদেরকে সমীহ করে মাঠে নামতে হয়েছে। প্রত্যেক দলকেই তাদের সাথে খেলতে একটু আলাদাভাবে চিন্তা-ভাবনা করে মাঠে নামতে হতো। কারণ তারা খুবই লড়াকু টিম; মানবিক দিক দিয়ে তারা খুবই দৃঢ়চেতা। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যায়; বিশেষ করে তাদের রক্ষণভাগে গোলরক্ষক মোমতাজ, ব্যাক কামাল, আনোয়ার, খুরশীদÑ এরা ছিল ‘মারু প্লেয়ার’। এদেরকে মাথায় রেখেই মাঠে নেমেছিলাম সেদিন। পাকিস্তান স্পোর্টিং শুরু থেকেই আমাদের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে। আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ডিফেন্সকে চাপের মধ্যে রাখে এবং গোল করার বেশক’টি সুযোগও তৈরি করে কিন্তু সফল হতে পারেনি। পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর ডিফেন্সে ঢুকে গোল করা একটু কঠিন হতো; কারণ ‘এই বুঝি স্টিকটা এসে পড়লো বলে’Ñ এ ধরনের আতঙ্ক নিয়ে খেলতে হতো। এর মধ্যে আমরাও আক্রমণ চালিয়ে খেলছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা একটা শট কর্নার (বর্তমানে পেনাল্টি কর্নার) পেলাম। আমাদের ফুলব্যাক সাবের আলী সজোরে হিটের মাধ্যমে মোমতাজকে পরাস্ত করলে আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। গোল খেয়ে পাকিস্তান স্পোর্টিং মরিয়া হয়ে হয়ে ওঠে এবং গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকে। এভাবে প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে খেলার ধারা একইরকম চলছিল। এরই মধ্যে আমি একটি বল নিয়ে দ্রুত গতিতে বিপক্ষ দলের ডিফেন্সকে কাটিয়ে ‘ডি’র দিকে ঢুকছি, পেছন থেকে দু’ব্যাক ধেয়ে আসছিল আর সম্মুখ থেকে গোলরক্ষক মোমতাজ ছুটে আসছে। টপ অব দ্য ডি থেকে আগুয়ান গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে বল পুশ করে দিয়েছিলাম পোস্টে। বল গোলপোস্টের বার ঘেঁষে বোর্ডে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। চমৎকার একটি গোল করতে পেরে সেদিন বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম। আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান স্পোর্টিং মরিয়া হয়ে ওঠে এবং গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকে। এভাবে প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে খেলার ধারা একইরকম চলছিল। এরই মধ্যে আমি একটি বল নিয়ে দ্রুতগতিতে বিপক্ষ দলের ডিফেন্সকে কাটিয়ে ‘ডি’র দিকে ঢুকছি। পেছন থেকে দু’ব্যাক ধেয়ে আসছিল আর সম্মুখ থেকে গোলরক্ষক মোমতাজ ছুটে আসছে। টপ অব দ্য ডি থেকে আগুয়ান গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে বল পুশ করে দিয়েছিলাম পোস্টে, বল গোলপোস্টের বার ঘেঁষে বোর্ডে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। চমৎকার একটি গোল করতে পেরে সেদিন বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম। আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান স্পোটিং-এর খেলায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। তারা একইরকম আক্রমণ চালিয়ে ভাল খেলা প্রদর্শন করে যায় শেষ পর্যন্ত।
ক্রমশ.
১৬ সেপ্টেম্বর
(বিরাশি)
দিনের অপর খেলায় রেল দল ইস্টবেঙ্গলকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল, যার তিন গোল করেছিল তাদের কৃতী লেফট ইন নিয়াজ, রাইট ইন কায়ফুল করেছিল দু’গোল এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড নাসরুল্লাহ ও রাইট আউট হামিদ করেছিল এক গোল করে। সেদিনের শেষ ম্যাচেও বিমানবাহিনী মোহামেডানের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলের বড় জয় পেয়েছিল। সেদিন মোহামেডান খুবই বাজে খেলে, বিশেষ করে তাদের ডিফেন্স এবং হাফ জঘন্য খেলেছিল বলে বিমানবাহিনী এত গোল করার সুযোগ পেয়েছিল। মাঠে ধুলাবালির ঝড়, আলোর স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে মোহামেডান খেলা বন্ধ রাখার আবেদন করলেও আম্পায়ার নিয়াজ আহমেদ খান কর্ণপাত না করে খেলা শেষ করেন। বিমানবাহিনীর সেন্টার ফরোয়ার্ড মোস্তাক এবং লেফট ইন আফসার দু’গোল করে করেছিল, রাইট ইন নিয়াজী এবং রাইট আউট রিয়াজ একটি করে গোল করেছিল।
সমমানের দুটো টিম পাকিস্তান স্পোর্টিং এবং পিডব্লিউডি ১৬ মার্চ মাঠে লড়েছে সব শক্তি দিয়ে কিন্তু ভাগ্য সেদিন পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর পক্ষে ছিল বলে তারা ৩-১ গোলে জয়ী হয়ে মাঠ ছেড়েছিল। তাদের লেফট আউট চুং, ইনসাইড রাইট ওসমান এবং খুরশীদ গোল করলে জাফর এক গোল করে ব্যবধান কমিয়েছিল। দিনের অপর খেলাও ছিল সমমানের, তবে নিচের দিকে। ইস্টবেঙ্গল এবং আজাদ স্পোর্টিং-এর মধ্যে। তারাও জেতার জন্য লড়েছিল কিন্তু উভয় দলই ১-১ গোল করার পর আর কারো পক্ষে গোল করা সম্ভব হয়নি। আজাদ স্পোর্টিং প্রথম গোল করেছিল তাদের রাইট ব্যাক রউফের নিখুঁত কর্নার হিটের মাধ্যমে আর শোধ দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের রাইট আউট মজিদ। দিনের শেষ খেলায় ওয়ান্ডারার্স কাব দেরিতে মাঠে আসায় তাদের বিপক্ষ রেল দল ওয়াকওভার পেয়ে যায়।
১৭ মার্চ ফায়ার সার্ভিস বিরতি পর্যন্ত মোহামেডানকে ড্র রাখতে বাধ্য করেছিল কিন্তু পরে তারা আর মোহামেডানকে ধরে রাখতে পারেনি। জিয়া পরপর দু’গোল করে দলকে এগিয়ে দিলে রাইট ব্যাক সালাম ভাই এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড রহিম বেগ গোল করে দলকে ৪-০ গোলের জয় এনে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় ওয়ারী ওয়াকওভার পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল কাব মাঠে না আসায়। দিনের বাকি দুটো ম্যাচ বৃষ্টির কারণে হতে পারেনি। ম্যাচ দুটো ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক বনাম কম্বাইন্ড এবং রেল বনাম পিডব্লিউডি।
ওয়ারী কাব ১৮ মার্চের খেলায় কোনরকম পুরো দুটি পয়েন্ট ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছিল কম্বাইন্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে। এই জয় পেতে ওয়ারীকে পুরো সময় কম্বাইন্ডের সাথে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে। জয়টা যে কোন দলের হতে পারতো; শেষ পর্যন্ত ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড শহিদের স্টিক দিয়েই জয়টা এসেছিল। সেদিনের দ্বিতীয় ম্যাচে রেল দল সহজেই মাহুতটুলীকে ৪-২ গোলে পাজিত করেছিল। বিজয়ী দলের হামিদ, মোহাম্মদ আলী, নাসিরুল্লাহ এবং নিয়াজ একটি গোল করেছিল আর মাহুতটুলীর পক্ষে দুটি গোল শোধ দিয়েছিল নাঈম এবং হাফিজ। দিনের তৃতীয় ম্যাচে লেফট ইন বুললান এবং সেন্টার হাফ ওমরের গোলের সুবাদে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে পুলিশকে হারিয়েছিল।
দিনের শেষ ম্যাচে ইস্পাহানী দুর্বল টিম আজাদকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। তাদের জাফর দু’গোল এবং তানভীর এক গোল করেছিল। ১৯ মার্চ হকি লীগের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল শক্তিশালী এবং লীগ শিরোপা প্রত্যাশী ইস্পাহানী টিম পুলিশকে ওয়াকওভার দেয়ায়। তারা মাঠেই উপস্থিত হয়নি। দিনের অপর খেলায় মোহামেডান জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাহুতটুলীকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। আর একমাত্র গোলটি করেছিল রাইট-ইন সেলিম। ২০ মার্চ ওয়ারী দ্বিতীয় পয়েন্ট খুইয়েছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে গোলশূন্য ড্র করে। পয়েন্ট খোয়াবার জন্য ওয়ারীর খেলোয়াড়রাই দায়ী। খেলাটাকে তারা খুবই হাল্কাভাবে নিয়েছিল, পুরো টিম ছন্দছাড়া, এলোমেলো খেলা বিশেষ করে তাদের আক্রমণভাগ ছিল একেবারেই ব্যর্থ। বেশক’টি সহজ সুযোগ তারা কাজে লাগাতে পারেনি। অন্যদিকে সেদিন ভিক্টোরিয়া খুব ভাল খেলেছে। প্রত্যেক বিভাগেই তাদের খেলোয়াড়রা সেরাটা খেলেছে, এমনকি আক্রমণ করে গোলেরও সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সফল হলে হয়তো ফলাফলটা অন্যরকম হতো। ওয়ারী দু’পয়েন্ট হারিয়েও হকি লীগের পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষস্থানেই অবস্থান করছিল। ওয়াকওভারের কোনরকম শাস্তি না থাকায় হকি লীগে যখন-তখন ওয়াকওভার দেয়াটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমন সেদিনের শেষ খেলাটায় পাকিস্তান স্পোর্টিং-এর মত ভাল একটি টিম কম্বাইন্ডকে ওয়াকওভার দিয়েছিল।
১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের অংশগ্রহণ এবং প্রস্তুতির জন্য ঢাকা হকি লীগ আরও একবার বন্ধ হয়েছিল। করাচিতে ২৫ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হবে। পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে চ্যাম্পিয়নশিপের অর্গানাইজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পাকিস্তান কাস্টমস এন্ড সেন্ট্রাল অ্যাকসাজ স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ডের ওপর। এয়ার মার্শাল নূর খান পাকিস্তান হকি ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর হকি উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এরই অংশ হিসেবে সে বছর থেকে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে প্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। যেমন অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে প্রথমে বাছাইপর্ব খেলতে হবে। পরবর্তীতে বাছাইকৃত দলসমূহ টুর্নামেন্টের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। পূর্বে কোন কোন জোন বা ইউনিট চ্যাম্পিয়নশিপে দুটো করে টিম এন্ট্রি করতো, যেমন করাচি ‘এ’ এবং করাচি ‘বি’। অনুরূপভাবে লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি জোনও দুটো টিম এন্ট্রি করতো; আর্মি করতো আর্মি রেড এবং আর্মি গ্রীন নামে। সে সুযোগ বন্ধ করে ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হকি ফেডারেশনের আওতাভুক্ত প্রত্যেক ইউনিট থেকে একটি মাত্র টিম এ চ্যাম্পিয়নশিপে এন্ট্রি নিতে পারবে।
এই টুর্নামেন্টে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, খেলাগুলো লীগ এবং নকআউট পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্ব হবে লীগ এবং পরবর্তী পর্ব হবে নকআউট ভিত্তিতে। বিগত বছরগুলো জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হতো শুধু নকআউট পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে দুর্বল দলগুলোকে একটি ম্যাচ খেলে হেরেই বিদায় নিতে হতো। দলগুলোকে একটি বছর অপেক্ষা করে, অনেক পরিশ্রম, অনেক অর্থ ব্যয় করে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করতে হতো। তারপর যদি মাত্র একটি ম্যাচ খেলেই বিদায় নিতে হয়, সেটা খুবই দুঃখের। এ পদ্ধতিতে হকি উন্নয়নে কোন অবদান রাখার সুযোগ ছিল না। ভাল খেলোয়াড়দের সাথে খেলায় অংশ নিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। আমি ১৯৬০ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের হয়ে নিয়মিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে আসছিলাম। প্রথমবার ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে ভারতের ওপর দিয়ে তিন/চারদিন পর করাচিতে পৌঁছে প্রথম ম্যাচে ৯-০ গোলে হেরে বিদায়। এত কষ্ট করে এত দূর গিয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে হলে খুব বিরক্ত লাগে।
পরের বছরগুলোতে আমরা বিমানে চড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে যেতাম। ট্রেন ভ্রমণের কান্তি না হলেও ফলাফল ঐ একই রকম হতো, প্রথম ম্যাচ খেলেই বিদায়। পরবর্তীতে এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া অনেকটা প্রমোদ ভ্রমণের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৯৬৭ সালের জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে অর্গানাইজিং কমিটি টুর্নামেন্টের পূর্ণ কর্মসূচি সাজিয়েছিল এভাবে :
পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের আওতাভুক্ত ২০টি ইউনিট বা টিম চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করবে। যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুটো দল ইপিএস এবং পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে (সার্ভিসেস টিম হিসেবে)। টিমগুলোকে চারটি গ্রুপে বিভক্ত করে প্রত্যেক গ্রুপে ৫টি করে টিম যারা নিজ নিজ গ্রুপে লীগ পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে খেলবে। প্রত্যেক গ্রুপের ১ এবং ২ স্থান অধিকারী টিমগুলো অর্থাৎ ৪ গ্রুপের ৮টি টিম কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সব খেলা হবে নকআউট পদ্ধতিতে।
অংশগ্রহণকারী টিমগুলোকে গ্রুপওয়ারী ভাগ করা হয়েছিল :
গ্রুপ এ- পিআইএ, লাহোর, পেশওয়ার, হায়দ্রাবাদ এবং কোয়েটা।
গ্রুপ-বি : পাক আর্মি, রাওয়ালপিন্ডি, বাহাওয়ালপুর, খায়েরপুর এবং দেরাইশ মাইল খান (ডিআই খান)।
গ্রুপ-সি : পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, সারগোদা, করাচি, নেভি এবং ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন।
গ্রুপ-ডি : পাকিস্তান কাস্টম, ওয়েস্ট পাকিস্তান পুলিশ, পাকিস্তান এয়ারফোর্স, মুলতান এবং পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে।
২৫ মার্চ ৪-৩০ মিনিটে হকি কাব অব পাকিস্তান, স্টেডিয়াম পাকিস্তান কাস্টম এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্সের খেলার মধ্যে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধন হবে। উদ্বোধন করবেন সেন্ট্রাল ফাইন্যান্স মিনিস্টার মি. ইউএম ওকেলি। প্রতিদিন দুটো মাঠে হকি কাব অব পাকিস্তান, স্টেডিয়াম এবং ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ৪/৫টি করে ম্যাচ খেলার শিডিউল করা হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তান হকি টিম গঠনের লক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি মাঠে মার্চ ১০-১২ তিন দিন ট্রায়াল ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। ১২ মার্চ রাতে বাংলাদেশ হকি টিমের নাম ঘোষণা করা হয়। ১৮ সদস্যের টিম। আমাকে ক্যাপ্টেন এবং আবদুস সাদেককে ভাইস ক্যাপ্টেন মনোনীত করা হয়েছিল। পূর্ণ টিমের তালিকা : গোলরক্ষক-রণজিত দাস এবং মো. সেলিম জাম্বু, ফুলব্যাক-মো. মোমতাজ, এএম সেরা এবং শফিক; হাফব্যাক- আব্দুস সাদেক, এহতেশাম সুলতান, ইব্রাহিম সাবের, আজিজ এবং মো. মহসিন; ফরোয়ার্ড- বশীর আহমেদ, মাহমুদ মামলী, আরবার মাহমুদ, আব্দুর রাজ্জাক (সোনা মিয়া), মীর আনোয়ার করিম।
৬ জন খেলোয়াড়কে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছিল। ফ্রান্সিস পালসার গোলরক্ষক, কামাল হায়দার, সাবের আলী, আব্দুল হক, বুলবান এবং আজিম।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে দ্বিতীয় টিম হিসেবে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে সুযোগ পেয়েছিল। তাদের নির্বাচিত টিম : গোলরক্ষক-এমএ কাদের এবং নবী বকশ; ফুলব্যাক- ইদ্রিস খান, মনসুর এবং আকবর; হাফব্যাক-খুরশীদ আলম, কালিম, আবিদ খান এবং মাহবুব; ফরোয়ার্ডস-হামিদ খান, কেডাব্লিউ খান, রাইস আহমেদ, নিয়াজ আহমেদ, মুস্তাক আহমেদ, নুরুল্লাহ বেগ এবং মোহাম্মদ আমিন।
১৭ সদস্য টিমের ক্যাপ্টেন আবিদ খান এবং ভাইস ক্যাপ্টেন ইদ্রিস খান আর টিমের ম্যানেজার মনোনীত হয়েছিলেন সিদ্দিকী।
১ অক্টোবর ২০১১
(তিরাশি)
জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত ২৫ মার্চ তারিখে উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি। একদিন পিছিয়ে ২৬ মার্চ উদ্বোধন করা হয়েছিল। অনেক জাঁকজমকের সাথে উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ ২০টি টিমের পতাকা উত্তোলন, বেলুন ওড়ানো, স্থানীয় ম্যারিকোলাকো স্কুলের ছাত্ররা গার্ড অব অনার প্রদর্শন এবং ২০টি টিমের মার্চপাস্টÑ যার লিড দিয়েছিল বিমানবাহিনী আর প্রধান অতিথি কর্তৃক সালাম গ্রহণ। পাকিস্তান টিমের সাবেক অধিনায়ক কাস্টমস দলের সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খানের খেলোয়াড়দের পক্ষে ওথ নেয়া, ফাইন্যান্স মিনিস্টার মি. ওকিলি কর্তৃক ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের শুভ উদ্বোধন ঘোষণাÑ সব মিলিয়ে জমকালো ও আকর্ষণীয় এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল।
উদ্বোধনী ম্যাচের দু’টিম কাস্টমস এবং এয়ারফোর্সের খেলোয়াড়দের সাথে প্রধান অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। কাস্টমস ৩-০ গোলে এয়ারফোর্সকে পরাজিত করেছিল। তাদের ফুলব্যাক খুরশীদ আলম পেনাল্টি কর্নার থেকে দুটি গোল করলে তৃতীয় গোলটি করেছিল লেফট-ইন লাইক। পরদিন থেকে দুটো মাঠে প্রতিদিন ৩/৪টি করে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
পিআইএ তাদের প্রথম খেলায় লাহোরকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড তারেক নিয়াজী দুটো গোল করলেও মিস করেছে বেশ কয়েকটা আর মিস করেছে হাটট্রিক করার সুবর্ণ সুযোগ।
টুর্নামেন্টের প্রথম হ্যাটিট্রিক করার গৌরব অর্জন করেছিল দেরাইশ মাইল খানের লেফট উইংগার মাহমুদ। বিপক্ষ দলটি ছিল বাহাওয়ালপুর। তারা ৫-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে ২-১ গোলে নেভিকে হারিয়ে ছিল। হায়দ্রাবাদ জিতেছিল ১-০ গোলে কোয়েটাকে। পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান রেল দল মুলতানের সাথে ২-২ গোলের ড্র করে প্রশংসিত হয়েছিল। আমাদের প্রথম খেলা ছিল শক্তিশালী করাচির সাথে। আমরা জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ০-১ গোলে পরাজিত হয়েছিলাম। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, করাচি টিমের রাইট-ইন ইসলাহউদ্দিন ঢাকায় ইস্পাহানি টিমের হয়ে লীগে খেলার সুবাদে আমাদের ইপিএসএফ টিমে নির্বাচিত হয়েছিল কিন্তু অসুস্থতার অজুহাতে টিমের সাথে না এসে পরবর্তীতে করাচি টিমের পক্ষে অংশ নেয় এবং আমাদের বিরুদ্ধেই খেলে জয়ী হয়।
১৯৬৭ সালের ফাস্ট এপ্রিল আমাদের হকির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন। জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের জন্মলগ্ন থেকে আমরা (ইপিএসএফ টিম) কোনদিন কোন টিমকে হারাতে পারিনি। সেবারই আমরা প্রথমবারের মত জয়ের মুখ দেখেছিলাম নেভিকে ১-০ গোলে পরাজিত করে। আমাদের জন্য যা ছিল গর্বের, আনন্দের। এ জয় ভবিষ্যতে ভাল হকি খেলার প্রেরণা হয়ে থাকবে। খেলার প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং হকি খেলার মানোন্নয়নে অনেকে এগিয়ে আসবেন। খেলার প্রথমার্ধে ২৭ মিনিটে আমরা একটা পেনাল্টি কর্নার পেয়েছিলাম। ফুলব্যাক মোমতাজ পোস্টে হিট করেছিল। বল গোলরক্ষকের প্যাড থেকে রিবাউন্ড হয়ে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়ার কাছে চলে যায়, আর সে চমৎকারভাবে সেটা থেকে গোল করলে আমাদের পুরো টিম আনন্দে মেতে ওঠে। গোল শোধ করার জন্য নেভি টিম আক্রমণ চালাতে থাকে। নেভি টিমের চাপ সামলাতে আমরা অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলতে থাকি। টিমের সবাই যেন গোল না খাওয়ার পণ করে যে যার দায়িত্ব দৃঢ়তার সাথে পালন করে গেছি আর জয়টাকে ধরে রাখতে আমরা লড়ে গেছি খেলার শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত। প্রথম জয়ের আনন্দ, বিশেষ একটা অনুভূত্ িযেমনটা হয়েছিল সাত বছর আগে এই করাচির ফুটবল মাঠে ১৯৬০ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের প্রথমবারের মত ফুটবল শিরোপা জয় করে। করাচিতে বসবাসরত বাঙালি ভাইয়েরাও আমাদের আনন্দে শামিল হয়েছিলেন। টুর্নামেন্টের কর্মকর্তা এবং সমর্থকরাও এগিয়ে এসেছিলেন আমাদেরকে অভিনন্দন জানাতে।
আমাদের টিমে সেদিন খেলেছিল : গোলরক্ষক-রণজিত দাস, ফুলব্যাক- মোমতাজ ও শফিক, হাফব্যাক-আজিজ, সাদেক এবং ইব্রাহিম সাবের, ফরোয়ার্ড-এহতেশাম, বশীর, রাজ্জাক, মোহাম্মদ হাসান এবং শেরা।
আমাদের পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশের কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হয়েছিল। খেলায় প্রচুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল পূর্ব রেল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারেননি শক্তিশালী দলটিকে। অন্যান্য ম্যাচের মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী মুলতানকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল। পেশওয়ার কোয়েটাকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। পাকিস্তান আর্মি দেরাইশ মাইল খানকে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলÑ যা ছিল ডিআই খানের জন্য খুবই হতাশাজনক হার; কারণ তারা গতদিনেই একই ফলাফল করে জয়লাভ করেছিল বাহাওয়ালপুর দলের সাথে। খেলা শুরুর ৭ মিনিটেই আর্মি টিমের লেফট-ইন জামির ডান দিক থেকে আসা একটি ক্রস রিসিভ করেই গোল করে। রাইট ফুল সাজ্জাদ পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড জাভেদ তৃতীয় গোল করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে লেফট ফুলব্যাক নাজিমুদ্দিন ৪র্থ গোল করলে ডিআই খানের গত গেমে হ্যাটট্রিক করা লেফট উইংগার মাহমুদ গোল করে ব্যবধান কমায়। পেনাল্টি কর্নারে আর্মির ফুলব্যাক সাজ্জাদ তার দ্বিতীয় গোল এবং রাইট-ইন আশফাক দলের পক্ষে গোলের সংখ্যা অর্ধডজন পূর্ণ করে। আর্মি টিম তাদের গোলের চাকা সচল রেখে পরদিন অর্থাৎ ৩ এপ্রিল বাহাওয়ালপুরকে ৫-০ গোলে পরাস্ত করে। গ্রুপের সবগুলো ম্যাচ জিতে আর্মি টিম গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর বাহাওয়ালপুর গ্রুপের সবগুলো ম্যাচ হেরেছিল। আর্মি টিমের তুখোড় লেফট-ইন জামির দু’গোল করা ছাড়াও সে ছিল আক্রমণভাগের প্রধান স্কিমার। খেলা শুরুর ১০ মিনিটের মধ্যেই আর্মি টিমের রাইট ফুল ব্যাক সাজ্জাদ পেনাল্টি কর্নারে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড জাভেদ এবং লেফট ইন জামির গোল করলে আর্মি বিরতির আগেই ৩-০ গোলের লিড নিয়ে নেয়। জামির দলের ৪র্থ গোল এবং জাভেদ গোল করে দলকে ৫-০ গোলের জয় এনে দেয়। কাস্টমস পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েকে ৫-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপের শীর্ষস্থানে অবস্থান করে। পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ টিমের লেফট ইন সাইডের খেলোয়াড় নাঈম মুলতানের বিরুদ্ধে চমৎকার হ্যাটট্রিক করে দলকে জয় এনে দিয়েছিল। পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল করাচিকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল আর পিআইএ গোলবন্যায় ভাসিয়ে ৯-০ গোলে হারিয়েছিল পেশাওয়ারকে। লাহোরও জয়লাভ করেছিল হায়দ্রাবাদকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে। আম্পায়াররা মাঠে উপস্থিত না থাকার কারণে নেভি আর সারগোদার ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
৫ এপ্রিল আমরা পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের কাছে ০-৭ গোলে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়েছিলাম। এই হারটা ছিল আমাদের জন্য খুবই হতাশার। শুরু থেকে তারা খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাঠে প্রাধান্য বিস্তার করে খেলতে থাকে। মাঠে আমাদের উপস্থিতি লক্ষ্যই করা যাচ্ছিল না। সারা মাঠজুড়ে অবাধে তারা বিচরণ করেছে।
আমরা তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেও পারছিলাম না। বিশেষ করে আফজাল মান্না, আখতার আর খুরশীদ আজম ‘ট্রায়ো’ মুহুর্মুহু আমাদের সীমানায় হানা দিয়ে ডিফেন্সকে তছনছ করে দিচ্ছিল আর এক এক করে গোল দিয়ে যাচ্ছিল। আফজাল মান্না জাতীয় দলের লেফট-ইন, লম্বা গড়ন, স্টিক বলে লম্বা লম্বা টান আর লম্বা স্টেপে আমাদের ডি বক্সে ঢুকে পড়াÑ কোনভাবেই তাকে রোধ করা যাচ্ছিল না। সে দু’গোল করলেও আখতার করেছে তিন গোল আর খুরশীদ আজম করেছে এক গোল। বাকি গোলটিও করেছিল আক্রমণভাগের খেলোয়াড় রাইট উইংগার ফারুক খান।
পিআইএ কোয়েটাকে ৫-০ গোলের পরাজিত করে গ্রুপের শীর্ষস্থান দখল করে নেয়। পিআইএ ‘ট্রায়ো’ হায়াত নিয়াজী আসাদ খুব একটা সফলতা পায়নি; নইলে গোলের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেত। বিরতি পর্যন্ত পিআইএ মাত্র ১টি গোল করতে পেরেছিল। হায়াত দু’গোল, নিয়াজী ও আসাদ বেশক’টি গোল মিস করার পর ১টি করে গোল করেছিল। নিয়াজী গোল করেছিল পেনাল্টি স্ট্রোক থেকে।
শক্তিশালী লাহোরকে দুর্বল পেশাওয়ার ১-১ গোলে বেঁধে রেখেছিল। যদিও লাহোর খেলার তৃতীয় মিনিটেই তারিক মিরের পাশে ইন সাইড লেফট রশীদ মালিকের দেয়া গোলে এগিয়ে যায়। জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে প্রথমার্ধ শেষ হয়। দ্বিতীয়ার্ধে পেশাওয়ার গোল শোধ করার জন্য লাহোরের ওপর চেপে বসে এবং শেষ পর্যন্ত রাইট ইন আমান উল্লাহ গোল শোধ করে ছাড়ে। লাহোর অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, খেলা ১-১ ড্র থাকে।
হাফ টাইম পর্যন্ত আমাদের পূর্ব পাক রেল দল লেফট-ইন ইকবালের দেয়া গোলে ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল। সেটা শোধ দিয়েছিল বিমানের রাইট-ইন গুলজার। আবারও ইকবাল তার দ্বিতীয় গোল করে পূর্ব রেল দল ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। খেলার শেষ মুহূর্তে বিমানবাহিনীর নিয়াজী গোল করলে আমাদের পূর্ব পাকিস্তান রেল দল জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মত জয়লাভের সম্মান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। খেলা ২-২ গোলে ড্র। প্রতিযোগিতামূলক খেলায় সারগোদা নেভিতে ১-০ গোলে হারিয়েছিল তাদের রাইট ইন আমিনের দেয়া গোলে। টুর্নামেন্টের অন্য একটি খেলায় ডিআই খান ৪-১ গোলে খায়েরপুরকে হারিয়েছিল।
৬ এপ্রিল আমরা সারগোদার সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ১-০ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। সেদিনের অপর একটি খেলায় পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন পুলিশ এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্সের খেলাটি ড্র হয়েছিল। নির্ধারিত সময় এবং অতিরিক্ত সময়েও কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। খেলার ধারা অনুসারে এয়ারফোর্সের জয় পাওয়া উচিত ছিল। তাদের দুর্ভাগ্য যে, তারা গোল পায়নি। অন্যদিকে খেলার ফলাফল ড্র হওয়ায় পুলিশের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছিল। তারা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। সেদিনে আরো একটি ম্যাচে রাওয়ালপিন্ডি সংঘবদ্ধ টিম হিসেবে চমৎকার খেলা প্রদর্শন করে ৪-০ গোলে খায়েরপুরকে হারিয়ে গ্রুপে দ্বিতীয় টিম হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল।
করাচির নাজমাবাদ কোম্পেনিয়ন স্পোর্টস ক্লাবের সভাপতি মোস্তাফিজ আহমেদ সিদ্দিকী আমাদের পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন করাচি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। খেলার পর সন্ধ্যায় আমরা গিয়েছিলাম। ইপিএসএফ হকি সেক্রেটারি আলমগীর আদেল, আমাদের টিম ম্যানেজার মাহমুদুর রহমান মোমিন, সেন্ট্রাল এক্সাইজ এন্ড ল্যান্ড কাস্টমসের কালেক্টর কমান্ডার এ হামিদ, পিডব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব কাফিলুদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। বক্তারা দুই উইং-এর মাঝে খেলাধুলার মাধ্যমে সেতুবন্ধন তৈরি করার কথা বলেন এবং খেলাধুলার উন্নতির সাথে দুই অঞ্চলের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খেলোয়াড়-সংগঠক সিভিল এবং মিলিটারির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। #
১৬ অক্টোবর ২০১১
(চুরাশি)
লিগ খেলা শেষে যে ৮টি দল কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল, সে দলগুলো হলো : পিআইএ, কাস্টমস, আর্মি, ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, ওয়েস্ট পাকিস্তান পুলিশ এবং লাহোর।
ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে রাওয়ালপিন্ডি জোনকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে প্রথম টিম হিসেবে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে রেল দল শক্তিশালী দল। তারপরও বিরতি পর্যন্ত খেলায় বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। প্রথমার্ধের ২০ মি. রেলের সেন্টার ফরোয়ার্ড খুরশীদ আজম আফজাল মান্নার কাছ থেকে বল পেয়ে প্রথম গোল করে। বিরতির ১০ মিনিটের মধ্যেই পিন্ডি টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড মোদাসসার গোল শোধ করলে তাদেরই দলের রাইট-ইন জুবায়ের পেনাল্টি কর্নারের রিবাউন্ড বলে গোল করে দিয়ে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। এ সময় পিন্ডি দল ডিফেন্সিভ হয়ে রেল দলকে গোল করার কোন সুযোগ দেয়নি। রেল দল গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। খেলায় উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং বেশ টাফ ও রাফ হয়ে ওঠে। রেল দলের খেলোয়াড়রা শক্তি প্রয়োগ করলে আম্পায়ার রেল দলের লেফট ফুলব্যাক আসলাম এবং লেফট ইন আফজাল মান্নাকে মাঠ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেন। পরবর্তীতে আম্পায়ার বহিষ্কৃত খেলোয়াড়দ্বয়কে যখন মাঠে খেলায় ফিরে আসার নির্দেশ দেন, তখন রেল দল যেন
জ্বলে ওঠে এবং পিন্ডি টিমের ওপর আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে থাকে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা
প্রায় ২০ মিনিটে, রেল দলের অলিম্পিয়ান লেফট আউট মতিউল্লাহ পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করলে ২-২ গোলের সমতা আনে। খেলার শেষ সময়ে পরপর দু’গোল করে রেল দল ৪-২ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে আর তাদের গোল করে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় আফজাল মান্না এবং খুরশীদ আজম।
অপর কোয়ার্টার ফাইনাল আর্মি এবং করাচি গোলশূন্য ড্র হয়। অতিরিক্ত ১৫ মিনিটেও কেউ কাউকে গোল দিতে পারেনি। করাচি টিমের তুলনায় আর্মি শক্তিশালী টিম কিন্তু আক্রমণভাগ খুবই বাজে খেলেছে। অন্যদিকে করাচি খেলার প্রথমদিকে কিছুক্ষণ নার্ভাস থাকলেও পরবর্তীতে তাদের লেফট ফুল ব্যাক মোমতাজ এবং লেফট হাফ ওয়াসিম বারী যেভাবে আর্মির রাইট ফ্ল্যাংককে সামাল দিয়েছে, তাতে তারা প্রশংসার দাবিদার। তাদের দৃঢ়তাপূর্ণ এবং তীক্ষè এন্টিসিপেশন দর্শকদের বাহবা কুড়ায়। করাচির সেন্টার হাফ মুজতবার দর্শনীয় খেলা দর্শকদের প্রচুর আনন্দ দেয়। আর্মি ৮৫ মিনিটে একটি সুযোগ পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয়। তারা ৮/৯টি পেনাল্টি কর্নার পেয়ে কোন সুফল লাভ করতে পারেনি।
৮ এপ্রিল পিআইএ ৪-০ গোলে পুলিশকে পরাজিত করে। কাস্টমস ৫-০ গোলে লাহোরকে এবং ফিরতি খেলায় আর্মি ২-১ গোলে করাচিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়। সেমিফাইনালের চতুর্থ টিম পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে পিন্ডিকে হারিয়ে আগেই উঠে গিয়েছিল।
পিআইএ খুবই স্কিলফুল টিম। সেদিন তাদের ডিফেন্স অ™ভুত সুন্দর খেলে পুলিশের আক্রমণকে একেবারেই অকেজো করে রাখে। পিআইএ গোল পেতে ২২ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। লেফট-ইন আসাদ মালিকের কাছ থেকে বল পেয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজী লম্বা লম্বা কদমে দ্রুত পুলিশের ডি’তে ঢুকে প্রচন্ড জোরে হিট দ্বারা গোলরক্ষককে পরাস্ত করে (১-০)। আসাদ মালিক বল নিয়ে একক চেষ্টায় ডি-বক্সে ঢুকে হিট করলে গোলরক্ষক প্যাড করে ফিরিয়ে দিলে পিআইএ দলের আগুয়ান সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজীর কাছে বল গেলে সেটার সদ্ব্যবহার করে দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেয়। দু’গোলে পিছিয়ে পুলিশ সমান তালে লড়তে থাকে এবং গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকে কিন্তু পিআইএ টিমের ডিফেন্স অত্যন্ত সুন্দর খেলে পুলিশের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করে। হায়াত মাহমুদ পিআইএ’র রাইট-ইন পরপর দু’গোল করে টিমকে ৪-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে। কাস্টমস অতিসহজেই লাহোরকে ৫-০ গোলে পরাজিত করে সেমিফাইনালে ওঠে। বিরতি পর্যন্ত তারা দু’গোলে এগিয়ে ছিল। সব দিক দিয়ে কাস্টমস ছিল শক্তিশালী দল। সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খান এবং ফুল ব্যাক খুরশীদ আসলামের বিপক্ষ দলের আক্রমণের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি থাকায় তারা সফল হতে পারেনি।
লাইক তার নিজস্ব স্টাইলে বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে হিট মারার পূর্বে বিপক্ষ খেলোয়াড় দ্বারা অবৈধ বাধা পায়। ফলে পেনাল্টি কর্নার যা থেকে ফুলব্যাক খুরশীদ আসলাম দলের পক্ষে প্রথম গোল করে। সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াহিদ লেফট ইন লাইক এবং লেফট আউট জাহাঙ্গীরের সম্মিলিত আক্রমণে ওয়াহিদ সেটার সুন্দর সমাপ্তি ঘটায় টিম ২-০ গোলে লিড নেয়। দু’গোল খাওয়ার পর লাহোর অনেকটাই হাল ছেড়ে দেয়। মজুতবার একটি সুন্দর পাশে রাইট আউট খালেদ মাহমুদ দলের পক্ষে ৩ নম্বর গোল করে। লাইক ডি’র ভেতর ঢুকে গোলপোস্টে হিট করার সুযোগ না পেয়ে আনোয়ারকে বল দিলে সে সেটা থেকে গোল করে ৪-০। গোলটি ছিল অ™ভুত সুন্দর। কাস্টমসের মুজতবা এবং লাহোরের লেফট ফুলব্যাক হুমায়ুনের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে স্টিক দিয়ে আঘাত করতে উদ্ধত হলে আম্পায়ার দুজনকেই মাঠ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেন, যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদেরকে খেলায় ডাকা হয়। রাইট আউট খালেদ মাহমুদ খুবই সুন্দর খেলা প্রদর্শন করে এবং শেষ গোলটিও সে করে।
অপর কোয়ার্টার ফাইনাল যা আগের দিনে ড্র ছিল আর্মি বনাম করাচি, খেলার ৫ মিনিটেই আর্মির সেন্টার ফরোয়ার্ড শাফাত বোগদাদী গোল করে দলকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। বিরতি পর্যন্ত সেটাই ছিল রেজাল্ট। দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মি. লেফট হাফ পারভেজ ডি’র বাইরে থেকে একটি ফ্রি হিট মারলে রশীদ সেটা থেকে গোল করে আর্মি দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেয়। এর এক মিনিট পরই করাচির রাইট-ইন ইসলাহ গোল করে ১-২ গোলের ব্যবধান কমায়। উল্লেখ্য, করাচির ইসলাহউদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তান টিমে চান্স দেয়া হয়েছিল কিন্তু সে অসুস্থতার ভান করে আমাদের টিমে না খেলে করাচির পক্ষে খেলেছে। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। করাচি গোল শোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কিন্তু করাচির সেন্টার ফরোয়ার্ড খালেক সব চেষ্টার ওপর পানি ঢেলে দেয় অনেকগুলো গোলের সুযোগ নষ্ট করে; নইলে খেলার ফলাফল অন্যরকম হতো। তারপরও বলতে হয়Ñ করাচি খুব ভাল খেলেছে। ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম দল হিসেবে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল আর্মিকে ১-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উঠেছিল। গোলটি করেছিল রেল দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড আক্তার। প্রথমার্ধের ১০ মিনিটের এ গোলটি শেষ পর্যন্ত ফলাফল নির্ধারণ করে দিয়েছিল। খেলা নিয়ে সবার প্রত্যাশা ছিল যে, খেলা মানসম্মত এবং উপভোগ্য হবে। বাস্তবে তা হয়নি। দুই টিমই গোল করার সুযোগ নষ্ট করেছে। রেল দলের আক্রমণভাগ ভাল খেলেছেও। তাদের ডিফেন্সের দুর্বলতা মাঠে স্পষ্ট দেখা গেছে কিন্তু আর্মি সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বলেই হার স্বীকার করতে হয়েছে। তবে নৈপুণ্যের ঝলক মাঠে উপস্থিত দর্শকরা যে মাঝেমধ্যে দেখেননিÑ তা বলা যাবে না। কাস্টমস এবং পিআইএ’র অপর সেমিফাইনালটি ১-১ গোলে ড্র হওয়ায় আগামী দিন বিকেল ৪-৪৫ মি. পুনরায় খেলাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ফাইনাল খেলাটিও পিছিয়ে দিয়ে আগামী ১১ এপ্রিল তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
নৈপুণ্যে ভরপুর দুটো টিম কাস্টমস এবং পিআইএ হকি ক্লাব অব পাকিস্তান স্টেডিয়ামে দর্শকদের বিমোহিত করে রেখেছিল পুরো সময়। খেলা খুবই দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিল, মুহূর্তে মুহূর্তে সীমানা বদল হচ্ছিল বলের। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ আর উপভোগ্য হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে বল কাস্টমসের কাছেই বেশি ছিল। পিআইএ দলের রাইট-ইন হায়াত প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে দ্রুতগতিতে তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড তারিক নিয়াজীকে দিলে সে খুব চমৎকার একটি গোল করে। তারপর থেকে কাস্টমস গোল শোধ করার চেষ্টা করে যায়। মুজতবার নেয়া ডি’র ভেতর থেকে গোলপোস্টে হিট করলে গোলরক্ষক তা ফিরিয়ে দেয়। এর কিছুক্ষণ পরই কাস্টমস একটি পেনাল্টি কর্নার লাভ করে এবং তা ফুলব্যাক খুরশীদ আলম হিট করে। পিআইএ দলের গোলরক্ষক হামিদ প্যাড করলে বল গোললাইনেই থাকে আর রাইট আউট খালেদ মাহমুদ ছুটে গিয়ে তা গোলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দলকে সমতায় ফেরায় (১-১)। শেষ পর্যন্ত কোন দলই আর গোলের দেখা পায়নি।
১০ এপ্রিল পিআইএ ফাইনাল খেলার যোগ্যতা পেল আর কাস্টমকে দুর্ভাগ্যবশত শেষ মিনিটে গোল খেয়ে বিদায় নিতে হলো। জয়সূচক গোলটি এসেছিল আসাদ মালিকের স্টিকের ছোঁয়ায়। এ খেলায়ও ছিল দৃষ্টিনন্দন স্টিকের ঝলকানি। জেতার জন্য জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধের ৩৪ মি. পিআইএ দলের ফুলব্যাক কামার আলী খান পেনাল্টি কর্নার হিট করে। কাস্টমসের গোলরক্ষক জহুর প্যাড দিয়ে তা আটকালেও বল চলে যায় ছুটে আসা লেফট ইন আসাদ মালিকের কাছে আর সে সুন্দরভাবে পুশ করে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। কাস্টমসের খালেদ মাহমুদের বানিয়ে দেয়া বল ওয়াহিদ মিস করাটা ছিল অমার্জনীয়। অবশ্য পিআইএ দলের হায়াতও দুটো গোল মিস করেছিল। বিশ্বের সেরা সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খানের (কাস্টমস) অবাক করা ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন মাঠের দর্শকরা আনন্দের সাথে উপভোগ করেছে। খেলার পূর্বে দু’দলের খেলোয়াড়দের পাকিস্তান নেভির সিএনসি রিয়াল এডমিরাল আহসানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
১১ এপ্রিল ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ ’৬৭-এর ফাইনাল খেলা। প্রায় ২০ হাজার দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ মুসা, এয়ার মার্শাল এম নূর খান, সিএনসি পাকিস্তান এয়ারফোর্স এসএম জাফরি, ভাইস চেয়ারম্যান ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন ব্যুরো সৈয়দ দরবার আলী শাহ, করাচির কমিশনার, ঊর্ধ্বতন সিভিল এবং মিলিটারি কর্মকর্তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় ফাইনাল খেলাটি উপভোগ করেছিলেন।
১ নভেম্বর ২০১১
(পঁচাশি)
পিআইএ দলের দ্রুতগতিসম্পন্ন রাইট উইংগার শওকত আলী অতিরিক্ত সময়ের ১৫ মিনিটের দুই অর্ধে দুটো গোল করে রীতিমত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
খেলার পুরো ৭০ মিনিট হকি ক্লাব অব পাকিস্তান স্টেডিয়ামের দর্শকরা ফাইনাল খেলাটি সত্যিকার অর্থে ফাইনাল খেলাই দেখেছিলেন। উত্তেজনায় ভরপুর দুই টিমের জেতার লড়াই, গোল করার সব কলাকৌশল প্রয়োগ, ব্যক্তিগত ও দলগত নৈপুণ্য, উন্নতমানের হকি ফাইনালে সবই ছিল, শুধু ছিল না গোল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটি প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠলেও কোন দলই গোল পাচ্ছিল না।
খেলার ১৭ মিনিটে রেল দল আফজাল মান্নার সেন্টার ফরোয়ার্ড আক্তারের উদ্দেশে মাঠচেরা থ্রু পাস দিয়ে প্রথম পিআইএ দলের সার্কেলে হানা দেয় কিন্তু আক্তারের হিট গোলরক্ষক হামিদ পেনাল্টি কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেছিল। পেনাল্টি কর্নারও কোন সুফল দিতে পারেনি। পিআইএ টিমের লেফট ইন আসাদ মালিকের দুর্বল হিট পোস্টের বাইরে চলে গেলে তারা একটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফুলব্যাক রিয়াজের পেনাল্টি কর্নারের হিট ‘স্টিক’-এর কারণে বাতিল হলে পিআইএ এ সুযোগও নষ্ট করে দেয়। পিআইএ দলের আক্রমণ তাদের অন্যান্য দিনের ম্যাচের মত তত ক্ষুরধার ছিল না; কারণ সেদিন তাদের লেফট ব্যাক সচল ছিল না। তাদের বেশিরভাগ আক্রমণ হচ্ছিল ডান দিক দিয়ে। রেল দলের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে খেলেছিল, বিশেষ করে তাদের রাইট হাফ জাফর ইকবাল এবং সেন্টার হাফ আনোয়ার শাহ খুবই সতর্কতার সাথে পিআইএ’র আক্রমণ ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একসময় খেলোয়াড়দের বেশ উত্তেজিত হয়ে খেলতে দেয়া যায়। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটে আম্পায়ার খুরশীদ পিআইএ দলের আসাদ মালিক এবং রেল দলের আসলামকে রাফ খেলার কারণে মাঠ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে খেলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। খেলার ধারানুযায়ী যে কোন দল গোল করে চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করতে পারতো কিন্তু ভাগ্য পিআইএ দলের দিকে থাকায় তাদের শওকত আলী আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় শূন্য অ্যাঙ্গেল থেকে গোল করতে পেরেছিল। খেলার অতিরিক্ত ১৫ মিনিটের দুই অর্ধে দুই গোল করে মাঠে চাঞ্চল্যের সৃষ্টিই করেনি বরং শওকত আলী টিমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং উজ্জ্বল নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ফাইনালে ‘হিরো’ হয়ে গিয়েছিল।
পিআইএ টিম : গোলরক্ষক-হামিদ, ব্যাক-রিয়াজ ও কামার আলী খান, হাফ-আনোয়ার, সাঈদ আনোয়ার এবং ফজলুর রহমান, ফরোয়ার্ড-শওকত, হায়াত, তারিক, নিয়াজী, আসাদ মালিক।
পাক ওয়েস্টার্ন রেল : গোলরক্ষক-আক্তার (জুনিয়র), ব্যাক-জাফর বেগ ও এম আসলাম, হাফ-জাফর ইকবার, শওকত ও আক্তার সিনিয়ার, ফরোয়ার্ড-ফারুক খান, খুরশীদ আজম, আখতার, আফজাল মান্না ও মতিউল্লাহ।
১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় পজিশনের জন্য কাস্টমস এবং পাক আর্মি খেলেছিল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে লেফট-ইন লাইকের দেয়া একমাত্র গোলে কাস্টম তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল।
এয়ার মার্শাল নূর খান পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের দায়িত্ব নেয়ার পর তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭তম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ ’৬৭ সম্পূর্ণ নতুন ফরমেটে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। তারই নির্দেশে পেশাওয়ারে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মাধ্যমে নতুন খেলোয়াড় তৈরি এবং জাতীয় দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে নির্বাচন কমিটি ৫৮ খেলোয়াড়কে বাছাই করেছিলÑ যারা পরবর্তীতে ট্রায়ালের মাধ্যমে পেশাওয়ার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ খান এবং নির্বাচকমন্ডলী লে. কর্নেল এমএইচ আতিফ, খাজা আসলাম, নেওয়াজ খান ও মাহমুদ এপ্রিলের ৮ ও ৯ এবং ১২ ও ১৩ তারিখে হকি ক্লাব অব পাকিস্তান, স্টেডিয়ামে ট্রায়াল ডেকে সেখান থেকে ৪৪ খেলোয়াড়কে পরবর্তীতে পেশাওয়ারে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য নির্বাচন করেছিলেন।
নির্বাচিত খেলোয়াড়রা
গোলরক্ষক-হামিদ, আখতার (জুনিয়র), সালাহউদ্দিন, জাফর এবং আনোয়ার। ফুলব্যাক-তানভীর দার, সাজ্জাদ, আখতারুল ইসলাম এবং ইজাজ বাট। হাফব্যাক-রশিদ, আনোয়ার শাহ, সামি, কাইয়ুম নিয়াজী, সাঈদ আনোয়ার, রিয়াজ, আলে মোজতবা, বশীর (লাহোর), আখতার (সিনিয়র), দেলাওয়ার, গুলরেজ এবং ফজলুর রহমান। ফরোয়ার্ড-খালেদ মাহমুদ, ফারুক খান, বশীর আহমেদ (ইস্ট পাকিস্তান), ইসমাইল, খুরশীদ আজম, ইসলাহ উদ্দিন, আশফাক, আমান উল্লাহ, তারিক নিয়াজী, শাফকাত বোগদাদী, মোদাসসির, কাসানী, লাইক, আসাদ মালিক, জামির, রশিদ, জাহাঙ্গীর বাট, মতিউল্লাহ, সাব্বির, মাহবুব এবং খিজির বাজওয়া। ৮ খেলোয়াড়কে স্ট্যান্ডবাই : ইসলাম, রঞ্জিত দাস, সাদেক, ফারুক মীর, মেহেদী, হাজী নেওয়াজ, ইব্রাহিম সাবেরকে।
এয়ার মার্শাল নূর খানের হকি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হকি খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করার জন্য ‘গোল্ড স্টার’, ‘সিলভার স্টার’ এবং ‘সিলভার প্লেট’ এই তিন ধরনের পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছিল। হকি খেলায় যারা বিশেষ অবদান রেখেছে, তাদের খেলার ক্যারিয়ার অনুযায়ী এ পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হকি উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা/অর্গানাইজারদেরকেও ‘সিলভার প্লেট’ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ শেষে ১২ এপ্রিল করাচিতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। যারা এ পুরস্কার পেয়েছিল, তারা হলো : আনোয়ার আহমেদ খান (কাস্টমস-এর খেলোয়াড়) তার স্বর্ণোজ্জ্বল ক্যারিয়ার পাকিস্তান হকিতে অশেষ অবদান রাখার জন্য হকি ফেডারেশন তাকে ‘গোল্ড স্টার’ পুরস্কার প্রদান করে। সাইদ আনোয়ার (পিআইএ’র খেলোয়াড়) পাকিস্তান হকি দলের সাবেক অধিনায়ক এবং অলিম্পিয়ানকে ‘সিলভার স্টার’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কামার আলী খান (পিআইএ’র খেলোয়াড়) দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় হকি দলের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ফুলব্যাকের দায়িত্ব পালন করে গেছে, তাকে ‘সিলভার প্লেট’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। পাকিস্তান হকিকে দীর্ঘদিন যাবৎ সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছে পাকিস্তান কাস্টমস, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে ‘সিলভার প্লেট’ প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়। করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে দারুণ একটা সুখবর পেলাম। পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া লেখক সমিতি ৭ এপ্রিল তাদের সভায় আমাকে ১৯৬৬-৬৭ সালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করেছে। ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদানের দিন ঠিক করা হলেও উক্ত দিনে আমাকে হকি ট্রায়ালের জন্য করাচিতে অবস্থান করতে হয়েছিল; সেজন্য অনুষ্ঠানের তারিখ পিছিয়ে ১৬ এপ্রিল করা হয়।
পুরস্কার পাওয়া সব সময়ই আনন্দের। স্কুলে পড়ার সময় থেকে ক্রীড়াঙ্গনের বহু পুরস্কার পেয়েছি; তবে ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ এরকম মর্যাদা আর সম্মানের পুরস্কার পাওয়ার ইচ্ছা মনে গোপন করে রেখেছিলাম অনেক দিন ধরে। এ পুরস্কারের জন্য ক্রীড়াবিদরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে, সবার ভাগ্যে এ সম্মান জোটে না। সেদিক দিয়ে আমি ভাগ্যবান, আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করেছেন- তাকে শুকরিয়া জানাই। পুরস্কারের সংবাদটি আমাকে অত্যন্ত আনন্দিত করলেও আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ আমি পাইনি। ঢাকায় পা রেখেই আমাকে হকি মাঠে সকাল-বিকাল অনুশীলনে কাটাতে হচ্ছিল। একদিকে হকি লিগে শিরোপা জয়ের লড়াই, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সম্মান বাঁচানোর লড়াই। ১৬ এপ্রিল বিকাল চারটায় ঢাকা স্টেডিয়ামের প্লেয়ার্স লাউঞ্জে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ১নং গেট দিয়ে ঢুকে হাতের ডান দিকে, এখন যেখানে লিফট লাগানো হয়েছে, ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান ছিল না, ছিল ফাঁকা যায়গা, সেখানে প্রভিন্সিয়াল হকি ফুটবলের ক্যাম্প করা হতো) সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার মত মানানসই কাপড় বাসায় খুঁজে পেলাম না। একটা সাদা হাফ হাওয়াই শার্ট আর একটা প্যান্ট পরে চলে গেলাম।
অনুষ্ঠানও আমার পোশাকের মত সাদামাটা। বিস্তারিত আমার মনে নেই। তবে শাহ আজিজুর রহমান, জহিরুদ্দিন, কেজি মোস্তফা, লাডু ভাই, তৌফিক আজিজ ভাই, বদি ভাই, মূসা ভাইÑ এদের কথা মনে আছে আর আতিকুজ্জামান খান সাহেবের চশমা পরা সৌম্য-ভদ্র চেহারাটা লিখতে বসেও চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সেদিন যারা আমার পরিচিতজন ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন। বেঁচে আছেন মূসা ভাই, আল্লাহ তার হায়াত দারাজ করুন। টিভি টকশোতে মূসা ভাইকে দেখলে আমার সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার নেয়ার দিনটির কথা মনে পড়ে যায়, কানে ভেসে আসে ‘ভাল করে খেলবা, বাঙালিদের ইজ্জত রাখবা।’ মনে পড়ে যায় সেদিন তাদের কাছ থেকে যে অকৃত্তিম স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছিলাম, যা আজও আমাকে ক্রীড়াঙ্গনে চলার প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলার প্রতি তাদের যে নিখাদ ভালবাসা দেখেছি, তাদের মাঝে যে আন্তরিকতা দেখেছি, সম্মানবোধ দেখেছিÑ সেটা ভোলার নয়। সে পথ ধরে ক্রীড়াঙ্গনে আমি হাঁটার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বড় একটা কাপ পুরস্কার পাওয়ার সাথে এতসব গুণীজনের আদর-স্নেহ সেদিন ছিল আমার কাছে অনেক পাওয়া।
ক্রীড়ালেখক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জামান খানের ডোনেশন দেয়া কাপটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ডিআইটির চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। লিখতে বসে তার কাছ থেকে পুরস্কার নেয়ার দৃশ্যটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আসছে। উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিদের অভিনন্দন গ্রহণ এবং বিনিময়ে ধন্যবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে কখন যে অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল টের পাইনি। মনের আনন্দে কাপ হাতে রিকশা করে বাসায় ফিরলে এত বড় কাপ দেখে সহজ-সরল মা আমার খুবই খুশি হয়েছিলেন সেদিন। ড্রইংরুমে আমার পাওয়া ছোট ছোট কাপগুলোর পাশে এই বড় কাপটি রেখেছিলামÑ যা আজও ড্রইংরুমে মাথা উঁচু করে আমাকে আমার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে; আমার সব ক্রীড়া কর্মকান্ডের জন্য প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে।
১৬ নভেম্বর ২০১১
(ছিয়াশি)
পরদিন পত্রিকার মন্তব্য ছিল এরকম (অংশবিশেষ)Ñ ‘ঞযব চড়ষষংঃবৎং যধফ হড় ফরভভরপঁষঃু রহ ৎবধপযরহম ধ ফবপরংরড়হ ইধংযরৎ অযসবফ ৎবধপযষু ফবংবৎাবং ঃযব যড়হড়ঁৎ. ঐব যধং ৎবঢ়ৎবংবহঃবফ ঊধংঃ চধশরংঃধহ নড়ঃয রহ ভড়ড়ঃ নধষষ ধহফ যড়পশবু. ইঁঃ ঃযরং ঃৎড়ঢ়যু রং হড়ঃ ধধিৎফবফ ড়হ চষধুরহম ধনরষরঃু ধষড়ষহব. ইবযধারড়ঁৎ ড়হ ধহফ ড়ভভ ঃযব ভরবষফ রং মৎবধঃ রসঢ়ড়ৎঃধহপব. অ ফরংঢ়ষধু ড়ভ ঃধহঃৎঁসং, রসসবফরধঃবষু ফরংয়ঁধষরভরবং ধ ঢ়ষধুবৎ, যড়বিাবৎ মড়ড়ফ যব সধু নব. ঞযব রফবধ নবযরহফ ঃযব ধধিৎফরহম ড়ভ ঃযরং ঃৎড়ঢ়যু রং ঃযব ভড়ংঃবৎরহম ড়ভ ঃযব ংঢ়ড়ৎঃরহম ংঢ়রৎরঃ; রঃ রং পড়সসবহফধনষব.”
গড়ৎহরহম হবংি (১৭.৪.৬৭) পত্রিকার মন্তব্য ছিল, ‘অ ঠরৎরষ ধহফ ুড়ঁহম ঢ়ষধুবৎ ইধংযরৎ যধং ধ ষড়হম ংঢ়ড়ৎঃরহম পধৎববৎ ধযবধফ ড়ভ যরস. ঝঢ়বধশবৎং ধঃ ঃযব ভঁহপঃরড়হ ুবংঃবৎফধু সধরহঃধরহবফ ঃযধঃ যড়হড়ঁৎ নবংঃড়বিফ ড়হ ইধংযরৎ পড়ঁষফ নব পড়হংরফবৎবফ ধং যড়হড়ঁৎ ভড়ৎ ধষষ ঃযব ংঢ়ড়ৎঃংসবহ. ঞযবু পধষষবফ ঃড় ভড়ষষড়ি যরং ভড়ড়ঃংঃবঢ়ং ধহফ সধরহঃধরহ ফবপরঢ়ষরহব রহ ধহফ ড়ঁঃ ড়ভ ভরবষফ.’
১৭ এপ্রিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি খেলার মাঠে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি হকি টিমের সৌজন্যমূলক হকি খেলা। পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মিলিত ইউনিভার্সিটি হকি টিম পূর্ব পাকিস্তানে ইউনিভার্সিটিগুলোর সাথে সৌজন্যমূলক হকি খেলার জন্য এসেছিল। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাথে প্রথম ম্যাচ। দুপুর বেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। আমরা কিছুটা খুশি হয়েছিলাম বৃষ্টি হয়েছিল বলে। আমাদের ধারণা পশ্চিম পাকিস্তানের বৃষ্টি কম হয়; সুতরাং বৃষ্টির মাঠে তারা তাদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারবে না। পিচ্ছিল মাঠের সুবিধা নিয়ে আমরা তাদের চেয়ে ভাল খেলা প্রদর্শন করে জয়লাভ করতে পারবো। মাঠে নেমেই বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের ধারণাটা একেবারেই ভুল। খেলা শুরু হলে আমাদের সব জল্পনা-কল্পনা ভেঙ্গে দিয়ে তারাই স্বাভাবিক খেলা খেলছিল আর আমরাই বরং পিচ্ছিল মাঠে খেলতে অসুবিধা বোধ করছিলাম। বল কন্ট্রোল, ডজিং, পাশিং সবই তাদের স্বাভাবিক ছিল। তবে গতি কিছুটা ধীর ছিল, সে তুলনায় আমাদের সব টেকনিক ছিল অস্বাভাবিক, বল কন্ট্রোল হচ্ছিল না, পাসিং ছিল এলোমেলো, বল নিয়ে দ্রুতগতিতে ছোটা ছিল অনেকটা অসম্ভব।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ইউনিভার্সিটিগুলো থেকে বাছাই করা খেলোয়াড়দের খেলার সমঝোতার কিছু অভাব দেখা গেলেও আমাদের টিমের অবস্থা ছিল ছন্নছাড়া। আমরা যারা পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমের হয়ে এ মাসের প্রথম দিকে খেলতে করাচি গিয়েছিলাম, তারাই কিছুটা খেলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। খেলোয়াড়দের দমের অভাব, সমন্বয়ের অভাব, প্র্যাক্টিসের অভাব, চোখে পড়ার মত বাজে পারফরমেন্স। সম্মিলিত ইউনিভার্সিটির টিম আমাদের তুলনায় অনেক ভাল টিমÑ তা মাঠে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সফরকারী দল প্রথম থেকেই প্রাধান্য বিস্তার করে খেলছিল এবং আমাদের ওপর চড়াও হয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। খেলার ১০ মিনিটেই তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড মোদাস্সির গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দেয়। খেলার ১৫ মিনিটেই তারা আরও একটি গোল করে নির্ভার হয়ে খেলতে থাকে। ধীরে ধীরে আমরাও তাদের সাথে অ্যাডজাস্ট হয়ে উঠি এবং স্বাভাবিক খেলার চেষ্টা করি এবং বিরতির পর আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকি। আমাদের রক্ষণভাগ দৃঢ়তার সাথে তাদের আক্রমণ সামলাতে থাকে। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে ২০ মিনিটে আমি বল পেয়ে একক প্রচেষ্টায় বিপক্ষ দলের ডি-বক্সে ঢুকে সজোরে হিটের মধ্যে গোল করলে গোলের ব্যবধান কমে ২-১ দাঁড়ায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা চিৎকার দিয়ে আমাদের উৎসাহ জোগাতে থাকে। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণে খেলাটা চরম উত্তেজনার সৃষ্টি করে। সফরকারী হকি টিম তখন কিছুটা চাপের মুখে পড়ে যায়। আমরা সে সুযোগে আমাদের আক্রমণকে জোরদার করি এবং তার ফলও আমরা পেয়েছিলাম একটি পেনাল্টি স্ট্রোকের আশীর্বাদ পেয়ে কিন্তু সাদেক সেটা মিস করলে গোল শোধ করার সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায়। খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে আমাদের ডিফেন্সের অসতর্কতার জন্য সফরকারী দল আরো একটি গোল করলে আমরা ১-৩ গোলে হেরে যাই।
পশ্চিম পাকিস্তান সম্মিলিত ইউনির্ভার্সিটি টিমে যারা খেলেছিলÑ
হারুন, রাজ্জাক এবং খালেদ, ওমর, খায়ের এবং আফজাল, তাহির নাজির, সাঈদ, মোদাসসির, আজিজ এবং আলতাফ।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি দল : রশিদ, ইকবাল এবং রাব্বী, এহতেশাম, সাদেক এবং ইব্রাহিম সাবের, আব্দুল হক, বশীর, বুলবান, প্রতাপ এবং মীর আনোয়ার করিম।
১৮ এপ্রিল থেকে হকি লীগ পুনরায় শুরু হয়েছিল। জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে দুটো টিম অংশগ্রহণ করায় ঢাকার হকি লীগ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। বারবার খেলা স্থগিত হওয়ার ফলে ক্লাব কর্মকর্তা, সংগঠক এমনকি দর্শকগণের কাছেও লীগের গুরুত্বটা কমে গিয়েছিল। লীগের অবশিষ্ট খেলার প্রতিও তারা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল। রেলওয়ে পাক পিডব্লিউডিকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করার মধ্যদিয়ে বন্ধ থাকা লীগের দরজা খুলেছিল। রেলদলের ৭ গোলের ৪ গোলই করেছিল তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড রাইস। বাকি ৩ গোল করেছিল ফুরব্যাক ওয়াহিদুল্লাহ, দুই ইন নাসিরুল্লাহ ও নিয়াজ। প্রথম দিনের অপর খেলা ন্যাশনাল ব্যাংক বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং-এর খেলা বৃষ্টির জন্য বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
কম্বাইন্ড তাদের ১৯ তারিখের খেলায় পাক পিডব্লিউডিকে দ্বিতীয়ার্ধের শেষ মুহূর্তে ২-০ গোলে জয়লাভ করে লীগ শিরোপা জয়ের আশা জিইয়ে রেখেছিল। তাদের দুই ইন বুরবান এবং প্রতাপ গোল দুটো করেছিল। স্লিপারী মাঠে খেলাটি খুবই বাজে হয়েছিল। দিনের অপর খেলা রেল বনাম ভিক্টোরিয়া। বৃষ্টির কারণে মাঠে অনুপযুক্ত থাকায় খেলাটি বাতিল করা হয়।
আমাদের খেলা কম্বাইন্ডের সাথে।
খেলা শুরু থেকে কম্বাইন্ড ভাল খেলছিল এবং বেশ কয়েকটা সহজ সুযোগ নষ্ট করেছিল, বিশেষ করে তাদের রাইট-ইন বুলবান এবং রাইটআউট সিকান্দার যে মিস করেছে তা ছিল অমার্জনীয়। তবে তারাই প্রথম গোল করেছিল তাদের লেফট-আউট ফুয়াদের মাধ্যমে। গোল শোধ করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম এবং এক পর্যায় আমাদের টিম ড্র করতে সক্ষম হয়েছিল আমার দেয়া গোলের সাহায্যে। আমাদের দুটিমের খেলা ড্র হওয়ায় দু টিমের পয়েন্টও সমান হয়েছিল। আমরা উভয় টিমই ৫ পয়েন্ট করে নষ্ট করেছিলাম। তবে আমরা পাঁচ টিমের সাথে ড্র করেছিলাম আর কম্বাইন্ড ওয়ারীর কাছে হেরেছিল এবং মাহুৎটুলী, রেলওয়ে এবং আমাদের সাথে ড্র করেছিল। আমরা ড্র করেছিলাম ওয়ারী, বিমানবাহিনী, রেলওয়ে মাহুৎটুলী এবং কম্বাইন্ডের সাথে। হকি লীগ কমিটি আমাদের দু টিমকেই যুগ্ম রানার্সআপ ঘোষণা করেছিল। এর আগেই ওয়ারী ক্লাব পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করায় (তারা তিন খেলায় মাহুৎটুলী, ভিক্টোরিয়া এবং আমাদের সাথে ড্র করে ৩ পয়েন্ট নষ্ট করেছিল এবং সে সুবাদে ১৯৬৭ সালের হকি লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
ক্রীড়ালেখক সমিতি ১৯৬৬-৬৭ সালের জন্য আমাকে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কৃত করায় কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি (মরহুম) চৌধুরী দাবীর আহমেদ সিদ্দিকী আমার সম্মানে ২৮-৪-৬৭ তারিখে একটি মধ্যহ্ন ভোজের আয়োজন করেছিল চুং ওয়াহ চাইনিজ হোটেলে। মধ্যহ্ন ভোজে ক্লাবের সদস্য ছাড়াও খেলোয়াড়, সংগঠক এবং ক্রীড়া সাংবাদিকগণ উপস্থিত হয়েছিলেন। আমি সে সময় কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সেদিন বন্ধুদের প্রীতিভোজ আমাকে এক আবেগময় ভালবাসায় ভাসিয়ে ছিল।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট পরবর্তীতে ‘অল পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ’ হিসেবে পাকিস্তানের সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেছিল এবং প্রথমবারের মত ১৯৬৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের দুটো টিম অংশগ্রহণ করায় টুর্নামেন্টের গুরুত্ব এবং আকর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক, করাচি এবং করাচি কাস্টমসসহ মোট ১৫টি টিম টুর্নামেন্টে এন্ট্রি করেছিল। ঢাকার লীগে অংশ নেয়া প্রায় প্রত্যেকটি টিম যেমন, ওয়ারী, ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, পুলিশ এসি, ঢাকা মোহামেডান ভিক্টোরিয়া, রেলওয়ে, পাক পিডব্লিউডি, বিমানবাহিনী, ইপিআর এবং ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সি তাছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে সাইয়েদপুর রেলওয়ে এবং চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া টুর্নামেন্টের প্রথম খেলা ৩.১৫ মি. ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা বনাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি এবং দ্বিতীয় ম্যাচ ৪.৩০ মি. ওয়ারী বনাম পুলিশ।
উদ্বোধনী খেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি টিম মাঠে উপস্থিত না হওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা টিমের ওয়াক-ওভার পাওয়ার মধ্যদিয়ে আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল। যা ছিল দুঃখজনক।
দ্বিতীয় খেলা ওয়ারী বনাম পুলিশ। আম্পায়ারদের দুর্বল আম্পায়ারিং এ খেলাটিকেও হাস্যরসে পরিণত করেছিল। এর জন্য সম্পূর্ণ দোষ ছিল পুলিশ টিমের। তারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে দু দুবার খেলায় গন্ডগোল পাকিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রথমবার পুলিশের লেফট-আউট শরিফ আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আম্পায়ার কামার সহিদকে গাল দিলে আম্পায়ার তাকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করে এতে শরিফ আরো উত্তেজিত হয়ে অস্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুরু করে এতে খেলা স্থগিত হয়। সহ আম্পায়ার ঈশা খান তাদের ক্যাপ্টেনকে ডেকে শরিফকে মাঠ ত্যাগ করতে বলেন। পাঁচ মিনিট পর শরিফ মাঠে ঢুকে উত্তেজিতভাবে খেলা শুরু করে। এদিকে ওয়ারী শক্তিশালী দল হিসেবে ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। প্রথম গোল করেছিল ওয়ারীর লেফটআউট শফি আর দ্বিতীয়টি করেছিল নিয়াজ আহমেদ। প্রথম গোল খাওয়ার পর থেকে পুলিশ দল আম্পায়ারিং এর বিরোধিতা করে বারবার খেলায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে খেলা স্থতিগত করে দিচ্ছিল যা দর্শকদের নিকট হাস্যরসে পরিণত হয়ে উঠেছিল। আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের শুরুটা ভাল হয়নি। ২৬ তারিখের খেলার রাইফেল ম্যানদের দৃঢ়তায় শেষ মুহ’র্তে ইপিআর ২-১ গোলে মোহামেডানকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। জয়সূচক গোল করেছিল তাদের রাইট-ইন ফরমান আলী। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দিনের খেলায় ঢাকা মোহামেডান ইপিআর এর বিরুদ্ধে প্রথমার্ধের দেয়া ১ গোলের লীড নিয়ে তা খেলা শেষ হওয়ার আগ মুহ’র্তে পর্যন্ত ধরে রেখেছিল। জয় যখন নিশ্চিত তখনই ইপিআর টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড কর্নেল শফি মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় মোহামেডানের ‘ডি’ বক্সে ঢুকে উড়ন্ত হিটে গোলরক্ষক জাম্বুকে পরাস্ত করে দলকে ১-১ গোলের সমতায় ফেরায়। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ। অতিরিক্ত সময় দু দলই সাবধানতা অবলম্বন করে রক্ষণাত্মক খেলা শুরু করে এবং গোল শূন্য প্রথমার্ধ শেষ করে। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে ইপিআর দল যেন জেগে ওঠে। তাদের রাইট আউট খুরশীদ রাইটইন ফরমান আলী এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড কর্নেল শফির সম্মিলিত আক্রমণ মোহামেডানের রক্ষণভাগকে বিচলিত করে তোলে। খেলা শেষ হওয়ার প্রায় ৩ মিনিট আগে তাদের ট্রায়োর এক সম্মিলিত আক্রমণে রাইট-ইন ফরমান আলী গোল করে দলকে ২-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
২৮ এপ্রিলের সকালের খেলায় ইস্টার্ন রেল পাক পিডব্লিউডিকে ২-১ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। গত দিন তারা ১-১ গোলে ড্র করেছিল। খেলাটি খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। সমমানের দুটিম আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ করে খেলতে থাকায় খেলায় বেশ আকষণ বেড়ে গিযেছিল। দু টিমের মধ্যে একটি মিল ছিল। দু টিমেই বেশিরভাগ খেলোয়াড় ছিল অবাঙালী। রেল দলের কৃতি লেফট-ইন নিয়াজ গোল করে দলকে ১-০ গোলের লীড এনে দিলে তা কিছুক্ষণের মধ্যেই মকবুল শোধ করে দেয় ১-১। অতিরিক্ত সময় ১৫ মিনিটও ড্র। অগত্যা ফলাফলের জন্য ‘সাডেন ডেথ’ পদ্ধতিতে খেলা শুরু হলে তা আরও কিছুক্ষণ খেলা চলে , প্রায় ১৫ মিনিটের সময় আবারও নিয়াজ রেল দলকে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয়। তারা শেষ পর্যন্ত হকির যুদ্ধে ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। ২৯ তারিখে বৃষ্টির জন্য খেলা মাঠে গড়ায় নাই। ৩০ তারিখে সকালে কম্বাইন্ড চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল। বিকেলে রেল দল বিমান বাহিনীকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। অপর খেলায় আমরা ৫-০ গোলে সৈয়দপুর রেলওয়ে হারিয়েছিলাম। কম্বাইন্ডের পক্ষে প্রথম গোল করেছিল বুলবান আর দ্বিতীয় গোল করেছিল প্রতাপ।
আমাদের খেলায় উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল আমাদের রাইট-ইন মিলুর অনবদ্য হ্যাটট্রিক। যদিও খেলার প্রথমার্ধে ফরিদ এবং আমি ২ গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলাম। ১ মে তারিখে দুটো খেলাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গত দিনে ওয়ারী এবং ইপিআর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। ১-১ গোলে অমিমাংসিত খেলাটি পুনরায় আরম্ভ করেছিল দু টিমই জয়ের আশা নিয়ে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর উত্তেজনাকর খেলায় প্রথমেই ইপিআর দলের ফরমান আলী গোল করে দলকে এগিয়ে দেয় কিন্তু পরক্ষণই তা শোধ করে দেয় ওয়ারীর নিয়াজ আহমেদ। দুদলই গোল না খাওয়ার পদ্ধতিতে খেলে নির্র্ধারিত সময় শেষ করে। অতিরিক্ত সময়ের দু অর্ধে ইপিআর দলের ক্যাপ্টেন মোক্তার দু গোল করলে সদ্য লীগ চ্যাম্পিয়ন ওয়ারী ক্লাব ১-৩ গোলের হার মেনে নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল।
ইপিআর দলের টিম লিস্ট : মো. শফি (গোলরক্ষক), খালিক দাদ ও রশীদ আহমেদ, মুনসিফ, ক্যাপ্টেন মোক্তার ও মো. হাবিব, মো. খুরশীদ, ওসমান আলী, কর্নেল মো. শফি, ফরমান আলী ও আলী আকবর।
ওয়ারী ক্লাব : ফ্রান্সিস (গোলরক্ষক), এসহক ও মোমতাজ, পোটলা, মোমিন ও আনোয়ার, নেওয়াজিস, নিয়াজ আহমেদ খান, তানভীর, মজিদ ও শফিক।
১ ডিসেম্বর ২০১১
(সাতাশি)
দিনের অপর খেলার কম্বাইন্ড ১-০ গোলে রেল দলকে পরাজিত করে সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল। খেলার ধারা অনুযায়ী যে কোন দল জয়ী হতে পারতো। খেলাটি খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। ওয়ারী ক্লাবের ফুলব্যাক শেরা কম্বাইন্ডের পক্ষে খেলায় দুই ব্যাক কাদের এবং শেরা তাদের ডিফেন্সকে শক্তিশালী করেছিল এবং দৃঢ়তার সাথে খেলে রেলের আক্রমণগুলোকে ভাল ভাবেই সামাল দিয়েছিল। সেন্টার হাফ সাদেক সেদিন চমৎকার খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল। খেলার ছয় মিনিটে কম্বাইন্ড পেনাল্টি কর্নার লাভ করে আর শেরা জুটিকে গোলে রূপান্তরিত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত সেই গোলই তাদেরকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দিয়েছিল।
২ মে আমরা (ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা), ইপিআরকে ২-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়েছিলাম। রাইফেলম্যানরা ওয়ারীর বিরুদ্ধে যে খেলা প্রদর্শন করেছিল সে খেলা আমাদের বিরুদ্ধে খুঁজে পাওয়া যায়নাই। সারা খেলা তারা রক্ষণাত্মক খেলা খেলেছিল বিশেষ করে তাদের আক্রমণ রচনার মূল নায়ক কর্নেল শফি তার স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারছিল না যার জন্য তাদের আক্রমণভাগ ছিল ব্যর্থ। প্রথমার্ধের শেষ সময়ে আমরা বিপক্ষে দলের ডি বক্সের কাছাকাছি একটি ফ্রি হিট পেয়েছিলাম। এহতেশামের ফ্রি হিট আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফরিদ ধরে ডি এর ভেতর ঢুকেই সজোরে হিট করার সাথে সাথে গোল বোর্ডে আওয়াজ, ইপিআর গোলরক্ষক মো. শফি পরাস্ত। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। দ্বিতীয়ার্ধে ইপিআর টিম গোলশোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে উপরšুÍ ফরিদ সুন্দর একটি প্লেসিং হিট দ্বারা শফিকে ২য় বার পরাস্থ করে তার দ্বিতীয় গোল করার সাথে আমাদেরকে সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ এনে দেয়। ৩ মে ন্যাশনাল ব্যাংক করাচি এবং কম্বাইন্ড প্রথম সেমিফাইনাল বৃষ্টির জন্য মাঠে গড়াতে পারেনি তাই তারা ৪ মে পুনরায় মাঠে নেমেছিল। খেলার শুরু থেকেই দু টিমের খেলোয়াড়দের উত্তেজিতভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও খেলার ছন্দ ছিল না, এলোমেলো আক্রমণ, সমঝোতার অভাব তাই খেলা সেরকম আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। ন্যাশনাল ব্যাংক সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালালেও সফল হতে পারেনাই বিশেষ করে কম্বাইন্ডের ডিফেন্স অত্যন্ত দৃঢ়তিার সাথে মোকাবেলা করেছিল তবে কিছুটা রাফ খেলার প্রবণতা ছিল যার জন্য কম্বাইন্ডের রাইটহাফ মহসিন এবং ন্যাশনাল ব্যাংক করাচির সাঈদকে আম্পায়ার সাময়িক বহিষ্কার করে খেলাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে দু টিমই জেতার জন্য খেলা শুরু করে। ন্যাশনাল ব্যাংক, করাচির আক্রমণ অন্যান্য দিনের মত ক্ষুরধার ছিল না, কিছুটা অগোছালো আর গোল করার ব্যর্থতা, তারপরও তারা তুলনামূলকভাবে ভাল খেলা খেলছিল শুধুমাত্র অতর্কিত একটি গোল, করাচির এই টিমকে টুর্নামেন্ট থেকে বের করে দিয়েছিল। আর এর জন্য কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনু প্রশংসার দাবিদার। বিপক্ষ দল ডি এর ভেতর আনুকে ফাউল করলে কম্বাইন্ড পেনাল্টি কর্নার লাভ করে। পেনাল্টি কর্নার হিট ফুলব্যাক শেরা করেছিল। গোলরক্ষক প্যাড করলে বল রিবাউন্ড হয়ে প্রতাপের কাছে চলে যায় : প্রতাপ সেটা ঠেলে দেয় আনুকে আর আনু সেটা থেকে গোল করে টিমকে জয় এনে দেয় এবং কম্বাইন্ডকে ফাইনাল খেলার সুযোগ করে দেয়। আনু সম্বন্ধে অল্প কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরছি। আনুর আসল নাম শামসুল আলম। আনু পরনো ঢাকার। আরমানিীটোলা গভ. হাই স্কুলের ছাত্র, আমার সহপাঠি এবং একই এলাকার। তার পুরো পরিবার ক্রীড়াবিদ পরিবার। বাবা আমজাদ সাহেব মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ওয়ারী ক্লাবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বড় ভাই নুরুভাই ফুটবল গোলরক্ষক, খেলেছেন মাহুৎটুলী ক্লাবে। মেজো ভাই ফখরুল আলম, পাকিস্তান বিমানবাহিনী ফুটবল দলের লেফট আউট, ঢাকায় ফিরে চাকরি নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা টিমে আমাদের সাথে ফুটবল হকি খেলেছেন। আনু স্কুল টিমে হকি খেলেছে, করাচিতে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় ফিরে কম্বাইন্ডে হকি খেলেছে। ওয়ারী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
২য় সেমিফাইনাল করাচি কাস্টমস বনাম ন্যাশনাল ব্যাংক ঢাকা। পাকিস্তান জাতীয় দলের ছয়জন খেলোয়াড় নিয়ে গড়া কাস্টমস টিম অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা আমাদেরকে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিল। গোলের সংখ্যা বেশি হলেও আমরা ভাল খেলার চেষ্টা করেছি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার সর্বাধিক চেষ্টা চালিয়ে গেছি। বিশেষ করে আমাদের ফুলব্যাক সাবের অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে কাস্টমসের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করেছে। হাফলাইনে এহতেশাম প্রশংসনীয় খেলা প্রদর্শন করেছিল, আমাদের গোলরক্ষক রঞ্জিত দাস দক্ষতার সাথে কাস্টমসের অনেকগুলো গোল সেভ করে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছিল, নইলে আমরা আরো অধিক গোলে পরাজিত হতাম, আমরা যে গোলগুলো খেয়েছিলাম তাতে রঞ্জিত দাসের কোন ত্রুটি ছিল না।
খেলার ছয় মিনিটেই কাস্টমস পেনাল্টি কর্নার লাভ করে এবং তাদের লেফটব্যাক ইকবাল শাহ গোল করে দলকে ১-০ গোলের লীড এনে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় লাইক গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছিল (২-০)। এর কিছুক্ষণ পর আবারও লাইক গোল করে দলকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পূর্বে আরও দু’বার আমাদের গোল বোর্ডে আওয়াজ তুলেছিল কাস্টমস দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড কাসানীর হিট করা বলের আঘাতে। আমাদের টিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল খাওয়ার মত টিম না, বেশ কয়েকবার আমরাও তাদের সীমানায় আঘাত করে মাঝেমধ্যে কাস্টমসকে বেকায়দায় ফেলেদিয়েছি, এমনি একটি আক্রমণের ফসল হিসেবে আম্পাদের রাইট ইন মির্জা ফরিদ (মিলু) ১টি গোল শোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিরতির পূর্বেই আমরা ১-৫ গোলে পিছিয়ে পড়েছিলাম। বিরতির পর খেলাটা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। কাসানীর হ্যাটট্রিকের জন্য অন্যান্য খেলোয়াড়রা গোল করতে আগ্রহী না থাকায় কাস্টমসের খেলা ছিল কাসানীকে লক্ষ্য করে। সবাই কাসানীকে দিয়ে হ্যাটট্রিক করাবার জন্য ব্যস্ত থাকায় খেলাটা আকর্ষণহীন হয়ে পড়েছিল। খেলা প্রায় শেষেরদিকে গড়াচ্ছিল, এমনি সময় কাসানী তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১-৬ গোলে পরাজিত হয়ে আমাদেরকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
করাচি কাস্টমসের অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়। কম্বাইন্ড ৫-০ গোলে পরাজিত।
৫ মে অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল। করাচি কাস্টমস বনাম কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। খেলার পূর্বে ঢাকা স্টেডিয়ামে ইস্ট পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট পাকিস্তান হকি যুদ্ধের একটা আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাঙালিরা সবাই কম্বাইন্ডের দিকে আর অবাঙালিরা ছিল করাচির পক্ষে। একদিকে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়সমৃদ্ধ করাচি কাস্টমস আর অন্যদিকে তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া কম্বাইন্ড স্পোর্টিং। ব্যক্তিগত এবং দলগত নৈপুণ্যে ভরপুর কাস্টমস দলের বিরুদ্ধে তরুণ কম্বাইন্ডের খেলোয়াড়রা যথেষ্ট ভাল খেলা প্রদর্শন করে তাদের সমর্থকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল; বিশেষ করে দুই ইন বুলবান এবং প্রতাপ আক্রমণভাগের মূল চালকাশক্তি হিসেবে আক্রমণকে সচল করে রেখেছিল আর কম্বাইন্ডের ডিফেন্স অত্যন্ত পরিশ্রম করে কাস্টমসের শক্তিশালী আক্রমণগুলোকে সামাল দিয়েছিল।
খেলা শুরুর সাথে সাথে কাস্টমসের সংঘবদ্ধ আক্রমণ কম্বাইন্ডের সীমানায় হানা দিয়ে ডিফেন্সকে অস্থির করে তুলেছিল। ৫ মিনিটের মধ্যে তারা দুটো পেনাল্টি কর্নার পেয়ে যায় কিন্তু কম্বাইন্ডের গোলরক্ষকের দৃঢ়তায় গোল হয়নি। কিছুক্ষণ পরই তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড কাসানি একক প্রচেষ্টায় ডি-এর ভেতর ঢুকে যায় কিন্তু ফুলব্যাক শেরা চমৎকার ট্যাকল দিয়ে বল ছিনিয়ে নিলে তারা গোলবঞ্চিত হয়। পিচ্ছিল আর কর্দমাক্ত মাঠ থাকায় আকর্ষণীয় হকি দর্শকরা দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারপরও কাস্টমসের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত এবং দলগত নৈপুণ্যের ঝলক মাঝে মাঝে দর্শকরা উপভোগ করেছিলেন, বিশেষ করে তাদের আন্তর্জাতিক লেফট-ইন লাইকের লম্বা লম্বা ডজ দিয়ে দ্রুত সীমানায় পৌঁছে যাওয়া দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে। প্রায় ২০ মিনিটের সময় লাইক তার নিজস্ব স্টাইলে বল নিয়ে কম্বাইন্ডের দুজন খেলোয়াড়কে ডজ দিয়ে ‘ডি’তে ঢুকে চমৎকার ক্লিকের সাহায্যে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নিয়েছিল। এরপরই আরেক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় লেফট-আউট জাহাঙ্গীর বাট দ্রুতগতিতে কম্বাইন্ডের গোল সীমানায় পৌঁছেই সজোরে হিট করলে বল কম্বাইন্ডের ব্যাক শেরার স্টিকে লেগে দিক পরিবর্তন করে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে পোস্টে ঢুকে যায় (২-০)।
বিরতির পূর্বে কম্বাইন্ডের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনু এবং কাস্টমসের ফুলব্যাক জাফর পরস্পরের দিকে স্টিক উঁচিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করলে খেলা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে।
দ্বিতীয়ার্ধে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাস্টমসের সেন্টার ফরোয়ার্ড কাসানি পরপর দু’গোল করেছিল। প্রথমটি লাইকের পাস থেকে, দ্বিতীয়টি মাহমুদের পাস থেকে (৪-০)। খেলা শেষ হওয়ার মিনিটখানেক বাকি থাকতে পেনাল্টি কর্নার থেকে ফুলব্যাক ইকবাল শাহ গোল করলে কাস্টমস ৫-০ গোলে জয়ী হয়ে অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
করাচি কাস্টমস টিমের প্লেয়ার লিস্ট : জহুর (গোলরক্ষক), জাফর ও ইকবাল শাহ, আবরার, সামি ও গুলরেজ, ইসমাইল, খালেদ মাহমুদ, কাসানি, লাইক এবং জাহাঙ্গীর বাট।
কম্বাইন্ড টিমের প্লেয়ার লিস্ট : সাদেক (বড়) (গোলরক্ষক), কাদের ও শেরা, মহসিন, সাদেক ও ইব্রাহিম সাবের, সিকান্দার, বুলবান, আনু প্রতাপ ও রহমান।
১৬ ডিসেম্বর ২০১১
(অষ্টাশি)
দ্বিতীয় শ্রেণীর হকি আম্পায়ারদের ১ম শ্রেণীতে উন্নীতকরণ প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা হিসেবে অল পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিংকে ধরা হয়েছিল এবং পরীক্ষক হিসেবে আলমগীর আদেল, আন্তর্জাতিক হকি আম্পায়ারকে পাকিস্তান হকি আম্পায়ার এসোসিয়েশন তাদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল। অংশগ্রহণকারী আম্পায়াররা ছিলেনÑ খুরশীদ জাহেদী, আবু জাফর, মাহমুদুর রহমান (মোমিন), শামি খান, ঈশা খান, আইয়ুব খান এবং এসএস ফরিদি।
লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল ইপরোয়া (ইস্ট পাকিস্তান রেফারি আম্পায়ার এসোসিয়েশন) টেন্টে। ৭ মে ১৯৬৭ তারিখে রেজিস্ট্রেশন ফি ৫ রুপি দিয়ে অংশগ্রহণকারী আম্পায়ারদের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।
অল পাকিস্তান আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথে সৈয়দ আনোয়ার আলীর মৃত্যুসংবাদে হকি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হকির একজন মুরব্বি, ভদ্র এবং ভাল মানুষ হিসেবে আমাদের অনেক সম্মানের ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ক্যালকাটা মোহামেডান ক্লাবের হকি ক্যাপ্টেন এবং সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমের ম্যানেজার হিসেবে আমাদের সাথে ট্রেনে করে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ভারতের ওপর দিয়ে ৩/৪ দিনে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। সেই ভ্রমণের অনেক স্মৃতি আজ লিখতে বসে মনে পড়ে যাচ্ছে।
হকি থেকে ফুটবল, মাত্র সাতদিনের ব্যবধান, ৫ মে অল পাকিস্তান আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল হকি মৌসুম আর মাত্র এক সপ্তাহ পর ১২ মে ফুটবল লিগের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ফুটবল মৌসুম। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) মৌসুমী খেলাগুলো একের পর এক সাজানো হতো আর আমাকে সে অনুযায়ী হকি, ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স খেলতে হতো। অনুশীলন করার মতো আমি সময় পেতাম না। সেবারের ফুটবল লিগ খেলতে গিয়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ৪ মে হকি টুর্নামেন্ট শেষ করেই ১২ মে স্টেডিয়ামে ফুটবল লিগ ম্যাচ খেলতে নামতে হয়েছিল। ব্যক্তিগত বা দলগত অনুশীলন করার সুযোগই পাওয়া যায়নি।
গত ফুটবল মৌসুমে ২য় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১ম বিভাগে উন্নীত হওয়া রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিমসহ ১ম বিভাগের অন্যান্য টিম যেমন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ইপিআইডিসি, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ারী ক্লাব, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ এসি, পাক পিডব্লিউডি, রহমতগঞ্জ এমএফএস, আজাদ স্পোর্টিং সেন্ট্রাল স্টেশনারি, বিজি প্রেসসহ মোট ১৩টি দল নিয়ে ইপিএসএফ ফুটবল কমিটি কর্তৃক আয়োজিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ১ম বিভাগ ফুটবল লিগ। লিগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান বনাম ১ম বিভাগে উন্নীত রেলওয়ে পাইওনিয়ারের ম্যাচ দিয়ে ১২ মে শুরু হয়েছিল ফুটবল লিগ। লিগ চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে শুরুটা আমাদের মোটেও ভাল হয়নি, বিশেষ করে নতুন টিম হিসেবে সদ্য উন্নীত রেলওয়ে পাইওনিয়ারের বিপক্ষে। আমরা ৩-০ গোলে জয়লাভ করলেও শিশু টিম হিসেবে তারা আমাদের শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ টিমের বিরুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়নি বরং যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথে খেলে প্রথমার্ধে ০-২ গোলে পিছিয়ে গিয়েছিল। খেলা শুরুর পাঁচ মিনিটেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমাদের রাইট আউট কামাল খুবই সহজ একটি গোল মিস করে সেই সুযোগ হাতছাড়া করে দেয়। অনুরূপভাবে রেলওয়ে পাইওনিয়ারের লেফট আউট নওয়াব সুন্দর একটি বল বানিয়ে দিয়েছিল তার লেফট ইনকে। সে আমাদের গোলরক্ষক নূরুন্নবীকে একা পেয়েও গোল করতে পারেনি। আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড হাফিজউদ্দিনের দেয়া পাসে কামাল সুন্দর একটি গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পূর্বে আমার দুর্বল শট গোলরক্ষক ধরতে গিয়েও হাত ফসকে গোলপোস্টের ভেতর ঢুকে গেলে আমরা ২-০ এগিয়ে যাই।
খেলার শেষ বাঁশির কিছুক্ষণ আগে আমরা একটি ফ্রি-কিক পেলে গফুর সরাসরি গোলপোস্টে মেরে দর্শনীয় গোল করে। ৩-০ গোলের জয় দিয়ে আমাদে লিগের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড় তালিকা : নুরুন্নবী (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব ও রফিক, রসুল বখশ ও গফুর, কামাল আব্দুল্লাহ, হাফিজউদ্দিন, বশীর ও মুসা।
রেলওয়ে পাইওনিয়ার : মহিউদ্দিন (গোলরক্ষক), আলম, কানাই ও গিয়াস, শাহ আলম ও ফজল, নুরুল্লাহ, আলিম, জেমস, মনোজ ও নওয়াব।
ভিক্টোরিয়া এবং ফায়ার সার্ভিসের খেলায় দুই টিম মিলে ৪ গোল করেছিল। সমশক্তির টিম দুটির খেলা বেশ জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল। ফায়ারের শরফুদ্দিন গোল করে দলকে এগিয়ে দিলেও বেশিক্ষণ তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নিÑ ভিক্টোরিয়ার ইমাম তা শোধ করে দেয়। সমতার ফলে খেলায় আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে গিয়ে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ বেড়ে যায়। খেলা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ভিক্টোরিয়ার রাইট ফুলব্যাক, আব্দুল্লাহ হোসেন এবং রাইট হাফ আলী মোহাম্মদ খুব ভাল খেলা প্রদর্শন করলেও তাদের গোলরক্ষক দুলু আফেন্দী ছিল নার্ভাস। অন্যদিকে ফায়ারের শরফুদ্দিন এবং ওহাব পরিশ্রম করে খেলে আক্রমণের চাকাকে সচল রেখেছিল এবং তাদের হাফ লাইনে সামাদ এবং জলিল আনসারী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খেলে মাঝ মাঠকে সুরক্ষিত রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের গোলরক্ষক মোতালেব দর্শনীয় খেলা খেলে দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ভিক্টোরিয়ার পক্ষে ইব্রাহিম সাবের গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দিলেও আইনুল কর্নার কিক থেকে হেডের সাহায্যে গোল করে ফায়ারকে সমতায় ফেরায়। খেলা ২-২ গোলে ড্র।
যারা সেদিন খেলেছিল
ফায়ার সার্ভিস : মোতালেব (গোলরক্ষক) মজিবর রহমান, আইনুল ও আবুল, সামাদ ও জলিল, কালাম, শরফুদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, আশরাফ ও ওহাব।
ভিক্টোরিয়া : দুলু আফিন্দী (গোলরক্ষক), আব্দুল্লাহ হোসেন, সালেহ ও সাদেক আলী মোহাম্মদ ও খসরু, ইব্রাহিম সাবের, ইউসুফ, ইমাম, আজিম ও টিপু।
শাজাহানের চমৎকার দুটি গোলে রহমতগঞ্জ স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেদিনের লিগের অপর খেলাটিতে দু’অর্ধে দুটি গোল হয়েছিল। স্টেশনারি চেষ্টা করেও ফলাফল পরিবর্তন করতে পারেনি।
রহমতগঞ্জের খেলোয়াড় : অনাথ (গোলরক্ষক), নাজির গাউস ও হাসনাত, কায়কোবাদ ও লালু, কাজী আলমগীর, শাহজাহান, সুলতান, আফজাল এবং নয়া।
স্টেশনারি : বাচ্চু (গোলরক্ষক), রফিক সিরাজ ও এনতাজ, মোশাররফ মনোয়ার, নুরু, আজিজ ইলিয়াস জামান এবং কামাল।
১৪ মে ইপিআইডিসির উৎসাহজনক লিগ আরম্ভ। পাক পিডব্লিউডির দেরিতে খেলায় ফেরা। প্রথমার্ধেই ইপিআইডিসি ৩ গোল করে পিডব্লিউডিকে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে বিরতির পূর্বে একটি গোল শোধ দিতে পেরেছিল পিডব্লিউডি (৩-১)। উদ্দেশ্যহীন আর অগোছালো দু’টিমের খেলা সেরকম মানসম্মত ছিল না। তুলনামূলকভাবে ইপিআইডিসি ভাল খেলা প্রদর্শন করেছিল, যদিও পিডব্লিউডি শেষ পর্যন্ত দু’গোল শোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। খেলা শুরু হলে ইপিআইডিসির লেফট ইন জব্বার গোলপোস্টে কিক করলে গোলরক্ষক মতিন বল ধরতে পজিশন নেয়, মাঝপথে তাদের স্টপার কানু হেড করলে বল দিক পরিবর্তন করে সোজা পোস্টে ঢুকে যায়। এর কিছুক্ষণ পর জব্বর সুন্দর একটি পাস হাশিমকে দিলে সেটা থেকে গোল হয়ে দলের গোলসংখ্যা দাঁড়ায় ২-০ এবং দু’মিনিট পরই হাশিম গাজীর সেন্টার থেকে গোল করে দলকে ৩-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির বাঁশি বাজার আগে পিডব্লিউডির এক বিচ্ছিন্ন আক্রমণে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা ওহাব বল পেয়ে যায় এবং সেটা থেকে গোল করে ব্যবধান কমায় ৩-১।
বিরতির পর হাশিমের হ্যাটট্রিকের জন্য সতীর্থ খেলোয়াড়রা চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি; উপরন্তু ফ্রি-কিক থেকে পাওয়া বলে হেড করে ওহাব দলের পক্ষে গোল করে দলকে সম্মানজনক হার এনে দেয় ২-৩।
ইপিআইডিসি প্লেয়ার লিস্ট : হাকিম (গোলরক্ষক) আমিন, গফুর, বালুচ ও সাইফুদ্দিন, গৌর ও মুসা, সলিম উল্লাহ, আলী হাফিজ, হাশিম উদ্দিন, জব্বর ও গাজী।
পিডব্লিউডির প্লেয়ারলিস্ট : মতিন (গোলরক্ষক), হামিদ, কানু ও বাটু, বিমল ও আকরাম, রোকন, বাবুল, ধীরেন, ওহাব এবং হাশেম উদ্দিন।
শিশু টিম আজাদকে হারিয়ে দিয়েছিল। দিনের অপর খেলায় সদ্য প্রমোশন পাওয়া তরুণ রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিম আজাদ স্পোর্টিংকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার আভাস দিয়েছিল, তাদের প্রথম খেলায় লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের বিরুদ্ধে ০-৩ হেরেও লড়াই করার মনোবল তাদের রয়েছেÑ এটা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বিরতি পর্যন্ত ড্র ছিল। লেফট-ইন আলিম এবং রাইট ইন নুরুল্লাহর গোলে তাদের জয় নিশ্চিত হয়েছিল।
আজাদ স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড়রা : এহতেশাম (গোলরক্ষক), সিরাজ,
মোবাশ্বের ও আহম্মদ, নজরুল ও গিয়াস, দেবু, নাসিম, আবুল হাসান, মিন্টু ও বাবু।
১ জানুয়ারি ২০১২
(ঊননব্বই)
১৬ মে আমরা (মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব) ওয়ারীকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে আমাদের জয়ের ধারাকে অক্ষুন্ন রেখেছিলাম। ওয়ারীর রক্ষণভাগের দুর্বলতার সুযোগে আমরা তাদের ওপর চেপে বসি। বিশেষ করে তাদের রাইট ব্যাক নুরুল ইসলাম আমাদের পাসগুলো সঠিক ইন্টারসেপ্ট করতে পারছিল না, তার সহযোগী ডিফেন্সের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিল না আর আমরা সেদিক দিয়েই আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত করে রেখেছিলাম। তবে তাদের থার্ড ব্যাক হামিদ প্রথমবারের মত লিগ খেলায় অংশ নিয়ে চমৎকার খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাদের লেফট ব্যাক শওকত যদি আরও দৃঢ়তার সাথে এবং শক্ত ট্যাকেল করে খেলতো, তাহলে আমরা অত সহজে গোল করতে পারতাম না। সম্মিলিত আক্রমণের জন্য আমাদের আক্রমণভাগ প্রশংসার দাবি করলেও রক্ষণভাগ ছিল হতাশাজনক, বিশেষ করে আমাদের রাইট ফুল জহির ভাই ছিলেন ফ্লপ। ওয়ারীর লেফট আউট মাহমুদকে আটকাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। বিপক্ষ খেলোয়াড়ের জার্সি ধরে টেনে রাখা, হাত ধরে রাখা, বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে আটকাতে চেষ্টা করছিলেনÑ যা ছিল দৃষ্টিকটু। খেলার এক পর্যায়ে অসৎ আচরণের জন্য জহির ভাই এবং মুসাকে রেফারি ঈসা খান সতর্ক করে দেন। সেদিন আমাদের টিমের তরুণ খেলোয়াড় জালু রাজশাহী থেকে এসে প্রথমবারের মত লিগে অংশ নিয়ে চমৎকার দুটো গোল করে সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। জালু রাজশাহীর কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসুর ছোট ভাই। খেলার শুরুতেই গফুরের একটি থ্রু পাস আশরাফ ভাই ধরতে ব্যর্থ হলে সহজ একটি গোল হাতছাড়া হয়ে যায়। মুসার দেয়া পাস আব্দুল্লাহ বুঝতেই পারেনি বলে আরেকটি গোল পাওয়া হলো না। খেলার ৫ মিনিটের সময় ওয়ারী একটি আক্রমণে জামিল আখতার মাহমুদকে একটি বল বানিয়ে দেয়, মাহমুদ সে বল পোস্টে মারলে বল বারপোস্টে লেগে নিশিথের কাছে ফেরত আসে। নিশিথ আমাদের গোলরক্ষক নূরুন্নবীকে পরাস্ত করলেও গোললাইনের ওপর থেকে তোরাব আলী ক্লিয়ার করে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি; কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা ওয়ারীর রাইট আউট ভুট্টো বল পেয়ে যায় আর সে ওয়ারীকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। গোল খেয়ে আমরা শোধ করতে জোর চেষ্টা চালাতে থাকি। আশরাফ ভাইয়ের ব্যাক ভলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এর পরপরই বাম প্রান্ত থেকে গফুরের লব হাফিজউদ্দিন হেড করলে বল বারপোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর মুসার কিক গোলপোস্টে লেগে ফেরত এলে মুসা দ্বিতীয় সুযোগে গোল করে আমাদের দলকে ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়। এর স্বল্প পরেই জালু গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পর আমাদের টিম পুরো উদ্যমে খেলা শুরু করে এবং আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় আবদুল্লাহ জালুর উদ্দেশে একটি থ্রু পাস দিলে জালু সেটার সদ্ব্যবহার করে দলকে ৩-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ এবং লেফট আউট মাহমুদের সম্মিলিত আক্রমণে ভুট্টো সহজ একটি গোল মিস করলে শেষ পর্যন্ত আমরা ৩-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
ওয়ারীর খেলোয়াড় তালিকা : তপন (গোলরক্ষক), নুরুল ইসলাম, হামিদ ও শওকত বেলাল ও খলিল, ভুট্টো, আজিজ, নিশিথ, জামিল আখতার ও মাহমুদ।
১নং আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দিনের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং সেন্ট্রাল স্টেশনারিকে ১-১ গোলে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। খেলার ১৫ মিনিটেই স্টেশনারির কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াস গোল করে দলকে এগিয়ে নেয় এবং বিরতি পর্যন্ত স্টেশনারি লিডটাকে ধরে রেখেছিল। বিরতির পর ১০ মিনিটে আজাদ একটি পেনাল্টি লাভ করে কিন্তু নজরুল গোলরক্ষক বাচ্চুকে পরাস্ত করতে না পারায় পুরো টিম হতাশ হয়ে পড়ে। আজাদ গোল শোধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়; এরই এক পর্যায়ে লেফট আউট বাটু একটি সুযোগ পেয়ে গোলপোস্টে সজোরে কিক করে, গোলরক্ষক বাচ্চু বল ধরার জন্য পজিশন নেয় কিন্তু তাদের রাইট ব্যাক এনতাজ মাঝখানে চলে আসে এবং বল তার গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে সরাসরি গোলপোস্টে ঢুকে যায়। গোলরক্ষক বাচ্চুর শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া করার আর কিছুই ছিল না। ফলাফল ১-১ ড্র।
১৭ তারিখের খেলায় ফায়ার সার্ভিসের গোলরক্ষকের ভুলের জন্য রহমতগঞ্জ পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। সমমানের দুটি দলের মধ্যে কে ভাল বলা কঠিন। প্রথমার্ধ যদি রহমতগঞ্জের হয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয়ার্ধটা ছিল ফায়ার সার্ভিসের। প্রথমার্ধে ফায়ারম্যানরা কমপক্ষে তিনটি সুযোগ নষ্ট করেছিল। সুযোগগুলো নষ্ট করার মূলে ছিল সেলিম। রহমতগঞ্জ শুরুটা ভাল করেছিল। তাদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে খেলার পাঁচ মিনিটেই তাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল কিন্তু রাইট-আউট নাজিরের জঘন্যভাবে মিস করাতে গোল পাওয়া সম্ভব হয়নি। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটে রহমতগঞ্জের রাইট-ইন শাজাহান দূর থেকে উঁচু করে একটি বল গোলপোস্টে কিক করলে গোলকিপার সীতাংসু প্রথমে বুঝতে পারেনি যে সেকি করবে। সে বল ধরার জন্য পোস্ট ছেড়ে এগিয়ে আসে কিন্তু সে বলের ফ্লাইট মিস করে ফেলে, বল সরাসরি গোলপোস্টের কোনা দিয়ে ভেতরে ঢুতে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের পুরোটা সময় ফায়ার সার্ভিস গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে কিন্তু সফল হতে পারেনি। সীতাংশুর ভুলের মাশুল টিমকে মেটাতে হয়েছে ১ গোলের পরাজয়বরণ করার মাধ্যমে।
রহমতগঞ্জের খেলোয়াড় : অনাথ (গোলরক্ষক), ফারুক, গাউস ও হাসনাত, লালু ও কায়কোবাদ, নাজির, শাহজাহান, সুলতান, গফুর ও নয়া।
ফায়ার : সীতাংশু (গোলরক্ষক), আবুল আইনুল ও জলিল, দিপু ও সামাদ, কামাল, শরফুদ্দিন, সালিম, সাহাবুদ্দিন ও আশরাফ।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত খেলায় পিডব্লিউডি এবং প্রেস নিজেদের মধ্যে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল, ফলে ১-১ গোলে ড্র করে। প্রেসের মোখতার প্রথম গোল করেছিল পিডব্লিউডির লেফট-ইন আবেদ।
ওয়ান্ডারার্স অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল আর রেলওয়ে পাইওনিয়ার লড়াই করে পরাজয়বরণ করেছিল। ১৮ মে তরুণ রেলওয়ে পাইওনিয়ার তাদের শক্তিশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে চমৎকার খেলা প্রদর্শন করেছিল। প্রথমার্ধে ওয়ান্ডারার্স অগোছালো খেলা আর অপরিকল্পিত আক্রমণ এবং লক্ষ্যহীন শুটিং করে বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ নষ্ট করেছিল; তারপরও তারা ২-১ গোলে এগিয়ে থেকে প্রথমার্ধ শেষ করেছিল। তাদের লেফট ফুল ব্যাক আসলাম করাচি থেকে প্রথমবারের মত এসে লিগে অংশ নিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। বিশেষ করে স্টপার নবী বখশের সাথে বোঝাপড়া হচ্ছিল না। খেলা শুরু হলে ওয়ান্ডারার্সের হাবিব সাদেক ও রিয়াজের সম্মিলিত আক্রমণে রেলওয়ে পাইওনিয়ারের গোলরক্ষক মহিউদ্দিন পরাজিত হলে তারা ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। রেল পাইওনিয়ারের স্টপার ফজলের দুর্বল ক্লিয়ারেন্সের বল রিয়াজ ধরে সুন্দর প্লেসমেন্টের সাহায্যে গোল করে দলকে ২-০ গোলের লিড এনে দেয়। বিরতির কিছু পূর্বে ফুল ব্যাক আসলাম এবং স্টপার নবী বখশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ফলস্বরূপ আসলাম দলীয় গোলরক্ষক সান্টুকে দিতে গিয়ে বল নিজ গোলেই ঢুকিয়ে দেয় ২-১। বিরতির পর রেলওয়ে পাইওনিয়ারের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। প্রায় ৮ মিনিটের সময় তাদের রাইট-ইন আমান উল্লাহ বল নিয়ে ওয়ান্ডারার্সের সীমানায় ঢুকে আসলামকে কাটিয়ে ছুটে আসা গোলরক্ষক সান্টুকেও কাটিয়ে বল পোস্টে ঠেলে দিয়ে দলকে ২-২ গোলের সমতায় ফেরায়। কিছুক্ষণের মধ্যে নুরুল্লাহ চমৎকার একটি শটের মাধ্যমে সান্টুকে পরাস্ত করে দলকে ৩-২ গোলের লিড এনে দেয়। গোল খেয়ে ওয়ান্ডারার্স যেন জেগে ওঠে এবং গোল শোধ করতে প্রচ চাপ প্রয়োগ করতে থাকে আর লেফট-ইন সাদেক ত্রাণকর্তা হিসেবে সেদিন তার একক নৈপুণ্য দ্বারা শুধু গোলই শোধ করেনি বরং পরপর দু’গোল করে দলকে ৪-৩ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। শেষ বাঁশি বাজার আগে হাবিব ও সাদেকের সহযোগিতায় আলাউদ্দিন আরও একটি গোল করলে ওয়ান্ডারার্স ৫-৩ গোলের জয় দিয়ে মাঠ ছাড়ে।
ওয়ান্ডারার্সের প্লেয়ার লিস্ট : সান্টু (গোলরক্ষক), আফজাল, নবী বখশ ও আসলাম, রিয়াজ ও ইসমাইল, রুশো, আনসার, আলাউদ্দিন, হাবিব, সাদেক ও তসলিম।
সেদিনের অপর খেলায় ইপিআইডিসি টিমের কাছে পুলিশ দাঁড়াতেই পারেনি; তবে খেলার শুরুতেই পুলিশের আরশাদ মল্লিক গোল করে ইপিআইডিসিকে চমক দিয়েছিল। প্রতিশোধ নিতে ইপিআইডিসি আক্রমণ চালাতে শুরু করে এবং সফলও হয় হাশিম উদ্দিনের করা গোলের মাধ্যমে ১-১। ইপিআইডিসি মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সারামাঠ বিচরণ করে খেলতে থাকে। পুলিশের তরফ থেকে সেরকম জোরদার বাধা পাচ্ছিল না। তাদের লেফট-ইন জব্বর বল ধরে পুলিশের ৩/৪ জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল করে দলকে ২-১ গোলের এগিয়ে দেয়।
আসলাম গোল করে দলকে ৩-১ গোলে লিড এনে দেয় আর পুলিশের নুরুল্লাহ ব্যাক পাস করতে গিয়ে নিজের গোল পোস্টে বল ঢুকিয়ে দিয়ে ১-৪ গোলের হার মেনে নিয়ে মাঠ ছেড়ে যায়।
মোহামেডানের প্রথম পয়েন্ট হারানো, ফায়ারের সাথে চার গোলের ভাগাভাগি, তৃতীয় ম্যাচেই আমাদের ১ পয়েন্ট খোয়ানো ছিল চিন্তার বিষয়। যদিও ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানানো উচিত যে, আমরা দুটো পয়েন্ট হারাইনি বলে। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া আমাদের শক্তিশালী দল ফায়ার সার্ভিস যে লড়াকু টিমÑ সেটাকে আমলেই নেয়নি। গোল না পাওয়ার জন্য যেমন আমাদের আক্রমণভাগ দায়ী, তেমনি গোল খাওয়ার জন্য আমাদের রক্ষণভাগও দায়ী। ফায়ার সার্ভিসের দ্বিতীয়ার্ধের খেলা ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। আমাদের সীমানায় হানা দিয়ে গোলপোস্টে কিক করে আমাদের চমকে দিয়েছিল। বিশেষ করে ফায়ারের শরফুদ্দিন জহির ভাই ও পিন্টুকে কাটিয়ে খালি পোস্টে কিক করতে পারেনি বলে আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। একটু পরই শরফুদ্দিন একটি বল বানিয়ে দিয়েছিল শাহাবুদ্দিনকে, সেটাও মিস হয়ে যাওয়ায় আমরা আবারও বেঁচে গিয়েছিলাম। ১৯ মে’র খেলায় দুজন খেলোয়াড় দর্শকদের দৃষ্টি কেড়েছিলÑ প্রথম আমাদের স্টপার পাকিস্তান দলের কৃতী খেলোয়াড় তোরাব আলী এবং অপরজন ফায়ারের শরফুদ্দিন। তাদের দর্শনীয় খেলা সেদিন উপস্থিত দর্শকরা উপভোগ করেছিলেন। এখানে শরফুদ্দিন সম্বন্ধে দু’চারটি কথা না বললেই নয়। নম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী কৃতী খেলোয়াড়টির সাথে আমার অনেক বছর পর দেখা হয়েছিল, দাড়ি রেখে আল্লাহওয়ালা মানুষ। কথা প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম (ডেপুটি চেয়ারম্যান-রেফারিজ কমিটি, বাফুফে) বললো, শরফুদ্দিন গত রোজার মাসে মারা গেছেন! আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন। শরফুদ্দিন ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করতো এবং খেলতো। বিয়ের জন্য সবাই চাপ দিচ্ছে। আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না বিধায় ফায়ার সার্ভিসের এবং দেশের ফুটবলের অন্যতম সংগঠক সিদ্দিকুর রহমান তাকে এক বছরের জন্য অন্য টিমে খেলার জন্য সুযোগ দিয়েছিলেন, যাতে সে অন্য টিমে খেলে টাকা পেয়ে সে টাকা দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করতে পারে। তারপরও তার বিয়ে হয়নি। কেন হয়নি জানি না; তবে সে একা জীবন কাটিয়েছে এবং সে অবস্থায় মারা গেছে।
ফায়ারের গোলরক্ষক সীতাংশু চমৎকার খেলেছিল। অনেক গোল সে সেভ করেছে। আমাদের টিম ফায়ারের তুলনায় অনেক শক্তিশালী, বার বার আক্রমণ করেও ফল আসছিল না। গফুরের একটি লব প্রতাপ হেড করলে তা ক্রশবারে লেগে ফেরত আসেÑ যা কাছেই দাঁড়ানো আবদুল্লাহ দৌড়ে গিয়ে সে বলটাকে পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। আমরা ১-০ গোলে এগিয়ে যাই। খেলার প্রায় ৩০ মিনিটের সময় শাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে বল পেয়ে শরফুদ্দিন একক প্রচেষ্টায় আমাদের বক্সে ঢুকে প্রচন্ড কিকের সাহায্যে নূরুন্নবীকে পরাস্ত করে ১-১। বিরতির পর ফায়ারম্যানরা ফায়ারের মত জ্বলে ওঠে এবং আক্রমণ চালিয়ে আমাদের রক্ষণভাগকে নাড়িয়ে দেয়। নুরুন্নবী একের পর এক গোল সেভ করে যায়। শরফুদ্দিন ও শাহাবুদ্দিন আমাদের ডিফেন্সে আতংক সৃষ্টি করে। এরকমই একটি আক্রমণে শরফুদ্দিন আবারও দর্শনীয় একটি গোল করে তার দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। পুরো গ্যালারি হাততালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানায়। গোল খেলে আমরা অনেকটা দিশেহারার মত হয়ে পড়ি এবং গোল শোধ করার জন্য সবাই চেষ্টা চালাতে থাকি। আমরা একটার পর একটা কর্নার আদায় করলেও প্রতি কর্নার কিক সীতাংশু তার দীর্ঘদেহের সুবাদে বল ধরে ফেলছিল কিংবা বল পাঞ্চ করে গোল সেভ করে দিচ্ছিল। এমনি একটি কর্নার কিক ক্রশবারে লেগে ছোট বক্সে ড্রপ পড়লে সীতাংশু বল ধরার জন্য ডাইভ দেয় কিন্তু কাছেই দাঁড়ানো মুসা তার আগেই পুশ করে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয় আর এতেই আমরা পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাই (২-২ গোলে) এবং ভাগ্যগুণে ১ পয়েন্ট নিয়ে টেন্টে ফিরে যাই।
১৬ জানুয়ারি ২০১২
(নব্বই)
খেলার ধারা অনুযায়ী ১৯-৫-৬৭ তারিখের খেলায় ওয়ারীর জয় পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু তাদের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের ব্যর্থতার কারণে স্টেশনারি টিমের সাথে গোলশূন্য ড্র করে একরাশ হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। পরদিন পুলিশ টিম প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল প্রেসকে ২-০ গোলে হারিয়ে। চার খেলায় তারা তিন পয়েন্ট পেলেও প্রেস তিন খেলায় মাত্র এক পয়েন্ট পেয়ে তালিকার শেষ দল হিসেবে অবস্থান করছিল। পুলিশের গফুর ও সাত্তার দুটি গোল করে দলকে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সহায়তা করেছিল। দিনের অপর খেলা যা আউটার স্টেডিয়ামে আজাদ স্পোর্টিং এবং পিডব্লিউডি টিমের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিলÑ তা ছিল উদ্দেশ্যহীন আর রাফ খেলার প্রদর্শন, যা দর্শকদের কাছে ছিল বিরক্তিকর। এক পয়েন্ট করে পেয়ে দু’দলই মাঠ ছেড়েছিল। ভিক্টোরিয়া নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী দল, বিশেষ করে দুর্বল স্টেশনারি দলের তুলনায়। তারপরও তাদেরকে দীর্ঘ ৫৫ মিনিট লড়াই করে বিপক্ষ গোলপোস্টের দুয়ারে ঢুকতে হয়েছিল। বিরতির ২০ মিনিটে রাইট আউট ইউসুফের কর্নার কিক বাতাসে বাঁক খেয়ে সরাসরি স্টেশনারির গোলপোস্টে ঢুকে পড়ে। গোলরক্ষক বাচ্চুর পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। কিছুক্ষণ পর আজিমের কাছ থেকে বল পেয়ে ইব্রাহিম সাবের গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করলে ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলের জয় দিয়ে ২০-৫-৬৭ তারিখের খেলাটি শেষ করেছিল।
২০-৫-৬৭ ইং লিগের অপর খেলাটি ছিল আউটার স্টেডিয়ামে রহমতগঞ্জ বনাম রেলওয়ে পাইওনিয়ার। সে সময় ১নং আউটার স্টেডিয়াম ফুটবল খেলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছিল। সকাল থেকে বাইরের ছেলেপেলেদের এই মাঠে খেলা শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। রোদ-বৃষ্টির কোন বালাই নেই, খেলা আর খেলাÑ মাঠের জীবন শেষ। তার ওপর লিগের খেলা। মাঠ সংস্কারেরও কোনো বালাই নেই। এখানেই খেলতে হবেÑ কর্তৃপক্ষের আদেশ, শেষ করতে হবে লিগ, নইলে ইজ্জত যাবে। খেলোয়াড়দের প্রতি নজর নেই, এই মাঠে খেলোয়াড়রা আঘাত পেতে পারে, পরোয়া নেই, খেলার মান নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই; ফুটবলের উন্নয়নে কারো চিন্তা নেই! একটাই তাদের চিন্তাÑ আসন আগলে রাখা। রহমতগঞ্জ রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। সেন্টার ফরোয়ার্ড বেলাল প্রথম গোল করে এবং পরপর আরো দু’গোল করে শাজাহান এবং গফুর। দ্বিতীয়ার্ধে রেলওয়ে পাইওনিয়ার একটি পেনাল্টি লাভ করলেও তাদের জেমস সেটি বাইরে মেরে দলকে গোলবঞ্চিত করে।
২১-৫-৬৭ তারিখে আমাদের ক্লাবে (ঢাকা মোহামেডান) একটা উৎসব উৎসব ভাব লক্ষ্য করলাম। নতুন কমিটি হয়েছে। ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ক্লাব সভাপতি মঈনুল ইসলামসহ আরো ১১ জন কর্মকর্তা যারা ১৯৬৭-৬৮ সালের জন্য ক্লাব পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।
সহ-সভাপতি সর্বজনাব লতিফুর রহমান, মোখলেসুর রহমান, এটিএমএফ করিম, আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম এবং সৈয়দ জিয়াউল আহসান। জেনারেল সেক্রেটারি- সৈয়দ মফিজউদ্দিন। জয়েন্ট সেক্রেটারি- মোল্লা আবদুল মজিদ এবং কে এ খালেক। ট্রেজারার আবুল হাশেম খান। চেয়ারম্যান ফুটবল কমিটি- শাহজাহান। ফুটবল সেক্রেটারি -কাজী শামসুল ইসলাম।
২২ মে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি খেলা। শক্তিশালী দুটি টিমের খেলা। একটি উচ্চমানের এবং জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা দেখার আশা নিয়ে প্রচুর দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন কিন্তু দু’টিমই সেদিন উপহার দিয়েছিল উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন আর নিম্নমানের খেলাÑ যাতে স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক-সমর্থকরা মর্মাহত এবং হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। দু’টিমের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের কাছ থেকে যেমন এলোমেলো খেলা আশা করেনি, তেমনি তাদের কাছ থেকে বল প্রয়োগ করে রাফ খেলাও প্রত্যাশা করেনি কেউ।
খেলার শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স তাদের বামদিক দিয়ে লেফট আউট তসলিমের মাধ্যমে আক্রমণ চালায়। তসলিম বল নিয়ে ইপিআইডিসির সীমানায় ঢুকে গোল পোস্টে কিক নিতে গেলে ব্যাক আমিন বাধা দিলে বল গোলপোস্টের বাইরে চলে যায়। এরপরই ইপিআইডিসির লেফট ইন জব্বর একক প্রচেষ্টায় দু’তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়েও দলের অন্য খেলোয়াড়দের সহযোগিতার অভাবে গোল করতে ব্যর্থ হয়। খেলার ২০ মিনিটে ওয়ান্ডারার্স এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ পেয়েছিল, ডান পাশ থেকে আনসারের লব হেড করার কিংবা ফাঁকা যায়গা থেকে কিক নেয়ার মত কোন খেলোয়াড় সময়মত সেখানে পৌঁছাতে না পারায়। আবারও তসলিম ইপিআইডিসির গোলরক্ষককে একা পেয়েও কিক নিতে দেরি করায় গোলরক্ষক হাকিম ডাইভ দিয়ে তসলিমের পা থেকে বল ছিনিয়ে নেয়। গোল মিস আর খেলোয়াড়দের শক্তি প্রয়োগ করে এলোমেলো খেলা দেখে দর্শকরা অতিষ্ঠ হয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে চিৎকার দিচ্ছিলেন। এমনি সময় হাফ টাইমের বাঁশি তাদেরকে স্বস্তি এনে দিয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমেই ওয়ান্ডারার্স গোল পেয়ে যায়। তসলিম বল নিয়ে দ্রুতগতিতে বিপক্ষ সীমানায় ঢুকে ক্রশ করে রাইট আউট ধর বল পেয়ে পোস্টে কিক নিতে গেলে ইপিআইডিসির লেফট ব্যাক সাইফুদ্দিন বাধা দেয়, বল তার পায়ে লেগে চলে যায়। ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা রাইট-ইন সাদেকের কাছে আর সে সুযোগের সঠিক ব্যবহার করে ওয়ান্ডারার্সকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। ওয়ান্ডারার্স আরও দুটো গোলের সুযোগ পেয়েছিলÑ যা সাদেক গোল করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে আনসারের বানিয়ে দেয়া বল গোলপোস্টে একা গোলরক্ষককে পেয়েও গোল করতে না পারাটা ছিল অমার্জনীয়। ইপিআইডিসি টিমও গোল শোধ করার চেষ্টা চালায় এবং ২২ মিনিটে সুযোগও এসেছিল। রাইট আউট সলিমুল্লাহ দ্রুতগতিতে বল নিয়ে ওয়ান্ডারার্সের বক্সে ঢুকে গোলমুখে রাইট-ইন হাশেমকে দিলে হাশেম বল ধরার আগেই ওয়ান্ডারার্সের গোলরক্ষক ফেরদৌস ডাইভ দিয়ে বল তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। খেলা প্রায় শেষদিকে ওয়ান্ডারার্সের রক্ষণভাগের ভুল বোঝাবুঝির জন্য হাশিম ফেরদৌসকে পরাস্ত করে একটি ‘গডগিফটেড’ গোল পেয়ে যায়; সে সাথে দলকে হারের হাত থেকে রক্ষা করে ১-১।
ওয়ান্ডারার্সের খেলোয়াড় : ফেরদৌস (গোলরক্ষক), আফাজ, নবী বখশ এবং আসলাম, রিয়াজ ও ইসমাইল রুশো, ধর আনসার, সাদেক, আলাউদ্দিন এবং তসলিম।
ইপিআইডিসির খেলোয়াড় : হাকিম (গোলরক্ষক) আমিন গফুল বেলুচ এবং সাইফুদ্দিন, আলী হাফিজ ও মুসা, সলিম উল্লাহ, হাশিম, বদরুল জব্বর এবং গাজী।
ওয়ারী এবং ফায়ার সার্ভিস দু’টিম মিলে ৬ গোল করেছিল কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। ২৩ মে স্টেডিয়ামে তারা ৩-৩ গোলের ড্র করেছিল। প্রথমার্ধে ওয়ারী দাপট দেখালে দ্বিতীয়ার্ধে ছিল ফায়ারের কর্তৃত্ব। ওয়ারী চার ম্যাচ খেলে একটিও জয়ের মুখ দেখতে পায়নি। ৩টি ড্র আর একটি হেরেছে, অন্যদিকে ফায়ার খেলেছে পাঁচটি ম্যাচÑ একটি জয়, তিনটি ড্র আর একটি হার। সমমানের দুটি টিম এবং খেলাও খেলেছে বেশ উন্নতমানের, যা দর্শকরা বেশ উপভোগ করেছেন। ওয়ারী শুরুটা খুব ভালভাবেই করেছিল। ফায়ারের ওউপর চাপ সৃষ্টি করে খেলে ১০ মিনিটে গোলের একটি সুযোগ আদায় করে নেয়। কিন্তু টি. চৌধুরীর গোলপোস্টে মারা শটটি বারপোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে যায়। রাইট আউট টি. চৌধুরী তার ইন জামির আক্তারকে একটি বল বানিয়ে দিলে সে ফায়ারের গোলপোস্টে কোণাকুণি মারে, বল বারপোস্টে লেগে কাছেই দাঁড়ানো মাহমুদের কাছে চলে যায়। কিন্তু সে মারতে ব্যর্থ হয়; তার আগেই বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় বল ক্লিয়ার করে দেয়। ফায়ারের সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিন এবং লেফট-ইন আশরাফের সম্মিলিত আক্রমণের একটি বল তপন সেভ করে। বক্সের ভেতর ফায়ারের স্টপার আইনুল হ্যান্ডবল করলে ওয়ারীর রাইট হাফ নজর পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ার্ধে ফায়ার সার্ভিস গোল শোধ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় এবং রাইট আউট মুনীরের পাশ থেকে শরফুদ্দিন গোল করে দলকে সমতায় ফেরায় (১-১)। জেতার জন্য দু’টিমই আক্রমণ করে খেলতে থাকে। খেলায় যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি খেলার আকর্ষণও বৃদ্ধি পায়। টি. চৌধুরীর বানিয়ে দেয়া পাশে জামিল আখতার গোল করে আবারও দলকে এগিয়ে দেয় ২-১। গোল খেয়ে ফায়ার হতাশ হয়ে পড়ে এবং কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে খেলতে থাকে। এ সুযোগে ওয়ারী ফায়ারের ওপর আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং এরই ধারাবাহিকতায় টি. চৌধুরী গোলপোস্টে সজোরে কিক করে যা গোলরক্ষক সীতাংশুর হাত ফসকে বল কাছেই দাঁড়ানো ভুট্টোর কাজে গেলে সে আলতো টোকা দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দেয় ৩-১। গোল খেয়ে ফায়ার আরেকবার চেষ্টা চালায় গোলের ব্যবধান কমানোর এবং ২৮ মিনিটে সুযোগ আসে আশরাফ এবং শাহাবুদ্দিনের সম্মিলিত আক্রমণ শাহাবুদ্দিনের গোলের মাধ্যমে (৩-২)। এ সময় খেলা বেশ জমে ওঠে। ফায়ার তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখে ওয়ারীকে কোণঠাসা করে রাখে, তাতে ওয়ারী বেসামাল হয়ে পড়ে। তাদের রাইটব্যাক নুরুল ইসলাম বক্সের ভেতর তাড়াহুড়ো করে বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে হ্যান্ডবল করে বসে। ফায়ারের লেফট-হাফ সামাদ পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ৩-৩ গোলের সমতায় ফেরায়।
ওয়ারীর খেলোয়াড় : তপন (গোলরক্ষক), নুরুল ইসলাম-মোহাম্মদ হোসেন ও সালামাত উল্লাহ, নজর ও খলিল, টি. চৌধুরী, জামিল আক্তার ভুট্টো, এইচ খান এবং মাহমুদ।
ফায়ারের খেলোয়াড় : সিতাংশু (গোলরক্ষক), মুজিবর রহমান, আইনুল ও আবুল, দিপু ও সামাদ, মুনীর, শরফুদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, আশরাফ এবং আরমান।
রহমতগঞ্জ প্রথম পয়েন্ট খুইয়েছিল দুর্বল প্রেসের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। রহমতগঞ্জ জয়ের জন্য সবরকম সুযোগ পেয়েও জয়লাভ করতে পারেনি তাদের আক্রমণভাগের ব্যর্থতার কারণে। বিশেষ করে তাদের রাইট আউট নাজির একাই ৩টি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করেছিল। এর মধ্যে গোলরক্ষক মাখনকে একা পেয়েও বল বাইরে মেরেছে, তার জন্য তাকে ক্ষমা করা যায় না। প্রেসের রক্ষণভাগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রহমতগঞ্জের আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করেছে। প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল গোলশূন্যভাবে।
দ্বিতীয়ার্ধের চিত্র ছিল ভিন্ন। প্রেস প্রথম থেকেই রহমতগঞ্জের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে এবং ২০ মিনিটে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড এআর খান বল নিয়ে দ্রুতগতিতে রহমতগঞ্জের সীমানায় ঢুকে পড়ে। রহমতগঞ্জের লেফট-ব্যাক হাসনাত তাকে আটকাতে না পেরে জার্সি ধরে টেনে রাখে। যার ফলে রেফারি মুনীর হোসেন পেনাল্টির নির্দেশ দেন।
প্রেসের এরশাদ পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ১-০ গোলের লিড এনে দেয়। গোল খেয়ে রহমতগঞ্জ খেলার ছন্দ হারিয়ে এলোমেলো খেলতে থাকে। কিছু সময় পর দুই ইন সুলতান ও শাহজাহানের নেতৃত্বে পুরো আক্রমণভাগ গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত শাহজাহানের গোলেই রহমতগঞ্জ পূর্ণ পয়েন্ট খোয়ানো থেকে বেঁচে যায়। ১-১ গোলের ড্র নিয়ে প্রেস খুশিমনে মাঠ ত্যাগ করে।
১ ফেব্রুয়ারি ২০১২
(একানব্বই)
লন্ডন হকি ফেসটিভ্যালে পাকিস্তান হকি দলের অংশগ্রহণ এবং অস্ট্রেলিয়া জাতীয় হকি দলের পাকিস্তান সফরকে সামনে রেখে দু’সপ্তাহের জন্য প্রাক-বাছাই ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়েছিল। সমগ্র পাকিস্তান থেকে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য যে ৫৬ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করা হয়েছিল (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে), তাদেরকে প্রাক-বাছাই ট্রেনিং ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমি ছাড়াও তিনজন স্ট্যান্ডবাই খেলোয়াড় আব্দুস সাদেক, ইব্রাহিম সাবের এবং গোলরক্ষক রঞ্জিত দাসকে ক্যাম্পে যোগদানের জন্য ডাকা হয়েছিল।
ঢাকায় তখন ফুটবল লিগ খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের পক্ষে আমি প্রথম ম্যাচ খেলেও ফেলেছিলাম। এমন সময় হকি ক্যাম্পের সংবাদ পেলাম আমাকে ক্যাম্পে যোগ দিতে হবে। এ অবস্থায় আমাকে পেশওয়ার ছুটতে হয়েছিল। পেশওয়ারের ইসলামিয়া কলেজে ক্যাম্প করা হয়েছিল। শহর থেকে কিছু দূরে বিশাল এলাকাজুড়ে ইসলামিয়া কলেজ, সবুজ গাছপালার মাঝে মোগল স্থাপনার ধাঁচে নির্মিত তাদের প্রধান কলেজ বিল্ডিং, কলেজের হোস্টেলে হকি ক্যাম্প, পাশেই মাঠ, সুন্দর পরিবেশ পড়াশোনা, খেলাধুলার জন্য আদর্শ স্থান।
১৫ মে থেকে ট্রেনিং শুরু হয়েছিল। ক’দিন আগেই হকি শেষ করে এক সপ্তাহের মধ্যে ফুটবল লিগ খেলতে মাঠে নেমে পড়তে হয়েছিল; নিজেকে খেলার জন্য তৈরি করতে পারিনি, আবার ফুটবল ছেড়ে ক্যাম্পে হকি ধরতে গিয়ে ওলট-পালট লাগছিল। আসলে হকি-ফুটবল কোনো খেলার জন্যই নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করার সময়-সুযোগ পাইনি। তবে সব সময় খেলার মধ্যে ছিলাম বলে ফিজিক্যাল ফিটনেসে সমস্যা হয়নি।
ক্যাম্প কমান্ডেন্ট মেজর আব্দুল হামিদ, অলিম্পিয়ান, পাকিস্তান দলের সাবেক ক্যাপ্টেন এবং তার সাথে কোচ ছিলেন লতিফ মীর, আব্দুর রশিদ, শেখ রহমতউল্লাহ, এজি খান এবং আখতার হোসেন। সমগ্র পাকিস্তানের বাছাই করা খেলোয়াড়। প্রত্যেক পজিশনে ৪-৫ জন করে দক্ষ-অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, নিজেদের সেরাটা দিয়ে সবার সেরা হওয়ার চেষ্টা। ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রাইটআউট পজিশনেও আমরা চারজন ছিলাম। খালেদ মাহমুদ এবং ফারুক খান দুজনই পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছে। খালেদ মাহমুদ পাকিস্তান দলকে সে সময় নেতৃত্ব দিচ্ছিল। খালেদ মাহমুদ কাস্টমসের খেলোয়াড় ব্যতীত আরও একজন কাস্টমসের খেলোয়াড় রাইট আউট পজিশনে আমাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল, তার নাম ইসমাইল।
সকাল-বিকাল দু’বেলা জোর ট্রেনিং। সকালে ফিজিক্যাল ফিটনেস আর টেকনিক্যাল ট্রেনিংটা সামাল দিলেও বিকেলের ট্রেনিংটা ছিল খুবই সিরিয়াস, বিশেষ করে প্র্যাকটিস ম্যাচ। প্রতিদিনের পারফর্মেন্স তীক্ষèভাবে লক্ষ্য করতেন ক্যাম্প কমান্ডেন্ট। তার রিপোর্টকে সিলেকশন কমিটি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমার রাইট আউট পজিশন অনেকটা পরুনির্ভরশীল। রাইট ইন এবং রাইট হাফ সহযোগিতা না করলে একা একা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা কঠিন। তাই অনেক সময় পাঞ্জাব, করাচি কিংবা টিমের খেলোয়াড় হিসেবে একে অন্যকে সহযোগিতা করার সুযোগ থাকে, সে হিসেবে আমি একাই সাধ্যমত ভাল করার চেষ্টা করে যেতাম।
২৯, ৩০, ৩১ মে তিনদিন ট্রায়াল শেষে ৩৫ জনকে বাছাই করা হয়েছিল দ্বিতীয় পর্ব ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য। এখান থেকেই পরবর্তীতে ১৮ জনের চূড়ান্ত দল বাছাই করা হবেÑ যারা সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া দলের পাকিস্তান সফরে ৩টি টেস্ট ম্যাচে অংশ নেবে এবং অক্টোবর মাসের ১০-২২ লন্ডন হকি ফ্যাস্টিভেলে অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচন কমিটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ খান নির্বাচিত ৩৫ জনের নাম ঘোষণা করেছিলেন :
গোলরক্ষক : জাকির (রাওয়ালপিন্ডি), জাফর (রেলওয়ে), ইফতেখার (আর্মি) এবং ইসলাম (রেলওয়ে)।
রাইট ফুল ব্যাক : তানভীর দার (পিআইএ), এজাজ বাট (কাস্টমস), সাজ্জাদ (আর্মি),
লেফট ফুলব্যাক : তারিক আজিজ (সারগোদা) এবং রিয়াজউদ্দিন (পিআইএ)।
রাইট হাফ : রশিদ (আর্মি), আনোয়ার শাহ (রেলওয়ে) ও দেলোয়ার (লাহোর)।
সেন্টার হাফ : সাঈদ আনোয়ার (পিআইএ), রিয়াজ (আর্মি) এবং কাইয়ুম নিয়াজী (করাচি)।
লেফট হাফ : ফাজাল (পিআইএ), গুলরেজ (কাস্টমস) এবং আখতার (রেলওয়ে)।
রাইট আউট : খালেদ মাহমুদ (কাস্টমস) এবং বশীর আহমেদ (ইস্ট পাকিস্তান)।
রাইট ইন : আশফাক (আর্মি), আমান উল্লাহ (পেশাওয়ার), খুরশীদ আজম (রেলওয়ে), রশিদ (ডিআই খান) এবং ইসলাহ (করাচি)।
সেন্টার ফরোয়ার্ড : তারিক নিয়াজী (পিআইএ), মোদাসসির (রাওয়ালপিন্ডি), ফারুক মীর (লাহোর), কাসানী (কাস্টমস)।
লেফট ইন : লাইক (কাস্টম), আসাদ মালিক (পিআইএ), রশিদ মালিক (লাহোর)।
লেফট আউট : জাহাঙ্গীর বাট (কাস্টমস), মাহবুব (ডিআই খান) এবং রশীদ (পিআইএ)।
২৬ মে ফায়ার সার্ভিস ওয়ান্ডারার্সকে ৩-০ গোল করে চমকে দিয়েছিল আর সে সাথে তাদের শরফুদ্দিন মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেছিল। ওয়ান্ডারার্স এই প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছিল। তারা ৪ ম্যাচে দুটি জয় এবং একটি ড্র করে। ফায়ার সার্ভিস ভাল খেলেই জয় পেয়েছিল, বিশেষ করে তাদের রাইট ইন শরফুদ্দিন চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল, যার জন্য পরদিন মর্নিং নিউজ পত্রিকা লিখেছিল : ‘ঝযধৎভঁফফরহ’ং নড়ড়ঃং ধঢ়ঢ়বৎধৎবফ ঃড় যধাব যধফ ঃযধঃ ঃড়ঁপয ড়ভ সধমরপ ধনড়ঁঃ রঃ. ঞড়ি ড়ভ ঃযৎবব মড়ধষং ঃযধঃ যব ংপড়ৎবফ বিৎব ঃৎঁষু সধমহরভরপবহ ড়হবং. ঞযবংব ঃড়ি বিৎব ঃযব ংবপড়হফ ধহফ ঃযব ঃযরৎফ, ইড়ঃয মড়ধষং নবরিষফবৎববফ ঃযব ধিহফবৎং শববঢ়বৎ, ংযধহঃড়.’
ওয়ান্ডারার্স দলের গোলরক্ষক সান্টু থেকে শেষ নম্বর তসলিম সবার খেলা ছিল হতাশ করার মত। তাদের দুই ইন হাবিব এবং আলাউদ্দিনের খেলা ছিল একেবারে জঘন্য। বিশেষ করে তাদের গোল মিসগুলো অমার্জনীয়। সাদেকও ছিল ব্যর্থ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আনসার। তার গোলপোস্টে অনর্থক এবং লক্ষ্যহীন শটগুলো ছিল বিরক্তিকর।
ফায়ার খেলার পাঁচ মিনিটেই গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে চমকে দেয়। আশরাফ ও শরফুদ্দিনের মিলিত আক্রমণে শরফুদ্দিন জোরালো গ্রাউন্ড শট দ্বারা সান্টুকে পরাস্ত করে ১-০। গোল খেয়ে ওয়ান্ডারার্স নড়েচড়ে ওঠে এবং লেফট আউট তসলিম দ্রুতগতিতে বল নিয়ে ফায়ারের সীমানায় ঢুকে সেন্টার ফরোয়ার্ডকে দিলে বল ধরার আগেই গোলরক্ষক সীতাংশু ছোঁ মেরে বল নিয়ে নেয়। তসলিম আবারও বল নিয়ে বিপক্ষ পোস্টের কাছে সাদেকের উদ্দেশে বল দিলে সে দুর্বল শটে সীতাংশুকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। বল চলে যায় সামনে দাঁড়ানো আনসারের কাছে। শতভাগ গোলের চান্স সে জঘন্যভাবে বাইরে মেরে দলকে এবং সমর্থকদের হতাশ করে দেয়।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স ড্র করার একটা সুযোগ পায়। রুশোর সেরা পাস তসলিম দ্রুত বক্সে ঢুকে গ্রাউন্ডার শট মারে, বল সাইড বারে লাগে। আউদ্দিনের কাছে গেলে সে বাইরে মেরে সেই সুযোগটাও সে হাতছাড়া করে দেয়। ওয়ান্ডারার্সের গোল মিসের মধ্যে ফায়ারের ডানপ্রান্ত থেকে আসা একটি লব শরফুদ্দিন আলতো পা লাগিয়ে বল গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দেয় ২-০। ওয়ান্ডারার্স মরিয়া হয়ে ওঠে এবং গোল করার যতরকম পন্থাÑ সব অবলম্বন করতে থাকে কিন্তু ফায়ারম্যানরা রক্ষণাত্মক খেলা খেলে গোল না খাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। খেলার অন্তিম মুহূর্তে শরফুদ্দিনের বুটের ছোঁয়ায় আরও একটি গোল আসে। শরফুদ্দিন মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিকের গৌরব অর্জন করে; সে সাথে দলকে ৩-০ গোলের জয় এনে দেয়।
২৬ মে আউটার স্টেডিয়ামে লিগের অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে ৪-০ গোলে পরাজিত করেছিল। রেলওয়ে পাইওনিয়ার দলের তরুণ খেলোয়াড়রা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্পিটেড খেলা প্রদর্শন করেছিল, শুধু তারা অভিজ্ঞতা আর স্কোরারের অভাবে গোল পায়নি। ২৫ মিনিটে ভিক্টোরিয়ার জানি গোল করে এগিয়ে নিলে হাই তা দ্বিগুণ করে। কিবরতির পর আলী ইমামের দু’গোলের সুবাদে ৪ গোলের জয় পায় ভিক্টোরিয়া। পরদিন ওয়ারী এবং আজাদের খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। জামিল আখতারের বানিয়ে দেয়া বলে নিশিথ টোকা দিয়ে গোল করে ওয়ারীকে এগিয়ে দিলেও তাদের গোলরক্ষক আউয়াল এবং স্টপার মাহমুদ বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় আর বল ধীরে ধীরে গোলপোস্টে ঢুকে পড়ে। ১-১ ড্র। খেলার অবশিষ্ট সময় দু’দলই গোল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং তাদেরকে এক পয়েন্ট নিয়েই ফিরতে হয়। দিনের অপর খেলায় ইপিআইডিসি স্টেশনারিকে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করে। তাদের পক্ষে জব্বার একাই তিন গোল করেছিল; বাকি দু’গোল ছিল আব্দুল্লাহ আকবর এবং আসলামের। ২৮ মে মোহামেডান প্রেসের বিরুদ্ধে ৭-১ গোলের বড় জয় পেয়েছিল; তবে খেলার শুরুতে ৬ মিনিটেই মোহামেডান ভানুর দেয়া গোল খেয়ে চমকে গিয়েছিল। তারপর মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ার মত অবস্থা হয়েছিল প্রেসের। মোহামেডান এক এক করে পাঁচ গোল দিয়ে গোল খাওয়ার জ্বালাটা মিটিয়েছিল। এটাই ছিল লিগের সর্বাধিক গোলের জয়। গোল শোধ দিতে ৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল মোহামেডানকে। মুসা সমতা আনে (১-১)। পরের গোলটিও মুসার। দলের তৃতীয় গোল রাইট আউট জালু করলেও ৪র্থ গোলটিও মুসার এবং পঞ্চম গোলটি করে হাফিজউদ্দিন (৫-১) বিরতির পর জালু ৬ষ্ঠ গোল এবং দলের শেষ গোলটিও করেছিল মুসা (৭-১)।
কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজার দর্শনীয় এক হ্যাটট্রিকের সুবাদে আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেদিনের অপর খেলায় পিডব্লিউডি পুলিশকে ৪-০ পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এটা ছিল মৌসুমের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। সমমানের দুটো টিম, পুলিশ টিম ৪ গোল খাওয়ার মত নয়; আক্রমণভাগের ব্যর্থতাই তাদের হারের মূল কারণ। খেলার মাঝামাঝি সময় পিডব্লিউডি টিমের আবিদ গোল করে দলকে এগিয়ে নেয় এবং দশ মিনিটেই সুজা সেটাকে দ্বিগুণ করে। বিরতির পরই সুজা দলকে ৩-০ গোলের লিড এনে দেয়; সে সাথে তার হ্যাটট্রিকের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়। সহ-খেলোয়াড়দের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত সুজা হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল আর পিডব্লিউডিকে ৪-০ গোলের জয় উপহার দিয়েছিল।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২
(বিরানব্বই)
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব আরও একটি হোঁচট খেয়েছিল যখন রহমতগঞ্জ তাদের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২৯ মে স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শকের উপস্থিতিতে তারা মানসম্মত খেলা উপহার দিতে পারেনি। খেলার ৫ মিনিটেই ওয়ান্ডারার্স গোল করে এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তারা সেটাকে ধরে রাখতে পারেনি। ৩০ মিনিটে রহমতগঞ্জ শোধ করে দেয় (১-১)। এ ড্র’র ফলে ওয়ান্ডারার্স পাঁচ ম্যাচ খেলে চার পয়েন্ট হারায়। ফায়ার সার্ভিসের সাথে তারা হ্যাটট্রিকসহ ৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল আর ইপিআইডিসি এবং রহমতগঞ্জের সাথে ড্র করায় মোট চার পয়েন্ট হারিয়ে তারা লিগ চ্যাম্পিয়নের দৌড়ে পেছনে পড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে রহমতগঞ্জ পাঁচ ম্যাচ খেলে ২টিতে জয় এবং ২টিতে ড্র করে মাত্র ২ পয়েন্ট হারিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে অন্যদের সাথে সমানতালে এগিয়ে গিয়েছিল।
ওয়ান্ডারার্স এবং রহমতগঞ্জ দলের ম্যাচ রেফারি ননী বসাক খেলা শেষ করে প্যাভিলিয়নে ফিরছিলেন, পথে কিছু উচ্ছৃংখল সমর্থক তাকে আক্রমণ করে এবং পানি খাওয়ার বোতল দিয়ে আঘাত করে তাকে গুরুতর আহত করে। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। এ ব্যাপারে রমনা থানায় সাধারণ ডাইরিও করা হয়েছিল।
২১ মে’র অপর খেলাটিও ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিমের তরুণ খেলোয়াড়রা অভিজ্ঞ এবং পরিণত দল ফায়ার সার্ভিসকে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। তারা সমান তালে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করে খেলে এক পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। খেলার ৩২ মিনিটে ফায়ারের রাইট আউট আবুল কালাম সম্মিলিত আক্রমণে রেলওয়ে পাইওনিয়ারের গোলরক্ষক মহিউদ্দিনকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে লিড এনে দেয় এবং এই লিড হাফ টাইম পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে। বিরতির পর দু’টিমই জোর আক্রমণ চালিয়ে খেলতে থাকে। ফায়ার অভিজ্ঞ দল পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশি বেশি আক্রমণ চালালেও পরিশ্রমী রেল পাইওনিয়ার দলের খেলোয়াড়রা দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণও চালাচ্ছিল। ফলে খেলা বেশ জমে উঠেছিল। খেলার ধারা এভাবেই শেষের দিকে গড়াচ্ছিল। তখনই ফায়ারেরর রাইট ব্যাক মুজিবর বক্সের ভেতর হ্যান্ডবল করে বসে, সাথে সাথে রেফারি মীর কবির পেনাল্টির নির্দেশ দেন। রেল পাইওনিয়ারের লেফট ব্যাক গিয়াসউদ্দিন গোল করে ১-১ গোলে সমতা আনে। অবশিষ্ট সময় ফায়ার চেষ্টা করেও ফলাফল পরিবর্তন করতে পারেনি।
৩০ মে ইপিআইডিসি এবং ওয়ারী মিলে চার গোল করেছিল। কোন দলই একক প্রাধান্য বিস্তার করে খেলতে পারেনি। মাঠে ইপিআইডিসি টিমকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়বে। কিন্তু খেলার শুরুতেই ওয়ারী জামিল আক্তারের মাধ্যমে আক্রমণ চালায়। সে উঁচু করে রাইট আউট তপনকে বল দিলে সে গোল মুখে আজিজকে বানিয়ে দেয় কিন্তু গোলভীতু আজিজ গোলরক্ষক হাকিমকে একা পেয়েও গোল করতে পারেনি। এরপরই ইপিআইডিসির সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলামের একটি হেড গোলপোস্টের সামান্য বাইরে চলে যায়। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটের সময় ওয়ারীর সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ তপনের পাস থেকে দর্শনীয় একটি গোল করে দলকে ১-০ গোল এগিয়ে দেয়।
বিরতির পর আসলাম ওয়ারীর দু’তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে সুন্দর একটি গোল করে ১-১ গোলের সমতা আনে। কিছুক্ষণ পর ইপিআইডিসির রাইট আউট সলিমউল্লাহ বল নিয়ে দ্রুত ছুটে ওয়ারীর সীমানায় পৌঁছেই গোলপোস্টে দারুণ শট করেÑ যা বারুেপাস্টে লেগে কাছেই দাঁড়ানো হাশেমের কাছে গেলে সে পুশ করে বল জালে ঢুকিয়ে দেয় (২-১)। ওয়ারী গোল শোধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং আক্রমণ চালাতে থাকে। খেলার ধারাবাহিকতায় ওয়ারী একটি কর্নার লাভ করে। বিজেএমসির আলী হাফিজ কর্নারের বল ক্লিয়ার করার সময় বল নিজ গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দেয় (২-২)। অবশিষ্ট সময় দু’দলই গোল করার চেষ্টা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলী হাফিজের আত্মঘাতী গোলের মাসুল দিয়ে ইপিআইডিসি ওয়ারীর সাথে ২-২ গোলের ড্রকে মেনে নিয়েছিল।
৩০ মে ’৬৭ ঐতিহ্যবাহী মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাবের নতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটিতে আমিও একজন গর্বিত সদস্য ছিলাম। মাহুৎটুলী পুরনো ঢাকার একটি মহল্লা। মাহুৎটুলী ক্রীড়াঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। বিশেষ করে হকি খেলার সাথে এ নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাহুৎটুলী আমার জন্মস্থান। মাহুৎটুলী কবি শামসুর রহমানের জন্মস্থান। মাহুৎটুলী বহু ক্রীড়াবিদের জন্মস্থান। মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশ বিভক্তির কাছাকাছি সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের দিকে। মীর ওয়াজির আলী, ফখরুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, শামসুল ইসলাম সহোদর ভাইরা, সহপাঠী খেলোয়াড়, পাড়ার খেলোয়াড়দের নিয়ে নিজ বাড়ি ৭৯ নং মাহুৎটুলীতে মহল্লার নামে গঠন করেছিলেন ‘মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাব’। পঞ্চাশ দশকে ঢাকার মাঠে দাপটের সাথে ফুটবল-হকি খেলেছে মাহুৎটুলী ক্লাব। সে সময় ক্লাবের হয়ে যারা খেলতেন, তাদের মধ্যে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা চার ভাই ছাড়াও বাহরাম, আলমগীর আদেল, ইসমাইল, জাহাঙ্গীর আদেল, নুরু উল্লেখযোগ্য নাম। আরো অনেকের নাম এ মুহূর্তে মনে আসছে না।
ষাট দশকে মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাবের পারফরমেন্স ধীরে ধীরে নিচের দিকে যাচ্ছিল। ক্লাবের জৌলুসও হারিয়ে যাচ্ছিল। তখন মহল্লার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিরা ক্লাবের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। সে উদ্দেশ্যেই ৩০ মে ১৯৬৭ সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৬৭-৬৮ সালের জন্য মাহুৎটুলী স্পোর্টিং ক্লাবের কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মদ সিদ্দিক, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউসুফ আলী চৌধুরী, এসএ মহসিন, আনোয়ার হোসেন, চান্দ সরদার, সাকী সরদার, জেনারেল সেক্রেটারি আলমগীর মো. আদেল, জয়েন্ট সেক্রেটারি শামসুদ্দিন আহমেদ, ট্রেজারার মোহাম্মদ খান, ফুটবল সেক্রেটারি শামসুল বারী, হকি সেক্রেটারি আরেফিন খান, ক্রিকেট সেক্রেটারি আতাউর রহমান। ১১ জন সদস্য : এফ কে হায়দার, সামিউদ্দিন খান, এএম সেরা, বশীর আহমেদ, মাহমুদুর রহমান মমিন, হেদায়েতুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, ফাজলুল হক, আকমল ইউসুফ, সৈয়দ মকবুল জামিল, লুৎফুল আলম, মঈনুল ইসলাম এবং জাহাঙ্গীর মো. আদেল ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
৩১ মে স্টেডিয়ামে ভিক্টোরিয়ার কাছে বিজি প্রেস হেরেছিল ৪-১ গোলে আর সেদিন আউটার স্টেডিয়ামে পুলিশ একমাত্র গোলে স্টেশনারিকে হারিয়েছিল। প্রেস টিম শুরুটা ভালই করেছিল; এমনকি গোল করার সুযোগও তৈরি করেছিল কিন্তু দক্ষ স্ট্রাইকারের অভাবে গোল পায়নি; উল্টো খেলার মাঝিমাঝি সময় ভিক্টোরিয়ার লেফট-ইন জানির বানিয়ে দেয়া বল আলী ইমামের দেয়া গোল হজম করতে হয়েছিল। গোল খাওয়ার পর প্রেস আর দাঁড়াতে পারেনি। এরপরই আলী ইমামের পাসে টিপু গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পর প্রেসের জিল্লু একটি গোল শোধ দিলে কিছুক্ষণের জন্য প্রেস খেলায় প্রায় ফিরে আসে। ভিক্টোরিয়া জয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আক্রমণ করে খেলতে থাকে এবং অনুরূপ একটি আক্রমণে লেফট-ইন জানি গোল করলে দর্শকরা অফ-সাইড বলে চিৎকার করে রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকে এবং মাঠে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে; ফলে খেলা কিছু সময় বন্ধ থাকে। পুনরায় খেলা শুরু হলে ভিক্টোরিয়ার রাইট আউট কবির গোল দিয়ে গোলের সংখ্যা ‘হালিতে’ পূর্ণ করে এবং দলকে ৪-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলাটি ছিল ঢিলেঢালা, মেড়মেড়ে; খেলার মান ছিল তৃতীয় বিভাগের মতো। খেলার একমাত্র উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল এরশাদের গোল, যার দ্বারা পুলিশ স্টেশনারিকে ১-০ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
১ জুনে ওয়ান্ডারার্স আরও একটি পয়েন্ট হারিয়েছিল পিডব্লিউডির সাথে গোলশূন্য ড্র করে। একটি বোরিং ফুটবল খেলায় ওয়ান্ডারার্স তাদের পঞ্চম পয়েন্ট হারিয়ে সমর্থকদের লজ্জায় ভাসিয়েছিল। দু’দলের খেলা ছিল নিম্নমানের, বিশেষ করে দু’দলের গোল মিস ছিল আরও জঘন্যÑ যা দর্শকদের হতাশ করেছিল। খেলার শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স এগিয়ে যেতে পারতো কিন্তু লেফট-আউট মনজুর ধীরেনের কাছে থেকে বল পেয়ে সহজ একটি গোল মিস করে পোস্টের ওপর দিয়ে বল মেরে। এরপর পিডব্লিউডির আবুল হোসেন ভাগ্যদোষে গোল পায়নি, ওয়ান্ডরার্সের গোলরক্ষক পরাস্ত হলেও তার মারা শট ক্রসবারে লেগে ফেরত আসে। এভাবেই এলোমেলো খেলা দিয়ে শেষ হয় প্রথমার্ধ। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ওয়ান্ডারার্স গোল করার সুযোগ পেয়েছিল কিন্তুু তসলিম পোস্টে বল মারতে দেরি করায় সহজ একটি গোল পাওয়া থেকে ওয়ান্ডারার্স বঞ্চিত হয়েছিল। খেলার শেষ পর্যন্ত দু’টিমই গোল করার চেষ্টা চালায়; তবে পরিকল্পনাহীন আক্রমণ আর লক্ষ্যভ্রষ্ট শটনির্ভর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দু’টিমই লড়ে গিয়েছিল, ফলাফল শূন্য।
ওয়ারীর প্রথম জয়। আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় তারা ৫-০ গোলে রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে বিধ্বস্ত করেছিল। খুবই লজ্জাজনক পারফরমেন্স ছিল তরুণ রেলওয়ে পাইওনিয়ার খেলোয়াড়দের। আগের খেলাগুলো তারা যেভাবে সাহসিকতার সাথে খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল, তা ওয়ারীর সাথে বিসর্জন দিয়ে দেয়। অপরদিকে ওয়ারী খুবই পরিকল্পিত এবং দলীয় সমঝোতা দিয়ে বিপক্ষকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। জামিল আখতার ওয়ারীর পক্ষে প্রথম গোল করে এগিয়ে দিলে সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ পরপর দু’গোল করে দলকে বিরতির পূর্বে ৩-০ গোলের লিড এনে দেয়। বিরতির পর ওয়ারীর দ্রুতগতির রাইট আউট তপন দুটি গোল করে দলকে ৫-০ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
১ মার্চ ২০১২
(তিরানব্বই)
২ জুন। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের জন্য একটি বিশেষ দিন, যে দিনটিতে তারা ফুটবল লিগে প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল; সে সাথে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শিবলী হ্যাটট্রিক করার গৌরবও অর্জন করেছিল। ফায়ারম্যানরা আজাদের কাছ থেকে এরকম একটা ধাক্কা খাবে ভাবতে পারেনি। তুলনামূলকভাবে আজাদের চেয়ে ফায়ার সার্ভিস শক্তিশালী দল। খেলা দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা আজাদকে আমলেই নেয়নি, হাল্কাভাবে নিয়েছিল, ‘ওভার কনফিডেন্ট’-এর মোহে তারা আক্রান্ত ছিল। দু’দলই পরিকল্পনাহীন এলোমেলো খেলা খেলে সময় নষ্ট করছিল। তবে মাঠে আজাদ বেশি তৎপর ছিল এবং গোল করার সুযোগও সৃষ্টি করেছিল কিন্তু ফায়ারের রক্ষণভাগের সতর্কতা এবং দৃঢ়তার জন্য কোনপ্রকার অঘটন ঘটাতে পারেনি। খেলার প্রথমার্ধ ছিল গোলশূন্য।
বিরতির পর ফায়ারের তরফ থেকে প্রথম আক্রমণ শানিয়েছিল তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিন, সে মাঠ কামরানো শট মেরে আজাদের গোলরক্ষক আমানকে পরীক্ষা করেছিল। ফায়ার তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখে রাইট আউট আবুল কালাম ডান প্রান্ত দিয়ে আজাদের সীমানায় ঢুকে প্রচন্ড জোরে গোলপোস্টে কিক করলে বল অল্পের জন্য ক্রশবারের ওপর দিয়ে চলে যায়। আবারও আবুল কালাম একক প্রচেষ্টায় আজাদের বক্সে ঢুকে সুন্দর প্লেসিং শটে আমানকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেয়। গোল খেয়ে আজাদের পুরো দল গোল শোধ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে বিশেষ করে ফরোয়ার্ডরা তাদের আক্রমণ জোরদার করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় বক্সের ভেতর রাইট আউট আবুল বল পেয়ে পোস্টে শট চালায় কিন্তু বল বারপোস্টে লেগে খেলায় ফেরত আসে এবং আজাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শিবলীর কাছে গেলে সে টোকা দিয়ে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয় (১-১)। গোল শোধ করার পর আজাদের আক্রমণ জোরদার হয়ে ওঠে। নজরুলের দেয়া থ্রু পাস শিবলী ধরে চমৎকার গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। ফায়ার পিছিয়ে পরে মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। শরফুদ্দিনের একটি লব ধরে সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিন পোস্টের ওপর দিয়ে মেরে একটি সহজ গোল মিস করে। খেলা প্রায় শেষের দিকে ফায়ারের আক্রমণ অব্যাহত, এমনি একটি কাউন্টার অ্যাটাক থেকে লেফট-আউট বাটু বল পেয়ে তা সুন্দরভাবে বানিয়ে দিলে গোল করতে শিবলীর কোন বেগ পেতে হয়নি। এই গোলের মাধ্যমে শিবলীর হ্যাটট্রিক পূর্ণ হয়, সেই সাথে আজাদও লিগের প্রথম জয়ের স্বাদ গ্রহণ করে (৩-১)। মৌসুমের তৃতীয় হ্যাটট্রিকের মালিক শিবলী।
আজাদের পক্ষে সেদিন যারা খেলেছিল : আমান (গোলরক্ষক), আহমেদ মোবাশ্বের এবং নূরুদ্দিন, গিয়াস এবং মালিক, আবুল হাসান, নাসিম, শিবলী, নজরুল এবং বাটু।
আউটার স্টেডিয়াম নং-১-এ অনুষ্ঠিত সেদিনে লিগের অপর খেলায় রহমতগঞ্জ ও পুলিশ নিজেদের মধ্যে পয়েন্ট ভাগ করে নিয়েছিল। সমমানের দুটি টিম। দু’টিমই প্রাধান্য বিস্তার করে জয়ের জন্য আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করে খেলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খেলাটিকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল। উপস্থিত দর্শকরা প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলেন মাঝারি মানের দুটি টিমের খেলায়। রহমতগঞ্জের রাইট-ইন শাজাহান তার নিজস্ব স্টাইলে গোল করে প্রমাণ করে যে, সে রহমতগঞ্জের প্রধান স্কোরার। গোল শোধের সব রকম চেষ্টা চালাতে থাকে পুলিশ এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যায় সেই সুযোগ যখন ডান প্রান্ত থেকে উড়ে আসা একটি বল লেফট ইন গফুর নিপুণভাবে রিসিভ করে গ্রাউন্ডার শট দ্বারা বিপক্ষ গোলরক্ষক অনাথকে পরাস্ত করে খেলায় ১-১ গোলের সমতা এনে দেয়। ড্র-ই ছিল খেলার ফলাফল।
পুলিশ টিমের খেলোয়াড় তালিকা : মালাকার (গোলরক্ষক), আখতার, কায়েম এবং মোহাম্মদ আলী, নুরুল ইসলাম এবং ফজলুর রহমান এরশদা, আব্দুর রব, মফিজ, গফুর এবং সাত্তার।
ফুটবল লিগের সেদিনের (৩ জুন) একটি মাত্র খেলায় চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান দুর্বল স্টেশনারিকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল। স্লো এবং ডাল ম্যাচে শক্তিশালী মোহামেডান গোল মিসের মহড়া দিয়ে প্রথমার্ধ গোলশূন্য ড্র রেখে দ্বিতীয়ার্ধে ৩ গোল করতে সক্ষম হয়েছিল। খেলায় চোখে পড়ার মত বিষয় ছিল মোহামেডানের ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতা। ম্যাচের পুরোপুরি কর্তৃত্ব নেয়া মোহামেডান বিপক্ষ গোল সীমানায় পৌঁছে সফলতা না পাওয়াটা ছিল অস্বাভাবিক। অন্যদিকে স্টেশনারি অতিরক্ষণাত্মক খেলে মোহামেডানের গোল ঠেকাও নীতি অবলম্বন করে সফল হয়েছিল। তদুপরি তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াস মোহামেডানের সীমানায় হানা দিয়ে গোলরক্ষক রানাকে চমকে দিয়েছিল, কোন অঘটন ঘটেনি। বিরতির পরও অর্ধেক সময় কেটে গিয়েছিল, তখনও কোন গোল হয়নি, এমনি যখন অবস্থা তখন মুসা তার একক প্রচেষ্টায় স্টেশনারির দু’তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে তার নিজস্ব স্টাইলে প্লেসিং শট দ্বারা গোলরক্ষক বাচ্চুকে পরাস্ত করলে মোহামেডান শিবির হাফ ছেড়ে বাঁচে। এর কিছুক্ষণ পর একটি সুযোগ পেয়ে আবদুল্লাহ পোস্টে কিক করলে জটলায় দাঁড়ানো ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে বাচ্চুকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়িয়ে যায় (২-০)। খেলার শেষ মুহূর্তে শামসুর বানিয়ে দেয়া বলে হাফিজউদ্দিন গোল করে মোহামেডানকে ৩-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে দেয়।
ইপিআইডিসি প্রমাণ করেছিল যে, তারা ফায়ারম্যানদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ৪ জুন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের খেলায় তারা ফায়ার সার্ভিসকে ৫-১ গোলে পরাজিত করেছিল। সব গোলই প্রথমার্ধে হয়েছিল। ইপিআইডিসি একনাগাড়ে চার গোল করার পর ফায়ার এক গোল শোধ করেছিল। এ লজ্জাজনক পরাজয়ের জন্য ফায়ারের ডিফেন্স দায়ী, বিশেষ করে মজিবর, আইনুল এবং জলিলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে। যে ফায়ার দল চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে প্রশংসিত হয়েছিল, তারাই ইপিআইডিসির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল। রোববার ছুটির দিনে অনেক দর্শক মাঠে এসেছিল কিন্তু নিম্নমানের খেলায় কোনরকম উত্তেজনা বা আকর্ষণ না থাকলেও রাফ খেলার প্রবণতা দু’টিমেই ছিল আর সেজন্য রেফারি ঈশা খানকে বেশ কয়েকবার দু’দলের খেলোয়াড়দের সতর্ক করে দিয়েও মাঠের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। ইপিআইডিসি জয়ের লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছিল আর খেলা শুরুর দুই মিনিটেই রাইট-ইন প্রতুল প্রচন্ড শটে গোলরক্ষক সীতাংশুকে পরাজিত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। গোল খেয়ে ফায়ার কিছুটা সজাগ হয়ে আক্রমণ চালাতে এগিয়েও গিয়েছিল কিন্তু তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকায় কোন আক্রমণই রূপ নেয়নি বরং ১০ মিনিটের সময় রাইট ব্যাক আমিনের ভলি করা বল হাশিম দক্ষতার সাথে বল আয়ত্তে এনে সুন্দর একটা গোল করে দলকে ২-০ গোলে লিড এনে দেয়। ১৮ মিনিটে আসলামের দুর্দান্ত শট সীতাংশুকে সেভ করার কোন সুযোগ না দিয়ে সোজা জালে জড়িয়ে যায়। সেই সাথে ইপিআইডিসি ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। ২৩ মিনিটে ইপিআইডিসির একটি আক্রমণ ফায়ারের ডিফেন্স বিপদমুক্ত করতে গিয়ে বল ইপিআইডিসির লেফট হাফ মুসার কাছে চলে যায়। আর মুসা দেরি না করে বলে আলতো টোকা মেরে পোস্টে ঢুকিয়ে দিয়ে গোলের সংখ্যা হালিতে পূর্ণ করে (৪-০)। বিরতি ৭ মিনিট থাকতে ফায়ার আচমকা একটি আক্রমণ চালায় এবং তাদের আশরাফ এই আক্রমণ থেকেই গোল করে ব্যবধান কমায় (৪-১)। হাফ টাইমের বাঁশি বাজার পূর্ব মুহূর্তে আসলাম গোল করে দলের গোলসংখ্যা বৃদ্ধি করে (৫-১)।
দ্বিতীয়ার্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ফায়ারের গোলরক্ষক সীতাংশু খেলার মাঠেই অসুস্থ হয়ে মাঠ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল আর ফায়ারকে বাকি সময় ১০ জন নিয়ে খেলতে হয়েছিল। সীতাংশু জ্বর নিয়ে খেলতে নেমেছিল, মনে করেছিল মাঠে নামলে জ্বর সেরে যাবে কিন্তু জ্বর আরও বেশি হওয়ায় তাকে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। তার জায়গায় রাইট হাফ আবুল হাসান গোলপোস্ট সামলাতে এগিয়ে এসেছিল এবং ইপিআইডিসির দূর থেকে পোস্টে মারা বল সেভও করেছিল।
বিজি প্রেস লিগে প্রথম জয়ের মুখ দেখেছিল। আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দিনের অপর খেলায় তারা রেলওয়ে পাইওনিয়ার টিমকে ৪-১ গোলে পরাজিত করেছিল। বিরতির পূর্বেই প্রেসম্যানরা ২ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। খেলায় আকর্ষণীয় কোন ঘটনা না থাকলেও প্রেস সেদিন ভাল খেলেই জয়লাভ করেছিল। পাইওনিয়ার আগের ম্যাচগুলোতে যে খেলা খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল, সে খেলা আর খেলতে পারছিল না। খেলা শুরুর ৫ মিনিটেই প্রেসের সেন্টার ফরোয়ার্ড খালেক গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। মোখতার গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে (২-০)। বিরতির পর সামাদ দলের জন্য তৃতীয় গোল এনে দেয় (৩-০) পাইওনিয়ারের পক্ষে একটি মাত্র গোল শোধ দিতে পেরেছিল মনোজ। খেলার শেষদিকে দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড খালেজ দলের গোলের সংখ্যা হালিতে পূর্ণ করে দলকে ৪-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
ভিক্টোরিয়া একমাত্র গোলে আজাদকে হারাতে পেরেছিল। জয়সূচক গোলটি এসেছিল ভিক্টোরিয়ার লেফট-আউট টিপুর বুট থেকে। ৫ জুনের খেলায় শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া ছিল অগোছালো, আত্মবিশ্বাসের অভাব স্কোরারের অভাব যদিও তারা খেলার ১৫ মিনিটে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে রেখেছিল। বিরতির পর আজাদ কিছু সময়ের জন্য নড়েচড়ে উঠেছিল। লেফট আউট নজরুল পরিশ্রম করে খেলে গোল করার দুটো সুযোগ তৈরি করেছিলÑ যা সফল হতে হতেও পারেনি। ভিক্টোরিয়াকেও আজাদের গোল সীমানায় হানা দিতে দেখা গেলেও আজাদের গোলরক্ষক এহতেশাম দক্ষতার সাথে সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছে। এহতেশামের সুন্দর গোল কিপিং সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। সেদিনের খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল কবির আইমেদের খেলায় অংশগ্রহণ। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন ভাইস ক্যাপ্টেন, রাইট আউট পজিশনের একজন চৌকস খেলোয়াড় যিনি দীর্ঘদিন ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হয়ে মাঠে নেমে পুরনো দিনের খেলার ঝলক কিছুটা দেখিয়ে উপস্থিত দর্শকদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি সেই কবির প্রমাণ করলেন যে, তিনি এখনও নতুন খেলোয়াড়দের কাছে তার অভিজ্ঞতা, বল নিয়ে স্পিড, স্ট্যামিনা এখনও অনুকরণীয়। খেলার ফলাফল শেষ পর্যন্ত ধরে রেখে ভিক্টোরিয়া জয়ের হাসি নিয়েই টেন্টে ফিরেছিল। #
১৬ মার্চ ২০১২
(চুরানব্বই)
মোহামেডানের বড় জয়, সেই সাথে মুসার হ্যাটট্রিক। স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৬ জুনের খেলায় পুলিশ ৭-০ গোলে পরাজিত হয়েছিল। খেলার ফলাফলই বলে দিচ্ছিল একতরফা খেলায় লজ্জাজনক হারের চিত্র। মোহামেডান সেদিন খুব পরিমিত এবং পরিকল্পিত আক্রমণ দ্বারা পুলিশকে কোণঠাসা করে পুরো মাঠে দাপটের সাথে বিচরণ করেছে। তারা আরো অধিক গোলে জয়লাভ করতে পারতো কিন্তু তারা আগ্রহ দেখায়নি। পুলিশ তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও মোহামেডানের দক্ষতা আর নৈপুণ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। চ্যাম্পিয়নদের পুলিশের গোলমুখ খুলতে ১৬ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল যখন গফুরের ঝড়ের বেগে শটটি মালাকারের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে জালে জড়িয়ে গিয়েছিল। ৭ গোল হজম করলেও মালাকার সেদিন বেশ অনেকগুলো গোল কৃতিত্বের সাথে সেভ করেছিল; নইলে তারা আরও বেশি গোলে হারতো। ২০ মিনিটে শামসু গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়। বিরতির পূর্বে মুসা ৩২ এবং ৩৪ মিনিটে পরপর দু’গোল করে দলকে ৪-০ গোলে লিড এনে দেয়; সেই সাথে তার হ্যাটট্রিকের আভাস জানিয়ে দেয়। বিরতির পর পুলিশ পরিশ্রম করে খেলে দলকে গোছানোর চেষ্টা করে; এমনকি তারা আক্রমণ করে মোহামেডানের পোস্টেও হামলা চালায় কিন্তু সফল হতে পারেনি। মুসার হ্যাটট্রিকের জন্য দলীয় খেলোয়াড়রা গোল করতে আগ্রহী না হওয়ায় মোহামেডানের গোলসংখ্যা বাড়াতে পারেনি। ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর মুসা তার কাক্সিক্ষত গোলটি পেয়ে যায়, সেই সাথে হ্যাটট্রিকের তকমাটাও তার গলায় ঝুলিয়ে নেয়। মুসার সেটা ছিল প্রথম হ্যাটট্রিক এবং লিগের ছিল চতুর্থ হ্যাটট্রিক। খেলার শেষ মুহূর্তে রসুল বখশ দু’গোল করে মোহামেডানের ৭-০ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজার দুটো দর্শনীয় গোলের সাহায্যে পিডব্লিউডি রেলওয়ে পাইওনিয়ারকে আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় পরাজিত করেছিল। প্রথমার্ধ ছিল গোলশূন্য। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথমদিকেই দ্রুত দুটি গোল খেয়ে পাইওনিয়ারে তরুণ খেলোয়াড়রা ভেবাচেকা খেয়ে যায়; তারপরও তারা গোল শোধ করার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে কিন্তু ফলাফল অপরিবর্তিত অবস্থায় খেলা শেষ হয়।
৭ জুন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের খেলায় ইপিআইডিসি অতিসহজেই ৯-১ গোল বন্যায় ভাসিয়ে প্রেসকে পরাজিত করেছিল। প্রেস প্রথমার্ধে মাত্র ৩ গোল খেয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেয়েছিল ৬ গোল আর এটি হয়েছিল লিগের সর্বাধিক গোলের হার। খেলার ফলাফলই বলে দেয় খেলার চিত্র। প্রথমার্ধের ২৫ মিনিট প্রেস অত্যন্ত ভাল খেলেছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তাদেরকে মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা মাঠে জঘন্যভাবে ব্যর্থ হয়ে ইপিআইডিসিকে অর্ধডজন গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এতগুলো গোল হওয়া সত্ত্বেও কোন হ্যাটট্রিক হয়নি। খেলার শুরু থেকে ইপিআইডিসি প্রেসের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে এবং গোল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। প্রেসও তাদের গোল ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে কিন্তু ইপিআইডিসির হাশিমকে আটকানো সম্ভব হয়নি, সে ১২ মিনিটে প্রেসের গোলমুখ খুলতে সক্ষম হয়েছিল (১-০)। ইপিআইডিসি অনবরত আক্রমণ চালিয়েও যখন সফল হতে পারছিল না, তখন লেফট ইন হাশিম আবারও গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির বাঁশি বাজার এক মিনিট আগে লেফট আউট গাজী গোল করে দলের গোলসংখ্যা ৩-০ গোলে উন্নীত করেছিল।
বিরতির পর প্রেস লড়াকু মনোভাব নিয়ে খেলতে শুরু করলেও ইপিআইডিসির শক্তির কাছে হার মানতেই হয়েছিল। প্রেসের পক্ষে ইপিআইডিসির গোলক্ষুধাকে নিভৃত করা সম্ভব হচ্ছিল না। রাইট ইন প্রতুল আসলামের পাস থেকে গোল করে দলকে ৪-০ এগিয়ে দেয়। গাজী আরও একটি গোল করে গোলের সংখ্যা ৫-০তে নিয়ে যায় আর সেটা অর্ধডজন পূর্ণ করতে জামানকে মাত্র ১ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
লাল মোহাম্মদের লব ধরে গাজী তার তৃতীয় গোল করলে ইপিআইডিসি ৭-০ গোলের বড় ব্যবধানে জয় নিশ্চিত করে। খেলা প্রায় শেষের দিকে ইপিআইডিসির স্টপার গফুর বেলুচ বক্সের ভেতর হ্যান্ডবল করলে প্রেসের এরশাদ পেনাল্টি মারতে কোন ভুল করেনি (৭-১)। শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে গোল করে প্রেস গোল উৎসবে মেতে উঠেছিল কিন্তু ইপিআইডিসির সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলাম দ্রুত পরপর দুটি গোল করে তাদের ক্ষণিকের আনন্দকে স্তব্ধ করে দিয়ে দলকে ৯-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিলÑ যা ছিল মৌসুমের অধিক গোলের জয়।
ইপিআইডিসির টিমে সেদিন যারা খেলেছিল : হাকিম (গোলরক্ষক) আমিন, গফুর বেলুচ এবং সাইফুদ্দিন, লাল মোহাম্মদ এবং আলী হাফিজ, এস জামান, প্রতুল আসলাম, হাশিম এবং গাজী।
রেফারি খেলা শুরু করার জন্য বাঁশি দিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু দু’টিমের কোন টিমই খেলার জন্য এগিয়ে আসছিল না; যদিও দু’টিমই মাঠে উপস্থিত ছিল। ওয়ারী মাঠের ভেতর ঘোরাফেরা করছিল আর রহমতগঞ্জ মাঠের বাইরে ওয়ার্মআপ করছিল। রেফারি তার দু’জন সহকারী নিয়ে প্রস্তুত। দুই ক্যাপ্টেন বাঁশি শুনতে পায়নিÑ এমনি ভাব করে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিল, যা ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। নির্ধারিত সময়ের ২০ মিনিট দেরিতে আরম্ভ হয়েছিল ৮ জুন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের ওয়ারী বনাম রহমতগঞ্জের খেলাটি। রহমতগঞ্জের গোলরক্ষক অনাথ সময়মত মাঠে পৌঁছাতে না পারার জন্য দু’টিমের এ জঘন্য নাটকÑ যা ছিল ফুটবলের একটি কলংকময় ঘটনা।
দু’টিম মাঠে নামার পর চিত্রটি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। পূর্বে তাদের মধ্যে না খেলার যে মনোভাব, সেটি একেবারেই উবে গিয়েছিল। প্রথম থেকেই দু’টিম গোল করার জন্য আক্রমণ চালায়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যা গত দু’দিনের খেলা দেখে দর্শকরা নিরুৎসাহিত হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। অবশ্য এ খেলাটি বেশ উপভোগ করেছিলেন। রহমতগঞ্জের দিকে খেলাটি ঝুঁকেছিল এবং মনে হয়েছিল তারা পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে ফিরবে। তাদের দ্রুতগতির ফরোয়ার্ডরা একাধিকবার ওয়ারীর সীমানায় হানা দিয়ে তাদেরকে চেপে ধরেছিল এবং শাজাহানের মাধ্যমে সহজ দুটো গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত অল্পের জন্য গোলের মুখ দেখতে পায়নি। ওয়ারীর বিচ্ছিন্ন আক্রমণ কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দু’সীমানায় যখন হামলা হচ্ছিল, তখন শাজাহানের বানিয়ে দেয়া বলে রাইট আউট নাজির গোলরক্ষক তপনকে পরাজিত করলে রহমতগঞ্জ ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। লেফট-আউট নয়া গোল পোস্টে বল মারতে দেরি না করলে তাদের গোলসংখ্যা দ্বিগুণ হতো।
বিরতির বাঁশি বাজার আগে ওয়ারীর জামিল আখতারের দেয়া বক্সের ভেতরে একটি একশত ভাগ গোল করার বল সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ মিস করে দলকে সমতায় ফেরাতে পারেনি। তবে বিরতির পাঁচ মিনিটেই ভুট্টোর থ্রু থেকে বল পেয়ে রাইট-আউট তপন চৌধুরীর ঝড়ের বেগে শটটি অনাথকে পরাস্ত করে দলকে ১-১ গোলে সমতায় ফিরিয়েছিল। খেলার নিয়ন্ত্রণ ওয়ারীর কাছে চলে যায়। জামিল আখতারের শট পোস্টে প্রতিহত হয়ে বক্সে দাঁড়ানো নিশিথের কাছে গেলে সে টোকা দিয়ে বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয়। ওয়ারী ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। রহমতগঞ্জ গোল শোধ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে থাকে, বিশেষ করে শাজাহান অক্লান্ত পরিশ্রম করে খেলে বিপক্ষ দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। নাজির ও নয়াকে সাথে নিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় নাজিরের পাস থেকে শাজাহান অত্যন্ত সুন্দর একটি গোল করে দলকে ২-২ গোলের সমতায় ফেরায়। জয়ী হতে দু’দলই সুন্দর ফুটবল উপহার দেয় কিন্তু দু’দলের রক্ষণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খেলে কোন অঘটন ঘটতে দেয়নি।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় স্টেশনারি ফায়ারকে রুখে দিয়েছিল। মাঠে ফায়ারের খেলোয়াড়দের ভীষণ ক্লান্ত এবং হতাশ দেখাচ্ছিল, যা তাদের খেলার মধ্যেও ফুটে উঠেছিল। তারা তাদের স্বাভাবিক খেলাটাও খেলতে পারছিল না। তাদের বিচ্ছিন্ন আক্রমণ বিপক্ষ দলকে পরাজিত করতে পারেনি। অন্যপক্ষ স্টেশনারি ফায়ারের দুর্বলতার সুযোগে তাদের ফরোয়ার্ডরা আক্রমণ করে বিপক্ষ রক্ষণকে চাপের মধ্যে রাখে। ফায়ারের ডিফেন্স সতর্কতার সাথে না খেললে স্টেশনারি জয় নিয়েই মাঠ ছাড়তো। গোলশূন্য ড্র ছাড়া খেলার আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।
ওয়ান্ডারার্সের ঘাম ঝরানো জয়। ৯ জুন স্টেডিয়ামে তারা ২-১ গোলে আজাদকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবকেও লিগ চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে ভাবা হয়েছিল কিন্তু এরই মধ্যে তারা পাঁচ পয়েন্ট হারিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে গিয়েছিল। তাদেরকে এগিয়ে যেতে হলে দলের শক্তি বাড়াতে হতো। বাম প্রান্তে তসলিম এবং ওয়ার্সী যারা এবছরই প্রথম লিগে অংশ নিচ্ছিল, তারা ভালই খেলছিল। ওয়ার্সী ছোটখাটো গড়নের খুব ছটফট আর গতিসম্পন্ন খেলোয়াড়। অল্প জায়গাতে বল ফাটানো, দ্রুত শরীরকে ঘুরানো ছিল তার বৈশিষ্ট্য। ওয়ান্ডারার্সের ডিফেন্স বেশ শক্তিশালী আর তাদের নির্ভরশীল গোলরক্ষক সান্টু রয়েছে। শুধু প্রয়োজন ছিল দক্ষ স্কোরারের।
আজাদ সেদিন খুবই চমৎকার খেলা প্রদর্শন করেছিল তাদের শক্তিশালী বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে। স্ট্যামিনায় ভরপুর আজাদের খেলোয়াড়রা অত্যন্ত পরিশ্রম করে সমান তালে লড়েছিল শক্তিশালী ওয়ান্ডারার্স দলের সাথে। বিশেষ করে আজাদের দীর্ঘদেহী স্টপার কাজী মোবাশ্বের হোসেন পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে বিপক্ষ দলের আক্রমণগুলোকে রুখে দিয়েছিল, তার জোরালো ট্যাকলিং, সময়মতো ইন্টারসেপ্ট ছিল অপূর্ব যার জন্য ওয়ান্ডারার্সের পক্ষে গোল করা সহজ হচ্ছিল না। আজাদের রাইট আউট আবুল ছিল সেদিন খুবই উজ্জীবিত, সে ওয়ান্ডারার্সের ডিফেন্সকে ব্যস্ত করে রেখেছিল।
বিরতির পূর্বে দু’দল দুটি অপ্রত্যাশিত গোল হজম করেছিল। খেলার মাত্র দু’মিনিটে আনসারের দেয়া পাসে জিয়া আজাদের পোস্টে দুর্বল শট মারলে গোলরক্ষক আমান বল ধরার জন্য প্রস্তুত কিন্তু দ্রুতগতিতে ওয়ার্সী ছুটে এসে বলে পা ছোঁয়ালে বল আমানের পাস দিয়েই পোস্টে ঢুকে যায় ১-০। ‘ফ্লুক’ গোল খেয়ে আজাদ গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং খুব তাড়াতাড়ি সুযোগও এসে গিয়েছিল শিবলির মাধ্যমে, সে ওয়ান্ডারার্সের পেনাল্টি বক্সের বাইরে একটি বল পেয়ে পোস্টে কিক চালায়।
সাটুর বুক বরাবর বল সহজভাবে ‘গ্রিপ’ (হাতে ধরতে) করতে গেলে বল সান্টুর হাত ফসকে জালে জড়িয়ে যায়। গোল শোধ করার পর আজাদ ওয়ান্ডারার্সের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে। এর জের ধরে তারা বক্সের বাইরে একটি ফ্রিকিক লাভ করে। দেবুর ফ্রি কিকটি ক্রসবারে লেগে ফিরে আসলে (পরাজিত) সান্টু এবং ওয়ান্ডারার্স হাফ ছেড়ে বাঁচে।
বিরতির পর ওয়ান্ডারার্স খেলায় ফিরে আসে এবং গোলের কয়েকটা সুযোগ সৃষ্টি করে, গোলও মিস করে। তাদের আক্রমণের ধারাবাহিকতায় জিয়া এবং ওয়ার্সী নিজেদের মধ্যে বল আদান-প্রদান করে আজাদের সীমানায় পৌঁছে বক্সের কাছে আনসারকে দিলে সে দ্রুততার সাথে আজাদের একজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বুলেটের মত শট দিয়ে আমানকে পরাস্ত করেছিল আর সেটাই ছিল ওয়ান্ডারার্সের ২-১ গোলের জয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন